উত্তরে ডুয়ার্স সফরে গেলে আমার প্রেসক্রিপশন– কাঞ্চনকন্যায় টিকিট কেটে জানলার পাশে দখল নিয়ে বসুন। পরদিন সকাল থেকেই যাত্রাপথের দু’ধারে ছবির গ্যালারি খুলে যাবে, যার সূচনা গুলমা স্টেশন থেকেই। গুলমা– নামটি যেমন কোমল, তেমন পেলব প্রকৃতি। অতঃপর মহানদী পেরিয়ে মহানন্দা অভয়ারণ্যে প্রবেশ। এই অরণ্য জড়িয়ে কত নদীর খোয়াবনামা। এ যেন নদী নয়, লাজুক লতা কবিতা। কারও নাম লিস, কেউ চপলা ঘিস, কেউ অপ্সরা ডিমা, কেউবা সুন্দরী ডায়না, আঁকাবাঁকা জলঢাকা রেলের জানলায় দেখা দিয়ে চলে গেল, ও চুপিচুপি কি বলে গেল! বন-ছুট নদীর সেই মন-ছুট ডাকের অবাধ্য হয় সাধ্য কার। তিন পাহাড়ের কাঁধে চড়ে করোনেশন সেতু, নীচে তার দুরন্ত তিস্তার বিস্তার।
ঘন বনের মাঝে মাঝে দ্বীপের মতো হল্ট স্টেশনগুলি– নাগরাকাটা, বাগরাকোট, চালসা, মাল, মেটালি, মাদারি। প্রকৃতির উদার বিস্তারের মাঝে বড়ো নম্র সব নাম। স্টেশন কেরনকে প্রথম দেখা এক কুয়াশা ঢাকা শীত-ভোরে। শিশির ভেজা স্টেশন। কয়েক টুকরো কাঠের বেঞ্চ, গ্যাসের বাতি। অনেকটা নীচে একফালি প্ল্যাটফর্মের নির্জন বেঞ্চ-এ একাগ্রচিত্তে বসেছিলেন কৃশকায় শ্বেতকায় ব্রিটিশ বৃদ্ধ।
হ্যাট-টাই-কোট-বুট। হাতে স্টিক। হয়তো চা বাগানের অবসরপ্রাপ্ত সাহেবটি, কেরনকে ভালোবেসে এখানেই স্থায়ী হলেন। প্ল্যাটফর্মের অপর দিকে রেলবাবুদের লাল ইটের কোয়ার্টার। তাদের নিত্যকার ঘর গেরস্থালি। তাদের বুকের ওপরে রেল স্টেশন, পিছনে পাহাড়, বন, সরীসৃপ ঝরনা। নির্জনতা চেরাই করে মাঝে মাঝে বুনো বাইসন নামে রেল পাড়ায়।
এখন আলিপুরদুয়ার নতুন জেলা। কাঞ্চনকন্যা ভিড়ল এসে আলিপুরদুয়ার জংশনে। আমাদের প্রথম হল্ট পরিমলের ঠেক-এ, অর্থাৎ রাজাভাতখাওয়া ট্রেকার্স হাট-এ। কাঠের দেয়াল, কাঠের সিঁড়ি, ঘর, বারান্দা– তক্তা জুড়ে জুড়ে অনবদ্য অনাড়ম্বর এক এথনিক হাট। অনেকটা ধূলি-ধূসর এক বাতিল ক্যাসল। তারই মুখোমুখি ভাতখাত্তয়া রেল স্টেশন।
চারিদিকে বুনো গন্ধ নিয়ে প্রাচীনত্বের সিলমোহরে ভাতখাওয়া বনাঞ্চল। এখানে মার্চেন্ট পাড়ায় আলাপ হয়েছিল আশু ঘোষের সঙ্গে। ভদ্রলোকের আশি ঊধর্ব বয়স। ২৮ বছর বয়সে ওপারের (বাংলাদেশ) সাতক্ষীরা থেকে একগুচ্ছ যুবক ভাগ্য ফেরাতে এসে খুঁটি করলেন গহন বনের মাঝে এইখানে। তখনও বন কাটাই দণ্ডনীয় অপরাধ হয়নি। গগনস্পর্শী লালি, কাঞ্চন, শাল, বহড়া কেটে টিম্বার ব্যাবসার ইলাহি সুযোগ। সন্ধে হলে বাইরে বেরোবার সুযোগ কম। টের পেতাম পাকা লাটোর খেতে হরিণ ঢুকেছে বনে। ঘরের বেড়ার পাশে লাটোর ফল চিবোচ্ছে। হামেশাই ঘটত এমনটা।
গরমে পাল খাওয়া বাঘের ডাকও শুনেছি। সেই মদন চড়া ডাকে যেন গাছের পাতা ঝরে পড়ে। এখান থেকে ছোটো লাইন গেছে জয়ন্তী। পাহাড়ের কোলে অনবদ্য রেল স্টেশন । তখন বন যেমন ছিল, বন্যও তেমন। সন্ধে নামলে গারো বস্তির ভেতর দিয়ে হাতির পাল ঢুকত ফরেস্ট কলোনিতে। এ ছিল নিত্যকার পাঁচালি। তখন কয়লার রেল চলত এ পথে। খানিক গিয়ে ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়েছে জঙ্গলের আঁধারে। হাতির দল নেমেছে। রেল ট্র্যাক অবরুদ্ধ ৷এখন আর জঙ্গল কোথায়? যা ছিল তার সিকি ভাগ উচ্ছেদ হয়ে গেছে। তখনকার দিনকাল হলে মার্চেন্ট পাড়া খুঁজে পেতে অত সহজে?
