অনেক মানুষ জীবনে ভুল করে থাকে, তা হয়তো পরে তার অনুতাপের কারণ হয়। রহমান সামান্য ফুর্তি আর আনন্দ পাওয়ার জন্য যে ভুল করেছিল তা যেন কেউ কোনও দিন না করে।
হাসানপুরের রহমান আর দীপক ছোটোবেলা থেকেই অন্তরঙ্গ বন্ধু। একই বছরে গ্রামের স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অনার্স-সহ একজন বিএ অন্যজন বিএসসি পাশ করে। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রহমান এমএ পাশ করে একটি গ্রামের স্কুলে মাস্টারি পায়, আর দীপক এমএসসি করে কলকাতার এক নামি কলেজে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হয়।
দীপকের মা শান্তাদেবী রহমানকে রমেন বলেই ডাকেন। মায়ের কথামতো দীপকও তাই। শান্তাদেবী রমেনকে নিজের ছেলের মতোই দেখেন। জাতপাতের বিচার তাঁর নেই।
দুই অন্তরঙ্গ বন্ধুতে বেশ কিছুদিন দেখা-সাক্ষাৎ নেই। মোবাইল থাকলেও পত্র লেখাতেই এদের বেশি আনন্দ। রহমানের প্রতি পত্রেই থাকে ওর ওখানে বেড়াতে যাওয়ার আমন্ত্রণ। দীপকেরও মাঝে মাঝে কলকাতার গণ্ডিবদ্ধ জীবনধারার বাইরে যেতে ইচ্ছে করে, কিন্তু কাজের চাপে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।
এবার রহমান লিখেছে, ‘কলকাতার বাবু, বড়োদিনের ছুটিতে না এলে আর পত্র লিখব না। মোবাইলও বন্ধ করে রাখব।’ আগত্যা দীপককে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়।
স্টেশনে রহমান নিজে উপস্থিত ছিল। দু’বন্ধুতে দু’বছর পর দেখা। রাত ন’টা নাগাদ বাড়ি ফিরে খাওয়াদাওয়া শেষে একই বিছানায় আশ্রয় নেয়। সারারাত গল্পের পর ভোরের দিকে দুজনেই গভীর ঘুমে জড়িয়ে পড়ে।
– বাবু আপনার প্রাইভেটের ছাত্রছাত্রীরা এসে পড়েছে। সাতটা বাজে। চাকর রামু দরজায় ধাক্বা দিতে দিতে বলে।
রমেন তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে, দীপক তখনও অঘোর ঘুমে আচ্ছন্ন।
প্রাইভেট পড়ানো প্রায় শেষ হওয়ার মুখে দীপক রমেনকে ডাক দেয়।
– বাবু পড়াতে বসেছে, আপনি মুখ হাত ধুয়ে নেন। চা-জলখাবার রেডি, বাবুরও ততক্ষণে পড়ানো শেষ হয়ে যাবে। রামু এসে জানায়।
– রমেন প্রাইভেট পড়ায় নাকি?
– হ্যাঁ, এখানের সব মাস্টারবাবুরাই তো পড়ায়।
এমন সময় রমেন এসে বলে, ‘দীপক উঠেছিস বুঝি? আমারও হয়ে এসেছে। চা খেয়ে তোকে আমাদের এখানকার বাজার দেখিয়ে আনব।’
রমেনের বাইরের ঘরে আঠারো-কুড়িটি ছেলেমেয়ে একমনে লেখাতে ব্যস্ত। সেদিকে তাকিয়ে একটি সুন্দরী মেয়েকে দেখে অবাক হয়ে যায় দীপক। পরনে দামি চুড়িদার, গায়ে রুচিসম্মত ওড়না জড়ানো, পিঠভর্তি কোঁকড়ানো চুলে দুটি বেনি, বেনি দুটিতে লাল ফিতে দিয়ে তৈরি দুটি গোলাপ ফুল আঁটা। কি অপূর্ব সৌন্দর্যে ঘেরা মুখশ্রী। এমন রূপসী মেয়ে দীপক জীবনে দেখেছে কি না সন্দেহ? এই বোধ হয় প্রথম।
আবাক বিস্ময়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে দীপক। হঠাৎ রমেনের ডাকে তার চেতনা ফেরে।
– কিরে আয়, জলখাবার খেতে হবে না?
