পানিবাই

ঘটকপুকুরে যেতে চাইলে দুটো স্টপেজে নামা যায়। এক, ডাক্তারখানা স্টপেজ। এক কামরার একটা মাটির চালা, সামনে ছোট্ট বারান্দা। একসময় রুগির ভিড় উপচে পড়ত সেই বারান্দায়, ভেতরঘরে নড়বড়ে চেয়ার-টেবিল পেতে বসে থাকত প্রতাপ ডাক্তার। প্রতাপ কাঁড়ার, হোমিওপ্যাথ। এক শিশি সুগার অব মিল্কে এক ফোঁটা ওষুধ ফেলে সাত গাঁয়ের লোককে খাওয়াত, লোকে কপালে হাত ঠেকিয়ে বলত, ‘সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি’। সেই ধন্বন্তরি প্রতাপ ডাক্তারকে হঠাৎ একদিন সকালে কেউ দেখতে পেল না। চেয়ার, টেবিল আছে, খোপ-খোপ ওষুধের বাক্স আছে, তক্তাপোশে তেলচিটে বিছানা, নীচে স্টোভ. কালি-লাগা হাঁড়িকুড়ি, দড়িতে ধুতি-গামছা, সব যেমনকার তেমন আছে। শুধু মানুষটা নেই। কেউ বলল, স্বপ্নে আদেশ পেয়ে হিমালয়ে চলে গেছে ডাক্তার, কেউ বলে বাড়ি থেকে খারাপ খবর পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে দৌড়েছে। প্রতাপ ডাক্তার চলে যেতে সাত গাঁয়ের লোক কিছুদিন হা-হুতাশ করল, তারপর নতুন ডাক্তার খুঁজে নিল। কিন্তু ডাক্তারের ঘরটা তেমনই পড়ে রইল, থাকতে থাকতে জরাজীর্ণ হয়ে গেলেও ঠিক দাঁড়িয়ে রইল মাটির ওপর। আর বাস স্টপেজের নাম হয়ে গেল ডাক্তারখানা।

দ্বিতীয় স্টপেজের নাম ঘটকপুকুর স্ট্যান্ড। এখান থেকে রাস্তা একদিকে রায়দিঘি অন্যদিকে কাকদ্বীপের দিকে চলে গেছে। জায়গাটা সবসময়ই সরগরম। তিন-চারটে মিষ্টির দোকান, চপ-ফুলুরিও বেশ কয়েকটা, সারের দোকান, টেলারিং, ইদানীং একটা টিভি মেরামতের দোকানও খুলেছে পঞ্চায়েত প্রধানের ভাইপো নাড়ু। বিকেলে একটা রোল-চাওমিনের চলমান দোকানও বসে। তার গায়ে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘ঘটকপুকুর রোল কর্নার’।

ঘটকপুকুর গ্রামে যেতে গেলে এই স্ট্যান্ড থেকে একটু পিছিয়ে আসতে হয়। ডাক্তারখানা স্টপেজে নেমে অবশ্য সোজা ঢুকে গেলেই হল। গাছগাছালির ছায়ায় ছায়ায়, পুকুরে হাঁসের সাঁতার দেখতে দেখতে গ্রামীণ ব্যাংকের পাশ দিয়ে সোজা ঘটকপুকুর হাটতলায় ঢুকে পড়া যাবে। এই হাটতলাটাই গ্রামের প্রাণকেন্দ্র। গ্রামটা তাকে ঘিরে পদ্মের পাপড়ির মতো ফুটে আছে।

ডাক্তারখানা আর স্ট্যান্ড– এই দুই স্টপেজের মাঝে গ্রামে ঢোকার আর একটা তৃতীয় রাস্তা আছে। বাস ওখানে দাঁড়ায় না। যদি দাঁড়ায়, তবে হয়তো স্টপেজটার নাম হতো, কাওরাপাড়া স্টপেজ। ঘটকপুকুরের কোনও মান্যগণ্য লোককে প্রকাশ্যে এ রাস্তায় যাতায়াত করতে দেখা যায় না। আগেকার দিনে বাড়িতে যেমন মেথর ঢোকার আলাদা পথ থাকত, এই রাস্তাটাও তেমনি। ভদ্রসমাজের অস্পৃশ্য, অব্যবহূত। আসলে এই পাড়ার বাসিন্দারাও তাই। পন্ডিতেরা বলেন এরা আগে ছিল জমিদারের পালকিবাহক, কাহার সম্প্রদায়। কাহার থেকে কাওরা। যারা পালকি না বইলে ভদ্রলোকের সভ্যতার গতিরুদ্ধ হয়ে যেত, অফিস-কাছারি, পালা-পার্বণে যাতায়াত বন্ধ হয়ে যেত, এমনকী পালকি শুদ্ধু গঙ্গায় ডুবিয়ে পুণ্যের থলিটা বোঝাই করা যাদের দাক্ষিণ্যে, তারা নাকি এত নীচু জাত যে গ্রামের ভেতরে তাদের বাস চলে না, তাদের রাস্তাটাও বিপদে না পড়লে কেউ ব্যবহার করে না। তো সেই কাওরাপাড়ায় লকলক করে লাউডগার মতো বেড়ে উঠছে ফুল্লরা কাওরা। তাকে নিয়েই এই গল্প।

ফুল্লরা একরাশ গোবর কুড়িয়ে ঘরে ফিরে দেখল তার মা সনকা দাওয়ায় বসে চুল খুলছে। সে প্রায়ই দড়ি দিয়ে চুল বাঁধতে গিয়ে গিঁট ফেলে দেয়, তাই দড়ির বদলে অনেকসময় শাড়ির পাড় ছিঁড়ে নেয়। আজ মার কাঁচাপাকা চুলে লালরঙের শাড়ির পাড় কেমন বেখাপ্পা লাগল ফুল্লরার। মার সিঁথির জায়গাটা ফটফটে ফাঁকা। তার বাপ দুখে মারা গেছে দু-মাসও হয়নি। স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, দুখেকে খুন করা হয়েছে।

দুখে কাওরার স্থায়ী কোনও পেশা ছিল না। মাঝে মাঝে সে নিত্য শাহ-র সিমেন্টের দোকানে মাল বওয়ার কাজ করত বটে, কিন্তু বেশিরভাগ দিনই তাকে কাজ করবার মতো সুস্থ অবস্থায় পাওয়া যেত না। সে পড়ে থাকত পঞ্চার তাড়ির ঠেকে কিংবা মণিকা-কণিকার বাড়ি। সেখানে মদের আসর বসত, তবে সেটা মুখ্য নয়। দুখে খুব ভালো গান গাইত। তার গলায় গোষ্ঠগোপাল দাসের ‘গুরু না ভজি মুই সন্ধ্যা সকালে মন প্রাণ দিয়া’ শুনে মহাপাতকের চোখেও জল আসত। তার গানের সঙ্গে নাল বাজাত সাগর। আর মণিকা-কণিকা, যাদের নামে গ্রামের সবাই বলে, তারা গ্রামের বুকেই, ভদ্রপাড়ায় লাইন খুলে বসেছে, তারা গানের মাঝে মাঝে মদ, চাট এবং হাসি পরিবেশন করত আর পরিবেশনের ফাঁকে ফাঁকে তাদের আঁচল বার-বার খসে পড়ত।

এরকম অবস্থায় তাবড়-তাবড় ঋষিদেরই ধ্যানভঙ্গ হয়, দুখে তো কোন ছার! সে শুধু মনস্থির করতে পারছিল না, মণিকা না কণিকা– কে তার মন বেশি টেনেছে। নিজের এই সংশয়ে সে এতই নিবিষ্ট ছিল যে খেয়ালই করেনি, যে তার বাজনদার সাগর, তাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করেছে। এ বাড়িতে সাগরের যাতায়াত দুখের অনেক আগে থেকে, দুটি বোনকেই সে তার হাতের বাজনার মতোই ভালো বাজাতে পারে। তারাই যখন, দুখের গানে মজে, নতুন হাতে বাজতে চাইল, সে মেনে নিল না।

দুখে আর সাগর মাঝে মাঝেই দূর দূর গ্রামে মাচা প্রোগ্রাম করতে যেত। সেবার তারা গেল কাঁটাগাছি, কাঁটাগাছি ব্যবসায়ী সমিতির ডাক পেয়ে। ফেরার সময় সাগর একাই ফিরল, দুখে নাকি ওখান থেকে কোথায় চলে গেছে, কাউকে কিছু না বলে। কয়েকদিন পর দুখের বডি ভেসে উঠল খালের জলে। সনকা থানায় রিপোর্ট লেখাতে গিয়ে ফিরে এল। একে তো সাগর উঁচুজাত, তার ওপর সে পঞ্চায়েত প্রধানের লতায়পাতায় আত্মীয় হয়। সনকা চোখের জল মুছে বাড়ি ফিরে এল।

সনকার ফটফটে সাদা সিঁথিটা দেখে ফুল্লরার মনে আবার সেই ভয়ংকর দিনগুলো ফিরে আসে। সেই জল থেকে তোলা ফুলে ঢোল বডি, বাবা বলে চেনাই যায় না। পোস্টমর্টেম রিপোর্টও হাওয়া হয়ে গেল। কিন্তু ফুল্লরা জানে তার বাবাকে ছুরি মেরে খুন করেছে সাগর। পুলিশের মুখ বন্ধ করলেও লোকের মুখ অত সহজে বন্ধ করা যায় না। ইস্কুলের টিউকলে জল নিতে গিয়ে শুনে এসেছে সে, গাঁয়ের বউ-ঝিরা সেখানে খাবার জল নিতে ভিড় করে সকালে-বিকেলে।

যত আগে গিয়েই লাইন দিক, ফুল্লরা জানে যে, সে জল পাবে সবার পরে। ছোটোবেলা থেকেই এমন দেখে আসছে। তখন বুঝত না। জেদ করে ওদের লাইনে দাঁড়াতে গিয়েছিল একবার। ওরা ঠেলে ফেলে দিয়েছিল। খোয়ার ওপর পড়ে কপাল একটুর জন্যে ফাটেনি, কিন্তু মাটির কলসি ভেঙে গিয়েছিল। ছোট্ট ফুল্লরার কপালে গাঁদা পাতার রস লাগাতে লাগাতে তার মা বুঝিয়েছিল উঁচুজাতের জলের লাইন আলাদা, ওদের ছোঁয়া লাগলে যে জল ওরা খেতে পারবে না। ফুল্লরা বুঝতে পারেনি, সরকারি কলের জল ওদের ছোঁয়ায় কী করে অশুদ্ধ হতে পারে। তখনও ইস্কুল ছাড়েনি। খিচুড়ি ইস্কুল। সেখানে খুব করে প্রার্থনা গাইতে হতো, ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।’ গাইতে গাইতে ওর বুকে কীরকম একটা কষ্ট হতো। ওর মনে হতো, এখানে যে আগুনের কথা বলা হয়েছে, সেই আগুন তো বইয়ের অক্ষরের মধ্যে লুকোনো আছে। সেই আগুন যে ছুঁয়েছে, সে-ই শুদ্ধ। তার আবার জল-অচল কী? ইস্কুলে বেশিদিন যেতে পারেনি ফুল্লরা, কিন্তু গানটা ভোলেনি।

সবার পরে জল নিতে এখন আর কষ্ট হয় না। ও জেনে গেছে এটাই নিয়ম। কাওরাপাড়ায় দুখে কাওরার ঘরে জন্মালে এরকমই হয়। সেই জন্মদাতা বাবাও যদি ওরকম বেঘোরে চলে যায়। শ্যাওলা-জড়ানো, ফুলে ঢোল দুখের লাশ মনে পড়ে যায় বারবার ফুল্লরার।

সনকার চুল খোলা হয়ে গেছিল। সে কেমন চোখে ফুল্লরাকে দেখতে দেখতে বলল, ‘ঘরে শ্যাম্পুর পাতা আছে, মাথা ঘষে চান কর। বিকেলে, তোর মামি গেলবার যে শাড়িটা দিয়েছিল, নীল করে, ওটা পরবি।’

ফুল্লরা অবাক হয়ে গেল। মার ভালো শাড়ি বলতে ওই একটাই। কোনওদিন চাইলেও পরতে দেয় না। বলে ছিঁড়ে যাবে। হরিসভায় মোচ্ছবের সময় তাদের পাড়ার মেয়েরা কত সেজেগুজে যায়। সেসময় কতবার শাড়িটা পরতে চেয়েছে ফুল্লরা, মা দেয়নি। আজ কী হল তার! সে তবু কিছু জিজ্ঞেস করে না মাকে। বাবা চলে যাবার পর মা কেমন খিটখিটে হয়ে গেছে। দশবাড়ি খেটে খেটে সারাক্ষণ তেতেপুড়ে থাকে, কিছু জিজ্ঞেস করলেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে।

সে গোবরটা উঠোনে রেখে হাত ধুয়ে কোমরে বাঁধা ওড়নায় মুছে নিল। তারপর ঘরে এল। শ্যাম্পুর পাতাটা নেবে। নীচু ঘর, দিনের বেলাতেও আলো ঢোকে না। দেয়ালে একটা আয়না ঝোলানো আছে। তার ঘষা কাচে ফুল্লরা নিজেকে দেখার চেষ্টা করে।

এ গাঁয়ের অনেক মেয়েরই সকাল সকাল বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের সরকারি বয়সে পৌছনোর অনেক আগেই। শুধু গরিব ঘরে বা নীচু জাতের মধ্যে নয়, বড়ো বড়ো ঘরেও এটাই স্বাভাবিক। ভালো ছেলে পেয়ে গেলে সবাই হাঁকপাঁক করে মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেয়। সে সামনে মাধ্যমিক থাকলেও। আর ফুল্লরা তো স্কুলেই যায় না। তারওপর বাবাও নেই। তাই তার এই বয়সে বিয়ে ঠিক হওয়ায় কেউ অবাক হল না। কিন্তু ছেলের বাড়ি কোথায় জেনে সবার চোখ কপালে উঠে গেল। কথায় বলে, ‘কোনও কালে নেই ষষ্ঠীপুজো। একেবারে দশভুজো।’ একেবারে বম্বে। বম্বে তো একেবারে কল্পলোক। সেখানে ক্যাটরিনা কইফ, সলমন খান, শাহরুখ খান রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ায়। ভোরে সমুদ্র ধরে হাঁটলে বিগ বি-র সঙ্গে ধাক্বা লাগতে পারে। সেখানে শ্বশুরঘর করতে যাবে কাওরাপাড়ার ফুল্লরা কাওরা!

ফুল্লরার বন্ধুরা শুনে বলল, ‘তোর নাকি শাহরুখ খানের সঙ্গে বিয়ে!’

যদিও ঠাট্টা, তবু ফুল্লরার বুক তিরতির করে কেঁপে উঠল। সত্যি তার বিয়ে, তাও আবার বম্বেতে! মাঠে গোবর কুড়োনো, সেফটিপিন দিয়ে ফ্রক আঁটা, সবার শেষে জল নেওয়া– এই ছেঁড়াফাটা, তালিমারা জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে তার? শাহরুখ খান না হোক, তার বরের নাকি মেলা জমি-জিরেত, এখনকার মতো ভাতের ভাবনা থাকবে না বিয়ের পর। কিন্তু তাদের গাঁয়ের লোকগুলো কি হিংসুটে, কেউ একবেলা ভাত দেবে না, কিন্তু কু গাইতে ওস্তাদ। তাদের কাওরা পাড়ার বউ-ঝি থেকে শুরু করে, যে-বাবুদের বাড়ি মা কাজ করে, তারাও বলছে, ‘হুট করে কোথায় বিদেশ বিভুঁইয়ে বিয়ে ঠিক করে ফেললে, জানো তো, বিয়ের নাম করে মেয়ে পাচার চক্র চলছে রমরমিয়ে, মেয়েগুলোকে দিয়ে কী যে করাবে–’

তার ধলাদাদু তাকে পাচার করে দেবে! ভাবলেও হাসি পায়। বাবা মারা যাবার পর এই দাদুই তো তাদের টেনেছে সাধ্যমতো। ধলাদাদু, মার কীরকম কাকা হয়, বম্বের একটা ফ্ল্যাটে পাহারাদারের কাজ করে। সেই এনেছে সম্বন্ধটা। ছেলের বাড়ি বম্বে শহর থেকে একটু দূরে। বিট্টলপুরা বলে একটা গাঁয়ে। ছেলের বয়স নাকি একটু বেশি। ছেলের এক মেসো কলকাতায় থাকে, সেই এসে দেখে গেছে ফুল্লরাকে। মা যেদিন তাকে নীল শাড়ি পরে সেজেগুজে থাকতে বলেছিল, সেইদিনই। মেসোর নাম ভগবান দাস। পাকানো গোঁফে মোচড় দিতে দিতে সেই ভগবান দাস ফুল্লরাকে একটা প্রশ্নই করেছিল–

‘পিনে কা পানি আনতে কতদূর যেতে হয় বেটি?’

প্রশ্ন শুনে অবাক হয়েছিল, কিন্তু ঠিকঠাক উত্তরই দিয়েছিল। খুশি হয়েছিল ভগবান দাস। কে জানে, এক ঘণ্টা-দু ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর কথা তাকে এত মুগ্ধ করেছিল কেন। হয়তো সে পরখ করে দেখতে চাইছিল ফুল্লরার ধৈর্য, সহ্যক্ষমতা। তারপর ফুল্লরাকে সুপুরি, রুপোর টাকা ও জরিন শাড়ি দিয়ে আশীর্বাদ করে চলে গেছিল ভগবান দাস।

কয়েকদিনের মধ্যেই নিত্য শাহ-র বাড়ি কাজ করতে করতে ফোনে শুভ খবর পেয়েছিল সনকা। ফুল্লরাকে ওদের পছন্দ হয়েছে। কিন্তু জমি-জিরেত ছেড়ে ছেলে বিয়ে করতে আসতে পারবে না। ফুল্লরাকেই যেতে হবে। তাকে নিয়ে যাবে ভগবান দাস।

এতদিন গাঁয়ের লোকের নানান কথাতেও সনকার মন টলেনি। কিন্তু এখন বিয়ে হবে শুনে সে কেমন কেঁপে উঠল। বিদেশ-বিভুঁই জায়গা, ভাষাও অন্য, মেয়েটাকে সে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিচ্ছে, সব সে জানে, আর কী-ই বা করার আছে তার? কিন্তু সাতপাকটা অন্তত যদি তার সামনে হয়ে যেত, বুকটা আঁটা থাকত। এই ভগবান দাস, যাকে সে একদিন মাত্র দেখেছে, তার হাতে একটা উঠতি বয়সের মেয়েকে সঁপে দেবে? ফোনের মধ্যে তার আশঙ্কা টের পেয়েছিল ভগবান দাস, সে আশ্বস্ত করেছিল সনকাকে। ‘আরে বেটি, ঘাবড়াও মৎ। তোর মেয়েকে আমি কোনও কোঠিতে বেচতে যাচ্ছি না। সোজা শাদির মন্ডপে নিয়ে গিয়ে তুলব। আর তোর চাচা তো আছেই ওখানে।’

নির্দিষ্ট দিনে ভগবান দাস তাকে নিতে এসেছিল। নিত্য শাহ-র বউয়ের দেওয়া একটা পুরোনো কাপড়ের ব্যাগে টুকিটাকি জিনিস গুছিয়ে নিতে নিতে ফুল্লরা আবিষ্কার করেছিল মা কখন যেন নীল শাড়িটা তার ব্যাগে ঢুকিয়ে দিয়েছে। এতদিন ঘোরের মধ্যে থেকে সে ভাবেইনি বিয়ে মানে মাকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাওয়া। নীল শাড়িটা তার সেই ভুলে থাকা ব্যথাটা খুঁচিয়ে দিয়েছিল। বিছানায় উপুড় হয়ে কেঁদেছিল ফুল্লরা।

নতুন জায়গায় ঘুম আসতে দেরি হয়। কিন্তু বিট্টলপুরায় এসে বিছানায় পিঠ ঠেকাতেই ঘুম এসে গেল ফুল্লরার। কারণ দুদিনের ট্রেন জার্নিতে সে প্রায় ঘুমোয়নি বললেই চলে। মাকে ছেড়ে এতদূর চলে আসার কষ্ট একটা ফোড়ার মতো টাটিয়ে ছিল বুকের মধ্যে, তার ওপর অচেনা একটা লোকের সঙ্গে আসা, প্রতি মুহূর্তেই মনে হচ্ছিল হিংস্র নেকড়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

স্টেশনে নেমে ধলাদাদুকে দেখে ওর মন অনেক হালকা হয়ে গেল। ধলাদাদু আজ যেতে পারছে না, তবে বিয়ের দিন অবশ্যই যাবে। তারপর দুবার বাস পালটে সন্ধে নাগাদ বিট্টলপুরায় এসে পৌঁছলো।

বাস থেকে নেমে সে দেখল পুরো গ্রামটা অন্ধকারে ডুবে আছে। মাঝে মাঝে টিমটিমে লণ্ঠনের আলো। গ্রামে এখনও বিদ্যুৎ আসেনি। বাস থেকে নেমে কাঁচা সড়ক দিয়ে অল্প একটু হেঁটে ওর শ্বশুরবাড়ি। একটা লোক আলো নিয়ে এগোতে গেছিল। উঠোন ঘিরে ছড়ানো ছিটোনো ঘর। লণ্ঠনের আলোয় ও বুঝতে পারল না ভালো। ওরা ঢুকতেই একদল বাচ্চা ছুটে এল। ওদের চিৎকার থেকে একটাই শব্দ বুঝতে পারল ফুল্লরা।

‘পানিবাই! পানিবাই!’

কাকে বলছে কথাটা? নতুন বউকে এরা পানিবাই বলে নাকি? ওকে হাত-পা ধোবার জায়গা দেখিয়ে দিতে গেল এক মহিলা। খুব শক্ত, হাড়-হাড় চেহারা, রাগি মুখ। সে দাঁতে দাঁত চেপে যা বলল, তা থেকে মোদ্দা কথা বুঝে নিল ফুল্লরা। মহিলা ওকে বলছে, এটা শুখা দেশ, বাংলার মতো হরা-ভরা নয়, তাই পানি কম খরচ করতে হবে।

তাদের ঘটকপুকুরে তাকে খাবার জল পাবার জন্যে সবার পেছনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়াতে হয়েছে সত্যি, কিন্তু সে তো অন্য কারণে। সেখানে জলের ছড়াছড়ি। বাড়ির পেছনে হাঁসপুকুরে তারা ঝাঁপাঝাঁপি করে চান করত। আর এখানে দু-এক ঘটিতে তো পুরো গা-ও ভিজবে না। রাতের খাবারে মোটা মোটা রুটি আর বিচ্ছিরি স্বাদের একটা সবজি খেতেও ওর তত কষ্ট হচ্ছিল না, যতটা জলের জন্য হচ্ছিল।

রাতে ওকে শুতে দেওয়া হল একটা বুড়ির সঙ্গে। তাদের দেশে বয়স হলে সাদা বা হালকা খোলের শাড়ি পরে, এ বুড়ি পরে আছে ক্যাটকেটে সবুজ রঙের শাড়ি। তবে মানুষটা এমনি খারাপ না। শুয়ে শুয়ে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল আর বিড়বিড় করে কীসব বলছিল। একসময় বুড়ির হাত ওর কোমরে এসে থামল। কোমর টিপে টিপে বুড়ি যেন কী পরখ করার চেষ্টা করছে। হাতটা সরিয়ে দেবার চেষ্টা করতে করতে ফুল্লরা কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, সে নিজেও জানে না। মাঝরাতে হঠাৎ কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙল। বিছানা হাতড়ে দেখল বুড়িটা নেই। ঘরের বাইরে থেকে মেয়েগুলোর কান্না আর পুরুষের চিৎকার ভেসে আসছে। শুনতে শুনতে ফুল্লরা আবার ঘুমিয়ে গেল।

পরদিন ঘুম ভাঙল শক্ত এক হাতের ধাক্বায়। সেই রাগি রাগি বউটা ওকে ঠেলা দিচ্ছে।

‘এত বেলা অবদি ঘুমোলে পানি মিলবে?’

কে যেন পাশ থেকে বলল, ‘আহা, সে তো আজই নয়, আগে তো শাদি হোক।’

‘আরে রাখো তোমার শাদি, আজ যদি ঝুঁটি ধরে না তুলি, তবে আদত পড়ে যাবে বিছানায় শুয়ে থাকার।’

আরেকটি বউ অমনি ঝনঝন করে হেসে উঠল, ‘আহা কোন সুখে বিছানা আঁকড়ে থাকবে বলো, সে তো তুমিই দখল করে আছ!’

এই কথা শুনে রাগি বউটি দপদপ করে চলে গেল। অন্য বউগুলো, যারা ফুল্লরার বিছানার চারদিক ঘিরে ছিল, তারা বলল, ‘জলদি জলদি উঠে পড়, আজ না তোর শাদি?’

তাদের গাঁয়ে ‘ওঠ ছুঁড়ি তোর বিয়ে’ বলে একটা কথা আছে। কিন্তু ফুল্লরার বুক কেমন ধক্ করে উঠল শুনে। ‘আজই শাদি! ধলাদাদু যে বলল তিনদিন পরে?’

‘আহা, এই তিনদিন পানি আনার জন্য অন্য বাই রাখবে নাকি?’

আসা থেকেই ‘পানি’ শব্দটা কতবার শুনেছে ফুল্লরা। মাথায় এখন যেন সেই জল টলটল করে উঠল। বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল ও। বউগুলো চেঁচিয়ে উঠে বলল, ‘হায় হায়! এই দুবলি পাতলি লেড়কি কী করে পানিবাই হবে? ভগবানচাচা কেমন মেয়ে ঢুঁড়ে আনল!’

পাশ থেকে কে যেন বলল, ‘আশপাশের গাঁয়ে তো কেউ রাজি হল না। ভগবানচাচা তাই বলল, বাঙালি লেড়কিরা কথা শোনে, তার ওপর বাপও নেই।’

বিয়ের মন্ডপে বসেও ফুল্লরার মাথায় টলমলানি যাচ্ছিল না। পানিবাই! পানিবাই মানে কী! নতুন বউকে এদেশে পানিবাই বলে নাকি? ভগবানচাচাকে ও কোথাও দেখতে পাচ্ছিল না। পেলে বলত মাকে ফোনে ধরে দিতে। মা এখন নিত্য শাহ-র বাড়ি ঘর মুছতে মুছতে জানতেও পারছে না তার মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।

নিজের চিন্তায় এতখানি ডুবে ছিল ফুল্লরা, যে সে বুঝতেও পারেনি বিবাহমন্ডপে কখন বর এসে হাজির হয়েছে। বাচ্চাদের ‘দুলহা আ গয়া, দুলহা আ গয়া’ চিৎকারে সে সচকিত হয়ে দেখল তার সামনে এক দীর্ঘদেহ, প্রশস্ত বক্ষ মানুষ, এদেশের রীতি অনুযায়ী মুখ ঢেকে এসে দাঁড়িয়েছে। ফুল্লরার বুক দুরদুর করে উঠল, সমস্ত ভয়, সন্দেহ, অপমান, ক্ষুধা দূর হয়ে যাবে এইবার। তার কল্পলোকের শাহরুখ খান এসে দাঁড়িয়েছে তার সামনে বরমাল্য হাতে। কে যেন চেঁচিয়ে বলল, ‘মুখ খোলো কিষণলাল।’ দুলহা মুখের ওপর থেকে চাঁদমালার মতো ঢাকা সরিয়ে নিল। অমনি ফুল্লরার নাকে এসে লাগল একটা পচা গন্ধ। বাবাকে জল থেকে তোলার পর যেমন গন্ধ বেরোচ্ছিল। কিন্তু সত্যি সত্যি তো এমন গন্ধ কোথাও নেই। চারদিকে ঘিরে থাকা বউ-মেয়েরা সুগন্ধি ফুল ছুঁড়ছিল, কিষণলাল কড়া সেন্ট মেখে আছে, তবে? আসলে বুড়ো মানুষদের শরীর থেকে একধরনের পচা গন্ধ বেরোয়, শিথিল চামড়া, নড়া দাঁতের গন্ধ, বহু বছর দুনিয়া দেখে ভেতরটা পচে যাবার গন্ধ। সামনে দুলহা সেজে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে, তার বয়স সত্তরের কম নয়। লোকটা ভাবলেশহীন চোখে ফুল্লরাকে দেখছিল, আর ফুল্লরার ষোলো বছরের সবুজ লাউডগা শরীর গুলিয়ে উঠছিল। এই তার শাহরুখ খান! সে মাথা ঘুরে মাটিতে পড়ে গেল।

জ্ঞান ফিরতে দেখল, সেই বুড়ি মহিলা তার চোখমুখে অল্প অল্প জলের ছিটে দিচ্ছে। জলের স্পর্শে আরাম হচ্ছিল ফুল্লরার। আবার মায়ের কথাও মনে পড়ছিল। সে ডুকরে কেঁদে উঠতেই বুড়ি তাকে প্রবোধ দিয়ে বলল, ‘দুলহার বয়স আর রূপ দেখে ফালতু কষ্ট পাচ্ছিস। যেমন নাম-কা-ওয়াস্তে শাদি, তেমনি নাম-কা-ওয়াস্তে পতি। তোর আসলি মরদ তো ওইটা।’ বলে কী যেন একটা আঙুল দিয়ে দেখায় বুড়িটা। তার আঙুল অনুসরণ করে ফুল্লরা দেখে ঘরের কোণে একটা পিতলের বিশাল কলশি। গড়নটা তাদের দেশের তুলনায় খানিকটা আলাদা, কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছে অনেক বেশি ভারী। এতে করে জল আনতে গেলে মোষের শক্তি দরকার। আচমকা তার মাথায় পর-পর কিছু দৃশ্য-শব্দ খেলে যায়, গত রাতে বুড়ির তার কোমর পরখ করা, দুবলি-পাতলি বাঙালি, পানিবাই! সে-ই পানিবাই নয়তো?

কান্নায় তার শরীর ফুলে ফুলে ওঠে। বুড়ি তার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘পাগলি কাঁহিকা! এখনও বরের বয়স ভাবছিস বসে বসে। আরে, ও তোকে কোনওদিনই বিছানায় নেবে না। সে তো আছেই আশাবাই। ধরমপত্নী। তবে কি না, পুরুষের কাম, কখন কাকে দেখে জেগে ওঠে। কুছ সাল পহলে, এক বরসাতের রাতে, আশাবাই বাচ্চা বিয়োতে মাইকে গেছে, আমাকে ডাকল। তা কী করে না বলি বল, পানিবাই হলেও বউ তো বটে। শরীরের স্বাদ পেয়েছিল তো, তাই আমায় তাড়ায়নি। এখন তো আর পানি আনতে পারি না, তাও রেখে দিয়েছে। অথচ কত পানিবাই এল আর গেল।’

কান্না থামিয়ে বিষ্ময়ে হতবাক ফুল্লরা বুড়ির দিকে তাকায়। এই বুড়ি কিষণলালের বউ!

বুড়ি বলে চলে, ‘আসলি বাত কী জানিস? এ হল শুখা দেশ। সহজে পানি মেলে না। পানি দু-তিন গাঁও ভেঙে আনতে যেতে হয়। সকালে গেলে ফিরতে ফিরতে বিকেল তিনটে-চারটে। তা ঘরের বউ যদি পানি আনতে যায়, তবে ঘরের কাম-কাজ কী করে চলবে, খানাপাকানো, বালবাচ্চাদের পালপোষ কে করবে? তাই পানিবাইদের দরকার। শাদি তো একটা হচ্ছে, তাই মাইনে দিতে হয় না, ডাল-রুটি তো মিলবে দুবেলা। তা, কিষণলালের খুব বদনাম, বউটাও রাগি, তাই এখানকার কেউ আর পানিবাই হয়ে আসতে চায় না। একজনকে তো পিটিয়েই…’ বুড়ি কী যেন বলতে গিয়ে চুপ করে যায়। ফুল্লরা হাঁটুর ওপর মুখ রেখে সেই নৈঃশব্দ্য থেকে কিছু খুঁড়ে বার করার চেষ্টা করে, জলের মতো। শুখা দেশে চোখের জলও যে শুকিয়ে যায়, কে জানত!

দূরে দূরে ছোটো কয়েকটা টিলা। পশ্চিমের টিলার পেছন থেকে কমলা আলোর বলটাকে আস্তে আস্তে নেমে যেতে দেখল ফুল্লরা। সূর্য ডুবছে। আজ তার বড্ড দেরি হয়ে গেছে। এখানকার বউরা মাথায় কলশি নিয়ে চলতে পারে। সেটা তার এখনও অভ্যাস হয়নি। সে কলশি নেয় কাঁখে। প্রথম প্রথম এত ভারী কলশি বইতে পারত না, একবার তো জলভরা কলশি দরজার কাছে পর্যন্ত এনে ফেলে দিয়েছিল। সেজন্য আশাবাই খুব মেরেছিল তাকে। রাতে খেতেও দেয়নি। গায়ের ব্যথায় সে পরেরদিন উঠতে পারেনি, জল আনাও হয়নি। সেই থেকে আশাবাই তাকে মারে না, কিন্তু বোলি বড়ো তীক্ষ্ণ তার। চাবুকের মতো সপাং করে গায়ে বেঁধে।

কিষণলাল বলে যে-লোকটা তার স্বামী, সে অবশ্য কিছু বলে না। উঠোনে পাতা চৌপাইতে বসে শুধু চোখ দিয়ে অনুসরণ করে তাকে। সে দৃষ্টি দেখলেই গা ছমছম করে ফুল্লরার। কারণ কিষণলাল তাকে যে দেখছে, সেটা আবার আশাবাই-এর নজর এড়ায় না। একসঙ্গে দুজোড়া চোখের ভার বহন করা কঠিন।

অন্যদিন ঠাঁ ঠাঁ দুপুর রোদে সে ফেরে। আজ রোদ পড়ে গেছে। অত কষ্ট হচ্ছে না তার। কিন্তু মাসিক শুরু হওয়ায় কোমরে সে আর কলশি রাখত পারছে না। এবার থেকে এদেশের বউ-ঝিদের মতো মাথায় কলশি বওয়া অভ্যাস করতে হবে তাকে।

রোদ নেই। তবু কলশি নামিয়ে একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য একটা গাছের ছায়া খুঁজল ফুল্লরা। গাছ, গাছের ছায়া তাকে বাংলার কথা, নদীর কথা, মায়ের কথা মনে পড়িয়ে দেয়। সেই বিয়ের দিন মাকে একবার ফোন করেছিল ভগবান চাচাকে ধরে করে। তারপর কত দিন, কত মাস হয়ে গেল কোনও খোঁজ খবর নেই। কিষণলালের একটা মোবাইল আছে, সারাক্ষণ সে সেটা গলায় ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কোনও বরসাতের রাতে সে যদি ফুল্লরার শরীর চায়, তাহলে, কিষণলালের মোবাইল নাগালে পেয়েও, মাকে ফোন করা হবে না ফুল্লরার। মার তো ফোন নেই। মাকে ফোন করতে হবে দিনের বেলা, মা যখন কারও বাড়ি কাজ করে। জল আনতে আসা-যাওয়ার পথে কোনও বাজার পড়ে না, যে সেখানে একটা ফোনের বুথ খুঁজে ফোন করতে পারে। তার কাছে অবশ্য পয়সা নেই, পানিবাইরা তো পেটখোরাকি, হাতে পয়সা পায় না। কিন্তু তার নাকে এককুচি রুপোর নাকফুল আছে, বাবার শেষ স্মৃতি। ফোনের বুথ পেলে ওই ফুল দিয়ে সে মাকে ফোন করবে। মা যেন ধলাদাদুকে পাঠিয়ে তাকে এখান থেকে নিয়ে যায়।

খুঁজতে খুঁজতে ফুল্লরা দেখল দূরে একটা শিমুল গাছ। মাংসল লাল ফুলে ছেয়ে আছে। শিমুল ফুল ফুটেছে! তার মানে এটা বসন্তকাল! আর কদিন পরেই বৈশাখ মাস পড়বে, তাদের হরিসভায় মোচ্ছব হবে, তাদের পাড়ার মেয়েরা সেজেগুজে গিয়ে কত মজা করবে, শুধু সে-ই থাকবে না। সবাই জানবে যে শাহরুখ খানের…

হঠাৎ শিমুলফুলের রং দেখে বুক ধক্ করে ওঠে ফুল্লরার। বসন্ত এসে গেছে! তার মানে একদিন বর্ষাও আসবে। আশাবাই-এর আবার গর্ভ হয়েছে, বুড়ি, যার নাম যশোমতী জানিয়েছে তাকে। বর্ষাকালেই হয়তো সে মাইকে যাবে। সেইসময়, অন্ধকার রাতে, কিষণলালের বুকে তৃষ্ণা জেগে ওঠে যদি? বাংলার শ্যামল-সবুজ জল-ছলছল শরীর পান করার সাধ জাগে তার? যশোমতী বলেছে তাতে অন্যায় কিছু নেই । কিষণলাল তো তার শাদি করা মরদ, সে তার শরীর নিতেই পারে। কিন্তু আশাবাই-এর মতো ঘর বা বিছানা সে পাবে না কোনওদিন। কিন্তু কিষণলালের ইচ্ছেয় সায় দিলে আখেরে তারই ভালো। যখন ফুল্লরা একদিন বুড়ি হয়ে যাবে যশোমতীর মতো, আর পানি আনতে পারবে না দূর গাঁও থেকে, তখন, কিষণলালের মনে জাগরুক থাকতে পারে তার শরীরের স্মৃতি, সে হয়তো তাড়াবে না ফুল্লরাকে। তা না হলে রাস্তায় রাস্তায় ভিখ মেগে বেড়াতে হবে তাকে।

ফুল্লরা কি তাহলে সারাজীবন জল বয়ে আনবে একটা সংসারের জন্য, যে-সংসারটা তার নয়। তার নিজের আনা জলে দু-ঢোঁকের বেশি অধিকার থাকবে না তার? জল আনতে আনতে যশোমতীর মতো বুড়ি হয়ে যাবে সে? তখন তাকে রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়াতে হবে, যদি না কোনও বরসাতের রাতে কিষণলালের ইচ্ছেয় সে সাড়া দেয়?

ভাবতেই ভেতরটা কেঁপে ওঠে। শিমুল ফুলের টকটকে লাল রং যেন বিপদ সংকেতের মতো তার চোখের সামনে নাচতে থাকে। বসন্ত থেকে বর্ষা আর কতই বা দূর। তাকে পালাতে হবে। তাকে এখনি পালাতে হবে। দৌড় শুরু করার আগে সে নিজের আনা জল, কলশি কাত করে আঁজলা ভরে আশ মিটিয়ে খেয়ে নেয়। তারপর ধাক্বা মেরে উলটে দেয় কলশিটা। জল মাটিতে গড়িয়ে যায়, শুখা মাটি তা শুষে নেয় মুহূর্তে।

অনেকক্ষণ থেকে মেয়েটাকে লক্ষ্য করছিলেন ইনস্পেকটর ঘোসলে। মেয়েটার সাজপোশাক মারাঠি গাঁয়ের বউয়ের মতো, কিন্তু ওর সবুজ পানপাতার মতো মুখ, নরম চাউনি বলে দিচ্ছে ও বাঙালি। কিছুক্ষণ আগে তিনি এক দল বাঙালি মেয়েকে উদ্ধার করেছেন মুম্বইয়ের এক কুখ্যাত কোঠি থেকে। এদের কলকাতা নিয়ে যাওয়ার জন্য পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের দুজন প্রতিনিধি এসেছে কলকাতা থেকে। তিনি নীচুগলায় তাদের সঙ্গে কীসব বলেন…

হাওড়া স্টেশনে ট্রেনটা থামার পর টিভি ক্যামেরা ঝাঁপিয়ে পড়ল মেয়েগুলোর ওপর। সবাই ওড়না বা শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে ফেলল অমনি। শুধু একটা মেয়ে উদাসীন মুখে বসেছিল। সাংবাদিকদের হাজার প্রশ্নের উত্তরে যে শুধু একটাই কথা বলল, ‘পানিবাই’।

আবার ইস্কুলের সামনের টিউকল থেকে জল নিতে এসেছে ফুল্লরা। আগে যেমন আসত। কিন্তু ঠিক আগের মতো যে আর সবকিছু নেই তা সে বুঝতে পারছে। আগের মতো জলের জন্য সবার পেছনে দাঁড়াতে হচ্ছে বটে, কিন্তু আগে তাকে দেখে বউদের এরকম কানাকানি, গা-টেপাটেপি ছিল না। সেদিন হাওড়া স্টেশনের ছবি অনেকেই দেখেছে টিভিতে। ওকে মুম্বইয়ের কোঠি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, এরকম একটা খবর রটে গেছে চারদিকে। তাতে নতুন করে কিছু ক্ষতি হয়নি, আগেও ওরা একটেরে কাওরাপাড়ায় আধপেটা খেয়ে থাকত, এখনও তাই। মায়ের কাজগুলোও যায়নি, বরঞ্চ তার মেয়ের মুখ টিভিতে দেখা গেছে বলে খানিকটা সমীহ তৈরি হয়েছে। তবে সবাই সনকাকে বলছে, ‘আগেই তোমাকে বলেছিলাম, শুনলে না।’

তবে লাভ একটা হয়েছে, কলকাতা থেকে ভালো শাড়ি-জামা পরা, চশমা চোখে একদল মহিলা দামি গাড়ি চেপে এসেছিল শুধু ওর সঙ্গে কথা বলতে। তারা ওকে শহরের মহিলা স্বনির্ভর কেন্দ্রে ভর্তির ব্যবস্থা করেছে। কাজ শেখার পাশাপাশি কিছু রোজগারও হবে।

সবার জল নেওয়া হয়ে গেছে ভেবে ফুল্লরা তাড়াতাড়ি তার প্লাস্টিকের বোতল কলের মুখে বসাতে গেল। ঘোষেদের মেজোবউয়ের যে আর একটা বোতল বাকি আছে সে দেখতে পায়নি। মেজোবউ অমনি খরখরে গলায় বলে ওঠে, ‘আরে ছুঁড়ি, মর মর। তোকে ছুঁয়ে আবার অবেলায় চান করব নাকি? একে কাওরা-হাঁড়ি, তারওপর দিল্লি বোম্বে সৃষ্টি জজিয়ে এসেছিস!’

শুনে শুনে অভ্যস্ত, তবু খামোখা চোখে জল এল ফুল্লরার। কয়েক মাস আগেও তার আনা জলের জন্য হাঁ করে থাকত আশাবাই আর তার ছেলেমেয়েরা। কিষণলাল লোটা ভরে পানি খেয়ে তৃপ্তিতে  বলত ‘আঃ’। ফুল্লরা বাড়ির জন্য কান্নাকাটি করলে যশোমতী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলত, ‘লোককে পানি পিলানা বড়ো পুণ্যের কাজ রে। পানিবাই কি যে সে হতে পারে?’ কয়েক মাসের তফাতে, সেই একই জল, তার ছোঁয়ায় অশুদ্ধ হয়ে গেল!

ভালো বাসা

সক্রোধে তখনও চেঁচিয়ে চলেছেন মৃণালিনী। ‘না আর এক মহূর্তও এই বাড়িতে থাকব না আমি। এ বাড়ির জলও আমার জন্য বিষ। আমার কি মান-সম্মান বলে কিচ্ছু নেই! সামান্য একটা কাজের লোক কিনা আমার মুখের উপর জবাব দেবে। এতবড়ো দুঃসাহস। এ অনাচার মেনে নেওয়া যায় না। আজই আমরা এ-বাড়ি ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাব।’

উৎপলেন্দুবাবু সামনের চেয়ারে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে খবরের কাগজের পাতা উলটে-পালটে দেখছিলেন। আর মাঝে মাঝে আড়চোখে চশমার ফাঁক দিয়ে গিন্নির পারদ মাপবার চেষ্টা করছিলেন। প্রথম প্রথম পাত্তা দেননি, কিন্তু বেগতিক দেখে বলে বসলেন, ‘বনমালি তোমাকে কী এমন বলেছে যে, সক্বাল সক্বাল বাড়ি একেবারে মাথায় তুলে ফেললে। বলার মধ্যে এই তো বলেছে, বাগান থেকে ফুল না তুলতে। ও তো দ্যাখে ওই গাছগুলোর পিছনে ওর বউদিমণি কতটা সময় ব্যয় করে। বরাবর বউমার তো একটাই স্বপ্ন, বাড়ির সামনে একটা ছোট্ট সুন্দর ফুলবাগান থাকবে। সেখানে তুমি যদি ওর সাজানো বাগান নষ্ট করতে যাও, তাহলে কথা তো উঠবেই। আজ ও বলছে, কাল কেয়া, বউমা কিংবা রক্তিম বলবে।’

স্বামীর কথা শুনে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন মৃণালিনী, ‘তুমি তো কখনওই অন্য কারওর দোষ দেখতে পাও না। ঘরে সাজিয়ে রাখব বলে সামান্য কয়েকটা গোলাপের কুঁড়ি-ই তো তুলেছিলাম! অমনি ওই বউদি-সোহাগি এসে বলে কিনা ফুল তুলবে না। বউদিমণি রাগ করবেন। কোথায় তোর বউদিমণি ডাক, আমিও দেখছি।’ কাকে ডাকবে সে, তার বউদিমণি, দাদাবাবু তো ততক্ষণে অফিসে পৌঁছে গেছে।

বনমালি এবাড়িতে বাগান দেখাশোনার কাজ করে। শুধুমাত্র বাগানের শখ মেটাবার জন্য বাড়ির-ই নীচের তলায় একটা ঘরে থাকতে দিয়েছে কেয়া আর রক্তিম। দু-বেলা খাওয়াদাওয়া, থাকা আর মাস গেলে কিছু টাকা পায় সে। তাতেই সে খুশি। চারকূলে তার যে আর কেউ নেই। কেয়ার বাগানের শখ দেখে এক প্রতিবেশী কাকিমাই বিশ্বস্ত এই বনমালিকে ঠিক করে দিয়েছেন। গাছ দেখাশোনা ছাড়াও ঘরের দোকান-বাজার করে দেয় ওই বনমালি-ই। কেয়ারটেকার বললেও খুব একটা ভুল বলা হয় না। খুব সাধাসিধে মানুষ। সংসারের এত মারপ্যাঁচ সে বোঝে না। আগে চাকদা গ্রামে থাকত। মাটির পাত্র বানাত। তাতে দুবেলা ঠিক করে খেতেও পেত না। এই কাজ পেয়ে সে খুব খুশি।

অন্যদিন ছেলে-বউমার সাথেই বেরিয়ে যান উৎপলেন্দুবাবু। আজ হাঁটুর ব্যথায় কাবু হয়ে পড়েছেন, তাই আর বেরোতে পারেননি। একটু বেলা করে উঠে সামনে পার্কে কিছুক্ষণের জন্য পা-টা ছাড়াতে গিয়েছিলেন। তখনই খানিক আভাস পেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা যে এতদূর গড়াবে বুঝতে পারেননি।

বাড়ি ফিরে দেখেন তখনও তর্জা চলছে। গিন্নি অনর্গল অকথা-কুকথা বলেই চলেছেন, আর সামনে দাঁড়িয়ে বনমালি মালি থরথর করে কাঁপছে। বারবার বোঝানোর চেষ্টা করছে ওভাবে সে বলতে চায়নি, কিন্তু কে-কার কথা শোনে। ভেবেছিলেন আশ মিটিয়ে বলার পর গিন্নি খানিক শান্ত হবে, তাই কিছু না দেখার ভান করে লক্ষ্মীকে চা দিতে বলে খবরের কাগজটা নিয়ে বসে পড়েছিলেন। মাঝে লক্ষ্মী এসে চুপিসাড়ে চা-ও দিয়ে গেছে। একটুও দাঁড়ায়নি সে-ও কী কম ডরায় গিন্নিমাকে। সব ওই মুখে মুখে চোপার কারণে।

বনমালির অনুনয়-বিনয় কাজে আসছে না দেখে নিজেই মাঠে নেমে পড়লেন উৎপলেন্দুবাবু। পরিবেশ হালকা করতে চেষ্টা চালালেন বটে, কিন্তু কাজে দিল না। ‘মাথা ঠান্ডা করো, মাথা ঠান্ডা করো। রক্তের চাপ বেড়ে যাবে।’ বলেই হাঁক দিলেন, ‘লক্ষ্মী তোর গিন্নিমাকে ফ্রিজ থেকে এক বোতল জল দিয়ে যাতো। মাথায় ঢালুক।’ আর সঙ্গে সঙ্গে বনমালিকেও ইশারা করলেন ওখান থেকে সরে পড়ার জন্য। বড়োবাবুর কথামতো সেও সুড়সুড় করে সরে পড়ল।

স্বামীর রসিকতা আর ইশারার বহর দেখে মেজাজ আরও সপ্তমে চড়ে যায় মৃণালিনীর। ‘তোলো তোলো, আরও মাথায় তোলো। তোমাদের সংসার তোমরা যা খুশি করো। মৃণালিনী কারওর গলগ্রহ হয়ে বেঁচে থাকবে না। কালই চলে যাব এখান থেকে। মৃণালিনী শেষ হয়ে যাবে তবু কথার নড়চড় করবে না।’

মৃণালিনীর কথায় কথায় হুমকি দেওয়াটা নতুন কিছু নয়। বাড়ির সকলেই কমবেশি ওনার এই অভ্যাস সম্পর্কে অবগত। কথায় কথায় শপথ নেওয়া, দিব্যি দেওয়া, তিলকে তাল করা, সুযোগ পেলেই সকলকে নীচু দেখানো এটা ওনার বরাবরের অভ্যাস। আগে নিজের সংসারে হুকুম চালাতেন এখন ছেলে-বউয়ের সংসারে। তফাতটা এই যা!

মৃণালিনী বরাবরই বদমেজাজি। সংসারে চ্যাঁচামেচি, টুকটাক ঝামেলা তো হয়ই, তবে বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি এর আগে কোনওদিন তৈরি হয়নি। রাগ করেছেন আবার নিজে নিজেই শান্ত হয়ে গেছেন। তার মালকিন হওয়ার অহংবোধ তাকে কোনওদিন একথা ভাবায়নি।

কিন্তু আজ ছবিটা একটু আলাদা। এটা তার ছেলে বউয়ের বাড়ি। ছেলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক-এর ম্যানেজার। বউমা একটা কর্পোরেট অফিসে আছে। শহরের সম্ভ্রান্ত এলাকায় দেখার মতো একটা বাংলো। ছেলেও মায়ের ব্যাপারে বেশ যত্নশীল। তৎসত্ত্বেও কিছু কিছু মহিলা এমন থাকেন, যারা ছেলের বিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাবতে শুরু করেন ছেলে পর হয়ে গেছে।

অথচ বিয়ের আগে এই ছেলেকেই চোখে হারাতেন মৃণালিনী। ছেলের সাথে মন-কষাকষি শুরু হয় কেয়ার সাথে বিয়ের অনুমতি চাওয়ার সময় থেকেই। এক তো নিজেদের পছন্দের মেয়ে নয় তার উপর জাত আলাদা। কিছুতেই মন থেকে মানতে পারছিলেন না মৃণালিনী। এই নিয়ে কম কথাকাটাকাটি হয়নি। শেষে উৎপলেন্দুবাবুর মধ্যস্থতায় মৃণালিনীর অমতেই রক্তিম আর কেয়ার বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছিল। ছেলের খুশির কথা মাথায় রেখে মত দিয়েছিলেন উৎপলেন্দুবাবু। সঙ্গে মৃণালিনীকেও বুঝিয়েছিলেন, ‘অসুবিধেটা কোথায়? কেয়া যথেষ্ট সুন্দরী। শিক্ষিত। ভালো পরিবারের মেয়ে। তাছাড়া যেখানে রক্তিম নিজে থেকে পছন্দ করেছে, সেখানে আমাদের রাজি হওয়া না হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। ভালো বলতে হবে রক্তিমকে যে ও তোমাকে সম্মান দিতে তোমার মতামত জানতে চেয়েছে।’

কিন্তু মৃণালিনী নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। না-জানি কেন ওনার বারবার মনে হয়েছে ওনার সাধাসিধে ছেলের মাথাটা এমবিএ করা কেয়া একেবারে চিবিয়ে খেয়েছে। আসলে উনি ব্যাংক ম্যানেজার ছেলের জন্য কোনও উচ্চশিক্ষিত মেয়ে চাননি বরং এমন মেয়ে আনতে চেয়েছিলেন, যে দিবারাত তার সেবা করবে, তার কথা মতোই চলবে।

উৎপলেন্দুবাবু কম বোঝাননি, যে সংসারটা শেষমেশ তাদেরকেই করতে হবে, মৃণালিনীকে নয়, তার থেকেও বড়ো কথা ওরা একে-অপরকে ভালোবাসে, জানে বোঝে, সুতরাং ওরা একে-অপরের সঙ্গে ভালো থাকবে। কিন্তু ছেলের পছন্দ করার কাঁটাটা মৃণালিনী কোনওদিন তুলে ফেলতে পারেননি। তবুও একরকম চলে যাচ্ছিল।

উৎপলেন্দুবাবুর বদলির চাকরি। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ভালো পোস্টে আছেন। কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গাতেই থাকতে হয়েছে। শেষে চাকরির আর বছর তিনেক বাকি থাকতে কলকাতায় ট্রান্সফার হয়ে এসেছেন। প্রথমে ভেবেছিলেন গ্রামের বাড়ি থেকেই যাতায়াত করবেন। কিন্তু এই বয়সে তিন-তিন ছয় ঘন্টা জার্নি করা খুব কষ্টের। শরীর দেবে কেন! তাই ঠিক করে ছিলেন ছেলের বাড়িতেই থাকবেন। কিন্তু মৃণালিনী আপত্তি জানিয়েছিলেন। তাই গিন্নির কথামতো ঠিক করেছিলেন অফিসের কাছাকাছি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকবেন। সেইমতো ব্যবস্থাও পাকা করে ফেলেছিলেন, কিন্তু ছেলে রাজি হয়নি। একপ্রকার জোর করেই মা-বাবাকে বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। ‘এই বয়সে তোমাদের একা থাকাটাও তো ঠিক নয়। শরীরের কথা তো বলা যায় না। কখন কি হয়। সবসময় কি এতটা পথ ঠেঙিয়ে আসাটা সম্ভব। তাছাড়া অদ্রিজা বড়ো হচ্ছে, সব কিছু সামলে সম্ভব হলে তো? তাছাড়া তোমরা ভাড়া থাকতেই বা যাবে কেন।’

একপ্রকার বাধ্য হয়ে মৃণালিনী এবাড়িতে আসতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। ছেলে-বউমা ওনার সবরকম সুবিধা-অসুবিধার খেয়াল রাখত। অভিযোগ করার কোনওরকম সুযোগ দিত না। তবু সুযোগ পেলেই উৎপলেন্দুবাবুকে বলতে ছাড়তেন না, ‘নিজেদের বাড়ির আলাদা একটা ব্যাপার। সেখানে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সব কিছু করা যায়, কোনও কিছুতে কিন্তু কিন্তু করতে লাগে না। কত করে বললাম– একটা বাড়ির ব্যবস্থা করতে, তা নয় অন্যের সংসারে জোয়াল টেনে মরছি।’

‘জোয়াল টানার কথা কেন বলছ মৃণাল, কেয়া তো কোনওদিন তোমাকে এক গ্লাস জলও গড়িয়ে খেতে বলেনি। তুমি নিজের ইচ্ছেয় করো। লক্ষ্মীকেও রান্নায় হাত লাগাতে দিতে চাও না। তাহলে কেন শুধু শুধু…। তাছাড়া অন্যের তো নয়, করছ তো নিজের সংসারেই। ছেলে-বউ-নাতনি তো আর পর নয়।’ মিষ্টি হেসে জবাব দেন উৎপলেন্দুবাবু।

কথাগুলো মৃণালিনীর মনোমতো হয় না, ‘এসব তোমরা ছেলেরা বুঝতে পারবে না। আর নাতনির কথা বলছ তাকেও তো প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে একেবারে মাথায় তুলে রেখেছে তোমার বউমা। এখন থেকেই মুখে মুখে জবাব দিতে শিখে গেছে। কেউ বলবে ক্লাস সিক্স-এ পড়ে। পোশাক-আশাক দেখেছ। ওই ছোটো ছোটো স্কার্টগুলো– সব মায়ের দোষ। নিজেও যেমন ছেলেদের জামাকাপড় পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তেমনি মেয়েটাকেও উচ্ছন্নে পাঠাচ্ছে। সারাদিন তো বাইরে পড়ে রয়েছে। মেয়ে, মানুষ হবে কী করে। চাকরি করছে চাকরি! বলি চাকরি করে হবেটা কী? এমন তো নয় যে ও উপায় করে আনলে তবে হাঁড়ি চড়বে। রক্তিমের আয় তো কম নয়। আসলে তা নয় ঘরে মন টেকে না।’

বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েন উৎপলেন্দুবাবু। একটু কর্কশ ভাবেই বলেন, ‘পড়াশোনা শিখেছে কি ঘরে বসে থাকবে বলে। এখন আর কেউ বাড়িতে বসে থাকে না। তোমার এই খিটখিটে মেজাজের জন্য অদ্রিজাটা পর্যন্ত তোমার কাছে ঘেঁষতে চায় না। সব সময় টিক-টিক, এই করিস না ওই করিস না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু বদলায়। তোমার কালে একরকম ছিল এখন আর এক রকম। এতবছর বাইরে থেকেও একটু বদলালে না তুমি। সেই পুরোনো চিন্তাভাবনা নিয়ে বসে আছ। কিছু বলার থাকলে ভালোবেসে বোঝাও। কেয়াকে দ্যাখো তো সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পরেও মেয়েটা কীভাবে হাসি মুখে বাড়ির প্রতি তার দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করে। মেয়েকে পড়ানো, তোমাদের সকলের ফরমায়েশ পূরণ করা।’ স্বামীর কথা শুনে মুখ বাঁকায় মৃণালিনী। স্ত্রীর আচরণে একটুও অবাক হন না উৎপলেন্দুবাবু। এই বদ্ধ পরিবেশ থেকে বাঁচতে দরজা খুলে বেরিয়ে যান তিনি।

এদিক থেকে উৎপলেন্দুবাবু অনেক উদার মনের মানুষ। খুব সহজেই সকলের সাথে মিশে যেতে পারেন। সকলকে আপন করে নিতে পারেন। তাই এত কম সময়ের মধ্যেই সকলের কাছে খুব প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। নাতনি তো একেবারে দাদুঅন্ত প্রাণ। কার্টুন দেখতে বসলেও দাদু। অঙ্ক করতে বসে কোনও সমস্যা হলেও দাদু আবার কোনও বায়না মেটাতে হলেও দাদু।

বউমা কেয়ার সাথেও উৎপলেন্দুবাবুর বেশ ভালো সম্পর্ক। পাকাপাকিভাবে উনি আসাতে কেয়াও অনেকটা নিশ্চিন্ত হতে পেরেছে। নাতনির পড়াশোনার পুরো দায়ভারটাই উনি নিজের ইচ্ছেয় কাঁধে তুলে নিয়েছেন। কেয়াকে সেভাবে আর দায়িত্বও নিতে হয় না। এমনকী প্রোজেক্ট ওয়ার্ক-টা পর্যন্ত উনি নিজের হাতে করেন। লক্ষ্মী-র ভরসায় তো আর পড়াশোনাটা ছাড়লে চলে না। সারাদিনের দেখভালের জন্য ও ঠিক আছে। বন্ধুদের জোরাজুরিতে বেড়াতে গিয়েছিল রক্তিম আর কেয়া। অদ্রিজার ক্লাস টেস্টের কারণে ওকে নিয়ে যেতে পারেনি। প্রথমে না-ই করে দিয়েছিল কেয়া, উৎপলেন্দুবাবুই জোর করে পাঠিয়েছিলেন তাদের। সেই নিয়েও মুখ ভার করতে ছাড়েননি মৃণালিনী।

‘কই আমার বেলায় তো এসব ভাবেনি কেউ। সব মনে আছে আমার, গ্রামের বাড়ি থেকে যখন মা আসতেন তখন আমরা দুজনে বেড়ানো তো দূর ঠিক করে কথা বলতে পর্যন্ত পারতাম না। মাথা থেকে ঘোমটা সরে যাওয়া নিয়ে কম গঞ্জনা শুনতে হয়নি আমাকে। মানুষ তো সবাই সমান তাহলে এত ভেদাভেদ কেন?’

‘ভুল করছ কোনও ভেদাভেদ নয়। নিজেরা যে দিনগুলো পেরিয়ে এসেছি, যাতে ওরা এই সমস্ত কষ্টের মুখোমুখি না হয়, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। তাছাড়া এখন যাবে না তো কবে যাবে। ওরা তো আমাদের সমস্ত রকম ব্যবস্থা পাকা করে তবেই যায় বলো। অসুবিধা করে তো কোথাও যাচ্ছে না।’

‘সমস্যাটা তো তোমার নয় আমার। তুমি তো অফিসে চলে যাবে। এই বুড়ো বয়সে সংসারের সমস্ত ঝক্বি সামলাতে হবে আমাকে।’

‘একটু ভেবে দেখো তো ও তোমাকে বিশ্বাস করে বলেই না তোমার উপর সংসারের দায়িত্ব দিয়ে নিশিন্তে থাকতে পারে।’ কোনও জবাব দিতে পারে না মৃণালিনী।

মৃণালিনী যে খুব খারাপ মনের মানুষ, তা কিন্তু নয়। তবে সংসারে তিনিই যে সর্বেসর্বা একথা প্রমাণ করতে নিরন্তর লড়াই চালাতে চালাতে কেমন যেন গাম্ভীর্যের খোলসে মুড়ে ফেলেছেন নিজেকে। এতদিন যেখানে ওনার ইচ্ছের বিরুদ্ধে বাড়ির একটা পর্দা পর্যন্ত বদলানো হয়নি, সেখানে এই বাড়িতে যে-যার দুনিয়ায় মগ্ন, শত ব্যস্ততা। এখানে যেন তার কোনও অস্তিত্ব-ই নেই। এতদিনে তার বানানো ভিতটা যেন নড়বড়ে মনে হতে থাকে তার, সবসময় একটা ইনসিক্যুরিটি  কাজ করতে থাকে। নতুন এই পরিবেশে হাঁপিয়ে উঠছিলেন মৃণালিনী। কোনও মতেই নিজেকে এই আলো-আঁধারি থেকে টেনে বার করতে পারছিলেন না। ক্রমশ ঘনান্ধকারে ডুবে যাচ্ছিলেন তিনি।

তার উপর গত সপ্তাহে অদ্রিজার ব্যাগ থেকে পাওয়া প্রেমপত্র নিয়ে তিনি বেশ চিন্তিত ছিলেন। চিঠি আবিষ্কারের পর সকলের উপস্থিতিতে নাতনিকে জিজ্ঞেস করাতে নাতনি চিঠিটা ওনার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘না বলে কারওর জিনিসে হাত দেওয়া উচিত নয়। কৃষাণু দাদা ওটা বিপাশা দিদিকে দিতে দিয়েছিল। আর তুমি না বলে পড়ে ফেললে। জানো না কারওর জিনিসে হাত দেওয়া উচিত নয়।’

নাতনির কথাতে একেবারে আকাশ থেকে মাটিতে নেমে এসেছিলেন মৃণালিনী। সব থেকে বেশি রাগ হয়েছিল ছেলে-বউয়ের উপর। এসব দেখেও তারা দু-ঠোঁট এক করল না। শাসন করার বদলে মেয়ের মুখে পাকাপাকা কথা শুনে হাসছিল তারা। তার উপর আজ বনমালির ফুল তুলতে মানা করার ঘটনাটা একেবারে আগুনের মধ্যে ঘি ঢালার কাজ করে দিয়েছে। সবমিলিয়েই আজকের ওনার এই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার ঘোষণা।

বনমালি আজ আর এমুখো হয়নি। লক্ষ্মীকে দিয়ে ঘরেই খাবার আনিয়ে নিয়েছেন মৃণালিনী। বনমালির ক’টা মাথা যে আবার গিন্নিমার সামনে এসে দাঁড়ায়।

দুপুরে উৎপলেন্দুবাবুই বুঝিয়েসুঝিয়ে গিন্নিকে খাওয়াতে রাজি করিয়েছিলেন। খাওয়াদাওয়ার যখন প্রায় একেবারে শেষ ঠিক তখনই কলিংবেলের আওয়াজ। লক্ষ্মী দরজা খুলতেই কেয়া-কে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। ‘আরে বউদি আজ তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেল? ভালোই হয়েছে, সবার এখন খাওয়া শেষ হয়নি, হাত-পা ধুয়ে এসে বসে পড়ো। আমি খাবার বাড়ছি।’ বউমাকে দেখে উৎপলেন্দুবাবুও একগাল হেসে বলে ওঠেন, ‘যা-মা যা, ফ্রেশ হয়ে এসে বসে পড়।’ সামনের টেবিলে ব্যাগটা রেখে ফ্যানের নীচে বসে পড়ে কেয়া।

‘না বাবা, এখন আর কিছু খাব না।’ বলে লক্ষ্মীর দিকে তাকিয়ে, ‘তুই বরং আমাকে একটু লেবুর শরবত বানিয়ে দে, তাহলেই হবে।’

‘কিছু খাবে না?’

‘না রে, এই গরমে আর ভালো লাগছে না।’

‘হ্যাঁরে বনমালিদা, কই রে? ফেরার পথে নার্সারি থেকে এই চারাগুলো আনলাম। বসাতে হবে তো। খেতে আসেনি?’

‘হ্যাঁ খেয়েছে। তুমি রাখো, তোমাকে শরবতটা করে দিয়ে তারপর চারাগুলো দিয়ে আসছি।’ কিন্তু কিন্তু করে জবাব দেয় লক্ষ্মী। বনমালির প্রসঙ্গ ওঠাতে উৎপলেন্দুবাবুও চুপ করে যান। শাশুড়ির মুখটাও কেমন যেন ভার ভার লাগে কেয়ার।

লক্ষ্মীর কথাবার্তাতেই কেয়া খানিক আঁচ করতে পারে যে কিছু একটা ঘটেছে। সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দেয়, খাবার সময়ে বনমালিদার অনুপস্থিতিটা। কেয়াও আর খুঁচিয়ে ঘা করতে চায়নি, পরে তো সব জানতেই পারবে।

‘ওহ্ বাবা ভাবছি বিকেলে একটু মার্কেটে যাব। তোমাদের কিছু লাগলে বোলো। ফেরার পথে নিয়ে আসব।’

মৃণালিনী যেন মুখিয়েই ছিলেন, উৎপলেন্দুবাবু কিছু বলার আগেই তাচ্ছিল্যের সুরে বলতে শুরু করলেন, ‘হ্যাঁ, এবাড়িতে শুধু উনিই আছেন। ওনার খিদমত খাটতে সবাই হাজির। শুধু আমিই সংসারের অতিরিক্ত বোঝা। আমার প্রয়োজনের কথা আর কে মাথায় রাখে। করার মধ্যে তো ওই রক্তিম-ই একটু…’ কথা শেষ করতে পারে না মৃণালিনী। তার আগেই কেয়া রাগত স্বরে বলে ওঠে, ‘আপনি হয়তো ঠিক করে শোনেননি, আমি আপনাদের দুজনের কথাই বলেছিলাম। আপনার প্রয়োজনের যথেষ্ট খেয়াল রাখি আমরা। ওইভাবে না বলে সোজাভাবেই বলতে তো পারেন কী লাগবে না লাগবে। এই সামান্য কথাতে রক্তিমকে টানার তো দরকার নেই।’ কথাগুলো বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না কেয়া। পায়ের শব্দ করতে করতে সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরের দিকে চলে যায় সে।

উৎপলেন্দুবাবু সহজে রাগেন না। তবে সকাল থেকে বাড়ির পরিবেশে মেজাজটা এমনিতেই বিগড়ে ছিল। ‘এবার শান্তি হয়েছে। এটাই তো চাইছিলে। কতবার বলেছি মানিয়ে নিতে শেখো। গতবার যখন মুম্বইতে গিয়েছিলে তখনও তোমার জন্য মেয়ে জামাইয়ের মধ্যে অশান্তি লেগে গিয়েছিল। তোমার আর জামাইয়ের মাঝে পিষে মেয়েটা শেষ হতে বসেছিল। যেখানেই যাবে সেখানেই কিছু না কিছু ঘটাবে তুমি। বয়স তো হল। এবার তো শোধরাও।’ রাগ সামলাতে না পেরে খাবার থালা ঠেলে উঠে যান তিনি।

মেয়ে জামাইয়ের কথা বলতে বোধকরি খানিক অনুশোচনায় ভুগছিলেন মৃণালিনী। মনে মনে ভাবছিলেন সত্যিই তো তার জন্য মেয়ের সংসারটাই ভাঙতে বসেছিল। কিন্তু সেটা তো সম্পূর্ণ ভিন্ন ঘটনা। আজ অন্তত কেয়ার ওইভাবে বলা উচিত হয়নি। তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে তার প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস কিনে দিতেই পারত সে।

উৎপলেন্দু তো সে সবের ধার দিয়েও হাঁটে না। আজ পর্যন্ত কোনওদিন একটা শাড়িও হাতে করে আনেনি তার জন্য। শুধু টাকা দিয়েই খালাস। কেয়া তো তো তবু মাঝে মধ্যেই এটা-ওটা-সেটা নিয়ে আসে তার জন্য। কী যে ভীমরতি ধরেছিল আজ, কেন যে কেয়াকে ওভাবে বলতে গেল। আর কেনই বা ঘর ছাড়ার কথাটা তুলতে গেল। এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবেটা কোথায়? গ্রামের বাড়িতে! আজ পর্যন্ত গ্রামের বাড়িতে এক সপ্তাহের বেশি থেকেছে কখনও! সারাজীবন তো বরের সাথে এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত করে বেড়িয়েছ। আর এই বুড়ো বয়সে গ্রামের বাড়িতে কাটাবে কীভাবে? শরীরেও তো নিত্যদিন কিছু না কিছু লেগেই রয়েছে। আগাগোড়াই চাকর-বাকর দিয়ে

সংসারের কাজ করিয়ে এসেছে। আর ছেলে-বউয়ের বাড়িতে এসে কাজ না করে করে তো বোধহয় হাত-পায়ে জং ধরে গেছে।

খেতে খেতে টিভি দেখাটা এবাড়ির সকলের বরাবরের অভ্যাস। ডাইনিং টেবিলে বসে সকলের চোখ আটকে থাকে টিভির পর্দায়। অবশ্য সকলে বলতে উৎপলেন্দুবাবু আর অদ্রিজার। রক্তিম তো আজ কয়েকদিন যাবৎ তাড়াতাড়িই ডিনার সেরে শুয়ে পড়ছে। ইয়ারএন্ডিং চলছে। কাজের প্রচণ্ড প্রেশার। সেই কাকভোরে বেরিয়ে যাচ্ছে আর ফিরতে ফিরতে রাত ন-টা দশটা। কেয়া আর লক্ষ্মী রান্নাঘরে সম্ভবত পরোটা ভাজছিল। ঠিক সেই সময়ে উৎপলেন্দুবাবুর চেয়ারের সামনে এসে দাঁড়ায় মৃণালিনী।

‘খাওয়া হয়ে গেলে তাড়াতাড়ি উপরে এসে ব্যাগ গুছিয়ে নিও।’

‘শুধু শুধু ব্যাগ গোছাতে যাব কেন?’ খুব সহজ ভাবে মৃণালিনীর দিকে না তাকিয়েই উত্তর দেন উৎপলেন্দুবাবু।

‘কেন আবার, কাল সকালের ট্রেনেই আমরা বেরিয়ে যাব।’

এইবার টিভির দিক থেকে চোখ সরিয়ে মৃণালিনীর দিকে তাকায় উৎপলেন্দুবাবু। বলেন, ‘যাচ্ছ তো তুমি, আমি ব্যাগ প্যাক করব কেন?’

কথাটা শুনে আঁতকে ওঠেন মৃণালিনী। কোনওমতে নিজেকে সামলে নেন। ‘মানে। মানে তুমি যাবে না তাই তো?’

‘ঠিক তাই।’ উৎপলেন্দুবাবুর সোজাসাপটা জবাব শুনে চমকে ওঠেন মৃণালিনী। স্বামীর কাছ থেকে কখনও এরকম উত্তর পাবেন আশা করেননি। প্রকাশ না করলেও একধাক্বায় মনের জোর কমে যায় মৃণালিনীর। এতদিনের বন্ধ ঘর খোলা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করা, জ্বালানির ব্যবস্থা করা, দোকানপাট সমস্ত একহাতে করার কথা ভেবেই যেন অসুস্থ বোধ করতে থাকেন তিনি। মনে হতে থাকে এভারেস্ট-এ ওঠার থেকেও এগুলো বোধকরি অনেক কঠিন কাজ। কিন্তু আর করারও তো কিছু নেই, মুখ ফসকে বাড়ি ছাড়ার কথাটা তো বলে বসেছেন। যদি উৎপলেন্দুর হূদয় পরিবর্তনের একটুও আভাস পেতেন তাহলে ভুল করেও এমন শপথ বাক্য পাঠ করতেন না।

অগত্যা মনোবল বাড়িয়ে জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করেছিলেন মৃণালিনী। কথামতো পরদিন সকালবেলা রক্তিম বেরিয়ে যাওয়ার পর ড্রাইভারকে গাড়ি বার করতে বলে ব্যাগ নিয়ে নীচে নেমে আসেন মৃণালিনী। গাড়িতে বসে দেখেন চালকের আসনে তার একমাত্র ছেলের বউ কেয়া। বেশ আশ্চর্য লেগেছিল মৃণালিনীর। কিন্তু পালটা কোনও প্রশ্ন করেননি। কোথায় ভেবেছিলেন যাবার সময় উৎপলেন্দু কিংবা বউমা আটকাবে। তা নয় এ যে একেবারে উলটো স্রোত। শাশুড়িকে বাড়ি থেকে তাড়াতে পারলে যেন হাড়ে বাতাস লাগবে। তাই এই ঔদ্ধত্য। ছেলে বাড়িতে থাকলে ব্যাপারটা হয়তো উলটো হতো। হয়তো…!

কেয়াদের বাড়ি থেকে স্টেশন চার কিলোমিটার। এতখানি পথ একটিও বাক্য ব্যয় করেনি কেউই। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে স্টেশনে পৌঁছে গেছেন বুঝতেই পারেননি মৃণালিনী। সম্বিৎ ফেরে এক কুলির কথাতে। ‘সামান দিয়ে আসব মাইজি?’ কুলির কথায় কর্ণপাত করেন না মৃণালিনী, ব্যাগটা নিজের হাতে নিয়েই পড়িমরি করে দরজাটা খুলে রাস্তাটা পার করতে যাবেন অমনি আচমকা সামনে একটা গাড়ি… তারপরে কিছুক্ষণের জন্য সব অন্ধকার। মাঝে একবার মনে হয়েছে, কে যেন তার হাতটা ধরে জোরে টান মেরেছে। তারপর আর কিছু মনে নেই।

সম্বিৎ যখন ফেরে তখন হাসপাতালের বেডে। মাথার সামনে বসে আছেন উৎপলেন্দুবাবু। আর কেয়া পুলিশের সামনেই সাতাশ-আঠাশ বছর বয়সি এক যুবককে ধমক দিয়েই চলেছে।

‘এইভাবে কেউ গাড়ি চালায়। যে-কোনও মুহূর্তে একটা বড়োসড়ো বিপদ ঘটে যেতে পারত। আজ আমি না থাকলে মানুষটা মারা পর্যন্ত যেতে পারত। কিছু হয়ে গেলে ফিরিয়ে দিতে পারতে। এই তোমাদের মতো বেপরোয়া ছেলেদের সাজা পাওয়াই উচিত। নইলে তোমরা শোধরাবে না। ইন্সপেক্টর সাহেব একদম ছাড়বেন না। কয়েকদিন জেলের হাওয়া খেলেই মজা টের পাবে।’

বিছানায় শুয়ে থাকা মৃণালিনীর আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, অন্য কেউ নয়, তার বউমা কেয়াই তাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরিয়ে এনেছে। বউমার জন্যই যে প্রাণ ফিরে পেয়েছেন। এখন তার চোখের সামনে তার জন্যই লড়াই করছে কেয়া। যাকে তিনি চিরকাল তার প্রতিদ্বন্ধী ভেবে এসেছেন, সে-ই আজ তার পরিত্রাতা হয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

মৃণালিনীর শরীরে কিছু কাটা-ছড়া ছাড়াও বড়ো ক্ষতি বলতে, ডান পা-টা ভেঙেছিল। প্লাস্টার করার পর তাই বাড়ি ফেরার অনুমতি দিয়েছিলেন ডাক্তার। ততক্ষণে খবর পেয়ে রক্তিম হাসপাতালে পৌঁছে ছুটে যায় মায়ের কাছে। মায়ের সাথে কথা বলার পর খানিক স্বস্তি পায় সে। তারপর বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করে।

বাড়ি ফেরার পরেই কেয়া লেগে পড়ে শাশুড়ির যত্নে। রক্তিমকে ইয়ারএন্ডিং-এর কারণে ফিরে যেতে হয় ব্যাংকে।

শাশুড়ির পায়ের উপর যাতে কোনওরকম চাপ না পড়ে সেজন্য সমরকম ব্যবস্থা করেছিল কেয়া। অ্যাটাচ বাথরুম থাকার জন্য নিজেদের বেডরুমটা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিল ওনাকে। সামনের টি-টেবিলে ওষুধ, জল, বিস্কুট থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সমস্তরকম জিনিস রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এমনকী ইলেকট্রিশিয়ানকে ডেকে বেডের নীচে একটা সুইচেরও বন্দোবস্ত করা হয়েছিল, যাতে বেলের আওয়াজে কেউ না কেউ ওনার সেবায় নিয়োজিত হতে পারে। মৃণালিনী সবিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন বউমার দিকে। লজ্জায় পাতাল প্রবেশ করার মতো অবস্থা হয় তার।

নিজের অজান্তেই চোখে জল চলে আসে মৃণালিনীর। লুকোবার আপ্রাণ চেষ্টা করে কিন্তু কেয়ার চোখকে ফাঁকি দিতে পারে না। শাশুড়ির চোখে জল দেখে খানিক মুচকি হেসে শাশুড়িমায়ের উদ্দেশ্যে বলে, ‘কাঁদছেন যে বড়ো। কাঁদলে চলবে। মনকে শক্ত করুন। তাড়াতাড়ি সুস্থ হতে হবে তো। নাহলে গ্রামের বাড়ি যাবেন কী করে।’ চোখ মুছে বউমার দিকে বিস্ময়ভরা নজরে তাকিয়ে থাকে মৃণালিনী। মনে মনে ভাবতে থাকে তাহলে কী…

ভাবনায় বাধ সাধে কেয়া, ‘গ্রামের বাড়ি যাবেন, তবে একা নয় আমরা সকলে দু-দিনের জন্য বেড়িয়ে আসব বুঝেছেন। এবার সবকিছু ভুলে গিয়ে সংসার, নাতনি সামলান তো। শুধু পালাই পালাই। আপনি থাকতে আমি সংসার সামলাতে যাব কেন।’ বলেই চাবির গোছাটা শাশুড়ির হাতে ধরিয়ে দেয় কেয়া।

বউমার হাত ধরে কিছু বলার চেষ্টা করছিলেন মৃণালিনী। ‘থাক আর কিছু বলতে হবে না। বাসন একসাথে থাকলে একটু ঠোকাঠুকি লাগবেই। তাছাড়া বুড়ো মা-বাবারা একটু খিটখিটেই হয়। কী বলো মা?’ এর মাঝে কখন যে উৎপলেন্দুবাবু ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়েছিল কেউ-ই খেয়াল করেনি। কেয়ার কথায় হঠাৎ করে তাদের সাথে সাথে উৎপলেন্দুবাবুও হেসে ওঠেন। আর মৃণালিনী কাঁদতে কাঁদতে বউমাকে জড়িয়ে ধরেন।

মৃণালিনীর, উৎপলেন্দুবাবুর কথাগুলো মনে পড়ে যায়। ‘সম্পর্কগুলোকে এভাবে জটিল করে ফেলো না মৃণাল। এটা কেন হল না, ও-কেন ওটা করল এটা বিচার করতে না বসে বরং মিলেমিশে থাকো। দেখবে শান্তি পাবে।’

সত্যিই আজ শান্তি বিরাজ করছে মৃণালিনীর মনে।

বাঘবনে বেড়াতে

তাহলে মিরিক? নাকি কালিঝোরা? আরও দূরে যেতে চাইলে বলে ফেলুন। দেখুন অয়নদা, এখনই ডিসিশন নিন। আর কোনও জায়গা মনে হলে বলে ফেলুন। কলি কফির কাপ এগিয়ে দিল।

অয়ন চিন্তিতভাবে কলির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ এখানে, মন দৃষ্টিটুকু নিয়ে অনেক দূরে। যেন মংপং, কালিঝোরা ছাড়িয়ে অন্যান্য পিকনিক স্পটগুলো দেখতে বেরিয়ে পড়েছে।

– এ কি? তুই যে ব্যোম মেরে রইলি! বলে ফেল বাবা। নাহলে কলি আমাকে পঞ্চাশবার পাঠাবে তোর কাছে। যশ হাসে।

– সত্যি? আহা, সে যে আমার পরম আকাঙিক্ষত। কলি আমাকে বার বার স্মরণ করছে, একথা ভাবতেই আমার হার্ট বিট বেড়ে গেছে।

– ইয়ার্কি নয়, ঠিকঠাক বলুন তো। কলি বুকের ওপর ওড়না ছড়িয়ে দিল– কী ভাবছেন? মিরিক?

– ভাবছি, বাঘবনে আজ ভিড় করেছে দত্যিদানো, বাক বন্দি বর্গিরা সব পালিয়ে কেন? বাঘবনে যাব। অনেক হল মংপং কালিঝোরা। এবার স্বাদ পালটাই চলো। বেতলার জঙ্গলে যাবে?

– বেতলা আমার দেখা। যশ মুচকি হাসে– বিয়ের আগে অবশ্য। তারপর আর বাঘ হওয়া হয়নি, মানে বাঘ দেখা হয়নি। কুছ পরোয়া নেই, পেঞ্চ-এ চল। পেঞ্চ রে বাবা! মধ্যপ্রদেশে। মুখ দেখে মনে হচ্ছে জায়গাটার নাম শোননি? পড়াশোনার ব্যাকগ্রাউন্ড সবার ভালো হবে তার মানে নেই!

কলি অবাক– তুমি কোথায় পেলে নামটা?

অয়ন হাসি চেপে যশের চোখে চোখ রাখে– তুই কোথায় শুনলি?

যশ হেসে ফেলে– এটা কিন্তু বউয়ের সামনে আমাকে আন্ডার এস্টিমেট করা হচ্ছে। কলির মাথায় গ্রে ম্যাটার কম, সেটা মানবি? ও বুঝবে না, তুই একজন ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফার, আমাদের সামনে আছিস, স্বাভাবিক ভাবে তোর কাছেই শুনব নামটা? গণ্ডারের গায়ে সুড়সুড়ি দেওয়া, আর কি! একদিন বুঝবে ঠিক।

কলি রেগে যাচ্ছে বুঝে হাত তুলে দাঁড়ায় যশ– ক্ষম দেবী এ দাসের অপরাধ যত! ভাবো, পিকনিক করতে নিয়ে যাচ্ছি বাঘের সামনে ঘোঘ কে। তোমার পাঁচ কোটি বার দেখা মংপং, কালিঝোরা নয়। মধ্যপ্রদেশে! বুইলে গিন্নি?

কলি অবাক হতে হতে খুশির চটক লাগাল চোখে মুখে– সত্যি অয়ন? কবে যাচ্ছি? মঞ্জিরা যাবে তো?

যশ থমকে গেল– কেন? কেন যাবে না? তোমার যত ডিপ্রেসড চিন্তা। বোগাস।

কলি থতমত খেয়ে গেল– আসলে লাস্ট ইয়ারে যাবে বলেও গেল না।

– সেটা তো লাস্ট মোমেন্টে কী একটা প্রবে ফেঁসে গেল বলে, না রে অয়ন?

যশ সিগারেটে আগুন ছোঁয়াতে চেষ্টা করছিল, থেমে হাসল– অয়ন যাচ্ছে, মঞ্জিরা যাবে না? তাহলে অয়ন, ডেট ঠিক করে ফেল।

অয়ন আড় চোখে কলিকে দেখল– ডেট ঠিক করব, কিন্তু দুজন সুন্দরী সঙ্গে থাকছে, বিউটি কনটেস্ট করলে কেমন হয়? তবে শিরোপা কে পাবে?

– যে যার বউকে দেবে। গৃহশান্তি বলে একটা কথা আছে। গুরুর নিষেধ, সেটা নষ্ট না করতে। হাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে অবশেষে আগুন ধরাতে পেরেছে যশ।

কলি অল্প হাসে, – বউ কেন? বান্ধবীকে দেবে বলো।

– বান্ধবী? সে আবার কে?

– আসবে! নো টেনশন। ফুশিয়া বর্ডারের লাইট পিংক শাড়ির ময়ূরগুলো দোল খেতে খেতে হাসে। অয়নের চোখের দৃষ্টি দেখে কলি বাধ্য হল চোখ পাকাতে। নিবিষ্ট চোখে খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল যশ। কলি সেদিকে তাকিয়ে বুঝল সন্ধে হয়ে এসেছে। ঠান্ডা বাতাস আসছে। জানালা বন্ধ করে না দিলে পন পন করে মশা ঢুকে যাবে। জানালা বন্ধ করতে গিয়ে দেখতে পেল বুবলিকে। এদিকেই আসছে। কলি ঘাড় ঘুরিয়ে যশের দিকে তাকাল– এই, যাও না, দরজাটা খুলে দাও না! বুবলি আসছে। যশও দেখেছিল। উঠে যেতে যেতে বলল– সন্ধে হয়ে যায়। এখন ক’দিন বাইরে যেতে দিও না। ঠান্ডা পড়ছে।

কলি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে– আমিও তাই ভেবেছিলাম।

ওদের কথাবার্তার মধ্যে ঢুকে পড়ে অয়ন– আরে, এদিকে দ্যাখো। জিন্দা লাশ হয়ে বসে আছি। আমি তাহলে ব্যবস্থা করে ফেলছি? মধ্যপ্রদেশের পেঞ্চ রিজার্ভ ফরেস্টে যাচ্ছি?

নেক্সট উইকে ডেট ঠিক হয়েছে। তুমুল গোছগাছ চলছে। অয়নের বউ মঞ্জিরা প্রায় রোজই আসছে। আলোচনা চলছে। সাংঘাতিক এক্সাইটেড কলি আর যশ। বাইরে যাওয়া হয় না ওদের অনেকদিন। দিনক্ষণ ঠিক হওয়া মাত্র অয়ন টিকিট কেটে ফেলেছে।

রাতে নেট সার্ফিং করে যশ। তখনই কলি পেছনে এসে দাঁড়াল। যশ মনিটরে চোখ রেখে বলল– কী? কিছু বলবে? কলি কথা বলছে না দেখে যশ তাকাল– কলি? কী হল? বলেই কলির হাতের দিকে চোখ পড়ল। বুবলির পুতুলের বাক্স। এলোমেলো ছোটো ছোটো পুতুল, রঙিন কাপড়ের টুকরো, ছোটো ছোটো সোফাসেট খাট…। রান্নাবাড়ির ক্ষুদ্র সংস্করণগুলোর নীচে মঞ্জিরার পারফিউমের শিশিটা! এটা সেদিন খুঁজে পাচ্ছিল না মঞ্জিরা।

তুলে হাতে নেওয়ার কথাটা মনে ছিল না। দুজনে স্থির হয়ে থাকে। কলির শাড়ির কুচিগুলো একবারও কেঁপে উঠল না কলির বুকের মতো। লজ্জা করছিল। কেউ কারও দিকে তাকাল না। চকচকে সুন্দর শিশি ভরা তরল পদার্থ। গতকালই মঞ্জিরা এটা বের করে সুগন্ধ ছড়িয়ে দিয়েছিল বাতাসে। কলির ঘাড়ে এসে পড়েছিল সুগন্ধি। অয়ন চোখ বুজে সজোরে শ্বাস নিয়েছিল– এত সুগন্ধি তুমি! অয়নের শ্বাস কলির ঘাড়ে, কানে… আবিষ্ট হয়ে যাচ্ছিল কলি। যশ মঞ্জিরাকে ওর বাগান দেখাতে নিয়ে গেছিল বাড়ির পেছনে। তখন বুবলি…! বুক জুড়ে উথাল পাথাল কান্নাকে গিলে ফেলতে ফেলতে উঠে দাঁড়ায় কলি। যশ অন্ধকার বারান্দায় চলে গেছে নিজেকে লুকোতে। কলি দেখতে পেল ছায়াশরীরকে।

– কী হল? ফিসফিস করে কলি।

– খুব ভুল হয়েছে আমাদের। সাবধান হওয়া উচিত ছিল। অথচ কোনও অভাব তো রাখিনি! কোথা থেকে এই জঘন্য স্বভাব পেল মেয়েটা। এর আগেও এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। ঠিক বলেছে যশ। সহেলির পেনসিল দিয়ে শুরু। মাসতুতো বোন দিয়ার নেইলপালিশ, রুপুদির মেয়ের ক্লিপ, দোতলার ভানুবাবুর গোঁফ কাটার কাঁচি, প্রাঞ্জলের স্কেচ পেন…!

– তোমার রাঙা পিসির সোনার চিরুনি? মনে আছে? জোরে কথা বলতে ভয় পাচ্ছে কলি। কথার শব্দে সভ্যতার মুখোশ ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে যেন।

যশ কলির হাত ধরে– এখনও সময় আছে। বকাবকি কোরো না। শুধরে নেওয়া যাবে।

– কিছু বলব না? মেরে ফেলব। কলি হাঁপায়।

এনজেপি থেকে শিয়ালদা। তারপর বিকেলের ফ্লাইটে কলকাতা থেকে নাগপুরের বিআর আম্বেদকর এয়ারপোর্ট পৌঁছোতে সন্ধে হয়ে গেল। গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছিল অয়ন। বিরানব্বই কিমি পথ পাড়ি দিয়ে মধ্যপ্রদেশের চেকপোস্টে পৌঁছে হাঁফ ছাড়ে ওরা। কলি অয়নের দিকে তাকায়– আর কদ্দূর অয়নদা?

অয়ন হাসে– আর একটু। এসেই গিয়েছি ধরে নাও। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রচুর গাড়ি। এখান থেকেই গাড়ির পারমিট নিতে হবে। অয়ন আগেই মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের একটি রিসর্টে থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছিল। সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশ। মন ভালো হয়ে গেল সবারই। অয়ন হেঁকে বলল– কি? কারও মুখে কথা নেই কেন? কলি সমুদ্রনীল ও লালের কম্বিনেশনের সালোয়ার কামিজে মোড়া শরীরটা দুলিয়ে হেসে উঠল– ওই অয়নদা, দারুণ সারপ্রাইজ দিলেন কিন্তু!

যশ মুগ্ধ গলায় বলে– তুমি জান না কলি, ওয়াইল্ড লাইফ ফোটোগ্রাফাররা খুবই অরগ্যানাইজড হয়। চোখ বুজে বিশ্বাস করা যায়।

পাশাপাশি দুটো কটেজ। পেছন দিকে এক্সট্রা ব্যালকনি। রাতে নাকি বাঘের গর্জন শোনা যায়। ঘরে ঢুকে অয়ন-মঞ্জিরা বাদে বাকি দুজনে থ মেরে গেল। বেডকভারে, ব্লাঙ্কেটে সব জায়গায় বাঘের গায়ের ছাপ বা পাগ মার্কের প্রিন্ট। যশ সোফায় বসে পড়ল– এতক্ষণে মনে হচ্ছে বাঘবনে এসেছি। নিজেকে বাঘ বাঘ মনে হচ্ছে, বলেই শব্দ করে মুখে– হালুম। কলি স্নানের তোড়জোড় করছে। একঘন্টা পরে ডিনার। এখন চা, কফি, স্ন্যাক্স এসেছে। ব্যালকনিতে বসে অয়ন কফির কাপে চুমুক দিয়ে কলিকে দেখল এক পলক– কি কলি? কেমন লাগছে? পালাজোর সঙ্গে লং কামিজ, জিওমেট্রিক শেপের কানের দুল, চুল গুছিয়ে তুলে ট্রেন্ডি ক্লিপে আটকে রাখা কলির চেহারায় ক্লাসি লুক এসেছে। পেছনের ব্যালকনিতে যশ মঞ্জিরার ঠোঁট চুষে চুষে ফুলিয়ে দিল। মঞ্জিরা হাঁপিয়ে উঠে নিজেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে– ছাড়ো বাঘ। যশ মত্ত হয়ে উঠেছে। মঞ্জিরার বুকে মুখ ঘষছে। মঞ্জিরা কেঁপে উঠল– এখন না। পরে, পরে…। কলি অয়নের কানে আলতো কামড় দেয়– আজ তোমার কাছে থাকব সারারাত। এখানে। বাঘের ডাক শুনব, বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়বে আমার শরীরের ওপর… কামড়ে খাবে আমাকে, খামচে খাবে…। অয়ন কলির কানে মুখ নিয়ে আসে– আজ রাতে এখানে… ঠিক?

পাঁচটায় বেড টি দিয়েছে। হুডখোলা গাড়িতে ছটা নাগাদ বেরিয়ে পড়ল ওরা। সঙ্গে ড্রাইভার ও একজন গাইড। চারপাশে জঙ্গল। জঙ্গলের রং শুকনো শুকনো। কিছুটা যাওয়ার পর বাঘের মল দেখা গেল। গাইড বলল কাছাকাছি বাঘ আছে। একটু পরেই পাগ মার্ক দেখা গেল। মঞ্জিরা চাপা গলায় বলল এবারে ফেরা যাক। লাঞ্চ সেরে ফের আসা যাবে। অয়ন হাসল– তুমি বাঘের অস্তিত্ব টের পেয়ে ভয় পেয়েছ। তোমাকে শেয়াল দেখাব। যশ কোনও কথা না বলে মন দিয়ে দেখে যাচ্ছে। কলি উশখুশ করে– মঞ্জিরা ঠিকই বলেছে। বুবলি ঘুমিয়ে পড়েছে। পরে আসা যাবে অয়নদা।

লাঞ্চ সেরে ব্যালকনি থেকে ক্যামেরা বের করে দাঁড়িয়েছে অয়ন। ভিউফাইন্ডারে চোখ রেখে কী তাক করছে কে জানে। যশকে দেখেছে কলি পেছন ব্যালকনি থেকে আসতে। ও ডাকল– রেডি? যশ আড়মোড়া ভাঙল– এত খেয়েছি। ঘুম পাচ্ছে। অয়ন ঘাড় ঘুরিয়ে যশের চোখে লেন্স তাক করল। চারদিকে পাখিদের কিচিরমিচিরের মধ্যে শাটারের শব্দ হল। অয়ন বলল– যশের চোখ দুটো শ্বাপদের মতো। পেছনের ব্যালকনি থেকে নিজেকে গুছিয়ে নিতে নিতে মঞ্জিরা অয়নের কথা শুনেছে। অলস গলায় ও বলল– কে গো? বাঘের মতো কে? কলি হেসে উঠেছে– শ্বাপদের মতো। মঞ্জিরা আরাম করে বসেছে– আমি একটু ঘুমোব। কোন ভোরে উঠেছি! তোমরা যাও। আমি কাল যাব, সিওর।

শেষে যশ আর মঞ্জিরা রয়ে গেল। কলি অয়নের সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল। বুবলি ঘুমিয়েছে। যশের পাশে আছে ও।

– আজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত জঙ্গলে ঘুরে বেড়াব। আপত্তি? অয়ন কলির হাতে অল্প চাপ দেয়। কলি গহিন চোখে তাকাল– ফিরতেই হবে?

সাদা বোগেনভিলিয়ার পাশ কাটিয়ে গাড়িতে উঠতে উঠতে অয়ন একটু দাঁড়াতে বলে কলির পরপর কয়েকটা স্ন্যাপ নিল। জিন্সের উপর ফেব্রিকের কাজ করা টপ। খোলা চুলে, ম্যাট টেক্সচারে ব্রাইট শেডের ঠোঁটে সিমপ্লি গ্ল্যামারাস হয়ে উঠেছে কলি। গাড়িতে উঠে বসেও ক্যামেরা কলির দিকে তাক করে রেখেছে অয়ন– এখন ড্রাইভার আর গাইড ছাড়া কেউ নেই। প্লিজ, টপের বোতাম খুলে দাও। নর্মাল থাকো…।

– স্যার, দেখুন, গাইড আঙুল তুলে দেখাচ্ছে। একপাল হরিণ ছুটে পালাচ্ছে। অয়ন লেন্সে চোখ রেখে উঠে দাঁড়াল। কিছু দূরে কয়েকটা ওয়াইল্ড ডগ চুপ করে দাঁড়িয়ে। ওদের দেখে দৌড় লাগাল। একটা ধবধবে সাদা গাছ দেখিয়ে গাইড জানাল এর নাম ঘোস্ট ট্রি। তাড়াতাড়ি করে বোতাম আটকে নিচ্ছিল কলি। লোকগুলো আবার পেছনে না তাকায়। কি ঝামেলা রে বাবা। গাড়ি চলতে চলতে একটা বাঁক নিতেই মুখোমুখি হয়ে গেল ওরা বাঘের। কি বিশাল চেহারা। মাত্র বিশ ফুট মতো তফাতে দাঁড়িয়ে তিনি। সোজা গাড়ির দিকে এগিয়ে আসছেন। ড্রাইভার ব্যাক গিয়ার দিয়ে পিছোতে শুরু করেছে। বাঘ এগিয়ে আসতে আসতে এখন প্রায় দশ ফিটের মধ্যে বনেটের সামনে। কলি শ্বাস বন্ধ করে গোঙাতে শুরু করেছে– তুমি আমাকে মেরে ফেললে অয়ন। আমি ফিরে যাব। আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলো। তোমার জন্য হল এসব। এখানে আমরা আসতে চাইনি। তুমি! তুমি দায়ী।

বাঘটা হুংকার দিল। অয়নের চোখ ফিউফাইন্ডারে। শাটারে আঙুল রেখে অপেক্ষা করছে ও। কলি চেঁচিয়ে উঠল– আমি বাঁচতে চাই… বাঁচাও…। আর তখনই শাটার পড়ল। চমকে গেল ফ্ল্যাশ। বাঘ থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। শরীরটা গুটিয়ে নিল। ধীরে এগোতে লাগল একটা হরিণের দিকে। হরিণ সম্মোহিত হয়ে গেছে। গাইড বলল– আজ কিলিং ডে। কিছু মারবেই আজ।

গাড়ি ফিরিয়ে নিতে বলেছে অয়ন। ওদের দেখে মঞ্জিরা ব্যালকনি থেকে চেঁচাল– কি? কিছু দেখতে পেলে? অয়ন হেসে জলের বোতল বের করে অনেকটা জল খেল। কলির দিকে এগিয়ে দিল বোতল– জল খাও। কলি মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে। হাত বাড়িয়ে বোতল নিল– সরি।

ওদের আওয়াজ পেয়ে যশ দ্রুত মঞ্জিরার ঘর থেকে ওর ঘড়িটা নিয়ে এল। এত তাড়াতাড়ি ফিরে এল ওরা! মঞ্জিরা ইচ্ছে করে জোরে কথা বলছে, যাতে যশ সামলে নিতে পারে। বুঝে মনে মনে হাসে যশ। একটু সুখ চুরি করাকে কি ক্লেপ্টোম্যানিয়া বলা যায়? অয়ন কি কলিকে সঙ্গী করে কীর্তন গেয়ে এল?

গুছিয়ে বসে বাঘ দেখার গল্প করছিল অয়ন। কলির ভয়ে কেঁদে ফেলাটাও বাদ দেয়নি। সব ফের স্বাভাবিক।

ডিনার সেরে ব্যালকনিতে বসেছে সবাই। কলির আসতে দেরি দেখে যশ উঠে গেল। নিশ্চয়ই সাজুগুজু করছে কলি। সবসময়ে মঞ্জিরার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলার অভ্যাসটা যে কবে ত্যাগ করবে ও! ঘরে ঢুকে অবশ্য থ হয়ে গেল। কলি শুয়ে আছে ঘুমন্ত বুবলির পাশে। সারাদিন ধকল গেছে। ঘুমুচ্ছে। যশ শব্দ না করে ফিরে গেল। তখন অয়নের কাছ ঘেঁষে বাঘের গল্প শুনছে মঞ্জিরা।

– আমাকে বাদ দিয়ে সব বলা হয়ে গেল নাকি? যশ হাসতে হাসতে বসে পড়ে– বাঘ কমে যাচ্ছে? সত্যি?

অয়ন ঘাড় নাড়ে– ঠিক। কাস্পিয়ান বাঘ, বালি বাঘ, জাভান বাঘ লুপ্ত। এখন যা আছে, সবই লুপ্তের দিকে। সাড়ে চারশো গ্রাম বাঘের হাড় পাঁচশো ডলারে পাওয়া যায় ভিয়েতনামে। বাঘের হাড়, মাংস দিয়ে বানানো মদের খুব চাহিদা। শুনেছি এক বাটি ব্যাঘ্র লিঙ্গের সুপ তাইওয়ানের কোনও এক রেস্তোরাঁয় মেলে। প্রচুর দাম। তাহলে বাঘ থাকবে কী করে?

মঞ্জিরা সুন্দর মুখটা তুলে বলে– বাঘ বাঁচাও প্রকল্প হচ্ছে শুনেছি!

– হচ্ছে। হাই তোলে অয়ন– কলি আজ ভয় কাকে বলে বুঝেছে। আর কখনও বাঘবনে আসবে বলে মনে হয় না। বাঘের ছবি না তুলে কলির ছবি তোলা উচিত ছিল। তাহলে বুঝতে তোমরা ঘোঘরা আসলে ছুঁচো। হেসে ওঠে অয়ন– বাঘ বাঁচাও প্রকল্প! আগে মানুষ বাঁচাও প্রকল্প হোক।

যশ অবাক প্রায়– মানে, মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেছে জানিস?

অয়ন অদ্ভুত ভাবে তাকায়– তাই? মানুষ আছে বলছিস? ও-ও তো লুপ্তের পথে! দিন এলে মানুষ বনে বেড়াতে যাব।

মঞ্জিরা জোরে হেসে ওঠে– এইরে, তুমি আজ বাঘ দেখে নিজেকেই বাঘ ভাবতে শুরু করেছ নাকি? জবাব না দিয়ে চলে গেল অয়ন। যশকে ইশারা করে মঞ্জিরাও চলে গেল। সবাই টায়ার্ড। কেউ বাঘ দেখে, কেউ না দেখে, কেউ বাঘ হয়ে, কেউ বাঘ হতে না পেরে। পেছনের ব্যালকনিতে অয়নকে জড়িয়ে গুটিসুটি কলি। বন ছমছম করছে। জঙ্গল, জীবজন্তুর মধ্যে থেকে রাতটাকে উপভোগ করছিল ওরা। অয়নের ভেতরে আজ বাঘ দেখে আপ্লুত কলি। নাক ভরে বাঘের গন্ধ নিতে নিতে কলি ভাবে, ডাক্তার বলেছে বুবলির ক্লেপ্টোম্যানিয়া আছে। পরের জিনিসের দিকে আকর্ষণ। তবে সেরে যাবে একটু যত্ন নিলে…। বুবলি সেরে যাবে। কিন্তু ক্লেপ্টোম্যানিয়া কি সবসময় সারে? সেরে যাওয়াটা কি সুখের হয়?

সাপ লুডো খেলা

ম্যাডাম, ও ম্যাডাম, ঘুমিয়ে গেছেন যে, কোথায় নামবেন?

সামনে বসে থাকা ভদ্রলোকটির কথাগুলো শুনে ম্যাডাম চোখ দুটো তাড়াতাড়ি খুলে চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কোন স্টপেজ?

চোপান, আপনি কোথায় নামবেন?

সরাইগ্রাম, দেরি আছে?

অনেক। সেই সকাল ৯টার আগে ঢুকছে না, লেটে রান করছে।

‘ও’ বলে ভদ্রমহিলা আবার কিছু সময় চুপ করে শুয়ে হঠাৎ উঠে বসে পড়লেন। তারপর হঠাৎই নিজের মনে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। রাত দুটো, কামরার আলো নেভানো থাকলেও মেয়েটির উলটো দিকে বসে থাকা ভদ্রলোক এতক্ষণ শুয়ে শুয়ে ভদ্রমহিলাকে দেখছিলেন। বেশ কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। একবার উঠে বসছেন, একবার শুচ্ছেন, শুয়ে শুয়ে কেঁদে উঠছেন।

উলটো দিকে বসে থাকা ভদ্রলোকের কেমন যেন সন্দেহ হল। তারপর দরজার কাছে ভদ্রমহিলা এসে দাঁড়াতেই পিছন থেকে তাকে চেপে ধরে ভিতরে ঢুকিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন। ভদ্রমহিলা ছটফট করলেও আর কোনও উপায় নেই। এমনিতেই ধস্তাধস্তির আওয়াজ শুনে কয়েকজন ঘুমন্ত প্যাসেঞ্জার ঘুম থেকে উঠেও পড়েছেন। ভদ্রলোক সব কিছু বলবার পরে সবাই শুনে অনেক কিছু জানবার চেষ্টা করে গেলেও, কোনও লাভ হল না।

কলকাতার আপ ট্রেন, বাঙালি যাত্রীর সংখ্যাও নেহাৎ কম নয়। কিন্তু ভদ্রমহিলা সমানে চিৎকার করে যেতে লাগলেন, আমাকে ছেড়ে দাও, আমার বেঁচে থাকবার কোনও অধিকার নেই। ভদ্রলোক অনেক বুঝিয়ে শেষে হার মেনে পরের স্টেশনে এক রকম জোর করেই তার সাথে নামালেন।

আজকাল দীক্ষাকে অপর্ণার কেমন যেন অচেনা মনে হয়। যত বয়স বাড়ছে মেয়ের আদিখ্যেতা বেড়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন আগেই মেয়েকে একবার বলে, দ্যাখ বড়ো হচ্ছিস এখন এমন ভাবে হাফ-প্যান্ট, গেঞ্জি পরে থাকিস না। কে কার কথা শোনে! কথাগুলো এক্কেবারে ফুত্কারে উড়িয়ে দিয়ে মেয়ে বলে ওঠে, তুমি সেই গাঁইয়াই রইলে, আমার বন্ধুগুলোকে দ্যাখো, সুইম করে, হাফ-প্যান্ট পরে পড়তেও আসে।

সেদিন কথাগুলো শুনেই মাথা ঘুরছিল অপর্ণার। ওদের মাদেরকেও বলিহারি, হাফ-প্যান্ট পরে কেউ বাইরে ছেড়ে দেয়। এই জন্যেই চারদিকে এত সব ঘটনা ঘটছে। আরে বাবা তুমি যদি তৈরি করা খাবার কারও-র মুখের সামনে তুলে দাও, কে আর না খেয়ে থাকতে পারে? আমরাও তো পড়াশোনা করেছি নাকি! ছেলেদের সাথে মিশেওছি।

সুপ্রকাশ নামের একটা ছেলে তো প্রায়ই বাড়ি আসত। ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করত, কই কোনও দিন তো নির্লজ্জ হতে পারেনি। বরং মা যেদিন সুপ্রকাশের সাথে নিজের পিরিওডস নিয়ে আলোচনা করে, সেদিন খারাপ লেগেছিল। সুপ্রকাশ চলে যেতেই মায়ের ওপর রেগে গিয়ে বলেছিল, এসব কথা কেউ ওর সাথে আলোচনা করে? মা অবাক হয়ে উত্তর দিয়েছিল, কেন ও তো আমার ছেলের মতো, ওর কাছে আবার কীসের লজ্জা? দীক্ষারা অবশ্য খোলাখুলি এসব নিয়ে আলোচনা করে।

একদিন অপর্ণার কানেও কিছু কথা আসে। তবে তন্ময় বাড়ি ফিরে আসার পরেই দীক্ষার সাহস একটু বেড়ে যায়। আগে ওর যখন বাইরে পোস্টিং ছিল, অপর্ণাকেই সব কিছু করতে হতো। সে টিউশনের স্যারের সাথে যোগাযোগই হোক অথবা স্কুলের কোনও সমস্যা। ক্লাস এইটে পড়তে তো একটা ছেলে কয়েকদিন খুব পিছনে লেগেছিল। অপর্ণা একাই ছেলেটার বাড়ি খুঁজে সেখানে গিয়ে তার বাবা মায়ের সাথে কথা বলে এবং ছেলেটির সঙ্গেও কথা বলে আসে। তার জন্য অবশ্য দীক্ষা খুব একটা খুশি হয়নি। বরং অপর্ণার ওপর রেগেই যায়।

ক্লাস নাইনে আবার দীক্ষার সাথে একটি ছেলের একটা সম্পর্কও তৈরি হয়। সেখানেও অপর্ণাকে বলতে হয়। তখন তন্ময় শুধু মাসে মাসে টাকা পাঠিয়ে দাযিত্ব পালন করে। এমনকী ফোনে এই প্রেম-টেম কথাগুলো শুনে খুব সাধারণ ভাবেই উত্তর দেয়, এই বয়সে এরকম একটু আধটু হয়, অ্যাডোলেসেন্ট পিরিয়ড, অপোজিট সেক্সের প্রতি একটু ভাব ভালোবাসা জন্মাবেই, তোমারও জন্মেছিল, এখন তুমি অস্বীকার করতেই পারো।

এরপর আর কী-ই বা বলা যায়, শুধু রেগে উঠে বলেছিল, বেশ, কিছু সমস্যা হলে আমাকে কিছু বলতে এসো না।

সমস্যা আর কী-ই বা হতে পারে, একটু প্রেম করবে, ফুর্তি করবে, এটাই তো বয়স।

বেশ, তুমিও তাহলে যেখানে আছো সেখানকার মেয়েের সাথে ফুর্তি করোগে। এখানে আমি সন্ন্যাসিনীর মতো থাকি।

আগে দীক্ষাকে বকে মেরেও কিছু কাজ হতো, কিন্তু তন্ময়ের আসার পরেই কী রকম সব যেন গণ্ডগোল হয়ে যেতে আরম্ভ করল। এমনি তো ফোর্সের কাজ, রিটায়ারমেন্ট নিয়ে বাড়ি এসে মাস ছয়েকের মধ্যেই আবার একটা সরকারি চাকরিও জুটিয়ে নেয়। এই কয়েক মাস রিটায়ারমেন্টের কিছু কাগজপত্র তৈরির জন্য এদিক ওদিক ঘোরে। সেসময় মেয়ে সাথে আগের মতোই যোগাযোগ ছিল। কিন্তু অপর্ণা কয়েকদিন বাড়িতে না থাকবার জন্য তন্ময়ে, মেয়ে সাথে একটা অন্য রকমের বন্ডিং তৈরি হল।

পাকাপাকি ভাবে এখানে আসার পরে প্রতিদিন সকালে উঠেই মেয়ে সাথে মাঠে ছুটতে বের হতো। দুজনেই হাফ-প্যান্ট আর গেঞ্জি পরত। প্রথম কয়েকদিন কোনও কিছু মনে না হলেও কয়েকদিন পরেই সামনের দোকানে একটা জিনিস কিনতে গিয়ে পাড়ার এক বউদির সাথে দেখা হয়। কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করবার পরেই বলে, দীক্ষাকে সকালে দেখি, হাফ-প্যান্ট পরে দৌড়ায়। সঙ্গে কে কর্তা? দেখে মনে হয় ওরাই যেন স্বামী স্ত্রী! কে বলবে তুমি মা! এখন তো তোমাকে কর্তার থেকেও বড়ো লাগে।

কথাগুলো অপর্ণার খুব কানে লেগেছিল। বাড়ি ফিরেই বাথরুমের দরজা বন্ধ করে নিজেকে আয়নার সামনে নগ্ন করে দেখার চেষ্টা করেছিল। শরীরে সত্যি সত্যিই অযাচিত বার্ধক্য বাসা বাঁধতে আরম্ভ করেছে কিনা। অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করে। শরীর ঝুলছে? সেদিনই দীক্ষার ওপর রাগ দেখিয়ে বলে ওঠে, সকাল সকাল এমন ভাবে হাফ-প্যান্ট পরে বাইরে যাস না, পাড়ায় কথা উঠছে।

কথা! হাউ স্যাভেজ ইউ আর অপর্ণা! ভেরি ব্যাড, আমি দীক্ষাকে মর্ডান করে মানুষ করবার চেষ্টা করছি, আর তুমি ওকে সেই পুরোনো মানসিকতার করে তুলতে চাইছ! কে কী বলছে তাতে মাই ফুট। তুমিও সব শোনো, যদি তোমার ভালো না লাগে বলবে। আমি দীক্ষাকে অন্য জায়গায় নিয়ে চলে যাব, অন্য কোথাও ভর্তি করে দেব। তুমি একা থাকো।

মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে অপর্ণার। এত বড়ো কথা, মেয়েে নিয়ে আলাদা থাকবে! শরীরটা কেঁপে ওঠে। এভাবেও কেউ বলতে পারে, এই ভাবনাটা মাথায় আসছে না অপর্ণার। খুব বাজে অবস্থা। তারপর থেকে দীক্ষাকে কথায় কথায় বকা বন্ধ করে। কিছুটা উদাসীন থাকবার চেষ্টাও করে। কিন্তু কতক্ষণ এভাবে উদাসীন থাকা যায়? সতেরো বছরের মেয়ে কথায় কথায় বাবাকে জাপটে ধরছে। বাবার সামনে একটা ভেস্ট পরে বেরিয়ে যাচ্ছে, এটা তো মেনে নেওয়া যায় না।

অপর্ণার নিজের ছোটোবেলার কথা মনে পড়ে। যেদিন থেকে বুকের দুদিকে দুটো মাংসপিণ্ড বড়ো হয়, সেদিনই মা বলে দেয়,মাম্পি, এবার থেকে পোশাকে একটু যত্ন নিবি। আর খালি গায়ে বাইরে বেরোবি না। বাবা কাকাদের সামনেও দুমদাম করে চলে যাবি না। জামার নীচে এবার থেকে একটা টেপ বা গেঞ্জি পরবি।

অপর্ণা কিন্তু কোনও দিন মাকে কী, কেন প্রশ্ন করেনি। বরং মা সময়ে সাথে একটু পরিবর্তিত হলেও, অপর্ণা নিজেকে পরিবর্তন করতে পারেনি। কিছু কিছু বিষয়ে মায়ের ওপর রেগেও যেত। এখন অবশ্য মেয়ে ওপর রাগতে পারছে না। কয়েকদিন পরে তন্ময় অফিস থেকে ফিরেই অপর্ণাকে বলে, কাল থেকে একটু ছোলা, বাদাম, পেস্তা ভেজাবে। আজ কিনে এনেছি, দীক্ষাকে জিমে ভর্তি করছি, শরীরে ফিটনেস আসবে। তারপর দেখি টেনিসে ভর্তি করবার ইচ্ছেও আছে।

কিন্তু এখন তো পড়ার খুব চাপ, আর এক বছর অপেক্ষা করলে হতো না?