ভাতখাওয়ায় ছোট্ট একটা লাঞ্চ ব্রেক সেরে আমাদের এগিয়ে যাওয়া গদাধর রেঞ্জ অফিসে। সেখানে কটা দিনের আশ্রয় রেঞ্জার ভবেন বসুমাতার মেহমান হয়ে। এই ভবেন বসুমাতা আমার ভ্রমণ জীবনে এক আবিষ্কার। সেই আবিষ্কারের গল্পটা একটু খুলেই বলি।
২৪ নভেম্বর, ১৯৯৬, রায়ডাক বন নিবাস থেকে ভুটানঘাট বাংলোয় থাকার উদ্দেশে ময়নাবাড়ি বিট-এ এসে গাড়ি থামল! এখানেই ভুটানঘাটের এন্ট্রি পয়েন্ট। বিটবাবু গাড়ি রুখলেন– পারমিট ছাড়া তো নাকা উঠবে না। আমরাও না-ছোড়। বিনা পারমিটে ডুয়ার্স তল্লাট টহল মারছি। বাবুটি ঠান্ডা গলায় বলেন– ও সব গল্প শুনিয়ে টলাতে পারবেন না ভাই। এই কোর ফরেস্টে ঢুকতে উপযুক্ত কাগজ চাই। তার উপরে ভুটানঘাট বাংলো ভিআইপি মর্যাদার রেস্ট হাউস। তিনি বোঝাতে চেষ্টা করেন, ডুয়ার্সের ৭৬১ বর্গ কিমি বনাঞ্চল কঠিন আইনে বাঁধা। এর ভিতরে যেমন মূল্যবান বৃক্ষ সম্পদ, তেমনই বন্যপ্রাণী, আবার ভুটানের জিরো পয়েন্ট। আমরাই এই সম্পদের নিরাপত্তারক্ষী। এবারে আপনাদের বিবেক কি বলে?
আমার বিবেক বলছে ফিল্ড ডিরেক্টর সাহেবের সঙ্গে একবার যোগাযোগ করতে হয়। বিটবাবু বলেন, কার কথা বলছেন?
নাম বলি। তিনি ফোন লাগান। আমরা গাড়ি থেকে নেমে জায়গাটা জরিপ করি। সামনে তুরতুরি চা বাগান। বিট কোয়ার্টারের পিছন থেকে পাইকারি জঙ্গল। ঘন অন্ধকার। সরু সিঁথি চেরা পথ ৫ কিমি টেনে এনেছে ভুটানঘাট বাংলোর গেট ইস্তক। এ সবই আমাদের বাইরে থেকে জানা শোনা।
ওদিকে ফোনে ওপরওয়ালার কী উপদেশ, আদেশ, নির্দেশ এল জানি না। অনেকক্ষণ কথাবার্তার পর বিট ভদ্রলোক বেশ রাশভারী গলায় আমাদের ডেকে নিয়ে বলেন, আপনাদের ছাড়া যাবে না। অর্থাৎ চা না খেয়ে আপনাদের ছাড় নেই। ততক্ষণে চায়ের জল বসেছে স্টোভে আর আমরা বসেছি গল্পে। এই ভদ্রলোকই ভবেন বসুমাতা, তখন ময়নাবাড়ি বিটের বিট অফিসার। এই অশান্ত বনের ঘেরাটোপে দু’জন বন গার্ড, একটি টহলদারি হাতি প্রমীলা– তার পাতাওয়ালা, আর তাঁকে ঘিরে এই কটি প্রাণী। সঙ্গে দু-নলা এক বন্দুক। ভবেন বলেন চিরস্থায়ী এক রেড অ্যালার্ট জোন এটা। বাইরে খেকে কিচ্ছু বুঝবেন না। আপনাদেরও বলে রাখছি, ভুটানঘাটে গিয়ে কোনও বাহাদুরির ভারী মাশুল গুনতে হতে পারে।
সেবারে ভুটানঘাট ছেড়ে আসার পর সেই যে সম্পর্ক-ছুট হয়ে গেলেন ভবেন, তাঁকে খুঁজে পেতে ২০ বছর কেটে গেল। অকস্মাৎ একদিন ফোনে যোগাযোগ। ভুটানঘাট এপিসোড মনে করাতে এক বারেই চিনে গেলেন এবং আন্তরিক আমন্ত্রণ জানালেন। সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে এই যাত্রা। অরণ্যপ্রিয় এই মানুষটাকে প্রথম দেখায় বুঝেছিলাম ইনিই আমার ডুয়ার্সের অভিধান হতে পারেন। সে বোঝায় যে কোনও খাদ ছিল না, ক্রমশ প্রকাশ পেয়েছে।
লাঞ্চের মাঝ পর্বেই ভবেন হাজির। চেহারা সেই একইরকম আছে– ছিপিছপে গড়ন, হালকা ট্যান করা গায়ের রং। মেদহীন পাঁচ ফুট ৭ ইঞ্চির কাঠামো। এসেই বলেন– লাঞ্চে মেনু কী রেখেছে পরিমল?
–এই তো ঢেঁকি শাক, দুধ কচু, চেপ্টি মাছের ঝাল।
–স্থানীয় আইটেম সব হিসেব করেই রেখেছে দেখছি।
–কেমন আছেন বলুন– শুধোই ভবেনকে।
–কেমন দেখছেন?
–বয়েস একেবারেই ছোবল বসায়নি শরীরে।
–সারাটা জীবন সবুজে থেকে এটুকু সজীব তো থাকব মশায়। ভবেন চেয়ার টেনে বসেন পাশে।
তাঁকে বলি, –২০ বছর হারিয়ে আসার গল্প শুনব আপনার মুখে। –বুনো মানুষদের গল্প একই। সেই ময়নাবাড়ি থেকে কাঠমবাড়ি। ৫ বছর দক্ষিণের জঙ্গলে কাটিয়ে আবার উত্তরের লাটাগুড়ি, নাথুয়া, কুমারগ্রাম করে এই বক্সা টাইগারে টানা ১৯ বছর।
লাঞ্চ শেষে উঠে বসি ভবেনের গাড়িতে। গন্তব্য গদাধর, রাজাভাতখাওয়ার একটি রেঞ্জ। ভবেনবাবুর বানপ্রস্থ জীবন এই রেঞ্জ কুঠিতে।
ভাতখাওয়া পেরিয়ে দমনপুরে এসে ডান দিকে পথের প্যাঁচ কাটিয়ে গাড়ি ওপরে উঠে ধরল ৩১ নং জাতীয় সড়ক। স্টিয়ারিং-এ খোদ ভবেন বসুমাতা। পথের দু’ধারে ছুটে চলেছে মাঝির ডাবরি চা-বাগান। মার্চের শেষ থেকে মে-র তৃতীয় সপ্তাহ জুড়ে চলবে এই ফার্স্ট ফ্ল্যাশের টি প্লাকিং। মে’র শেষ থেকে বাকি ৩ মাস সেকেন্ড ফ্ল্যাশের প্লাকিং শুরু হবে। সেই চায়ের কদর বিশ্ব জুড়ে। পথের পাশে গাড়ি থামিয়ে নেমে গিয়ে ভিড়ে যাই চা মেয়েদের সঙ্গে। এই মদেশীয় মেয়েরা কেউ জার্লিনা, মেরি, ডায়না, সুরিনা –সকলেই জিশুপন্থী।
আমাদের দেখে সহকারি ম্যানেজার সহাস্যে এগিয়ে এসে প্রস্তাব দেন– চলুন তবে ভবেনবাবু ওদের ফ্যাক্টরিটা ঘুরিয়ে দেখিয়ে দিই। ভবেন হেসে বলেন– এই সবে চা দুনিয়ায় ওরা পা রাখলেন। আগে সবুজ পাতা চিনুন, তারপর তো ফিনিশ্ড চা। বড়ো বাগানের চা আইন বেশ কড়া ধাতের। ব্রিটিশরাই করে গেছেন। অধিকাংশ বাগানের মালিক তো তাঁরাই ছিলেন। সহ মানেজার বলেন– যেমন ধরুন সকাল ৭ টায় হুটার বাজিয়ে বাগানে হাজিরা শুরু। তখন কুলি লাইন ফাঁকা করে কামিনরা বেরিয়ে এসে বাগানে ঢুকবে। বাগানবাবু ওদের হাজিরা দেখবে। কাজের তদারকিতে বাগান সর্দার। জল পানের প্রয়োজনে পানিওয়ালা ঘুরছে। দিনে ৩ দফা পাতা কাঁটায় (ওজন) তোলা হবে। বিকেল ৩টেয় বইদার প্রতি প্লাকারের সেদিনের উৎপাদন লিপিবদ্ধ করবে। ফি দিন ন্যূনতম ২৪ কেজি পাতা তুলতেই হবে। বেশি হলে উপরি মজুরি।
হপ্তা মজুরির দিন বাগান গেটে হাট বসে। হাট মানে সারা সপ্তাহের কেনাকাটা, হাট মানে মদপানি, জুয়ার ঠেক। হাট মানে কাবুলি ব্যাংকে সুদ-আসলের বোঝাপড়া। ম্যানেজার সাহেবের হাটের বাগান শুনে মনে পড়ল এক চা বাগানের হাটের অভিজ্ঞতা। সে ছিল মথুরা চা বাগানে সোমবারের হাট। চিলাপাতা বাংলো থেকে রিক্সাযোগে চলেছি আমবা দু’জন। দূরত্ব ৩ কিমি। পথে অগণিত মানুষেব পা চলেছে হাটে। দু’ধারে মথুরা চা বাগান। মাঝে মসৃণ সড়ক। মার্চের নরম বিকেল। মাথার ওপর আদিগন্ত আকাশ।
মাঝির ডাবরি বাগান ছেড়ে এগোচ্ছে গাড়ি। উত্তরে কালকূট নদীটা দেখে নামিতা সাংমাকে মনে পড়ল। নদীর পারে সুপুরি ছায়ায় গারোদের গ্রাম। নমিতা, সূচনা, মারাক একবার আকুতি জানিয়েছিল,
