অন্য দিনের চেয়ে সহেলির ঘুম আজ একটু তাড়াতাড়ি ভেঙে গেল। পাশে রাখা ঘড়িটায় চোখ পড়ল, সাড়ে ছ’টা প্রায় বাজে। সকালের খবরের কাগজটা এতক্ষণে নিশ্চয়ই এসে গিয়ে থাকবে। মনে হতেই চটপট বিছানা ছেড়ে নেমে এল। বারান্দার দরজা খুলতেই মাটিতে পড়ে থাকা খবরের কাগজটায় ওর চোখ আটকাল। সযত্নে তুলে এনে নিজের বিছানায় এসে বসল। কাগজটা চোখের সামনে মেলে ধরে একটা একটা করে পাতা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। চোখে মুখে এক অধীর আগ্রহ। হঠাৎ-ই একটা খবরে এসে চোখ আটকে গেল তার। মুখে ফুটে উঠল কুটিল হাসি।
রান্নাঘর থেকে মায়ের গলা ভেসে এল, ‘চায়ের কাপটা এসে নিয়ে যা, শুধু শুধু ঠান্ডা হচ্ছে।’
সহেলি উত্তর দিল না। পুরো খবরটা মন দিয়ে পড়া শেষ করে কাগজটা পাশে সরিয়ে রাখল। আবার মায়ের গলা পেল, চায়ের জন্য ডাকাডাকি করছেন।
‘এত চ্যাঁচাচ্ছ কেন, খবরের কাগজটা একটু পড়ছিলাম। তোমার আর তর সইছে না…’, বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয় সহেলি।
মেয়ের কথায় মা-ও চুপ করে থাকেন না, ‘এই শীতের সকালে উঠে তোদের জন্য করেও মরব আর তোরা কথা শোনাতেও ছাড়বি না। এমন কী খবর পড়ছিস যে সকলের আগে আজ কাগজ নিয়ে বসে পড়লি?’
‘খবর তো সবসময় স্পেশাল-ই হয় তাই জন্যই তো পাতায় আলাদা করে ছাপা হয়, যাতে সকলে পড়ে আর জানতে পারে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে সহেলি মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, ‘মা আমাকে তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। তবে খবরের কাগজে কী পড়ছিলাম সেটা যদি জানতে চাও আমি বলতে পারি। তুমি কি শুনতে ইন্টারেস্টেড?’
‘হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি বল…’ মা তাড়া লাগান।
‘মা… রকি-কে তোমার মনে আছে, আমার সঙ্গে কলেজে পড়ে? হিরোদের মতো হাবভাব… তুমি যার চুলের স্টাইল দেখে হেসে গড়াতে…’
‘ও… হ্যাঁ… রকি? বাইকে করে আসত? তোর পেছনেও তো কিছুদিন ঘোরাঘুরি করেছিল?’
‘হ্যাঁ, মা… তুমি ঠিকই বলছ… আমার জন্য অনেক ঘোরাঘুরি করেছে… ওর অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। খবরটা বেশ বড়ো করে বেরিয়েছে। সম্ভবত ড্রিংক করে বাইক চালাচ্ছিল। খবরটা কাল আমায় ফোন করে রজত জানিয়েছিল। সে তো সাংবাদিক, ওকে দেখতে হাসপাতাল যাব। ওখান থেকে সোজা কলেজ চলে যাব।’
‘তোর হাসপাতাল যাওয়াটা সত্যিই কি খুব জরুরি? এখন তো তোর সঙ্গে কথাবার্তাও খুব একটা হয় না…’
‘সেই জন্যই তো বেশি জরুরি, মা। আমার অন্য বন্ধুরা মনে করবে আমি হয়তো রিলেশনশিপটা ভেঙে যাওয়াতে আজও রাগ করে বসে আছি অথচ আমার মনে কিন্তু ওর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই। সমাজে টিকে থাকতে এগুলো তো একটু-আধটু করতেই হয়।’
‘তোর কথাটাই বোধহয় ঠিক… তুই স্নানটা সেরে নে, আমি ততক্ষণ তোর টিফিন-টা প্যাক করে দিচ্ছি।’
রেডি হয়ে হাসপাতাল পৌঁছোতেই রকির কেবিনে কলেজের বন্ধুদের ভিড় দেখে একটু ইতস্তত করে কেবিনে ঢোকে সহেলি। ওকে দেখেই রকি বিছানায় উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে বলে, ‘আরে সহেলি তুমি।’
‘শুয়ে থাকো, তোমাকে উঠতে হবে না, বিছানার পাশে এসে দাঁড়ায় সহেলি, ‘এসব কী করে হল রকি?’ গলার স্বর নামিয়ে সহেলি প্রশ্ন করে।
‘আরে আমার…’ কথাটা শেষ করার আগেই রকির একজন বন্ধু মজার ভঙ্গিতে বলে, ‘আরে দ্যাখো গিয়ে, কোনও বড়ো পার্টি অ্যাটেন্ড করে ফিরছিল রকি… ড্রিংক-টা হয়তো একটু বেশিই করে ফেলেছিল… ভেবেছে বোধহয় আকাশে উড়ছে… নিজেকে খুব হালকা মনে করছিল… ব্যস লাগিয়ে দিয়েছে…’, সকলে হেসে ওঠে বন্ধুটির কথা শুনে।
‘তোমাকে কতবার বলেছি রকি ড্রিংক করে বাইক চালিও না…’
সহেলিকে থামিয়ে আর একজন বন্ধু অরুণাভ টিপ্পনি কাটে, ‘আর চালাবে না। একবার দেখে নিয়েছে এর পরিণতি কী হতে পারে। ধাক্বা না খেলে মানুষ শেখে না। বুঝিয়ে কজনকে সঠিক পথে আনা গেছে বলতে পারিস সহেলি?’
সকলেই আর একবার হেসে ওঠে সহেলি ছাড়া।
রকি এত কথার মধ্যেও বিরক্ত বোধ করে, ‘তোদের লজ্জা করছে না? আমি এখানে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি আর তোরা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি করে যাচ্ছিস… কীরকম বন্ধু তোরা?’
‘বন্ধুরা এরকমই হয়। বন্ধুর কষ্ট ভুলিয়ে তাকে হাসানোটাই তো বন্ধুর মতো কাজ।’ রকির বন্ধুদের মধ্যে থেকে একজন বলে ওঠে, আর সকলে তাকে সমর্থন করে।
‘ওকে, আমি এখন চলি। প্লিজ টেক কেয়ার রকি। হেল্প লাগলে বোলো, সহেলি সকলকে হাত নেড়ে কেবিনের দরজার দিকে এগিয়ে যায়। রকিও হাত তুলে সহেলিকে বিদায় জানায়।
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে নিজের স্কুটি স্টার্ট করে কলেজের পথে রওনা দেয় সহেলি। স্কুটি রাস্তায় ছুটতেই ধীরে ধীরে সহেলির মুখের ভাব বদলে যায়। মনটা যেন পাখা মেলে ধরে। নিজের মনেই সহেলি আওড়ায়, ‘বেচারা, এখন যত খুশি ফুর্তি কর হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে। এক মাসের আগে কিছুতেই এখান থেকে ছাড়া পাবি না চাঁদু।’
সন্ধেবেলায় বাড়ি পৌঁছে সহেলির নিজেকে খুব রিল্যাক্সড মনে হচ্ছিল।… রোজের মতো পরীক্ষার জন্য চিন্তার ছাপ সেদিন আর ওর মুখে দেখা গেল না। একটু বিশ্রাম নিয়ে জুত করে নিজের জন্য এক কাপ কফি নিয়ে বসল। সামনে রাখা পত্রিকাটা টেনে নিয়ে চোখ বুলোতে লাগল। মেয়ের উপস্থিতি বুঝে মা এসে ঘরে ঢুকলেন, ‘কী রে, কফি নিয়ে বসলি? আজ জিম যাবি না?’
‘না-মা, আজ আর জিম যাব না।’
‘সে কী রে? অন্যদিন তো তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকিস, আর আজ কী হল যে নিজেই জিম যেতে চাইছিস না?’ মা-কে একটু চিন্তিত দেখায়।
‘মা, এখন আমি একদম ফিট। আমার ট্রেনারই বলেছেন, ওনার ট্রেনিং ছাড়াই নিজে নিজে কিছু ব্যায়াম করলেই আমার জন্য যথেষ্ট। আর সত্যিই নিজেকে বেশ ফিট লাগছে, ফিজিক্যালি তো বটেই, মেন্টালিও।’
মেয়ের কথা মা ঠিক বুঝতে পারেন না, ‘ফিজিক্যালি তো বুঝলাম, মেন্টালি ফিট কথাটার মানে ঠিক বুঝলাম না।’
‘তুমি বোঝার চেষ্টাও কোরো না, তুমি বুঝতে পারবে না, সহেলির গলায় বিদ্রুপটা মা ঠিক বুঝতে পারেন।
মা-ও দমবার পাত্রী নন। গলার জোর বাড়িয়ে মেয়েকে বলেন, ‘কেন বুঝতে পারব না? তুই বোঝালে তবে না বুঝব? কিছু খুলে না বললে কোথা থেকে বুঝব? আজকালকার ছেলেমেয়েরাও মা-বাবাকে কিছুই খুলে বলতে চায় না… এ এক যুগ এসেছে বটে।’
‘তুমি এরকম কেন ভাবছ?’ সহেলি মা-কে বোঝাবার চেষ্টা করে, ‘আমি তো সবকিছুই তোমার সঙ্গে শেয়ার করি।’
‘তাহলে পরিষ্কার করে বলছিস না কেন কী হয়েছে, কারণ তোর ব্যবহার আজ একেবারে অন্যরকম লাগছে।’
‘অন্যরকম আবার কী, আমি যে-রকম সেরমই ব্যবহার করছি।’
‘আমি তোর মা, তোকে খুব ভালো করে চিনি। আমার কাছে লুকোবার চেষ্টা করিস না। অন্যদিন তোকে অনেক বেশি চিন্তিত লাগে দেখে কিন্তু আজ চেহারায় পরম নিশ্চিন্ত ভাব তোর। রকির সঙ্গে সব মিটমাট হয়ে গেছে মনে হচ্ছে? সকালে ওকে দেখতে হাসপাতাল গিয়েছিলি না? কী কথা হল? ও কেমন আছে এখন? লক্ষ্য করেছি যবে থেকে তোদের দু’জনের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে তোর চেহারাটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে। ভালোই করেছিলি ভালো ভালো বই পড়া শুরু করেছিলি আর জিম গিয়ে নিজেকে ফিট রাখতে শুরু করেছিলি। কিন্তু হঠাৎ এখন…’
সহেলি চুপ করে বসে মায়ের কথা শুনে যায়, কোনও উত্তর দেয় না। ভাবলেশহীন চেহারা, শূন্যে কোথাও হারিয়ে যায় ওর স্থির দৃষ্টি।
মা অস্থির হয়ে ওঠেন, ‘কীরে কোনও উত্তর দিচ্ছিস না কেন… রকির সঙ্গে কী কথা হল? আমি তোর মা… আর শুধু মা-ই নই, আমি তোর বন্ধুও বটে।’
‘মা তোমার কাছে আমার লুকোবার কিছুই নেই… আমার জীবনের সব কিছুই তো তোমার কাছে খোলা পাতা…’ একটু শ্বাস নেয় সহেলি, তারপর আবার বলে, ‘তোমার মনে আছে মা, গতবছর নিউ ইয়ার পর্টিতে আমি রকির সঙ্গে গিয়েছিলাম আর পার্টি শেষ হওয়ার পর ও আমাকে বাড়িতে পৌঁছোতে এসেছিল?’
‘হ্যাঁ মনে আছে।’
‘রকি আমাকে বাড়িতে নামানোর আগে রাস্তায় একবার বাইক দাঁড় করিয়েছিল। আমাকে বলেছিল ওর একজন বন্ধুকে কোনও জরুরি কিছু কাগজ দেওয়ার আছে, পাঁচ মিনিটের বেশি লাগবে না। ও আমাকে বন্ধুর বাড়িতে নিয়ে যায়। ছেলেটির সঙ্গে আড়ালে গিয়ে কিছু কথাবার্তা বলে। তার কিছুক্ষণ পরই ছেলেটি আসছি বলে বেরিয়ে যায়। রকি টেবিলের উপর কিছু কাগজপত্র রেখে রান্নাঘরে ঢুকে যায়। নিজেই ফ্রিজ খুলে জল বার করে খায় এবং আমাকেও এক গেলাস জল এনে দেয়। ওর বন্ধু কোথায় গেল জিজ্ঞেস করলে উত্তর না দিয়ে, জলের গেলাস আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। পার্টি থেকে আসার পর আমারও খুব তেষ্টা পেয়ে গিয়েছিল। আমি পুরো জলটাই খেয়ে ফেলি এবং তার পরেই আমার মাথা ঘুরতে শুরু করে।
যখন জ্ঞান ফেরে দেখি আমি বিছানায় শুয়ে আছি। শরীরে কোনও পোশাক নেই। রকি আমার পাশে শুয়ে। পুরো ব্যাপারটা বোধগম্য হতে এক সেকেন্ড লাগে। তারপরই একপ্রস্থ ঝগড়া হয়ে যায় রকির সঙ্গে, কান্নাকাটিও করি কিন্তু ওর উপর কোনও প্রভাব পড়েছিল বলে একেবারেই মনে হয়নি। এমনকী আমার কাছে ক্ষমা চাওয়ারও প্রয়োজন মনে করেনি। মা, রকি আমার জলের গেলাসে নেশার কিছু মিশিয়ে দিয়ে সেদিন আমাকে ও ধর্ষণ করেছিল।’
‘সে কী?’ চমকে ওঠেন মা, ‘তুই আজ আমাকে বলছিস একথা?’
‘হ্যাঁ মা, সেদিন বলতে পারিনি। রকি আমাকে ভোরবেলা বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিল। অত দেরি করে ফেরার জন্য তুমি খুব বকেছিলে।’
‘সেদিনই তোর উচিত ছিল পুরো ঘটনা খুলে বলা, কেন বলিসনি সেদিন?’
‘কী লাভ হতো বলে, তোমার আরও চিন্তা বাড়ত। সেদিন যদি আমি তোমাকে সবকিছু বলে দিতাম তুমি ভয় পেতে। সমাজ, অসম্মান এসবের কথা বলে আমাকেও ভয় পাইয়ে দিতে। কিন্তু এই দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর আমি এতটুকুও ভয় পাইনি। রকির সঙ্গে কথা বলা শুধু বন্ধ করে দিই।’
‘ভালো করেছিস। এরকম বন্ধু থাকার থেকে না থাকাই মঙ্গলের।’
‘আমি ঘটনাটার জন্য প্রতিশোধ নেওয়া মনস্থির করি। নানা ধরনের বই পড়ে পড়ে একটা প্ল্যান মাথায় আসে। জিম জয়েন করি নিজেকে মানসিক এবং শারীরিক ভাবে শক্ত করে তুলতে।’
‘জিমে যে-ট্রেনারের আন্ডারে আমি ট্রেনিং নিচ্ছিলাম তিনি আমাকে এক্সারসাইজ করাবার আগে এবং পরে স্ট্রেচিং করাতেন। পিঠের পিছনে হাত নিয়ে গিয়ে দুটো হাত জোড় করতে হতো। প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হতো। জোর করে স্ট্রেচ করতে গেলে কাঁধের হাড় ভেঙে যেতে পারে বা ডিসলোকেশন হতে পারে। তাই খুব ধীরে ধীরে প্রাক্টিসের মাধ্যমে পুরো জিনিসটা আয়ত্তে আনতে বলেছিলেন ট্রেনার। স্ট্রেচিং এর জন্য শরীর ফ্লেক্সিবল হওয়াটা খুব জরুরি।
মা, একবছর আমি ধর্ষণের দংশন সহ্য করেছি। যে-বন্ধুকে এতটা বিশ্বাস করেছি, অবলীলায় ওর সঙ্গে রাতের পার্টি অ্যাটেন্ড করতে চলে গেছি, সেই আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল। আমার কী দোষ ছিল? দোষ, একটাই যে আমি ওকে ভরসা করেছিলাম।’
মা এতক্ষণ চুপ করে মেয়ের কথা শুনছিলেন। রকির প্রতি ঘৃণায়, বিতৃষ্ণায় তাঁর মন ভরে ওঠে। মেয়েকে সান্ত্বনা দিতে দিতে বলেন, ‘ভালো হয়েছে, সম্পর্কটা থেকে সরে আসতে পেরে। কথায়-বার্তায় রকিকে এতদিন ভদ্র সভ্যই জানতাম, ও যে এরকম জঘন্য কাজ করতে পারে স্বপ্নেও কোনওদিন ভাবিনি।’
‘মা ওর জন্য আমার মানুষের উপর থেকে বিশ্বাসই উঠে গেছে। আমার সঙ্গে কলেজে যে ছেলেরা পড়ে, তাদেরকেও আমি এখন ভরসা করতে পারি না। খালি মনে হয় ওরাও রকির মতনই হবে। অনেকবারই ভেবেছি একটি ছেলে খারাপ বলে সবাই ওর মতন কখনওই হতে পারে না। কিন্তু বার বার নিজের মন-কে বোঝালেও কোথায় যেন একটা লুকোনো ভয় মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে চায়। এর জন্য দায়ী একমাত্র রকি। যেদিন থেকে মা জিমে গিয়ে ট্রেনারের আন্ডারে স্ট্রেচিং করা শুরু করি সেদিন থেকেই মনের মধ্যে একটা প্ল্যান দানা বাঁধতে শুরু করে। যত দিন এগিয়েছে, মনের ভিতর প্ল্যানটাও আরও জোরদার হয়ে উঠেছে, সহেলি এতটা বলে নিঃশ্বাস নিতে একটু থামে।
মা-ও কথা বলেন না। মেয়ের মুখের দিকে শুধু তাকিয়ে থাকেন।
সহেলি আবার বলতে থাকে, ‘প্ল্যান অনুযায়ী আমি আবার রকির সঙ্গে কথাবার্তা বলতে আরম্ভ করি। আগের মতো মেসেজ পাঠানো শুরু করি। রকিও প্রথম প্রথম আমার ব্যবহারে খুব আশ্চর্য হয়ে যায় কিন্তু পরে ধীরে ধীরে সবকিছু আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে আসে। মেয়ে হিসেবে শালীনতা বজায় রেখে যতটা পুরুষকে আকর্ষণ করা যায় সেই সব পন্থাই আমি রকির ক্ষেত্রেও অবলম্বন করি। যখন বুঝতে পারি রকি আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে তখন একদিন ওকে আমি একটা মেসেজ করি সামান্য শালীনতার গন্ডি পেরিয়ে। মেসেজ পড়ে রকি আমার সঙ্গে আবার একলা দেখা করার জন্য পাগল হয়ে ওঠে। আমিও ঠিক এটাই চাইছিলাম। কলেজেই ওর সঙ্গে বসে একটা দিন ঠিক করে একটা জনহীন জায়গায় ডে আউট করার প্ল্যান করি শুধু আমি আর রকি। রকিও প্ল্যান শুনে খুব খুশি হয়।’
মা নিজের উত্তেজনা রোধ করতে পারেন না, সকৌতুকে জিজ্ঞাসা করেন মেয়েকে, ‘তুই বললি আর রকি রাজি হয়ে গেল তোর কথায়? একসঙ্গে পিকনিকে গিয়েছিলি? ওখানে কী হল?’
মায়ের উত্তেজনার রেশ লাগে সহেলির কথাতেও, ‘রাজি হবে না আবার? ও তো সুযোগ খুঁজছিলই। আমি প্রস্তাব দিতেই টোপ গিলে ফেলল।’
‘এত কান্ড হয়ে গেল, অথচ আমি কিছুই জানি না, মায়ের মনের কষ্টটা সহেলি বুঝতে পারে।
‘তোমাকে জানালে তবেই তো তুমি জানতে পারবে। ওই সময় আমি ব্যাপারটা নিয়ে কারও সঙ্গে আলোচনা করাটা ঠিক বলে মনে করিনি। ছাড়ো এই সব কথা। প্ল্যান মতো আমি আর রকি একটা নির্জন জায়গা বেছে নিই। খাওয়া-দাওয়া, গল্প করে আমরা অনেকটা সময় কাটাই। রকির জন্য আলাদা করে আমি হার্ড ড্রিংক্স কিনে নিয়ে গিয়েছিলাম কারণ জানতামই ও নেশা করতে চাইবে। ও প্রায় পুরো বোতল শেষ করে নেশায় চুর হয়ে পড়ে আর আমাকে জড়িয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে নেবার চেষ্টা করতে থাকে। আমিও খুব একটা বাধা দিই না। এরপর রকি নিজের উপর পুরোপুরি কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলে। আমিও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম। আমি ওকে মাটিতে উপুড় করে শুইয়ে দিয়ে হাতদুটো মুচড়ে দিই। ওর চোখে মুখে যন্ত্রণার চিহ্ন ফুটে উঠতেই বুঝতে পারি ওর কাঁধের হাড় ভেঙে গেছে।
এরপর ওর বাইক-টা স্টার্ট করে একটু পিছন দিকে নিয়ে গিয়ে স্টার্ট অবস্থায় ছেড়ে দিই। বাইকটা নির্জন রাস্তায় একটু রাস্তা গিয়ে প্রায় রকির পাশেই উলটে পড়ে যায়। পথের পাশে রকিকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখে যে-কেউই মনে করবে বাইক উলটে ও রাস্তায় ছিটকে পড়েছে। আমিও এর পর বেশ খানিকটা রাস্তা পায়ে হেঁটে রিক্শা ধরে তারপর মেন রোডে এসে বাস ধরি বাড়ি ফেরার জন্য।’সহেলি পুরো ঘটনা মাকে বিস্তারিত বলে অনেক হালকা বোধ করে।
‘ও-হো! তাই তুই সেদিন অত রাত করে বাড়ি ফিরেছিলি। সারাদিন আমি চিন্তা করেছি কারণ কলেজে যাসনি সেটা জানতাম। তখনই যদি পুরোটা খুলে বলতিস… আমি তো ভেবেই অস্থির। তার উপর তোর ফোন-ও সুইচড অফ ছিল…।’ মায়ের গলার স্বরেই সহেলি বুঝতে পারে ওকে নিয়ে সেদিন মা কতটা চিন্তা করেছিলেন।
মেয়েকে খানিক নিরীক্ষণ করেন মা। মেয়ের মুখের ভাবান্তর লক্ষ্য করে মা আবার বলেন, ‘কিন্তু সহেলি আমি তাও বলব তুই যেটা করেছিস সেটা অন্যায়।’
সহেলির চোখ দিয়ে যেন আগুন ঠিকরে বেরোতে চায়, ‘তুমি বলছ আমি যেটা করেছি সেটা অন্যায় আর রকি কি আমার সঙ্গে ন্যায় করেছে? কী মনে হয় তোমার মা?’
‘কিন্তু তুই হাসপাতালে গেলি ওর সঙ্গে দেখা করতে, ও কিছু বলল না তোকে?’ মা নিজের মনের ভয় লুকোতে পারেন না।
‘কী করে বলবে মা?
আর হাসপাতালে সকলের সামনে আমি হাসিমুখেই ওর সঙ্গে কথা বলেছি আগের মতোই। আমাদের দুজনের মধ্যে প্যাচ-আপ হয়ে গেছে কলেজের সবাই জানল। সুতরাং সন্দেহের কোনও অবকাশও নেই। ড্রিংক করে ও প্রায় বেহুঁশ হয়ে পড়েছিল। হাসপাতালে রক্ত পরীক্ষায় সেটা ধরা পড়তে বাধ্য। গ্রামের লোকেরা ওকে হাসপাতালে এনেছে। ওরাই বয়ান দেবে বেহুঁশ অবস্থায় বাইক চালাতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে রকি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে। কাগজেও সেই খবরই বেরিয়েছে, ‘এই দ্যাখো মা। সহেলি খবরের কাগজের পাতাটা মায়ের সামনে খুলে ধরে।
‘পিকনিকের দিন আমি ওর সঙ্গে ছিলাম সেটার কোনও প্রমাণ ওর কাছে নেই। আমি ওকে পুরো ব্যাপারটা গোপন রাখতে বলেছিলাম। আমিও কলেজে বলে রেখেছিলাম দু’দিনের ছুটি নিয়ে কাকার কাছে বর্ধমানে যাব। সেদিনকে রকি এতটাই নেশা করেছিল ওর কিছু মনে থাকাটাই অস্বাভাবিক। আর যদি মনেও পড়ে, ও কারও কাছে মুখ খুলতে পারবে না কারণ তাতে ওরই সম্মানহানি বেশি হবে। আর ও যদি মুখ খোলেও আমি ধর্ষণের ঘটনা সকলের সামনে বলে দেব। সেদিনের জামাকাপড় সব সযত্নে তুলে রেখেছি আমি।’
‘কিন্তু সহেলি তুই এসব করার সাহস কী করে পেলি মা?’
‘আর নয়তো কী করতাম? সারাজীবন এই অসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতাম? কাউকে যদি বলতে যেতাম, উলটে আমাকেই লোকে দোষ দিত, কেন আমি এত রাতে ওর সঙ্গে বাড়ি ফিরছিলাম? কেন আমি একটা ছেলের সঙ্গে পার্টি অ্যাটেন্ড করতে গিয়েছিলাম? আমি খুব ভালো করেই জানতাম কেউ আমাকে সহানুভূতি জানাবে না বরং দুর্ঘটনাটার জন্য আমাকেই দায়ী করবে। সেদিন রকি শুধু আমার শরীরটাকেই নয়, আমার আত্মারও ধর্ষণ করেছিল। আজ আমি সেই পুরোনো যন্ত্রণার হাত থেকে মুক্তি পেলাম।
কত নিরীহ মানুষ, কত মহিলা, নির্দোষ বাচ্চারা এইভাবে বলি হয়, এই দংশন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে। আমিও কি তাহলে ওদের মতোই তিলে তিলে নিজেকে শেষ করে দিতাম? পাপ রকি করেছে, ফলভোগ ওকেই করতে হবে। আমি নিজেকে একবারেই দোষী মনে করি না আর তুমিও আমাকে দোষী ভাববে না।… আর একটা কথা… তোমাকে যা বললাম সেটা তোমার আর আমার মধ্যেই যেন থাকে।
এর পরে যা কিছু ঘটবে সব আমি ম্যানেজ করে নেব শুধু মা, তোমার সাপোর্ট আমার খুব দরকার,’ সহেলি বলা থামিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। অন্ধকারের পথ সে বেছে নিয়েছে বটে, কিন্তু তার বিবেকের কাছে সে নির্দোষ, এটাই তার একটা বড়ো ভরসা।
‘ও ভালো হয়ে যদি সবকিছু সবাইকে বলে দ্যায়, তাহলে তুই কী করবি’, সহেলির মা চিন্তিত হন।
ওর কিছু মনে থাকলে তবেই তো বলতে পারবে। তুমি তোমার মেয়েকে এতটা কাঁচা কাজ করবে কী করে ভাবলে? আমিও জানতাম ও ঘটনাটা পরে পুলিশের কাছে জানাতেই পারে। কী করে ঘটনার স্মৃতি ওর মন থেকে মুছে ফেলতে পারব তাই নিয়ে পড়াশোনা করতে করতে ‘রোহিপনল’ নামে একটি ড্রাগের বিষয়ে জানতে পারি, যেটা ড্রিংক-এর সঙ্গে সহজে মিশেও যায় এবং খাওয়ার পর কিছুই আর মনে থাকে না। আমিও সেটাই কষ্ট করে জোগাড় করে রকির ড্রিংকে মিশিয়ে দিয়েছিলাম।’