গ্র্যান্ড ক্যানাল

এই তো সামনে ভেনিসের গ্র্যান্ড ক্যানালে!

কতদিন ধরে শব্দ দুটো শুনে আসছি, কতদিন স্বপ্ন দেখেছি, বসে আছি ভেনিসের বিশ্বখ্যাত গন্ডোলায়। শেষ পর্যন্ত পুত্র ঋতঙ্করের কল্যাণে তারই স্পন্সরশিপে হতে পারল আমার ভেনিস ভ্রমণ। কিন্তু মনে একটা আশঙ্কা ছিলই– শেষ পর্যন্ত ‘ইউরো ভিজিটেড’-এর অভিজ্ঞতা হবে না তো? প্রশ্ন জাগাবে না তো, ‘ইজ দিস ভেনিস’?

না। ভেনিসে পৌঁছেই মনে হল অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে অপেক্ষা করে আছে ভেনিস। জলের রহস্য আর স্থলভাগের মনোহারিণী রূপ নিয়ে ভেনিস অনন্যা। ভেনিস আপনাকে দেবে চমক, উত্তেজনা আর বিস্ময়।

এই তো সামনে ভেনিসের গ্র্যান্ড ক্যানেল। প্রায় চার কিলোমিটার লম্বা, গভীরতা মাত্র পাঁচ মিটার, গড় প্রস্থ প্রায় পঞ্চাশ মিটার। এর বুকের ওপর ভাসছে নানা কিসিমের জলযান– ভাপোরেত্তি, গন্ডোলা। দু’পাশে জল ঘেঁষে, অপরূপ ফুলের সমারোহ নিয়ে চমৎকার চেয়ার টেবিল পাতা। মনোহারি সব ইটারি আর ওপেন-এয়ার রেস্তোরাঁ। গিজগিজ করছে পর্যটক। খাও, দাও, গান শোনো। ওই দ্যাখো, হিস্টোরিয়া রিগাটার ক্লক টাওয়ারে উড়ছে পাখাঅলা সিংহ। ভেনিসের ঐশ্বর্যের প্রতীক। ইতিহাসের ভেনিস, শিল্পের ভেনিস, রোমাঞ্চকর জলযাত্রার ভেনিস আপনাকে মুগ্ধ করবেই।

কীভাবে ভেনিস, ‘ভেনিসহল ?

ইতিহাসবিদ এবং ভ্রামণিকেরা বলবেন ভেনিস পৃথিবীর সুন্দরতম শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। আমি বলব ভেনিস পৃথিবীর সুন্দরতম বন্দর শহরের মধ্যে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী। ব্যতিক্রমী এর চেহারায়, শহর পরিকল্পনায়, স্রেফ জলের ওপর দীর্ঘশতাব্দী ধরে ভেসে থাকার স্থাপত্য ভাবনায়। একদিন ছিল ছোটো ছোটো  দ্বীপ নিয়ে গড়ে ওঠা আঁশটে গন্ধঅলা জনপদ। মেছেলদের হই-হল্লা আর নেশাখোরদের গানে-গাঁজালিতে মেতে থাকা মনুষ্যাবাস। মধ্যযুগে, কীভাবে এই  দ্বীপগুলি বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের ছোঁয়ায় এসে বদলে গেল, হয়ে উঠল ঝলমলে, তাক লাগানো, ডিউক-শাসিত ‘দোজে’–সে এক রোমাঞ্চকর কাহিনি।

নবম শতকে রোম-এ তখন ফ্রাঙ্ক শাসকদের আধিপত্য। ভেনিস কিন্তু তাদের অধীনতা মেনে নেয়নি। গির্জা, ব্যাসিলিকা, সুরম্য প্রাসাদ, শিল্পপ্রদর্শশালায়, ভেনিস তখন একাই একশো। অহংকার করার মতো তার অনেক ঐশ্বর্য। ‘সেরিনিসিমা’ নামে খ্যাত ভেনিস হয়ে উঠল সমুদ্র বাণিজ্যের প্রধান মার্কোপোলো-র শহর। আদপে একটি গোলকধাঁধা ভেনিসকে যুক্ত করেছে ১১৭টা  দ্বীপ, ৪০০ সেতু, ১৫০টি খাল।

Travel Venice

জল থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে ভেনিস

সর্বত্র জল, জল আর জল। এই জল সোহাগাভরে স্থলকে ঘিরে রেখেছে। পৃথিবীর বিস্ময় এই শহর-বন্দর-জেটি দেখে অবাক হতে হয়। এ কী করে সম্ভব? সম্ভব হয়েছে। ক্যানালগুলোর (স্থানীয় ভাষায় ‘রি’-Rii) ওপরে একদা ছিল শ’য়ে শ’য়ে দ্বীপ। এগুলিকে নতুন করে গড়া হল। জলের ওপর শক্তপোক্ত ভাবে ধরে রাখার জন্য ব্যবহার করা হল হাজার হাজার ‘পাইলন’ বা থাম– যেগুলি অনেক গভীরে শক্ত মাটির ওপর পোঁতা হল।

আগেই বলছি এই  দ্বীপগুলি মধ্যযুগে বাইজানটাইন সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রভাবে নতুন ভাবে গড়ে উঠতে লাগল রাজনৈতিক এবং সামাজিক অস্তিত্ব হয়ে। তখন ইতালির মূলভূমি ‘লঙ্গোবার্ড’দের দ্বারা অধ্যুষিত। ভেনিস তখন মূলভূমির প্রভাবের বিপরীতে প্রবল শক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

পনেরো-ষোলো শতকে আক্রমণকারী তুর্কীদের হারিয়ে দিয়ে ভেনিস হয়ে উঠল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু, সে ডেকে নিয়ে এল ইতালির বিখ্যাত সব ছবি-আঁকিয়েদের। এলেন বেলিনিস, কার্পাচিও, জর্গিওনে, টিটিয়ান, টিন্টোরেটো এবং ভেরোনাস। অথচ পাঁচ থেকে আট শতকের মধ্যে বারবার লুঠ হয়ে গিয়েছিল ভেনিস– হূন গথ, বার্বারিয়ানদের হাতে। অস্ত গিয়েছিল এর যাবতীয় গরিমা। তো সম্পূর্ণ নতুন এক শাসনব্যবস্থা চালু করে দিল ভেনিস– স্থানীয় ভাষায় ‘দোজে’ (মূল নাম ‘ডুচে)।

পনেরো-ষোলো শতকের নতুন ভেনিসের গৌরব ঝলমল করতে থাকে। প্রবাদপ্রতিম ‘ভেনিসিয়ান মার্চেন্ট’দের রমরমা তখন। ভেনিস হয়ে ওঠে প্রাচ্যদেশের সঙ্গে বাণিজ্যের মূল সেতু। তখনই শুরু হয় গ্রেট ‘বিল্ডিং বুম’ –বড়ো বড়ো অট্টালিকা, মহার্ঘ্য প্রাসাদ তৈরির ধুম পড়ে যায়। কিন্তু ১৮৬৬-তে এসে আর একা রইল না ভেনিস। ইতিহাসের প্রয়োজনেই যেন মিশে গেল রোমের সামাজিক রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গে।

লঞ্চ থেকে নেমেই চোখ ছানাবড়া। মিলান থেকে ভেনিস এসেছি লঞ্চে। সে এক বিস্ময়-যাত্রা। লঞ্চের ডানদিকে বিচিত্র অট্টালিকার মেলা। সেগুলির স্থাপত্য শৈলী দেখে হতবাক আমরা। রঙের শোভাযাত্রা। ভেনিসে নেমে আরেক বিস্ময়। ডানদিকে অ্যাড্রিয়াটিক সমুদ্র। সমুদ্রের ভেতরে ঢুকে আসা খাঁড়িতে জলযানের মেলা। ওয়াটার ট্যাক্সি, বড়ো বড়ো লঞ্চ, গন্ডোলা চালকদের হাঁকডাক। একটা একটা নাম না-জানা জেটিতে বিদেশি পর্যটকদের উপচে পড়া ভিড়। বাঁয়ে, অনেকদূর পর্যন্ত চোখ চালিয়ে দেখলাম শিল্প-সুষমায় অলংকৃত সেতুগুলি আমাদের আহ্বান জানাচ্ছে। সারি দিয়ে, জলের প্রায় গা ঘেঁষে অভিজাত হোটেল রেস্তোরাঁ। সারা বিশ্বের পর্যটকদের লাইভ চ্যাট আর খানাপিনা চলছে।

রূপকথার গন্ডোলা

ট্রাভেল এক্সপি-তে দেখেছি। একদিকে উঠোনো, সরু সরু মনোহারি জলযান। এবার সামনাসামনি। একটার পর একটা গন্ডোলা চটকদার সেতুর তলা দিয়ে ঢুকছে। একেকটা গন্ডোলায় সাত আটজন নানান ভঙ্গিমায় বসে দাঁড়িয়ে, হেলান দিয়ে। ইংল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, আফ্রিকা, ইন্ডিয়া –নানাদেশের নানান হাতনাড়া আর উল্লাস।

ভেনিসে এসেছি অথচ গন্ডোলায় চড়ব না?

জেটিতে স্টার্টিং পয়েন্টে দাঁড়ালাম। কিন্তু গন্ডোলা চালকদের কাঠকাঠ কথায় মনটা দুমড়ে গেল। আধঘন্টার জন্য ৮০ ইউরো! আমাদের মুদ্রায় প্রায় সাত হাজার টাকা। দু’মিনিটের কিন্তু কিন্তুর পর ভাবলাম জীবনে একবার স্বপ্নভ্রমণে এসেছি, গন্ডোলা না চড়াটা বোকামি হবে।

উঠে বসলাম টিকিট কেটে। গন্ডোলা চলল আদিম জলনালির সরু পেট ফুঁড়ে, কারুকার্যময় সেতুগুলোর তলা দিয়ে। দুপাশে আকাশছোঁয়া সব মধ্যযুগীয় প্রাসাদ– দাঁড়িয়ে আছে স্রেফ জলের বুকে। নীচ থেকে ওপরের দিকে তাকালাম। ইতিহাস যেন ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। নিশ্চুপ প্রাসাদের জানালায় কি কোনও চোখ আমাদের দেখছে? একটার পর একটা বাঁক পেরোচ্ছি, প্রাসাদ-আকীর্ণ গোলকধাঁধায় ঢুকে পড়ছি, চোখ বড়ো বড়ো করে গিলছি বিচিত্র-দর্শন প্রাসাদ, এক এক বাঁকে জল থেকে ওপরে উঠে সরু সরু সিঁড়ি বেয়ে শহর ভেনিসের হূদপিণ্ডে পৗঁছে যাবার হাতছানি, নানা রঙের নানা মানুষের বিস্ময়মাখা চিৎকার, হুল্লোড়। গন্ডোলা চালকের (নির্দিষ্ট বাঁকগুলোয়) পাশের প্রাসাদের গায়ে পা ঠেকিয়ে গন্ডোলার মুখ ঘুরিয়ে নেবার কসরত। খচাখচ ছবি উঠছে, হারিয়ে যাচ্ছে পথের চকিত রেখা, ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের একচিলতে আলো। তারপর ঘোর শেষ।

শহর ভেনিসের পথে পথে

এরপর শহর পরিক্রমা। কাকে ছেড়ে কাকে দেখব? প্রথমে দেখেছি বারোক রীতিতে বানানো, চার্চ অফ স্কালজি। মন কেড়ে নিয়েছে। অন্যদিকে পালাজেও (প্রাসাদ) পাসেরো, ডাইনে ফন্ডাও ডি চার্চি (চার্চ)। পালাজেও পাসেরোর পেটের মধ্যে আর্ট মিউজিয়াম– গালোরিয়া ডি আর্তে মোদের্না’ আবার প্রাচ্য দেশীয় শিল্পের মিউজিয়াম– মুসেও ডি আর্তে ওরিয়েন্টাল। বাঁদিকে বহুশ্রুত রিয়ালটো ব্রিজ, ব্রিজ অফ সাইজ-এর কাছে দু’দুটো ভেনিসিয়ান প্রাসাদ– পালাজেও লোরেদান, ডি ফার্গেটি।

হাঁ করে দেখতে হয়, চমকে যেতে হয়, ইতিহাসের শ্বাস পড়ে গায়ে। রিয়ালটো ব্রিজ তৈরি করেছিলেন খ্যাতনামা স্থপতি আন্তোনিও ডি পন্তি। আহা! সামনেই যে ভেনিসের সিগনেচার স্থাপত্য– ব্যাসিলিকা ডি সানমার্কো। কথিত, এটি তৈরি করতে সময় লেগেছিল ৮৫০ বছর। স্থাপত্যরীতি অতশত বুঝি না, তবে এর কসমোপলিটান ইমেজটি মনে গেঁথে গেল।

বাইজানটাইন প্যাটার্ন-এর পেঁয়াজাকৃতি বাল্ব, গম্বুজ, গ্রিক রীতির ক্রস লে-আউট, গথিক রসেট-উইন্ডো, মিশরীয় মার্বেলের তৈরি দেয়াল। ভেতরে, প্রায় ৮৫০০ বর্গমিটার জুড়ে মোজাইক– ডোম অফ জেনেসিস, ডোম অফ হোলি স্পিরিট।

পা চলছে না আর। আগস্ট মাসের সূর্যও বড়ো ক্ষমাহীন। একেবারে রাগি চোখ যেন ঝলসে দিচ্ছে। সকালে, রাতে ঠান্ডা, দুপুরে বেশ গরম। কত দেখব? দিন চারেক থাকতে পারলে ধীরে সুস্থে দেখা যায়। তাও দেখলাম পিয়াজা সান মার্কো, (পিয়াজার অর্থ স্কোয়ার বা চত্বর) ডানদিকে আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম। ৮২৮ সালে ভেনিসে আনা হয়েছিল সেন্ট মার্ক ডি এভানজেলিস্ট-এর দেহাবশেষ, মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া থেকে চুরি করে। উরিববাস! বাইজানটাইন সাম্রাজ্যের সোনার বাহার দেখবার মতো। গথিক স্পায়ার, রোমান রাউন্ড আর্চ এবং সবশেষে নয়ের শতকে তৈরি দোজে প্রাসাদ। স্থপতি মাসেনে, রিজ্জো এবং দা পন্তের জাদু ছোঁয়ায় ষোড়শ শতকে সম্পূর্ণ দ্যুতিময় দোজে প্যালেস।

Travelogue Venice

দোজে প্যালেস দেখতে ভুলবেন না যেন

নবম শতকে তৈরি হয়েছিল দোজের প্রাসাদ। এর নির্ভার, হালকা গঠনশৈলী, একতলায় গথিক আর্চ বা খিলান, বারান্দা, চারদিক-খোলা প্রশস্ত, চক্বর মারার জায়গা– আপনাকে চমৎকৃত করবে। একটু সময় নিয়ে আসুন, তাড়াহুড়ো নয়। সিলিং-এ বা প্রাসাদের ওপরের দিকটায় ঢেউ খেলানো সাদা এবং গোলাপি নক্সাসমেত এই প্রাসাদ মনোরম, পর্যটক প্রিয়। এর প্রাঙ্গণে দৈত্যাকার সিঁড়ি (Scala De Giganti), সিনেট হল সিংহের মুখ বা বোকে দি লিওনে (Bocche de leone), সালা দেল দেই ত্রেকাপি,যেখানে অতি গোপনে রাজদ্রোহী বা বিদ্রোহীদের বিচার এবং প্রাণদণ্ড হতো (Sala Del Scrutinio)বা বিচারশালা আজও পৃথিবীর বিস্ময়।

 

দীর্ঘশ্বাসের সেতু

চলে আসুন Bridge Of Sighs বা দীর্ঘশ্বাসের সেতু দেখতে। সেতুটি দোজে প্যালেসকে যুক্ত করেছে। ষোড়শ শতকে তৈরি, ডিজাইন করেছিলেন আন্তোনিও কন্তিনি, সতেরো শতকের ব্যারোক রীতিতে (স্থাপত্যবিদ্যার পাঠকেরা বা বেত্তারা ভালো জানেন)। তবে, কোনও রোমান্টিক নায়ক নায়িকার (লোনাভালার মতো) দীর্ঘশ্বাস শোনা যায় না এখানে। এখানে কান পাতলে শোনা যায় রাজদ্রোহী, বিদ্রোহী বা কোন না কোন অপরাধে দণ্ডিত মানুষের দীর্ঘশ্বাস। ন্যায়ে হোক, অন্যায়ে হোক, ইতিহাস বড়ো বিচিত্র।

আকাদেমিয়া দি পিতোরিয়ে স্কালতোরি

ভেনিসে থাকবেন অথচ ‘Accademia dei Pittori দেখবেন না? তাহলে আপনার জীবন বৃথা। ১৭৫০ সালে তৈরি, হেড কোয়ারটার্স ছিল সান মার্কোর গিয়ার্ডিনেত্তিতে। পিয়াজেতা ছিলেন এর প্রথম ডিরেক্টর। পরে ডিরেক্টর হন স্বনামখ্যাত তিওপোলো, ১৭৫৬ সালে।  ১৭০০ সালে এটি উঠে এসেছিল গ্র্যান্ড ক্যানালের ধারে চারিতা কনভেন্ট-এ (Convento delca Carita)। শুরু হয়েছিল চিত্রকলা শিক্ষণের স্কুল হিসেবে। পরে কিন্তু পৃথিবীর অন্যতম আর্ট গ্যালারি হয়ে ওঠে। গ্যালারির প্রথম চিত্রসংগ্রহশালা উৎসর্গ করা হয়েছে ১৪ শতকের ভেনিসিয়ান স্কুলের নামে। যাঁরা চিত্রশিল্পী বা ছবির কদর বোঝেন, তাঁদের কাছে এটি স্বর্গরাজ্য। আমাদের মতো মুগ্ধ দর্শকদের কাছে এ যেন মায়া সাম্রাজ্য। প্রধান কাজ বা সৃষ্টিগুলির মধ্যে রয়েছে পাওলো ভেনেজিয়ানের Coronation of the Virgin, লরেঞ্জো ভেনেজিয়ানোর Mystic Marriage of Saint Catherine এবং Annuciation Alterpiece. রয়েছে জ্যাকোবেলো ডেল , আন্তোনিও ভিভারিনির শিল্পকর্ম।দু’নম্বর প্রদর্শশালায় এরকম অসংখ্য মণিরত্ন প্রদর্শিত আছে ২১টি কক্ষে। একসঙ্গে এত দেখা অবশ্য খুবই কষ্টকর।

সান্তামারিয়া গ্লোরিওসা দেই ফ্রারি

এখানে রয়েছে পৃথিবীর বিরলতম শিল্পসংগ্রহ। দেখতে পারেন তিশিয়ান-এর বিখ্যাত– মাস্টারপিস। একটি উঁচু বেদির পেছনে, Madonna di Cs Pesaro

পিয়াজালে রোমা

ভেনিসে ঘুরতে ঘুরতে অসুবিধেয় পড়লে পৌঁছে যান পিয়াজালে রোমা-তে। ১৯৩৩ সালে তৈরি Ponte della Liberta-র সেতু পেরিয়ে। এখান থেকেই আপনি পেয়ে যাবেন শহরের আশেপাশে অনেকদূর পর্যন্ত বাস যোগাযোগ। Fondamenta De Santa থেকে আপনি ৩০ মিনিটে পৌঁছে যাবেন গ্র্যান্ড ক্যানালে ধরে Vaporetti (দ্রুতগামী জলযান) নিয়ে বিখ্যাত Piaza San Marco-তে। কাছেই Rail Road Station. ১৮৪৬ সালে উদ্বোধন হয় এই স্টেশনটির। শান্তা লুসিয়া নামের ষোড়শ শতকের এক সন্ত-এর নামে এটি উৎসর্গীকৃত হয়। তৈরি করতে লেগেছিল ৭৫০০০ পাইলন বা থাম।

পিয়াজা সান মার্কো

প্রথমে ছিল ঘাসের গালিচা পাতা ভূখণ্ড। ভেতর দিয়ে চলে গিয়েছে একটা খাল। দুদিকের প্রান্তদেশে ছিল দুটো ছোটো গির্জা– সান তেওদোরো, সান জেমিনিয়ানো। কিন্তু পরের দিকে এই জায়গাটাই নতুন সাজে অলংকৃত হয়ে, হয়ে উঠল পৃথিবীর জীবন্ত স্কোয়ার বা চত্বরগুলির অন্যতম। শহরের ধর্মীয় প্রাণকেন্দ্রও বটে। এর

ওপেন-এয়ার পার্লারে গভীর রাত পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতে পারেন, ফুর্তি করতে পারেন, পুরোনো দিনের ঐতিহাসিক কাফেতে কফির স্বাদ নিতে পারেন। কেনাকাটাও করতে পারেন, তবে এখানে বেশ কিছু স্থাপত্য দেখবার মতো, তারিফ করার মতো। এর বেল টাওয়ার এবং ক্লক টাওয়ার ইতিহাস-প্রসিদ্ধ। কথিত, যখন Clock Moors-বা Terrace-এর ঘণ্টাগুলি বাজাতো তখন Clock Tower-এর ঘণ্টাগুলিও একসঙ্গে বেজে উঠত।

হাঁ, কষ্ট হলেও ছেড়ে যাবেন না বিব্লিওটেকা নাজিওনাল মারাসিয়ানা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সংগ্রহে মহার্ঘ্য এই লাইব্রেরি। পনেরো শতকের গ্রিক মানবতাবাদী পণ্ডিত কার্ডিনাল বেসারিওনে বিপুল

সংখ্যায় দুষ্প্রাপ্য বই দিয়ে সমৃদ্ধ করেন এই লাইব্রেরি। লাইব্রেরির নকশা করেছিলেন জ্যাকপো স্যানসোভিনো। এই বাড়িতে এখন দুটি মূল্যবান দর্শনীয় স্থান- বিব্লিওটেকা নাজিওনালে মার্সিয়ানা এবং আর্কিওলজিক্যাল মিউজিয়াম। গ্রিক এবং রোমান স্থাপত্যের মহাসম্মিলন।

দ্বীপের নাম মুরানো

শিল্পকীর্তি অনেক দেখলেন, ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত। আজ বিশ্রাম নিন। পরের দিন চলুন অন্য ভ্রমণে। চলুন মুরানো গ্লাস-এর  দ্বীপ

‘মুরানো’-তে। সকাল সকাল জেটিঘাট থেকে টিকিট কেটে উঠে পড়ুন লঞ্চে। অতীতে এর নাম ছিল Amurianum দশম এবং একাদশ শতকে হুনদের আক্রমণে দিশেহারা, ছত্রভঙ্গ হয়ে আলতিনোর মেইনল্যান্ড থেকে লোকেরা পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছিল এই দ্বীপে। কালক্রমে এটি হয়ে দাঁড়ায় Major Lagoon Centre. তেরো শতকের অক্লান্ত পরিশ্রমে Glass Blowing-এর কাজ করতে করতে শরণার্থীরা মুরানোকে খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে দেয়।

পনেরো শতকে এসে সারা বিশ্বকে চমকে দেয় এখানকার তৈরি Barovier Cup, মুরানো দ্বীপটি ঘুরে দেখতে হাতে সময় রাখবেন। বাসের টিকিট connecting লঞ্চের টিকিটের টাইমিং ঠিকমতো দেখে নেবেন। মুরানো গেলে অবশ্যই হাঁটবেন Canaled Degli Angeli-র ধার ঘেঁষে এবং নদী Rio Dei Vetrai-র তীরভূমি বরাবর। গ্লাস মিউজিয়ামটিতে দেখতে ভুলবেন না গ্লাস ফ্যাক্টরির লাইভ ডেমো। অবাক হওয়ার মতো সব নির্মাণ হতে শুরু করবে আপনার সামনে।

বুরানো

এরপর চলুন বুরানো দ্বীপে। যদিও আপনার এনার্জি প্রায় শেষ। কিন্তু বৈচিত্র্য আপনাকে এনার্জি দেবে। নতুন ল্যান্ডস্কেপ, ওয়াটারস্কেপ আপনাকে টেনে নিয়ে যাবে। ভেনিস বেড়াতে গেলে মুরানোর সঙ্গে বুরানোর টার্গেট-টি আপনাকে রাখতেই হবে। তা নাহলে অসম্পূর্ণ থেকে যাবে অনেক কিছুই। মূলত জেলেদের বাস ছিল বুরানোতে। চারটে ছোটো ছোটো দ্বীপের সমষ্টি। পঞ্চম এবং ষষ্ঠ শতকে আলটিয়াম থেকে পালিয়ে আসা লোকজনই এই  দ্বীপের আদি বাসিন্দা। হূন সম্রাট আটিকার আক্রমণে ঘরবাড়ি ছেড়ে এঁরা পালিয়ে আসেন এই  দ্বীপে। তারপর জীবন সংগ্রাম।

মুরানো যদি তার গ্লাস ওয়ার্কের জন্য বিখ্যাত হয়ে থাকে, বুরানো খ্যাতি অর্জন করেছে তার Lacework-এর জন্য। বংশ পরম্পরায় চলে আসা এই Lacework আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে।

এবার এই অফুরন্ত সৗন্দর্য, শিল্প কীর্তি, হই হই জলবিহার, রহস্যময় দ্বীপভূমির হাতছানিকে বিদায় জানিয়ে আপনার বাড়ি ফেরার পালা। আমাদের তো আরেকটি বিস্ময় অপেক্ষা করেছিল– ইতিহাসের রোম। আপাতত ভেনিসকে বিদায় জানিয়ে রোম-এ যাওয়া।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...