–এখানে একটা হোমস্টের ব্যবস্থা দিন না করে! আমরা স্বর্গ ছেঁড়া স্বনির্ভর গোষ্ঠী চালাই। হোমস্টেতেও সফল হব দেখবেন।
–সুপুরি ছায়ায় গ্রাম, অবাধ এক মেছো নদী কালকূট, দূরে ভাতখাওয়া জঙ্গলকে পেঁচিয়ে ধরে এগিয়ে গেছে। পাশেই চেকো বিট। এখানে এক পর্যটন আবাস হলে গারো মেয়েদের যত্নবান হাতের পরিষেবায় ওদের স্বপ্ন সফল হতো। টুরিস্টরা পেতেন এক নতুন ঠিকানা। আজও হল না! সে আক্ষেপ রয়েই গেল!
কলকূটের পরে গেল গদাধর নদী।
–এ নদীও কি ফিশ ব্যাংক? ভবেন বলেন, –উত্তরের কোন নদীই বন্ধ্যা নয় জানবেন। এর বিশেষ কৃতিত্ব সরপুঁটিতে। গদাধরের সরপুঁটির নেশা সুযোগ পেলে ধরিয়ে দেব।
৩১ নং হাইওয়ে থেকে বাঁ-দিকে বাঁক নিয়ে মাইল ছয়েক গেলে রেঞ্জার কোয়ার্টার। পাশেই অফিস। কোয়ার্টারে একাই থাকেন ভবেন। আর একটি কাজের ছেলে কুমার রাভা। রান্না থেকে যাবতীয় ঘরকন্না তার হাতে। আর আছে একটি দিশি সারমেয়– বাঘা, তার গতিবিধি বেডরুম টু বাথরুম। গাড়ি থেকে নামতেই ছুটে এসে সে-ই আমাদের উদ্যম খানিক ড্যামেজ করে দিল। তারপর প্রভু-বন্ধু বুঝতে পেরে ল্যাজ গুটিয়ে ঘরে অদৃশ্য হল। পরে অবশ্য বেশ ক’বার এসে আন্দাজ নিয়ে গেছে আগন্তুকরা তার প্রভুর কতটা হিতাকাঙক্ষী!
ভবেন বলেন– বাঘা এই কোয়ার্টারের কেয়ার টেকার। ওর কাছে ছাড়পত্র না পেলে নো এন্ট্রি। একবার সকালের দিকে বারান্দায় শুনছি ওর বিকট চিৎকার। ভিতর ঘরে ছুটে এসে আমাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে। ওর সঙ্গে বারান্দায় বেরিয়ে এসে দেখি ৩ ফুটের এক দুধরাজ সাপ বারান্দা থেকে ঘরের দিকে আসতে চাইছে। আর প্রহরী তা রুখে দিয়ে তারস্বরে চিৎকার জুড়েছে।
অবশেষে ওটাকে বস্তায় ভরে জঙ্গলে পাঠালাম। টেবিলে চা পড়েছে, সঙ্গে গল্প।
ভবেন প্রস্তাব দেন,
– আজ বাকি দিনটা রেস্ট করে, কাল তাড়তাড়ি লাঞ্চ সেরে, ফরেস্ট ট্রিপ।
–তাঁর প্রস্তাব মঞ্জুর।
পরদিন তাড়াতাড়ি লাঞ্চ সেরে নিয়ে প্রস্তুত হলাম। গাড়ি বেরোল। পুরোধায় ভবেন, সঙ্গে বিটবাবু, গানম্যান, আর চালককে ধরে আমরা আরও চারজন। বুঝলাম বেশ আঁটোসাঁটো বন্দোবস্ত করে জঙ্গলে নামছেন ভবেন। আমরা আগেই জানিয়েছি বন্যপ্রাণী দেখা নিয়ে আমাদের কোনও হ্যাংলামি নেই। সামনে সাইট হলে ভালো, নইলে ভাতখাওয়া, পানবাড়ি, জয়ন্তীর জঙ্গল একাই একশো।
–বেশ, আগে গদাধর রেঞ্জ থেকে শুরু করি, চালক বলে।
জনপদ ছেড়ে নির্জনতায় প্রবেশ ঘটছে। তার সূচনায় কয়েকটি বিচ্ছিন্ন গাছ, নাগবেলা লতার ঝোপ, খোলা প্রাঙ্গণ ছেড়ে হুড়মুড়িয়ে জঙ্গল এসে পড়ল। এই গদাধর রেঞ্জ। আসল কোর ফরেস্ট শুরু হবে পানবাড়ি থেকে। পানবাড়ি শুনে মনে পড়ল একবার ভাতখাওয়া থেকে ২৩ মাইল টাওয়ারে এসে পানবাড়ি জঙ্গলের নমুনা দূর থেকে দেখে ভেবেছিলাম, একবার কোনও ফিকিরে ঢুকতে পারলে জঙ্গলের বিক্রম দেখা যেত। সেই পানবাড়ির পরদা ফাঁস হতে চলেছে।