খেয়েদেয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ে বাজারের দিকে। গ্রামটি যেন পটে আঁকা ছবির মতো। বেশির ভাগই ধনী। রমেনের স্কুলটিও বেশ সুন্দর জায়গায়, গ্রামের একেবারে শেষ মাথায়। তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে একটি ছোট্ট নদী, রূপসী। এর চারপাশের সৗন্দর্য সত্যিই সকলকে মুগ্ধ করবে!
বাজার বেড়িয়ে ফেরার পথে হঠাৎ নারী কণ্ঠের ডাকে দুজনেই চমকে ওঠে। দীপক তাকিয়ে দেখে একটি বড়ো বাড়ির বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে সেই মেয়েটি। কতরকমের ফুলে ভরা বাগানটির বেশিরভাগই গোলাপ, তাও লালই বেশি।
– মাস্টারমশাই, আমাদের বাড়িতে আসুন না। বাবা আছেন।
রমেন উত্তর দেয়, ‘আজ থাক্। পরে একদিন আসব।’
– বেশ প্রাইভেট টিউশন শুরু করেছিস রে ভাই, পথেঘাটে আমন্ত্রণ। শুধু পড়ানো, না আরও কিছু? হাসতে হাসতে টিপ্পনি কাটে দীপক।
–সে ভাই ইচ্ছে থাকলেও উপায় নাই। মেয়েটি যদিও আমাদের স্বজাতি, কিন্তু মস্ত বনেদি বাড়ির মেয়ে। কত যে ধনী তা তো দেখেছিস-ই। ওর নাম ফিরোজা। ওর বাবা এখানকার একজন নামকরা ডাক্তার। দুই দাদা, বড়ো ইঞ্জিনিয়ার, ছোটদাদা বিদেশে গবেষণা করছে। মেয়েটি পড়াশোনায় খুব ভালো। ভালো রেজাল্ট করে।
– আহা বড়ো বাড়ির মেয়ে তো কি হল? তোর ওকে ভালো লাগে না?
– না ভাই ও জিনিসে লোভ না করাই ভালো। বামন হয়ে চাঁদে হাত বাড়িয়ে কী লাভ বল? আমি হচ্ছি গরিব স্কুল মাস্টার। যেমন আছি ঠিক আছি। বুঝলি দীপক তোর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। মেয়েটির ব্যবহার খুব ভালো। কোনও অহংকার নেই।
দীপক বলে, ‘সত্যি রমেন এমন সুন্দরী মেয়ে সচরাচর দেখা যায় না।’
– কিরে তুই দেখছি ওর প্রেমে পড়ে যাচ্ছিস? বলে রমেন।
– তা পড়লে দোষ কি?
সারারাত গল্পের পর ভোরবেলায় দীপক ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমোনোর ইচ্ছা তার মোটেও ছিল না। সকাল সাতটায় ফিরোজা আসবে। ওকে দেখার জন্য যে ওর প্রবল একটা ইচ্ছা মনের মধ্যে আছে, তা তো আর রমেনকে বলতে পারে না। ভোরের ঘুমটা সব বারোটা বাজিয়ে দিল।
দীপকের ঘুম ভাঙল রমেনের ডাকে। সব ছাত্র-ছাত্রী তখন চলে গেছে যে যার নিজের বাড়িতে।
– কিরে ওঠ। ন’টা বাজে যে।
– ন’টা, আমাকে তুলিসনি কেন?
– তোমার সুন্দরী নূরজাহান আজ আসেনি বন্ধু। উঠলেও কিছু লাভ হতো না।
– বাঃ নামটা বেশ দিয়েছিস তো? ওই নামেই ওকে ডাকা উচিত। কি বলিস রমেন?
সেদিন ওরা ঘুরতে ঘুরতে ফিরোজাদের বাড়ির দিকেই যাচ্ছিল। রমেন অবশ্য বারকতক গেছে এর আগে। কাছে যেতেই ফিরোজার মধুর আহ্বানে ফিরে তাকায় দুজনেই।
– একি, ফিরোজা তুমি! বলে রমেন।
পরনে জাফরানি রঙের চুড়িদার, নীল ওড়না, তার দুটি বেনিতে ওদেরই বাগানের দুটি রক্ত গোলাপ।
সত্যি এ মেয়ের তুলনা বুঝি কারও সাথেই চলে না। দীপক অবাক হয়ে ভাবতে থাকে।
এবার আর ফিরোজার অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারে না ওরা। তবে দীপকের আর এক দফা অবাক হবার পালা। যেরকম সুরুচি সম্পন্ন আসবাবপত্র, সেরকম নিপুণ হাতে সাজানো সারা বাড়িটি! গৃহকর্তাকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছা জাগে তার।
ফিরোজার বাবার সাথে আলাপের পর ফিরোজাকে জিজ্ঞাসা করে রমেন, ‘আজ পড়তে যাওনি কেন?’
‘উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিল স্যার।’ ছোট্ট উত্তর ফিরোজার।
এবার দীপকের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হাসে রমেন। কথায় কথায় প্রায় ঘন্টাখানেক কেটে যায় ওদের। ফিরোজার মা আর বড়ো দাদার সাথেও পরিচয় হয় দীপকের। ফেরার সময় ফিরোজা ওদের মূল রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দেয়। আবার আসার আনুরোধ করে।
পথে নেমে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলে দুটি নির্বাক মন। মৌনতা ভেঙ্গে রমেন প্রশ্ন করে, ‘কিরে দীপক বাকশক্তি হারিয়ে ফেললি নাকি?’
– তা হারালে দোষের কি ভাই!
– তুই কী ভাবছিস বল তো?
– ভাবছি, ভগবানের কি নিখুঁত তুলির কাজ।
– কিন্তু একটু ওলট-পালট হয়ে গেছে বন্ধু। তবে এ ব্যাপারে মন খারাপ কোরো না, ঘটকালিটা না হয় আমিই করব!
পরদিন অবশ্য ঘুম থেকে উঠতে দীপকের দেরি হয় না। তখন রমেন পড়াতে বসে গেছে। দীপক একটু ঘোরাফেরা করে সামনের রাস্তায়। দূর থেকে ফিরোজার দিকে দৃষ্টি পড়তেই দেখে ফিরোজা ওরই দিকে তাকিয়ে আছে। সত্যি মেয়েটিকে যেন সবসময় দেখতে ইচ্ছা করে। চোখ ফেরাতে মন চায় না। কেন যে এমন হয়?
ফিরোজা এসেছে আজ দেরি করে। আগের দিন আসতে পারেনি তাই আজ সবার ছুটির পরেও ফিরোজা একাই কিছুক্ষণ পড়ছে। রমেন ওকে পড়াচ্ছে। বাড়ির থেকে গাড়ি এসে ওকে নিয়ে যাবে। ধীরে ধীরে দীপক আসে সেখানে। বলে,‘ রমেন এবেলা আর তোকে বাজারে যেতে হবে না, আমিই যাচ্ছি।’
– আরে বাবা বোস না একটু এখানে, দুজনেই যাব। ফিরোজার গাড়ি এল বলে। হ্যাঁ ফিরোজা, তোমার বই রেখে যেও।
দীপক বলে, ‘আমি ভেতরে যাচ্ছি। তুই আয়, তারপর দুজনে বেরোব।’
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর ফিরোজার বইটি দাগ দিতে দিতে বইয়ের ভিতরে একখানা ছবি দেখে রমেন দীপককে ডাকে।
– শোনো শোনো দীপকবাবু, তোমার স্বপ্নসুন্দরী নিজেই ধরা দিয়েছে। একবার এসে দেখে যাও।
ফিরোজার একখানা ছবি। শাড়ি পরা, চুল একই ভাবে সামনের দিকে বেনি বাঁধা আর তাতে গোঁজা ফুটন্ত লাল গোলাপ। মেয়েটা সত্যিই খুব ফুল ভালোবাসে।
দীপক ছবিটা রেখে দেয় নিজের কাছে গোপনে।
সেদিন রবিবার। দুপুরের দিকে রমেন পড়াশোনা করছে।। বিকেলে রমেনের টিউশনি আছে। আজ আর ফিরোজাদের নয়, অন্যদের। দীপক আস্তে আস্তে হেঁটে নদীর কাছাকাছি চলে যায়। একটু ফাঁকা জায়গা দেখে চুপ করে বসে থাকে আকাশের দিকে তাকিয়ে। মনে হয়, এখানকার সবই সুন্দর। রমেনটা বেশ আছে।
– আপনি এখানে যে সাহেব?
হঠাৎ ফিরোজার ডাকে তাকায় দীপক।
– এমনি বসে আছি। রমেনের ব্যাচ আছে তাই। তা তুমি এদিকে কোথায়?
– আমি আমার বন্ধুর বাড়ি থেকে আসছি। চলুন না আমাদের বাড়ি। বলে ফিরোজা।
– না আজ থাক। তাছাড়া রমেনও সঙ্গে নেই। তুমি বুঝি মোটর সাইকেল চালাতে পারো?
– হ্যাঁ কিছুদিন হল শিখেছি। আপনি কলকাতায় থাকেন তাই না।
– হ্যাঁ ওখানে একটা কলেজে পড়াই।
– স্যার বলেছেন।
– তোমার নাম তো ফিরোজা?
– হ্যাঁ সাহেব।
দীপক বলে, ‘নূরজাহান তোমার উপযুক্ত নাম।’
– ধ্যাৎ কি যে বলেন। লজ্জায় মুখ নামায় ফিরোজা।
– আমি এখন যাই। যাবেন স্যারের সাথে আমাদের বাড়ি।
–আচ্ছা ফিরোজা তুমি আমাকে সাহেব বললে কেন?
– বাঃ রে আপনার গায়ের রং সাহেবকেও হার মানায়। সাহেব, এবার আমি আসি।
বলেই মুচকি হেসে ফিরোজা বাড়ির পথ ধরে।
ফিরোজার ফিরে যাওয়ার পথের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে দীপক। সত্যি এই বুঝি ভালোবাসার নিয়ম। এদিকে কখন যে রমেন এসে দাঁড়িয়েছে খেয়াল করেনি দীপক।
– কিরে তুই এখানে? আমি তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। অমন করে কী দেখছিলিরে ভাই?
– তুই তো সবই দেখেছিস। আবার জিজ্ঞাসা করছিস কেন?
– দীপক তুই ভুল করছিস। এ হবার নয়।
– কেন নয়? ভালোবাসা কি মানুষ ইচ্ছা করে করে? ভালোবাসা কি চেষ্টা করে করতে হয়? ভালোবাসা হয়ে যায়। নিজের অজান্তেই হয়তো হয়ে যায়। যখন এমন ঘটে যায় তখন জাত-ধর্ম খড়কুটোর মতো উড়ে যায়।
– তা না হয় হল, কিন্তু ওর বাবাকে তুই চিনিস না। তাছাড়া তোর মা কি মেনে নেবেন? দ্যাখ ফিরোজাকে তুই ভুলে যা ভাই। বলিস তো সুন্দরী শিক্ষিতা তোর উপযুক্ত মেয়ে আমি দেখি।
দীপক নিরুত্তর থাকে।
দেখতে দেখতে দীপকের ছুটিও একদিন শেষ হয়ে যায়। বন্ধুর কাছে বিদায় নিয়ে চলে যায় কলকাতায়। ছবিটা রয়ে যায় দীপকের কাছে আর মনটা পড়ে থাকে ফিরোজার কাছে।
বন্ধুর চিঠিতে ফিরোজার খবরাখবর দীপক মাঝে মাঝে পায়। ফিরোজাকে দেখতেও মন চায় কিন্তু লজ্জায় এত তাড়াতাড়ি বন্ধুর ওখানে যেতে পারে না।
কেটে যায় একটা বছর।
যৌবনে নারী-পুরুষ দুজনে দুজনের প্রতি আকৃষ্ট হয়। এতে দোষের কিছু নেই। যদি জাত, ধর্ম, বয়স সব ক্ষেত্রে মিলে যায়, তাহলে তাদের প্রেম সঠিক পথে এগোয় আর যদি এগুলি না মেলে, তাদের প্রেমের পথে বাধা আসে প্রচুর। দীপকের বেলাতেও তাই হল। কোনও ব্যতিক্রম ঘটল না।
ছেলের বইয়ের আলমারি গোছাতে গিয়ে একটি সুন্দরী মেয়ের ছবি পান দীপকের মা শান্তা। ব্যস সেই শুরু! এ মেয়েকে তাঁরও খুব পছন্দ। কিন্তু যখন জানতে পারলেন এ মেয়ে ভিন্নধর্মের, আর এর সূত্রপাত রমেনের বাড়ি, তখন রমেনকে আসতে পত্র লিখলেন। সব জেনেও ছেলের বিয়ের জন্য অন্যত্র মেয়ে দেখা শুরু করলেন। ছেলের বন্ধুকে নিজের ছেলের মতো দেখা, সে যতই বিধর্মী হোক, তা দোষের নয়! তবে একটি মুসলমানের মেয়েকে পুত্রবধূ করে আনা সেটা বোধ হয় কোনও হিন্দু মা-ই পারে না। এতটা উদার মনের মানুষ দীপকের মা-ও নন এইক্ষেত্রে।
নানা জায়গা থেকে সম্বন্ধ আসতে লাগল। কয়েকটি মেয়ে সত্যিই সুন্দরী। অবশেষে একটি মেয়েকে পছন্দ করে তাদের বাড়িতে ওর মা কথা দিয়ে এলেন। দীপক কিছুতেই রাজি হল না।
এদিকে ফিরোজার অবস্থাও সঙ্গিন। প্রথম কয়েকবার চিঠি আদান-প্রদানে বাড়ির কেউ তেমন জানতে বা বুঝতে পারেনি। পরে সব জানাজানি হয়ে যায়। পাছে রহমানের মাধ্যমে সূক্ষ্ম যোগাযোগ থেকে যায় এবং কোনওদিন ওরা লুকিয়ে চলে যেতে পারে এই ভয়ে, ফিরোজার বাবা উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর মেয়েকে সৌদি আরবে ওর কাকার কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
বছর দুই পরে ওখানেই ফিরোজার কাকা বিয়ের ঠিক করেন একটি উপযুক্ত ছেলের সঙ্গে! কোনও কিছুতেই কোনও শুভফল হল না! ছেলেটিকে সব কথা জানিয়ে দেয় ফিরোজা।
অবশেষে মেয়েকে ফিরিয়ে এনে প্রায় জোর করে রহমানের সাথেই বিয়ে দিয়ে দেন ফিরোজার বাবা ডাক্তারসাহেব। রহমানকে তিনি অনেকদিন ধরেই দেখছেন। পাত্র হিসাবে মোটেই খারাপ নয়। হয়তো ওদের মতো ধনী নয়, তবে ছেলেকে বাড়ি, গাড়ি, মূল্যবান জিনিসপত্র আর মেয়েকে সোনা দিয়ে মুড়ে দিলেন। সর্বতোভাবে মেয়েকে সুখী করার চেষ্টা করলেন!
এতেও ফল ভালো হল না। মেয়েকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন ঠিকই তবে ফিরোজা বা রহমান কেউই সুখী হল না জীবনে। প্রথম প্রেমিককে ফিরোজা কিছুতেই ভুলতে পারল না। ফিরোজার মন আর ভালোবাসা কোনওদিনই পেল না রহমান। নিত্য অশান্তি আর অসুখের সংসার করতে করতে দুজনেই জেরবার। ফিরোজার মনে আজও একটা সংশয়, দুদিক দিয়ে কথা চালাচালি রহমানই করেছে তাকে পাওয়ার জন্য। হয়তো এই জন্যই ওর বাবা এ বিয়ে দিয়েছেন।
এদিকে মায়ের চোখের জলের কাছে হার মেনে মায়ের কথা দেওয়া মেয়েটিকেই বিয়ে করতে বাধ্য হয় দীপক। মেয়েটি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী। অপরূপা না হলেও বেশ সুন্দরী। তবে ফিরোজাকে শত চেষ্টা করেও সে ভুলতে পারেনি আজও। এ নিয়ে ওদের সুখের সংসারে অনেক ঝড় বয়ে গেছে। তবুও অনেক যন্ত্রণা, অনেক কষ্টের পর একটি পুত্র সন্তান এসেছে ওদের সংসারে।
এরপর কেটে গেছে অনেকগুলি বছর। ফিরোজার ছবিটি এখনও আছে দীপকের কাছে। সেই ছবিটি সে নিজের হাতে রং তুলি দিয়ে এঁকেছে। ছবিটি এতটাই জীবন্ত যেন এক্ষুনি কথা বলবে। সেটি সে রহমানকে পাঠিয়ে দিয়েছে উপহার হিসাবে।
শান্তি-অশান্তি নিয়ে কেটে গেল আরও বেশ কয়েকটা বছর। দেখতে দেখতে দীপকের ছোট্ট ছেলেটি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে গেল। সে এখন অনেক বড়ো হয়েছে। বর্তমানে চেন্নাই-এ কর্মরত। কিছুদিনের মধ্যেই বিদেশ যাবে। দীপকের মা কিছুদিন আগে মারা গেছেন। ফিরোজার আর বেশি খবর সে রাখে না। হয়তো রহমানের সাথে ভালোই আছে!
ঘটনার চোরাস্রোতে এক বর্ণমুখর সন্ধ্যায় রহমানের সঙ্গে হঠাৎ দীপকের দেখা হয়ে যায়। প্রথমে না চেনার ভান করে রহমান। পরে অবশ্য সবই বলে সে দীপককে। চেহারারও অনেক পরিবর্তন হয়েছে রহমানের। ওর কাছেই জানতে পারে, ফিরোজা আর বেঁচে নেই। রমেন এখন ফিরোজাদের গ্রামে থাকেও না। তার একমাত্র মেয়েকে ওর মামা নিয়ে চলে গেছে, তার বয়স যখন মাত্র পাঁচ। তারপর থেকে সে তাকে আজও দেখেনি! ওখানকার স্কুলের চাকরি অনেকদিন আগেই ছেড়ে দিয়েছে।
শত অনুরোধ সত্ত্বেও রহমান সেদিন দীপকের বাড়িতে যায়নি। কোথায় থাকে, কীভাবে চলছে তার সেসব কিছু সে বলেনি। যেমন এসেছিল সেভাবেই চলে গেল।
বাড়ি ফিরে দীপক একটি মজার কথা শোনে ওর স্ত্রীর কাছে। তার ছেলে রোহন নাকি তহমিনা বলে একটি প্রবাসী মুসলমান মেয়েকে ভালোবাসে। তাকে সে বিয়ে করবে। এ বিয়ে যেন বাড়ি থেকে মেনে নেওয়া হয়।
মনে মনে হাসতে থাকে দীপক।
ফিরোজার বাবা ডাক্তার সাহেব বেঁচে আছেন। রহমান ফিরোজারা আজ না থাকলেও, ওদের বাড়িটি রং করানো চলছে, ঘরের সব অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ফেলে দিয়ে। তবে বাড়ির দেখভাল করার লোকটি একটি ছবি সরিয়ে ফেলে, কলকাতায় বিক্রি করলে এসব ছবির ভালো দাম পাওয়া যাবে ভেবে। বিয়ের পর ডাক্তার সাহেবের নাতনি নাতজামাই এই প্রথম আসবে। তাই এই সাজ সাজ রব। এত আয়োজন। অবশ্য মা মরা তহমিনার বিয়ে দিয়েছে ওর ছোটো মামা।
এদিকে রোহন তার স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতার বাড়িতে এসেছে। ওদের মেনে নিতে হয়েছে সবকিছু। কিন্তু বউমাকে দেখে দীপক অবাক। একি! এ যে ফিরোজার প্রতিমূর্তি। ঠিক যেন যৌবনের ফিরোজা। এ কী করে সম্ভব?
রোহন যে-মেয়েটিকে বিয়ে করেছে তার বাবা মা কেউ নেই। ধনী মামারাই তাকে মানুষ করেছে। পাঁচ বছর বয়স থেকেই সে প্যারিসে মানুষ। এখন চাকরি করে প্যারিসেই। রোহনকে তার কোম্পানি প্যারিসের একটি প্রোজেক্ট হ্যান্ডল করতে পাঠায়। সেখানেই তহমিনার সঙ্গে তার আলাপ এবং প্রেম। মা-বাবা রাজি থাকায় রোহন আর দেরি করতে চায়নি। বিয়েটা সেরে ফেলে চটজলদি। এদিকে মা বাবা কাউকেই তহমিনার ভালো করে মনে নেই। ছোটোমামার কাছেই সে থাকত। তহমিনার মুখে তার মামার বাড়ির কথা শুনে স্তব্ধবাক্ হয়ে যায় দীপক। ডাক্তারসাহেবের সঙ্গে তার কি নতুন করে আত্মীয়তা তৈরি করা উচিত? নাকি পরিচয়টুকু গোপন-ই থাক– এই দোলাচলে মনটা বেশ অস্থির হয়ে ওঠে তার।
দীপক ভাবে তার মা যা পারেননি ওদের তা পারতে হল। রোহনদের এ বাড়িতে আসা বেশ কয়েকদিন হয়ে গেছে। রোজই বিকালের দিকে ওরা কোথাও না কোথাও বেড়িয়ে আসে। এই কদিনে অনেক জায়গা ঘুরে, দেখে এসেছে। আর কদিন পরে ওরা যাবে তহমিনাদের বাড়িতে। ওখান থেকেই চলে যাবে নিজেদের কাজের জায়গায়।
সেদিন রোহন-তহমিনা রাত্রে ফিরে একটি মজার ঘটনা শোনায়। আজ একটি ছবির দোকানে ওরা একখানি বাঁধানো ছবি দেখে অবাক হয়ে গেছে। ছবিটি অপরূপা এক নারীর। ছবির নীচের কোণে ডি কে স্বাক্ষর করা। আশ্চর্যের ব্যাপার ছবিটি যেন হুবহু তহমিনাকে দেখে আঁকা।
সবই বুঝতে পারে দীপক। ফিরোজাকে উপহার দেওয়া তারই নিজের হাতে আঁকা ছবি।
আজ সকালে মাকে নিয়ে রোহনরা দক্ষিণেশ্বরে গেছে। বিকালে ওরা ছবিটি কিনে নিয়ে আসবে বলে ঠিক করেছে। ভেবে কূলকিনারা পায় না দীপক কী করবে সে এখন। আজ বাড়িতে কেউ নেই, যা করার তাকে এবেলাতেই করতে হবে। আজ সে কলেজে যাবে না।
এগারোটা নাগাদ সে ছবির দোকানে যায়। বহু অর্থের বিনিময়ে দীপক ছবিটি কিনে নেয়। এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে খবরের কাগজে মোড়া ছবিটি গঙ্গায় বিসর্জন দেয়। সেই সঙ্গে ফিরোজার বই থেকে পাওয়া ছবিটিও।
যে অন্তরে আছে তাকে বাইরে রেখে লাভ কি? ডি কে নামের অনুসন্ধান করতে গিয়ে শেষে সব জানাজানি হওয়ারই বা দরকার কি!