রাউরকেলা-ভুবনেশ্বর ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ১০ মিনিট দেরি করে প্ল্যাটফর্ম ছাড়ল ভোর ৫টা ২০ নাগাদ। কাক-ভোরে চেপে বসেছি ট্রেনে। প্রথম গন্তব্য ঢেনকানল। সেখান থেকে সপ্তশয্যা, কপিলাস ও জোরান্ডা যাওয়ার ইচ্ছে।

সকাল পৌনে ৬টায় রাজগাঙপুর এবং সোয়া ৬টায় বামরা পেরিয়ে গেলাম। শুরু থেকেই কাচের জানলার বাইরে দেখছি গাছে গাছে রক্তবর্ণ পলাশের মেলা। ফসল-কেটে-নেওয়া চাষজমি। শাল, মহুয়া, আম ও বাঁশ গাছই চোখে পড়ছে বেশি। মাঝে মাঝে তাল ও খেজুর গাছ। কখনও আবার ইউক্যালিপ্টাস প্ল্যান্টেশন। ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙছে লোকালয়ের। গাড়ি ধুতুরা পৌঁছোল ৬টা ৪৫-এ। মাঝে দুটো সিমেন্ট কারখানা পেরিয়ে ঝাড়সুগুদায় ট্রেন এসে থামল আরও ১০ মিনিট পরে। রেনগালি পেরিয়ে ট্রেন সম্বলপুর সিটি জংশনে পৌঁছোল পৌনে ৮টায়। ফ্লাস্ক থেকে গরম চা নিলাম, সঙ্গে বিস্কুট। ঢেনকানল স্টেশনে এসে পৌঁছোলাম বেলা ১১টা ২০ মিনিটে।

ওভার ব্রিজ পেরিয়ে প্ল্যাটফর্মের বাইরে এলাম। স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে ছিল ৪-৫টা অটো। আগে থেকে ঠিক করা এক হোটেলের নাম বলে অটোয় চড়ে বসলাম।  প্রায় ১৫ মিনিট গাড়ি চলার পর আমরা এসে পৗঁছোলাম জাতীয় সড়ক ৫৫-র পাশেই অবস্থিত সুন্দর, বাগান-ঘেরা হোটেল। হোটেলের প্রকৃত অবস্থান সম্বলপুর-কটক হাইওয়ের পাশে ঢেনকানলের মহিসাপোত রোড-এ।

আমাদের বুকিং আগেই করা ছিল তাই একতলায় আমাদের জন্য নির্ধারিত ঘর পছন্দ না হওয়ায় আমাদের লাগেজ দোতলার একটি ঘরে পাঠানো হল। এই ঘরটি চমৎকার। কাচের জানলার পর্দা সরাতেই চোখে পড়ে নীচে সুদৃশ্য বাগান, দৃষ্টি প্রসারিত করলে হাইওয়ে এবং তার পিছনে সবুজ জঙ্গল।

একে একে স্নান সেরে নিলাম। বেশ খিদে পেয়েছে– সেই কাক-ভোরে বেরিয়েছি যে! নীচে নেমে চলে এলাম সাজানো ডাইনিং রুমে। সরু চালের ভাত, ডাল ফ্রাই, মিক্সড ভেজিটেবল এবং ফিশ কারিতে জমিয়ে লাঞ্চ সারলাম। তখনই হোটেল কর্মচারীর ফোন এল। সপ্তশয্যা যাওয়ার জন্য গাড়ির কি ব্যবস্থা হল জানতে চাইলে সে বলল, একটা অটো জোগাড় করা হয়েছে। আমি বললাম, কোনও অসুবিধে হবে না। মাত্র কয়েক কিলোমিটারের পথ তো। ঠিক হল, বিকেল ৪টের আগেই আমরা রওনা হব।

হোটেলে অটো চলে এসেছে বিকেল পৌনে ৪টে নাগাদ। ক্যামেরা ও জলের বোতল নিয়ে চড়ে বসলাম গাড়িতে। গন্তব্য ১০ কিলোমিটার দূরের সপ্তশয্যা। অটো হাইওয়েতে এসে বাঁ দিকে কিছু দূর এগিয়ে চলে এল ইস্ট ইন্ডিয়া মার্কেট কমপ্লেক্স-এ। সেখান থেকে আবার বাঁ দিকে এগিয়ে চলে এলাম মহিসাপোত রোড-এ। এবার ফাঁকা রাস্তা। ডান দিকে দূরে দেখা যাচ্ছে পূর্বঘাটের ছোটো ছোটো পাহাড়। রাস্তার দুপাশেই চাষজমি। রাস্তা প্রায় জনহীন। কিছু দূর এগোতেই রাস্তার বাঁ পাশে দেখি ‘কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র, যা ‘ওড়িশা ইউনিভার্সিটি অফ এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজি-র ঢেনকানল শাখা।

অটো এগিয়ে চলল, কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্রের মহিসাপোত ক্যাম্পাস যেন আর শেষ হয় না! আরও প্রায় ৫-৬ কিলোমিটার যাবার পর পৌঁছোলাম সপ্তশয্যা গ্রামে। আর-পাঁচটা গ্রামের সঙ্গে এই গ্রামের আপাতদৃষ্টিতে তেমন কোনও প্রভেদ নেই। মাঝে মাঝে ছোটো পুকুর, কুঁড়ে ঘরের পাশে মুরগি ছুটে বেড়াচ্ছে, পথের পাশে কোথাও অলস কুকুর শুয়ে আছে। গ্রাম ছাড়াতেই পথের দুপাশে জঙ্গল শুরু হল। অটোচালক দীপু জানাল, চোরা কারবারিদের দৌরাত্মে পথের দুপাশে জঙ্গল হালকা হয়ে গিয়েছে। আরও কিছুদূর এগোতেই বাঁ পাশে সপ্তশয্যা স্যাংচুয়ারির গেট।

আমাদের অটো এগিয়ে চলল। আরও প্রায় ১ কিলোমিটার এগোনোর পর গাড়ি এসে থামল অটোস্ট্যান্ডে। এখান থেকেই চড়াই শুরু, তাই অটো আর এগোবে না। সঙ্গে কার থাকলে এগোতে পারতাম আরও প্রায় ২ কিলোমিটার রাস্তা। প্রথমে সিমেন্ট বাঁধানো রাস্তা কিছুদূর পর্যন্ত, বাকিটা মাটির পথ। সপ্তশয্যা গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত সর্দার ব্লকের অধীনে গাড়ি পার্কিং-এর ওই জায়গা।

কেমন যেন থমথমে লাগল জায়গাটা। পথের পাশে অদূরে কয়েকটি লোক বোধ হয় তাস খেলায় ব্যস্ত। পদযাত্রার শুরুটা ভালো লাগল না মোটেই। পথের দু’পাশে গাছের ছায়ায় বিকেল সাড়ে ৪টেতেই আলো কমে এসেছে। দীপু অভয় দিল, আপনারা এগিয়ে যান। সে তার ফোন নাম্বার দিয়ে দিল, যাতে হঠাৎ দরকার পড়লে ওর সাহায্য চাইতে পারি। নিস্তব্ধ, নির্জন বনাঞ্চল। তাই হাঁটা শুরু করলাম একটু জোরেই।

আমার কাছে এই চড়াই সামান্য, বরং ভালো লাগছিল দুই পাশে জঙ্গল দেখে। গৃহিণীর মুখ ভার। জানাতে ভুলল না, গাড়ি নিয়ে এলে এই চড়াই পথটা পেরিয়ে যেতে পারতাম অনায়াসে। বুঝলাম, ওর কষ্ট হচ্ছে। এদিকে গন্তব্যে তাড়াতাড়ি পৌঁছোতে না পারলে সন্ধে হয়ে যাবে। অস্বীকার করছি না, আমিও কিছুটা অস্বস্তিতে রয়েছি। নিরাপত্তার কথা ভেবে। দীপুর কাছ থেকে কিছু উদ্বেগদায়ক তথ্য জেনেছি যে। ‘এই তো সামান্য দূরত্ব’ বলে তাকে উৎসাহ দিতে থাকি।

travel kapilas

কিছু দূর এগোনোর পরেই উপর থেকে নীচে নেমে এল মোটর সাইকেলে চাপা দুই যুবক। সে ভীত, আমি কিন্তু একটুও উদ্বেগ প্রকাশ করলাম না। আরও দশ-বারো মিনিট হাঁটার পর দেখি, বাইকে চেপে নেমে আসছে আরও তিন যুবক। আমি তাদের থামতে অনুরোধ করি, তারা থামেও। ভদ্রসন্তান মনে করে তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করি, পথ আর কতটা? সে জানায়, এক কিলোমিটারও বাকি নেই। অন্য জন জানায়, বাকি পথটুকু চলা একটু মুশকিল। আড়চোখে তার দিকে তাকিয়ে নিয়ে ধন্যবাদ জানাই তাদের। আমাদের আশ্বস্ত করে তারা জানায়, উপরে আরও দু-তিনটে ফ্যামিলি এসেছে বেড়াতে। এবার তার মুখে হাসি ফেরে।

আরও মিনিট দশেক চড়াই ভেঙে এক প্রশস্ত জায়গায় এসে পৌঁছোলাম। সেখানে বাঁ পাশে পার্ক করা রয়েছে একটি কার ও একটি জিপ। উলটো দিক থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে একেবারে সোজা। সে সেখানেই বসে পড়ে বিশ্রাম নিতে। আমি এবার নির্ভয়ে সিঁড়ি চড়তে থাকি। উপর থেকে নেমে আসছিল ৬-৭ জনের এক বাঙালি পরিবার। আমি তাদের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করি, আর কতগুলো সিঁড়ি চড়তে হবে মন্দিরে পৗঁছোতে? এক অল্পবয়সি মেয়ে জানায়, ঠিক ১০০টা সিঁড়ি।

চওড়া সিঁড়ি, বাঁ পাশে রেলিং। আমি দ্রুত উঠতে থাকি। উপরে এসে দেখি এক প্রশস্ত চাতাল। সেখানে এক পাশে সপ্তঋষির আশ্রম, আসন বা শয্যা, তাই এই অঞ্চল ‘সপ্তশয্যা’ নামে পরিচিত। মতান্তরে, এই গ্রাম চারিদিক সাতটি পাহাড় দিয়ে ঘেরা, তাই গ্রামের ওই নাম। এই অঞ্চলকে নিয়ে প্রচলিত আছে আরও ‘মিথ’ বা পুরাণকাহিনি। যেমন, বনবাসকালে শ্রীরাম এই স্থানে সাত দিন অতিবাহিত করেন। আরও এক কাহিনি জানায়, পাণ্ডবেরা তাঁদের ১২ বছর অজ্ঞাতবাসকালে এই সাত পাহাড়কে পছন্দ করেন আশ্রয়স্থল হিসেবে।

কারণ যাই হোক, আমি এগিয়ে গিয়ে আরও কিছু সিঁড়ি ভেঙে পৌঁছে গেলাম রঘুনাথ মন্দিরে। ভারি সুন্দর শান্ত পরিবেশ। শ্রীরামের সুন্দর মূর্তি সামনে। অন্যান্য দেবদেবীর বিগ্রহগুলিও ভারি সুন্দর। পুরোহিতকে পুজোর প্রণামী এবং যজ্ঞের জন্য কিছু অনুদান দিয়ে নীচে নামতেই দেখি সেও উপস্থিত। আমি বললাম, মন্দির ও বিগ্রহ দর্শন করে তাড়াতাড়ি নীচে নেমে আসতে। আলো কমে আসছে, অথচ আরও কয়েকটা জায়গা দেখা বাকি তখনও। আমরা দুজনে দ্রুত নামতে লাগলাম।

হঠাৎ কিছু মনে হওয়ায় পিছন ফিরতেই দেখি, ৩-৪টি বাঁদর সামান্য দূরত্ব রেখে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে। বুঝলাম, আমার হাতের পলিথিন প্যাকেটটাই তাদের লক্ষ্য। এবার পথের পাশে গাছের ডাল থেকে নেমে এল আরও দু’টি বাঁদর। অবস্থা বেগতিক দেখে পথে পড়ে থাকা লাঠি সদৃশ একটা ডাল তুলে নিলাম হাতে। লাঠি দেখালে তারা পিছিয়ে যায়, পরক্ষণেই এগিয়ে আসে।

এই সময় নীচের গাড়ি স্ট্যান্ড থেকে এক স্থানীয় ব্যক্তি হাতে একটা মোটা লাঠি নিয়ে উঠে এসে আমাদের সঙ্গ দিল এবং বাঁদরকূলকে ভয় দেখিয়ে আমাদের গাড়ি স্ট্যান্ডে নিয়ে এল। জানাল, এটা তার রুটিন কাজ– বিনিময়ে তার কিছু রোজগার হয়। আমরাও খুশি হয়ে উপকারী, গরিব মানুষটিকে কিছু অর্থ সাহায্য করলাম।

অটোয় চড়ে বসলাম। ড্রাইভার দীপু একেবারে সোজা এসে গাড়ি থামাল সপ্তশয্যা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারির গেট-এ। মাত্র ২০ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই স্যাংচুয়ারি একটি ইকো ট্যুরিজম কমপ্লেক্স ও রিজার্ভ ফরেস্ট। ছোটানাগপুর প্লেটোতে অবস্থিত এই মিশ্র পর্ণমোচী অরণ্যে শাল গাছেরই আধিক্য। রয়েছে মহুয়া, পলাশ, আম এবং আরও কিছু চেনা-অচেনা গাছ। ১৯৭০ সালে এই রিজার্ভ ফরেস্ট স্যাংচুয়ারির মর্যাদা পায়। জঙ্গলে দেখা যায় গরু, ছাগল, মোষ ও লেপার্ড। বহু রকমের পাখি এই ছোটো জঙ্গলের প্রধান আকর্ষণ।

সন্ধে ঘনিয়ে আসছে। অটোয় চেপে চলে এলাম আইসিএআর অধীনস্থ সপ্তশয্যা ম্যাঙ্গো জার্মপ্লাজম ব্যাংক যেখানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সৃষ্টি করা হয়েছে উন্নত প্রজাতির আম গাছ। একটু এগিয়েই দেখি হর্টিকালচার ডিপার্টমেন্ট-এর সেগুন গাছের বাগান এবং বি-ফার্ম। উলটো দিকে তাকালেই অপরূপ প্রকৃতি, সপ্তশয্যার সাত পাহাড়। ছবি তুলে গাড়িতে এসে বসলাম। গাড়ি এসে থামল সীতারাম মন্দির কমপ্লেক্স-এ। এই স্থানে অন্নপূর্ণা মন্দির, কালী মন্দির এবং সূর্যনারায়ণ মন্দির স্থাপিত হয় যথাক্রমে ১৯৮২, ১৯৮৫ এবং ১৯৯০ সালে। এই মন্দির কমপ্লেক্স-এ আরও রয়েছে রামেশ্বরম শিব, গণেশ এবং মহাবীর মন্দির। ভারি সুন্দর নবগ্রহ মন্দিরটি। দেখা শেষ করে আবার অটোয় চড়ে বসলাম।

গাড়ি চালানোর মাঝে দীপু জানাল কাছাকাছি গ্রামগুলোর নাম বদ্রপল্লী, কামনিং, পদ্মনাভপুর ও পত্রভাগ। সপ্তশয্যা গ্রাম পেরিয়ে চলে এলাম মহিসাপোত রোড-এ। অটো দ্রুত ফিরে চলেছে আমাদের হোটেলের পথে। পর পর কয়েকটি সরকারি কার্যালয়, কলেজ বিল্ডিং এবং কৃষি বিজ্ঞান কেন্দ্র পেরিয়ে চলে এলাম ইস্ট ইন্ডিয়া মার্কেট কমপ্লেক্স। কয়েক মিনিটের মধ্যেই পৗঁছে গেলাম আমাদের হোটেলে।

ঘরে এসে মুখ-হাত ধুয়ে বাতানুকুল পরিবেশে আরাম পেলাম। ফোনে অর্ডার দিতে পাঁচ মিনিট পরেই ঘরে এসে গেল গরম চা। চা পান করার একটু পরেই অমরেশ পারিডা-র ফোন এল। জানাল, আমাদের ইচ্ছেমতো পরদিন সকাল ৯টার মধ্যেই গাড়ি প্রস্তুত থাকবে হোটেল প্রাঙ্গণে। গাড়ি আমাদের কপিলাস মন্দির কমপ্লেক্স, জুলজিক্যাল পার্ক, সাঁই মন্দির দেখিয়ে নিয়ে যাবে জোরান্ডায়। রাতে আমাদের পৗঁছেও দিয়ে আসবে ঢেনকানল স্টেশনে। কার-এ পুরো ট্রিপ-এর খরচা পড়বে ২৫০০ টাকা। আমি তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলাম। ডিনার ঘরেই আনালাম গরম তাওয়া রুটি ও চিকেন কড়াই। সুস্বাদু খাবার খেয়ে রাত ১০টাতেই বিছানায়।

সকাল ৬টায় ঘুম থেকে উঠে চলে এলাম নীচে, হোটেলের সুন্দর বাগানে। হালকা ঠান্ডা বাতাসে ভারি ভালো লাগছিল। হোটেলের গেট পেরিয়ে চলে এলাম হাইওয়ের কাছে। একের পর এক লরি চলেছে কটক-ভুবনেশ্বরের পথে। একটু পরে ঘরে ফিরতেই গরম চা পেয়ে গেলাম। চা খেয়ে একে একে স্নান সেরে নিলাম। সকাল ৮টা নাগাদ চলে এলাম ডাইনিং রুমে। কমপ্লিমেন্টারি ব্রেকফাস্ট-এ আমাদের পছন্দমতো গরম ইডলি-বড়া চলে এল সাম্বার-চাটনি সমেত। পরে গরম কফি। ঘরে ফিরে সদাসঙ্গী ক্যামেরা ও দুটো ঠান্ডা জলের বোতল নিয়ে নীচে নেমে এলাম। রিসেপশন পেরিয়ে বাইরে এসে দেখি, বাগানের পাশে গোলাকার পথে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।

আমরা গাড়িতে চড়ে বসলাম। হোটেল থেকে একটু এগিয়েই গাড়ি চলে এল হাইওয়েতে। যে দিকে সপ্তশয্যা গিয়েছিলাম তার উলটো পথে গাড়ি চলতে লাগল। কিছুদূর এগিয়ে গাড়ি বাঁদিকের সরু পিচ রাস্তায় ঢুকে পড়ল। ডান পাশে শ্যামাচরণপুর স্টেশন, খুরদা রোড ডিভিশনে ঢেনকানলের বাইপাস স্টেশন। আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল সোজা পথে। ডান পাশে গভর্নমেন্ট আইটিআই বিল্ডিং ছাড়িয়ে চলে এলাম কাইমাটি গ্রামে। রাস্তার দুই দিকেই দৃষ্টি প্রসারিত করে মুগ্ধ হচ্ছি পূর্বঘাটের ছোটো-বড়ো পাহাড়ের অসাধারণ সৗন্দর্যে। কিছুদূর এগিয়ে বাঁপাশের পেট্রল পাম্প থেকে গাড়িতে তেল ভরা হল।

কপিলাস-এর দূরত্ব ঢেনকানল থেকে ২৬ কিলোমিটার। পথের দুপাশে বড়ো, বড়ো সবুজ গাছ– আম, বট, খেজুর, তাল, নারকেল, শাল ও মহুয়া। আর দেখছি, সবুজ চাষজমি। দিগন্তে পাহাড়। গাড়ির ড্রাইভার চিত্রসেন মহান্তি ভারি ভালো লোক। যেখানে বলছি সেখানেই গাড়ি দাঁড় করাচ্ছে সে। আর আমরা নেমে এসে ফটো তুলছি প্রকৃতির।

আমাদের গন্তব্য কপিলাস। কপিলাসকে বলা হয় ‘ওড়িশার কৈলাস’। চারদিকেই পূর্বঘাটে ঘেরা কপিলাস যেন ছবির মতো সুন্দর! পথের দু’পাশেই জঙ্গল– শাল, সেগুন, কেন্দু, জারুল ও মহুয়া ছাড়াও আরও বহু প্রকার গাছ সেখানে। জঙ্গলে রয়েছে প্রধানত বাঁদর, জংলী বিড়াল, ময়ুর ও কাঠবিড়ালী। স্থানীয় মানুষ বিশ্বাস করেন, কপিলাস স্বয়ং মহাদেব চন্দ্রশেখরের আসন।

গ্রামের সমতল পথ ছাড়িয়ে উঠে এসেছি অনেকটা উঁচুতে। এখন পাহাড়কে পাক দিয়ে পথ ক্রমশই উপরে উঠছে। সমতল থেকে কমপক্ষে ১৩৫২-টি সিঁড়ি ভেঙেও মন্দিরে পৗঁছোনো যায়। আমরা এলাম বড়াবাংকি হয়ে মোটর পথে। এবার বাঁপাশে কিছুদূর এগোতেই কপিলাস মন্দিরের প্রবেশ তোরণ। একটু এগিয়ে ডান দিকে বাঁক নিতেই গাড়ি স্ট্যান্ড। ঘড়িতে সকাল সোয়া দশটা। গাড়ি থেকে নেমে চলে এলাম সারিবদ্ধ দোকানগুলোর একটাতে। সেখানে

চটি-জুতো রেখে কিনে নিলাম পুজো সামগ্রী। ধীরে ধীরে এসে পৌঁছোলাম শ্রীচন্দ্রশেখর মহাদেব মন্দিরে। গত তিন বছর ধরে মনের মধ্যে পোষণ করা ইচ্ছা বাস্তব রূপ পেল আজ। চন্দ্রশেখর মহাদেব মন্দিরের প্রধান অংশের উচ্চতা ৬০ ফুট। গঙ্গা বংশের রাজা প্রথম নরসিংহদেব ১২৪৬ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। মন্দিরের বাম পাশে ‘পয়মন্ত কুণ্ড’এবং ডান পাশে ‘মারীচি কুণ্ড’। চন্দ্রশেখর মন্দিরের চারিপাশে বিভিন্ন দেব-দেবীর মন্দির এবং প্রতিটি মন্দিরেই বহু সংখ্যায় বাঁদরের উদ্বেগজনক উপস্থিতি। লম্বা লাইনে দাঁড়ালাম পুজোর জিনিস সমেত যথেষ্ট সতর্কতায়।

মিনিট কুড়ির মধ্যেই নন্দীকে প্রণাম জানিয়ে, ঘণ্টা বাজিয়ে প্রবেশ করলাম মহাদেব মন্দিরে। গর্ভগৃহে বিরাট শিবলিঙ্গ রূপে পূজিত হচ্ছেন শ্রীচন্দ্রশেখর মহাদেব। মন্দিরে রয়েছেন কাঠের তৈরি জগমোহন, শ্রীগণেশ, কার্তিকেয় এবং গঙ্গাদেবী। পতিতপাবনী শ্রীজগন্নাথ পূজিত হচ্ছেন পার্শ্বদেবতা হিসেবে। মন্দিরের পাণ্ডারা ভদ্র এবং যথেষ্ট শৃঙ্খলা-পরায়ণ। এবার চললাম শ্রীবিশ্বনাথ মন্দিরে। প্রায় ১৫-২০টা সিঁড়ি ভেঙে উঠে ডান দিকে এগিয়ে পৌঁছে গেলাম মন্দিরে।পণ্ডিতগণের মতে বিশ্বনাথ মন্দির চন্দ্রশেখর মন্দিরের চেয়েও বেশি পুরোনো। এগিয়ে গেলাম শ্রীনারায়ণ মন্দিরে। তারপর অন্য পথ দিয়ে নীচে নেমে এলাম। পৌঁছোলাম শ্রীপার্বতী মন্দিরে। এখানেও অনেক পূণ্যার্থী পুজো দিচ্ছিলেন। আমরাও তাই করলাম। মন্দির চত্বরে দাঁড়িয়ে আরও একবার ভালো করে দেখে নিলাম শ্বেতবর্ণের মন্দিরগুলিকে।

কিছুদূর হেঁটে পৗঁছে গেলাম আমাদের জন্য অপেক্ষারত সিয়াজ গাড়িতে। ড্রাইভারকে প্রসাদ দিয়ে আমরাও প্রসাদ নিলাম। মনে ভারি আনন্দ নিয়ে চড়ে বসলাম গাড়িতে। চিত্রসেন জানাল, আমরা এবার যাব কপিলাস জু দেখতে। ছোট্ট এই জু-এর বিশেষত্ব হল, প্রায় সব জন্তু, সরিসৃপ ও পাখিই ঢেনকানল অঞ্চলের জঙ্গল থেকে উদ্ধার করা। মাত্র ৭-৮ মিনিট পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম জু ও ডিয়ার পার্ক সহ কপিলাস বায়োলজিকাল পার্ক-এর প্রবেশদ্বারে।

travel joranda

ঘড়িতে তখন বেলা সোয়া ১রটা। জন প্রতি ২০ টাকার টিকিট কেটে প্রবেশ করলাম এক অতি সুন্দর জুলজিক্যাল গার্ডেনে। সাজানো জু-তে দেখলাম অনেক রকম পাখি, সরীসৃপ ও জন্তু। শেষে প্রায় ৫-৬ মিনিট হেঁটে পৌঁছোলাম বিশাল ডিয়ার পার্কে। সেখানে চরে বেড়াচ্ছিল অন্তত ৩৫টা চিতল হরিণ ও কয়েকটা শিঙাল শম্বর। কিছুটা সময় বেশ ভালো কাটল বায়োলজিকাল পার্কে। সেখান থেকে বাইরে এসে চড়ে বসলাম আমাদের কারে। ড্রাইভার জানাল, এবার চলেছি সাঁই মন্দিরে। মিনিট পাঁচেক গাড়ি চলার পর এসে পৌঁছোলাম গন্তব্যে।

বিরাট প্রবেশদ্বার দিয়ে ভিতরে এসে মনে হল, মন্দির কোথায়! এতো কয়েকটি বিশাল অট্টালিকার সমাবেশ। ভক্তি তো দূরের কথা, এত বৈভব ভালো লাগল না মোটেই। আমি এক জায়গায় বসে ভাবছিলাম, সিরডি সাঁইবাবার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কথা। গৃহিণী ঘুরে ঘুরে সব দেখে দশ মিনিট পরে ফিরলেন কল্পতরুর নীচে, যেখানে আমি বসেছিলাম। বাইরে এসে চড়ে বসলাম কারে। গাড়ি চলতে শুরু করার পরই চিত্রসেন জিজ্ঞেস করল, আমরা এবার কোথায় যাব? আমি জানাই, আমাদের হোটেলে।

দুপুর সাড়ে ১২টা বেজেছে। আমাদের হাতে পর্যাপ্ত সময়। সন্ধের আগে হোটেলে ফিরলেই চলবে– ঘরে ফেরার ট্রেন সেই রাত ১১টায়। গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা চলে এলাম হোটেলে। মুখ-হাত ধুয়ে চলে এলাম ডাইনিং রুমে। ভাত, ডাল, মিক্সড ভেজিটেবলস এবং মিষ্টি দই সহযোগে সেরে নিলাম তৃপ্তিদায়ক লাঞ্চ। সোয়া ১টা নাগাদ গাড়িতে এসে বসলাম। ‘জোরান্ডা গাদি’বা মন্দির কমপ্লেক্স কপিলাস থেকে ৩২ কিলামিটার দূরত্বে অবস্থিত। প্রায় ঘণ্টাখানেকের রাস্তা।

ঢেনকানল জেলার গোন্ডিয়া তহশিলে জোরান্ডা গ্রাম। কপিলাস রোড ধরে যাত্রা শুরু করলাম। গাড়ি চলছে দ্রুত গতিতে। নেউলাপোই এসে পৌঁছোলাম আধ ঘণ্টা পরে। এবার দেওগাঁও গ্রাম্য রোড ধরে এগিয়ে চললাম। রাস্তার অবস্থা ভালোই। তাই জোরান্ডা গাদি-তে পৌঁছে গেলাম দুপুর ২টো-র পরেই। জোরান্ডা, নাতিমা ও পাটনা– এই তিন গ্রামের মিলনস্থলে মন্দির কমপ্লেক্স অবস্থিত। এই স্থানেই বিশ্বব্যাপী মহিমা আন্দোলনের কেন্দ্রীয় দফতর।

‘জোরান্ডা গাদি’ হল ‘সর্বোচ্চ প্রভু’-র প্রতি উৎসর্গীকৃত কয়েকটি অসাধারণ মন্দিরের সমাবেশ। ‘মহিমা ধর্ম’-এ বিশ্বাসী ভক্তজনেরা প্রভুর পুজো করেন শূন্য ব্রহ্ম বা নিরাকার দেবতা হিসেবে। এই ধর্মগোষ্ঠীর মধ্যে

মূর্তি-পুজো নিষিদ্ধ।

নির্দিষ্ট জায়গায় গাড়ি পার্ক করা হল। গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গেলাম শ্বেত বর্ণের মন্দিরগুলির কাছে। মন্দিরের প্রাচীরও শ্বেত বর্ণের। বেশ কয়েকজন দর্শনার্থীকে দেখলাম মন্দিরের বাইরে। মন্দির চত্বরে প্রবেশ করে কয়েকজন কৗপীনধারী মহিমা ধর্মগোষ্ঠীভুক্ত সাধুরও দর্শন পেলাম। এই মন্দিরগুলি নির্মিত হয় ২০ শতকের শুরুতে, যদিও ১৪ শতকের শুরুতেই এই স্থানে পুজোস্থল ছিল। মহিমা ধর্মের প্রবর্তক মহিমা গোস্বামীর সমাধিপীঠও এই স্থানে। প্রথাগত ভারতীয় ধর্মগুলির তুলনায় মহিমা ধর্ম ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। তবে এই ধর্মের রীতি-নীতির সঙ্গে কিছু সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায় পঞ্চশাখা, বৌদ্ধ ধর্ম, তন্ত্র এবং জৈন ধর্মের সঙ্গে।

ঢেনকানলের মহারাজা ভগীরথ মহীন্দ্রা বাহাদুর, মহিমা স্বামীকে তাঁর অবস্থান ও মতধারা প্রচার করার জন্য এই অঞ্চল দান করেন। প্রায় ৮০ একর জায়গা জুড়ে ‘মহিমা গাদি ধাম’অবস্থিত। মহিমা গাদি মন্দির, উন্মুক্ত মন্দির, অগ্নিপূজা মন্দির এবং আশ্রম এই ধামে অবস্থিত। এখানে শোভা পাচ্ছে এক অনির্বান অগ্নিশিখা। প্রধান মহিমা পুজোস্থলে গাদি মন্দির, ধুনি মন্দির, অখণ্ডবাতি মন্দির এবং ঘণ্টা মন্দির অবস্থিত। এই আশ্রমে রয়েছেন বিভিন্ন শ্রেণীর তপস্বী, সাধু এবং তাঁদের অনুগামীরা, যাঁরা নিষ্ঠা সহকারে পুজোর দৈনিক কার্যবিধি পালন করে চলেছেন। এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা লাভ করে গাড়িতে এসে বসলাম। গাড়ি ফিরে চলল ফেলে আসা পথে।

ঘড়িতে দেখি বিকেল সাড়ে ৩টে বেজে গেছে। মসৃণ রাস্তায় গাড়ি ছুটে চলল। দু’পাশেই চাষের খেত। দেখছি অজস্র খেজুর গাছ। এবার নজরে এল পর পর কয়েকটি কাজু প্ল্যান্টেশন। মন হারিয়ে যাচ্ছে দূরের পূর্বঘাটে। গরমের দাবদাহ নেই, এত হাওয়া! ফিরে এলাম সুন্দর কাইমাটি গ্রামে। একটু পরেই গ্রাম ছাড়িয়ে চলে এলাম শ্যামাচরণপুর স্টেশনের কাছে। সেখান থেকে গাড়ি চলে এল এনএইচ-৫৫তে। আরও ৪-৫ কিলোমিটার দূরন্ত গতিতে চলার পর বিকেল পৗনে ৫টা নাগাদ পৌঁছে গেলাম হোটেলে।

রাত সাড়ে ৮টায় চলে এলাম ডাইনিং রুমে। পনির মশালা ও তাওয়া রুটিতে ডিনার সেরে নিলাম এবং হোটেলে থাকাখাওয়ার বিল মিটিয়ে দিলাম। ঘর থেকে লাগেজ নিয়ে এসে যখন অপেক্ষমান গাড়িতে চড়ে বসলাম, তখন ঘড়িতে রাত প্রায় ১১টা। মিনিট ২০ পরে পৌঁছে গেলাম ঢেনকানল স্টেশনে। এক মনের মতো ভ্রমণ সেরে ফিরে চললাম রাউরকেলার দিকে।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...