কক্ষচ্যুত এক নক্ষত্র

( এক )

আরশির সামনে বেদানার রসে ভরা গেলাসটা ঠক করে নামাতেই বিভাবরীর চোখে পড়ল শ্রীয়ের কঠিন মুখটা। চোখের কোণ দিয়ে দেখলেন, আরশি এক চুমুক দিয়ে গেলাসটা নামিয়ে রাখল। বিভাবরী উঠে গিয়ে বিট নুনের কৌটোটা নিয়ে এলেন। বেদানার রসে এক চিমটি বিটনুন মিশিয়ে দিয়ে গেলাসটা আরশির হাতে তুলে দিলেন। আরশি বাধ্য মেয়ের মতো এক চুমুকে গেলাসটা শেষ করে নামিয়ে রেখে অল্প হাসল।

বড়ো বিষণ্ণ সে হাসি। এমনটা তো হবার কথা ছিল না! আরশি আর শ্রী দুই বোন একে অন্যকে চোখে হারায়। আর তাই জন্যই আরশি এত বড়ো পদক্ষেপটা নিতে পেরেছে। কিন্তু শ্রী! সে এত বদলে গেল কেন? চশমার কাচ মুছতে মুছতে বিভাবরী বাগানের দিকে চেয়ে থাকেন।

গেট খোলার শব্দ হয়, মালতীর ছেলেটা এসেছে। হাতের ঠোঙাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, এই নাও ঠাকুমা, কাঁচা তেঁতুল।

শ্রী এসে দাঁড়িয়েছে, তেঁতুল কেন রে?

তা আমি কী জানি! মামাবাবু অফিস যাবার সময় বলল গাছ থেকে পেড়ে দিয়ে আসতে। আমাকে একটা দশ টাকার কয়েনও দিয়েছে। মালতীর ছেলে সাদা দাঁত ঝিকিয়ে হাসে।

শ্রীর মুখে কালির পোঁচ। দুম দুম করে পা ফেলে সে ভিতরে চলে যায়। বিভাবরী ঠোঙাটা নিয়ে হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন।

( দুই )

স্নিগ্ধ এত জোরে বাইক চালিও না, আমার ভয় করে।

তীব্র হাওয়ায় আরশির আকুতি উড়ে গেল। স্নিগ্ধ বাইকের স্পিড আরও বাড়িয়ে দিল। ব্রিজের উপর দিয়ে বাইকটা উড়ে যাচ্ছিল যেন, নীচে দামোদর নদী তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে আরশির ভয় আরও বেড়ে গেল। আরশির সাদা ওড়নাটা পাখির ডানার মতো দুপাশে উড়ছিল।

লুকিং গ্লাস দিয়ে আরশির ভয় পাওয়া মুখটা দেখতে দেখতে স্নিগ্ধ চিৎকার করে ওঠে, তোমার উড়তে ইচ্ছা করে না আরশি? পাখির মতো ডানা মেলে?

এই স্নিগ্ধকে চিনতে পারে না আরশি। গম্ভীর প্রফেসর স্নিগ্ধময় মিত্র আর এই স্নিগ্ধ আকাশ পাতাল তফাৎ। হঠাৎ একটা ধাক্কা, বাইকটা ছিটকে পড়ে রাস্তায়। রক্তে ভেসে যাচ্ছে, রক্তের মধ্যে স্নিগ্ধ ছটফট করতে করতে স্থির হয়ে গেল। স্নিগ্ধর নাম ধরে চিৎকার করে উঠল আরশি।

স্নিগ্ধ এখনও তোর স্বপ্নে আসে? আমি তো ভাবলাম তোর পুরোটাই দখল করে নিয়েছে উজান। অন্ধকার ঘরে আরশিকে শুয়ে থাকতে দেখে লাইট জ্বালাতে এসেছিল শ্রী। সুযোগ পেয়ে খোঁচাটা দিতে ভুলল না।

আরশি ককিয়ে উঠল, দিদি, উজানদা আমার জামাইবাবু, তাকে আমি দাদার মতো শ্রদ্ধা করি।

হ্যাঁ তাই তো তেঁতুল খাবার শখ হলে উজানকে জানাস, বাড়িতে দুজন মেয়েমানুষ থাকা সত্ত্বেও। রাত্রে জল খাবার নাম করে তোর ঘরে আসে, আমি বুঝি জানতে পারি না?

স্তম্ভিত হয়ে যায় আরশি। এই তার প্রাণের থেকে প্রিয় দিদি? যার জন্য কিনা সে সমাজ, লোকলজ্জা, ভবিষ্যৎ কিছুর তোয়াক্কা করেনি? হ্যাঁ উজানদা, মাঝে মাঝেই রাত্রে ঘরে ঢুকে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থেকে চলে যায়, পাশে জেঠিমা শোয়। উজানদা এক অমোঘ টানে বারে বারে আরশির কাছে ছুটে আসে, কারণ ওদের সন্তান আরশির গর্ভে তিলে তিলে বেড়ে উঠছে। উত্তেজনা, উদ্বেগ অনাগত সন্তানের পিতা হিসাবে থাকা তো স্বাভাবিক। এটা তো দিদির মধ্যেও থাকা উচিত ছিল। দিদি এমন বদলে গেল কেন? আরশির চোখ দিয়ে জমাট মুক্তোর বিন্দু টুপটাপ করে ঝরে পড়তে লাগল।

( তিন )

ট্রাফিকে গাড়িটা অনেকক্ষণ আটকে ছিল। উজান মোবাইলটা হাতে নিয়ে আরশির বেবি বাম্পের ছবিটা দেখছিল। অনেক সাধ্য সাধনা করে ছবিটা আদায় করেছে। বাড়িতে কথা প্রায় হয় না দুজনের। তবে অফিস থেকে উজান অজস্র টেক্সট পাঠায়। প্রথম দিকে কৃতজ্ঞতার ভাগটাই বেশি ছিল। শ্রীর পরপর তিনটে মিসক্যারেজের পর আরশি এগিয়ে না এলে আজকের এই দিনটা আসতই না।

ডক্টর দুবে বলেই দিয়েছিলেন, এই কেসটা সলভ করা খুব সহজ না। আপনারা রাজি থাকলে সারোগেট মাদার খোঁজ করুন, চাইলে আমিও হেল্প করতে পারি। অভাবী ঘরের প্রচুর মেয়ে মোটা অর্থের বিনিময়ে একাজ করছে।

শ্রী আর উজানের স্বপ্ন অন্য সম্পূর্ণ অচেনা কারুর জঠরে প্রতিপালিত হবে? ওরা দুজনেই ব্যাপারটা মানতে পারেনি। দিশাহারা অবস্থা তখন ওদের। মা বরং আধুনিক মানুষ, বলেছিলেন, একটা বাচ্চা দত্তক নিলেই তো সমস্যার সমাধান হয়? আমাদের দেশে কত অনাথ বাচ্চা, একজনকেও যদি কাছে টেনে নিই ক্ষতি কীসের! বরং শিক্ষিত নাগরিক হিসাবে এটাই আমাদের কর্তব্য হওয়া উচিত।

বাবু, মালা নেবেন?

বাচ্চা ছেলেটা ফুলের মালা নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছিল। জানলার কাচে টোকা দিতেই উজান একটা জুঁইয়ের মালা কিনে নিল। তারপর কী মনে হতে দুটো মালা নিল। আসলে আরশি জুঁইফুল খুব ভালোবাসে। ওর ডিপিতে আজও স্নিগ্ধর সঙ্গে একটা ছবি আছে পরনে সাদা কেরালা কটনের শাড়ি, মুক্তোর গয়না, আর খোঁপায় জুঁই ফুলের মালা। ছেলেটাকে টাকা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই সিগন্যালের সবুজ আলো জ্বলে উঠল।

ড্রাইভ করতে করতে উজান ভাবছিল, কৃতজ্ঞতাটা একসময় মায়ায় বদলে গেল। মেয়েটার কষ্ট যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুকের মধ্যে কবে যে-টলটলে একটা মায়ার সরোবর তৈরি হয়ে গেল! আর এখন কি শুধুই মায়া! উজানের চাহিদা যে-আকাশছোঁয়া!

আরশি, এভাবে মন ভরে নাকি? বেবি বাম্প-সহ তোমার পুরো ছবি দাও। একথা বলল কেন কাল? আরশি কি কেঁপে গিয়েছিল! ওর আঙুল কি কয়েক মুহূর্ত থমকে গিয়েছিল কী প্যাডের উপর? নাহলে কিছু সময় পরে কেন উত্তর দিয়েছিল, এ হয় না উজানদা, আমাকে দেখতে চেও না প্লিজ।

জুঁইফুল? এ আমি পছন্দ করি না, গন্ধটা তীব্র লাগে। যার জন্য এনেছ তাকেই দিও। আর হ্যাঁ, এবার থেকে সব জিনিসই দুটো করে আনবে নাকি? চায়ের কাপ হাতে তুলে দিতে দিতে তাচ্ছিল্যে শ্রীর ঠোঁটটা বেঁকে গেল। বারান্দার টেবিল ঘিরে বাকি তিনটে মানুষ পাথরের মূর্তির মতো বসে থাকে। চায়ের কাপ শীতার্ত কুয়াশায় ঢেকে যাচ্ছে।

( চার )

আমি কিন্তু এই গরমে কোথাও যেতে পারব না, তাছাড়া পুজোর ভোগ রাঁধার জন্য ওই পারিবারিক পচা পুকুরে ডুব দিতেও পারব না। বাবার কাজের সময় ওখানে স্নান করে সারা গায়ে যা ইনফেকশন হয়েছিল! শ্রী স্পষ্ট জানিয়ে দিল সে গ্রামের বাড়িতে যাবে না।

এদিকে সাত মাসের পুজোটা পারিবারিক মন্দিরেই দিতে হয়, তেমনটাই বসু পরিবারের নিয়ম। বিভাবরী টের পাচ্ছেন পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে। তিনি এও টের পাচ্ছেন, শ্রী যত উজানকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, উজান আশ্রয় খুঁজছে আরশির মধ্যে। আরশিকে তিনি খুব একটা বুঝতে পারেন না, সারাদিন বই মুখেই কাটিয়ে দেয়। অল্প বয়সে স্বামীকে হারাল, সাধ আহ্লাদ ওরও কি নেই? নাহলে উজান শেষ মুহূর্তে নেপাল যাওয়াটা ক্যানসেল করল কেন? খুব ক্রিটিক্যাল অবস্থা তো না আরশির। তবু সেদিন রাত্রে শুয়ে মেয়েটা কেন বলেছিল, জেঠিমা, দিদিরা বারোদিন বাইরে থাকলে ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকতাম। উজানদা থাকলে ভরসা পাই। আজ খুব নিশ্চিন্তে ঘুমাব জানো তো! তার মানে ওদের না যাওয়ায় আরশির ভূমিকা ছিল?

সংসারে নতুন অতিথি আসছে, আনন্দে ভেসে যাওয়ার কথা কিন্তু সবাই থমথমে মুখে রোবটের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। শ্রী একদিন বলেই ফেলেছিল, এর থেকে বাচ্চা না হয় না-ই আসত।

শ্রীকে ওর মায়ের জিম্মায় রেখে ওরা সবাই কুসুমপুরে এসেছে। ওদের আসার খবর পেয়ে জীর্ণ বাড়িটা ঘষে-মেজে পরিষ্কার করে রেখেছে মানদা আর বসন্ত মিলে। সারা বছর জমি বাড়ি, ঠাকুরপালা ওরাই সামলায়। কালকে মা অন্নপূর্ণার পুজো। গ্রামেও এখন আধুনিকতার ছোঁয়া, টিভি সিরিয়ালের দৌলতে সারোগেসি ব্যাপারটা আর নতুন না। অনেকেই আরশিকে দেখে গেল। আরশিও আজ খুব খুশি, উজান সিঁড়ির অন্ধকারে টেনে নিয়ে প্রথমে ওর বেবি বাম্পে তারপর ওর ঠোঁটে চুমু খেয়েছে। আরশি আর উজানের চোখে স্বপ্ন উপচে পড়ছে। বিভাবরী, বউ-মেয়েদের সঙ্গে বসে পুজোর জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছিলেন।

উজান বলে উঠল, একটু চা হলে মন্দ হতো না।

বিভাবরীও বলেন, যা বলেছিস, আমারও মাথাটা ধরেছে কিন্তু এখন হাত জোড়া, একটু অপেক্ষা করতে হবে।

আরশি চা বানাতে উঠে যায় হাসিমুখে। রান্নাঘরে পা দেবার একটু পরেই বীভৎস চিৎকার আর তারপরেই ভারী কিছু পড়ে যাবার আওয়াজ। আরশির তেমন ক্ষতি না হলেও বাচ্চাটাকে বাঁচানো যায়নি।

আরশির নিজেকে বারেবারে দোষী মনে হয়েছে। বার্নারটা এমন দাউদাউ করে জ্বলে উঠল যে, সে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসতে গিয়ে চৌকাঠে হোঁচট খেল।

শ্রী আগের মতোই বোনকে কাছে টেনে নিয়েছে। উজান সিদ্ধান্ত নিয়েছে একটি শিশুকে দত্তক নেবে।

আরশি এখন অনেকটাই সুস্থ, হায়দরাবাদে নতুন অফিসে জয়েন করতে যাবার আগের দিন সবার সঙ্গে দেখা করতে এল।

বিভাবরীকে বারান্দার এক কোণে টেনে নিয়ে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, আপনি কেমিস্ট্রির ভালো ছাত্রী ছিলেন তাই না? অ্যাস্ট্রিঞ্জেন্ট লোশনের মধ্যে মিশে থাকা ইথানলের ফোঁটাগুলোই আমাদের কক্ষচ্যুত হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিল।

আরশির শীতল দৃষ্টির সামনে বিভাবরীর নিজেকে কক্ষচ্যুত এক নক্ষত্র মনে হল।

 

 

অল্প কথায় গল্প

ডেজার্ট

—বেশ তুমি যা ক্যারি করতে পারবে তাই পরো, নীলু।

—আশ্চর্য! এখানে ক্যারির প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে? শাড়ি পড়তে আমার ভালো লাগে, সুদীপ! যাও, আমি যাব না…

—আরে আরে… বেশ তোমার যেমন মন চায় তেমনই ড্রেস-আপ করে যেও। আর শোনো, আমাদের এই গেট-টুগেদার প্রতি বছরই হয়। অন্য সব রান্না কেটারাররা করে। তা বাদে ডেজার্ট রান্নার কম্পিটিশন হয়। সব অফিসারদের স্ত্রী-রা যে যার হাতের স্পেশাল ডেজার্টটি বানিয়ে নিয়ে আসেন। তুমি কী ডেজার্ট বানাচ্ছ শুনি?

—সারপ্রাইজ!

—ওকে, ম্যাডাম!

মাত্র ছমাস বিয়ে হয়েছে সুদীপ আর নীলাঞ্জনার। বিয়ে পর কোন্ননগরের কানাইপুর গ্রাম থেকে নীলাঞ্জনা সোজা এসে পৌঁছেছে মহারাষ্ট্রের হাইটেক সিটি পুনেতে। চারদিকে গগনচুম্বী অট্টালিকার জঙ্গল! সবাই যেন কী ভীষন ব্যস্ত! এই ছমাসের ভেতরে আজ সন্ধেতে প্রথম তারা এখানকর কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে যাচ্ছে।

—ওই দ্যাখ দ্যাখ, মিসেস সেনকে। কী গাঁইয়া গাঁইয়া সাজরে বাবা!… তারপরই হাসির ফোয়ারা ওঠে।

আড় চোখে তাকিয়ে নীলাঞ্জনা দেখে অত্যাধুনিক স্বল্পবসনা মহিলারা সব। তার মাঝে নীলাঞ্জনার এই বিষ্ণুপুরি বালুচরি শাড়ি, এক ঢাল খোলা চুলে রজনীগন্ধা— একটু বেমানান বই কি!

সুসজ্জিত হলটিতে ঢুকে নীলাঞ্জনা দেখে চারদিকে নারী-পুরুষেরা ওয়াইনের গেলাস হাতে প্লাস্টিক হাসি হাসছে! একটা সাদা টেবিল ক্লথে ঢাকা টেবিলে, কত্ত রকমারি ডেজার্ট রাখা! দেখে সে তো একেবারে থ! নামগুলোও লেখা আছে সব ক্যারামেল ব্রেড পুডিং, লেচে ফ্ল্যান, মিল্ক পুডিং, ব্ল্যাক ফরেস্ট ডেজার্ট, ব্রেড কাস্টার্ড পুডিং আরও কতো কী!

দুরু দুরু বুকে নিজের বানানো ডেজার্টের হাঁড়িটা টেবিলে রাখল নীলাঞ্জনা। হাঁড়ি দেখেই ওপাশের স্বল্পবসনাদের মধ্যে আবার হাসির রোল উঠল। গায়ে মাখল না নীলাঞ্জনা।

ডিনার শেষে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। সব ডেজার্টগুলো টেস্ট করার পর নীলাঞ্জনার হাঁড়ি থেকে একটা করে রসগোল্লা মুখে পুরে বিচারকরা তো সবাই ক্লিন বোল্ড আউট! ডায়াসে ঘোষক তখন ঘোষণা করছেন, ফার্স্ট হয়েছে নীলাঞ্জনা সেনের নলেন গুড়ের রসগোল্লা। নীলাঞ্জনার হাঁড়ি দ্রুত সাবার হতে থাকে আর হল ফেটে পড়ে হাততালিতে!

ভাগ্যিস আসবার সময় মা দুবোতল নলেন গুড় দিয়েছিলেন! ততক্ষণে উঠোনে বড়ো বড়ো লোহার কড়াইতে মায়ের খেজুরের রস জ্বাল দেওয়ার সেই মিষ্টি গন্ধটা ছড়িয়েছে নীলাঞ্জনার বুকের ভেতর!

 

মায়ের গন্ধ

 

Bangla story Mayer Gondho

বিয়ে হয়ে সান্যাল বাড়িতে আসার পর থেকে লাবণ্য বুঝতে পারল, এ বাড়ির সব কিছুই আলাদা। এদের খাওয়া-দাওয়া থেকে জীবনযাপনে সম্পূর্ণ আভিজাত্যের ছাপ। এই ছাঁচে যেন এঁটে উঠতে পারছে না আশরীর মধ্যবিত্তের খোলসে মোড়া শ্যামনগরের লাবণ্য। সেজন্য মাঝে মাঝে পাঁচফোড়নী কথাও শুনতে হয় তাকে।

এ বাড়িতে সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে ব্রেকফাস্ট টেবিলে নিঁখুত ভাবে সাজানো থাকে বাটার, টোস্ট, ডিম পোচ, কলা, কফি। খেয়ে বেরিয়ে যান কর্পোরেট সেক্টরের ম্যানেজিং ডিরেক্টর, তার স্বামী সুগত সান্যাল। তারপর বেরোন বিজনেস টাইকুন শ্বশুরমশাই আর দেওর। তারা চলে যেতে শাশুড়ি মায়ের নির্দেশে রান্না করে রাঁধুনি মালতি মাসি। লাবণ্যর শ্বশুরকুল পশ্চিমবঙ্গীয় বারেন্দ্র ব্রাক্ষ্মণ। তাঁদের রান্না-বান্নার ধরনধারণ আলাদা। নুন-ঝাল কম, রান্নায় মিষ্টি দেবার প্রবণতা।

মা-বাবাকে অকালে হারিয়েছে লাবণ্য। কাকুর অভিভাবকত্বেই এই বিয়ে তার। একটা হালকা বিষণ্ণতা সবসময় ছুঁয়ে থাকে তাকে। তার খুব ইচ্ছে হয় মাঝেমধ্যে জলখাবারে পাঁচফোড়ন সম্বার দিয়ে সাদা আলুর চচ্চড়ি আর লুচি খায়। ঠিক যেমন ছোটোবেলায় মা করতেন। কিন্তু লজ্জায় মুখ ফুটে বলতে পারে না। কে জানে, হয়তো গাঁইয়া ভাববেন এরা!

আনলক-১ শুরু হতেই আজ হঠাৎ বাড়িতে এসেছেন সোনা ঠাম্মা। শ্বশুরমশাইয়ের কাকিমা। কথায় তাঁর পূর্ববঙ্গীয় টান! উৎকর্ণ হয় লাবণ্য। মনটা হুহু করে ওঠে, স্মৃতির পাতা থেকে ভেসে আসে মায়ের মুখ!

বিকেলে গা ধুয়ে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশে অস্তরাগের রংবাহারি খেলা দেখছিল লাবণ্য। হঠাপাঁচফোড়ন সম্বারের গন্ধে ম ম বাতাসটা নাক ছুঁয়ে দিলে, চমকে ওঠে সে…মা! মায়ের গন্ধ! দৌড়ে যায় রান্নাঘরে।

এক গাল হেসে সোনা ঠাম্মা বলেন, বুজলা নাত বউ, পাঁচফুড়ুন সম্বারা দিয়ে হলুদ ছাড়া আলুর চচ্চড়ি রানতাছি। ছুডুবেলা থিকা আমার হাতের এই রান্নাডা তুমার শ্বশুরের বড়ো প্রিয়।

চোখ ঝাপসা হয়ে আসে লাবণ্যর।

 

মরূদ্যান

 

Story Morudyan

সুজিত ঠিকা শ্রমিক। দিল্লির গোকুলপুরীতে ঘিঞ্জি শ্রমজীবী মহল্লায়, বৃদ্ধ বাবা-মা-কে নিয়ে তার বসবাস। প্রতিবেশীরা হিন্দু, মুসলমান, শিখ হলেও তাদের আসল পরিচয় তারা শ্রমিক। সারাদিন ছাদ ঢালাইয়ের কাজ শেষ করে, সেদিন সন্ধেতে বাড়ি ফিরে সুজিত দেখল গোটা মহল্লা জ্বলছে। তাদের ঘর, ঘরের যাবতীয় জিনিসপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। আশেপাশের বহু ঘরই আগুনে ছাড়খার। চারদিকের ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে তাদের আধপোড়া আবাসন। দমকল নাকি চারঘন্টা চেষ্টার পর আগুন আয়ত্তে এনেছে।

এলাকাটা থমথম করছিল কদিন থেকেই। ঈশ্বর-ভক্তদের আনাগোনা খুব বেড়েছিল। ঈশ্বর ভক্তদের নিশানায় ছিল সুজিতদের আবাসনের নীচের তলায় মুসলিমদের তিনটি দোকান। তারা নাকি এনআরসি, সিএএ বিরোধী মিছিলে অংশ নিয়েছিল।

প্রথমে ওই তিনটি দোকান লক্ষ্য করে চলেছিল পাথর বৃষ্টি। তারপর ঈশ্বরের নাম নিয়ে দোকানগুলিতে আগুন ধরিয়ে দেয় ধর্মের ধ্বজাধারীরা। সেই আগুন বাড়তে বাড়তে একসময় দোতলায় সুজিতদের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। আগুন তো ধর্ম চেনে না। তাই তার লেলিহান শিখা পৌঁছে যায় সুজিতের মায়ের লক্ষ্মী ঠাকুরের আসনেও।

সুজিত দেখল চারিদিকে ছাইয়ে গাদায় শ্মশানের নীরবতা। আগুন নিভে গেলেও ঘর প্রচণ্ড তেতে আছে। আর তার মা-বাবা ঘরে নেই। আতঙ্কে সে ছুটে যায় তাদের বহুদিনের প্রতিবেশী ইকবালদের ঘরে। সেখানে গিয়ে সুজিত দেখে, চোখে ছানিপড়া তার বৃদ্ধ বাবা আর হাঁপানি রোগী বয়স্কা মাকে আগ্রাসী আগুন থেকে উদ্ধার করে, পরম মমতায় আগলে রেখেছেন ইকবালের মা আমিনা চাচি।

ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে সুজিত দেখতে পায় এক টুকরো মরূদ্যান।

 

দু’টি ভিন্নস্বাদের গল্প

ব্যাবসা-বৃত্ত

ইন্টারভিউ দিতে দিতে ক্লান্ত হতাশ সমীর। কী-ই বা করবে, ওকে তো মালিকপক্ষ জানিয়ে দিয়েছে যে, সামনের মাসেই ইস্তফা দিতে হবে।

বাজোরিয়া ড্রাগস-এ সেল্সম্যান-এর চাকরিটা ওর অনেকদিনের। তবে এই কোম্পানিতে ওর খুব সুনাম, বিশ্বস্ত কর্মচারী হিসাবে। মার্কেট থেকে অর্ডার তোলার ব্যাপারে সমীর এক নম্বর। ওর কাজে খুশি হয়ে ওকে অতিরিক্ত দায়িত্ত্ব দিয়েছিল মার্কেট থেকে বকেয়া টাকা কালেকশানের। ও অনেক অনেক টাকা মার্কেট থেকে কালেক্ট করে আনত সময় মতো মালিকপক্ষের হয়ে, তার জন্য ইনসেনটিভও পেত। সব মিলিয়ে ভালোই রোজগার হতো।

অলক মুখার্জি, মুখার্জি এন্টারপ্রাইজের মালিক। ওষুধেরই ব্যাবসা। এই মার্কেটেই অফিস। সমীরের একদম ছোটোবেলার বন্ধু। দুই পরিবারের মধ্যে যথেষ্টই ভালোবাসা, আসা-যাওয়া। অলকেরও প্রথমে ছোটো ব্যাবসা ছিল, এখন ব্যাবসা বৃদ্ধি ঘটেছে।

সমীরের চিন্তা বাড়ছে চাকরি নিয়ে ইদানীং সে লক্ষ্য করছিল মিঃ বাজোরিয়া ওর হাতে আর টাকা পয়সা ছাড়ছে না। ক্রমেই ও মনমরা হয়ে যাচ্ছিল। ওর স্ত্রী একদিন বলল, তুমি অলকদাকে বলে দেখতে পারো তো একবার।

ব্যস চাকরিও হয়ে গেল বলা মাত্র। শুধু অলক বলল, দ্যাখ তোকে অত টাকা এখুনি দিতে পারব না। তোকে একটা বুদ্ধি দিতে পারি বাড়তি উপার্জনের। তুই চাকরি ছাড়ার সময় যে-প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্র্যাচুইটির টাকা পাবি, সেটা একসাথে করে আমার কোম্পানিতে ইনভেস্ট করতে পারিস- তোকে আমি ব্যাংকের থেকে অনেকটাই বেশি সুদ দেব মাসে মাসে। তাতে তোর মাস গেলে আয় বাড়বে আবার আসল টাকাটাও খরচা হবে না, সুরক্ষিত থাকবে।

মুখার্জি এন্টারপ্রাইজের অর্ডার বাড়তে লাগল মার্কেটে আর বাজোরিয়ার কমতে থাকল।

একদিন পুরোনো অফিসের দুলালবাবুর সঙ্গে দেখা। দুলালবাবু ফস করে বলে বসলেন- এখন তো আমি রিটায়ার্ড, তাই নির্ভয়ে বলতে পারি, যত নষ্টের মূল আপনার ওই বন্ধুটি, অলক মুখার্জি। একদিন এসে বাজোরিয়ার কাছে ঢেলে নিন্দে করে গেছে আপনার। বলল, আপনি নাকি খুব ড্রিংক করেন, আপনার হাতে টাকাপয়সা না ছাড়তে।

ব্যস! সমীর অঙ্কটা চট করে ধরে ফেলল। ওর মার্কেট পপুলারিটি আর সেল্সম্যানশিপ স্কিল কাজে লাগিয়ে অলকের নিজের ব্যাবসা বৃদ্ধি, তাই বাজোরিয়া ইন্ডাসট্রিজ থেকে সমীরকে ভাঙিয়ে নেওয়ার সুযোগটা ও চট করে লুফে নেয়৷ ও যাতে চাকরি ছাড়তে না পারে, তাই নিজের কোম্পানিতেই বাড়তি উপার্জনের নামে ওর টাকাটাই কায়দা করে আটকে রাখে।

সমীর ড্রিংক করে না, তবে ওর আজ মনে হল, যদি ড্রিংক করে বন্ধুর এই প্রতারণা ভুলতে পারত!

  গল্প  :   দেবারতি ভট্টাচার্য

 

অন্তর্দৃষ্টি

 

Antardrishti story in bangla

 

ই-বুকের বর্ষা সংখ্যার জন্য সোমনাথের কাছে জমা পড়েছে প্রচুর কবিতা। এগুলো দেখা হয়ে গেলে যাবে এডিটিং-এ। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় রাতের নিস্তব্ধতাকে সঙ্গী করে সে পড়ে চলেছে কবিতাগুলো। মোটামুটি লেখাগুলো ভালোই, যেটুকু বাদ দিচ্ছে তা ওই ব্যাকরণগত ত্রুটি ও যতি চিহ্নের জন্য।

এর মধ্যেই মোবাইলে মেসেজের টুংটাং, লেখা এখনও জমা পড়ছে। ফোন নাম্বারও দেওয়া আছে, কোনও সমস্যায় ফোন করার জন্য। একটা লেখা সে সরিয়ে রেখেছে, কান্না নামের এই কবিতাটার আয়তন পরিসীমা সীমার লাইনের বাইরে হওয়ায়। সামান্য কমালে লেখাটা ঠিক হতো।

কিন্তু এভাবে সংশোধনের নিয়ম তো প্রকাশনা সংস্থার নেই। এসে যাওয়া মেসেজগুলো চেক করে দেখল, একই নাম্বার থেকে এসেছে, যে কান্না কবিতাটা জমা দিয়েছে। কথার ভিড়ে বাকি কবিতাগুলো হারিয়ে না যায়, সে সন্ত্রস্ত হল! অনুরোধ জানাল ফোন করার জন্য যদি কান্না কবিতাটাকে কোনও ভাবে নিয়মে আনা যায়। এদিকে ও-প্রান্ত থেকে ফোন তো ধরলই না, উলটে একের পর এক মেসেজ আসতে থাকল।

সোমনাথ ক্লান্ত হয়ে নিজের কাজে মন দিল। কৌতূহল বশত কান্না কবিতাটার প্রেরকের ঠিকানাটা দেখতে গিয়ে দেখল, ডেফ অ্যান্ড ডাম্ব হোম দমদম। এতক্ষণে সে বুঝতে পারল ফোন না ধরার কারণটা। হোয়াটস্অ্যাপে লিখল তোমার কবিতাটা ষোলো লাইনে করে দাও, তাহলে ছাপবার অসুবিধে হবে না, ভালো থেকো।

ও-প্রান্ত থেকে একটা সুন্দর স্মাইলি এল। ওই স্মাইলির আড়ালে সোমনাথ তার নির্বাক পৃথিবীর হাসিখুশি মুখটা দেখতে পেল।

              গল্প  : সুতপা রায়

নিতাইধনের উড়ান

এক

চিনতে কততি হবে না। মাস তিনেক আমি সামলে নেবানে। তিন মাস বেশ লম্বা টাইম। তদ্দিনে মরা বাপ-মাকেই লোকে ভুলি যায়। আর পুলিশ তো পরের দিনই দেকতি পায় না, চোখ উলটি দেয়। না হলি এত এত মরা মর্গ জুড়ে পড়ি থাকে! বড়োবাবু ছমাস পর্যন্ত রাকেন, তারপর একসাথে জড়ো করি জ্বালায় দেন।

বিশে এক লপ্তে অনেকখানি কথা বলে ফেলে হেলেপড়া বটতলায় বসে আবার একখানা বিড়ি ধরাতে চেয়ে হাত পাতল। দুপুর বেশ খরখরে। সকালে দুটো বডি বেরিয়েছে। পার্টি তাগড়াই ছিল। নেবার কালে পাঁচশো করে দিয়েছে। কিন্তু আজ আর একটা দুটো পাঁচশোর পাতি হলে ভালো হয়। আজ রাতে ঝুমরোর ডাক আছে। সেই চেতলার ব্রিজের তলায় হনুমান মন্দিরের পাশের বস্তিতে যেতে হবে। সে কবে থেকে একখান ট্যাঁকে গোঁজা ফোনের কথা কচ্ছে কিন্তু কিছুতেই জুত করতে পারছে না বিশে। তার মনে হচ্ছে, হয়ে যাবেনে আজ। আর নেপাদা শুধুমুধু তো কথা খসাচ্ছে না। সে-ও খানিক অ্যাডভ্যান্স দেবেনে মনে হয়। হাজার দুয়েক হলি আর দেখতি হবে না। আজই ঝাক্কাস একখান ফোন হাতে দাঁড়ালে ওই শাপলার নালের মতো সুন্দরী তারে বুকে টানে নিতি বেশি ভাববে নানে।

বিশে, তুই বলছিস যখন, কাজটায় এগোই। কী বলিস?

সত্যি সত্যি ভাবনা মিলে যাচ্ছে বিশের। নেপাদার হাতে নতুন দু’হাজার টাকার পাতি। ছোঁ দিয়ে তুলে নিতে নিতে বলল, তুমি চিনতে কোরো নাকো। তোমাকে এখানে আমি ঠিক নুইক্কে রাখব। তোমার বাপটা থানায় ডাইরি করবে আনে। ব্যস, কাম ফতে!

পুলিশের কাছে মিসিং ডায়েরি করার পর তো আমার কাম ফতে হবে রে বিশে ! পুলিশ হাত ধুয়ে মার পেছনে পড়ে যাবে৷আমার মোবাইল ট্র্যাক করবে৷শ্মশানঘাটের চুল্লির ভেতর থেকেও টেনে নিয়ে চলে আসবে৷

কী ছেরাদ্দর কতা কইছ ন্যাপাদা! পুলিশের খেইয়ে দেইয়ে কাজ নেই যে জোয়ান মদ্দ ছেলে হারায়ে গেলি খুঁজতি যাবেনে! মেয়েমানুষ হলি খানিক কতা ছেল। তাও তো নয়।

নে বিড়িটা ধরা বিশে। কামধেনু বিড়ি। একটু কড়া হবে। ধরা ধরা।

দু’জনের খোসগল্প আর বিড়ির ধোঁয়ায় বটগাছতলায় একখান মেঘ উঠল। মেঘের উপরে বৃষ্টি নেই। শুধু দুপুরই দুপুর। ন্যাপাদা বলল, বিশে, সেই কোন ল্যাংটোবেলা থেকে তুই আমার বন্ধু। তোকে না বলে কোনও কাজই আমি যে কেন করতে পারি না!

কাঁটাপুকুর মর্গের এগারো বছরের স্থায়ী চাকুরে ডোম বিশে বাগদি বড়োলোক বন্ধুর এই প্রশংসায় না ভিজে পারে না। সে চোখ পিটপিট করতে করতে বন্ধুর চোখে চোখ রেখে তাকে মাপে। মনের ভেতর ভালোলাগা লালা ঝরায় তখন।

এই যে দ্যাখ একটা সাদামাটা খুন করব, তাও তোকে বলছি। তোর কাছ থেকে সায় না পেলে মনে জোর হয় না রে বিশে।

আজ যেন ন্যাপাদা বিশেষ আবেগময় হয়ে আছে। সব কথা গলগল করে কইতে লেগেছে চা-র দোকানের কাঠের লম্বা বেঞ্চে বসে। তাদের বেঞ্চে অন্য কোনও লোক নেই। তাছাড়া ভরদুপুরে এমনিতেই এই চত্বরে মানুষজন কম। ন্যাপাদা কথা চালায়।

বিয়ে করার আগে তোর সাথে শলা করেছি, তোর মনে আছে? আবার সেই বিয়েকরা বউ মালতিকে সালটাতে যাবার আগেও তোর শলা নিলাম। তোর বুদ্ধির উপর আমার বেশ ভরসা রে বিশে। তুই বললি বলেই তো পাতাখোর ছিদাম গুঁইকে দিয়ে আমি মালতির পেট চিরে মাতলায় ফেলেছিলাম। পেট চিরে লাশ জলে ফেললে যে ভাসে না, তা জানতাম নাকি!

বিড়িটা হেবি কড়া ন্যাপাদা। মগজে গিয়ে ঘাই মারতিছে। তবে কতিছি কি, এবারে আর তোমারে বিপদের ধারে-কাছেও যেতি দেব নানে। বুক দে আগলে রাখব আনে।

হ্যাঁ রে সত্যি! সেবার প্রায় ফেঁসে গেছিলাম আর কী! আমার মোবাইল-এ মালতির কল ছিল। ভাগ্যিস লাশ পাওয়া যায়নি। তিন দিন থানায় রেখে খানিকটা ঠুসেছিল। কিন্তু এক বাপের ব্যাটা আমি। মুখ খোলাতে পারেনি। কোর্টে নব্বই দিনের মধ্যে চার্জশিটই জমা দিতে পারল না। তবে তাতে হাবুলদা-র হাত দিয়ে থানাকে হাজার দশেক খাওয়াতেও হয়েছিল।

গুরু শোনো। ঝ্যাকোন তোমার ইস্তিরিকে মারতি গিছিলে বড্ড তাড়াহুড়ো ছেল। এবার সময় নিয়ে সাজিয়ে গুছিয়ে করতি হবে। আরে খুন করা একটা আর্ট। তা শিখতি হয়, জানতি হয়। এ লাইনে যে যত বড়ো শিল্পী তার তত দর।

ন্যাপাদা বিশেকে বলতে দেয়। সে যেন ভাজামাছ উলটে খেতে জানে না এমন ভঙ্গি করে বিশের মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে থাকে। ন্যাপাদা জানে বিশে একটু বকতে পারলে খুশি। তা তার খুশিতে বাগড়া দেবার দরকার কী! তাছাড়া এবার বিশের সাহায্য খুবই দরকার ন্যাপাদার। খুনের আগে পরে লুকিয়ে রাখা, বাবাকে দিয়ে মিসিং ডায়ারি করানো, নতুন সিম ভরা মোবাইলে অনেক অনেক কাজ। এসবের জন্য একদম কাছের একটা লোক দরকার। আর তা ডোম বিশে হলে সোনায় যে সোহাগা তা জমি, বাড়ির দালাল ন্যাপাদা বেশ ভালোই জানে।

বিশে বিড়ির শেষটুকুতে ফুস ফুস করে জোরালো দুটো টান দিয়ে বলতে থাকে। ধরো তুমি নিজেই নিজেরে সুপারি দেচ্ছ। তুমিই মালিক, তুমিই কর্মচারী। দু-দু’খান কাজ করতি হবে তোমারে। খুব যত্নের কাজ। ওই যে যেরাম ক্যারামবোর্ডের এদিক থেকে পোঙা ঘষটে গিয়ে একবার সাদা গুটি আবার উলটো দিকে ফিরে আসি কালো গুটিরে প্যাঁদাতে হয়, ত্যামোন। কাউকেই ছাড়ি দেয়া যাবে না।

ন্যাপাদা চায়ের দোকানির দিকে ফিরে আঙুল দিয়ে আরও দুটো চায়ের অর্ডার দিয়ে রংচটা ময়ালামাখা প্লাস্টিকের টেবিলের উপর কনুই-এর ভর রেখে হাতের তালুতে মুখ মেলে বেশ জাঁদরেল একটা মনোযোগী পোজ দিল। বিশে বলে চলেছে তার কথা।

হ্যাঁ, এক নম্বর কাজ হল গে, খুনের বরাত দেবার সময় সব ইনফর্মেশন আর মোটিভ যত্ন করি খুনিরে বলি দেয়া। আর খুনের পরে নিজেরে বোকা পাঁঠার মতো সাজ্যে রাখা। মানে তুমি যে গোবেচারা ভালোমানুষের পো, তা যেন জনে জনে কতি থাকে।

ন্যাপাদার বিড়িও ফুরিয়ে এসেছিল। সে হাতের নিভে যাওয়া বিড়ির টুকরো রাস্তার ধারের কালো নিকাশি খানার ভেতর টিপ করে ছুড়ে ফেলে দিতে সক্ষম হয়ে, বেশ একটা হিরো হিরো ভাব খায়। জিন্সের পকেট থেকে ধবধবে সাদা ভাঁজ করা রুমাল বের করে পুরু ঠোঁটের উপর বিড়ির কশা দাগ মুছে দিতে বার দুয়েক ঘষে। বিশের ঢ্যামনা মার্কা মুখের উপর সে রুমাল ঝেড়ে আবার ভাঁজ করে প্যান্টের হিপ পকেটে রেখে দিতে দিতে নিজের গুরুত্ব বোঝায়।

ঠিক বলেছিস বিশে। এই কাজটা এক্কেবারে নিখুঁত করে করতে চাই। শালা ঘাটের মড়া বাবাটারে খচ্চা করে দিতে পারলে ওই ভাঙাচোরা চুন-সুড়কি, কড়ি-বরগার বন-বাদাড় নিকেশ করে একখান স্বর্গের ইন্দ্র-বাড়ি বানাতে পারব। তাই পা মেপে মেপে এবার কাজ করছি। বউ মালতিদের সম্পত্তি হাতাবার সময় একটু কাঁচা ছিলাম। এখন বুদ্ধি আমার বেশ পেকে গেছে রে!

বিশে গামছা দিয়ে পিঠের মাছি সরাতে সরাতে বলে, হ্যাঁ, বলো দিনি কিরাম ভাবিছ বরাত দেবার জন্যি! এট্টুস শোনাও। ফাঁকফোকর থাকলি আমি ভরে দেবানে।

ভাবা-টাবার জায়গায় আর নেই রে! এখন কত তাড়াতাড়ি কাজটা নামানো যায় তাই দেখার। তুই-ই বল আমার পাঁচ-সাত কোটি টাকা আটকে আছে এখানে! তিন বিঘের এই জমিটাতে কম করে পাঁচটা টাওয়ারের কমপ্লেক্স উঠে পড়বে। এক একটা টাওয়ার থেকে কম করে এক-দেড় কোটি নাফা আসবেই। তো বাপ শালাটাকে আর কদ্দিন বাঁচিয়ে রেখে আমি নিজেকে ঠকাব, অ্যাঁ! সে তো ওই ভাঙা বাড়িতেই ডবকা শালিকে নিয়ে নিজে মস্তি মারছে। এদিকে ছেলেটা যে মাস ছয় হল বউ হারিয়ে বিবাগি হতে বসেছে, সে খেয়াল আছে তার!

ঠিক বলেছ ন্যাপাদা। ঝে খুন করাবে সে ঝ্যানো মনের ভেতর থে হইচই করি ডাক পায়। খুব জোরাল হতি হবে খুন করানোর মোটিভ। নরম-সরম হলি কাজ কমপ্লিট হবে না, সব কুবোকাত। তোমার দেখছি দু-দুখানা মোটিভ আছে। খুনের জন্যি একদম পাক্কা সওয়াল করিছ। পেছু হটার কোনও উপায় নেই।

ন্যাপাদা মেয়েছেলে দোকানির হাত থেকে চায়ের গেলাস নামিয়ে টেবিলের উপর রাখতে রাখতে, বিশের দেয়া নম্বর নিজের পিঠে যোগ করে বেশ ভারি হয়ে ওঠে। কথায় সেই ওজন ধরা পড়ে। নে বিশে, চা ধর। বিস্কুট খাবি? বাপুজি কেকও খেতে পারিস। ঘুগনি মুড়িও আছে। যেটা খুশি।

বিশে বিড়িটা খেয়ে বেশ মেজাজে আছে। সে তা নষ্ট করতে চায় না। চা-এর সাথে অন্য কিছু না নিয়ে সে কথার সংযোগ রাখে। বলে, এবার হল গে দুই নম্বর কাজ। মানে ধরি নাও, তুমি খুনের বরাত পেয়ে গেছ। মানে খুনি হিসেবে ইদিক-উদিক, ঠিক-বিঠিক ভাবতি হবে। মানে কাজের আগে মনের ভেতরে নানা গলিপথ সড়কপথ ধরে ঘুরিফিরি রেকি করা আর কী! মানে কোনও ক্লু না রেখে, পুলিশকে ঘোল খাইয়ে কাজ হাসিল করার ছক কষা।

খুন তো আমি করে ফেলব রে বিশে। কিন্তু সমস্যাটা হল গে তারপর পুলিশ যেন দুয়ে দুয়ে চার না করে! মানে পরদিন খবরের কাগজে তিন নম্বর পাতার পাঁচ নম্বর কলমে হয়তো লেখা হল, সম্পত্তির লোভে বাবাকে খুন। আজকাল মিডিয়া এমন উসকে দেয় পুলিশকে যে কুচো চিংড়ির মতো পুলিশ লাফাতে থাকে।

ধইয্য ধরো গুরু। এইখানে তো আমি আমার খেল দেখাবানে। প্রথমে এক মাস হারায়ে যাও। লোকে জানবে তোমারে পাওয়া যাচ্ছে না। তারপর কাজ সালটে আরও এক মাস গোপনে থাকতি হবে। শেষকালে ভাদোর মাসের পর আশ্বিনে পুজোর সোরগোলের ভেতর সন্ন্যাসীরাজার মতো ফিরে এসে বাড়ির জমি-দলিল নিজের করি নিতি হবে। ব্যস! এই কয়’মাস আমি তোমাদের বাড়ি নজর রাখব আর তোমার নুক্কে থাকার দেকভাল করি দেব।

কিন্তু বিশে, তোর তো চাপ বেড়ে যাবে রে। একদিকে আমাকে লুকিয়ে রাখা আবার অন্য দিকে আমার বাবাকে দিয়ে থানায় মিসিং ডায়ারিটা করানো, খুব সহজ কাজ নয়। আমার বাবাটা যা একখান খচ্চর মাল! সে বলে বসতে পারে, হারিয়ে গেছে তো আপদ চুকেছে। আর থানা-পুলিস হ্যাপা করতে হবে না।

মেজাক ঠান্ডা রাকতি হবে ন্যাপাদা। বাড়ি নিয়ে অতশত ভেব না তো! মেশামেশাই-এর সাথে আমার যা সম্পক্ক, ঠিক সালটে নেব। দরকারে দুটো হুইস্কির বোতল পেন্নামি ঠুকে দেবানে! ও তুমি ভেবোনিকো। আর তুমি তো কঞ্জুষগিরি করতিছ না। মাল পটাপট ছাড়তিছ। এই তো দু’হাজার দিলে, আবার দেবে। আমি তার থে এট্টুস খরচাপাতি করতে পারব না! পারব পারব।

তুই পারলে আমিও পারব। কাচের গেলাসের শেষ নিংড়ে গলায় তিতকুটে লাল চা-টুকু চালান করে দিতে দিতে বিশের মুখের কাছে মুখ এনে ন্যাপাদা ফিসফিসায়।

দোকানি দু’একবার দুই পুরুষমানুষের ওরকম ঘন তাকান আর ফিসফিসানি নজর যে করেনি, তা নয়। ওরকম চোখে চোখে কথায় যে শরীর সিরসির করে, সে জানে। এ-পাড়ার চোলাই বেচা জোয়ান ছেলেটা, ওই যে হারান, মাঝে মাঝে একটু বেশি রাতের দিকে এসে অমনি করে। ছেলেটা ভালো। একফোঁটা চোলাই নিজে খায় না। খানিক টাকাকড়িও করেছে। চায়ের গেলাস নিতে এসে হাত ছুঁয়ে দিয়ে ফিসফিস করে। বলেও তো, ওই বুড়ো হার জিরজিরে লোকটা তোকে কী দেবে! কিছু দিতে পারবে না। চল পালাই।

কিন্তু দোকানি মনে মনে ওই ভালোলাগা কথাগুলোকে শুধু আওড়ায়। পালায় না। ওটুকু ভালোলাগা সে কৃপণের মতো সঞ্চয় করে রাখে। খরচ করে না। সে এখন সেরকম ফিসফিসানি যেন টের পাচ্ছে ওই দুই দামড়া লোকের কথায়। দোকানে অন্য খদ্দের আছে, অত সময় কোথায় কান পেতে শোনার! থাকগে, বলুক গে। তার মনে হয়, এ দুটোই বুঝি জমির দালালি নিয়ে কথাবার্তা কইছে। সব দালালেরা ওরকম করে।

ন্যাপাদা ছুকরি দোকানির দিকে এক ছুঁক তাকিয়ে বোঝে সে পাশে দাঁড়িয়ে কথা শুনছে। খানিকটা অস্বস্তি হয়। কথা থামিয়ে দুটো গেলাস-ই দোকানির হাতে ধরিয়ে জায়গা হালকা করাতে চায়। তারপর দোকানি চলে গেলে আবার কথা শুরু করে। হ্যাঁ, যা বলছিলাম রে। এক মাস তোর এখানে লুকিয়ে থেকে একদিন রাতের অন্ধকারে গিয়ে বাবাটাকে সালটে দেব। তারপর আবার এখানে ঢুকে পড়ব। মাসখানেক এখানে কাটিয়ে একদিন দূরে কোথাও ট্রেনে পকেটমারি-টারি করে ধরা পড়ব।

বিশে টেবিলে একটা নরম করে ঘুসি মেরে বলল, দারুণ! দারুণ ছক তোমার। তবে দেকে নিও ধরা দেবার সময় সিকেনে ঝ্যানো পুলিশ থাকে। নালে পাবলিকের ঝাড় খেয়ে সগ্গে গেলে আমার ফ্ল্যাটে থাকার স্বপ্নের প্যাট খসে পড়ে যাবেনে।

না না তুই চিন্তা করিস না। আমার কাছে তো মাল পাবে না। শুধু পকেটমারির অভিনয় করব। আর বিনা টিকিটের যাত্রী হব। দুটো কেসে সাকুল্যে মাসখানেকের জেল। একমাস জেল খাটব। তারপর ফিরে এসে পাল সাম্রাজ্যের আমিই অধিশ্বর। আর হ্যাঁ বলে রাখছি, লেখা-পড়া করেই দেব তোকে দু’কামরার একখান ফ্ল্যাট। সেখানে তুই নিয়ে আসতে পারবি চেতলার ওই মাগিটাকে।

বিশে অবাক হয়ে লজ্জা পেতেও ভুলে যায়। ন্যাপাদার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। সে জানল কী করে!

হ্যাঁ, আমি জানব না কেন রে!

হকচকিয়ে যাওয়া বিশের মুখের উপরে হাত নেড়ে তার ঘোর ভাঙাতে চায়। আর মুখের কথা সরে গেছে দেখে, ন্যাপাদা বিষয়টা নরম করতে গিয়ে আরও খানিক বলে, একটু রাতের বেলায় ইয়েছিয়ে করবি। মানে মস্তি-টস্তি করবি। তাই তো তোকে দু’হাজার টাকার নোটটা দিলাম রে! যা, একটু সিনেমা-টিনেমা দেখে ফুরফুরে হয়ে নে। পরশু থেকে তো আবার আমার দেখভাল করতে হবে! চাইলেও কোথাও যেতে পারবি না।

ও তুমি চিনতে কোরো না গুরু। তোমারে ভালো রাখার দায়িত্ব আমার। গদগদ স্বর বিশের। ধরা পড়ে যাওয়ার পর নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টাও যে এটা, তা বিশের অঙ্গভঙ্গি থেকেও বোঝা যায়।

আর হ্যাঁ বিশে, বাবার লাশ তো পুলিশ এই মর্গেই আনবে। তুই আমাকে একবার ট্রে নাম্বার জানিয়ে দিবি। ভেতরে বসেই পেন্নাম-টেন্নাম ঠুকে শ্রাদ্ধ-শান্তি করে নেব।

তা গুরু, খালাস করার ভাবনাটা ভাবিছ? মানে কীভাবে খুনটা করতি চাও! মানে কতিছিলাম ম্যালা ফ্যাচাং যেন না হয়। মানে খুনের আগে পরে তোমাদের বাড়ির কেউ যেন তোমারে দেখতি না পায়।

হ্যাঁ, আগে পাশের ঘরে বাপের শালিকে মারব মুখে বালিশ চেপে। তারপর বাপকে মাথায় এক সাবলের বাড়ি মেরে ভবের জ্বালা মিটিয়ে দেব। আর দুটোরই কাপড়-চোপর এমন এলোমেলো করে রাখব যে লোকে ঘরে ঢুকে ওদের দিকে তাকাতে লজ্জা পাবে।

বিশে একটু অবাক চোখে চেয়েছে। মানে নিজের বাবা আর মাসিকে ওরকম ন্যাংটোফ্যাংটো করে বাইরের লোককে দেখাবার দরকার কী, সে বুঝতে পারছে না।

ন্যাপাদা বিশের ভাবনা বুঝতে পেরে বলে,  খুনের মোটিভকে ঘুলিয়ে দিতে হবে না! লোকে চট করে যেন অন্য ভাবনায় চলে যায়। মানে ধর ওই সেক্সুয়াল ভাবনায় গেলে আর সেখান থেকে লোকে বের হতে পারে না। মানে ভাবনাটা শরীর দিয়ে ঘুরপাক খাবে। নানা গল্প বানাবে। বুড়ো বাপের চরিত্র নিয়ে কথা তুলবে। কেচ্ছায় কেচ্ছায় নানা রঙের মিলন হবে। খুনের কথা লোকে তেমন ভাববে না। সন্দেহের তির চোরা স্রোতের ভেতর ঘুরতে থাকবে। বুঝেছিস!

গুরু, তোমার এলেমের তুলনা নেই। গার কাপুড় হটায়ে পোগ্রাম একদম সড়সড়ে করে দিছ গো!

আরে এমনিতেই তো দুটোই নিয়ম করে, মানে আমার বাবা আর মাসি রোজ রাতে মালটাল খেয়ে ওইসব করে। ওদিনও শেষবারের মতো সেসব করবে। তারপর আমার কাজ সেরে, আলমারি ভেঙে কিছু গয়না আর টাকা হাতিয়ে দোতলার জানলার ভাঙা রডে শাড়ি আর ধুতির দড়ি ঝুলিয়ে নেমে আসব। শোন, চাইলে তোকে একখান বিছেহার দিয়ে দিতে পারি। তুই বরংচ আমার হয়ে তোর ওই চেতলার বস্তির ছেমড়িকে সেটা উপহার দিয়ে দিস। আর বাকিগুলো আমার থাকবে। এই কেসটা সালটে নিতে পারলে, ভাবছি আবার একটা বিয়ে করে ফেলব। একা একা কাটানোটা বেশ টাফ্ রে।

দুই

 প্রথম চোটেই ঘুম এসে গেছে। হলদেটে আলোয় ঘেরা চওড়া প্যাসেজ। মর্গের ভেতরটা সাদা টাইলস-এ বাঁধানো। তকতকে পরিষ্কার। কোথাও ময়লার ছিটেফোঁটা নেই। বিশেকে বলা ছিল ভালো করে ট্রে যেন পরিষ্কার করে। বরফ-টরফ ফেলে দিয়ে অগুরু-টগুরু দিয়ে যেন জায়গাটা ফুরফুরে রাখে। পই পই করে বলেছে, আরে মরা মানুষ না জ্যান্ত লোক শোবে। তার মতো ব্যবস্থা করবি।

এখানে ঢোকার আগে বিশের সাথে অনেকটা মাল টেনেছিল ন্যাপাদা। শুয়োরের মাংস আর পরোটাও সেঁটেছিল। বিশে বলছিল পেট ভরাট থাকলে মন চলবে না। মন না চললে ভয়-ভীতের সম্ভাবনা কম। আর মালের গুঁতোয় এক ঘুমে রাত কাবার হবে। ভোর ভোর আমি তোমাকে ট্রে থেকে নামিয়ে মর্গের টয়লেটে পাঠিয়ে দেব। সেখানে হাগা-মোতা স্নান সেরে, চা-টা খেয়ে আবার নিজের জায়গায় সেঁধিয়ে যাবে এ তল্লাটে কেউ আসার আগেই। দুপুরবেলায় ওখানে শুয়ে শুয়ে খাবে। এক ফাঁকে আমি খাবার পৌঁছে দিয়ে আসব। রাতের বেলায় সবাই চলে গেলে তোমাকে বের করে এনে আবার মদ আর খাওয়া-দাওয়ার মস্তি। সমস্যাটা প্রথম রাত নিয়ে জেগে উঠলে আবার ভয়-টয় পেও না।

ভয় পাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই। পকেটে বিদেশি পয়েন্ট বত্রিশ বোরের পিস্তল সব সময় থাকে ন্যাপাদার। ভূত-ফুত ব্যাপারটাই ভূতুড়ে। সব মনের দুর্বলতা। আর ন্যাপাদা অমন দুবলা মন নিয়ে জন্মায়নি। এখনও মনে আছে পুরুলিয়ায় গিয়ে হোটেলে সেই মাগিটার ছ্যাঁচড়ামোর কথা। কলকাতা থেকে তিন দিনের কড়ারে নিয়ে গিয়েছিল। বিছানায় শুয়ে টাকা টাকা করে খুব চিৎকার করেছিল সে মাগি। আর ধৈর্য রাখতে পারেনি ন্যাপাদা। গলা টিপে ধরে চ্যাঁচানি জন্মের মতো খতম করে দিয়েছিল। কিন্তু বিছানায় রাতের মস্তি কী করে হবে! কলকাতা থেকে গাড়ি ভাড়া করে গিয়ে শেষমেশ মস্তি হবে না! তখন ওই মরা মাগিটাকেই ন্যাংটো ফ্যাংটো করে সারা রাত ধরে যা করার করেছিল সে। তারপর সকাল বেলায় মরা মাল ট্রলি ব্যাগে পুরে হোটেল থেকে বেরিয়ে ধা। আসার পথে ড্রাইভারকে পানমশলা আনতে দূরে পাঠিয়ে পাহাড়ের উপর থেকে জঙ্গলের ভেতর ট্রলিব্যাগের মায়া কাটিয়েছিল। মানে মাগিটাকে ব্যাগশুদ্ধ শান্তিস্বর্গে পাঠানো। তারপর পান পরাগে গা গরম করে নেয়া ছাড়া বিশেষ কিছু করতে হয়নি।

এখানে কেউ এসে হুজ্জতি করলে দান ছেড়ে দেবে না ন্যাপাদা। মেরে দেবে। কিন্তু গলাটা চেনা চেনা লাগল যেন!

কী যেন একটা মিষ্টি গন্ধও নাকে এসে লাগছে। ন্যাপাদার এই গন্ধটা চেনা। চোখ বন্ধ করে বুক ভরে সেই মিষ্টি গন্ধটা নিচ্ছে সে। কী যে মন আকুল করা সে গন্ধ! ন্যাপাদা পাশ ফিরে মশারির ভেতর শুয়ে আছে যেন।

অনেক রাত। জানলা দিয়ে জ্যোত্স্না এসে এমন রামপুরহাটের বন বাংলোর ভেতরের দোতলা ঘরটাকে ভাসিয়ে নিচ্ছে! ন্যাপাদার মনে হল সে আকাশে উড়ছে। তার নতুন বউটিও তার সাথে হাওয়ায় ভাসছে। তারা দু’জনেই তো পোশাকবিহীন তখন। এক একটা শাল, পিয়াল, সোনাঝুরি, ইউক্যালিপটাসের মাথায় তারা সামান্য একটু বসে জিরিয়ে নিচ্ছে। আবার হাত ধরাধরি করে উড়ে যাচ্ছে। মহুয়াফুলের হলদেটে সাদা রং মালতির বড়ো করে বাঁধা খোঁপায় জোনাকির মতো গুঁজে দিতে ইচ্ছে করল।

মহুয়া গাছের গায়ে হাত বুলিয়ে তারা গাছকে শুধোল, গাছ তোমার কাছ থেকে দুটো ফুল নিই? রাগ কোরো না।

নিতাইধন, কী গো রাগ করেছ!

হ্যাঁ এই গলাটা চেনা তো! আরে এই নাম তো সে ভুলে গেছে। এই পিতৃদত্ত নামে কে এমন করে ডাকে! কে! সে যে কী করে নিতাইধন থেকে ন্যাপাদা হয়েছে আজ আর তা মনে নেই। এমন ভালোবাসা মাখিয়ে তার হারিয়ে যাওয়া একান্ত নিজের নামটা কানে আসতে কেমন যেন আচ্ছন্নতার ঘোর। প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে।

নিতাইধন, রাগ কোরো না। কতদিন আমরা একসাথে উড়ি না। এসো উড়বে। নীল ঘুড়ি, লাল ঘুড়ি আকাশে একসাথে উড়ছে। ফিসফিস করে সোঁ সোঁ হাওয়ায় কথা কইছে। দেখোনি তুমি! আমাদের রামপুরহাটের হানিমুন মনে পড়ছে না! চলো নিতাইধন আমরা আবার উড়ি।

হ্যাঁ, তার গলা। সে। সে যে মালতি বউ। বড্ড সুরেলা ছিল তার দেহ। মাচার উপরে উঠে পুঁইডগা যেভাবে ডগমগায়, সে-ও তো তেমন করে বাইকের পেছনে বসে ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে উড়ে যেত। নিতাইধনের পিঠে খিলখিল করে হাসত তার যৌবন।

ন্যাপাদা চোখ খুলতে চাইছে, কিন্তু পারছে না। দেখতে তো হবে মালতিকে। এখানে কোথা থেকে এল! দুটো স্লিপিং ব্যাগের ভেতর ঢুকে আছে বটে, কিন্তু তাতে ঠান্ডার প্রকোপ কম হলেও লাগছে। হাত দিয়ে চেনটা না খুললে মালতিকে ছোঁবে কী করে!

নিতাইধন, তোমার পিঠের নীচে আমার একটা প্রিয় জিনিস রয়েছে। একটু পাস করো না।

হ্যাঁ, ন্যাপাদার মনে হল, পিঠের নীচে কী যেন একটা খোঁচা খোঁচা লাগছে। সত্যি তো। ওটা নেবেই বা কী করে! তার এই ধুমসো শরীর সরিয়ে সে নেবে বা কী করে! ন্যাপাদা কাত হয়। চোখ খোলে না। বুকের উপরে থাকা স্লিপিং ব্যাগের চেন খুলে হাত বের করে। তারপর পিঠের নীচ থেকে গোলাকার একটা বস্তু বের করে চোখের সামনে মেলে দেখার চেষ্টা করে।

নিতাইধন, আমার হাতের আংটি ওটি। তুমি বিয়ে সময় হাতে পরিয়ে দিয়েছিলে। দাও দাও। ওটা আমার খুব প্রিয়। তোমার বন্ধুই তো, ওই যে বিশে পাগলা, সে-ই যত নষ্টের গোড়া। তড়িঘড়ি করে তোমার থাকার জায়গা করে দিতে আমাকে তাড়িয়েছে এখান থেকে। মর্গের পেছন দিকে আশ-শ্যাওড়ার নোংরা বনে পুটুলি করে আমাকে রেখে এসেছে। কাল সকালে হয়তো জ্বালিয়ে দেবে। কিন্তু আমার হাতের আঙুল থেকে আংটিটা খুলে পড়ে গেছে। দাও নিতাইধন, আমাকে দাও।

হু হু করে ঠান্ডা ঢুকছে স্লিপিং ব্যাগের ভেতর। চেন খোলা বুকের। নিতাইধন ওরফে ন্যাপাদা আপ্রাণ চেষ্টা করছে চোখ খোলার। আংটিটা তো একবার দেখতে হবে। মালতিকে তো একবার দেখতে হবে। মালতির হাতে আংটি পরিয়ে সে আজ আবার একটু উড়বে। দুজনে মিলে উড়বে। আজ সেরকম গন্ধময় বাতাস। জ্যোত্স্না রাঙানো আবহ। আজ মাটির থেকে অনেকটা উপরে ওঠা চাই তাদের। যেমন জ্যোত্স্নার গায়ে কোনও মলিনতা নেই।

পৌনঃপুনিক

আত্মহত্যা করার জন্য দমদমে রেল-লাইনের ধারে এসে দাঁড়াল অম্বরীশ। রাত তখন দশটা বেজে গেছে। মাঘ মাসের রাত। বেশ ঠান্ডা। অম্বরীশের হাতে সিগারেট। একটা লম্বা টান দিতেই, আগুনটা জোরালো হল। সেই আগুনের হালকা আলোয় দেখতে পেল, তিনটে ইটের ওপর মাটির হাঁড়ি রেখে লাইনের ধারে ঝোপের পাশে একটা লোক ভাত রান্না করছে। পাশে একটা বাচ্চা খেলা করছে।

অম্বরীশের মায়ের কথা, বেশি করে, মায়ের মুখটা মনে পড়ছে। দুর্বল করে দিচ্ছে তাকে। পরক্ষণেই শক্ত করে নিচ্ছে নিজেকে। না হলে সে পারবে না। সবাইকে নিজের কাছে খারাপ করে তুলতে হবে। মনকে বিষিয়ে নিতে হবে। অনুভূতিটাকে কেউ ভালোবাসে নার জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। অম্বরীশ ভাবে, শুধু তো মালবিকার বাবা-মা নয়, আমার নিজের বাবা-মা-ও তো ষড়যন্ত্রী। তারাও তো একবারও ভাবেনি মালুকে না পেলে অম্বুর কতটা কষ্ট হবে!

আজকে এই বিংশ শতাব্দীর শেষ লগ্নে এখনও রাশি, গণ, গোত্র, কুষ্ঠির দোহাই দিয়ে একটা প্রেমকে ওরা হত্যা করল। অম্বরীশ শুধু একটা রহস্যই ভাবতে লাগল যে, কীভাবে ভবিষ্যতের অকল্যাণের ভয় দেখিয়ে ওরা মালবিকাকে রাজি করাল। দূরে সরিয়ে দিল আমার থেকে। এক কথায়, ওর বাবার পছন্দ করা ছেলেকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেল। আমি হাতজোড় করে, বুক চিরে মনটা দেখাতে চেয়েছি, কেউ করুণা করেনি। আজকে সব শেষ করে বুঝিয়ে দেব, আমাদের কীসে কল্যাণ।

যে-মালবিকার ভোরবেলা ভৈরবী রাগের আরোহণ, অবরোহণের প্রতিটি স্বরনিক্ষেপ জানলা দিয়ে ভেসে এসে হৃদয় আন্দোলিত করে দিত। প্রথম বুঝেছিলাম কর্ণ একটা ইন্দ্রিয়। সামান্য হলুদ জামাটা বারান্দায় একবার চোখের দেখা দেখলে বুঝতাম ইন্দ্রিয়সুখ কাকে বলে। গত অষ্টমীতে, পাশে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি দেবার সময় যে-গন্ধটা পেয়েছিলাম, সেটা আজও নাকে স্পষ্ট। গত বছর দোলে মালু বুঝিয়ে দিয়েছিল, জিহ্বা, ত্বক সবই ইন্দ্রিয়। সেই মালবিকাকে তোমরা কেড়ে নিলে! শাস্তি তোমাদের পেতেই হবে।

পাঁচ নম্বর রেল লাইনের দিকটা নির্জন কিন্তু অনেকক্ষণ কোনও ট্রেন আসছে না। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আবার; গত বছর সরস্বতী পুজোয় শাপমোচন নৃত্যনাট্যর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আলোকের এই ঝরনাধারায় গানের সাথে আলতার ফোঁটা দেওয়া নরম ফর্সা রক্তাভ ওই পেলব হাতের যে-নৃত্যভঙ্গিমা আজও আমার বুকে মোচড় দেয়, সেই হাত দুটো আজ মঙ্গলঘটে অন্য পুরুষের হাতের ওপর। এ অসম্ভব! এ নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না।

আমি মঞ্চের পিছনে অন্ধকারে ভাষ্যপাঠ করছি, গন্ধর্বকুমার, অরুনেশ্বরের কথা কমলিকাকে…। কিন্তু না! কেন এত ভালো হচ্ছে, আমি জানি। আসলে অম্বরীশ তো মালবিকাকেই বলছে। সবাই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছে। নাচের সাথে, মালবিকার যে-হাসিটা আমি প্রাণভরে দেখেছি, সেটার জন্য, শুধু সেটার জন্য, আমি এক পৃথিবী সুখ হেলায় ছেড়ে দিতে পারি। ওই তো! ট্রেন আসছে। অম্বরীশ প্রস্তুত। একবার আকাশের দিকে তাকাল, চাঁদের দিকে, নাকি তার জ্যোত্স্নার দিকে। বিদায় পৃথিবী। ঝাঁপ দিয়ে দিল অম্বরীশ।

চোখে একটা ঠান্ডা জলের ঝাপটা। তা-ও চোখ খুলতে পারছে না অম্বরীশ। মাথার পিছনে অসহ্য একটা ব্যথা অনুভব হচ্ছে। ধীরে ধীরে একটু ফাঁক করল চোখটা। আবার সেই একই চাঁদ-টা মুখের ওপর। তবে জ্যোত্স্না-টা এবার ভেজা। সেই পাগলাটে ধরনের লোকটা, মুখটা ওর মুখের কাছে নিয়ে এসে পরিষ্কার ঝকঝকে বাংলায় বলল, মরতে যাচ্ছিলেন কেন? পৃথিবীতে এমন কোনও কারণ হতে পারে না, যা থেকে আত্মহত্যা ছাড়া আর কোনও পথ খোলা নেই। মৃত্যু কোনও সমাধান নয়, ওটা হেরে যাওয়া। বাঁচার রসদ সবসময় আছে, মানুষ খুঁজে পায় না। আপনার ইচ্ছে করলেও আপনি চিরকাল বাঁচতে পারবেন না। এত তাড়া কীসের? অম্বরীশ বোকার মতো তাকিয়ে আছে।

আমার গল্প শুনলে তাহলে আপনি কী করবেন?

অম্বরীশ ধীরে ধীরে উঠে বসল।

লোকটি শুরু করল, আমি মালদার বাসিন্দা। কলেজের পড়াশোনা শেষ করে, একটা ছোটো চাকরি নিলাম। মন বসছিল না সেই চাকরিতে। নিজের ব্যাবসা ছোটো করে শুরু করলাম। একটা ছোটো ঘর নিয়ে এসটিডি বুথ করলাম। ফ্যাক্সও বসালাম। বেশ ভালো চলছিল। বিয়ে করলাম। একটি ছোটো ফুটফুটে মেয়ে হল। মেয়ে আমার লক্ষ্মী। পেজার-এর ব্যাবসায় নামলাম। ব্যাবসা ফুলেফেঁপে উঠতে লাগল। বাড়ি, দোকান, ব্যাংক-এ বন্ধক দিয়ে অনেক টাকা লোন নিয়ে ব্যাবসায় পুঁজি বাড়ালাম। পেজার তখন মুড়ি-মুড়কির মতো বিক্রি হতো। প্রচুর টাকার মাল, সস্তায় তুললাম। হঠাৎ বাজারে এল মোবাইল। ধীরে ধীরে তার দাম, কলচার্জ সব কমতে লাগল। মানুষ পেজার ছেড়ে মোবাইলের দিকে ঝুঁকে পড়ল। এসটিডি, ফ্যাক্স সব ধীরে ধীরে বন্ধ হতে শুরু করল। যাদের পুঁজি অনেক বেশি, তারা লাইন চেঞ্জ করতে পারল।

প্রচুর ছোটো ব্যবসায়ী নিঃশব্দে নিঃস্ব হয়ে গেল। আমার বাড়ি দোকান সব চলে গেল। সংসারে শুরু হল চরম অশান্তি। স্ত্রী একদিন মেয়েকে নিয়ে বিষ খেল। সব শেষ। ছমাসের মধ্যে আমার সুন্দর পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেল। ওখানে আর লজ্জায় থাকা সম্ভব নয়। অল্প

যে-টাকাপয়সা ছিল, সঙ্গে নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। এক স্টেশন থেকে আর এক স্টেশনে।

মাস ছয়েক হল এই দমদম স্টেশনে এসেছি। উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে বেঁচে থাকার শক্তি ক্রমশ হারিয়ে ফেলছিলাম। একদিন মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, সব যখন শেষ হয়ে গেছে,আর এভাবে জীবনকে টেনে লাভ নেই। সেই সময় ঈশ্বর বাঁচার রসদ জুগিয়ে দিলেন। ওই বাচ্চা মেয়েরা। কে যেন ফেলে দিয়ে চলে গেছে। সেই থেকে ওকে নিয়ে আছি।

দু-তিনটে দোকানে ফাইফরমাস খাটি। ভালোই আছি। রান্না করি, দুজনে খাই। তবে এবার ওই সামনের বস্তিতে একটা ঘরভাড়া নেব।

অম্বরীশ মৃত্যুকে খুব কাছে থেকে দেখে নিয়েছে। এবার যেন জীবনকে দূর থেকে দেখতে পাচ্ছে। সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হল।

বিশ বছর কেটে গেছে। যাদবপুর থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে কিছুদিন পর চাকরি নিয়েছিল অম্বরীশ। বাবা-মার অনুরোধে সংসারও পাতল। স্ত্রী অতসী। ভারী ভালো মেয়ে প্রেমিকার গুণ কম থাকলে, স্ত্রীগুণ বেশি থাকে মেয়েদের। সেটাই সংসার গড়তে বেশি কাজের। আর ছেলেদের কথা আমি লিখতে পারব না, কারণ কোনও ক্ষেত্রেই আমি সফল নয়। যে-সব পুরুষের কাছে সেই শংসাপত্র আছে, অন্তত পরিপূর্ণ প্রেমিক বা সফল স্বামী যে-কোনও একটা বা দুটোই তকমা আছে তারা বলতে পারবে। ওদের দুটো

ছেলে-মেয়ে আছে। বজ্র, আর বৃষ্টি। ছেলে বড়ো, মেয়ে ছোটো। এখন অম্বরীশ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। দক্ষিণ কলকাতায় থাকে।

ওদিকে মালবিকার বিয়ে হয়েছিল মযূখের সাথে। মযূখ ব্যাংক-এ চাকরি করে। যাদবপুরে নিজেদের বাড়ি। ওদের একটাই ছেলে। মৈনাক, ডাক্তারি পড়ে। মালবিকা বরাবরই নাচে গানে পারদর্শী। ছেলেকে তবলা শিখিয়েছে। ভালোই বাজায়।

ঘটনাটা ঘটল একদিন প্যান্ট কাচতে গিয়ে মালবিকার বরাবরের অভ্যাস সব পকেট হাতড়ে তারপর ওয়াশিংমেশিনে দেওয়া। মৈনাকের প্যান্টে মানিব্যাগটা থেকে গেছে। ব্যাগের ভেতরের খাপে একটি মেয়ে ফটো। মুখটা মালবিকার খুব চেনা। কিন্তু কোথায় দেখেছে, মনে করতে পারছে না।

মেয়ে বন্ধু এখন সব ছেলেরই অনেক থাকে। সবই এখন কো-এডু স্কুল। সেই আগের পাঁচিল এখন ভেঙে গেছে। আগে যেমন আইবুড়ো ছেলেমেয়ে কথা বললেই, বড়োরা ভাবত প্রেম করছে। আর এখন প্রেম করলেও কথা বলে না। সবটাই তরঙ্গবাহিত। ডিজিটাল প্রেম। তবে প্রেম করলে, সাজ বাড়বে, আর গলায় সুর না থাকলেও একটু গুন গুন করবেই। মালবিকারও ছেলের হাবভাব কিছুদিন হল ভালো ঠেকছিল না।

মৈনাক বাথরুমে ঢোকার পর ওর মোবাইলটা দেখল মালবিকা। একটা মেসেজ রয়েছে একটা নাম্বার থেকে, প্রোফাইলে কোনও ছবি নেই। একটা গোলাপ ফুলের ফটো। লেখা রয়েছে বৃষ্টি ঠিক সময়ে আসবে, তুমি দেরি করবে না।

বাথরুম থেকে বেরাবোর পর মালবিকা সরাসরি মৈনাক-কে জিজ্ঞেস করল, মানিব্যাগের ভেতর ছবিটা কি বৃষ্টির? এসব ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার সেরা উপায় হল আক্রমণাত্মক হওয়া। স্বাভাবিক ভাবেই মৈনাক সেই রাস্তাই নিল। বলে উঠল, কে বৃষ্টি?

মালবিকা অনেক বুঝিয়ে বলল, এটা কোনও অপরাধ নয়। আসলে এখনকার অভিভাবকরা অনেক আধুনিক। সাহস পেয়ে মৈনাক স্বীকার করল। ওরা পরস্পরকে ভালোবাসে। পুরো নাম বৃষ্টি সেনগুপ্ত।

এক নিঃশ্বাসে মালবিকা প্রশ্ন করল, বাবার নাম?

অম্বরীশ সেনগুপ্ত।

মুহূর্তে, তদন্ত করতে গিয়ে নিজের মুখটাই অপরাধীর মতো হয়ে গেল মালবিকার। মুখে আচ্ছা বলে নিজেই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে নিল। চোখ দুটো কিন্তু অম্বরীশের মতো টানা আর উজ্জ্বল। তবে হোয়াটসঅ্যাপ থেকে বৃষ্টির নাম্বারটা আগেই টুকে রেখেছে। মৈনাক বেরিয়ে যাবার পর, অনেক দোটানা কাটিয়ে মালবিকা বৃষ্টি-কে ফোন করল।

হ্যালো? আমি মৈনাকের মা বলছি।

হ্যাঁ আন্টি, বলো…।

মালবিকা ভাবল নতুন প্রজন্মের মেয়েরা কত চৌখস। জানা নেই, শোনা নেই, দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়া একটা মেয়ে প্রথমেই তুমি, আর কী আপন সম্মোধন!

তুমি মৈনাককে চেনো?

হ্যাঁ আন্টি, আমি তো ঢাকুরিয়া কলাকুঞ্জে নাচ শিখি। ওখানেই আলাপ।

মৈনাক কি তোমার বন্ধু?

হ্যাঁ, আমাদের নাচের ক্লাসে তবলা বাজায় তো।

জানি, তোমরা কি শুধুই বন্ধু?

হ্যাঁ আন্টি, মৈনাকদা খুব ভালো ছেলে।

মালবিকা মনে মনে ভাবল, অম্বরীশের মেয়েটা খুব পাকা হয়েছে তো! ওইটুকু মেয়ে দুমিনিটে ফোনেই মুগ্ধ করার ক্ষমতা রাখে। মেয়েটিকে ভালো লাগছে মালবিকার। দেখতেও বেশ চটক আছে। মালবিকা ওর বাবার ফোন নাম্বারটা চাইল।

এবার একটু ভয় পেয়েছে বৃষ্টি! জিজ্ঞেশ করল, কেন আন্টি? না মানে; আমি কিন্তু কোন ইয়ে..

তোমার কোনও ভয় নেই। তোমার বাবা তোমায় একটা কথাও বলবে না। আমি কথা দিলাম।

বাবা বকবে না তো আন্টি?

না রে বাবা, তোর কোনও ভয় নেই। ফস্ করে মুখ থেকে তুই বেরিয়ে গেল মালবিকার। বৃষ্টি, ওর বাবার নাম্বার পাঠিয়ে দিল।

মালবিকা ভাবছে, এই মেয়ে তুলনায় ওর ছেলে তো ভীষণ বোকা। আসলে, ছেলেরা পুরুষ হয় বিয়ে পর। আর মেয়েরা বযঃসন্ধিতেই নারী হয়ে যায়। তবে মেয়েটি ভারি মিষ্টি। অম্বরীশকে কি ফোন করা উচিত হবে? মযূখ যদি জানতে পারে। মযূখ ওকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। পরক্ষণেই ভাবল, একজন অভিভাবক আর একজন অভিভাবকের সঙ্গে দেখা করবে, এতে বিশ্বাসভঙ্গের কোনও ব্যাপার নেই। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে অম্বরীশকে ফোনটা করেই ফেলল মালবিকা।

হ্যালো… হ্যালো… হ্যালো…? কথা বলতে পারছে না মালবিকা।

অম্বরীশ গম্ভীর গলায় আবৃত্তি করত। এখন গলা আরও গম্ভীর হয়ে গেছে। মালবিকার গলা কেঁপে গেল।

আ…মি মালু।

ওপারেও নীরবতা। তারপর ভীষণ আস্তে। কেমন আছো?

সুখের সংসারে যেমন সবাই ভালো থাকে। তোমার খবর বলো।

ভালোই। আমার নাম্বার পেলে কোত্থেকে?

বৃষ্টি দিয়েছে।

তুমি বৃষ্টিকে চেনো?

হ্যাঁ, কলাকুঞ্জে আমার ছেলে তবলা বাজায়।

একদিন দেখা করবে?

বলো… কোথায়?

শনিবার বিকেল চারটে, গড়িয়াহাট আনন্দমেলা।

আসার আগে ফোন করে নিও। আমি এখন অন্যের বউ, তোমার প্রেমিকা নয়। বলে হাসল।

ফোন রেখে মালবিকা ভাবতে লাগল, সে আবার দুর্বল হয়ে পড়বে না তো! পরক্ষণেই ভাবল, জীবনের মধ্যাহ্বে যে-উত্তাপকে সে চেপে রাখতে পেরেছে, এখন এই গোধূলি বেলায় রং ছড়াতে পারে বড়োজোর, রঙিন করতে পারবে না।

কেন জানি না! আজ একটু অন্যরকম সাজল মালবিকা। আবির রঙের ফিনফিনে সিফনের শাড়ি, সঙ্গে ফিরোজা ব্লাউজ। পিঠে একরাশ খোলা চুল। কয়েক গোছা অবাধ্য কপালের ওপর। চল্লিশ পেরিয়ে শাঁখের মতো বক্ষ। কলকে ফুলের মতো নাভি। মনকে যতই অভিভাবক বলে সান্ত্বনা দিক, পুরোনো ব্যথা সারে না। আজকে আয়নায় একটু বেশিই দেখছে নিজেকে। হয়তো আর একবার একটু দুর্বল করতে চাইছে অম্বরীশকে। এমনিই…।

ঠিক বিকেলবেলা গড়িয়াহাট মোড়ে গিয়ে দাঁড়াল। দূর থেকে দেখল, অম্বরীশ আসছে। বরাবরই গম্ভীর প্রকৃতির। গাম্ভীর‌্যটা আরও বেড়েছে। দুজনে চোখাচোখি হল। পুরোনো হিন্দি সিনেমায়, মেলায় বা নৌকাডুবিতে হারিয়ে যাওয়া যমজ ভাইকে খুঁজে পেলে যে-দৃষ্টি বিনিময় হতো, ঠিক সেই ভাবে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকল। দুজনে গিয়ে কফি ক্যাফে ডে-তে বসল। দু-একটা কথা বলার পরেই স্বাভাবিক নারীসুলভ প্রশ্নটাই করল মালবিকা, তোমার বউয়ের কথা বলো।

অম্বরীশ বলল, ভালো।

আমার থেকে সুন্দরী?

মোবাইলে অতসীর ছবিটা দেখাল, তারপর বলল, পাহাড়ও সুন্দর, আবার সমুদ্রও সুন্দর। এর তুলনা চলে না। এক জায়গায় ঢেউ বিশেষ মুহূর্তে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে, অপর জায়গায় অনন্তকাল ধরে তরঙ্গ গতিশীল।

বাব্বা! এখনও সেই গম্ভীর গলায় ভারী ভারী কথা।

যাকগে, তোমার কথা বলো।

মযূখ দারুণ মানুষ। ছেলেটাকেও ভালো মানুষ করেছি। ঠিকই আছে। আচ্ছা, আমাদের বিয়ে হলে কি আমরা বেশি সুখী হতাম?

প্রেমের শ্রেষ্ঠ পরিণতি বিরহ, বিবাহে তার মৃত্যু। সংসারে একটা সুখের অভ্যাস আছে, বিরহবেদনায় একটা বিলাস আছে। দৈনন্দিন জীবনের বিক্ষিপ্ত মনামোলিন্য, কখনও হতে পারে তিক্ত। কিন্তু সেটার অভাবে তুমি আরও বেশি রিক্ত।

তাহলে মশাই, আমদের ছেলে-মেয়েরা যে প্রেম করছে তার কী হবে?

মনে করো না একই হিমবাহ থেকে তৈরি দুটো ঝরনা। নদী হয়ে কিছুটা যাবার পর আবার সমুদ্রে মিশছে। ওদের-কে এখন ওদের মতো ভাসতে দাও।

মালবিকা অম্বরীশের হাতের ওপর হাত রাখল। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। গোধূলির আকাশে শরীর না মিললেও, দিগন্তে রক্তের সাথে রক্ত মিশে যাচ্ছে।

হাত্থি ঠাকুরের গল্প

আলের উপর দিয়ে হেঁটে পিচের রাস্তার দিকে যাচ্ছিল জিয়ন। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখল, মেঘ জমছে। যে-কোনও সময় বৃষ্টি নামতে পারে। সকালবেলায় খটঙ্গা গ্রাম থেকে ও যখন বেরিয়েছিল, তখন ঝকঝকে রোদ্দুর। সাইকেল চালিয়ে ওর খেত জমিতে আসার সময় দরদর করে ঘামছিল। জিয়ন তখন মনে মনে মারাংবুরুর কাছে প্রার্থনাও করেছিল, যেন দু’একদিনের মধ্যে বৃষ্টি নামে। অনেক কষ্টে সেচের জল এনে ধান রুয়েছে। সেই ধানগাছ এখন হাঁটুর সমান বেড়ে উঠেছে। জলের অভাবে যেন শুকিয়ে না যায়। কানালি জমি এমনিতে নীচু, ধানচাষ খুব শক্ত। কিন্তু, উপায় নেই। বাপ-ঠাকুদ্দার রেখে যাওয়া জমি জিয়ন শুখা ফেলে রাখবে কী করে?

পিয়াল গাছের নীচে সাইকেলটা রাখা আছে। বৃষ্টি নামার আগেই ওকে বাড়ি ফিরতে হবে। বছর দুয়েক আগে পুবের দেশে জনমজুরি খাটতে গিয়ে কিছু টাকা জমিয়েছিল জিয়ন। তখনই বর্ধমানে ঠিকাদারের এক সর্দারের কাছ থেকে ও পুরোনো সাইকেলটা কেনে। এখন খুব কাজে লাগছে। খেতের নজরদারির জন্য যখন-তখন ও চলে আসতে পারে। সাইকেল নিয়ে হুটহাট ঝালদা শহরে চলে যায়। চাষ দফতরের বাবুদের সঙ্গে গিয়ে দেখা করে। আজকাল সরকার থেকে বিনে পয়সায় বীজধান পাওয়া যায়। প্রয়োজনমতো রাসায়নিক সার ইউরিয়া আর কীটনাশকও। ঠিক সময়ে পাওয়ার জন্য পঞ্চায়েত আপিসে গিয়ে মুরুব্বিদের তোয়াজ করতে হয়। এ বারই যেমন, এখনও ইউরিয়া পাওয়া যায়নি। জিয়ন ভেবে রেখেছিল, বাড়ি ফিরে কিছু মুখে দিয়ে একবার ঝালদা শহরে যাবে। কবে ইউরিয়া পাওয়া যাবে সে সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার জন্য। কিন্তু, বৃষ্টি নামলে যে বাড়ি থেকে ওর আর বেরোতেই ইচ্ছে করবে না।

সাইকেল নিয়ে পিচের রাস্তায় উঠে আসার সময়ই জিয়ন দেখতে পেল, উলটো দিক থেকে সুবোধ খুটদার মোটর বাইকে করে আসছেন। মাঝবয়সি, পঞ্চায়েতের মেম্বার। থাকেন ওদের খটঙ্গাতেই। বদমাশ টাইপের লোক। মানুষটাকে দেখেই ওর ভ্রু কুঁচকে গেল। উনি এদিকে কোত্থেকে আসছেন? নিশ্চয় আনন্দপুর আশ্রমে গিয়েছিলেন। আবার কোনও অশান্তি ঘটাতে না কি? আশ্রমের সন্ন্যাসীদের সঙ্গে পঞ্চায়েতের সম্পর্ক খুব খারাপ। দোষটা খুটদার খুড়াদের মতো লোকেদেরই। সন্ন্যাসীরা গেরামের উন্নতির জন্য অনেক কিছু করতে চান। রাস্তা-ঘাট, স্কুল, টিউবওয়েল বসানো। কিন্তু খুটদার খুড়ারা ওঁদের কিছুতেই করতে দেবেন না। আশ্রমের জিপগাড়ি নাকি অনেকদিন আগে একবার চাপা দিয়েছিল একটা বাচ্চাকে। তারপর থেকে মুরুব্বিরা আশ্রমের উপর খাপ্পা।

খুড়াকে আসতে দেখে জিয়নের মনে হল, যাক, ঝালদায় যাওয়ার ঝামেলা তা হলে আর পোয়াতে হবে না। উনি নিশ্চয়ই খবর দিতে পারবেন ইউরিয়া সম্পর্কে। জিয়ন দ্রুত রাস্তায় উঠে এল যাতে খুটদার খুড়া ওকে দেখতে পান। বাইক কাছে এসে দাঁড়াতেই খুড়ার গলায় মোটা সোনার চেনটা ওর চোখে পড়ল। এই বছর তিনেক আগেও বাজারে খুড়ার টেলরিং শপ ছিল। পঞ্চায়েতে ঢোকার পর উনি অবস্থা ফিরিয়ে ফেলেছেন। ও কিছু বলার আগেই বাইকের ইঞ্জিন বন্ধ করে খুটদার খুড়া বললেন, ‘তু কুত্থায় থাকিস রে জিয়ন? পরশু মিছিলে এলি না ক্যানে? মুর্মুদা তুর নামে কাইল যা তা কইছিলঅ পঞ্চায়েত আপিসে।’

মিছিলের কথা মনেই ছিল না জিয়নের। পার্টির লোকজন বাড়ি বয়ে এসে বলে গিয়েছিল বটে। দিল্লির সরকার টাকা পাঠাচ্ছে না। একশো দিনের কাজের প্রোগ্রাম আটকে গিয়েছে। গাঁয়ের লোকেদের কাজ দেওয়া যাচ্ছে না। তাই প্রতিবাদ মিছিল খটঙ্গা, মারামু, বেরাদি… আশপাশের গ্রাম থেকে বেরিয়ে ঝালদার দিকে যাবে। ওই মিছিলে যাওয়াটা কত জরুরি, অনেকক্ষণ ধরে তা বুঝিয়েছিলেন স্কুলের মাস্টার দশরথ মুর্মু। বলেছিলেন, বেলা দশটার সময় স্কুলের মাঠে হাজির হতে। কিন্তু আগের রাতে বুধিরামের বাড়িতে পরব ছিল। একটু বেশি হাঁড়িয়া খাওয়া হয়ে গিয়েছিল জিয়নের। ঘুম থেকে উঠতেই সেদিন বেলা এগারোটা। সত্যি কথা বলতে কী, মিছিলের কথা মনে থাকলেও ও যেত কি না সন্দেহ। পঞ্চায়েতের সব শালা হারামখোর।

কথাটা বললে সুবোধ খুটদার চটে উঠতে পারেন। তাই ও বলল, ‘শরীলটা জুত ছিল না খুড়া।’

‘ই কথা কইলে চইলবে?’ খুটদার খুড়া বললেন, ‘মিটিন ত তুদের জন্যেই। তুরা যাতে কাজকম্ম পাস, তার জন্যঅ। তুদের মতো জুয়ান মরদরা যদি লা আসিস, মোদের খেইটে লাভ কী?’

খুড়ার গলায় বিরক্তির ঝাঁঝ। শুনে মুখ নীচু করে রইল জিয়ন। মুর্মু খুড়া ওর নামে কী বলেছেন, সেটা শোনার খুব কৌতূহল হল ওর। কিন্তু সে কথা সরাসরি জিজ্ঞেস করা যায় না। মুর্মু খুড়া ইদানীং স্কুলে পড়ানোর থেকে অনেক বেশি সময় দেন পার্টির কাজে। আর সুযোগ পেলেই ওকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করেন। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে খুটদার খুড়া জিজ্ঞেস করলেন, ‘তু লা কি আইজগাল রুজ সন্তোষ হাঁসদার ঘরকে যাচ্ছিস? মুর্মুদা কইছেল। ই তো ভালো কতা লয় বাপ।’

প্রশ্নটা করেই খর চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন সুবোধ খুটদার। যেন জরিপ করে নিচ্ছেন। কথাটা অবশ্য মিথ্যে নয়। ইদানীং মাঝে মাঝেই ওকে সন্তোষ খুড়ার বাড়িতে যেতে হচ্ছে। খুড়া এখন ঘরছাড়া। পার্টিগত বিবাদ। উনি আশ্রয় নিয়েছেন বলরামপুরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সন্তোষ খুড়ার মেয়ে রাইমণি বাড়িতে এখন একা। মিত্তিরবাবুদের বাড়িতে কাজ করে। সেইসঙ্গে শুয়ারের খোঁয়াড় করেছে। সেই কাজে সাহায্য করার জন্যই কখনও সখনও রাইমণি ওকে ডেকে নিয়ে যায়। এই লোকগুলো কি তাহলে রাইমণির পিছনেও লেগেছে! গেরাম থেকে উৎখাত করার চেষ্টা করছে না কি? যদি তা করে, তা হলে কিন্তু ও ছেড়ে দেবে না। রাইমণিকে ও প্রথম দেখে চাকলাদাঁড়ি পরবের সময়। অন্য মেয়াদের সঙ্গে ঝিকা নাচছিল। সেদিনই জিয়ন ঠিক করে ফেলেছিল, বিহা যদি করে, তো এই মেয়াকেই করবে। খুড়ার প্রশ্ন করার ধরনটা জিয়নের ভালো লাগল না। ও কার বাড়িতে যাবে, সেটা পঞ্চায়েতের লোকেরা ঠিক করে দেবে না কি?

কৈফিয়ত চাওয়ার ভঙ্গিতে খুটদার খুড়া ফের জিজ্ঞেস করলেন, ‘বইল না ক্যানে?’

আকাশে মেঘ গুড়গুর করে উঠল। জিয়নের বুকের ভিতরে রাগটাও। মুখ কঠিন করে ও তাকাল। ওর মুখ দেখে খুটদার খুড়া কী বুঝলেন, কে জানে? আকাশের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে, বাইকের ইঞ্জিন চালু করে, খানিকটা বোঝানোর ভঙ্গিতেই খুড়া বললেন, ‘সন্তোষের মেয়াছেনাটা ভালো লয় রে বাপ। রাইত-বিরেতে ল্যাংটা হইয়ে ঘুইরে বেরায়। জানগুরু বলছে, উ মেয়া ডাইন। উয়ার সঙ্গে তু পীড়িত কইরিস না।’

শুনে চমকে উঠল জিয়ন। সাঁওতাল সমাজে যে মেয়ার নামে ডাইন অপবাদ জোটে, তার কপালে অশেষ দুর্ভোগ অনিবার্য। ও জানে, রাইমণি কত দুঃখী মেয়া। কী দুর্দশার মধ্যে ও জীবন কাটাচ্ছে। একটার বেশি দুটো কাপড় ওর নেই। রাতে সেই কাপড় শুকোতে দিলে ওকে ল্যাংটা হয়েই থাকতে হয়। খুড়া শুধুশুধু বদনাম দিচ্ছেন। জিয়ন তা মানবে কেন? পালটা কিছু বলতে না চাইলেও ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, ‘ই তু কী কইছিস খুড়া? রাইমণি সে র’ম মেয়া লয়। তুর কথা মাইনতে পারলাম লাই।’

‘অ… না মাইনতে চাস, মানিস লাই।’ ভ্রু কুঁচকে খুড়া বললেন, ‘তুরে কিন্তুক সাবধান কইরে দিলাম। পরে মোকে দুষ দিবি নাই।’

হিমশীতল গলায় কথাটা বলেই খুটদার খুড়া আর অপেক্ষা করলেন না। ধুলো উড়িয়ে বাইক ছুটিয়ে দিলেন গেরামের দিকে। খুড়াকে আসল কথাটাই জিজ্ঞেস করা হল না। ইউরিয়া কবে পাওয়া যাবে। কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে জিয়ন সাইকেলে উঠে বসল। মনে মনে বলল, ‘রাইমণির কুনও ক্ষেতি হলে তুদের ছাইড়বক না খুড়া।’ কথাটা বলেই ও একবার আকাশের দিকে তাকাল। ঘরে পৌঁছোতে ওর মিনিট দশেক লেগে যাবে। এর মধ্যে জোরে বৃষ্টি নেমে গেলে কোথাও গাছের তলায় গিয়ে দাঁড়ানো ছাড়া উপায় নেই। কাঁচা রাস্তায় এত পাঁক হবে, নিশ্চিন্তে সাইকেল চালানো যাবে না। গেরামের ভিতর রাস্তা মেরামতির দিকে খুড়াদের কারও নজর নেই।

কাঁচা রাস্তার একপাশে জঙ্গল। ছোটোবেলায় মায়ের সঙ্গে জিয়ন এই জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে আসত। তখন আশেপাশে প্রচুর শাল, সেগুন, মহুয়া, পিয়াল, কুসুম, কেঁদ, আমলকী গাছ ছিল। মহুয়া ফুলের গন্ধে ম ম করত পুরো অঞ্চল। কিন্তু ঝাড়খণ্ডের কাঠ মাফিয়ারা রাতের অন্ধকারে এসে শাল, সেগুন গাছ কেটে নিয়ে গেছে। সবাই জানে, কারা তাদের মদত দিয়েছিল। রাস্তার এইদিকটা এখন আকাশমণি, ইউক্যালিপটাস আর রাধাচূড়া গাছে ভর্তি। বাপের কাছে জিয়ন শুনেছে, রাস্তায় কোনও গাছই হয়তো আর অবশিষ্ট থাকত না, আনন্দপুর আশ্রমের সন্ন্যাসীরা যদি না এসে এইসব গাছ তখন লাগিয়ে দিতেন। বাপ প্রায়ই ওই আশ্রমে গিয়ে পড়ে থাকত। ফাইফরমাশ খেটে রোজ দশ-বিশ টাকা রোজগার করে আনত। বাপের সুবাদে সন্ন্যাসীদের অনেকেই জিয়নকে চেনেন। রাস্তা-ঘাটে কোথাও দেখা হলে তাঁরা দু’দণ্ড কথা বলেন।

সাইকেল চালানোর ফাঁকেই জিয়ন পিছন থেকে গাড়ি আসার শব্দ শুনল। পিছন দিকে তাকিয়ে ও দেখল, আনন্দপুর আশ্রমের দিক থেকে একটা জিপগাড়ি আসছে। গাড়িটাকে জায়গা দেওয়ার জন্য ও দাঁড়িয়ে পড়ল। ওকে দেখে জিপগাড়িটাও দাঁড়িয়ে গেল। গেরুয়া রঙের পোশাক পরা দু’জন সন্ন্যাসী জিপে বসে আছেন। তাঁদের একজনকে জিয়ন চিনতে পারল। দয়ানন্দ মহারাজ। সঙ্গে সঙ্গে দু’হাত জোড় করে ও প্রণাম জানাল। আশীর্বাদের ভঙ্গিতে হাত তুলে মহারাজ ওকে বললেন, ‘তুমি ঠাকুরদাস টুডুর ছেলে… জিয়ন না?’

শুনে ঘাড় নাড়ল জিয়ন। দয়ানন্দ মহারাজ বললেন, ‘একটা খারাপ খবর আছে জিয়ন। রাঁচির জঙ্গল থেকে একটা হাতির দল এসে বেলামু পাহাড়ের কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করছে। দু’একদিনের মধ্যেই দলটা গাঁয়ের মধ্যে ঢুকে পড়বে। সব্বাইকে সাবধান করে দিও।’

শুনে উত্তেজনায় সাইকেল থেকে নেমে দাঁড়াল জিয়ন। এ বারও গণেশ ঠাকুরের দল খেতের ফসল নষ্ট করে দেবে? গত বছর গেরামের কয়েকটা বাড়ি ভেঙে দিয়েছিল। ওদের আক্রমণ ঠেকাতে গিয়ে মারা গিয়েছিল দুর্যোধন হাঁসদা বলে ওরই বয়সি একজন। সেই গণেশ ঠাকুর শুঁড় দিয়ে পেঁচিয়ে তুলে দুর্যোধনকে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। তাতেও সন্তুষ্ট হয়নি। পরে পায়ে পিষে ওকে মেরে ফেলে। রাতের অন্ধকারে এমন সময় হাত্থির দল এসে হাজির হয়, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লোকজনকে পর্যন্ত খবর দেওয়া যায় না। আশ্রমের সন্ন্যাসীদের কাছ থেকে এবার অন্তত একটা আগাম খবর পাওয়া গেল। দয়ানন্দ মহারাজ সাবধান করে দেওয়ার কথা বলছেন। কিন্তু গেরামের মানুষের করার কী আছে? গণেশ ঠাকুরের প্রতি লোকের এত ভক্তি, ওদের পালটা আঘাত করার কথা কেউ ভাবতেও পারে না।

ও জিজ্ঞেস করল, ‘গণেশ ঠাকুরদেরকে বেলামুতেই আটকে দ্যান না ক্যানে মহারাজ?’

‘মনে হয়, সম্ভব না। আশ্রমের পাঁচিল ভেঙে ওরা ভিতরে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারেনি। আমরা শূন্যে ফায়ার করে ওদের ভয় দেখিয়েছি বলে। দলটা বেশ বড়ো। দশ-বারোজনের মতো। আমরা এও খবর পেয়েছি, ওদের মধ্যে একটা খুনিয়া হাতি আছে। দাঁতাল, সে-ই লিডার।’

খুনিয়া হাত্থি মানে যে হাত্থি ইতিমধ্যেই মানুষ খুন করেছে। গত বছরও এই রকম একটা হাত্থি এসেছিল দলের সঙ্গে। এবার কার কপালে মৃত্যু লেখা আছে, কে জানে? জিয়ন শূন্যচোখে তাকিয়ে রইল। হাত্থির দল এত ক্ষতি করে যাচ্ছে, তবুও ওদের শিক্ষা দেওয়ার কথা কেউ ভাবে না! গেরামের দু’চারজনের সঙ্গে জিয়ন কথা বলেছিল। ‘পাগলা হইয়েনছিস তু’ বলে তারা সরে গিয়েছিল। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে দয়ানন্দ মহারাজ বললেন, ‘তোমাদের সুবোধ খুটদার একটু আগে আশ্রমে এসেছিলেন। তাঁকে সব জানিয়েছি। আমরা এখন ঝালদার দিকে যাচ্ছি। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের আপিসে খবর দিতে। তুমি যত তাড়াতাড়ি পারো, গাঁয়ের লোকদের জানাও।’

দয়ানন্দ মহারাজ চলে যাওয়ার পর জিয়ন নিজেকেই প্রশ্ন করল, ‘কী করা যায়, বল ক্যানে?’

গণেশ ঠাকুরদের অত্যাচার কী করে বন্ধ করা যায়, সে কথা গত তিন বছর ধরে জিয়ন ভাবছে। এই একটি ভাবনাই ওকে এখন তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। কীভাবে ওদের শায়েস্তা করা যায়? পরপর তিন বছর ওরা খেতের ফসল নষ্ট করে দিয়েছে। ওর জীবনের চূড়ান্ত সর্বনাশ করে দিয়েছে, এই হাত্থির একটা দল। সেই কথা যখনই জিয়ন ভাবে, অসহ্য রাগে ওর পেশিগুলো ফুলে ওঠে। বদলা নেওয়ার ইচ্ছেয় হাত নিসপিস করে। কিন্তু ঠাকুর-দ্যাবতার বিরুদ্ধে ও লড়বে কী করে? ওদের সাঁওতাল সমাজে হাত্থি যে ঠাকুর। গেরামের সবাই তাদের পুজো করে। অক্ষমতা ওর ক্রোধ আরও বাড়িয়ে দেয়। তখন কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। মারাত্মক এক বিষণ্ণতা ওকে গ্রাস করে। তখনই বাড়ির উঠোনে ও ধামসা মাদল বাজাতে শুরু করে। যতক্ষণ না ক্লান্ত হয়ে লুটিয়ে পড়ে, ততক্ষণ মাদল বাজিয়েই যায়।

গেরামে ঢোকার মুখে বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটা পড়তে শুরু করল। পরনের টি শার্ট আর পাজামা যাতে ভিজে না যায়, সেজন্য নকুল মণ্ডলের দোকানে চালার নীচে এসে দাঁড়াল জিয়ন। বাড়িতে ফিরে পোশাক বদলে ও লুঙ্গি পরে নেবে। খটঙ্গার স্কুলে ও আর নকুল একসঙ্গে আট ক্লাস অবধি পড়েছিল। ছোটোবেলার বন্ধু। স্কুল ছেড়ে দেওয়ার পর বাপের মুদিখানা দোকানে বসে যায় নকুল। আর জিয়ন চাষের কাজে হাত লাগিয়েছিল বাপের সঙ্গে। নকুলের দোকানটা বাজারের ঠিক পাশে। বুদ্ধি করে ও একটা চায়ের ঠেক বানিয়েছে। পুরুলিয়া শহর থেকে একটা সাদা-কালো টিভি সেট কিনে এনে লাগিয়েছে লাগোয়া দোকানে। চা খাওয়ার ফাঁকে অনেকেই বসে খবর শোনে। এই মুহূর্তে অবশ্য দোকানে কোনও খদ্দের নেই। অন্য সময় নকুল কথা বলার সময় পায় না। আজ জিয়নকে দেখে একটা টুল এগিয়ে দিয়ে ও বলল, ‘বোস না ক্যানে।’

গেরামে এই একটি লোকের সঙ্গেই জিয়ন মন খুলে কথা বলে। মাঝেমধ্যে এলে নকুলের কাছে গেরামের অনেক খবর পায়। রাইমণিকে ডাইন অপবাদ কারা দিল, কেন দিল, কথায় কথায় ও জিজ্ঞেস করবে, ভেবে নিয়ে টুলে বসে পড়ল জিয়ন। বেশ জোরে বৃষ্টি হচ্ছে। স্কুলের মাঠটা ঝাপসা দেখাচ্ছে। লম্বা ইউক্যালিপটাস গাছগুলো মাথা নাড়াচ্ছে বাতাসের দমকে। দৃষ্টি সরিয়ে এনে জিয়ন দেখল, দ্রুত হাতে চা বানাচ্ছে নকুল। দোকানে এলে এইটুকু আতিথ্য ও পায়। একটু পরেই চা ঢেলে মাটির ভাঁড় ওর দিকে এগিয়ে দিল নকুল। কাচের বয়াম খুলে বেকারির বিস্কুট বাড়িয়ে দিল। গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে দু’জনে কথা বলতে লাগল। চা খাওয়ার অভ্যাস আগে জিয়নের ছিল না। ভিন দেশে জনমজুরির কাজ করতে গিয়ে অভ্যাসটা করে ফেলেছে। কানালি জমিতে একবারের বেশি চাষ করা যায় না। খেতির কাজকর্ম যখন থাকে না, তখনই ও বেরিয়ে পড়ে। বছরে পাঁচ-ছ’মাস গেরামেই থাকে না।

বাজারের হালচাল, পঞ্চায়েতের পক্ষপাতিত্ব, গেরামের রাজনীতি নিয়ে কথা বলতে লাগল নকুল। একটা সময় সন্তোষ খুড়া হয়ে ওদের আলোচনা চলে এল রাইমণিতে। খুটদার খুড়া হুমকি দিয়েছেন শুনে নকুল বলল, ‘উকে লষ্ট কইরে দিবেক শালা হড়ডপটরা। তুকে এগটা কথা কইব ভাবছিলাম জিয়ন। তু ত উকে ভালোবাসিস। রাইমণিকে তু বিহা কইরে ফ্যাল না ক্যানে?’

রাইমণিকে ঘরে আনার ইচ্ছেটা জিয়নের মাঝেমধ্যেই জাগে, যখন ও ভিন দেশে কাম করতে যায়। সেখানে মরদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জনমজুর খাটে মেয়ারা। প্রবাসে তাদের সুখী দাম্পত্য জীবন দেখে, প্রতিবারই জিয়ন ভাবে, গেরামে ফিরে রাইমণির সঙ্গে বিহাটা সেরে ফেলবে। দু’জনে মিলে পাকাপাকিভাবে রাঁচি অথবা হাজারিবাগ চলে যাবে। খটঙ্গার সঙ্গে আর কোনও সম্পর্কই রাখবে না। কিন্তু গেরামে ফেরার পরই ওর আক্রোশ ফের চাগাড় দিয়ে ওঠে। বদলা নেওয়ার আগুন জ্বলতে থাকে ওর বুকে। প্রতি রাতেই নির্জন ঘরে শুয়ে থাকার সময় সেই দুঃস্বপ্নের দৃশ্যগুলো ওর চোখের সামনে ভাসে। সেকথা মনে করে জিয়ন বলল, ‘তু কইলি, আর আমি ঝপ কইরে বিহা কইরে লুব! অ্যাখুন আমি বিহা কইরতে পারবক লাই ভাই। মোর এগটা কাম বাকি আছে। তু ত জানিস।’

‘হাত্থিদের ফাইন্দে ফ্যালার কাম বুঝি?’ নকুল বলল, ‘পাগলার মতন কথা বলিস না ভাই। গেরামের মানুষ তুর নামে কী কয়, তু জানিস? তুর মাতথায় ব্যামো হইনছে।’

‘বলুক গা। তাতে কিছু আইসে যায় না।’

‘শুন ভাই, অতীতে কী হইনছে, মুনের মধ্যে চেইপে রাখিস না। ভুইলে যা। হাত্থি ঠাকুরের সঙ্গে তুই লড়বি কী কইরে? উয়াদের সঙ্গে লড়া অততো সহজ কথা লয়। উয়াদের কাছে মানুষ ত লিইলিপুট। তু একা কী কইরবি, বল? হাত্থি ঠাকুরকে মেইরে ফেলবি? উ চেষ্টা করিস লা ভাই। কইরলে ফরেস্টবাবুরা তুকে ধরে লিয়ে যাবেক।’

নকুল আরও কী বলতে যাচ্ছিল, দু’তিনজন খদ্দের এসে যাওয়ায় চুপ করে গেল। বৃষ্টির তোড় কমে এসেছে। আনন্দপুর আশ্রমের দিকটা এখন পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। গেরাম আর আশ্রমের মাঝে প্রায় এক কিলোমিটার পাথুরে রুক্ষ জমি। অনেক ঘুরে ঘুরে, পায়ে হেঁটে আশ্রমে যেতে হয়। আশ্রমটা কীসের, সে সম্পর্কে জিয়নের কোনও ধারণা নেই। তবে ভিতরটা বিশাল, বলতে গেলে ছোটোখাটো একটা শহরের মতো। কী নেই তাতে? স্কুল, ব্যাংক, হাসপাতাল, পোস্ট অফিস, বাজার… সব আছে। বাপের মুখে জিয়ন শুনেছে, ওখানে যারা থাকে, তারা বেশিরভাগই বিদেশি। ওখানে যাকে তাকে ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হয় না। বিনা অনুমতিতে পুলিশও ওখানে ঢুকতে পারে না। বাপের সঙ্গে অবশ্য বেশ কয়েকবার জিয়ন আশ্রমের ভিতরে গিয়েছে। সে এক আশ্চর্য জগৎ।

‘শুইনেছিস, গণেশ ঠাকুরের দল লা কি আবার গেরামের দিকে আইসছে।’

নকুলের কথা শুনে জিয়ন এদিকে মুখ ফেরাল। খবরটা খদ্দেরদের মধ্যেই কেউ নিশ্চয় ওকে দিয়ে গেল।

জিয়ন ঘাড় নেড়ে বলল, ‘শুইনেছি। আজকাইলের মধ্যেই গেরামে ঢুইকবেক।’

‘গেরামের মানুষ রাইত জেইগে খেত সামাল দিবে বইলে তৈরি হইনছে। খুটদার খুড়া মিটিন ডেইকেছেন। তু একবার যা না ক্যানে পঞ্চায়েতে।’

কোনও উত্তর না দিয়ে জিয়ন মুখ গোঁজ করে বসে রইল। পঞ্চায়েতের অফিসে গিয়ে কী আর হবে? না, না, কিছুতেই ও খুটদার খুড়াদের কাছে যাবে না। বেলামু পাহাড়ের দিক থেকে হাত্থির দল যখন এ দিকে আসবে, তখন প্রথমেই পড়বে ওর খেত। হাত্থিদের দাপাদাপিতে ধানগাছের কী অবস্থা হবে, ভাবতেই রাগ হতে লাগল জিয়নের। গত দু’মাসের পরিশ্রম বৃথা যাবে। রাতে ক্যানেস্তারা পিটিয়ে, মশাল জ্বালিয়ে, হই হট্টগোল করে হয়তো হাত্থি তাড়ানোর চেষ্টা করা হবে। পাহারাদারদের লক্ষ্য থাকবে, নিজের খেত বাঁচিয়ে অন্যের খেতের দিকে হাত্থির পালকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাতে কোনও লাভ হবে না।

গণেশ ঠাকুরের দল আগে দলমা থেকে বেরিয়ে অযোধ্যা পাহাড় হয়ে নেমে আসত। কিন্তু, তিন বছর আগে সেই প্রথম রাঁচির দিক থেকে আচমকাই একটা দল বেলামু পাহাড়ের পাশ দিয়ে ঢুকে পড়েছিল ওদের গেরামে। মানুষজন সচেতন হওয়ার আগেই গেরামে কান্নার রোল উঠেছিল। গভীর রাতে পোষা কুকুরের ডাকে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল জিয়নের। ভয়ার্ত সেই ডাক। বিছানা ছেড়ে দাওয়ায় এসে দাঁড়াতেই মূর্তিমান বিভীষিকা চোখে পড়েছিল ওর। একটা দাঁতাল হাত্থি উঠোনে দাঁড়িয়ে। প্রবল বেগে মাথা নাড়াচ্ছে। মুলো বাঁশের মতো তার দুটো দাঁত। বিরাট কান দুটো ফটরফটর করছে। কুকুরের ডাক শুনে বিরক্ত। প্রায় জমি ছোঁয়া ওর লম্বা শুঁড় থেকে ভোঁস ভোঁস শব্দ ভেসে আসছে। হাত্থিটা এক পা বাড়িয়ে লক্ষ্য স্থির করায় ব্যস্ত। শুঁড়ে পেঁচিয়ে কুকুরটাকে শূন্যে তুলে নেবে।

মাটির বাড়ির ভিতরের ঘরে বাপ-মা আর বোন শুয়ে আছে। তাদের ঘুম ভেঙে গিয়েছে কি না, জিয়ন বুঝতে পারেনি। ওর কাছে এমন সময়ও ছিল না, ভিতরে ঢুকে সবাইকে ডেকে তোলে। বাড়ির উঠোনে প্রকাণ্ড জীবটাকে আগে কখনও দেখেনি। কুকুরের আস্ফালন তাই আরও বেড়ে গিয়েছিল। কাছাকাছি কোথাও একটা গাছ ভেঙে পড়ার শব্দ শুনতে পেয়েছিল জিয়ন। তার মানে আশেপাশে আরও সঙ্গী নিয়েই দাঁতালটা ঢুকেছে। শুক্লপক্ষের রাত। হালকা জ্যোৎস্নায় কী চোখে পড়েছিল কে জানে? কুকুরটা হঠাৎই রণে ভঙ্গ দিয়েছিল। ভয় পেয়ে পিছু হটে, ঘরের ভিতর ঢুকে আশ্রয় নিয়েছিল চৌকির নীচে। সেখান থেকেই কুঁইকুঁই আওয়াজ করছিল। ওকে তাড়া করে, এর পর ঘরে ঢোকার চেষ্টায় হাত্থিটা যখন মাটির দেয়ালে ঢুঁসো মারে, তখনই প্রাণভয়ে দাওয়া থেকে লাফিয়ে নেমে জিয়ন খিড়কির দিকে ছুটে গিয়েছিল। পরক্ষণেই ও টালির চাল হুড়মুড় করে ভেঙে পড়তে দেখে। খিড়কি থেকেই ও বাপ-মায়ের আর্তনাদ শুনতে পেয়েছিল। সেইসঙ্গে উন্মত্ত হাত্থির হুঙ্কার।

শেষ রাতে গণেশ ঠাকুরের দলটাকে পিচের রাস্তা ধরে চলে যেতে দেখেও জিয়ন জঙ্গল থেকে বেরোনোর সাহস পায়নি। আতঙ্কে থরথর করে কেঁপেছিল পিয়াল গাছের আড়ালে। আলো ফোটার পর ফিরে এসে দেখে বাড়ির কোনও চিহ্নই নেই। কুকুরকে খুঁজে পাওয়ার তাগিদে ভগ্নস্তুপের উপর দাপাদাপি করে গিয়েছে হাত্থির দল। মাটির কলসিতে রাখা হাঁড়িয়াও খেয়ে গিয়েছে। গেরামের লোক চৌকির নীচ থেকে টেনে বের করেছিল থেঁতলে যাওয়া তিনটে দেহ। ওর বাপ, মা আর বোনকে। কুকুরটার কোনও হদিশই পাওয়া যায়নি। মনে আছে, জিয়নের সব মনে আছে। উঠোনে তিনটে মৃতদেহ পড়েছিল অনেক বেলা পর্যন্ত। পঞ্চায়েতের লোকজন বলেছিল, ফরেস্টবাবুরা না আসা পর্যন্ত সৎকার করা যাবে না। হাত্থির তাণ্ডবে কেউ মারা গেলে না কি ফরেস্টবাবুদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ পাওয়া যায়। সারাটা দুপুর জিয়ন শোকস্তব্ধ হয়ে বসে ছিল। এক ফোঁটা চোখের জলও ফেলেনি। ওর বুকে তখন আগুন জ্বলছিল ধিকধিক করে। ফরেস্টবাবুরা বিকেলের দিকে এসে রিপোর্ট নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। না, পরে কোনও ক্ষতিপূরণ জিয়নের কপালে জোটেনি। বাবুরা বলেছিলেন, নিছক দুর্ঘটনা। টালির চালা ভেঙে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের।

নকুলের দোকানে চালার নীচে বসে অতীতের কথা ভাবতে ভাবতে জিয়নের ফের একবার কৈলাস স্যারের কথা মনে পড়ল। স্কুলের বাংলা টিচার ছিলেন কৈলাস স্যার। ক্লাসে পড়ানোর সময় স্যার একদিন জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আচ্ছা বল তো, সবথেকে বুদ্ধিমান প্রাণী কে?’ ওরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করেছিল। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করার পর স্যার নিজে থেকেই বলেন, ‘পৃথিবীতে যত প্রাণী আছে, তার মধ্যে সব চাইতে বুদ্ধিমান হল মানুষ। বুদ্ধিতে মানুষের সঙ্গে অন্যরা পেরে উঠবে না।’ গত তিন বছরে জিয়ন অনেকবারই ভেবেছে, স্যারের কথা যদি সত্যি হয়, তা হলে এই গুন্ডা হাত্থিগুলোকে শিক্ষা দেওয়ার মতো বুদ্ধি কেন মানুষ দেখাতে পারছে না? এমন উপায় কেন খুঁজে পাচ্ছে না, যাতে ওরা আর না আসে? তা হলে কি হাত্থিদের বুদ্ধি আরও বেশি? না হলে কয়েকশো মাইল দূর থেকে রাস্তা চিনে প্রতিবছর ফসলের সময়ই ওরা আসে কী করে।

‘জল থেইমে গেনছে। ঘরকে যাবিক নাই?’

নকুলের প্রশ্নে সম্বিত ফিরল জিয়নের। সামনের দিকে তাকিয়ে ও দেখতে পেল বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। টুল ছেড়ে উঠে ও সাইকেলের কাছে নেমে এল। মনের মধ্যে যে-প্রশ্নটা এতক্ষণ পাক খাচ্ছিল, হঠাৎ সেটাই ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘তু বুল ত ভাই নকুল। হাত্থিদের বুদ্ধি কি মানুষের থেইকে বেশি?’

প্রশ্নটা শুনে নকুল হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল।

চাদর মুড়ি দিয়ে দাওয়ায় শুয়ে ছিল জিয়ন। অনেক বেলা হয়ে গিয়েছে। তবুও, শুয়ে নিজের দুর্দশার কথা ভাবছিল। হঠাৎ রাইমণির গলা শুনতে পেল, ‘শুইয়ে আনছিস ক্যানে? শরীলডা খারাপ?’

দাওয়ায় উঠে এসে মাথার কাছে বসল রাইমণি। কপালে হাত দিয়ে পরীক্ষা করল গা গরম কি না? চোখ মেলে ওর সোন্দর মুখটা দেখে জিয়নের মন ভালো হয়ে গেল। রাইমণির হাতটা ধরে ও নিজের গালে ছোঁয়াল। গত তিন-চারটে দিন ওর অসহ্য মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে কেটেছে। হাত্থি ঠাকুরের দল ফের লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গিয়েছে ওর খেত। বুধিরাম এসে যখন খবরটা দেয়, তখন খেতে দৌড়ে যাওয়ার ইচ্ছেটুকুও জিয়নের হয়নি। নিজেকে বাড়ির মধ্যেই ও আটকে রেখেছিল। পরে শুনেছে, ঝালদার দিকে যাওয়ার সময় হাত্থির দল গেরামের অনেক ক্ষতি করে দিয়েছে। গাছপালা উপড়েছে। শুধু মাটির বাড়িই নয়, বুধিরামদের পাকা গাঁথনির দেওয়ালও ওদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এই প্রথম বুধিরাম বলে গিয়েছে, এবার একটা ব্যবস্থা করা দরকার। কদ্দিন আর সহ্য করা হবে হাত্থি ঠাকুরের অত্যাচার?

মাঝে রাইমণি একদিন এসেছিল। ওকে স্ত্বান্না দিয়ে গিয়েছে। জানতে চেয়েছিল, এ বার ও কী করবে? তখনও জিয়ন কিছু ঠিক করেনি। গেরামে পড়ে থাকার কোনও মানে নেই। কিন্তু, যাবেই বা কোথায়? বর্ষার সময় ইমারতির কাজ বন্ধ থাকে। বাইরে জনমজুরির কাজ পাওয়াও শক্ত। একমাত্র বর্ধমানের দিকে গেলে হয়তো কাজ পাওয়া যেতে পারে। ওখানে বড়ো বড়ো বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। জিয়ন মাঝেমধ্যেই ভাবছে, রাইমণিকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। ওখানে গিয়ে নতুন সংসার পাতবে। কথাটা ভাবা মাত্র, এই বিপর্যয়ের মধ্যেও, একটা সুখের কম্পন ও শরীরে অনুভব করছে। এই মুহূর্তে রাইমণির হাতের ছোঁয়া আরও নিবিড়ভাবে পাওয়ার জন্য জিয়ন ওর কোলে মাথা রাখল। এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল ওর কোমর।

চুলে হাত বোলাচ্ছে রাইমণি। খানিকক্ষণ পর কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ও বলল, ‘উঠ না ক্যানে। দয়া মহারাজ তুকে ডেইকেনছেন।’

দয়া মহারাজ মানে, আনন্দপুর আশ্রমের দয়ানন্দ মহারাজ। এই তো ক’দিন আগে রাস্তায় ওর সঙ্গে দেখা হল। হঠাৎ ওকে ডেকেছেন কেন, জানার জন্য জিয়ন উঠে বসল। জিজ্ঞেস করল, ‘তুর সঙ্গে উয়ার দেখা হইয়েনছিল লা কি?’

‘হ। মো আইশ্রমে কাম কইরতে গেইনছিলাম কাইল।’

‘কী কইলেন তুকে?’

‘মুর্মু খুড়া জানগুরু লিয়ে এইসেছেন রাঁঞ্চি থেইকে। মোকে ডাইন অপবাদ দিবার লেগ্যে।’

খবরটা খুটদার খুড়ার কাছ থেকে আগেই শোনা জিয়নের। এইবার ও বুঝতে পারল, ষড়যন্ত্রের মূলে তা হলে মুর্মু খুড়া। নিশ্চয় কোনও বদ মতলব আছে। সন্তোষ খুড়ার ঘরটাও হাতিয়ে নিতে চান। রাঁচি থেকে জানগুরু নিয়ে আসা চাট্টিখানি কথা নয়। হাজার খানিক টাকা তো তাঁকে দিতেই হবে। সেইসঙ্গে শুঁয়ার আর পাঁঠা। এত খরচ মুর্মু খুড়া এমনি এমনি করবেন না। জিয়ন কিন্তু অবাক হল এই ভেবে, খবরটা এত তাড়াতাড়ি দয়ানন্দ মহারাজের কানে পেৌঁছোল কী করে? পরক্ষণেই ওর মনে হল, গেরামে আশ্রমের কৃপাপ্রার্থী অনেকেই আছে। গেরামের ভালো-মন্দ অনেক খবরই তাই সন্ন্যাসীরা আগাম পেয়ে যান।

ওদের সাঁওতাল সমাজে নানারকম কুসংস্কার আছে। দয়ানন্দ মহারাজরা সেইসব কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। এর আগে একবার ডাইন অপবাদ থেকে ওঁরা বাঁচিয়েছিলেন বারুদি গেরামের একজনকে। সেই মেয়াকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয়েছিল রাতের অন্ধকারে ঘরে আগুন লাগিয়ে। আগে খবর পেয়ে সন্ন্যাসীরা পুলিশ নিয়ে হাজির হন সেখানে। তা হলে কি রাইমণিকেও উয়ারা বাঁচাতে চান? সেই কারণেই ওকে ডেকে পাঠিয়েছেন? কথাটা মনে হওয়া মাত্র জিয়ন উঠে পড়ল। বলল, ‘তু ইগট্টু বোস ক্যানে। আমি চট কইরে রেডি হইয়ে লিই। মোর সঙ্গে তু আইশ্রমে যাবিক।’

… ঘণ্টাখানেক পর পাথুরে রুক্ষ জমির উপর দিয়ে দু’জনে যখন সাইকেলে আনন্দপুর আশ্রমে পৌঁছোল, তখন মাঝ দুপুর। প্রকাণ্ড গেটটার খানিক আগে কালভার্টের উপর এসে ওরা দাঁড়াল। বেলামু পাহাড় থেকে নেমে আসা ছোটো একটা নদী নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। ছোটোবেলায় হেঁটেই জিয়নরা শুখা নদীটা পেরিয়ে যেত। কিন্তু, গত কয়েকদিনের বৃষ্টির কারণে নদীর জল এখন টইটুম্বর। সাইকেলটা কালভার্টের নীচের ঢালে দাঁড় করানোর ফাঁকে ওরা দেখতে পেল, কাঁধে রাইফেল নিয়ে দু’জন গেট পাহারা দিচ্ছে। প্রায় পাঁচ-ছ’বছর পর জিয়ন এই আশ্রমের দিকে এল। আগে কখনও আর্মড গার্ড ওর চোখে পড়েনি। দেখে, কেন জানে না, ওর মনে হল, পার্টির লোকেরা যাতে দলবল নিয়ে হঠাৎ চড়াও না হতে পারে, সেই কারণেই এত কড়াকড়ি।

অফিস ঘরে দয়ানন্দ মহারাজের সঙ্গে দেখা হতেই উনি হাসিমুখে বললেন, ‘এসো জিয়ন। একটু আগে তোমার কথাই ভাবছিলাম।’

হাতজোড় করে প্রণাম জানিয়ে জিয়ন বলল, ‘আপনি ডেইকেছিলেন মহারাজ?’

‘আগে বোসো। তোমার সঙ্গে কয়েকটা ব্যাপারে আলোচনা করার ছিল। হাতিরা কতটা ক্ষয়ক্ষতি করেছে, তা দেখার জন্য কাল আমি তোমাদের গ্রামে গেছিলাম। তোমার খেতে তো ধানগাছের চিহ্ন আর নেই বললেই চলে। এখন কী করবে বলে তুমি ভাবছ?

গত তিন বছর ধরে যে-ইচ্ছেটা ও লালনপালন করছে, রাগের মাথায় সেটাই জিয়ন বলে বসল, ‘মুনে লয়, হাত্থিগুলানকে গুলি কইরে মারি।’

শুনে হাসি মিলিয়ে গেল মহারাজের মুখ থেকে। ওর দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে উনি বললেন, ‘হাতিদের উপর তোমার এত রাগ কেন জিয়ন? কখনও কি ভেবে দেখেছ, জঙ্গল ছেড়ে প্রতি বছর ওরা লোকালয়ে আসে কেন? এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী তো আমরা… মানুষরা। বসতি বাড়ানোর জন্য আমরা জঙ্গল কেটে নিয়েছি। জঙ্গলে ওদের খাবার ভাঁড়ারে টান পড়েছে। খাবারের খোঁজে তাই ওরা মানুষের ডেরায় ঢুকছে। হাতিদের কি দোষ দেওয়া যায়, বলো? ওদেরও কি বাঁচার অধিকার নেই? এই পৃথিবীর উপর ওদের দাবি তো অনেক বেশি। কেন-না, মানুষের অনেক আগে ওরা এই পৃথিবীতে এসেছে। যা বলছি, তুমি কি বুঝতে পারছ, জিয়ন?’

শুনে হাঁ করে তাকিয়ে রইল জিয়ন। এক ঝটকায় ওর চিন্তাভাবনা এলোমেলো হয়ে গেল। দয়ানন্দ মহারাজ যা বলছেন, তার পিছনে যুক্তি আছে। অস্বীকার করার উপায় নেই, মানুষের মতো হাত্থিরাও প্রাণী। ওদেরও খিদে আছে। বেঁচে থাকার আকুতি আছে। নিজের প্রজাতিকে বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছে আছে। তবুও, মনে মনে পালটা প্রশ্ন হাতড়াতে লাগল জিয়ন। জঙ্গল কেটে বাপ-ঠাকুর্দারা যদি ভুল করে গিয়ে থাকে, তা হলে তার খেসারত ওদের দিতে হবে কেন? ওদের মুখে অন্ন তা হলে কে জোটাবে?

দয়ানন্দ মহারাজ বোধহয় মনের কথা বুঝতে পারেন। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে ফের বললেন, ‘হাতিদের নিয়ে সমস্যাটা শুধু তোমাদের খটঙ্গা গ্রামেরই নয়… সারা দেশের। ওদের অন্নসংস্থানের কথা যে আমাদেরই ভাবতে হবে জিয়ন। এক জঙ্গলে যদি ওদের খাবার শেষ হয়ে যায়, তা হলে ওরা যাতে কাছাকাছি অন্য জঙ্গলে গিয়ে খাবার পায়, তার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সেইসঙ্গে দুটো জঙ্গলের মাঝে যাতায়াতের সময় ওদের জন্য নিরাপদ একটা করিডর। তাহলে গ্রামে ঢোকার কথা ওরা আর ভাববেই না।’

হাত্থি ঠাকুর সম্পর্কে আরও অনেক কথা বলতে লাগলেন দয়ানন্দ মহারাজ। লেখাপড়া জানা মানুষ… কত কী জানেন! ভিন্ রাজ্যে নাকি হাতি আটকানোর জন্য গেরামের চারপাশে ইলেকট্রিকের বেড়া লাগানো হয়। একবার শক্ খেলে হাতি আর গেরামে ঢোকার সাহস পায় না। পথ বদলে অন্যদিকে সরে যায়। হাত্থি ঠাকুরের না কি অসীম বুদ্ধি। ওরা ঠিক বুঝতে পারে, কে ওদের ক্ষতি করতে চায়, কে নয়? কয়েকটা উদাহরণও দিলেন দয়ানন্দ মহারাজ। কথাগুলো শুনতে শুনতে জিয়ন দ্বিধায়। ওর বাপ, মা, বোন তো হাত্থি ঠাকুরের কোনও ক্ষতি করেনি? তাহলে ওদের মরতে হল কেন? একটা সময় হাতি প্রসঙ্গ থেকে সরে এসে মহারাজ হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘চাষ করার ইচ্ছে কি আর তোমার আছে, জিয়ন?’

উত্তরটা ও ঠিক করে রেখেছে। জিয়ন বলল, ‘না।’

‘তোমার কাছে একটা প্রস্তাব আছে। খটঙ্গা থেকে আশ্রম পর্যন্ত একটা রাস্তা বানানোর কথা আমরা ভাবছি। তার জন্য মাটি দরকার। তোমার খেত থেকে যদি আমরা মাটি তুলে নিই, তাহলে কি তোমার আপত্তি আছে? মাটি কেনার টাকা তুমি পাবে। মাটি তোলা নিয়েও তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। আমরাই লোকজন দিয়ে মাটি কাটার ব্যবস্থা করে নেব। তুমি কি তাতে রাজি?’

প্রস্তাবটা শুনে জিয়নের মন্দ লাগল না। কানালি জমি এমনিতেই নীচু। বছরে একবারের বেশি চাষ করা যায় না। চাষ করেই বা আর লাভ কী? একে গেরাম থেকে ওর মন উঠে গিয়েছে। পঞ্চায়েতের লোকজনদের ওর সহ্য হচ্ছে না। খেতের ওই জমি আর রাইমণির টানেই ও অ্যাদ্দিন খটঙ্গায় পড়ে আছে। পাকাপাকিভাবে এবার সম্পর্ক ছিন্ন করে দিলে ক্ষতি কী? রাইমণির দিকে তাকিয়ে জিয়ন বুঝতে পারল, ওর অসম্মতি নেই। তাই বলল, ‘মো রাজি।’

‘গুড। তা হলে টাকা পয়সার কথা তোমাকে পরে জানিয়ে দেব।’

একটু থেমে রাইমণির দিকে তাকিয়ে দয়ানন্দ মহারাজ মৃদু হেসে বললেন, ‘আর একটা কথা। রাইমণি সম্পর্কে কি তুমি কোনও সিদ্ধান্ত নিয়েছ? যদি না নিয়ে থাকো, তাহলে আমি বলি কি, ও এখন আমাদের আশ্রমেই থাক। ও যে কী বিপদের মধ্যে আছে, নিশ্চয়ই তুমি তা জানো। ঘরে একা থাকা ওর পক্ষে ঠিক হবে না। আশ্রমের হেঁসেলে নানা রকম কাজ থাকে, রাইমণি আপাতত সেই কাজ করুক।’

দয়ানন্দ মহারাজের সঙ্গে আরও কিছু কথা বলে জিয়ন যখন আনন্দপুর থেকে বেরিয়ে এল, তখন মন খুশিতে ভরপুর। রাইমণিকে নিয়ে আর কোনও আশঙ্কা ওর নেই। তার থেকেও বড়ো কথা, একটা দিশা পাওয়া গিয়েছে। বুদ্ধির খেলায় এইবার হাত্থি ঠাকুরদের ও হারিয়ে দিতে পারবে। আশ্রম থেকে বেরোনোর সময় জিয়ন লম্বা একটা শ্বাস নিল।

গেরামে ওকে একঘেরিয়া করে দেওয়া হবে, এমন একটা কথা খুব রটেছে। পরিস্থিতিটা এমন, পারলে খুটদার খুড়ারা জিয়নকে ছিঁড়ে খান। ওর খেতের জমির কাছে যেদিন মাটি কাটার যন্তর এসে দাঁড়ায়, সেদিনই সবাই বলাবলি করেছিল, ঠাকুরদাসের ব্যাটার মাথার ঠিক নেই। ব্যামোটা আবার বেড়েছে। না হলে চাষের জমিতে কেউ খাদান করে? কী শুনেছিল, কে জানে? সেদিনই দুপুরে নকুল ওর কাছে এসে বিরক্ত গলায় জিগ্যেস করেছিল, ‘তুর মতলবটা কী বুল ত? গেরামে থাকার ইচ্ছে তুর আছে?’

প্রশ্নটা কেন করছে জিয়ন তা জানে। তবুও বলেছিল, ‘ই কথা কইছিস ক্যানে?’

‘আইশ্রমের সন্ন্যাসীদের সঙ্গে তুকে কে ইত ভাবভালোবাসা কইরতে বুলেছে? উয়াদের কানছে তু জমি বিককিরি কইরেছিস ক্যানে? তু জানিস না, পঞ্চায়েতের কেউ উয়াদের পছন্দ করে না?’

‘মুই ত জমি বিককিরি করি লাই। মোর জমি… মুই কী কইরব, পঞ্চায়েত বলার কে বটে?’

নকুলের সঙ্গে সেদিন অনেকক্ষণ কথাকাটাকাটি হয়েছিল জিয়নের। ও ভয় দেখিয়েছিল, খুটদার খুড়ারা ভয়ানক চটে রয়েছেন। মুখিয়া যে-কোনওদিন মিটিন ডেকে শাস্তি দিতে পারেন। সাঁওতাল সমাজে সেই বিধান গেরামের সবাই মানবে। পরবের সময় কেউ ওকে ডাকবে না। হাটে-বাজারে কেউ ওর সঙ্গে কথা বলবে না। ও একঘরে হয়ে যাবে। এসব শুনেও জিয়ন একটুও পিছিয়ে আসেনি। নকুলকে কিছু বলা মানে, সবার কানে তা পেৌঁছে দেওয়া। জোর গলায় ও বলে দিয়েছিল, মাটি কাটা হয়ে গেলে আপাতত ও তাতে জল ভরে রাখবে। তারপর কী করবে, পরে ঠিক করবে।

নকুল মোটামুটি একটা ধারণা নিয়ে গিয়েছিল, জমিতে ধরে রাখা জল জিয়ন সেচের জন্য দেবে। জেলার নানা জায়গায় এই রকম জলাধার তৈরি করার জন্য গেরামের লোকেদের আজকাল উৎসাহ দিচ্ছে সেচবাবুরা। মুখে নকুলকে যা-ই বলুক না কেন, জিয়ন ঠিক করেই ফেলেছে, ও কী করবে। মাটি খননের কাজ চলছে প্রায় তিন হপ্তা ধরে। খেতের এক দিকটায় প্রায় পাঁচ-ছ’ফুট মাটি তোলা হয়ে গিয়েছে এক্সক্যাভেটর দিয়ে। এই যন্তরটা জিয়ন চেনে। জনমজুরি খাটতে গিয়ে দেখেছিল। রাঁচি থেকে দুটো এক্সক্যাভেটর নিয়ে এসেছেন দয়ানন্দ মহারাজরা। সেইসঙ্গে চার-পাঁচটা ডাম্প ট্রাকও। মাটি তোলার সঙ্গে সঙ্গে ডাম্প ট্রাকে করে তা ওঁরা নিয়ে যাচ্ছেন আশ্রমের দিকে।

রাতে রোজই একবার করে টর্চ নিয়ে খেতের দিকে যায় জিয়ন। আজও বেরিয়েছে, কত মাটি কাটা হয়েছে, তা দেখার জন্য। বিকেলের দিকে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল। মেঘশূন্য আকাশে বাঁকা চাঁদ। পিছল আল ধরে এক চক্বর মারার সময় হঠাৎ ওর চোখে পড়ল, একটা এক্সক্যাভেটর গাছের উপর কাত হয়ে রয়েছে। এত বড়ো যন্তরটার ওই অবস্থা হল কী করে, তা নিয়ে খানিকক্ষণ ভাবতেই জিয়নের মনে হল, এ মানুষের কম্ম নয়। নিশ্চয়ই হাত্থি ঠাকুরদের কাজ। ঝালদা থেকে এই রাস্তা দিয়েই হয়তো ওরা আজই ফিরে গিয়েছে বেলামুর দিকে। ওদের আক্রোশ থেকে যন্তরও রেহাই পায়নি। আজব যন্তরটা কী, জানার জন্য নিশ্চয় ওরা ঢুঁসো মেরে গিয়েছে। জিয়ন ভেবে একটু অবাকই হল, হাত্থি ঠাকুরের দল খটঙ্গার পাশ দিয়ে চলে গেল, অথচ গেরামের লোক কেউ টের পেল না!

মেঠো রাস্তার দিকে এগোনোর সময  হঠাৎ ক্ষীণ স্বরে হাত্থির ডাক শুনতে পেল জিয়ন। ডাক না বলে, আর্তনাদ বলা ভালো। টর্চের আলো ফেলতেই ওর চোখে পড়ল, বাচ্চা একটা হাত্থি প্রাণপণ খাদ থেকে উঠে আসার চেষ্টা করছে। বোধহয় দলছুট হয়ে গিয়েছে। অন্ধকারে বুঝতে পারেনি, তাই গড়িয়ে পড়ে গিয়েছে খাদে। দলের বড়োদেরও সেটা চোখে পড়েনি। কয়েক মিনিট ধরে বাচ্চাটার ভয়ার্ত ডাক শুনে জিয়ন আর স্থির খাকতে পারল না। খাদে বৃষ্টির জল জমে রয়েছে। হাল ছেড়ে দিয়ে, বাচ্চাটা একটা সময় জলে ডুবেও মারা যেতে পারে। ওর খেতে যদি তা হয়, তা হলে কী হবে ভাবতেই শিউরে উঠল জিয়ন। গেরামের মানুষের ধারণা হবে, বদলা নিতে গিয়ে ও-ই মেরে ফেলেছে হাত্থি ঠাকুরকে। সবার রোষ এসে পড়বে ওর উপর। না, না, রাতের মধ্যে যে করেই হোক, বাচ্চাটাকে উদ্ধার করতে হবে। কথাটা ভাবতেই হাত্থি বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে ও দৌড়োতে শুরু করল বুধিরামের বাড়ির দিকে।

আধ ঘণ্টার মধ্যেই গেরামের মানুষ এসে হাজির খেতের চারপাশে। জুয়ান মরদরা তো বটেই, এমনকী মেয়া-বউরাও। হাত্থি ঠাকুরকে বাঁচাতেই হবে। না হলে পুরো গেরাম মারাংবুরুর কোপে পড়বে। কারও হাতে রশি, বাঁশ। কারও হাতে মশাল, হ্যাজাক, টর্চ আর কাঠের পাটাতন। অতি উৎসাহে অনেকেই খাদে নেমে পড়ল। কিন্তু, এত মানুষজন আর আলো দেখে মারাত্মক ভয় পেয়ে গিয়েছে বাচ্চাটা। বারবার চেষ্টা করছে খাদের ঢাল দিয়ে উপরে ওঠার। কিন্তু নরম কাদায় পা পিছলে বারবারই নীচের দিকে নেমে যাচ্ছে। খানিকক্ষণ এদিক ওদিক দৌড়োদৌড়ি করে, শেষে লুকোনোর জন্যই জলে গা ডুবিয়ে দিল বাচ্চা হাত্থিটা। কিছুতেই তাকে আর ডাঙ্গায় তোলা যায় না। গেরামের মাতব্বররা একেকজন এক এক রকম পরামর্শ দিচ্ছেন। কিন্তু, ওই হই হট্টগোলে, কে শোনে কার কথা?

ঘণ্টা পাঁচেক যুদ্ধ করে মরদরা গলদঘর্ম। কে যেন বুদ্ধি করে কলাগাছ কেটে এনেছিল। সেটা মুখের কাছে ধরতেই জল থেকে বাচ্চা হাতিটা উঠে এল। বোধহয় খিদে পেয়েছিল। নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে সে কলাগাছ চিবোতে শুরু করল। দৃশ্যটা দেখে আলে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো উৎফুল্ল, ‘হাত্থি ঠাকুর সেবা লিয়েছে গ।’ সেই সুযোগে নকুল ফিসফিস করে জিয়নকে বলল, ‘চল ভাই, পেইটে রশির ফাঁস দেই বটে। পরে টেইনে উপরে তুইলে লিব।’ জিয়ন তখন পরম মমতায় বাচ্চাটার মাথায় হাত বোলাচ্ছে।

বাচ্চাটাকে আলের উপর তোলা হয়েছে। চারদিকে গোল হয়ে তাকে সবাই ঘিরে রয়েছে। ভোরের আলোয় একটা অদ্ভুত দৃশ্য জিয়নদের চোখে পড়ল। পূব দিক থেকে মত্ত হাত্থির দল এদিকে আসছে। মাঝ রাস্তায় হয়তো ওদের খেয়াল হয়েছে, বাচ্চাটা সঙ্গে নেই। তাকে উদ্ধার করার জন্য রণহুংকার দিয়ে ফের ওরা ফিরে আসছে। ভয়ে গেরামের মানুষ পালিয়ে গেলেও নকুলের সঙ্গে জিয়ন কিন্তু আলের উপর দাঁড়িয়ে রইল। হাত্থি ঠাকুরদের আর ও ভয় পাচ্ছে না। ওদের উপর ওর আর কোনও রাগও নেই। দয়ানন্দ মহারাজের কথাই ঠিক। এই পৃথিবীটা শুধু মানুষদেরই নয়, সব প্রাণীর। মানুষ যেহেতু সবথেকে বুদ্ধিমান, তাদেরই সবথেকে বেশি মানিয়ে চলার চেষ্টা করতে হবে। আলের উপর দাঁড়িয়ে জিয়ন দেখতে পেল, বাচ্চাটাকে পেয়ে হাত্থি ঠাকুরের দল প্রচণ্ড খুশি। শুঁড় দিয়ে সবাই ওকে আদর করছে। শুঁড় উঁচিয়ে ওরা ডাকছে। দেখে জিয়নের মনে হল, গেরামের মানুষদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে। খানিক পরে থামের মতো পাগুলোর আড়াল দিয়ে ওরা বাচ্চাটাকে নিয়ে রওনা হল বেলামু পাহাড়ের দিকে।

জিয়নের সারা মন জুড়ে এখন আনন্দের অনুভূতি। মেঠো রাস্তা দিয়ে নকুলের সঙ্গে বাড়ির দিকে আসার সময় মনে মনে ও স্থির করে নিল, বেলায় ও একবার আনন্দপুর আশ্রমে যাবে। দয়ানন্দ মহারাজের আশীর্বাদ নিয়ে আসবে। মহারাজ ওকে একটা ভালো পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘মাটি কাটা হয়ে যাওয়ার পর বৃষ্টির জল ধরে রেখে তুমি মাছের চাষ শুরু করো জিয়ন। তোমার মাছ আমরাই কিনে নেব। এর পর থেকে হাতির দল গেরামে এলেও তোমার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না।’ কথাটা ওর মনে ধরেছিল। হাত্থি ঠাকুরদের জব্দ করার এই সুযোগটা ছাড়তে চায়নি জিয়ন। মাঝে দয়ানন্দ মহারাজ কিছু টাকা ওকে দিয়েছেন। একদিন তাই পুরুলিয়া শহরে গিয়ে ও কথাও বলে এসেছে মৎস্য দফতরের বাবুদের সঙ্গে। ওঁরা বলেছেন, সবরকম সাহায্য করবেন।

এই মুহূর্তে আরও একটা কাজ বাকি রয়েছে জিয়নের। তার জন্য ওকে বলরামপুর যেতে হবে। গিয়ে সন্তোষ খুড়াকে বলতে হবে, ‘রাইমণিকে বিহা কইরতে চাই। কত্তো টাকা গন্নকাউডি (পণ) দিইতে হবেক, দয়া কইরে বলেন।’

বৃষ্টি বৃষ্টি

আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে অঝোরে।

আকাশে কালো ঝাঁক মেঘ। বৃষ্টির দাপটে আর হাওয়ার ভারে কোথায় কোন দিকে চলে যাচ্ছে বোঝা মুশকিল। সকাল গড়িয়ে দুপুর হল ভিজতে ভিজতে, দুপুর গড়িয়ে বিকেলের মুখোমুখি অন্ধকার নামল। পুরো শহরটা বৃষ্টিতে ঝাপসা, তার ভেতরেই চলছে বাস, ট্রাম। ছাতা মাথায় লোকজন, বৃষ্টি বলে কাজ থেকে কোনও ছুটি নেই। তবে সব দৃশ্যাবলি পালটে গেছে! মনে হচ্ছে, অচেনা শহর যেখানে সব সময় বৃষ্টি হয়, খানিকটা চেরাপুঞ্জির মতন। কলকাতা তবে অঝোর বর্ষণে চেরাপুঞ্জি হল? হোক না। পালটে যাক সবকিছু– প্রকৃতি, শহরের ধুলোমাটি, মানুষজন।

গড়িয়াহাট থেকে ত্রিকোণ পার্কের রাস্তার কোনায় এই দোতলা রেস্তোরাঁ। দোতলায় জানলার ধারে বসে আছে শ্রেয়া। বৃষ্টিভেজা চেনা শহর সামনে। না, ঠিক চেনা নয়, নতুন শহর। ভেজা ট্রাম, বাস, ট্রাম লাইনে বুলেভার্ডের নাম জলে ডুবে গেছে। ডোবা ট্রাম লাইন, একটা ট্রাম দাঁড়িয়ে গেছে, এগোচ্ছে না, জল নামলে এগোবে। বুলেভার্ডের জলে মনে হচ্ছিল, এই শহরের গায়ে বড়ো নদী থেকে বান এসেছে। তার এখানে আসার পরে সন্ধে নেমেছে, মনে হচ্ছে, বেশ রাত। তাকে হাওড়ায় কদমতলায় ফিরতে হবে, অত দূরের গাড়ি পাওয়া একটু অনিশ্চিত এই ঝাম বৃষ্টিতে।

নীলেশের দেখা নেই, হয়তো আসবে না, বসিয়ে রাখবে।

যতটুকু সে জেনেছে, আজকাল তার আড্ডাখানা খালাসিটোলায়, মদে টালমাটাল হলেই সে নিজের মধ্যে নিজেকে ফিরে পায়। কোনও দিন ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ওদিকের বারের ছোটো নাচনি জুটে যায়। কোনও দিন গার্ডেনরিচের জুয়োর আড্ডা থেকে ফিরতে ফিরতে রাত ফুরোয়। সব কিছু খুইয়ে ওটাই খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরেছে নীলেশ। এমন পুরুষের ছায়াগ্রহ থেকে বেরিয়ে অনেকটা স্বস্তি পেয়েছে শ্রেয়া। প্রথমে সংকোচ, কষ্ট, লজ্জা ছিল, এখন কিছু নেই।

এই রেস্তোরাঁয় আসা নতুন নয়। যখন ওদের দু’জনের জানাচেনা, তখন থেকে। নীলেশ একটা পেন্টস্ কোম্পানির সেলসের নীচুতলার অফিসার ছিল। সপ্রতিভ, স্মার্ট চেহারা, মুখে অনর্গল বাংলা, ইংরেজি, কিছুটা হিন্দি। শ্রেয়া হাওড়ার বেলিলিয়াস রোডে একটা নামি ইংলিশ মিডিয়াম গার্লস স্কুলের টিচার। স্কুল রং করাবার টেন্ডারে নীলেশ এসেছিল। প্রিন্সিপালকে খুব স্মার্টভাবে রাজি করিয়েছিল। শ্রেয়ার দেখাশোনার মাধ্যমে কাজটি।

প্রথম পরিচয়টুকু যখন গাঢ় হল, টেন্ডারের লাভ-ক্ষয়ের পাওনাটুকু ওদের লুকোচুরি দিয়ে আরও এত কাছে এনেছিল, মনে হয়েছিল, ইট কাঠের বাড়ি কোনও আশ্রয় নয়। তারা দু’জনে পরস্পরের আশ্রয়। দুই বাড়িতে ওদের বিয়ের অভিমত একরকম ছিল না। তবু তারা সান্ত্বনা পেয়েছিল, যখন কোর্ট ম্যারেজ হয়ে গেল। নীলেশ ঠাট্টা করে ছুটির দিনে মাঝে মাঝে বলত, ‘তুমি কাগজের বউ’। সঙ্গে কিছুটা আদর আতিশয্য, মনে হতো, মেয়েলি জীবনে যা কিছু ধরাবাঁধা, তার বাইরে, শুধুই আনন্দ! দিশেহারা হয়ে যেত শ্রেয়া। তার মেয়েলি বয়সের আনাচেকানাচে।

ব্রাউন ড্রেস পরা কাজের ছেলেটা ওকে অনেকদিন থেকে চেনে, বছর তিনেক আগে তারা যখন এখানে প্রায়ই আসত। জানলার ওপিঠে রাস্তা, এপিঠে ছোটো টেবিল, এটাই ছিল তাদের পছন্দের জায়গা। কথা বলতে বলতে শহরটাকে মগ্ন চোখে দেখা। নীলেশ আচ্ছন্নের মতো অন্যরকম বলত। তারা শহরের কেউ নয়, শুধু দুটি মানুষের ভালোলাগা বলে এখানে থাকা। শহরটি নিজেই বড়ো জটিল, বিশ্রাম বলে কিছু নেই। তাদের দু’জনের পরস্পরের মনের জটিলতা কোথায়, কখন কেটে গেল, তারা বুঝতে পারেনি। জীবন তো এমনই, বোঝা যায় না!

নীলেশ তিরিশ, শ্রেয়া পঁচিশ। পাঁচ বছরের ফাঁকটুকু নিয়ে শ্রেয়া অন্য চোখে দেখত নীলেশকে। প্রথমে সমীহ খানিকটা দূরত্ব। ওটা একদিন সরে গিয়ে প্রেম-ভালোবাসা, সেটাও সরে গিয়ে প্রথম কদম ফুলের আমোদে শারীরিক সম্পর্ক। শ্রেয়ার বয়সটা আকুল-বিকুল। তখন মেয়েরা অবলম্বনই খোঁজে। পছন্দ-অপছন্দের আড়াল পড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক বা ওটা সরিয়ে আরও কাছাকাছি আসা।

কাজের ছেলেটা কাছে এসে দাঁড়াল, ‘দিদি, আর একবার চা, না কফি?’ শ্রেয়া মাথা নাড়াল, এখন নয়। ছেলেটা চলে গেল অন্য টেবিলে। ঘড়ি দেখল শ্রেয়া। নীলেশের আসার সময় ফুরিয়ে গেছে। মোবাইল নাড়াচাড়া করে দেখল। কোনও কল মেসেজ আসেনি। তার মোবাইল নম্বরটা এখনও নীলেশের ফোনে আছে. না মুছে গেছে?

বিয়ের দিনকাল বছর দুয়েক গড়াতেই তারা পরস্পরের কাছ থেকে মুছে যাচ্ছিল।

বাঘাযতীন স্টেশনে দু’ নম্বর প্ল্যাটফর্মের উলটোদিকে জলাজমি, ডোবা। তবু বাড়িঘর উঠছিল। ওখানেই একটা দোতলা ঘরের ওপরে দু’কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল নীলেশ। এদিকটা নাবাল বলে আরও অনেক ফাঁকা জমি ছিল তখন, এলোমেলো ছাঁদের কিছু বাড়িঘর। তখন ভোরের মিহি নৈঃশব্দ্য ভেঙে কয়েকজনের কীর্তনের দল চৈত্র-বৈশাখ দু’মাস খোল খঞ্জনি বাজিয়ে ঘরে ঘরে নামগান শোনাত। প্রোমোটারদের জমি দখল চলছিল। একদিন দলটা কবে, কোথায় চলে গেল, কেউ জানল না তেমন করে।

বাড়ির একটু দূরে একটা জলাভূমি ছিল, সেখানে থোকা থোকা শালুক, জলপিপি, কোঁচবক, কখনও কখনও পানকৌড়ি। মজা জলাভূমি, বর্ষার জল থৈ থৈ, অন্য সময় প্রায় শুকনো। বর্ষায় জলাভূমির পাড়ে কাশফুল ফোটে। ওটাও প্রোমোটারের দখলে, বুজিয়ে আবাসন উঠবে, বদলে যাবে চারপাশ।

তার আগেই বদলে গিয়েছিল নীলেশ।

বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে নানা অসংগতি ধরা পড়ছিল শ্রেয়ার চোখে। নীলেশের জুয়োখেলার, মদের নেশা, কাজে মন নেই। সে বুঝতে পারছিল, নীলেশের কাছে পরিবার, সংসার এসব অবান্তর কথা। জীবন আছে বলে, ওদিকে একটা মোড় নেবে, তা কেন? বিয়ের আগে স্বাভাবিক মেলামেশায় নিজের চরিত্রের অনেক কিছু আড়ালে রেখেছিল, জানতে দেয়নি।

কাজের প্রতি কোনও নিষ্ঠা ছিল না নীলেশের। পেন্টস্ কোম্পানিতে সেলসের কাজ, মাসের সেলস্ টার্গেট ছিল, সেটা কোনও দিনও পূর্ণ করতে পারেনি, চেষ্টাও ছিল না। পরিণতি এগিয়ে এল, একদিন চাকরিটা আর রইল না। তারপরই উড়নচন্ডী ও ছন্নছাড়া জীবন। টাকাপয়সা ও অন্যান্য ব্যাপারে শ্রেয়ার মুখাপেক্ষী, তাও বেশ জোর খাটিয়ে। খালাসিটোলায় মদের আড্ডা, নাচনি-বারের মেয়েদের কাছে যাওয়া, জুয়োর দান ফেলা, টাকা উঠলে ঘরে না ফেরা। এক অবাঞ্ছিত কষ্ট, ভাঙচুর নিয়ে শ্রেয়ার জীবন নানা নিন্দায় জড়িয়ে যাচ্ছিল।

শেষে ঘর ছাড়তে হল। বাঘাযতীনের ভাড়ার ঘর ছেড়ে হাওড়ার কদমতলায় বাবার বাড়ি। একবছরের মাথায় ডিভোর্স নেওয়ার সব কাগজপত্র তৈরি। কেস আদালতে উঠবে। নিজেকে নতুন করে গুছিয়ে নিয়েছে শ্রেয়া। মুছে ফেলেছে পুরোনো জীবন। একটা ঘটনা কোনও দিনই মোছা যাবে না, তার যৌবনের কুমারীত্ব নেই, সেটা লুঠ হয়ে গেছে নীলেশের হাতে। এই লুকোনো জায়গাটা কাউকে বোঝানো যায় না, দেখানোও যায় না। নীলেশ ভেবেছিল, ওটুকু দিয়েই সে শ্রেয়ার হাতে দড়ি পরিয়ে বেঁধে রেখেছে কিন্তু শ্রেয়া ততদিনে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, সব কাছের মানুষ কাছের হয় না। নীলেশ তার জীবনে প্রকৃত মানুষ ছিল না, চোখে একটাই শৌখিন নেশা ছিল শরীর লুঠপাটের।

নীলেশ এখনও বাঘাযতীনের ভাড়ার ঘরে থাকে, টাকাপয়সা কোথা থেকে পাচ্ছে, কে জানে। শ্রেয়ার জানারও দরকার নেই। সে পাঠ বছর খানেক হল উঠিয়ে দিয়েছে। আজ সকালে তাকে ফোনে বলেছিল, ডিভোর্সের কাগজে সই করতে হবে। দু’জনের বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া ভালো।

শ্রেয়া যখন কথা বলছিল, ঘরের দরজা বন্ধ, বাইরে অশ্রান্ত বৃষ্টি, ফোনের আওয়াজ ভালো শোনা যাচ্ছিল না, তবু নীলেশকে সব বলেছিল, পুরোপুরি বিচ্ছেদের কথা। সঙ্গে সঙ্গে সে রাজি। বিকেল বা সন্ধের সময় ত্রিকোণ পার্কের রেস্তোরাঁয় আসতে বলেছিল। তার বাড়ি থেকে ত্রিকোণ পার্ক দূর নয় কিন্ত শ্রেয়ার কদমতলা থেকে দূর। সেই দূর ভেঙে এসে পড়েছে শ্রেয়া। এর পেছনে আর একটা নতুন জীবনের হাতছানি ছিল।

এখনও সমানে বৃষ্টি, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, মেঘ ডাক দিচ্ছে, নীলেশ আসেনি।

তার শর্তে শ্রেয়া রাজি হয়েছিল। ডিভোর্সের কাগজপত্রে নীলেশ সই করবে, তার বদলে হাজার দশেক টাকা চাই। এটাই তার শেষ দাবি, এরপর তো জীবন থেকে মুক্তি। কথাগুলোয় কোনও হূদ্যতা ছিল না। হাসি ছিল চিবিয়ে চিবিয়ে। কাছাকাছি না থেকেও যথেষ্ট অত্যাচার করা যায়। নীলেশের বাইরে ও ভেতরটা সবই ধরা পড়ছিল। এ জিনিস যে লুকোনো যায় না।

শ্রেয়া মোবাইলে ডায়াল করল নীলেশকে, রিং হচ্ছে, তুলছে না। লাইন কাটল সে। এখন অনিশ্চিতভাবে বসে থাকতে হবে এখানে, কতক্ষণ কে জানে। হয়তো নীলেশ আসবে না। তার বিদ্রূপের হাসি বারবার কানে বেজে উঠছিল। কাগজে সই করার বাহানায় বারবার তাকে ডেকে পাঠাবে, সইয়ের দরও বাড়িয়ে দেবে, তবু আসবে না। স্বস্তি নেই। রাগে, ক্ষোভে শ্রেয়া আনমনা হয়ে যাচ্ছিল। নীলেশ মানুষটা যে এত স্বার্থপর, এটুকু জানা ছিল না। তার জীবনটা বারবার বৃষ্টিতে ভিজেছে– প্রথম প্রথম শান্ত, নির্মল আনন্দে, আনন্দটুকু ফুরিয়ে গেলে বেলাটুকু ফুরিয়ে গেল, তখন ঝমঝম দামাল বৃষ্টি।

অনেকক্ষণ থেকে চায়ের কাপটা সামনে রাখা। বৃষ্টি বাতাসে কখন ঠান্ডা হয়ে সর পড়েছে। এটা আর খাওয়া যাবে না। রাস্তায় বাস, ট্রাম আগের মতো, বৃষ্টি বলে কোথাও কিছু বন্ধ হয়নি। শহর থামতে জানে না। সুখ দুঃখ নিয়ে তার জীবন যে কোথায়, কখন থেমে গেল, সেটা আজ আর মনে পড়ে না। ওখানে উঁকিঝুঁকি দিয়ে আর লাভ কী? ওই জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা উদ্বেগ, দুর্ভাবনা, নীলেশের তাকে নিয়ে ছেলেখেলা। সব কিছু ফুরিয়ে তার চারপাশে শূন্য হয়ে যাওয়ার বেদনা, দুঃখ।

সেই শূন্য জীবনটা আবার ভরে দিতে চাইছে অতীন বলে একজন।

তাদের গার্লস স্কুলের সায়েন্সের টিচার অতীন মিত্র, একই বয়সি। স্কুলের পরিবেশে নানা কিছুতে মানিয়ে নিতে তাকে সাহায্য করেছে। দু’জনে বেশ কাছাকাছি এখন। বাইরে কত খোলা আলো বাতাস নির্জনতা! শ্রেয়া হাঁপিয়ে উঠেছিল। এখন তার নানা অনুশোচনা কিছুটা খেয়ালিপনায় চাপা পড়ে গেছে, মূর্ত হয়ে উঠেছে নতুন জীবন।

গত রবিবারে মেঘলা দিনে তারা চলে গিয়েছিল ত্রিবেণী সঙ্গমে।

হুগলি-রূপনারায়ণ-দামোদর এই তিন নদীর সঙ্গম গাদিয়াড়ায়। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য! মেঘলা দিন, কিন্তু সারা দুপুর বৃষ্টি ছিল না। লোকাল ট্রেনে উলুবেড়িয়া স্টেশন। ওখান থেকে বাস, ঘন্টা দেড়েক পরে গাদিয়াড়া। ভ্যান রিকশায় নদীর পিকনিক স্পটে। খাবারের প্যাকেট সঙ্গে। সারা দুপুরটা সেখানেই কাটিয়েছিল শ্রেয়া ও অতীন। বিকেলের মুখে ঝেঁপে বৃষ্টি চারদিক আঁধার করে, নদীর মোহনা ঝাপসা। ফেরা হয়ে ওঠেনি সেদিন। একটা হোটেলে দু’জনকে রাত কাটাতে হয়েছিল। পরের দিন সকালে ফেরা।

সারারাত নদী মোহনার, সঙ্গমের ঝড়বৃষ্টি।

তিন নদীতে বৃষ্টির শব্দ, আলাদা নয়, একই – ঝমঝমাঝম। রাতে আলো চলে গেল। লোডশেডিং। সেদিন শ্রেয়ার জীবনে এক পশলা বৃষ্টি নেমেছিল সেই নির্জন, নিঃসঙ্গ রাতে। আগের সমস্ত গ্লানি তাকে জড়িয়ে ছিল না, ক্রমশ খুলে যাচ্ছিল, এক পরম শান্তি। অতীন মিশে যাচ্ছিল পুরোপুরি শ্রেয়ার সঙ্গে। অতীনের কাছে টর্চ, জ্বালতে দেয়নি শ্রেয়া।

বাইরে বৃষ্টি, ঘরে বৃষ্টি।

দুটো বৃষ্টি এক নয়। দুটো বৃষ্টি এক নয়, দাপট এবং গহনতা, মগ্নতা, সব আলাদা আলাদা, কারও সঙ্গে কারও মিল নেই। এত বৃষ্টির ধারা? তবু মনে হচ্ছিল, এক স্তব্ধতার ভেতর তারা দু’জনে হয়ে উঠেছিল ব্যাকুলতর। শ্রেয়ার ব্যাকুলতা ফুল কুড়োবার মতো কুড়োচ্ছিল অতীন।

সকালে ব্রেকফাস্টের সময় কথাটা তুলেছিল সে। সারারাত বৃষ্টির পরে শান্ত, ধোয়া, ঝিমধরা ভোর। নদীর বাতাসে গাছপালায় দোলন। কোথাও মলিনতা নেই। তিন নদী মিলেমিশে একাকার। রাতেও তো তারা ওরকম মিলেমিশে…।

‘আমাদের বিয়ের আগে তোমার ডিভোর্সটা হয়ে যাওয়া দরকার।’ অতীন কফি খাচ্ছিল।

‘হ্যাঁ, তাই হবে।’

কথা দিয়েছিল শ্রেয়া। যেটুকু দিলে নিজের বিমূঢ়তা বোঝানো যায়, সেটুকু সে অতীনকে সে রাতেই দিয়েছে। কোথাও কোনও উদ্বেগ ছিল না। সব ব্যাকুলতা শান্ত হয়ে ছিল নিজের মতো। খোলা ছাদে অন্ধকারে জ্যোৎস্নার আবিলতায়। কী সুখ, কী সুখ! একবারও নীলেশের কথা মনে হয়নি। সে আর অতীন, দু’জন মানুষ তুমুল বৃষ্টিতে মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল। নদীটা উঠে এসেছিল ঘরে, তারা ডুবে গিয়েছিল। স্পষ্টই মনে হচ্ছিল, এ-ডোবা জলে ডোবা নয়, অন্য কিছু।

শ্রেয়া দেখল, নীলেশ ঢুকছে।

অবিন্যস্ত, ভেজা চেহারা। ভেজা চুল, মুখ। ভেঙে পড়া চেহারা। ভাঙা গাল, চোখ বসা, চোখের নীচে কালো ছাপ। ময়লা শার্ট। আগে হাতে ঘড়ি থাকত। এখন নেই, জুয়োর অড্ডায় হয়তো বিক্রি হয়ে গেছে। টলায়মান চেহারা। শ্রেয়ার সামনে চেয়ারে বসতে মদের গন্ধ পেল শ্রেয়া। গা গুলিয়ে উঠছিল। নিজেকে চেপে রাখল। যে কাজে এসেছে, তার ভাঙনটুকু নয়, আসলটুকু নিয়ে ফেরা। মুখ বুজে নীলেশের সব বিরোধিতা সহ্য করতে হবে, অপূর্ণ বলে কিছু নিয়ে সে ফিরবে না।

‘বৃষ্টির জন্যে আসতে দেরি হল।’ হাসল নীলেশ। ‘স্কুলে পড়েছিলাম ইমপেশন্ট রেইন, এটা তাই।’

‘কোথায় ছিলে এতক্ষণ? আমি কখন থেকে বসে আছি এখানে।’

‘গার্ডেনরিচ, বেহালা হয়ে আসছি। দুটো জুয়োর আড্ডায় জিতেছি।’

জামার কলার তোলা, এলোমেলো। মুখে দাড়ি, হয়তো শেভ-টেভ করে না। কথাগুলো স্পষ্ট নয়, জড়িয়ে যাচ্ছিল। অর্ডার নিতে সেই ছেলেটা এল, নীলেশকে দেখে মাথা ঝোঁকাল। দু’কাপ কফি আর এক প্লেট ডিম টোস্টের অর্ডার দিল শ্রেয়া। নিজের জন্যে শুধু কফি। বাইরে সমানে বৃষ্টি, গাদিয়াড়ার নয়, কলকাতার। এখানে কোনও বিস্তৃত মোহনা নেই, শুধু ঘরবাড়ি। সাগরের নিম্নচাপ কি বাড়ল? তাকে তো ভিজতে ভিজতে অনেক দূর যেতে হবে– সেই কদমতলা।

শ্রেয়া ব্যাগ থেকে ডিভোর্সের কাগজ বের করল। কোথায় কোথায় সই করতে হবে দেখাল। নীলেশের জামার পকেটে পেন নেই। ব্যাগ থেকে নিজের পেন বের করে দিল শ্রেয়া। নীলেশ চেয়ে আছে তার দিকে, কৌতূহল নেই। অন্যমনস্ক। মুখ তুলে বাইরের বৃষ্টি দেখল। কাগজ দেখছে না, পেনটা ঘোরাচ্ছে। হাওয়ায় কাগজ উড়ে যাচ্ছিল, হাত দিয়ে চেপে রাখল শ্রেয়া। মনে হল, জীবনকে সে হাত দিয়ে চেপে রেখেছে, কাগজ নয়। নীলেশের কাছে এ কাগজ হুড়মুড় করে বৃষ্টি ঢোকার মতো নয়। কিছু একটা পৌরুষেয় অপূর্ণতা, কোথায় তার কষ্ট, মুখে ফুটে উঠছে। মুখ ঘোরাল সে শ্রেয়ার দিকে, সেখানে একরাশ দুর্বলতা, হাসিখুশির চিহ্ন নেই। এ মুখে একদিন আনন্দ ছিল, এখন কিছু নেই।

‘তুমি চলে গেলে বাড়ি ছেড়ে’ নীলেশ আরও অন্যমনস্ক হয়ে গেল নিজের ভেতর। হয়তো ওরকম প্রচ্ছন্নে থাকতে তার ভালো লাগে। ‘আমি এখনও ওখানেই আছি। কষ্ট করে ভাড়া জুটিয়ে আসছি, যে মাসে জুয়োয় টাকাপয়সা পাই, অসুবিধে হয় না, না পারলে ভাড়া বাকি। বাড়িওলা মেনে নিয়েছে। সবসময় যে কাজের মেয়েটি ছিল, তাকে এখনও রেখেছি। যেদিন খুব ড্রিংক করে আসি, সে আমাকে যত্ন করে ঘরে তোলে। তারও জানা হয়ে গেছে, আমার সন্তান দেওয়ার ক্ষমতা নেই, নপুংসক। তুমি জানার পরে বাড়ি ছেড়েছিলে, ও কিন্তু ছাড়েনি।’

রেস্তোরাঁর ছেলেটা কফি, টোস্ট নিয়ে এল। সাজিয়ে চলে গেল। টেবিলে ডিভোর্সের কাগজের ওপর ব্যাগ চাপা দিল শ্রেয়া, উড়ে না যায়। এ যেন মাটির তলার কোনও একটা বীজ, মাটির ওপরে উঠে এসেছে, সামলে রাখতে হবে। নীলেশ একবারও কাগজটা দেখল না। কাঁটাচামচে ডিমটোস্ট খাচ্ছে। বেশ খিদে, ঠোঁট দিচ্ছে কফিতে। ওর হাত কাঁপছে, কফির কাপটা পড়ে না যায়, হয়তো মদটা আজ বেশি হয়ে গেছে বৃষ্টির দিনে। আগেও বৃষ্টিভেজা রাতে ঘরে মদের বোতল ঢুকত।

সংসারে যা কিছু মেয়েলি প্রাপ্য তা পাবে বলেই নীলেশকে নিয়ে ঘর বেঁধেছিল শ্রেয়া। তার কিছুই সে পায়নি। রাতে বিছানায় নীলেশ শুধু জেগে থাকত, বুকে ব্যথা বা নেশার ঘোরে ঘুমিয়ে পড়ত। একবারও ফিরে তাকাত না শ্রেয়ার দিকে। শ্রেয়ার তখন বড়ো কষ্টে মনে হতো, সে বিবাহিত হলেও সংসারে প্রাপ্য বলে মানুষটির কাছে কিছুই নেই। দু’জনের সম্পর্ক ভেঙে দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করেছিল।

‘তোমার কি বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভালো লাগে?’ নরম, হালকা, আন্তরিক গলায় এমন একটা কথা শুনে অবাক হল শ্রেয়া। বৃষ্টিও কি মানুষকে বদলে দেয়? সম্পর্কগুলো ধুয়ে মুছে যায়, না নতুন করে জোড়া লাগে? চেনা মানুষটাকে কৌতূহল নিয়ে দেখল শ্রেয়া।

টোস্ট খাওয়া হয়ে যেতে প্লেট সরিয়ে রাখল নীলেশ। খালি কফির কাপটা শ্রেয়ার কাপের পাশে রাখল, পাশাপাশি কিন্তু মাঝখানে একটু ফাঁক। দুটো খালি কাপের এটাই হয়তো সান্ত্বনা, তারা পাশাপাশি আছে।

নীলেশ কাগজের দিকে হাত বাড়াল। ব্যাগের নীচ থেকে কাগজটা বেশ আগ্রহ নিয়ে বের করে দিল শ্রেয়া। পাশেই পেন পড়ে আছে। পেন তুলে নিল নীলেশ, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল। দেখছিল না, ভাবছিল কিছু। তার ভাঙাচোরা চেহারা দেখে শ্রেয়ার হঠাৎ মনে হল, এই নীলেশকে সে চেনে না। সে কি কাগজে সত্যিই সই করবে, কি করবে না? বড়ো আশা নিয়ে এসেছে শ্রেয়া আজকের প্রবল বৃষ্টিতে। আর একটা জীবন তার নাগালের বাইরে, যদিও গাদিয়াড়ার বৃষ্টিতে ভিজেছিল দু’জনে। ওই জীবনটাও কি কোনও শূন্য জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে? এক জীবনে কত পুরুষকে সে দেখবে?

‘সই দেওয়ার পরে আমাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে?’

নীলেশ সই করল! পেনটা শুইয়ে রাখল কাগজের পাশে। অবাক হল শ্রেয়া। রোগীরা ওষুধ খাওয়ার আগে যেমন শুকনো হাসি হাসে, বাহানা করে, নীলেশের ইচ্ছে তেমনই যেন কিছু, বলছে না।

‘সম্পর্ক শেষ করার জন্যই তো কাগজপত্রে সই করা। এ কাগজ যাবে কোর্টে, জজের বিচারে ডিভোর্স হবে। আমরা তখন বিচ্ছিন্ন পরস্পরের কাছ থেকে।’

‘বি-চ্ছি-ন্ন শব্দটি বেশ। এই বৃষ্টিবাদলার দিনে শব্দটি শুনতে ভালো লাগছে। আমার কিন্তু আরও শর্ত আছে। আসলে আজ দু’বোতল ঠাররা নিয়েছি, মাথাটা ঠিক কাজ করছে না, কোনটা নকল কোনটা আসল বুঝতে পারছি না, ঝাপসা লাগছে। তোমাকে ঠিক দেখা যাচ্ছে না, চেনা যাচ্ছে না– সব ঝাপসা ঝাপসা, অথচ একদিন তুমি আমার ছিলে। তোমার সবই আমার চেনা– রূপ, যৌবন, শরীর।’

চমকে উঠল শ্রেয়া। নীলেশের অনেক কথাতে চমক ছিল। স্পষ্ট হয়ে উঠত না অনেক কিছু– তাদের একসঙ্গে থাকা, নরনারীর স্বাভাবিক বা গোপন সম্পর্ক, কিন্তু আজ অন্যরকম লাগছে তাকে। পুরুষ যখন ঝাপসা হতে থাকে তখন তার আর নিজের অন্তর নিয়ে হয় বড়ো মুশকিল।

‘শর্ত তো তোমার একটাই, দশ হাজার টাকা চেয়েছিলে, এনেছি।’ শ্রেয়া ব্যাগে হাত রাখল– ‘চেন খুলতে হবে, টাকাটা ভেতরে।’

‘আমি তো ভুলেই গেছলাম। দাও।’

ব্যাগের ভেতর পাঁচশ টাকার কুড়িটা নোট রবার ব্যান্ডে বাঁধা। সেটা বের করে নীলেশকে দিল শ্রেয়া। টাকাটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল নীলেশ। হাতের তালুতে কয়েকবার বাজাল। বৃষ্টি দেখল জানলা দিয়ে। ঘন বৃষ্টি, ট্রাম লাইন ঝাপসা, ভেজা আলোর নীচে বাস, ট্রাম। এই দুর্যোগের বেলাতেও সবাই চলমান।

হঠাৎ শ্রেয়ার ব্যাগ কাছে টেনে নিল নীলেশ। চেন খুলে পুরো টাকার বান্ডিল ঢুকিয়ে রাখল। ‘এটা আমার কাছে থাকলে জুয়োয় বা মদে উড়ে যাবে। খালাসিটোলায় পড়ে থাকব, কোথাও যাব না। আমার শর্ত ফিরিয়ে নিলাম।’

শ্রেয়া দেখল ডিভোর্সের কাগজটা এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে টেবিলে, পেনটা চাপা দেওয়া। হাওয়ায় কাঁপছে, বিয়ে ভাঙার কাগজ। শ্রেয়া কাগজের বউ নয়। মানুষ, যুবতি। অতীনকে গুছিয়ে নিয়েছে নতুন ঘর বাঁধার। চিরটা কাল সে ভাঙা ঘাটে নৌকো লাগিয়ে থাকবে না, ঘাট বদল করবে।

‘আমার অন্য শর্ত আছে সই করার।’

নীলেশ হাসল। দুর্বল মুখে হাসিটা আরও দুর্বল, বেমানান। শ্রেয়ার সঙ্গে সে বাগড়া করতে আসেনি, কোনও অসদাচরণ নয়। শ্রেয়া কথা বলল না, বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। মুখ তুলল, সে মুখে প্রশ্নের চিহ্ন কিন্তু শব্দ নেই। ঘরের ভেতরে উজ্জ্বল আলো, পাখাও চলছে।

‘আজকের রাতটা আমার সঙ্গে কাটাতে হবে, বাঘাযতীনের বাড়িতে, তারপর কাগজে সই করব।’

শ্রেয়ার মনে হল, চারদিকে নিরবচ্ছিন্ন আঁধার, ঘুটঘুটে, দামাল বৃষ্টি। কত রকম শব্দ ভাসছে। ভাসতে ভাসতে দূরে চলে যাচ্ছে। নীলেশ তুচ্ছ, তার খালাসিটোলাটা উঠে আসছে দু’হাত বাড়িয়ে। জুয়োর পাশা ফেলেছে নীলেশ। পাশার দান বেয়ে তাকে ঘরে উঠতে হবে, সেখানে শুরু হবে রাতের দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ খেলা।

শক্ত হল শ্রেয়া, ‘তোমার শর্তে আমি রাজি নই।’

‘আসলে বাইরে বৃষ্টি পড়ছে তো। বৃষ্টি পড়লে মন নরম হয়। আমি মোদো-মাতাল। বৃষ্টিতে বদলে যাই। অ্যান্টিসোশ্যাল লোকও বৃষ্টি দেখে ভাবে, কোনও মেয়েকে ভালোবাসবে। বৃষ্টি দেখে আজ আমার পুরোনো ঘরের কথা মনে পড়ল, তুমি আর আমি। বেশ যেও না।’ নীলেশের নরম গলা।

নীলেশ ডিভোর্সের কাগজটা নিয়ে শ্রেয়া যেখানে সই করতে বলেছিল, সই করল। কাগজটা হাতে দিল। ব্যাগবন্দি করল শ্রেয়া। ‘রাত হচ্ছে, বৃষ্টির রাত। আমাকে সেই কদমতলায় ফিরতে হবে।’

‘সেইজন্যই তো কাছাকাছি করে তোমাকে ডেকে ছিলাম। যা কিছু পাপ, ধুয়ে ফেলার ইচ্ছে, এই বৃষ্টিতেও সেটা হল না। ঠিক আছে, যাও।’

নীলেশের দিকে তাকাল শ্রেয়া। আত্মতৃপ্তি না হলে মুখ যেমন বিষণ্ণ ভাঙাচোরা মনে হয়, ঠিক তেমনি। মদের ঘোরে টলমলে, চকচকে চোখ, একটা অসহায় অন্য জগতের মানুষ। এলোমেলো চুল নেমে এসেছে কপালে, সবই হতশ্রী, বোঝা যায়।

‘বৃষ্টিটা পুরোনো কথা মনে পড়িয়ে দেয়।’ বলল নীলেশ। ‘একবার বৃষ্টির দিনে ছাদে আমরা দু’জনে ভিজেছিলাম, মনে আছে? তুমি গাইছিলে– বারি ঝরে ঝরঝর, আজ বারি সারাদিন। এখনও ভুলিনি কিছু। ছোটোবেলায় বৃষ্টিতে কাগজের নৌকো ভাসাতাম, ডুবে যেত। তোমার ডিভোর্সের কাগজে তৈরি নৌকোটা ভাসিয়ে দিলে ভেসে যাবে, ডুবে যাবে।’

‘না, ডিভোর্সটা আমার চাই।’

অতীনকে নিয়ে শ্রেয়া মুক্তির আনন্দ চাইছে। খালাসিটোলার মানুষের বৃষ্টিতে ভেসে যাবে না সে। কতদিন একা একা। ভালো লাগছে না কিছু। কাঁধে ব্যাগ নিল সে, দরজার কাছে গিয়ে একবার পেছন ফিরল শেষবারের মতো। নীলেশ জানলায় বৃষ্টি দেখছে। এই বৃষ্টিতে তার পুরোনো নেশা ফিরে এসেছে, শ্রেয়াকে নিয়ে রাত কাটাবে। ওটা কি খালাসিটোলার নেশা থেকে আরও গাঢ়, আরও আনন্দময়, নাকি পুরোটাই বেদনাময়?

সে দেখল, দুটো খালি কাপ পাশাপাশি, মাঝে একটু ফাঁক বা দূরত্ব। থাক না দূরত্বটুকু। কী দরকার কাছাকাছি আসার? এলেই টুঙ্ শব্দ উঠবে, সেই নাড়াচাড়ায় হয়তো একটা কাপ ভেঙেও যেতে পারে। দূরত্বে থেকেও তো তার জীবনটা ভেঙে গেল। সবই অসময়– জীবন, বৃষ্টি।

রাস্তায় বেরিয়ে শ্রেয়া দেখল, বেশ জোরেই বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা খুলল সে। একটা ডবলডেকার বাস ভিজতে ভিজতে আসছে, মাথায় লেখা – হাওড়া। এই বাস অনেক বছর বন্ধ ছিল, আবার শুরু হয়েছে। এগিয়ে গেল সে বাসের দিকে।

পেছনে তাকালে সে দেখতে পেত, রেস্তোরাঁর জানলার বাইরে নীলেশের মুখ ঝুঁকে আছে। কাউকে খুঁজছে। বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে আসছে মুখটা, সেই সঙ্গে ঝাপসা– সমস্ত নিঃসঙ্গতা, সম্পর্ক, ঘরবাড়ি। কারও কোনও অপেক্ষা নেই। বৃষ্টি– বৃষ্টির মতো ঝরল। শ্রেয়া চলে গেল।

সময়

‘রূপা, দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি করো।’

‘এক মিনিট অপেক্ষা করো প্লিজ।’

শ্যামলের ঘন ঘন পায়চারি এবং মাঝেমধ্যে ‘রূপা, রূপা’ বলে হাঁক পাড়া দেখেই নীলিমা বুঝে গিয়েছিলেন, ছেলে আর ধৈর্য রাখতে পারছে না। টেনশন কাটাবার জন্যে সামান্য হেসে ছেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, ‘এত অস্থির হলে চলবে? এখন তুই একা নোস। বাড়িতে বউ এসেছে। জানিসই তো। মেয়েদের সাজতেগুজতে একটু সময় বেশি লাগে।’

‘মা, রাস্তায় যা ট্রাফিক। যদি একবার গাড়ি ফেঁসে যায় তাহলে হয়তো দেখা যাবে, হোস্ট যে, সেই সবথেকে দেরিতে পৌঁছোচ্ছে। সেটা কি ভালো দেখাবে?’

‘চলো আমি রেডি।’ কথার মাঝে দুজনের কেউ-ই খেয়াল করেননি কখন রূপা ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে ঢুকেছে।

শ্যামল প্রশংসার চোখে রূপার দিকে একবার তাকিয়েই মা আর বউকে নিয়ে গাড়িতে এসে বসে। শ্যামল নিজেই ড্রাইভ করতে পছন্দ করে তাই ড্রাইভারও রাখেনি। গাড়ি চালাতে চালাতেই রূপার পুরো চোহারাটা ওর চোখের সামনে মুহূর্তের জন্যে ভেসে ওঠে। লাল শাড়ি আর লাল সিঁদুরের টিপে ও যেন আরও সুন্দরী হয়ে উঠেছে। রূপার চেহারাটা চোখের সামনে থেকে সরাবার চেষ্টা করে শ্যামল। নিজেকেই নিজে সতর্ক করে। শহরের ব্যস্ততম রাস্তায় ও গাড়ি চালাচ্ছে। চোখ কান সজাগ না রাখলে চলবে কী করে! আধা ঘন্টা পার করে গাড়ি এসে দাঁড়ায় হোটেলের সামনে। হোটেলের যে-ঘরটা, ঘর বলা অবশ্য ভুল, যে-হলটা শ্যামলের কোম্পানি বুক করেছিল গেস্টদের জন্যে, সেখানে অতিথিদের আনাগোনা তখন শুরু হয়ে গেছে।

শহরের পাঁচ তারা হোটেলে পার্টির আয়োজনটা করা হয়েছিল। শ্যামলের অ্যাডভারটাইজিং কোম্পানির বার্ষিক সম্মেলন। সঙ্গে রূপাকেও অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার এটাই মস্ত সুযোগ। দুটোই শ্যামলের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ব্যবস্থা করাই ছিল। শ্যামল এসে সোজা এক পাশে রাখা মাইকের সামনে এসে দাঁড়ায়। ‘মাই ডিয়ার ফ্রেন্ডস্, আজকে এখানে উপস্থিত হওয়ার জন্যে সকলকে জানাই আমার শুভেচ্ছা। আপনারা হয়তো সকলেই জানেন, আজ আপনাদের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি শুধুমাত্র আমার বন্ধু এবং ভাই অর্ণবের জন্যে। বাঁচার সব রাস্তা যখন আমার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখন একমাত্র ও-ই আমাকে আশার আলো দেখিয়েছিল। নিরাশায় যখন আমি ডুবে গিয়েছিলাম তখন একমাত্র অর্ণবই আমাকে সাহায্য করেছিল এই কোম্পানিটাকে আবার নতুন করে শুরু করতে। ওর চেষ্টায় এবং আপনাদের সকলের সহযোগিতায় আজ আমি এই জায়গায় পৌঁছোতে সফল হয়েছি, এটা আজ আর কারও অজানা থাকার কথা নয়।’

হাত বাড়িয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রূপাকে মাইকের সামনে টেনে নেয় শ্যামল, ‘আর আমি পরিচয় করিয়ে দিই, আমার স্ত্রী রূপার সঙ্গে। পার্টি উপলক্ষে রূপাকে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সুযোগটা আমি একেবারেই হাতছাড়া করতে চাইনি।’

কোম্পানির সিনিয়র ম্যানেজার মিস্টার বিশ্বাস এগিয়ে আসেন শ্যামলের সঙ্গে করমর্দন করতে। হেসেই জিজ্ঞেস করেন, ‘কী ব্যাপার শ্যামল? লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়েটা তাহলে সেরেই ফেললে? ঘুণাক্ষরেও কাউকে জানতে দিলে না!’

শ্যামলের বন্ধু হিমাংশুও পার্টিতে উপস্থিত ছিল। রূপার সৌন্দর্য তার মনে সামান্য ঈর্ষার অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিল শ্যামলের প্রতি, ‘ভগবান বেছে বেছে তোকেই সবকিছু ঢেলে দিয়েছে। ফুলে ফেঁপে ওঠা ব্যাবসা, সঙ্গে পরমা সুন্দরী বউ। হিংসা না করে পারছি না ভাই তা তুই যাই মনে করিস না কেন।’ শ্যামল হেসে উত্তর এড়িয়ে যায়। লক্ষ্য করে পার্টি সফল করে তুলতে যা কিছু ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তার কিছুই অর্ণব বাদ দেয়নি। অতিথিদের সেবা যত্নে যাতে কোনও ত্রুটি থেকে না-যায় একা দাঁড়িয়ে সেসব সামলাচ্ছে অর্ণব। এমনকী রূপার মা-বাবাকে নিমন্ত্রণ করতে পর্যন্ত সে ভোলেনি।

আজকের দিনটা রূপার কাছে খুব আনন্দের। এই রকমই তো সে শ্যামলকে দেখতে চেয়েছিল। আজকে মা-বাবা, ভাই, ভাইয়ের বউ সকলেই নিজের চোখে দেখতে পেল শ্যামল কোথা থেকে কোথায় পৌঁছেছে। রূপা মনে গর্ব অনুভব করে, যে সে শ্যামলের মতো স্বামী পেয়েছে। অথচ একসময় এই স্বামীর উপরেই কত মানসিক অত্যাচার সে করেছে। আজ ভাবলে লজ্জায় তার মাথা নীচু হয়ে আসে।

হোটেল থেকে বেশ রাত করেই বাড়ি ফেরে রূপারা। নীলিমা সোজা নিজের ঘরে চলে যান। শ্যামল রূপাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন লাগল, আমার বন্ধুদের সঙ্গে আর অফিসের সকলের সঙ্গে পরিচয় করে?’

‘ভীষণ ভালো। তোমার সঙ্গে পার্টিতে গিয়ে আমি সত্যিই খুব আনন্দ পেয়েছি। একটা কথা বলব শ্যামল?’ একটু আমতা আমতা করে বলেই ফেলে রূপা। ‘আমি সত্যিই সরি যে একসময় আমি তোমাকে মানসিক ভাবে নির্যাতন করেছি। আজ মনে পড়লে নিজেকে খুব ছোটো মনে হয়।’

‘চুপ করো, পুরোনো কথা ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবনটাকে এনজয় করো।’ শ্যামল রূপার ঠোঁটে আঙুল রেখে ওকে চুপ করিয়ে দেয়।

সারাদিনের পরিশ্রমের পর, শোবার ঘরে ঢুকে শ্যামল হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় এসেই গভীর ঘুমে ঢলে পড়ে। কিন্তু পাশে শুয়ে ঘুম আসে না রূপার। অতীতের স্মৃতিগুলো এক এক করে সামনে ভেসে উঠতে থাকে।

রূপা সবে সবে তখন এমবিএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। ফ্রেশার্স পার্টিতে শ্যামলের সঙ্গে ওর প্রথম পরিচয়। বন্ধুদের অনুরোধে শ্যামলকে গান গাইতে হয়েছিল। গলাটা সত্যিই মনে রাখার মতো। এর পরে কলেজের কোনও ফাংশনই শ্যামলকে বাদ দিয়ে হতো না। রূপার সঙ্গে পার্টিতে শ্যামলের আলাপ হলেও, শ্যামল রূপাকে এড়িয়েই চলত। সামনা-সামনি দেখা হলে ওই একটা দুটো কথা হতো শুধু। এদিকে শ্যামলের ব্যবহারে রূপার মধ্যেও জেদ চেপে যায় ছেলেটিকে শায়েস্তা করার, কারণ কখন যে নিজের অজান্তেই ধীরে ধীরে ছেলেটি রূপার মনের মধ্যে জায়গা বানিয়ে নিয়েছিল সেটা রূপাও নিজে প্রথমে বুঝতে পারেনি।

কলেজে বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর একদিন রূপা নিজে থেকেই শ্যামলের কাছে গেল। শ্যামল বই খুলে সবে পড়াতে মন দিয়েছে, রূপা পাশে এসে দাঁড়াল, ‘চলো, কোথাও বসে একটু কফি খাওয়া যাক। অনেকক্ষণ লাইব্রেরিতে এসেছি। পড়াশোনার মাঝে একটু রিক্রিয়েশনও দরকার। চলো, ওঠো ওঠো।’ অগত্যা উপায় কী? শ্যামলকে উঠতেই হল। কফিশপে বসে একটু কফি খাওয়া আর গল্পগুজব। ব্যাপারটা এখানেই থেমে থাকল না। কফিশপ থেকে সিনেমা হল, রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসা। রূপার ধীরে ধীরে মনে হতে শুরু করল, শ্যামলকে ছাড়া ওর জীবন শূন্য। একটা অদ্ভুত পাগলামি রূপাকে গ্রাস করতে আরম্ভ করল। শ্যামলকে একান্ত আপন করে পাওয়ার পাগলামি।

এমবিএ কোর্সের ফাইনাল সেমিস্টারের দিন এগিয়ে আসছিল। ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর শ্যামল রূপাকে ডেকে কলেজের বাইরে নিয়ে গেল, ‘শোনো, এখন কিছুদিন আমাদের দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ করা খুব দরকার। কিছুদিন পরেই ফাইনাল পরীক্ষা। যেমন করে হোক আমাকে ভালোভাবে পাশ করতেই হবে ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য।’

‘ও তোমারি বুঝি খালি পরীক্ষা? আমি যেগুলো বুঝতে পারছি না সেগুলো আমাকে কে পড়াবে শুনি?’

‘দ্যাখো, তোমার নম্বর সামান্য খারাপ হলেও তোমার বাড়িতে কেউ কিছু বলবে না কারণ কেরিয়ার নিয়ে তোমার বাবা-মা বা তুমি ভাববে না। ধনী পরিবারে তোমার জন্ম। কোনও বড়োলোকের ছেলে দেখে তোমার বাবা তোমার বিয়ে দিয়ে দেবেন। কিন্তু ক্যাম্পাস সিলেকশনে যদি আমি চাকরি না পাই তাহলে মা খুব ভেঙে পড়বেন। ছোটোবেলায় বাবা মারা গেছে। মা চাকরি করে আমাকে এতদূর পড়াশোনা করিয়েছেন। মায়ের প্রতি আমার একটা কর্তব্যও তো আছে। সুতরাং কিছুদিনের জন্য আমাকে একটু কনসেন্ট্রেট করতে দাও।’ এরপর শ্যামল রূপাকে ছেড়ে হনহন করে হাঁটা লাগিয়েছিল।

কিন্তু এর পরেও রূপা শ্যামলকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিতে পারেনি। সেটা অবশ্য খানিকটা জেদের বশেও বটে। ছোটো থেকে যা চেয়েছে, সেটা খুব সহজে রূপা পেয়েছে। আর যে-ছেলেটিকে রূপা নিজের সবটুকু দিতে প্রস্তুত, সে-ই কিনা রূপার জীবন থেকে সরে যেতে চাইছে, এটা রূপা সহজে কীভাবে মেনে নিত। শুরু হল নীলিমার অনুপস্থিতিতে শ্যামলের বাড়িতে যাওয়া-আসা শ্যামলের মানা করা সত্ত্বেও। সকাল দশটার মধ্যে নীলিমা চাকরিতে বেরিয়ে যান, রূপা সেটা জানত। পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করতে সময় নিল না রূপা। সুতরাং শ্যামলের ভয়টাই সত্যি হল। আগুন আর ঘিয়ের সমন্বয় দুজনকেই দগ্ধ করল কামনার আগুনে।

পরীক্ষার পর বেশ কিছুদিন কেটে গেল। একদিন সকালেই শ্যামল শুনল রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। সাইবার কাফেতে গিয়ে নেটে নিজের রেজাল্ট দেখল। কোনওরকমে জাস্ট পাশ করেছে। ক্যাম্পাস সিলেকশনে ভাগ্যে চাকরিও জুটল না শ্যামলের। রূপার কাছে জানল সে পাশ করতে পারেনি।

ভালো চাকরির সন্ধানে শ্যামল সব জায়গায় দরখাস্ত দিল। কোথাও থেকে ডাক না আসাতে শ্যামল আরও ভেঙে পড়ল। মাঝে শুনল, কোনও এক বড়োলোকের ছেলের সঙ্গে রূপার বিয়ে স্থির হয়েছে।

নিজের চিন্তাতে শ্যামল এতটাই মশগুল ছিল, ফোন কতক্ষণ ধরে বেজে চলেছে তা ও বুঝতেই পারেনি। হঠাৎই আওয়াজ কানে যেতে ও ফোনটা তুলে নিল, ‘হ্যালো?’

‘শ্যামল, প্লিজ ফোনটা নামিয়ে দিও না। শোনো আমার বাড়ি থেকে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারব না। এছাড়াও একটা কথা বলি বলি করেও এতদিন বলতে পারিনি। আমি তোমার সন্তানের মা হতে চলেছি। তাই তাড়াতাড়ি আমাদের বিয়েটা হয়ে যাওয়া উচিত। চলো আমরা মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে নিই।’

‘কিন্তু রূপা এক্ষুনি আমি কী করে বিয়ে করব? আমি অত্যন্ত সাধারণ বাড়ির ছেলে তার ওপর আমার এখন চাকরিও নেই।’ শ্যামলের স্বর করুণ শোনায়। ও কিছুতেই রূপার কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না। ঘটনার মোড় যে ওকে এই পর্যায় এনে ফেলতে পারে সেটা শ্যামল কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। মায়ের মুখখানা খালি চোখের সামনে ওর ভেসে উঠছিল।

‘আমরা এত দূর এগিয়ে এসেছি যে আমাদের আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই। আমি বাড়ি ছেড়ে কিছুক্ষণের মধ্যে তোমার কাছে চলে আসছি,’ এই বলে রূপা ফোনটা কেটে দিল।

শ্যামলের বাড়ি যখন রূপা পৌঁছোল, দেখল শ্যামল বেশ দিশাহারা। ‘এভাবে বসে কী লাভ? মুড টা ঠিক করো। মা অফিস থেকে ফিরলে তুমি না পারো, আমিই মা-কে সবকিছু বুঝিয়ে বলব। উনি কিছুতেই মানা করতে পারবেন না।’

উত্তরে শ্যামল কী বলবে বুঝে পেল না। মায়ের জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় তো কিছু নেই।

অফিস থেকে ফিরে একটি অচেনা মেয়েকে শ্যামলের সঙ্গে দেখে নীলিমা একটু অবাকই হলেন। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রূপা ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম সেরে হাত ধরে ওনাকে চেয়ারে বসান। জিজ্ঞেস করার আগেই রূপা বলে উঠল, ‘মা আমি আর শ্যামল একে অপরকে ভালোবাসি। আমরা দুজনে বিয়ে করতে চাই অথচ আমার বাড়ি থেকে অন্য একটি ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আমি পালিয়ে এখানে চলে এসেছি।’

নীলিমার মাথায় যেন বাজ পড়ল। ‘বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছ মানে? সেকি। না, না, এত তাড়াহুড়োর কী আছে। তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো, বিয়ে করতে চাও, সে তো ভালো কথা। আমিই না হয় যাব তোমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু আগে শ্যামলকে স্বাবলম্বী হতে দাও।’

‘আমার হাতে যে অত সময় নেই মা!’ বলেই নীলিমাকে হতচকিত করে কান্নায় ভেঙে পড়ল রূপা।

নীলিমা তাকে একটু সামলাতে যে কথাটা রূপার মুখ থেকে বেরোল, তাতে যেন পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে গেল নীলিমার। ‘আমি প্রেগন্যান্ট মা। শ্যামলের সন্তান আমার পেটে। এদিকে বাড়ির লোক আমার অন্য জায়গায় বিয়ের ঠিক করেছে।’

নীলিমার ইচ্ছে করছিল ছেলের গালে সজোরে থাপ্পড় কষিয়ে দিতে। ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে এই প্রতিদান ছেলে দিল? লজ্জায় সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াবার আর জো রইল না। কিন্তু সেসব কিছু না করে রূপাকে বললেন চেয়ারে গিয়ে বসতে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার বাড়ির লোকেরা যদি এখানে এসে ঝামেলা করে? কী বলবে তাদের?’

‘আমি ঠিক সামলিয়ে নেব।’

পরের দিন রূপার বাবা আর ভাই এসে শ্যামলের বাড়িতে হাজির হল। মেয়েকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে অনেক চেষ্টা চালাল কিন্তু রূপার মুখে একটাই কথা, ‘আমি এখন প্রাপ্তবয়স্ক। গতকালই আমরা বিয়ে করে নিয়েছি সুতরাং শ্যামল এখন আমার স্বামী।’ বিয়ের কথাটা মিথ্যা হলেও শ্যামলকে সত্যিই রূপা ভালোবাসতে শুরু করেছিল।

এই পুরো ঘটনায় শ্যামলের মুখ থেকে একটাও কথা বেরোয়নি। অপ্রত্যাশিত ঘটনাক্রম শ্যামলকে বোবা করে দিয়েছিল। দুদিন পর নীলিমা পাঁচ-ছয়জন আত্মীয়কে সঙ্গে করে নিয়ে মন্দিরে গিয়ে শ্যামল আর রূপার বিয়ে দিলেন।

রূপা বড়োলোকের আদুরে মেয়ে। নিজের বাড়িতে জল গড়িয়ে কোনওদিন খায়নি। সে এসে শ্বশুরবাড়িতে কাজ করবে এটা নীলিমা আশাও করেননি। শুধু ছেলের স্বপ্ন তাঁর চোখে লেগে থাকত যে শ্যামল একটা ভালো চাকরি নিশ্চই পাবে।

গতানুগতিক সংসারটা চলতেই থাকে নীলিমার। চোখের সামনে ছেলেকে চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরতে দেখেও কোনওভাবেই সাহায্য করার রাস্তা খুঁজে পান না। একদিন শ্যামল এসে মা কে জানায় অনেক কষ্টে কল সেন্টারে একটা চাকরি জোগাড় করা গেছে অবশ্য মাইনে অত্যন্ত সামান্য।

রূপাও খুশি হয় শ্যামলের চাকরির খবর শুনে। বাড়িতে বসে বসে ওর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। সুযোগ বুঝে একদিন সন্ধেবেলা শ্যামল বাড়ি ফিরলে, রূপা ওর গলা জড়িয়ে ধরে, ‘চলো না, আজকে বাইরে থেকে খেয়ে আসি। সেই বিয়ের পর থেকে কোথাও তো আমাকে নিয়ে যাওনি।’

‘কিন্তু রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া মানে বিশাল খরচ।’

‘টাকার চিন্তা তুমি কোরো না। বিয়ের আগে ব্যাংকে আমার একটা অ্যাকাউন্ট করা হয়েছিল সেটাতে বাবা মাসে মাসে টাকা ফেলতেন। ওটা থেকেই টাকা তুলে খরচ করব।’

‘তোমার বাবার টাকায় আমি হাত দিতে পারব না।’

‘এত তোমার কীসের অহঙ্কার? মাইনে তো ওই কটা টাকা। বিয়ের আগে একদিনে ওই পরিমাণ টাকা আমি একসঙ্গে খরচ করেছি।’

‘এই কথাটা বিয়ের আগেই তোমার ভাবা উচিত ছিল। আমি তোমাকে আগেই এটা বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম।’

টাকাপয়সা নিয়ে ঝগড়া, রোজকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রূপার ধৈর্য তলানিতে এসে ঠেকেছে সেটা নীলিমার অভিজ্ঞ চোখ ধরতে পেরে গিয়েছিল। একদিন শ্যামল বেরিয়ে যাওয়ার পর রূপাকে ডেকে বললেন, ‘রূপা, তোমার বিয়ের প্রায় চার মাস হতে চলল। শ্যামল কে নিয়ে একদিনও তোমাকে ডাক্তারের কাছে যেতে দেখলাম না। তোমার চেহারারও তো কোনও পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। অথচ বিয়ের আগে তুমিই তো আমাদের তোমার প্রেগনেন্সির কথা জানিয়েছিলে।’

‘আমি মিথ্যে বলেছিলাম। কোনওরকম ভাবে শ্যামলকে বিয়ের জন্যে রাজি করাতে চেয়েছিলাম। এটা না বললে ও কিছুতেই বিয়েতে রাজি হতো না।

রূপার কথা শুনে নীলিমা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কোনও মেয়ে যে নিজের কাজ গোছাবার জন্যে নিজের সম্মানেকে এভাবে জলাঞ্জলি দেয়, সেটা এই প্রথমবার নিজের চোখে দেখার দুর্ভাগ্য হল তাঁর।

মাঝে মাঝে শ্যামলের বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যেত। একদিন বাড়ি এসে মায়ের প্রচণ্ড জ্বর দেখে রূপাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, ‘ডাক্তার ডেকেছিলে?’

‘সামান্য তো জ্বর, ডাক্তারের কী দরকার?’

তর্ক না করে, হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে শ্যামল মা-কে দুধ গরম করে ওষুধ খাওয়াল। মাথায় জলপট্টি করে জ্বর সামান্য কমলে মায়ের আরামের সব ব্যবস্থা করে নিজের ঘরে গেল। রূপা শুয়ে পড়েছিল। শ্যামলকে দেখে বিছানায় উঠে বসল, ‘সারারাত মায়ের সেবা করে কাটালেই তো পারতে। ঘরে আসার কী দরকার ছিল?’

‘তুমিও তো মায়ের কাছে বসে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারতে।’

‘তোমার মায়ের যদি সেবারই দরকার হয় লোক রাখো, সে-ই সারাদিন সেবা করবে।’

‘প্লিজ, তুমি তোমার মুখ বন্ধ রাখো। আমার তোমার সঙ্গে কথা বলতে এখন ইচ্ছে করছে না।’

‘তোমার তো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, আর আমার এক মুহূর্তও তোমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করছে না। চার মাস বিয়ে হয়েছে, সংসারে শুধু নেই, নেই শুনে আসছি। কী কুক্ষণে যে তোমাকে বিয়ে করেছিলাম, জানি না।’

‘আমি তো তোমাকে মানাই করেছিলাম। তুমিই আমার কথা শোনোনি।’

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতে শ্যামল দেখল রূপা সুটকেস গুছিয়ে রেডি। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই জবাব এল, ‘বাপের বাড়ি যাচ্ছি। যদি মনে করো তোমার জীবনে আমার প্রয়োজন আছে তাহলে ওখানেই চলে এসো। আমি এই বাড়িতে আর ফিরতে চাই না।’

শ্যামলেরও জেদ চেপে গিয়েছিল, রূপাকে ফেরাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও সে করল না।

রূপার জীবনের সবথেকে বড়ো ভুল ছিল বাপের বাড়ি ফিরে যাওয়াটা। রূপার বাবা মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে কোনও ভাবেই রাজি ছিলেন না, শুধু স্ত্রীয়ের পীড়াপীড়িতে রূপাকে বাড়িতে স্থান দিয়েছিলেন। প্রথম পাঁচ-ছয় মাস রূপার আগের মতোই হাসি, গল্প আনন্দে দিন কাটতে লাগল। মাঝেমধ্যে শ্যামলের খেয়াল আসত, কিন্তু রূপা মনে করেছিল তার টানে শ্যামল ঘরজামাই হতে আপত্তি করবে না। কিন্তু সেই আশার আলোটা ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করল। বাড়িতে আসা দূরে থাক, একটা ফোন পর্যন্ত করল না শ্যামল। ধীরে ধীরে মা-বাবা, ভাই-ভাইয়ের বউরাও রূপাকে কথা শোনাতে আরম্ভ করল। রাতদিন রূপার সঙ্গে সঙ্গে শ্যামলের কথা তুলেও তারা অপমান করতে ছাড়ত না। বাড়ির বাইরেও একই অবস্থা হল রূপার। বন্ধুদের বাড়িও যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কারণ সেখানেও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো রূপাকে।

দেখতে দেখতে শ্যামলকে ছেড়ে আসার এক বছর হয়ে গেল। রূপা বুঝতে পারছিল শ্যামলকে ওভাবে ছেড়ে চলে এসে ও কত বড়ো ভুল করেছে। কিন্তু শ্যামলের কাছে ফিরে যাওয়ার রাস্তাও তো ও বন্ধ করে এসেছে। ক্ষমা যেমন করেই হোক ওকে চাইতেই হবে, কিন্তু কী করে? সবথেকে আগে দরকার নিজের পায়ে দাঁড়ানো।

ফেসবুক খুঁজে শ্যামলের প্রোফাইল বার করল। দেখল শ্যামল এবং ওর আর এক বন্ধু অর্ণব মিলে একটা অ্যাডভারটাইজিং কোম্পানি শুরু করেছে। বিভিন্ন কোম্পানিতে নিজের প্রোফাইল দিয়ে চাকরির দরখাস্ত করল রূপা। কিছুদিন চেষ্টা করার পর একটা কোম্পানিতে এইচআর-এ একটা পদে বহাল হল। রূপা বুঝেই গিয়েছিল বাপের বাড়িতে তার থাকা চলবে না, পদে পদে সেখানে অপমান সহ্য করতে হবে। মা-বাবাকে বলে একটা মেয়েদের হস্টেলে এসে উঠল।

প্রথম প্রথম একটা একা থাকার ভয় রূপার মধ্যে কাজ করত কারণ একা আগে কোনওদিন রূপাকে থাকতে হয়নি। ধীরে ধীরে হস্টেল এবং চাকরি জীবনে রূপা নিজেকে সেট্ল করে নিল। স্মিতা নামে ফেসবুকে নতুন অ্যাকাউন্ট খুলল। প্রথমে শ্যামলের কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল। শ্যামল অ্যাকসেপ্ট করাতে শুরু হল চ্যাট্ করা। ছোটোখাটো অসুবিধায় পড়লে রূপা চ্যাটেই শ্যামলের কাছে মৌখিক সাহায্য চেয়ে নিত। একদিন চ্যাটে নানা কথায় কথায় রূপা শ্যামলকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, আপনার কোনও বন্ধু যদি কোনও ভুল করে, আপনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন?’

‘ও কী ভুল করেছে তার ওপর ক্ষমা করা নির্ভর করে। কিন্তু আপনি হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন জিজ্ঞাসা করছেন আমাকে?’

‘জাস্ট এমনি। জানতে ইচ্ছে হল।’

শ্যামল অনেকবারই স্মিতা মনে করে রূপার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে। রূপাই কোনও না কোনও বাহানায় দেখা করতে রাজি হয়নি। ওর মনে সবসময় ভয় রয়েছে শ্যামল ওকে যদি ক্ষমা না করে তাহলে। একটাই প্রশ্ন খালি ওর মনে ঘুরপাক খায় কীভাবে ও শ্যামলের কাছে ক্ষমা চাইবে? কী ভাবে শ্যামলকে বিশ্বাস করাবে যে ও পুরোপুরি বদলে গেছে? আগের ব্যবহারের জন্যে ও আজ সত্যিই লজ্জিত।

একদিন সন্ধেবেলা রূপা সিসিডি-তে বসে কফি খাচ্ছিল হঠাৎ দেখতে পেল কয়েকটা টেবিল ছেড়ে শ্যামলও বসে রয়েছে একা। ওর হাতেও কফির কাপ। রূপার দিকে চোখ পড়তেই কফির কাপ নামিয়ে রেখে শ্যামল তাড়াতাড়ি দরজার দিকে পা বাড়াল। রূপা এসে শ্যামলের রাস্তা আটকে দাঁড়াল। ‘শ্যামল।’

‘তুমি এখানে? একা এসেছে?’

‘হ্যাঁ। অফিস থেকে ফেরার পথে একটু কফি খেয়ে যেতে ইচ্ছে হল।’

‘ভালো কথা। আচ্ছা আমার একটু তাড়া আছে। আমি চলি।’

‘শ্যামল, প্লিজ। আমাকে একটু সময় দাও, আমার কিছু কথা আছে তোমার সঙ্গে।’

‘আমাদের মধ্যে আর কিছু কথা বাকি রয়েছে বলে আমার মনে হয় না।’ শ্যামল দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

রূপা শ্যামলের হাত চেপে ধরে, ‘প্লিজ, আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি পুরো বদলে গিয়েছি। আমাকে একটা সুযোগ দাও প্লিজ।’ রূপার চোখ জলে ভরে আসে।

‘না রূপা, আর তা হয় না। তুমি অনেক দেরি করে ফেলেছ। আমি এখন অন্য একটি মেয়েকে ভালোবাসি।’

‘কী নাম?’

‘স্মিতা। ও আমার জীবনে বিশেষ একটা জায়গা বানিয়ে নিয়েছে।’

মৃদু একটা সলজ্জ হাসিতে রূপার চোখদুটো চিকচিক করে ওঠে। শ্যামল বিরক্ত হয়, ‘এর মধ্যে হাসির কী দেখলে?’

রূপা বাঁ হাত দিয়ে শ্যামলের হাতটা জড়িয়ে ধরে, ‘তুমি এখনও সেই বোকাই রয়ে গেলে। আরে ফেসবুকে আমিই স্মিতা নাম দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলেছিলাম কারণ সোজাসুজি তোমার সঙ্গে কথা বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না।’

সেদিন হস্টেল ছেড়ে দিয়ে রূপা চলে এসেছিল শ্যামলের সঙ্গে, শ্যামলের বাড়িতে। হঠাৎই অ্যালার্মের আওয়াজে রূপা অতীত থেকে ফিরে আসে বর্তমানে। ঘুমের আবেশে শ্যামল জড়িয়ে ধরে রূপাকে কাছে টেনে নেয়। অতীত বর্তমান মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় রূপার।

সম্পর্কের সমীকরণ

সময় কারও জন্য থেমে থাকে না রাহুল। সে তার নিয়মেই বয়ে চলে। মানুষ বর্তমান নিয়েই বাঁচে। কাল কে দেখেছে বলতো?’

‘ফিলোজফি ঝেড়ো না তো অরিদা। যখনই দেখা হয়, তোমার সেই একই কথা। সবসময় মানুষের মনে আঘাত দিতে ভালো লাগে? তোমাদের মতো করে যারা ভাবে তাদের জন্যই আমাদের মতো কষ্টে জর্জরিত মানুষগুলো বাঁচার আশাই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।’

‘বাঁচার আশা ছাড়বে না, বরং আরও ভালো করে বাঁচতে শিখবে! কখনও কারও মনে দুঃখ দেবে না, আর কেউ কষ্টে থাকলে তাকে মাঝ দরিয়ায় ছেড়েও দেবে না। আমরা মানুষ রাহুল। সমাজে বাস করি। রোজ না জানি কত লোকের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়, তাদের সকলের সঙ্গেই যে আমরা ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে পারি এমনটা তো সম্ভব নয়। কখনও কখনও তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে ফেলি। কটু কথাও বলে ফেলি। সেক্ষেত্রে তৎক্ষনাৎ একটা ‘সরি’ বললেই প্রবলেম সলভড্। কোনও কিছু কালের উপর না ছাড়াই ভালো, কারণ কাল কখনও আসে না।’

‘গতকাল দেরি করে অফিসে আসার জন্য আমি আমার চাপরাশিকে দু-চার কথা শুনিয়েছি। তাই বলে আমি তার কাছে ক্ষমা চাইব নাকি?’

‘ওনার দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করেছিস একবারও? যদি তিনি রোজই দেরি করে অফিস পৌঁছন তাহলে আলাদা কথা। কিন্তু যদি তিনি আগে কোনওদিন দেরি না করে থাকেন, শুধুমাত্র সেইদিনই… তাহলে নিশ্চয়ই কোনও বিশেষ কারণ থাকবে। ওই ভদ্রলোক তোর বাবার বয়সি। সারাদিনে সকলের সঙ্গে কত তো কথা বলিস। তার থেকে যদি দু-চারটি বাক্য ওই মানুষটার জন্য ব্যয় করিস, তাতে তোর জাত যাবে? যদি একটা ‘সরি’ বলিস, কী হবে তাতে? মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?’

‘কী বলতে চাইছ বলোতো? তোমার কথা অনুযায়ী আমাকে তাহলে সুগার কোটেড ট্যাবলেট-এর মতো করে বাঁচতে হবে। বাইরে থেকে মিষ্টি আর ভিতরে তেতো।’

‘বাইরে মিষ্টি ভিতরে তেতো কেন হবে? তাহলে তো ভিতরে ভিতরে নিজেকেই জ্বলতে হবে। আমরা নিজেকেও জ্বালাব না আর কাউকে কষ্টও পেতে দেব না।’

রবিবার। কোথায় রাহুল ভেবেছিল আজ একটু বেশি ঘুমোবে, এগারোটার আগে কোনও মতেই বিছানা ছাড়বে না। রোজই তো সকাল সাতটায় উঠে কোনওরকমে নাকে-মুখে গুঁজে অফিস ছুটতে হয় তাকে। যদিও তার দুশ্চিন্তা তাকে কতটা শান্তিতে ঘুমোতে দেয় কে জানে! সে ছুটে বেড়ায় শান্তির খোঁজে। আজকাল বাড়িতেও ভালো লাগে না রাহুলের। সংসারে মোটে তিনটে প্রাণী। মা-বাবা আর সে। তারা কেউ কথা বলে না রাহুলের সঙ্গে। রাহুলও কথা বলার সাহস পায় না।

ঘড়িতে তখন সবে আটটা দশ। কানের কাছে বেজে উঠল মোবাইল ফোনটা। ঘুম চোখে বিরক্তিমাখা মুখে ফোনটা কানে দেয় রাহুল—

‘হ্যালো, কে বলছেন?’

‘আরে অরিজিৎ বলছি রে।’

‘আরে হ্যাঁ। বলো বলো। হঠাৎ কী মনে করে এত সকালে ফোন করলে? সিরিয়াস কিছু?’

‘না রে তেমন সিরিয়াস না হলেও তোর সঙ্গে কিছু দরকারি কথা আছে। তাছাড়া অনেকদিন দেখাও তো হয়নি। আজ বিকালে আমাদের বাড়িতে আয়, তখনই সব কথা হবে। তোর বউদিও বাপের বাড়ি গেছে। তুই এলে আমারও কম্প্যানি হবে।’

‘এই কথাগুলো একটু বেলায় বললে খুব অসুবিধা হতো? শুধুশুধু আমার ঘুমটা মাটি করে দিলে। আচ্ছা ঠিক আছে, কখন যেতে হবে বলো?’

‘এক কাজ কর সকালেই চলে আয়। একসঙ্গে লাঞ্চ করব। দুজনে মিলে যা হোক একটা কিছু বানিয়ে নেওয়া যাবেখন।’

‘ঠিক আছে, আমি ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আসছি।’

অরিজিৎ, অতুলের বেস্ট ফ্রেন্ড। লম্বা, চওড়া, সুঠাম দেহ তার। দেখতেও বেশ সুদর্শন। কলকাতারই একটি নামিদামি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চিফ্ অ্যাকাউন্ট্যান্ট, মাত্র সাত মাস বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে সে।

অতুলদের বাড়িতে নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল অরিজিতের। সে প্রায় বাড়িরই একজন হয়ে উঠেছিল। বাড়িতে হইহুল্লোড়, আনন্দ, হাসি-ঠাট্টা, মজা, সুখ-দুঃখ সবেতেই সামিল হতো সে। অতুলের মতো অরিজিৎও হয়ে উঠেছিল রাহুলের অরিদা। অতুলের অকাল মৃত্যুতে তার আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল রাহুলদের বাড়িতে।

আজ সেই সম্পর্কের টানেই একটা ফোন পেয়ে অরিদার বাড়িতে ছুটে আসা রাহুলের। এর আগেও বহুবার এখানে এসেছে সে অতুলদার সঙ্গে। চার মাস আগে যখন এসেছিল তখন বারান্দায় বসানো বেলফুলের চারাগুলি সবে ডানা মেলছিল। আজ তাতে ফুল ভরে গেছে। পুরো বারান্দা গন্ধে ম ম করছে। কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল রাহুল।

— ‘কী রে শুনছিস কী বললাম? কোথায় হারিয়ে গেলি?’ অরিজিতের কথায় চমকে উঠল রাহুল।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, কী যেন বলছিলে? মাঝে মাঝে কী যে হেঁয়ালি করে কথা বলো না, কিছুই বুঝি না। মাথার উপর দিয়ে যায়। লোককে ভুরিভুরি উপদেশ দেওয়ার রসদ কোথা থেকে পাও বলো তো। কপালে একটা বড়ো লাল তিলক আর গেরুয়া বস্ত্র গায়ে চড়িয়ে বসে যাও। প্রচুর টাকা কামাবে।’

‘দ্যাখ, ভগবানের দয়ায় টাকার অভাব নেই আমার। আর গেরুয়া বস্ত্র কেন পরব বলতো? যারা সংসার ত্যাগ করে তাদের ওই পোশাক মানায়। তাদের মতো আমি তো মহামানব নই, আর ভবিষ্যতেও সংসার ত্যাগ করার কোনও পরিকল্পনাও আমার নেই। আমি সংসারী মানুষ। সারাজীবন সংসার নিয়েই সুখে-দুঃখে কাটাতে চাই। দায়িত্ব থেকে পিছপা হওয়ার মতো ছেলে আমি নই। আর অতটা দয়িত্বজ্ঞানহীনও হতে পারব না।’ অরিজিৎ বেশ উত্তেজিত হয়েই কথাগুলি বলল।

‘কোথা থেকে কোথায় চলে এলে অরিদা? কী বলছ কিছুই বুঝলাম না। আর হঠাৎ করে এত উত্তেজিতই বা হয়ে গেলে কেন?’

‘এত ছোটো তো তুই নোস, যে আমার কথা বুঝতে পারছিস না। কী করছিস ভেবে দেখেছিস একবারও। নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছিস? মেয়েটার কী হবে বলতো?’

এতক্ষণে রাহুলের বোধগম্য হল যে অরিদা কী বলতে চাইছে। তার আর মৌসুমির সম্পর্ককে ঘিরেই এত জল্পনা। সেই সম্পর্ক যেটা না রাহুল বহন করতে পারে আর না সহন করতে পারে।

‘তুমি আমার জায়গায় থাকলে কী করতে?’

‘হয়তো আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতাম। দাদার মৃত্যুর পর কখনও তার বিধবা স্ত্রীকে গ্রহণ করতাম না। মা-বাবা যতই চ্যাঁচামেচি করুক, অন্যায় আবদার করুক, না বলে কাটিয়ে দিতাম। অন্তত তাদের রোজ তিল তিল করে মরার জন্য ছেড়ে দিতাম না। যদি সম্পর্ক রাখারই না ছিল তাহলে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলি কেন? আমি এরকম সম্পর্কে কখনও আবদ্ধ হতাম না যেটা আমার নিজের এবং অন্যের জীবনের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াবে।’

‘যদি এই সম্পর্ক ওর মৃত্যুর কারণ হয়, তাহলে আমিও তো ক্রমশ সেই দিকেই এগোচ্ছি। না পারছি গিলতে, না পারছি ফেলতে। আমিও যে ভালো নেই অরিদা।’

‘ভালো থাকবি কী করে বলতো? চার মাস ধরে মেয়েটা বাপের বাড়িতে পড়ে আছে। অতুলের মৃত্যুর পর একবারও তাকে চোখের দেখা দেখতে যাসনি। এখনও সময় আছে রাহুল, সব দ্বিধা কাটিয়ে যা ওর কাছে। দায়িত্ব যখন নিয়েছিস ওকে ওর মর্যাদা দিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আন ভাই।’

চুপ করে থাকে রাহুল। এর কী জবাব দেবে সে নিজেই জানে না। বোধহয় সেই উত্তর খোঁজার জন্যই হারিয়ে যায় তার উদাসীন মন।

মৌসুমি বাবা-মায়ের আদরের একটিই মাত্র মেয়ে। লম্বা, ফর্সা, ছিপছিপে চেহারা। টানা টানা চোখ, টিকালো নাক, ছোট্ট কপাল–যাকে বলে প্রকৃত সুন্দরী। বিএ পড়তে পড়তেই বান্ধবীর সূত্রে অতুলের সঙ্গে আলাপ। তারপর প্রেম এবং পরে বিবাহ। অতুল সরকারি কর্মচারী এবং সৎ হওয়ার কারণেই মৌসুমিদের বাড়ি থেকে কোনও আপত্তি ওঠেনি।

শ্বশুর, শাশুড়ি, দেওর আর স্বামীকে নিয়েই ছিল তার সুখের সংসার। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সে সুখ তার কপালে বেশিদিন সইল না। বিয়ের সাত মাস পরেই ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট-এ মারা গেল অতুল। সেদিন মৌসুমির জন্মদিন ছিল। মৌসুমিকে উপহার দেওয়ার জন্য একটা লাল রঙের জরিপাড় শাড়ি এবং একতোড়া গোলাপফুল কিনেছিল সে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়েই এই দুর্ঘটনা। খবর পেয়ে তারা যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছল, তখনও লাল টুকটুকে শাড়ি আর গোলাপের তোড়া সেইখানেই পড়ে ছিল। শাড়িটা হাতে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল মৌসুমি। একটা সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল সে।

তিনদিনে সমস্ত কাজ মিটে যাওয়ার পর অখিলেশবাবু তার মেয়ে মৌসুমিকে পাকাপাকি ভাবে সঙ্গে করে নিয়ে চলে যেতে চাইলেন তাদের বেহালার বাড়িতে।

সেকথা শোনা মাত্রই রাহুলের মা-বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এমনিতেই পুত্রশোকে তারা মৃতপ্রায়, তার উপর আবার তাদের স্নেহের বউমার বাড়ি থেকে চলে যাওয়াটা তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তারা কাঁদতে কাঁদতে শুধু অখিলেশবাবুর পায়ে ধরতে বাকি রেখেছেন। কত অনুনয়-বিনয় করেছেন মৌসুমিকে এ বাড়িতে রাখার জন্য। কিন্তু তাঁর একটাই কথা, এখানে থেকে সে কী করবে। কী পরিচয়ে থাকবে? অতুলের বিধবার পরিচয়ে! সেটা তিনি কিছুতেই হতে দেবেন না। আবার তিনি অন্যত্র মেয়েকে পাত্রস্থ করবেন।

এ সমস্তকিছুই লক্ষ্য করছিল রাহুল। এমন সময় তাকে দেখে মা মীনাদেবী ছুটে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তার হাত দুটি ধরে পীড়াপীড়ি শুরু করে দেন। একমাত্র সে-ই পারে মৌসুমিকে এ বাড়িতে রাখতে। সে যদি মৌসুমিকে বিয়ে করে তাহলে মৌসুমি এ বাড়িতে বউয়ের সম্মান নিয়েই চিরজীবন থেকে যেতে পারে।

কিন্তু সেটা রাহুলের পক্ষে কীভাবে সম্ভব? যাকে সে এতদিন বউদি বলে ডেকে এসেছে, বন্ধুর মতো মিশেছে তার সঙ্গে, তাকে সে কীভাবে নিজের স্ত্রী হিসাবে মেনে নেবে? শুধু তার কেন, কারওর পক্ষেই কি এটা সম্ভব?

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এই প্রস্তাবটা নিয়ে কোনও জোরালো প্রতিবাদ করলেন না অখিলেশবাবু। শেষ পর্যন্ত শত চেষ্টা করেও মা-বাবার এই শোকার্ত আবেদন এড়িয়ে যেতে পারেনি রাহুল। সে বাধ্য হয়েছিল মৌসুমির মাথায় সিঁদুর তুলে দিতে। কিন্তু হায়, ভাগ্যের কী পরিহাস! যাকে নিয়ে এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত, সে স্থানুবত এক পুতুল। অতুলের নয়, রাহুলের স্ত্রী, হিসাবে জীবনটা অতিবাহিত করতে তার আপত্তি আছে কিনা তা নিয়ে কোনও মতামত চাওয়া হয়নি মৌসুমির।

এরপর অখিলেশবাবু প্রায় জোরাজুরি করেই পনেরো দিনের জন্য মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের বাড়িতে। তারপর কেটে গেছে চার চারটি মাস। এবাড়ির কেউ মৌসুমিকে আনেওনি, এমনকী ফোন পর্যন্ত করে খবর নেয়নি। এই নিয়েই যত অশান্তি। বাবা-মা রাগে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছেন রাহুলের সঙ্গে। তাদের রাগ বাড়ির বউ আর কতদিন বাপের বাড়িতে পড়ে থাকবে।

সহসা কলিং বেল-এর আওয়াজে চমকে ওঠে রাহুল। দুধওয়ালা দুধ দিয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে আবার বলতে শুরু করল রাহুল। ‘সময় মানুষকে কখন কোন পরিস্থিতিতে দাঁড় করাবে আগে থেকে তা কে বলতে পারে অরিদা? মানছি ওর দায়িত্ব আমি নিয়েছি। দায়িত্ব এড়াতেও চাই না। ভেবেছিলাম যে, সমস্যা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা আরও জটিলাকার ধারণ করল। সব থেকে বড়ো সমস্যা হল আগে একরকম করতাম আর এখন অন্যরকম ব্যবহার। মৌসুমির সঙ্গে নতুন সম্পর্ক তো দূর, পুরোনো সম্পর্কটাই কীভাবে সামলাব বুঝতে পারছি না। ও ছিল আমার বউদি কাম বেস্ট ফ্রেন্ড। সমস্ত আলোচনাই করতাম ওর সঙ্গে। এমনকী কবে কোন মেয়ের পিছনে লাগলাম, কার প্রেমে পড়লাম সমস্ত কিছুই। মাঝেমধ্যে দাদা আমাকে বলত, ‘কখনও তোর বউদিকে আমার সঙ্গেও একটু-আধটু সময় কাটাতে দে।’

একদিন তো এমনও হয়েছে, ‘বউদি বউদি’ করে ডেকেই যাচ্ছি। বউদির কোনও সাড়া নেই। যে-বউদিকে ডাক দিলেই সমস্ত হাতের কাজ ফেলে ছুটে আসে, তার আজ কী হল! আবার ডাকলাম, – এল না। ‘বউদি একবার এসো, তোমাকে কিছু দেখানোর আছে।’ খেতে বসেও সেই একই ব্যাপার। সকলের সঙ্গে কথা বলছে, শুধু আমার সঙ্গে বলছে না।

এইসব দেখে মা ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করার কারণ। সেদিন কোনও উত্তর দিতে পারেনি সে। উত্তরের পরিবর্তে শুধু মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে ও।

পুরো ব্যাপারটাই বুঝতে পেরেছিল দাদা। বসে বসে মুচকি হাসি হাসছিল। পরে দাদার থেকে জানতে পারি দাদা নাকি ইয়ার্কি করে ওকে বলেছে, ও দাদার থেকে আমাকেই বেশি ভালোবাসে। তাই সারাদিন মুখ গোমড়া করে রেখেছিল।

কথাটা যে আমিও ভালোভাবে নিতে পেরেছিলাম তা কিন্তু নয়। আমারও কেমন যেন একটা খটকা লেগেছিল। শুধু মনের কোণে একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল, আমাদের দেওর-বউদির সম্পর্ককে দাদা অন্যরকম ভাবে নিচ্ছে না তো?

বাড়িতে বেশ একটা গুরুগম্ভীর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। মৌসুমির মুখের হাসি ফিরিয়ে আনতে দাদা যখন ওকে আমার ঘরে নিয়ে এসেছিল, তখনও কাঁদছিল ও। আমাকে দেখে আরও বেশি করে কাঁদতে শুরু করেছিল। সেদিন প্রথম আমি ওর মাথায় হাত রেখেছিলাম।

সব শুনে অরিজিৎ বলল, ‘মৌসুমিকে ভালো যে বাসিস তা তোর কথায় স্পষ্টই বোঝা যায়। তবে এটা ঠিক যে তোর ভালোবাসার ধরনটা ছিল আলাদা। এখন তোদের সম্পর্কের সমীকরণটা বদলেছে। মানছি এক সম্পর্ক থেকে হঠাৎ করে অন্য সম্পর্কে যাওয়াটা খুব সোজা নয়। কিন্তু অসম্ভবও তো নয়। এই সংসারে কত লোকই তো আছে যারা এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, তারা কি সুখে ঘর করছে না বল?’

অতীত ভুলে যা ভাই, বর্তমানে ফিরে আয়। আমার বিশ্বাস তুই পারবি।’

‘কী করে বলো?’

‘আজ বিকেলে মৌসুমিদের বাড়িতে যা। ওর সঙ্গে কথা বল। আগের মতো ওর ভালো বন্ধু হয়ে যা। পাশে বস। তুই যেমন তোর ভাইকে হারিয়েছিস ও-ও তো স্বামীকে হারিয়েছে, তাই না?’

‘ওর স্বামী নাকি বন্ধু কোন পরিচয়ে গিয়ে দাঁড়াব ওর কাছে? তুমি যাবে আমার সঙ্গে?’

‘অবশ্যই যাব। এক কাজ করি আমি মৌসুমিকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি। তখন কথা বলে নিস।’

‘না অরিদা। প্লিজ ওকে এনো না।’

রাহুল হঠাৎই থামিয়ে দিয়েছিল অরিজিৎকে। সে ভয় পেতে শুরু করেছিল। কীভাবে সে মৌসুমির সামনে গিয়ে দাঁড়াবে?

রাতে বাড়ি ফিরে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ে রাহুল। মনে মনে ভাবতে থাকে তার সমস্ত সুখশান্তি দাদা কেড়ে নিয়ে গেছে। অরিদা ঠিকই বলেছে, কতদিন আর এরকম চলবে? কিছু তো একটা ডিসিশন নিতেই হবে। কিন্তু তার আগে এটাও তো জানা দরকার মৌসুমি তার ব্যাপারে কী ভাবে? সে কী চায়? এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে রাহুল।

পরদিন সকাল সাতটায় অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙে রাহুলের। কোনও রকমে নাকে মুখে গুঁজে রওনা দেয় অফিসে। পথটাও অনেকটা। সেক্টর ফাইভ। প্রায় দশ কিলোমিটার। ভালো পোস্টে আছে রাহুল। বেতনও পায় বেশ মোটা অঙ্কের।

অফিস শেষ করে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয় রাহুল। চড়ে বসে গাড়িতে। কিন্তু আশ্চর্যের কথা বাড়ি না গিয়ে এ কোথায় এল সে! তার অবচেতন মন তাকে কোথায় নিয়ে এল? এ যে মৌসুমিদের দরজার সামনে এসে গেছে সে! মৌসুমির মা-বাবা তাকে দেখতে পেয়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন। তাদের কাছ থেকে সে জানতে পারে মৌসুমি অসুস্থ। অতুলের মৃত্যুর পর থেকেই সে অবসাদে ভুগছে।

মৌসুমির ঘরে ঢোকা মাত্রই চমকে উঠল রাহুল-এ কী অবস্থা তার। চোখে-মুখে কালি পড়ে গেছে, চুল উশকোখুশকো, জরাজীর্ণ চেহারা। ফর্সা টুকটুকে রং একেবারে কালো হয়ে গেছে।

অতুল মৌসুমিকে খুব ভালোবাসত। বলত ‘এই পাগলিটাকে নিয়ে কী করি বলতো? এই যুগে এত সহজ, সরল হলে সমাজে বাঁচবে কী করে। কী করে সামলাব এই মেয়েকে আমি?’

রাহুল বলতো, ‘ভালোই তো, আসল সোনা পেয়েছ, তাতে খাদ মেশানোর চেষ্টা করছ কেন?’

‘আমি মরে গেলে কী হবে ওর? বাঁচবে কেমন করে? সমাজে বাস করতে হলে একটু চালাক-চতুর হতে হয়।’

‘কেন বাজে কথা বলো, বলো তো। ভালো কথা বলতে পারো না।’ সেদিন দাদার এই কথায় চেঁচিয়ে উঠেছিল রাহুল। কী জানি, দাদা কী তার মৃত্যুর কিছু পূর্বাভাস পেয়েছিল, নাকি এমনিই! মৌসুমিকে দেখে রাহুলের মনে পড়ে গেল কথাগুলো।

মনে মনে ভাবতে থাকল বাবা-মা বিশ্বাস করে তার হাতে সঁপে দিয়েছিল মৌসুমিকে। আর সে কী করছে। তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। তার এই অবস্থার জন্য নিজেকেই দূষতে থাকে সে।

এমন সময় মৌসুমির বাবা বলেন, ‘মউ দ্যাখ মা আমার, কে এসেছে তোর সঙ্গে দেখা করতে। দ্যাখ রাহুল এসেছে। রাহুলের সঙ্গে কথা বল মা। কতটা দূর থেকে এসেছে তোর সঙ্গে দেখা করতে।’

চুপ করে বসেছিল মৌসুমি। আর কী কথাই বা বলবে? কী-ই বা বলার আছে? তাদের দুজনেরই ভবিষ্যৎ অন্ধকারে আর অতীত তো চিরজীবনের মতো দিশাহীন করে দিয়ে গেছে। রাহুলের দিকে দেখল সে। সেই নিশ্চল চোখ। রাহুলের চোখে জল এসে যায়। দাদার মুখটা চোখের উপর ভেসে ওঠে। যেন আসল সোনা তার হাতে তুলে দিয়ে দাদা বলছে ‘দেখিস ভাই আমার মৌসুমির দায়িত্ব এবার তোর। তুই ছাড়া আর কাকেই বা এই গুরুদায়িত্ব দিতাম বল। বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যা রাহুল। বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যা।’

রাহুলের চোখ জলে ভরে গিয়েছিল। সহসা নিজের হাতের উপর একটা স্পর্শ অনুভব করার সঙ্গে সঙ্গে কানে এল, ‘কেমন আছো রাহুল?’

উত্তর দিতে না পেরে হাউহাউ করে কেঁদেই ফেলল রাহুল। মনে হচ্ছিল যেন দাদার দাহ সংস্কার করে সবে ফিরেছে সে। দাদা মরে গিয়ে বেঁচে আছে, আর তারা বেঁচেও মরে আছে।

‘রাহুল। কাঁদছ কেন?’

অল্পক্ষণেই রাহুলের মনে হল যেন তার দেহ-মনের জ্বালা একেবারে জুড়িয়ে গেছে। কোথা থেকে যেন শান্তি ফিরে এসেছে। মৌসুমি তার আঁচল দিয়ে রাহুলের চোখ মুছিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।

মৌসুমির বাবা রাহুলকে ঘরে দিয়েই চলে গিয়েছিলেন। কেউ থাকলে মৌসুমিকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথাটা অন্তত পাড়তে পারত সে।

মৌসুমি বলে ওঠে, ‘সোজা অফিস থেকে এসেছ না? কিছু তো খাওয়াও হয়নি মনে হয়। তুমি বসো। আমি কিছু নিয়ে আসি।’ এই বলে কোনওরকমে দেয়াল ধরে ওঠার চেষ্টা করে সে।

‘না খেতে ইচ্ছে করছে না’, বলে মাথা নাড়ায় রাহুল।

‘সবাই কেমন আছে? আমার কথা বাবা-মায়ের মনে পড়ে?’

‘আগে বলো বাড়ি যাবে আমার সাথে? সবাই তোমাকে খুব মিস করে।’ সাহস করে বলেই ফেলে রাহুল।

‘এখন আর ওখানে গিয়ে কী করব, কে আছে আমার?’

‘কেন এরকম বলছ?’

‘তুমি খুব ভালো করে জানো রাহুল, ওখানে আর আমার আপন বলতে কেউ নেই, তবুও…।’

কথাগুলি শুনে দম বন্ধ হয় আসে রাহুলের। তাহলে কি মৌসুমি মনে করতে চাইছে না তাদের সম্পর্কটা এখন কী? হতবাক দৃষ্টি নিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে রাহুল। যদি তাকে সাহায্য করার জন্য কেউ আসে। ওর মা-বাবা যে কেউ একজন।

‘কী হল রাহুল? তোমাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?’ মৌসুমি তার হাত দুটি ধরে বলল।

‘তুমি আমার সঙ্গে বাড়িতে চলো। তোমাকে ছাড়া কিছু ভালো লাগে না। বাড়ি যেন গিলতে আসে। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায়। কেউ কারওর সঙ্গে কথা বলে না’, বলতে বলতে আবার কেঁদে ফেলে রাহুল।

‘আমি গিয়ে কী করব বলো তো? ভগবান ও বাড়িতে ওই পর্যন্ত অন্ন মেপেছিল আমার জন্য।’

‘বারবার অতীতটাকে ফিরিয়ে আনতে চাইছ কেন? যে গেছে সে কি আর ফিরে আসবে?’ বেশ চিৎকার করেই কথাগুলো বলল রাহুল। কথাগুলো যেন নিজের কানেই বড়ো বাজল রাহুলের।

চিৎকার শুনে ছুটে এল মৌসুমির মা-বাবা। কখন যে তার মধ্যে অধিকারবোধ জন্মাল সে নিজেই জানে না।

রেগেমেগে তার মা-বাবার উদ্দেশ্যে রাহুল বলতে থাকে, ‘আপনারা কেন সবকিছু জানাননি ওকে। আপনারাই তো জোর করেছিলেন। তাহলে ওকে বলেননি কেন? চুপ করে আছেন কেন? আমাকে মাটির পুতুল ভেবেছেন, যখন যা খুশি তখন তাই করাবেন। বোঝান ওকে সত্যটা কী। আমি আর পারছি না মৌসুমি। তুমি কি কিছুই বুঝতে পারছ না, নাকি আমাকে যাচাই করছ? প্লিজ দয়া করো আমাকে, চলো বাড়ি চলো। আমি মানছি আমার ভুল হয়ে গেছে, বিগত চার মাসে একবারও তোমার খোঁজ নিইনি। কিন্তু সঙ্গে এটাও তো সত্যি একটা মুহূর্তের জন্যও তোমাকে ভুলতে পারিনি।’ বলতে বলতে সকলের সামনেই মৌসুমিকে জড়িয়ে ধরে সে।

এতদিন রাহুল-যে সম্পর্কটাকে বোঝা ভাবত, সেটা যে তার কাছে কী তা সে আজ টের পাচ্ছে। মৌসুমির তাকে অস্বীকার করা, সেটা কোনওভাবেই মানতে পারছে না সে।

‘আবার কাঁদে। আরে কাঁদছ কেন? কী হয়েছে তোমার রাহুল? আমি তো ভলোই আছি এখানে। এখানে আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না।’

এমন সময় মৌসুমির বাবা অখিলেশবাবু রাহুলকে অন্য ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ‘চার মাস একটা খবর পর্যন্ত নাওনি। আমার মেয়ে আমার কাছে বোঝা নয়। তাকে দুবেলা খেতে দেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। ঘাড় থেকে বোঝা নামাব বলে তোমার উপর মেয়ের দায়িত্ব দিইনি রাহুল। ভেবেছিলাম আমরা বুড়ো-বুড়ি আর ক’দিন। তারপর অন্তত মেয়েটাকে দেখার কেউ থাকবে।’

‘বাবা, তুমি রাহুলের সঙ্গে এইভাবে কথা বলছ কেন?’ কোনওরকম ভাবে মৌসুমি উঠে এসেছিল তাদের কাছে।

‘দাদার মৃত্যুর পর আমাদের এই আকস্মিক বিয়ে। তারপর থেকে আমিও তো ভালো নেই। শুধু ভেবেছি কী করব? ওর কী হবে? ও কীভাবে নেবে। প্রতিদিন একটু একটু করে মরছি। আর আপনারা ভাবছেন আমি চিন্তা করি না।’

‘রাহুল তুমি কি সত্যি কথা বলছ? তুমি মন থেকে মেনে নিতে পেরেছ এই বিয়ে? বলো আমাকে।’

‘ঘরে চলো তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার।’, হয়তো বাবা-মায়ের জুড়ে দেওয়া সেই অধিকারের জোরেই মৌসুমির হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে রাহুল নিয়ে যায় পাশের ঘরে। দরজা বন্ধ করে দেয়। অল্পক্ষণের জন্য দুজনেই চুপ করে যায়।

জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় মৌসুমি। কাছে যায় রাহুল। বলতে থাকে—‘খুব কষ্ট দিয়েছি না তোমাকে? আচ্ছা তুমিও কি তাই মনে করো? আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই তোমার খোঁজ নিইনি? কিন্তু বিশ্বাস করো একটা মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারিনি তোমার উপস্থিতির কথা। তখন বুঝতেই পারিনি তুমি আসলে আমার কী? দাদা চলে গেছে কিন্ত আমি তো বেঁচে আছি। তোমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাব না। সারাজীবন তোমার সঙ্গেই থাকব। যেদিন তোমার মাথায় সিদুঁর দিয়েছিলাম সেদিন যে-শপথ নিইনি আজ তা নিলাম।’

কথাটা শোনা মাত্রই চিৎকার করে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে মৌসুমি। বাইরে থেকে মেয়ের কান্না শুনে পড়িমরি করে দরজা খুলে ছুটে আসেন মৌসুমির মা-বাবা। মেয়েকে চুপ করানোর জন্য এগিয়ে আসতেই হাত দেখিয়ে বাধা দেয় রাহুল। হাত জোড় করে বলে ‘দয়া করে আপনারা যান আমি সামলে নেব।’

‘মৌসুমি শোনো, আমার কথা শোনো। দ্যাখো আমার দিকে একবার দ্যাখো।’

তাকে কিছুতেই সামলাতে পারছে না রাহুল। একপ্রকার জোর করেই মৌসুমিকে চেপে জড়িয়ে ধরে রেখেছে কোনওমতে। ‘অভিমান হয়েছে? রাগ হয়েছে? বলো তুমি সত্যিই বোঝো না তোমার আমার সম্পর্ক?’

মৌসুমি শুধু একটা কথাই বলে চলে–‘না এটা হতে পারে না। আমি তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিতে পারি না।’

রাহুল বাহুবলে আরও কাছে টেনে নেয় মৌসুমিকে। একেবারে বুকের কাছে। এতটাই কাছে যে তার প্রতিটি হূদয়ের স্পন্দন অনুভব করে সে। সে এক আলাদা অনুভূতি, যেটা সে আগে কোনওদিন অনুভব করেনি।

রাহুল বলতে থাকে-‘কে বলেছে তুমি আমার জীবন নষ্ট করেছ? তুমি জানো না তুমি আমাদের কাছে কী সোনা–বলতে বলতে মৌসুমির কপালে চুমু খায় রাহুল। যাকে গলার কাঁটা ভাবতাম সেটাই যে গলার হার হয়ে দাঁড়াবে তা কি আগে জানতাম? বুঝলামই যখন তখন…’

চুপ করে রাহুলের বুকে মাথা দিয়ে থাকে মৌসুমি। এখন সে অনেকটা শান্ত।

দুই হাত দিয়ে মৌসুমির মুখটি তুলে ধরে বলে, ‘যাবে তো আমার সঙ্গে, যাবে না? কিছু বলবে না? আচ্ছা ঠিক আছে বলতে হবে না।’

রাহুল বুঝে যায় মৌসুমির নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ।

 

ফেরা

বদলির চাকরি অনুজার। রিটায়ারমেন্ট-এর আর বছর ছয়েক বাকি। তার মধ্যে আবার নাগপুরে ট্রান্সফারের অর্ডার। চাকরির সুবাদে প্রায় তিরিশটা বছর ঘরসংসার, স্বামী-সন্তান ছেড়ে থাকতে হয়েছে তাকে। তিনবছর আগে কলকাতায় পোস্টিং হওয়ার সময়তেই ঠিক করেছিল এবার কলকাতার বাড়িতেই পাকাপাকিভাবে থেকে যাবে। হাজার হোক এখানেই তার পরিবার। ভিআরএস নেওয়ার ডিসিশন নিয়েই ফেলেছিল। সেইমতো আজ কদিন যাবৎ-ই অফিস আর ব্যাংক-এ ছুটোছুটি করতে হচ্ছে তাকে। স্বামী অলোক ইউনিভার্সিটি যাওয়ার পথেই তাকে ব্যাংক-এ ড্রপ করে দিয়ে গেছে। কাজ শেষ করে বাইরে বেরোতেই অনুজার চোখে পড়ে আকাশের ভয়ংকর করাল রূপ। রাশি রাশি কালো মেঘ সূর্যকে একেবারে গ্রাস করে ফেলেছে। মেঘ ভেদ করে বিদ্যুত্যের তীব্র ঝলকানি যেন মেঘের বুক চিরে বেরিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এক লহমায় আকাশটা ভেঙ্গে পড়বে মাটিতে।

আর এক মুহূর্তও দেরি না করে একটা রিকশা ধরে সোজা বাড়ির পথে রওনা দেয় অনুজা। মাঝপথেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। সঙ্গে হাওয়ার ভীষণ রকম দাপট। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই রিকশা কোনওরকমে এগিয়ে চলে বাড়ির দিকে। ততক্ষণে ভিজে একেবারে কাকস্নান অবস্থা। রিকশা থেকে নেমে কোনওরকমে তালাটা খুলে সোজা বাথরুমে ঢুকে যায় অনুজা। তখনই কলিং-বেল-এর আওয়াজ কানে যায় তার। একবার নয় একাধিকবার। যেনতেনপ্রকারে শাড়িটা জড়িয়ে আইহোলে চোখ রাখতেই নজর পড়ে দরজায় পাশের বাড়ির মায়া। বেশ অবাকই লাগল অনুজার। এরকম ঝড়-জল মাথায় করে… কিছু ঘটল নাকি…!

দরজা খুলতেই হাঁফাতে হাঁফাতে ঘরে ঢুকে আসে মায়া। তার শরীরের বেশ খানিকটা অংশ ভিজে গেছে। চোখ একেবারে রক্তবর্ণ। কোনও কিছু বলার আগেই সামনে থাকা একটা তোয়ালে মায়ার দিকে এগিয়ে দেয় অনুজা। ‘কী হয়েছে এরকম অবস্থা কেন তোমার?’

‘রিনিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না অনুজা।’ শুনেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে অনুজার।

‘কী যা-তা বলছ?’

‘সেই কোন সকালে বাজার যাচ্ছি বলে বেরিয়েছে, আড়াইটে বাজতে চলল এখনও ফেরেনি। ফোনেও পাচ্ছি না, লাগাতার সুইচড্ অফ আসছে। আমি একা মানুষ কী করি বলোতো?’

মায়ার স্বামী অনেক বছর আগেই গত হয়েছেন।

সংসার বলতে ছেলে নীহার আর ওই বউমা রিনি। ছেলে মাস ছয়েক হল কর্মসূত্রে দুবাইতে। ওখানে সেটেল করেই বউকে নিয়ে যাওয়ার কথা। তার মাঝেই এই বিপত্তি।

‘দাঁড়াও দাঁড়াও এখনি এত ঘাবড়িয়ো না। ঝড়জলে কোথাও আটকে পড়েছে হয়তো। বৃষ্টি থামলেই চলে আসবে।’ সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে অনুজা।

‘না গো প্রসূনরা পর্যন্ত খুঁজে এসেছে। আমি নিজে দু-বার বাজারের দিকটা দেখে এসেছি।’

‘কিন্তু বাজারের উপর দিয়ে তো একটু আগে আমি-ই ফিরলাম। কই কিছু চোখে তো পড়ল না। তবে বিশুর দোকানে একদল ছেলে কী যেন একটা বলা-বলি করছিল, কানে এল… কার বউ? কার বউ এরকম কিছু একটা… বৃষ্টির মাঝে ওইটুকু সময়ের মধ্যে আমিও ঠিক বুঝতে পারিনি।’ চোখেমুখে বিস্ময়ের স্পষ্ট ছাপ ফুটে ওঠে মায়ার। অনুজার মুখের দিকে হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে মায়া। যেন ও-ই একমাত্র অবলম্বন। পারলে ও-ই পারবে তাকে উদ্ধার করতে। ফ্ল্যাট কালচারে অভ্যস্ত ব্যস্ত মানুষজন কেউ কারওর খোঁজ না রাখলেও এই তিন বছরে বেশ বন্ধুত্ব হয়েছে তাদের দুটির। তাই মায়ার আশার পারদটাও বোধকরি একটু বেশিই।

কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পরে অনুজা আবার প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা রিনির বন্ধুবান্ধবদের ফোন করে খোঁজ নিয়েছিলে?’

‘এখানে ওর বন্ধুবান্ধব কে-ই বা আছে। এই তো কটাদিন হল বিয়ে হয়েছে।’

‘হ্যাঁ, সেটাও ঠিক। ঝগড়া-টগড়া কিছু হয়েছিল নাকি?’

‘তুমি তো জানো, আমি ওকে কীভাবে আগলে আগলে রাখি। নীহার থাকে না বলে উঁচু গলায় কথা পর্যন্ত বলি না। পাছে মেয়েটা কষ্ট পায়।’ বলতে বলতে থেমে যায় মায়া। কী যেন ভাবতে শুরু করে। হঠাৎই চমকে উঠে অনুজার হাতদুটো চেপে ধরে, ‘কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি তো?’ মুখে একরাশ যন্ত্রণা নিয়ে সামনে রাখা চেয়ারে সজোরে বসে পড়ে মায়া। দুচোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ে তার।

‘না না বাজার তো মোটে মিনিট দশেকের রাস্তা। সেরকম কিছু ঘটলে এতক্ষণে খবর পাওয়া যেত। তাছাড়া আমি তো ওখান দিয়েই এলাম, কিছু ঘটলে অ্যাটলিস্ট কানে তো আসত।’

রাত পর্যন্ত রিনির কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না। দশটা নাগাদ অনুজার স্বামী অলোকের সাথে মায়া থানায় একটা ডায়ারি লিখিয়ে এল। সেখানেও এক বিপত্তি, যিনি ডায়ারি লিখবেন তাঁর হাজারো রকম প্রশ্ন, ‘ছেলে-বউ কেন আলাদা থাকত? নিশ্চয়ই কোনও গড়বড় কেস… পণ দিতে পারেনি তাই বোধহয় আপনারা অত্যাচার করতেন? দেখুন কোনও ইয়ারের সঙ্গে পাত্তাড়ি গুটিয়ে বেমালুম ফুর্তিতে আছে। আপনারা অযথাই টেনশন করছেন আর রাতবিরেতে আমাদেরও টেনশন দিচ্ছেন।’

সকাল থেকে কেঁদে কেঁদে মায়ার বেহাল অবস্থা, তার উপর ওনার এইধরনের অপ্রত্যাশিত প্রশ্নবাণে যেন আরও ভেঙে পড়ে মায়া। এই নিয়ে পুলিশ অফিসারের সঙ্গে অলোকের প্রায় বচসা বাধতে বসেছিল।

‘এক্সকিউজ মি অফিসার। একজন মহিলার সঙ্গে আপনি এভাবে কথা বলতে পারেন না।’

‘আপনি কে মশাই? আপনি আমাকে বলে দেবেন আমি কার সাথে কীভাবে কথা বলব?’

‘অফকোর্স। প্রয়োজন পড়লে তা-ও করব।’ চ্যাঁচামেচি শুনে ভিতর থেকে আর এক উচ্চপদস্থ অফিসার সামনে আসতেই ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়। মেয়ের কলেজের প্রফেসার বলে কথা। ব্যাপারটা সেখানেই গুটিয়ে যায়। ওনাকে পার্সোনালি এই কেসটা দেখার জন্য অনুরোধও করে আসে অলোক।

বছর ঘুরে গেলেও এই কেসের কোনও সুরাহা করতে পারে না পুলিশ। এই ঘটনার পরে পরেই দুবাই থেকে মায়ার ছেলে এসে চার-পাঁচ মাস থানা-পুলিশ করে করে অবশেষে নিরাশ হয়ে সেও পুলিশের অনুমতি নিয়ে কাজের জগতে ফিরে যায়। রিনির বাপের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে মায়াদের ভীষণ ভালো সম্পর্ক। তারাও খুব ভালো করেই জানত রিনির অন্তর্ধানের পিছনে অন্তত তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিলক্ষণ কোনও হাত নেই। প্রথম প্রথম সকলে ভেবেছিল অপহরণ হলেও হতে পারে। কিন্তু কয়েকদিন পরেই সে ভুল ভেঙে যায় সকলের। কারণ অপহরণ হলে অন্ততপক্ষে অপহরণকারীরা টাকার দাবি করত। সেরকম কিছু ঘটেনি।

এতদিনে তাদের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে হয়তো অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে মারা গেছে মেয়েটা। ট্রেস না পেয়ে হয়তো মর্গ থেকে বার করে আর-পাঁচটা বডির সাথে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর নয়তো দুষ্কৃতীদের হাতে…।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খোঁজখবর করা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল সকলেই। এমনকী পুলিশও হাত গুটিয়ে নিয়েছিল এই কেসটা থেকে। মায়া-ই মেয়েটার আত্মিক বন্ধন ছিঁড়ে বেরোতে পারেনি। মাঝে মাঝেই রিনিকে নিয়ে তার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠত। রিনির বাবা-মা তো কবেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ওই একরত্তি মেয়েটাকে দাদা-বউদির ভরসায় ছেড়ে গিয়েছিল সেই দাদা-বউদিও বোধকরি মেয়েটাকে নিয়ে অত ভাবে না, যতটা মায়া। কথা বলতে বলতে কোনও না কোনও কারণে রিনির প্রসঙ্গে ঠিক টেনে আনবেই। ‘কত শখ করে বাড়ির বউ করে এনেছিলাম মেয়েটাকে। নিজের পছন্দ নিয়ে কত গর্ব ছিল আমার। কোনওদিন একা কোথাও যেত না, সবসময় আমাকে সঙ্গে নিয়ে…। কী যে হয়ে গেল…’ অনুজা বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলেও মনে মনে খুব ভালো করেই জানত এই ঘা সারাজীবনেও যাওয়ার নয়।

একদিন বিকেলে অনুজা আর মায়ার কথা হচ্ছিল। ‘দ্যাখো মায়া, মনে হয় না রিনি আর কোনওদিন ফিরে আসবে। দেখতে দেখতে তো অনেকগুলো দিন-ই কেটে গেল। এবার ছেলের একটা বিয়ের বন্দোবস্ত করো। ওর তো সারা লাইফটা পড়ে রয়েছে। এভাবে তো আর একা একা…’ অনুজার কথাগুলো শুনেই মুহুর্তে মায়া-র চোখমুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কিছুক্ষণ স্থির থাকার পর একটা ক্ষীণ স্বর কানে গেল অনুজার। ‘রিনির জায়গায় অন্য কেউ….?’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়া, ‘জানি নীহারের কথাও তো ভাবতে হবে। এখন ও যা ভালো বোঝে।’ মায়ার কথা শুনে একটুও অবাক হয়নি অনুজা। বরং মনে মনে ভেবেছে একটা মানুষকে কতটা ভালোবাসলে তবে তার থেকে এই ধরনের উত্তর আশা করা যায়। মায়ার মনের অবস্থা বুঝে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায় অনুজা। এদিক-ওদিককার নানারকম কথায় ব্যস্ত করে তোলে মায়াকে।

‘ওহ্ পাওলির বিয়ের গিফট-টা তোমাকে দেখানো হয়নি না?’

‘দেখেছ, একদম মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল, পাওলি-র বিয়েতে তোমার আবার দিল্লি যাওয়ার আছে না। কবে যেন বলেছিলে। ছাব্বিশ না সাতাশ কী যেন একটা…’ মনে করতে পারে না মায়া।

‘আরে সামনের সপ্তাহেই তো। বুধবার রাতে ট্রেন। দাঁড়াও তোমাকে জিনিসটা দেখাই।’ বলে মিনিট খানেকের মধ্যেই জিনিসটা নিয়ে এসে মায়ার হাতে ধরিয়ে দেয় অনুজা।

‘বাহ্, সেট-টা খুব সুন্দর হয়েছে। খুব ভালো মানাবে ওকে।’

সময়ের চাকা কখন যে কোনদিকে ঘোরে তা বোধকরি স্বয়ং উপরওয়ালারও বোধগম্যের বাইরে। অনুজার বড়দির ওই একমাত্র মেয়ে পাওলি। বাঙালি পরিবার হলেও বিগত বাইশ বছর দিল্লিতে থেকে ওখানকার রঙেই রাঙিয়ে নিয়েছে নিজেদের। অনুজারা দু’দিন আগেই বড়দির বাড়ি পৌঁছে গিয়েছে। আলাদা করে একটা মেহেন্দির অনুষ্ঠানও রাখা হয়েছে। ডিজে-র তালে তালে সকলে মেতে উঠেছে। অনুজারও বেশ ভালো লাগছিল। এমন সময় জনাকয়েক রব তুলল, ‘পাম্মি গেল কোথায়? এখনও এসে পৌঁছোয়নি? ও না এলে কী মেহেন্দির অনুষ্ঠান জমে?’

‘এই পাম্মি-টা আবার কে রে? বিশেষ কেউ?’ দিদি অনুভাকে প্রশ্ন করে অনুজা।

‘আরে না-না, দিল্লি, মুম্বইতে আজকাল মেহেন্দির অনুষ্ঠানে লাইভ গানের বেশ একটা চল হয়েছে। পাম্মি ওই একটা অর্কেস্ট্রা সেটের সঙ্গে গান করে। বেশ ভালো গলা মেয়েটার। একটা শোয়ের জন্য তিন হাজার টাকা করে নেয়।’ হাসতে হাসতে জবাব দেয় দিদি অনুভা।

মিনিট দশ বাদে বেশ একটা সুরেলা, মধুর কণ্ঠ কানে আসে অনুজার। সেই সুরকে লক্ষ্য করে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতেই এক ঝটকায় মাথাটা ঘুরে যায় অনুজার। অনায়াসেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, ‘রিনি’!

অনুভা মেহেন্দি লাগাতে লাগাতেই মুখটা ঘুরিয়ে বলে, ‘রিনি! সেটা আবার কে?’

‘এযে অবিকল রিনি। আমার পাশের বাড়িতে মায়া আছে না। তুই তো দেখেছিস। ওর বউমা, বছরখানেক হল নিখোঁজ। তারপর আর…’ অর্ধেক কথা মনের মধ্যেই চাপা রয়ে গেল অনুজার। সকলে মেহেন্দি আর গানবাজনার মধ্যে ডুবে রয়েছে। পাম্মিও গাইতে গাইতে পাওলির পরিবারের একএকজনকে স্টেজে ডেকে নিয়ে বেশ জমিয়ে নাচাচ্ছে। অনুজার দিকে এগিয়ে আসতেই পাম্মির অমন চাঁদপানা মুখটা কেমন যেন তামাটে হয়ে গেল।

অনুজার মুহূর্তও লাগেনি ব্যাপারটা আঁচ করতে। রিনি নিশ্চয়ই তাকে চিনে ফেলেছে। কিন্তু ও যদি সত্যি সত্যি রিনি-ই হয়ে থাকে, তাহলে এখানে কী করছে? ছোটোখাটো এরকম একটা অর্কেস্ট্রা গ্রুপ-এ…? এটা কীভাবে সম্ভব? এমন হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে অনুজার মনে। মনে মনে ঠিক করে যে ভাবেই হোক একবার মেয়েটার মুখোমুখি হতেই হবে। আসল ব্যাপারটা কী, তাকে জানতেই হবে। সেই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল অনুজা। মেহেন্দি লাগাতে বসেও চোখ আটকে রইল সেই পাম্মির দিকেই।

মেহেন্দির পরেই খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। খাওয়ার ফাঁকেই মেয়েটা কোথায় যেন সরে পড়েছে। মেয়েটার খোঁজে অনুজার চোখ নিরন্তর এদিক-ওদিক করতে থাকে। অনুষ্ঠান শেষে যে-যার বাড়ির দিকেও রওনা দিয়েছে। এমন সময় হঠাৎ-ই দিদি অনুভাকে হন্তদন্ত হয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখে অনুজা। ‘কি হল এভাবে এদিক-ওদিক করছ কেন?’

‘আর বলিস না। পাম্মিকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। ওর টাকাটাও তো দেওয়ার ছিল। কত কাজ ওদিকে।’

‘ঠিক আছে তুমি যাও। আমি থাকছি এখানে। টাকা নিতে এলে দিয়ে দেব।’

কিছুক্ষণ পর একটা পায়ের শব্দ কানে আসে অনুজার। ধীর পায়ে কেউ এগিয়ে আসছে সেই ঘরের দিকেই। ধারণা একদম ঠিক।

‘ম্যাডাম, আমার টাকাটা।’

‘রিনি, টাকাটা আমার কাছে আছে। ভিতরে এসে নিয়ে যাও।’

একটু সাহস সঞ্চয় করে ঘরে ঢুকে পাম্মি জবাব দেয়, ‘আপনি বোধহয় ভুল করছেন, আমার নাম পাম্মি।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু তবু কেন জানি না মনে হচ্ছে তুমি আমাদের সেই রিনি-ই। যার জন্য তার শাশুড়ি আজও পথ চেয়ে বসে আছে। যদি কখনও তার আদরের বউমা…’

‘এসব শোনার সময় আমার নেই। টাকাটা দিন তাড়া আছে।’ একটু কঠোর হওয়ার চেষ্টা করে পাম্মি। অনুজার হাত থেকে টাকার খামটা নিয়ে উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

পাম্মি চলে যাওয়ার পরও অনুজা সেখানে দীর্ঘক্ষণ বসে রইল। মাথায় কতকিছু যে ঘুরপাক খাচ্ছে তার। মনটা কেমন যেন ভার ভার লাগছে। রাতেও ঠিক করে ঘুমোতে পারেনি অনুজা। চোখ বুজলেই সেই সরল সাধাসিধে মুখটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। বারবার যেন কেউ কানের কাছে বলে চলেছে, ‘ওর জায়গায় অন্য কেউ?’

সকালে একদম আলাদা পরিবেশ। বিয়ের দিন বলে কথা। চতুর্দিকে হইহুল্লোড়, ব্যস্ততা। সাজো সাজো রব। তার উপর সানাইয়ের সুর। মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠেছিল অনুজার। সব ভুলে সেও বিয়েতে মেতে উঠেছিল। মেক-আপ করাতে বিউটিশিয়ানের পাশে বসতেই সে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে উঠল, ‘দিদি ম্যায় রশ্মি। আপনি-ই অনুজা দিদি আছেন, না?’

অনুজা বেশ চমকে গেল, তাকে কী করে চিনল রে বাবা? এর আগে কোথাও। দেখতেও বেশ। বাঙালির সঙ্গে থেকে থেকে বাংলা হিন্দি মিশিয়ে একটা আলাদাই ভাষা তৈরি করেছে এরা। সাঁতপাঁচ ভাবতে থাকে অনুজা। এমন সময় সে আবার বলে ওঠে, ‘দিদি কাল দোপহর কো কুছক্ষণ কে লিয়ে বাহার আসতে পারেন কী? আপসে জরুরি কাম হ্যায়।’

‘আমার সাথে, মেরা মতলব হ্যায় কে মুঝ সে? ম্যায় তো ইহা রহতি ভি নেহি অউর কিসি কো পহচানতি ভি নেহি…’

‘দিদি উয়ো পাম্মি আছে না ও আপনার সাথে দেখা করতে চায়। উয়ো ভি আকেলে মে। একদম আমার পাশেই থাকে, আপনি যাবেন দিদি?’

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় অনুজা। মনে মনে ভাবে পাম্মি দেখা করতে চেয়েছে মানেই– সে ঠিক তার অনুজা আন্টিকে চিনতে পেরেছে।

পরের দিন সময়মতো রশ্মির সাথে বেরিয়ে পড়ে অনুজা। এই নিয়ে আগে থেকেই দিদি অনুভার সঙ্গে সাঁট করে রেখেছিল সে। কথাই ছিল তারা বেরোনো মাত্রই ড্রাইভার সদানন্দ গাড়ি নিয়ে তাদের পিছু পিছু যাবে। যদি কিছু বেগতিক দেখে সদানন্দ সামলে নেবে। রশ্মির অটোতে ওঠার কথা বলতেই বেশ ভয় ভয় করছিল অনুজার, পাম্মি-র সাথে দেখা করতে যাওয়ার চক্বরে যদি কোনও ঝামেলায় ফেঁসে যায়। পরে সদানন্দের কথা ভেবে ভয় কেটে যায়। অটোতে উঠে বসে। মিনিট দশ পরে অটোটা একটা বস্তির সামনে এসে দাঁড়াতেই মুখে রুমাল চাপা দিয়েই রশ্মিকে জিজ্ঞাসা করে অনুজা, ‘তোমরা এখানে থাকো?’ রশ্মি ধীর গলায় জবাব দেয়, ‘দিদি, আমাদের মতো….’

‘ঠিক আছে।’ আরও কিছু বলার আগেই রশ্মিকে থামিয়ে দেয় অনুজা। অটো থেকে নেমে মিনিট পাঁচেক ভিতরে গিয়েই একটা দরজা ধাক্বায় রশ্মি। দরমার বাড়ি। একেবারে হাইড্রেনের গা ঘেঁষে রয়েছে। খানিকটা হেলেও পড়েছে। রাস্তার দুপাশে থরে থরে হাইড্রেন থেকে নোংরা তুলে রাখা। দুর্গন্ধে গা ঘিনঘিন করে ওঠে অনুজার। কোনওরকমে সামলে নেয় নিজেকে। অভিজ্ঞ চোখ পরখ করতে থাকে সবকিছু। ঠিক তখনই দরজাটা খুলে দেয় পাম্মি। হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গিয়ে একটা ভাঙা চেয়ারে বসতে দেয়।

‘তাহলে আমার ধারণাই ঠিক। কী রিনি তাই তো?’ কোনও জবাব দিতে পারে না পাম্মি। মাথা নীচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে অনুজার সামনে। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। রিনির হাতটা ধরে সামনের চৌকিতে বসায় অনুজা। মিনিট কয়েক এভাবেই কেটে যায়। কাঁদলে খানিক হালকা হবে এই ভেবে অনুজাও বাধা দেয়নি। এর মাঝে চা নিয়ে ঢুকে পড়ে রশ্মি। দু-জনকে দু-ভাঁড় চা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে। চা খেতে খেতে ঘরের ভিতরটায় ভালো করে চোখ বুলিয়ে নেয় অনুজা। আসবাব বলতে এই একটা চৌকি আর একটা আলনা। এক কোনায় রাখা রয়েছে একটা স্টোভ আর কয়েকটা বাসনপত্র। অনুজা তার ক্ষুরধার দৃষ্টি দিয়েই রিনির অবস্থাটা খানিক আঁচ করে ফেলে। চেহারাতেও দৈন্যতার ছাপ ফুটে উঠেছে। চোখের নীচে কালি পড়েছে। পরনের কামিজটাও দু-এক জায়গায় ছেঁড়া। নিজের মনটা ঘোরায় অনুজা। চায়ে চুমুক দিতে দিতেই প্রশ্ন করে, ‘এবার বলো তো এখানে কী করে এলে? কেউ কি জবরদস্তি…?’

ততক্ষণে পাম্মি নিজেকে খানিক সামলে নিয়েছে। খুব ধীরভাবে বলে ওঠে, ‘না কেউ জবরদস্তি করেনি। আমি স্ব-ইচ্ছায় চলে এসেছি।’

রিনির কথা শুনে অবাক হয়ে যায় অনুজা। বোকার মতো তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। মেয়েটা এসব কী বলছে নিজের ইচ্ছায়…! মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছিল অনুজার। তাকে এতদিন সে যেভাবে চিনত, জানত– মেলাতে পারছিল না কিছুতেই। ওদিকে এতদিন পরে কাছের একজনকে পেয়ে জমাট বাঁধা আবেগগুলো ঝড়ের গতির মতো বেরিয়ে আসছিল রিনির মুখ দিয়ে। ‘ছোটো থেকেই ইচ্ছে ছিল বড়ো গায়িকা হব। স্কুলকলেজেও সবাই আমার গানের গলার খুব তারিফ করত। যতদিন বাবা-মা ছিল ততদিন একরকম ছিলাম, তারপর দাদা-বউদি একপ্রকার জোর করেই আমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়েটা দিয়ে দিল। ধরেই নিয়েছিলাম আর-পাঁচটা মেয়ের মতো আমার এত দিনের সাজিয়ে রাখা স্বপ্নটাও চারদেয়ালের মধ্যে আটকে রয়ে যাবে। ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে আসত। কেমন যেন একটা জেদ চেপে বসেছিল। নিজেকে প্রমাণ করবার। সুযোগও পেয়ে গেলাম। বিয়ের পাঁচ মাস পরে নীহার দুবাই চলে গেল। সংসারে তখন মা আর আমি। তখনও ভাবিনি এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসব। ও যাওয়ার পর শূন্যতা যেন আরও ঘিরে ধরল আমায়। একাকীত্ব কাটাতে আঁকড়ে ধরলাম গানকে। দিনরাত ওই নিয়েই পড়ে থাকতাম। সময় তো কাটাতে হবে। ঠিক ওই সময়েই স্বাতীর সাথে আলাপ।’

‘স্বাতীটা কে?’

‘ওই যে দিনকতকের জন্য প্রসূনদাদের বাড়িতে এসেছিল না। মা তখন নিয়ে গিয়েছিল ওদের বাড়িতে। ওনার মুখেই শুনেছিলাম দিল্লিতে কোনও একটা বড়ো চ্যানেলে নাকি গানের অডিশন শুরু হচ্ছে। একবার সিলেক্ট হতে পারলেই আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না। টিভিতেও সেই অডিশনের সম্পর্কে জানতে পারি। আর ধরে রাখতে পারিনি নিজেকে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস দেখুন, দুদিন ধরে দীর্ঘ লম্বা লাইনে অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎই একজন অসুস্থ হয়ে পড়ে যাওয়াতেই বিপত্তি ঘটে গেল। উত্তেজিত জনতার মারামারি, পুলিশের লাঠিচার্জ– অডিশনটাই আর দেওয়া হল না।’ ঘরটার মধ্যে কেবল একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল।

এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিল অনুজা। এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, ‘তোমার গানের গলা খুব সুন্দর, এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই। কিন্তু তাই বলে তুমি যে পদক্ষেপ নিয়েছ সেটা কি ঠিক? তুমি তো শ্বশুরবাড়িতে থেকেও তোমার স্বপ্নপূরণ করতে পারতে। মায়াকে আমি যতদূর চিনি-জানি, ও কোনওদিন বাধা দিত না।’

‘তখন বুঝিনি, কতবড়ো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে চলেছি। আমার জীবনটাই নষ্ট হতে বসেছে। কী যে হল সেদিন… না হলে ওইরকম স্বামীকে ছেড়ে মাকে ছেড়ে চলে আসি কখনও। নীহারও কতবার ফোনে বলেছে ‘আর ক’টা দিন একটু কষ্ট করো। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি তোমাকে আমার কাছে নিয়ে চলে আসব।’ তবুও কেন যে… শুধু মনে হতো সংসারে থাকলে আমি জীবনে কিছু করতে পারব না। আমাকে এখান থেকে বেরোতেই হবে। আসলে সবই আমার নিয়তি।’

‘বুদ্ধিবিভ্রম বলো বা নিয়তি-ই বলো ভুল তো তুমি করেইছ। আচ্ছা একটা কথা বলো তো শুধুমাত্র অডিশন দেওয়ার জন্য একটা অজানা-অচেনা শহরে কোনও চেনাপরিচিতি ছাড়াই হুট করে চলে এলে? এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হল না!’

‘আমার কলেজের এক বান্ধবী থাকে এখানে। ওর ঠিকানা সম্বল করেই বেরিয়ে পড়ি। এখানে এসে দেখি ওরাই একটা ঘরে কোনওরকমে দিন গুজরান করছে। সেখানে আবার বাড়তি আমি।

কষ্ট করে কটাদিন থেকে গেলাম ওখানে। একটু সুযোগের জন্য এই স্টুডিয়ো থেকে সেই স্টুডিয়ো– পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছি। তখনই বুঝেছি এই দিল্লি, মুম্বইয়ের মতো শহরে কিছু না দিলে কিছু পাওয়া যায় না। আর নয়তো নামিদামি বাবা-মায়ের ট্যাগ-টা গায়ে লেগে থাকতে হবে। তবেই এখানকার মাটিতে টিকে থাকা সম্ভব। যা টাকাপয়সা এনেছিলাম ততদিনে সব শেষ হয়ে গেছে। মাঝে সুনীতার থেকেও বারকয়েক টাকা ধার করেছি। আর কোনও রাস্তা না দেখে বারে গান গাওয়া শুরু করি। ওখান থেকেই অর্কেস্ট্রা গ্রুপ-এর সঞ্জয়ের সঙ্গে আলাপ। তারপর থেকে এভাবেই চলছে। এখন এটাই আমার ঠিকানা।’ নিরাশা ঘিরে ধরে রিনিকে।

‘এই জীবন তো স্বেচ্ছায় বেছেছ। এখন আর আপশোশ করে লাভ কী?’ জবাব দিতে পারে না রিনি। জবাব দেওয়ার মতো আছেটাই বা কী! তার ভুলের মাশুল যে তাকেই গুনতে হবে। মনে মনে ভাবে এখন শহরের প্রান্তে এই নোংরা বস্তি-ই তার ঠিকানা। জীবনের শেষ দিনটা পর্যন্ত এখানেই কাটাতে হবে তাকে। রিনির মনের অবস্থা বুঝে রাগ সংবরণ করে খানিক নরম হওয়ার চেষ্টা করে অনুজা। গলা নামিয়ে ধীর ভাবে বলে, ‘অডিশনের পরেও তো ফিরে যেতে পারতে?’

‘কোন মুখে যেতাম আন্টি, সব পথ যে আমি নিজে বন্ধ করে এসেছি। একবার অবশ্য বাড়িতে ফোন করেছিলাম। ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল। আর সাহস হয়নি করার।’

‘তা এবার কী করবে ভেবেছ?’

রিনির ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি লক্ষ্য করে অনুজা। সে হাসি আনন্দের নয়, বিদ্রুপের। ‘ব্যস বাঁচা-মরা সব এখন এখানেই। আর কোনও রাস্তাও তো খোলা নেই আমার কাছে। মা আমার জন্য এখনও অপেক্ষা করে আছে জেনে, মনটা আনন্দে ভরে গেল। এ পৃথিবীতে কেউ তো আছে, যে আজও আমাকে মনে রেখেছে। তাতেই আমার শান্তি। মা-র কথা শোনার পর থেকেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। প্লিজ আন্টি, এব্যাপারে ওনাকে কিছু জানাবেন না। আমি চাই না ওনার কাছে আমার ছবিটা বদলে যাক। জানেন আন্টি মাকেও দু-বার ফোন করেছি। কিন্তু সাহস হয়নি কথা বলার। মা হ্যালো বলতেই ভয়ে ফোনটা রেখে দিয়েছি। ভয় লেগেছে, মা যদি বলে দেয় মায়ের কাছে আমি মৃত…। নীহারকেও…শুধু একটু গলা শোনার জন্য… কতবার ভেবেছি সবকিছু খুলে বলি ওকে, সেই সৎসাহস দেখাতে পারিনি। ভয়ে আঁতকে উঠেছি, আমার গলা শুনলেই যদি আমার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসে। সহ্য করতে পারতাম না। একদিন তো ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে ছিলাম। ফোন করি অথচ কথা বলি না। এতেই ও ধরে ফেলেছিল, ওটা আমি, তারপর থেকে আর…’, বলতে বলতে কেঁপে কেঁপে উঠছিল রিনি। অপরাধবোধের স্পষ্ট ছাপ তার চোখেমুখে ছেয়ে যায়। সান্ত্বনা দিতে রিনির হাতদুটো চেপে ধরে অনুজা। কী যেন চিন্তা করে বলে, ‘আর একবার চেষ্টা করে দ্যাখো না। হতে পারে ওরা তোমাকে গ্রহণ করবে না বা হয়তো… … কিছুই জানি না আমি। কিন্তু তবু বলছি এই আপশোশ তো অন্তত থাকবে না ‘ইস্ যদি একবার চেষ্টা করে দেখতাম।’ কাঁপা গলায় রিনি কোনওরকমে তার অনুজা আন্টিকে জিজ্ঞাসা করে, ‘ফিরে যেতে বলছেন আমাকে? কিন্তু কোন্ মুখে যাব?’

‘ঠিক যেমন করে বাড়ি ছেড়ে এসেছিলে, সেইভাবেই’ এইবার একটু রুক্ষ্ম শোনায় অনুজাকে। কেঁদে ফেলে রিনি। ‘রোজ যে তিলতিল মরছি, এটা তারই সাজা আন্টি।’

রিনিকে কাঁদতে দেখে তার মাথায় হাত রাখে অনুজা। ‘আমার কথাটা হয়তো শুনতে খারাপ লাগছে তোমার। কিন্তু আমি তোমার ভালোর জন্যই বলছি, ফিরে যাও। গিয়ে সব সত্যিটা খুলে বলো ওদের। তারপর সবই ভগবানের ইচ্ছে। অন্তত ভুল শোধরানোর একটা চেষ্টা তো করো। তোমাদের প্রতি একটা আন্তরিক টান আছে বলেই বলছি’, বলতে বলতে উঠে পড়ে অনুজা। তারও চোখে জল ভর্তি। ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে গাড়িতে উঠে পড়ে। সদানন্দ গাড়ি ঘুরিয়ে নেয় বাড়ির দিকে। মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে যায় তার। সারাক্ষণ মনের মধ্যে ঘুরতে থাকে, ‘মেয়েটা কী করবে, কে জানে।’ মিনিট দশেক পর বাড়ি ফিরলে সবাই তার উদাসীনতার কারণ জিজ্ঞেস করে। এড়িয়ে যায় সে।

বিয়ের পরেও আরও কয়েকটা দিন দিল্লিতে থাকার কথা ছিল অনুজার। তারপর ওখান থেকে গোয়া। কোথাও গিয়ে যেন শান্তি পাচ্ছে না সে। সারাক্ষণ ওই একই চিন্তা। কথাবার্তার মাঝে ফোন নাম্বার-টাও নিতে ভুলে গেছে। নিজেকেই দূষতে থাকে সে। নাম্বারটা নিলে অন্তত যোগাযোগ তো করা যেত। অবশ্য দিদির থেকে নিতে পারত। কিন্তু কাউকে আর ঘাঁটাতে চায়নি সে।

দিন পনেরো পর গোয়া থেকে বাড়ি ফিরে আসে অনুজা। ফিরেছে একেবারে কাকভোরে। তখনও কেউ ওঠেনি। বাড়িতে তেমন বাজার-দোকান না থাকায় প্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিস নিতে বেলার দিকে বেরোতেই মায়াকে দেখতে পেল সে। বাজার সেরে ফিরছে। বেশ হাসিখুশি লাগছে মায়াকে। অনুজাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে আসে তার দিকে। ‘ঘোরা হল তোমার? তুমি জানো এর মাঝে কী হয়েছে? আমার বউমা গত পরশু বাড়ি ফিরে এসেছে।’ এক মুহুর্তে মনটা ভীষণ রকম ভালো হয়ে যায় অনুজার। মনে মনে ভাবে তার বোঝানো তাহলে বিফলে যায়নি। রিনি তার আন্টি-র কথা রেখেছে। সে পেরেছে জীবনের মূল স্রোতে ফিরে আসতে।

ভাবনায় বাধ সাধে মায়া। কানে কানে বলে ওঠে, ‘তুমি তো ঘরের লোক অনুজা, তোমার কাছে আর কী লুকোব। এমন মেয়ে, কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গিয়েছিল দিল্লি, গানের অডিশন দিতে। এরকম ভুল কেউ করে বলো? ছোটো মেয়ে। যদি কিছু একটা অঘটন ঘটে যেত, তাহলে তখন তুই কী করতিস! বাবুও আসছে। ও-ও বলেছে গান-টান যা করার সব এখান থেকেই করতে হবে। একা একা কোথাও যাওয়া চলবে না। তুমি বলো কী দুঃসাহস! একা একা…’ থেমে যায় মায়া। কী যেন ভেবে নেয়। তারপর আবার বলতে শুরু করে, ‘কিন্তু পাড়াপড়শিদের তো আর এসব বলা যায় না। এমনিতেই তো কম কুৎসা রটায়নি তারা। কানপাতা দায় হয়ে গিয়েছিল। ওদের সকলকে বলেছি অ্যাক্সিডেন্ট-এ স্মৃতিশক্তি চলে গিয়েছিল। মারাঠি একটি পরিবারের দয়ায় হাসপাতালে ছিল। সবকিছু মনে পড়তেই ফিরে এসেছে।’ অনুজা আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকিয়েছিল মায়ার মুখের দিকে।

আকাশটা আজ অনেক পরিষ্কার। ঝড়-ঝঞ্ঝা-মেঘ কাটিয়ে সূর্য যেন মাথার উপর আবার জ্বলজ্বল করছে।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব