অয়নের আজ প্রথম দুটো ক্লাস অফ। সে যখন কলেজের স্টপে বাস থেকে নামল, ঘড়িতে এগারোটা। অর্থাৎ সবে ফার্স্ট ক্লাস শেষ হয়েছে। হাতে এখনও চল্লিশ মিনিট। কয়েক পা কলেজের দিকে এগিয়ে তাকে দাঁড়িয়ে পড়তে হল। অসীমা কলেজ থেকে বেরিয়ে আসছে। তার আজ পরপর ক্লাস। ফার্স্ট হাফে কোনও অফ নেই। অয়নের কপালে ছোট্ট ভাঁজ পড়ল। অসীমা ক্লাস অফ পচ্ছন্দ করে না। কলেজে এলে সে প্রত্যেকটা ক্লাস অ্যাটেন্ড করবেই। তাদের গ্রুপটা যত অ্যাট্রাক্টিভ প্রোগ্রামই অ্যারেঞ্জ করুক না কেন, সে একটা ক্লাসও মিস করতে চায় না। তার খুব সহজ কথা, কলেজে এলে ক্লাস করবই। প্রোগ্রাম করতে হলে কলেজ শেষের পর। নইলে পুরো দিন অফ করে।

গত দুটো বছর ধরে অয়ন লক্ষ্য করছে, আধা খ্যাঁচড়া ভাবে কোনও কাজ করা অসীমা পচ্ছন্দ করে না। যা করে, খুব গুছিয়ে করে।

সেই অসীমা কলেজ কেটে হাওয়া হয়ে যাচ্ছে। এটা আজ প্রথম নয়। গত তিন মাস ধরে চলছে। শুধু কলেজ কেটে নয়, প্রোগ্রাম কেটেও দু’বার হাওয়া হয়েছে। অয়ন লক্ষ্য করেছে অসীমার মোবাইলে ফোন আসে। ফোনটা রিসিভ করার পর তার মুখের চেহারা সম্পূর্ণ পালটে যায়। দুঃখে না আনন্দে, বিষণ্ণতায় না আতঙ্কে, কিছুই বোঝা যায় না। মুখটাকে অন্য হাতের চেটো দিয়ে আড়াল করে মিনিট খানেক কথা বলে। তারপর কাউকে কিছু বলার জন্য সামান্যতম সময় নষ্ট না করে হনহন করে কিছুটা উদ্ভ্রান্তের মতো বেরিয়ে যায়।

কয়েকবার ব্যর্থ চেষ্টার পর অসীমার মোবাইল বেজে ওঠার সময় অয়ন একদিন এক মুহূর্তের জন্য তার মোবাইলের স্ক্রিনটা দেখার চান্স পেয়েছিল। সেখানে ফুটে ওঠা নম্বরটা ছিল ল্যান্ড লাইনের। এত অল্প সময়ের জন্য সে নম্বরটা দেখতে পেয়েছিল যে তার মেমারি সেটা ক্যাচ করতে পারেনি।

কেন অসীমা এমন ভাবে চলে যায়, প্রশ্নটা বেশ কয়েকবার অনেক রকম ভাবে অনেকে অসীমাকে করেছে। উত্তর একই, আছে বস, আছে। সব কিছু কি আর শেয়ার করা যায়। ওটা বড্ড বেশি সিক্রেট চ্যাপ্টার। প্যানডোরার বক্সের মতো ওপেন হলেই অজানা ব্যথায় পৃথিবী ভরে যেতে পারে। কথাগুলো শেষ করে মিনিট খানেক ধরে সে হাসে। সেই হাসির পর নীল আকাশ জুড়ে রোদ আসে। তারপর সকলের মন থেকে প্রশ্নটা হারিয়ে যায়।

নিজস্ব মুহূর্তেও কয়েকবার অয়ন প্রশ্নটা করেছে। কোনও উত্তর না দিয়ে প্রতিবারই অসীমা মিষ্টি হাসিতে নিজেকে আরও সুন্দর করে তুলেছে। প্রশ্নটাও প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। অসীমার অনুপস্থিতিতে মাঝেমধ্যেই অয়নকে বন্ধুদের কাছে প্যাঁক খেতে হয়। নীরবে সে সব হজম করা ছাড়া তার কিছু করার থাকে না। তখন অসীমার উপর মনে মনে তার খুব রাগ হয়। কেন এই ব্যাপারটা নিয়ে সে এমন লুকোচুরি খেলে? কী এমন রহস্যজনক বিষয়? তবে অসীমা সামনে এলে তার আর কিছু মনে থাকে না।

মুশকিল হচ্ছে তাদের সম্পর্কটা সকলে জেনে গেছে। জানাজানিটা ঘটিয়েছে অসীমাই। সেদিন প্যারাডাইস সিনেমা হলে আমির খানের একটা ছবি দেখতে যাওয়ার কথা ছিল। আমির খান অসীমার সবচেয়ে ফেভারিট হিরো। প্রোগ্রামটা অসীমাই ঠিক করেছিল। কথা ছিল, শো শুরুর এক ঘণ্টা আগে সকলে হলের সামনে চলে আসবে। টিকিট সহ সব খরচ অসীমার।

নির্দিষ্ট সময়ের কিছুটা আগে অয়ন পৌঁছে গিয়েছিল। তারও আগে এসে টিকিট কাউন্টারের সামনের ফুটপাথে অসীমা দাঁড়িয়েছিল।

যে-কোনও প্রোগ্রামে সে-ই সকলের শেষে আসে। অয়ন তাই জিজ্ঞাসা করেছিল, সূর্য আজ কোন দিকে উঠেছে রে? ঠিক দেখছি তো? আমার কোথাও ভুল হয়নি তো?

মিষ্টি হাসিতে মুখ ভরিয়ে অসীমা বলেছিল, ঠিক দেখছিস। কোথাও কোনও ভুল হচ্ছে না। তবে আজ এখনও সূর্য ওঠেনি। কিছুক্ষণ পর উঠবে। তখন টের পাবি।

অসীমার হেঁয়ালি অয়ন ধরতে পারেনি। বোকার মতো বলেছিল, উঠবে মানে?

অসীমা আরও মিষ্টি হেসে বলেছিল, তুই একটা হাঁদারাম। সবাইকে আসতে দে। দেখবি সূর্য ওঠা কাকে বলে।

একে একে সঞ্চিতা, রাহুল, আশা এসে পড়লে সবাইকে অবাক করে দিয়ে অসীমা বলেছিল, ‘আজ সিনেমা দেখতে ইচ্ছে করছে না। চল, ভিক্টোরিয়ার মাঠে বসে আড্ডা মারি।’

সঞ্চিতা অসীমার কথা বিশ্বাস করেনি। বলেছিল, তোর আমির খান–

অসীমা সঞ্চিতাকে কথা শেষ করতে দেয়নি। বলেছিল, আমির খান পর্দায় সেঁটে থাক। এখন চল একটা ট্যাক্সি নিয়ে ভিক্টোরিয়া যাই। জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে।

রাহুল ফুট কেটেছিল, বস, কাউন্টারে টিকিটের প্রাইস লিস্ট দেখে হিরোকে পর্দায় সাঁটিয়ে দিলে?

অসীমা বলেছিল, না গুরু, প্রাইস লিস্ট আমি দেখিনি। ফেরার পথে রেস্টুরেন্টের খরচা আমার।

সকলে হই হই করে রাহুলকে প্যাঁক দিয়েছিল। দলে অয়নও ছিল।

ভিক্টোরিয়ার মাঠে বসে কোনওরকম ভনিতা না করে অসীমা বলেছিল, তোদেরকে একটা খুব জরুরি কথা জানানোর জন্য সিনেমা দেখা বাদ দিয়ে এখানে এসেছি।

এমন আচমকা নাটুকেপনায় সকলেই বেশ একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল, সে তো তুই প্যারাডাইসের সামনে বলতে পারতিস। হাতে তো অনেকটা সময় ছিল। শুধু শুধু সিনেমাটা মিস করালি।

সঞ্চিতার কথার কোনও উত্তর না দিয়ে অসীমা অয়নের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, এই যে হাঁদারাম, আমার কথাটা তোর খুব মন দিয়ে শোনা দরকার। সূর্য ওঠার ব্যাপারটা আছে।

এটুকু বলে অসীমা থেমে গেলেও কেউ কিছু আর জানতে চায়নি। একটু দম নিয়ে, নাকি মনে মনে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে অসীমা বলেছিল, অনেক আগেই অয়ন নামে একটা ভীতু চোর আমার কাছে ধরা পড়েছে। অবশ্য চোরটা সে কথা জানে না। তবে চোরটার চুরি করার সাধ থাকলেও সাহস একেবারেই নেই।

প্রায় সকলেই আকাশ থেকে পড়েছিল। অয়ন কোন দিকে তাকাবে বুঝতে পারছিল না।

– চান্স পেলেই আমার চোখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে আর নিজের মনে কথা বলে। এমন হাঁদারাম, এটুকু জানে না যে, কারও চোখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে কথা বললে, অন্য জন সে কথা সহজেই জেনে যায়।

এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে, অয়ন স্বপ্নেও ভাবেনি! কলেজে ডাকাবুকো ছেলে বলে পরিচিতি থাকলে কী হবে, সেই মুহূর্তে তার নিজেকে সত্যিই একটা হাঁদারাম বলে মনে হচ্ছিল।

– অয়নের যে-কোনও দিন মুখ ফুটবে না, সে আমি বুঝে গেছি। তাই আমিই তোদের জানিয়ে দিচ্ছি ,অয়নের জন্য আমারও মনে কুছ কুছ হোতা হ্যায়। সকলে সেদিন মন প্রাণ ঢেলে সেলিব্রেট করেছিল। রাত প্রায় ন’টা নাগাদ তারা বাড়িমুখো হয়েছিল। সেদিন কীভাবে বাড়ি ফিরেছিল অয়নের কিছু মনে নেই। সূর্যের প্রখর আলোয় তার দৃষ্টি মন সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন ছিল।

অসীমা অয়নের পাশ দিয়ে চলে গেল। তাকে দেখতেই পেল না। অয়ন নিশ্চিত, আজ সেই ফোনটাই আবার এসেছে। অসীমা এখন একটা মিসাইলের মতন। আশপাশের সবকিছু তুচ্ছ করে রহস্যে ঘেরা লক্ষ্যের দিকে উড়ে যাবে। লক্ষ্যে পৗঁছে তার বিস্ফোরণ কেমন হয়, সে জানে না। আজ ঠিক করল, অসীমাকে অনুসরণ করবে। রহস্যটা আজই সে ভেদ করে ফেলবে।

ভাবতে ভাবতেই পিছন ফিরে দেখল, অসীমা অনেকটা এগিয়ে গেছে। এক দিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। রাস্তায় এখন মানুষজনের সংখ্যাও অনেক। অসীমা তার উপস্থিতি টের পাবে না।

নাক বরাবর অসীমা হেঁটে চলেছে। গতি যথেষ্ট বেশি। ডান দিকের ফুটপাথ দিয়ে হাঁটার জন্য অয়নের একটু অসুবিধা হচ্ছে। বেশ কিছুটা দূরের অসীমাকে নজরে রেখে উলটো দিক থেকে হেঁটে আসা অসংখ্য মানুষকে সামলাতে হচ্ছে। অবশ্য ডান ফুটপাথ ব্যবহার করায় একটা বিষয়ে নিশ্চিত, অসীমা কোনও বাসে উঠবে না। যেখানে যাওয়ার হেঁটেই যাবে।

অসীমা হঠাৎ ফুটপাথ বদল করে বাঁ দিকে বাঁক নিল। পড়িমরি করে অয়ন রাস্তা পার হয়ে বাঁ দিকে বেঁকে যাওয়া রাস্তাটার মুখে এসে হাঁপ ছাড়ল। এটা কোনও পাড়ার গলি নয়। রাস্তাটা বাস-ট্রাম রুটের আওতায় নয়। তবে সেখানে অন্যান্য গাড়ির যথেষ্ট ভিড়। রাস্তার দু’পাশের প্রায় সব বাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোরে একাধিক দোকান। জায়গাটা একটা মার্কেটের মতন। তবে এখন ফুটপাথে ক্রেতাদের তেমন যাতায়াত নেই। একটা কফি শপের সামনে অসীমা দাঁড়িয়ে। একা। বেশ কিছুটা দূর থেকে হলেও অয়ন তার বডি ল্যাঙ্গুয়েজ পড়ে ফেলল। খুবই উদ্বিগ্ন, কাউকে খুঁজছে।

সে একটা সিগারেট ধরাল। একা একা রাস্তার মোড়ে দাঁড়িযে দূরের কোনও মেয়ের শরীরী ভাষা পরখ করা যথেষ্ট সন্দেহজনক ব্যাপার। পাবলিকের নজর পড়ে গেলে বিপদ হতে পারে। হঠাৎ অসীমার সামনে একটি ছেলে এসে দাঁড়াল। অয়ন একটু চমকে উঠল। ছেলেটি যেন মাটি ফুঁড়ে উদয় হল। কোথা দিয়ে এল সে টের পেল না। নিজেকে সামলে নিয়ে সে ভালো ভাবে নজর করল। ছেলেটি তাদের চেয়ে বয়সে অনেকটাই বড়ো। সে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। অসীমা হাত নেড়ে কথা বলেই চলেছে। একটু পরে ওরা কফি শপে ঢুকে গেল। পা চালিয়ে অয়ন কফি শপের কাছে চলে এল। নিজেকে আড়ালে রেখে সে কাচের দরজা দিয়ে দেখল পাশাপাশি দুটো চেয়ারে ওরা বসেছে। দরজার দিকে পিছন ফেরা। অসীমার মাথা নীচু। ছেলেটি তার পিঠে হাত রেখে কিছু বলছে।

অয়নের মনটা তেতো হয়ে গেল। সে ফুটপাথ পালটে এলোমেলো পায়ে কলেজে ফিরে এল। সেকেন্ড অফটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। কিন্তু তার ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করল না। কমন রুমের দিকে এগোল। সেখানে রাহুলের মুখোমুখি হয়ে পড়ল। তাকে দেখে রাহুল হই হই করে উঠল, এ কী রে, তোর মুখের কী অবস্থা। কেস কী?

নীচু স্বরে অয়ন বলল, কথা আছে। এই ক্লাসটা অফ করতে পারবি? খুব জরুরি।

রাহুল একটু ঘাবড়ে গেল। –কেস জন্ডিস নাকি রে? গুলি মার তোর ক্লাসের। প্রবলেম কী?

– এখানে নয়। বাইরে চল।

ওরা একটা চা-টিফিনের দোকানে মুখোমুখি বসল। দোকানে তেমন একটা ভিড় নেই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে তিনজন কাস্টমার। শুধু দু কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে রাহুল বলল, এবার ঝেড়ে কাশ তো বাবা। কেসটা কী?

অয়ন পুরো ঘটনাটা বলল। রাহুলের চোখ জোড়া ছানাবড়া হয়ে গেল।

–সে কী রে, তার মানে অসীমা তোর সাথে গেম খেলছে!

সাংঘাতিক মেয়ে তো! একেবারেই বোঝা যায় না। টাইম পাস করার জন্য তোকে বাছল!

– কিছুই তো বুঝতে পারছি না।

–ঠিকঠাক দেখেছিস তো? নাকি ভগবান দেখতে গিয়ে ভূত দেখে লাফাচ্ছিস?

–বাজে কথা বলিস না। এখন এসব ভালো লাগছে না।

–মালটা কেমন?

–সুন্দর চেহারার একটা ডেফিনেশন আছে না– টল, ডার্ক অ্যান্ড হ্যান্ডসাম? তবে চেহারাটা বেশ রাফ টাইপের। বয়সটাও আমাদের চেয়ে অনেকটাই বেশি।

এবারে রাহুলের কপালে ভাঁজ পড়ল।

-অসীমা এমন লুকোছাপা করে কারও সাথে রিলেশন করবে, ভাবতে গেলেই গা গুলিয়ে উঠছে। কী ক্যারেক্টার রে ভাই! বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।

–কিন্তু ঘটনাটা ঘটেছে। আমারই চোখের সামনে।

–দাঁড়া, এমন হা-হুতাশ করিস না। ভাবতে দে। কনফার্মড হতে হবে। আরও ইনফরমেশন জোগাড় করতে হবে। নইলে দেখবি হাতে হ্যারিকেন নিয়ে ফ্যা-ফ্যা করছিস।

অয়ন বুঝতে পারল, তার মাথাটা পুরোপুরি ঘেঁটে গেছে। অসহায় ভাবে সে রাহুলের দিকে তাকাল।

–এমন গাধার মতন তাকিয়ে থাকিস না। কেসটা বেশ জন্ডিস! ভেবেচিন্তে এগোতে হবে।

–গাধা, গরু যা খুশি বল, আমি তাই। এখন একটু তাড়াতাড়ি কিছু একটা ভাব।

–আচ্ছা, ছেলেটা অসীমা-র দাদা-টাদা হবে না তো?

–না, হবে না। অয়ন বেশ জোর দিয়ে বলল। তোরা জানিস না, অসীমা বেশ কয়েকবার আমায় ওদের বাড়ি নিয়ে গেছে। ওর

বাবা-মায়ের সাথে পরিচয় হয়েছে। অনেক কথা হয়েছে। কোনও দাদা থাকলে নিশ্চয়ই কথাবার্তায় তার কথা আসত। এক-আধ বার দেখা হওয়ারও চান্স মিলত।

–কোনও তুতো দাদা নয়তো?

–এবার তুই গাধার মতো কথা বললি। তুতো দাদার ফোন পেয়ে কেউ অমন বিশ্ব ভুলে দৌড় লাগায় না। তাও এক-আধ বার নয়, বারবার।

রাহুল ঘাড় নাড়ল। –তোর কথায় দম আছে। তবে একটা কথা শোন, এখনই কাউকে কিছু বলিস না। আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। আগে সেটা অ্যাপ্লাই করতে হবে।

–কী প্ল্যান? অসীমার পিছনে স্পাই লাগাতে হবে।

–মানে?

–ঘাবড়াস না। আমার বাবার জানাশোনা এজেন্সি আছে। তারা এসব কাজ করে। সাবজেক্ট কিচ্ছুটি টের পাবে না। একেবারে নাড়ির খবর টেনে বের করবে। বেশি সময়ও নেবে না।

অয়ন সত্যিই ঘাবড়ে গেল। বলল, উলটো-পালটা কিছু হবে না তো রে?

–ফালতু কথা বলিস না। প্রফেশনাল লোকজন কাজ করবে। মাখনের মধ্যে ছুরি চলবে। কেউ কিছু বুঝবে না।

দিন কুড়ি বাদে রাহুল হ য ব র ল মার্কা একটা খবর আনল। এর মধ্যে ফোন কলে সাড়া দিয়ে বার দুয়েক অসীমা কলেজ কেটেছে। সে অয়নকে উপদেশ দিয়েছিল, ঘটনাটার কথা কাউকে না বলতে। কিন্তু মাথামুণ্ডহীন খবরটা এনে সে হাটের মাঝেই ঝাঁপি খুলে বসল। একটু আগেই ফোন পেয়ে অসীমা কলেজ কেটেছে। সোমবার পর পর চারটে অনার্সের ক্লাস থাকে। সেসবের তোয়াক্বা করেনি। তাতেই হয়তো রাহুল উৎসাহিত হয়ে গোপন তথ্য ফাঁস করে ফেলল। এটা তার বরাবরের দোষ। উৎসাহিত হয়ে পড়লে তার পেটে আর কোনও কথা থাকে না।

ঘনিষ্ঠ পাঁচ জনের মধ্যে একজনের পিছনে গোয়েন্দা লাগানো হচ্ছে। অয়ন ভাবল, বাকিরা ব্যাপারটা সমর্থন করবে না।

যে-কোনও বিষয়ে আগ বাড়িয়ে উলটো পালটা কিছু একটা করে ফেলার বদনাম রাহুলের আছে। কিন্তু এই গোয়েন্দা লাগানোর ব্যাপারটা রাহুলের মস্তিষ্ক প্রসূত হলেও, অয়নের ভয় হল বাকিরা তাকেই দূষবে।

কিন্তু তার দিকে কেউ ফিরেও তাকাল না। দু’জনই রাহুলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, কোথায় যায় বলতো? জিজ্ঞাসা করলে কিছু বলতে চায় না। একি রাধিকা প্রেম?

–বাব্বা, একেবারে কলির রাধা।

তিনজনই বিশ্রী ভাবে হেসে উঠল। অয়নের খুব খারাপ লাগল। হতে পারে অসীমার এমন কোনও ব্যক্তিগত বিষয় আছে যেটা সে কারও সাথে শেয়ার করতে চায় না। এই মুহূর্তে হয়তো তাকেও নয়। তাই বলে তার অনুপস্থিতিতে তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা ঠিক নয়। সে সকলের মুখের দিকে তাকাল। তার উপস্থিতি নিয়ে কারও কোনও মাথাব্যথা নেই। তার আরও খারাপ লাগল, বন্ধুদের প্রতি বিশ্বাসে চিড় ধরে গেল। তার কোনও বিষয় নিয়ে এরা হয়তো ভবিষ্যতে এমনি মজা করবে।

–অয়নটাও কিছু জানে না। একেবারে ভ্যাদা।

–ঠিক বলেছিস। ওর উচিত অসীমাকে আচ্ছা করে চেপে ধরা।

কথাটা ঠক করে অয়নের কানে লাগল। প্রেমিক বা প্রেমিকার কোনও গোপন ব্যাক্তিগত বিষয় থাকতেই পারে। একজনের জীবনের সবকিছু অন্যজনের কাছে পরিচিত নাও হতে পারে। শেষের মন্তব্যটা রাহুলের করা। তার মনে হল, সেদিন তার রাহুলের সামনে অতটা রিঅ্যাক্ট করা ঠিক হয়নি। রাহুলকে থামানোর জন্য সে বলল, কী তখন থেকে আজেবাজে বকছিস। কাজের কাজ কিছু হল?

এমন হঠাৎ আক্রমণে রাহুল একটু থতমত খেয়ে গেল। বাকিরাও মুহূর্তের মধ্যে নিজেদের মুড পালটে ফেলল।

–ঠিকই তো। তোর সিক্রেট এজেন্সির প্রোগ্রেস কী?

–আমার কোনও সিক্রেট এজেন্সি নেই। যারা কাজটা করছে তারা প্রফেশনাল।

–প্রোগ্রেসটা বল। প্রায় গনগনে স্বরে অয়ন বলল।

সামান্য একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে রাহুল বলল, ‘ছেলেটিকে এখনও আইডেন্টিফাই করা যায়নি। তবে তার সাথে অসীমার সম্পর্ক বেশ গভীর। দু’বার রেস্টুরেন্টের কেবিনে সে ছেলেটির সামনে কান্নাকাটি করে। ছেলেটিকে সে বাড়ি নিয়ে যেতে চায়। তবে এখনও হয়তো পারেনি। ছেলেটি খুব ধুরন্ধর।’

–কান্নাকাটি করেছে। বাড়ি নিয়ে যেতে চায়। এসব কথার মানে কী? অয়ন ঝাঁঝিয়ে উঠল।

–খুব বেশি ডিটেল এখনও জানা যায়নি। তবে সবই জানা যাবে। আর একটু সময় লাগবে।

হঠাৎই অয়নের মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। কমন রুমে একটা

টি টি টেবিলে হেলান দিয়ে সে দাঁড়িয়েছিল। সেখান থেকে সরে গিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।

–ডিটেলে আর নতুন কী জানবি। এতো সোজাসাপটা টাইম পাসের খেলা।

–অসীমাকে দেখে কিন্তু কিছু বোঝা যায় না।

–আমাদের কথা বাদ দে। অয়নও কিছু বুঝতে পারেনি।

–এটা কিন্তু মেনে নেওয়া যায় না। অসীমাকে এবার সোজাসুজি চার্জ করতে হবে। ওকে বুঝিয়ে দেওয়া দরকার, এমন নোংরা গেম আমরা কেউ পছন্দ করি না। এনজয় করি না।

হঠাৎ রাহুলের মোবাইল ফোন বেজে উঠল। সকলে এক সাথে চমকে উঠল। পকেট থেকে মোবাইল সেট বের করে রাহুল আরও চমকে উঠল– অসীমা ফোন করেছে।

কলটা রিসিভ না করে রাহুল সকলের উদ্দেশ্যে বলল, অসীমা ফোন করেছে।

সকলে এতটা চমকে উঠল যে কেউ কোনও কথা বলতে পারল না। মোবাইলটা চুপ করে গেল।

প্রায় আর্তনাদের স্বরে অয়ন বলল, রিং ব্যাক কর। রিং ব্যাক কর।

রাহুল রিং ব্যাক করল। আশা বলল, লাউডস্পিকার অন করে দে।

ও প্রান্তে অসীমা কলটা রিসিভ করতেই রাহুল নিজের মোবাইলের লাউডস্পিকার অন করে দিল।

রাহুল ‘হ্যালো’বলার আগেই অসীমার স্বর ভেসে এল, একটা রিকোয়েস্ট করছি। প্লিজ রাখিস। আমার হয়ে একটু সকলকে বলিস, রিকোয়েস্টটা যেন রাখে। খুব জরুরি একটা কারণ আছে।

–রিকোয়েস্টটা বল। না রাখার কিছু নেই।

–কাল তোরা কলেজ ড্রপ কর। এগারোটা নাগাদ ভিক্টোরিয়ার মাঠে চলে আয়। ওখানেই কথা হবে। অসীমা লাইনটা কেটে দিল।

কয়েকটা মুহূর্ত নির্বাক অবস্থায় কাটার পর সঞ্চিতা বলল, আবার কী নাটক হবে ভগবান জানে। আমি বাবা কাল কলেজে আসব।

আশা বলল, এসব গেম-টেমের মধ্যে আমি নেই। কাল আমিও কলেজে আসব।

রাহুল দু’জনকেই বোঝানোর চেষ্টা করল, এমন করিস না। দেখা যাক না ও কী বলতে চায়। সিরিয়াস কিছুও তো হতে পারে। হয়তো আমাদের কোনও হেল্প ওর প্রয়োজন।

সকলের ঘড়িতে অনেকক্ষণ এগারোটা বেজে গেছে। এক রাউন্ড বাদাম, তারপর চা শেষ হয়েছে। সকলেই একটু একটু রেগে উঠল। সবচেয়ে বেশি বিরক্ত হয়ে উঠল অয়ন। সকালের দিকে সে একবার ভেবেছিল কলেজে চলে যাবে। অসীমা ফোনে তাকে একটু হিন্টস দিতে পারত। গত রাতে সে দুটো পর্যন্ত জেগে ছিল। অসীমা ফোন করেনি। সে-ও করতে পারত। কিন্তু তার ইগোতে লেগেছিল। অসীমা তাকে সকলের দলে ফেলে দিয়েছে! মনটা একেবারে তিতকুটে মেরে গেছে। খুব অনিচ্ছাতেই সে এখানে এসেছে।

–অসীমার সেন্স অফ টাইমিং-ও তো খারাপ নয়।

–নিজে প্রোগ্রাম করে নিজে এত লেট?

–আমাদের এখানে ভাগিয়ে এনে নিজে আবার কলেজে চলে যায়নি তো?

–হতে পারে। যা খেল দেখাচ্ছে।

–এটাও যদি অসীমার একটা গেম হয়, মেয়ে বলে কিন্তু কোনও ছাড় পাবে না। স্রেফ কেলিয়ে দেব। তখন কেউ জ্ঞান মারতে আসবি না– কথাগুলো রাহুল বলল।

তারা নিজেদের মধ্যে এমন কথা বলে না। কিন্তু আজ বলছে। অয়নের মনে হল তার মাথার ভিতরটা আস্তে আস্তে অবশ হয়ে যাচ্ছে। আগে কখনও এমন হয়নি।

অসীমা গেট দিয়ে বাগানে ঢুকছে। সকলের সাথে অয়নও দেখল। অসীমা নিশ্চয়ই তাদের দেখেছে। তার ঠোঁটের এক কোণে একটা ছোট্ট খুশির ছোঁয়া। অয়ন অনুভব করল, তার মনের তিতকুটে ভাবটা একটু কেটে গেল। মাথাটাও একটু ঝরঝরে হয়ে গেল। সবই অসীমার ওইটুকু হাসির জন্য।

অসীমা এসে রাহুলের পাশে বসল। অয়নকে যেন দেখতেই পেল না।

–একটা খুব জরুরি বিষয় তোদের সামনে শুরু করেছিলাম। আজ সেটা তোদের সামনেই শেষ করতে চাই। কথা দিচ্ছি আর কোনও দিন তোদের কাউকে কলেজ কাটার রিকোয়েস্ট করব না।

হেঁয়ালি করে কথা বলা অসীমা একেবারে পচ্ছন্দ করে না। অথচ এখন নিজেই সেটা করছে। খুব তাড়াতাড়ি অয়ন এদিক-ওদিক একটু ভেবে দেখল। হেঁয়ালির কোনও অর্থ মিলল না।

–অয়নের প্রেমিক হওয়ার কোনও যোগ্যতাই নেই। তোদেরও বন্ধু হিসেবে মানতে একটুও ইচ্ছে করছে না।

চারজনই বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেল। অসীমা কী বলছে! অয়ন নিজের কান দুটোকে বিশ্বাস করতে পারল না।

–তোরা আমার পিছনে প্রফেশনাল স্পাই লাগিয়েছিস?

অয়ন ভীষণ ভাবে চমকে উঠল। রাহুলের দিকে তাকাল। তারও চক্ষু ছানাবড়া।

–বিশেষ একটা ফোন পেয়ে আমি কোথায় যাই, সেটা জানার জন্য তোরা এমন একটা কাজ করলি! একটু ধৈর্য ধরলে সত্যিটা আমি যে-কোনও দিন তোদের বলে দিতাম।

অসীমার চোখের তারায়, ঠোঁটের কোণে কোথাও কোনও হাসির ছোঁয়া নেই। সে খুব রেগে গেলেও এমনটা হয় না।

–আমায় ফোন করে আমার দাদা। একমাত্র দাদা।

চারজনই আকাশ থেকে পড়ল।

–আমার আর কিছু বলার নেই। তোদের আর কিছু জানার অধিকারও নেই। অসীমা উঠে দাঁড়াল।

–আসি রে। ইচ্ছে করলে তোরা এখন কলেজে চলে যেতে পারিস। সে গেটের দিকে পা বাড়াল।

অনেক কথাই অসীমা তার বন্ধুদের বলতে পারল না। তার দাদা অসীম খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিল। কিন্তু পড়াশোনা শেষ না করে দেশ উদ্ধারের কাজে নেমেছিল। এমন একটা রাজনৈতিক দলের সদস্য হয়েছিল, যে দলটাকে দেশের, রাজ্যের সরকার ভয় পায়। সাধারণ মানুষও ভয় পায়। অথচ অসীমের বিশ্বাস একমাত্র তারাই দেশের প্রান্তিক মানুষদের কথা ভাবে। তাদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করে। তাদের অবস্থার কথা দেশের বাকি মানুষদের জানাতে চায়।

পুলিশ কোনও দিন অসীমকে ধরতে পারেনি। সেজন্য প্রথম দিকে তাদের পরিবারের উপর অনেক অত্যাচার হয়েছে। শুধু পুলিশের দিক থেকে নয়। আগে অসীমারা যেখানে থাকত সেখানকার মানুষজনও তাদেরকে পাড়া ছাড়া করানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছিল। অশান্তি এড়ানোর জন্য অসীমা-র বাবা ও-পাড়ার ফ্ল্যাট বিক্রি করে দিয়েছিলেন। ক’টা বছর সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা জায়গায় ওরা ভাড়া বাড়িতে ছিল। সেই সময় থেকে অসীম ওদের পরিবারে অস্তিত্বহীন। শেষে অসীমার বাবা কলকাতায় ফ্ল্যাট কেনেন। ওরা এখানকার ভিড়ে মিশে যায়। সকলেই জানে ওদের তিনজনের সংসার। নির্ঝঞ্ঝাট, সুখী একটা পরিবার। ভেতরের দগদগে ক্ষতের কথা কেউ জানে না।

অসীম তার বোনকে অত্যন্ত ভালোবাসত। নিজে দূরে হারিয়ে গিয়েও সে বোনের খোঁজ করেছে। এক সময় খোঁজ পেয়েছে। কলকাতায় কাজে এলে সুবিধা মতন বোনকে ডেকে নেয়। কয়েকটা মুহূর্ত বোনের সাথে কাটায়।

একথা অসীমার মা বাবা জানেন না।

চারজন পলকহীন দৃষ্টিতে দেখল অসীমা গেট পার হয়ে দূরে মিলিয়ে গেল। চারজনের কেউ কারও মুখের দিকে তাকাতে পারল না। প্রত্যেকের লক্ষ্যহীন দৃষ্টি দূরে দূরে ঘুরতে লাগল। বেলা বাড়তে থাকল। গাছের ছায়ারা সরে সরে যেতে লাগল।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...