গাড়ি চলছে শম্বুক গতিতে। স্টিয়ারিং-এ আছে টাইগার নার্জিনারি। ভবেন বলেন– আমাদের এই টাইগার কিন্তু রয়েল বেঙ্গল থেকে খুব পিছিয়ে নেই। ওর যেমন সাহস, তেমন ক্ষুরধার বুদ্ধি, তেমনই দৃষ্টি শক্তি। বাঁ দিকে ভয়ংকর জঙ্গল। ডান দিকে বনের আড়ালে ২০ মাইল বনবস্তি।
–গদাধরের জঙ্গলে সম্বরটা বেশি দেখা যায়, বিটবাবু বলেন। যদিও এই পুরো অঞ্চলটাতেই অ্যানিমেল সাইট হয়। তবে সকালে আর বিকেলে ওরা রোড ক্রস করে।
রেঞ্জকুঠি থেকে আমরা ৭ কিমি ভেতরে ঢুকে পড়েছি। এখানে একটি ওয়াচ টাওয়ার গড়ে উঠছে। নিশ্ছিদ্র বনভূমিতে দিনের বেলায় ঝিঁঝির ডাক শুনছি। বন্যপ্রাণী প্রতিহত করতে টাওয়ারের চারদিকে সোলার ফেন্সিংয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে। পাশে হাতির খাদ্য হিসাবে বাঁশের চাষ হচ্ছে। ডানদিকে চোখ ফেরাতে দেখি কয়েক লক্ষ প্রজাপতি কাগজকুচির মতো উড়ছে। জঙ্গলের এতটা পথে কোথাও একটা কীট পতঙ্গ চোখে পড়েনি, অথচ ওই একটা জায়গায় সাদা ইউনিফর্মে ওদের ছন্দবদ্ধ ডান্স ড্রামার অর্থ কি? গানম্যানটি বলেন– প্রকৃতির মতলব ব্যাখ্যাতীত দাদা।
এই শিহরণ জাগানো জঙ্গলে ভবেনের আগ্রহে নামতে হল। তিনি বেঁটেখাটো পেটাই স্বাস্থ্যের এক জনকে ধরে এনে বলেন– ও হেন্সিং, খুব মজার চরিত্র, কথা বলে দেখুন।
–লোকটি অনুগত ভঙ্গিতে সামনে দাঁড়িয়ে বলে– না স্যার, এখন আর কোনও কুকাজ করি না। এই বাবুটা আমার জীবনের ডিজাইন পালটে দিয়েছেন।
সংক্ষেপে বলতে গেলে দুর্গম জঙ্গলে নির্মীয়মাণ এই টাওয়ারের বর্তমান চৌকিদার ও একাই। একটি টর্চ আর কুকরি সম্বল মানুষটি সারা রাত আগলে রাখে ইট, বালি, সিমেন্ট থেকে আধা নির্মিত টং ঘরটা।
গানম্যানটি বলেন– এই লোক একটা হাতিকে একাই ঘোল খাইয়ে ছাড়বে। বাইসন, হাতির হার্ডের মুখে পড়লে অক্ষত বেরিয়ে আসবে। অসম্ভব মনের জোর, শরীরের কষ আরও বেশি দাদা। বিশ মাইল বস্তির এই ছেলেটি দশ ক্লাস পর্যন্ত পড়ে একটা বিয়ে করে বসল। আর তারপর ওর জীবনের ছক গেল বদলে। জঙ্গলের হরিণ মারে, চোরা পথে মাংস বিক্রী করে, আর চোরা বাজারে চামড়া চালান করে। ক্রমে এই টাইগার রিজার্ভে পয়লা নম্বরের পোচার হয়ে দাঁড়াল।
বন দপ্তর ফাঁদ পাতে, ও জাল কেটে বেরিয়ে যায়। ২০ মাইল বন বস্তিতে পুলিশ দিনে রাতে হানা দিয়েও ব্যর্থ। হরিণ নিধন চলতেই থাকে। এবারে হেন্সিং-এর নামে পরওয়ানা জারি হল। ধারিয়ে দিলে অথবা ওর সন্ধান দিলে পুরস্কার ঘোষণা হল। চতুর ব্যক্তিটি বুঝল এবারে বাঁচতে হলে জঙ্গল ছাড়তে হবে। হেন্সিং-এর বাবা ছিল বোড়ো, মা নাগা। সে নাগাল্যান্ডে আত্মগোপন করে রইল ১১ বছর। তারপর ফিরে এল অন্য স্লক হেন্সিং।
আজ অতীত কৃতকর্মের জন্য সত্যিই সে অনুতপ্ত! ভবেন ওর সাহসকে ভালো কাজে লাগাতে প্রয়াসী হলেন। সেই ভক্ষকই আজ সরকারি সম্পত্তির রক্ষক।
ওকে বলি– এখন তোমার বোধ বিবেচনা কি বলছে?
একটু ভেবে নিয়ে সে বলে– পাপ যা করেছি স্যার বাকি জীবনের সু-কর্মেও তা নিষ্পত্তি হওয়ার নয়। আরও একটা জীবন লাগবে।
–ওকে থামিয়ে দিয়ে বলি– অপরাধ বোধটাই তোমার প্রায়শ্চিত্তের প্রথম ধাপ, তুমি পেরিয়ে এসেছ। বাকিটা কর্মের মধ্যে দিয়ে খালাশ পেয়ে যাবে। কি বুঝল জানি না, হেসে ঘাড় কাত করল হেন্কসিং নার্জিনারি।
সামনে ২৩ মাইল টাওয়ারে যেতে দু-ধারের জঙ্গল পাঁচিল তৈরি করেছে। তার ভিতরে ব্ল্যাক হোলে কে লুকিয়ে আছে বোঝার বাইরে। টাইগার কিছু একটা আন্দাজ করে গাড়ি থামিয়ে দিয়েছে।
ভবেন নীচু গলায় বলেন– কিছু সাইট হল?
গানম্যান ভালো ভাবে নজর করে বলে– একটা হার্ড দেখছি ওদিকে মুখ ফিরিয়ে আছে। বাঁ দিকে এসে পড়েছে এক থেকে চার নম্বর পানবাড়ি ফরেস্ট কম্পার্টমেন্ট। ডান দিকে জয়ন্তি ৯ নম্বর কূপ। ওদিকেই গেল পিজি ফরেস্ট রোড। এ জঙ্গলে সাধারণের প্রবেশ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। তবে সঙ্গগুণে নিজেদের অ-সাধারণ ভাবতে ক্ষতি কি?
ত্রি-তল বিশিষ্ট, ২৩ মাইল টাওয়ার একটি চৗপথির মুখে। চারিদিকে হাই ফরেস্ট। সামনে জঙ্গল কেটে বেশ খানিক খোলা জায়গা বার করে আনায় চোখের রিলিফ হচ্ছে। এখানে দাঁড়ালে পূর্ব দিকে ফেলে এসেছি গদাধর এবং পানবাড়ি ফরেস্ট এলাকা, পশ্চিমে রাজাভাতখাওয়া কম্পার্টমেন্ট, উত্তরে গেলে জয়ন্তির জঙ্গল। দক্ষিণে সাংহাই রোড ধরে টানা গেলে চেকো বিট হয়ে পথ গিয়ে মিলল ৩১ নং সড়কে। চারিদিকে তাকিয়ে দেখি চিকরাশি, তুং, কাওলা, লাটোর, পাকাসাজ, আঁখাতরু, লালি, কুম্ভি –কত যে গাছের নাম, তাদের শরীরী ভঙ্গিমা। লসুনি ফুলের মিঠে গন্ধ নাকে আসছে। সবুজ স্টিকের মতো ঝুলছে টোটোলা ফল।
টাওয়ারের টং-এ জলপাই উর্দিতে দুই নজরদার গোলাপ সাংমা এবং বিপাই ওঁরাও। সঙ্গে দু’খানা দো-নলা। রবিবার ওরা টং-এ চড়েছে, বৃহস্পতিবার বনবাসের মেয়াদ শেষ। প্রতি বৃহস্পতি থেকে পালা করে চারদিন ধরে জঙ্গল লুঠের ওপর নজরদারি। টাওয়ারে শোওয়া, রান্না করে খাওয়া। এ জীবন আমাদের কল্পনার বাইরে। টাওয়ারের চারিদিকে পরিখা কাটা, তার উপরে সোলার ফেন্সিং-এ নিরাপত্তা বলয়। মাচার ওপর বসেই অ্যানিমেল সাইট হয়। সামনে মাটি খানিক চৗরস করে লবণ আর বিট লবণ ঢালা হয়েছে। সেই লবণের টানে আসে হাতি, সম্বর, হরিণ, বাইসন।
টাওয়ারের নীচে বসে গল্প চলছে। ফোটোবাজ বন্ধুটির লেন্সে হঠাৎ এক পাল হাতি ধরা পড়তেই সে উত্তেজিত। ভবেনবাবু ওকে ডেকে নেন। বলেন তাড়াতাড়ি পিছিয়ে আসুন। ওরা টাটকা নুনের সন্ধান পেয়েছে। কথা শেষ হওয়ার আগেই পূর্ব-পশ্চিম-দক্ষিণের জঙ্গল ধরে দলবদ্ধ হাতি আসছে লবণের সন্ধানে। আমরা যে যার মতো ক্যামেরা, মুভি, মোবাইল খুলে তুলে রাখি বন্য সুন্দরের টাটকা সাবুদ।
জঙ্গলে ডাকছে ক্রৌর-ক্রৌর বসন্ত বৌরি, ডাকছে ময়ূর, পাপিয়া। খুব কাছ থেকে ডেকে উঠেছে কোনও আজব জীব ট্যাঁকো-ট্যাঁকো শব্দে। বুঝতে পারি না প্রাণীটা আমার ঝোলার মধ্যে ঢুকে পড়েছে
কী-না! এক জন বনগার্ড বলে– ও ব্যাটা রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকেছে, তক্ষক। দেখবেন?
–চলো তো। ঘরের কপাটের পাশে দেখি শাল খুঁটি আঁকড়ে আড়াই ফুট গিরগিটির মতো প্রাণীটির শরীর কালো-হলুদ রং-এ চিত্রিত। বীভৎস জীবটির ওপর টর্চের আলো পড়তেই সে মুখটি আড়াল করার চেষ্টা করে। আমাদের দিশি মাতালের মতো, মনে করছে মুখটি আড়াল করলেই কেউ তাকে দেখতে পাবে না।
হাতির দল অদৃশ্য হল বটে, তবে চারটি পিলারের ওপর ভর দিয়ে একটা আড়াই তলা বাড়ি মাঠের মধ্যে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল। লোন টাস্কার। না সরলে বেরোবার উপায় নেই। বিটবাবু রসিকতা করে বলেন– নারী আর করী (হাতি) ‘কোন পথে যেতে কোন পথে যায়’, ওদের মন বোঝা দায়। তাঁকে বালি– এ কি রিসেন্ট অভিজ্ঞতা? আমার হঠাৎ বিস্ফোরণে বাবুটি লজ্জায় খানিক গুটিয়ে যান।
গাড়ি ছুটছে। আরও বন্য এ অরণ্য। স্ল বনে দিবারাত্রির কোনও কাব্য নেই। শুধুই অন্ধকারের পাঁচালি। মনে পড়ছে ৭ বছর আগে, তখন বিকেল ৩-টে, ঠিক এই পথে যেতে ছোটন বর্মন তার গাড়ির দম বন্ধ করে নিঃসাড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তরল অন্ধকারে তলিয়ে আছে আমাদের যানটি। চারিদিকে লরং (ঝিঁঝি ) ডাকছে প্রবল বিক্রমে। জোনাকির হলুদ ফুল উড়ছে। বুকের মধ্যে নৈঃশব্দের চোরা চালান টের পাচ্ছি। মিনিট তিনেক কেটে গেছে।
ছোটনকে চাপা গলায় শুধোই– তোমার ঘোড়ার রোগটি কী হে?
সে গাড়ি চালু করে দিয়ে বলল– পরে বলব স্যার।
পরে সে বলেছিল– আপনি পড়াদার লোক, বে-নোটিসে গাড়ি থামিয়ে যে রগড়টি করলাম তাতে আপনি কতটা লাভ ‘লোকসান’ গুনলেন তা আপনিই জানবেন। ঠিক কি-না? সেদিন বুঝলাম ছোটন বেপরোয়া মদ্যপই নয়, রীতিমতো বুদ্ধিও ধরে। আমার অভিজ্ঞতার তোষাখানায় ওই ৩ মিনিট বড়ো দুর্লভ আমানত হয়ে আছে আজও!
৭ বছর আগের সেই পথেই এগিয়ে চলেছি জয়ন্তী। হেড লাইটের আলোয় পথ দেখা! পথের দু’ধারে ব্ল্যাক বোর্ড ঝুলছে। তার মধ্যেও আমাদের গানম্যানের অব্যর্থ দৃষ্টিশক্তি। সে শান্ত গলায় বলে গাড়ি রুখ টাইগার। ওই দ্যাখ। বাঁ দিকে টর্চ মারতেই দেখি একটা কালো মুষকো বাইসন। কপালে সাদা তিলক, পায়ে সাদা মোজা, দুদিকে বাঁকানো সিং। ছবির জন্য সে তৈরিই ছিল। কিন্তু আলো বৈরী হল।
ভবেন বলেন– আজ আপনাদের অ্যানিমেল লাক সুপ্রসন্ন বলতে হয়।
বিকেল যে ফুরিয়ে এসেছে জঙ্গলে তার কোনও হেরফের নেই। গাড়ির মধ্যে মূক কতগুলি মানুষ বসে দেখছে ডুয়ার্স বনের হিম্মত। অন্ধকারে ছুটে যাচ্ছে টিমুর, টাটারি, লামপাতি, জারুল, রানিচাপ। কত দুষ্প্রাপ্য অর্কিড গাছের শাখায় ঝুলে আছে। কোথাও ওদালের মাথায় ঝুলছে ৮ ফুটের মৌচাকে কয়েক কুইন্টাল বুনো ফুলের মধু। দক্ষিণবঙ্গে মার্চের জঙ্গল মানে পলাশের রঙে হোলি খেলা। চিংরি ফুল, ধাতকি, মহুয়া গন্ধ। উত্তরে বসন্তের বনে ফোটে লসুনি, চিলৌনি, ওদাল। বিভিন্ন ফুলের বিচিত্র গন্ধের ঝাপটা লাগে হঠাৎ করে। মাঝে মাঝে তৃণভোজীদের জন্য গড়া হয়েছে ফুড ব্যাংক– মালসা, পুরুন্ডি, চেপ্টি, ঢাঢ্ঢার চাষ। কখনও ছুটে যাচ্ছে বেতবন।
ভবেন বলেন– এ বনে বেত পাবেন চার ধরনের। মোটা গড়াল বেত, দুধে বেত, পুত্লি বেত, মাঝারি মোটা। এই বেত বেশি হয় এদিকে। সরু মুবগি বেত। বেত বনে সাপের আড্ডা বেশি, বিশেষ করে অজগর।
ফরেস্ট গার্ডটি বলে– ২৩ মাইলে গঁক-গঁক শব্দে ধনেশের ডাক শুনেছেন? বিলক্ষণ শুনেছি। নেপালিরা বলে হাংরায়। এছাড়াও হরিতাল, ভীমরাজ, ময়না, বাজপাখি, কীট-পতঙ্গ, সরীসৃপ সব মিলিয়ে জীব বৈচিত্র্যের আদর্শ ভাণ্ডার এই তামাম বনভূমি।
সন্ধের মুখে এসে ভিড়লাম জয়ন্তী জনপদে। থাকা নয়, শুধুমাত্র চায়ের টানে। মাথার ওপর ছাউনি, চারিদিকে খোলা বড়োসড়ো এক চা-ঠেক-এ৷ ৩০ জন বসতে পারে। অনেক টুরিস্ট তাদের চায়ের মজলিশ জমিয়ে তুলেছেন। চায়ের ফাঁকে নদীটা একবার দেখে আসি।
আমার প্রস্তাবে ভবেন বলেন– রাতে কী দেখবেন?
দেখব ৭ বছর আগে ফেলে যাওয়া আমার স্মৃতিকে।
নদীর বুকে হেঁটে সেবারে দেখতে গিয়েছিলাম মহাকাল। জটার মতো জয়ন্তীর জলের ধারা কখনও গোড়ালি ভেজা, কখনও হাঁটু ডোবা। তীব্র তার টান। এখন চাঁদের আলোয় তার নিদ্রাতুর রূপটি না দেখেই ফেরার মানে হয় না। ভবেন সঙ্গে গাড়িটাকে জুড়ে দেন। বলেন– এটাকে সঙ্গে নিলে সময় সংক্ষেপ হবে।
বিস্তীর্ণ নদীর ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে কয়েক ছড়া জলের ধারা। ভরা চাঁদের আলো পড়েছে জলে-স্থলে-পাহাড়ে। চাঁদের ছোঁয়ায় ছিপছিপে নদী ঝিকমিক করছে। ওপারে কালো জোববায় ঢাকা পাহাড় শ্রেণি। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছে মার্চের সন্ধ্যায়। ওদিকে ফেরার সময়ও তাড়া দিচ্ছে। মনে পড়ছে নদীর কিনারে বাংলো, তার পাশে এক ময়না গাছে সারা রাত ফিসফিস সে ডেকেছিল– ভুতু-ভুতু-ভুতু! সেই হাড় হিম করা ডাক নাকি হুতুম পেঁচার! সেই সব স্মৃতি ফেলে রেখে হয়তো চিরকালীন এই ফিরে চলা! বিদায় হে জয়ন্তি!
চা-পকোড়া শেষ করে গাড়িতে ওঠার মুখে কিছু টুরিস্টের সামনে পড়ে গেলাম। তারা জয়ন্তীতে কটা দিন থিতু হতে এসেছেন। –আর আপনারা?
ভবেন বলেন– আমরা তো ভাতখাওয়ার পেট ফুঁড়ে বেরিয়ে এলাম। এবারে গদাধরে ফেরা।
একজন জানতে চাইলেন– ভাতখাওয়ায় ঢুকতে কী করতে হবে দাদা?
মুখে গাম্ভীর্য বজায় রেখে ভবেন সপ্রতিভ হয়ে বলেন, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টে চাকরি নিতে হবে। –ভদ্রলোক খানিক ঝটকা খেয়ে বলেন– আপনি তা হলে…?
টাইগার ততক্ষণে গাড়ি ছুটিয়ে দিয়েছে!