জানতাম তুমি বাধা দেবে।

কথাগুলো শেষ করবার সময়ে দীক্ষা ঘরে আসতেই, তন্ময় দীক্ষাকে জাপটে ধরে নিজের কোলে তুলে নেয়। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অপর্ণার শরীরে কারেন্ট লাগে। এমন ভাবে তো কেউ কোনও দিন ওকে কোলে তোলেনি। দীক্ষা আবার তন্ময়ে কোলে উঠেই তন্ময়ে গালে কপালে চুমু খেতে আরম্ভ করে। মুখে বলে, ও সুইট ড্যাডি আই লাভ ইউ।

অপর্ণা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, কে জানে চুমুটা কখন ঠোঁটে পড়ে যায়।

রান্নাঘরে সবজি কাটার সময় আঙুল কেটে ফেলে, হাতে ভাতের ফ্যান পড়ে যায়। ভগবান এ তুমি কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছ। শেষ কালে কিনা মেয়ে তার বাবার সাথে এমন সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে, আর মা হয়ে সেটা ড্যাব ড্যাব করে দেখতে হচ্ছে!

এক রাতে অপর্ণার হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় পাশে তন্ময়কে না পেয়ে এক পা এক পা করে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই, দীক্ষার ঘরের ভেতর থেকে একটা চাপা গলার আওয়াজ শুনতে পায়। কোনও কিছু না বলে তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলতেই নিজের চোখ দুটো লজ্জায় বন্ধ হয়ে আসে।

তন্ময় বিছানার ওপর একটা ছোটো প্যান্ট পরে শুয়ে আছে। আর তার শরীরে শরীর লাগিয়ে একটা ভেস্ট পরে শুয়ে আছে দীক্ষা। নীচে প্যান্টিটাও নেই। অপর্ণা আর চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, চিত্কার করে ওঠে, এসব কী হচ্ছে, তুমি তো বাবা, ও তো তোমার মেয়ে তোমার লজ্জা করছে না?

তন্ময় প্রথম দিকটাতে ভ্যাবাচ্যাকা মেরে গেলেও পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে চিত্কার করতে আরম্ভ করে, তুমি পারভার্টেড হয়ে গেছ, ও আমার মেয়ে ওর সাথে কোনও সর্ম্পকই খারাপ সম্পর্ক নয়! সেটা না দেখে তুমি এইসব ভাবছ, তোমার লজ্জা করছে না, যাও নিজের ঘরে যাও।

পারভার্টেড! তাহলে কি সত্যি সত্যিই দীক্ষা আর তন্ময়কে অকারণ সন্দেহ করছে? বাবা-মেয়ে অপত্যস্নেহ! তার মধ্যে কি সত্যিই শরীর এলেও আসে না? ছোটোবেলাতে অপর্ণা একবার বাবার সাথে ডাক্তার দেখাতে গেছিল। মায়ে কি একটা কাজ ছিল। কিন্তু সেই ডাক্তার তো কিছুতেই দেখবেন না।

বাবাকে কড়া করে শুনিয়ে দিয়েছিলেন, মায়ে সাথে পাঠাবেন, আপনার সামনে ওর সব সমস্যা আলোচনা করা ঠিক নয়। মেয়ে বড়ো হলে প্রত্যেক বাবার উচিত তাকে স্নেহের সাথেও একজন মেয়ে হিসাবে মর‌্যাদা দেওয়া। যেমন ধরুন এই যে আপনার মেয়ে আপনার সাথে এসেছে, এখন মেয়ে যদি কিছু প্রাইভেট দেখার প্রয়োজন হয় আপনার সামনে মেয়ে কি সাবলীল হতে পারবে?

সেদিন ডাক্তারের চেম্বার থেকে বাবা বাইরে বেরিয়ে আসে। তারপর থেকে আর কোনও দিন অপর্ণাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যায়নি, সমস্যা হলেই তার মাকে পাঠিয়েছে। এটাই তো স্বাভাবিক, বাবা কাকা যতই নিজের হোক তারাও তো পুরুষ।

এক বিখ্যাত উপন্যাসে ঘরের মামাতো পিসতুতো দাদাদের জোর করে তার সাথে যৌন সর্ম্পক করার বর্ণনা পড়ে চমকে উঠেছিল অপর্ণা। এমনটা কি সত্যি সত্যিই হতে পারে? তবে ওটা তো তুতো দাদা। কিন্তু তা বলে বাবা!

পরের দিন সকালেই কাজের মেয়ে টুম্পা ময়লার বালতিটা একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে ফেলবার সময় মুচকি হেসে ওঠে। অপর্ণা ওর হাসি দেখে একটু জোর করেই বলে, কী হল রে? জিজ্ঞেস করতেই টুম্পা বলে, বউদি তোমাদের মেয়ে তো বয়স হয়ে গেছে। এখন আরেকটা ছেলে-মেয়ে কিছু নিতেই পারো।

অপর্ণার মাথাতে আবার বিদু্যৎ খেলে যায়, রেগে ওঠে। এরকম বলবার কারণ জিজ্ঞেস করতেই টুম্পা প্যাকেটটা একটু ফাঁক করে আঙুল দিয়ে দেখায়। চমকে ওঠে অপর্ণা, দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া এই কেন-র কোনও উত্তর নেই। তন্ময় এখানে ফিরে আসার পর এখনও পর্যন্ত তাদের মধ্যে কোনও শারীরিক সম্পর্ক হয়নি। কনডোমের কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তার ওপর আবার ডাস্টবিনে ফেলা। ওরা শেষকালে এতটা নীচে নেমে গেল? হায় ভগবান এর থেকে মরে যাওয়াটাই ভালো।

কয়েকদিন তন্ময়দের সাথে কথা বলা এক্কেবারে বন্ধ করে দিল সে। একই ঘর, এক ছাদের নীচ, শুধু কথা বলা বন্ধ। এমনি ভাবেও তো বেশিদিন থাকা যায় না। বাপের বাড়িতে গিয়ে যে-কয়েক দিন থাকবে তারও কোনও উপায় নেই। এদিকে যে কী হবে তা বলা মুশকিল। তাছাড়া বাপের বাড়িতে মা ছাড়া এখন কেউ নেইও। মাকে তো এই সব অনাসৃষ্টির কথা বলা যায় না। কিন্তু বলবার জন্যেও একজন বন্ধুর প্রয়োজন।

একদিন সকালের দিকে পেপার পড়তে পড়তে এক মনোবিদের ফোন নম্বরে ফোন করে অ্যাপযে্টমেন্ট নেয়। ওখানে গিয়ে সব কিছু বলতে ডাক্তার ম্যাডাম ক্লাইটেমনেস্ট্রা, এজিস্টাস, ইলেকট্রা, ওরিস্ট্রেস সব নাম একের পর এক বলে বিভিন্ন ধরনের যৌন বিকৃতির কথা বলতে আরম্ভ করেন।

উলটো দিকে বসে থাকা অপর্ণা অপেক্ষা করে বসে থাকে, এই বুঝি কোনও উপায় বলবেন। বললেনও তবে অনেক শেষে। নিজেকে হাজব্যান্ডের কাছে আরও প্রেজেন্টবল করে তোলার সাথে মেয়েকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।

বাড়ি ফিরে মাথাটা আবার গরম হয়ে যায়। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে দেখে তন্ময় দীক্ষার ঘরের বিছানাতে শুয়ে আছে। দুজনের শরীরে কোনও সুতো নেই।

জীবনে এক ভাবা ছিল, এক হল। কয়েক বছর ধরে আয়নার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, অথচ এই আয়নাটাই এখন নিত্য সঙ্গী হয়ে গেল। মাসে একবার করে মাকে দেখতে যাওয়াটাই কাল হল, অবশ্য এর আগেও বহুবার মাকে দেখতে গেছে কিন্তু কোনও বার এমনি ভাবে কোনও মহিলার সাথে দেখা হয়নি। তাও যদি শুধু দেখা হতো তাহলে না হয় ঠিক হতো, কিন্তু এমনি ভাবে একটা সম্পর্ক তৈরি হয়ে যাবে কে জানত? ভদ্রমহিলা অবশ্য বেশ ভালো, কোনও রকম ঝামেলা নেই। বহুবার জিজ্ঞেস করবার পরেও নিজের সম্পর্কে কিছুই বলেনি। প্রথম দিন শুধু নিজের পরিচয় দিয়ে বলেছিল, আমার নাম অপর্ণা, আপনার।

কুশল।

এরপর থেকে আর কিছু না বললেও কুশল প্রতিদিন অফিস বের হবার সময় ভাবে, নিশ্চয়ই ফিরে দেখব উনি নেই। কিন্তু উনি থাকেন। বাড়িতে ফিরে প্রতিদিন কুশল, অপর্ণার হাতে তৈরি নতুন নতুন খাবার খায়। তখনই চোখের সামনে অ্যাসাইলামের ভিতর থেকে মা উঠে আসে, পাশে বাবা।

বাবা ডাকে, কুশল ছুটে পালায়। পাড়ার লোক বাবাকে অপমান করে। মা-বাবা পাড়া ছাড়ে, বাবা চাকরি ছেড়ে নতুন ঠিকানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। তারপরেও অবশ্য নিস্তার নেই। কুশলের বড়ো হবার সঙ্গে সঙ্গে বাবা মায়ে ঝগড়া আরম্ভ হয়। বাবা, মায়ে গায়ে হাত তুলতে আরম্ভ করে। তারপর একদিন রেললাইনে মাথা দেয়।

কুশল কিছুই জানতে পারে না। একা মা তাকে বড়ো করতে থাকে। একদিন একটা ফাইলের ভিতরে একটা কাগজ দেখে চমকে ওঠে কুশল। মাকে জিজ্ঞেস করে, ঝগড়া হয়, মাকে অপমান করে, মা আর সহ্য করতে পারে না।

একটা কথা জিজ্ঞেস করব?

নিশ্চয়ই।

এই যে আমি আপনার বাড়িতে আছি আপনাকে কেউ কিছু জিজ্ঞেস করেনি? মানে আপনার অফিসে, পাড়ায়?

কুশল একটা শ্বাস টানে, এক্কেবারে যে করেনি এটা বলব না, তবে বলেছি আমার দিদি। জামাইবাবু মারা যাওয়াতে আমার কাছে থাকছে।

অপর্ণা কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দেয়, এটা কিন্তু আপনি ঠিকই বলেছেন, আমার স্বামী সত্যি সত্যিই মারা গেছেন। তারপরেই ব্যাগ থেকে একটা খবরের কাগজ বের করে একটা খবর দেখিয়ে বলে, আত্মহত্যা, আমার মেয়ে ও উনি, দুজন একসঙ্গে।

কুশল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, হঠাৎ!

হঠাৎ না।

মানে? আপনার মেয়ে আর স্বামী দুজন একসাথে সুইসাইড করেছে, আপনি কিছু করতে পারেননি।

আমি ঘটনার দুমাস আগেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে একটা হোমে থাকতে আরম্ভ করেছিলাম। চাকরির চেষ্টা করছিলাম।

কী এমন ঝামেলা করলেন?

আমার মেয়ে প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছিল, অ্যান্ড বাই হার ফাদার।

কুশল শেষের কথাগুলো শুনে চমকে উঠল। এক-পা এক-পা করে একটা জানলার ধারে অন্ধকারের দিকে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে থাকে সে। রাত্রি অন্ধকার হলেও দিনের আলোর মতো জটিল নয়। শহরটাতে মানুষ খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে, না হলে কুশলের দুচোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জল দেখতে পেত। নাহলে পড়তে পারত দুটো বার্থ সার্টিফিকেট। অনেক চেষ্টা করেও যেদুটো থেকে বাবার নামটা মোছা যায়নি। পাশাপাশি রাখলে পড়া যায় কুশলের দাদুই তার বাবা।

প্রায়শ্চিত্ত

ক্রিং ক্রিং…। ফোনটা অনবরত বেজে চলেছে। ঘড়িটার দিকে তাকালাম। বিরক্তি চেপে রেখে ফোনটা তুললাম। ওপাশ থেকে গলা ভেসে এল। প্রথমটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। অজয়ের গলা। এক যুগ কেটে গেছে। কবে শেষবারের মতো ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল মনে পড়ল না। সেই কবেই ওর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে আর তার প্রধান কারণ ছিল ওর অহংকার। অহংকারে এতটাই ও অন্ধ হয়ে গিয়েছিল যে বিবেক বলে ওর আর কিছুই ছিল না। ওর ব্যবহারে আমি এতটাই ব্যথা পেয়েছিলাম, যে ওর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করে দিয়েছিলাম। ও-ও যোগাযোগ রাখার কোনও চেষ্টা করেনি। বন্ধুত্ব আছে বলেই যে ওর হ্যাঁ তে হ্যাঁ মেলাব এমন কোনও মানে নেই। যেটা অন্যায় সেটা স্পষ্ট করে বলে দেওয়াটাই আমার অভ্যাস। অজয়েরও সেটা খারাপ লাগতেই পারে তাই বলে এতটাও নয় যে ও খুব খারাপ ভাষায় আমাকে ওর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলবে। এত বছরের বন্ধুত্ব, একজন মহিলার জন্যে এভাবে যে ওর কাছে মূল্যহীন হয়ে যেতে পারে, সেটা দেখে আমি প্রচন্ড ব্যথা পেয়েছিলাম। সেদিনই ঠিক করে নিয়েছিলাম অজয়ের সঙ্গে কোনওরকম সম্পর্কই আর রাখব না।

আমি আর অজয় একই পাড়ায় থাকতাম। স্কুল, কলেজ সব একসঙ্গে। তারপর আলাদা চাকরির জগৎ। সুখ-দুঃখ আমরা সবসময় একসঙ্গে ভাগ করে নিয়েছি। অজয় প্রথম বিয়ে করে নিজে দেখে। স্বাতিকে। স্বাতি যথেষ্ট সুন্দরী, বুদ্ধিমতী এবং ধনী পরিবারের মেয়ে। মা-বাবার একমাত্র সন্তান ও সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী। অজয়ের মা-বাবাও স্বাতিকে খুবই ভালোবাসতেন। ওর স্বভাবটাই এতটা মিষ্টি ছিল যে সকলেই ওকে পছন্দ করত। ওর সঙ্গে দাদা-বোনের সম্পর্ক পাতিয়েছিলাম। আমি ওর বাড়িতে গেলেই খাতিরদারীর কোনও সুযোগ ও হাতছাড়া করত না। আমিও ওকে নিজের বোন ছাড়া বন্ধুর স্ত্রী হিসেবে কোনওদিন ভাবতে পারিনি।

এরই মধ্যে স্বাতি দুই সন্তানের মা হল। অজয় সরকারি চাকরি করত। প্রোমোশন পেয়ে পেয়ে এমন জায়গায় পেৌঁছে গিয়েছিল যেখানে উপরি-কামাইয়ের কোনও অন্ত ছিল না। মধ্যবিত্ত একটা পরিবারকে কালো টাকার আবর্তে ধীরে ধীরে ঠেলে দিচ্ছিল। কিন্তু ভগবান বাধ সাধলেন। অজয়ের কপালে সুখ সহ্য হল না। স্বাতি আক্রান্ত হল ক্যানসারে। তিন বছর ধরে জলের মতো টাকা খরচ করেও স্বাতিকে বাঁচানো গেল না। স্বাতির মৃত্যুতে অজয় প্রচন্ড ভাবে ভেঙে পড়ল। বাচ্চা দুটো অসময়ে তাদের মা-কে হারাল।

কথায় আছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব আঘাতের চিহ্নই ধীরে ধীরে মুছে যায় তা সে যত বড়ো আঘাতই হোক না কেন। কয়েকমাস পার হয়ে যাওয়ার পর অজয়ের ডিভোর্সি ছোটো বোন কানপুর থেকে চাকরি নিয়ে কলকাতায় দাদার কাছে এসে উঠল। পৈতৃক বাড়ি, আজয়ও বোনকে মানা করল না। অন্বেষার নিজের কোনও সন্তান না থাকায় দাদার বাচ্চাদের দেখাশোনা করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নিল। অজয়ও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচল।

স্বাতির মৃত্যুর দুই বছর তখনও হয়নি। অন্বেষা এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজনেরা অজয়কে দ্বিতীয়বার বিয়ে করার জন্যে চাপ দিতে আরম্ভ করল। অজয়ের বয়স তখন বিয়াল্লিশ ছুঁই ছুঁই। বাচ্চারা মায়ের আদর ফিরে পাবে এই ভেবে আমিও অজয়কে বিয়ে করার পরামর্শ দিই। অজয়ের মনে সংশয় ছিল যে সৎমা আসলে বাচ্চাদের সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করবে? অনেক বোঝাবার পরে অজয় রাজি হল কিন্তু চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। লুকোবার চেষ্টা করলেও আমার কাছে ধরা পড়ে গেল। আমার কাঁধে হাত রেখে বলে, ‘কী দোষে বল তো আমাকে মাঝ সমুদ্রে ফেলে রেখে দিয়ে স্বাতি আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে গেল? আমি কি কখনও বাচ্চাদের মায়ের জায়গা নিতে পারি? রাত্তিরে আমি ওদের নিয়ে শুই। মাঝরাতে মায়ের জন্যে কেঁদে উঠলে আমি ওদের চুপ করাতে পারি না। অফিসে গেলে বাড়ি ফেরার জন্যে উতলা হয়ে উঠি, কত বেশি বাচ্চাদের সঙ্গে থাকতে পারব এই ভেবে। আমি সবসময় চাই যাতে ওরা মায়ের অভাব বুঝতে না পারে।’

অজয়ের কথায় আমিও ভাষা হারিয়ে ফেলি। মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে সংযত করে বেশ জোরের সঙ্গে বলি, ‘যা হবার ছিল হয়েছে। অতীতে পড়ে না থেকে বর্তমান ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাব।’

‘কী ভাবব? বাচ্চারা বড়ো হচ্ছে কিন্তু মায়ের স্মৃতি আজও ওরা অাঁকড়ে ধরে রেখেছে। আজও চোখে ওদের জল আসে মায়ের কথা উঠলেই। ওদের জন্যেই আমার বেশি চিন্তা হয়।’

‘দ্যাখ, স্বাতির অভাব আমরা সকলেই ফিল করি আর বাচ্চারা তো করবেই। তুই দ্বিতীয় বিয়ে করলে হয়তো মায়ের এই অভাব কিছুটা হলেও দূর হবে।’

‘হতে পারে কিন্তু এর গ্যারান্টি কোথায়? যদি আমার বিয়ে করার বিচার ভুল প্রতিপন্ন হয়, তাহলে আমি নিজেকে কোনওদিন ক্ষমা করতে পারব না। বাচ্চাদের চোখেও আমি সারা জীবনের মতো অপরাধী হয়ে থাকব।’

অজয়ের ভয় অমূলক নয় জানি কিন্তু আশঙ্কার উপর নির্ভর করে পথচলা তো আর বন্ধ করা যায় না। ভবিষ্যতে কী হবে আর কী হবে না, সেটা কে জানে? এমনও তো হতে পারে অজয়-ই পুরোপুরি বদলে গেল?

অজয়ের জন্যে বহু পাত্রীর সম্বন্ধ এল। অন্বেষা অনেক সম্বন্ধ প্রথমেই নাকচ করে দিল সুন্দরী মেয়ে চাই বলে। নিন্দুকেরা এই নিয়ে মশকরা করতে ছাড়ল না যে এই বয়সেও সুন্দরী ভার্যার প্রয়োজন পড়ল। শেষে একটা সম্বন্ধ অজয়ের মনে ধরল। ফরসা, সুন্দরী, ডিভোর্সি, এক সন্তানের মা। নাম সুনন্দা। কানে এসেছিল মহিলার স্বামী কোনও কোম্পানিতে মার্কেটিং বিভাগে কাজ করতেন এবং পথ দুর্ঘটনায় তার একটা পা চলে যায়।

অজয় আর অন্বেষা দুজনেই যে সুনন্দাকে পছন্দ করেছিল তার প্রধান কারণ ছিল সুনন্দা সুন্দরী। ওর একটি মেয়ে, বয়স আট বছর। কেন জানি না সুনন্দার সঙ্গে অজয়ের বিয়েটা আমি মন থেকে মেনে নিতে পারিনি।

আমার সুনন্দাকে দেখে মনে হয়েছিল, অজয়ের জন্যে সুনন্দা উপযুক্ত নয়। অজয়ের দরকার ছিল ঘরোয়া একজন সাধারণ মেয়ের। কিন্তু সুনন্দা খুবই ব্যক্তিত্বময়ী এবং অজয়ের সঙ্গে ওর ব্যক্তিত্বের জমিন-আসমান ফারাক।

অজয় আমার বন্ধু ঠিকই কিন্তু মানবিকতার দৃষ্টি দিয়ে দেখলে মনে হয় ভগবান বোধহয় অন্যায়ই করেছেন সুনন্দার সঙ্গে। সুনন্দার মেয়ে শ্রেয়াও যথেষ্ট স্মার্ট এবং সুন্দরী সেই তুলনায় অজয়ের ছেলেমেয়ে অতটা অসাধারণ নয়। একলা কোনও নারীর পক্ষে একাকী সারাজীবন কাটানো সহজ নয় এবং সেই কারণেই হয়তো সুনন্দার মা-বাবা সামাজিক সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে অজয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেওয়াই উচিত মনে করেছেন।

সুনন্দার সঙ্গে বিয়ের পর থেকেই অজয় প্রচণ্ড বদলে যেতে থাকে। স্ত্রীয়ের সৌন্দর্য ওকে কীরকম যেন একটা পাগল করে তুলতে থাকে। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু এমনকী বাচ্চারাও ওর কাছে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলতে শুরু করে। চোখের সামনে থেকে সরে গেলেই সুনন্দা অপর কারও হয়ে যেতে পারে এই ভয় অজয়কে কুরে কুরে খেতে আরম্ভ করে ফলে অফিস না যাওয়ারও নানা বাহানা ধীরে ধীরে অজয় তৈরি করা আরম্ভ করে।

আমার আসা-যাওয়াও অজয়ের বাড়িতে অনেক কমে গেল। অজয় আমাকেও সুনন্দার সঙ্গে সময় কাটাতে দিতে পছন্দ করত না। সর্বক্ষণ সুনন্দার সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকত। সুনন্দাও স্বামীর দুর্বলতা বুঝতে পেরে নিজের মতো অজয়কে চালাবার চেষ্টা করতে লাগল। নিজে যেটা ভালো বুঝত, অজয়কে দিয়ে সেটাই করাত। অজয়ের চারিত্রিক পরিবর্তন ওর দুই সন্তানকে ভীষণ ভাবে প্রভাবিত করল। ওরা বাবার থেকে ক্রমশ দূরে সরে যেতে থাকল। অফিস থেকে ফিরে বাচ্চাদের ঘরে না ঢুকে অজয় সোজা সুনন্দার ঘরে চলে যেত।

সেদিন সুনন্দার কোনও আত্মীয়ের বিয়ে ছিল। অজয়, সুনন্দা মেয়েকে নিয়ে বিয়েতে যাবার জন্যে তৈরি হচ্ছিল। অজয়ের ছেলে অয়নও যাওয়ার জন্যে বাবার কাছে আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু অজয় ওকে বকা দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়, ‘গিয়ে পড়াশোনা করো, কোথাও যাওয়ার দরকার নেই।’

বাবার কথা শুনে ছেলে ঘরে এসে মায়ের ছবির সামনে দাঁড়ায়, চোখে জল ভর্তি। অন্বেষা ভাইপোর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ঘরে এসে ঢোকে। অয়নকে ছোট্ট থেকে দেখছে অন্বেষা, খুবই মুখচোরা ছেলে। বাপের মুখের উপর কথা বলবে এমন অভ্যাস ওদের দুই ভাই-বোনের কারওরই নেই। অজয় আজকাল সুনন্দার কথায় ওঠে বসে। সুনন্দার মেয়ের খেয়াল রাখাটা অজয়ের কাছে বেশি জরুরি। অন্বেষা প্রতিবাদ করাতে অজয় জানিয়েছিল, পিতৃহীন মেয়েকে সময় দেওয়াটা অনেক বেশি দরকার। অথচ অজয়ের একবারও মনে হয়নি মা-মরা তার নিজের দুটি সন্তানের কষ্ট। বাচ্চাদের স্কুলের মাইনে, জরুরি কিছু জিনিসপত্র কিনে দেওয়াকেই অজয় ভেবে নিত বাচ্চাদের প্রতি তার কর্তব্য শেষ। অয়ন আর রিয়া বুঝে গিয়েছিল তারা বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত হতে চলেছে। বাড়িতে যেটুকু ভালোবাসা পাচ্ছে সেটা পিসির কাছ থেকেই। বাড়ির পরিবেশে নিজেদের মানিয়ে নিতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল দুই ভাই-বোন।

হঠাৎই অজয় একদিন নিজের বাড়ি ছেড়ে সুনন্দা আর তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে স্বাতির পৈতৃক বাড়িতে এসে ওঠে। স্বাতির মা মৃত্যুর আগে নাতির নামে বাড়িটা লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন। অজয়ের নিজের বাস্তুভিটে ত্যাগ করার প্রধান কারণ ছিল ওখানে বাড়ির অন্যান্যদের মধ্যে ওর স্বাধীনতা খর্ব হচ্ছিল। অন্বেষাই একমাত্র মাঝেমধ্যে বাচ্চাদের দেখতে অজয়ের নতুন আস্তানায় যেত।

আমি অয়নের থেকেই অজয়ের খবরাখবর পেতাম। অজয়ের ব্যবহারে আমিও খুশি ছিলাম না। অনেকবার মনে হয়েছে ওকে বোঝাই কিন্তু অপমানিত হওয়ার ভয়ে সবসময় পিছিয়ে এসেছি। এরই মধ্যে অয়নের কাছ থেকে জানতে পারলাম সুনন্দা মা হতে চলেছে। অজয়ের যা বয়স সেটা ভেবে অবাক হলাম। পঁয়তাল্লিশ ছুঁই ছুঁই, নিজের দুটি সন্তান প্রথম স্ত্রী থেকে। তাছাড়াও সুনন্দারও মেয়ে তখন এগারোয় পড়বে। সন্তানের সত্যিই কি কোনও দরকার ছিল ওদের জীবনে? হঠাৎই অজয় আর সুনন্দাকে প্রচন্ড স্বার্থপর বলে মনে হল আমার।

দ্বিতীয়বার অজয় যখন বিয়ে করতে সম্মতি দিয়েছিল তখনই ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল। ও বলেছিল একে অপরের সঙ্গী হতে পারবে বলেই এই বিয়ে করা। আর সন্তানরাও নতুন করে মা-বাবার স্নেহ ভালোবাসা পাবে। তাহলে হঠাৎ কী ভেবে সুনন্দা মা হবার জন্যে রাজি হয়ে গেল?

অজয়, সুনন্দার ছেলে হল। শহরের বড়ো হোটেলে পার্টিও দিল ওরা। আমন্ত্রিতদের লিস্টে আমারও নাম ছিল। অতিথিরা প্রায় সকলেই উপস্থিত ছিলেন ঠিকই কিন্তু আড়ালে আবডালে তাদের মুখে অজয়দের সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য ছাড়া কিছু শুনলাম না। অবশ্য অজয়কে দেখলাম এব্যাপারে বেশ নির্লিপ্ত। ওর জগতে সুনন্দা এবং ওদের ছোট্ট শিশুসন্তান ছাড়া আর কেউই নজরে পড়ল না।

পার্টিতেই দেখা হয়ে গেল অয়ন আর রিয়ার সঙ্গে। এতটা উদাস ওদের আগে কখনও দেখিনি। জানি কারণটা অজয়। ওদের প্রতি অজয়ের উদাসীনতাই এর জন্যে দায়ী। টাকা-পয়সা দিয়ে বাচ্চাদের মন হয়তো ভোলানো যায় কিন্তু মন জয় করা সম্ভব নয়। অয়ন আর রিয়ার দরকার ছিল মায়ের স্নেহ মমতার কিন্তু মা না থাকায় কর্তব্যটা বর্তায় বাবার উপর। অথচ দ্বিতীয়বার বিয়ে করবার সময় বাচ্চারাই বাবাকে সবথেকে বেশি জোর দিয়েছিল নিজের জীবনসঙ্গিনী খুঁজে নেওয়ার জন্যে। সেই বাবাই যদি সন্তানদেরথেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাহলে সন্তানদের মনের অবস্থা কী হতে পারে এটা কারওরই অজানা নয়।

একটা ব্যাপার আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল যে এই বয়সে অজয়ের কী দরকার ছিল তৃতীয় সন্তানের। তৃতীয় বলাও ভুল কারণ সুনন্দার মেয়েকে ধরলে অজয়ের মোট চারটি সন্তান। অয়নের সঙ্গে রাস্তায় একদিন দেখা হয়ে গেল। জোর করে বাড়িতে ধরে নিয়ে এলাম। স্বাভাবিক ভাবেই অজয়ের কথা উঠে এল। ‘আচ্ছা কাকু বলোতো, এই বয়সে বাবার আবার কেন ‘বাবা’ হওয়ার সাধ জাগল? বাড়ির বাইরে গেলেই বন্ধুরা, আত্মীয়স্বজনেরা এই নিয়ে হাসি তামাশা করতে ছাড়ে না। কোথাও মুখ দেখাতে পারি না। মনে হয় চুরির দায়ে আমিই চোর সাব্যস্ত হয়েছি। এইসব কারও ভালো লাগে বলো?’ অয়নের কথাগুলো এসে বুকে বিঁধল। কী উত্তর দেব বুঝে পেলাম না। অজয়কে নিয়ে আলোচনা করতে ইচ্ছে হল না। স্বাতির মুখটা মনে পড়ল। ও থাকলে কি অজয় পারত সন্তানদের এভাবে অবহেলা করতে, নিজের স্নেহ থেকে ওদের দূরে রাখতে? স্বাতিকে তো অজয় ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। তাহলে তার আমানতকে কী করে অজয় দূরে সরিয়ে রাখতে পারল শুধুমাত্র সুনন্দার জন্যে? অয়নের মুখেই শুনলাম সুনন্দার মা-বাবা ওদের বাড়িতে এসেছিল। ও সুনন্দার মা-কে, অজয়ের কাছে বলতে শুনেছে, ‘যাক বাবা এখন তোমার আর সুনন্দার পরিবার সম্পূর্ণ হল। এক ছেলে এক মেয়ের বাবা-মা তোমরা।’

আশ্চর্য হয়ে গেলাম, রাগও হল। তার মানে অয়ন আর রিয়া অজয়ের পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আর পড়ে না? সুনন্দাই তাহলে চতুর্থ সন্তানের জন্যে অজয়ের ব্রেন ওয়াশ করেছিল! হয়তো সুনন্দার মনে হয়েছিল অজয়ের সন্তান যদি সুনন্দা ধারণ না করে তাহলে সম্পত্তির পুরো অধিকার চলে যাবে অয়ন আর রিয়ার হাতে। মনে মনে সুনন্দাকেই দোষী ঠিক করে নিলাম।

কথা বলার জন্যে একদিন অজয়কে ফোন করে ওর বাড়ি গেলাম। অয়ন আর রিয়ার পক্ষ টেনে অজয়কে বোঝাবারও চেষ্টা করলাম, ‘দ্যাখ অজয় তুই অয়ন এবং রিয়ার সঙ্গে অন্যায় করছিস। ওদের মা মারা যাওয়ার পর তোর উপরেই ওদের ভরসা ছিল। কিন্তু সুনন্দাকে বিয়ে করার পর ওদের উপর থেকে স্নেহের হাতটা কেন তুলে নিলি তুই?’

‘কে বলেছে? জানিস অয়নের ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সের জন্য দশ লাখ টাকা খরচ করেছি। রিয়াকে প্রচুর টাকা দিয়ে এমবিএ কোর্সে ভর্তি করিয়েছি। আর তুই বলছিস আমি ওদের জন্য কিচ্ছু করিনি।’

‘টাকা দিয়ে স্নেহের অভাব পূরণ করা যায় না। তুই শুধু বাবার কর্তব্যটুকুই করেছিস।’

‘তোকে কি অয়ন আর রিয়া আমার কাছে পাঠিয়েছে? ওদের বলে দিস আমার পক্ষে যেটুকু করা সম্ভব ছিল আমি করেছি। এর বেশি কিছু আমার পক্ষে করা সম্ভব নয়। আর তুই-ও আসতে পারিস এবার কারণ আমি চাই না এধরনের কথাবার্তা সুনন্দার কানে পৌঁছোক।’

এখানেই আমার আর অজয়ের সম্পর্কের ইতি। অপমানিত হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম সেদিন। অয়ন বিটেক পাশ করে চাকরি নিয়েছে খবর পেয়েছি। একদিন এল আমার কাছে বিয়ে করছে জানাতে।

‘বাবাকে জানিয়েছিস?’

‘না। আমাদের নিয়ে বাবা যখন কিছু ভাবে না তখন আমরা কী করছি না করছি জানাতে যাব কেন? কোনওদিন ভালোবেসে আমাদের সঙ্গে দুটো কথা বলে?’

‘তোদের পড়াশোনা তো করিয়েছে?’

‘পড়িয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা শুধুই দায়িত্ব মনে করে। আমাদের সঙ্গে বাবার মনের সংযোগ সেই কবেই কেটে গেছে। টাকাপয়সা নিয়ে আমার বা বোনের কোনও চিন্তা নেই কারণ দিদা, মায়ের নামে যা টাকা রেখে গিয়েছিলেন তা এখন আমাদের দুই ভাইবোনের নামেই। তাছাড়া বাবারা এখন যে বাড়িতে রয়েছে সেটাও আমার নামেই।’

‘তোরা আজকালকার ছেলে, যা ভালো বুঝিস।’

অয়নের বিয়েতে আমি গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। শুনেছি অজয় রিয়ার বিয়ে দিয়ে দিয়েছে কিন্তু আমাকে জানায়নি। তবে এটুকু জানতাম অয়নের সঙ্গে অজয় কোনওরকম সম্পর্ক রাখেনি।

সময় কারও জন্যে থেমে থাকে না। সম্পর্ক না থাকলেও অজয়ের সব খরবই আমার কানে আসত। সুনন্দার নামে একটা ফ্ল্যাট কিনে অজয়রা সেখানেই উঠে গিয়েছিল। অয়নও এসে বাবার হাত থেকে দিদার ফ্ল্যাটের চাবি হস্তগত করে। চাবি দেওয়ার সময় অজয়ও অয়নকে জানিয়ে দেয় পৈতৃক সম্পত্তি থেকে কানাকড়িও অয়ন পাবে না।

সুনন্দার মেয়েও ধীরে ধীরে বিবাহযোগ্য বয়সে এসে পৌঁছোয়। সুনন্দা পাত্রও পছন্দ করে কিন্তু পণের বড়োসড়ো টাকার অঙ্ক দিতে অজয় অস্বীকার করে। সুনন্দা আর অজয়ের মধ্যে সেই প্রথম ঝগড়ার সূত্রপাত। সুনন্দাই প্রথম অশান্তি শুরু করে অজয় পণের টাকা দিতে না চাইলে।

‘অয়নকে দশ লাখ টাকা খরচ করে পড়াতে পারো আর আমার মেয়ের বিয়ের জন্যে তোমার কাছে টাকা নেই?’

‘এভাবে কেন ভাবছ? ফ্ল্যাট কেনার পর আমার হাতে আর বেশি টাকা নেই। আর পণ দিয়ে মেয়ের বিয়ে দেওয়াটা কি একান্ত দরকার? আর একটু দ্যাখো, ভালো ছেলে নিশ্চই পাবে যারা কিনা পণ চাইবে না।’

‘অয়নের থেকে কিছু টাকা চাও না। ওর তো উচিত বাবাকে কিছু টাকা দেওয়া।’

‘তোমার জন্যে ওর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখিনি। আজ কোন মুখে ওর কাছে টাকা চাইব?’

‘আমার জন্যে? বরং বলো ইঞ্জিনিয়ার হয়ে দুটো পয়সা কামাচ্ছে বলে ও চালবাজ হয়ে গেছে।’

‘যাই বলো আমি ওর কাছে টাকা চাইতে পারব না।’

‘তাহলে এক কাজ করো। পৈতৃক বাড়িটা বিক্রি করে দাও।’ সুনন্দার এই প্রস্তাবটা অজয়ের খারাপ লাগল না কারণ ওই বাড়িতে শুধু অন্বেষাই থাকত। সেও প্রায় তিন বছর আগে নিজে ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছে। বাড়ি বিক্রির খবরটা চারিদিকে চাউর হয়ে গেল। অয়নের কানেও খবরটা পৌঁছোল। সঙ্গে সঙ্গে সে অজয়ের কাছে গেল।

‘বাড়ি বিক্রি করলে সকলকে সমান ভাগ দিতে হবে,’ অয়ন বলল আজয়কে।

‘সকলকে মানে?’

‘রিয়াকেও ভাগ দিতে হবে।’

‘রিয়ার বিয়েতে আমি যা খরচ করেছি, তাতেই সব বরাবর হয়ে গেছে।’

‘তোমার লজ্জা করে না বাবা? বোনের বিয়ের হিসেব করছ?’

‘তোমাদের কাছে ফ্ল্যাট রয়েছে।’

‘সেটা দিদার ফ্ল্যাট। এটা আমার ঠাকুরদার বাড়ি। আইনত এটার উপর আমাদেরও অধিকার রয়েছে। সুতরাং বিক্রির সময়ই হোক অথবা টাকা ভাগ করার সময়, আমি সামনে থাকব।’ অয়নের সামনে সুনন্দা মুখ না খুললেও পরে অজয়কে একলা পেয়ে সুনন্দা এক মুহূর্তও দেরি করে না নিজের রাগ প্রকাশ করতে।

‘খুব তো ছেলে ছেলে করতে, এখন কীরকম মুখে ঝামাটা ঘষল। আমার ছেলে-মেয়েকে বঞ্চিত করে ওকে কেউকেটা বানিয়েছ। আজ তার ভালো প্রতিদান পেলে।’

‘আমি কারও অধিকার ছিনিয়ে নিইনি। তাছাড়া অয়নও আমারই সন্তান।’

‘সেটাই তো বলতে চাইছি। ছেলে হয়ে তাই এরকম দায়িত্বের কাজ করেছে।’

‘শ্রেয়া তোমার মেয়ে, আমার মেয়ে নয়’, অজয়ের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল।

অজয়ের কথায় সুনন্দাও আর রাগ সামলাতে পারে না, ‘তোমার মতো নির্লজ্জ আমি জীবনে দেখিনি। বিয়ের সময় তুমিই বলেছিলে আমার মেয়েকে বাবার পরিচয় দেবে। তোমার পরিচয়েই ও বড়ো হবে। এত সহজে আমি তোমাকে ছাড়ছি না।’

‘তোমারও আসল রূপ বেরিয়ে পড়েছে।’ ঘৃণা ঝরে পড়ে অজয়ের গলায়। ‘তোমার মেয়ের জন্যে আমার কাছে এক টাকাও নেই। ওকে ওর নিজের বাবার কাছে পাঠিয়ে দাও। আমি ওর বাবা নই।’

অজয়ের কথায় সুনন্দার আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। চোখে জল এনে সুনন্দা বলে, ‘তাহলে এই ছেলেও তোমার নয়? একেও কি তুমি অস্বীকার করবে?’ ইশারাটা নিজের ছেলের দিকে।

ছেলেকে দেখে অজয় কিছুটা শান্ত হয়। সুনন্দারও ঠোঁটে ছুঁয়ে যায় আত্মতৃপ্তির তীর্যক হাসি।

শেষমেশ অয়নের শর্ত অনুযায়ীই অজয়ের পৈতৃক সম্পত্তির বিক্রি স্থির হল এবং বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া গেল তা সমান ভাবে সকলের মধ্যে অজয়কে ভাগ করে দিতে হল। অবশ্য এই ঘটনার পর অজয় ছেলের মুখ না দেখার প্রতিজ্ঞা করল।

রিটায়ার করার পর অজয় ভীষণ একলা হয়ে গেল। অয়ন, রিয়ার সঙ্গে তো আগেই সম্পর্ক শেষ হয়ে গিয়েছিল। সুনন্দার মেয়ের বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর বাড়িতে সুনন্দা আর ছোটো ছেলে। সেও দেখতে দেখতে কৈশোরে পা দিয়েছে। বাবার থেকে মায়ের সঙ্গেই তার বেশি ওঠাবসা। নামেই শুধু বাবা হয়ে থেকে গেছে অজয়, সুনন্দার ছেলে মেয়ের কাছে। সেই শুরু অজয়ের আত্মদহনের। অয়ন, রিয়ার কাছে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল, সেই বাবার দায়িত্বটাও সে পুরোপুরি পালন করতে পারেনি। মনে মনে নিজেকেই ঘৃণা করতে শুরু করে অজয়। মানসিক এই পরিস্থিতির মধ্যেই পুরোনো সম্পর্কগুলো ঝালিয়ে নিতেই অজয় আমাকে ফোন করে।

এত বছর পর ওর গলা শুনে সত্যিই আশ্চর্য হয়েছিলাম কিন্তু বন্ধুত্বের টানে না গিয়েও পারলাম না। দেখলাম অনেক বদলে গেছে অজয়। নিজের ভুল শোধরাতে চায়। অয়ন, রিয়ার সঙ্গে দেখা করতে চায় আমার সাহায্য নিয়ে। কথা দিতে পারলাম না শুধু আশ্বাস দিলাম যে চেষ্টা নিশ্চই করব। কয়েকদিন পরই সুনন্দা ফোন করে জানাল অজয় হাসপাতালে ভর্তি। দুদিন আগে রাতে শরীর খারাপ হওয়াতে পাড়ার সকলে মিলে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করেছে। সমস্যা হার্ট স্ট্রোক।

দৌড়োলাম হাসপাতালে। আরও চব্বিশ ঘণ্টা না কাটলে নাকি ডাক্তাররা আশ্বাস দিতে পারছেন না। অয়ন, রিয়াকেও জানালাম। খবর পেয়েই পরের দিন রিয়া বাবাকে দেখতে এল। আশা করেছিলাম সঙ্গে অয়নও আসবে। ও এল না। অয়নের বাড়ি গেলাম। অজয়ের সঙ্গে আমার যা কথা হয়েছে সবই ওকে জানালাম। সব শুনে ও বলল, ‘কাকু, কোনও সন্তানই চায় না তার মায়ের জায়গা সৎমা নিক। কিন্তু বাবার মুখ চেয়ে বাবার বিয়েতে বাধা দিইনি। বাবাও কথা দিয়েছিলেন ভালোবাসার কোনও অভাব আমাদের হবে না। কিন্তু নতুন মা আসার পর থেকে বাড়ির পরিবেশটাই বদলে গেল। মাকে আমি দোষ দেব না। আমার অভিযোগ বাবার বিরুদ্ধে যিনি আমাদের নিজের স্নেহ থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছেন। বোনের বিয়ে বাবা যেমন তেমন করে সেরেছেন অথচ নতুন মায়ের মেয়ের জন্যে পৈতৃক বাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করেছেন। আমার টাকার উপর কোনও মোহ নেই কিন্তু নতুন মা-কে বাবা ফ্ল্যাট কিনে দিয়েছেন, তাহলে আমরা পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ কেন পাব না? বাবার পিএফ, বিমা, পেনশন সবকিছুর ওপর অধিকার রয়েছে নতুন মায়ের তাহলে আমরা আমাদের অধিকার ছাড়ব কেন?’

‘কিন্তু টাকার কি দরকার আছে তোর?’

‘আমাদের শুধু দরকার ছিল মা-বাবার ভালোবাসার যা ওঁরা আমাদের দেননি। মায়ের জায়গা হয়তো নেওয়া সম্ভব নয় কিন্তু রাত্রে ঘুমন্ত সন্তানের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর তো করতে পারতেন।’

‘তোদের বাবা আজ অনুশোচনার আগুনে জ্বলছেন।’

‘অনুশোচনা তো করতেই হবে। নতুন মায়ের প্রতি মোহ, আকর্ষণ কমেছে বয়সের সঙ্গে তাই ছেলে মেয়ের কথা এখন মনে পড়েছে।’

‘তোদের বাবা যে ভুল করেছেন, তুইও কি একই ভুল করতে চাস? প্রতিশোধ নিতে চাস?’

‘আমি আর কী করব? যা অন্যায় করেছেন তার ফল আজ উনি ভোগ করছেন।’

‘তাও উনি তোর বাবা। উনি তোর কাছে কিছু চাইছেন না শুধু নিজের কৃতকর্মের জন্যে লজ্জিত। তার প্রায়শ্চিত্ত করতে চান। একবার ওনার কাছে যা। তোর কাছে ক্ষমা চাইতে পারলে ওনার মনের বোঝা খানিকটা হালকা হবে।’

অয়ন আমার কথা শুনল। পরের দিন আমার সঙ্গে হাসপাতালে বাবাকে দেখতে এল। ওকে দেখে অজয়ের চোখের জল বাঁধ মানল না। অয়নের হাত চেপে ধরে রাখল, মুখ থেকে একটা কথাও বেরোল না। সুনন্দাও স্বামীর স্বাস্থ্যের কথা ভেবে অভদ্রতা না করে অয়নের কুশল জিজ্ঞেস করে চুপ করে থাকল।

অজয় যতদিন হাসপাতালে থাকল অয়ন নিয়ম করে বাবাকে দেখে যেত। হাসপাতাল থেকে ছাড়ার দিন অয়ন এসে সব বিল মিটিয়ে বাবাকে বাড়ি পেৌঁছে দিল। অজয় ছাড়ল না অয়নকে, ‘তোদের কাছে আমি অপরাধী। নিজের প্রতিজ্ঞা আমি রাখতে পারিনি। এতটাই স্বার্থপর হয়ে উঠেছিলাম যে ভুল করেও ভুলটাকে স্বীকার করিনি। আমাকে ক্ষমা করিস।’

‘মানুষের এতটা স্বার্থপর হওয়া উচিত নয় বাবা।’ অয়ন উত্তর করলে সুনন্দা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। অজয় ওকে থামিয়ে দিল। আমিও পুরোনো রাগ পুষে রেখেছিলাম। উপযুক্ত সময় দেখে মুখ থেকে বেরিয়েই গেল, ‘বউদি, তোমাদের দুজনের উচিত ছিল সংসারটাকে ধরে রাখার। ছেলে মেয়েদের মধ্যে ভেদাভেদ করা কখনওই উচিত হয়নি। সৎ বোন, সৎ ভাই এই চিন্তাটাই বাচ্চাদের মনে কেন আসবে যদি মা-বাবা সঠিক শিক্ষায় বাচ্চাদের মানুষ করে? তুমি আসতেই কেন অজয়ের ছেলে মেয়েকে নিজের সন্তান ভেবে মাতৃস্নেহে ভরিয়ে তুলতে পারোনি? অজয়কে বিয়ে করে তুমি যে সামাজিক সুরক্ষা পেয়েছ সেটা কীভাবে অস্বীকার করবে? অজয় তো তোমার সঙ্গে এমনটা করেনি। ও তোমার মেয়েকে বাবার পরিচয়ে বড়ো করেছে। ওর বিয়েতে, পৈতৃক বাড়ি বিক্রি করতেও ও পিছপা হয়নি।’ বহুদিনের জমে থাকা কথাগুলো বলতে পেরে অনেক হালকা মনে হচ্ছিল নিজেকে। ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে আমি আর অয়ন অজয়ের বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিজেদের গন্তব্যে রওনা হলাম।

খবর পেলাম অয়নের দিল্লিতে বদলি হয়েছে। বউকে নিয়ে একদিন দেখা করতে এল। জানাল পরের মাসে অজয়, সুনন্দাও ওর সঙ্গে দিল্লি যাচ্ছে। দুই তিন মাস ওখানে থেকে অয়নের সংসারটা গুছিয়ে দিয়ে কলকাতা ফিরবে। খুশি হলাম। দেরি করে হলেও সুনন্দা বউদি যে নিজেকে বদলাতে পেরেছে সেটা ভেবে আনন্দ পেলাম।

প্রতুলের দিনগুলি

‘রাধা কৃষ্ণ। রাধা কৃষ্ণ। কই গেলি রে রাধাকৃষ্ণ। চলে আয়। আমি এসেছি।’

বারান্দায় দাঁড়িয়ে রেলিঙের ভেতর থেকে হাত বের করে বিস্কুটের ভাঙা টুকরো ছড়িয়ে দিচ্ছিল প্রতুল। কিন্তু ওদের দেখা নেই। প্রতুল চায়ের কাপে চুমুক দিল। চার-পাঁচটা ঝগড়ুটে কাক আর কয়েকটা শালিক উড়ে এসে বিস্কুটের দখল নিল। চড়ুইয়ের দল নিম গাছের মাথায় চ্যাঁচামেচি করছে। বাউন্ডারিওয়াল বা পেয়ারা-নিমের ডালে কোথাও রাধাকৃষ্ণের দেখা নেই। ওরা কি আজ আসবে না! প্রতুল ভাবল, ওরা এখন এলেও কাকের দলের সাথে পেরে উঠবে না। কাক ভীষণ চালাক আর বুদ্ধিমান, শালিকও।

সেই মারাত্মক দুর্ঘটনার দুদিন পরের কথা। প্রতুল সকালে চায়ের কাপ হাতে বসেছিল বারান্দায়। একটা জড়পদার্থের মতো, নিস্তেজ হয়ে। চুমুক দিতে ভুলে গেছে। তখনই ছোট্ট বাগানের এককোণে লম্বা ঘাস আর লজ্জাবতীর আড়ালে পাখিদুটোকে নজর পড়ল। ধূসর রঙের দুটো ঘুঘু। মেয়ে পাখিটার গলায় বাদামি গোল দাগ, মনে হয় গলার হার। ঘাসের মধ্যে থেকে কিছু খুঁটে খাচ্ছিল ওরা। ছেলে পাখিটার ডান পায়ে খুঁত আছে। পা-টা ভাঁজ হয় না, হাঁটার সময় একপায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। মেয়ে পাখিটা বেশ চালাক-চতুর মনে হয়। খাবারের টুকরো বা শস্যদানা খুঁজে দিচ্ছে সঙ্গীকে। ছেলেটা ডান পা পালকে ঢেকে মাথা নীচু করে সেই শস্যদানা গিলে নিচ্ছে।

প্রতুলের মনে পড়ল ওর ভাঁজ-করা বাঁ-পা চেয়ারের ওপর, ডান-পা লম্বা করে ছড়িয়ে রেখেছে মেঝেতে। সুলেখার মৃত্যুর পর থেকে জটিল নার্ভের অসুখে ভুগে ভুগে এখন ওর দুটো হাত কাঁপে, ডান পা-টা হাঁটু থেকে ভাঁজ হতে চায় না। ছেলে পাখিটার সাথে ওর মিল আছে। একটা বিস্কুট ভেঙে বাগানে ছড়িয়ে দিতেই পাখিদুটো এগিয়ে এল। প্রথমে ও ভেবেছিল পায়রা। পরে ভালো করে দেখে বুঝল পায়রা নয়, ঘুঘু পাখি। গলা আর পেটের দিকে সামান্য সাদা, মাথার ওপরে আর ডানায় বাদামি-খয়েরি রঙের ছিটে। মেয়েটার গলার চারপাশে বাদামি গোল দাগ, রিং-এর মতো।

প্রতুল ওদের নামকরণ করল, রাধাকৃষ্ণ। সেই থেকে প্রায় তিনমাস হতে চলল ওরা নিয়মিত ওর বারান্দার সামনে আসছে। ওদের জন্য দুটো বিস্কুট বরাদ্দ। আগে কখনও ভোরবেলা এসে হাজির হতো। অত সকালে প্রতুল উঠতে পারে না।

দুটো কাক ওর দিকে তাকিয়ে গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে, বো-কা-কা, বো-কা-কা। হদ্দ বোক্বা, হদ্দ বোক্বা। বো-কা-কা।

চায়ের কাপটা এককোণে রেখে প্রতুল ভাবল, কে বোকা! কাকে বোকা বলছে ওরা! কাকগুলোও কি জেনে গেছে, প্রতুল একটা হদ্দ বোকা। ওই ঘটনার আগে ও নিজেকে বুদ্ধিমান বলে ভাবত। বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, শিক্ষিত এবং ভদ্র। বিশেষ বিশেষ সময়ে অন্যের চেয়ে নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবতে ভালোও লাগত। এখন ওর আত্মবিশ্বাসের পারদ শূন্যে নেমে গেছে। নিজের ওপর ঘেন্না ধরে গেছে।

কাকগুলো উড়ে গিয়ে বসেছে রাস্তার ওপারে সরকারদের বাড়ির ছাদের কার্নিশে। ওরা উড়ে যেতেই কয়েকটা চড়ুই কিচিরমিচির করে প্রতুলের সামনে এসে রীতিমতো অভিযোগ শুরু করে দিল। আমরা ফেলনা নাকি। আমাদের ভাগেরটা কই। সারাদিন তো আমরাই তোমার বাড়ির বারান্দায় হুটোপাটি করি। পাশে নিমের ডালে ঠোঁট ঘষি, সুখ-দুঃখের কথা বলি, বসে বিশ্রাম নিই। বাউন্ডারি ওয়ালের ওপর দিয়ে হুলোটা যখন নিঃশব্দে দৌড়ে যায়, রান্নাঘরের জানালার ভেতর উঁকি দেয়, আমরাই চ্যাঁচামেচি করি। প্রতুল ঘরে গিয়ে আবার বিস্কুট নিয়ে আসে। গ্রিলের বড়ো বড়ো ফাঁক দিয়ে চড়ুইগুলো বারান্দায় চলে আসে। একেবারে প্রতুলের হাতের কাছাকাছি। ওরাই এখন ওর বন্ধু, সময় কাটাবার, নিঃসঙ্গতা দূর করার সাথি। কিন্তু রাধাকৃষ্ণ আজ গেল কই? ওদের কি শরীর খারাপ? নাকি অন্য কিছু?

অর্চনা মোবাইল হাতে বারান্দায়, ‘অ্যাই তোমার ফোন। দ্যাখো, সুভাষদা আবার কী বলবে। টাকা-পয়সার কথা বলতে পারে। তুমি রাজি হবে না কিন্তু। আর ব্যাপারটা ভালো করে শুনে নিও। যদি সেরকম মনে করো, টাকা পয়সা কিছু দিতে হবে, তাহলে আপ-ডাউন ভাড়াটা শুধু দিয়ে দিও। কাজ শেষ করে ফিরে আসলে ফিজটা দিও।’

অর্চনা মোবাইলটা প্রতুলের হাতে দিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল। ও এখন গতকালের এঁটো বাসন মাজবে, বালতির জলে ডিটারজেন্ট মিশিয়ে বাসি কাপড় ভেজাবে, তারপর সবজি কুটতে বসবে। দুপুর একটা বেজে যাবে তাও অর্চনার কাজ শেষ হবে না।

কাঁপতে কাঁপতে একসময় ছোট্ট যন্ত্রটা থেমে গেল। প্রতুল ফোনটা রিসিভ করল না। কী বলবে ওই প্রান্ত থেকে সুভাষদা, প্রতুল অনুমান করতে পারে। অর্চনার দূর সম্পর্কের মাসতুতো না পিসতুতো দাদা, সুভাষ ঘোষ, বার অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র উকিল। হয়তো আরেকবার ফোন করবে। প্রতুল রিসিভ না করলে ল্যান্ড-লাইনে ফোন করবে। শেষে স্কুটারে চেপে নিজেই হয়তো চলেই আসবে এ বাড়িতে। লোকটাকে গত দুমাস ধরে দেখছে ও। ওর চাকরিজীবনে সেই মারাত্মক ঘটনাটা ঘটে যাবার পর, অর্চনাই পরামর্শ দিয়েছিল সুভাষদাকে ধরতে। ফোন করে এবাড়িতে ডেকে নিয়ে এসেছিল অর্চনাই। আইনি পরামর্শ পেতে। এর আগে প্রতুল কখনও লোকটাকে দেখেনি, নামও শোনেনি। লোকটির কথাবার্তা শুনে প্রথমদিনই প্রতুল বুঝে গিয়েছিল উকিলের ছোঁয়া মানেই ছত্রিশ ঘা। শুধু পুলিশে ছুঁলে তাও হয়তো বাঁচতে পারত।

এপর্যন্ত ত্রিশ হাজার টাকা খরচ করেছে ও। প্রথমে অ্যান্টিসিপেটরি বেল-এর জন্য আবেদন করেছিল লোকাল কোর্টে। সেই আবেদন নাচক করে দিয়েছে ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট। এর বিরুদ্ধে হাই কোর্টে আবেদন জানাতে হবে। সেই ব্যাবস্থাও পাকা করে ফেলেছে সুভাষদা। এখন কলকাতায় যাবে কেসটাকে মুভ করাতে। প্রতুল ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিল ভস্মে ঘি ঢালা হচ্ছে। ও চাইছিল না হাইকোর্টে কেসটা মুভ করুক। কিন্তু সুভাষদা জোঁকের মতো ওর রক্ত খেয়েই চলেছে।

আশিস, নির্মল, কল্যাণ, টিকালাল কেউ উকিলের খপ্পরে পড়েনি, একমাত্র ও ছাড়া। ভয় তো সকলেরই ছিল, এখনও আছে। সকলেই আত্মীয়-বন্ধুদের চেনাজানা উকিলদের কাছ থেকে আইনি পরামর্শ নিয়েছে, কিন্তু জড়িয়ে পড়েনি। সবাই ভয়ে ভয়ে আছে, কী হয় কী হয়। ডিপার্টমেন্টাল এনকোয়ারিতে নাকি প্রতিদিনই নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে।

যাদের জেল হাজত হয়েছে, ওদের কথা আলাদা। একজনের জায়গায় দুজন উকিল নিয়োগ করেছে কেউ কেউ। একের পর এক হেয়ারিং-এর ডেট পড়ছে, ম্যাজিস্ট্রেট আসছেন, রায় দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু জেল হাজত থেকে মুক্তি মিলছে না। স্থগিতাদেশ দিয়ে চলে যাচ্ছেন ম্যাজিস্ট্রেট। কখনও পুলিশের জোগাড় করা নথিপত্র যথেষ্ট নয়, কখনও জেলা আদালত থেকে প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানের ভিডিও রেকর্ডিং হাতে আসেনি– এইসব অজুহাতে একের পর ডেট পেরিয়ে যাচ্ছে।

প্রতিদিন নতুন নতুন তথ্য উঠে আসছে। এখন জানা যাচ্ছে, সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত পার্টির বয়ান এখনও শেষ হয়নি, প্রতিদিন নাকি নতুন নতুন পার্টি আসছে, পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাচ্ছে। জেলা আদালতের নির্দেশে সেইসব ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের বয়ানের ভিডিও রেকর্ডিং হচ্ছে মহকুমা কোর্টে। জেল হাজত থেকে মুক্তি পেতে সেইসব বয়ান খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফলে কিছুতেই জামিন হচ্ছে না চারজনের। মূল জালিয়াত বৃন্দাবন মণ্ডল সহ তিনজন আধিকারিক। দুজন সহকারী ম্যানেজার, একজন হেড ক্যাশিয়ার।

ব্যাংকের এক কোটি সাত লাখ টাকার জালিয়াতির ঘটনায় সিনিয়ার ম্যানেজারসহ ব্রাঞ্চের তেরোজন স্টাফ, সবাই সাসপেন্ড হয়েছে। ঘটনার পর প্রায় তিন মাস হতে চলল। প্রতুলের কাছে এখনও মনে হয় সবটাই স্বপ্ন। চোখের সামনে দিনের পর দিন চার ফুট দশ ইঞ্চির রোগা-পটকা একটা ছেলে কাস্টমারের লক্ষ লক্ষ টাকা জালিয়াতি করে হজম করে ফেলল, ব্যাংকের কেউ কিচ্ছুটি টের পেল না! অসংখ্য কাস্টমারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে হাতে লেখা ব্যাংকের ফিক্সড ডিপোজিট রিসিপ্ট দিয়েছে ছেলেটা, যথাযথ জায়গায় সই-সাবুদ করা রিসিপ্ট। মান্থলি ইনকাম স্কিম যাদের, তাদের অ্যাকাউন্টে মাসের প্রথমে নিয়মিত টাকা জমা পড়েছে। কেউ বিন্দুমাত্র সন্দেহ করেনি।

দৈনিক একশো কুড়ি টাকা মজুরির অস্থায়ী কর্মী বৃন্দাবন দুবছরের মধ্যে কয়েকটি গাড়ির মালিক হবার পরেও কেউ কোনওরকম সন্দেহ করল না। প্রতুল সামান্য সিঙ্গল উইন্ডো অপারেটর। কাজ শেষ হলেই বাড়ি ফেরার জন্য ছটফট করত। কে কী করছে এসব ব্যাপারে মাথা ঘামাত না। ইচ্ছেও ছিল না। কিন্তু যারা ব্যাংকের চার দেয়ালের মধ্যে বসে থেকে গাড়ির ব্যাবসা করে, শেয়ার বাজারে টাকা খাটায়, এমনকী ঠিকাদারি পর্যন্ত করে, তারা? বিকেল পাঁচটার পর যারা বোতল খুলে বসে, বৃন্দাবনকে দিয়ে কাজুবাদাম, ভুজিয়ার প্যাকেট আনায়, তারা? কারও মনে কোনও প্রশ্ন জাগল না?

বারান্দায় বসে প্রতুলের খুব মনে হয়, এরা সব কাকের দল। এ মার্ডার অব ক্রোস। ঠুকরে ঠুকরে মাংস খেল, ঠোঁট মুছে উড়ে পালাল। আর ভয়ংকর ধূর্ত সেইসব নেকড়ে আর শেয়ালের দল! ওরাই তো ব্যাংকের দণ্ডমুন্ডের কর্তা। জোনাল ম্যানেজার, চিফ অফিসার, এমনকী জেনারেল ম্যানেজার পর্যন্ত বৃন্দাবনের এসি গাড়িতে বিভিন্ন সময়ে টুর করেছে দিনের পর দিন। এয়ারপোর্টে গাড়ি পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে দার্জিলিং-গ্যাংটকে লাক্সারি হোটেল বুক করা সবটাই হতো বৃন্দাবনের সৌজন্যে। অত বড়ো মাপের কোনও অফিসার কেউ কখনও প্রশ্ন তোলেনি এই ছেলেটির আয়ের উৎস কী? বিলাসবহুল হোটেলে দামি খাদ্য-পানীয় ইত্যাদিতেই মজে থাকত। কেউ কখনও কোনও সন্দেহ করল না। অফিসে অডিটর এলে খাতা-পত্র এগিয়ে সামাল দিত বৃন্দাবনই। ‘বৃন্দাবনজি আপ’ বলে সম্বোধন করত জোনাল ম্যানেজার, প্রতুল নিজের কানে শুনেছে। তিন বছরের মাথায় বিশাল দুটি ফ্ল্যাটের মালিক। পরের বছর যাত্রীবাহী লাক্সারি বাস, নামে-বেনামে অসংখ্য জমির প্লট– এসব দেখেশুনে খোদ সিনিয়র ম্যানেজার পর্যন্ত বৃন্দাবনের সাথে সম্ভ্রমের সাথে কথা বলত। প্রতুল কিছুটা দূর থেকে এসব লক্ষ্য করত, কিন্তু কখনও ভেতরে ঢুকত না। এখন মনে হচ্ছে, প্রতুল সত্যিই ভীষণ বোকা, কমবুদ্ধির মানুষ।

বৃন্দাবনের ছুড়ে দেওয়া উচ্ছিষ্ট খেয়ে শেয়াল-নেকড়ের দল মুখ মুছে ফেলল। ওদের দোষ দেখার তো কেউ নেই। অথচ ওরাই অফিসসুদ্ধ সবাইকে সাসপেন্ড করল। প্রতুলরাই নাকি বৃন্দাবনের সাথে মিলেমিশে ব্যাংকের টাকা জালিয়াতি করেছে। ভিজিলেন্স অফিসারের সাথে চিফ অফিসার যখন ইন্সপেকশান করছিলেন, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করছিলেন কর্মীদের বাবা-মায়ের নাম তুলে।

গ্যারাজের একটা ছেলে সেদিন রাস্তায় প্রতুলকে দেখে জোরে জোরে বলছিল, ‘ওই যে লোকটা যাচ্ছে। লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ব্যাটা। এখন চাকরি গেলেই বা কী! কেমন গরুচোরের মতো মুখ করে চুপচাপ হাঁটছে লোকটা, দ্যাখ।’ প্রতুল বাজারে যাচ্ছিল সামান্য মাছ আর সবজি কিনতে। দুজন লোকের জন্য কতটুকুই আর বাজার লাগে। তবু সপ্তাহে একবার বাজারের জন্য বাড়ি থেকে বের হতেই হয়। কথাটা শুনে দপ করে মাথায় রক্ত উঠে গিয়েছিল। সেই রক্ত সহজে মাথা থেকে নামল না।

অর্চনা বলেছিল, ‘শরীর খারাপ লাগছে? ছাতা নিয়ে বাজারে যেতে পারো না? প্রেশার-সুগার চেক করিয়ে নেবে কাল-পরশু। এখন শুয়ে থাকো। একদম উঠবে না বিছানা থেকে।’

ওদের ব্যাংকে জালিয়াতির ঘটনাটা গোটা শহরে হইচই ফেলে দিয়েছিল। ওই ঘটনার পর থেকে সারাদিন বারান্দায় বসে, নয়তো শুয়েই দিন কাটছে ওর। সকালে খবরের কাগজ, বিকেলে অর্চনার সাথে বসে টিভি সিরিয়াল, নিউজ দেখা। এর বাইরে ওর কোনও কাজও নেই। অফিস কলিগদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ হয়েছে বহুদিন। বিরাট একটা সামাজিক কলঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতা মাথায় নিয়ে ও ধীরে ধীরে একটা কেঁচোর মতো মাটির নীচে চলে যেতে চাইছিল। এই শহরেই ওর রক্তের সম্পর্কের মানুষ আছে তিনজন। ওদের বাড়ি যাওয়াও বন্ধ হয়েছে বহুদিন। অর্চনাকে বিয়ের পর থেকে।

থানা থেকে ফোন করে ওকে দেখা করতে বলেছিলেন আইসি। এমনিতে ও দুর্বল মনের মানুষ, থানা-পুলিশের নাম শুনলে ভয় পায়, ঝুটঝামেলার মধ্যে নিজেকে জড়াতে চায় না। ফোনটা পেয়ে ও কাঁপতে শুরু করল। অর্চনা বার-দুই বমি করে অজ্ঞান হয়ে গেল। সুভাষদা এসে পরিস্থিতি সামাল দিল। থানার ঝামেলাটা মিটতে না মিটতেই ব্যাংকের চার্জশিট এসে হাজির প্রতুলের নামে। অন্যদের একপাতা, নয়তো দুপাতা। প্রতুলের তিনপাতা। কাজে মারাত্মক গাফিলতি, নিয়ম বহির্ভূত লেনদেনে যুক্ত থাকা, মূল অভিযুক্ত বৃন্দাবনের সঙ্গে সরাসরি লক্ষাধিক টাকার লেনদেন– চার্জশিটে এরকম চব্বিশটা অভিযোগ আছে ওর নামে। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ওর নামে।

প্রতুল ভাবছিল এবার ও কী করবে? বাঁচার বোধহয় আর কোনও রাস্তা নেই। চাকরিটা গেলে ও খাবে কী? এত খারাপ কপাল কারও হয়? ছোটোবেলা থেকেই ও দেখছে, ওর পোড়া কপাল। পৈতৃক দোতলা বাড়ি ভাড়াটে দখল করে নিল। আর ও বছরের পর বছর ভাড়া বাড়িতে কাটিয়ে দিল। দুর্ভাগ্য নিয়েই বোধহয় ও জন্মেছিল। নইলে সুলেখার সাথে ওর বিয়েটাও কেন সুখের হল না। ষোলো বছর ঘর করার পরও, সুলেখা একটা সন্তানের জন্ম দিতে পারল না। শেষদিকে ওর দুটো কিডনিই খারাপ হয়ে গেছিল, চার মাস ডায়ালেসিস-এর পর মারা গেল। আর ও মারা যাবার পর যেন দুর্যোগের ঝড়টা সাইক্লোন হয়ে দেখা দিয়েছে।

সুলেখার মৃত্যুর বছর না ঘুরতেই ও আবার বিয়ে করে বসল। প্রাক্তন শ্বশুরবাড়ির লোকজন, অফিস কলিগ, পাড়ার দুচারজন ছ্যা-ছ্যা করল। প্রতুল পাত্তা দিল না। অর্চনা মাধ্যমিক পাশ, শরীর-স্বাস্থ্য ভালো, বয়স ওর বয়সের প্রায় অর্ধেক। প্রতুল ভেবেছিল, সুলেখা ওকে যা দিতে পারেনি, অর্চনা সেটা পারবে। এবার নিশ্চয়ই একটা সন্তান আসবে। বিয়ের চার বছর হতে চলল। কিন্তু এখনও কোনও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। দুবার ডাক্তার দেখিয়ে টেস্ট করা হয়েছে। অর্চনার কোনও গন্ডগোল নেই, সবকিছুই স্মুথ। তাহলে কি দোষটা ওর? নাকি ওর ভাগ্যের!

সুলেখা বেঁচে থাকতে এই নিয়ে কম তরজা হয়নি। সুলেখার বোন সুরেখা তো একদিন রীতিমতো ঝগড়ার ভঙ্গিতে বলেছিল, ‘প্রতুলদা, দিদিকে দোষারোপ করার আগে, নিজের দোষটা দেখুন। ভুল ট্রিটমেন্ট আর ওষুধ খেয়ে খেয়ে দিদির শরীর এখন না-হয় ভেঙে গেছে। প্রথম থেকে আপনি যদি নিজের ট্রিটমেন্টটা করাতেন, তাহলে দিদিকে আজ ভুগতে হতো না।’

নিমের ডালে বসে দুটো কাক মন্থর গলায় ডাকছে, বো-কা-কা, বো-কা-কা। তাকিয়ে আছে প্রতুলের দিকেই। হদ্দ বোকা, অপদার্থ, অলস, ভীতু আর আর…? সুরেখা একদিন রেগে গিয়ে ওকে বলেছিল, ‘প্রতুলদা আপনি নিজের দোষ ঢাকতে দিদির ওপর অত্যাচার করছেন। শুধু ষাঁড়ের মতো উচিয়ে গেলেই হয় না। ভেতরে কিছু থাকতে হয়, বুঝলেন! নপুংসক একটা!’ আরও বোধহয় কিছু বলতে চেয়েছিল সুরেখা। সুলেখা ওকে থামিয়েছিল।

ইউনিয়ন চার্জশিটের সব অভিযোগের উত্তর লিখে দিয়েছে। কাগজপত্রের ফিজিক্যাল ভেরিফিকেশন শেষ হতে লাগল তিন মাস। তারপর চলল স্ক্রুটিনি, ক্রস এক্সামিনেশন। কখনও ব্রাঞ্চে, কখনও জোনাল অফিসে ওকে ছুটতে হল। সঙ্গে ইউনিয়নের লিডার, কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পরমেশ লাহিড়ি। কলকাতার লোক। এই করতেই বছর ঘুরে গেল। এখন অর্ধেক নয়, পুরো মাইনেটাই পাওয়া যাচ্ছে।

হেয়ারিং শেষ। পরমেশদা এবার কলকাতা ফিরবে। প্রতুল পরমেশদাকে একান্তে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আচ্ছা পরমেশদা, আমার বিরুদ্ধে এতগুলো মারাত্মক অভিযোগ, বাঁচার কোনও রাস্তা সত্যি আছে?’

‘ম্যানেজমেন্ট বৃন্দাবনের সাথে তোমার, তোমাদের ইনভলভমেন্টের অনেকগুলো প্রমাণ পেয়েছে। এতসব তুমি অস্বীকার করবে কী করে?’

‘কিন্তু, পরমেশদা, সত্যি বলছি, আপনি লোকাল লিডারদের কাছেও এর প্রমাণ পাবেন। অন্যদের সাথে বৃন্দাবনের যেমন ওঠাবসা ছিল, আমার সাথে কিছুই ছিল না। অন্যরা ওর গাড়ি ভাড়া নিয়ে ঘুরতে চলে যেত, টাকা ধার নিয়ে সময়মতো ফেরত দিত না, বৃন্দাবনের পয়সায় হোটেলে খেত। আমি কিন্তু কখনও ওর গাড়ি ভাড়া নিইনি, টাকাও ধার নিইনি।’

‘তার মানে এদের চোখে তুমি বোকা। সবাই তোমাকে ইউজ করেছে। বৃন্দাবনের সাথে তোমাদের স্টাফদের মধ্যে লেনদেনগুলো এমন হয়েছে যাতে পরিষ্কার ইউ আর ভেরি মাচ ইনভলভড। এনিওয়ে, এখন অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে। ভেঙে পড়লে চলবে না। এখানে একটা কথা তোমাকে বলি, ট্রেড ইউনিয়ন লড়াই করে, জিততেও পারে, হারতেও পারে। হারা-জেতাটাকে আমরা গুরুত্ব দিই না। গুরুত্ব দিলেই লড়াইটা থেমে যাবে। দরকার হলে আমরা আরও বড়ো আন্দোলনে যাব।’

রাধা-কৃষ্ণ এখনও ওর ছোট্ট বাগানে আসে বিস্কুট খেতে। কৃষ্ণের ডান-পাটা ভাঁজ হয় না, টেনে টেনে চলে। প্রতুলের মতো। ওদেরও হয়তো ছেলেমেয়ে নেই। ওদের জীবনে কি হারা-জেতা আছে? প্রতুল ভাবল, ওর চাকরিটা চলে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। চাকরিটা চলে গেলেও ও না খেয়ে মরবে না। কারণ পেনশন, গ্র্যাচুইটি নিশ্চয়ই পাবে। রেকারিং, ফিক্সড ডিপোজিটে বেশ কিছু টাকাও আছে। দুটো মানুষের আর কত চাই। দিব্যি ঘুরে ঘুরে বেড়াতে পারবে। রাধা-কৃষ্ণের মতো এদিকে-ওদিকে ঘুরে বেড়াবে। কিন্তু সোশ্যাল স্টিগমা! কলঙ্কচিহ্ন মুছবে কেমন করে! পাখিদের সমাজে কি কলঙ্কচিহ্ন আছে! ডানা ঝাপটালেই সব ক্লেদ-কলঙ্কচিহ্ন ঝরে পড়বে না!

প্রতুল ভাবল, মানুষের সমাজ মানে কী? বৃন্দাবন মণ্ডল তিন মাস পরে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। ওর বিরুদ্ধে জালিয়াতি-প্রতারণা-সরকারি টাকা নয়ছয় সহ যতগুলি ভারী ভারী কেস ছিল সেগুলি এখন তুলোর মতো হালকা। প্রতুল শুনেছে, এজন্য বৃন্দাবন সাত লাখ টাকা ছড়িয়েছে। শকুন-কাকের দলে পাউরুটি ছুড়ে দেবার মতো– ওর উকিল, অখিল ঝা-র হাত দিয়ে। আন্ডার-লাইন পাইপের জলের মতো এই টাকা ছড়িয়েছে থানার ইন-চার্জ থেকে কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত। অথচ থানার এই ইন-চার্জ প্রতুলকে মুখোমুখি বসিয়ে ঠান্ডা গলায় কী সাংঘাতিক হুমকি দিয়েছিল সাত-আট মাস আগে।

বৃন্দাবন এখন লাইন-হোটেল খুলেছে বড়ো রাস্তার পাশে। মাত্র পনেরো কিলোমিটার দূরে। বেশ ভালো ব্যবস্থা। অনেক যুব-নেতা, পুলিশের ছোটোবাবু, মেজোবাবু সন্ধে নাগাদ এই লাইন-হোটেলে বসে খানা-পিনা করেন, কিছুটা সময় কাটান। বেশি রাতে নাকি একদুজন উর্বশী-অপ্সরা আসে সেখানে, বিনোদনের অঢেল আয়োজন। এছাড়া বিরাট এক স্টেশনারি দোকান খুলেছে বৃন্দাবন পাশের শহরে।

প্রতুল বুঝতে পারল, আমাদের সমাজটাও বেশ সুশৃঙ্খল, পাখিদের মতোই। কাক-শালিকদের রুটির টুকরো ছড়িয়ে দিলেই আর সমস্যা থাকে না। ওরা দুয়ারের সামনে চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করে না, ছাদের মাথায় ঝামেলা করে না। পাড়ার সবচেয়ে মস্তান কুকুরটাও দুয়ারের সামনে পাহারা দেয়, যদি নিয়মিত দুবেলা এঁটো-কাঁটা পায়। বৃন্দাবন সুন্দর বুঝেছে এই সমাজ আর তার মানুষগুলোকে। তাই আজ ওর লাইন-হোটেলের রমরমা। এই কথাগুলো বুঝতে প্রতুলের অনেকসময় লেগে গেল।

কিন্তু ইউনিয়ন লিডার পরমেশ লাহিড়ি। সে তো এই গ্রহেরই মানুষ। পরমেশদা যা পারে, প্রতুল তার একাংশও পারে না কেন? ও একজন দুর্ভাগা লোক, হেরো লোক, এটাই কি একমাত্র কারণ? দুর্ভাগ্যের ভাবনাটা নিয়েই যে ও অনেকগুলি বছর কাটিয়ে দিল। শেষবারের মতো কলকাতা ফিরে যাবার আগে পরমেশদা ওকে কী বোঝাতে চেয়েছিল? হেরে-যাওয়াটাকে গুরুত্ব দিলে সব থেমে যাবে? কিন্তু ও তো লড়াইটা শুরুই করতে পারেনি।

সামাজিক কলঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতার বোধমুক্ত রাধা-কৃষ্ণ কীভাবে ওর ছোট্ট বাগান থেকে উড়াল দেয় কাল সকালে, দেখতে হবে মন দিয়ে।

 

ঝিলমিল

ঝিলমিল তার বাবা, মা আর প্রতিবেশী কয়েজন বন্ধুবান্ধবের সাথে সুন্দরবন বেড়াতে এসেছে। ঝিলমিল ক্লাস থ্রিতে পড়ে। স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা শেষ, তাই ধরাবাঁধা জীবনের থেকে কটা দিন মুক্তি। সবাই সহমত হয়ে জল-জঙ্গল দেখবার আকর্ষণে মেতে উঠেছে। লঞ্চের নামটাও কি সুন্দর, মালঞ্চ। টুরিস্টরা যখন ভয়ে ভয়ে পদক্ষেপ ফেলছে, ওঠানামায় সাহায্যের দরকার হচ্ছে, সেখানে পনেরো ষোলো বছরের ছেলেগুলো এ-লঞ্চ ও-লঞ্চ অনায়াসেই টপকে যাচ্ছে। যেন জলেই ওদের জন্ম হয়েছে।

গদখালি থেকে যখন লঞ্চ ছাড়ল তখন চারদিক সোনা রোদে চিকচিক করছে। বিদ্যাধরীর পাড়ে পাড়ে সুন্দরী, বাইন, হেতাল আর গর্জনের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে সবুজের হাতছানি। সবাই মনোনিবেশ করে আছে যদি দক্ষিণরায়কে দেখা যায় কিন্তু তাকে দেখা তো সৌভাগ্যের ব্যাপার। একটা বাজপাখি ছোঁ মেরে একটা মাছকে ওঠাতেই ঝিলমিল হাততালি দিয়ে বলে উঠল, আরে দ্যাখো দ্যাখো বাজপাখি এখন জেলে হয়ে গেছে।

উঁচু ক্লাসে পড়া রাহুল বিবেচকের মতো বলল, আরে ওটা ওদের খাদ্য খাদকের সম্পর্ক। মাছ খাদ্য আর বাজপাখি খাদক। ঝিলমিলের মা ঝলমলে হাসি হাসতে হাসতে বললেন, ওই দ্যাখো কাকের কাণ্ড দ্যাখো। বাজপাখির নেওয়া মাছটা ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল! রাহুল বিজ্ঞের মতো বলল, প্রকৃতির বুকে আন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম চলছে।

এই সবকিছুর মাঝে টুর কোম্পানির রান্নার বউ কমলা ওদের জন্য গরম ভাতের সঙ্গে ঝুরি আলুভাজা, মুগডাল, চিকেন কষা আর টম্যাটোর চাটনি রেঁধে ফেলেছে। লঞ্চের ডেকের ওপর সুন্দর আযোজনে লাঞ্চ সারা হল। সবাইকে খাইয়ে সার্ভিস বয় মিঠুন সবার অনুরোধে নদী আর বনবিবিকে নিয়ে লোকসঙ্গীত গাইল। ওর অকৃত্রিম মেঠো সুর সবাই খুব উপভোগ করল।

পাখিরালয়ে পাখিরা হোটেলে সবার থাকার ব্যবস্থা। ওখানে পৌঁছোতে পৌঁছোতে সন্ধে নেমে গেল। পলিতে জল পড়ে জায়গায় জায়গায় পিচ্ছিল, ওরকম একটা রাস্তা পেরিয়ে পা টিপে টিপে সন্তর্পণে ঝাঁ চকচকে একটা হোটেলে পৌঁছোনো গেল। সবার ছোটো দিব্য আর ঝিলমিল তো ঘুমিয়ে কাদা। হোটেল ম্যানেজারের উষ্ণ অভ্যর্থনায় সবার মন ভরে গেল। তবে রান্নার দাযিত্ব সেই কমলা আর ওর স্বামী ফটিকের।

সন্ধেবেলায় সুন্দর সময় কাটানোর জন্য বসল বাউল-গানের আসর। চরম দারিদ্র‌্যের মধ্যে থেকেও গানের কলিতে ওরা আপ্রাণ ফুল ফোটানোর চেষ্টা করে গেল। চারদিকে ঝিঁঝি পোকার ডাক আর পূর্ণিমার আলোয় সে বাউল-গান, মনে হচ্ছিল স্বর্গীয় সুরধ্বনি।

ছোট্ট দিব্য বেশ চাঙ্গা হয়ে বাউলদের নাচের দলে ভিড়ে গেল। দিব্যর বাবা ছেলের নাচের ভিডিও তুলছেন। কমলাও এসে দাঁড়িয়েছে, ওর কোলে তার আট মাসের সন্তান নয়ন। রুজির তাগিদে ওদের সপরিবারে জলে ভেসে থাকা।

রাতে কাঁকড়ার ঝোল মেখে ভাত খেতে খেতে রাহুল মস্করা করল, বুঝলে সবাই আমরা সর্বোচ্চ সারির খাদক তথা সর্বভুক। ডাল আলুভাজাও খেলাম, আবার কাঁকড়াও খাচ্ছি। সকলে এ বিষয়ে ওর সঙ্গে সহমত হল।

দিব্য আর ঝিলমিলকে তাদের মাযেরা ভাত মেখে খাইয়ে দিচ্ছে। বাইরে দরজার কাছে একটা নেড়ি আর তার বাচ্চা লেজ নেড়ে নেড়ে খাওয়ার দৃশ্য দেখছে। দিব্যর বাবা কিছুটা মাখা ভাত নিয়ে নেড়িকে খাওয়াতে গেলে, দিব্য আর ঝিলমিলও খাওয়া ফেলে ছুটল। সব বাচ্চার মতো দিব্য আর ঝিলমিলও পশুপাখি ভালোবাসে।

নেড়ি ভাত খাচ্ছে, ঝিলমিলরা নেড়ির বাচ্চাকে আদর করছে। খাওয়া শেষ হতে যে যার রুমে ফিরল। শীতটাও বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। কমলা, ফটিক, মিঠুন আগুন জ্বালিয়ে তার পাশে আগুন পোহাচ্ছে। দিব্য আর ঝিলমিলের সে দৃশ্য দেখারও ইচ্ছে ছিল, মায়ের বকুনি খেয়ে ফিরতে হল।

পরদিন সকালে কুয়াশা কেটে গেলে ওদের গন্তব্য হবে সুধন্যখালি, যেখানে সাতটা নদী এসে মিশেছে। শরীরের ক্লান্তি আর পরদিন ভোর ভোর ওঠার তাড়ায় সবাই ঘুমোতে গেল।

ঝিলমিল মায়ের কোল ঘেঁষে বালিহাঁসের ডাকে চমকে চমকে উঠছিল। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে ওর বাবা পরেশ সেনের নাক ডাকা। মায়ের আদরের থাবড়ানিতে ঝিলমিল ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ঝিলমিল জলের স্বপ্ন দেখল, সে যেন একা একটা নৌকায় কোথায় ভেসে যাচ্ছে।

 

পরদিন কুয়াশা না কাটতে মিঠুন এসে জানিয়ে গেল তাড়াহুড়ো করতে হবে না, লঞ্চ সকাল দশটার আগে ছাড়বে না। অতএব সবাই বেরোল স্থানীয় বাজারে মধু কিনতে আর খেজুরের রস খেতে। সুন্দরী, বাইন আর গর্জনের ছোটো ছোটো চারাও পাওয়া যাচ্ছিল। দিব্যর খুব ইচ্ছে ওই চারাগুলো দিয়ে ওদের কলকাতার ফ্ল্যাটে একটা জঙ্গল বানায়। অনেক করে বোঝানোর পর একটা খেলনা বাঘ হস্তগত করে ওর বায়না থামল।

সুন্দরবনে মধুরই মাহাত্ম্য, তারল্য বেশি খাঁটি মধু। আর একে সংগ্রহ করতে গিয়ে ওদের পরিবারে কতই না বিষাদের ইতিহাস। কখনও সাপের কামড়ে, কখনও কুমীরের কবলে কখনও বা বাঘের পেটে চলে যাওয়া। অনায়াসে সবকিছু পাওয়ার জীবন ওদের নয়, বড়ো কষ্টের ওদের যাপন।

পরেশ সেনদের গোটা দলটাই ফেরিঘাটে লঞ্চে উঠল। সকালের জলখাবারে ছাতুর কচুরি আর কাবলি চানার ঘুগনি। ডেকের ওপর নদীর শোভা, লঞ্চ-জাহাজের যাতায়াত দেখতে দেখতে খাওয়া এক অনন্য অনুভূতি। দিব্য একটা কচুরি নিয়ে হাঁ করে বসে রইল। ঝিলমিলকে আজ বেশ চনমনে লাগছে, রাহুল যথারীতি প্রাজ্ঞ, অনুসন্ধিৎসু।

প্রায় দু-ঘন্টা নদীবক্ষে ভেসে থাকার পর এল দোবাঁকি। প্রত্যেকেরই আশা যদি হঠাৎ করে দক্ষিণরায়কে দেখা যায়। কারণ এখানে হোগলা আর হেতালের মাঝে একটা বড়ো পানীয় জলের জলাশয় আছে। আহা কি অপূর্ব, সেই জলাশয় ঘিরে চিতল হরিণ আর বালি হাঁস বিচরণ করছে। দিব্য হাততালি দিয়ে খুশিতে বলে উঠল, কত হরিণ, একটা বাড়ি নিয়ে যাব, পুষব!

দলের প্রধান খাদ্যরসিক মন্ডলদা বলে উঠলেন, হরিণের মাংস দারুণ স্বাদের, একসময় কত খেয়েছি। দিব্য আর ঝিলমিলের একটুও পছন্দ হল না মন্ডলকাকুর কথা। প্রাণভরে ছবি তুললেন ঝিলমিলের বাবা। অনেকগুলো লঞ্চ একসঙ্গে আসায় বেশ ভিড় জমে গেছে। শান্ত প্রকৃতি এই কোলাহলে বিরূপ হচ্ছে, তবুও সইতে হচ্ছে। একটা জিনিস ভালো লাগার মতো যে, কেউ এদিক ওদিক ময়লা ফেলছে না।

ঝিলমিল একবার জঙ্গল, একবার হরিণের দল আর নদীর দিগন্ত জোড়া বিস্তৃতির দিকে তাকিয়ে বিহ্বল হয়ে পড়ছে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে নেমে সবাই লঞ্চে ফিরে এল। এবারের গন্তব্য ঝড়খালি।

লঞ্চে পাঁঠার মাংস, ভাতের বিপুল আযোজন কমলার কল্যাণে। অসম্ভব সুন্দর স্বাদে সবাই পরিতৃপ্ত। দিব্য আর ঝিলমিল তাদের পছন্দের মাংসের মেটে পেয়ে গেছে, ওদের আর পায় কে!

ঝড়খালিতে পুনর্বাসন কেন্দ্রে বুড়ো অসুস্থ বাঘ দেখে ঝিলমিলের মন খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে গডের কাছে ওদের জন্য অনেক প্রে করল। কুমীর দেখে সবাই খুব খুশি হল, কারণ ওদের বেশ চনমনে লাগছিল। পাখিরালয়ে ওদের হোটেলে ফিরতে রাত হয়ে গেল।

প্রতিদিনের মতো আজ ঝুমুর নাচের ব্যবস্থা। কী সুন্দর স্থানীয় মহিলারা নাচল সেই শ্রমসাধ্য নাচ! কাহিল হয়েও মুখের হাসিটুকু ধরে রাখল। দিব্য, ঝিলমিল, রাহুল, এমনকী দিব্য আর রাহুলের মা-ও নাচে অংশ নিল ওদের ডাকে। খুশি হয়ে যে যা দিল তাই নিয়ে ওরা হাসিমুখে চলে গেল।

ওরা বাড়ি ফিরবে কেউ পায়ে হেঁটে কেউ বা সাইকেলে। ঝিলমিল কমলার বাচ্চাকে কোলে তুলতে চেষ্টা করছে আর সে মায়ের কাছে থাকবে বলে প্রাণপণে চ্যাঁচাচ্ছে। কমলার হাতের পারশের ঝাল খেয়ে হাত চাটতে চাটতে সব পরিতৃপ্তির ঢেকুর তুলছে। সবার এই পরিতৃপ্তিটুকু কমলা উপভোগ করছে।

পরদিন সকাল নটা নাগাদ সবাই হোটেল ছাড়ল। ফিরতে হবে, তাই সবার মন খারাপ! ডেকের ওপর যে-যার মতো গল্প করছে। দূরে বকের সারি, জলের স্রোত, আকাশের ছড়ানো রোদ সবাই যেন বিদায় জানাচ্ছে। বাতাস কানে কানে বলে যাচ্ছে আবার এসো কিন্তু। বকশিশের টাকা হাতে করে কমলার চোখেও জল। দিব্য, ঝিলমিল মিঠুনের দুপাশে জমিয়ে বসে জল-জঙ্গল, রয্যাল বেঙ্গল টাইগার আর বনবিবির গল্প শুনছে।

গদখালি পৌঁছোতে প্রায় চার পাঁচ ঘন্টা লেগে যাবে তাই লাঞ্চের ব্যবস্থা লঞ্চেই। কমলা ওর কচিটাকে নিয়ে ব্যস্ত রান্নায়। লঞ্চ চালাচ্ছে যে-ছেলেটা ওর চোখেমুখেও বাড়ি ফেরার ছটফটানি। ইঞ্জিনের ঘড়ঘড় শব্দ শোনা যাচ্ছে, জোয়ারের টানও ভালো আছে তাই লঞ্চ তরতরিয়ে চলেছে।

 

হঠাৎ একটা ঝুপ শব্দ। আরে ঝিলমিল পড়ে গেল যে জলে, সবার মিলিত আর্তনাদের মাঝে ‘মা মা গো আমি ডুবে যাচ্ছি’।

কমলা সেই ডাক শুনে এসে কোলের ছেলেটাকে নামিয়ে রেখে ঝাঁপ দিল জলে। সবাই আতঙ্কিত, কমলা জল তোলপাড় করে ফেলছে, হ্যাঁ হাতে একটা কিছু ঠেকল ওর, আরে এ তো ঝিলমিলের চুল। তাই ধরেই টেনে তুলল কমলা, নিজের সঙ্গে ভাসিয়ে নিয়ে চলল। হ্যাঁ কমলা পেরেছে ঝিলমিলকে জলে ডুবে যাওয়ার থেকে বাঁচাতে।

ডেকের ওপর ওঠানোর পর মিঠুন ঝিলমিলের গিলে ফেলা জল ওকে শুইয়ে চাপড় মেরে মেরে বার করল। একটু সুস্থ হতে ঝিলমিলকে গরম দুধ খাওয়ানো হল কিন্তু আতঙ্কে ও পুরোপুরি ট্রমাটাইজড। ঝিলমিলের মা এখনও কেঁদে চলেছে। ফেরার অভিজ্ঞতা সকলের জন্য ভীষণ খারাপ হল।

কমলা সকলের খাওয়ার বন্দোবস্ত করল, ও যে এত বড়ো একটা কাজ করল তা ওর মুখ দেখে এখন বোঝবার উপায় নেই। খাওয়াদাওয়া মিটলে ঝিলমিলের বাবা কমলাকে কিছু টাকা দিতে চাইলেন। কমলা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, আমার ছেলে যদি জলে পড়ে যেত, আমি কি ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করতাম না! সেরকমই তো, মাফ করবেন আমায়। এ টাকা আমি নিতে পারব না। কমলার ওপর কৃতজ্ঞতায় সবার অন্তর ভরে ওঠে।

তুমি আমার যে-উপকার করলে, তা সাত জন্মেও শোধ করতে পারব না, বলে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে ঝিলমিলের মা। কমলা শান্ত ভাবে বলে, এতে উপকারের কিছু নেই। আপনারা আবার এখানে বেড়াতে আসবেন আর আশীর্বাদ করুন আমার নয়নকে যেন ঠিকমতো মানুষ করতে পারি।

ঝিলমিল ওর কানে এখনও জলের গর্জন শুনছে আর কমলামাসিকে মিঠুনদার গল্পের বনবিবির মতো লাগছে, যে তাকে উদ্ধার করছে।

 

সুন্দরবনের ঘটনার পর অনেক বছর পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে পরেশবাবু সপরিবারে অনেকবার এসেছেন সুন্দরবনে। মালঞ্চ লঞ্চটা খুঁজে পেলেও কমলাকে আর খুঁজে পাননি তাঁরা। বিশেষ করে মায়ের কাছে ওই দুর্ঘটনার বিবরণ বারবার শুনতে শুনতে কমলাকে দেবীর আসনে বসিয়ে রেখেছে ঝিলমিল। যার জন্য সে পঁচিশটা বসন্ত পার করতে পেরেছে, না হলে তো দুর্গাদোয়ানি নদীতে কবেই ওর সলিলসমাধি ঘটে যেত।

কমলামাসির মুখটা ঝিলমিলের হালকা মনে পড়ে, তার চেয়ে বেশি মনে পড়ে জলের মধ্যের সেই দমবন্ধ পরিবেশ, যা অনেক দিন ওকে তাড়া করেছিল।

ঝিলমিল এখন ডাক্তারির চূড়ান্ত বর্ষের ছাত্রী। কত জলে ডোবা রোগী আসে। কাউকে বা আনা হয় মৃত অবস্থায়। তখন ঝিলমিল আঁতকে ওঠে! মনে মনে ভাবে তারও তো এই অবস্থা হতে পারত, হয়নি যে তা ঈশ্বরের নয় কমলামাসির দান।

ঝিলমিল ভাবে, এবারে যে করেই হোক কমলামাসিকে খুঁজে বের করতেই হবে। নিশ্চয়ই এখন বয়স হয়ে গেছে, একবার দেখা করতেই হবে। তার ভাবনায় ছেদ পড়ে, ঝিলমিলদি একবার আসুন ডাক্তার কনক বসু আপনাকে তাড়াতাড়ি ডাকছেন। বলেই সিস্টার বোস ছুট লাগালেন।

ঝিলমিল ডাক্তার কনক বসুকে খুঁজতে খুঁজতে এমার্জেন্সিতে হাজির হল। আরে এখানটা এত লোকে লোকারণ্য কেন? মানিকতলায় একটা মেলা চলছে, সেখানে গ্যাস বার্স্ট করে কয়েজন অগ্নিদগ্ধ হয়েছে তাদেরকে আনা হয়েছে ঝিলমিলের হাসপাতালে।

সেই ভিড় থেকে একজন বয়স্ক মানুষ ঝিলমিলের দিকে এগিয়ে এল। তুমি ঝিলমিল দিদিমণি না, আমাকে চিনতে পারছ? আমি কমলার স্বামী ফটিক, সেই তুমি সুন্দরবন বেড়াতে এসে জলে ডুবে যাচ্ছিলে মনে আছে?

কমলামাসি কোথায়? ঝিলমিলের মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল কথাটা। ফটিক ইশারায় মেঝের বিছানায় শুয়ে থাকা অর্ধদগ্ধ এক মহিলাকে দেখাল।

অগ্নিকাণ্ডে কমলা মারাত্মক জখম হয়েছে তাদের মেলায় দেওয়া চপের দোকানে। ঝিলমিল আর অপেক্ষা করেনি, চেষ্টা করে কেবিনে ভেন্টিলেশনে রেখে চিকিৎসা করছে কমলামাসির। মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে চলেছে ঝিলমিল, নয়নের মাকে যেন নয়নের কাছে ফিরিয়ে দিতে পারে। যেমন করে একদিন কমলামাসি ফিরিয়ে দিয়েছিল ঝিলমিলকে তার মায়ের কোলে।

 

শিকার

শেষ রাতের আবছা অন্ধকার। লোকটা এক বুক ঘৃণা আর আদিম এক প্রতিশোধস্পৃহা নিয়ে বন্দুকটা ভালো করে আঁকড়ে ধরে। আজ সে দৃঢ়সংকল্প। খতম করবে ওই নোংরা লোভী আর তস্কর জীবটাকে! তার হাত থেকে নিস্তার নেই বাছাধনের।

দিন দিন ওর সাহস বেড়ে যাচ্ছে। পোলট্রির অর্ধেক মুরগির বাচ্চা খেয়ে সাবাড় করেছে এই ক’দিনে। এভাবে চললে পোলট্রির সব মুরগি অচিরেই শেষ হয়ে যাবে। আর তার এতদিনের লাভবান ব্যাবসা বন্ধ হয়ে, সে দারিদ্র্যের অন্ধকারে ডুবে যাবে। তাই আজ একটা শেষ নিষ্পত্তি সে করবেই!

ভোর হবার এখনও অনেক দেরি। অপেক্ষায় প্রহর গুনতে গুনতে লোকটার স্নায়ুগুলো কিঞ্চিৎ শ্লথ। আর কিছুক্ষণ পরেই পুবদিকের আকাশ হালকা হবে। আর হালকা হলেই সে বেরুবে রোজকার মতো।

মুরগির বাচ্চাগুলো কারা যে খেয়ে যাচ্ছে তা প্রথমে বুঝতে পারেনি লোকটা। বহু ঘুমহীন রাত অপেক্ষা করে ওত পেতে শেষে সে বুঝতে পারে শিয়াল না, খটাশ না একটা কালো হুতুম পেঁচাই ঘাতক। তার সমস্ত মুরগির বাচ্চা খেয়ে যাচ্ছে।

আরও কিছুদিন অপেক্ষা করার পর লোকটা জেনেছে পোলট্রির পেছনে কিছুটা দূরে যে বুড়ো খিরিশ গাছটা আছে তার একটা উঁচু মোটা ডালের কোটরে সে থাকে। ওরা দুজন। একটা ছেলে অন্যটা মেয়ে পেঁচা।

এতক্ষণে পুবদিকের আকাশ ফিকে হতে শুরু করেছে। একটা লালের আভা। এবার পেঁচাটার বেরুবার সময়। আবছা অস্পষ্টতার বুক চিরে একটা বিশ্রি কর্কশ ডাক ভেসে এল। শয়তান পেঁচাটার ডাক। লোকটা সতর্ক হয়। হাতের মুঠোর বন্দুকটা শক্ত হাতে চেপে ধরে। এবার সে ওই ধূর্ত লোভী শঠ পেঁচাটাকে নির্দয়ভাবে মারবে। তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেবে, তার সীমাহীন অপরাধ আর কৃতকর্মের জন্য।

পেঁচাটা তার কোটর থেকে বেরিয়ে পড়েছে। সন্তর্পণে পাখনাটা মেলে সে উড়ে আসছে, পোলট্রি ঘরের চালার মাথায়। যতটা শব্দ কম করা যায় সেইভাবে নিঃশব্দে উড়ে আসছে। এই আবছা অন্ধকারে উড়ন্ত টার্গেটকে গুলি করা মুশকিল। তবুও লোকটা আজ বদ্ধপরিকর। ঠিক তার মাথার ওপর দিয়ে কালো ছায়াটা যখন উড়ে যাচ্ছে, তখনই বন্দুকের ট্রিগারটা সে টিপে দিল অনেকটা আন্দাজে। নিশানা ব্যর্থ হয়েছে মনে হয়। কারণ মাটিতে আছড়ে পড়ার কোনও শব্দ বা ডানার ঝাপটানি তার কানে যায়নি।

পুব আকাশ আরও অনেকটা ফর্সা হয়েছে। লোকটা পায়ে পায়ে পোলট্রি ফার্মের দিকে এগোল। মুরগির বাচ্চাগুলো ঠিক আছে কিনা একবার গুনে এল। চারপাশটা তন্ন তন্ন করে খুঁজল কিছু পড়ে আছে কিনা। আর ঠিক সেই সময় কাছে কোথাও ডানা ঝাপটানোর শব্দ কানে এল। প্রাণীটা মাটিতে পড়ে কাতরাচ্ছে। লোকটার মন আনন্দে ভরে গেল। যাক তাহলে নিশানা ব্যর্থ হয়নি। শিকার গুলি খেয়েছে। অব্যক্ত বর্বর এক জিঘাংসায় তার মন ভরে গেল।

কাছে গিয়ে লোকটা দেখল, পেঁচাটা বেশ বড়ো সাইজের। মাটিতে পড়ে ডানা ঝাপটাচ্ছে। বৃথা চেষ্টা করছে ওড়বার। ওর ধূসর রঙের ডানা দুটোর একটাতে গুলি লেগেছে। সে ডানাটা অকেজো হয়ে দেহ থেকে ঝুলছে। সারা ডানাটা মাটি আর রক্তে মাখামাখি। ওর বিশ্রি গোল মুখের হলদেটে চোখদুটোতে যন্ত্রণার চিহ্নমাত্র নেই। লোকটা দেখল, সে চোখে হিংস্র একটা বিদ্বেষ আর ক্রোধ জমা হয়েছে।

এখন আর আলো আঁধারির অস্পষ্টতা নেই। পরিষ্কার ভোর। আর সেই ফুটে ওঠা ভোরের আলোয় পেঁচার সঙ্গে মানুষের প্রথম দৃষ্টি বিনিময় হল। দুজনের চোখে বিজাতীয় হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষ আর জিঘাংসা কাজ করছে। কিন্তু লোকটার চোখে অতিরিক্ত কিছু একটা ছিল। তা হল শত্রু নির্যাতনের উৎকট আনন্দ আর পরিতৃপ্তি!

আহত প্রাণীটির দিকে তাকিয়ে অপরিসীম ঘৃণা আর তাচ্ছিল্যের সঙ্গে লোকটা বলে উঠল, ‘কিরে কেমন জব্দ! কেমন লাগল গুলি খেতে? আর একটা গুলি খাবি?’

পেঁচাটা তার ভালো ডানাটা ঝাপটে মাটি থেকে একটু ওঠার চেষ্টা করল। কিছুটা উঠেই আবার পড়ে গেল মাটিতে। পেঁচাটার এই ব্যর্থতা ও হতাশা দেখে লোকটা জোরে শব্দ করে হেসে ওঠে বিশ্রি অঙ্গভঙ্গি করে।

এবার গলা বাড়িয়ে রাগে পেঁচাটা তেড়ে আসে লোকটার দিকে। তার পায়ের জুতোয় ঠোঁট দিয়ে জোরে ঠোক্বর মারে। লোকটা লাথি মেরে পেঁচাটাকে দূরে ফেলে দেয়। অসহায় ভাবে মড়ার মতো কিছুক্ষণ চুপ মেরে থাকে পেঁচাটা।

লোকটা একবার বন্দুক দেখায়। পেঁচাটার চোখে ভয়ের লেশমাত্র নেই। বন্দুকের নলটা তার পেটের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে খোঁচা দেয়। পেঁচাটার হলদে চোখদুটোতে শুধু জ্বালা। অসহায় আক্রোশ! কিন্তু ভয় কোথাও নেই।

প্রচণ্ড রেগে গেল এবার লোকটা। তার অহংকারে ঘা লাগল। সে মনে মনে স্থির করে ফেলল, এটাকে সে এখনই মারবে না। একে বাঁচিয়ে রেখে তিলে তিলে যন্ত্রণা দেবে। যেমন কষ্ট সে পেয়েছে এত দিন। নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে দুশ্চিন্তা আর দুর্ভাবনা নিয়ে। তেমনি করে একে দগ্ধে দগ্ধে যন্ত্রণা দিয়ে এর পাপের শাস্তি দেবে। এর ঔদ্ধত্য আর দম্ভকে চিরতরে ভেঙে দেবে!

জখম ডানাটা এড়িয়ে অন্য ডানাটা ধরে সে পেঁচাটাকে তুলতে গেল। আর ঠিক তখনই প্রচণ্ড আক্রোশে পাখিটা তার তীক্ষ্ণ নখ লোকটার হাতে বসিয়ে দিল। চামড়া ভেদ করে সুচলো নখ মাংসের অনেক গভীরে ঢুকে গেল। লোকটা যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল। যতই সে চেষ্টা করে পেঁচাটাকে ফেলে দিতে, বিচ্ছিন্ন করতে তার শরীর থেকে, ততই তাকে আরও জোরে আঁকড়ে ধরে। আঁচড়াতে কামড়াতে থাকে। লোকটার হাত থেকে রক্ত ঝরে। পেঁচাটার পালকে রক্ত। লোকটা এবার চেঁচাতে থাকে। শাপশাপান্ত করে। তার একবার মনে হয় গিয়ে দেয়ালের গায়ে জোরে আছাড় মারে জীবটাকে। পরক্ষণেই তার মনে পড়ে নিজের প্রতিজ্ঞার কথা। একে সে সহজে মারবে না। বাঁচিয়ে রেখে যন্ত্রণা দেবে। তারপর পরিশেষে চরম শাস্তিদান।

এবার সে দুটো হাত দিয়ে পেঁচাটাকে চেপে ধরে শক্ত করে। তারপর তার মুখে একদলা থুতু ছেটাল। পাখিটা বার দুই চোখ পিট পিট করল। কিন্তু ভয় পেল না একটুকুও। লোকটা রাগে কাঁপতে কাঁপতে তার ফার্ম হাউসের বারান্দায় এক কোণে ঝোলানো একটা বড়ো লোহার খাঁচায় পেঁচাটাকে ঢুকিয়ে মুখটা বন্ধ করে দিল।

পেঁচাটাকে খাঁচাবন্দি করার পর লোকটা কিছুটা শান্ত হল। বন্দুকটা যথাস্থানে রেখে এল। তারপর জল দিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফার্স্ট-এড বক্স বের করে আনল। প্রথমে সে রক্তাক্ত পাখিটার ডানা পরিষ্কার করে ওষুধ লাগিয়ে দিল। তারপর নিজের হাতেও অ্যান্টিসেপটিক ক্রিম লাগাল। ব্যান্ডেজ বাঁধল।

সেদিন বিকেলে কাছের শহর থেকে কয়েকজন খদ্দের মুরগি কিনতে এল তার পোলট্রি ফার্মে। খাঁচার মধ্যে পেল্লাই ওই পেঁচাটাকে দেখে তো তারা তাজ্জব। জিজ্ঞেস করল, ‘এটাকে ধরলে কী ভাবে?’

লোকটা তার খদ্দেরদের কাছে পেঁচাটার যাবতীয় কীর্তিকলাপ খোলসা করে বলল। ব্যান্ডেজবাঁধা হাতটাও দেখাল। সব শুনে খদ্দেরদের মধ্যে একজন বলল, ‘এখন এটাকে নিয়ে কী করতে চাও?’

জবাবে লোকটা তৎক্ষণাৎ উত্তর দিল, ‘আমার হাতটা আগে ভালো হয়ে যাক। তারপর এটাকে গুলি করে মারব। পায়ের নখগুলো কেটে চোখের সামনে ঝুলিয়ে রাখব স্মৃতি হিসেবে।’

পোলট্রি মালিকের মুখে এধরনের কথা শুনে খরিদ্দার লোকটির মনে দৃঢ় ধারণা হল, মুরগির বাচ্চার শোকে ভদ্রলোকের মাথার ঠিক নেই। সে আর কথা না-বাড়িয়ে চলে গেল।

টুকিটাকি কিছু কাজ শেষ করে লোকটি আবার পেঁচাটার খাঁচার কাছে এল। খাঁচাটার দিকে তাকাতে তার গা রিরি করে উঠল রাগে। দেখল, পেঁচাটা তার দিকে স্থির ভাবে চেয়ে আছে। পায়ের নখ দিয়ে খাঁচার গা আঁকড়ে ধরে আছে। লোকটা রেগে গিয়ে খাঁচাটা নামিয়ে নীচে বসাল। তারপর জোরে লাথি কষাল। পেঁচাটা ছিটকে পড়ল মেঝেতে। তার চোখে অতলান্ত ঘৃণা।

সেদিন সারারাত লোকটা শুনতে পেল পেঁচাটা তার সাথিটাকে ডাকছে। ওপাশে গাছের আড়াল থেকে সাড়াও আসছে। লোকটার মনে খুব আনন্দ হল পেঁচাটাকে জ্যান্ত ধরতে পেরেছে বলে।

পরদিন সকালে উঠে লোকটা খাঁচার কাছে গেল। আজও সে পেঁচাটার চোখে কোনও ভয় দেখল না। আর সে জন্য সে হতাশ হল। হতাশা তাকে এক সময় ক্ষিপ্ত করে তুলল। সে চিৎকার জুড়ে দিল। ‘দাঁড়া, দাঁড়া। সবুর কর। আমি তোকে ভয় পাইয়েই ছাড়ব।’

লোকটা খাঁচাটা মাটিতে নামাল। খাঁচার বাইরে জল রাখল। খাবার হিসেবে একটা ছোট্ট মুরগির বাচ্চা। খাঁচার খুব কাছে কিন্তু পাখিটার নাগালের বাইরে। পেঁচাটা নির্বিকার চোখে সব দেখল। ক্ষুধা আর তৃষ্ণায় সে কাতর। তবু লোকটার চালাকি সে ধরে ফেলেছে। ভয় বা কাতরতা তাকে গ্রাস করল না। সে একটা বড়ো তাচ্ছিল্য খাঁচার বাইরের লোকটার দিকে ছুড়ে দিল।

এরপর আবার একদিন মুরগি কিনতে এক খদ্দের এল। ইনি বেশ সম্ভ্রান্ত। মনে হয় অপেক্ষাকৃত বড়ো ব্যবসায়ী। লোকমুখে পেঁচাটার কথা শুনে তিনি লোকটার কাছে প্রস্তাব দিলেন, ‘আপনি পেঁচাটা আমাকে পাঁচশো টাকায় বেচে দিন। এতবড়ো সাইজের পেঁচা সাধারণত পাওয়া যায় না। রেয়ার। তাছাড়া আমার এজাতীয় রেয়ার পাখিদের একটা কালেকশন আছে। আমি নিজেকে ভাগ্যবান ভাবব, যদি ওটা আমাকে বেচেন।’

লোকটা ব্যাজার মুখ করে বলল, ‘না মশাই। মাফ করবেন। আমি ওকে হাতছাড়া করতে চাই না।’

ক্রেতা ভদ্রলোক ভেবে নিলেন, বোধহয় দাম পছন্দ হয়নি। তাই সে রাজি হচ্ছে না বেচতে।

‘আচ্ছা বেশ, আমি আপনাকে সাতশো টাকা দেব। তাহলে দেবেন তো?’

এতেও লোকটা রাজি হল না। ‘না, মাফ করবেন। আমি ওকে বেচব না।’

‘কিন্তু কেন? আমি যদি হাজার দিই?’

‘তাহলেও না। হাজার কেন, পাঁচ হাজার দিলেও না। ওটার জন্য আমার হাতের অবস্থা দেখেছেন? টিটেনাস ভ্যাকসিন নিতে হয়েছে। আমার ফার্মের অর্ধেক মুরগির বাচ্চা ও খেয়ে ফেলেছে।’

‘বেশ তো, বুঝেছি। ও আপনার অনেক ক্ষতি করেছে। কিন্তু ভেবে দেখুন, ও তো অবুঝ পাখি একটা। ও খিদের জ্বালায় আপনার ফার্মে ঢুকে মুরগির বাচ্চা খেয়েছে। অন্যায় তো কিছু করেনি। খাদ্য-খাদক সম্পর্ক। তাছাড়া অমন সুন্দর দেখতে’ –

লোকটার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। – ওই শয়তান পাখিটাকে আপনি বলছেন সুন্দর দেখতে! কি বিশ্রি চোখ ওর। ওকে আমি গুলি করে মারব।

‘তা হোক। রাগের মাথায় বোধবুদ্ধি হারিয়েছেন। একটা পাখিকে কেন অযথা গুলি করে মারবেন?’

‘মারব, মারব, নিশ্চয়ই মারব। ও আমার বড়ো শত্রু। নিজের হাতে ওকে শাস্তি দেব। আপনি এখন যান’-

বেচারা ভদ্রলোক বেগতিক দেখে কেটে পড়ে।

লোকটা এবার দিন গোনে। কবে ওকে খতম করবে। খতম করার আগে ওর মনোবল ভাঙতে হবে। ও আজকাল কিছুই খায় না। খাবারের দিকে তাকায় না। অথচ একদৃষ্টে লোকটার দিকে চেয়ে থাকে। যখন সে খাঁচার কাছে আসে পেঁচাটা একটা বিদ্রুপাত্মক দৃষ্টি ছোড়ে।

লোকটার মাথায় এক নতুন মতলব আসে। সেও আরও হিংস্র আরও ভয়ংকর প্রতিশোধ নিতে চায়। পুরুষ পেঁচার মেয়ে সঙ্গীটি আজকাল প্রায়শই খাঁচার আশপাশে ঘোরাঘুরি করে। কখনও দূরে পাঁচিলটার উপর এসে বসে। খুব সকালে কিংবা সন্ধের দিকে প্রায়ই ডাকে। কিন্তু পুরুষটি তেমন ভাবে সাড়া দেয় না। ভাবটা যেন একদম এদিকে আসিস না। লোকটা ভয়ানক বজ্জাত! হাড় শয়তান!

আজকাল লোকটা সব সময় নিজের হাতের কাছে বন্দুকটা রাখে। সাবধানে থাকে। ওত পাতে। সুযোগ এলে যেন ফসকে না যায়। প্রথমে সে মাদি পেঁচাটাকে শেষ করে পুরুষটির সামনে ফেলবে। দেখতে চায় ওর যন্ত্রণা হয় কি না! কষ্ট হয় কি না! তারপর তো ওর পালা!

সুযোগও এসে গেল অচিরেই। তিন-চার দিন পর। মেয়ে পেঁচাটা ক্ষুধা উদ্বেগ বা কৌতূহলে পুরুষ সঙ্গীটিকে খুঁজতে খুজতে খাঁচার কাছাকাছি চলে এসেছিল। তাকে দেখে পুরুষ সঙ্গীটি ঝটপট করছিল। তাকে কেমন উত্তেজিত দেখাচ্ছিল। মেয়ে সঙ্গীটির নিরাপত্তার কথাই কি সে ভাবছিল! লোকটাকে বিশ্বাস নেই। মেয়ে পেঁচাটা বার দুই ডেকে পাঁচিলের ওপর গিয়ে বসল। লোকটার কানে গেল সেই ডাক। ভোর হয় হয়। ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল সে বিছানায়। মুহূর্তে বন্দুকটা হাতে নিয়ে সে বেরিয়ে পড়ে। ‘দাঁড়া, দিচ্ছি তোকে সাবড়ে!’ লোকটার ঠোঁটে ব্যঙ্গ। খাঁচায় বন্দি পেঁচাটা বোধহয় কিছু বুঝতে পেরেছে। সে এবার ডাক বন্ধ করে দেয়। প্রত্যুত্তর দেয় না। চুপ করে থাকে। যাতে মেয়ে পেঁচাটা সাড়া না পেয়ে ওখান থেকে চলে যায়।

কিন্তু লোকটা আর বিলম্ব চায় না। পাঁচিলের ওপর বসা মেয়ে পেঁচাটা তার নজরে এসেছে। অন্যদিন উড়ে যায়। আজ কিন্তু সে উড়ছে না। বৃথা কালক্ষেপ না করে লোকটা তাক করে মেয়ে পেঁচাটার দিকে। তার দোনলা বন্দুকের দুটো নলই সে ব্যবহার করে। একটা শব্দ, কিছু ধোঁয়া। মুহূর্তে মেয়ে পেঁচাটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এবার আর আধমরা নয়। অব্যর্থ অমোঘ মৃত্যু।

লোকটার হাতে বারুদের গন্ধ। চোখে অদ্ভুত খুশি নিয়ে সে মেয়ে পেঁচাটার মৃতদেহ এনে পুরুষ পেঁচাটার খাঁচার সামনে ফেলে।

‘কিরে? দেখলি? দ্যাখ্ কেমন লাগে?’ লোকটার চোখ-দুটো দিয়ে ঠিকরে বেরুচ্ছে প্রতিশোধের আগুন।

খাঁচার বন্দি পাখিটা তার মৃত সঙ্গিনীটির দিকে একবার তাকায়। তারপর লোকটাকে দেখে। ওর হলদে চোখদুটোতে কোনও পরিবর্তন নেই। সেই সীমাহীন ঘৃণা আর অঢেল বিতৃষ্ণা! ওর ওই বুনো চোখদুটোতে লোকটা ভয় আনতে চেয়েছিল। ওর সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে সর্বহারার হাহাকার বাজুক সেটাই চেয়েছিল লোকটা। কিন্তু না। তা হয়নি। কিন্তু লোকটা নিজেকে এবার পরাজিত ভাবল। সে ভেবেছিল খাওয়া বন্ধ করে, অত্যাচার চালিয়ে সঙ্গিনীকে নিধন করলে ওর মনোবল ভেঙে যাবে। ওকে ধবস্ত বিবর্ণ দেখাবে। তা না হওয়ায় লোকটা নিজের মনে পরাজয়ের একটা তীব্র জ্বালা অনুভব করল। এক সামান্য নিশাচর তস্কর পেঁচার কাছে সে হেরে গেল! লোকটা সদর্পে ঘরের মধ্যে ঢুকে তার দোনলা বন্দুকে আবার দুটো টোটা ভরে নেয়। বাইরে বেরিয়ে এসে সে চ্যাঁচাতে লাগল, ‘শয়তান এবার তোকে শেষ করব!’

খাঁচার তারের ফাঁকের মধ্যে দিয়ে বন্দুকের নলটা ঢুকিয়ে দিতে পেঁচাটা সরোষে এসে নলটাকে আক্রমণ করল। কিন্তু লোহার নলের কোনও ক্ষতি সে করতে পারল না। হতাশ হয়ে খাঁচার অন্যপাশে সরে গেল।

লোকটা বন্দুকের নলটা খানিকটা পেছন দিকে সরিয়ে আনল। যাতে পেঁচা থেকে বন্দুকের দূরত্ব যেন কয়েক ফুট থাকে। শেষবারের মতো সে ওই কুৎসিত বদমায়েশ লোভী বেয়াড়া পেঁচাটার চোখে কোনও অন্তিম ভয় আছে কিনা দেখল। না, কিছু নেই। শুধুই ঘৃণা। লোকটার সমস্ত বোধবুদ্ধি দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে গেল। ক্রোধান্ধ হয়ে সে ট্রিগার টেপার পরিবর্তে সেটাতে একটা জোরে ধাক্বা দিয়ে বসল। গুলি রিবাউন্ড বা রি-কয়েল করা বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। জিঘাংসাপ্রিয় রাগান্ধ লোকটির বিবেচনাতে সে কথা আসেনি। আর তাতেই ঘটল বিপদ।

প্রথমে সে বুঝতেই পারেনি কী ব্যাপার হল। গুলির শব্দের সঙ্গে সঙ্গে ঝনাৎ করে একটা শব্দ হল। আর সঙ্গে সঙ্গে লোকটা অনুভব করল কি যেন একটা অকস্মাৎ ভয়ংকর তীক্ষ্ণ ও তীব্র আঘাত করল তার বুকে। সে আঘাতের তীব্রতা এতটাই ছিল যে লোকটা টলে পড়ে গেল। তার হাত থেকে বন্দুকটা ছিটকে পড়ল দূরে। সে বুকে হাত দিয়ে দেখল তার হাত রক্তে ভিজে উঠছে। বুকে প্রচণ্ড আঘাত আর যন্ত্রণা অনুভব করল। নিশ্বাস আটকে আসছে। গলা দিয়ে গরম তরল লাল বর্ণের পদার্থ উঠে আসছে। চোখের সামনের পৃথিবীটা একটু একটু করে অন্ধকার হয়ে আসছে।

অন্তিম অন্ধকার নেমে আসার আগে, সম্পূর্ণ চেতনাহীন হবার আগে লোকটা বুঝতে পারছিল ভয়ংকর দুর্ঘটনাটা কী ঘটেছে। খাঁচার ঠিক পেছনে যে সরু লোহার পাত ছিল, তাতে গুলিটা লেগে ঠিকরে এসে উলটো দিকে দাঁড়ানো তারই বুকে ঢুকেছে। শিকারি নিজেই শিকার হয়ে গেছে!

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! হঠকারিতায় লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়াতে পেঁচাটা শুধু বেঁচে যায়নি, গুলির আঘাতে লোহার খাঁচাটা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। বন্দি পাখি এখন মুক্ত। পেঁচার জখম ডানাটা এই কদিনে অনেকটা ভালো হয়েছে। ভাঙা খাঁচা থেকে গুটি গুটি পায়ে সে বেরিয়ে এল। পিট পিট করে চোখ মেলে মরনোন্মুখ মানুষটার সামনে এসে দাঁড়ায়। এখন আর তার চোখে কোনও ঘৃণা নেই। বিদ্বেষ নেই। অভিযোগের লেশমাত্র নেই। যা কিছু বিদ্বেষ, ঘৃণা, ক্রোধ, জিঘাংসা বা মানসিক বিকার সবই ওই লোকটার মধ্যেই ছিল।

 

একটি বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে।

 

অগ্নিশুদ্ধি

জাতীয় স্তরে খুব বড়ো করেই এবার প্রতিযোগিতার আসর বসানো হয়েছে। গল্পের প্রতিযোগিতা। দেশের প্রায় সব রাজ্য থেকেই ছোটো-বড়ো বহু গল্প জমা পড়েছিল। তারই মধ্যে পঁচিশজন লেখককে সনাক্ত করা হয়েছে যাদের লেখা পুরস্কার পেতে চলেছে। বিশাল আয়োজন। স্টেজের উপর বেশ কিছু লেখক চেয়ারে বসে রয়েছেন। লেখকদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন রঞ্জন কর্মকার। গল্পটি একটি বাচ্চাকে নিয়ে।

অনাথ একটি বাচ্চা জীবনের সব বাধা অতিক্রম করে কীভাবে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠবে তাই নিয়ে গল্প। গল্পগুলি যারা সিলেক্ট করেছেন সেই বিচারকদের মধ্যেই মাধবীও একজন। তিন বছর আগে এই সংস্থাই মাধবী-কেও বেস্ট রাইটার-এর খেতাবে সম্মানিত করেছিল। মাধবী প্রথম যখন গল্পটি পড়ে, খুবই প্রভাবিত হয় কিন্তু লেখকের নাম দেখে তার কপালে বিস্ময়ের ভাঁজ পড়ে। রঞ্জন কর্মকার… এ সে-ই লোক নয়তো! মনের মধ্যে ঝড় ওঠে মাধবীর।

স্টেজে উপস্থিত একজন বয়োজ্যেষ্ঠ লেখককে মাধবী জিজ্ঞেস করে, অরুণদা এই রঞ্জন কর্মকারকে আপনি চেনেন? তার কোনও ছবি দেখাতে পারবেন?

মাধবী, তুমি তো জানো প্রতিযোগিতায় ছবি পাঠাবার নিয়ম নেই। নয়তো সংস্থারই বদনাম হয়ে যাবে যে চেনা লোকেদেরই এরা পুরস্কার দেয়।

মাধবী লজ্জিত হল, সরি, আমি ভুলে গিয়েছিলাম।

কী ব্যাপার, বলো তো?

না না, সেরকম কোনও ব্যাপার নয়, জাস্ট কৌতূহল হল বলে জিজ্ঞেস করলাম, কথোপকথন শেষ করতে মাধবী তৎপর হয়ে উঠল। বাড়ি ফিরতে হবে। আজকে এখানকার সব কাজ বসে শেষ করে ফেলেছে মাধবী।

বাড়ি পৌঁছেও মনের উপর একটা ভার চেপে বসেছে অনুভব করল সে। ঝেড়ে ফেলতে চেয়ে কিছুতেই ঠেলে সরাতে পারল না। অদিতি এসে জড়িয়ে ধরল মাধবীকে একটু আদর পাওয়ার আশায়। কিন্তু মাধবীর মন আজ স্মৃতির পাতা উলটে-পালটে দেখতে গিয়ে বর্তমানের পটভূমিকা ছেড়ে অনেক দূর চলে গিয়েছিল। শুধু একটা নাম, যা মনের মধ্যে সংগোপনে রাখা আগুনের ফুলকিকে উসকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

মাধবী তো ভুলতে বসেছিল সবকিছু কিন্তু ওই একটা নাম আবার অতীতের ক্ষতটাকে খুঁচিয়ে দগদগে করে দিতে চাইল। মাথা ভারী মনে হল মাধবীর, লুকোনো একটা ব্যথা বুকের পাঁজর ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইল। মনে হচ্ছিল এই তো সেদিনকার কথা, যেটা ভুলে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছিল ও মনে মনে। না চাইতেও পুরোনো স্মৃতির পাতাগুলো একটার পর একটা খুলে যেতে লাগল চোখের সামনে।

 

দেয়াল ঘড়িতে বারোটার ঘণ্টাটা জোরে বেজে উঠতেই মাধবী দৌড়ে জানলাটার কাছে গিয়ে রাস্তার দিকে দৃষ্টিপাত করল। লোকটা এত রাতে কোথায় কে জানে। এখন তো এটাই মাধবীর জীবনে রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। মধ্যরাত পর্যন্ত লোকটার অপেক্ষায় ঘড়িতে সময় দেখে কাটানো। অথচ লোকটার এই নিয়ে কোনও আক্ষেপ নেই।

মাধবী প্রথমে ঘড়ি দেখত, তারপর জানলা খুলে রাস্তা, যদি লোকটাকে দেখতে পায়। আজও রাস্তা ফাঁকা, বহুদূর পর্যন্ত একটা মানুষও ওর চোখে পড়ল না।

প্রায় দেড়টা বাজতে যায়, দরজায় ধাক্কা শুনে উঠে এল মাধবী। দরজা খুলতেই টলোমলো পায়ে লোকটা ভিতরে ঢুকে এল।

আজকে তুমি আবার এক গলা খেয়ে এসেছ? রাগে, দুঃখে মাধবীর চোখে জল চলে এল।

হ্যাঁ খেয়ে এসেছি। তোমার বাবার টাকায় তো খাইনি। অশ্লীল ভাষায় আরও দুটো গালমন্দ করে লোকটা থামল।

কেন এভাবে নিজের জীবনটা নষ্ট করতে উঠেপড়ে লেগেছ?

নষ্ট করতে! পাগলের মতো হেসে উঠল বাহ্যজ্ঞানশূন্য লোকটা। জীবনটা স্বস্তি দিলই কখন? যবে থেকে তুমি আমার জীবনে পা রেখেছ, আমার জীবন নরক হয়ে উঠেছে।

কেন কী এমন করেছি আমি? মাধবী জিজ্ঞেস করেই ফেলে।

তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি কী চাই।

কিন্তু সেটার জন্য আমি কী করতে পারি? ক্লিনিকে গিয়ে তো নিজের চেক-আপ করিয়েছিলাম। মা হওয়ার জন্য আমি সব দিক থেকে সক্ষম। ডাক্তার তো বলেই দিয়েছে দুজনের চেক-আপ…

কথা শেষ হওয়ার আগেই একটা থাপ্পড় এসে পড়ল মাধবীর গালে, তুমি কি মনে করো আমি নপুংসক? সন্তান দেওয়ার ক্ষমতা নেই আমার?

আমি একথা কখন বললাম? আমি খালি…

নিজেই নিজের ঝোল টানছ? বেয়াদপ মেয়েছেলে, আরও একটা থাপ্পড় এসে পড়ল মাধবীর গালে।

তুমি যদি চাও আমি ঠিকমতো ব্যবহার করি তাহলে আমার যা চাহিদা সেটা পূরণ করো। পাঁচবছর আমাদের বিয়ে হয়েছে, আজ পর্যন্ত বাচ্চার কান্না-হাসিতে বাড়িটার শূন্যতা ভরল না। বন্ধুবান্ধবরা আমাকে ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করে। আর আমি সহ্য করতে পারছি না।

তুমি চেক-আপও করাবে না আর আমাকে বাচ্চার জন্য জোরও দেবে! এটা কি আমার একার পক্ষে সম্ভব? মাধবী বোঝাবার চেষ্টা করে।

আমি কিছু শুনতে চাই না, আমি শুধু রেজাল্ট চাই ব্যস, গলার আওয়াজ জোরালো হয়।

শোনো না, আমরা অনাথাশ্রম থেকেও তো বাচ্চা নিয়ে এসে মানুষ করতে পারি, সাহস জুটিয়ে বলে মাধবী।

কী বললে, আর একবার বলো, অনাথাশ্রমের বাচ্চা?

ক্ষতি কী?

মুহূর্তের মধ্যে লোকটা আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। লাথি, চড়, ঘুঁসি এসে পড়ে মাধবীর উপর। এতেও লোকটার রাগ শান্ত হয় না। মাধবীর হাত ধরে টানতে টানতে দরজা খুলে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসে। পিঠে একটা লাথি মেরে মাধবীকে রাস্তায় ফেলে দেয়, আজ থেকে এ বাড়ির দরজা তোমার জন্য বন্ধ। যেখানে যেতে ইচ্ছে করে যাও। তোমার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। বাঁজা কোথাকার।

লোকটার মুখের এই অশ্লীল শব্দ, মাধবীর কানের মধ্যে যেন গরম তরল লোহা ঢেলে দিল। রাস্তাতেই পড়েছিল সে, হঠাৎই শরীরে উপলব্ধি করল এক দুর্জয় শক্তি। মুখ থেকে বেরিয়ে এল, বাঃ বাঃ খুব ভালো, ভালো লাগল নারীবাদী লেখকের মুখে এমন কথা শুনে। অথচ নিজের বাড়ির মেয়েদের প্রতি যার মনে এতটুকু সম্মান নেই। যাও যাও বাড়ির এই গল্পটাও লিখে ফেলো। তোমার দুঃখের কাহিনিটা-ও সকলকে জানাও, তবেই না তোমার জয়জয়কার হবে।

আমাদের মতো পুরুষপ্রধান দেশে মেয়েদের নিয়ে গল্পই খালি লেখা হয়। তোমার লেখাটাও আর একটা গল্প যোগ করবে। কিন্তু মনে রেখো রঞ্জন কর্মকার, সন্তানের মুখ তুমি কোনও দিনই দেখতে পাবে না। পারো তো একবার গিয়ে নিজেকে পরীক্ষা করিয়ে নিও। হাজার বার বলব তুমি নপুংসক। আর হ্যাঁ, তুমি আমাকে বাড়ি থেকে কী বার করবে, আমি নিজেই এই নরকের পরিবেশ থেকে দূরে চলে যাচ্ছি, যেখানে তোমার মতো লোকের ছায়া পর্যন্ত পৌঁছতে পারবে না।

রঞ্জন পাথরের মতো দরজায় দাঁড়িয়ে থাকে। মাধবীকে আটকাবার কোনও চেষ্টাই করে না। জনশূন্য রাস্তার নিস্তব্ধতা ফুঁড়ে মাধবী পায়ে পায়ে এগিয়ে চলে অজানা এক ভবিষ্যতের দিকে।

 

আজ চোদ্দো বছর পর ওই ফেলে আসা নামটা আবার মাধবীর চোখের সামনে অক্ষর হয়ে এসে দাঁড়াল। এতগুলো বছর মাধবীকে কম লড়াই করতে হয়নি। কত সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে, সব মনে আছে ওর, লোকের বাড়িতে কাজ করেছে পর্যন্ত। একটাই ভালো হয়েছে শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক অরুণ বসুর আশীর্বাদধন্য হতে পেরেছে মাধবী। তাঁরই উৎসাহে এ কয়েক বছরে বেশ কয়েকটা বই লিখে বেশ নাম করেছে মাধবী। অবশ্য লেখাগুলো সবই মধুমালতী ছদ্মনামে। অরুণ বসুই প্রকাশনার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন।

দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও মাধবী যথেষ্ট জনপ্রিয় লেখিকা এখন। অর্থের কোনও অভাব আর নেই মাধবীর। নিজস্ব একটা ফ্ল্যাট কিনে অনাথাশ্রম থেকে একটি শিশুকন্যাও দত্তক নিয়েছে সে। বেশ আনন্দেই কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। কিন্তু রঞ্জন কর্মকারের নামটা ওর চোখের সামনে এসে উপস্থিত হয়ে সব কেমন এলোমেলো করে দিল। মন খালি বলছে, এটা হওয়া সম্ভব নয়। একই নামে বহু লোক আছে এই পৃথিবীতে। সুতরাং এ কিছুতেই অতীতের সেই রঞ্জন নয়।

ফোনটা বেজে উঠতেই চিন্তায় ছেদ পড়ল মাধবীর। অরুণ বসুর নামটা স্ক্রিনে ভেসে উঠল। ফোন তুলতেই অরুণবাবু জানালেন, লেখক সংগঠন থেকে ঠিক করা হয়েছে, রঞ্জন কর্মকারের হাতে প্রথম পুরস্কার তুলে দেওয়ার দাযিত্ব মাধবী তোমাকে নিতে হবে।

অবাক হল মাধবী, যেটাই এড়াতে চায় সেটাই আরও বেশি করে ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। ফোনেই মাধবী জানাল, সেদিন ওর পক্ষে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা কিছুতেই সম্ভব নয়। কিন্তু অরুণবাবু জোর দিলেন, ডাকযোগে লেখকদের জানানো হয়ে গেছে যে, মাধবী-ই সেদিন পুরস্কার দেওয়ার দাযিত্বে থাকবে।

কিন্তু এটা ঠিক করার আগে একবার আপনি কেন আমাকে জানালেন না? বিরক্তির স্বরে মাধবী জিজ্ঞেস করল।

এটা কী ধরনের কথা মাধবী! লোকে জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য এ ধরনের অনুষ্ঠানগুলোতে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে, আর তুমি কিনা… কথার মাঝেই মাধবী বলে উঠল, সরি অরুণদা, সেদিন আমি কিছুতেই আসতে পারব না।

তার মানে আমার সম্মানটা মাটিতে মিশিয়ে দিতে চাও। এখন তো কার্ডগুলোও সবাইকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঠিক আছে, তুমি যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছ তখন আর আমি কী বলব?

অরুণদার গলাটা শুনে মাধবীর মনে হল, যুদ্ধে হেরে যাওয়া এক সৈনিক। যুদ্ধ করার আগেই হেরে বসে আছেন। ঠিক আছে অরুণদা আমি যাব, নিশ্চিন্ত করে মাধবী।

অরুণ বসুকে মাধবী আদর্শ মনে করে চলে। বড়ো ভাইয়ের স্নেহই পেয়ে এসেছে মাধবী ওনার কাছে বরাবর। সুতরাং আজ সেই মানুষটার মনে আঘাত দেওয়ার মানসিকতা কিছুতেই হল না তার।

ঘড়িতে ঠিক সন্ধে সাতটা। লেখক ও বুদ্ধিজীবীর ভিড়ে হল গমগম করছে। আলো বন্ধ হতেই পিন পতন নিস্তব্ধতা গোটা প্রেক্ষাগৃহে। স্টেজের উপরে মাইকে অরুণ বসু ঘোষণা করলেন, প্রথম পুরস্কার গ্রহণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে লেখক রঞ্জন কর্মকারকে। দয়া করে স্টেজে এসে আসন গ্রহণ করুন।

মাধবী তৈরিই ছিল। স্টেজের সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসা ব্যক্তিটিকে দেখে মাধবী পাথর হয়ে গেল। রঞ্জনও এক ঝলক মাধবীর মুখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিল। এত বছর ধরে যে-মুহূর্তটাকে মাধবী ভুলে যেতে চেয়েছে, এড়িয়ে এসেছে, আজ সেই মুহূর্তটাই এক বুক কষ্টর ঝাঁপি খুলে মাধবীর মনটাকে তাতে ডুবিয়ে দিল।

এতগুলো বছর ধরে রঞ্জনও ভেবে এসেছে, মাধবী ওর থেকে দূরে চলে যাওয়ার পর, মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেছে। গুম হয়ে গেছে, যেখান থেকে সভ্য সমাজে ফিরে আসা আর কখনও সম্ভব নয়। অথচ, অদৃষ্টের কি নিষ্ঠুর পরিহাস যে, সেই মাধবী ওরফে মধুমালতী-র হাত থেকেই তাকে আজ পুরস্কার গ্রহণ করতে হচ্ছে। এর থেকে নিয়তির নিষ্ঠুরতা আর কী হতে পারে?

মাধবীর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই রঞ্জনের অহংকার, ভাঙা কাচের মতো গুঁড়ো হয়ে রঞ্জনকেই বিদ্ধ করল। মাধবী অরুণদার হাত থেকে পুরস্কার নিয়ে রঞ্জনের হাতে ধরাল। রঞ্জনও কলের পুতুলের মতো পুরস্কার গ্রহণ করে, কোনও রকমে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে দর্শকদের উদ্দেশ্যে কিছু না বলে, স্টেজে রাখা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়ল। দেখে যে-কেউই ভাবতে পারে রঞ্জন কর্মকারকে সম্মানিত করার বদলে জুতোপেটা করা হয়েছে।

এরপর ধীরে ধীরে অন্য লেখকদের পুরস্কার প্রদান পর্ব শেষ হতেই অরুণদাকে বলে হল ছেড়ে বেরিয়ে এল মাধবী। অন্য আরও অনুষ্ঠানগুলো দেখার মতো মানসিকতা ছিল না তার। গাড়ি বাইরেই রাখা ছিল। গাড়িতে উঠে বসল মাধবী।

 

বাড়িতে ঢুকতেই মাধবীর মনে হল একটু কাঁদতে পারলে হয়তো বুকের উপর চেপে বসে থাকা বোঝাটা হালকা হতো। কিন্তু একফোঁটা জলও চোখ দিয়ে বেরোল না। গলার কাছটায় শুধু একটা ঘড়ঘড় শব্দ শুরু হয়ে বন্ধ হয়ে গেল। দরজায় ধাক্কা দেওয়ার আওয়াজে মাধবীর ঘোর কাটল।

কে? চোখের জল মুছে নিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল মাধবী কে এসেছে দেখতে। দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা রঞ্জনকে দেখে ঘৃণায় চোখমুখ কুঁচকে উঠল ওর।

তুমি কেন এসেছ এখানে? জানলা দিয়ে প্রশ্নটা ছুড়ে দিল মাধবী।

আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি মাধবী।

মাধবী? কে মাধবী? চোদ্দো বছর আগে মাধবী মারা গেছে। আমার নাম মালতী, মধুমালতী। আমি তোমাকে চিনি না, চলে যাও এখান থেকে। শেষের দিকে মাধবীর গলার স্বর বেশ জোরালো শোনালো।

চলে যাব, শুধু একবার বলে দাও যে তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছ, হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে রঞ্জন বন্ধ দরজার সামনে, গলায় কাকুতি।

বললাম তো আমি তোমাকে চিনি না। ভালোয় ভালোয় চলে যাও নয়তো চেঁচিয়ে লোক জড়ো করব, বলে জানলা বন্ধ করে দেয় মাধবী।

বহুক্ষণ আর কোনও আওয়াজ নেই, মাধবীর মনে হল রঞ্জন নিশ্চয়ই চলে গেছে। ভালোই হয়েছে। ওর সঙ্গে যখন কোনও সম্পর্কই নেই, তখন ক্ষমা করার প্রশ্নই উঠছে কোথা থেকে। আমার জীবন নরক করে তুলে আজ আমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছে!

হঠাৎ-ই নিজের মনেই ধিক্কার অনুভব করল মাধবী। ভিতর থেকে নিজের বিবেকই প্রশ্ন তুলল, বাহ! মালতী এখন তুমি মাধবী থেকে মধুমালতী হয়েছ, নাম বদলে ফেলেছ জনপ্রিয়তা পেয়ে, কিন্তু স্ত্রীধর্ম? তুমি যদি ওকে চেনো না, তাহলে কার জন্য হাতে লোহা, মাথায় সিঁদুর ছোঁয়ানো? হাতের লোহা খুলে ফেলে দাও, মাথার সিঁদুর মুছে ফেলো। রঞ্জন কর্মকারের সঙ্গে জুড়ে থাকা এই বন্ধন আজও কেন বয়ে বেড়াচ্ছ? না মাধবী তুমি এসব কিছুই করতে পারবে না। উপরে উপরে যাই তুমি বলো না কেন, তোমার মন কি কখনও ওকে ভুলতে পেরেছে? না পারেনি। তোমার লেখায় এত দরদ কোথা থেকে আসে? জীবন দিয়ে তুমি উপলব্ধি করেছ বলেই না!

চুপ করো, আমি কিছু শুনতে চাই না, হঠাৎই নিজে নিজেই চেঁচিয়ে ওঠে মাধবী।

মাধবীর গলা শুনে অদিতি জেগে যায়। কোনও ভাবে আবার ঘুম পাড়িয়ে দেয় মেয়েকে কিন্তু নিজে ঘুমোতে পারে না মাধবী। পুরোনো ঘটনাগুলো ঘুরেফিরে চোখের সামনে আসতে থাকে।

রাত প্রায় একটা। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মাধবী ঘুমোবার চেষ্টা করে। হঠাৎ ফোনের আওয়াজে তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা ওর কেটে যায়। ফোনটা ধরতে ইচ্ছে করে না কিন্তু এক নাগাড়ে বাজতে থাকায় বাধ্য হয়ে উঠে আসে মাধবী।

হ্যালো, কে বলছেন?

আমি অরুণ বলছি, শান্ত আওয়াজ ভেসে আসে ওপার থেকে।

এত রাতে অরুণদা… সব ঠিক আছে তো? চিন্তিত হয় মাধবী।

আমি যা জিজ্ঞেস করছি তার সত্যি উত্তর দেবে? তুমি কি রঞ্জন… মানে রঞ্জন কর্মকারকে চেনো?

চমকে ওঠে মাধবী কিন্তু মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, হঠাৎ এত রাতে ফোন করে এসব কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?

আগে উত্তর দাও তুমি ওকে চেনো কি চেনো না?

হ্যাঁ, একসময় আমার স্বামী ছিলেন। ছিলেন শব্দটার উপর বিশেষ জোর দেয় মাধবী।

মাধবী, ছিলেন নয় আজও তিনি তোমার স্বামী কারণ তোমাদের ডিভোর্স হয়নি।

কিন্তু অরুণদা কী ব্যাপার বলুন তো? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে মাধবী।

হয়তো রঞ্জন আর বাঁচবে না। কাল যখন তোমাদের বাড়ি গিয়েছিল, তুমি দরজা খুলে না দেওয়াতে ও অনেক্ষণ ওখানেই বসে ছিল। হয়তো ভেবেছিল তুমি দরজা খুলবে। বহুক্ষণ পরে সব আশা ত্যাগ করে ও যখন ওখান থেকে উঠে পড়ে রাস্তায় পা বাড়ায়, তখনও হয়তো মনে ক্ষীণ আশা বাঁচিয়ে রেখেছিল যে দরজা খুলে তুমি নিশ্চয়ই বেরিয়ে আসবে। পিছন ফিরে সেটাই দেখতে গিয়ে একটা চলন্ত ট্রাক এসে ওকে ধাক্কা মারে। হাসপাতালে ও এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। ডাক্তাররা আশা ছেড়ে দিয়েছেন। ও একবার তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

কিন্তু আপনি এত কথা জানলেন কী করে? চোখের জল সামলাতে সামলাতে মাধবী প্রশ্ন করে।

প্রোগ্রাম শেষ হওয়ার পর তুমি যখন হঠাৎ অনুষ্ঠান ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে গেলে, রঞ্জনও তোমার পিছনে পিছনে দৌড়োল। আমার একটু সন্দেহ হয় কারণ যখনই এই নামটা তোমার সামনে আসে, তুমি কীরকম যেন অস্থির হয়ে ওঠো। আমিও বেরিয়ে আসি হল ছেড়ে আর তোমাদের পিছু নিই। তোমাদের বাড়ির কাছে এসেই রঞ্জন ট্যাক্সি ছেড়ে দেয় কিন্তু ততক্ষণে তুমি বাড়ি ঢুকে গেছ। আমিও একটু দূরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে প্রতীক্ষা করতে থাকি। রাস্তায় এসে দাঁড়াতেই ট্রাকটা ওকে ধাক্কা মারে। আমারও কিছু করার ছিল না। ওকে তুলে হাসপাতাল নিয়ে আসি। ডাক্তাররা আশা দিতে পারছেন না।

অরুণদা, আমি এখুনি আসছি, রিসিভার নামিয়ে রাখে মাধবী।

মাথার সিঁদুরের উপর চোখ যায় মাধবীর। মলিন সিঁদুরের রেখাটা খুব কষ্ট করে চোখে পড়ে। তাড়াতাড়ি করে মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে তৈরি হয়ে গাড়িতে এসে বসে। হাসপাতালের দিকে গাড়ি ঘোরায় মাধবী।

মা এত রাতে আমরা কোথায় যাচ্ছি? অদিতি জিজ্ঞেস করে।

তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে।

মিথ্যা কথা, তুমি মিথ্যা বলছ। তুমিই তো এতদিন বলেছ, আমার বাবা কোথাও হারিয়ে গেছে, চেঁচিয়ে ওঠে অদিতি।

হ্যাঁ বলতাম কিন্তু আজই হঠাৎ ওনার খোঁজ পাওয়া গেছে।

তাহলে এখন থেকে বাবা কি আমাদের সঙ্গে থাকবে?

হয়তো।

তাহলে তো খুব মজা হবে, অদিতি উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।

অদিতি, এখন একটু চুপ করো। মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে।

হাসপাতালে পৌঁছতেই গাড়ি রেখে রিসেপশনেই অরুণদার দেখা পেল মাধবী। মাধবীদের নিয়ে রঞ্জনের বেড-এর সামনে দাঁড়াতেই চোখ খুলে চাইল ও। এসে গেছ। তোমারই আসার প্রতীক্ষা করছিলাম। এমার্জেন্সি ওয়ার্ডে রাখা হয়েছে রঞ্জনকে। মাধবীদের ঘরে রেখে অরুণ বাইরে এসে দাঁড়ালেন।

রক্তাক্ত শরীরটাকে কোনও ভাবে টেনে তুলে রঞ্জন উঠে বসার চেষ্টা করতেই মাধবী জোর করে ওকে শুইয়ে দিল।

এ কী হাল করছে শরীরের? কাঁদতে কাঁদতেই জিজ্ঞেস করে মাধবী।

সবই আমার কর্মদোষ! আমি তোমার উপর যে-অত্যাচার করেছি, আজ তারই ফল আমাকে ভুগতে হচ্ছে। আমার এই নিয়ে কারও কাছে কোনও অভিযোগ নেই। আর তো কিছুক্ষণের অতিথি আমি। আমার শেষ ইচ্ছা, যেন তোমার সামনেই এই পাপে ভরা প্রাণটা ত্যাগ করতে পারি।

মাধবী রঞ্জনের হাত দুটো নিজের মুঠিতে তুলে নেয়, তোমার কিচ্ছু হবে না, আমি তোমাকে বাঁচাব।

আমাকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না। হঠাৎ অদিতির দিকে দৃষ্টি পড়তেই ইশারায় জিজ্ঞেস করে রঞ্জন, এটি তোমার মেয়ে?

হ্যাঁ, আমার মেয়ে, দত্তক নিয়েছি।

ভালো করেছ মাধবী, নয়তো আমার চিতায় কে আগুন দিত? সারা জীবন এই একটাই চিন্তা আমাকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে যে, মৃত্যুর পর আমার কী হবে? কিন্তু এখন আর কোনও চিন্তা নেই। এখন আমি নিশ্চিন্তে মরতে পারব, বলে রঞ্জন অদিতিকে স্নেহের স্পর্শে কাছে টেনে নেয়।

 

কী শান্তি! এই শান্তি আগে তো কোনও দিন অনুভব করেনি রঞ্জন। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে কে আপন কে পর তার হিসেব কে রাখে? আর তো কিছু মুহূর্ত…

যদি রঞ্জন সেদিন আমার কথা শুনতে, তাহলে আজ আমরা সবাই একসঙ্গে থাকতাম। কিন্তু আ.., মুখের কথা মুখেই থেকে যায় মাধবীর। গলা শুকিয়ে ওঠে। রুদ্ধ হয়ে আসে স্বর।

আমি তোমাকে কখনও হেয় করতে চাইনি মাধবী। কিন্তু কী যে পশু ভর করেছিল আমার মাথায়! সময়, কড়ায় গন্ডায় হিসেব নিয়েছে আমার পাপের! এমন অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছে, যেখান থেকে বেরোবার শক্তি আমি জোটাতে পারিনি। তবুও বলব আজ আমি খুব খুশি। মৃত্যুর সময তো আমি তোমাকে কাছে পেলাম। আমার লেখায় আদর্শের ছড়াছড়ি কিন্তু বাস্তবে নিজের জীবনে আদর্শকে কোনও ঠাঁই দিইনি। খুব ইচ্ছে করছে তোমাকে যদি সুখী রাখতে পারতাম। আমি সত্যিই লজ্জিত মাধবী, ক্ষমা কোরো আমাকে। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে মাধবী।

মাধবী কিছু বলার আগেই রঞ্জনের মাথা একপাশে হেলে পড়ল। মাধবী কাছে আসতেই বুঝতে পারল রঞ্জনের যাবতীয় কষ্টের অবসান ঘটেছে।

পরের দিন হাজারো সাহিত্যকারের ভিড়ে অদিতি, রঞ্জনের মুখাগ্নি করল। মাধবী অপলক দৃষ্টিতে চিতার আগুনের দিকে তাকাতেই মনে হল, আগুনের শিখার ভিতর থেকে রঞ্জনের হাসিমাথা মুখটা যেন মূর্ত হয়ে উঠছে। মাধবীকে বলছে, তুমি আমার শেষইচ্ছা পূরণ করে দিয়েছ, যেটা এতগুলো বছর ধরে আমার গলায় ফাঁসের মতো আটকে ছিল, আমার অসম্পূর্ণ গল্প আজ সম্পূর্ণ হল মাধবী। এখন আমি নিশ্চিন্তে চলে যাচ্ছি।

মাধবী শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের শেষ অশ্রুবিন্দুটুকুও জোর করে মুছে নিল। আর কান্না নয়, অদিতির জন্য বাকিটা জীবন তাকে হাসি মুখেই কাটাতে হবে।

 

নাম জানা হয়নি

একদিকে প্রশান্ত মহাসাগরের অতল গভীরতা আর অন্যদিকে মাউন্ট ফুজির গগনচুম্বী বরফঢাকা শিখর। দু’পাশে প্রকৃতির সবুজ গালিচাকে সাক্ষী রেখে ছুটে চলেছে শিনকানসেন– জাপানি বুলেট ট্রেন। অসম্ভব গতির জন্য জানলার বাইরের সমস্ত দৃশ্যই যেন ঘষা ছবি। যেন একটা সদ্য জলরং করা ছবি অনবরত কেউ ঘেঁটে দিয়ে যাচ্ছে। বেশিক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকতে মন চাইল না সার্থকের।

সংরক্ষিত আসনের বিলাসী ব্যাকরেস্ট পিছন দিকে হেলিয়ে দিয়ে, সে তার ক্লান্ত চোখদুটি বন্ধ করল। একটু-একটু তন্দ্রা মাঝেমধ্যে তাকে আচ্ছন্ন করে যাচ্ছে। খানিকটা তার অজান্তে আর খানিকটা সচেতনে তার মন বুলেটের চেয়েও দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছে অতীতে। মুহূর্তে আশেপাশের রঙিন প্রকৃতি চোখের সামনে থেকে উধাও। তার বদলে ফিরে এল অন্য সময়, অন্য পরিপ্রেক্ষিত।

বছরখানেক আগে সেই মেয়েটির সঙ্গে তার আলাপ। গ্র্যাজুয়েশনের রেজাল্ট দেখে এসে আর একমুহূর্তও খামোখা নষ্ট করতে চায়নি সার্থক। বাবা রাগারাগি করেছিলেন। মা কেঁদেকেটে একশা হয়েছিলেন। কিন্তু কিছুতেই টলানো যায়নি সার্থককে। জীবনের সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটা সে নিয়ে ফেলেছিল আগেই। সম্ভবত তার ছেলেবয়সেই। বাবা বলেছিলেন, ‘পড়াশোনা করতে না চাস তো সমবায় থেকে লোন নিয়ে ছোটোখাটো একটা দোকান করে দিচ্ছি। তিনটে তো পেট

সংসারে। ঠিক চলে যাবে–!’

সার্থক বাবাকে বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করেনি। গররাজি মুখ করে চুপ করে গিয়েছিল। বাবা এই মফসসল শহরে বসে কী করেই বা বুঝবেন, তাঁর সীমাবদ্ধ ভাবনা আর সার্থকের লাগামবিহীন স্বপ্নের মধ্যে দূরত্ব কত যোজন! ছোটোবেলা থেকেই সে ঠিক করে রেখেছে বিদেশে তাকে যেতেই হবে। উন্নতির একমাত্র ঠিকানাই বিদেশ।

অনেক আগে এ কথাটা তার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছিল তাদেরই পাড়ার ছেলে সুধন্য। বছরতিনেক আগে কীসব পরীক্ষা-টরীক্ষা দিয়ে সেও কেটে পড়ল আমেরিকায়। প্রথম প্রথম মাঝেমধ্যে ফোন করত। আইএসডি। সেই উৎসাহ স্বাভাবিকভাবেই পরবর্তীকালে বজায় থাকেনি। কিন্তু সুধন্যর কথাগুলো মনে আছে সার্থকের। সুধন্য গল্প করেছিল, কীভাবে জাহাজের খালাসি হয়ে একজন পৌঁছে গিয়েছিল আমেরিকাতে। এখনও কত লোক প্রতিদিন ভারত-বাংলাদেশ থেকে ভাগ্যের সন্ধানে সেখানে গিয়ে পৌঁছোয়! তাদের বেশিরভাগের আবার ভিসা-পাসপোর্ট কিছুই নেই।

সেইদিন থেকে সার্থক একটাই লক্ষ্যের দিকে এগোচ্ছে। বেসরকারি অফিসের অল্প মাইনের কেরানি তার বাবা। সামান্য মাইনেয় তিনজনের পরিবার টানতেই তাঁর প্রাণান্ত দশা হয়। সে তো চোখের সামনে দেখেছে, দিনের পর দিন কত কষ্টে অতিবাহিত হচ্ছে! একটা ছোটো সাইজের জামাকে অনেক বড়োসড়ো বপুতে গলানোর চেষ্টা করতে করতেই জীবন কেটে গেল বাবার। একই ভবিতব্য তার জন্যও অপেক্ষা করে আছে, এ কথা ভাবতে গেলেই সে শিউরে ওঠে। বিএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোনোর পরেই সে যেন মরিয়া হয়ে উঠল।

সার্থককে বুঝিয়ে যখন হার মানলেন মা, খুব উদ্বিগ্ন আর হতাশ গলায় জানতে চাইলেন, ‘কলকাতায় গিয়ে কী করবি?’

‘প্রথমে একটা চাকরির চেষ্টা করব।’

‘মেসে কষ্ট করে থাকতে পারবি তো বাবা?’ মা চোখের জল মোছেন আঁচলে।

‘নিশ্চয়ই পারব। কেন পারব না?’ সার্থক কঠিন গলায় বলে।

বৈশাখের কড়া রোদেলা শহর। সারাদিন ব্যস্ত মানুষ রাস্তা পারাপার করে। পথে কাটাকুটি খেলে অসংখ্য বাস-ট্রাম-ট্যাক্সি-রিকশা। সবাই যে কলকাতার, তা তো নয়। আশেপাশের জেলাশহর থেকেও প্রতিদিন কত মানুষ আসছে ক্ষুধার অন্ন জোটাতে।

একটা চলনসই গোছের চাকরি জুটে গেল অল্পদিনেই। এক ছোটোখাটো কোম্পানির সেলসম্যানের কাজ। মাইনে সামান্য। কিন্তু ঘুরে বেড়িয়ে শহরটাকে আবিষ্কারের নেশাটা পেয়ে বসল তাকে অচিরেই।

এমনই একদিন সে বসে ছিল জাপান দূতাবাসের উলটো দিকে ফুটপাথের এক চায়ের দোকানে। দুপুর রোদে একটু ছায়া উপভোগ করছিল। গ্রীষ্মের দুপুর বলেই শহরটা একটু নিস্তরঙ্গ, নিস্তেজ। জাপান দূতাবাসের মূল দরজা পেরিয়ে ছোটোখাটো চেহারার এক জাপানি মহিলাকে সে অলস চোখে রাস্তা পেরোতে দেখল। জাপানি মেয়েদের গায়ের রং পার্ক স্ট্রিটে দেখা ফরাসি কিংবা বেলজিয়ান মেয়েদের তুলনায় অনেক বেশি লালচে ফরসা এবং ত্বকও অনেক বেশি মসৃণ।

মেয়েটি রাস্তা পেরিয়ে এসে ফুটপাথ ঘেঁষে দাঁড়াতে, সার্থক আন্দাজ করল মেয়েটির বয়স তার মতোই হবে। হয়তো এই প্রথমবার কলকাতায় এসেছে। চোখমুখের উৎকণ্ঠিত ভাব সে কথাই বলছে। ফুটপাথের ধারে দাঁড়িয়ে সে বোধকরি ফাঁকা ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।

মেয়েটি কি ইংরেজি বোঝে? সার্থক থেমে থেমে ইংরেজিতে কথা বলতে পারে। কিন্তু ট্যাক্সিওয়ালা কি বুঝবে মেয়েটির ভাষা? কিংবা মেয়েটি তার? অনেকক্ষণ ধরে মেয়েটিকে দেখে তার মনে হচ্ছে বিদেশবিভুঁইয়ে, অপরিচিত পরিবেশে সে যেন খানিকটা হতচকিত, থতোমতো!

তার চা খাওয়া হয়ে গেছিল। সঙ্গে প্রজাপতি বিস্কুট।

চা-ওয়ালাকে দাম মিটিয়ে অন্যদিকে চলে যেতে গিয়েও কী ভেবে সে থমকে তাকাল। মেয়েটি তেমনই বিভ্রান্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ইতস্তত পায়ে মেয়েটির পাশে গিয়ে সার্থক জিজ্ঞেস করল, ‘মে আই হেলপ ইউ?… আপনি কি ইংরেজি বলায় স্বচ্ছন্দ?’

মেয়েটি স্মিত হেসে নাতিদীর্ঘ গ্রীবা হেলাল, অর্থাৎ, জানে।

সার্থক আশ্বস্ত হয়ে জানতে চাইল, ‘কোনও সাহায্য করতে পারি?’

‘আসলে, কাল রাতেই আমি কলকাতায় এসেছি। কাল সকালের ফ্লাইটে জয়পুর চলে যাব। ভাবছি যতটা সময় পাচ্ছি, তার মধ্যে শহরটাকে একটু দেখে নেব। শুনেছি, কলকাতা ইজ আ বিউটিফুল সিটি। অনেক কিছু দেখার আছে–!’

এ’কদিনের শহরবাসে কলকাতা শহরটাকে পায়ে হেঁটে ভালোই চিনে ফেলেছে সার্থক। তার পেশাটাও অবশ্য এ ক্ষেত্রে খুবই সাহায্য করেছে।

সে তাই বলল, ‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, অ্যান্ড ফিল কমফর্টেব্ল, আমি কিন্তু শহরটা ঘুরিয়ে দেখাতে পারি আপনাকে–!’

মুহূর্তের জন্য জাপানি তন্বী চুপ করে রইল। স্বাভাবিক, যে এ শহরটাকে চেনেই না, সংস্কৃতিটাকে জানেই না, সে কীভাবে তক্ষুনি এক অপরিচিত পুরুষের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলে দেয়! তার পক্ষে সহজ নয় ব্যাপারটা।

মেয়েটির হ্যাঁ ও না-এর সম্ভাবনার দোলায় খানিকক্ষণ দুলল সার্থক নিজেও। অনেক সাহস করে প্রস্তাবটা দিয়ে বসেছে সে, প্রত্যাখ্যানে মন ভেঙে যাবে তার। হঠাৎ-ই মেয়েটি বলল, ‘শিয়োর। কিন্তু আপনি সব জায়গা চেনেন তো?’

হ্যাঁ-বাচক ঘাড় নেড়ে একটা চলতি ট্যাক্সিকে থামাল সার্থক। শিভালরি দেখিয়ে পিছনের দরজা খুলে ধরল জাপানি মেয়েটির জন্য। নিজে গিয়ে বসল ড্রাইভারের পাশের সিটে।

শহরের রাস্তা ধরে গাড়ি ছুটল ময়দান, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, লালদিঘি, যাদুঘর, সিটি সেন্টার…। জাপানি তরুণী অবাক চোখে দেখছিল। প্রতিটি ছোট্ট ছোট্ট ঘটনা উপভোগ করছিল। হুইলার স্টল থেকে একগোছা গোলাপি ক্যান্ডিফ্লস কিনে সেটি কী করে খেতে হয়, শিখিয়ে দিল সার্থককে। সার্থক অবশ্য জানত। ‘বুড়ির মাথার পাকা চুল’ নামে এ জিনিসটাই ফেরিওয়ালার কাঁধে চেপে প্রায়ই আসত তাদের মফসসল শহরে। এখন সেই জিনিসটাই জাপানি মেয়ের মসৃণ, চকচকে গোলাপি ঠোঁটে মিশে যাচ্ছে।

জাপানি যুবতির সান্নিধ্য খুবই ভালো লাগছিল সার্থকের। কিন্তু দেখতে দেখতে দিনটা ফুরিয়ে এল। খিদে পেয়েছিল ওদের। জাপানি কন্যে জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার খিদে পায়নি সার্থক?’

সার্থক সলজ্জে বলল, ‘হুঁ।’ কাউকে খিদের কথা জানাতে তার ভারি লজ্জা হয়। ছোটোবেলার অভ্যেস।

যুবতি বলল, ‘তাহলে একটা ভালো রেস্তোরাঁয় চলো–!’

সার্থক ওর চেনা একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকল। এর আগে মাত্র একবারই এসেছে। সেই অর্থে চেনা নয়। তবে জানে, এটা তার পকেট এবং মধ্যবিত্ত ম্যানারের মাপেমাপে। আরও বড়ো রেস্তোরাঁয় ঢোকার সাহস পেল না সার্থক।

জাপানি তরুণী যে-কোনও বিষয়েই তার উপর বড়ো নির্ভরশীল। সার্থকের সব কথাতেই তার হ্যাঁ। খাওয়াদাওয়ার পরে রাস্তায় এসে তার কী মনে হল, জানতে চাইল, ‘আচ্ছা, সার্থক, তোমাদের শহরে কোনও নদী নেই?’

‘আছে তো। গঙ্গা। বিশাল নদী।’

‘নদীতে নৌকো চলে?’

‘চলে।’

‘আমায় নিয়ে যাবে?’

শহরের গঙ্গায় শেষ লঞ্চ অনেক আগেই চলে গেছে। যে-কটি আলো জ্বলছে বাতিস্তম্ভে, তাতে অন্ধকারটাই যেন আরও গাঢ় হয়েছে। কেবল কালো গঙ্গার বুক ভেসে যাচ্ছে হলুদ জ্যোৎস্নায়। ইতিউতি কয়েক জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকা ছায়ার মতো পরস্পরের লগ্ন হয়ে আছে। দূরে কয়েকটি নৌকো দেখা যায়। হ্যারিকেনের ম্লান আলো তাদের প্রায়-অনস্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলছে।

সেদিকে আঙুল দেখিয়ে যুবতি বলল, ‘সার্থক, ওই নৌকোগুলোয় চড়া যায়?’

মুখের কাছে দু’হাতের তালু জড়ো করে সার্থক ডাক দিল, ‘মাঝিভাই, ও মাঝিভাই, নেবে নাকি?’

খানিক পরে নৌকো ঘাটে লাগলে, ওরা উঠে বসল ছইয়ের ভিতর। মাঝির হাতে দাঁড়ের প্রথম টানে দুলে উঠল নৌকো। আর, যুবতির শরীরও যেন টলে পড়ল সার্থকের গায়ে। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিল বিদেশিনি। সার্থকের একটি হাত নিজের হাতে বন্দি করে আনমনা গলায় বলে উঠল, ‘আমি অনেক দেশে ঘুরেছি সার্থক। দেশে দেশে কত বন্ধু হয়েছে। কিন্তু তারা একজনও তোমার মতো নয়। তোমার শহর থেকে অনেক সুখস্মৃতি নিয়ে যাচ্ছি।’

বুক ভর্তি করে খোলা হাওয়া নিল তরুণী। সার্থকের হাতে অল্প চাপ দিয়ে বলল, ‘জাপানে চলে আসছ না কেন? ওখানে অনেক সুযোগ। যদি আসতে চাও, আমায় জানিয়ো। কাল সকাল পৌনে নটায় আমার ফ্লাইট। সাতটা নাগাদ একবার হোটেলে এসো। আমার কার্ডটা তোমায় দিয়ে দেব।’

মিষ্টি হাওয়া বইছে। নৌকো কি এখন মাঝগঙ্গায়? ঘাট দেখা যাচ্ছে না অন্ধকারে। মেয়েটি গুনগুন করে কোনও জাপানি সুর গাইছে। সুরটা অনেকটা ভাটিয়ালির মতোই। যেন গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে গঙ্গায়। আশ্চর্য তৃপ্ত আর ভরাট লাগছে মেয়েটির মুখ। সে যেন সার্থকের ভালোবাসায় লীন হয়ে যাচ্ছে।

মেয়েটির মুঠো থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে সার্থক অস্ফুটে বলল, ‘মাঝিকে ঘাটে নৌকো ভেড়াতে বলি? অনেক রাত হল।’

মেয়েটিও যেন তন্দ্রা ভেঙে উঠে বসল। হোটেলে তাকে পৌঁছে দিল সার্থক। বিদায়ের মুহূর্তে হাত নেড়ে সে বলল, ‘কাল সকালে দেখা হচ্ছে।’

রাস্তায় নেমে সার্থকের মনে পড়ল, মেয়েটির নাম-ই জানা হয়নি। সে পিছন ফিরে ডাকবে তাকে, ভাবল। কিন্তু মেয়েটি চলে গেছে। তাকে আর দেখতে পেল না সার্থক।

অনেক রাতে সার্থক ফিরে এল মেসে। খাওয়াদাওয়ার পাট ছিল না। কেন-না রেস্তোরাঁয় খেয়ে তখনও পেট ভর্তি। সে সরাসরি বিছানায় শরীর ছুড়ে দিল। শরীর জুড়ে ক্লান্তি, তবু তার ঘুম এল না। সন্ধের সুখস্মৃতি তাকে ঘুমোতে দিল না। রোমন্থনে জাগিয়ে রাখল। মনে হল, তার হাতটি যেন এখনও নিজের উষ্ণ করতলে ধরে রেখেছে সেই বিদেশিনি, যার নাম সে জানে না। ইস, কী ভুলটাই না সে করেছে! সার্থক ভাবে।

ঘুম না আসার অবশ্য আরও এক কারণ ছিল। সেটা তার উদ্বেগজনিত। ভোরবেলা উঠতে হবে। না উঠতে পারলে, হোটেলে মেয়েটির সঙ্গে দেখা করতে যেতে দেরি হয়ে যাবে। কিন্তু অতিরিক্ত সতর্কতায় অনেকসময় ভুল হয়ে যায় বেশি।

কখন তার চোখদুটো লেগে এসেছে সার্থক জানে না। ধড়ফড় করে জেগে উঠে, বালিশের পাশে রাখা হাতঘড়িটায় দেখল, আটটা বাজে। হোটেলে গিয়ে এখন জাপানি যুবতিকে দেখতে পাওয়া একরকম দুরাশাই। পৌনে নটায় তার ফ্লাইট, সার্থক জানে। তবু, বড়ো আশায় বুক বেঁধে সে হোটেলের দিকে রওনা দিল।

সকালে হোটেলে তেমন ব্যস্ততা নেই। হাতেগোনা কয়েকজন চেক আউট করা বোর্ডার, বাক্স-ব্যাগ নিয়ে বড়ো দরজার কাছে অপেক্ষা করছে ট্যাক্সির জন্য।

রিসেপশনের সদ্য ঘুমভাঙা ডাগর চোখমুখের মেয়েটি বলল, ‘কাল সন্ধেয় আপনি যাকে পৌঁছে দিলেন হোটেলে, তার কথা জানতে চাইছেন তো? উনি তো অনেকক্ষণ চেক আউট করে গেছেন। বোধহয় আপনার জন্যই লবিতে অনেকক্ষণ বসে ছিলেন। কেন-না, ওর চোখমুখ দেখেই মনে হচ্ছিল, কাউকে খুঁজছেন। তারপর চলে গেলেন।’

সার্থকের বুকের মধ্যেটা হঠাৎই ফাঁকা হয়ে গেল। সব হারানোর যন্ত্রণা কুরে কুরে খেতে থাকল তাকে। তার সব আশা যেন ভেঙে গেছে। সব ভাবনা যেন মিশে গেছে ধুলোয়। কিন্তু এই যন্ত্রণা থেকেই তার মধ্যে আর-এক ধরনের শক্তিপুঞ্জ তৈরি হচ্ছে, টের পেল সার্থক। সেই শক্তি তাকে বেঁধে দিল এক কঠিন অঙ্গীকারের রজ্জুতে। একদিন নিশ্চয়ই সে তাকে খুঁজে বের করতে পারবে।

সামান্য হোঁচট খেয়ে শিনকানসেন থেমে যেতে, ভাবনার গতিপথেও বাধা পড়ল। ট্রেনের স্বচ্ছ কাচের জানলা দিয়ে বাইরে চোখ রাখল সার্থক। নিরিবিলি স্টেশন। দু-চারজন মানুষ চলাফেরা করছে। একটা বোর্ড আছে বটে, কিন্তু জাপানি ভাষায় লেখা বলে, স্টেশনের নামটা পড়তে পারল না সার্থক। পাশের সিটের প্রৌঢ় সহযাত্রীকে জিজ্ঞেস করে সার্থক জানতে পারল, স্টেশনের নাম হমামাতসুচো। একটা হাঁফ ছাড়ল সে। তার মানে, অর্ধেক পথ আসা গেছে এতক্ষণে। এবার সে স্টেশনটিকেই একটু ভালো করে ঠাহর করে দেখতে থাকল। ভারতের যে-কোনও স্টেশনের থেকে কত ফারাক! কোনও চ্যাঁচামেচি নেই, ব্যস্ততাও কত ব্যক্তিগত ও নীরব, প্ল্যাটফর্মটা এতই সাফসুতরো যে, জুতো পরে হাঁটতে সংকোচ হয়।

ট্রেন সামান্য সময়ের জন্য থেমেছিল। কিছু যাত্রী নেমে গেল, আবার অনেকে উঠল। কোনও তাড়াহুড়ো নেই। ধাক্বাধাক্বি নেই। অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্রেন আবার তীব্র গতিতে ছুট লাগাল। অমনি বাইরের যাবতীয় ছবি ঘেঁটে একশা। ফের চোখ বন্ধ করে ফেলল সার্থক। এত গতি তার অস্বস্তি বাড়িয়ে দেয়।

সার্থকের আবার মনে পড়তে থাকল, জাপানি যুবতির সেই পর্বটি মিটলে, সেলসম্যানের কাজটা ছেড়ে দিয়েছিল সার্থক। পরিশ্রম আর উপার্জনে সামঞ্জস্য হচ্ছিল না কিছুতেই। এবার সে চাকরি নিল শহরের এক নামি রেস্তোরাঁয়। রেস্তোরাঁর ম্যানেজার। মাইনে ভালোই, উপরন্তু দুপুরে ও রাতে খাওয়াটা ফ্রি। পেটের চিন্তা অনেকটা মিটল। কিন্তু তবু যেন কীসের অমোঘ টানে সে এখনও মাঝেমধ্যেই নিয়ম করে জাপানি দূতাবাসের উলটোদিকের ফুটপাথে, গাছতলার চায়ের দোকানে গিয়ে বসে। বৃদ্ধ দোকানিটি মরে গেছে। এখন তার ছেলে চা বানায়। তাগড়া যুবক।

রেস্তোরাঁর কাজে ছুটিছাটা কম। সন্ধেগুলোতেই ভিড় বেশি। তার উপর সাধারণ ছুটির দিনেও খদ্দেরদের সামলাতে হিমশিম খেতে হয়। কেবল দুপুরটায় কাজের চাপ একটু কম থাকে। তখন রসুইঘরে খাবার তৈরির আগের পর্যায়ের কাজ চলে।

এই সময়টাতেই মাঝেমধ্যে ফুটপাথের সেই চায়ের দোকানে চলে আসে সার্থক। এক কাপ চা নিয়ে একঘণ্টা বসে থাকে। সঙ্গে দুটো প্রজাপতি বিস্কুট।

একদিন একটা কাণ্ড ঘটল।

দুপুরে রাস্তা এমনিতে ফাঁকাই থাকে। একটা অটোরিকশা তীব্র বেগে এগিয়ে এসে, ঠিক চায়ের দোকানের সামনে ফুটপাথ ঘেঁষে ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে পড়ল। এক জাপানি যুবক নেমে জিন্সের পিছনের পকেট থেকে পার্স বের করে ভাড়া মেটালেন। তারপর পার্সটিকে আবার পিছনের পকেটে চালান করে দিয়ে, দূতাবাসের দিকে হাঁটা দিলেন। দেখে মনে হল যুবকের খুব তাড়া।

অলস চোখে তাকে লক্ষ করছিল সার্থক। এও তার চোখে পড়ল, তাড়াহুড়োয় পার্সটি যুবকের জিন্সের পকেটে না ঢুকে সশব্দে পড়ল রাস্তায়। ব্যস্ততায় যুবক তা খেয়াল করল না। এক সেকেন্ডের ব্যবধানে সার্থক যে তাকে ডেকে উঠল, সেটাও কানে গেল না তার। লম্বা পা ফেলে, সে দূতাবাসের অন্দরে সেঁধিয়ে গেল।

রাস্তা থেকে পার্সটা কুড়িয়ে আনল সার্থক। খুলে দেখল তাতে একগোছা দুই হাজার টাকার নোট। এত টাকা কোনওদিনও একসাথে দেখেনি সে। হাত কাঁপছে তার। কাউকে বলতেও পারছে না। পার্সটা বন্ধ করে, দুহাতের করতলে শক্ত করে ধরে রেখে সে ভাবতে থাকল, এখন কী করণীয়!

একঝলক দেখে সার্থকের মনে হয়েছে, অন্তত পঞ্চাশটা দু’হাজার টাকার নোট রয়েছে সেই গোছায়। মুহূর্তের জন্য চকচক করে উঠল তার চোখদুটো। এই টাকাগুলো বাবা পেলে, বাড়ির অনেকগুলো অসমাপ্ত কাজ করে ফেলত। রান্নাঘরটা মেরামত করত। ছাদের যে-জায়গাগুলো দিয়ে জল পড়ে, সারাত সেগুলোও। মাকে কয়েকটা নতুন শাড়িও হয়তো কিনে দিত। আর স্যাকরার দোকানে মায়ের কানের যে দুলটা বাঁধা রেখে টাকা নিতে হয়েছিল সেবার মায়ের অসুস্থতার সময়, সেটাও হয়তো ছাড়িয়ে আনত।

পার্সটা একবার খুলল সার্থক। একগোছা কাগজের টুকরো। অথচ কী অসীম ক্ষমতা তাদের। পরমুহূর্তেই পার্স বন্ধ করে সে নিজের মনেই বলল, ছি। সে এসব কী ভাবছে?

তখনই উদ্ভ্রান্তের মতো সেই জাপানি যুবককেও রাস্তা পেরিয়ে এপাশে আসতে দেখা গেল। তার চেহারা ইতিমধ্যেই বেশ পালটেছে। চুল এলোমেলো। চোখে উদ্বেগের স্পষ্ট ছাপ। কিছু খুঁজছে যেন।

সার্থক যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যুবকের মুখোমুখি হয়ে বলল, ‘এক্সকিউজ মি, আই হ্যাভ ইয়োর ওয়ালেট। ইউ ড্রপ্ড ইট হিয়ার।’

যুবকটি সার্থকের হাত থেকে খপ করে পার্সটি কেড়ে নিয়ে ভিতরটা আঁতিপাঁতি করে দেখল। তারপর ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল ঠায় সার্থকের দিকে।

সার্থক ম্লান হাসল। যুবক নিজের অভিভূত ভাবটা সামলে নিয়ে বলল, ‘আই অ্যাম ভেরি মাচ ইমপ্রেসড। মে আই ডু সামথিং ফর ইউ?’

সার্থক যেন বহুযুগ ধরে অপেক্ষা করছিল এই প্রশ্নটার জন্য! উত্তরটা সাজানোই ছিল জিভের ডগায়, এমনভাবে সে বলে ফেলল, ‘আমি আপনার দেশে যেতে চাই। শুনেছি ওখানে কেরিয়ার তৈরির অনেক সুযোগ–!’

জাপানি যুবক হঠাৎ কিছুক্ষণ থেমে গিয়ে কী যেন ভাবল। তারপর সার্থকের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, ‘কাছাকাছি কোনও রেস্তোরাঁ আছে? আমার খুব খিদে পেয়েছে!’

কাছাকাছি সত্যিই একটা রেস্তোরাঁ আছে, জানে সার্থক। যুবকটি নিজেই অর্ডার করল। সার্থকের যদিও খিদে ছিল না, তবু অল্পস্বল্প কিছু নিতে হল। খেতে খেতে যুবকটি প্রশ্ন করে জেনে নিতে থাকে সার্থকের জীবনের নানা কথা। কেবল শোনেই না, নিজের কথাও বলে।

যুবকের নাম হারুকি। সম্প্রতি সে বিয়ে করেছে। পেশায় সে ব্যবসায়ী। এক বছর আগে হারুকির বাবা হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। উত্তরাধিকার সূত্রে হারুকি এখন তাঁর প্লাস্টিক কারখানাটির মালিক। ব্যাবসা সংক্রান্ত কাজেই এবার সে ভারতে এসেছে। তার সদ্যপরিণীতা স্ত্রী অবশ্য এর আগে অনেকবারই এদেশে এসেছে। ভারতের সংস্কৃতি নিয়ে সেসময় রিসার্চ করছিল সে।

গত বছর হারুকির কোম্পানি অপ্রত্যাশিত লাভ করেছে। জাপানি ভাষায় কোম্পানিকে বলে ‘খায়শা’। হারুকির খায়শা এখন রমরম করে চলায়, সে কিছুদিনের জন্য তার স্ত্রীর হাতে দায়িত্ব সঁপে ভারতে এসেছে।

হারুকি বলল, ‘সব কিছু ঠিকঠাক চললে আগামী কয়েক বছরে কোম্পানি আরও বড়ো হবে সার্থক! কারখানা করার জন্য জমিও কিনেছি। অনেক কর্মীরও দরকার হবে। তুমি যদি আমার সঙ্গে কাজ করতে চাও, তাহলে আমার কোম্পানিতে একটা চাকরি তোমায় দিতে পারি। শর্ত দুটো। এক, পাকাপাকিভাবে জাপানেই থাকতে হবে। নাগরিকত্বের ব্যবস্থা আমি করে দেব। আর দুই, মন দিয়ে কাজ করতে হবে। জাপানে সকলকেই কিন্তু খুব পরিশ্রম করতে হয়।’

খানিকটা সময় থেমে থেকে হারুকি আবার বলল, ‘তুমি রাজি থাকলে বলো–!’

সার্থক যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেছিল। হারুকির প্রশ্নে চমকে উঠে বলল, ‘কী বলে আপনাকে ধন্যবাদ দেব জানি না। আমি যাব।’

হারুকি উঠে পড়ে বলল, ‘আজ রাতের ফ্লাইটে আমি মুম্বই উড়ে যাচ্ছি। দু’দিন ওখানে থাকব। তারপর ফিরে যাব জাপানে। ওখান থেকে যাবতীয় জরুরি ডকুমেন্টস তোমায় পাঠিয়ে দেব। আমার চিঠির জন্য অপেক্ষা কোরো।’

একটা ট্যাক্সি ডেকে হারুকিকে তুলে দিয়ে, বাস ধরে নিজের রেস্তোরাঁয় ফিরে এল সার্থক। সন্ধে নেমে গিয়েছিল। মানুষের ভিড়ও বাড়ছিল। আজ ক্রেতারা তার কাছ থেকে পেল একটু বাড়তি হাসি। একটু বেশি সৌজন্য। তখন এক আশ্চর্য ভালোলাগায় ভেসে যাচ্ছে সার্থক। আর মাত্র কয়েক দিন, বন্ধু। ওগো চেনা মুখ, তোমাদের বড়ো মিস করব জাপানে।

হারুকি মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায়নি। সে জাপানে ফিরে যাওয়ার পনেরো দিনের মাথায়, সার্থকদের রেস্তোরাঁর ঠিকানায় তার নামে একটা প্যাকেট এল। নিজের মেসে গিয়ে কাঁপা হাতে প্যাকেটটা খুলল সার্থক। ভিসা সংক্রান্ত যাবতীয় জরুরি কাগজপত্র, সেইসঙ্গে একটা ওপন ডেটেড এয়ার টিকিট। তার উপর সরু ক্লিপে আটকানো এক টুকরো কাগজ। তাতে স্বহস্তে হারুকি লিখেছে, ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জাপানে চলে আসার চেষ্টা করো!’

চোখে হঠাৎই জল চলে এল সার্থকের। সেই কোন ছোটোবেলার অধরা স্বপ্নপূরণ হতে চলেছে। পরের কয়েক দিন কেটে গেল দূতাবাসে ভিসা সংক্রান্ত কাজকর্মের ব্যস্ততায়। তার কয়েক দিন পরেই তার উড়ান নামল অশোকা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়ছিল। এয়ারপোর্টে ক্লিয়ারেন্সের যাবতীয় কাজ মিটে যেতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগল। হারুকি যেভাবে বলে দিয়েছিল, ঠিক সেভাবে অশোকা স্টেশন থেকে টোকিয়োগামী বুলেট ট্রেনে উঠে বসেছিল সার্থক।

শিনকানসেন এখন সাঁঝবেলার কুয়াশামাখা অন্ধকার ভেদ করে ছুটছে। দূরে দূরে ছোটো ছোটো জনপদ টের পাওয়া যায় মিটমিট করে জ্বলা আলো দেখে। পিছনে পড়ে রইল তার দেশ। ক্রমশ দূরত্ব বাড়ছে। দেশের বাড়ি, বাবা-মা…। চোখ জ্বালা করে উঠল সে কথা মনে পড়তে। প্রৌঢ় সহযাত্রীটি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই বললেন, ‘টোকিয়ো স্টেশন আসছে। আর দশ মিনিট।’

সত্যিই তাই! চোখেমুখে জল দিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসবে বলে টয়লেটে ঢুকেছিল সার্থক। বেরিয়েই চমকে গেল। অন্ধকার উধাও। মিটমিট করে জ্বলা আলোরাও বিগত অতীত। তার বদলে মসৃণ এক শহর আলোয় আলোয় খিলখিল করে হাসছে। সিটে ফিরে আসতে বৃদ্ধ সহযাত্রী একগাল হেসে বললেন, ‘টোকিয়ো এসে গেছে।’

আগেই ফোনে কোথায় সার্থকের জন্য অপেক্ষা করবে বলে দিয়েছিল হারুকি। সেইমতো, পশ্চিমের দরজা দিয়ে স্টেশনের বাইরে বের হয়ে, রিজার্ভেশন কাউন্টারের কাছে যেতেই সে হারুকিকে দেখতে পেল। হেসে হাত বাড়িয়ে দিল হারুকি। বলল, ‘কোনও অসুবিধা হয়নি তো?’

সার্থক মাথা নেড়ে বলল, ‘না।’

গাড়িতে উঠে নিজে ড্রাইভারের সিটে বসল হারুকি। গাড়ি চলতে শুরু করল ফ্লাইওভার ধরে। এমন শহর সার্থক কেবল ছবিতে দেখেছে। আকাশে থেকে থেকে আগুনের ফুলকি ছড়িয়ে পড়ে রংবেরঙের ফুল হয়ে যাচ্ছে।

অবাক চোখে সেদিকে তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হারুকি বলল, ‘খুব কাছে সুমিদা নদী। প্রত্যেক বছর এই দিনে নদীর পারে আতশবাজির প্রদর্শনী হয়। তুমি খুব ভালো সময়ে এসেছ। আমরা নদীর পার ধরেই যাব। দেখতে পাবে–!’

‘তোমার বাড়ি কি কাছেই?’

‘ফ্ল্যাট…। হ্যাঁ কাছেই।’

আধঘণ্টার মধ্যে গাড়িটা বাঁক নিয়ে একটা বড়ো লোহার গেট পেরিয়ে খানিকটা গিয়ে থামল। সেখানে আরও অনেক গাড়ি রয়েছে। সার্থক বুঝতে পারল, এই অ্যাপার্টমেন্টের কোনও ফ্ল্যাটেই থাকে হারুকি ও তার বউ। সাজানো ফ্ল্যাটে ঢুকে, ড্রয়িংরুমে বসার পর, হারুকি বলল, ‘তুমি কি টয়লেটে যেতে চাও?’

সত্যিই শরীর এখন চাইছে স্নান। দ্রুত হাতে ব্যাগ থেকে রাতপোশাকটা বের করে টয়লেটে ঢুকল সার্থক। আহা, স্নানের ঘর যে এমন হয়, সে কি জানে দেশে তার পরিচিত মানুষরা? কত বড়ো বাথটাব! দেয়ালে কতরকম কলের প্যাঁচ। কোনটার কী কাজ কে জানে! জেনেই বা কী দরকার! দেশে তো বাড়ির বাইরের টিপকল থেকে বালতি বালতি জল টেনে এনে ছাদখোলা টিনের দরজাওয়ালা বাথরুমে স্নান করত তারা।

বাথটাবের কল ছেড়ে দিয়ে, সার্থক আক্ষরিক অর্থে গা ভাসাল। টয়লেটের বাইরে বের হয়ে দেখল ড্রয়িংরুমে পানীয় হাতে নিয়ে একাই বসে আছে হারুকি।

তাকে দেখে বলল, ‘একটু বোসো। আমার বউ এইমাত্র অফিস থেকে ফিরেছে। ওকে খবরটা দিয়ে আসি।’

সোফার নরম গদিতে প্রায় পুরোটাই ডুবে যায় সার্থক। সামলে নিয়ে সতর্ক হয়ে বসে। মাথাটা হেলিয়ে দিতেই বুজে আসে ক্লান্ত চোখদুটো। আর তখনই চোখের পর্দায় ভাসে সেই আশ্চর্য সুন্দর মুখটা। তার দেশের কেউ নয় সে, তার দেশের কারু মতো দেখতে নয় তাকে। তবু, সেদিন যখন সন্ধেবেলা গঙ্গার বুকে ভাসা নৌকোর ছইয়ের মধ্যে সে চেপে ধরেছিল সার্থকের হাতদুটি, তাকে দেখতে লাগছিল প্রতিমার মতো। সে মুখ ভোলার নয় কখনও। শুধু তাকে একটিবার দেখবে বলে, সে গিয়ে বসে থাকত দূতাবাসের উলটোদিকে চা-দোকানের ভাঙা চেয়ারে। শুধু জীবনধারণ নয়, তাকে খোঁজার জন্যও জাপানে আসা তার। তার নামও যে জানা হয়নি সেদিন।

হারুকির ডাকে ভাবনার সূত্রটা ছিঁড়ে গেল সার্থকের। হারুকি ফিরে এসেছে ঘরে।

‘সার্থক, এই হচ্ছে আমার বউ, মিকা–!’ তার পাশ থেকে কেউ রিনরিনে গলায় বলে উঠল, ‘হ্যালো!

জবাবে ‘হ্যালো’ বলতে গিয়ে উত্তেজনায় দাঁড়িয়ে পড়ল সার্থক। সেই মুখ। নরম দুটো চোখ। একবার সার্থকের দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি যেন মেঝেয় গেঁথে ফেলেছে মেয়েটা। তার মানে, সার্থককে সে আগেই চিনেছে। ধরা দিতে চায় না। সার্থকের কাছেও না, তার স্বামীর কাছেও না।

মিকা বলল, ‘আমি যাই। খুব ক্লান্ত। কাল কথা হবে–।’

সে চলে যেতে, নিজের মনেই একচোট হাসল সার্থক। তারপর অকম্পিত গলায়, ‘সি ইউ’ বলে সোফার নরম ঔদার্যে ডুবিয়ে দিল শরীর।

তার এখন জব্বর ঘুম পাচ্ছে।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব