মনসাসুন্দরী

ওই যে ধন্যিমেয়ে বইতে উত্তমকুমার দাঁত মুখ খিঁচোয়ে ওর অমন সুন্দর ভাইডারে বলতিছিল গো, এই বগলা গোল দে, এই বগলা গোল দে, ত্যাকোন থে মুঁই বগলার প্রেমে। আহা, কচি কলাপাতার মোতন ডগমগে রূপ ঝ্যামোন, আর নামডাও তেমনি ডাংগুলির গুলি ঝ্যানো। বনবন করি হাওয়ায় ঘুরতি ঘুরতি বুকের ভেতর সেঁইধে যায়।

বেশি লোকজন নেই। কাজের সুবিধেই হয়েছে। স্টেশনের দুচারজন দোকানদার কলকাতার বাবুদের দেখে পায়ে পায়ে এসেছে। তা আসুক। এটুকু ঝক্কি সামলেই ওরা কাজ করে।

তা যা বলেন বাবুরা, ত্যাকোন থে মোর মাথাটা লড়বড়ে হুয়েছে। ওই যে গেরামের মাঠে তাঁবু খাটায়ে বই পড়ল। মুঁই ধন্যিমেয়ে দ্যাকলাম। ব্যাশ, মোর প্রেম পালো। মনে মনে ঠিক করি নিলাম, না আর মুঁই মাঠে গোবর কুড়ব নে। মোর একখান বগলা চাই-ই চাই। আর সারা দিনমান ঘরে, বাইরে, পুকুরঘাটে— ঝিদিক পানে যাই না ক্যান, সিকেনেই গানখানা গুনগুন করি। জয়া ভাদুড়ি গেয়েছিল গো। বইয়ে তার নাম মনসা ছেল। আর মোর নামও মনসা। হি হি হি!

তা দিদি, ওই গানটি একটিবার শোনাও আমাদের! মদন, ভাই দোকানদারকে বল না, টিনের গেলাসে দু-কাপ চা আর কয়েকটা ভালো বিস্কুট কাগজে মুড়ে দিতে।

সামনে থেকে টিনের গেলাস তুলে নিয়ে মদন নামে ছেলেটি প্ল্যাটফর্মের স্টলে চা আনতে গেলে বেশ উৎসাহ লাগিয়ে মনসা বলে ওঠে, চা খাওয়ার আগে গাতি হবে, না কি পরে গাবানে?

দিদি, তোমার মন চাইলে এখনই গাইতে পারো।

মনসা মাথাটা চুলকে নেয়। উকুনগুলো সড়সড় করে চলে ফিরে কিছু বলছে। ও কান পেতে ওদের কথা ধরার চেষ্টা করে। এক কানে হাত চাপা দিয়ে অন্য কানের দিকে চোখ আর মন যত্ন করে লাগায়।

তার একমাথা চুল কাকের বাসার মতো নয় ঠিক, তবে বেশ এলোমেলো। মাঝে মাঝে চুলকোয়। তবে উকুন মারে না সে। উকুনরা যে তার আশ্রয়ে আছে। গুটি কয়েক প্রাণকে সে তার এই বিরাট মাথার ভেতর আশ্রয় দিয়েছে, তা কী এমন বেশি! তাছাড়া সন্ধের পর এই নির্জন প্ল্যাটফর্মে কার সাথে কথা কয়ে সময় কাটাবে! ওরা না থাকলি অমন থেবড়ে বসা রাতখানা কাটায় কী করে সে! ঘুম তো আসতি চায় না। ওদের সাথেই তো সুখ-দুঃখের কথা কইতে কইতে ভোরের ট্রেনের খবর নেয় কানে। প্যাসেঞ্জারের পায়ে শব্দে মনে আরাম হয়।

সুধাময়, প্রাণেশ, টিঙ্কু-রা নানা কোণ থেকে ছবি তুলছে, তবে গোপনে। স্টেশন চত্বরের চার-পাঁচজনের ভিড়টা লক্ষ করেনি যে ছবি উঠছে খেপির। তারা দেখছে একজন নীল জিন্স প্যান্ট আর কালো টি-শার্ট পরা সুন্দর মতো লোক মাটিতে পা মুড়ে বসে খেপির সাথে কথা বলতে লেগেছে।

কদবেলের দোকানদার উবু হয়ে বসে সবটা বুঝতে চাইছিল। সে বলল, গা তো খেপি ওই গানটা। কদবেল মাখা দেব দুপুরবেলায়। গা।

প্যাসেঞ্জাররা তাড়াহুড়োয় দেখে না সবটা। কদবেলওলা বেল ফাটিয়ে চিনি, লংকা, নুন, ধনেপাতা আর কাসুন্দি দিয়ে মেখে তুলে দেয় প্লাস্টিকের বাটিতে। কিন্তু গেলাসের নীচে খানিকটা যে ফেলে রাখে দোকানদার তা নজরে পড়ে না খদ্দেরদের। আর পরেরটা বানানোর আগে দোকানদার চামচ দিয়ে টেনে তুলে তা একটা বাটির ভেতর রেখে দেয়। দুপুর পর্যন্ত যা জমে তা খেপিকে এক ফাঁকে দিয়ে আসে।

মনসা উকুনদের সাথে কথা বলা ছেড়ে দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় লুঙ্গি পরা, বুক খোলা পেট উঁচু ওই কদবেল দেওয়া লোকটার দিকে। তার চোখের তারায় মেঘ ঢোকে। ছায়া লাগে মুখে, বুকের ভেতর জয়া ভাদুড়ির সেই আদুরে আর অভিমানী মুখের ঢল নামে। পেটের ভেতর গুড়গুড় করে, গলা খুসখুস করে। কথা হয়, কিন্তু কেউ শোনে না। শুধু মনসা ঠোঁট নাড়ে জয়া ভাদুড়ির মতো। উকুনেরা দিব্যি শুনতে পায় তা যা যা বেহায়া পাখি যা না। অন্য কোথা যা না, কেউ করেনি মানা।

ভিডিও রেকর্ডিং করছিল যে মোবাইলগুলো, তারা একটু একটু এগিয়ে আসে। প্ল্যাটফর্মের একটা গোটা দিক, রেল লাইন, সিগন্যাল, স্টেশনের নাম লেখা কংক্রিটের বোর্ড, একটা খেঁকুরে কুকুরের হেঁটে যাওয়া কিছুই বাদ যায় না। তারা মোবাইল ফোনের লেন্স মনসার দিকে যতটা পারে জুম করে। সামনে বসে গল্প করতে থাকা ওদের এডি শুভঙ্করের ছবিও একই ফ্রেমের ভেতর রাখতে হবে যে।

মনে হয় এবার গান শুরু হবে। গান আর মুখের প্রথম অভিব্যক্তি ধরা চাই। তারপর কলকাতায় ফিরে, এডিটিং করে, মনসা পুজোয় মনসার গান ক্যাপশন দিয়ে ইউ টিউব-এ ছাড়বে কাল। কাল যে শ্রাবণ মাসের শেষ, মনসা পুজো।

টিউবে ওদের চ্যানেলের নাম দ্য নেচার। কৃত্রিমতাহীন সবকিছুই ওদের সাবজেক্ট। বাজারে খাসি কাটার দৃশ্য, তার ব্যা ডাক, আর অল্প পা-দাপানো যেমন থাকে, তেমনি ঘুঘু পাখি, পায়রা বা ফড়িং-এর সোহাগদৃশ্য হাঁ করে দেখছে তিন-চার বছরের বাচ্চারা, তাও দেখায়।

ওরা চায় প্রাকৃতিক কিন্তু অড সাবজেক্ট। এই আগস্ট মাসের শুরুতেই একটা ভিডিযো গোটা ইউ টিউবে হইচই ফেলেছে। সেটা ছিল, হাত-পা হীন এক কিশোরীর সমারসেট ভল্ট। সে গ্রামের দিকে হাটে বাজারে খেলা দেখায়। সুন্দরী মেয়েটি একেবারে পেঙগুইনের মতো কোমরের নীচে একটুকু ছড়ানো থাই দিয়ে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতেই সে মাটি থেকে শূন্যে লাফ দিয়ে উঠে ডিগবাজি খেয়ে আবার দাঁড়ায়। এরপর সে মাদারি খেলার মতো দুটো বাঁশের আগায় বাঁধা দড়িতে উঠে যায়। তার তো হাত নেই। সে ব্যালান্সের লাঠিটা দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে দড়ির এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে বাবার ডুগডুগির বাজনা কানে নিয়ে চলে যায়। তারপর আবার ফেরে। ফিরে আসে দড়ির মাঝখানে। সেখান থেকে সে মুখের সরু বাঁশটি ফেলে দেয়। ডুগডুগিতে দ্রিমি দ্রিমি দ্রুতলয়ে বাজে। সে ওখান থেকে ঝাঁপ মারে মাটিতে। শূন্যে দুটো-তিনটে ভল্ট দিয়ে সে অনায়াসে মাটিতে দাঁড়ায় থপ করে। তার ঘন করে লাল করা ঠোঁট খুলে যায়, এক ঝলক সাদা দাঁত হাসির বিদ্যুৎ ছড়ায়।

মনসাদি গাও।

এটা কলকাতার বাবু, সামনে যে বসে আছে, তার গলা। যে এসেই একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিয়েছে। তার কথা মান্যি করবে না তো মদনার কথা শোনবে! তারপর বাবু একেবার মনসার সঙ্গে মাটিতে বসেছে। কেমন লেপটে বসেছে। হি হি হি স্টেশনের ধুলো-ময়লার কোনও জ্ঞান-গম্যি নাই বাবুর। তারে কেমন নিজের নিজের লাগে মনসার। এসব ভাবতে ভাবতে সে বলেই ফেলল, গাইব! কোনটা গাতি হবে বল ত?

মদন চায়ের গেলাস আর পাউরুটির ঠোঙায় জড়ানো বিস্কুট নিয়ে সিনের ভেতর এন্ট্রি নিয়ে ফেলেছে। এখানে তো কাট, ক্লাপস্টিক-এর ব্যাপার নেই। মনসা চায়ের গেলাস হাতে তুলে নিয়ে চুমুক দিতেই একটা মোবাইলে ধরা পড়ে তার মুখে কী সরল হাসির ঝিলিক খেলে গেল। মেঘের ভেতর থেকে এক চিলতে রোদের মুখ বার করার মতো। তারপর সে কাগজে মোড়া হাতের বিস্কুট থেকে একটা লম্বা বিস্কুট নিয়ে চায়ের গেলাসে ডুবিয়ে কামড় দিল।

আহ! কি দারুণ দাঁত! একেবারে সুচিত্রা সেন না!

প্রাণেশ এর কাছাকাছি চলে এসেছিল টিঙ্কু। এই যে গান হবে হবে করে হচ্ছে না, তাতে ওর বিরক্তি লেগে গেছে। আর অফিসের বস ইচ্ছে করে ওকে পাঠিয়েছে এত দূরে। শয়তানি আর কী! না হলে কলকাতার মেয়েকে এতটা দূরে সমুদ্রগড়ে পাঠানো কেন!

প্রাণেশ টিঙ্কুর দিকে ফিরে বলল, যা বলেছিস। একে সাজিয়ে গুছিয়ে চোখে কাজল আর চুলের কলি কানের উপর টেনে বের করে একখানা সাদা কালো হাসির সাইড ভিউ তুলে নিলে দর্শকরা স্মৃতি রোমন্থন করতে থাকবে। কে কত উত্তম-সুচিত্রা জুটির সিনেমা দেখেছে, আর তাঁদের সিনেমা দেখে প্রেম করতে শিখেছে কেমন ভাবে দিব্য ঘোরের ভেতর ঢুকে যাবে। সাবস্ক্রাইব করে ফেলবে এক দিনেই কয়েক হাজার।

খেপি, তাড়াতাড়ি চা খাওয়া শেষ কর। গানটা গা।

ওই লুঙ্গি পরা লোকটা আবার এন্ট্রি নেয়। কী করবে, খানিকটা মস্করাটস্করা করে সময় কাটাতে চায় কদবেল, আমড়া, কল-ওঠা ছোলার দোকানদার। ট্রেনের ঘন্টা হয়নি। ট্রেন না এলে তার খদ্দের নেই। পরের আপ ট্রেন ঢুকতে এখনও ঘন্টাখানেক।

চায়ের ভেতর বিস্কুট ডোবাতে ডোবাতে মনসা ডুব দিয়েছে ভাবনায়। এই যে সামনে উবু হয়ে বসে আছে বুক খোলা দোকানদার, সে যে কদবেল আর ছোলা খাইয়ে কতবার তাকে খেয়েছে সন্ধাবেলায় নদীর চরে নিয়ে গিয়ে তার ইয়ত্তা নেই। বেহুলা নদীর পাশে সরু কাশ বনের ভেতর অনেকখানি জায়গা বেশ পরিষ্কার। কাশ আর হোগলা শুকিয়ে বেশ অনেকটা জায়গা বিছানার মতো করে রাখা। সেসব খুব মনে পড়ছে এখন মাথা নীচু করে থাকা মনসার। এই কদবেলের কারবারি ছাড়াও লাইনের ওপারে ভাতের হোটেলের থালাবাসন ধোওয়ার লোকটাও তাকে নিয়ে গেছে কয়েকবার সেখানে। বদলে সে প্রায় সন্ধেতে দুটো আলাদা আলাদা প্যাকেটে গুছিয়ে রাখা সারাদিনের হোটেলের খদ্দেরদের ফেলে দেওয়া ভাত তরকারি এনে দেয়। মনসা আরাম করে খায়।

তার এখন মনে এল, এই লোকটার বাচ্চা তো সে পেটে ধরেছিল। সেটা ছেলেই হবে। আর ওই হোটেলের লোকটার মেয়ে তারা সব কোথায় গেল! ওরা সব কোথায় গেল! হারিয়ে গেল! মনে পড়ল তার, চাঁদ, তারা বন্ধু আমার ছিল।

হেমন্তের গান। বগলার সাথে ভাব হবার পর বগলা রেডিও কিনে দিয়েছিল। লাল টুকটুকে রেডিও। সেখান থেকে শুনে শুনে কত গান যে শিখেছে সে।

মনসা জানে এই যে সে বিড়বিড় করে কথা কইছে, গান গাইছে, উকুনেরা সেসব শুনছে কান পেতে। তখন ওরা চুপ করে থাকে। মাথায় নড়াচড়া করে না। মনসার মাথা চুলকোতে হয় না। এই কথা বলা বা গান গাওয়ার তালে মনসা ওদের জব্দ করে রাখে। ওরা ভালো ছেলেমেয়ের মতো মনোযোগী হয়। মনসার গান, গল্পে মজে যায়।

মনসা চুপি চুপি মুখে মৃদু হাসি টেনে এখন মাথা নিচু করে ওদেরই শোনাচ্ছে সব। উকুনদের শোনাচ্ছে মনসার পুরোনো জীবন। অনেকগুলো বছর আগে ছেলে-মেয়ে সহ ওদের তিনজনকেই নবদ্বীপ স্টেশনে ভিক্ষা করতে রেখে এসেছিল এই কদবেল ব্যাপারী-ই। তখন বয়স অনেক কম, শরীরে যৌবন থইথই করছে।

শ্রীচৈতন্য ভক্তরা স্টেশনে নেমে গেটের বাইরে বেরিয়ে দেখত একখানা রাধা যেন বসে আছে। দিতও হাত খুলে। মেলা মানুষ, মেলা পয়সা। কিন্তু ভিড় যে-ভালো লাগে না মনসার। একদিন ট্রেনে চেপে নিজে নিজে ফিরে আসে পুরোনো জায়গায়। বাচ্চা দুটোর কথা ভুলেই মেরে দেয়। তা সে দুটো গেল কোথায়! এতদিনে তো ডাগর হওয়ার কথা!

মদনাকেই দোষারোপ করা শুরু করেছে সকলে। ওর কোনওদিন কাণ্ডজ্ঞান হবে না। কোন সময় কী করা উচিত, তা নিজে নিজে কিছুতেই ভেবে উঠতে পারে না। একদম কলের পুতুল। তা না-হয়ে ওর উপায় কী! অভ্যাস অভ্যাস! ও যে-মাছের দোকানে কাজ করত আগে, সেখানে তো ছিল ভিড় আর ভিড়। সকালবেলায় দম ফেলার ফুরসত নেই। মাছ মাপার সঙ্গে সঙ্গে আঁশ ছাড়াতে হতো। তারপর দোকানদার মাছ কাটতেই ডাক্তারকে চিৎকার করে ডাকা। সেই মাছের ডাক্তার রুইমাছের মাথার ভেতর সন্না ঢুকিয়ে একটা গোলমতো সাদা কড়াইয়ের দানা টেনে বের করে নিজের বাঁ হাতের তালুতে লাগিয়ে নিয়ে চলে যেত। তখন মদনের কাজ মাছের মাথার কানকো ফেলে দেওয়া। তারপর সাদা পলিথিনের প্যাকেটে মাছ ভরা আর গুছিয়ে খদ্দেরের হাতে তুলে দেওয়া। এই রুটিনের বাইরে তার তো ভাবার কোনও অধিকার নেই। দুপুরের দিকে দোকান গুটোনোর কাজ, মাঝেমধ্যে খইনি বানানো সেসব এক্সট্রা। অন্যমনস্ক হলেই চোদ্দো-গুষ্ঠির আকাশ থেকে নেমে আসার মতো গালাগালির বৃষ্টি। একদিন তো সেই মাছের ব্যাপারী লাথি মেরেই বসল ভরা বাজারে, অত লোকের সামনে। সেই দিনই মদন কাজ ছেড়ে চলে এসেছে। এখানে প্ল্যাটফর্মে সে জুতো পরিষ্কার করে। তাতে কম টাকা হলে হোক, কারও কথা তো শুনতে হয় না।

মদনও দেখল মনসাদি চায়ের গেলাসে বিস্কুট ডুবিয়ে ফিকফিক করে হাসছে। আর গেলাসের ভেতর দেখছে। সে বুঝতে পারল বিস্কুট ভিজে গিয়ে হাত ছুটে গেলাসের নীচে পড়ে গিয়েছে। সে এক দৌড়ে গিয়ে চায়ের দোকান থেকে একটা চামচ এনে দিতেই মনসাদির হাসি মুখ থেকে সারা গালে ঝাঁপিয়ে পড়ল। যেমন চাঁদ ঝাঁপিয়ে পড়ে কোজাগরীতে। সে চামচ দিয়ে গোলা বিস্কুট তুলে তুলে খেতে লাগল।

কী চার্মিং না! কী সরল না! প্রাণেশ একেবারে বিগলিত। সে টিঙ্কুর চোখে চোখ রাখে।

জানিস, আমার ছোটোবেলায় এরকম হতো। দুধের ভেতর ঢুকে যেত বিস্কুট। আঙুল দিয়ে তুলতে গেলে হাতে ছ্যাঁকা লাগত। তখন বাধ্য হয়ে সব দুধটা চোঁ চোঁ মেরে দিতাম ওই বিস্কুট খাবার লোভে। অনেককাল পরে বুঝেছিলাম ওটা ছিল মায়ের কারসাজি। মা বিস্কুট চুবিয়ে খেতে বলত। কারণ আমি একদম দুধ পছন্দ করতাম না।

ঢং ঢং করে বড়ো একখানা ঝোলানো রেলের পাতের গায়ে ছোটো লোহা পেটানোর শব্দ হল। জুতোকালি করা ছেলে মদন, শুভঙ্করের কাছে উবু হয়ে বসেছিল। সে বলল, আপ ট্রেনের খবর হল। তবে আসতে আসতে এখনও মিনিট চল্লিশ। এই ফাঁকে গানটা না হলে আবার লোকজন যে-জমে যাবে দা! মনসাদির গানের মুড আনতে তখন আবার সময় লাগবে। তখন সে ভিক্ষে করবে। বলবে দাও, দশটা টাকা দাও, ভাত খাব।

শুভঙ্কর যে কথাটা ভাবেনি, তা নয়। কিন্তু সে তার অভিজ্ঞতায় জানে, জোরাজুরি করে এদের কাছ থেকে কিচ্ছুটি বের করা যায় না। এদের মনের ভেতর ঢুকে যেতে পারলে, তবে নদী কি ঝরনার দেখা মেলে।

শুভঙ্কর বলল, মনসাদি, তোমার বাড়ি কোথায় ছিল গো?

মনসা মুখ তুলে বাবুটির দিকে তাকিয়ে ফিক করে হেসে ফ্যালে। তা আমি কতি পারব নাকি! আমার কি তা মনে আছে!

তোমার মা-বাবার কথা, ভাই-বোনের কথা মনে পড়ে না? শুভঙ্কর ইচ্ছে করে বরের কথা জিজ্ঞাসা করল না। কী জানি সেখানে কোনও দুর্বলতা থাকতে পারে। বিরাগ থাকতে পারে। এরকম পথের ভিখিরি মেয়েরা একশোটার মধ্যে প্রায় একশোটাই স্বামী খ্যাদানো হয়।

মনসা শুভঙ্করের মুখের উপর তার আয়ত চোখ ফেলে রেখে মাথা নাড়ল। না মনে পড়ে না।

মুখে খানিকটা মেঘ উড়ে এসে বসেছে। মনসা চেষ্টা করছে মায়ের কথা মনে করতে। চেষ্টা করছে বাবার মুখটা কেমন ছিল স্মৃতির ভেতর দেখে উঠতে। কিন্তু শীতের দিনের ভোরবেলায় যেমন ধু ধু মাঠ থাকে, গাছপালা, বাড়িঘর কিচ্ছুটি চোখে পড়ে না, সেরকমই ওই সাদা জলছাপের ভেতর থেকে দুখানি মানুষের চেহারা বের হয়ে আসতে চেষ্টা করছে, পারছে না। মনসার চোখের উপর ভাসছে কালো কালো দুটি ছবি, ছটফট করছে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

শুভঙ্করের চোখে পড়েছে মনসার মুখের উপর থেকে ঝকমকে ভাবখানা যেন ফিকে হয়ে যাচ্ছে। সে মনসাকে এই আটকে পড়া অবস্থা থেকে বের করে আনার চেষ্টা করে। মনসাদি, তোমার যে-একটা ছাগলাছানা ছিল, বলো, তার কী হল!

একদম ঠিকঠাক জায়গায় ছুঁয়ে দিয়েছে শুভঙ্কর। এই ছুটে বেড়ানোর কাজ করেও সে কবিতা লেখাটা ফেলে দিতে পারেনি। মাঝেমধ্যেই লেখে। আর সে তা লেখে মানুষের নরম মনের কাছে পৌঁছোতে। বছরে পাঁচ-ছটা লিখলেও সই। সে জোরাজুরি করে কবিতা লেখে না। কবিতা তার কাছে ধরা দিলে সে লেখে।

মনসা ছটফট করে উঠল। সে তার গায়ে কাপড় টেনেটুনে নিয়ে বাবুটির আরও একটু কাছে ঘষটে গিয়ে বলল, হ্যাঁ গো, মোর তো ছাগলছানা ছেল না। মোর ছেল এক সাদা ধবধবে বাছুর। ওরে নে মুঁই মাঠে যাতাম ঘাস খাওয়াতি। আমাগে ছেল ধুধু করা মাঠ, আর তার ভেতর দিয়ে হুস করে চলে যাওয়া নদী। আমাগে ধানের খেত ছেল, পাটের খেত ছেল। আর পুকুরভর্তি হাঁস। ঝুপঝুপ করে ওদের সাথে সাঁতার কাটতাম। সারাদিন মাঠেঘাটে চই চই। লাল লাল চুকোই ফল তুলতাম কোঁচড়ে। তারপর নুন মাখিয়ে পা ছড়িয়ে খাতাম। ওরা সব কোথায় গেল? হারিয়ে গেল। চাঁদ, তারা বন্ধু আমার ছিল।

আহা কী মিঠে সুর! ফিসফিস করল প্রাণেশ। টিঙ্কুর চোখটা যেন একটু ভিজে। কিন্তু দারুণ, দারুণ। পুরোটা তুলেছে। দুজনে দুরকম অ্যাঙ্গেলে। ওরা জানে, সুধাময়ও তুলছে অন্যদিক থেকে। বড়ো মুভি ক্যামেরায়। লোকজনের ভেতর থেকে ফাঁকফোকর খুঁজে ওর ফোকাস। ছেলেটা ছমাসের সিনে কোর্স করেছিল। স্পেশাল পেপার নিয়েছিল ক্যামেরা। ওর অনেক সাধ ছিল বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকবে। কিন্তু শিকে ছিঁড়তে পারেনি।

শুভঙ্কর উল্লসিত। মনসা মন মেলছে। শুভঙ্কর যে-মনে মনে নিজেকে মনের ডাক্তার ভাবে। সে মানুষের মনের উপর যে-কালো মেঘ এসে জমে, তাকে ইরেজার দিয়ে মুছে দিতে চায়। তাইতো এরকম অ্যাসাইনমেন্ট পেলে সে লুফে নেয়।

কী ওলট পালট গাইছিস রে খেপি! তোর গান গা। ওই যে চোখ গেল, বয়ে গেল! সেই গান।

আরে মশাই, সেই তখন থেকে আপনি ওস্তাদি করছেন। কে আপনাকে বলতে বলেছে! এখানে বসলে, চুপ করে বসুন। সমস্ত মাটি করে দিলেন! আপনার গান আমরা রেকর্ড করতে আসিনি কলকাতা থেকে। মনসাদেবীর গান শুনতে আর রেকর্ড করতে এসেছি।

কদবেলওলা বমকে গেছে ওই তাড়া খেয়ে সে এতক্ষণ বুঝতে পারেনি, তার ঠিক পাশেই এক বাবু মোবাইল ক্যামেরায় ফটো তুলে যাচ্ছে। সে খানিকটা শঙ্কিত হয়। সত্যিই তো। তার কথা বলা উচিত হয়নি। সামনের বাবুটি খুব রেগে গেছে।

শুভঙ্করের রাগ শুধু রেকর্ডিং-এর সমস্যার জন্য নয়। এই যে মনসা নিজে নিজে চেষ্টা করছিল তার মনের কালো অংশ সরিয়ে যেটুকু ভালো, তা সামনে আনতে, সেটাতে হোঁচট খেল তো! পারবে সে, আবার পারবে! শুভঙ্করকে দোলাচল ঘেরে।

মনসা শুভঙ্করকে আশ্বস্ত করে। সে তার মনের দরজা বন্ধ করেনি। বলে, তালে, ওই গানখান গাই বাবু! ওই গানখান গালি আমার যে খুব প্রাণের আরাম হয়। আমার বগলা সামনে আসি দাঁড়ায়। আমার গানখান শুনে সে ঝরঝর করি কাঁদে, আর বলে, তোরে নিয়া পালায় যাবানে রে মনসা। আর একানে থাকবনি। পালায় গিয়া বিয়া করবানে।

বলতে বলতে মনসা গান ধরে, যা যা বেহায়া পাখি যা না। অন্য কোথা যা না, কেউ করেনি মানা।

খুব নরম হয়ে গেছে শুভঙ্করের মন। ভিডিও রেকর্ডিং হচ্ছে। সে জানে যত বেশি সম্ভব রেকর্ডিং হবে, তত ভালো। ৫০ মিনিট তুললে তবে কেটে ছেঁটে সাচ্চা ৩০ মিনিট বানাতে পারবে। ইউ টিউব চ্যানেল ৩০ মিনিটের জন্য ভিডিযো দিলে এবং সাবক্রিপশন ৪০ হাজার ছাড়ালে ভালো টাকা দেয়।

শুভঙ্কর বলল, মনসাদি, তা তোমার বগলার সাথে তুমি পালিয়ে গিয়েছিলে?

মনসা একটু লজ্জা পেয়েছে যেন এমন একটা ভাব করে শাড়ির আঁচল মাথায় নিয়ে আঁচলের প্রান্ত দাঁতে চিবোতে চিবোতে বলল, হ্যাঁ পালায় গেলাম তো। বগলা একদিন ভোর রাতে মোর হাত ধরে পলান দিল। তারপর কত টেরেন চাপল, বাস চাপল, ঝালমুড়ি খাওয়াল। কত গেরাম ছাড়ায়ে কোন দেশের দিকে যাতি লাগল যে, জানি না। এক চড়ক মেলায় বগলার সাথে আলাপ হয়ে ছেল, আবার পালাতি পালাতি অমন এক মেলার মাঠে গিয়ে বগলারে হারায় ফেললাম। আর পালাম না বগলারে।

শুভঙ্কর বুঝে ফেলেছে হিউম্যান ট্রাফিকিং-এর খপ্পরে পড়েছিল মনসাদি। তার মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ায় হয়তো রাস্তায় ছেড়ে দিয়েছে। সেকথা এখানে জানানোর দরকার নেই। কিন্তু এই যে মনসা অনেকটা নিজের কথা বলতে পারল, অতীত বলতে পারল, তা অনেক। শুভঙ্কর জানে এই মনসার মুক্তি গানে। কিন্তু গান করার সুযোগ কোথায় পাবে সে! আর শুভঙ্করেরও এমন কিছু ক্যাচ নেই যে মনসার জন্য কিছু করতে পারে। দ্য নেচারের এপিসোডটুকু দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ক্ষমতা নেই। সে সামান্য অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর। ডিরেক্টর কলকাতার বাইরে যেতে চায় না বলে শুভঙ্কর বাইরে এসে এই স্বাধীনতাটুকু এনজয় করে। নিজের মতো করে বিষয়টা সাজায়, শুট করে। মোবাইলে ভিডিও তোলে। আর তার নিজের সোশাল সাইটে একটা প্রিলিউড-এর মতো করে পোস্ট দেয়। তাতেই আনন্দ।

ফিরে যাবার আগে টিঙ্কু বলল, শুভঙ্করদা, মনসাদির লুকের ভেতর একটা সুচিত্রা সুচিত্রা ভাব আছে না! তুমি আমার মোবাইলে দ্যাখো। এই যে ওর দাঁত মেলে হাসি। শাড়ি পরিয়ে সুধাময়দার ক্যামেরায় একটা দুটো লুক শুট করলে হয় না!

স্টেশনের পাশের বাজার থেকে সামান্য তিনশ টাকা দিয়ে একটা নীল রঙের শাড়ি কিনে আনা হল। মনসাদি যথেষ্ট ফরসা। তোলা কাপড় পেয়ে সেও ডগমগ। আর এবার সুধাময়ের এক্তিয়ার। সে নানা পোজে ছবি তুলল মনসার। সুধাময় তার শেখার সবটা দিয়ে প্রায় নিখুঁত সুচিত্রা লুক দাঁড় করিয়ে দিল।

দুই

এই দাদা, তুই কনে রে! তখন থেকে কল করতিছি, কিছুতেই লাগতিছে না।

মুঁই গাড়ি চালাইতেছি রে, একটু বাদে তোরে ফোন দি?

পাঁচ মিনিট হয়নি আবার সে ফোন করে। সে যে ধৈর্য ধরতে পারছে না। তাছাড়া দিদিভাই, মানে যে-বাড়িতে সে কাজ করে, সে গেছে গড়িয়াহাটে। দাদাবাবু অফিসে যাবার পর ফোন করে কয়েকটা জিনিস আনতে বলেছে। তার টুর আছে কালই। চম্পা ফাঁকা বাড়িতে বসে মোবাইল দেখছে আর ঘরের ভেতর পায়চারি করছে। এক একটা সেকেন্ড তার কাছে অনেকক্ষণ। সে উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছে। মা যদি চিনতে পারে তো আর দাসীগিরি করতে হয় না। মা তো এখন খুবই জনপ্রিয় মানুষ। টাইম লাইন ভরে যাচ্ছে মায়ের ফটোতে। শেয়ার হয়েছে কত কত। মায়ের চেহারার কী খোলতাই হয়েছে। খুব গর্ব হচ্ছে চম্পার। একেবারে সিরিয়ালের দিদিমণিদের মতো দেখতে লাগছে।

ডাবলু হালতু বাজারে সওয়ারিকে নামিয়ে ভাড়া নিতে না নিতেই আবার ফোন। সে পোস্ট অফিসের দিকে রিকশা সাইড করে ফোন ধরল। তার স্বরেও উত্তেজনা। ডাবলু বলল, আমার মোবাইলে তো ছবি দেখা যায় না। তুই কি তোর বউদির মোবাইলে পাঠাতে পারবি? আমি বাড়ি গিয়ে দেখে নিতাম। তবে শুধু ছবি পাঠাবি। অন্য কিছু লেখার দরকার নেই। তার যা কুচুটে বুদ্ধি, কোথা থেকে আবার কী বাগড়া না দিয়ে বসে।

হাওড়া স্টেশন থেকে সকাল আটটার নবদ্বীপ লোকাল ধরেছে ওরা। সমুদ্রগড় যেতে ঘন্টা আড়াই। কিন্তু দুই ভাই-বোন উত্তেজনায় ছটফট করছে। চম্পা বলল, এই দাদা, মায়ের বাড়িতে থাকি যাই কটাদিন, কী বলিস? আর মোটে পারা যাচ্চে না। আর ইচ্ছা করে না এই ঝি-গিরি করতে। তুই অন্য আর একজনকে জোগাড় করে দিদিমণিকে দিস আনে। নাইলে তার কষ্ট হবে।

ডাবলু বলল, সে তুই চিন্তা করিসনে। তুই মায়ের কাছে কিছুদিন থাকবি, থাক। তার জন্যি একটা ভালো বাড়ি ভাড়া কততি হবেনে। তারে কইলকাতায় নে যাবানে। সবাই মিলে একসাথে থাকবানে। মায়ের কাছ থে কিছু ট্যাকা পেলি একখান ব্যাটারির রিকশাক কিনুম আনে, ভাবছি। তাতে একটু আয়-টায় বেশিই হবে।

চম্পা বলল, অ্যারা, কিন্তুক মা সমুদ্রগড়ে কুথায় থাহে তাই তো জানি নারে দাদা! ফেসবুকে সবাই তো কইছে সমুদ্রগড়ের মনের মানুষ মনসাসুন্দরী। তো সিকেনে সবাই ঝ্যাকোন চেনে, ত্যাকোন লিশ্চই কয়েক দেবেনে, তাই নারে দাদা?

হ্যাঁ, তাই তো মনে কয়।

একটু লেট করে ট্রেন সমুদ্রগড়ে এগারোটা নাগাদ এল। বেশি লোক নামে না। জনা পঞ্চাশেক হবে। ওরা ভাই-বোন দুজন দুনম্বর প্ল্যাটফর্মের শেডের নীচে এমনি এমনি কিছুটা সময় দাঁড়িয়ে রইল। ভিড়টা কমে গেলে জিজ্ঞাসা করতে করতে এগোবে। একজন সাইকেলের রডে দু-কাঁদি ডাব ঝুলিয়ে বাঁশের স্ট্যান্ড লাগিয়ে বিক্রি করছিল। চম্পার খুব লোভ হল। এখন তো তারা বড়োলোক। মায়ের পয়সা মানে তার ছেলে-মেয়েদের পয়সা। সে দাদাকে বলল, দ্যাখ দাদা, কী সুন্দর ডাব। কইলকাতায় এমুন তাজা ডাব পাওয়াই যায় না। খাবা?

ডাবলু একটু কিন্তু কিন্তু করছিল। ট্রেনের টিকিট কেটেছে। হাওড়ায় আসার বাসের টিকিট কেটেছে। তারপর আজ তো কাজ হল না। মানে রোজগার নেই। ঘরে ফিরে টাকা ধরাতে না পারলে তো বউ-এর মুখ ঝামটা শুনতে হবে। কিছু পয়সা বাঁচিয়ে ঘরে না দিলে তো বিপদ। সে তো তো করে।

চম্পা বোঝে। সে বলে, দাদা তুমি তো অনেক খরচ করিছ, আমি ডাবের দাম দেবানে। তাছাড়া দিদিভাই আজ সকালেই মাইনে দেছে।

ডাব খাওয়া শেষ করে টাকা মিটিয়ে কী মনে করে চম্পা ডাবঅলাকে জিজ্ঞাসা করল, আচ্ছা আপনি কতি পারেন মনসাসুন্দরী এখানে কই থাহেন!

ডাবওয়ালা পরের খদ্দেরের জন্য ডাব কাটতে কাটতে পেছন দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। ভাই-বোন চটপট সে দিকেই পা চালায়। মনে মনে চম্পা ভাবল, ডাবঅলাও বলে দিতে পারল মানে মায়ের খুবই জনপ্রিয়তা হয়েছে।

প্ল্যাটফর্মের শেষে লেভেলক্রসিং-এ রেললাইনের উপরেই গোটা দুয়ে্ক টোটো দাঁড়িয়ে হাঁকছে। দুজন আসছে দেখে তারা উৎসাহী হয়েছে। ডাবলু আর চম্পার চোখও টোটোঅলাদের দিকে। ওদের যে-কোনও একটাতে উঠে বসে মনসাসুন্দরীর বাড়ির কাছে নামাতে বলবে।

প্ল্যাটফর্মের প্রায় শেষে এসে পড়েছে। চম্পা একটা স্বর শুনে পিছন ফিরল। গলাটা চেনা যেন! একজন মহিলা গাছতলায় বসে আছে। সে হাত বাড়িয়ে ডাকছে, ও মা, ও বাবা, দশটা টাকা দাও না, ভাত খাব।

চম্পার পা আটকে গেছে। সে দাদার হাত খামছে ধরেছে। যেন ভূত দেখছে। চম্পার পা কোনও দিকে যাচ্ছে না। না সামনে না পেছনে। সামনের ভিখারিনি তখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই ট্রেনের থেকে নামা আর তেমন কোনও প্যাসেঞ্জার নেই। এদের কাছ থেকে যদি পাওয়া যায়। ও মা, ও বাবা, দশটা টাকা দাও না, ভাত খাব।

চম্পা তার কাজের বাড়ির একটা বাতিল লেডিজ ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে এসেছিল। সে ব্যাগের ভেতর থেকে দশটা টাকা খুঁজে হাতে নেয়। হাত মুঠো করে। টাকাটা দলা পাকায়। তারপর এক পা এগিয়ে সেই দলাকরা টাকা ছুড়ে দেয় ভিখারিনির থালার দিকে। থালার একটু আগেই পড়ে টাকা। চম্পা মুহূর্তও দাঁড়ায় না। সে দাদার হাত ধরে টান দেয়। এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে যাবে ডাউন ট্রেনের জন্য। কলকাতায় ফিরবে।

ভিখারিনি টাকা কুড়িয়ে সেটা সোজা করতে করতে মনের খুশি ওর মাথার উকুনদের জানাতে চেয়ে খানিকটা জোরেই গেয়ে ফেলে, যা যা বেহায়া পাখি যা না। অন্য কোথা যা না, কেউ করেনি মানা…।

 

ফাগুন বাসর

ওরে হিমু, কোথায় গেলি রে? পুকুরপাড়ে একগাদা এঁটো বাসন পড়ে আছে। তাড়াতাড়ি একটু মেজে নিয়ে আয় না, মা। সবাই সক্কাল সক্কাল বেরোবে। রান্না চাপাতে হবে যে।

হিমু তখন মুগ্ধ চোখে দেখছে মাঠের পুব-ধারে একটু একটু করে ঘোমটা খুলছে উষারানি। কপালে যেন গোল থালার মতো এক মায়াময় সিঁদুরের টিপ। অন্ধকারের বুক চিরে বেরিয়ে আসছে ফিকে হলুদ আলো। হাঁসগুলোকে তাড়িয়ে পুকুরে নামিয়ে দিয়ে ধবলী আর করালীকে জাবনা দিতে যায় হিমু। জাবনা দিতে দিতে দেখে উষারানির টিপটা কেমন ঘেঁটে গিয়ে চারদিকে ফিকে লাল রং ছড়িয়ে পড়েছে। কী অপূর্ব! মনটা যেন জুড়িয়ে যায়!…ওই মা ডাকছে… চমক ভাঙে হিমুর,

ধবলী আর করালীকে মাঠে বেঁধে দিয়ে এখুনি বাসনগুলো মেজে নিয়ে আসছি, মা।

ধবলী আর করালীকে মাঠের বেশ ঘন ও বড়ো বড়ো ঘাসওয়ালা জায়গায় বেঁধে দিয়ে পরম মমতায় করালীর কালো কুচকুচে শরীরটাতে হাত বোলায় হিমু। বাড়ির সবাই, পাড়া-পড়শীরা আসতে যেতে ধবলীর লালচে সাদা শরীরে আদুরে হাত বোলায় কিন্তু করালীর দিকে কেউ ফিরেও তাকায় না। দেখে বড়ো কষ্ট হয় হিমুর। অথচ করালীটা যখন গামলা গামলা দুধ দেয়, তখন তো সবাই বেশ আয়েশ করে গেলাস গেলাস দুধ সাবাড় করে! চোখটা ছলছল করে ওঠে। কোথাও যেন করালী আর নিজেকে এক সারিতে দেখতে পায় হিমু।

অ্যাই হিমু, হিমু… শিগগির এদিকে আয় তো। আমার জামাপ্যান্টগুলো কেচে ইস্তিরি করে রাখিসনি কেন? এখন আমি কি পরে যাব? একখানাও ইস্তিরি করা নেই! হিমু…উ…উ…উ…

হিমুর তখন চোখের পলক পড়ছে না। নিস্তব্ধ দুপুরে দূরের বাঁশঝোপের আড়াল থেকে পাঁজর ফাটিয়ে ডাকছে কোকিলটা! পুকুরের বুকে নুয়ে পড়েছে বাঁশঝাড়, সবুজ ছায়া তিরতির কাঁপছে টলটলে জলে। লাল-হলুদ-সবুজ ফড়িং আর রংবেরঙের প্রজাপতির দল উড়ে উড়ে খেলে বেড়াচ্ছে। উতল দুপুর ঘাই মারছে হিমুর বুকে! কী যে অসহ্য রূপ এই দুপুরের… ইশ!

অ্যাই হিমু, কানে কানে জল ঢোকেনি বুঝি, না রে? তাড়াতাড়ি এদিকে আয়। বিধুদা এল বলে। কনে-দেখা আজ, আলো থাকতে থাকতে মেয়ের বাড়িতে পৌঁছোতে হবে। হিমু, এই হিমু।

চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায় হিমুর। দাদা ডাকছে।

যাই গো দাদা।

আজ পাড়ার বিধু ঘটকের সঙ্গে পাশের গাঁয়ে মেয়ে দেখতে যাবে হিমুর দাদা। হুগলির রিষড়ায় সে এক গেঞ্জি কারখানায় প্যাকেজিং ডেসপ্যাচিংয়ের কাজ করে। হিমুর বিয়ে না দিয়ে তার দাদা বিয়ে করতে চাইছিল না। কিন্তু বিয়ের বাজারে হিমুর মতো নিকষ কালো মেয়েকে কেউ পছন্দ করে না। বিধু ঘটক হিমুর জন্য পাত্রের সন্ধান এনে এনে একেবারে হাঁপিয়ে গেছে। তাই দাদা আর কদ্দিন অপেক্ষা করবে? তারও তো বিয়ের বয়স গড়িয়ে যেতে বসেছে। পুরুষ মানুষ কদ্দিন আর মেসে থেকে হাত পুড়িয়ে রেঁধে খাবে! তারও তো একটা শখ আহ্লাদ আছে, নাকি! অগত্যা পাশের গাঁয়ে প্রদীপ স্যাকরার মেয়ে অপালার সঙ্গে দাদার বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে বিধুদা। একমাত্র মেয়ে, দেবে থুবেও ভালো।

অ্যাই হিমু, পুকুরধারে কী করছিস রে? তখন থেকে ডাকছি, শুনতে পাচ্ছিস না?

এক বুক পাথর ভার নিয়ে দাদার ঘরের দিকে এগিয়ে যায় হিমু।

হিমু, হিমু…উ…উ… অ হিমু, হিমু রে, আমার লাইগ্যা একটু আকন্দফুলের পাতা আইন্যা দে না রে, মা। পূন্নিমা আইতাছে। বাতের ব্যাতাটা আবার বড়ো বাড়ছে রে! উঃ! সব্বার মরণ হয়, আমার ক্যান হয় না? আরে অ হিমু…

হিমু তখন পুকুর ঘাটে। হাঁ করে গিলছে পলাশ গাছটার বুক জ্বালানো রূপ! বসন্ত বাণে জ্বলে খাক হয়ে যাচ্ছে হিমুর যুবতি-শরীর, মন। আমবাগানে ডাল-পাতার ফাঁক দিয়ে ফিকে কমলারঙা গোল থালার মতো সূর্যটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে মাঠের পশ্চিম দিকে। দিনের তেজ কমে আসছে, গোলাপি আভা ধরেছে আকাশে। কোথা থেকে এক ঝলক ফিসফিসে বাতাস এসে চোখে মুখে ঠান্ডা স্পর্শ বুলিয়ে দিচ্ছে হিমুর,.আহা! ওই ঠাম্মা বুঝি ডাকছে…

আসছি…ই…ই…ই…

ঠাম্মা বহুদিন থেকেই বাতের রোগী। প্রতিদিন সন্ধেবেলায় হরেন বৈদ্যের কালচে সবুজ এক কবিরাজি তেল ঠাম্মার কোমরে, পায়ে মালিশ করে দেয় হিমু। তেলের গন্ধটা ভারি বিশ্রী! বমি চলে আসে। কিন্তু কি আর করা, মায়ের সারাদিন সংসারের নানা কাজ থাকে। উদয়াস্ত পরিশ্রম তাঁর। দিদিরা তো সবাই যে-যার শ্বশুরবাড়িতে। তাই হিমু ছাড়া আর কে-ই বা আছে হাতনুরকুৎ? এছাড়া অমাবস্যা, পূর্ণিমায় ব্যথাটা খুব বেড়ে যায় ঠাম্মার। তখন জ্বলন্ত হ্যারিকেনের মাথার ওপর আকন্দপাতা গরম করে সেঁক দিয়ে দেয় হিমু। পুকুরের পুব-ধারে আকন্দগাছের ঝাড়, সেখান থেকে পাতা সংগ্রহ করে নিয়ে আসে সে।

তার বাড়ির সকলেরই একখানাই তো ভাঙাকুলো হিমু। অঘ্রাণ মাসে জন্ম হয়েছিল বলে ঠাম্মা বড়ো শখ করে নাম রেখেছিলেন হৈমন্তী। হেমন্তে জন্ম হলেও হেমন্ত প্রকৃতি তার সোনারঙা ফসলের ভরপুর সৌন্দর্য দিয়ে সাজায়নি হৈমন্তীকে। হৈমন্তী সেই কবেই হিমু হয়ে গেছে সকলের মুখে মুখে। ঠাম্মার কাছে শুনেছে জন্মের পর তার কালো কুৎসিত ছোট্ট শরীরটা দেখে তীব্র ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন বাবা। আর কোনওদিনই বাবা নাকি কোলে তোলেননি তাকে। এ সবই মুখরোচক গল্পচ্ছলে বাড়ির মেয়েদের কাছ থেকে শোনা হিমুর। নীরবে হৈমন্তিক শিশির ঝরেছে টুপটাপ। বড়ো হেলাফেলায় সবার ফাইফরমাশ খেটে, সবার মন জুগিয়ে যৌবনে পা দিয়েছে হিমু। শুধু নিজের মনটাই আলো-হাওয়া না পেয়ে পেয়ে কবে যেন পাথর চাপা পড়ে গেছে!

তবু জীবন তো থেমে থাকেনি। হিমুর দাঁত উঁচু, নাক বোঁচা, শনের মতো চুলওয়ালা, থ্যাবড়ামুখো কালো কুৎসিত শরীরেও একদিন দাপিয়ে যৌবন এসেছে নিঃশব্দে। কালো মেয়ে বলে মা-ঠাকুমার বিলাপ, পাড়া-পড়শির করুণার মধ্যেই বড়ো হয়েছে সে। তার মুখ কেউই দেখতে চায় না। পাড়ার কেউ কোনও শুভ কাজে রওনা হলে হিমু তার ধারে কাছে ঘেঁষে না। তার অপয়া মুখ দেখলে নাকি হওয়া কাজও পণ্ড হয়ে যায়। ইচ্ছে থাকলেও পড়াশোনায়ও তেমন এগোতে পারেনি হিমু। বছর বছর গণিতে, বিজ্ঞানে ফেল করে করে স্কুলের গণ্ডি ডিঙোনোর আগেই ধৈর্যহারা হয়ে পড়াশোনায় ইতি ঘটে যায় তার। মোটা টাকার প্রলোভন দেখিয়েও তার মতো কালো কুৎসিত মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করা যায়নি। বেশ কয়েকবার পাত্রপক্ষ এসে মিষ্টি ধ্বংস করার পর বলতে বলতে গেছেন, আমরা তো কয়লার বস্তা ঘরে নিয়ে যেতে আসিনি! যত্তসব!!

নিজের কানে এইসব কথা শুনে টুপটাপ ঝরে পড়ে হৈমন্তিক শিশির। ভেসে যায় বুক। স্তব্ধ হয়ে যায় হিমুর ভিতর ঘর।

হিমুর দুই দিদি জয়তী আর রেবতী উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা। মোটামুটি দিয়েথুয়ে বিয়ে হয়ে গেল তাদের। লাজুক মুখে এক মাথা সিঁদুর নিয়ে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল তারা। যাবার সময় দুজনেই হিমুকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদে কেটে বলল,

তোর জন্য দেখছি কোনও ব্যবস্থা করা যায় কিনা। চিন্তা করিস না। কিন্তু শ্বশুরবাড়ি গিয়ে সংসারের বেড়াজালে হিমুর কথা তাদের আর মনেই রইল না।

এই অঘ্রাণে তেইশে পড়েছে হিমু। এখনও অনুঢ়া সে। শরীরে তার ভরা যৌবন! মনে সুনামির জলোচ্ছ্বাস! ফুলেভরা শিমূলের ডালে, হলুদ অমলতাসের ঝাড়ে, ফুলের ভারে নুয়েপড়া কাঞ্চনগাছে প্রকৃতি যেন উড়িয়ে দিয়েছে রংবেরঙের ফাগ। দেখে বুকটা ধড়াস ধড়াস করে হিমুর। কান্নায় গলা বুজে আসে! আকাশ কী সুন্দর নীল! প্রকৃতির কত অপরূপ রং-রূপ-রস। সেও তো এই প্রকৃতিরই অংশ, তবে কেন সে এত কুৎসিত? এ পৃথিবীতে কোথাও কি তার জন্য এতটুকু ভালোবাসা থাকতে নেই?

কাল দোলপূর্ণিমা। হিমুর ছোড়দি রেবতী এসেছে বর আর বাচ্চা নিয়ে বাড়িতে বেশ একটা হই হই ব্যাপার। হিমুর খরা বুকেও যেন বাজছে টুংটাং বাসন্তী সুর। ছোড়দির ছেলেটা টলোমলো পায়ে হাঁটতে শিখেছে, আধো বুলি ফুটেছে মুখে। মনটা বড়ো ভিজে ওঠে হিমুর। তবে দিদিরা আসায় তার খাটুনি অনেকখানিই বেড়েছে। রান্নার সব দাযিত্বই যে-তার। মা অবশ্য সাহায্য করছেন। এই একটি বিষয়ে হিমুর খুব নাম। তার রান্না স্বাদ ও গন্ধে অতুলনীয়। সব্বাই চেটেপুটে খায়। রান্না করতে করতে আনমনা হয়ে পড়ে সে!

রজতদা ছোড়দিকে কী ভালোবাসে! চোখে হারায় একদম! সকালে দেখছিল জলখাবার খাওয়ার সময় রজতদা ছোড়দির মুখে লুচি তুলে দিচ্ছে আবার নিজেও খাচ্ছে। ভালোবাসার রঙে রাঙা হয়ে উঠছিল ছোড়দির মুখটা! বুকটা ভারী হয়ে ওঠে হিমুর। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে! তাকে এভাবে আদর-আহ্লাদ করার কেউ নেই এই পৃথিবীতে!

সন্ধে নামতেই গোল থালার মতো ভরা-যৌবনা চাঁদটা রুপোলি আলোয় ভাসিয়ে নিল মাঠ-ঘাট, পুকুর, সজনেগাছের সারি, আমবাগান, শিমূলবন। এমন গভীর চাঁদরাত গায়ে মেখে, আমের মুকুলের গন্ধ বুকে ভরে নিয়ে আমবাগানে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে খুব ভালোবাসে হিমু। রাতের আবডালে তার কুৎসিত মুখখানাও কিছুটা ঢাকা পড়ে যায়। বুক ভরিয়ে দিয়ে কী যেন এক নাম না-জানা গন্ধ ছুঁয়ে দিচ্ছে হিমুর গভীরে কোথাও। সে গন্ধ যেন এক তীব্র কষ্ট হয়ে হৃদপিণ্ডটাকে খামচে ধরছে। যে-গন্ধের কোনও কারণ জানে না হিমু। হঠাৎ ধপ করে একটা আওয়াজ কানে আসে পাশের ঘর থেকে। পাশের ঘরে শুয়েছে রজতদা আর ছোড়দি। একটা নিষিদ্ধ জিনিসের আকর্ষণে জালনার ফুটোতে চোখ রাখে হিমু। দেখতে পায় আধো অন্ধকার ঘরে দুই ছায়ামূর্তি রজতদা আর ছোড়দি! রজতদা যেন একেবারে মিশে যেতে চাইছে ছোড়দির নগ্ন শরীরে!

মাথা ঝিমঝিম করতে থাকে হিমুর। কেমন একটা নেশা নেশা লাগে। সেই অনামি গন্ধটা যেন ক্রমশ এগিয়ে আসতে থাকে তার দিকে! মাঝরাতে জ্যোৎস্নার চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে গোটা গ্রাম। শুধু ঘুম আসে না হিমুর। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আসে সে। পুকুরঘাটের দিকে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ে টলটলে জল-আয়নায় ভাসছে রুপোলি চাঁদ। সজনে গাছগুলোর তলা সাদা সাদা ফুলে ছেয়ে আছে! চারদিক একেবারে শুনশান! দূর থেকে ভেসে আসছে রাতচরা পাখিদের ডানা ঝাপটানোর শব্দ। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে হিমু। সহসা কিছু বোঝার আগেই একটা বলিষ্ঠ লোমশ হাত পেছন থেকে জাপটে ধরে হিমুকে শুইয়ে দেয় সজনেফুলের সাদা বিছানায়। ছিঁড়ে খুঁড়ে ফেলতে থাকে তার পোশাক। ঘোরলাগা চোখে লোকটাকে চিনতে পারে না সে। লোকটার মুখে হাড়িয়ার গন্ধ। পরম আশ্লেষে লোকটাকে জাপটে ধরে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে হিমু ফিসফিসিয়ে বলে,

আমি কুৎসিত নই, ততটা কুৎসিত নই। একবার ভালোবেসে এসো ভেতরে আমার, হাড়-মাস-চামড়া ছাড়িয়ে একেবারে ভেতরে, অনেক ভেতরে…

লোকটার মুখের হাড়িয়ার গন্ধ ভেদ করে সেই বিশেষ গন্ধটা যেন খুব ধীরে ধীরে হিমুর আরও কাছে এগিয়ে আসতে থাকে, যে-গন্ধের কাছাকাছি এলে ভালোবেসে খুব মরে যেতে ইচ্ছে হয় তার। বহুদিনের জমাটবাঁধা একটা বরফখণ্ড যেন গলে গলে জল হয়ে বেরিয়ে আসতে থাকে হিমুর যুবতি শরীর থেকে।

 

ডেডলি গেম(Crime Thriller)অন্তিম পর্ব

সাত

হ্যালো, গৌতমদা আপনার সাথে জরুরি একটা বিষয়ে কনসাল্ট করার দরকার ছিল। ফোনে হবে না, আপনি কি কিছুটা সময় দিতে পারবেন?

অফ কোর্স। তুমি ঘন্টাখানেক পরে চলে এসো। ওদিকে কতটা প্রোগ্রেস হল?

সেই ব্যাপারেই কথা বলতে চাই। আপনার কিছু সাজেশনও লাগবে। আমি আসছি তখনই কথা হবে।

ডিসিপি গৌতম চ্যাটার্জীর অফিস রুমে ঢুকে রক্তিম দেখল আর কেউ নেই। কিছুটা অবাক হল। গৌতম চ্যাটার্জী হাসি মুখে বললেন, এসো রক্তিম। বাকি সব কাজ মিটিয়ে তোমার অপেক্ষাতেই বসে আছি। তোমার ফোন ও অ্যাটিটিউড দেখেই বুঝেছিলাম সামথিং হ্যাজ হ্যাপেনড। মনে হয় তুমি কিছু একটা উদ্ধার করতে পেরেছ। অ্যাম আই রাইট?

রক্তিম হেসে বলল, এই জন্যেই লোকে বলে পুলিশের চোখকে ফাঁকি দেওয়া মুশকিল। তবে এখনও কোনও বিষয়ে কনফার্ম হতে পারিনি। খুনি কে তাও জানতে পারিনি। সাফল্যর মধ্যে নেক্সট টার্গেট কে হতে পারে তার একটা আভাস পেয়েছি। আর সেই পথ ধরেই আমি খুনি পর্যন্ত পৌঁছোতে চাইছি। বলতে পারেন এটাই আমার শেষ রাস্তা।

কে এই টার্গেট?

নীলম মাথুর। ওরফে পায়েল মিত্র।

অভীক পাত্রের পিএ মেয়েটা?

হ্যাঁ। শুনলে অবাক হবেন, এরা সবাই একটা ডার্টি গেম-এর পার্ট। এতদিন গেম-টি একতরফা চলছিল। যার ফলে বাইরের দুনিয়ায় তার কোনও আলোড়ন দেখা যায়নি। কিন্তু কেউ বা কারা এই গেম-এ অখুশি হয়ে ওঠাতেই এই সব বিপত্তি। ডার্টি গেম পরিণত হয়েছে ডেডলি গেম-এ। সম্ভবত এই খেলারই অংশ সিরিয়াল কিলিং। মার্ডারের ক্যারেক্টার বলে দিচ্ছে এর পিছনে যে-মাস্টার মাইন্ড রয়েছে সে অত্যন্ত শার্প অ্যান্ড ডেডিকেটেড। ওকে থামানো অত সহজ কাজ নয়। আবার না থামাতে পারলে একের পর এক অনর্থ ঘটতেই থাকবে।

হুঁ চিন্তার বিষয়ই বটে। তোমার কোনও প্ল্যান আছে?

আছে। কিন্তু আমার প্ল্যানে রিস্ক ফ্যাক্টরও আছে। এখন সেটাকে এগজিকিউট করার পারমিশন দেবেন কিনা সেটা জানতেই মূলত আপনার কাছে আসা। অনেক ভাবেই ভেবে দেখেছি কিন্তু রিস্ক ফ্যাক্টর একেবারে এড়াতে পারিনি। আমার হিসেবে ঝুঁকি একটা নিতেই হবে।

তুমি তোমার প্ল্যান আমাকে খুলে বলো। তারপর দেখি কী করা যায়।

বলছি। নীলম মাথুর নেক্সট টার্গেট বলছি ঠিকই কিন্তু তার ওপর কবে, কীভাবে অ্যাটাক হবে আমরা কেউ জানি না। আবার হবেই তেমন গ্যারান্টিও নেই। কারণ পুলিশ যে অনেকটা অ্যালার্ট সে বুঝে গিয়েছে। তবুও আমার বিশ্বাস, সে অ্যাটাক করবেই, আজ হোক বা কাল হোক। সুতরাং আমার প্ল্যানের প্রথম পার্ট হল ধৈর্য ধরা। বাঘ শিকারের আগে যেমন হান্ড্রেড পার্সেন্ট কনসেন্ট্রেশন ও ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করে ঠিক তেমনি। সেকেন্ড পার্ট হল তদন্তের গতি একটু ঢিলে করে দেওয়া। যাতে সে স্বাধীন ভাবে কিছু করার কথা ভাবার অবকাশ পায়। কারণ তার অ্যাক্টিভিটি না থাকলে আমরা অ্যাক্টিভ হতে পারব না। এখানেই রয়েছে সবচেয়ে বেশি রিস্ক ফ্যাক্টর। প্ল্যানের থার্ড পার্ট হল, কয়েকটি ফোন লাগাতার ট্যাপ করে যেতে হবে। সেই সাথে একটা টিমকে নির্দিষ্ট সময় ধরে তৈরি থাকতে হবে। কারণ কবে কখন কোনদিন সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসবে তা তো জানা নেই। আর একটা কথা, আপনি যে অফিসিয়ালি গোয়েন্দা টিম গঠনের কথা বলেছিলেন তার কী খবর?

প্রোটোকলের গ্যাঁড়াকলে আপাতত সেটা স্থগিত হয়ে আছে। আবার কোনও অঘটন না ঘটা পর্যন্ত সে ফাইল এগোবে বলে মনে হয় না।

একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। একসাথে তদন্ত চললে হচপচ হয়ে যেত। আমার প্ল্যান কিছুটা শুনলেন, রিস্ক ফ্যাক্টর শুরু হবে সেকেন্ড স্টেজ থেকে। ভালো করে অবজার্ভ করলে দেখবেন, মার্ডারগুলো হয়েছে স্টেপ ওয়াইজ। প্রথমে লোকেশন সিলেক্ট করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে ভিকটিমকে ফোন করে ডেকে নিয়ে আসা হয়েছে বধ্যভূমিতে। তৃতীয় ধাপে স্পটে গিয়ে সমস্ত প্রমাণ লোপাট করা হয়েছে ধীরে সুস্থে। সবগুলো ক্ষেত্রেই চয়েস করা হয়েছে দারুণ দুর্যোগের রাত। কারণ তাতে লোকজনের নজরে পড়ার সম্ভাবনা অনেক কম থাকছে। আমার ধারণা পরের বারও তার ব্যতিক্রম হবে না। কিন্তু তার জন্য উপযুক্ত সময় ও পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে আমাদেরকেই। আমি কী বলতে চাইছি বুঝতে পারছেন তো গৌতমদা?

খুব ভালো করেই বুঝতে পারছি ভাই। খুনিকে খুন করতে প্ররোচিত করা। কিন্তু নীলমের জীবন সংশয়ে ফেলাটা কি ঠিক হবে?

রিস্কটা এখানেই নিতে হবে। একটা ভালো টিম সাথে থাকলে আমার মনে হয় না নীলমের কোনও ক্ষতি হবে।

কিন্তু তোমরা যদি কোনও ভাবে ফেইল করো এবং বড়ো কোনও অঘটন ঘটে যায় — তাহলে কী হবে ভেবে দেখেছ? মিডিয়া, সরকার, পাবলিক, পলিটিক্যাল পার্টি সব আমাকে চিবিয়ে খাবে।

বুঝতে পারছি দাদা। কিন্তু আমার কাছে কোনও বিকল্প অপশন নেই। আপনি পারমিশন না দিলে আমি কেস থেকে নিজেকে উইথড্র করে নেব। কারণ থেকে কোনও লাভ হবে না। গতানুগতিক ইনভেস্টিগেশন করে এই খুনিকে হাতে পাওয়া যাবে না। অন্তত আমার তাই ধারণা। আই অ্যাম সরি।

কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ভাবলেন গৌতম চ্যাটার্জী। তারপর গম্ভীর মুখে বললেন, রিস্ক নিতে আমি ভয় পাই না। তাছাড়া তোমার প্রতি আমার যথেষ্ট আস্থাও আছে। একটু ভাবতে দাও। তুমি টিম হিসাবে কাদের চাও?

আইসি প্রিয় প্রসাদ দেবের থানার টিমটা পেলেই চলবে। এই কদিনে ওদের সাথে একটা ভালো আন্ডারস্ট্যান্ডিং গড়ে উঠেছে, তাছাড়া ওরা প্রথম থেকেই কেসটা ধরে ধরে সিরিয়াসলি হ্যান্ডেল করছে। আইসি দেব নিজেও ভীষণ কোঅপারেটিভ।

কিন্তু এই ধরনের রিস্ক নিতে ওরা রাজি হবেন তো? কিছুটা আঁচ ওদের গায়ে কিন্তু আসবে।

আপনি কথা বলে দেখুন। আমি একটু হিন্টস দিয়েছিলাম, মনে হয় ওরা অরাজি হবেন না।

গৌতম চ্যাটার্জী তক্ষুণি ফোন করলেন আইসি দেবকে। অনেকটা সময় ধরে কথা হল দুজনের মধ্যে। রক্তিম চুপচাপ শুনল। কথা শেষ হবার পর ফোন রেখে গৌতম চ্যাটার্জী হেসে বললেন, উনি তো তোমার প্রতি দারুন ইমপ্রেসড। কী করে করলে? একজন পুলিশের লোককে ইমপ্রেস করা অত সহজ কাজ নয়।

রক্তিমও হাসল, ওকে ইমপ্রেস করার জন্য আমি তো কিছুই করিনি। এখন ইমপ্রেস হয়ে থাকলে সে তো আমার ভাগ্য। আমি অতি সাধারণ এক গোয়েন্দা।

কামিং টু দ্যা পয়েন্ট। আমি ওন রেসপনসিবিলিটিতে তোমাদের পারমিশন দিচ্ছি রক্তিম। পুরোটাই কিন্তু তোমার ওপর আস্থা রেখে। বুঝতেই পারছ কীরকম চাপে থাকব আমি।

রক্তিম আশ্বাস দিয়ে বলল, চাপ আমারও কিছু কম থাকবে না। আমাকে হয়তো কোনও কৈফিয়ত দিতে হবে না কাউকে কিন্তু ব্যর্থ হলে আমার কেরিয়ারের ব্যাপক ক্ষতি হবে। রেপুটেশন খারাপ হয়ে গেলে কে কেস দেবে? তবুও রিস্ক নিচ্ছি কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে আমি সফল হবই।

শ্রাবণ মাসের অর্ধেক পার হতেই আবার শুরু হল দুর্যোগ। আবহাওয়া দফতর পরিষ্কার জানিয়ে দিল, তিন চার দিনের আগে এই প্রবল নিম্নচাপ কমার কোনও চান্স নেই। রক্তিমের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে উঠল। এই সুযোগ কাজে লাগাবার চেষ্টা সে অবশ্যই করবে।

দুর্যোগের দ্বিতীয় রাতেই বেজে উঠল সেই প্রত্যাশার ফোন। ঘড়িতে তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। রক্তিম থানাতেই বসে। এমন সময় এসআই বিকাশ ব্যস্ত ভাবে বলল, স্যার নীলমের ফোনে সাসপেক্টের কল এসেছে।

যুদ্ধকালীন তৎপরতায় শুরু হয়ে গেল প্রস্তুতি। এই রাতটার জন্য টিমের সবাইকে নিয়ে রীতিমতো ট্রেনিং ক্লাস নিয়েছে রক্তিম। প্রত্যেকের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়েছে ধরে ধরে। কে কতটা রেসপন্স করছে সেটা যাচাই করার জন্য বারে বারে টেস্ট নিয়েছে।

রক্তিম বলল, এবারের লোকেশন কোথায়? বলেছে কিছু?

বিকাশ বলল, হ্যাঁ, নাগের বাজার…।

রক্তিম মনে মনে হিসাব করে বলল, নীলম থাকে লেনিন সরণিতে। ওখান থেকে স্পটে পৌঁছোতে পৌঁছোতে পঁচিশ-ত্রিশ মিনিট লাগবে। আপনার টিম নিয়ে এক্ষুণি বেরিয়ে পড়ুন মিঃ দেব। নীলম যেন কোনও ভাবেই ওখানে আগে পৌঁছোতে না পারে। হারি আপ। আমি আমার টিম নিয়ে আমার গন্তব্যের দিকে যাচ্ছি। কোনও সমস্যা হলেই ফোন করবেন। কাইন্ডলি আমার ইন্সট্রাকশনের বাইরে কিচ্ছু করতে যাবেন না।

টিম বিভাজন থেকে শুরু করে যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় আগে থেকেই ব্যাখ্যা করে দিয়েছিল রক্তিম। দুর্যোগ শুরু হওয়ার পর থেকেই, রাত দশটা এগারোটা অবধি থানাতেই অপেক্ষা করেছে সবার সাথে। রক্তিম ভাবতে পারেনি ফোনটা এত তাড়াতাড়ি আসবে।

জিপে বসে রক্তিম বলল, অবিনাশের টাওয়ার লোকেশন ওটাই দেখাচ্ছে তো বিকাশ, যেটা আমি বলেছিলাম?

বিকাশ হেসে বলল, একদম। ইউ আর গ্রেট! কী করে বুঝলেন ওখান থেকেই ফোনগুলো করা হয়েছে বা করা হতো?

কিছুটা অনুমান আর কিছুটা বিজ্ঞান। শান্তার এবং মুকেশের রেকর্ড করা কলগুলো ঘেঁটে আমি একটা অদ্ভুত জিনিস আবিষ্কার করেছিলাম বিকাশ। তোমরাও শুনেছ কিন্তু বুঝতে পারোনি। একটা অদ্ভুত আওয়াজ। প্রথমে আমিও বুঝিনি। সন্দেহ বশে বারবার শুনি। একসময় রহস্য বোধগম্য হয়। বুঝতে পারি ওটা কোনও অ্যান্টিক পেন্ডুলামওয়ালা ঘড়ির বিশেষ ধরনের ঘন্টাধ্বনি, যেটা আধঘন্টা অন্তর অন্তর সময় জানান দেয়। শান্তা ও মুকেশের কথা বলার সময়গুলো আন্দাজ করে মিলিয়ে দেখেছি, প্রায় মিলে গিয়েছে। আমার ভাগ্য আরও সুপ্রসন্ন, ওই বাড়িতে যেদিন যাই সেদিন সময়টা ছিল ঠিক ঘন্টা বাজার সময়। শুনেই যেমন চমকে উঠেছিলাম তেমনি খুলে গিয়েছিল জ্ঞানচক্ষু। উনিই বলেছিলেন ওই রকম অ্যান্টিক ঘড়ি কলকাতা শহরে একটাই আছে। তখন কি উনি অতশত ভেবে বলেছিলেন? যাইহোক যেটুকু সংশয় ছিল আজ দূর হয়ে গেল। সঠিক পথেই চলেছি আমরা।

পলাশ মিত্র বললেন, ওই বাড়িতেই তাহলে অবিনাশ রুদ্র থাকেন?

অবিনাশ রুদ্র না অবিনাশ রুদ্রের ভূত, তা আমি জানি না। একটু পরেই দেখতে পারবেন আশা করছি।

আপনি জানেন ওই ভূতটি কে?

না। তবে অনুমানে একটা নাম আছে। কিন্তু শুধু অনুমানের উপর ভিত্তি করে কারও নাম বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না। একটু বাদে দেখার সুযোগ আসবে, ধৈর্য‌্য ধরুন। তবে আবারও কথাটা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, যে তিনটে খুন করেছে, তার আরও দু-একটা খুন করতে কিন্তু হাত কাঁপবে না। তাই শেষের এই পর্বটা আমাদের কাছে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং। সামান্য ভুলের জন্য অনেক বড়ো মাশুল গুনতে হবে সবাইকে। রিমেমবার ইট।

রক্তিমদের জিপ এসে দাঁড়াল মেইন রোডের ধারে। ওর নির্দেশ মতো জিপ থেকে নেমে সবাই পায়ে হাঁটা শুরু করল। অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে বাইরে। কিছুটা জলও জমতে শুরু করেছে রাস্তায়। বিকাশ, পলাশ মিত্র ছাড়াও দুজন বন্দুকধারী পুলিশ রয়েছে টিমে। আইসি দেবকে ফোন করে ওদের অবস্থান জেনে নিল রক্তিম। অপারেশনের টাইম অ্যাডজাস্টমেন্ট ভীষণ ভাইটাল। তালমিল ঘেঁটে গেলে বড়ো বিপদ হয়ে যেতে পারে। নীলম মাথুরকে নিয়ে কী করতে হবে তার প্রয়োজনীয় নির্দেশ আগেই দেওয়া আছে, তবু আর একবার মনে করিয়ে দিল।

আইসি দেব বললেন, নীলম বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছে। ওর মোবাইল লোকেশন দেখাচ্ছে স্পটের দিকেই এগোচ্ছে।

গুড, আমার সিগন্যাল না পাওয়া পর্যন্ত ওকে ইন্টারাপ্ট করবেন না। এদিকে আমরা আমাদের স্পটে এসে পড়েছি। একটু বাদেই শুরু হবে অ্যাকশন। আপনি শুধু খেয়াল রাখবেন, নীলম যেন কোনও ভাবেই পয়জন পয়েন্ট পর্যন্ত পৌঁছোতে না পারে।

দুজন বন্দুকধারীকে সদর দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে রক্তিম, বিকাশ ও পলাশ মিত্রকে নিয়ে বারান্দায় উঠে এল, কলিং বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। দরজা খুললেন দেবলীনার মা। ভীষণ বিরক্তি নিয়ে বললেন, আপনি আবার এসেছেন? আপনার কি কোনও টাইম জ্ঞান নেই? এই মুহূর্তে আমি আপনার সাথে কোনও কথা বলতে পারব না। আপনারা কাল সকালে আসবেন।

রক্তিম বলল, সরি ম্যাডাম, আমরা ভেতরে সার্চ করব। আমরা জানি ভেতরে এই মূহুর্তে আরও একজন আছেন, মূলত তার সন্ধানেই আমরা এসেছি। আপনার সাথেও কথা আছে, তবে সেটা পরে হবে। লিগাল পারমিশন নিয়ে আমরা এসেছি। পুলিশের কাজে বাধা সৃষ্টি করলে অহেতুক বিপদে পড়বেন।

ভদ্রমহিলাকে আর কোনও কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রক্তিমরা হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরের ঘরে। ফোনে ব্যস্ত ভাবে কথা বলছিলেন একজন, ওদের দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল। ফোনে তখনও ভেসে আসছে একটা মহিলা কন্ঠ, হ্যালো অবিনাশবাবু আপনি শুনতে পাচ্ছেন? আমি এই মুহূর্তে রয়েছি…

রক্তিম ফোনটা তুলে বলল, হ্যালো নীলম, আমি রক্তিম বিশ্বাস বলছি, চিনতে পারলেন তো? ওকে, শুনুন… আপনি যেখানে আছেন সেখানেই থাকুন। একটু পরেই পুলিশ আপনার কাছে পৌঁছে যাবে। ওরা আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। সরি… এই মুহূর্তে ডিটেলসে বলার সময় নেই, পরে সব জানতে পারবেন।

ফোন কেটে রক্তিম সামনের ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনার খেলা শেষ অভীকবাবু। অবিনাশ রুদ্রের নাম দিয়ে ভালোই খেলা দেখালেন। অথচ মানুষটা তো খুব ভালো ছিলেন। সৎ, আদর্শবান, নীতিপরায়ণ খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আপনার মাস্টারমশাই ছিলেন। ওঁর আদর্শকে আপনি এভাবে শেষ করে দিলেন? কেন?

অভীক পাত্র ধপ করে সামনের সোফায় বসে পড়লেন। চোখে অসহায় চাহনি।

এই সব খুনের পিছনে আপনার উদ্দেশ্য কী ছিল? এভাবে বিবাহিত ভালো ঘরের মেয়েদের হত্যা করে কী হাসিল করার ইচ্ছে ছিল আপনার?

কিছুটা ধাতস্থ হয়েছেন অভীক পাত্র, রাগত স্বরে বললেন, আপনি বোধহয় ভুল করছেন মিঃ ডিটেকটিভ। প্লিজ, আপনি এগুলোকে নিছক হত্যা বলে চালাবেন না। এটা ট্রিটমেন্ট। এক ধরনের থেরাপি। একটা সুন্দর বাগান যখন আগাছায় ভরে যায় তখন সেই অপ্রয়োজনীয় গাছগুলোকে কেটে ফেলতে হয়। নইলে বাগানটাই একদিন শেষ হয়ে যায়। আমি সেই কাজটাই করেছি।

আগাছা কি শুধু মেয়েরাই, ছেলেদের কোনও দোষ নেই?

অবশ্যই আছে। আমি সবাইকেই শাস্তি দিতাম। আপনি সব গোলমাল করে দিলেন।

দেবলীনা আপনার ভালোবাসার মূল্য দেয়নি মানলাম কিন্তু শান্তা, তিয়াসা ওদের আপনি মারলেন কেন?

ওদের আমি বারবার বলেছিলাম তোমাদের স্বামীদের শোধরাও। কিন্তু শোনেনি আমার কথা। চরিত্রহীন স্বামীদের পক্ষ নিয়ে আমাকেই বিপদে ফেলে দিয়েছিল। অদ্ভুত! কতকগুলো চরিত্রহীন মানুষের জন্য ওদের আদিখ্যেতা মার্কা ভালোবাসা দেখে আমি মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। মনে হয়েছে, এদের জন্যই ওদের এত সাহস। সুতরাং এদেরই আগে মরা উচিত। বিষবৃক্ষ কাটার আগে তার শিকড় কাটা দরকার।

আর নীলম?

প্রথমে মনে হয়েছিল ও খুব ভালো, সেনসেটিভ মেয়ে, পরে দেখলাম সি ইজ আ স্মার্ট প্রস্টিটিউট। স্বামী, সংসার, পরিবার এসব ও বোঝে না। বোঝে শুধু কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আর নোংরামো। ওরও শাস্তি প্রাপ্য ছিল কিন্তু দিতে পারলাম না।

রক্তিম মৃদু হেসে বলল, পৃথিবীতে অনেক অনাচার হয় অভীকবাবু। আমিও মানি সেটা। কিন্তু সেসব দেখার জন্য আইন আছে, প্রসাশন আছে, আমরা নিজেরাই আইন হাতে তুলে নিলে বাস্তবিক অনাসৃষ্টি ছাড়া আর কিছুই হবে না। আমি নিশ্চিত আপনার আদর্শবাদী শিক্ষকমশাই বেঁচে থাকলে তিনিও এর বিরোধিতা করতেন। এবার আপনারা আমাদের সাথে থানায় চলুন। বাকি কথা ওখানেই হবে।

দেবলীনার মা এক কোণায় দাঁড়িয়েছিলেন, ওখান থেকেই বললেন, আমি কেন যাব? আমি কী করেছি?

রক্তিম হেসে বলল, আপনি অনেক কিছু করেছেন। খুন করছে জেনেও একজন খুনিকে সাপোর্ট করেছেন। এটা কি কম অপরাধ? দেবলীনা যে খারাপ কিছু করে আপনি সব জানতেন। কিন্তু কিছুই বলেননি, কারণ আপনার কাছে দেবলীনা ছিল সোনার ডিমওয়ালা হাঁস। সেই মেয়ে যখন টাকা দিতে অস্বীকার করল, জামাইকে তার বিরুদ্ধে উসকে দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা বোধ করেননি। এমনকী খুন করার প্রোরোচনাও দিয়েছেন হয়তো। আবার খুন হয়ে যাবার পর সুযোগ বুঝে জামাইকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করেছেন। সেই লেনদেনের প্রমাণ আছে আমার কাছে। কিন্তু এই কাহিনির মধ্যে বড়ো একটা টুইস্ট আছে। আমি অনেক পরে তার সন্ধান পেয়েছি। হয়তো অভীকবাবুও সেটা জানেন না।

দেবলীনার মা বাকরুদ্ধ, পাথরের মতো শক্ত।

রক্তিম বিষন্ন মুখে বলল, ভীষণ খটকা লেগেছিল আমার। মেয়ে যত খারাপই হোক, একজন মা কী করে এমন করতে পারেন? পাগলের মতো ছুটেছি কয়েক দিন। তারপর দেবলীনার বাবার এক বন্ধুর কাছ থেকে পেয়ে যাই কাঙ্খিত সত্য।

ঘরের মধ্যে পিন ড্রপ সাইলেন্স। কাপড়ের আঁচলে মুখ ঢেকেছেন দেবলীনার মা। বাকি সবার চোখেই অসম্ভব কৌতূহল। এমনকী অভীক পাত্রও হতভম্ব হয়ে গিয়েছেন এসব শুনে!

বিকাশ জিজ্ঞেস করল, কী সেই সত্য?

আসলে দেবলীনা ওঁর নিজের মেয়ে নয়। দেবলীনা আসলে অনাথ মেয়ে যার বাবা-মা এক ভয়ংকর বাস অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান, তখন ওর বয়স মাত্র এক বা দুই। ওকে বাড়িতে নিয়ে আসেন ওঁর দয়ালু স্বামী। না চাইলেও হয়তো মানতে হয়েছিল ওঁকে। কিন্তু মন থেকে যে মানতে পারেননি সেটা প্রমাণ করে দিয়েছেন। দেবলীনা ছিল ওঁর কাছে টাকা রোজগারের মেশিন মাত্র। মরেও সে টাকা দিয়ে গিয়েছে।

ফেরার পথে জিপে বসে রক্তিম বলল, এই সাফল্যের জন্য আমাদের টিম ওয়ার্কই মেইন ফ্যাক্টর। সবাই দারুণ কাজ করেছেন। তবে এর পরেও একজনকে আমি স্পেশাল কৃতজ্ঞতা জানাব। নামটা শুনলে আপনারা কিন্তু অবাক হবেন।

বিকাশ বলল, কে?

সুজয় ঘোষ। দেবদূত ঘোষের ভাই।

বিকাশ ও পলাশ মিত্র সত্যি সত্যি অবাক চোখে তাকালেন।

বিকাশ হেসে বলল, সুজয়! এই কেসের সাথে ওর সম্পর্ক প্রায় নেই বললেই চলে। খুব সামান্য একটা কানেকশন। ও তোমাকে কীভাবে হেল্প করল। যার জন্য একেবারে স্পেশাল কৃতজ্ঞতা জানাবে?

আপাত দৃষ্টিতে ব্যাপারটা খুবই সামান্য। ছোট্ট একটা ইনফরমেশন দিয়েছিল সুজয়। কিন্তু সেটাই পরে বিশাল টার্নিং পয়েন্ট হয়ে দাঁড়ায়। হয়তো মিত্রবাবু আপনিও ব্যাপারটা শুনেছেন কিন্তু তখন গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি। কারণ আমি জানি, আপনি ওর সাথে দুবার কথা বলেছেন।

পলাশ মিত্র অবাক হয়ে বললেন, আমি ঠিক মনে করতে পারছি না। একটু খুলে বলবেন?

অবশ্যই। যে-রাতে শান্তা খুন হয়েছিল, সেই রাতে সুজয় তার দাদা দেবদূতকে নেওয়ার জন্য ওই বাড়িতে এসেছিল মনে আছে তো?

হ্যাঁ মনে আছে।

ও কিন্তু অনেকটা পরে ঢুকেছিল। ঢোকার সময় ও দেখেছিল একজন লোক অন্যমনস্ক ভাবে পায়চারি করছে বাড়ির সামনে বৃষ্টির মধ্যেই। রেইনকোট পরা থাকলেও ভিজে যাচ্ছিল। লোকটার সাথে ঠোকাঠুকিও হয়ে যায় সুজয়ের। সুজয় ভেবেছিল আশেপাশের কোনও বাড়ির লোক হবে হয়তো, কৌতূহলবশত দেখতে এসেছে। তবে চেহারাটা মনে রেখেছিল। ওর বর্ণনা শুনে আমার সন্দেহ হয়। কিছুটা কৌতূহলবশেই অভীক পাত্রের ছবি দেখাই সুজয়কে। সুজয় কিন্তু এক দেখাতেই আইডেন্টিফাই করে ফেলে। আমি কনফার্ম হওয়ার জন্য কয়েকদিন কন্টিনিউ ফলো করি অভীক পাত্রকে। দেবলীনার মায়ের ব্যাপারটাও ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে যায়।

কাজ হয়ে যাওয়ার পরেও অভীক পাত্র ওখানে কী করছিলেন?

আমার মনে হয় রক্তমাখা গ্লাভসটা উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন। মনে হয় ওটা নিয়ে ওর মনে টেনশন তৈরি হয়ে গিয়েছিল। থানাতে পৌঁছে ওর মুখেই সব শোনা যাবে। ওদের নিয়ে যাওয়ার জন্য আর একটা গাড়ি ও এক্সট্রা ফোর্স পাঠিয়ে দিয়েছেন স্বযং ডিসিপি। উনি যে আজ কতটা চাপমুক্ত হয়েছেন তা ঈশ্বর জানেন। আমিও আজ একটু মনের শান্তিতে ঘুমোতে পারব। আপনাদেরও খুব ধকল গেছে। সব মিলিয়ে আমরা কিন্তু পারলাম।

বিকাশ হেসে বলল, তোমার সাথে কাজ করে আমরাও খুব আনন্দ পেয়েছি।

রক্তিম জানালার ঝাপসা হয়ে যাওয়া কাচ ভেদ করে বাইরে তাকিয়ে একটা স্বস্তির প্রশ্বাস ছাড়ল। বাইরে তখন অঝোরে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। অবিরাম…। যেন আকাশ ভেঙে পড়বে।

                             সমাপ্ত

ডেডলি গেম(Crime Thriller)চতুর্থ পর্ব

নন্দীবাগান থেকে কিছুটা ভেতর দিকে স্কুলটা। মানদাময়ী গার্লস হাইস্কুল। এই স্কুলেই চাকরি করতেন তিয়াসা সরকার। হেড মিস্ট্রেস কল্যাণী মণ্ডল নিজের ঘরে বসালেন রক্তিমকে। ভীষণ আন্তরিক ভাবে বললেন, তিয়াসার মৃত্যুটা আমরা কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না স্যার। আমরা চাই ওর হত্যাকারী কঠোর সাজা পাক।

রক্তিম বলল, আমরা সেই চেষ্টাই করছি। তিয়াসা সম্পর্কে আপনার কেমন ধারণা ছিল একটু খুলে বলুন।

খুবই ভালো মেয়ে, টিচার হিসেবেও বেশ ভালো ছিল। যেমন মিষ্টি দেখতে, স্বভাবটিও তেমনি। ছাত্রী মহলে ওর একটা আলাদা নাম ছিল সুন্দরী ম্যাডাম। তবে ব্যক্তিগত ভাবে ওর জীবন খুব একটা সুখের ছিল না বলেই শুনেছি। যদিও ওসব ও কাউকে মুখ ফুটে কখনও বলত না। আমি রীতা, পম্পা ওদের মুখে শুনেছি।

ওরা কারা?

আমার স্কুলেরই দিদিমণি। ওদের সাথে তিয়াসার বন্ধুত্বটা গাঢ় ছিল।

ওদের সাথে একটু কথা বলা যাবে?

পম্পা আজ আসেনি। রীতা এসেছে, আপনি ওর সাথে কথা বলতে পারেন।

একটা ফাঁকা ঘরে বসার বন্দোবস্ত করে দিলেন হেড ম্যাডাম। রীতা নামের ম্যাডামকে বেশ নার্ভাস দেখাচ্ছিল। রক্তিম ওকে স্বাভাবিক করার জন্য হেসে বলল, আপনি নার্ভাস হবেন না। সেই অর্থে আমি পুলিশের লোক নই, একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ, পুলিশের হয়ে কাজ করছি মাত্র। কয়েকটি সিম্পল কোশ্চেন করব, জানা থাকলে অবশ্যই ঠিক ঠিক উত্তর দেবেন, ব্যস এইটুকুই অনুরোধ। কাজ হল।

সহজ গলায় রীতা বড়ুয়া বললেন, বলুন কী জানতে চান?

আপনি তিয়াসাকে কতদিন হল চেনেন?

পাঁচ বছর হবে। আমরা দুজনে প্রায় একসাথেই এই স্কুলে জয়েন করি। কয়েক মাসের তফাতে। তারপর ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে।

ওর বৈবাহিক জীবনে একটা ক্রাইসিস ছিল সে ব্যাপারে আপনি কতটুকু জানেন?

তিয়াসা হুট করে বিয়ে করেছিল। দুজনের বয়সের ডিফারেন্সটাও অনেকটা বেশি। তবুও প্রথম দিকে খুশিই ছিল। তলে তলে অশান্তি বাড়ছিল। মাঝে মাঝে বলত, আমার পাপের বোঝা তো আমাকেই বহন করতে হবে। অনেক জোরাজুরিতে একদিন ওর হুট করে বিয়ে করার কারণটা বলেছিল আমাদেরকে।

কী কারণ?

বিয়ের আগে ফেসবুক বন্ধুত্বের মাধ্যমে একটি ছেলের প্রেমে পড়েছিল তিয়াসা। কিন্তু ছেলেটি বিবাহিত। ছেলেটা ওকে জানিয়েছিল, ওর বউয়ের সাথে কিছুতেই অ্যাডজাস্ট হচ্ছে না, খুব শিগগিরই ডিভোর্স নিয়ে তিয়াসাকে বিয়ে করতে চায়। প্রেমে অন্ধ তিয়াসা তাতেই রাজি হয়ে যায়। কিন্তু বাড়ির লোক মানতে চায়নি, ফলে তুমুল অশান্তি তৈরি হয়। ওর বাবা-মা, দাদা তড়িঘড়ি বিয়ে ঠিক করে ফেলে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের চাকুরে দিবাকর দাশগুপ্তের সঙ্গে। ইতিমধ্যে সেই ছেলেটির ওয়াইফ একদিন অনেক আজেবাজে কথা শোনায় তিয়াসাকে। কিছুটা অভিমানেই বাবা মায়ের পছন্দ করা পাত্রের সাথে বিয়েতে মত দেয় তিয়াসা।

তারপর?

বিয়ের কয়েক মাস পরেই তিয়াসা বুঝতে পারে, দিবাকর দাশগুপ্ত আসলে একটা পারভার্ট ম্যান। অসংখ্য নারীর প্রতি আসক্ত। আরও একটা সিক্রেট ব্যাপার জেনে ফেলেছিল।

কী?

সেই ছেলেটির ওয়াইফের সাথেও দিবাকর দাশগুপ্তের শারীরিক সম্পর্ক আছে।

তিয়াসা সেই ছেলেটির নাম কখনও বলেছিল আপনাকে?

হ্যাঁ বলেছিল। ছবিও দেখিয়েছিল। ভেরি হ্যান্ডসাম।

কী নাম?

অভীক পাত্র।

চমকে উঠলেও সামলে নিল রক্তিম। লতায় পাতায় এমন ভাবে গিট লাগিয়ে বসে আছে চরিত্রগুলো। মা ঠিকই বলেছিল, ভিকটিম তিন মহিলা সমস্ত রহস্যের রাশ আগলে বসে আছেন। কে জানে আরও কত বাকি আছে!

আপনি কখনও কথা বলেছেন তার সাথে?

না। তিয়াসাও কখনও ইন্টারেস্ট দেখাত না।

অভীক পাত্রের স্ত্রীর সঙ্গে দিবাকরবাবুর সম্পর্কের বিষয়ে আর কিছু বলেছিলেন কখনও?

না।

আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?

আমার তো দিবাকর দাশগুপ্তকেই সবচেয়ে বেশি সন্দেহ হয়। তিয়াসা শেষের দিকে ওকে ছেড়ে কথা বলত না। মাঝে মাঝে বলত লোকটা মুখোশের আড়ালে কত বড়ো শয়তান তোরা বাইরে থেকে কল্পনাও করতে পারবি না। দেখিস আমি একদিন ওর মুখোশ টেনে খুলে দেব। আমার মনে হয় তিয়াসা, দিবাকর দাশগুপ্তের অনেক গোপন কম্ম জেনে ফেলেছিল। তাই ওকে প্ল্যান মাফিক পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আপনারা ওকে ধরুন অনেক কিছু পেয়ে যাবেন।

অসংখ্য ধন্যবাদ। প্রয়োজন হলে আবার যোগাযোগ করব। আপনার ফোন নম্বরটা দিন।

————-

 

ফেরার পথে একবার সুমিত সেনের ফ্ল্যাটে ঢুঁ দিল। ভাগ্য ভালো, তিনি তখন ফ্ল্যাটেই ছিলেন। রক্তিমকে দেখে বেশ অবাক ও বিরক্ত হলেন।

রক্তিম সে সবে ভ্রুক্ষেপ না করে সরাসরি বলল, আপনি ইন্দ্রজিৎ লাহিড়িকে চেনেন?

সুমিত সেনের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল, আ… প… নি… আপনি কী করে জানলেন?

রক্তিম মৃদু হেসে বলল, কী করে জানলাম? সেসব পরে শুনবেন। আগে বলুন এসব বিজনেস কবে থেকে চালাচ্ছেন?

আমি আপনাকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই।

বেশ, তাহলে পুলিশকে বলবেন। আমি ওদের সামারিটা দিয়ে দেব, বাকিটা ওরা ঠিক বের করে নিতে পারবে। আপনি দেবলীনাকে শিবানী বানিয়েছেন। হয়তো আরও কত মেয়েকে এই লাইনে এনেছেন। এইসব কানেকশন পেলে পুলিশ নিঃসন্দেহে আপনাকে গ্রেফতার করবে। আপনি আমার কাজটা অনেক সহজ করে দিলেন। পুলিশও এই সহজ সমাধান পেয়ে খুশি হবে। আমি তবে উঠি সুমিতবাবু। ডিসিপি-কে সমস্ত কিছু জানিয়ে কেস থেকে অব্যাহতি নিয়ে শান্তিতে একটু ঘুমোবার আয়োজন করি গে, কী বলেন?

আপনাকে যদি পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছতে না দিই?

আচমকা উঠে সামনের ড্রয়ার থেকে একটা পিস্তল বের করে সুমিত সেন বললেন, আমাকে ফাঁসিয়ে আপনি কোথায় যাবেন? সে সুযোগ আপনাকে দেব না। আপনাকে মেরে লাশ বস্তাবন্দি করে রাতের অন্ধকারে গঙ্গায় ফেলে দিয়ে আসব। কাকপক্ষীও টের পাবে না। বড্ড বেশি জেনে ফেলেছেন আপনি।

রক্তিম নির্বিকার ভাবে বলল, হাতে পিস্তল নিয়ে ভয় দেখাচ্ছেন? ভালো। তার মানে আপনি স্বীকার করে নিচ্ছেন যে এই তিনটে খুনের পিছনের মাস্টার মাইন্ড আপনি, তাই তো?

মোটেও না। আমি ওদের খুন করিনি। কিন্তু আপনি তো সেটা বিশ্বাস করবেন না। তাই আপনাকে মরতেই হবে।

কেন বিশ্বাস করব না? শুনুন সুমিতবাবু আপনি যদি সত্যি সত্যি খুন না করে থাকেন তাহলে একমাত্র আমিই কিন্তু আপনাকে বাঁচাতে পারি। আপনি কী ভাবছেন আমাকে মারলে পুলিশ আপনার কুকীর্তি ধরতে পারবে না? এটা আপনার সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। তাতে পুলিশের সন্দেহ আরও বাড়বে। যেটুকু বাঁচার রাস্তা আছে সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে। যাক গে, মারার আগে আমার কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর অন্তত দিন।

কী প্রশ্ন?

আপনি খুন করেননি বলছেন, তবে কে খুন করেছে আপনি জানেন?

না।

আপনি এত বড়ো একজন ইঞ্জিনিয়র, এই লাইনে এলেন কেন?

আমাকে নিয়ে এসেছে ধীরাজ। আমি অনেক অনেক বড়োলোক হতে চেয়েছিলাম। সৎ পথে মানুষ কত আর বড়োলোক হতে পারে?

ধীরাজ তো বিদেশে থাকে। ওর সাথে কীভাবে যোগাযোগ হল আপনার?

টেকনোলজির যুগে দূরত্বটা এখন কোনও ফ্যাক্টর নয়। ফিজিক্যালি না থাকলেও ধীরাজের টাকাতেই সব চলে। আমি সুপারভাইজ করি একটা টিমের মাধ্যমে।

মুকেশ কুমারের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ডিটেলস ঘেঁটে পাওয়া গিয়েছে, ওকে বিদেশের কোনও অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা ট্রান্সফার করা হয়েছিল। তার মানে সেটা ধীরাজই পাঠিয়েছিল?

মুকেশ কুমারটা কে?

আপনি চেনেন না মুকেশ কুমারকে? স্ট্রেনজ!

সত্যি চিনি না। ধীরাজ কেন ওকে টাকা পাঠাবে?

দেবলীনাকে ভয় দেখানোর জন্য। যাতে ও এই পেশা থেকে সরে আসে।

হোয়াট! দেবলীনা আমাদের সবচেয়ে হট মডেল। ধীরাজ কেন এই কাজ করতে যাবে? তাও আমাকে না জানিয়ে ইমপসিবল। তাছাড়া ধীরাজ এলেবেলে যে-কারও অ্যাকাউন্টে টাকা ট্রান্সফার করে নিজে বিপদে পড়ার রিস্ক কেন নেবে? এ তো সহজ হিসাব। এসব ব্যাপারে ধীরাজের মস্তিষ্ক ভীষণ তেজ চলে।

পুলিশ কিন্তু সেটাই পেয়েছে। সিক্রেট ব্যাপার বলে দিলাম। এমনও তো হতে পারে, চোরের ওপর বাটপারি করছে কেউ।

ভিতরে ভিতরে মারাত্মক কন্সপিরেসি চলছে এখন বুঝতে পারছেন তো? প্রতিশোধ নিতে চাইছে কেউ।

কে?

অফ কোর্স আমাদের কোনও এনিমি। কিন্তু মুশকিল হল তার সম্পর্কে মিনিমাম ধারণা আমাদের নেই। হয়তো সে আমাদের সাথেই আমাদের বন্ধু সেজে আছে। কারণ সে যে আমাদের সবকিছু জানে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

দেবলীনাকে মারার কারণ কিছুটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু শান্তা ও তিয়াসা কেন? কোনও ধারণা আছে আপনার?

তিয়াসার ব্যাপার বলতে পারব না, তবে শান্তাকে মারার কারণ বোধহয় আমাকে হার্ট করা। শান্তা আমার দুর্বল জায়গা সে জানে। শান্তাকে আমি খুব ভালোবাসি। এই যে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা রোজগার করি সে তো ওকে সুখে রাখার জন্যেই। মানুষ এতটা ভযংকর আর নির্দয় হতে পারে?

সুমিত সেন পিস্তল রেখে দুহাতে মুখ ঢাকলেন। একটু আগে তার চোখে মুখে যে উগ্রতা ছিল, এখন সেটা উধাও।

রক্তিম বলল, যেমন কাজ তার পেমেন্টও তেমনই হয় সুমিতবাবু। আজ আপনার কুকর্মের ফল ভোগ করতে হল শান্তাকে। লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু। শান্তার মৃত্যু দেহের, আপনার মৃত্যু মনের এটা কি কম শাস্তি? আপনার কি একবারের জন্যও মনে হচ্ছে শান্তার আত্মা যাতে শান্তি পায়, তার জন্য কিছু করা দরকার? যদি মনে হয়, তবে আমি কিন্তু আপনাকে হেল্প করতে পারি। তবে একটা শর্ত আছে।

কী শর্ত?

আপনাকে ওই দুনিয়া থেকে সরে আসতে হবে। নিজের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। উচ্চ বনেদি বংশের ছেলে আপনি, বংশের ধারা বজায় রেখে চলার চেষ্টা করতে হবে। কি, রাজি?

এসব আপনার টোপ নয়তো? আপনি বুঝে গিয়েছেন আমি কোণঠাসা হয়ে আছি।

মে বি। তবুও বলছি আপনার বাঁচার উপায় একমাত্র আমার কাছেই আছে। ভেবে দেখুন কী করবেন?

কিছুটা সময় পর সুমিত সেন বললেন, ঠিক আছে আমি রাজি।

বেশ, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। তিয়াসা সরকারের সাথে আপনার পরিচয় কীভাবে?

তিয়াসার হাজব্যান্ড দিবাকর দাশগুপ্ত দেবলীনার ক্লায়েনট। ক্লায়েনটদের খোঁজখবরও আমাদের রাখতে হয়। এই লাইনে টাকা যেমন আছে বিপদও তেমনি আছে। আর বিপদটা কোন দিক থেকে আসবে সেটা তো জানা থাকে না।

দেবলীনা বিবাহিত ছিল আপনি জানতেন?

ও নিজে মুখে বলেনি তবুও জানতাম। ওকে সেটা বুঝতে দিতাম না। ওর হাজব্যান্ড সম্পর্কেও সমস্ত খবর ছিল আমার কাছে। লোকটা খুব ক্রিটিক্যাল। বাইরে থেকে জাজমেন্ট করা খুব মুশকিল। অনেক গোপন ব্যাপার আছে লোকটার।

আচ্ছা, পায়েল মিত্র বলে আপনি কাউকে চেনেন?

হ্যাঁ চিনি। তবে এই নামের পিছনে একটা সিক্রেট আছে। হয়তো কাজে লাগতে পারে আপনার। আসলে পায়েল মিত্রের কোনও বাস্তব অস্তিত্ব নেই। ওটা একটা ডুপ্লিকেট নেম যেটা ব্যবহার করে নীলম মাথুর। সি ইজ অলসো পার্ট অফ দিস গেম।

ক্রমশ…

ডেডলি গেম(Crime Thriller)তৃতীয় পর্ব

আপনার কষ্ট হচ্ছে না?

তা হচ্ছে বৈকি। মুখে ওর নামে এসব বলছি বটে কিন্তু একদিন ওকে তো ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলাম। কিন্তু যেদিন আবিষ্কার করলাম, আমার ভালোবাসাটা একতরফা– সেদিন সত্যি সত্যি মনটা ভেঙে গিয়েছিল। দেবলীনার মতো মেযেরা নিজেকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসে না। খুব স্বার্থপর।

আপনি বলছেন দেবলীনা ভাবত আপনি ওর কেরিয়ারের পথে বাধা ছিলেন, ঠিক তেমনি দেবলীনাও আপনার পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়াননি তো অভীকবাবু?

অভীক পাত্রের গলার স্বর হঠাৎ রুক্ষ হয়ে উঠল, ঠিক বুঝলাম না একটু পরিষ্কার করে বলুন। বানিয়ে বুনিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করবেন না।

রক্তিম হেসে বলল, বিরুদ্ধ কথা বললেই রাগ দেখানোটা ঠিক নয় অভীকবাবু। আমি কিন্তু ক্যালকুলেশন করেই কথাটা বলেছি। শুনেই দেখুন, মনে হয় তারপরে অতটা ফ্যালনা মনে হবে না। চোখ দুটো সরু করে তাকালেন অভীক পাত্র।

রক্তিম বলল, আপনি একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির ভালো পোস্টে চাকরি করেন। ভালো মাইনে পান। আপনার পিএ নীলম মাথুর সুন্দরী ও স্মার্ট। তার সাথে আপনার একটা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আমি জানি। আপনি তাকে বিয়ের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। তাই যদি হয় তাহলে দেবলীনাকে আপনার পথের কাঁটা বলাটা কি খুব অন্যায় হবে?

তেড়েফুঁড়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন অভীক। রক্তিম হাত তুলে থামিয়ে দিয়ে বলল, দাঁড়ান দাঁড়ান আরও আছে। আগে আমারটা শেষ হোক তারপর আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ আপনাকেও দেব বৈকি। একটু আগে আপনি একটা ডাহা মিথ্যে কথা বলেছেন বুঝতে পারছেন তো?

কী মিথ্যে কথা বলেছি? আমি কোনও মিথ্যে কথা বলিনি।

বলেননি? বেশ আমি তবে মনে করিয়ে দিচ্ছি। আপনি বলেছেন আপনি মুকেশ কুমারকে চেনেন না। আমি যদি বলি আপনি তাকে খুব ভালো করেই চেনেন, অস্বীকার করতে পারবেন? হ্যাঁ বা না সরাসরি জবাব দিন।

ঢোক গিললেন অভীক পাত্র, না… মানে হ্যাঁ।

তোতলাচ্ছেন কেন? ভাষা হারিয়ে গেল? দেখুন মিঃ পাত্র গোয়েন্দাগিরি অত সোজা কাজ নয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবে আমরা একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হই। মুকেশ কুমারের সঙ্গে আপনার কিছু ছবি পুলিশ পেয়েছে যাতে প্রমাণিত হয়…

রক্তিমকে থামিয়ে অভীক বললেন, এখন ছবি তোলাটা কোনও ব্যাপার হল? প্রত্যেকের হাতেই স্মার্ট ফোন রয়েছে।

মানলাম ছবি তোলাটা কোনও ব্যাপার নয়। কিন্তু পরিচয় না থাকলে কেউ কারও সাথে হাসিমুখে ছবি তোলে? আপনি সেরকম কোনও সেলিব্রিটিও নন যে প্রতিদিন হাসিমুখে বহু মানুষের সাথে পোজ দিতে হয়। পুলিশ সেসব ছবি কোথা থেকে পেয়েছে জানেন?

কোথা থেকে?

মুকেশ কুমারের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে। তাতে এমন এমন সব ক্যাপশন দেওয়া আছে, সম্পর্কটা অস্বীকার করার কোনও রাস্তা নেই। এরপরেও যদি স্বীকার না করেন তাহলে স্বীকার করানোর দায়িত্বটা আমি পুলিশকেই দিয়ে দেব। আমাকে কোনও দোষ দিতে পারবেন না।

কলে আটকা পড়া ইঁদুরের মতো ছটফট করতে লাগলেন অভীক পাত্র।

মিথ্যে বলে আর কোনও লাভ নেই। তাতে আপনার বিপদ বাড়বে।

কিছুক্ষণ থম মেরে রইলেন অভীক পাত্র। তারপর মিন মিনে গলায় বললেন, হ্যাঁ, আমি মুকেশকে চিনি। কিন্তু দেবলীনার সাথে ওর কী কারণে ক্ল্যাশ তা আমি জানি না। মুকেশকে আমরা অফিসিয়াল মাসলম্যান হিসেবে ব্যবহার করি। অফিসের হায়ার অথরিটি সব জানে, সাপোর্ট দেয়। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন। ছোটোখাটো ঝুট ঝামেলা হলে ওরাই সামলে দেয়।

হ্যাঁ, আমি জানি। অনেক বেসরকারি সংস্থা, ব্যাংক, ফিনান্সিয়াল এজেন্সি এই ধরনের ম্যাসলম্যান পোষে। কিন্তু দেবলীনা অর্থাৎ আপনার ওয়াইফকে ও ডিসটার্ব করছে অথচ আপনি কারণটা জানেন না, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য কথা হল? জানা না থাকলে আপনি তো ওকে ফোন করেই জেনে নিতে পারতেন? কিন্তু আপনি সেসব কিছুই করেননি। এ থেকে যে-কেউ অনুমান করে নিতে পারবে, এসব আপনিই করিয়েছেন।

সেটাই আমার ভুল হয়েছে। করিনি দুটো কারণে। এক, প্রথমে ভেবেছিলাম এ মুকেশ অন্য কোনও মুকেশ। সুতরাং আমি ওদের মাঝে যাব না। পরে যখন জানলাম এ মুকেশ আমার চেনা মুকেশ তখন মনে হল, মুকেশ নিশ্চয়ই আমার স্ত্রীকে চেনে না। কারণ আমিও কাউকে দেবলীনার পরিচয় দিতাম না। বুঝলাম দেবলীনারই কোনও শত্রু টাকা দিয়ে মুকেশকে সেট করেছে। মুকেশদের কোনও নীতিফিতি থাকে না, টাকার জন্য ওরা সব কিছু করতে পারে। আমার মাথায় একটা বদ বুদ্ধি খেলে গিয়েছিল। ভেবেছিলাম এই একটা সুযোগ, মুকেশ যদি দেবলীনাকে একটু টাইট দেয় তাতে ক্ষতি কী? কিন্তু মুকেশ যে এভাবে দেবলীনাকে খুন করে ফেলবে সেটা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।

মুকেশ দেবলীনাকে খুন করেনি বলেই আমার ধারণা। মুকেশের মতো ক্রিমিনালরা ছুরি, চাকু, পিস্তল এসব ব্যবহার করতে জানে। এটা মোটা দাগের খুন নয়। এর পিছনে শার্প মাইন্ড আছে। আপনার গল্প কতটা সত্যি সেটাও খুব শিগগিরই যাচাই হয়ে যাবে আশা করছি।বলতে বলতেই ফোন বেজে উঠল রক্তিমের। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল আইসি দেবের নম্বর। রিসিভ করে বলল, বলুন স্যার ফোন করেছেন কেন?

ও প্রান্ত থেকে আইসি দেব বললেন, একটু আগে আমার স্টাফ পলাশ মিত্র ফোন করেছিল। ও মুকেশকে পাকড়াও করতে পেরেছে এবং জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে আসছে। মিনিট পনেরো কুড়ির মধ্যেই হয়তো পৌঁছে যাবে। আপনি কি ওকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চান?

অফ কোর্স। ওকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করার আছে আমার। আমি আসছি, না পৌঁছানো পর্যন্ত ওকে ছাড়বেন না, ইটস ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট।

————–

থানায় ঢুকে রক্তিম দেখল আইসি দেব ফিল্মি কায়দায় টেবিলের উপর বসে একটা পা ঝুলিয়ে আর একটা পা সামনের চেয়ারের নীচের প্রান্তে রেখে দেহটাকে ঝুঁকিয়ে চেয়ারে বসা ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। রক্তিমকে দেখে সামনে এগিয়ে এলেন।

রক্তিম চাপা গলায় বলল, কিছু বের করতে পারলেন?

আইসি দেব বিরক্ত গলায় বললেন, দাগী মাল, সহজে ছাড়বে না। কিছু রোগ আছে উইদাউট ট্রিটমেন্টে কিছুতেই সারতে চায় না। দেব নাকি হালকা ওষুধ?

রক্তিম হেসে বলল, আমি একটু চেষ্টা করে দেখি, তারপরে না হয় দেখা যাবে।

বেশ। আমি পাশের ঘরেই আছি। অন্য একটা কেসের ব্যাপারে ওদের একটু ইনস্ট্রাকশন দিয়ে আসি।

রক্তিম মুকেশের সামনের চেয়ারে গিয়ে বসল। লম্বা চওড়া পেশীবহুল শক্তিশালী শরীর। চোয়াড়ে মুখ। গোঁফটা বিশেষ কায়দায় ছাঁটা। ঝাঁকড়া চুল কাঁধ পর্যন্ত নেমেছে। গলায় ইউপি স্টাইলে উত্তরীয় জড়ানো। কপালে মেটে সিঁদুরের তিলক।

মুকেশই অবাঙালি টানে বলল, দেখেন সাব আপনি কোন অফিসার আছেন হামি জানি না, ওই সাব কিন্তু বহুত জুলুম কোরলেন। আরে হামি যেটা জানি না সেটার উত্তর কেমন করে দিব? আপনাকে দেখে সমঝদার লাগছে, আপনি একটু বুঝিয়ে বোলেন ওনাকে। কেন হামাকে ডেকে আনা হয়েছে সেটাই তো বুঝতে পারছি না হামি।

রক্তিম বলল, আমি বুঝিয়ে বলছি। গত কয়েক দিনে কলকাতায় তিনজন মহিলা মার্ডার হয়েছেন। দুটো কেসে আপনার নাম পাওয়া গিয়েছে। তাই আপনাকে তুলে এনেছে কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য।

এটুকু বুঝেছি। কিন্তু এই সব মার্ডারের সাথে হামার কী সম্পর্ক?

এই সময় ঢুকলেন আইসি দেব। মুকেশের কথা ধরেই বললেন তুমি দেবদূতকে চেনো না?

তা তো হামি অস্বীকার করিনি। কিন্তু যে-মহিলা খুন হয়েছেন তাকে হামি চিনি না। শান্তা কুলকার্নি এই নামও শুনিনি কোনও দিন।

রক্তিম বলল, দেবদূতকে আপনি কীভাবে চিনলেন?

দেবদূতের সাথে হামার বিজনেস টার্মস আছে।

কী ব্যাবসা করেন আপনি?

এক্সপোর্ট ইমপোর্ট আরও অনেক কিছু।

রক্তিম হেসে বলল, যেমন সুপারি কিলিং, রাহাজানি, গুন্ডাগর্দি, দাদাগিরি তাই তো?

এসব কী বলছেন সাব? হামি পুজাপাঠওয়ালা আদমি আছি, ওসব কেন করতে যাব?

রক্তিম আইসি দেবের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। আইসি দেবও হাসলেন। মুকেশ নির্বিকার ভাবে বলল, হামার মোনে হয় আপনাদের কোনও গলদ ফ্যামি হোচ্ছে সাব। এরকম ঝুটা ইলজাম আপনারা হামাকে দিতে পারেন না। হামি কিন্তু চুপচাপ বসে থাকব না হায়ার অথরিটিকে জানাব। তখন কিন্তু ব্যাপারটা ভালো হোবে না সাব, আপনি জানেন না…

আচমকা চেয়ার ছেড়ে গর্জে উঠল রক্তিম, শাট আপ আর একটা আজে বাজে কথা বললে জিভ টেনে ছিঁড়ে ফেলব।

চমকে উঠল মুকেশ। রক্তিমের রক্তচক্ষু দেখে থতমত খেয়ে গেল।

আইসি দেব বললেন, মালটা ঠ্যাটা তখনই বলেছিলাম আপনাকে। সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না রক্তিমবাবু।

মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে কন্ট্রোল করে নিল রক্তিম। মুচকি হেসে বলল, মুকেশ কুমার সব জায়গায় তো তোমার দাদাগিরি চলবে না। এবার তুমি বড়ো জায়গায় ফেঁসেছ বস। দ্যাখো তো এই ছবিটা চিনতে পারো কিনা?

রক্তিম মোবাইল থেকে দেবলীনার ছবি বের করে দেখাল মুকেশকে। নিমেষে মুকেশের ফর্সা গাল লাল হয়ে উঠল। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আপন মনেই বিড় বিড় করে বলে উঠল, শিবানীর ছবি আপনার কাছে এল কী করে?

শিবানী ! রক্তিম বলল, আমি অবশ্য এমন কিছুই সন্দেহ করেছিলাম। তার মানে দেবলীনা বাইরের দুনিয়ায় শিবানী নামে পরিচিত ছিল। যাই হোক তুমি একে চেনো এটা অন্তত স্বীকার করলে। না করে উপায়ও ছিল না অবশ্য।

শিবানীকে হামি চিনি। শুনেছি শিবানীও…

ঠিকই শুনেছ। শিবানীও খুন হয়েছে। আর শিবানী খুনে তোমাকে সরাসরি অ্যারেস্ট করা যায়। কারণ তুমি তাকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলে তার প্রমাণ আছে আমার কাছে।

মুকেশ কুমারের মুখ চুপসে আমচুর। দাদাগিরি মার্কা তেজ উধাও। আইসি দেব অবাক হয়ে বললেন, এসব ইনফরমেশন আপনি কোথায় পেলেন?

রক্তিম সে কথার জবাব না দিয়ে মুকেশকে বলল, শিবানীর আসল নাম তুমি জানো?

না সাব। শিবানীর আবার কটা নাম?

ওর আসল নাম দেবলীনা পাত্র। ওর স্বামীর নাম জানো?

মুকেশের চোখ দুটো আরও বড়ো হল, স্বামী! হামি তো জানি ও আন ম্যারেড।

অবাক লাগছে? ওর স্বামীর নামটা শুনলে আরও অবাক হবে। ওর স্বামীর নাম অভীক পাত্র। নিকলসন ইন্ডিয়া গ্রুপের এজিএম।

কথাটা বলেই রক্তিম তীক্ষ্ণ নজর ফেলে রাখল ওর মুখের উপর। মুকেশ কুমারের মুখের অভিব্যক্তির সামান্য ওঠা পড়াও যেন এড়িয়ে যেতে না পারে। মুকেশ কুমার উত্তেজনায় চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল, অভীকবাবুর ওয়াইফ আছে শিবানী ! আপনি ঠিক বলছেন তো ? কোনও গড়বড় হচ্ছে না তো ?

হাসি খেলে গেল রক্তিমের ঠোঁটে, বিলকুল নেহি মুকেশ ভাই। এবার কষ্ট করে আর একটা সচ তোমাকে বলতে হবে, তাহলেই আপাতত তোমার ছুটি। ঝুট বলার চেষ্টা করবে না একদম। আমি কী জিনিস আছি নিশ্চয়ই কিছুটা বুঝে গিয়েছ এতক্ষণে।

মাথা নীচু করে মুকেশ বলল, বোলেন কী জানতে চান? তবে বিশ্বাস কোরেন সাব, কোনও খুন হামি করি নাই, মা কসম।

সেটা তদন্ত শেষ হলেই বোঝা যাবে। শিবানীকে তুমি হুমকি দিয়েছিলে৷ কিন্তু কেন?

হামাকে যেমন বলা হয়েছিল হামি তাই করেছি মাত্র। তার জন্য টাকা পেয়েছিলাম।

কে দিয়েছিল টাকা? সেই কী এসব করতে বলেছিল?

হামি তাকে সামনাসামনি দেখিনি। ফোনে কথা বলেছিল। টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিল অ্যাকাউন্ট ট্রান্সফার করে। হামি প্রথমে বলেছিলাম ক্যাশ চাই। তখন সে বলেছিল তাহলে অন্য কাউকে দিয়ে কাজ করাবে। হামি আর ঘাঁটাইনি। কারণ কাজটা ছিল সামান্য কিন্তু সেই হিসাবে টাকাটা ছিল অনেক। লোভ সামলাতে পারিনি সাব।

কত টাকা দিয়েছিল তোমাকে?

এক লাখ।

কী করতে বলেছিল?

সেরকম কিছুই না। শিবানী কোথায় যায়, কী করে, কার সাথে দেখা করে এইসব। আর মাঝে মাঝে ফোন করে হুমকি দিয়ে ভয় দেখানো। ব্ল্যাকমেল টাইপের ব্যাপার।

কিন্তু ব্ল্যাকমেল তো এমনি এমনি হয় না। ভয় দেখানোর জন্য কিছু একটা সিক্রেট ইস্যু থাকতে হয়। সেটা কী ছিল ?

শিবানী নাকি ব্লু ফিল্মে অ্যাক্টিং করত। যদিও সেটা সত্যি কিনা আমি জানি না। যিনি টাকা দিয়েছিলেন তিনি বলে দিয়েছিলেন এসব বন্ধ করার ভয় দেখাতে হবে, হামি সেটাই বলতাম।

এসব ফাঁস করে দেওয়ার সাথে সাথে টাকার দাবি করতে বলেনি?

না সাব। জানে মেরে ফেলার কথা বললেও টাকার কথা কিন্তু বলতে বলেনি কোনও দিন।

আশ্চর্য‌্য!

আমারও তাজ্জুব লেগেছিল। একবার পুছেও ছিলাম। কিন্তু সাব গুসসা হয়ে যেত।

তোমার সাথে কতদিনের কন্ট্রাক্ট ছিল?

সেরকম কোনও কথা হয়নি। হামিও পুছিনি। তবে হামার কথায় সেরকম কাজ হচ্ছে না বুঝতে পারতাম। কারণ শিবানী সেই সব কাজ করেই যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন শুনলাম শিবানী খতম। মনে মনে খুশিই হয়েছিলাম, হামার পেমেন্ট পেয়ে গেছি, আর কোনও ঝামেলা থাকল না। কিন্তু এখন তো দেখছি শিবানী মরে ফাঁসিয়ে দিয়ে গেছে। আপনারা আমাকে জোর করে টেনে আনছেন। এর বেশি আর কিছু জানি না সাব।

এবার তোমাকে ছেড়ে দেব। আর একটা লাস্ট কোশ্চেন আছে। যিনি তোমাকে এসব করতে বলেছিলেন, টাকা দিয়েছিলেন, তিনি তার নামটা বলেছিলেন?

হাঁ সাব। অবিনাশ রুদ্রা। বললেও হামার মনে হয়েছে নামটা ভুয়ো আছে। এই সব লাইনে অনেক দিন হয়ে গেল। খারাপ কাজ করাচ্ছে, আসল নাম বলবে, হামার বিশ্বাস হয়নি। নিজের সেফটি সবাই বোঝে। হামিও নিজের সেফটির কথা ভেবে একটা কাজ করেছিলাম। ওর সাথে যখনই কথা বলতাম সমস্ত কল রেকর্ড করে রাখতাম সাব। হামি যা কিছু করেছি ওই লোকটার কথাতেই করেছি তার সুবুদ আপনারা ওখান থেকে পেয়ে যাবেন আশা করি।

রক্তিম তাকাল আইসি দেবের দিকে। আইসি দেব হেসে বললেন, আবার সেই অবিনাশ রুদ্র? একজন মৃত ব্যক্তি কীভাবে এসব করে বেড়াচ্ছে? স্ট্রেনজ !

রক্তিমও হাসল। মনে হয় ওর ভূত করাচ্ছে স্যার। যাই বলুন খেলাটা কিন্তু বেশ জমে উঠেছে। এর আগে কোনও দিন কোনও ভূতের সাথে লড়াই করিনি। মনে হয় এবার সেটাও করতে হবে। আপনি ওর রেকর্ড করা কলগুলো ট্রান্সফার করার ব্যবস্থা করে ওকে ছেড়ে দিন। তারপর শান্তা ও মুকেশ দুজনেরই রেকর্ড করা কলগুলো আমার মোবাইলে পাঠিয়ে দিন। আমি ঠান্ডা মাথায় বাড়িতে বসে ওগুলো শুনতে চাই।

ছয়

মণিশঙ্কর দত্ত লেনের সরু একটা গলি। দুপাশে পর পর বাড়ি। এ দিকটায় কোনও দিন আসেনি রক্তিম। একটা গলি শেষ হতেই আর একটা গলির শুরু। তস্য গলি। একজনকে জিজ্ঞেস করে জেনে নিল এটাই বিধু দত্ত লেন। একটু এগিয়ে যেতেই নজরে পড়ল চোদ্দো নম্বর বাড়িটা। বাড়ির নাম প্রধান ফটকে লেখা, কেতকি ম্যানসন। নীচে তৈরির সাল লেখা রয়েছে। হলুদ রঙের পুরোনো সাবেকি মডেলের দোতলা বাড়ি। সামনে ঢোকার মুখে একটা মাধবীলতা গাছ সদর গেটটাকে জড়িয়ে ঝাঁকিয়ে উঠেছে। সর্বাঙ্গে লাল সাদা ফুলের বুনোট। থোকা থোকা ফুল আর সবুজ পাতা, যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবি।

কিছুটা দূরের বাঁকে একটা চায়ের দোকান। সামনে বেঞ্চ পাতা। একটা লোক ছিল, সেও উঠে গেল। কী মনে হল, রক্তিম চায়ের দোকানে গিয়ে বসল। এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে সিগারেট ধরাল। আকাশ মেঘলা, যে-কোনও সময় নেমে যেতে পারে, তাই লোক চলাচল কম। আশেপাশের বাড়ি থেকে টিভির শব্দ ভেসে আসছে। চায়ের দোকানে বসে চা খেলেও রক্তিমের নজর চোদ্দো নম্বর বাড়িটার দিকে। কিছুটা আন্দাজেই চলে এসেছে। খবরটা যদি সত্যি হয় তাহলে ভেতরে ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা অনুভব করে। যদি মিথ্যে হয় তাহলেও কিছু বলার নেই। একজন গোয়েন্দার প্রাথমিক কর্তব্য হল, যত ক্ষীণ সূত্রই হোক সেটা যাচাই করা। সেটাই করতে এসেছে রক্তিম।

একটু আগেই সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামল। গলির মোড়ে হ্যালোজেন বাতি জ্বলে উঠতেই জায়গাটা ঝলমল করে উঠল। রাস্তার একধারে জমে থাকা জলে আলো পড়তেই ঝলসে উঠল যেন। বাতাসে হালকা হিমেল ভাব। ফলে প্যাচপেচে গরমটা আর নেই। রক্তিম মনে মনে ভাবল, আগ বাড়িয়ে ওই বাড়ির কড়া নাড়াটা কি ঠিক হবে? একটা কিছু বানিয়ে বলে ঢোকা যাবে ঠিকই কিন্তু তাতে উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া কিছুটা নিশ্চিন্ত না হয়ে মুখ দেখানোটাও বোধহয় ঠিক হবে না। যদি সত্যি সত্যি ইনফরমেশন ভুল থাকে। মনের মধ্যে পক্ষে বিপক্ষে নানা যুক্তি বুদবুদের মতো উঠে আসতে লাগল।

এদিকে রাত বাড়ছে, দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া দরকার। এতদূরে এসে খালি হাতে ফিরে যেতেও মন চাইছে না। এই রকম দোলাচলে চায়ের বিল মেটাতে উঠল। ঠিক তক্ষুনি একটা টানা রিকশা এসে দাঁড়াল চোদ্দো নম্বরের সামনে। রিকশা থেকে যিনি নামলেন তাকে দেখে প্রথমে নিজের চোখকেই ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না রক্তিম। সুমিত সেন এখানে! রক্তিমের কাছে যা ইনফরমেশন আছে, তাতে এই বাড়িটি দেবলীনার বাপের বাড়ি। দেবলীনার বাপের বাড়িতে সুমিত সেন এসেছেন কেন? তবে কি সুমিতের সাথে দেবলীনার কোনও সম্পর্ক ছিল? কেমন জানি মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল রক্তিমের।

সুমিত সেন রিকশা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে গেলেন। দেখেই বোঝা গেল এ বাড়িতে তার যাতায়াত আছে। রক্তিম আবার বেঞ্চে বসে পড়ল। আপাতত অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই। তবে আশান্বিত হল, এই বাড়িতে যে রহস্যের একটা জট পেকে আছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। মনে মনে আশ্বস্ত হল, ভুল জায়গায় এসে পড়েনি।

প্রায় কুড়ি মিনিটের মতো সময় নিলেন সুমিত সেন। তারপর বেরিয়ে হন হন করে হাঁটা দিলেন মেইন রোডের দিকে। ইচ্ছে করলেই সুমিত সেনকে ধরতে পারে রক্তিম। কিন্তু সে চেষ্টা করল না। এই বাড়িতে ঢোকাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করল।

কলিংবেল টিপে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। খুললেন মাঝ বয়সি একজন প্রৌঢ়া। অবিকল দেবলীনার মুখ। আলাদা করে চেনানোর কোনও প্রয়োজনই পড়ে না।

রক্তিম বলল, আপনি তো দেবলীনা পাত্রের মা, আমি রক্তিম বিশ্বাস পুলিশের তরফ থেকে আসছি, কিছু জরুরি কথা বলার ছিল।

পুলিশের নাম শুনেই কিনা ঠিক বোঝার উপায় নেই, তবে বেশ নার্ভাস লাগল ভদ্রমহিলাকে।

কিছুটা কাঁপা গলায় বললেন, কিন্তু পুলিশকে তো যা বলার সবই বলেছি আমি। আবার কেন এসেছেন? আমি একা থাকি সময় নেই অসময় নেই, এভাবে বিরক্ত করার কোনও মানে হয়?

সরি অসময়ে আসার জন্য আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আপনার মেয়ে মার্ডার হয়েছেন ম্যাডাম, আপনি চান না তার হত্যাকারী ধরা পড়ুক?

অবশ্যই চাই।

তবে তদন্তে একটু সহযোগিতা তো করতেই হবে। পুলিশ প্রাণপণ চেষ্টা করছে।

ভেতরে আসুন। আমাকে একটু তাড়াতাড়ি ছাড়লে সুবিধা হয় কিছু জরুরি ফোন করার আছে।

অফ কোর্স। আমি বেশি সময় নেব না।

ভেতরে ঢুকেই রক্তিম বুঝতে পারল প্রাচুর্যের কোনও অভাব নেই এ বাড়িতে। আসবাব থেকে ঘরের পর্দা সবই দামি। বেশ কিছু অ্যান্টিক শো পিস রয়েছে। নরম সোফায় বসে রক্তিম বলল, আপনার কয় ছেলেমেয়ে?

এক ছেলে এক মেয়ে, দেবলীনা বড়ো। ছোটো দেবোপম বেঙ্গালুরুতে ডাক্তারি পড়ছে। একটা বেসরকারি কলেজে।

কিছু মনে করবেন না। সে তো অনেক টাকার ব্যাপার, এত টাকা কোথায় পেলেন?

রেগে উঠলেন ভদ্রমহিলা, সে কৈফিয়ত আপনাদের দিতে হবে? আশ্চর্য তো ! আমার স্বামী রেলের বড়ো পোস্টে চাকরি করতেন। ওদের বনেদি পরিবার। স্থাবর অস্থাবর সম্পদের পরিমাণ নেহাত কম নেই। তাছাড়া আমার মেয়েজামাই দুজনেই যথেষ্ট উপার্জনশীল, ওরাও ওর পড়ার ব্যাপারে অনেক হেল্প করে।

আপনার স্বামী কতদিন হল মারা গিয়েছেন?

চার বছর হল। হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক। তিনদিন ভেন্টিলেশনে থাকার পর।

সরি, দেবলীনা মডেল ছিল ওর কাজকর্ম সম্পর্কে আপনার কোনও ধারণা আছে?

ও বেশ নামকরা মডেল ছিল। একটা ফিল্মে হিরোইন হবারও কথা চলছিল। দিনরাত খাটত নিজের পজিশন তৈরির জন্য। টাকাও রোজগার করত ভালোই।

দেবলীনার সঙ্গে ওর স্বামীর সম্পর্ক কেমন ছিল?

দুজনেই মহা ব্যস্ত মানুষ। কেউ কাউকে ঠিক মতো সময় দিতে পারত না। যার ফলে একটু ঠোকাঠুকি লেগে থাকত। ওটা কোনও বড়ো ব্যাপার নয়। তবে দেবলীনার হিরোইন হবার ব্যাপারটা আমার জামাই মেনে নিতে পারেনি। ডিভোর্স দেবার কথাও তুলেছিল একবার। আসলে ওদের ফ্যামিলি ভীষণ ব্যাকডেটেড, এসব দ্যাখেনি কোনও দিন।

রক্তিম হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, একটু আগে আপনার বাড়ি থেকে যিনি বেরিয়ে গেলেন তিনি কে?

একটু থমকালেন দেবলীনার মা। কী যেন ভাবলেন। তারপর তির্যক হেসে বললেন, আপনারা এভাবে গোয়েন্দাগিরি করছেন?

রক্তিম হেসে বলল, আপনি যা ভাবছেন সেরকম কিছু না। সামনাসামনি হয়ে গিয়েছিল তাই জিজ্ঞেস করছি। ইচ্ছে না হলে এ প্রশ্নের জবাব না-ও দিতে পারেন।

জিজ্ঞেস যখন করলেন তবে শুনেই রাখুন। ওর নাম ইন্দ্রজিৎ লাহিড়ি, একজন প্রোডিউসার। ওর কাছে দেবলীনার কিছু পেমেন্ট বাকি ছিল সেটাই দিতে এসেছিলেন। খুব সজ্জন মানুষ। নইলে এই বাজারে মরা মানুষের টাকা কেউ দেয়?

রক্তিম ভীষণ অবাক হয়ে গেল। সুমিত সেনের এই নতুন নাম নেওয়ার মানেটা কী? তবে কি সুমিত বেনামে মেয়েদের দিয়ে ব্যাবসা চালায়? ওই কি তবে দেবলীনার খুনি ? হয়তো ব্যাবসা সংক্রান্ত কোনও গোলমাল হয়েছিল ওদের মধ্যে। তবে শান্তা ও তিয়াসার খুনি কে? ওটাও কি সুমিতের কাজ? যেভাবে কানেকশনগুলো বেরিয়ে পড়ছে অসম্ভব কিছু নয়। সুমিত যে এতটা জড়িয়ে আছে, এখানে না এলে জানতে পারত রক্তিম? যাকে দেখছে সে-ই কিছু না কিছু রহস্য ক্রিয়েট করে রেখেছে! চারদিকে ছড়িয়ে পড়া এই জাল গুটিয়ে তোলা অত সহজ কাজ হবে না।

কী অত ভাবছেন? এবার আমাকে ছাড়ুন।

সরি আর দু-একটা কথা জিজ্ঞেস করেই ছেড়ে দেব। একটা বিষয় বোধহয় জানেন না, আপনি হয়তো শুনে কষ্ট পাবেন তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি, একদিন তো আপনি জানবেনই। দেবলীনা মডলিং-এর পাশাপাশি পর্ন ফিল্মে কাজ করতেন। সেখান থেকেই কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা আসত। আপনি কি জানতেন সেটা?

কী যা তা বলছেন আপনি?

আপনার পক্ষে মেনে নেওয়া হয়তো কষ্টকর কিন্তু এটাই সত্যি। মডেলিং ছিল লোক দেখানো ব্যাপার। তবে দেবলীনা স্বেচ্ছায় নাকি অন্য কারও চাপে পড়ে এই প্রফেশন বেছে নিয়েছিল, সেটা আমি বলতে পারব না।

কিছুক্ষণ থম মেরে রইলেন ভদ্রমহিলা। ধীরে ধীরে মুখ তুলে বললেন, এসব আমি জানতাম না। জামাই কিছুটা হিন্টস দিলেও ওর কথায় গুরুত্ব দিইনি। ভাবতাম ওর কথাই ঠিক, জামাই জেলাসিতে ভোগে। ছিঃ ছিঃ ওর বাপঠাকুরদার কত বড়ো বনেদি বংশ। এখনও মানুষ সমীহ করে। সেই বংশের মেয়ে হয়ে এসব করতে পারল? আর সেই টাকা আমি এতদিন হাত পেতে নিয়েছি? ঘেন্নায় আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে। দুহাতে মুখ ঢাকলেন দেবলীনার মা।

রক্তিম বলল, এবার আমি উঠছি মাসিমা। আমার সাথে আপনার এই সাক্ষাতের কথা কাউকে না বলাই ভালো। তাতে আপনার বিপদের ঝুঁকি বাড়তে পারে। আপনি এতটা জেনে গেলেন এটা অনেকের সহ্য না-ও হতে পারে।

 

 

বাড়ি ফিরতে ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে গেল। চটজলদি ফ্রেশ হয়ে সোজা খাবার টেবিলে চলে এল। জবর খিদে পেয়েছে। মা খাবার পরিবেশন করতে করতে বললেন, খিদে তো পাবেই। সেই কোন সকালে খেয়ে গিয়েছিলি। সারাদিন নিশ্চয়ই অনেক ধকল গিয়েছে। কিছু প্রোগ্রেস হল?

ঠিক বুঝতে পারছি না। বনের মধ্যে পথ হারানোর মতো ব্যাপার হচ্ছে। অনেক ঘোরাঘুরি করে শেষে মনে হচ্ছে যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানেই আবার এসে পৌঁছেছি।

আগে ঠান্ডা মাথায় খেয়ে নে। তারপর আমাকে সব খুলে বল। দেখি তোকে কোনও ভাবে হেল্প করতে পারি কিনা।

খাওয়া শেষ করে দুজনে ঝুল বারান্দার ব্যালকনিতে এসে বসল। রক্তিম সংক্ষেপে ব্রিফিং করল মাকে। মা সব শুনে বললেন, এক্সেলেন্ট, দারুণ প্রোগ্রেস। এর চেয়ে আর বেশি কী চাস? কেসটা অনেক বেশি ছড়ানো, একটু সময় লাগবে। আমি তোকে সেদিনই বলেছিলাম, ভিকটিম তিনটে মেয়ে তোর ট্রাম্প কার্ড। ওরাই রহস্যের সূত্র। এক দেবলীনাই এত কিছু জানিয়ে দিল, শান্তা ও তিয়াসা এখনও বাকি। আমার ধারণা ওরাও অনেক রহস্য নিয়ে বসে আছে। একটা জোরে ঝাঁকি দিতে হবে। গাছে ফুল থাকলে যেমন জোরে ঝাঁকি দিলে ঝরে পড়ে, এখানে রহস্য ঝরে পড়বে। তোকে যথার্থ ফুল সংগ্রাহক হতে হবে। ওই ফোন কল দুটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদিও যে-ফোন করেছে, সে সব রকম সতর্কতা অবলম্বন করেই করেছে বলে মনে হয়। তবুও একবার ভালো করে চেক করা দরকার। খুব বড়ো ক্রিমিনালও অনেক সময় খুব সাধারণ ভুল করে বসে। কিন্তু ভুল তো নিজে থেকে ধরা দেবে না, তোকে খুঁজে বের করতে হবে। সত্যি কথা বলতে একজন ডিটেকটিভের সাফল্যের পিছনে কোনও শর্টকাট ওয়ে থাকে না। প্রত্যেকটা ইভেন্ট, প্রত্যেকটা খুঁটিনাটি নিয়ে কাজ করতে পারলে তবেই সাফল্য আসবে।

রক্তিম হেসে বলল, তোমার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারছি। আমাকে আরও খাটতে হবে। থ্যাংক ইউ ফর ইওর প্রেশাস অ্যাডভাইস। এবার আমি শুতে চললাম।

মা হেসে বললেন, তুই যে এখন কেমন শুবি সে তো বুঝতেই পারছি। ওই কল রেকর্ড শোনার চক্করে অযথা বেশি রাত করিস না, শরীর খারাপ করবে।

 

————

সকালবেলা রক্তিমের ঘুম ভাঙল মোবাইলের গোঙানিতে। ঘুম চোখে তুলে দেখল আইসি দেবের ফোন। সাত সকালে আবার নতুন কিছু ঘটল নাকি?

আইসি দেব বললেন, ঘুমোচ্ছিলেন নাকি? আপনি মুকেশের ব্যাংক ডিটেলসটা চেয়েছিলেন তাই করলাম। কাল রাতেই পেয়েছি কিন্তু অনেক রাত হয়ে যাওয়ায় আর ফোন করিনি।

ঘুম ছুটে গিয়েছে, উঠে বসল রক্তিম, গুড। আমি থানায় গিয়ে দেখে নেব। তাছাড়া ইন্সপেক্টর পলাশ মিত্রের সাথেও একটু কথা বলার দরকার আছে। আচ্ছা, দেবদূতের ভাই সুজয় ঘোষ সম্পর্কে আপনারা কোনও খোঁজ খবর করেছিলেন?

সেরকম কিছু না। সামান্য কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল মিত্র। কেন বলুন তো?

না সেরকম গুরুত্বপূর্ণ কোনও ব্যাপার নেই। থানাতে গেলে কথা হবে এখন রাখছি।

দাঁত ব্রাশ করে ড্রযিং রুমে এসে বসল রক্তিম। একটু বাদে মা চায়ের ট্রে হাতে ঘরে প্রবেশ করে বললেন, কী রে রাতে ঠিকমতো ঘুমিয়েছিলি তো?

রক্তিম হেসে বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ খুব ভালো ঘুমিয়েছি।

মা হাসলেন, বুঝতে পারছি। তোকে বেশ ফ্রেশ লাগছে। কে ফোন করেছিল একটু আগে?

আইসি প্রিয় প্রসাদ দেব। মুকেশ কুমারের ব্যাংক ডিটেলসটা পেয়েছেন সেটাই জানালেন।

কল রেকর্ড দুটো শুনলি? কিছু পেলি?

সেরকম কিছু নেই। ওদের মুখে যা শুনেছি সে সবই রয়েছে তবে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলে অদ্ভুত একটা জিনিস শোনা যায়। আমার ভুলও হতে পারে, তুমি একটু শুনবে? আমি সব সেট করে দিচ্ছি মন দিয়ে শুনবে কিন্তু। যদি তুমিও ধরতে পারো তাহলে বুঝব আমার অনুমান ঠিকই আছে।

মাকে সব অ্যারেঞ্জ করে দিয়ে রক্তিম চা খেতে বসল। মা চোখ বন্ধ করে শুনতে লাগলেন। একবার নয়, দু-তিনবার শুনলেন। একসময় তার চোখ দুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হেড ফোন খুলে বললেন, আই থিংক ইউ আর রাইট। দারুণ আবিষ্কার করেছিস। কালকেই বলেছিলাম, বড়ো বড়ো ক্রিমিনালও ভুল করে অ্যান্ড দিস ইজ মোস্ট ভাইটাল ওয়ান। এখন এটাকে কতটা কাজে লাগাতে পারবি তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। কি ঠিক ধরতে পেরেছি তো ?

রক্তিম মায়ের ব্যাখ্যা শুনে বলল, ইউ আর অ্যাবসুলিউটলি রাইট। কিন্তু এত লোকের মাঝে খুঁজে বের করা অত সহজ কাজ হবে না, সেটাও বুঝতে পারছি। আমার মাথায় একটা প্ল্যান এসেছে। তোমার অ্যাপ্রুভাল পেলে এগজিকিউট করার কাজে হাত দেব।

শোনা, দেখি তোর প্ল্যানিং।

রক্তিম মাকে ব্যাখ্যা করে শোনাল ওর নেক্সট প্ল্যানিং।

মা শুনে উচ্ছসিত হলেন দারুণ। তোর চিন্তা ভাবনার মধ্যে অনেক পরিপক্কতা এসেছে। যদি সফল ভাবে কেসটা সলভ করতে পারিস আমি দারুণ খুশি হব।

 

ক্রমশ…

ডেডলি গেম(Crime Thriller)দ্বিতীয় পর্ব

বিকাশের কথাতে জোরে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন আইসি দেব, এগজ্যাক্টলি… আমিও ঠিক এই অ্যাঙ্গেলটাই ধরতে চেয়েছি। তুমি ওই কেসের পুরো ডিটেলসটা জোগাড় করো। তবে শান্তার কল রেকর্ডের ব্যাপারে আগেই কিছু বলতে যেও না। ওটা সিক্রেট ইস্যু। খুব প্রয়োজন ছাড়া ফাঁস করা যাবে না। খুনি অ্যালার্ট হয়ে যাবে।

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন স্যার।

এবার সাহাবাবুর দিকে তাকিয়ে আইসি দেব বললেন, দেবদূতের ব্যাপারে কিছু ইনফর্মেশন পাওয়া গেল সাহাবাবু?

উত্তম সাহা বললেন, তেমন ব্রেকিং নিউজ কিছু নেই স্যার। ছেলেটা নেহাতই সাদামাটা। শরীর চর্চা আর দোকানদারি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। একটা নন বেঙ্গলি মেয়ের প্রেমে পড়েছে। এই নিয়ে বাড়িতে মাঝেমধ্যেই অশান্তি হয়। তবে একটা ব্যাপারে একটু খটকা আছে…

কী ব্যাপারে?

দেবদূত মাঝে মাঝে হাওড়ার একটা নিষিদ্ধ পল্লিতে যায়। ওখানে মুকেশ কুমার নামে একজনের সাথে খুব দোস্তি। মুকেশ কুমার সম্পর্কে যতটুকু জেনেছি তাতে ছেলেটা খতরনাক গুন্ডা। খুন, জখম, রাহাজানি, ধর্ষণ, সুপারি কিলিং… এসবই ওর পেশা। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন জাগে, ওই রকম একটা ছেলের সাথে দেবদূতের কী সম্পর্ক থাকতে পারে? কিন্তু এবিষয়ে সঠিক কোনও তথ্য এখনও পাইনি।

লেগে থাকুন। আপাত দৃষ্টিতে তুচ্ছ মনে হলেও কোনও বিষয়কেই নেগলেক্ট করা যাবে না। কোথায় যে এই রহস্যের টিকি বাঁধা আছে আমরা কেউ জানি না। সুমিত সেন সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন?

যেটুকু পেয়েছি বলছি। ওর আদি বাড়ি কৃষ্ণনগর। বনেদি পরিবার। বাবা কাকারা সব একসাথেই থাকেন, যৌথ পরিবার। অনেক রকমের ব্যাবসা আছে। সুমিত সেন পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর দুবছর বিদেশে চাকরি করেন। তারপর চলে আসেন কলকাতায়। পড়ার সময়ে শান্তার সাথে প্রেম। বিদেশ থেকে ফিরেই বিয়ে করেন দুজনে। আগে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। রিসেন্টলি ফ্ল্যাট নিয়েছেন বালিগঞ্জে। বন্ধু-বান্ধব মহলে ভালো ছেলে বলেই পরিচিত। পরকিয়ার গল্পটা সম্পূর্ণ বানানো, এমনই তার মত। শান্তা মার্ডারের সাথে সুমিতের কোনও প্রত্যক্ষ যোগ নেই বলেই মনে হচ্ছে স্যার।

হাসলেন আইসি দেব, মঞ্চে নাটক শো হয় সাহাবাবু। কিন্তু নাটক যিনি নির্মাণ করেন তিনি থাকেন পর্দার আড়ালে। কলাকুশলীরা তার হাতের পুতুল মাত্র। আপনি সুমিতের ফোন চেক করুন। আমরা জানি পারফেক্ট মার্ডার বলে কিছু হয় না। কিছু না কিছু খুঁত থাকেই। সেটাই খুঁজে বের করতে হবে আমাদের। কাজটা অত সহজ নয়।

ঠিক আছে স্যার।

আইসি দেব এবার ঘুরলেন পলাশ মিত্রের দিকে, আশেপাশের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছিলে মিত্র? সেরকম কোনও খবর পাওয়া গেল?

না স্যার। একে বর্ষার রাত ছিল, তার ওপর সবাই ঘরবন্দি। কেউ কিছুই জানে না, কেউ কিছুই দেখেনি। শুনে ওরাই অবাক। আমাকেই প্রশ্ন করতে শুরু করল, কীভাবে হল স্যার? কে খুন করল স্যার? ইত্যাদি ইত্যাদি। ওই বাড়ির গৃহকর্তা-গৃহকর্ত্রী সম্পর্কে লোকের ধারণা ভালোই। নির্বিবাদী, সাতে-পাঁচে থাকেন না। নির্ঝঞ্ঝাট অবসর জীবনযাপন করেন।

ওদের সাথে কথা বলেছ তুমি?

হ্যাঁ স্যার। ভীষণ ভয় পেয়েছেন দুজনেই। আপাতত দেবদূতদের বাড়িতেই আছেন। নিজেদের বাড়িতে যেতে ভয় পাচ্ছেন।

ওদের সন্তানরা বিদেশে থাকে দেবদূতের মুখেই শুনেছি। কী করে তারা?

দুজনেই সুপ্রতিষ্ঠিত। একজন ডাক্তার, অন্যজন ইঞ্জিনিয়ার। বড়ো ধৃতিমান থাকে জার্মানিতে, ছোটো ধীরাজ থাকে সুইডেনে। এই ধীরাজের সাথে খুব সামান্য হলেও একটা লিঙ্ক রয়েছে শান্তা কুলকার্নি ও সুমিত সেনের।

ভ্রু সামান্য বাঁকা হল আইসি দেবের, কী রকম?

দেবদূতের মেসোমশাই ধীমান তালুকদারই আমাকে একটা পুরানো গ্রুপ ফটো এনে দেখালেন। দেখিয়ে বললেন, যে-মেয়েটি খুন হয়েছে সে আমার ছেলে ধীরাজের সাথে পড়াশোনা করত। একই কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে। ধীরাজের মুখে নামটা বহুবার শুনেছেন। তাই তাঁর সন্দেহ হয়, দুটো একই মেয়ে নয়তো? নিজের কৌতূহলেই শান্তার এখনকার ছবি আর পুরোনো ছবি মিলিয়ে দেখেন। দেখে অবাক হয়ে যান! আমাকেও দেখালেন। ওই ছবিতে সুমিত সেনও আছেন।

আশ্চর্য সংযোগ তো! যদিও এতে কিছুই প্রমাণিত হয় না। তবুও কেমন জানি একটা রহস্যের ধোঁয়া উঠছে যেন। আর ধোঁয়া দেখলে স্বাভাবিক ভাবে যেটা মনে আসে, ধোঁয়া যখন আছে তখন আগুনের অস্তিত্ব অবশ্যই আছে। তাই না?

দারুণ বললেন স্যার। আমার মনেও ঠিক তেমনই অনুভূতি হয়েছিল। ওনাকে নানা ভাবে প্রশ্ন করেছিলাম, যদি কোনও ক্লু পাওয়া যায়। কিন্তু কিছুই পাইনি। নেহাতই একটা কাকতালীয় সংযোগ। পাশ করার পর ওরা যে-যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। তারপরে আর কোনও দেখা সাক্ষাৎ হয়নি।

তুমি ওনাকে জিজ্ঞেস করোনি, শান্তার নামটা ধীরাজের মুখে কীভাবে শুনেছিলেন?

করেছিলাম স্যার। শান্তা ওদের ব্যাচে টপার ছিল। অসাধারণ মেধাবী। তাই ধীরাজের মুখেও উঠে আসত ওর মেধার কথা। তখনই জেনেছিলেন শান্তার কথা। সেই শান্তা এভাবে তাঁরই বাড়িতে খুন হয়েছে, বিশ্বাসই করতে পারছেন না ভদ্রলোক।

স্বাভাবিক। শান্তা সম্পর্কে আর কিছু জানেন উনি?

না স্যার।

তুমি ধীরাজের ফোন নম্বর কালেক্ট করে রেখো। দরকার হতে পারে।

করেছি স্যার। এটা আমারও মনে হয়েছিল। তাই তখনই নিয়ে সেভ করে রেখেছি আমার মোবাইলে।

গুড। আর কোনও খবর আছে তোমার কাছে?

ওই বাড়িতে পরের দিন সকালে তল্লাশি চালাতে গিয়ে আর একটা জিনিস পেয়েছিলাম স্যার, সেটা বলাই হয়নি। একটা রক্তমাখা গ্লাভস। বাড়ির সামনের লনে একটা গাছের মধ্যে আটকে ছিল। বৃষ্টির জলে বেশির ভাগ ধুয়ে গেলেও কিছুটা রক্ত তখনও লেগে ছিল।

তিন জনেই একসাথে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকালেন পলাশ মিত্রের দিকে। আইসি দেব বেশ উষ্মা প্রকাশ করে বললেন, সেটা তুমি আজ বলছ? গ্লাভসটা এখন কোথায়?

বিকাশ বলল, ফরেনসিকের লোকেরা দেখেছেন? ওটা কিন্তু আমাদের একটা দারুণ কাজের সূত্র হতে পারত মিত্রদা।

পলাশ মিত্র দুজনকেই  আস্বস্ত করে বললেন, গ্লাভসটা আমি ওদের হাতেই দিয়েছি। নানা ব্যস্ততায় বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। আই অ্যাম সরি।

আইসি দেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, তবুও বাঁচোয়া, ফেলে-টেলে দাওনি।

পলাশ মিত্র হেসে বললেন, কী যে বলেন স্যার। সাত বছর হয়ে গেল পুলিশে। কোনটা দরকারি আর কোনটা অকেজো এখন বুঝতে পারি।

আমি সেটা মিন করিনি মিত্র। তুমিও জানো একটা সামান্য এভিডেন্সও আমাদের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় কখনও কখনও। তাই ভয় পেয়েছিলাম! যাকগে, রক্তমাখা গ্লাভস ওখানে এল কী করে? খুন হয়েছে বিষ প্রয়োগে, রক্তারক্তি তো কিছু হয়নি।

উত্তম সাহা বললেন, এটা আবার কোন রহস্য! ভীষণ কনফিউজিং ম্যাটার। ও বাড়িতে ঠিক কী হয়েছিল সত্যি বলা মুশকিল।

বিকাশ মজা করে বলল, এমনও তো হতে পারে সাহাবাবু, কনফিউজ করার জন্যই এই কনফিউজিং ম্যাটার তৈরি করা হয়েছে। এর আগেও আমরা অনেক কেসে দেখেছি, খুব হোম ওয়ার্ক করে-টরে যারা ক্রাইম করে, তাদের একটা টার্গেট থাকে পুলিশকে মিসগাইড করা।

আইসি দেব বললেন, বিকাশ কথাটা খারাপ বলেনি সাহাবাবু। কোনও রক্তপাত হয়নি, অথচ রক্তমাখা গ্লাভস। একটা কাল্পনিক রহস্য তৈরি করে দেওয়ার পক্ষে কিন্তু ব্যাপারটা খারাপ নয়। আসলটাকে ছেড়ে নকলটাকে নিয়ে মাথা ঘামাতে বাধ্য করানো। একটা ইলিউশন তৈরি করে দেওয়া। তাই যদি হয় তবে মানতেই হবে, হি অর শি ইজ আ স্মার্ট গাই।

শি? আপনি কি মনে করেন কোনও মহিলাও খুনি হতে পারে? উত্তম সাহা অবাক হয়ে বললেন।

হোয়াই নট। নাথিং ইজ ইম্পসিবল। খুনি যে পুরুষই আপনি জানেন?

চুপ করে গেলেন উত্তম সাহা।

আইসি দেব চিন্তিত মুখে বললেন, আরও একটা ব্যাপার হতে পারে। কোনও ভাবে তার নিজের শরীরের কোথাও কেটে যায়। তাড়াহুড়োতে মুছতে গিয়ে রক্ত লাগিয়ে ফেলে গ্লাভসে। অসতর্ক মুহূর্তে সেটা ছুড়ে ফেলে বাগানের মধ্যে।

বিকাশ বলল, সম্ভবনার দিক থেকে বিচার করলে হতেই পারে। কিন্তু একজন শার্প খুনি এরকম রিস্ক নেবে বলে আপনার মনে হয়?

হিসেব মতো নেওয়ার কথা নয়। কিন্তু সবকিছু তো সবসময় হিসেব মতো চলে না। পরিবেশ পরিস্থিতি যে সবসময় তাকে সাপোর্ট করবে, এমন তো কথা নেই। হয়তো সে করতে বাধ্য হয়েছিল। গ্লাভসটা ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনও উপায় ছিল না। কারণ আমরা রাতে দুজন কনস্টেবলকে ওই বাড়িতে পাহারায় বসিয়ে রেখে এসেছিলাম।

আপনার কথাতেও যুক্তি আছে। কোনটা ঠিক, সময়ই বলবে। তবে একটা কথা পরিষ্কার যে, শান্তা মারা যাবার পর ওই বাড়িতে কেউ একজন অবশ্যই ঢুকেছিল, অসমাপ্ত কাজগুলো সম্পূর্ণ করার জন্য। যেমন, লাইট নেভানো, প্রমাণ লোপাট ইত্যাদি ফাইনাল টাচ দেওয়ার জন্য।

উত্তম সাহা বললেন, সব মিলিয়ে সামারিটা দাঁড়াল এরকম, আপাতত আমরা অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে চলেছি, কোনও আলোর কিরণের আশা নিয়ে৷ সেরকম জোরালো কিছু আমাদের হাতে নেই যেটা ধরে বলতে পারি কেস সলভ হবেই। তাই তো?

আইসি দেব বললেন, আমি চিরকালই চুড়ান্ত অপটিমিস্ট। চেষ্টা জারি রাখলে কোনও না কোনও সূত্র ঠিক পেয়ে যাব। তবে এই কেসের নেচারটা একটু অন্যরকম। অনেক বেশি ছড়ানো বলেই মনে হচ্ছে। আর কে না জানে, যে-জিনিস যত বেশি ছড়ানো, তাকে গোটানো তত বেশি কঠিন। তাই টিম ওয়ার্ক ভালো হতেই হবে। একা একা জাল গোটানো যাবে না।

মিত্র বললেন, আমরা সবাই আপনার সাথে আছি স্যার। আমরা আমাদের ডিউটি মনপ্রাণ দিয়ে পালন করব।

ঠিক আছে এখন আপনারা আসুন। যার যে দায়িত্ব আছে সেটা ফলো করুন। টাইম টু টাইম আমাকে রিপোর্ট করুন। আবারও বলছি, কোনও ছোটোখাটো বিষয়ও যেন এড়িয়ে না যায়। ইজ ইট ক্লিয়ার?

চার

এবার ঠিক দশ দিনের মাথায়। বেহালার একটা নির্জন বাড়িতে। তিনতলা বাড়ির নীচের তলার ফ্ল্যাটে, যে-ভদ্রলোক ফ্যামিলি নিয়ে ভাড়া থাকেন, তিনি ফ্যামিলি সমেত কয়েক দিনের জন্য কল্যাণীতে গিয়েছেন। মাঝের তলাতে আপাতত কেউ থাকেন না। তিনতলায় বাড়ির মালিক বয়স্ক বিধবা মহিলা বলতে গেলে একাই থাকেন। ছেলেমেযেরা বাইরে থাকে, মাঝে মাঝে এসে দেখে যায়। রাতে আলো দেখে উনি ভেবেছিলেন ওরা হয়তো ফিরে এসেছে। কিন্তু সকালে ডেকেও ওদের সাড়া না পেয়ে সন্দেহ হয়। ভেজানো দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখেন বেডরুমে পড়ে রয়েছে একটি মেয়ের লাশ। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে খবর দেন। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান, বিষ প্রয়োগে মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে।

খবরটা মন দিয়ে পড়ছিল রক্তিম। রক্তিম বিশ্বাস। প্রাইভেট ডিটেকটিভ। ক্রাইম সংক্রান্ত যত ছোটো খবরই হোক, মন দিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে রক্তিম। সেরকম মনে হলে পেপার কাটিং ফাইলবন্দি করে রেখে দেয়। আজকের খবরটা পড়েই নড়েচড়ে বসল রক্তিম। একই পদ্ধতিতে তিন তিনটে খুন! প্রায় চোখের সামনেই ঘটে যাচ্ছে খুনগুলো। ফাইল থেকে পুরোনো দুটো পেপার কাটিং বের করে আনল। প্রথমটা সল্টলেক, দ্বিতীয়টা পদ্মপুকুর, তৃতীয়টা বেহালা। তিনটে ক্ষেত্রেই ভিকটিম বাড়ি থেকে দূরে কোথাও গিয়ে খুন হয়েছে। তিনটেই ছিল দুর্যোগের রাত। একমাত্র পদ্মপুকুরের ঘটনাটিকে লোকাল থানার আইসি আত্মহত্যার ঘটনা বলেছেন। কিন্তু ওই যুক্তি খাটে না। প্রথম দুটো খবর ছোটো করে ছাপলেও আজকের খবর বেশ বড়ো করে ছেপেছে কয়েকটি সংবাদপত্র। অর্থাৎ মিডিয়াও সচকিত হচ্ছে ব্যাপারটা নিয়ে কিন্তু পুলিশ এখনও সিরিয়াসলি নিচ্ছে না কেন ব্যাপারটা?

রক্তিমের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা গেল। তবে কি কলকাতার বুকে কোনও সিরিয়াল কিলিং শুরু হয়ে গিয়েছে? বেছে বেছে অল্পবয়স্ক বিবাহিত মেয়েদেরকে নিশানা করছে এই কিলার ! কিন্তু কেন? নিঃসন্দেহে খবরটা ভয়ের। কে জানে, খুনি হয়তো এরমধ্যেই তার নেক্সট টার্গেট ঠিক করে ফেলেছে! সে কথা ভাবতেই রক্তিমের মাথার মধ্যে রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হল। আপন মনেই বিড়বিড় করে বলে উঠল, আই হেট ক্রাইম। আই হেট ক্রিমিনালস। আই হ্যাভ টু স্টপ দিস ডেডলি গেম।

ডেডলি গেম! কথাটা উচ্চারণ করে নিজেই অবাক হল রক্তিম। পরক্ষণেই একটা বাঁকা হাসি খেলে গেল ঠোঁটের কোণে। কিছু লোকের কাছে মানুষ-হত্যাটাও একটা খেলা! যে-খেলা খেলে, তারা বিকৃত আনন্দ উপভোগ করে। এরকম একটা মানুষ এখনও খোলা আকাশের নীচে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। অন্যমনস্ক ভাবে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে শুরু করল রক্তিম। ঠিক তক্ষুণি চেনা সুরে বেজে উঠল ওর মুঠো ফোন। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ভীষণ অবাক হল। এর নামই কি টেলিপ্যাথি! মনে মনে এরকম একজনের ফোনই কি আশা করেছিল সে? গৌতম চ্যাটার্জীর ফোন, ডেপুটি কমিশনার অফ পুলিশ। ফোন ধরে সহাস্যে বলল, নমস্কার গৌতমদা। এতদিন পর এই অধমকে মনে পড়ল?

আরে না না ভাই… নানা কাজের চাপে হয়ে ওঠে না। কিছুটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারো। কত ধরনের প্রেশার নিয়ে কাজ করতে হয় আমাদের। সত্যি কথা বলতে আমরা তো আর যথার্থ শান্তির চাকরি করি না ৷ একটা না একটা ঝুট ঝামেলা লেগেই আছে। আজকের খবরের কাগজ পড়েছ?

রক্তিম হেসে বলল, হ্যাঁ পড়েছি। বুঝতে পারছি আপনি কেন ফোন করেছেন। বেহালার মার্ডার কেস নিয়ে কিছু বলতে চান তো?

ঠিকই ধরেছ। সল্টলেকের ঘটনার তদন্ত করছেন যিনি, তার নাম প্রিয় প্রসাদ দেব। আমার পরিচিত ও কাছের মানুষ। উনি এসেছিলেন একটু আগেই। ভদ্রলোক যা ব্যাখ্যা দিলেন তাতে যথেষ্ট চিন্তার বিষয় রয়েছে। খুন করার টেকনিক অভিনব। ওঁর আশঙ্কা এই খুনি সহজে থামার নয়। কিন্তু না থামাতে পারলে আমাদের বারোটা বেজে যাবে। মিডিয়া, পাবলিক সব যদি একযোগে আক্রমণ শানে, ল অ্যান্ড অর্ডার সামলানো দায় হয়ে যাবে।

ওঁর কথা খুব একটা অমূলক নয়। ইতিমধ্যেই আমার কাছে অনেকগুলো ফোন এসেছে। মিডিয়া, টিভি চ্যানেল ধীরে ধীরে রক্তের স্বাদ পেতে শুরু করেছে। হোম সেক্রেটারি ফোন করেছিলেন কমিশনারকে। এখন জাস্ট ঘটনা সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এরকম চলতে থাকলে সেটা আর জানতে চাওয়ার পর্যায় থাকবে না। সো ইমিডিয়েটলি আমাদের কিছু করতে হবে।

রক্তিম বলল, আপনাদের গোয়েন্দা বিভাগকে লাগিয়ে দিন। আমার ইন্টারফিয়ারেন্স কি ভালো দেখাবে?

আমাদের সমস্ত উইংসকে অ্যালার্ট করে দেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দা বিভাগের একটা স্পেশাল টিমও তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু আমি পার্সোনালি চাই তুমি আমাদের সহযোগিতা করো। কারণ তোমার প্রতি আমার আলাদা একটা বিশ্বাস আছে। সেই বিশ্বাসের মর্যাদাও তুমি রেখেছ। আসলে আমি কোনও রকম রিস্ক নিতে চাইছি না। আমি আইসি প্রিয় প্রসাদ বাবুর সাথে তোমার বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। ভদ্রলোক তোমার নাম ভালো করেই জানেন। উনিও বেশ আগ্রহ দেখালেন। তুমি আর না কোরো না।

না করার প্রশ্নই নেই। যেখানে মানুষের জীবন বাঁচানোর প্রশ্ন জড়িত থাকে সেখানে আমি ইগো দেখি না। আরও কিছু মেয়ের জীবন বিপন্ন অবস্থায় রয়েছে। ওদের রক্ষা করতে পারলে আমার গোয়েন্দা-জীবন সার্থক হবে। আমি আজ থেকেই কাজ শুরু করতে চাই।

দ্যাটস বেটার। আমিও সেটাই চাই। কোথাও কোনও সমস্যা হলে তুমি আমার পার্সোনাল নম্বরে ফোন করবে।

আমি প্রথমেই আইসি দেবের সাথে দেখা করে কেস ডিটেলসটা একটু ভালো করে বুঝে নিতে চাই। আপনি ওঁকে একটু জানিয়ে দিন।

নো প্রবলেম, আমি এক্ষুণি ফোন করে দিচ্ছি। এখন তাহলে রাখছি, পরে আবার কথা হবে।

ফোন রেখে আপন খেয়ালেই বেশ কয়েকবার ঘরের মধ্যে পায়চারি করে ফেলল রক্তিম। এরমধ্যে মা কখন ঘরে ঢুকেছে টেরই পায়নি। চায়ের কাপ টি-টেবিলে রাখতে রাখতে মা বললেন, কী রে নতুন কোনও কেস হাতে এসেছে নিশ্চয়ই ? তোর এই পায়চারি দেখলেই আমি বুঝতে পারি। কেসটা কীসের?

রক্তিম ধরা পড়ার হাসি হাসল। মা তার বন্ধু কাম গাইড। একসময় আইপিএস অফিসার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। কিন্তু সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়নি নানা কারণে। স্বামী অর্থাৎ রক্তিমের বাবা ইন্ডিয়ান আর্মির একজন কর্নেল। কার্গিল যুদ্ধে বীরের মতো প্রাণ দেন। মা একা ওদের দুই ভাই বোনকে মানুষ করেছেন। রক্তিম প্রাইভেট ডিটেকটিভ হতে চাইলে, বাধা দেননি। নতুন কেস এলে মায়ের সাথেই প্রথম ডিসকাশন করে নেয়। সে দেখেছে ভদ্রমহিলার দুর্ধর্ষ আই কিউ। কোন কেসের কোন অ্যাঙ্গেল, কতটা গুরুত্বপূর্ণ এক নিমেষে বুঝে যান। মনে মনে তাই মাকেই নিজের গোয়েন্দাগিরির গুরু মানে রক্তিম।

এ পর্যন্ত যতটা জেনেছে সবটাই খুলে বলল মাকে। সবশেষে যোগ করল, তোমার কী মনে হচ্ছে, কোথা থেকে শুরু করা উচিত আমার?

মা গম্ভীর মুখে বললেন, আমার মনে হয় তোর প্রথম কাজ হওয়া উচিত ভিকটিম তিনটে মেয়ে সম্পর্কে খোঁজ করা। আমার ধারণা ওরাই এই রহস্যের প্রবেশদ্বার। কোনও না কোনও লিঙ্ক ওদের মধ্যে অবশ্যই আছে। আরও একটা জিনিস মনে হচ্ছে জানিস, তবে কতটা সঠিক সময়ই বলবে।

কী?

খুনি কোনও অধিবিদ্যায় পারদর্শী। যা দেখানো হচ্ছে সেটা আসলে মরীচিকা। আসলটা অন্য কিছু।

রক্তিম হেসে বলল, আই মাস্ট বি অ্যালার্ট। আপাতত আমি সল্টলেকে চললাম। দেখি কেসের ডিটেলসটা জোগাড় করতে পারি কিনা। ক’টা দিন খুব চাপে থাকব মনে হচ্ছে। রাত করে খাবার টেবিলে তোমার সাথে বসব।

———-

 

আইসি দেব সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, ডিসিপি স্যার আমাকে সব বলেছেন। ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম মিস্টার বিশ্বাস। আপনার কথা আমি পড়েছি। বলুন কীভাবে আমি সাহায্য করতে পারি।

রক্তিম বলল, পুরো কেস হিস্ট্রিটা আমাকে একবার প্রথম থেকে বলুন। কতটুকু এগোতে পেরেছেন সেটাও বলবেন। ওই দুটো থানা থেকেও আমি শুনব।

বেশ বলছি। তার আগে একটু চায়ের কথা বলে দিই।

ঘন্টাখানেক বাদে থানা থেকে বেরিয়ে এল রক্তিম। আকাশ থমথমে। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। একটা ক্যাব বুক করে তাতে উঠে বসল সে। সুমিত সেনের ফ্ল্যাটে যখন পৌঁছোল তখন বৃষ্টির তোড় আর একটু বেড়েছে। কলিংবেল টিপতে দরজা খুললেন সুমিত সেন নিজেই। ছবি দেখেছে, তাই চিনতে অসুবিধা হল না রক্তিমের। পরনে বারমুডা আর আকাশি রঙের হাতকাটা গেঞ্জি। অবাক চোখে রক্তিমের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না। হু আর ইউ?

আমি রক্তিম বিশ্বাস। প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আপনার ওয়াইফের মৃত্যুর ব্যাপারে দুচারটে কথা বলতে চাই। আইসি দেব নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে বলেছেন আপনাকে।

হ্যাঁ, একটু আগেই ফোন করে বললেন আমি যেন বাড়িতেই থাকি, কোথাও না যাই। আর আমি যেন আপনার সাথে কো-অপারেট করি।

দেখুন সুমিতবাবু আমি আনঅফিসিয়ালি এই কেসে পুলিশকে সহায়তা করছি। তাই বেশি জানাজানি হওয়াটা কাম্য নয়।

হুম… বুঝলাম। আমার কাছে কী জানতে চান?

আপনার ওয়াইফকে যেভাবে খুন করা হয়েছে সেটা নিঃসন্দেহে কুল ব্রেনের কাজ। কোনও ধুরন্ধর অপরাধীই এতটা অ্যাডভান্স ভাবতে পারে। আপনি কি জানেন গত কয়েক দিনে আরও দুজন মহিলা একই ভাবে খুন হয়েছেন? একজন বেহালায়, অন্যজন পদ্মপুকুরে! কিছু শুনেছেন?

না তো। বলেন কী? এ তো মারাত্মক ব্যাপার !

ঠিকই বলেছেন। ইটস আ ভেরি ভেরি সিরিয়াস ম্যাটার। কোনও ভাবে সিরিয়াল কিলিং-এর ইঙ্গিতও দিচ্ছে। বাকি যে-দুজন মহিলা খুন হয়েছেন, তাদের একজনের নাম তিয়াসা সরকার, অন্যজনের নাম দেবলীনা পাত্র। তিয়াসা একটা বেঙ্গলি মিডিয়াম স্কুলের দিদিমণি। দেবলীনা মডেল। আপনি এই নাম দুটো কখনও শুনেছেন?

না। প্রথম শুনলাম।

আপনার মিসেসের সাথে কোনও কানেকশন?

যতদূর জানি, ছিল না। শান্তার বন্ধু-বান্ধবদের বেশির ভাগকেই আমি চিনি। শান্তা ভীষণ খোলামেলা টাইপের মেয়ে ছিল। আমাকে সব খুলে বলত।

আপনি ধীরাজ তালুকদারকে চেনেন?

জানি না আপনি কোন ধীরাজের কথা বলছেন। ধীরাজ নামে আমাদের এক সহপাঠী ছিল। বেঙ্গালুরুতে একসাথে পড়তাম।

হ্যাঁ, আমি সেই ধীরাজের কথাই বলছি। আপনি কি জানেন শান্তাকে যে-বাড়িতে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয়েছে, সেটা ধীরাজদের বাড়ি?

হোয়াট! কিন্তু ধীরাজ তো বহুদিন আগেই বিদেশে চলে গিয়েছে বলেই জানি। আমরা যখন বিদেশে ছিলাম একবার ফেরার সময় দেখাও হয়েছিল। সম্ভবত হিথরো এয়ারপোর্টে। তারপর আর কোনও যোগাযোগ নেই। ও কি ফিরে এসেছে?

না। ওই বাড়িতে ওর বাবা মা থাকেন। কানেকশনটা একটু অদ্ভুত! তাই না?

কীসের কানেকশন? আমি কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না।

আমিও বুঝতে পারিনি। বোঝার চেষ্টা করছি মাত্র। ওটা যদি ধীরাজদের বাড়ি না হয়ে অন্য কোনও বাড়ি হতো, তাহলে প্রশ্নটা উঠত না। এমনও হতে পারে খুনি ইচ্ছে করেই ওই বাড়ি চয়েস করেছিল। ইটস জাস্ট আ প্ল্যান ফর ক্রিয়েংটি আ মিস্ট্রি। একটা পার্সোনাল কোয়েশ্চেন করব কিছু মনে করবেন না প্লিজ।

ভ্রূ তুলে তাকালেন সুমিত সেন, কী কোয়েশ্চেন?

কখনও কি শান্তার সাথে ধীরাজের কোনও রিলেশন গড়ে উঠেছিল?

খেঁকিয়ে উঠলেন সুমিত, কী যা তা বলছেন? আমার মৃত স্ত্রীকে নিয়ে আপনি এসব কথা বলতে পারেন না। আই থিঙ্ক ইউ ক্রসড ইওর লিমিট।

রক্তিম শান্ত গলায় বলল, সরি মিস্টার সেন। আপনাকে হার্ট করার উদ্দেশ্য আমার নেই। আসলে মার্ডার কেস বলে কথা, সবদিক খতিয়ে দেখতে হয়। আপনি স্বীকার করুন বা না করুন, ব্যাপারটা কি খুব অসম্ভব? যদি এটার কোনও সত্যতা পরবর্তীতে খুঁজে পাই, তাহলে এটুকু বলতে পারি, আপনি অবশ্যই বিপদে পড়বেন। গোয়েন্দা হিসাবে আমার কমিটমেন্ট হল, দরকার পড়লে মাটি খুঁড়ে সত্যটা বের করে আনা। কোনও কিছুই আমাকে আটকাতে পারবে না।

আপনি কি আমাকে হুমকি দিচ্ছেন মিঃ ডিটেকটিভ? এসব কী? আপনি কি ধরেই নিয়েছেন আমার স্ত্রীর হত্যাকারী আমি?

রক্তিম হেসে বলল, হুমকি নয়, আমার কমিটমেন্ট। আপনি অতটা রিঅ্যাক্ট করছেন কেন? আমি জাস্ট একটা সম্ভবনার কথা বলেছিলাম। আপনি এমন করছেন যেন ওটাই সত্যি !

থতমত খেয়ে চুপ করে গেলেন সুমিত সেন।

রক্তিম বলল, আপনার স্ত্রীকে ফিরিয়ে দিতে পারব না সুমিতবাবু। তবে তার হত্যাকারীকে অবশ্যই প্রকাশ্যে আনব। আপনি সহযোগিতা করুন বা না-ই করুন।

রক্তিমের শক্ত চোয়ালের দিকে তাকিয়ে সুমিত সেন নরম গলায় বললেন, আই অ্যাম স্যরি। আসলে এই মুহূর্তে আমার মাথার ঠিক নেই। শান্তাকে হয়তো অনেকেই পছন্দ করত। কিন্তু ও কাউকে পাত্তা দিত না। ধীরাজের সাথে কোনও রিলেশন থাকলে আমি ঠিক জানতে পারতাম। এখন একতরফা ভাবে কিছু থাকলে সেটা আমার জানার কথা নয়।

এই কথাগুলো আগেই বলতে পারতেন। যাকগে, আপনার আসল বাড়ি তো কৃষ্ণনগর। ওখান থেকে কেউ আসেননি?

বাবা, মা, কাকা, ভাই, খুড়তুতো ভাই অনেকেই এসেছিল। অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন করে ওরা চলে গিয়েছেন। শুধু ভাই আছে। পুলিশের বারণ না থাকলে আমিও চলে যেতাম। একদম ভালো লাগছে না।

বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা। আপনার ভাই কী করে?

ইকনমিক্সে মাস্টার্স কমপ্লিট করে পিএইচডি করছে।

আপনাদের বিয়েটা প্রেমের বিয়ে ছিল, আমি শুনেছি। অনেক অশান্তিও হয়েছিল।

ঠিকই শুনেছেন। শান্তার বাবা ভীষণ গোঁড়া। পরে অবশ্য মেনে নিয়েছিলেন। আমার বাড়িতে কোনও প্রবলেম হয়নি। আমার বাবা মা পুরো ফ্যামিলির সাপোর্ট পেয়েছি।

কাউকে সন্দেহ হয় আপনার?

না। শান্তাকে মেরে কার কী লাভ?

লাভ লোকসান সবসময় খালি চোখে দেখা যায় না সুমিতবাবু। শান্তাদেবীর বাড়ি থেকে কেউ আসেননি?

ওর দাদা এসেছিল। বাবা মা অসুস্থতার কারণে আসতে পারেননি।

নাকি পুরোনো অভিমান?

হতে পারে। কী করে বলি বলুন? শান্তাও ওদের এড়িয়ে চলত। তবে ওর মামা এখন বিদেশে, উনি থাকলে অবশ্যই আসতেন এবং আমার পাশে দাঁড়াতেন। শান্তার দাদা কোনও রকমে বুড়ি ছোঁয়া করেই পালিয়ে গেল।

ঠিক আছে… এখন উঠছি। দরকার পড়লে আবার আসব।

বাইরে বেরিয়ে ঘড়ি দেখল রক্তিম। একটা দশ। তিয়াসা সরকারের বাড়ি ঢাকুরিয়া। এখান থেকে খুব একটা দূরও নয়। একবার ঢুঁ মারলে কেমন হয়? আজ রবিবার। ওর স্বামী সরকারি চাকুরে। নিশ্চয়ই বাড়িতে পাওয়া যাবে। ইনভেস্টিগেশনের কাজে ডিলে করার কোনও মানে হয় না, মুহুর্তে ডিসিশন নিয়ে ফেলল রক্তিম। খুঁজে পেতে খুব একটা অসুবিধা হল না। বিশাল তিনতলা বাড়ি, তিয়াসার স্বামী দিবাকর দাশগুপ্তের। বেশ বড়ো পোস্টে আছেন। কলিংবেল টিপতে একজন বয়স্ক মহিলা দরজা খুললেন। পিছনে একটি শিশুকন্যা দাঁড়িয়ে ভারি মিষ্টি দেখতে।

নমস্কার জানিয়ে রক্তিম বলল, দিবাকরবাবুর সাথে একটু কথা বলতে চাই। আপনি কি ওঁর মা?

হ্যাঁ। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক চিনলাম না? কোথা থেকে আসছেন?

থানা থেকেই বলতে পারেন। আমি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। আমার নাম রক্তিম বিশ্বাস। তিয়াসা সরকারের মৃত্যুর তদন্তের ব্যাপারে পুলিশকে সহায়তা করার চেষ্টা করছি।

ভেতরে আসুন। আমি বাবুকে ডেকে দিচ্ছি। পুলিশ হলে ভেতরে ডাকতাম না। বউমার হঠাৎ করে এরকম মৃত্যু আমি মেনে নিতে পারিনি। পুলিশ আত্মহত্যা বললেও আমার কিন্তু তা মনে হয় না। বউমা এভাবে অন্য জায়গায় গিয়ে আত্মহত্যা করতে যাবে কেন? তাছাড়া ওসব বিষ বউমা পাবে কোথায়? আপনি আসল রহস্য খুঁজে বের করুন।

আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব এই রহস্যের কিনারা করতে।

বসার ঘরটা সুন্দর করে গোছানো। দামি আসবাবপত্র। দেয়ালে দামি পেইন্টিং-এর পাশাপাশি বেশ কিছু বাঁধানো স্টিল ফটোগ্রাফও রয়েছে। তার মধ্যে দু-তিনটে গ্রুপ ফটো। চিনামাটির ফুলদানিতে এখনও কিছু ফুল শুকোচ্ছে। শো কেসের নীচটা জুড়ে গল্পের বই। শো কেসের মাথায় বত্রিশ ইঞ্চি এলইডি টিভি দেওয়ালে ঝুলছে। ডানদিকে তিয়াসাদের হাসি মুখের ফ্যামিলি ছবি। খুব সুন্দর দেখতে ছিলেন তিয়াসা সরকার। সেই তুলনায় দিবাকর দাশগুপ্ত অনেকটাই বেমানান। মোটাসোটা, টেকো, ভুঁড়িওয়ালা বাবু।

 

নমস্কার, আসতে পারি?

রক্তিম হেসে বলল, অনুমতি নেবার কিছু নেই। এটা আপনারই বাড়ি। আসুন দিবাকরবাবু, বসুন। ঘরটা দেখছিলাম। খুব সুন্দর করে গোছানো, নিপুণ হাতের কাজ, এটাও কিন্তু এক ধরনের আর্ট। আমি রক্তিম বিশ্বাস, প্রাইভেট ডিটেকটিভ। তিয়াসা সরকারের মৃত্যুর ব্যাপারে দুচারটে কথা জানতে এসেছি।

দেখুন পুলিশকে আমি সবই বলেছি। আর কী জানতে চান বলুন? তিয়াসার মৃত্যুতে আমি বেসামাল হয়ে পড়েছি। বাড়িতে তিন বছরের ওইটুকু বাচ্চা মেয়ে ওকে সামলানো কি সহজ কথা! তবুও মা আছে বলে রক্ষে। জানি না এর পরে কী হবে। যাইহোক, আপনি একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ বলছেন। কে নিয়োগ করেছে আপনাকে?

অবশ্যই এটা জানার অধিকার আপনার আছে। যাচাই করারও। আপনি চাইলে সরাসরি ডিসিপি গৌতম চ্যাটার্জীর সাথে কথা বলে নিতে পারেন। লাগিয়ে দেব ফোন?

না না, তার দরকার নেই। আমি জাস্ট কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করছিলাম। নকল গোয়েন্দা সেজে বিশেষ কী লাভ হবে? দেখুন চেষ্টা করে, কোনও কিনারা করতে পারেন কিনা। আমি কিন্তু পুলিশের সাথে একমত। তিয়াসা আত্মহত্যাই করেছে। ওকে খুন করার মতো কোনও কারণ আমি দেখছি না। তবে স্পটটা নিয়ে একটু কনফিউশন আছে। বুঝতে পারছি না, ও ওই বাড়িতে কেন গেল মরার জন্য?

রক্তিম বলল, কনফিউশন আরও অনেক আছে দিবাকরবাবু। এটা একটা প্রিপ্ল্যানড মার্ডার, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আরও দুজন তিয়াসার মতো একই পদ্ধতিতে খুন হয়েছেন। একজন সল্টলেক, অন্যজন বেহালায়। শান্তা কুলকার্নি ও দেবলীনা পাত্র ওদের নাম। ওই দুটো নাম শুনেছেন কখনও?

না। এসব কী বলছেন আপনি? ওইসব মৃত্যুর সাথে তিয়াসার কী কানেকশন?

এখনও পাইনি কিছু। ওদের ছবি দেখাচ্ছি, দেখুন তো চিনতে পারেন কিনা?

রক্তিম মোবাইলের গ্যালারি খুলে শান্তা আর দেবলীনার ছবি বের করল। আইসি দেব তিনটে কেসের যাবতীয় ডকুমেন্টস পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তার মোবাইলে। রক্তিমই চেয়ে নিয়েছিল। দেবলীনার ছবি দেখেই কেমন জানি চমকে উঠলেন দিবাকর দাশগুপ্ত। রক্তিমের গোয়েন্দা চোখ সেটা ঠিক ধরে ফেলল। তবে সেটা প্রকাশ করল না। মনে মনে আশান্বিত হল, খুব ক্ষীণ হলেও একটা সূত্রের ইঙ্গিত যেন দিয়ে দিলেন দিবাকর দাশগুপ্ত।

তাহলে আপনি এদের কোনও দিন দেখেননি, নামও শোনেননি… তাই তো?

হানড্রেড পার্সেন্ট। মিথ্যে বলে আমার কী লাভ?

তা ঠিক। না চেনাই স্বাভাবিক। এত বড়ো শহর আমাদের এই কলকাতা! ঠিক আছে আজ তবে উঠছি। মনে হয় খুব শিগগিরই আবার আসতে হবে।

কেন? কেন?

রক্তিম হেসে বলল, আপনি কী ভাবছেন, দুদিনেই এই তদন্তের কিনারা হয়ে যাবে? আমরা কেউ সুপারম্যান নই মিঃ দাশগুপ্ত।

 

 

মেইন রোডে এসে রক্তিম ফোন করল ডিসিপি গৌতম চ্যাটার্জীকে। ফোন করে বলল, একটা ফোন নম্বর ট্র‌্যাক করার ব্যবস্থা করতে হবে গৌতমদা। খুব আর্জেন্ট।

কার নম্বর?

তিয়াসা সরকারের হাজব্যান্ড দিবাকর দাশগুপ্তের। চিনতে পারছেন তো! পদ্মপুকুরের ভিকটিম তিয়াসা সরকার, তার স্বামী।

বুঝতে পেরেছি। তুমি নম্বরটা পাঠিয়ে দাও, আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

পাঁচ

অভীক পাত্র ঠোঁটকাটা লোক। নিঃসংকোচে ক্ষোভ উগরে দিয়ে বললেন, দেখুন এটা তো একদিন হবারই ছিল। যেমন কর্ম তেমন ফল। অসৎ সঙ্গে পড়ে গিয়েছিল আমার ওয়াইফ। সংসারের দিকে কোনও মন ছিল না। মানি, ফেম, বিলাস এসবই ছিল ওর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। এসবের জন্য ও সব করতে পারত… সবকিছু।

রক্তিম জিজ্ঞাসা করল, আপনাদের বিয়ে কীভাবে হয়েছিল?

প্রেম করে। তখন দেবলীনার রূপে মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। অন্ধও বটে, অন্য কিছু দেখতেই পাইনি! আমাদের ফ্যামিলি একটু সেকেলে। প্রথমে মেনে নিলেও কিছুদিন পর যখন দেবলীনার শরীর দেখানো ছবি বিভিন্ন জায়গায় বেরোতে লাগল, বাবা একদিন ডেকে বললেন, ওকে এসব বন্ধ করতে হবে, লোকে ছিঃ ছিঃ করছে। ব্যস, শুরু হয়ে গেল অশান্তি। অশান্তি এমন একটা পর্যায় পৌঁছে গেল যে, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলাম। কালীঘাটের নবীনপল্লির এই ফ্ল্যাট কিনলাম লোন-টোন নিয়ে দেবলীনাই সব ব্যবস্থা করে ফেলল। এখানে আসার পর শুরু হল আমার সাথে অশান্তি। ব্যাপারটা একটা সময় রুটিনের মতো হয়ে দাঁড়াল।

তারপর?

ইদানীং একজন নন-বেঙ্গলি প্রোডিউসারের সঙ্গে খুব সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। প্রায়ই বলত, এবার আমি হিরোইন হব। দাগাজি তার নতুন প্রোজেক্টে আমাকে সিলেক্ট করেছেন।

কে এই দাগাজি, আপনি চেনেন?

দূর, পুরো নামটাও জানি না। শোনারও চেষ্টা করিনি। আমি ভালো করেই জানি এই দাগারা কেমন লোক হয়! কেমন করে নায়িকা সিলেক্ট করে। আমি পরিষ্কার বলে দিয়েছিলাম, যদি এসব করতে হয় তবে আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দাও। তারপর তোমার যা ইচ্ছা হয় তাই করো। নায়িকা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর দেবলীনা তাতে রাজিও হয়েছিল। কিন্তু তারপরেই এই ঘটনা ঘটে গেল।

আপনার কাউকে সন্দেহ হয়?

ও যাদের সাথে মিশত, তারা কেউ ভালো লোক নয়। ওদের সাথে না মিললেই খুন করে দেবে। সুতরাং ওরা সবাই সন্দেহের মধ্যে থাকবে। একই ছাদের তলায় থাকলেও আমরা কেউ কারও পার্সোনাল লাইফ নিয়ে ইন্টারফেয়ার করতাম না। সকালে দুজনে  যে যার  কাজে বেরিয়ে পড়তাম, ফিরতাম রাতে। কোনও কোনও রাতে দেবলীনা ফিরতই না। এটাই অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তবে…

তবে কী?

মারা যাওয়ার কয়েক দিন আগে এক রাতে, দেবলীনাকে একটি ছেলের নামে কাউকে নালিশ করতে শুনেছিলাম। সম্ভবত ছেলেটা ওকে কোনও ভাবে খুব বিরক্ত করছিল। জানি না ব্যাপারটা কতটা সিরিয়াস ছিল। তবে দেবলীনা বেশ উত্তেজিত ছিল। কথা বলতে গিয়ে প্রচন্ড রাগ দেখাচ্ছিল।

একটু খুলে বলুন প্লিজ।

বলছি। সে রাতে বেশ দেরি করেই ফিরেছিল দেবলীনা। আমি খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। সারা দিন অফিসে প্রচন্ড ধকল গিয়েছিল, তাই চোখে ঘুম এসে গিয়েছিল। দেবলীনা কখন ফিরেছে টেরই পাইনি। হঠাৎ ওর উত্তেজিত গলা পেয়ে ঘুম ভেঙে যায়। ও ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে কথা বললেও, ভেতর থেকে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল।

ছেলেটার নাম শুনেছিলেন?

হ্যাঁ। মুকেশ কুমার।

আপনি জানার চেষ্টা করেননি, ব্যাপারটা কী?

করেছি। কিন্তু হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছে, ওসব শুনে তুমি কী করবে? এসব লাইনে ওসব একটু আধটু হয়ে থাকে। তুমি অত চিন্তা কোরো না, আই উইল হ্যান্ডেল দেম। এই উত্তরের পর আর কি কিছু বলার থাকে?

মুকেশ কুমারকে আপনি কোনও দিন দেখেছেন?

না।

দেবলীনা যাদের সাথে ওঠাবসা করত, তাদের আপনি চেনেন? মানে প্রত্যক্ষ পরিচয় ছিল?

কী করে থাকবে? দেবলীনা মনে করত আমি ওর কেরিয়ারের পথে বাধা। তাই আমাকে কখনওই ওর লাইনের লোকদের সাথে মিট করাত না। তাছাড়া আরও একটা কারণ ছিল…

সেটা কী?

ম্যারেড মেয়েদের হিরোইন হিসাবে গ্রেড কমে যায়। তাই ও বাইরে প্রচার করত, সে আন ম্যারেড। কখনও কাউকে বাড়িতে ইনভাইট করত না। এই ফ্ল্যাটে আসার পর থেকেই শাখা-সিঁদুরের পাট চুকিয়ে দিয়েছিল। আমিও বলা ছেড়ে দিয়েছিলাম। জানতাম ওর এই বেলাগাম উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য একদিন মারা পড়বে! সেটাই হল শেষপর্যন্ত।

ক্রমশ…

 

ডেডলি গেম (Crime Thriller) প্রথম পর্ব

শ্রাবণ মাস। ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ। সামযিক বিরতির পর আবার শুরু হয়েছে হালকা চালে। প্রায় সারাদিন ধরেই লাগাতার বৃষ্টি হয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে একটু বিরতি নিলেও সেটা দীর্ঘস্থাযী হচ্ছে না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল শান্তা, আটটা বাজে। রাত বেশি না হলেও চারপাশটা ঝিমিয়ে আছে। সেটা অতিবৃষ্টির কারণে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই দুর্যোগের মধ্যে কে আর সাধ করে বাইরে বেরুবে!

চিপস আর কফির কাপ হাতে টিভি খুলে বসল শান্তা। শান্তা কুলকার্নি। মারাঠি মেয়ে বাঙালি ছেলে সুমিত সেনকে বিয়ে করে এখন পুরোদস্তুর বাঙালি বউ। দুজনেই সফটওয্যার ইঞ্জিনিয়ার। বেঙ্গালুরুতে পড়ার সময় আলাপ, আলাপ থেকে প্রেম, তারপর বিয়ে। এখন শুনতে সহজ মনে হলেও, বিয়ের পিঁড়িতে বসতে দুজনকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল।

শান্তার পরিবার বেশ গোঁড়া। প্রথমে যথেষ্ট আপত্তি তুলেছিল, যদিও শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে বাধ্য হয়। তার পিছনে ছিল শান্তার অদম্য জেদ আর ছোটোমামা সুনীল আপ্তের ফুল সাপোর্ট।

সুমিতদের আদি নিবাস কৃষ্ণনগরে। ওখানেই থাকে পুরো ফ্যামিলি। সুমিতরা কর্মসূত্রে কলকাতাতেই থাকে। উইকএন্ডে চলে যায় বাড়িতে। দুএকদিন খুব হই-হুল্লোড় করে কাটিয়ে আসে। প্রথমে একটু অসুবিধা হলেও এখন বাংলাটা বেশ ভালোই বলে শান্তা।

ফোন বেজে উঠল চেনা রিং টোনে। টিভির সাউন্ড মিউট করে দিল শান্তা। প্রথমে ভেবেছিল সুমিতের ফোন। সুমিত এই মুহূর্তে দিল্লিতে। বিশেষ একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে গিয়েছে, অফিস থেকেই পাঠিয়েছে। অচেনা নম্বর দেখে ভ্রু-টা ঈষৎ কোঁচকাল শান্তার। এই সময় আবার কে ফোন করল?

রিসিভ করে বলল, হ্যালো… কে বলছেন?

ওপার থেকে ভেসে এল গম্ভীর পুরুষ কন্ঠ, আপনি কী শান্তা কুলকার্নি বলছেন?

শান্তা অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ বলছি… আপনি কে বলছেন বলুন তো, ঠিক চিনতে পারছি না।

মাইসেল্ফ অবিনাশ রুদ্র। আপনি আমাকে চিনবেন না কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। আমি কয়েকটা জরুরি কথা বলার জন্য আপনাকে ফোন করেছি। কথাগুলো আপনার পক্ষে খুবই ইম্পর্ট্যান্ট। হয়তো আপনার শুনতে খুব একটা ভালো লাগবে না, তবুও বলতে বাধ্য হচ্ছি। কারণ আমার মনে হয়েছে কথাগুলো আপনাকে বলা দরকার।

শান্তা এবার সত্যি সত্যি ভীষণ অবাক হল। ভেতরে ভেতরে একটা অদম্য কৌতূহল তৈরি হচ্ছে তার, বেশ বুঝতে পারছে। লোকটা কে? কী এমন গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চায় যাতে শান্তার খারাপ লাগতে পারে?

আপনি ঠিক কী বলতে চাইছেন বলুন তো… আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

সেটাই তো বলতে যাচ্ছি। একটু মন দিয়ে শুনুন প্লিজ। মিষ্টার সুমিত সেন আপনার হাজব্যান্ড, তাই তো?

হ্যাঁ। কী হয়েছে সুমিতের? কোনও বিপদ টিপদ…

আরে না না… সেসব কিছু না। বহাল তবিয়তেই আছেন তিনি। বাই দ্য ওয়ে আমার কথাটা কিন্তু ওনাকে নিয়ে। আপনি কি জানেন সুমিতবাবু এখন কলকাতাতেই আছেন?

তড়াক করে লাফিয়ে উঠল শান্তা।

কী যা তা বলছেন আপনি? আপনার উদ্দেশ্যটা কী বলুন তো? সুমিত এখানে আসবে কোথা থেকে?

বসুন… বসুন… বুঝতে পারছি উত্তেজনায় আপনি দাঁড়িয়ে পড়েছেন। সেটাই স্বাভাবিক। মাথা ঠান্ডা করে আমার বাকি কথাগুলো শুনুন প্লিজ।

লজ্জা পেল শান্তা। লোকটার কি এক্সট্রা চোখ আছে? আবার বসে পড়ল সোফাতে।

দেখুন ম্যাডাম আমি আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী। তাই ফোনটা করেছি। অন্যের ফ্যামিলি ম্যাটার নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও ইচ্ছাই আমার নেই। আপনার স্বামী সুমিত সেন, পায়েল মিত্র নামে একটা মেয়ের সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িত… সেটা কি আপনি জানেন?

শান্তা যেন হাজার ভোল্টের শক্ খেল। কোনও কথাই মুখ দিয়ে বের হল না।

আপনার বাকরুদ্ধ অবস্থা দেখে বুঝতে পারছি, আপনি এসব কিছুই জানেন না। আমি কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম, আপনাকে বোকা বানানো হচ্ছে।

শান্তা বলল, আমি বিশ্বাস করি না। আপনি যে সত্যি বলছেন তার প্রমাণ কী?

জানতাম আপনি একথাই বলবেন। আপনি হয়তো ওকে মনপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসেন। বিশ্বাস করেন। ভালোবাসার মানুষ সর্ম্পকে এসব কথা শুনলে মেনে নিতে কষ্ট হয় বৈকি। কিন্তু ম্যাডাম সত্যি তো সত্যিই, তাকে অস্বীকার করবেন কী করে?

এতটা কনফিডেন্স নিয়ে বলছেন। আপনার কাছে কী প্রমাণ আছে?

না সেরকম কোনও প্রমাণ নেই। আমার চোখ দুটোই প্রমাণ। কোনও ছবি তুলে রাখিনি, ভয়ে রেকর্ডও করিনি। তবে আপনি চাইলে ওদের হাতে-নাতে ধরতে পারেন।

মানে?

মানেটা খুব সহজ ম্যাডাম। ওরা কোথায় আছে আমি জানি। ঠিকানাটা দিয়ে দিচ্ছি। সেখানে চলে যান, হাতে নাতে ধরে ফেলতে পারবেন। আপনি চাইলে আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। তবে…

আপনি কোথায় থাকেন?

ওরা যে-ঠিকানায় আছে তার আশেপাশেই। এখন ভেবে দেখুন কী করবেন।

শান্তা অন্যমনস্ক ভাবে বলল, ঠিক আছে আপনি ঠিকানাটা পাঠিয়ে দিন।

ফোন কেটে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল শান্তা। সুমিত এত বড়ো বিশ্বাসঘাতকতা করল তার সাথে! কনফারেন্সের নাম দিয়ে এত বড়ো মিথ্যাচার? মাত্র দুবছরের মধ্যে সমস্ত ভালোবাসা উবে গেল? অথচ এই ভালোবাসা রক্ষার জন্য শান্তাকে কী লড়াইটাই না লড়তে হয়েছিল একদিন। নিজের কাছের মানুষগুলোকে দূরে ঠেলে দিতে পিছপা হয়নি। বিশ্বাস করতে মন চাইছে না, তবুও কেন জানি মন বলছে এটাই সত্যি। একটা অজানা অচেনা লোক আগ বাড়িয়ে মিথ্যে বলতে যাবে কেন? যদি অন্য কোনও অভিসন্ধি থাকত, তাহলে শান্তাকে ফোন না করে সুমিতকে ফোন করত। শান্তাকে এসব জানিয়ে ওর অন্য কিছু লাভ আছে বলে মনে হল না। অর্থাৎ সান্ত্বনা খুঁজে কোনও লাভ নেই। সত্যিটা নির্মম হলেও রূঢ় বাস্তবতা নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে, মুখ ফেরানোর আর কোনও উপায় নেই।

ফোন খুলে দেখল ইনবক্সে ঠিকানা পাঠিয়ে দিয়েছেন অবিনাশ রুদ্র। সল্টলেকের একটা বাড়ির ঠিকানা। ওই এলাকা ভালো করেই চেনে শান্তা। খুঁজে পেতে খুব একটা সমস্যা হবে না। মনে মনে ডিসিশন নিয়ে ফেলল, সত্যটাকে যাচাই করে দেখা দরকার। ঘরের পোশাক পালটে জিন্স আর টপ পরে নিল শান্তা। ঘর বন্ধ করে নেমে এল গ্যারেজে। গাড়ি বের করতে গিয়ে একবার মনে হল, এই দুর্যোগের রাতে এভাবে একা যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? পরক্ষণেই মনে হল, কাকে নেবে সাথে? যত বন্ধুই হোক, এসব খবরে এক ধরনের বিকৃত আনন্দ উপভোগ করে সবাই। তাছাড়া ওদের সুখী বিবাহিত জীবন নিয়ে জেলাসি করার লোকের অভাব নেই।

এখন এরকম একটা খবর ওদের হাতে এসে পড়লে জীবন অতিষ্ট করে ছাড়বে। সুতরাং খবরটার সত্যতা যাচাই তার নিজে করাই ভালো বলে মনে হল শান্তার। যাকে সাথে নিয়ে যাবে সেও তো দেখবে সত্যিটা, দেখেশুনে সে কি মৌন হয়ে থাকবে? কানাঘুষোয় ঠিক বেরিয়ে পড়বে সব। সেরকম কোনও বন্ধুর কথা মনে পড়ল না শান্তার, যে এই মুহুর্তে তাকে সাহায্য করতে পারে। দাঁতে দাঁত চেপে গাড়ি বের করে ফেলল শান্তা। সিচুযেশন যাই হোক নিজেই হ্যান্ডেল করবে। কঠিন পরিস্থিতি সে জীবনে কম দেখেনি!

অঝোর ধারায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে আবার। রেইনকোট, ছাতা দুটোই সঙ্গে নিল শান্তা। ইস্টার্ন বাইপাস ধরে গাড়ি চলল যথাসম্ভব দ্রুত বেগে। ড্রাইভিংটা খারাপ করে না শান্তা। প্রথমে শেখার ইচ্ছেই ছিল না, সুমিত জোর করে ভর্তি করে দিয়েছিল পরিচিত একটা ড্রাইভিং স্কুলে। বলেছিল আমরা দুজন মানুষ, কত ধরনের বিপদ আপদ হয়, রাতবিরেতে কিছু হলে কোথায় ড্রাইভার খুঁজে বেড়াবে? শেষ পর্যন্ত এই কাজে লাগছে! মেজাজটা তিরিক্ষে হয়ে উঠল শান্তার। স্পিড বাড়িয়ে দিল আরও।

অন্যদিনের তুলনায় আজ গাড়ির ঢল অনেকটা কম। নিজ নিজ বাড়িতে বর্ষা রাতের মজা উপভোগ করছে শহরবাসী। একটু আগে শান্তাও সেটাই করছিল। একটা ফোন এসে দমকা বাতাসের মতো এতদিনের বিশ্বাসকে এক নিমেষে তছনছ করে দিয়ে গেল। এই বিশ্বাস আর কি ফিরে আসবে কোনও দিন! ভেতরটা মুচড়ে উঠল কিন্তু চোখ ঝাপসা হতে দিল না কিছুতেই।

এই এলাকাটা বেশ নির্জন। বাড়ি আছে বটে কিন্তু বাইরে কোনও লোকজন নেই। ঠিকানা কনফার্ম করার জন্য কাউকে জিজ্ঞেস করবে তার কোনও উপায় নেই। নিরুপায় হয়ে শান্তা ফোন করল অবিনাশ রুদ্রকে। ওর ইন্সট্রাকশন অনুযাযী সামনের মোড় ঘুরতেই দেখতে পেল হলুদ রঙের ছিমছাম দোতলা বাড়িটা। এটাই তাহলে পায়েল মিত্রের বাড়ি! মিস্টার সুমিত সেনের শান্তির জায়গা! একরাশ ঘৃণা ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইল যেন শান্তার গলা দিয়ে। তেতো ঘৃণাটাকে গলাধঃকরণ করে নিয়ে শান্তা বলল, আপনি আসছেন তো?

আমার আসাটা কি ঠিক হবে ম্যাডাম? ব্যাপারটা আপনাদের পার্সোনাল ম্যাটার… আগে আপনি গিয়ে ব্যাপারটা বুঝুন। সমস্যা হলে ডাকবেন, অবশ্যই যাব। আসলে আমি…

শান্তা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, বুঝেছি… ঠিক আছে আমি দেখছি।

 

রাস্তার ধার ঘেঁষে গাড়ি দাঁড় করাল শান্তা। গাড়িতে বসেই রেইনকোট পরে নিল। আশেপাশের বাড়িগুলোতে আলো জ্বলছে। তবে রাস্তায় একটা লোকও নেই। পুরো শুনশান। গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বের হতেই বৃষ্টি-ভেজা হাওয়ার ঝাপটা লাগল মুখে। এলোপাথাড়ি বৃষ্টি রেইনকোট ভেদ করে ভিজিয়ে দিচ্ছে শরীর। ছাতাটাও খুলে নিল শান্তা। প্রায় দৌড়ে বাড়ির গেটের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। গেটের গ্রিলে হ্যাজবোল্ট লাগানো। তবে কোনও তালা লাগানো নেই। হ্যাজবোল্ট খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল শান্তা। গেট পেরিয়ে একফালি লন। নানা রকম দেশি-বিদেশি গাছের সম্ভার। একটা সময় শান্তারও খুব গাছের শখ ছিল। নানা কাজের চাপে সেসব হারিয়ে গিয়েছে।

কলিং বেল টিপল। দুতিনবার টেপার পরেও কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। ভেতরে আলো জ্বলছে, তার মানে লোক তো অবশ্যই আছে। তবে কি ওরা বুঝে গিয়েছে, শান্তা এখানে এসে পড়েছে? বারান্দায় কোনও সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে কিনা ভালো করে দেখল শান্তা। কিন্তু সেরকম কিছু নজরে পড়ল না। এমনও হতে পারে হিডেন ক্যামেরা লাগানো আছে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আরও দুবার কলিং বেল টিপল। কোনও সাড়া নেই। দরজায় কড়া নেড়ে বেশ জোরেই ডাকল এবার, ভেতরে কেউ আছেন?

না এভাবে ওরা সাড়া দেবে না। দরজায় বেশ জোরে ধাক্কা দিল শান্তা। কাপুরুষ কোথাকার! ধরা পড়ার ভয়ে লুকিয়ে পড়েছে অন্য একটা মেয়ে শাড়ির আঁচলের তলায়! কিন্তু কী আশ্চর্য! ধাক্কা দিতেই দরজা হাট করে খুলে গেল। শান্তা ভেবে পেল না, এটা কী ধরনের কাণ্ড হল? যদি ওরা টেরই পেয়ে থাকে তবে দরজা খুলে রাখবে কেন? নাকি কোনও গোপন পথে পালিয়ে গিয়েছে?

পায়ে পায়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল শান্তা। সুসজ্জিত ড্রযিংরুম। ড্রযিংরুম পেরিয়ে প্রশস্ত হলঘর। দুদিকে বেডরুম। মাঝ বরাবর সিঁড়ি। মেজেনাইন ফ্লোর পর্যন্ত আলাদা একটা ঘোরানো সিঁড়ি। সবগুলো ঘরেই আলো জ্বলছে, অথচ মানুষের কোনও সাড়া শব্দ নেই। এবার কী করবে, কিছুই বুঝে উঠতে পারল না শান্তা। আবার ফোন করল অবিনাশ রুদ্রকে।

এটা কী হল? আমার সাথে এসব করলেন কেন? আমারই ভুল… একজন অচেনা অজানা লোককে বিশ্বাস করে…

অবিনাশ রুদ্রের গলায় অবিশ্বাসের সুর, ওরা নেই ভিতরে? হতেই পারে না, আমার ইনফরমেশন কখনও মিথ্যে হয় না! আমি নিজের চোখে দেখেছি। আপনি ভালো করে দেখুন।

শান্তা বিরক্ত গলায় বলল, আর দেখার কিছু নেই। ফাঁকা বাড়ি, খোলা দরজা, একটা লোকেরও সাড়াশব্দ নেই। এভাবে আমাকে হ্যারাস করার জন্য আপনাকে পস্তাতে হবে। আপনি আমাকে চেনেন না অবিনাশবাবু।

বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, আমি কোনও ভুল ইনফরমেশন দিইনি। আপনি ভালো করে দেখুন। ওরা যদি পালিয়ে গিয়ে থাকে কোনও না কোনও সূত্র অবশ্যই পাবেন। আমি ফোনে আছি, আপনি দেখুন…।

এভাবে অন্যের বাড়িতে ঢুকে সার্চ করা আমার ভালো লাগছে না। তবুও এতটা এসেছি যখন একবার দেখছি। এই মুহূর্তে ড্রযিংরুমে দাঁড়িয়ে আছি। সেরকম সন্দেহজনক কিছুই নজরে পড়ছে না। দেয়ালে এক বয়স্ক দম্পতির ছবি টাঙানো রয়েছে, ওঁরা কারা?

আমি কী করে বলব? পায়েল মিত্রের বাবা-মা হতে পারেন। এরপরে কোন ঘর?

হলঘর… তারপরে পরপর তিনটি বেডরুম। হলঘরে এসেছি। সোফা, আলমারি, শো কেস, টি টেবিল এসব দিয়ে ভর্তি।

তাহলে আপনি বেডরুমে যান। ওরা পালালেও বেশিক্ষণ হয়নি, তাজা প্রমাণ কিছু না কিছু ঠিক পাবেন। গো ফাস্ট।

ঢুকেছি। একদম সামনের বেডরুমে আছি এই মুহুর্তে। কেমন জানি একটা ভ্যাপসা গন্ধ বের হচ্ছে ঘরটা থেকে। মনে হয় কেউ শোয় না এই ঘরে। দীর্ঘ দিন ফাঁকা পড়ে থাকলে যেমন গন্ধ হয় ঠিক সেরকম।

তাহলে পরেরটায় যান।

এসেছি। সুযোগ পেয়ে ভালোই বাঁদর নাচাচ্ছেন। এখানে তো উলটো কেস। বিছানা পুরো এলোমেলো। মনে হয় কেউ শুয়েছে কিন্তু শোওয়ার পর আর বিছানা গুছিয়ে রাখেনি। এখানে কোনও কিছুই নেই যেটা আপনার তাজা প্রমাণ হতে পারে।

শেষ বেডরুমটা দেখুন। লাস্ট ট্রাই। ওখানেও যদি কিছু না পান তাহলে আমি দোষ স্বীকার করে নেব। আপনি যা শাস্তি দেবেন মাথা পেতে নেব। মিথ্যে বলে আমার কী লাভ ছিল বলুন? আমি আপনার ভালোর জন্যই…

ভালো করতে গিয়ে আমার কতটা ক্ষতি করে দিলেন আপনি জানেন? আপনাকে আমি জেল খাটিয়ে ছাড়ব। এক সেকেন্ড… ওখানে ওটা কী?

আপনি কী পরের ঘরে ঢুকে পড়েছেন? মনে হচ্ছে কিছু একটা পেয়েছেন! পেতেই হবে… আমি নিশ্চিত জানি, ওরা ওই বাড়িতেই ছিল। কী পেলেন ম্যাডাম?

আহা… অত উতলা হচ্ছেন কেন? আমাকে ভালো করে দেখতে দিন আগে। দুটো চায়ের কাপ… অর্ধেক চা রয়েছে দুটো কাপেই। পাশে বিস্কুটের টুকরো। মনে হয় কিছুক্ষণ আগেই কেউ খেয়েছে। টেবিলের ওপাশে ওটা কী? আমার ছবি… আশ্চর্য আমার ছবি এখানে এল কী করে!

কী, এবার নিশ্চয়ই কনফার্ম হলেন, আমি মিথ্যে বলিনি। একটু আগে তো হাত দিয়ে আমার গর্দান নিতে যাচ্ছিলেন। এবার বিশ্বাস হল তো?

স্ট্রেঞ্জ! ছবির উপর এগুলো কী? কিছু একটা লেগে রয়েছে যেন।

কী আবার হবে, বিস্কুটের গুঁড়োটুরো হবে হয়তো।

না না অন্য কিছু। দাঁড়ান একটু মুখে দিয়ে দেখি, জিনিসটা কী?

অদ্ভুত একটা শব্দ হল। তারপর সব চুপ।

অবিনাশ রুদ্র বেশ জোরেই বলে উঠলেন, কী হল ম্যাডাম? হঠাৎ চুপ করে গেলেন কেন? আর ইউ ওকে? অবশ্য যে ধাক্কাটা খেলেন, কথা বলবেনই বা কী করে? ভগবান আপনাকে শান্তি দিন।

দুই

আইসি প্রিয়প্রসাদ দেব গম্ভীর মুখে সাব ইন্সপেক্টর উত্তম সাহার দিকে তাকিয়ে বললেন, ব্যাপারটা কিছু বুঝতে পারছেন সাহাবাবু?

ভীষণ গোলমেলে লাগছে স্যার। সত্যি কথা বলতে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ভদ্রমহিলা এখানে থাকেন না। এখানকার কেউ দেখেওনি তাকে। এই বাড়ির সাথে কোনও কানেকশন নেই। অথচ উনি দুর্যোগের রাতে এখানে এলেন এবং মারা পড়লেন। এখানে এলেনই বা কেন? আর মারাই বা পড়লেন কেন? এটা খুন না আত্মহত্যা, সেটাও তো বোধগম্য হচ্ছে না।

আইসি দেব অন্যমনস্ক ভাবে বললেন, প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযাযী এটা খুন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে কীভাবে খুন হলেন সে বিষয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে। বাইরে ওর গাড়ি দাঁড় করানো। সম্ভবত নিজেই গাড়ি চালিয়ে এখানে এসেছিলেন। লাশের পাশে ওর মোবাইল পড়ে রয়েছে। আত্মহত্যার জন্য অজানা অচেনা একটা বাড়িতে এসে পড়বেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে উনি এখানে এসেছিলেন অথবা ওকে ডেকে আনা হয়েছিল। আমার অনুমান মিথ্যে না হলে এটা নিঃসন্দেহে প্রি-প্ল্যানড মার্ডার। যাই হোক ঘরটা সার্চ করে কিছু পাওয়া গেল?

সেরকম কিছু না। সার্চ চলছে।

পুরো বাড়িটা ভালো করে দেখুন। যে-ঘরে খুন হয়েছে লাশ নিয়ে যাবার পর সিল করে দিন। একটা জিনিসেও কেউ হাত না দেয়। বাড়ির মালিক কোথায়?

বাইরের ড্রযিংরুমে বসে আছেন। ইযং ছেলে। ভয়ে রীতিমতো কাঁপছেন।

ঠিক আছে, আমি ওর সাথে কথা বলছি, আপনি এদিকটা দেখুন।

পায়ের শব্দ পেয়ে চমকে উঠলেন বাড়ির মালিক। চোখে মুখে আতঙ্ক মেশানো বিস্ময়। আইসি দেবকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন। আইসি বললেন, রিলাক্স মিস্টার…

দেবদূত… দেবদূত ঘোষ।

আপনি এই বাড়ির মালিক?

আজ্ঞে না স্যার। এই বাড়ির মালিক আমার মেসোমশাই ধীমান তালুকদার। আমি তো জাস্ট বাড়ি পাহারা দিচ্ছিলাম। এভাবে ফেঁসে যাব স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি। এরকম একটা কাণ্ড ঘটবে জানলে কিছুতেই রাজি হতাম না। বিশ্বাস করুন স্যার আমি কিচ্ছু জানি না, কিচ্ছু করিনি।

তাহলে অত ভয় পাচ্ছেন কেন? আপনি সবকিছু একটু খুলে বলুন প্লিজ। আমাকে একটু বুঝে নিতে দিন।

বলছি স্যার। বাড়িটা আমার মেসোমশাইয়ের। ওরাই থাকেন এখানে। ওদের দুই ছেলে বিদেশে থাকে। গত পরশু মাসি মেসো দুর্গাপুরে গিয়েছেন একটা বিয়ের নেমতন্ন রক্ষা করতে। ওরা যখন বাইরে কোথাও যান, আমি রাতে এসে এখানে থাকি। বলতে পারেন পাহারা দিই আর কী। দেখতেই পাচ্ছেন এদিকটা একটু নির্জন। ফাঁকা বাড়ি পেলে মাঝে মাঝেই চুরিটুরিও হয়। এর আগেও অনেকবার থেকেছি। কোনও দিন কিছু হয়নি। কিন্তু এবার…

দুহাতে মুখ ঢাকলেন দেবদূত। সাতাশ-আটাশ বছরের গাট্টা গোট্টা যুবক। জিম করা শরীর। টাইট গেঞ্জি ভেদ করে পেশিগুলো ফুটে উঠেছে। চওড়া মুখমণ্ডল। একটু ভোঁতা টাইপের নাক। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। সামনের দিকের চুল বেশ হালকা।

দেখুন দেবদূতবাবু এসব ঘটনা তো বলেকয়ে ঘটে না। আপনার অবস্থাটা বুঝতে পারছি। তবে অযথা ভয় পাবেন না। আপনি যদি কিছু না করে থাকেন তবে আপনার কোনও ভয় নেই। পুলিশ আপনার পাশে থাকবে। কিন্তু যেহেতু এই ঘটনার সঙ্গে আপনি সরাসরি জড়িয়ে আছেন, কিছু প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া, কিছু আইনি ফর্মালিটি মেনে চলতেই হবে। আমি আশা রাখি আপনি সব রকমের সহযোগিতা করবেন।

নিশ্চয়ই স্যার।

আপনি আজ সকাল কটার দিকে এখান থেকে বেরিয়েছিলেন?

সাড়ে নটা-দশটা হবে। অন্যদিন আগেই উঠে পড়ি, আজ বৃষ্টির জন্য ঘুম ভাঙতে একটু দেরি হয়ে যায়। সকালে চা খেয়ে কোনও রকমে স্নান সেরেই বেরিয়ে পড়ি।

আপনি কী করেন?

ফুলবাগানে আমার একটা ভ্যারাইটি স্টোর্স আছে স্যার।

আর আপনাদের বাড়িটা কোথায়?

ফুলবাগানেই স্যার। উপেন্দ্র কিশোর সরনিতে।

এখান থেকে যাওয়ার পর কী কী করেছেন একটু ডিটেলসে বলুন।

এখান থেকে সোজা বাড়িতে যাই। কিছু খেয়ে চাবি নিয়ে দোকানে চলে যাই। আমার দোকানের কর্মচারী রাজেশ একটু দেরিতে আসায় আমি নিজেই দোকান খুলে ঝাড়াপোছা করে ধূপধুনো দিই। রাজেশ এলে দোকানে বসিয়ে আমি কিছু দরকারি কাজ সারতে বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। ফিরতে ফিরতে অনেকটা বেলা হয়ে যায়। রাজেশ খেয়ে আসার পর আমিও খেতে চলে যাই বাড়িতে। খাওয়ার পর কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে আবার চলে আসি দোকান। আটটার দিকে দোকান বন্ধ করে বাড়ি গিয়ে মাকে তাড়াতাড়ি খেতে দিতে বলি। কারণ বৃষ্টির জন্য আমি এখানে আসতে দেরি করতে চাইছিলাম না। তবুও বেরোতে বেরোতে সাড়ে নটা বেজে গেল। বাবা মা দুজনেই বলেছিল, এই দুর্যোগের মধ্যে আজ আর যাওয়ার দরকার নেই। কিন্তু আমি শুনিনি। আমার ভয় ছিল, কিছু একটা অঘটন ঘটে গেলে ওদের কাছে মুখ দেখাতে পারব না। দাযিত্বটা আমি নিজে থেকেই নিয়েছিলাম। কিন্তু এরকম একটা অঘটন ঘটবে… আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। সবকিছু একটা দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।

এখানে এসে কী দেখলেন?

দেখি সামনের গ্রিলের গেট কিছুটা খোলা। বাড়ির সামনে একটা দামি গাড়ি দাঁড় করানো। বারান্দায়, ভেতরে সব জায়গায় লাইট জ্বলছে। ভীষণ অবাক লাগল। কারণ সকালবেলা বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমি নিশ্চয়ই লাইট জ্বেলে যাইনি, তবে কীভাবে জ্বলল? একবার মনে হল, তাহলে নিশ্চয়ই মেসো-মাসি ফিরে এসেছেন। কারণ বাড়ির চাবি একটা আমার কাছে আর একটা ওদের কাছে থাকে। তবুও খটকা গেল না। মেসোমশাই ভীষণ প্যাংচুয়াল লোক, এই রকম দুর্যোগের রাতে আমাকে এরকম হয়রানি করাবেন বলে বিশ্বাস হচ্ছিল না। যদি এসেই থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই ফোন করে সেকথা জানিয়ে দিতেন। একথা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মনে হল, চোর ঢোকেনি তো? পরক্ষণেই মনে হল, চোর কখনও লাইট জ্বেলে চুরি করে? বাইরের দামি গাড়িটাও সংশয়ে ফেলে দিল। আর বেশি না ভেবে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। একরাশ বিস্ময় নিয়ে এ-ঘর ও-ঘর করতে করতে পৌঁছে গেলাম ওই বেডরুমে যেখানে লাশটা পড়ে ছিল। পড়ে থাকার ভঙ্গিমা দেখেই বুঝেছিলাম দেহে প্রাণ নেই। এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম যে কী করব, কী করা উচিত কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি প্রথমে। একটু পরে বাবা আর ভাইকে ফোন করে সব জানালাম। ওরা বলল, তুই এক্ষুনি পুলিশকে ফোন কর, আমরা আসছি। ফোন করার পনেরো কুড়ি মিনিটের মধ্যেই আপনারা চলে এলেন।

আপনি লাশ দেখেছেন, মহিলাকে চেনেন?

জীবনে কোনও দিন দেখিনি স্যার। চেনা তো দূরের কথা। উনি কেন এখানে এলেন? কীভাবে মরলেন? কিছুই বুঝতে পারছি না।

প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে বিষ প্রযোগে হত্যা। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত কোনও কিছুই কনফার্ম বলা যাবে না। শুধু শুধু তো কেউ খুন হয় না, মোটিভ একটা থাকেই। ইনভেস্টিগেশন শুরু হয়েছে, ধীরে ধীরে সব বেরিয়ে আসবে।

ঘরে ঢুকলেন একজন তরুণ পুলিশ অফিসার। আইসি দেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, লাশ আইডেন্টিফাই করা গিয়েছে স্যার। সি ওয়াজ শান্তা কুলকার্নি। স্বামীর নাম সুমিত সেন। দুজনেই সফটওয্যার ইঞ্জিনিয়ার। ওর মোবাইল থেকেই ডেটাগুলো পেয়েছি। গাড়িটা ওর হাজব্যান্ড সুমিত সেনের নামে।

আইসি দেব চিন্তিত মুখে বললেন, ওর স্বামীকে ফোন করেছিলেন?

হ্যাঁ স্যার। উনি এখন দিল্লিতে। দুদিন আগে একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে গিয়েছেন। শুনে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, আপনি চলে আসুন অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল।

খুব ভালো করেছ। গুড জব। ওকে আমাদের দরকার হবে। একটা বিষয় বারবার মনে স্ট্রাইক করছে, বুঝলে বিকাশ…

কোন বিষয় স্যার?

মোবাইলের বিষয়। যদি কেউ ওকে সাথে করে নিয়ে এসে থাকে তাহলে তার পক্ষে মোবাইলটা সরিয়ে দেওয়াটাই বেশি সেফটি ছিল না? তোমার কী মনে হয়?

আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার। আমার হিসেবে এর পিছনে দুটো কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, সে জানে মোবাইলে এমন কোনও ডেটা নেই যাতে সে বিপদে পড়তে পারে। দ্বিতীয়ত, পুলিশকে মিসগাইড করা। কোনও কিছু না পেয়ে কনফিউজড পুলিশও একসময় ভাবতে শুরু করবে, ইটস আ সুইসাইড কেস। আমার কিন্তু দ্বিতীয় সম্ভবনটাই বেশি জোরালো মনে হচ্ছে।

গুড অর্বজারভেশন। আমিও তোমার সাথে একমত। ইচ্ছে করেই মোবাইল সরানো হয়নি। তবে ওতে কিছুই নেই সেটা বলা যাবে না। ওটা থানায় নিয়ে চলো। আর মিত্রকে একটু পাঠিয়ে দাও ওর বয়ানটা লিখে নিক। দেবদূতের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বিকাশকে নির্দেশ দিলেন আইসি দেব।

তারপর দেবদূতকে বললেন, অনেক রাত হল। বয়ান লিখিয়ে আপনি বাড়ি চলে যেতে পারেন। এ বাড়ি আপাতত পুলিশ পাহারা দেবে। ফরেনসিক ভিজিট না হওয়া পর্যন্ত আমরা কোনও রকম রিস্ক নেব না। তবে এই মুহূর্তে আপনি শহর ছেড়ে কোথাও যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। আপনার মেসোমশাইকে জানিয়েছেন ব্যাপারটা? না জানিয়ে থাকলে জানিয়ে দিন।

পরের দিন বিকেলেই থানায় হাজির হলেন সুমিত সেন। বিধ্বস্ত চেহারা। চোখের নীচে কালি। সঙ্গে তার এক বন্ধু এসেছেন। আইসি দেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পরখ করে নিলেন একবার। দীর্ঘকায় সুদর্শন যুবক। ত্রিশ বত্রিশ বছর বয়স হবে হয়তো। বেশ ফর্সা গায়ের রং। একমাথা ঝাঁকড়া চুল। টিকালো নাক। গালে একদিন বা দুদিনের না কাটা দাড়ির কালচে আভাস। চশমা বারবার ভিজে যাচ্ছে চোখের জলে।

আইসি দেব গম্ভীর মুখে বললেন কন্ট্রোল ইওরসেল্ফ মিস্টার সেন। ঘটনাটি আপনার কাছে কতটা বেদনাদায়ক, বুঝতে পারছি। সরি টু সে, ইটস আ কোল্ড ব্লাডেড মার্ডার বলেই মনে হচ্ছে আমাদের। ইনভেস্টিগেশন শুরু হয়েছে। আশা করি খুব শীঘ্রই সত্যটা বেরিয়ে আসবে। এবিষয়ে আপনার কিছু বলার আছে?

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না অফিসার। শান্তা ভীষণ মিশুকে স্বভাবের মেয়ে ছিল। কখনও কোনও কনট্রোভার্সিতে জড়াত না। অসম্ভব হেল্পফুল মেন্টালিটি। ওকে কেউ কেন খুন করতে যাবে?

তাহলে তো ধরে নিতে হয় উনি সুইসাইড করেছেন। সেরকম কোনও কারণ আছে বলে কি আপনি মনে করেন?

না। সুইসাইড করার মতো কোনও কারণও আমি দেখছি না। সবসময় পজিটিভ চিন্তা করত। কখনও ডিপ্রেসড হতে দেখিনি।

আইসি দেব মৃদু হেসে বললেন, বিনা কারণে এই জগতে কিছু হয় না। অকারণটাও একটা কারণ হয়ে যায় কোনও কোনও সময়। আপনাকে এই মুহূর্তে খুব টায়ার্ড লাগছে, তাই বেশি বিরক্ত করব না।

বেল টিপে কাউকে ডাকলেন আইসি দেব। পাশের ঘর থেকে উত্তম সাহা এলে তাকে বললেন, সাহাবাবু আপনি ওদের বুঝিয়ে দিন। আপনারা ওনার সাথে যান, কিছু জরুরি ফর্মালিটিজ করতে হবে।

পোস্টমর্টেম রিপোর্ট-এ আইসি দেবের ধারণাই সত্যি প্রমাণিত হল। পটাশিয়াম সায়ানাইডে মৃত্যু হয়েছে শান্তা কুলকার্নির। ফরেনসিক এক্সপার্টরাও ওই ঘর থেকে তার নমুনা পেয়েছে। টি টেবিলে শান্তার যে ছবিটা পাওয়া গিয়েছে তাতেই ছিল বিষের ছোঁয়া। সেখান থেকেই আঙুলে করে নিজের মুখে পুরেছিলেন নিজের মৃত্যুর কারণ। শান্তার ডান হাতের তর্জনীর মাথাতেও পাওয়া গিয়েছে বিষের অস্তিত্ব। কিন্তু ওই ঘরে দেবদূত ছাড়া আর কোনও সন্দেহজনক ব্যক্তির ফরেনসিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাহলে বিষ মেশানো ছবিটা ওখানে রাখল কে? দেবদূত? নাকি শান্তা নিজেই? তাই যদি হয় তবে এটা নিঃসন্দেহে আত্মহত্যার কেস।

চিন্তান্বিত মুখে চায়ের কাপে চুমুক দিলেন আইসি দেব। উলটো দিকে বসে আছেন উত্তম সাহা। তার মুখেও চিন্তার ছাপ। হঠাৎ বলে উঠলেন, আপনি কী দেবদূতকে সন্দেহ করছেন স্যার?

কিছুটা হলেও করতে বাধ্য হচ্ছি সাহাবাবু। ওই ঘরে যদি অন্য কেউ ঢুকে না থাকে তাহলে বিষ মেশানো ছবিটা রাখল কে? ছবিটা প্ল্যান করে আগে থেকেই কেউ রেখেছিল। কারণ শান্তা কুলকার্নি গাড়ি করে বিষ সমেত ছবি নিয়ে এসে আবার নিজেই সেই বিষ চেখে দেখবেন, সেটা তো হতে পারে না, তাই না?

তা ঠিক। তবে এটাও ঠিক ফরেনসিক টিমকে ধোঁকা দেওয়া কী খুব কঠিন কাজ? পাকা ক্রিমিনালরা কী দিয়ে কী হয়, কোনও কোনও ক্ষেত্রে পুলিশের চেয়ে বেশি জানে। আমি কী বলতে চাইছি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন স্যার।

ইয়েস। পয়েন্টটা আপনি বেশ ভালো ধরেছেন। আর এসব প্রমাণ লোপাটের জন্য অফুরন্ত সময়ও সে পেয়েছে। এবার প্রশ্ন আসছে, শান্তা কুলকার্নি হঠাৎ করে এই বাড়িতে এলেন কী করে? এমনও হতে পারে কোনও মিথ্যে ইনফরমেশন দিয়ে তাকে এবাড়িতে ডেকে আনা হয়েছিল।

আমারও কিছুটা সেরকমই মনে হচ্ছে। কিন্তু একটা খটকা আছে। শান্তার তর্জনীর মাথায় লেগে থাকা বিষ প্রমাণ করে, সে নিজেই নিজের মুখে বিষ পুরেছিল। এমন নয় তো, ওকে ভুল বুঝিয়ে মানে ওটা কোনও খাদ্যবস্তু, এসব বলেটলে খাওয়ানো হয়েছিল বিষটা?

হতেই পারে। আমাদের এখন প্রথম কাজ হল, শান্তা এবাড়িতে কেন এসেছিলেন সেটা খুঁজে বের করা। এই প্রশ্নের উত্তর পেলে অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে। আপনি একটা কাজ করুন, সুমিত সেনের ব্যাকগ্রাউন্ড যাচাই করুন। আর সেই সাথে দেবদূতের পেছনে একজন ইনফর্মার লাগিয়ে দিন। সব রকম ট্রাই করতে হবে আমাদের।

এই সময় হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন সাব ইন্সপেক্টর বিকাশ। আইসি দেব ওকে সামনের চেয়ার দেখিয়ে বললেন, বোসো বিকাশ। তোমাকে খুব এক্সাইটেড লাগছে। এনিথিং রং?

বিকাশ বলল, তা বলতে পারেন। শান্তা কুলকার্নির মোবাইল থেকে একটা দারুণ জিনিস পাওয়া গিয়েছে স্যার।

কী জিনিস?

শান্তা ওর মোবাইলে লাস্ট কল রেকর্ড করেছিলেন। মৃত্যুর সময়, ওই কল টাইম, সব মিলে যাচ্ছে। এইমাত্র আমি পুরোটা শুনে এলাম। সাইবার এক্সপার্ট বিশ্বাসকে বলে এসেছি আপনার মোবাইলে পাঠিয়ে দিতে। শুনলে আপনি চমকে যাবেন। অবিনাশ রুদ্র নামে একজন ব্যক্তি শান্তাকে ডেকে এনেছিলেন এই বাড়িতে। পায়েল মিত্র নামে একটা মেয়ের সাথে ওর স্বামী সুমিত সেনের পরকীয়া ধরিয়ে দেবেন বলে। শান্তা তার কথা বিশ্বাস করে চলে আসেন। অবিনাশ ফোনে ফোনেই ওকে নিয়ে যান ওই ঘর পর্যন্ত। কথায় কথায় শান্তাকে দিয়ে বিষটা খাওয়ান। সম্পূর্ণ অভিনব পদ্ধতিতে খুন, অন লাইন মার্ডার। ক্রাইম ইতিহাসে বোধহয় প্রথম। ওদের কথাবার্তা শুনে আমি তো স্টান্ট হয়ে গিয়েছি স্যার। হোয়াট আ ব্রেন!

মোবাইল বেজে উঠল বিকাশের। পকেট থেকে বের করে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে বলল, বিভাসের ফোন। মনে হয় পাঠিয়ে দিয়েছে স্যার। আপনি মোবাইল খুলুন। আমি ওকে বলে এসেছিলাম পাঠানো হলে একটি মিসকল দিস।

মোবাইল খুলে নোটিফিকেশন দেখে আইসি দেব বললেন, হ্যাঁ, পাঠিয়েছে মনে হচ্ছে। দাঁড়াও ওপেন করি।

তিনজনে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগলেন অবিনাশ রুদ্র ও শান্তা কুলকার্নির রেকর্ড করা কথোপকথন। শেষ হবার পর আইসি দেবের কোঁচকানো ভ্রু স্বাভাবিক হতে অনেকটা সময় লাগল।

উত্তম সাহা প্রথম কথা বললেন, এ তো মারাত্মক ব্যাপার স্যার। রীতিমতো লোকেশন সেট করে চিত্রনাট্য মেনে সিনেমা বানানোর মতো ব্যাপার। বিকাশ ঠিকই বলেছে। একদম অভিনব স্টাইল। পাকা মাথার কাজ। সবচেয়ে বড়ো কথা, শান্তা ম্যাডাম বুদ্ধি করে কল রেকর্ড না করলে কিছুই বুঝতে পারতাম না।

আইসি দেব বললেন, অবিনাশ রুদ্র লোকটা কে? ওই নম্বর ধরে কিছু বের করতে পেরেছ বিকাশ?

সিমটা অবিনাশ রুদ্রের নামেই আছে। কিন্তু সেই অবিনাশ রুদ্র এক বছর আগে মারা গিয়েছেন। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা কী হয়েছে? সুতরাং এই সূত্র ধরে এগোনোর রাস্তা নেই ধরে নেওয়া যায়।

আইসি দেব আপন মনেই বলে উঠলেন, আমার মনে হয় এই কল রেকর্ডের ব্যাপারটা নকল অবিনাশ রুদ্র জানে না। হয়তো তার ভাবনাতেও আসেনি শান্তা একরকম একটা কাণ্ড করে বসবে। তাহলে ফোনটা কিছুতেই রেখে যেত না।

বিকাশ বলল, আমারও তাই মনে হচ্ছে স্যার। এই অ্যাডভান্টেজ আমাদের কাজে আসতে পারে।

একদম ঠিক বলেছ। তবে ব্যাপারটা আপাতত গোপন রাখতে হবে। কাউকে কিচ্ছু বলার দরকার নেই। বিকাশ তুমি শান্তার ফোন থেকে পুরো এক মাসের কলারস লিস্ট বের করে দিতে বলো ওদের। তারপর সেটা ভালো করে ভেরিফাই করো। সামান্য কোনও সন্দেহজনক কিছু পেলেই আমাকে দেখাও। আমার মন বলছে, এটা কিন্তু আর পাঁচটা সাধারণ খুনের কেস নয়, এর পিছনে বড়োসড়ো কোনও ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে।

তিন

কয়েক দিন যেতে না যেতেই আবার খুন। একই স্ক্রিপ্ট, শুধু লোকেশনটা আলাদা। এবার পদ্মপুকুর থেকে একটু ভেতরে, সদ্য নির্মিত একটি ফ্ল্যাটে। লোকাল থানার আইসি সরাসরি সুইসাইড কেস বলে দেগে দিয়েছেন। খবরটা সংবাদপত্রে খুব ছোট্ট করে ছাপা হয়েছে। ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াও সেরকম কোনও গুরুত্ব দেয়নি।

কিন্তু খবরটা পড়েই নড়েচড়ে বসলেন আইসি দেব। বিকাশ আর উত্তম সাহা ঢুকতেই খবরের কাগজটা দেখিয়ে বললেন, আমার কথা কেমন মিলে গেল দেখলে? এখনও পাবলিক, মিডিয়া সেভাবে বুঝে উঠতে পারেনি। তবে সেটা হতে আর বেশি বাকি নেই। ওরা খেপলে পুলিশের ঘুম মাথায় উঠবে, তুমি মিলিয়ে নিও।

বিকাশ গম্ভীর মুখে বলল, লোকাল থানার আইসি ব্যাপারটা এত লাইটলি নিলেন কেন, বুঝে উঠতে পারছি না। উনি কি কিছুই বুঝতে পারলেন না?

কী জানি। কিন্তু আমার মনে হয় উনি ভুল করছেন। এখনই এই কেস নিয়ে সিরিয়াসলি না ভাবলে, পরে পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে ল্যাজে গোবরে হতে হবে। আমাদের থানাতেই যেহেতু প্রথম কেস, আমাদেরকেই বেশি ইনিশিয়েটিভ নিতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে এক্সপ্ল্যানেশন দিতে কোনও অসুবিধায় পড়তে না হয়।

আপনার কথা একদম সত্যি স্যার। আপনি লিড করুন, আমরা তদন্তে কোনও ফাঁক রাখব না।

গুড। সাহাবাবু আর মিত্রকে ডাকো। সবাই মিলে একটু ডিসকাস করে নিই। একটা গাইডলাইন ঠিক করে নেওয়া দরকার।

তিনজন অফিসারকে নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসলেন আইসি দেব। পদ্মপুকুরের ঘটনা উল্লেখ করে প্রথমেই বললেন, এটাকে আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলতে রাজি নই আমি। একই পদ্ধতিতে দু-দুটো খুন, আর যে হবে না গ্যারান্টি দিয়ে বলা যাবে না। তাই নতুন করে কিছু ঘটার আগেই আমাদের তদন্ত শেষ করতে হবে।

উত্তম সাহা বললেন, এ বিষয়ে আপনি কিছু ভেবেছেন স্যার?

হ্যাঁ। কীভাবে এগোব, কাদের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে, এসব নিয়ে মনে মনে একটা প্ল্যান করেছি। আমার মনে হয় দুটো খুনের মধ্যে অবশ্যই একটা লিঙ্ক আছে। পদ্মপুকুরের ভিকটিম এরকম কোনও ফোন পেয়েছিল কিনা, তিনিও কল রেকর্ড করেছিলেন কিনা এইসব তথ্যগুলো আমাদের জানা দরকার।

মিত্র বললেন, চান্স কম। হঠাৎ করে কোনও আজেবাজে কল এলে কজন আর সেটা রেকর্ড করার কথা ভাবে?

আইসি দেব বললেন, শান্তার উপস্থিত বুদ্ধির জন্য আমরা এটা পেয়েছি। আমার মনে হয় ওরা এরকম কিছু পায়নি। পেলে ওখানকার আইসি হুট করে সুইসাইড বলে দেগে দিতেন না। তোমার কী মত বিকাশ?

আমি আপনার সাথে একমত স্যার। নিশ্চয়ই ওরা ভিকটিমের ফোন কল ঘাঁটাঘাঁটি করে ফেলেছে এতক্ষণে। ওরা কতদূর কী জানল আমাদের জানা দরকার। দুটো ঘটনার মধ্যে আদৌ কোনও লিঙ্ক আছে কিনা, থাকলেও কতটা আছে, তার একটা আভাস পাওয়া যাবে। তাছাড়া মোটিভ অফ ক্রাইম সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই, সেটাও জানা দরকার। সব মিলিয়ে ওই ঘটনাটাকেও একসাথে বিশ্লেষণ করা জরুরি বলেই আমার মনে হয়।

ক্রমশ…

 

মৌন-মুখর

দিল্লি এয়ারপোর্ট-এর অ্যারাইভাল টার্মিনাল দিয়ে বেরোতেই, সদ্য বিবাহিত বর-কনেকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে এল শ্বশুরবাড়ির সকলে। ফুল দিয়ে সাজানো একটা ইনোভা অপেক্ষা করছিল ওদেরই জন্য। আর বরণের জিনিসপত্র নিয়ে গাড়ির সামনেই হাসিমুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন সুজাতা।

তাঁর বহুদিনের স্বপ্ন আজ বাস্তবায়িত হল। একমাত্র ছেলে অভিরূপের বিয়ে হবে, এই স্বপ্ন সেই কতবছর ধরে দেখে আসছিলেন সুজাতা। স্বামী বীরেন্দ্র দেখতে পেলেন না এটাই যা আক্ষেপের। অভি অবশ্য তার পছন্দের পাত্রীকেই বিয়ে করেছে। কর্মসূত্রে কলকাতায় কিছুদিন ছিল অভি। সেই কোম্পানিতেই কর্মরতা বৃষ্টির সঙ্গে প্রেম হয়ে যায় অভির। বছর দুয়েক আগে দিল্লিতে নিজের শহরে ফিরে এলেও, বৃষ্টি আর অভি, লং ডিস্ট্যান্স সম্পর্কটা সফল ভাবে রাখতে পেরেছিল।

কিন্তু শেষ অবধি সুজাতা একদিন ছেলেকে, ছদ্ম রাগ দেখিয়ে বলেন কী বাপু তোদের এযুগের প্রেম বুঝি না। বিয়ে করে বৃষ্টিকে এ বাড়িতে নিয়ে চলে আসবি তা নয়, ফোনে আর ই-মেলে চলছে তোদের সম্পর্ক! মায়ের কাছে খোঁচা খেয়ে হয়তো শেষ অবধি একটা সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় দুজনে।

বৃষ্টিকে আপাত ভাবে দেখলে একটু কেরিয়ারিস্ট-ই মনে হতে পারে। হবেই বা না কেন। তার মা মানসী রায় ভৌত বিজ্ঞানের শিক্ষিকা, বাবা প্রতুল রায় একজন অধ্যাপক। বাড়িতে বরাবরই পড়াশোনার আবহাওয়া। সফটওয্যার কোম্পনিতে বৃষ্টি জয়ে করার পর, তার দ্রুত উন্নতিই হয়েছে। অভির সঙ্গে প্রেমটা তার কাছে সত্যিই কেরিয়ারের মতো প্রায়োরিটি ছিল না।

বৃষ্টি একটু রিজার্ভ। আসলে বাড়িতে মা তাঁর কাজ নিয়ে ব্যস্ত থেকেছেন। বাবাও অ্যাকাডেমিক ক্ষেত্রটাতে নানা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। নানা বড়ো পদে তাঁর অধিষ্ঠান। ফলে সংসারে তেমন সময় দিতে পারেননি। বৃষ্টির সে অর্থে বন্ধুবান্ধবও নেই। যেটুকু যা আছে ওই সোশ্যাল সাইট-এ আর কর্মক্ষেত্রে।

অভি তুলনায় খুব প্রাণখোলা। হইচই করতে ভালোবাসে। আপাত গুরুগম্ভীর চেহারার হবু শ্বশুর-শাশুড়িকে কোন মন্ত্রবলে এমন পকেটস্থ করেছিল অভি, বৃষ্টি আজও তা জানে না। তবে এর সুফল মিলেছে দ্রুত। বৃষ্টির সঙ্গে অভির বিয়ে প্রস্তাবে আপত্তি করেননি মানসী ও প্রতুল। শুধু একটিবার মেয়েে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, কলকাতার কালচার ছেড়ে দিল্লিওয়ালাদের সঙ্গে অ্যাডজার্স্ট করতে পারবি তো মা? তোর শাশুড়ি কিন্তু একটু সেকেলে। বাড়ির বাইরে পা রাখেন না। পুজোপাট, ব্রত উপবাস নিয়ে কেটে যায়। পারবি তো মানাতে?

মায়ের এই সাবধান বাণী নিয়ে একেবারেই যে ভাবেনি বৃষ্টি, তা নয়। কিন্তু অভির সঙ্গে সম্পর্কটা অনেকদূর গড়িয়ে গেছে। অভিকে স্বামী হিসাবে বরণ করলে, তার পরিবারকেও মেনে নিতে হবে। সুতরাং বৃষ্টি মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল। এই মুহূর্তে যে-মহিলা বধূবরণ করে তাকে ঘরে তুলছেন, এক নজরে তাঁকে খারাপ লাগেনি বৃষ্টির। সামান্য ভারিক্কি চেহারা, ফর্সা সুন্দর মুখশ্রী, দেখে বোঝা যায় কমবয়সে বেশ সুন্দরী ছিলেন। নিজের প্রতি তেমন মনযোগ দেননি বলে বয়সের চাইতে বেশি বয়স্ক দেখায়, কিংবা অকাল বৈধব্য তাঁকে বুড়িয়ে দিয়েছে।

চিত্তরঞ্জন পার্কের বাড়িতে পেঁছে আত্মীয়স্বজনরা নানা রকম আচার অনুষ্ঠান শুরু করল। খুব ক্লান্ত লাগছিল বৃষ্টির। একে বিয়ে ধকল, তারপর ভোরের ফ্লাইট, চোখ টেনে আসছিল। অভি ব্যাপারটা বুঝে আচার অনুষ্ঠান থামাতে বলার আগেই, সুজাতাদেবীই হই হই করে উঠলেন আত্মীয়দের উদ্দেশ্যে। আরে থামো তোমরা এবার। মেযোকে একটু বিশ্রাম দেবে না, নাকি? জার্নি করে এসেছে অত দূর থেকে।

বৃষ্টি রীতিমতো অবাক হল। সুজাতাদেবী সম্পর্কে তার ধারণা ছিল মহিলা একদম ওল্ড ফ্যাশনড। কিন্তু তিনিই যে ওর ত্রাণে এভাবে এগিয়ে আসবেন, এটা তার কাছে বেশ চমকপ্রদ।

দিন যায়, বৃষ্টি আর সুজাতা আজ গল্প করতে বসেছে। আত্মীয়স্বজনরা এক এক করে বিদায় নিয়েছে, এক সপ্তাহ ধরে বিয়ে হই হুল্লোড় সেরে। তাই আজ ফুরসত মিলেছে দুজনে মুখোমুখি বসার। অফিস থেকে কটা দিন ছুটি নিয়েছে বৃষ্টি আর অভি। তাদের প্ল্যান আছে হনিমুন সেরে আবার কাজে যোগ দেবে। বৃষ্টি কলকাতার অফিস থেকে ট্রান্সফার নিয়েছে গুরগাঁওতে। ফলে অভি আর বৃষ্টি এখন সহকর্মী।

কাজে যোগ দেওয়ার আগে হনিমুন করে মনটা ফ্রেশ করে নিতে হবে। অভি বলেছিল। সেইমতো তারা পরদিনই চলে যাচ্ছে মানালি। আজ ডাইনিং টেবল-এ টুকিটাকি সবজি কাটায় সাহায্য করছিল বৃষ্টি, তার শাশুড়িকে। খুবই চুপচাপ মানুষ। কথায় কথায় বৃষ্টি বোঝে, মানুষটা একটু নিঃসঙ্গও। সুজাতা বলেন, অভি সারাদিনের জন্য বেরিয়ে যায়। ফেরে সেই রাতে। সারাদিন আমি একাই থাকি। যাক, এখন তুই এসে গেছিস, মনের কথা বলার একটা লোক পেলাম। তুই কড়াইশুঁটিগুলো ছাড়া, আমি পুজোটা সেরে নিই। সকাল থেকে উপোস করে আছি।

বৃষ্টি আন্তরিকতার সঙ্গে বলে, কেন মা, উপোস করে পুজো করলে কি ঠাকুর বেশি খুশি হবেন? এবার থেকে এত উপোস কোরো না। অসুস্থ হয়ে পড়লে তো পুজোটাই করতে পারবে না। তাতে তো ঠাকুর আরও অসন্তুষ্ট হবেন, তাই না? সুজাতা হাসেন বৃষ্টির কথায়। বলেন, ওরে মেয়ে তুই ভালো যুক্তি দিয়েছিস তো! বেশ শুনব পরের বার থেকে তোর কথা। বৃষ্টির মাথায় আঙুল দিয়ে চুলে বিলি কেটে দেন সুজাতা। খুব অদ্ভুত একটা অনুভতি হয় বৃষ্টির। সত্যিই মা   দিন এ ভাবে তাকে আদর করেনি। সময়ই পেত না মা। আজ বৃষ্টির ভেতর থেকে যেন একটা স্নেহ-কাঙাল সত্তা বেরিয়ে আসতে চাইছে। কেন যেন খুব ভালোবেসে ফেলল সে সুজাতাদেবীকে।

মাসদুয়েক কেটে গেছে। বৃষ্টি আর অভি এখন একসঙ্গেই অফিস বেরোয়। সকালের দিকটায় তাই দম ফেলার ফুরসত পান না সুজাতা। ওদের ব্রেকফাস্ট বানিয়ে টিফিন প্যাক করে দেন। বৃষ্টি বার দুয়েক প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে বলেছিল, মা লাঞ্চটা বাইরেই করে নেব, তোমায় কষ্ট করতে হবে না। তা সে কথা কানেই নেন না সুজাতা। নিজে হাতে রান্না করে খাওয়ানোর মধ্যেই তাঁর তপ্তি।

আজ সান ডে। বৃষ্টি সবাইকে সারপ্রাইজ দেবে বলে আজ সুজাতাদেবীরও আগে ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে ঢুকেছে। আলুর পরোটা বানাবে বলে। সুজাতাদেবী আলুথালু শাড়ি সামলে রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে অবাক। আরে তুই কেন এলি, একটা দিন ছুটি পাস। আমি করে দিচ্ছি। তুই যা বিশ্রাম নে। বৃষ্টি দুহাতে সুজাতাকে হাতে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে বলে, চুপচাপ এখানে বসে থাকবে। আজ তোমার সান ডে। তুমি রেস্ট নেবে। এবেলার পুরো দাযিত্ব আমার। রাতে ডিনার বাইরে। সুজাতার কোনও ওজর আপত্তি শুনল না বৃষ্টি।

অভি শাশুড়ি-বউয়ে এই রাগ-অনুরাগের খেলা দেখে বেশ মজা পায়। সে বোঝে বৃষ্টির সঙ্গে সুজাতার একটা আলাদা ইকোয়েন কাজ করে। তাই মিটিমিটি হাসে, কিছু বলে না। ব্রেকফাস্টের পর বৃষ্টি চুপি চুপি সুজাতার কানের কাছে মুখ এনে বলে, আজ বিকেলে একটা জায়গায় তোমায় নিয়ে যাব। কাউকে কিছু বলবে না আগে থেকে। এমনকী তোমার ছেলেকেও নয়। সুজাতা বেশ অবাক। উত্তেজিত হয়ে বলতে যান, কোথায় নিয়ে যাবি রে বৃষ্টি! বৃষ্টি সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে, চুপ জানতে পারবে সময় মতো।

একটা উবর বুক করতে করতে বৃষ্টি অভিকে বলে, আমি মা-কে নিয়ে একটু বেরোচ্ছি। তুমি রাত নটা নাগাদ চাইনিজ টেম্পল রেস্টুরেন্ট-এ একটা টেবিল বুক করে রাখো। ওখানেই তোমার সঙ্গে দেখা হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে অভি কী, কেন এসব !9  করে না। সে বৃষ্টিকে ভালো মতোই চেনে। জানে  করেও লাভ হবে না। বৃষ্টির প্ল্যান আগে থেকে সে কিছুতেই বলে না। তাই সে সংক্ষেপে, যথা আজ্ঞা ম্যাডাম বলে নেটফ্লিক্স-এর নতুন সিরিজ-এ মনোনিবেশ করে।

উবরটা এসে একটা বিউটি পার্লারের সামনে দাঁড়ায়। সুজাতাকে সঙ্গে নিয়ে বৃষ্টি দরজা ঠেলে ঢুকে পড়ে পার্লারে। তারপর একজন বিউটিশিয়ানকে ইশারায় ডেকে, তাকে কী যেন বুঝিয়ে দেয়। সুজাতার অবাক হওয়ার আরও কিছুটা বাকি ছিল। বিউটিশিয়ান মেয়েটি সুজাতাকে বসিয়ে দেয় একটা ঘোরানো চেয়ারে। সুজাতা বৃষ্টিকে বলার চেষ্টা করেন, আরে কী হচ্ছে এসব! বৃষ্টি ঠোঁটে আঙুল রেখে কপট রাগের ভঙ্গি করে। তারপর হাসি মুখে বলে, এত সুন্দরী একজন মহিলা, এভাবে এলোঝেলো কেন থাকবে। চুপটি করে বসো। ওরা যা যা করছে করতে দাও।

সুজাতা আড়ষ্ট হয়ে বসলেও, আস্তে আস্তে শরীরে আরাম নেমে আসে। দুটি মেয়ে তাঁর মাথা হেলিয়ে বেসিনে শ্যাম্পু করে দিচ্ছে চুল। চোখ বুজে আসে সুজাতার। মেয়ে দুটি বলে, আন্টি আপকে বাল কিতনে সুন্দর হ্যায়, আপ স্পা করেঙ্গে তো অউর ভি সুন্দর হো জাযো। সুজাতা একটু হেসে ওদের হাতে নিজেকে সমর্পণ করেন।

চোখ বুজে চেয়ারে গা এলিয়ে কত কথা মনে পড়ে সুজাতার। তাঁর সেই বিয়ে দিনটা, কনের সাজে সাজা। তারপর বর্ধমানের মেয়ে দিল্লির প্রবাসী বাঙালি পরিবারে বউ হয়ে আসার কথা। তখন শরিকি বাড়িতে যৌথ পরিবারে থাকতেন সুজাতা। ভাসুর, দেওর, নিয়ে বিরাট পরিবার। সময়ই পেতেন না নিজের যত্ন নেওয়ার। স্বামী মারা যাওয়ার পর ছেলেকে বড়ো করতে করতে আর সুযোগই পাননি নিজেকে সাজানোর। আজ ছেলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সিআর পার্কের এই ছিমছাম ফ্ল্যাটে অঢেল সময় সুজাতার হাতে কিন্তু কী আশ্চর‌্য সাজার ইচ্ছেটাই যেন মরে গেছে।

চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল বৃষ্টির ডাকে। দ্যাখো তো মা, তোমায় কত সুন্দর দেখাচ্ছে। ইতিমধ্যেই শ্যাম্পু করা চুলে সুন্দর করে ইউ কেটে দিয়েছে পার্লার প্রসাধিকারা। ফেসিয়ালের প্রলেপ, আইব্রো, ওয়াক্সিং, সব নিখুঁত। সুজাতা নিজেকে পার্লারের আয়নায় দেখে হতবাক। এই ঘরের ছটা আয়নায় যার মুখ প্রতিবিম্বিত হচ্ছে, সত্যিই তিনি! বয়সটা যেন হঠাৎই কমে গেছে সুজাতার। কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না। কথা হাতড়াচ্ছেন।

বৃষ্টি কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়েছে, মুগ্ধতা তার চোখে স্পষ্ট। বলে, এত সুন্দর তুমি, কেউ ভাবতে পারত। কী চেহারা করে রেখেছিলে নিজের! আমি কিন্তু ওজর শুনব না। প্রতি মাসে একবার করে এখানে আসবে তুমি। আমি কথা বলে রাখব। বৃষ্টির জোরের কাছে হার মেনেছেন সুজাতা। এই পাগলি মেয়ের যে কী করবে, আগে থেকে কিছু বোঝা যায় না।

পার্লার থেকে সুজাতা যখন বেরোলেন, অনেকেই যে তাঁকে দেখছে, তা টের পেতে তাঁর অসুবিধে হল না। একটা হালকা নীল শাড়ি পরে বেরিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। বিধবা হওয়ার পর শুধু সাদাই পরতেন। কিন্তু অভি ওই বেশে মাকে দেখলেই কান্না জুড়ে দিত। তাই মনের সংস্কার কাটিয়ে খুব হালকা রঙের শাড়ি পরা শুরু করেছিলেন সুজাতা। আপাত ভাবে দেখলে তাঁকে সেকেলে ভাবতে পারে অন্যরা। কিন্তু সুজাতা নিজে জানেন, ভেতর থেকে তিনি অনেকের থেকে বেশি সংস্কারমুক্ত। সমাজের চাপে পড়ে কিছু নিয়ম তাঁকে মানতে হয়েছে ঠিকই কিন্তু সবেতে যে তাঁর সায় ছিল, তেমন নয়।

পার্লারে যে প্রায় তিন ঘন্টা অতিক্রান্ত হয়েছে তা এতক্ষণে খেয়াল হল সুজাতার। মণিবন্ধে বাঁধা ঘড়িটা দেখে তিনি বৃষ্টিকে তাড়া দিলেন, ওরে ভয়ংকর দেরি হয়ে গেল যে!

উফ্ কীসের দেরি মা। রাতে তো আর তোমায় রান্না করতে হচ্ছে না। আমরা বাইরে ডিনার করব বললাম না?

বৃষ্টি সুজাতাকে নিয়ে চাইনিজ টেম্পল রেস্তোরাঁয় ঢুকল। অভি ইতমধ্যেই পেঁছে অপেক্ষা করছে নির্দিষ্ট টেবিলে। এবার আরও একবার অবাক হওয়ার পালা সুজাতার, অভি ওদের দেখেই উঠে দাঁড়াল। এসো মা, এসব বৃষ্টির প্ল্যান, আমি করলে হইচই বাধাতে, বকতে। নাও এবার সামলাও তোমার বউমা-কে, বলে হাসতে থাকে অভি।

সুজাতা টেবিলের দিকে তাকিয়ে দেখেন একটা ঢাউস কেক-এ লেখা হ্যাপি বার্থডে মা। মোমবাতি আর বেলুন দিয়ে পার্সোনালাইজ করে এই টেবিলটা সাজানো। সুজাতা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে দেখেন সে মিটিমিটি হাসছে। সুজাতার নিজের জন্মদিন মনেই থাকে না। এভাবে পালন করার তো প্রশ্নই নেই। অভি নির্ঘাৎ তারিখটা বলেছে বৃষ্টিকে। পরম মমতায় বৃষ্টিকে কাছে টেনে নেন সুজাতা। দ্যাখো তো পাগলির কাণ্ড! ইশ এই বয়েছে আমার জন্মদিন! লজ্জায় লাল হয়ে যান সুজাতা।

অভি এবার ভালো করে লক্ষ্য করে মা-কে, মা তুমি কী করেছ বলো তো। দারুণ গ্ল্যামারাস দেখাচ্ছে তোমাকে!

সারপ্রাইজ। বুঝলে অভিবাবু। মা-কে পার্লারে নিয়ে গেছিলাম আজ, হাসতে হাসতে বলে বৃষ্টি। গল্পে, আড্ডায় জমিয়ে খাওয়াদাওয়া করে তিনজনে। বৃষ্টি আসার পর যেন জীবনটাই বদলে গেছে সুজাতার। আর পাঁচ জায়গায় তিনি শোনেন শাশুড়ি-বউয়ে নাকি বনিবনা হয় না। বাড়িতে ঝগড়া, অশান্তিতে কাক চিল বসতে পারে না। কিন্তু তাঁর বেলায় ঘটেছে এর ঠিক উলটো। এই মেয়ে এতই আপন করে নিয়েছে তাঁকে, যেন নিজের মা।

সেদিন গা ধুয়ে টিভি-টা চালিয়েছেন। ছেলে-বউ এখনও অফিস থেকে ফেরেনি। ফোনটা বেজে উঠল সুজাতার। তাঁর ওই হাত দিয়ে সুইচ টেপা আদ্যিকালের ফোনটা ধরতে ধরতেই কেটে গেল। আবার নম্বর খুঁজে কল ব্যাক করা এক হয়রানি। ছেলে অনেকবার বলা সত্ত্বেও ফোন বদলাননি সুজাতা। তাঁর বাড়িতে এখনও একটা ল্যান্ড লাইন আছে। আত্মীয়স্বজনরা তাতেই ফোন করে। কিন্তু এই নম্বরটা কার? ফোনের কী টিপে হাতড়াতে গিয়ে আবার ফোন এল একই নম্বর থেকে। এবার আর দেরি হল না ধরতে। সুজাতা হ্যালো বলতেই ওপার থেকে ভেসে এল মানসীদেবীর গলা। খোঁজখবর নেওয়ার জন্য ফোন করেছেন। কুশল বিনিময় হল দুই বেয়ানে। তারপর মানসী একটু অভিমানের সুরেই যেন বললেন, কী জাদু করেছেন দিদি। মেযো তো বাপের বাড়ি আসার নামই করছে না, বলে হাসতে থাকলেন মানসী। হাসির আড়ালে অনুযোগটা কিন্তু চিনতে ভুল হল না সুজাতার। খুবই বিনীত ভাবে বললেন, খুব ভালো মেয়েটি আপনার দিদি। কী যে আপন করে নিয়েছে আমায়। তবে ওরা দুটিতে বড্ড ব্যস্ত। একটু সময় পেলে নিশ্চয়ই যাবে আপনার কাছে। আজ এলেই বলছি।

এরপর আরও কিছুক্ষণ চলল গল্পগাছা। তারপর আবার টিভি দেখায় মন দিলেন সুজাতা। কলিংবেল বাজল। ঝড়ের বেগে ঢুকল বৃষ্টি। মা চটপট তৈরি হও। বেরোব। শপিংয়ে যাব। এরকম প্রায়ই করে বৃষ্টি। কখনও তাড়াতাড়ি ছুটি নিয়ে বাড়ি এসে শপিংয়ে নিয়ে যায় সুজাতাকে। কখনও আবার ফিল্ম দেখতে যায় দুজনে। এখানে বাংলা ছবি এলেই মাল্টিপ্লেক্স-এ টিকিট কাটে বৃষ্টি। অনলাইন-এ ওরা খুব চটপটে। ব্যাংক থেকে সিনেমার টিকিট সবই ফোন-এ করে। সুজাতা এসব ব্যাপারে ভীষণ আনাড়ি। তাই সভয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেন ছেলে-বউয়ে কাণ্ড। ছেলে যতবারই বলেছে নতুন ফোন কিনে দিই, হাঁ হাঁ করে ওঠেন সুজাতা। বলেন, খেপেছিস। এই বয়সে কী করতে কী করে ফেলব। অত দামি ফোন। পাগল! আমার ওই সুইচ টেপা ফোনই ভালো।

কিন্তু এই আপত্তিও ধোপে টিকল না। আজ শপিংয়ের প্ল্যানটা বৃষ্টি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে করেছে। মল-এর একটা মোবাইল স্টোর-এ জোর করে ঢোকাল সুজাতাকে। তারপর বেশ দামি একটা অ্যান্ড্রয়ে ফোন একরকম জোর জবরদস্তি করে কিনে দিল বৃষ্টি। এটা তোমায় নিতেই হবে। কোনও কথা শুনব না, জোর করে বৃষ্টি। সুজাতা কী যে করবেন এই মেয়েকে নিয়ে ভেবেই পান না।

ফোন বাড়িতে আসার পরও সুজাতা যত্ন করে সেটাকে তুলে রেখে  দেন, কাজ চালান সেই পুরোনো ফোনটাতেই। বৃষ্টি ব্যাপারটা খেয়াল করে মৃদু ধমক লাগায় শাশুড়িকে, ব্যাপারটা কী! ফোন-টা তোমায় ব্যবহার করার জন্যই তো কিনে দিলাম নাকি?

ও আমার দ্বারায় হবে না। বলার চেষ্টা করেন সুজাতা।

আলবাত হবে। নিয়ে এসো ফোন। বৃষ্টি নাছোড়। এরপর সারা দুপুর ধরে চলল ফোন ব্যবহার করার টুকিটাকি শেখানো। সুজাতা ভুল করেন, হাসেন, বকুনি খান কিন্তু মনের ভেতর একটা ভারি ভালো লাগা কাজ করে। এই বয়সে পেঁছেও তিনি এদের বোঝা নন। ওনার প্রতি এদের অকৃত্তিম ভালোবাসা ভরিয়ে রাখে সুজাতাকে। বিয়ের পর ছেলে পর হয়ে যাবে, এরকম অমূলক ভয় তাঁর জীবনে কাজ করেনি। স্বামী হারিয়েছেন অল্প বয়সে ঠিকই, অনেক দুঃখ যন্ত্রণা পেরিয়েছেন এটাও ঠিক কিন্তু এখন তাঁর আর কোনও দুঃখ নেই, নিঃসঙ্গতা নেই। বৃষ্টি তাঁর জীবনের সব একাকীত্ব দূর করে দিয়েছে।

কিন্তু নিরবিচ্ছিন্ন দুঃখ যেমন মানুষের জীবনে থাকে না, সুখেরও সেটাই ধর্ম। একদিন বিকেলে সুজাতা ব্যস্ত স্যান্ডউইচ বানাতে, ছেলে-বউমা অফিস থেকে এসে যাবে। কলিংবেল বাজল। বৃষ্টি একাই ফিরেছে। সুজাতা বললেন, কইরে সে কোথায়?

বৃষ্টি ব্যাগটা সোফার উপর ছুড়ে দিয়ে গা এলিয়ে বসল। আসবে আসবে। আমি আগে বেরিয়েছি। আচ্ছা মা, তোমাকে একটা সিরিয়াস কথা বলার আছে, বলে বৃষ্টি।

কী কথা? বল শুনি। পাশে এসে বসেন সুজাতা।

আমায় ছমাসের জন্য চেন্নাই ব্রাঞ্চে পাঠানো হচ্ছে একটা বিশেষ কাজের দাযিত্ব দিয়ে পরশু সকালেই ফ্লাইট।

কথাটা শুনে সুজাতার মুখটা ম্লান হয়ে গেল। বৃষ্টিকে ছাড়া বাড়িটাই যেন আর বাড়ি মনে হবে না। মন খারাপ করা গলায় সুজাতা বললেন, তোকে ছাড়া আর কাউকে পেল না ওরা? অভিটাই বা কী! সে কী করে অফিসে? বলতে পারল না, আমি সদ্য বিয়ে করেছি, আমার বউ যাবে না?

বৃষ্টি হেসে ফেলে শাশুড়ির কথায়। মা এটা খুব প্রেস্টিজিয়াস ব্যাপার। আমার প্রমোশন হয়েছে। সেই জন্যই কোম্পানি আমায় দাযিত্ব দিয়ে পাঠাচ্ছে। এবার সুজাতা একটু ধাতস্থ হন। বলেন, কিন্তু তুই ছাড়া আমি তো খুব একলা হয়ে যাব রে।

কে বলল একলা হয়ে যাবে। তোমার ফোন আছে না!

সুজাতার বৃষ্টির কথাটা মোটেই গ্রহণযোগ্য মনে হল না। একজন মানুষের পরিপূরক কি কখনও একটা মোবাইল ফোন হতে পারে?

বৃষ্টি উৎসাহ নিয়ে বলে, মা এখন সোশ্যাল সাইট-এ। আজই তোমায় একটা অ্যাপ নামিয়ে দেব ফোন-এ। এর নাম ফেসবুক। দেখবে তোমার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদেরও খুঁজে পাবে সেখানে। আরে সাত সমুদ্দুর তেরো নদী পারের লোকেদেরও ওখানে চাক্ষুস দেখতে পাবে। তারপর করো না ভিডিযো চ্যাট, গল্প, আড্ডা। একটুও একা লাগবে না আর তোমার!

সুজাতা চুপ করে রইলেন। সত্যি বলতে কী, তাঁর মনটা খুবই খারাপ হয়ে গেছে বৃষ্টির চেন্নাই যাওয়ার খবরে।

মা-কে রাজি করাতে বৃষ্টিরও খুব খারাপ লেগেছিল। চেন্নাইয়ে অ্যাপার্টমেন্ট-এ সে এখন একা। ভীষণ মিস করছে সুজাতাকে। হ্যাঁ অভিকে মিস করাটা আছে, কিন্তু সুজাতা তার মনে একটা অন্য জায়গা জুড়ে আছেন। এমন স্নেহ সে ছোটো থেকে পায়নি। এক সপ্তাহ হল এসেছে। কাজে যোগ দিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। সারা সপ্তাহ ব্যস্ততায় এই একলা লাগাটা ফিল করেনি বৃষ্টি। কিন্তু আজ প্রথম উইক এন্ড-এ বেশ ফাঁকা ফাঁক লাগছে। অভির সঙ্গে কথা হয়েছে একটু আগে। মায়ের সঙ্গেও কিন্তু তাতে মনখারাপটা আরও বেড়ে গেছে।

মোবইলটা একাকিত্বের শেষ ভরসা। সেটা নিয়ে বিছানায় গা এলাল বৃষ্টি। খানিক ইনস্টাগ্রাম ঘাঁটাখাঁটি করল। তারপর পাশে রেখে দিল ফোনটা। একটু চোখ বুজে শুয়ে থাকবে ঠিক করল। হঠাৎই একটা নোটিফিকেশন আসার শব্দ হল। আলস্যে ভর করে ফোনটা আবারও হাতে তুলে নিল বৃষ্টি। ফেসবুক-এর নোটিফিকেশন। একটা ফ্রেন্ড রিকোযে্ট এসেছে। অবহেলায় ক্লিক করে বৃষ্টি। সুজাতা সেন সেন্ড ইউ আ ফ্রেন্ড রিকোযে্ট।

বৃষ্টি উঠে বসে বিছানায়। মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে বৃষ্টির। অ্যাকসেপ্ট বাটনটা প্রেস করে। সুজাতার একটা খুব সুন্দর ছবি রয়েছে প্রোফাইলে। একটা ছোট্ট সাফল্যের আনন্দে মনটা ভরে ওঠে বৃষ্টির। এই প্রথম যেন একটা অন্য জগতের সঙ্গে যোগাযোগ হতে যাচ্ছে সুজাতার। আর তার সেতুটা তৈরি করেছে সে, অর্থাৎ বৃষ্টি। ভিডিযো কল বাটনটা টিপে দেয় বৃষ্টি। স্ক্রিনের ওপর ভেসে ওঠে সুজাতার হাস্যময় মুখ।

কেমন আছিস সোনা, বাড়িটা কী যে ফাঁকা লাগছে…। বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন সুজাতা। বৃষ্টিরও ভারি কান্না পাচ্ছিল, সে যথা সম্ভব সেটা চেপে নিয়ে বলে, কোথায় বাড়ি ছেড়ে গেছি আমি মা? এই আছি তোমার স্ক্রিনে।

অন্ধের দিনরাত্রি

এস্থার ঘড়ির দিকে তাকাল। বেশ কয়েক সেকেন্ড ধরে হয়তো অ্যালার্ম-টা বাজছে। এত তাড়াতাড়ি সকালে ওঠার অভ্যাস আগে একেবারেই ছিল না। সকাল আটটার আগে ওর ঘুমই ভাঙত না। কিন্তু এখানে এটা শোভনীয় নয়! এটা শ্বশুরবাড়ি। মাত্র দুদিন হল তার বউভাত হয়েছে। একেবারে নতুন বউ। কিন্তু এ-বাড়ির প্রতিটা সদস্য যেভাবে তাকে আপন করে নিয়েছে, এস্থারেরও মনে হচ্ছে, পরিবর্তে ওদের জন্যও তার কিছু হলেও করা উচিত।

প্রসূনের মুখেই শুনেছিল, প্রসূনের মা সুনন্দা খুব সকালে উঠে পড়েন সংসারের কাজ সামলাতে। সুনন্দার নাকি ওটাই বরাবরের অভ্যাস। এস্থার দেখল ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে, তার মানে শাশুড়ি এতক্ষণে উঠে পড়েছেন। বাড়ির সকলের সকাল সকাল চা পানের অভ্যাস। সেও তাড়াতাড়ি রাতের পোশাক বদলে চোখমুখে জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল।

এস্থার কল্পনাও করেনি প্রসূনের মা-বাবা এত সহজে প্রসূনের সঙ্গে তার বিয়েতে রাজি হয়ে যাবেন। কারণ সব সময় প্রসূনের মুখে শুনেছে, এদের পরিবার খুব গোঁড়া ব্রাহ্মণ আর সেখানে এস্থার খ্রিস্টান পরিবারের মেয়ে কিন্তু বউভাতের দিনই তার মনের এই শঙ্কা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। এক মুহূর্তের জন্যেও ওর মনে হয়নি, ও অন্য ধর্মের এবং ভিন্ন জাতের।

জাতি, ধর্ম কখনওই স্নেহ, ভালোবাসার মধ্যে দেয়াল হয়ে উঠতে পারে না, তার জ্বলন্ত উদাহরণ প্রসূনের পরিবার। এই সবই ভাবতে ভাবতে এস্থার রান্নাঘরে ঢুকতে যাবে, হুঁশ ফিরল প্রসূনের একমাত্র পিসির চিৎকারে, আরে আরে… বউমা এ কী অনর্থ করতে যাচ্ছো…।

প্রসূনের বিধবা পিসি সুমিত্রা বেশিরভাগ সময়ে নিজের শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে ভাইয়ের সংসারেই পড়ে থাকেন। সকাল সকাল উঠে পড়েন এবং হাতে জপের মালা নিয়ে একটা ধুনুচি জ্বালিয়ে আসন পেতে হলঘরটায় বসে থাকেন। ভান করেন জপ করছেন কিন্তু আসলে নজর রাখেন বাড়ির কে কী করছে। হলঘরটা থেকে সব ঘরগুলো পরিষ্কার দেখা যায়।

সুমিত্রার চিৎকারে, ভাইয়ের বউ সুনন্দা তাড়াতাড়ি বাথরুম থেকে দৌড়ে এসে ঘরে ঢোকে। এস্থারও হঠাৎ পিসিমার চিৎকারে স্থানুবৎ রান্নাঘরের দরজায় কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়, ভয়ে ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে।

সুনন্দা কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই পিসিমা এস্থারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এই বাড়িতে পা দিয়ে তুমি আমার ভাইয়ের নাক কাটিয়েছ সমাজে। জাত-কুল সব নষ্ট হয়েছে। এখন আবার স্নান না করেই রান্নাঘরে ঢুকে আমাদের ধর্মও নষ্ট করার ইচ্ছে রয়েছে? ধর্ম নিয়ম বলে কিছু আছে তো নাকি? অবশ্য তোমরা মোমবাতি জ্বালানো ছাড়া আর কী-ই বা জানো? কিন্তু সুনন্দা, তুমি… তোমার তো এই পরিবারে এতগুলো বছর কেটে গেল, এখনও কি তুমি নিয়মগুলো শিখতে পারলে না?

সুনন্দা উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। পিসিমা আবার বলেন, বউমাকে বুঝিয়ে দাও এ সংসারের কিছু রীতি নিয়ম আছে। এখানে কী কী করা যাবে আর কী না, সেটা ওকে পরিষ্কার করে বলে দাও। ছেলের মোহ-তে এতটাও অন্ধ হয়ে যেও না যে বাড়ির পুরোনো নিয়ম বদলে ফেলতে হবে।

এস্থার ভয়ে রান্নাঘরের দরজাতেই কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রথম দুদিন সুনন্দা ওকে কোনও কাজ করতে দেয়নি। আজ এস্থার নিজে থেকেই ঠিক করে নিয়েছিল শাশুড়িকে যতটা সম্ভব সাহায্য করবে। সে কিছুতেই বুঝতে পারছিল না কাল অবধি যে-পিসিমা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন, আজ এমন কী দোষ করে ফেলল যে তার উপর পিসিমা এতটা রেগে উঠলেন?

সুনন্দা ভয় মিশ্রিত গলায় উত্তর দিলেন, ও তো একেবারে নতুন দিদি, আস্তে আস্তে সব শিখে যাবে। আপনি চিন্তা করবেন না। আমি নিজে হাতে করে সব শিখিয়ে দেব। এবারের মতো ওকে ক্ষমা করে দিন।

হ্যাঁ শিখতে তো হবেই। তোমার ছেলে শুধু বেজাতের বউ-ই নয় অন্য ধর্মেরও মেয়ে বাড়ি নিয়ে এসেছে। সব শুনে সুনন্দা চুপচাপ ওখান থেকে চলে যেতে যেতে এস্থারকেও ইশারা করলেন সঙ্গে আসার জন্য।

ননদের চোখের আড়াল হতেই সুনন্দা, এস্থারকে কাছে টেনে নিয়ে স্নেহবশত ওর মাথায় হাত রাখলেন, দিদির কথায় কষ্ট পেও না। একটু কড়া কড়া কথা বলেন ঠিকই কিন্তু মনের দিক থেকে খুবই ভালো মানুষ। তুমি বরং স্নানটা সেরে নাও, ততক্ষণ আমি পুজোটা করে নিচ্ছি। তারপর দুজনে মিলে চা-জলখাবার করব, বলে সুনন্দা পুজোর ঘরের দিকে চলে গেলেন।

এত সকালবেলায় স্নানের কথা এস্থার ভাবতেও পারে না। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির সকলের মন জিততে গেলে সকালেই তাকে স্নান করতে হবে। প্রসূন আগেই বলে দিয়েছে, এস্থারকে নিয়ে কোনও অভিযোগ পরিবারের মুখ থেকে শুনতে সে রাজি নয়। কারণ এই ব্যাপারে ও স্ত্রীকে কোনও সাহায্যই করতে পারবে না।

 

সকালের ঘটনায় এস্থার কিছুটা নিরাশ হয়ে পড়েছিল। মনের মধ্যে কোথাও যেন বাড়ির সদস্যদের প্রতি একটা বিতৃষ্ণার মনোভাব উঁকি মারার চেষ্টা চালাচ্ছিল। এস্থার জোর করে মন থেকে নেতিবাচক মনোভাব সরিয়ে রেখে স্নানে চলে গেল। স্নান সেরে তৈরি হয়ে বাইরে এসে দেখল সকলে খাবার টেবিলে এসে বসেছে।

শাশুড়িমা চা-জলখাবার বানিয়ে টেবিলে পরিবেশন করে দিয়েছেন। সকলেই খাওয়ায় মনোনিবেশ করেছে। একা সুনন্দা সকলকে পরিবেশন করছেন। কেউ লুচি চাইছে তো কেউ তরকারি। কেউ আর এক কাপ চায়ের ফরমায়েশ করছে। এমনকী সুনন্দার একমাত্র মেয়ে শিল্পীও মা-কে দুপুরে কী খাবে তার ফরমায়েশ জানাচ্ছে। বেচারি সুনন্দা একা হিমশিম খাচ্ছেন!

এসব দেখে এস্থার ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড রেগে উঠলেও মুখে কিছু না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সকলের ওর উপর চোখ পড়লেও, কেউই মুখে কিছু বলল না। এমনকী প্রসূনও না! সুনন্দা রান্নাঘরে ছিলেন। সকলের ব্যবহারে এস্থার এতটাই মনে আঘাত পাচ্ছিল যে, ওর চোখে জল এসে গেল। সুনন্দা এস্থারকে দেখতে পেয়ে বললেন, এস্থার তুমিও চা খেয়ে নাও।

সুনন্দার কথা শেষ হতেই টেবিলে চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে প্রসূনের ঠাকুমা বলে ওঠেন, বউমা, এখন তুমি বাড়ির বউ শুধু নও, শাশুড়ি হয়ে গেছ। সুতরাং তোমার দাযিত্ব এখন যে, ভুল করেও এমন কিছু কোরো না যেটা নিয়ে পরে তোমাকে পস্তাতে হতে পারে। এটা তোমার বাপের বাড়ি নয়, যেখানে সবকিছু সবাই মেনে নেবে।

ঠিক আছে মা, মাথা নীচু করে সুনন্দা উত্তর করলেন।

প্রসূনের ঠাকুমা আবার বললেন, আর একটা কথা বউমা, কাল আমার গুরুদেবকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছি। যা যা ব্যবস্থা করার সব করে রেখো। পুজোর সমস্ত সামগ্রী গুরুদেব নিজেই নিয়ে আসবেন। পুরো বাড়ি শুদ্ধ করে দেবেন এবং একই সঙ্গে এই ছুঁড়িটার নাম বদলে ওকেও শুদ্ধ করে দেবেন।

মায়ের কথা শুনেই সুমিত্রা জপের মালা আঙুলে ঘোরাতে ঘোরাতে ঈশ্বরের আরাধনায় সামান্য বিরাম টেনে জিজ্ঞেস করলেন, নাম বদলে… কিন্তু কেন?

তোরও কি জ্ঞানগম্যি সব লোপ পেল সুমি? ছুঁড়িটার নাম মুখে এলেও জিভ মনে হয় অশুদ্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া গুরুদেবও বলেছেন, নাম বদলালেই প্রসূনের বিবাহিত জীবন সুখময় হতে পারবে, ভবিষ্যতে নয়তো বিচ্ছেদের সম্ভাবনা থাকবে। তাছাড়াও ছুঁড়িটার কারণে পরলোকে আমাদের পূর্বপুরুষদের উপর যে-কলঙ্ক লেগেছে, সেটাও গুরুদেব যজ্ঞ করে দূর করে দেবেন। ওনাদের ওখানে তাহলে আর নরকবাস করতে হবে না। একই সঙ্গে শিল্পীর বিয়ের জন্যও গ্রহশান্তির ব্যবস্থা করাবার কথা বলছিলেন গুরুদেব। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে থেমে যান সুনন্দার শাশুড়ি গায়ত্রীদেবী।

একটু দম নিয়ে এবার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বললেন, প্রদীপ, ব্যাংক খুললেই সকাল সকাল গিয়ে এক লক্ষ টাকা তুলে আনিস। পুজোর জন্য লাগবে।

টাকার অঙ্ক শুনেই প্রসূনের বাবা আঁতকে উঠে মায়ের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বললেন, মা এক লক্ষ টাকা, তাও শুধু পুজোর জন্য! একটু বেশি নয় কি?

ভাইয়ের কথা শুনে সুমিত্রা বলে উঠলেন, বেশি কোথায় রে ভাই। এটা খুবই কম! আমাদের পরিবারের উপর গুরুদেবের আশীর্বাদ রয়েছে। এছাড়া মা গুরুদেবের পরমভক্ত, তাই এতটা কমে এই পুজোপাঠ করতে রাজি হয়েছেন তিনি। তুই আর সুনন্দা তো ছেলের প্রতি অন্ধ হয়ে একটা বিধর্মী মেয়েকে বাড়ির বউ করে নিয়ে এসেছিস। তোদের জন্য আমাদের পরলোকগত পূর্বপুরুষদের সারাজীবন কষ্ট পেতে হবে।

প্রসূন এতক্ষণ চুপ করে থেকে বাবার মুখে চিন্তার আনাগোনা লক্ষ করছিল। ও বাবাকে নিশ্চিন্ত করতে বলল, বাবা, তোমাকে কোথাও যেতে হবে না, আমি আমার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে আনব।

এস্থার অবাক হয়ে যায় প্রসূনের ব্যবহারে। এতদিন ধরে ওর সঙ্গে মেলামেশা করছে, প্রসূনের এরকম অন্ধবিশ্বাস আগে কখনও সে দেখেনি। সেই সঙ্গে প্রসূনের পুরো পরিবার এতটা শিক্ষিত এবং আধুনিক হয়ে কীভাবে এই অন্ধবিশ্বাসের অন্ধকার গারদে স্বেচ্ছায় বন্দি থেকে গেছে, সেটা এস্থারের কিছুতেই বোধগম্য হল না। তার খালি মনে হচ্ছিল, এই ধরনের মানসিকতার মানুষগুলো কী করে প্রসূনের সঙ্গে তার বিয়েতে রাজি হয়েছিল।

 

আসলে এস্থারের এটা অজানাই ছিল যে, এই গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবার তাকে বউ হিসেবে এইজন্যই মেনে নিয়েছিল, যাতে তাদের একমাত্র রোজগেরে ছেলে বিয়ের পরে আলাদা না থাকতে শুরু করে দেয়। তাছাড়া এস্থারও খুব বড়ো চাকরি করে। ফলে ছেলে, বউমা দুজনকেই প্রযোজনে কাজে লাগবে। এছাড়াও বাড়ির একমাত্র মেয়েরও বিয়ে দিতে হবে সুতরাং সেখানেও টাকার দরকার পড়বে।

এইসব নানা কথা চিন্তা করতে করতে হঠাৎ এস্থারের খেয়াল হল যখন গুরুদেব আর গ্রহশান্তির কথা হচ্ছিল, তখন সে কথা শুনে শাশুড়িমা-র মুখটা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে পড়েছিল আর শিল্পীর মধ্যেও একটা অস্থিরতা এস্থার টের পেয়েছিল।

যে-মেয়ে হেসে হেসে এতক্ষণ সকলের সঙ্গে গল্প করছিল, গ্রহশান্তির কথা শুনেই তার মুখের এই ভাবান্তর, ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া এবং শিল্পীর পিছনে সুনন্দারও চলে যাওয়াটা এস্থারকে ভাবিয়ে তুলছিল। এস্থারও একটু বসে নিজের ঘরে যেতে গিয়ে শিল্পীর ঘরের সামনে পৌঁছোতেই, সুনন্দা আর শিল্পীর কথোপকথন তার কানে এল।

শিল্পী বলছে, মা আমি গ্রহশান্তির জন্য কিছুতেই পুজোয় বসব না, তাতে আমার বিয়ে হোক আর নাই হোক।

সুনন্দা মেয়েকে বোঝাবার চেষ্টা করতে করতে বলছেন, শিল্পী, ঠাকুমা আগে থেকেই তোমার গ্রহশান্তির জন্য গুরুদেবকে বলে রেখেছেন, সুতরাং তোমাকে তো পুজোতে বসতেই হবে। এই পুজোর ফলে তোমার ভালো বাড়িতে বিয়ে হবে। স্বামী, শ্বশুরবাড়ি সব ভালো হবে।

এস্থার আর অপেক্ষা করতে পারল না, দরজা ঠেলে ঘরের ভিতর ঢুকে এল। শাশুড়িকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল, মা কী হয়েছে, গ্রহশান্তির কথা শুনে শিল্পী এত কাঁদছে কেন? সুনন্দা উত্তর করলেন না। একই ভাবে মেয়েকে বোঝাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

হঠাৎই শিল্পী নিজের রাগ সামলাতে না পেরে সুনন্দার উপর চেঁচিয়ে উঠল, মা তুমি কেন বুঝতে পারছ না, পুজোর পর প্রতিবার আমি অজ্ঞান হয়ে যাই। আমার সারা গায়েহাতে প্রচণ্ড ব্যথা করে। মা, আমার ভীষণ ভয় লাগে। প্লিজ মা আমি পুজোতে বসব না।

শিল্পীর কথার থেকে বেশি ওর চোখে, মনের ভয়টা পরিষ্কার ফুটে উঠেছিল। শিল্পীর অবস্থা দেখে স্বাভাবিক কণ্ঠেই এস্থার শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করল, মা, শিল্পীর পুজোতে বসা কি খুব দরকার?

এস্থার, তোমার এ বাড়িতে মাত্র তিন-চারদিনই হয়েছে। সুতরাং প্রশ্ন করা ছেড়ে কালকে গুরুদেবের সেবায় এবং খাওয়াদাওয়ার আযোজনে আমাকে সাহায্য কোরো। আর প্রসূনকে বোলো এক লক্ষের একটু বেশি টাকা তুলতে। কারণ পুজোর খরচ ছাড়াও গুরুদেবকে দক্ষিণাও দিতে হবে, যাতে শিল্পীর জন্য ভালো সম্বন্ধ আসে।

শাশুড়ির কথা শুনে এস্থার বুঝে গিয়েছিল, সময় থাকতে তাকেই সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। নয়তো তার সংসার ভেঙে গুঁড়িয়ে যাবে, সেই সঙ্গে তার নিজের পরিচয়, অস্তিত্ব সবই ধুলোয় চাপা পড়ে যাবে।

এই পরিবারের লোকেদের চোখে অন্ধবিশ্বাসের এমন ঠুলি পরানো আছে, যা বার করে ফেলাটা খুব সহজ নয়। এস্থার এও জানে সে চেষ্টা করলেই সফল হবে এমন কোনও নিশ্চয়তাও নেই। তাই শুদ্ধিকরণ, নামকরণ, বিয়ের জন্য গ্রহশান্তির পুজো এসব যে কতটা বুজরুকি তা জেনেও, পরের দিন সকালে উঠে এস্থার, শাশুড়িকে সাহায্য করার জন্য তৈরি হয়ে নিল।

 

যথাসময়ে গুরুদেব পাঁচ শিষ্যকে সঙ্গে করে এস্থারের শ্বশুরবাড়িতে এসে উপস্থিত হলেন। এস্থার বাদে সকলে গুরুদেবের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিল। সবার হয়ে গেলে গায়ত্রীদেবী এস্থারকে ইশারা করলেন, গুরুদেবের পা ছুঁয়ে আশীর্বাদ নিতে।

আশীর্বাদ দেওয়ার নামে গুরুদেব যেভাবে এস্থারকে স্পর্শ করলেন, তাতে এস্থারের সারা শরীর শিউরে উঠল। গুরুদেবের শিষ্যদের দৃষ্টিও ক্ষুধার্ত পশুর মতো মনে হল এস্থারের। সেই মুহূর্তে গায়ত্রীদেবী পুজো শুরু করে দেওয়ার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করতেই এক রহস্যময় হাসি খেলে গেল গুরুদেবের মুখে। এস্থারকে দেখিয়ে বললেন, আমি প্রথমে এই মেয়েটিকে শুদ্ধ করে তবে পুজোয় বসব। পুজোর ঘরে আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ থাকবে না, বলে গুরুদেব সকলকে বাইরে যেতে বলে পুজোর ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন।

প্রায় দুঘন্টা পর গুরুদেব ও এস্থার ঘর থেকে বেরোতেই তৎক্ষণাৎ শিষ্যদের নিয়ে গুরুদেব পুজোয় বসে পড়লেন। পুজো করতে করতে বারবার এস্থারের সঙ্গে কাটানো সময়ের প্রতিটা মুহূর্ত গুরুদেবের মনে পড়তে লাগল। এরকম অবস্থার সম্মুখীন আগে কখনও তাঁকে হতে হয়নি।

এস্থার চালাকি করে আগে থেকেই মোবাইলে ভিডিও ক্যামেরা অন করে এমন ভাবে লুকিয়ে রেখেছিল যাতে ঘরের মধ্যে যা-যা ঘটবে সব মোবাইল ক্যামেরায় রেকর্ড হতে থাকবে। গুরুদেব কীভাবে পুজোর সামগ্রীর সঙ্গে আনা মাদক পুরিয়া এস্থারকে খেতে দিয়েছেন, এস্থার অজ্ঞান হয়ে পড়েছে ভেবে তার সঙ্গে অশালীন আচরণ করতে উদ্যত হয়েছেন, এস্থার কীভাবে ওঁর মুখ থেকে সব সত্য বার করে আনতে ওঁকে বাধ্য করেছে সব মোবাইলে রেকর্ড হয়েছে। গুরুদেব ভালো করেই জানেন, এই সত্যি প্রকাশ পেলে জেলের ঘানি টানা থেকে তাঁকে কেউ বাঁচাতে পারবে না।

তাড়াতাড়ি পুজো সেরে ওই বাড়ি থেকে কখন বেরোবেন ভাবতে ভাবতে অস্থির হয়ে পড়ছিলেন গুরুদেব। কারণ এস্থারের দেওয়া হুমকি তখনও কানে বাজছিল গুরুদেবের। সকলের অগোচরে বদ্ধ ঘরের আড়ালে এস্থার তাঁকে সাবধান করে দিয়েছিল, চুপচাপ শান্তিপূর্ণ ভাবে পুজো সেরে এ-বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, নয়তো পুলিশ ডেকে ভিডিও সমেত আপনাকে ধরিয়ে দেব। ভিডিও সামনে এলেই সকলে বুঝতে পারবে আপনার পুরোটাই সাজানো একটা চক্র যার প্রধান পাণ্ডা আপনি। পুজো, ধর্ম, গ্রহশান্তির নাম করে বাড়ির মেয়েদের সতীত্ব নষ্ট করা, তাদেরকে নিজের শিকার বানাবার সঙ্গে সঙ্গে পুরো পরিবারকে আর্থিক ভাবে লুঠে নেওয়া ইত্যাদি কারসাজি আমি সবার সামনে নিয়ে আসব যাতে জেলে যাওয়া থেকে আপনাকে কেউ আটকাতে না পারে।

পুজো শেষ করেই গুরুদেব শিষ্যদের নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরোবার জন্য হুড়োহুড়ি করতে গায়ত্রীদেবী একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এত তাড়াহুড়ো কেন করছেন গুরুদেব? এখনও তো এই ছুঁড়ির নামকরণ এবং আমার নাতনির গ্রহশান্তির পুজো করেননি।

গুরুদেব এস্থারের দিকে তাকিয়ে উত্তর করলেন, নামকরণের কোনও দরকার নেই। খুবই শুভলগ্নে ওদের বিয়ে হয়েছে। এই মেয়ে ঈশ্বরের আশীর্বাদ। এই বাড়িতে ওর পা পড়তেই বাড়ির সব বাধাবিঘ্ন দূর হয়ে গেছে। সমস্ত গ্রহও সুস্থানে বিচরণ করছে। সুতরাং গ্রহশান্তি করাবারও আর কোনও দরকার নেই। আর এই পুজোর জন্য আমি কোনও দক্ষিণাও গ্রহণ করব না। এই বলে গুরুদেব শিষ্যদের নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন।

মুহূর্তে এস্থার অনুভব করল বাড়ির সকলের দৃষ্টি তার উপরে। সকলেরই চোখের ভাষা একদম বদলে গেছে। হঠাৎ করেই ভালোবাসার ফল্গুধারা সকলের চোখ থেকে প্রবাহিত হতে দেখে মনে মনে হাসল এস্থার। নিজের মনেই বলল, এদের অন্ধবিশ্বাস এখনও কাটেনি ঠিকই কিন্তু এই অন্ধবিশ্বাসের কারণে না-তো শিল্পীর বিয়ে আটকাবে আর না-তো এই মেয়ের উপর গুরুদেবের দৈহিক অত্যাচার চলতে থাকবে, যা এতদিন ধরে এ বাড়িতে চলে এসেছে।

 

বিষবৃক্ষ

ঘটনাটা ১৯৮১ সালের। সুজয় তখন ব্যাচেলার। চাকরি পেয়ে কলকাতা থেকে দিল্লি এসেছে বেশ কিছুদিন হল। অ্যান্ড্রুজগঞ্জে অমিতের সাথে মেসে থাকে। বাড়ি থেকে এসে মনটাও বেশ খারাপ লাগছিল। দিল্লিতে অমিতের বেশ কয়েক বছর হয়ে গেছে। একদিন সুজয় অমিতকে বলল দ্যাখ, একটু আশেপাশে বেড়াতে গেলে হয়। অমিতও রাজি হয়ে গেল। পরেরদিনই বেরিয়ে গেল হরিদ্বার ও ঋষিকেশের উদ্দেশে।

হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যখন যাচ্ছিল তখন বেশ ভালোই লাগছিল। সে সময় হরিদ্বারের চণ্ডী পাহাড়ে বা মনসাদেবী পাহাড়ে রোপওয়ে হয়নি। পায়ে হেঁটেই উঠতে হতো। প্রথম দিন মনসাদেবী পাহাড়ে চড়ে সুজয় বেশ আপ্লুত হল। একটা বেশ নতুন অনুভূতি। তাই অমিতকে বলল চল কাল খুব সকাল সকাল আমরা চণ্ডী পাহাড়ে চড়তে যাব।

দ্যাখ, অত সকালে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?

কিছু হবে না। চল তো।

পরের দিন সকালে চণ্ডী পাহাড়ে উঠতে গিয়ে একটা জিনিস লক্ষ্য করল। আর অন্য কোনও লোকজনই ওদের আশেপাশে নেই। তাই একটু অবাক হল। চণ্ডী পাহাড়ে উঠতে উঠতে হঠাৎ দেখতে পেল, কে যেন চিত্কার করে হিন্দিতে তাদের ডাকছে। ওপরে তাকিয়ে দেখল একজন সাধু কমণ্ডলু হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের উঁচু একটা জায়গায় আর তাদের নিষেধ করছে ওপরে যেতে। সেই সাধুটি চণ্ডী পাহাড় থেকে নামার সিঁড়ির ওপরের দিকে একজায়গায় দাঁড়িয়ে ছিল।

তার হিন্দি থেকে যা বোঝা গেল, তা হল সাধুবাবা তাদের ওপরে উঠতে এখন নিষেধ করছে। ওরা দুজনেই কিছু বুঝতে না পেরে সেখানেই দাঁড়িয়ে গেল। এর মিনিট পাঁচেক পর আবার সেই সাধু চিত্কার করে তাদের জানাল যে, তারা এখন ওপরে উঠতে পারে। এসবের কিছু মাথামুণ্ডু বুঝতে না পেরে দুই বন্ধু আবার যাত্রা শুরু করল। হঠাৎ নজরে পড়ল, সিঁড়ির দুপাশের গাছপালা কেউ যেন দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে চলে গেছে। কিছু গাছপালা সিঁড়ির মাঝখানেও পড়ে আছে। দেখে মনে হবে কিছুক্ষণ আগে এখানে কেউ তোলপাড় করে গেছে। ওপরে উঠতে উঠতে সিঁড়ির মাঝপথেই দেখা হয়ে গেল সেই সাধুর সঙ্গে।

সাধু হিন্দিতে যা বললেন তা তরজমা করলে এরকম দাঁড়ায় দেখে তো তোমাদের লেখাপড়া জানা শিক্ষিত লোক বলে মনে হয়। এই পাহাড়ে অনেক জন্তু, জানোয়ার আছে। কাকভোরে এই পাহাড়ে আসা ঠিক নয়, এটাও কি তোমরা জানো না? দেখছ না আর অন্য কোনও লোক এই ত্রিসীমানায় নেই। তোমরা আজ বেঁচে গেলে। একটু আগে বুনো হাতির দল এখান দিয়ে যাওয়ার সময় সব লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে। আমি তোমাদের সতর্ক না করলে তোমরা ওই হাতিদের আক্রমণের শিকার হতে। এর পর থেকে আর এরকম ভুল কোরো না। সন্ধের পরেও এদিকে আসবে না। আর হ্যাঁ, তোমরা নতুন মনে হচ্ছে এখানে। ঋষিকেশ যাওয়ার পথে যে-জঙ্গলটা অতিক্রম করে যেতে হয়, তার ভেতরে ঢুকতে যেও না। যদিও পাশেই একটা ছোটো গ্রামে কিছু লোক বসবাস করে, তবে সেখানে না যাওয়াই ভালো। একথা বলেই সাধু সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল।

চণ্ডী পাহাড় থেকে ফিরে হর-কি-পৌরিতে স্নান সেরে দাদা বউদির হোটেলে সুস্বাদু খাবার খেয়ে দুজনেই হোটেলে ফিরে একটা ঘুম দিল। ঘুম থেকে উঠে দুজনে মিলে ঠিক করল আগামীকাল তারা গাড়ি নিয়ে ঋষিকেশ রওনা হবে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। পরের দিন গাড়িতে রওনা হল ঋষিকেশের উদ্দেশে।

অমিত পাকা ড্রাইভার, খালি রাস্তা পেয়ে গাড়ির গতিবেগ বাড়িয়ে দিল। সুজয় বলল অমিত অত জোরে চালাস না। তার ওপর গতকাল রাতে বৃষ্টি হয়ে রাস্তাও পেছল হয়ে আছে।

তুই ভাবিস না, আমি দিল্লির রাস্তায় চালিয়ে অভ্যস্ত। তুই একদম ভাবিস না।

কিছুদূর যাবার পর একটা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল। দুপাশে কয়েকটা হরিণও চোখে পড়ল। বাঁদরের পাল খাবারের উদ্দেশে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। দুজনেই এই প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে মোহিত হয়ে পড়েছিল। যখন দুজনেই গল্পে মশগুল, হঠাৎ অমিত ব্রেক কষল। হঠাৎ করে এমন ব্রেক মারাতে দুজনেই সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল।

গাড়ির সামনে হঠাৎ একজন বৃদ্ধ এসে গেছে। তাকেই বাঁচাতে এই ব্রেক মারতে হল। মনে হল বাঁচাতে পেরেছি। চল নীচে নেমে দেখি। দুজনেই তাড়াতাড়ি দরজা খুলে গাড়ির সামনে গিয়ে দেখল এক বৃদ্ধ পড়ে আছে গাড়ির সামনে।

চামড়া ঝুলে কুঁচকে গেছে। চোখের দৃষ্টি ঘষা কাচের মতো। মাথার চুলগুলো বেশিরভাগই পেকে সাদা। খুব বাঁচা বেঁচে গেছে। না, কোনও ক্ষতি হয়নি। উঠে বসার চেষ্টা করছে বৃদ্ধ লোকটি। গায়ে ছেলে ছোকরাদের হাফ শার্ট ও পরনে একটা

থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট। এসব বেশি বয়সের জন্য বেমানান। কাঁপছে তার শরীর। সুজয় ও অমিত দুজনে তাকে তুলে বসাল। গাড়ি থেকে জলের বোতল বের করে খেতে দিল। মুখে, চোখে একটু জল ছিটিয়ে দিল। লক্ষ্য করল, লোকটা ঢকঢক করে বোতলের অর্ধেকের বেশি জল শেষ করে দিল। টেনে টেনে আস্তে আস্তে করে বলল ভুখ লাগা হ্যায়।

লোকটিকে দুজনে ধরাধরি করে নিয়ে গিয়ে রাস্তার পাশে একটি গাছের নীচে হেলান দিয়ে বসাল। জায়গাটা বেশ ছায়াময়। বাতাসও বইছে। সুজয় গাড়ি থেকে কেক, বিস্কুট, জুস এনে খেতে দিল। গোগ্রাসে খেতে লাগল লোকটা। মুহূর্তের মধ্যে সব খাবার শেষ করে দিল। একটু সুস্থ হতেই বলল ম্যায় নেহি বাঁচ পঊঙ্গা (আমি বাঁচব না)। এরপর লোকটি হিন্দিতে যা যা বলল তার তরজমা করলে এরূপ দাঁড়ায়

কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে হয় মরে যাব।

কেন? তোমার তো চোট লাগেনি, অমিত প্রশ্ন করল।

যা দেখেছি, আমার চোখের সামনে যে আশ্চর্য রোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে, তার ব্যাখ্যা আমার জানা নেই।

সুজয় জিজ্ঞাসা করল, কী ঘটনা? তুমি সুস্থ না হলে আমরাও যেতে পারছি না। আমরা জানতে চাই, কী সে রোমহর্ষক ঘটনা! আমাদের দুজনেরই শুনতে খুব ইচ্ছে করছে।

লোকটি কিছুক্ষণ গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে রইল, তারপর সহসাই চোখ মেলে তাকাল। বড়ো বড়ো দুটো চোখে আতঙ্কের ছায়া স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। বলতে শুরু করল…

কিছুক্ষণের মধ্যেই মনে হয় আমি মারা যাব। আমি যা দেখেছি, যা আমার চোখের সামনে ঘটেছে। এর কোনও ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই।

অমিত জিজ্ঞাসা করল কি ঘটনা? আমাদের বলুন।

সুজয় বলল, বুঝতে পারছি আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু ঘটনাটা না শুনে যাওয়াটা ঠিক হবে না। লোকটা যেমন হিন্দি বলছেন তাতে একদম অশিক্ষিত বলে মনে হচ্ছে না তাঁকে। আপনি বলুন। আমরা শুনতে চাই।

আমার নাম রতন সিং। এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে আমার খামারবাড়ি ছিল। পাহাড়ে আমার কিছু নিজের জমি আছে এবং কিছুটা লিজে নিয়েছি। সেখানে এই ঠান্ডায় বাঁধাকপি, ফুলকপি আর টম্যাটো লাগিয়েছিলাম। প্রতিবছর বেশ ভালো ফলন হয়। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। একা সব সামলাতে পারি না বলে চাষবাসে সাহায্য করার জন্য কয়েকজন লোকও রেখেছিলাম। আমার ছোট্ট পরিবার, স্ত্রী আর একটি ছেলে। আমার বাড়িটা পাহাড়ের ঢালেই ছিল। ওপরে টালির ছাদ দেওয়া। সামনে সুন্দর ফুলের বাগান।

একদিন সন্ধেবেলা সব কাজকর্ম সেরে ফিরছি, হঠাৎ নজরে পড়ল আকাশ থেকে কী যেন একটা নীচের দিকে ধেয়ে আসছে। লাল রঙের আগুনের গোলক ছিল সেটা। আমার বাড়ির থেকে প্রায় দুশো গজ দূরে একটা ঝোপের মধ্যে এসে পড়ল সেটা। ঝপাৎ করে বেশ জোরে একটা শব্দ হল। ভয় পেয়ে গেলাম। ভাবলাম আগুন না লেগে যায় চারিদিকে। কিন্তু না, তা হল না। মনে হল আগুনের পিণ্ডটা যেন নিভে গেছে। জায়গাটা দেখে রাখলাম। ঠিক করলাম, পরের দিন সকালে গিয়ে দেখতে হবে ওটা কী ছিল! শব্দটা শুনে মনে হল না যে ওটা ভেঙে গেছে। এমনকী আশেপাশে আগুনও ধরে যায়নি। এত রাতে জীবজন্তুর ভয়ে ওই ঝোপের দিকে যেতে সাহস হল না।

রাতটা বেশ দুঃশ্চিন্তা ও আতঙ্কে কাটালাম। স্ত্রী ও ছেলেকে রাতে ওই ঘটনার কথা জানাইনি। ভোর হতেই সূর্য ওঠার আগে পৌঁছে গেলাম ওই ঝোপের কাছে। চারিদিকে ফুলের বাহার দেখে মনটাও আনন্দে ভরে গিয়েছিল। খুঁজতে খুঁজতে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। ওখানে একটা বেশ বড়ো স্বচ্ছ পাথরখণ্ড দেখতে পেয়ে অবাক হলাম। স্বচ্ছ পাথর খণ্ডের মধ্যে কালচে রঙের কী যেন দেখা যাচ্ছিল।

পাথরটা যেন কেমন আমায় টানছিল। একটা অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করলাম। দৌড়ে গিয়ে ওটা হাতে তুলে নিলাম। দেখে মনে হল মহাজাগতিক কোনও বস্তু এই প্রথম হাতে নিয়েছি। অনন্ত কোটি গ্রহাণুর কোনও একটির থেকে হয়তো খসে পড়েছে বলে নানারকম উদ্ভট কল্পনা মাথায় আসছিল। শরীরটা কেমন রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল। ইতিমধ্যেই সূর্য‌্য উদয় হয়েছে।

পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে আলো এসে আমার হাতের স্ফটিক খণ্ডটার ওপর পড়াতে ওটা যেন আরও ঝলমলে হয়ে উঠল। ভেতরের কালো জিনিসগুলো স্পষ্ট দেখতে পেলাম। আগে যেগুলোকে কালো মনে হচ্ছিল সেগুলো সূর্য‌্যের আলোয় মনে হল বেদানার বীজের মতো লালচে রঙের। মনে মনে ভাবলাম, এগুলো অন্য কোনও গ্রহের গাছের বীজ নয়তো! আজকাল তো পৃথিবীর মতো দেখতে আরও অন্য গ্রহেও জীবন আছে বলে নানা পরীক্ষা চলছে। ভাবলাম তেমনও হতে পারে।

এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে স্ফটিকটা ভেঙে ফেললাম। ঘাসের ওপর ওটার টুকরোগুলো ছড়িয়ে পড়ল। বীজগুলোও চারিদিকে ছড়িয়ে গেল। ওগুলো দেখতে এতই অদ্ভুত ছিল যে, সেগুলো থেকে কেউ চোখ ফিরিয়ে নিতে পারবে না। আমিও ওখান থেকে চারটে বীজ তুলে নিয়ে আমার ফতুয়ার পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম। পাথরগুলো এতই অসাধারণ ছিল যে সূর্য‌্যের আলোতে ওগুলো থেকে যেন দু্যতি ছড়িয়ে পড়ছিল। মনে হচ্ছিল ওগুলো চুনি, পান্নার মতো দামি পাথর। ঠিক তখনই মাথার মধ্যে একটা ইচ্ছে জাগল। এগুলো যদি কোনও গাছের বীজ হয় তবে বীজগুলো রোপণ করেই দেখা যাক না। রোজ জল দিয়ে দেখব গাছ জন্মায় কিনা।

তখনও বুঝতে পারিনি যে, ওই বীজ রোপণ করাটাই আমার কাল হবে। চলে গেলাম আমার অন্য একটা জমিতে যেখানে অন্যান্য ফসল ফলাতাম। পাহাড়ের একটা ঢাল দেখে সেখানে গিয়ে খুরপি দিয়ে মাটি খুঁড়ে একটা বীজ পুঁতে দিলাম। জায়গাটা জল দিয়ে ভিজিয়ে ফিরে গেলাম নিজের আস্তানায়। ভাবলাম পরের দিন এসে আবার জল ঢেলে দেব।

পরের দিন সকালে উঠেই জল দিতে চলে গেলাম সেই জায়গায়। ওপর থেকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। পাহাড়ের নীচে আমার জমিটাতে আমার স্ত্রী, ছেলে ও কাজের লোকেরা জমি ও গাছের পরিচর‌্যা করে চলেছে। গতকালের বীজের জায়গাটায় পৌঁছে অবাক হয়ে গেলাম। গতকাল যে-বীজটা লাগিয়ে গিয়েছিলাম, সেটা থেকে একটা চারাগাছ হয়েছে। গাছের পাতাগুলো ভেলভেটের মতো। মনমাতানো তার অদ্ভুত রং। আমি এর আগে এমন গাছ কখনও দেখিনি। অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম গাছটার দিকে। তারপর জল ঢেলে ফিরে গেলাম অন্যান্য মজুরদের কাজকর্ম দেখতে।

পরের দিন আবার যখন সেখানে গাছটাতে জল দিতে গেলাম, অবাক করা কাণ্ড দেখতে পেলাম। দেখলাম গাছটা এই একদিনে আরও প্রায় তিন-চার হাত লম্বা হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকল গাছটার প্রতিদিন বেড়ে ওঠা। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে গাছটা বিশাল রূপ নিল। সূর্য‌্যের আলোয় দেখতে পেলাম গাছের পাতাগুলো অদ্ভুতরকম দ্যুতি ছড়াচ্ছে। সূর্য‌্যের রক্তিম ছটায় পাতাগুলো লাল হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন আগুন ছড়াচ্ছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। গাছটা যেন আমাকে কেমন সম্মোহিত করে ফেলেছে। লাল রঙের ফুলও ফুটেছে।

গাছটাকে উঁচু পাহাড় থেকে কেমন লাগছে দেখতে দেখার জন্য একটু উঁচু জায়গায় উঠে গেলাম। গাছটাকে দেখতে দেখতে চোখ চলে গেল আমার খেতের দিকে। সেখানে আমার বউ, বাচ্চাকে দেখলাম ফসলের পরিচর‌্যা করে চলেছে। একবার ভেবেছিলাম, বাড়ির লোকেদের এই গাছটার কথা বলে দেব। আবার পরক্ষণেই ভাবলাম কয়েকদিন বাদেই সব জানিয়ে একটু অবাক করে দেব ওদের। পাহাড়ের চড়ায় উঠে গাছটাকে দেখলে দেখতে পেতাম এক অদ্ভুত দৃশ্য। মনে হতো গাছটা থেকে যেন সূর্য‌্যের সাত রং ছিটকে পড়ছে। দেখে মনে হতো, গাছটা রং বদলাচ্ছে। সকালে এক রং, দুপুরে অন্য রং আর বিকেলে আর এক অন্য রং। এমনকী সূর্য‌্যাস্তের পরও গাছের আশপাশটায় তীব্র আলো ছড়িয়ে থাকত। এরপর হঠাৎই ঘটল এক অঘটন।

সেদিনও আমি পাহাড়ের অন্য একটা চড়া থেকে গাছটাকে দেখছিলাম। কিছু বোঝার আগেই বিনা শব্দে বিস্ফোরিত হল গাছটা। গাছের ডালপালা, পাতা সবকিছু চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। শুধুমাত্র কাণ্ডটা দাঁড়িয়ে আছে সোজা হয়ে হঠাৎ লক্ষ্য করলাম গাছের কাণ্ডটার ভেতরের গর্ত থেকে গুবরে পোকার চেয়ে বড়ো বড়ো কিন্তু লাল রঙের পোকা বেরিয়ে আসছে লক্ষ লক্ষ নয়, কোটি কোটি। এ যেন আগ্নেয়গিরির লাভা। শেষ-ই হচ্ছে না। পোকাগুলো পিল পিল করে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল। পোকাগুলো পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নীচের দিকে নেমে চলেছে। যেখান দিয়ে যাচ্ছে সেখানকার সব গাছপালা, ঝোপঝাড়, সবকিছুকে এমনকী ছোটো প্রাণীগুলোকেও নিমেষে ধ্বংস করে এগিয়ে চলেছে।

এই দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে গেলাম, যখন দেখলাম ওই পোকাগুলো ঢালটা পেরিয়ে আমার খেতের দিকে, আমার বউ-বাচ্চার দিকে এগিয়ে চলেছে। চিত্কার করে

বউ-বাচ্চাকে সাবধান করার জন্য ডাকতে লাগলাম। কিন্তু আমার ডাক ওদের কানে পৌঁছোনোর আগেই আমার বউ, বাচ্চা, খেত সব কিছুকেই বন্যার জলের মতো ধ্বংস করে এগিয়ে যেতে লাগল প্রাণীগুলো। এ ধ্বংসলীলা সহ্য করার মতো শক্তি আমার ছিল না। ওগুলো যখন আমার জমি পেরিয়ে গেল, তখন দেখলাম কয়েকটা কঙ্কাল পড়ে আছে আর কিছু নেই। আমার ফসল, স্ত্রী, বাচ্চা কেউ আর বেঁচে নেই।

তবুও সাহস করে দৌড়ে নামতে গেলাম, আর তখনই দেখতে পেলাম পোকাগুলো শব্দ করে ফাটছে আর একরকম লালাজাতীয় রস বের করে মরে যাচ্ছে। এই বিভীষিকা মনের মধ্যে আর সহ্য করতে পারছিলাম না। পোকাগুলোই বা কেন মরল, বুঝতে পারলাম না। ভাবছিলাম ওগুলো তো মরল। একটু আগে মরলে আমার পরিবার ও ফসলগুলো বেঁচে যেত। কিন্তু আমাকে শেষ করে দিয়ে গেল।

অনুশোচনায় ভুগতে লাগলাম, আমি নিজেই এই বীজ বপন করেছি এই কথা ভেবে। আর এই বীজই আমার সব কিছু কেড়ে নিল। হাতের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেলাম। দেখলাম আমার হাতের চামড়া কুঁচকে গেছে নব্বই বছরের বৃদ্ধের মতো। দৌড়ে বাড়ি গেলাম। আয়নার সামনে নিজেকে দেখে চমকে উঠলাম। দেখে মনে হল আমি আর টগবগে ৩৫ বছরের যুবক নেই। আমার বয়স বেড়ে নব্বই হয়ে গেছে। এমনকী আমার কালো চুলগুলোও সাদা হয়ে গেছে। আমি নিজের এই দশা দেখে অসহায় বাচ্চার মতো কাঁদতে লাগলাম।

তখন মনে পড়ল, গাছটায় যখন বিস্ফোরণ হয় তখন ওখান থেকে নীলাভ আলো এসে আমার গায়ে লেগেছিল। নিজের এই অবস্থা দেখে নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছিল। একবার ভাবলাম আত্মহত্যা করি কিন্তু শেষ অবধি করতে পারলাম না…। এই কথাগুলো বলার পর লোকটি হঠাৎ স্থির হয়ে গেল।

গাছে হেলান দেওয়া অবস্থাতেই মারা গেল। হাতের মুঠোটা আপনা থেকেই খুলে গিয়ে কয়েকটা লাল স্ফটিকের মতো পাথর গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। দেখে মনে হচ্ছিল বেদানা ফলের বীজের মতো। ওগুলো বেশ চিকমিক করছিল।

সুজয় আর অমিত একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল সেদিকে। এটা কি গল্প ছিল, না সত্যি ঘটনা? নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না! সুজয় ওই বীজগুলোর দিকে হাত বাড়াতে যেতেই অমিত হাতটা চেপে ধরল সুজয়ের। চিত্কার করে উঠল, ওগুলো ছুঁতে যাস না। বিষবৃক্ষের ফল হতে পারে!

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব