কলকাতার জিগোলো

।।১।।

গাড়িটা এটিএম-এর সামনে এসে দাঁড়াল। গাড়ি থেকে নেমে এল এক স্মার্ট সুদর্শনা যুবতি। সে নিজেই ড্রাইভ করছিল।

এটিএম-এর সামনে দাঁড়িয়েছিল সিকিউরিটি গার্ড যুবকটি। সে যেন তার জন্যই অপেক্ষায়। ভদ্রমহিলাকে স্যালুট করে সে বলল– গুড ইভিনিং ম্যাডাম।

যুবতিটি মৃদু হেসে প্রত্যুত্তর দিল– গুড ইভিনিং। কেমন আছো ঋষভ?

– ভালো। ক’দিন এটিএম-এ আসেননি ম্যাডাম?

– হ্যাঁ, ক’দিন আসা হয়নি। অফিস অফিস করে কেটে গেছে। তবে টাকার-ও বোধহয় অতটা প্রয়োজন হয়নি। নইলে এটিএম-এ না এসে পারা যায়? তুমি আমার আসা যাওয়ার হিসাব রাখো নাকি?

– না না, ঠিক হিসাব রাখা নয়। আমাদের তো এটিএম-কেন্দ্রিকই চাকরি। কিছু কাস্টমার মাঝেমাঝেই আসেন। তাদের আসারও নির্দিষ্ট সময় আছে। আপনি তাদেরই একজন।

যুবতিটি ঋষভের পাশে দাঁড়াল। পারফিউমের মিষ্টি গন্ধে তার সারাদিনের একাকিত্বের ক্লান্তি এক নিমেষে ভেসে গেল। যুবতিটি এলে এমনই হয় বারবার। ঋষভ কি করে তাকে বলবে–সে দীর্ঘদিন এটিএম-এ না এলে মনের মধ্যে এক ধরনের আকুলতা তৈরি হয়। অথচ সে যুবতিটির প্রায় কিছুই জানে না। এমনকী নামও নয়। জানতে ইচ্ছা হলেও উপায় নেই। কোনও কাস্টমারের ব্যক্তিগত বিষয়ে প্রশ্ন করার হক তার নেই। কাস্টমারদের় এটিএম থেকে টাকা তোলার তারা শুধু নীরব দর্শক। কাস্টমারের টাকা তোলার সময় পারতপক্ষে স্ক্রিনে চোখ রাখে না তারা।

আট বাই দশ-বারো সাইজের ঘরে এটিএম বক্স-এর পিছনে এক টুকরো ড্রেসিংরুম আর একটি মাত্র বসার টুল নিয়ে অফিস পরিধিতে সে একমাত্র কর্মী। কথা বলার সঙ্গী বলতে কেউ নেই। এখানে উপরওয়ালার রক্তচক্ষু নেই। তারা নিধিরাম সর্দারের মতো ঢালতরোয়ালহীন। শুধু অর্থদাতা যন্ত্র আগলে পড়ে থাকা। নিজেই নিজের বস আর আর্দালি। এই বসকে কেউ পাত্তা দেয় না। তাকে গুরুত্ব দিয়ে কী-ই বা লাভ? এটিএম-এর ছোট্ট রুমটায় ঢুকে বড়োজোর কাস্টমাররা আড়চোখে তার দিকে তাকায়। তবে হ্যাঁ, অর্থদাতা যন্ত্রের যান্ত্রিক গোলোযোগ দেখা দিলে দু’-চার জন কথা বলে। ব্যাংকের অপদার্থতার অভিযোগ তার মুখের উপর ছুড়ে দিয়ে চলে যায়। হয়তো বা কেউ বলে– ফালতু সব লোকজন। সত্যিই তো, কে দেবে তার মতো একজন তুচ্ছ ব্যক্তিকে পাত্তা। অথচ যুবতি যেন একটু আলাদা–ঋষভের সাথে এক আধটা কথা বলে।

এটিএম-এ সাধারণত রাত সাড়ে ন’টা থেকে দশটার মধ্যে আসে। তখন প্রায় দিনই অন্য কাস্টমার থাকে না। প্রথম প্রথম একটু আধটু হাসত। নিউ টাউনের এমন জনমানবশূন্য জায়গায় অন্তত একটি লোকের দেখা মিলছে ভেবে হয়তো হাসত। এখন কখনও দু’দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলে আর নরম চোখে মৃদু হাসে। সেই হাসি ঋষভের শরীর মন জুড়ে ছড়িয়ে দেয় ভালোলাগা অনুভূতি। যুবতি চলে যাওয়ার পরও এটিএম ঘর মেখে থাকে পারফিউম আর মেয়েলি গন্ধে। ঋষভ কাস্টমার না থাকলে ঘরটার মধ্যে ঘুরে ঘুরে যুবতির রেখে যাওয়া গন্ধ শোঁকে। কখনও এটিএম-এর কি-বোর্ডে নাক ঘষে। তারপর আস্তে আস্তে ঢুকে যায় নির্জনতার গহ্বরে। ফিরে পায় নিজেকে। রাত বাড়ার সাথে আরও গুটিয়ে যায় নিজের গণ্ডির খোলসে।

– ঋষভ।

– অ অ, টাকা তোলা হয়ে গেছে ম্যাডাম?

– তুমি কোন ভাবের ঘোরে ঘুরে এলে? টাকা তুলেছি কিনা দেখতে পাওনি?

ঋষভের সম্বিত ফিরল। সে মাথা নীচু করে থাকল। বুঝতে পারল যুবতি তার সামনেই আসা অবধি দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাবনার ঘোরে ডুবেছিল এতক্ষণ। মাথা চুলকাতে চুলকাতে লাজুক হাসি হেসে বলল,

– টাকা তুলবেন না ম্যাডাম?

– না। তুমি আমাকে সারাক্ষণ ম্যাডাম, ম্যাডাম করো কেন? আমি তোমার বসও নই দণ্ডমুণ্ডের কর্তাও নই।

– তা নন কিন্তু আমরা সব কাস্টমারকে স্যার বা ম্যাডাম বলে সম্বোধন করি। আজকাল তো অনেক সবজিওয়ালাও খরিদ্দারকে স্যার বলে। সুবিধাও কম নয়, সব ভাষাভাষি লোকেদের একটি শব্দ দিয়েই জুড়ে দেওয়া যায়। খরিদ্দাররাও খুশি হয়।

– ঋষভ, তুমি বেশ গুছিয়ে কথা বলো তো। একটা কথা বলবে?

– বলুন ম্যাডাম।

– আমি এই এটিএমটায় প্রায় দু’আড়াই বছর ধরে নিয়মিত আসি। তোমার সাথে আমার সম্পর্কও বেশ ভালো অথচ তুমি আমার নাম পর্যন্ত জানতে চাওনি কখনও। কেন?

– পেশাগত কারণে আমরা কোনও খরিদ্দারের প্রতি অহেতুক উৎসাহ দেখাই না। যদি না সন্দেহজনক কিছু থাকে।

– আমার নাম জানতে তোমার ইচ্ছা হয় না ঋষভ?

সে মাথা নীচু করে। কী বলবে? শুধু নামই বা কেন আরও অনেক কিছু জানতে ইচ্ছা হয়। অথচ সে তো জানে বাতুলতার পরিণতি কী ভয়ংকর হতে পারে। অভাবী সংসারে ঠেকা দেওয়া সামান্য চাকরিটার ভবিষ্যৎ বিপন্ন হতে পারে। তার দিকে তাকিয়ে থাকা মুখগুলোর কথা ভেবে সে কখনও অতটা মরিয়া হতে পারবে না। ঋষভ তার সীমার গণ্ডি ভালো করে জানে।

মৃদুস্বরে যুবতি বলল– আমি মেয়েমানুষ। আমরা পুরুষদের না বলা কথা বুঝতে পারি। চোখের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ঋষভ, আমাকে তোমার ভালোলাগে?

অপ্রত্যাশিত প্রশ্নের অভিঘাতে ঋষভ চমকে উঠল। অন্ধ আবেগে অনেক কথা বলতে চেয়েছে সে কিন্তু বলা হয়নি কখনও। নিয়ন জ্যোৎস্না মাখা যুবতির মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলল– আপনি এলে দু’টো কথা বলে প্রাণ বাঁচে। মনে হয় কেউ অন্তত আমাদের মানুষ ভাবে।

যুবতি মেয়েটি ঠোঁটে কমনীয় হাসি ঝুলিয়ে বলল আজ আমি টাকা তুলতে আসিনি। তোমাকে নিতে এসেছি। চলো আমার সঙ্গে।

– আমি! ডিউটি ছেড়ে কোথায় যাব? কেন যাব? আপনি কি জানেন আমাদের চাকরি কত ঠুনকো?

– হ্যাঁ, তুমি আমার সঙ্গে যাবে। কলকাতার কত এটিএম-ই তো নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া অরক্ষিত থাকে। তুমি এক রাতের জন্য শুধু আমার সঙ্গে হারিয়ে যাবে। তোমার ক্লান্তি থেকে মুক্তি।

– কিন্তু কেন যাব?

– সব কথা এখানে বলা হয়ে গেলে রাতভর কী বলব তোমার সাথে। তোমার চাকরির কোনও সমস্যা হলে আমি দেখব। আর কথা নয়। ঋষভ, গাড়িতে ওঠো।

ঋষভের মনে হল সামনে দাঁড়িয়ে নারী মরীচিকা। তবু নারীর ডাকে তার জাটিঙ্গা পাখি হতে ইচ্ছা হচ্ছে। হয়তো পুড়ে, পালক নিকষ কালো হয়ে যাবে। কিন্তু সে মনের থেকে কিছুতেই মায়াটান কাটাতে পারছে না। ঐন্দ্রজালিক জাদুকাঠিতে সম্মোহিত মানুষের মতো অচেনা যুবতির পিছু পিছু ঋষভ গাড়িতে উঠল।

জ্যোতি বসু নগরী দিয়ে গাড়ি ছুটছে এয়ারপোর্টের দিকে। তীব্রবেগে পিছনে ছুটে যাচ্ছে এক একটি বাতিস্তম্ভ। যুবতির হাতে স্টিয়ারিং, গাড়িটি যেন পক্ষীরাজ ঘোড়া। তার মুখে ঝুলে মৃদু হাসি। চোখেমুখে উচ্ছ্বাস। সত্যিই আজ একই দিনে অনেকগুলো পালক জুটেছে তার ঝুঁটিতে। গাড়ি এসে দাঁড়াল নীল আলো মাখা অনিমিখ-এর এইচআইজি কমপ্লেক্স-এ।

ড্রয়িংরুমে একা বসে আছে ঋষভ। খানিকটা জড়োসড়ো হয়ে একটি সোফার মধ্যে প্রায় ডুবে আছে সে। এমন আধুনিক সাজানো-গোছানো ফ্ল্যাটে আগে কখনও আসেনি। দামি আসবাবপত্রে পরিকল্পিত সাজানো ঘরদোর, ফ্ল্যাটের এমন রুম ঋষভ দেখেছে টিভি-তে, সিনেমায়। গোটা ঘরটায় ইন্টেরিয়র ডিজাইনারের পেশাদারিত্বের ছোঁয়া। কিন্তু ঘরটা প্রাণহীন অচঞ্চল। বাড়িতে বোধহয় মালকিন বাদে আর কেউ থাকে না। তালা খুলে তারা দু’জনে রুমে ঢুকেছে। ঋষভকে ড্রয়িং রুমে বসতে বলে মেয়েটি চলে গেল অন্দরমহলে। অন্দরমহল মনে আসতেই ঋষভের মনে হল তার ভাবনার মধ্যে একটা প্রাচীন বনেদি বাড়ির ছায়া আছে। ফ্ল্যাট তেমনটি কেমন করে হবে? ফ্ল্যাট মানেই তো কয়েকটি ঘরের সমষ্টি। বেশি হলে ডাইনিং, ড্রয়িংরুম। অবশ্য ছোটো বড়ো সব ফ্ল্যাটেই ডাইনিং, কিচেন, বাথরুম থাকে। এ বাড়ির ভিতর সে আন্দাজ করতে পারছে না। যুবতি হয়তো সারাদিনের ক্লান্তির আভরণ ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। তার পোশাকটা কী হবে? ভাবতেই ঋষভের গা ঘিনঘিন করে উঠল। নিজের শরীরে এখনও সারাদিনের ডিউটি করা ইউনিফর্ম। ইউনিফর্মে সিকিউরিটি এজেন্সির ব্যাচ। মানুষটার পরিচয় আটকে আছে শুধুমাত্র এজেন্সির লোগোতে। ঘরের ম-ম করা সুবাসকে ছাপিয়ে যাচ্ছে নিজের জামা প্যান্টের বাসি দুর্গন্ধ। তার অস্তিত্ব কী? তার অস্বস্তি ক্রমিক হারে বেড়ে যাচ্ছিল ঘরময় আভিজাত্যের নিস্তব্ধতায়। তার অস্তিত্বহীন অস্তিত্বের সংকটে।

ডোরবেল বেজে উঠল। ঋষভ ভাবছিল খুলবে কি খুলবে না। তখনই ড্রয়িংরুমে বেরিয়ে এল যুবতি। সাদা রঙের হাফ প্যান্ট আর উপরে টপ্ পরেছে। আধুনিকা মেয়েটির আয়নায় নিজেকে দেখে ঋষভ আরো গুটিয়ে গেল। দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটি জিজ্ঞেস করল,

– কে?

বাইরের থেকে উত্তর এল – হোম ডেলিভারি ম্যাডাম।

দরজা খুলে সে বলল, – ডাইনিং টেবিলে রেখে যাও।

সাদা রঙের হোটেল ইউনিফর্ম পরা একটি লোক পলি-প্যাকেটে খাবার হাতে ঋষভের সামনে দিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে চলে গেল। লোকটা তার দিকে কোনও আগ্রহ দেখাল না। তার দিকে একবার তাকিয়ে ডাইনিং রুমে ঢুকে গেল। মনে হল অভ্যস্ত চোখ। ডাইনিং রুমের দিকে যেতে যেতে মালকিন লোকটিকে জিজ্ঞেস করল,

– ক্যাসা লাপোসতোলে পেয়েছ?

– হ্যাঁ, ম্যাডাম। ম্যানেজার অনেক ফোনাফোনি করে জোগাড় করেছে। ওয়াইনটা জোগাড় করা খুব কঠিন। খাবার সার্ভ করে দেব ম্যাডাম?

– না, থাক। তুমি এখন এসো।

– গুড নাইট ম্যাডাম। পেমেন্ট নিয়ে ডেলিভারি বয় চলে গেল। সে চলে যাওয়ার পর গৃহকর্ত্রী একটা বারমুডা আর টি-শার্ট এনে বলল– ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসো।

পুরুষহীন বাড়িতে পুরুষদের পোশাক দেখে ঋষভ একটু অবাকই হল।

– কিন্তু আমাকে কেন ডেকে এনেছেন? সে আবার জানতে চাইল।

– ঋষভ, সব কথা হবে। আগে তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো। দেরি হলে খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে। মাইক্রোওভেন অন করো, খাবার গরম করো, ওসব পারব না। এই উঠে পড়ো তো শিগ্গির।

ডাইনিং টেবিলে তারা দু’জন মুখোমুখি বসেছে। যুবতিটি কাচের গ্লাসে ওয়াইন ঢালতে ঢালতে ঋষভকে বলল – গোমড়া মুখে থেকো না। তুমি এখনও আমার নাম জানতে চাইলে না।

– হ্যাঁ ম্যাডাম, আপনার নাম জানা হয়নি।

– আমি হিমিকা। হিমি বলে ডাকতে পারো। আমি খুশিই হব। আজ রাতে তুমি আমার অতিথি।

– কিন্তু আমাকে ডিউটি থেকে তুলে আনার উদ্দেশ্যটা কী?

হিমিকা ঋষভের নীল চোখের দিকে তাকিয়ে থাকল। ঋষভের নীল চোখের মায়াজাল তাকে পাগল করে দেয়। অথচ কোনও দিন সামাজিক অবস্থানের খাতিরেই প্রকাশ করতে পারেনি। ঋষভকে দেখলে তার মনে হয় ইউরোপীয় রক্ত বইছে তার ধমনিতে। টিকোলো নাক আর রেশমি চুলে ঋষভ গড়পড়তা ভারতীয়দের থেকে কোথায় যেন আলাদা। চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ঋষভের বুঝতে অসুবিধা হল না রাত কুহেলিকা হিমিকা কি ভাবছে। তাকে ঘিরে এমন ভাবনা অনেকেরই হয়। তারা ঋষভের মধ্যে আভিজাত্যের যোগসূত্র খুঁজতে চায়। এখানেই সবাই ভুল করে বসে। সেই অর্থে শিক্ষাদীক্ষা বা ধনসম্পত্তির উত্তরাধিকার তার নেই বা বিখ্যাত পূর্বপুরুষের রেখে যাওয়া কোনও সংরক্ষিত উত্তরণপথ। হিমিকা তার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কৌতূহল আর চাপতে পারল না – ঋষভ, তুমি কোথায় পেলে এমন ব্লু আই?

– জানি না ম্যাডাম।

– আবার ম্যাডাম বললে! আমি বলছিলাম, তোমার বাবা-মা কার চোখ এমন নীল?

– আমার বাবা-মা’র চোখ আপনার মতো গভীর কালো। তবে লোকে মশকরা করে বলে আমার শরীরে নাকি ইউরোপীয় রক্ত বইছে।

– তাই নাকি? হিমিকা নিজের কল্পনার সমর্থন পায়।

– আমি একটি মফসসল শহরের ছেলে। কোনও কোনও শিশু এখনও চোখ কটা-নীল, ফর্সা চামড়া নিয়ে জন্মায় ওখানে। কোনও এক সময়ে ফরাসি বেনিয়া রক্ত মিশে গিয়েছিল কয়েক পুরুষ আগের মহিলাদের জঠরে। এখনও তলে তলে ধারা বইছে। সুযোগ পেলেই জিন থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসে বেনিয়াদের লালসার ফল। রং যাই হোক না কেন এ তো একধরনের উপজাতপ্রাপ্তি।

– নিজেকে ওভাবে ভাবছ কেন? চেহারা তো মানুষের সম্পদই। শুধু জানতে হয় সম্পদের সদ্ব্যবহার। নারীমন বোঝ ঋষভ? বলতে বলতে বাঁহাতে ঋষভের হাত চেপে ধরল হিমিকা। অন্য হাতে গ্লাস ভরিয়ে দিল নীল মদিরায় – কাছে এসো ঋষভ। আজ রাতে তোমার আগুনে আমাকে গলিয়ে দাও লাভার মতো। স্রেফ্ তোমাতে ভাসার জন্য তোমাকে এমনভাবে নিয়ে এসেছি। আমি আর পারছি না ঋষভ। হিমিকা উঠে গিয়ে ঋষভকে জড়িয়ে ধরে পাগলের মতো ঠোঁটে চুমু খেতে লাগল। মদিরার নীল নেশায় ঋষভ ক্রমশ ডুবে গেল তার নারীক্ষুধার কাছে। যাবতীয় পৌরুষত্বের সংযম ভেসে গেল বাঁধভাঙা জলোচ্ছ্বাসে।

গড়ে ওঠা জ্যোতি বসু নগরে অর্ধেক আকাশ জুড়ে অর্ধেক চাঁদ। পড়ে থাকা ফাঁকা জমি রাতের আঁধারে বিষন্নতায় ঢাকা। দাঁত মুখ খিঁচোনো নির্মীয়মান বাড়িঘর রাতের কোটরে কেমন নির্জীব। রাত দ্বিপ্রহরে বিমানবন্দরগামী বাবুদের গাড়ি উল্কাপাতের মতো ছুটে যাচ্ছে। ঋষভের অনুরোধে জানালা খুলেছে হিমিকা। হিমিকার ঘর রৌদ্র ছোঁয় না বা বলা যেতে পারে এসি ঘরে সে জানালা খোলার তাগিদ অনুভব করে না। খোলা জানালা দিয়ে রাতের নরম হাওয়া তেরো তলার ঘরে ঢুকছে। জানালার পাশে বসে আছে দুই আদিম নরনারী। দিদির বয়সি হিমিকাকে আরও বুকের কাছে টেনে এনে ঋষভ বলল – শুধু এ জন্যই আমাকে ডেকে এনেছ?

– আজ আমার প্রাপ্তির দিন, ভোগের দিন।

– ভোগের দিন না হয় বুঝলাম কিন্তু ভোগেই কি প্রাপ্তি ঘটে?

– না, আনন্দ উপভোগের এটা একটা দিক। প্রাপ্তি অন্য জায়গায়। আমি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর পদে প্রোমোশনের চিঠি আজই হাতে পেয়েছি।

– সত্যিই আনন্দের দিন তোমার হিমি।

হিমিকা বাইরের দিকে তাকিয়ে কেমন উদাসীন হয়ে গেল। নিশ্চুপে কেটে গেল অনন্ত প্রহর। তাকে ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে ঋষভ ডাকল, – হিমি।

– ও হ্যাঁ, বিনিময়ে আমাকে দিতে হয়েছে কত জানো?

– না, আমি কী করে জানব? আমার জানার পরিধি শুধু আট ফুট বাই বারো ফুট ঘর।

– আমি কাজ করি একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। চাকরিতে ঢোকার দিন থেকেই কোম্পানি টার্গেট বেঁধে দেয়। টার্গেটে পৌঁছোও তো টিকে থাকো। না পৌঁছোও তো পিছনে ঘন্টাধবনি– কেটে পড়ো। কেটে পড়ো। লক্ষ্যে পৌঁছোলেও নিস্তার নেই। টার্গেটের পরিধি আরও বেড়ে যাবে। সামনে খুঁড়োর কলের মতো অনেক রঙিন স্বপ্ন। গাড়ি, বাড়ি, পয়সা ওড়ানো ক্লাবের মেম্বারশিপ, বিদেশ ভ্রমণ এমন অনেক রঙিন ফানুস। সামনে ঝোলানো একটি মাত্র টোপ প্রোমোশন। আখের ছিবড়ার মতো রক্তশূন্য অবস্থায় জিভ বের করে কেউ সত্যি সত্যিই হয়তো পৌঁছাবে চূড়ায়। আবার এমনও হতে পারে যার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে সে হয়তো ঘোড়সওয়ারদের মধ্যেই নেই। সেখানে অন্য সমীকরণ, অন্য কেউ। বুঝলে ঋষভ, এই ডার্ক হর্সকে কেউ চেনে না। কিন্তু সে-ই জয়ী হবে। আমি জোকা থেকে ম্যানেজমেন্টে পিজি করে এখানে ঢুকেছি। তখন আমার কত আর বয়স হবে? পঁচিশের নীচে। এখন? না থাক, মেয়েদের বয়স গুপ্ত থাকাই ভালো। আমাকে দেখে তোমার যত বয়স মনে হয় ধরে নাও সেটাই আমার বয়স। চূড়ায় পৌঁছানোর জন্য বিয়ে করার সময় বের করতে পারিনি। এ তো এক ধরনের নেশা। প্রথম প্রথম সম্পদের মোহ টানে। তারপর বলতে পারো ক্ষমতা, পজিশনের মোহে মানুষ অন্ধ হয়ে যায়। তখন সমাজ টমাজ কাউকে চিনতে চায় না। ছোটে, দমবন্ধ করে নিজেকে বাজি রেখে ছোটে। আমিও ছুটেছিলাম। বেশ কয়েক বছর ধরেই আড়াই হাতের মধ্যে ফসকেই যাচ্ছিলাম। অথচ আমার পারফর্মেন্স, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বা নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতার মধ্যে কোনও ঘাটতি ছিল না। বেশ কয়েক জন অযোগ্য লোকও আমাকে সুপারসিড করে গেল। আমার দুর্বলতা নিয়ে অনেক ভেবেছি আর হতাশায় ডুবে যাচ্ছিলাম। মানসিক অবসাদে রাত আমাকে সর্ব অর্থে গ্রাস করে নিত। একাকিত্ব, অবসাদ সব কিছু থেকে মুক্তি পেতে প্রতি রাতে আমি তুলে আনতাম পেশাদার জিগোলোদের।

ঋষভ আবছা আলোয় হিমিকার মুখের দিকে তাকাল। অনেক ইংরাজি শব্দই তার বোধগম্য নয়। জিগোলো শব্দটা তার কানে ঠকাস করে লাগল। মুখে কিছু বলল না।

হিমিকা আবার বলতে শুরু করল – পরে আমি বুঝেছি রোগটা মনের, শরীরের নয়। রাতের অতিথিরা কী করবে? একদিন মরিয়া হয়ে দেখা করলাম ম্যানেজিং ডিরেক্টর-এর সাথে। তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলাম,

– স্যার, হোয়াট ইজ মাই ডেফিসিয়েন্সি টু গেট প্রমোশন?

সে রিভলবিং চেয়ারে মৃদু দুলে দুলে বলল– ইউ আর দ্য মোস্ট এফিশিয়েন্ট অফিসার। কিন্তু মিস্ ব্যানার্জী যোগ্যতাই কি সব উন্নতির মাপকাঠি? পৌরাণিক যুগ থেকেই চলে আসছে বিনিময় প্রথা। কিছু পেতে গেলে কিছু দিতে হয়।

– আমাকে কী দিতে হবে?

– ইউ আর অ্যান ইনটেলিজেন্ট বিউটিফুল গার্ল। ইউ ক্যান হ্যাভ আ সলিটরি মিটিং টু ডিসাইড ইয়োর ফিউচার। মিস্ ব্যানার্জী, একটা সিদ্ধান্তে জীবনের মোড় ঘুরে যেতে পারে।

এমডি একটা বুড়ো ভাম। ওর লালসার চোখ দেখে আমার গা ঘিনঘিন করে উঠেছিল। কিন্তু পরক্ষণে মনে হল শরীরের সতীত্ব কি আমার আছে? আমি তো পয়সার বিনিময়েই কামনা হতাশা ঝলসাই প্রতি রাতে। আর একদিন বুড়োর সাথে নির্জন অবসর কাটালেই যদি খুলে যায় উন্নতির সিঁড়ি, দোষের কি? ঋষভ, সাফল্য অবশেষে এসেছে। আজ রাতে তুমি আনকোরা আলট্রা ফ্রেশ উত্তাপে আমাকে পাগল করে দিয়েছ। ইউ আর ট্রুলি…।

ঋষভ হাঁ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হিমিকাকে তার অত্যাশ্চর্য মনে হয়।

সকাল সাড়ে আটটা। ঋষভ চালক আসনের পাশে বসতে গেল। হিমিকা তাকে বলল

– পিছনের সিটে বসো। হিমিকা গাড়ি চালাচ্ছে। আর একটাও কথা বলল না ঋষভের সাথে। ঋষভ সিকিউরিটি গার্ডের ইউনিফর্মের মধ্যে আরও গুটিয়ে যেতে লাগল। হু হু করে ছুটছে গাড়ি। গাড়িটা এসে থামল এটিএম-এর সামনে। ঋষভ নেমে চালক আসনের কাছে এসে বলল – আর কি দেখা হবে?

হিমিকা তার সামনে এগিয়ে দিল একটা প্যাকেট

– এটা ধরো।

– কী আছে এতে?

– তোমার রাতের চার্জ।

– সে কি হিমি, তুমি আমাকে টাকা দিচ্ছ!

– আমি বিনা পয়সায় কাজ করাই না। খুশি হয়ে অন্যদের থেকে একটু বেশিই দিয়েছি।

– ম্যাডাম, আমি…।

ঋষভ কথা শেষ করতে পারল না। গাড়ির চাকা গড়াল। তার চোখের সামনে গাড়িটা দ্রুত অদৃশ্য হয়ে গেল। হাতের মুঠোয় টাকার প্যাকেট নিয়ে কাঁদবে না ছুড়ে ফেলবে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না ঋষভ। তার হাত-পা কেমন অসাড় মনে হল।

এটিএম-এ ঢুকতে বাধা পেল সে – সারা রাত কোথায় ছিলে? যমদূতের মতো সামনে দাঁড়িয়ে সিকিউরিটি সুপারভাইজার। জাঁদরেল গোঁফের নীচে কঠিন কঠোর চেহারা। সে প্রাক্তন সেনাকর্মী। চাকরি থাকার সময় যা না গোঁফের বহর ছিল এখন বুড়ো বয়সে আরো পোক্ত হয়েছে। বুড়োকে আড়াল আবডালে সিকিউরিটি গার্ডরা বলে ঢ্যাঁড়স। সেই সিকিউরিটি সুপারভাইজার যে কত ভয়ংকর হতে পারে তা হাতেনাতে টের পাচ্ছে ঋষভ।

সুপারভাইজার গোঁফে পাক দিতে দিতে বলল,

– রাত বারোটায় আমি রাউন্ড আপে এসেছিলাম কিন্তু এটিএম খোলা হাট। তোমার দেখা নেই। বুঝেশুনে বড়ো নৌকায় পাল তুলেছ ভাই। তবে উড়ে উড়ে মধু খাবে আর সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করবে, দু’টো একসাথে তো হবে না। এই ধরো তোমার টার্মিনেশন লেটার। আর ডুবে ডুবে জল খেতে হবে না।

ঋষভের চাকরিটা ঠুনকো চুড়ির মতো চলে গেল।

।।২।।

– ঋষভ, কেমন আছ?

সে প্রথমে হতচকিত হয়ে গেল। ভদ্রমহিলার মুখের দিকে তাকিয়ে চিনতে পারল – ম্যাডাম, আপনি এখানে? টাকা তুলতে এসেছেন?

– না, টাকাপয়সা নয়। তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে দু’বছর কেটে গেছে। কাল হঠাৎ আবিষ্কার করলাম তুমি এটিএম-এর সামনে দাঁড়িয়ে আছো। তখনই আসতাম কিন্তু কোন মু্খে তোমার সামনে দাঁড়াই? কালকে সাহস পাইনি। রাতভোর নিজের সীমাহীন অপরাধের কৈফিয়ত দিতে হয়েছে মনের কাছে। হতাশা বা উন্নতির সর্পিলরেখার দোহাই দিয়েও আমার কর্মের কোনও সদুত্তর দিতে পারিনি। তবু মরিয়া হয়েই তোমার কাছে এসেছি। তোমার গভীর নীল চোখের সরলতার কাছে আমি আগেই হেরেছি ঋষভ।

– ম্যাডাম, এখন আমি ডিউটিতে আছি। কাল ডে-শিফটে ডিউটি। চাইলে সন্ধ্যায় আমি আপনার ফ্ল্যাটেও যেতে পারি। দেয়ার উই ক্যান নেগোশিয়েট দ্য ডিল।

বিস্মিত চোখে ঋষভের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল হিমিকা খানিকক্ষণ। তারপর বলল– আমার ফ্ল্যাটটা একটা শয়তানের গুহা। আমি চাই না ওখানে আর আমাদের এভাবে দেখা হোক। ফোন নম্বর বলো, কথা বলে মিটিং প্লেস ঠিক করব।

প্রিন্সেপঘাটে আগেই এসে বসে আছে হিমিকা। বিকেলের পড়ন্ত সূর্যের আলো খানিকটা কেটে কেটে পড়ছে জেমস প্রিন্সেপ-এর স্মৃতিসৌধের উপর। খোদ কলকাতায় বিজ্ঞানপ্রযুক্তির বিদ্যাসাগর সেতু আর ঐতিহাসিক স্থাপত্যে সূর্যের আলোর আচ্ছন্নতা ভেঙে দিল ঋষভ – হাই ম্যাডাম, হাউ লং? ঋষভ এসেছে। কালো গেঞ্জি-জিন্স আর পায়ে নর্থস্টার শু-তে তাকে শার্প-স্মার্ট লাগছে।

হিমিকা বলল – অনেকক্ষণ। নির্ধারিত সময়ের বেশ খানিকটা আগেই।

– তা বলুন ম্যাডাম, কেন আমাকে খুঁজছেন।

– আমি জানি ঋষভ, তোমার প্রতি আমি অন্যায় করেছি। পেশাগত জীবনে যেখানেই পৌঁছাই না কেন, আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নেই– আমি ক্লেদাক্ত। তবু ভিতরে ভিতরে তোমার জন্য আমি দুর্বলতা অনুভব করি। আমার মনে হয়েছে তুমিই পারো আমাকে ফিরিয়ে আনতে। আমাকে একটু আশ্রয় দেবে ঋষভ?

– ম্যাডাম, টু ইয়ার্স ব্যাক আই হ্যাভ বিন অ্যান ইনোসেন্ট ইয়ুথ। কিন্তু আপনি আমার সামনে অনেকগুলো রাস্তা খুলে দিয়েছিলেন। আয়ের রাস্তা আর নরকের রাস্তা। বাস্তবে আপনি ছিলেন আমার প্রথম খরিদ্দার। কৃতজ্ঞতা বোধ থেকে বিনা পয়সায় আজ বিকালে আপনার সাথে সঙ্গ দিতে এলাম। যদিও আমার সঙ্গদান থেকে বেডরুম শেয়ারের আলাদা আলাদা রেট আছে। তা বলতে পারেন দু’বছর আগের থেকে রেটটা একটু হাই। আর প্রোফাইল বুঝে রেট হেরফের হয় বটে। হাজার থেকে দশ হাজার। এখন অন-লাইনে শরীর বিকিকিনি হয়। রাস্তায় না দাঁড়িয়েও ঘরে বসে ডিল হয়। হাতে একটা সেলফোন – ব্যস যৌনতার জগৎ হাতের মুঠোয়। একান্ত প্রয়োজন হলে স্টাইলিশ কালো ব্যান্ড হাতে চিরাচরিত পদ্ধতিতে পথের পাশে রেলিং-এ এসে ইশারাময় শরীর খোঁজা। কেউ কেউ বোল্ড পত্রমিতালির বিজ্ঞাপন দেয়। আপনার মতো মেয়েদের কাছে বিজ্ঞাপনের বক্তব্য মানে অন্য কিছু। তাই না?

– ঋষভ! একি কথা বলছ?

– ওকে। আই নো ইউ ক্যান্ট অ্যাকসেপ্ট মি লাইক দিস। আপনি সেই সরল নীল চোখের ঋষভকে খুঁজছেন। সে তো আর নেই। আপনি কি কখনও জানতে চেয়েছেন আমি কেমন আছি?

হিমিকা মাথা নীচু করে রইল। এমন প্রশ্নের সামনে তাকে পড়তে হবে তার কল্পনায় ছিল না। সে বলল – আমার নেশা কাটতে বেশ খানিকটা সময় লেগেছিল। তারপর যখন ফিরে এলাম তখন তোমার বদলি হয়ে গেছে। পাগলের মতো রাস্তার অলিগলিতে কোথায় খুঁজিনি তোমায়?

– আপনি ভুল শুনেছেন। আমার বদলি হয়নি। কর্তব্যে অবহেলার জন্য সিকিউরিটি গার্ডের সামান্য চাকরিটা চলে যায়। মাস গেলে ন্যূনতম মজুরি আর ওভারটাইম মিলিয়ে চার-পাঁচ হাজার টাকা আসত। এক রাতের ফুর্তির ধাক্বায় তা বন্ধ হয়ে গেল। একটা অভাবের সংসারে হঠাৎ চার-পাঁচ হাজার টাকার রোজগার বন্ধ হয়ে গেলে তার অভিঘাত কত ভয়ংকর হতে পারে ভাবতে পারেন ম্যাডাম?

হিমিকা কোনও উত্তর খুঁজে পেল না।

– আমি জানি আপনি কোনও দিন এতটা মাপা জীবন দেখেননি। আমার সেই অর্থে কোনও যোগ্যতা বা বিদ্যা নেই যা দিয়ে তৎক্ষণাৎ কিছু একটা জুটিয়ে নিতে পারতাম। ভালো থাকার ইচ্ছা আছে সব মানুষের কিন্তু ভালো থাকার রসদ উপার্জনের মুরোদ নেই অধিকাংশ মানুষের। অনেকে তাই চাহিদাপূরণের সহজ পথ বেছে নেয়। অপরাধের উৎসভূমি বিস্তৃত হয়। আমারও হয়েছিল। তখন আপানার কথা মনে পড়ে গেল। আমার নীল চোখে নাকি নারীহূদয় বশ করার জাদু আছে। চেহারার সদ্ব্যবহার জানলে নাকি আয়ের রাস্তা খুলে যায়। আপনার কাছেই প্রথম শুনেছিলাম জিগোলো শব্দটা। তখন মানে জানতাম না। কিন্তু রাতের শয্যাসঙ্গী হওয়ার বিনিময়ে আপনি আমাকে টাকা দিয়েছিলেন। তাই একটা ভাবার্থ মনে হয়েছিল। অভিধানে জিগোলোর মানে প্রৌঢ়া বা বৃদ্ধা স্ত্রীলোকের অর্থপুষ্ট তরুণ প্রণয়ী। আমার শরীর আছে – যৌবন আছে, তা হলে ক্ষুধার কাছে মার

খাওয়া কেন?

– ঋষভ!

– জানেন, প্রথমে জানতাম না কারা জিগোলো। কোথায় থাকে তারা। কোন মেয়ে পয়সার বিনিময়ে যৌন সঙ্গী খুঁজছে। শুধু একটা সিনেমা থেকে জেনেছি পার্ক স্ট্রিট জিগোলোদের স্বর্গরাজ্য। তারা হাতে কালো রুমাল বাঁধে। একদিন সত্যি সত্যিই কালো রুমাল বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়লাম পার্ক স্ট্রিটে। কিছু সময় যেতে না যেতে কয়েকটা ছেলে আমাকে ঘিরে ধরল – এখানে কী চাই?

আমি ঘাবড়ে গেলাম– না মানে…

হো হো করে হেসে উঠল তারা – মুরগি, …কক্-কক্। ব্লাডি হোর, উড বি মেল এসকর্ট। পার্ক স্ট্রিট শুধুমাত্র ক্যালকাটা জিগোলো ক্লাব সদস্যদের জন্য। হেই রাসটিক গাই, এখানে ফের এলে বটল শুদ্ধু নিপল ধরিয়ে দেব। তারা আমাকে প্রায় ঘাড় ধাক্বা দিয়ে পার্ক স্ট্রিট থেকে তাড়িয়ে দিল। চকচকে লালটুস চেহারার যুবকের দল। বেশভূষায় হিপি হিপি ভাব। অনর্গল ইংরাজিতে কথা বলে। ফিরে এলাম সেদিন। কিন্তু পেটে খিদে থাকলে পশুরা বিপদ অগ্রাহ্য করেও ফিরে আসে, আমাকেও ফিরতে হয়েছিল। পরদিন থেকে দাঁড়াতে শুরু করলাম পার্ক স্ট্রিটের আশেপাশে। কখনও ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটে, কখনও লিনডসে স্ট্রিটে। ক’দিন যেতে না যেতে আমার মতো ছুটকো পাবলিকদের চিনতে শুরু করলাম। শহরের রাস্তা সবার অথচ ভিতরে ভিতরে করে খাওয়ার এলাকা ভাগ থাকে। প্রথম প্রথম এরাও আমাকে এক চুল জায়গা ছাড়তে চায়নি। কিন্তু সমস্যাটা কি জানেন ম্যাডাম?

– কী? হিমিকা শুকনো গলায় জানতে চাইল।

– কে বা কারা খরিদ্দার তাই চিনি না। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আঠারো থেকে পঞ্চান্ন বছরের মহিলাদের মনে হতো প্লেবয় খুঁজছে। আবার তাদের বেশভূষা চাল-চলনে ভড়কে যেতাম। আমার মফসসল শহরের গাঁইয়া চেহারা প্রকট হয়ে উঠত। একজন বয়স্ক জিগোলোর সাথে পরিচয় হল। সে বলল – তুমি ভাই সারা জীবন বঁড়শিতে একটাও গাঁথতে পারবে না। এ তো মাছ নয় যে ফাতনা ডুবিয়ে তোমায় টেনে নেবে। এদের পেটে খিদে নেই। চোখে খিদে। শরীর অভুক্ত। তোমাকে চোখের অভুক্ত  চাহনি পড়তে হবে। চালচলনে চেকনাই চাই। অর্ধেক কথা হবে চোখে চোখে।

– তুমি দুষ্টু লোকটার কথা শুনে পালটে গেলে ঋষভ?

হায় ভগবান!

– আমার তো কোনও ভার্জিনিটির অহংকার ছিল না। তা আপনার কাছে আগেই খুইয়েছি। আমার দরকার ছিল একজন অভিজ্ঞ লোকের টিপস। লোকটার পরামর্শে ইংরেজি শিখতে লাগলাম। আর সামর্থ্যের মধ্যে সাজগোজ পালটে ফেললাম। মানুষের পোশাক এক ধাক্বায় বদলে দেয় অনেকটা। একটু ব্যক্তিত্ব যোগ করতে পারলেই কেল্লাফতে। ওর পেশাগত নাম পিটার। পিটার আমাকে ইন্দ্র, ইন্দ্রজিৎ বলে ডাকত। বলত – পুরুষরা সব সময় ইন্দ্রর মতো। যা পেতে ইচ্ছা হয় তা যেনতেনপ্রকারেণ আদায় করে নেবে। নারীকে জয় করায় কোনও পাপ নেই। পুরুষ বহুগামী। যথা সময়ে ঋষি হয়ে গেলেই হল। পৌরাণিক যুগ থেকে পুরুষরা এরকমই স্বার্থপর আত্মকেন্দ্রিক সাধু। প্রথম প্রথম পিটার আমাকে দু’চারটে খরিদ্দার ধরে দিত। তবে কমিশনের ব্যাপারে পিটারের কোনও আপস নেই। অন্যের গতর খাটানো পয়সা কে না খায়। হোটেল ম্যানেজারগুলো এক একটা তিলে খচ্চর। ফরেনারদের সাথে মোটা টাকার ডিল হয়। আমরা পাই সামান্যই। ম্যানেজার হারামিগুলো মেরে দেয় সিংহভাগ।

– ঋষভ, আমার আর শুনতে ভালো লাগছে না।

– ফিরে যখন এসেছেন তখন কষ্ট করে না হয় একটু শুনলেন ম্যাডাম। এখন আমি সমাজের উচ্চবিত্ত মহিলাদের সাথে কাজ চলার মতো কমিউনিকেটিভ ইংলিশ শিখেছি। আঠারো থেকে পঞ্চান্ন বছরের স্টুডেন্ট, ওয়ার্কিং লেডি, হাউস ওয়াইফ, উইডো, ডিসস্যাটিসফায়েড লেডি– সবাই আমাদের খরিদ্দার। আইটি সেক্টরের অনেক ওয়ার্কিং লেডি আজকাল আর লিভ টুগেদারের ঝামেলাও চায় না। তারা সব ফ্যান্টাস গাইদের হায়ার অ্যান্ড ফায়ার করতে অভ্যস্ত। টাকায় রেডিমেড আনন্দ পেলে কে পোহায় হ্যাপা-বিয়ে-শাদি-লিভ টুগেদার-এর? সবাই মেতে থাকতে চায় সেল্ফ-অ্যাপোতে। নিজেকে নিয়ে মেতে থাকা। সংসার নামক সনাতনী জোয়ালটি কে বইতে চায়? পিটার আমাকে পিএসএল পদ্ধতি-র মতো আধুনিক এবং পৌরাণিক কামসূত্র শিখিয়েছে। নাও আই নো দ্যা আর্ট অফ স্যাটিসফায়িং ওমেন।

– চুপ করো, চুপ করো। আমি আর শুনতে চাই না।

– আমি আবার একটা সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি নিয়েছি। এজেন্সি আমার অনুরোধে পার্ক স্ট্রিটের এটিএম-এ পোস্টিং দিয়েছে। বলতে পারেন এই পোস্টিংটা আমার সোনায় সোহাগা হয়েছে। প্রতিদিন ইভিনিং ডিউটি করি আর এটিএমের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি উপোসি চোখের খোঁজে। চাকরিটা এখন আমার গৌণ আয়ের জায়গা, তবু ইউনিফর্মে ঢেকে রাখি নষ্ট আমিটাকে। আর কিছু খরিদ্দার ছাড়া ইন্দ্রজিৎকে কে চেনে বলুন? ম্যাডাম, আমি এখন শুধু মেয়েদের কামনাময় চোখ খুঁজি। আপনার চোখ এখন স্বাভাবিক। অসুস্থ অস্থিরতা নেই। চোখের অস্থিরতার কাছে আমরা জিগোলোরা বিকিয়ে যাই। কেউ আনন্দ করতে গিয়ে বিকিয়ে যায় – কেউ বা পেটের টানে। আমি জানি না পুরুষ যৌনকর্মী বলে অভিধানে কোনও শব্দ আছে কিনা, বা বেশ্যার পুংলিঙ্গ কী হবে? কিন্তু আমার বলতে দ্বিধা নেই আমি বাস্তবে একজন জিগোলো। প্রয়োজন হলে ডাকবেন, আপনার ক্ষেত্রে অল্প টাকায় কাজ করে আসব। আপনি ফিরে যান ম্যাডাম।

হিমিকা হাঁটুতে চিবুক ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে আছে। তার নিজেকে মনে হচ্ছে সাপ-লুডোর নিরানব্বই-এ সাপে খাওয়া ঘুঁটি। যাবতীয় বিষন্নতা শরীরে ভর করেছে। তবু মরিয়া হয়ে সে ঋষভের হাত জড়িয়ে বলল – বুকের পাথরটা একটু নেমেছে ঋষভ?

– বিষের ব্যথা কখনও নামে?

– তোমার সব দুঃখ যন্ত্রণার ভার আমাকে বইতে দেবে…

– তা হয় না ম্যাডাম। আপনি ফিরে যান। আমাদের আর কোনওদিন না দেখা হওয়াই মঙ্গল। জিগোলোদের কখনও প্রেমে পড়তে নেই। জিগোলো একট ব্যাধি।

হিমিকা ফোঁপাতে ফোঁপাতে দ্রুত পায়ে হাঁটা লাগাল। তার চলে যাওয়া দেখতে দেখতে ঋষভের বুকের মধ্যে হঠাৎ কান্না দলা পাকিয়ে উঠল। মনে হল একটা আলোর বিন্দু এসেছিল। এখন ক্রমশ বিলীন হয়ে যাচ্ছে। তার তীব্র ইচ্ছে হল হিমিকার হাত ধরে নতুন করে বাঁচতে। দৌড়ে গিয়ে পিছন থেকে ডাকতে – হিমি, যেও না। চলো আমরা গঙ্গার পাড় দিয়ে হাঁটি। শুনেছি গঙ্গা সব গ্লানি ধুয়ে দেয়।

 

জলার হাওয়া

পুলিশ দুই প্রকার, ভালো পুলিশ আর খারাপ পুলিশ। সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, সাধারণ মানুষ কখনওই পুলিশকে সুনজরে দেখে না। পুলিশ মানেই যেন খারাপ চরিত্রের। পুলিশের চাকরিতে ঢোকার আগেই শুভ্রজ্যোতি জানতেন এটা। যুবক বয়সে নিজেও থানাপুলিশ এড়িয়ে চলেছেন। চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার সময় বাছাবাছিতে যাননি। কারণ, তখনই চাকরির বাজার বেশ খারাপ। এমনই কপাল, শিকে ছিঁড়ল পুলিশের চাকরিতেই। গুরুজন এবং চেনাজানারা সকলেই বলল, যতই হোক সরকারি চাকরি। এইবেলা ঢুকে পড়।পরে এই চাকরিও দুর্লভ হয়ে যাবে।

জয়েন করে গেলেন শুভ্রজ্যোতি। ট্রেনিং পিরিয়ডে, বিশেষকরে থিয়োরির ক্লাসগুলোতে মনে হতো আমি ভালো পুলিশ হয়ে উঠব। পুলিশের চাকরি যথেষ্ট মর্যাদাকর। কতিপয় খারাপ মানুষ এই চাকরিতে ঢুকে পুলিশের বদনাম তৈরি করে। প্রথম পোস্টিং হল ডক এরিয়ার থানায়। অপরাধপ্রবণ এলাকা। সেই থানাতে একটাও ভালো পুলিশ ছিল না। দু’জন সৎ পুলিশ ছিল। তারা পয়সা খেত না, কোনও কাজও করত না। একেবারে নিস্ক্রিয়। শুভ্রজ্যোতি বসে বসে মাইনে নিতে পারবেন না। অলসতা তাঁর স্বভাবে নেই। কাজ করতে গেলেন, ধরে রাখতে পারলেন না সততা। প্রলোভন এবং পরিস্থিতির চাপের কাছে হার মানলেন। অনেক পুলিশ আছে, যারা হার মানে না। শুভ্রজ্যোতির কাছে তারা প্রণম্য।

সেইসব নমস্য পুলিশদেরও বিশ্বাস করে না সাধারণ পাবলিক। বলাবলি করে, পুলিশ ঘুষ খায় না, তা আবার হয় নাকি! বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কোনওদিন হয়তো বিড়াল মাছ খাওয়া ছেড়ে দেবে। পুলিশ ঘুষ খাওয়া ছাড়বে না। এরকম একটা ধারণা শুভ্রজ্যোতির প্রতি

আত্মীয়-পরিজনেরও ছিল। ঠাকুরদার দেওয়া অমন সুন্দর নাম ওই বদনামকে আড়াল করতে পারেনি। এমনকী ফুলশয্যার রাতে চন্দ্রিমা দু’চার কথার পরই জানতে চেয়েছিল, স্যালারি কত পাও সে তো বাবার থেকে শুনেছি, উপরি কীরকম হয়?

বেশি নয়। নিতে হয় বলে নিই। নয়তো চাকরি টেকাতে পারব না। বলেছিলেন শুভ্রজ্যোতি।

চন্দ্রিমা বলে, বেশি নিয়ে কাজ নেই বাবা। স্বভাব নষ্ট হয়ে যাবে।

নববধূর ইমেজ রাখতেই কথাটা বলেছিল চন্দ্রিমা। পরবর্তীকালে বিলাসব্যসনের এই যে এত আয়োজন, জানতে চায়নি কোথা থেকে, কীভাবে আসছে? স্বভাব সত্যিই নষ্ট হল কিনা, কখনও খোঁজ করেনি।

চরিত্র ধীরে ধীরে অধঃপাতেই গেছে শুভ্রজ্যোতির। এক থানা থেকে অন্য থানায় বদলি হয়েছেন। বেড়েছে পদমর্যাদা। শুকনো থানায়, মানে যেখানে দুনম্বরি পয়সার আমদানি কম, সে সব জায়গায় পোস্টিং-এর খবর কানে এলেই দৌড়েছেন ওপর মহলে। নানান কৌশলে আটকেছেন বদলির চিঠি। তার জন্য প্রশাসনের হয়ে অন্যায় কাজ করে দিয়েছেন অনেক। যতদিন গেছে শাসকদল এবং প্রশাসনের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন। তবে এটাও ঠিক গোটা দেশ কিন্তু শুধুমাত্র দুর্নীতির ওপর ভর করে চলে না। এখনও সততা, ন্যায়নিষ্ঠার জোর অপরিসীম। এমনই এক সৎ, কর্তব্যনিষ্ঠ বড়োকর্তা শুভ্রজ্যোতির ডানা ছাঁটতে দেবনগরের আইসি করে পঠিয়ে দিলেন। বহু তদ্বির করেও বদলি ঠেকাতে পারেননি শুভ্রজ্যোতি। দেবনগর একেবারেই বন্ধ্যা জায়গা। কলকারখানা নেই, পুরোনো হাইওয়ে যেটা আছে, মাল পাচারকারীদের কাছে সেটা পরিত্যক্ত। বড়ো মার্কেট নেই। ক্রাইম প্রায় নেই বললেই চলে। সবচেয়ে যেটা মারাত্মক, রাজ্যের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল এখানে ভাই-ভাই। কলেজ ইউনিয়নের নির্বাচন হয় রাখি উৎসবের মেজাজে।

দেবনগরে এসে প্রথমদিকে খুবই ডিপ্রেশনে ভুগতেন শুভ্রজ্যোতি। বউ-ছেলে থাকে বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে। ওদের স্ট্যান্ডার্ড অফ লিভিং বাড়িয়ে ফেলেছেন শুভ্রজ্যোতি। কীভাবে খরচ জোগাবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। থানার অন্যান্য সহকর্মীদের কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। দেবনগরের সামাজিক আবহাওয়ায় মানিয়ে নিয়েছে। আলস্যে দিন কাটায়। শুভ্রজ্যোতি খুঁটেখুঁটে ক্রাইম বার করে দু’চার পয়সা কামাতে লাগলেন। এই যেমন, হেলমেটহীন বাইক আরোহীকে থানায় ধরে নিয়ে আসতে বলা। অন্ধকার মাঠে মাতাল, প্রেমিক-প্রেমিকাদের ধরপাকড় করা। যা টাকা পাওয়া যায়, তাই নিয়ে ছেড়ে দেওয়া। এরকম বিবিধভাবে তোলা তুলতে লেগেছিলেন শুভ্রজ্যোতি। নিজের ওপরে ধিক্বার এসে যাচ্ছিল। আগে যে থানাগুলোতে ঘুরে এসেছেন, বাঁয়া-ডাঁয়া দু’পা গেলেই পাঁচ-দশ হাজার আপনা থেকেই হাতে এসে যেত। কিন্তু ওই যে, কী যেন বলে না, ‘যেখানেই যাও কপাল যায় সঙ্গে সঙ্গে’, শুভ্রজ্যোতির হচ্ছে ঘুষের কপাল। দেবনগরের মতো শুখা থানাতেই বিরাট একটা দাঁও মারার চান্স এসে গেছে। যাকে বলে বিগ শট। এতটাই বিগ, কাজটা সাকসেসফুলি উতরে গেলে যে-টাকাটা পাবেন, বাকি জীবন চাকরি না করলেও আরামে চলবে। ছেলের জীবনও কেটে যাবে ওই টাকাতেই।

লটারি লাগার মতো এরকম একটা সুযোগ যে আসবে, এই দেবনগরে বসে, কল্পনাও করতে পারেননি শুভ্রজ্যোতি। রেলের লাইনের ওপারে নসিবপুর, দেবনগর থানার আন্ডারে। ওখানে একটা স্টিল ফ্যাক্টরি আছে। অনেকদিন ধরেই টিমটিম করে চলছে। কারখানার গায়ে প্রায় বিশ একর জুড়ে জলাভূমি। লোকে বলে হাতিডোবার বিল। বিশ একরের দশ একর কারখানার সম্পত্তি, বাকিটা খাস। বিলের মাঝে বড়ো একটা চরা আছে। সেখানে প্রায় তিরিশ ঘরের বসবাস। সকলেই উদ্বাস্তু। র্যাশন কার্ড নেই। জায়গাটার নাম মেছোডাঙা। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যবস্থা একমাত্র নৌকো। কারখানা সমেত গোটা এলাকা জুড়ে আধুনিক শহর তৈরি হবে। ডেভলপমেন্ট হওয়ার কথা দেশি-বিদেশি সংস্থার কোলাবোরেশনে। কারখানার মালিক নিজের সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করতে রাজি। খাসজমি অধিগ্রহণের সময় সরকার চোখ বুজে থাকবে। কারণ, সরকার উন্নয়ন চায়। বাধ সেধেছে একটা গোষ্ঠী। যারা নিজেদের পরিবেশকর্মী বলছে। জলাজমি বুজিয়ে ফেললে জনবসতির ড্রেনেজ ব্যবস্থা ব্যাহত হবে। অল্প বৃষ্টিতেই ডুবে যাবে চতুর্দিক। বিলে প্রত্যেক বছর পরিযায়ী পাখি আসে, তারা আর আসবে না। প্রচুর মাছ চাষ হয় বিলে। মেছোডাঙার বাসিন্দাদের ওটাই জীবিকা। এছাড়াও আছে ক্ষতির নানান ফিরিস্তি। সব ছাই মনেও থাকে না শুভ্রজ্যোতির। পরিবেশ কর্মীদের সঙ্গে স্বাভাবিক কারণেই যোগ দিয়েছে মেছোডাঙার পরিবারগুলো। সাকুল্যে দু থেকে আড়াইশো জন এই আন্দোলনে সামিল হয়েছে। স্টিল ফ্যাক্টরি সবে নিজের জমি ভরাট করতে শুরু করেছে, হইচই বাঁধিয়ে দিয়েছে তারা। ফ্যাক্টরির জেনারেল ম্যানেজার থানার সাহায্য চেয়ে পাঠিয়েছিলেন প্রথম যেদিন কারখানার গেটের সামনে বিক্ষোভ হল। আড়াইশোজনের অ্যাজিটেশন লাঠি উঁচিয়ে ফাঁকা করে দেওয়া পুলিশের কাছে কোনও ব্যাপার নয়। ঘটেওছিল তাই। তারপরই ম্যানেজার শুভ্রজ্যোতিকে ডেকে পাঠান নিজের চেম্বারে। গোটা পরিকল্পনাটা ভেঙে বলেন, বিশ একরে আধুনিক শহরের প্ল্যান। বলেছিলেন, অত কম বিক্ষোভকারী দেখেঞ্জভাববেন না ওদের শক্তি কম। আইনের জোর আছে ওদের পিছনে। কারখানা বাড়ানোর নাম করে আমরা নিজেদের জলাজমি ভরাট করছি, এখনকার আইন বলছে তা আমরা করতে পারি না। পরিবেশ দফতরের পারমিশন লাগবে। ‘জলাজমি’ ব্যাপারটা এখন এত সেনসেটিভ, অনুমতি পাওয়া যাবে না। আন্দোলনকারীরা কোর্টে যাওয়ার আগেই কারখানার দশ একর ভরাট করে ফেলতে হবে আমাদের। কয়েকটা রাতের মধ্যে চুপিচুপি সেরে ফেলতে হবে কাজ। আপনি আমাদের প্রোটেকশন দেবেন। কোর্টের রায় যদি এসেও যায় আপনার হাতে, আপনি অ্যাকশন নিতে গড়িমসি করবেন। একবার ভরাট হয়ে গেলে বাকিটা সামলে নিতে পারব আমরা। আমি ইতিমধ্যে মেছোডাঙার বাসিন্দাদের অফার দিয়েছি, কারখানা বড়ো করে চাকরি দেব তোমাদের। আমরা যে কারখানা বিক্রি করে সরে পড়ার তাল করছি, এটা ওদের বুঝিয়েছে আন্দোলনে থাকা শিক্ষিত মানুষ। মেছোডাঙার লোকেরা আমাদের বিশ্বাস করছে না। আপনি যদি পুরো অবস্থাটা আমাদের ফেভারে নিয়ে আসতে পারেন, প্রচুর টাকা দেব।

টাকার অঙ্ক শুনে চোখ কপালে উঠেছিল শুভ্রজ্যোতির। তখনও জানতেন না আরও দু’টো পার্টির থেকে এরকমই আকর্ষণীয় অফার আসবে। সরকারের এক প্রভাবশালী ফোন করে বললেন, কাজটা করে দিন। ভালো জায়গায় বদলি এবং প্রোমোশন দেব। পার্টির ছেলেদের দিয়ে কাজটা অনায়সে করানো যেত। আড়াইশোজনের প্রতিবাদ ধোপে টিকত না। কিন্তু এইসব সেনসেটিভ ইস্যুতে ইন্টারফিয়ারেন্স নিলে পার্টির বদনাম হবে। বিরোধী পার্টির সঙ্গেও আপসরফা হয়ে গেছে। আপনি শুধু ওই আড়াইশোজনকে সামলান।

এরপর ফোন এসেছিল ডেভলপারের কাছ থেকে। কাজটা করে দেওয়ার জন্য তারা যে-টাকার অফার দিয়েছে, স্বপ্নেও তা কল্পনার অতীত।

এত সব উজ্জ্বল প্রস্তাব পেয়ে নার্ভাস ব্রেক-ডাউনের মতো হয়ে গিয়েছিল শুভ্রজ্যোতির। তিনটে পার্টির কাছেই তিনি সময় চেয়ে নেন। বলেন, আমাকে প্ল্যান সাজাতে দিন। আমি না-বলা পর্যন্ত আপনারা কোনও স্টেপ নেবেন না।

কাজ অনেকটাই মেরে এনেছেন শুভ্রজ্যোতি। মাথা ঠান্ডা রেখে ঝড়ঝাপটা সামলাতে হয়েছে ভালোই। এখন লাস্ট অ্যান্ড ফাইনাল অপারেশনটা বাকি। উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় আছেন। টেনশন বাড়ছে, নাগালের মধ্যে এসে গেছে বিপুল টাকা, চাকরির উন্নতি! স্টেপিং-এর সামান্য ভুলে সমস্ত কিছু চলে যেতে পারে হাতের বাইরে। উৎকণ্ঠায় কাহিল হয়ে শুভ্রজ্যোতি, জীবনে প্রথমবার কোনও প্রফেশনাল জ্যোতিষীর কাছে চলেছেন। সন্তানের কোষ্ঠীবিচার বাবা হয়তো কখনও করিয়েছিলেন, ফলাফল জানা নেই শুভ্রজ্যোতির। আত্মীয়বন্ধু মহলে দু’চারজনের কাছে হাত দেখিয়েছেন। সেসব ভবিষ্যদ্বাণী কিছুই মেলেনি। ভাগ্যবিচারকে বুজরুকি, দুর্বল মনের আশ্রয় বলেই গণ্য করতেন শুভ্রজ্যোতি। টেনশনের চোটে এখন মনে হচ্ছে সামনেটা যদি একটু জানা যেত, মনটা বশে থাকত অ্যাটলিস্ট।

জ্যোতিষীর কাছে যাচ্ছেন, একজন ছাড়া কেউ জানে না। সেই ব্যক্তিই দিয়েছিল জ্যোতিষীটির হদিস। জ্যোতিষীর শরণাপন্ন হওয়াটা গোপন রাখতে চান শুভ্রজ্যোতি। চন্দ্রিমাকে বলার প্রয়োজন নেই। দূরে থাকে বলে জানতেও পারে না, শুভ্রজ্যোতি কোথায় যান না যান। থানার সহকর্মীদেরও কিছু বলেননি। চেনা একজনের গাড়ি নিয়ে সিভিল ড্রেসে চলেছেন চণ্ডীতলা। সেখানেই জ্যোতিষীর বাড়ি, একতলায় চেম্বার।

দেবনগরের পর দু’টো থানা-এরিয়া পেরিয়ে গঙ্গার খালের ব্রিজের ওপারে চণ্ডীতলা। জ্যোতিষীর বাড়ি নাকি খালের গায়েই। সঙ্গে কোনও সহকর্মী এবং থানার গাড়ি নিয়ে আসতেই পারতেন শুভ্রজ্যোতি। আনেননি দুটো ভিন্ন কারণে। এক, জ্যোতিষীর কাছে পুলিশ পরিচয় লুকোতেই পরনে সিভিল ড্রেস এবং ‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়ি নেননি। সামান্য ক্লু পেলেই জ্যোতিষীরা অ্যানালিসিস করে প্রচুর অপ্রয়োজনীয় কথা বলে দেয়। ফালতু সময় নষ্ট। শুভ্রজ্যোতি সামান্য হলেও ভবিষ্যতের ইঙ্গিত পেতে চান। আর সহকর্মী কারওকে আনেননি নিজের ইমেজের কথা ভেবে। থানার সকলেই জানে তিনি রাফ অ্যান্ড টাফ। এইসব মানুষের জ্যোতিষীর শরনাপন্ন হওয়া মানায় না।

সাবঅর্ডিনেটরা সমীহ করবে না। ওদের ওপর কর্তৃত্ব বজায় রাখতে না পারলে জলাভূমি দখল করা মুশকিল। এখন অবধি ওরা যে কো-অপারেশনটা করছে, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নয়, সমীহ থেকে। এই তো যেদিন মেছোডাঙার চার মাথাকে ফল্স কেস-এ চালান করলেন কোর্টে, কাজ মিটিয়ে ফিরে আসছেন থানায়, গাড়িতে পাশের সিটে বসেছিল সিনিয়র স্টাফ বাসুদেব গড়াই। বলেছিল, হাতিডোবার বিলটা না বোজালেই নয় স্যার? ওদিক থেকে দারুণ একটা হাওয়া দেয় বলেই দেবনগর এলাকাটা এত শান্ত। তারপর ধরুন সস্তায় টাটকা মাছ পাওয়া যায়। শীতকালে কাছে পিঠে এত সুন্দর পিকনিক স্পট! সেই সাইবেরিয়া থেকে পাখি আসে…

উত্তরে শুভ্রজ্যোতি বলেছিলেন, আপনি এক কাজ করুন, চাকরিতে রিজাইন দিয়ে পছন্দসই গ্রামে বসবাস করতে চলে যান। রিটায়ারমেন্টের সময় তো হয়েই এল, লস খুব একটা হবে না।

বাসুদেব গড়াই আর কথা বাড়ায়নি। কাজ শেষের মুখে গড়াইয়ের ন্যাকামি শুনে গা জ্বলে গিয়েছিল শুভ্রজ্যোতির। কত সতর্ক হয়ে মিশনটাতে এগিয়েছেন। অফারগুলো আসার পর প্রথমে মিটিং করলেন পরিবেশ কর্মীদের সঙ্গে। জলাজমি বুজিয়ে কী হতে চলেছে বললেন পুরোটাই। যদিও ওরা সবই জানত। শুভ্রজ্যোতি বলেছিলেন, জায়গাটার উন্নয়ন হচ্ছে, আপনারা বাধা দিচ্ছেন কেন?

ওদের বক্তব্য, কারখানা বন্ধ করে বড়োলোকদের বাসস্থান কী ধরনের উন্নয়ন। গরিব সাধারণ মানুষের কী উপকার হবে এতে? পরিবেশ নষ্ট হয়ে বরং ক্ষতিই হবে মানুষের।

এর পরের মিটিং শুভ্রজ্যোতি করলেন মেছোডাঙার বাসিন্দাদের সঙ্গে। মেছোডাঙায় গিয়ে ওদের বোঝালেন, তোমরা প্রচুর টাকা ক্ষতিপূরণ পাবে। জীবনের মান উন্নত হবে তোমাদের। চরা ছেড়ে চলে যাও।

ওরা বুঝল না। বলল, আমরা ছিটেবেড়ার ঘরে ভালোই আছি। খেয়েপরে দিন চলে যাচ্ছে। কোনও উন্নতির দরকার নেই আমাদের।

কিন্তু সকলেই তো আর নির্লোভ নয়। শুভ্রজ্যোতি ছোট্ট একটা দান চেলে রেখে এসেছিলেন মেছোডাঙায়। বলেছিলেন, ঠিক আছে, তোমরা ভালো করে ভেবে দ্যাখো। আমি জোর করব না। যদি মত পরিবর্তন হয় থানায় এসে আমাকে জানিও। তোমাদের জন্য দরজা সব সময় খোলা।

ওদের মধ্যে মাত্র দু’জন এসেছিল চুপিচুপি। তারা জীবনে উন্নতি চায়। তাদের ইনফর্মার হিসেবে নিয়োগ করলেন শুভ্রজ্যোতি। তিনি জানতেন মেছোডাঙায় মাঝে মাঝে বাইরের থেকে দুষ্কৃতিরা এসে গা ঢাকা দেয়। মেছোডাঙার বাসিন্দারা ভয় পেয়ে আশ্রয় দেয় তাদের। দুই ইনফর্মার এক দাগি অপরাধীর গাঞ্জঢাকা দেওয়ার খবর দিল। ফোর্স নিয়ে তাকে ধরতে গেলেনঞ্জশুভ্রজ্যোতি। নৌকো করেই যেতে হয়েছিল। তাছাড়া অন্য উপায় তো নেই। অপরাধী পালাল। শুভ্রজ্যোতি জানতেন নৌকোর মতো ধীর গতির যান নিয়ে অপরাধীকে ধরা যাবে না। দুষ্কৃতিরা সেটা বুঝেই ওখানে গা ঢাকা দেয়। শুভ্রজ্যোতির আসল উদ্দেশ্য অবশ্য সফল হল। দাগি দুষ্কৃতিকে আশ্রয় দেওয়ার অপরাধে মেছোডাঙার চার মাথাকে অ্যারেস্ট করলেন।

এতেই আন্দোলনকারীদের মনোবল অনেকটা ভেঙে গেছে।

যে-কেসে অ্যারেস্ট করেছেন, থানায় এসে বিক্ষোভ জানাতে পারছে না তারা। তবে ওরা খুব শীঘ্রই বিক্ষোভ জানাবে কারখানার গেটে। শুভ্রজ্যোতির নির্দেশে কারখানার ম্যানেজার ভরাট করতে যাবেন জলা। এটা আসলে টোপ। আন্দোলনকারীরা বিক্ষোভে সামিল হলেই, শুভ্রজ্যোতি তার দুই ইনফর্মার এবং দু’চারটে ভাড়াটে গুন্ডা ঢুকিয়ে দেবে ভিড়ে। তারা ভাঙচুর করবে কারখানায়। পুলিশ এলে ইট ছুড়বে। শুভ্রজ্যোতি বেছেবেছে আন্দোলনকারীদের মাথাগুলোকে অ্যারেস্ট করবেন। এবার তারা বেল পেয়ে জেল থেকে বেরোতে বেরোতে ঠিকাদাররা ভরাট করে ফেলবে হাতিডোবার বিল। বাধা দেওয়ার মতো লোকবল, পাকামাথা ওদের দলে থাকবে না। কারণ, হাতিডোবার বিল নিয়ে দেবনগর এবং আশপাশের শহর মফস্সলের বাসিন্দাদের কোনও মাথাব্যথা নেই। জলার হাওয়ায় তারা শান্তি পায়। দেখতে যায় না হাওয়াটা আসছে কোথা থেকে? হাওয়া যে দেখা যায় না। এমনই স্বার্থপর হয়ে উঠেছে মানুষ। অথচ যত দোষ শুধু পুলিশের!

এই ফুলপ্রুফ প্ল্যানে একটাই কাঁকর, গোপার ছেলে সৌম্য। সে আন্দোলনকারীদের একজন। গোপার সঙ্গে শুভ্রজ্যোতির ফস্টিনস্টির সম্পর্ক। শুভ্রজ্যোতি যখন যে থানায় গেছেন, সেই এরিয়ায় নিশ্চিত করে একটা নষ্টামির রিলেশন তৈরি হয়েছে, যার অাঁচ কিছুতেই পেৌঁছোতে দেন না বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে। পার্টনারের সঙ্গে সেরকমই অ্যাডজাস্টমেন্ট করা থাকে। গোপা হাজব্যান্ড সলিলকে নিয়ে থানায় এসেছিল বাড়িওলার নামে অভিযোগ জানাতে। দোষ যদিও গোপাদের। দীর্ঘদিন ধরে ভাড়া দেয় না। স্বাভাবিক কারণেই বাড়িওলা ওদের উঠে যেতে বলছে। হুমকি দিয়েছে অল্পবিস্তর। জলের লাইন কেটে দিয়েছে। গোপাকে পছন্দ হয়ে গেল শুভ্রজ্যোতির। ওদের বাড়িতে চা খেতে আসার নেমতন্ন পেলেন গোপার থেকে, সঙ্গে গোপার ভ্রূ ভঙ্গিতে আরও গোপন কিছু পাইয়ে দেওয়ার ইঙ্গিত। শুরু করলেন ওদের বাড়িতে যাওয়া। বাড়িওলা জলের লাইন জোড়া লাগিয়ে দিল। ভাড়াও চায় না। সলিলটা ভেডুয়া টাইপের, শুভ্রজ্যোতি ওদের বাড়ি গেলেই কোনও একটা অছিলায় বেরিয়ে যায়। সমস্যা সৌম্যকে নিয়ে। কলেজে পড়া ছেলে। বাড়ির বাইরেই থাকে বেশিরভাগ। তবু কখনও যদি বাড়ি এসে শুভ্রজ্যোতিকে দেখে, এমন ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকায়, সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে শুভ্রজ্যোতির পক্ষে।

পরিবেশকর্মী বা আন্দোলনকারীদের মধ্যে দেবনগর, নসিবপুরের লোক হাতেগোনা। বেশিরভাগ বাইরের। হাতেগোনা ক’জনের মধ্যে কেন যে সৌম্য কাঁকরের মতো রয়ে গেল… বিক্ষোভে কিংবা মিটিংয়ে যতবারই আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি হয়েছেন শুভ্রজ্যোতি, সৌম্যর মতো ঘৃণার দৃষ্টিতে কেউ তার দিকে তাকায়নি। ও রাগ তো জলাভূমি নিয়ে নয়।

শুভ্রজ্যোতি গোপাকে বলেছেন, ছেলেকে ওসব আন্দোলনে থাকতে বারণ করো। লেখাপড়ার ক্ষতি হবে।

গোপা বলেছে, ও যেমন আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাকে এবাড়িতে আসতে বারণ করে না, আমিও ওর ইচ্ছেতে বাধ সাধব না।

শুভ্রজ্যোতি একটা ব্যাপারে ভীষণ আশঙ্কিত হচ্ছেন, প্ল্যান মাফিক যে- গন্ডগোলটা কারখানার গেটে পাকাবেন ঠিক করেছেন, কোনও ভাবে যদি সৌম্য উন্ডেড হয়, একেবারে সাড়ে সর্বনাশ। ফোর্সকে তিনি যতই একজনকে বাঁচিয়ে অ্যাকশন করতে বলুন, ওই পরিস্থিতিতে সেই নির্দেশ পালন করা বেশ কঠিন।

সৌম্য পুলিশের মারে জখম হলে গোপা ছেড়ে দেবে না শুভ্রজ্যোতিকে। প্রতিশোধস্পৃহায় ফুঁসে উঠবে মায়ের মন। গোপা হয়তো চলে যাবে বালিগঞ্জের ফ্ল্যাটে, আগুন জ্বালিয়ে দেবে শুভ্রজ্যোতির সংসারে। এই সব সম্ভাবনার কথা ভেবে শুভ্রজ্যোতির মনে উৎকন্ঠার পারদ ক্রমশ চড়ছে। ভবিষ্যতের আভাস পাওয়ার প্রয়োজন হয়েছে সেই কারণেই।

চণ্ডীতলার জ্যোতিষীর সন্ধান দিন দশেক হল পেয়েছেন শুভ্রজ্যোতি। ছেলে দেবাংশুর সঙ্গে দেখা করে জলপাইগুড়ি থেকে ট্রেনে ফিরছিলেন। সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে দেবাংশুর এখন ফার্স্ট ইয়ার। মেধাবী স্টুডেন্ড, জয়েন্টে র্যাংক করে চান্স পেয়েছে। বাবার ঘুষের টাকায় প্রাইভেট কলেজে ভর্তি হতে হয়নি।

সে যাই হোক, এই ট্রিপে চন্দ্রিমা সঙ্গে ছিল না। শুভ্রজ্যোতির অপোজিট বার্থে বছর তিরিশের এক কো-প্যাসেঞ্জার বারবার পাথর লাগানো আংটিতে চুমু খেয়ে আংটির হাতটা কপালে ঠেকাচ্ছিল। চোখের সামনে ক্রমাগত একই ঘটনা ঘটতে থাকায় বেশ বিরক্ত হচ্ছিলেন শুভ্রজ্যোতি। ছেলেটিকে একসময় বলেই ফেললেন, আপনি তো বেশ ভক্ত লোক মশাই। আপনার বয়সে এত ভক্তি সহজে দেখা যায় না।

খোঁচাটা খেয়ে ছেলেটি রাগ রাগ চোখে তাকিয়ে ছিল। মুখে কিছু বলেনি। ঘটনাটা কিন্তু ঘটিয়েই যাচ্ছিল। অনেক কষ্টে সহযাত্রীর কাণ্ডকারখানা থেকে মনটাকে বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছিলেন শুভ্রজ্যোতি।

ট্রেন শিয়ালদা পৌঁছোনোর পর যে কাণ্ডটা ঘটল, জানা গেল সহযাত্রীর ওই আচরণের কারণ। প্ল্যাটফর্মে নেমে ছেলেটি একটু বুঝি ত্রস্ত পায়ে হাঁটছিল শুভ্রজ্যোতির সামনে। ওর ধরনধারণ দেখে একটু ছিটিয়াল টাইপের বলেই মনে হচ্ছিল। আচমকা কোথা থেকে দুটো ছেলে ছুটে এসে ধাক্বা মারল ওই সহযাত্রীকে। মুহূর্তের মধ্যে ওর কাঁধের ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে দু’জনেই ধাঁ।

পুলিশ হয়েও শুভ্রজ্যোতি ঘটনাটায় বেশ হকচকিয়ে গিয়েছিলেন। দুষ্কৃতিদের চেজ করা হয়ে ওঠেনি। সহযাত্রী ছেলেটি ততক্ষণে প্ল্যাটফর্মে বসে পড়ে মাথা চাপড়াচ্ছে। বলছে, আমার সর্বনাশ হয়ে গেল। সব গেল আমার… ও মা, এবার আমি কী করব…

শুভ্রজ্যোতি সহযাত্রীটির পাশে গিয়ে উবু হয়ে বসেছিলেন। পিঠে হাত রেখে সহমর্মীর গলায় বলেন, মনে হচ্ছে ওদের কাছে খবর ছিল দামি কিছু ক্যারি করছেন আপনি। কী ছিল ব্যাগে?

হা-হুতাশ থামিয়ে ছেলেটি রাগের চোখে তাকিয়ে ছিল শুভ্রজ্যোতির দিকে। মুখ ঝামড়ে বলেছিল, প্রচুর টাকা ছিল। আমার বিজনেসের টাকা। ট্রেনে আপনি বলছিলেন না, আমার ভক্তি বেশি। ভক্তি এই কারণে। বলে ছেলেটি হাতের আংটিটা দেখিয়ে মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছিল। আংটিতে পান্না বসানো। যে-জ্যোতিষী দিয়েছিলেন, বলে দেন বিপদে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিলেই রত্নের রং গাঢ় হতে শুরু করবে। তখনই যেন সতর্ক হয়ে যায় ছেলেটি। ট্রেন জার্নি-তে পান্নার রং আরও সবুজ হতে দেখে ছেলেটি চিন্তায় পড়ে যায়। সামনের স্টেশনে নেমে পড়বে, নাকি পুরোটাই যাবে? বিপদ দু-জায়গাতেই ওত পেতে থাকতে পারে। তাই সে আংটিতে চুমু খেয়ে আংটি কপালে ঠেকিয়ে ভগবানের কাছে বারবার প্রার্থনা করছিল, এ যাত্রায় সে যেন বেঁচে যায়।

শেষ রক্ষা হয়নি। শুভ্রজ্যোতি কিন্তু তাঁর এই টেনশনের সময়কালে পাওয়ারফুল জ্যোতিষীর সন্ধান পেয়ে গেলেন। ছেলেটিকে বলেছিলেন, ব্যাপারটা আপনি আগে বলবেন তো আমাকে! আমি পুলিশ। আর্মস আছে সঙ্গে। অ্যালার্ট থাকতে পারতাম।

আপনি পুলিশ, আমি জানব কী করে! বলেছিল ছেলেটি। ভুল কিছু বলেনি। ছেলেটিকে শুভ্রজ্যোতি নিয়ে যান জিআরপি-তে। নিজের পরিচয় দিয়ে ডায়ারি লেখান। ততক্ষণে জ্যোতিষী চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্যর ঠিকানা নিয়েছেন ছেলেটির থেকে। জ্যোতিষী সপ্তাহে তিনদিন দুপুর দু’টো থেকে সন্ধে ছ’টা অবধি চেম্বারে বসেন। প্রবল ভিড় হয়। নাম লেখাতে হয় আগে থেকে। সোমবার ভিড় একটু কম।

আজ সোমবার। গত শনিবার ফোন করেছিল পল্লব, ট্রেনের সেই সহযাত্রী। সুখবর শোনাল। বলল, আপনার সঙ্গে গিয়েছিলাম বলেই জিআরপি উঠে পড়ে লেগে আমার অনেকটা টাকাই উদ্ধার করে ফেলেছে। আপনি পুলিশ অফিসার বলেই কেসটা সিরিয়াসলি নিয়েছিল ওরা। কী বলে যে ধন্যবাদ জানাব আপনাকে… যাই হোক চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্যের কাছে গিয়েছিলেন নাকি ইতিমধ্যে?

না, যাইনি। দু’একদিনের মধ্যেই যাব। বলেছিলেন শুভ্রজ্যোতি।

পল্লব বলল, সোমবার চলে আসুন। আমি যাচ্ছি। নাম লিখিয়ে রাখব। ক’টা নাগাদ আসবেন বলুন।

বিকেল চারটের আশেপাশে যাবেন বলে রেখেছেন শুভ্রজ্যোতি। আধঘন্টা মতো দেরি হয়ে গেল। পল্লব নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে।

খালের ব্রিজে গাড়ি নিয়ে এসে পড়েছেন শুভ্রজ্যোতি। খালে টলটলে জল। ব্রিজ থেকে নেমে যে-রাস্তাটা খাল বরাবর চলে গেছে, সেখানেই জ্যোতিষীর বাড়ি।

রাস্তাটা অপ্রশস্ত এবং শুনসান। ডানপাশে খাল, বাঁ দিকে পরপর চালাঘর, পাকা ছাদের বাড়ি চোখেই পড়ছে না। গাড়ির স্পিড আস্তে করে নিয়েছেন শুভ্রজ্যোতি, একটা ছেলে সাইকেল চালিয়ে আসছে। ওকে জিজ্ঞেস করতে হবে জ্যোতিষীর বাড়ি কোনটা?

ছেলেটি এসে পড়ল। শুভ্রজ্যোতি গাড়ি থামালেন। ছেলেটিকে বললেন, চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্যের বাড়িটা কোথায়?

– সোজা চলে যান। লাল রকওলা দোতলা বাড়ি। বলার পর ছেলেটি জানতে চাইল, আপনি কি হাত দেখাতে এসেছেন?

হ্যাঁ বা না কিছুই বললেন না শুভ্রজ্যোতি। শুধু ছেলেটার দিকে চেয়ে রইলেন, এটা পুলিশি অভ্যেস। ছেলেটা নিজের থেকেই প্রশ্নের কারণটা বলবে। এবং বলল, উনি হাত দেখা ছেড়ে দিয়েছেন মাস খানেক হল। গিয়ে কোনও লাভ হবে না।

কেন ছেড়ে দিয়েছেন জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেলেন না শুভ্রজ্যোতি। সাইকেল চালিয়ে বেরিয়ে গেল ছেলেটা। পল্লব কি তাহলে জানে না হাত দেখা ছেড়ে দিয়েছেন চিত্তরঞ্জন? ও যে বলল নাম লিখিয়ে রাখবে? নাম না লেখাতে পেরে একটা ফোন করতে পারত। পল্লবকে এখন কি একবার ফোন করবেন শুভ্রজ্যোতি? না, থাক। জ্যোতিষীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যাক না ব্যাপারটা। এতটা যখন এসেই পড়েছেন।

নীচের তলার ঘরে চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্য গোমড়া মুখে বসে রয়েছেন তক্তপোশের ওপর। সামনে কাঠের চেয়ারে শুভ্রজ্যোতি। সাইকেল আরোহী সঠিক খবরই দিয়েছে, ভাগ্যগণনা করা ছেড়ে দিয়েছেন চিত্তরঞ্জন। কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, পর পর ছ’জনের হাতে আসন্ন মৃত্যুযোগ দেখার পর তাঁর মনে হয়েছে, ঈশ্বর চান না তিনি আর ভাগ্যবিচার করুন। তাই সেই সব মানুষকেই হাত দেখাতে পাঠাচ্ছেন, যাদের ভবিষ্যৎ বলে কিছু নেই। যে ছ’জনের গণনা তিনি করেছিলেন, চারজনের মৃত্যুর খবর কানে এসে পৌঁছেছে, দু’জনের কী হয়েছে জানেন না। মৃত্যুযোগ প্রতিকারের ক্ষমতাও নেই চিত্তরঞ্জন জ্যোতিষীর। মিছিমিছি ভাগ্যগণনা করে কী লাভ! ঈশ্বর তাঁকে যতটুকু সম্পদ দিয়েছেন, বাকি জীবনটা ওতেই চলে যাবে।

শুভ্রজ্যোতি অনেক অনুনয়-বিনয় করে নিজের হাতটা দেখানোর চেষ্টা করলেন। পল্লবের রেফারেন্স দিলেন। বললেন ওঁরই দেওয়া সেই আশ্চর্য পান্নার কথা, বিপদ কাছে এলে যার রং গাঢ় হয়ে যায়। চিত্তরঞ্জন পল্লবকে মনে করতে পারলেন না। পরপর খারাপ হাত দেখে জ্যোতিষ ব্যাপারটা থেকে মন উঠে গেছে তাঁর। বাধ্য হয়ে শুভ্রজ্যোতি হুমকি দিলেন, হাত আপনাকে আমি দেখিয়েই ছাড়ব। এতেই ঠিক হয়ে যাবে কার মরণ আসন্ন, আপনার না আমার।

এরপর থেকেই গুম মেরে গেছেন চিত্তরঞ্জন। এবার মুখ তুললেন। বললেন, আপনি পুলিশ বলেই এভাবে জোর খাটাচ্ছেন। ভাগ্যবিচার আমি করে দিচ্ছি। দেখে যেটা বুঝব, সেটাই বলব। ধাক্বাটা সহ্য করতে পারবেন তো?

আমি পুলিশ, কী করে জানলেন? নিশ্চয়ই পল্লব বলেছে। অথচ বলছেন পল্লবকে মনে করতে পারছেন না।

আপনার কথা কেউ আমাকে বলেনি। চুলের ছাঁট, কোমরে বেল্ট, জামা গুঁজে পরা, ঠায় শিরদাঁড়া সোজা রেখে বসা, এক দু’বার ঝোঁকার চেষ্টা করেও পারলেন না। বগলের তলায় বেল্টের সঙ্গে বাঁধা আছে পিস্তল। সর্বপরি আপনার শীতল চাহনি, দীর্ঘদিন পুলিশে চাকরি না করলে এমনটা হয় না। পিস্তল আর চাহনির চাপে পড়েই আপনার ভাগ্য গণনায় রাজি হলাম আমি। একটু বসুন, ওপর থেকে খাতাপত্তর নিয়ে আসি।

তক্তপোশ থেকে নেমে ঢিমেতালে বাড়ির ভিতরে গেলেন চিত্তরঞ্জন। শুভ্রজ্যোতির একটু ভয় ভয় করছে, লোকটা যা বলছেন, সত্যি হবে না তো? মৃত্যুযোগ কি আমার হাতেও আছে? ভগবানের পাঠানো সাত নম্বর ব্যক্তি কি আমি? …চিন্তাটা কাক তাড়ানোর মতো মাথা থেকে তাড়ান শুভ্রজ্যোতি। আগের ঘটনাগুলো সম্পূর্ণ কাকতালীয়। তাছাড়া ছ’জনের মধ্যে দু’জন হয়তো বেঁচে আছে, যাদের খবর পাননি চিত্তরঞ্জন। পল্লবের ব্যাপারটা নিয়ে শুধু ধোঁয়াশা থেকে যাচ্ছে। বলল, আজ আসবে। নাম লিখিয়ে রাখবে…

চিত্তরঞ্জন ফিরে এলেন। হাতে হালখাতার মতো লাল পুরোনো খাতা আর ম্যাগনিফায়িং গ্লাস। তক্তপোশে উঠে বসে চিত্তরঞ্জন বললেন, বলুন, আপনার জন্মের সময় আর তারিখ।

বললেন শুভ্রজ্যোতি। খাতা খুলে ছক কাটতে লাগলেন চিত্তরঞ্জন। নিজের মনে বিড়বিড় করে যাচ্ছেন। আঁক কাটা শেষ হতে বললেন, দিন, এবার ডানহাতটা দিন।

হাত বাড়ালেন শুভ্রজ্যোতি। হাতটা ধরে ঝুঁকে পড়ে খুঁটিয়ে দেখছেন চিত্তরঞ্জন। মোটা কাচের চশমা তো আছেই, আতসকাচও ব্যবহার করছেন।

এবার বাঁ-হাতটাও চেয়ে নিলেন। শুভ্রজ্যোতি নিবিষ্ট হয়ে জ্যোতিষীর এক্সপ্রেশন পড়ার চেষ্টা করছেন। চিত্তরঞ্জনের কপালের ভাঁজ এক এক করে মিলিয়ে যাচ্ছে। প্রশান্তি দেখা দিচ্ছে চেহারায়। এবার মুখ তুলে একগাল হেসে বললেন, নাঃ, নেই মৃত্যুযোগ। এখনও বহুদিন বাঁচবেন। উন্নতি করবেন জীবনে। প্রচুর অর্থ উপার্জনও হবে। সুখে কাটবে বাকি জীবনটা।

শুভ্রজ্যোতির মুখে হাসি ফিরে এসেছে। হাত দু’টো ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, দেখলেন, কেমন একটা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে পড়েছিলেন। আমি জোর না করলে ভুলটা আপনার ভাঙত না, থেকেই যেত।

আসলে একের পর এক মৃত্যুর গ্রহণ লাগা হাত দেখতে কার ভাল লাগে বলুন! বিষণ্ণ গলায় বললেন চিত্তরঞ্জন।

শুভ্রজ্যোতি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। পার্স বার করে একটা পাঁচশো টাকার নোট বাড়িয়ে ধরলেন চিত্তরঞ্জনের দিকে। বললেন, এতে হয়ে যাবে তো?

টাকা দিচ্ছেন কেন! আমি তো ভাগ্যগণনা করা ছেড়ে দিয়েছি। আপনি জোর করলেন বলেই…

শুভ্রজ্যোতি জ্যোতিষীর ডানহাতটা তুলে ধরে নোটটা রাখলেন। বললেন, প্রফেশন ছেড়ে দেবেন কেন? এই তো আজ একটা ভালো হাত পেলেন। এবার থেকে দেখতে থাকুন। মিছিমিছি নিজের ক্ষমতাকে অপচয় করবেন না।

শুভ্রজ্যোতি রিল্যাক্সড্ ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। নোটটা ফতুয়ার পকেটে ঢোকাতে অস্বস্তি হচ্ছে চিত্তরঞ্জন ভট্টাচার্যের। আবার অবসাদ ঘিরে ধরেছে তাকে। এই লোকটাও বাঁচবে না। মানুষটাকে মিথ্যে প্রবোধ দিয়েছেন চিত্তরঞ্জন। কালসর্প যোগ আছে লোকটার। মানে অপঘাতে মৃত্যু। ফণা উঁচিয়ে আছে নিয়তি। আর ঘন্টা খানেকও বাঁচবে কিনা সন্দেহ। এরকম দাপুটে মানুষটা নিয়তির কাছে বড়ো অসহায়! লোকটার প্রতি মায়া হয় চিত্তরঞ্জনের। মানুষটাকে শেষবার দেখার জন্য বাড়ির রকে এসে দাঁড়ালেন। আঁতকে উঠলেন সামনের দৃশ্য দেখে! মৃত্যু যে বাইরেই ওত পেতে ছিল, ভাবতেই পারেননি। চার, নাকি পাঁচজন যুবক পুলিশ লোকটার কপালে বন্দুক ঠেকিয়ে গাড়ির বনেটে শুইয়ে দিয়েছে। চোখ বন্ধ করে নিলেন চিত্তরঞ্জন। এক্ষুনি গুলি চালানোর শব্দ আসবে কানে।

আসছে না দেখে চোখ খুললেন। এখন অন্য দৃশ্য, কপালে বন্দুক ঠেকানোই আছে পুলিশের। লোকটাকে দিয়ে একটা কাগজে কী সব লেখাচ্ছে ছেলেগুলো। বেশি লিখতে হল না। সই করাল সম্ভবত। লোকটাকে ছেড়ে দিল ওরা। পুলিশটা দৌড়ে গাড়িতে উঠে পড়ল। দু’টো বাইকে পাঁচজন যুবক চেপে চলে গেল জুটমিল বস্তির দিকে। নিয়তি তার মানে ছেলেগুলির ইচ্ছে অনুযায়ী ফণা নামিয়ে নিল। বেঁচে গেল লোকটা। ওই যুবকরা কি তা হলে নিয়তির চেয়েও শক্তিমান।

ছেলেগুলো খুন করেছে। শুভ্রজ্যোতিকে নয়, ওঁর ভিতরে থাকা খারাপ পুলিশটাকে। ব্রিজের ওপর উঠে এসে শুভ্রজ্যোতি আর গাড়ি চালানোর রিস্ক নেননি। হাত কাঁপছে, ধড়াস ধড়াস করছে বুক। গাড়ি থেকে নেমে ব্রিজের রেলিং-এর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। খারাপ পুলিশটার নগ্ন দেহ যেন খালের জলে ভেসে আসতে দেখছেন। এরকম হুমকিই দিয়েছিল ছেলেগুলো। আচমকা মাটি ফুঁড়ে উঠে এসেছিল পাঁচজন। শুভ্রজ্যোতি নিজের আর্মস বার করার সুযোগই পাননি। কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে ছেলেগুলোর মধ্যে একজন বলল, কোনও সেয়ানাগিরি নয়। যা বলছি শোন। নয়তো দানা ভরে জামাকাপড় খুলে লাশ ফেলে দেব খালে। ভাটার টাইম, ভাসতে ভাসতে অন্য জেলায় চলে যাবি।

শুভ্রজ্যোতিকে জ্যোতিষীর কাছে নিয়ে আসাটা ছিল ট্র্যাপ। শুনশান এলাকা। খালটা জেলার সীমানায়। এখানে বডি ফেলে দিলে নিখোঁজ শুভ্রজ্যোতিকে জেলার পুলিশ খোঁজার পর সারা রাজ্যজুড়ে তল্লাশি চলত। ততক্ষণে বডিটা হয়তো পৌঁছে যেত সাগরে। খুনের কোনও প্রমাণ থাকত না।

পাঁচজনের দলে পল্লব তো ছিলই আর ছিল গোপার ছেলে সৌম্য, সঙ্গে আরও দু’জন আন্দোলনকারী। বাকি দু’টো ছেলেকে আগে কখনও দেখেননি শুভ্রজ্যোতি। ওরা যে-কাগজে সই করাল, তাতে শুভ্রজ্যোতি পুলিশ জীবনে যা যা অপরাধ করেছেন, সমস্ত লেখা আছে। ছেলেগুলো এতসব জোগাড় করল কী ভাবে, কে জানে! কাগজটা ছিল স্বীকারোক্তির বয়ান। শুভ্রজ্যোতিকে সাইন করিয়ে ওরা বলল, হাতিডোবার বিলে হাত বাড়াবি না। পুলিশ হওয়ার অ্যাডভান্টেজ নিবি না আর কখনও। যদি নিস, এই ডিক্লেয়ারেশনের এক কপি যাবে সিআইডি  ডিপার্টমেন্টে, আর একটা কপি মিডিয়ায়। প্রাণে বেঁচেছিস, এটাই জানবি তোর চোদ্দো পুরুষের ভাগ্যি।

মৃত্যুকে এত কাছ থেকে আগে কখনও দেখেননি শুভ্রজ্যোতি। কী ভয়ানক অভিজ্ঞতা! এখন অনেকটা ধাতস্থ লাগছে। খারাপ পুলিশটা ব্রিজের তলা দিয়ে আবর্জনার মতো ভেসে গেছে সাগরের দিকে। পশ্চিম দিক থেকে ঠাণ্ডা ভেজা বাতাস বয়ে আসছে। সম্ভবত হাতিডোবা বিলের হাওয়া। শুভ্রজ্যোতি এবার চন্দ্রিমাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে দেবনগরে নিয়ে আসবেন। বলবেন, ছেলে যখন বাইরে, কলকাতায় একা থেকে কী করবে! দেবনগরে একসঙ্গে থাকি চলো। জায়গাটা বেশ ভালো। হইচই নেই। নিরিবিলি। পশ্চিমি হাতিডোবার বিল থেকে উঠে আসা হাওয়ার প্রভাবেই এলাকাটা এত শান্ত! যে-কথা বলবেন না, তা হল, কিছু অশান্ত, দামাল যুবক অহর্নিশ হাওয়াটাকে পাহারা দেয়।

মা

ক্রিং… ক্রিং… ক্রিং…

শোবার ঘর থেকে দৌড়ে এসে ফোনটা ধরে প্রিয়া।

‘হ্যালো।’

হ্যালো বলতেই অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে ওঠে প্রিয়ার ছোটোপিসি সুশীলার গলা।

‘পিসি! এত রাতে ফোন করছ, কিছু হয়েছে নাকি?’

‘হয়েছে তো বটেই। কিন্তু তোকে যে কীভাবে বলি। শুনলেই তুই তো আবার রাগারাগি করবি। আমার উপরেই ঝাঁপিয়ে পড়বি। ব্যাপারটা কীভাবে নিবি কে জানে?’

‘দ্যাখো পিসি হেঁয়ালি ছাড়ো, পরিষ্কার করে বলো তো কী হয়েছে?’

বেশ ত্রস্তকণ্ঠেই সুশীলা বলে ওঠে, ‘প্রিয়া, একটু আগেই বড়দি ফোন করে বলল, দাদা নাকি আবার

বিয়ে করেছে।’

‘কী যা তা বলছ… মাথার ঠিক আছে তো তোমার?’

‘যা তা বলছি না রে। দিদিই নাকি কোনও এক ডিভোর্সি মহিলার সঙ্গে দাদার বিয়েটা দিয়েছে।’

এত রাতে ফোনের আওয়াজ শুনে বুকটা ধড়াস করে উঠেছিল প্রিয়ার। ভয় পেয়েছিল কোনও খারাপ সংবাদ নয়তো! তার ভাবনাটাই সত্যি হল, কোনও মৃত্যুসংবাদ না পেলেও এই বয়সে তার বাবার বিয়েটা তার কাছে মৃত্যুসংবাদের থেকে কম শকিং নয়। পিসির কাছ থেকে কথাটা শোনা মাত্রই হকচকিয়ে মাটিতেই বসে পড়েছিল প্রিয়া। এ তার কাছে এক বিশাল লজ্জার ঘটনা। শাশুড়ি, বড়ো-জা, ননদ এমনকী স্বামী নীলাদ্রিকেই বা কী করে মুখ দেখাবে। তাদের সকলের কাছে তো হাসির পাত্রী হয়ে দাঁড়াবে সে। একী করল বাবা। কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিল না প্রিয়া, অঝোর নয়নে কেঁদে চলেছিল।

প্রিয়ার বিয়ের সময়তেও তার বড়োপিসির এহেন কথার জন্য বেশ গোল বেধে গিয়েছিল বাড়িতে। প্রিয়া রেগেমেগে পিসিকে দু-চার কথা শুনিয়েও দিয়েছিল। আজ এতদিন পরে প্রিয়া হাড়েহাড়়ে টের পাচ্ছে ওই মহিলা সেদিন সেই মুহূর্তের জন্য চুপ করলেও মনে মনে বদ্ধপরিকর ছিল তার একাকী, নিঃসঙ্গ দাদার আবার বিয়ে দিয়েই ছাড়বে। মনে মনে পিসিকে দুষতে থাকে প্রিয়া। ‘পিসিকে না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল, কিন্তু বাবা…! বাবা একবারও তার কথা ভাবল না। ভাবল না যে, এই ঘটনা তার বিবাহিত মেয়ের জীবনে কতটা প্রভাব ফেলবে? সবাই বলত বাবা নাকি মেয়ে অন্ত প্রাণ। তাহলে বাবা এমন অবিবেচক হল কেন? ভারি অভিমান হল প্রিয়ার।

সংসার বলতে তো ছিল চারটে প্রাণী। প্রিয়া, প্রিয়ার বাবা নরেনবাবু, মা মোহিনীদেবী এবং অন্ধ, বিকলাঙ্গ ভাই হেমেন। বাড়ির একমাত্র ছেলে এমন হওয়ায় সবার মধ্যে একটা চাপা কষ্ট ছিল ঠিকই, কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে মোহিনীদেবীর ভালোবাসা সংসারে যেন এক আশ্চর্য সুখশান্তির বাতাবরণ তৈরি করে রেখেছিল। কিন্তু সেই সুখের সংসারে হঠাৎই একদিন বাধ সেধে বসে এক মারণ ব্যাধি। ক্যানসারে আক্রান্ত হলেন মোহিনীদেবী। ব্যস, দু’বছরের মধ্যেই সব শেষ। তখন প্রিয়া তেরো আর হেমেন বছর নয়েকের। তারপর কেটে গেছে দশটা বছর। সময় তার নিয়মেই বয়ে গেছে। এরই মধ্যে বাবা-মেয়ে মিলে সংসারের সব দায়িত্ব সামলেছে। পাশাপাশি প্রিয়া স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছে। বছর তিনেক হল একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে তার বিয়েও হয়েছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বদলালেও বদলায়নি মোহিনীদেবীর প্রতি সকলের ভালোবাসা।

তার নিজের বিয়ের পরেও কেটে গেছে তিন-তিনটে বছর। মাস আষ্টেকের একটি মেয়েও আছে। সবই তো ঠিক চলছিল। ভাইকেও বাড়ির পুরোনো কাজের লোক মিনতিদি বেশ যত্ন নিয়েই দেখাশোনা করছিল। তাহলে আজ কী এমন ঘটে গেল যে, এই বয়সে বাবাকে এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতে হল? এই কথাগুলি বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল প্রিয়াকে।

অনেকক্ষণ প্রিয়া আসছে না দেখে ঘর থেকে নীলাদ্রি ডাকতে থাকে প্রিয়াকে। নীলাদ্রির ডাক শুনে সম্বিত ফিরে পায় প্রিয়া। কোনওরকমে চোখমুখ মুছে নিজেকে সামলে নিয়ে সাড়া দেয়, ‘হ্যাঁ আসছি। এক্ষুনি আসছি।’

প্রিয়াকে দেখেই চমকে ওঠে নীলাদ্রি। ‘কী হল এমন উদ্ভ্রান্ত দেখাচ্ছে কেন তোমায়, চোখ দুটো এত লাল লাগছে কেন? কেঁদেছ নাকি? কার ফোন এসেছিল?

নীলাদ্রির প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুনে হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও নিজেকে সামলাতে না পেরে নীলাদ্রিকে জড়িয়ে ধরে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে সে। শত চেষ্টা করেও কিছুতেই তার কান্না থামাতে পারে না নীলাদ্রি। খানিকবাদে প্রিয়া নিজেই ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলে, ‘জানো, বাবা আবার বিয়ে করেছে!’

অবিন্যস্ত, অগোছালো, বেদনাতুর প্রিয়াকে দেখেই নীলাদ্রি বুঝে গিয়েছিল আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা, সুতরাং বৃষ্টি তো নামারই ছিল। আকস্মিক এই ঘটনায় কিছুটা আশ্চর্য হলেও পরিস্থিতি সামলাতে ইয়ার্কির ছলে নীলাদ্রি বলে ওঠে, ‘সেকি বাবা বিয়ে করেছেন? এই বয়েসে? তা আমাদের নিমন্ত্রণ করলেন না কেন?’

রেগেমেগে প্রিয়া বলে ওঠে, ‘সবটাতে ইয়ার্কি ভালো লাগে না। ভেবে দেখেছ এরপর লোকের কাছে আমরা মুখ দেখাব কী করে?’

পরিস্থিতি হালকা করতে হাসতে হাসতে নীলাদ্রি বলে, ‘না দ্যাখো, সাদা চুলে টোপর পরে বাবাকে কেমন দেখতে লাগে, সেটা দেখার ইচ্ছে জাগাটা কি অন্যায় বলো? নাকি বাবা, বিয়ের আগে ডাই করেছিলেন কে জানে। কিছুই তো জানতে পারলাম না, জানলে না হয় একটু ফেসিয়াল, টেসিয়াল…’

নীলাদ্রির কথা শোনামাত্রই আরও জোরে কেঁদে ওঠে প্রিয়া।

‘আচ্ছা, আচ্ছা, সরি, বাবা আর ইয়ার্কি করব না, কিন্তু দ্যাখো ব্যাপারটা যখন ঘটেই গেছে তখন মেনে নেওয়াটাই কি…’

নীলাদ্রির কথার ইঙ্গিত বুঝেই একপ্রকার গর্জে ওঠে প্রিয়া। ‘তোমার সঙ্গে কথা বলাটাই আমার ভুল হয়েছে।’ এই বলে গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দরজার দিকে এগিয়ে যায় সে।

ভাবগতিক খারাপ দেখে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে প্রিয়ার হাত ধরে টেনে বিছানায় বসায় নীলাদ্রি। নিজেও তার পাশে বসে তার হাত দুটি ধরে বলে, ‘আচ্ছা বলো তুমি এখন কী চাইছ?’

নীলাদ্রির এই স্নেহস্নিগ্ধ আচরণে প্রিয়ার চোখ জলে ভরে যায়। একটু শান্ত হয়ে বলে, ‘তুমি বলো বাবা এটা কী করল? একবারও আমার কথা ভাবল না। ভাবল না যে, এসব জানলে শ্বশুরবাড়িতে সবার কাছে আমি কতটা হাস্যকর হয়ে উঠব। শুধু তাই নয় বাবা যে দেখাত মার মৃত্যুর পরেও বাবা মাকে কতটা ভালোবাসে, বাবার পৃথিবী নাকি মায়ের স্মৃতি জুড়েই, তাহলে সবই লোক দেখানো, মিথ্যে!’

প্রিয়া কাঁদতে কাঁদতেই বলতে থাকে, ‘তুমি তো জানো আমি ওদের কতটা ভালোবাসি। আমার বিয়ের পর আমি কতটা চিন্তায় থাকতাম। ঘরের কাজ, বাইরের কাজ সব বাবাকে একা হাতে সামলাতে হতো। প্রথমে বাবাকে হেল্প করার মতো কেউ ছিল না। ভাইয়ের পক্ষে তো নিজেরটাই নিজের সামলানো সম্ভব নয়। কাজেই সবসময় ওদের জন্য চিন্তা হতো। তারপর পাশের বাড়ির রমামাসি ওদের গ্রাম থেকে মিনতিদিকে এনেছিল আমাদের বাড়িতে। ব্যস তারপর থেকে তো বাবাকে আর সংসারের দিকে তাকাতে হয়নি। তাহলে, আজ কেন এই ডিসিশন?’

কথার মধ্যেই নীলাদ্রি বলে ওঠে, ‘প্লিজ আর কেঁদো না। শরীর খারাপ করবে। একটু জল খাবে?’

একটু চুপ করে থেকে আবার বলতে শুরু করে প্রিয়া। ‘রোজকার মতো কালকেও দু’তিনবার ফোন করেছি বাবাকে। অথচ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি যে, বাবা এরকম একটা কাণ্ড ঘটাতে চলেছে। শুধু বলেছিল পিসির সঙ্গে নাকি কী দরকার আছে তাই পিসির বাড়ি যাবে। বাবার মনে এই ছিল!’

কথা বলতে বলতে দেয়াল ঘড়িটার দিকে চোখ যায় নীলাদ্রির। রাত আড়াইটে বেজে গেছে দেখে নীলাদ্রি বলে, ‘প্রিয়া অনেক রাত হয়েছে, কাল সকালে মিষ্টুর ভ্যাকসিনের ডেট আছে। শুয়ে পড়ো প্লিজ। একটু ঘুমিয়ে নাও। কাল না হয় যা হোক একটা…।’

মেয়ের কথা শুনে মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত প্রিয়া একটু স্থির হয়ে গা এলিয়ে দেয় বিছানায়। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বলে ওঠে, ‘বাবার সঙ্গে আমি আর কোনও সম্পর্ক রাখব না। আমি জানব মার সঙ্গে সঙ্গে বাবাও এ পৃথিবী থেকে চলে গেছে।’

কথাগুলি শুনে নীলাদ্রি বলে, ‘ছিঃ প্রিয়া, উনি না তোমার বাবা। আজ না হয় একটা তোমার অপছন্দের কাজ করেছেন, কিন্তু এতদিন তো তাঁর কর্তব্য তিনি যথাযথ ভাবে পালন করে এসেছেন। সম্পর্ক রাখবে না মনে হলে রেখো না, কিন্তু এরকম বাজে কথা বোলো না। অনেক রাত হয়েছে, এবার ঘুমিয়ে পড়ো।’

নীলাদ্রি কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেও সারারাত প্রিয়া দু-চোখের পাতা এক করতে পারল না। দেখতে দেখতে রাত গড়িয়ে সকাল হয়ে এল। অন্যান্য দিনের মতোই বাড়ির সকলে যে-যার কাজে ব্যস্ত। শ্বশুর, ভাসুর অফিস যাবার জন্য আর শাশুড়ি, বড়ো-জা তাদের টিফিন, খেয়ে যাওয়ার রান্না নিয়েই ব্যস্ত। অন্যান্য দিন প্রিয়াও তাদের সঙ্গে এই কাজে হাত লাগায়, কিন্তু মেয়েকে নিয়ে ডাক্তারখানায় যাবার জন্য আজ তার হেঁশেল থেকে ছুটি। তাই সকালে প্রিয়াকে কারওরই মুখোমুখি হতে হল না।

তবে ওইটুকু সময়ের মধ্যেই সবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারলেও শ্বাশুড়ি স্নিগ্ধাদেবীর চোখকে ফাঁকি দিতে পারল না প্রিয়া। ক্ষণিকের দেখাতেই তিনি প্রিয়ার চোখ-মুখ দেখে বুঝে গিয়েছিলেন, তাঁর প্রাণবন্ত, ফুটফুটে ছোটোবউমাটির কিছু একটা হয়েছে। সাধারণত শ্বাশুড়ি-বউয়ের সম্পর্ক কোনও দিনই মধুর হয় না। কিন্তু অবিশ্বাস্য শোনালেও প্রিয়া আর তার শ্বাশুড়ির সম্পর্ক ব্যতিক্রমীই বলা যেতে পারে। স্নিগ্ধাদেবীর কোনও মেয়ে না থাকার কারণে তিনি তাঁর দুই বউকেই মেয়ের মতো ভালোবাসেন, তবে ছোটোবউমা প্রিয়াকে একটু বেশিই স্নেহ করেন। ছটফটে, মিষ্টি স্বভাবের এই মেয়েটির, শাশুড়ির মন জয় করতে একটুও সময় লাগেনি। আর এই কারণেই বড়ো-জা সহেলির প্রচ্ছন্ন রাগও আছে। তবে সেটা মনে মনে। এমনিতে প্রিয়া আর বড়ো-জায়ের মধ্যে বেশ মিল, তবে মাঝেমধ্যে সংসারের নিয়মে যেমন ঘটি-বাটি ঠোকাঠুকি হয়, তেমনি আর কী। কিন্তু সেটা কোনওদিন বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পৌঁছোয় না।

ডাক্তারখানা থেকে ফেরার পর থেকেই প্রিয়াকে চুপচাপ দেখে বড়ো-জা সহেলি তাকে ডেকে প্রশ্ন করল, ‘কী হয়েছে রে তোর? এত চুপচাপ আছিস যে!’

একটু চুপ থেকে প্রিয়া উত্তর দিল, ‘কই কিছু হয়নি তো, মাথাটা একটু ধরেছে এই যা।’

দুপুরবেলাতেও খাবার টেবিলে একই জিনিস, যে প্রিয়া একমুহূর্ত বকবক না করে থাকতে পারে না, সেই প্রিয়া এত শান্ত, অথচ আজ আবার নীলাদ্রিও বাড়িতে। অফিস যায়নি। বাড়ি থাকলে সারাক্ষণ দুজনের খুনশুটি চলতেই থাকে, খানিক বাদে বাদেই শাশুড়ির কাছে ছুটে যায় স্বামীর বিরূদ্ধে নালিশ করতে। আজ হঠাৎ করে তার স্বভাবে এতটা পরিবর্তন সত্যিই বাড়ির লোকের কাছে বিস্ময়কর বই-কি।

খাওয়া শেষ হতেই স্নিগ্ধাদেবী ছোটোছেলে আর বউমাকে ডেকে বললেন, ‘সত্যি করে বল তো তোদের কী হয়েছে রে? দ্যাখ সহেলির মতো আমাকে বোঝাতে যাস না। তোকে পেটে ধরেছি, আর ওকে পেটে না ধরলেও ওর শিরা-উপশিরা সব চিনি। কী হয়েছে বলে ফেল।’

ছলছলে চোখে মাথা হেঁট করে বসে থাকে প্রিয়া।

খানিক চুপ থেকে নীলাদ্রি বলে, ‘মা, ওর বাবা কাল হঠাৎ বিয়ে করে বসেছেন। তাই…।’

স্নিগ্ধাদেবী যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মহিলা। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘বউমা, তোমার রাগ হওয়াটা হয়তো স্বাভাবিক। কিন্তু একবার বাবার জায়গায় নিজেকে রেখে দ্যাখো তো, বাড়িতে বিকলাঙ্গ ছেলে, যে নিজেরটুকু নিজে করে নেওয়ার ক্ষমতা রাখে না, তার উপর অফিস, এই বয়সে একটা মানুষের পক্ষে কি সবদিক সামলানো সম্ভব? এতদিন তুমি ছিলে, দুজনে মিলে কোনওরকমে পরিস্থিতি সামলেছ, কিন্তু এখন তুমি নেই…।’

কথা শেষ হওয়ার আগেই জল ভর্তি চোখে প্রিয়া বলে ওঠে, ‘কিন্তু মিনতিদি তো আছে!’

‘হ্যাঁ আছে। কিন্তু সে তো আদপে একজন কাজের লোক ছাড়া কিছু নয়। তার উপর তুমিই তো বলতে, ইদানীং মিনতি মাঝেমাঝেই ছুটি নেয়। তাহলে সেই অবস্থাতে তিনি অফিস সামালাবেন না ঘর সামলাবেন। বাড়িতে কথা বলার কেউ নেই। সারাদিন পরিশ্রম করে আসার পর মুখের সামনে যে কেউ একগ্লাস জল ধরবে, সেরকমও কেউ নেই। তিনিও তো একটা মানুষ। চোখের সামনে অমন সমর্থ ছেলে অকেজো হয়ে পড়ে আছে, যার কোনও ভবিষ্যৎ নেই… এমন অবস্থায় তারও তো মনের দুটো কথা বলার লোক চাই। আমার তো মনে হয় এই সিদ্ধান্ত ওনার অনেক আগেই নেওয়া উচিত ছিল। তোমার তো খুশি হওয়া উচিত, যে তোমার বাবা-ভাইকে দেখাশোনা করার মতো একজন লোক এসেছে।’

শাশুড়ির কথায় খানিকটা হলেও মন হালকা হয় প্রিয়ার। গত দেড় দিনের ধকলে সে প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল। বিছানায় শুতেই ঘুমিয়ে পড়ল প্রিয়া।

এরপর দেখতে দেখতে সপ্তাহখানেক কেটে গেছে। বহুবার চেষ্টা করেও বাবাকে ফোন করে উঠতে পারেনি প্রিয়া, নাম্বার ডায়াল করেও ফোনটা কেটে দিয়েছে।

হঠাৎ একদিন বিকালে বড়োপিসির আগমন। কলিংবেলের আওয়াজ শুনে দরজা খুলতেই বড়োপিসিকে দেখে বেশ অবাকই হল প্রিয়া। হাতে বেশ কয়েকটা প্যাকেট আর ব্যাগ।

‘কিরে ভিতরে আসতে বলবি না?’

মনে মনে রাগ থাকলেও বলে, ‘হ্যাঁ এসো।’

ঘরে ঢুকে সোফার উপর বসে পড়ে বলে, ‘নে এগুলো, তোর জন্যই এনেছি।’

‘আমার জন্য? কী এগুলো।’ প্রিয়া অবাক হয়ে তাকায় পিসির দিকে। মনে মনে ভাবে আর যাই হোক বড়োপিসি তার জন্য এতগুলো টাকা খরচ করবে না। ছোটোপিসি হলেও না হয়…। পিসির হঠাৎ এই দরদের কারণ জিজ্ঞাসা করার আগেই, পিসি যেই ব্যাগটা থেকে নারকেলনাড়ু বার করেছিল সেই ব্যাগটার উপর নজর যায় প্রিয়ার। কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে। হ্যাঁ সে ঠিকই ধরেছে। এই ব্যাগটাতেই তো তার বাবা দোকান-বাজার করে। এটা থেকে প্রিয়া যেন তার বাবার গায়ের গন্ধ পেল। উৎসুক হয়ে প্রিয়া জিজ্ঞাসা করে, ‘এটা তো বাবার ব্যাগ পিসি, তাহলে কি বাবাও এসেছে?’

‘হ্যাঁ এসেছে তো। কিন্তু তোর সামনে আসতে ইতস্তত বোধ করছে। এই সমস্ত জিনিস তো তোর নতুন মা-ই পাঠিয়েছে তোর জন্য। তোর বাবা তো তোর সঙ্গে দেখা করার জন্য ছটফট করছে রে।’

মা-বাবা দুজনেই বাইরে অপেক্ষা করছিল।

পিসির কথা শুনে সমস্ত রাগ-অভিমান ভুলে দরজার দিকে ছুটে যায় প্রিয়া।

মেয়েকে দেখামাত্রই মেয়ের দিকে অপরাধীর মতো এগিয়ে এসে নরেনবাবু বলেন, ‘আমায় ক্ষমা করে দিস মা, আমি তোর অপরাধী।’

এ ক’দিনে আরও যেন শীর্ণ হয়ে গেছে বাবার চেহারাটা। প্রিয়ার মনে হয় বাবাও যেন এক দুর্নিবার মানসিক সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে চলেছে। রাগ নয়, এই মুহূর্তে ভারি মায়া হল প্রিয়ার। যে-অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে মানুষটা, তাতে যে-কোনও সময় কোনও ভারি অসুখে পড়তে পারে। কে দেখবে তখন বাবাকে। ভাবতে গিয়ে মনটা কেমন ভিজে যায়। বাবার হাত দুটো ধরে ধরা গলায় প্রিয়া বলে, ‘না, বাবা এমন করে বোলো না। আমি শুধু নিজের কথাই ভেবেছি, একবারও তোমাদের কথা ভাবিনি। ভাবিনি যে তোমরা কতটা কষ্টে ছিলে।’

হঠাৎই প্রিয়া অনুভব করে পিঠে কারও একটা নরম হাতের স্পর্শ। ভারি মায়াময় সেই হাত। ঘুরে তাকাতেই এক বছর পঞ্চাশের স্নিগ্ধ চেহারার মহিলাকে দেখতে পায় প্রিয়া। অপ্রস্তুত অবস্থা কাটিয়ে মহিলা বলে ওঠে, ‘প্রিয়া আমি সোমলতা। আমি জানি, তোমার মায়ের জায়গাটা আমি কখনও নিতে পারব না, ভরে দিতে পারব না তোমার মনে তাঁর অভাববোধ। কিন্তু দুটো অচেনা মানুষ, মেরুর দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে বন্ধুও কী হতে পারে না? হবে আমার বন্ধু?’

প্রিয়া বিমূঢ় হয়ে যায়। কোনও কথা সরছে না মুখে। কিন্তু সোমলতার আন্তরিকতা তাকে কোথাও যেন নাড়িয়ে দিয়ে যায়। সমাজ আর সংস্কারে বাঁধা পড়া মনটা যেন শিকল ভেঙে বেরোতে চায়। বাবা ছোটো থেকেই তার আদর্শ ছিল, মানুষটা ব্যতিক্রমী বলে। আজ সেই বাবাকেই যেন আবার ফিরে পায় প্রিয়া।

কক্ষচ্যুত এক নক্ষত্র

( এক )

আরশির সামনে বেদানার রসে ভরা গেলাসটা ঠক করে নামাতেই বিভাবরীর চোখে পড়ল শ্রীয়ের কঠিন মুখটা। চোখের কোণ দিয়ে দেখলেন, আরশি এক চুমুক দিয়ে গেলাসটা নামিয়ে রাখল। বিভাবরী উঠে গিয়ে বিট নুনের কৌটোটা নিয়ে এলেন। বেদানার রসে এক চিমটি বিটনুন মিশিয়ে দিয়ে গেলাসটা আরশির হাতে তুলে দিলেন। আরশি বাধ্য মেয়ের মতো এক চুমুকে গেলাসটা শেষ করে নামিয়ে রেখে অল্প হাসল।

বড়ো বিষণ্ণ সে হাসি। এমনটা তো হবার কথা ছিল না! আরশি আর শ্রী দুই বোন একে অন্যকে চোখে হারায়। আর তাই জন্যই আরশি এত বড়ো পদক্ষেপটা নিতে পেরেছে। কিন্তু শ্রী! সে এত বদলে গেল কেন? চশমার কাচ মুছতে মুছতে বিভাবরী বাগানের দিকে চেয়ে থাকেন।

গেট খোলার শব্দ হয়, মালতীর ছেলেটা এসেছে। হাতের ঠোঙাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, এই নাও ঠাকুমা, কাঁচা তেঁতুল।

শ্রী এসে দাঁড়িয়েছে, তেঁতুল কেন রে?

তা আমি কী জানি! মামাবাবু অফিস যাবার সময় বলল গাছ থেকে পেড়ে দিয়ে আসতে। আমাকে একটা দশ টাকার কয়েনও দিয়েছে। মালতীর ছেলে সাদা দাঁত ঝিকিয়ে হাসে।

শ্রীর মুখে কালির পোঁচ। দুম দুম করে পা ফেলে সে ভিতরে চলে যায়। বিভাবরী ঠোঙাটা নিয়ে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন।

( দুই )

স্নিগ্ধ এত জোরে বাইক চালিও না, আমার ভয় করে।

তীব্র হাওয়ায় আরশির আকুতি উড়ে গেল। স্নিগ্ধ বাইকের স্পিড আরও বাড়িয়ে দিল। ব্রিজের উপর দিয়ে বাইকটা উড়ে যাচ্ছিল যেন, নীচে দামোদর নদী তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে আরশির ভয় আরও বেড়ে গেল। আরশির সাদা ওড়নাটা পাখির ডানার মতো দুপাশে উড়ছিল।

লুকিং গ্লাস দিয়ে আরশির ভয় পাওয়া মুখটা দেখতে দেখতে স্নিগ্ধ চিৎকার করে ওঠে, তোমার উড়তে ইচ্ছা করে না আরশি? পাখির মতো ডানা মেলে?

এই স্নিগ্ধকে চিনতে পারে না আরশি। গম্ভীর প্রফেসর স্নিগ্ধময় মিত্র আর এই স্নিগ্ধ আকাশ পাতাল তফাৎ। হঠাৎ একটা ধাক্কা, বাইকটা ছিটকে পড়ে রাস্তায়। রক্তে ভেসে যাচ্ছে, রক্তের মধ্যে স্নিগ্ধ ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে গেল। স্নিগ্ধর নাম ধরে চিৎকার করে উঠল আরশি।

স্নিগ্ধ এখনও তোর স্বপ্নে আসে? আমি তো ভাবলাম তোর পুরোটাই দখল করে নিয়েছে উজান। অন্ধকার ঘরে আরশিকে শুয়ে থাকতে দেখে লাইট জ্বালাতে এসেছিল শ্রী। সুযোগ পেয়ে খোঁচাটা দিতে ভুলল না।

আরশি ককিয়ে উঠল, দিদি, উজানদা আমার জামাইবাবু, তাকে আমি দাদার মতো শ্রদ্ধা করি।

হ্যাঁ তাই তো তেঁতুল খাবার শখ হলে উজানকে জানাস, বাড়িতে দুজন মেয়েমানুষ থাকা সত্ত্বেও। রাত্রে জল খাবার নাম করে তোর ঘরে আসে, আমি বুঝি জানতে পারি না?

স্তম্ভিত হয়ে যায় আরশি। এই তার প্রাণের থেকে প্রিয় দিদি? যার জন্য কিনা সে সমাজ, লোকলজ্জা, ভবিষ্যৎ কিছুর তোয়াক্কা করেনি? হ্যাঁ উজানদা, মাঝে মাঝেই রাত্রে ঘরে ঢুকে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়, পাশে জেঠিমা শোয়। উজানদা এক অমোঘ টানে বারে বারে আরশির কাছে ছুটে আসে, কারণ ওদের সন্তান আরশির গর্ভে তিলে তিলে বেড়ে উঠছে। উত্তেজনা, উদ্বেগ অনাগত সন্তানের পিতা হিসাবে থাকা তো স্বাভাবিক। এটা তো দিদির মধ্যেও থাকা উচিত ছিল। দিদি এমন বদলে গেল কেন? আরশির চোখ দিয়ে জমাট মুক্তোর বিন্দু টুপটাপ করে ঝরে পড়তে লাগল।

( তিন )

ট্রাফিকে গাড়িটা অনেকক্ষণ আটকে ছিল। উজান মোবাইলটা হাতে নিয়ে আরশির বেবি বাম্পের ছবিটা দেখছিল। অনেক সাধ্য সাধনা করে ছবিটা আদায় করেছে। বাড়িতে কথা প্রায় হয় না দুজনের। তবে অফিস থেকে উজান অজস্র টেক্সট পাঠায়। প্রথম দিকে কৃতজ্ঞতার ভাগটাই বেশি ছিল। শ্রীর পরপর তিনটে মিসক্যারেজের পর আরশি এগিয়ে না এলে আজকের এই দিনটা আসতই না।

ডক্টর দুবে বলেই দিয়েছিলেন, এই কেসটা সলভ করা খুব সহজ না। আপনারা রাজি থাকলে সারোগেট মাদার খোঁজ করুন, চাইলে আমিও হেল্প করতে পারি। অভাবী ঘরের প্রচুর মেয়ে মোটা অর্থের বিনিময়ে একাজ করছে।

শ্রী আর উজানের স্বপ্ন অন্য সম্পূর্ণ অচেনা কারুর জঠরে প্রতিপালিত হবে? ওরা দুজনেই ব্যাপারটা মানতে পারেনি। দিশাহারা অবস্থা তখন ওদের। মা বরং আধুনিক মানুষ, বলেছিলেন, একটা বাচ্চা দত্তক নিলেই তো সমস্যার সমাধান হয়? আমাদের দেশে কত অনাথ বাচ্চা, একজনকেও যদি কাছে টেনে নিই ক্ষতি কীসের! বরং শিক্ষিত নাগরিক হিসাবে এটাই আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত।

বাবু, মালা নেবেন?

বাচ্চা ছেলেটা ফুলের মালা নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছিল। জানলার কাচে টোকা দিতেই উজান একটা জুঁইয়ের মালা কিনে নিল। তারপর কী মনে হতে দুটো মালা নিল। আসলে আরশি জুঁইফুল খুব ভালোবাসে। ওর ডিপিতে আজও স্নিগ্ধর সঙ্গে একটা ছবি আছে পরনে সাদা কেরালা কটনের শাড়ি, মুক্তোর গয়না, আর খোঁপায় জুঁই ফুলের মালা। ছেলেটাকে টাকা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই সিগন্যালের সবুজ আলো জ্বলে উঠল।

ড্রাইভ করতে করতে উজান ভাবছিল, কৃতজ্ঞতাটা একসময় মায়ায় বদলে গেল। মেয়েটার কষ্ট যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুকের মধ্যে কবে যে-টলটলে একটা মায়ার সরোবর তৈরি হয়ে গেল! আর এখন কি শুধুই মায়া! উজানের চাহিদা যে-আকাশছোঁয়া!

আরশি, এভাবে মন ভরে নাকি? বেবি বাম্প-সহ তোমার পুরো ছবি দাও। একথা বলল কেন কাল? আরশি কি কেঁপে গিয়েছিল! ওর আঙুল কি কয়েক মুহূর্ত থমকে গিয়েছিল কী প্যাডের উপর? নাহলে কিছু সময় পরে কেন উত্তর দিয়েছিল, এ হয় না উজানদা, আমাকে দেখতে চেও না প্লিজ।

জুঁইফুল? এ আমি পছন্দ করি না, গন্ধটা তীব্র লাগে। যার জন্য এনেছ তাকেই দিও। আর হ্যাঁ, এবার থেকে সব জিনিসই দুটো করে আনবে নাকি? চায়ের কাপ হাতে তুলে দিতে দিতে তাচ্ছিল্যে শ্রীর ঠোঁটটা বেঁকে গেল। বারান্দার টেবিল ঘিরে বাকি তিনটে মানুষ পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকে। চায়ের কাপ শীতার্ত কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে।

( চার )

আমি কিন্তু এই গরমে কোথাও যেতে পারব না, তাছাড়া পুজোর ভোগ রাঁধার জন্য ওই পারিবারিক পচা পুকুরে ডুব দিতেও পারব না। বাবার কাজের সময় ওখানে স্নান করে সারা গায়ে যা ইনফেকশন হয়েছিল! শ্রী স্পষ্ট জানিয়ে দিল সে গ্রামের বাড়িতে যাবে না।

এদিকে সাত মাসের পুজোটা পারিবারিক মন্দিরেই দিতে হয়, তেমনটাই বসু পরিবারের নিয়ম। বিভাবরী টের পাচ্ছেন পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে। তিনি এও টের পাচ্ছেন, শ্রী যত উজানকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, উজান আশ্রয় খুঁজছে আরশির মধ্যে। আরশিকে তিনি খুব একটা বুঝতে পারেন না, সারাদিন বই মুখেই কাটিয়ে দেয়। অল্প বয়সে স্বামীকে হারাল, সাধ আহ্লাদ ওরও কি নেই? নাহলে উজান শেষ মুহূর্তে নেপাল যাওয়াটা ক্যানসেল করল কেন? খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থা তো না আরশির। তবু সেদিন রাত্রে শুয়ে মেয়েটা কেন বলেছিল, জেঠিমা, দিদিরা বারোদিন বাইরে থাকলে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতাম। উজানদা থাকলে ভরসা পাই। আজ খুব নিশ্চিন্তে ঘুমাব জানো তো! তার মানে ওদের না যাওয়ায় আরশির ভূমিকা ছিল?

সংসারে নতুন অতিথি আসছে, আনন্দে ভেসে যাওয়ার কথা কিন্তু সবাই থমথমে মুখে রোবটের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। শ্রী একদিন বলেই ফেলেছিল, এর থেকে বাচ্চা না হয় না-ই আসত।

শ্রীকে ওর মায়ের জিম্মায় রেখে ওরা সবাই কুসুমপুরে এসেছে। ওদের আসার খবর পেয়ে জীর্ণ বাড়িটা ঘষে-মেজে পরিষ্কার করে রেখেছে মানদা আর বসন্ত মিলে। সারা বছর জমি বাড়ি, ঠাকুরপালা ওরাই সামলায়। কালকে মা অন্নপূর্ণার পুজো। গ্রামেও এখন আধুনিকতার ছোঁয়া, টিভি সিরিয়ালের দৌলতে সারোগেসি ব্যাপারটা আর নতুন না। অনেকেই আরশিকে দেখে গেল। আরশিও আজ খুব খুশি, উজান সিঁড়ির অন্ধকারে টেনে নিয়ে প্রথমে ওর বেবি বাম্পে তারপর ওর ঠোঁটে চুমু খেয়েছে। আরশি আর উজানের চোখে স্বপ্ন উপচে পড়ছে। বিভাবরী, বউ-মেয়েদের সঙ্গে বসে পুজোর জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিলেন।

উজান বলে উঠল, একটু চা হলে মন্দ হতো না।

বিভাবরীও বলেন, যা বলেছিস, আমারও মাথাটা ধরেছে কিন্তু এখন হাত জোড়া, একটু অপেক্ষা করতে হবে।

আরশি চা বানাতে উঠে যায় হাসিমুখে। রান্নাঘরে পা দেবার একটু পরেই বীভৎস চিৎকার আর তারপরেই ভারী কিছু পড়ে যাবার আওয়াজ। আরশির তেমন ক্ষতি না হলেও বাচ্চাটাকে বাঁচানো যায়নি।

আরশির নিজেকে বারেবারে দোষী মনে হয়েছে। বার্নারটা এমন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল যে, সে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসতে গিয়ে চৌকাঠে হোঁচট খেল।

শ্রী আগের মতোই বোনকে কাছে টেনে নিয়েছে। উজান সিদ্ধান্ত নিয়েছে একটি শিশুকে দত্তক নেবে।

আরশি এখন অনেকটাই সুস্থ, হায়দরাবাদে নতুন অফিসে জয়েন করতে যাবার আগের দিন সবার সঙ্গে দেখা করতে এল।

বিভাবরীকে বারান্দার এক কোণে টেনে নিয়ে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি কেমিস্ট্রির ভালো ছাত্রী ছিলেন তাই না? অ্যাস্ট্রিঞ্জেন্ট লোশনের মধ্যে মিশে থাকা ইথানলের ফোঁটাগুলোই আমাদের কক্ষচ্যুত হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল।

আরশির শীতল দৃষ্টির সামনে বিভাবরীর নিজেকে কক্ষচ্যুত এক নক্ষত্র মনে হল।

 

 

গোবর্ধনের নতুন অ্যাসাইনমেন্ট

গত রাত্রি থেকে গোবর্ধন সরকার খুব ঝামেলায় আছে। খুশির মেজাজটা টেনশনে মিলেমিশে এখন একটা ঘোলাটে অবস্থায়। খবরটা পাওয়ার পর থেকে নিজেকে আর কন্ট্রোলে রাখতে পারছে না সে। কাল রাত্রিতে ভালো করে ঘুমটাই হল না। আজ তো সকালে পাখি ডাকার আগেই উঠে পড়েছে। সামনে একটা বড়ো চ্যালেঞ্জ।

দৈনিক জবর খবর-এর সম্পাদক স্বযং ফোন করে আর্টিকেলটা লিখতে বলেছেন। হাতখরচ-এর উপর একটা তথ্য নির্ভর আর্টিকেল লিখতে হবে। খবরটা শুনে তাৎক্ষণিক আনন্দ যা পেয়েছিল, পরে বিষয়টার গুরুগম্ভীরতা দিকটির কথা ভেবে, এখন টেনশনে এসে ঠেকেছে।

এতদিন স্বল্প পরিচিত কিছু সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক কাগজে ফ্রিল্যান্সার কালচারাল রিপোর্টার হিসাবে খবর লিখেছে। সে সব খবরে মাথা খাটাবার বিশেষ কিছু নেই। কোনও ইনকাম ট্যাক্স অফিসারের স্ত্রীর গানের সিডি উদ্বোধনের অনুষ্ঠানের কভারেজ বা কাউন্সিলরের মেয়ের নাচের স্কুলের অনুষ্ঠান এই সবই বেশি। আর এতে মাথার পরিশ্রম তো নেই-ই উপরন্তু পাওনা, খাবারের বড়ো বড়ো প্যাকেট, নানান সব গিফট। কখনও সখনও ককটেল পার্টিও জুটে যায় ভাগ্যে।

অবিবাহিত গোবর্ধনের রাত্রের খাবারটা প্রায় এভাবেই হয়ে যায়। না হলে ভজার দোকান থেকে দশ টাকায় চারটে রুটি নিয়ে ঘরে ঢোকে। চিনি, গুড়, জ্যাম যা থাকে তা দিয়ে ডিনার।

বাবার আমলে নেপাল হালদার লেনের ভাড়া করা ঘর দুটোর দখল নিয়ে দুভাই-এর সংসার। তার একটা ঘরে প্লাইউড দিয়ে পার্টিশন করা আধখানা অংশ গোবর্ধনের ভাগে জুটেছে। বাকি অর্ধেকে থাকে দাদার ছেলে, মানে ওর ভাইপো বাপি। বাদ বাকি পুরো একটা ঘর দাদা-বউদির দখলে। ভাড়া বাড়িটাতে ওদের জন্য সেপারেট ল্যাট্রিন বাথরুম আছে। আর ঘর দুটোর লাগোয়া বারান্দার একটা অংশ ঘিরে নিয়ে তৈরি হয়েছে রান্নাঘর।

গোবর্ধনের এসব নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যথা নেই। ষোল বাই বারোর অর্ধেক, আট বাই বারো ঘরটাই অনেকটা। একটা চার-ছয়ের তক্তাপোষ, তিন-দুই-এর সস্তা কাঠের টেবিল, একটা ফোল্ডিং চেয়ার আর একটা টিনের বড়ো বাক্স, আসবাবপত্র এই পর্যন্ত। টিনের বাক্সটা তক্তাপোষের তলায় ঢোকানো আছে। তার মধ্যেই যাবতীয় মূল্যবান সম্পত্তি। জামা-কাপড়, দুচারটে বই, অনুষ্ঠান কভার করে পাওয়া নানান গিফট আইটেম, আরও যতসব হাবিজাবি। গিফট আইটেমগুলোর বেশির ভাগই পূর্ণ-র মোড়ে বন্ধুর গিফট স্টোর্সে দিয়ে দেয় বিক্রির জন্য। তাতেও মাসে হাজার বারোশো হয়ে যায়।

গোবর্ধন ভোর সকালেই স্নান সেরে নিয়েছে। দেয়ালে টাঙানো সরস্বতী, মা কালী, গণেশ ও আরও কিছু ঠাকুর দেবতার ফটোয় প্রণাম সেরে ধূপকাঠি জ্বালিয়ে সারা ঘরে ঘুরিয়ে দেয়ালের ফাটলে গুঁজে দেয় ধূপকাঠিটা। ঘরে বেশ একটা শান্তির আবহাওয়া। কিন্তু গোবর্ধনের মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। পাখিদের কাকলি জনমানবের কলরবে চাপা পড়ে গিয়েছে, বেলা বাড়ছে। কী লিখবে, কাদের নিয়ে লিখবে আর কোথা থেকে যে শুরু করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। আসলে গোবর্ধন নিজের খরচের মধ্যে হাতখরচ আর মূল খরচের পার্থক্যটা ঠিক করতে পারে না।

প্রতিদিন সকালে স্নান সেরে ঠাকুরকে ধূপ দেখিয়ে একবাটি মুড়ি বাতাসা দিয়ে খেয়ে নেয় সে। তারপর ঢকঢক করে এক বোতল জল। বাড়ির সামনের টেপাকল থেকে নিয়ম করে তিন বোতল জল সকালে ভরে রাখে গোবর্ধন। এক বোতল সকালের জন্য, এক বোতল রাত্রির প্রয়োজনে আর একটা এক্সট্রা। এরপর জামা কাপড় গায়ে চড়িয়ে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সারা দিনের জন্য বেরিয়ে পড়া।

পকেটের রেস্ত বুঝে কখনও কালীঘাট ট্রামডিপোর সামনের ফুটপাতের হোটেলে ভাত-ডাল-মাছ বা কখনও ডালহৌসির অফিস পাড়ায় ফুটপাতের হোটেলে ফ্রায়েড রাইস চিলি চিকেন। পাঁচ সাতটা কাগজের কল্যাণে রাতের খাওয়ার খরচটা বেশির ভাগ দিনই বেঁচে যায়। মোটামুটি এই খাওয়ার খরচ ছাড়া মেট্রোর স্মার্ট কার্ডে মাসে পাঁচশ টাকা আর মোবাইলে দুশো টাকা রিচার্জ করলেই হয়ে যায়। এছাড়া আছে মেট্রো রুটের বাইরে এদিক ওদিকে যাওয়ার বাস ভাড়া। নিজের পয়সায় চা-সিগারেট-মদ কোনওটাই সে খায় না। এর মধ্যে মূল খরচ বাদ দিয়ে হাতখরচ-এর আলাদা হিসেব কষা বেশ কঠিন।

তবে গোবর্ধন শুনেছে অফিসবাবু, বাড়ির বউদি, স্কুল কলেজ পডুয়া, পড়াশোনা শেষ করে ঘুরে বেড়ানো বেকার ছেলে-মেয়ে সকলেরই একটা আলাদা হাতখরচ আছে। নিজের খরচের মধ্যে হাতখরচের ভেদাভেদ না করায় ও হাতখরচের বিশেষ তাৎপর্য না থাকায় এতদিন এ বিষয়ে গোবর্ধনের কোনও আগ্রহ ছিল না। এখন সেটা নিয়ে যত মাথা ব্যথা।

এতদিন ধরে দৌড়ঝাঁপের পরে দৈনিক জবর খবর-এ একটা লেখার সুযোগ পাওয়া গেল, সেটা ঠিক মতো নামাতে পারলে কাগজের সঙ্গে পাকাপাকি ভাবে জুড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু এমন একটা সাবজেক্ট দিল, যে-বিষয়ে তার জ্ঞান নিতান্তই সামান্য। সমস্যাটা সেখানেই। তবে একবার প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো পেয়ে গেলেই আট দশটা নিজস্ব পেটেন্ট শব্দ জুড়ে দিয়ে খসখস করে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ঝক্কাস লেখাটা নামিয়ে ফেলতে পারবে এ বিশ্বাস তার আছে। কিন্তু এসব তথ্য জোগাড় করবে কোথা থেকে? এখন সেটাই ভাবনার! রাস্তায় বেরিয়ে এবার থেকে চোখটা ঝানু গোয়েন্দার মতো জাগ্রত রাখতে হবে। দুচার জনের সঙ্গে গল্প করার ছলে তাদের হাতখরচের কথাটা জেনে নেওয়া যেতেই পারে। তাহলেই লিখতে পারবে এক্কেবারে আঁখো দেখা হাল।

গোবর্ধন আর দেরি না করে জলের বোতল দুহাতে উপরে তুলে ধরে ঢকঢক করে মুখে ঢেলে নেয়। তারপর বোতলটা টেবিলের পাশে নামিয়ে রেখে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রাস্তায় বেরিয়ে পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে টিপে দেখে নেয়, কটা বাজল। আটটা চল্লিশ।

নেপাল হালদার লেন থেকে বেরিয়ে এসে কালিঘাট ফায়ার ব্রিগেড পার হয়ে হাজরার মোড়ের কাছে যতীন দাস পার্কের সামনে এসে দাঁড়ায়। পার্কের রেলিং এর ধারে ইট বাঁধানো জায়গায় একটু ছায়া দেখে বসে। পার্কের রেলিং ধরে পনেরো বিশ জনের লাইন। সকলেই হাতে মোবাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করছে। গোবর্ধনও মোবাইল বের করে ফ্রি নেট সারভিস কানেক্ট করে কিছুক্ষণ ঘাঁটাঘাঁটি করে। ফেসবুকে আপডেট দেয়, দু-চার জনকে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজও পাঠায়। এখানে বসে বসেই গোবর্ধন মাথার মধ্যে এক্সেল ফাইল-এর মতো ছকটা এঁকে ফেলে।

মানুষগুলোকে কতগুলো ক্যাটাগরিতে ফেলা যায় ভেবে নিয়ে তাদের এক একটা রো-তে ফেলেছে। তাদের কার কোন কোন খাতে কত খরচ হয়? হাতখরচের মাসিক বাজেট কত হতে পারে? এগুলোকে এক একটা কলাম করে মনে মনে ছকটা সাজিয়ে নেয়।

হাজরার মোড়ে বসে ছকটা সাজিয়ে নিয়ে গোবর্ধন প্রথমে আশুতোষ কলেজের সামনের চা-জল খাবারের স্টলগুলোয় সময় কাটিয়ে সারাদিন চক্কর খেয়েছে পরিচিত বন্ধু-বান্ধবদের অফিস-বাড়িতে। কথায় কথায় কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে, বন্ধুপত্নীদের থেকেও হাতখরচের ব্যাপারটা আন্দাজ করেছে। কিন্তু সকলের হিসাব যেন কেমন অসম্পূর্ণ। হিসেবে একটা অঘোষিত রহস্য আছে, সেটা কেউই খোলসা করে বলতে চায় না! গোবর্ধন মনে মনে ভাবে, এই না বলা খরচগুলো তাকে সাংবাদিকের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে খুঁজে নিতে হবে।

তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কলেজের পুরোনো বন্ধু রজতের অফিসে আসা। অনেকদিন পর দেখা, গল্পে কথায় অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে, ছটা বাজে প্রায়। এবার যেন বন্ধুটি উঠবার জন্য উশখুশ করছে। আরও দু-চার জন অফিসের সহকর্মী পাশে এসে জড়ো হয়েছে। তারা রজতকে ওঠবার জন্য তাড়া লাগায়। অগত্যা গোবর্ধনও উঠে পড়ে। একসাথেই সকলে অফিস থেকে বের হল ঠিকই কিন্তু তারপর কখন যেন গোবর্ধনকে ফেলে রেখে অন্যরা সব দলছুট হয়ে গেল।

গোবর্ধন রহস্যের গন্ধ পেয়ে দূরত্ব বজায় রেখে পিছু নেয় ওদের। ওরা সব ললিত গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল পার হয়ে ডেকার্স লেনের গলিতে ঢুকল! পিছু পিছু এগিয়ে যায় সে। যেমন ধারণা ঠিক তেমন, দল বেঁধে সব পিংপং বার-এ ঢুকল। এখানে গানবাজনা হয়। পয়সা ফেললে সব কিছুই পাওয়া যায়। গোবর্ধন হিসেব কষে, রজত তো এই খরচের ব্যাপারটা বলেনি, চেপে গিয়েছে। কিন্তু এই খরচটা তো হাতখরচের মধ্যেই ধরতে হবে।

এখানে লাইন দিয়ে অনেকগুলো বার আছে। সেগুলো পার হয়ে গোবর্ধন পিয়ারলেস-ডেকার্স লেনের মোড়ে এসে দাঁড়ায়, এক কাপ চা নিয়ে সময় কাটায় অন্যদের অপেক্ষায়। এখানে তাদের অনেক সাংবাদিক বন্ধুই আড্ডা দিতে আসে। এখনও কাউকে দেখা যাচ্ছে না, হয়তো কিছু পরেই এসে পড়বে। গোবর্ধন চা শেষ করে আর অপেক্ষা না করে, পা বাড়িয়ে ধর্মতলা মোড়ে পিআরও সেবাব্রতের অফিসে পৌঁছোয়। নিয়ম করে মাঝেমধ্যেই এখানে ঢুঁ মারে সে। অনেক প্রেসমিটের ইনভিটেশন এখানে ডাইরেক্ট পেয়ে যায়।

আজ ছয়-আট ঘরটা প্রায় ভর্তি। পরিচিত দু-চারজন সাংবাদিককে পেয়ে গিয়ে গোবর্ধন কুশল বিনিময় করে। বসার জায়গা না পেয়ে সে দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে।

সেবাব্রত আগ বাড়িয়ে বলে, কাল একটা ফিলমের প্রিমিয়ার শো কাম প্রেসমিট আছে। বড়ো মিডিয়া হাউসকে ডাকতে বলেছে, তোমাকে ডাকতে পারলাম না। দ্যাখো, এদেরকেও ডাকিনি।

গোবর্ধন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শোনে। সেখানে উপস্থিত অল্পবয়সি মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে সেবাব্রত বলে, তুই কালকে ওই ব্ল্যাক ড্রেসটা পরে আসবি। একদম সেক্স বম্ব লাগবে, সবাই তোকে দেখে হাঁ করে থাকবে।

গোবর্ধন ঘাবড়ে যায়। প্রেসমিটে সেক্স বম্বের আবার কী প্রয়োজন! যাক, পরে আসব তবে, বলে কেটে পড়ে সে। এখন নতুন যুগ আর পরিবর্তন-উন্নয়ন পত্রিকার অফিসে যাবে একবার। কাছাকাছিই অফিস পত্রিকা দুটোর, আটটা সাড়ে আটটা পর্যন্ত থাকে অনেকেই।

পরিবর্তন-উন্নয়ন পত্রিকা অফিসে ঢোকবার মুখে সুলেখার সঙ্গে দেখা। সেবাব্রতের অফিসে পরিচয় হয়েছিল সুলেখার সঙ্গে। তারপর ওখানেই পরে বেশ কয়েক বার দেখা হয়েছে, গল্প করেছে। বেশ মিশুকে, মালটি ট্যালেন্টেড মেয়ে গল্প কবিতা চিত্রনাট্য লেখে। তিন চারটে শর্ট ফিল্ম ডিরেক্টও করেছে। বেশ কিছু বড়ো মাপের লোকজনের সঙ্গে জানাশোনা আছে ওর। কেউ নেতা-মন্ত্রী বা কেউ বড়ো ব্যবসাদার। গায়ের রংটা একটু চাপা হলেও সুলেখার হাইট ভালো, বেশ সেক্সি ফিগার। হাতে ধরা সিগারেটে টান দিয়ে এগিয়ে আসে গোবর্ধনের দিকে।

—বর্ধনদা কেমন আছেন?

গোবর্ধন ইতিবাচক মাথা নাড়ায়। সুলেখার মুখে বর্ধনদা সম্বোধনটা বেশ লাগল শুনতে। কেউ তো এভাবে ডাকে না। মেয়েটা বুদ্ধি করে গো বাদ দিয়ে তাকে একটু জাতে তুলে দিল।

—যান ঘুরে আসুন। আমি এখানে অপেক্ষা করছি, একসঙ্গে ফিরব।

গোবর্ধন হাসি মাখা খুশি মনে এগিয়ে যাওয়ার সময় বলে যায়, বেশ তাই হবে।

মিনিট দশেক পরে গোবর্ধন বেরিয়ে এসে দেখে রাস্তার রেলিং-এ ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সুলেখা আরও একটা সিগারেট ধরিয়েছে। গোবর্ধন মনে মনে ভাবে, মেয়েটার তো বেশ হাতখরচ হয়রে বাবা। সিগারেটের পিছনেই না কত খরচা!

গোবর্ধনকে দেখে সুলেখা এগিয়ে আসে।

—কাজ মিটল? কদিন ধরে আপনার কথা ভাবছিলাম কিন্তু নাম্বারটা পাচ্ছিলাম না। কী ভাগ্য, আজ হঠাৎ দেখা হয়ে গেল।

তাকে খুঁজছে জেনে গোবর্ধন বিস্মিত হয়! আমাকে আবার বিশেষ কী প্রয়োজন? কোথাও ভুল কিছু করেছি নাকি?

—না না, সে রকম কিছু নয়। আপনাকে আমারই দরকার। একটা ফিচার ফিলম করছি। প্রোডিউসার ফাইনাল। এখন স্ক্রিপ্ট নিয়ে ভাবছি। চলুন না ই-মলের উপরে একটু বসি। স্ক্রিপ্ট নিয়ে আলোচনা হবে।

গোবর্ধন আমতা আমতা করে বলে, আমি! আমি তোমার ফিলমে কী কাজে লাগব? সুলেখা হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে।

—আরে বাবা চলুন না। একটা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বসে কফি খাবেন, গল্প করবেন। তাতেও কিন্তু কিন্তু!

এমন লোভনীয় প্রস্তাবে গোবর্ধনকে ম্রিয়মান দেখে সুলেখা বলে, আজকের খরচা আমার। গোবর্ধন লজ্জা পায়।

—না না তা কেন, দুজনে ভাগ করে নেব।

সুলেখা বলে, না তার কোনও প্রয়োজন নেই। পরের দিনটা আপনার।

গোবর্ধন মনে মনে ভাবে তাহলে আজকের পরে আবার কফি হাউসে বা রেস্টুরেন্টে বসবে ওর সঙ্গে। অবিবাহিত গোবর্ধনের মনে রোমান্স উঁকি ঝুঁকি মারে। ই-মলের উপর তলায় ফুড কোর্টে বসে সুলেখা কফি অর্ডার করে, সঙ্গে দুটো ফিশফ্রাই। দুজনে টেবিলে সামনা সামনি বসেছে।

গোবর্ধন কথা পাড়ে, তোমার ফিলমের জনার কী? গল্প ঠিক হয়েছে?

সুলেখা মুখ বেঁকিয়ে বলে, ঠিক হয়নি এখনও, হয়ে যাবে একটা। তবে হ্যাঁ প্রোডিউসার ফাইনাল। ছিপে গেঁথে নিয়েছি। বর্ধমানে রাইস মিল, কোল্ড স্টোরেজ আছে। কলকাতাতেও প্রোমোটিং করছে। ভালো পলিটিক্যাল কানেকশন আছে, শুনেছি ওদের টাকা পয়সাও এর হাত দিয়ে খরচা হয়। গত সপ্তাহে মন্দারমনিতে গিয়েছিলাম একসঙ্গে। ওখানেই সব ফাইনাল হল। এই ফিলমটার পাশাপাশি একটা ডেইলি নিউজপেপার পাবলিশ করার কথা হয়েছে। চেনাজানা সব সাংবাদিক বন্ধুরা থাকবে সঙ্গে। আপনি থাকছেন তো? গোবর্ধন যেন হাতে চাঁদ পায়।

—হ্যাঁ হ্যাঁ তোমার পেপারে থাকব না মানে! থাকতেই হবে। মুখে এসব বললেও প্রোডিউসারের সঙ্গে মন্দারমনি যাওয়ার ব্যাপারটা জেনে মনের মধ্যে কেমন যেন একটা খচখচ করছে। আবার নিজেই ভাবে, যাক গে যার যা ইচ্ছে সে তা করুক তার কী!

—তাহলে কালচারাল পেজের এডিটর হচ্ছেন আপনি।

গোবর্ধন সলজ্জ ভাবে বলে, আমি কিন্তু পলিটিক্যাল আর্টিকেলও লিখি।

—সম্পাদকীয় কলমে মাঝেমধ্যেই লিখবেন। নিজেদেরই তো পেপার। গোবর্ধন খুশি আর উত্তেজনায় সুলেখার হাতের উপর হাত রাখে।

—আমি আছি তোমার সঙ্গে। এখন থেকে পেপারের ব্যাপারে যে-কোনও প্রয়োজনে, যখন খুশি আমায় ফোন করবে।

সুলেখা গোবর্ধনের হাতটা আলতো করে ধরে হাতের উপর থেকে নামিয়ে দেয়। চোখের কোণে উঁকি দেয় দুষ্টুমি।

—বর্ধনদা, আপনার লেখা কোনও ভালো গল্প আছে? মানে এই মিডিল ক্লাস সোসাইটির প্রবলেম, কারেন্ট কোনও ইসু্, টানটান উত্তেজনা, শেষে একটা মনকাড়া সলিউশন।

—আছে আছে, এই সবে লেখাটা শুরু করেছি। দু-এক দিনের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে।

—তাহলে ওই লেখাটা নিয়ে আমি ফিলম করছি। ফাইনাল। দুজনে মিলে আলোচনা করে স্ক্রিপ্টটা লিখব। গোবর্ধন খুশিতে উত্তেজিত হয়ে ওঠে।

—আমি স্ক্রিপ্টও লিখব?

—বাঃ আপনার গল্প, আপনিই তো ক্যারেক্টারগুলো ভালো করে চিনবেন। আপনিই তো সেটআপ, এক্সপোজিশন, স্ট্রাগল, কনফ্লিক্ট, ক্লাইম্যাক্স, রেজিলিউশন ভালো ভাবে বুঝবেন। আমার ফ্ল্যাটে এক্সট্রা রুম আছে। ওখানে আরামসে বসে লিখতে পারবেন। একসঙ্গে খেয়ে নেব। প্রয়োজনে রাত্রিতে থেকেও যেতে পারবেন। সুলেখার চোখেমুখে দুষ্টুমি খেলে যায়।

গোবর্ধন ঢোঁক গিলে বলে, আগে স্ক্রিপ্ট লেখাটা তো শুরু হোক। সে দেখা যাবেখন। আমার তো কালীঘাটে বাড়ি, রাত্রি হলেও ফিরতে তেমন অসুবিধা হবে না।

ওয়েটার এসে বিল দিয়ে গেল, তিনশো আশি টাকা। সুলেখা ব্যাগ খুলে টাকা বের করতে যায়। গোবর্ধন চেঁচিয়ে ওঠে, না না তুমি দেবে কেন? আমি দেব, সঙ্গে একজন পুরুষ মানুষ থাকতে, তুমি…।

সুলেখা গোবর্ধনের হাত চেপে ধরে রেখে পাঁচশো টাকার নোট বের করে দেয় বিল পেমেন্টের জন্য। গোবর্ধন দেখল ওরকম আরও অনেকগুলো পাঁচশো টাকার নোট সুলেখার ব্যাগে আছে। তার কাছে থাকা একমাত্র পাঁচশ টাকার নোটটা আস্তে আস্তে মানিপার্সে ঢুকিয়ে রাখে।

গোবর্ধন বলে, পরের দিনের খরচা কিন্তু আমার। জোরাজুরি করবে না সেদিন।

দুজনে দুজনের ফোন নাম্বার, হোয়াটসআপ নাম্বার আদান প্রদান করে টেবিল ছেড়ে ওঠে।

বাড়ি ফিরে লিখতে বসে, হাতখরচের নতুন পাওয়া পয়েন্টগু-লো লিখতে থাকে গোবর্ধন। এই যেমন সুলেখার সিগারেটের খরচ, রজত ও তার বন্ধুদের বারে যাওয়া ও তৎ-পরবর্তী খরচ আর দুজনে মিলে একান্তে বসলে রেস্টুরেন্টে কফি-স্ন্যাক্স-এর খরচ।

গোবর্ধন বুঝে গিয়েছে এতদিন হাতখরচের ব্যাপারে মাথা না ঘামালেও আগামী দিনে তার কিছু হাতখরচ হবেই, সেটা পাক্কা। আর তার জন্য একটা বাজেট করতে হবে। এই যে সুলেখা বলল ওই বিজনেস পার্সন-এর সঙ্গে মন্দারমনি গিয়েছিল। তা যাওয়া আসা, হোটেল-রিসর্ট-এ থাকার খরচটা কি সুলেখার? না যার সঙ্গে গিয়েছিল তার? এমন খরচা তারও তাহলে ভবিষ্যতে হতে পারে।

লেখাটা বেশ অনেকটা এগিয়েছে। কিন্তু আগামী দিনে হাতখরচের সংস্থান করার চিন্তাটা চেপে বসেছে গোবর্ধনের মাথায়। হাতখরচের বাজেট রাখতে গেলে উপার্জন বাড়াতে হবে। উপার্জন যত বেশি হবে, হাতখরচও তত বেশি করা যাবে। ভাবে রজতের তাহলে বেশ উপার্জন, তাই না ফি সন্ধেয় বারে বসে খরচা করতে পারে।

রজতের বাঁশদ্রোণীতে দোতলা বাংলো টাইপের বাড়ি। গাড়ি বাইক দুটোই আছে। গত বছর মেয়েকে পঞ্চাশ-ষাট লাখ টাকা খরচা করে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজে ভর্তি করেছে। ওর বউ বেশ সুন্দরী, সুন্দর ফিগার, বয়সে প্রায় তার বউদিরই মতো। তবুও এখনও…। নিশ্চয় সে নিয়মিত জিমে, বিউটি পার্লারে যায়। এসবেও তো খরচা আছে।

পরদিন গোবর্ধন হাতখরচের ব্যাপারে অজানা আরও অনেক কিছু তথ্য হাতে পেল। আশুতোষ কলেজের পাশে লাইন দিয়ে বসে থাকা ছেলে-মেয়েগুলোর কথা, ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে আড়ি পেতে শুনছিল। ওদের অনেকেই মনের সুখে বসে সিগারেটে সুখটান দিচ্ছে, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে। তবে মেয়েদের সংখ্যাটাই যেন বেশি। ওদের মধ্যে কয়েক জন ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে হুক্কা বারে যাওয়ার প্ল্যান করছিল। সেটা আবার কী? গোবর্ধন দাঁড়িয়ে ভাবতে ভাবতে ওরা বুক করা ক্যাবে চেপে বেরিয়ে গেল।

আরও বড়ো বিস্ময় অপেক্ষা করছিল গোবর্ধনের জন্য। নিউটাউনের দিকে এসেছিল একটা রিপোর্টিং-এর জন্য। আজই সকালে ফেসবুকে জেনেছে সুলেখার জন্মদিন কাল, একটা কিছু গিফট দিতেই হয়। কিছু একটা কেনার উদ্দেশ্যে সিটি সেন্টার-এ এসেছিল। কিন্তু যা দেখল তাতে তো নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছে না! –

মামাতো ভাই অতীন-এর বউ মিতা, এ কার সঙ্গে এসেছে মলে! ওর থেকে অল্প বয়সের ছেলেটির হাত ধরে ঘনিষ্ঠ ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অতীন গোবর্ধনের সমবয়সি। অতীন-মিতা নিঃসন্তান। অতীন মুম্বইতে বড়ো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির রিজিওনাল ম্যানেজার। মিতা রাজ্য সরকারের অফিসে অফিসার। গোবর্ধন ঘুরে ঘুরে ওদের পিছনে পিছনে ঘুরতে থাকে।

মিতা একটা দামি ব্র‌্যান্ডের শোরুম থেকে ছেলেটির জন্য প্যান্টশার্ট কিনে কার্ডে পেমেন্ট করল। ছেলেটি মিতাকে হাগ করে আলতো কিস করে। গোবর্ধন ভাবে এসবেও তো হাতখরচই হচ্ছে। সুলেখার জন্য কিছু একটা কিনতে যে এখানে এসেছিল, সেটাই প্রায় ভুলতে বসেছিল। হঠাৎ সম্বিত ফেরে। কিন্তু সে কিনবেটা কী? টপ, জিনস, শার্ট, ট্রাউজার না শাড়ি? সুলেখার প্রোপোরশনেট শরীর সে সামনে বসে দেখেছে কিন্তু পোশাকের সাইজ আন্দাজ করা মুশকিল।

শাড়িই ভালো, কোনও মাপজোক-এর প্রয়োজন নেই, সকলের জন্যই সমান। একটা শাড়ি পছন্দ করে ভালো করে গিফট প্যাক করিয়ে নেয় গোবর্ধন। পকেট থেকে ডেবিট কার্ডটা বের করে দেয় পেমেন্ট করার জন্য। তারও একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে, একটা ডেবিট কার্ডও আছে। তবে আজই প্রথম সেটা ইউজ করল। পয়সা খরচের সঙ্গে সঙ্গে কেমন যেন একটা সুখানুভুতি হচ্ছে গোবর্ধনের। এটাই বোধহয় গোবর্ধনের প্রথম হাতখরচ।

সুলেখাকে চমকে দেবে বলে পরের দিন সকাল সকাল উঠে স্নান সেরে, পরিষ্কার জামা কাপড় পরে লেক মার্কেট থেকে ফুলের তোড়া মিষ্টি কিনে নিয়েছে। আগের দিনের কেনা গিফটটা নিয়ে সুলেখার ফ্ল্যাটে যাবে বলে বেরিয়ে পড়ে। বাইপাসের ধারে সারি সারি নতুন সুন্দর ফ্ল্যাটগুলোতে বাস করছে কত না স্বপ্ন।

গড়িয়ার বাইপাস যেন এখন ফুল বাগিচার মধ্যে বিছানো এক সুরম্য পথ, যা পৌঁছে দেবে তাকে তার ঘুম কাড়া স্বপ্নের কাছে। এইসব ফ্ল্যাটের কোনও একটাতেই থাকে সুলেখা। মেট্রো থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে চলেছে গোবর্ধন। গত রাত্রে লেখাটাও শেষ হয়েছে। চাপমুক্ত। হালকা মনে একটা স্বপ্নিল সুখানুভুতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে সে। এই ভালো লাগার মধ্যেও কেন যে বুকটা দপদপ করে নাচছে। এমন তো তার আগে কখনও হয়নি!

ফ্ল্যাটের গেটে নাম লিখিয়ে ছতলা ফ্ল্যাটের চার তলায় উঠে আসে লিফট বেয়ে। তার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের রক্তচাপও যেন উপরে চড়ছে উত্তেজনায়। ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে কলিং বেল টিপতে সুলেখা এসে দরজা খুলে দাঁড়ায়। সদ্য ঘুমছাড়া জড়ানো চোখ। পরনে হাউস কোট, উপর থেকে বুকের কাছ পর্যন্ত কয়েকটা বোতাম খোলা।

গোবর্ধনের দৃষ্টি হঠাৎ সুলেখার মুখ ছাপিয়ে বুকের খাঁজে আর পাশের দৃশ্যমান গোলকে এসে থামে। গোবর্ধন নিজেকে সামলে চোখ সরিয়ে মুখ তুলে বলে, শুভ জন্মদিন।

কিছু ভাববার আগে, প্রত্যুত্তর-এর বদলে সুলেখা হ্যাঁচকা টানে গোবর্ধনকে ভিতরে টেনে ঢুকিয়ে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। কখন যে ছাড়া পাবে এখান থেকে বলা যায় না। আজ হাতখরচের উপর লেখা আর্টিকেলটা দৈনিক জবর খবর-এর অফিসে জমা দেওয়ার ছিল, সঙ্গেই এনেছে। কিন্তু সে সময় কি আজ আর পাবে!

তবে লেখাটা শুরুর সময় যে উত্তেজনা ছিল গোবর্ধনের, সেটা এখন অনেকটা স্তিমিত। এখন গোবর্ধনের নতুন অ্যাসাইনমেন্ট। এখন তো সুলেখার ফিলমের স্ক্রিপ্ট লিখতে হবে, সুলেখার নিউজ পেপারের এডিটোরিয়াল করতে হবে। সুলেখার জন্য আরও কত কী যে করতে হবে! গোবর্ধনের বুঝি এতদিনে একটা ফুলটাইম কাজ জুটল।

 

মনসাসুন্দরী

ওই যে ধন্যিমেয়ে বইতে উত্তমকুমার দাঁত মুখ খিঁচোয়ে ওর অমন সুন্দর ভাইডারে বলতিছিল গো, এই বগলা গোল দে, এই বগলা গোল দে, ত্যাকোন থে মুঁই বগলার প্রেমে। আহা, কচি কলাপাতার মোতন ডগমগে রূপ ঝ্যামোন, আর নামডাও তেমনি ডাংগুলির গুলি ঝ্যানো। বনবন করি হাওয়ায় ঘুরতি ঘুরতি বুকের ভেতর সেঁইধে যায়।

বেশি লোকজন নেই। কাজের সুবিধেই হয়েছে। স্টেশনের দুচারজন দোকানদার কলকাতার বাবুদের দেখে পায়ে পায়ে এসেছে। তা আসুক। এটুকু ঝক্কি সামলেই ওরা কাজ করে।

তা যা বলেন বাবুরা, ত্যাকোন থে মোর মাথাটা লড়বড়ে হুয়েছে। ওই যে গেরামের মাঠে তাঁবু খাটায়ে বই পড়ল। মুঁই ধন্যিমেয়ে দ্যাকলাম। ব্যাশ, মোর প্রেম পালো। মনে মনে ঠিক করি নিলাম, না আর মুঁই মাঠে গোবর কুড়ব নে। মোর একখান বগলা চাই-ই চাই। আর সারা দিনমান ঘরে, বাইরে, পুকুরঘাটে— ঝিদিক পানে যাই না ক্যান, সিকেনেই গানখানা গুনগুন করি। জয়া ভাদুড়ি গেয়েছিল গো। বইয়ে তার নাম মনসা ছেল। আর মোর নামও মনসা। হি হি হি!

তা দিদি, ওই গানটি একটিবার শোনাও আমাদের! মদন, ভাই দোকানদারকে বল না, টিনের গেলাসে দু-কাপ চা আর কয়েকটা ভালো বিস্কুট কাগজে মুড়ে দিতে।

সামনে থেকে টিনের গেলাস তুলে নিয়ে মদন নামে ছেলেটি প্ল্যাটফর্মের স্টলে চা আনতে গেলে বেশ উৎসাহ লাগিয়ে মনসা বলে ওঠে, চা খাওয়ার আগে গাতি হবে, না কি পরে গাবানে?

দিদি, তোমার মন চাইলে এখনই গাইতে পারো।

মনসা মাথাটা চুলকে নেয়। উকুনগুলো সড়সড় করে চলে ফিরে কিছু বলছে। ও কান পেতে ওদের কথা ধরার চেষ্টা করে। এক কানে হাত চাপা দিয়ে অন্য কানের দিকে চোখ আর মন যত্ন করে লাগায়।

তার একমাথা চুল কাকের বাসার মতো নয় ঠিক, তবে বেশ এলোমেলো। মাঝে মাঝে চুলকোয়। তবে উকুন মারে না সে। উকুনরা যে তার আশ্রয়ে আছে। গুটি কয়েক প্রাণকে সে তার এই বিরাট মাথার ভেতর আশ্রয় দিয়েছে, তা কী এমন বেশি! তাছাড়া সন্ধের পর এই নির্জন প্ল্যাটফর্মে কার সাথে কথা কয়ে সময় কাটাবে! ওরা না থাকলি অমন থেবড়ে বসা রাতখানা কাটায় কী করে সে! ঘুম তো আসতি চায় না। ওদের সাথেই তো সুখ-দুঃখের কথা কইতে কইতে ভোরের ট্রেনের খবর নেয় কানে। প্যাসেঞ্জারের পায়ে শব্দে মনে আরাম হয়।

সুধাময়, প্রাণেশ, টিঙ্কু-রা নানা কোণ থেকে ছবি তুলছে, তবে গোপনে। স্টেশন চত্বরের চার-পাঁচজনের ভিড়টা লক্ষ করেনি যে ছবি উঠছে খেপির। তারা দেখছে একজন নীল জিন্স প্যান্ট আর কালো টি-শার্ট পরা সুন্দর মতো লোক মাটিতে পা মুড়ে বসে খেপির সাথে কথা বলতে লেগেছে।

কদবেলের দোকানদার উবু হয়ে বসে সবটা বুঝতে চাইছিল। সে বলল, গা তো খেপি ওই গানটা। কদবেল মাখা দেব দুপুরবেলায়। গা।

প্যাসেঞ্জাররা তাড়াহুড়োয় দেখে না সবটা। কদবেলওলা বেল ফাটিয়ে চিনি, লংকা, নুন, ধনেপাতা আর কাসুন্দি দিয়ে মেখে তুলে দেয় প্লাস্টিকের বাটিতে। কিন্তু গেলাসের নীচে খানিকটা যে ফেলে রাখে দোকানদার তা নজরে পড়ে না খদ্দেরদের। আর পরেরটা বানানোর আগে দোকানদার চামচ দিয়ে টেনে তুলে তা একটা বাটির ভেতর রেখে দেয়। দুপুর পর্যন্ত যা জমে তা খেপিকে এক ফাঁকে দিয়ে আসে।

মনসা উকুনদের সাথে কথা বলা ছেড়ে দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় লুঙ্গি পরা, বুক খোলা পেট উঁচু ওই কদবেল দেওয়া লোকটার দিকে। তার চোখের তারায় মেঘ ঢোকে। ছায়া লাগে মুখে, বুকের ভেতর জয়া ভাদুড়ির সেই আদুরে আর অভিমানী মুখের ঢল নামে। পেটের ভেতর গুড়গুড় করে, গলা খুসখুস করে। কথা হয়, কিন্তু কেউ শোনে না। শুধু মনসা ঠোঁট নাড়ে জয়া ভাদুড়ির মতো। উকুনেরা দিব্যি শুনতে পায় তা যা যা বেহায়া পাখি যা না। অন্য কোথা যা না, কেউ করেনি মানা।

ভিডিও রেকর্ডিং করছিল যে মোবাইলগুলো, তারা একটু একটু এগিয়ে আসে। প্ল্যাটফর্মের একটা গোটা দিক, রেল লাইন, সিগন্যাল, স্টেশনের নাম লেখা কংক্রিটের বোর্ড, একটা খেঁকুরে কুকুরের হেঁটে যাওয়া কিছুই বাদ যায় না। তারা মোবাইল ফোনের লেন্স মনসার দিকে যতটা পারে জুম করে। সামনে বসে গল্প করতে থাকা ওদের এডি শুভঙ্করের ছবিও একই ফ্রেমের ভেতর রাখতে হবে যে।

মনে হয় এবার গান শুরু হবে। গান আর মুখের প্রথম অভিব্যক্তি ধরা চাই। তারপর কলকাতায় ফিরে, এডিটিং করে, মনসা পুজোয় মনসার গান ক্যাপশন দিয়ে ইউ টিউব-এ ছাড়বে কাল। কাল যে শ্রাবণ মাসের শেষ, মনসা পুজো।

টিউবে ওদের চ্যানেলের নাম দ্য নেচার। কৃত্রিমতাহীন সবকিছুই ওদের সাবজেক্ট। বাজারে খাসি কাটার দৃশ্য, তার ব্যা ডাক, আর অল্প পা-দাপানো যেমন থাকে, তেমনি ঘুঘু পাখি, পায়রা বা ফড়িং-এর সোহাগদৃশ্য হাঁ করে দেখছে তিন-চার বছরের বাচ্চারা, তাও দেখায়।

ওরা চায় প্রাকৃতিক কিন্তু অড সাবজেক্ট। এই আগস্ট মাসের শুরুতেই একটা ভিডিযো গোটা ইউ টিউবে হইচই ফেলেছে। সেটা ছিল, হাত-পা হীন এক কিশোরীর সমারসেট ভল্ট। সে গ্রামের দিকে হাটে বাজারে খেলা দেখায়। সুন্দরী মেয়েটি একেবারে পেঙগুইনের মতো কোমরের নীচে একটুকু ছড়ানো থাই দিয়ে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতেই সে মাটি থেকে শূন্যে লাফ দিয়ে উঠে ডিগবাজি খেয়ে আবার দাঁড়ায়। এরপর সে মাদারি খেলার মতো দুটো বাঁশের আগায় বাঁধা দড়িতে উঠে যায়। তার তো হাত নেই। সে ব্যালান্সের লাঠিটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে দড়ির এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে বাবার ডুগডুগির বাজনা কানে নিয়ে চলে যায়। তারপর আবার ফেরে। ফিরে আসে দড়ির মাঝখানে। সেখান থেকে সে মুখের সরু বাঁশটি ফেলে দেয়। ডুগডুগিতে দ্রিমি দ্রিমি দ্রুতলয়ে বাজে। সে ওখান থেকে ঝাঁপ মারে মাটিতে। শূন্যে দুটো-তিনটে ভল্ট দিয়ে সে অনায়াসে মাটিতে দাঁড়ায় থপ করে। তার ঘন করে লাল করা ঠোঁট খুলে যায়, এক ঝলক সাদা দাঁত হাসির বিদ্যুৎ ছড়ায়।

মনসাদি গাও।

এটা কলকাতার বাবু, সামনে যে বসে আছে, তার গলা। যে এসেই একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়েছে। তার কথা মান্যি করবে না তো মদনার কথা শোনবে! তারপর বাবু একেবার মনসার সঙ্গে মাটিতে বসেছে। কেমন লেপটে বসেছে। হি হি হি স্টেশনের ধুলো-ময়লার কোনও জ্ঞান-গম্যি নাই বাবুর। তারে কেমন নিজের নিজের লাগে মনসার। এসব ভাবতে ভাবতে সে বলেই ফেলল, গাইব! কোনটা গাতি হবে বল ত?

মদন চায়ের গেলাস আর পাউরুটির ঠোঙায় জড়ানো বিস্কুট নিয়ে সিনের ভেতর এন্ট্রি নিয়ে ফেলেছে। এখানে তো কাট, ক্লাপস্টিক-এর ব্যাপার নেই। মনসা চায়ের গেলাস হাতে তুলে নিয়ে চুমুক দিতেই একটা মোবাইলে ধরা পড়ে তার মুখে কী সরল হাসির ঝিলিক খেলে গেল। মেঘের ভেতর থেকে এক চিলতে রোদের মুখ বার করার মতো। তারপর সে কাগজে মোড়া হাতের বিস্কুট থেকে একটা লম্বা বিস্কুট নিয়ে চায়ের গেলাসে ডুবিয়ে কামড় দিল।

আহ! কি দারুণ দাঁত! একেবারে সুচিত্রা সেন না!

প্রাণেশ এর কাছাকাছি চলে এসেছিল টিঙ্কু। এই যে গান হবে হবে করে হচ্ছে না, তাতে ওর বিরক্তি লেগে গেছে। আর অফিসের বস ইচ্ছে করে ওকে পাঠিয়েছে এত দূরে। শয়তানি আর কী! না হলে কলকাতার মেয়েকে এতটা দূরে সমুদ্রগড়ে পাঠানো কেন!

প্রাণেশ টিঙ্কুর দিকে ফিরে বলল, যা বলেছিস। একে সাজিয়ে গুছিয়ে চোখে কাজল আর চুলের কলি কানের উপর টেনে বের করে একখানা সাদা কালো হাসির সাইড ভিউ তুলে নিলে দর্শকরা স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকবে। কে কত উত্তম-সুচিত্রা জুটির সিনেমা দেখেছে, আর তাঁদের সিনেমা দেখে প্রেম করতে শিখেছে কেমন ভাবে দিব্য ঘোরের ভেতর ঢুকে যাবে। সাবস্ক্রাইব করে ফেলবে এক দিনেই কয়েক হাজার।

খেপি, তাড়াতাড়ি চা খাওয়া শেষ কর। গানটা গা।

ওই লুঙ্গি পরা লোকটা আবার এন্ট্রি নেয়। কী করবে, খানিকটা মস্করাটস্করা করে সময় কাটাতে চায় কদবেল, আমড়া, কল-ওঠা ছোলার দোকানদার। ট্রেনের ঘন্টা হয়নি। ট্রেন না এলে তার খদ্দের নেই। পরের আপ ট্রেন ঢুকতে এখনও ঘন্টাখানেক।

চায়ের ভেতর বিস্কুট ডোবাতে ডোবাতে মনসা ডুব দিয়েছে ভাবনায়। এই যে সামনে উবু হয়ে বসে আছে বুক খোলা দোকানদার, সে যে কদবেল আর ছোলা খাইয়ে কতবার তাকে খেয়েছে সন্ধাবেলায় নদীর চরে নিয়ে গিয়ে তার ইয়ত্তা নেই। বেহুলা নদীর পাশে সরু কাশ বনের ভেতর অনেকখানি জায়গা বেশ পরিষ্কার। কাশ আর হোগলা শুকিয়ে বেশ অনেকটা জায়গা বিছানার মতো করে রাখা। সেসব খুব মনে পড়ছে এখন মাথা নীচু করে থাকা মনসার। এই কদবেলের কারবারি ছাড়াও লাইনের ওপারে ভাতের হোটেলের থালাবাসন ধোওয়ার লোকটাও তাকে নিয়ে গেছে কয়েকবার সেখানে। বদলে সে প্রায় সন্ধেতে দুটো আলাদা আলাদা প্যাকেটে গুছিয়ে রাখা সারাদিনের হোটেলের খদ্দেরদের ফেলে দেওয়া ভাত তরকারি এনে দেয়। মনসা আরাম করে খায়।

তার এখন মনে এল, এই লোকটার বাচ্চা তো সে পেটে ধরেছিল। সেটা ছেলেই হবে। আর ওই হোটেলের লোকটার মেয়ে তারা সব কোথায় গেল! ওরা সব কোথায় গেল! হারিয়ে গেল! মনে পড়ল তার, চাঁদ, তারা বন্ধু আমার ছিল।

হেমন্তের গান। বগলার সাথে ভাব হবার পর বগলা রেডিও কিনে দিয়েছিল। লাল টুকটুকে রেডিও। সেখান থেকে শুনে শুনে কত গান যে শিখেছে সে।

মনসা জানে এই যে সে বিড়বিড় করে কথা কইছে, গান গাইছে, উকুনেরা সেসব শুনছে কান পেতে। তখন ওরা চুপ করে থাকে। মাথায় নড়াচড়া করে না। মনসার মাথা চুলকোতে হয় না। এই কথা বলা বা গান গাওয়ার তালে মনসা ওদের জব্দ করে রাখে। ওরা ভালো ছেলেমেয়ের মতো মনোযোগী হয়। মনসার গান, গল্পে মজে যায়।

মনসা চুপি চুপি মুখে মৃদু হাসি টেনে এখন মাথা নিচু করে ওদেরই শোনাচ্ছে সব। উকুনদের শোনাচ্ছে মনসার পুরোনো জীবন। অনেকগুলো বছর আগে ছেলে-মেয়ে সহ ওদের তিনজনকেই নবদ্বীপ স্টেশনে ভিক্ষা করতে রেখে এসেছিল এই কদবেল ব্যাপারী-ই। তখন বয়স অনেক কম, শরীরে যৌবন থইথই করছে।

শ্রীচৈতন্য ভক্তরা স্টেশনে নেমে গেটের বাইরে বেরিয়ে দেখত একখানা রাধা যেন বসে আছে। দিতও হাত খুলে। মেলা মানুষ, মেলা পয়সা। কিন্তু ভিড় যে-ভালো লাগে না মনসার। একদিন ট্রেনে চেপে নিজে নিজে ফিরে আসে পুরোনো জায়গায়। বাচ্চা দুটোর কথা ভুলেই মেরে দেয়। তা সে দুটো গেল কোথায়! এতদিনে তো ডাগর হওয়ার কথা!

মদনাকেই দোষারোপ করা শুরু করেছে সকলে। ওর কোনওদিন কাণ্ডজ্ঞান হবে না। কোন সময় কী করা উচিত, তা নিজে নিজে কিছুতেই ভেবে উঠতে পারে না। একদম কলের পুতুল। তা না-হয়ে ওর উপায় কী! অভ্যাস অভ্যাস! ও যে-মাছের দোকানে কাজ করত আগে, সেখানে তো ছিল ভিড় আর ভিড়। সকালবেলায় দম ফেলার ফুরসত নেই। মাছ মাপার সঙ্গে সঙ্গে আঁশ ছাড়াতে হতো। তারপর দোকানদার মাছ কাটতেই ডাক্তারকে চিৎকার করে ডাকা। সেই মাছের ডাক্তার রুইমাছের মাথার ভেতর সন্না ঢুকিয়ে একটা গোলমতো সাদা কড়াইয়ের দানা টেনে বের করে নিজের বাঁ হাতের তালুতে লাগিয়ে নিয়ে চলে যেত। তখন মদনের কাজ মাছের মাথার কানকো ফেলে দেওয়া। তারপর সাদা পলিথিনের প্যাকেটে মাছ ভরা আর গুছিয়ে খদ্দেরের হাতে তুলে দেওয়া। এই রুটিনের বাইরে তার তো ভাবার কোনও অধিকার নেই। দুপুরের দিকে দোকান গুটোনোর কাজ, মাঝেমধ্যে খইনি বানানো সেসব এক্সট্রা। অন্যমনস্ক হলেই চোদ্দো-গুষ্ঠির আকাশ থেকে নেমে আসার মতো গালাগালির বৃষ্টি। একদিন তো সেই মাছের ব্যাপারী লাথি মেরেই বসল ভরা বাজারে, অত লোকের সামনে। সেই দিনই মদন কাজ ছেড়ে চলে এসেছে। এখানে প্ল্যাটফর্মে সে জুতো পরিষ্কার করে। তাতে কম টাকা হলে হোক, কারও কথা তো শুনতে হয় না।

মদনও দেখল মনসাদি চায়ের গেলাসে বিস্কুট ডুবিয়ে ফিকফিক করে হাসছে। আর গেলাসের ভেতর দেখছে। সে বুঝতে পারল বিস্কুট ভিজে গিয়ে হাত ছুটে গেলাসের নীচে পড়ে গিয়েছে। সে এক দৌড়ে গিয়ে চায়ের দোকান থেকে একটা চামচ এনে দিতেই মনসাদির হাসি মুখ থেকে সারা গালে ঝাঁপিয়ে পড়ল। যেমন চাঁদ ঝাঁপিয়ে পড়ে কোজাগরীতে। সে চামচ দিয়ে গোলা বিস্কুট তুলে তুলে খেতে লাগল।

কী চার্মিং না! কী সরল না! প্রাণেশ একেবারে বিগলিত। সে টিঙ্কুর চোখে চোখ রাখে।

জানিস, আমার ছোটোবেলায় এরকম হতো। দুধের ভেতর ঢুকে যেত বিস্কুট। আঙুল দিয়ে তুলতে গেলে হাতে ছ্যাঁকা লাগত। তখন বাধ্য হয়ে সব দুধটা চোঁ চোঁ মেরে দিতাম ওই বিস্কুট খাবার লোভে। অনেককাল পরে বুঝেছিলাম ওটা ছিল মায়ের কারসাজি। মা বিস্কুট চুবিয়ে খেতে বলত। কারণ আমি একদম দুধ পছন্দ করতাম না।

ঢং ঢং করে বড়ো একখানা ঝোলানো রেলের পাতের গায়ে ছোটো লোহা পেটানোর শব্দ হল। জুতোকালি করা ছেলে মদন, শুভঙ্করের কাছে উবু হয়ে বসেছিল। সে বলল, আপ ট্রেনের খবর হল। তবে আসতে আসতে এখনও মিনিট চল্লিশ। এই ফাঁকে গানটা না হলে আবার লোকজন যে-জমে যাবে দা! মনসাদির গানের মুড আনতে তখন আবার সময় লাগবে। তখন সে ভিক্ষে করবে। বলবে দাও, দশটা টাকা দাও, ভাত খাব।

শুভঙ্কর যে কথাটা ভাবেনি, তা নয়। কিন্তু সে তার অভিজ্ঞতায় জানে, জোরাজুরি করে এদের কাছ থেকে কিচ্ছুটি বের করা যায় না। এদের মনের ভেতর ঢুকে যেতে পারলে, তবে নদী কি ঝরনার দেখা মেলে।

শুভঙ্কর বলল, মনসাদি, তোমার বাড়ি কোথায় ছিল গো?

মনসা মুখ তুলে বাবুটির দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফ্যালে। তা আমি কতি পারব নাকি! আমার কি তা মনে আছে!

তোমার মা-বাবার কথা, ভাই-বোনের কথা মনে পড়ে না? শুভঙ্কর ইচ্ছে করে বরের কথা জিজ্ঞাসা করল না। কী জানি সেখানে কোনও দুর্বলতা থাকতে পারে। বিরাগ থাকতে পারে। এরকম পথের ভিখিরি মেয়েরা একশোটার মধ্যে প্রায় একশোটাই স্বামী খ্যাদানো হয়।

মনসা শুভঙ্করের মুখের উপর তার আয়ত চোখ ফেলে রেখে মাথা নাড়ল। না মনে পড়ে না।

মুখে খানিকটা মেঘ উড়ে এসে বসেছে। মনসা চেষ্টা করছে মায়ের কথা মনে করতে। চেষ্টা করছে বাবার মুখটা কেমন ছিল স্মৃতির ভেতর দেখে উঠতে। কিন্তু শীতের দিনের ভোরবেলায় যেমন ধু ধু মাঠ থাকে, গাছপালা, বাড়িঘর কিচ্ছুটি চোখে পড়ে না, সেরকমই ওই সাদা জলছাপের ভেতর থেকে দুখানি মানুষের চেহারা বের হয়ে আসতে চেষ্টা করছে, পারছে না। মনসার চোখের উপর ভাসছে কালো কালো দুটি ছবি, ছটফট করছে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

শুভঙ্করের চোখে পড়েছে মনসার মুখের উপর থেকে ঝকমকে ভাবখানা যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। সে মনসাকে এই আটকে পড়া অবস্থা থেকে বের করে আনার চেষ্টা করে। মনসাদি, তোমার যে-একটা ছাগলাছানা ছিল, বলো, তার কী হল!

একদম ঠিকঠাক জায়গায় ছুঁয়ে দিয়েছে শুভঙ্কর। এই ছুটে বেড়ানোর কাজ করেও সে কবিতা লেখাটা ফেলে দিতে পারেনি। মাঝেমধ্যেই লেখে। আর সে তা লেখে মানুষের নরম মনের কাছে পৌঁছোতে। বছরে পাঁচ-ছটা লিখলেও সই। সে জোরাজুরি করে কবিতা লেখে না। কবিতা তার কাছে ধরা দিলে সে লেখে।

মনসা ছটফট করে উঠল। সে তার গায়ে কাপড় টেনেটুনে নিয়ে বাবুটির আরও একটু কাছে ঘষটে গিয়ে বলল, হ্যাঁ গো, মোর তো ছাগলছানা ছেল না। মোর ছেল এক সাদা ধবধবে বাছুর। ওরে নে মুঁই মাঠে যাতাম ঘাস খাওয়াতি। আমাগে ছেল ধুধু করা মাঠ, আর তার ভেতর দিয়ে হুস করে চলে যাওয়া নদী। আমাগে ধানের খেত ছেল, পাটের খেত ছেল। আর পুকুরভর্তি হাঁস। ঝুপঝুপ করে ওদের সাথে সাঁতার কাটতাম। সারাদিন মাঠেঘাটে চই চই। লাল লাল চুকোই ফল তুলতাম কোঁচড়ে। তারপর নুন মাখিয়ে পা ছড়িয়ে খাতাম। ওরা সব কোথায় গেল? হারিয়ে গেল। চাঁদ, তারা বন্ধু আমার ছিল।

আহা কী মিঠে সুর! ফিসফিস করল প্রাণেশ। টিঙ্কুর চোখটা যেন একটু ভিজে। কিন্তু দারুণ, দারুণ। পুরোটা তুলেছে। দুজনে দুরকম অ্যাঙ্গেলে। ওরা জানে, সুধাময়ও তুলছে অন্যদিক থেকে। বড়ো মুভি ক্যামেরায়। লোকজনের ভেতর থেকে ফাঁকফোকর খুঁজে ওর ফোকাস। ছেলেটা ছমাসের সিনে কোর্স করেছিল। স্পেশাল পেপার নিয়েছিল ক্যামেরা। ওর অনেক সাধ ছিল বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকবে। কিন্তু শিকে ছিঁড়তে পারেনি।

শুভঙ্কর উল্লসিত। মনসা মন মেলছে। শুভঙ্কর যে-মনে মনে নিজেকে মনের ডাক্তার ভাবে। সে মানুষের মনের উপর যে-কালো মেঘ এসে জমে, তাকে ইরেজার দিয়ে মুছে দিতে চায়। তাইতো এরকম অ্যাসাইনমেন্ট পেলে সে লুফে নেয়।

কী ওলট পালট গাইছিস রে খেপি! তোর গান গা। ওই যে চোখ গেল, বয়ে গেল! সেই গান।

আরে মশাই, সেই তখন থেকে আপনি ওস্তাদি করছেন। কে আপনাকে বলতে বলেছে! এখানে বসলে, চুপ করে বসুন। সমস্ত মাটি করে দিলেন! আপনার গান আমরা রেকর্ড করতে আসিনি কলকাতা থেকে। মনসাদেবীর গান শুনতে আর রেকর্ড করতে এসেছি।

কদবেলওলা বমকে গেছে ওই তাড়া খেয়ে সে এতক্ষণ বুঝতে পারেনি, তার ঠিক পাশেই এক বাবু মোবাইল ক্যামেরায় ফটো তুলে যাচ্ছে। সে খানিকটা শঙ্কিত হয়। সত্যিই তো। তার কথা বলা উচিত হয়নি। সামনের বাবুটি খুব রেগে গেছে।

শুভঙ্করের রাগ শুধু রেকর্ডিং-এর সমস্যার জন্য নয়। এই যে মনসা নিজে নিজে চেষ্টা করছিল তার মনের কালো অংশ সরিয়ে যেটুকু ভালো, তা সামনে আনতে, সেটাতে হোঁচট খেল তো! পারবে সে, আবার পারবে! শুভঙ্করকে দোলাচল ঘেরে।

মনসা শুভঙ্করকে আশ্বস্ত করে। সে তার মনের দরজা বন্ধ করেনি। বলে, তালে, ওই গানখান গাই বাবু! ওই গানখান গালি আমার যে খুব প্রাণের আরাম হয়। আমার বগলা সামনে আসি দাঁড়ায়। আমার গানখান শুনে সে ঝরঝর করি কাঁদে, আর বলে, তোরে নিয়া পালায় যাবানে রে মনসা। আর একানে থাকবনি। পালায় গিয়া বিয়া করবানে।

বলতে বলতে মনসা গান ধরে, যা যা বেহায়া পাখি যা না। অন্য কোথা যা না, কেউ করেনি মানা।

খুব নরম হয়ে গেছে শুভঙ্করের মন। ভিডিও রেকর্ডিং হচ্ছে। সে জানে যত বেশি সম্ভব রেকর্ডিং হবে, তত ভালো। ৫০ মিনিট তুললে তবে কেটে ছেঁটে সাচ্চা ৩০ মিনিট বানাতে পারবে। ইউ টিউব চ্যানেল ৩০ মিনিটের জন্য ভিডিযো দিলে এবং সাবক্রিপশন ৪০ হাজার ছাড়ালে ভালো টাকা দেয়।

শুভঙ্কর বলল, মনসাদি, তা তোমার বগলার সাথে তুমি পালিয়ে গিয়েছিলে?

