প্রবাদ আছে– যার পেট ভালো, তার সব ভালো। যারা পেটের অসুখে ভুগেছেন অথবা ভুগছেন, তারা অন্তত এই প্রবাদের যথার্থতা উপলব্ধি করতে পেরেছেন। আসলে, শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ভালোমন্দ অনেকটাই নির্ভর করে পেটের সুস্থতার উপর। একটু ভালো ভাবে নজর রাখলে প্রমাণ পাবেন, মাথার চুল পড়ে যাওয়া এবং ত্বকের জৗলুস হারিয়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হল ওই পেটের অসুখ। তবে শুধু চুল পড়া কিংবা ত্বকের সমস্যাই নয়, পেপটিক আলসার কিংবা লিভার ক্যানসারের মতো বড়ো অসুখগুলির সূত্রপাতও কিন্তু নিয়মিত হজমের গোলমাল কিংবা অ্যাসিডিটি থেকে। অতএব, পেটের সুস্থতা জরুরি। কীভাবে পেট ভালো রাখবেন, সেই বিষয়ে একগুচ্ছ গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিলেন ডা. সঞ্জয় মণ্ডল।

প্রতিদিন সকালে অ্যান্টাসিড খাওয়া কি পাকযন্ত্রের পক্ষে ভালো?

বিনা প্রয়োজনে ওষুধ খাওয়া উচিত নয়। কেবলমাত্র সেই সমস্ত মানুষেরই ওষুধ খাওয়া উচিত, যাদের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। এই বিষয়টি অ্যান্টাসিড গ্রহণের ক্ষেত্রেও সমান ভাবে প্রযোজ্য। নিয়মিত কখনওই অ্যান্টাসিড খাওয়া উচিত নয়।

একজন ডায়াবেটিক রোগী কীভাবে তাঁর পরিপাক সম্পর্কিত বিষয়গুলিকে বিবেচনা করবেন?

একজন ডায়াবেটিক রোগীকে প্রথমেই চিনি ও কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাদ্য বর্জন করতে হবে। তাঁদের খাদ্য-তালিকায় রাখতে হবে প্রোটিন জাতীয় খাবার। অন্যান্য সাধারণ মানুষের মতোই অত্যধিক তেল ও মশলা জাতীয় খাবারকে তাদের খাদ্য-তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে। খাদ্য-তালিকা হতে হবে সুষম এবং খাদ্য গ্রহণ করতে হবে পর্যাপ্ত সময়ের ব্যবধানে। ডায়াবেটিক রোগীকে ভরপেট খাওয়া এড়িয়ে চলতে হবে। খাবারের মধ্যে ক্যালোরি’র মাত্রাকে সঠিক ভাবে বিচার করে খাবার খেতে হবে। একজন ডায়াবেটিক রোগীকে ইনসুলিন ও ওরাল হাইপোগ্লিসিমিক্সকে এড়িয়ে যাওয়া বন্ধ করতে হবে।

প্রাত্যহিক কর্মজীবনে পাকযন্ত্রকে সুস্থ রাখার জন্য কোন কোন বিষয়গুলিকে মাথায় রাখতে হবে?

ব্রেকফাস্ট করতে হবে ভারী। লাঞ্চ হবে হালকা এবং ডিনারটিও করতে হবে হালকা। এটাই হচ্ছে প্রাত্যহিক জীবনের ভালো খাদ্যাভ্যাস। তাছাড়া তেল-মশলা জাতীয় খাবারকে বর্জন করতে হবে। অ্যালকোহল ও ধূমপান বর্জন করতে হবে। ভালো ভাবে তৈরি টাটকা খাবার খেতে হবে এবং রেস্তোরাঁর খাবারকে এড়িয়ে চলতে হবে।

বর্তমান সময়ে পড়াশোনার কারণে ছাত্রদের মধ্যে প্রচন্ড ভাবে মানসিক চাপ তৈরি হচ্ছে। একইসঙ্গে দেখা যায় যে তাদের পাচন প্রক্রিয়াটিও যথাযথ নয়। ছেলেমেয়েদের পাকযন্ত্রকে সুস্থ রাখার জন্য তাদের বাবা-মায়েদের কী টিপ্স দেবেন?

ছেলেমেয়েদের বাড়িতে তৈরি খাবার দিতে হবে। খাবারকে হতে হবে সুষম ও পুষ্টিকর। বাইরের রেস্তোরাঁর খাবার থেকে তাদের দূরে রাখতে হবে। ছেলেমেয়েদের টাটকা ফল ও তরিতরকারি খেতে উৎসাহিত করতে হবে। ঠান্ডা ও নরম পানীয় এবং বাইরের খাবার এড়িয়ে চলতে হবে।

কেউ যদি তার জীবনচর্চার প্রাত্যহিক নির্ঘন্টকে নতুন করে সাজাতে চায়, তাহলে সেখানে স্বাস্থ্যকর পরিকল্পনা কী হতে পারে?

নিয়মিত ভাবে ব্যয়াম করতে হবে। সময়মতো খাবার খেতে হবে এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ও সঠিকমাত্রার ক্যালোরি-যুক্ত খাবার খেতে হবে। অস্বাস্থ্যকর খাবারকে বর্জন করতে হবে।

ডায়েটিং কতটা স্বাস্থ্যসম্মত অথবা সঠিক ডায়েটটাই বা কী?

খাবারকে এড়িয়ে গিয়ে কখনওই ডায়েটিং হতে পারে না। সঠিক সময় উপযুক্ত ও পর্যাপ্ত মাত্রায় খাবার গ্রহণ করেই সঠিক ডায়েটিং হতে পারে। একজন মানুষকে সবসময় অতিরিক্ত কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার, চিনি ও তেল-মশলা জাতীয় খাবারকে এড়িয়ে চলতে হবে।

অ্যাসিডিটি’র কারণ কী, এর প্রভাব এবং এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কী?

অ্যাসিডিটি হল কোনও মানুষের দেহের পাকস্থলি থেকে অতিরিক্ত মাত্রায় অ্যাসিড ক্ষরণের ঘটনা। এর কারণে পেটের উপরের দিকে ব্যথা হয় এবং বমি বমি ভাব তৈরি হয়। এর মাত্রা বেড়ে গেলে পাকস্থলিতে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। সেখান থেকে রক্ত বের হয় এমনকী অন্ত্রে ছিদ্রও হয়ে যেতে পারে। এর চিকিৎসায় অ্যান্টাসিড খেতে হয়। কোনও কোনও ক্ষেত্রে চিকিৎসা হয় প্রোটন পাম্প ইনহিবিটার-এর সাহায্যে, যাকে পিপিআই বলা হয়ে থাকে।

সুস্থ পাকযন্ত্রের জন্য কোনও ব্যায়াম কি রয়েছে?

সুস্থ পাকযন্ত্র তৈরির ক্ষেত্রে কোনও সুনির্দিষ্ট ব্যায়াম নেই। তবে সার্বিক ভাবে নিয়মিত ব্যায়াম করলে সেটা শরীর এবং পরিপাক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে ভালো হয়।

সুস্থ জীবনপ্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হলে দিনের শুরুতে ব্রেকফাস্ট কীরকম হতে হবে?

ব্রেকফাস্ট হল দিনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আহার। ব্রেকফাস্ট-এ সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ক্যালোরিযুক্ত খাবার রাখতে হবে। ব্রেকফাস্ট কিংবা অন্য যে-কোনও খাবারই হোক না কেন, খাবার হতে হবে প্রাকৃতিক ও স্বাস্থ্যকর। রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট এবং অত্যধিক পরিমাণে তেল ও চর্বি জাতীয় খাবার বর্জন করতে হবে।

ভারী অথবা তেল, মশলাযুক্ত খাবার গ্রহণের পর তাৎক্ষণিক ভাবে এর প্রতিকার কী হতে পারে?

যে-কোনও মানুষেরই উচিত সবসময় ভারী আহার এড়িয়ে চলা। তবে যদি কোনও কারণে ভারী আহার হয়ে যায়, তখন সমস্যা দেখা দিলে অ্যান্টাসিড খাওয়া যেতে পারে। সঙ্গে এনজাইমও খেতে হবে। এই এনজাইম খাবারকে হজম করতে সাহায্য করে।

পেপটিক আলসার গ্যাস্ট্রাইটিসকে এড়াতে হলে কী করতে হবে?

তেল ও মশলা জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলতে হবে এবং সেইসঙ্গে বর্জন করতে হবে ধূমপান এবং মদ্যপান।

জীবনে সুস্থ ও কর্মক্ষম ভাবে বাঁচার জন্য দৈনন্দিন সঠিক নির্ঘন্ট কী হওয়া উচিত?

নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে। নিয়ম করে আহার গ্রহণ করতে হবে। মানসিক চাপমুক্ত হয়ে থাকতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমোতে হবে। অতিরিক্ত মাত্রায় চা, কফি ও এনার্জি ড্রিংকস বর্জন করতে হবে।

ভাইরাল গ্যাস্ট্রোএন্টারাইটিস-এর কারণ ও তার চিকিৎসা কী, এর জন্য কী ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে?

স্বাস্থ্যকর অভ্যাস বজায় রাখতে হবে। এরমধ্যে রয়েছে– খাবার আগে ভালো ভাবে হাত ধুয়ে নিতে হবে। খাবার তৈরি ও সংরক্ষণ করতে হবে সঠিক স্বাস্থ্যবিধি মেনে। টাটকা ও সঠিক ভাবে তৈরি খাবার খেতে হবে। ফল ও তরিতরকারি খাবার আগে সেগুলিকে ভালো ভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। যদি কারোর গ্যাস্ট্রোএন্টারাইটিস দেখা দেয় তাহলে প্রচুর পরিমাণে জল পান করতে হবে এবং ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন নিতে হবে। প্রয়োজনে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সেইমতো চলতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণ করতে হবে। অধিকাংশ সময়ই গ্যাস্ট্রোএন্টারাইটিস ভাইরাল অসুখ হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের তেমন একটা প্রয়োজন হয় না।

ক্ষুধামান্দ কী, এর কারণ ও প্রতিকার কী?

নানান কারণে ক্ষুধামান্দ দেখা দিতে পারে। অধিকাংশ সময়ই এটা দেখা দেয় সীমিত সময়ের জন্য। তখন এর জন্য কোনও চিকিৎসারও প্রয়োজন হয় না। তবে যদি এই ঘটনা বেশিদিন ধরে চলতে থাকে এবং দিন দিন দেহের ওজন কমে যেতে থাকে তখন অবশ্যই এই বিষয় নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসক তখন প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করে ক্ষুধামান্দ’র প্রকৃত কারণ নির্ণয় করতে পারবেন। সেই ভাবে তিনি তখন চিকিৎসা করতে পারবেন।

৫০ বছরের বেশি বয়সি মানুষের পরিপাক ক্রিয়া সঠিক ভাবে করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় টিপস কী হতে পারে?

প্রতি ঘন্টা ধরে হালকা খাবার গ্রহণ করতে হবে। অতিরিক্ত লবণ এবং অতিরিক্ত চিনি খাওয়া বর্জন করতে হবে।

——-

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...