নারীদেহ সম্পূর্ণ ভাবে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি এবং সেই শরীর নিয়ে সে তার ইচ্ছেমতো যা-খুশি করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। সেই রাজা-রাজড়ার আমল থেকে শুরু করে, বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের শাসনকাল পর্যন্ত– নারী শরীরের উপর নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। জোর খাটিয়েছে সমাজ৷বর্তমান সমাজেও নারীদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিবাহপূর্ব যৌনসম্পর্ক স্থাপন অপরাধ হিসাবে বিবেচিত হতো এযাবৎ। তবে চলতি দশকে এই আইনের পরিবর্তন ঘটেছে। অবশ্য আজও বহু দেশের আইনি বইতে এই বিষয়টি তেমন প্রাধান্য পায়নি, বইয়ের এক কোণায় অবহেলিত ভাবে উল্লিখিত আছে।
গর্ভপাতের বিষয়ে আইন একইরকম অবহেলিত। বেশিরভাগ দেশে গর্ভপাত করানোর বিষয়টি নারীর মৌলিক কিংবা প্রাকৃতিক অধিকার হিসাবে গণ্য হয় না। কারণ, ধর্ম গর্ভপাত বিরোধী। অথচ, ভগবানের উপর আস্থা, বিশ্বাস, ভক্তি প্রভতি যতই ধর্ম-কর্ম করা হোক না কেন ধর্ষণ নিয়ন্ত্রণ কিংবা বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে কি? না। কারণ, ধর্মের কাছে বেশিরভাগ সরকার-ই হার শিকার করে নেয়।
মুম্বই নিবাসী এক মহিলা গর্ভধারণের ২৫ সপ্তাহ পর গর্ভপাতের অনুমতি পেয়েছিলেন সুপ্রিম কোর্ট থেকে। এই অনুমতি দেওয়া হয়েছিল আসলে অন্য কারণে। ওই মহিলার গর্ভস্থ যমজ সন্তানের মধ্যে একজনের ডাউন সিনড্রোম-এর সমস্যা ছিল। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত তো চিকিত্সক-ই নিতে পারতেন। এ বিষয়ে সরকার, আদালত, ধর্মগুরু, পূজারি, শাশুড়ি কিংবা স্বামী কারওর-ই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থাকা উচিত নয়। এক্ষেত্রে গর্ভবতী মহিলা এবং তার দ্বারা নিযুক্ত চিকিত্সক-ই গর্ভপাত করানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র অধিকারী হওয়া উচিত। মেডিকেল টার্মিনেশন অফ প্রেগন্যান্সি অ্যাক্ট ১৯৭১ মোতাবেক, সব ক্ষেত্রে গর্ভপাত করানোর স্বাধীনতা নেই গর্ভবতীর। আইনের ৩ নম্বর ধারা অনুযাযী, চিকিত্সক ছাড়াও, কিছু ক্ষেত্রে গর্ভপাতের অনুমতি নিতে হবে উচ্চ আদালত থেকে।
যদি ১৮ বছরের কম বয়সি কোনও মেয়েকে গর্ভপাত করাতে হয়, সে ক্ষেত্রে তার মা কিংবা বাবার লিখিত অনুমতি আবশ্যক। কিন্তু প্রশ্ন হল এই যে, যদি গর্ভধারণের জন্য কারও অনুমতি না নিতে হয়,তাহলে গর্ভপাতের জন্য অনুমতির প্রয়োজন হবে কেন? অবশ্য গর্ভাবস্থায় যদি গর্ভবতীর কোনও শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়, সেক্ষেত্রে গর্ভপাতের আইনি ছাড়পত্র পাওয়া যাবে। এর বাইরে যদি কেউ গর্ভপাত করান, তাহলে তা অবৈধ বিবেচিত হবে।
এই ধরনের রীতিনীতিকে সমর্থন করা যায় না এবং দুঃখের বিষয় হল এই যে, আজও যেন ধর্মীয় হুকুম বলবৎ করা হচ্ছে মনে হয়। আসলে, ধর্মের ধ্বজাধারীরা আজও নারীর যৌনাঙ্গকে নিজের অধিকারে রাখতে চায়। তাই, তারা প্রতিদিন নিজের মতো করে নিয়ম তৈরি করে এবং নিয়ম বদলাতে থাকে। কখনও, কোথাও নারীকে দিয়ে পুজো করায়, তো কোথাও আবার শুদ্ধতার প্রমাণ চাওয়া হয়। আবার স্বামীর অতিরিক্ত যৌন চাহিদা পূরণ কিংবা অনেক সময় অনিচ্ছুকও যৌন চাহিদা পূরণ করতে হয় স্ত্রী-কে। এই অত্যাচার যদি স্বামীর উপর স্ত্রী করেন, তাহলে কি সমাজ তা ভালো ভাবে নেবে?
গর্ভপাত আইন আসলে নারীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে। গর্ভপাতের সময় যেমন গর্ভবতী নারী কষ্ট পান, ঠিক তেমনই গর্ভপাতের অনুমতি নিতে গিয়ে শাস্তি পান। কারণ, গর্ভপাতের বিষয়টি অবৈধ এবং অপরাধ হিসাবেই বিবেচিত হয় বেশিরভাগ মানুষের চোখে। সারা পৃথিবীতে প্রায় ছয় কোটি গর্ভপাত হয় প্রতি বছর। কিন্তু ধর্মীয় এবং আইনি ঝামেলার ভয়ে এদের মধ্যে প্রায় ৪৫ শতাংশ ভোগেন নিরাপত্তাহীনতায়। এমনকী, ধর্ষিত কোনও নারীও যদি গর্ভপাত করাতে যান, তাকেও চিকিত্সকের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। তাই সারা পৃথিবীতে গোপনে চলে বহু অ্যাবর্শন সেন্টার।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই যে, গর্ভধারণ এবং গর্ভপাত নারীর স্বাভাবিক মৌলিক অধিকার হওয়া উচিত। এক্ষেত্রে পুরুষদের নাক গলানো উচিত নয়। মোটকথা, শরীর যার, সেই শরীরকে যেমন খুশি ব্যবহার করার অধিকার তারই থাকা উচিত। কিন্তু তার অনিচ্ছার বিরুদ্ধে কোনও কিছু হওয়া বা করা কাম্য নয়। পুরুষ যেমন তার শরীর নিজের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করে, নারীর ক্ষেত্রেও তেমনই হওয়া বাঞ্ছনীয়। কাজ করতে গিয়ে হাতে-পায়ে আঘাত লাগলে যেমন স্বাভাবিক ভাবে চিকিত্সা পরিষেবা নেওয়া যায়, কোনও ধর্ম কিংবা আইন বাধা হয়ে দাঁড়ায় না ঠিক তেমনই নারী তার নিজের শরীর ইচ্ছেমতো নির্দ্বিধায় ব্যবহার করবে, এমনটাই কাম্য। কোনও কারণে যদি নারী গর্ভবতী হয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে চাইলে সে মাতত্বের স্বাদ নিতে পারে কিংবা গর্ভপাত করাতে পারে। সিদ্ধান্ত তার ইচ্ছানুসারে হওয়া উচিত। কারণ, শরীর তার, মনও তারই।