‘আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল…’
সময়টা এখন ডিসেম্বরের শেষ। সাড়ে দশটার নরম হলুদ সকাল। ব্রেকফাস্ট সেরে হোটেলের সামনে থাকা সুন্দর করে সাজানো লনে এসে বসেছি। সামনে আদিগন্ত নীল, শুধু নীল জল। গোপালপুর অন সি-তে আসার ইচ্ছা আমার অনেক দিনের।
‘বাবাই, ফুল ছেঁড়ে না’, চেঁচিয়ে ওঠে সুমি, ‘ওঃ, এই এক ছেলে হয়েছে, এত অসভ্য! আমি আর পারি না। রাকেশ, এই রাকেশ, দ্যাখো তোমার ছেলে একটুও কথা শোনে না।’
টঙ্কাস ততক্ষণে টবের গাছ থেকে বেশ কয়েকটি ফুল ছিঁড়ে, মুঠোয় ভরে হাসছে। ওর চোখে-মুখে দিব্যতা, দুষ্টুমি ঝরে পড়ছে।
ভায়রা রাকেশ সকলের সঙ্গে সেলফি তুলে বেড়াচ্ছিল। ছুটে এসে ছেলের মাথায় সাঁটিয়ে কষাল এক উড়ন-চাঁটি। তাতে বছর ছয়েকের টঙ্কাস একটু থতমত খেয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকাল, তবে কাঁদল না। মাথার পিছনে হাত বুলিয়ে বুলিয়ে ঘটনার গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করতে লাগল সম্ভবত। ও মোটেও ছিঁচকাঁদুনে নয়। তবে খুব দুরন্ত।
রাকেশ চোখ পাকিয়ে বলে উঠল, ‘তোমাকে কতবার বারণ করা হয়েছে অসভ্যতা না করতে।’
পরিস্থিতি সামাল দিতে আমি এগিয়ে গেলাম।
ওদিকে মেয়েরা হোটেলের লনে বিভিন্ন পোজে বিভিন্ন পজিশনে কখনও একক, কখনও বা যৌথ ভাবে ফটো তুলতে ব্যস্ত। খেয়াল নেই, সকলেই প্রায় ঘরোয়া পোশাকে রয়েছে।
হোটেলের নাম ‘সং অফ দ্য সিগাল’।
নামটি শুনলেই সমুদ্রের ফেনার মতন হালকা হয়ে যায় মন। নীল জল যেখানে বালির সীমানা ছুঁয়েছে তার ওপর উড়তে থাকা শঙ্খচিলগুলোর ডাক বুঝি শোনা যায় বুকের গভীরে।
অসীম আর হরলালদা এগিয়ে আসে আমার দিকে। ওরা আমাদের খানিক পর ব্রেকফাস্ট সেরে বেরোল। হরলালদা কাছে এসে বলল, ‘আরে শালাবাবু, একটু ধূমপান চলবে নাকি?’
‘চলো, ওদিকটায় গিয়ে বসি’, বলে আমি ওদের হোটেলের গাড়িবারান্দার কাছাকাছি নিয়ে গেলাম। কয়েকটি চেয়ার টেনে বসলাম তিনজন। তারপর সিগারেট ধরালাম।
বললাম, ‘গতকাল ইস্টকোস্ট এক্সপ্রেস লেটে চলছে জেনে দুশ্চিন্তায় পড়েছিলাম। সঙ্গে বাচ্চা-কাচ্চা, মেয়েরা। কারণ, শুনেছিলাম গোপালপুর জায়গাটা পুরীর মতন অত জমজমাট নয়, বেশ ফাঁকা ফাঁকা।’
অসীম বলল, ‘কী আর এমন লেট করল ট্রেন? শেডিউলড টাইম ছিল দশটা পঞ্চাশ। তার জায়গায় ট্রেন ব্রহ্মপুর স্টেশনে ঢুকল সাড়ে এগারোটায়। এতেই লেট বলছ?’
‘মালপত্তর নিয়ে স্টেশন ছেড়ে বেরোতে বেরোতে আরও আধ ঘন্টা’ বলল হরলালদা, ‘আরে তুমি তো রেল কোম্পানির লোক, কোম্পানির দোষ কি আর চোখে দেখতে পাবে? কী বলো, গৌতম?’ আমার সাপোর্ট চায়।
হরলালদা সম্পর্কে অসীমের বড়ো ভায়রা হয়। ফলে সুযোগ পেলে লেগপুল করতে ছাড়ে না।
‘হ্যাঁ, সে আর বলতে’, বললাম আমি তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আবির কোথায় গেল? ওদের কি এখনও ব্রেকফাস্ট শেষ হয়নি?’
‘তোমার হ্যান্ডসাম ফ্রেন্ডকে দেখলাম এই হোটেলের মালকিনের সঙ্গে কী একটা বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনায় মগ্ন’, হরলালদা জবাব দিল।
আমি হরলালদার চোখের দিকে তাকালাম সরাসরি। ওর কথার শেষ দিকে কীসের যেন ইঙ্গিত কানে বাজল। আর মুহূর্তেই বিশালজির মিসেসের ছবিটা মাথার মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠল।
গতকাল রাতে ব্রহ্মপুর স্টেশন থেকে হোটেলে পৌঁছোতে খুব বেশি যে সময় লেগেছিল তা নয়। ট্রাভেল এজেন্ট শুভজিৎ চৌধুরি স্টেশনে দুটি গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। রাত দশটা থেকেই ড্রাইভাররা আমাদের সঙ্গে কনট্যাক্ট রাখছিল। ফলে ব্রহ্মপুর পৌঁছে গাড়ি পেতে অসুবিধা হয়নি আমাদের। সতেরো কিলোমিটার দূরত্ব। গভীর রাতের ফাঁকা রাস্তায় আসতে বড়ো জোর আধ ঘন্টাটাক। তবে এখানে তখন রাত নিশুতি।
হোটেলে পৌঁছে মেন গেটে নক করতে বিশালজি দুটি রুম-বয়কে নিয়ে এগিয়ে এলেন। হোটেলে পা রাখতেই দেখলাম বাঘের মতন বিশালকায় কালো কুকুর একবারে চেন বাঁধা অবস্থায় আমাদের স্বাগত জানাতে প্রস্তুত। আমরা পাঁচটি পরিবার নির্দিষ্ট পাঁচটি রুমে প্রবেশ করলাম। ছেলে দুটি আমাদের লাগেজ পৌঁছে দিল প্রত্যেকের রুমে। খাওয়া-দাওয়া ট্রেনেই সেরে এসেছিলাম। ফলে শীতের রাতে বেশি দেরি না করে যে যার মতন শুয়ে পড়লাম।
চিরকালের লেট রাইজার আমি। সাড়ে আটটা নাগাদ দরজায় ঠকঠক করে নক। অনিতাকে বললাম, ‘দ্যাখো তো, কে।’
দরজা খুলে ও দ্যাখে আমার পিসতুতো বোন বুলা। ওরা ব্রেকফাস্ট করতে ডাইনিং রুমে যাচ্ছে তা জানাতে এসেছে। ওদের এগোতে বলে অনিতা ঘুম থেকে ডেকে তুলল ফুলকে।
কিছুক্ষণের মধ্যে তৈরি হয়ে আমরা ডাইনিংয়-এ গেলাম। দেখলাম সেখানে কল্পনাদি, ওর হাজব্যান্ড হরলালদা, বুলা, ওর হাজব্যান্ড অসীম, ওদের কন্যা মাম, আমার বন্ধু আবির, ওর স্ত্রী ইরা, রাকেশ, ওর স্ত্রী সুমি ওদের ছেলে-মেয়ে নিয়ে সকলেই উপস্থিত এবং পাশাপাশি তিনটি টেবিল ভরে একদম হইচই জুড়ে দিয়েছে।
আমরা যেতে আর এক প্রস্থ শোরগোল উঠল।
ব্রেকফাস্ট সেরে আমিই প্রথম বেরিয়ে এসে লনে বসেছিলাম। একে একে সবাই আসতে লাগল।
ফটো তোলা শেষ করে রাকেশ এসে বলল, ‘যাই বলো গৌতমদা, হোটেলটা কিন্তু একঘর। প্রত্যেকেই সি-ফেসিং রুম পেয়েছে।’
বললাম, ‘চৌধুরি-কে সেরকম ব্যবস্থা করতেই বলেছিলাম।’
হরলালদা বলে উঠল, ‘দেখলে তো, তোমরা হোটেল বুক করলে ট্রাভেল এজেন্ট ধরে। আমি করলাম নিজে। তাও আবার তোমাদের থেকে পাঁচশো টাকা কম রেটে।’
‘তুমি যদি আগে থেকে জানাতে এখানে বেড়াতে আসবে তা হলে তোমার জন্যও ঘর বুকিং করতে বলতাম’, বললাম আমি।
‘আমি কী করে বলব? অসীম তো সব ব্যবস্থা পাকা করে তারপর আমাকে জানাল যে তোমরা গোপালপুর যাচ্ছ।’
‘এই লালদা, একদম বাজে কথা বলবেন না কিন্তু। আমি আপনাকে আগেই বলেছিলাম যে আমাদের গোপালপুর যাওয়া একদম ফাইনাল। গৌতম আর রাকেশ সব ব্যবস্থা করছে। আপনি তখন কী বললেন?’
‘কী বললাম?’
‘বললেন, আরে তোমাদের ব্যবস্থা আগে করো তো দেখি। ওরকম যাবার প্ল্যান-প্রোগ্রাম অনেক হয়। তারপর সব কেঁচিয়ে যায়।’
‘যাকগে ওসব, ট্রেনের টিকিট থেকে শুরু করে হোটেল বুকিং, তাও আবার একই হোটেলে পাশাপাশি রুমে থাকার ব্যবস্থা করলাম। তোমাদের থেকে কম রেটে। এবার তো তোমরা আমাকেই গুরু বলে মানবে!’
হরলালদার মুখে সাফল্যের হাসি।
রাকেশ বলে, ‘আচ্ছা গৌতমদা, এটা কীভাবে হয়? আমরা যে রুম দু-হাজার টাকা করে পার ডে-তে থাকছি, লালদারা সেই এক রুম দেড় হাজারে থাকছে কী করে?’
‘তোরা কি চৌধুরি-কে ব্যবসা-ট্যাবসা করতে দিবি না?’ বলতে বলতে আবির এসে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল। পরনে একটি গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি, আর আকাশি জিন্স।
ওর পিছন পিছন স্ত্রী ইরা। ইরা মহিলাদের দিকে এগিয়ে গেল।
রাকেশ বলল, ‘ব্যবসা বলে ব্যবসা? আমাদের চার-চারটি ফ্যামিলি চারদিন থাকবে পাঁচশো টাকা করে বেশি রুম রেন্ট দিয়ে?’
হরলালদা হাসতে হাসতে বলল, ‘বাকিটা শুনবে? তোমাকে এমন একটা খবর দেব যে গায়ে এক্ষুনি ফোসকা পড়ে যাবে।’
সবাই হরলালদার দিকে তাকাল।
একটু থেমে ও বলল, ‘আমার এক বন্ধু ফ্যামিলি নিয়ে আজ সন্ধ্যায় আসছে। ওরাও এই হোটেলেই উঠবে। ওদের জন্যও ঘর বুক করেছি আমি। একই রেটে, দেড় হাজার।’
চোখ-মুখ দেখে মনে হল, এবার বেশ রেগে গেল রাকেশ। বলল, ‘আমি যাচ্ছি, এক্ষুনি এর একটা হেস্তনেস্ত করা দরকার।’
অসীমও বলল, ‘ঠিকই তো, এটা ঘোরতর অন্যায়।’
আবির বলল, ‘বাহ্, বেশ জমেছে তো ব্যাপারটা। তবে কী জানেন অসীম, হোটেল মালিক বলবে, আপনারা আপনাদের ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে বোঝাপড়া করে নিন।’
অসীম বলল, ‘গৌতম, চৌধুরি-কে একবার ফোন লাগাও তো। দেখি ও ব্যাটা কী বলে। আমাদের এত পয়সা চোট যাবে?’
বললাম, ‘শোনো, চুপচাপ মাথা ঠান্ডা করে বোসো সবাই। একটিবার ভাবো তো, চৌধুরি যদি ট্রেনের টিকিট বুক করে না দিত এই গোপালপুর ট্যুর তোমাদের হতো? তোমার ট্রাভেল এজেন্টকে তুমি বললে, সে বলল, বড়ো জোর তিনটে টিকিট ম্যানেজ করতে পারবে। রাকেশের এজেন্ট বলল, চারটে কনফার্মড, দুটো আরএসি। তার বেশি সম্ভব নয়। আবির বলল, ও এ সবের মধ্যে নেই, সব দায়িত্ব আমাদের। তোমাদের এক এজেন্ট বলল, ট্রেনের টিকিটে পার হেড আড়াইশো করে নেবে, আর একজন বলল, দুশো করে। অপরদিকে চৌধুরি কী করল? সক্বলের টিকিট কনফার্মড, যাওয়া এবং আসা। পার হেড নয়, পার টিকিটে ও দেড়শো টাকা করে নিল। পরিবর্তে রুম রেন্ট থেকে কিছুটা কমিশন ম্যানেজ করল। চার দিনে পার ফ্যামিলি দু’হাজার টাকা। সেটা কি খুবই বেশি? ও তো ব্যবসা করতে বসেছে। আমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা ঠিকঠাক করে দিয়ে ও যদি দুটো টাকা রোজগার করে এতে অভিযোগের তো আমি কিছু দেখি না।’
আমার কথায় সকলে কিছুটা শান্ত হল বলে মনে হল। বললাম, বেড়াতে বেরিয়ে অত লাভ-লোকসানের কথা ভাবলে চলে? সুবিধা-অসুবিধার কথাগুলি একবার ভাবো।’
‘থাক গে ওসব, ছাড়ো’, বলে হরলালদা, ‘একটু পর বসবে তো?’
অসীম বলল, ‘সে আর বলতে? গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছে। আবির?
আবির বলল, ‘ভাবছি স্নানে যাব।’
‘আরে স্নানে তো আমরাও যাব’, চেঁচিয়ে উঠল রাকেশ।
বললাম, ‘গোপালপুর সি-বিচ সম্বন্ধে কিন্তু যথেষ্ট বদনাম আছে। বেশ কয়েকটা দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে শুনেছি।’
হরলালদা বলল, ‘আরে আমরা বেশি দূরে যাবই না। দু-পেগ করে মেরে জলে নামব।’
বললাম, ‘যা ভালো বোঝো করো।’
অসীম বলল, ‘তুমি নেবে না ড্রিংকস?’
‘নাহ্, দিনের বেলা ড্রিংকস নিতে ভালো লাগে না আমার। রাতে দ্যাখা যাবে।’
আমি চেয়ার ঠেলে উঠে দাঁড়ালাম।
আবির বলল, ‘আমি নেব, দু পেগ। ওনলি টু।’ আঙুল তুলে দ্যাখাল।
আমি আবিরের দিকে তাকালাম।
ও উঠে আমার কাছে এসে কানে কানে বলল, ‘তুই তো জানিস, মদ এবং মহিলা– পৃথিবীর কেবল মাত্র এই দুটি বিষয়ে আমার ভীষণ আগ্রহ।’
ওর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে একবার চোখ মেরে রহস্যময় হাসি হেসে ও চলে গেল।
রাকেশ বলল, ‘এই শোনো না, বিয়ার খেলে কেমন হয়? দুপুরবেলা বিয়ারই ভালো। না না, আমি বিয়ারই খাব।’
অসীম বলল, ‘যার যা খুশি খাও না, কে বারণ করেছে! আগে চলো, রেশনটা তো তুলে আনি।’
দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার খানিক পর বিশালজির সঙ্গে ঘুরে ঘুরে আমি হোটেলের চারপাশটা দেখছিলাম। প্রায় দু’বিঘা জমির ওপর দোতলা এই হোটেল। হোটেলের সামনের লন সবুজ ঘাসের নরম গালিচায় ঢাকা। সামান্য উঁচু পাঁচিল যাতে লনে বসে সমুদ্র দেখার কোনও অন্তরায় না হয়। অসংখ্য টবে নানা ধরনের ফুল গাছ। বেশ কিছু নারকেল গাছও আছে এক পাশে। লনে একটি হলুদ, একটি সবুজ ও একটি আকাশি কাঠের হেলান দেওয়া চেয়ার আছে যাতে রীতিমতন শুয়ে শীতের নরম রোদ উপভোগ করা যায়, আছে বেতের কিছু চেয়ারও।
বিশালজি বললেন, ‘ইয়ে হোটেল ম্যায়নে এক বাঙ্গালিসাব-সে খরিদা থা। আজ সে লগভগ বাইশ সাল পহলে। উস টাইম এক হি ফ্লোর থা। দুসরা ম্যায়নে বানায়া।’
বললাম, ‘পহলেসেই আপ হোটেল বিজনেস মে থে?’
‘নাহি সাব, ভুবনেশ্বর মে মেরা দো বড়িয়া দুকান থা। এক ডোমেস্টিক স্টিল অ্যাপ্লায়েন্স কা, দুসরা গারমেন্টস কা। এক মে ম্যায় বৈঠতা থা, দুসরা মে মেরি বিবি বৈঠতি থি। শুরু শুরু মে ইয়ে হোটেল ম্যায়নে লিজ মে লিয়া থা। চার সাল বাদ খরিদ লিয়া।’
‘আউর উও দো দুকান?’
‘উও দোনো আভিভি হ্যায়। লেকিন কিরায়ে পে দে দিয়া। অ্যাকচুয়ালি ইয়ে জগহ মুঝে ইতনা আচ্ছা লগা। ইতনা কাম অ্যান্ড কোয়ায়েট, পলিউশন ফ্রি। সোচা কি এহি পে রহে জাউ।’ উনি মৃদু হাসলেন।
দেখলাম, হোটেলের বাউন্ডারি ওয়ালের সঙ্গে গোপালপুরের বিখ্যাত লাইটহাউস এরিয়া একদম অ্যাডজাসেন্ট। পাঁচিলের ওপারটাই সরকারি এলাকা। লাল-সাদা রঙের সুউচ্চ লাইটহাউসটি বেশ সুদৃশ্য। তবে জানতে পারলাম, লাইটহাউস ঘিরে থাকা কয়েক বিঘা জমিতে সরকারি লোকজন থাকলেও জনসাধারণের জন্য প্রবেশ একেবারেই নিষিদ্ধ।
এই ফ্যামিলি পরিচালিত হোটেলটি আদ্যন্তই বিশালজি, তার স্ত্রী এবং জনাদশেক আঞ্চলিক ছেলে নিয়ে চালান। বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। খাবার-দাবার, রুম সার্ভিস, কোনও বিষয়েই অভিযোগ করার মতন কিছু নেই। ডিসেম্বর মাস, তাই হোটেলে বোর্ডার যথেষ্ট। দু’জন ফরেনারও দেখতে পেলাম।
হোটেল দেখে রুমে ফিরে এলাম। রুম থেকে পর্দা সরিয়ে কাচে ঢাকা সমুদ্রের দিকে তাকালে কেমন মায়াবী জগৎ বলে মনে হয়। অনিতা আর ফুল নীচে সুমিদের রুমে গেছে বোধ হয়।
আমি দরজা ঠেলে ব্যালকনিতে এসে বসলাম। হাত দশেকের মধ্যে একটি নারকেল গাছ। তারপর আরও একটি। লাইটহাউসের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে ওরা।
ব্যালকনি থেকে কুড়ি-বাইশ ফুট দূরে হোটেলের সামনের সীমানা পাঁচিল। সেখানে হাত দশেকের চওড়া রাস্তা। তারপর ঢাল নেমে গেছে প্রায় আড়াই-তিন তলা বাড়ির সমান। ঢালের শেষপ্রান্ত থেকে শুরু হয়েছে সি-বিচ। সি-বিচ চওড়ায় প্রায় দু-আড়াইশো ফুট, সংকোচনশীল। মোট কথা, সমুদ্র চোখের একদম নাগালে। তার জলদগম্ভীর অপূর্ব কণ্ঠস্বর বেশ স্পষ্ট এবং জোরালো ভাবেই জানান দিচ্ছে তার অস্তিত্ব।
বালির ওপর চারটি বাঁশ গেঁথে নীল পলিথিন টাঙিয়ে ডাব বিক্রি করা হচ্ছে কিছুটা দূর অন্তর অন্তর। এখন বিচে লোকজন কম। বিকেলের দিকে বোধহয় বাড়বে।
দূরে ভেসে যাচ্ছে জেলে ডিঙিগুলি।
রোদে চকচক করছে দূরের জল। তীরে ক্রমাগত আছড়ে পড়ছে ঢেউ। বেশ কয়েকটি শঙ্খচিল মন্থর ডানায় ভেসে বেড়াচ্ছে, যাকে বলে গ্লাইডিং।
সমুদ্রের দিকে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে থাকতে একটুও বোর লাগে না আমার। ঘন্টার পর ঘন্টা সমুদ্র দেখতে পারি আমি।
সামনের নারকেল গাছে একটি কাক উড়ে এসে বসল। বেশ কয়েকবার গলা ছেড়ে ডাকল। তারপর উড়ে গেল।
লাইটহাউসের শীর্ষে বিশালাকার ব্লেডটি ঘুরে চলেছে ক্রমাগত।
আমাদের ঠিক নীচের রুমটাই রাকেশদের। ওর ছেলে ছোটো, দুরন্ত। তাই গ্রাউন্ড ফ্লোরে রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সুমি ওর ছ-মাসের মেয়েকে সামলাতে ব্যস্ত। মেয়েতো নয়, যেন একটি ফর্সা গোলগাল পুতুল। যে-দেখে সে-ই অবাক হয়ে যায়, বলে, ‘কি মিষ্টি দ্যাখো বেবিটা।’
ওদের কিছু কিছু কথাবার্তা লাফিয়ে উঠে আসছে দোতলায়। দেখলাম টঙ্কাস একাই একটি বলে লাথি মেরে চলেছে ক্রমাগত। রাকেশের চিৎকার শোনা গেল, ‘বাবাই, পাঁচিলের বাইরে যাবি না।’
হরলালদা, অসীম, আবির সবাই বোধহয় বিশ্রাম নিচ্ছে।
হঠাৎ কলিংবেল বাজলে আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। ফুল বলল, ‘বাবা, কাল নাকি আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্ট আউট হচ্ছে।’
‘তো, তাতে কী হল?’
‘উফ্, আমার কপালটাই খারাপ। একটু শান্তি নেই। এতদিন ধরে কোথাও কিছু নেই, যেই দুদিনের জন্য বেড়াতে এসেছি অমনি উৎপাত। যাচ্ছেতাই একেবারে।’
দড়াম করে টয়লেটের দরজা বন্ধ করে দিল। একটু পর পা মুছে খাটে এসে বসল। একের পর এক বন্ধুকে শুরু হল ফোন করা।
বললাম, ‘চাপ নিস না, পাশ করে যাবি। তোর ওপর তো ফার্স্ট হবার কোনও দায় নেই। তোর মা কিংবা আমি কি কখনও দাবি করেছি যে তুই ফার্স্ট হয়ে দ্যাখা?’
‘তুমি কি একটু চুপ করবে? খুব মজা লাগছে তাই না?’
যা বাব্বা, কী কথার কী উত্তর। অনিতা মুচকি মুচকি হাসছিল। হাওয়া খারাপ দেখে খাটের ধার ঘেঁষে শুয়ে পড়লাম।
বিকেলে হোটেল থেকে বেরিয়ে খানিক এগিয়ে গেলাম আমরা দল বেঁধে। ভ্রমণার্থীদের জন্য গোপালপুরে বসার একমাত্র পার্কটি চোখে পড়ল। পার্কের এক পাশে পিচের রাস্তা। অপর পাশে ধাপে ধাপে সিঁড়ি নেমে গেছে সি-বিচে।
আমরা ছোটো ছোটো গ্রুপে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলাম।
হরলালদা আর অসীম চা পান শেষে ধূমপানে মনোযোগ দিল।
রাকেশ ওর বাচ্চার বায়না মেটাতে কী যেন খেলনা কিনে দিচ্ছে। আমার মেয়ে আর মাম নিজেদের মধ্যে আড্ডায় মত্ত।
বাকিরা পার্কের মধ্যে থাকা উঁচু বেদিতে বালি-সিমেন্টে তৈরি মৎস্যকন্যার সঙ্গে ফটো তুলতে ব্যস্ত। অনেক উঁচুতে স্ট্রিট লাইট। মনে হল ফটো তোলার জন্য আলো যথেষ্ট নয়।
আবিরকে সে কথা বলাতে ও বলে উঠল, ‘ফ্ল্যাশ অন করে ফটো তোল।’
একটু পরে রাকেশ, আবির আর আমি সিঁড়িতে বসে সমুদ্রের হাওয়া খেতে খেতে চা-ওয়ালাকে ডাকলাম। বলল, লিকার চা, বিট নুন আর লেবু দেওয়া। বললাম, ‘ঠিক আছে তাই চলবে।’
চা খেতে খেতে গল্পগুজব চলছিল।
অসীম আর হরলালদা কাছাকাছি কোথাও গেছে। বোধহয় রাতের প্ল্যান-প্রোগ্রাম করছে।
রাকেশ বলল, ‘গৌতমদা, কাল আমি সুমিদের নিয়ে পুরী যাচ্ছি। তুমি তো জানো ছেলের নামে একটা পুজো দিতে হবে।’
আবির বলল, ‘সে কী, এই তো এলে গোপালপুর। এখনই পালাতে চাইছ?’
‘না-না, পালাতে চাইছি না, পুজো দেবার প্রোগ্রাম আমার আগেই ছিল। গৌতমদা জানে। কী গো তোমাকে বলিনি?’
‘হ্যাঁ, তা কাল কখন বেরোবে তোমরা?’
‘লাঞ্চ করে। রাত্রে পুরীতে থাকব। পরশু পুজো দেব। আশা করছি পরশু রাতেই ফিরে আসতে পারব।’
‘দু-দুটো বাচ্চা নিয়ে চাপ হয়ে যাবে না?’
‘আরে তুমি ভেব না। পুজো তো আমাদের সকালেই দেওয়া হয়ে যাবে। দুপুরে একটু তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া সেরে বেরিয়ে পড়ব। তোমরা চিন্তা কোরো না। পরশু রাতের পার্টিতে অবশ্যই থাকছি।’
একটু দূর থেকে সুমি হঠাৎ ওকে ডেকে উঠল, ‘রাকেশ, এদিকে একটু এসো না।’
ও উঠে গেল।
দেখলাম রাকেশের ছেলে প্যাঁ প্যাঁ শব্দে বিচ্ছিরি এক বাঁশি ক্রমাগত বাজিয়েই চলেছে। ওর বয়সি দু-তিনটে ছেলেও জুটে গেছে। বাঁশি বাজানোর ফাঁকে ফাঁকে কী সব বকে চলেছে ওদের সঙ্গে।
আবিরকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘বল, তোর কী প্রোগ্রাম?’
‘ভাই তোকে সত্যি বলছি, গোপালপুর জায়গাটা মোটেও জমজমাট নয়। অন্তত তিন-চার দিন কাটানোর মতন নয়। নেহাত বিশালজির ওয়াইফ না থাকলে রাকেশের মতন আমিও পুরী কেটে পড়তাম।’
‘তুই আর পালটালি না’, বললাম আমি, ‘সেই কলেজ জীবন থেকে তো দেখছি। চল্লিশ ক্রস করেছিস, এবার তো সন্ন্যাস নেবার কথা ভাব।’
‘কী যে বলিস বন্ধু, সবে তো কলির সন্ধে। জানিস না, আফটার ফর্টি বয়েজ গেট নটি?’
‘একটা কথা বলি তোকে…’
‘হ্যাঁ বল না। তোর কথা শুনতে খারাপ লাগে না।’
‘নারী মধু নারী বিষ, বুঝেশুনে পা ফেলিস।’
সিগারেটে জোরে একটা টান মেরে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে জবাব দিল, ‘নাহ্, এ প্রবাদটা আগে কোথাও পড়েছি বা শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। আয়াম শিওর, ইউ হ্যাভ কয়েনড ইট।’
মৃদু হাসলাম, কিছু বললাম না। একবার ওকে আপাদমস্তক জরিপ করলাম। প্রায় ছ’ফুট উচ্চতার সুন্দর সুঠাম চেহারা। শ্যামলা রং, চোয়ালের কাঠিন্যে প্রকট পুরুষালি দৃঢ়তা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে। চোখেমুখে অদ্ভুত এক কনফিডেন্স। দেখেছি, এসব ছাড়াও কী এক অনির্বচনীয় ব্যক্তিত্ব ওর মধ্যে আছে যা কিছু কিছু নারীর হৃদয়ে ওর আকর্ষণ অমোঘ করে তোলে।
খেয়াল করেছি, নারীদের চোখে আমিও নেহাত ফেলনা নই। তবে আমার সঙ্গে তারা মেশে, কথা বলে কেমন যেন সমীহ করে। তাদের আচার-আচরণে একটা সম্ভ্রম, শ্রদ্ধার ভাব ফুটে ওঠে। কখনওই তা মাত্রা ছাড়ায় না।
নারীদের মধ্যে যাদের সবাই আল্ট্রা মডার্ন বা ড্যাম স্মার্ট বলে জানে, শরীর নিয়ে যাদের নেকু নেকু বা পরপুরুষ ছুঁলে জাত যাবে –এমন মনোভাব নেই, সে ধরনের মহিলারাও দেখেছি আমার তেমন কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করে না। বরং ‘তুমি রবে নীরবে, হৃদয়ে মম…’ গোছের কিংবদন্তি স্লোগানের দূরত্বে রাখতেই ভালোবাসে আমাকে।
অথচ আবিরের বেলায় ঘটনাটা ঘটে সম্পূর্ণ বিপরীত। কত দ্রুত কত কাছাকাছি আসা যায় বুঝি সেরকমই একটি প্রতিযোগিতা চলে ওর আর সদ্য পরিচিতা নারীটির মধ্যে।
সিগারেট শেষ করে বাট ছুড়ে ফেলে বললাম, ‘ইরা অশান্তি শুরু করবে। সাবধান কিন্তু।’
‘করুক গে, চল যাওয়া যাক।’
রাতে ছাদে বসার ব্যবস্থা হল। টেবিল, চেয়ার, জল, খাবার-দাবার সব কিছু হোটেলের ছেলেরা তুলে দিয়ে গেল।
ছাদটা ভারি সুন্দর। বেশ ছড়ানো ছিটোনো, অনেকটা স্পেস। সামনের দিকে অনতিদূরে সুবিশাল উঁচু লাইটপোস্টে হ্যালোজেন জ্বলছে। দেখেছি দিনের বেলা ওর মাথায় একটি চিল বসে থাকে। হ্যালোজেনের আলোতে হোটেলের গেটের অংশটি স্পষ্ট ভাবে আলোকিত। সেই আলো ছাদে এসে পড়েছে আংশিক। ফলে পরিবেশটা হয়ে উঠেছে চমৎকার।
হোটেলের পিছন দিকটাতে নাগরিক আলো অল্পবিস্তর। সামনে সমুদ্রের হা হা অন্ধকার। এক পাশে লাইটহাউসের শিখরে জ্বলতে থাকা অসম্ভব জোরালো আলো দূর দিগন্তের কোনও নাবিককে দিশা দেখাতে ব্যস্ত। ক্রমশ চারপাশের কোলাহল কমে আসছে।
হোটেলের নিয়ম অনুযায়ী রাত দশটার মধ্যে খাওয়া-দাওয়ার পাট শেষ করতে হবে। ঠিক হল, মহিলারা যারা ড্রিংকস নেবে না তারা বাচ্চাদের সঙ্গে ডিনার সেরে ফেলবে নির্দিষ্ট সময়ে। বাকিদের খাবার কন্টেনারে, ফয়েলে ভরে রুমে পাঠানো হবে। রুমে ফিরে যে যার মতন খেয়ে নেবে।
ছাদে আসর বসতে না বসতেই হরলালদার বন্ধু জগন্নাথবাবু এবং ওনার স্ত্রী সুইটি উঠে এলেন আলাপ করতে। প্রাথমিক পরিচয় পর্ব শেষ হতে আরও দুটি চেয়ারের ব্যবস্থা করল অসীম।
সুমি, ইরা, আমার স্ত্রী কেউই এল না আসরে। তবে কথাবার্তা হাসি-ঠাট্টা, আবৃত্তি, লোকসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত ইত্যাদিতে কিছুক্ষণের মধ্যেই জমে উঠল পরিবেশ।
সকলে মিলে পরিকল্পনা করতে লাগল দারিংবাড়ি বেড়াতে যাবার। বিশেষত হরলালদার বন্ধু এবং ওনার স্ত্রী-র উৎসাহই বেশি বলে মনে হল।
আমি দারিংবাড়ি যাবার পক্ষে ছিলাম না। যতদূর শুনেছিলাম ওখানে দেখার মতন তেমন কিছু নেই। সে কথা বললাম ওদের।
অসীম বলল, ‘জানো, ওখানে বরফ পড়ে?’
রাকেশ বলল, ‘পড়ে, না কোন কালে একবার পড়েছিল?’
বললাম, ‘তোমরা কি আশা করছ এখন ওখানে গেলে বরফ দেখতে পাবে?’
‘বুলা, কল্পনাদি বলল, ‘গিয়েই দেখা যাক না। এসেছি তো ঘুরতে।’
রাকেশ আবিরকে বলল, ‘তুমি যাচ্ছ নাকি দারিংবাড়ি?’
‘আমি? নাহ্, তবে ইরা যাবে।’
বললাম, ‘ইরা জানে দারিংবাড়ির প্রোগ্রাম?’
‘জানে না, জেনে যাবে।’
‘না-ও তো যেতে পারে।’
‘যাবে না মানে? আলবৎ যাবে। একশো বার যাবে। বেড়াতে এসে আনন্দ করবে না? আমি বলব আর ও যাবে না, এত হিম্মত?’ আবিরের গলা সকলকে ছাপিয়ে গেল।
বুলা, কল্পনাদি, সুইটি– সকলে নিজেদের মধ্যেকার কথা থামিয়ে চমকে ওর দিকে তাকাল। বুঝলাম ওর নেশা চড়েছে ভালোরকম।
হঠাৎ হরলালদা গলা ছেড়ে গেয়ে উঠল, ‘এমন মানুষ পেলাম না রে যে আমায় ব্যথা দিল না। নয়নজলে বুক ভাসাইলাম…’
পরিস্থিতি লঘু করতে আবিরকে টেনে তুললাম চেয়ার থেকে, ‘চল ওদিকে। একটু ধোঁয়া টানা যাক।’
সকলে ফের গল্পে মশগুল হয়ে পড়ল।
খুব দ্রুত ড্রিংকস নেয় আবির। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই বোধহয় চার-পাঁচ পেগ নিয়েছে। ছাদের আধো অন্ধকারে পেগের মাপও নিশ্চয়ই কেউ নিক্তি মেপে ঢালছে না।
যেদিকে সমুদ্র সেদিকে গিয়ে দাঁড়ালাম। উড়ে আসছে আর্দ্র বাতাস। বাতাসে জোর যথেষ্ট। অনেক চেষ্টা ও তৎপরতায় বাতাস আড়াল করে সিগারেট ধরানো হল।
সকলে আশা করেছিল সমুদ্রের কাছে নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া হবে। কিন্তু দেখা গেল জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। ডিসেম্বর মাস, মনে করিয়ে দিচ্ছে ভালোরকম। মহিলারা মাথায় স্কার্ফ, দোপাট্টা জড়িয়েছে, পুরুষরা টুপি, মাফলার। নাহলে কুয়াশা মাথায় চাপলে আর দেখতে হবে না, বেড়ানো মাটি। দেখলাম আবির মাথায় কিছু দেয়নি।
বললাম, ‘একটা টুপি চাপাতে পারতিস মাথায়।’
‘নাহ্, ঠান্ডা লাগবে না। আমার গরম বেশি। তুই তো জানিস।’
বস্তুত ওর জীবনে নারীঘটিত প্রায় সকল কাহিনিই আমি শুনেছি বা জানি। এক অদ্ভুত বিজয়ীর ভঙ্গিতে ও আমার কাছে সব ঘটনার বর্ণনা করে কী এক আত্মপ্রসাদ লাভ করে কে জানে।
বললাম, ‘যা মন চায় কর, কিন্তু এভাবে সিন ক্রিয়েট করা ঠিক নয়। আই এক্সপেক্ট আ বিট ম্যাচিয়োরিটি ফ্রম ইউ।’ একটু দৃঢ়তার সঙ্গে কথাগুলি উচ্চারণ করলাম।
ছাদের রেলিং ধরে সমুদ্রের কালো অন্ধকারের দিকে চেয়ে থাকল, কোনও জবাব দিল না। সিগারেটে ঘন ঘন টান দিচ্ছিল। আগুনটা জোরে জ্বলে উঠছে মাঝে মাঝে। আমার দিকে একবার অস্থির দৃষ্টিতে তাকাল। তারপর বলল, ‘নিরুপমাকে কেমন দেখলি?’
‘হু ইজ সি?’
‘ওয়াইফ অফ মিস্টার বিশাল শর্মা।’
বললাম, ‘হুম। কিছু মহিলাকে ঈশ্বর নারীসুলভ আশীর্বাদ উজাড় করে দেন। নিরুপমাও সেরকম একজন মহিলা।’
‘ভাই তুই তো লেখক মানুষ, তোর কাছ থেকে আরও ভালো বর্ণনা আশা করেছিলাম। শালা, কালিদাস পড়িসনি নাকি! গুরুস্তনী, গুরুনিতম্বিনী, রম্ভোরূ, আর কামনা মদির পুরু মোটা ঠোঁটকে এক কথায় কী যেন বলে?’
হেসে বললাম, ‘এবার তুইও লেখালেখি শুরু কর। যতদূর মনে হয় ভদ্রমহিলার বয়স হয়েছে।’
‘কত হতে পারে বলে মনে হয় তোর?’
‘অ্যারাউন্ড ফর্টি ফাইভ।’
‘বাহ্, তোর নারীজ্ঞান তো বেশ টনটনে দেখছি। আমারও সেরকমই ধারণা। তবে জেনে রাখ, মাঝ-সমুদ্র ওপর থেকে আপাত শান্ত দেখালেও অনেক চোরা-স্রোত বয় তার গহিন গোপনে। সেরকম ঝড় উঠলে সেও বলগাহীন হয়ে উঠতে দেরি হয় না। ডুবিয়ে দিতে পারে যে-কোনও জাহাজ।’
হেসে বললাম, ‘অনেক দূর এগিয়েছিস মনে হচ্ছে।’
ও টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। ইতিমধ্যে কেউ ওর গেলাসটি ভরে দিয়েছিল। সেটা থেকে প্রায় অর্ধেক গলায় ঢালল। তারপর গেলাস হাতে ফের এগিয়ে এল আমার দিকে। বলল, ‘শিকারি তার শিকার ঠিক চিনে নেয়। কথাটা নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বাদ দে জ্ঞানের কথা, তোকে একটা সুখবর দিই, সম্ভবত বিশালজি পরশুদিন ভুবনেশ্বর যাচ্ছেন।’
বেশ অর্থপূর্ণ দৃষ্টি ছুড়ে দিল আমার দিকে।
হঠাৎ কল্পনাদি চেঁচিয়ে ডাকল আমাদের, ‘ভাই, তোরা কি নিজেদের মধ্যেই আড্ডা দিবি দুজন? আমরা বাদ?’
ওকে বললাম, ‘চল টেবিলে।’
আচমকা ছাদে নিরুপমাজি উঠে এলেন। আমাদের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, ‘আরে আপলোগ ইতনি দের তক পার্টি মানা রহে হো, সোনে নেহি যায়েঙ্গে?’
সকলে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল। কী জবাব দেওয়া উচিত তৎক্ষণাৎ ভেবে পেল না কেউ। এটা কি মামুলি প্রশ্ন, নাকি হোটেলের নিয়মনীতি অনুযায়ী অভিযোগ?
আবির মুহূর্তে চটুল গানের সুরে বলে উঠল, ‘আরে অভি তো পার্টি শুরু হুয়ি হ্যায়…’
সকলে হইহই করে সাপোর্ট করে উঠল।
দেখলাম নিরুপমাজীও বেশ রসিক মহিলা। রাগ তো করলেনই না বরং হেসে বললেন, ‘জরুর, জরুর। আপলোগ এনজয় করনে কে লিয়েই তো ইতনি দূর সে আয়ে হ্যায়। হম বস দেখনে আয়ে থে, সব কুছ ঠিক-ঠাক চল রহা, কি নেহি?’
হরলালদা জমিয়ে দিল, ‘ব্যস ম্যাডাম, সির্ফ আপহি কি কমি হমলোগ মেহসুস কর রহে থে।’
হাসির ফোয়ারা জেগে উঠল ফের।
সবাই বলল, ‘বৈঠ জাইয়ে ম্যাম, হামারা সাথ দো পেগ পি লিজিয়ে।’
‘না বাবা না। অভি অভি ম্যায়নে খানা খায়া। আপলোগ এনজয় করো। গুডনাইট এভরি বডি, বাই’, বলে উনি পালিয়ে বাঁচলেন।
রাকেশ প্রশ্ন করল, ‘ভদ্রমহিলা হঠাৎ ছাদে উঠে এলেন?’
বললাম, ‘খুবই স্বাভাবিক, হোটেল ওনার। শুতে যাবার আগে চারপাশটা একবার চোখ বুলিয়ে যাবেন না, আবাসিকরা কোথায় কী অবস্থায় আছে!’
কল্পনাদির বন্ধু সুইটি ছাদের অপর দিকটি ঘুরে দেখে এসে জানালেন যে, ওদিকে ফার্স্ট ফ্লোরে একটি বড়ো ব্যালকনিতে আমাদের মতন এত বড়ো না হলেও জনা চারেক নারী-পুরুষের একটি ছোটোখাটো পার্টি বসেছে।
আমাদের কেউ কেউ উঁকি মেরে এল।
আরও কিছু সময় আড্ডা মেরে পরস্পরকে শুভরাত্রি জানিয়ে যে যার রুমে ফিরে গেলাম আমরা।
***
‘অতিদূর সমুদ্রের ’পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি…’
***
পরদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে অসীম বলল, ‘তোমরা যে কী করো, খালি পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছো। সমুদ্রের কাছে এসে সূর্যোদয় না দেখলে আসাটাই বৃথা।’
‘অত রাতে শুয়ে সকালে ওঠা যায়?’ বলল কল্পনাদি।
‘আমি তো উঠলাম। উঠে সি-বীচে…’
ওর কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে হরলালদা বলে উঠল, ‘তুমি তো তাড়াতাড়ি উঠবেই। বুড়ো হলে ঘুম কমে যায়।’
সকলে হেসে উঠল। অসীম বাকরুদ্ধ দৃষ্টিতে হরলালদার দিকে তাকাল।
বললাম, ‘সি-বিচে হাঁটলে?’
‘হাঁটলাম। জেলেরা মাছ ধরে এনেছে দেখে ওদের থেকে মাছ কিনলাম।’ সকলে অবাক।
আবির বলল, ‘ওগুলো সব তেচোখো মাছ, যে খাবে সেই মরবে।’
সবাই হেসে উঠল ফের। অসীমকে রাগাতে কেউ কসুর করছে না।
অসীম রেগে বলল, ‘মোটেও না। ওদের থেকে আমি আমার চেনা মাছগুলোই কিনেছি।’
হরলালদা সিগারেটে টান মেরে বলল, ‘হুঁ, গড়িয়া বাজারে ও যে মাছগুলোকে চিনে এসেছিল ওদের এখানে কিনল। যাও, সব পচা মাছ।’
‘এই লালদা, না জেনেশুনে একদম কথা বলবেন না বলে দিচ্ছি। পচা মাছ? আপনি দেখেছেন?’
মেয়েকে কোলে সামলাতে সামলাতে সুমি প্রশ্ন করে, ‘মাছগুলো কিনে কী করলেন অসীমদা?
‘এখানে একজনকে দিয়ে মাছগুলো কাটালাম, ধুয়ে ভালো করে পরিষ্কার করালাম। তারপর মাছভাজার একটা দোকানের ফ্রিজে রেখে এলাম। পরে সময় মতন ভেজে নিয়ে আসব।’
হরলালদা বলল, ‘ওই বাজে তেলে ভাজা মাছ তুমিই খেও। ওসব খেয়ে সবাই পেট ছেড়ে মরুক আর কী। আরে এ বদমায়েশটা তো মনে হচ্ছে আমাদের সকলের দারিংবাড়ি যাবার প্রোগ্রামটা নষ্ট করার তালে আছে।’
ওর বলার ভঙ্গিতে হাসির রোল উঠল ফের।
অসীম বলল, ‘ঠিক আছে, ড্রিংকসের সঙ্গে মাছভাজা চাইলে কপালে দুঃখ আছে, মনে থাকে যেন।’
বেলা বারোটা নাগাদ রাকেশরা বেরিয়ে গেল। আর বাকিরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল সমুদ্র-স্নানে। তারপর দুপুরের খাওয়া সেরে রেস্ট নিতে গেল সকলে।
রুমে ফিরে মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তোর রেজাল্টের খবর কী?’
‘কাল বেরোবে বলেছে’, বলেই মোবাইলে মনোযোগ দিল।
বিকালের দিকে বললাম, ‘চল, সি-বিচে একটু হেঁটে আসি। যাবি? মনটা ভালো লাগবে।’
‘তুমি যাও। আমি ওদের সঙ্গে একটু পর বেরোব।’
আবিরকে ফোন করলাম, ভাবলাম ওকে বলি আমার সঙ্গে যেতে। ফোন বেজে গেল, ও ধরল না। বোধহয় ঘুমোচ্ছে।
প্যান্টের ওপর পাঞ্জাবি, তার ওপর একটি জ্যাকেট চাপিয়ে সি-বিচে বেড়াতে গেলাম।
একটু পর সূর্য পশ্চিম দিকে ঢলে পড়বে। সূর্যোদয় তো দেখা হল না সূর্যাস্তই দেখা যাক ভেবে পশ্চিম দিকে রওনা হলাম।
দু’পা হাঁটলে ডান দিকে নজরে আসে লাইটহাউসের পাঁচিল থেকে নেমে আসা কংক্রিটের বাঁধানো ঢাল। তার গায়ে বিশালাকৃতি এক তিমির ছবি। বুঝি সেটি রাতের অন্ধকারে বাম দিকের সমুদ্র থেকে সুযোগ বুঝে লাফিয়ে উঠে পড়েছে ঢালে। আর ওখান থেকে পর্যবেক্ষণ করছে বিচের মানুষজন তথা আদিগন্ত সমুদ্র। সময় হলেই লাফিয়ে ফিরে যাবে তার অফুরান নীলে।
সি-বিচের কিছুটা সমতল কিছুটা মালভূমি সদৃশ মাঝারি উঁচু। তারপর ঠেলে উঠে গেছে অনেকটা। মানুষ যা কিছু গড়েছে বা গড়ার চেষ্টা করেছে এখানে, তা সবই হোটেলের সম-উচ্চতায়।
পুরোনো কোনও বিশালাকৃতি বাড়ি ভাঙা বিবর্ণ অবস্থায় চোখে পড়ল। বেশ কিছুটা অঞ্চল মাঝারি মাপের ঝোপেঝাড়ে ভরা। কিছুটা ঊষর।
মাঝেমধ্যে দু-একজন ময়লা মানুষ আমার বিপরীত দিক থেকে হেঁটে আসছে একা একা।
পায়ের শব্দে ছোটো ছোটো গর্ত থেকে উঠে আসা বালিমাখা স্বচ্ছ খুদে খুদে কাঁকড়া প্রাণভয়ে ছুটে যাচ্ছে আশ্রয়ের খোঁজে।
অনবরত ঢেউ ভাঙছে বিকেলের সমুদ্রে। গড়িয়ে যাচ্ছে ফেনা।
দূরে দূরে ভেসে যাচ্ছে জেলে ডিঙি।
নির্জনতা এখানে স্তব্ধতার সমাহারে অবিরত নিজেকে সাজিয়ে তুলছে অনন্ত আয়োজনে।
একটু এগোতে দেখলাম একটি দাড়িওয়ালা যুবক গিটার হাতে নেমে আসছে সি-বিচের পাশে থাকা কোনও রিসর্ট থেকে। সঙ্গে পরির মতন এক কিশোরী।
ক্রমশ আমি তাদের কাছাকাছি পৌঁছোলাম। অপূর্ব রূপসী মেয়েটি ছোট্ট একটি কালো ফ্রক পরেছে, তাতে যেন আরও ছোটো দেখাচ্ছে তাকে।
ছেলেটি প্রায় হাঁটুজলে নেমে গিটার বাজিয়ে কোনও সুর তুলল। কিশোরীটি গোড়ালি ভিজিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে একবার ডানদিক একবার বামদিকে নেচে বেড়াতে লাগল অদ্ভুত ছন্দে।
ছোটো-বড়ো-মাঝারি ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছিল ক্রমাগত। পড়ন্ত সূর্যের আলোয় সামুদ্রিক পটভূমিতে এ দৃশ্যে আমি এত আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম যে, কিছু সময়ের জন্য স্থানটি ছেড়ে এগোতে ভুলে গেলাম। মনে হল আমি বুঝি কোনও ফিল্মের খণ্ড অংশ দেখছি যা যে-কোনও মুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে যাবে আমার দৃষ্টি থেকে।
সামনে এগোতে যাব হঠাৎ নজরে এল, এক বয়স্ক প্রবীণ ব্যক্তি, মধ্যপ্রদেশ যথেষ্ট স্ফীত, হাফপ্যান্ট পরা, গলায় তোয়ালে জড়িয়ে সমুদ্রের দিকে নেমে আসছেন। তার সঙ্গে সুইমস্যুটে তিন যুবতি।
যুবতি তিনজন নিজেদের মধ্যে দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলতে বলতে হাসিতে ফেটে পড়ছিল। প্রবীণ ব্যক্তিটি তাদের সঙ্গে নিয়ে স্নানে নামলেন গিটারিস্টের থেকে অনেকটা দূরত্ব রেখে।
এ দৃশ্য দাঁড়িয়ে দেখার মতন নয়। এগোলাম সামনের দিকে। অনেকটা দূর যাবার পর দেখলাম, একটি নৌকো দাঁড় সমেত ডান দিকের অপেক্ষাকৃত উঁচু বালিতে রাখা। নৌকোর তলার অংশ কালো, তার ওপর সাদা, তারও ওপরে লাল এবং নীল আড়াআড়ি ভাবে নির্দিষ্ট দূরত্ব রেখে রং করা।
খেয়াল করলাম, নৌকোটির আড়ালে একটি কালো যুবক নিজের মনে ধূমপান করে চলেছে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে। তার পাশে বৃত্তাকারে পাকে পাকে রাখা মোটা কাছি। যুবকটি আমাকে ভ্রূক্ষেপ করল না।
আরও হাফ মাইল এগিয়ে যাবার পর মনে হল বুঝি পৃথিবীর একদম কিনারে এসে পৌঁছেছি। এই নির্জন সমুদ্র সৈকতে আমি ছাড়া আর কেউ নেই। সমুদ্রের দিকে দৃষ্টির ঝাপসায় কালো অস্পষ্টতা। সূর্য অস্তাচলে। হু হু বাতাসে প্রকৃতির অস্ফুট কলরব। বালিতে আছড়ে পড়া ফেনাজল ফিরে যাচ্ছে তার চেনা বুকে।
পৃথিবীর আদিম প্রশান্তি আমাকে অভিভূত, আপ্লুত করে তুলল। কী এক অনন্ত ঐশ্বর্যে ভরে উঠল আমার হৃদয়। কতক্ষণ সেখানে আচ্ছন্ন অবস্থায় কাটালাম কে জানে!
হঠাৎ শীত শীত বোধ হল। ভাবলাম এবার ফেরা দরকার। যেদিক থেকে এসেছিলাম সেদিকে রওনা হলাম। ভাঙা ঢেউয়ের মতন মানুষকে বার বার ফিরে আসতে হয় তার চেনা ঘরে।
নীল আকাশ ফুঁড়ে ক্রমাগত উঁচুতে উড়ে যাচ্ছে কোনও এক রকেট। পড়ন্ত সূর্যের মহান আলোয় রুপোর মতন ঝকঝক করছে সেটি। পিছনে ফেলে যাচ্ছে গ্রামের আলপথের মতন বিধবার সাদা সিঁথি যা ক্রমশ বিলীয়মান।
খানিক এগোতে দেখলাম মাথার ওপর একটি চিল। ভারি আশ্চর্য! আমাকে লক্ষ্য করে কিছুটা পথ সেটি পাকে পাকে উড়ে চলল। আমার মুঠোফোনে বন্দি করলাম তাকে। ল্যাপটপে হিমায়িত করে রাখতে হবে এই ক্ষণিকের সখ্যতা।
ফেরার পথে নজরে পড়ল তিনটি জলকন্যার সঙ্গে সেই প্রবীণ ব্যক্তিটি তখনও সামুদ্রিক বিলাসে মেতে আছেন। ভাগ্যবান সফল পুরুষ!
সেই গিটারিস্ট যুবক ও পরিটি নজরে এল না।
আরও খানিক এগোতে দেখলাম আমার কন্যা এবং স্ত্রী অনেকের সঙ্গে এগিয়ে আসছে। ওরা বেশি দূর যেতে রাজি হল না। ফলে সদলবলে ফিরে চললাম।
একটি জেলে-ডিঙি মাছ ধরে সমুদ্র থেকে ফিরে এসেছে। বেশ কিছু মেয়ে-মদ্দ জালবদ্ধ মাছ বেছে ঝুলিতে ভরছে। আর বেশ কিছু সবুজ মাথাওয়ালা বেঁটে বেঁটে মাছ জেলেরা জাল থেকে খুলে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছিল। ওগুলি মানুষে খায় না। কাক-চিলের খাদ্য হয় বোধ হয়। দেখলাম, বালির ওপর কুয়াশা মাখা ভোর-রঙা গোলাকার থকথকে জেলিফিশ পড়ে রয়েছে। আমরা সকলে আগ্রহ ভরা দৃষ্টিতে ঝুঁকে পড়লাম। সকলের হাতে মোবাইল থাকায় ফটো তোলার বিরাম নেই।
সূর্য অস্ত গেছে কিছুক্ষণ হল। ফেরার পথে হাঁটতে হাঁটতে আমার মোবাইল থেকে পাবলো নেরুদার একটি কবিতা ইংরেজি অনুবাদে আমি পড়ে শোনালাম। কবিবন্ধু পীযূষ বাগচী দুপুরে ওটি আমাকে পাঠিয়ে ছিল। কবিতাটি শুনে মেয়ের মুখ থেকে উৎকণ্ঠার মেঘ কিছু সময়ের জন্য দূর হল বলে মনে হল।
আমরা ফিরে চললাম গোপালপুরের পার্ক সংলগ্ন অঞ্চলে। ওখানে বালির ওপর বেশ কিছু দোকান। ঝিনুক-শামুক প্রভৃতিতে তৈরি নানা উপহার সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে।
আমাদের দলের মহিলারা কেউ কেউ কেনাকাটি করল।
অসীম বলল, ‘চলো, চা খাওয়া যাক।’
নরম বালির ওপর হাঁটা বেশ কঠিন।
অবশেষে আমরা সিঁড়ি বেয়ে উঠলাম। পার্ক সংলগ্ন চায়ের দোকানে চা অর্ডার করা হল।
কিছুক্ষণের মধ্যে হরলালদা, আবির এবং বাকিরা এসে হাজির। জানাল, গাড়ি বুুক করা হয়ে গেছে। আগামীকাল সকাল সাতটায় ওরা রওনা হবে দারিংবাড়ি।
বুলা, ইরা, মাম, ফুল সবাই এসে জানাল যে, ওখানে ফুচকা খেতে গিয়ে যা অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে কলকাতার ফুচকার টেস্ট ভুলে যাবার জোগাড়।
কে যেন বলল, ‘এখানে ঘুগনি যা বানায় না, অপূর্ব। একবার খেলে জীবনে ভুলবি না।’
সাড়ে আটটা অবধি আড্ডা মেরে আমরা হোটেলে ফিরে গেলাম।
পরদিন খুব ভোর নাগাদ ঘুম ভাঙলে ফুল, অনিতা আর আমি বেরোলাম সূর্যোদয় দেখার উদ্দেশ্যে। ঠান্ডা ছিল বেশ। তাই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হল একটু বেশি রকম। ফুলের ঠান্ডা লাগার ধাত। তাছাড়া অসুস্থতার পর ওর মায়েরও চট করে ঠান্ডা লেগে যাবার প্রবণতা।
সি-বিচে ভোরবেলা লোকজন কমই দেখা গেল। হয়তো শীতকাল বলেই! টুরিস্টদের মধ্যেও উন্মাদনা যেন তত প্রবল নয়। খানিকক্ষণ হেঁটে বেড়াবার পর কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্য যখন মুখ তুলল তখন তা আকাশের অনেকটা ওপরে।
জেলেদের মেছো নৌকোগুলি ফিরেছে। মাছ সংগ্রহের আগ্রহ আমাদের বিন্দুমাত্র নেই। তবে নৌকোগুলি ঘিরে কিছু মানুষের জটলা, ব্যস্ততা, কোলাহল ভালোই লাগল।
বাইরে এক প্রস্থ চা পান করে হোটেলে ফিরলাম। তখন অসীম, হরলালদা-রা দারিংবাড়ি রওনা হয়ে গেছে।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে আবিরকে বললাম, ‘ইরাকে ওদের সঙ্গে পাঠিয়ে দিলি। তোর মতলব ভালো ঠেকছে না আমার।’
ও চোখ মেরে বলল, ‘আজ একদম আমার খোঁজ করবি না তুই।’
সামান্য গল্পগুজব করে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। কোথায় গেল কে জানে।
আমরা রুমে ফিরে এলাম।
ফোন নিয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বসলাম।
মেয়ে ওর বন্ধুদের সঙ্গে ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছে। খুবই টেনস্ড শোনাচ্ছিল ওর কণ্ঠস্বর। রেজাল্ট সংক্রান্ত আলোচনা চলছে।
আধ ঘন্টা পর চেঁচিয়ে উঠল আনন্দে। ব্যালকনিতে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল। বলল, ‘থার্ড পেপার, আর প্র্যাক্টিক্যালটা নিয়ে খুব চিন্তা ছিল। ভেবেছিলাম অনার্স বোধহয় কেটেই যাবে। জোর বাঁচা বেঁচে গেছি এবারের মতন।’
বললাম, ‘এরকম রেজাল্ট করলে ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। মাস্টার্সে চান্স পাক্বা।’
‘আহা, তুমি একদম চাপ নিও না, বুঝলে? দেখবে এবার সেকেন্ড ইয়ারে কেমন পড়াশোনা করি।’
অনিতা বলে, ‘রাত দেড়টা-দুটো অবধি ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ করলে পড়াশোনা হবে কী করে। সব গোল্লায় যাবে।’
‘ওঃ মা, তুমি না…’ ওর ফোন বেজে উঠল, ‘হ্যাঁ বনিতা, বল…’
বন্ধুর সঙ্গে কথায় ডুবে গেল।
মনে মনে আমারও চাপা উদ্বেগ ছিল। মেয়েটা এ বছর এত ফাঁকি মেরেছে যে বলার নয়। পরীক্ষার আগের রাতে কান্নাকাটি করছিল, সব ভুলে যাচ্ছে। থ্যাংক্ গড, এ যাত্রায় বেঁচে গেল। মাঝারি মানের স্টুডেন্টদের যে ফাঁকি মারা উচিত নয়, সেটাই বোঝে না মেয়েটা।
সারাটি দিন শুয়ে-বসে আলসেমি আর মাঝেমধ্যে একে তাকে ফোন করেই কেটে গেল।
***
‘সব পাখি ঘরে আসে– সব নদী– ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন, থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার…’
***
গোপলপুরে শেষ রাত্রি
কাল অনেক রাতে দারিংবাড়ি টিম ফিরেছিল। রাকেশদের ট্রেন লেট করায় ওরা যখন ফিরল তখন তো রাত সাড়ে এগারোটা। হোটেলে বলা ছিল, তাই রাতের খাবার জুটেছিল। টঙ্কাস তখন গভীর ঘুমে।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে সকলে একটু বেলা করেই ঢুকল।
সুমি সকলকে পুরীর প্রসাদ দিচ্ছিল।
জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেমন কাটল পুরী?’
‘ভালোই, তবে তোমাদের খুব মিস করছিলাম।’
অনিতা বলল, ‘আমরাও। আমরা তো সারাদিন একা একাই কাটালাম।
কল্পনাদিকে রাকেশ জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমরা কেমন বেড়ালে দিদি?’
‘ধুর, আর বলিস না, রাস্তার যা অবস্থা! যাওয়াটা তবু একরকম, ফেরার সময় খুব কষ্ট হয়েছে।’
বুলা বলল, ‘দেখলাম ঠিকই। তবে মন ভরল না।’
বললাম, ‘তোমার কেমন লাগল ইরাবতী?’
‘কী বলুন তো দাদা, ওখানে একটা দিন স্টে করলে হয়তো ভালো লাগত। এত জার্নি করে পোষায় না।’
দিদি বলল, ‘নারে, সত্যি কথা বলতে কী, ওখানে দর্শনীয় তেমন কিছু নেই। ওসব ছোটোখাটো ফল্স, পাহাড় দেখার জন্য অতদূর যাবার মানেই হয় না।’
হরলালদা বলল, ‘এই অসীমটাই হল যত নষ্টের গোড়া, খালি বরফ দেখব বরফ দেখব বলে লাফাচ্ছিল।’
‘দেখলে বরফ’, আমি প্রশ্ন করলাম।
‘হ্যাঁ দেখেছি। নিয়েও এসেছি পকেটে করে। রাতে তোমার গেলাসে ঢেলে দেব কিছুটা। বাকিটা অসীমের মাথায়।’
রাকেশ বলল, ‘বাদ দাও ওসব। আজ গোপালপুরে শেষ দিন। আজ রাতে গ্র্যান্ড মস্তি।’
ঠিক সে সময় আবির ডাইনিং রুমে ঢুকে বলল, ‘আজ ড্রিংক্সের টোটাল খরচ আমার।’
সকলে হইহই করে ওকে স্বাগত জানাল।
হরলালদা জিজ্ঞাসা করল, ‘কী ব্র্যান্ড খাওয়াচ্ছ?’
‘কী খাবেন বলুন?’
‘স্কচ, ভালো স্কচ চাই।’
‘দ্যাখা যাক, এখানে কী পাওয়া যায়।’
অসীম বলল, ‘তাহলে স্কচের সঙ্গে খাবার মতন কিছু ব্যবস্থা করি?’
‘তোমার ওই পচা তেচোখো মাছ?’ হরলালদা বলে।
সবাই হাসিতে ফেটে পড়ে।
‘আচ্ছা, পচা মাছ? সেদিন তো বেশ ভালোই সাঁটালেন। পমফ্রেট, পার্শে, ভেটকি, বেলে। আজ সব তেচোখো হয়ে গেল?’
‘শোনো, ভালো শিক কাবারের ব্যবস্থা করো দেখি। আর হোটেলে কী পাওয়া যায় দ্যাখো, স্পেশাল কিছু।’
সুমির বাচ্চা মেয়েটির টানে সব মহিলার ভিড় ওর ঘরেই। একবার এ কোলে নেয় তো একবার ও। সবার কোলেই যায়, একটুও কান্নাকাটি নেই। সকলেই খুশি!
তবে বাচ্চাটির ঠান্ডা লেগে গেছে। সামান্য জ্বরও হয়েছে। বেচারির নাকটি বোধ হয় বন্ধ, সারাক্ষণ মুখ খোলা।
সুমি ওর ছেলেকে ভালো করে গরম জামাকাপড় পরিয়ে দিয়েছে। যাতে ওর আবার ঠান্ডা-টান্ডা না লেগে যায়। রাকেশ কিচেনে গেল মেয়ের জন্য জল গরম করে আনতে। যাবার সময় আমাকে বলে গেল, ‘গৌতমদা, আজ আয়োজন একদম জমজমাট।’
হরলালদার ঘরে নক করতে কল্পনাদি দরজা খুলে দিল। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী রে, লালদা কই?’
‘ওই দ্যাখ না এখনও শুয়ে রয়েছে।’
বললাম, ‘কী লালদা, ভর সন্ধেবেলা শুয়ে রয়েছো। ওঠো, ওঠো, ছাদে যাবে তো।’
‘আর বোলো না, দুপুরে অনেকক্ষণ স্নান করেছি। তার ওপর পেটে দু-চার পেগ ছিল। খুব টায়ার্ড লাগছিল। লাঞ্চ করে এসে একদম নাক ডাকিয়ে ঘুম।
অসীম ঘরে ঢুকে বলল, ‘যা স্নান করলেন সে তো দেখলাম। গোপালপুরের সমুদ্র আপনাকে মনে রাখবে। হাঁটুজলে ডুবকি মেরে খাবি খেয়ে অস্থির।’
‘এই তুমি আর বোলো না। পেট ভরে, নুনজল গিলে এলে।’
‘আমি!’
‘নয়তো কে? তুমিই তো বললে, জলে খুব নুন। না খেলে, জানলে কীভাবে? থাক গে, একটা সিগারেট দাও তো। আর কিচেনে বলে দাও চা দিতে।’
দরজা খোলাই ছিল। ইরা হঠাৎ ঘরে ঢুকে বলল, ‘দিদি, তোমার কাছে মাথা ধরার কোনও ট্যাবলেট আছে?’
কল্পনাদি বলল, ‘কেন, কার আবার মাথা ধরল?’
‘সকাল থেকেই মাথাটা টিপটিপ করছিল। এখন ব্যথাটা বাড়ছে। তার ওপর আবার জেদ ধরেছে আমাকে ছাদে যেতে হবে, তোমাদের সঙ্গে বসতে।’
দিদি বলল, ‘গ্যাসের ব্যথা নয় তো? অনেক সময় গ্যাস-অম্বল থেকেও মাথার যন্ত্রণা হয়। এক কাজ কর, এই দুটো ট্যাবলেট নিয়ে যা। গরম জল দিয়ে খাবি। একটু রেস্ট নে। দেখবি আধ ঘন্টার মধে ফিট হয়ে গেছিস।’
ও ইরার হাতে দুটি ট্যাবলেট দেয়।
ট্যাবলেট নিয়ে ইরা চলে গেল।
বললাম, ‘এই ইরা কী ছিল, কী রকম দেখতে হয়ে গেল!’
ওরা আমার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি মেলে চাইল।
বললাম, ‘বছর দশেক আগে আবিরের সঙ্গে ইরাবতীকে যখন দেখতে যাই তখন ওর বয়স বছর বাইশ। ডানাকাটা পরি বললে হয়তো কম বলা হবে। যেমন রূপ, তেমনই যৌবন! আবিরের তো দ্যাখা মাত্র পছন্দ হয়ে গেল। আমারও বন্ধু-পত্নী হিসেবে নির্বাচনে দ্বিধা ছিল না। তবে একটা সমস্যা ছিল। ইরার মা-বাবা কেউই ছিল না। এক কার-অ্যাক্সিডেন্টে দুজনই মারা যান। তখন ওর বয়স দশ-কী এগারো। সেই থেকে ও মামার বাড়িতে মানুষ। ভাগ্নীর বিয়েতে মামার মোটা টাকা খরচ করার ইচ্ছা থাকলেও মামীর ভয়ে তা করার উপায় ছিল না। দেনা-পাওনার কোনও গল্প ছিল না। আর তা নিয়ে আবির কিংবা ওর বাড়ির কারও কোনও অভিযোগও ছিল বলে শুনিনি। নমো নমো করে বিয়ে হল।
একটি হোটেল বয় এসে আমাদের চা দিয়ে গেল। চায়ের কাপ তুলে সিপ করছিলাম।
কল্পনাদি বলল, ‘তারপর?’
‘বিয়ের পর বছর চারেক সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু ক্রমশই আবির আর ইরার মধ্যে মানসিক ব্যবধান বাড়তে লাগল। আচমকা ইরা অসুস্থ হয়ে পড়লে ওকে নার্সিংহোমে ভর্তি করা হল। মাস তিনেক কাটিয়ে ও বাড়ি ফিরল ঠিকই কিন্তু কেমন যেন পালটে গেল। আমাদের বাড়ি ওরা মাঝেমধ্যে আসত। আমরাও যেতাম। কখনও ও খুব বেশি রকম কথা বলত আবার কখনও খুব চুপচাপ, সংযত। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি শব্দও খরচ করত না! তবে মনে হতো, ওর মধ্যে কোনও গভীর কষ্ট বা অসহায়তা আছে যা ও কখনও আমাদের বলেনি।’
‘তোকে না বলুক, অনিতাকেও বলেনি?’ দিদি প্রশ্ন করে।
‘সম্ভবত না। বললে জানতে পারতাম।’
‘তারপর?’
তারপর খুব দ্রুত ওর শরীর শুকিয়ে যেতে লাগল। আবিরকে বলতাম ওকে ভালো ডাক্তার দেখাতে। ও বলত, ‘কত ডাক্তার তো দেখালাম। কিছুই হল না। তোর জানাশোনা ভালো কোনও ডাক্তার থাকলে বল।’ কোনও ডাক্তারই ওর রোগ ধরতে পারল না। দিনে দিনে ইরা শুকনো বিবর্ণ পাতার মতন হয়ে গেল। ওকে দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়। আবিরের পাশে একদিন ও কিন্তু মোটেও বেমানান ছিল না। পরে মনে হয়েছে, হয়তো ওদের কোনও ইস্যু না থাকাই ওর অসুস্থতার মূল কারণ।
‘ডাক্তার কী বলছে, প্রবলেমটা কার?’ অসীম জিজ্ঞাসা করে।
‘বড্ড টাচি ব্যাপার। ও নিয়ে আমি ওদের কাউকে কখনও প্রশ্ন করিনি। নিজে থেকে যে যতটুকু বলে ততটুকুই শুনি।’
হঠাৎ খোলা দরজাতেই নক। দ্যাখা গেল, দরজার সামনে হরলালদার বন্ধু এবং তার ওয়াইফ। বললেন, ‘সবাই এখানে? আমাদের বাদ দিয়ে জমিয়ে গপ্প হচ্ছে? ভাবলাম ছাদে যাবার আগে একবার নক করে যাই।’
‘আসুন, আসুন ভিতরে আসুন’, অসীম বলে।
ওরা ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসলেন। অসীম আর আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম।
আটটা নাগাদ বুলা ফোন করে জানাল ছাদে যেতে। সবাই ওখানে যাচ্ছে। ভাবলাম রাকেশকে একবার ডেকে যাই। ওর রুমে গিয়ে শুনলাম কী যেন আনতে রাকেশ দোকানে গেছে। ওকে ফোনে ধরতে জানাল মিনিট কয়েকের মধ্যেই ফিরে আসছে। আমি যেন ওয়েট করি।
হঠাৎ রাকেশের যে-ফোনটি সুমির কাছে থাকে, সেটা বেজে উঠল। দৌড়ে গিয়ে সেটি তুলে নিল টঙ্কাস। বলতে লাগল, ‘হ্যালো, কে?’
ওদিক থেকে সম্ভবত কেউ প্রশ্ন করল, তুমি কে। যার উত্তরে ও বলল, ‘আমি রাকেশের ছেলে। তুমি কে বলছ?’
ফোনের অপর প্রান্তের ব্যক্তিটি কণ্ঠস্বরে মজা পেয়ে নিজের নাম বলছে না। ওর কথা শোনার জন্য অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছে।
‘আগে বলো তুমি কে? তুমি কি কোনও চোর? সত্যি করে বলো তুমি চোর কি না?’ টঙ্কাস প্রশ্ন করে চলে।
অপর প্রান্ত কী জবাব দিচ্ছে কে জানে!
‘আমি জানি তুমি একটা চোর। বাবা আসলে বলব, তোমাকে একটা চোর ফোন করেছিল।’
সুমি এসে এক থাবা দিয়ে ফোনটি ওর হাত থেকে কেড়ে বাম হাতে সেটি কানে ধরল। প্রায় একই সঙ্গে ডান হাতে টঙ্কাসের চুলের মুঠি ধরে বার দুয়েক আচ্ছা করে ঝাঁকানি দিল। তারপর ফোনে কথা বলতে শুরু করল, ‘হ্যাঁ, কে বলছেন? ও আচ্ছা। রাকেশ আসুক, আমি ওকে বলছি ফোন করতে। আপনি কিছু মনে করবেন না দাদা। বাচ্চা, বোঝে না, কী বলতে কী বলে ফেলেছে। ও হ্যাঁ ধরুন, রাকেশ এসে গেছে, দিচ্ছি ওকে।’
‘কে গো?’ হাতের জিনিসগুলি সুমিকে দিয়ে ওর হাত থেকে ফোন নিয়ে জানতে চায় রাকেশ।
‘গিরিনদা, তোমার দোকানের ম্যানেজার’, ধরো ফোনটা।
রাকেশ ফোন নিয়ে কথা বলতে বলতে রুমের বাইরে চলে যায়।
টঙ্কাস তখন এক মনে রুমের নাইট বাল্বের সুইচটি একবার অন একবার অফ করায় মনোযোগ দিয়েছে।
সুমি চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কীরে ও…ই। কী করছিস শয়তান? ওহ্ আমি যে কী করি এই ছেলেকে নিয়ে?’
‘খেলা করছি তো’, নিষ্পাপ হাসি টঙ্কাসের মুখে।
বললাম, ‘ওরকম করে না বাবা। লাইটটা নষ্ট হয়ে যাবে। সবাই বলে, টঙ্কাস ভালো ছেলে। খুব কথা শোনে। তুমি এদিকে এসো, আমি একটা গল্প বলব।’
দেখলাম বাধ্য ছেলের মতন আমার কাছে চলে এলো, ‘বলো কী বলবে আমায়!’
‘সে কথা পরে বলছি। তুমি আগে বলো স্কুলে তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড কে?’
‘জুনি।’
‘সে আবার কে?’
‘একটা ভালো মেয়ে।’
‘কেমন দেখতে ওকে?’
‘খুব সুন্দর। ও তো আমাদের বাড়ি এসেছিল।
‘কবে এসেছিল?’
‘আমার বার্থ-ডে তে। সুরাইয়া, সেজুঁতি, নীল, জুনি –অনেক বন্ধু এসেছিল। খুব মজা হয়েছিল। ওরা কততো গিফ্ট দিয়েছে আমাকে! আমিও ওদের রিটার্ন গিফ্ট দিয়েছি।’
‘কেক কেটেছিলে?’
‘হ্যাঁ, সব্বাইকে দিয়েছিলাম।’
রাকেশ রুমে ফিরে এসে আমাকে বলল, ‘চলো গৌতমদা। সুমি, তোমার জিনিসপত্র দেখে নিয়েছ? আর কিছু লাগবে না তো? আমি ওপরে গেলে কিন্তু ডাকবে না বলে দিচ্ছি। একদম ডিসটার্ব করবে না আমাকে।’
সুমি নালিশ করে, ‘তোমার ছেলে গিরিনদাকে বলেছে চোর।’
‘অ্যাঁ!’ রাকেশ টঙ্কাসের মাথায় এক চাঁটি মেরে বলে, ‘কীরে, গিরিনদাকে কী বলেছিস?’
মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আমি বলেছি, তুমি কে? তুমি কি একটা চোর?’
‘তুই হঠাৎ ওকে চোর বলতে গেলি কেন?’
‘তোমরা সবাই যে বললে!’
‘আমরা সবাই!’ রাকেশ ভ্যাবাচাকা খেয়ে বলে, ‘আমরা বললাম গিরিনদা চোর? কখন বললাম?’
‘ওই যে কালকে, রাত্তির বেলা। আমি তখন ঘুমোচ্ছিলাম।’
হঠাৎ ওরা স্বামী-স্ত্রী চমকে দু’জনে দুজনার দিকে তাকায় অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে।
এমন সময় অসীমের ফোন। আসছি বলে ফোন কেটে দিলাম।
রাকেশকে বললাম, ‘ছাড় ওসব। বাচ্চা মানুষের কথা ধরতে নেই। চল এখন, ওরা অপেক্ষা করছে।’
ওকে টেনে নিয়ে চললাম, সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বললাম, ‘খুব সাবধান রাকেশ। তোমার ছেলে কিন্তু ডেঞ্জারাস। ও সব বোঝে।’
‘আরে গৌতমদা, কাল রাতে ওকে শুইয়ে দিয়ে সুমি আর আমি নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলাম, গিরিনদা একা দোকানে আছে কী করছে কে জানে।’
সুমি বলল, ‘দ্যাখো মালপত্তর আবার সরাচ্ছে কি না।’ ছেলে এর থেকে বুঝে নিল ম্যানেজার চুরি করছে।’
এবার থেকে মুখ সামলে কথা বলবে ওর সামনে’, আমি বললাম।
‘ঠিক বলেছ, তাই বলতে হবে দেখছি।’
ছাদে উঠে দেখি, পার্টি শুরু হব হব করছে! আমরা দুজন যেতেই সকলে চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে কোথায় গেছিলে তোমরা? আমরা তো শুরু করতে পারছি না তোমাদের ছাড়া।’
দেখলাম ভারি অবাক ব্যাপার, আজকের পার্টিতে ইরাও এসেছে। বললাম, ‘তুমি!’
‘ও জোর করল’, আবিরকে দেখিয়ে বলল।
‘আরে বেড়াতে আসা মানে তো আনন্দ-ফূর্তি করতে আসা। একটু-আধটু খেলে কোনও দোষ নেই। আমি বলছি তো ওকে খেতে’, বলে আবির।
‘বছর খানেক হল আপনার বন্ধু আমাকে ড্রিংক্স নেওয়া শেখাচ্ছে।’
‘শেখাতে চাইলে আর শিখছ কই? এক পেগ, খুব জোর দু-পেগ। গেলাস নিয়েই বসে থাকে পার্টিতে। নিয়ম রক্ষা করে আর কী!’
‘কই আমাদের বাড়িতে তো মাস চারেক আগেও এলি তোরা, দেখিনি তো ওকে ড্রিংক্স নিতে?’ বললাম আমি।
‘তোর বউ খায় না, তাই ওকেও জোর করিনি। যেখানে মহল আছে সেখানে খাওয়া যেতেই পারে। তাই না হরলালদা?’
‘ঠিক ঠিক, একদম ঠিক কথা’, জোর সমর্থন জানায় লালদা।
সকলে ‘চিয়ার্স’ জানিয়ে শুরু হল পার্টি। কল্পনাদি ওর বন্ধু সুইটিকে বলল, ‘তুই একটা রবীন্দ্রসংগীত গা।’
আমরা সমস্বরে ওর অনুরোধকে স্বাগত জানালাম। ভদ্রমহিলার গলা ভারি মিষ্টি।
আমাদের অনুরোধে উনি পরপর বেশ কয়েকটি গান গাইলেন।
পারস্পরিক কর্থাবার্তার মধ্যেই চলছিল গান।
আবির বলল, ‘তোমাদের গান-টান শেষ হলে আমি কিন্তু আমার পছন্দের গান শোনাব।’
আমি একটু অবাক হলাম, ‘তুই গান গাইবি?’
ওর দ্বিতীয় পেগ শেষ। বলল, ‘বলেছি যখন গান শোনাব, তো শোনাব। তুই চাপ নিস না।’
হরলালদা হঠাৎ আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে গেয়ে উঠল, ‘ওরে আমি চাইলাম যারে পাইলাম নারে … বাস করে অন্যের ঘরে।’
সকলে হই হই করে উঠল। দেখলাম, বুলা আর কল্পনাদি জমিয়ে গল্প শুরু করেছে ইরার সঙ্গে। রাকেশ আর আবির নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় ব্যস্ত। আমি ছাদের কিনারে সমুদ্রের দিকে উঠে গেলাম।
সুইটি এগিয়ে এসে আমাকে বললেন, ‘আপনার সম্পর্কে অনেক কথা শুনলাম।’
‘ভালো, না মন্দ?’
‘ভালো! যা শুনেছি সবই ভালো।’
‘কী শুনেছেন যদি বলেন’, বলে আগ্রহসূচক ভঙ্গিতে চাইলাম।
‘শুনলাম আপনি লেখালেখি করেন, অনেক বইপত্র আছে।’
‘চেষ্টা করি একটু-আধটু। আপনি ড্রিংক্স নেন না?’
‘না, আমি ঠিক স্ট্যান্ড করতে পারি না। তবে এ ধরনের আসর যদি পরিচ্ছন্ন মানুষদের মধ্যে হয় তা খারাপ লাগে না।’
‘কী খারাপ লাগে আপনার?’
‘মানুষের নীচতা, পরশ্রীকাতরতা, ঈর্ষা– মানুষের দোষের কি আর শেষ আছে?’
‘আর কী ভালো লাগে?’
‘রবীন্দ্রনাথ, আর নাচ। আমার একটা নাচের স্কুল আছে।’
‘নাচ শেখান আপনি?’
‘ওই আপনারই মতন। চেষ্টা করি একটু-আধটু। যাকগে ওসব, কোথায় পাব?’
‘কী পাবেন?’
‘আপনার বইপত্র?’
‘খুঁজবেন! পেয়ে যাবেন।’
‘কোথায় খুঁজব? কলেজ স্ট্রিটে যাওয়া সম্ভব নয়।’
‘যেখানে সবাই খোঁজে। গুগুলে, ফেসবুকে। ফেসটা তো চিনে রাখলেন, একই নামের হলেও আইডেন্টিফাই করতে অসুবিধা হবে না। একান্তই না হলে বলবেন, ওয়েবসাইটটা বলে দেব।’
‘আপনার হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারটা যদি দেন, প্লিজ! অবশ্য যদি আপত্তি না থাকে।’
‘না না, আপত্তির কী আছে।’
ভদ্রমহিলা আমার নাম্বার নিলেন। বললাম, ‘একটা মিসকল দিয়ে দিন।’
সিগারেট হাতে আবির এগিয়ে এসে বলল, ‘মিস নয়, মিসেস কল।’ আমাকে প্যাকেটটা এগিয়ে দিল।
ভদ্রমহিলা মৃদু হেসে টেবিলে ফিরে গেলেন।
উনি চলে গেলে আবিরকে ইঙ্গিত করে বললাম, ‘ইন্টারেস্টেড?’
ও হেসে বলল, ‘উঁহু জমবে না আমার সঙ্গে।’
‘কী করে বুঝলি?’
‘ঠিক যেভাবে বুঝতে পেরেছিলাম নিরুপমার সঙ্গে জমবে।’
‘ক’ পেগ নিলি?’
‘বোধ হয় চার, পাঁচও হতে পারে। তোর তো দেখলাম গেলাসটা পড়ে আছে টেবিলে।’
বললাম, ‘নিলাম তো একটা।’ ‘আজ পার্টি থ্রো করার কারণ আমি আন্দাজ করতে পারছি।’
ও ডান হাত মুঠো করে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ তুলে ইঙ্গিতে জানাল মিশন সাকসেসফুল।
‘কাল কোথায় গেছিলি? সারা দিন দেখলাম না। কয়েকবার ফোন করলাম, বেজে গেল, ধরলি না।’
‘কোথাও যাবার দরকার কী? হোটেলে এত ঘর।’
‘বিশালাজি এখনও ফেরেননি শুনলাম’, আমি বললাম।
‘রিয়েলি গড ইস সো গুড, আজ রাতেও ফিরছেন না।’
রাকেশ হঠাৎ ফোন পেয়ে নীচে ছুটল।
অসীম এগিয়ে এসে আমাকে বলল, ‘তোমার মতলব কী? চলো চলো, টেবিলে চলো।’
টেবিলে যেতেই শুনলাম টেবিল বাজিয়ে সুইটির হাজবেন্ড জগন্নাথবাবু গান শুরু করেছেন, ‘মনে পড়ে রুবি রায়…’
হঠাৎ আবির চেঁচিয়ে বলে ওঠে, ‘ধ্যাৎ, সব বাজে গান। এবার আমি গান শোনাব।’
বললাম, ‘শোনা, তোর গান তো কখনও শুনিনি।’
সকলে আগ্রহ ভরা দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকাল। ভাবলাম গান গাইবে। ও মোবাইলে সম্ভবত প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিল। বিশেষ কোনও বাটন টিপতেই গান বেজে উঠল, ‘দো বুঁদ মুঝে ভী পিলা দে শরাবি দেখ ফির হোতা হ্যায় ক্যা…’। সঙ্গে কোমর দুলিয়ে নাচ। ওর সঙ্গে যোগ দিল হরলালদা।
অসীম একটু লাজুক প্রকৃতির। ওদের উৎসাহ দিলেও নিজে নাচে যোগ দিল না। মহিলাবৃন্দ নিজেদের মধ্যে কথাবার্তায় ব্যস্ত।
আমি আবার একটু সরে গেলাম সিগারেট নিয়ে। সমুদ্রের দিকে ফিরলাম। খেয়াল করলাম, পিছনে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে, পাশ ফিরতেই দেখলাম, ইরা।
‘কিছু বলবে ইরাবতী?’
ইরাবতীর হাতে গেলাস। একটু ড্রাংক মনে হল। বলল, ‘অনেক কিছুই তো বলার ছিল দাদা।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ বলো না, নির্দ্বিধায় বলো।’
‘দাদা, আপনার বন্ধু সম্বন্ধে আপনি অনেক কিছুই জানেন, আমাকে কিছু জানতে দেন না কেন?’
আমি চুপ করে রইলাম।
সত্যি করে বলুন, ওর চরিত্রের ব্যাপারে আপনি কিছু জানতেন না? আপনার মৌনতা প্রমাণ করছে আপনি সব জানতেন। কোনও দিন আমাকে সে কথা বলেননি কেন?’
‘বলতে পারিনি। আমি কিছু বললে ওর কি পরিবর্তন হতো বলে তোমার মনে হয়? শুধু শুধু তোমার যন্ত্রণা বাড়ত।’
একটু চুপ থেকে ইরা বলল, ‘তা হয়তো ঠিক।’
‘আমার জায়গায় তুমি থাকলে তুমিও কি বলতে পারতে এসব কথা? ভেবে দ্যাখো একবার। বন্ধু হিসাবে যতটুকু বলার অনেক বার বলেছি।’
ইরা বলল, ‘মহিলাদের প্রতি ওর দুর্বলতার কথা বিয়ের বছর খানেকের মধ্যেই জানতে পেরেছিলাম। তবে আমল দিতে চাইনি। আমার তো পাশে দাঁড়াবার মতন কেউ নেই। মা-বাবা-অর্থ-সম্পত্তি-কোনও সাপোর্টই নেই। থাকার মধ্যে ছিল কিছুটা রূপ। ঈশ্বরের অভিশাপে সেটুকুও গেছে। নারীর শেষ এবং একমাত্র সম্বল স্বামীর ভালোবাসা, সেটুুকুও…।’
ইরা চোখ ফিরিয়ে নিল, বুঝলাম ওর চোখের কোল ভিজে উঠেছে।
‘দাদা, যন্ত্রণার কথা কোথায় জানেন, আজ আমাদের সন্তান না হবার জন্যও সর্বদা ও আমাকেই দায়ী করে। বলে, আমি নাকি একটা বাঁজা। অথচ তিন-তিনবার আমি মেডিকেল চেক-আপ করিয়েছি তিনটি আলাদা ক্লিনিকে। প্রত্যেকটি রিপোর্ট আমার ফেভারে।’
আমি ওর চোখের দিকে তাকাই। যে-জ্বলন্ত দৃষ্টি মেলে আমার দিকে চেয়ে ইরাবতী কথাগুলি বলছে তা একমাত্র চরম সত্য থেকেই উঠে আসতে পারে। অবিশ্বাস জাগার প্রশ্নই ওঠে না।
‘দাদা, আমার খুব লজ্জা করছে আপনাকে এসব কথা বলতে, খুব কষ্ট হচ্ছে। তবু বলছি, ওর গালাগাল, সময়ে-অসময়ে গায়ে হাত তোলা, দুর্ব্যবহার, লোকের সামনে আমাকে অপদস্থ করা– সব, সব আমি সহ্য করি মুখ বুজে। ওর মহিলাপ্রীতি, আকণ্ঠ মদ্যপান, সব মেনে নিই কেবল একটি কথা ভেবে…।’
ও চুপ করে যায়।
‘কী কথা?’
‘যদি ওকে জানাই, মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী আমি সেন্ট পার্সেন্ট ফিট, দোষ যদি কিছু থাকে তবে তা ওরই –এ কথায় মানুষটা হয়তো বড়ো কষ্ট পাবে, আঘাত পাবে মনে। ওর মধ্যে পৌরুষের অহং যে খুব খুব বেশি। ওকে কষ্ট দিতে যে আমি পারব না দাদা… কথাটা জানলে মানুষটার যে বুক ভেঙে যাবে!’
চুড়িদারের ওড়নায় মুখ চেপে ধরে কান্না চাপার চেষ্টা করে ইরাবতী। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে দমকে দমকে কাঁদতে থাকে।
ওকে সান্ত্বনা দেবার মতন ভাষা আমার নেই। এই জীর্ণ-শীর্ণ কংকালসার নারীটির অসীম শক্তির কাছে কত সামান্য আমি। কী অপার ভালোবাসা বুকে থাকলে একজন মানুষ এতটা যন্ত্রণা নীরবে মুখ বুজে দিনের পর দিন সহ্য করে চলতে পারে। শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে আসে হৃদয়। ওপরে তাকাই, মাথার ওপর কৃষ্ণপক্ষের আকাশ। সামনে সমুদ্রের সীমাহীন অন্ধকার। গোপালপুর লাইটহাউসের বিশাল ঘূর্ণায়মান ব্লেড মাথায় আলো নিয়ে অবিরাম ঘুরে চলেছে। মোবাইলের সংগীতের সুরে তখনও মেতে আছে একজনই, আবির… হাতে বোতল নিয়ে ক্রমাগত নেচে-গেয়ে চলেছে, ‘আজ কি পার্টি মেরি তরফ সে…, আজ কি পার্টি….।’
———