সারপ্রাইজ

অভিজিতের সঙ্গে পুনায় তার কর্মস্থলে চলে যাচ্ছে নন্দিনী। স্টেশনে তাদের দুজনকে সি-অফ করতে এসেছেন অভিজিতের বাবা-মা এবং বোন সীমা। মাত্র একমাস হল অভিজিতের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে নন্দিনীর। বিয়ের পর এই কটা দিন যেন সুখের স্রোতে ভেসে কেটে গেছে। অভিজিতের পরিবারের সদস্যরা মাত্র একদিনেই ভালোবেসে ফেলেছেন মাতৃহারা মেয়েটিকে।

আজ ছেলে-বউমাকে বিদায় জানাতে এসে সে-কথাটি বিলক্ষণ বুঝছেন সুরমা। তার দুচোখ জলে ভরে এসেছে। নন্দিনীর চিবুক ধরে আদর করে বলে উঠলেন, ‘মন চাইছে না তোকে ছেড়ে দিতে নন্দিনী। কিন্তু কী করব বল! ছেলেটা বিদেশবিভুঁইয়ে একা থাকবে, এটাই বা মা হয়ে কী করে সহ্য করি বল! জানি, তোর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মন খারাপ করিস না মা। যখন ইচ্ছে করবে চলে আসবি। আর ফোন তো রইলই!’

সুরমার কথা শুনতে শুনতে মনটা ভিজে উঠল নন্দিনীরও। সুরমার কাঁধে মাথা রেখে সে ফুঁপিয়ে উঠল। নিজের মায়ের স্মৃতি, সময়ের ব্যবধানে আর খুব বেশি উজ্জ্বল নয় তার কাছে। সুরমার মধ্যে, তার দেওয়া স্নেহের মধ্যে, সে তার নিজের মায়ের ছায়া দেখতে পেয়েছিল।

সীমা এগিয়ে এসে কানেকানে বলল, ‘বউদি, তুমি কী গো? আজকালকার মেয়েরা ভাবে, কতক্ষণে শ্বশুর-শাশুড়ির কড়া শাসনের বাইরে বের হবে। তোমার কাছে বিনা আয়াসে সেই সুযোগ যখন এসেইছে, তখন তুমি কাঁদছ? সত্যি তোমার দ্বারা কিস্যু হবে না!’

সীমার কথা শুনে সুরমার কাঁধ থেকে মাথা তুলে নন্দিনী ম্লান হাসি নিয়ে তাকাল।

পুনেতে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে অভিজিৎ। তবে এখনও গৃহপ্রবেশ করেনি। একেবারে নন্দিনীকে নিয়ে সেই বাড়িতে গিয়ে উঠবে, ঠিক করেছে। ফার্নিচারগুলো অবশ্য বিয়ে উপলক্ষ্যে কলকাতায় ছুটি নিয়ে আসার আগেই নতুন ফ্ল্যাটে রেখে দিয়ে এসেছে সে। আর, চাকুরেদের যে-মেসটায় থাকত এতদিন, বকেয়া মিটিয়ে ছেড়ে দিয়ে এসেছে সেটা।

ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে আসতে, ওরা নিজেদের কামরায় উঠে পড়ল। একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিন ভাড়া নিয়েছে অভিজিৎ। ভারী স্লাইডিং দরজাটা টেনে দিলে কেবিনটা একেবারে ব্যাক্তিগত হয়ে যায়। জানলার বাইরে গাঢ় অন্ধকার নেমেছে। কাচের বাধা ভেদ করে বাইরে কিছুই দেখা যায় না। রাত নটা নাগাদ ট্রেনের প্যান্ট্রি কার থেকে খাবার দিয়ে গেল। খেয়েদেয়ে দশটা নাগাদ উপরের বাংকে শুতে চলে গেল অভিজিৎ।

নন্দিনীও হাতে একটা পেপারব্যাক নিয়ে আধশোয়া হল। কিন্তু তার ঘুম আসছিল না। পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে বেরিয়ে হঠাৎই তার নিজেকে খুব একা মনে হতে লাগল। আর মনে পড়ে যেতে থাকল পুরোনো স্মৃতিগুলো।

মনে পড়ল, অমরশংকর কত চিন্তিত ছিলেন মেয়ের বিয়ে দেওয়া নিয়ে! নন্দিনী সুন্দরী, উচ্চশিক্ষিতা। বাধাটা সেদিক থেকে নয়। কিন্তু, পারিবারিক ইতিবৃত্তটি শোনার পর পাত্রপক্ষেরা পিছিয়ে যায়। আর, অমরশংকর তো সে কাহিনি না বলে মেয়ের বিয়ে দেবেন না। একসময় পাত্রপক্ষের সামনে সেজেগুজে বসতে বসতে ক্লান্ত নন্দিনী তো বাবাকে বলেই ফেলেছিল, ‘তুমি আর চেষ্টা করো না। বিয়ে করাটাই তো জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়! আমি পড়ব। আরও পড়ব। ভালো একটা কেরিয়ার তৈরি করব।’

অমরশংকরও হতাশ হয়ে পড়ছিলেন ক্রমশ। এইসময়েই হঠাৎ দেবদূতের মতো হাজির হলেন সুরমা আর জয়ন্ত। সব শুনেও ওরা ওদের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন।

অথচ সেই ইতিহাসের জন্য নন্দিনী কোনওভাবেই দায়ী ছিল না। নন্দিনীর মা বিনতা খুবই অর্ন্তমুখী স্বভাবের মহিলা ছিলেন। এমনকী কষ্টের কথাও তাকে কেউ কখনও মুখ ফুটে বলতে শোনেনি।

অমরশংকর সবে কলেজ পাশ করে চাকরি পেয়েছেন, এই সময়টায় বাড়িরঅমতে বিয়ে করেছিলেন বিনতাকে। বিয়ে করে আর দক্ষিণ কলকাতার সাবেকি বাড়িতে ওঠেননি ওরা। অন্যত্র বাসা নিয়েছিলেন। নন্দিনীরও জন্ম এখানেই। সমস্যার শুরু তার পরে।

নন্দিনীর খুব আবছা ভাবে মনে পড়ে শীতকালের এক দুপুরের কথা। স্কুল ছুটি ছিল। তাই বাড়িতেই ছিল সেদিন নন্দিনী। অমরশংকর যথারীতি অফিসে গেছিলেন। বাইরের বারান্দায় একা বসে, পুতুল এবং খেলনাবাটি নিয়ে সংসার পেতেছিল নন্দিনী। এইসময় সহসা বেজে উঠেছিল ফোনের ঘণ্টিটা। বিনতা ফোন ধরে কথা বলছিলেন। হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হতে কৗতূহলী হয়ে মায়ের ঘরের দরজায় ছুটে এসে দাঁড়িয়েছিল নন্দিনী। তারপর ভিতরের দৃশ্য দেখে সে যেন পাথর হয়ে গেছিল।

ফোনের রিসিভারটা ঝুলছে। বিনতা উপুড় হয়ে পড়ে আছেন মেঝের উপর। চুলগুলো খোলা। হাওয়ায় উড়ছে। থরথর করে কাঁপছে বিনতার শরীরটা। মুখ দিয়ে একটা গোঙানির আওয়াজ বের হচ্ছে। উন্মত্তের মতো মাথাটাকে এপাশে-ওপাশে দোলাচ্ছেন বিনতা।

নন্দিনীর বুকের মধ্যেটা শুকিয়ে গিয়েছিল। সে কী করবে প্রথমে বুঝে পেল না। তারপর নিজেই দরজা খুলে পাশের বাড়ি থেকে ডেকে এনেছিল দীপা কাকিমাকে। দীপাও ঘাবড়ে গিয়ে অমরশংকরকে ফোন করেছিল তাঁর অফিসে। দ্রুত বাড়িতে চলে এসেছিলেন অমরশংকর।

খানিকক্ষণ পরে ডাক্তার এসেছিলেন। বিনতাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। ক’দিনের মধ্যে বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন বিনতা। কিন্তু ডাক্তারবাবু সতর্কবাণী শুনিয়ে গেলেন। হিস্টিরিয়ার লক্ষণ দেখা দিচ্ছে বিনতার মধ্যে।

বিনতা সেই সময়ের মতো সুস্থ হয়ে গেলেও ক”দিন পরে আবার তার মধ্যে ফের একইরকম বৈকল্য দেখা দিল। তারপর থেকে বারবারই এমন হতে থাকল। উন্মত্তের মত আচরণ করতে লাগলেন বিনতা। এমনকী এসময় বিনতার কাছাকাছি যেতে ভয় পেতেন অমরশংকর নিজেও। ভয়টা যতটা তার নিজের জন্য, তার ঢের বেশি বিনতার জন্য।

বিনতা যখন পাগলের মতো আচরণ করেন, তখন কেউ তার দিকে এগোলেই তিনি ভাবতে থাকেন তাকে বুঝি মারতে আসছে। তার এই রোগটা ক্রমেই বাড়তে লাগল। কেবল প্রকোপের সময়টুকুতেই নয়, তার বাইরেও তিনি অসংলগ্ন আচরণ করতে শুরু করলেন।

অমরশংকর যেন মনের দিকে থেকে ভেঙেচুরে গেলেন। তার কাছের বন্ধুরা তাকে পরামর্শ দিলেন, বাড়িতে না রেখে বিনতাকে কোনও মেন্টাল অ্যাসাইলামে রাখতে। তাদের আসলে ভয় ছিল নন্দিনীকে নিয়ে। ডাক্তারবাবুও বলেছিলেন, ‘বিনতা যেরকম ভায়োলেন্ট হয়ে পড়ছে, তাতে করে আপনার নন্দিনীর কথাটা বোধহয় একটু ভাবা উচিত অমরবাবু। শুধু শারীরিক ক্ষতির ভয়ই নয়, বাচ্চা মেয়ে, তাই মনের উপরেও বিশ্রী চাপ পড়ার ভয় থেকেই যায়।’

অমরশংকর স্ত্রীকে খুবই ভালোবাসতেন। কিন্তু ডাক্তারবাবুর পরামর্শ শোনার পর আর ঝুঁকি নিতে রাজি হলেন না। সবচেয়ে নামি ও খরচবহুল একটি মেন্টাল অ্যাসাইলামে বিনতাকে রেখে এলেন তিনি। মাস-মাস মোটা টাকা ডোনেশন দিতে হতো সেখানে। বিনিময়ে বিনতা পেতেন সেরা যত্ন এবং দেখভাল।

নন্দিনীর মনে আছে, সপ্তাহে দুবার বিনতার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন অমরশংকর। ঘণ্টাখানেক বিনতার পাশে বসে কাটিয়ে আসতেন। বিনতা বেশি কথা তো বলতেন না। অমরশংকরও চুপ করে তার পাশে বসে থাকতেন। মাঝেমধ্যে নন্দিনীর কথা আলোচনা করতেন।

এক সোমবার সকালে অ্যাসইলাম থেকে ফোন এল। বিনতা নেই। ফোনটা রেখে বাবা গুম মেরে বসে রইলেন। তারপর নন্দিনীকে ডেকে বললেন, ‘আমাদের এক্ষুনি একবার মেন্টাল অ্যাসাইলামে যেতে হবে। তুমি তৈরি হয়ে নাও।’ কী ঘটেছে, তা টেলিফোনের কথোপকথন শুনেই বুঝতে পেরেছিলন নন্দিনী। আলদা করে বলতে হয়নি।

বিনতার ক্রিয়াকর্মে যোগ দিতে নন্দিনীর দাদু-ঠাকুমাও এলেন। নন্দিনী তখন দশ বছরের বালিকা। প্রতিমা– অমরশংকরের মাকে এই প্রথম সে দেখল। ভদ্রমহিলার চোখেমুখে একটা অস্বাভাবিক কাঠিন্য আছে। কাজকর্ম মিটে যেতে প্রতিমা ছেলেকে বললেন, ‘তুমি তো ও বাড়িতে ফিরবে না। সে প্রত্যাশাও আমি বা তোমার বাবা করি না। কিন্তু নন্দিনীর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তোমার উচিত ওকে আমাদের কাছে রেখে মানুষ করা।’

অমরশংকর শুনে, গলায় শ্লেষ ঢেলে বললেন, ‘বেঁচে থাকতে বিনতাকে কোনওদিন তোমরা মেনে নাওনি। এখন তার মেয়েকে নিয়ে যেতে চাও?’

প্রতিমার ঠোঁটের চারপাশ আর চোখের তলার চামড়াটা আশ্চর্য ভাবে কুঁচকে গেল। কর্কশ স্বরে বললেন, ‘বিনতা তোকে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছিল অমর। ওকে কোনওদিন ক্ষমা করতে পারব না আমরা।’

‘বিনতা নয়, তোমরা। তেমারাই আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলে।’ অমরশংকর রুখে উঠলেন, ‘সেখানেই শেষ নয়। আজ আমি ভালোই জানি, কার ফোন পেয়ে বিনতা অমন পাগলের মতো আচরণ করত।’

প্রতিমা চুপ করে গিয়েছিলেন। নন্দিনীর অতিসংবেদী শিশুমন তখনই স্পষ্ট করে বুঝে গিয়েছিল, সেদিন দুপুরে আসা ফোনটার অন্য প্রান্তে কে ছিল। ঘৃণায় ভরে গিয়েছিল তার মন। সে ঘৃণা আজও মোছেনি মন থেকে। কিন্তু এই কদর্য ছবিটার উলটো দিকে একটা সদর্থক ছবিও ছিল। যার জন্য অমরশংকরের জন্য নন্দিনীর মনে শ্রদ্ধার ভাবটা বেড়ে গিয়েছিল বহু শতগুণ। নিজের মনে একাকী হয়ে পড়েছিলেন তিনি। রাতে তার চোখে ঘুম আসতে চাইত না। সবটাই লুকিয়ে দেখেছিল নন্দিনী। বাবার পাশে দাঁড়ানোর বয়স বা সাহস কোনটিই তার ছিল না। কেবল অমরশংকরের জন্য অদ্ভুত এক কষ্ট তাকে পীড়িত করত।

অথচ অন্য সময় অমরশংকর যেন অন্য মানুষ। নন্দিনীকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন, দুপুরে সে বাড়ি ফেরার পর নিয়ম করে নির্দিষ্ট সময়ে ফোনে খবর নিচ্ছেন, আয়াকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছেন, পার্টি এড়িয়ে চলছেন, কারণ তাঁকে সন্ধেয় দ্রুত বাড়িতে ফিরে নন্দিনীকে সঙ্গ দিতে হবে। দেখতে দেখতে দশটা বছর কোথা দিয়ে যেন কেটে গেল। পলক ফেলতে না ফেলতে।

অমরশংকর এবার নন্দিনীর বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন। দ্রুত জবাব আসতে লাগল। পাত্রপক্ষের খুব পছন্দও হয় নন্দিনীকে। কিন্তু অমরশংকর যেই বিনতার কথা খুলে বলেন, তারা পিছিয়ে যায়। অমরশংকরের বন্ধুবান্ধবরা পরামর্শ দেন, ‘এত বিস্তারিত ভাবে পাত্রপক্ষকে সবকথা জানানোর কী আছে? ওরা কি মেয়েটাকে ঘরে নেবে, না তোমার বংশপরিচয়কে?’

অমরশংকর সব শুনেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। আর পাত্রপক্ষ শুকনো মুখে জানায়, ‘মেয়েকে তো আমাদের খুবই পছন্দ ছিল অমরবাবু। কিন্তু ভয় পাচ্ছি। মেয়ের মা পাগল। শেষে মেয়েও যদি কোনওদিন…!’

অমরশংকর ম্লান হাসেন।

নন্দিনীও ক্লান্ত হয়ে গেছিল প্রায় সন্ধ্যাতেই সেজেগুজে পাত্রপক্ষের সামনে হাজিরা দিতে দিতে। শেষে একদিন  মরিয়া হয়ে মুখ ফুটে বলে উঠেছিল, ‘বাবা তুমি কি মনে করো বিয়েই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য? এখন মেয়েরা নিজেদের কেরিয়ারটাই আগে গড়তে চায়। আমিও কি সেরকম হতে পারি না?’

অমরশংকর বলেছিলেন, ‘অবশ্যই পারিস। কিন্তু কেরিয়ারের সঙ্গে বিয়ের তো বিরোধ নেই কোনও।’

এই সময়েই অকস্মাৎ একটা যোগাযোগ হয়ে গেল। অমরশংকরের সঙ্গে তার বন্ধু সুবিমলের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে গেছিল নন্দিনী। সেখানেই সুরমা তাকে প্রথম দেখেন। আর তারপরই খোঁজখবর নিয়ে ছেলে অভিজিতের জন্য সম্বন্ধ নিয়ে আসেন। মাল্টিন্যাশনাল ফার্মে মোটা মাইনের চাকরি করে অভিজিৎ। পারিবারিক কৗলিন্যও রয়েছে। অমরশংকরের ‘না’ বলার কোনও প্রশ্নই ছিল না। এবং কী আশ্চর্য, অমরশংকর পুরোনো সব কথা বলার পরেও সুরমা এবং জয়ন্তকে তাদের সিদ্ধান্ত থেকে টলানো গেল না।

জয়ন্ত বললেন, ‘মায়ের একটা মানসিক অসুস্থতা ছিল বলে ওরও থাকবে, এটা এ ক্ষেত্রে তেমন যুক্তিযুক্ত বোধহয় নয়।’

সুরমা বললেন, ‘আমাদের ভাগ্যে যদি সেটা থাকেই, তাহলে ঘটবে–!’

অমরশংকর ভারি নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল অভিজিৎ আর নন্দিনীর। কিন্তু বাস্তবের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে নন্দিনী সেভাবে নিশ্চিন্ত হতে পারল না। বিয়ের কয়েকদিন পরেই কোনও এক দুর্বল মুহূর্তে চোখের জল ফেলে অভিজিতের কাছে সে জানতে চেয়েছিল, ‘আমিও যদি কোনওদিন মায়ের মতো অসুস্থ হয়ে পড়ি?’

জানলা দিয়ে ভোরের আলো ঢুকে এসে চোখের পাতায় বসতেই ঘুম ভেঙে গেল নন্দিনীর। সকালে হালকা ব্রেকফাস্ট করে অফিসে চলে যায় অভিজিৎ। কাজেই তার অফিসে বেরোনোর আগে অবধি, রান্নার তেমন ব্যস্ততা থাকে না। সেটা শুরু হয় পরে। অভিজিৎ বেরিয়ে যাওয়ার পর।

অভিজিতের অফিস তাদের ফ্ল্যাটের খুব কাছে হওয়ার জন্য, লাঞ্চের অবসরে অভিজিৎ ঘণ্টাখানেকের জন্য বাড়িতে আসে। তখন ওরা দুজনে একসঙ্গে খেতে বসে।

বিছানা থেকে নেমে নন্দিনী ঠিক করল, রেসিপির বইটা দেখে আজ কিছু আনকোরা রান্না তৈরি করবে। ভাবতে ভাবতেই ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভার তুলেই নন্দিনী বুঝল, ফোনের অন্য প্রান্তে রয়েছেন অমরশংকর।

প্রথমেই বললেন, ‘শুভ জন্মদিন নন্দিনী! কেমন আছিস মা?’

‘ভালো আছি বাবা। তোমার শরীর ঠিক আছে?’

‘শরীর ঠিক আছে। তবে সত্যি বলতে কি, তুই শ্বশুর বাড়িতে চলে যাওয়ার পর বাড়িটা বড়ো ফাঁকা লাগে।’

নন্দিনীর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে।

অমরশংকর বলেন, ‘তোর জন্য একটা উপহার কিনে গতকালই কুরিয়র কোম্পানিকে দিয়ে দিয়েছি। আজই পেয়ে যাবি। পছন্দ হয়েছে কিনা জানাস–!’

অমরশংকর ফোনটা ছেড়ে দিলেন। অভিজিৎ বাথরুমে ঢুকেছে। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কে ফোন করেছিল নন্দিনী?’

‘বাবা!’

অভিজিৎ নিজের মনেই বলল, ‘ও!’

কিচেনের দিকে যেতে গিয়ে আবার থমকে যেতে হল নন্দিনীকে। আবার ফোনের ঘণ্টি বাজছে। এবার সীমা।

ফোন তুলতেই কলকল করে উঠল, ‘শুভ জন্মদিন বউদি। তা, দাদা আজ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেলিব্রেট করতে?’

‘সেলিব্রেশন? তোমার দাদা?’ বলতে বলতে নন্দিনীর বুকে একটা অভিমান দলা পাকিয়ে ওঠে, ‘এখনও অবধি উইশ করেনি জানো? বোধহয় ভুলেই গেছে।’

‘ভুলে গেছে?’ সীমা স্পষ্টতই অবাক হয়, কিন্তু প্রসঙ্গ পালটে বলে, ‘আচ্ছা, আমি এখন কলেজে যাচ্ছি, কেমন বউদি? বাবা-মা তোমার সঙ্গে কথা বলবে। আমি রাতে ফোন করব আবার। হিহি!’

সুরমা ও জয়ন্তর সঙ্গে কথা বলে ফোনটা রেখে পিছন ফিরতেই নন্দিনী দেখল, অভিজিতের স্নান হয়ে গেছে। তোয়ালেতে মাথা মুছতে মুছতে সে বাথরুমের বাইরে বেরিয়ে নিজের মনে গুনগুন করছে।

নন্দিনীকে দেখে উদাসীন গলায় বলল, ‘বাব্বা! আজ দেখছি একের পর এক ফোন আসছে তোমার। ব্যাপারখানা কী?’

ক্লিষ্ট হেসে সরে যেতে যেতে নন্দিনী বলল, ‘হয় এক-একদিন এরকম!’

কিন্তু মনটা তার ভেঙে দুমড়ে যাচ্ছে। অভিজিৎ কী করে বউয়ের জন্মদিনের কথাটা ভুলে যেতে পারে? কিন্তু আচরণ দেখে মনে হচ্ছে বিষয়টা মাথাতেই নেই ওর।

টেবিলে ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে সে অভিজিৎকে ডাকল। কোনও কথা না বলে ওরা খাচ্ছে। নীরবতা ভেঙে অভিজিৎ সহজ গলায় জানতে চাইল, ‘তোমার কি মন খারাপ নন্দিনী?’

‘না তো! কেন?’– নন্দিনীর চোখদুটো জ্বালা করে উঠল।

‘না, তোমাকে অন্যমনস্ক দেখে ভাবলাম, হয়তো বাবার জন্য মন কেমন করছে। সেক্ষেত্রে কয়েকদিন তোমার বাবার ওখান থেকে আমরা ঘুরেও আসতে পারি।’

নন্দিনীর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। খাওয়া শেষ হয়ে গেছে অভিজিতের। গলার টাইটা বেঁধে নিতে নিতে বলল, ‘ও। শোনো, একটা কথা তো তোমায় বলাই হয়নি। আমার একবন্ধুর জন্মদিন আজ। হোটেলে পার্টি থ্রো করেছে। যেতেই হবে। তুমি সন্ধেয় সেজেগুজে তৈরি থেকো।’

অভিজিৎ চলে যাওয়ার পর বন্ধ দরজাটায় পিঠ ঠেকিয়ে নন্দিনী ভাবতে থাকল, বন্ধুর জন্মদিন মনে রাখতে পারে অভিজিৎ। কেবল তার বেলাতেই ফাঁকি। এমন নয় যে, অভিজিৎ জানে না আজ তার জন্মদিন। কিন্তু কত সহজে সে সে-কথা ভুলে গেছে! প্রচণ্ড অভিমানে নন্দিনীও ঠিক করল, অভিজিৎকে কক্ষনও সে তার জন্মদিনের কথাটা মনে করিয়ে দেবে না। এমনকী সীমা বা সুরমার কাছ থেকে জানতে পেরে সে যদি কোনও উপহার কিনেও আনে, সে নেবে না। ফিরিয়ে দেবে।

মনের মধ্যে চিনচিনে একটা ব্যথা সত্ত্বেও সে অনেকক্ষণ ধরে সাজল। ভোটশিপের সময়, অভিজিতের পছন্দ করে কিনে আনা শাড়িটা পরে, সে অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখল আয়নায়।

অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে নন্দিনীকে দেখে চমকে গেল অভিজিৎ। মুগ্ধ চোখ ফেরাতে পারল না। যদিও তেমন উৎসাহ দেখাল না নন্দিনী। মনটা অশান্ত হয়ে আছে। সুরমা হয়তো এরকম কোনও দিনের আগাম কল্পনা করেই, চলে আসবার দিন নন্দিনীকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘কখনও কখনও খুব ছোটো ছোটো ঘটনাও বড়োসড়ো ঝগড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একটু বুদ্ধি দিয়ে ব্যাপারগুলোকে সামলালে দেখবি, সব ঠিক হয়ে গেছে। কোনও কথা যদি খারাপ লাগে, তাহলে তক্ষুনি জবাব না দিয়ে ঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।…’

নিজেও দ্রুত তৈরি হয়ে নিয়ে অভিজিৎ ব্যস্ততার সঙ্গে বলল, ‘চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় আবার একটা ছোটোখাটো প্রেজেন্টেশনও কিনে নিতে হবে।’

সন্ধে নেমে এসেছে। চর্তুপাশ ঝলমল করছে আলোয়। গাড়ির ঢল নেমেছে। একটা বড়ো গয়নার দোকান দেখে তার সামনে গাড়ি থামাল অভিজিৎ। বলল, ‘তোমাকে বলা হয়নি নন্দিনী। আমার এই বন্ধুটি একজন ভদ্রমহিলা। অল্প দিন হয়েছে, তার সঙ্গে আমার আলাপ।’

দোকানের সুবেশ ছেলেটিকে হিরের আংটি দেখাতে বলল অভিজিৎ। নানা ডিজাইনের আংটি চলে এল। বেশ কয়েকটা পছন্দসই মনে হল অভিজিতের। সবকটাই একে একে নন্দিনীর আঙুলে পরিয়ে শেষপর্যন্ত একটিকে চূড়ান্ত বাছাই করল সে। আংটিটা সত্যিই খুব সুন্দর দেখতে। নন্দিনীকে জিজ্ঞেস করতে সেও মাথা হেলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল।

আংটির দাম পঁচিশ হাজার টাকা। সব দেখে নন্দিনী যেন মনে মনে আরও বেশি করে নিভে যাচ্ছিল। বন্ধুর জন্য এত দামের উপহার, আর নিজের স্ত্রীর জন্য কিছুই না! কী অসম্ভব পরিহাস লুকিয়ে আছে গোটা ঘটনাটার মধ্যে।

গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। অনেকটা পথ পেরিয়ে এবার এসে থামল এক বিরাট পাঁচতারা হোটেলের নীচে। গাড়িটা পার্ক করে, চোখের ইশারায় তাকে অনুসরণ করার কথাই বলল অভিজিৎ। সে হাঁটতে লাগল হোটেলের রেস্তোরাঁটির দিকে। চারপাশে তাকাতে তাকাতে। যদি নিমন্ত্রিত বন্ধুবান্ধবদের কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যায়!

রেস্তোরাঁর মধ্যেটা নরম আলোর ঠান্ডা স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। খুব হালকা ভল্যুমে কোনও চেনা সুর বাজছে। টেবিলে টেবিলে ছায়ার মতো নারী-পুরুষ। সেদিক না মাড়িয়ে অভিজিৎ একটু নিরালা থাকা দামি কেবিনগুলোর একটার দিকে এগেল।

কেবিনের ভারী পর্দাটা সরিয়ে অভিজিৎ বলল, ‘ওয়েলকাম ম্যাম!’

নন্দিনী একটু অবাক হয়। বলে, ‘কই গো, তোমার হোস্ট কই? আমরাই কি প্রথম এলাম নাকি?’

আবছায়ায় অভিজিৎ একটু হাসল। কখন আরও দুটি ছায়ামূর্তি কেবিনের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের পরনে হোটেলের কর্মীদের ইউনিফর্ম। হাতে ফুলের বোকে। দুজনে দুপাশ থেকে নন্দিনীর হাতে বোকে-দুটো তুলে দিতেই কেবিন মধ্যে হঠাৎ লাল-নীল নানা রঙের আলো জ্বলে উঠল। সেইসঙ্গে আলোয় লেখা ফুটে উঠল, ‘শুভ জন্মদিন, নন্দিনী’।

নন্দিনীর মনে হচ্ছিল সে যেন স্বপ্ন দেখছে। বিহ্বল মুখটা ফেরাতেই, সে আর লাল জামা পরা লোক দুজনকে দেখতে পেল না। বদলে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অভিজিৎ। নন্দিনীর ডানহাতের অনামিকা তুলে ধরে সযত্নে হিরের আংটিটি পরিয়ে দিল অভিজিৎ।

নন্দিনী জানতে চায়, ‘এসব কী অভিজিৎ? তোমার বান্ধবী কই?’

‘বান্ধবী! তোমার চেয়েও ভালো ও কাছের বান্ধবী আর কেউ আছে নাকি আমার?’

নন্দিনীর গালদুটি নিজের বাড়িয়ে ধরা করতলে নিয়ে অভিজিৎ বলে ওঠে।

এত সুখ নন্দিনীকে যেন মাতাল করে দিচ্ছে। অভিজিৎ হাতে তালি দিতেই দুটি লোক হাতে খাবারদাবার নিয়ে এসে, টেবিলভর্তি করে সাজিয়ে দিয়ে চলে গেল।

অভিজিৎ নিজেই, তার আর নন্দিনীর প্লেটে খাবার তুলে দেয় চামচ দিয়ে। আর নিজের মনেই বলতে থাকে, ‘আমি কী ভাবছিলাম জানো নন্দিনী? সকাল থেকে তোমায় উইশ করিনি একবারও। তার উপর বান্ধবীর নাম করে দামি হিরের আংটি কিনেছি, তোমায় দিইনি– এতকিছুর পরে তুমি নিশ্চয়ই আমার উপর বেজায় খেপে যাবে। অভিমান করবে। কথা বলবে না। কিন্তু ঘটনা হল, কাছের মানুষজনকে সারপ্রাইজ দিতে আমার খুব ভালো লাগে। কোনও জিনিস স্বাভাবিক ভাবে হাতে এলে যত আনন্দ, আকস্মিক ভাবে এলে মজাটা তার বেশ কয়েকগুন হয়ে যায়। তাই নয় কি?’

অনেকক্ষণ পরে তার মনে হল, সে একাই বকবক করে যাচ্ছে, অথচ নন্দিনী কিছু বলছে না। তাই সে চোখ তুলে ডাকতে গেল, ‘নন্দিনী!’ কিন্তু তার মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হল না। সে দেখতে পেল চেয়ারে অদ্ভূত ভাবে এলিয়ে পড়ে আছে নন্দিনী। চুলটা খোলা। এলোমেলো। শাড়িটাও বিস্রস্ত। যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে নন্দিনীর উপর দিয়ে।

উদ্বিগ্ন অভিজিৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে নন্দিনীর কাছে গিয়ে তার কাঁধদুটো ধরে ঝাঁকিয়ে ডেকে উঠল, ‘নন্দিনী, নন্দিনী, কী হয়েছে তোমার?’ পাছে আওয়াজটা বাইরে গিয়ে লোকের মনে কৗতূহল সৃষ্টি করে, তাই যথেষ্ট চাপা গলায় সে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে।

নন্দিনী চোখদুটো খুলল হঠাৎ। ভয় পেয়ে গেল অভিজিৎ। কেবিনের আলো-আঁধারিতে তার চোখদুটো অসম্ভব ঘোলাটে দেখাচ্ছে। দৃষ্টিটা যেন এ পৃথিবীর নয়। রঙিন ঠোঁট ভীষণ ছড়িয়ে হাসল নন্দিনী। এ তো স্বাভাবিক হাসি নয়। বুকে কাঁপন ধরানো এমন হাসি সে আগে কখনও দেখেনি।

দু-পা পিছিয়ে এল অভিজিৎ। তার মনে পড়ে, নন্দিনীই একদিন জিজ্ঞেস করেছিল তাকে, ‘আমার মায়ের মানসিক অসুস্থতা ছিল। আমার আবার সেরকম কিছু হবে না তো?’

সময় নষ্ট না করে, সে নিজের মনেই বিড়বিড় করল, ‘ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে হবে–!’

বলে, ঘুরে দাঁড়াতেই কেউ যেন তার জামা ধরে টানল। ফিরে তাকিয়ে চমকে গেল অভিজিৎ। নন্দিনী হাসছে। সহজ, স্বাভাবিক, সরল, মজা-পাওয়া হাসি।

উদভ্রান্ত অভিজিৎ তার মুখটা নিজের করতলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কেমন আছো নন্দিনী?’

‘আমার কিছু হয়ইনি।’

‘তাহলে?’

নন্দিনী হাসতে হাসতেই জবাব দিল, ‘সারপ্রাইজ!’

পরকীয়া

 

অমিতের হাত দুটো শক্ত করে ধরল রত্না। ওর চোখেমুখে ভয় স্পষ্ট। এখন কী হবে অমিত?

কিচ্ছু হবে না, আমি আছি তো। তুমি চিন্তা কোরো না। খুব তাড়াতাড়ি তোমার পায়ে চোট সেরে যাবে। তুমি হাঁটতে পারবে। বলেই রত্নার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল অমিত। কিন্তু অমিতের আশ্বাসেও ভয় কাটল না রত্নার। পরিস্থিতি বুঝে রত্নার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল অমিত। তারপর রত্নাকে পায়ে ব্যথা নিরাময়ে ওষুধ খাওয়াল।

ওষুধ খাওয়ার কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়ল রত্না। আর তার পাশে আধশোওয়া থেকে আনমনা হয়ে পড়ল অমিত। তার চোখের সামনে তখন ভেসে উঠল সপ্তাহখানেক আগের ঘটনাটা অফিসের কাজে যাচ্ছি এই অজুহাতে কলকাতা থেকে বোলপুর পেঁছেছিল অমিত এবং রত্না। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে চেনাজানা একটি হোটেলে উঠেছিল দুজনে। দুদিনের জন্য বুকিং করে, বরাদ্দ ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করেছিল ওরা। যেন এই সময়টার অপেক্ষায় ছিল দুজনে। তাই, আলিঙ্গন, চুম্বনের পর চড়ান্ত শরীরী উষ্ণতা উপভোগ করতে অমিত এবং রত্না কেউই সময় নষ্ট করেনি। তবে এ ব্যাপারে রত্না একটু বেশি সক্রিয় ছিল। যেন ক্ষুধার্ত বাঘিনির মতো। দীর্ঘদিন অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে থাকার পর যেন সে ক্ষুধা নিবারণ করল। তাই, অমিত তাকে বাইরে বেরোনোর প্রস্তাব দিলেও, প্রথমে সে রাজি হয়নি। কারণ, বন্ধ ঘরে আরও কিছুটা সময় সে অমিতকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে চেয়েিল। কিন্তু একঘেয়েি কাটানোর জন্য অমিত-ই প্রায় জোরাজুরি করে বাইরে বের করেছিল রত্নাকে। আর তারপরই ঘটেছিল বিপত্তি। সোনাঝুরির জঙ্গলে অমিতের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে গর্তে একটা পা পড়ে গিয়েিল, তা বুঝতে পারেনি রত্না।

হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে এক্স-রে করানোর পর চিকিত্সক জানিয়েিলেন, রত্নার ডান পায়ে হাড়ে হালকা চিড় ধরেছে, ক্রেপ ব্যান্ডেজের পর অন্তত পনেরো দিন বিশ্রামে থাকতে হবে।

পায়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ নিয়ে হোটলের বিছানায় এক সপ্তাহ কাটিয়ে ফেলেছে রত্না। দুদিনের হোটেল বুকিং বাড়িয়ে কুড়ি দিন করেছে অমিত। এখনও অনেক দিন থাকার পর বাড়ি ফিরতে পারবে দুজনে। অফিসের কাজ বেড়েছে বলে দুজনেই বাড়িতে বার্তা পাঠিয়েে। কিন্তু অমিতের স্ত্রী সেই বার্তা বিশ্বাস করে নিলেও, রত্নার হ্যাজব্যান্ড সুনীল যে সন্দেহের বাইরে রাখেনি, কথা বলে তা বেশ বুঝতে পেরেছে রত্না। যাইহোক, রত্নার পাশে শুয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই অমিতের ঘোর কাটল ওর মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠায়।

অমিত দেখল ওর বউ নীলিমার ফোন। ফোন কাটল অমিত। তারপর, বিজি অ্যাট প্রেজেন্ট, আই উইল কল ব্যাক লেটার লিখে পাঠিয়ে দিল। ওকে রিপ্লাই পাওয়ার পর শান্তিতে চোখ বন্ধ করল অমিত।

ঘুম ভাঙার পর রত্না দেখল অমিত ঘুমোচ্ছে। বিশ্রাম নিচ্ছে দেখে অমিতকে আর বিরক্ত করল না রত্না। বরং, চুপচাপ শুয়ে থেকে ভাবতে লাগল, অমিতের সঙ্গে পুনর্মিলনের সেই মুহূর্তটির কথা।

বছরখানেক আগের এক বিকেল। রত্না যে-এডুকেশনাল ইন্সটিটিউট-এর ফ্যাকাল্টি, সেই ইন্সটিটিউট-এর স্টুডেন্টস ওয়ার্কশপ ছিল ধর্মতলায় অবস্থিত একটি পাঁচতারা হোটেলে। ওয়ার্কশপ শেষ হওয়ার পর রত্না হল থেকে বেরিয়ে হাঁটছে লিফ্ট-এর দিকে। হঠাত্ একজনকে দেখে খুব চেনা মনে হল।

লিফট-এর একটু দূরে ঘুরে ফিরে কথা বলছিল অমিত। তাই, অমিত কিনা তা নিশ্চিত হতে রত্না দাঁড়িয়ে পড়ল।

এরই মধ্যে রত্নার মনে পড়ে গেল, বছর পাঁচেক আগের বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনগুলির কথা। অমিত ওর মনের মানুষ ছিল। তাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখত রত্না। কিন্তু ইউনির্ভাসিটির পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর, অমিত হঠাত্ কেন যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল, তার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ দর্শাতে পারেনি। অনেক অপেক্ষার পর তাই মা-বাবার পছন্দের পাত্র সুনীলকে বিয়ে করে রত্না। শুধু তাই নয়, বিয়ে পর রত্না সুনীলের সন্তানের মা-ও হয়েে নির্দিষ্ট সময়ে কিন্তু, সুনীলের বদমেজাজ আর অমিতের প্রতি সুপ্ত ভালোবাসার কারণে, রত্না ভালো স্ত্রী হতে পারেনি। যাইহোক, এসব ভাবতে ভাবতেই অমিতের মুখোমুখি হল রত্না। অমিত একবারেই রত্নাকে চিনতে পারল। ফোন ছেড়ে, এক মুখ হাসি নিয়ে রত্নাকে জিজ্ঞেস করল

আরে রত্না, তুমি এখানে!

আমার ইন্সটিটিউট-এর স্টুডেন্ট ওয়ার্কশপ ছিল। কিন্তু তুমি এখানে কী করছ?

আমার কোম্পানির প্রোডাক্ট লঞ্চ ছিল এখানে। বাই দ্য ওয়ে কেমন আছো রত্না?

আছি একপ্রকার, মণিহারা ফণির মতো।

কথাটা বলেই হাসতে হাসতে অমিতের চোখের দিকে তাকাল রত্না। যেন সে অমিতের মনের কথা বোঝার চেষ্টা করছে। এর ঠিক কয়ে সেকেন্ড পরে রত্না অমিতকে বলল, তুমি কেমন আছো?

ওই চলছে একপ্রকার।

ব্যস্ত মানুষ। তা এখন হাতে একটু সময় আছে? খুব বেশি সময় নষ্ট করব না। এতদিন বাদে দেখা, তাই একসঙ্গে বসে একটু কফি খাওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।

সেদিন রত্নার কফি খাওয়ার অনুরোধ রক্ষা করে, নিজেও খুশি হয়েিল অমিত। আড্ডা জমেছিল অনেক রাত পর্যন্ত। দুজনের বিবাহিত জীবন কেমন চলছে, একে অপরকে না পেয়ে কতটা দুখি, সবই সেদিন শেয়ার করেছিল পরস্পরকে। আর সেদিনের জন্য যখন একে অপরের থেকে বিদায় নিয়েিল, তখন দুটো শরীর যেন চুম্বক আর লোহার রূপ নিয়েিল। রাত বাড়ছে, বাড়ি ফিরতে হবে, ভেবেই হয়তো বাহুমুক্ত হতে বাধ্য হয়েিল তারা।

এরপর প্রতি মুহূর্তে দুজনে দুজনকে চোখে হারিয়েে। সময় পেলেই ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, কিংবা ম্যাসেঞ্জারে দীর্ঘ সময় ধরে মনের ঝাঁপি খুলে ধরেছে।

রত্না এবং অমিত অফিস আওয়ার্স-এ বেশি কথা বলত। কারণ দুজনে যেহেতু অন্যের সঙ্গে ঘর বেঁধেছে, তাই ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে বাড়ি থেকে খুব কম কথা বলত তারা। তবে সংসার এবং কর্মক্ষেত্রের জন্য ওই দিনের পর আর দেখা করতে না পারলেও, মনের টান বাড়তে লাগল উভয়ে। এ ব্যাপারে বেশি কাছে আসতে চাইত রত্না। একবার দূরভাষে রত্না অমিতকে জীবনসঙ্গী হিসাবে না-পাওয়ার জন্য এতটাই আক্ষেপ করতে শুরু করেছিল যে, অমিত জিজ্ঞেস করল বিয়ে করে তুমি কি খুশি নও?

অমিতের কথার উত্তরে রত্না সেদিন বলেছিল, আজ নয়, সময় এলে তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আমি অন্য ভাবে দিতে চাই।

একটু থেমে রত্না আবার অমিতকে আবেগভরা গলায় বলল, আমরা যে পরস্পরকে আজও ভালোবাসি, এটা তো সত্যি।

ভালোবাসা ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু এর বেশি আর কীই-বা করতে পারি আমরা? আমরা তো এক বিছানা শেয়ার করতে পারব না। কেউ কি সমর্থন করবে আমাদের এই সম্পর্ককে? কেউ কি বুঝবে যে, আমরা বিয়ে করেছি একজনকে আর ভালোবাসি অন্য কাউকে?

অমিতের আবেগ দ্বিগুন হল। আবারও সে বলতে শুরু করল, তুমি-ই বলো রত্না, কী করা উচিত আমাদের?

উত্তরে রত্না সেদিন জানিয়েিল, বিয়ে এবং ভালোবাসা দুটি ভিন্ন বিষয় আমার কাছে। যাদের আমরা বিয়ে করেছি, তাদের জায়গায় রেখেও তো আমরা আমাদের দুজনের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি, নতুন করে আমাদের যা মন চায় তাই করতে পারি।

মানলাম আমরা দুজনে যা মন চাই তাই করলাম, কিন্তু আমাদের বাড়তি চাওয়ার ফলে তো সংসার থেকে মনও উঠে যাবে। আমাদের জীবনসঙ্গীরা তো কোনও অন্যায় করেনি, আমাদের সন্তানরা তো কোনও অন্যায় করেনি। তাহলে তারা অকারণে কেন শাস্তি পাবে?

অমিতের কথা কেড়ে নিয়ে রত্না বলেছিল, আমি কাউকে শাস্তি দিতে বলছি না, শুধু আমাদের চাহিদা পূরণের কথা বলছি। তাছাড়া আমরা তো ওদেরকে খুশি রেখেছি এতদিন। আজ যদি ভালোবাসার মানুষকে আমরা নতুন করে পেতে চাই, তাহলে অন্যায়টা কোথায় অমিত?

সেদিন আর কথা বাড়ায়নি অমিত। কিন্তু দূরভাষে এভাবেই মাঝেমধ্যে কাছে আসার জন্য উতলা করে তুলত রত্না। অমিতও রত্নাকে কাছে পাওয়ার একটা অদ্ভুত টান অনুভব করত। কিন্তু বউ-বাচ্চার কথা ভেবে আবার পিছিয়ে যেত। এভাবেই রত্নাকে এবং নিজের মনকে বহুবার সামাল দিয়ে এসেছিল অমিত। কিন্তু ওদের পুনর্মিলনের এক বছর যখন পূর্ণ হতে চলেছিল, তখন রত্না জানাল, অমিত, আমি আর পারছি না, অন্তত দুটো দিন তোমার সঙ্গে একান্তে কাটাতে চাই। আগামী মাসের চার তারিখ আমাদের দেখা হওয়ার এক বছর পূর্ণ হবে। ওই দিন আমরা বোলপুরে গিয়ে দুদিন কাটাব। ব্যস, এটুকুই আমার চাওয়া। ওই দুদিনের স্মৃতি নিয়ে আমি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। তুমি রাজি হয়ে যাও প্লিজ।

রত্নার অনুরোধে দুদিন পর ভেবেচিন্তে বোলপুরে আসার সম্মতি জানিয়েিল অমিত। কিন্তু সেই সুখ কপালে সইল না। হোটেলের বিছানায় অমিতের পাশে শুয়ে রত্না তাই ভাবছিল, কী যে হয়ে গেল! বেশ ছিলাম হোটেলে, কেন যে মরতে বাইরে বেরোলাম, আরও এক সপ্তাহ পর কীভাবে যে সুনীলের মুখোমুখি হব বাড়ি গিয়ে এভাবেই ভাবনা আর অনুভবে পাশাপাশি থাকতে থাকতে অমিত ও রত্না কাটিয়ে দিয়েে আরও এক সপ্তাহ। এখন অমিতের কাঁধে ভর করে কিছুটা হাঁটতেও পারছে রত্না। ওর পায়ে ব্যান্ডেজ খুলে দিয়েেন ডক্টর। এবার ওদের বাড়ি ফেরার পালা।

হোটেল ছাড়ার আগে রত্না অমিতকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে রয়েে। মিনিটখানেক ওভাবে থাকার পর রত্না অমিতের চোখে চোখ রেখে জানাল, আমার মনের দরজা সারা জীবন শুধু তোমার জন্য খোলা থাকবে। তুমি যখন খুশি আসতে পারো, আমি তোমার কাছে আত্মসমর্পন করে আনন্দ পাব।

রত্না এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি। স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে পারছিল না। তা দেখে অমিত কিছুতেই রত্নাকে একা বাড়ি ফিরতে দিল না। আরও কিছুটা সময় যাওয়ার পথে অমিতকে কাছে পাবে, তাই রত্নাও আর বাধা দেয়নি।

ফেরার পথে ওরা আর ট্রেন ধরল না। বোলপুর থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিল কলকাতার বালিগঞ্জের উদ্দেশে। ওখানেই রত্নার শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু অমিত থাকে উত্তর চব্বিশ পরগণার ব্যারাকপুরে। তাই, রত্নাকে অমিত জানিয়েিল, ওর শ্বশুরবাড়ির কিছুটা আগে ওকে রিকশোতে তুলে দেবে। কিন্তু রত্না জানাল, না, তুমি আমাকে বাড়িতে পেঁছে দিয়ে আসবে। আমি সুনীলকে ম্যানেজ করব, আলাপ করিয়ে দেব তোমার সঙ্গে।

বাড়ি পেঁছোনোর আগে সুনীলকে ফোন করে তাকে রিসিভ করার কথা জানিয়েিল রত্না। সেইমতো রাস্তায় এসে ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়েিল সুনীল।

গাড়ি থেকে নেমেই রত্না প্রথমে ছেলেকে কোলে তুলে নিল। কারণ, বিগত পনেরো দিন সে শুধু দূরভাষে ছেলের খবর নিয়েিল, টুকটাক কথা বলেছিল। ছেলের জন্য রত্নার বেশি চিন্তা ছিল না, কারণ রত্না জানত, ওর শাশুড়ি নাতিকে খুব ভালোবাসেন, তাই সামলে নেবেন।

সোনা বাবা, তুমি কেমন আছো? ঠাকুমা তোমায় আদর করেছিল তো? ছেলের গালে চুমু দিতে দিতে কথাগুলো বলতে থাকে রত্না।

ঠাকুমা আমায় অনেক গল্প শুনিয়েে। সদ্য কথা বলতে শেখা ছেলেটি তার মাকে জানায়।

রত্নাকে নামিয়ে অমিত গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতে চেয়েিল, তখনই রত্না গাড়ির ড্রাইভারকে থামতে বলে এবং অমিতকে নামতে বলে ইশারায়।

সুনীল, এদিকে এসো, আলাপ করিয়ে দিই আমার বন্ধু অমিতের সঙ্গে। মনে কোনও দ্বিধা-সংশয় না রেখে, খুব স্বাভাবিক ভাবে অমিতের সঙ্গে সুনীলের আলাপ করিয়ে দেয় রত্না।

অমিতের সঙ্গে আলাপ পর্বে সুনীল কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি ঠিকই, কিন্তু হতবাক হয়েিল হঠাত্ এমন একটি অভাবনীয় ঘটনার মুখোমুখি হয়ে তাই অমিত চলে যাওয়ার পর, একাধিক প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছিল কিছুটা উত্তেজিত হয়ে কিন্তু রত্নাকে নিরুত্তাপ দেখে, সামযিক ভাবে ঘাবড়ে গিয়েিল সুনীল।

সময় এগিয়ে চলে তার নিজস্ব গতিতে। কাজের ব্যস্ততায় সুনীলের মাথা থেকেও বেরিয়ে যায় অমিতের বিষয়টা। পায়ে ব্যথা সেরে গিয়ে স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারার পর রত্নাও আবার কাজে যোগ দেয়। সময় পেলেই অমিতকে ফোনও করতে থাকে নিয়মিত। এভাবেই চলছিল সবকিছু, কিন্তু দিনের পর দিন বিছানায় রত্নাকে আর আগের মতো না পেয়ে নতুন করে আষাঢ়ের মেঘ ঘনীভত হতে শুরু করে সুনীলের মনে।

রাত দশটা। ডিনার সেরে নিয়েে রত্না। ছেলেকে খাইয়ে ওর ঠাকুমার ঘরে দিয়ে এসেছে। ঠাকুমার সঙ্গেই এখন ঘুমোনোর অভ্যাস ছেলের। রত্না তাই এখন একা। সুনীলের ফিরতে এখনও ঘন্টাখানেক বাকি। তাই এই ফাঁকা সময়ে অমিতের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হল রত্নার।

অমিত সেই রাতে অফিসের কাজে উত্তরবঙ্গে ছিল। কাজ সেরে হোটেলের ঘরে বসে টিভি দেখছিল। রত্নার ফোন রিসিভ করে টিভি বন্ধ করে দেয়। তারপর বেশ নিশ্চিন্তে কথোপকথন চালাতে থাকে অমিত এবং রত্না।

আবেগে চোখ বন্ধ রেখে কথা বলছিল রত্না। তাই, সুনীল কখন ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে ওর প্রেমালাপ শুনছিল, বুঝতেই পারেনি। হঠাত্ ঘরে কারওর উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খোলে রত্না। আচমকা সুনীলকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ফোন কেটে দেয় সে।

ফোনের ওপারে কে ছিল? ওই লোকটা যে তোমাকে পেঁছোতে এসেছিল? কর্কশ ভাবে প্রশ্নগুলো রত্নার দিকে ছুড়ে দেয় সুনীল।

হ্যাঁ, আমিতই ছিল, তো কী হয়েে?

প্রেম তো বেশ জমে উঠেছে দেখছি। এইজন্যই ভাবছিলাম, রাতে এখন শরীরে তোমার প্রাণ থাকে না কেন?

বাজে কথা রাখো। রাত হয়েে, আমার ঘুম পাচ্ছে, ফালতু বকবক করতে পারব না।

তা পারবে কেন! সব এনার্জি তো ওই লোকটার সঙ্গে বকবক করে শেষ করে ফেলেছ। লজ্জা করে না। বাচ্চার মা তুমি। আমি কী অভাব রেখেছি তোমার?

তুমি আমার শরীরের খবর রেখেছ, মনের খবর রেখেছ কি?

বাহ্, ভালো বলেছ। এখন অনেক কথাই তুমি বলবে। ওই ইতরটার সান্নিধ্য পেয়ে না। এখন তো আমার সবই তোমার কাছে মূল্যহীন মনে হবে। যাইহোক, একটা কথা স্পষ্ট জানিয়ে রাখছি, আর যদি ওই লোকটার সঙ্গে যোগাযোগ রাখো, তাহলে তোমার সঙ্গে আমার ফাটাফাটি হবে বলে দিলাম। আমার সম্মান নষ্ট করলে আমি ছাড়ব না।

তোমার যা করার আছে তুমি করে নাও। অমিত আমার বন্ধু, আমি যোগাযোগ রাখবই।

ওহঃ তাই? দেখাচ্ছি মজা…

বলেই রত্নার হাত থেকে ওর মোবাইল ফোনটা কেড়ে নিয়ে মাটিতে আছাড় মারে সুনীল। ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে ফোনের যন্ত্রাংশ। ভাঙা ফোনটা থেকে সিম কার্ডটা খুলে নিয়ে সুনীলের গালে সপাটে একটা চড় মেরে, অফিসের ব্যাগটা কাঁধে তুলে নেয় রত্না। ঘর থেকে বেরোনোর আগে সুনীলকে ধাক্কা মেরে ঠেলে ফেলে দেয় এবং বাইরে থেকে দরজা আটকে দিয়ে রাস্তায় আসে। তারপর একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা হাতিবাগানে মায়ে বাড়িতে ওঠে।

অমিত সেদিন ওর মাকে ফোন করে দরজা খুলিয়ে উদ্ধার হয়েিল ঘর থেকে। রাগের মাথায় সুনীল সেদিন রত্নার বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিতে চেয়েিল কিন্তু ওর মা নিতে দেননি।

ওই ঘটনার পর কেটে গেছে এক সপ্তাহ। রত্নার কোনও খবর নেই। ছেলের খোঁজটুকুও নেয়নি। এদিকে ছোট্ট ছেলেটিকে ঠাকুমা আগলে রাখলেও, মাঝেমধ্যে মা-র জন্য কান্নাকাটি করতে থাকে। ওই দৃশ্য দেখে সুনীল আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। মনকে বুঝিয়ে রত্নার খোঁজ শুরু করে। রত্নার অফিস থেকে কোনও খবর পায় না। এক আত্মীয়ে মাধ্যমে জানতে পারে রত্না ওর মায়ে বাড়িতে আছে।

ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আর পরিবারের সামাজিক সম্মান বাঁচানোর তাগিদে, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে রত্নার মুখোমুখি হয় সুনীল। শাশুড়িকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আর রত্নার হাত ধরে অনেক অনুনয়, বিনয়ে পর, রত্নাকে বাড়ি ফেরাতে সক্ষম হয় সে। কিন্তু সুনীলকে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়, অমিত-রত্নার সম্পর্কের ব্যাপারে আর কখনও সে নাক গলাবে না।

ফিরে এসো মলি

ভাইয়ের জ্বর কমছে না কিছুতেই। ওই ১০৪ ডিগ্রিতে আটকে রয়েছে। মলয়ের কপালে হাত রেখে থার্মোমিটার-টায় আর একবার চোখ বুলিয়ে নিল হিমানী। তারপর আবার কাপড় ভিজিয়ে মলয়ের কপালে রাখল।

নিজের মনে মনেই বিড়বিড় করতে থাকল হিমানী, কেন যে জ্বর নামছে না কে জানে? কতবার ভাইকে ডাক্তারের কাছে যেতে বললাম, কিন্তু সেই এক জেদ… ঠিক হয়ে যাবে।

দিদি চিন্তা করিস না, ডাক্তার দেখিয়ে বা কী হতো ক্ষীণ স্বরে মলয় হিমানীকে বোঝাবার চেষ্টা করে।

আমি আর তোর এই অবস্থা দেখতে পারছি না। চোখের তলায় কে যেন কালি ঢেলে দিয়েে মনে হচ্ছে! এত দুর্বল শরীর। আমি জানি মলির চলে যাওয়াটাকে তুই কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিস না। তুই নিজেই তো কাণ্ডটা বাঁধিয়েিস। কাউকে কিছু না বলে ডিভোর্স নিয়ে নিলি? সাতবছর একসঙ্গে সংসার করলি। সন্তান হয়নি তো কী হয়েে? আমি জানি মলির দুবার মিসক্যারেজ হয়েে কিন্তু বাচ্চা দত্তক নিতেই বা কী অসুবিধা ছিল? মা-বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন বলার কেউ ছিল, এখন তো তোদের স্বাধীন জীবন।

আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না মলি কী করে এতটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল? তুই চিরকালই কম কথা বলিস। বেচারা মলি নিঃসঙ্গতা কাটাবার জন্য স্কুলে পড়াবার চাকরি-টা নিল আর বাড়িতে টিউশন করা আরম্ভ করেছিল। ওর দুটো কাজই তুই মেনে নিতে পারলি না। তোর মনে হল টাকার জন্য ও কাজ করছে। তোর অহংকারে লাগল। ভাই, আমি ভালো করেই জানি, তুই আজও পুরোনো বস্তাপচা সংস্কার আঁকড়ে ধরে চলার চেষ্টা করিস। তুই শুধু যে মা-বাবাকে হারিয়েিস তা তো নয়, মলিও দ্বিতীয়বার মা-বাবার স্নেহের আঁচল থেকে বঞ্চিত হয়েছে। জানিস-ই তো কী প্রচণ্ড ভালোবাসত ও মা-বাবাকে।

মলয় চুপ করে থাকে। হিমানী কথাগুলো না বলেও থাকতে পারে না। ও জানে দোষ মলয়ের তাই দোষটা চোখে আঙুল দিয়ে ওকে দ্যাখানো দরকার। হিমানী আবার বলে, তোর রাগ তো আমি জানি ভাই। নিশ্চয়ই চ্যাঁচামেচি করতিস মেযোর উপরে। একটা ভালো পড়াশোনা জানা মেয়ে একা সে করবেটাই বা কী? কারও সঙ্গে ওকে মিশতে দিবি না, বাড়িতেও কেউ আসা-যাওয়া করবে না। এখন ও চলে গেছে তাতেও তোর শান্তি নেই।

ও-বেচারারই বা কী অবস্থা কে জানে!

দিদি, প্লিজ চুপ কর, যন্ত্রণায় মাথা ফেটে যাচ্ছে। তুই যা ভাবছিস তা মোটেই নয়। আমার কোনও সমস্যা হচ্ছে না! যার সঙ্গে খুশি ও থাকতে পারে, আমার কী? আমাকে বলেছে, আমি মরলেও জিজ্ঞেস করার কেউ থাকবে না আমার কাছে। ও এটাই চায়। তুই কী করে মলিকে সাপোর্ট করছিস? বেশি আর কী হবে মরেই যাব, এই তো?

তোর একটু শরীর খারাপ হলেই কান্নাকাটি করে একশা করত। তোর আঘাত লাগলে মুখ চুন করে ঘুরত। মায়ে অপারেশনের সময় কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞানই হয়ে পড়েছিল। ও যা মায়ে সেবা করেছে, আমিও হয়তো করতে পারতাম না। সেই মেয়ে সব ছেড়েছুড়ে সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে চলে গেল বিশ্বাস হয় না!

ওকে কনট্যাক্ট করার কোনও তো নম্বর হবে, আমাকে প্লিজ দে ভাই। একবার কথা বলতে চাই। ওর বান্ধবী শুভ্রার নম্বর তোর কাছে আছে? হিমানী নিজেই মলয়ের মোবাইলটা খাটের পাশ থেকে তুলে নিয়ে নম্বর খুঁজতে থাকে।

এখন আর কিছুই করার নেই দিদি। মলি নিজে বলেছে ও শশাঙ্ক-কে বিয়ে করে কানাডা চলে গেছে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মলয়।

হিমানী মলয়ের থেকে চার বছরের বড়ো। হিমানীর বিয়ে পাঁচ বছর বাদে মলয়ের বিয়ে হয়। স্বভাবে মলয় আর মলি একেবারে বিপরীত দুটো মানুষ। মলয় অন্তর্মুখী আর মলি উচ্ছল ঝরনাধারার মতো। বিয়ে হয়ে এসেই মলয়ের মা-বাবাকে আপন করে নিয়েছিল মলি নিজের ব্যবহারে। হঠাত্-ই মলয়ের মা মারা যান স্ট্রোক-এ। বাবাও আর বেশিদিন বাঁচেননি। সুগারের রুগি ছিলেন।

মা-বাবার মৃত্যু মলয় মানতে পারেনি। ডিপ্রেসড থাকতে শুরু করে। মলিও কিছুতেই ওকে এই অবসাদ থেকে টেনে বের করতে পারে না। ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়া শুরু হয়।

অথচ মলি নিজের শ্বশুর-শাশুড়ির যত্নের কোনও অবহেলা কোনওদিন করেনি। বাড়ির সব কাজ সেরে মাঝেমধ্যে বাইরে ঘুরে আসত মলি। বাইরের কাজ থাকলে সেটা করে পাড়া-প্রতিবেশীদের খবরাখবর নিত। তাদের বাড়ি যেত, তাদের বাড়িতে ডাকত। সকলের সঙ্গে সঙ্গে শ্বশুর-শাশুড়িরও আদরের ছিল সে। সকলেই তাকে ভালোবাসত। কিন্তু তাঁরা মারা যাওয়ার পর থেকেই, লোকজনের বাড়িতে আসা-যাওয়াটা মলয়ের কাছে অসহ্য হয়ে উঠল। অল্পেতেই মলয বিরক্ত হতো। কখনও মায়ে মতো রান্নায় স্বাদ হয়নি বলে, মলিকে বকাবকি করত। আবার কখনও ওর এত বাইরে যাওয়া নিয়ে অশান্তি আরম্ভ করে দিত।

শশাঙ্ক মলির ছোটোবেলার বন্ধু। ক্লাস টুয়েভ অবধি একসঙ্গে পড়েছে। সবসময় হাসিমুখ, অন্যের প্রযোজনে পাশে দাঁড়ানো, লোকের বিপদে আগু-পিছু না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়া এই সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য সবার কাছেই খুব পপুলার ছিল শশাঙ্ক। স্কুল শেষ হওয়ার পর আর যোগাযোগ ছিল না, হঠাত্ই রাস্তায় একদিন মুখোমুখি দেখা। সেই একই রকম চেহারা রয়েে। মুখে দুষ্টু-মিষ্টি হাসিটা লেগে রয়েে। চোখদুটো যেন কথা বলছে। শুধু তফাত, আগের থেকে চেহারা খানিকটা ভারিক্কি হয়েে আর মুখের ফ্রেঞ্চকাট দাড়িটা।

আরে, শশাঙ্ক তুই, এখানে! চিনতে পারছিস? মলি খপ করে ওর হাতটা ধরে ফেলে।

হ্ঁযা। তুই মলি? বিশ্বাস হচ্ছে না। মলি মানেই সেই স্কার্ট-ব্লাউজ পরা, দুটো বিনুনি ঝোলানো, রুমাল দিয়ে নাক মুছতে থাকা মেযোকেই মনে পড়ে। শাড়ি পরে মাথায় সিঁদুর, না রে আমি কিছুতেই মেলাতে পারছি না! হা হা করে রাস্তার মাঝেই হাসতে আরম্ভ করে শশাঙ্ক।

আর তুই এখনও বিয়ে করিসনি? হেসেই জিজ্ঞেস করে মলি।

ঝটপট উত্তরও পেয়ে যায়, পাগল! এখনও আমি স্বাধীন। কষ্ট করে পড়াশোনা করেছি, ভালো একটা চাকরিও জোগাড় করেছি। এত সহজে হাড়িকাঠে মাথা দেব ভেবেছিস? একটু তো প্রাণখুলে নিঃশ্বাস নিই। মলির মনে হয় শশাঙ্ককেই মানায় এই প্রাণখোলা হাসিটায়।

কী করছিস? কিছু কেনাকাটা করার আছে নাকি? নয়তো চল বাইক সঙ্গে আছে, কোথাও বসে একটু আড্ডা মারি, শশাঙ্ক বলে।

না রে, সারাদিন বাড়িতে থেকে হাঁপিয়ে উঠলে সন্ধেবেলায় একটু ঘুরে আসি। প্রযোজনে টুকিটাকি জিনিসও মাঝেমধ্যে কিনে নিই। সেটাই কিনতে যাচ্ছি এখন, হাসে মলি।

কেন রে, তোর পতিদেব বাইরের হাওয়া খেতে ভালোবাসে না! নাকি বউয়ে হাত ধরে বেরোনো তার পছন্দ নয়? নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ওঠে শশাঙ্ক। লক্ষ্য করে না ওর এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে, মলির মুখে একটা ছায়া পড়ে, আবার মিলিয়ে যায়।

ঠিক আছে, চল না, জিনিসগুলো কিনে নে। তারপর কোথাও একটু চা খেয়ে তোকে না হয় আমি বাইকে ছেড়ে দিয়ে আসব।

খানিক্ষণের মধ্যে বাইকের পিছনে বসে যেতে যেতে মলি শশাঙ্কের বলে যাওয়া জোক্সগুলো একটার পর একটা শুনতে শুনতে, অনেকটা হালকা বোধ করল। মনের উপর থেকে একটা ভারী পাথর যেন সরে গেছে। শশাঙ্কটা কিছুতেই গম্ভীর হয়ে থাকতে দেয় না। খিলখিলিয়ে হেসে উঠল মলি এবার। বহুদিন বাদে এভাবে মনখুলে মলি হাসতে পারল। শশাঙ্কর দ্বারা বোধহয় কিছুই অসম্ভব নয়। শশাঙ্ক এবার প্লিজ থামবি। হাসতে হাসতে পেট ব্যথা করছে, কপট রাগ প্রকাশ করল মলি। মলির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দুজনের কথা হচ্ছিল।

উফ্, মলি তুই কি বোরিং হয়ে গেছিস। কোথায় বরের সঙ্গে ঘুরবি, মুভি দেখতে যাবি, রেস্টুরেন্টে খাবি তা না করে

দোকান-বাজার করছিস। বিয়ে কেন করেছিস? চল তোর বরের জন্য সিঙাড়া কিনে দিই। কী করে না খায় দেখব। বাড়ি ঢুকে আগে গরম গরম চা কর। আশ্চর‌্য মলিকে বাড়িতে ছাড়তে অথবা বাড়িতে এসে মলির বরের সঙ্গে আলাপ করতে, এতটুকুও সঙ্কোচ বোধ ছিল না শশাঙ্কর। বরং মলি একটু বিব্রত বোধ করছিল। শশাঙ্কর উপস্থিতি মলয় কীভাবে নেবে, সেটা মলি বুঝে উঠতে পারছিল না।

দ্বিধা নিয়ে মলি শশাঙ্ককে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। মলয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে শশাঙ্ককে বসিয়ে মলি চা করতে চলে গেল। চা-সিঙাড়া ট্রে-তে সাজিয়ে ঘরে ঢুকে দেখল মলয় চুপচাপ বসে, শশাঙ্ক একাই কথা বলে যাচ্ছে। শশাঙ্কর অনেকবার অনুরোধ করায় সিঙাড়ার একটা কোণ ভেঙে একটু মুখে দিয়ে প্লেট সরিয়ে রাখল। শশাঙ্কর মজার মজার কথাতেও মলয়ের মুখের কোনও পরিবর্তন হল না। মলয়ের মতে একটা বয়সের পর মানুষকে গম্ভীর হয়ে যেতে হয়। বাচ্চাদের মতন আচরণ তখন মানায় না। এর জন্য় কত বকা যে শুনতে হয় মলিকে, তার গুনতি করাই অসম্ভব।

ওদের কথার মাঝেই মলয় উঠতে চাইলে শশাঙ্ক উঠে দাঁড়ায়, আপনি বসুন, আমি এখন উঠব। অনেক বোর করলাম কিন্তু শিগগির আবার আসব। তৈরি থাকবেন।

গেট পর‌্যন্ত এসে মলির কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে শশাঙ্ক বলল, এই লোকটাকে মানুষ বানিয়ে তবে ছাড়ব। আমি সহজে হার মানছি না। একে কী করে তুই বিয়ে করেছিস মলি! কাল সন্ধেবেলায় দেখা হচ্ছে। বাই, দিয়ে স্পিডে বেরিয়ে গেল।

পরের দিন সন্ধে ছটার সময় শশাঙ্ক মলির বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল। মলি দরজা খুলতেই পকেট থেকে তিনটে গোলাপি রঙের সিনেমার টিকিট চোখের সামনে নাচিয়ে শশাঙ্ক বলল, তাড়াতাড়ি তৈরি হ। তোর ব্যাজারমুখো বরটা কোথায়? ওটাকেও তৈরি হতে বল। আটটার শো। একটা ভালো কমেডি ছবি এসেছে।

তোকে তো বলেছিলাম মলয় সিনেমা দেখা পছন্দ করে না। বিশেষ করে কমেডি তো একেবারেই নয়। আরে ডাক না তোর বরকে। ওর পছন্দের ব্ল্যাক কফি খাওয়াব। রাতের ডিনারটাও না হয় আমার তরফ থেকেই। দ্যাখ এদিকটায় নতুন নতুন এসেছি কাউকে এখনও সেরকম চিনি না। ভাগ্যিস তোর সঙ্গে দেখা হয়েিল! নে নে তাড়াতাড়ি কর। কুড়ি মিনিট পর ক্যাব পেঁছে যাবে, শশাঙ্ক অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে।

মলয় না করা সত্ত্বেও জোর করে ধরে নিয়ে যায় শশাঙ্ক সিনেমা দেখাতে। সারাটা সন্ধে আর বিশেষ কথা বলে না মলয়। চুপচাপ ডিনার খাওয়া শেষ করে শশাঙ্ক ওদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। বাড়ি এসেই মলির উপর রাগ উগরে দেয় মলয়।

মলি, তোমার বন্ধু খুব বেশি বাড়াবাড়ি করছে। ওকে আমার পছন্দ-অপছন্দগুলো বলে দিও। এরপর যদি করে, আমি কিন্তু যা-তা বলতে বাধ্য হব। ওর ফালতু রসিকতা তোমার মতো বেকারের পছন্দ, আমার নয়। মলিকে সাবধান করে দেয় মলয়।

শ্বশুর-শাশুড়ি মারা যেতে স্নেহভরা পরিবেশ মলিও হারিয়েিল। কুড়ি বছর বয়সে নিজের বাবাকে হারিয়েিল সে। চারপাশটা কেমন শূন্য মনে হয় মলির। চরম বিষাদেও নিজেকে অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেয়নি মলি। ভাঙা মন জোড়া লাগিয়ে আবার নতুন উদ্যমে বাড়ির পরিবেশটাকে খুশিতে ভরিয়ে তুলেছিল।

কিন্তু মলয়ের ক্ষেত্রে পুরোপুরি হেরে গেছে মলি। দুবছর কেটে গেছে, মা-বাবার মৃতু্যর শোক আজও ভুলতে পারেনি মলয়। অবসাদের পরিবেশ কাটিয়ে উঠতে, কাছেই একটা স্কুলে চাকরি নিয়েিল মলি। সেখানে সারাদিন বাচ্চা পড়িয়ে মনটা ভালো থাকত। এরপর বাড়িতেও বাচ্চাদের পড়াতে আরম্ভ করে সে। কিন্তু শনিবারগুলো মলয় বাড়ি থাকত। এছাড়া যেদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরত, সেদিন বাড়িতে চার-পাঁচটা বাচ্চার হাসি, কথাবার্তা, সবেতেই বিরক্ত হয়ে উঠত মলয়। তাই, মলয়কে খুশি করতে সপ্তাহান্তে বাচ্চা পড়ানো বন্ধ করে দিয়েিল মলি।

মলির ব্যস্ততার কারণে আর মলয়ের অপছন্দ করার ফলে, শশাঙ্কও মলির বাড়ি আসা-যাওয়া কমিয়ে দিয়েিল। মাঝেমধ্যে শনিবার এলেও, মলির সঙ্গে গল্প করেই চলে যেত। মলয় একদিনও ওদের সঙ্গে বসে আড্ডায় যোগ দিত না। শশাঙ্কর মজা করার অভ্যাস কিছুটা প্রাণ ফিরিয়ে আনত মলির।

একদিন একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরতেই, মলয় দেখল বাড়িতে হইহই হচ্ছে। বাড়িতে কেক কাটা চলছে। মলির কোনও ছাত্রের জন্মদিন পালন করা হচ্ছে। কিছু না বলে চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল মলয়।

বাড়ি খালি হতেই মলয় একপ্রকার ঝাঁপিয়ে পড়ল মলির উপর, তোমাকে বলেছি না, বাড়ি ফিরে আমার একটু শান্তি চাই। এইসব ড্রামা আমার একদম পছন্দ নয়। কাল থেকে কোনও বাচ্চা যেন আমার বাড়িতে পড়তে না আসে। পড়াবার ইচ্ছে থাকলে কোথাও ঘর ভাড়া করে পড়াও। আমার খুশি তো তুমি কখনওই দ্যাখো না, যা ইচ্ছে তাই করো। আমি এটা বরদাস্ত করব না, বলে আবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

ধৈর‌্যের শেষ বাঁধটুকুও ভেঙে গেল মলির। মলয়ের কথাগুলো ছুরির আঘাত ওর কোমল হৃদয়টাকে রক্তাক্ত করে তুলল। মলয়ের ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় ধাক্কা মেরে জোর করে দরজা খুলিয়ে প্রথমবার মলয়ের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল।

তুমি কী বলছিলে? তোমার বাড়ি? তোমার খুশি? আমি তো বিয়ে পর এটাকেই নিজের বাড়ি বলে ভেবে এসেছি। তোমার হুকুম শোনার জন্য আমি বিয়ে করিনি। আমি তোমার চাকর নই। তুমি শুধু নিজের খুশির চিন্তা করো, বউয়ে খুশি নিয়ে একদিনও ভেবেছ?

আমিও আদরে মানুষ হয়েি। একটা বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে মেযো সেটাকেই নিজের বাড়ি ভেবে নেয়, ওই বাড়ির নিয়মে নিজেকে আবার নতুন করে ঢেলে সাজায়। আর তুমি এক নিমেষে আমাকে বাইরের রাস্তা দেখিয়ে দিলে? তোমার যদি এরকমই মেয়ে পছন্দ ছিল তাহলে অনাথ, গরিব, অশিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করলেই পারতে। হাত জোড় করে তোমার আজ্ঞা পালন করত। কিন্তু তা তো হবার নয়। বিয়ে করতে হবে শিক্ষিত, সুন্দরী, ভালো ঘরের মেয়েে। যাতে সবার কাছে সম্মানটা বজায় থাকে, রাগে কাঁপতে কাঁপতে এক নিশ্বাসে মলি কথাগুলো বলে হাঁপাতে থাকে। মলয় বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকে মলির দিকে, মুহূর্তে কোনও উত্তর জোগায় না মুখে।

পুরুষ মানুষ, বউয়ে কাছে হেরে যাওয়া লজ্জার কথা। সুতরাং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মলয় বলে উঠল, এতই যদি দম্ভ, বড়োলোক দেখে বিয়ে করলে না কেন? শশাঙ্কই তো ছিল। ওর সঙ্গে সময় কাটাবার জন্য তোমার মন কাঁদে সব সময়। কেন, আগে ও ভালো চাকরি করত না বলে বিয়ে করনি?

খবরদার মলয়, একটা বাজে কথা মুখ থেকে আর বার করবে না। তোমার নোংরা মনের পরিচয় আমি আগেই পেয়েি। আমি শশাঙ্কর কাছেই চলে যাচ্ছি। একটাই শান্তি, ও তোমার মতো নীচ মনের মানুষ নয়। ওর সঙ্গে আমি অনেক ভালো থাকব, বলে রাগের মাথায় শশাঙ্ককে ফোন করল মলি।

অফিস ফেরত শশাঙ্ক সোজা মলিদের বাড়ি এল। মলিকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করল। মলয়ও অনেক অনুনয়-বিনয় করল কিন্তু মলি মন ঠিক করে নিয়েিল। কেউই কিছু বোঝাতে পারল না মলিকে। অগত্যা শশাঙ্ক বলল, ঠিক আছে, তুই আমাকে মাসিমার নম্বরটা দে। আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি। এলাহাবাদে গিয়ে কয়ে দিন কাটিয়ে আয়। আমি টিকিট কেটে দিচ্ছি।

না রে, মা শুধু শুধু চিন্তায় পড়ে যাবে। সত্যিটা জানতে পারলে কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না, জলে ভেসে যেতে থাকে মলির দুচোখ।

সত্যিটা বলবি কেন? বলবি এমনি ঘুরতে এসেছিস। ধীরে ধীরে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। দুজনেরই রাগ ঠান্ডা হয়ে এসেছে। ঠিক আছে কালই আমি টিকিট কিনে নিচ্ছি।

মলিকে বুঝিয়েসুঝিয়ে শশাঙ্ক সবে বড়ো রাস্তায় পড়েছে। হঠাৎ-ই রং সাইড থেকে একটা ট্রাক এসে ধাক্কা মারল শশাঙ্কর বাইককে। ছিটকে পড়ল শশাঙ্ক। হেলমেট থাকা সত্ত্বেও বুঝতে পারল মাথায় চোট লেগেছে, পা-টাও নাড়াতে পারছে না। মলির মুখটা মনে পড়ল। ধীরে ধীরে জ্ঞান হারাল সে। ততক্ষণে ভিড় জমে গেছে। পুলিশ এসে অ্যাম্বুল্যান্স করে হাসপাতালে পেঁছোল শশাঙ্ককে। ততক্ষণে অনেক সময় পার হয়ে গেছে। শশাঙ্ক তখন কোমায়। মোবাইলটাও ভেঙে রাস্তায় ছিটকে পড়েছিল।

তিনদিনের পরও যখন শশাঙ্ক এল না বা ওর ফোনও পাওয়া গেল না, মলয় পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মলিকে ব্যঙ্গ করতে ছাড়ল না, তোমার ভালোবাসার মানুষ ভয় পেয়ে পালিয়েে।

সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। অন্যের সঙ্গে চলে যাব সেই ভয়ে কি ডিভোর্স দিচ্ছ না? বিরক্ত হয়ে মলি জিজ্ঞেস করে।

ভয় কাকে করব? শশাঙ্ককে? একটা উজবুক। কালই চলো ভালো কোনও উকিলের সঙ্গে কথা বলব।

ঠিক আছে, আবার অবস্থান বদলে ফেল  না, রাগের মাথাতেই নিশ্চিত হতে চাইল মলি।

সত্যি বলতে কী, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াল। শেষমেশ ডিভোর্সের পর সাহস করে মলি এলাহাবাদে মায়ে কাছে গিয়ে দাঁড়াতে, মলিনাদেবী শোকে পাথর হয়ে গেলেন। মলি ধীরে ধীরে তাঁকে আবার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারলেও, নিজে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারল না। শরীর ভাঙতে আরম্ভ করল। মলয়েরও মন আত্মগ্লানিতে ভরে উঠল। নিজের

অংহবোধ-এর জন্য মলির সঙ্গে ডিভোর্স নিয়েিল ঠিকই কিন্তু মনে মনে জানত ওদের সংসারের জন্য, ওর বুড়ো মা-বাবার জন্য মলি কতটা আত্মত্যাগ করেছে। মলি মিষ্টি ব্যবহার দিয়ে পাড়া-প্রতিবেশী সকলের মন জয় করে নিয়েিল। সকলেই জিজ্ঞেস করত মলি কেন চলে গেল? কিন্তু এর কোনও উত্তর ছিল না মলয়ের কাছে।

এ বাড়িতে আর কেউই আসত না। খালি বাড়িটা যেন গিলে খেতে আসত মলয়কে। আগে সামান্য চ্ঁযাচামেচি হলে রেগে উঠত, আর এখন খালি মনে হতো বাড়িতে কেউ তো আসুক। প্রায়শ্চিত্তের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে শয্যাশাযী হয়ে গিয়েিল মলয়। জল এগিয়ে দেওয়ারও কেউ ছিল না। ভাগ্যিস, হিমানীকে কেউ খবর দিয়েিল। দিদি না এলে এতদিনে প্রাণটুকুও হয়তো হারাতে হতো।

শুভ্রাকে ফোন করে হিমানী জানতে পারল, শুভ্রা ইদানীং আর এলাহাবাদে থাকে না। দিল্লি চলে গেছে। ও সোজাসুজি হিমানীকে বলল, এখন আর কী হবে দিদি। ডিভোর্স হয়ে গেছে। মলয় ওর জীবন নরক করে তুলেছিল। ওর দুঃখ সহ্য করতে না পেরে মাসিমাও মারা গেলেন। এখন মলি শশাঙ্ককে বিয়ে করে কানাডায় সেটেলড। ওরা ভালো আছে। আপনারা আর ওর চিন্তা করবেন না।

এটা কিছুতেই হতে পারে না শুভ্রা।

মলয়ের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে মলির, শশাঙ্ককে বিয়ে করায় অসুবিধা কোথায়…, জোরের সঙ্গে বলল শুভ্রা। সেটাই তো। আমি জানি ওই বাড়ির সঙ্গে ও কতটা ক্লোজ ছিল। এই বাড়ি, এই বাড়ির মানুষগুলোর সঙ্গেও। ভাইয়ে বউ ছিল ও, কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বও কিছু কম ছিল না। মলি ডিভোর্স করে বিয়ে করে নিল, মন কিছুতেই মানতে চাইছে না। শুভ্রা ঠিক করে বলো। একবার বলো তুমি যা বলছ সব মিথ্যা। মাত্র দেড় বছর হল আমরা নিউজিল্যান্ডে শিফ্ট করেছি, আর এর মধ্যে এত কাণ্ড! প্লিজ শুভ্রা ওর কনট্যাক্ট নম্বরটা একবার দাও। আমি ওর মুখ থেকে নিজের কানে শুনতে চাই, হিমানী করুণ স্বরে রিকোযে্ট করে শুভ্রাকে।

দিদি, ও নম্বর দিতে বারণ করেছে। আর কী করবেই বা তুমি? হাড় কটা রয়ে গেছে শরীরে। ওর অবস্থা চোখে দেখতে পারবে না। কেউ ওর কথা জিজ্ঞেস করলে এগুলোই সবাইকে বলতে বলেছে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে শুভ্রা। হিমানীর অনুরোধ কিছুতেই ফেলতে পারে না, হেরে গিয়ে মলির নতুন নম্বরটা হিমানীকে দিয়ে দেয় শুভ্রা।

শুভ্রা, এটা তো ইন্ডিয়ারই নম্বর, আশ্চর‌্য হয় হিমানী।

দিদি মলি শশাঙ্ককেও বিয়ে করেনি, কানাডাও যায়নি। শশাঙ্ক আমার পিসির ছেলে। কলকাতায় গিয়ে সাংঘাতিক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। চারমাস কোমাতে পড়ে ছিল। তারপর জ্ঞান ফিরলেও নানা সমস্যা হচ্ছিল। পিসিরা ওকে দিল্লিতে নিয়ে এসে চিকিত্সা করায়। এখন ভালো হয়ে ওরা সবাই এলাহাবাদ ফিরে গেছে। শশাঙ্কই আমাকে মলির খবরাখবর দিতে থাকে। শুভ্রা বিস্তারিত খুলে বলে হিমানীকে।

 

হিমানী, শুভ্রার ফোন ছেড়েই মলির নম্বর ডায়াল করে।

হ্যালো… সেই মিষ্টি গলা কিন্তু আজ তাতে আর যেন প্রাণ নেই।

মলি, আমি তোর হিমানীদি। এতটা পর করে দিলি আমাদের! কাউকে কিছু জানালি না। কী করলি তোরা? তোরা কি পাগল!

ওদিকে কোনও উত্তর নেই দীর্ঘশ্বাসের মৃদু আওয়াজ ছাড়া।

তোদের দুজনকে ভালোমতন জানি। তোর যা অবস্থা, মলয়েরও তাই। মলয়ও বিছানায় পড়ে রয়েে। এত ভালোবাসা কিন্তু এত ইগো কেন? মলয় প্রচুর ভুল করেছে। প্রিয়জনদের হারিয়ে ওর মাথায় ভত চেপেছিল যার জন্য তোকে ও হারিয়েে। আজ নিজের আচরণের জন্য ও লজ্জিত। প্রতি মুহূর্তে তোকে মিস করছে। মলি, মলয় আজও তোকেই ভালোবাসে।

মলি নিশ্চুপ।

এই ভাবে চললে দুজনের কেউই বাঁচবি না। অনেক তো লুকোবার চেষ্টা করলি। শুভ্রা আমাকে সব সত্যিটা বলেছে। ফিরে আয় মলি। আমি আসছি তোর কাছে, ভাইটাকেও কান ধরে নিয়ে আসব। আগে তো ক্ষমা চাইবে তোর কাছে। এরপর কখনও যদি তোকে দুঃখ দেয়, তোকে কাঁদায় তাহলে ও আমায় জীবিত পাবে না, এই আমি ওকেও জানিয়ে রাখলাম।

হিমানীর কথা শেষ হওয়ার আগেই মলয় বিছানা থেকে উঠে বসে দিদির মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরল, দিদি আর কোনও দিন এই কথাটা বলবি না।

তাহলে দুজনেই কান ধরে ক্ষমা চা আমার কাছে, মৃদু হেসে হিমানী বলল, যেটা মলয় ছাড়াও ফোনের ওপাশে মলির কানে গিয়ে পেঁছোল। মলি এমন একটা মেয়ে যে পুরো বাড়ি মাথায় করে রেখেছিল, সবাইকে আপন করে নিয়েিল তার সঙ্গে তুই অ্যাডজাস্ট করতে পারলি না ভাই, কেন? মানছি তোর কিছু পছন্দ, অভ্যাস, সংস্কার আছে, সেরকম মলিরও তো কিছু চাহিদা আছে… তাই না কি? অ্যাডজাস্ট খালি ওই করে যাবে? আমি কি প্রথম থেকে এরকম ছিলাম? রানার জন্য অনেক নিজেকে বদলেছি। রানাও নিজেকে কম বদলায়নি। তাই আজ আমরা সুখী দম্পতি। তোকেও ভাই বদলাতে হবে, কিছু ত্যাগ করতে হবে মলির জন্য। পারবি না মলির জন্য নিজেকে বদলাতে? আশা নিয়ে মলয়কে জিজ্ঞেস করে হিমানী।

হ্ঁযা দিদি, তুই যা বলছিস আমি শুনব, আশ্বাস দেয় মলয়।

তাহলে কথা বল ওর সাথে। নম্বর-টা ডায়াল করে হিমানী ভাইয়ে হাতে ফোনটা দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল।

মলি, কোন মুখ নিয়ে আমি কথা বলব তোমার সাথে। আমি অপরাধী, আমাকে পারো তো ক্ষমা করে দাও। বিয়ে পর থেকে বাড়ির সব দাযিত্ব তুমি পালন করেছ। হনিমুন কেন কখনও কোথাও তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাইনি। নিজের ইচ্ছে শুধু তোমার উপর চাপিয়ে গিয়েি। তোমার সঙ্গে পা মিলিয়ে দুপা হাঁটতেও কখনও চেষ্টা করিনি আমি। বাচ্চা দত্তক নিতে চেয়ে, আমি মত দিইনি। বাড়িতে টিউশন আরম্ভ করেছিলে, সেখানেও আমি তোমাকে অপমান করেছি। তোমার বন্ধু সম্পর্কে যা নয় তাই বলেছি। তোমাকে পাঁকে নামাতেও আমি দ্বিধা করিনি। এতটা নীচে নামতে পেরেছি আমি। মলি এতদিন আমি যা করে এসেছি সব ভুল করেছি! তুমি কেন কেউই সহ্য করতে পারত না। প্লিজ কিছু বলো মলি। আমাকে থাপ্পড় মারো, গালাগালি দাও, বাজে কথা বলো কিন্তু প্লিজ কথা বলো, কথা না বললে আমি ওখানে চলে আসব।, মলয় অনুনয় বিনয় করতে থাকে।

ফোনের ওপাশ থেকে মলির কান্না মলয়ের বুকের গভীরে ক্ষত আরও বাড়িয়ে তোলে।

আমি আসছি মলি তখন মন ভরে আমাকে  মেরে নিও কিন্তু তুমি আমার প্রাণ। আমাকে আমার প্রাণ ফিরিয়ে দাও। দিদিকে দিচ্ছি আমি বলে হিমানীকে ফোন ধরায় মলয়।

আর কাঁদিস না মলি, অনেক কেঁদেছিস তোরা দুজন। তুই আসার জন্য তৈরি থাকিস। মলয় ফিট হলেই ওকে নিয়ে যাচ্ছি, হিমানী বলে। ওপাশে কান্না বন্ধ হয়ে গিয়েিল, কিছু বলবি না মলি! হেসে জিজ্ঞেস করে হিমানী। না দিদি তোমরা এসো, ক্ষীণ স্বরে মলি উত্তর দেয়।

তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে নে, আমরা আসছি। বিয়ে দিয়ে নতুন বউ ঘরে তুলব। দুর্গাপুজো এবার কলকাতায় একসঙ্গে কাটাব ঠিক করেই রেখেছি। রানা তোদের নিয়ে অসম্ভব চিন্তায় রয়েে। ওকেও আনন্দের খবরটা জানাতে হবে। দিদির উপর বিশ্বাস রাখ মলি। তোর সংসার তোর প্রতীক্ষায় রয়েে। ব্যস শুধু নিজের বাড়ি ফিরে আয় মলি।

ঠিক আছে দিদি। তোমরা যা চাও তাই হবে, মলির স্বরে প্রাণ ফিরে এসেছে হিমানী ঠিকই ধরতে পেরেছিল।

নে ভাই, এবার তুইও সুস্থ হয়ে নে, তাড়াতাড়ি আমরা সবাই একসঙ্গে এলাহাবাদ যাব, হিমানী মলয়ের কপালের জলপট্টিটা বদলাতে বদলাতে মৃদু হেসে বলে।

মলয়কে ওষুধ খাইয়ে হিমানী উঠে গিয়ে স্বামীকে ফোন করল, মলি আর মলয়ের সুসংবাদটা দেবে বলে।

আলো আঁধারির গপ্পো

সাউথ ফেসিং অ্যাপার্টমেন্ট। জি-প্লাস ফোর ফ্ল্যাট। সুনন্দের ফ্লাটটা ঠিক মাঝখানে। ব্যালকনিটাও সাউথ ফেসিং। সামনে ছোটো একটা মাঠ। তারপরে সবুজ বনানী। আগাছা জঙ্গল ভরা নয়। নানা রকম বাহারি ফুল, বাহারি জঙ্গল। বনানি দেখভালের জন্য একজন মালিও নিয়োজিত। তারও ওপারে একটা দিঘি। কাচের মতো স্বচ্ছ তার জল। সুইমিং, বোটিং। গোটা কতক দশাসই আমগাছ তুলে এনে ‘ইনস্টল’ করা হয়েছে। নতুন নাম ‘মাঝের গাঁ’। এ সবই খদ্দের পটানোর বন্দোবস্ত।

একটা লম্বা হাই তুলে সুনন্দ ব্যালকনির ইজি চেয়ারটাতে বসেছে। দুপুরের ভাত ঘুম। পাতলা ঘুম। পাতলা ঘুম অতল স্পর্শ করে না। অগভীর ঘুমে মনের সুখ বাসনাগুলি ছেঁড়া ছেঁড়া পেঁজা তুলার মতো ভাসতে থাকে। বাসনার বিপরীত মুখী হয়ে অবচেতন মনের সামনে বিরক্তি ঘটায়। না পাওয়ার অস্বস্তিতে হতাশা আসে। বাইরে প্রকৃতির অনাবিল রূপের ডালি! সুনন্দর নজর সেদিকে নেই। আকাশে মেঘ নেই। সুনন্দর মুখে আছে। এক রাশ ঘনীভূত আষাঢ়ের মেঘ। ঝরব ঝরব করছে। ঝরেনি। বাইরে অসহায়ের মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।

পড়ন্ত বিকেল। সূর্য এক অত্যাচারী শাসক। সারাদিন রক্তচক্ষু দিয়ে জগৎ শাসন করেছে। বসুন্ধরার রক্তরস ছিবড়ে করে নিজেই ক্লান্ত। বিশ্রামের জন্য পশ্চিমে রওনা হয়েছে।

হাতে এক কাপ চা। মধুছন্দা দেবী ব্যালকনির দরজায় দাঁড়িয়ে। টের পায়নি। –কী দেখছিস ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে? ব্যাবসার কথা ভাবছিস? ভাবিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে –নাঃ তেমন কিছু না। মাথা তুলতেই মায়ের দৃষ্টি এড়ায় না।

–ও মা এ কি! চোখ দুটো অমন লাল কেন? মুখ খানাও কেমন গোমড়া। ব্যাবসায় আরও কিছু ক্ষতি হ’ল নাকি?

–না সেসব কিছু না। একটা আজেবাজে স্বপ্ন দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মায়ের মন অস্থির হয়ে ওঠে।

–ও মা সে কি? কী বাজে স্বপ্ন? কু-স্বপ্ন মনে চেপে রাখতে নেই। বলে দে। মায়ের পীড়াপীড়ি এড়াতে পারে না।

মেঘমুক্ত আকাশ। পশম মেঘ। বুনো মেঘ। গোটা আকাশে কিছু নেই। হঠাৎ কোথা থেকে কচিকাঁচা মেঘেরা মুক্ত আকাশে খেলতে নেমেছে। আমাকে হাত ধরে টানাটানি। আমি বললাম– আরে আমি কি তোদের সাথে খেলতে পারব?

–এসো না। খুব পারবে।

ওদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে লাগলাম। তারপর যা হওয়ার তাই। অল্প সময়েই হাঁপিয়ে পড়লাম। ওরা বলল– এসো তবে কিছু জলযোগ করে নিই। বলে আমাকেও চাট্টি মুড়ি দিল। আমি পরমানন্দে খেতে লাগলাম। তারপরই হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল।

–ওহ, এটা আবার দুঃস্বপ্ন কীসের?মুড়ি তো ভালো জিনিস। এতে মুখ গোমড়া করে বসে থাকার কি হয়েছে?

–না আমি ভাবছি অন্য কথা। তারপরই মাকে প্রশ্ন করে –আচ্ছা মা, মেঘেদের খাবার কিনতে শুধু খাবার কেন কোনও কিছুই জোগাড় করতে তো পয়সা লাগে না। এত ভালো ভালো খাবার থাকতে শুধু মুড়ি। তাই ভাবছি বাকি জীবনটা কি তাহলে আমাকে মুড়ি…।

–ছিঃ বাবা অমন কথা বলতে নেই। ঘুমটা ভালো হয়নি তো! পাতলা ঘুমে ওরকম হিজিবিজি স্বপ্ন দেখে মানুষ। ওসব কথা মনে করে কষ্ট পেতে নেই।

ড. ডি কে বাসু! এটা কেতাবি নাম! বাপ-মায়ের দেওয়া নাম দিলীপ কুমার বোস। বিদেশে গিয়ে সাহেবি নাম হয়েছে। প্রথম নামটি। বার্কিংহাম ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির প্রফেসরের পাশাপাশি গোটা ইউরোপ ঘুরে জ্ঞানের ঝুলিটা ফুলে ফেঁপে লাউ। জ্ঞানের ঝুলিটা যত ভারী, দাম্ভিকতার তবলা সমপরিমাণে টিউনিং। মুখে লেগে থাকে নেটিভ ইন্ডিয়ান। ইন্ডিয়ান কালচারটা একেবারে বস্তাপচা। জ্ঞানের ভান্ডার দিয়ে ইউরোপকে সমৃদ্ধ করেছে, মাতৃভূমিকে ছড়িয়েছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস।

কৌতুকবশত সুনন্দ বলেছিল– মামা, তুমি গেঞ্জিটা উলটো পরেছ।

ড. বাসু একগাল তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে– আসলে কি জানিস, ইন্ডিয়ানরা কমফর্ট ব্যাপারটা ঠিক বোঝে না। সেলাইয়ের দিকটা ভেতরে থাকলে কমফর্ট ব্যাপারটা ডিসটার্ব হয়। এ গল্পে ড. বাসুর প্রবল আত্মকেন্দ্রিকতা, মাতৃভূমির উপর ঘৃণা, ইউরোপিয়ান আদব-কায়দা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করা। এসব একান্তই অনাবশ্যক ছিল! যদি না দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর দেশের মাটিতে পদার্পণ ঘটিয়ে, বোনের বাড়িতে সটান এসে স্বঘোষিত অভিভাবক হয়ে না উঠত।

সুনন্দের হাতে এখন অঢেল সময়। ডিমনিটাইজেশনের জেরে ট্রাভেলিং-এর ব্যাবসা যত তলানিতে ঠেকছে বিশ্রামের সময় ততই বাড়ছে। ব্যাবসা এখন চড়ায় আটকে যাওয়া নৗকার মতো। পরিশ্রম কম হলে ঘুম আসে না। পায়চারি করে।

ব্যালকনির কর্নারে একটা টব। গোলাপ গাছ। বেচারা। অনাদরে অবহেলায় শুকিয়ে কঙ্কাল। সময় আছে যথেষ্ট। উৎসাহে গলগ্রহ। সেই গলগ্রহে গাছটার অকাল প্রয়াণ। পাশ দিয়ে আরও এক অবহেলিত অনাহুত গাছ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। পথ শিশুদের আদর যত্নের প্রয়োজন হয় না।

জাত ধর্ম সবারই আছে। গাছেরও আছে। শুধু অনাহুত গাছটা শনাক্ত কেউ করতে পারল না। কৗতুহলটা ঘরের চৗকাঠ পেরিয়ে দোতলা তিনতলা। গোটা অ্যাপার্টমেন্টময় ছড়িয়ে পড়ে।

অবশেষে এলেন পরান হালদার। উড়িষ্যার জঙ্গল। আদিবাসীপাড়া। ঝাড়ফুক। তুকতাক। ঘরবন্ধন। ভূত ছাড়ানো। এসবে হাত যশ আছে। সব ছাড়িয়ে পয়সার ঝোলাটা আরও ভারী।

পরান হালদার গাছটা দেখেই অাঁতকে ওঠে। কি সর্বনাশ! এ-তো এক ভয়ংকর বিপদের ইঙ্গিত। গাছটা তোমরা চিনতে পারলে না? –সুনন্দের কৗতুহল বাড়তে থাকে।

–কেন কি গাছ?

–আরে, এ-তো ভূতের বাসস্থান।

–সেটাই তো জানতে চাইছি। এটা কি গাছ? ভূতেরা আবার আলাদা গাছে থাকে না কি?

–থাকে বাবা থাকে। তোমরা শিক্ষিত। এ যুগের ছেলে। ওসব বুঝবে না।

–না, বলছি গাছটার একটা নাম তো আছে?

–আছে বাবা আছে। এটা শ্যাওড়া গাছ। বলে দাঁড়ায় না। পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখে চাপা দিয়ে হন্ হন্ করতে করতে বের হয়ে যায়। পরানবাবু ভয় পেয়েছে। নাক মুখ দিয়ে সুরুৎ করে ভুতের বাচ্চা শরীরে ঢুকে গেলে আর রক্ষে নেই।।

সুনন্দ ভাবছে। নোট জেলে বন্দি। কবে ছাড়া পাবে কে জানে। ট্যুরিস্টেরের পকেটে নেই টাকা। তাই গাড়ির ঘোরেও না চাকা। নোট বন্দি। না বাক্বন্দি। বাক্বন্দি না জীবনবন্দি। ধ্যাৎ! যত্তসব! ঘরের ভিতরটা কেমন গুমোট হয়ে আসছে। মাথার পেছনটা কেমন ভারী ভারী লাগছে। কোন আগন্তুকের পদশব্দ! সুনন্দ চমকে ওঠে।

একটা কিশোর। বয়স বছর বারো তেরো। খালি গা। পরনে ছেঁড়া হাফ প্যান্ট। গায়ে খড়ি উঠে গেছে। তেল সাবান বহুদিন পড়েনি বোধ হয়। মাথায় শেষ কবে চিরুনি পড়েছিল কে জানে! চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকম জ্বল জ্বল করছে। তবু কেমন নিরীহ নিরীহ লাগে।

সুনন্দ ধড়মড় করে উঠে বসে। –আরে রে রে। তুই কোথা থেকে এলি? দরজা তো বন্ধ।

–ওই তো দরজা খুলে।

সুনন্দ ভাবছে বাঁ দিকে ব্যালকনির দরজাটা খোলা। কিন্তু সেদিক থেকে দোতলা উঠবে কি করে! আরও এক ঝলক ভাবে– ডানদিকের দরজা এখনও বন্ধ। লক করা ছিল না হ্যান্ডেল লকটা খুলল। ঢুকল। আবার বন্ধ করল। আমি কিছুই টের পেলাম না। সে যাক্।

–এখানে এসেছিস কেন?

–একটু থাকতে দেবে দাদাভাই?

–তোর বাড়ি কোথায়? নামটাই বা কি?

–জন্ম উড়িষ্যায়। এখন থাকি ফুটপাথে। আর নাম লালু! লালু নায়েক ছিল। এখন যে যা বলে তাই।

–কী করে চলে? মানে খাস কি?

–ভিক্ষা করে। তা-ও ঠিক হচ্ছে না।

তারপরেই লালু পা-দু’টো ধরে বলে– দাও না দাদাভাই একটু থাকতে। আমি তোমাদের সব কাজ করে দেব। এই ধরো হাট বাজার। ঘরের কাজ সব কিছু পারি। ছেলেটার কথায় একটা মাদকতা আছে। সুনন্দ নরম হয়। তারপরই বলে– সবই তো বুঝলাম। কিন্তু তুই এখন যা বাপু! আমার এখন কাজের লোক রাখার সামর্থ্য নেই। আর তা ছাড়া থাকবিই বা কোথায়? আমাদের তো মাত্র তিনটে বেডরুম। লালু মনের ভাব বুঝতে পারে। বলে, –দাদাভাই তোমাদের এঁটো কাঁটা যা দেবে তাতেই আমার হবে। আর থাকার কথা বলছ, সে তোমাদের স্টোররুমেই চলে যাবে। থাকতাম তো ফুটপাথে।

সুনন্দ বিরক্ত হয়। ভাবছে, আচ্ছা মুশকিলে ফেলল তো ছেলেটা। ওকে বোঝাই কি করে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে খাওয়ার মতো অবস্থাতেও আমি নেই।

কথার শব্দে মধুছন্দার ভাত ঘুমটা ভাঙে। হাঁটুর আড়ষ্ঠতা কাটিয়ে সুনন্দর ঘরে ঢুকে বলে, ‘ও মা এ ছেলেটা কে? কী চায়?’

লালু মধুছন্দার পা জড়িয়ে বলে, – মা, ওমা, একটু থাকতে দাও। দাদাভাইকে একটু বলো না। মায়ের মন। ‘মা’ সম্বোধনে গলে জল!

সুনন্দ বিরক্ত হয়ে বলে– আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল তো। কোথা থেকে এসে কাঙালিপনা করছে। একে কীভাবে বিদায় করি বলো তো?

–থাক। থাক। মা বলে ডেকেছে। ও আমি সামলে নেব। দু’মুঠো কম খেলে আমার কিছু হবে না। তাছাড়া ঘরের কাজ সামলে বাজার হাট করা। এখন শরীর দেয় না। হাঁটুর ব্যথাটাও ইদানীং বড্ড বেড়েছে।

মধুছন্দা আঁচলের খুট থেকে পঞ্চাশ টাকার নোটটা দিয়ে লালুকে বলে– যা তো বাবা এক কেজি চাল আর এই শিশিতে একটু সরষের তেল নিয়ে আয়। লালু কাগজের ঠোঙায় চাল আর তেলের শিশিটা ধরিয়ে দিয়ে কোথায় ফুড়ুত করে হাওয়া। আপতত আর দেখা গেল না।

কাজ কম তাই হিজিবিজি ভাবনাটা বেশি। সুনন্দ ভাবছে। ঘরটা কেমন নির্জন নীরব মনে হচ্ছে কেন? তিন জনের সংসারে এখন চারজন। মামা থেকেও নেই। দুপুরে বেরোয়। গভীর রাতে দুলে দুলে ঘরে ফেরে। অশীতিপর বৃদ্ধ। চলাফেরায় এখন আর বলিষ্ঠতা নেই। লালুটা কখন যে কোথায় থাকে বোঝা ভার। অথচ ডাকলেই হাজির। গোটা ঘরটা এক অদ্ভূত রকমের রহস্যময় লাগছে।

জ্যৈষ্ঠের দুপুর। দূরে একটা তৃষ্ণার্ত কাকের ‘কা’ ‘কা’ শব্দে সুনন্দের গলা শুকিয়ে আসছে। টেবিলের উপর বোতলগুলো সার সার খালি। মাকে বিরক্ত করতে মন সায় দেয় না। ডাকে– লালু একটু আয় তো। সাড়া নেই। এবার তৃতীয় স্বরে– লালু। নিস্তব্ধ। এবার সপ্তমে চড়িয়ে ডাকে– লালু। নাঃ ছেলেটা গেল কোথায় এই ভরদুপুরে। ছেলেটা মনে হয় ঘুমোচ্ছে। স্টোর রুমের দরজাটা খুলতেই আঁতকে ওঠে। উফ্। এ-কি দেখলাম। ক্যাম্প খাটে যেটা শুয়ে আছে সেটা কি? একটা কঙ্কাল! গোটা শরীরটা হিম হয়ে আসছে। পা দুটো অসাড়। কোনওরকমে মাতালের মতো টলতে টলতে নিজের ঘরে ঢুকতেই লালু বলে– দাদাভাই ডাকছিলে? একটু বাইরে গেছিলাম।

সুনন্দের ঠোট দুটো তখনও কাঁপছে। অনেক কষ্টে স্বর বেরোয় –তোর ঘরের খাটে ওটা কী?

–কী?

–একটা কঙ্কাল। ওটা কোথা থেকে এল?

তুই এনেছিস?

–কই না-তো।

চল তো দেখি! পা দুটো তখনও কাঁপছে। সাহসের ভাঁড়ার শূন্য। লালু হাতটা ধরে জোর করেই নিয়ে গেল। দরজা খোলাই ছিল। ক্যাম্প খাটের দিকে তাকাতেই তাজ্জব।

–একি! বিছানা শূন্য। ছাপা বেডশিট পরিপাটি করে সাইড মোড়া। এ বিছানায় আজ কেন, দু’চার দিনেও কেউ গা দিয়েছে বলে মনে হয় না। তাহলে তখন…। বার বার চোখ কচলে নেয় সুনন্দ। অদ্ভুত! সুনন্দ স্তম্ভিত। সমস্ত জমাট বাঁধা রক্ত যেন ঝরঝর করে নীচে নেমে যাচ্ছে। লালু হাতটা ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে– হি হি, হি হি। দাদাভাই তুমি ভুল দেখেছিলে। কাল রাতে মনে হয় ভূতের স্বপ্ন দেখেছ।

মধুছন্দার বয়স বেড়েছে। নানা কাজে ভুল হচ্ছে। রান্না ঘরে ঢুকে অাঁচলের খুট খুলতে গিয়ে কী মনে হয়, চালের টিন খুলেই তাজ্জব! টিন প্রায় ভর্তি চাল। ষোলো কিলোর টিন। তিন দিন খেয়েও টিন প্রায় ভর্তি। তেলের শিশির দিকে তাকিয়ে দেখে সামান্য খালি। কি হচ্ছে এসব! মাথাটা আমার গেছে! এত দিন সংসার করছি…।

লালুকে ডেকে বলে– তোকে কবে চাল আনতে বলেছি, আর ক’কেজি?

–কেন পরশু। এক কেজি চাল এনে দিলাম। দুশো সরষের তেল। মনে নেই মা? কেন?

–তা-তো ঠিক। কিন্তু টিন ভর্তি চাল। তেলের শিশি ভর্তি…।

–তাহলে চাল, তেল সব আগে থেকেই ছিল। তুমি ভুল করেই আবার আনতে দিয়েছ।

–হবেও হয়তো। মধুছন্দা ভাবে। নাই ঘরে চাহিদা বেশি। শুধু নাই নাই মন।

আওয়াজটা প্রথমে মধুছন্দাই পেয়েছে। দাদার ঘর থেকে একটা গোঙানির শব্দ। দৗড়ে গিয়ে দেখে গলা দিয়ে কেমন ঘড় ঘড় আওয়াজ। মুখ দিয়ে কালো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। উদভ্রান্ত মধুছন্দা সুনন্দকে ফোন করে। সুনন্দ শিগগির ঘরে আয়। তোর মামার শরীর খুব খারাপ।

সুনন্দ বিভ্রান্ত। তর তর করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে ছুটোছুটি করতে থাকে। যাকে দেখছে বলছে– দাদা একটা অ্যাম্বুল্যান্স জোগাড় করে দিতে পারেন? আচমকাই সুনন্দের নজরে পড়ে গলি দিয়ে এমার্জেন্সি হর্ন বাজিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স তীব্র গতিতে এগিয়ে আসছে। বাঁদিকের জানালা দিয়ে একটা কচি হাত বার করে ইশারা করছে। সুনন্দ বুঝতে পারছে না। সামনে আসতেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল লালু। বলে– দাদাভাই আমি রাস্তাতেই খবর পেয়েছি। তাই অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এলাম।

নার্সিংহোমে যখন পৗঁছোল রাত দশটা। ডাক্তার এস দত্ত বললেন– পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রেডি থাকুন।

ভোর রাতে সুনন্দকে ডাক্তার বলে– কে হন ইনি?

– আমার মামা।

– সরি। উই আর কমপ্লিটলি হেল্পলেস।

অনেকদিন পর আজ সুনন্দ ঘুমিয়েছে। যাকে বলে একেবারে সাউন্ডস্লিপ। সেই ঘুমে সুনন্দের সামনে এক ছায়ামূর্তি। ছায়ামূর্তি বলছে – দাদাভাই আমি চলে যাচ্ছি। আমার কাজ শেষ। তবে বিশ্বাস করো। মামাবাবুকে আমি মারিনি। শুধু আমার স্বরূপ দেখিয়েছি। বোধহয় তাতেই…। সেটা তুমি স্টোররুমেই সেদিন দেখেছ। আমি তোমাকে হ্যালুসিনেশনের লেবেল সেঁটে দিয়েছিলাম। এছাড়া আমার কোনও গতি ছিল না। তোমার মামাবাবুর অঢেল টাকা। কলকাতায় দু’টো ফ্ল্যাট, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিয়ে আনুমানিক প্রায় দশ কোটি। তোমরা হয়তো জানো না। মামাবাবু দুপুরে বেরিয়ে কোথায় যেতেন! রেসের মাঠে। অঢেল টাকা ওড়াতেন। আরও অনেক বাজে অভ্যেস ছিল। অথচ তোমাদের এই সংকটে পাশে দাঁড়াননি। আমি জানি তোমার ব্যাবসা এখন ডুবন্ত নৗকা। অবশ্য একটা মহৎ কাজ তিনি করেছেন। সেটা পরে বুঝবে। আর একটা কথা। টবের গাছেই আমি থাকতাম। টবটা এখুনি ফেলে দাও। গাছটা আমি নিয়ে গেলাম। ভালো থেকো।

সুনন্দ খাটে শুয়ে আছে। ভাবছে। বিষয়- লালুর আগমন নিঃস্্ক্রমণের হেতু। কলিং বেলটা ডিং ডং আওয়াজ। সুনন্দ দরজা খুলতেই কালো কোট প্যান্ট পরা এক অপরিচিত মানুষ। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। নীরবতা নব আগন্তুকই ভাঙে।

–নমস্কার। আমি অ্যাডভোকেট পার্থ সান্যাল। বারাসাত কোর্টে প্র্যাকটিস করি। এসেছি মধুছন্দা দেবীর কাছে। যদি ভুল না করি আপনি…।

– একমাত্র ছেলে সুনন্দ ঘোষ।

–একটু বসতে পারি?

– ওহ, নিশ্চই।

তাহলে মাকে একটু ডেকে দিন।

অ্যাডভোকেট বলছে– ড. ডি কে বাসু আমার ক্লায়েন্ট। উনি একটা উইল করে গেছেন। ওর সমস্ত সম্পত্তি দান করেছেন। সম্পত্তির আনুমানিক মূল্য প্রায় দশ কোটি। অবশ্য কিছু শর্ত সাপেক্ষে। ওর শেষ জীবনে যে বা যারা দেখভাল করবে সে সম্পত্তি তারই প্রাপ্য। এ-ও উল্লেখ করেছেন বর্তমানে তার বোন শ্রীমতী মধুছন্দা ঘোষ-এর বাড়িতেই বসবাস করছেন। ডিটেলসটা পরে নেবেন। সম্মতি থাকলে প্রসিডিংস-টা স্টার্ট করি?

সুনন্দ ধড়মড় করে উঠে পড়ে। ছুটে যায় ব্যালকনিতে। আশ্চর্য! কালকেও দক্ষিণা হাওয়ায় গাছটার পাতাগুলো পত পত করে দোল খাচ্ছিল। এখন গাছটা শুকিয়ে দড়ি হয়ে আছে। সুনন্দের চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়ে গাছের গোড়াটা সিক্ত করে দিল।

অপেক্ষা

এটাই লাস্ট সেমিস্টার। সিদ্ধার্থ কিছুটা অধৈর্য হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে। বিবিএ পাশ করে ইচ্ছে ছিল এমবিএ-টা করে নেবে কিন্তু টাকা কোথায়? বাবা চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন। চাকরি থাকতেই বড়ো দুই দিদির বিয়ে শুধু বাবা দিতে পেরেছিলেন, তাও পিপিএফ থেকে বড়ো একটা অঙ্কের টাকা বার করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ছোড়দির বিয়ে দুমাস পরেই মা-ও হঠাৎই মারা যান।

বাবার পেনশনের টাকায় ওদের দুজনের ভালোমতোই চলে যায় সেটা সিদ্ধার্থ জানে। বাবার কথাতেই বিবিএ পড়তে ও রাজি হয়ে গিয়েছিল। সিদ্ধার্থ ভেবেছিল বিবিএ করে ব্যাবসার কিছু কিছু ও জেনে যাবে। সুতরাং চাকরি না পেলেও ক্ষতি নেই, কিছু একটা ব্যাবসা শুরু করবে। টাকা রোজগার করতে আরম্ভ করলে এমবিএ-টাও করে নেবে। বাবা অবশ্য সিদ্ধার্থকে বলে রেখেছেন, ওর প্রয়োজন পড়লে পড়াশোনার জন্য বাড়িটা বন্ধক রাখতেও রাজি আছেন। ওদের এই একটাই সম্বল, ঠাকুরদার বাবা এই বাড়িটা তৈরি করে গিয়েছিলেন।

এইসব নানা কথা ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধার্থ বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ-ই তার চোখে মুখে, কিছুটা জলের ছিটে এসে স্বপ্নভঙ্গ করল। বর্ষাকাল নয়, আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিটেফোঁটা মেঘও সে দেখতে পেল না। আবার একটু জলের ছিটে তার মাথায় আর মুখে এসে লাগল। উপরের দিকে তাকাতে গিয়ে নজর পড়ল যেখানে ও দাঁড়িয়ে ঠিক তার পাশের বাড়ির দোতলায় দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে বারান্দায় তোয়ালে দিয়ে নিজের ভিজে চুল ঝাড়ছে।

চোখাচোখি হতেই মেয়েটির মুখে লজ্জিত হাসি ফুটে উঠল। ধীর স্বরে কিছু একটা বলল, যেটা সিদ্ধার্থর কানে এসে পেঁছোল না। তবে ওর মনে হল মেয়েটি সরি বলছে। সিদ্ধার্থর মাথায় একটু দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। সে হাত তুলে মেয়েটিকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, না না ঠিক আছে তবে আপনার হাসিটা কিন্তু বড়ো অমায়িক। আর একবার প্লিজ হেসে দিন।

সিদ্ধার্থের কথা শুনে মেয়েটি জোরে হেসে উঠল। তারপর হঠাৎই নিজের ব্যবহারে লজ্জিত হয়ে ভিতরে চলে গেল। সিদ্ধার্থও নিজের মুগ্ধতা কাটিয়ে আবার হাঁটা শুরু করল।

এই ঘটনার দুদিন পর ওই একই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে নিজের অজান্তেই সিদ্ধার্থর চোখ চলে গেল আগের দিনের মেয়েটি যে-বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল, সেই বারান্দার দিকে। দেখল মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আজ চুল বাঁধা আছে বলেই মনে হল সিদ্ধার্থর। হঠাৎই মেয়েটির চোখ পড়ল সিদ্ধার্থর উপর আর সঙ্গে সঙ্গে ওর সুন্দর মুখশ্রী মৃদু হাসিতে ঝলমল করে উঠল। অদ্ভুত এক ভালোলাগায় সিদ্ধার্থর বুক ভরে উঠল। এই অনুভূতি আগে কোনওদিন সিদ্ধার্থ অনুভব করেনি। এরপর প্রায় দুই সপ্তাহ মেয়েটিকে দেখতে পেল না সে।

হঠাৎই একদিন বাজারে গিয়ে আবার মেয়েটির মুখোমুখি হল। মেয়েটি সবজি কিনতে ব্যস্ত ছিল, ফলে সিদ্ধার্থকে দেখতে পায়নি। সিদ্ধার্থ-ই সাহস করে এগিয়ে গিয়ে প্রথম কথা বলল, কযেদিন আপনাকে দেখতে পাইনি, কোথাও গিয়েছিলেন বুঝি?

চমকে তাকাতেই সিদ্ধার্থর দিকে চোখ পড়ল মেয়েটির। সঙ্গে সঙ্গে একমুখ হাসি নিয়ে সে জবাব দিল,হ্যাঁ , ছুটি ছিল। দিদির কাছে বেড়াতে গিয়েছিলাম। গতকালই ফিরেছি।

সিদ্ধার্থ ভাবতেই পারেনি মেয়েটি ওর প্রশ্নের উত্তর এত সাবলীল ভঙ্গিতে দেবে। মেয়েটির হাতে দুটো ব্যাগ-ভর্তি সবজিপাতি ছিল। মেয়েটি দুই হাতে ব্যাগদুটো ভাগ করে নিয়ে সিদ্ধার্থের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করল। সিদ্ধার্থ ওর হাত থেকে ব্যাগ নেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু মেয়েটি কিছুতেই রাজি হল না, না না আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমার দুটো ব্যাগ নিতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। বাড়ি তো কাছেই আর অসুবিধা বোধ করলে একটা রিকশা নিয়ে নেব।

মেয়েটির কথায় সিদ্ধার্থ আমল না দিয়ে ওর হাত থেকে একটা ব্যাগ একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে নিজের হাতে নিল, আরে এতে কষ্টের কী আছে? আর রিক্শার পয়সা বাঁচিযে রাখুন, চা খাওয়া যাবে।

বলতে বলতেই সামনে চায়ের দোকান দেখে সিদ্ধার্থ বেঞ্চের উপর সবজির ব্যাগ নামিয়ে রেখে দুটো স্পেশাল চায়ের অর্ডার দিল। চা খেতে খেতে দুজনে নিজেদের মধ্যে পরিচয় আদান-প্রদান করে নিল। মেয়েটি জানাল তার নাম সুলগ্না। মায়ের সঙ্গে থাকে। বাবা অনেকদিন হল মারা গেছেন। কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা করে একটি প্রাইভেট স্কুলে কর্মরতা। সিদ্ধার্থও নিজের পড়াশোনা আর ভবিষ্যতের ইচ্ছের কথা মন খুলে মেয়েটিকে জানাল। চায়ের পয়সা দেওয়ার জন্য পার্স বের করতেই মেয়েটি সিদ্ধার্থের হাত চেপে ধরল, রিকশার টাকা বেঁচে গেছে সুতরাং চায়ের টাকা আমি দেব।

সুলগ্নার চায়ের টাকা দিয়ে দেওয়াটা সিদ্ধার্থর ভালো লাগল না। তবুও সে আর কিছু বলল না। দাম মিটিয়ে বাড়ির পথ ধরল ওরা। প্রথমে সুলগ্নার বাড়ি। বাড়ির দরজায় এসে সিদ্ধার্থর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ওকে থ্যাংকস জানিয়ে সুলগ্না বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল। সিদ্ধার্থ নিজের বাড়ির দিকে পা চালাল।

এরপর প্রায়শই সুলগ্না আর সিদ্ধার্থ বাড়ির বাইরে দেখা করতে শুরু করল। সুলগ্নার ভালো চাকরি ছিল ঠিকই কিন্তু সিদ্ধার্থ কিছুতেই মনের মতো চাকরি পাচ্ছিল না। বিবিএ-র রেজাল্ট তার ভালো হওয়া সত্ত্বেও যে-চাকরিগুলো পাচ্ছিল সেগুলো কম মাইনের। ব্যাবসা শুরু করার কথাও মাথাতে ছিল সিদ্ধার্থর। সুলগ্নাও সবসময় ওকে উৎসাহ জোগাতে থাকত, নানা লোকের উদাহরণ দিত, যারা জীবনের প্রথমে কঠিন সংঘর্ষ করলেও পরে তারা সকলেই জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

সিদ্ধার্থ দিনের অনেকটা সময় ল্যাপটপে কাটিয়ে দিত চাকরি খুঁজতে আর নয়তো বিকল্প কোনও ব্যাবসার সন্ধানে। মাঝেমধ্যে সুলগ্নার সঙ্গে ওর বাড়িতেও যেত সিদ্ধার্থ। সুলগ্নার মা ওকে খুবই স্নেহ করতেন। একদিন সুলগ্না এসে জানাল যে, ওদের স্কুলে প্রাইভেটে কম্পিউটার ক্লাস খোলার কথা চলছে, যার জন্য অনেক কম্পিউটার একসঙ্গে স্কুল কিনবে। এই সংক্রান্ত একটা প্রোজেক্ট রিপোর্ট আর টেন্ডার তৈরি করতে বলে, সুলগ্না।

সিদ্ধার্থর কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনের কোর্স করাই ছিল এবং পড়ার সময় টেন্ডার, মার্কেটিং বিষয়ে অনেক কিছু শিখেও ছিল। সিদ্ধার্থর বাবা ছেলেকে এই সুযোগ না ছাড়ার পরামর্শ দিলেন।

সিদ্ধার্থ টেন্ডার ভরল। ভাগ্যও ওর সহায় ছিল। জীবনে প্রথম সুযোগ পেল ভালো কিছু করে দেখানোর। সিদ্ধার্থর টেন্ডার পাস হয়ে গেল। সুলগ্নাদের স্কুলের অনেকগুলো ব্রাঞ্চ ছিল সারা রাজ্যজুড়ে এবং এই কম্পিউটার প্রোজেক্টটার প্রধান ইনচার্জ ছিলেন সুলগ্নার স্কুলের প্রিন্সিপাল। প্রিন্সিপাল সিদ্ধার্থ-কে ডেকে জানালেন, তিনি সিদ্ধার্থর কাজে খুশি হলে রাজ্যের বাইরে তাঁদের যতগুলি স্কুল আছে সেখানেও সিদ্ধার্থর নাম রেকমেন্ড করবেন। যখন তাদের স্কুলেও একই প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু হবে, তখন সিদ্ধার্থর কাজের আরও সম্ভাবনা বাড়বে।

সুলগ্নার সঙ্গে দেখা হলে সিদ্ধার্থ ওকে জানাল, সুলগ্না, আমি কিন্তু টিচার হতে চাই না। আমি একটা কাজ করে দিতে পারি, সেটা হচ্ছে কম্পিউটারগুলো ইন্সটল করে নেটওয়ার্কিং ইত্যাদি। এরপর বেসিক-টা না হয় একজন টিচার এবং কযেজন স্টুডেন্টকে শিখিয়ে দেব। তারপর তোমরা কী করে এগোবে সেটা কিন্তু সম্পূর্ণ তোমাদের দায়িত্ব। এই নিয়ে তোমার স্কুলের সঙ্গে কোনও কথা হয়নি।

ঠিক আছে, তুমি আমাকে পুরোটা শিখিয়ে দিও। আমারও কম্পিউটার নিয়ে অল্প পড়াশোনা আছে সেটা তুমি ভালো করেই জানো।

এই প্রথম কাজটাতেই সিদ্ধার্থ আশাতীত সাফল্য পেল। সিদ্ধার্থর কাজে প্রিন্সিপাল এতটাই খুশি হলেন, তিনি সিদ্ধার্থকে বাকি বারোটা স্কুলের টেন্ডার জমা দিতে বললেন। সুযোগটা পেয়ে সিদ্ধার্থর আনন্দের সীমা থাকল না। খবরটাতে সিদ্ধার্থর বাবাও অত্যন্ত খুশি হলেন। তিনি ছেলেকে ডেকে বললেন, মেয়েটি তোর জন্য অত্যন্ত শুভ। ওর সঙ্গে আলাপ হতে না হতেই এত বড়ো কাজটা হাতে পেলি। আমার মনে হয় সিদ্ধার্থ তোরা দুজনে একসঙ্গে মিলে কাজটা কর। একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, সিদ্ধার্থ, এটা আমার মনের কথা, মেয়েটাকে বড়ো পছন্দ আমার। তোর সঙ্গে ওকে মানাবে ভালো।

সুলগ্নার মায়েরও মনে এই ইচ্ছেটাই শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছিল। সিদ্ধার্থ, সুলগ্নাকে নিজের করে পাওয়ার ইচ্ছে অনেকদিন ধরেই মনের মধ্যে সুপ্ত রেখেছিল, কাউকেই বুঝতে দেয়নি। সে জানত আগে তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, তবেই চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর যোগ্য হয়ে উঠবে।

বাবার আশীর্বাদ আর ব্যাবসায় সাফল্য পেযে সিদ্ধার্থ নিজের বাড়ি থেকেই, নতুন কোম্পানির উদ্বোধন করল, সিদ্ধার্থ ডট কম। বাকি স্কুলের টেন্ডারগুলো আগেই সিদ্ধার্থ ভরে জমা দিয়ে দিয়েছিল। ওই কাজগুলোও সে পেল। ছেলেকে ব্যাবসায় প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে তার বাবা সুলগ্নার মায়ের সঙ্গে দেখা করে, ওদের দুজনের বিয়ের কথা পাকা করে ফেললেন। শুভদিন দেখে ওদের বিয়ের ভালোমতো ব্যবস্থা করলেন। ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে সুলগ্নাকে বাড়ির বউ করে বাড়িতে নিয়ে এলেন।

বিয়ের পর দিনগুলো ভালোই কাটতে লাগল সিদ্ধার্থর। প্রচুর কাজও পেতে আরম্ভ করল সে। কাজের চাপ এতটাই বেড়ে গেল, একা আর সবদিক দেখা তাদের পক্ষে সম্ভবপর হল না। দুজন লোক রাখতে সিদ্ধার্থ বাধ্য হল। বাড়ি থেকে অফিস শিফট করে একটু বড়ো জায়গা নিল ভাড়ায়। বাইরের ঘরটায় দুজন স্টাফের বসার বন্দোবস্ত করল আর ভিতরের ঘরটায় নিজের বসার। প্রয়োজনমতো অফিসটাকে কাজের জন্য গুছিয়ে সাজাল। সুলগ্নাও সময় করতে পারলে মাঝেমধ্যেই সিদ্ধার্থর অফিসে চলে আসত তার কাজে সাহায্য করতে। বেশ সুখেই কাটতে লাগল তদের দাম্পত্য জীবন।

দুবছর এ ভাবেই কাটার পর সুলগ্না সন্তানসম্ভবা হল। সিদ্ধার্থর জীবনে নতুন করে আনন্দর জোয়ার সব বাধা অতিক্রম করে গেল। কাজের চাপে বাড়িতে আগে বেশি সময দিতে পারত না সে। এখন সেই সিদ্ধার্থই কাজ ফেলে সুলগ্নার কাছাকাছি সবসময় থাকার চেষ্টা করতে লাগল, যাতে সুলগ্নার যত্নের কোনও ত্রুটি না হয়। বরং সুলগ্নাই বকাবকি করত সিদ্ধার্থর এই অবুঝ ব্যবহারের জন্য, আমি কি পালিযে যাচ্ছি নাকি আমি নিজের যত্ন ঠিক করে নিতে পারব না? তুমি কাজ ফেলে বাড়িতে সময বেশি দিচ্ছ, এটা ঠিক হচ্ছে না। এতে তোমার কাজের ক্ষতি হবে।

সিদ্ধার্থও বুঝত এতে কাজের ক্ষতি হচ্ছে। বাজারে একবার বদনাম হয়ে গেলে কেউ তাকে আর কাজ দেবে না। কিন্তু তাও নিজেকে শোধরাবার চেষ্টা করল না সে। এরই মধ্যে সুলগ্নার মা হঠাৎই মারা গেলেন। সুলগ্না শোকে যেন পাথর হয়ে গেল। দুর্ভাগ্যবশত গর্ভাবস্থা চারমাসে পড়তেই সুলগ্নার মিসক্যারেজ হয়ে গেল। এই ঘটনার পর সে পুরোপুরি ডিপ্রেশনে ডুবে যেতে থাকল।

এমন দুঃসময়ে সিদ্ধার্থ আরও বেশি করে সুলগ্নার কাছে থাকতে শুরু করল। সুলগ্না চেষ্টা করত নিজে থেকেই ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠতে। সিদ্ধার্থকেও বোঝাবার চেষ্টা করত কাজে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সিদ্ধার্থর সেই এক গোঁ, তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাও, তারপরেই আমি কাজে যাব।

সিদ্ধার্থ কারও কথা শুনল না। এই করে তার প্রোজেক্টগুলোও ডেডলাইন মিস করতে লাগল। নতুন কাজ আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। পুরোনো ক্লায়েন্টরাও আর তার উপর ভরসা রাখতে পারল না। সুলগ্নার শরীর ধীরে ধীরে ঠিক হতে আরম্ভ করলেও সিদ্ধার্থর ব্যাবসার ভরাডুবি ঘটল।

দুজন স্টাফকে ছাঁটাই করতে বাধ্য হল সিদ্ধার্থ। ভাড়ার অফিস ছেড়ে দিয়ে আবার বাড়ি থেকেই কাজ করা আরম্ভ করল সে। তবে কাজ বলতে, এখন নতুন কাজের অনুসন্ধান। কারণ সিদ্ধার্থর হাতে কোনও কাজই ছিল না। সুলগ্নাও তাকে নতুন কাজ খোঁজার জন্য চাপ দিতে শুরু করল। এটা সিদ্ধার্থর কিছুতেই সহ্য হতো না, সম্মানে বাধত। এতদিন সে সবাইকে কাজ দিয়ে এসেছে, এখন লোকের দরজায় কড়া নেড়ে কাজ খুঁজতে যাওয়াটায় তার অপমান বোধ হতো। মনে হতো এটা নিয়ে সুলগ্নার সঙ্গে ওদের যত দ্বন্দ্বের সূত্রপাত।

একদিন কাজের সন্ধানে বেরিয়ে বাড়িতে ফিরে সিদ্ধার্থ দেখল সুলগ্না বাড়িতে নেই। টেবিলে তার লেখা একটা কাগজ পড়ে আছে। তাতে লেখা, আমি তোমাকে ছেড়ে, এমনকী এই শহর ছেড়েও চলে যাচ্ছি। আমাকে নিয়ে চিন্তা করা ছেড়ে দাও। আমি তোমার জীবনে ফিরে আসব কিনা এখনই বলতে পারছি না। তবে প্রতি মুহূর্তে তোমার কথা আমার মনে পড়বে এবং এটাই আমার বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট। একটা কথা মনে রেখো সিদ্ধার্থ জীবন কাটানো খুব সহজ কাজ নয়। লড়াই ছাড়া কেউ প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না। সোনাকেও আগুনে পুড়িয়ে হাতুড়ির বাড়ি মেরে তবেই আকার দেওয়া যায়। তুমিও চেষ্টা ছেড়ো না। পরিশ্রম করে যাও, ফল একদিন পাবেই, এই আমার বিশ্বাস। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি যাতে জীবনে তুমি সফল হও। তোমার জন্য রইল আমার শুভকামনা।

এত বড়ো আঘাতের জন্য সিদ্ধার্থ প্রস্তুত ছিল না। সুলগ্না কেন এই সিদ্ধান্ত নিল কিছুতেই বোধগম্য হল না সিদ্ধার্থর। বাবাকেও জিজ্ঞেস করল, সুলগ্না কিছু বলেছে কিনা কিন্তু বাবাও মাথা নাড়লেন। সিদ্ধার্থর মতো তিনিও সম্পূর্ণ অন্ধকারে।

আঘাতের উপর আঘাত। খড়কুটোর মতো একমাত্র বাবাকেই আঁকড়ে ধরল সিদ্ধার্থ, ডুবন্ত জাহাজের নাবিকের মতো। সুলগ্নার স্কুলে খোঁজ করেও তার কোনও ঠিকানা জোগাড় করতে পারল না। তার মনে আশা ছিল অন্য শহরের ব্রাঞ্চে হয়তো সে ট্রান্সফার নিয়েছে। কিন্তু সেখানেও আশাহত হতে হল। কাজে কিছুতেই মন বসাতে পারছিল না সিদ্ধার্থ। বাবা পরামর্শ দিলেন, এক কাজ কর সিদ্ধার্থ, কাজের ব্যাপারে এখন ভাবা ছেড়ে দে, বরং ম্যানেজমেন্ট-টা করেনে। গ্র‌্যাজুয়েশন তো করাই আছে, মাস্টার্স কমপ্লিট কর। তাহলে মাস্টার্সের পর অনেক দিক তোর কাছে খুলে যাবে। আমি, বাড়ি বন্ধক রেখে তোর পড়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

পড়াশোনায় বরাবরই সিদ্ধার্থ ভালো ছিল। সুতরাং কটা মাস প্রচণ্ড পরিশ্রম করার পর পরীক্ষা দিয়ে আহমেদাবাদে আইআইএম-এ ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেল। নিজেকে পড়াশোনার মধ্যে ডুবিয়ে দিল সে। পড়তে পড়তেই দ্বিতীয় বছরেই একটা নামি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ভালো প্লেসমেন্ট পেয়ে গেল সিদ্ধার্থ। পড়া শেষ হতেই ছয় মাসের জন্য কোম্পানি তাকে লন্ডন পাঠাল ট্রেনিংয়ের জন্য। কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী ট্রেনিংয়ের পর ইচ্ছেমতো বিদেশে ওদের যতগুলো অফিস আছে, সেখান থেকে বেছে কোনও একজায়গায় সিদ্ধার্থ চাকরি করার সুযোগ পাবে।

লন্ডনে তিন বছর চাকরি করে সে আরও অনেক জায়গায় পোস্টিং পেল। দুই-তিন বছর পর পরই ওকে জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া পোস্টিং দেওয়া হল আর সঙ্গে প্রতিবারই প্রোমোশন। এভাবেই দশ-দশটা বছর কাটিয়ে ফেলল সিদ্ধার্থ। প্রথম প্রথম সুলগ্নার কথা খুবই মনে পড়ত। কিন্তু প্রোমোশনের সঙ্গে সঙ্গে টার্গেট পুরণ করার চাপে সিদ্ধার্থ তার নিজের জীবন সম্পর্কে ভাবার আর সময় পেত না। বাবার সঙ্গে ফোনে মাঝেমধ্যে কথা হতো।

দু-তিন বছর পর পর সময় করে বাবাকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে দেখে যেত। মনের মধ্যে শুধু একটা ক্ষীণ আশা বেঁচে ছিল যে, হযতো কোনও এক দিন সুলগ্না আবার তার জীবনে ফিরে আসবে।

সিদ্ধার্থদের কোম্পানি মুম্বইতে একটা নতুন ব্রাঞ্চ খোলার পরিকল্পনা নিলে, ঠিক হয় সিদ্ধার্থকে ওই অফিসের চিফ করে পাঠানো হবে। অফিস পুরো সেট-আপ হয়ে গেলে সিদ্ধার্থর এক জুনিয়র কলিগকে মুম্বই পাঠায় কোম্পানি, ওখানকার সব কাজ সুষ্ঠু ভাবে তদারকি করার জন্য। নতুন অফিসের জন্য কিছু সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়রের প্রয়োজন ছিল। এটার জন্য সিদ্ধার্থর জুনিয়র কলিগই প্রথম রাউন্ড ইন্টারভিউ নিয়ে তার সম্পূর্ণ ডিটেলস সিদ্ধার্থকে পাঠিয়েরাখত। ফোন এবং ভিডিও কনফারেন্সে ফাইনাল ইন্টারভিউ করার দায়িত্ব সিদ্ধার্থর উপরে ছিল।

মোট বারো জনের লিস্ট তৈরি করে সিদ্ধার্থকে পাঠানো হলে, লিস্ট দেখে ও চমকে উঠল। প্রথম নামটাই সুলগ্নার। বারোজনের মধ্যে সাতজনকে সিলেক্ট করার দায়িত্ব তার কাঁধে। প্রথমে সন্দেহ ছিল অন্য কোনও সুলগ্না হবে হয়তো কিন্তু সিভি দেখার পর সে নিশ্চিত হয়ে গেল, এ তারই সুলগ্না। সে এমসিএ করে গত ছবছর ধরে একটি কোম্পানিতে সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়র হিসেবে কাজ করছে।

সিদ্ধার্থ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সুলগ্নার ফাইনাল ইন্টারভিউ নিল। এই দশ বছরে সিদ্ধার্থ দাড়ি রাখতে আরম্ভ করেছিল, চোখে চশমা উঠেছিল। কানের পাশের চুলগুলো সব সাদা হয়ে গিয়েছিল। আগের সিদ্ধার্থকে চেনার কোনও উপায় ছিল না। অফিসকেও ইন্সট্রাকশন দেওয়া ছিল যেন সিদ্ধার্থের নাম প্রকাশ না পায়। শুধু চিফ এগজিকিউটিভ বলেই সুলগ্নাকে জানানো হয়।

বহুদিন পর সুলগ্নাকে দেখে সিদ্ধার্থ চোখের জল লুকোতে পারল না। সুলগ্না আগের মতোই সুন্দর আছে। নিজেকে খুব ভালো মেইনটেন করেছে। সিদ্ধার্থও সিলেকশন লিস্টের প্রথমে সুলগ্নার নামটাই রাখল। ওকে এখনও ভালোবাসে বলে নয় বরং পোস্টটার জন্য ওর যোগ্যতাই সবচেয়ে বেশি বলে।

মুম্বই অফিস সেট করার জন্য সিদ্ধার্থের যে-কলিগ গিয়েছিল, সে কোম্পানিতে জুনিয়র হলেও সিদ্ধার্থর অতীত সম্পর্কে সে সবই জানত। অফিসের বাইরে ওরা বন্ধুই ছিল। ওকে সিদ্ধার্থ জানাল যে, এই সুলগ্নাই তার এক সময়ের স্ত্রী। ভাগ্য আজ আবার দুজনকে মুখোমুখি এনে ফেলেছে।

তাকে অনুরোধ করল সিদ্ধার্থ, সুলগ্নার মনের কথা যদি কোনও ভাবে জানতে পারে, তাহলে যেন অবশ্যই তাকে জানায়। কিন্তু কাজটা এমন ভাবে করতে হবে যাতে সুলগ্নার মনে কোনও সন্দেহ না জাগে।

কিছুদিন পরেই সিদ্ধার্থ জানতে পারল, সুলগ্না আজও সিংগল। ওর ফ্যামিলি বলতে ও একাই। তবে সুলগ্না আজও নিজেকে বিবাহিতাই মনে করে। যদিও দশ বছরের উপর হয়ে গেছে স্বামীর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। সে নাকি আজও সিদ্ধার্থকেই সম্মান করে, ভালোবাসে। সে চেয়েছিল সিদ্ধার্থ জীবনে অনেক উন্নতি করুক, যেটা তার জন্যই সম্ভব হচ্ছিল না। সে সিদ্ধার্থর উন্নতির পথে কাঁটা হয়ে উঠেছিল। তাই ভালোর জন্যই সিদ্ধার্থকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এই দশ-বারো বছরে দূরত্ব এতটাই বেড়ে গেছে যে, সিদ্ধার্থ কোথায় আছে, কী করছে জানার কোনও উপায়ই তার ছিল না,কারণ ততদিনে সিদ্ধার্থরা বাসস্থান বদলে ফেলেছে।

সুলগ্না শুধু এটুকুই জেনেছিল মুম্বই-তে তার যে ইন্টারভিউ নিয়েছে সেই ভদ্রলোক সিদ্ধার্থর পুরোনো বন্ধু। সুলগ্নাকে জিজ্ঞেস করেছিল সে, আমার বন্ধুর সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায় তাহলে আপনি কি তার কাছে ফিরে যাবেন? তাতে সুলগ্না বলেছে, আমার ছেড়ে যাওয়াতে যদি সিদ্ধার্থ নিজের পথ খুঁজে পেয়ে জীবনে সফল হয়ে থাকে, তাহলে বুঝব আমার এই ত্যাগ স্বীকারই সত্যি করে একজন মানুষের জীবন তৈরি করে দিতে পেরেছে। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব।

কিন্তু সে কোথায় রয়েছে আজকাল? আমি শুনেছিলাম যে, এমবিএ করে বিদেশ চলে গেছে? সুলগ্না জানতে চেয়েছিল।

বন্ধুটির উত্তর ছিল, আমিও ঠিক জানি না। তবে কোনও খবর জানতে পারলে আপনাকে নিশ্চয়ই জানাব কথা দিচ্ছি। এরপর জয়েনিং লেটার তৈরি করে সুলগ্নার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল।

আজ শুক্রবার, আপনি সোমবার থেকে কাজে জয়েন করুন। আমাদের চিফ-ও উইক-এন্ডে মুম্বই পৌঁছোবেন। সোমবার থেকে উনিও এখানে অফিস জয়েন করবেন। শেষ অবধি এই কথাই হয়েছিল ওদের দুজনের মধ্যে।

সোমবার সিদ্ধার্থ নিজের কেবিনে বসেছিল।  তার পিএ ফোনে জানাল, স্যার, সুলগ্না ম্যাম হ্যাজ কাম। শি ইজ গোয়িং টু রিপোর্ট ইউ।

প্লিজ সেন্ড হার ইন।

গুড মর্নিং স্যার। দিস ইজ সুলগ্না, ইয়োর কোম্পানিজ নিউ সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়র, সুলগ্না জানাল।

ওয়েলকাম ইন আওয়ার ফ্যামিলি।

আমার কোম্পানিই আমার এখনকার ফ্যামিলি।

সুলগ্না এখনও সিদ্ধার্থকে চিনতে পারল না, এতটাই পরিবর্তন হয়েছিল তার চেহারায়। সিদ্ধার্থই বলল, আপনি আপনার কেবিনে গিয়ে বসুন। আপনাকে কাজ বুঝিযে দেওয়া হবে। কাল সকালে যখন আসবেন, আমি বাকি সব কাজ বুঝিযে দেব।

পরের দিন সিদ্ধার্থ কেবিনের সামনে নিজের নেমপ্লেট সিদ্ধার্থ সেন ঝুলিয়ে  দিয়ে চেয়ারে এসে বসল। আজ সে ক্লিন শেভ হয়ে অফিস এসেছে। সুলগ্না নক করে কেবিনে ঢুকতেই সিদ্ধার্থকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। আজ আর সিদ্ধার্থকে চিনতে কোনও অসুবিধাই হচ্ছে না। অস্ফুটে সুলগ্না বলে উঠল, সিদ্ধার্থ তুমি?

দরজার বাইরে নেমপ্লেট দ্যাখোনি?

ঠিক খেয়াল করিনি।

সুলগ্না, এটাই আমার কোম্পানি, আমার ফ্যামিলি। আজ থেকে তুমিও এই ফ্যামিলির একজন বিশিষ্ট সদস্য। আমার আশা ছিল একদিন না একদিন তুমি নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। তোমাকে ছাড়া অন্য কারও কথা আমি কোনওদিন ভাবতেই পারিনি।

কিন্তু তুমি… সুলগ্না থেমে যায়।

হ্যাঁ সুলগ্না, আমার এই বন্ধুই তোমার সম্পর্কে সব জানায় আমাকে, বিশেষ করে আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ। তোমার আত্মত্যাগের জন্যই আজ আমি সাফল্যের চূড়া, ছুঁতে পেরেছি। এর পুরো ক্রেডিট তোমার প্রাপ্য।

সিদ্ধার্থ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সুলগ্নাকে কাছে টেনে নিয়ে ওর চুলে মুখ রাখে। কাচের দরজার বাইরে কলিগের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সিদ্ধার্থ আর ওর বন্ধুর মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে। হাতে থামস আপ সাইন দেখিয়ে সিদ্ধার্থের কলিগ দুজনকে একটু একা থাকার সুযোগ দিয়ে ওই ঘরটা ছেড়ে চলে যায়।

সেদিনের সেই দিনগুলি

অনবরত চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল স্নেহার। বারবার ফিরে যাচ্ছিল অতীতের ফেলে আসা দিনগুলোয়। আনন্দের মুহূর্তগুলো বারবার স্নেহার স্মৃতিকোঠায় ফিরে আসছিল। আর কিছুক্ষণ পরই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে সে তাই বোধহয় এত স্মৃতি ভিড় করে আসছে মনে।

কলেজের সেই প্রথম দিনটা। কেমিস্ট্রি-র ক্লাস চলছিল। প্রফেসর নতুন ছাত্র-ছাত্রীদের কেমিস্ট্রির জ্ঞান পরখ করার চেষ্টা করছিলেন। একটার পর একটা প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন। স্নেহার আজও মনে পড়ে, ঋদ্ধ একাই প্রত্যেকটা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিল। ঋদ্ধর বিষয়ের প্রতি এতটা গভীর জ্ঞান দেখে সেদিনই স্নেহা ঋদ্ধর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করে।

কলেজে ওদের ক্লাসে সকলেই নতুন, তাই ছাত্র-ছাত্রীদের একে অপরের সঙ্গে পরিচয় হতে বেশ কয়েকটা দিন কাটল। একদিন স্নেহা কলেজে ঢুকতে গিয়ে দেখল ঋদ্ধ কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছে। স্নেহা-কে দেখে ঋদ্ধ এগিয়ে এল, ‘এত তাড়াতাড়ি কলেজে কী ব্যাপার। ক্লাস তো প্রায় একঘন্টা পর।’

‘বাবার, এদিকে একটা কাজ ছিল তাই আমিও বাবার সঙ্গেই বেরিয়ে পড়লাম। একটু না হয় লাইব্রেরিতে বসে সময় কাটাব’, হেসে জবাব দিল স্নেহা।

‘তাহলে চল, একটু ক্যান্টিনে বসা যাক’, ঋদ্ধকে না বলতে পারল না স্নেহা। প্রথম দিন থেকেই ঋদ্ধ-র প্রতি একটু বেশি দুর্বলতা বোধ করছিল স্নেহা।

ক্যান্টিনে বসে দু’জনে কফি খেতে খেতে গল্প করছিল। মাঝেমধ্যেই স্নেহা অনুভব করছিল ঋদ্ধর দৃষ্টি ওর মুখের উপর এসে কিছু যেন খোঁজার চেষ্টা করছে। ক্লাসের সময় এগিয়ে আসাতে দু’জনে ক্যান্টিন ছেড়ে ক্লাসরুমে এসে পাশাপাশি বসে পড়ে।

বিকেলে ক্লাস শেষ হবার পর ঋদ্ধ স্নেহা-কে বলে, ‘একটু দাঁড়া। স্যারকে বইটা দিয়ে এক্ষুনি আসছি। একসঙ্গে বেরোব।’

গেট অবধি পৌঁছোতেই ঋদ্ধ চলে আসে। দু’জনে হেঁটে বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে যায়। স্নেহা বলে, ‘ঋদ্ধ তুই এবার যা, বাস এলে আমি উঠে পড়ব। কিন্তু তুই তো এখান থেকে বাস পাবি না। তোকে তো একটু হাঁটতে হবে।’

‘হ্যাঁ যাচ্ছি। স্নেহা তোকে একটা কথা বলার ছিল। তোকে আমার খুব ভালো লাগে, সবসময় তোকে দেখার জন্য, কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকি। এটাই বোধহয় ভালোবাসা। আমি নিশ্চিত যে আমি তোকে ভালোবাসি।’

স্নেহা ঘটনার আকস্মিকতায় থ হয়ে যায়। কী বলবে বুঝে উঠতে পারে না। লজ্জায় লাল হয়ে ওঠে ওর মুখ। নিজের হূৎস্পন্দন যেন নিজের কানকেই আঘাত হানছে মনে হয় ওর। বাসটা এসে পড়ায় মুহূর্তের লজ্জার হাত থেকে নিজেকে কিছুটা বাঁচাতে পারে স্নেহা। সিটে বসে জানলা দিয়ে খেয়াল করে, ঋদ্ধ তখনও দাঁড়িয়ে বাসস্ট্যান্ডে।

বাড়ি ফিরে এক মুহূর্তের জন্যও ঋদ্ধর চিন্তা মন থেকে দূর করতে পারল না স্নেহা। ওর চোখের গভীর চাহনির আকর্ষণ যেন প্রতিক্ষণেই স্নেহাকে মনে মনে চঞ্চল করে তুলতে লাগল। প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে গুণতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে স্নেহা ঠিকমতো মনে করতে পারল না। ঘুম ভাঙল একেবারে সকালবেলায়। অভ্যাসমতো মোবাইল-টা ঘাঁটতেই চোখে পড়ল ঋদ্ধর পাঠানো ছোট্ট মেসেজটায়, ‘সুপ্রভাত। দেখা হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম।’

রোমাঞ্চ অনুভব করল স্নেহা। ভালোবাসার প্রথম অনুভূতি বুঝি এমনটাই হয়, স্নেহার মনে হল। অনেক ভেবেও উত্তরে কী লিখবে বুঝতে পারল না। চিন্তা করার শক্তিও যেন লোপ পেয়েছে। ‘সুপ্রভাত’ লিখে পাঠিয়ে দিল স্নেহা।

শুরু হল স্নেহার জীবনের নতুন অধ্যায়। ঋদ্ধর সঙ্গে আলাপ হওয়া, রোজ কলেজে একসঙ্গে বসে ক্লাস করা, ভালোবাসার উড়ানে গা ভাসিয়ে দেওয়া এই সবকিছুই স্নেহার ভালো লাগতে আরম্ভ করল। উভয়ের দেখা না হওয়া পর্যন্ত মন অস্থির হয়ে উঠত। ক্লাস অফ থাকলেই পার্কে, কখনও গঙ্গার ধারে কখনও আবার কোনও মল-এ ওদের দুজনের একসঙ্গে দেখা পাওয়া যেত। কলেজেও দুজনকে নিয়ে ভালোই চর্চা শুরু হয়েছিল।

স্নেহা জানত, ঋদ্ধর মা-বাবা গাড়ি অ্যাক্সিডেন্টে মারা যান এবং কাকা-কাকিমার কাছে ও মানুষ হয়েছে। গ্রামের বাড়িতে থাকেন

কাকা-কাকিমা। শহরে একটা ঘর ভাড়া করে ঋদ্ধ থাকে। টিউশন করে কলেজের মাইনে দেয় ঋদ্ধ। পড়াশোনায় ভালো বলে প্রফেসররা নোট এবং বই দিয়ে ঋদ্ধকে সাহায্য করতেন একথাও অজানা ছিল না স্নেহার।

সেদিন কলেজে গিয়ে স্নেহা ঋদ্ধকে কোথাও দেখতে পেল না। একটা ক্লাস হয়ে যাওয়ার পর রীতিমতো চিন্তায় পড়ল স্নেহা। এতদিন হয়ে গেল ঋদ্ধ এরকম কখনও করেনি। ফোনেও কোনও মেসেজ করেনি। স্নেহা ঋদ্ধ-র নম্বরে ফোন করল। ফোন সমানে বেজে চলেছে ওপাশ থেকে কোনও উত্তর নেই। ভয় পেয়ে গিয়ে মরিয়া হয়ে আবার ফোন করল স্নেহা। এবার উত্তর এল। অস্ফুট কণ্ঠে উত্তর এল, ‘স্নেহা আজ আমি কলেজ যেতে পারব না। প্রচণ্ড জ্বর, উঠতে পারছি না। চিন্তা করিস না। জ্বরটা কমলেই কলেজ যাব।’

পরের দিনও ঋদ্ধ কলেজ আসতে পারল না। ক্লাসে কিছুতেই মন লাগল না স্নেহার। খালি মনে হচ্ছিল একবার ঋদ্ধ-কে দেখতে যাওয়া খুব দরকার। এত জ্বরে একা একা সবকিছু কী করে সামলাচ্ছে ঋদ্ধ।

ঠিকানা জানাই ছিল। বাড়ি খুঁজে পেতে তবুও বেশ কষ্ট হল। অনেকবার দরজায় ধাক্বা দেওয়ার পর ঋদ্ধ এসে দরজা খুলল। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে, চোখদুটো জবাফুলের মতো লাল। ঋদ্ধকে দেখে কষ্ট হওয়ার বদলে রাগই হল স্নেহার। ‘এতটা জ্বর আর তুই কিছুই জানাসনি? ওষুধ খেয়েছিস? বাড়ির কাউকে জানিয়েছিস?’

চোখের পাতা খুলে রাখতে পারছিল না ঋদ্ধ। সেই অবস্থাতেই শিথিল স্বরে জবাব দিল, ‘কাকা-কাকিমাকে জানিয়ে কী হবে? শুধু শুধু অত দূরে ওনারা চিন্তা করবেন। আর ডাক্তারে কাছে যাওয়ার অবস্থা আমার ছিল না।’

দুদিনেই ঋদ্ধ অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। চোখের নীচে কেউ যেন কালি ঢেলে দিয়েছে মনে হচ্ছিল। ঋদ্ধর অবস্থা দেখে স্নেহার কান্না পাচ্ছিল। হয়তো দুদিন কিছুই খাওয়া হয়নি ঋদ্ধর কারণ ও নিজেই রান্না করে খেত। এতক্ষণে ঘরের চারপাশে তাকিয়ে দেখল স্নেহা। জিনিসপত্র এধার-ওধার ছিটিয়ে পড়ে আছে। ছোটো একটা কাঠের টেবিলের উপর কাচের গেলাসে অর্ধেকটা জল পড়ে রয়েছে আর একটা বিস্কুটের খোলা প্যাকেট রাখা আছে।

স্নেহা প্রথমে একটা বাটিতে জল ভরে, রুমালের সাহায্যে ঋদ্ধর কপালে জলপট্টি দিতে লাগল যাতে জ্বরটা একটু কম হয়। কপালটা একটু ঠান্ডা হয়েছে বলে মনে হলে উঠে ঘরদোর পরিষ্কার করে, জায়গার জিনিস জায়গায় গুছিয়ে রাখল। বাইরে বেরিয়ে সামনের দোকান থেকে ব্রেড আর দুধ নিয়ে ফিরে এল। দুধ ফুটিয়ে, ব্রেড সেঁকে ঋদ্ধকে জোর করে খাওয়াল তাও একটাই ব্রেড খেতে পারল ঋদ্ধ।

নিজেদের পারিবারিক ডাক্তারকে ফোন করে স্নেহা ঋদ্ধর অবস্থা জানাল। ডাক্তারের কাছ থেকে ওষুধের নাম জেনে দোকান থেকে ওষুধ কিনে এনে ঋদ্ধকে খাওয়াল। সন্ধে অবধি ঠায় বসে রইল ঋদ্ধর পাশে। ঋদ্ধর কৃতজ্ঞতা ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে কপট রাগ দেখাল স্নেহা। ‘আমার পক্ষে যেটুকু করা সম্ভব সেটুকুই করলাম। তোকে আর কৃতজ্ঞতা দেখাতে হবে না।’

‘জানিস স্নেহা, ছোটো বেলায় মা-বাবা মারা যাওয়ার পর আমার জীবন থেকে খুশি উধাও হয়ে গিয়েছিল। কাকু-কাকিমা আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু ওদের জন্য আমি বোঝা। তুই আমার জীবনে আসাতে আবার আমি নতুন করে ভালোবাসা পেয়েছি। তুই আমার যা সেবা করলি হয়তো আমার মা বেঁচে থাকলে এতটাই করত। তাই কৃতজ্ঞতা নয়, এটা আমার অনেস্ট কনফেশন।

অবশ্য কাকু-কাকিমার বিরুদ্ধে আমার কোনও নালিশ নেই। আমি তো তাদের নিজের সন্তান নই। তাঁরা যে আমাকে আশ্রয় দিয়েছেন এটাই আমার পক্ষে যথেষ্ট’, ঋদ্ধর চোখ জলে ভরে আসে।

‘তুই চুপ করবি ঋদ্ধ। এইসব কথা বলার সময় নয় এটা। শরীরটা আগে। নিজেকে একলা ভাবিস না, আমি সব সময় তোর পাশে আছি।’ পাশে রাখা ভিজে তোয়ালে দিয়ে ঋদ্ধর মুখটা ভালো করে মুছে দিয়ে স্নেহা উঠে দাঁড়াল। ঋদ্ধর জ্বরটা একটু কমেছে বোধ হল। এদিকে সন্ধেও হয়ে এসেছে। দেরি হলে বাড়িতে সকলে চিন্তা করবে। নিজের কলেজের ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে নিল স্নেহা, ‘ঋদ্ধ আজ আসি। দুধ আর ব্রেড রাখা রইল। পাত্রে দুধটা একটু গরম করে খেয়ে নিস। ওষুধটাও খাবি। রাত্রে কোনওরকম অসুবিধা হলে ফোন করিস। আমি একা মেয়ে রাত্রে কী করব এই ভেবে আবার সমস্যা নিয়ে বসে থাকিস না। আমি তোর জন্য সব কিছু করতে পারি।’

বাড়িতে এসেও ঋদ্ধর চিন্তাটা কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারল না স্নেহা। রাত্রে সবাই ঘুমিয়ে পড়লে ঘরের দরজা বন্ধ করে ঋদ্ধকে ফোন করল। ঋদ্ধ অনেকটাই সুস্থ বোধ করছে জানতে পেরে নিশ্চিন্ত হল স্নেহা। বিছানায় গা এলাতেই ঘুমের জগতে পৌঁছে গেল।

চারদিনের দিন সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠল ঋদ্ধ। এই দুদিন স্নেহা সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে বাড়ি থেকে ঋদ্ধর জন্য খাবার নিয়ে গিয়ে ওকে খাইয়ে আসত। ঘন্টার পর ঘন্টা ঋদ্ধ-র কাছে বসে ওর সঙ্গে গল্প করত। পঞ্চম দিন থেকে ঋদ্ধ কলেজ আসতে আরম্ভ করল। এই ক’দিনে ওরা দুজন আরও বেশি করে পরস্পরের কাছাকাছি এসে পড়েছিল এবং দুজনেই বুঝতে পারল একে অপরজনকে ছাড়া আলাদা থাকা তাদের কারও পক্ষেই সম্ভব নয়।

দেখতে দেখতে কলেজে তিনটে বছর কেটে গেল। এই তিনটে বছর স্নেহার জীবনে সবথেকে সুখের যার স্মৃতি আজও স্নেহার মনে উজ্জ্বল। কলেজ শেষ হতেই ঋদ্ধ হায়ার এডুকেশনের জন্য অন্য একটি কলেজে অ্যাডমিশন নিল। স্নেহার বাবা মেয়েকে আর পড়াশোনা করাতে রাজি হলেন না। সুতরাং ঋদ্ধ-র সঙ্গে দেখা করাটা সমস্যা হয়ে উঠল স্নেহার কাছে। ঋদ্ধ-র সঙ্গে দেখা না হলেই মন খারাপ হয়ে যেত স্নেহার। ফোনে কথা বলে আশ মিটত না ওর।

স্নেহার মা-বাবাও মেয়ের বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা শুরু করে দিল। মেয়ের দায়িত্ব কতদিন আর বয়ে বেড়ানো যায়! বাড়ি থেকে বেরোতে হলে হাজার কৈফিয়ত। দিনের বেলা ঋদ্ধ-র কলেজ সুতরাং দেখা করতে হলে সেই সন্ধেবেলা। সেটাও স্নেহার বাবার জন্য বন্ধ হয়ে গেল। সন্ধেবেলায় বাড়ির মেয়ের রাস্তায় কী কাজ? রোজ মিথ্যা বলা সম্ভব নয়। একপ্রকার বন্দি জীবন হয়ে উঠল স্নেহার। সুযোগ পেলেই ঋদ্ধকে ফোন করে কিছু একটা উপায় বার করার জন্য অনুরোধ জানাত স্নেহা যাতে দুজনে একসঙ্গে থাকতে পারে। কিন্তু চাকরি ছাড়া কীভাবে বিয়ে করা সম্ভব সেটা ঋদ্ধ কিছুতেই ভেবে পেত না।

ছেলের বাড়ি থেকে কেউ দেখতে এলেই স্নেহার চোখে জল চলে আসত। ঋদ্ধকে ছাড়া অন্য কারও সঙ্গে জীবন কাটানোর কথা ও ভাবতেই পরত না। এদিকে

মা-বাবাকে ঋদ্ধ-র সম্পর্কে জানাতেও কিছুতেই সাহসে কুলোতে পারছিল না স্নেহা। বাবা পুলিশে ছিলেন সুতরাং শক্ত ডিসিপ্লিনের মধ্যে মানুষ হতে হয়েছিল স্নেহাকে। যদিও একটিমাত্র কন্যা হওয়ার কারণে মা-বাবার আদরের সন্তান ছিল স্নেহা। স্নেহা মনে করতে পারে না, ওর সঙ্গে বাবা কোনওদিন উঁচু গলায় কথা বলেছেন বলে।

একদিন স্নেহার মা ওকে জানালেন পাত্রপক্ষ ওকে সন্ধেবেলায় দেখতে আসবে। পাত্র ডাক্তার। মন অশান্ত হয়ে উঠল। ঋদ্ধকে ফোনে সব কিছু জানিয়ে দেখা করার জন্য সময় নির্দিষ্ট করে নিল। বন্ধুর বাড়ি যাওয়ার মিথ্যা অছিলায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঋদ্ধ-র সঙ্গে দেখা করল স্নেহা। ঋদ্ধকে দেখে চোখের জল বাধ মানল না।

‘ঋদ্ধ, প্লিজ তুই কিছু একটা কর। বাবার কাছ থেকে আমাকে চেয়ে নে। তোকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না।’

স্নেহার মানসিক অবস্থা দেখে ঋদ্ধও কিছুক্ষণ কোনও উত্তর দিতে পারল না। স্নেহা একটু শান্ত হলে ঋদ্ধ বলল, ‘স্নেহা, আজ আমার নিজেরই দাঁড়াবার মতো সামর্থ্য নেই, আমি কোন মুখে তোর বাবার কাছে তোর হাত চাইব? উনি যদি মানা করে দেন তাহলে আমাদের দুজনেরই আশা ভেঙে যাবে। যতক্ষণ না আমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারছি ততক্ষণ তোকে ধৈর্য রাখতেই হবে। যোগ্য হয়ে উঠতে দে, ততদিন কিছু বলে মা-বাবাকে বুঝিয়ে রাখ। খুব শিগগির তোর বাবার কাছে যাব।’

‘যদি সত্যি সত্যি এরকম করতে পারতাম। শেষ নিঃশ্বাস নেওয়া পর্যন্ত তোর জন্য অপেক্ষা করতে পারতাম! জানি না কেন বাবা-মা আমার বিয়ে নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে? তুই একটু তাড়াতাড়ি কর, আমি সারা জীবন তোর কাছে কৃতজ্ঞ থাকব।’ একটু দম নেয় স্নেহা, ‘ঋদ্ধ আমি আর কাউকে বিয়ে করতে পারব না। তোকে না পেলে আমি আত্মহত্যা করব।’

ঋদ্ধ ঘাবড়ে গেল, ‘এই ভুল খবরদার করিস না। তোকে ছেড়ে থাকার কথা আমিও ভাবতে পারি না। কিন্তু আপাতত আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।’

ঋদ্ধ-র কাছে আশ্বাস পেয়ে এক বুক আশা নিয়ে স্নেহা বাড়িতে ফিরে এল। ঋদ্ধ প্রমিস করেছে, আর কয়েকটা দিন। তারপরেই ওরা দুটিতে একসঙ্গে সংসার পাতবে। সন্ধেবেলায় পাত্রপক্ষ এসে স্নেহাকে দেখে গেল। কলের পুতুলের মতো ওদের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেল স্নেহা। আর কয়েকটা দিনের অপেক্ষা।

কয়েক দিন পরেই স্নেহার স্বপ্নের সংসার গুঁড়িয়ে চুরমার হয়ে গেল। স্নেহার মা এসে জানালেন পাত্রপক্ষ স্নেহাকে পছন্দ করেছে। ছেলে এবার নিজে আসবে স্নেহাকে দেখতে। ঘাবড়ে গিয়ে স্নেহা ঋদ্ধকে ফোন করল। কিন্তু একি? রিং হয়ে যাচ্ছে অথচ ওধার থেকে কেউই কল রিসিভ করছে না। ঋদ্ধ-র হল কী? ফোন ধরছে না কেন? উৎকণ্ঠা বাড়তে লাগল স্নেহার।

মনে হল হয়তো কোনও কাজে ব্যস্ত রয়েছে। ফোন রেখে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করল স্নেহা। আবার ফোন করল কিন্তু ঋদ্ধ ফোন ওঠাল না। এরকম তো ঋদ্ধ কখনও করে না। সেই মুহূর্তে ধরতে না পারলেও পরে পরেই ফোন করে নেয়। ঘড়ি দেখল স্নেহা। মধ্যরাত, এত রাতে বাইরে থাকারও কথা নয় ঋদ্ধর। চোখের পাতায় কিছুতেই ঘুম এল না। চেষ্টা করতেই লাগল। শেষমেশ উলটো দিকে ফোন সুইচ অফ হয়ে গেল। কোনও উপায় না দেখে বালিশ অাঁকড়ে স্নেহা কান্নায় ভেঙে পড়ল।

পরের দিন সকালে বাবা কাজে বেরিয়ে গেলে মিথ্যা বাহানা করে স্নেহা বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা ঋদ্ধ যে বাড়িতে ভাড়া থাকে সেখানে গেল। দরজায় তালা দেখে আশেপাশে জিজ্ঞেস করাতে জানতে পারল, ঘর খালি করে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে ঋদ্ধ কোথাও চলে গেছে। কিন্তু কোথায় গেছে কেউ-ই বলতে পারল না। কী করবে, কোথায় যাবে কিছুই ভেবে পেল না স্নেহা। কাউকে কিছু না বলে ঋদ্ধ কোথায় যেতে পারে? ও যে এরকম করতে পারে কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না স্নেহার।

সন্ধে হয়ে আসতে মায়ের জোরাজুরিতে স্নেহাকে সেজেগুজে তৈরি হতে হল। ডাক্তার ছেলেটির দেখতে আসার কথা। স্নেহার খালি মনে হচ্ছিল ছেলেটির যদি ওকে দেখে পছন্দ হয়ে যায় তাহলে ও নিজের মনকে কী করে এই বিয়েতে রাজি করাবে? ঋদ্ধ ছাড়া আর কাউকে বিয়ে করাটা ওর পক্ষে কখনওই সম্ভব হবে না।

মনকে কিছুতেই মানাতে পারছিল না, ঋদ্ধ-র হঠাৎ করে কোথাও চলে যাওয়ার ঘটনাটা। তাহলে কি শুধু ফূর্তি করার জন্যই স্নেহার সঙ্গে ভালোবাসার নাটক করল ও, না, না, এটাও কী সম্ভব! ঋদ্ধ-র চোখে ওর জন্য ভালোবাসা স্পষ্ট দেখেছে স্নেহা, সুতরাং নিজের চোখকে কী করে অবিশ্বাস করে স্নেহা? তাহলে কোনও কিছু না জানিয়ে হঠাৎ-ই ঋদ্ধ-র অন্তর্ধান হওয়ার পেছনে কী রহস্য লুকিয়ে থাকতে পারে?

ছেলে এসে স্নেহাকে পছন্দ করে গেল। স্নেহার বিয়ে নিয়ে বাড়িতে সকলেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল। চারিদিকে খুশির পরিবেশ। স্নেহার মা, আত্মীয়স্বজন সকলকেই মেয়ের বিয়ের ঠিক হওয়ার খবরটা জানিয়ে রাখলেন। বাবাও ধুমধাম করে একমাত্র মেয়ের বিয়ে দেওয়ার আয়োজন শুরু করে দিলেন। এই হইচই-এর পরিবেশ থেকে স্নেহা নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখল কারণ রোজ একটাই প্রার্থনা করত স্নেহা, যাতে এই বিয়েটা কোনওভাবে ভেঙে যায়।

এই ভাবেই প্রায় এক মাস পার হতে চলল। ঋদ্ধ-র কোনও খবর পেল না স্নেহা। তবে একটা এমন ঘটনা ঘটল যাতে স্নেহার সমস্যা কিছুটা হলেও মিটল। হঠাৎই পাত্রপক্ষ স্নেহার সঙ্গে বিয়েটা নিয়ে কিন্তু কিন্তু শুরু করে দিল। স্নেহার বাবা ভিতর থেকে খবর আনলেন যে টাকার লোভে ছেলের অভিভাবকেরা অন্য জায়গায় ছেলের সম্বন্ধ ঠিক করেছে। খবরটা পেয়ে স্নেহা সবথেকে আনন্দ পেল। বহুদিন পর ওর মুখে হাসি ফুটল।

ঘুরতে ফিরতে ঋদ্ধকে ফোন করাটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল স্নেহার। কিন্তু এত কিছুর পরেও সেই ‘সুইচ অফ’ ছাড়া ওপার থেকে কোনও উত্তর পাওয়া গেল না। মেসেঞ্জার-এও মেসেজ পাঠাল স্নেহা কিন্তু উত্তর এল না। কয়েকদিন পর স্নেহা খেয়াল করল ঋদ্ধ ওকে ফেসবুকেও ব্লক করে দিয়েছে। খুব রাগ হল ওর, যাকে কাছে পাওয়ার জন্য ও মরিয়া হয়ে উঠেছে সেই-ই ওকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যদি বিয়ে করার ইচ্ছা ছিল না তাহলে প্রথমে বলে দিলেই হতো, এভাবে ভীতুর মতো কিছু না জানিয়ে পালিয়ে যাওয়ার কী অর্থ ছিল?

ধীরে ধীরে স্বপ্ন দেখা বন্ধ করে দিল স্নেহা। মোবাইলে ঋদ্ধ-র ফোন নম্বরটা টাইপ করতেও আর আঙুল চলত না স্নেহার। রোজই মনে হতো ঋদ্ধ-র ফোন আসবে। কিন্তু না একটা ফোন কল আর না যে নিজে একবারের জন্যেও স্নেহার সামনে এল। দু মাস ধরে লাগাতার চেষ্টা করে করে স্নেহা অবশেষে হার মানল। মোবাইলে ঋদ্ধর নম্বর ডায়াল করাই বন্ধ করে দিল। একদিন ঋদ্ধ-র নম্বরটাই মুছে দিল নিজের মোবাইল থেকে।

সময়ের স্রোত নিজের গতিতে বইতে লাগল। ইতিমধ্যে স্নেহার বাবারও বদলির খবর এল। শিলিগুড়িতে নতুন বদলি। সুতরাং পুরো পরিবার নিয়ে স্নেহার বাবা শিলিগুড়ি চলে এলেন।

ঋদ্ধকে পাওয়ার আশা স্নেহা পুরোপুরি ত্যাগ করে দিল। শিলিগুড়িতে এসে স্নেহার মনে হল এবার অতীতকে ভোলা অনেক সহজ হবে। বাড়িতে যখনই ওর বিয়ের কথা উঠত স্নেহা নিজের ভিতরে নিজেই গুটিয়ে যেত। বিয়ে এবং ভালোবাসা এই দুটো শব্দের সঙ্গে ওর শত্রুতা তৈরি হয়েছিল। স্নেহা বাড়িতে বিয়ে নিয়ে কোনওরকম আলোচনা করতে মা-কে বারণ করে দিল।

দু’বছরের উপর স্নেহা-রা শিলিগুড়িতে কাটিয়ে ফেলল। মাঝেমধ্যেই স্নেহার মনে হতো, আদৗ কি ঋদ্ধ কখনও ওর কথা মনে করে? পুরোটাই ওর যদি ছলনা ছিল তাহলে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি কেন দিল? একবার যদি ও নিজের মনের কথা জানাত তাহলে মনে হাজার দুঃখ পেলেও ও ঋদ্ধকে ক্ষমা করে দিতে পারত। সত্যিকারের ভালোবাসা যে আজও আছে, এই ভুলটা অন্তত ওর ভাঙত।

শিলিগুড়ি আসার পর থেকে বাড়ির বাইরে খুব একটা বেরোত না স্নেহা। ওর কিছু ভালো লাগত না। একদিন ওর মা জোর করে ওকে প্রতিবেশী কাকিমার বাড়ি নিয়ে গেল। একটা ছোটোখাটো অনুষ্ঠান ছিল। কাকিমার মেয়ে রূপা-কে পাত্রপক্ষের দেখতে আসার কথা ছিল।

মায়ের মন, তাই মনে হল বিয়ের পরিবেশ দেখে মেয়ের মনে যদি কোনও পরিবর্তন আসে। সন্ধ্যাকে সাজিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে আনার দায়িত্ব এসে পড়ল স্নেহার উপর। নিজে সাজতে ভুলেই গিয়েছিল স্নেহা। রূপাকে সামনে পেয়ে অতীত এসে আবার স্নেহার সামনে দাঁড়াল। এমনই সেজেগুজে ঋদ্ধ-র কাছে যেত স্নেহা। নিশ্চয়ই ওরই মধ্যে কোনও কিছুর অভাব ছিল যার কারণে ঋদ্ধ ওর জীবন থেকে সরে গেল।

ছেলের বাড়ির সকলেই এসে গিয়েছিল। ইচ্ছে না থাকলেও কাকিমার ইচ্ছেমতো রূপার শৃঙ্গার শেষ করে ওর হাত ধরে স্নেহা বসার ঘরের দিকে পা বাড়াল।

সামনে সোফায় বসা ছেলেটির দিকে তাকাতেই স্নেহার চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে এল। প্রতিটা ক্ষণ যার অপেক্ষা করে থেকেছে, যার জন্য এত চোখের জল ফেলেছে, নিজের সুখ-শান্তি সব ছেড়েছে আর যে কিনা ভীরুর মতো চুপিচুপি ওর জীবন থেকে পালিয়ে গেছে, সেই বিশ্বাসঘাতক ঋদ্ধ ওর সামনে বসে আছে। আজ সে আর একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করবে বলে এসেছে।

‘স্নেহা… স্নেহা…’ চোখ খুলতেই সেই পরিচিত মধুর আওয়াজ স্নেহার কানে এসে প্রবেশ করে। আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসে। কেউ ওর মুখে জলের ঝাপটা দিচ্ছে। বহু পরিচিত একটা স্পর্শ অনুভব করতে পারছে স্নেহা। পরিচিত বাহুর বেষ্টনী ওকে ঘিরে রয়েছে।

‘চোখ খোল স্নেহা…’ আবার সেই মধুর আওয়াজ কানে আসে।

‘ঋদ্ধ না?’ না চাইতেও মুখ ফসকে বেরিয়ে আসে নামটা।

‘হ্যাঁ, আমি ঋদ্ধ।’

অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে স্নেহার চোখ বেয়ে। মনের ভিতর জমে থাকা অভিমান কথার মধ্যে বেরিয়ে আসে, ‘তুই কেন এভাবে আমাকে ঠকালি ঋদ্ধ? কেন আমাকে না জানিয়ে তুই পালিয়ে গেলি? আজও তোকে আমি খুঁজে যাচ্ছি। তোর জন্য অনেক কেঁদেছি, অনেক কষ্ট পেয়েছি। যদি আমাকে ছেড়ে চলেই যাবি ভেবেছিলি তাহলে আমাকে মুখের উপর বলে দিতে পারতিস। আমিই বোধহয় পাগল ছিলাম যে তোকে নিজের করে পেতে চেয়েছিলাম।’

‘স্নেহা, তোকে ছেড়ে এসে আমিও প্রচুর কেঁদেছি’, ঋদ্ধ বলে, ‘যেদিন তুই শেষবার আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলি সেই দিনটার কথা তোর মনে আছে?’

‘হ্যাঁ… কেন?’

‘সেদিন তুই চলে যাওয়ার পর, তোর বাবা চার-পাঁচজন লোক নিয়ে আমার ওখানে আসেন। সবারই গায়ে পুলিশের পোশাক ছিল।’

‘সে কী…’, বিস্ফারিত চোখে ঋদ্ধর দিকে তাকায় স্নেহা।

‘হ্যাঁ, তোর বাবা এসে আমাকে শাসান, আমি যেন তোর সঙ্গে কোনওদিন আর দেখা না করি। তোর কাছ থেকে আমি যেন অনেক দূরে চলে যাই। নয়তো ফল ভালো হবে না। ওনার কোনও সহকর্মী আমাদের দুজনকে পার্কে বসে থাকতে দেখেছিল এবং তোর বাবাকে বলে দেয়। তোর বাবা চেয়েছিলেন আমাকে দূরে পাঠিয়ে তোর তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেবেন। আমার এখানে কিছুই করার ছিল না। পুলিশের সঙ্গে কী করে লড়ব বিশেষকরে যেখানে তোর বাবা উপস্থিত। তোর জীবনে যাতে ঝড় না আসে তাই আমি চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম।

নিজের সিম কার্ড ভেঙে ফেলে দিয়ে দিল্লি চলে যাই। ওখানে বন্ধুর বাবার মাধ্যমে একটা চাকরি জোগাড় করি আর বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলোর জন্য নিজেকে তৈরি করতে থাকি। একবছর বাদে পরীক্ষা দিয়ে ব্যাংক-এ অফিসার পদে নির্বাচিত হই। কিন্তু সবকিছু হলেও তুই আমার জীবনে ছিলি না তাই স্বাচ্ছন্দ্য থাকলেও সুখ ছিল না। এই ভেবে মনকে শান্ত রাখতাম যে, এতদিনে নিশ্চয়ই তোর বিয়ে হয়ে গেছে আর তুই নতুন জীবনে সুখে আছিস। আবার কখনও এও মনে হতো, তুই আমার ছাড়া অন্য কারও কিছুতেই হতে পারিস না।

একবার তো সাহস করে কলকাতায় যাই এই ভেবে যে, হয়তো তুই আজও আমার অপেক্ষায় রয়েছিস। কিন্তু গিয়ে দেখি সপরিবারে তোরা অন্য কোথাও চলে গিয়েছিস। অনেক চেষ্টা করার পরেও তোদের খোঁজ না পেয়ে কাকু-কাকিমার জেদ আর ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দিই। এখানে কাকিমার এই আত্মীয়ার সঙ্গে আমার বিয়ের কথাবার্তা হয়েছিল তাই আমার এখানে আসা। কিন্তু তোকে যখন একবার খুঁজে পেয়েছি, আর আমি তোকে হারাতে চাই না।’

স্নেহার পুরোটাই স্বপ্ন মনে হচ্ছিল। আজ ওর বিশ্বাস হল, সত্যিকারের ভালোবাসা অটুট হয়। ঋদ্ধকে নিয়ে গর্ববোধ করল যে, এত বছরেও ঋদ্ধ ওকে ঠকায়নি।

ঠেলা

সামনের রোববার বিকেলে যেন কোনও কাজ রেখো না।

শ্রীদীপ্তা ড্রেসিং টেবিলের টুলটায় বসে মুখে ময়েশ্চারাইজার ঘষছিল। বাড়তি যত্ন চল্লিশ-এর দিকে ছুটে যাওয়া শরীর চায়। শ্রীদীপ্তা সে চাওয়া সারাদিনে না পারলেও রাতে মেটায়। কমপিউটার সি্্ক্রন থেকে মুখ তুলল না জয়। রীতিমতো উপেক্ষা মনে হয় শ্রীদীপ্তা’র। বেশ কিছু বছর ধরেই চলে আসছে এই ঘটনা। শুধু ছোট্ট একটা জবাব বুঝিয়ে দিল শোবার ঘরটায় শ্রীদীপ্তা একা নেই।

–আচ্ছা।

জয় এ রকমই। সবেতেই হ্যাঁ। অথচ থেকেও যেন নেই। সবার মতের বিপক্ষে বেরিয়ে আসা। ঘুপচি একটা ঘরে ভাড়া থেকে জীবন শুরু। তখন কিন্তু জয়ের মধ্যে তাপ পেয়েছে। দাঁতে-দাঁত চিপে দু’জনের লড়াই চালানো। জীবনের সিঁড়ি দিয়ে পাঁচজনের চেয়ে একটু দ্রুতই উঠেছে। রোজগার বেড়েছে। বেড়ে গেছে দু’জনের দূরত্ব। আগে রাগ হয়ে যেত। এখন সয়ে গেছে। এই ফ্ল্যাট, তার গোছগাছ, অর্পর স্কুলে ভর্তি হওয়া–সব ব্যাপারগুলোতেই যেন জয় নিজেকে কীভাবে আলগা করে নিয়েছে। শ্রীদীপ্তা মানে, একজন মাল্টিন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ-এর হাতে আজকাল খুব বেশি সময় থাকে না তার পরিবারের জন্য। তবুও যেখানটায় ন্যূনতম দায়িত্ব পালন বা সিদ্ধান্ত নিতে মতামত দেবার দরকার, তাও পাওয়া যায় না আজকাল ।

–শুনলে?

ল্যাপটপ বন্ধ হয়েছে এতক্ষণে।

–হ্যাঁ, শুনেছি। তুমি শনিবার সকালে একবার মনে করিয়ে দিও। সোমবার হেড অফিস রিপোর্টিং থাকলে, ক্যানসেল করাতে হবে ফ্লাইটের টিকিট।

চুপ আবার জয়। অসহ্য! ছেলেও ঠিক একই স্বভাবের হয়েছে। যত কম কথা বলা যায়! বাধ্য হয়ে শ্রীদীপ্তা বলে ওঠে, –জানতে চাইলে না, কেন?

–কেন?

বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে জয়। বুঝতে পারল না শ্রীদীপ্তা, চুপ করে যাবে না কথাবার্তা আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। বলেই ফেলে শেষমেশ।

–তোমার ছেলে এবার চেস-এ ডিসট্রিক্ট চ্যাম্পিয়ন হয়েছে জুনিয়র লেভেলে। রোববার রবীন্দ্রভবনে ওরা প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন সেরিমনিটা রেখেছে। কে একজন গ্রান্ড-মাস্টার আসছে। চিঠি দিয়ে ওরা ইনভাইট করেছে পেরেন্ট-দের।

আয়নায় নিজের ক্রিম ঘষা মুখটা ভালো করে দেখল শেষবার শ্রীদীপ্তা। এবার আলো নেভাবে। গর্ব না ক্রিম কীসে মুখ এত জ্বলজ্বল করছে, হদিস পেল না। কোনও কথা ভেসে এল না দেখে বিছানার দিকে ফিরে তাকায় শ্রীদীপ্তা।

অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে মাল্টিন্যাশনালের এক্সিকিউটিভ।

দুই

বাইরে হর্ন-এর আওয়াজ। মানে, সাড়ে তিনটে। ফিরল ছেলে। ম্যাগাজিনটা কোল থেকে সরিয়ে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে সোফা ছাড়ে শ্রীদীপ্তা।

দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ফ্ল্যাটে ঢুকল ছেলে। স্কুল ইউনিফর্মে যুদ্ধের চিহ্ন। একটা জুতোর ফিতে কখন খুলে গেছে। প্রায় নিজের ওজনের থেকেও ভারী একটা ব্যাগ পিঠে। খালি হয়ে যাওয়া ওয়াটার বটলটা বেসিনের নীচে প্রায় ছুড়ে ফেলে দিয়েই সোফায় বই-এর ব্যাগটাকে নামায় অর্প। সারাটাদিন স্কুলের ধকল সামলেও ছেলে যে এখনও কিছুটা তরতাজা, এতেই শান্তি পায় শ্রীদীপ্তা।

কতকগুলো বাঁধা প্রশ্ন থাকে ছেলের জন্য রোজ। আজকেও

একটা-একটা করে ছুড়ে দেবার জন্য তৈরি হল। অর্প এখন কিছু খুঁজছে সোফায়। টিভির রিমোটটা পেয়ে যেতেই সুইচ টিপে অন করে। চ্যানেল সার্ফ করতেই চোখের সামনে সব কিম্ভূতকিমাকার কার্টুন। বিস্ময় আর আনন্দ অর্পর মুখে। কিছু বলার নেই শ্রীদীপ্তার। ক্লাস সিক্সে পড়া তার ছেলে এখনই আওয়াল নাম্বার প্রায় সবেতেই। সেন্ট নিকোলাস-এর মতো স্কুলে ফার্স্ট বয়। কমপিউটার জিনিয়াস। ড্রয়িং-এ অন্তত ছ’টা জায়গার চ্যাম্পিয়ন। উপরি পাওনা, জেলা দাবা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে কিছুদিন হল। স্কুল থেকে ফিরে এই আধঘন্টা তাই ছেলে কার্টুন নেটওয়ার্কে সময় ব্যয় করলেও খুব একটা আপত্তি থাকার কথা নয়।

ছেলের পাশে এসে বসে শ্রীদীপ্তা। চ্যানেলের আলো ছেলের চোখের মণি আর মুখটায় মেখে গেছে। বেশ মায়াবী। এলোমেলো চুলে সিঁথিটা সারাদিনের ধকলে কোথাও হারিয়েছে। মমতা মাখিয়ে প্রশ্ন ছোড়ে শ্রীদীপ্তা –টিফিন শেষ করেছ আজ?

–হুঁ।

ছেলের মনের বেশিরভাগ জায়গা জুড়েই এখন কার্টুনের দাপাদাপি। অবশ্য প্রশ্নটা না করলেও চলত। টিফিনে আজ মিক্সড চাউমিন করে দিয়েছিল। টিফিন ফেরত আসার কথা নয়। ভীষণ পছন্দ করে চাইনিজ অর্প।

–হোমওয়ার্ক কপি সব ঠিক আছে?

– হ্যাঁ।

এ প্রশ্নটাও না করলে চলত। শেষ কবে অর্প-র হোমওয়ার্ক কপিতে কারেকশান হয়েছে, মনে পড়ে না শ্রীদীপ্তার। ঘামের গন্ধ ভেসে আসছে ছেলের গা থেকে। স্কুলের ইউনিফর্মটাও বেশ নোংরা লাগছে। এবার বিরক্তি জন্মাচ্ছে শ্রীদীপ্তার ভেতর। প্যান্টের দু’পাশটা তো রীতিমতো কালো। কীসের যেন ছোপ লেগে রয়েছে। কালকেই ফ্রেশ ইউনিফর্ম দিয়েছে। অথচ আজকের মধ্যেই ড্রেসটার এই অবস্থা! কী করে অর্পটা স্কুলে! মারপিট না কি ধুলোয় গড়াগড়ি খায়! এতক্ষণে জুতসই প্রশ্ন খুঁজে পেয়েছে ছেলেকে করার মতো!

–কালকেই তো নতুন ড্রেস দিলাম। এর মধ্যেই এই অবস্থা! করোটা কী স্কুলে!

–স্কুলে নয়।

ছেলে পাত্তাই দিল না প্রশ্নটায় যেন। রাগে ভিজছে শ্রীদীপ্তা।

–তবে?

ফিরল ছেলে ওর দিকে। চোখে মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়েছে। নরম হচ্ছে শ্রীদীপ্তার রাগ।

–মাঝ রাস্তায় আজ পুলকার স্টপ হয়ে গিয়েছিল। ঠেলতে হল।

–মানে! কারা ঠেলল!

শ্রীদীপ্তা অবাক। মুখ দিয়ে বিরক্তিকর শব্দ বেরিয়ে আসে ছেলের। তারপর বলে– কারা? মনীষ, অঙ্কুর, জিৎ আর আমি।

কঠোর হতে চেষ্টা করে শ্রীদীপ্তা এবার।

–যা করেছ, করেছ। তুমি গাড়ি থেকে নামবে না। বলবে ড্রাইভার আঙ্কলকে– মা বারণ করেছে।

–কেন! ওরা একা-একা লেবার দেবে! নাঃ, স্কুলে ফাদার ব্রুজ সবসময় আমাদের টিম এফোর্ট দিতে বলেন।

শ্রীদীপ্তা চোখ পাকাতেই চুপ করে যায় ছেলে। অর্প আবার ওই একই কাজ করবে! কথা শুনবে না! শ্রীদীপ্তা জানে, তার ছেলে এরকম নয়!

তিন

বেস ফোনটা বেজে উঠতেই বিরক্ত হল শ্রীদীপ্তা। বাথরুমে চানে মগ্ন ছিল। ভেজা শরীর নিয়ে ড্রয়িং-এ আসতে ভালো লাগে না। মেঝেটা জলে জলময় হয়ে যায়। অথচ আসতেই হবে। অর্প স্কুলে, জয় অফিসে। জয়-এর ফোন করার হ্যাবিট বিয়ের বছরখানেক পরই চলে গেছে। দাদা কি! হতেও পারে। চুলে একটা তোয়ালে জড়িয়ে ভেজা শরীরেও একটা তোয়ালে জড়াল শ্রীদীপ্তা। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল। ফোনটা তুলে হ্যালো বলতেই অপর প্রান্তে একটা গম্ভীর গলা সরব হয়।

– হ্যাঁ, এটা কি ৩ছছ…..?

– হ্যাঁ, বলুন।

শ্রীদীপ্তা সহজ হচ্ছিল। আবার প্রশ্ন। এবার শ্রীদীপ্তা সচকিত হয়ে ওঠে। –আসলে… একটা পুলকার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। একটু চুঁচুড়া হাসপাতালে আসুন।

মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল। নীচের তোয়ালেটা খুলে পড়ে গেল। গা-এর জল কখন শুকিয়ে গেছে শ্রীদীপ্তার।

–অ্যাঁ!

আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে গলাটা ওকে।

–না, দেখুন সবাইকেই হসপিটালাইজড করা হয়েছে। প্রত্যেকেই স্থিতিশীল। আমরা গাড়ির মধ্যে স্কুলের ব্যাগ সার্চ করে যাদের যাদের স্কুল ডায়ারি পেয়েছি, খবর দিচ্ছি।

হাত থেকে রিসিভার পড়ে যাচ্ছিল। তবুও সব শক্তিকে একত্রিত করল শ্রীদীপ্তা।

–আপনি কে বলছেন?

–আমি সন্দীপ নন্দী, ইনভেস্টিগেটিং অফিসার, লোকাল থানা।

আর কিছু বলার আগেই ফোন কেটে যায়।

চোখ জ্বালা করছে। কান-মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। দেয়ালে ঠেস দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে শ্রীদীপ্তা। কী করবে এখন! কেউ ইয়ার্কি মারল না তো!

হঠাৎ করে খেয়াল পড়ল ড্রাইভারের ঠিকানা আর ফোন নাম্বার। নোট করা আছে ডায়ারিতে। কোনওক্রমে একটা ম্যাক্সি গলিয়ে নিজেকে ঢাকল। তারপর ডায়ারি বের করে ফোন করল। নাঃ, সুইচ অফ। তাহলে কি সত্যি সত্যিই–? চোখ দিয়ে আপনা থেকেই জলের ধারা নোনতা স্বাদ নিয়ে মুখের গোড়ায় চলে আসছে। দু’বছর চেষ্টা করেও কনসিভ হয়নি অর্প। তারপর হঠাৎই একদিন ওর আসার অস্তিত্ব ধরা পড়া! কী আনন্দ, কী খুশি! এগারোটা বছর ধরে তিলে তিলে বেড়ে ওঠা…।

চোখের জল মুছে আবার কাঁপা-কাঁপা হাতে ডায়াল করল জয়-এর মোবাইলে। অফিস থেকে আসতেও ওর সময় লাগবে। রিং হচ্ছে। তুলল জয়।।

–হ্যালো-তুমি? শোনো, এই… এইমাত্র একটা ফোন এল থানা থেকে। বলছে, অর্পদের পুলকারটা নাকি অ্যাক্সি…।

কথা শেষ করতে পারল না শ্রীদীপ্তা। গলা ভিজে গেল। দম আটকে এল। জয়-এর গলা আশ্চর্য রকম শান্ত!

–কেউ ইয়ার্কি-ফিয়ার্কি–।

–না গো না। গলাটা ভীষণ সিরিয়াস লাগল। আর তাছাড়া অমিত-এর মোবাইলেও ট্রাই করলাম। সুইচ অফ। আমি কী করব! তুমি এখুনি…।

– হ্যাঁ, আসছি। আর এমনি কেমন আছে, কিছু বলল?

– স্টেবল, হসপিটালাইজড হয়েছে।

একটু চুপ থেকে জয় ভরসা জোগাল।

–তুমি একদম সোজা হসপিটালেই যাও। আর পারো তো, লোকাল থানায় যাচাই করে নাও। আমি আসছি। আর শোনো, সাবধানে।

মাল্টিন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ-এর গলাকে অনেকদিন পর কেঁপে যেতে শুনল শ্রীদীপ্তা।

চার

হাসপাতালের সিঁড়িতেই বসে পড়েছে শ্রীদীপ্তা। একদিক থেকে চিন্তা মুক্ত হয়েছে। অন্যদিক থেকে চিন্তা শতগুণ বেড়ে গেছে। প্রাথমিক শোকের ধাক্বা কাটিয়ে এখন ও উদ্বেগের শিকার। একটু দূরে করিডরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন পুলিশ অফিসার আর কনস্টেবল-এর সঙ্গে কথা বলছে জয়।।

ঘন্টা দু’য়েক হয়েছে হসপিটালে এসেছে শ্রীদীপ্তা। জয় আসার আগেই পৗঁছে গিয়েছিল। খবর পেয়ে একে একে পৌঁছে গিয়েছিল অনিরুদ্ধ, জিৎ আর মনীষ-এর বাবা-মাও। প্রত্যেকেরই চোখে জলের রেখা। উদভ্রান্ত চেহারা। গোটা হসপিটালটায় ভিড়েভিড়াক্বার। বেশ কিছু পুলিশ। খবর পেয়ে দু-তিনজন সাংবাদিকও এসে গেছে। মৃত্যুর খবর বিক্রি করে ব্যাবসা– এখনকার সমাজের নতুন ট্রেন্ড। হাত-পা থর-থর করে কাঁপছিল। অপেক্ষা বাঁধ মানছিল না। হাসপাতাল চত্বরে আসতেই এবার নিজেকে একা লাগছে শ্রীদীপ্তার।

টুকরো টুকরো আলোচনা আর ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের কথা থেকে কাহিনিটা খাড়া করল কোনওক্রমে শ্রীদীপ্তা। পুলকার কোনও কারণে আজ আবার জিটি রোডের উপর বিগড়োয় স্কুল যাবার পথে। কিছু ছেলে ঠেলতে নেমেছিল। গাড়ি স্টার্ট হতে তারা আবার উঠেও পড়ে। হঠাৎই উলটোদিক থেকে আসা একটা লরি পুলকারটাকে ধাক্বা দেয়। আন্দাজ তখন সাড়ে আটটা। চারপাশের সব দোকান খোলেওনি। রাস্তায় সেভাবে ভিড়ও ছিল না। ভিড় জমার আগেই লরিটা পালিয়ে যায়। ড্রাইভার স্পটেই শেষ। অন্তত ছ’টা বাচ্চা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে এখন।

খুব তাড়াতাড়ি বাকি বাবা-মা’র সাথে এর্মাজেন্সি ইউনিটে পৗঁছেছিল শ্রীদীপ্তা। প্রত্যেকেরই পেটে আর বুকে সিরিয়াস চোট ছিল। একজনের ব্রেনে। ব্লাডের ব্যাগ, স্যালাইনের বোতল, ব্যান্ডেজ আর ছোপ ছোপ রক্তের মধ্যে আলাদা করে অর্পকে খুঁজে পাচ্ছিল না মা’র চোখ। কাচের দরজার উলটোদিকে দাঁড়িয়ে কেবলই ভগবানকে ডাকছিল শ্রীদীপ্তা। মস্তিষ্কে চোটটা যেন অর্প’র না লাগে। ওর ব্রেনের অনেক দাম। মুহূর্তে ও যেন স্বার্থপর হয়ে উঠছিল। দু’জন তাদের ছেলেকে চিহ্নিত করে আসার পরই শ্রীদীপ্তাকে ইশারা করে একজন নার্স। থর থর করে কাঁপতে থাকা পা দুটো নিয়ে এগিয়ে যায় শ্রীদীপ্তা।

একইরকম স্কুলড্রেস, ব্যান্ডেজ, আর ওষুধের গন্ধে হারিয়ে যাচ্ছিল সবকিছু। চোখে জলের ধারা কখন বন্ধ হয়ে গেছে। বমি পেয়ে যাচ্ছে তার বদলে। বার বার চোখের দৃষ্টি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে চেনার চেষ্টা করছিল শ্রীদীপ্তা যুঝতে থাকা দেহগুলোর মধ্যে তার নিজের দেহের অংশটা কোথায়! ভীষণ অবাক হয়ে যাচ্ছিল ও। অন্য রকম অস্বস্তি গ্রাস করছিল ওকে। মা হয়েও চিনতে ভুল হবে!

জয় আসতে ও আবার ছুটেছে ওয়ার্ডে। জয়ও চেষ্টা করেছে। নাঃ, আহতদের মধ্যে অর্প নেই। পুলিশ ওদের কাছ থেকে সেইমতো স্টেটমেন্টও নিয়েছে। কিছুতেই শ্রীদীপ্তা বুঝতে পারছে না, ছেলেটা কোথায় গেল! গাড়িতে অর্পর ব্যাগ, বই, টিফিনবক্স, ডায়ারি– সবকিছুই রয়েছে। অ্যাটেন্ডিং ডাক্তার ওকে অ্যাসিওর করেছে, যে মারা গেছে সে ড্রাইভার-ই। তার বাড়ির লোক আইডেন্টিফাই-ও করেছে।

কথা বলা শেষ পুলিশের সাথে। জয় এগিয়ে আসছে। শ্রীদীপ্তা বলল, ‘কী বলছে ওরা?’

–ব্যাপারটা বেশ মিস্টিরিয়াস! ওরা বলছে, ব্যাগ গাড়িতে ছিল। গাড়ি ওরা মাইনুটলি সার্চ করেছে। আশে-পাশেও। বডি বা ইনজিওরড– কাউকেই ওরা পায়নি।

–টয়লেট করতে-টরতে–।

–মনে হয় না।

–আমাদের একবার গেলে হয় না!

–আমাদের থেকেও ওদের এসব সেন্স অনেক বেশি। এটা ওদের প্রফেশন। ওরা ঠিক যেটা দেখার দেখে নিয়েছে।

জয় বিপদেও মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে। শ্রীদীপ্তা পারছে না। ছেলেটার মুখটা! উঃ! চোখে জলের ধারা বাঁধ মানছে না শ্রীদীপ্তার! মাতৃস্নেহ…।

–ওরা যে ঠিক বলছে, তার কী মানে?

সিঁড়িতে ওর পাশটাতেই বসে পড়ল জয় হঠাৎ। ফরসা মুখটা লাল। চোখেতে জল আসব আসব করেও উথলে ওঠেনি। বাবাদের কি কাঁদতে নেই! শ্রীদীপ্তার কাঁধে একটা হাত তুলে দিল।

–ভেবে দ্যাখো একবার। বেশ পাবলিক সিমপ্যাথি পেয়েছে ঘটনাটা। আর মিডিয়া তো এখন ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পুলিশকে তার দায়িত্ব পালন করতেই হবে।

নরম জয়-এর গলা। এ গলার অাঁচ অনেকদিন পরে পাচ্ছে শ্রীদীপ্তা। ভালোবাসা বোধহয় মরে না। এতদিন পরে যেন খুব হালকা ছোঁয়া পাচ্ছে। অনেকটা দুধ কড়ায় ফোটালে পরিমাণে কমে যায়। তৈরি হওয়া সলিড ক্ষীরটা তখন বোধহয় আরও টেস্টি। এরকম বিপদে জয়কে পাশে পাচ্ছে। যেভাবে জয় ওর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে, এও তো একধরনের প্রেমই। এ রকম দুর্ঘটনাই বোধহয় মানুষের মধ্যে বোধশক্তিকে জাগিয়ে দেয়। শ্রীদীপ্তা নতুন করে জয়কে আবিস্কার করছে। জয় আর ও আবার একসাথে লড়ছে। ঠিক যেভাবে বেশ কিছু বছর আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে শুরু করেছিল। লড়াইটা সেবারও ওরা জিতেছিল। এবারও…

আপনি কি জয় ঘোষ?

সামনে খেঁকুড়েপনা একটা লোক এসে দাঁড়িয়েছে। করিডরে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি বাবা-মা’র দিকে একবার তাকিয়ে নেয় শ্রীদীপ্তা। জয় উঠে দাঁড়িয়েছে।

– হ্যাঁ, বলুন।

– আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল। আপনার মোবাইল নাম্বার তো…জ্ঝজ্জ্ব্ব….।

– হ্যাঁ, হ্যাঁ বলুন না, কী ব্যাপার।

জয়-এর ভ্রু কুঁচকে গেছে। বুকে এবার হাতুড়ি পিটছে ওর। জয় এগিয়ে গেল লোকটার সাথে। শ্রীদীপ্তাও হাঁটা দিল পেছন পেছন। কথাগুলো ভেসে আসছিল ওর কানে।

–আমার একটা চা-এর দোকান আছে। যেখানে অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে, সেখান থেকে একটুখানি।

শ্রীদীপ্তা পা চালিয়ে ওদের মধ্যে পৗঁছে গেছে। জয় দাঁড়িয়ে গেছে। ওরা এখন হসপিটাল মেন গেটের কাছাকাছি।

–হ্যাঁ, কিন্তু আমার মোবাইল নাম্বার কী করে আপনার কাছে –!

লোকটা চারদিক তাকিয়ে নেয়। তারপর হেসে বলে ওঠে– আপনার ছেলে দিল।

–মানে!

জয় চিৎকার করে উঠেছে। শ্রীদীপ্তার মনে নতুন শঙ্কা। শেষে কি ছেলে অপহরণ হল!

–কিন্তু ও কোথায়?

জয় দাঁতে দাঁত ঘষছিল। অজান্তেই খামছে ধরেছে

জয়-এর জামাটা ও।

–বাইরেই রিকশায় বসে আছে। ফোনই করতাম। একটু কিন্তু কিন্তু লাগল।

–ওর কাছে নিয়ে চলুন।

এবার শ্রীদীপ্তা মুখ খুলেছে।

–হ্যাঁ, আসুন না।

লোকটার ব্যবহারে এবার একটু একটু করে সন্দেহ কমছে শ্রীদীপ্তার।

– হ্যাঁ, ব্যাপারটা কী হল! যেতে যেতেই পুরো ব্যাপারটার রহস্য ভেদ করতে চাইছে জয়।

লোকটাও যেন তৈরিই ছিল বলার জন্য।

–আসলে অ্যাক্সিডেন্ট হবার সময় আপনার ছেলেও গাড়িটাকে বাইরে থেকে ঠেলছিল। কোনও কারণে গাড়ি বা ওর বন্ধুরা এগিয়ে যায়। আর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঘটনাটা ঘটে আপনার ছেলের চোখের সামনে। ভয়ে, আপনার ছেলে আমার দোকানে ঢুকে যায়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল শ্রীদীপ্তা। লোকটা থামতেই জয় বলে ওঠে, –তারপর?

–দোকানে তখন আমি আর আমার কর্মচারি ছিলাম। ওদিকে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিড় জমে গেল। এদিকে আপনার ছেলের এই অবস্থা। তখনও আমরা ভাবছি, ছেলেধরা-টরা হবে। দোকানের ঝাঁপ ফেলে দিলাম ভয়ে। দুধ খাইয়ে ওকে চাঙ্গা করতে আপনার নাম, ফোন নাম্বার পেলাম! খবর পেলাম, সব বাবা-মা’রা এখানেই আসছে। তাই…।

চোখে পড়েছে শ্রীদীপ্তা-র অর্পকে। চুপটি করে বসে আছে রিকশায়। দৗড়ে চলে যায় ছেলের কাছে। রিকশা থেকে ছেলে নেমে আসতেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। একদম অক্ষত ছেলে। এগিয়ে আসে জয় আর লোকটি। জয় লোকটার একটা হাতকে দু’মুঠোর মধ্যে ধরে নিয়েছে।

–কী বলে যে আপনাকে…।

– না, না। কোনও ব্যাপার নয়। আসলে ভয়ই লাগছিল নিজেরও। না কেস খাই! নতুন দোকান। কারওর ভালো করতে যাওয়াটাও আজকাল বিপদ!

শ্রীদীপ্তা ছেলের দিকে তাকায়। আর পুলকার নয়। এবার নিজেই।

নাম, ঠিকানা জানার পর ভদ্রলোককে একদিন বাড়িতে আসতে বলল জয়। হঠাৎই দিনটাকে আবার ভালো লাগতে শুরু করেছিল শ্রীদীপ্তা-র। সব রাতের শেষেই যেমন দিন, সব টেনশনের শেষে একটা স্বস্তি লুকিয়ে থাকে। শ্রীদীপ্তা’র সব টেনশন এখন যেমন আছড়ে পড়েছে হসপিটাল চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু বাবা-মা’র উপর।

শ্রীদীপ্তা হালকা ঝাঁকুনি দেয় অর্পকে।

–ওরা তো দৗড়ে ঢুকে পড়েছিল গাড়ির ভেতর। তুই কোথায় ছিলিস! অর্পর মুখ নীচু।

–জুতোর ফিতেটা খুলে গেল! বাঁধছিলাম আর ঠিক…তখনই…  ঞ্জ

ফাঁদ

হাতকাটা গোপাল ঘরে বসে ভোজালিটা একটু ধার দিয়ে নিচ্ছিল। গোপাল জীবনে এমন কোনও বাজে কাজ করতে বাদ রাখেনি। এক সময়ে টাকার জন্য ওয়াগন ব্রেকারদের সাথে রাতের পর রাত কাজ করেছে। তারপর একটা রাজনৈতিক দলে ঢুকে সত্তর-একাত্তর সালে অনেক বোমাবাজি করেছে। তাদের হয়ে বোমা বেঁধেছে। কয়েক বছর আগে বোমা বাঁধতে গিয়ে ওর একটা হাত উড়ে যাওয়ায় সবাই ওকে হাতকাটা গোপাল হিসেবেই চেনে।

কিছুদিন বর্ষাতিয়ার দলেও কাজ করেছে। এখন নিজের দল

বানিয়ে কাজকর্ম চালায় তাই বর্ষাতিয়ার সাথে প্রায়ই গণ্ডগোল লেগেই থাকে। আজকাল অপরাধ জগতে বেশ নাম-ডাকও হয়েছে। তবে গর্ব করে বলে যে গোপাল বা তার দল কোনও মেয়ের দিকে ফিরেও তাকায়নি। আর ওর এই গুণটার জন্য পাড়ার লোকেরাও ওকে নিয়ে মাথা ঘামাত না।

হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ হতেই ঘরের এককোণে ভোজালিটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। কারণ ওর দলের সকলকে বলা আছে, কেউ দরজায় আওয়াজ না দিয়ে ঘরে ঢুকবে না। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল ‘জাসসি’ ঘরে ঢুকছে। মুখে সেই ভুবন ভোলানো হাসি। জাসসি এখন অপরাধ জগতের ‘বিউটি কুইন’ নামেই পরিচিত। গোপাল জাসসি-র দিকে তাকিয়ে ভাবছে– মেয়েটা সুন্দরী এতে কোনও সন্দেহ নেই। শ্যাম্পু করা কালো রেশমের মতো চুল ঘরের আলোয় চকচক করছে। ওকে দেখে আর যাই হোক কুখ্যাত একটা চোরের দলের সদস্য বলে মনে হয় না।

–কিরে তুই এই অসময়ে? আমি-তো অন্য কেউ ভাবছিলাম।

–এসেছি একটা কাজে। বলেই হাতের ব্যাগটা টেবিলে রেখে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ল।

ভুবন ভোলানো হাসি দিয়ে গোপালকে কাত করার চেষ্টা করল। এই হাসিটাই ওর একটা বড়ো সম্পদ। বলল– গোপাল, আমার ধারণা আমরা একজন আর একজনকে ভালোমতো বুঝতে পারি। সেটা বুঝতে পেরেছি বর্ষাতিয়ার দলে একসাথে কাজ করতে গিয়ে। আর এখন এটাও জেনে গেছি যে বর্ষাতিয়ার সাথে তোর

সাপে-নেউলের সম্পর্ক।

–তা তোর আসার উদ্দেশ্যটা কী বল। কী খাবি? ঠান্ডা না গরম?

–না থাক। আজ হাতে সময় নেই। তাছাড়া কেউ জানতে পারলে এতক্ষণে খবর পৗঁছে যাবে বর্ষাতিয়ার কাছে।

–তুই তো আজকাল বর্ষাতিয়ার খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিস। এমনকী শুনেছি তুই নাকি বর্ষাতিয়ার লাইফ পার্টনার হতে চলেছিস?

–সব বাজে কথা। আজকাল বর্ষাতিয়া রুমি-র সাথে খুব ঢলাঢলি করছে। অযোগ্য মেয়েটার প্রেমে মজে ওর পরামর্শে আমাকে দল থেকে বের করে দিয়েছে। এত খারাপ লাগছে তোকে কি বলব। আমার মাথায় এখন অপমানের আগুন দাউ-দাউ করে জ্বলছে। আর সে জন্যই তোর কাছে এসেছি।

–বলে ফ্যাল। তুই কি আমার দলে যোগ দিতে এসেছিস? তা যদি ভেবে থাকিস তাহলে সরি, আমি তোকে নিতে পারব না। আমার দলে আমি জেনেশুনেই কোনও মেয়েকে রাখি না। শালা, মেয়ে এলেই লাফরা শুরু হয়ে যাবে। আর তুই তো এমনিতেই মক্ষীরানি। তাই ঝগড়াটা বেশ ভালোই হবে। তুই তো সবাইকে খেলিয়ে বেড়াবি সিনেমার নায়িকাদের মতো।

মৃদু হেসে জাসসি জবাব দিল– বোকার মতো কথা বলিস না গোপাল। কোটি টাকা দিলেও আমি তোর দলে কাজ করব না। ধূর্ত শিয়ালকে বিশ্বাস করা যায় কিন্তু তোকে যায় না। যাক সে কথা। আমি এসেছি তোকে সাবধান করে দিতে।

মৃদ শিস দিতে দিতে গোপাল বলল– বল, কী বলতে এসেছিস।

–ভাবিস না হঠাৎ তোর প্রেমে পড়ে গিয়ে তোকে সব বলতে এসেছি। আমি এসেছি বর্ষাতিয়ার অবিচারের বদলা নিতে। তুই তো জানিস, দিল্লি থেকে অ্যান্টিক জিনিসের ব্যবসায়ী রামলাল আগরওয়াল এসেছে শহরে নিলামে একটা অ্যান্টিক দামি হরিণ বিক্রি করার জন্য, যেটার দাম এর মধ্যেই পঞ্চাশ লাখের ওপর উঠে গেছে। বড়ো অঙ্কের বিমা পলিসিও করিয়েছে জিনিসটার জন্য…।

–জানি, অ্যান্টিক হরিণটা সোনার তৈরি আর ওটার গায়ে নানা রকম দামি দামি রত্ন বসানো। সম্রাট আকবরের আমলের জিনিস ওটা। আগের আমলে মুখশুদ্ধি বা মশলা-দানি হিসেবে ব্যবহার করা হতো ওই হরিণটা। শুধু তাই নয়, ওই হরিণটার পেটের জায়গাটাতে যেখানে মশলা রাখা হতো সেখানে একটা দামি হিরাও রাখা আছে।

ধানাই-পানাই ছেড়ে তুই আমাকে কেন এসব শোনাচ্ছিস সেটা বল।

–বর্ষাতিয়া জেনে গেছে যে তুইও হরিণটার পেছনে লেগে আছিস।

–জেনেছে তো কি হয়েছে? বয়েই গেলো। তুই কি আমাকে সাবধান করতে এসেছিস? এটা হল বিজনেস। আমি শালা বর্ষাতিয়ার বাবার পয়সায় খাই না বুঝলি। গিয়ে বলে দিস তোর বসকে। আসল কথাটা বল।

–শোন তাহলে,  রামলাল আগরওয়াল যে-বাড়ির ফ্ল্যাটে উঠেছে, সেই বাড়ির ঠিক ওপরের ফ্ল্যাটে তুই তোর দলের আববাসকে ভাড়াতে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিস কারণ তুই আগেই ওই রেনডিয়ারটা হাতাতে চাস। বর্ষাতিয়ার ধারণা যে ওই রামলাল আগরওয়ালকে চোখে চোখে রাখার জন্যই তুই এটা করেছিস। তোকে সে সুযোগ দিতে চায় না বর্ষাতিয়া। আগামীকাল রাতেই বর্ষাতিয়া ওটা চুরি করতে চায়। এখন তোর উচিত, তার আগেই কাজটা সেরে ফেলা। বর্ষাতিয়া, আগরওয়ালের ফ্ল্যাটের নকল চাবি বানিয়ে ফেলেছে। ওর আয়রন সেফ খোলার পিন নম্বরও জোগাড় করে ফেলেছে। আমি সেগুলো চুরি করে নিয়ে এসেছি।

আমি জানি আমাকে ধরে ফেললে বর্ষাতিয়া আমাকে মেরে ফেলবে তাই আগামীকাল শহর ছেড়ে দেব ঠিক করেছি। তবে ভাবিস না আমি বিনা স্বার্থে এটা করছি। আমার বদলা নেওয়াও হবে আর আমার অর্ধেক ভাগ চাই আগামীকাল সকালে। তোকে আজ রাতের মধ্যেই কাজটা করতে হবে। হাতে সময় বেশি নেই। রামলাল আগরওয়াল এখন গ্র্যান্ড হোটেলে গেছে। সেখানে মদ খেয়ে নাচানাচি করছে। ফিরতেও অনেক রাত হবে। তাই আজই সবচেয়ে ভালো সুযোগ। দেরি করিস না। কাজটা চুপচাপ করে ফেল। আর আমি জানি একমাত্র তুই-ই পারবি এটা করতে। তুই যদি ওটা বিক্রির টাকা আমাকে না-ও দিস আমার দুঃখ নেই। আমি বর্ষাতিয়ার থেকে প্রতিশোধ নিতে পারলেই খুশি।

–আমাকে একটু ভাবতে দে জাসসি।

গোপাল কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। নীরবে ভোজালিটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল। কিন্তু মনটা অন্য কোথাও পড়ে আছে। দেখেই বোঝা যায় কি একটা চিন্তা করছে। এমন সময় বাইরে থেকে হরবোলা মন্টুর আওয়াজ শোনা গেল। মন্টুকে এলাকার সবাই চেনে। মুখ দিয়ে নানা রকম আওয়াজ করে কিছু উপার্জন করে আর বাচ্চাদের আনন্দ দেয়। উঠে গিয়ে জানলার সামনে দাঁড়াল গোপাল। দেখল মন্টু ওর দিকে তাকিয়ে আছে। গোপাল বুঝল, ওকে কোনও জরুরি খবর দিতে এসেছে। মাঝে মাঝেই দেয়। কারণ, মন্টু হরবোলা ওর চর।

জাসসি কে উদ্দেশ্য করে বিরক্তির ভঙ্গিতে বলল– দেখলি তো কি রকম আওয়াজ শুরু করেছে। টাকা না দিলে যাবে না, এরকম ভ্যা ভ্যা করতে থাকবে। যাই, দুটো টাকা দিয়ে আসি।

ঘরের বাইরে সামনের গেট দিয়ে না বেরিয়ে পেছনের গেট দিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। দেয়ালের ছায়ায় দাঁড়িয়ে রাস্তার অন্য পাড়ে তাকিয়ে দেখল বেশকিছু বাচ্চার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে মন্টু হরবোলা। ইশারায় কাছে ডাকল। পকেট থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে মন্টুর দিকে এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল– কি গো মন্টুদা, কোনও খবর আছে নাকি?

পাঞ্জাবির ছেঁড়া পকেট থেকে ডান হাতটা বেরিয়ে এল মন্টুর। গোপালের হাত থেকে টাকাটা নেওয়ার সময় একটুকরো কাগজ গুঁজে দিল গোপালের হাতে।

–সাবধানে থাকবেন, গোপালদা, এই কাগজে সব লিখে দিয়েছি, পড়লেই বুঝতে পারবেন। তারপর গোপালের দেওয়া ক্র্যাচে ভর দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল।

গোপাল আবার বাড়ির দরজার কাছে ফিরে এল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাগজটা ভালো করে পড়ে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে বড়ো হাইড্রেনে ফেলে দিল। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখল জাসসি টিভিটা খুলেছে। গোপাল ঘরে ঢুকতেই জাসসি জিজ্ঞাসা করল– গোপাল, কী ঠিক করলি? হাতে কিন্তু তোর বেশি সময় নেই। আজ রাতের মধ্যেই কাজটা সারতে হবে।

গোপাল মাথাটা ঝাঁকাল। বলল– কাজটা হয়ে যাবে জাসসি। কাল সকালে খবর পেয়ে যাবি।

জাসসি একটু মুচকি হাসল, বলল– আমি জানতাম একমাত্র

তুই-ই পারবি, তাই তো তোর কাছেই এলাম। বলে ব্যাগ থেকে একটা চাবি আর এক টুকরো কাগজ বের করে টেবিলে রাখল। বলল– চাবিটা আগরওয়াল-এর ফ্ল্যাটের আর কাগজে লেখা আছে ঘরের ভেতরে যে সেফটা আছে, তার কোড নম্বর। আমি চলি রে। আমাকে এগিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। কেউ দেখে ফেলতে পারে। সাবধানে থাকিস। বলেই বেরিয়ে গেল জাসসি। যাওয়ার সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেল।

( দুই )

অনেকক্ষণ চুপচাপ দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল গোপাল। কী যেন চিন্তা করছে। পরিস্থিতিটা বেশ মজার। মোবাইল থেকে  আববাসকে ফোন করল। অনেক কথা হল, কথার শেষে বলল– আববাস, আমি তোর ফ্ল্যাট-এ আসছি। দুজনের কথা হল ফোনে। তারপর চাবিটা আর কাগজে লেখা পিন কোডটা সঙ্গে নিল। রাস্তায় নেমে হাঁটতে শুরু করল অলোকনন্দা অ্যাপার্টমেন্টের উদ্দেশে। বাড়িটা খুব দূরে নয়। হেঁটে যেতে অল্প কয়েক মিনিট লাগল। বাড়ির গেটে পৌঁছে দেখল গার্ড গুমটির ভেতরে বসে বসে ঘুমোচ্ছে। নিঃশব্দে মূল গেটের কোনায় লাগানো ছোটো দরজার পাল্লাটা খুলে ঢুকে পড়ল গোপাল। খুব দ্রুত গতিতে আববাসের ফ্ল্যাটে গিয়ে পৌঁছোল। আববাস সেখানে অপেক্ষা করছিল গোপালের।

গোপাল– আববাস, আমি আগরওয়ালের ফ্ল্যাট-এ যাচ্ছি। তুই ওপরের জানালা থেকে নজর রাখ। কেউ এলে সিগন্যাল দিবি। সিঁড়ি দিয়ে নীচের ফ্ল্যাট-এ নেমে এসে দরজায় কান পেতে বোঝার চেষ্টা করল যে কেউ আছে কিনা। যখন বুঝল ভেতরে কেউ নেই তখন জাসসির চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকল।

কুড়ি মিনিট পর ঘর থেকে বেরিয়ে, নিঃশব্দে দরজাটা লাগিয়ে, মৃদু শিস দিয়ে আববাসকে ডাকল। সিঁড়িতেই নেমে এল আববাস। তারপর ঘুমন্ত গার্ডের পাশ কাটিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল দুজনে। হন হন করে হাঁটতে হাঁটতে বলল– আববাস, শরবতের সাথে মনে হয় তোর ঘুমের ওষুধটা একটু বেশিই দিয়ে দিয়েছিস। তোর আর ওখানে থাকা চলবে না। বলেই নিজের ফ্ল্যাটের দিকে রওনা হল।

–ঘটনাটা কী গুরু? তুমি যখন আগরওয়ালের ফ্ল্যাটে ঢুকলে, তখন আমি দু-জন লোককে রাস্তার অন্যদিকে দাঁড়িয়ে এই ফ্ল্যাটের দিকে নজর রাখতে দেখেছি। মনে হল সাদা পোশাকে পুলিশের লোক। তুমি পিছনে লক্ষ্য করো, ওরা আমাদের ফলো করছে। হাসল গোপাল, কোনও উত্তর দিল না।

দশ মিনিট পর আববাসকে নিয়ে নিজের বাড়িতে ঢুকল গোপাল। বেরোনোর সময় ঘরের লাইট, ফ্যান ও টিভিটা অন করে গিয়েছিল। গোপাল বলল– আববাস, আজ বর্ষাতিয়ার প্রেমিকা জাসসি এসেছিল। আমাকে বেশ ভালো একটা গল্প শোনাল। বর্ষাতিয়া নাকি অন্য একটা মেয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে আর তাই জাসসিকে তাড়িয়ে দিয়েছে। জাসসি প্রতিশোধ নিতে চায়, তাই আগরওয়ালের ফ্ল্যাটের নকল চাবি আর আয়রন সেফের কোড নম্বর লেখা কাগজ চুরি করে এনেছে বর্ষাতিয়ার থেকে। সেগুলো আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছে আজই যেন ওই দামি হরিণটা চুরি করে সরিয়ে ফেলি। তাহলে বর্ষাতিয়া আর সেটা পাবে না আর জাসসি-র-ও প্রতিশোধ নেওয়া হবে।

 

জানিস, আমার গল্পটা শুনে খুব কাঁচা মনে হয়েছে। ওটা চুরি করতে হলে আমাকে দিয়ে কেন? জাসসি তো নিজেই চুরি করতে পারত। আপন মনে যখন এসব কথা ভাবছিলাম, তখন হরবোলা মন্টুদা আমাকে সংকেত দিল। আর তখন জাসসি আমার ঘরে বসেছিল। মন্টুদাকে ভিক্ষে দেওয়ার নাম করে নীচে নেমে গেলাম। মন্টুদা কাগজে লেখা একটা মেসেজ দিল। আমাকে সাবধান করে দেওয়ার জন্য। দুদিন আগে মন্টুদা বর্ষাতিয়া, আগরওয়াল আর জাসসি-কে মিটিং করতে দেখেছে। জানলার পাশের টেবিলে বসে কথা বলছিল ওরা। সন্দেহ হওয়ায় মন্টুদা কান পেতে ওদের কথা শুনেছে।

 

আমাকে ফাঁদে ফেলার পরিকল্পনা করছিল ওখানে বসে। জাসসি যখন বলেছিল ও টাকা চায় না, তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল। ও তো টাকার জন্য সব কিছু করতে পারে, তবে টাকার কথা বলাতে আমার সন্দেহটা বেড়ে গিয়েছিল। আর মন্টুদার খবরটা পেয়ে আরও নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম। ওরা জানত, আগরওয়ালের হরিণটার ওপর আমার নজর আছে। ওরা ঠিক করেছিল আমাকে চুরি করার সুযোগ করে দেবে আর পুলিশ ইন্সপেক্টর বদ্যিনাথ দত্ত-কেও জানিয়ে রাখবে। পুলিশ আমার ওপর নজর রাখবে। এভাবে পথের কাঁটা সরাতে চেয়েছে বর্ষাতিয়া। অর্থাৎ কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা আর কি!

–গুরু, আজকাল তুমি তো বেশ পোড় খাওয়া লোকের মতো কথা বলছ। তোমার দিমাকটাও আজকাল বেশ চলছে।

–তুই আর তেল লাগাস না তো! ওরা বুঝতে পারেনি যে আমি ওদের ফন্দিটা বুঝতে পেরেছি। ওরা হয়তো ভাবছে আমি ওদের ফাঁদে পা দিয়েছি। দেখবি একটু বাদেই হয়তো পুলিশ আসবে আমার কাছে। শুনলাম ওই দামি হরিণটা নাকি ইন্স্যুরেন্স করিয়ে রেখেছে মোটা টাকার। যাতে চুরি গেলে আগরওয়ালের কোনও ক্ষতি না হয়, বেশি টাকা পায়। এককথায় বলতে পারিস, ওরা চেয়েছিল যাতে সাপও মরে লাঠিও না ভাঙে। ওরা এখনও হাতকাটা গোপালকে চেনেনি। ওরা চলে ডালে ডালে আর আমি চলি পাতায় পাতায়। তুই খালি মজাটা দেখে যা। আমি যা যা বলব তাই করে যা।

আববাস জিজ্ঞাসা করল– হরিণটা কি তুমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ?

–পাগল হয়েছিস? এসব জেনেও সঙ্গে আনব? জায়গা মতো সেট করে এসেছি। তোকে বলব তবে এখন নয় পুলিশের চলে যাওয়ার পর।

আববাস একটু থেমে বলল– আচ্ছা, আমি বুঝতে পারছি না এতে রামলাল আগরওয়ালের কী স্বার্থ আছে?

এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল– দরজা খোল। দরজা খোল, নয়তো দরজা ভেঙে ফেলব।

আববাস-এর দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে গোপাল এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। দেখল দরজার সামনে সাদা পোশাকে আরও তিনজন পুলিশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইন্সপেক্টর বদ্যিনাথ দত্ত। বদ্যিনাথ দত্তকে চেনে না এই শহরে খুব কম লোকই আছে। বিশেষ করে বদ্যিনাথ দত্ত অপরাধ জগতের সবার কাছে এক বিভীষিকা। দরজাটা খুলে দিতেই ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকে বলল– মালটা বের করে দে।

–কোন মালটা স্যার?

–ভেবেছিস আমি কোনও খবর রাখি না? রামলাল আগরওয়ালের চুরি যাওয়া দামি হরিণটা। আমি ওটা চাই। তোকে ওখান থেকে বেরোতে দেখেছি।

–স্যার, আমি তো আববাসের কাছে গিয়েছিলাম। বিশ্বাস করুন আমাকে। আপনি যখন এতই শিওর তাহলে খুঁজে দেখুন।

চারজন মিলে তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখল ঘরগুলো। জিনিসপত্রগুলো তছনছ করল, ওলট-পালট করে ফেলল। কিন্তু কোথাও সেই দামি হরিণটা খুঁজে পেল না। একঘন্ট৆া ধরে কঠোর পরিশ্রমের পর ঘর্মাক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিল চারজনে। রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ইন্সপেক্টর বদ্যিনাথ দত্ত হতাশার ভঙ্গিতে সহকারীদের দিকে তাকালেন।

গোপাল হাসিমুখে বলল– স্যার আমি তো আগেই বলেছিলাম যে আমি জিনিসটা নিইনি। প্রথমেই যদি আমার কথা বিশ্বাস করতেন তবে অকারণে আপনাদের এই কষ্টটা করতে হতো না। বরং যদি আমাকে সব ঘটনাটা খুলে বলতেন তাহলে হয়তো অনুমান করতে পারতাম যে ওটা কারা উড়িয়েছে।

ইন্সপেক্টর রেগে গিয়ে বললেন– চুপ কর শালা, আমি কি মজা করছি এতক্ষণ? তোর হিম্মত দেখে অবাক হচ্ছি। আমি চাইলে তোকে ধরে নিয়ে গিয়ে এনকাউন্টার করে দিতাম কিন্তু ওই জিনিসটা না পাওয়া অবধি তোকে মারতে পারব না। দেখ, পালাতে যাস না। পালাতে চেষ্টা করলে কিন্তু কুত্তার মতো মারব।

আমি যে সোর্স থেকে শুনেছি তাতে শিওর ছিলাম যে ওটা এখানেই পেয়ে যাব। আমার ইনফরমেশন ভুল হতে পারে না। দু’ঘণ্টা আগে তুই রামলাল আগরওয়ালের ফ্ল্যাটে গিয়েছিলি আর হরিণটা তুইই চুরি করেছিস।

গোপাল– স্যার, আমার মনে হয় আপনাকে কেউ ভুল বুঝিয়েছে বা ভুল ইনফরমেশন দিয়েছে। মনে হয় রামলাল আগরওয়াল থানায় রিপোর্ট করেছে আর বর্ষাতিয়া বলেছে যে আমিই ওটা লোপাট করেছি। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আমি পালাব না। তবে আপনাকে কথা দিচ্ছি, আপনি নিশ্চিন্ত হয়ে গিয়ে ঘুমোন। আগামীকাল আমি বারোটা নাগাদ আপনার সাথে দেখা করব। হরিণটা কোথায়, কার কাছে আছে আপনি জেনে যাবেন।

কঠোর দৃষ্টিতে ইন্সপেক্টর গোপালের দিকে তাকালেন। রুক্ষকন্ঠে বললেন– চুপ কর শালা, তুই একটা মহা ধড়িবাজ, শয়তান। তুই ভাবছিস তোকে আমি চিনি না। আমার আগেই ভাবা উচিত ছিল যে তুই তো এত বোকা নয় যে হরিণটা নিজের কাছে রাখবি। আমি শহরের চারিদিকে পাহারা বসিয়ে দিচ্ছি যাতে তুই পালাতে না পারিস। যাই হোক, আমি আজ যাচ্ছি। কাল থানায় ১চ্টায় তোর জন্য অপেক্ষা করব। তুই তো জানিসই ওটা না পেলে বদ্যিনাথ দত্ত কী করতে পারে। তোর ছাল ছাড়িয়ে নেব, হতভাগা। মনে থাকে যেন।

–জানি স্যার, এনকাউন্টার। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন কাল আপনি ওটা পেয়ে যাবেন।

ইন্সপেক্টর বেরিয়ে যাওয়ার পর গোপাল আববাসকে বলল– দেখে নে তো আপদগুলো চলে গেছে কিনা?

–তুমি ঠিকই করেছ গুরু। আজ মালটা হাতছাড়া হয়ে যেত আর তুমিও ফেঁসে যেতে। বেফালতু শালা আমাকেও দুটো ডান্ডা মেরে গেল। তোমার ওটা পেলে যে কি ক্যালাত তা বুঝতে পারছ?

–তাই তো মালটা নিয়ে আসিনি। যা আজ গিয়ে শুয়ে পড়। কাল একটু কাজ আছে।

( তিন )

পরের দিন সকাল দশটায় গোপাল পৌঁছে গেল স্থানীয় ইনসিয়োরেন্স কোম্পানির অফিসে। অফিসে ঢুকেই বলল– ম্যানেজারের সাথে দেখা করতে চাই। পাঁচ মিনিট পর ডেকে পাঠালেন। ম্যানেজার বললেন– বলুন, আপনার কী বলার আছে?

গোপাল– আজ সকালে বিশাল একটা অঙ্কের চুরির ক্লেইম হয়তো আপনি পেয়েছেন। রামলাল আগরওয়ালের কাছ থেকে। কারণ কাল রাতেই আগরওয়াল-এর দামি হরিণটা চুরি হয়ে গেছে আর তাই গতকাল রাতেই আগরওয়াল থানায় ডায়ারি লিখিয়ে এসেছে। গলাটা একটু নীচু করে ফিস ফিস করে গোপাল বলল– জিনিসটা কোথায় আছে আমি জানি।

ম্যানেজার বিস্ময়ের চোখে তাকালেন, বললেন– আপনি জানেন? তাহলে সঙ্গে নিয়ে এলেই পারতেন। বসুন, আমি পুলিশকে খবর দিচ্ছি।

–ওসব এখনই করতে যাবেন না। পুলিশের সাথে আমার কথা হয়ে গেছে। আজই জেনে যাবেন।

–মশাই, যে করে হোক ওটা আমার চাই, নয়তো আমার কোম্পানির অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। আজই আমি একটা প্রেস রিলিজ পাঠিয়েছি তাতে লিখেছি ওই দামি হরিণটার সন্ধান যে দিতে পারবে, তাকে সাত লক্ষ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। বলেই ফাইল থেকে একটা কপি বের করে দেখালেন। বললেন – আপনি ওটা পাইয়ে দিলে আপনিও টাকাটা পেতে পারেন। তবে আগে নয়।

–ঠিক আছে, আপনি আমাকে চেক দিয়ে ব্যাংকে বলে দিন যাতে আপনার অনুমতির আগে যেন ওটা রিলিজ না করে। কারণ আপনি তো জানেনই আমরা কখন, কোথায় থাকি তার ঠিক নেই। তাছাড়া আমরা অ্যাডভান্স না নিয়ে কাজ করি না।

–ঠিক আছে, তাহলে এই নিন চেক। এতটা ভরসা তো আপনাকে করতেই হবে। তবে মনে রাখবেন চালাকি করতে গেলে কিন্তু একটা পয়সাও পাবেন না বরং জেল যেতে হবে।  বলেই একটা সাত লাখ টাকার চেক লিখে খামে ভরে দিয়ে দিলেন।

গোপাল যেতে যেতে দরজা থেকে আবার ফিরে এসে বলল– আর হ্যাঁ, বেশি চালাকি করবেন না, যদি জিনিসটা পাওয়ার পরও চেকটা ক্যাশ না হয় তবে আমরা কিন্তু কোর্টে কেস করি না। আমাদের হিসেবটা একটু অন্যরকম হয়। এই পৃথিবী থেকেই তাকে সরিয়ে দিই। বিশ্বাস না হয়, এই শহরে যে কাউকে হাত-কাটা গোপালের সম্পর্কে জেনে নেবেন। বলেই দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেল।

গোপাল বেরিয়ে যেতেই ভদ্রলোক ব্যাংকে ফোন করে বলে দিলেন যে ওনার সাথে কথা না বলে যেন, চেকটার পেমেন্ট না করা হয়।

গোপাল একটা ট্যাক্সি ভাড়া করে ফিরে এল নিজের বাড়িতে। দেখল বারোটা বাজতে আর বেশি দেরি নেই, তাই যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে। ফোন করে পুলিশ ইন্সপেক্টর ও ইনসিয়োরেন্স কোম্পানির ম্যানেজারকে-কেও কিছু বলল। এরপর ফোন করল কয়েকজনকে।

ঠিক পৗনে বারোটার সময় জাসসি যে হোটেলে থাকে, সে লিফট দিয়ে উঠতে দেখা গেল ওই হোটেলের দারোয়ানকে। হাতে

রং-বেরঙের ফুল দিয়ে সাজানো একটা সুন্দর ফুলের তোড়া। জাসসির ফ্লোরে নেমে ঘরের সামনে গিয়েই কলিং বেলটা বাজাল দারোয়ান। জাসসি দরজা খুলে দিলে তোড়াটা তার হাতে দিল। বলল– কয়েক মিনিট আগে এক ভদ্রলোক তোড়াটা আপনাকে দিতে বলেছেন। না, তাঁর নাম, ঠিকানা কিংবা পরিচয় কিছুই জানাননি ভদ্রলোক। দারোয়ানকে দশটাকার একটা নোট বকশিশ দিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিল জাসসি। আর ঠিক সেই সময় মোবাইলটা বেজে উঠতেই দৗড়ে গেল মোবাইলটা ধরতে। নম্বরটা অজানা। তাড়াহুড়োতে দরজাটা লক করতেই ভুলে গেল। ফোনটা তুলে নিতেই অন্য দিক থেকে কণ্ঠস্বর ভেসে এল– হ্যালো, জাসসি, আশাকরি ফুলের তোড়াটা তোর ভালো লেগেছে। পরের বার আমাকে ঠকাতে আসার আগে ভেবেচিন্তে আসিস। গুড লাক।

–গোপাল তুই কি বলছিস? এটুকু কথা বলার সাথে সাথেই ফোনটা কেটে গেল।

রাগে লাল হয়ে গেল ওর মুখটা। তোড়াটা ছুড়ে মারল মেঝেতে। মেঝেতে পড়েই তোড়াটার বাঁধন গেল খুলে। ফুলগুলো সব চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। আর মেঝেতে একটা ধাতব জিনিস পড়ার আওয়াজ হতেই চমকে উঠল জাসসি। সেটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। ছড়ানো ফুলগুলোর মধ্যে চকচক করছে মনিরত্ন খচিত একটা হরিণ। ওটা হাতে তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অবাক হয়ে দেখতে লাগল জিনিসটা।

ওর বিস্ময়ের ঘোর কাটার আগেই ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। সাদা পোশাকপরা পাঁচজন অফিসারকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন ইন্সপেক্টর বৈদ্যনাথ দত্ত।

ইন্সপেক্টর বললেন– মিস জাসসি, আপনি যে রামলাল আগরওয়ালের দামি হরিণটা চুরি করেছেন তা হাতকাটা গোপাল আমাদের আগেই বলে দিয়েছে। আপনি আর বর্ষাতিয়া মিলে ওকে ফাঁসাতে চেয়েছিলেন।

–মিথ্যে কথা। এটার ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। এইমাত্র গোপালের পাঠানো ফুলের তোড়ার মধ্যে পেলাম। নিশ্চয়ই আমাকে ফাঁসানোর জন্য গোপালই একাজ করেছে।

–চোরাই মাল আপনার কাছে পাওয়া গেছে তাই আপনাকেই আমাদের অ্যারেস্ট করতে হবে। কে কী করেছে, সেটা তদন্ত করলেই বেরিয়ে যাবে। আপাতত আপনাকে আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে। একটু থেমে ইন্সপেক্টর বললেন– আর একটা কথা, শুধু গোপাল নয়,  আপনার বস বর্ষাতিয়াও বলেছে, ওই হরিণটা আপনিই চুরি করেছেন।

( চার )

এই সুযোগে গোপাল পৌঁছে গেল ব্যাংকে। প্রায় এক ঘণ্টা বাদে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে এল গোপাল। মুখে প্রশান্তির হাসি। হরিণটার সন্ধান দিতে পারার জন্য পুরস্কার হিসেবে চেকটা এনক্যাশ করার অনুমতি দিয়েছে ইনস্যুরেন্স কোম্পানি।

নিজের বাড়ির কাছে আসতেই দেখা হয়ে গেল ইন্সপেক্টর বৈদ্যনাথ দত্তর সাথে। কঠিন হাসি হেসে ইন্সপেক্টর বললেন– টাকাটা যত তাড়াতাড়ি পারিস খরচ করে ফেল গোপাল। তোকে খুব বেশিদিন আর বাইরে থাকতে দেব না। জেলে আমি তোকে ঢোকাবই। যত চালাকিই তুই করিস না কেন! আমি জানি যে ওই হরিণটা তুই-ই চুরি করেছিলিস। এখন শুধু সেটা প্রমাণ করা বাকি।

এটুকু বলেই রাগ দেখিয়ে ইন্সপেক্টর গট গট করে হেঁটে চলে গেলেন।

বিপরীত স্রোত

রান্নাঘরে অঞ্জনের টিফিন বানাতে বানাতে নমিতা টিভির পর্দায় মাঝে মাঝেই চোখ রাখছিল। কয়েকদিন ধরেই মিডিয়াগুলো ‘মি টু’ আন্দোলন নিয়ে পড়েছে। রোজই নতুন নতুন খবর উঠে আসছে। খবরটা নমিতা নিয়ম করেই দেখে। কোথায় কী হচ্ছে নয়তো জানবে কীভাবে?

অঞ্জন এসে শেল্ফ-এর সামনে দাঁড়াল। নমিতার ফ্ল্যাটে ওপেন কিচেনের ব্যবস্থা সুতরাং রান্না করতে করতে টিভি দেখাটাও নমিতার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্বামীকে দেখে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল।

‘সকাল সকাল এদের আবার শুরু হয়ে গেছে। দেশে বেকারত্বের সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে, চাষি আত্মহত্যা করছে, দেশের অবস্থা দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে। আর এই মহিলাদের দ্যাখো, এদের আর কোনও কাজ নেই, মি টু-তে সমস্বরে গলা মেলাচ্ছে। আমার শুধু এদের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে, যখন ঘটনাটা ঘটেছিল তখন কেন প্রতিবাদ করেনি, ব্যাপারটা গোপন করে গিয়েছিল? এখন চেঁচিয়ে কী লাভ? আসলে এরা চায় প্রচারের আলোয় থাকতে। এ হচ্ছে পুরুষদের বিরুদ্ধে চক্রান্ত। বন্ধ করো টিভি, খবরে আজকাল আর কিছুই দেখাবার নেই’, বিরক্ত বদনে নিজেই এগিয়ে গিয়ে টিভিটা বন্ধ করে দেয় অঞ্জন।

টিফিন কৗটোর ঢাকনা বন্ধ করতে করতে নমিতা উত্তর দেয়, ‘আচ্ছা এইসব মহিলারা মিথ্যা বানিয়ে বলছে আর তোমরা পুরুষরা সব ধোয়া তুলসীপাতা? আমাদের সমাজটা এইভাবেই মহিলাদের চুপ করিয়ে তাদের শালীনতায় মুড়ে রাখতে চায়। গলা তুলতে গেলেই, সেটা মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে সমাজ উঠেপড়ে লেগে যায়।’

‘আমি ঠিক এটা বলতে চাইনি। কিন্তু ৩০ বছরের পুরোনো কাদা ঘেঁটে লাভটা কী হবে বলতে পারো? সেক্সুয়াল অ্যাসল্ট বা হ্যারাসমেন্ট যখন ফেস করেছিল তখনই দরকার ছিল প্রতিবাদ করার’, অফিসের শার্ট-টা পরতে পরতে জবাব দেয় অঞ্জন।

অঞ্জনের মনোভাব বুঝতে পেরে রেগে যায় নমিতা, ‘তোমার এটা চিৎকার-চ্যাঁচামেচি মনে হচ্ছে কারণ তুমি সত্যিটা দেখতে চাইছ না। আসলে এটা শুধু পুরুষদের দোষ নয়, সমাজের বানানো নিয়মে অত্যাচার করার পরেও ওই মেয়েগুলোকেই আবার চুপ করে থাকার জন্য ভয় দেখানো হয়।

অফিসে গিয়ে দ্যাখো মেয়েরা যৗন শোষণের বিরুদ্ধে সরব হলেই তাদের চাকরি চলে যাচ্ছে আর যারা বাড়িতে রয়েছে তাদের এত সাহস কোথায়? ছোটো থেকে মেয়েদের শেখানো হয় লজ্জাই মেয়েদের ভূষণ অথচ ছেলেদের স্বাধীনতা ছুট দিয়ে রেখেছে সমাজ।

আমার তো খুব আনন্দ হচ্ছে এই দেখে যে ভারতবর্ষের মতো দেশে এই প্রথম পুরুষরা কিছুটা ভয় পেয়েছে। আগে হয়তো এমন কোনও অপরাধ সে করে এসেছে, যেটা এই আন্দোলনের ফলে সবার সামনে ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে সে মনে মনে ভীত হয়ে পড়ছে। সীতাকে আর অগ্নিপরীক্ষা দিতে হবে না, এবার রামের পালা’, গর্বের সঙ্গে বলে নমিতা।

‘আচ্ছা এবার বক্তৃতা দেওয়া বন্ধ করো… খেতে দেবে তো দাও নয়তো টিফিন নিয়ে আমি অফিস বেরিয়ে যাচ্ছি’, বিরক্ত মুখে বলে অঞ্জন।

ভাতের থালাটা অঞ্জনের সামনে নামিয়ে রাখতে রাখতে আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল নমিতা, ‘কী ব্যাপার বলো তো, তুমি এত রেগে যাচ্ছ কেন? তুমিও কি কারও সঙ্গে… ভয় পাচ্ছ নাকী যে তোমারও পুরোনো পাপ ধরা পড়ে যাবে?’

নমিতার কথা শুনে ভাত আটকে যায় অঞ্জনের গলায়। এক ঢোঁক জল খেয়ে গলাটা পরিষ্কার করে বলে, ‘কী… পাগলের মতো বলছ? বিনা কারণে আমাকে এসবের মধ্যে টেনে আনছ কেন? দোষ কেউ করেছে আর সন্দেহ আমার উপর। সকলেই জানে আমি কীরকম, সুতরাং নিজের সম্পর্কে আমি কিছুই বলতে চাই না।’

‘হুঁ, এটা ভুলো না যাদের চরিত্রের সত্যিটা আজ সকলের সামনে খুলে গেছে তাদের সম্পর্কেও কিন্তু মানুষের আগে অন্যরকম ধারণা ছিল… হঠাৎ করেই হয়তো জানতে পারলাম তুমিও কোনও মেয়ের সঙ্গে… আর আমি এটা তো শুধু উদাহরণ দিচ্ছি’, টিফিন বক্সটা অঞ্জনের হাতে দিতে দিতে নমিতা বলল।

অঞ্জন জ্বলে উঠল নমিতার কথা শুনে। ইচ্ছে করছিল টিফিনটা ছুড়ে মারে নমিতার মুখের উপর। আবিশ্বের পুরুষরা সব খারাপ আর মহিলারা সব সতীসাধবী! নিজেকে সংযত করল অঞ্জন। নমিতার সামনে প্রতিবাদ করা মানে নিজেকেই সন্দেহের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো। বরং সুর নরম করল অঞ্জন, ‘এখন নিজের স্বামীকেও ভরসা করছ না? আমাকে তোমার এতটাই নীচ চরিত্রের মনে হয় যে, তুমি আমাকে এসব কথা বলতে পারছ?’

নমিতার মনে হল একটু বেশি-ই বলা হয়ে গেছে অঞ্জনকে। ও যাতে মনে দুঃখ না পায় তাই গলায় যথা সম্ভব মাধুর্য নিয়ে এসে বলল, ‘আমি তো এমনি-ই তোমাকে এইসব বলছিলাম, আমি কি তোমাকে চিনি না? আচ্ছা এবার অফিসে বেরোও, নয়তো পরে বলবে আমার জন্য তোমার অফিস যেতে দেরি হয়ে গেল।’

‘হুঁ, আজ আবার একটা মিটিং আছে অফিসে’, বলে বেরিয়ে আসে অঞ্জন। অফিস যেতে যেতে মনের মধ্যে তোলপাড় হতে থাকে ওর। ভয় বাসা বেঁধেছে ওর মনে। মি টু নিয়ে যা আরম্ভ হয়েছে তাতে ওর নিজের কেলেঙ্কারি ফাঁশ হবার আশঙ্কা কিছুতেই উড়িয়ে দিতে পারছে না। শিউরে ওঠে অঞ্জন। নমিতা কিছুতেই ওর অন্যায় বরদাস্ত করবে না, শাস্তি পাওয়ার সব ব্যবস্থা করে তবে ছাড়বে। বাচ্চাদের চোখেও ওর সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে। এতদিনের চেষ্টায় সমাজে যে মান-সম্মান অর্জন করেছে, তাও আর বজায় রাখা সম্ভব হয়ে উঠবে না।

মিটিং-এও ঠিকমতো মন দিতে পারল না অঞ্জন। রোজকার মতো সবাইকে বকে ধমকে কাজ করিয়ে নেওয়ার এনার্জি কিছুতেই জোগাতে পারল না। অফিসে কিছুই ভালো লাগছিল না। সন্দীপ এসে কেবিনে উঁকি মারল।

‘কী হল, আজ এত চুপচাপ যে? ঢুকলি যখন আমার ‘গুডমর্নিং’-এ সাড়া দিলি না, আবার এখন এভাবে বসে থাকা, কারও ওপর চ্যাঁচামেচি করছিস না… কী হল কী তোর? কোনও মহিলা তোকে আবার ফাঁসিয়ে দেয়নি তো?’ সন্দীপ এমন ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল, কেবিনের বাইরে যারা বসে তাদের মধ্যে হাসির রোল উঠল।

কেবিনের বাইরে থেকে কারও গলা ভেসে এল, ‘ছাড় না সন্দীপ, বউয়ের সঙ্গে হয়তো ঝগড়া হয়েছে। ওকে ওর মতো থাকতে দে না।’ সন্দীপ বেরিয়ে আসে ঘর থেকে।

অফিসে দিনটা কোনওমতে কাটিয়ে অঞ্জন বাড়িতে ফিরে আসে। হাত-মুখ ধুয়ে বসতে বসতে খেয়াল করে নমিতা ফোনে ব্যস্ত রয়েছে। নমিতার কথাগুলো কানে ভেসে আসে, ‘দেখিস লোকটা যেন কোনওমতেই ছাড়া না পায়, নিজেকে কী ভাবে বলতো? খুব তো ভদ্র সেজে ঘুরত। নাতি, নাতনি সব রয়েছে অথচ দেখ নিজের মেয়ের বয়সি একটা মেয়েকে… আচ্ছা এখন আমি রাখছি, অঞ্জন অফিস থেকে ফিরেছে’, বলে নমিতা ফোন নামিয়ে রাখে।

‘কী হয়েছে?’ অঞ্জন জানতে চায়। ‘আমি তোমাকে ফোন করতেই যাচ্ছিলাম। জানো, পাড়ার সুজিতদার উপর কোনও মেয়ে নাকি হ্যারাসমেন্টের কেস দিয়েছে, অথচ সুজিতদাকে দেখে ভদ্র বলেই মনে হতো। ভদ্রলোকের বউয়ের বক্তব্য, মেয়েটি মিথ্যা আরোপ দিচ্ছে, সুজিতদাকে নাকি বদনাম করতে চাইছে। বউদি সবাইকে বলেছে মেয়েটি সুজিতদার কাছে চাকরি করত। কোনও কারণে মেয়েটিকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করায় সুজিতদার উপর রেগে যায় মেয়েটি এবং মিথ্যা বদনাম দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। আমার তো বউদির উপর রাগ হচ্ছে যে একজন অপরাধীকে বাঁচাবার চেষ্টা করছেন উনি। কিন্তু যতই চেষ্টা করুন না কেন সুজিতদাকে কিছুতেই বাঁচাতে পারবেন না। ওনার বউকেও জেলে পুরে দেওয়া উচিত’, রাগে নমিতার মুখ-চোখ লাল হয়ে ওঠে।

‘হতে তো পারে যে সুজিতদাই সত্যি কথা বলছেন আর মেয়েটি মিথ্যা…’

‘মিথ্যা…?’ অঞ্জনের কথার মাঝখানেই নমিতা ওকে থামিয়ে দেয়। ‘কেন কোনও মেয়ে শুধু শুধু নিজেকে বদনাম করবে? নিশ্চয়ই ওর সঙ্গে কিছু ঘটেছে বলেই না ও গলা তুলেছে। সাধারণত মেয়েরা প্রতিবাদ করে না বলেই পুরুষরা বেঁচে যায়। আর বউগুলোকে দ্যাখো, স্বামী দোষী জেনেও তাকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে থাকে। সত্যি বলছি অঞ্জন, আমার স্বামী যদি এরকম করত, আমি ছাড়তাম না, জেলে পাঠিয়ে তবে বিশ্রাম নিতাম।’ নমিতার কথা শুনে ভিতরে ভিতরে শিউরে উঠল অঞ্জন।

‘একবার ভেবে দ্যাখো, আমাদেরও মেয়ে রয়েছে। কেউ যদি ওর সঙ্গে এরকম করত তাহলে? ছিঃ মেয়েরা জড়পদার্থ নাকি যে, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যার যেরকম ভাবে ইচ্ছে তাকে ব্যবহার করবে? এটা সমাজের পক্ষে লজ্জাকর, অঞ্জন’, নমিতা কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে।

কথা শেষ করে নমিতার দৃষ্টি পড়ে অঞ্জনের ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া মুখটার উপর। ‘একী, তোমার কী হল, মুখটা এত শুকনো লাগছে কেন? আমি জানি তোমারও ব্যাপারটা শুনে খুব খারাপ লাগছে,

যে-কোনও ভদ্রলোকেরই ঘটনাটা জেনে ঠিক এরকমই মনোভাব হবে। আসলে কারও চরিত্র সম্পর্কে হলফ করে কিছু বলা আজ আর সম্ভব নয়’, বলে নমিতা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।

মনের মধ্যে ঝড় চলতে থাকে অঞ্জনের। আজ সুজিতদা পাড়ায় আলোচনার বস্তু হয়ে উঠেছেন, যে-কোনও দিন অঞ্জনের নামও আলোচনার বিষয় হয়ে উঠতে পারে। নিজের সন্তানদের কাছে মুখ দেখাবে কী করে? ঘেমে ওঠে অঞ্জন, চুপচাপ এসে শোবার ঘরে শুয়ে পড়ে।

রাতের খাওয়া-দাওয়া মিটিয়ে নমিতা আর বাচ্চারা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লেও, হাজার চেষ্টা করেও অঞ্জন দুচোখের পাতা এক করতে পারল না। নানা চিন্তা এসে ওকে ঘিরে ধরছিল। ওর খালি মনে হচ্ছিল সকলে এমনকী বাড়ির প্রতিটা আসবাবপত্র পর্যন্ত ওকে উপহাস করছে, বলছে, ‘দেখছ তো অঞ্জন, এতদিন স্রোতে গা ভাসিয়ে চলে এসেছ আজ স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কীরকম বোধ করছ? বাঁচতে তো তুমিও পারবে না। হ্যাঁ দেরি হয়েছে বটে কিন্তু সকলেই নিজের নিজের কর্মের ফল একদিন পাবেই, তুমিও বাদ যাবে না।’ ঘেমে নেয়ে বিছানাতেই উঠে বসে অঞ্জন। জোরে জোরে নিঃশ্বাস পড়তে থাকে। ভয় যেন সম্পূর্ণ গ্রাস করে ওকে কিন্তু কাকে বলবে এইসব কথা এবং কী-ই বা বলবে? ওর করা অপরাধের কথা যদি সবাই জানতে পেরে যায়, তাহলে এতদিনের সংসারটা ওর তছনছ হয়ে যাবে।

নিজের মনেই হাজারো প্রশ্ন উঠতে থাকে অঞ্জনের। আবার নিজেই নিজেকে স্ত্বান্না দেয়। মন বলে এরকম কিছুই ঘটবে না, বেকার কেন ও এত চিন্তা করছে? শ্রেয়া কখনওই নিজের মুখ খুলবে না, আর যদি খোলে ওকে মিথ্যা প্রমাণ করতে কতটুকুই বা পরিশ্রম হবে? ও প্রমাণ জোগাড় করার চেষ্টা করতে পারে কিন্তু কার সাহস হবে অঞ্জনের বিরুদ্ধে কিছু বলতে? ও বরং নিজেই শ্রেয়াকে দোষী প্রমাণিত করে দেবে। অঞ্জনের চোখের সামনে ৭-৮ বছর আগেকার ঘটনাগুলো ভেসে উঠতে থাকে। শ্রেয়ার উপর করা এক-একটা অত্যাচারের পাতা পরপর খুলে যেতে থাকে অঞ্জনের চোখের সামনে।

সাত-আট বছর আগে যে কোম্পানিতে ছিল অঞ্জন, সেখানেই শ্রেয়া অঞ্জনের অধীনে কাজ করত। তন্বী চেহারার মেয়েটির এক মাথা ঘন কালো চুল, ডাগর দুটো চোখ এবং ত্বকের গোলাপি আভা অঞ্জনের দুর্নিবার আকর্ষণের কারণ ছিল। শ্রেয়াকে দেখলেই ওকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করত অঞ্জন যা শ্রেয়ার কাছে অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছিল। ওর সামনে এলে শ্রেয়া কিছুতেই সহজ হতে পারত না, জামাকাপড় ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে উঠত যেন।

শ্রেয়া বুঝতে পারত, অঞ্জনের ওর প্রতি দুর্বলতার কারণ ওর শরীরটা ছাড়া আর কিছু নয়। আপ্রাণ চেষ্টা করত সময়ের মধ্যে সব কাজ গুছিয়ে ছুটি হলেই অফিস থেকে বেরিয়ে যেতে, কিন্তু রোজ সেটা সম্ভব হয়ে উঠত না। অন্য কোনও কাজের অছিলায় অঞ্জন মাঝেমধ্যেই ওকে নিজের কেবিনে ডেকে পাঠাত। ছুটির পরেও ওকে আটকে রাখত। কাজ করতে করতেও শ্রেয়া বেশ বুঝতে পারত ওকে ঠিক কী নজরে দেখছেন অঞ্জন স্যার। মাঝে মাঝে চোখ পড়ে যেত স্যারের চোখে কিন্তু তাতেও অঞ্জন বিন্দুমাত্র বিচলিত হতো না বরং বাধ্য হয়ে লজ্জায় শ্রেয়াকেই দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে হতো।

ধীরে ধীরে সাহস বাড়তে আরম্ভ করে অঞ্জনের। ছলছুতো করে শ্রেয়ার গায়ে হাত দিতেও শুরু করে দেয়। কখনও পিঠে, ঘাড়ে, বুকে অনাবশ্যক হাত দিয়ে ফেলে আবার অমায়িক একটা ‘সরি’ ছুড়ে দিতেও কসুর করত না।

শ্রেয়ার রক্তাক্ত মনে অশ্রু ঝরত শুধু, প্রতিবাদ করে উঠতে পারত না। মেয়ে হয়ে জন্মানো পাপ বলে মনে হতো। বাবার হঠাৎ মৃত্যুর পর মা আর ভাইয়ের দায়িত্ব না নেওয়া ছাড়া উপায় কিছু ছিল না আর অঞ্জন স্যার ওর বাড়ির অবস্থা পুরোটাই জানতেন এবং সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে মুহূর্ত সময় নষ্ট করেননি।

সেদিনও এমনি এমনি মিথ্যা কাজের বাহানায় অঞ্জন শ্রেয়াকে নিজের কেবিনে বসিয়ে রেখেছিল। অফিস অনেকক্ষণ ছুটি হয়ে গিয়েছিল। অঞ্জন ওকে বাড়ি ছেড়ে দেবে এই অজুহাতে শ্রেয়াকে আটকে রেখেছিল। শ্রেয়া তাড়াতাড়ি কাজ সেরে বাড়ি যাওয়ার চেষ্টা করছিল, হঠাৎ-ই অঞ্জন পিছন থেকে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে নিজের দিকে জোর করে টেনে নেয়। শ্রেয়ার সারা শরীরে, মুখে ত৫ চুম্বনের রেখা স্লঁকে দিতে থাকে।

শ্রেয়া নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। কোনওমতে মুখ সরিয়ে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে, ‘স্যার, এটা কী করছেন আপনি? ছাড়ুন আমাকে।’

‘শ্রেয়া, এই দিনটার জন্য কতদিন আমি অপেক্ষা করেছি। আজ কী করে তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেব বলো’, শ্রেয়ার চুলে মুখ ঘষতে ঘষতে বলে অঞ্জন।

হঠাৎ-ই কেবিনের দরজায় টোকা। অবাক হয়ে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেয় শ্রেয়াকে। ‘কাম ইন’, বলাতে অফিসের পিওন এসে ঢোকে যাকে আগেই ছুটি দিয়ে দিয়েছিল অঞ্জন।

‘কী ব্যাপার, তুমি ফিরে এলে যে?’

‘না স্যার, আমার টিফিনের কৗটোটা নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম। সেটাই নিতে এসেছি’, কাঁচুমাচু ভাবে জবাব দেয় পিওন।

‘ঠিক আছে, নিয়ে নাও’, বিরক্তি সহকারে জবাব দেয় অঞ্জন।

শ্রেয়া কিন্তু মনে মনে ধন্যবাদ জানায় পিন্টুকে। হোক না অফিসের পিওন কিন্তু সবসময় সম্মান দিয়ে কথা বলে শ্রেয়া ওর সঙ্গে। ওর কেন জানি না মনে হয় কিছু একটা অঘটনের অাঁচ পেয়েই পিন্টুদা অফিসে ফিরে এসেছে। টিফিন কৗটোটা একটা বাহানা মাত্র। পিন্ঢু৆দার জন্য আজ ও বেঁচে গেল এই জঘন্য লোকটার হাত থেকে।

অঞ্জন কিন্তু মোটেই খুশি হল না। ওর এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী করল পিন্টুকেই এবং সুযোগ বুঝে শ্রেয়াও অফিস ছেড়ে বেরিয়ে এল। অঞ্জন এখানেই থেমে থাকল না, সুযোগ খুঁজতে লগল শ্রেয়াকে নিজের জালে ফাঁসাবার।

সুযোগ এল খুব শিগগির। শহরের বাইরে কাজ পড়ল অঞ্জনের। তৎক্ষণাৎ ফোন করল শ্রেয়াকে, ‘শ্রেয়া কাল তৈরি হয়ে অফিসে এসো। দুদিনের জন্য আমার সঙ্গে তোমাকে অফিসের কাজে শহরের বাইরে যেতে হবে।’

‘কিন্তু স্যার, আমার পক্ষে যাওয়া…’, শ্রেয়ার না-যাওয়ার বাহানা না শুনেই ওকে থামিয়ে দেয় অঞ্জন, ‘শ্রেয়া তোমার ইচ্ছে, অনিচ্ছে জানতে চাইনি আমি। ইট্‌স মাই অর্ডার। বসের সঙ্গে তোমার যাওয়ার সুযোগ হচ্ছে নয়তো তোমার মতো মেয়েদের সকলে জুতোর তলায় রাখে।’

শ্রেয়া ভালো করেই জানত ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যই হচ্ছে ওর শরীরটাকে ভোগ করা। অঞ্জনের হাত থেকে ওর নিস্তার নেই। অফিসে থাকতে গেলে অঞ্জন স্যারের কথামতো চলতে হবে আর নয়তো চাকরি হারাতে হবে। এই সত্য বুঝতে পেরে গিয়েছিল শ্রেয়া। মুহূর্তে নিজের মনকে তৈরি করে নিল ও। পদত্যাগপত্র লিখে জমা করে বেরিয়ে এল অফিস ছেড়ে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল। অনেকদিন ধরেই অন্য চাকরির সন্ধান করছিল কারণ অঞ্জনের সঙ্গে এক অফিসে চাকরি করতে পারবে না বেশ বুঝতে পারছিল শ্রেয়া। জানে কটা দিন একটু কষ্ট করতে হবে কিন্তু পার্থ আছে ওর পাশে। কটা দিন পরেই পার্থর সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। একদিক দিয়ে ভালোই হল বলে শ্রেয়ার মনে হল। এই অফিসের কেলেঙ্কারির কথা যদি বিয়ের পর পার্থ-র মা-বাবা জানতে পারতেন তাহলে কতটা লজ্জার সম্মুখীন হতে হতো সেটা ভেবে শ্রেয়া শিউরে ওঠে।

কয়েকদিন ঘোরাঘুরি করে একটা ভালো চাকরিও পেয়ে গেল শ্রেয়া। নতুন চাকরিতে জয়েন করার তিনমাস পরেই পার্থর সঙ্গে শ্রেয়ার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর নিজের ফোনের নম্বর বদলে ফেলল ও, যাতে অঞ্জন কোনও ভাবেই ওকে কনট্যাক্ট করতে না পারে। অতীতের দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে নতুন জীবনের সুখে নিজেকে ভাসিয়ে দিল শ্রেয়া। অঞ্জনের স্মৃতি মন থেকে মুছে ফেলতে বদ্ধপরিকর হল ও।

শ্রেয়া জানতে পারল না, একদিন যেখানে ও অঞ্জনের মুখোমুখি যাতে না হতে হয় তার জন্য পালিয়ে বেড়াত, সেখানে আজ অঞ্জন শ্রেয়ার ভয়ে ভীত হয়ে রয়েছে। সবসময় অঞ্জনের মনে হতো এই বুঝি শ্রেয়া এসে সকলের সামনে অঞ্জনের আসল চেহারার উপর থেকে পর্দাটা সরিয়ে দেবে। রাত্রে ভালো করে ঘুমোতেও পারত না। অজানা, অচেনা কেউ বাড়িতে এলেও ভয়ে কুঁকড়ে যেত অঞ্জন। কলিংবেল বাজলে বুক কেঁপে উঠত ওর, ভাবত ওই বুঝি শ্রেয়া ওর দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে ওর কুকীর্তির সাক্ষী হয়ে।

একদিন অফিস থেকে ফিরতেই নমিতা জানাল একটি লোক অঞ্জনের নামে একটা মুখবন্ধ খাম দিয়ে গিয়েছে।

‘কোথায় রেখেছ খামটা। কী থাকতে পারে ওতে?’ শঙ্কিত হয়ে অঞ্জন নমিতার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিল।

‘জানি না, হয়তো ফোটো বা ওই ধরনের কিছু হবে। দেখি খামটা খুলে’, বলে খামটা হাতে নিতেই অঞ্জন ছোঁ মেরে নমিতার হাত থেকে খামটা ছিনিয়ে নিল।

‘আমার চিঠি তুমি খুলছ কেন?’ নমিতা অঞ্জনের কান্ডকারখানা দেখে অবাক হয়ে গেল। তোমার কী হয়েছে বলো তো। আগে তোমার সব চিঠি আমি-ই তো খুলতাম, আজ হঠাৎ হল কী? তুমি তো এমন ভয় পাচ্ছ যেন মনে হচ্ছে এর মধ্যে তোমার গোপন কোনও তথ্য লুকোনো রয়েছে?’

নমিতার কথা শুনে চমকে ওঠে অঞ্জন। নমিতা কি ওকে সন্দেহ করতে শুরু করেছে? কাঁপা কাঁপা হাতে খামটা খুলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। খামটাতে অন্য কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রয়েছে যেটা ওরই বন্ধু পাঠিয়েছে।

অঞ্জনের ব্যবহারে নমিতা প্রায়শই আশ্চর্য হয়ে পড়ত। মাঝেমধ্যেই মনে হতো অঞ্জনের মাথার কোনও গোলমাল হল না তো? সত্যিটা নমিতা জানবেই বা কী করে? অতীতে করে আসা পাপের দংশনই যে অঞ্জনকে ভীত, ত্রস্ত করে তুলছে। অঞ্জনের সব সময় মনে হতো একবার শ্রেয়ার সঙ্গে দেখা করে ও ক্ষমা চেয়ে নিলেই সব ঠিক হয়ে যেতে পারত। অথবা পুরোনো দিনগুলো যদি ফেরত আনা যেত তাহলে নিজের চরিত্রটা শুধরে নেওয়ার একটা সুযোগ থাকত। কিন্তু অতীত-কে ফিরিয়ে আনা কি সম্ভব?

অঞ্জন সিদ্ধান্ত নেয়, যেভাবেই হোক শ্রেয়ার সঙ্গে দেখা করে ওকে ক্ষমা চাইতেই হবে। নয়তো সারাজীবন এই অশান্তিতে ওকে কাটাতে হবে যে, কবে ও ধরা পড়ে যাবে। চেষ্টা করে শ্রেয়ার ঠিকানাও জোগাড় করে ফেলে। যাবে যাবে করতে করতে একদিন হঠাৎই শ্রেয়াকে ও দেখে একটা থানায় ঢুকতে। দেখেই মনের মধ্যে পুরোনো ভয়টা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ওর মনে হয় শ্রেয়া নিশ্চয়ই ওর বিরুদ্ধে রিপোর্ট লেখাতেই থানার দ্বারস্থ হয়েছে নয়তো শ্রেয়ার মতো মেয়ের থানায় কী কাজ থাকতে পারে?

থানার বাইরে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে অঞ্জন, শ্রেয়ার বাইরে বেরোবার জন্য কিন্তু কোনও লাভ হয় না। বাধ্য হয়ে ও ওখান থেকে চলে আসে। খালি মনের মধ্যে একটাই প্রশ্ন বারবার ঘুরেফিরে আসতে থাকে যে শ্রেয়া থানায় কেন গিয়েছিল?

এই ভাবেই কেটে যায় দু-তিন সপ্তাহ। এর মধ্যে অঞ্জন জানতে পারে শ্রেয়ার থানায় আসার কারণ। ওর ভাইয়ের বউ, শ্রেয়ার মা ও ভাইয়ের বিরুদ্ধে থানায় রিপোর্ট লিখিয়েছে মানসিক ও শারীরিক অত্যাচারের। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই শ্রেয়ার থানায় আসা।

একটু যেন স্বস্তি পায় অঞ্জন। শ্রেয়া পুলিশে জানালে এতদিনে নিশ্চয়ই পুলিশ বসে থাকত না, আইনি পদক্ষেপ অবশ্যই নিত। কিন্তু বলা যায় না। নমিতার কাছেই শুনছিল পাড়ার সুজিতদা আপাতত বাড়িতে ফিরেছে ঠিকই কিন্তু কোর্ট-কাছারি করতে হচ্ছে। নমিতা তো বেশ জোর গলায় বলল, যে-পাপ লোকটি করেছে তার সাজা অবশ্যই একদিন লোকটাকে পেতেই হবে। এটাই ওর ভরাডুবির কারণ হবে।

আজ অঞ্জন মনে করছে ও শ্রেয়ার হাত থেকে বেঁচে গেছে কিন্তু ভয়, আশঙ্কার খাঁড়াটা সারা জীবন ওর ঘাড়ের উপর ঝুলতে থাকবে। যে-কোনও মুহূর্তে ওটা লক্ষ্যে নেমে আসতে পারে। স্রোতের বিপরীতে থাকতে পারার জন্য মুহূর্তের আনন্দ বিষাদে বদলে যেতে পারে যদি শ্রেয়া ‘মি টু’ আন্দোলনে নিজেকে শামিল করে নেয়। এই সবই অঞ্জন ভালো করেই বুঝতে পারছিল এবং এই সত্যটাও ওর অজানা ছিল না যে, এখন থেকে সারাটা জীবন ওকে ভয়ে ভয়েই কাটাতে হবে। ভবিষ্যতে ওর ভাগ্যে কী আপেক্ষা করছে সেটা জানার আজ আর কোনও উপায় নেই।                                           ঞ্জ

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব