আধুনিক সময় হয়তো অনেক কিছুকেই সহজ করে দিয়েছে। হাত বাড়ালেই গ্যাজেট, আর গ্যাজেটের সোনার কাঠিটি ছোঁয়ালেই জীবনযাপনে আসে একেবারে রাজকীয় আরাম। কিন্তু এই হাই স্ট্যান্ডার্ন্ড লিভিং-ই আসলে আমদের জীবনে বড়োসড়ো বিপদ ডেকে আনছে। বিলাসী বাসস্থান, আধুনিকতম গাড়িতে যাতায়াত, হাইটেক যন্ত্রপাতির নিত্য ব্যবহার, পর্যাপ্ত ক্যানড্ এবং রেডি টু কুক ফুড, অর্থ ও বিত্তের প্রতুলতা, পরিশ্রম বিমুখতার প্রবণতা– এসবই আসলে অভিশাপ নিয়ে আসছে আমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জীবনে। সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে উচ্চরক্তচাপ, মধুমেহ, হাইপারটেনশন, ওবেসিটি, উৎকণ্ঠা, ডিপ্রেশন, স্ট্রেস, হার্ট অ্যাটাক, কিডনি ফেলিয়োর, ব্রেন হেমারেজ, স্লিপ্ড ডিস্ক, জয়েন্ট পেইন, কিডনি স্টোন, গল ব্লাডারে স্টোন, নানা ধরনের ক্যানসার, টিউমার প্রভৃতি রোগের। প্রকোপ বাড়ছে সাধারণ হজমের গন্ডগোল ও পেটের সমস্যারও।
প্রশ্নটা হল এই সমস্যার কোনও সমাধান আছে কী? সমস্যার মূলে পৌঁছোতে পারলে সমাধানও করতে পারবেন। ভেবে দেখুন আপনার জীবনশৈলীতে হাল সময়ে আপনি কতটা পরিবর্তন এনেছেন। মূল সমস্যাটা হল কৃত্রিম এই স্বচ্ছলতায় ভেসে, আমরা প্রকৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আমরা কায়িক পরিশ্রম বড়ো একটা করতে চাই না। ব্যায়াম, খেলাধূলা যা শরীর গঠনে কাজে লাগে, চল্লিশ পেরোনোর পর তাতেও আজকাল অনীহা। জেট গতির যুগে আমরা নিরন্তর ছুটছি, যদিও জীবনে শান্তি কীসে আসবে তা আমাদের অজানা। ব্যালেন্সড্ ডায়েট, ব্যায়াম, মেডিটেশন এবং সংযমী জীবনযাপনই একমাত্র সুস্থ জীবনের মন্ত্র। কিন্তু একথা অস্বীকার করে আমরা ইনডিসিপ্লিন্ড জীবনস্রোতে গা ভাসাই। ফলাফল, অসুস্থ হয়ে পড়া। চিকিৎসকরা বারবার সচেতন হতে বলা সত্ত্বেও আমরা বেপরোয়া জীবনযাপন করি এবং শেষ পর্যন্ত এমনই একটা পর্যায়ে পৌঁছোই যেখান থেকে নিরাময়ের সম্ভাবনা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যুতিন যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে আমাদের জীবনযাপনে। ফ্রিজ, এসি, কোটেড বাসনপত্র ছাড়াও, হাইটেক গ্যাজেট যেমন মোবাইল, ইন্টারনেট– এগুলির রেডিয়েশন আমাদের শরীর মনেরই শুধু না, পরিবেশেরও ক্ষতি করে।
আমরা দৈনন্দিন জীবনে যা খাই তার প্রভাবও পড়ে আমাদের স্বাস্থ্যের উপর। ফল, শস্য, ডাল– যে-কোনও কৃষিজাত সামগ্রী এখন পেস্টিসাইড ও সারের রাসায়নিকযুক্ত। সেইগুলোই খাদ্যের সঙ্গে আমাদের শরীরেও প্রবেশ করে। ফলে এই বিষ শরীরে ঢুকে নানা রকম রোগের জন্ম দেয়। অন্যদিকে বায়ুদূষণ, জলদূষণ ও পরিবেশ দূষণের সমস্যা তো রয়েছেই। এই প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে আমাদের প্রতিরোধক্ষমতা অনুযায়ী আমরা লড়ি। কিন্তু একসময় নতি স্বীকার করতেই হয়। তাই প্রথম থেকেই কিছু সতর্কতা মেনে চলা ভালো।
ব্লাড প্রেশার সামলাতে
- সাধারণ তাপমাত্রায় রাখা জল পান করুন। মাটির বা তামার পাত্রে রাখা জলঞ্জএক্ষেত্রে সবচেয়ে উপযোগী
- খালি পায়ে ঘাসের উপর অন্ততপক্ষে ১ কিমি করে হাঁটুন রোজ সকালে
- প্রাণায়াম ও মেডিটেশন করার অভ্যাস করুন সকালে, প্রাতরাশ করার আগে এবং রাতে ঘুমোনোর আগে
- রোজের খাবার তিন দফায় খান, ব্রেকফাস্ট – লাঞ্চ – ডিনার। মাঝখানে খাবার অভ্যাস ত্যাগ করুন
- ব্রেকফাস্ট ভারী খান, লাঞ্চ হোক হালকা
- রোজকার খাবারের মধ্যে ৫০ শতাংশ যেন রান্না করা খাবার থাকে আর বাকি ৫০ শতাংশ হবে রান্না না-করা খাবার অর্থাৎ স্যালাড, জুস প্রভৃতি
- বিকালেও হাঁটার অভ্যাস থাকা ভালো
- ভোরবেলায় খবরের কাগজ পড়ার বদলে গান শুনুন
- বেশি চা, কফি বা তৈলাক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন
- অতিরিক্ত খাবার খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করুন
- যতক্ষণ না খিদে পাচ্ছে, না-খাওয়ার চেষ্টা করুন
- অতিরিক্ত উত্তেজিত কথাবার্তা, রাগ এড়িয়ে চলুন। পরিবারের অশান্তি বা বাইরের ঝামেলা, যা আপনার উৎকণ্ঠা বাড়াচ্ছে, তা থেকে দূরে থাকুন
- ওভার রিঅ্যাকশনের জন্য স্ট্রেস হরমোন ক্ষরণের পরিমাণ বেড়ে যায়, যা ক্লান্তি ও অবসাদ বাড়িয়ে তোলে। এতে হার্ট ব্লকেজ পর্যন্ত হতে পারে। সুতরাং সেই পরিস্থিতিতে কোনও ভাবেই পৗঁছোবেন না, নিজের আগেবকে নিয়ন্ত্রণ করুন
ওবেসিটি যখন চোখ রাঙায়
বৈজ্ঞানিকদের মতে পেটে ১ মিলিমিটার পুরু মেদ মানেই ১০ রকম জটিলতা তৈরি হওয়ার পথ প্রশস্ত। ক্রমশ কি আপনার চেহারা অ্যাপেল শেপ নিচ্ছে? তাহলে এখনই সাবধান হোন। আপনি ওবেসিটির শিকার হতে শুরু করেছেন। এখনই কয়েকটি বিষয় মেনে চলুন।
- প্রত্যেকদিন সকালে বেশি করে জল পান করুন
- ১-২ কিমি রোজ সকালে হাঁটার অভ্যাস করুন
- প্রাতরাশে যেন অঙ্কুরিত মুগ, ভিটামিন সি ও ফাইবার-যুক্ত ফল থাকে। নিয়মিত শসা খাবেন
- প্রসেস্ড ফুড বা ফাস্ট ফুড যেমন পিৎজা, বার্গার, স্যান্ডউইচ, পকোড়া, সিঙারা, কচুরি, পরোটা এড়িয়ে চলুন
- লাঞ্চ-এ হোল গ্রেন বা মাল্টি গ্রেন আটার রুটি, সবজি ও রায়তা খান
- খাবার ঠিক আগে আর পরে জল খাবেন না
- লাঞ্চ বা ডিনারের সঙ্গে ফল খাবেন না
- ডিনারে ৪০ শতাংশ থাকবে রান্না করা খাবার, যেমন রুটি-শাকসবজি, বাকি ৬০ শতাংশ থাকবে স্যালাড
মাইগ্রেন থেকে বাঁচতে
- উপরে বলা হয়েছে যেমন, তেমনই ব্যালান্সড্ ডায়েট গ্রহণ করুন
- প্রতিদিন-ই হাঁটুন। ডিপ ব্রিদিং জরুরি। প্রাণায়াম করুন
- অন্তত ৩০ মিনিট মেডিটেশন করুন সূর্য ওঠার আগে
- ক্ল্যাসিকাল মিউজিক বা কোনও বাদ্যযন্ত্র চর্চা করুন
- উদ্বেগ, উত্তেজনা ও ডিপ্রেশন এড়াতে
- প্রত্যেকদিন ১ ঘন্টা হাঁটা আবশ্যক। কাছাকাছি উদ্যান বা নিজের লনে হাঁটুন ভোরবেলায়
- খাদ্যপ্রক্রিয়া আগের অসুখগুলোতে যেমন বলা হয়েছে, সেভাবেই মেনে চলুন। ভিটামিন সি এবং ই-যুক্ত ফল খান
- প্রসেসড্ ফুড ও ফাস্ট ফুট এড়িয়ে চলুন। পিৎজা, বার্গার, পেস্ট্রি, স্যান্ডউইচ খাওয়ার লোভ সংবরণ করুন
- চা, কফি, অ্যালকোহল, কোল্ড ড্রিংকস্, প্যাকড্ জুস অ্যাভয়েড করুন
- গ্রিন টি, ফ্রেশ জুস চিনি ও নুন ছাড়া খাওয়াই সবচেয়ে ভালো
অ্যাসিডিটি, গ্যাসট্রিক ও আলসার থেকে বাঁচুন
- বেশি করে জল খান সকালে
- খালি পায়ে ঘাসের উপর হাঁটুন
- আধঘন্টা মেডিটেশন করুন রোজ সকালে
- নানারকম ফল, অঙ্কুরিত মুগ (কাঁচা) খাওয়ার অভ্যাস করুন
- ব্যালান্সড্ ডায়েট গ্রহণ করুন
- মিক্স ভেজিটেবল, রায়তা ও নারকেলের শাঁস খান নিয়মিত
- সবুজ ও লাল লংকা, গোলমরিচ, আচার, মোরব্বা, কোল্ড ড্রিংকস্, প্যাক্ড জুস, ময়দার ভাজাভুজি এড়িয়ে চলুন
- মশলাদার ও তৈলাক্ত খাবার একেবারেই খাবেন না, পরোটা, পকোড়া, ভাজা মিষ্টি, দুধ ও দুগ্ধজাত জিনিস না খাওয়াই ভালো
ক্যানসার, টিউমার সমস্যা
সমস্ত ধরনের ক্যানসার, টিউমার বা ওই ধরনের রোগে, চিকিৎসার পাশাপাশি প্রয়োজন নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করা। সোয়াইন ফ্লু, ডেঙ্গু, হার্ট ও লিভারের সমস্যার অনেকটাই সুরাহা করা সম্ভব সঠিক খাদ্যপ্রণালী মেনটেন করে। ডায়েট, মেন্টাল অ্যাটিটিউড-এ পরিবর্তন, হাই পাওয়ার নিউট্রিশন, ডিটক্সিফিকেশন, মেডিটেশন ও নিয়মিত ব্যায়াম, আপনাকে রোগমুক্তির দিশা দেখাবে। কেমো বা রেডিয়েশন থেরাপিরও প্রয়োজন হবে না যদি সঠিক সময়ে সচেতন হওয়া যায়।