স্বপ্ন ছোঁয়ার গল্প

বাথরুম থেকে মাঝেমাঝেই স্মিতার চুড়ির টুং টাং শব্দ আসছে। আর নাকে এসে লাগছে সুন্দর একটা সাবানের গন্ধ। অস্বচ্ছলতার মধ্যেও, এই একটা বিলাস স্মিতা ত্যাগ করতে পারেনি। স্নানের জন্য একটা সুগন্ধী সাবান সে ব্যবহার করে। আজ আর সকালে বেরোয়নি স্মিতা। নিশ্চয়ই অন্য কোনও কাজ আছে। তাই হয়তো একটু সময় নিয়ে স্নান করছে। ভিজে চুল পিঠের ওপর ছড়িয়ে একটা সুন্দর সুগন্ধের ঢেউ তুলে বাথরুম থেকে ঘরের দিকে গেল স্মিতা। একটুক্ষণ মুগ্ধ চোখে তাকিয়েই অনিকেতের মনে হল, খাবারটা বেড়ে দেওয়া দরকার। হয়তো খেয়েই বেরোবে স্মিতা। দুবেলা পরিশ্রম করে মুখ বুজে। এক এক সময় নিজেকে বড়ো অপরাধী মনে হয় অনিকেতের।

খাবার বলতে কেবল ভাত, আর আলুভাতে। দুপুরের খাবারের তালিকায় কোনও সবজি নেই। মাসের শেষ। সংসারখরচেও তাই টান পড়েছে। অনিকেত একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে খেতে বসল। ‘তুমিও এসো, একসঙ্গে খাই’– খুব আন্তরিকভাবেই সে ডাকল স্মিতাকে। স্মিতা তার স্ত্রী। তার সন্তানের মা। একটা স্কুলে পড়ায়।

বাইরে থেকে দেখলে অনিকেতকে খুব সংসারী বলে মনে না হলেও দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের যথাযথভাবে পেট ভরানোর মতো খাবারের অভাব প্রতিদিনই সে টের পায়। স্মিতা সংসারের এই বেহাল দশা লুকোনোর চেষ্টা করে। কিন্তু অনিকেত তো লেখক, তার অতিসংবেদি মনের আয়নায় ধরা পড়ে যায় সব কিছুই। সে খাবার তুলতে পারছিল না মুখে। কেন এমন হয় যে, সম্ভাবনাময় লেখকেরা কখনওই কেবল লিখে জীবনধারণ করতে পারেন না? অনিকেত খুব জনপ্রিয় লেখক নয়। তার লেখার আবেদন এক বিশেষ শ্রেণির পাঠককুলের কাছে। সাধারণ পাঠক পাঠিকাদের কাছে সে ‘সিরিয়াস’ লেখক। বারো বছরেরও বেশি সময়ের লেখকজীবনে বিভিন্ন পত্রিকায় তার কমবেশি ৫০টি গল্প প্রকাশিত হয়েছে। যদিও না-ছাপা লেখার সংখ্যা অনেক বেশি।

এ যাবৎ মাত্র একটি গল্পসংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে অনিকেতের। প্রকাশক খুব নামি নয়। প্রত্যেকটি গল্পে অনিকেত ডুব দিয়েছে চরিত্রের মানসিকতার গভীরে। প্রত্যেকটি গল্পের শেষভাগে থাকে টানটান উত্তেজনা। যখনই কোনও পত্রিকায় তার লেখা ছাপা হয়, অনিকেতের মানসিক জোর সেই সময়ের জন্য অনেকখানি বেড়ে যায়। পাশাপাশি যে সাম্মানিক পাওয়া যায়, তা যত সামান্যই হোক, তা দিয়ে সংসারের কিছু সুরাহা হয়। কিন্তু এরকম তো সবসময় হয় না!

‘বই ভালো বিক্রি হচ্ছে না দাদা’, প্রকাশকের মুখোমুখি হলেই তার এক কথা। কয়েকশোবার সে অনিকেতকে একথাটা বলেছে। অতএব, সে বেচারা আর কী করে রয়্যালটি দেয়। পত্রপত্রিকাগুলোও আজকাল ভালোর কদর না করে সাধারণ মানুষ যা চায় তাই ছাপতে উৎসাহী। ফলে সার্বিকভাবে সাহিত্যের গুণগত মানও কমে যাচ্ছে। ফলে প্রত্যেক মাসেই মূল পান্ডুলিপিসমেত ‘দুঃখিত, আপনার লেখাটি মনোনীত করা গেল না’ লেখা চিরকুট পাওয়ার পরও কোনও মনোজ্ঞ পাঠকের প্রশংসা অনিকেতকে নতুন লেখার উৎসাহ যুগিয়ে দেয়।

এই লেখালেখির প্রবণতাই আগের তিনটি চাকরি খোয়ানোর মূল কারণ। শেষ চাকরিটা যাওয়া ইস্তক অনিকেত খুবই বিমর্ষ হয়ে পড়েছে। সে একজন বিবাহিত পুরুষ। বাড়িতে তার যুবতি স্ত্রী রয়েছে। রয়েছে ছোট্টো একটি শিশুসন্তান। কী করে এই সংসার চালাবে সে?

অনিকেতের মনে হয়, গৃহস্থ মানুষের স্বপ্ন দেখাই উচিত নয়। সে মাঝেমধ্যেই ভাবে, শেষ চাকরিটির মালিকের কাছে গিয়ে আবার হারানো চাকরিটি ফিরে পাওয়ার জন্য তদ্বির করে আসবে। যে-কোনও উপায়ে তাকে একটি চাকরি পেতেই হবে।

স্মিতা কিন্তু কোনওমতেই মানতে রাজি হল না সে কথা। সে স্পষ্ট বলল, ‘না অনিকেত। তুমি একজন সৃষ্টিশীল মানুষ । কেরানি নও। আমার তো একটা চাকরি আছে। কোনওরকমে দুমুঠো ডালভাত আমার টাকায় জুটে যাবে। তুমি চিন্তা কোরো না। আমি জানি, তুমি একজন সর্বসময়ের লেখক হতে চাও। তাই হও। আমি তোমার পাশে আছি। দেখবে একদিন তোমার লেখার জন্য অনেক সম্মান পাবে তুমি। আর, তা যদি না-ও পাও, একথাটা তো ঠিক, এই কাজেই তুমি সবচেয়ে সুখী। সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’

অনিকেতের দু’চোখ জলে ভিজে এল। কোনও কথা না বলে নীরবে সে শুধু তার দু’হাত স্মিতার দু’কাঁধে রাখল। আর কীভাবেই বা সে তার কৃতজ্ঞতা জানাতে পারে? স্মিতার স্যাক্রিফাইস ছাড়া তার যাবতীয় প্রচেষ্টা জলে যেত। তার প্রতিভার উপর স্মিতার আস্থা তাকে সাফল্যের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলল।

অনিকেতের লেখার ঘর বাড়ির সামনের দিকের ছোটো ঘরটা। সে লেখার টেবিলে বসতে গিয়ে দেখল দরজার কাছে মেঝের উপর ডাকবিভাগের দুটো খাম পড়ে আছে। ডাকপিওন এসে সম্ভবত জানলা দিয়ে ফেলে গেছে। অনিকেত খামদুটি হাতে নিল। সে আগে লম্বা খামটি নিয়েই পড়ল। খুব নামি পত্রিকা থেকে এসেছে।  এক মাস আগে এই ছোটোগল্পটা লিখে পাঠিয়েছিল অনিকেত। সেটাই ফেরত এসেছে, সঙ্গে ‘দুঃখিত, মনোনীত হল না’ লেখা চিরকুট। আলগোছে খামসহ পাণ্ডুলিপিটাকে টেবিলের উপর ফেলে দিল অনিকেত। দ্বিতীয় খামটা দেখে সে খুব খুশি হয়ে উঠল। খামের উপরে বাঁদিকে পত্রিকার নাম লেখা। মাস দুই আগে এই পত্রিকায় একটা অণু-উপন্যাস পাঠিয়েছিল সে। সাধারণ আকৃতির হালকা খামে সব সময় ভালো খবরই আসে।

তবু একটু উৎকণ্ঠা নিয়ে সে খামের মুখটা ছিঁড়ল। এবং দেখল, তার ভাবনাটাই ঠিক। লেখাটা মনোনীত হয়েছে। সম্পাদক অণু-উপন্যাসটি সম্পর্কে চিরকুটে লিখেছেন, লেখাটি ‘সুন্দর আর

সংবেদনশীল’ হয়েছে। সম্পাদকের মন্তব্য উদ্বেল করে তুলল তাকে। সাহিত্যের পাঠক-সমালোচক মহলে পত্রিকাটির গুরুত্ব রয়েছে। খুবই শিল্পমনস্ক ত্রৈমাসিক সাহিত্য-পত্রিকা হিসাবে যথেষ্ট নাম রয়েছে। আর সেই পত্রিকাই কিনা তার লেখাকে বলছে সুন্দর আর সংবেদনশীল!

পত্রিকাটির সাম্প্রতিকতম সংখ্যাটি দশদিনও হয়নি প্রকাশিত হয়েছে। এর একটি কপি সে কিনেওছে। যদি ধরেও নেওয়া হয় তার অণু-উপন্যাসটি আগামী সংখ্যাতেই প্রকাশিত হবে, তা হলেও এখনও তিন মাস দেরি। একটু দমে গেল অনিকেত। সাফল্যের স্বাদ পেতে তিন মাস সময়টা এমন কিছু বেশি নয়। কিছুক্ষণের জন্য চোখ বুজে বসে রইল সে। সাফল্যের স্বাদটা উপভোগ করতে চাইল। এরকম নামি পত্রিকায় আর কয়েকটা লেখা ছাপা হলেই আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তার একটা স্থায়ী জায়গা তৈরি হতে পারে। লেখাটি ছাপা হবে তিন মাস পরে। সাম্মানিক পাওয়া যাবে লেখা প্রকাশিত হওয়ার পর। সে কি একবার সম্পাদকের সঙ্গে দেখা করে কিছু অগ্রিম চাইবে? পেয়ে গেলে আজই পরিবারসমেত রাতে ভালোমন্দ কিছু খাওয়া যেতে পারে। পেটভরে খেয়ে একবার তৃপ্তির চোখে তাকাবে স্মিতা, এই তার সুখ। এই সুখের প্রতি যে খুব লোভ অনিকেতের!

পরমুহূর্তেই তার মনে হল, অগ্রিম চাওয়াটা কি উচিত কাজ হবে? একজন লেখকের কাছে আত্মমর্যাদা অনেক মূল্যবান। কী করে অনিকেত সেই আত্মসম্মানকে বিসর্জন দেবে? একজন লেখক, যিনি ‘সুন্দর এবং সংবেদনশীল’ লেখালেখি করেন, তার কি এরকম ব্যবহার করা সংগত? স্মিতাই বা কী ভাববে?

‘অনিকেত,’ স্মিতা ডাকল। পরিপাটি সুতির শাড়ি পরে আছে। সুন্দর করে চুল আঁচড়ে ক্লিপে আটকেছে চুলের ঢাল। ডান কাঁধে হ্যান্ডব্যাগ। অন্য হাতে অনিকেত-স্মিতার সন্তান। ‘বেরোচ্ছি, বুঝলে? আজ একবার ডিআই অফিসে যেতে হচ্ছে। বাবানকে খাইয়ে দিয়েছি। দুপুরে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ো। রান্নাঘরে দুধ গরম করা আছে। বিকেলে ওকে খাইয়ে দিয়ো। কেমন? আমি তাড়াতাড়িই ফেরার চেষ্টা করব।’

‘আমি সব করে রাখব। তুমি কোনও চিন্তা কোরো না।’

মঞ্জুরি-চিঠিটাকে খামে ঢুকিয়ে রেখে অনিকেতও লিখতে বসল। সাড়ে চারটে নাগাদ হঠাৎ-ই তার পুরোনো সহকর্মী হরি এসে হাজির। অনিকেতের শেষ চাকরির জায়গায় গৌরহরি ছিল স্টেনোগ্রাফার।

‘কেমন আছো অনিকেত? আশা করি ভীষণ সৃষ্টিশীল হয়ে আছো।’ হাসতে হাসতে বলল হরি।

‘আরে, সেরকম কিছু না। ভেতরে এসো।’ ততোধিক আন্তরিকতা নিয়ে হরিকে আমন্ত্রণ জানাল সে।

‘কিন্তু, একটা কথা মানতেই হবে ভাই, তুমি দুর্দান্ত লেখো। সেদিন তোমার একটা বই পড়ছিলাম। প্রত্যেকটা গল্পই এত উচ্চমানের যে ভাবা যায় না!’

প্রশংসায় অনিকেতের মুখচোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে জানত, হরি মন-রাখা কথা বলার লোক নয়। সে সলজ্জ হয়ে বলল ‘থ্যাংক ইউ হরি। আগে তুমি বসো।’

অনিকেত খানিকক্ষণ কথা বলার পর উঠে চা করল। হরি অনেকদিন পরে এসেছে। ইচ্ছে হচ্ছিল ওকে কফি খাওয়ানোর। কিন্তু কফির চেয়ে চায়ে কম দুধ দিতে হয়। সুতরাং সে চা-ই করল । ইতিমধ্যে ছেলেও উঠে পড়েছে। কিছুক্ষণ ছেলের সঙ্গে খেলল সে। খানিকক্ষণ পরে হরি আবার বলল, ‘এবার আর একটা বই প্রকাশ করো অনিকেত।’

‘ইচ্ছে হয়। যতই বিভিন্ন ম্যাগাজিনে একটা-দুটো করে লেখা বের হোক, বই হচ্ছে এমন একটা জিনিস যা আসলে একজন লেখকের আস্ত পরিচয় বহন করে। কিন্তু, আমার বই বের করবে কে, হরি? আমি সেই অর্থে জনপ্রিয় লেখক নই। আমার পাঠক সীমিত। আমার পাবলিশার তো বলে থাকে, আমার বই নাকি বিক্রিই হয় না।’

‘তাই নাকি? তোমাকে এই কথা বলেছে? বিক্রিই যদি না হবে তাহলে তোমার বই-এর দ্বিতীয় সংস্করণ বের হল কীভাবে?’

‘কী বলছ?’ অনিকেত উত্তেজনায় ঢোঁক গিলে বলল, ‘দ্বিতীয় সংস্করণ?’

‘আসলে আমি যে-বইটা পড়েছিলাম সেটা দ্বিতীয় সংস্করণ।’

‘বলছ কী? তুমি ঠিক দেখেছিলে?’

‘আলবাত।’

‘লোকটা তো পাকা জালিয়াত দেখছি! প্রত্যেকবার যখন রয়্যালটির জন্য গেছি, লোকটা মুখের উপর বলেছে, ‘আপনার বই বিক্রি হয় না’। একবার মাত্র রয়্যালটি দিয়েছে। প্রথম যখন বইটা বের হল, অগ্রিম হিসাবে দু’হাজার টাকা দিয়েছিল। সেও তিন বছর আগে। বলেছিল, বই বিক্রি হলে আস্তে আস্তে বাকি টাকা পাওয়া যাবে।’

‘ভালোমানুষকে কীভাবে ঠকতে হয় দেখেছ? একটা পুরো সংস্করণের জন্য কত পাওনা হয় তোমার?’

‘পনেরো হাজারের মতো।’

‘আর, এই সামান্য টাকার জন্য লোকটা তোমায় ঠকাল! তোমার বই-এর ভালো কাটতি হওয়া সত্ত্বেও!’

সন্ধে নাগাদ চলে গেল হরি। তার মুখ থেকে দ্বিতীয় সংস্করণ বের হওয়ার কথাটা জানা ইস্তক খুবই অশান্ত হয়ে ছিল অনিকেতের মনটা। স্মিতা ফিরতেই সে পুরো ঘটনাটা বিবৃত করল। বলল, ‘কাল বদমাশ লোকটার কলার চেপে ধরে আমি পুরো পাওনা বুঝে নেব।’

কলেজ স্ট্রিটের এক সরু অন্ধকার গলির মধ্যে তার বই-এর দোকানে নিশ্চিন্তে বসে ছিল বিপ্লব দত্ত। দোকানে কোনও দ্বিতীয় ব্যক্তি নেই। দূর থেকে অনিকেতকে আসতে দেখেই জোড়হাত করে উঠে দাঁড়াল সে। চোখেমুখে শ্রদ্ধা, আন্তরিকতা, উৎসাহের ভঙ্গি মিশিয়ে বলল, ‘আসুন, আসুন অনিকেতবাবু। ভীষণ খুশি হয়েছি, আপনি এসেছেন। বসুন। বলুন, চা না কফি।’ তেতো গলায় বলল অনিকেত, ‘বিপ্লব, আমি তোমার আতিথেয়তা পেতে আসিনি। আমি কাজে এসেছি।’

‘ওঃ কাজ! আপনিও স্যার এমন বলেন–।’ দেঁতো হাসি হেসে বলল বিপ্লব। অনিকেত তার আপাদমস্তক ভালো করে দেখে নিল। চল্লিশের এপাশেই বয়স হবে। উজ্জ্বল সাদা পাজামা আর পাঞ্জাবিতে খুবই স্মার্ট দেখাচ্ছে। নিষ্পাপ মুখচোখ বজায় রেখে একটা লম্বা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বিপ্লব বলল, ‘আপনি একজন এরকম উঁচুমানের লেখক, আপনিও কিনা সাধারণ লেখকদের মতো বিজনেসের কথা বলেন? মনে বড়ো ব্যথা দিলেন–।’

‘রয়্যালটি চাইছেন? কীসের রয়্যালটি স্যার? কতবার আমি আপনাকে বলব, আপনার বই একেবারেই…’

‘বিক্রি হয় না, তাই তো? বেশ, সেইজন্যে বুঝি বইটার দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপাতে হল?’

‘দ্বি-দ্বিতীয় সংস্করণ?’ হাসার চেষ্টা করে বিপ্লব বলল, ‘এইসব গল্প কে শুনিয়েছে আপনাকে বলুন তো?’ কোনও কথা না বলে অনিকেত উঠে দেয়ালের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত টানা বই-এর র‍্যাকগুলির দিকে এগোল। র‍্যাকের একধারে তার বইটির অসংখ্য কপি রাখা রয়েছে। সুন্দর সোনালি হরফে বইটির শিরোনাম ও তার নাম সে দেখতে পেল বাঁধাই-এর ধার বরাবর। প্রত্যেকবার যখন এই অফিসে বিপ্লবকে সে রয়্যালটির কথা বলতে এসেছে, এই তাকগুলিকে দেখিয়েই বিপ্লব বলেছে, ‘দেখেছেন তো, বইগুলি যেমন ছিল তেমনভাবেই রয়েছে। বিক্রিই হয় না। যদি বিক্রিই হতো, তাহলে কি আপনাকে রয়্যালটি দিতাম না, বলুন! অনিকেত কোনওদিনও তার কথায় অবিশ্বাস করে বইগুলো হাতে তুলে দেখেনি। নতমুখে বের হয়ে এসেছে। কী ভুলই যে করেছে! আজ আর সেই এক ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটাবে না সে। সে দ্রুত পায়ে র‍্যাকের সামনে এসে দাঁড়াল। একটি কপি তুলে প্রচ্ছদ উলটে দ্বিতীয় পাতায় আসতেই মুদ্রণ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য চোখে পড়ল। হরি ঠিকই বলেছিল, অনিকেতও দেখল, লেখা আছে, ‘দ্বিতীয় সংস্করণ। ফেব্রুয়ারি ২০১৫’। বিপ্লবের টেবিলের উপর সশব্দে বইটির ওই পাতাটি খোলা অবস্থায় রাখল অনিকেত।

‘এর মানে কী বিপ্লব?’ বলতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল তার।

‘স্যার, আমায় ভুল বুঝবেন না…আপনি জানেন না, কী ভীষণ আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে আমাকে।’ বিপ্লবের মুখ ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল। তা সত্ত্বেও ক্রমাগত কাহিনির জাল বুনে যাচ্ছিল সে। অনিকেত সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে সাফ বলল, ‘তোমাকে দেখে তা মনে হয় না। এই জায়গাটারও তো যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। শেষবার যখন এখানে এসেছিলাম, এটা ছিল একটা বই-এর দোকান। এখন তো দিব্যি প্রকাশনা সংস্থার মতো মনে হয়।’

বিপ্লব বলল, ‘না স্যার। সেসব কিছু হয়নি। বিশ্বাস করুন। আমার সত্যি অনেক আর্থিক দায়দায়িত্ব রয়েছে।’

‘আরে সে তো জানি! আমাকে আমার পাওনাটুকু মিটিয়ে দেওয়ার দায়িত্বই শুধু তোমার নেই। প্রথম সংস্করণের সবক’টি কপি বিক্রি হয়ে যাওয়ার দরুন আমার পাওনা হয় পনেরো হাজার টাকা। তুমি আমাকে দু’হাজার টাকা অগ্রিম দিয়েছিলে। সুতরাং এখন তোমায় দিতে হবে পনেরো হাজার মাইনাস দু’হাজার… এক্ষুনি আমার টাকাটা আমি চাই।’

‘স্যার, আমি ধারের টাকায় ব্যাবসা চালাচ্ছি। শুধুমাত্র এই আশায় যে, আমার বইগুলো ভালো ব্যাবসা করবে। সব লেখকরাই তো নামকরা। আর আপনি সকলের মধ্যে সেরা…’

‘আমি ওসব অনেক শুনেছি বিপ্লব। আমার টাকা…।’

‘স্যার, একটা কথা বোঝার চেষ্টা করুন। বই বাজারে কাটুক বা না কাটুক, কম্পোজিটর, প্রুফ রিডার, শিল্পী, ছাপাখানা, বাঁধাইওলা, পরিবেশক—ওদের সকলকে আমায় টাকা দিতে হয়।’

‘ওদের কেউ বিনা টাকায় কাজ করবে না, তাই না?’

‘ঠিক। ওরা কি ছেড়ে দেবে বলুন?’

‘অর্থাৎ, সবার সব পাওনা তোমায় মিটিয়ে দিতে হয়, শুধু লেখকদেরই না দিলেও চলে।’

‘স্যার, আমায় শুধু একটু সময় দিন। আমার সময়টা ফিরুক। এই মুহূর্তে আমার কাঁধে পরিবারের অনেক দায়দায়িত্ব রয়েছে। আমার বোনের স্বামী হঠাৎ মারা গেল…।’

‘তোমার অর্নগল মিথ্যে বলা আমায় ক্লান্ত করে বিপ্লব।’ অনিকেত দেখল, মিথ্যে ধরা পড়ে যাওয়ায় সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে বিপ্লবের। সে বলল, ‘আমি তো আপনার শত্রু নই। আমরা তো বন্ধু। এখন একটু টানাটানির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। দেখি, এই মুহূর্তে কতটা দেওয়া যায়…। আমি আপনাকে ইতিমধ্যে দু’হাজার দিয়েছি। এখন আরও হাজার দিচ্ছি। তাহলেই তিন হাজার হয়ে গেল। কী…?’ উৎসুক চোখে সে তাকাল অনিকেতের দিকে।

‘আমি দান-খয়রাত চাইছি না বিপ্লব। আমার পাওনা বুঝে নিতে এসেছি। চলি–।’ অনিকেত উঠে দাঁড়ায় ও চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়।

‘আরে, না না, যাবেন না। আমি না হয় আরও এক হাজার টাকা দিচ্ছি। বাকিটা, সত্যি বলছি, আস্তে আস্তে দিয়ে দেব।’

অনিকেত চলে যেতে গিয়েও দাঁড়াল। এখন হাতে দু’হাজার টাকা মোটেও কম টাকা নয়। বিশেষ করে এই সময়ে। পেলে সংসার নিয়ে ব্যাতিব্যস্ত স্মিতা অন্তত কয়েকদিনের জন্য হাঁফ ছাড়বে। কিন্তু বিপ্লব বাকি টাকাটা দেবে তো?

‘ঠিক আছে দাও দু’হাজার টাকা। এক মাসের মধ্যে বাকি টাকাটা কিন্তু দিতে হবে।’

‘নিশ্চয়ই স্যার, নিশ্চয়ই। তবে আমার অবস্থা…’

‘আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি স্যার। আপনি একজন আপাদমস্তক ভদ্রলোক। আপনার লেখারও আমি একজন ভক্ত। আসলে,’ চশমার উপর দিয়ে অনিকেতকে দেখে নিয়ে সে বলল, ‘আপনি যদি রাজি থাকেন, তাহলে আপনার আর একটা বই আমায় দিন। আর একটা গল্পসংগ্রহ।’

অনিকেত একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘মানে?’

‘মানে, বলতে চাইছি, পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এমন গল্প কি আছে আপনার কাছে। অপ্রকাশিত গল্প হলেও চলবে।’

‘বই বের করার টাকা কোথায় পাবে?’

‘ধার করব স্যার। এভাবেই তো করি। ঝুঁকি হলেও এবার আমি অনেকটা নিশ্চিত কারণ, আপনি খুব ভালো লেখেন। লোকেও আপনার লেখা নিতে শুরু করেছে। আপনার বই ভালো কাটলে আমার অন্য বইগুলোও পাঠকরা নেবে। আমি একটু সুখের মুখ দেখব স্যার। তখন আপনার সব পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দেব। যতটা ভাবছেন, ততটা অসৎ লোক আমি নই।’

অনিকেতের হূৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল। এক আশ্চর্য কিশোরসুলভ উত্তেজনায় বড়ো বড়ো হয়ে গেল তার চোখদুটো। আর একটি বই! সে যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। ‘কতগুলো গল্প চাই তোমার বিপ্লব?’ বলতে গিয়ে গলা কেঁপে গেল তার।

বিপ্লব মৃদু হাসল। ‘কুড়িটার মতো গল্প দিতে পারবেন?’

‘কুড়িটার বেশি দিতে পারব। প্রকাশিত হয়েছে এমন গল্প, অথচ প্রথম বইতে নেই কিন্তু এবার আর পনেরো নয়, তোমাকে দিতে হবে পঁচিশ।’

অনিকেতের মনে হল, কেউ যেন তার ফুসফুসে বাড়তি কিছু তাজা অক্সিজেন ভরে দিয়েছে। পাবলিশারের অফিসের বাইরে এসে সে লাফিয়ে যখন বাসে উঠল, তার মনে হল, সে যেন নিজের মধ্যে নেই। যেন মাটিতে তার পা নেই। যেন সুখের সমুদ্রে সে ভেসে বেড়াচ্ছে। বসতে জায়গা পেল না সে, তবু একটুও অস্বস্তি হল না তার। বদলে সে ভাবতে লাগল কোন গল্পগুলো যথাযথ হবে। অনিকেতের মনের পটে ভেসে উঠতে লাগল তার প্রিয় সৃষ্টিগুলি। কোনওরকমে বাড়ি পৌঁছে স্মিতার হাতে রয়্যালটির টাকাগুলো তুলে দিতে সে খুব খুশি হয়ে উঠল।

স্মিতা বলল ‘বাঃ। তোমার প্রকাশক তাহলে তোমাকে কিছুটা রয়্যালটি দিল শেষ পর্যন্ত। বাকিটা কবে দেবে গো?’

‘জানি না… কিন্তু আমি আর ওকে এর জন্য চাপ দিতেও চাইছি না। বেচারা। ও নানারকম ব্যাপারে ফেঁসে আছে। তাছাড়া…, ‘এবার নরম আর নীচু হয়ে এল অনিকেতের গলা,’ ও আমার আর একটা বই প্রকাশ করতে চাইছে।’

‘তাই?’ রীতিমতো লাফিয়ে উঠে বলল স্মিতা।

‘আজ দিনটা বড্ডো সুন্দর। চলো স্মিতা, সেলিব্রেট করি। বাইরে কোথাও যাই। রাতের খাবারটা বাইরেই সেরে আসি। অনেকদিন পেটভরে কিছু ভালোমন্দ খাওয়া হয়নি। ছেলের জন্য আইসক্রিমও কিনে আনব।’

পরের সন্ধেয় অনিকেত গেল হরির কাছে। হরি বাড়িতেই ছিল। অনিকেত বলল, ‘হরি, কাল আমি তোমার অফিসে আসছি। ম্যানেজারবাবুকে একবার রিকোয়েস্ট করবে আবার একটা কাজের যাতে ব্যবস্থা করে দেয়? আমি ওকে বলব, আর কোনওদিন অফিসে বসে গল্প লিখব না। আমি একটু আর্থিক অনটনে আছি হরি, তুমি জানো। আমার হয়ে একটু বলবে ম্যানেজারবাবুকে?’

ঝলমলে গড়িয়াহাট, দুপাশে পশরা সাজিয়েছে দোকানদাররা। ট্রামটা এসে থামতেই এক লাফে উঠে পড়ল অনিকেত। বুকের বাঁদিকটা অনেকটা হালকা লাগছে আজ। একটা কিছু সুরাহা যেন হয়ে যাবে। যাবেই। হঠাৎই এই কৃতঘ্ন শহরটাকে যেন, অনেক বেশি উজ্জ্বল মনে হল অনিকেতের।

 

টান

আজ ক’দিন ধরেই মেজাজ বিগড়ে রয়েছে আত্রেয়ীর। ছেলেটার জন্য বড়ো দুশ্চিন্তায় পড়েছে। কী যে করবে ছেলেটাকে নিয়ে। ছেলের দিকে নজর দেবে নাকি সংসারের দিকে। সংসারে সাহায্য করার মতো তো আর দ্বিতীয় লোক নেই। বছর চরেক আগেও আত্রেয়ীদের জয়েন্ট ফ্যামিলি ছিল। ভাসুর, দেওর, জা নিয়ে একেবারে ভরাভর্তি ফ্যামিলি। তারাও তো এখন যে-যার কর্মসূত্রের কারণে শহরের বাইরে থাকে। এখন আত্রেয়ীর সংসার বলতে তারা স্বামী-স্ত্রী, বছর দশ এগারোর এক ছেলে আর শাশুড়ি। শাশুড়িও বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে। তবে নাতি অন্ত প্রাণ। তার সামনে নাতিকে কিছু বলা যাবে না। সেটা নিয়েই আত্রেয়ীর যত আপত্তি। সারাদিন সংসারে সব ঝক্বি-ঝামেলা মুখ বুঝে সামলাবে কিন্তু ছেলে শাসন করার সময় কেউ কিছু বললেই মাথা গরম হয়ে যায় তার। এই নিয়ে মাঝেমধ্যে লেগেও যায় শাশুড়ির সঙ্গে। একে মনসা তায় আবার ধুনোর গন্ধ। দিনচারেক হল আবার আত্রেয়ীর বড়ো ননদ সহেলী এসেছে এবাড়িতে। ব্যস পিসি আর ঠাম্মার প্রশ্রয়ে আরও মাথায় উঠেছে ছেলেটা। শুধু জেদ আর জেদ। সকাল থেকে মায়ের পিছন পিছন ঘুরছে অমূলক বায়না নিয়ে।

‘মা আমায় সিডি প্লেয়ারটা দাও না। কখন থেকে চাইছি। দাও না।’ মায়ের আঁচল ধরে টানতে থাকে বিট্টু।

‘দেব না যখন বলেছি, তখন কোনওমতেই তোকে আমি ওটা দেব না। মাথা খারাপ করিস না। যা এখান থেকে।’

‘কেন দেবে না, তুমিই তো বলেছিলে দেবে। তাহলে এখন কেন না বলছ। আমি কিছু জানি না, আমার ওটা চাই।’ জেদ বেড়ে যায় বিট্টুর।

ছেলের কথায় ঝাঁঝিয়ে ওঠে আত্রেয়ী। হ্যাঁচকা মেরে আঁচলটা ছাড়িয়ে নেয়। ‘খুব সাহস হয়েছে নারেতোর। আমি বলে দিচ্ছি এক্ষুনি এখান থেকে চলে যা, নইলে চ্যালাকাঠ ভাঙব তোর পিঠে।’ আরও জেদ চেপে যায় বিট্টুর। হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে সামনে বসে থাকা বড়োপিসিকে অনুনয়ের সুরে বলে, ‘বড়োপিসি তুমি বলো না সিডি প্লেয়ারটা দিতে, তুমি বললে মা শুনবে।’ ছোট্ট ভাইপোর অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারে না সহেলী। এতক্ষণ বউদিকে হাতে হাতে সাহায্য করতে গিয়ে সবই তার চোখে পড়েছে।

‘দিয়ে দাও না আত্রেয়ী, সামান্য একটা জিনিসই তো চাইছে। দ্যাখো তো কেঁদে কেঁদে ছেলেটার চোখমুখ একেবারে ফুলে গেছে।’

‘প্লিজ দিদি, এই নিয়ে তুমি আর কিছু বলতে এসো না। প্রশ্রয় পেয়ে পেয়েই ছেলেটা আরও বিগড়ে যাচ্ছে। এইটুুকু ছেলের জেদ দেখেছ, যেটা চাই বলবে সেটা চাই-ই। দিন দিন একেবারে বাঁদর তৈরি হচ্ছে।’

‘মানলাম আমরা একটু বেশিই আদর-আহ্লাদ দিই। কিন্তু তুমিই তো ওকে প্রমিস করেছিলে। প্রমিস করে কথার খেলাপ করাও তো ঠিক নয়।’ বলেই বিট্টুর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দেয় সহেলী। ‘কাঁদিস না বাবু, বিকেলে আমি তোকে একটা আইপড কিনে দেব।’

বড়ো ননদের কথার ভঙ্গি দেখে মাথা আগুন হয়ে যায় আত্রেয়ীর। কোনওমতে রাগ সংবরণ করে নিয়ে বলে, ‘যদি বা দিতাম, এখন তো আর দেবই না।’ রাগে গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় আত্রেয়ী। বিট্টুও বড়োপিসির কথায় খানিক আশ্বস্ত বোধ করে অন্য খেলনা নিয়ে মেতে ওঠে।

দুপুরে লাঞ্চ সেরে ননদ, ভাজ মিলে বিছানায় গড়িয়ে নিতে নিতে সংসারের নানারকম আলোচনা হতে থাকে। বিট্টুর প্রসঙ্গ উঠতেই আত্রেয়ীর চোখেমুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উঠে বসে পড়ে সে। ‘এই ছেলেটা আমাকে পাগল করে দেবে দিদি। কারওর কথা শোনে না। পড়াশোনার কথা তো ছেড়েই দাও। সারাক্ষণ শুধু দুষ্টুবুদ্ধি মাথায় পাক খেতে থাকে।’

‘কী যা-তা বলছ আত্রেয়ী। বিট্টু কত বিনয়ী, পড়াশোনায় ভালো, আর কী চাই তোমার? তাছাড়া ও এখন ছোটো, তুমি যেভাবে গড়েপিঠে মানুষ করবে, ও ঠিক তেমনটাই তৈরি হবে।’ আত্রেয়ীকে বোঝানোর চেষ্টা করে সহেলী।

‘আমার হাতে কী আছে বলো? সংসারটা কি শুধু আমার একার?’ বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আত্রেয়ী। তারপর আবার বলতে শুরু করে, ‘যখনই ওকে বোঝাতে যাই, কেউ না কেউ মাঝখানে এসে কথা কাটবেই। যেভাবেই হোক আমাকে ভুল প্রমাণ তাদের করতেই হবে। এরকম চললে বাচ্চারাও তো কনফিউজড্ হয়ে যায় বলো। তারাও তো ঠিক করতে পারবে না কোনটা ঠিক কোনটা ভুল। এই পরশুদিনের কথাই ধরো না, তোমার ভাইয়ের বস আর তার দুই ছেলেমেয়ে এসেছিল বাড়িতে। ওদের জন্য রসগোল্লা আর কিছু স্ন্যাকস্ আনা হয়েছিল। সকলের প্লেটেই দু’টো রসগোল্লা আর স্ন্যাকস্ সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বিট্টুকেও তাই। সকলের জন্য ম্যাঙ্গো শেক আনতে রান্নাঘরে ঢুকেছি, সেইসময় সেখানে গিয়ে বিট্টুর বায়না, ‘মা আমাকে আরও দুটো রসগোল্লা দাও।’

আমি বললাম, ‘ঠিক আছে ওরা যাক, তারপর খেয়ে নিস। সত্যি বলতে কী, সকলকে আর দু’টো দেওয়ার মতো অত আনেনি সেদিন তোমার ভাই। ওকে বোঝাতে ও মেনেও গিয়েছিল, কিন্তু মাঝখানে মা এসে বলতে লাগলেন, ‘দু’টো রসগোল্লাই তো খেতে চেয়েছে’ বলে ওকে দিয়ে চলে গেলেন। সে-ও প্লেট হাতে সোজা গেস্টদের সামনে। সম্মানটা থাকে তুমি বলো? ঠিক সেই কারণেই আমি পরে দেব বলেছিলাম। এখন তুমিই বলো ওকে আমি সঠিক শিক্ষা দেব কেমন করে? পড়ানোর সময়ও ঠিক এমনটাই ঘটে। পড়া না পারলে একটু বকলে মা চলে আসবেন, ব্যস ইনিও পড়াশোনার পাট তুলে দিয়ে ঠাম্মার অাঁচলের তলায় গিয়ে লুকোবে। এভাবে ছেলে মানুষ করা যায়! এখন পড়ার নাম শুনলেই তার গায়ে জ্বর চলে আসে।’

‘হাফ-ইয়ারলির রেজাল্ট আউট হয়েছে না? কেমন নাম্বার পেয়েছে?’ প্রশ্ন করে সহেলী।

‘রেজাল্ট নিয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসা কোরো না। এখন তো মিথ্যে বলতেও শিখে গেছে।’ ভারি মনমরা দেখায় আত্রেয়ীকে।

‘কেন, কী এমন করেছে যে এরকম করে বলছ?’

‘কয়েকদিন ধরেই ওকে জিজ্ঞাসা করছি, কীরে পরীক্ষার খাতা দেখায়নি। সমানে মিথ্যে বলে গেল। দিন সাতেক পর ওর ক্লাসেরই এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে জানতে পারি খাতা বেশ কয়েকদিন আগেই দেখানো হয়ে গেছে।’ চোখ চিকচিক করে ওঠে আত্রেয়ীর। সান্ত্বনা দিতে আত্রেয়ীর হাতটা চেপে ধরে সহেলী।

‘জানো দিদি ওর বন্ধু সৃঞ্জয় বলল, ‘কেন আন্টি বিট্টু তোমাকে কপি দেখায়নি? ও-তো এবারে চারটে সাবজেক্টে পাশ মার্ক তুলতে পারেনি।’ লজ্জায়, অপমানে মুখটা কোথায় লুকোব ঠিক করতে পারিনি। সৃঞ্জয়ের মায়ের ওই তীর্যক হাসি যেন আমাকে দুমড়ে-মুষড়ে এক করে দিচ্ছিল। কোনওরকমে পালিয়ে আসি ওদের বাড়ি থেকে।’ নিজেকে সামলাতে পারে না আত্রেয়ী। গাল বেয়ে জল নেমে আসে তার।

সব শুনে সহেলীও অবাক হয়ে যায়, ‘কী বলছিস রে, আমাদের বিট্টু!’ কথা শেষ করতে পারে না সহেলী। তার আগেই আত্রেয়ী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে ওঠে, ‘তাহলে আর বলছি কী! প্রথমে কী বলে, মারধোর করতে তবে গিয়ে স্বীকার করল সব। এখন তুমিই বলো আমি কী করব? এখানেই শেষ নয় রিপোর্ট কার্ডটা পর্যন্ত আমাদের হাতে দেয়নি জানো। বেশ কয়েক সপ্তাহ পরে ওয়াশিং মেশিনের নীচ থেকে ওটা পেয়েছি। আর কী বলব তোমাকে, মাসিক রিপোর্ট কার্ডে পর্যন্ত তোমার ভাইয়ের সইটা নকল করে জমা দিয়েছে। আমি ফেড-আপ হয়ে গেছি।’ মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ে আত্রেয়ী।

‘বিশ্বাসই হচ্ছে না, যে-ছেলেটা গতবছর পর্যন্ত র‍্যাঙ্ক করে এসেছে, তার এই অবনতি কীভাবে? জাস্ট ভাবতে পারছি না।’ বিস্ময় ঘিরে ধরে সহেলীকে।

‘তোমার ভাই তো জীবনেও ওকে পড়ার জন্য বলে না, কোনওদিন বসেও না ছেলেকে নিয়ে। সবসময় আমিই পড়াশোনা নিয়ে টিকটিক করি, সেইজন্য এখন আমি ওর চোখের বিষ। মা হয়ে কী করে আমি ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে দেখব বলো দিদি?’

‘কিন্তু আত্রেয়ী, বাচ্চাদের ভালোবাসা দিয়ে বোঝাতে হবে। কাছে টানতে হবে। সবসময় মারলে, বকলেও আরও হাতের বাইরে চলে যাবে। পড়াশোনাতেও ওই জন্য ওর মন নেই। পড়াতে বসলে তুমি পড়াও কম, মারো বেশি। বাচ্চাদের সাথে এমন করলে চলবে কেন. যেমন কালকেই তুমি ওকে বলছিলে, আরে ওই ছেলে মানুষ হবে নাকি। জীবনে কিছু করতে পারবে না, জুতো সেলাই করে পেট চালাতে হবে। বাচ্চাদের সামনে তুমি যদি এরকম কথাবার্তা বলো, তাহলে ওদের মনে কেমন প্রভাব পড়বে বুঝতে পারছ আত্রেয়ী। জীবনে কোনওদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না, সারাক্ষণ হীনন্মন্যতায় ভুগবে। নতুন কিছু করার সাহসই জোগাতে পারবে না।’

ডাইনিং রুমের মেঝেতে বসে বিট্টু কীসব আঁকিবুকি করছিল মন দিয়ে। হঠাৎই সেসব ছেড়ে দিয়ে পিসির হাতটা ধরে বলতে শুরু করল, ‘পিসি, পিসি দাবা খেলবে আমার সাথে?’

‘কিন্তু বাবু আমি যে দাবা খেলতে পারি না। তাহলে তোমার সাথে খেলব কেমন করে?’

‘খুব সোজা। আমি শিখিয়ে দেব।’ ঝটপট উত্তর দেয় বিট্টু।

‘তারচেয়ে বরং লুডো খেলি। কী বলিস?’

‘ঠিক আছে।’ বলে লুডো আনতে দৌড়ে যায় ঠাম্মির ঘরে। মিনিট দুয়েকের মধ্যে ফিরে এসে ঘুঁটি সাজাতে শুরু করে দেয় বিট্টু।

‘সাপ-লুডো খেলি, কী বলো পিসি। তোমার সাথে দারুণ জমে যাবে। ঠাম্মি তো ঠিক করে দান-ই চালতে পারে না।’

‘লুডো ছাড়া আর কী কী খেলা জানিস রে বাবু?’ জানতে চায় সহেলী।

‘দাবা, স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড, কার রেস, বিজনেস গেম, কবাডি।’ গড়গড় করে একটার পর একটা নাম বলতে থাকে বিট্টু।

‘আরে আরে থাম থাম। বাপরে বাপ, কার সাথে খেলিস এসব?’ হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে সহেলী।

‘কারওর সাথেই নয়।’

‘কিন্তু এসব খেলা তো একা একা খেলা যায় না বাবু। একাই যদি খেলবে কিনেছ কেন এই সমস্ত গেম?’ অবাক হয়ে যায় সহেলী।

‘কিছু মাসি কিনে দিয়েছিল। জেঠু এসেও কয়েকটা কিনে দিয়ে গেছে, আর গতবারের জন্মদিনে আরও অনেকগুলো পেয়েছি। একা একা খেলব না-তো কী করব বলো। মা যে সঞ্জুদের  বাড়িতে ওগুলো নিয়ে যেতে দেয় না। বলে দামি জিনিস নষ্ট হয়ে যাবে। সঞ্জু বাড়িতে এলেও খেলতে বসলে মা রাগ করে। বলে সবসময় বাড়িতে হইহল্লা লেগেই রয়েছে, বন্ধ করো এসব। খেলা বন্ধ করে মা ওকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে আমাকে জোর করে পড়তে বসিয়ে দেয়। ঠাম্মিও তো এসব খেলতে পারে না। কত চেষ্টা করেছি শেখানোর।’ বিট্টুর কথাগুলো মনের মধ্যে বিঁধতে থাকে সহেলীর।

‘ঠাম্মি পারে না তো কী হয়েছে, মাঝেমধ্যে বাবা-মা-র সঙ্গেও তো খেলা যেতে পারে। কী বলো বিট্টু সোনা?’ বড়োপিসির কথা শুনে মাথা নীচু করে নেয় বিট্টু। চোখের কোনা চিকচিক করে ওঠে। তীর্যক দৃষ্টিতে একবার মায়ের দিকে দেখে পিসির কথার উত্তর না দিয়েই ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে।

সহেলী বুঝতে পারে তার কথায় বিট্টু কতটা আঘাত পেয়েছে। পরিবারের সকলে থাকা সত্ত্বেও সে যে কত একা, তা বুঝতে বাকি থাকে না বিট্টুর বড়োপিসির। এতটুকু ছেলের একটা খেলার সঙ্গী নেই। তার উপর সারাক্ষণ মায়ের কড়া শাসন। শাসনের চোটে ভালোবাসাগুলো ম্লান হয়ে গেছে, আর তাই দিন দিন রগচটা হয়ে যাচ্ছে। সবথেকে বেশি রাগ মা-র উপর। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে স্থির করে নেয় আত্রেয়ীকে যেভাবেই হোক বোঝাতে হবে। এখনও সময় আছে। ভাজের উপর খানিক রাগই হয় সহেলীর। পরক্ষণেই আবার নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে, ভাবে আসলে ছেলেটাকে নিয়েই আত্রেয়ীর পৃথিবী। তাকে ঘিরেই তার যত স্বপ্ন। যার কারণে একটু এদিক-ওদিক দেখলেই কেমন যেন অস্থির হয়ে ওঠে আত্রেয়ী। সবসময় চোখে চোখে রাখার চেষ্টা করে ছেলেকে। চতুর্দিকের ঘটনা দেখে ভয়ে ছেলেটাকে দূরে স্কুলে পর্যন্ত ভর্তি করেনি। কী-যে ভয় ওর। বিট্টু তো তাদেরও মনের খুব কাছাকাছি। বিয়ের প্রায় বছর আটেক পর বিট্টু জন্মায়। তার আগে দু’দুটো বাচ্চা…। কিন্তু সেসব অতীত আঁকড়ে ধরে থাকলে চলবে? বর্তমানকে নিয়ে বাঁচতে হবে।

তারপর নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকে, আর ভাইটাও হয়েছে তেমনি। ব্যাবসা ছাড়া কিছুই বুঝল না। শুধু টাকা আর টাকা। বলি এত টাকা নিয়ে কী করবি, যদি ছেলেটাকেই না মানুষ করতে পারলি। দু’দণ্ড ছেলেটার পাশে বসে একটু সময় দিলে কী হয়। এদিকে মুখে বলছে আমি যা রেখে যাব আমার ছেলেকে আর খেটে খেটে হবে না। এদিকে সেই ছেলের জন্যই সময় নেই। একজন চিন্তায় অস্থির, আর একজন উদাসীন! না আত্রেয়ীর সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতেই হবে। এভাবে বিট্টুর ছেলেবেলাটা নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না।

সহেলী ভাইবোনেদের মধ্যে সবথেকে বড়ো। কাজেই সবাই সমীহ করেই চলে। অবশ্য সমীহ করার মতোই তার ব্যক্তিত্ব। ছেলে বিদেশে থাকে আর মেয়ের বছর খানেক হল বিয়ে হয়ে গিয়েছে। স্বামী রিটায়ার্ড কর্নেল। বেড়াতে ভীষণ ভালোবাসেন। বছরে অন্তত বারচারেক তল্পিতল্পা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বেশ কয়েকদিনের জন্য। এবারের মিশন মিশর। সেই কারণেই কয়েকদিনের ছুটিতে এবাড়িতে এসেছে সহেলী। আত্রেয়ীও বড়ো ননদকে খুব ভালোবাসে। সে অন্তত তাকে বোঝে। তাই সমস্ত কিছু শেয়ার করে বড়ো ননদের সঙ্গে। মনের কথা বলে খানিক শান্তি পায়।

সেইদিনই সন্ধ্যাবেলায় ননদের বোঝানোতে সিডি প্লেয়ারটা আলমারি খুলে ছেলেকে বের করে দেয় আত্রেয়ী। সেটা হাতে পেয়েই লাফাতে লাফাতে বিট্টু সোজা পৌঁছে যায় বড়োপিসির ঘরে। বড়োপিসিকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে আটখানা হয়ে। ‘থ্যাঙ্ক ইউ পিসি, আমি জানি তোমার কথাতেই মা সিডি প্লেয়ারটা  ফেরত দিয়েছে আমাকে।’

‘তাই! তুমি কেমন করে জানলে?’ বিট্টুকে খোলা মনে হাসতে দেখে সহেলীর মনটা ভালো হয়ে যায়।

‘আমি জানি। আচ্ছা শুনবে এতে কী আছে?’ বলেই যন্ত্রটার বাটন-টা প্রেস করে দেয় বিট্টু। শুরু হয় খুব মিষ্টি একটা গান।

‘আরে এটা তো বিট্টু সোনার গলা। বাবা আমার বিট্টু সোনা গানও গাইতে পারে। তা-ও আবার এত সুরে!’ অবাক হয়ে যায় সহেলী।

পিসির কাছ থেকে নিজের প্রশংসা শুনে লজ্জায় মুখটা রাঙা হয়ে ওঠে বিট্টুর। অদ্ভুত এক ঝলক খেলে যায় বিট্টুর চোখেমুখে। প্রশান্তির সেই ছাপ চোখ এড়ায় না সহেলীরও।

সহেলীর বুঝতে বাকি থাকে না বিট্টুর সিডি প্লেয়ার চাওয়ার ওই অদম্য জেদ কেন চেপেছিল। আসলে সে চেয়েছিল তার স্কুলের প্রোগ্রামে গাওয়া গানটা পিসিকে শোনাতে। নিজের খুশি জাহির করতে বাচ্চারা তাদের ভালোবাসার মানুষকে খোঁজে। ইস্ আত্রেয়ী যদি একটু বুঝত ছেলেটা কেন ওভাবে জেদ ধরেছিল। মা হয়ে ছেলেটার ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলো বুঝল না।

পরদিন সকালেও বিট্টুর মনটা বেশ ভালো ছিল। সকালে উঠে নিজেই লাফাতে লাফাতে তৈরি হয়ে স্কুল গেল। পিসির কাছে আবদার করে গেছে ফিরলে তাকে ভূতের গল্প শোনাতে হবে। সেইমতো স্কুল থেকে ফিরে সোজা পিসির ঘরে হানা দেয় বিট্টু। তখন ননদ ভাজের আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। কোনও কিছু নিয়ে ইয়ার্কি-ঠাট্টা হচ্ছিল বোধ করি। বিট্টুর মাঝে ঢুকে পড়াতে আত্রেয়ীর হাসি মুহূর্তে বিরক্তিতে পরিণত হয়।

‘কতবার তোমাকে বলেছি না বড়োরা কথা বললে এভাবে বিরক্ত করবে না। যাও ঠাম্মিকে বলো খেতে দিতে।’

‘আমার পেট ভর্তি আমি খাব না।’

‘পেট ভর্তি মানেটা কী? সেই কোন সকালে একটু হরলিক্স আর দুটো বিস্কুট খেয়ে বেরিয়েছ। যাও খেয়ে নাও।’ চোখ রাঙায় আত্রেয়ী।

মায়ের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করেই জবাব দেয় বিট্টু, ‘বলছি তো খিদে নেই।’ বলে সহেলীর পাশে গিয়ে বসে পড়ে।

‘ও পিসি, তারপর কী হল? তারপর? ভূতটা কী করল?’

‘দেখেছ দিদি, দেখেছ, এই ছেলে আমাকে কোনওদিন শান্তি দেবে? দু’দণ্ড যে কারওর সাথে কথা বলব তা এই ছেলের সহ্য হয় না। আমার বোন এলেও এমনটাই করে। বাপের বাড়িতে গিয়েও বন্ধুবান্ধবদের সাথে একটু গল্প করতে, মনের কথা খুলে বলতে পারি না জানো। সেখানেও মুখের সামনে বসে সব গিলবে, আর বাড়ি ফিরে বাবা-ঠাম্মিকে সব লাগাবে। সত্যি বলছি দিদি আর পেরে উঠছি না।’ গর্জে ওঠে আত্রেয়ী।

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে, অতো বিরক্তির কী আছে। আর তো ক’দিন পর বড়ো জেঠুর কাছে চলেই যাব। বাবা তো কথাও বলে নিয়েছে। তখন চাইলেও তোমার কাছে আর ফিরে আসব না।’

‘আচ্ছা আচ্ছা, আর অতো রাগ করতে হবে না। মার কথা শোনো, একটু খেয়ে এসো। তারপর তো বাকি গল্পটা বলবই। যাও যাও ছুটে যাও, ঠাম্মির থেকে খেয়ে এস।’ বিট্টুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠাম্মির কাছে পাঠিয়ে দেয় সহেলী। তারপর আত্রেয়ীর দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,’ হঠাৎ বড়ো জ্যেঠুর কাছে, ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না।’

‘ছেলেটা যেভাবে বিগড়ে যাচ্ছে, তাই আমরা ঠিক করেছি ওকে বড়দার কাছে পাঠিয়ে দেব। ওখানেই থাকবে, পড়াশোনা করবে। আমাদের তো ধর্তব্যের মধ্যেই ধরে না, কম সে কম ওনাকে তো একটু ভয় পায়।’

কথাটা শোনামাত্রই মাথায় বিদ্যুৎ খেলে যায় সহেলীর। ‘মানে, নিজের দায় অন্যের উপর চাপিয়ে দিয়ে দায় মুক্ত হতে চাইছ। কিছু মনে কোরো না আত্রেয়ী এভাবে ছেলে মানুষ হয় না। একটা মানুষের পিছনে দিনরাত্রি খিটখিট করলে, সে তো বিরক্ত হবেই। ছেলে মানুষের নামে দিনরাত কড়া অনুশাসন, স্কুলের পর দুটো টিউটর, হাঁফ ফেলতে পারে না ছেলেটা ঠিক করে। মিশতে দেবে না কারওর সঙ্গে, ছেলে নাকি এতে খারাপ হয়ে যাবে। ভাবলেই অবাক লাগে এই বয়সের একটা ছেলের খেলার সঙ্গী নেই। ছেলে বিগড়োনোর জন্য কিন্তু দায়ী তোমরাই। এভাবে কোনওদিন ছেলে মানুষ করতে পারবে না।’

ননদের কথার কোনও প্রতিবাদ করতে পারে না আত্রেয়ী। যৗক্তিকতার চাপে গলা রূদ্ধ হয়ে আসে তার। চোখ ভিজে যায়। একটা ক্ষীণ স্বর সহেলীর কানে পৌঁছোয় ‘তুমি শুধু আমার দোষটাই দেখছ দিদি। কষ্টটা বুঝতে পারছ না। একজন মা কতটা প্যাঁচে পড়লে তবে তার বাচ্চাকে নিজের কাছছাড়া করার কথা ভাবে বলো তো?’

‘শোনো আত্রেয়ী, মাঝে মাঝে কাছের মানুষগুলোর কাছে ভালোবাসা প্রকাশ করতে হয় বুঝেছ। রাগের বশবর্তী হয়ে এমন কিছু ডিসিশন নিও না, যাতে ছেলেটা তোমার থেকে আরও দূরে সরে যায়। একটু আমার কথামতো চলেই দ্যাখো না, দেখবে তোমার ছেলে সত্যিই ভালো।’ আবেগের বশে কখন যে ভাজকে জড়িয়ে ধরে চোখে জল এসে গেছে বুঝতেও পারে না সহেলী।

দেখতে দেখতে কেটে যায় আরও একটা সপ্তাহ। এই কয়েক দিন সহেলী, ভাইপো বিট্টুকে নিয়েই বেশি সময় কাটিয়েছে।

পিসির কথা শুনে খাওয়াদাওয়া, পড়াশোনা সবই করেছে বিট্টু। এক মুহূর্তেও কথার অবাধ্য হয়নি বিট্টু। আত্রেয়ীর অভিযোগের সঙ্গে বিন্দুমাত্র মেলাতে পারেনি ছেলেটাকে। একটু ভালোবাসা একটু প্রশংসা পাওয়ার জন্য কী না করতে পারে ছেলেটা। আত্রেয়ীকে ভুল প্রমাণ করার জন্য তাকে দিয়েই কোয়েশ্চেন সেট বানিয়ে পরীক্ষা নিয়েছে বিট্টুর। একেবারে পঞ্চাশে পঞ্চাশ। ফুল মার্কস পেয়ে ছেলের কী লাফানো।

‘দেখেছ আত্রেয়ী, একটু ভালোবাসা পেলে ছেলেটা কী করতে পারে। আমার কী আছে বলো, আমি তো আর সারাজীবন থাকতে যাব না এখানে। তোমার জামাইবাবুরা দুর্যোগের জন্য সময়ের আগেই ফিরে আসছে বর্ডার থেকে। পরশুই আমাকে চলে যেতে হবে।

নিজের মনে খেলতে খেলতেই, পিসির কথাটা কানে যায় বিট্টুর। খেলা ছেড়ে দিয়ে একলাফে দৌড়ে আসে সহেলীর কাছে। বরাবরই বড়োপিসিকে সে একটু বেশিই ভালোবাসে। এই কদিনে সহেলীর আরও কোলঘেঁষা হয়েছে সে। ‘পিসি তুমি চলে যাবে? তুমি যে বলেছিলে এখন থাকবে তাহলে কেন? আমার সাথে কে খেলবে?’ বিট্টুর কথাগুলো সহেলীর কানে গিয়ে ধাক্বা মারে।

‘কী করব বলো, পিসেমশাই ফিরে আসছে। আমি বাড়ি না গেলে উনি খাবেন কী? ওনাকে কে দেখবে? তবে আমি কথা দিতে পারি, তুমি যদি আমার কথা শোনো, তাহলে আমি প্রতিমাসে দু’দিন করে এসে তোমার সাথে দেখা করে যাব। আর তোমার গরমের ছুটির সময় তোমাকে আমার ওখানে নিয়ে যাব।’

‘কী কথা বলো?’ উৎসাহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে বিট্টু।

‘বলব, তবে আগে প্রমিস করতে হবে, আমি যা বলব তুমি তাই শুনবে।’ শর্ত রাখে সহেলী।

‘তোমায় কথা দিতে হবে ভালো ছেলের মতো মা-র সব কথা শুনবে। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে। ভালো রেজাল্ট করে প্রমাণ করতে হবে তুমি ভালো ছেলে।’ সহেলীর কথা মন দিয়ে শোনে বিট্টু। কোনও সাড়া করে না।

‘কি আমার কথা রাখবে তো?’ বিট্টুর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় সহেলী।

‘প্রমিস পিসি, তোমার কথা মতোই আমি চলব, কিন্তু তুমি প্রমিস ভাঙবে না তো? সপ্রতিভ চোখে পিসির দিকে তাকিয়ে থাকে বিট্টু।

‘পিসি কোনওদিন কথার খেলাপ করেছে?’ ঘাড় নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে বিট্টু। বিট্টুকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে সহেলী। চোখ ভিজে যায় তার। একদিনে ছেলেটার প্রতি যেন আরও মায়া পড়ে গেছে। ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবতেই চোখে জল চলে এসেছে।

দেখতে দেখতে কেটে যায় আরও দু’টো দিন। আজ মা-বাবার সঙ্গে স্টেশনে এসেছে সহেলীকে ছাড়তে। সকাল থেকে বায়না ধরেছিল স্টেশনে আসার জন্য। বাড়ি থেকে স্টেশন পর্যন্ত একটি বারও পিসির কাছছাড়া হয়নি।

‘বাবু ভালো থাকিস। মা-র কথা শুনবি।’ বলে বিট্টুকে জড়িয়ে ধরে একটা চুমু খায় সহেলী। ঠিক সেই সময়তেই ট্রেনের হুইসল বেজে ওঠে। ট্রেনে উঠে পড়ে সহেলী। ধীর গতিতে ট্রেন চলতে শুরু করে। বিট্টু আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ডুকরে কেঁদে ওঠে।

‘প্লিজ পিসি, যেও না আমাকে ছেড়ে।’

‘কাঁদে না বাবু, আমি বলেছি না আমি ঠিক আসব।’ ট্রেন তখন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে দ্রুত গতিতে ছুটতে শুরু করেছে। বিট্টুও করুণ মুখ করে দেখছে সেই ট্রেনের চলে যাওয়া। ‘আমার কথা রেখো কিন্তু,’ সহেলীর ক্ষীণ আওয়াজ ভেসে আসে বিট্টুর কানে।

হাত নাড়তে নাড়তে বলতে থাকে ‘শুনব পিসি, শুনব।’

বিট্টুর কষ্টটা অনুভব করতে পারে সহেলী। চোখ ভিজে যায় জলে, কিন্তু বিট্টুর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভেবে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে।

পাকদণ্ডি

কেউ ঝুঁকে পড়ে পায়ে হাত রাখতেই চমকে উঠল বন্দনা। ‘না-না, বলে সংকুচিত হয়ে উঠলেও যে প্রণাম করতে এসেছিল, সে কোনও ওজর-আপত্তি শুনতে আগ্রহী নয়। লোকটি চলে যাওয়ার পরই বন্দনা চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল। এই সময়ে তার মন অতীত স্মৃতির নানা গলিপথে ঘুরে বেড়াতে শুরু করে। একের পর এক মুখ ভেসে উঠতে শুরু করল স্মৃতিপটে। অনেকগুলি মুখ ধোঁয়াশায় আবছা হয়ে এসেছে। মুখ মনে আসছে, অথচ মুখের মালিকের নাম মনে পড়ছে না। এখন কারওর উপরেই সে আর ভরসা করতে পারে না। তা সত্ত্বেও শৈশবের এক স্বভাব সে কখনওই ছাড়তে পারেনি। মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসিকান্নার পাশে থাকার অভ্যাসেই সে স্কুলের চাকরির পাশাপাশি সমাজসেবাকেও ব্রত হিসাবে নিয়েছে।

সন্ধে সাতটার সময় সুদর্শন পান্ডের বাড়িতে তার ছোটোছেলের জন্মদিনের অনুষ্ঠান ছিল। বিশেষ ইচ্ছে ছিল না যাওয়ার। কিন্তু সুদর্শন তার সমাজসেবী সংস্থা ‘অর্চনা’র সদস্য। বন্দনা স্নান করল, আলমারি থেকে নামিয়ে একটা ময়ূরকণ্ঠী রঙের উজ্জ্বল শাড়ি পরল, সামান্য সাজল, বেরিয়ে পড়ল তারপর।

সুদর্শনের বাড়িতে আজ উৎসবের মেজাজ। ইতিমধ্যে অন্য অতিথিরাও দলে দলে আসতে শুরু করে দিয়েছেন। সকলের সঙ্গে বন্দনার পরিচয় করিয়ে দিয়ে সুদর্শন বলতে লাগল, ‘ইনি বন্দনা দত্ত, ‘অর্চনা’ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রধান।’কয়েকটি কৌতূহলী চোখ চমকে তাকাল বন্দনার দিকে। বন্দনা এ ধরনের দৃষ্টিপাতে অভ্যস্ত। আগে অস্বস্তি হতো তার। এখন আর হয় না। পঁয়তাল্লিশে পড়ল সে গতমাসে। হয়তো এখনও তার ধারালো চোখমুখ আর টানটান শরীর বাইরে লোকের কাছে আকর্ষক মনে হয়। কিন্তু, এরই পাশাপাশি তাদের চোখে অন্য একটা প্রশ্ন ফুটে উঠতে দেখে বন্দনা ভেবে কুল পায় না। সেই চোখগুলি প্রশ্ন করে, ‘এত সুন্দরী হওয়া সত্ত্বেও কেন আপনি বিয়ে করেননি বন্দনা?’

এককালে এইসব প্রশ্ন তাকে বিরক্ত করত, এখন আর করে না। এরই মধ্যে কোনও কোনও কৌতূহলী সাহসী পুরুষ তার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করে। কারওর বাচ্চার অ্যাডমিশন নিয়ে সমস্যা, কারওর বা সংসারে পণ দেওয়া নিয়ে ঝামেলা। এসব কিছু না থাকলে সমাজসেবা করার ঝুটো ইচ্ছের ছুতোয় কাছে আসার প্রক্রিয়া জারি থাকে। অনেকক্ষেত্রে বন্দনা এমনও টের পেয়েছে, হয়তো কোনও সমস্যাই নেই, তবু, কোনও কোনও পুরুষ শুধু তার সঙ্গ পাবে এই আশায় তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে।

চিরকালই বন্দনার মধ্যে তার সামাজিক প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা এবং আত্মমর্যাদাবোধ খুবই বেশি। অভিজ্ঞতা থেকে সে শিখেছে, কার সঙ্গে কতটা কথা বলতে হবে, কার সঙ্গে কতটা দূরত্ব বজায় রাখা সংগত। সুদর্শনের ঘরোয়া পার্টি খুব জমে উঠেছিল। খাওয়াদাওয়ার ভালো বন্দোবস্ত, বন্দনা দেরি করল না। এমনিতেই তার শরীরটা খুব একটা ভালো নেই। সামান্য কিছু খেয়ে সে তাড়াতাড়ি বাড়ি পৌঁছোতে চাইছিল। প্লেটে খাবার নিয়ে দু-এক চামচও খায়নি, এমন সময় পাশে এসে দাঁড়াল বিজন। নিজের প্লেট হাতে নিয়ে সে বন্দনার পাশে দাঁড়িয়ে কথায় কথায় বলল  ‘আপনার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।’

বন্দনা একটু অবাক চোখে তাকাতেই সে ফের বলল, ‘আপনিই তো মৃদুলাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠিক রাস্তায় ফিরিয়ে এনেছেন।’

মৃদুলা বিজনের একমাত্র মেয়ে। যে-স্কুলে বন্দনা অধ্যক্ষ, সেখানেই পড়ে মৃদুলা। অনেকদিন ধরেই তার নামে নানা অভিযোগ আসছিল। ক্লাসরুমে অনুপস্থিত থাকে। ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়ায়, অভিযোগের কোনও অন্ত নেই। উপায়ান্তর না দেখে বিজন তখন বন্দনার দ্বারস্থ হয়। সেই ওদের প্রথম দেখা। তারপর বেশ কয়েকবার বিজন এসেছে তার কাছে। অনেক কষ্টের কথা বলেছে। বন্দনা এখনও বোঝে না, কোনওরকম আকর্ষণ থেকেই কি সে তার কাছে আসত? নাকি, সত্যিই সে ব্যতিব্যস্ত ছিল তার মেয়ের ব্যাপারে?

সে সময় বন্দনা মৃদুলাকে ডেকে অনেক বুঝিয়েছিল। বুঝিয়েছিল, নদীর জল আর সময় কারু জন্য অপেক্ষা করে না। সময় থাকতে থাকতে তার যথাযথ উপযোগিতাটাও জরুরি। তাতে ভবিষ্যৎ জীবন সুন্দর ও সুখের হবে। তার কথায় কী যে জাদু থাকে, যে-শোনে সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে। এসব ঘটনার পর একদিন হঠাৎ-ই বিজন এসে হাজির। তার নিশ্চিন্ত মুখচোখ দেখে খানিকটা স্বস্তি পেল বন্দনা। বিজন বললছ ‘মৃদুলা খুব প্রশংসা করে আপনার। এখন তো দেখছি বাড়িতেও খুব মন দিয়ে পড়াশোনা করছে।’উপকারের কথা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ ভুলে যায়। কিন্তু, বিজন সেই বিরল প্রকৃতির মানুষ, যে, কৃতজ্ঞ থাকতে ভালোবাসে আর বারবার সেই কথার পুনরাবৃত্তি করে বন্দনাকেও কিছু ভুলতে দেয় না।

‘আচ্ছা ম্যাডাম, রাজনীতির জগতের মানুষজনও তো সকলেই আপনাকে চেনে। আপনার এক কথায় কত লোকের কত কাজ হয়ে যায়!’

একটু হকচকিয়ে গেল বন্দনা। তার ব্যাপারে বিজন এত খবর রাখে কেন? মনের দোলাচল তার কথাতেও বের হয়ে এল,  ‘আপনি তো দেখছি, আমার সম্পর্কে প্রচুর খবর রাখেন।’

‘সত্যি বলতে কি ম্যাডাম,’ বিজন বলল, ‘ব্যাপারটাকে কাকতালীয় বলতে পারেন, কিন্তু, আপনার অতীত ও বর্তমানের অনেক কথাই আমার জানা।’

বন্দনা হেসে ফেলল, ‘আমার সম্পর্কে এত কিছু যখন জানেন, তখন নিশ্চয়ই আমার ভবিষ্যৎটাও জানেন আপনি!’

একথা শুনে একটু চুপ করে রইল বিজন। তারপর নীচু গলায় কেটে-কেটে বলল, ‘ভবিষ্যৎ তো আপনার নিজেকেই স্থির করতে হবে।’ তারপর হঠাৎ-ই সে খুব গম্ভীর হয়ে গেল।

সেদিন পার্টি শেষ করে বাড়ি চলে আসার পর থেকে বেশ কিছুদিন বন্দনা বিজনের কথাগুলি ভাবছিল। ভাবছিল, কী বিচিত্র মানুষ এই বিজন! বলে কিনা তার অতীত-বর্তমান, সবকিছু সে জানে! বন্দনার অতীত… কোন অতীত?

বন্দনার বাবা ছিলেন বামপন্থী রাজনীতির সক্রিয় কর্মী। একসময় অনেক লড়াই দেখেছে বন্দনা, ঘরে-বাইরে। পার্টি গড়ে ওঠার সময়ে বহু মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এমন স্যাক্রিফাইস করেছেন। অত্যধিক পরিশ্রমে বন্দনার বাবার শরীর ভেঙে গিয়েছিল শেষদিকে। সেই টালমাটাল সময়ে বন্দনা দেখেছে কী প্রচণ্ড কষ্টে সংসার সামলেছেন মা! বিএ পাশ করেই তাই বন্দনাকে চাকরির খোঁজে বের হতে হল। অন্য আর পাঁচটা সমবয়সি মেয়ের কাছে সেই সময়টা ছিল চোখে রঙিন স্বপ্নের জাল বোনার। আর তখনই স্বপ্ন দেখার সঙ্গে বন্দনার ছিল আড়ি। কাঁধের উপর যে বিরাট সংসারের দায়! সুজয়, আরাধনা দুই ভাইবোন, আর মা। পুরো সংসারকে টানতে স্কুলের চাকরির পরেও বাড়িতে কোচিংক্লাস খুলতে হল বন্দনাকে। তারপর হঠাৎ-ই একদিন মা’ও মারা গেলেন। মাথার উপর আর রইল না কেউ। ওই সময় বড়ো অসহায় হয়ে পড়েছিল বন্দনা। সময় সব ক্ষত মুছিয়ে দেয়। জীবনের স্বভাবই হল গড়িয়ে যাওয়া। কিন্তু সুজয় আর আরাধনার সংসার সাজিয়ে দিয়ে যখন সে একটু নিজের দিকে তাকানোর সময় পেল, দেখল, চুলে ততদিনে পাক ধরেছে।

অতীতের ইতিহাসের পাতা উলটালে তার চোখ জলে ভিজে আসে। মনে হয়, এক পলকে সে পৌঁছে গেছে সেই গাঁ-এ, যেখানে দাদু-দিদা’র সঙ্গে কয়েকদিন খুব আনন্দে কেটেছিল। সারাদিন গ্রামের সমবয়সি ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ছুটোছুটি করে প্রজাপতি ধরে বেড়ানোর সুখ ভোলা যায় না। ভোলা যায় না, তারপর পাকদণ্ডি পথ বেয়ে অনেক বেশি রাস্তা ঘুরে দেরি করে বাড়ি ফেরা …।

ওই কয়েকটা বছর সংসারের উপর দিয়ে খুবই ঝড়ঝাপটা গেছে। রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়া বাবা কোনওভাবেই কোনও চাকরির ব্যবস্থা করে উঠতে পারছিলেন না। বাধ্য হয়েই দাদু-দিদা, মা আর ভাইবোনদের নিয়ে গিয়েছিলেন গ্রামের বাড়িতে। আস্তে আস্তে ভাইবোনরাও বড়ো হচ্ছিল। বাবা বাধ্য হয়ে শহরে নিয়ে এলেন সকলকে। এখন এই নিশ্চিন্ত জীবনের অবসরে চোখ বুজলেই গ্রামের সেই পাকদণ্ডি পথ চোখে ভাসে। পাকদণ্ডি হচ্ছে সেই পথ, যেটি মানুষের চলাচলের মাধ্যমে আপনা-আপনিই তৈরি হয়ে যায়।

বন্দনা নিজেও জানে, সারাজীবন ধরে সে পাকদণ্ডিই হয়ে রইল। চেনাপরিচিত মানুষজনের কাছে, এমনকী ভাইবোনদের কাছেও। একমাত্র বিজন অন্যরকম। যখনই দেখা হয়, অত্যন্ত আন্তরিক হাসিতে সে অভিবাদন জানায়। বিজনের ভাবনাচিন্তার ধরন ভালো লাগে বন্দনার। কিন্তু, সে তার অতীত বিষয়ে কী জানে, সেটা জানার আগ্রহ থাকলেও সংকোচবশত কোনও কথা জিজ্ঞেস করতে পারে না বন্দনা। অতীত… কোন অতীত? এ প্রশ্ন কতবার তার ঠোঁটের ডগায় চলে এসেছে। শেষ মুহূর্তে সামলে নিয়েছে বন্দনা। অনেকদিন হল, বিজন আসেনি। স্কুলে মৃদুলার সঙ্গে দেখা হতে বন্দনা তার কাছে বিজনের কথা জানতে চাইল। মৃদুলা জানাল, তার বাবা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। বিজনের ব্যক্তিত্ব আর শালীনতাবোধ সেই প্রথমদিন থেকেই বন্দনাকে মুগ্ধ করে। হয়তো এইজন্যই সে ঠিক করল, এক সন্ধেয় বিজনকে সে দেখে আসবে।

বিজন শুয়ে ছিল, বন্দনাকে ঘরে ঢুকতে দেখে তাড়াতাড়ি উঠে বসল সে। ‘আরে, ম্যাডাম…। আপনি…,’ তার মুখে যেন প্রথমে কোনও কথাই জোগাল না। বিছানা থেকে উঠে বসার চেষ্টা করতে যেতেই বাধা দিল বন্দনা, বলল ‘আপনি উঠবেন না, শুয়ে থাকুন। মৃদুলা বলল আপনি অসুস্থ, তাই, দেখতে চলে এলাম।‘ যেন কোনও ঘোরের মধ্যে থেকে বন্দনার প্রশ্নের জবাব দিতে থাকল বিজন। তারপর হঠাৎ-ই বিছানার উপরে সোজা হয়ে বসে বলল, ‘বন্দনা, এখনও কি তোমার প্রজাপতি ধরার শখ আছে?’

বন্দনা চমকে উঠল। দুটো কারণে। বিজন ‘আপনি’র সম্পর্ক ভেঙে দিল। সচেতনভাবে ভেঙে দিল নাকি? পাশাপাশি, প্রজাপতির পিছনে ছোটার প্রসঙ্গও তাকে খুব আশ্চর্য করে দিল। ‘তুমি… আপনি…,’ কোন সম্বোধনে কীভাবে যে কথা শুরু করবে তাই বুঝে উঠতে পারছিল না বন্দনা।

‘তুমি-ই চলুক না বন্দনা…। তোমার মনে আছে, তোমার প্রজাপতি ধরার অভিযানে একজন থাকত, বিজু নামে?’ বন্দনার দিকে সরাসরি না তাকিয়েই বলল বিজন।

‘আরে…?’ বলতে গিয়ে খুশি উছলে পড়ল বন্দনার গলায়। মনে হল, সত্যি সত্যি আর একবার সে প্রজাপতি ধরার সেই বয়সে পৌঁছে গেছে। ‘ছোটোবেলাটা কী আশ্চর্য, তাই না? ছেড়ে গিয়েও যেন আজীবন জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। আরে… সেইজন্যেই তুমি বারবার বলতে আমার অতীতের কথা জানো?’  বালিকাসুলভ খুশি ঝিলিক দিয়ে উঠল বন্দনার চোখে। সে ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে জানতে চাইল, ‘মৃদুলাকে দেখছি না, সে কোথায়?’

‘মৃদুলা বন্ধুর বাড়ি গেছে।’

‘আর ওর মা?’, জিজ্ঞেস করল বন্দনা। একটা কৌতূহলও ছিল। বিজনের সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় যতবার দেখা হয়েছে, ওকে একাই দেখেছে। ‘সে নেই বন্দনা,’ গভীর একটা শ্বাস নিয়ে বিজন বলল, ‘মৃদুলার যখন দশ বছর বয়স, তখনই ওর মা…।’

সেদিনের পর থেকে বন্দনার সঙ্গে প্রায়ই বিজনের দেখা হতে থাকল। বন্দনা তার চাকরি ও সমাজসেবা নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও কেন কে জানে, বিজনের ফোন এলে সে খুশি হয়ে উঠত, আর বিজনের সঙ্গে দেখা করা আর কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল তার মন। সরষেখেতের পিছনে প্রজাপতি ধরতে যাওয়ার দিনগুলির স্মৃতি তাকে যেন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত।

বন্দনার জীবনে কখনও প্রেম আসেনি। মাঝেমধ্যে একা থাকলে বন্দনা ভাবতে বসত, এই যে বিজনের জন্য একটা আকুলতা সে টের পায় মনের মধ্যে, একেই কি প্রেম বলে? ভিতরে ভিতরে এক ভীষণ যন্ত্রণা অথচ উপর-উপর সব শান্ত। যে-যার নিজস্ব সামাজিক মর্যাদার জালে বন্দি, যে-যার নিজস্ব খোলসে আবদ্ধ।

সমস্যাটা হল অন্য জায়গায়। বন্দনা যদিও টিচার্স রুম-এ বসে না, তবু, কানে এল, বন্দনা এবং বিজনের একসঙ্গে ঘোরাফেরার বিষয়টিকে অনেকেই রীতিমতো চর্চার বিষয় করে তুলেছে। বন্দনা খুব চিন্তায় পড়ে গেল। সারাজীবনে অন্য লোকে কী ভাবল তা নিয়ে আদৌ ভাবেনি সে। কিন্তু, এখন তার একটা সামাজিক মর্যাদা রয়েছে। নিজেকে কি তাহলে সে গুটিয়ে নেবে? কিন্তু, মন কেন চাইছে অন্য কিছু? কেন বালিকার মতো অবুঝ হয়ে উঠছে? আবেগে ভেসে নিজের সব প্রতিষ্ঠা ও মর্যাদাকে কি সে বিসর্জনের চতুর্দোলায় তুলে দেবে? অনেক ভেবে বন্দনা স্থির করল, মনে লাগাম পরানো দরকার। বিজন এরপর থেকে ফোন করে দেখা করতে চাইলে সে ঘুরিয়ে অসম্মতি জানাতে শুরু করে দিল। বেশ কিছুদিন ‘না’  শোনার পর বিজনও ফোন করা বন্ধ করে দিল।

জীবন দৌড়ে চলছিল। প্রথম-প্রথম একটু অস্বস্তি হলেও বন্দনা কাজকর্মের মধ্যে ভুলে থাকার চেষ্টা করছিল রুদ্ধ আবেগ। কিন্তু হঠাৎই একদিন মৃদুলার এক কাণ্ড বন্দনা আর বিজন দুজনকেই চমকে দিল।

তার সমাজসেবী সংস্থার দফতরে বসে ফাইলপত্র ঘাঁটছিল বন্দনা। দেখা করতে আসা মানুষজন খানিকক্ষণ আগেই বিদায় নিয়েছে। সন্ধে হয়ে এসেছে। হঠাৎ-ই ফোন। বন্দনা ‘হ্যালো’ বলতেই, ওপার থেকে মৃদুলা বলে উঠল, ‘ম্যাডাম, বাবা হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আপনি এক্ষুনি একবার আসতে পারবেন? আমি কী করব, কিছুই বুঝতে পারছি না।‘ মৃদুলার উদ্বেগ-মাখা কণ্ঠস্বর খুবই বিচলিত করে দিল বন্দনাকে। ফোন রেখে কোনওমতে রাস্তায় নেমেই সে ট্যাক্সি ধরল।

বিজনের বাড়ির দরজায় ট্যাক্সি থামতে নেমে পড়ল বন্দনা। ট্যাক্সিওলাকে ভাড়া মিটিয়ে খুচরোও ফেরত নিল না। কিন্তু বিজনের ঘরে ঢুকে সে সত্যিই চমকে উঠল। বসার ঘরের হেলানো চেয়ারে দিব্যি পা তুলে বসে খবরের কাগজ পড়ছিল বিজন। শরীরে অসুস্থতার কোনও লক্ষণ পর্যন্ত নেই। সে বলে উঠল ‘আরে, তুমি তো দেখছি দিব্যি সুস্থ আছ। মৃদুলা যে বলল তোমার ভীষণ শরীর খারাপ?’

‘তাই নাকি,’ অবাক হওয়া গলায় বিজনও বলে ওঠে, ‘মৃদুলা এরকম বলবে কেন?’ তাদের কথাবার্তার মাঝখানেই পাশের ঘর থেকে বের হয়ে এল মৃদুলা। বলল, ‘আমি বলছি বাবা, কেন ফোন করেছিলাম।’

মৃদুলার কথায় বিজন ও বন্দনা দুজনেই বিব্রত হয়ে পড়ল। দুজনের অর্থবহ দৃষ্টিবিনিময় হল। দুজনের মনেই সম্ভবত একই ভাবনা খেলা করতে থাকল, তাদের ঘনিষ্ঠতার বিষয়ে কোনও গুরুতর অভিযোগ করতে চায় নাকি মৃদুলা! বন্দনার মনে একটা গ্লানি এল। নিজের বয়স ও সম্মান ভুলে তার কখনওই এরকম আচরণ করা ঠিক হয়নি। কেন এত বড়ো ভুলের পথে পা বাড়াল সে! এখন তো এর মাশুল গুনতেই হবে। নিজের হূদস্পন্দনও তার কানে আসছিল।

ঘরের মধ্যের দমবন্ধ ভাবটা কাটিয়ে তখনই মৃদুলা হেসে বিজনের গলা জড়িয়ে ধরে বলে উঠল, ‘বাবা, আগে আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।‘ বিজন খুব বিব্রত চোখে দেখল মৃদুলাকে। মৃদুলা হাসি ধরে রেখে বলল, ‘আজকাল তোমরা দুজন আর একসঙ্গে কোথাও বের হও না কেন?’

দুজনের কেউ-ই এই প্রশ্ন আশা করেনি। চমকে উঠে দুজনেই দুজনকে দেখল। খানিকক্ষণ ঘরে যেন হাওয়াবাতাস বন্ধ হয়ে রইল। তারপর বিজনই নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়ে বলল, ‘সময় কোথায় পাই মৃদু?’ মৃদুলা হাসল না, বলল ‘কথাটা আন্টি বললে মানা যায়। নিজের চাকরি ছাড়াও তার অনেক কাজ। তা সত্ত্বেও তো উনি সময় বের করতেন।’

মৃদুলার এমন স্পষ্ট কথায় লজ্জা পেল বন্দনা। চোখ তুলে একবার মৃদুলার দিকে তাকাতেই তার চোখে দুষ্টুমির রং দেখতে পেল সে। ‘আচ্ছা, সে না হয় ঠিক আছে! কিন্তু, আগে বলো, আমাদের দুজনের একসঙ্গে ঘোরাফেরা করাটা কি তোমার অপছন্দ?’ জিজ্ঞেস করল বন্দনা।

‘একদম নয়,’ মৃদুলা বলল।

মৃদুলা নয়, বরং মা-হারা এক মেয়ের গলায় ভালোবাসা আর স্নেহের চাহিদা ঝরে পড়তে দেখল বন্দনা। তার চোখদু’টিও আবেগে ভিজে এল।

‘বাবা, তুমি নিজেই জানো না, তুমি কতটা অসুস্থ!’ একথা বলেই মৃদুলা বন্দনার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আন্টি ওই দিনগুলোতে বাবার চেহারায় কত জৌলুস ছিল! যেন নতুন জীবন পেয়েছে বলে মনে হতো! অথচ, এখন…।’ মৃদুলার কথায় বিজনের দিকে তাকাল বন্দনা। মৃদুলা ঠিকই বলেছে, একই অনুভবের সাগরে সে ও বিজন দুজনেই সাঁতার কেটেছে এতদিন।

‘আর এখন…।’মৃদুলা তার বক্তব্য জারি রাখে, ‘বাবা বিকেল থেকে মনমরা হয়ে বসে থাকে। হয় টিভি দেখে, নয়তো বাসি খবরের কাগজটাই দু’বার, তিনবার করে পড়ে। বাবার মনমরা ভাবটা তুমিই দূর করতে পারো আন্টি।’

বন্দনার মনে হল, মৃদুলাকে যতটা বালিকা ভাবত সে ও বিজন, সে ততটা ছোটো আর নেই। বন্দনাকে, তার এই পরিণত বয়সেও একরাশ লজ্জা যেন ঢেকে ফেলল। তার বিব্রত ভাব কাটাতে এবার বিজনই বলে উঠল, ‘মৃদু, বাকি জীবন একসঙ্গে চলার ফয়সালা তো আমরা করেই ফেলেছি! আমাদের সিদ্ধান্তকে তুমি কীভাবে নিলে সেটাও একবার আমরা যাচাই করে নিতে চেয়েছিলাম।’

‘বাবা…,’ মৃদুলা খুশিতে উদ্বেল হয়ে উঠে এক হাতে বিজন, অন্য হাতে বন্দনার হাত ধরে বলে উঠল  ‘আমি একলা থাকতে থাকতে হাঁফিয়ে উঠেছি বাবা। আমারও মায়ের হাতের ছোঁয়া পেতে ইচ্ছে করে…।’ মৃদুলার চোখের কোনে টলটল করা জল বন্দনার মাতৃহূদয়কে উদ্বেল করে তুলল। হঠাৎ-ই মনে হল, এই ভালোবাসার জন্য এতকাল মরুভূমি হয়ে ছিল তার মনের ভিতরটা।

মৃদুলা পাশের ঘরে চলে যেতেই বিজন বলল, ‘বন্দনা, তোমার কোনও আপত্তি নেই তো?’

‘কীসে আপত্তি?’ খুব অবাক চোখে বিজনের দিকে তাকিয়ে বলল বন্দনা। আবার একটা পাকদণ্ডির সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বন্দনা। কিন্তু এই পথটা যেন তার আর অচেনা ঠেকছে না।

‘না, মানে…।’ কোনওমতে বলল বিজন।

‘আর না-মানে, না-মানে করতে হবে না। অনেক হয়েছে, এবার ওঠো। মৃদুলাকে নিয়ে আজ রাতের খাবারটা বাইরেই সারব। দেখলে না মেয়েটা কত দুঃখী!’

 

অবস্থান

দরজাটা বন্ধ করে দাও রাজু…। অঙ্কিতা অফিস বেরোল। সিল্কির সঙ্গে পাজল গেম খেলছিল রাজু বারান্দায় বসে। শুনল কি শুনল না, রাতে রান্না বসাতে গিয়ে চোখ কপালে উঠল অনুর––কুকারটা গেল কোথায়! দরজার পাশে এঁটো বাসনের সঙ্গে ছিল যে!

টুলুর মেজে ধুয়ে রেখে যাওয়া বাসনের বাস্কেট, আরও যথা যথাস্থানে হাতড়ে না পেয়ে হতাশ অনু রাজুর সামনে চড়াও হল, দরজাটা তখন বন্ধ করেছিলে রাজু?

দিনভর বন্দিদশা কাটিয়ে গায়ে শার্ট চড়াচ্ছে রাজু। বেরোবে। কুকারের কথায় ভ্রূ কুঁচকে তাকাল,

–মানে… তখন সিল্কি এমন…।

– বাহ্। অনু স্পষ্টত বিরক্ত।

– তাই বলে দরজা বন্ধ হবে না! নতুন জায়গা অচেনা পাড়া, পাশের ফাঁকা মাঠ দিয়ে ময়লা কুড়োতে এসে উঁকিঝুঁকি মারে। একদিন তো ঢুকেই পড়েছিল, এসব তো জানোই…।

রাজু একটু ইতস্তত করে বলল,

– কিন্তু চোর কি শুধু কুকারটাই নেবে! খুঁজলে সব?

অনুর মুখ গনগনে। মিল্কি তার মা আসামাত্র গা লেপ্টেছে। রাজু নিজেও খুঁজতে শুরু করে। বিরক্ত অনু থামা দেয়-– হয়েছে। আর খুঁজে কী হবে! দরজার পাশেই ছিল, খোলা পেয়ে সহজেই নিয়ে সটকান মেরেছে।

ফলত এক অপরাধবোধ এখন। মোড়ের গুমটি থেকে সিগারেট কিনে খাওয়া, কি পাড়ার ছোট্ট ক্লাবঘরে এক চক্বর দিয়ে আসবে, সেই ফুরসতও তার নিজস্ব নয়। কখন কোন দিক থেকে হুকুম আসবে। কোনটা জরুরি হয়ে উঠবে তার ঠিক নেই। আপাতত মশার ধূপ জ্বেলে দিল রাজু। ঘরে পাখা চলছিল। অফ করল। সামান্য একটু অপেক্ষা করল কোনও ফরমায়েশের। পরে বাজারের থলিটা টেনে নিয়ে হাতে মুড়ল। চাল কেনার বাকি টাকাটা সকালে ফেরত

– যায় নি, যাহোক বাজার আনবে ওই থেকে।

নজর করে অনু বলল, ড্যাডিকে চা খেয়ে যেতে বলো মিল্কি।

চটি পরা স্থগিত থাকল। এমনটাই যেন চাইছিল রাজু। এইভাবে ডেকে  চা বা আড়াইশো গ্রাম পেঁয়াজ এনো, বলার ভেতর দিয়ে অনুরও যেন কোথাও খানিক মেরামতির ছুতো থেকে যায়।

কাপ হাতে চেয়ারে বসেছে রাজু। সামান্য তফাতে অন্যমনস্ক অনু। অফিস ফেরত শাড়ি পালটে নাইটি পরেছে। কিন্তু চুলে চিরুনি পড়েনি। ঝুরো ক’গাছি চুল লেপটে আছে বাঁ-গালে। চিবুকের ডৗলটুকু বেশ আধখানা ডাঁসা পেয়ারার মতো। প্লাক্ড ভ্রূর নীচে টানা টানা চোখ দু’টো যেন গাত্রবর্ণকে অনেকটাই ছাড় দিতে পেরেছে। চেহারা কিছুটা ভারীর দিকে হলেও টান টান শাড়ির প্যাঁচে তন্বির চেষ্টা আছে। তবু নজর করলে ফরসা ঢ্যাঙ্গা রাজু ওর ছোটো না বড়ো ভাবতে হবে…।

কাপ নামিয়ে গলা ঝাড়ল রাজু

– অনু, দরজাটা বন্ধ করে দাও…।

সাড়ে ছ’শো স্কোয়ার ফিটের ছোট্ট বাড়িটা শান্তনু শুরু করলেও শেষ করে যেতে পারেনি। বাকি যা ছিল, শোক সন্তাপ কাটিয়ে অঞ্চিতা তাতে হাত দেয়। ভাড়া বাড়ির বসবাস মার মৃত্যুর সঙ্গেই চুকিয়ে, বছরখানেক হল তাদের এখানে আসা।

জায়গাটা এখনও নিরিবিলি। বাইপাস সন্নিকটে না হলেও, জমি ডোবার দ্রুত ভরাটে দোকান, বাড়ি, বাজার যা এগোচ্ছে, বাইপাস সংলগ্ন হতে বেশিদিন লাগবে না।

নতুন কালভার্টের কাজ চলছে, সেটা পেরিয়ে রাজু যেখানে এসে দাঁড়াল, ঝাঁ-চকচকে সুপার মার্কেট-এর এক মিনি মডেল। চতুর্দিকের আলো ঠিকরে ঝলমল করছে দোকানের সম্ভার। এখান থেকে একটি কুকার কিনে অনুর পাশে দাঁড়াতে পারলে পরিস্থিতিটা হয়তো পালটাত। কিন্তু তার পার্সে দু’শোরও কিছু কম পড়ে আছে।

– রাজুদা, তুমি কোথায়?

কানে মোবাইল তুলে নিয়েছে রাজু।  নাম্বারটা দেখেও, কেটে না দিয়ে বলল, বল!

– এই আর কী! মানে বলছিলাম যে…।

শুনতে গরজ নেই রাজুর। চণ্ডীতলার বঙ্কা যে কি বলবে তার জানা। কেনা-বেচার কোনও চক্বরে সে আর নেই। অনেক হয়েছে। শেষে মূলধনেরই পুঁজি থাকে না, তো লাভ। পরে মহাজনের দ্বারস্থ হওয়া, সে এক শনির কোপ। পিছল সেই খানাখন্দে হাঁটার কথা ভাবলে এখনও গায়ে কাঁটা দেয় রাজুর। বস্তুত হিংস্রতার উগ্র আদি বীজ কি রক্তে ওর আদৗ ছিল!

বাপ যার নিরীহ ছা-পোষা রং মিস্ত্রি! তিনতলা বাঁশের ভাড়া থেকে পিছলে পড়ে থেঁতো হল! নেহাত পেটের দায়ে পথের বিচার সম্ভব হয়নি, তাই রাজু কোন পথে না হেঁটেছে। সম্মুখ যখন ধূধূ, দল-দ্বন্দ্বের হাতিয়ার হতেও পিছপা হয়নি। হাত পাকাতে ছোটোখাটো হাতাহাতি চলছিলই। বড়ো সংঘর্ষের সূচনায়, মানে, এলাকা দখলের ছুরি শান দেবার পর্বে পিছোতে হল রাজুকে। লাশ ফেলে দেওয়া যেখানে মুহূর্তের ডিসিশন মাত্র। নিমরাজি ইচ্ছাটা শেষতক সেখানেই ফনা গুটিয়ে নিয়েছিল ওর। বেরিয়ে আসা সহজ ছিল না। যদি না গাড়োল ভেবে নিয়ে তারা লাথি ঝাড়ত।

সেই টানাপোড়েন, সেই মরিবাঁচি সময়ের কতককাল পরে আজকের অধ্যায়টির সূচনা…। মা ভাই নিয়ে একত্র বসবাসের পাট চুকিয়ে তবেই না…। বঙ্কাকে জানিয়ে দিল, আমার সময় হবে না রে বঙ্কা… আমার মেয়ের কাল পোলিও আছে।

– তোমার মেয়ে। বলছ কী, সে আবার কবে হল? খুক খুক হাসছে বঙ্কা। নাকি রাজুরই মনের ভুল, কেটে দিয়ে বাজার ঢুকে পড়ল সে।

জাঁকিয়ে বসেছে সবজির সান্ধ্যহাট। বিট গাজর আলু কাঁকরোল, শেষে কিনল আড়াইশো পেঁয়াজ। মোচা কেনার ইচ্ছা থাকলেও সেটা তাকেই ছাড়াতে হবে ভেবে নিল না। ক’টা মুসম্বি রাখল সিল্কির জন্য। এই ফলের রসটুকু আর অফিস ফিরে মেয়ের পড়া, খাওয়া ছাড়া বাদবাকি যত হ্যাপা রাজুর। স্কুল ইউনিফর্ম পরিয়ে সাইকেলে স্কুলে ছেড়ে আসা, ঘড়ি ধরে ঘরে আনা থেকে খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো– সব। মেয়ে না ঘুমিয়ে বলল, কার্টুন চালাও। রাস্তার ডুগডুগি শুনে বাঁদর-নাচ দেখতে চাইল। বলল, মিউ ধরে আনো। কেক খাব। চাউ বানিয়ে দাও। বলল, আমার বন্ধু জিজা তো মার কাছে ঘুমোয়। ওর কোনও ড্যাডি নেই, বাপী আছে… হাজারো প্রশ্ন আর বায়না।

এসময় অদ্ভুত একটা তুলনা মনে এল রাজুর। মঙ্গলা হাট থেকে কিনে ট্রেনে রিকশায় কাপড়ের গাঁটরি বয়ে এনে দোকানে ধরানো, কি সাইকেল চাপিয়ে ফিরি করা, অন্যদিকে সর্বক্ষণ এক মেয়েলি ঘরকন্নার ঊনকোটি দায় সামাল দেওয়া, দুটো কাজের শ্রমগত লাভটা কোনদিকের বেশি।

চট করে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেলল সে। ভাবল, শ্রমের পাল্লা যেদিকেই ঝুঁকুক, এখানে তার আসা– বিপদে বিপথে বিপর্যস্ত এক যুবকের অবস্থার বিপাকে মাথা বিকানো হিসেবে। অন্যদিকে স্বনির্ভর, সসন্তান এক বিধবার সঙ্গহীন স্বেচ্ছাসমর্পণ। সেদিক দিয়ে দেখলে, প্রয়োজনের পাল্লাটি কোন দিকে কতটা ভারী, নাকি ভারসাম্যতা রাখছে, সেটা খতিয়ে ভাববার।

রাজু হিসাব গুলিয়ে বাড়ির পথ ধরল। ক্লাবে যাবার ইচ্ছা থাকলেও বুধবারে সেখানে তালা ঝোলে। মনটা গুমোট। বাড়ি ঢুকে ততোধিক গুমোট ঠেকল পরিপাশ। সাড়াশব্দহীন ঘর। টিভি। সিল্কিও। এমন উত্তুরে হাওয়া সতর্ক করল রাজুকে। মেয়েকে নিয়ে শুয়ে পড়েছিল অনু। দরজা খুলে দিয়ে আবার ঢুকে গেছে, আর এলই না। চুপচাপ বাজারের থলি চুবড়িতে উপুড় করল রাজু। প্যাসেজে আলো জ্বালাতেই চোখে পড়ল টেবিলে খাবার ঢাকা। ক্লাব থেকে ফিরতে দেরি হলেও তো এটা হয় না। আজ তো ক্লাবই নেই। ন’টাও বাজেনি এখনও। প্লাস্টিকের ঢাকা তুলে দেখল রুটি ডাল ডিমের কারি সাজানো একটাই প্লেট। অনুরটা কোথায়! আগে তো খায় না। না খেয়েই শুয়ে পড়ল নাকি!

খাবার দেখলে খিদে চাগাড় দেয় রাজুর। ক্ষুধা লজ্জাহীন। জীবনভর এই তাড়নাটা তাকে নানা ঘাটের জল খাইয়েছে। কত যে কঠিন সময় তাকে পেষাইকলের দাঁতের মতো চিবিয়েছে! প্রত্যয় হয়েছে, সব মানুষই ক্ষুন্নিবৃত্তির শর্তে বাঁধা।

ঝপ্ করে ঢাকনাটা নামিয়ে দিল প্লেটের। অনুকে বাদ দিয়ে খাওয়া ঠিক হবে না। মান-অভিমানের একটা বড়ো ভূমিকা আছে এই খাওয়ায়। সাধাসাধিতে সেটা ভাঙতে পারলে লাভ ছাড়া ক্ষতি নেই। কিন্তু কীভাবে এগোবে!

– তুমি খাবেনা অনু! শরীর খারাপ? শুয়ে পড়লে যে!

অনু হয়তো কথাই বলল না। বললেও দায়সারা গোছের, – তুমি খেয়ে নাওগে না। আমার ইচ্ছে নেই।

শুনেই হামলে পড়ে একা খাওয়া ভালো দেখায় না। হয়তো বলা উচিত, তোমাকে ছাড়া আমি একা কোনওদিন খেয়েছি, অনু! প্লিজ… ওঠো…! নিজের মনেই হাসল রাজু। কথাগুলো সাজিয়ে গুছিয়ে অনুর কাছে গিয়ে দাঁড়াল আদত বুঝি খিদের টানেই।

বাক্যব্যয়হীন দিন দুই পর ছুটির দুপুরে অনুকে সহজ হতে দেখা গেল।

ঘরের আসবাব ঝাড়পোঁছ করছিল রাজু। দেয়াল থেকে ল্যামিনেট করা দাম্পত্যের ছবিখানা নামিয়ে, সেখান থেকে ভোঁতা নাক, খুদি চোখ, পুরু ঠোঁটের পুরুষটিকে কি বাদ দিয়ে ধুলো মুছবে রাজু!

পাশের কনেবউ যেখানে আজকের অঙ্কিতা !

দুর্ঘটনার দু’মাস পর সিল্কির জন্ম না হলে আরও একখানি ছবি ঝুলত দেয়ালে। একইভাবে সে ছবি মুছত সে। এই ভবিতব্যের প্রথম দৃশ্য তাই মনে রয়ে গিয়েছে তার।

হসপিটাল থেকে ফিরছে প্রসূতি, ন্যাপিতে মোড়া শিশু। দুধেল গন্ধ মাখা প্রথম বিষণ্ণ মাতৃত্ব। সঙ্গে বৃদ্ধা মা, গলায় গুনগুনে কান্নার বিলাপ। রাজু ছিল ওই অটোর সহযাত্রি। গাড়ির চালক দীপক তার বন্ধু। উচ্চকিত মনটা রাজুর পড়ে ছিল অনিশ্চিত ফায়দার দিকে। বয়ে আনা জামাকাপড়ের গাঁটরির বিক্রি ব্যবস্থা করার আছে। দোকান মালিকের কিস্তিমাফিক টাকায় তেমন লাভ হয় না। নিজস্ব ফিরিতে থেকে যায় উশুলের একটা দুর্নিবার লোভ। দরদামের কচকচি। যেটায় রাজু তেমন পোক্ত নয়।

চিন্তাগুলো ঘোঁট পাকালেও চোখকান পিছলে যাচ্ছিল পাশ্ববর্তিনীর দিকেও। পুতুলের মতো লালচে বাচ্চাটা নজর কাড়ছিল। সেই শুরু…। আর কে না জানে, কোনও সূত্রপাতেরই গড়িয়ে যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। যাতায়াতে, সাহায্যে – সহযোগিতায়…। পাড়াটি যখন সংলগ্ন আর অটোড্রাইভার দীপক যার বন্ধু…।

ছবি মুছতে মুছতে দেখল রাজু, সামনে দাঁড়িয়েছে দেড়খানা মানুষ।

ভ্রূ নাচাল সে। সিল্কি না মা-কে? সিল্কি ছিল মার কোলে। মাঝেমধ্যে মেয়েকে সাধ করে কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় অনু। দিনভর সঙ্গহীনতার চাপা ভরতুকি!

রাজু বলল, কুকারের শোকপালন শেষ হল?

উত্তর এল না।

– তার মানে ওটা পাওয়া গেছে?

– অত সোজা। চোর যেন ফিরিয়ে দেবার জন্য নিয়েছে। সিল্কিকে নামিয়ে অনু মোড়া টেনে বসল। ঝাড় পোঁছে অনুর সঙ্গে শান্তনুকেও সমান মনোযোগ পেতে দেখেই কি এই প্রসন্নতা! মাথা ঝুঁকিয়ে রাজু যখন শান্তনুর চওড়া কপাল থেকে ধুলোর আস্তরণ তুলছিল, অনু ছিল পিছনে, নিঃশব্দ। এখন মুখোমুখি বসে বলল, রাজু, তুমি অনেক কিছুই বোঝো, আবার কিছু জিনিস বোঝার চেষ্টাই করো না।

চশমা ফোঁড় চেয়ে থাকল রাজু সেই বোঝার চেষ্টায়। অনু চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, দিনটা ছিল সেভেন্থ মার্চ…।

–তো! বলেই হঠাৎ মনেপড়ার উদ্ভাসে বলল সে, তাই তো! অনু চোখের জল সামলে বলল, কুকারটা শান্তনু আমাকে সেকেন্ড অ্যানিভার্সারিতে প্রেজেন্ট করেছিল। আমি মাংস রেঁধে খাইয়েছিলাম। অতীত স্মৃতির কাতরতা সামলে বলে, আসলে, যে সময় থেকে স্বামীরা বউকে শুধু বিছানাতেই নয়, রান্নাঘরেও দেখতে চায়, সেই সময়ের কেনা আর কি।

অধোবদন রাজু অনুর একটা দীর্ঘশ্বাস পড়তে শুনল। হাতটি বাড়িয়ে অনুকে ছুঁয়ে বলল, সরি অনু!

উঠে পড়ে দেয়ালে ছবিটা সেট করে রাজু হাত ঝাড়ল। এইভাবে যদি ঝেড়ে ফেলা যেত চোরা ক্ষোভ দ্বন্দ্বের মালিন্য, ধুলোবালির মতোই। তা কী আর হয়! গভীর কারও দুঃখ প্রকাশের সামনে বিমুখতা কী শোভন! জীবন যেখানে সহভাগে মিশেছে। যেজন্য নিজেকে জুড়েছে অনু। তারই পাশাপাশি নিবিড় মিলমিশের এই যে আয়োজন! উন্মুখতা যেখানে একই তৃষ্ণার তাগিদে একাকার! অনু কি তা জানে! নাকি সহজলভ্য দাম্পত্যে তার সেই খেয়াল দরকার পড়ে না! রাজু তার মুখের ভাব লুকোতে ঊধর্বমুখ উত্তর খোঁজে। হাতে তার ঝুলদন্ড।

ছুটির দিন সিল্কির স্নানখাওয়া মার হাতে। কিছুটা পাশ কাটাতে অন্য কাজে ব্যস্ত থাকে সে। কিন্তু মায়ের গল্পবিহীন ধমকভরা ভাতে সিল্কির গরজ নেই। শুরু হয়েছে ড্যাডির বায়না। এদিকে আলমারির পিছনে মস্ত এক মারড়সা রাজুর নজরবন্দি, ঝুলকাঠিতে জাল সমেত টেনে আনতে যাবে, অনু তার হাত থাবড়ে বলল, ওসব ছাড়ো তো এখন! আগে তোমার মেয়ে সামলাও…।

…সপ্তাহ শেষের দুপুরটা আজ অনুর পাশে গড়ানো গেল না। কাজের মেয়ে টুলু এসে গেল বিকেলের কাজ দুপুরে চুকোতে। রাজু ঠায় চেয়ারে তার পাহারাদার, যতক্ষণ না সে কাজ সেরে বেরিয়ে যাচ্ছে। ফলত ভাতঘুম-ছুট মাথাটার দখল নিল এমন কিছু চিন্তা, যা তার দিনগত আচরণে মিলবে না। অলস মস্তিষ্কের ধর্ম! হবে বা। রাজুর তো মনে হয় শর্তমাফিক রাজুতেই আছে সে। কালি মিশেল হু হু ধুম্র তবে কেন। কোন রন্ধ্র দিয়ে মাথায় ঢুকে তছনছ করে দেয় নিভৃত কুলুঙ্গিটি! যা হয়তো সময়ের অপেক্ষায় তুমুল হতে পারত– কিন্তু রাজুর সতর্কতায় তা হয়নি।

ল্যান্ডফোন বাজল…। কেটেও গেল। উঠতে গিয়ে ওঠা হল না। সদ্য কুকার খোয়া গেছে। ভাবল সে, টুলু গেলে দরজা বন্ধ করল কী! ঘুম থেকে উঠে এই নিয়েই হয়তো ধুন্ধুমার হবে অনু। যাকে যা মানায়। ওর লাইফ স্টাইলে এটাই স্বাভাবিক। শান্তনুর মৃত্যুবাবদ চাকরিটি ওর বেঁচে থাকা কায়েম করেছে। দ্রুত বৈধব্য ঘুচিয়ে রসে বসে রেখেছে আর একটি পুরুষ। রীতিমতো রেজিস্টার্ড স্বামী রাজেন্দ্র দাস। দাসানুদাস। দাসত্ব এমন যে, ছাড়তে হয়েছে রক্তবন্ধনও। মা ভাইয়ের ফোন এলে রাজু ফাঁপরে পড়ে যায়। অনুর ভ্রূ এলোমেলো হয়। মুখ তৗল করে বলে, কে এত ফোন করে বলো তো! তোমার কী ঘরসংসার বউবাচ্চা নেই? কথা বাড়বার আগেই ফোন কেটে দেয় সে।

সময়ের দখলদারিতে অনুর অধিকার, কি আদ্যন্ত নির্ভরশীল এক যুবকের এই অবনমন, রাজুর অস্বাভাবিক মনে হয় না। ক্ষুণ্ণতা তার অন্য জায়গায়। একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষশরীরে অদম্য হয়ে ওঠে যে প্রদানক্ষমতা, যার তাড়না একসময় তাকে প্রজন্মকামী করে তুলতেই পারে– এখানে তা নস্যাৎ করেছে অনু সিল্কিকে একক মনস্থ রেখে। রাজু সিল্কির ড্যাডি। বিনা বিস্তারে রাজুর বংশ? তা হলে…।

এই সময় সেই চারাগাছটির কথা মনে পড়ে রাজুর। কোনও একসময় সবজি চালানের ব্যাবসায় নেমেছিল যখন, মহিষবাথান থেকে জোগান আনতে বাসস্ট্যান্ডে নেমে মেঠোপথে খানিক হাঁটতে হতো খেতের দিকে। রাস্তার পাশে বুনো ঝোপঝাড়ে মিশে থাকা একটি ছোট্ট গাছ, যাকে সে জলধারায় ভিজিয়ে তখন প্যান্টের বোতাম আঁটছে, চকিত চেনায় মাথাজোড়াহীন সেই চারাগাছের দশা দেখে কে বলবে সেটি লংকাগাছ। বিশেষ ঝাঁজ ঝাল যার প্রকৃতিগত। কিন্তু ঘন সন্নিবেশিত কাঁটা ঝোপ তাকে বাড়বার পরিসর দেয়নি। বস্তুত অঙ্গ থেকেও অঙ্গহানি যার, মরণ কি শুধু মরণেই! মাথা নাড়ায় রাজু। পিছনের উত্তপ্ত দিনগুলোর কথা ভেঙে হৃৎপিণ্ড উত্তাল হয়ে ওঠে।

লোডশেডিং। সিল্কি কান্না জুড়েছে।

– একটা পাখা দাও তো…।

গ্রিল বারান্দা থেকে রাস্তার চলাচল দেখছে রাজু। হেলদোল নেই। সদ্য তৈরি ঝকঝকে রাস্তায় আড়াআড়ি একটা বেড়াল পেরোল। কিন্তু কালো নয়। তবু ব্রেক কষে থেমে পড়েছে হাই স্পিডের স্করপিওটি। নিজের মনেই হেসে ফেলল রাজু। …হায় জীবন…।

– কি গো একটা পাখা চাইছি যে…।

অনুর মেজাজ চড়ছে। কটু কথায় তিক্ত হচ্ছে রাজুরও জিভ, চাপা স্বরে বিড়বিড় করল, –দিচ্ছি রে বাবা দিচ্চি… আচ্ছা বে-শরম মেয়েছেল বটে, উঠে পাখাটাও আনতে পারে না! পাখা হাতড়ায় রাজু। কিন্তু কোথায় পাখা! কারেন্ট এলেই যার প্রয়োজন শেষ। খাদানের কুলির মতো খেটে খেটে আর ফুসফুস নিঙড়ে এদের হাওয়া দিয়ে রাজু হবে ডাঙার মাছ। খাবি খাবে।

এইভাবেই অভ্যস্ত আপোসনামা ছিঁড়ে মানুষেরও কখনও কখনও এনার্জিক কারেন্ট চলে যায়। ঘনঘোর অন্ধবোধ বড়ো দুর্বহ তখন, ঠিক এই মুহূর্তটির মতো।

আবার ল্যান্ডফোন…। বাজছে তো বাজছেই।

অনুর তিরিক্ষি নির্দেশ আসবার আগেই দৌড়োল রাজু, – হ্যা..লো..ও..। মুহূর্তেই তার স্বর নেমে এল একপরত – ধরুন, ম্যাডামকে দিচ্ছি…।

খাটের পাশে এসে দাঁড়াল সে প্রকৃত নফরের মতো, বলল, তোমার ফোন। গলার খন্দে আটকে থাকল বাকি কথা।

– কার? অনু চোখ কুঁচকে মাথা তুলেছে।

– ব্যাংকলোনের। চোখ সরিয়ে মাথা নামাল রাজু। রাজুর বিগত ধারদেনার জন্য ব্যাংকলোন নেওয়া আছে অনুর। কিন্তু সিল্কির এককালীন স্ল্যাডমিশন ফি জোগাতে আপাতত সেটা বাদ পড়েছে দু-মাস। অনুর এই অপারগতায় তার যথেষ্ট দুঃখবোধ হলেও, এখান থেকেই যে সুরক্ষাটি তাকে বর্তমান অবস্থানে এনেছে, সেই স্বস্তিসুখও এড়াতে পারে না। একের দায় অন্যে বহন করার মূল রসায়ন সম্বন্ধে আর একটু সচেতন হল কী সে! হয়তো বা। বিছানায় অনুর অনিচ্ছ উঠে বসা দেখতে দেখতে কেনই বা ভেসে উঠবে সেই রসায়নের ছবি। রাজুর পায়ে হোঁচট খেয়ে কবে একদিন পা ছুঁয়ে হাতটি মাথায় ঠেকিয়েছিল অনু। কাছে টানতেই মনোরম হয়ে উঠেছিল সেই সমর্পণ। রাজু বলেছিল, আরে, আরে, প্রণাম কেন। এসব আর চলে না অনু। উচ্ছ্বসিত হয়ে অনু বলেছিল, সময়টা দু’হাজার প্লাস বলেই তুমি এটা বলতে পারলে রাজু। আমাদের দিদিমণি বলতেন, রামায়ণের যুগে মেয়েদের তো পুরুষমানুষের নীচে রাখতে ঊনমানুষ বলা হতো।

দু’জনেই হেসেছিল খুব। সময়মতো সুখস্মৃতির উদ্ভাস যেন বিবেকের পালাগানের মতো সচেতন করে রাজুকে।

অন্তরঙ্গ এমন ঘেরাটোপের পিছনেই তার হিম স্থির এক অতীত, সে জানে। কত যে খণ্ডদৃশ্য। ফিরে ফিরে আসে জিতু রতন গিরিধারীরা…। ঘনশ্যাম দল পালটালেও মদের ঠেক ওকে ছাড়তে হয়েছিল পাবলিকের মারের চোটে। রতন ওয়াগন ব্রেকিং-এ পুলিশের তাড়া খেয়ে ট্রেনে কাটা পড়ল। পড়ে থাকল লাইনের ধারে। খবরটা রাজুকেই দিতে হয়েছিল ওর মাকে।

আর ছিল গিরিধারী। জ্যাংরা এলাকায় নির্মিয়মান ফ্ল্যাটে বিশিষ্ট একজনের জন্য মধুচক্রের ব্যবস্থা করে দিতে গিয়ে, মূল মেহমান ও অন্যান্যরা সটকালেও ধরা পড়ল শুধু গিরিধারী। পুলিশের মারে সে কী ফালাফালা পিঠ। রাজু গা-ঢাকা দিতে পেরেছিল– ক’দিন মাসির বাড়ি বাগনান পালিয়ে।

…সেইসব সহযাত্রীরা …দিকশূন্য বাজপাখিগুলি…। তাদের মুখ থুবড়ে পড়া থেঁতো রক্তাক্ত মুখ, রাতের ঘুম কেড়ে নেয় রাজুর আজও। অস্থির উত্তাল সেই দুর্বহ বোধই কী স্তিমিত হয়ে ফিরিয়ে আনে তাকে আপাত অবস্থানে! তাই যদি, তাহলে খেদ অসন্তোষের দিকগুলি বাদ দিয়ে বাকিটা রাজুর কেমন? কতটা ভাল?

না, প্রাপ্তির তলদেশ ঘাঁটতে আর ইচ্ছা হয় না। বরঞ্চ ভেবে নেওয়া যাক জল বাদ দিয়ে দুধ যেমন একা উথলোয় না, সংসারে দুঃখ সুখের অবস্থানও অনেকটা সেইরকম…। এটাই বোধহয় নিয়ম।

এরপর তার দীর্ঘসময়ের গুমোট নিশ্বাস মোচন, আর পরবর্তী সুখটানের মতো টেনে নেওয়া তাজা বাতাস, দু’টোই তাকে এমন আশ্চর্য সহায়তা দেয় যে, হঠাৎ খেয়াল হয় হাতপাখাটা খুঁজে পেয়ে হাতে নিয়েই তো দাঁড়িয়ে আছে সে। অনু খাট থেকে নামতেই ছিট্কে পড়া তার চপ্পলজোড়া পা দিয়ে টেনে এগিয়ে দেয় অনুর পায়ের নীচে। অবিন্যস্ত নাইটি সামলে, পায়ে চটি গলিয়ে উদভ্রান্তের মতো ফোন ধরতে যাচ্ছে অনু। অপলক রাজু সেই মুখ দেখতে দেখতে সিল্কিকে বাতাস দেয়। ভেবে রাখে, অনু এলে তাকেও দেবে…।

মায়ানদী

‘এই ছেঁড়া মাতলা!’

শান্তনুর এত বিস্ময়ের কারণ খুঁজে পেল না মারুনা। মাতলার একটা ছোটো শাখা নিশ্চয়ই, তাই ছেঁড়া মাতলা। কিন্তু শান্তনুর কথায় মনে হচ্ছে এই নদীর অনুষঙ্গে কোনও স্মৃতি মনে পড়ে গেছে ওর! যাকে বলে অ্যাসোসিয়েশন মেমরি। চোখটা জ্বালা-জ্বালা করে উঠল তার। তাদের সব জার্নিতেই কি পিয়ালীর ব্যাগেজ বয়ে বেড়াতে হবে?

গতকাল থেকেই লক্ষ্য করেছে যে-কোনও স্পটে পৌঁছেই শান্তনু বলছে ‘এখানে আমরা এসেছিলাম।’ এমনকী ছবি তুলতে তুলতে বলল ‘ঠিক এই সিঁড়িটার সামনে পিয়ালীর একটা ছবি আছে। স্মাইল!’ মারুনার হাসিটা বেঁকে গিয়েছিল ধেবড়ে যাওয়া কাজলের মতো। শান্তনুর এই হৃদয়হীন ব্যবহারের কোনও অর্থই খুঁজে পায়নি মারুনা। মারুনা তো সেধে ওর জীবনে আসেনি, পিয়ালীকেও তাড়ায়নি।

মানুষের জীবনের প্রথম আতান্তরটি বোধহয় ‘ওই যাঃ, পাখি উড়ে গেল, দুশ যাঃ!’ উড়ে গেল, না উড়িয়ে দিল কেউ, মারুনা বুঝতে পারেনি। শান্তনুর সঙ্গে এই দেড়বছরের একত্রযাপনে কখনও এসেছে এমন সঙ্কট? আসেনি। সে বরাবরই অজস্র মনোযোগ পেয়েছে, অজস্র আদর, তার মনে হতে শুরু করেছিল সে একেশ্বরী। কিন্তু সুন্দরবনে না এলে সে যে এত দীন– তা তো বুঝতেই পারত না।

আপনজন হোটেল, পাখিরালয়, ঘাটে নেমে জায়গাটার কোনও বিশেষত্ব খুঁঝে পায়নি। ঘাটের কাছে, যেমন হয় আর পাঁচটা পর্যটন কেন্দ্রে, হরেক জিনিসের দোকান, ডাব খাবার ভিড়, সেগুলো ফেলে বাঁদিকে গিয়ে একটা ছোট্ট কাঠের সাঁকো পেরিয়ে ওদের হোটেল। বিশাল বড়ো, আর ছিরিছাঁদহীন, বাথরুম-টাথরুম খুব খারাপ নয়, কিন্তু পুরোটাই জেনারেটর নির্ভর। বাপরে! এই মার্চ মাসে দোলের সময় এখানে আসে কেউ? মারুনার মনে হল ওরাই এ মরশুমের শেষ পর্যটক।

আসলে এবার ওদের অন্য কোথাও যাবার কথা ছিল। কখনওই সুন্দরবন নয়। কিন্তু মারুনার একটা ইন্টারন্যাশনাল সেমিনার হবার কথা ছিল জানুয়ারিতে, সেই জন্য লম্বা কোনও টুর আগে থেকে বুক করা হয়নি। অথচ সেই সেমিনার জানুয়ারিতে হল না, পেছিয়ে গেল, মাঝখান থেকে লম্বা টুরও হল না। মারুনা প্রস্তাব দিয়েছিল, ‘চলো গাড়ি নিয়ে লং-ড্রাইভে বেরিয়ে পড়ি’ শান্তনু অন্যমনস্ক গলায় বলেছিল, ‘তুমি তো গান জানো না!’

কথাটা ঠক করে লেগেছিল মারুনার বুকে। ও জানে, এরপর অবধারিতভাবে পিয়ালীর গানের প্রসঙ্গ আসবে। পিয়ালী দারুন গান গাইত, রবীন্দ্রসংগীত থেকে সেমি ক্লাসিক্যাল সবই। মারুনা চুপ করে শুনবে, কোনও কথা বলতে পারবে না, কারণ কথাটা তো সত্যি। পিয়ালী তো সত্যিই দারুণ গান গাইত। ওর গান শুনে মারুনাও তো মুগ্ধ হয়েছে, এখনও হয়। ওর একটা গান এখন এফএম, টিভি, পুজো প্যান্ডেল সর্বত্র বাজছে, বলিউডে বড়ো ব্রেক পেয়েছে যে-গানটা গেয়ে ‘নাজুক কলহাইয়া মোরি’।

মারুনার তবু চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করেছে, ‘আমি গান জানি না বলেই তো আমাকে বিয়ে করেছ তুমি। এখন তা হলে আমাকে নিয়ে লং-ড্রাইভে যেতে অসুবিধে কোথায়?’

বড়ো টুর হল না, লং-ড্রাইভ হল না, ফেব্রুয়ারিতে মারুনার মা অসুস্থ হলেন হঠাৎ, তাঁকে নিয়ে নার্সিংহোম, ঘর ছোটাছুটি– শান্তনুই করল বেশি। মার্চ আসতে দুজনের মনের অবস্থাই সাংঘাতিক, কোথাও একটা যেতেই হবে। শহরের সব ট্র্যাভেল এজেন্সিতে খোঁজ নিয়ে দেখা গেল বেদুইন ট্রাভেলসেরই, দোলে সুন্দরবন প্যাকেজে দুটো সিট পড়ে আছে। ঝটপট সেটাই বুক করে ফেলল শান্তনু।

সত্যি বলতে কি, বিয়ের পর এই তাদের প্রথম বাইরে যাওয়া। পিয়ালী শান্তনুকে ছেড়ে মুম্বই গিয়েছিল অনেকদিন, সেখানে কে এক মিউজিক ডিরেক্টর পবন চতুর্বেদীর সঙ্গে লিভ-ইন করছিল, এটাও জানা ছিল। এসব সত্ত্বেও সে শান্তনুকে ডিভোর্স দিতে রাজি ছিল না। মুম্বইয়ে সুবিধে করতে না পারলে কলকাতায় ফিরে আসবে, তাই শান্তনুকে কুশন হিসেবে রাখতে তার ইচ্ছে হয়তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু শান্তনু তা মেনে নেবে কেন? শুরু হল টানাপোড়েন। শান্তনু না চাইলেও অ্যাডাল্টরির অভিযোগ আনতে হল। যেহেতু ওটাই স্ট্রং গ্রাউন্ড। অভিযোগ সম্পূর্ণ সত্যি হলেও শান্তনু যে কেন পিয়ালীকে সর্বসমক্ষে ব্যভিচারিণী বলতে চায়নি, তা মারুনার কাছে স্পষ্ট নয়, যেমন স্পষ্ট নয়, পিয়ালী ফেরত নিতে এলেও জরুরি ডকুমেন্টস ছাড়া, তার ব্যবহূত জিনিসপত্র, কসমেটিক্স, ব্যাগ, শাড়ি, অন্য পোশাক, টুকটাক গয়না কিছুই কেন শান্তনু ফেরত দেয়নি, এমনকী পিয়ালীর লঁজারি পর্যন্ত।

ছোট্ট ফ্ল্যাট নয়, বেশ বড়ো বাড়ি শান্তনুর, মাস্টারদা সূর্য সেন মেট্রো স্টেশনে নেমে সামান্য হাঁটলেই বাড়িটা। বাড়ি ঘিরে বিশাল বাগান, এমনকী একটা পুকুর পর্যন্ত আছে। সেই বিশাল বাড়ির একটি ঘরে ঠাসা শুধু পিয়ালীর জিনিস। ওটা আগে ওদের বেডরুম ছিল। এখন শান্তনু তার আর মারুনার জন্য অন্য একটি ঘর সাজিয়ে নিয়েছে। মারুনার প্রতি তার যত্ন ও আদরের কোনও ত্রুটি নেই। মারুনার প্রতিটি সুবিধে অসুবিধের দিকে তার সদাসতর্ক দৃষ্টি। কিন্তু ওই যে তালাবন্ধ ঘরটা, ঘরে ঠাসা পিয়ালীর জিনিস। সারাক্ষণ মারুনার মনের সবটুকু জুড়ে আছে ওই স্মৃতির ঘর। এখানেও যেন সেই ঘরটা সঙ্গে বয়ে এনেছে ওরা। শান্তনু সেটা সারাক্ষণ পিঠে বয়ে বেড়াচ্ছে, আর মারুনা একটুও স্বস্তি পাচ্ছে না, একটুও আনন্দ পাচ্ছে না তাদের বিবাহিত জীবনের প্রথম যৗথ ভ্রমণে। তার খালি মনে হচ্ছে বেড়াতে না এলেই ভালো হতো। বাড়িই ভালো।

নদী এখানে অনেকটা চওড়া হয়ে গেছে, বিকেলের হলুদ আলো গাছগুলোর মাথা আলগোছে ছুঁয়ে আছে। সূর্য ডুবতে বেশি দেরি যে নেই, তা বোঝা যাচ্ছে সবার চোখেমুখে চাপা টেনশন দেখে। সূর্যাস্তের ছবি তুলতেই হবে। বন্দুকের ট্রিগারে হাত রাখার মতো সবাই ক্যামেরা নিয়ে তৈরি। বেশিরভাগই আলাদা ক্যামেরা আনে না আজকাল, মোবাইলেই তোলে। মারুনাও তার মোবাইল বার করে ফেলল। সূর্য, নদী, অরণ্য– নৈর্ব্যক্তিক এই ছবিগুলো অন্তত পিয়ালীর কথা বলবে না।

‘দ্যাখো, দ্যাখো, আমি জাস্ট ভাবতে পারছি না!’

শান্তনু আচমকা এত প্রাবল্যের সঙ্গে তার পিঠে হাত রাখল যে আর একটু হলেই তার মোবাইলটা হাত ফসকে জলে পড়ে যাচ্ছিল। খুব বিরক্ত হয়ে সে পেছন ফিরে বলল ‘যাচ্ছিল মোবাইলটা। এত এক্সাইটমেন্টের হয়েছেটা কী? ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে সেই তো জল আর জল দেখে যাচ্ছি।’

শান্তনু নাটকীয় গলায় বলল,

‘জল শুধু জল, দেখে দেখে চিত্ত তোর হয়েছে বিকল– তাই না রে? ওরে অবোধ বালিকা, এক্সাইটেড হব না! ওই যে গাইডটা দেখছ, সকাল থেকে আমাদের পেছনে ফেউয়ের মতো লেগে আছে, ওই যে, কলকেতার বাবুরা হাঁ করে যার জ্ঞানবাণী গিলে যাচ্ছে, ওই লোকটা কে জানো?’

‘কে? ডোনাল্ড ট্র্যাম্প? না রয়েল বেঙ্গল টাইগার?’

‘তার চেয়ে বেশি। সকাল থেকে তাই ওকে এত চেনা-চেনা লাগছিল। আরে সেবার যখন পিয়ালীকে নিয়ে এখানে এসেছিলাম, এই লোকটাই গাইড ছিল। ওর নাম হচ্ছে আশুতোষ খাঁড়া। পিয়ালী ওর কাছ থেকে একটা রুটম্যাপ লিখে নিয়েছিল। লোকটার হাতের লেখা মুক্তোর মতো। পিয়ালী ওকে দুশো টাকা দিয়েছিল আলাদা করে।’

পিয়ালী, পিয়ালী, পিয়ালী! উঃ! মারুনার মুখ নিমেষে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তবু সে যথাসাধ্য নিজেকে সামলে নিয়ে বলল ‘কাগজটা কোথায়?’

‘মানে?’

‘ওই যে বললে কাগজে রুটম্যাপ লিখে দিয়েছিল’,

শান্তনুর মুখ হাজার দীপশিখায় জ্বলে ওঠে। ‘আছে। আমি দিইনি তো কিছু ফেরত। আমার সঙ্গে থাকার প্রতিটি মুহূর্ত, আমার সূত্রে যা যা অর্জন করেছে পিয়ালী, সব, সব  রেখে দিয়েছি। ওই তালা বন্ধ ঘরে আছে। ওয়াল ক্যাবিনেটের বাঁদিকের তিন নম্বর খোপে পেয়ে যাবে।’

মারুনা যেন এতক্ষণে একটা আঁকড়ে ধরার মতো কিছু পায়। ওয়াল ক্যাবিনেটের তিন নম্বর খোপে যেন ওর সুখের ঘরের চাবি আছে। সে বেশ গুছিয়ে মোবাইল ক্যামেরা তাক করে পশ্চিম আকাশের দিকে, মুরুবি৩ চালে বলে ‘একি! সূর্যাস্তের ছবি তুলবে না?’

সকাল থেকে যতটা খারাপ গেছে, সন্ধেটা তার তুলনায় অনেক অনেক ভালো কাটল। হোটেলটা খুব খারাপ না। অনেকখানি জায়গা জুড়ে। যদিও কোনও ছিরিছাঁদ নেই, এল শেপের স্কুলবাড়ির মতো। তার ওপর লোডশেডিং-এর দৗরাত্ম্য। বাথরুমে একরাশ অজানা পোকা, গা ধুতে গিয়ে চোখে নাকে ঢুকে গেল। তিনতলার ঘর, ছাদ রোদে তেতে আগুন হয়ে আছে। গা ধুয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতে বেশ আরাম হল। সারা হোটেলে নাকি দুটো মাত্র এসি ঘর, যারা আগে বুক করে এসেছে তারা পাবে। নীচে এ নিয়ে চ্যাঁচামেচি শোনা গেল খুব। ম্যানেজারকে যাচ্ছেতাই করে কথা শুনিয়ে এল কয়েকজন। ‘আগে জানালে আমরাও এসি বুক করে আসতে পারতাম। কেন সেই অপশনটাও দেওয়া হল না!’

কিছুক্ষণ চলল এরকম, তারপর সব শান্ত হয়ে এল। আসন্ন সন্ধের মায়া ছড়িয়ে পড়ল আকাশে। বারান্দা থেকে দেখল সন্ধেলাগা নদীর ওপর চাঁদ উঠল, সোনার থালার মতো চাঁদ। মারুনার আচমকা মনে পড়ল আজ পূর্ণিমা। যে সে পূর্ণিমা নয়, দোলপূর্ণিমা। দোল আর পরের শনি-রবি এই মিলিয়েই তো ট্রিপটা সম্ভব হয়েছে তাদের। আজ দোল, অথচ এক ফোঁটা আবিরও কেউ কারও কপালে ছোঁয়ায়নি। ফোনে কয়েকটা মেসেজ এসেছে, ‘হ্যাপি হোলি’। এছাড়া সারাদিনে মনেই পড়েনি আজ দোল। প্রতিবার দোলে তাদের বাড়িতে উৎসবের মেজাজ, মা পূর্ণিমার শিন্নি দেয় একদিকে, অন্যদিকে মামাতো, মাসতুতো, পিসতুতো ভাইবোনেরা মিলে রং মেখে হুল্লোড় করে। এখানে না এলে এবারও সেখানেই থাকত। বুকে একটা চিনচিনে ব্যথা উঠেই মিলিয়ে গেল। মহাসমারোহে দোল পালন করতে না পারা, শান্তনুর লাগাতার পিয়ালী – পিয়ালী– সব মুছে গেল মুহূর্তে। নদী আর তার বুকে মস্ত চাঁদ, মারুনার সমস্ত না-পাওয়াকে তুচ্ছ করে দিল। বারান্দায় আরও অনেকে চেয়ার পেতে বসে গজল্লা করছিল। তাদের কথাও মারুনার কানে গেল না। কতক্ষণ যে সে ওইভাবে বসেছিল কে জানে। হঠাৎ ট্রাভেলসের একটা ছেলে এসে প্লেটে প্লেটে চাউমিন দিয়ে গেল, আর সেটা দেখেই নিশ্চয়ই শান্তনু বেরিয়ে এল ঘর থেকে, ছেলেটাকে বলল, ‘চা দেবে না?’

‘এটা খেয়ে নিন, চা আসছে।’ বাব্বা! ছেলেটার গলা কী গম্ভীর! খেতে খেতে সেই গম্ভীর গলা চড়িয়ে ছেলেটা বলে গেল, ‘চা খেয়ে নীচের লনে আসবেন। যাত্রা হবে।’

‘কী যাত্রা ভাই?’

‘বনবিবির পালা।’

শান্তনুর সামনে বসে খেতে রীতিমতো অস্বস্তি হচ্ছিল মারুনার। হয়তো বলে বসবে, সেবার পিয়ালীর সঙ্গে যখন এসেছিল, বিকেলে ঠিক এই টিফিনই খেয়েছিল। তাকে আশ্বস্ত করে শান্তনু কিছু বলল না, চাউমিনটা চেটেপুটে খেয়ে নিল, তারপর বারান্দা থেকে নীচের লনে উঁকি মেরে বলল, ‘দেখেছ, স্টেজ বাঁধা হয়ে গেছে।’

মারুনাও উঁকি মারল নীচে। খুব নীচু মঞ্চ, স্টেজের পেছনে কয়েকজন বসে মেক-আপ করছে। যারা স্টেজ বাঁধছিল, তারাও মেক-আপ নিতে বসে গেল একটু পরে। একজন ব্যানার টাঙিয়ে দিল একটা, তাতে লেখা ‘মা নৃত্যাঞ্জলি অপেরা’। দেখে মজা লাগল মারুনার।

‘যাবে না নীচে? ওঃ তোমার তো আবার গান-টানে ইন্টারেস্ট নেই।’

মারুনার বুক ধক্ করে উঠল। গান থেকে পিয়ালীতে যেতে এক সেকেন্ডও লাগবে না শান্তনুর। বিয়ের পর এই তাদের প্রথম যৗথ ভ্রমণ, যাকে মধুচন্দ্রিমা বলাই দস্তুর, একেবারে পলিটিক্যালি কারেক্ট, চাঁদও উঠেছে সঙ্গতি রেখে– তবু সারাক্ষণ পিয়ালী-পিয়ালী জপে কেন যে কানের পোকা বার করে দিচ্ছে লোকটা? হয় ও অতিবোকা, নয় অতি হূদয়হীন, নয় যে কী ভেবে পেল না মারুনা। সে শান্তনুকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে নেমে এল নীচে।

স্নান সেরে লংস্কার্ট আর কুর্তি পরেছিল। চুল খোলা, চোখে কোহল, ঠোঁটে লিপবাম, বডি পারফিউমের গন্ধটা তাকে ঘিরে রেখেছে। লনে সারি সারি পাতা চেয়ারে চাঁদের নীচে বসে তার নিজেকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করছিল। যেন শান্তনুর সঙ্গে নয়, সে একাই এসেছে। একটু পরে যাত্রা শুরু হল। গরিব বিধবা মায়ের সন্তান দুখে, সে কীভাবে বনবিবির কৃপায় বাঘের হাত থেকে রক্ষা পেল– এই প্রচলিত লোকগল্প নিয়েই পালা। যাত্রা ফর্মটা তার কোনওদিন দেখা না থাকায় প্রথম প্রথম হাসি পাচ্ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পর সে লোকশিল্পের শক্তি টের পেল। গানে, অভিনয়ে গোটা সুন্দরবনের লোকজীবন, নদী, অরণ্য, নোনামাটি তার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল। শেষে যখন দুখে গান ধরল ‘এই মায়ানদী ক্যামনে হব পার’– অকারণেই তার চোখে জল চলে এল। হঠাৎ সে চমকে উঠে দেখল শান্তনু কখন এসে মন দিয়ে তার ছবি তুলছে।

পালার শেষে দুখে সকলের কাছে গিয়ে টাকা সংগ্রহ করছিল। মারুনা দেখল দুখে আসলে একটি ছোটো মেয়ে। ভারি সুন্দর দেখতে আর গানের গলার তো তুলনা হয় না। সে একবার ভাবল শান্তনুকে বলবে মেয়েটার ছবি তুলতে। ভয়ে বলল না। শান্তনু যদি বলে বসে পিয়ালীও সেবার এমন আবদার করেছিল।

রাতের খাওয়াটা ভালোই হল। যদিও মেনু নিয়ে অনেকেই নাক সিঁটকেছে। ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেনের সঙ্গে বেগুনি! ছোঃ! ফিশফ্রাই করতে পারল না! আর ওটা চিলি চিকেন হয়েছে? মারুনা আদৗ রাঁধতে জানে না, তাই খাওয়া নিয়ে সে কোনও সমালোচনায় যায় না। তার তো ভালোই লেগেছে। একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গেছে। সে শান্তনুকে বলে ফেলল ‘চলো না, একটু হেঁটে আসি।’

শান্তনু কী যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল। তারপর বলল, ‘চলো যাই।’

হাঁটতে হাঁটতে তারা বাজার ছাড়িয়ে অনেকটা চলে এল। বাজার এলাকাটুকু ছাড়া পাখিরালয় একটা সাধারণ গ্রাম, রাত দশটা বাজতে না বাজতেই নিঝুম হয়ে গেছে। ওরা দুজন, নদী আর চাঁদ ছাড়া কেউ নেই চরাচরে। মারুনার ভয় করছিল একটু। সে শান্তনুর পাঞ্জাবি টেনে বলল ‘চলো ফিরি।’

শান্তনু তখনি আঙুল দেখিয়ে বলল ‘ওই জেটিটা’।

মারুনা ওর আঙুল অনুসরণ করে দেখল একটা পরিত্যক্ত জেটি, এই দ্বীপ থেকে কেমন বিচ্ছিন্ন হয়ে নদীর বুকে প্রসারিত হয়ে আছে। যেন পৃথিবীর মাটির নয়, জেটিটা নদীর আর চাঁদের। মারুনার খুব ইচ্ছে হল ওখানে গিয়ে দাঁড়াতে। ও শান্তনুর হাত ধরে টানল, ‘চলো না, ওই জেটিটায় গিয়ে একটু দাঁড়াই।’

শান্তনু এর উত্তরে কী একটা বলতে গিয়ে থেমে যায় আবার। মারুনা বুঝতে পারে আবার পিয়ালীকে নিয়ে কিছু একটা মনে পড়ে গেছে ওর। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল হয়েছে, এধরনের কথায় মারুনা হার্ট হচ্ছে, তাই হয়তো বলতে পারছে না। হঠাৎ মাথাটা গরম হয়ে যায়। চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে ও জেটির দিকে ছুটে যায়। শান্তনু আঁতকে ওঠে ‘মারুনা শোনো, ওটা ভাঙা জেটি, যে-কোনও মুহূর্তে ভেঙে পড়তে পারে।’

মারুনা ছুটতে ছুটতেই বলে ‘ভাঙুক, তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্কটাও তো তাই, ভেঙে পড়বে যে-কোনও মুহূর্তে।’

শান্তনু ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে নিবিড় করে। ‘না ভাঙবে না। তুমি আমায় ছেড়ে যাবে না, জানি আমি।’

কান্না থেমে যায় মারুনার। কি নির্লজ্জ লোক রে বাবা! মারুনা কি কুকুর নাকি এত অপমান সয়ে পড়ে থাকবে? ‘আমি যাব, চলে যাব, বারবার এভাবে পিয়ালীর কথা বললে।‘

‘আর বলব না মারুনা, ক্ষমা, ক্ষমা, শুধু একটা কথা, শেষবারের মতো।’

জেটিটা প্রবল টানে মারুনাকে। তবু সে থমকে যায় শান্তনুর কথা শোনার জন্যে।

‘এই জেটিতে দাঁড়িয়েই পিয়ালী ওই বাস্টার্ডটার কথা আমাকে বলেছিল, যেটার সঙ্গে ও থাকে মুম্বইতে। আমি চাই না মারুনা, তুমি ওই জেটিতে যাও।’

কান্নায় জড়িয়ে আসে শান্তনুর গলা। চাঁদের আলো পড়ে সেই চোখের জলে। মারুনা অবাক হয়ে দেখে শান্তনুর চোখে নদী, তার এপার-ওপার দেখতে পায় না সে।

ছেলেধরা

আমি উত্তমকুমার।

হাবরা থানার সেকেন্ড অফিসার টেবিল থেকে মুখ তুলে দুটো ভ্রূ যথাসম্ভব কাছাকাছি আনলেন। তাঁর চোখের শ্লেষ ও বিরক্তির জিজ্ঞাসায় কিছুটা থতমত, টেবিলের অপর প্রান্তের দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি গড়গড় করে বলতে থাকে– মানে আমি উত্তমকুমার দাম। আজ ২টো ২০-র বনগাঁ লোকালে আমার পিক্পকেট হয়েছে। হাজার দেড়েক টাকা ছাড়াও ওয়ালেটে ছিল ব্যাংকের ডেবিট কার্ড। আর পকেটের মোবাইলটাও গেছে। হাবরা থানার সেকেন্ড অফিসারকে এটুকু বলতেই ঘেমে একসার। আসলে থানা-পুলিশ নিয়ে তার দুর্বলতা আছে।

সেদিনও ঘেমে নেয়ে দুপুর রোদের ভেতর এক সংবাদপত্রের অফিসের বিজ্ঞাপন বিভাগে ঢুকে কাগজে লেখা টুকরোটি দিয়েছিল। ‘আমি উত্তমকুমার দাম। বয়স পঁয়ত্রিশ। অবিবাহিত। কর্পোরেট সংস্থায় চাকুরে। বিবাহে ইচ্ছুক। দ্রুত যোগাযোগ করুন।’সেদিন মঙ্গলবার, পরের রোববারের কাগজে বেরিয়ে যাবে বিজ্ঞাপন। সুইং ডোর ঠেলে পথে নেমে পড়ে। দেখা যাক। নীরদ চৌধুরির কথাটা প্রেমে ল্যাং খাবার পর প্রতিদিনই চোখের সামনে ভেসে উঠছে– ‘বাঙালিরা কোনও কাজ নিজে নিজে করতে পারে না, এমনকী নিজের বিবাহটাও নয়।’ দেখা যাক। গোটা ব্যাপারটাই নিজের হাতে করব। ছাঁদনাতলা থেকে রাঁধুনি– সব নিজের হাতে করব। এমনকী করবীকে নিজের হাতেই বিয়ের আমন্ত্রণপত্রটি দিয়ে চা খেয়ে আসব। বিয়ের একটা ডেট ঠিক করে ফেলা যাক। ১৮ অগ্রহায়ণ। শুক্রবার। ঠিক থাকল। না অন্য কেউ দিন ঠিক করবে না। যে মেয়ে বিয়ে করবে তাকেও ওই দিনেই বিয়ে করতে হবে। কোনও পালটাপালটি নয়। কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে আজই কার্ডের নমুনা টমুনা দেখে আসতে হবে। বিয়ের কার্ড অন্তত শ’পাঁচেক ছাপতে হবে। রাসবিহারী কানেক্টরে বোসপুকুরের কাছে বিয়ে বাড়িটার যেন কী নাম– ‘নীলিমা’! অগ্রিম দিয়ে আসতে হবে। ভাবতে ভাবতে দুপুর রোদের ভেতর হেঁটে হেঁটেই ডালহউজি নিজের অফিসে ফিরে আসে।

বেশ ছটফট করছে সে। বুকের ভেতর অশান্তি নামে নাছোড় এক পদার্থ গড়িয়ে গড়িয়ে ছেয়ে যাচ্ছে সমস্ত শরীরে। রক্তের প্রবাহ পথে, তার মনে হচ্ছে সমস্ত শরীরেই এই আনচান ভাবটা ঢুকে পড়েছে। মনে পড়ছে গত পরশু দিন বিকেল বেলায় ওই যে শব্দের ছোবল কানের ভেতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করল– তারপর থেকেই এই অস্থিরতা। গত দুবছরে কতদিনই তো রেস্তোরাঁয় বসে চা-কফি খেতে খেতে পায়ের আশ্লেষে হূদয়ের আকুলতা প্রকাশ করেছে উত্তম। তাতে তো সায়ই দিয়েছে করবী, ওর নগ্ন দু-পা আরও প্রলম্বিত করে। অথচ পরশু শান্তনুর কথাটা তুলে পার্ক স্ট্রিটের ফেলিনি-তে টেবিলের তলায় পা দিয়ে পায়ে ছোঁয়া লাগাতেই, খাঁচার বাঘিনীর মতো গর্জে উঠেছে করবী। ইউ রাসকেল্ হোয়াই আর ইউ প্রেসিং সো হার্ড! মাইন্ড ইট দ্যাট ইউ আর অ্যাবভ থার্টি-ফাইভ, হোয়ারআজ  আই এম টোয়েন্টি টু অনলি। থতমত উত্তম করুণ করে বলেছিল– মানে!

কোনও মানে নেই। সব কথার উত্তর তোমাকে দিতে হবে তার কোনও মানে নেই। শান্তনুও আমার ভালো বন্ধু, তার সাথে আমি সিঙ্গাপুরে যেতেই পারি। বড়ো কথা কোম্পানি আমাদের পাঠাচ্ছে সিঙ্গাপুরে, কোম্পানির স্বার্থেই। উত্তম ভালো করে জানে না কী কোম্পানি, তাদের কী ব্যাবসা সিঙ্গাপুরে। একটা দম নিয়ে পুনরায় করবী বলে, তোমার গায়ে জ্বালা হচ্ছে যখন, লেট মি সে টাটা, বাই। করবী টেবিলটাকে এমন পুশ্ করে উঠে পড়েছিল যে ঝুঁকে থাকা উত্তমের বুকে এসে সজোরে ধাক্বা মারে। উত্তম কোনও কথা বলতে পারেনি। বুকে হাত বোলাতে বোলাতে করবীর তেজী ভঙ্গির ক্ষীপ্র গমনটিকে চোখে গেঁথেছিল, বুঝে উঠতে পারেনি। যেভাবে ভারী কোনও আঘাত প্রথমে সমস্ত ইন্দ্রিয়কে অনুভবহীন করে দেয়– কিছু পরে মস্তিষ্কের নিউরনে যন্ত্রণা পাঠাতে থাকে, তেমনই।

বিয়ে করল উত্তমকুমার। পাত্রীও তার পছন্দের। নম্রস্বভাব। সুশ্রী, সুন্দরী। বিয়ের পরেই প্রেম করবে ভাবল সে। অনেক ভালোবাসবে। ওকে ভালোবেসেই বুকের জমানো অন্ধকার দূর করে ফেলবে। বিয়ের রাতে তৃণাকে উত্তম এক অবসরে জিজ্ঞাসা করেছে– কি, বর পছন্দ? মুখে সলজ্জ হাসি টেনে মাথা নেড়ে ইতিবাচক মতামত জানিয়েছে। উত্তম জানিয়েছে দিন দশেকের মধ্যেই তারা বেরিয়ে পড়বে হানিমুনে। কাঠমান্ডু যাবে। সেখান থেকে ফেরার পথে বেনারস, লখনউ হয়ে একমাস পরে বাড়ি ফিরবে। দশ লাখ টাকা খরচ করবে হনিমুন টুরে।

এসব শোনার পর তৃণা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসেছিল উত্তমের। মেয়েবাড়িতে এর বেশি এগোনো যায় না। শুধু ছোঁয়াছুঁয়ি আর আকার-ইঙ্গিতে ভালো লাগা ব্যক্ত করা যায়। বউভাত ও তার পরের কয়েকদিন উত্তমের অসাধারণ কেটেছে। বউভাতে করবীও এসেছিল শান্তনুকে নিয়ে। উত্তম করবীকে নিয়ে বউ-এর সাথে আলাপ করিয়েছে। উদ্দেশ্য আরও কাছ থেকে দ্যাখো, দ্যাখো কে বেশি সুন্দরী– তুমি না আমার বউ। খুব বয়স নয় তৃণার, ২৫-এর কাছাকাছি হবে। উত্তম করবীর মুখের নানা পরিবর্তন দেখে নিজেকে তারিফ করেছে। করবীকে বিট্ করতে পারার এই আনন্দেই যেন কটা দিন চলে গেল। এরপর দ্বিরাগমনের প্রথা ট্রথা কাটিয়ে অফিসে জয়েন করেছে। হনিমুন ট্রিপের জন্য গোছগাছ।

এসময় উত্তমের জন্য আবার একটি ভয়ংকর আঘাত অপেক্ষা করে ছিল। অফিস ফেরত দেখে বউ বাড়ি নেই। বৃদ্ধা মা জানায় সকাল বেলায় এগারোটা নাগাদ ট্যাক্সি ডেকে একটা বড়ো সুটকেশ নিয়ে বউ বাপের বাড়ি চলে গেছে। উত্তম ফোন বাজায় কেউ ফোন ধরে না। উদ্বিগ্ন উত্তম ঠিক করেছে সকাল হলেই সে শ্বশুড়বাড়ি যাবে খোঁজখবর নিতে। পরের দিন সকালের ঘুম ভাঙে তার কলিং বেলের আওয়াজে। ঘুম চোখেই দরজা খুলে দাঁড়িয়ে দেখে একজন পুলিশ অফিসার, সঙ্গে দু-তিনজন কনস্টেবল।

– আপনি উত্তমকুমার দাম?

ভ্যাবাচ্যাকা উত্তম কিছু না বুঝেই ঘাড় নাড়ে।

আপনি আমার সঙ্গে চলুন, কড়েয়া থানায়। আপনার উপর বধূ নির্যাতনের অভিযোগ আছে। আপনাকে দেখে সম্ভ্রান্ত মনে হয়, কিন্তু টাকার জন্য এরকম ফুটফুটে মেয়ের শরীরে সিগারেটের ছ্যাঁকায় বীভৎস দাগ করে দিতে পারেন? ক্যাশ টাকা দিয়েছিল ওরা তিন লাখ, আর আপনার আরও দু লাখের ডিমান্ড ছিল!

উত্তমের মাথায় কিছু ঢুকছে না। একটা বড়ো বিপদ যে আসছে বুঝতে পারল। মোবাইল থেকে সঙ্গে সঙ্গে ফ্রেন্ড-ফিলসফার অফিসের শম্ভুদাকে ফোন করে বলল, কড়েয়া থানায় আসতে। শম্ভুদা ওকে জামিনে ছাড়িয়ে আনল বটে তবে উত্তমের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে তিন লাখ টাকা নিঃশব্দে চলে গেল ওর বউ, মানে তৃণা নামে সেই মেয়েটির বাড়িতে। সোনা-গয়না বিয়ের দামি উপহার সামগ্রী-সহ আরও লাখ দুয়েক টাকার জিনিস মেয়েটা সুটকেস ভর্তি করে নিয়ে গিয়েছিল। হাজতেই ডিভোর্স পেপার সই হয়ে গিয়েছিল। এই তিন লাখের এক লাখ নিঃসন্দেহে থানার বড়োবাবু পেয়েছিল। না হলে এত নিখুঁত, সাজানো নাটক করা যেত না। থানার বাইরে চার-পাঁচজন মহিলাকে ও দেখেছিল পোস্টার হাতে স্লোগান দিতে– নারীনির্যাতনকারী উত্তমকুমার দামের শাস্তি চাই। এত দ্রুত, এত সকালে চলে এসেছে ওরা! বড়োবাবুও খুব ভালোমানুষের মতো উপদেশ দিয়েছে ওদের টাকাটা ফিরিয়ে দিন, আর বিয়েটা যখন ভেঙেই যাবে এখনই ডিভোর্স পেপারে সইটই করে মানসম্মান বাঁচান। এখনও লোক জানাজানি হয়নি তেমন। উত্তম বোঝাতেই পারেনি যে পণ নিয়ে ও বিয়ে করেনি। আর বধূ-নির্যাতনের কথা তো দূরঅস্ত, একটু জোরে বউয়ের নাম ধরে ডাকাও হয়ে ওঠেনি তখনও।

টাকার ক্ষতি, ক্ষতি নয়, নিজের উপর থেকে বিশ্বাসটাই চলে গেল। বুক ভেঙে গেছিল, শোবার ঘর থেকে এক সপ্তাহের মধ্যে বাইরেই বের হয়নি। এক সময়কার কলকাতার মাঠের ডাকসাইটে স্টপার ছিল। যত গোল করেছে তার চেয়ে ঢের বেশি করিয়েছে। কিন্তু এখন পরপর গোল খেয়ে যাচ্ছে। করবীকে টেক্বা দিতে তেমন কোনও খোঁজখবর না নিয়েই খুব দ্রুত বিয়েটা সেরেছিল। কিন্তু কী করে পারল মেয়েটা! আজও ভেবে পায় না। এখন হাবরা থানায় ডিউটিরুমে বসে এফআইআর লেখাতে লেখাতে উত্তমের মনে পড়ছিল এসব কথা। পাশের কনস্টেবল দাদার কাছ থেকে বিড়ি চেয়ে একটা বিড়ি ধরাল। মাথাটা উত্তর কলকাতার ট্র্যাফিক জ্যামের মতো জমাট হয়ে আছে।

এখন সে বিড়ি খায়। বলে, বিড়ি না ফুঁকলে মাটির কাছাকাছি যাওয়া যায় না। আমার কাজই মাটির সাথে, মাঠের সাথে– বলে অল্প করে হাসে। এবছর উত্তম বড়ো ক্লাবের স্পটার। গোদা কথায় ছেলেধরা। ফুটবল মরশুমের আগে কলকাতার মাঠের বড়ো ক্লাবগুলির রিক্রুটারদের কাছে ওর ডিমান্ড এখন বেশ। গত নয় বছর ও এই ছেলেধরা, মানে স্পটারগিরি করছে। আচমকাই এই কাজটা শুরু হয়। করবীর কাছ থেকে আঘাত ও বিয়ের পর বউ পালানো ও থানা-পুলিশ ইত্যাদির ধাক্বায়, উত্তমকুমার বেশ গভীর একটা ডিপ্রেশনের মধ্যে পৌঁছে গিয়েছিল। অফিসে যেত মাসে হাতে গোনা কয়েকদিন। মানুষজন পছন্দ করত না। নিজের কাছে নিজেকেই লুকোতে চাইত। সারাদিন গোটা কলকাতার খোলা মাঠের কোণটোনে বসে কাটিয়ে, অনেক রাতে ঘরে ফিরত। এরকম করতে করতে গোটা কলকাতার মাঠের ফুটবল খেলা দেখে ফেলেছিল সে বছর। একদিন উত্তর কলকাতার একটা মাঠে স্কুল ফুটবল দেখছিল। একটা বছর ১৪-১৫ ছেলের খেলা ওকে নাড়িয়ে দেয়। স্টপার। খেলা শেষে নাম জিজ্ঞাসা করে। ওর নাম হাসান। বস্তিতে থাকে। দেশবন্ধু স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্র। উত্তম ছেলেটার ভেতর একদম নিজের গড়ন দেখল। বেশ লম্বা। ছ’ফুটের উপর হবে। দারুণ সম্ভাবনা। রাতে ঘুম হল না। পরের দিন অফিসে গিয়ে শম্ভুদাকে বলল, ওই ছেলেটিকে একটা ক্লাব দিতে হবে। সেই শুরু। ছেলেটিও ইতিমধ্যে ভারতীয় জার্সি গায়ে দিয়ে ফেলেছে।

গত দু’বছরে কলকাতার মাঠের তাঁবুগুলোতে তার নাম একটা বিষয়। এভারেডি ইলেভেন ২ঙ্মঙ্মজ্জ-এর ক্লাব ফুটবলের হিসেব-টিশেব সব বদলে দিয়েছে। চারটে বড়ো ক্লাবকেই গোল মেরে দিয়েছিল। দু’টোর সাথে ড্র, দুটো জয়। সেই এভারেডির দুটো স্টপারই এবছর, ২০০৭-এ গোটা ভারতের মাঠ শাসন করছে। বিড়িখোর উত্তমই ওই স্টপার দুটোর স্পটার ছিল। এবছর বড়ো ক্লাবের স্পটার হিসেবে তিনটে জায়গাতে অ্যাসাইনমেন্ট আছে। গোলকিপার, ডিপ ডিফেন্স আর তার নিজস্ব প্রিয় জায়গা স্টপার পজিশনের জন্য। মোটা টাকার চুক্তি। বছরে বিশ লাখ। দশ লাখ টাকা অ্যাডভান্স পেয়েছে। অফিসে হাজিরা খাতায় সই করে দু-এক কাপ চা খেয়ে, শম্ভু-দার সঙ্গে একবার দেখা করে কেটে পড়ে। প্লেয়ার কোটায় চাকরি হয়েছিল বছর ষোলো আগে। গ্রুপ ডি। এখন পদোন্নতি হয়েছে। গ্রুপ সি। ওর শুধু আসা-যাওয়া। কাজের মধ্যে নিয়ম করে শম্ভুদার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানো। এই মানুষটাকে ও প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে আর শ্রদ্ধা করে। শ্রদ্ধা করারই মতো।

প্রথম দিন শম্ভুদার কাছে গল্পটা শুনেই সে আপ্লুত হয়ে গিয়েছিল। গল্পটা শম্ভুদার স্ত্রী আত্রেয়ীকে নিয়ে যতটা, তার চেয়ে ঢের শম্ভুদা নিজেই। লাখোটিয়া কম্পিউটার সেন্টার, কলকাতার প্রথম যুগের কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টারের অন্যতম। সেখান থেকে এক বছরের কোর্স করেই এন্টালির ডাকাবুকো বিএ পাস শম্ভু রাহা, এই কোম্পানির কম্পিউটার অপারেটরের চাকরিটি পায়। মাঝে মধ্যেই শম্ভুদার সহকর্মী দীপকের খোঁজ করে অফিসের ল্যান্ড ফোনে কল আসত আত্রেয়ীর। দীপক অফিসে বেশ অনিয়মিত ছিল, তাই ফোনটা ধরতেন শম্ভুদাই। প্রথম প্রথম আড়ষ্ট আলাপ, ক্রমশ বন্ধুত্ব। তারপর অন্তরঙ্গতা। এদিকে অনিয়মিত হওয়ার কারণে দীপকের চাকরিটি গেল। একদিন আত্রেয়ী চাইল দেখা সাক্ষাৎ হোক। শম্ভুদা বলল, বেশ। কোথায়, কখন তা আত্রেয়ী ঠিক করে। প্রথম দিন ছিল শনিবার, ধর্মতলায় মেট্রো সিনেমার সামনে, সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায়। কিন্তু কী করে চিনব, শম্ভুদা জিজ্ঞাসা করেছিল। আত্রেয়ী জানায় সে কালো রঙের চুড়িদার পরবে।

শম্ভুদা বলেছিল, আমি থাকব পিংক টি-শার্ট আর ব্লু জিনসে। শনিবার দুটোর পরেই ছুটি। শম্ভুদা ক্লাব, ক্যান্টিন করতে করতে চারটে বাজিয়েছে মাত্র। আরও দেড় ঘন্টা! সময় আর কাটতেই চায় না। অফিস থেকে এসপ্ল্যানেড হেঁটে দশ মিনিটের পথ। আর এই বিশেষ দিনে তো হাঁটা যায় না, ট্যাক্সি করতে হবে। শম্ভুদা সাড়ে চারটের মধ্যেই চলে এসেছে। এত আগে কী করবে, ফুটপাথে বইপত্রের দোকান থেকে বইপত্র দু-একটা তুলে তুলে দেখছে। ইতিমধ্যে সিনেমার শো ভেঙেছে। অনেক মানুষ। খুঁজে পাবে তো! মনে মনে একটা আশঙ্কাও তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে, কই কালো-চুড়িদারে কাউকে তো দেখা যাচ্ছে না। শম্ভুদা মনে মনে ভাবল, আমার ঘড়িটা ঠিক আছে তো! ঠিক এখানটাতেই তো বলেছিল! তখনও মোবাইল ফোনের যুগ চালু হয়নি। ফলে প্রতীক্ষার দীর্ঘতা অস্বস্তি বুনে চলে মাথার ভেতর। প্রায় একঘন্টা কেটে গেছে, সাড়ে ছ’টা নাগাদ নীল শিফন শাড়ি পরা একটা মিষ্টি মেয়ে তার দিকে এগিয়ে এল। ঘন্টাখানেক আগেই ওই দীর্ঘাঙ্গী সুশ্রী মেয়েটা ওর চোখে পড়েছে। শম্ভুদা ভেবেছিল সিনেমা দেখতে এসেছে, ওর সঙ্গীর জন্য অপেক্ষা করছে। মেয়েটি জিজ্ঞাসা করল, আপনি শম্ভু রাহা?

হ্যাঁ। কিন্তু আপনি?

মেয়েটি হেসে জবাব দেয়, সে-ই আত্রেয়ী। বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে শম্ভুদা অনেকক্ষণ ওর চোখে তাকিয়ে ছিল। কোনো অনুযোগ করেনি। পোশাক পালটানোর কারণও জিজ্ঞাসা করেনি। পরে অবশ্য জেনেছিল, ইচ্ছা করেই আত্রেয়ী নিজের পোশাকের ভুল বিবরণ দিয়েছিল যাতে না-দেখা পরিচয়ের শম্ভুদাকে অপছন্দ হলে নিঃশব্দে কেটে পড়তে পারে। শম্ভুদা বলল কোথায় বসে কথা বলা যায়! চলুন কাছেই কাফে দ্য মণিকা-র দোতলায় কফি খেতে খেতে গল্প করা যাক। কফি খেতে খেতে শম্ভুদা আত্রেয়ীর রূপে মজে যায়। বলে সংশয় ছিল, না না-দেখা আত্রেয়ীর ঘোর, দেখা আত্রেয়ী এসে যদি নষ্ট করে দেয়। কিন্তু এখন দেখছি আমার ভাবনা পেরিয়েও আপনি অপরূপা। আত্রেয়ী অল্প হাসে এবং ঘড়ির কাঁটা দ্রুত সাড়ে আটটা পার করে দেয়। আত্রেয়ী উঠব উঠব করে। শম্ভুদা বলে, রাত হয়ে গেছে। চলুন, আপনাকে পৌঁছে দিয়ে আসি। আত্রেয়ী সশব্যস্ত হয়ে বলে, না না আমি একাই যেতে পারব। শ্যামবাজার। আপনি আমাকে একটা ট্যাক্সি ধরে দিন শুধু। তারপর হাতব্যাগ খুলে ব্যাগের ভেতর খুঁজতে খুঁজতে মুখ চুন করে বলে, কিন্তু আমার মানিপার্স বাড়িতে ফেলে এসেছি। শম্ভুদা ব্যস্ত সমস্ত হয়ে নিজের মানিব্যাগ থেকে পাঁচশো টাকা বার করে হাতে গুঁজে দিয়ে তাকে ট্যাক্সিতে তুলে দেয়। এরপর প্রায় প্রতিদিনই শম্ভুদার বিকেল কেটেছে আত্রেয়ীর সাথে আড্ডায়। কখনও সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ের কফিহাউসে, কখনও ইডেনে, কখনও গঙ্গার ঘাটে, কখনও সেন্ট্রাল লাইব্রেরির চত্বরে, কখনও মেট্রো সিনেমা হলে। প্রায় একবছর শম্ভুদা হাবুডুবু। এই হাবুডুবুতে শম্ভুদা নজর করেনি আত্রেয়ী তার বাড়ির ঠিকানা, পরিবার পরিজন নিয়ে কোনও কথাই বলেনি কোনও দিন। কিন্তু প্রতিদিনই আত্রেয়ী হাত পেতে তার কাছ থেকে দুশো-পাঁচশো টাকা নিয়ে গেছে। এই রহস্যটা ভেঙেছিল দুর্গাপুজোর সময়। হঠাৎ কলেজস্কোয়ারের ঠাকুর দেখতে এসেছিল, ভিড়ের ভেতর একটু ছাড়াছাড়ি হয়েছে। শম্ভুদা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করে, একটা ছেলে আত্রেয়ীর হাত ধরে টানাটানি করছে। শম্ভুদা কাছে এসে সজোরে এক থাপ্পড়। ছেলেটি ছিটকে পড়ে, আর সোরগোল ফেলে দেয়। এন্টালিতে থাকা শম্ভুদাকে কলেজস্কোয়ারের অনেকেই চেনে। তখনই ও জানতে পারে, আত্রেয়ী বউবাজারের হাড়কাটাগলির যৌনকর্মী। পাঁচ মিনিটেই সামলে নিয়েছিল এই সত্যতার ঝটকা।

তারপর সেই প্যান্ডেল থেকে সোজা লালবাজার। পরিচিত পুলিশ অফিসারকে সব ব্যাপারটা খুলে বলে। রাত্রেই পুলিশ রেইড ক’রে হাড়কাটাগলি থেকে এক মাসি সহ গোটা চারেক মাস্তানকে তুলে আনে। লালবাজারে আত্রেয়ীকে দেখিয়ে অফিসার বলেছিল, এ আমার বোন, এর দিকে আর কোনও দিন চোখ তুলে যদি তাকিয়েছিস তোরা, মার্ডার কেসে সোজা সবকটাকে যাবজ্জীবন ফাঁসিয়ে দেব। তারপর দিনই কোর্ট-ম্যারেজ। ওই অফিসার তার নিজের বোনের পরিচয়ে পরিচিত করিয়ে শম্ভুদার বাড়িতে আত্রেয়ীকে তুলে দিয়েছিল। তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে শম্ভুদার সুখী পরিবার এখন! শম্ভুদা সে গল্পও করে। শম্ভুদার এই সোজা-সাপটা খাদহীন ভালোবাসার কাহিনিকে আদর্শ মেনেছে উত্তম।

উত্তম, মানে উত্তমকুমার দাম এই মধ্য-চল্লিশেও মেদহীন ধনুকের ছিলার মতো শরীর রেখেছে। মাথায় কদমছাঁট চুল। শহর, শহরতলীর কোথায় কোন পাড়ায় ফুটবল টুর্নামেন্ট সেসব ওর এখন মুখস্থ। কলকাতার মাঠে কম যায়। জেলায় জেলায় খেলোয়াড় হিসেবে নিজের পরিচয়ের সুযোগে সোর্স কাজে লাগায়। যেভাবে পুলিনের কথায় আজ দুটো কুড়ির বনগাঁ লোকালে উঠে যাবে হাবরা। পুলিন হাবরা লিগ ম্যাচে রেফারিগিরিও করে। আজ সবুজ সংঘ ও প্রগতির ম্যাচ। সোর্স পুলিন টেলিফোনে প্রথমে নাটা দেবাশিসের কথা বলেছিল। অসাধারণ ট্যালেন্ট। বল পায়ে চুম্বকের মতো লেগে থাকে আর দারুণ প্রেডিক্ট করতে পারে। মাঠে নামলেই একটা না একটা গোল করবেই। উত্তম সরাসরি নাকচ করে দেয়। পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চির নীচের কোনও প্লেয়ার নিয়ে ও ভাববে না। ফুটবল বডি গেমও।

ক্রমে যত দিন যাচ্ছে, বিদেশিরা যত আসছে তত রাগবির মতো হতে চলেছে ফুটবল। শরীর কতটা ধকল নিতে পারবে তা কিছুটা উচ্চতা নির্ভরও। সোর্স পুলিন দু’নম্বরটির কথা জানায়। সবুজ সংঘের গোপাল। ভালো হাইট, আর ফুটবলারের চেয়ে বেশি ও দৌড়বীর। এমন চোঁ চোঁ দৌড় লাগায় এদিক ওদিক মনে হয় কিছু একটা যেন হতে চলেছে। অথচ বল হয়তো উলটো দিকে আছে। উত্তম সোর্সের এই তথ্যটাকেই আজকের প্রাইম হিসেবে ঠিক করেছে। চোখে মুখে কিছুটা উল্লাস। এরকমই খুঁজছিল। নাস্তানাবুদ করা স্প্রিন্টার। তারপর ফুটবল তো কোচের হাতে পড়লে কথা বলবে।

উত্তম যা ভেবেছিল তার চেয়ে বেশি। এ একদম ইউরেকা। ছেলেটা একটাও গোল করেনি। কিন্তু ওর টিম দু’গোলে জিতল। বিরতির পরপরই ছেলেটা মাঝমাঠ ক্রস করে হঠাৎ লেফ্ট উইং থেকে

চোঁ-চোঁ করে দৌড় লাগাল রাইট উইং-এর দিকে। দু’টো ডিফেন্ডার কেটে গেল। পেছন থেকে ওই নাটা ছেলেটা সম্ভবত উইথড্রয়াল স্টপার খেলছিল– গোল মেরে দিল মাখনে ছুরি দেবার মতো। ব্রিলিয়ান্ট! গোলটা হবার পরে উত্তম চ্যাঁচাল, তারপর পকেটে হাত দিল পেন আর কাগজ নেবে বলে। কী যেন নাম! হাত চালিয়ে বুক পকেটে পেন, ছোটো ডায়েরি খুঁজে না পেয়ে চোখ নামাল।

আরে আশ্চর্য! আমি তো পেন-টেন নিয়েই বেরিয়েছি। কী মনে করে পেছনের পকেটে হাত দিয়ে দেখে লেপাপোছা। অর্থাৎ জিনসের হিপ্পকেটে তখন কিছুই নেই। উত্তমের বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে। সোর্স পুলিনের জন্য হাজার খানেক টাকা ছাড়াও যাতায়াতের খরচ ইত্যাদির জন্য আরও শ’পাঁচেক ছিল। এসবিআই ডেবিট কার্ড, জরুরি কাগজপত্র, কিছু তথ্য, নোট– এতক্ষণের আনন্দে এসময় ভাঁটার টান।

বনগাঁ লাইনের ভিড়। শিয়ালদা থেকেই বসার জায়গা পায়নি। ভেতরের দিকে দাঁড়িয়ে ছিল মনে পড়ছে। দমদম আসতে চারপাঁচজন তরুণী ভিড় ঠেলে ঢুকে পড়েছিল। সকলেই খুব উচ্ছ্বল। নিজেদের ভেতর নানারকম কথাবার্তা চালাচ্ছিল। টুকরো ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা মিশিয়ে। মাই নেম ইজ খান থেকে ম্যানিকিউর সবই তাদের বিষয়। উত্তম এসময় খেলাপাগল। নারী নিয়ে তেমন মাথাব্যথা নেই। ও মাঠের কথা ভাবতে ভাবতে চলেছে। ভিতরে একটা আর্জ। এবছর এই বড়ো তিনটি ক্লাবের জন্য অন্তত গোটা পাঁচ-ছয় সোনার ছেলে তুলে দিতে হবে। আনকোরা কিন্তু সলিড। বড়ো ক্লাবগুলিরও তাতে লাভ। দু’তিন বছর খুব কম পয়সায় এদেরকে কাজে লাগাতে পারে। হিসেবে অন্তত কোটি টাকার ফয়দা। উত্তমের মনে হচ্ছে আজ একটা হিল্লে হবে।

একটা মেয়ে ওর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। ভিড়ের ভেতর প্যাসেজেও ডাবল লাইন। মেয়েটির সমুন্নত বুক মাঝে মাঝেই ওর খোলা কনুই ঘষে দিচ্ছিল। উত্তম একবার তাকাতেই মেয়েটি মিষ্টি হাসে। দীর্ঘ সুশ্রী চেহারার। চুড়িদারে লোকাট ফ্রেম। উত্তাল বুকের অনেকটাই প্রকাশমান। ডান দিকের অপেক্ষাকৃত শ্যামাশ্রী মেয়েটি একটু চেপে দিলে ও আরও একটু বাঁয়ে এই সুন্দরীর দিকে ঘেঁষে আসে। এ মেয়েটি তেমন নড়ে না আর তার কোমল বুক সেঁটে উত্তমের গোটা বাহুতে লগ্ন হয়ে যায়। এবার মেয়েটির দেহ থেকে একটা সুগন্ধ টের পায় যা ওর চেনা চেনা লাগে। উত্তমের তখন কাঠকাঠ ভাব। হাত-পা নড়ানোর জায়গা রাখেনি সপ্রতিভ মেয়ে দুটো। জগন্নাথপম অবস্থা। এই স্থির অবস্থায় উত্তম অনুভব করে দুদিক থেকেই দু’টো মেয়ে বুক মেলে ওকে ঘঁষে চলেছে।  ও কোনও দিকে তাকাতে পারছে না। অসহায়ের মতো নিম্নগামী মুখমণ্ডল। উত্তম মাঠের ফুটবল, বল দখল, পজিশন মেকিং– এসবের ভেতর ভাবনা চারিয়ে দিয়ে রাস্তাটুকু পার করে দিতে চাইল।

এই মেয়েগুলিই কি ওকে এতখানি বিপদে ফেলল! এত সুন্দর সুন্দর কথা বলছিল মেয়েগুলো– তবে সেটা ট্র্যাপ! অন্তত ডেবিট কার্ড আর মোবাইল ফোনের জন্য থানায় কমপ্লেইন লজ করতেই হবে। পুলিনকে নিয়ে তাই ও হাবরা থানায় এসে বসেছে।

বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে হঠাৎ ওর মনে ঝিলিক দিল– বাঁদিকে যে-মেয়েটি বেশি লগ্ন ছিল, একটু বেশি বয়সের, সে কোনও কথা বলছিন না কেন! মেয়েটি হাসবার জন্য মুখ ঘোরাতেই ওর চোখ পড়েছিল কানের নীচের তিলটির ওপর। তখন মাঠের ভাবনায় মত্ত থাকায় ফোকাস্ড ছিল নতুন ছেলে রিক্রুটিং নিয়ে। চুলটা মাথার উপরে চুড়ো করে রেখেছিল সে। ফলে মুখটা একটু গোল লাগলেও ওই তিলটি তো ওর চেনা। ওই-ই কি করবী! বাবুঘাটে কতবার ওই তিলের উপরেই চুম্বন রেখেছে সে। না না, তা কী করে সম্ভব! করবী পকেটমারের গ্যাং করেছে! উত্তমের এই একলা একা জীবনের নেপথ্যে দাঁড়িয়ে থাকা একটি স্নিগ্ধ প্রতিমা প্রতীম করবী পকেটমার!

থানায় বসে শিউরে উঠল। গা সিরসির করতে লাগল। ওই নিষ্পাপ মুখমণ্ডলের মেয়েটি, যাকে একদিন এই জীবন তুলে দেবে ভেবেছিল, সোনারপুরের ওই গ্রাম্য মেয়ে করবী নিশ্চয়ই ওকে চিনেছে। এখনও সেরকম ছিমছাম চেহারা উত্তমের। শুধু দুটো জুলফির কাছের কিছু চুল পেকেছে। তবুও ও আমার পকেট কাটল! এখন নিশ্চিত হচ্ছে ওই যে চেনা চেনা লাগছিল গন্ধটা, তা করবীই ব্যবহার করত। ভিক্টোরিয়ার মাঠে সন্ধ্যায় অনেকবার করবীই উত্তমের ঝাঁকড়া মাথা ওর আধখোলা বুকে টেনে নিয়েছে। সুগঠিত স্তনের খাঁজে নাক গুঁজে গেছে। কিন্তু উত্তম কখনও শরীরে হাত দেয়নি। শুধু ওর বুকের ওই মিষ্টি গন্ধটা ও প্রাণ ভরে নিত। ও চেয়েছিল অপাপ করবীকে গৃহলক্ষ্মী করবে।

এসময় উত্তমের খুব শীতবোধ হতে থাকে। গা-হাত-পা ছেড়ে দেয়। থানার বেঞ্চে এলিয়ে পড়ে। পুলিন দাস ফুলস্কেপ সাদাকাগজ কিনে এনে মোবাইলে মিসিং কমপ্লেইন ডায়েরি লেখাতে লেখাতে পেছন ফিরে তাকিয়ে বুঝে যায় শরীর খারাপ হয়েছে উত্তমের। থানার গায়েই হাবরা হাসপাতাল। ধরাধরি করে সেখানে নিয়ে যায়। পুরোনো দিনের খেলোয়াড় পরিচয়ে খুব দ্রুত ডাক্তার অ্যাটেন্ড করে। সেরিব্রাল অ্যাটাক। ম্যাসিভ। ডাক্তার রেফার করে এনআরএস। অ্যাম্বুলেন্স দেয়। মুখে অক্সিজেন সিলিন্ডার। সোর্স পুলিন দাস, হাবরা হাসপাতালের একজন নার্স ও অচেতন উত্তম যশোর রোড ধরে চলেছে। এসময় উত্তম দেখে, সাদা পোশাকের এক মিষ্টি মেয়ে, মুখটা খুব চেনা চেনা, কোনও পরি হবে, তার কপালে আলতো করে দু’টো চুমু খেল। আর কানের কাছে মুখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমি তোমাকে ভালোবাসি উত্তম। এই প্রথম উত্তম তার সারাজীবনের কাঙিক্ষত শব্দকটি শুনতে পেল। এবং এই প্রথম তার কান্না পেল। বোজা চোখের দুই কোল ঘেঁষে দুফোঁটা জল গড়িয়ে নামল সাদা চাদরে ঢাকা বালিশের উপর।

এনআরএস-এর এমার্জেন্সির ডাক্তার কয়েক মিনিট দেখেই বললেন, অনেকক্ষণ আগেই প্রাণ দেহ ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।

 

সেই দিনগুলি

মনটা ভালো নেই দীপ্তির। ফোনটা বেজে চলেছে, কিন্তু তুলতে ইচ্ছে করছে না। তুললেই কথা বলতে হবে। কিন্তু যে ফোন করছে সে নাছোড়বান্দা। ছাড়বার পাত্র নয়। অগত্যা দীপ্তিকে ফোনটা ধরতেই হল, ‘হ্যালো!’

‘হাই, কে দীপ্তি?’

‘হ্যাঁ।’

‘বাবা! কী ব্যাপার তোর? দেড় বছর তোর সঙ্গে কোনও কন্ট্যাক্ট নেই। চিনতে পারছিস তো? আমি সূচি।’

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, গলাটা তোর একই আছে। কিন্তু এতদিন কোথায় ছিলি?’

দীপ্তি সাধারণ ভাবেই প্রশ্নটা ছুড়ে দেয়, কিন্তু গলার স্বরে উৎসাহের অভাব লক্ষ্য করে সূচি।

‘কী হয়েছে রে তোর দীপ্তি? গলার স্বরটা কেমন যেন লাগছে। রাগ করিস না প্লিজ। আমারই দোষ, এতদিন তোকে কন্ট্যাক্ট করতে পারিনি। কিন্তু বিশ্বাস কর, প্রতিটা মুহূর্তে তোর কথা আমার মনে হয়েছে। তোর জন্যই মলয়ের সঙ্গে আমার বিয়েটা হওয়া সম্ভব হয়েছিল।’

‘এখন তুই কোথা থেকে বলছিস?’

‘সবে পরশু দেশে ফিরেছি। জানিস-ই তো মলয়ের সঙ্গে আয়ারল্যান্ড চলে গিয়েছিলাম। ওর ওখানে কোম্পানির সঙ্গে দেড় বছরের কন্ট্র্যাক্ট ছিল। আমিও ওখানে একটা চাকরি খুঁজে জয়েন করে নিয়েছিলাম। তবে এত সব দৌড়াদৌড়ির মধ্যে আমার মোবাইলটা শ্বশুরবাড়িতেই রয়ে গিয়েছিল। গতকাল শহরে পৌঁছেছি। আজ সকালে প্রথম তোকেই ফোন করলাম। এবার দেখবি একদিন তোর বাড়িতে উপস্থিত হয়েছি। এখন বল তো, তোর বাড়ির সকলে কেমন আছে? কাকু-কাকিমা, সৌরভদা আর উজ্জ্বল?’

এক নিশ্বাসে সবকিছু বলে দেবার পর সুচি খেয়াল করে দীপ্তি যেন মুখে তালা দিয়ে রেখেছে। ওর কোনওরকম প্রতিক্রিয়া সুচি বুঝতে পারে না।

ধৈর্য হারায় সূচি, ‘কীরে কী হল তোর? তখন থেকে আমি একাই বকবক করে যাচ্ছি। তুই তো কিছুই বলছিস না… কী হয়েছে? সব ঠিক আছে তো?’ সূচির আওয়াজে ওর অধৈর্য ভাবটা স্পষ্ট ফুটে ওঠে।

‘সবকিছু বদলে গেছে রে সুচি এই দেড় বছরে… বাবা আর নেই, মা বিছানায় পড়ে, প্যারালিসিস। দাদা সারাদিন মদ খেয়ে পড়ে থাকে। মদের নেশা ওকে গ্রাস করছে। বউদি ছোট্ট পারিজাতকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে…’

‘আর উজ্জ্বল?’

‘উজ্জ্বল ঠিক আছে। এখন ক্লাস নাইনে পড়ছে। কিন্তু ভবিষ্যতে ওর-ও যে কী হবে এখনও জানি না। সুচি, বাড়িতে কিছুই ঠিক নেই… বলতে বলতে, দীপ্তির চোখের জল বাঁধ মানে না।

‘কাঁদিস না দীপ্তি… বি ব্রেভ… কলেজে সবথেকে সাহসী বলে পরিচিত, অন্যের যে-কোনওরকম সমস্যায় এগিয়ে এসে তার সমাধান বার করতে যে এক মুহূর্ত ভাবত না, সেই দীপ্তির কাছে নিজের সমস্যার কোনও সমাধান নেই, এমন কখনওই হতে পারে না… কাম অন ইয়ার। এই কথাটা আগে তুই সবাইকে বলতিস এখন আমি বলছি, সমস্যার সমাধান অবশ্যই আছে। চল, আমি পরের সপ্তাহে আসছি। একদম চিন্তা করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ ফোনটা কেটে গেল।

কলিংবেল-টা বেজে ওঠে। শাড়ির আঁচলে চোখের জলটা মুছে নিয়ে দীপ্তি সদর দরজাটা খুলে দেয়। রোজকার সেই চিরপরিচিত দৃশ্য। মদ এবং সুগন্ধির চেনা গন্ধটা এসে নাকে ঢুকল দীপ্তির। নেশার ঘোরে সৌরভ দরজায় ঠেসান দিয়ে কোনওমতে দাঁড়িয়ে। ওকে ঘিরে আরও চার-পাঁচজন বন্ধু যারা নিজেরাও কেউ সুস্থ নয়, কম-বেশি সকলেই নেশায় বুঁদ। দাদার হাত ধরে দীপ্তি ঘরের ভিতর নিয়ে আসার চেষ্টা করে। এই সুযোগে কেউ দীপ্তির হাত-টা ছুঁয়ে নেয়, কারও গরম নিঃশ্বাস এসে পড়ে দীপ্তির পিঠে। পেছন থেকে কেউ দীপ্তির কোমরটা জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করে। এক ঝটকায় হাতটা সরিয়ে দীপ্তি দরজাটা বন্ধ করে দেয়। বোনের সম্মান রাখাটা দাদার কর্তব্য কিন্তু সেই দাদা নিজেই যেখানে বেহুঁশ সেখানে বন্ধুদের ও প্রতিরোধ করবে কী ভাবে? দীপ্তির চোখটা আবার জলে ভিজে আসে।

বাবার মৃত্যুর পর, ব্যাবসার সব দায়িত্ব, টাকাপয়সা সবকিছুই সৌরভের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। ব্যাংকের ভালো চাকরি ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি ব্যাবসায় মন দেয় সৌরভ। ব্যাবসাও বাড়তে থাকে, সেই সঙ্গে টাকাও। কাঁচা টাকা হাতে আসতেই বন্ধু-বান্ধবের সংখ্যাও বাড়তে থাকে, সৌরভের পা মাটিতে থাকে না। দামি গাড়ি, দামি শখ, বিদেশি মদ অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায় সৌরভের। মা জয়ন্তী স্বামীর মৃত্যুর পর মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েন। সৌরভের বিয়ে আগে থেকেই ঠিক হয়ে ছিল কিন্তু জয়ন্তীর মানসিক ও শারীরিক অবস্থার কারণে বিয়ে আটকে যায়। পাত্রীর বাবা রমানাথবাবু চিন্তিত হয়ে পড়েন। অনেক বুঝিয়ে জয়ন্তীকে সুস্থ করে তোলা হয়। রমানাথবাবু জয়ন্তীকে বলে তাড়াতাড়ি ছেলের বিয়ে দিয়ে দিতে অনুরোধ জানান যাতে বাড়ির পরিবেশ কিছুটা হলেও বদলায়। বিয়ে হলে ছেলেও বাড়িমুখো হবে এটাও ওনার বিয়ের জন্য তাড়া দেওয়ার আর একটা উদ্দেশ্য ছিল।

অনেক ভেবেচিন্তে বিয়ের দিন স্থির করা হল। কিন্তু বিয়ের দিন মদের নেশায় সৌরভ বিয়ের আয়োজন ঠিকমতো করা হয়নি বলে রমানাথবাবুর সঙ্গে গণ্ডগোল পাকিয়ে বসল।

ছেলের ব্যবহারে লজ্জিত জয়ন্তী, রমানাথবাবুর হাত ধরে ক্ষমা চাইতে গেলে, পাত্রী সঞ্চিতা উঠে এসে জয়ন্তীর হাত ধরে থামায়। সঞ্চিতা জয়ন্তীর অবস্থা দেখে নিজেই লজ্জিত বোধ করে। ছেলের জন্য মায়ের এই অপমান মেনে নিতে অসুবিধা হয় ওর। শান্তস্বরে জয়ন্তীকে বলে, ‘কাকীমা, এটা আপনি কী করছেন? এরকম ছেলের জন্য আপনি কেন ক্ষমা চাইছেন? সৌরভের স্ট্যাটাস আমাদের থেকে একটু বেশিই মনে হয় উঁচু হয়ে গিয়েছে। আমিই এই বিয়ে করতে অস্বীকার করছি।’

পরিস্থিতি সামলে শেষমেশ সঞ্চিতা, জয়ন্তীর বাড়িতে বউ হয়ে এল। কিন্তু সৌরভকে বদলাতে পারল না সঞ্চিতা। মেয়ে হয়ে যাওয়ার পরও সৌরভকে সঠিক রাস্তায় ফিরিয়ে আনার সব চেষ্টা বিফল হলে, বিয়ের তিন বছরের মাথায় সঞ্চিতা ছোট্ট পারিজাতকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল।

এই ধাক্বা জয়ন্তী সহ্য করতে পারলেন না। সেরিব্রাল হয়ে পক্ষাঘাতে সম্পূর্ণ ভাবে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন।

সকালে সৌরভ অন্য মানুষ। মদের ঘোর কেটে গিয়ে হুঁশ ফিরে আসলে নিজের ব্যবহারের জন্য লজ্জিত হতো। মা, দীপ্তি, উজ্জ্বল সকলের কাছেই ক্ষমা চাইতে দ্বিধা করত না। কিন্তু হলে কী হবে? সন্ধে হলেই বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আকণ্ঠ গিলে পুরো মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরত।

মাঝেমধ্যে দীপ্তি সৌরভকে বোঝাবার চেষ্টা করত, ‘দাদা, তুই আর কারও কথা না ভাব, বউদি আর পারিজাতকে তো বাড়িতে নিয়ে আসতে পারিস। তাছাড়া উজ্জ্বল এখনও ছোটো আছে। কী অবস্থায় রাত্রে বাড়ি ফিরিস একবারও ভেবেছিস কি? আর তোর বন্ধুবান্ধবগুলোও বা কী? ওদের সঙ্গে মিশিস কেন?’

‘ওদের সম্পর্কে কিছু বলিস না। বাবার ব্যাবসাটা দাঁড় করাতে ওরাও আমাকে অনেক সাহায্য করেছে, নয়তো আমি ব্যাবসার কী-ই বা জানতাম। ওদের জন্যই এত তাড়াতাড়ি ব্যাবসার এতটা উন্নতি করতে পেরেছি।

আর ওরা সবাই ভালো বাড়ির ছেলে। কমবেশি সকলেই ড্রিংক করে। ওদের নিজেদের উপর যথেষ্ট কন্ট্রোল আছে। শুধু আমারই একটু বেহাল অবস্থা হয় ড্রিংক করলে। কেন, তোর মনে হয় না যে আমার বন্ধুরা তোকে ছোটো বোনের মতো ভালোবাসে?’

মনে মনে হাসে দীপ্তি। কাকে বলবে সত্যিটা কী? সৌরভের মদ্যপ বন্ধগুলোর চোখে লোভ, লালসা ছাড়া আর কিছু নজরে পড়েনি দীপ্তির। ওদের সামনে যেতে ভয়ে, ঘৃণায় দীপ্তির ভিতরটা কুঁকড়ে যায়। কিন্তু কাকে বলবে এই কথাগুলো? সৗরভ মানতে রাজিই নয় যে ওর বন্ধুরা দীপ্তিকে নিজেদের লালসার শিকার বানাতে পারে। দাদা নিজে সুস্থ থাকলে তবেই না বোনের কষ্টটা বুঝতে সক্ষম হবে। সুতরাং সকলের অলক্ষে চোখের জল ফেলা ছাড়া দীপ্তির উপায় কী?

সুচি কথামতো পরের সপ্তাহেই দীপ্তির বাড়ি এসে হাজির হল। সুচিকে দেখে দীপ্তির এতদিনকার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। ধীরে ধীরে সব ঘটনা সূচি দীপ্তির কাছ থেকে জেনে নিল। গলা জড়িয়ে দুই বন্ধু অনেকক্ষণ কাঁদল।

চোখের জল ফুরিয়ে এলে, সূচি সোজা হয়ে বসল। দীপ্তির মুখটা দুহাত দিয়ে ধরে সূচি বলল, ‘চোখের জল মুছে ফেল, দীপ্তি। এই সমস্যার কোনও না কোনও বিহিত নিশ্চয়ই আছে। হার স্বীকার কেন করবি? এবার একটু হাস তো।’

‘দীপ্তি, তোর মনে আছে মলয় কী প্রচণ্ড গুটখা খেত? ডাক্তারের বারণ সত্ত্বেও কিছুতেই নেশাটা ছাড়তে পারছিল না। প্রবলেমটা তোকে বলতেই তুই মজা করে যে সমাধানটা দিয়েছিলি সেটা যে কতটা কাজ দিয়েছিল সেটা কি কেউ ভাবতে পেরেছিল? ঘটনাটা ভাবলে এখনও আমার হাসি পায়।’

ঘটনাটা মনে আসতে দীপ্তির মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ওর কথামতো, সুচি একটা বিয়েবাড়িতে যাওয়ার সময় মলয়ের পকেট থেকে গুটখার প্যাকেটগুলো বার করে কনডোমের কয়েকটা প্যাকেট রেখে দিয়েছিল মলয়ের অজান্তে। বিয়েবাড়িতে গিয়ে গুটখা পকেট থেকে বার করতে গিয়ে সকলের সামনে কনডোমের প্যাকেট হাতে উঠে আসতে সকলের ঠাট্টার পাত্র হতে হয়েছিল মলয়কে। ব্যাস পকেটে গুটখা রাখার অভ্যাস ছাড়তে বাধ্য হয়েছিল মলয়। শেষমেশ দীপ্তির পরামর্শে সুচি মলয়কে কিছুদিন নেশামুক্তি কেন্দ্রে নিয়ে গেলে মলয়ের গুটখার নেশা একেবারেই চলে যায়।

দীপ্তিকে হাসতে দেখে সুচির মুখও হাসিতে ভরে ওঠে।

চোখে-মুখে জল দিয়ে সুচি একটু ফ্রেশ হয়ে নিয়ে নিজের ব্যাগ খুলে একটা ক্যামেরা বার করে দীপ্তির দিকে এগিয়ে দিল, ‘এই নে, এটা তোর জন্য, ভিডিও ক্যামেরা।’

‘বাবাঃ, এটা তো খুব দামি ক্যামেরা। এত দাম দিয়ে আমার জন্য এটা আনার কী দরকার ছিল?’ দীপ্তি কৃত্রিম রাগ দেখায়।

‘কী দরকার ছিল…?’ সুচি দীপ্তিকে ভেংচি কাটে। ‘ফালতু বকবক বন্ধ কর। ক্যামেরার ফাংশনগুলো দ্যাখ। দারুণ ভিডিও তোলা যায় ক্যামেরাটায়।’

ইতিমধ্যে উজ্জ্বলও স্কুল থেকে এসে পড়ে। সুচি আর সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরা দেখে ও আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে, ‘সুচিদি এটা বিদেশ থেকে এনেছ? কি দারুণ ক্যামেরাটা। আমি এটা দিয়ে ছবি তুলব।’

‘বাবাঃ! উজ্জ্বল, তুই কত লম্বা হয়ে গিয়েছিস। বেশ একটা বড়োবড়ো ভাব চলে এসেছে।’

‘দিদি, আমি চেঞ্জ করে আসছি। এসে আমি তোমাদের কথাবার্তা সব ভিডিও করব,’ বলে উজ্জ্বল বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

‘দীপ্তি, আমি ভাবছি এটা দিয়ে তোর সমস্যারও একটা সমাধান করা যাবে।’

দীপ্তি অবাক চোখে তাকায় সুচির দিকে, ‘কীভাবে সেটা সম্ভব?’

‘রাত্রে যখন সৌরভদা বাড়ি ফিরবে তখন লুকিয়ে আড়াল থেকে দাদা এবং দাদার বন্ধুদের কীর্তি সব শ্যুট করতে হবে। সকালে পুরো ভিডিওটা সৌরভদার সামনে টিভির পর্দায় চালিয়ে দিলেই দাদা বুঝতে পারবে ওর বন্ধুরা কীরকম এক-একটা রত্ন,’ সুচি মনের মধ্যে থাকা সমাধানটা দীপ্তির কাছে স্পষ্ট করে।

উজ্জ্বল আর সুচি সৗরভের বাড়ি ফেরার আগেই ক্যামেরা নিয়ে রেডি হয়ে যায়। সুচি বরের থেকে তিনদিনের ছুটি নিয়েই দীপ্তির বাড়ি এসেছিল। বিয়ের আগেও বহুবার দুই বন্ধু একে অপরের বাড়ি রাত কাটিয়েছে। কখনও কখনও সপ্তাহ কেটে গেলেও নিজের বাড়ি ফেরার ইচ্ছে হতো না। দু’জনের বাড়িতেই এটা নিয়ে বাদবিবাদ কখনও হয়নি কারণ সকলেই জানত দু’জনে হরিহরাত্মা। মলয়ও তাই সুচির ইচ্ছায় বাদ সাধেনি।

রাত এগারোটার কাছাকাছি ডোরবেল বেজে উঠতেই সুচি আর উজ্জ্বল, দীপ্তিকে ইশারা করে দরজাটা খুলতে। ওরা দুজন পর্দার পেছনে জায়গা করে নেয় যেখান থেকে সদর দরজাটা পরিষ্কার দেখা যায়। সুচি হাতের ক্যামেরাটার রেকর্ডিং অন করে দেয়।

দরজা খুলতেই সৗরভকে ধরে ওর এক বন্ধু দীপ্তির দিকে এগিয়ে আসে, ‘এই নাও, তোমার ভাইকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে গেলাম।’ আর একটি ছেলে দরজা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করে, ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখী… আমাদেরও একটু এভাবে ধরে ঘরে নিয়ে যেতে পারো তো সোনা।’ ছিটকে সরে আসে দীপ্তি। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে সুচির হাতটা নিশপিশ করতে থাকে।

অন্য আরও তিনবন্ধু দরজা ঠেলে সৌরভের সঙ্গে ভিতরে ঢুকে পড়ে। তারই মধ্যে একজন দীপ্তিকে জোর করে জড়িয়ে ধরে। সৌরভের কোনওদিকে খেয়াল নেই। নেশায় বুঁদ অবস্থায় সোফার উপরেই এলিয়ে পড়ে। বোনের প্রতি বন্ধুদের অভব্য ব্যবহার কিছুই চোখে পড়ে না ওর।

দীপ্তি উজ্জ্বলকে ডাকে। সবাই ঘরে ঢুকে পড়াতে ও ভয় পেয়ে যায়। উজ্জ্বল লেবুর জল নিয়ে ঘরে ঢুকে সৗরভের দিকে গেলাসটা বাড়িয়ে দেয়।

‘লেবুর জল আমাদেরও একটু দাও উজ্জ্বলবাবু। তোমার দিদিকে দেখে আমাদের নেশা আরও চেপে বসছে। আমরাও তোমার দিদিকে বড়ো ভালোবাসি…,’ বলতে বলতে একটি ছেলে দীপ্তির হাত ধরে টেনে কোলে বসাতে যায়।

‘আমার দিদির হাত ছাড়ুন,’ উজ্জ্বলের তীক্ষ্ন কণ্ঠস্বরে ছেলেটি দীপ্তির হাত ছেড়ে দিয়ে উজ্জ্বলকে জোরে ধাক্বা মেরে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করে।

সুচি আর চুপ থাকতে পারে না। একবার ভাবে পুলিশ ডাকবে কিন্তু তাহলে সৌরভদাকেও পুলিশ ছাড়বে না… দীপ্তি কীভাবে এগুলো রোজ সহ্য করে। পরক্ষণেই মন ঠিক করে নেয়। ভয় ঝেড়ে ফেলে ক্যামেরাটা নামিয়ে টেবিলের উপর রেখে বসবার ঘরে ঢোকে। ক্যামেরাতে প্রুফ রেকর্ড করাই আছে সুতরাং লোকগুলোকে বাড়ির বাইরে বার করতেই হবে। কঠিন গলায় সুচি চেঁচিয়ে ওঠে, ‘কী হচ্ছে এখানে? আপনাদের লজ্জা করে না? সৌরভের বন্ধু হয়ে ছোটো বোনের সঙ্গে এরকম ব্যবহার করছেন। কাকিমা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না, উজ্জ্বল এখনও ছোটো, স্কুলে পড়ে আর সৌরভদা বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে… আর আপনারা এই সুযোগে বাড়ির ভিতর ঢুকে এসে যাচ্ছেতাই আচরণ করছেন। এই মুহূর্তে আপনারা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান, নয়তো আমি এখুনি পুলিশ ডাকব,’ সুচি মোবাইল উঠিয়ে ডায়াল করতে আরম্ভ করে।

সুচির রণচণ্ডী মূর্তি দেখে আর পুলিশের হাতে পড়ার ভয়ে, সৌরভ ছাড়া সকলে উঠে পড়ে দরজার দিকে পা বাড়ায়। দরজা দিয়ে বেরোতেই উজ্জ্বল দৌড়ে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়। সুচিকে ধন্যবাদ জানিয়ে দীপ্তি আর উজ্জ্বল সৌরভকে শোবার ঘর অবধি নিয়ে যেতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

সকালে একটু দেরি করেই ঘুম ভাঙল সৌরভের। মাথাটাও ভারী ভারী ঠেকছে। গতকাল রাতে মাত্রাটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুগুলো না থাকলে কী যে হতো কে জানে? মনে হল ওদের একবার ফোন করে ধন্যবাদ জানানো দরকার। মুখে চোখে জল দিয়ে ঘরে ঢুকতে যাবে, চোখে পড়ল খাবার টেবিলে বসে দীপ্তি সুচির সঙ্গে গল্প করছে।

‘আরে সুচি না, তুই কখন এলি? হঠাৎ কোথায় চলে গিয়েছিলি? কোনও খবর নেই এতদিন পর? মানসকে পেয়ে আমাদেরই ভুলে গিয়েছিলি?’ মস্তিষ্কে জোর দিয়ে সৌরভ সুচির বরের নামটা মনে করার চেষ্টা করে।

‘দাদা, মানস নয়, মলয়। মলয়ের সঙ্গে দেড় বছরের জন্য বিদেশ চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু এখানে এসে দেখছি সবকিছুই কেমন বদলে গেছে। তুমি এখানে থেকেও না থাকারই সমান… নিজের লোকেদেরই তুমি ভুলে গেছ…,’ সুচি গলার দৃঢ়তা বজায় রাখে। জানে যেমন করেই হোক সৌরভের বিবেককে জাগাতে হবে।

‘সুচি তুই কী বলতে চাইছিস?’ সৌরভ সুচির পাশের চেয়ারটা টেনে ওর মুখোমুখি হয়।

‘তোমাদের বাড়ির পরিবেশ খুব বদলে গেছে। …কাকু বেঁচে নেই। কাকিমা বিছানায় পড়ে। বউদি, পারিজাতকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে আর তুমি…?

‘হ্যাঁ, তুই ঠিকই বলেছিস সুচি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু এভাবেই বদলে যায়…’ সৌরভ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, ‘তুই একটু বস সুচি আমি ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে আসছি।’

দীপ্তি চা তৈরি করে ডাইনিং টেবিলে এনে রাখল। ইতিমধ্যে সুচি ডাইনিং হলে রাখা টিভি-টার সঙ্গে ভিডিও ক্যামেরাটা অ্যাটাচ্ করে রেখেছিল। সৗরভ এসে চেয়ার টেনে চায়ে চুমুক মারতেই সুচি সামনে এসে দাঁড়াল, ‘দাদা, টিভির রিমোট-টা ধরো। টিভিটা অন করো, ভিডিও ক্যামেরায় একটা ভালো ভিডিও বানিয়েছি। ক্যামেরাটা বিদেশ থেকে দীপ্তির জন্য এনেছি… তুমি ভিডিও-টা দেখে বলো আমি কেমন বানাতে পেরেছি শর্ট ফিল্ম-টা। আমি ততক্ষণ দীপ্তিকে রান্নাঘরে একটু হেল্প করে দিই,’ বলে সুচি দীপ্তির সঙ্গে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

সৗরভ চায়ের কাপটা টেনে নিয়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে টিভি-টা অন করে দিল। চোখ টিভির পর্দার দিকে। নড়েচড়ে বসল সৗরভ। ভাবতে পারেনি পর্দায় ওরই ছবি ফুটে উঠবে। টিভির পর্দায় নিজের অবস্থা, নিজেরই ড্রইংরুমে বন্ধুদের হাতে দীপ্তি আর উজ্জ্বলের হেনস্থা দেখে লজ্জায়, রাগে সৗরভের মুখ লাল হয়ে উঠতে লাগল। যে বন্ধুদের ও অগাধ বিশ্বাস করেছে, যাদের বিরুদ্ধে একটা কথাও শুনতে চায়নি দীপ্তির মুখ থেকে, তারা যে এত বড়ো বিশ্বাসঘাতক হতে পারে নিজের চোখে না দেখলে, ও কি এটা কোনওদিন বিশ্বাস করত? নিজের দুঃখ, লজ্জা ঢাকবার জন্য সৗরভ দু’হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে নেয়। নিজের ওপরেই ঘৃণা বোধ করে সৗরভ।

সুচি এসে দাঁড়ায় টেবিলের পাশে। টিভি বন্ধ করে দেয় টেবিল থেকে রিমোটটা নিয়ে। ভিডিও-টা শেষ হয়ে গিয়েছিল।

‘সরি… দাদা’, বলে সৌরভের মুখ থেকে হাতটা সরিয়ে দেয় সুচি। ‘দীপ্তি আর কাকিমার বারণ সত্ত্বেও তুমি বন্ধুদের অগাধ বিশ্বাস করে এসেছ। কোনওদিন ওদের আসল চেহারাটা জানারও চেষ্টা করোনি। এর জন্য দীপ্তিকে কী কী সহ্য করতে হয়েছে নিজের চোখেই দেখলে। বাধ্য হয়ে আমাকে এটা করতে হয়েছে… আমি এর জন্য সত্যিই দুঃখিত।’

‘তুই কেন ক্ষমা চাইছিস? দোষ তো আমি করেছি। এত বড়ো অন্যায় করেছি। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে তুই ভালো কাজই করেছিস। আমার জন্য দীপ্তিকে অসম্মানিত হতে হয়েছে, উজ্জ্বলের উপরেও না জানি এই সব ঘটনার কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে কে জানে? মদের নেশায় আমি এতটাই নীচে নেমে গেছি যে বাড়ির লোকদের ছেড়ে আমি বাইরের লোককে বিশ্বাস করেছি। ওদের বোঝানোতেই সঞ্চিতাকেও বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে আমিই প্ররোচিত করেছি। ছোট্ট পরি-কে নিয়ে চলে যেতে ও বাধ্য হয়েছে। রোজ ভাবি মদ ছোঁব না কিন্তু সন্ধে হলে কী যে হয়… জানি না… আমার কী ভবিষ্যৎ?’

‘দাদা, এতটাও ভেঙে পোড়ো না,’ সুচি বোঝাবার চেষ্টা করে, ‘তুমি মনে জোর আনলে অবশ্যই মদ ছাড়তে পারবে… যাবে আমার সঙ্গে দাদা?’

‘কোথায়?’

‘দাদা আজকেই চলো আমার সঙ্গে যেখানে গুটখার নেশা ছাড়াবার জন্য মলয়কেও নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের বাড়ির কাছেই নেশা ছাড়াবার রিহ্যাব। যাবে তো দাদা?’

সৗরভ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে। দীিঀ৫ এসে পিছনে দাঁড়িয়েছিল সৗরভ বুঝতে পারেনি। আনন্দে দীপ্তি পিছন থেকেই দাদার গলা জড়িয়ে ধরে। চোখ দিয়ে বইতে থাকে আনন্দাশ্রু। সৌরভ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে দীপ্তিকে বুকে টেনে নেয়। ভাই-বোনের ভালোবাসা দেখে সুচির চোখেও জল চলে আসে।

সুচির দু’বছরের বিবাহবার্ষিকীর দিন দীপ্তি সকাল থেকেই উপস্থিত। দুই বন্ধুর কথার যেন কোনও শেষ নেই। মলয় দু’জনকে কিছুটা প্রাইভেসি ছেড়ে দিতে বাইরের ছোটোখাটো কাজগুলো সারতে বেরিয়েছে। অনুষ্ঠান তো সেই সন্ধেবেলা। ক্যাটারার বলাই আছে সুতরাং বাড়িতে রান্নার কোনও ঝামেলা নেই।

‘হ্যাঁরে দীপ্তি, সৗরভদা তো এখন সম্পূর্ণ সুস্থ তাই না,’ একা পেয়ে সুচি প্রশ্নটা ছুড়ে দেয় বন্ধুর দিকে, ‘বউদিকে কবে বাড়ি নিয়ে আসছিস? তাড়াতাড়ি করে বউদিকে বাড়ি আন তবেই না আমি আমার বউদিকে বাড়ি নিয়ে আসতে পারব।’

‘মানে? কী যে বকিস, কোনও মাথামুন্ডু থাকে না।’

‘সেই! এখন আমার কথা তোর ফালতুই মনে হবে,’ কপট রাগ দেখায় সুচি, ‘তুই তো জানিস না দীপ্তি, আমার জ্যেঠুর ছেলে সিদ্ধার্থ দিল্লিতে চাকরি করে। ও আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে আর তোকেও।’

‘আমাকে?’ আশ্চর্য হয় দীপ্তি।

‘হ্যাঁ, কলেজে ছিলাম যখন তখন দু’তিনবার ও কলেজে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। তখনই ও তোকে আমার সঙ্গে দেখেছে। তাছাড়া তোর অনেক গল্পই আমি ওর সঙ্গে করেছি যার মধ্যে মলয়ের গুটখার নেশা ছাড়াবার ঘটনাটাও রয়েছে। বিকেলে সিদ্ধার্থ-ও আসছে।’

লজ্জায় দীপ্তির মুখ রাঙা হয়ে ওঠে। সুচির কাছে মনের ভাব লুকোবার জন্য উঠে অন্যত্র যাওয়ার চেষ্টা করলে, সুচি দীপ্তিকে বুকে জড়িয়ে ধরে।

রক্তের রাজনীতি

উত্তরপ্রদেশের রাজনীতির ধরনটাই একটু ভিন্ন। নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা এখানে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় গোড়া থেকেই। এখানে অঙ্কুরিত হয় বৃহত্তর রাজনীতির ক্ষেত্রে পদার্পণ করার স্বপ্ন। ক্ষমতা দখলের খেলায় খুব সহজেই মেতে ওঠে ইয়ং জেনারেশন। বদলে যায় তাদের জীবনদর্শন। জীবনযাপন আর সাদামাটা থাকে না তখন।

মণীশ যখন প্রথম এরকমই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্র‌্যাজুয়েশন করতে এসেছিল, সে ভাবেনি জীবন তার জন্য ঠিক কী কী নির্দিষ্ট করে রেখেছে। ফার্স্ট ইয়ার-এ র‌্যাগিং-এর সময়টাতেই প্রথম সিনিয়রদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল মণীশকে। সেখানেই প্রথম সে দেখেছিল দেবেন্দ্র ওরফে দেব-কে। ইউনিয়নের জিএস হওয়ার দরুন সবাই চিনত দেব-কে। তার ব্যক্তিত্বকে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই কারও। রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকবে বলেই সে এমএ-টাও এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই করবে ঠিক করেছিল। দেব-এর পড়াশোনার ব্যাপারে যত না আগ্রহ, তার চেয়ে বেশি আগ্রহ ছিল পাকাপাকি রাজনীতিতে চলে আসার। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু থেকেই সে নিজেকে চোখে পড়ার মতো জনপ্রিয়তার স্তরে তুলে এনেছিল।

র‌্যাগিং-এ খুব বেশি নাজেহাল হতে হয়নি মণীশ-কে। কারণ দেব-এর চোখে পড়ে গিয়েিল সে, ভালো টেবিল টেনিস খেলার জন্য। দেব বড়ো ভাইয়ে মতোই মণীশকে আগলাতে শুরু করেছিল, সেই ফার্স্ট ইয়ার থেকেই। তারপর থেকে নানা প্রযোজনে মণীশ, দেব ভাইয়া-কে পাশে পেয়েছে। কখনও তাকে সাহায্য না করে ফেরায়নি দেব। মণীশ যে-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, সেখান থেকে তার বাড়ি বেশ খানিকটা দূরে। একটু মফস্সল বললেও ভুল হয় না। দেব-ই ব্যবস্থা করে দিয়েিল, যাতে কোনও কোনও দিন বাড়ি ফিরতে না পারলেও, সে হোস্টেলে দেব-এর ঘরে থেকে যেতে পারে।

গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর মণীশ বেশ কিছুটা মানসিক অবসাদে ভুগছিল। তার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো নয়। একটা ট্রেন দুর্ঘটনায় বাবার পা কাটা গিয়েছিল। বোন-কে খুব কষ্ট করে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াচ্ছে বাবা, তাঁর শেষ সম্বল ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে। এই অবস্থায় মণীশ

এমএ-তে ভর্তি হবে, নাকি একটা চাকরি খুঁজবে সেটা নিয়ে সে কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিল না। টাকার খুব প্রযোজন তার। দু-একটা টিউশনি করে কিছু টাকা সে আয় করে ঠিকই কিন্তু পরিবারের প্রযোজন মেটাতে সেটা যথেষ্ট নয়। বোন রিঙ্কুর জন্য এখনই একটা ল্যাপটপ-এর প্রযোজন। কিন্তু সেই টাকাটাও জোগাড় করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে মণীশকে। চাকরির চেষ্টা যে সে করছে না তা নয়, কিন্তু ভালো চাকরি পাওয়াও তো মুখের কথা নয়।

এসব ক্ষেত্রে তার একমাত্র ভরসা দেব ভাইয়া। দোনামোনা করে দেব-এর

হোস্টেল-এর দিকেই পা বাড়ায় মণীশ। হোস্টেলের ঘরে বসে দেব তখন তার চ্যালাচামুণ্ডাদের নিয়ে কলেজের ইলেকশনের ব্যাপারে আলোচনা করছে। ইশারায় মণীশকে বসতে বলে কাজের কথাগুলো সেরে নেয় ছেলেগুলোর সঙ্গে। তারপর ওরা চলে গেলে, মণীশকে বলে

বল ভাই, সকাল সকাল আজ কী মনে করে?

দেব ভাইয়া আর কী বলব তোমায়, তুমি তো সবই জানো।

আরে নির্দ্বিধায় বল। তুই আমার নিজের ভাইয়ে মতো। দাদাকে বলবি না তো কাকে বলবি?

আসলে তুমি তো জানোই, বোনের এটা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সেকেন্ড ইয়ার। ওকে এবার একটা ল্যাপটপ না কিনে দিলেই নয়। খুব মেধাবী আমার বোনটা। আমার মতো নয়।

হ্যাঁ জানি রে। তা রিঙ্কু তো আমারও বোন। তার জন্য কিছু করতে পারলে আমারও ভালো লাগবে।

আমি অল্প কিছু টাকা জমিয়েছি, কিন্তু…

ওই টাকাটা তুই রেখে দে। রাখিতে একটা মোবাইল কিনে দিস। আপাতত তোর দেব ভাইয়া ওর জন্য ল্যাপটপ-এর ব্যবস্থা করছে।

কথাটা বলে দেব সত্যি সত্যি পকেট থেকে ফোন বের করে মণীশের অ্যাকাউন্ট-এ পঁচিশ হাজার টাকা ট্রান্সফার করে দিল। কৃতজ্ঞতায় প্রায় নুয়ে পড়েছে মণীশ। পায়ে হাত দিতে যায় দেব-এর। দেব তাড়াতাড়ি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে।

পাগল, তুই আমার ভাই।

সে জানি দেব ভাইয়া, কিন্তু এটা ধার হিসেবে নিচ্ছি আমি। টাকাটা আমি শোধ দিয়ে দেব যত তাড়াতাড়ি পারি।

ধুর বোকা। বললাম না রিঙ্কু আমারও বোন। এটা আমি আমার বোনকে উপহার দিলাম।

এরকম ভালোবাসা পেয়ে মণীশ সত্যিই অভিভত। প্রায়ই এমন হয়, দেব তাকে ভালো ভালো হোটেলে খাওয়ায়, মাঝে মাঝে পাঁচশো-হাজার এমনিই পকেটে গুঁজে দেয়। মণীশ বুঝতে পারে না, কী এমন দেখল দেব ভাইয়া তার মধ্যে, যে এত ভালোবাসে!

বোন ল্যাপটপ পেয়ে তো দারুণ খুশি। দাদাকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে কেঁদেই ফেলল। মা শুধু একবার অবাক হয়ে আড়ালে জিজ্ঞেস করেছিলেন, হ্যাঁ রে মণীশ, এত টাকা কীভাবে জোগাড় করলি?

সত্যি-মিথ্যের মাঝামাঝি একটা উত্তর দিয়ে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিল মণীশ।

এর কিছুদিন পর দেব ভাইয়া কলেজে ডেকে পাঠাল মণীশকে।

বুঝলি মণীশ জোর ক্যাম্পেন করতে হবে তোকে আমার হয়ে এবারও ইলেকশনটা জিততেই হবে। দেখিস সব জায়গায় যেন ঠিকঠাক পোস্টার লাগানো হয়।

ইলেকশনে এবারও দেবের জয় নিশ্চিত ছিল। মণীশও দারুণ খুশি এই জয়ে দেবকে কাঁধে তুলে তারা গোটা ক্যাম্পাস ঘুরল, বিজয় মিছিলে।

এর কিছুদিন পর রাখি। মণীশ ঠিক করল রিঙ্কুকে রাখিতে একটা ভালো মোবাইল ফোন কিনে উপহার দেবে। সেইমতো একটা ফোন কিনে বোনের কাছে রাখি পরতে বসল মণীশ। রিঙ্কু খুশিতে দিশেহারা হয়ে উঠল। বলল,

তোমার মতো দাদা যেন জন্ম জন্ম ধরে পাই।

এই আনন্দঘন ঘটনার দিনদুয়েক পরে, হঠাত্-ই দেবের ফোন।

মণীশ, ভাই একবার ক্যাম্পাসে আয় তো, একটু জরুরি কথা আছে।

হ্যাঁ ভাইয়া, এখুনি যাচ্ছি আমি।

ক্যাম্পাসে পৌঁছে দেখে সকলে প্রস্তুতি নিচ্ছে বিধানসভা অভিযানের। দলের একটি ছেলেকে অপোনেন্ট পার্টির ছেলেরা মারধর করেছে। তাদের শাস্তি আর অধ্যক্ষের পদত্যাগের দাবিতে এই অবস্থানের পরিকল্পনা। দেব, মণীশকে আলাদা করে একটু সাইডে ডেকে নিয়ে গিয়ে বলল এসব সিরিয়াস কিছু না, চল একটু স্লোগান দিবি, দুটো মিডিয়ার সামনে বাইট দেব, তারপর খাওয়া দাওয়া করে ফিরে আসব।

মণীশ এসব ব্যাপারে আগে কখনও থাকেনি। কিন্তু বিষয়টা যে এতটাই অন্যরকম, সেই অভিজ্ঞতা অর্জন করার লোভ সে সামলাতে পারল না। এভাবেই দেবের সংস্পর্শে আস্তে আস্তে সেও পরোক্ষ ভাবে রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে লাগল।

মাস খানেক পরে ঘটল আরও এক অভাবনীয় ঘটনা। বাজারে সবজি কিনতে এসেছিল মণীশ। সেই সময় মোবাইলটা বেজে উঠতেই দেখে দেবের ফোন। ডান হাতে সবজির বোঝাটা নিয়ে বাঁ হাতে ফোনটা ধরতেই ওপাশে দেবের অস্থির কণ্ঠ ভেসে এল।

কোথায় আছিস? জরুরি দরকার। না, না ফোনে বলা যাবে না। হোস্টেলে চলে আয়।

হোস্টেলে পৌঁছে আজ একটু যেন অন্যরকম লাগল দেবকে। গোটা ঘরে অস্থির ভাবে পায়চারি করছে। আর তার খুব ক্লোজ, জনাদুয়েক ছেলে রয়েছে ঘরে। মণীশকে দেখে বেশ উত্তেজিত হয়ে ওঠে দেব।

ভাই এসেছিস! বোস। খুব মন দিয়ে শোন যা বলছি।

হ্যাঁ বলো ভাইয়া

তুই আমার জন্য কী করতে পারিস?

আরে, এ কেমন প্রশ্ন ভাইয়া। তোমার জন্য জান হাজির।

একটা ছেলেকে তুলতে হবে। পারবি?

তুলতে মানে?

কথাটা বলার সময় একটু যেন ঘাবড়ে গেল মণীশ। কী বলছে দেব ভাইয়া, কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না! দেব ভাইয়া তার অবাক হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে একটু যেন শ্লেষের সঙ্গে বলে,

বড্ড সরল তুই মণীশ। আমি যে এই ছাত্র সংগঠনটা করছি, এটাই তো শেষ নয়। আমার একটা বড়ো ফোকাস আছে, তুই জানিস। এবার আমি যুব সংগঠনের সেক্রেটারি হতে চাই। কিন্তু এই পথে একটা বাধা আছে। আমার পথের কাঁটা। অপোনেন্ট পার্টির এই ছেলেটাকে তুই-ও এক-আধবার দেখেছিস। সুরজিত্। এই ছেলেটা ক্রমশ পপুলার হওয়ার চেষ্টা করছে। শালাকে এমন শিক্ষা দেব, যাতে ও আর কখনও মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। তোর হেল্প চাই, ভাই।

কাঁপা গলায় মণীশ বলে কী ভাবে সাহায্য করতে বলছ আমায়?

কিছু না। তুই যখন টেবল টেনিস খেলতিস কমন রুমে, আমি তোকে খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য করতাম, দারুণ রিফ্লেক্স তোর। পারলে তুই-ই পারবি। সুরজিত্ হালওয়াই সরাই-এ থাকে। রোজ ভোরবেলা জগিং করতে আসে দিলবাগ-এ। ঠিক পাঁচটায় রোজ ও দিলবাগ-এর গেট-এ পেঁছোয়। ওখানেই একটা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবি তুই আর এই দুজন।

ঘরে যেন পিনপতন নিস্তব্ধতা। দেব যে দুজনের কথা বলছে, তাদের দিকে এক বার দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেয় মণীশ। তার বুকের ভিতর ঢিপঢিপ আওয়াজটা যে দ্রুততর হচ্ছে, সে টের পায়। দেব পকেট থেকে একটা রামের নিপ বের করে ছোট্ট চুমুক দেয়। তারপর আবার মণীশকে বলে,

সুরজিত্ জগিং করতে করতে গাড়ির পাশে এলেই, তুই ঝট করে বেরিয়ে ওর মুখে কাপড় বেঁধে তুলে নিবি গাড়িতে। তোর মুখে মাস্ক থাকবে। তোর ভয় নেই।

আমতা আমতা করে মণীশ বলার চেষ্টা করল,

কিন্তু দেব ভাইয়া, এটা তো অপহরণ।

তো?

না আমি এসব কখনও করিনি।

সব কিছুরই একটা প্রথমবার হয় মণীশ। তুই পারবি।

দরদর করে ঘামছে মণীশ। ঠিক তখনই একটা মোক্ষম কথা বলল দেব।

কাজটা করার পরই তোর

অ্যাকাউন্ট-এ পাঁচ হাজার টাকা ঢুকে যাবে। আর এখন পাঁচ। ভেবে দ্যাখ, কড়কড়ে দশ হাজার টাকা। ছেড়ে দিবি?

মণীশের অভাবের সংসারে দশ হাজার টাকার ভ্যালু সে জানে। মায়ে চোখের ছানিটা অপারেশন না করালেই নয়। সে আর কিছু ভাবতে পারে না। খপ করে দেবের হাতটা ধরে নিয়ে বলে,

কবে করতে হবে কাজটা ভাইয়া?

মুখে একটা নিষ্ঠুর হাসি খেলে যায় দেবের। বলে,

কালই। বাকিটা তোকে আমার এই দুই শিষ্য বুঝিয়ে দেবে।

ঠিক পাঁচটার সময় একটা কালো রঙের অলটো পিক আপ করল দেব-কে। ভেতরে আগের দিনের দুজন, আছে। আর অপরিচিত একজন ড্রাইভার। ঠিক হয়ে আছে সুরজিত্-কে গাড়িতে তোলার পরই একজন ভালো ভাবে বেঁধে ফেলবে তার মুখ আর হাত দুটো। কিছুটা দূর গিয়ে একটা সিনেমা হলের সামনে গাড়ি থেকে নেমে পড়বে মণীশ। তার পরিবর্তে অন্য একজন গাড়িত উঠবে। ব্যস তার দাযিত্ব শেষ।

ভেতরে ভেতরে উত্কণ্ঠা টের পাচ্ছে মণীশ। এরকম কাজ আগে কোনওদিন করা তো দূরে থাক, ভাবেওনি যে সে করতে পারে। তাকে চিরকাল তার বাবা-মা একটু খাটো নজরেই দেখে এসেছে। পড়াশোনায় খুবই সাধারণ সে। নিজে হাতে এই প্রথম অনেকগুলো টাকা রোজগার করেছে একদিনের কাজে।

পাশের ছেলেটা সিগারেট খেতে খেতে গাড়ির সাইড মিরর দিয়ে খেয়াল রাখছিল জগিং করতে করতে সুরজিত্ আসছে কিনা। এবার সে মুখ দিয়ে একটা ইঙ্গিতপূর্ণ আওয়াজ করতেই, সচকিত হয়ে উঠল মণীশ। একটা নেভি ব্লু ট্র‌্যাক সুট পরে ধীর পায়ে জগিং করতে করতে গাড়ির পাশে আসতেই, তার মুখ চেপে ধরে সবলে তাকে গাড়িতে ঢুকিয়ে নিল মণীশ। সুরজিত্ ঘটনার আকস্মিকতায় এবং মুখ বাঁধা অবস্থায় গোঙাতে লাগল। মাস্ক পরা আগন্তুকদের সে ভালো চিনতে পারছে না। শুধু মণীশের চোখের নীচে বড়ো আঁচিলটা খুব চেনা মনে হতে লাগল তার।

মণীশের বুকের ভেতর কে যেন হাতুড়ি পিটছে। সে অধীর হয়ে রইল সিনেমা হলটার সামনে গাড়িটা না পেঁছোনো অবধি। তারপর দরজা খুলে নেমে যেতেই অন্য একজন তার জায়গায় উঠে পড়ল। গাড়িটা একরাশ ধুলো উড়িয়ে গোমতী নদীর দিকে চলে গেল।

সবে সকাল হচ্ছে। একটা ফাঁকা চায়ে দোকানে বেঞ্চ-এ বসে চা-এর অর্ডার দিল মণীশ। তারপর খুব মৃদু গলায় ফোন করে দেবকে জানাল কাজটা হয়ে গেছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ব্যাংক অ্যালার্ট এল। তার অ্যাকাউন্ট-এ এখন সদ্য উপার্জিত দশ হাজার টাকা।

আর অতটা খারাপ লাগছে না মণীশের। এটা জাস্ট একটা কাজ। ক্রাইম তো নয়। তাছাড়া ছেলেটাকে হয়তো ওরা একটু শাসানি দেবে, হুমকি দেবে, চড়চাপড় মেরে ছেড়ে দেবে। যাতে সে আর দেবের বিরুদ্ধে ফণা না তুলতে পারে। দেবের এখন অনেক ওপর লেভেল-এ চেনাজানা। যেভাবে রাজনীতির সোপানে সে তরতর করে উপরে উঠছে, ভবিষ্যতে তার বড়োসড়ো নেতা হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।

কিন্তু যতটা নিশ্চিন্তে থাকবে ভেবেছিল মণীশ, তা আর পারা গেল না। দিন দুয়ে পরে গোমতী নদীতে লাশ ভেসে উঠল সুরজিতের। মিডিয়া, পুলিশ, তোলপাড়। খবরটা পাওয়া মাত্র ছুটতে ছুটতে দেবের কাছে গিয়ে পৌঁছোল মণীশ।

দেব ভাইয়া, এরকম তো হবার কথা ছিল না! দেব তখন তার ইয়ার দোস্তদের সঙ্গে হোস্টেল-এর পেছনের মাঠের ঝুপসি অন্ধকারে মদের আসর বসিয়েে। লাইটার জ্বেলে সে মণীশের মুখের খুব কাছে ধরে বলল,

ন্যাকা আমার। জলে নামব আর চুল ভিজবে না। রাজনীতিতে এসব হয়?

কিন্তু ওকে মারার কথা তো বলোনি ভাইয়া! আমি… আমি কিছুতেই করতাম না এই কাজ, তুমি ওকে জানে মারবে জানলে।

চুব বে! শত্রুর শেষ রাখতে নেই। যা করেছিস বেশ করেছিস মেরা শের। আয় বুকে আয়। তোকে কত ভালোবাসি জানিস ভাই আমার। নে মদ খা। অ্যায়ে কর।

দেব নেশাগ্রস্ত। মণীশকেও বাকিরা প্রচুর মদ খাওয়াল সে রাতে। মদ খাওয়ার পর মণীশের খারাপ লাগাটা কমে গেল। দেবের হোস্টেলের ঘরে শুয়ে শুয়ে সে জড়ানো গলায় বলল

মিডিয়া, পুলিশ, এসব কুত্তাদের চিত্কার কী করে সামলাবে ভাইয়া?

তুই কিছু ভাবিস না ভাই। ওসব আমার বাঁ হাতের খেল। তুই শুধু কটা দিন আন্ডারগ্রাউন্ড-এ চলে যা।

মাসখানেক কেটে গেছে। একটা কন্ট্রাক্টে কিছু কাজের অফার পেয়েছে, এই বলে কিছুদিন বাড়ির বাইরে রইল মণীশ। ঘরে নিয়মিত টাকা পৌঁছোনোর ব্যবস্থা করেছে দেব। পরিবারের সবাই খুব খুশি মণীশ উপার্জন করছে শুনে। সুরজিত্-এর খবরটা ধামাচাপা পড়ার পর আবার যখন সব স্বাভাবিক, আবার প্রকাশ্যেই দেবের সঙ্গে দেখাসাক্ষাত্ শুরু হল মণীশের।

একদিন কমনরুমে দেবের সঙ্গে টেবিল টেনিস খেলছিল মণীশ। ক্যাম্পাস এখন ফাঁকা। দেওয়ালির ছুটিতে বেশির ভাগ ছাত্ররাই যে-যার বাড়িতে গেছে। খেলতে খেলতে হালকা ভাবেই দেব বলল, এবার আর-একটা দাযিত্ব দেব তোকে ভাই। তুই ছাড়া আমার ভরসাযোগ্য কে আছে বল? খেলা থামিয়ে সরাসরি দেবের মুখের দিকে তাকায় মণীশ।

কী হয়েছে, আমায় বলো ভাইয়া। কী দায়িত্ব?

কিছু না, খুব সাধারণ একটা কাজ। একজনকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হবে ভাই। শুট করতে হবে।

এত সহজ স্বাভাবিক ভাবে কথাগুলো বলছিল দেব, যে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাচ্ছিল মণীশ। সে নার্ভাস হয়ে বলল, কী বলছ ভাইয়া, আমি কী করে… মানে মার্ডার!

হ্যাঁ ভাই। মার্ডার। শুট করতে হবে।

কঠিন হয়ে উঠেছে দেবের চোয়াল, তবু তার মুখে ঝুলে আছে একটা নিষ্ঠুর হাসি। সরাসরি মণীশের চোখের দিকে চোখ রেখে তাকে জরিপ করছে দেব।

মণীশ কোনও রকমে তোতলাতে তোতলাতে বলে,

আমি তো বন্দুক চালাতেই পারি না ভাইয়া। আমি পারব না।

দেবের পা দুটো ধরে বসে পড়ে মাটিতে মণীশ।

দেব তাকে তুলে দাঁড় করায় কাঁধ দুটো ধরে।

তোকে আমার লোক ট্রেনিং দিয়ে দেবে। তুই কাল থেকে দশ দিনের জন্য আমার ফার্ম হাউসে থাকবি। ওখানেই হবে তোর ট্রেনিং। টার্গেট যেন মিস না হয়।

আমি পারব না ভাইয়া। হাত জোড় করে মণীশ।

পারতে তো তোকে হবেই। আর পারলেই ৫০ হাজার টাকা সোজা ঢুকে যাবে তোর অ্যাকাউন্ট-এ।

না ভাইয়া। এ কোন অন্ধকারে তুমি আমায় টেনে নামাচ্ছ। ছেড়ে দাও আমায়।

একটা পৈশাচিক হাসি হেসে ওঠে দেব। তারপর বলে,

ভাই এটা এমনই একটা অন্ধকার, যেখানে ঢোকা সহজ, বেরোনোটাই কঠিন। এই দ্যাখ এটা।

বলার সঙ্গে সঙ্গে দেব তার মোবাইলটা অন করে একটা ভিডিয়ো প্লে করল মণীশের সামনে। সেদিনের গাড়ির অপহরণের ভিডিয়ো। মণীশের মুখে মাস্ক থাকলেও তাতে মুখের নীচের দিকটা ঢাকা পড়েছে। কিন্তু প্রমাণ হিসেবে জ্বলজ্বল করছে তার চোখের নীচের বড়ো আঁচিলটা। মানুষের চোখও তার একটা আইডেন্টিফিকেশন। মণীশ পালাতে পারবে না। সে ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে পাঁকে। যে-পাঁক থেকে তার নিস্তার নেই।

টার্গেট মিস যেন না হয়। এটাই মন্ত্রের মতো এই কদিনে মাথায় ঢুকিয়ে নিয়েে মণীশ। আজ সেই দিন। সেই গাড়ি। সেই একই সওয়ারি। স্থান কাল পাত্র শুধু আলাদা। পাত্র বলা ভুল হল। পাত্রী। দেবের গার্ল ফ্রেন্ড। গদ্দারি দেব সহ্য করতে পারে না। তাকে আর একটা অন্য লোকের সঙ্গে বিছানায় দেখে খুন চেপে গেছে দেবের মাথায়। মেয়েটি দেবের অনেক কুকীর্তি এবং প্ল্যান জেনে ফেলেছে। তাই, চিরতরে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে চায় সে তার প্রেমিকাকে। আর আজ তাকে মারার বরাতটাই পেয়েছে মণীশ।

প্ল্যান মাফিক নিখুঁত কাজ করল মণীশ॥ গাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে যওয়ার সময় পেছন থেকে শুট করল মেযোকে। গুলিটা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেল মেযোর শরীর। কিন্তু সাইলেন্সার লাগানো বন্দুকের আওয়াজ কারও কানে গেল না। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে রক্তাক্ত কবুতরির মতো ছটফট করছিল যখন মেযো, গাড়িটা তখন স্পিডে বেরিয়ে গেল। সন্ধ্যার মুখে স্ট্রিট লাইটগুলো তখন সবে একটা একটা করে জ্বলতে শুরু করেছে।

আর কোনও অপরাধ বোধ হচ্ছে না মণীশের। দেবের হোস্টেলের ঘরে ঢুকে চিল্ড বিয়ার খেতে খেতে, সে গা এলিয়ে ভাবছিল ৫০ হাজার টাকা দিয়ে কী কী করবে। বোনের মাস দুয়ে পর ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ফাইনাল। খুব পরিশ্রম করছে রিঙ্কু। তাকে খুশি দেখলে বড্ড ভালো লাগে মণীশের।

কিন্তু সব ভালো বোধহয় চিরস্থায়ী হয় না। কিছুদিন পরই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উত্তপ্ত হয়ে উঠল সিএএ অর্থাত্ নাগরিকত্ব প্রমাণের বিষয়টি নিয়ে পরিষ্কার দুদলে ভাগ হয়ে গেল মানুষ মতাদর্শের নিরীখে। যুব ও ছাত্ররাজনীতির ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়ল। সরকারের পক্ষে ও বিপক্ষে ভাগ হয়ে মারামারি শুরু হল বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে। এরকমই একদিন, গেট ক্র‌্যাশ করে নানা কলেজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্ল্যান করে ফেলল দেব। যড়যন্ত্রে সামিল করল মণীশকেও। টুকরো টুকরো দলে ভাগ হয়ে তারা ছড়িয়ে পড়ল নানা কলেজে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে বলে। বিকেলের দিকে গেটের মুখে দেশনায়কের মতো পুলিশের জিপে ওঠার আগে, মিডিয়াকে বাইট দিল দেব, আমাদের লড়াই চলছে চলবে… ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করে দিল পুলিশ। মণীশ বিপদ বুঝে বাড়িতে চলে এল।

এর কিছুক্ষণ পরই বাড়ির সামনে একটা শোরগোল শুরু হল। গাড়ির আওয়াজ পেয়ে জানলা দিয়ে উঁকি মারতেই দেখে, একটা পুলিশের জিপ ও একটা অ্যাম্বুল্যান্স এসে হাজির। দরজা খুলে বেরোতেই মণীশের বাকরুদ্ধ অবস্থা। অ্যাম্বুল্যান্স-এর দরজা খুলে যাকে নামানো হল মাটিতে সে রিঙ্কু। তার চোখ দুটো বন্ধ। রক্তে ভেসে যাচ্ছে গোটা দেহ। টুপি খুলে এসআই এগিয়ে এলেন।

হাসপাতালে যাওয়ার পথেই মৃতু্য হয়েে ওনার। কলেজের বইখাতা ঘেঁটে ঠিকানা পেলাম। আজ একদল ছেলে চড়াও হয়েিল এদের ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। দুদলের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। ইটের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ইনি। তারপর আমরা রেসকিউ করে হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার পথেই…

মণীশ হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে পড়ে। হাউ হাউ করে কাঁদছে সে। মা-ও বেরিয়ে এসেছেন ঘরের ভিতর থেকে। বাবা ক্রাচটা ধরে থরথর করে কাঁপছেন। কাকে সামলাবে মণীশ। এ তো তারই পাপের শাস্তি পেল তার ফুলের মতো বোনটা! রিঙ্কুর নিথর রক্তাক্ত দেহটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে সে। হাতে রক্ত লেগে যায় তার। এ রক্ত কি সারাজীবনেও ধুতে পারবে মণীশ!

কুড়ি বছর আগে পরে

খুব গরম আজ।

একটা কোল্ড ড্রিংক্ আনি? – আরে না না। ঠিক আছে। বরং একটু ঠান্ডা জল পেলে ভালো হয়।

– হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়ই…

বলে লোকটা জল আনতে গেল। লোকটার চামচাগিরি এই গরমে একদমই ভালো লাগছিল না। কিছুক্ষণের জন্য মুক্তি। আমি একটু একা থাকতে চাইছিলাম।

পার্কটার এককোণে বিরাট স্টেজ করেছে। বড়ো বড়ো স্ট্যান্ড ফ্যান চললেও গরমের তাতে বিশেষ যাচ্ছে-আসছে না। কারণ স্টেজটার মাথায় ত্রিপল। যেটা থাকলে হাওয়া চলাচল করতে পারে না। ফলে গরম আরও বেড়ে যায়। যদিও পার্কটায় প্রচুর বড়ো বড়ো গাছ ভর্তি। বিশ বছর আগেও জায়গাটা এমনই ছিল। আসার সময় দেখছিলাম সেই বাড়িটা এখনও একই ভাবে আছে, কুড়ি বছর আগের মতো।

আসলে আজ এখানে আমার সংবর্ধনা। সরকারের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মান প্রাপ্ত হবার পর এরকম অনেক জায়গাতেই আমার এমন সংবর্ধনা পর্ব চলছে। তবে অধিকাংশ আমন্ত্রণই আমি গ্রহণ করছি না। যেগুলো কোনও ভাবেই এড়াতে পারছি না কেবল সেগুলোতেই যাচ্ছি। ওরা যখন আজকে এখানে আসার জন্য আমন্ত্রণ করেছিল তখন জায়গাটার নাম শুনে এককথায় রাজি হয়ে যাই। কারণটা কি? কারণ হল, কুড়ি বছর আগে এখানে আমি থাকতাম।

সেই লোকটা একটা মিনারেল ওয়াটারের বোতল নিয়ে আবার হাজির হল। সাথে একটা দামি সিগারেট প্যাকেট। আমার দিকে সেসব বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

– নিন স্যার।

জলটা বেশ ঠান্ডা। গলায় ঢালতেই শরীরটা জুড়িয়ে গেল। এবার একটা সিগারেট ধরালাম।

– আপনি এখানে আসতে এককথায় রাজি হয়ে যাবেন আমরা ভাবতেও পারিনি…

লোকটা আবার আহ্লাদে গদগদ হয়ে বকতে লাগল। যে-ক্লাবটা আমায় সংবর্ধনা দিচ্ছে ও তার সেক্রেটারি। নিমন্ত্রণ করার সময় যখন এসেছিল তখন জেনেছিলাম ও এই এলাকার সব থেকে বড়ো চালের কারবারি। ও সবসময়, মানে আমি যে দু’বার দেখলাম দুধসাদা জামা প্যান্ট জুতো পরে থাকে। কুড়ি বছর আগে অবশ্য ও এত সাদা জামা প্যান্ট পরত না। সিগারেটটা টানতে টানতে মনে পড়ে গেল কুড়ি বছর আগের কথা। তার আগে সিগারেট প্রায় খেতামই না বলা চলে। এখানে এসেই ধরেছিলাম একরকম। সিগারেট ধরাতে দেখলেই সুতপা রাগ করত খুব।

– আগে তো খেতে না। হঠাৎ ধরলে কেন?

অনুযোগ করেছিল ও। ভাবত টেনশন থেকেই আমার এই সিগারেট ধরা।

আস্তে আস্তে পার্কটার নির্জনতা কমে আসছে। টুকটাক করে লোকজন আসতে শুরু করেছে। মাইকে ঘোষণা চলছে– আর কিছুক্ষণ পরেই আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে যাবে। বিখ্যাত সাহিত্যিক হীরক মিত্র আমাদের মধ্যে এসে গেছেন…

বাড়িটা সেই একইরকম আছে। কোথাও কোনও বদল নেই। শুধু রংটা বেশ আবছা হয়ে গেছে। দু’একটা সবুজ পাতা এদিক ওদিক কার্নিশে দেখা যাচ্ছে। পুরোনো পুরোনো একটা ভাব এসেছে বাড়িটার শরীরে। যখন প্রথম এখানে এসেছিলাম তখন বাড়িটা সবে হয়েছে মাত্র। যাকে বলে সদ্যোজাত। আমরাই প্রথম ব্যবহার করি তিনতলার ফ্ল্যাটটা।

বাড়িটা সাহাদের। আমাদের চুক্তি হয়েছিল বড়ো ভাই শংকর সাহার সাথে। তিন ভাইয়ের যৌথ সম্পত্তি। আগে টিনের বাড়ি ছিল। কলোনি এলাকা। তখনই সবে শেষ হয়েছিল টিনের বাড়ি থেকে ফ্ল্যাট বাড়িতে উত্তরণের। পুরো এলাকাটাই এরকম ছিল। আস্তে আস্তে বদল ঘটেছিল কলোনির চরিত্রে।

সুতপা ভাবত আমি সিগারেট খাই টেনশনের জন্য। আমি কিছুতেই ওকে বোঝাতে পারতাম না যে আমার কোনও টেনশন নেই। সামান্য একটু-আধটু টেনশন থাকলেও ওটা বলার মতো বা ভাবার মতো কিছু না। অমন একটু-আধটু সকলেরই থাকে। আসলে সুতপা যবে থেকে আমার জীবনে এসেছিল তবে থেকে আমার সব টেনশন ভ্যানিশ হয়ে গেছিল। একটা সময় অবধি আমার অনেক অনেক বাঁচতে ইচ্ছে করত। সুতপা আসার পর সে ইচ্ছেটা চলে গেছিল। কথাটার ভুল মানে করলে হবে না। যেটা ঘটনা হয়েছিল, সেটা হল সুতপা আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। আর ভালো জিনিসের দীর্ঘায়ু হয় না। আমি তাই বুঝতে পারতাম এর কোথাও একটা শেষ আছে। আর সেই শেষের আগে চলে যেতে পারলে ভালো। মানে সুখ ফুরোবার আগে পালাও। ফলত, আগে সিগারেট খাবার যে অস্বস্তিটা ছিল, এসব ভাবনায় তা হারিয়ে গেল। সুতপা ভাবত আমি হতাশা থেকে মৃত্যুর কথা ভাবছি। আসলে ব্যাপারটা একদমই উলটো।

স্টেজের সামনের চেয়ারগুলো প্রায় ভরে গেছে। মাইকের গমগমানি বেড়েছে। স্থানীয় কলেজের একদল ছাত্র-শিক্ষক আমাকে আলাদা কোণে নিয়ে গিয়ে কিছুক্ষণ বকাল।

আমরা সবাই স্টেজে উঠলাম। আমার বাঁদিকে স্থানীয় এমএলএ। ডানদিকে ক্লাব প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি। শুরুতেই একদল লাল পাড় শাড়ির যুবতি কোরাস গাইল। তারা নেমে যেতে শুরু হল পরের পর ভাষণ পর্ব। ভক্তি গদগদ ভাব নিয়ে এমএলএ, ক্লাব-এর সেক্রেটারি, প্রেসিডেন্ট বলে গেল। সবই আমার প্রশংসা, ওদের ক্লাব কত মহান! একটি কমবয়সি ছেলে আমার লেখা থেকে পাঠ করে শোনাল। তারপর আমার হাতে মানপত্র, ফুলের স্তবক, মিষ্টি– আরও কী সব তুলে দেওয়া হল। সেক্রেটারি আমার কানের কাছে মুখ এনে বলল– ফুলের ভিতর টাকার খামটা আছে।…

কুড়ি বছর আগে সাহাদের ফ্ল্যাটটায় আমি ঘর বেঁধেছিলাম সুতপার সাথে। একটা স্বপ্নের মধ্যে দিয়ে কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো। মাত্র তো একটা মাস আমরা ছিলাম। তবু এখনও ভাবলে মনে হয় অনেকদিন।

আমরা দুজনে একটু একটু করে ফ্ল্যাটটাকে সাজাচ্ছিলাম। প্রতিদিন কিছু না কিছু হাতে করে কিনে নিয়ে ঘরে ঢুকতাম। পর্দা, পাপোশ, ফুলদানি, বেডকভার আরও কতো কি! এমনকী দুটো খতম হওয়া রেড ওয়াইনের বোতলে দুটো মানি প্ল্যান্টও এনে লাগাল সুতপা। ওর জন্য আমি পছন্দ করে কিনে এনেছিলাম একটা লাল রঙের নাইটি। প্রতিদিন গল্প করতে করতে রাত ভোর হয়ে যেত আমাদের। রাত্রির গাঢ় অন্ধকার কাটিয়ে যখন সূর্যের হালকা আমেজ দেখা যেত, পাখিদের ডাক শোনা যেত, তখন আমরা ঘুমিয়ে পড়তাম তৃপ্তির আমেজ মেখে। আমরা দুজনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম বাকি জীবনটা একসাথে কাটাব। সে প্রতিজ্ঞা শেষ অবধি সুতপা রাখলেও আমি পারিনি। মাত্র একমাস পরেই আমাদের এই তিল তিল করে গড়ে তোলা স্বপ্নমহল ভেঙে চুরমার হয়ে গেছিল।

এবার আমায় বলতে ডাকা হল। আমি আয়োজক এবং স্থানীয় মানুষদের অভিনন্দন জানিয়ে বলা শুরু করলাম।

‘আপনাদের সকলকে আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাই। এই পাড়াটা আমার অত্যন্ত প্রিয় পাড়া। এই পার্ক আমায় অনেক স্মৃতি মনে পড়ায়। আপনারা হয়তো কেউ জানেন না এই পাড়াটায় আমি একসময় থেকে গেছি।’  আমার এই কথায় চারদিকে একটা বিস্ময়ের গুনগুন শুরু হল। এই তথ্য কেউই জানত না। না জানাটাই স্বাভাবিক। বা ভুলে যাওয়াটা। আয়োজক দাদারা মনে হল সবথেকে বেশি অবাক-অপ্রস্তুত হল। এতক্ষণ ওদের ভাষণে মনে হচ্ছিল আমার বিষয়ে ওরা সব জানে। মানে পাবলিককে তাই বোঝাচ্ছিল আর কী। আমি বলা থামালাম না।

– আজ থেকে কুড়ি বছর আগে এই পাড়ায় আমি এসে উঠেছিলাম একটি ভাড়া বাড়িতে। সেই বাড়িটা আজও আছে একই ভাবে। কিছুদিন ছিলাম। মাস খানেকের মতো। এই সময়েই আমি ‘লাইফলাইন চলছে’বলে গল্পটা লিখেছিলাম। এই বাড়িতে বসেই। আপনারা জানেন যা এখন দু-দুটি ইউনিভার্সিটির সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এবং দেশি-বিদেশি মিলিয়ে অন্তত পনেরোটি ভাষায় অনুদিত হয়েছে। তাই বিশ বছর পর আজ যখন আমি এই গলিতে পা রাখলাম, আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। আমি বুঝতে পারলাম আরও একটি গল্পের জন্ম হতে চলেছে… গোটা পার্কটা স্তব্ধ হয়ে শুনছিল আমার কথা। একটা চিনতে না পারা পোকা পার্কের সব থেকে উঁচু গাছটার টঙে ভনর ভনর করলেও শোনা যাবে এমন এক স্তব্ধতা। বলতে বলতে আমার মন পার্কের আকাশের দিকে উড়ে যেতে লাগল। আমি হারিয়ে যেতে লাগলাম বিশ বছর পিছনে…

আমি হীরক মিত্র। আমার সব থেকে দীর্ঘস্থায়ী পেশা লেখা। যা আমি আজও করে চলেছি। দীর্ঘস্থায়ী পেশা কথাটা বললাম এই কারণে যে, তার আগে আমি অনেক কিছু করেছি। কম্পিউটার অপারেটর, টিউশন, রাজনীতি আরও কত কিছু। কিন্তু শেষ অবধি বুঝলাম আমার দ্বারা ওই লেখাটাই হবে। দুম করে কোনও কিছু ছেড়ে নতুন কিছু শুরু করে দেওয়াটা আমার মজ্জাগত। কলেজ জীবনে হঠাৎ গ্র্যাজুয়েশন শেষ না করে একটা সেলসের কাজে ঢুকে পড়েছিলাম। পয়সাটা খুব দরকার মনে হয়েছিল সে সময়। বছর খানেক কাজটা করার পর আমারই মনে হল অন্তত গ্র্যাজুয়েশনটা রাখা প্রয়োজন। সারাজীবন একটা খিঁচ থেকে যাবে। বয়স থাকতে থাকতে করে ফেলা জরুরি। চাকরি ছেড়ে আবার কলেজে ঢুকে পড়লাম। একদম ফার্স্ট ইয়ার থেকে। পাশ করার পর ভাবলাম ফোটোগ্রাফার হব। কোর্স-এ ভর্তিও হলাম। কিন্তু লাস্টে পরীক্ষা দিলাম না। ভেবে দেখলাম ফোটোগ্রাফির প্রাইমারি ইনভেস্টমেন্ট আমার পক্ষে অনেক। অনেক কিছু কিনতে হবে গোড়াতেই। তারপর কম্পিউটার অপারেটর হলাম। কিছুদিন পর সেটাও ছেড়েছুড়ে রাজনীতিতে। ট্রেড ইউনিয়নে হোলটাইমার। তাও ছাড়লাম নেতাদের কারবার দেখে। লাস্টে এই লেখা।

লিখতে লিখতেই আলাপ হয়ে গেল সুতপার সাথে। বিবাহিত। তবে স্বামীর সাথে থাকত না। পেশায় আর্কিটেক্ট। ইন্ডিয়ান রেলে।

ও-ও লিখত। তবে আমার মতো গদ্যের লোক ছিল না। কবিতা লিখত। খারাপ লিখত না। অনেকেই চিনত। প্রথম দেখাতেই ভালোবেসেছিলাম ওকে। লভ অ্যাট ফার্স্ট সাইট আর কী। বুঝেছিলাম এই আমার মানুষ। এর জন্যই আমি অপেক্ষায় ছিলাম এতদিন। এর জন্যই জন্মেছি আমি। তখন আমার বছর চল্লিশ বয়স। ভবঘুরে মানুষ। তিনকুলে কেউ নেই। একটা বাড়ি আছে। তাতে থাকি, আর ভাড়ার টাকায় ভাত-বিড়ি হয়ে যায়। কিছুদিন মেশার পর বুঝলাম, ওরও আমাকে ভালো লেগে গেছে। সে সময়ে ওর বর সমানে চেষ্টা চালাচ্ছিল ওকে ফিরিয়ে নিতে। নরমে গরমে নানা ভাবে। সুতপা আমার থেকে বছর তিনেকের ছোটো। অর্থাৎ বয়সটা কম নয়। বাড়বে আরও। একা থাকার যন্ত্রণাও বাড়বে। তাই ও প্রায় সিদ্ধান্ত করেই ফেলেছিল বরের কাছে ফিরেই যাবে। সমস্যা যা আছে মানিয়ে নেবে। ঠিক এরকম একটা সময়ে ওর জীবনে আমি ঢুকে পড়লাম। সুতপার সব ভাবনা চিন্তা সিদ্ধান্ত আমূল বদলে গেল রাতারাতি। ডিভোর্সের মামলা করল ও। ওর বর এরকম পাকা গুটি কেচে যাওয়ায় ব্যাপক খেপল। চাকরি করা বউ কে আর ছাড়তে চায়। আমাদের পিছনে পড়ে গেল লোকটা।

ডিভোর্সের মামলা চলতে লাগল অনন্তকাল ধরে। কবে কি হবে জানি না। আদৌ হবে কিনা বুঝতে পারছিলাম না। তাহলে আমরা কী এভাবেই কাটাব বৃদ্ধবয়স অবধি! শেষমেশ দুজনে একদিন ঠিক করে ফেললাম গোপনে বিয়েটা সেরে একসাথে থাকা শুরু করব। যা আইনের চোখে মান্যতা পায় না। আর সুতপার বর জানতে পারলে এটা নিয়ে ঝামেলা পাকাবেই। যা হয় হোক, আগুনকে সাক্ষী রেখে আমি সুতপার সিঁথি রাঙিয়ে দিলাম এমনই এক বৈশাখে। তারপর এসে উঠলাম সাহাদের তেতলায়।

সংবর্ধনা সভা শেষ হয়ে গেছে। আমি স্টেজ থেকে নেমে এসে মাঠের মধ্যে চেয়ার টেনে বসলাম। সাথে সাথে চারপাশে গুণমুগ্ধদের জটলা তৈরি হল। যাদের মধ্যে অনেকেই আমার নিয়মিত পাঠক, সামনে পেয়ে নানান প্রশ্ন করতে চায়। আবার অনেকে শুধু আমার নামটুকুই জানে। বইপত্তর কিছু পড়েনি। একজন বিখ্যাত লোকের

সংস্পর্শে আসতে ভিড় করেছে শুধু।

এখন আমি সত্যিই একজন বিখ্যাত জন। প্রায়দিনই নানা অনুষ্ঠানে মন্ত্রীদের সাথে আমাকে ডাকা হয়। প্রায় সব পুজো সংখ্যাতেই আমার গল্প বা উপন্যাস থাকে। বিভিন্ন সরকারি কমিটি, আকাদেমিতে আমার নাম থাকা প্রায় বাধ্যতামূলক পর্যায়ে। কুড়ি বছর আগে যখন এখানে থাকতাম তখন আমায় প্রায় কেউ চিনত না। কলেজ স্ট্রিট, নন্দন চত্বরে ফেকলুর মতো ঘুরে বেড়াতাম। কাঁধে ব্যাগ, মুখে বিড়ি, না-কাটা দাড়ি। সুতপার যে আমাকে কী দেখে ভালো লেগেছিল, জানি না।

অনেকগুলো অটোগ্রাফের খাতা আমার সামনে এখন। একটা একটা করে সারতে লাগলাম সেগুলো। এমএলএ মশায় আমার সামনে চেয়ার টেনে বসলেন।

– আমি এখানে চল্লিশ বছর ধরে রাজনীতি করছি। দু’বারের এমএলএ। তার আগে কাউন্সিলারও ছিলাম বহুদিন। আপনার মতো একজন বিখ্যাত মানুষ এখানে থেকে গেছেন অথচ আমরা কেউ সেটা জানতাম না!

ওনার এই অবাক হওয়া দেখে আমিও হেসে বললাম, আপনিও আমায় চিনতেন। মনে করতে পারছেন না।

– চিনতাম! কোন বাড়িটায় থাকতেন বলুন তো?

– পার্কের উলটোদিকের ওই বাড়িটায়। সাহাদের বাড়ি। তেতলায়। এমএলএ সাহেব জট ছাড়াতে না পেরে একটা সিগারেট ধরিয়ে ফেললেন। তারপর ক্লাব প্রেসিডেন্টকে বললেন, শংকরদা? তোমার কিছু মনে পড়ছে?

– নাহ্, তবে যেদিন ওনার বাড়িতে প্রোগ্রামটার ব্যাপারে যাই, সেদিন ওনাকে সামনে থেকে দেখে খুব চেনা চেনা লাগছিল। কোথায় যেন দেখেছি। মনে করতে পারছি না।…

আস্তে আস্তে ভিড়টা হালকা হয়ে এল প্রায়। মাথারা ছাড়া সকলে চলে গেছে একরকম। আমরা ক’জন মিলে পার্কের কোণের ক্লাবঘর খুলে বসলাম। সেক্রেটারি হাত কচলে বলল, একটু জলখাবারের আয়োজন রাখা হয়েছে। বসুন একটু।

এমএলএ সাহেবের কাজ ছিল। কিন্তু উনিও যেন আটকা পড়ে গেছেন আমার সম্বন্ধে পুরোটা জানার কৌতূহলে।

সুন্দর কাচের প্লেটে গরম গরম ফিশফ্রাই এল। সেক্রেটারি আমার একদম সামনে এসে বলল, স্যার, এমন সুযোগ তো বারবার আসে না, আপনি অনুমতি করলে একটু হুইস্কি দিয়ে সেবা করি।

আমি হেসে বললাম,

– তাও আছে! ঢালুন এক পেগ…

প্রথম পেগ শেষ করেই এমএলএ আমায় চেপে ধরলেন,

– দাদা আর হেঁয়ালি করবেন না। বলুন না, আপনার সাথে আগে কি আমার কখনও মোলাকাত হয়েছিল?

কৌতূহলে ওর গোল গোল চোখগুলো চকচক করছিল ওর দু’হাতের তিনজোড়া আংটির মতোই। আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে লম্বা টান মেরে বললাম, আজ থেকে কুড়ি বছর আগে সাহাদের তেতলায় আমি থাকতাম। একটা ঘটনার পর আপনার নেতৃত্বে একদল ছেলে এসেছিল আমার ফ্ল্যাটে…

…আমার এখনও মনে আছে দরজাটাকে ঢাকের মতো দুমদুম করে বাজিয়েছিল ওরা ‘দরজা খুলুন’ বলে চিৎকার করে। সুতপা ভয়ে সিঁটিয়ে গেছিল ঘরের কোণে। আমি দরজা খুলে বেরিয়ে এসে বলেছিলাম, এভাবে দরজা ধাক্বাচ্ছেন কেন, এটা ভদ্রলোকের বাড়ি।

প্রায় তেড়ে আসার ভঙ্গিতে ওরা বলেছিল, চোপ। বড়ো একেবারে ভদ্দোলোক এয়েছে। শুনে রাখুন, এটা ভদ্দোরলোকের পাড়া। সব শিক্ষিত মান্যগণ্য লোকেরা এখানে থাকে। এসব নষ্টামি এখানে চলবে না। তিনদিনের মধ্যে পাড়া ছেড়ে চলে যাবেন…

পরে শুনেছিলাম সেদিন দুপুরে সুতপার স্বামী এসে বাড়িতে হুজ্জোত করে গেছিল, যখন আমি বা সুতপা কেউ ছিলাম না।

ক্লাবঘরটা মর্গের ঠান্ডা ঘরের মতো হয়ে গেল যেন। অসম্ভব নিস্তব্ধতা। এমএলএ, ক্লাব প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি সবাই মাথা নীচু করে বসে। আমি নিজেই বোতল থেকে আরেকটা পেগ ঢেলে নিলাম গ্লাসে। এক চুমুকে সেটা শেষ করে উঠে পড়লাম।

– আচ্ছা চলি তাহলে। ভালো থাকবেন।

পার্কের গেট অবধি ওরা সবাই চুপ করে অনুসরণ করল আমাকে। সংবর্ধনায় পাওয়া ফুল, মালা ও যাবতীয় সব কিছু ক্লাবঘরেই পড়ে রইল। সেটা দেখেও ওরা কেউ কিছু বলতে সাহস করল না। আমি গেটের কাছে এসে বললাম, আপনাদের আর আসতে হবে না। আমি একটু সাহাদের বাড়ি ঘুরে যাব, যদি আপনাদের আপত্তি না থাকে।

এমএলএ ভদ্রলোক আমার দু’হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, কি বলছেন! আপত্তি! আমাদের ক্ষমা করে দেবেন। কুড়ি বছর আগে কম বয়সের তেজে অনেক কিছু বলে ফেলেছিলাম আমরা, জানি আপনি সে অপমান কোনওদিনও ভুলতে পারবেন না। তবু ছোটো ভাই ভেবে ক্ষমাঘেন্না করে দেবার চেষ্টা করবেন।

আমি মাননীয় এমএলএ-র পিঠে হাত রেখে বলি, আমি কিছু মনে রাখিনি। তাহলে কি আসতাম? মনে রেখে কি হবে বলুন, তাতে তো কিছু বদলাবে না।

ক্লাব সেক্রেটারি ছলছলে চোখে জিজ্ঞেস করল, বউদি এখন কেমন আছেন? উনি কি আপনার সাথেই আছেন?

আমি একটা সিগারেট ধরালাম। মানা করার জন্য তো আর সুতপা নেই। ওরা আমার উত্তরের জন্য প্রতীক্ষারত। পার্কের গেটে দাঁড়িয়ে পরপর দু’তিনটে টান মারলাম সিগারেটে। হুইস্কির নেশাটা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে মাথায়। সন্ধ্যা নেমে এসেছে পুরোপুরি। পার্কটা এখন নিকষ কালো। সোডিয়াম ভেপারের আলো তাতে খুব বেশি নাক গলাতে পারছে না বড়ো বড়ো গাছপালার জন্য। আমি ওদের সকলের দিকে তাকিয়ে বললাম, সেদিনের ঘটনার পরদিন আপনাদের বউদি, মানে আমার সুতপা রেললাইনে সুইসাইড করেছিল।

 

লাভার্স মিট

একাকী দাঁড়িয়ে থাকে তন্বী। বারান্দার রংচটা গ্রিলটা ধরে। বারান্দার গ্রিলটা যেন তন্বীর প্রাণের বন্ধু হয়ে গিয়েছে। বর্ষার দিনে মুঠোতে শক্ত করে ধরে, এক দৃষ্টিতে দ্যাখে কীভাবে বৃষ্টির ফোঁটা আকাশ থেকে ঝরে মাটিতে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। আর বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা জল ভূমির ঢাল ধরে ছোটো ড্রেন, হাইড্রেন হয়ে হু হু করে বইছে। হয়তো নদী হবে বলে।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে অভ্যাসমতো বারান্দায় গিয়ে এক মনে কী যে ভাবে তন্বী কে জানে? পাখির কিচিরমিচির শব্দে প্রতিদিন ভোরে ঘুম ভাঙে তন্বীর। ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশকুসুম ভাবে। উঠোনের কাঁঠাল আর পেয়ারা গাছটা সকাল-সন্ধে পাখির কলকাকলিতে মুখর। পাখিদের সংসার যেন তন্বীর খুব চেনা হয়ে গিয়েছে। কাঁঠাল গাছটাকে বর্ষার আগাছা আর বিভিন্ন লতাগুল্ম আঁকড়ে ধরে থাকে। বৃষ্টিস্নাত সবুজ গাছের পাতায় জল গড়িয়ে পড়ে। গাছ-গাছালি বেশ ঝাঁকড়া হয়ে যায় এই সময়টায়। বিভিন্ন ঋতুতে গাছগুলোর বিভিন্ন রুপ দেখেছে। আর সকাল-সন্ধে পাখিদের সংসার, আনাগোনা সব এখন নখদর্পণে তন্বীর।

সকালের পাখির ডাকে ঘুম ভাঙে। ঘুম ভাঙানিয়া পাখপাখালি সারাদিন কী ব্যস্ত থাকে। আবার কোথায় উড়ে চলে যায় দূর আকাশে। মন দিয়ে পাখিদের খুনসুটি দেখে। কখনও পাখি হতে ইচ্ছা করে তন্বীর। আবার সন্ধ্যায় আকাশ-পথ চিনে কীভাবে যে ওরা ফেরত আসে বাসায়, তার কূলকিনারা খোঁজার চেষ্টা করে। এই পাখিগুলোর ব্যস্ত আনাগোনা দেখতে দেখতে কখনও হিংসা হয়। ভাবতে থাকে এরা তো কেউ বেকার নয়।

বৃষ্টিভেজা কচি সবুজ পাতা তন্বীর খুব প্রিয়। রাতের খাবার সেরে প্রতিদিন ব্যালকনিতে দাঁড়ানো যেন নিয়ম হয়ে গিয়েছে। দৈত্যের মতো আবাসানগুলো শহরের আকাশ, মেঘ, সব যেন গিলে খাচ্ছে। তবুও একফালি আকাশ এখনও দেখা যায়। আর শীতের বেলায় ধবল কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ। আগে তো হিমালয়ে আকাশ ছুঁই ছুঁই চড়াগুলো বারান্দা থেকে দেখা যেত স্পষ্ট। কয়েকটা বছরে কেমন যেন বদলে গেল শহরটা। জ্যোত্স্না রাতে চাঁদটা বেশ কিছুক্ষণ দেখা যায় এক টুকরো মেঘের ফাঁকে। রাত বাড়লে হারিয়ে যায়। শহরের নিয়ন আলোয় আকাশের তারাগুলো আত্মগোপন করে। আজ রোহনের কথা মনে পড়ছে খুব। চাঁদের মায়াবি আলো এসে পড়ে তন্বীর চোখেমুখে। সন্ধ্যার দিকে বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী টিউশন পড়তে আসত।

বেশ কিছু দিন আগে স্থানীয় একটি নার্সারি স্কুলে শিক্ষিকার পদে কাজ করত সে। কিন্তু বেসরকারি স্কুলের ফাইফরমাশ খাটতে খাটতে জেরবার হয়ে যায়। এক সময় সেই কাজটা ছেড়ে দেয়। ভোরবেলায় ঘুম ঘুম চোখের ঘোর কাটাতে বাইরের আলোতে কিছুক্ষণ কাটিয়ে নেয়। আবার রাতের খাবার সেরে বেশ কিছুক্ষণ একাগ্র চিত্তে দাঁড়িয়ে থাকে গ্রিলটা ধরে। শিলিগুড়ি শহরের ব্যস্ততম রাস্তার ধারে অপূর্ব কাঠের দ্বিতল ঘরে তন্বীদের বাস। এই শহরে কিছুদিন আগেও ছবির মতো কাঠের কারুকাজ করা সুন্দর ঘরগুলো শহরের অহংকার ছিল। তন্বীদের পুরোনো কাঠের ঘরটা এখনও প্রমোটারদের থাবা থেকে বেঁচে আছে।

বাবা বলাই চৌধুরী-রা তিন ভাই। তাদের মধ্যে বড়ো তন্বীর বাবা। আর দুই ভাইয়ে একজন থাকে বিদেশে। আর একজন দিল্লিতে কর্মরত। বহুদিন শিলিগুড়িতেই আসেনি কেউ। তন্বী কাকুদের চিনতেই পারবে না। তবে অ্যালবামে ছবি দেখেছে সবার।

বার্মা টিকের কাঠের দ্বিতল বাড়িটার অধিকাংশ রুম জরাজীর্ণ। নীচের ঘরগুলোর মধ্যে একটায় বইয়ের দোকানের গোডাউন। কিছু ভাড়া পাওয়া যায়। সেই টাকা দিয়ে মাঝেমধ্যে ঘর মেরামত করা হয়। শহরের ব্যস্ততম রাস্তার পাশে এক সময় এই কাঠের ঘরটা ছিল দেখবার মতো। পঁক পঁক রিকশার হর্নের শব্দ শুনতে কান অভ্যস্ত হয়ে গিয়েে তন্বীর। শিলিগুড়ি রিকশার শহর নামে খ্যাত।

উঠোন থেকে লোহার প্যাঁচানো সিঁড়িটা বেয়ে উপরের কাঠের বারন্দায় উঠতে হয়। তারপর সার-সার দুটি ঘর। বন বাংলোর মতো একটা অনুভূতি হয় রুমে ঢুকলে। এই দুটো ঘরেই তন্বীদের সংসার। বাকি ঘরগুলো ভাম, বিড়ালদের বাস, ব্যবহার হয় না। ফুল বাগিচায় সাজানো গোছানো উঠোন। লাল টুকটুকে জবা ফুল ফুটে থাকে উঠোনময়। নয়নতারা, টগর, বেলি আর রাতে রজনীগন্ধার সুবাসে মনটা ভরে ওঠে।

তন্বীর মা পুজো অর্চনা নিয়ে থাকেন। প্রতিবেশীরা ফুল তুলতে আসেন। খুব সখের বাগান তাঁদের। একটা বাংলা শর্ট ফিল্মের শুটিংও হয়েছিল।

তন্বীর বাবা বলাই চৌধুরী যজমানি করে রোজগার করেন। তাঁর একমাত্র কন্যাসন্তানকে মানুষ করেছেন বহু কষ্টে। বড়ো সাধ ছিল মেয়ে একটা সরকারি চাকরি করবে। রোজ সকালে ফুলের সাজি আর সিঁদুরগোলা পাত্র নিয়ে পুজো করতে বার হয়ে যান তিনি। তন্বীর মা রুমা ফুলের সাজি আর একটা ছোটো বাটিতে সিঁদুর গুলে রাখেন পরিপাটি করে।

রেল লাইন পার হলেই লোকাল বাসস্ট্যান্ড। সকালের দিকে স্ট্যান্ডে থাকা বাসগুলোতে ফুল, ধূপ দিয়ে পুজো করেন বলাইবাবু। এছাড়াও বেশ কিছু বাঁধা দোকান, সেলুনে পুজো সেরে দুপুরে ঘরে ফেরেন। হাটবারে ওঁদের বাড়ির দেযাল লাগোয়া জায়গায় শাকসবজির পসরা নিয়ে বসে সবজি বিক্রেতারা। এক পা বাড়ালেই হাটবাজার, সবই হাতের মুঠোয়।

বৃষ্টির দিনে আজ মনটা কেমন করে উঠল তন্বীর। খুব রোহনের কথা মনে পড়ছে। হঠাৎ ভোর রাতে ঘুম ভেঙে গেছে। রোহনের স্বপ্ন দেখেছে সে। বহুদিন রোহনের সঙ্গে দেখা হয় না। ছোটোবেলার প্রিয বন্ধু যেন স্বপ্নে ধরা দিল ভোর রাতে। বেশ কয়েক বছর হল রোহন আর এ শহরে আসেনি।

অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। কখনও মেঘের বুক চিরে বিদ্যুৎ ঝিলিক। গাছের শাখায় শাখায় কচিপাতা গজিযে উঠছে। বৃষ্টি ভেজা সবুজ গাছের পাতায় টলটলে বৃষ্টির ফোঁটা, দেখতে ভীষণ ভালো লাগে তার। মনে পড়ে যাচ্ছে সেদিনটার কথা। কলেজ পথে একদিন রোহনের চারচাকা গাড়িতে ফুলবাড়ি ক্যানাল ধরে গাজলডোবা গিয়েছিল।

টুকটুকে পুতুল পুতুল চেহারার তন্বী খুব আকর্ষণীয় ছিল। তাদের অজান্তে ভালোবাসার একটা অজানা স্রোত প্রবাহিত ছিল। দুটো পরিবার আসতে পেয়েছিল। তিস্তা ক্যানাল বর্ষার অতি বৃষ্টিতে টইটুম্বুর। দুপাশে ঘন লকলকে সবুজ ছুঁয়ে গাজোলডোবায় পৌঁছে গিয়েছিল সেদিন। ওদের মনের ভেতর বইত ভালোবাসার অন্তঃসলিলা। কলেজ লাইফ বেশ কেটেছে। কলেজ জীবনের স্মৃতি ফিল্মের রোলের মতো ভেসে আসছে। কিছুটা নিজেকে সামলে নিয়ে রোজকার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তন্বী।

ইতিহাসে মাস্টার ডিগ্রি কমপ্লিট করে ঘরে বসে আছে তন্বী। কোনও চাকরি জোটেনি। সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনে নজর রাখে। দরখাস্তও করে। সাফল্য আসেনি এখনও। আসলে শিক্ষকতার পেশায বিএড খুব জরুরি। কিন্তু দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের মেয়ে তন্বী, লাখ লাখ টাকা দিয়ে ভর্তি হওয়া আকাশকুসুম কল্পনা।

এদিকে সরকারি, বেসরকারি বিভিন্ন দফতরে অ্যাপ্লাই করেই চলেছে। কিন্তু সুযোগ আসেনি একটাও। কিছুদিন আগে একটা নার্সারি স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি জুটিযেছিল। কিন্তু বেসরকারি স্কুলের সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি।

সামনের বড়ো রাস্তাটা পার হলেই রোহনদের বিশাল বাড়ি। প্রশস্ত উঠোন। যখন ছোটো ছিল ওরা একসঙ্গে খেলাধূলা করত। প্রাইমারি থেকে কলেজে পড়া পর‌্যন্ত ওরা দুজন দারুণ জুটি। রোহন পড়াশোনায খুব ভালো। উচ্চমাধ্যামিকে স্কুলের টপার হয়েছিল। তন্বীও মনযোগী ছাত্রী ছিল। ছোটোবেলার খেলার সাথি ওরা। কলেজেও একসঙ্গে পড়েছে। রোহনদের বাড়ির সহযোগিতা দারুণ ভাবে পেযেছে তন্বী। আসলে তন্বীর বাবা রোহনদের পরিবারের কূল-পুরোহিত। রোহনের বাবার বিয়েও পুরোহিত ছিলেন বলাইবাবু।

বেশিরভাগ সময় রোহনদের বাড়িতে কাটাত তন্বী। রোহনের মা মিতার খুব পছন্দের মেয়ে ছিল সে। রোজ স্কুল শেষে যখন রোহনদের বাড়িতে খেলতে আসত, মাথার ঘন কালো কোঁকড়া চুলে কৃষ্ণচড়ার ঝুঁটি বেঁধে দিতেন রোহনের মা। আত্মীয-কুটুমদের মধ্যে কানাঘুষো হত, তন্বীকে বউ করে নিয়ে আসবে ঘোষ পরিবার। কিন্তু তন্বীর মা আবার খুব গোঁড়া। ধর্মকর্ম পুজো নিয়ে থাকেন। বলবার সাহস হয় না মিতার।

রোহনের বাবা বাদল ঘোষ শহরের নামজাদা ব্যবসাযী। কযেটা গোডাউন রযেে। বাদল ঘোষ ধনেমানে বড়ো হলে কী হবে, লেখাপড়া ছিটেফোঁটাও জানেন না। স্কুলছুট হয়ছিলেন। সে আর এক গল্প। পণ্ডিত স্যারের কানমলা খেযে নাকি আর স্কুলমুখো হননি। কিন্তু এখন এই শহরের বেশ ধনী ব্যবসায়ী। বাদল ঘোষের বাবাও ব্যবসায়ী ছিলেন। ব্যাবসাটা ওদের পরিবারের মজ্জাগত। এখন বাদলবাবু ফুলে-ফেঁপে কলাগাছ। এদিকে রাজনীতির সঙ্গেও যুক্ত।

রোহন কলেজে অনার্সে ভালো ফল করেছে। রোহনের বাবা খুব খুশি। এই আনন্দে ঠিক করেছেন রোহনকে কলকাতায হোস্টেলে রেখে পড়াবেন। ব্যাবসার সুত্রে পরিচিত এক বন্ধুর বাড়িতে কিছুদিন ছিল রোহন। কিন্তু মন বসেনি। মাঝপথে সব ছেড়ে চলে আসে। সুযোগ পেলেই তন্বীকে নিয়ে শুকনার জঙ্গল দেখতে বেরিয়ে পড়ে। রংটঙের টযট্রেনের নির্জন ষ্টেশনে বসে চলে ওদের প্রেমালাপ। কখনও দিনের শেষে ধূমাযিত কফি কাপে চুমুক দিতে দিতে, ভালোবাসায বুঁদ হয়ে যায দুজনে। কিছুক্ষণ কাটিয়ে আবার মোমো শপে গরম মোমো খেযে বাড়ি ফেরে।

এদিকে তন্বী ইতিহাসে এমএ করছে বিশ্ববিদ্যালয থেকে। মাঝপথে রোহন সব ছেড়ে চলে আসায, রোহনের বাবা-মায়ের মন খুব খারাপ। তন্বীদের সঙ্গে রোহনদের একটা ঘরোযা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। পাড়াপড়শি, আত্মীযমহলে আলোচনা করে অনেকে। তন্বীও ফের ভর্তি হতে বলে রোহনকে। যাইহোক রোহন নেক্সট ইয়ার বেঙ্গালুরুতে বিজনেস ম্যনেজমেন্টে ভর্তি হয়। এখন ওখানেই থাকে। বেশ মন বসে গিয়েছে। চিরবসন্তের শহরে এক অন্য জগতের পড়াশোনা নিয়ে মজে গেছে। শিলিগুড়ি আর আসতেই চায় না রোহন। টাকা পযসার তো আর অভাব নেই। বাবা টাকা পাঠান।

এখন অফিসের কাজে ব্যস্ত হয়ে গিয়েছে। বিজনেস ম্যনেজমেন্ট পাশ করে নামকরা বেসরকারি কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টরের পদে আসীন। বেকার বসে থাকতে হল না আর। প্রথম দিকে তন্বীর খোঁজ খবর নিত। ফোন করত নিয়ম করে। কিছুদিন হল সেসব পাট যেন চুকে গেছে।

রোহনের বাবা বাদল ঘোষের বাড়িতে ঘটে গিয়েছে অঘটন। পুলিশ রেড হয়েছে। রেশন দুর্নীতিতে আপাদমস্তক ডুবে গিয়েছেন বাদলবাবু। রাজনীতির কেউকেটা হয়ে নাকি পার পাওয়া যাচ্ছে না।

কোনও অভিযোগের ভিত্তিতে গুদামে, বাড়িতে পুলিশ প্রশাসন রেড করে বেআইনি শস্য উদ্ধার করেছে। দুর্নীতির শিকড় নাকি বহুদূর। মন্ত্রী-আমলারাও যুক্ত। আসলে এদেশে শস্য নিয়ে দুর্নীতি মারাত্মক। আর এরাই আবার রাজনীতির হর্তা-কর্তা-বিধাতা। কিন্তু পাপ তো বাপকেও ছাড়ে না। কাজেই বলাই ঘোষ গ্রেফতার হয়েছেন। তদন্তে কী হবে কেউ জানে না!

বিভিন্ন সংবাদপত্রে রেশন দুর্নীতি নিয়ে কযেকদিন ধারাবাহিক লেখাও বার হয়েছে। রোহনের কানে সব খবর গিয়েে। লজ্জায় ঘৃণায় রোহনের মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে। তারপর থেকে আর শিলিগুড়ির বাড়ি আসা যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। কীভাবে বন্ধু আত্মীয়দের মুখ দেখাবে রোহন! চায়ের দোকান থেকে ঘরে-বাইরে আড্ডায় এখন মুখরোচক খবর, বলাই ঘোষের দুর্নীতি।

এরকম বিপর্যয়ের মুখে একদিন রোহনের ফোন আসে। তন্বীর মুখে সে ঘটনার সত্যাসত্য জানতে চায়। তন্বী রোহনকে সান্ত্বনা দেয়। তারপর বহুদিন আর ফোন করা হয়নি। মনে হয় রোহন এড়িয়ে যাচ্ছে। তন্বী খুব বাস্তববাদী। মনে মনে ঘরের বারন্দার গ্রিলটা ধরে ভাবে কতো কী। আবার এগিয়ে যেতে হবে। জীবনের আর এক নাম লড়াই। ছোটো থেকে দেখেছে বাবাকে, কী ভাবে জীবনসংগ্রাম করে তাকে মানুষ করেছেন।

সব কিছু মানিয়ে নেওয়ার অভ্যাস ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে তন্বীর। জীবন যন্ত্রণার বহু করুণ-কাহিনির সাক্ষী সে নিজে। হয়তো আরও পথ যেতে হবে তাকে। জীবনটাকে চ্যালেঞ্জ হিসাবেই নিতে চায় তন্বী। তাই হতাশার কোনও ঠাঁই নেই তন্বীর অভিধানে। সম্পর্কে এইভাবেই দূরত্ব তৈরি হয়। রোহন তন্বীর সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলেও সে রোহনকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারেনি।

এদিকে বলাই ঘোষের জামিন হয়েে কিন্তু কেস চলছে। বলাই ঘোষ বিচারাধীন। তাঁর অনুগামীরা জামিনের দিন ফুলের মালা দিয়ে সংবর্ধিত করেছেন। সংবাদে সচিত্র এমন সংবাদ পড়ে অনেক কিছু ভাবতে থাকে তন্বী। ওদের বাড়ির বারান্দা থেকে দেখা যায় মহকুমা শাসকের দফতরের জাতীয পতকাটা পতপত করে উড়ছে। আর ওইখানেই আদালত। তন্বী এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হাঁ করে পতাকাটার দিকে। আনমনা হয়ে যায়।

তন্বীর বাবার বয়স হচ্ছে। সেদিন পুজো করতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। মুখ দিয়ে ফেনা বার হচ্ছিল। পাতলা ছিপছিপে চেহারার মানুষ। লো-প্রেশারের রোগী। অনেকবার তন্বীর মা বলেছেন মেযোর জন্য পাত্র খুঁজতে। কিন্তু তন্বী নারাজ। মা যতবার বলেছেন, তন্বী তুই সব খুলে বল। তন্বী ততবার বলেছে, আমি নিজের পায়ে দাঁড়াব, কিছু একটা করব।

এমন সময় একটা কলিং বেলের শব্দে তন্বী দরজা খুলে দেখে পিয়ন কাকু। বহুদিন পর দেখা। আসলে আজকাল চিঠিপত্তর তেমন আর আসে না। একটা বাদামি খাম তার হাতে ধরিয়ে দিল লোকটি। খামের মুখ খুলে দেখে ইন্টারভিউ লেটার। গ্যাংটকে ভেনু। সময় তারিখ সব দেওয়া আছে। মনটা বেশ চনমনে হয়ে উঠল। মাকে সব বলল। বাবাও ফিরেছেন পুজোর কাজ সেরে।

সপ্তাহে নিয়ম করে একটা খবরের কাগজ রাখে তারা। সাপ্তাহিক কাগজে দেশবিদেশের খবর থাকে। বেশ কিছুদিন আগে একটা ভালো মাইনের চাকরির বেসরকারি কোম্পানির বিজ্ঞাপন দেখে অবেদন করেছিল। পদটি অফিস সহকারীর। এক নামকরা ওয়াটার পাম্প কোম্পানির অফিস অ্যাসিস্ট্যান্ট। সারা দেশ জুড়ে বিভিন্ন শহরে এই কোম্পানির মূল অফিস। হিল এরিযায নতুন অফিস খুলবে। তরাই-ডুযার্স, অসম, সিকিম এলাকার চা-বাগিচায় ওয়াটার পাম্পের ডিমান্ড রযেছে।

বাবাকে সঙ্গে নিয়ে ইন্টারভিউ-এর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে সেভক রোডের কাছে একটা টাটা সুমোতে চেপে বসে তন্বী। বেলা দশটার মধ্যে গ্যাংটকে পৌঁছে ইন্টারভিউ বোর্ডের মুখোমুখি হতে হবে। সাক্ষাত্ প্রার্থীরা একটা হোটেলের করিডরে অপেক্ষা করছে। এই হোটেলটা থেকে দূর পাহাড়ের উপত্যকার মাঝে তিস্তা নদী দেখা যায়। হোটেলের পিছনের দিকে কনফারেন্স রুমে বসবার ব্যবস্থা। কাগজপত্র ভেরিফিকেশন হবার পর ইন্টারভিউ-এর সময় হল। কযেজনের পর ডাক পড়ল তন্বীর।

শীতশীত আবহাওয়া। আজ যদিও আকাশে সূর‌্যের দেখা মিলেছে। ফাইল নিয়ে বোর্ডের সামনে চেযারে বসতেই, সারা শরীরে কেমন শিহরণ অনুভব করল সে। খুব চেনা মানুষ ইন্টারভিউ বোর্ডের হেড। ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, গোলাপি হাফ সোয়েটার। চশমার ফাঁকে বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটো ঘুরছে। চোখ আর জোড়াভুরু দুটো খুব চেনা। পাশে বসে এক আধুনিকা। কাগজপত্র মিলিয়ে বেশ কিছুক্ষণ আলাপের ছলে ভদ্রমহিলা অনেক কিছু প্রশ্ন করলেন। কিন্তু সেই চেনা মানুষটির যখন প্রশ্নের পালা এল কোনও প্রশ্ন না করে, ওকে বলে শেষ করলেন।

রুম থেকে বেরিয়ে আসতেই বাবা জিজ্ঞেস করলেন, ইন্টারভিউ কেমন হল তন্বী? তন্বী বাবার কথা এড়িয়ে বলল, হয়েছে চলো, দেরি হয়ে যাবে। লাস্ট বাসটা ধরতে হবে।

কিছু একটা গড়বড় হয়েছে, বাবা সহজেই বুঝলেন। খানিকটা হেঁটে বাজারের বাসস্ট্যান্ডে কিছু শুকনো খাবার কিনে, বাসের জানলার দিকে সিট নিয়ে বসল তন্বী। মেঘমুক্ত আকাশে স্পষ্ট দেখা যায তিস্তার মূল স্রোতে কত অনামি জলধারা এসে মিশছে। সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ, সবুজ উপত্যকায ঘুরে বেড়াচ্ছে।

গ্যাংটক ছাড়িয়ে বাসটা পাহাড়ের পাকদণ্ডি পথে ছুটছে। জানলার দিকে তাকিয়ে রোহনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে, এক সমযে সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিযে পড়েছে তন্বী। হঠাত্ বাসটা বাঁক নিয়ে ব্রেক কষলে এক ঝটকায় ঘুমটা ভেঙে যায তন্বীর।

এখন রাস্তাটা তিস্তা নদী ঘেঁষে চলেছে। সামনেই তিস্তা বাজার জনবসতি। বাসের জানলা থেকেই দেখা যাচ্ছে প্রধান নদী তিস্তায়, রঙ্গিত নদী মিশছে। সিকিম থেকে রঙ্গিত, তিস্তা বাজারে তিস্তার মূল প্রবাহে মেশে।

তিস্তা-রঙ্গিতের সঙ্গমস্থল লাভার্স মিট দেখতে দেখতে কেমন নস্টালজিক হয়ে যায তন্বী।

রোহনের আজকে না চেনার ভান নাকি কোম্পানির প্রোটোকল কোনটা সঠিক ভাবতে থাকে তন্বী। কখনও নিজেকে সান্ত্বনাও দেয়। ভাবতে থাকে এমনটাই কাঙ্খিত ছিল। অভিমানে গাল বেয়ে দুফোঁটা মুক্তো দানা ঝরে পড়ে। রোহনের সাথে হঠাত্ দেখা হওয়া যেন স্মৃতির দরজা ধরে এক ঝলক ফিরে দেখার অপেক্ষা। কে জানে যদি আবার সেই দিনগুলো ফিরে আসে!

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব