মাঝেমধ্যে হয়

প্রায় ফাঁকা লেডিস কম্পার্টমেন্টটার দিকে তীব্র ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকিয়ে পার হতে গিয়েই বিপদটা ঘটল। আসলে… আটটা পঁচিশের কাটোয়া লোকাল ভায়া ব্যান্ডেল, এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে। কৃপয়া ধ্যায়ান দে… শোনা মাত্র হাওড়া স্টেশনের কয়েক হাজার লোক মুহূর্তে তাদের নখ দাঁত বার করে হুড়মুড় করে ছুটতে শুরু করল এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে। যেন এটাই পৃথিবীর শেষ ট্রেন। চুয়ান্ন বছরের সুতনু চক্রবর্তীও সেই ভিড়ে ডুবেছিলেন মিনিটকয়েক আগে। আজ কপালটাই খারাপ। মনে মনে নিজের কপাল এবং অফিসের মালিক দিনেশ পরশরামপুরিয়াকে দুটো মোক্ষম গালাগাল দিয়ে একগলা ভিড়ে ভাসতে ভাসতে এগোচ্ছিলেন প্ল্যাটফর্ম বেয়ে। এত দেরি রোজ হয় না। সাতটা চল্লিশ কিংবা সাতটা পঞ্চান্নর ট্রেনটা ধরেন উনি। আজ অফিস থেকে বেরোনোর শেষ মুহূর্তে মালিক ডাকলেন। কেজরিওয়ালের ফাইলটা আপডেট করে দিতে বললেন। ব্যস, করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেল। যার ফল পেটে গুঁতো, পায়ে বুটের মাড়ানো, পিঠে ক্রমাগত ধাক্বা। শালা আর সয় না। কুত্তার জাত সব।

ওই ভাবেই এগোতে এগোতে আচমকা পিছনের কোনও সহমর্মী সহযাত্রীর ধাক্বায় দুটো কম্পার্টমেন্টের মাঝখানের ফাঁকায় মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছিলেন তিনি। প্রচণ্ড ভয়ে চোখ বুজেও ফেলেছিলেন সঙ্গে সঙ্গে। তারপর চোখ খুলে বুঝলেন যে এযাত্রায় বেঁচে গেছেন। উনি লাইনের ওপর নয় একটা কম্পার্টমেন্টের দরজা গলে ফুটবোর্ডের ওপর পড়েছেন। তার ওপরেই থেবড়ে কয়েক মুহূর্ত বসে রইলেন। তারপর উঠলেন। মাথাটা পুরো ঘেঁটে গেছে। আর একটু হলে কী বিপদটাই না হচ্ছিল! এ কামরাটা পুরো ফাঁকা। কেন? তার মানে লেডিসে ঢুকে পড়েছেন। জিআরপি দেখতে পেলে অপমানের একশেষ। দরজা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলেন। না ওই তো ঠিক পিছনের কামরাটাতেই ধাক্বাধাক্বি করে সব মহিলারা উঠছেন। তার মানে ওটা লেডিস বগি। তাহলে এটা?

চোখের সামনে দিয়ে লক্ষ লক্ষ লোক বন্যার তোড়ে খড়কুটোর মতো ভেসে যাচ্ছে কিন্তু এদিকে কেউ তাকাচ্ছেও না। আশ্চর্য তো। তাহলে ডেফিনিট… হয় বমি না হয় পায়খানায় ছড়াছড়ি হয়ে রয়েছে বগিটা। চারদিক দেখলেন। নাহ তাও নেই।

ভুতুড়ে ব্যাপার ভেবে নেমে যেতে গেলেন ঠিক তক্ষুনি আবার একটা ছেলে হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ল কামরাটাতে, একদম সুতনুর স্টাইলেই। পড়েই আবার চট করে উঠে দাঁড়াল। সুতনুর মতোই গোটা কামরাটাকে এদিক-ওদিক ভালো করে দেখল অবাক হয়ে। সুতনুও বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখলেন ছেলেটাকে। বড়ো জোর আঠেরো থেকে কুড়ি বছর বয়স হবে। রোগাপ্যাংলা চেহারা। কালো রঙের একটা টি-শার্ট আর জিন্স-এর প্যান্ট। সরু থুতনিতে খানিকটা দাড়ি। আর পিঠে একটা ইয়া লম্বা কালো ব্যাগ। দেখেই বোঝা যায় ওটার ভেতর গিটার জাতীয় কিছু একটা আছে। ছেলেটা সুতনুকে জিজ্ঞেস করল, কাকু ডিসপুট কেস নাকি?

অ্যাঁ!

মানে পটি-টটি পড়ে রয়েছে কি?

জানি না। দেখলাম তো নেই।

ছেলেটা শ্রাগ করল, তারপর জানলার ধারের একটা সিটে বসে উলটো দিকের সিটের ওপর সটান নিজের পা-দুটো তুলে দিল। এখানেই শেষ নয়, টুক করে পকেট থেকে একটা মোবাইল বার করে তার গুঁজে গান চালিয়ে দিল। উফ্ এই এক অসহ্য হয়েছে। এখনকার জেনারেশন যেন গান ছাড়া থাকতেই পারে না। গানের তালে তালে মাথা ঝাঁকাচ্ছে ছেলেটা। সুতনু ভুরু কুঁচকে কয়েক মুহূর্ত দেখলেন তারপর অন্যদিকে তাকালেন। ভেতরে একটা চাপা টেনশন হচ্ছে। একটা লোকও কেন উঠছে না কম্পার্টমেন্টটায়! ঘড়ি দেখলেন। আটটা পঁচিশই বাজে। একবার ভাবলেন নেমে যাবেন, দরকার নেই বাবা এমন কিম্ভূত কামরায় বসে। তার থেকে ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে যাওয়াও ভালো।

ভাবা মাত্রই উঠে দাঁড়ালেন উনি, আর সঙ্গে সঙ্গে ট্রেন ছাড়ার হুইসেল দিল। বাধ্য ছেলের মতো আবার সিটে বসে পড়লেন সুতনু।

ট্রেনটা অলস্টপ তো কাকু? জিজ্ঞেস করল ছেলেটা।

হুঁ।

ওক্বে। আবার গান শুনতে মগ্ন হয়ে গেল। এমন যে একটা আশ্চর্য বিষয় ঘটছে সে বিষয়ে কোনও ভ্রূক্ষেপই নেই ওর। আশ্চর্য জেনারেশন! অবাক হতেই ভুলে যাচ্ছে এই নতুন প্রজন্মটা।

ট্রেনটা ছাড়ল। বাইরের লোকের আরও ঠেলাঠেলি দৌড়াদৌড়ি। যেভাবে হোক এই ট্রেনে উঠতেই হবে। সুতনু মনেপ্রাণে চাইছিলেন কামরাটা আর পাঁচটা কামরার মতোই ভিড়ে ভিড় হয়ে যাক। দরকার হলে নিজের সিটটা কাউকে ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে যেতেও রাজি উনি। কিন্তু কেউই উঠল না।

আর ঠিক তখনই আবার একজন মহিলা হুমড়ি খেয়ে পড়লেন ফুটবোর্ডে। কাঁধের ব্যাগটাও পড়ল ছিটকে। বেকায়দায় পড়ার জন্য উঠে দাঁড়াতে পারছিলেন না। ট্রেন স্পিড নিয়ে নিয়েছে এবার। প্ল্যাটফর্ম পেরিয়ে গেল। মহিলাকে উঠতে সাহায্য করার জন্য সুতনু সবে উঠে দাঁড়াতে যাবে, তার আগেই ওই ছেলেটা ঝট করে গিয়ে ওঁকে তুলে ধরল। মনে মনে বেশ খানিকটা খুশি হলেন সুতনু। যাক ছেলেটার মধ্যে এই ফিলিংসটা অন্তত রয়েছে এখনও। ভদ্রমহিলার বয়স সুতনুর কাছাকাছি হবে। ছোটোখাটো, ভারী চেহারা। একমাথা কোঁকড়া চুলের বেশ কয়েকগাছির রং রুপোলি। খুব সাধারণ একটা শাড়ি। কপালে, সিঁথিতে সিঁদুর নেই। ছেলেটার হাতে হাত রেখে সামান্য খুঁড়িয়ে এসে সিটে বসল। সুতনুর সঙ্গে চোখাচুখি হতেই সুতনু জিজ্ঞেস করলেন, লেগেছে?

নাহ্, তেমন কিছু না। এই গোড়ালিটায় শুধু…।

জল দেবেন? রয়েছে আমার কাছে।

না না থাক।

কারশেড পেরিয়ে গেল ট্রেন। চারদিকে অন্ধকারের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু উঁচু ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোগুলো আপ্রাণ হলদে আলো স্প্রে করছে চারিদিকে।

এই বগিটায় আর কেউ উঠল না?

মহিলার প্রশ্নে সামান্য হাসলেন সুতনু। সে প্রশ্ন তো আমাদেরও। কেন ওঠেনি কে জানে। তবে নোংরা-টোংরা কিছু পড়ে নেই সেটা দেখে নিয়েছি।

শুনে মহিলা যে খুব আশ্বস্ত হলেন তা নয়। বেশ কিছুক্ষণ তিনজনেই চুপ। ট্রেনটা দুরন্ত গতিতে ছুটছে। রোজের তুলনায় অনেকটা বেশিই স্পিড। বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না। লিলুয়া স্টেশন আসতে আর কতদূর? ভাবতে ভাবতেই আচমকা আবার সুতনুর চোখের সামনে একটা কাগজ ভেসে উঠল। বিবর্ণ হলুদ হয়ে যাওয়া একটা কাগজ। তার মধ্যে নীল রঙের পেনসিলে আঁকা প্রায় ক্ষয়ে আসা একটা ছবি। একটা বাড়ির ছবি। উফ্ফ আবার। মাথা ঝাঁকিয়ে দৃশ্যটাকে ভুলতে চাইলেন। হারামজাদা যখন তখন এসে মনের ভেতরটাকে মুহূর্তে পুড়িয়ে দিয়ে যায়। বিড়বিড় করে বলে উঠলেন, দূর হ দূর হ।

কিছু বললেন?

মহিলার কথায় হুঁশ ফিরল সুতনুর। না না কিছু না।

আজ বড়ো দেরি হয়ে গেল আমার। নইলে রোজ সাতটা পঁচিশের কাটোয়াটা ধরি। বললেন মহিলা।

ও আচ্ছা।

আপনি কোথায় নামবেন দাদা?

শ্রীরামপুর।

অ, আমি নামব ভদ্রেশ্বর। এ্যাই ছেলে তুই কোথায় নামবি।

কানের থেকে হেডফোনটা নামিয়ে ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, কিছু বললেন?

উফ্ তোদের এই সারাক্ষণ এক কেতা হয়েছে কানের মধ্যে তার গুঁজে রাখা। আমার ছোটো ছেলেটাও দিন-রাত এই কানে মোবাইল ঠুসে বসে থাকে। কাজকম্ম নেই খালি…।

ছেলেটা কিছু উত্তর দিল না, শুধু হাসল।

তুই নামবি কোথায়?

রিষড়া।

গান করিস নাকি?

না, আমি গিটার বাজাই, আমাদের একটা ব্যান্ড আছে।

অ। তা বেশ, গানবাজনা নিয়ে আছিস। আমার ছেলেটা যে কী করে কে জানে। জিজ্ঞেস করলে বলে ব্যাবসা করছে। এমন ব্যাবসা যে মাস গেলে একটা টাকারও মুখ দেখি না। আর পারি না। তেইশ বছর ধরে এই যাতায়াত। কবে যে শেষ হবে? নিজের মনেই বিড়বিড় করলেন উনি।

কোথাও গেছিলেন?

হ্যাঁ, এত বছর ধরে যেখানে যাই, সেখানেই।

ও, অফিস?

ধুস অফিস! ওসব তো আপনারা করেন। আমি পগেয়াপট্টিতে একটা শাড়ির দোকানে কাজ করি। কত্তা ওখানেই কাজ করতেন। দুম করে চলে গেলেন একদিন। দুটো ছেলেকে নিয়ে আমি তখন অথই জলে। পেট চালাতে ওই দোকানে ঢুকে পড়েছিলাম। সেই চলছে। বলে বড়োসড়ো একটা নিশ্বাস ফেললেন উনি। সুতনু শুনছিলেন আর খানিকটা কষ্টের সঙ্গে সঙ্গে অবাকও হচ্ছিলেন। মহিলা ওদের চেনেন না, ওরা কেউই কাউকে চেনে না, সম্পূর্ণ অপরিচিত পরস্পরের, অথচ কী নির্দ্বিধায় অনায়াসে নিজের দুঃখের কথা বলে গেলেন। হয়তো এই কথা জীবনে বহু মানুষকে বহুবার শুনিয়েছেন, তাই বলাটা অভ্যাস হয়ে গেছে, কিংবা হয়তো কেউ নেই ওর কথা শোনার জন্য। তাই অপরিচিত দুজনকে এইটুকু সময়ের মধ্যেই যতটা সম্ভব মনের কষ্ট উগরে দিয়ে খানিকটা হালকা হতে চাইলেন। আর ক’টাইবা স্টেশন। যে যার মতো নেমে যাবে। আর কোনওদিন দেখাই হবে না হয়তো পরস্পরের সঙ্গে। কিন্তু লিলুয়া এখনও এল না কেন? জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেন সুতনু। এখন বাইরের অন্ধকারটা আরও গভীর। অবিশ্বাস্য গতিতে ছুটছে ট্রেনটা। হাওয়ার ঝাপটা লাগছে চোখে মুখে। এত অন্ধকার কেন? আর ট্রেনটা…

কাকু, আমার কিন্তু কেস একটু লোচা লাগছে। বলেই সিট ছেড়ে উঠে গিয়ে দরজার সামনে গেল ছেলেটা। ঝুঁকে বাইরে দেখতে গেল। অমনই হাঁ হাঁ করে উঠলেন মহিলা। আরে রে ওই ছেলে করিস কী? এত ওস্তাদি কীসের তোর? ওইভাবে চলন্ত ট্রেন থেকে কেউ বাইরে ঝোঁকে? চুপ করে এসে বোস বলছি। যখন স্টেশন আসার ঠিক আসবে।

ছেলেটা আবার এসে বসল।

নাম না জেনেই বকা দিয়ে দিলাম, কী নাম তোর?

শীর্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়।

বাহ সুন্দর নাম। আমার বডো় ছেলে দুবাইতে থাকে, সোনার কাজ করে। ওর নাম দেবাশিস। অনেকদিন আসে না বাড়িতে। ভুলেই গেছে মাকে। বিয়েও করেছে, একটা ছোটো ছেলেও হয়েছে। ফোন করে জানিয়েছিল আর ওদের একটা ফটো পাঠিয়েছিল একবার। ব্যস ওইটুকুই। আজ পর্যন্ত সামনাসামনি বউমা-নাতির মুখ দেখিনি। আর ছোটো ছেলেটার নাম শুভাশিস। শুভ বলে ডাকি। এক নম্বরের বিচ্ছু। তোরই বয়সি। বাড়িতে কে কে আছে তোর? প্রশ্নটা করার সঙ্গে সঙ্গে সেকেন্ডের মধ্যে চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেল ছেলেটার। খুব সংক্ষেপে স্পষ্ট করে বলল, কেউ নেই।

মানে! মুখ ফসকে প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল সুতনুর।

মানে আমি যে-বাড়িতে থাকি সেখানে আমার কেউ নেই।

ও। তোর বাড়ি এখানে নয় তাহলে? ভাড়া থাকিস বুঝি একা? বাবা এইটুকু বয়সে…।

শীর্ষ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না বাড়িতে সকলেই আছে, বাট আমি একা।

সে আবার কী কথা!

আমার বাবা-মা নোবডি লাইক মি। বাট আই ডোন্ট কেয়ার।

ধ্যাত তাই আবার হয় নাকি। বলে ফেললেন সুতনু।

হ্যাঁ হয়। অন্তত আমার ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।

তুই কী করিস বাবা?

ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি।

বাহ্ খুব ভালো, মন দিয়ে পড়াশোনা কর, অনেক বড়ো মানুষ হ।

করি তো। কিন্তু আমার বাবা-মা কেউ চান না আমি গানবাজনা করি। আমার বাড়িতে কোনও বন্ধুদের আসা বারণ। তাদের মতে আমার ফ্রেন্ডসরা সব স্পয়েল্ড। ডিসগাসটিং…।

ওহ ওটা কোনও ইস্যু না। সব বাবা-মায়েরাই তাদের সন্তানদের নিয়ে একটু আধটু চিন্তায় থাকেন। ঠিক হয়ে যাবে।

কিচ্ছু ঠিক হবে না কাকু। আমি ওদের চিনি। আমার বাড়ি ঢুকতে ইচ্ছে করে না। তবু শালা রোজ… সরি। বলে চুপ করে গেল শীর্ষ। বাইরের দিকে তাকাল।

সুতনু হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। এইটুকু ছেলে, ওর ওই বয়সেই এত দুঃখ! এখনই বলে বাড়ি ঢুকতে ইচ্ছে করে না! আর গত কুড়ি বছর ধরে সকালবিকেল, সারা রাত ধরে মনের মধ্যে যে স্বপ্ন-বাড়ির প্ল্যানটাকে বয়ে বেড়াচ্ছেন, তার কথা কেউ জানে? জীবনের পঞ্চান্নটা বছর পার হয়ে গেল দেড়খানা রুমের ঘুপচি ভাড়া বাড়িতে। খুব সখ ছিল নিজের মনের মতো একটা বাড়ি বানানোর। দেড় কাঠা জমিও কিনেছিলেন অনেক কষ্ট করে, তাও আজ থেকে বছর দশেক হল। বাড়ির প্ল্যান তৈরি হল। সবে বাড়ির কাজে হাত দেবেন ভাবছেন ঠিক তখনই স্ত্রী তনুশ্রী পড়ল কঠিন অসুখে। ব্রেস্ট ক্যানসার। বছর দুই ধরে যমে মানুষে টানাটানির পর তনু সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরল ঠিকই কিন্তু ততদিনে সুতনুর জমানো সমস্ত পুঁজি হাসপাতাল-ডাক্তার আর ওষুধের দোকানে। আর জমল না। নিজেকে বহু বুঝিয়েছেন সুতনু, টাকা গেছে যাক, বাড়ি নাই বা হল, মানুষটা তো ফিরে এসেছে। তবু এমন একটা দিনও যায়নি, যেদিন ইঞ্জিনিয়ারের বানিয়ে দেওয়া সেই বাড়ির প্ল্যানটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে না। পৃথিবীর কেউ জানে না, মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে তনুকে লুকিয়ে, সেই প্ল্যানের পুরোনো হয়ে যাওয়া বিবর্ণ কাগজটা আলমারির থেকে বার করে লাইট জ্বালিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকিয়ে থাকেন নিঃসন্তান সুতনু, আজও।

মন খারাপ করিস না রে, এই নে বিস্কুট খা, বলে নিজের জীর্ণ ঘসা ব্যাগটার ভেতর থেকে একটা ছোটো বিস্কুটের প্যাকেট বার করে সেখান থেকে দুটো বিস্কুট বাড়িয়ে দিলেন মহিলা।

না না আমি কিছু খাব না।

পাকামো করিস না তো। যা দিচ্ছি খা।

শীর্ষ সামান্য হেসে বিস্কুট দুটো নিল। নীচু স্বরে বলল,থ্যাংক ইউ।

খুব হয়েছে। খেয়ে ফেল। জল রয়েছে আমার কাছে। এই নিন আপনিও খান দুটো।

আরে না না। বলে উঠলেন সুতনু।

কেন বড়োদের বিস্কুট খেতে নেই নাকি? আমি তো সবসময় সঙ্গে রাখি। ডাক্তার বলেছেন একদম খালি পেটে না থাকতে। খুব গ্যাস-অম্বলের রোগ আমার।

সে আমারও। বলে বিস্কুট নিলেন সুতনু। কামড় দিলেন।

এই বাড়ি গিয়েই আবার রান্নাবান্না। ছেলে কখন ফিরবে কিছুই জানি না। আর ভাল্লাগে না। একটা কেউ নেই যে আমাকে একটু হেল্প করবে। ভেবেছিলাম দুই ছেলের বিয়ে দিয়ে বউমা-নাতি-নাতনি নিয়ে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব… সবই কপাল আমার।

লিলুয়া কি পেরিয়ে গেল? জিজ্ঞেস করলেন সুতনু।

না না আর লিলুয়া আসবে বলে মনে হচ্ছে না। এটা শিওর ঘোস্ট কম্পার্টমেন্টে উঠেছি আমরা।

মানে? জিজ্ঞেস করলেন মহিলা।

ভূতের কামরা।

চুপ। রাত্তিরে এসব হাবিজাবি কথা কেউ বলে? আমার কিন্তু বাপু বেশ ভয় করছে এবার।

ভাগ্যিস আমি একা নই।

বাইরের লাইটগুলোও কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না এবার। বলল শীর্ষ।

তাই? বলে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিলেন সুতনু। সত্যিই তো, নিকষ অন্ধকার ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। ট্রেনটা যেন আলোর গতিতে ছুটছে। এবার সত্যি সত্যিই ভয় লাগতে শুরু করল। ঘড়ির দিকে তাকালেন। যাব্বাবা ঘড়িটাও কখন যেন বন্ধ হয়ে গেছে। সেই আটটা পঁচিশই বেজে রয়েছে এখনও।

কী করা যায় কাকু? চেন টানব?

উঁ… চেন? টানো। অন্যমনস্কভাবেই উত্তর দিলেন সুতনু।

শীর্ষ উঠে দাঁড়িয়ে জানলার একটু ওপরে ঝুলতে থাকা চেনটা প্রাণপণে টানল। কোনও লাভ হল না। ট্রেনের একই গতি।

কী হবে গো তাহলে? আর ফিরতে পারব না বাড়ি? হাউমাউ করে উঠলেন মহিলা।

তাই আবার হয় নাকি। আমার মনে হচ্ছে আমরা ভুল করে কোনও দূরপাল্লার ট্রেনে চেপে বসেছি।

তিনজনেই একই ভুল করলাম? আর এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে এত আগে কোনওদিন মেল ট্রেন দেয়? বললেন সুতনু।

হুম। কোনও উত্তর দিল না শীর্ষ। মোবাইলটা হাতে নিয়ে বলে উঠল যাব্বাবা, টাওয়ারও নেই।

এ সত্যিই ভূতের বগিতে উঠলাম নাকি? হে রামঠাকুর, হে লোকনাথবাবা রক্ষা করো বাবা…। কাঁদো কাঁদো স্বরে বলে উঠলেন মহিলা।

কেউ উত্তর দিল না। মনে হচ্ছিল যেন একটার পর একটা ছায়াপথ হুশ হুশ করে পেরিয়ে যাচ্ছে কামরাটা।

চুপ করে পরস্পরের গা ঘেঁসে বসেছিল তিনজন অসমবয়সি মানুষ।

তারপর হঠাৎ একটা সময় গতিটা যেন কমতে শুরু করল।

থামছে থামছে বলে চিৎকার করে উঠল শীর্ষ।

সত্যি সত্যিই থামল ট্রেনটা। না কোনও প্ল্যাটফর্মে না, বাইরেটা একই রকম অন্ধকার। সুতনু আর শীর্ষ ভুরু কুঁচকে তাকাল বাইরের দিকে। এটা আবার কোন স্টেশন। ওরা কেউ কিছু বলার আগেই আবার হাউমাউ করে উঠলেন সে মহিলা, আরে আরে একি একি, এটা আমার বাড়ি যে… ওই তো আমার দুই ছেলে! ও মা, বড়োছেলেটা কখন এল দুবাই থেকে? ওই দেখুন দাদা, আমার বউমা আর নাতি। হি..হি..হি… আমার ছোটোটার সঙ্গে কেমন খেলায় মেতেছে দেখুন, আমি চললাম। বলেই প্রায় একঝাঁপে কামরা থেকে নেমে গেলেন মহিলা। আর দেখা গেল না ওকে। মুহূর্তে অন্ধকারে মিশে গেলেন। সুতনু কিছু একটা বলতে গেলেন, গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না। ট্রেন আবার ছেড়ে দিল।

দুজনেই চুপ করে বসে। সুতনুর কান-মাথার ভেতর থেকে গরম হাওয়া বের হচ্ছে টেনশনে। এসব কী হচ্ছে। এ কোন মৃত্যুকূপ! চোখ বুজে ইষ্টনাম জপ করতে শুরু করলেন উনি। চোখ বুজে গুরুদেবকে ডাকতে ডাকতে কখন যেন চোখ লেগে এসেছিল। আবার চটকা ভাঙল। ট্রেনটা আবার থেমেছে।

কাকু কি আশ্চর্য দেখুন! কান্ট বিলিভ!

কী হল আবার? জিজ্ঞেস করলেন সুতনু।

আমার বাড়ি।

তোমার বাড়ি? মানে… তোমারও কি মাথাটা..

না না আয়্যাম ফাইন। ওই দেখুন বাড়ির সামনে, বলে জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে ঘুটঘুটে অন্ধকারে হাত বাড়াল শীর্ষ।

ওই দেখুন আমার বাড়ির সামনের লনটায় আমার সব বন্ধুরা রিহার্স করছে, আমার মা-বাবা শুনছে, কথা বলছে ওদের সঙ্গে! হোয়াট ইজ দিস! উত্তেজনায় প্রাণপণ চিল্লে উঠল শীর্ষ।

এটা বিভ্রম শীর্ষ।

না না ইট ইজ নট হ্যাল। ওই দেখুন রাতুল, অঙ্কন, শ্রীজা, দীপ সব্বাই রয়েছে, ওই দেখুন আমাকে দেখতে পেয়েছে ওরা… হেই দীপ, অর্ক… ওই দেখুন ওরা আমাকে ডাকছে। বাই কাকু, সি ইউ…  বলেই ট্রেন থেকে এক লাফ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

অসহায়ভাবে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন সুতনু। ট্রেন ছেড়ে দিল। গোটা কামরাটায় সুতনু একা কিন্তু আশ্চর্য একটুও ভয় করছে না আর। বরং বড়ো অদ্ভুত ভালোলাগায় ভর্তি হয়ে উঠছে ভেতরটা। একটা ঝিম ঝিম ঘোর তৈরি হচ্ছে। আর কিছুক্ষণ পরেই…

হ্যাঁ আর কিছুক্ষণ পরেই সুতনু সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। চারদিকে নরম আলো আর আলো। ট্রেনটা থেমেছে সুতনুর বাড়ির একেবারে সামনে। কয়েক পলক মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলেন সুতনু। চোখের সামনে তার সেই স্বপ্ন-বাড়ি, এতদিন পর কাগজের পৃষ্ঠা থেকে প্রাণ পেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। সুতনু দেখতে পাচ্ছেন সেই ছোট্ট সুন্দর দোতলা বাড়ির ড্রয়িংরুম থেকে শোয়ার ঘর, ডাইনিং রুম থেকে কিচেন, টয়লেটের দুধসাদা টাইলস। বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা বাগান। কিচেনে তনু কী যেন একটা রান্না করছে মন দিয়ে। মিষ্টি গন্ধ আসছে তার। আমার… শুধু এই শব্দটুকু বলে ট্রেনের বাইরে পা রাখলেন সুতনু।

এর ঠিক তিনদিন পরে দু-একটি খবরের কাগজের ভেতরের পাতায় খুব ছোট্ট করে একটা খবর প্রকাশ হয়েছিল…

গতপরশু রাত আটটা কুড়ি নাগাদ হাওড়া স্টেশনের এক নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা আপ কাটোয়া লোকালের দ্বিতীয় মহিলা কামরা ও তার আগের কামরার মাঝামাঝি এক যুবক, এক মাঝবয়সি ব্যক্তি এবং একজন মহিলাকে সন্দেহজনকভাবে ঘুরঘুর করতে দেখা যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, ওই তিনজন প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরেই দুই কামরার মাঝখানে আপ্রাণ কী যেন খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। কিছুক্ষণ পর জিআরপি এসে তাদের তিনজনকে আটক করে। কোনও নাশকতামূলক চক্রান্তের ছক কষছিলেন কি না তাই নিয়ে তাদের পৃথকভাবে দীর্ঘক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করার পর উক্ত তিনজনই এক উদ্ভট কল্পকাহিনির গল্প শোনান। পুলিশের অনুমান উক্ত তিনজনই মানসিক অবসাদগ্রস্ত। তিন ব্যক্তিকেই পরে ছেড়ে দেওয়া হয়। সবথেকে আশ্চর্যের ঘটনা, গতকাল হাওড়া স্টেশনে ঠিক ওই ট্রেনের ওই জায়গাতেই উক্ত তিনজনকে আবার দেখতে পাওয়া যায়, সঙ্গে আরও কয়েকজন বিভিন্ন বয়সের পুরুষ ও মহিলা, যারা একইভাবে ওই দুই কামরার মাঝখানে কিছু খুঁজছিলেন।

শীতল পরশ

সকাল থেকেই কেমন যেন গুমোট আবহাওয়া। আকাশে মেঘের ঘনঘটা। গাছের পাতা একেবারে স্তব্ধ। হাওয়ার লেশমাত্র নেই। সবমিলিয়ে বেশ একটা দমচাপা পরিবেশ।

এমনিতেই ক’দিন ধরে বাপ-ছেলের গন্ডগোলের জেরে মালার প্রাণ একেবারে ওষ্ঠাগত। বেচারা সবসময় ভয়ে-ভয়েই থাকে এই বুঝি আবার যুদ্ধ লাগল। তার উপর এরকম একটা ঝিমোনো পরিবেশে দমবন্ধ হয়ে আসছিল মালার। আজ মনটা কেমন যেন কু গাইছে তার। বোধহয় বড়ো কিছু হওয়ার একটা অশনি সংকেত পাচ্ছিল সে। যতই হোক মায়ের মন তো।

যা ভাবা ঠিক তাই। অতনু অফিস বেরোবার সময় রমাকান্তের মুখোমুখি। তিনি তখন প্রাতর্ভ্রমণ সেরে অন্যান্য দিনের মতোই বাজার করে ঘরে ঢুকছেন।

ছেলেকে দেখামাত্রই ভ্রূকুঞ্চিত করে, ‘কিছু ভাবলে?’

রমাকান্তের এই অ্যাটিটিউড-টাই পছন্দ নয় অতনুর। সবসময় একটা বসিং বসিং ব্যাপার। নিজের সিদ্ধান্ত অন্যের উপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া। কথা বলার ভঙ্গিও এতটাই খারাপ যে, যে-কোনও মানুষেরই মাথা গরম হওয়ার জন্য যথেষ্ট।

‘ভাবার কী আছে। তোমাকে তো আগেই বলেছি। বিয়ে আমি স্টেলাকেই করব।’ রাগত স্বরে জবাব দেওয়া মাত্রই গর্জে ওঠে রমাকান্ত। ‘রাসকেল! দুটো পয়সা উপায় করছ বলে কি ধরাকে সরা জ্ঞান করছ নাকি? শুনে নাও, ও মেয়ে কখনওই আমার বাড়ির বউ হয়ে আসবে না। এটাই আমার শেষ কথা।’

‘আনব না! তোমার গোঁড়ামো নিয়ে তুমিই থাকো। এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে শুধুমাত্র জাতপাতের দোহাই দিয়ে একটা মেয়েকে চিট করা, আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সরি, যাকে এতদিন ভালোবেসে এসেছি, শুধুমাত্র তোমার অনর্থক জেদের কারণে তাকে আমি ছাড়তে পারব না’, বলেই পাশ কাটিয়ে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় অতনু।

অতনু আর রমাকান্তকে মুখোমুখি দেখেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠেছিল মালার। কেবল নির্বাক শ্রোতার মতো বাপ-ছেলের এই প্রহসন শুনতে শুনতে সে রীতিমতো ক্লান্ত। কাকে বোঝাবে? কে বুঝবে তার কথা। কেবলমাত্র ওই দীপ্তি ছাড়া। দীপ্তি, অতনুর ছোটো বোন। ওর থেকে বছর পাঁচেকের ছোটো। সেও তো বাবার ভয়ে তটস্থ। এই কোরো না সেই কোরো না। সন্ধে হলে মেয়েরা বাইরে বেরোবে কেন? কোনও ছেলের সাথে বন্ধুত্ব করবে না। ছেলেদের সঙ্গে মেয়েদের কখনওই বন্ধুত্ব হয় না।

অতনু যাওয়ার পর মাথা ধরে সোফার উপর বসে পড়ে মালা। মাইগ্রেন-এর ব্যথাটাও বেড়েছে বেশ কয়েকদিন হল। তার উপর এ-এক চিন্তা। এর যে শেষ কোথায় কে জানে! যত বয়স বাড়ছে লোকটা যেন আরও খিটখিটে হয়ে উঠছে। রিটায়ারমেন্ট-এরও আর মাত্র বছর চারেক বাকি। এখনই মাঝেমধ্যে শরীর বিগড়োচ্ছে, নতুন বিজনেসের কারণে অফিসে ইরেগুলার। রিটায়ার হওয়ার পর তাহলে কী হবে? তখন তো সারাদিন বাড়িতেই থাকবে। ভেবেই আতঙ্কে শিউরে ওঠে মালা। কী করবে এই লোকটাকে নিয়ে। এতদিন না হয় সে সবকিছু মুখ বুজে সহ্য করেছে। কিন্তু ছেলেমেয়েরা? আর কেনই বা তারা মুখ বুজে এইসব অন্যায় সহ্য করবে। না, আজ যেভাবেই হোক, অতনুর বাবার সঙ্গে কথা বলতেই হবে, যদি কিছু বোঝানো যায়। আজ তো অফিস যাবে না ঠিক করেছে, যে-কোনও সময় একবার…।

দুপুরবেলা রমাকান্তকে খেতে দিয়ে পাশে বসে মালা বলেই ফেলে কথাটা, ‘বলছি মেয়েটাকে একবার দেখতে দোষ কী? লেখাপড়া জানা মেয়ে। বাবুর অফিসে ভালো পদে আছে। শুনেছি দেখতেও ভালো। ব্যবহারটাও। অন্য জাতের হওয়াটা তো দোষের নয় বলো?’

চুপচাপ মাথা গুঁজে খেয়ে যাচ্ছিল রমাকান্ত। জাতপাতের কথা শোনামাত্রই ভাতের থালা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ফুঁসে ওঠে, ‘ছেলের হয়ে ওকালতি করতে এসেছ? তোমার জন্যই আজ বাবুর এই বাড়বাড়ন্ত। আমিও দেখছি ও কী করে ওই বেজাতের মেয়েকে বিয়ে করে!’

খেয়ে নেওয়ার জন্য মালার বারংবার অনুরোধ একপ্রকার উপেক্ষা করেই কলতলার দিকে চলে যায় রমাকান্ত। সে কোনও কিছুর বিনিময়েই স্টেলাকে মেনে নেবে না। তাই বোধহয় সবকিছু জেনেশুনে আজও ছেলের জন্য মেয়ে দেখে চলেছে।

সন্ধে সাতটা নাগাদ থমথমে মুখে ঘরে ফেরে অতনু। ছেলের চোখমুখ দেখেই হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নেয় মালা। বলে, ‘তুই আগে বোস। জল দিই একটু জল খা। শরীরটা খারাপ লাগছে নাকি রে বাবু? সারাদিন ঠিকঠাক খেয়েছিস তো?’

‘শোনো মা, শোনো। আমার কিছু হয়নি। শরীর ঠিক আছে। তুমি আমার কাছে বসো, তোমার সাথে কথা আছে।’

‘কথা! কী কথা রে? পরে বলিস। আগে ঘরে যা, হাত-মুখ ধুয়ে একটু রেস্ট নে। তারপর না হয়…।’

‘না মা ঘরে যাব না। বলছি আমি একটা ফ্ল্যাট দেখেছি।’

‘কী দেখেছিস!’

‘ফ্ল্যাট।’

‘কী বলছিস বাবু। তুই কি পাগল হলি। তোর বাবার জন্য তুই আমাদের থেকেও…’ চোখে জল চলে আসে মালার।

‘না মা। শোনো আগে। এভাবে বোলো না। তুমি তো চাও, আমি একটু ভালো থাকি। শান্তিতে থাকি। রোজ বাবার এই গঞ্জনা, অশান্তি আমি আর সহ্য করতে পারছি না। একদিকে বাবার জেদ, অহংকার, অন্যদিকে ‘ওর’ ওই এক গোঁয়ারতুমি, বাবা আর্শীবাদ না করলে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে না। দুজনের জেদাজেদিতে আমি হাঁপিয়ে উঠছি মা। অন্য জায়গায় গেলে অন্তত একটা দিক থেকে তো রেহাই মিলবে। এই বাড়িতে তো প্রাণখুলে শ্বাসও নেওয়া যায় না।

‘সবই তো বুঝলাম বাবু, কিন্তু তোকে ছেড়ে…’ কথা শেষ করতে পারে না মালা। দু-চোখ বেয়ে জল নেমে আসে।

‘আরে কাঁদছ কেন? আগে কথাটা শোনো। আমি কাছাকাছিই ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। যখনই মনে হবে তুমি আর ছুটকি চলে আসবে।’

ছেলের কথা ভেবে নিজেকে খানিক ধাতস্ত করে মালা, ‘যাবি কবে?’

মায়ের হাতদুটো ধরে অতনু জবাব দেয়, ‘আজই মা।’

‘আজই’, কাঁপা গলায় বলে ওঠে মালা।

একপ্রকার বুকের ওপর পাথর চাপা দিয়েই ছেলেকে বিদায় জানায় মালা। যাওয়ার সময় কয়েকটা প্রয়োজনীয় জিনিস এবং নিজের পোশাকআশাক ছাড়া কিছু সঙ্গে নেয়নি অতনু। রমাকান্ত বাড়ি ফিরলে ছেলের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া নিয়ে চলে আর এক প্রস্থ। আর সেটাই বোধহয় স্বাভাবিক– যার সম্বল কেবলমাত্র অহং আর জেদ, সেই অহংকারে আঘাত হানা– পারতপক্ষে ব্যাপারটা তার পক্ষে মেনে নেওয়া বেশ কঠিন।

ওদিকে রমাকান্ত অফিসে বেরোলেই সংসারের সমস্ত কাজকর্ম গুছিয়ে মালা সোজা ছেলের বাড়িতে। ঘরগোছানো, ছেলের জন্য রান্না করা। কখনও বা রান্না করে তার জন্য নিয়ে যাওয়া। কখনও দীপ্তির হাতে পাঠানো। তাছাড়া ফোন তো রয়েইছে। দেখতে দেখতে এইভাবেই বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেল। এরই মধ্যে স্টেলার সঙ্গে পরিচয়ও হয়েছে। মা-মেয়ের বেশ ভালোই লেগেছে তাকে।

মাসখানেক হয়ে গেল বাবা-ছেলের দেখাসাক্ষাৎ নেই।

তার আড়াল-আবডালে যে কী চলছে, কিছুই জানতে বাকি রইল না রমাকান্তের। তবুও সবকিছু জেনেশুনে একপ্রকার না জানার ভান করা আর কী! হয়তো কিছুটা মন ও বয়সের ভারে, আবার কিছুটা কাজের চাপে। কথা ছিল অতনু আর রমাকান্ত দুজনে মিলে ব্যাবসাটা দাঁড় করাবে। কিন্তু নিজের জেদের কারণে সব জায়গায় একা একা দৌড়োনো, এই বয়সে বেশ সমস্যাই হচ্ছিল।

তাই অনেক ভেবেচিন্তে রমাকান্তই মালাকে বলে, ‘মালা অনেকদিন তো হল, তোমার সুপুত্তুরকে বলো বাড়ি ফিরতে।’

কথাটা শুনেই অবাক হয়ে রমাকান্তের দিকে তাকায় মালা।

‘আরে কী হল! তোমাকেই বলছি। এরকম অবাক হলে কেন? বলছি তোমার সপুত্তুরকে বলো এবার বাড়ি ফিরতে।’

‘আমাকে বললে?’

‘তবে কাকে বলছি, এখানে তুমি ছাড়া আর কেউ আছে নাকি?’

নিজেকে খানিক সামলে নেয় মালা, ‘যেতে যখন তুমি বলেছ, আসতেও তুমিই বোলো। তোমারই তো ছেলে। তুমি না বললে কী আর সে…।’

কোনও জবাব না দিয়েই রমাকান্ত উপরে ঘরের দিকে চলে যায়। সন্ধে সাতটা নাগাদ কাউকে কিছু না জানিয়ে সোজা অতনুর ভাড়া নেওয়া ফ্ল্যাটে হাজির রমাকান্ত। অতনু তখন সবেমাত্র অফিস থেকে ফিরেছে। উইদাউট এনি ইনফরমেশন বাবার হঠাৎ আগমনে, বেশ আশ্চর্য হয় অতনু।

‘চলো অনেক হয়েছে। জিনিসপত্র গোছাও আর বাড়ি চলো।’

‘না বাবা। আমি এখানেই ঠিক আছি। জাতপাত, বৈষম্য এসবের থেকে অনেক দূরে। এখানে আমি নিজের মতো ভাবতে পারি, সিদ্ধান্ত নিতে পারি। জোর করে কেউ কিছু চাপিয়ে দেয় না আমার উপর। আজ তোমার মনে হয়েছে তাই আনতে এসেছ, কাল মনে হলেই আবার লাথি মারবে। তোমার আমার মত কোনওদিনই মিলবে না। ভবিষ্যতে স্টেলাকে নিয়েও প্রবলেম হবে। আজ আমাকে অপমান করছ। বিয়ের পর স্টেলাকে করবে। সেটা আমি কখনওই মেনে নিতে পারব না। আমি যেমন আছি, ভালো আছি। প্লিজ আমাকে আমার মতো থাকতে দাও।’

‘এটা কী ধরনের অসভ্যতা। ইগো দেখাচ্ছ আমাকে। ইগো! একটা বেজাতের মেয়ের জন্য আমাকে অপমান করছ। রমাকান্ত সান্যালকে। এত বড়ো স্পর্ধা তোমার। দ্যাখো এবার আমি কী করতে পারি’, বলেই রাগে গটগট করতে করতে উলটো পায়ে ফিরে গেল রমাকান্ত।

বাড়ি ফেরার পর থেকেই মুখ গম্ভীর করে বসে থাকে রমাকান্ত। মালার বহুবার জিজ্ঞাসা করাতেও কোনও সদুত্তর মেলে না। কেবলই কী যেন ভাবতে থাকে।

দিন সাতেক পর একটি নামকরা দৈনিক পত্রিকাতে বড়ো বড়ো হরফে লেখা বেরোয়, ‘আমি শ্রী রমাকান্ত সান্যাল, মন্দিরতলা ফার্স্ট লেন, কামরাবাদ, সোনারপুর এলাকার বাসিন্দা, সজ্ঞানে আইন মারফত আমার পুত্র অতনু সান্যালকে (২৯) কে ত্যাজ্য করলাম। আমার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি, কোনও কিছুতেই তার অধিকার রইল না।’

শ্রী রমাকান্ত সান্যাল

সকালেই সুশীলার ফোন। ‘কীরে দিদি, জামাইবাবু এটা কী করল?’ কিছু বোধগম্য হওয়ার আগেই রমাকান্তের চায়ের জন্য হাঁকডাকে ফোনটা কেটে দিতে হয়েছিল মালাকে। তারপর চা করার সময় উলটো দিকের বাড়ির গীতাও তার রান্নাঘর থেকে কী যেন একটা বলার চেষ্টা করছিল। প্রথমে বুঝতে পারেনি মালা। তারপর দুই নম্বর পাতায় আজকের খবরের কাগজটা দেখাল। চা দেওয়া হয়ে গেলে কৌতূহলবশত পাতাটা ওলটাতেই চক্ষু ছানাবড়া মালার। ‘এটা কী করল অতনুর বাবা। রাগ মেটাতে শেষপর্যন্ত এই পদক্ষেপ নিল লোকটা। কাগজটা হাতে করে জড়বতের মতো বসে রইল মালা। পাড়াপড়শি থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজন, সকলের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে সারাদিন পরিশ্রান্ত হয়ে গেল মালা। এখন ফোন ধরাও প্রায় ছেড়ে দিয়েছে সে। রিং হতেই থাকে। দীপ্তি থাকলে কখনওসখনও ধরে নয়তো কেটেই যায়।

দু-একজন শুভাকাঙক্ষীর পরামর্শে মালা আবারও স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করে। ‘অনেক হয়েছে। এই বয়সে ছেলের বিরুদ্ধে কোর্টকাছারি করছ, সেটা কি ভালো দেখাচ্ছে। লোকে যে ছি ছি করছে।’

‘যা করছি ঠিক করছি। আমার ঘরের মান-সম্মান, সংস্কৃতি কোনও কিছুই আমি ক্ষুণ্ণ হতে দেব না। না পোষালে তুমিও যেতে পারো।’

এই ঘটনার পর থেকে মালা প্রায় নিজেকে ঘরবন্দি করে ফেলেছে। ওদিকে পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন ব্যাপারটা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছে। ঘরের শান্তির জন্য নিজের আত্মসম্মান শিকেয় তুলে দিয়ে সর্বদা স্বামী নামক জীবের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলানো এ যেন তার জীবনের এক এবং একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ দুটো মানুষ একেবারে দুই মেরুর। পছন্দ, চিন্তাভাবনা কোনও কিছুই মেলে না তাদের। তৎসত্ত্বেও জীবনের তিরিশটা বছর কাটিয়েছে একে-অপরের সঙ্গে। বিয়ের পর থেকেই লক্ষ্যহীনভাবে কেবলই পতিদেবতার কথা মতো কাজ করেছে।

সংসারে কোনওদিনই তার ইচ্ছে বা মতামত প্রাধান্য পায়নি। প্রথমদিকে রমাকান্তকে বদলানোর বহু চেষ্টা করেছে মালা। কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি। সারাজীবন স্বামীর মিথ্যে অহংকারের তুষ্টির জন্য নিজের ইচ্ছের বলিদান দিয়ে এসেছে সে।

ভাগ্যের পরিহাসে এখনও তার জন্য অনেক কিছু অপেক্ষা করছে এই ধারণা মালার বদ্ধমূল ছিলই। এরই মধ্যে দীপ্তির পড়াশোনা কমপ্লিট হয়েছে। জোরকদমে মেয়ের বিয়ের জন্য দেখাশোনা শুরু করেছে রমাকান্ত। ব্যাবসার চাপ, পাত্র খোঁজা, অফিস– সব নিয়ে রমাকান্ত বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

অঙ্কুশকে মনে ধরে রমাকান্তের। এক অফিস কলিগের ছেলের বিয়েতে তার সঙ্গে আলাপ। তারপর বন্ধু কেশবের থেকে জানতে পারে, অঙ্কুশ বেশ বড়োমাপের বিজনেসম্যান। শহরে বেশ নামডাকও আছে তার। ছেলে হিসেবেও নাকি ভীষণ ভালো, ভদ্র নম্র। যদি দীপ্তির এখানে বিয়ে হয়ে যায় তাহলে দীপ্তির ভাগ্য ফিরে যাবে।

বন্ধু কেশবকে সঙ্গে করে একদিন সোজা অঙ্কুশের বাড়িতে হাজির হয় রমাকান্ত। কেশবের সাহায্য নিয়ে যদি তার বাবার সাথে কথা বলে পাকাপাকি একটা ব্যবস্থা করা যায়।

সেইমতো প্রথমে সৌজন্যমূলক কথাবার্তার পর সম্বন্ধর কথা উঠতেই, অঙ্কুশের বাবা একেবারে সরাসরিই প্রশ্ন করে বসলেন, ‘কাগজে আপনিই নোটিশ ছাপিয়েছিলেন না? ছেলের সাথে কী এমন ঝগড়া?’

রমাকান্ত কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। কোনওমতে কিছুটা থেমে জবাব দিল, ‘তেমন কিছু নয়। ব্যস ছেলের আর আমার মতের মিল একদমই হতো না। তারপর কথা বাড়তে বাড়তে…।’

‘ক্ষমা করবেন রমাকান্তবাবু। যে বাড়িতে বাপ-ছেলের সম্পর্ক আদালত পর্যন্ত গড়ায়, সে বাড়ির মেয়েকে আমি ছেলের বউ করে আনতে পারব না।’

অগত্যা মুখ চুন করে ফিরে আসে রমাকান্ত। তারপর থেকে যত সম্বন্ধ হয়েছে, ছেলের প্রসঙ্গ উঠতেই সে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেছে।

মহা ফাঁপড়ে পড়েছে রমাকান্ত। কায়িক এবং মানসিক পরিশ্রমে কয়েকদিনেই আরও বুড়িয়ে গেছে সে। স্বাস্থ্যও ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে।

বাল্যবন্ধু উমাচরণবাবু রমাকান্তের এই অবস্থা দেখে ঘর বয়ে এসে তাকে বুঝিয়ে গেলেন। ‘রমাকান্ত যুগ বদলেছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানুষের চিন্তাভাবনাও বদলাচ্ছে। এখনও সেই সেকেলে চিন্তাভাবনা নিয়ে বসে থাকলে চলবে কেন ভাই? দুনিয়াটা কত এগিয়ে গেছে বলোতো। মানুষের থেকে কি জাতপাত বড়ো হতে পারে? মনের এই সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে এসে দ্যাখো, দুনিয়াটা তোমাকে স্বাগত জানাবে।’

‘কিন্তু বছরের পর বছর চলে আসা পরম্পরা, সামাজিক নিয়মে বাঁধা মন, এত সহজে কি শিকল কেটে বেরিয়ে আসতে পারবে?’ বিষাদময় কণ্ঠে জবাব দেয় রমাকান্ত।

‘জীবনের পঞ্চাশ-ষাটটা বছর তো এটা ভেবেই কাটিয়ে দিলে যে, লোকে কী বলবে? সংসারের কথা না ভেবে লোকের কথা ভাবলে বেঁচে থাকা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে, তা তো হাতেনাতে টের পেয়েছ। নতুন প্রজন্ম যদি পুরোনো নিয়মের বাইরে বেরিয়ে ভালো কিছু করতে চায়, তাতে বাধা দেওয়া কেন বাপু। লাইফটা যখন তোমার ছেলের, সে কার সাথে সংসার করবে না করবে সিদ্ধান্তটা তারই হওয়া উচিত। চেষ্টা তো করো। একবার মেয়েটার সঙ্গে দেখা করো। দ্যাখো তো ছেলের পছন্দটা কেমন।’

‘ঠিক আছে। চেষ্টা করব’, পাশের ঘরে বসে থাকা মালা ও দীপ্তি রমাকান্তের এই কথা শোনা মাত্রই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। মালার চোখ ভরে এল জলে। দীপ্তি তো লাফিয়ে লাফিয়ে দাদাকেও ফোনে সব জানিয়ে দিল।

পরের দিন সন্ধেবেলা অতনুর রুমের ডোরবেলটা বেজে উঠল। সামনেই বড়োদিন। ভিতরে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব মিলে তারই আয়োজন চলছে। ঠিক সেই সময় ডোরবেল বেজে ওঠাতে বেশ বিরক্তই হল তারা। ডোরবেলটা আবারও বেজে উঠল। দরজা খুলে বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল অতুন। সামনে বাবা। সে জানত বাবা আসবে, তবে এত তাড়াতাড়ি আশা করেনি। কোনও কথা সরছিল না তার মুখে। মিনিট দুয়েক-তিনেক এভাবে কেটে গেল। অতনুর কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে ভিতর থেকে কে যেন বলে উঠল, ‘কে এল রে অতনু?’

বন্ধুর আওয়াজে সম্বিৎ ফিরে পেল অতনু।

‘ওহ! বাবা তুমি, ভিতরে এসো।’

ভিতরে ঢুকেই রমাকান্তের চোখে পড়ল ড্রইংরুমে আট-দশজন অতনুর বন্ধুর মধ্যে তিনটি মেয়েও রয়েছে। নিজেদের মধ্যে হাসি-ঠাট্টা চলছিল। তাকে দেখামাত্রই যেন আনন্দে ভাটা পড়ে গেল। প্রথমেই সামনে বসা তিনটি মেয়ের দিকে নজর পড়ল রমাকান্তের। বোধহয় প্রবীণ চোখ বিশেষ কাউকে খোঁজার চেষ্টা করছিল।

‘বাবা ভিতরের ঘরে চলো।’

রমাকান্ত ভিতরের ঘরে গিয়ে চেয়ারে বসল।

‘এরা এক্ষুনি চলে যাবে। তুমি বসো, আমি আসছি।’

‘ঠিক আছে। আমি কিছুক্ষণ বসছি। তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। ওরা যাক, তারপর এসো।’ নিজের বিনম্র ব্যবহারে রমাকান্ত নিজেই অবাক হয়ে যায়। তার স্বভাব তো এমন নয়! বরং উলটোটাই। কোনওদিন তো তলিয়ে দেখেনি। উমাচরণ বোঝানোর পর কাল থেকে যত পিছন ফিরে তাকিয়েছে তত যেন নিজেকে দোষী বলে মনে হয়েছে। বারবার বাড়ির সকলের করুণ মুখগুলো ভেসে উঠেছে চোখের সামনে।

পাখার হাওয়ায় পর্দাটা উড়ছে। ফাঁক দিয়ে ড্রইংরুমের কিছুটা অংশ দেখা যাচ্ছে। তিনটি মেয়ের মধ্যে দুটিতে মিলে একটি মেয়েকে সমানে ক্ষ্যাপাচ্ছে। ওদের হাবভাবে, রমাকান্তের আর বুঝতে বাকি থাকল না ওই মেয়েটিই স্টেলা। বেশ সুন্দর, স্মার্টও। বাচ্চাদের নিজেদের মধ্যে খুনসুটি ভালোই লাগছিল তার। কোথাও একটা মনে হচ্ছিল এরা কত সুন্দর, প্রাণবন্ত। কত সহজ করে নিয়েছে এরা জীবনটাকে। সুন্দরভাবে একে অপরের সুখ-দুঃখ শেয়ার করতে পারে। নিজের কথা সবার সামনে বলার ক্ষমতা রাখে এরা। মনে পড়ে যায় স্ত্রী মালা এবং মেয়ে দীপ্তির কথা।

নতুন প্রজন্মে জাতিধর্মকে ছাপিয়ে গিয়ে মানব সম্বন্ধকে প্রাধান্য দেওয়া, মহিলা পুরুষদের সমতুল্য ভাবা– জাতিধর্মের বন্ধন থেকে বেরিয়ে এই ধরনের নতুন নতুন বিচার ঘুরতে থাকে রমাকান্তের মনে। পুরোনো ধ্যানধারণার উপর নতুন ধ্যানধারণা ভারী হয়ে দাঁড়ায়। এমন সময়, স্টেলা ঘরে ঢুকে পায়ে হাত দিয়ে নমস্কার করতেই চমকে ওঠে রমাকান্ত। আশীর্বাদ করার জন্য হাতটা বাড়াতে গিয়েও…।

‘কেমন আছ বাবা?’ প্রশ্নটা শোনামাত্রই স্টেলার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে থাকে রমাকান্ত। কত আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মেয়েটি বাবা বলে ডাকছে। আবার মিষ্টি স্বরে, ‘বাবা তোমাকে খুব ক্লান্ত লাগছে। একটু শরবত বানিয়ে দিই?’

‘না না কিছু লাগবে না।’

‘না, তা বললে তো হবে না। জানি তুমি লেবু দেওয়া চা খেতে ভালোবাসো, কিন্তু এই গরমে চা খেলে শরীর খারাপ করবে যে। আমি বরং শরবত বানিয়ে নিয়ে আসি।’

রমাকান্তর বিস্ময়ের শেষ থাকল না। এত সহজে কেউ আপন হয়ে উঠতে পারে! এইটুকু একটা পুঁচকে মেয়ে, শরীরে ভয়ের লেশমাত্র নেই। কোথায় তার নামে বাঘে-গরুতে একঘাটে জল খায়, বাড়ির লোক দু-ঠোঁট এক করতে পারে না, আর এই মেয়েটি কিনা দিব্যি শাসন করে চলে গেল। বলে কিনা, গরমে চা খেতে হবে না, শরবত খাও!

খানিক পরে স্টেলা এসে শরবত দিয়ে গেল। যাবার সময় বলে গেল, ‘আমরা সবাই যাচ্ছি বাবা।’ বলে আবার একটা প্রণামও করে গেল। মনে হল কোনও ঠান্ডা হাওয়া বয়ে গেল।

মেয়েটিকে দেখে রমাকান্তের মনে প্রশ্ন ঘুরতে থাকল, সত্যিই কি মানুষের থেকে বংশের মানমর্যাদা, জাতপাত বড়ো হতে পারে? প্রত্যেকবারই এক জবাব পেয়েছে সে।‘না’। ‘কখনওই নয়’। বন্ধুদের ছেড়ে অতনু যতক্ষণে ঘরে ঢুকল, ততক্ষণে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে গেছে। লোকের কথা ভেবে সিদ্ধান্ত না নিয়ে মনের কথা শুনে চলাই শ্রেয়। তাতে সকলে মিলে ভালো থাকা যায়। সুতরাং তার বাড়ির বউ হওয়ার যোগ্য পাত্রী স্টেলা ছাড়া আর কেউ হতেই পারে না।

 

হঠাৎ দেখা

সকাল সাড়ে চারটেয় ফ্লাইট। বিমান বন্দরে ট্যাক্সি নামিয়ে দিয়ে গেল রাত বারোটা নাগাদ।

চেক-ইন সেরে ইমিগ্রেশন পার হয়ে ভেতরে ঢুকে নিরালা একটা জায়গা দেখে বসে পড়লাম জানলার ধারে। কাচের জানলা দিয়ে দূরে শহরে যাওয়ার হাইওয়ে দেখা যাচ্ছে। শেষ ডিসেম্বরের রাত। হালকা কুয়াশার মধ্যে রাস্তার বাতিগুলো যে-আলো ছড়াচ্ছে, সেটাও আবছা লাগছে।

হঠাৎ মনে হল আমাদের জীবনটাই কেমন যেন আবছা। আলো ছায়া অন্ধকার মেশানো। সঙ্গে সবসময়ই একটা বই থাকে পড়ার জন্যে। কিন্তু পড়তে ইচ্ছে করছিল না। গভীর রাতে যাত্রী সংখ্যাও বেশ কম। দূরে দূরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছেন তাঁরা।

হঠাৎ একটু অস্বস্তি লাগল। ঘরের মধ্যে দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে দেখতে চেষ্টা করলাম, কোনও এমন কিছু চোখে পড়ল না, যাতে এরকম লাগতে পারে। কিন্তু কেবলই মনে হচ্ছে কারও নজরের মধ্যে আছি যেন।

কায়রোর এই বিমান বন্দরটি যাত্রীদের জন্যে অত্যাধুনিক সব রকম আরাম আয়েসের ব্যবস্থা করে রেখেছে। উঠে একটু পায়চারি করে অন্য একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম। এ দিকটায় অনেকগুলো ইজিচেয়ার রয়েছে। সবগুলোতে দূরপাল্লার যাত্রীরা চাদরমুড়ি দিয়ে আধশোয়া হয়ে ঘুমোচ্ছেন। আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে এমন দৃশ্য হামেশাই দেখা যায়। নতুন কিছু নয়। বিসদৃশও নয়। আমার এখনও প্রায় ঘন্টা তিনেক বাকি ফ্লাইটে ওঠার। খালি একটা এরকম চেয়ার পেলে পিঠটাকে টান করে নেওয়া যেত।

ভাবছি। হঠাৎ এক ভদ্রলোক সামনে এসে দাঁড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন, মাফ করবেন আপনি বাঙালি? উত্তরে কিছু বলার আগেই আবার তাঁর প্রশ্ন, আপনি কি খুলনার? মানে বাংলাদেশের খুলনার কথা বলছি।

কেন বলুন তো? খুলনার কাউকে আপনি খুঁজছেন?

না, ঠিক তা নয়। কিন্তু আপনাকে আমার খুব চেনা লাগছে।

আমাকে আপনি চিনবেন কেমন করে! আমি বাঙালি অবশ্যই। তবে প্রবাসী বাঙালি। বহুকাল ধরে, বলতে গেলে সারা জীবনই আমি প্রবাসে আছি।

ভদ্রলোক একটু আনমনা হলেন। খুব আস্তে করে বললেন, আমি চিনি আপনাকে।

আমি হাসলাম। হয়তো আপনার পরিচিত কারও মতো মনে হয়েছে আমাকে দেখে। আমি আপনাকে চিনি না। আমি পেছন ফিরে উলটো দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। সত্যিই ভদ্রলোককে আমার পরিচিত বলে মনে হচ্ছে না। সরে এসে একটু দূরে বসে এবার সঙ্গের বইটি খুলে চোখ রাখলাম।

বাংলাদেশ বিমানের এই ফ্লাইট-এর যাত্রীদের উদ্দেশ্যে অ্যানাউন্স করা হচ্ছে। প্যাসেঞ্জার্স হু আর ট্রাভেলিং বিমান বাংলাদেশ, ফ্লাইট নাম্বার ০২২১, প্লিজ গো টু গেইট নাম্বার বি ২৫। আশেপাশের থেকে অনেকেই সঙ্গের হাতব্যাগ, ট্রলি নিয়ে উঠে রওয়ানা হচ্ছেন নির্ধারিত গেটের দিকে। সামনে দিয়ে যাচ্ছেন কয়েজন একসঙ্গে।

আরে রওশন আরা খানম, নয়? এখানে আপনি? মুখ তুলে তাকাবার সঙ্গে সঙ্গে তার শ্লেষ মিশ্রিত বাক্য, কী-ইই ম্যাডাম, চিনতে পারছেন?

হাতের বইটা বন্ধ করে উত্তর দিতেই হল, না চেনবার কারণ নেই, রায়হান সাবেহান।

বেশ বেশ। বিখ্যাত আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ম্যাডাম, কেমন আছেন? এখানে কেন? বাংলাদেশে যাচ্ছেন?

যাচ্ছি তো কোথাও নিঃসন্দেহে। তবে সেটা বাংলাদেশে না-ও হতে পারে।

তা বটে, তা বটে। সৌভাগ্য আপনি আমাকে মনে রেখেছেন।

হ্যাঁ, এই যে সেজো ভাই, আসেন পরিচয় করিয়ে দেই। ইনি মার্কিন মুলুকে বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে বাঙালি নারী সাংবাদিক। বিখ্যাত। আমাদের মতো ছাপোষা অখ্যাত বাংলা কাগজের সাংবাদিক নন। এনার বিচরণ অন্য লোকে। তাকিয়ে দেখি আমি খুলনার কিনা জিজ্ঞেস করেছিলেন যিনি, সেই ভদ্রলোক!

এবার একটু থমকাবার পালা আমার। এমনিতেই রায়হান সাবেহানের মতো এঁটেল ব্যক্তির সঙ্গে হিসেব করে কথাবার্তা বলা অতীব জরুরি। তীব্র ব্যঙ্গ দিয়ে কথাবার্তা বলে, সে তার গুরুত্ব বোঝাতে খুব পারঙ্গম। তার ওপর বোঝা গেল এরা আত্মীয়। হাত তুলে সালাম দেওয়ার আগেই রায়হান সাবেহান বলল, এর আর একটা পরিচয় দেই সেজো ভাই। ইনি আমাদের শহরেরই মেয়ে।

ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন, অনেকক্ষণ আগে আমি দূর থেকে দেখেই ওঁকে চিনতে পেরেছি। আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি অবশ্য খুলনার কিনা সেটা বলতে চাইছিলেন না। অনেক দিন হয়ে গেল। প্রায় পঞ্চান্ন বছর! রায়হান সাবেহানের মতো ঘাঘু লোকও এবার বাক্যহারা বলে মনে হল। আমি নিজেও।

আপনি কি আমার বড়ো ভাই, কি মামাদের সঙ্গে পড়তেন? মানে আমি ঠিক আপনাকে চিনতে পারছি না।

আমাকে আপনার চেনবার কথাও নয়। তবে আমি আপনাকে চিনি। আমার ডাক নাম তরু। নামটা আপনি শুনেছেন কিনা জানি না অবশ্য। হয়তো শুনে থাকতে পারেন। খুলনায় যান না আপনি কখনও?

হ্যাঁ যাই তো। তবে কম। মানে দেশেই তো আসা হয় না তেমন। তার ওপর এখন আর আমার পরিবারের প্রায় কেউ সেখানে নেই।

হ্যাঁ জানি আমি। আপনাদের সেই বড়ো বাড়িটাও বিক্রি হয়ে গেছে। আমি সবই জানি। আসবেন। খুলনা এলে নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবেন।

মুহুর্মুহু তাড়া আসছে মাইক্রোফোনে তখন নির্ধারিত গেটে যাওয়ার জন্যে। বিমানে যাত্রীদের তোলা শুরু হয়েছে।

হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। যদি খুলনা যাওয়া হয় কোনও সময়। আপনাদের ফ্লাইটে লাস্ট কল দিচ্ছে।

রায়হান সাবেহান একেবারে চুপ। ও একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে একবার ওই ভদ্রলোকের দিকে। ভদ্রলোক নিঃশব্দে হাত তুললেন। প্রত্যুত্তরে আমিও। ওরা এগিয়ে যাচ্ছে গেটের দিকে।

শুনতে পেলাম রায়হান সাবেহানের প্রশ্ন, সেজো ভাই এই তাহলে সেই, যার জন্যে আপনি… বাকি কথাগুলো অস্পষ্ট হয়ে গেল। ভদ্রলোক কিছু বললেন সেটা আর শোনা গেল না। আমিও চুপ করে বসে রইলাম। মনে হল এই তাহলে সেই তরু!

পাত্রী দেখতে এসেছে দুই বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে শুনেই বললাম, যাব না সামনে। শেষ পর্যন্ত বড়ো ভাই, মা-এর চাপে যেতেই হল। বড়ো ভাই বললেন, যা শুধু গিয়ে দাঁড়াবি, আর চলে আসবি। আমি ঠিক তাই করেছিলাম। গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম নীচের দিকে চোখ রেখে। তিন জোড়া পায়ে জুতো দেখেছিলাম।

ওরা বসেছিল। কে কোন জন তাও আমি দেখিনি। আমাকে বসতে বলা হল, বসলাম। একবারও মুখ তুলে তাকাইনি। কয়েক মিনিট পর ওরা বললেন ঠিক আছে, তুমি ভেতরে যাও। আমি চলে এলাম।

তখন বিয়ে সম্বন্ধ আসছে। বাবা নেই। মা অস্থির হয়ে গেলেন মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্যে। বাড়িতে একজনকে পছন্দ করা হল। ওরা ঢাকার। খুলনার এই পাত্রটির বাড়ি থেকে বেশ কয়েকবার এদের বাড়ির বড়ো বউ, মা খালারা এলেন। তাদের ছেলের খুব পছন্দ হয়েছে মেয়েকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিয়ে হয়ে গেল ঢাকাতেই।

আমার বুক ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়ে আপনারা ওকে অন্যত্র বিয়ে দিলেন, এমন একটা কথা বলেছিল এই ছেলে আমাদের বাড়ির কাউকে। আর সেটা নিয়ে বেশ হাসি তামাশাও হয়েছিল আমাদের বাড়িতে।

নুরুল আমিনের সঙ্গে আমার বিয়ে টিকল না। বছর দশেক টানাটানি করে সম্পর্কটা বহাল থাকল বটে কিন্তু সে বছরগুলো ছিল আমার জন্যে এবং আমার পরিবারের জন্যেও এক দুঃসহ সময়। তখন এই তরু নামটি অনেকবার উচ্চারিত হতে শুনেছি বাড়িতে।

বড়ো মামি খুব বলতেন, ছেলেটি ওকে এত পছন্দ করেছিল, ঠিক ওর দীর্ঘনিশ্বাস লেগেছে! কেন ওর সঙ্গে তোমরা বিয়েতে রাজি হলে না গো? এর ঠিক কোনও সদুত্তর ছিল না। মা তখন নিঃশ্বাস ফেলে বলতেন, ভাগ্য। নাহলে ওরা এত অনুরোধ করেছিল।

একটি এনজিওতে কাজ করার সুবাদে ইউরোপে যাওয়া। তারপর জীবন গড়িয়ে গেছে। দু’-দু’বার সংসার পাতার চেষ্টা, কোনওটাই সফল হয়নি। আমিও ভাবি, ভাগ্য। আজ পড়ন্তবেলায় এভাবে এক বিমান বন্দরে দেখা হয়ে যাবে কে জানত! নামটা শুনেছিলাম বহুবার। আজ সে নামের সঙ্গে একটা চেহারা যুক্ত হল। আমার ফ্লাইটের এখনও ঘন্টা দুয়েক বাকি। কাজেই ঢাকা বিমান বন্দরে দেখা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। সেটাই স্বস্তির।

তৃতীয় অঙ্ক

আকাশ মেঘলা থাকায় সামনের সবুজ ঢেউয়ের মতো পাহাড়, পাহাড়ের গায়ে লেপটে থাকা ছোটো ছোটো জনপদ, আঁকাবাঁকা পথরেখা, ইউক্যালিপটাস, সাইপ্রাস আর পাইন বনের শোভা উপভোগ করা যাচ্ছিল না। আচমকা পাহাড়ের ওপর থম মেরে দাঁড়ানো মেঘেরা সরে গেল। নাটকের মঞ্চের মতো কোনও এক অদৃশ্য আলোক পরিকল্পকের অমোঘ ইশারায় মেহগনি ছোপ পড়তে শুরু করল পালানি হিলসের গায়ে। গাঢ় ছায়া সরে গিয়ে ঝলমল করে উঠল কোদাইকানালের পাহাড়।

ঝেড়েঝুড়ে একটা বেঞ্চে বসলাম। পাশের বেঞ্চে মিলিটারি গোঁফওলা এক প্রবীণ খবরের কাগজ পড়ছেন। পাখির দল এসে বসছে গাছে। একটা গাঢ় নিস্তব্ধতার ছায়া চারদিকে। পাহাড়ি অর্কিড আর পাইন গাছের পাতায় লেগে আছে ভেজা শিশির আর মেঘবাষ্প। এখানে গাড়ির মিছিল নেই, মর্নিংওয়াকারের কলরব নেই, হকারের উৎপাত নেই, বাচ্চাদের প্র্যামগাড়ির অত্যাচার নেই– এই পার্ক যেন কোলাহলবিহীন প্রকৃতির এক স্বর্গরাজ্য।

রুনুদার হার্টের আর্টারিতে একটা ব্লকেজ ধরা পড়ায় তড়িঘড়ি চলে আসা হয়েছিল বেঙ্গালুরুতে। রিন্টির এখন উঁচু ক্লাস, প্রাইভেট টিউশন থাকে সপ্তাহ জুড়ে। রিন্টি আসেনি ওর বাবা মায়ের সঙ্গে। তবে অসুবিধে কিছু হয়নি, মা রুনুদাদের ফ্ল্যাটে এসে রিন্টির সঙ্গে আপাতত থাকছে। বেঙ্গালুরুতে ডক্টর আয়েঙ্গার অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করলেন দু’দিন পর। যতটা সময় লাগবে ভাবা হয়েছিল তার আগেই সব মসৃণভাবে হয়ে গেল। ডাক্তারবাবু ওষুধপত্র দিয়ে ছেড়ে দিলেন রুনুদাকে। বলে দিলেন ফ্যাট-ফ্রি ডায়েট চলবে এক বছর আর সামনের বছর চেক-আপের জন্য একবার আসতে হবে তাঁর কাছে।

রুনুদা বেড়াতে ভালোবাসে। ওর ইচ্ছেতে সায় দিয়ে আমরা এসেছি কোদাইকানালে। হোটেলের পাশেই কোদাই লেক। গতকাল একটা গাড়ি ভাড়া করে সিলভার ক্যাসকেড, পিলার রকস আর গ্রিন ভ্যালি ভিউ দেখে বিকেলে আমরা এলাম বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন মানমন্দির সোলার অবজারভেটরিতে। ফেরার পথে ড্রাইভার জানাল সিজন টাইমে কোদাই নাকি টুরিস্টে গিজগিজ করে। নেহাত বর্ষাকাল বলে এখন লোকজন একটু কম।

সাইট সিইং করে রুনুদা একটু টায়ার্ড। মেঘলা মেঘলা দিন, দিদিও বলল হোটেল থেকে বেরোবে না। মশালা ধোসা আর মোটা করে চা খেয়ে সকালে আমি একাই বেরিয়েছিলাম। কিছুক্ষণ হেঁটে যে জায়গাটায় এসেছি এর নাম কোয়েকার্স ওয়াক। সিমেন্টের ফলক দেখে জানা গেল কোয়েকার নামে এক সাহেব দেড়শো বছর আগে কোদাই শহরের মানচিত্র তৈরি করতে এসে এই জায়গাটা দেখে অভিভূত হন। এক কিলোমিটার লম্বা পায়ে চলা পথ বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সেটাই কোয়েকার্স ওয়াক।

তলপেটে চাপ অনুভব করছি কিছুক্ষণ থেকে। গলা খাঁকারি দিয়ে মিলিটারি গোঁফওলা ভদ্রলোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কড়ে আঙুল উঁচিয়ে দেখালাম। তাতে কাজ হল। ভদ্রলোক চশমাটা নাকের ডগায় এনে আমাকে একবার জরিপ করে আঙুল দিয়ে সামনের দিকে ইশারা করে আবার কাগজে মন দিলেন। দেখি রাস্তার ওপাশে একটা একতলা পাকা বাড়ি। ওপরে অবোধ্য তামিল ভাষায় লেখা আছে কিছু। নীচে ইংরেজিতে ‘ইউজ মি’।

ভেতরে এসে দেখি এক দক্ষিণী তরুণী হলদে সিল্কের শাড়ি আর গোলাপি স্টোল গায়ে বসে রয়েছে একটা চেয়ারে। মাথায় সাদা ফুলের গজরা। সামনে একটা কাঠের টেবিল। ওপরে টিনের বাক্স। তামিল আর ইংরেজি দুটো ভাষাতেই লেখা আছে বড় বাইরে করলে খরচ দশ টাকা, ছোটো বাইরে দু’টাকা। পাশাপাশি দুটো ইউরিনাল। একটায় ছবি পাগড়ি পরা গোঁফওলা একজন পুরুষের। পাশেরটায় শাড়ি পরা হাসিখুশি এক মহিলার।

মাঝারি সাইজের কমন চত্বর। দু’দিকে দুটো দরজা। ঠেললে খোলে, আপনা আপনি বন্ধ হয়ে যায়। টয়লেটে ঢুকতেই চমক। সরকারি প্রস্রাবাগার এমন হতে পারে সেটা ভাবিনি। মার্বেলের মতো টাইলের মেঝে। দাগ নেই কোথাও। ঘরের তিন দিকের দেয়াল ঝকঝকে সাদা। ভেন্টিলেটরের মতো একজস্ট ফ্যান ঘুরছে। দেয়ালের সঙ্গে লাগানো গোটা দশেক বেসিন। ওপরে ফিট করা আয়না। সাবানদানিতে শোভা পাচ্ছে সাবান। ইউরিনাল থেকে বেসিন সব জায়গায় দেওয়া আছে দুধসাদা ন্যাপথলিন। সব কিছুই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।

দু’টাকা দিতে গিয়ে বিপত্তি। আমার পার্সে পাঁচ টাকা তো দূরস্থান একটা দশ টাকা অবধি নেই। একটা একশো টাকার নোট এগিয়ে দিতে মেয়েটি তামিলে কিছু বলল। মুখে বিড়ম্বনার একটা ভাব ফুটিয়ে জানালাম খুচরো নেই। মেয়েটি মনে হল যেন ভাবনায় পড়ল। আটানব্বই টাকা সে এখন কী করে ফেরত দেয়! অন্য কেউ হলে নির্ঘাত আমার গুষ্টির তুষ্টি করত। কিন্তু এই মেয়ে রাগ দেখাতে জানে না বোধ হয়। এদিকে আমাকে ফ্রি-তে  ছেড়ে দিতে তার নীতিবোধে বাধছে কোথাও। একটু ইতস্তত করে দক্ষিণী তরুণীর নাম জিজ্ঞেস করলাম।

মেয়েটির চোখেমুখে কিশোরীসুলভ সারল্য, নাম বলল, রাধিকা পিল্লাই।

রাধিকাকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করলাম, একশো টাকা একদিনের জন্য তার কাছে জমা থাক। কাল সকালে কোয়েকার্স পার্কে এসে দু’টাকা খুচরো দিয়ে একশো টাকা ফেরত নিয়ে যাব। নিরুপায় রাধিকা কী ভাবল খানিক। তারপর নিমরাজি হল আমার কথায়।

হোটেলে ফিরে আসার পর কোয়েকার্স পার্কের ঘটনাটা সবিস্তারে বললাম দিদি আর রুনুদাকে। রাধিকার কাছে আমার একশো টাকা জমা রেখে আসার গল্প শুনে দুজনেই খুব হাসল। দিদি বলল, কাল সকালে তাহলে কী করবি? যাবি টাকাটা ফেরত নিতে?

–আলবাত যাব। একশো টাকা কি সস্তা নাকি?

রুনুদা মুচকি মুচকি হাসছে, মেয়েটা কি সুন্দরী নাকি? আমাদের ফেরার টিকিট কিন্তু তিনজনের। একস্ট্রা কাউকে নিয়ে যেতে হলে কোলে বসিয়ে নিয়ে যেতে হবে সেটা মনে রেখো।

পরদিন সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরেই চলে এসেছি কোয়েকার্স পার্কে। রাধিকা বসে আছে মাথায় গজরা ঝুলিয়ে। পরনে কালকের সেই হলদে শাড়ি আর গোলাপি স্টোল। দু’টাকার একটা কয়েন এগিয়ে দিলাম রাধিকার দিকে। হাসল রাধিকা, নিজের বটুয়া থেকে একশো টাকার একটা নোট বার করে আমার দিকে এগিয়ে দিল। কয়েনটা ফেলে দিল টিনের বাক্সে।

টাকাটা পকেটে রেখে জিজ্ঞেস করলাম, এই সরকারি ইউরিনাল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব কি তোমার ওপর?

রাধিকা বলল, সারাদিন নয়। প্রতিদিন ভোর পাঁচটা থেকে সকাল এগারোটা অবধি আমার ডিউটি।

আমি জিজ্ঞাসু, তাহলে তো রাত ফুরোবার আগেই উঠে পড়তে হয় তোমাকে?

রাধিকা ভাঙা ভাঙা হিন্দিতে বলল, অন্ধকার ঘুমন্ত নৈঃশব্দ্যের পাহাড়ি পথে হেঁটে হেঁটে ডিউটিতে চলে আসে সে। ওয়াচম্যান তখন বসে বসেই ঘুমে অচৈতন্য। তাকে না জাগিয়েই দরজা ঠেলে টয়লেটে ঢুকে পড়ে রাধিকা। সমস্ত দেয়াল, মেঝে, আয়না, সাবান আর ফিনাইল দিয়ে ঝেড়েমুছে তকতকে করে রাখে। সব ক’টা বেসিনে লিকুইড সোপ আর ওডোনিল রাখে ঠিক করে। তারপর স্নানঘরে ঢুকে স্নান সেরে পরিষ্কার হয়ে সারাদিনের জন্য সে তৈরি।

–তোমার ভাইবোন নেই?

রাধিকা দু’-চার সেকেন্ড চুপ করে থাকল। হয়তো মনে মনে ভেবে নিল আমার মতো একজন অপরিচিত লোকের কাছে কথাটা বলা যায় কিনা। তারপর বলল, আমার এক দাদা আছে, তার নাম কার্তিক। সে-ই এই টয়লেটের দেখাশোনার দায়িত্ব পেয়েছিল। কিন্তু একটা অ্যাক্সিডেন্টে তার একটা পা হাঁটু থেকে কাটা যায়। অন্য পায়েও বড়ো জখম। ও এখন বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না। ফলে আমাকেই এই দায়িত্ব নিতে হয়েছে। আমাদের এক বোন আছে। ওর নাম পদ্মাক্ষী, কলেজে পড়ে।

–তোমার বাবা কী করেন?

মনে হল রাধিকা একটা শ্বাস বুঝি গোপন করল, আমার বাবা ছিল ড্রাইভার, সরকারি বাস চালাত। লেভেল-ক্রসিং না থাকা রেললাইন পার হতে গিয়ে ট্রেনের সঙ্গে ধাক্বা লেগেছিল বাবার বাসের। হাসপাতালে নিতে নিতেই সব শেষ। আমার বয়স তখন দু’বছর। তখন আমরা চেন্নাইতে থাকতাম।

আনম্যানড লেভেল-ক্রসিং পার হতে গিয়ে কত অ্যাক্সিডেন্ট হয় কাগজে দেখি। একটুক্ষণের জন্য মনটা ভার হয়। এক সেকেন্ড পরেই নিস্পৃহমুখে পাতা উলটে অন্য খবরে চলে যাই। এই মুহূর্তে রেল আর বাসের সংঘর্ষে মৃত বাস ড্রাইভারের একজন মেয়ে আমার চোখের সামনে বসা। সেই কালান্তক সময়ে কী দুঃসহ ঝড় রাধিকাদের ওপর দিয়ে গিয়েছে কে জানে! জিজ্ঞেস করলাম, সরকার ফ্যামিলি পেনশনের ব্যবস্থা করেনি?

–হ্যাঁ করেছিল। দাদার বয়স তখন পাঁচের মতো। পদ্মাক্ষী সবে হয়েছে। ওই অল্প টাকায় আমাদের তিন ভাইবোন নিয়ে মা সংসার চালাতে পারছিল না। তবে ইউনিয়নের লোকেরা সে সময় হেল্প করেছিল। ওদের সাহায্যেই ছ’মাসের মধ্যে মা বাস চালাতে শিখে নিয়েছিল। বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না এক বছরের মধ্যেই মা সিটি-বাস চালাবার চাকরি পেয়ে গেল। চেন্নাইয়ের হাতে গোনা মহিলা বাস ড্রাইভারদের মধ্যে একজন ছিল আমার মা।

অচেনা অদেখা এক মহিলার জীবনযুদ্ধে ঘুরে দাঁড়াবার দুর্জয় সাহস আমাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল ভেতর থেকে। আন্তরিক স্বরে বললাম, তোমার মা-র মনের জোরের কথা শুনে খুব ভালো লাগল। ওঁকে আমার প্রণাম জানিও।

রাধিকা আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। ঠোঁট টিপে বলল, সে উপায় নেই। আমার মা মারা গেছে এগারো বছর আগে।

আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, মানে?

রাধিকা বলল, বাবার মারা যাবার পর বারো বছর ধরে মা আমাদের তিন ভাইবোনকে বড়ো করল। তারপর ঘটল সেই ঘটনা। একদিন মা ডিউটি করে সন্ধেবেলা বাড়ি এল। সেদিন মায়ের চেহারাটা একটু যেন কেমন কেমন। সকাল থেকেই নাকি বুকে ব্যথা। কার্তিক গিয়ে দোকান থেকে গ্যাসের বড়ি কিনে নিয়ে এল। সে ওষুধ খেয়ে কিছু হল না। একটু পরে ব্যথা আরও বাড়ল। যন্ত্রণায় ছটফট করা শুরু করল মা। ডাক্তারকে খবর দিতে দিতেই সব শেষ।

রাধিকার কথায় কী যেন ছিল মনটা দ্রব হয়ে গেল। সেই ভয়ংকর সন্ধের প্রত্যেকটা দৃশ্য চোখের সামনে অভিনীত হতে দেখলাম যেন। এই বিরাট স্বার্থপর পৃথিবীতে তিন কপর্দকহীন নাবালক সন্তানের বেঁচে থাকা যে কতটা কঠিন সেটা অনুমান করাটা শক্ত নয়। আর্দ্র স্বরে বললাম, ইস্ তোমরা তো তখন অথই জলে পড়লে।

রাধিকা বলল, সে তো পড়লাম ঠিকই। চেন্নাই ছেড়ে আমরা চলে এলাম কোদাইতে। মামার ব্যাবসা আছে এখানে। টুরিস্টদের রেলের টিকিট, প্লেনের টিকিট, বাসের টিকিট কেটে দেয়। অনেক লোকের সঙ্গে খাতির আছে। এক পরিচিত অফিসারকে ধরে মামা কার্তিককে ঢুকিয়ে দিয়েছিল এই সরকারি ইউরিনালে। কিন্তু সেটাও আমাদের কপালে সইল না। একদিন ডিউটি করে কার্তিক বাড়ি ফিরছিল। একটা গাড়ি পেছন থেকে এসে ধাক্বা দেয়। খাদে পড়ে যায় কার্তিক। মারাত্মক চোট লাগে তার। একটা পা হাঁটু থেকে কেটে বাদ দিতে হয়েছিল। ওর জায়গায় আমি ঢুকেছি কয়েক মাস আগে।

আমাদের কথার মধ্যেই টুকটাক লোকজন দেখি টয়লেটে আসছে যাচ্ছে। টিনের বাক্সে কয়েন ফেলে দিয়ে যাচ্ছে প্রত্যেকে। রাধিকা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে আপনার জামাইবাবুর?

জানালাম, হার্টের সমস্যা ছিল। বেঙ্গালুরুর এক হসপিটালে অপারেশন করা হয়েছে। এখন ভালো আছে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন সামনের বছর চেক-আপের জন্য আর একবার আসতে হবে।

রাধিকা স্মিতমুখে বলল, তাহলে তো ভালোই হল। সামনের বছর আপনারা সকলে বেঙ্গালুরু থেকে কোদাইতে চলে আসবেন। বারো বছর পর পর পালানি পাহাড়ে ফোটে করৌঞ্জি ফুল। সামনের বছর আবার সেই ফুল ফুটবে। সে এক অসাধারণ দৃশ্য।

আমি হেসে বললাম, কাল আমরা মুরুগানের মন্দির গিয়েছিলাম। সেখানেও তো প্রচুর করৌঞ্জি গাছ রয়েছে দেখলাম। তবে ফুল ফোটেনি সে গাছে।

রাধিকা বলল, বললাম যে ফুল ফুটবে সামনের বছর। আসলে করৌঞ্জি ফুল দেবতা মুরুগানের খুব প্রিয়। দেবতা মুরুগানের ছয় অধিষ্ঠানের একটা আমাদের এই পালানি পাহাড়ে। আপনারা মুরুগানকে চেনেন কার্তিক হিসেবে। দক্ষিণ ভারতে তিনি ইন্দিবর নামে পরিচিত। ইন্দিবর মানে হল পাহাড়ের অধীশ্বর।

আমি হাসলাম, আমাদের গাড়ির ড্রাইভারের মুখে শুনেছি করৌঞ্জি ফুল কোদাইয়ের সৌভাগ্যের প্রতীক।

রাধিকা ঘাড় নাড়ল, আমাদের ফ্যামিলিতে ব্যাপারটা উলটো। আমার বাবা যখন মারা যায় সেবার করৌঞ্জি ফুল ফুটেছিল পালানি পাহাড়ে। ঠিক বারো বছর পর আমার মা মারা যায়। পরের বছর আবার করৌঞ্জি ফুল ফুটবে। আমাদের আবার কী ক্ষতি হবে কে জানে!

রাধিকার কথায় ঝাঁকি খেয়েছি একটু। মনে মনে অঙ্ক কষে ফেললাম। হ্যাঁ ঠিকই তো। ওর বাবা মারা যাবার ঠিক বারো বছর পর ওর মা-র মৃত্যু হয়েছিল। তারপর এগারো বছর কেটে গেছে। সামনের বছর আবার করৌঞ্জি ফুল ফুটবে পালানি পাহাড়ে। তাহলে কি সামনের বছর কার্তিকের জন্য একটা বড়ো ফাঁড়া অপেক্ষা করে আছে? মুখে সেই উদ্বিগ্ন ভাবটা ফুটতে দিলাম না। ঘাড় ঝাঁকিয়ে বললাম, ধুস এটা নেহাতই কাকতালীয় ব্যাপার। ওসব নিয়ে উলটোপালটা ভেবে দুশ্চিন্তা কোরো না।

–আপনি আমাদের পরিবারের লোক হলে টেনশনটা বুঝতেন। কী হাসিখুশি ছেলে ছিল কার্তিক। প্রচুর পরিশ্রম করতে পারত। দারুণ ফুটবল খেলত। সেই ছেলে এখন শুয়ে থাকে বিছানায়। কার্তিকের ট্রিটমেন্ট চালাতে গিয়ে মামার জমানো টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছে জলের মতো। তাছাড়া… রাধিকা কথাটা বলবে কি বলবে না ভেবে শেষে বলেই ফেলল, তাছাড়া আমার বিয়েতেও তো অনেক টাকা লাগবে। মামা যে কী করে সবকিছু সামাল দেবে কে জানে!

আমি হাসলাম, কবে তোমার বিয়ে?

– সামনের বছর মাঝামাঝি হতে পারে। রাধিকা একটু লজ্জা পেল, তবে ডেট এখনও ঠিক হয়নি।

আমার কৌতূহল একটু বাড়ল, ডোন্ট মাইন্ড প্লিজ, কী করে তোমার উড বি?

– ওর নাম মুরলিধর আইয়ার। তামিল ব্রাহ্মণ। কর্পোরেশন অফিসে চাকরি করে। ওর বাবা সরকারি চাকরি করত। কোদাইতে ওদের নিজেদের বাড়ি আছে।

–কনগ্র্যাচুলেশনস রাধিকা। আমি বললাম, কিন্তু একটা কথা তোমাকে না বলে পারছি না। তোমাদের মুরুগান কিন্তু বেশ রসিক দেবতা। তিনি রাধিকার জন্য খুঁজে খুজে ঠিক একজন মুরলিধর জোগাড় করে দিয়েছেন।

রাধিকার মুখে আবির ছিটিয়ে দিল কেউ। লজ্জা পেয়ে বলল, আমার বন্ধুরা তো এই বলেই আমার পেছনে লাগছে সারাক্ষণ।

আমি হাসছি। রাধিকা কেজো গলায় বলল, আপনার ঠিকানাটা লিখে দিয়ে যান এই কাগজটায়। আপনার বাড়িতে বিয়ের কার্ড পোস্ট করে দেব।

–ঠিকানা আর ফোন নম্বর দুটোই লিখে দিয়ে যাচ্ছি। সামনের বছর যখন কোদাই আসব তখনই যদি তোমার বিয়ের তারিখটাও পড়ে যায় তাহলে কথা দিচ্ছি পুরো কবজি ডুবিয়ে ভোজ খেয়ে যাব!

রাধিকা বলল, আমাদের আমিষ চলে না। আপনার ভেজ থালিতে আপত্তি নেই তো?

আমি বললাম, একেবারেই আপত্তি নেই। সত্যি বলতে নিরামিষই আমি ভালো খাই। তাছাড়া সাউথ ইন্ডিয়ান ডিশ তো আমার ভীষণ পছন্দের।

রাধিকা হেসে ফেলল আমার কথায়।

রাধিকার বিয়ের কার্ড পাইনি। খুব যে প্রত্যাশা ছিল তা অবশ্য নয়। কোথাও বেড়াতে গিয়ে কত লোকের সঙ্গেই তো আলাপ হয়। ফোন নম্বরও বদলাবদলি হয়। কিন্তু ব্যস্ত নাগরিক জীবনে যত একটার পর একটা দিন চেপে বসে তত সেসব আপাতসখ্যের জোড় আলগা হয়ে যায়। ফোন আর করা হয়ে ওঠে না কাউকেই। এক্ষেত্রেও তাই হল। স্বস্থানে ফিরে আসার পর রাধিকার কথা একরকম ভুলেই গিয়েছিলাম। ফের মনে পড়ল বেঙ্গালুরু থেকে কোদাইকানাল যাবার বাসের সিটে বসে। এখন কেমন আছে রাধিকা? বিয়ের পর চাকরিটা কি করছে এখনও? কোদাই গিয়ে ওর দেখা মিলবে তো? মনটা হঠাৎ উচাটন হল রাধিকার কথা ভেবে।

বেঙ্গালুরুতে রুণুদাকে নিয়ে চেক-আপে আসা হয়েছিল। ডক্টর আয়েঙ্গার পরীক্ষানিরীক্ষা করিয়ে সার্টিফিকেট দিলেন সবকিছুই নর্মাল। রুনুদা এখন যাকে বলে ফাইটিং ফিট। সেদিন সন্ধেবেলা হোটেলের ঘরে বসেই ঠিক হল আমরা আবার কোদাইকানালেই যাব। দীর্ঘ এক যুগ পর আবার করৌঞ্জি ফুল ফুটবে কোদাই পাহাড়ের উপত্যকা জুড়ে। সেটা মিস করা যাবে না কিছুতেই।

কাল পৌঁছেছি কোদাইতে। আজ সকাল থেকে আকাশ মেঘে ঢাকা। সঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো বৃষ্টি। তার মধ্যেই আমরা বেরিয়েছি গতবার যে জায়গাগুলো দেখা হয়নি সেগুলো দেখতে। প্রথমে শোলা ফরেস্টে গিয়েছিলাম। এখানেই আছে পাম্বার ফল্স। সেখান থেকে এলাম বেরিজাম লেকে, যে হ্রদ থেকে পানীয় জল সরবরাহ করা হয় কোদাই শহরে। সারাদিন ধরে আকাশ গোমড়া থাকার পর বিকেলের দিকে আকাশ পরিষ্কার হল। আমাদের ড্রাইভার নিয়ে এল এদিকের বিখ্যাত লা সালেথ চার্চে।

ফিরে আসছিলাম যখন তখন বিকেল। একটা জায়গায় ঘ্যাস্স করে গাড়ি দাঁড় করাল ড্রাইভার। গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আমাদের তিনজনের চোখ স্থির হয়ে গেল। পাহাড়ের চুড়োতে পাইন গাছগুলোর মাথায় উঁকি মারছে নীল আকাশ। বর্ষার ধূসর মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে সেই আকাশে। সূর্য উঁকি দিচ্ছে মেঘের ফাঁক দিয়ে। সোনালি রোদ এসে পড়েছে উপত্যকায়। সৃষ্টি হয়েছে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। মায়াবী নীলচে বেগুনি আলো বিছিয়ে আছে গোটা উপত্যকা জুড়ে।

আগে পিছে আরও অনেকগুলো গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে। খাদের একেবারে ধারে হাঁটু গেড়ে বসে এসএলআর ক্যামেরা তাক করে আছে এক বিদেশিনি। ওদিকে একটা জটলা। এক গাইডকে ঘিরে রেখেছে কিছু মঙ্গোলয়েড মুখের পর্যটক। সেই দক্ষিণ ভারতীয় গাইড টিপিকাল সাউথ ইন্ডিয়ান অ্যাকসেন্টের ইংরেজিতে বলছে, দীর্ঘ এক যুগের প্রতীক্ষার অবসান হয়েছে। দেবতা মুরুগান তাঁর করুণা বর্ষণ করেছেন পালানি পাহাড়ের উপত্যকায়।

প্রকৃতি বোধ হয় সেই আয়না যার মধ্যে দিয়ে ঈশ্বরের অবয়ব ধরা পড়ে। দিদি কেঁদে ফেলল এই অলৌকিক দৃশ্য দেখে। প্র্যাক্টিক্যাল ম্যান রুণুদা প্রকৃতির রূপ দেখে বিহ্বল। আমাদের ড্রাইভার, যে কিনা স্থানীয় মানুষ, সে পর্যন্ত হাঁ।

রাশি রাশি করৌঞ্জি ফুলের দল যেন নীলচে বেগুনি রং দিয়ে হোলি খেলছে এখানে। এমন অপার্থিব দৃশ্য দেখার জন্য একশো মাইল হেঁটে আসা যায়। বড়ো একটা শ্বাস ফেললাম। এই অপার্থিব সৌন্দর্যের এক আনাও যদি ক্যামেরাবন্দি করা যেত!

এবার আমরা কোয়েকার্স পার্কের দিকে এগোচ্ছি। সেখানে কিছুক্ষণ কাটিয়ে সোজা হোটেলে ফিরব। পার্ক লাগোয়া সেই সরকারি টয়লেটে রাধিকার ডিউটি ছিল ভোররাত থেকে দুপুর পর্যন্ত। এই পড়ন্ত বিকেলে কি ওর দেখা পাব? তাছাড়া বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে দিয়েছে কিনা সেটাও তো জানা নেই।

ড্রাইভার গাড়ি পার্ক করল। দিদি আর রুণুদা টিকিট কেটে কোয়েকার্স পার্কের ভেতরে ঢুকল। আমি গেটের উলটোদিকের সরকারি টয়লেটের দিকে তাকালাম। বছরখানেক বাদে এলাম কিন্তু একদম একই আছে সেই ছোট্ট পাকা বাড়িটা।

রাধিকা নয়, নীল সিল্কের শাড়ি পরা এক কিশোরী বসে রয়েছে চেয়ারে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। ভাবলেশহীন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, টু রুপিজ ফর ইউরিনাল। টেন ফর টয়লেট।

বিনা ভূমিকায় সরাসরি প্রশ্ন করলাম, রাধিকা পিল্লাই নামে একজন সকালের শিফটে ডিউটি করত এখানে। তার সঙ্গে একটু দেখা করতে চাই। ওর ডিউটি কি সকালবেলাতেই আছে এখনও?

মেয়েটি ভুরু কুঁচকে আমাকে দেখল একটুক্ষণ। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল, হাও ডু ইউ নো রাধিকা?

রাধিকার সঙ্গে আমার এই সরকারি ইউরিনালে কীভাবে আলাপ হয়েছিল সেটা ভেঙে বললাম। নীল শাড়ি কিশোরী বলল, আমার নাম পদ্মাক্ষী। আমি রাধিকার ছোটো বোন। মর্নিং কলেজ করে এখানে চলে আসি। দুপুর থেকে সন্ধে পর্যন্ত আমিই এখানে ডিউটি করি।

প্রশ্নের বাণ ছুড়লাম পদ্মাক্ষীর দিকে, রাধিকা বিয়ের পর কাজ ছেড়ে দিয়েছে? নাকি সকালের শিফটে আছে এখনও? কার্তিক কেমন আছে এখন?

লক্ষ্য করলাম পদ্মাক্ষীর মুখে কেমন একটা ভাঙচুর হচ্ছে। চোখ ভিজে উঠছে জলে। আঙুল ইশারা করে পাশের দেয়ালে দিক নির্দেশ করল পদ্মাক্ষী।

সাদা ফুলের মালা দেওয়া রাধিকার একটা ফটো টাঙানো রয়েছে দেয়ালে। চোখ যে দৃশ্য দেখল তার ছবি পাঠাল মস্তিষ্কে। কিন্তু মস্তিষ্কের ধূসর অংশ সেই সিগনালের মানে করতে পারল না। বিমূঢ় গলায় বললাম, এটা কেন টাঙিয়ে রেখেছ এখানে?

পদ্মাক্ষী নিজেকে সংযত করল চোয়াল শক্ত করে। তারপর যা শোনাল তার জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না।

কয়েক মাস আগে এক ফরেনার কোয়েকার্স পার্কে ফটো তুলছিল। চারজন মাতাল ক্রমাগত বিরক্ত করে যাচ্ছিল সেই বিদেশিনিকে। মহিলা তার প্রতিবাদ করায় দু-তরফে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। ঝামেলা বাড়ে একটু একটু করে। এক সময় মদ্যপের দল সেই মহিলাকে টেনে নিয়ে যায় পার্কের ভেতর। পার্কে যে দু-একজন ছিল তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল ঘটনাটা। শুধু একজন ছাড়া। শান্তশিষ্ট মেয়ে বলে যাকে সকলে চিনে এসেছে এতদিন, সেই রাধিকা দৌড়ে গিয়েছিল পার্কের ভিতর। ততক্ষণে সেই বিদেশিনিকে বিবস্ত্র করে ফেলেছে লোকগুলো।

আমি রুদ্ধশ্বাসে বললাম, তারপর?

–একটা ইট কুড়িয়ে নিয়ে রাধিকা ছুড়েছিল ওদের দিকে। একজনের মাথায় গিয়ে লাগে সেটা। ইটটা কুড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে আসে লোকটা। কাছে এসে ঠান্ডা মাথায় থেঁতলে দেয় রাধিকার মাথা। কানের নীচে আঘাত লাগায় সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারায় রাধিকা। লোকগুলো পার্ক ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কেউ তাদের আটকাবার সাহস দেখায়নি। রাধিকাকে নিয়ে যাওয়া হয় কোদাই হসপিটালে। পরদিন বিকেলেই তার লড়াই শেষ হয়ে যায়।

মাথাটা শূন্য হয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। পদ্মাক্ষীর মুখোমুখি ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। নিভে যাওয়া গলায় বললাম, ওই ছেলেগুলির কী হল? অ্যারেস্ট হয়নি ওরা?

–পুলিশ ধরেছে চারজনকে। সেই মহিলা ফ্রান্সের হিউম্যান রাইটস সংক্রান্ত একটা এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত। পুলিশ থেকে টিআই প্যারেডের ব্যবস্থা করেছিল। সেখানে সেই মহিলা আইডেনটিফাই করেছে প্রত্যেককে। স্থানীয় আদালতে সাক্ষ্যও দিয়েছে। সেই মহিলা বলেছে এর শেষ দেখে ছাড়বে। লোয়ার কোর্টে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে গেলে হাইকোর্টে যাবে।

ফটোটার দিকে বিহ্বল হয়ে তাকালাম। চব্বিশ বছর আগে রাধিকা হারিয়েছিল তার বাবাকে। বারো বছর আগে মারা যায় তার মা। এ বছর আর সকলের মতো রাধিকা নিজেও কার্তিকের জন্য উদ্বিগ্ন ছিল। কিন্তু নাটকের তৃতীয় অঙ্কে কী ঘটতে চলেছে তা কি আঁচ করেছিল ওদের পরিবারের কেউ? তার নিজের জীবন যে এভাবে শেষ হয়ে যাবে সেটা কি ঘুণাক্ষরেও টের পেয়েছিল রাধিকা? পারেনি। আসলে এই পুতুলনাচের সব সুতো হয়তো দেবতা মুরুগানের হাতে। যেমন টানেন তেমন নাচে মর্ত্যলোকের পুতুলের দল। নইলে সেদিন শান্তশিষ্ট রাধিকা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেন ছুটে গিয়েছিল পার্কের ভেতর? তাও আবার এমন একজনকে ধর্ষকদের হাত থেকে বাঁচাতে, যাকে সে জন্মে দেখেনি!

ধীর পায়ে বাইরে এসেছি। অন্যমনস্ক হয়ে কোয়েকার্স পার্কে ঢুকেছি। খানিকটা হাঁটার পর এক জায়গায় এসে দাঁড়ালাম। এই ভিউপয়েন্ট থেকে উপত্যকার অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায়। এখন যতদূর দৃষ্টি যায় সামনে নীল মেশানো বেগুনি রঙের এক অপরূপ প্রপাত। মেঘের ফাঁক দিয়ে গুনে গুনে ঠিক তিনটে আলোর রেখা এসে পড়েছে পাহাড়ি উপত্যকায়। ভারি অদ্ভুত লাগছে ভ্যালিটাকে। প্রগাঢ় আঁধার আর হিরণ্যবর্ণ রোদের জাফরিকাটা আলোছায়াতে গোটা পাহাড়ি উপত্যকাটাকে মনে হচ্ছে যেন নাটকের মঞ্চ।

নাটকের মঞ্চই তো। তবে এই নাটকের নিয়মটা একটু অন্যরকম। এখানে একবার যবনিকা পড়লে আবার পর্দা ওঠে ঠিক একযুগ পরে।

মৃত তারার আলো

অনেকদিন থেকেই ঘ্যানঘ্যান করছিল শৌনক। এতদিন এটা ওটা বলে দেওরকে পাশ কাটিয়ে এসেছে নিবেদিতা। সৌমেনেরও ইচ্ছে ছিল না এতদূরে স্রেফ বেড়াতে আসার। এমনিতেই সে উদ্ভিদ গোত্রের মানুষ। একবার যেখানে শিকড় চালিয়ে বসল সাধ্য কার তাকে সেখান থেকে নড়ায়। কলেজ থেকে ফিরে চা জলখাবার খেয়ে ল্যাপিতে ফেসবুক খুলে সেই যে একবার বিছানায় আধশোওয়া হল, তারপর বোধহয় ঘরে আগুন দিলেও তার হুঁশ ফেরানো যাবে না। বন্ধুরা টিটকিরি দেয় ক্রিকেট খেললে সে নাকি অনায়াসেই রাহুল দ্রাবিড় হতে পারত। বেডিং বেঁধে বসে যেত ক্রিজে। আচ্ছা আচ্ছা ফাস্ট বোলারের কালঘাম ছুটে যেত তাকে টলাতে।

সৌমেনকে নিয়ে এক একবার নিজেরও বিরক্তি ধরে নিবেদিতার। মনে পড়ে যায় কলেজ লাইফের এক্সারশনের দিনগুলোর কথা। শুধু নতুন নতুন জুলজিক্যাল স্পিসিসই নয় বলতে গেলে সেই ক’টা দিনই যেন তাকে এক নতুন পৃথিবীরও খোঁজ দিয়েছিল। দুটো বছর দেদারে ঘুরেছে তারপর। দীঘা, জুনপুট বা হাজারদুয়ারির সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়লে একান্তে আজও আনমনা হয়ে যায় সে। জুনপুটের সেই রাত। হাজার বছর অতীতের মৃত তারাদের আলোতে মাখামাখি চিকচিকে বালির বিছানায় শুয়ে গ্রহান্তরের গল্প শোনা…

এইরকম সময় কতবার মনে হয়েছে নিবেদিতার, যদি তারা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ত বা প্রফেশনাল কোনও কোর্স তাহলে বাড়িতে বলে কয়ে হয়তো আটকে রাখা যেত আরও দু’ একটা বছর। ছুটির দিনে সৌমেন যখন অনেক রাত অবধি হুইস্কি নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে হুল্লোড় করে তখন আরওই ফাঁকা ফাঁকা লাগে। প্রায় মাঝরাতে সৌমেনের বেঁহুশ বেসামাল শরীরটা টলতে টলতে এসে ধপ করে পড়ে যায় বিছানায়। প্রাণপণে নাক মুখ কুঁচকে শুয়ে থাকে নিবেদিতা। সেই মুহূর্তেই মনে পড়ে যায়– ছ’বছরেরও বেশি হয়ে গেল বিয়ে হয়েছে তাদের।

শৌনককে দেখে তাই আরওই ভাবে নিবেদিতা– সৌমেনেরই তো আপন ভাই। কিন্তু একেবারে অন্য মেরু। ইলেকট্রিক্যালে বি.টেক করার পর প্রায় বছরখানেক বসেছিল বাড়িতে। ক্যাম্পাসিংয়ে চাকরি পায়নি। পাগলের মতো পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছিল সরকারি চাকরির। একদিন হুট করেই ডিভিসির চিঠি এল। এখন এক্সিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের পদে রয়েছে শৌনক। দু’ বছর চাকরি করার পর এই সবে গেল বছর বিয়েও করেছে। কলেজের ইয়ারমেট অঙ্গনাকেই।

সেম এজে বিয়ে করলে শৌনক, অঙ্গনাকে চোখ টিপে বলেছিল নিবেদিতা, অঙ্গনা তোমায় মানে তো? নাকি বউয়ের কথায় উঠছ বসছ আজকাল?

এসব আবার কী কথা বউদি, শৌনকের কথার সুরে বিস্ময়, ফ্র্যাংকলি স্পিকিং, তোমার কাছে এমনটা এক্সপেক্ট করিনি আমি…

অঙ্গনা অবশ্য বুঝেছে। শৌনককে রাগাচ্ছে নিবেদিতা। সেও হাসছে বড়ো জায়ের কথায়। কিন্তু শৌনক হঠাৎ সিরিয়াস, দ্যাখো, হোল ওয়ার্ল্ড খুঁজলেও কখনও এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যার সঙ্গে আমার একেবারে হুবহু মেলে। যে দশটা জিনিস আমার চয়েসে একদম এক্সেলেন্ট তার দশটাই কখনওই অঙ্গনার পছন্দ হতে পারে না। ওরও সব ডিসিশন আমার ঠিক মনে হবে এমন নয়। দেখতে হবে ফ্রিকোয়েন্সি ম্যাচ করছে কিনা। ওটা হলেই কাফি। তারপরে একটা লিবারাল স্পেস রাখতে হবে। আমাকে তুমি চেঞ্জ করতে আসবে না কখনও। আমিও যাব না তোমার যেসব ব্যাপার আমার অপছন্দ তাতে ইন্টারফেয়ার করতে…

আমরা কেউ কাউকে ডমিনেট করতে যাই না দিদি, এবারে মুখ খোলে অঙ্গনা, ওর এই মেন্টালিটিটাই আমার ভালো লেগেছিল কলেজে প্রথম মিশতে গিয়ে। ইনফ্যাক্ট আমিই শৌনকের চাইতে মাস তিনেকের বড়ো। বাড়িতে অ্যাজ ইট ইজ একটা হালকা আপত্তিও ছিল তাই। কিন্তু আমি কেয়ার করিনি। বলেই দিয়েছিলাম বিয়ে করতে হলে শৌনককেই করব। আর ওকে যদি ভুলে যেতে হয় আমায়, দেন ইউ অলসো ফরগেট অ্যাবাউট মাই ম্যারেজ ফর এভার…

অঙ্গনার কথা শুনতে শুনতে ভাবছিল নিবেদিতা– সবাই তো আর অঙ্গনা হতে পারে না।

তা বলে লিবারাল স্পেসের মানে এই নয় যে অঙ্গনা কারুর সঙ্গে শুতে চলে গেলে আমি টলারেট করব, বেশি সিরিয়াস হয়ে গেলে শৌনক যে আর আলগা ভদ্রতার ধার ধারে না অনেকবারই টের পেয়েছে নিবেদিতা। চশমাটা চোখ থেকে নামিয়ে বলে যায় সে, তেমন আমিও যদি প্রায়দিনই ড্রিংক করে রাস্তায় গড়াগড়ি দিই ও অফকোর্স সেটা হজম করবে না।

অঙ্গনার কাছে শুনেছে নিবেদিতা। শৌনকও মদ খায়। মাঝেমধ্যে অনেকটাই। কিন্তু অদ্ভুত সীমা রেখে।

বিয়ের এক বছরের মাথায় দিনকয়েকের ছুটিতে কলকাতার বাড়িতে এসে উঠেছিল শৌনক আর অঙ্গনা। তখনই হয়েছিল এত কথা। নিবেদিতা হঠাৎ অকারণেই বলে উঠেছিল, না আসলে সেম এজে বিয়ে তো বেশি হয় না। এখন অবশ্য হচ্ছে কিছু। আর তোমরা যেমন একজন আরেকজনের জন্যে ওয়েট করে বসেছিলে তেমনও হয় না ম্যাক্সিমাম কেসে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায় আগেই। কলেজ লাইফের প্রেম টেকে খুব রেয়ার…

আরও কিছু হয়তো বলে ফেলতে যাচ্ছিল নিবেদিতা। কিন্তু সামলে নিল শেষ মুহূর্তে।

আমার কিন্তু তা মনে হয় না। আমাদের ক্লাসে ইনক্লুডিং আমি আর অঙ্গনা মোট সাতটা পেয়ার ছিল। পাঁচটা পেয়ারেরই বিয়ে হয়েছে। ফেলিওর মাত্র দুটো… বউদির কথার জবাবে বলে উঠেছিল শৌনক।

শৌনক, একটা কথা বলি এখানে, দিদির কথাটা আমি একেবারে কনডেম করব না, শৌনককে থামিয়ে দিয়ে এবারে বলেছিল অঙ্গনা, দেখ, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বাকিদের কমপেয়ার করলে চলবে না। দিদি যেটা বলছেন সেটাও ঠিক। জেনারেল গ্র্যাজুয়েশনের পর পরই একটা ছেলে চাকরি পেয়ে যায় খুব কমই। ক’ বছর লাগবে তার এস্টাব্লিশড হতে কোনও শিওরিটি নেই। আর মেয়েদের মোটামুটি গ্র্যাজুয়েশন হয়ে গেলেই বাড়ি থেকে বিয়ের কথা ভাবতে শুরু করে। তাই সিরিয়াস থাকলেও অনেক মেয়ে বাড়ির প্রেশারে অ্যাট লাস্ট ভেঙে পড়ে। একটা ইঞ্জিনিয়ার ছেলের জন্য বরং মেয়ের বাড়ি তাও বছরখানেক ওয়েট করতে রাজি থাকে…

হ্যাঁ এটা অবশ্য ঠিক। আমি ভাবিনি এ দিকটা, স্বীকার করেছিল শৌনক।

অঙ্গনার কথা শুনতে শুনতে অস্বস্তি হচ্ছিল নিবেদিতার। মেয়েটা যথেষ্ট স্মার্ট। কলেজ ক্যম্পাসিংয়ে শৌনকের আগেই চাকরি পেয়ে গিয়েছিল। সেক্টর ফাইভের একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে। বিয়ের পর চাকরি ছেড়ে না দিলে এতদিনে আরও উঁচুতে উঠতে পারত। হাঁ করলে হাই ধরতে পারে এসব মেয়েরা। নিবেদিতার কথায় কি কিছু আন্দাজ করে ফেলল মেয়েটা? এই প্রসঙ্গটা এখন তুলতে না গেলেই হয়তো ভালো হতো।

ছুটি শেষে অফিসে ফেরার আগে বরাবরের মতোই দাদা বউদিকে কয়েকদিনের জন্য ডিভিসি ঘুরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিল শৌনক। এবারে আর সে একা নয় খুব ধরেছিল অঙ্গনাও, একদিনের জন্যে মাইথন খুব ভালো আউটিং হবে দাদা। ডিভিসির ব্যারেজ, ডিয়ার পার্ক, দামোদরে বোটিং। খুব ভালো লাগবে…

হ্যাঁ, টানা দিন তিন চারেকের লিভ পেলেই যাব। শৌনকও বলছে অনেকদিন থেকেই। যাব এবারে অফকোর্স, চেলো রাইসের প্লেট থেকে এক টুকরো মাটন কাঁটায় গেঁথে নিতে নিতে বলেছিল সৌমেন।

পিটার ক্যাটের সোফায় বসে বসে ভাবছিল নিবেদিতা। শৌনকরা চলে গেলেই মাইথনের কথাও বেমালুম ভুলে যাবে সৌমেন। আর অন্তত এই একটা কথা কখনও তাকে মনে করিয়ে দিতে চায় না নিবেদিতাও।

কিন্তু মানুষ ভেবে রাখে এক আর হয় আর এক। কলকাতার হেড অফিস যে আচমকা সৌমেনকে দুর্গাপুর এনএসএইচএম-এর ম্যানেজমেন্ট বিভাগের হেড করে সেখানে বদলি করতে চলেছে সে কথা সৌমেন নিজেও জানতে পারেনি সপ্তাখানেক আগেও। দুর্গাপুরের কলেজে এতদিন যিনি ওই বিভাগের দায়িত্ব সামলাচ্ছিলেন সেই প্রফেসরের আকস্মিক মৃত্যুতেই সংস্থা বিপাকে পড়ে। আর যেসব ম্যানেজমেন্টের ফ্যাকাল্টি রয়েছে ওখানকার কলেজে বয়স বা অভিজ্ঞতা কোনওটার ভিত্তিতেই তাদের কাউকেই এই দায়িত্ব দিতে চাইছিল না হেড অফিস। অগত্যা কলকাতার কলেজ থেকে অন্তত কোনও অ্যাসোসিয়েট প্রফসরকেও বদলি করতেই হতো। দায়িত্বটা স্বভাবতই এসে পড়ল সৌমেন সর্বাধিকারীর ঘাড়ে। তবে আশ্বাস মিলল, বছর দুয়েক বাদে তাকে আবার কলকাতাতেই ফিরিয়ে আনা হবে। মুরারীপুকুরের বাড়ি কেয়ারটেকারের জিম্মায় রেখে অগত্যা সৌমেন আর নিবেদিতাকে চলে আসতে হল দুর্গাপুর। ভিরিঙি মোড়ের কাছাকাছি নাচন রোডে একটা ভালো বাড়ি ভাড়া পাওয়া গেল।

দুর্গাপুরে আসার সপ্তাখানেকের মধ্যেই একদিন ডিনারে বসে সৌমেন নিজেই বলল, বুঝলে নিবু, অনেকদিন থেকেই শৌনক বলছে তাছাড়া সেবার আমাদের ওখানে গিয়ে অঙ্গনাও খুব রিকোয়েস্ট করছিল, তা ভাবছি এত কাছে যখন এসেই পড়তে হল একবার ওদের ওখান থেকে ঘুরেই আসি। তুমি কী বলো? তাছাড়া এমনিও আমরা সেই হনিমুনের পরে আর বাইরে কোথাও যাইনি। শৌনককে জানিয়ে দিই যে আমরা একটা শনিবার দেখে যাচ্ছি…

ভাতের দলা মুখে তুলতে গিয়ে সহসা নিথর হয়ে গেল নিবেদিতা। দুর্গাপুরে এসে এখনও কলিগদের সঙ্গে সেভাবে সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি সৌমেনের। শনি-রোববারের সন্ধেগুলোয় তাই আর হুইস্কির আসর বসেনি এখনও অবধি। অথবা এমনও হতে পারে– সৌমেনের মনে হয়েছে এতদিন সে ছিল এক সাধারণ ফ্যাকাল্টি। কিন্তু আজ সে ডিপার্টমেন্টাল হেড। জুনিয়র ফ্যাকাল্টিদের আগের মতোই বাড়িতে ডেকে আনাটা শোভন না-ও দেখাতে পারে। তাছাড়া এসব দিক বাদ দিলেও নতুন জায়গায় এসে সৌমেন হঠাৎ সংসারের খুঁটিনাটি বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন হয়ে উঠেছে। নতুন বাসা কিভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে নেবে সেই ব্যাপারে আজকাল মাথাও ঘামাচ্ছে বেশ। সন্ধেগুলো আর ফেসবুক নিয়ে কাটায় না সেইভাবে। এতদিনে যদি সে স্ত্রীর একাকিত্বজনিত একঘেয়েমিকে একটুও উপলব্ধি করে থাকে, তবে সে তো খুবই আনন্দের বিষয়। কিন্তু নিবেদিতা আচমকা কোনও জবাব দিতে পারল না সৌমেনের কথায়। মাথা নীচু করে আবার মাছের কাঁটা বাছতে লাগল।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে অপরাধীর মতো গলায় সৌমেন আবার বলতে থাকে, আমি বুঝেছি তোমার ব্যাপারটা। আসলে কি জানো, কলকাতায় অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল। বাড়িতে ছিল চব্বিশ ঘণ্টার কাজের লোক। আর বাড়ির যা কিছু টুকিটাকি সব মা-বাবাই গুছিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন। সংসারের কোনও দিকে যে মাথা ঘামানোর দরকার আছে আমার সেই কথাটাই তাই এতকাল খেয়াল হয়নি সেভাবে। কিন্তু এখানে এসে নতুন বাড়িতে ঢুকে ফিল করলাম অনেক কিছু গোছগাছ করতে হবে নিজের মতো করে। আর আমার নিজেকেই এবার অনেক দায়িত্ব নিতে হবে। তখনই ফিল করতে পারলাম তোমার কেসটাও। আমি তো সকালে উঠে এতদিন কলেজে চলে গেছি। সারাটা দিন কলেজে কাটিয়ে বাড়ি ফিরে আবার নিজের জগতে ঢুকে গেছি। কিন্তু সারাদিন তুমি…

সৌমেনের কথা শুনতে পাচ্ছে না নিবেদিতা। তার চোখের সামনে ক্রমশ ভেসে উঠছে একটা মৃত তারার মিটমিটে আলো। যে আলোটা আকাশের বুক থেকে হয়তো নিভে গেছে সাড়ে সাতশো বছর আগেই। কিন্তু হাজার আলোকবর্ষ দূরের তারাটা থেকে সেই আলোটুকু এইমাত্র এসে পৌঁছল পৃথিবীতে, যে আলোর যাত্রা শুরু হয়েছিল তারার জীবনকালে।

মরে যাওয়া তারার গল্প শুনিয়েছিল জয়দীপ। জুনপুটের সেই রাতে। তারপর কেটে গেল আজ আটটা বছর। আট বছর আগের একটি দিন। জীবনানন্দের নাম জানা ছিল কিন্তু সম্যক পরিচয় হয়েছিল জয়দীপের সূত্রেই।

বালিয়াড়ির বুকে পাশাপাশি শুয়েছিল নিবেদিতা আর জয়দীপ। সমুদ্রের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ভেসে আসছিল যেন কোন অনাদির বুক চিরে।

তোর আর আমার যদি বিয়ে না-ও হয় কোনওদিন, দীর্ঘক্ষণের নিস্তব্ধতা ভেঙে বলেছিল জয়দীপ, তবু এই অনন্ত নক্ষত্রলোকের কাছে অমর হয়ে রয়ে যাবে আমাদের এই সহবাস…

জয়দীপের মুখে হাত চেপে ধরেছিল নিবেদিতা। মৃত তারার আলোয় তার সিঁথিতে তখনও জ্বলজ্বল করছে জয়দীপের দেওয়া কালীঘাটের সিঁদুর। স্বামী-স্ত্রীর পরিচয়ে রেজিস্ট্রির কাগজপত্তর নিয়েই তারা এসেছে জুনপুটে। জুনপুটের এই রাত তাদের মধুচন্দ্রিমার প্রথম রাত। এমন রাতে এসব কী অনাসৃষ্টির কথা বলছে জয়দীপ!

নিবেদিতার হাত নিজের মুখের উপর থেকে সরিয়ে দিয়েছিল জয়দীপ। সমুদ্রের কোলাহলের সঙ্গে মিশে যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসছিল তার উদাস কণ্ঠস্বর, পৃথিবী ছাড়া এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আর কোথাও কি প্রাণ থাকতে পারে না নিবেদিতা?

আমার তো মনে হয় না আছে বলে। থাকলে কি আর এতদিনে খোঁজ পাওয়া যেত না? সহজ সুরেই উত্তর দিয়েছিল নিবেদিতা। ততদিনে এমন অদ্ভুত সব কথার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে সে।

এই বিরাট আকাশের কতটুকুই বা আমরা জানি! ওই যে তারাটা জ্বলছে আকাশের ওই কোণায়, একদিকে আঙুল দিয়ে দিক নির্দেশ করেছিল জয়দীপ, ওই তারাটা আর সত্যি সত্যিই ওখানে আছে কিনা কে বলতে পারে?

এবারে সত্যিই অবাক হয়েছিল নিবেদিতা, মানে! তারাটাকে দিব্যি দেখতে পাচ্ছি। আর তুই বলছিস ওটা নাও থাকতে পারে ওখানে?

হ্যাঁ, ঠিক তাই, একটু থেমে আবার শুরু করেছিল জয়দীপ, হয়তো ওই তারাটা থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছোতে সময় লেগে যায় একহাজার বছর। তাই এইমাত্র যে আলোটা দেখছি আমরা আসলে সেটা সেই হাজার বছরের পুরোনো আলো। হয়তো সাড়ে সাতশো বছর আগেই নিভে গেছে তারাটা। কিন্তু আরও আড়াইশো বছর আলোটাকে অমনি দেখা যাবে…

শুনতে শুনতে ঘোর লেগে আসছিল।

জয়দীপ বলে যাচ্ছিল, আমাদের এই ছায়াপথেই আছে সূর্যের মতো কত নক্ষত্র। সূর্যেরই মতো তাদেরও কত গ্রহ উপগ্রহ। আবার এই ছায়াপথ আকাশের কতটুকুই বা। তারও বাইরে আরও কত দূর দূরান্তে এমন আরও কত অজস্র ছায়াপথ। আরও কত লক্ষ কোটি নক্ষত্র। তাদের গ্রহ উপগ্রহ। আমরা হয়তো জানি না কিন্তু এই বিশালতার আর কোথাও প্রাণ থাকা কি সত্যিই অসম্ভব?

জয়দীপের এই প্রশ্নের কোনও উত্তর ছিল না তার কাছে। সে শুধু মুগ্ধ বিস্ময়ে তাকিয়েছিল ছেলেটার মুখের দিকে। আবছা অন্ধকারে জয়দীপকে বহু আলোকবর্ষ দূরের মানুষ মনে হচ্ছিল। তার সেই অনন্ত অনুসন্ধিৎসাও যেন গ্রহান্তরের বিস্ময়। মৃত তারার পাণ্ডুর আলো মেখে জয়দীপের গালের চাপদাড়ি যেন পৌরাণিক দেবতার দাড়ির মতো সবুজ হয়ে গেছে। সেই সবুজ দাড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে জয়দীপ বলেছিল, আড়াইশো বছর পরে ওই তারাটা পৃথিবীর মানুষের কাছেও মরে যাবে। কিন্তু তখনও হয়তো ওর জন্ম মুহূর্তের আলোটাও আকাশের সব কোণায় কোণায় পৌঁছবে না। হয়তো আরও দূরে অন্য কোনও এক ছায়াপথের এমন এক ছোট্ট গ্রহের উন্নত প্রাণী সেদিনও দেখতে পাবে তারাটাকে। মরে যাওয়ার পরেও তাই অনন্তকাল আকাশের দূর দূরান্তে বেঁচেই থাকবে তারাটা…

কি অপূর্ব এক মাদকতায় ভেসে যাচ্ছিল নিবেদিতা। জয়দীপের কথাগুলোর খানিক খানিক তাকে স্পর্শ করছিল আবার খানিক খানিক হারিয়ে যাচ্ছিল সামুদ্রিক ঝিমেল বাতাসে। জয়দীপ বলে চলেছিল, সেই গ্রহের বাসিন্দাদের হয়তো আছে আরও হাজারগুন উন্নত যন্ত্রপাতি। এই পৃথিবী থেকে আলো যেতে সেখানে সময় লাগে দশ হাজার বছর। ঠিক এই মুহূর্তে তুই আর আমি এই যে শুয়ে আছি জুনপুটের বালিতে এই ছবিটা সেই গ্রহের প্রাণীরা দেখতে পাবে আরও দশ হাজার বছর বাদে। ততদিনে আমরা আর কেউই বেঁচে নেই। হয়তো পৃথিবীটাই ধবংস হয়ে গেছে পারমাণবিক বোমায়। কিন্তু আমাদের এই সহবাসের ছবিটা অনন্তকাল আকাশের বিভিন্ন দূর দূরান্তের গ্রহ থেকে দেখাই যাবে। তাই বলছিলাম যদি তোর আর আমার কখনও ছাড়াছাড়ি হয়েও যায় আমাদের এই মুহূর্তের ভালোবাসাটুক…

হাত দিয়ে আবার জয়দীপের মুখ চেপে ধরেছিল নিবেদিতা।

আজ মনে হয় জুনপুটের সেই রাতে মৃত তারার আলো মেখে সবুজ হয়ে ওঠা দাড়িগোঁফের জয়দীপ যেন সত্যি সত্যিই স্বর্গের দেবতাদের মতো দিব্যদৃষ্টি লাভ করেছিল। নাহলে সে কেমন করে জানতে পারল সত্যিই একদিন ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবে তাদের। বাড়ির চাপের মুখে ভেঙে পড়তে হবে নিবেদিতাকে। বিয়ে করতে হবে বয়সে প্রায় বছর সাতেকের বড়ো কর্মজীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত সৌমেনকে।

বিয়ের পর বছরখানেক ফোনে যোগাযোগ ছিল কলেজের বান্ধবী সায়ন্তনীর সঙ্গে। তার মুখেই খবর পেত নিবেদিতা– জয়দীপ কেমন বিবাগি ধরনের হয়ে গেছে। কবিতা লেখার হাত ছিল কলেজে থাকতেই। আর ততদিনে নাকি একেবারে কবি বনে গেছে জয়দীপ। চাকরি বাকরির হাল হদিশ না করে শুধু নাকি লিখে যাচ্ছে ছোটো বড়ো সব লিটল ম্যাগাজিনে।

নাম বলতে পারিস? কোথায় কোথায় লেখে জয়দীপ? কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে তাহলে একদিন… বলেছিল নিবেদিতা।

জানি না রে। লিটল ম্যাগাজিনের খোঁজ আর কে রাখে বল? নিউজ পেপার বা রেপুটেড ম্যাগাজিনে লিখলে তাও হয়তো চোখে পড়ত, নির্লিপ্ত গলায় বলেছিল সায়ন্তনী, কী আর হবে এসব করে? পয়সা আসবে? অথচ কত ব্রাইট ছেলে ছিল। আর কীভাবে নিজেকে স্পয়েল করছে আজকাল…

ফোনের এপাশে তখন নীরবতা।

ওপাশ থেকে তারপরেই মুখ ঝামটা দিয়েছিল সাযন্তনী, তোর কী রে এসব ভেবে? মাসিমা মেসোমশাই দেখেশুনে ভালোই বিয়ে দিয়েছেন। জাস্ট ভুলে যা। ফরগেট। আমারই ভুল হয়েছে। তোকে ওর কথা বলে। শোন, আর যদি কখনও তুই জয়দীপ শব্দটা উচ্চারণ করিস আমি দেন অ্যান্ড দেয়ার ফোনটা কেটে দেব। আর কখনও ধরবও না তোর ফোন। সে নিজের জীবনটাকে নষ্ট করছে, করতে দে। নইলে তোর ম্যারেড লাইফটা শেষ হয়ে যাবে। সৌমেনদা জানতে পারলে…

শেষ খবরটা অবশ্য সেই সায়ন্তনীই দিয়েছিল। বেড়াতে গিয়ে পাথরের খাঁজে খাঁজে অনেক নীচে নেমে গিয়েছিল জয়দীপ। উঠে আসতে আর কেউই দেখেনি…

সায়ন্তনীর গলাও ধরে এসেছিল সেদিন, যতই বল, একসঙ্গে কাটিয়েছি তো তিনটে বছর। শেষের দিকে যেমনই বাউন্ডুলে ছন্নছাড়া হয়ে যাক না কেন সত্যিকারের ভালো ছেলে তো ছিল এককালে…

শৌনক, তোমার ক্যামেরার অপটিক্যাল জুমটা আর একটু বাড়াও তো। যতটা বাড়ানো যায়, প্রাণপণে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে নিবেদিতা। কণ্ঠস্বরে যেন এতটুকুও উত্তেজনা প্রকাশ না পেয়ে যায়। প্রায় খাড়া একটা পাথরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে সে। শৌনক রয়েছে পাশেই। সৌমেন আর অঙ্গনা দিব্যি বোল্ডারের মতো পাথর বেয়ে নেমে গেছে জলের একদম কাছে। এখান থেকে প্রায় পুতুলের মতো ছোটো দেখায় তাদের। নিবেদিতা শুরুতে নামতে চায়নি অত নীচে।

তোমরা ঘুরে এস না। আমি ততক্ষণ এখানে বসেই ওয়েট করছি না হয়। বলেছিল সে।

কিন্তু সবাই জোরাজুরি করল।অঙ্গনা বলল, আমাকে খেয়াল রাখবেন দিদি। কীভাবে নামব আমি। আপনি জাস্ট ফলো করে যান।

নিবেদিতা এড়ানোর চেষ্টা করছিল যদিও, শাড়ি পরে কি আর পারব? তুমি সালোয়ার-কামিজ পরে যতটা এফিশিয়েন্টলি পারবে নামতে…

তখন সৌমেন বলল, ভয়ের কিছু নেই। ধাপ ধাপ আছে বেশ পাথরগুলো। সিঁড়ির মতো নেমে যাবে। কোনওটা একটু খাড়া মনে হলে জাস্ট অ্যাভয়েড করে পাশের পাথর বেয়ে নামবে।

শেষে শৌনক বলল, ঠিক আছে। অঙ্গনা আর দাদা আগে নেমে যাক। আমি তোমার সঙ্গে থাকছি। কোনও প্রবলেম হলে আমি থাকছি পাশে।

অগত্যা নামতেই হল। আর এখানে এসে প্রথমে যেমন আড়ষ্ট লাগছিল, অঙ্গনাদের সঙ্গে কথায়বার্তায় ঠাট্টাইয়ার্কিতে সেই ভাবটা আপনা থেকেই কেটেও গিয়েছিল একসময়। শৌনকের কোয়ার্টারটা পড়ে ঝাড়খণ্ডে। আবার কাজের জায়গাটা বেঙ্গলেই। অফিস ঘুরিয়ে দেখাল শৌনক। আন্ডারগ্রাউন্ডে যেখানে টারবাইন রয়েছে সেখানে দাদা-বউদিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বিশেষ পাসও করিয়ে রেখেছিল। অফিস দেখার পর লাঞ্চ সারতে গাড়ি চেপে যাওয়া হল আবার ঝাড়খন্ড। মাইথন হোটেলের খাওয়াদাওয়া একটু কস্টলি হলেও কোয়ালিটি বেশ ভালো। দুপুরে সাদা ভাত খেতেই ভালোবাসে নিবেদিতা। পাতলা করে মাছের ঝোল সঙ্গে থাকলে বেশ হয়। সেসব আর এখানে কোথায়! ডাল ফ্রাই আর চিকেন নিল সে। শৌনক খেল হায়দ্রাবাদি মাটন বিরিয়ানি। অঙ্গনা আর সৌমেন ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন বাটার মসালা নিয়েছিল। ভরদুপুরে এরা যে কী করে এত রিচ খেতে পারে!

খাওয়াদাওয়ার পর ড্যাম দেখতে আসা হয়েছে। পাথরের ধাপে নামতে গোড়ায় যতটা ভয় লাগছিল দু’ কদম চলার পর নিবেদিতা দেখল ব্যাপারটা অত মাথাব্যথার কিছুই নয়। বরং বেশ মজারই। ঠাট্টা করে বললও শৌনককে, এডমন্ড হিলারি পাহাড়ে উঠে বিশ্বজয় করেছিলেন আর আমরা খাদে নেমে মাইথন জয় করছি।

যা বলেছ, হাসল শৌনক। ক্যামেরাটা নিবেদিতার হাতে দিয়ে বলল, ফটো তুলতে পারো এখানে। দূরের পাহাড়ের বা ড্যামের। সিনিক বিউটি পাবে এনাফ…

ছবি তুলতে বরাবরই খুব ভালোবাসে নিবেদিতা। তাও দোনামোনা করছিল ক্যামেরাখানা হাতে নিতে, দ্যাখো, আমার হাতে দিচ্ছ। ক্যালাস ভাবে নামতে গিয়ে যদি পা হড়কায় তোমার এত কস্টলি ক্যামেরাখানাই কিন্তু যাবে তখন।

কিচ্ছু হবে না। তুমি ক্যামেরার ফিতেটা গলায় ঝুলিয়ে নাও বরং।

দূরের খাদের পাথরের দিকে ক্যামেরা তাক করল নিবেদিতা। কিছুটা গাছপালা নিয়ে ভালো ছবি আসতে পারে। ক্যামেরা চোখে লাগানোর আগেই মনে হচ্ছিল একটা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে পাথরের ধাপে ধাপে। আঙুল তোলে সে, একটা লোককে ওইখানে ঘুরতে দেখছ শৌনক। বাপ রে, শখ বলিহারি। কোথায় চলে গেছে।

তার নির্দেশ করা দিকে তাকিয়ে শৌনক বলল, কই আমি তো কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না। না না একদম ফাঁকা। কোথায় লোক। আর ওদিকে যাবেই বা কেন। জল নেই শুধুই পাথর। অবশ্য অ্যাডভেঞ্চারের জন্যে যেতেও পারে। কিন্তু কেউ নেই তো…

সে কি তুমি দেখতে পাচ্ছ না! ওই তো হেঁটে যাচ্ছে। এবার দাঁড়াল। এই আমাদের দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে এখন, নিবেদিতা স্পষ্ট দেখতে পায় একটা মানুষের মতো অবয়ব।

শৌনক বলে, তুমি দেখতে পাচ্ছ? আমি দেখতে পাচ্ছি না কেন? কেস খেয়েছে। পাওয়ার বেড়েছে বোধহয়…

ক্যামেরাখানা শৌনকের দিকে এগিয়ে দিয়ে নিবেদিতা বলে, জুমটা একটু বাড়িয়ে দাও। আমি লোকটার ছবি নিয়ে তোমায় দেখাচ্ছি।

শৌনক অপটিক্যাল জুম বাড়িয়ে দেয় খানিকটা।

কিন্তু লেন্সে চোখ রেখেই ভয়ানক চমকে উঠল নিবেদিতা। সঙ্গে সঙ্গে চোখ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে আবার শৌনকের দিকে বাড়িয়ে দিল সে। উত্তেজনায় তার সারা শরীর কাঁপছে। আকাশির উপর নেভি ব্লু স্ট্রাইপ দেওয়া ওই শার্টটা তার অনেক কাল আগের চেনা। তাছাড়া চোখমুখও…

কণ্ঠস্বরকে যথাসম্ভব সংযত রেখে বলে ওঠে নিবেদিতা, শৌনক, তোমার ক্যামেরায় অপটিক্যাল জুমটা আর একটু বাড়াও তো। যতটা বাড়ানো যায়…

শৌনক এবারে আশ্চর্য হয়, তুমি কি লোকটার ফুল সাইজ ফটো নেবে নাকি? একটা অচেনা লোকের ফটো নিয়ে কি হবে বেকার!

শৌনক। শৌনক, তোমায় যা বলছি তাই করো, নিবেদিতার গলায় এবার সুস্পষ্ট আদেশের সুর।

বউদির গলায় এমন জোর কখনও শোনেনি শৌনক। সে আশ্চর্য হয়। কিছুই বুঝতে পারে না। তবু অপটিক্যাল জুমটা যথাসম্ভব বাড়িয়ে বউদির হাতে দেয় ক্যামেরাখানা।

লেন্সে চোখ রেখে এবার নিবেদিতার সারা শরীর কাঁপতে থাকে। উত্তেজনায়, নাকি ভয়ে সে নিজেও জানে না। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সে মানুষটাকে। চোখ মুখ নাকের প্রত্যেকটা রেখা এখন পরিষ্কার। আর সারা গালে সবুজ রঙের দাড়ি। কোনও মানুষের দাড়ি এত সবুজ হতে দেখেনি নিবেদিতা। দূরের পাহাড়ের ঢাল থেকে জয়দীপ হাসছে তার দিকে তাকিয়ে। বিকেলের মরা রোদ জয়দীপের মুখে চোখে। সেই রোদে সবুজ দাড়ি আর তপ্ত কাঞ্চন শরীরের জয়দীপকে পুরাণের গল্পে বর্ণিত দেবরাজ ইন্দ্রের মতোই অপরূপ সুন্দর দেখাচ্ছে। তার শরীরও পৃথিবীর মানুষের মতো নয়। যেন অপার্থিব এক জ্যোতি নির্গত হচ্ছে তার অবয়ব থেকে। আরও আশ্চর্য এত বছর পরেও তার চেহারা সেই পুরোনো দিনের মতোই রয়ে গেছে। এই আট বছরে অনেক মেদ জমেছে নিবেদিতার শরীরে। কিন্তু জয়দীপ সেই জুনপুটের দিনগুলোর মতোই নির্মেদ বলিষ্ঠ। আট বছর আগেকার হাফস্লিভ শার্টটাও অত উজ্জ্বল থাকতে পারে না এতদিন ধরে। আকাশির ওপর সেই নেভি ব্লু স্ট্রাইপের দাগগুলো ঠিক তেমনি আছে।

কতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পেরেছিল নিবেদিতা মনে ছিল তা তার। হয়তো দু’ এক মুহূর্তই।

শৌনক জড়িয়ে না ধরলে টলে পড়ে যেত সে। শৌনকের চিৎকারে অঙ্গনা আর সৌমেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উঠে এসেছে পাথরের ধাপে ধাপে দৌড়ে।

শৌনক বলে, পড়ে যাওয়ার আগে ক্যামেরার শাটার টিপেছিল বউদি। আমার স্পষ্ট মনে আছে।

অঙ্গনা বলল, দেখ তো ফটোটা একবার…

কিন্তু ফটোয় শুধু একটা বড়ো পাথর। জুম করার কারণেই পাথরের প্রত্যেকটা দাগ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।

শৌনক বলে, আমি ঠিকই দেখেছিলাম। কেউ ছিল না ওখানে।

শুধু নিবেদিতা দেখতে পেয়েছিল জয়দীপকে।

অনেক আলোকবর্ষ দূরের মানুষ হয়ে গেছে আজ জয়দীপ। সেই দূরত্ব থেকে আলো পৃথিবীতে এসে পৌঁছোতে লেগে যায় অনেক বছর। যতদিন বাঁচবে নিবেদিতা, এমন করেই মাঝে মাঝে দেখতে পাবে বহু আলোকবর্ষ দূরান্তের সেই মানুষটাকে।

মৃত তারার আলো যেমনি করে অনন্তকাল পরিক্রমা করে চলে অনন্ত আকাশে।

 

কালো ছায়া

সন্ধেবেলা অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই লক্ষ্য করছি, বাড়ির পরিবেশটা কেমন যেন গুমোট হয়ে রয়েছে। চোখের সামনে দিয়ে আমার চটুল, বাক্পটু স্ত্রী ঘোরাফেরা করছে, অথচ টুঁ-শব্দটি নেই। মনে হল ঝড়ের আগের পূর্বাভাস। ক্ষণিকের শান্তির আবেশ। নাহলে তো অফিস থেকে ফেরার পর থেকেই কাটা রেকর্ড-এর মতো সর্বক্ষণ বাজতেই থাকে। যাই হোক এই শান্ত পরিবেশ তো আর সহজে পাওয়া যায় না। ব্যাপারটা বেশ এনজয়-ই করছিলাম। তাই আর ওকে ঘাঁটাতে মন চাইছিল না। মানে মৌচাকে ঢিলটা কেই-ই বা ছুড়তে চায় বলুন! কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে হল জিজ্ঞাসা না করলেই যে রেহাই মিলবে তারও তো উপায় নেই। পরে সেই নিয়ে আবার বচসা বাধবে। তার থেকে ভালো, জিজ্ঞাসা করেই ফেলি। হাত-পা ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিউজ চ্যানেল চালিয়ে বসলাম। তার মিনিট দুয়েক পরে চা দিতে এল নীরা। তখনই প্রশ্ন করলাম, ‘কী হয়েছে?’

‘রথীনদা ওনার ফ্ল্যাটটা জনাকয়েক ছাত্রকে ভাড়া দিয়েছে।’ একমুহূর্ত অপেক্ষা না করেই মুখটা বেশ ব্যাজার করেই উত্তর দিল নীরা।

‘এটা তো খুব ভালো খবর। এতদিন ধরে ফ্ল্যাটটা ফাঁকা পড়ে ছিল। চলো, মানুষজন আসাতে অন্তত ওদের কলরব তো শোনা যাবে। তারপরে একটা পড়াশোনার পরিবেশও…। বাই দ্য ওয়ে তোমাকে এত চিন্তিত লাগছে কেন?’

আমার কথা শোনা মাত্রই ঝাঁঝিয়ে উঠল নীরা। ‘সাংসারিক চিন্তাভাবনা, বোধভাষ্যি কোনওদিনই তোমার ছিল না। তুমি এসবের কী বুঝবে! আজকালকার ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার নামে বাবা-মায়ের অলক্ষ্যে বাড়ির বাইরে কী সব ঘটনা ঘটিয়ে বেড়াচ্ছে, জানো তুমি? রোজ তো টিভিতে, খবরের কাগজে দেখছ। বাবা-মায়েরা ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে কত কষ্ট করে তাদের পড়তে পাঠাচ্ছে, আর তাদের দ্যাখো, বেলেল্লাপনা করে বেড়াচ্ছে।’

‘আশ্চর্য! একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না, অন্যের ছেলেদের নিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা কীসের? তুমি এত টেনশড কেন, খোলসা করে বলবে আমাকে?’

‘পরিষ্কার করে না বললে কি কিছু বোঝো না তুমি? বলি, আমার ঘরে দু-দুটো মেয়ে রয়েছে নাকি। সারাদিন আমরা বাড়ি থাকি না। মেয়ে দু-টো একা থাকে। চিন্তা হবে না? আর রথীনদাকেই বলি, ভাড়া দিবি, দে না বাবা, কে মানা করেছে? কিন্তু নিদেনপক্ষে একটা ফ্যামিলি দেখে তো দিতে পারত। তা নয় যত্তসব উটকো ঝামেলা,’ আপনমনে বিড়বিড় করতে থাকে নীরা।

‘কারওর সম্পর্কে কিছু না জেনে, ভুল ধারণা পোষণ করাটা ঠিক নয় নীরা। তাছাড়া ওরা পরের ছেলে, ওদের নিয়ে আমরা এত ভাবতে যাবই বা কেন? আমরা তো জানি আমাদের দুই মেয়েকে আমরা কী শিক্ষায় মানুষ করেছি। এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।’ খানিক শান্ত করার চেষ্টা করলাম ওকে।

‘দ্যাখো এই বয়সটা খুব খারাপ। সামনাসামনি থাকতে থাকতে কখনও যদি কিছু ভুলচুক করে বসে! তুমি এখনই রথীনদার সঙ্গে কথা বলো। বলো ওদের বদলে ফ্যামিলি দিতে, নয়তো তুমি অন্য বাড়ির ব্যবস্থা করো। আমি এখানে থাকব না।’ আমার বোঝানোতে লাভ যে কিছু হল, নীরার কথায় তেমনটা মনে হল না।

ডিনার সেরে শুতে যাওয়ার সময়ও বাড়ি বদলানোর ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করতে বলল সঙ্গে চোখ-কান খোলা রাখার পরামর্শও। এমনকী রথীনদার ভাড়াটে ছেলেগুলোর সঙ্গে বেশি মাখোমাখো সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারটাও এড়িয়ে গেল না নীরা। কারণ ও জানে আমি খুব সহজেই মানুষের সঙ্গে তাদের মতো করে মিশে যেতে পারি, ওটাই আমার স্বভাবসিদ্ধ বৈশিষ্ট্য। যাই হোক, ওর কথাগুলো আমায় বেশ ভাবিয়ে তুলল। নীরা যতটা ভাবছে, সত্যিই কি এতটা চিন্তার বিষয় এটা? এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই, এখন আকছার যা-সব ঘটনা শোনা যাচ্ছে, তাতে ভয়টা অমূলক নয়।

হঠাৎ-ই মিত্তির বাড়ির কথা মনে পড়ে গেল। এই তো দু-চারটে বাড়ির পর চোখের সামনে যা ঘটে গেল! বিজনদার সংসার বলতে তো ওই তিনজন। বিজনবাবু নিজে, ওনার স্ত্রী, আর মেয়ে সোহিনী। বিজনবাবুকে ব্যাবসার কাজে মাঝেমধ্যেই বাইরে যেতে হয়। মেয়ে আর স্ত্রী একা থাকবে, সেই কারণে চেনাজানার মধ্যেই দুজন পিজি রেখেছিলেন তিনি। দেখলে মনে হতো একেবারে ঘরের ছেলে। সেই তারাই কী পাশবিক ঘটনাটাই না ঘটাল! বিজনবাবু যখন সপ্তাহ খানেকের জন্য মধ্যপ্রদেশ গেলেন, সেই সুযোগে দুজন ছেলে মিলে সোহিনীকে একেবারে ছিঁড়ে খেল। বিজনবাবুর স্ত্রী বাধা দিতে গেলে, তাকে এমন মাথায় আঘাত করল যে, হাসপাতাল থেকে তিনি আর বেঁচে ফিরলেন না। আর মেয়েটা এখন অ্যাসাইলামে। মানসিক ভারসাম্যহীন। মনে পড়ে গেলেই গোটা শরীর শিউরে ওঠে। মানুষ কী এতটাও পাষণ্ড হতে পারে, যে নিজের বিকৃত পাশবিক কামনা-বাসনা চরিতার্থ করতে একটা মানুষকে খুন করতেও হাত কাঁপে না তাদের।

ধাতস্ত হতে খানিক সময় লাগল। তখন মনে হয় এসব নেতিবাচক চিন্তাকে প্রশ্রয় দেওয়া একেবারেই উচিত নয়। সবাই তো আর সমান নয়। উলটোটাও তো হতে পারে। আমি কালই বাচ্চাগুলোর সঙ্গে কথা বলব। রবিবারও আছে, ওদের পরখ করার জন্য সারাটা দিন সময় পাব। তারপর না হয় যা ডিসিশন নেওয়ার নেব।’

পরদিন সকালে বাজার সারার পর ইচ্ছা করেই ঘরের দরজাটা খুলে রাখলাম। ওখানেই খবরের কাগজটা হাতে একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়লাম। লক্ষ্য করলাম জনাচারেক ছেলে, বয়স আনুমানিক বাইশ কী তেইশ হবে। তাদের প্রয়োজনে আসা-যাওয়া করছে কিন্তু আমার ঘরের দিকে উঁকিঝুঁকি মারার মতো প্রবৃত্তি কারওর মধ্যে দেখলাম না, বরং ওদের একজনের সঙ্গে চোখাচোখি হতে ভদ্রতার খাতিরে একটু মুচকি হাসল ছেলেটি। আমি-ই আগ বাড়িয়ে বললাম, ‘নাম কী?’

‘সরি আঙ্কল কিছু বললেন?’ বোধকরি ঠিক শুনতে পায়নি।

‘বলছি নাম কী?’

‘ওঃ নাম! অভীক।’

‘অভীক কী?’

‘আজ্ঞে অভীক রায়।’

‘বাড়ি কোথায়?’

‘মুর্শিদাবাদ’।

‘দেখেছ আমিও কেমন, তোমাকে বাইরে দাঁড় করিয়েই…। এক কাজ করো বন্ধুদের নিয়ে চলে এসো। চা-জলখাবার খেয়ে যাও। তখনই না হয় কথা হবে। পাশাপাশি যখন থাকতেই হবে তখন একে-অপরকে জেনে রাখাই ভালো, কী বলো ইয়ং-ম্যান? যাও যাও বন্ধুদের ডেকে নিয়ে এসো।’

নীরার পারমিশন ছাড়াই বাচ্চাগুলোকে চা-জলখাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছি শুনলে, ও যে খুব একটা খুশি হবে না সেটা আমি ভালো মতোই জানি। তার চেয়ে চুপ থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। ওরা এলে অনাদর করবে না নীরা, এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস।

হলও তাই। এক এক করে চারজন ছেলেই ‘নমস্কার আঙ্কল’ বলে ঘরে প্রবেশ করল। তার মিনিট পাঁচেক পরে চায়ের ট্রে হাতে ঘরে ঢুকল নীরা। সঙ্গে চারটে প্লেটে সকালের বানানো লুচি তরকারি। সকলকে ভাগ করে দিল নীরা। দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলাম। বোধকরি এতটাও আশা করিনি।

কথায় কথায় ওদের পরিবার, ঠিকানা, যোগাযোগের নম্বর সমস্ত কিছু জেনে নিলাম। একবারও মনে হল না ছেলেগুলোর কোনও বদ মতলব আছে, বরং প্রত্যেককেই সম্ভ্রান্ত পরিবারের সুশিক্ষায় শিক্ষিত বলেই মনে হয়েছে। মনে হয়েছে সত্যিই এই নম্র-ভদ্র ছেলেগুলি চাকরির জন্য পড়শোনা করতেই এসেছে, বেলেল্লাপনা করতে নয়।

নীরা খানিক আশ্বস্ত হল বটে তবে মা তো, কিন্ত কিন্তু একটা থেকেই যায়। সাধারণত বাচ্চারা একটু মায়েদের কোল-ঘেঁষা হয়, যার কারণে মায়েরা, বাবাদের তুলনায় বাচ্চাদের সঙ্গে বেশি অ্যাটাচ্ড। তাই একটু বাড়তি সচেতনতা– প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে বেরোনো যাবে না, ব্যালকনিতে দাঁড়ানো যাবে না, বেশি হাসাহাসি, কোলাহল চলবে না, আরও অনেক কিছু।

ওদিকে যে-ছেলেগুলোর জন্য এত বাধা-নিষেধ, তারাই দিনের বেশির ভাগ সময়টা কাটায় কোচিং সেন্টারে। রাতটুকু বাড়িতে থেকে সকালে সেই একই রুটিন। ওদের কারণে আমাদের দিনচর্যার যে খুব একটা তফাত কিছু হয়েছে এমনটা নয়। উলটে কিছু কিছু বিষয়ে আমরা ওদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। ইন্টারনেটে কোনও কিছু জানার থাকলে, মোবাইলের কোনও সমস্যা হলে ওদের কাছে ছুটে যাওয়া। ওরাও পাড়াপড়শিদের মতো কখনও সখনও ‘আন্টি চা চাই চিনি চাই’। সম্পর্ক বলতে এই।

কিছুদিন পরে আমাদের ছেলেটা বড়ো হবে। তাকেও পড়াশোনার জন্য বাইরে থাকতে হতে পারে। তখন আমরাও তো চাইব সে যেখানে থাকবে, আশপাশের লোকেরা যেন তাকে ভালোবাসে। সেই কারণে ওদের সঙ্গে ছেলের মতো ব্যবহার করি আমি।

মাস চার-পাঁচেক এইভাবেই কেটে গেল। নীরাও এখন অনেকটা আশঙ্কামুক্ত। ছেলেগুলোকে দেখলে আজকাল আর মুখ ব্যাজার করে না। কিছু চাইতে এলেও বিরক্তি দেখি না ওর মুখেচোখে। সামনের রবিবার বাবুর জন্মদিন। বাবুর কয়েকজন বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। মনে মনে ভাবছিলাম ছেলেগুলোকেও যদি বলা যেত। বলব বলব করে সাহস করে আর নীরাকে বলা হয়ে ওঠেনি। রাত্রে খেতে বসে নীরা নিজেই বলে বসল, ‘বলছি, রবিবার ছেলেগুলো বাড়ি থাকবে। না বললে কেমন একটা দেখায় না?’

বললাম, ‘আমিও তোমায় কথাটা বলব বলব ভাবছিলাম। ঠিক আছে। গৃহমন্ত্রীর পারমিশন যখন পেয়ে গেছি, কাল সকালেই ওদের বলে দেব।’ বলে রাত ররটা নাগাদ শুতে চলে গেলাম। নীরার কথা শুনে মনটা বেশ ভালো হয়ে গেল।

সেই রাতেই যত বিপত্তি। রাত দুটো নাগাদ হঠাৎই মনে হল ঘরের মধ্যে কারা যেন কথা বলছে। দরজা খোলারও আওয়াজ হল। উঠে এসে দেখি, বড়ো মেয়ে ঈশিতা আর ছেলে বাবু, হন্তদন্ত হয়ে ঘরের মধ্যে এদিক-ওদিক কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে। বাইরের দরজাটা হাট করে খোলা। সামনের ফ্ল্যাটের অরুণাভ আর মোহিতও ওদের ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কী যেন বলাবলি করছে। বেশ চিন্তিত লাগল দুজনকে। কিন্তু এত রাতে এরা বাইরে কেন? কী করছে? ছুটে গেলাম ঈশির কাছে, ‘কী হয়েছে? তোরা এত রাতে এখানে কী করছিস? সুমি কোথায়? আর এত রাতে দরজাটাই বা কেন খোলা?’ হাজারো প্রশ্নে ঘাবড়ে গেল দুই ভাইবোন। কোনওমতে জবাব দিল, ‘বাবা, সুমি কোথাও নেই।’

‘কী বলছিস পাগল-টাগল হলি নাকি? বাথরুমে গেছে হয়তো। না দেখেই…’ ঝাঁঝিয়ে উঠল নীরা।

‘না মা বাথরুম যাব বলেই, উঠে দেখি, সুমি ঘরে নেই। ভাবলাম, বাথরুমে গেছে হয়তো। সেখানেও নেই। সব জায়গায় দেখেছি।’

এক মুহূর্তে মনে হল পায়ের তলায় আর মাটি নেই। সেই সময়ই নীরা বলে বসল, ‘মানসম্মান আর রইল না আমাদের। বিশ্বাসের এই মর্যাদা দিল ছেলেগুলো!’ কথাটা শোনা মাত্রই মাথায় রক্ত চড়ে গেল। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে গেলাম পাশের ফ্ল্যাটে। দরজাটা খোলাই ছিল। চারজনের মধ্যে দুজন সামনেই দাঁড়িয়েছিল। বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিল ওরা।

‘অভীক আর সুমন কোথায়?’ চিৎকার করেই জিজ্ঞাসা করলাম।

প্রত্যুত্তরে দু’জন একসঙ্গে বলে উঠল, ‘আঙ্কল ওরা একটু বেরিয়েছে। এক্ষুনি চলে আসবে।’

‘এত রাতে বেরিয়েছে। আমায় শেখাচ্ছ। ভালো চাও তো বলো আমার মেয়েকে ওরা কোথায় নিয়ে গেছে। নয়তো সবকটাকে জেলে ভরে দেব।’

‘আঙ্কল আপনি ভুল করছেন। ওরা সুমিকে নিয়ে কোথাও যায়নি।’ অরুণাভ থতমত খেয়ে জবাব দিল।

‘ভুল হচ্ছে ভুল! তোমরা কেমন করে জানলে যে সুমিই বাড়িতে নেই? আমি তো তোমাদের বলিনি।’ নিজের স্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে আপন করে নিয়েছিলাম ছেলেগুলোকে। আর ছেলেগুলো আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে মুখে একেবারে চুনকালি লেপে দিল, ভেবেই যেন আরও ক্ষিপ্র হয়ে উঠলাম আমি। সামনে রাখা ব্যাটটা নিয়ে সপাটে চালাতে শুরু করলাম।

নিজেদের বাঁচাতে ওরাও বলপ্রয়োগ করল আমার উপর। সজোরে হাত থেকে ব্যাটটা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল মোহিত। ওরাও উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল।

‘আপনার বয়সের কথা ভেবে এতক্ষণ চুপ ছিলাম, কিন্তু আর নয়। শুধুমাত্র আপনার সম্মান বাঁচাতে অভীক আর সুমন এত রাতে ঝুঁকি নিয়ে দৌঁড়োল, আর আপনি পিঠ চাপড়ানোর বদলে দোষারোপ করছেন? আন্টি তো সবসময় আমাদের সন্দেহ করে। আমরা না হয় বাজে ছেলে, কিন্তু আপনার মেয়ে তো খুব ভালো, সচ্চরিত্র তাহলে এমন দিন দেখতে হল কেন আপনাদের? আপনার ছোটো মেয়ে আমার বন্ধুদের সঙ্গে নয়, পাড়ার এক বখাটে ছেলের সাথে ভেগেছে। ওকে নিয়ে ফিরলেই সব জানতে পারবেন।’

শুনে অবাক হয়ে গেলাম। ছেলেগুলো কী বলছে! সত্যি কী মিথ্যে– দোটানায় পড়ে গেলাম। এমন সময় পেছন থেকে নীরা ভাঙা গলায় বলে উঠল, ‘এদের কথায় ভুলো না। এসব এদের চাল। এখনও সময় আছে, তুমি পুলিশে ফোন করো।’

‘প্লিজ আঙ্কল বিশ্বাস করুন, আপনি যেমনটা ভাবছেন ব্যাপারটা তা নয়। এত রাতে পুলিশ এলে সবাই সব জেনে যাবে, তাতে বদনাম আপনাদেরই হবে। তার চেয়ে আমাদের উপর একটু বিশ্বাস রেখে মিনিট দশেক অপেক্ষা করেই দেখুন না, ততক্ষণে যদি ওরা না ফেরে তখন না হয় যা ডিসিশন নেওয়ার নেবেন।’ বোঝানোর চেষ্টা করল মোহিত।

সত্যি বলতে কী, ওদের উপর বিশ্বাস করে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোনও পথ খোলা ছিল না। হতভম্বের মতো সামনে রাখা চেয়ারটায় বসে পড়লাম। আমার অবস্থা দেখে বোধহয় ওদেরও করুণা হল। মোহিত গলার স্বর নামিয়ে বলতে থাকল, ‘আঙ্কল আপনি তো জানেনই আমাদের রাত জেগে পড়ার অভ্যাস রয়েছে। বেশ কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করছিলাম, মাঝরাতে সুমি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ফোনে ফিসফিস করে কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। সত্যি বলতে কী আমরা অত গুরুত্ব দিইনি। লাস্ট দু-তিনদিন রাত্রিবেলা দু’টো ছেলে বিল্ডিংয়ের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছিল। আপনাকে বললে আপনি কীভাবে নেবেন, আদৌ বিশ্বাস করবেন কিনা, এই নিয়ে আমরা আজকেও পড়তে পড়তে আলোচনা করছিলাম। এমন সময় একটা গাড়ির আওয়াজ কানে এল। অভীক তখন ঘুম কাটানোর জন্য ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল। হঠাৎই ছুটে এসে দরজাটা খুলতে খুলতে বলল, ‘মনে হয় সুমি ওই ছেলেগুলোর সঙ্গে পালাচ্ছে। আমি ওকে এতবড়ো ভুল করতে দেব না। আমি এখুনি ওকে নিয়ে আসছি।’ ওকে একা যেতে দেখে সুমনও ওর পিছু পিছু ধাওয়া করল। আপনাকে কীভাবে জানাব, এসব ভাবতে ভাবতেই আপনি নিজেই জেগে গেলেন।’ খানিক থেমে আবার বলতে শুরু করল মোহিত, ‘এই অজানা শহরে আপনার থেকে যে স্নেহভালোবাসা পেয়েছি, তা তো ভোলার নয় আঙ্কল। তাছাড়া ঈশিতা, সুমিকে কোনওদিন নিজের বোন ছাড়া অন্য চোখে…।’

মোহিতের কথা শেষ হওয়ার আগেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকল অভীক আর সুমন। সঙ্গে ভীতসন্ত্রস্ত সুমি। সুমির হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছিল অভীক। আমার দিকে এগিয়ে এসে সুমির হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নিন আপনার মেয়ে। জানেন আঙ্কল পাড়ার ওই বখাটে সঞ্জুর সঙ্গে পালাচ্ছিল আজ। আর ছেলে পেল না ও! রাগে কয়েক ঘা দিয়েও দিয়েছি। জীবনটা কী ছেলেখেলা নাকি? এমন একটা পদক্ষেপ নেওয়ার আগে একবারও আপনার কথা ভাবল না। আমি ভেবে অবাক হয়ে যাই, যে মানুষটা অন্যের ছেলেকে এমন উদার ভাবে ভালোবাসতে পারে, নিজের করে নিতে পারে, সে তার নিজের সন্তানকে কত ভালোবাসে। আর এই মেয়ে কিনা…’ বলেই সুমির দিকে থাপ্পড় মারার ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল অভীক।

হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছিলাম আমি। নীরাও। ‘হ্যাঁ বাবা মারো। বড়ো দাদা হয়ে তোমরা শাসন করবে না তো কে করবে। আমাদের আর আছেটাই বা কে?’

সেদিন একটাও কথা বলতে পারেনি নীরা। বলার ছিলটাই বা কী?

মাতৃরূপেণ

ভোরে উঠে পড়ার অভ্যেসটা এখনও ছাড়তে পারেননি সুজাতা। ওঠার তেমন দরকার পড়ে না, তবুও। অনির্বাণ অবসর নিয়েছেন বছর দুয়েক হল। অফিসের রান্না করে দেবার তাড়া নেই আর। রুমকি যতদিন এ বাড়িতে ছিল, ওকে ঘিরে ব্যস্ত থাকার সুযোগ ছিল। স্কুল-কলেজের পাট চুকলে, রুমকির নাচ, নাচের দলের দেশ-বিদেশ সফর, সেইসব সফরের প্রস্তুতিপর্ব– সব মিলিয়ে বাড়িটা গমগম করত। ছাত্রী, ছাত্রীর মায়েরা, অনুষ্ঠানের আয়োজক, মিডিয়ার লোকজন আসার বিরাম ছিল না। সেসব অবশ্য এখনও আছে। তবে দুটো বাড়ির মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে জনস্রোত। শুধু রুমকিকে ভোরে উঠে তুলে দেওয়ার কাজটা আর নেই। সেদিনও পর্যন্ত সেটা ছিল তাঁর মস্ত দায়িত্ব। ভোরে উঠে এক-দেড় ঘণ্টা নাচ প্র্যাকটিস করত রুমকি। ভোরের এই সময়টা যে-কোনও সাধনার পক্ষে সবচেয়ে আদর্শ– একথা তো তিনিই ছোটোবেলা থেকেই রুমকির কানে ঢুকিয়ে এসেছেন।

রুমকি এখন এখানে থাকে না। তাই ওকে ঘুম থেকে তুলে নাচে জুতে দেবার কাজও নেই তাঁর। কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে তাই। অবসর নেওয়ার পর প্রথম ক’দিন খুব উৎসাহে মর্নিং ওয়াক শুরু করেছিলেন অনির্বাণ। তাঁকেও টেনে নিয়ে যেতেন। ফিরে এসে ছাদের টেরেসে একসঙ্গে বসে চা খাওয়া, কাগজ পড়া তারপর দুজনে মিলে ব্রেকফাস্ট বানানো। মর্নিং ওয়াকারদের একটা দলও তৈরি হয়ে গিয়েছিল। ‘সাতসকাল’ নামে লেটারহেড ছাপাও হয়ে গিয়েছিল। রবীন্দ্রজয়ন্তী, রক্তদান– এমন দু-চারটে কর্মকাণ্ডও হয়েছিল তাঁদের গোষ্ঠীর। তারপর তাঁরা কীভাবে যেন খসে পড়লেন সেই গোষ্ঠী থেকে।

তারপরও অনির্বাণ চেষ্টা করেছিলেন তাঁর অবসরজীবনে সুজাতাকে জড়িয়ে নিতে। সারাজীবন সময় দিতে পারেননি। সুজাতার স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে ওভারটাইম করে গিয়েছেন। মধ্যবিত্ত পরিবারে নাচ চালিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি কথা না। দামি দামি কস্টিউম, মিডিয়ার সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ, ছাত্রী ধরে রাখার জন্যে বছরে শহরের নামি-দামি হলে দু-তিনটে প্রোগ্রাম, ওয়ার্কশপ– আরও কত কী। পাশাপাশি নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা। তারপর ইউনিভার্সিটি। বছরের পর বছর ধরে সাধারণ চাকুরিজীবী অনির্বাণকে সেসবের খরচ জুগিয়ে যেতে হয়েছে। রুমকি কীভাবে বড়ো হল, সুজাতা কখন যে যৌবন পেরিয়ে গেলেন– দেখা হয়নি অনির্বাণের।

এতদিন, এতগুলো বছর পরে সুজাতার সঙ্গে আবার সেতু গড়ে তুলতে গিয়ে দেখলেন, কোথায় যেন আটকে যাচ্ছে। সুজাতার সমস্ত জীবনের একটিই অভিমুখ– মেয়ে রুমকি, রুমকির নাচ। তাঁর সব ভাবনা, স্বপ্ন, গল্পের বিষয়, নাচকে ঘিরে রুমকির কেরিয়ার। মেয়েকে প্রাণাধিক ভালোবাসলেও অনির্বাণ সুজাতার মতো মেয়েসর্বস্ব হয়ে উঠতে পারেননি। আর পাঁচটা বিষয়ে তাঁর সমান আগ্রহ। তিনি নিয়মিত খুঁটিয়ে খবরের কাগজ পড়েন, মেয়ের নাচ ছাড়াও নাটক, সিনেমা দেখতে ভালোবাসেন, বিভিন্ন খবরের চ্যানেলগুলো তাঁর দেখা চাই, ছোটো হলেও তাঁর নিজস্ব একটি বন্ধুবৃত্ত আছে। এসব কিছু নিয়ে তিনি সুজাতাকে নতুন করে পেতে চেয়েছিলেন, পাননি। এখন তিনি দেরি করে ঘুম থেকে ওঠেন, নিজস্ব ছন্দে কেটে যায় সকাল থেকে সন্ধে, নিজের ছোটো ছোটো ভালো লাগাগুলোর সঙ্গে। বেলায় একবার নীচেরতলায় মেয়ের নাচের ঘরে উঁকি দিয়ে দেখেন মেয়ে নাচে মগ্ন, সুজাতা চায়ের কাপ হাতে জগৎ-ভুলে মেয়ের নৃত্যরতা রূপ দেখছে। কিংবা, মা-মেয়ে মিলে ভবিষ্যৎ কোনও অনুষ্ঠানের পরিকল্পনায় ব্যস্ত। এক ঝলক দেখে সরে আসেন তিনি। মেয়ে অবশ্য যাওয়া-আসার সময় তাঁর সঙ্গে দেখা না করে যায় না।

আসলে রুমকি আর সুনন্দন যে-ফ্ল্যাটটায় থাকে, সেটায় জায়গা বড়ো কম। তাই প্রতিদিনই দশটার মধ্যে ও চলে আসে এখানে। সুজাতার তিল তিল পরিশ্রম, স্বপ্ন ও সাধে গড়ে উঠেছে যে বাড়ি– ‘ভঙ্গিমা’। পুরো বাড়িটা যেন নাচের একটি মুদ্রার মতো দাঁড়িয়ে। একতলার গোটাটাই প্রায় হলঘর। রুমকির প্র্যাকটিস, ক্লাস, অনুষ্ঠানের মহড়া সবই চলে সেখানে। ছোটোখাটো অনুষ্ঠানও হতে পারে হেসে খেলে। হয়ও। তার জন্যে লাগোয়া একটা ড্রেসিং রুমও আছে। এছাড়া দুটো টয়লেট, একটা শুধু রুমকির, অন্যটি ছাত্রীদের। আর আছে একটা ছোট্ট কিচেন। প্র্যাকটিসের ফাঁকে ফাঁকে কফি বা হেলথ ড্রিংক, স্যান্ডউইচ– টুকিটাকি সবই জোগানো যায় প্রয়োজনমতো। রুমকি যতক্ষণ থাকে, সুজাতা পারতপক্ষে দোতলায় আসতে চান না। তাঁর নিজের হাতে লাগানো বীজ কীভাবে আস্তে আস্তে মহিরুহ হয়ে উঠছে তার প্রতিটি মুহূর্ত তিনি উপভোগ করতে চান তারিয়ে তারিয়ে। সন্ধেবেলা বাড়ি ফেরার পথে সুনন্দন তুলে নিয়ে যায় রুমকিকে। কখনও-কখনও ওর নাইট-শিফট থাকলে রুমকি তাঁর কাছেই থেকে যায়। দুই সখীর মতো গল্পে গল্পে কেটে যায় রাত, বলা বাহুল্য, যে গল্পের পুরোটাই নাচ নিয়ে। আরও, আরও ভালো হতে হবে, আরও আয়ত্ত করতে হবে মুদ্রাগুলি– একথা আজও পাখিপড়ার মতো করে তিনি বুঝিয়ে চলেন মেয়েকে।

রুমকি যখন প্রথম তাঁকে জানাল, সে সুনন্দনের প্রেমে পড়েছে, মনে মনে প্রমাদ গুনেছিলেন সুজাতা। বিয়ে, সংসার, সন্তানপালন– এসব সাধারণ মেয়েদের জন্যে। এসবে জড়িয়ে পড়লে ওর এই ঝকঝকে কেরিয়ার একদম বরবাদ হয়ে যাবে। রুমকি আর পাঁচটা মেয়ের মতো হেঁশেল আর বাচ্চা সামলাচ্ছে– এ দৃশ্য কল্পনা করতেও ভয় পান সুজাতা। সুনন্দন আইটি-তে বড়ো চাকরি করে, লাখ দেড়েক মাইনে, প্রায়ই বিদেশ যেতে হয়– এসব শুনেও মন গলেনি তাঁর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রুমকির জেদ আর অনির্বাণের প্রবল আগ্রহের কাছে মাথা নোয়াতে হল তাঁকে। তবে, ঠাকুর বাঁচিয়েছেন, সুনন্দন আর-পাঁচটা বাঙালি ছেলের মতো ঘরকুনো নয়। বউকে জড়িয়ে বসে থাকার সময় নেই তার। সবসময়ই ছুটছে। ভালোই হয়েছে। যে যার কাজ নিয়ে ব্যস্ত। শ্বশুর-শাশুড়ি টাটানগরে থাকে। তাই ওসব ঝামেলাও নেই। সেন্টার থেকে ডেলি রোজের আয়া রেখে নিয়েছে। সে-ই সংসার সামলায়। কামাইয়ের ভয় নেই। রুমকি পুরোপুরি নাচে মন দিতে পারছে। আর কী চান সুজাতা।

তবু কেন যে এতটা খালি-খালি লাগে। একটা শূন্যতা, হাহাকার সোফার তলায় লুকোনো বেড়ালের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে থেকে থেকে। কী যেন একটা নেই। সুনন্দন যখন রুমকিকে নিতে আসে, গাড়ি থেকে নামে না, ঘনঘন হর্ন বাজায়। ওই শব্দটা বুকে এসে ধাক্বা মারে যেন। মনে হয়, রুমকির ওপর সব অধিকার সুনন্দনেরই, তিনি কেউ নন। যেন পরের ধন চুরি করে এনেছেন, সে এসেছে নিজের জিনিস ফেরত নিতে। রুমকিও হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে ওঠে, দ্রুত গাড়িতে উঠে চলে যায়, মাকে বিদায় জানাতেও মনে থাকে না কোনও-কোনও দিন। কেমন যেন সুর কেটে যায় সারাদিনের।

পরের দিন আবার সব তিক্ততা মুছে নতুন করে শুরু করতে চান সুজাতা। তিনি বিশ্বাস করেন প্রতিদিন একটা নতুন দিন। কিন্তু রুমকি না আসা পর্যন্ত কেমন যেন একটা ছটফটানি তাঁর মধ্যে, খালি খালি লাগে সমস্ত সকাল।

চা শেষ করে আজ নীচের ঘরে এসে ফার্নিচারের ধুলো ঝাড়ছিলেন সুজাতা। ধুলো থাকার কথা নয়, তাঁর বহু বছরের কাজের লোক কমলা অনেক যত্ন নিয়েই ঘরদোর ঝাড়ামোছা করে। বিশেষত দিদির এই নাচের ঘরটিকে মন্দিরের মতো ধুয়েমুছে রাখার নির্দেশ আছে তার ওপর। তবু রোজ সকালে কায়াহীন ধুলোই ঝাড়েন সুজাতা, ঝাড়তে ঝাড়তে তাঁর মনও পরিষ্কার হয়ে আসে।

আজ ঝাড়তে ঝাড়তে, কী মনে হল, আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালেন। ত্বকের সে মসৃণতা আর নেই, চুলের রুপোর ঢল লুকোতে নিয়মিত কালার করতে হয়, তবু শরীরের মাপজোকে তিনি এখনও তরুণী। তাঁর স্তন, কোমর এখনও টানটান। ঘাড়ের ভঙ্গিমায় উদ্ধত ঘোটকীর আভাস আসে। পেটের ওপর আনমনে হাত রাখেন সুজাতা। রুমকির পর কাউকে আনতে পারেননি সাহস করে। অবস্থা তেমন ছিল না। আজকাল বড্ড একা লাগে। রুমকি যখন তাঁর গর্ভে ছিল, সেই অপেক্ষায় উদ্বেল দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যায়। নতুন কাউকে পৃথিবীতে আনার আনন্দ… বুক দুটো টনটন করে ওঠে, দুধের ভারে যেমন হতো সে সময়।

হঠাৎ আয়নায় রুমকির নির্মেদ, সুঠাম শরীরটা ভেসে ওঠে। কখন এল! কই, গাড়ির শব্দ পাননি তো? এত ডুবে ছিলেন নাকি নিজের ভাবনায়! লজ্জা পেয়ে যান সুজাতা। তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়ান মেয়ের মুখোমুখি। লাল টপ, ব্লু জিন্স আর অক্সিডাইজড দুলে ওকে কী দারুণ দেখাচ্ছে। ঠোঁটে ন্যুড লিপস্টিক আর চোখে ঘন কালো কাজল। ব্যাস, আর কোনও মেক-আপ নেই। কিন্তু ওর মুখ তো অন্যদিনের মতো ঝলমল করছে না? চিন্তার ছাপ স্পষ্ট মুখেচোখে।

‘কী রে? কফি করে নিয়ে আসি?

‘না মা, বোসো, তোমার সঙ্গে কথা আছে।’

ভয়ে বুক দুরদুর করে ওঠে সুজাতার।

‘কী কথা? তোকে কেমন যেন দেখাচ্ছে।’

‘মা আমরা কদিন ধরেই আলোচনা করছি, ইনফ্যাক্ট ইচ্ছেটা আমারই, মানে মা হবার এই এক্সপেরিয়েন্সটা– মানে আমি বাচ্চা চাই মা।’

ধপ করে একটা মোড়ায় বসে পড়েন সুজাতা। ঠিক এই ভয়টাই তিনি করে আসছেন রুমকির বিয়ের পর থেকে। বাচ্চা, ন্যাপি পালটানো, রাত জাগা– একেবারে শেষ হয়ে যাবে কেরিয়ারটা। মিনিমাম দু-তিন বছর স্টেজ থেকে সরে থাকতে হবে। এই ঈর্ষণীয় ফিগারটাই কি আর ধরে রাখতে পারবে? ওঃ, বোকা, কী বোকা মেয়ে! আবার বলে কিনা ওর ইচ্ছে, সুনন্দন যে সুকৌশলে ওর কেরিয়ার শেষ করে দিতে চাইছে, বুঝতেও পারছে না। মা হবার এক্সপেরিয়েন্স, হুঁ! বিয়ের আগে ঠিক এমনই বলেছিল, বিয়ের এক্সপেরিয়েন্সটা নাকি ওর নাচের জন্যে জরুরি। মা হতে চাই! হায় ঈশ্বর! মা হওয়ার মানে বুঝিস? মা হওয়া মানে নিজের সবকিছু সন্তানের জন্য নিঃশেষ করে দেওয়া, যেমন তিনি করে চলেছেন সারা জীবন ধরে। রাগে, দুঃখে কথা বেরোয় না সুজাতার মুখ দিয়ে।

মায়ের এই ভাবান্তর খেয়াল করে না রুমকি। যেন কোনও ড্রিম প্রোজেক্টের প্ল্যান বলছে, এমন তদ্গত ভাবে বলে যায় অনর্গল, ‘কিন্তু, আমি তো জানি, কেরিয়ারের এই পিক পয়েন্টে বাচ্চা নেওয়া মানে অনেকখানি পিছিয়ে পড়া। এবছরেই কলামন্ডলমের স্কলারশিপটা পাওয়ার কথা চলছে, পেলে তো চেন্নাইতে চলে যেতে হবে। সুনন্দনও দু-তিন মাসের মধ্যে স্টেটস-এ চলে যাবে। তিন বছর তো থাকবেই। তার মানে এখনই বাচ্চা না নিলে… সামনের বছর আমিও তিরিশ পেরিয়ে যাব। তার মানে আরও কমপ্লিকেশন।’

সুজাতা এর পরেও কোনও মন্তব্য করেন না। ওর মুখ থেকে পুরোটা শুনে নিতে চান আগে।

‘তো সুনন্দন একটা ওয়ে আউট বার করেছে। যাতে বাচ্চাও আসে, আমাদের কেরিয়ারেরও কোনও ক্ষতি না হয়।’

অ্যাডপ্ট করবে নাকি? সুজাতা একটু বুকে বল পান, উদগ্রীব হয়ে ওঠেন মেয়ে এবার কী বলে শোনার জন্য।

‘সারোগেট মাদার জানো তো, যারা কিছু টাকার বিনিময়ে গর্ভ ভাড়া দেন। মানে সবকিছু আমাদেরই রইল, শুধু বাচ্চা বেড়ে উঠবে এক ভাড়া করা মহিলার পেটে, জন্মের পর বাচ্চাটাকে আমরা নিয়ে নেব, আফটার অল আমাদেরই বাচ্চা।’

সুজাতা ধীরে ধীরে মাথা নাড়েন। এবার রুমকি অস্থির হয়ে ওঠে, ‘কী হল মা? তোমার মত নেই? তুমি কি বেবির কেয়ার নিয়ে ভাবছ? আয়া রাখব, তাছাড়া তুমি তো আছোই।’

‘হ্যাঁ, আমি তো আছিই। সেইজন্যেই স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি। আমি থাকতে, তোমরা কী করে ভাবলে এসব?’

‘ওঃ কাম অন মা, তুমি তো কখনও এত ব্যাকডেটেড ছিলে না। এসব খবর তো কাগজেই হামেশা বেরোচ্ছে। কলকাতাতেই কত হচ্ছে। আচ্ছা, যারা খুব ব্যস্ত, তারা কী করবে বলো? তোমাদের দিন একরকম কেটে গেছে। তুমি যেমন শুধু আমাকে নিয়ে লেগে ছিলে, আমার পক্ষে কি তা সম্ভব?’

‘না সম্ভব নয় রুমকি। সুনন্দন খুব ম্যাচিওর্ড ছেলে, ও ঠিকই ভেবেছে। কিন্তু আমি বলতে চাইছি, আমি থাকতে অন্য ভাড়া করা মহিলার কথা তোমরা কী করে ভাবলে? হাইজিনের ব্যাপার আছে, পরিবেশ আছে, শিক্ষা-সংস্কৃতির তফাত আছে। তাছাড়া আইনি প্যাঁচপয়জার কতরকম হয় বোঝো তোমরা? সে যদি দাবি করে বসে বাচ্চাটা তারই? এরকম ঘটনাও তো ঘটেছে।’

রুমকি বিভ্রান্তের মতো মার দিকে তাকায়। সারাজীবন সমস্ত সংকট মুহূর্তে যেভাবে তাকিয়েছে।

‘শোন রুমকি, বাইরের আজেবাজে কোনও মহিলা নয়, তোর সন্তান বেড়ে উঠবে আমার শরীরে, সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে, বুঝলি?’

রুমকির সব কেমন গুলিয়ে যায়। তার সন্তান থাকবে মায়ের গর্ভে! সে কী হবে তার তাহলে? দিদি না মা? মার মাথার ঠিক আছে তো? বাবা শুনে কী বলবে? আর সুনন্দন? একবার সুনন্দন বলেছিল, ‘তোমার মা কিন্তু এখনও বেশ অ্যাট্রাকটিভ।’ সেই নিরীহ কথাটাও কেমন কুৎসিত লাগে এই মুহূর্তে। অসহায়ের মতো সেও ধপ করে বসে পড়ে আর একটা সোফায়।

‘তুই কেন এত চিন্তা করছিস রুমকি? তোর বাচ্চা হলে এমনিতে তো তাকে আমাকেই মানুষ করতে হবে। তুই কি তাকে সময় দিতে পারবি? তার চেয়ে এই ভালো হল না? গোড়া থেকেই সে আমার সঙ্গে জড়িয়ে গেল আষ্টেপৃষ্ঠে, ওকে মানুষ করতে গেলে কখনও মনে হবে না পরের বাচ্চা মানুষ করছি। তোর মতো ওকেও গোড়া থেকে গাইড করতে পারব, ছকে দিতে পারব ভবিষ্যৎ।’

স্বপ্নে টলটল করে সুজাতার দুচোখ। খালি-খালি ভাবটা উধাও হয়ে যায় বুক থেকে। আবার যেন পুরোনো উদ্যম ফিরে পেয়েছে তাঁর শরীর। সামনে এখন অনেক কাজ, আবার তাঁর হাতে গড়ে উঠতে চলেছে এক নবজীবনের রূপরেখা।

‘মনে হবে না পরের বাচ্চা মানুষ করছি।’ মার এই কথাটা কেমন যেন কানে লাগে, রুমকি কেঁপে ওঠে একটু, পরমুহূর্তেই সে নিজেকে সামলে নেয়। ঠিকই তো বলেছে মা। তার সামনে অনেক কাজ। সে একজন শিল্পী, শুধুই শিল্পী, আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো জীবনের ছোটো-ছোটো চাওয়া-পাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে তার চলবে? সমাজ, সংসার, চরাচর মুছে যায় তার চোখের সামনে থেকে, শুধু ভেসে ওঠে একটি মঞ্চ, দুটি নৃত্যপরা পা, তারই ওপর সমস্ত আলো। পা দুটি নেচে যাচ্ছেই, নেচেই যাচ্ছে নিজের ছন্দে। মাকে জড়িয়ে ধরে রুমকি।

সুজাতা অবশ্য বাস্তববোধ হারাননি। সিদ্ধান্তটা তো শুধু আবেগের নয়। অবশ্যই ডাক্তারের মতামত নিতে হবে, জেনে নিতে হবে এই গুরুভারের জন্যে তাঁর শরীর কতটা প্রস্তুত। আর অনির্বাণ, তার মতটাও…

রুমকি কি তাঁর মনের কথাটা পড়েই বলে, ‘বাবা কী বলবে মা?’

‘বাবার ব্যাপারটা তুই আমার ওপর ছেড়ে দে। মানুষটা কোনোওদিন আমার কথা ফেলেনি। আর সুনন্দন, সত্যি কত আধুনিক মনের ছেলে। আমরা খুব লাকি রে রুমকি!’

গভীর প্রশান্তিতে রুমকিকে বুকে টেনে নেন সুজাতা। তাঁর গর্ভের ওম উষ্ণ পৃথিবীকে উষ্ণতর করে তোলে।

 

কার্তিকের বনলতা

রবিবার। সন্ধ্যায় চা-দোকানে জমজমাট আড্ডা। ছুটির দিন হওয়ায় উপস্থিতির সংখ্যাও বেশি। সেই কলেজ লাইফে শুরু, দেড়যুগ পেরিয়ে আজও চলছে। সারাদিনের কাজকর্মের শেষে এখানে মিলিত হওয়াটা এখন অভ্যাস। কর্মসূত্রে যাদের বাইরে থাকতে হয়, সপ্তাহান্তে ছুটির দিনে তারা মিলিত হয়। সুখ-দুঃখের কথা হয়, বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা হয়, এমনকী বিতর্কিত বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্কও হয়। আজকের বিতর্কের বিষয় যেমন পুরসভা নির্বাচন। অর্থাৎ শাসকদল-কে সমর্থন করা উচিত কি না। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়নি। সমস্ত বিতর্কে জল ঢেলে দিয়েছে কার্তিকের হাসি হাসি মুখে আবির্ভাব।

বন্ধুদের মধ্যে কার্তিক একমাত্র আইবুড়ো। এখনও হাল ছাড়েনি। গত পাঁচ বছরে কত মেয়ে দেখেছে তার হিসেব নেই। এক জনকেও মনে ধরেনি। অথচ তাদের অনেকেই রূপে-গুণে সামাজিক প্রতিষ্ঠায় সব দিক থেকেই ঈর্ষণীয়। আমাদের অনেকেই ওরকম কোনও মহিলাকে জীবনসঙ্গী হিসাবে পেলে রীতিমতো গর্ব অনুভব করতাম। কার্তিক অপছন্দ করছে।

– কেন রে? এর থেকে বেশি আর কী চাওয়ার থাকতে পারে?

– সে কথা বলিনি তো।

– তবে অপছন্দ কেন?

– ঠিক জানি না। তবে যেমন চাইছি ঠিক তেমনটা নয়।

– কেমন চাইছিস?

– তাও জানি না। মানে বুঝিয়ে বলতে পারব না। ধর এরকম হবে, যাকে দেখলে মনটা ভরে যাবে। মনে হবে এতদিন তো একেই খুঁজছিলাম। এর কাছেই গচ্ছিত আছে আমার সুখের ঘরের চাবি। সে দেখতে সুন্দরী হতে পারে আবার নাও হতে পারে, কালো হতে পারে আবার ফরসাও হতে পারে, বেঁটে হতে পারে আবার লম্বাও হতে পারে, রোগা হতে পারে আবার মোটাও হতে পারে।

– এই থাম। কার্তিককে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, নেশাটেশা করে এসেছিস নাকি! ভাট বকতে শুরু করলি…

বন্ধুদের মধ্যে কবিরত্ন হিসাবে খ্যাত সপ্তর্ষি হোড় কথার জের টেনে নিয়ে বলেছিল, তোরা থাম। কার্তিকের সমস্যাটা আমি বুঝতে পেরেছি। ও বনলতা সেন খুঁজছে। ‘আমাদের দু’দণ্ডের শান্তি দিয়েছিল নাটোরের…’

– তো কোথায় সে নাটোর, ঠিকানাটা দে, খুঁজে আনছি। প্রয়োজন হলে পাতাল ফুঁড়ে পৃথিবীর ওপ্রান্ত থেকেও তাকে তুলে আনব। কার্তিকের জন্য আমরা সব করতে পারি।

কার্তিক গম্ভীর হয়ে গিয়েছিল। সব বিষয়ে ঠাট্টা তার অপছন্দ। ইদানীং একটা জিনিস সে লক্ষ্য করছে, তাকে নিয়ে হাসিঠাট্টা করাটা বন্ধুদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সেদিন থেকেই এ বিষয়ে বন্ধুদের সাথে কথা বলা সে বন্ধ করে দিয়েছে। তবে মনের মানুষ খোঁজার উৎসাহে কোনওরকম ছেদ পড়েনি। প্রতি রবিবারই নিয়ম করে কোথাও না কোথাও মেয়ে দেখতে যাচ্ছে।

আজই প্রথম ব্যতিক্রম ঘটল। কার্তিকের হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে মুহূর্তে ভ্যানিস হয়ে গেল নির্বাচন। বদলে গেল আলোচনার বিষয়। কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে একটাই প্রসঙ্গ

– মেয়ে পছন্দ হল?

– মেয়ে দেখতে কেমন রে?

– পড়াশোনা?

– বাড়ি কোথায়?

– হাইট?

– ছবি এনেছিস?

একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্নের মুখে পড়েও কার্তিক আজ বিব্রত হল না। বরং মুখের হাসিটি আরও চওড়া হল। বসতে বসতে বলল, বউদি এককাপ চা। তারপর ফস করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল। না না বিড়ি নয়, সিগারেটই। দেখতে একটুও ভুল হচ্ছে না আমাদের। মৌজ করে একটা টান দিয়ে বলল, তোদেরকে কিছু বলাও বিপদ। সব বিষয়ে ইয়ার্কি মারাটা তোদের অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। আবার না বলেও থাকা যায় না। হ্যাঁ, মেয়ে পছন্দ হয়েছে। অনেকটা সেই মেয়ের মতো। শান্তনু জানে, সেই যে কাকদ্বীপ পাঁচ মাইল…

একটু থমকাই। মুহূর্তমাত্র। মনে পড়ে যায়, জীবনের স্মরণীয় ঘটনাগুলোর একটা। কার্তিকের জীবনে তো বটেই।

প্রায় দশ-বারো বছর আগের ঘটনা। তিন বন্ধু মিলে বকখালি বেড়াতে গিয়েছি। তিন জনই কাঠ বেকার। একমাত্র টিউশনি ভরসা। সাধ্যের মধ্যে সাধ পূরণের জন্য তাই কাছেপিঠে ভ্রমণের পরিকল্পনা। তাও মাত্র দু’দিনের টুর। পরের দিন হোটেল ভাড়া বাঁচানোর জন্য বারোটার মধ্যে রুম ছেড়ে দিয়েছি। ফুটপাথের হোটেলে খাওয়াদাওয়া সেরে একটায় কলকাতাগামী বাসে।

পাশাপাশি তিনটে সিটে আমরা তিনজন। বাস ছাড়তেই জুতো-মোজা খুলে আরাম করে বসলাম। নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করছি। শান্তনু একটু বেশি কথা বলে, মূলত সেই বকছে। মাঝে মধ্যে আমি। কার্তিক একেবারে চুপচাপ। হঠাৎ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ আটকে গেল। বিন্দু বিন্দু ঘাম। অথচ বাস চলছে স্পিডে। জানলা দিয়ে হু হু করে হাওয়া ঢুকছে।

– কী ব্যাপার কার্তিক, এত ঘামছিস?

– ও কিছু না, এমনিই।

– জানলায় বসবি?

– না, ঠিক আছে।

বাস ছুটে চলে। আমরা ফিরে আসি পুরোনো প্রসঙ্গে। বকবক করি। কিছুক্ষণ পর আবার তাকাই কার্তিকের দিকে। চোখ মুখ লাল। দর দর করে ঘামছে। কেমন একটা অস্বাভাবিক দৃষ্টি।

– শরীর খারাপ লাগছে?

– না। কার্তিক মাথা নাড়ে।

– চোখ মুখ লাল কেন?

– গরমে বোধহয়।

– দেখিস, লুকাসনে। শরীর খারাপ লাগলে বলিস। সঙ্গে ওষুধপত্র আছে।

বাস ততক্ষণে কাকদ্বীপ পার হয়েছে। ভালোই চলছে। এভাবে চললে ঠিক সময়েই ধর্মতলা পৌঁছে যাব। পরবর্তী স্টপেজ পাঁচ মাইল। খুব ছোটো জায়গা। হাতে গোনা গুটি কয় দোকান নিয়ে গ্রাম্য বাজার। বাস এসে স্টপেজে থামতেই তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়ায় কার্তিক। এক ছুটে বাসের দরজার দিকে এগোতে এগোতে বলে, আর পারছি না। জোর চেপেছে।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে নেমে যায়, ব্যাগপত্র ফেলে। হাতে কেবল জলের বোতলটা। তড়িঘড়ি আমরাও এগিয়ে যাই মালপত্র নিয়ে। এক হাতে লাগেজ, অন্যহাতে জুতো। কিন্তু নামতে পারি না, তার আগেই বাস ছেড়ে দেয়। কনডাক্টরকে বলি বাস থামাতে। সে রাজি হয় না। এটা লোকাল বাস নয়। তারপর সরকারি। নিয়মের বাইরে সে বেরোবে না। অনেক কাকুতিমিনতির পর এবং অন্যান্য প্যাসেঞ্জারের আবেদনে যদিও বা বাস থামে, ততক্ষণে পাঁচ কিলোমিটার এগিয়ে এসেছি।

হাঁটু অবধি গোটানো প্যান্ট, হাতে জুতো এবং লাগেজ– এমন কিম্ভুত অবস্থায় নামতে দেখে লোকজন বিস্ময়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেন অন্যগ্রহের জীব দেখছে। কৌতূহল চাপতে না পেরে দু’একজন এগিয়ে আসে। জানতে চায়। সমস্ত শোনার পর তারাই একটা ভ্যান-রিকশার ব্যবস্থা করে দেয়।

মিনিট কুড়ি-পঁচিশের ব্যবধানে ‘পাঁচমাইল’ স্টপেজ। স্টপেজ লাগোয়া একটা পান গুমটিতে ঢুকে জিজ্ঞাসা করি, দাদা এখানে ল্যাট্রিন কোথায়?

– বলতে পারব না। আমার কাছে নেই।

– না না, আমরা কিছু কিনতে আসিনি। জানতে চাইছি বাজারে পায়খানা ঘর কোথায়?

দোকানি লোকটা আমাদের দিকে সন্দেহের চোখে তাকায়, কী ব্যাপার বলেন তো? একটু আগে একজন পায়খানা খুঁজতে এসেছিল, এখন আপনারা…

– আমরা তাকেই খুঁজতে এসেছি।

– তা এখেনে কেন, দ্যাখেন না মাঠে গিয়ে। চারপাশে অনেক মাঠ আছে। তাকেও মাঠে পাঠিয়েছি।

বাস স্টপেজকে কেন্দ্র করে ছোট্ট বাজার। বাজার পেরোলেই মাঠ। যে-কোনও দিকে কয়েক মিনিট হাঁটলেই আদিগন্ত চাষের জমি। আন্দাজে কোন দিকে খুঁজতে যাব? বরং এখানেই অপেক্ষা করি। যে দিকেই যাক কাজকম্ম মিটিয়ে এখানেই ফিরে আসবে। বাজার চত্বরেই ঘোরাফেরা করি আমরা।

বেশ অনেকক্ষণ বাদে বাবু এলেন হাসতে হাসতে। চোখ মুখ স্বাভাবিক।

– হয়েছে? জিজ্ঞাসা করলাম।

কার্তিক ঘাড় নাড়ে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে… বাপরে, কী জায়গা! জীবনে ভুলব না। উফ্!

– কেন কী হয়েছে?

– সে অনেক কথা, কার্তিক কোনওরকম রাখঢাক না করেই বলে, বাস থেকে নেমে প্রথমেই চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। দেখতেই পাচ্ছিস এটা একটা বাজার। এমন জায়গায় বারোয়ারি ল্যাট্রিন থাকা স্বাভাবিক। দু’জন লোক ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে গল্প করছিল। তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলাম, দাদা এখানে পায়খানাটা কোথায়? আচমকা এমন প্রশ্নের জন্য লোক দুটো মোটেই প্রস্তুত ছিল না। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে আমার আপাদমস্তক ভালো করে দেখে নিয়ে প্রশ্ন করল, বাইরের মানুষ?

– আজ্ঞে হ্যাঁ।

– কোথায় বাড়ি?

– কোলকাতা।

– এখানে কার বাড়িতে আসা হয়েছে?

– আজ্ঞে, কারও নয়।

– তবে বুঝি কাজে এসেছেন?

– তাও না।

– তবে?

– পায়খানা করতে।

– কোলকাতা থেকে পাঁচমাইল এসেছেন হাগতে! ঠাট্টা করছেন আমার সাথে। জানেন আমি কোন গাঁয়ের মানুষ? লোকটা খড়গহস্ত হয়ে ওঠে। এই মারে তো সেই মারে। অবস্থা বেগতিক দেখে তাড়াতাড়ি সামলে নিই, সমস্ত ঘটনা সংক্ষেপে জানিয়ে অনুরোধ করি, যদি একটু সাহায্য করেন।

লোকটা শান্ত হয়। বিশ্বাস করে আমার কথা। বলে, দ্যাখেন আমরা ভীন গাঁয়ের মানুষ। কইখালির বাসিন্দা। এখান থেকে তিন মাইল। পঞ্চাত পোধান রফিকুল মোল্লার নাম শুনেচেন তো? আমরা সেই রফিকুল মোল্লার গাঁয়ের লোক। পাঁচমাইল এসেছি বাজার করতে। ছোটো ভাইয়ের সম্বন্ধি এয়েছে তো! নতুন কুটুম, বুঝতেই পারছেন… ডালভাত তো দেয়া যায় না। তাই কেজি খানিক পাখির মাংস নিলাম। এ দিগরের খবর আমরা বিশেষ জানিনে।

বুঝতেই পারছিস আমার অবস্থা। প্রায় প্যান্টে হব হব। আর উনি লাগলেন মহাভারত শোনাতে। শরীর জ্বলে যাচ্ছে অথচ কিছু বলতে পারছি না। লোকটার কথা শেষ হতেই বললাম, ধন্যবাদ। মানে কেটে পড়লাম। ওই যে পান-বিড়ির গুমটিটা দেখছিস না, ওখানে গেলাম। ভেতরে একটা লোক বসে দুলে দুলে বিড়ি বাঁধছিল। তাকেই জিজ্ঞাসা করলাম। আমার প্রশ্ন শুনে সেও এক দৃষ্টিতে তাকাল। ভ্রান্তি মেটাতে বললাম, আমি বাইরের মানুষ। জোর চাপায় বাস থেকে নেমে পড়েছি। বাজারে কোথাও পায়খানা নেই?

– না নেই। কী করে থাকবে শুনি। বাজার কমিটি তো করতে চেয়েছিল, পঞ্চাত পোধান বাধা দিল। আলাদা পার্টি বলে এমন কাঠি নাড়ল যে…

– আপনারা কোথায় করেন হঠাৎ চাপলে?

– রাজনীতির মুখে।

– প্লিজ দাদা, সত্যি বলছি জোর চেপেছে…

– জোর চেপেছে তো দাঁড়িয়ে আছেন কেন, জান না, চারদিকে এত মাঠ চোখে দেখছেন না?

পরামর্শটা মনে ধরে গেল। লোকালয় থেকে বেরোতে পারলেই ফাঁকা মতো একটা জায়গা দেখে বসে পড়া যাবে। আগে তো হালকা হই, পরের কথা পরে। হনহন করে হাঁটতে শুরু করি। বাজার ছাড়িয়ে মিনিট দু’য়েক হাঁটতেই আদিগন্ত মাঠ। নিরিবিলি দেখে এক জায়গায় রাস্তা থেকে নেমে পড়ি। আলপথ ধরে কিছুদূর এগোতেই দু’পাশে হাঁটু সমান উঁচু ধানের খেত। অনেকটা দূরের একটা জমিতে কিছু লোক কাজ করছিল। অনেকটাই দূরে, অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। পটাপট প্যান্টের হুক, জিপ সব খুলে ফেললাম। কোমর থেকে নামিয়ে সবে বসতে যাব, দূরের ওই জমি থেকে একজন চিৎকার করে উঠল, ও দাদা কী করছেন? কী করছেন?

বলতে বলতে লোকটা ছুটে আসে, পেছন পেছন আরও একজন।

তাড়াতাড়ি প্যান্টটা কোমরের উপর তুলে নিই। মারমুখী ভঙ্গিতে লোকদুটোকে ছুটে আসতে দেখে তখন আমার অবস্থা আরও খারাপ। কী করব বুঝতে পারছি না। পালাতে গেলে যদি চোর ডাকাত কিছু ভেবে বসে। সেক্ষেত্রে ধরা পড়লে গণপিটুনি অনিবার্য। তাছাড়া তল পেটের যা অবস্থা, দৌড়ানোর মতো পরিস্থিতিও ছিল না। অগত্যা দাঁড়িয়ে থাকাটাই ঠিক মনে হল।

লোকদুটি ছুটতে ছুটতে সামনে এসে দাঁড়াল। বলল, জানেন না এটা নিম্মল গ্রাম। সরকার নিম্মল গ্রাম ঘোষণা করেছে। এখানে বাহ্য ফিরতে কেউ আর মাঠে আসে না।

– তবে যে এত ময়লা দেখছি। চারপাশেই তো…

– সেইজন্যই তো আমাদের সন্দেহ। কারা এসব করে! অনেকদিন ধরেই তক্বে তক্বে আছি, আজ হাতে নাতে ধরেছি। এসব তাহলে আপনারই কাজ?

– কী বলছেন! আমি কী করে হব! আমি তো বাইরের মানুষ।

পুরো ঘটনাটা আরও একবার রিপিট করতে হল। লোক দুটো বিশ্বাস করল। একটু বোধহয় মায়াও হল আমার উপর। বলল, বাইরের লোক বলে ছেড়ে দিলাম। ভবিষ্যতে আর এমুখো হবেন না।

– হব না, কথা দিচ্ছি। কিন্তু এখন কোথায় যাব? আমার অবস্থা তো…

– গ্রামে যান। কারও বাড়িতে ঢুকে বলুন, ব্যবস্থা একটা হয়ে যাবে। এখানকার মানুষ ভালো। আপনাদের শহরের মতো না।

গ্রামে ঢোকার পথ বলে দেয় লোকটি। তলপেটে অসহ্য চাপ নিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করি। তা মিনিট পাঁচেকের পথ তো হবেই।

– এক মিনিট, কার্তিককে থামিয়ে দিই, বাস আসছে না?

– হ্যাঁ, বাসই তো। শান্তনু বলে।

আমরা তৈরি হই। বিকেল গড়িয়ে এখন প্রায় সন্ধ্যা। কোলকাতা পৌঁছোতে মাঝরাত হয়ে যাবে। সে হোক, এই পাণ্ডব বর্জিত জায়গা থেকে আগে পালাই। বাস না পেলে সারারাত রাস্তায় বসে কাটাতে হবে।

দেখতে দেখতে বাসটা সামনে এসে দাঁড়ায়। অল্প কিছু মানুষ নামে। ওঠার আমরা তিনজনই। বিশেষ ভিড় ছিল না। বসার জায়গাও পেয়ে গেলাম। কার্তিককে বললাম তারপর?

– গ্রামে তো ঢুকলাম। প্রথম দু-তিনটে বাড়ি ছেড়ে একটা পছন্দ হল। পছন্দ বলতে, প্রথম বাড়িগুলি বড়ো বড়ো, অবস্থাপন্ন পরিবার। ঢুকতে সাহস হল না। তুলনামূলক একটা একটু কমা। পাঁচ ইঞ্চি ইটের গাঁথনি, টালির চাল, পাশাপাশি তিনটে ঘর, অনেকটা স্কুল বাড়ির মতো। সামনে টানা বারান্দা। বারান্দার এক কোণে দুটি অল্প বয়সি বউ বসে গল্প করছিল। বাড়িতে অচেনা মানুষ ঢুকতে দেখে গল্প থামিয়ে আমার দিকে তাকাল। তাদের কাছেই আর্জি জানালাম, আমি বাইরের মানুষ। এখানে কেউ চেনাজানা নেই। হঠাৎ খুব পায়খানা পেয়েছে। কোথায় যাব বুঝতে পারছি না। আপনাদের বাড়িতে যদি একটু ব্যবস্থা হয়…

বউ দুটি বিস্মিত। যেন এমন আজব আবদার তারা জীবনে শোনেনি। আমার মত উজবুকও এই প্রথম দেখছে, এমন ভাবে তাকিয়ে আছে।

– পায়খানাটা কোনদিকে বলবেন?

আমার তখন এখন-তখন অবস্থা। এতটা হাঁটাহাটির পর শরীরের উপর আর কন্ট্রোল নেই। এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজতে লাগলাম সেই কাঙ্খিত জায়গাটা।

উত্তরে তাদের একজন গলা ছেড়ে ডাক দিল, ওমা মা, দ্যাখেন তো কী বলছে। একটা অচেনা লোক…

– কে! বাড়ির পেছন থেকে উত্তর এল বাজখাই গলায়। মা অর্থাৎ শাশুড়ি, ভারিক্বি চেহারার রাশভারি একজন মহিলা, মুখের কথা শেষ করেই সামনে এসে দাঁড়াল।

– কাকে চাই?

– আজ্ঞে, একটু ঢোক গিলে বললাম, একটু পায়খানায় যেতাম।

– তা এখেনে কেন? এপাড়ায় কী আর কোনও বাড়ি পায়খানা নেই!

– আমি তো বাইরের লোক, এখানকার কাউকে চিনি না।

– তাই বুঝি কচি বউ দুটোকে দেখে এ বাড়িতেই ঢুকতে ইচ্ছা হল! তোমার মতলব তো ভালো ঠেকছে না বাছা।

– বিশ্বাস করুন, মা কালীর দিব্যি…

আমার অবস্থা তখন কেঁদে ফেলার মতো। পারলে মহিলার পায়ে পড়ি। বিধি বাম, সেক্ষেত্রে নীচু হতে হবে। আর নীচু হলেই… মা গো! মাঝেমধ্যে পেটের মধ্যে এমন মোচড় মারছিল না… বউটির বোধহয় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু মায়া হয়েছিল। এতক্ষণে সে মুখ খুলল, মনে হচ্ছে লোকটা খারাপ না, সত্যি কথাই বলছে…

– তুমি থামো তো বাছা, আর ওকালতি কোরো না।

বউটি থতোমতো খেয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ভদ্রমহিলা আবার গর্জে উঠলেন, পরপুরুষের কষ্ট দেখে দরদ উথলে উঠছে না? আজ আসুক বাড়িতে… আর তুমিও বলিহারি! এখনও দাঁড়িয়ে আছো! বললাম না এখানে ওসব হবে না। পায়খানায় তালা মারা আছে। বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। শাশুড়ি বউমার ঝগড়া শোনার মতো অবস্থা তখন নেই। কিন্তু তালা মারা শুনে আপনা থেকে পা আটকে গেল। নিজের অজান্তেই প্রশ্ন করে ফেললাম, তালা মারা কেন?

– এখানে সব বাড়িতেই তালা মারা থাকে। সরকার বানিয়ে দিয়েছে তো।

– সে তো ব্যবহার করার জন্যে।

– কে বলেছে আমরা ব্যবহার করি না? বাড়ির মেয়েরা যায়, রাতবেরাতে আমিও যাই। মাঠে কেবল পুরুষ মানুষগুলো…

– ছিঃ ছিঃ মাঠে যায়! আপনাদের গ্রাম না নির্মল গ্রাম?

– অতশত জানি না, সবাই যায়। আমরাও যাই। তা তুমি এত কথা জিজ্ঞাসা করছ কেন? তুমি কি সরকারের লোক?

– না, আমি কার্তিক সরকার।

– ঠিক সন্দেহ করেছি। তা বাবা ভেব না আমি মিথ্যা বলছি। পায়খানা আমাদের আছে, অন্যদের মতো ভাড়ার ঘর বানাইনি। বিশ্বাস না হলে নিজের চোখে দেখে যাও।

– বেশ তো তালাটা খুলে দিন।

– চাবি তো নেই।

– হারিয়ে গেছে?

– না ছেলের কাছে। ছেলে বাজারে। মাছের দোকানে। ডেকে আনব?

– থাক, দরকার নেই।

আমার অবস্থা তখন শোচনীয়। অত সময় অপেক্ষা করার ক্ষমতা নেই। ভেতর-ভর্তি আবর্জনা একেবারে দ্বারপ্রান্তে এসে কড়া নাড়তে শুরু করেছে। যে-কোনও মুহূর্তে বাঁধ ভাঙবে। দুপুরে সস্তার হোটেলে খাওয়া উচিত হয়নি। যা হোক, মহিলার খপ্পর থেকে বেরিয়ে পাশের বাড়িতে ঢুকি।

রাস্তামুখো বাড়ি। বারান্দায় বসে একজন বয়স্কা, অন্যজন কিশোরী। মেয়েটি বৃদ্ধার পিঠের ঘামাচি মারছিল। দুজনের মুখই রাস্তার দিকে। আমাকে ঢুকতে দেখে বৃদ্ধা জিজ্ঞাসা করলেন, কে বাবা?

– আমাকে চিনবেন না, বাইরের মানুষ।

এক নিশ্বাসে এখানে আসার কারণ জানিয়ে আসল কথাটা পেড়ে ফেললাম।

– এসেছ ঠিক করেছ। কথায় বলে হাগা চাপলে বাঘের ভয় থাকে না। আমাদের মানুষটাও ওই রকম ছিল, এক মিনিটও দেরি করতে পারত না। বছর ভোর আমাশায় ভুগত তো…

– আঃ ঠাকমা! আবার তুমি শুরু করলে! মানুষটা বলে কষ্ট পাচ্ছে।

মেয়েটার দিকে চোখ যায়। শ্যামলা রং, দোহারা গড়ন, চোখ দুটো বেশ বড়ো বড়ো। মনে হল মায়াদয়া আছে। করুণ চোখে তাকালাম তার দিকে। গলায় আকুতি এনে বললাম যদি একটু সাহায্য করেন, সত্যিই আর পারছি না।

– তা বাবা, নাতনির হয়ে বৃদ্ধাই উত্তর দিলেন। সাহায্য যে করব সে উপায় নেই। পায়খানায় তালা মারা। চাবি কোথায় থাকে আমি জানি নে।

– আমি জানি, এনে দেব? মেয়েটি বলে উঠল।

– তা দে না, জানিস যখন বসে আছিস কেন! দেখছিস মানুষটা কষ্ট পাচ্ছে। আহারে! তোর দাদুও…

মেয়েটি ততক্ষণে চাবি এনে আমার সামনে দাঁড়িয়েছে। প্রায় ছোঁ মেরে তার হাত থেকে চাবিটা নিয়ে নিই। সেইসঙ্গে বেগটাও বেড়ে যায়। যাকে বলে মরণকামড়। সঙ্গে সঙ্গে ছুট লাগাই পায়খানার দিকে।

– গামছা নিলেন না? মেয়েটি পেছন থেকে চিৎকার করে।

ধুত্তোর গামছা। আমার হাতে তখন সুখের ঘরের চাবি। স্বর্গের চাবি বললেও বেশি বলা হবে না। পোশাক বদলাবার মতো ধৈর্য বা পরিস্থিতি কোনওটাই আমার তখন নেই। জলের বোতল হাতেই ছিল। জামাপ্যান্ট পরা অবস্থাতেই ভিতরে ঢুকে গেলাম।

– শান্তি?

– হ্যাঁ, শান্তি।

– তারপর?

– তারপর আর কী! হালকা হয়ে বাইরে বেরিয়ে দেখলাম মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটের কোণায় মিটমিট হাসি। মুখের দিকে তাকাতে একটু লজ্জা করছিল ঠিকই। কী আর করা যাবে। অন্যদিকে তাকিয়ে চাবিটা মেয়েটির হাতে দিলাম।

– কিছু বললি না?

– কী বলব! ধন্যবাদ জানালাম। মেয়েটা আড়চোখে একবার ওর ঠাকমাকে দেখে নিয়ে নীচু গলায় বলল, আবার আসবেন।

– হাগতে না প্রেম করতে?

– কে জানে!

– যাবি তো?

– পাগল!

ফিরে আসার পর যখন বেড়ানোর প্রসঙ্গ উঠেছে, অবধারিত ভাবেই কার্তিকের নাম এসে পড়েছে। কার্তিকের সঙ্গে সঙ্গে সে মেয়েটিও, যে তাকে পায়খানার, থুড়ি সুখের ঘরের চাবি এনে দিয়েছিল। কার্তিককেও দেখেছি মেয়েটির প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে। আমরা ওর পেছনে লেগেছি। কার্তিক কখনও খুশি হয়েছে, লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছে মুখ, আবার কখনও রেগে গেছে। বলেছে, সবকিছু নিয়ে আড্ডা ঠিক না।

তারপর যা হয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবই ফিকে হয়ে আসে। বয়স বাড়ে, সঙ্গে দায়িত্বও। এক সময় ভুলে যাই আমরা। কার্তিক বাদে এখন সকলে সংসারি। সংসারের চাপে বদলে গেছে জীবনের রুটিন। কেবল সন্ধ্যার আড্ডাটাই এখনও অপরিবর্তিত।

তবে আমরা ভুললেও, কার্তিক যে ভোলেনি, মনের গভীরে বাঁধিয়ে রেখেছে সযত্নে, এতদিনে সেটা পরিষ্কার হল। মেয়ে দেখার নামে এতবছর ধরে সে তার কাছেই ফিরতে চেয়েছে, এভাবেই মেটাতে চেয়েছে ঋণ, সেটা আমরা কীভাবে বুঝব!

এখন শুভ কাজ যত তাড়াতাড়ি সম্পন্ন হয় ততই মঙ্গল।

পত্রমিতালি

মাস ছয়েক হল সাতপাকে বাঁধা পড়েছে অরিত্রি। সবে সবে এমএ কমপ্লিট করেছে, তারপরেই সম্বন্ধ করে বিয়ে। বরানগরের সাহা বাড়ির জ্যেষ্ঠ পুত্র ঋদ্ধির সঙ্গে। অফিস কলিগের ছেলের বিয়েতে গিয়েই ঋদ্ধির বাবা-মায়ের চোখে পড়ে যায় অরিত্রি। পড়বে না-ই বা কেন, ফরসা, টিকোলো নাক, টানাটানা চোখ, যাকে বলে একেবারে প্রকৃত সুন্দরী। ব্যস তারপরেই পাকাদেখা, আর চারহাত এক করা।

অরিত্রির নতুন পরিবার বলতে ঋদ্ধি, শ্বশুর-শাশুড়ি আর সমবয়সি এক দেওর। ভীষণ ফিচেল। হবি বলতে সময় পেলেই শার্লক হোমস্-এর বই নিয়ে বসে পড়া। কেমন যেন সন্দেহপ্রবণ। সবেতেই নাকি রহস্যের গন্ধ পায় সে। আর একজন বিবাহিত ননদ। সাংসারিক কিছু সমস্যার জন্য ইদানীং বাপের বাড়িতেই থাকছে। তবে ভীষণ মিষ্টি স্বভাবের। যাই হোক অরিত্রি এগুলো বেশ এনজয়ই করে। এযুগের মেয়ে হলেও নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি অরিত্রির একেবারেই পছন্দের নয়। বরং বরাবরই সংযুক্ত পরিবারের প্রতিই তার ঝোঁক বেশি। সে তার পছন্দ মতোই পরিবার পেয়েছে বটে। সারাদিন কাজ বলতে শাশুড়ির হাতেহাতে টুকটাক কিছু। আরও একটি ব্যাপারে অরিত্রি বেশ প্রাচীনপন্থী। এই ফেসবুক, টুইটারের যুগেও সে পত্রমিতালিতেই আস্থাশীল।

সেদিনও বেলা এগারোটা নাগাদ শাশুড়ি আর দেওরের সঙ্গে বসার ঘরে গল্প করছিল অরিত্রি। শ্বশুর ধৃতিমান আর স্বামী ঋদ্ধি তখন অফিসে। সেই সময় কলিংবেলটা বেজে উঠল। সোহম-ই দরজা খোলার জন্য উঠে গেল। খানিক পরে একটা গোলাপিরঙা খাম নাকে দিয়ে শুঁকতে শুঁকতে ঘরে ঢুকল। খামটা অরিত্রির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এই নাও বউমণি তোমার চিঠি।’ ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি।

মুহুর্তেই অরিত্রির মুখচোখের রঙই বদলে গেল। একপ্রকার লাফিয়ে উঠেই সোহমের হাত থেকে চিঠিটা ছিনিয়ে নিল সে। নিজের ঘরের দিকে যাবার উপক্রম করতেই শাশুড়ি বিমলাদেবী প্রশ্ন করে বসলেন, ‘কার চিঠি বউমা?’

‘আমার বন্ধুর’ কোনওমতে জবাব দিয়েই নিজের ঘরের দিকে চলে গেল অরিত্রি।

বউমণির হাবভাব দেখে অবাক হয়ে গেল সোহম। এমনিতে তো অষ্টমঙ্গলার দিন-দুয়েক পর থেকেই চিঠি আসা শুরু হয়েছে। তবে সোহমের মারফত এই প্রথম। মনে মনে ভাবতে থাকল, এমন কার চিঠি যে হাতে পাওয়া মাত্রই বউমণির মুখে এক অদ্ভুত বিদ্যুৎ খেলে গেল? অমন ভাবে ছিনিয়েই বা নিল কেন? তার উপর খামের ওই সুগন্ধী! আরও যেন উসকে দিল সোহমের সন্দেহপ্রবণতাকে।

ভাবনায় বাধ সাধলেন বিমলাদেবী। চিন্তিত কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘হ্যাঁরে সোহম আজও দিদির কোনও ফোন বা চিঠিপত্তর কিছু এল না নারে?’

‘মা এব্যাপারে আমাদেরও তো কোনও তৎপরতা নেই বলো। আমরাও যেমন ভাবছি ওদিক থেকে কোনও সাড়া পেলে আমরা এগোব, তেমন ওরাও হয়তো সেটাই ভাবছে। তাছাড়া ওরা দিদিকে যেভাবে হেনস্থা করেছে, তাতে করে ওর আর ওবাড়িতে না যাওয়াই ভালো। ও এখানেই থাক।’ কথা বলতে বলতেই কানে ভেসে এল রবীন্দ্রসংগীত। সম্ভবত বউমণির ঘর থেকেই। ‘দ্যাখ সংসার থাকলে একটু-আধটু অশান্তি হয় বটে। পরে সব ঠিকও হয়ে যায়। তাছাড়া মা-বাবা যেমনই হোক জামাই তো আমাদের খুব ভালো। লজ্জায় হয়তো ফোন করতে পারছে না। চিঠি পাঠালেও তো পাঠাতে পারে। আচ্ছা বউমা তো মাঝেমধ্যেই পোস্ট অফিসে যায়, না? তা ওকে বললেই তো একটু খোঁজ নিতে পারে।’

‘তোমার বউমা তো তার বন্ধুকে চিঠি দিতে যায়। ননদের কথা ভাবার কি তার সময় আছে? এই দ্যাখো না পনেরো দিনের মাথায় দু-বার চিঠি এল বউমণির। সেদিন তো নিজেই নিল। আর আজ… সেই একই গোলাপি খামে সুগন্ধী দেওয়া চিঠি।’ সোহম বেশ গম্ভীর ভাবেই বলল।

‘বউমার এই চিঠির কথা ঋদ্ধি জানে? নিশ্চয়ই জানে।’ আশঙ্কা প্রকাশ করেও নিজেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেন তিনি। এমনিতে অরিত্রিকে নিয়ে অভিযোগের জায়গাই ছিল না বিমলাদেবীর। দেখতে যেমন, তেমনই মিষ্টি ব্যবহারও। সকলকে যত্ন করে খাওয়ানো, কেউ কষ্ট পেলে তা লাঘব করার চেষ্টা, একেবারে আপন করে নেওয়ার ক্ষমতা ছিল ওর। তবু মা তো। ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরাবে সেটাই তো স্বাভাবিক। এমনিই মেয়েকে নিয়ে যথেষ্ট চিন্তায় আছেন, তার উপর এখন আবার ছেলে। সোহমের কথাগুলো বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল বিমলাদেবীকে।

‘ঠিকানাটা দেখলি? কোথা থেকে এল চিঠিটা?’

সোহম কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দিল, ‘আমি কী করে জানব, বউমণির পেন ফ্রেন্ড। কাজেই ওটা বউমণিই জানবে।’

‘পেন ফ্রেন্ড’ আবার কী জিনিস রে?’ ভুরু কোঁচকালেন বিমলাদেবী।

‘মা তুমিও না! কী করে বোঝাই বলো তো? মানে পত্রমিত্র।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, এবার বুঝতে পেরেছি। ঋদ্ধি যখন ছোটো ছিল, তখন বাচ্চাদের পত্রিকা থেকে ঠিকানা খুঁজে খুঁজে ও তাদের চিঠি লিখে পাঠাত।’

‘মা, তুমি না খুব সহজ সরল। তোমাকে বোকা বানানো খুব সোজা। মানুষ বছরের পর বছর একসঙ্গে স্কুলে পড়ার পর সেইসব বন্ধুদের একটা সময় পর ভুলে যায়, আর এ তো কোন পত্রমিত্র। বউমণির মতো নিয়মিত পত্রমিত্র-র চিঠি আসতে কখনও দেখিনি।’

সোহমের কোথাও বেরোনোর ছিল বোধহয়। বন্ধু ডাকতে হনহন করে বেরিয়ে গেল। বিমলাদেবী খানিকক্ষণ সেখানেই বসে রইলেন। হয়তো কিছু ভাবছিলেন। তারপর গতানুগতিক ভাবে সাংসারিক কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

ঋদ্ধি আবার খিদে সহ্য করতে পারে না। খিদের সময় খাবার না পেলে ওর মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়। তাই বিকাল বিকাল জলখাবার বানাতে শুরু করে দেন বিমলাদেবী। সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে খেতে বসে, ‘ওহ্, অরিত্রি তোমার দাদা ফোন করেছিল। তোমাকে ফোনে না পেয়ে আমাকে কল করেছিল। কাল রমামাসি নাকি কে যেন আসবে ওবাড়িতে। তাই আমাদের যাওয়ার জন্য বলছিল। আমার তো সময় হবে না, তুমি ঘুরে এসো।’

‘ঠিক আছে। তুমি গেলে ভালো হতো। কিন্তু সময় না পেলে আর কী করা যাবে। সময় করে আমিই একবার দেখা করে আসব।’

পরদিন ঋদ্ধি অফিস যাবার পর অরিত্রি পরিপাটি হয়ে সেজেগুজে বাপের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল। রমামাসি অরিত্রির ছোটোমাসির বড়োজা। ছোটোমাসি মারা গেলেও ওনার জায়ের সঙ্গে অরিত্রির মায়ের ভীষণ ভালো সম্পর্ক। একেবারে মায়ের পেটের বোনের মতো। অসুস্থ থাকায় অরিত্রির বিয়েতে আসতে পারেননি। তাই আসার সময় আদরের অরিত্রির জন্য একছড়া সোনার মালা আর কানের দুল এনেছেন। সেটা পেয়ে অরিত্রি একেবারে আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে।

রমামাসির সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হওয়ায় সকলে গল্পে মশগুল হয়ে গেল। গল্পের মাঝে হঠাৎই অরিত্রির মা বিভাদেবীর কিছু মনে পড়ে যাওয়াতে ‘একটু আসছি’ বলে ভিতর ঘরে গেলেন। খানিক পরে একটা খাম হাতে করে নিয়ে এসে মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই নে অরি, পরশুদিন এটা এসেছিল। বলব বলব করে আর বলা হয়ে ওঠেনি।’ সেই গোলাপিরঙা খাম দেখে একপ্রকার মায়ের হাত থেকে কেড়েই নিল অরিত্রি।

‘কার কার্ড রে?’ অরিত্রির নেওয়ার ভঙ্গিমা দেখে প্রশ্ন করে বসল বউদি অনিন্দিতা।

‘কেন তুমি আমার পত্রমিত্র-র কথা জানো না? নতুন নাকি?’

‘বাবা, তোরা যে কীভাবে না দেখেশুনে একজন অচেনা লোকের সঙ্গে বন্ধুত্ব পাতাস কে জানে। এইভাবে আবার…’ বলতে বলতে হঠাৎই থেমে যায় অনিন্দিতা। মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায় তার। কোনও এক অশনিসংকেতের আভাসে মুহূর্তেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় তার।

‘হ্যাঁরে ওবাড়িতে এইরকম কোনও চিঠি যায় না তো?’ শঙ্কা প্রকাশ করে অনিন্দিতা।

‘কেন, না যাওয়ার কী আছে?’

‘তোর এই পত্রমিত্রের কথা ঋদ্ধি জানে?’

‘নাহ্। আর জানলেই বা কী হবে? আমি তো কোনও অন্যায় করছি না।’ সহজ ভাবে উত্তর দেয় অরিত্রি।

‘ভুলে যাস না অরি, তুই এখন বিবাহিত। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ভীষণ স্পর্শকাতর। সামান্য থেকে সামান্য জিনিসও অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কাজেই এমন কিছু করিস না, যেটাতে ওর বা ওর বাড়ির লোকের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে। ছেলেমানুষি ছাড়, এসব চিঠিপত্র দেওয়া-নেওয়া বন্ধ কর।’ অরিত্রিকে বোঝানোর চেষ্টা করে অনিন্দিতা।

‘বউদি তুমি ভালো করেই জানো আমাদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছাড়া আর অন্য কোনও সম্পর্ক নেই। এই সামান্য একটা কারণে আমার আর ঋদ্ধির সম্পর্কে ফাটল ধরবে, ঋদ্ধি আমাকে সন্দেহের চোখে দেখবে এটা আমি কিছুতেই মানতে পারছি না। সরি বউদি, তোমার এই অ্যাডভাইস-টা মানতে পারলাম না।’

গল্প আর কথার মাঝে বিকাল গড়িয়ে সন্ধে নেমেছে। বাড়িতে ফেরারও তাড়া ছিল। তাই আর কথা না বাড়িয়ে মাসির দেওয়া উপহারগুলো সঙ্গে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ফিরে গেল অরিত্রি।

দেখতে দেখতে আরও দুটো মাস কেটে গেল। শীত গড়িয়ে গরম হাওয়া বইতে শুরু করেছে। এইরকমই এক গ্রীষ্মের দুপুরে অরিত্রি স্নান সেরে ঘরে ঢুকে দেখল ঋদ্ধি মুখটা ভার করে বসে রয়েছে। তার দিকে ফিরেও দেখছে না। অথচ অন্যান্য দিন ভিজে চুলে অরিত্রিকে দেখে ঋদ্ধির যে কী হয় কে জানে। নিজেকে একদম কন্ট্রোল করতে পারে না। অরিত্রি নানা অছিলায় তাকে আকর্ষিত করার চেষ্টা করে। ইচ্ছে করেই বুক থেকে আঁচলটা খসিয়ে দেয় সে। কিন্তু কিছুতেই কোনও লাভ হচ্ছে না দেখে চিন্তিত স্বরে বলে ওঠে, ‘আজ কী হয়েছে তোমার? এত নির্লিপ্ত কেন?’

অরিত্রির গলার আওয়াজ শুনে ঘাড়টা ফিরিয়ে ঋদ্ধি বউয়ের হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিল, ‘তোমার চিঠি’। ঋদ্ধির কপালে অসন্তোষের ভাঁজ স্পষ্ট।

‘আমার চিঠি!’ চিঠির দিকে চোখ যেতেই আনন্দে হাসতে হাসতে খামটা খুলতে খুলতে বলল, ‘আরে এটা তো সুরজের চিঠি।’ বলেই চিঠিটা পড়তে শুরু করল।

সিগারেট ধরিয়ে টান দিতে দিতে প্রশ্ন করল, ‘সুরজ কে? এর কথা তো আগে কখনও বলোনি!’

‘আমার পত্রমিত্র। ভীষণ ভালো। ওর গুণের তুলনা হয় না।’ পড়তে পড়তেই জবাব দিল অরিত্রি। তারপর আবার চিঠির মধ্যে ডুবে গেল। পরে আয়নার সামনে বসে গুনগুন করে গাইতে থাকল। ঋদ্ধি আড়চোখে অরিত্রিকে পরখ করছিল। পরপুরুষের প্রতি স্ত্রীর প্রীতি কোন পুরুষই বা মেনে নিতে পারে? রাগ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কোনওমতে নিজেকে সংযত করে বেশ দৃঢ় ভাবেই বলল, ‘আজ খাবারদাবার পাওয়া যাবে নাকি?’

‘খাবার তো রেডিই আছে,’ বলে রান্নাঘরে চলে গেল সে। স্ত্রীর এত খুশির কারণ কী? ওই চিঠিতে কী এমন লেখা রয়েছে? কৌতূহল ধরে রাখতে না পেরে অরিত্রি যাওয়া মাত্রই আলমারি থেকে চিঠিটা বার করে পড়তে শুরু করল ঋদ্ধি। হিমাচল প্রদেশের কোনও এক গ্রাম থেকে চিঠিটা এসেছে। প্রতিটি ভাষায় রয়েছে পর্বতীয় সংস্কৃতির ছাপ। অরিত্রিকে সপরিবারে ওখানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছে সুরজ। নতুন বছরে কার্ড পাঠাবার জন্য অরিত্রিকে ধন্যবাদ জানিয়েছে, সঙ্গে ওর কিছু প্রশ্নের উত্তরও। চিঠির ভাষা আর লেখনী সত্যিই তারিফযোগ্য।

অরিত্রি খাবার দেওয়ার পর একে একে সকলে এসে টেবিলে খেতে বসে গেছে। ঋদ্ধি খেতে বসলেও খাওয়ায় বিন্দুমাত্র মন নেই তার। কেমন যেন উদাস। সোহম শুরু থেকেই দাদাকে খেয়াল করছিল। কারণ এই খাম আসার সাক্ষী সে নিজেও, তাই হয়তো দাদার কষ্টটা ও ফিল করছিল। মনে মনে বউমণিকে দূষতে ছাড়েনি সে।

দাদার মন ঘোরাতে মটর পনিরের বাটিটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘দাদা এটা তো খেলেই না। দারুণ টেস্ট, খেয়ে দ্যাখো।’

‘না না দিস না। পেটটা ভারভার লাগছে।’ বলে টেবিল থেকে উঠে চলে গেল ঋদ্ধি।

দাদার অবস্থা দেখে সোহম মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছিল এবার কোনও চিঠি এলে সে তার বউমণিকে না দিয়ে দাদা ঋদ্ধির হাতেই তুলে দেবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই রহস্য ভেদ করতেই হবে।

সোহমের পরিকল্পনা অনুযায়ী দিন পনেরো পরে সেই শুভক্ষণ উপস্থিত হল। বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতে যাবে বলে বেরোচ্ছে, এমন সময় গেটের মুখে ডাকপিয়োন হরিদার সঙ্গে দেখা। দাদার অফিসের একটা চিঠির সাথে সাথে বউমণির সেই গোলাপিরঙা খাম পকেটস্থ করে বেরিয়ে গেল সোহম।

সিনেমা, খাওয়াদাওয়া সেরে সোহম যখন ফিরল তখন ঋদ্ধিও অফিস থেকে বাড়ি ফিরে গেছে। বউমণি রান্নাঘরে আর মা বারান্দায় বসে বসে রেডিয়োতে পুরোনো দিনের গান শুনতে ব্যস্ত। সেই সুযোগে সোজা দাদার কাছে গিয়ে, ‘দাদা, এগুলো নাও। এটা বোধহয় তোমার অফিসের, আর এটা বউমণির। দুপুরে বেরোনোর সময় রাস্তাতেই হরিদার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল।’

‘ওহ্, ঠিক আছে। টেবিলে রেখে যা। আমি দেখে নেব।’ সোহম যাওয়ার পর অফিসের চিঠিটা নিজের কাছে রাখল। অরিত্রির-টা ওর বালিশের নীচে।

ডিনার সেরে অরিত্রি যখন শুতে এল তখন ঋদ্ধি তার চিঠির কথা তাকে জানাল, সঙ্গে এও জানাল সেটা তার বালিশের নীচে রয়েছে।’

‘আমার চিঠি এই সময়?’ অরিত্রি বেশ আশ্চর্য হয়েই কথাগুলি বলে বসল।

‘ওটা দুপুরেই এসেছে। ছোটোন নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল। এখন দিয়ে গেল।’ ঋদ্ধির মুখের দিকে তাকাল অরিত্রি। ‘সুরজ-এর চিঠি তাই তো?’ তাচ্ছিল্যের সুরেই বলল সে।

‘হ্যাঁ, তুমি কেমন করে জানলে?’ হাসতে হাসতেই প্রশ্ন করল অরি।

‘খাম দেখে। তা, যে আমার বউয়ের মনের এত কাছে, সেই মহাশয়ের সম্পর্কে আমারও তো জানার অধিকার রয়েছে নাকি?’ বিছানায় বসে পড়ল ঋদ্ধি।

‘অবশ্যই রয়েছে। সুরজের সম্পর্কে তোমাকে কী বলব, ঠিক ভাষা খুঁজে পাই না। আমারই সমবয়সি হবে। যেমন সুন্দর তেমনি ব্যক্তিত্ব, আকর্ষকও বটে। ভীষণ ভালো লেখে। মনে হয় পড়তেই থাকি। আর ওর চোখ দুটো…’ বলতে বলতে থেমে যায় অরি। বোধহয় ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। এমনটা মনে হয় ঋদ্ধির। সন্দেহ আর ঈর্ষায় জ্বলে যেতে থাকে সে। তারপর আর মুখ খোলেনি ঋদ্ধি। পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছে সে। অরিত্রি একবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সাড়া দেয়নি ঋদ্ধি। সেও পাশ ফিরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

এই কদিনে ঘর সংসারের কোনও পরিবর্তন না হলেও, ঋদ্ধির আচার-ব্যবহারে বেশ একটা পরিবর্তন এসেছে। দেরি করে বাড়ি ফেরে। অরিত্রি না খেয়ে বসে থাকলেও ‘বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি’ বলে হাত-পা ধুয়ে সোজা বিছানায় চলে যায়।

বিমলাদেবী আর সোহমও ঋদ্ধির এই আকস্মিক পরিবর্তনে চিন্তান্বিত হয়ে উঠেছিল। চোখের সামনে ছেলেটা সিগারেটের পর সিগারেট খেয়ে চলেছে। বাড়িতে কারওর সঙ্গে ঠিক করে কথা পর্যন্ত বলছে না। চিন্তা হওয়াটাই স্বাভাবিক।

একদিন সন্ধ্যাবেলা কোনও কারণে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরেছে ঋদ্ধি। ফেরা থেকেই ঘর থেকে এক পা বেরোয়নি। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে সিগারেটে টান দিয়েই চলেছে। একটা শেষ হলে আরেকটা। সামনে টিভি চালিয়ে বসেছে, কিন্তু একবারের জন্যও সেদিকে তাকিয়ে দেখছে না। যেন অন্য কোনও জগতে রয়েছে।

চোখের সামনে এসব আর দেখতে পারছিল না অরিত্রি। রাগে হাত থেকে সিগারেট কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল সে, ‘কী হয়েছে তোমার? আমাকে খোলসা করে বলোতো। আমাকে দেখলে তুমি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছ কেন? বেশ কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি। আমি কি এতটাই অবহেলার পাত্রী? নাকি আমাকে আর পছন্দ হচ্ছে না তোমার?’

টুঁ-শব্দটি পর্যন্ত করল না ঋদ্ধি। তাই দেখে রাগে গা জ্বালা করে উঠল অরিত্রির। কিন্তু তাতেও স্বামীর কোনওরম তাপোত্তাপ নেই দেখে একটু নরম হয়েই জিজ্ঞাসা করল, ‘কী এত ভাবো তুমি? কারণটা আমাকে বলা যায় না? আগে তো এত সিগারেট খেতে না। কী এমন হল বলো না?’ চোখ ছলছল করে উঠল অরিত্রির।

‘তুমি আগেও যেমন সুন্দর ছিলে, এখনও তেমনি সুন্দর আছ। বরং আমিই তোমার যোগ্য নই। সুরজের মতো আমি সুন্দরও নই, অত সুন্দর কথাও বলতে পারি না, আর আকর্ষকও নই।’ কথাগুলো কানে গিয়ে লাগল অরিত্রির।

‘এসব কী বলছ তুমি?’

‘ঠিকই বলছি। তোমাকে আমি আর বেশিদিন ধরে রাখব না। যাতে খুব তাড়াতাড়ি পাকাপাকি ভাবে সুরজের কাছে যেতে পারো, সেই ব্যবস্থাই করছি।’ ঠান্ডা মেজাজে জবাব দিল ঋদ্ধি।

‘তুমি কী পাগল হলে? এসব কী আবোল-তাবোল বকছ তুমি?’ বলেই হাউহাউ করে কেঁদে উঠল অরিত্রি। সে ভালোমতোই বুঝে গিয়েছিল ঋদ্ধির মনে সন্দেহ বাসা বেঁধেছে। সহজে এটা যাওয়ারও নয়।

‘তুমি যেটা মুখ ফুটে বলতে পারোনি, আমি সেই সত্যিটা-ই বলছি। প্লিজ আমাকে ভালোবাসার নাটকটা এবার বন্ধ করো।’ কঠোরভাবেই ঋদ্ধি কথাগুলো বলে গেল।

‘এমন করে কেন বলছ। সুরজ শুধুই আমার পত্রমিত্র। আমি তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসি না। শুধু শুধু সন্দেহ করছ।’ দু-গাল দিয়ে জল বয়ে নেমে এল অরিত্রির।

‘তুমি যতই সাফাই দাও না কেন, আমি জানি তোমাদের সম্পর্কটা কী। স্ত্রীকে পরপুরুষে প্রেমপত্র পাঠাচ্ছে, এটা কোন স্বামী মেনে নেবে।’ একই ভঙ্গিমায় বলে যাচ্ছিল ঋদ্ধি।

‘তুমি পড়ে দ্যাখো, এগুলো প্রেমপত্র নয়।’ দৌড়ে আলমারি থেকে চিঠিগুলো নিয়ে এসে স্বামীর হাতে ধরিয়ে দিল অরিত্রি।

কিন্তু ঋদ্ধির সেই এক গোঁ। অরিত্রির কোনও কথাই সে শুনবে না। ‘ওগুলো নিজের ভবিষ্যতের জন্য রেখে দাও।’ বলেই চিঠিগুলো অরিত্রির মুখের উপর ছুড়ে মারল।

‘তুমি জানো না ঋদ্ধি, আমাদের সম্পর্ক এই কাগজের চিঠিপত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তোমাকে কী করে বোঝাব।’

‘বোঝানোর আর আছেটা কী? কী বোঝাবে আমাকে? ধরা পড়ে গেছ অরি। এত বোকা ভেব না আমাকে।’ রাগে বিছানা থেকে বালিশটা নিয়ে সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়ল ঋদ্ধি।

কাঁদতে কাঁদতে অরিত্রি আওড়ে যেতে থাকল, ‘তুমি ভুল বুঝছ। ফোটো ছাড়া আমি তাকে কোনওদিন দেখিনি পর্যন্ত, বন্ধুত্ব ছাড়া কোনও সম্পর্ক নেই আমাদের। প্লিজ ট্রাস্ট মি।’ অরিত্রির পৌনঃপুনিক কাতর স্বীকারোক্তি ঋদ্ধির কান পর্যন্ত পৌঁছাল কিনা কে জানে। অনেক রাত পর্যন্ত ওই ভাবেই বসে রইল অরিত্রি। ভোরের দিকে গা এলিয়ে দিল বিছানায়।

পরদিন সাততাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যায় ঋদ্ধির। অরিত্রি তখনও অবচেতন ভাবে ঘুমিয়ে রয়েছে। প্রায় সাতটা নাগাদ বাড়ির ল্যান্ড ফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙে তার। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠেই কোনওরকমে হাত-পা মুখ ধুয়েই ছোটে রান্নাঘরের দিকে। ব্রেকফাস্ট রেডি করে আনতে আনতেই বেরিয়ে যায় ঋদ্ধি। প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে থাকে অরিত্রি। ছেলেকে বেরিয়ে যেতে দেখে, ‘কী হল বউমা?’ প্রশ্ন করেন বিমলাদেবী।

‘কিছু না মা।’ লোকানোর চেষ্টা করে অরিত্রি।

‘বাবু না খেয়েই চলে গেল?’

‘তাড়া ছিল তাই…’

‘এত কীসের তাড়া, যে না খেয়ে চলে যেতে হল। বেশ কয়েকদিন ধরেই লক্ষ্য করছি তোমাদের দুজনের কিছু একটা হয়েছে। যাই হোক ঝামেলা মিটিয়ে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। ভেবে দেখো’ বলে অন্যত্র চলে গেলেন বিমলাদেবী।

সেইদিন ঋদ্ধি বাড়ি ফিরলও বেশ রাত করে। সকলে অপেক্ষা করছিল তার জন্য।

ফ্রেশ হয়ে যখন খাবার টেবিলে এল, তখন বিমলাদেবী ছেলেকে পাশে বসিয়ে একপ্রকার চেপে ধরলেন, ‘হ্যাঁরে বাবু আগে তো অফিস থেকে ফিরতে এত দেরি করতিস না। কদিন ধরে কী হচ্ছে, রোজই দেরি করছিস, ঠিক করে খাচ্ছিস না।’

‘মা, অফিসে ভীষণ কাজের চাপ। তাই দেরি হচ্ছে।’

‘কেন জানি না, আমার মনে হচ্ছে তুই ভালো নেই।’ ছেলের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন বিমলাদেবী।

‘না-না মা। সেরকম কিছু নয়।’ হাসার চেষ্টা করল ঋদ্ধি।

‘জানিস বাবু তুই তো তাড়াহুড়োতে না খেয়ে চলে গেলি। তারপর থেকে মেয়েটা সারাটা দিন কিচ্ছুটি মুখে দিল না।’

‘পতিব্রতা নারীদের মতো?’ কথার মাঝেই ঝাঁপিয়ে পড়ে তীর্যক উক্তি করল সোহম। ছোটোছেলের রসিকতার জন্য বিমলাদেবী তাকে বকাও দিলেন। ওদিকে অরিত্রি লক্ষ্য করল শাশুড়ি বলার পর থেকেই ঋদ্ধি আড়চোখে তাকেই দেখে যাচ্ছে। ভালো করে খাচ্ছে না দেখে এবার শাশুড়িই ছেলেকে খাওয়াতে উদ্যোগী হলেন। হাতে খানিকটা ভাতের দলা তুলে ছেলের মুখে দিতে দিতে বললেন ‘তোর মনে আছে বাবু, ছোটোবেলায় তুই একটা গল্প শুনতে খুব ভালোবাসতিস। বামুন আর পাঁঠার গল্প। সেই যে বলি দেবে বলে বামুন হাট থেকে একটা স্বাস্থ্যবান পাঁঠা কিনে ফিরছিল। ফেরার পথে একদল দুষ্টু লোক বামুনকে বোকা বানিয়ে পাঁঠা নিয়ে কেটে খাবে বলে তাকে বলল, ‘এমা পুরুতমশাই আপনি একটু কুকুর ঘাড়ে করে কোথায় চললেন?’ বামুন তো একপ্রকার তাদের গালমন্দ করে ভাগিয়ে দিলেন। ‘অন্ধ মুখপোড়ার দল কিছুই কি তোদের চোখে পড়ে না?’

ঋদ্ধি ছেলেমানুষের মতো গল্প শুনতে শুনতে ভাত মুখে পুরতে থাকে। বিমলাদেবী গল্পের জাল বুনতে থাকেন। তারপর আরেকদল ছেলে একই উদ্দেশ্যে বলে, ‘ও পুরুতমশাই এই গাধাটাকে ঘাড়ে নিয়ে কোথায় চললেন?’ এই শুনে পুরোহিত তাদের এই মারে তো সেই মারে। কিন্তু তৃতীয়বার একই উদ্দেশ্যে একদল চাষী যখন বলে ওঠে ‘ও ঠাকুরমশাই ব্রাহ্মণ হয়ে আপনি শেষে কিনা একটা মরা বাছুর ঘাড়ে নিয়ে চললেন’। এবার পুরুতমশাই তাদের কথায় বিশ্বাস করে ওখানেই পাঁঠাটাকে নামিয়ে দিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। এই গল্পের নীতিবাক্যটা মনে আছে বাবু? সত্যতা যাচাই করে তবেই কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো উচিত। চল উঠে পড় খাওয়া শেষ তোর।’

ঋদ্ধি যেন ঘোর ভেঙে উঠে পড়ল। পরিবেশ হালকা করার জন্য এবার বিমলাদেবী বললেন, ‘তাহলে আজকে একটা সায়গলের গান হয়ে যাক, কী বলিস বাবু।’

অন্যমনস্ক থাকায় হঠাৎই মায়ের কথা শুনে চমকে উঠল ঋদ্ধি। কোনওমতে জবাব দিল, ‘ঠিক আছে।’

ডিনার সেরে ওঠার পর হালকা করে সায়গলের গান চালিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। শরীরটাও খুব একটা ভালো নেই ঋদ্ধির। হয়তো মানসিক অশান্তিও এর একটা কারণ। ঘরে ঢুকে আলো জ্বালতেই বিছানায় থাকা বিয়ের অ্যালবামগুলো নজরে পড়ল। স্বাভাবিক ভাবেই হাত চলে গেল অ্যালবামগুলোর দিকে। বিছানায় বসে অ্যালবামগুলো হাতে নিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে ওলটাতে পালটাতে থাকল সে। বিয়ের সেইসব সুখের মুহূর্তগুলো ভেসে উঠল চোখের সামনে। সারাদিনের ক্লান্তি এক নিমেষে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেল।

সমস্ত কাজ গুছিয়ে ঘরে ঢুকে সোজা স্বামীর পাশে গিয়ে বসল অরিত্রি। ‘বিশ্বাস করো আমার মনে কোনও পাপ নেই। হ্যাঁ পত্রমিত্র-র ব্যাপারটা আমি আগাগোড়াই সহজভাবে নিয়ে এসেছি। এটা নিয়ে কোনওদিন গভীর ভাবে ভাবিইনি। এটাই আমার সব থেকে বড়ো ভুল। প্রতিটি ক্ষণে যার মাসুল গুনছি আমি।’

ঋদ্ধি অ্যালবামের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে ছিল। অরিত্রি বলে চলেছিল তার কথা। ‘আজ সারাদিন ভেবেছি, এই সামান্য একটা ভুলের জন্য আমার সংসারটা আজ ভাঙতে বসেছে। আমার ভালোবাসা প্রশ্নচিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই ঠিক করেছি এই কাগজের সম্পর্ক আমি আজই শেষ করব’ বলে সমস্ত চিঠিগুলো টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলে দিল অরিত্রি। তারপর একটু এগিয়ে ঋদ্ধির গা ঘেঁষে বসে তার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বলে, ‘আমি শুধু তোমার… শুধু তোমার। ভুল বুঝে আমাকে দূরে সরিয়ে দিও না প্লিজ। একটা মুহূর্ত তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারব না আমি।’

বারবার মায়ের বলা গল্পটা ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথার মধ্যে। অরিত্রির কথা শুনে জমে থাকা সব অভিমান গলে জল হয়ে গেল ঋদ্ধির। চোখ ছলছল করছিল তার। অরিত্রির হাত দুটো নিজের মুঠোয় শক্ত করে চেপে ধরে, ‘তুমি জানো না অরি এই কয়েকদিনে তোমার থেকে বেশি কষ্ট পেয়েছি আমি। প্রতিটি মুহূর্তে ছটফট করেছি। সুরজের প্রতি তোমার অ্যাটেনশন, কথায় কথায় ওর প্রশংসা, মেনে নিতে পারছিলাম না। সুরজের নাম শুনলেও কেমন একটা আশঙ্কা তাড়া করে বেড়াচ্ছিল আমাকে।’ খানিক চুপ করে যায় ঋদ্ধি। অরি-র হাতদুটো আরও শক্ত করে চেপে ধরে বলে, ‘জানো ছোটোন যখন তোমার চিঠিটা লুকিয়ে আমাকে দিতে এল, তখন লজ্জায় ওর চোখের দিকে তাকাতে পর্যন্ত পারিনি। শুধু মনে হয়েছে ওরা তোমাকে কত ছোটো নজরে দেখছে। তোমার চরিত্র নিয়ে… বিশ্বাস করো তোমাকে কেউ ছোটো করুক সে আমি চাইনি।’ মাথা হেঁট করে নেয় ঋদ্ধি।

স্বামীকে কাছে টেনে নেয় অরিত্রি। ‘দুঃস্বপ্ন ভেবে সব ভুলে যাও। দেখো আমরা খুব সুখী হব।’ একে-অপরের খুব অন্তরঙ্গ হয়ে আসে ওরা। দেখতে দেখতে রাত গড়িয়ে ভোর হয়ে যায়। তখনও দুজনের চোখে গভীর ভালোবাসার সঙ্গে সুদূর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন জ্বলজ্বল করছে।

 

কাটমানি

ঘরের বাইরে এসে পাপোশের উপর ডান পা রাখতেই পুরোনো পাপোশ প্রতিশোধ নিল। হড়হড় করে তিন হাত দূরে সরে যাওয়া আর ৮২ কিলো ওজনের ধপাস আওয়াজ। এ তো যে সে বউ নয় যে, ওই লাশ টেনে তোলার আয়োজন করবে! বদলে রান্নাঘর থেকে চিল চিৎকার– পই পই করে বলি মিনসেরে, অত নোকের চোকের জল সইবে না, সইবে না। ঠিক একদিন না একদিন প্রাশ্চিত্তি করতি হবেই হবে– তা আমার কতা শুনবে না। এখন হল তো! আমার কপাল খেল। ও মাগো রে, ও বাবা গো রে, এ আমার কোথায় থুয়ে তোমরা চলে গেলে! এই কম্পোজিশনে কড়াই-খুন্তির ঝনাৎকারও তখন প্রবল।

কালিশংকর সেই যে থেবড়ে বসে পড়েছে আর নট্ নড়নচড়ন। রান্নাঘরের ভয়ে আঃ ওঃ টুকুও করতে পারছে না। আজ তাড়াতাড়ি অফিস যাবার কথা, তাড়াতাড়ি চানে ঢুকেছিল আর আজই কি না যত বিপত্তি! বসে থেকে থেকেই কোমরে হাত দেয় সে। না, কোমর থেকে যন্ত্রণাটা আসছে না। ডান পায়ের মালাইচাকির পেছন দিকে যন্ত্রণায় টাটিয়ে যাচ্ছে। উঠতে পারছে না সে। কিছু একটা ধরতে পেলে হয়, একটু সাপোর্ট পেলে হয়তো ঠেলে উঠতে পারবে। মনে জোর আছে। কিন্তু কাছাকাছি সাপোর্ট নেবার মতো কিছুই তো চোখে পড়ছে না। বউ শান্তিবালা হারগিস হাত বাড়াবে না। চাই কি আর এক প্রস্থ আগুনে ঘরের জল-বাতাস ঝলসে দিতে পারে।

কালিশংকর ঘষটাতে ঘষটাতে অনেকখানি যেয়ে সোফার কাছাকাছি গেল। তারপর সোফায় হাতের ভর দিয়ে কোনওক্রমে উঠে বসল। বসতে বসতে নিজের বুদ্ধির একটা তারিফও করে ফেলল মনে মনে। বউয়ের নির্দেশ না মেনেই সে বাড়িতে হাফপ্যান্ট বা বার্মুডা চালু করে দিয়েছিল আগেই। চানঘর থেকে বার্মুডার বদলে যদি গামছা বা তোয়ালে পরে সে বের হতো, তবে তো ধিঙ্গি শিবের অবস্থাতে আরও কেলো!

যাই হোক সোফায় বসতে না বসতেই কালিশংকরের হাঁটুর ব্যথা ছাপিয়ে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। আজ অফিস না যেতে পারলে নিবাস তো পুরোটাই ঝেড়ে দেবে। আজকে পেমেন্ট আছে। আজ পিওন থেকে, দরোয়ান থেকে, ক্লার্ক থেকে, ক্যাশিয়ার থেকে অ্যাকাউন্ট্যান্ট থেকে শুরু করে ড্রাফট্সম্যান, ইঞ্জিনিয়ার, চিফ– সবাই হাজির থাকবে। আজ অফিস বসে পড়বে দশটা বাজতে না বাজতেই। অন্য দিন, যখন পেমেন্ট থাকে না তখন গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে দেড়টা দুটোতে সব বাবুরা আসেন। আজ পেমেন্ট আছে আর আজ কি না কালিশংকরের এই অবস্থা! উঠে গিয়ে যে আরনিকা থার্টি-র দু’ফোঁটা জিভে ফেলবে তারও উপায় নেই।

খুব যন্ত্রণা করছে। এই পঞ্চাশোর্ধ বয়সে গোটা শরীরই নাড়াচাড়া খেয়েছে। জ্বর আসতে পারে। ঘরে মুভ আছে। তা লাগিয়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ বেঁধেটেধে সে যাবে কোনওক্রমে। ট্যাক্সি নিয়ে হলেও যাবে। এমনিতেই আগের মতো অবস্থায় নেই কোম্পানি। বাজেট সেকশান কুঁতে কুঁতে ফান্ড দেয়। মাসে দুবার, তিনবার। নেই নেই করেও তা-ও চল্লিশ-পঞ্চাশ লাখের পেমেন্ট হয়। সে গতকাল বিলটিল সব রেডি করে ক্যাশিয়ারের ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে এসেছে। কিন্তু না গেলে তো সব চৌপাট! এমন দিনে এরকম হতে আছে! মাথা চাপড়াল। ছয় জনের পেমেন্ট আছে। সবাই একটা করে হাজার টাকার পাত্তি ছোঁয়াবে। সে স্টোরকিপার। মেজারমেন্ট বুক, এগ্রিমেন্টের কপি– এসব বের করে দিতে হয় তাকে। মুশকিলটা হল ওই নিবাস মুনশিকে নিয়ে। ব্যাটা পিওন– সবার সাথে লদকালদকি। ভান করে যেন সব কাজ জানে। অফিসে যখন বিড়ি ফোঁকে তখন মনে হয় লাটের বাট। কালিশংকর না গেলেই তো দখলদারি নিয়ে নেবে। আর এই ছয় হাজার টাকা ওর ট্যাঁকে। ভাবতেই গা জ্বলে যাচ্ছে।

এই সময় মেয়ে নিশার কথা মনে এল। মেয়ে বলেছিল– বাবা, বয়স বাড়ছে, একটা গাড়ি নিয়ে নাও। মাঝেমধ্যে মেয়ের শ্বশুরবাড়ি বা এদিকওদিক যাওয়া, একটু কাছাকাছি বেড়ানো, মার্কেটিং– খুব জরুরি একটা গাড়ি। মেয়ে বুঝিয়েছে, গাড়ি আজকাল আর বিলাসিতা নয়। জল, বিদ্যুৎ, বাজারহাটের মতো জরুরি একটা বিষয়। কালিশংকর গা করেনি। তার হাউজিং-এ একমাত্র কালিশংকরেরই গাড়ি নেই। আজ এখন গাড়িটা সত্যি খুব জরুরি মনে হচ্ছে কালিশংকরের।

টেলিফোনের এতখানি আর্তি! ঠিক টেলিফোনের নয়, টেলিফোনের মাধ্যমটি থেকে সে আর্তি ঝরে পড়ছে– আমাকে ছেড়ে যেও না, প্লিজ! অথচ এই দুজনেরই, মানে যে শুনছে আর যে শোনাচ্ছে, তাদের কারও কিছু দেবার বা নেবার নেই। তাহলে কেন মিসেস মুখার্জি, ওরকম সম্ভ্রান্ত পরিবারের সুন্দরী গৃহিণী, এমন আর্ততায় ভরিয়ে তুলবে রৌণকের কাজের দুপুর! মিসেস নিশা মুখার্জি তখনও বলে যাচ্ছেন– আমি তো তোমার কাছে কিচ্ছু চাইনি রৌণক, কিচ্ছুটি না। শুধু তুমি আমার পাশে থাকো। আমার সাথে কথা বোলো। মাঝেমধ্যে সময় পেলে দেখা কোরো, ব্যাস!

রৌণক সেনগুপ্ত তরুণ সুরকার। মুম্বই ও বাংলায় কিছুটা নামডাক হয়েছে। চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই গোটা তিরিশ ফিল্মের সুরকার সে। মিসেস মুখার্জিও ওর সুরে কয়েকটা ফিল্মে গান করেছেন। আর অফকোর্স সংগীত পরিচালক হিসেবে সে সব কটিতেই রৌণকের পছন্দ ছিলেন তিনি। আজকাল মুম্বইতেই বেশিটা সময় কাটে রৌণকের। নিশাও কলকাতায় স্বামী-সন্তান লালন করেও গানের জগতে পুরোপুরি ঢুকে পড়েছেন। চেনাজানা বেড়েছে তারও। টালিগঞ্জে একটা দুটো ডাকও পেয়েছেন। গানের অ্যালবাম হয়েছে। তবুও রৌণকের জন্য মন কেমন তার। রৌণক যেখানেই থাকুক প্রতিদিন কিছুক্ষণ কথা বলা চাই। তিনি টের পাচ্ছিলেন, আজকাল রৌণক তেমন আন্তরিকতায় কথা বলে না। কোথায় যেন প্রাণের অভাব। কী যেন এক ভুল তারে বেজে যায় রৌণকের স্বর। কিন্তু কেন এমন হল! গত বছরও তো এমন ছিল না! তাহলে কি সুমন ভরদ্বাজের সুরে গান গেয়ে তার একটু নাম হয়েছে বলে রৌণক ঈর্ষাতুর হয়েছে! কে জানে! কিন্তু ওরকম কোল্ড ব্যবহার নিশার সহ্য হচ্ছে না। ও ভেতরে ভেতরে মরে যাচ্ছে। কী করে যে রৌণক তার গোটা মনটা দখল করে বসে আছে! আজকাল ডিপ্রেশনও বেড়ে গেছে। রেকর্ডিং থাকলে বাড়ি থেকে হয়তো বের হল, কিন্তু না থাকলে সারাদিন ঘুমিয়ে কাটায়। রৌণক নিজে থেকে ফোন করলে মনটা ফুরফুর করে, নচেৎ বিষাদের শ্রাবণে সারাদিনমান শুধু অশ্রুরই গান যেন।

কাল একটু বেশিই খেয়ে ফেলেছিল বলে সকাল এগারোটাতেও ঘুম ভাঙেনি নিশার। ছয়-সাত পেগ তো হবেই। রবীন্দ্রসদনে একক অনুষ্ঠান ছিল তার। গান শেষ হবার পর শুভংকর মানে ওর অনুষ্ঠানের আয়োজক ক্যালকাটা ক্লাবে নিয়ে গেছিল। বেসামাল ফিরতে ফিরতে রাত সাড়ে বারোটা একটা তো হয়েছেই। গাড়ির ভেতর শুভংকর কত কি কান্ড ঘটাচ্ছিল। ঘাড়ে চুমু খাচ্ছিল, মুখে চুমু খাচ্ছিল। নিশা ঠোঁট বাঁচিয়ে যাচ্ছিল লাস্য দিয়ে। শুভংকর কাল পুরো আউট ছিল মনে হয়। না হলে তো এমন করে না। গাড়িতে বুকেও হাত দিয়েছে। খুব জোরে একবার চটকে দিয়েছে। বেশ ব্যথা। নিশা রৌণক ছাড়া কাউকেই শরীর দিতে মন থেকে সাড়া পায় না। এমনকী স্বামীকেও। অঘোরে ঘুমোচ্ছে। প্রোগ্রাম করে মাঝে মাঝেই বেশি রাতে ফেরে নিশা। ফলে পরের দিন ওকে তেমন কেউ ডাকে না। আজ কলকাতায় ভোরের ফ্লাইটে এসেই দু-তিনবার বাজিয়েছে রৌণক। নিশা ফোন তোলেনি। সাইলেন্সে আছে। ঘুমও ভাঙেনি। রৌণক ভাবছে কী হল রে বাবা! ফোন ধরছে না কেন! অভিমান খুব বেশি কি জমে গেছে! তা না হলে ওর ফোনের জন্য তো মুখিয়ে থাকে নিশা!

ব্যাপারটা টের পায় নিশা বেলা দুটোর পর। দেড়টা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে স্নানটান করে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং টেবিলে বসেছে। দু’পিস ব্রেড-বাটার গোলমরিচ দিয়ে নিয়েছে। হাফ আপেল। এটাই লাঞ্চ। আজকাল মদ্যপানের বহর যেভাবে বেড়ে গেছে মধ্যপ্রদেশে স্ফীতির একটা ভাব ধরা পড়ছে। নিশা জানে শরীর চলে গেলে অনেক কিছুই চলে যাবে। যেখানে যতটুকু নামডাক– তাও থাকবে না। তখনও থ্রি-স্টেপ চুল থেকে দু-এক ফোঁটা জলকণা উঁকি মেরে গ্রীবার চিকন লাবণ্যে ঝাঁপ খেলছিল। এরকম একটি ফোঁটা টেবিলে রাখা মোবাইলের উপর পড়তেই নিশা ওটা শাড়িতে মুছে দিতে গিয়ে দেখে অনেকগুলো মিস্ড কল। খুলতেই দেখে রৌণক বাজিয়েছে। আরে আজ এতগুলো ফোন করেছে রৌণক! আর ও কিনা ফোন ধরেনি! নিশ্চয়ই আহত হয়েছে। কিছু ভাবনা ভেবে নিয়েছে। তড়িঘড়ি রিং ব্যাক করে। দেখে সুইচ্ড অফ্।

বিকেলে রৌণকই ফোন করে আবার। কী হলো, ফোন ধরছ না যে নিশা? এনগেজ আছ?

আরে না না, ঘুমিয়ে ছিলাম, শুনতে পাইনি। তুমি তো জানো আমি একটু দেরি করে উঠি। আর গতকাল রবীন্দ্রসদনে আমার একক গানের অনুষ্ঠান ছিল। ঘুমোতে ঘুমোতে বেশ রাত। তাই… তা তুমি কেমন আছ? ফোন করলে যে বড়ো!

কেন আমি ফোন করতে পারি না? গলায় একটু অভিমান লাগায় রৌণক।

না, আমি তা বলিনি! সচরাচর তুমি তো করো না। শরীর ঠিক আছে তো? খবরের কাগজে দেখলাম মুম্বই তো জলের তলায়। তুমি নিশ্চয়ই বাড়ি থেকে বের হতে পারোনি। তাই আড্ডা মারার জন্য ফোন করেছ। বেশ বেশ। আমার ভালো লাগল।

আরে মুম্বই কেন, আমি তো তোমার দরজায় দাঁড়িয়ে।

মানে?

মানে আমি এখন কলকাতায়। আর মোদ্দা কথাটি হল যদি তেমন ব্যস্ত না থাকো, গাড়ি বার করো, সন্ধ্যা ছ’টার মধ্যে হোটেল ব্রডওয়ে, মানে র্ব নং গনেশচন্দ্র অ্যাভিনিউ-এর ব্রডওয়ে হোটেল, আমার রুম নম্বর চ্জ্ঝ। সেকেন্ড ফ্লোরে। চলে এসো।

নিশার শরীরে একটা আশ্চর্য কাঁপন। কতদিন হল রৌণক, তার রৌণককে সে চোখের দেখাটিও দেখতে পাচ্ছে না। বছর দেড়েক তো হবেই। মনে মনে একবারে আর্ত হয়ে আছে। কিন্তু নিজেকে ধরা না দেবার ঈপ্সায় নিশা বলে– আজ না এলে হয় না! কাল যদি দুপুর দুপুর আসি!

সশব্যস্ত হয়ে রৌণক বলে– একদম অন্যথা কোরো না। কাল বিকেলের ফ্লাইটে আমি ফিরে যাচ্ছি। আর শোনো তোমাকে একজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে চাই। তোমার কেরিয়ারের জন্য দেখো খুব একটা বড়ো স্টেপিং হবে। চলে এসো।

রৌণক ফোন রাখতে না রাখতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে নিশা। কতদিন বাদে রৌণকের সামনে যাবে। কী শাড়ি পরবে, কেমন করে সাজবে– হাতে তো মাত্র দেড়টি ঘণ্টা সময়। রৌণকের খুব পছন্দ সমুদ্র-নীল শাড়ি। ওই রঙের শাড়ি পরে যতদিন দেখা করেছে, ততদিনই আবেগে কলকল করেছে রৌণক। কত না গান শুনিয়েছে, ছোটো ছোটো মিড়ের কাজ, ঝিলিক দিয়েছে চোখের তারায়। নিশার একটা বিশেষ গুণ আছে, ও ঠোঁট ভালো করে প্রেজেন্ট করতে জানে। অর্থাৎ দিন-রাত্রি, সময়-টময় মেপে ঠোঁটের সীমানা কমিয়ে বাড়িয়ে তাতে আশ্চর্য আরোপ করা। এছাড়াও নিশা আজ ঠিক করল নীল আংটিটা পরবে।

ঘণ্টা খানেকের মধ্যে মেক-আপ নিয়ে আয়নার সামনে একবার পাক খেয়ে নিজের সৌন্দর্যের উপর আস্থাশীল থাকল সুন্দরী। শাড়ির নীলাভ মায়ার আড়ালে নিজের নিক্তিমাপা বুকের আধখানা দেখে নিজেই কিছুটা যেন আসক্ত, পুলকিত। এখনও মনেই হয় না তার বিয়ে হয়েছে। তার একটা ছেলে আছে ক্লাস এইটে পড়ে। নিশার এখনও মনে হয় সে যাদবপুরের কম্পারেটিভ লিটারেচারের ছাত্রী। আর সে মাথা চিবিয়ে খাচ্ছে শিক্ষক, ছাত্র, বন্ধুদের। এমনিতেই লাস্য ছড়ানোর একটা সাবলীল আবহ তার অধিগত। নিশা তার বিখ্যাত জুঁই ফুলের এসেন্স ছড়িয়ে কপালের উপর থেকে নেমে আসা একগুচ্ছ অলকচূর্ণকে একটু হাওয়ায় উড়িয়ে দেখে নিল পুনরায়। মনে মনে হাসল– আজ রৌণককে পাগল করে দেবে। আজ অবহেলার জবাব নেবে। নিশা দেখল আজ সব মিলিয়ে পারফেক্ট অ্যাপিয়ারেন্স তার।

পাকা গমের রং চকচক করে আছে কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে। মুখ যেন গর্জনতেল মাখা দেবীপ্রতিমা। মাথায় ধবধবে সাদা একরাশ চুল, এলোমেলো। কালো জিনস্, কালো টি-শার্ট। উজ্জ্বল, গভীর কালো চোখে রিমলেস চশমা। রৌণক পাশেই বসে আছে, কিন্তু হোটেলের ঘরে ঢুকে বেশ খানিকটা সময় ধরে নিশার চোখ তাকে ফোকাস করতে পারেনি। রৌণক পরিচয় করাল– ইনি মিস্টার হিম্মতসিংকা, অসমের বিখ্যাত ব্যবসায়ী।

হিম্মতসিংকাও নিশার চোখে চোখ রেখে হাত জোড় করলেন। বেশ কিছুক্ষণ তিনজনই দাঁড়িয়ে ছিল। রৌণক বলল– বসো নিশা। ফোনে ওনার কথাই তোমাকে বলছিলাম। ওঁর জন্যই আমি মুম্বই থেকে কলকাতায় এসেছি। উনি এখানে সিনেমা প্রোডিউস করছেন একসঙ্গে অনেকগুলি। হিম্মতসিংকা থামিয়ে বলে– হ্যাঁ, ছ’খানা বাংলা ছবি আমি করব এ বছরই। আপনার কথা আমি শুনেছি মিসেস মুখার্জি, আপনি ভালো গান করেন। রৌণকবাবু তো আপনার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। আসুন না, আপনিও আমাদের সাথে কাজ করুন। কী রাজি তো!

নিশাকে কোনও কথা বলতে দেয় না হিম্মতসিংকা। এমনিতেই ওই প্রৌঢ়-র রূপ ও ব্যক্তিত্বের ছটায় ঘোর লেগে আছে নিশার চোখে। রৌণকের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে নিশা কিন্তু এখনও রৌণককে ফোকাস করে উঠতে পারেনি। গাড়িতে আসতে আসতে একটা আন্দাজ করেছিল কিছু একটা সুযোগ-টুযোগ আসতে পারে। কিন্তু এত দ্রুততায় সেসব!

নিশা মাথা একদিকে কাত করে সম্মতির ইঙ্গিত দিতেই ভদ্রলোক ব্রিফকেস থেকে চেক বই বের করে অ্যাডভান্স করলেন। পাঁচ লাখ। প্রথম ছবির ফিমেল ভয়েস নিশারই। কী মিস্টার সেন, ঠিক আছে তো?

সার্টেনলি ও কে।

রৌণকের দিকে একটা ব্ল্যাংক চেক এগিয়ে দিয়ে হিম্মতসিংকা বললেন– আমার ছ’টা ছবিরই সুরকার, সংগীত পরিচালক আপনি। অ্যামাউন্ট বসিয়ে নিন। কাল সকালে আমার সেক্রেটারি কনট্র্যাক্ট সই করিয়ে নিয়ে যাবে।

তারপর নিশার দিকে তাকিয়ে বলল– আপনার কনট্র্যাক্ট ফর্মও কাল আপনার বাড়িতে পৌঁছে যাবে। হিম্মতসিংকাকে একপ্রকার থামিয়েই রৌণক বলে– ওকে আজই সই করিয়ে নিন। ওর বাড়ি তো আপনার হোটেলের রাস্তাতেই। বেহালায় থাকে। আপনি তো তাজ-এ উঠেছেন। ওই পথেই যাবে।

ব্রডওয়ের লবি পর্যন্ত নিশা ও হিম্মতসিংকাকে এগিয়ে দিল রৌণক। –গুড নাইট নিশা, পরে ফোনে কথা হবে। এই কনট্র্যাক্ট-টা সই করেই যাও।

নিশা তখনও ভেবে উঠতে পারছে না ঘটনার পরম্পরা। কী একটা টানে কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। রৌণকের সাথেও একটু একান্তে কথা বলতে পারল না। অথচ কত কী ভেবেছিল। কত কী আদর করবে রৌণককে। বুকে মুখ ডুবিয়ে হাউহাউ কাঁদবে ভেবেছিল। কিন্তু তা না হয়ে এখন হিম্মতসিংকার গাড়িতে উঠতে হবে তাকে। তার গাড়ি ড্রাইভার নিয়ে যাবে। নিশা দেখল রৌণক অন্যরকম হয়ে গেছে। অবলীলায় হিম্মতসিংকার সামনেই সই করা ব্ল্যাংক চেকে প্তঙ্ম লাখ বসিয়ে নিয়েছে। নিশার সাথে ভালো করে কথাও বলেনি। কেবল কত তাড়াতাড়ি হিম্মতসিংকার গাড়িতে তুলে দেবে তাই যেন ভাবছিল। নতুন কাজ পাবার আনন্দ তেমন করে লাগল না নিশার। বদলে কী এক শূন্যতা চোখের তারায় নিয়ে একবার মুখ ঘুরিয়ে চোখাচোখি করল রৌণকের।

অনেকখানি খরচা হয়ে গেল কালিশংকরের। গজগজ করতে লাগল। ফ্ল্যাটের নীচেই ওষুধের দোকান সন্তোষ মেডিকো। ফোন করে মেডিকেল শপের ছেলেটিকে দিয়ে নিয়ে এল ক্রেপ ব্যান্ডেজ, ব্যথা কমানোর জন্য ক্রোসিন অ্যডভান্স। ওতে দুরকম সুবিধা, জ্বর আসাটাও প্রোটেক্ট হবে। ডাক্তারখানার ছেলেটা তার উপর একটা স্প্রে ওষুধ দিল। সাড়ে চারশো টাকার ধাক্বা। তারপর আরও রচ্প্ত টাকা খরচ করে ট্যাক্সি করে অফিস আসতে হয়েছে তাকে। পায়ে ব্যান্ডেজ, খোঁড়াতে খোঁড়াতে আসতে দেখে অফিসের লোকেরা তো হইচই বাধিয়ে চেয়ারে বসাল তাকে। তারপর সব বৃত্তান্ত শুনে নিবাসই বলে বসে– এলেন কেন, এই ভাঙা পা নিয়ে কেউ অফিসে আসে? যান, বাড়ি গিয়ে ভালো করে ডাক্তার দেখান, এক্সরে করান। কালিশংকর একবার নিবাসের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত ঘ’ষে– তাহলে তোমার বিশেষ সুবিধা হয়। আমার ভাগটা পুরোটাই ঝেড়ে দেবার ধান্দা। মাত্র ওয়ান পার্সেন্ট ওদের তিন জনের মধ্যে ভাগ হয়– রেকর্ডকিপার, পিওন আর ফ্রাঞ্চাইজির ছেলেটা, যে কম্পিউটারে বিল লোড করে। থ্রি পার্সেন্ট নেবে ক্যাশিয়ার। চিফ্ এগ্জিকিউটিভ সিক্স পার্সেন্ট। ওটা গত একবছর ধরে টেন পার্সেন্ট হয়েছে। অন্য এগ্জিকিউটিভ শাক্যদেবের ফোর পার্সেন্ট এই এগ্জিকিউটিভ নিয়ে নেয়। আর আড়ালে সবাই শাক্যদেবকে বোকা, গাধা বলে হাসে। শাক্যদেবও মাঝেমধ্যে হাসেন যখন গ্রুপ ডি ইউনিয়নের নেতা কর্মিরা বাবা-মা তুলে সবার সামনেই ক্লাস ওয়ান অফিসার চিফ্ এগ্জিকিউটিভকে ডাঁটে। ঘুসখোর, চোর বলে তাকে আটকে রাখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।

চিফ্ এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারও আজ এসেছেন। আজ ভরা অফিস। শ্যাম বারে বারে ফ্লাস্ক ভর্তি করে চা নিয়ে আসছে। অবশ্যই কন্ট্রাক্টরদের পয়সায়। চেক লেখা হচ্ছে আর হিসাব মতো অডিটর, ক্যাশিয়াররা টাকা পেয়ে যাচ্ছে। কালিশংকরদের হিসেব হবে সবার শেষে। তা সন্ধ্যা সাতটা তো হয়ে যাবেই। কিন্তু এখন তো সবে পাঁচটা। আর পারছে না তো সে। খুব যন্ত্রণা করছে পায়ে। বসে থাকা যাচ্ছে না। মাথাটা দপদপ করছে। জ্বর এল বলে। তবে কি ভেঙেছে! দুশ্চিন্তা হচ্ছে কালিশংকরের। বাড়ি ফিরবে কীভাবে! বাড়ি ফিরল না হয়, কিন্তু রাতে ডাক্তার পাবে কোথায়! বউ তো কোনও হেল্প করতে পারবে না। কেবল চ্যাঁচাবে। একমাত্র সন্তান মেয়ে, সেই বেহালায় থাকে, তাকে তো রাতবিরেতে এই সামান্য কারণে ডেকে পাঠানো যায় না! তারও তো ঘর গেরস্থালি আছে। তা-ছাড়াও তার মেয়ে যে গান-বাজনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে তা-ও জানে কালিশংকর। বেহালা থেকে বালিগঞ্জ খুব একটা দূরের নয়। কিন্তু জামাইবাবাজি অত রাতে… কী ভাববে… সাত-পাঁচ কালিশংকরের সামনে সমাধান ধরা দিচ্ছে না। বরং সকাল থেকেই আজ সবকিছু প্রতিকূল। মেয়ে নিশার গাড়ি আছে, তাকে কি এখনই বলে দেবে একবার গাড়ি পাঠিয়ে একটু অফিস থেকে নিয়ে যেতে! কিন্তু এখন বললেও বিপদ– হয়তো এখনই গাড়ি পাঠিয়ে দিল। তার ভাগ-বাটোয়ারা তো সেই সাতটার পরে।

এক কাপ চা খাওয়াল শ্যাম। কিন্তু বিস্বাদ লাগছে। সেই থেকে ক্যাশিয়ারের ঘরের সামনেটায় বসে আছে। বিশেষ নড়াচড়া করতে পারছে না। কিন্তু এক একজন কন্ট্রাক্টরের নাম আর চেক অ্যামাউন্ট লিখে রাখছে একটা কাগজে। আজ মুখ বিকৃত হচ্ছে তার। একবার খেঁকিয়ে ওঠে ক্যাশিয়ারের উপরঃ আর কত সময় লাগাবি! একদিনও কি তাড়াতাড়ি শেষ করতে নেই! সাড়ে ছ’টার সময় আর পারছিল না কালিশংকর। মেয়েকে ফোন করে বলে দিতে হবে, না হলে আজই যন্ত্রণায় মরে যাবে সে। বাড়ির কাছেই রুবি হাসপাতাল। রাত্রে বরং ওখানেই ভর্তি করে দিক। ওরা ওষুধপত্র দিয়ে কিছু একটা করতে পারবে, যন্ত্রণা কমাতে পারবে। কিন্তু নিশাকে ফোন করে দেখল, ফোন সুইচড অফ। সন্ধ্যা সাতটায় সুইচড অফ কেন? দু-তিনবার ইলেকট্রনিক শীতল সুইচড অফ ঘোষণার পর বাড়িতে, ল্যান্ডলাইনে বউকে ফোন করে নিশাকে ফোন করতে বলল। নিশার শ্বশুড়বাড়িতে ল্যান্ডে ফোন করে তারপর বউ জানাল নিশা শুটিং-এ গেছে। আর তা-ই ফোন অফ্ রেখেছে।

রুবিতে নয়, অফিসের গাড়িতে ডিসানে নিয়ে এসেছে কলিগেরা। রাত সাড়ে আটটা। ডিসান ওদের রিকগনাইজড হসপিটাল। পয়সা লাগবে না। মেডিকেল কার্ড দেখিয়ে ভর্তি করে দেওয়া গেল।

কালিশংকর যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। সবাই যে যার মতো হিসেবনিকেশে ব্যস্ত থাকায় কেউই তেমন করে ওর মুখের দিকে চায়নি। না হলে যন্ত্রণা তো ফুটে উঠেছিল সেখানে। জ্ঞান হারিয়ে যখন চেয়ার থেকে সশব্দে পড়ে যায় তখনই সকলের চোখে পড়ে। ধরাধরি করে এগ্জিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারের গাড়িতে তুলে এখানে নিয়ে আসা গেছে। এমার্জেন্সির ডাক্তার দেখে তো খুব ধমকালেন। এরকম মেজর ফ্র্যাকচার এতক্ষণ রেখে দিতে আছে! এক্সরে-তে দেখা গেছে গোড়ালির হাড়ে অনেকগুলো টুকরো হয়েছে। অপারেশন করতে হবে। তবে রাতে তো আর অর্থোপেডিক সার্জনকে পাওয়া যাবে না। ডাক্তার গুপ্ত কলকাতার বিখ্যাত অর্থোপেডিক সার্জন। কাল সকাল ন’টায় সময় দিয়েছেন। কালিশংকরকে ঘুমের ইনজেকশন, ব্যথার ওষুধ, আর একটু অক্সিজেন মাস্ক দিয়ে ততক্ষণ ফেলে রাখা হবে।

মণিজিঞ্জির জায়গাটা একবার দেখে নিতে এসেছে। ঝাঁ ঝাঁ করছে এপ্রিলের রোদ। দুপুর দুটো-আড়াইটে হবে। তাড়াহুড়োয় ঘড়ি পরে আসতে ভুলে গেছে। রেলের গুমটি থেকে খাকি হাফপ্যান্ট পরা এক মাঝবয়সি লোক পিটপিট করে তাকাচ্ছে। অদ্ভুত এই জায়গাটা। দুটো রেল স্টেশন আর একটা জাতীয় সড়ক লোকালয়ের মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে গেছে। একটা পাকদণ্ডি পথ ওই রেলগুমটির পাশ থেকেই নীচে নেমেছে। অটো ট্যাক্সিতে বড়ো রাস্তায় অনেকে নেমে ওই শর্টকাট অ্যাভেল করে। দিনের বেলায় কিচ্ছুটি বোঝার উপায় নেই যে সন্ধ্যা থেকেই গুমটির চার পাশটা ছোঁক ছোঁক করে উঠবে চোলাই খদ্দেরদের আগমনে। দিন সাতেক আগেও বসের গাড়িতে লিফট্ নিয়ে এই পথেই রাত সাড়ে আটটায় বুক ঢিপঢিপ করতে করতে বাড়ি ফিরেছে। আজ ভয়ডর নেই, বা বলা চলে একটি ডেসপারেট অ্যাটেম্প নেবে বলে মণিজিঞ্জির মহড়া দিতে এসেছে এখন। সারদা স্ক্যামের সাথে তাদের কোম্পানি জড়িয়ে ছিল না। কিন্তু কী আশ্চর্য, জড়িয়ে গেল এবং ছোবল এল তারই মস্তকে।

সারদাগোষ্ঠীর কাগজ সকালবেলা বন্ধ হয়ে গেছে। সকালবেলার একটি মেয়েকে চাকরি দেওয়ায় মণিজিঞ্জিরকে স্যাক্ করল কোম্পানি। মুখে সহানুভূতি বইয়ে দিয়ে বললঃ অত দূর থেকে আসো, এত কম স্যালারিতে তোমার পোষাবে না। তুমি বরং কাছাকাছি কিছু একটা দেখে নাও। এক কথায় খতম। কিন্তু বাবার পেনশনের টাকায় হার্টের অসুখের চিকিৎসা-সহ সংসার চালানো অসম্ভব ব্যাপার। গত চার-পাঁচ দিনে ঘুরে কিচ্ছুটি জোগাড় করতে পারেনি। প্লেন গ্রাজুয়েট, বাংলা ডিটিপি জানে, আর খবরের কাগজের অফিসে দুবছর ডেস্কে কাজ করেছে– এই। এতে কিছুই হবার নয়। নকরি ডট কমে দিয়ে রেখেছে সিভি। ডিপ্রেসড হয়ে যখন একেবারে হাল ছেড়ে দিয়েছে তখন আজ সকালবেলায় খবরের কাগজে চোখ বোলাতেই মাথায় ঢুকে পড়ল এই মতলব। সরকার ঘোষণা করেছে ধর্ষিতদের এককালীন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে পঞ্চাশ হাজার থেকে দুই লক্ষের মধ্যে। বয়স অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ। যার বয়স যত কম সে তত বেশি ক্ষতিপূরণ পাবে। মণিজিঞ্জির গত ফেব্রুয়ারিতে চ্চ্ছ্র বছর পার করেছে। ফলে সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী তার হক লক্ষাধিক টাকার। মণিজিঞ্জির ভাবল এটা কি সরকারি ঘুস! না ল-অ্যান্ড অর্ডারের বিকল্প এটি! সেদিন তো চ্যানেল দাপিয়ে এক বুদ্ধিজীবী বলে বেড়াচ্ছিলেনঃ ধর্ষণ থাকবেই, ধর্ষণ মানুষের ইনস্টিংক্ট, তাকে চাপা দেওয়া যাবে না।

সত্যি সত্যি একটা বোটকাগন্ধ নাকে লাগে, মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে। গুমটির পাশ দিয়ে নামতে নামতে তবু খুঁটিয়ে দেখতে থাকে ধাপে ধাপে নেমে যাওয়া মাটির পথ। পথের পাশে ভূতভৈরবীর ঘন ঝোপ। এমনিতে জায়গাটা নির্জন। এই পথে যেতে দু দুটো রেললাইন পেরোতে হয়। ফলে তেমন বিশেষ লোকজন হয় না এই ঝুঁকির রাস্তায়। রাতে আরও অন্য হয়ে যায় এই স্থান। মুখে কাপড়চাপা দিয়ে টেনে নিয়ে গেলে কেউ টেরটি পাবে না। কিন্তু, মণিজিঞ্জির ভাবে, যদি মেরে ফেলে তাকে, তবে তো বাবা-মাকে দেখার লোক নেই কেউ। আগে ধর্ষণ ছিল, কিন্তু ধর্ষণ করে খুন করে ফেলাটা আজকাল রেওয়াজ হয়ে গেছে। একটু বুক কাঁপে। যদি চার পাঁচজন মিলে লাইনে ফেলে ট্রেনে কাটা দেখিয়ে দেয়। শিয়ালদায় লাশকাটা ঘরে রেলপুলিশ অনুসন্ধান করতে যাবে না ধর্ষণ কি না। ফলে বাবা-মা টাকাটাও তো পাবে না। সব ব্যর্থ হয়ে যাবে। কিন্তু ওখানে যারা থাকে সব চোলাই খেতে খেতে বুকের খাঁচা হারানো প্যাংলা লোকজন। ওদের সাধ্য হবে না, মানে মনে জোরও হবে না খুন করে ফেলার। নেশার ঝোঁকে বড়ো জোর রেপ করতে পারে। দাঁতে দাঁত চেপে চার-পাঁচজনকে অ্যালাউ করতে হবে। দেখা যাক। একবারই তো। রং মেখে এসকর্ট সার্ভিসে যারা প্রতিদিন ধর্ষিত হচ্ছে তাদের অবস্থাটা একবার অনুমান করার চেষ্টা করল মণিজিঞ্জির। না না রোজ রোজ ওই মৃত্যু সে ডেকে আনতে পারবে না। একদিনের ঘটনা দুর্ঘটনা হিসেবেও মেনে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু গোটা জীবন শরীর ব্যাবসায় লাগিয়ে দিতে পারবে না।

মুখোমুখি ধাক্বা যাকে বলে তা-ই। লোকটার হাতের ফাইল ছিটকে গেছে। চশমা বাঁচাতে কোনওদিকে না তাকিয়ে লোকটা তরতর করে নেমে যাচ্ছে নীচে। মণিজিঞ্জির মাটিতে বসে পড়েছে, চোখে সরেষেফুল ফুটেছিল কয়েক সেকেন্ড। কপালে ব্যথা করছে। নিশ্চয়ই ফুলে ঢোল। ব্যথায় কান্না পাচ্ছে। লোকটার দোষ নয়। অন্যমনস্ক হয়ে নাকমুখ চাপা দিয়ে, হয়তো ওড়নায় চোখও ঢেকে গেছিল, এই জায়গাটা দ্রুত  পার হতে গিয়ে এই বিপত্তি। লোকটা চশমাটা বাঁচিয়ে ফেলেছে। দুপুরের রাস্তা ফাঁকা হলেও বালির লরি চলাচল করে। মণিজিঞ্জির একা একা উঠতে পারছে না, কারও হাত চাই টেনে তোলবার। এমনিতেই জায়গাটায় ঢাল। হাত পা কাঁপছে। লোকটা চশমা কুড়িয়ে ফের উঠে আসছে। ভালো করে তাকাতে পারছে না মণিজিঞ্জির। কপালে খুব যন্ত্রণা। ভাবে, কেন যে মরতে এসেছিলাম। লোকটা কি তাকে একটু উঠতে সাহায্য করবে, না কি গালাগাল দেবে! মুখের দিকে তাকাতেও সাহস হচ্ছে না। ওর ফাইলের কাগজপত্রও তো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। খুব ভয় লাগছে, চড়-ফড়ও কষিয়ে দিতে পারে। এই গনগনে দুপুরে কেউ কোথাও নেই তল্লাটে। মণিজিঞ্জির দম বন্ধ করে, মাটির দিকে চেয়ে লোকটার উপরে উঠে আসা দুটো পা-কেই শুধু দেখতে পায়।

খুব লেগেছে ম্যাডাম? সো সরি। গলায় খুব স্নিগ্ধতা। কোত্থাও কোনও ঝাঁঝালো ভাব নেই। আসুন, আমার হাতটা ধরে ওঠার চেষ্টা করুন। গলাটা চেনা চেনা লাগছে মণিজিঞ্জিরের। কিন্তু তেমন করে চোখ খুলতে পারছে না। ডানদিকের ভ্রু-র উপর এমন ফুলে উঠেছে, চোখ মেলতে গিয়ে টনটন করছে। ওঠা দরকার। অনন্তকাল তো এখানে রাস্তার মাঝখানে পড়ে থাকা যায় না! হাত বাড়িয়ে দিতে খুব যত্ন করে লোকটা তুলে দিল। তারপর বললঃ একটু দাঁড়ান, আমি কাগজপত্র তুলে নিই, আপনাকে বাসস্ট্যান্ড পেৌঁছে দিচ্ছি।

নীচে বাসস্ট্যান্ডে একটা চা-এর দোকানের বেঞ্চে বসাল তাকে। আপনার ব্যাগে রুমাল আছে? লোকটা জিজ্ঞাসা করে। ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে দিতেই পাশের দোকান থেকে বরফের পেটি থেকে কয়েক টুকরো তাতে নিয়ে কপালে চাপা দিয়ে ফোলা ভাবটা কমাতে চায়। লোকটার হাতে কী যেন জাদু আছে। কপালে হাতের ছোঁয়া পেতেই কেমন আশ্চর্য ভালোলাগা এসে উপস্থিত হল সমস্ত অনুভূতিতে। মনে মনে সমর্পণের ভাব এল। গত কয়েকদিন ধরে চাকরি হারাবার পর পাগলের মতো নতুন চাকরি খোঁজা। বাবার অমন ভঙ্গুর দশা, দাদা-র বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়ার স্মৃতি– সব কিছু তার উপর অক্টোপাসের আকার নিয়ে ঘিরে ধরেছিল। সমস্ত স্নায়ুগুলো জট পাকিয়ে উত্তেজনায় টানটান ছিল। এই মুহূর্তে সে সব উধাও হতে চাইছে। যেন কোনও আশ্রয় এসে উপস্থিত। এই ভালোলাগা থেকে মণিজিঞ্জির শরীরের সমস্ত প্রতিরোধ ছেড়ে দিল আর ওই অচেনা লোকটির হাতের উপরেই সে মূর্চ্ছিত হয়ে পড়ল।

চোখ মেলে মণিজিঞ্জির নিজের বিপন্নতা খোঁজার চেষ্টা করল। আঃ সে বেঁচে আছে। ধর্ষণকারীরা তার গলা কেটে রেললাইনে ফেলে দেয়নি। সরকারের ঘোষিত ক্ষতিপূরণের টাকা কয়টা নিশ্চয়ই পেয়ে যাবে। হাত-পা ছড়িয়ে বড়ো করে একটা শ্বাস নিতে গিয়ে দেখল হাতে স্যালাইনের সূচ টনটন করে উঠেছে। উলটো দিক থেকে নার্স হইহই করে উঠল– হাত-পা ছুড়ছেন কেন, স্যালাইনের পাইপ ছিঁড়ে যাবে যে! আর একটি কণ্ঠস্বর মাথার পেছন থেকে জেগে উঠলঃ যাক, জ্ঞান ফিরেছে। মণিজিঞ্জিরের চিত হওয়া চোখের মণি একটু ঊধর্বমুখী করতেই মনে হল, এই মুখ তো সে চেনে। লোকটির মুখের প্রসন্নতা থেকে আস্তে আস্তে মণিজিঞ্জির বুঝতে পারছে সে এখন কোনও হাসপাতাল বা নার্সিংহোমের বেডে রয়েছে।

লোকটি জিজ্ঞাসা করল, এখন কেমন লাগছে? খুব কষ্ট হচ্ছে না তো! মণিজিঞ্জির মাথা নেড়ে জানায়, তার কষ্ট হচ্ছে না। তার মনে পড়ে যায় কপালের আঘাতের কথা, দুপুরের ওই নিজেকে বিনিয়োগের অ্যাডভেঞ্চারের কথা। আর ভাবতেই ভয়ে সারা শরীর কেঁপে উঠল। মুখে যন্ত্রণা ফুটে উঠল ফের। তাকে তো ফের যুদ্ধে নেমে পড়তে হবে। এই সমাজ তো তাকে হিংস্র চিতার মতো তাড়া করে ফিরবে। তার অমন ব্রিলিয়ান্ট দাদা কোথায় আজ… কোথায়!

মণিজিঞ্জিরের এই মুখের ভাবের পরিবর্তনে শঙ্কিত ও ত্রস্ত হয়ে লোকটি মাথার কাছ থেকে ঘুরে এসে পাশে দাঁড়াল। কপালে হাত রাখলঃ খুব কষ্ট হচ্ছে আপনার?

সন্ধ্যা সাড়ে ছটা সাতটা হবে। সেই দুপুর থেকেই লোকটা রয়েছে তার সঙ্গে। প্রথমদিকে মণিজিঞ্জির জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পর লোকটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সুন্দরী যুবতিকে একলা ফেলে রেখে যাবে– সে ভয়ের সঙ্গে যোগ হয়েছিল, যদি রাস্তাঘাটের লোকজনেরা কিছু একটা অ্যালিগেশন দিয়ে তাকে চার্জ করে তবে! এই অঞ্চলে তার বিশেষ প্রভাব-ট্রভাবও নেই। যেটুকু ওই কর্মস্থলে। ওখানে খবর পেৌঁছানোর আগেই রাস্তার লোকজনেরা মেরেধরে তার সবটুকু কেড়ে নেবে তো বটেই উপরন্তু কোনও কথা না শুনেই মানুষজন তাদের বেসিক হিংস্রতার ইনস্টিংক্ট প্রকাশ করবে। আর গণপ্রহারে খুব দ্রুত জায়গা হবে পুলিশ মর্গে। আর যদি বেঁচেও যায় পুলিশে ছুঁলে তো এখন ছত্রিশ ঘা। উর্দিপরা মস্তান তারা। যা কিছুই হয়ে যেতে পারে। ফলে দুপুর বেলায় মণিজিঞ্জির জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পর মাথা ঠান্ডা রেখে লোকটি চায়ের দোকানের লোকজনেরই সাহায্য নিয়েছিল নার্সিংহোমে নিয়ে যেতে। শুধু চায়ের দোকানে নয়, নার্সিংহোমেও নিজের স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিতে হয়েছে। লোকটা ভাবছিল মণিজিঞ্জিরের জ্ঞান এলেই একটু শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে। না হলে যদি বেফাঁস কিছু বলে ফেলে! নার্সিংহোম কর্তৃপক্ষ তো পুলিশকে ডাকবে। সে বিস্তর হ্যাপা। মণিজিঞ্জির চোখ মেলতেই লোকটি নার্সকে রুমের বাইরে পাঠিয়েছে। এবার একটি টুল টেনে এনে পাশে বসে মাথায় হাত রাখল। আর ধীর স্বরে মণিজিঞ্জিরকে বললঃ দেখুন, আমি আপনার কপালে হাত  দিতে বাধ্য হচ্ছি, না-হলে ওরা বুঝবে না আমরা স্বামী-স্ত্রী।

মণিজিঞ্জির চোখ কপালে তুলে অস্ফুটে বলে, তার মানে!

দেখুন তেমন বিশেষ কোনও মানে নেই। আমি শাক্যদেব মুখোপাধ্যায়। আমি একটি কর্পোরেট সেক্টরে এগ্জিকিউটিভ। আপনাকে স্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়েই এখানে আমি ভর্তি করেছি। আমার কোনও উপায় ছিল না। আপনার নাম দিয়েছি আলোকণা মুখোপাধ্যায়। ফর্ম ফিলাপ করতে হয় তো। যা মনে এসেছে তা-ই বসিয়ে দিয়েছি। আমার অপরাধ নেবেন না। প্লিজ!

এই প্রথম, কত বছর বাদে সে কাঁদতে পারল ঠিক মনে নেই। দুঃখ জমতে জমতে পাথর হয়ে গিয়েছিল। দাদা হারিয়ে যাবার পর একবার কেঁদেছিল অজানা ভবিষ্যতের ভয়ে, আর কাঁদেনি সে। মণিজিঞ্জির এবার নিজে লোকটির হাত চেপে ধরল। নিজের মুখের উপর চেপে ধরল। আর অনর্গল রচিত অশ্রুতে দুটি হাতই তখন ভিজে সপসপ। লোকটিও হঠাৎ এই কান্নায় আরও আকুল হয়ে গেল।

কাঁদবেন না প্লিজ। শারীরিক ভাবে তো দুপুরে আপনাকে আহত করেছিই কিন্তু মানসিক দিক থেকে আমি যদি আপনাকে আহত করে থাকি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

মণিজিঞ্জির এইবার চোখ মুছে খুব সংক্ষেপে দুপুরের দুর্ঘটনার আগের তার বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থার বর্ণনা রাখল লোকটার কাছে। তার দাদার গৃহত্যাগের ঘটনার কথাও বলল। লোকটা মণিজিঞ্জিরের হাত শক্ত করে ধরে বললঃ আপনি সুন্দরী, সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে এভাবে নিজের জীবনকে নষ্ট করতে আছে! না না আপনাকে মানায় না। আর আপনার বাবা-মা-র কথা ভাবলেন না! আপনার অবর্তমানে তাঁরা কীভাবে বেঁচে থাকবেন! আপাতত আপনি আমাকে বন্ধু মানুন, ভালো বন্ধু। তারপর দেখছি কী করা যায়। কিন্তু আপনাদের ফেলে রেখে আপনার দাদার পালিয়ে যাওয়া আমি মেনে নিতে পারছি না।

দেখুন প্রথম প্রথম আমিও পারিনি। কিন্তু পরে বোঝার চেষ্টা করেছি কতটা নিজের ভেতরে ছিন্ন হয়ে গেলে শুধু তো পরিবার নয়, তার ভালোবাসার জগৎ– সাহিত্য জগৎ থেকেও সে মুখ ফিরিয়ে নিল। শুধু তো বাংলা সাহিত্য নয়, সারা পৃথিবীর সাহিত্য নিয়ে তার অগাধ জানাশোনা। গ্যেটে ও রবীন্দ্রনাথ কতখানি একে-অপরের পরিপূরক যেমন ভেবেছে তেমনি পাকিস্তানের ছোটোগল্পের উজ্জীবনে দেশভাগের কী ভূমিকা, সে নিপুণ বর্ণনা করত। যাদবপুরে কম্পারেটিভের প্রতিটি পরীক্ষায় সে প্রথম। ভেবেছিল বিদেশে যাবে আরও আলো পেতে। প্রাচ্যের জ্ঞানভাণ্ডারের সাথে পাশ্চাত্যের কোথায় সংঘাত তাকে দেখতে হবে। জানেন, একদিন দাদা আর নিশার ভেতর খুব তর্কাতর্কি হচ্ছিল। দাদা আমাকেই সাক্ষী মানতে ডেকে আনে। নিশা বলছিল, মানুষের প্রয়োজনের তুলনায় প্রাপ্তি কম বলেই তাকে অসৎ উপায় অবলম্বন করতে হয়। নীতিবোধ খুব একটা কাজের বিষয় নয়। ওটা বোকা মানুষদের একধরনের আপ্তবাক্য, ঢাল।

না, একদম নয়। যুগে যুগে সমস্ত আলোর যাত্রীকে তার গন্তব্য গুলিয়ে দেবার জন্য এরকমই দোলাচলের মধ্যে টেনে নিয়ে গেছে সমাজ। দাদা প্রতিরোধ করেছে।

জ্ঞান দেবার সুযোগ পেলে না তুমি গল্পের গরু একেবারে গাছে তুলে দাও। নিশা একটা বাঁকানো হাসির সাথে কথাগুলো ছুড়ে দেয়। আর দাদা চেয়ার ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে হাঁটুতে চাপড় মেরে বলেঃ একদম ঠিক। ওই গল্পটুকু আছে বলেই জগৎসংসার চলছে। আমাদের এই চরম স্বার্থসিদ্ধির জগতেও নীতিবোধ একেবারে অবলুপ্ত হয়ে যায়নি বলেই তরুণ-তরুণীরা শান্তির জন্য সংগ্রাম করছে, প্রকৃতি রক্ষার জন্য যুদ্ধরত, একজন পপস্টার গাইছে ইথিওপিয়ার মানুষদের জন্য। কেন, এসব তো এঁরা না করলেও পারেন। এ ধরনের অনেক উদাহরণই প্রমাণ করে যে এই বস্তু-অধ্যুষিত স্বার্থোন্মাদ জগতেও এথিক্স মরে শুকিয়ে যায়নি।

দাদা পায়চারি করতে করতে যখন দিশাহারার মতো দুচোখে কিছু খোঁজার চেষ্টা করছে, তখন নিশা দাদাকে আরও রাগিয়ে দেবার জন্য প্রায় স্বগতোক্তির মতো করে, অথচ যাতে সবাই শুনতে পায় তেমন উচ্চারণে, কপালে জোড়া হাতের গুঁতো মেরে বলেঃ হে ভগবান, হে মা মঙ্গলচণ্ডী, এই বিশিষ্ট নির্বোধটিকে একটু দেখো। বাঁচিয়ে রেখো। তারপর শব্দ করে কফির কাপে চুমুক দিয়েছে।

দাদা এবার প্রচন্ড রেগে গেছে। রেগে গেলে গলার স্বর আশ্চর্য ঠান্ডা হয়ে যেত তার! ঠিক নিশা, এই বহুবিজ্ঞাপিত নীতিশূন্য যুগে তোমার ওই প্রণাম ভঙ্গিটির কথাই বলেছেন বিশিষ্ট দার্শনিক বিমলকৃষ্ণ মতিলাল। বলেছেন, রাজনৈতিক নেতা জনমত কেনার জন্য অবলীলাক্রমে নীতিধারীর মুখোশ পরে, টেকস আ মরাল পসচার। এবং এই বহুবিজ্ঞাপিত নীতিশূন্য যুগে যখনই সে ওই নৈতিক ভঙ্গি গ্রহণ করে, তখনই সে বাহবা পায়। রাজনীতিবিদরা যা ইচ্ছে তাই করছে কিন্তু পসচার-টি ছাড়ছে না। কেন? কারণ তারা বিলক্ষণ জানে যে এই সমূহ ভ্যাকিউম-এর যুগে এই পসচার নিতান্তই লাভজনক, বিশেষ করে সংখ্যাধিক্যের কাছে যারা ভঙ্গির পশ্চাতে উপস্থিত অভিসন্ধির খবর রাখে না। রাজনীতির ক্ষেত্রে যে মরাল পসচার বিজয়ী, শনিপূজার ক্ষেত্রেও পূজারি বা সংগঠক সেই একই পসচার দেখিয়ে সফল। এক সার্বিক শূন্যতাবোধের কাছে এরা আবেদন রাখতে পেরেছে।

নার্স এসে ইতিমধ্যে বলে দিয়ে গেছে ভিজিটিং আওয়ার শেষ, পেশেন্ট পার্টি যেন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যায়। শাক্যদেব মণিজিঞ্জিরের কথা শুনতে শুনতেই হাতের ইশারায় আরও পাঁচটি মিনিট সময় চেয়ে নিয়েছে।

জানেন, আমাকে বন্ধুর মতো ট্রিট করত। মণিজিঞ্জির বলে। সব বলত। নতুন কিছু জানলে আমাকে না জানালে তার শান্তি ছিল না। সব তো ঠিকঠাকই চলছিল। ক্লাসে তো ওর অনুরাগিনীদের মধ্যে এমন অসূয়া জন্ম নিয়েছিল যে প্রত্যেকে দেখাতে ব্যস্ত থাকত সে কতটা সারদাপ্রসাদের কাছের। সারদাপ্রসাদ মানে আমার দাদা। অনেকেই আমাদের বাড়িতে এসেছে। সবথেকে বেশি যে আসত সে হল ওই নিশা। খুব সুন্দরী। ভালো গান করত। আর তার আর একটি পরিচয় ছিল সে কম্পারেটিভের হেড অফ দি ডিপার্টমেন্টের আত্মীয়া। দাদার কোনও শত্রু ছিল না। ছিল স্বপ্ন, বিদেশে যাবার এবং ভারততত্ত্বের উপর গবেষণা করার স্বপ্ন।

আপনাকে একটুও বাড়িয়ে বলছি না। মণিজিঞ্জির তখনও নিজের হাতের ভেতর শাক্যদেবের হাত ধরে রেখেছে। কেটলির মুখ থেকে যেভাবে গমকে গমকে বাষ্প বেরিয়ে আসে সেভাবেই মণিজিঞ্জির ভেতরে জমে থাকা অসহায়তার উত্তাপ একটুখানি সমর্থনের আবহে ঝিঁকিয়ে উঠেছে। গল্প থামায় না সে বা শাক্যদেবকে যেতে দিতে চায় না। বলে চলেঃ ফাইনাল পরীক্ষার আগে হেড অফ দি ডিপার্টমেন্ট ওদের বসু স্যার একদিন দাদাকে ডেকে পাঠায় নিজের ঘরে। বসো সারদাপ্রসাদ। শোনো এই বিভাগের সবাই জানে তুমিই গোল্ড মেডেলিস্ট হবে। তোমাকে ডিঙানোর ক্ষমতা কারও নেই। কিন্তু তোমাকে একটা কথা রাখতে হবে, এবছর তুমি পরীক্ষা দেবে না। এবছর থেকেই জার্মানির একটা বৃত্তি চালু হয়েছে। আমাদের বিভাগের প্রথম যে হবে সেই চান্স পাবে জার্মানিতে দুবছরের স্কলারশিপের। তুমি এবছর পরীক্ষা দেবে না। আমি চাই নিশা ওই বৃত্তিটা এবার পাক।

আকাশ ভেঙে পড়েছিল। নিশা তো ওর বন্ধু, একটু বেশি বন্ধু-ই। দাদা নিজের হাতে কত নোট্স বানিয়ে দিয়েছে! সেই নিশার জন্য কি না এতবড়ো একটা নেপোটিজম-এর কথা শুনতে হবে প্রিয় মাস্টারমশাইয়ের মুখে! দাদা শুধু সেবছর নয়, আর যাদবপুরের পথ মাড়ায়নি। আর বিদেশ থেকে ফিরে এসে কম্পারেটিভ-এর ওদের ব্যাচেরই অন্য এক বন্ধুকে যখন বিয়ে করল নিশা। খবরটা শোনার পর দাদা খুব বেশিদিন ঘরেও থাকেনি।

আপনারা খোঁজখবর করেননি? শাক্যদেবের গলায় আকুলতার সাথে মণিজিঞ্জিরের দাদা সম্পর্কে নিজের ভ্রান্ত ধারণা প্রকাশ করে ফেলার বিড়ম্বিত বোধ কেমন একটা ধরা ধরা গলা হয়ে একসাথে উঠে এল।

অনেক খুঁজেছি। পাগলের মতো খুঁজেছি। প্রাইভেট ডিটেকটিভও লাগিয়েছিলাম। কিন্তু খোঁজ মেলেনি। তবে আমরা এখনও আশা করি, বিশেষ করে মা ভাবেন হয়তো কোনওদিন ফিরে আসবে দাদা। এবার আপনিই বলুন তো সমাজ নানা ছকে দিনের পর দিন ব্যক্তিকে নষ্ট করে দিচ্ছে না, ধবংস করে দিচ্ছে না! বলুন না!

শাক্যদেব নার্সিংহোমের বিছানার সাদায় চোখ রেখে মাথা নাড়ে। ওই সাদায় কী এক অনন্ত শূন্যতা। সে জানে সমাজ কীভাবে এক একটি সুন্দর মনের গলা টিপে মেরে ফেলতে চায়। সে তো নিজেও এর শিকার। তার অফিসে চূড়ান্ত কোরাপশন। একা একা প্রতিরোধ করতে করতে সে ক্লান্ত। তার চোখের সামনে কালিশংকর বাবু, নিবাস মুনসি, শ্যাম পুরকায়েত, ড্রাফট্সম্যান পাল, অডিটর ভৌমিক, চিফ্ ইঞ্জিনিয়ার, ক্যাশিয়ার কীভাবে দিনের পর দিন কন্ট্র্যাক্টরদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কোম্পানির স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছে। আর তাকে, শাক্যদেবকে নিজেদের পথে না আনতে পেরে শারীরিক, মানসিক নির্যাতনের পথে ঠেলে দিয়েছে। স্রোতের বিরুদ্ধে গোটা অফিসে সে একা। কিন্তু সব সময় সে টের পায় একটা দৃপ্ত আত্মা তাকে ঘিরে আছে। বিপদে বুকে আগলে রাখছে। মণিজিঞ্জিরের গল্প শোনার পর শাক্যদেব ভাবল, এই পরিবারটির পাশে তাকে দাঁড়াতেই হবে।

আস্তে আস্তে মণিজিঞ্জিরের হাতের ভেতর থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিতে নিতে শাক্যদেব বলেঃ ডাক্তার কাল সকালে আপনাকে ডিসচার্জ করবে বলেছে। আমি সকাল দশটার মধ্যেই চলে আসব। আপনি কিন্তু মনে করে একবার আপনার বাড়িতে ফোন করে দেবেন। না হলে ওরা নিশ্চয়ই খুব চিন্তা করবে।

বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ উত্তাল ওই একটি কথায়। চুদুরবুদুর। শব্দটি কাঁটাতার ডিঙিয়ে এপারে অস্বস্তি গোপন করতে পারে না। সাগ্নিককে ওই শব্দটির জন্য গোটা ক্লাস দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে সেদিন। বন্ধুদের ফিক্ফিক্ পায়ের ব্যথা চারগুণ বাড়িয়ে দিয়ে টপটপ করে চোখের কোণ থেকে জল ঝরিয়েছে। শরীরের ব্যথা সহ্য করা যায়, কিন্তু অপমান সহ্য করা যায় না। পুপু-ই উসকেছিল, যা জিজ্ঞাসা কর শব্দটার মানে। গোপনে ওরা চিঙ্কি ম্যাম বলে ডাকে বাংলার টিচারকে। চোখ দুটো ছোটো ছোটো বলে ওই নাম তাঁর। আর রেগে যাবার পর তা আরও ছোটো হয়ে যায়। কোর্টের অর্ডার আর স্কুল কর্তৃপক্ষের কড়া নির্দেশ থাকার ফলে পেটাতে পারেন না বলে মাঝে মাঝে টেবিলে নিজেই ঘুষি মেরে নিজে আহত হন, বিশেষ করে যখন হিন্দি টাঙে বাংলা উচ্চারণ করে বাঙালি ছেলেমেয়েরা। সাউথ পয়েন্ট, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। বাংলা ভাষাকে দ্বিতীয় বা তৃতীয় পছন্দের হিসেবে রাখতে হয়েছে সরকারি অনুজ্ঞায়। না হলে বাংলা পড়ানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই গোয়েঙ্কাদের। বাংলা ম্যামের ভাষা প্রীতি আবার নজর কাড়ার মতো। তাঁর ক্লাসে কড়া নির্দেশ আছে বাংলা খবরের কাগজ পড়তে হবে প্রতিদিন ছাত্রদের। আর ক্লাসে কিছুটা সময় র্যাপিড রিডিং-এ তা থাকবে। ফলে তিনি প্রতিদিনই একটি দৈনিক সংবাদপত্র সহ ক্লাসরুমে ঢোকেন। আর সাগ্নিকদের ক্লাসের সাতচল্লিশ জনের মধ্যে যাকে খুশি তিনি মানে জিজ্ঞাসা করেন কোনও শব্দের, সেই কাগজের লেখা থেকে।

আজ ম্যাম প্রশ্ন করেননি। বন্ধুদের উসকানিতে দ্বিতীয় রো-র কর্নারে বসা, অষ্টম শ্রেণির এই সাদাসিধে সাগ্নিক উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করে, ওই শব্দটির অর্থ কি?

অষ্টম শ্রেণির পাঠ্যক্রমে নতুন অন্তর্ভূক্ত হয়েছে মৃদুল দাশগুপ্তের কবিতা। ম্যাডাম তার কবিতা নিয়েই আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছিলেন। তিনি নিজেও কবিতা লেখেন। মাঝেমধ্যে এক নামি পত্রিকাতে তাঁর কবিতা দেখা যায়। কবিতাতে তাঁর একটু বিশেষ পক্ষপাতও আছে। সাগ্নিকের প্রশ্নে বেশ কিছুদিনের অসংগঠিত ভ্রূর অরণ্য প্রথমে কেঁপে উঠল। তখনও ওইদিনের খবরের কাগজ তিনি পড়ে উঠতে পারেননি। ফলে ওই আগন্তুক শব্দের ধাক্বার প্রস্তুতি সামলাতে তাকে কয়েকবার চুলে হাত চালাতে হল। নাক মোচড়াতে হল দু-তিনবার। সাহিত্য-বিচিত্রা বইটা দুম করে বন্ধ করে দিতে হল। সাগ্নিক অশুভ কিছু একটা টের পেয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলেঃ ম্যাম আজকের কাগজে আছে। আমরা কেউ শব্দটার মানে বুঝতে পারিনি। তা…ই।

নিজেকে সামলে নেবার জন্য শাড়ির অাঁচল ঠিক করার ম্যানারিজম আর একটু দেখালেন ম্যাম। তারপর অমোঘ সেই স্বর ধবনিত হল– এখন আমাদের আলোচনার বিষয় ছিল মৃদুল দাশগুপ্ত। তুমি ইচ্ছাকৃত ভাবে গোলোযোগ শুরু করেছ। গোটা পিরিয়ড দাঁড়িয়ে থাকো।

যাঃ বাবা, প্রশ্ন করতে পারব না! নিজের মনে গজর গজর করতে করতে সাগ্নিক নিজেকেই বলে, ওদিকে মা-বাবা তো সারাক্ষণই বলে যায়, বুঝতে না পারলে ক্লাস টিচারদের কাছ থেকে জেনে নেবে। খুব খারাপ লাগছিল সাগ্নিকের। এই পানিশমেন্টটা তার সহ্য হচ্ছিল না। দোষ না করে কেন পানিশমেন্ট পেতে হবে! ও রোজ পড়া করে আসে। ক্লাসে গন্ডগোল করে না। কারও সঙ্গে মিসবিহেভ করে না। অথচ ওর বন্ধুরা তো সব এক একটা বিচ্ছু। ক্লাস এইট তো কী! সবকটাই লুকিয়ে-চুরিয়ে সিগারেট খায়। পুপুও খায়। ক্লাসের পরীক্ষার রেজাল্ট ট্যাম্পারিং করে বাড়িতে দেখায় পুপু। একদিন তো মোবাইলে নেকেড মেয়েদের ছবি ডাউনলোড করে নিয়ে এসেছিল পুপু। ধরাও পড়েছিল এই ম্যামের কাছে। কিন্তু ম্যাম তো কোনও শাস্তি দেননি তাকে।

স্কুলগাড়ি থেকে নামার পর নিশা দেখতে পায় ছেলে সাগ্নিকের মুখটা অন্যদিনের তুলনায় যথেষ্ট কালো। আজ কি পিটি ক্লাস ছিল? রোদে খুব পুড়েছিল?

সাগ্নিক মাথা নেড়ে জানায়– না। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে পায়ের জুতো ছুড়ে দেয়।

কী রে অমন করছিস কেন রে শমু? কিছু হয়েছে? বন্ধুদের সাথে গন্ডগোল? আজকাল গার্জিয়ানরা তটস্থ থাকে কোথায় কী হল! বাচ্চা ঘরে না ফেরা পর্যন্ত স্বস্তি থাকে না। নিশা শমুর মাথার চুল নেড়ে দিয়ে আদর জানায়। আজ নিশাই স্কুল-গাড়ি থেকে নামিয়েছে শমুকে।

রাত্রে জ্বর এল সাগ্নিকের। পরের দিন স্কুলে গেল না, এবং তার পরের দিনও। ডাক্তার ফ্লু বলে কোনও ওষুধ দিলেন না, কেবল ক্যালপল। জ্বর কমছে না, আবার টেস্ট হল– কিছু না। তবে! বাবা-মায়ের চিন্তা বাড়িয়ে এরপর সাগ্নিক বেশ কিছুদিন বলতে থাকল পেট ব্যথা করছে। স্কুলে যাওয়াও হল না তা বেশ ছ-সাত দিন।

জ্বর কমেছে। ভিডিও গেমে মেতে আছে সাগ্নিক। আজ রবিবার। কাল থেকে আবার স্কুল যেতে হবে। বুক থেকে বড়ো একটা শ্বাস নেয়। ভিডিও গেমে ঢ্যাঁ ঢ্যাঁ করে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে চালাতে এগোয় সে। উলটো দিক থেকে একটার পর একটা দানব আসছে। সে মেরে ফেলছে, আবার আসছে। কিছুতেই তাকে সীমানায় পেৌঁছোতে দেবে না। এই নিয়ে তিনবার হল। স্কোর সাড়ে ছশো, সাতশোর মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। সাগ্নিকের হাজার চাই-ই চাই। কাজের পিসি জুনিয়র হরলিক্স দিয়ে গেছে, তা ঠান্ডা হচ্ছে। সাগ্নিক মনে মনে এই সেল্ফ-ইমপোজ্ড মিশনে স্কুল টিচারের কথা আওড়াল– ইট ইজ বেটার টু ট্রাই অ্যান্ড ফেইল দ্যান ফেইল টু ট্রাই।

সাগ্নিক একটা জিনিস দেখে অবাক হল। দানবগুলোকে আলাদা আলাদা না ভেবে যেই বাংলা ম্যাম হিসেবে চিহ্নিত করেছে অমনি ওর কিবোর্ড ছুঁয়ে ছেড়ে দেওয়া গুলি গুলো ঠিকঠিক টার্গেটে লাগতে লাগল। কম গুলি খরচ করে বেশি বাংলা ম্যাম নিকেশ করছে তখন। আর স্কোরও হু হু করে ঊধর্বমুখী। কখন যে হাজার ছাড়িয়ে গেছে। দেড়হাজার, বাইশ শো। শেষে মা ঘরে ঢুকে ডাকতেই তাল কেটে গেল। একটু যেন খিঁচিয়ে উঠল ঠান্ডা স্বভাবের সাগ্নিকঃ কেন কী হয়েছে! সারাদিন পড়া পড়া কোরো না তো!

নিশা বিস্মিত হয়! সে তো কিছুই বলেনি। কোনও প্রশ্নও না। তাহলে! শমু এমন বস্তির ছেলেদের মতো চেঁচিয়ে উঠল! মাথায় হাত রাখল নিশা। অল্প গরম আছে। যাক জ্বরটা বাড়েনি। কিন্তু কোনও অ্যান্টিবায়োটিক তো পেটে পড়েনি শমুর। তাহলে এত রুক্ষতা কোথা থেকে এল!

শমু তোমার হরলিক্সটা টেবিলে পড়ে রয়েছে, ঠান্ডা হয়ে গেছে। একটু গরম করে দেব?

না না খেতে ইচ্ছা করছে না।

নিশা ব্যস্ত হয়। ছেলের ভেতর একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করছে। এত রুক্ষতা তো কখনও ছিল না! নিশা বলেঃ শমু আজ বিকেলে সাউথ সিটিতে তুমি আর আমি সিনেমা দেখতে যাব, জানলে। এই জানলে শব্দটি নিশার একটি অন্তরঙ্গতা জ্ঞাপক বিশেষ চিহ্ন।

শমু বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব না দিয়েও কেবল মাকে সরিয়ে দেবার জন্য মাথা নাড়েঃ ঠিক আছে। নিশা আবার বলেঃ কাজের পিসি একটু বাদে আসবে, তোমার মাথা ধুইয়ে হট্ স্পঞ্জ করে দেবে। একটু রেস্ট নাও। আজ আর পড়াশুনো করতে হবে না।

এই সফ্টনেস বা সিনেমার টোপটা তাকে দিতেই হতো। সাগ্নিকের থেকে সে যেন দূরে সরে না যায়। এমনিতেই তার একটা গিল্টি ফিলিং আছে। গান গান করে সংসারকে সময়ই দিতে পারে না। আর এখন তো সিনেমার প্লে ব্যাক করছে। হুটহাট করে রেকর্ডিং-এ যেতে হয়। হিম্মতসিংকা মাঝেমধ্যেই শুটিং-এর সময় তাকে ডেকে নেয়। কখনও কয়েকদিনের জন্য আউটডোরেও যায়। গুয়াহাটি, শিলং ঘুরে এসেছে গত মাসে। নিশা ভয় পায়, ছেলে কি তাকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে! কোথাও কি একটা চিড় ধরেছে মনে মনে! যদি তা-ই হয় দ্রুত মেরামতি করা দরকার। তাই নিশা সিনেমা দেখানোর প্রলোভন দিল সাগ্নিককে।

সাগ্নিকের ঘরে থাকতে থাকতেই নিশার মোবাইল বেজে ওঠে।  কে, মা? বলো।

আজ কাইল তুই তো খুবই ব্যস্ত থাকিস। তোর বাপটারে একবার শ্যাষ চোখের দ্যাখাটা দেইখ্যা আয়গা। কাল পাও ভাঙছে। অফিস থনে ডিসান হাসপাতালে ভর্তি কইরা দিয়া গেছে। অপারেশন হইব। অখনো জ্ঞান আয় নাই শুনছি। তুই সময় পাইলে একবার দেইখা আয়। কাইল সন্ধ্যাকালে তরে অনেকবার ফোন করছিল, কিন্তু পায় নাই।

সে কি, এতক্ষণ বলোনি কেন! কী করে ভাঙল! আচ্ছা আমি আর তোমার জামাই এখনি আসছি। ডিসান তো আমাদের বাড়ির কাছেই। বাবাকে দেখে আমি একবার বাড়ি ঘুরে যাব। তোমাকেও তো অনেকদিন দেখি না।

এতদিনে কুলোর বাতাস পেল কালিশংকর। মনে মনে নিবাস একথা বললেও মুখে আহা উঁহু করছে তখন থেকে। নিবাস মুনশি অনেকদিন ধরে চেয়েছে কালিশংকর বাগচির ট্রান্সফার। একে ওকে কানে বিষ ঢেলে দিয়েছে, লাগান-ভাগান দিয়েছে, কিন্তু কিছুতেই কিছু করে উঠতে পারেনি। এবার পার্মানেন্ট ট্রান্সফার হয়ে গেল কালিশংকরের। অনেকখানি রিলিভড। রোজ রোজ পার্সেন্টেজ নিয়ে খুচ্ খুচ্ ঝগড়াঝাঁটি আর করতে হবে না। তাই প্রাণের আনন্দেই যেন ফোন করে অফিসের সব লোকজন টেনে এনেছে এই ছুটির দিনেও। ফোন করে বলেছেঃ স্যার কেস বিলা। টেঁসে গেছে।

ধমক লাগিয়েছে শাক্যদেব।  চুপ করুন! একজন মারা গেছেন, আপনার কলিগ, আর আপনি তার সম্পর্কে এরকম কথা বলছেন! খুব মনখারাপ শাক্যদেবের। ঘুস খেলেও লোকটা সব সময় তার সাথে সাথে থাকত। অফিসের সব খবরাখবর দিত। সে একবার শেষ দেখা দেখতে এল। আর তাছাড়া অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার হিসেবে তাকে পেশেন্ট আইডেন্টিফাই করতে হয়। সার্টিফিকেট দিতে হয়। নাহলে কোম্পানির হে্কেয়ার ইউনিট হাসপাতালকে পয়সা দেবে না। ফলে আসতেই হতো।

অফিসের পিওন শ্যাম এসে বললঃ নিবাসদা বাড়ির লোকজনকে তো দেখছি না!

ন্যাকামো করিস না। একটু আগের স্যারের ধমক এবার ও নীচের দিকে চালান করল। শ্যামের মুখ কাঁচুমাচু। বলেঃ বাড়ির লোক খবর পেয়েছে তো!

বড্ড ভ্যানতারা করিস তুই! এত লোককে ফোন করছি, আর আসল বাড়িতে করব না! ওই গতরখাকি বউ-এর কথা ছাড়। গজ গজ করে উঠল নিবাস মুনশি। সারাদিন মানুষটারে এতটুকু শান্তি দেত না। দাঁতের চাপানির তলায় রেখে দেত। বউ বলে পরিচয় দেবার জুগ্গি নাকি সে! আসপে না রে আসপে না। অত দপ্প বিধেতাপুরুষ সইবে কেন! তাই তো অকালে পেরাণটা গেল কালি-দার। নাইলে পা ভাঙলে কারুর পেরাণ যায়!

সকালে অপারেশন টেবিল পর্যন্ত পৌঁছোয়নি। কালিশংকরের জ্ঞান সেই যে গিয়েছিল আর ফেরেনি। অপারেশনের আগে অ্যানিস্থেশিস্ট এসেছে। ছুরি-কাঁচি সহ অপারেশন থিয়েটারও প্রস্তুত। ডাক্তার গুপ্ত বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছেন। অফিসের নিবাস আর শ্যামও উপস্থিত। তখনই খবরটা জানা গেল। সিরিয়াস কার্ডিয়াক অ্যাটাক হয়েছিল। ভোর রাত্রে। কিচ্ছু করার ছিল না।

ডাক্তার সার্টিফিকেট দিতে দিতে তিনটে বাজিয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যে নিশারা বিধবস্ত হয়ে বসে আছে ডিসানের অফিসের সামনে। নিশার পাগল পাগল লাগছে। বাবা কাল তাকে ফোন করেছিল অথচ সে কথা বলতে পারেনি। কালকে এলে কি একবার কথা বলতে পারত! হিম্মতসিংকা তাকে প্রচার দিচ্ছে বটে কিন্তু প্রাইভেট লাইফের একেবারে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। যখন তখন তাকে ডাকে দামি হোটেলে। ভালো ভালো মদ খাওয়ায় আর শরীর নেয়। সেদিনের পর থেকে রৌণকের উপর থেকেও টানটা উঠে গেছে নিশার। বাবা তাকে খুব ভালোবাসত। সে-ও বাবাকে। আর তো তেমন কেউ রইল না তার যার জন্য এই পৃথিবী সুন্দর লাগে। তেমন করে বেঁচে থাকা যায়। নিশা বেশ জানে ছেলে সাগ্নিক তাকে চায় না। তার স্বামীও চায় না। শুধু থাকে একসাথে। বার বার ফুঁপিয়ে কাঁদছে নিশা। বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু এত লোকের সামনে ভালো করে কাঁদতেও পারছে না। চোখ টকটকে লাল হয়ে আছে।

শ্যাম আর ক্লার্ক মানব সিংহ শাক্যদেবকে গাড়িতে তুলে দিয়ে এল। শ্যাম সকাল থেকেই খুঁজছে কালিদার বাড়ির লোকজনকে। কাল একবার রাতে নিবাসদার খোমা শুনেছে। মানে মুখ ঝামটা। নিবাস শ্যামকে খুব ঝেড়েছে, কেন সে কালিশংকরের ভাগের টাকা দিয়ে আসেনি কাল। শ্যাম যত বোঝায়ঃ কাকে দেব! কালিদার সেন্স ছিল না তো। হসপিটালে পকেট থেকে যদি কেউ টাকা তুলে নিয়ে যায়! শ্যাম এখন কী করবে! আবার অফিসে গিয়ে ঝাড় খেতে পারবে না।

আরে ওই তো কালিদার মেয়ে বসে আছে সোফায়। মানব সিংহ আঙুল তুলে দেখায়। মানব নিশাকে চেনে। নিশার বিয়েতে এসেছিল সে। ওই যে নীলচে রুমালে চোখ মুছছে বারবার এক সুন্দর দেখতে বউ, ও-ই নিশা, কালিদার মেয়ে। তখনও মৃতদেহ বের হয়নি, সবাই অপেক্ষা করছে। নিশা, তার বর। নিশার বর ফোন করে শববাহী গাড়ি ডেকে নিয়েছে। তা দাঁড়িয়ে রয়েছে গেটের পাশে। শ্যাম মাথা চুলকোতে চুলকোতে গিয়ে নিশার সামনে দাঁড়ায়। ম্যাডাম, আমরা কালিদা-র অফিসের কর্মচারী, কাল থেকেই আছি। তারপর নিশার বিহ্বলতার ভেতর, তাকে কোনও কথা বলতে না দিয়েই শ্যাম পকেট থেকে একটা বন্ধ খাম বের করে নিশার হাতে দিয়ে বললঃ এর মধ্যে ছ’হাজার আছে ম্যাডাম। এটা কালিদার শেয়ার।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব