‘এই তো একটু আগেই এখানে হাতি ঢুকেছিল। গার্ডরা পটকা ফাটিয়ে তাড়াল দাঁতালটিকে৷’ কথাটা যখন বলছিলেন ম্যানেজার ম্যাডাম বিস্ময়ে আমাদের চোখ বিস্ফারিত। অন্ধকারের মধ্যে যতদূর চোখ যায়, ঠাওর করার চেষ্টা করছি কোথাও এক ঝলক যদি দেখা যায় গণপতির কানটুকু। আসলে এই ঘটনা হাল-হামেশাই ঘটে টিলাবাড়িতে। জঙ্গল থেকে হাতির পাল কখনও কখনও এদিক ওদিক হানা দেয় খাদ্যের সন্ধানে। পথ ভুলে ঢুকে পড়ে পাইথন আর কদাচিত্ লেপার্ডও।

চা-বাগানের সবুজে যেখানে গুচ্ছ মেঘের ছায়া, আর সেই সবুজ-কে আগলে রাখে গরুমারা বনাঞ্চল, তারই কোল ঘেঁষে তিলে তিলে গড়ে উঠেছে এই তিলোত্তমা৷

জায়গাটার নাম টিলাবাড়ি। আর এই নামানুসারেই ওয়েস্ট বেঙ্গল টুরিজম প্রপার্টির নিজস্ব পর্যটকাবাস, এই তিলোত্তমা।

ডুয়ার্স এমনই একটি জায়গা, যেখানে সারা বছরই লেগে থাকে পর্যটকদের আনাগোনা। গরুমারা, চাপড়ামারি, জলদাপাড়া থেকে বক্সা– সর্বত্রই দুয়ার খুলে ডুয়ার্স আহ্বান করে পর্যটকদের। এই ভাবনা থেকেই টিলাবাড়ির এই নির্জন বনবাসর গড়ে ওঠে।

ব্রিটিশরা কলকাতার গরমের সঙ্গে মোকাবিলা না করতে পারায়, দার্জিলিং-কে সাজিয়ে তোলে গ্রীষ্ম আবাস হিসাবে। আর পাহাড়ের পায়ের নীচে একটু একটু করে জনপ্রিয় হতে থাকে এই ডুয়ার্স অঞ্চল। ছোটো ছোটো বাড়ি, ব্যাকড্রপে পাহাড়, ঝকঝকে নীল আকাশ আর নির্মল অক্সিজেনের এই সাম্রাজ্যে কটা দিন কাটিয়ে গেলে সত্যিই মন ভালো হয়ে যায়। আকাশ পরিষ্কার থাকলে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে টিলাবাড়ির হাতায় বসে মুগ্ধ চোখে দেখতে পাবেন কাঞ্চনজঙ্ঘা।

কালিম্পং, দার্জিলিংয়ে ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে যারা নির্জনবাস পছন্দ করেন, এ জায়গাটা তাদের জন্য আদর্শ। আধুনিক ব্যবস্থায় ১০টি কটেজ ও বেশ কয়েকটি ঘর রয়েছে তিলোত্তমায়। যদি কোনও কিছু না-ও করেন, ভোরবেলা ল্যান্ডস্কেপ গার্ডেনে হাঁটুন আর বুক ভরে নিন বাঁচার আনন্দ। পাইন, বার্চ, জারুল, শিমূল, অজস্র গাছগাছালি আর অর্কিডে সাজানো এই জায়গাটায়, একদা মনে পড়ে যেতে পারে অমিত আর লাবণ্যকে।

বাচ্চাদের বিনোদনের জন্য নানা খেলার সরঞ্জাম রাখা হয়েছে বিস্তৃত লন-এ। আর আছে বাড়তি আকর্ষণ একটি ইকো মিউজিয়াম। গাছগাছালি, পাখপাখালি, এক কথায় বন্যজগতের এক আস্ত ছবি আঁকা হয়ে যাবে ছোটোদের মনজগতে। মিউজিয়ামে রয়েছে নানা ধরনের খেলা, কু্ইজ ও বিনোদনী ব্যবস্থা। প্রকৃতিপাঠের এক অনন্য সুযোগ। সকাল থেকেই টিলাবাড়ির গাছগুলিতে চলে নানা পাখির আনাগোনা। ফলে চোখ বুজে শুধু পাখির ডাক শুনেই সময় কেটে যায়।

Rhino in Gorumara Forest

অনতিদূরেই গরুমারা জাতীয় উদ্যান। প্রায় ৮০ স্কোয়ার কিলোমিটার জুড়ে এর বিস্তার। পার্কটি দেশের সংরক্ষিত বনাঞ্চল হিসাবে সেরার শিরোপা লাভ করেছে। তরাই বনভূমির অসংখ্য গাছগাছালি, নানা প্রজাতির পাখি, হাতি, গন্ডার, বাইসন, হরিণ, মযূর প্রভৃতিতে ভরা এই বনস্থলি। ওয়াচটাওয়ার থেকে জঙ্গলটি দেখা যেন রোমাঞ্চে ভরপুর।

বেড়াতে গিয়ে রসনা তৃপ্তির কথা যারা ভাবছেন, তাদেরও মন ভরে যাবে এখানকার কিচেনে তৈরি হওয়া সুস্বাদু ভুরিভোজে। ডাইনিং এরিয়া বা রুম সার্ভিস পরিবেশনে নিখুঁত। কটেজের ডেকরেও অসম্ভব সুন্দর, পরিপাটি ছাপ। দেয়ালে টাঙানো ছবি থেকে পেয়ালা-পিরিচ সবেতেই যার আদর আপ্যায়ন লেগে, তাঁর নামটি বাদ দিলে চলবে না। তিনি এখানকার ম্যানেজার গৌরী ঘোষ। শুধু টিলাবাড়িই নয়, মূর্তি বাংলোর দায়িত্বও তাঁর তরুণ কাঁধে ন্যস্ত। ‘সত্যি বলতে কী এত কম বয়সি এবং সর্বোপরি মহিলা ম্যানেজার হয়ে পরিচালনার কাজটি করা শুরুতে সহজ ছিল না’, সলজ্জ হাসি গৌরীর। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থাটি দেখলে বোঝা যায় তাঁর নিরলস পরিশ্রমে কীভাবে নিখুঁত হয়ে উঠেছে তিলোত্তমা।Teagardens near Tilabari , Dooars

কোভিডের এই দমচাপ কষ্ট কাটিয়ে একটু মন ভালো করতে যদি বেরিয়ে পড়েন, মন্দ লাগবে না। জঙ্গল সাফারির ব্যবস্থা করে দেবেন ম্যানেজার ম্যাডাম। সব মিলিয়ে এক অপূর্ব স্মৃতি খুঁটে বেঁধে ফিরতে পারবেন শহুরে রোজনামচায়।

কীভাবে যাবেন : এনজেপি বা নিউ মাল জংশন, দু’জায়গাতেই নামতে পারেন টিলাবাড়ি আসার জন্য। এনজেপি থেকে ঘন্টা দুয়েকের পথ। করোনেশন ব্রিজ পেরিয়ে ডানহাতে বেঁকে মেটেলি চা-বাগানের পাশ দিয়ে পথ গেছে তিলোত্তমায়। সবুজের হাতছানি এড়াতে পারবেন কী?

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...