মনসা একটু লজ্জা পেয়েছে যেন এমন একটা ভাব করে শাড়ির আঁচল মাথায় নিয়ে আঁচলের প্রান্ত দাঁতে চিবোতে চিবোতে বলল, হ্যাঁ পালায় গেলাম তো। বগলা একদিন ভোর রাতে মোর হাত ধরে পলান দিল। তারপর কত টেরেন চাপল, বাস চাপল, ঝালমুড়ি খাওয়াল। কত গেরাম ছাড়ায়ে কোন দেশের দিকে যাতি লাগল যে, জানি না। এক চড়ক মেলায় বগলার সাথে আলাপ হয়ে ছেল, আবার পালাতি পালাতি অমন এক মেলার মাঠে গিয়ে বগলারে হারায় ফেললাম। আর পালাম না বগলারে।

শুভঙ্কর বুঝে ফেলেছে হিউম্যান ট্রাফিকিং-এর খপ্পরে পড়েছিল মনসাদি। তার মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ায় হয়তো রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে। সেকথা এখানে জানানোর দরকার নেই। কিন্তু এই যে মনসা অনেকটা নিজের কথা বলতে পারল, অতীত বলতে পারল, তা অনেক। শুভঙ্কর জানে এই মনসার মুক্তি গানে। কিন্তু গান করার সুযোগ কোথায় পাবে সে! আর শুভঙ্করেরও এমন কিছু ক্যাচ নেই যে মনসার জন্য কিছু করতে পারে। দ্য নেচারের এপিসোডটুকু দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ক্ষমতা নেই। সে সামান্য অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। ডিরেক্টর কলকাতার বাইরে যেতে চায় না বলে শুভঙ্কর বাইরে এসে এই স্বাধীনতাটুকু এনজয় করে। নিজের মতো করে বিষয়টা সাজায়, শুট করে। মোবাইলে ভিডিও তোলে। আর তার নিজের সোশাল সাইটে একটা প্রিলিউড-এর মতো করে পোস্ট দেয়। তাতেই আনন্দ।

ফিরে যাবার আগে টিঙ্কু বলল, শুভঙ্করদা, মনসাদির লুকের ভেতর একটা সুচিত্রা সুচিত্রা ভাব আছে না! তুমি আমার মোবাইলে দ্যাখো। এই যে ওর দাঁত মেলে হাসি। শাড়ি পরিয়ে সুধাময়দার ক্যামেরায় একটা দুটো লুক শুট করলে হয় না!

স্টেশনের পাশের বাজার থেকে সামান্য তিনশ টাকা দিয়ে একটা নীল রঙের শাড়ি কিনে আনা হল। মনসাদি যথেষ্ট ফরসা। তোলা কাপড় পেয়ে সেও ডগমগ। আর এবার সুধাময়ের এক্তিয়ার। সে নানা পোজে ছবি তুলল মনসার। সুধাময় তার শেখার সবটা দিয়ে প্রায় নিখুঁত সুচিত্রা লুক দাঁড় করিয়ে দিল।

দুই

এই দাদা, তুই কনে রে! তখন থেকে কল করতিছি, কিছুতেই লাগতিছে না।

মুঁই গাড়ি চালাইতেছি রে, একটু বাদে তোরে ফোন দি?

পাঁচ মিনিট হয়নি আবার সে ফোন করে। সে যে ধৈর্য ধরতে পারছে না। তাছাড়া দিদিভাই, মানে যে-বাড়িতে সে কাজ করে, সে গেছে গড়িয়াহাটে। দাদাবাবু অফিসে যাবার পর ফোন করে কয়েকটা জিনিস আনতে বলেছে। তার টুর আছে কালই। চম্পা ফাঁকা বাড়িতে বসে মোবাইল দেখছে আর ঘরের ভেতর পায়চারি করছে। এক একটা সেকেন্ড তার কাছে অনেকক্ষণ। সে উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে। মা যদি চিনতে পারে তো আর দাসীগিরি করতে হয় না। মা তো এখন খুবই জনপ্রিয় মানুষ। টাইম লাইন ভরে যাচ্ছে মায়ের ফটোতে। শেয়ার হয়েছে কত কত। মায়ের চেহারার কী খোলতাই হয়েছে। খুব গর্ব হচ্ছে চম্পার। একেবারে সিরিয়ালের দিদিমণিদের মতো দেখতে লাগছে।

ডাবলু হালতু বাজারে সওয়ারিকে নামিয়ে ভাড়া নিতে না নিতেই আবার ফোন। সে পোস্ট অফিসের দিকে রিকশা সাইড করে ফোন ধরল। তার স্বরেও উত্তেজনা। ডাবলু বলল, আমার মোবাইলে তো ছবি দেখা যায় না। তুই কি তোর বউদির মোবাইলে পাঠাতে পারবি? আমি বাড়ি গিয়ে দেখে নিতাম। তবে শুধু ছবি পাঠাবি। অন্য কিছু লেখার দরকার নেই। তার যা কুচুটে বুদ্ধি, কোথা থেকে আবার কী বাগড়া না দিয়ে বসে।

হাওড়া স্টেশন থেকে সকাল আটটার নবদ্বীপ লোকাল ধরেছে ওরা। সমুদ্রগড় যেতে ঘন্টা আড়াই। কিন্তু দুই ভাই-বোন উত্তেজনায় ছটফট করছে। চম্পা বলল, এই দাদা, মায়ের বাড়িতে থাকি যাই কটাদিন, কী বলিস? আর মোটে পারা যাচ্চে না। আর ইচ্ছা করে না এই ঝি-গিরি করতে। তুই অন্য আর একজনকে জোগাড় করে দিদিমণিকে দিস আনে। নাইলে তার কষ্ট হবে।

ডাবলু বলল, সে তুই চিন্তা করিসনে। তুই মায়ের কাছে কিছুদিন থাকবি, থাক। তার জন্যি একটা ভালো বাড়ি ভাড়া কততি হবেনে। তারে কইলকাতায় নে যাবানে। সবাই মিলে একসাথে থাকবানে। মায়ের কাছ থে কিছু ট্যাকা পেলি একখান ব্যাটারির রিকশাক কিনুম আনে, ভাবছি। তাতে একটু আয়-টায় বেশিই হবে।

চম্পা বলল, অ্যারা, কিন্তুক মা সমুদ্রগড়ে কুথায় থাহে তাই তো জানি নারে দাদা! ফেসবুকে সবাই তো কইছে সমুদ্রগড়ের মনের মানুষ মনসাসুন্দরী। তো সিকেনে সবাই ঝ্যাকোন চেনে, ত্যাকোন লিশ্চই কয়েক দেবেনে, তাই নারে দাদা?

হ্যাঁ, তাই তো মনে কয়।

একটু লেট করে ট্রেন সমুদ্রগড়ে এগারোটা নাগাদ এল। বেশি লোক নামে না। জনা পঞ্চাশেক হবে। ওরা ভাই-বোন দুজন দুনম্বর প্ল্যাটফর্মের শেডের নীচে এমনি এমনি কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে রইল। ভিড়টা কমে গেলে জিজ্ঞাসা করতে করতে এগোবে। একজন সাইকেলের রডে দু-কাঁদি ডাব ঝুলিয়ে বাঁশের স্ট্যান্ড লাগিয়ে বিক্রি করছিল। চম্পার খুব লোভ হল। এখন তো তারা বড়োলোক। মায়ের পয়সা মানে তার ছেলে-মেয়েদের পয়সা। সে দাদাকে বলল, দ্যাখ দাদা, কী সুন্দর ডাব। কইলকাতায় এমুন তাজা ডাব পাওয়াই যায় না। খাবা?

ডাবলু একটু কিন্তু কিন্তু করছিল। ট্রেনের টিকিট কেটেছে। হাওড়ায় আসার বাসের টিকিট কেটেছে। তারপর আজ তো কাজ হল না। মানে রোজগার নেই। ঘরে ফিরে টাকা ধরাতে না পারলে তো বউ-এর মুখ ঝামটা শুনতে হবে। কিছু পয়সা বাঁচিয়ে ঘরে না দিলে তো বিপদ। সে তো তো করে।

চম্পা বোঝে। সে বলে, দাদা তুমি তো অনেক খরচ করিছ, আমি ডাবের দাম দেবানে। তাছাড়া দিদিভাই আজ সকালেই মাইনে দেছে।

ডাব খাওয়া শেষ করে টাকা মিটিয়ে কী মনে করে চম্পা ডাবঅলাকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আপনি কতি পারেন মনসাসুন্দরী এখানে কই থাহেন!

ডাবওয়ালা পরের খদ্দেরের জন্য ডাব কাটতে কাটতে পেছন দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। ভাই-বোন চটপট সে দিকেই পা চালায়। মনে মনে চম্পা ভাবল, ডাবঅলাও বলে দিতে পারল মানে মায়ের খুবই জনপ্রিয়তা হয়েছে।

প্ল্যাটফর্মের শেষে লেভেলক্রসিং-এ রেললাইনের উপরেই গোটা দুয়ে্ক টোটো দাঁড়িয়ে হাঁকছে। দুজন আসছে দেখে তারা উৎসাহী হয়েছে। ডাবলু আর চম্পার চোখও টোটোঅলাদের দিকে। ওদের যে-কোনও একটাতে উঠে বসে মনসাসুন্দরীর বাড়ির কাছে নামাতে বলবে।

প্ল্যাটফর্মের প্রায় শেষে এসে পড়েছে। চম্পা একটা স্বর শুনে পিছন ফিরল। গলাটা চেনা যেন! একজন মহিলা গাছতলায় বসে আছে। সে হাত বাড়িয়ে ডাকছে, ও মা, ও বাবা, দশটা টাকা দাও না, ভাত খাব।

চম্পার পা আটকে গেছে। সে দাদার হাত খামছে ধরেছে। যেন ভূত দেখছে। চম্পার পা কোনও দিকে যাচ্ছে না। না সামনে না পেছনে। সামনের ভিখারিনি তখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই ট্রেনের থেকে নামা আর তেমন কোনও প্যাসেঞ্জার নেই। এদের কাছ থেকে যদি পাওয়া যায়। ও মা, ও বাবা, দশটা টাকা দাও না, ভাত খাব।

চম্পা তার কাজের বাড়ির একটা বাতিল লেডিজ ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে এসেছিল। সে ব্যাগের ভেতর থেকে দশটা টাকা খুঁজে হাতে নেয়। হাত মুঠো করে। টাকাটা দলা পাকায়। তারপর এক পা এগিয়ে সেই দলাকরা টাকা ছুড়ে দেয় ভিখারিনির থালার দিকে। থালার একটু আগেই পড়ে টাকা। চম্পা মুহূর্তও দাঁড়ায় না। সে দাদার হাত ধরে টান দেয়। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে যাবে ডাউন ট্রেনের জন্য। কলকাতায় ফিরবে।

ভিখারিনি টাকা কুড়িয়ে সেটা সোজা করতে করতে মনের খুশি ওর মাথার উকুনদের জানাতে চেয়ে খানিকটা জোরেই গেয়ে ফেলে, যা যা বেহায়া পাখি যা না। অন্য কোথা যা না, কেউ করেনি মানা…।

 

ফাগুন বাসর

ওরে হিমু, কোথায় গেলি রে? পুকুরপাড়ে একগাদা এঁটো বাসন পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি একটু মেজে নিয়ে আয় না, মা। সবাই সক্কাল সক্কাল বেরোবে। রান্না চাপাতে হবে যে।

হিমু তখন মুগ্ধ চোখে দেখছে মাঠের পুব-ধারে একটু একটু করে ঘোমটা খুলছে উষারানি। কপালে যেন গোল থালার মতো এক মায়াময় সিঁদুরের টিপ। অন্ধকারের বুক চিরে বেরিয়ে আসছে ফিকে হলুদ আলো। হাঁসগুলোকে তাড়িয়ে পুকুরে নামিয়ে দিয়ে ধবলী আর করালীকে জাবনা দিতে যায় হিমু। জাবনা দিতে দিতে দেখে উষারানির টিপটা কেমন ঘেঁটে গিয়ে চারদিকে ফিকে লাল রং ছড়িয়ে পড়েছে। কী অপূর্ব! মনটা যেন জুড়িয়ে যায়!…ওই মা ডাকছে… চমক ভাঙে হিমুর,

ধবলী আর করালীকে মাঠে বেঁধে দিয়ে এখুনি বাসনগুলো মেজে নিয়ে আসছি, মা।

ধবলী আর করালীকে মাঠের বেশ ঘন ও বড়ো বড়ো ঘাসওয়ালা জায়গায় বেঁধে দিয়ে পরম মমতায় করালীর কালো কুচকুচে শরীরটাতে হাত বোলায় হিমু। বাড়ির সবাই, পাড়া-পড়শীরা আসতে যেতে ধবলীর লালচে সাদা শরীরে আদুরে হাত বোলায় কিন্তু করালীর দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। দেখে বড়ো কষ্ট হয় হিমুর। অথচ করালীটা যখন গামলা গামলা দুধ দেয়, তখন তো সবাই বেশ আয়েশ করে গেলাস গেলাস দুধ সাবাড় করে! চোখটা ছলছল করে ওঠে। কোথাও যেন করালী আর নিজেকে এক সারিতে দেখতে পায় হিমু।

অ্যাই হিমু, হিমু… শিগগির এদিকে আয় তো। আমার জামাপ্যান্টগুলো কেচে ইস্তিরি করে রাখিসনি কেন? এখন আমি কি পরে যাব? একখানাও ইস্তিরি করা নেই! হিমু…উ…উ…উ…

হিমুর তখন চোখের পলক পড়ছে না। নিস্তব্ধ দুপুরে দূরের বাঁশঝোপের আড়াল থেকে পাঁজর ফাটিয়ে ডাকছে কোকিলটা! পুকুরের বুকে নুয়ে পড়েছে বাঁশঝাড়, সবুজ ছায়া তিরতির কাঁপছে টলটলে জলে। লাল-হলুদ-সবুজ ফড়িং আর রংবেরঙের প্রজাপতির দল উড়ে উড়ে খেলে বেড়াচ্ছে। উতল দুপুর ঘাই মারছে হিমুর বুকে! কী যে অসহ্য রূপ এই দুপুরের… ইশ!

অ্যাই হিমু, কানে কানে জল ঢোকেনি বুঝি, না রে? তাড়াতাড়ি এদিকে আয়। বিধুদা এল বলে। কনে-দেখা আজ, আলো থাকতে থাকতে মেয়ের বাড়িতে পৌঁছোতে হবে। হিমু, এই হিমু।

চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায় হিমুর। দাদা ডাকছে।

যাই গো দাদা।

আজ পাড়ার বিধু ঘটকের সঙ্গে পাশের গাঁয়ে মেয়ে দেখতে যাবে হিমুর দাদা। হুগলির রিষড়ায় সে এক গেঞ্জি কারখানায় প্যাকেজিং ডেসপ্যাচিংয়ের কাজ করে। হিমুর বিয়ে না দিয়ে তার দাদা বিয়ে করতে চাইছিল না। কিন্তু বিয়ের বাজারে হিমুর মতো নিকষ কালো মেয়েকে কেউ পছন্দ করে না। বিধু ঘটক হিমুর জন্য পাত্রের সন্ধান এনে এনে একেবারে হাঁপিয়ে গেছে। তাই দাদা আর কদ্দিন অপেক্ষা করবে? তারও তো বিয়ের বয়স গড়িয়ে যেতে বসেছে। পুরুষ মানুষ কদ্দিন আর মেসে থেকে হাত পুড়িয়ে রেঁধে খাবে! তারও তো একটা শখ আহ্লাদ আছে, নাকি! অগত্যা পাশের গাঁয়ে প্রদীপ স্যাকরার মেয়ে অপালার সঙ্গে দাদার বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে বিধুদা। একমাত্র মেয়ে, দেবে থুবেও ভালো।

অ্যাই হিমু, পুকুরধারে কী করছিস রে? তখন থেকে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছিস না?

এক বুক পাথর ভার নিয়ে দাদার ঘরের দিকে এগিয়ে যায় হিমু।

হিমু, হিমু…উ…উ… অ হিমু, হিমু রে, আমার লাইগ্যা একটু আকন্দফুলের পাতা আইন্যা দে না রে, মা। পূন্নিমা আইতাছে। বাতের ব্যাতাটা আবার বড়ো বাড়ছে রে! উঃ! সব্বার মরণ হয়, আমার ক্যান হয় না? আরে অ হিমু…

হিমু তখন পুকুর ঘাটে। হাঁ করে গিলছে পলাশ গাছটার বুক জ্বালানো রূপ! বসন্ত বাণে জ্বলে খাক হয়ে যাচ্ছে হিমুর যুবতি-শরীর, মন। আমবাগানে ডাল-পাতার ফাঁক দিয়ে ফিকে কমলারঙা গোল থালার মতো সূর্যটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে মাঠের পশ্চিম দিকে। দিনের তেজ কমে আসছে, গোলাপি আভা ধরেছে আকাশে। কোথা থেকে এক ঝলক ফিসফিসে বাতাস এসে চোখে মুখে ঠান্ডা স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে হিমুর,.আহা! ওই ঠাম্মা বুঝি ডাকছে…

আসছি…ই…ই…ই…

ঠাম্মা বহুদিন থেকেই বাতের রোগী। প্রতিদিন সন্ধেবেলায় হরেন বৈদ্যের কালচে সবুজ এক কবিরাজি তেল ঠাম্মার কোমরে, পায়ে মালিশ করে দেয় হিমু। তেলের গন্ধটা ভারি বিশ্রী! বমি চলে আসে। কিন্তু কি আর করা, মায়ের সারাদিন সংসারের নানা কাজ থাকে। উদয়াস্ত পরিশ্রম তাঁর। দিদিরা তো সবাই যে-যার শ্বশুরবাড়িতে। তাই হিমু ছাড়া আর কে-ই বা আছে হাতনুরকুৎ? এছাড়া অমাবস্যা, পূর্ণিমায় ব্যথাটা খুব বেড়ে যায় ঠাম্মার। তখন জ্বলন্ত হ্যারিকেনের মাথার ওপর আকন্দপাতা গরম করে সেঁক দিয়ে দেয় হিমু। পুকুরের পুব-ধারে আকন্দগাছের ঝাড়, সেখান থেকে পাতা সংগ্রহ করে নিয়ে আসে সে।

তার বাড়ির সকলেরই একখানাই তো ভাঙাকুলো হিমু। অঘ্রাণ মাসে জন্ম হয়েছিল বলে ঠাম্মা বড়ো শখ করে নাম রেখেছিলেন হৈমন্তী। হেমন্তে জন্ম হলেও হেমন্ত প্রকৃতি তার সোনারঙা ফসলের ভরপুর সৌন্দর্য দিয়ে সাজায়নি হৈমন্তীকে। হৈমন্তী সেই কবেই হিমু হয়ে গেছে সকলের মুখে মুখে। ঠাম্মার কাছে শুনেছে জন্মের পর তার কালো কুৎসিত ছোট্ট শরীরটা দেখে তীব্র ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন বাবা। আর কোনওদিনই বাবা নাকি কোলে তোলেননি তাকে। এ সবই মুখরোচক গল্পচ্ছলে বাড়ির মেয়েদের কাছ থেকে শোনা হিমুর। নীরবে হৈমন্তিক শিশির ঝরেছে টুপটাপ। বড়ো হেলাফেলায় সবার ফাইফরমাশ খেটে, সবার মন জুগিয়ে যৌবনে পা দিয়েছে হিমু। শুধু নিজের মনটাই আলো-হাওয়া না পেয়ে পেয়ে কবে যেন পাথর চাপা পড়ে গেছে!

তবু জীবন তো থেমে থাকেনি। হিমুর দাঁত উঁচু, নাক বোঁচা, শনের মতো চুলওয়ালা, থ্যাবড়ামুখো কালো কুৎসিত শরীরেও একদিন দাপিয়ে যৌবন এসেছে নিঃশব্দে। কালো মেয়ে বলে মা-ঠাকুমার বিলাপ, পাড়া-পড়শির করুণার মধ্যেই বড়ো হয়েছে সে। তার মুখ কেউই দেখতে চায় না। পাড়ার কেউ কোনও শুভ কাজে রওনা হলে হিমু তার ধারে কাছে ঘেঁষে না। তার অপয়া মুখ দেখলে নাকি হওয়া কাজও পণ্ড হয়ে যায়। ইচ্ছে থাকলেও পড়াশোনায়ও তেমন এগোতে পারেনি হিমু। বছর বছর গণিতে, বিজ্ঞানে ফেল করে করে স্কুলের গণ্ডি ডিঙোনোর আগেই ধৈর্যহারা হয়ে পড়াশোনায় ইতি ঘটে যায় তার। মোটা টাকার প্রলোভন দেখিয়েও তার মতো কালো কুৎসিত মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করা যায়নি। বেশ কয়েকবার পাত্রপক্ষ এসে মিষ্টি ধ্বংস করার পর বলতে বলতে গেছেন, আমরা তো কয়লার বস্তা ঘরে নিয়ে যেতে আসিনি! যত্তসব!!

নিজের কানে এইসব কথা শুনে টুপটাপ ঝরে পড়ে হৈমন্তিক শিশির। ভেসে যায় বুক। স্তব্ধ হয়ে যায় হিমুর ভিতর ঘর।

হিমুর দুই দিদি জয়তী আর রেবতী উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা। মোটামুটি দিয়েথুয়ে বিয়ে হয়ে গেল তাদের। লাজুক মুখে এক মাথা সিঁদুর নিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল তারা। যাবার সময় দুজনেই হিমুকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদে কেটে বলল,

তোর জন্য দেখছি কোনও ব্যবস্থা করা যায় কিনা। চিন্তা করিস না। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সংসারের বেড়াজালে হিমুর কথা তাদের আর মনেই রইল না।

এই অঘ্রাণে তেইশে পড়েছে হিমু। এখনও অনুঢ়া সে। শরীরে তার ভরা যৌবন! মনে সুনামির জলোচ্ছ্বাস! ফুলেভরা শিমূলের ডালে, হলুদ অমলতাসের ঝাড়ে, ফুলের ভারে নুয়েপড়া কাঞ্চনগাছে প্রকৃতি যেন উড়িয়ে দিয়েছে রংবেরঙের ফাগ। দেখে বুকটা ধড়াস ধড়াস করে হিমুর। কান্নায় গলা বুজে আসে! আকাশ কী সুন্দর নীল! প্রকৃতির কত অপরূপ রং-রূপ-রস। সেও তো এই প্রকৃতিরই অংশ, তবে কেন সে এত কুৎসিত? এ পৃথিবীতে কোথাও কি তার জন্য এতটুকু ভালোবাসা থাকতে নেই?

কাল দোলপূর্ণিমা। হিমুর ছোড়দি রেবতী এসেছে বর আর বাচ্চা নিয়ে বাড়িতে বেশ একটা হই হই ব্যাপার। হিমুর খরা বুকেও যেন বাজছে টুংটাং বাসন্তী সুর। ছোড়দির ছেলেটা টলোমলো পায়ে হাঁটতে শিখেছে, আধো বুলি ফুটেছে মুখে। মনটা বড়ো ভিজে ওঠে হিমুর। তবে দিদিরা আসায় তার খাটুনি অনেকখানিই বেড়েছে। রান্নার সব দাযিত্বই যে-তার। মা অবশ্য সাহায্য করছেন। এই একটি বিষয়ে হিমুর খুব নাম। তার রান্না স্বাদ ও গন্ধে অতুলনীয়। সব্বাই চেটেপুটে খায়। রান্না করতে করতে আনমনা হয়ে পড়ে সে!

রজতদা ছোড়দিকে কী ভালোবাসে! চোখে হারায় একদম! সকালে দেখছিল জলখাবার খাওয়ার সময় রজতদা ছোড়দির মুখে লুচি তুলে দিচ্ছে আবার নিজেও খাচ্ছে। ভালোবাসার রঙে রাঙা হয়ে উঠছিল ছোড়দির মুখটা! বুকটা ভারী হয়ে ওঠে হিমুর। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে! তাকে এভাবে আদর-আহ্লাদ করার কেউ নেই এই পৃথিবীতে!

সন্ধে নামতেই গোল থালার মতো ভরা-যৌবনা চাঁদটা রুপোলি আলোয় ভাসিয়ে নিল মাঠ-ঘাট, পুকুর, সজনেগাছের সারি, আমবাগান, শিমূলবন। এমন গভীর চাঁদরাত গায়ে মেখে, আমের মুকুলের গন্ধ বুকে ভরে নিয়ে আমবাগানে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে খুব ভালোবাসে হিমু। রাতের আবডালে তার কুৎসিত মুখখানাও কিছুটা ঢাকা পড়ে যায়। বুক ভরিয়ে দিয়ে কী যেন এক নাম না-জানা গন্ধ ছুঁয়ে দিচ্ছে হিমুর গভীরে কোথাও। সে গন্ধ যেন এক তীব্র কষ্ট হয়ে হৃদপিণ্ডটাকে খামচে ধরছে। যে-গন্ধের কোনও কারণ জানে না হিমু। হঠাৎ ধপ করে একটা আওয়াজ কানে আসে পাশের ঘর থেকে। পাশের ঘরে শুয়েছে রজতদা আর ছোড়দি। একটা নিষিদ্ধ জিনিসের আকর্ষণে জালনার ফুটোতে চোখ রাখে হিমু। দেখতে পায় আধো অন্ধকার ঘরে দুই ছায়ামূর্তি রজতদা আর ছোড়দি! রজতদা যেন একেবারে মিশে যেতে চাইছে ছোড়দির নগ্ন শরীরে!

মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে হিমুর। কেমন একটা নেশা নেশা লাগে। সেই অনামি গন্ধটা যেন ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকে তার দিকে! মাঝরাতে জ্যোৎস্নার চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে গোটা গ্রাম। শুধু ঘুম আসে না হিমুর। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে সে। পুকুরঘাটের দিকে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে টলটলে জল-আয়নায় ভাসছে রুপোলি চাঁদ। সজনে গাছগুলোর তলা সাদা সাদা ফুলে ছেয়ে আছে! চারদিক একেবারে শুনশান! দূর থেকে ভেসে আসছে রাতচরা পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে হিমু। সহসা কিছু বোঝার আগেই একটা বলিষ্ঠ লোমশ হাত পেছন থেকে জাপটে ধরে হিমুকে শুইয়ে দেয় সজনেফুলের সাদা বিছানায়। ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলতে থাকে তার পোশাক। ঘোরলাগা চোখে লোকটাকে চিনতে পারে না সে। লোকটার মুখে হাড়িয়ার গন্ধ। পরম আশ্লেষে লোকটাকে জাপটে ধরে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে হিমু ফিসফিসিয়ে বলে,

আমি কুৎসিত নই, ততটা কুৎসিত নই। একবার ভালোবেসে এসো ভেতরে আমার, হাড়-মাস-চামড়া ছাড়িয়ে একেবারে ভেতরে, অনেক ভেতরে…

লোকটার মুখের হাড়িয়ার গন্ধ ভেদ করে সেই বিশেষ গন্ধটা যেন খুব ধীরে ধীরে হিমুর আরও কাছে এগিয়ে আসতে থাকে, যে-গন্ধের কাছাকাছি এলে ভালোবেসে খুব মরে যেতে ইচ্ছে হয় তার। বহুদিনের জমাটবাঁধা একটা বরফখণ্ড যেন গলে গলে জল হয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে হিমুর যুবতি শরীর থেকে।

 

ডেডলি গেম(Crime Thriller)অন্তিম পর্ব

সাত

হ্যালো, গৌতমদা আপনার সাথে জরুরি একটা বিষয়ে কনসাল্ট করার দরকার ছিল। ফোনে হবে না, আপনি কি কিছুটা সময় দিতে পারবেন?

অফ কোর্স। তুমি ঘন্টাখানেক পরে চলে এসো। ওদিকে কতটা প্রোগ্রেস হল?

সেই ব্যাপারেই কথা বলতে চাই। আপনার কিছু সাজেশনও লাগবে। আমি আসছি তখনই কথা হবে।

ডিসিপি গৌতম চ্যাটার্জীর অফিস রুমে ঢুকে রক্তিম দেখল আর কেউ নেই। কিছুটা অবাক হল। গৌতম চ্যাটার্জী হাসি মুখে বললেন, এসো রক্তিম। বাকি সব কাজ মিটিয়ে তোমার অপেক্ষাতেই বসে আছি। তোমার ফোন ও অ্যাটিটিউড দেখেই বুঝেছিলাম সামথিং হ্যাজ হ্যাপেনড। মনে হয় তুমি কিছু একটা উদ্ধার করতে পেরেছ। অ্যাম আই রাইট?

রক্তিম হেসে বলল, এই জন্যেই লোকে বলে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল। তবে এখনও কোনও বিষয়ে কনফার্ম হতে পারিনি। খুনি কে তাও জানতে পারিনি। সাফল্যর মধ্যে নেক্সট টার্গেট কে হতে পারে তার একটা আভাস পেয়েছি। আর সেই পথ ধরেই আমি খুনি পর্যন্ত পৌঁছোতে চাইছি। বলতে পারেন এটাই আমার শেষ রাস্তা।

কে এই টার্গেট?

নীলম মাথুর। ওরফে পায়েল মিত্র।

অভীক পাত্রের পিএ মেয়েটা?

হ্যাঁ। শুনলে অবাক হবেন, এরা সবাই একটা ডার্টি গেম-এর পার্ট। এতদিন গেম-টি একতরফা চলছিল। যার ফলে বাইরের দুনিয়ায় তার কোনও আলোড়ন দেখা যায়নি। কিন্তু কেউ বা কারা এই গেম-এ অখুশি হয়ে ওঠাতেই এই সব বিপত্তি। ডার্টি গেম পরিণত হয়েছে ডেডলি গেম-এ। সম্ভবত এই খেলারই অংশ সিরিয়াল কিলিং। মার্ডারের ক্যারেক্টার বলে দিচ্ছে এর পিছনে যে-মাস্টার মাইন্ড রয়েছে সে অত্যন্ত শার্প অ্যান্ড ডেডিকেটেড। ওকে থামানো অত সহজ কাজ নয়। আবার না থামাতে পারলে একের পর এক অনর্থ ঘটতেই থাকবে।

হুঁ চিন্তার বিষয়ই বটে। তোমার কোনও প্ল্যান আছে?

আছে। কিন্তু আমার প্ল্যানে রিস্ক ফ্যাক্টরও আছে। এখন সেটাকে এগজিকিউট করার পারমিশন দেবেন কিনা সেটা জানতেই মূলত আপনার কাছে আসা। অনেক ভাবেই ভেবে দেখেছি কিন্তু রিস্ক ফ্যাক্টর একেবারে এড়াতে পারিনি। আমার হিসেবে ঝুঁকি একটা নিতেই হবে।

তুমি তোমার প্ল্যান আমাকে খুলে বলো। তারপর দেখি কী করা যায়।

বলছি। নীলম মাথুর নেক্সট টার্গেট বলছি ঠিকই কিন্তু তার ওপর কবে, কীভাবে অ্যাটাক হবে আমরা কেউ জানি না। আবার হবেই তেমন গ্যারান্টিও নেই। কারণ পুলিশ যে অনেকটা অ্যালার্ট সে বুঝে গিয়েছে। তবুও আমার বিশ্বাস, সে অ্যাটাক করবেই, আজ হোক বা কাল হোক। সুতরাং আমার প্ল্যানের প্রথম পার্ট হল ধৈর্য ধরা। বাঘ শিকারের আগে যেমন হান্ড্রেড পার্সেন্ট কনসেন্ট্রেশন ও ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করে ঠিক তেমনি। সেকেন্ড পার্ট হল তদন্তের গতি একটু ঢিলে করে দেওয়া। যাতে সে স্বাধীন ভাবে কিছু করার কথা ভাবার অবকাশ পায়। কারণ তার অ্যাক্টিভিটি না থাকলে আমরা অ্যাক্টিভ হতে পারব না। এখানেই রয়েছে সবচেয়ে বেশি রিস্ক ফ্যাক্টর। প্ল্যানের থার্ড পার্ট হল, কয়েকটি ফোন লাগাতার ট্যাপ করে যেতে হবে। সেই সাথে একটা টিমকে নির্দিষ্ট সময় ধরে তৈরি থাকতে হবে। কারণ কবে কখন কোনদিন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসবে তা তো জানা নেই। আর একটা কথা, আপনি যে অফিসিয়ালি গোয়েন্দা টিম গঠনের কথা বলেছিলেন তার কী খবর?

প্রোটোকলের গ্যাঁড়াকলে আপাতত সেটা স্থগিত হয়ে আছে। আবার কোনও অঘটন না ঘটা পর্যন্ত সে ফাইল এগোবে বলে মনে হয় না।

একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। একসাথে তদন্ত চললে হচপচ হয়ে যেত। আমার প্ল্যান কিছুটা শুনলেন, রিস্ক ফ্যাক্টর শুরু হবে সেকেন্ড স্টেজ থেকে। ভালো করে অবজার্ভ করলে দেখবেন, মার্ডারগুলো হয়েছে স্টেপ ওয়াইজ। প্রথমে লোকেশন সিলেক্ট করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে ভিকটিমকে ফোন করে ডেকে নিয়ে আসা হয়েছে বধ্যভূমিতে। তৃতীয় ধাপে স্পটে গিয়ে সমস্ত প্রমাণ লোপাট করা হয়েছে ধীরে সুস্থে। সবগুলো ক্ষেত্রেই চয়েস করা হয়েছে দারুণ দুর্যোগের রাত। কারণ তাতে লোকজনের নজরে পড়ার সম্ভাবনা অনেক কম থাকছে। আমার ধারণা পরের বারও তার ব্যতিক্রম হবে না। কিন্তু তার জন্য উপযুক্ত সময় ও পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে আমাদেরকেই। আমি কী বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন তো গৌতমদা?

খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি ভাই। খুনিকে খুন করতে প্ররোচিত করা। কিন্তু নীলমের জীবন সংশয়ে ফেলাটা কি ঠিক হবে?

রিস্কটা এখানেই নিতে হবে। একটা ভালো টিম সাথে থাকলে আমার মনে হয় না নীলমের কোনও ক্ষতি হবে।

কিন্তু তোমরা যদি কোনও ভাবে ফেইল করো এবং বড়ো কোনও অঘটন ঘটে যায় — তাহলে কী হবে ভেবে দেখেছ? মিডিয়া, সরকার, পাবলিক, পলিটিক্যাল পার্টি সব আমাকে চিবিয়ে খাবে।

বুঝতে পারছি দাদা। কিন্তু আমার কাছে কোনও বিকল্প অপশন নেই। আপনি পারমিশন না দিলে আমি কেস থেকে নিজেকে উইথড্র করে নেব। কারণ থেকে কোনও লাভ হবে না। গতানুগতিক ইনভেস্টিগেশন করে এই খুনিকে হাতে পাওয়া যাবে না। অন্তত আমার তাই ধারণা। আই অ্যাম সরি।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভাবলেন গৌতম চ্যাটার্জী। তারপর গম্ভীর মুখে বললেন, রিস্ক নিতে আমি ভয় পাই না। তাছাড়া তোমার প্রতি আমার যথেষ্ট আস্থাও আছে। একটু ভাবতে দাও। তুমি টিম হিসাবে কাদের চাও?

আইসি প্রিয় প্রসাদ দেবের থানার টিমটা পেলেই চলবে। এই কদিনে ওদের সাথে একটা ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং গড়ে উঠেছে, তাছাড়া ওরা প্রথম থেকেই কেসটা ধরে ধরে সিরিয়াসলি হ্যান্ডেল করছে। আইসি দেব নিজেও ভীষণ কোঅপারেটিভ।

কিন্তু এই ধরনের রিস্ক নিতে ওরা রাজি হবেন তো? কিছুটা আঁচ ওদের গায়ে কিন্তু আসবে।

আপনি কথা বলে দেখুন। আমি একটু হিন্টস দিয়েছিলাম, মনে হয় ওরা অরাজি হবেন না।

গৌতম চ্যাটার্জী তক্ষুণি ফোন করলেন আইসি দেবকে। অনেকটা সময় ধরে কথা হল দুজনের মধ্যে। রক্তিম চুপচাপ শুনল। কথা শেষ হবার পর ফোন রেখে গৌতম চ্যাটার্জী হেসে বললেন, উনি তো তোমার প্রতি দারুন ইমপ্রেসড। কী করে করলে? একজন পুলিশের লোককে ইমপ্রেস করা অত সহজ কাজ নয়।

রক্তিমও হাসল, ওকে ইমপ্রেস করার জন্য আমি তো কিছুই করিনি। এখন ইমপ্রেস হয়ে থাকলে সে তো আমার ভাগ্য। আমি অতি সাধারণ এক গোয়েন্দা।

কামিং টু দ্যা পয়েন্ট। আমি ওন রেসপনসিবিলিটিতে তোমাদের পারমিশন দিচ্ছি রক্তিম। পুরোটাই কিন্তু তোমার ওপর আস্থা রেখে। বুঝতেই পারছ কীরকম চাপে থাকব আমি।

রক্তিম আশ্বাস দিয়ে বলল, চাপ আমারও কিছু কম থাকবে না। আমাকে হয়তো কোনও কৈফিয়ত দিতে হবে না কাউকে কিন্তু ব্যর্থ হলে আমার কেরিয়ারের ব্যাপক ক্ষতি হবে। রেপুটেশন খারাপ হয়ে গেলে কে কেস দেবে? তবুও রিস্ক নিচ্ছি কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে আমি সফল হবই।

শ্রাবণ মাসের অর্ধেক পার হতেই আবার শুরু হল দুর্যোগ। আবহাওয়া দফতর পরিষ্কার জানিয়ে দিল, তিন চার দিনের আগে এই প্রবল নিম্নচাপ কমার কোনও চান্স নেই। রক্তিমের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। এই সুযোগ কাজে লাগাবার চেষ্টা সে অবশ্যই করবে।

দুর্যোগের দ্বিতীয় রাতেই বেজে উঠল সেই প্রত্যাশার ফোন। ঘড়িতে তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। রক্তিম থানাতেই বসে। এমন সময় এসআই বিকাশ ব্যস্ত ভাবে বলল, স্যার নীলমের ফোনে সাসপেক্টের কল এসেছে।

যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি। এই রাতটার জন্য টিমের সবাইকে নিয়ে রীতিমতো ট্রেনিং ক্লাস নিয়েছে রক্তিম। প্রত্যেকের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে ধরে ধরে। কে কতটা রেসপন্স করছে সেটা যাচাই করার জন্য বারে বারে টেস্ট নিয়েছে।

রক্তিম বলল, এবারের লোকেশন কোথায়? বলেছে কিছু?

বিকাশ বলল, হ্যাঁ, নাগের বাজার…।

রক্তিম মনে মনে হিসাব করে বলল, নীলম থাকে লেনিন সরণিতে। ওখান থেকে স্পটে পৌঁছোতে পৌঁছোতে পঁচিশ-ত্রিশ মিনিট লাগবে। আপনার টিম নিয়ে এক্ষুণি বেরিয়ে পড়ুন মিঃ দেব। নীলম যেন কোনও ভাবেই ওখানে আগে পৌঁছোতে না পারে। হারি আপ। আমি আমার টিম নিয়ে আমার গন্তব্যের দিকে যাচ্ছি। কোনও সমস্যা হলেই ফোন করবেন। কাইন্ডলি আমার ইন্সট্রাকশনের বাইরে কিচ্ছু করতে যাবেন না।

টিম বিভাজন থেকে শুরু করে যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় আগে থেকেই ব্যাখ্যা করে দিয়েছিল রক্তিম। দুর্যোগ শুরু হওয়ার পর থেকেই, রাত দশটা এগারোটা অবধি থানাতেই অপেক্ষা করেছে সবার সাথে। রক্তিম ভাবতে পারেনি ফোনটা এত তাড়াতাড়ি আসবে।

জিপে বসে রক্তিম বলল, অবিনাশের টাওয়ার লোকেশন ওটাই দেখাচ্ছে তো বিকাশ, যেটা আমি বলেছিলাম?

বিকাশ হেসে বলল, একদম। ইউ আর গ্রেট! কী করে বুঝলেন ওখান থেকেই ফোনগুলো করা হয়েছে বা করা হতো?

কিছুটা অনুমান আর কিছুটা বিজ্ঞান। শান্তার এবং মুকেশের রেকর্ড করা কলগুলো ঘেঁটে আমি একটা অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করেছিলাম বিকাশ। তোমরাও শুনেছ কিন্তু বুঝতে পারোনি। একটা অদ্ভুত আওয়াজ। প্রথমে আমিও বুঝিনি। সন্দেহ বশে বারবার শুনি। একসময় রহস্য বোধগম্য হয়। বুঝতে পারি ওটা কোনও অ্যান্টিক পেন্ডুলামওয়ালা ঘড়ির বিশেষ ধরনের ঘন্টাধ্বনি, যেটা আধঘন্টা অন্তর অন্তর সময় জানান দেয়। শান্তা ও মুকেশের কথা বলার সময়গুলো আন্দাজ করে মিলিয়ে দেখেছি, প্রায় মিলে গিয়েছে। আমার ভাগ্য আরও সুপ্রসন্ন, ওই বাড়িতে যেদিন যাই সেদিন সময়টা ছিল ঠিক ঘন্টা বাজার সময়। শুনেই যেমন চমকে উঠেছিলাম তেমনি খুলে গিয়েছিল জ্ঞানচক্ষু। উনিই বলেছিলেন ওই রকম অ্যান্টিক ঘড়ি কলকাতা শহরে একটাই আছে। তখন কি উনি অতশত ভেবে বলেছিলেন? যাইহোক যেটুকু সংশয় ছিল আজ দূর হয়ে গেল। সঠিক পথেই চলেছি আমরা।

পলাশ মিত্র বললেন, ওই বাড়িতেই তাহলে অবিনাশ রুদ্র থাকেন?

অবিনাশ রুদ্র না অবিনাশ রুদ্রের ভূত, তা আমি জানি না। একটু পরেই দেখতে পারবেন আশা করছি।

আপনি জানেন ওই ভূতটি কে?

না। তবে অনুমানে একটা নাম আছে। কিন্তু শুধু অনুমানের উপর ভিত্তি করে কারও নাম বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না। একটু বাদে দেখার সুযোগ আসবে, ধৈর্য‌্য ধরুন। তবে আবারও কথাটা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, যে তিনটে খুন করেছে, তার আরও দু-একটা খুন করতে কিন্তু হাত কাঁপবে না। তাই শেষের এই পর্বটা আমাদের কাছে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। সামান্য ভুলের জন্য অনেক বড়ো মাশুল গুনতে হবে সবাইকে। রিমেমবার ইট।

রক্তিমদের জিপ এসে দাঁড়াল মেইন রোডের ধারে। ওর নির্দেশ মতো জিপ থেকে নেমে সবাই পায়ে হাঁটা শুরু করল। অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। কিছুটা জলও জমতে শুরু করেছে রাস্তায়। বিকাশ, পলাশ মিত্র ছাড়াও দুজন বন্দুকধারী পুলিশ রয়েছে টিমে। আইসি দেবকে ফোন করে ওদের অবস্থান জেনে নিল রক্তিম। অপারেশনের টাইম অ্যাডজাস্টমেন্ট ভীষণ ভাইটাল। তালমিল ঘেঁটে গেলে বড়ো বিপদ হয়ে যেতে পারে। নীলম মাথুরকে নিয়ে কী করতে হবে তার প্রয়োজনীয় নির্দেশ আগেই দেওয়া আছে, তবু আর একবার মনে করিয়ে দিল।

আইসি দেব বললেন, নীলম বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। ওর মোবাইল লোকেশন দেখাচ্ছে স্পটের দিকেই এগোচ্ছে।

গুড, আমার সিগন্যাল না পাওয়া পর্যন্ত ওকে ইন্টারাপ্ট করবেন না। এদিকে আমরা আমাদের স্পটে এসে পড়েছি। একটু বাদেই শুরু হবে অ্যাকশন। আপনি শুধু খেয়াল রাখবেন, নীলম যেন কোনও ভাবেই পয়জন পয়েন্ট পর্যন্ত পৌঁছোতে না পারে।

দুজন বন্দুকধারীকে সদর দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে রক্তিম, বিকাশ ও পলাশ মিত্রকে নিয়ে বারান্দায় উঠে এল, কলিং বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। দরজা খুললেন দেবলীনার মা। ভীষণ বিরক্তি নিয়ে বললেন, আপনি আবার এসেছেন? আপনার কি কোনও টাইম জ্ঞান নেই? এই মুহূর্তে আমি আপনার সাথে কোনও কথা বলতে পারব না। আপনারা কাল সকালে আসবেন।

রক্তিম বলল, সরি ম্যাডাম, আমরা ভেতরে সার্চ করব। আমরা জানি ভেতরে এই মূহুর্তে আরও একজন আছেন, মূলত তার সন্ধানেই আমরা এসেছি। আপনার সাথেও কথা আছে, তবে সেটা পরে হবে। লিগাল পারমিশন নিয়ে আমরা এসেছি। পুলিশের কাজে বাধা সৃষ্টি করলে অহেতুক বিপদে পড়বেন।

ভদ্রমহিলাকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রক্তিমরা হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরের ঘরে। ফোনে ব্যস্ত ভাবে কথা বলছিলেন একজন, ওদের দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল। ফোনে তখনও ভেসে আসছে একটা মহিলা কন্ঠ, হ্যালো অবিনাশবাবু আপনি শুনতে পাচ্ছেন? আমি এই মুহূর্তে রয়েছি…

রক্তিম ফোনটা তুলে বলল, হ্যালো নীলম, আমি রক্তিম বিশ্বাস বলছি, চিনতে পারলেন তো? ওকে, শুনুন… আপনি যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন। একটু পরেই পুলিশ আপনার কাছে পৌঁছে যাবে। ওরা আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। সরি… এই মুহূর্তে ডিটেলসে বলার সময় নেই, পরে সব জানতে পারবেন।

ফোন কেটে রক্তিম সামনের ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার খেলা শেষ অভীকবাবু। অবিনাশ রুদ্রের নাম দিয়ে ভালোই খেলা দেখালেন। অথচ মানুষটা তো খুব ভালো ছিলেন। সৎ, আদর্শবান, নীতিপরায়ণ খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আপনার মাস্টারমশাই ছিলেন। ওঁর আদর্শকে আপনি এভাবে শেষ করে দিলেন? কেন?

অভীক পাত্র ধপ করে সামনের সোফায় বসে পড়লেন। চোখে অসহায় চাহনি।

এই সব খুনের পিছনে আপনার উদ্দেশ্য কী ছিল? এভাবে বিবাহিত ভালো ঘরের মেয়েদের হত্যা করে কী হাসিল করার ইচ্ছে ছিল আপনার?

কিছুটা ধাতস্থ হয়েছেন অভীক পাত্র, রাগত স্বরে বললেন, আপনি বোধহয় ভুল করছেন মিঃ ডিটেকটিভ। প্লিজ, আপনি এগুলোকে নিছক হত্যা বলে চালাবেন না। এটা ট্রিটমেন্ট। এক ধরনের থেরাপি। একটা সুন্দর বাগান যখন আগাছায় ভরে যায় তখন সেই অপ্রয়োজনীয় গাছগুলোকে কেটে ফেলতে হয়। নইলে বাগানটাই একদিন শেষ হয়ে যায়। আমি সেই কাজটাই করেছি।

আগাছা কি শুধু মেয়েরাই, ছেলেদের কোনও দোষ নেই?

অবশ্যই আছে। আমি সবাইকেই শাস্তি দিতাম। আপনি সব গোলমাল করে দিলেন।

দেবলীনা আপনার ভালোবাসার মূল্য দেয়নি মানলাম কিন্তু শান্তা, তিয়াসা ওদের আপনি মারলেন কেন?

ওদের আমি বারবার বলেছিলাম তোমাদের স্বামীদের শোধরাও। কিন্তু শোনেনি আমার কথা। চরিত্রহীন স্বামীদের পক্ষ নিয়ে আমাকেই বিপদে ফেলে দিয়েছিল। অদ্ভুত! কতকগুলো চরিত্রহীন মানুষের জন্য ওদের আদিখ্যেতা মার্কা ভালোবাসা দেখে আমি মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। মনে হয়েছে, এদের জন্যই ওদের এত সাহস। সুতরাং এদেরই আগে মরা উচিত। বিষবৃক্ষ কাটার আগে তার শিকড় কাটা দরকার।

আর নীলম?

প্রথমে মনে হয়েছিল ও খুব ভালো, সেনসেটিভ মেয়ে, পরে দেখলাম সি ইজ আ স্মার্ট প্রস্টিটিউট। স্বামী, সংসার, পরিবার এসব ও বোঝে না। বোঝে শুধু কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আর নোংরামো। ওরও শাস্তি প্রাপ্য ছিল কিন্তু দিতে পারলাম না।

রক্তিম মৃদু হেসে বলল, পৃথিবীতে অনেক অনাচার হয় অভীকবাবু। আমিও মানি সেটা। কিন্তু সেসব দেখার জন্য আইন আছে, প্রসাশন আছে, আমরা নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিলে বাস্তবিক অনাসৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই হবে না। আমি নিশ্চিত আপনার আদর্শবাদী শিক্ষকমশাই বেঁচে থাকলে তিনিও এর বিরোধিতা করতেন। এবার আপনারা আমাদের সাথে থানায় চলুন। বাকি কথা ওখানেই হবে।

দেবলীনার মা এক কোণায় দাঁড়িয়েছিলেন, ওখান থেকেই বললেন, আমি কেন যাব? আমি কী করেছি?

রক্তিম হেসে বলল, আপনি অনেক কিছু করেছেন। খুন করছে জেনেও একজন খুনিকে সাপোর্ট করেছেন। এটা কি কম অপরাধ? দেবলীনা যে খারাপ কিছু করে আপনি সব জানতেন। কিন্তু কিছুই বলেননি, কারণ আপনার কাছে দেবলীনা ছিল সোনার ডিমওয়ালা হাঁস। সেই মেয়ে যখন টাকা দিতে অস্বীকার করল, জামাইকে তার বিরুদ্ধে উসকে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করেননি। এমনকী খুন করার প্রোরোচনাও দিয়েছেন হয়তো। আবার খুন হয়ে যাবার পর সুযোগ বুঝে জামাইকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করেছেন। সেই লেনদেনের প্রমাণ আছে আমার কাছে। কিন্তু এই কাহিনির মধ্যে বড়ো একটা টুইস্ট আছে। আমি অনেক পরে তার সন্ধান পেয়েছি। হয়তো অভীকবাবুও সেটা জানেন না।

দেবলীনার মা বাকরুদ্ধ, পাথরের মতো শক্ত।

রক্তিম বিষন্ন মুখে বলল, ভীষণ খটকা লেগেছিল আমার। মেয়ে যত খারাপই হোক, একজন মা কী করে এমন করতে পারেন? পাগলের মতো ছুটেছি কয়েক দিন। তারপর দেবলীনার বাবার এক বন্ধুর কাছ থেকে পেয়ে যাই কাঙ্খিত সত্য।

ঘরের মধ্যে পিন ড্রপ সাইলেন্স। কাপড়ের আঁচলে মুখ ঢেকেছেন দেবলীনার মা। বাকি সবার চোখেই অসম্ভব কৌতূহল। এমনকী অভীক পাত্রও হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন এসব শুনে!

বিকাশ জিজ্ঞেস করল, কী সেই সত্য?

আসলে দেবলীনা ওঁর নিজের মেয়ে নয়। দেবলীনা আসলে অনাথ মেয়ে যার বাবা-মা এক ভয়ংকর বাস অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান, তখন ওর বয়স মাত্র এক বা দুই। ওকে বাড়িতে নিয়ে আসেন ওঁর দয়ালু স্বামী। না চাইলেও হয়তো মানতে হয়েছিল ওঁকে। কিন্তু মন থেকে যে মানতে পারেননি সেটা প্রমাণ করে দিয়েছেন। দেবলীনা ছিল ওঁর কাছে টাকা রোজগারের মেশিন মাত্র। মরেও সে টাকা দিয়ে গিয়েছে।

ফেরার পথে জিপে বসে রক্তিম বলল, এই সাফল্যের জন্য আমাদের টিম ওয়ার্কই মেইন ফ্যাক্টর। সবাই দারুণ কাজ করেছেন। তবে এর পরেও একজনকে আমি স্পেশাল কৃতজ্ঞতা জানাব। নামটা শুনলে আপনারা কিন্তু অবাক হবেন।

বিকাশ বলল, কে?

সুজয় ঘোষ। দেবদূত ঘোষের ভাই।

বিকাশ ও পলাশ মিত্র সত্যি সত্যি অবাক চোখে তাকালেন।

বিকাশ হেসে বলল, সুজয়! এই কেসের সাথে ওর সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। খুব সামান্য একটা কানেকশন। ও তোমাকে কীভাবে হেল্প করল। যার জন্য একেবারে স্পেশাল কৃতজ্ঞতা জানাবে?

আপাত দৃষ্টিতে ব্যাপারটা খুবই সামান্য। ছোট্ট একটা ইনফরমেশন দিয়েছিল সুজয়। কিন্তু সেটাই পরে বিশাল টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ায়। হয়তো মিত্রবাবু আপনিও ব্যাপারটা শুনেছেন কিন্তু তখন গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি। কারণ আমি জানি, আপনি ওর সাথে দুবার কথা বলেছেন।

পলাশ মিত্র অবাক হয়ে বললেন, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। একটু খুলে বলবেন?

অবশ্যই। যে-রাতে শান্তা খুন হয়েছিল, সেই রাতে সুজয় তার দাদা দেবদূতকে নেওয়ার জন্য ওই বাড়িতে এসেছিল মনে আছে তো?

হ্যাঁ মনে আছে।

ও কিন্তু অনেকটা পরে ঢুকেছিল। ঢোকার সময় ও দেখেছিল একজন লোক অন্যমনস্ক ভাবে পায়চারি করছে বাড়ির সামনে বৃষ্টির মধ্যেই। রেইনকোট পরা থাকলেও ভিজে যাচ্ছিল। লোকটার সাথে ঠোকাঠুকিও হয়ে যায় সুজয়ের। সুজয় ভেবেছিল আশেপাশের কোনও বাড়ির লোক হবে হয়তো, কৌতূহলবশত দেখতে এসেছে। তবে চেহারাটা মনে রেখেছিল। ওর বর্ণনা শুনে আমার সন্দেহ হয়। কিছুটা কৌতূহলবশেই অভীক পাত্রের ছবি দেখাই সুজয়কে। সুজয় কিন্তু এক দেখাতেই আইডেন্টিফাই করে ফেলে। আমি কনফার্ম হওয়ার জন্য কয়েকদিন কন্টিনিউ ফলো করি অভীক পাত্রকে। দেবলীনার মায়ের ব্যাপারটাও ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে যায়।

কাজ হয়ে যাওয়ার পরেও অভীক পাত্র ওখানে কী করছিলেন?

আমার মনে হয় রক্তমাখা গ্লাভসটা উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন। মনে হয় ওটা নিয়ে ওর মনে টেনশন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। থানাতে পৌঁছে ওর মুখেই সব শোনা যাবে। ওদের নিয়ে যাওয়ার জন্য আর একটা গাড়ি ও এক্সট্রা ফোর্স পাঠিয়ে দিয়েছেন স্বযং ডিসিপি। উনি যে আজ কতটা চাপমুক্ত হয়েছেন তা ঈশ্বর জানেন। আমিও আজ একটু মনের শান্তিতে ঘুমোতে পারব। আপনাদেরও খুব ধকল গেছে। সব মিলিয়ে আমরা কিন্তু পারলাম।

বিকাশ হেসে বলল, তোমার সাথে কাজ করে আমরাও খুব আনন্দ পেয়েছি।

রক্তিম জানালার ঝাপসা হয়ে যাওয়া কাচ ভেদ করে বাইরে তাকিয়ে একটা স্বস্তির প্রশ্বাস ছাড়ল। বাইরে তখন অঝোরে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। অবিরাম…। যেন আকাশ ভেঙে পড়বে।

                             সমাপ্ত

ডেডলি গেম(Crime Thriller)চতুর্থ পর্ব

নন্দীবাগান থেকে কিছুটা ভেতর দিকে স্কুলটা। মানদাময়ী গার্লস হাইস্কুল। এই স্কুলেই চাকরি করতেন তিয়াসা সরকার। হেড মিস্ট্রেস কল্যাণী মণ্ডল নিজের ঘরে বসালেন রক্তিমকে। ভীষণ আন্তরিক ভাবে বললেন, তিয়াসার মৃত্যুটা আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না স্যার। আমরা চাই ওর হত্যাকারী কঠোর সাজা পাক।

রক্তিম বলল, আমরা সেই চেষ্টাই করছি। তিয়াসা সম্পর্কে আপনার কেমন ধারণা ছিল একটু খুলে বলুন।

খুবই ভালো মেয়ে, টিচার হিসেবেও বেশ ভালো ছিল। যেমন মিষ্টি দেখতে, স্বভাবটিও তেমনি। ছাত্রী মহলে ওর একটা আলাদা নাম ছিল সুন্দরী ম্যাডাম। তবে ব্যক্তিগত ভাবে ওর জীবন খুব একটা সুখের ছিল না বলেই শুনেছি। যদিও ওসব ও কাউকে মুখ ফুটে কখনও বলত না। আমি রীতা, পম্পা ওদের মুখে শুনেছি।

ওরা কারা?

আমার স্কুলেরই দিদিমণি। ওদের সাথে তিয়াসার বন্ধুত্বটা গাঢ় ছিল।

ওদের সাথে একটু কথা বলা যাবে?

পম্পা আজ আসেনি। রীতা এসেছে, আপনি ওর সাথে কথা বলতে পারেন।

একটা ফাঁকা ঘরে বসার বন্দোবস্ত করে দিলেন হেড ম্যাডাম। রীতা নামের ম্যাডামকে বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছিল। রক্তিম ওকে স্বাভাবিক করার জন্য হেসে বলল, আপনি নার্ভাস হবেন না। সেই অর্থে আমি পুলিশের লোক নই, একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ, পুলিশের হয়ে কাজ করছি মাত্র। কয়েকটি সিম্পল কোশ্চেন করব, জানা থাকলে অবশ্যই ঠিক ঠিক উত্তর দেবেন, ব্যস এইটুকুই অনুরোধ। কাজ হল।

সহজ গলায় রীতা বড়ুয়া বললেন, বলুন কী জানতে চান?

আপনি তিয়াসাকে কতদিন হল চেনেন?

পাঁচ বছর হবে। আমরা দুজনে প্রায় একসাথেই এই স্কুলে জয়েন করি। কয়েক মাসের তফাতে। তারপর ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

ওর বৈবাহিক জীবনে একটা ক্রাইসিস ছিল সে ব্যাপারে আপনি কতটুকু জানেন?

তিয়াসা হুট করে বিয়ে করেছিল। দুজনের বয়সের ডিফারেন্সটাও অনেকটা বেশি। তবুও প্রথম দিকে খুশিই ছিল। তলে তলে অশান্তি বাড়ছিল। মাঝে মাঝে বলত, আমার পাপের বোঝা তো আমাকেই বহন করতে হবে। অনেক জোরাজুরিতে একদিন ওর হুট করে বিয়ে করার কারণটা বলেছিল আমাদেরকে।

কী কারণ?

বিয়ের আগে ফেসবুক বন্ধুত্বের মাধ্যমে একটি ছেলের প্রেমে পড়েছিল তিয়াসা। কিন্তু ছেলেটি বিবাহিত। ছেলেটা ওকে জানিয়েছিল, ওর বউয়ের সাথে কিছুতেই অ্যাডজাস্ট হচ্ছে না, খুব শিগগিরই ডিভোর্স নিয়ে তিয়াসাকে বিয়ে করতে চায়। প্রেমে অন্ধ তিয়াসা তাতেই রাজি হয়ে যায়। কিন্তু বাড়ির লোক মানতে চায়নি, ফলে তুমুল অশান্তি তৈরি হয়। ওর বাবা-মা, দাদা তড়িঘড়ি বিয়ে ঠিক করে ফেলে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের চাকুরে দিবাকর দাশগুপ্তের সঙ্গে। ইতিমধ্যে সেই ছেলেটির ওয়াইফ একদিন অনেক আজেবাজে কথা শোনায় তিয়াসাকে। কিছুটা অভিমানেই বাবা মায়ের পছন্দ করা পাত্রের সাথে বিয়েতে মত দেয় তিয়াসা।

তারপর?

বিয়ের কয়েক মাস পরেই তিয়াসা বুঝতে পারে, দিবাকর দাশগুপ্ত আসলে একটা পারভার্ট ম্যান। অসংখ্য নারীর প্রতি আসক্ত। আরও একটা সিক্রেট ব্যাপার জেনে ফেলেছিল।

কী?

সেই ছেলেটির ওয়াইফের সাথেও দিবাকর দাশগুপ্তের শারীরিক সম্পর্ক আছে।

তিয়াসা সেই ছেলেটির নাম কখনও বলেছিল আপনাকে?

হ্যাঁ বলেছিল। ছবিও দেখিয়েছিল। ভেরি হ্যান্ডসাম।

কী নাম?

অভীক পাত্র।

চমকে উঠলেও সামলে নিল রক্তিম। লতায় পাতায় এমন ভাবে গিট লাগিয়ে বসে আছে চরিত্রগুলো। মা ঠিকই বলেছিল, ভিকটিম তিন মহিলা সমস্ত রহস্যের রাশ আগলে বসে আছেন। কে জানে আরও কত বাকি আছে!

আপনি কখনও কথা বলেছেন তার সাথে?

না। তিয়াসাও কখনও ইন্টারেস্ট দেখাত না।

অভীক পাত্রের স্ত্রীর সঙ্গে দিবাকরবাবুর সম্পর্কের বিষয়ে আর কিছু বলেছিলেন কখনও?

না।

আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?

আমার তো দিবাকর দাশগুপ্তকেই সবচেয়ে বেশি সন্দেহ হয়। তিয়াসা শেষের দিকে ওকে ছেড়ে কথা বলত না। মাঝে মাঝে বলত লোকটা মুখোশের আড়ালে কত বড়ো শয়তান তোরা বাইরে থেকে কল্পনাও করতে পারবি না। দেখিস আমি একদিন ওর মুখোশ টেনে খুলে দেব। আমার মনে হয় তিয়াসা, দিবাকর দাশগুপ্তের অনেক গোপন কম্ম জেনে ফেলেছিল। তাই ওকে প্ল্যান মাফিক পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপনারা ওকে ধরুন অনেক কিছু পেয়ে যাবেন।

অসংখ্য ধন্যবাদ। প্রয়োজন হলে আবার যোগাযোগ করব। আপনার ফোন নম্বরটা দিন।

————-

 

ফেরার পথে একবার সুমিত সেনের ফ্ল্যাটে ঢুঁ দিল। ভাগ্য ভালো, তিনি তখন ফ্ল্যাটেই ছিলেন। রক্তিমকে দেখে বেশ অবাক ও বিরক্ত হলেন।

রক্তিম সে সবে ভ্রুক্ষেপ না করে সরাসরি বলল, আপনি ইন্দ্রজিৎ লাহিড়িকে চেনেন?

সুমিত সেনের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল, আ… প… নি… আপনি কী করে জানলেন?

রক্তিম মৃদু হেসে বলল, কী করে জানলাম? সেসব পরে শুনবেন। আগে বলুন এসব বিজনেস কবে থেকে চালাচ্ছেন?

আমি আপনাকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই।

বেশ, তাহলে পুলিশকে বলবেন। আমি ওদের সামারিটা দিয়ে দেব, বাকিটা ওরা ঠিক বের করে নিতে পারবে। আপনি দেবলীনাকে শিবানী বানিয়েছেন। হয়তো আরও কত মেয়েকে এই লাইনে এনেছেন। এইসব কানেকশন পেলে পুলিশ নিঃসন্দেহে আপনাকে গ্রেফতার করবে। আপনি আমার কাজটা অনেক সহজ করে দিলেন। পুলিশও এই সহজ সমাধান পেয়ে খুশি হবে। আমি তবে উঠি সুমিতবাবু। ডিসিপি-কে সমস্ত কিছু জানিয়ে কেস থেকে অব্যাহতি নিয়ে শান্তিতে একটু ঘুমোবার আয়োজন করি গে, কী বলেন?

আপনাকে যদি পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছতে না দিই?

আচমকা উঠে সামনের ড্রয়ার থেকে একটা পিস্তল বের করে সুমিত সেন বললেন, আমাকে ফাঁসিয়ে আপনি কোথায় যাবেন? সে সুযোগ আপনাকে দেব না। আপনাকে মেরে লাশ বস্তাবন্দি করে রাতের অন্ধকারে গঙ্গায় ফেলে দিয়ে আসব। কাকপক্ষীও টের পাবে না। বড্ড বেশি জেনে ফেলেছেন আপনি।

রক্তিম নির্বিকার ভাবে বলল, হাতে পিস্তল নিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন? ভালো। তার মানে আপনি স্বীকার করে নিচ্ছেন যে এই তিনটে খুনের পিছনের মাস্টার মাইন্ড আপনি, তাই তো?

মোটেও না। আমি ওদের খুন করিনি। কিন্তু আপনি তো সেটা বিশ্বাস করবেন না। তাই আপনাকে মরতেই হবে।

কেন বিশ্বাস করব না? শুনুন সুমিতবাবু আপনি যদি সত্যি সত্যি খুন না করে থাকেন তাহলে একমাত্র আমিই কিন্তু আপনাকে বাঁচাতে পারি। আপনি কী ভাবছেন আমাকে মারলে পুলিশ আপনার কুকীর্তি ধরতে পারবে না? এটা আপনার সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। তাতে পুলিশের সন্দেহ আরও বাড়বে। যেটুকু বাঁচার রাস্তা আছে সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে। যাক গে, মারার আগে আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর অন্তত দিন।

কী প্রশ্ন?

আপনি খুন করেননি বলছেন, তবে কে খুন করেছে আপনি জানেন?

না।

আপনি এত বড়ো একজন ইঞ্জিনিয়র, এই লাইনে এলেন কেন?

আমাকে নিয়ে এসেছে ধীরাজ। আমি অনেক অনেক বড়োলোক হতে চেয়েছিলাম। সৎ পথে মানুষ কত আর বড়োলোক হতে পারে?

ধীরাজ তো বিদেশে থাকে। ওর সাথে কীভাবে যোগাযোগ হল আপনার?

টেকনোলজির যুগে দূরত্বটা এখন কোনও ফ্যাক্টর নয়। ফিজিক্যালি না থাকলেও ধীরাজের টাকাতেই সব চলে। আমি সুপারভাইজ করি একটা টিমের মাধ্যমে।

মুকেশ কুমারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ডিটেলস ঘেঁটে পাওয়া গিয়েছে, ওকে বিদেশের কোনও অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা ট্রান্সফার করা হয়েছিল। তার মানে সেটা ধীরাজই পাঠিয়েছিল?

মুকেশ কুমারটা কে?

আপনি চেনেন না মুকেশ কুমারকে? স্ট্রেনজ!

সত্যি চিনি না। ধীরাজ কেন ওকে টাকা পাঠাবে?

দেবলীনাকে ভয় দেখানোর জন্য। যাতে ও এই পেশা থেকে সরে আসে।

হোয়াট! দেবলীনা আমাদের সবচেয়ে হট মডেল। ধীরাজ কেন এই কাজ করতে যাবে? তাও আমাকে না জানিয়ে ইমপসিবল। তাছাড়া ধীরাজ এলেবেলে যে-কারও অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করে নিজে বিপদে পড়ার রিস্ক কেন নেবে? এ তো সহজ হিসাব। এসব ব্যাপারে ধীরাজের মস্তিষ্ক ভীষণ তেজ চলে।

পুলিশ কিন্তু সেটাই পেয়েছে। সিক্রেট ব্যাপার বলে দিলাম। এমনও তো হতে পারে, চোরের ওপর বাটপারি করছে কেউ।

ভিতরে ভিতরে মারাত্মক কন্সপিরেসি চলছে এখন বুঝতে পারছেন তো? প্রতিশোধ নিতে চাইছে কেউ।

কে?

অফ কোর্স আমাদের কোনও এনিমি। কিন্তু মুশকিল হল তার সম্পর্কে মিনিমাম ধারণা আমাদের নেই। হয়তো সে আমাদের সাথেই আমাদের বন্ধু সেজে আছে। কারণ সে যে আমাদের সবকিছু জানে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

দেবলীনাকে মারার কারণ কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু শান্তা ও তিয়াসা কেন? কোনও ধারণা আছে আপনার?

তিয়াসার ব্যাপার বলতে পারব না, তবে শান্তাকে মারার কারণ বোধহয় আমাকে হার্ট করা। শান্তা আমার দুর্বল জায়গা সে জানে। শান্তাকে আমি খুব ভালোবাসি। এই যে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা রোজগার করি সে তো ওকে সুখে রাখার জন্যেই। মানুষ এতটা ভযংকর আর নির্দয় হতে পারে?

সুমিত সেন পিস্তল রেখে দুহাতে মুখ ঢাকলেন। একটু আগে তার চোখে মুখে যে উগ্রতা ছিল, এখন সেটা উধাও।

রক্তিম বলল, যেমন কাজ তার পেমেন্টও তেমনই হয় সুমিতবাবু। আজ আপনার কুকর্মের ফল ভোগ করতে হল শান্তাকে। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। শান্তার মৃত্যু দেহের, আপনার মৃত্যু মনের এটা কি কম শাস্তি? আপনার কি একবারের জন্যও মনে হচ্ছে শান্তার আত্মা যাতে শান্তি পায়, তার জন্য কিছু করা দরকার? যদি মনে হয়, তবে আমি কিন্তু আপনাকে হেল্প করতে পারি। তবে একটা শর্ত আছে।

কী শর্ত?

আপনাকে ওই দুনিয়া থেকে সরে আসতে হবে। নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। উচ্চ বনেদি বংশের ছেলে আপনি, বংশের ধারা বজায় রেখে চলার চেষ্টা করতে হবে। কি, রাজি?

এসব আপনার টোপ নয়তো? আপনি বুঝে গিয়েছেন আমি কোণঠাসা হয়ে আছি।

মে বি। তবুও বলছি আপনার বাঁচার উপায় একমাত্র আমার কাছেই আছে। ভেবে দেখুন কী করবেন?

কিছুটা সময় পর সুমিত সেন বললেন, ঠিক আছে আমি রাজি।

বেশ, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। তিয়াসা সরকারের সাথে আপনার পরিচয় কীভাবে?

তিয়াসার হাজব্যান্ড দিবাকর দাশগুপ্ত দেবলীনার ক্লায়েনট। ক্লায়েনটদের খোঁজখবরও আমাদের রাখতে হয়। এই লাইনে টাকা যেমন আছে বিপদও তেমনি আছে। আর বিপদটা কোন দিক থেকে আসবে সেটা তো জানা থাকে না।

দেবলীনা বিবাহিত ছিল আপনি জানতেন?

ও নিজে মুখে বলেনি তবুও জানতাম। ওকে সেটা বুঝতে দিতাম না। ওর হাজব্যান্ড সম্পর্কেও সমস্ত খবর ছিল আমার কাছে। লোকটা খুব ক্রিটিক্যাল। বাইরে থেকে জাজমেন্ট করা খুব মুশকিল। অনেক গোপন ব্যাপার আছে লোকটার।

আচ্ছা, পায়েল মিত্র বলে আপনি কাউকে চেনেন?

হ্যাঁ চিনি। তবে এই নামের পিছনে একটা সিক্রেট আছে। হয়তো কাজে লাগতে পারে আপনার। আসলে পায়েল মিত্রের কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই। ওটা একটা ডুপ্লিকেট নেম যেটা ব্যবহার করে নীলম মাথুর। সি ইজ অলসো পার্ট অফ দিস গেম।

ক্রমশ…

ডেডলি গেম(Crime Thriller)তৃতীয় পর্ব

আপনার কষ্ট হচ্ছে না?

তা হচ্ছে বৈকি। মুখে ওর নামে এসব বলছি বটে কিন্তু একদিন ওকে তো ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু যেদিন আবিষ্কার করলাম, আমার ভালোবাসাটা একতরফা– সেদিন সত্যি সত্যি মনটা ভেঙে গিয়েছিল। দেবলীনার মতো মেযেরা নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসে না। খুব স্বার্থপর।

আপনি বলছেন দেবলীনা ভাবত আপনি ওর কেরিয়ারের পথে বাধা ছিলেন, ঠিক তেমনি দেবলীনাও আপনার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াননি তো অভীকবাবু?

অভীক পাত্রের গলার স্বর হঠাৎ রুক্ষ হয়ে উঠল, ঠিক বুঝলাম না একটু পরিষ্কার করে বলুন। বানিয়ে বুনিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করবেন না।

রক্তিম হেসে বলল, বিরুদ্ধ কথা বললেই রাগ দেখানোটা ঠিক নয় অভীকবাবু। আমি কিন্তু ক্যালকুলেশন করেই কথাটা বলেছি। শুনেই দেখুন, মনে হয় তারপরে অতটা ফ্যালনা মনে হবে না। চোখ দুটো সরু করে তাকালেন অভীক পাত্র।

রক্তিম বলল, আপনি একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ভালো পোস্টে চাকরি করেন। ভালো মাইনে পান। আপনার পিএ নীলম মাথুর সুন্দরী ও স্মার্ট। তার সাথে আপনার একটা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আমি জানি। আপনি তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। তাই যদি হয় তাহলে দেবলীনাকে আপনার পথের কাঁটা বলাটা কি খুব অন্যায় হবে?

তেড়েফুঁড়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন অভীক। রক্তিম হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলল, দাঁড়ান দাঁড়ান আরও আছে। আগে আমারটা শেষ হোক তারপর আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ আপনাকেও দেব বৈকি। একটু আগে আপনি একটা ডাহা মিথ্যে কথা বলেছেন বুঝতে পারছেন তো?

কী মিথ্যে কথা বলেছি? আমি কোনও মিথ্যে কথা বলিনি।

বলেননি? বেশ আমি তবে মনে করিয়ে দিচ্ছি। আপনি বলেছেন আপনি মুকেশ কুমারকে চেনেন না। আমি যদি বলি আপনি তাকে খুব ভালো করেই চেনেন, অস্বীকার করতে পারবেন? হ্যাঁ বা না সরাসরি জবাব দিন।

ঢোক গিললেন অভীক পাত্র, না… মানে হ্যাঁ।

তোতলাচ্ছেন কেন? ভাষা হারিয়ে গেল? দেখুন মিঃ পাত্র গোয়েন্দাগিরি অত সোজা কাজ নয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবে আমরা একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হই। মুকেশ কুমারের সঙ্গে আপনার কিছু ছবি পুলিশ পেয়েছে যাতে প্রমাণিত হয়…

রক্তিমকে থামিয়ে অভীক বললেন, এখন ছবি তোলাটা কোনও ব্যাপার হল? প্রত্যেকের হাতেই স্মার্ট ফোন রয়েছে।

মানলাম ছবি তোলাটা কোনও ব্যাপার নয়। কিন্তু পরিচয় না থাকলে কেউ কারও সাথে হাসিমুখে ছবি তোলে? আপনি সেরকম কোনও সেলিব্রিটিও নন যে প্রতিদিন হাসিমুখে বহু মানুষের সাথে পোজ দিতে হয়। পুলিশ সেসব ছবি কোথা থেকে পেয়েছে জানেন?

কোথা থেকে?

মুকেশ কুমারের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে। তাতে এমন এমন সব ক্যাপশন দেওয়া আছে, সম্পর্কটা অস্বীকার করার কোনও রাস্তা নেই। এরপরেও যদি স্বীকার না করেন তাহলে স্বীকার করানোর দায়িত্বটা আমি পুলিশকেই দিয়ে দেব। আমাকে কোনও দোষ দিতে পারবেন না।

কলে আটকা পড়া ইঁদুরের মতো ছটফট করতে লাগলেন অভীক পাত্র।

মিথ্যে বলে আর কোনও লাভ নেই। তাতে আপনার বিপদ বাড়বে।

কিছুক্ষণ থম মেরে রইলেন অভীক পাত্র। তারপর মিন মিনে গলায় বললেন, হ্যাঁ, আমি মুকেশকে চিনি। কিন্তু দেবলীনার সাথে ওর কী কারণে ক্ল্যাশ তা আমি জানি না। মুকেশকে আমরা অফিসিয়াল মাসলম্যান হিসেবে ব্যবহার করি। অফিসের হায়ার অথরিটি সব জানে, সাপোর্ট দেয়। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। ছোটোখাটো ঝুট ঝামেলা হলে ওরাই সামলে দেয়।

হ্যাঁ, আমি জানি। অনেক বেসরকারি সংস্থা, ব্যাংক, ফিনান্সিয়াল এজেন্সি এই ধরনের ম্যাসলম্যান পোষে। কিন্তু দেবলীনা অর্থাৎ আপনার ওয়াইফকে ও ডিসটার্ব করছে অথচ আপনি কারণটা জানেন না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য কথা হল? জানা না থাকলে আপনি তো ওকে ফোন করেই জেনে নিতে পারতেন? কিন্তু আপনি সেসব কিছুই করেননি। এ থেকে যে-কেউ অনুমান করে নিতে পারবে, এসব আপনিই করিয়েছেন।

সেটাই আমার ভুল হয়েছে। করিনি দুটো কারণে। এক, প্রথমে ভেবেছিলাম এ মুকেশ অন্য কোনও মুকেশ। সুতরাং আমি ওদের মাঝে যাব না। পরে যখন জানলাম এ মুকেশ আমার চেনা মুকেশ তখন মনে হল, মুকেশ নিশ্চয়ই আমার স্ত্রীকে চেনে না। কারণ আমিও কাউকে দেবলীনার পরিচয় দিতাম না। বুঝলাম দেবলীনারই কোনও শত্রু টাকা দিয়ে মুকেশকে সেট করেছে। মুকেশদের কোনও নীতিফিতি থাকে না, টাকার জন্য ওরা সব কিছু করতে পারে। আমার মাথায় একটা বদ বুদ্ধি খেলে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম এই একটা সুযোগ, মুকেশ যদি দেবলীনাকে একটু টাইট দেয় তাতে ক্ষতি কী? কিন্তু মুকেশ যে এভাবে দেবলীনাকে খুন করে ফেলবে সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।

মুকেশ দেবলীনাকে খুন করেনি বলেই আমার ধারণা। মুকেশের মতো ক্রিমিনালরা ছুরি, চাকু, পিস্তল এসব ব্যবহার করতে জানে। এটা মোটা দাগের খুন নয়। এর পিছনে শার্প মাইন্ড আছে। আপনার গল্প কতটা সত্যি সেটাও খুব শিগগিরই যাচাই হয়ে যাবে আশা করছি।বলতে বলতেই ফোন বেজে উঠল রক্তিমের। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল আইসি দেবের নম্বর। রিসিভ করে বলল, বলুন স্যার ফোন করেছেন কেন?

ও প্রান্ত থেকে আইসি দেব বললেন, একটু আগে আমার স্টাফ পলাশ মিত্র ফোন করেছিল। ও মুকেশকে পাকড়াও করতে পেরেছে এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসছে। মিনিট পনেরো কুড়ির মধ্যেই হয়তো পৌঁছে যাবে। আপনি কি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চান?

অফ কোর্স। ওকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার আছে আমার। আমি আসছি, না পৌঁছানো পর্যন্ত ওকে ছাড়বেন না, ইটস ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট।

————–

থানায় ঢুকে রক্তিম দেখল আইসি দেব ফিল্মি কায়দায় টেবিলের উপর বসে একটা পা ঝুলিয়ে আর একটা পা সামনের চেয়ারের নীচের প্রান্তে রেখে দেহটাকে ঝুঁকিয়ে চেয়ারে বসা ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। রক্তিমকে দেখে সামনে এগিয়ে এলেন।

রক্তিম চাপা গলায় বলল, কিছু বের করতে পারলেন?

আইসি দেব বিরক্ত গলায় বললেন, দাগী মাল, সহজে ছাড়বে না। কিছু রোগ আছে উইদাউট ট্রিটমেন্টে কিছুতেই সারতে চায় না। দেব নাকি হালকা ওষুধ?

রক্তিম হেসে বলল, আমি একটু চেষ্টা করে দেখি, তারপরে না হয় দেখা যাবে।

বেশ। আমি পাশের ঘরেই আছি। অন্য একটা কেসের ব্যাপারে ওদের একটু ইনস্ট্রাকশন দিয়ে আসি।

রক্তিম মুকেশের সামনের চেয়ারে গিয়ে বসল। লম্বা চওড়া পেশীবহুল শক্তিশালী শরীর। চোয়াড়ে মুখ। গোঁফটা বিশেষ কায়দায় ছাঁটা। ঝাঁকড়া চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমেছে। গলায় ইউপি স্টাইলে উত্তরীয় জড়ানো। কপালে মেটে সিঁদুরের তিলক।

মুকেশই অবাঙালি টানে বলল, দেখেন সাব আপনি কোন অফিসার আছেন হামি জানি না, ওই সাব কিন্তু বহুত জুলুম কোরলেন। আরে হামি যেটা জানি না সেটার উত্তর কেমন করে দিব? আপনাকে দেখে সমঝদার লাগছে, আপনি একটু বুঝিয়ে বোলেন ওনাকে। কেন হামাকে ডেকে আনা হয়েছে সেটাই তো বুঝতে পারছি না হামি।

রক্তিম বলল, আমি বুঝিয়ে বলছি। গত কয়েক দিনে কলকাতায় তিনজন মহিলা মার্ডার হয়েছেন। দুটো কেসে আপনার নাম পাওয়া গিয়েছে। তাই আপনাকে তুলে এনেছে কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।

এটুকু বুঝেছি। কিন্তু এই সব মার্ডারের সাথে হামার কী সম্পর্ক?

এই সময় ঢুকলেন আইসি দেব। মুকেশের কথা ধরেই বললেন তুমি দেবদূতকে চেনো না?

তা তো হামি অস্বীকার করিনি। কিন্তু যে-মহিলা খুন হয়েছেন তাকে হামি চিনি না। শান্তা কুলকার্নি এই নামও শুনিনি কোনও দিন।

রক্তিম বলল, দেবদূতকে আপনি কীভাবে চিনলেন?

দেবদূতের সাথে হামার বিজনেস টার্মস আছে।

কী ব্যাবসা করেন আপনি?

এক্সপোর্ট ইমপোর্ট আরও অনেক কিছু।

রক্তিম হেসে বলল, যেমন সুপারি কিলিং, রাহাজানি, গুন্ডাগর্দি, দাদাগিরি তাই তো?

এসব কী বলছেন সাব? হামি পুজাপাঠওয়ালা আদমি আছি, ওসব কেন করতে যাব?

রক্তিম আইসি দেবের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। আইসি দেবও হাসলেন। মুকেশ নির্বিকার ভাবে বলল, হামার মোনে হয় আপনাদের কোনও গলদ ফ্যামি হোচ্ছে সাব। এরকম ঝুটা ইলজাম আপনারা হামাকে দিতে পারেন না। হামি কিন্তু চুপচাপ বসে থাকব না হায়ার অথরিটিকে জানাব। তখন কিন্তু ব্যাপারটা ভালো হোবে না সাব, আপনি জানেন না…

আচমকা চেয়ার ছেড়ে গর্জে উঠল রক্তিম, শাট আপ আর একটা আজে বাজে কথা বললে জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব।

চমকে উঠল মুকেশ। রক্তিমের রক্তচক্ষু দেখে থতমত খেয়ে গেল।

আইসি দেব বললেন, মালটা ঠ্যাটা তখনই বলেছিলাম আপনাকে। সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না রক্তিমবাবু।

মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে কন্ট্রোল করে নিল রক্তিম। মুচকি হেসে বলল, মুকেশ কুমার সব জায়গায় তো তোমার দাদাগিরি চলবে না। এবার তুমি বড়ো জায়গায় ফেঁসেছ বস। দ্যাখো তো এই ছবিটা চিনতে পারো কিনা?

রক্তিম মোবাইল থেকে দেবলীনার ছবি বের করে দেখাল মুকেশকে। নিমেষে মুকেশের ফর্সা গাল লাল হয়ে উঠল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আপন মনেই বিড় বিড় করে বলে উঠল, শিবানীর ছবি আপনার কাছে এল কী করে?

শিবানী ! রক্তিম বলল, আমি অবশ্য এমন কিছুই সন্দেহ করেছিলাম। তার মানে দেবলীনা বাইরের দুনিয়ায় শিবানী নামে পরিচিত ছিল। যাই হোক তুমি একে চেনো এটা অন্তত স্বীকার করলে। না করে উপায়ও ছিল না অবশ্য।

শিবানীকে হামি চিনি। শুনেছি শিবানীও…

ঠিকই শুনেছ। শিবানীও খুন হয়েছে। আর শিবানী খুনে তোমাকে সরাসরি অ্যারেস্ট করা যায়। কারণ তুমি তাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলে তার প্রমাণ আছে আমার কাছে।

মুকেশ কুমারের মুখ চুপসে আমচুর। দাদাগিরি মার্কা তেজ উধাও। আইসি দেব অবাক হয়ে বললেন, এসব ইনফরমেশন আপনি কোথায় পেলেন?

রক্তিম সে কথার জবাব না দিয়ে মুকেশকে বলল, শিবানীর আসল নাম তুমি জানো?

না সাব। শিবানীর আবার কটা নাম?

ওর আসল নাম দেবলীনা পাত্র। ওর স্বামীর নাম জানো?

মুকেশের চোখ দুটো আরও বড়ো হল, স্বামী! হামি তো জানি ও আন ম্যারেড।

অবাক লাগছে? ওর স্বামীর নামটা শুনলে আরও অবাক হবে। ওর স্বামীর নাম অভীক পাত্র। নিকলসন ইন্ডিয়া গ্রুপের এজিএম।

কথাটা বলেই রক্তিম তীক্ষ্ণ নজর ফেলে রাখল ওর মুখের উপর। মুকেশ কুমারের মুখের অভিব্যক্তির সামান্য ওঠা পড়াও যেন এড়িয়ে যেতে না পারে। মুকেশ কুমার উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল, অভীকবাবুর ওয়াইফ আছে শিবানী ! আপনি ঠিক বলছেন তো ? কোনও গড়বড় হচ্ছে না তো ?

হাসি খেলে গেল রক্তিমের ঠোঁটে, বিলকুল নেহি মুকেশ ভাই। এবার কষ্ট করে আর একটা সচ তোমাকে বলতে হবে, তাহলেই আপাতত তোমার ছুটি। ঝুট বলার চেষ্টা করবে না একদম। আমি কী জিনিস আছি নিশ্চয়ই কিছুটা বুঝে গিয়েছ এতক্ষণে।

মাথা নীচু করে মুকেশ বলল, বোলেন কী জানতে চান? তবে বিশ্বাস কোরেন সাব, কোনও খুন হামি করি নাই, মা কসম।

সেটা তদন্ত শেষ হলেই বোঝা যাবে। শিবানীকে তুমি হুমকি দিয়েছিলে৷ কিন্তু কেন?

হামাকে যেমন বলা হয়েছিল হামি তাই করেছি মাত্র। তার জন্য টাকা পেয়েছিলাম।

কে দিয়েছিল টাকা? সেই কী এসব করতে বলেছিল?

হামি তাকে সামনাসামনি দেখিনি। ফোনে কথা বলেছিল। টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিল অ্যাকাউন্ট ট্রান্সফার করে। হামি প্রথমে বলেছিলাম ক্যাশ চাই। তখন সে বলেছিল তাহলে অন্য কাউকে দিয়ে কাজ করাবে। হামি আর ঘাঁটাইনি। কারণ কাজটা ছিল সামান্য কিন্তু সেই হিসাবে টাকাটা ছিল অনেক। লোভ সামলাতে পারিনি সাব।

কত টাকা দিয়েছিল তোমাকে?

এক লাখ।

কী করতে বলেছিল?

সেরকম কিছুই না। শিবানী কোথায় যায়, কী করে, কার সাথে দেখা করে এইসব। আর মাঝে মাঝে ফোন করে হুমকি দিয়ে ভয় দেখানো। ব্ল্যাকমেল টাইপের ব্যাপার।

কিন্তু ব্ল্যাকমেল তো এমনি এমনি হয় না। ভয় দেখানোর জন্য কিছু একটা সিক্রেট ইস্যু থাকতে হয়। সেটা কী ছিল ?

শিবানী নাকি ব্লু ফিল্মে অ্যাক্টিং করত। যদিও সেটা সত্যি কিনা আমি জানি না। যিনি টাকা দিয়েছিলেন তিনি বলে দিয়েছিলেন এসব বন্ধ করার ভয় দেখাতে হবে, হামি সেটাই বলতাম।

এসব ফাঁস করে দেওয়ার সাথে সাথে টাকার দাবি করতে বলেনি?

না সাব। জানে মেরে ফেলার কথা বললেও টাকার কথা কিন্তু বলতে বলেনি কোনও দিন।

আশ্চর্য‌্য!

আমারও তাজ্জুব লেগেছিল। একবার পুছেও ছিলাম। কিন্তু সাব গুসসা হয়ে যেত।

তোমার সাথে কতদিনের কন্ট্রাক্ট ছিল?

সেরকম কোনও কথা হয়নি। হামিও পুছিনি। তবে হামার কথায় সেরকম কাজ হচ্ছে না বুঝতে পারতাম। কারণ শিবানী সেই সব কাজ করেই যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন শুনলাম শিবানী খতম। মনে মনে খুশিই হয়েছিলাম, হামার পেমেন্ট পেয়ে গেছি, আর কোনও ঝামেলা থাকল না। কিন্তু এখন তো দেখছি শিবানী মরে ফাঁসিয়ে দিয়ে গেছে। আপনারা আমাকে জোর করে টেনে আনছেন। এর বেশি আর কিছু জানি না সাব।

এবার তোমাকে ছেড়ে দেব। আর একটা লাস্ট কোশ্চেন আছে। যিনি তোমাকে এসব করতে বলেছিলেন, টাকা দিয়েছিলেন, তিনি তার নামটা বলেছিলেন?

হাঁ সাব। অবিনাশ রুদ্রা। বললেও হামার মনে হয়েছে নামটা ভুয়ো আছে। এই সব লাইনে অনেক দিন হয়ে গেল। খারাপ কাজ করাচ্ছে, আসল নাম বলবে, হামার বিশ্বাস হয়নি। নিজের সেফটি সবাই বোঝে। হামিও নিজের সেফটির কথা ভেবে একটা কাজ করেছিলাম। ওর সাথে যখনই কথা বলতাম সমস্ত কল রেকর্ড করে রাখতাম সাব। হামি যা কিছু করেছি ওই লোকটার কথাতেই করেছি তার সুবুদ আপনারা ওখান থেকে পেয়ে যাবেন আশা করি।

রক্তিম তাকাল আইসি দেবের দিকে। আইসি দেব হেসে বললেন, আবার সেই অবিনাশ রুদ্র? একজন মৃত ব্যক্তি কীভাবে এসব করে বেড়াচ্ছে? স্ট্রেনজ !

রক্তিমও হাসল। মনে হয় ওর ভূত করাচ্ছে স্যার। যাই বলুন খেলাটা কিন্তু বেশ জমে উঠেছে। এর আগে কোনও দিন কোনও ভূতের সাথে লড়াই করিনি। মনে হয় এবার সেটাও করতে হবে। আপনি ওর রেকর্ড করা কলগুলো ট্রান্সফার করার ব্যবস্থা করে ওকে ছেড়ে দিন। তারপর শান্তা ও মুকেশ দুজনেরই রেকর্ড করা কলগুলো আমার মোবাইলে পাঠিয়ে দিন। আমি ঠান্ডা মাথায় বাড়িতে বসে ওগুলো শুনতে চাই।

ছয়

মণিশঙ্কর দত্ত লেনের সরু একটা গলি। দুপাশে পর পর বাড়ি। এ দিকটায় কোনও দিন আসেনি রক্তিম। একটা গলি শেষ হতেই আর একটা গলির শুরু। তস্য গলি। একজনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল এটাই বিধু দত্ত লেন। একটু এগিয়ে যেতেই নজরে পড়ল চোদ্দো নম্বর বাড়িটা। বাড়ির নাম প্রধান ফটকে লেখা, কেতকি ম্যানসন। নীচে তৈরির সাল লেখা রয়েছে। হলুদ রঙের পুরোনো সাবেকি মডেলের দোতলা বাড়ি। সামনে ঢোকার মুখে একটা মাধবীলতা গাছ সদর গেটটাকে জড়িয়ে ঝাঁকিয়ে উঠেছে। সর্বাঙ্গে লাল সাদা ফুলের বুনোট। থোকা থোকা ফুল আর সবুজ পাতা, যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবি।

কিছুটা দূরের বাঁকে একটা চায়ের দোকান। সামনে বেঞ্চ পাতা। একটা লোক ছিল, সেও উঠে গেল। কী মনে হল, রক্তিম চায়ের দোকানে গিয়ে বসল। এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে সিগারেট ধরাল। আকাশ মেঘলা, যে-কোনও সময় নেমে যেতে পারে, তাই লোক চলাচল কম। আশেপাশের বাড়ি থেকে টিভির শব্দ ভেসে আসছে। চায়ের দোকানে বসে চা খেলেও রক্তিমের নজর চোদ্দো নম্বর বাড়িটার দিকে। কিছুটা আন্দাজেই চলে এসেছে। খবরটা যদি সত্যি হয় তাহলে ভেতরে ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা অনুভব করে। যদি মিথ্যে হয় তাহলেও কিছু বলার নেই। একজন গোয়েন্দার প্রাথমিক কর্তব্য হল, যত ক্ষীণ সূত্রই হোক সেটা যাচাই করা। সেটাই করতে এসেছে রক্তিম।

একটু আগেই সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল। গলির মোড়ে হ্যালোজেন বাতি জ্বলে উঠতেই জায়গাটা ঝলমল করে উঠল। রাস্তার একধারে জমে থাকা জলে আলো পড়তেই ঝলসে উঠল যেন। বাতাসে হালকা হিমেল ভাব। ফলে প্যাচপেচে গরমটা আর নেই। রক্তিম মনে মনে ভাবল, আগ বাড়িয়ে ওই বাড়ির কড়া নাড়াটা কি ঠিক হবে? একটা কিছু বানিয়ে বলে ঢোকা যাবে ঠিকই কিন্তু তাতে উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া কিছুটা নিশ্চিন্ত না হয়ে মুখ দেখানোটাও বোধহয় ঠিক হবে না। যদি সত্যি সত্যি ইনফরমেশন ভুল থাকে। মনের মধ্যে পক্ষে বিপক্ষে নানা যুক্তি বুদবুদের মতো উঠে আসতে লাগল।

এদিকে রাত বাড়ছে, দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। এতদূরে এসে খালি হাতে ফিরে যেতেও মন চাইছে না। এই রকম দোলাচলে চায়ের বিল মেটাতে উঠল। ঠিক তক্ষুনি একটা টানা রিকশা এসে দাঁড়াল চোদ্দো নম্বরের সামনে। রিকশা থেকে যিনি নামলেন তাকে দেখে প্রথমে নিজের চোখকেই ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না রক্তিম। সুমিত সেন এখানে! রক্তিমের কাছে যা ইনফরমেশন আছে, তাতে এই বাড়িটি দেবলীনার বাপের বাড়ি। দেবলীনার বাপের বাড়িতে সুমিত সেন এসেছেন কেন? তবে কি সুমিতের সাথে দেবলীনার কোনও সম্পর্ক ছিল? কেমন জানি মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল রক্তিমের।

সুমিত সেন রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে গেলেন। দেখেই বোঝা গেল এ বাড়িতে তার যাতায়াত আছে। রক্তিম আবার বেঞ্চে বসে পড়ল। আপাতত অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই। তবে আশান্বিত হল, এই বাড়িতে যে রহস্যের একটা জট পেকে আছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মনে মনে আশ্বস্ত হল, ভুল জায়গায় এসে পড়েনি।

প্রায় কুড়ি মিনিটের মতো সময় নিলেন সুমিত সেন। তারপর বেরিয়ে হন হন করে হাঁটা দিলেন মেইন রোডের দিকে। ইচ্ছে করলেই সুমিত সেনকে ধরতে পারে রক্তিম। কিন্তু সে চেষ্টা করল না। এই বাড়িতে ঢোকাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করল।

কলিংবেল টিপে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। খুললেন মাঝ বয়সি একজন প্রৌঢ়া। অবিকল দেবলীনার মুখ। আলাদা করে চেনানোর কোনও প্রয়োজনই পড়ে না।

রক্তিম বলল, আপনি তো দেবলীনা পাত্রের মা, আমি রক্তিম বিশ্বাস পুলিশের তরফ থেকে আসছি, কিছু জরুরি কথা বলার ছিল।

পুলিশের নাম শুনেই কিনা ঠিক বোঝার উপায় নেই, তবে বেশ নার্ভাস লাগল ভদ্রমহিলাকে।

কিছুটা কাঁপা গলায় বললেন, কিন্তু পুলিশকে তো যা বলার সবই বলেছি আমি। আবার কেন এসেছেন? আমি একা থাকি সময় নেই অসময় নেই, এভাবে বিরক্ত করার কোনও মানে হয়?

সরি অসময়ে আসার জন্য আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আপনার মেয়ে মার্ডার হয়েছেন ম্যাডাম, আপনি চান না তার হত্যাকারী ধরা পড়ুক?

অবশ্যই চাই।

তবে তদন্তে একটু সহযোগিতা তো করতেই হবে। পুলিশ প্রাণপণ চেষ্টা করছে।

ভেতরে আসুন। আমাকে একটু তাড়াতাড়ি ছাড়লে সুবিধা হয় কিছু জরুরি ফোন করার আছে।

অফ কোর্স। আমি বেশি সময় নেব না।

ভেতরে ঢুকেই রক্তিম বুঝতে পারল প্রাচুর্যের কোনও অভাব নেই এ বাড়িতে। আসবাব থেকে ঘরের পর্দা সবই দামি। বেশ কিছু অ্যান্টিক শো পিস রয়েছে। নরম সোফায় বসে রক্তিম বলল, আপনার কয় ছেলেমেয়ে?

এক ছেলে এক মেয়ে, দেবলীনা বড়ো। ছোটো দেবোপম বেঙ্গালুরুতে ডাক্তারি পড়ছে। একটা বেসরকারি কলেজে।

কিছু মনে করবেন না। সে তো অনেক টাকার ব্যাপার, এত টাকা কোথায় পেলেন?

রেগে উঠলেন ভদ্রমহিলা, সে কৈফিয়ত আপনাদের দিতে হবে? আশ্চর্য তো ! আমার স্বামী রেলের বড়ো পোস্টে চাকরি করতেন। ওদের বনেদি পরিবার। স্থাবর অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ নেহাত কম নেই। তাছাড়া আমার মেয়েজামাই দুজনেই যথেষ্ট উপার্জনশীল, ওরাও ওর পড়ার ব্যাপারে অনেক হেল্প করে।

আপনার স্বামী কতদিন হল মারা গিয়েছেন?

চার বছর হল। হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক। তিনদিন ভেন্টিলেশনে থাকার পর।

সরি, দেবলীনা মডেল ছিল ওর কাজকর্ম সম্পর্কে আপনার কোনও ধারণা আছে?

ও বেশ নামকরা মডেল ছিল। একটা ফিল্মে হিরোইন হবারও কথা চলছিল। দিনরাত খাটত নিজের পজিশন তৈরির জন্য। টাকাও রোজগার করত ভালোই।

দেবলীনার সঙ্গে ওর স্বামীর সম্পর্ক কেমন ছিল?

দুজনেই মহা ব্যস্ত মানুষ। কেউ কাউকে ঠিক মতো সময় দিতে পারত না। যার ফলে একটু ঠোকাঠুকি লেগে থাকত। ওটা কোনও বড়ো ব্যাপার নয়। তবে দেবলীনার হিরোইন হবার ব্যাপারটা আমার জামাই মেনে নিতে পারেনি। ডিভোর্স দেবার কথাও তুলেছিল একবার। আসলে ওদের ফ্যামিলি ভীষণ ব্যাকডেটেড, এসব দ্যাখেনি কোনও দিন।

রক্তিম হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, একটু আগে আপনার বাড়ি থেকে যিনি বেরিয়ে গেলেন তিনি কে?

একটু থমকালেন দেবলীনার মা। কী যেন ভাবলেন। তারপর তির্যক হেসে বললেন, আপনারা এভাবে গোয়েন্দাগিরি করছেন?

রক্তিম হেসে বলল, আপনি যা ভাবছেন সেরকম কিছু না। সামনাসামনি হয়ে গিয়েছিল তাই জিজ্ঞেস করছি। ইচ্ছে না হলে এ প্রশ্নের জবাব না-ও দিতে পারেন।

জিজ্ঞেস যখন করলেন তবে শুনেই রাখুন। ওর নাম ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ি, একজন প্রোডিউসার। ওর কাছে দেবলীনার কিছু পেমেন্ট বাকি ছিল সেটাই দিতে এসেছিলেন। খুব সজ্জন মানুষ। নইলে এই বাজারে মরা মানুষের টাকা কেউ দেয়?

রক্তিম ভীষণ অবাক হয়ে গেল। সুমিত সেনের এই নতুন নাম নেওয়ার মানেটা কী? তবে কি সুমিত বেনামে মেয়েদের দিয়ে ব্যাবসা চালায়? ওই কি তবে দেবলীনার খুনি ? হয়তো ব্যাবসা সংক্রান্ত কোনও গোলমাল হয়েছিল ওদের মধ্যে। তবে শান্তা ও তিয়াসার খুনি কে? ওটাও কি সুমিতের কাজ? যেভাবে কানেকশনগুলো বেরিয়ে পড়ছে অসম্ভব কিছু নয়। সুমিত যে এতটা জড়িয়ে আছে, এখানে না এলে জানতে পারত রক্তিম? যাকে দেখছে সে-ই কিছু না কিছু রহস্য ক্রিয়েট করে রেখেছে! চারদিকে ছড়িয়ে পড়া এই জাল গুটিয়ে তোলা অত সহজ কাজ হবে না।

কী অত ভাবছেন? এবার আমাকে ছাড়ুন।

সরি আর দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করেই ছেড়ে দেব। একটা বিষয় বোধহয় জানেন না, আপনি হয়তো শুনে কষ্ট পাবেন তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি, একদিন তো আপনি জানবেনই। দেবলীনা মডলিং-এর পাশাপাশি পর্ন ফিল্মে কাজ করতেন। সেখান থেকেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আসত। আপনি কি জানতেন সেটা?

কী যা তা বলছেন আপনি?

আপনার পক্ষে মেনে নেওয়া হয়তো কষ্টকর কিন্তু এটাই সত্যি। মডেলিং ছিল লোক দেখানো ব্যাপার। তবে দেবলীনা স্বেচ্ছায় নাকি অন্য কারও চাপে পড়ে এই প্রফেশন বেছে নিয়েছিল, সেটা আমি বলতে পারব না।

কিছুক্ষণ থম মেরে রইলেন ভদ্রমহিলা। ধীরে ধীরে মুখ তুলে বললেন, এসব আমি জানতাম না। জামাই কিছুটা হিন্টস দিলেও ওর কথায় গুরুত্ব দিইনি। ভাবতাম ওর কথাই ঠিক, জামাই জেলাসিতে ভোগে। ছিঃ ছিঃ ওর বাপঠাকুরদার কত বড়ো বনেদি বংশ। এখনও মানুষ সমীহ করে। সেই বংশের মেয়ে হয়ে এসব করতে পারল? আর সেই টাকা আমি এতদিন হাত পেতে নিয়েছি? ঘেন্নায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। দুহাতে মুখ ঢাকলেন দেবলীনার মা।

রক্তিম বলল, এবার আমি উঠছি মাসিমা। আমার সাথে আপনার এই সাক্ষাতের কথা কাউকে না বলাই ভালো। তাতে আপনার বিপদের ঝুঁকি বাড়তে পারে। আপনি এতটা জেনে গেলেন এটা অনেকের সহ্য না-ও হতে পারে।

 

 

বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে গেল। চটজলদি ফ্রেশ হয়ে সোজা খাবার টেবিলে চলে এল। জবর খিদে পেয়েছে। মা খাবার পরিবেশন করতে করতে বললেন, খিদে তো পাবেই। সেই কোন সকালে খেয়ে গিয়েছিলি। সারাদিন নিশ্চয়ই অনেক ধকল গিয়েছে। কিছু প্রোগ্রেস হল?

ঠিক বুঝতে পারছি না। বনের মধ্যে পথ হারানোর মতো ব্যাপার হচ্ছে। অনেক ঘোরাঘুরি করে শেষে মনে হচ্ছে যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানেই আবার এসে পৌঁছেছি।

আগে ঠান্ডা মাথায় খেয়ে নে। তারপর আমাকে সব খুলে বল। দেখি তোকে কোনও ভাবে হেল্প করতে পারি কিনা।

খাওয়া শেষ করে দুজনে ঝুল বারান্দার ব্যালকনিতে এসে বসল। রক্তিম সংক্ষেপে ব্রিফিং করল মাকে। মা সব শুনে বললেন, এক্সেলেন্ট, দারুণ প্রোগ্রেস। এর চেয়ে আর বেশি কী চাস? কেসটা অনেক বেশি ছড়ানো, একটু সময় লাগবে। আমি তোকে সেদিনই বলেছিলাম, ভিকটিম তিনটে মেয়ে তোর ট্রাম্প কার্ড। ওরাই রহস্যের সূত্র। এক দেবলীনাই এত কিছু জানিয়ে দিল, শান্তা ও তিয়াসা এখনও বাকি। আমার ধারণা ওরাও অনেক রহস্য নিয়ে বসে আছে। একটা জোরে ঝাঁকি দিতে হবে। গাছে ফুল থাকলে যেমন জোরে ঝাঁকি দিলে ঝরে পড়ে, এখানে রহস্য ঝরে পড়বে। তোকে যথার্থ ফুল সংগ্রাহক হতে হবে। ওই ফোন কল দুটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদিও যে-ফোন করেছে, সে সব রকম সতর্কতা অবলম্বন করেই করেছে বলে মনে হয়। তবুও একবার ভালো করে চেক করা দরকার। খুব বড়ো ক্রিমিনালও অনেক সময় খুব সাধারণ ভুল করে বসে। কিন্তু ভুল তো নিজে থেকে ধরা দেবে না, তোকে খুঁজে বের করতে হবে। সত্যি কথা বলতে একজন ডিটেকটিভের সাফল্যের পিছনে কোনও শর্টকাট ওয়ে থাকে না। প্রত্যেকটা ইভেন্ট, প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি নিয়ে কাজ করতে পারলে তবেই সাফল্য আসবে।

রক্তিম হেসে বলল, তোমার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারছি। আমাকে আরও খাটতে হবে। থ্যাংক ইউ ফর ইওর প্রেশাস অ্যাডভাইস। এবার আমি শুতে চললাম।

মা হেসে বললেন, তুই যে এখন কেমন শুবি সে তো বুঝতেই পারছি। ওই কল রেকর্ড শোনার চক্করে অযথা বেশি রাত করিস না, শরীর খারাপ করবে।

 

————

সকালবেলা রক্তিমের ঘুম ভাঙল মোবাইলের গোঙানিতে। ঘুম চোখে তুলে দেখল আইসি দেবের ফোন। সাত সকালে আবার নতুন কিছু ঘটল নাকি?

আইসি দেব বললেন, ঘুমোচ্ছিলেন নাকি? আপনি মুকেশের ব্যাংক ডিটেলসটা চেয়েছিলেন তাই করলাম। কাল রাতেই পেয়েছি কিন্তু অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় আর ফোন করিনি।

ঘুম ছুটে গিয়েছে, উঠে বসল রক্তিম, গুড। আমি থানায় গিয়ে দেখে নেব। তাছাড়া ইন্সপেক্টর পলাশ মিত্রের সাথেও একটু কথা বলার দরকার আছে। আচ্ছা, দেবদূতের ভাই সুজয় ঘোষ সম্পর্কে আপনারা কোনও খোঁজ খবর করেছিলেন?

সেরকম কিছু না। সামান্য কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল মিত্র। কেন বলুন তো?

না সেরকম গুরুত্বপূর্ণ কোনও ব্যাপার নেই। থানাতে গেলে কথা হবে এখন রাখছি।

দাঁত ব্রাশ করে ড্রযিং রুমে এসে বসল রক্তিম। একটু বাদে মা চায়ের ট্রে হাতে ঘরে প্রবেশ করে বললেন, কী রে রাতে ঠিকমতো ঘুমিয়েছিলি তো?

রক্তিম হেসে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ খুব ভালো ঘুমিয়েছি।

মা হাসলেন, বুঝতে পারছি। তোকে বেশ ফ্রেশ লাগছে। কে ফোন করেছিল একটু আগে?

আইসি প্রিয় প্রসাদ দেব। মুকেশ কুমারের ব্যাংক ডিটেলসটা পেয়েছেন সেটাই জানালেন।

কল রেকর্ড দুটো শুনলি? কিছু পেলি?

সেরকম কিছু নেই। ওদের মুখে যা শুনেছি সে সবই রয়েছে তবে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলে অদ্ভুত একটা জিনিস শোনা যায়। আমার ভুলও হতে পারে, তুমি একটু শুনবে? আমি সব সেট করে দিচ্ছি মন দিয়ে শুনবে কিন্তু। যদি তুমিও ধরতে পারো তাহলে বুঝব আমার অনুমান ঠিকই আছে।

মাকে সব অ্যারেঞ্জ করে দিয়ে রক্তিম চা খেতে বসল। মা চোখ বন্ধ করে শুনতে লাগলেন। একবার নয়, দু-তিনবার শুনলেন। একসময় তার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হেড ফোন খুলে বললেন, আই থিংক ইউ আর রাইট। দারুণ আবিষ্কার করেছিস। কালকেই বলেছিলাম, বড়ো বড়ো ক্রিমিনালও ভুল করে অ্যান্ড দিস ইজ মোস্ট ভাইটাল ওয়ান। এখন এটাকে কতটা কাজে লাগাতে পারবি তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। কি ঠিক ধরতে পেরেছি তো ?

রক্তিম মায়ের ব্যাখ্যা শুনে বলল, ইউ আর অ্যাবসুলিউটলি রাইট। কিন্তু এত লোকের মাঝে খুঁজে বের করা অত সহজ কাজ হবে না, সেটাও বুঝতে পারছি। আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। তোমার অ্যাপ্রুভাল পেলে এগজিকিউট করার কাজে হাত দেব।

শোনা, দেখি তোর প্ল্যানিং।

রক্তিম মাকে ব্যাখ্যা করে শোনাল ওর নেক্সট প্ল্যানিং।

মা শুনে উচ্ছসিত হলেন দারুণ। তোর চিন্তা ভাবনার মধ্যে অনেক পরিপক্কতা এসেছে। যদি সফল ভাবে কেসটা সলভ করতে পারিস আমি দারুণ খুশি হব।

 

ক্রমশ…

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব