বৃষ্টি থামার শেষে

কলেজ থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়েই সোজা বিছানা নিয়েছে কেয়া। আর পেরে উঠছে না। কয়েকদিন যাবৎ একটু বাড়তি খাটনি হয়ে যাচ্ছে তার। ছাত্র-ছাত্রীদের আবদার মেটাতে প্রায় রোজই কলেজের পরে তাদের ঘন্টা-দুয়েক করে এক্সট্রা টাইম দিতে হচ্ছে। সামনেই এক্সাম, তাই না করতে পারেনি কেয়া। বাচ্চাগুলোকে বড্ড ভালোবাসে সে। আর তারাও কেয়াদি বলতে অজ্ঞান। আসলে কেয়ার ব্যবহারটাই এত মিষ্টি। কলিগদের পছন্দের তালিকায় তার নামটা সবার আগে। সাইকোলজির ডিপার্টমেন্টে বেশ ফেমাস।

আজও বাড়ি ফিরতে প্রায় সাতটা হয়ে গেছে। ফেরার পথে খানিক সবজি নিয়ে ফিরেছে। সেগুলো টেবিলের উপরেই রাখা রয়েছে। ফ্রিজে তোলা হয়নি, শুয়ে শুয়ে এসবই সাতপাঁচ ভাবছিল কেয়া। এমন সময় কৌশানীর হাসির শব্দ কানে এল। সঙ্গে খুব চেনা একটা স্বর। বুঝতে একমিনিটও সময় লাগেনি কেয়ার। নিশ্চয়ই সুশোভন। মনে মনে বিরক্তই হয় কেয়া। আজকাল এ বাড়িতে তার যাতায়াত বড্ড বেড়ে গিয়েছে। সময় নেই, অসময় নেই যখন তখন চলে আসে। তাড়াতাড়ি উঠে হাউসকোট-টা চড়িয়ে নেয়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই মেয়ে কৌশানীকে প্রশ্ন করে ‘কে রে কৌশী?’

‘শুভ অঙ্কল মা।’ হঠাৎই মেয়ের ‘সুশোভন আঙ্কল’-এর পরিবর্তে ‘শুভ আঙ্কল’ সম্বোধন মনটাকে যেন আরও সংকুচিত করে দেয় কেয়ার। ক’দিন যাবৎ কেয়া নোটিস করছে, কৌশী-র প্রতি একটু বাড়তি-ই স্নেহ দেখাচ্ছে সে। সুশোভন আঙ্কল থেকে শুভ আঙ্কলের অন্তরালে আরও কত কী রহস্য আছে কে জানে। ভেবেই শিউরে ওঠে কেয়া। মনে মনে ভাবতে থাকে অনেক আদর যত্ন আর শিক্ষার সঙ্গে মানুষ করেছে কৌশী আর কুশলকে। সেই কারণেই তো লোকে এত প্রশংসা করে বাচ্চাদের। কিন্তু যতই লালন-পালন ভালো হোক না কেন, বয়স– বয়স মানুষকে ভুল পথে চলতে বাধ্য করে। বিশেষত কৌশী-র বয়সি মেয়েদের। সবে স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছে। তার আর কত বোধ তৈরি হবে। মেয়ের মা হওয়াটা যে কতবড়ো দায়িত্বের। না কিছুতেই মেয়েকে বিপথে চালিত হতে দেওয়া যাবে না। ধৈর্য আর বুদ্ধি দিয়ে বিষয়টা ট্যাকল করতে হবে।

ভাবনায় বাধ সাধে সুশোভন। ‘কেমন আছেন বউদি?’ বোধকরি এর আগেও বার কয়েক জিজ্ঞাসা করেছে? ‘কী ভাবছেন?’

চমকে ওঠে কেয়া। খানিক সহজ হওয়ার চেষ্টা করে। ‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ। না না কিছু ভাবছি না তো।’

‘উঁহু, মনে হল।’

‘আরে না না, ওই একটু ক্লান্ত আর কী, জানেনই তো, সবকিছু।’ মনের মধ্যে বিতৃষ্ণা থাকলেও হাসার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে কেয়া। তারপর প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘তা, কী মনে করে?’

‘ওই আরকী, কাছেই একটা কাজ ছিল, তাড়াতাড়ি মিটে গেল, তাই ভাবলাম একটু খবর নিয়ে যাই। নইলে তো বন্ধুর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। ফিরে এসে বলবে তার অনুপস্থিতিতে আমি দায় এড়িয়ে গেছি।’

‘তা বটে, আমাদের ভালো থাকা না থাকাটা তো এখন আপনারই হাতে।’ কথাটা একটু আস্তে বললেও সুশোভনের কান পর্যন্ত ঠিকই পৌঁছোয়। কেয়ার কথার কী মানে করে কে জানে, একটু অপ্রতিভ হয়েই সুশোভন বলে, ‘এমন করে বলছেন কেন, এটা তো আমার কর্তব্য।’

‘চা খাবেন নিশ্চয়ই’– উত্তরের অপেক্ষা না করে, মেয়ের দিকে ফিরে বলে, ‘কৌশী দু-কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এসো তো।’

এর মিনিট পনেরো পর চা-খাইয়ে সুশোভনকে বিদায় করে বারান্দায় এসে বসে কেয়া। মন খারাপ হলে এখানেই এসে বসে সে। বাগানের গাছগুলো যেন কথা বলে তার সঙ্গে। আজ গাছেরাও যেন তার মন ভালো করতে অসমর্থ্য। খুব ভারাক্রান্ত লাগে কেয়ার। কুশীলব দেশে নেই। ছেলে ব্যাঙ্গালোরে। বাড়িতে মা আর মেয়ে। তার মাঝে এই দুশ্চিন্তা, তাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। কখনও ভাবেনি কুশীলবের অনুপস্থিতিতে তাকে এরকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।

মাস ছয়েক আগেও সবকিছু ঠিক ছিল। যখন আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি সম্পর্কিত বিশেষ জ্ঞান আর যোগ্যতার জন্য, ছাত্রদের সুবিধার্থে কুশীলবকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, সংসারের কথা ভেবে পিছিয়ে গিয়েছিল কুশীলব। এক বছর মানে তিনশো পঁয়ষট্টিটা দিন পরিবারকে ছেড়ে সুদূর আমেরিকায় থাকা সম্ভব নাকি? তাছাড়া ছেলেও পড়াশোনার কারণে বাড়ি থেকে দূরে ব্যাঙ্গালোরে থাকে। সে চলে গেলে বাড়িতে কেয়া আর কৌশী একা, ভাবতেই পারে না কুশীলব। কাছাকাছি তেমন কোনও রিলেটিভও নেই যাদের ভরসায় রেখে যাওয়া যায়। কুশীলবের মা-বাবা কবেই গত হয়েছেন। দুই দাদাও থাকে অ্যাব্রডে। কেয়ার বাপের বাড়িও বেশ ঘন্টা পাঁচেকের পথ। বিপদে-আপদে যে তারা পাশে এসে দাঁড়াবে সে উপায়ও নেই। এসব ভেবেই আরও পিছিয়ে যাচ্ছিল কুশীলব। তখন কেয়াই বুঝিয়ে সুঝিয়ে…।

‘মানছি এটা আমার জন্য খুবই গর্বের বিষয়। কিন্তু একবার ভেবে দেখেছ, তুমি একা এতগুলো দিন কীভাবে সামলাবে?’ কুশীলবের ভাবনাও অমূলক নয়।

‘কেন আমার উপর বিশ্বাস নেই তোমার?’ স্বামীর কাছ ঘেঁষে আসে কেয়া।

‘বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসছে না কেয়া, আমি জানি তুমি তোমার সামর্থ্য অনুযায়ী সবটুকু দিয়ে সামলে নেবে। কিন্তু তবুও…’। ভাবনাগুলো আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরে কুশীলবকে।

‘তুমি দেখো আমি সব সামলে নেব। এমন অপারচুনিটি বারবার আসে না কুশীলব। আর তাছাড়া তুমি এমন ভাবে রিঅ্যাক্ট করছ যেন আমি প্রথম গ্রাম থেকে শহরে এসেছি।’ কুশীলবকে চিন্তামুক্ত করার চেষ্টা করে কেয়া।

‘তোমাদের ছেড়ে একটা বছর’। চোখের কোণা চিকচিক করে ওঠে কুশীলবের। আবেগপ্রবণ হয়ে বুকে টেনে নেয় কেয়াকে। দূরে থাকার কথা ভেবে কেয়াও মুহূর্তের জন্য ইমোশনাল হয়ে পড়ে। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কুশীলবকে। চোখ জলে ভরে আসে। বেগতিক বুঝে কোনওমতে নিজেকে সামলে নেয় কেয়া। মনে মনে ভাবে… না, স্বামীর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য তাকে শক্ত হতেই হবে। তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কুশীলবের হাত দুটো ধরে দৃঢ় কণ্ঠে বলে, ‘একটা তো বছর। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। তাছাড়া বদলে কী পাচ্ছ সেটাও তো দেখতে হবে। কিছু পেতে হলে কিছু তো ছাড়তেই হয়।’ হাসার চেষ্টা করে কেয়া।

‘কিন্তু…।’

‘আবার কিন্তু কীসের? আর কোনও কিন্তু নেই। তুমি যাচ্ছ, এটা ফাইনাল।’ শেষ পর্যন্ত কেয়ার কাছে হার মানতে হয় কুশীলবকে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজনদের আশ্বাস পায় বটে, তবে খটকা থেকেই যায় তার। আসলে কুশীলব যে ধরনের মানুষ, তাতে তার বিচলিত না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। ভীষণ দায়িত্বশীল। অন্যান্য বন্ধুবান্ধবদের মতো কলেজের পরে কোনওদিন আড্ডাতে বসেনি, পরিবার নিয়ে থাকতেই সে ভালোবাসে। কোথাও যাওয়ার থাকলে দুজনে একসাথে।

নির্ধারিত দিনে আমেরিকার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয় কুশীলব। বাড়িতে এখন শুধু কেয়া আর কৌশানী। কুশীলব যাওয়ার পর বাড়িটা বড়ো খালি খালি লাগে কেয়ার। সপ্তাহে তিনদিন সন্ধের দিকে কৌশীর টিউশন থাকে। তখন একাকীত্ব যেন আরও চেপে ধরে কেয়াকে। নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য গান শোনে। পুরোনো দিনের গান। এগুলো বরাবরই কেয়ার খুব পছন্দের। কিন্তু আজকাল আর এসবও শুনতে ইচ্ছে করে না। মনে পড়ে যায় গানের মাঝে কুশীলবের গলা ছেড়ে গান ধরা, ‘ওগো কাজল নয়না হরিণী…’ মনটা আরও ভারাক্রান্ত হয়ে যায় তার। কৌশী-র বন্ধুবান্ধবরা এলে অবশ্য ঘরটা গমগম করে, বেশ ভালো লাগে কেয়ার। তাদের আবদার মেটাতে মেটাতেই টাইম চলে যায় তখন।

দিনগুলো একরকম কাটছিল। তবে কৌশী বরাবরই একটু বাবা ঘেঁষা। বাবা পাশে থাকলেই যত খুনশুটি, যত আবদার। বাবাই ছিল সবথেকে বড়ো বন্ধু। বাবার অনুপস্থিতিতে কৌশী বেশ একা হয়ে গিয়েছিল। বাবাতে-মেয়েতে মিলে পুরো বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখত। সঙ্গে মাঝেমধ্যেই কৌশীর বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ। ‘দ্যাখো না মা, বাবা যাবে না বলছে… এটা আনেনি… টিভির চ্যানেল ঘুরিয়ে দিয়েছে…’ হাজারো নালিশ। এখন বাড়িতে কৌশীর উপস্থিতি ফিল করতে পারে না কেয়া। এর মাঝে কুশীলবের বন্ধু কখনও একা, আবার কখনও পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে খোঁজখবর নিয়ে যেত। গল্পগুজব করে খানিকটা সময় কাটিয়ে যেত। কেয়ার বন্ধুরাও আসে মাঝে মাঝে। তবে কুশীলবের বন্ধু সুশোভন আর কেয়ার বন্ধু মীরার যাতায়াত ছিল অনেক বেশি। সুশোভন, কুশীলবের খুব কাছের বন্ধু। ওর সঙ্গে একই ডিপার্টমেন্টে রয়েছে। বিয়ে-থা করেনি। যাকে বলে, ঝাড়া হাত-পা আর কী। খুব সহজেই সকলের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। মন জিতে নিতে পারে। আকর্ষকও বটে। এই ক’দিনেই কৌশীর সঙ্গে বেশ ভাব জমেছিল সুশোভনের। আর মীরা কেয়ার কলিগ হলেও খুব ঘনিষ্ঠ। দুজনের ভাবনাচিন্তায় অদ্ভুত মিল থাকায় তাদের অন্তরঙ্গতা। একে-অপরের সঙ্গে সমস্ত কিছু শেয়ার করে তারা। মীরার বর ডাক্তার। দুই ছেলে অক্ষয় আর অভয়। এই বছরেই অক্ষয় পিসিএস-এর জন্য নির্বাচিত হয়েছে। আর অভয় বিএসসি ফাইনাল ইয়ার।

এর মাঝে ছেলে কুশলও কলকাতায় এসে দিন দশ-বারো কাটিয়ে গেছে। কুশলের আসাতে বাড়িতে বেশ একটা আনন্দের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। দুই ভাই-বোনের হাসি-ঠাট্টায় সামিল হতে হতো কেয়াকেও। কোনও প্ল্যানিং ছাড়াই তিনজনে হুট করে শপিং করা, খাওয়াদাওয়া করা, ঘোরা, সারাদিন পরে ঘরে ফেরা। সবকিছুর মাঝেও কুশীলবকে খুব মিস করছে কেয়া। এতগুলো বছর একসাথে থাকার একটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। কোনওদিন কেউ কাউকে ছেড়ে থাকেনি। এমনকী কুশল, কৌশী হবার সময়তেও কেয়াকে বাপের বাড়িতে পাঠায়নি কুশীলব। সেই নিয়ে কম ঠাট্টা শুনতে হয়নি কুশীলবকে বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে। হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছে ‘বউকে ভালোবাসা কি অন্যায় নাকি?’ এতদিনের অভ্যাস বদলাতে একটু সময় তো লাগবেই। সপ্তাহে দু’দিন ফোন করে কুশীলব। সারা সপ্তাহ মুখিয়ে থাকে কেয়া ওই দিনটার জন্য। কুশীলবের সঙ্গে কথা বলার মুহূর্তটা নিয়েই বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিত সে।

একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসের মধ্যেই মাথা ঘুরে একদম মাটিতে পড়ে গেল কেয়া। কলেজের ছাত্র আর কলিগদের তৎপরতায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় কেয়াকে। উচ্চরক্তচাপ, হার্টের সমস্যার কারণে লম্বাচওড়া প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে একমাস রেস্টে থাকতে বলে ছেড়ে দিলেন চিকিৎসক। সংসারের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ে কৌশীর উপর। একাকী ছোট্ট একটা মেয়ের পক্ষে ঘর সামলে, অসুস্থ মায়ের দেখভাল করে কলেজে পৌঁছোনোটা খুব মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। তখন সুশোভন আর মীরাকে পাশে পেয়েছিল কেয়া। বাজার, দোকানপাট সমস্ত কিছুই করে দিত সুশোভন।

সেই সময় কেয়া অসুস্থ থাকায়, বাড়িতে অতিথি অভ্যাগতদের আপ্যায়ন কৌশীকেই করতে হতো। মীরা এলে কেয়ার পাশে দু-দণ্ড বসে গল্পগুজব করত, কিন্তু সুশোভন মায়ের থেকে বেশি মেয়ের সঙ্গেই সময় কাটাতে পছন্দ করত। অথচ আশ্চর্যরকম ভাবে কেয়ার উপস্থিতিতে দুজনের ব্যবহারেই কেমন যেন জড়তা লক্ষ্য করত কেয়া। তারা একাকী থাকলে যতটা উচ্ছল থাকে, কেয়ার উপস্থিতিতে সেটা বদলে যায়, এটা একাধিকবার খেয়াল করেছে কেয়া। আর এক অজানা ভয় ঘিরে ধরেছে তাকে। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে আর ভেবেছে, সুশোভন আর কৌশী? দুজনের মধ্যে বয়সের কত তফাত। কুশীলবের থেকে দু-চার বছরের ছোটো হবে হয়তো সুশোভন। বাবার বয়সি একজন লোক এভাবে একটা কচি মেয়ের সঙ্গে ইনভল্ভড… ছিছি, মনটা বিষিয়ে ওঠে কেয়ার। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় কেয়ার সুস্থতার খবর নিতে এসে, তাকে ভুলে গিয়ে বেহায়ার মতো নীচ থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চ্যাঁচাতে থাকে, ‘কৌশী, বড়ো রাস্তার দিকে যাচ্ছি, যাবে নাকি? চলো একটু ঘুরে এলে মনটা ভালো লাগবে। আর তোমার যদি কিছু নেওয়ার থাকে নিয়ে নিও।’ কৌশীও ‘আসছি’ বলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই চেঞ্জ করে খটখটিয়ে বেরিয়ে যেত।

কৌশী তো না হয় ছোটো, ভালোমন্দ সেভাবে বুঝতে শেখেনি? কিন্তু সুশোভন। ও কী করে এই অন্যায়টা করছে। সরলতার সুযোগ নিয়ে একটা ছোট্ট মেয়েকে… আচ্ছা ওরা ফিজিকালি ইনভল্ভ নয় তো? দৈহিক ক্ষিদে কী ওর এতটাই বেড়ে গেছে যে বয়সের ব্যবধানও তার নজরে পড়ছে না। মনটা ভয়ে শিউরে ওঠে কেয়ার। কথায় কথায় কৌশীর জন্য গিফট আনাটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না কেয়া। শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল কেয়া। ভাগ্য আজ ক্লিকও করে গেছে। চুড়িদারের সেট-এর সঙ্গে ম্যাচিং অ্যাকসেসরি নিয়ে ফিরেছে কৌশী আর সুশোভন। ঘরে ঢুকেই হাসতে হাসতেই প্যাকেটটা মায়ের দিকে বাড়িয়ে দেয় কৌশী, ‘এই দ্যাখো মা, আমাকে এগুলো কিনে দিয়ে…’ মেয়েকে কথা শেষ করার সুযোগ দেয় না কেয়া। তার আগেই বলে বসে, ‘ঠিক আছে দেখছি। তার আগে তুই একটা কাজ করতো, উপরে ওষুধটা রয়ে গেছে, নিয়ে আয় তো মা। আর শোন প্রেসক্রিপশনটার সাথে একবার মিলিয়ে নিস। নাহলে কোনটা বলতে কোনটা খেয়ে নেব।’ তারপরেই মুখের চেহারা বদলে যায় কেয়ার। ‘এসবের কিন্তু কোনও দরকার ছিল না। রোজ রোজ এভাবে। ওর কিছু কমতি তো রাখিনি আমি।’, বেশ দৃঢ় শোনায় কেয়াকে।

‘কেন এভাবে বলছেন বউদি, আমি কি ওকে কিছু দিতে পারি না। এটুকু অধিকারও কি আমার নেই? স্নেহ করি বলেই তো…’ বলেই কৌশীর মুখের দিকে তাকায় সুশোভন। সে নজরে স্নেহ নেই, আছে শুধু কামনা। সেই দৃষ্টি চোখ এড়ায় না কেয়ার। আপ্রাণ চেষ্টা করে কেয়া একটু সংযত হবার, কিন্ত যেখানে মেয়ের সম্মানের প্রশ্ন সেখানে তাকে রুখে দাঁড়াতে হবেই।

‘সরি কিছু মনে করবেন না, জানি আপনি আমাদের জন্য অনেক করেছেন। তার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। এর বেশি কিছু চাই না। আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন, আমি কী বলতে চাইছি। এবার আপনি আসুন।’ মাথা নীচু করে বেরিয়ে যায় সুশোভন।

খানিক হালকা লাগে কেয়ার। কতদিন ভেবেছে কুশীলবকে সবকিছু খুলে বলবে। নাম্বার ডায়াল করেও ফোনটা কেটে দিয়েছে এই ভয়ে যে, সবকিছু শুনলে কুশীলব কিছুতেই আর বিদেশবিভুঁইয়ে পড়ে থাকবে না। সবকিছু উপেক্ষা করে ছুটে আসবে। আর তো ক’টা মাস। সে ঠিক সামলে নেবে। ছেলেকে পর্যন্ত বলেনি এই সমস্যার কথা। ফাইনাল ইয়ার। পড়াশোনার ক্ষতি হোক চায় না কেয়া। মেয়ের কথায় সম্বিৎ ফেরে কেয়ার। ‘মা, ও-মা প্রেসক্রিপশনটা কোথায় রেখেছে সেটাই তো খুঁজে পেলাম না। মেলাব কী করে?’ বলতে বলতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নেয় কৌশী। তারপর খুব সহজ ভাবে প্রশ্ন করে বসে, ‘শুভ আঙ্কল কোথায় গেল?’ মেয়ের মুখে সুশোভনের নাম শুনে যেন মুহূর্তেই জ্বলে উঠল কেয়া।

‘ওনার কী কোনও কাজ নেই যে, দিবারাত্রি এখানে পড়ে থাকবেন। যাও নিজের ঘরে যাও।’ হঠাৎই মায়ের ধমকে চমকে ওঠে কৌশী। মায়ের রাগের কারণ খুঁজে পায় না সে। ধীর পায়ে নিজের ঘরের দিকে এগোতে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মায়ের সেই স্নেহমাখা ডাক, ‘শোনো কৌশী। এখন আর তুমি ছোট্টটি নও। বড়ো হয়েছ, কলেজে পড়ছ। নিজের ভালোমন্দগুলো নিজেকেই বুঝে নিতে হবে। আশপাশের মানুষগুলোকে চিনতে হবে। বুঝতে হবে, তারা কেমন। তারা তোমার থেকে ঠিক কী চাইছে। তারা কী সত্যিই তোমার শুভাকাঙক্ষী, নাকি…’ আর কথা বলতে পারে না কেয়া। মেয়ের মাথায় একবার হাতটা বুলিয়ে দেয়।

মায়ের কথার অর্থ আঁচ করতে পারে কৌশী। লজ্জায় সংকুচিত হতে থাকে সে। ‘ইস্ এতদিন তো সেভাবে ভাবেনি কখনও। তাহলে কি সত্যিই সে নিজের অজান্তে ভুল পথে পা বাড়িয়ে দিয়েছিল, নাকি সে শুধু বাবার বন্ধু হিসেবেই বাবার শুন্যস্থানটা পূরণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু মায়ের অভিজ্ঞ চোখ, তাহলে কি কাকুর খারাপ কোনও অভিসন্ধি রয়েছে।’ মুখে কোনও কথা বলতে না পারলেও মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে কৌশীর।

‘কী হল, যাও। এভাবে দাঁড়িয়ে রইলে কেন?’ মায়ের কথায় চমকে ওঠে কৌশী। মায়ের হাতদুটো চেপে ধরে। ‘বিশ্বাস করো মা, আমি জানি না কাকু আমাকে কী নজরে দেখে, কিন্তু আমি কখনও ওনাকে…’ কেঁদে ফেলে কৌশী।

‘আমিও তোমার থেকে ঠিক এটাই আশা করেছিলাম। ঠিক আছে যাও, ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নেবে এসো। কাল সকালে আবার তোমার কলেজ আছে।’

রাতটা খুব নিশ্চিন্তে কাটে কেয়ার। অনেকদিন পর ভালো করে ঘুমিয়েছে সে। বুকের উপর চেপে বসা পাথরটা সরে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছে সে। সকালে টিফিন সেরে আর এক কাপ চায়ে চুমুক দিতে যাবে, ঠিক তখনই মোবাইলটা বেজে উঠল। মীরা কল করেছে। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে গলা ভেসে আসে মীরার, ‘শোন আজ আড্ডা মারার মুডে আছি, ভাবছি তোর বাড়িতে চলে যাই। তোর কোনও অসুবিধে নেই তো?’

‘অসুবিধের কী আছে, তুই এলে খুব ভালো লাগবে। জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। কিন্তু তোর কলেজ?’

‘আরে মাঝে মাঝে তো আমাদেরও ফাঁকি দিতে ইচ্ছে করে নাকি’ বলে হেসে ওঠে মীরা।

বারোটা নাগাদ মীরা এসে হাজির হয়। কেয়ার হাতে হাতে সে-ও খানিক কাজ এগিয়ে দেয়। তারপর খাওয়াদাওয়ার পর হাজারো প্রসঙ্গের মাঝে এসে ঢুকে পড়ে কৌশী।

‘জানিস আজকাল মেয়েটাকে নিয়ে খুব টেনশন হয়। একদম চালাকচতুর নয়। খুব ভয় করে। কতদিন আর নিজের কাছে রাখব বল, একটা সময় তো বিয়ে দিতেই হবে। অন্যের হাতে তুলে দিতেই হবে, কী যে করবে কে জানে।’ চিন্তার ভাঁজ পড়ে কেয়ার কপালে।

‘কী বোকা বোকা কথা বলিস বলতো, কতই বা বয়স ওর। এখনই এই সমস্ত ভাবছিস। তুই বরং এক কাজ কর, তোর অসুবিধা থাকলে ওকে আমাকে দিয়ে দে, আমি আমার অক্ষয়ের বউ করে নিয়ে যাব।’

‘ভেবে বলছিস, এ-মেয়ে কিন্তু কিচ্ছু পারে না। পরে বলিস না যে, আমি বলিনি।’

‘ওসব আমার উপর ছেড়ে দে। তাছাড়া পারার আছেটা কী-রে। আজ অবধি আমি সংসারের ক’টা কাজ করেছি যে ও-কে বলব কাজ করতে। পড়াশোনা করবে, বাড়ির মেয়ের মতো থাকবে ঘুরবে-ফিরবে। ব্যস আর কী চাই। তাছাড়া অমন মেয়ে আমি চাইলেই পাব কোথা থেকে।’ বলেই হো-হো করে হেসে ওঠে দুজনে। কেয়া কিছু বলার আগে মীরা প্রস্তাব রাখে, ‘বরং আগামী রবিবার তুই তোর মেয়েকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আয়।’

কথা কাটে কেয়া। ‘তার চেয়ে বরং সপরিবারে তোরাই চলে আয়। রাতের খাওয়াটা এখানে সারবি কিন্তু।’

‘শুধু আমরা কেন, যদি বলিস আরও দশ-বারো জনকে ডেকে নেব। শরীর একটু ভালো না হতে হতেই শুরু করে দিয়েছিস না।’

‘ইয়ার্কি ছাড় তো। বাড়িতে তো আমরা ওই মা আর মেয়ে। তোরা এলে ভালো লাগবে।’

‘ঠিক হ্যায় হুজুর। আপকে মনোরঞ্জন কে লিয়ে হাম আ জায়েঙ্গে’ বলেই আবার হো হো করে হেসে ওঠে মীরা। সঙ্গে কেয়াও।

এর মাঝে কুশীলবকে কিছুটা আভাস দিয়ে রাখে কেয়া। দু-বছর পরে হলেও, একমাত্র মেয়ের বিয়ের কথা ভেবেই মনটা ভিজে যায় কুশীলবের। কিন্তু মীরার পরিবারকে সে ভালোমতোই চেনে। এরকম পরিবারে সম্বন্ধ করার জন্য মা-বাবারা মুখিয়ে থাকে, সেখানে বাড়ি বয়ে এমন সম্বন্ধ এসেছে, এড়িয়ে যাওয়াটা বোকামো হবে। তাই আর কেয়ার প্রস্তাবে না করেনি কুশীলব।

আজ সকাল থেকেই মনটা বেশ ফুরফুরে কেয়ার। বাজার দোকান সমস্ত নিজের হাতে করেছে। তারপর থেকে চলছে রান্নার তোড়জোড়। এত আয়োজন দেখে কৌশী তো প্রশ্নই করে বসল, ‘কী ব্যাপার মা। এত তোড়জোড় কীসের? কেউ আসছে নাকি?’

‘এমনিই… অনেকদিন পর আজ শরীরটা ভালো আছে, তাই তোর মীরা আন্টিদের ডেকেছি। ওর ছেলে অক্ষয় এতদিন পর বাড়ি ফিরেছে, না ডাকলে খুব খারাপ লাগত রে। ও হ্যাঁ তুই-ও বাড়িতে থাকিস।’

‘কিন্তু মা, আমার তো টিউশন আছে।’

‘একটা দিন না গেলে কিছু হবে না। একবার ভেবে দ্যাখ, বাড়িতে লোক বলতে তো তুই আর আমি। ওদের ডাকলাম, এখন তুই যদি চলে যাস, ওদের খারাপ লাগবে না। তুই বরং তোর বন্ধুদের থেকে নোট নিয়ে নিস।’

‘ঠিক আছে মা।’

কথামতো সন্ধেবেলা মীরা, ডাক্তারসাহেব, অক্ষয়, অভয় সকলে এসে পৌঁছেছে কেয়াদের বাড়িতে। রসিক স্বভাবের ডাক্তারসাহেব ঢুকতে না ঢুকতেই বলেন, ‘কী ব্যাপার কেয়া, অসুস্থতার পরে মনে হচ্ছে আরও একটু বেশি সুন্দর লাগছে।’

‘এই বুড়ো বয়সে আমার বন্ধুর দিকে কেন নজর দিচ্ছ শুনি।’

‘কী করব বলো, সারাজীবন তো তোমাকে ছাড়া আর কাউকে দেখতেই দিলে না। এই বুড়ো বয়সে তো একটু ছাড়ো।’ সকলে মিলে হেসে ওঠে।

‘আগে ভিতরে তো আসুন। কথা তো আমারও আপনার সঙ্গে আছে।’

‘কী কথা, কী কথা, সবার সামনে বলা যায় নাকি, অন্য কোথাও যাবে…’

‘ও সত্যি পারেনও আপনি।’ মাকে অনেকদিন পর এভাবে হাসতে দেখে কৌশানীরও ভালো লাগে।

কৌশীও খুব তৎপরতার সঙ্গে সকলকে স্বাগত জানায়। স্ন্যাক্স আর কফি খেতে খেতে অক্ষয়-অভয়ের সঙ্গে বিভিন্ন কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে কৌশী।

কথার ফাঁকেই অক্ষয়কে লক্ষ্য করতে থাকে কেয়া। যেমন দেখতে তেমনি ব্যক্তিত্ব। টল, ডার্ক অ্যান্ড হ্যান্ডসাম যাকে বলে। আজকালকার ছেলেদের থেকে যেন একটু আলাদা। ব্যবহারের মধ্যেও একটা শালীন ব্যাপার রয়েছে তার। খুব মিশুকে, সবসময় মুখে হাসি লেগে রয়েছে। কেয়া যেমনটা চেয়েছিল ঠিক তেমনটাই। কৌশীর সাথে খুব ভালো মানাবে।

ডাক্তারসাহেব আর মীরা তো কৌশীকে ভালোমতো চেনে। আগাগোড়াই শান্ত স্বভাব আর ব্যবহারের কারণে কৌশী তাদের সুনজরে ছিলই। অক্ষয়কে দেখেও কেয়ার মনে হল তারও অমত হবে না। তবে এব্যাপারে কৌশীর কী প্রতিক্রিয়া হয় সেটাই দেখার।

গল্প করতে করতে হঠাৎই চোখ যায় ঘড়ির দিকে। কেয়া তৎপর হয়ে ওঠে। ‘দেখেছ, কথা বলতে বলতে বুঝতেই পারিনি দশটা বেজে গেছে। চলো চলো সবাই টেবিলে চলে এসো। এই যে ডাক্তারসাহেব আপনাকে কি আবার আদরআহ্লাদ করে নিয়ে যেতে হবে নাকি?’

‘সেই সৌভাগ্য কি আর আমার হবে?’

‘চলুন চলুন।’

‘হ্যাঁ, চলো।’

সকলে টেবিলে বসে পড়ে। কেয়া আর মীরা এক এক করে প্লেটে খাবার সার্ভ করতে থাকে। মায়ের কাজে হেল্প করে কৌশীও। খাবার শেষে অক্ষয় তারিফ না করে পারে না। ‘আন্টি, তোমার হাতের খাবার না, জাস্ট লাজবাব। মনে হচ্ছে তোমার হাতে খাওয়ার জন্য বারবার আসতে হবে তোমার কাছে।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার যখন মনে হবে চলে আসবে।’ হাসতে হাসতে জবাব দেয় কেয়া।

খাওয়াদাওয়ার পর্ব মেটার পর ফিরে যাবার সময় নিজের স্ত্রী-র উদ্দেশ্যে বলেন ডাক্তারসাহেব, ‘কী ম্যাডাম আপনি কি শুধু খেতে জানেন, নাকি খাওয়াতেও জানেন?’ মীরাও একবার বরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, ‘ওসব, আমাদের সারা হয়ে গেছে মশাই। ওরা আমাদের বাড়িতে রবিবার দিনই আসছে বুঝেছ।’

‘চলো তাহলে তো ঠিকই আছে। দুই বন্ধুতে মিলে যখন আগেই সেরে রেখেছ। বেশ বেশ, আসছি রে মা, ভালো থাকিস।’ ডাক্তারসাহেবের কথায় মাথা নাড়ে কৌশী। যাওয়ার সময়তে অক্ষয় একঝলক ভালো করে দেখে নেয় কৌশীকে। তারপর মুচকি হেসে গাড়িতে উঠে পড়ে।

ল্যান্ডফোনে সচরাচর এখন আর ফোন আসে না। মোবাইল হয়ে গিয়ে ওটা এখন খানিকটা শো-পিসের মতোই। কখনও-সখনও কোম্পানি থেকে ফোন আসে, কখনও আবার ফোনটা সচল রাখার জন্য কুশীলব ফোন করে। ল্যান্ডফোনের ব্যবহার বলতে এই। পরদিন সক্বালবেলাই ফোনটা হঠাৎ করে বেজে ওঠাতে চমকে ওঠে কেয়া। আগের দিনের খাটাখাটনির কারণে তখনও বিছানা ছেড়ে ওঠা হয়নি তার। ফোনের আওয়াজ পেয়ে উঠে পড়ে সে। সিঁড়ি বেয়ে নামার আগেই ফোনটা কেটে যায়। ফোনটা আবার বেজে ওঠে। কেয়া শুনতে পায় কৌশী ফোনটা ধরে বলছে, ‘দ্যাখো কাকু, আমার মা চায় না আমি তোমার সাথে কথা বলি। আর কী এমন প্রয়োজনীয় কথা যে, মোবাইল সুইচ অফ বলে ল্যান্ডে করতে হচ্ছে। মায়ের ধারণাই তাহলে ঠিক।’ রিসিভারটা নামিয়ে রাখে কৌশী। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সবটাই কানে আসে কেয়ার। একটু আশ্বস্ত হয়।

দেখতে দেখতে কেটে যায় আরও চারটে দিন। এর মাঝে মীরার সাথে বেশ কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে। অক্ষয়ের নাকি বেশ পছন্দ হয়েছে কৌশীকে। বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তে সে রাজি। আজও সকালে ফোন করেছে সক্বাল সক্বাল ওদের বাড়ি পৌঁছানোর জন্য। সেই মতো যাওয়ার তোড়জোড়ও শুরু করেছে কেয়া।

‘কৌশী আজ তুই ওই গোলাপি সালোয়ার-কামিজটা পরিস। ওটা তোকে খুব ভালো মানায়।’

‘কোনটা মা, গতবছর পুজোয় বাবা যেটা দিয়েছে।’

‘হ্যাঁ, ওটাই। চল চল তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। ওদিকে তোর মীরা আন্টির তিনচারবার ফোন করা হয়ে গেছে।’

তৈরি হয়ে পৌঁছোতে পৌঁছোতে সোয়া বারোটা বেজে গেছে। পৌঁছে দেখে ডাক্তারসাহেব, অক্ষয় সকলে হাত মিলিয়েছে রান্নার কাজে। কেয়াও হাত লাগানোর জন্য এগিয়ে যায়।

‘আরে তুই বস তো। একটা দিন ওদের করতে দে। আজ ওদের পরীক্ষা। দেখি না কেমন টেস্টি খাবার বানাতে পারে। দেখছিস না বাবা-ছেলে কেমন কোমর বেঁধে নেমেছে।’ কথাগুলো বলতে বলতেই মীরার চোখ চলে যায় কৌশীর উপর। ‘ওমা তোকে কী মিষ্টি লাগছে রে।’ বলেই গালদুটো টিপে দেয় মীরা। তারপর ডাক্তারসাহেবের দিকে ফিরে বলে। ‘আরে ডাক্তারসাহেব একটু এদিকেও দ্যাখো। একে দেখে তোমার রান্না যদি একটু সুস্বাদু হয়।’

লজ্জা পেয়ে যায় কৌশী– ‘ও আন্টি তুমিও না।’

অক্ষয়ের চোখে চোখ পড়ে যায় কৌশীর। সে-ও একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। চোখ নামিয়ে অন্যদের সাথে ব্যস্ত হওয়ার ভান করে সে। এদিক-ওদিককার নানা কথা হওয়ার পর মীরা চা বানাবার জন্য উঠতে গেলে কৌশী বলে, ‘চা আমি বানাচ্ছি আন্টি, তোমরা কথা বলো।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ মা, তাই কর। এরা যে কখন খেতে দেবে তার তো কোনও ঠিক নেই। ততক্ষণ না হয় একটু চা-ই খাই। তাছাড়া তোর আঙ্কল বানালে সে চা মুখে দেওয়া যাবে না।’ ডাক্তারসাহেবের বক্র দৃষ্টি দেখে সকলে হেসে ফেলে।

কৌশী চা বানাবার জন্য এগোতেই অক্ষয় তার দিকে এগিয়ে যায়– ‘চলো আমি তোমাকে হেল্প করছি।’

ততক্ষণে ডাক্তারসাহেবও রান্নার পরিসর ছেড়ে মীরার কাছে এসে বসেছে। দুজনকে একসাথে যেতে দেখে বলেন– ‘দুজনকে দারুণ মানাবে গিন্নি। কী বলো?’

‘সত্যিই মানাবে’ ডাক্তারসাহেবের কথায় সম্মতি প্রকাশ করে মীরা। তারপর কেয়ার উদ্দেশ্যে বলে, ‘কেয়া, ডাক্তারবাবুর আর আমার দুজনেরই কৌশীকে খুব পছন্দ। আমার মনে হয় অক্ষয়েরও মনে ধরেছে কৌশীকে। নাহলে অন্য সময় বিয়ের কথা বললে হাজারো বাহানা শুরু করে দেয়। কাল কৌশীর কথা বলতে হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দ্যাখ আমাকে তো ছেলের বিয়ে দিতেই হবে। এখন তুই যদি বলিস তাহলে কুশীলবদা ফিরলে আশীর্বাদটা সেরে রাখব। দু-বছর পর কৌশীর গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হলে বিয়ে হবে, ক্ষতি কী। তুই বরং কৌশীর মতামতটা জেনে নে।’

আনন্দে চোখে জল চলে আসে কেয়ার। মীরা যে তার কত বড়ো উপকার করল, সেটা একমাত্র কেয়াই জানে। গলা ভারী হয়ে আসে তার। ‘আমার মেয়ের কপালে যে এত ভালো একটা সম্বন্ধ লেখা রয়েছে, ভাবতেও পারিনি। অক্ষয়ের মতো ছেলে, তোদের মতো শ্বশুর-শাশুড়ি, এত ভালো পরিবার,’ আর কথা বলতে পারে না কেয়া। গলা আরও বুজে আসে তার।

পরিবেশ হালকা করতে ডাক্তারসাহেব বলে বসেন, ‘আরে ভাই আমরাই কী ভেবেছি আমাদের বুদ্ধুটার কপালে…’ বলতে বলতে থেমে যান ডাক্তারসাহেব। কপালে রেখার ভাঁজগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।’ ‘আচ্ছা চা-টা কী দার্জিলিং থেকে আসছে।’ সত্যিই তো কথার মাঝে কেউ খেয়াল করেনি সময়তো অনেকটাই গড়িয়েছে। এতক্ষণে তো বোধহয় চারবার চা বানানো খাওয়া হয়ে যেত। তখন মীরা আর কেয়া কয়েক কদম এগিয়েই আবার পিছিয়ে আসে। সম্ভবত বিয়ের প্রসঙ্গেই কথা হচ্ছে তাদের। যতদূর তাদের কানে আসে, ‘বাড়ির সবার ইচ্ছে তোমার সাথে আমার বিয়ে হোক।’

‘আঙ্কল, আন্টি তো বুঝলাম। আর তোমার?’ ক্ষীণ স্বর কানে আসে অক্ষয়ের।

‘তোমার কী মনে হয়?’ কৌশীর হাতদুটো ধরে অক্ষয়।

‘জানি না যাও’ বলে মাথা নীচু করে নেয় কৌশী।

আর সেখানে দাঁড়ায় না মীরা আর কেয়া। ধীর পায়ে ড্রয়িংরুমে ফিরে দুজনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর একসাথে হেসে ওঠে।

 

বৃষ্টি বৃষ্টি

আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে অঝোরে।

আকাশে কালো ঝাঁক মেঘ। বৃষ্টির দাপটে আর হাওয়ার ভারে কোথায় কোন দিকে চলে যাচ্ছে বোঝা মুশকিল। সকাল গড়িয়ে দুপুর হল ভিজতে ভিজতে, দুপুর গড়িয়ে বিকেলের মুখোমুখি অন্ধকার নামল। পুরো শহরটা বৃষ্টিতে ঝাপসা, তার ভেতরেই চলছে বাস, ট্রাম। ছাতা মাথায় লোকজন, বৃষ্টি বলে কাজ থেকে কোনও ছুটি নেই। তবে সব দৃশ্যাবলি পালটে গেছে! মনে হচ্ছে, অচেনা শহর যেখানে সব সময় বৃষ্টি হয়, খানিকটা চেরাপুঞ্জির মতন। কলকাতা তবে অঝোর বর্ষণে চেরাপুঞ্জি হল? হোক না। পালটে যাক সবকিছু– প্রকৃতি, শহরের ধুলোমাটি, মানুষজন।

গড়িয়াহাট থেকে ত্রিকোণ পার্কের রাস্তার কোনায় এই দোতলা রেস্তোরাঁ। দোতলায় জানলার ধারে বসে আছে শ্রেয়া। বৃষ্টিভেজা চেনা শহর সামনে। না, ঠিক চেনা নয়, নতুন শহর। ভেজা ট্রাম, বাস, ট্রাম লাইনে বুলেভার্ডের নাম জলে ডুবে গেছে। ডোবা ট্রাম লাইন, একটা ট্রাম দাঁড়িয়ে গেছে, এগোচ্ছে না, জল নামলে এগোবে। বুলেভার্ডের জলে মনে হচ্ছিল, এই শহরের গায়ে বড়ো নদী থেকে বান এসেছে। তার এখানে আসার পরে সন্ধে নেমেছে, মনে হচ্ছে, বেশ রাত। তাকে হাওড়ায় কদমতলায় ফিরতে হবে, অত দূরের গাড়ি পাওয়া একটু অনিশ্চিত এই ঝাম বৃষ্টিতে।

নীলেশের দেখা নেই, হয়তো আসবে না, বসিয়ে রাখবে।

যতটুকু সে জেনেছে, আজকাল তার আড্ডাখানা খালাসিটোলায়, মদে টালমাটাল হলেই সে নিজের মধ্যে নিজেকে ফিরে পায়। কোনও দিন ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ওদিকের বারের ছোটো নাচনি জুটে যায়। কোনও দিন গার্ডেনরিচের জুয়োর আড্ডা থেকে ফিরতে ফিরতে রাত ফুরোয়। সব কিছু খুইয়ে ওটাই খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরেছে নীলেশ। এমন পুরুষের ছায়াগ্রহ থেকে বেরিয়ে অনেকটা স্বস্তি পেয়েছে শ্রেয়া। প্রথমে সংকোচ, কষ্ট, লজ্জা ছিল, এখন কিছু নেই।

এই রেস্তোরাঁয় আসা নতুন নয়। যখন ওদের দু’জনের জানাচেনা, তখন থেকে। নীলেশ একটা পেন্টস্ কোম্পানির সেলসের নীচুতলার অফিসার ছিল। সপ্রতিভ, স্মার্ট চেহারা, মুখে অনর্গল বাংলা, ইংরেজি, কিছুটা হিন্দি। শ্রেয়া হাওড়ার বেলিলিয়াস রোডে একটা নামি ইংলিশ মিডিয়াম গার্লস স্কুলের টিচার। স্কুল রং করাবার টেন্ডারে নীলেশ এসেছিল। প্রিন্সিপালকে খুব স্মার্টভাবে রাজি করিয়েছিল। শ্রেয়ার দেখাশোনার মাধ্যমে কাজটি।

প্রথম পরিচয়টুকু যখন গাঢ় হল, টেন্ডারের লাভ-ক্ষয়ের পাওনাটুকু ওদের লুকোচুরি দিয়ে আরও এত কাছে এনেছিল, মনে হয়েছিল, ইট কাঠের বাড়ি কোনও আশ্রয় নয়। তারা দু’জনে পরস্পরের আশ্রয়। দুই বাড়িতে ওদের বিয়ের অভিমত একরকম ছিল না। তবু তারা সান্ত্বনা পেয়েছিল, যখন কোর্ট ম্যারেজ হয়ে গেল। নীলেশ ঠাট্টা করে ছুটির দিনে মাঝে মাঝে বলত, ‘তুমি কাগজের বউ’। সঙ্গে কিছুটা আদর আতিশয্য, মনে হতো, মেয়েলি জীবনে যা কিছু ধরাবাঁধা, তার বাইরে, শুধুই আনন্দ! দিশেহারা হয়ে যেত শ্রেয়া। তার মেয়েলি বয়সের আনাচেকানাচে।

ব্রাউন ড্রেস পরা কাজের ছেলেটা ওকে অনেকদিন থেকে চেনে, বছর তিনেক আগে তারা যখন এখানে প্রায়ই আসত। জানলার ওপিঠে রাস্তা, এপিঠে ছোটো টেবিল, এটাই ছিল তাদের পছন্দের জায়গা। কথা বলতে বলতে শহরটাকে মগ্ন চোখে দেখা। নীলেশ আচ্ছন্নের মতো অন্যরকম বলত। তারা শহরের কেউ নয়, শুধু দুটি মানুষের ভালোলাগা বলে এখানে থাকা। শহরটি নিজেই বড়ো জটিল, বিশ্রাম বলে কিছু নেই। তাদের দু’জনের পরস্পরের মনের জটিলতা কোথায়, কখন কেটে গেল, তারা বুঝতে পারেনি। জীবন তো এমনই, বোঝা যায় না!

নীলেশ তিরিশ, শ্রেয়া পঁচিশ। পাঁচ বছরের ফাঁকটুকু নিয়ে শ্রেয়া অন্য চোখে দেখত নীলেশকে। প্রথমে সমীহ খানিকটা দূরত্ব। ওটা একদিন সরে গিয়ে প্রেম-ভালোবাসা, সেটাও সরে গিয়ে প্রথম কদম ফুলের আমোদে শারীরিক সম্পর্ক। শ্রেয়ার বয়সটা আকুল-বিকুল। তখন মেয়েরা অবলম্বনই খোঁজে। পছন্দ-অপছন্দের আড়াল পড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক বা ওটা সরিয়ে আরও কাছাকাছি আসা।

কাজের ছেলেটা কাছে এসে দাঁড়াল, ‘দিদি, আর একবার চা, না কফি?’ শ্রেয়া মাথা নাড়াল, এখন নয়। ছেলেটা চলে গেল অন্য টেবিলে। ঘড়ি দেখল শ্রেয়া। নীলেশের আসার সময় ফুরিয়ে গেছে। মোবাইল নাড়াচাড়া করে দেখল। কোনও কল মেসেজ আসেনি। তার মোবাইল নম্বরটা এখনও নীলেশের ফোনে আছে. না মুছে গেছে?

বিয়ের দিনকাল বছর দুয়েক গড়াতেই তারা পরস্পরের কাছ থেকে মুছে যাচ্ছিল।

বাঘাযতীন স্টেশনে দু’ নম্বর প্ল্যাটফর্মের উলটোদিকে জলাজমি, ডোবা। তবু বাড়িঘর উঠছিল। ওখানেই একটা দোতলা ঘরের ওপরে দু’কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল নীলেশ। এদিকটা নাবাল বলে আরও অনেক ফাঁকা জমি ছিল তখন, এলোমেলো ছাঁদের কিছু বাড়িঘর। তখন ভোরের মিহি নৈঃশব্দ্য ভেঙে কয়েকজনের কীর্তনের দল চৈত্র-বৈশাখ দু’মাস খোল খঞ্জনি বাজিয়ে ঘরে ঘরে নামগান শোনাত। প্রোমোটারদের জমি দখল চলছিল। একদিন দলটা কবে, কোথায় চলে গেল, কেউ জানল না তেমন করে।

বাড়ির একটু দূরে একটা জলাভূমি ছিল, সেখানে থোকা থোকা শালুক, জলপিপি, কোঁচবক, কখনও কখনও পানকৌড়ি। মজা জলাভূমি, বর্ষার জল থৈ থৈ, অন্য সময় প্রায় শুকনো। বর্ষায় জলাভূমির পাড়ে কাশফুল ফোটে। ওটাও প্রোমোটারের দখলে, বুজিয়ে আবাসন উঠবে, বদলে যাবে চারপাশ।

তার আগেই বদলে গিয়েছিল নীলেশ।

বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে নানা অসংগতি ধরা পড়ছিল শ্রেয়ার চোখে। নীলেশের জুয়োখেলার, মদের নেশা, কাজে মন নেই। সে বুঝতে পারছিল, নীলেশের কাছে পরিবার, সংসার এসব অবান্তর কথা। জীবন আছে বলে, ওদিকে একটা মোড় নেবে, তা কেন? বিয়ের আগে স্বাভাবিক মেলামেশায় নিজের চরিত্রের অনেক কিছু আড়ালে রেখেছিল, জানতে দেয়নি।

কাজের প্রতি কোনও নিষ্ঠা ছিল না নীলেশের। পেন্টস্ কোম্পানিতে সেলসের কাজ, মাসের সেলস্ টার্গেট ছিল, সেটা কোনও দিনও পূর্ণ করতে পারেনি, চেষ্টাও ছিল না। পরিণতি এগিয়ে এল, একদিন চাকরিটা আর রইল না। তারপরই উড়নচন্ডী ও ছন্নছাড়া জীবন। টাকাপয়সা ও অন্যান্য ব্যাপারে শ্রেয়ার মুখাপেক্ষী, তাও বেশ জোর খাটিয়ে। খালাসিটোলায় মদের আড্ডা, নাচনি-বারের মেয়েদের কাছে যাওয়া, জুয়োর দান ফেলা, টাকা উঠলে ঘরে না ফেরা। এক অবাঞ্ছিত কষ্ট, ভাঙচুর নিয়ে শ্রেয়ার জীবন নানা নিন্দায় জড়িয়ে যাচ্ছিল।

শেষে ঘর ছাড়তে হল। বাঘাযতীনের ভাড়ার ঘর ছেড়ে হাওড়ার কদমতলায় বাবার বাড়ি। একবছরের মাথায় ডিভোর্স নেওয়ার সব কাগজপত্র তৈরি। কেস আদালতে উঠবে। নিজেকে নতুন করে গুছিয়ে নিয়েছে শ্রেয়া। মুছে ফেলেছে পুরোনো জীবন। একটা ঘটনা কোনও দিনই মোছা যাবে না, তার যৌবনের কুমারীত্ব নেই, সেটা লুঠ হয়ে গেছে নীলেশের হাতে। এই লুকোনো জায়গাটা কাউকে বোঝানো যায় না, দেখানোও যায় না। নীলেশ ভেবেছিল, ওটুকু দিয়েই সে শ্রেয়ার হাতে দড়ি পরিয়ে বেঁধে রেখেছে কিন্তু শ্রেয়া ততদিনে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, সব কাছের মানুষ কাছের হয় না। নীলেশ তার জীবনে প্রকৃত মানুষ ছিল না, চোখে একটাই শৌখিন নেশা ছিল শরীর লুঠপাটের।

নীলেশ এখনও বাঘাযতীনের ভাড়ার ঘরে থাকে, টাকাপয়সা কোথা থেকে পাচ্ছে, কে জানে। শ্রেয়ার জানারও দরকার নেই। সে পাঠ বছর খানেক হল উঠিয়ে দিয়েছে। আজ সকালে তাকে ফোনে বলেছিল, ডিভোর্সের কাগজে সই করতে হবে। দু’জনের বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া ভালো।

শ্রেয়া যখন কথা বলছিল, ঘরের দরজা বন্ধ, বাইরে অশ্রান্ত বৃষ্টি, ফোনের আওয়াজ ভালো শোনা যাচ্ছিল না, তবু নীলেশকে সব বলেছিল, পুরোপুরি বিচ্ছেদের কথা। সঙ্গে সঙ্গে সে রাজি। বিকেল বা সন্ধের সময় ত্রিকোণ পার্কের রেস্তোরাঁয় আসতে বলেছিল। তার বাড়ি থেকে ত্রিকোণ পার্ক দূর নয় কিন্ত শ্রেয়ার কদমতলা থেকে দূর। সেই দূর ভেঙে এসে পড়েছে শ্রেয়া। এর পেছনে আর একটা নতুন জীবনের হাতছানি ছিল।

এখনও সমানে বৃষ্টি, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, মেঘ ডাক দিচ্ছে, নীলেশ আসেনি।

তার শর্তে শ্রেয়া রাজি হয়েছিল। ডিভোর্সের কাগজপত্রে নীলেশ সই করবে, তার বদলে হাজার দশেক টাকা চাই। এটাই তার শেষ দাবি, এরপর তো জীবন থেকে মুক্তি। কথাগুলোয় কোনও হূদ্যতা ছিল না। হাসি ছিল চিবিয়ে চিবিয়ে। কাছাকাছি না থেকেও যথেষ্ট অত্যাচার করা যায়। নীলেশের বাইরে ও ভেতরটা সবই ধরা পড়ছিল। এ জিনিস যে লুকোনো যায় না।

শ্রেয়া মোবাইলে ডায়াল করল নীলেশকে, রিং হচ্ছে, তুলছে না। লাইন কাটল সে। এখন অনিশ্চিতভাবে বসে থাকতে হবে এখানে, কতক্ষণ কে জানে। হয়তো নীলেশ আসবে না। তার বিদ্রূপের হাসি বারবার কানে বেজে উঠছিল। কাগজে সই করার বাহানায় বারবার তাকে ডেকে পাঠাবে, সইয়ের দরও বাড়িয়ে দেবে, তবু আসবে না। স্বস্তি নেই। রাগে, ক্ষোভে শ্রেয়া আনমনা হয়ে যাচ্ছিল। নীলেশ মানুষটা যে এত স্বার্থপর, এটুকু জানা ছিল না। তার জীবনটা বারবার বৃষ্টিতে ভিজেছে– প্রথম প্রথম শান্ত, নির্মল আনন্দে, আনন্দটুকু ফুরিয়ে গেলে বেলাটুকু ফুরিয়ে গেল, তখন ঝমঝম দামাল বৃষ্টি।

অনেকক্ষণ থেকে চায়ের কাপটা সামনে রাখা। বৃষ্টি বাতাসে কখন ঠান্ডা হয়ে সর পড়েছে। এটা আর খাওয়া যাবে না। রাস্তায় বাস, ট্রাম আগের মতো, বৃষ্টি বলে কোথাও কিছু বন্ধ হয়নি। শহর থামতে জানে না। সুখ দুঃখ নিয়ে তার জীবন যে কোথায়, কখন থেমে গেল, সেটা আজ আর মনে পড়ে না। ওখানে উঁকিঝুঁকি দিয়ে আর লাভ কী? ওই জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা উদ্বেগ, দুর্ভাবনা, নীলেশের তাকে নিয়ে ছেলেখেলা। সব কিছু ফুরিয়ে তার চারপাশে শূন্য হয়ে যাওয়ার বেদনা, দুঃখ।

সেই শূন্য জীবনটা আবার ভরে দিতে চাইছে অতীন বলে একজন।

তাদের গার্লস স্কুলের সায়েন্সের টিচার অতীন মিত্র, একই বয়সি। স্কুলের পরিবেশে নানা কিছুতে মানিয়ে নিতে তাকে সাহায্য করেছে। দু’জনে বেশ কাছাকাছি এখন। বাইরে কত খোলা আলো বাতাস নির্জনতা! শ্রেয়া হাঁপিয়ে উঠেছিল। এখন তার নানা অনুশোচনা কিছুটা খেয়ালিপনায় চাপা পড়ে গেছে, মূর্ত হয়ে উঠেছে নতুন জীবন।

গত রবিবারে মেঘলা দিনে তারা চলে গিয়েছিল ত্রিবেণী সঙ্গমে।

হুগলি-রূপনারায়ণ-দামোদর এই তিন নদীর সঙ্গম গাদিয়াড়ায়। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য! মেঘলা দিন, কিন্তু সারা দুপুর বৃষ্টি ছিল না। লোকাল ট্রেনে উলুবেড়িয়া স্টেশন। ওখান থেকে বাস, ঘন্টা দেড়েক পরে গাদিয়াড়া। ভ্যান রিকশায় নদীর পিকনিক স্পটে। খাবারের প্যাকেট সঙ্গে। সারা দুপুরটা সেখানেই কাটিয়েছিল শ্রেয়া ও অতীন। বিকেলের মুখে ঝেঁপে বৃষ্টি চারদিক আঁধার করে, নদীর মোহনা ঝাপসা। ফেরা হয়ে ওঠেনি সেদিন। একটা হোটেলে দু’জনকে রাত কাটাতে হয়েছিল। পরের দিন সকালে ফেরা।

সারারাত নদী মোহনার, সঙ্গমের ঝড়বৃষ্টি।

তিন নদীতে বৃষ্টির শব্দ, আলাদা নয়, একই – ঝমঝমাঝম। রাতে আলো চলে গেল। লোডশেডিং। সেদিন শ্রেয়ার জীবনে এক পশলা বৃষ্টি নেমেছিল সেই নির্জন, নিঃসঙ্গ রাতে। আগের সমস্ত গ্লানি তাকে জড়িয়ে ছিল না, ক্রমশ খুলে যাচ্ছিল, এক পরম শান্তি। অতীন মিশে যাচ্ছিল পুরোপুরি শ্রেয়ার সঙ্গে। অতীনের কাছে টর্চ, জ্বালতে দেয়নি শ্রেয়া।

বাইরে বৃষ্টি, ঘরে বৃষ্টি।

দুটো বৃষ্টি এক নয়। দুটো বৃষ্টি এক নয়, দাপট এবং গহনতা, মগ্নতা, সব আলাদা আলাদা, কারও সঙ্গে কারও মিল নেই। এত বৃষ্টির ধারা? তবু মনে হচ্ছিল, এক স্তব্ধতার ভেতর তারা দু’জনে হয়ে উঠেছিল ব্যাকুলতর। শ্রেয়ার ব্যাকুলতা ফুল কুড়োবার মতো কুড়োচ্ছিল অতীন।

সকালে ব্রেকফাস্টের সময় কথাটা তুলেছিল সে। সারারাত বৃষ্টির পরে শান্ত, ধোয়া, ঝিমধরা ভোর। নদীর বাতাসে গাছপালায় দোলন। কোথাও মলিনতা নেই। তিন নদী মিলেমিশে একাকার। রাতেও তো তারা ওরকম মিলেমিশে…।

‘আমাদের বিয়ের আগে তোমার ডিভোর্সটা হয়ে যাওয়া দরকার।’ অতীন কফি খাচ্ছিল।

‘হ্যাঁ, তাই হবে।’

কথা দিয়েছিল শ্রেয়া। যেটুকু দিলে নিজের বিমূঢ়তা বোঝানো যায়, সেটুকু সে অতীনকে সে রাতেই দিয়েছে। কোথাও কোনও উদ্বেগ ছিল না। সব ব্যাকুলতা শান্ত হয়ে ছিল নিজের মতো। খোলা ছাদে অন্ধকারে জ্যোৎস্নার আবিলতায়। কী সুখ, কী সুখ! একবারও নীলেশের কথা মনে হয়নি। সে আর অতীন, দু’জন মানুষ তুমুল বৃষ্টিতে মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল। নদীটা উঠে এসেছিল ঘরে, তারা ডুবে গিয়েছিল। স্পষ্টই মনে হচ্ছিল, এ-ডোবা জলে ডোবা নয়, অন্য কিছু।

শ্রেয়া দেখল, নীলেশ ঢুকছে।

অবিন্যস্ত, ভেজা চেহারা। ভেজা চুল, মুখ। ভেঙে পড়া চেহারা। ভাঙা গাল, চোখ বসা, চোখের নীচে কালো ছাপ। ময়লা শার্ট। আগে হাতে ঘড়ি থাকত। এখন নেই, জুয়োর অড্ডায় হয়তো বিক্রি হয়ে গেছে। টলায়মান চেহারা। শ্রেয়ার সামনে চেয়ারে বসতে মদের গন্ধ পেল শ্রেয়া। গা গুলিয়ে উঠছিল। নিজেকে চেপে রাখল। যে কাজে এসেছে, তার ভাঙনটুকু নয়, আসলটুকু নিয়ে ফেরা। মুখ বুজে নীলেশের সব বিরোধিতা সহ্য করতে হবে, অপূর্ণ বলে কিছু নিয়ে সে ফিরবে না।

‘বৃষ্টির জন্যে আসতে দেরি হল।’ হাসল নীলেশ। ‘স্কুলে পড়েছিলাম ইমপেশন্ট রেইন, এটা তাই।’

‘কোথায় ছিলে এতক্ষণ? আমি কখন থেকে বসে আছি এখানে।’

‘গার্ডেনরিচ, বেহালা হয়ে আসছি। দুটো জুয়োর আড্ডায় জিতেছি।’

জামার কলার তোলা, এলোমেলো। মুখে দাড়ি, হয়তো শেভ-টেভ করে না। কথাগুলো স্পষ্ট নয়, জড়িয়ে যাচ্ছিল। অর্ডার নিতে সেই ছেলেটা এল, নীলেশকে দেখে মাথা ঝোঁকাল। দু’কাপ কফি আর এক প্লেট ডিম টোস্টের অর্ডার দিল শ্রেয়া। নিজের জন্যে শুধু কফি। বাইরে সমানে বৃষ্টি, গাদিয়াড়ার নয়, কলকাতার। এখানে কোনও বিস্তৃত মোহনা নেই, শুধু ঘরবাড়ি। সাগরের নিম্নচাপ কি বাড়ল? তাকে তো ভিজতে ভিজতে অনেক দূর যেতে হবে– সেই কদমতলা।

শ্রেয়া ব্যাগ থেকে ডিভোর্সের কাগজ বের করল। কোথায় কোথায় সই করতে হবে দেখাল। নীলেশের জামার পকেটে পেন নেই। ব্যাগ থেকে নিজের পেন বের করে দিল শ্রেয়া। নীলেশ চেয়ে আছে তার দিকে, কৌতূহল নেই। অন্যমনস্ক। মুখ তুলে বাইরের বৃষ্টি দেখল। কাগজ দেখছে না, পেনটা ঘোরাচ্ছে। হাওয়ায় কাগজ উড়ে যাচ্ছিল, হাত দিয়ে চেপে রাখল শ্রেয়া। মনে হল, জীবনকে সে হাত দিয়ে চেপে রেখেছে, কাগজ নয়। নীলেশের কাছে এ কাগজ হুড়মুড় করে বৃষ্টি ঢোকার মতো নয়। কিছু একটা পৌরুষেয় অপূর্ণতা, কোথায় তার কষ্ট, মুখে ফুটে উঠছে। মুখ ঘোরাল সে শ্রেয়ার দিকে, সেখানে একরাশ দুর্বলতা, হাসিখুশির চিহ্ন নেই। এ মুখে একদিন আনন্দ ছিল, এখন কিছু নেই।

‘তুমি চলে গেলে বাড়ি ছেড়ে’ নীলেশ আরও অন্যমনস্ক হয়ে গেল নিজের ভেতর। হয়তো ওরকম প্রচ্ছন্নে থাকতে তার ভালো লাগে। ‘আমি এখনও ওখানেই আছি। কষ্ট করে ভাড়া জুটিয়ে আসছি, যে মাসে জুয়োয় টাকাপয়সা পাই, অসুবিধে হয় না, না পারলে ভাড়া বাকি। বাড়িওলা মেনে নিয়েছে। সবসময় যে কাজের মেয়েটি ছিল, তাকে এখনও রেখেছি। যেদিন খুব ড্রিংক করে আসি, সে আমাকে যত্ন করে ঘরে তোলে। তারও জানা হয়ে গেছে, আমার সন্তান দেওয়ার ক্ষমতা নেই, নপুংসক। তুমি জানার পরে বাড়ি ছেড়েছিলে, ও কিন্তু ছাড়েনি।’

রেস্তোরাঁর ছেলেটা কফি, টোস্ট নিয়ে এল। সাজিয়ে চলে গেল। টেবিলে ডিভোর্সের কাগজের ওপর ব্যাগ চাপা দিল শ্রেয়া, উড়ে না যায়। এ যেন মাটির তলার কোনও একটা বীজ, মাটির ওপরে উঠে এসেছে, সামলে রাখতে হবে। নীলেশ একবারও কাগজটা দেখল না। কাঁটাচামচে ডিমটোস্ট খাচ্ছে। বেশ খিদে, ঠোঁট দিচ্ছে কফিতে। ওর হাত কাঁপছে, কফির কাপটা পড়ে না যায়, হয়তো মদটা আজ বেশি হয়ে গেছে বৃষ্টির দিনে। আগেও বৃষ্টিভেজা রাতে ঘরে মদের বোতল ঢুকত।

সংসারে যা কিছু মেয়েলি প্রাপ্য তা পাবে বলেই নীলেশকে নিয়ে ঘর বেঁধেছিল শ্রেয়া। তার কিছুই সে পায়নি। রাতে বিছানায় নীলেশ শুধু জেগে থাকত, বুকে ব্যথা বা নেশার ঘোরে ঘুমিয়ে পড়ত। একবারও ফিরে তাকাত না শ্রেয়ার দিকে। শ্রেয়ার তখন বড়ো কষ্টে মনে হতো, সে বিবাহিত হলেও সংসারে প্রাপ্য বলে মানুষটির কাছে কিছুই নেই। দু’জনের সম্পর্ক ভেঙে দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করেছিল।

‘তোমার কি বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভালো লাগে?’ নরম, হালকা, আন্তরিক গলায় এমন একটা কথা শুনে অবাক হল শ্রেয়া। বৃষ্টিও কি মানুষকে বদলে দেয়? সম্পর্কগুলো ধুয়ে মুছে যায়, না নতুন করে জোড়া লাগে? চেনা মানুষটাকে কৌতূহল নিয়ে দেখল শ্রেয়া।

টোস্ট খাওয়া হয়ে যেতে প্লেট সরিয়ে রাখল নীলেশ। খালি কফির কাপটা শ্রেয়ার কাপের পাশে রাখল, পাশাপাশি কিন্তু মাঝখানে একটু ফাঁক। দুটো খালি কাপের এটাই হয়তো সান্ত্বনা, তারা পাশাপাশি আছে।

নীলেশ কাগজের দিকে হাত বাড়াল। ব্যাগের নীচ থেকে কাগজটা বেশ আগ্রহ নিয়ে বের করে দিল শ্রেয়া। পাশেই পেন পড়ে আছে। পেন তুলে নিল নীলেশ, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল। দেখছিল না, ভাবছিল কিছু। তার ভাঙাচোরা চেহারা দেখে শ্রেয়ার হঠাৎ মনে হল, এই নীলেশকে সে চেনে না। সে কি কাগজে সত্যিই সই করবে, কি করবে না? বড়ো আশা নিয়ে এসেছে শ্রেয়া আজকের প্রবল বৃষ্টিতে। আর একটা জীবন তার নাগালের বাইরে, যদিও গাদিয়াড়ার বৃষ্টিতে ভিজেছিল দু’জনে। ওই জীবনটাও কি কোনও শূন্য জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে? এক জীবনে কত পুরুষকে সে দেখবে?

‘সই দেওয়ার পরে আমাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে?’

নীলেশ সই করল! পেনটা শুইয়ে রাখল কাগজের পাশে। অবাক হল শ্রেয়া। রোগীরা ওষুধ খাওয়ার আগে যেমন শুকনো হাসি হাসে, বাহানা করে, নীলেশের ইচ্ছে তেমনই যেন কিছু, বলছে না।

‘সম্পর্ক শেষ করার জন্যই তো কাগজপত্রে সই করা। এ কাগজ যাবে কোর্টে, জজের বিচারে ডিভোর্স হবে। আমরা তখন বিচ্ছিন্ন পরস্পরের কাছ থেকে।’

‘বি-চ্ছি-ন্ন শব্দটি বেশ। এই বৃষ্টিবাদলার দিনে শব্দটি শুনতে ভালো লাগছে। আমার কিন্তু আরও শর্ত আছে। আসলে আজ দু’বোতল ঠাররা নিয়েছি, মাথাটা ঠিক কাজ করছে না, কোনটা নকল কোনটা আসল বুঝতে পারছি না, ঝাপসা লাগছে। তোমাকে ঠিক দেখা যাচ্ছে না, চেনা যাচ্ছে না– সব ঝাপসা ঝাপসা, অথচ একদিন তুমি আমার ছিলে। তোমার সবই আমার চেনা– রূপ, যৌবন, শরীর।’

চমকে উঠল শ্রেয়া। নীলেশের অনেক কথাতে চমক ছিল। স্পষ্ট হয়ে উঠত না অনেক কিছু– তাদের একসঙ্গে থাকা, নরনারীর স্বাভাবিক বা গোপন সম্পর্ক, কিন্তু আজ অন্যরকম লাগছে তাকে। পুরুষ যখন ঝাপসা হতে থাকে তখন তার আর নিজের অন্তর নিয়ে হয় বড়ো মুশকিল।

‘শর্ত তো তোমার একটাই, দশ হাজার টাকা চেয়েছিলে, এনেছি।’ শ্রেয়া ব্যাগে হাত রাখল– ‘চেন খুলতে হবে, টাকাটা ভেতরে।’

‘আমি তো ভুলেই গেছলাম। দাও।’

ব্যাগের ভেতর পাঁচশ টাকার কুড়িটা নোট রবার ব্যান্ডে বাঁধা। সেটা বের করে নীলেশকে দিল শ্রেয়া। টাকাটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল নীলেশ। হাতের তালুতে কয়েকবার বাজাল। বৃষ্টি দেখল জানলা দিয়ে। ঘন বৃষ্টি, ট্রাম লাইন ঝাপসা, ভেজা আলোর নীচে বাস, ট্রাম। এই দুর্যোগের বেলাতেও সবাই চলমান।

হঠাৎ শ্রেয়ার ব্যাগ কাছে টেনে নিল নীলেশ। চেন খুলে পুরো টাকার বান্ডিল ঢুকিয়ে রাখল। ‘এটা আমার কাছে থাকলে জুয়োয় বা মদে উড়ে যাবে। খালাসিটোলায় পড়ে থাকব, কোথাও যাব না। আমার শর্ত ফিরিয়ে নিলাম।’

শ্রেয়া দেখল ডিভোর্সের কাগজটা এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে টেবিলে, পেনটা চাপা দেওয়া। হাওয়ায় কাঁপছে, বিয়ে ভাঙার কাগজ। শ্রেয়া কাগজের বউ নয়। মানুষ, যুবতি। অতীনকে গুছিয়ে নিয়েছে নতুন ঘর বাঁধার। চিরটা কাল সে ভাঙা ঘাটে নৌকো লাগিয়ে থাকবে না, ঘাট বদল করবে।

‘আমার অন্য শর্ত আছে সই করার।’

নীলেশ হাসল। দুর্বল মুখে হাসিটা আরও দুর্বল, বেমানান। শ্রেয়ার সঙ্গে সে বাগড়া করতে আসেনি, কোনও অসদাচরণ নয়। শ্রেয়া কথা বলল না, বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। মুখ তুলল, সে মুখে প্রশ্নের চিহ্ন কিন্তু শব্দ নেই। ঘরের ভেতরে উজ্জ্বল আলো, পাখাও চলছে।

‘আজকের রাতটা আমার সঙ্গে কাটাতে হবে, বাঘাযতীনের বাড়িতে, তারপর কাগজে সই করব।’

শ্রেয়ার মনে হল, চারদিকে নিরবচ্ছিন্ন আঁধার, ঘুটঘুটে, দামাল বৃষ্টি। কত রকম শব্দ ভাসছে। ভাসতে ভাসতে দূরে চলে যাচ্ছে। নীলেশ তুচ্ছ, তার খালাসিটোলাটা উঠে আসছে দু’হাত বাড়িয়ে। জুয়োর পাশা ফেলেছে নীলেশ। পাশার দান বেয়ে তাকে ঘরে উঠতে হবে, সেখানে শুরু হবে রাতের দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ খেলা।

শক্ত হল শ্রেয়া, ‘তোমার শর্তে আমি রাজি নই।’

‘আসলে বাইরে বৃষ্টি পড়ছে তো। বৃষ্টি পড়লে মন নরম হয়। আমি মোদো-মাতাল। বৃষ্টিতে বদলে যাই। অ্যান্টিসোশ্যাল লোকও বৃষ্টি দেখে ভাবে, কোনও মেয়েকে ভালোবাসবে। বৃষ্টি দেখে আজ আমার পুরোনো ঘরের কথা মনে পড়ল, তুমি আর আমি। বেশ যেও না।’ নীলেশের নরম গলা।

নীলেশ ডিভোর্সের কাগজটা নিয়ে শ্রেয়া যেখানে সই করতে বলেছিল, সই করল। কাগজটা হাতে দিল। ব্যাগবন্দি করল শ্রেয়া। ‘রাত হচ্ছে, বৃষ্টির রাত। আমাকে সেই কদমতলায় ফিরতে হবে।’

‘সেইজন্যই তো কাছাকাছি করে তোমাকে ডেকে ছিলাম। যা কিছু পাপ, ধুয়ে ফেলার ইচ্ছে, এই বৃষ্টিতেও সেটা হল না। ঠিক আছে, যাও।’

নীলেশের দিকে তাকাল শ্রেয়া। আত্মতৃপ্তি না হলে মুখ যেমন বিষণ্ণ ভাঙাচোরা মনে হয়, ঠিক তেমনি। মদের ঘোরে টলমলে, চকচকে চোখ, একটা অসহায় অন্য জগতের মানুষ। এলোমেলো চুল নেমে এসেছে কপালে, সবই হতশ্রী, বোঝা যায়।

‘বৃষ্টিটা পুরোনো কথা মনে পড়িয়ে দেয়।’ বলল নীলেশ। ‘একবার বৃষ্টির দিনে ছাদে আমরা দু’জনে ভিজেছিলাম, মনে আছে? তুমি গাইছিলে– বারি ঝরে ঝরঝর, আজ বারি সারাদিন। এখনও ভুলিনি কিছু। ছোটোবেলায় বৃষ্টিতে কাগজের নৌকো ভাসাতাম, ডুবে যেত। তোমার ডিভোর্সের কাগজে তৈরি নৌকোটা ভাসিয়ে দিলে ভেসে যাবে, ডুবে যাবে।’

‘না, ডিভোর্সটা আমার চাই।’

অতীনকে নিয়ে শ্রেয়া মুক্তির আনন্দ চাইছে। খালাসিটোলার মানুষের বৃষ্টিতে ভেসে যাবে না সে। কতদিন একা একা। ভালো লাগছে না কিছু। কাঁধে ব্যাগ নিল সে, দরজার কাছে গিয়ে একবার পেছন ফিরল শেষবারের মতো। নীলেশ জানলায় বৃষ্টি দেখছে। এই বৃষ্টিতে তার পুরোনো নেশা ফিরে এসেছে, শ্রেয়াকে নিয়ে রাত কাটাবে। ওটা কি খালাসিটোলার নেশা থেকে আরও গাঢ়, আরও আনন্দময়, নাকি পুরোটাই বেদনাময়?

সে দেখল, দুটো খালি কাপ পাশাপাশি, মাঝে একটু ফাঁক বা দূরত্ব। থাক না দূরত্বটুকু। কী দরকার কাছাকাছি আসার? এলেই টুঙ্ শব্দ উঠবে, সেই নাড়াচাড়ায় হয়তো একটা কাপ ভেঙেও যেতে পারে। দূরত্বে থেকেও তো তার জীবনটা ভেঙে গেল। সবই অসময়– জীবন, বৃষ্টি।

রাস্তায় বেরিয়ে শ্রেয়া দেখল, বেশ জোরেই বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা খুলল সে। একটা ডবলডেকার বাস ভিজতে ভিজতে আসছে, মাথায় লেখা – হাওড়া। এই বাস অনেক বছর বন্ধ ছিল, আবার শুরু হয়েছে। এগিয়ে গেল সে বাসের দিকে।

পেছনে তাকালে সে দেখতে পেত, রেস্তোরাঁর জানলার বাইরে নীলেশের মুখ ঝুঁকে আছে। কাউকে খুঁজছে। বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে আসছে মুখটা, সেই সঙ্গে ঝাপসা– সমস্ত নিঃসঙ্গতা, সম্পর্ক, ঘরবাড়ি। কারও কোনও অপেক্ষা নেই। বৃষ্টি– বৃষ্টির মতো ঝরল। শ্রেয়া চলে গেল।

সময়

‘রূপা, দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি করো।’

‘এক মিনিট অপেক্ষা করো প্লিজ।’

শ্যামলের ঘন ঘন পায়চারি এবং মাঝেমধ্যে ‘রূপা, রূপা’ বলে হাঁক পাড়া দেখেই নীলিমা বুঝে গিয়েছিলেন, ছেলে আর ধৈর্য রাখতে পারছে না। টেনশন কাটাবার জন্যে সামান্য হেসে ছেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, ‘এত অস্থির হলে চলবে? এখন তুই একা নোস। বাড়িতে বউ এসেছে। জানিসই তো। মেয়েদের সাজতেগুজতে একটু সময় বেশি লাগে।’

‘মা, রাস্তায় যা ট্রাফিক। যদি একবার গাড়ি ফেঁসে যায় তাহলে হয়তো দেখা যাবে, হোস্ট যে, সেই সবথেকে দেরিতে পৌঁছোচ্ছে। সেটা কি ভালো দেখাবে?’

‘চলো আমি রেডি।’ কথার মাঝে দুজনের কেউ-ই খেয়াল করেননি কখন রূপা ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে ঢুকেছে।

শ্যামল প্রশংসার চোখে রূপার দিকে একবার তাকিয়েই মা আর বউকে নিয়ে গাড়িতে এসে বসে। শ্যামল নিজেই ড্রাইভ করতে পছন্দ করে তাই ড্রাইভারও রাখেনি। গাড়ি চালাতে চালাতেই রূপার পুরো চোহারাটা ওর চোখের সামনে মুহূর্তের জন্যে ভেসে ওঠে। লাল শাড়ি আর লাল সিঁদুরের টিপে ও যেন আরও সুন্দরী হয়ে উঠেছে। রূপার চেহারাটা চোখের সামনে থেকে সরাবার চেষ্টা করে শ্যামল। নিজেকেই নিজে সতর্ক করে। শহরের ব্যস্ততম রাস্তায় ও গাড়ি চালাচ্ছে। চোখ কান সজাগ না রাখলে চলবে কী করে! আধা ঘন্টা পার করে গাড়ি এসে দাঁড়ায় হোটেলের সামনে। হোটেলের যে-ঘরটা, ঘর বলা অবশ্য ভুল, যে-হলটা শ্যামলের কোম্পানি বুক করেছিল গেস্টদের জন্যে, সেখানে অতিথিদের আনাগোনা তখন শুরু হয়ে গেছে।

শহরের পাঁচ তারা হোটেলে পার্টির আয়োজনটা করা হয়েছিল। শ্যামলের অ্যাডভারটাইজিং কোম্পানির বার্ষিক সম্মেলন। সঙ্গে রূপাকেও অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার এটাই মস্ত সুযোগ। দুটোই শ্যামলের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ব্যবস্থা করাই ছিল। শ্যামল এসে সোজা এক পাশে রাখা মাইকের সামনে এসে দাঁড়ায়। ‘মাই ডিয়ার ফ্রেন্ডস্, আজকে এখানে উপস্থিত হওয়ার জন্যে সকলকে জানাই আমার শুভেচ্ছা। আপনারা হয়তো সকলেই জানেন, আজ আপনাদের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি শুধুমাত্র আমার বন্ধু এবং ভাই অর্ণবের জন্যে। বাঁচার সব রাস্তা যখন আমার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখন একমাত্র ও-ই আমাকে আশার আলো দেখিয়েছিল। নিরাশায় যখন আমি ডুবে গিয়েছিলাম তখন একমাত্র অর্ণবই আমাকে সাহায্য করেছিল এই কোম্পানিটাকে আবার নতুন করে শুরু করতে। ওর চেষ্টায় এবং আপনাদের সকলের সহযোগিতায় আজ আমি এই জায়গায় পৌঁছোতে সফল হয়েছি, এটা আজ আর কারও অজানা থাকার কথা নয়।’

হাত বাড়িয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রূপাকে মাইকের সামনে টেনে নেয় শ্যামল, ‘আর আমি পরিচয় করিয়ে দিই, আমার স্ত্রী রূপার সঙ্গে। পার্টি উপলক্ষে রূপাকে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সুযোগটা আমি একেবারেই হাতছাড়া করতে চাইনি।’

কোম্পানির সিনিয়র ম্যানেজার মিস্টার বিশ্বাস এগিয়ে আসেন শ্যামলের সঙ্গে করমর্দন করতে। হেসেই জিজ্ঞেস করেন, ‘কী ব্যাপার শ্যামল? লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়েটা তাহলে সেরেই ফেললে? ঘুণাক্ষরেও কাউকে জানতে দিলে না!’

শ্যামলের বন্ধু হিমাংশুও পার্টিতে উপস্থিত ছিল। রূপার সৌন্দর্য তার মনে সামান্য ঈর্ষার অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিল শ্যামলের প্রতি, ‘ভগবান বেছে বেছে তোকেই সবকিছু ঢেলে দিয়েছে। ফুলে ফেঁপে ওঠা ব্যাবসা, সঙ্গে পরমা সুন্দরী বউ। হিংসা না করে পারছি না ভাই তা তুই যাই মনে করিস না কেন।’ শ্যামল হেসে উত্তর এড়িয়ে যায়। লক্ষ্য করে পার্টি সফল করে তুলতে যা কিছু ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তার কিছুই অর্ণব বাদ দেয়নি। অতিথিদের সেবা যত্নে যাতে কোনও ত্রুটি থেকে না-যায় একা দাঁড়িয়ে সেসব সামলাচ্ছে অর্ণব। এমনকী রূপার মা-বাবাকে নিমন্ত্রণ করতে পর্যন্ত সে ভোলেনি।

আজকের দিনটা রূপার কাছে খুব আনন্দের। এই রকমই তো সে শ্যামলকে দেখতে চেয়েছিল। আজকে মা-বাবা, ভাই, ভাইয়ের বউ সকলেই নিজের চোখে দেখতে পেল শ্যামল কোথা থেকে কোথায় পৌঁছেছে। রূপা মনে গর্ব অনুভব করে, যে সে শ্যামলের মতো স্বামী পেয়েছে। অথচ একসময় এই স্বামীর উপরেই কত মানসিক অত্যাচার সে করেছে। আজ ভাবলে লজ্জায় তার মাথা নীচু হয়ে আসে।

হোটেল থেকে বেশ রাত করেই বাড়ি ফেরে রূপারা। নীলিমা সোজা নিজের ঘরে চলে যান। শ্যামল রূপাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন লাগল, আমার বন্ধুদের সঙ্গে আর অফিসের সকলের সঙ্গে পরিচয় করে?’

‘ভীষণ ভালো। তোমার সঙ্গে পার্টিতে গিয়ে আমি সত্যিই খুব আনন্দ পেয়েছি। একটা কথা বলব শ্যামল?’ একটু আমতা আমতা করে বলেই ফেলে রূপা। ‘আমি সত্যিই সরি যে একসময় আমি তোমাকে মানসিক ভাবে নির্যাতন করেছি। আজ মনে পড়লে নিজেকে খুব ছোটো মনে হয়।’

‘চুপ করো, পুরোনো কথা ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবনটাকে এনজয় করো।’ শ্যামল রূপার ঠোঁটে আঙুল রেখে ওকে চুপ করিয়ে দেয়।

সারাদিনের পরিশ্রমের পর, শোবার ঘরে ঢুকে শ্যামল হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় এসেই গভীর ঘুমে ঢলে পড়ে। কিন্তু পাশে শুয়ে ঘুম আসে না রূপার। অতীতের স্মৃতিগুলো এক এক করে সামনে ভেসে উঠতে থাকে।

রূপা সবে সবে তখন এমবিএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। ফ্রেশার্স পার্টিতে শ্যামলের সঙ্গে ওর প্রথম পরিচয়। বন্ধুদের অনুরোধে শ্যামলকে গান গাইতে হয়েছিল। গলাটা সত্যিই মনে রাখার মতো। এর পরে কলেজের কোনও ফাংশনই শ্যামলকে বাদ দিয়ে হতো না। রূপার সঙ্গে পার্টিতে শ্যামলের আলাপ হলেও, শ্যামল রূপাকে এড়িয়েই চলত। সামনা-সামনি দেখা হলে ওই একটা দুটো কথা হতো শুধু। এদিকে শ্যামলের ব্যবহারে রূপার মধ্যেও জেদ চেপে যায় ছেলেটিকে শায়েস্তা করার, কারণ কখন যে নিজের অজান্তেই ধীরে ধীরে ছেলেটি রূপার মনের মধ্যে জায়গা বানিয়ে নিয়েছিল সেটা রূপাও নিজে প্রথমে বুঝতে পারেনি।

কলেজে বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর একদিন রূপা নিজে থেকেই শ্যামলের কাছে গেল। শ্যামল বই খুলে সবে পড়াতে মন দিয়েছে, রূপা পাশে এসে দাঁড়াল, ‘চলো, কোথাও বসে একটু কফি খাওয়া যাক। অনেকক্ষণ লাইব্রেরিতে এসেছি। পড়াশোনার মাঝে একটু রিক্রিয়েশনও দরকার। চলো, ওঠো ওঠো।’ অগত্যা উপায় কী? শ্যামলকে উঠতেই হল। কফিশপে বসে একটু কফি খাওয়া আর গল্পগুজব। ব্যাপারটা এখানেই থেমে থাকল না। কফিশপ থেকে সিনেমা হল, রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসা। রূপার ধীরে ধীরে মনে হতে শুরু করল, শ্যামলকে ছাড়া ওর জীবন শূন্য। একটা অদ্ভুত পাগলামি রূপাকে গ্রাস করতে আরম্ভ করল। শ্যামলকে একান্ত আপন করে পাওয়ার পাগলামি।

এমবিএ কোর্সের ফাইনাল সেমিস্টারের দিন এগিয়ে আসছিল। ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর শ্যামল রূপাকে ডেকে কলেজের বাইরে নিয়ে গেল, ‘শোনো, এখন কিছুদিন আমাদের দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ করা খুব দরকার। কিছুদিন পরেই ফাইনাল পরীক্ষা। যেমন করে হোক আমাকে ভালোভাবে পাশ করতেই হবে ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য।’

‘ও তোমারি বুঝি খালি পরীক্ষা? আমি যেগুলো বুঝতে পারছি না সেগুলো আমাকে কে পড়াবে শুনি?’

‘দ্যাখো, তোমার নম্বর সামান্য খারাপ হলেও তোমার বাড়িতে কেউ কিছু বলবে না কারণ কেরিয়ার নিয়ে তোমার বাবা-মা বা তুমি ভাববে না। ধনী পরিবারে তোমার জন্ম। কোনও বড়োলোকের ছেলে দেখে তোমার বাবা তোমার বিয়ে দিয়ে দেবেন। কিন্তু ক্যাম্পাস সিলেকশনে যদি আমি চাকরি না পাই তাহলে মা খুব ভেঙে পড়বেন। ছোটোবেলায় বাবা মারা গেছে। মা চাকরি করে আমাকে এতদূর পড়াশোনা করিয়েছেন। মায়ের প্রতি আমার একটা কর্তব্যও তো আছে। সুতরাং কিছুদিনের জন্য আমাকে একটু কনসেন্ট্রেট করতে দাও।’ এরপর শ্যামল রূপাকে ছেড়ে হনহন করে হাঁটা লাগিয়েছিল।

কিন্তু এর পরেও রূপা শ্যামলকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিতে পারেনি। সেটা অবশ্য খানিকটা জেদের বশেও বটে। ছোটো থেকে যা চেয়েছে, সেটা খুব সহজে রূপা পেয়েছে। আর যে-ছেলেটিকে রূপা নিজের সবটুকু দিতে প্রস্তুত, সে-ই কিনা রূপার জীবন থেকে সরে যেতে চাইছে, এটা রূপা সহজে কীভাবে মেনে নিত। শুরু হল নীলিমার অনুপস্থিতিতে শ্যামলের বাড়িতে যাওয়া-আসা শ্যামলের মানা করা সত্ত্বেও। সকাল দশটার মধ্যে নীলিমা চাকরিতে বেরিয়ে যান, রূপা সেটা জানত। পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করতে সময় নিল না রূপা। সুতরাং শ্যামলের ভয়টাই সত্যি হল। আগুন আর ঘিয়ের সমন্বয় দুজনকেই দগ্ধ করল কামনার আগুনে।

পরীক্ষার পর বেশ কিছুদিন কেটে গেল। একদিন সকালেই শ্যামল শুনল রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। সাইবার কাফেতে গিয়ে নেটে নিজের রেজাল্ট দেখল। কোনওরকমে জাস্ট পাশ করেছে। ক্যাম্পাস সিলেকশনে ভাগ্যে চাকরিও জুটল না শ্যামলের। রূপার কাছে জানল সে পাশ করতে পারেনি।

ভালো চাকরির সন্ধানে শ্যামল সব জায়গায় দরখাস্ত দিল। কোথাও থেকে ডাক না আসাতে শ্যামল আরও ভেঙে পড়ল। মাঝে শুনল, কোনও এক বড়োলোকের ছেলের সঙ্গে রূপার বিয়ে স্থির হয়েছে।

নিজের চিন্তাতে শ্যামল এতটাই মশগুল ছিল, ফোন কতক্ষণ ধরে বেজে চলেছে তা ও বুঝতেই পারেনি। হঠাৎই আওয়াজ কানে যেতে ও ফোনটা তুলে নিল, ‘হ্যালো?’

‘শ্যামল, প্লিজ ফোনটা নামিয়ে দিও না। শোনো আমার বাড়ি থেকে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারব না। এছাড়াও একটা কথা বলি বলি করেও এতদিন বলতে পারিনি। আমি তোমার সন্তানের মা হতে চলেছি। তাই তাড়াতাড়ি আমাদের বিয়েটা হয়ে যাওয়া উচিত। চলো আমরা মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে নিই।’

‘কিন্তু রূপা এক্ষুনি আমি কী করে বিয়ে করব? আমি অত্যন্ত সাধারণ বাড়ির ছেলে তার ওপর আমার এখন চাকরিও নেই।’ শ্যামলের স্বর করুণ শোনায়। ও কিছুতেই রূপার কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না। ঘটনার মোড় যে ওকে এই পর্যায় এনে ফেলতে পারে সেটা শ্যামল কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। মায়ের মুখখানা খালি চোখের সামনে ওর ভেসে উঠছিল।

‘আমরা এত দূর এগিয়ে এসেছি যে আমাদের আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই। আমি বাড়ি ছেড়ে কিছুক্ষণের মধ্যে তোমার কাছে চলে আসছি,’ এই বলে রূপা ফোনটা কেটে দিল।

শ্যামলের বাড়ি যখন রূপা পৌঁছোল, দেখল শ্যামল বেশ দিশাহারা। ‘এভাবে বসে কী লাভ? মুড টা ঠিক করো। মা অফিস থেকে ফিরলে তুমি না পারো, আমিই মা-কে সবকিছু বুঝিয়ে বলব। উনি কিছুতেই মানা করতে পারবেন না।’

উত্তরে শ্যামল কী বলবে বুঝে পেল না। মায়ের জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় তো কিছু নেই।

অফিস থেকে ফিরে একটি অচেনা মেয়েকে শ্যামলের সঙ্গে দেখে নীলিমা একটু অবাকই হলেন। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রূপা ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম সেরে হাত ধরে ওনাকে চেয়ারে বসান। জিজ্ঞেস করার আগেই রূপা বলে উঠল, ‘মা আমি আর শ্যামল একে অপরকে ভালোবাসি। আমরা দুজনে বিয়ে করতে চাই অথচ আমার বাড়ি থেকে অন্য একটি ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আমি পালিয়ে এখানে চলে এসেছি।’

নীলিমার মাথায় যেন বাজ পড়ল। ‘বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছ মানে? সেকি। না, না, এত তাড়াহুড়োর কী আছে। তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো, বিয়ে করতে চাও, সে তো ভালো কথা। আমিই না হয় যাব তোমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু আগে শ্যামলকে স্বাবলম্বী হতে দাও।’

‘আমার হাতে যে অত সময় নেই মা!’ বলেই নীলিমাকে হতচকিত করে কান্নায় ভেঙে পড়ল রূপা।

নীলিমা তাকে একটু সামলাতে যে কথাটা রূপার মুখ থেকে বেরোল, তাতে যেন পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে গেল নীলিমার। ‘আমি প্রেগন্যান্ট মা। শ্যামলের সন্তান আমার পেটে। এদিকে বাড়ির লোক আমার অন্য জায়গায় বিয়ের ঠিক করেছে।’

নীলিমার ইচ্ছে করছিল ছেলের গালে সজোরে থাপ্পড় কষিয়ে দিতে। ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে এই প্রতিদান ছেলে দিল? লজ্জায় সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াবার আর জো রইল না। কিন্তু সেসব কিছু না করে রূপাকে বললেন চেয়ারে গিয়ে বসতে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার বাড়ির লোকেরা যদি এখানে এসে ঝামেলা করে? কী বলবে তাদের?’

‘আমি ঠিক সামলিয়ে নেব।’

পরের দিন রূপার বাবা আর ভাই এসে শ্যামলের বাড়িতে হাজির হল। মেয়েকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে অনেক চেষ্টা চালাল কিন্তু রূপার মুখে একটাই কথা, ‘আমি এখন প্রাপ্তবয়স্ক। গতকালই আমরা বিয়ে করে নিয়েছি সুতরাং শ্যামল এখন আমার স্বামী।’ বিয়ের কথাটা মিথ্যা হলেও শ্যামলকে সত্যিই রূপা ভালোবাসতে শুরু করেছিল।

এই পুরো ঘটনায় শ্যামলের মুখ থেকে একটাও কথা বেরোয়নি। অপ্রত্যাশিত ঘটনাক্রম শ্যামলকে বোবা করে দিয়েছিল। দুদিন পর নীলিমা পাঁচ-ছয়জন আত্মীয়কে সঙ্গে করে নিয়ে মন্দিরে গিয়ে শ্যামল আর রূপার বিয়ে দিলেন।

রূপা বড়োলোকের আদুরে মেয়ে। নিজের বাড়িতে জল গড়িয়ে কোনওদিন খায়নি। সে এসে শ্বশুরবাড়িতে কাজ করবে এটা নীলিমা আশাও করেননি। শুধু ছেলের স্বপ্ন তাঁর চোখে লেগে থাকত যে শ্যামল একটা ভালো চাকরি নিশ্চই পাবে।

গতানুগতিক সংসারটা চলতেই থাকে নীলিমার। চোখের সামনে ছেলেকে চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরতে দেখেও কোনওভাবেই সাহায্য করার রাস্তা খুঁজে পান না। একদিন শ্যামল এসে মা কে জানায় অনেক কষ্টে কল সেন্টারে একটা চাকরি জোগাড় করা গেছে অবশ্য মাইনে অত্যন্ত সামান্য।

রূপাও খুশি হয় শ্যামলের চাকরির খবর শুনে। বাড়িতে বসে বসে ওর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। সুযোগ বুঝে একদিন সন্ধেবেলা শ্যামল বাড়ি ফিরলে, রূপা ওর গলা জড়িয়ে ধরে, ‘চলো না, আজকে বাইরে থেকে খেয়ে আসি। সেই বিয়ের পর থেকে কোথাও তো আমাকে নিয়ে যাওনি।’

‘কিন্তু রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া মানে বিশাল খরচ।’

‘টাকার চিন্তা তুমি কোরো না। বিয়ের আগে ব্যাংকে আমার একটা অ্যাকাউন্ট করা হয়েছিল সেটাতে বাবা মাসে মাসে টাকা ফেলতেন। ওটা থেকেই টাকা তুলে খরচ করব।’

‘তোমার বাবার টাকায় আমি হাত দিতে পারব না।’

‘এত তোমার কীসের অহঙ্কার? মাইনে তো ওই কটা টাকা। বিয়ের আগে একদিনে ওই পরিমাণ টাকা আমি একসঙ্গে খরচ করেছি।’

‘এই কথাটা বিয়ের আগেই তোমার ভাবা উচিত ছিল। আমি তোমাকে আগেই এটা বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম।’

টাকাপয়সা নিয়ে ঝগড়া, রোজকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রূপার ধৈর্য তলানিতে এসে ঠেকেছে সেটা নীলিমার অভিজ্ঞ চোখ ধরতে পেরে গিয়েছিল। একদিন শ্যামল বেরিয়ে যাওয়ার পর রূপাকে ডেকে বললেন, ‘রূপা, তোমার বিয়ের প্রায় চার মাস হতে চলল। শ্যামল কে নিয়ে একদিনও তোমাকে ডাক্তারের কাছে যেতে দেখলাম না। তোমার চেহারারও তো কোনও পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। অথচ বিয়ের আগে তুমিই তো আমাদের তোমার প্রেগনেন্সির কথা জানিয়েছিলে।’

‘আমি মিথ্যে বলেছিলাম। কোনওরকম ভাবে শ্যামলকে বিয়ের জন্যে রাজি করাতে চেয়েছিলাম। এটা না বললে ও কিছুতেই বিয়েতে রাজি হতো না।

রূপার কথা শুনে নীলিমা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কোনও মেয়ে যে নিজের কাজ গোছাবার জন্যে নিজের সম্মানেকে এভাবে জলাঞ্জলি দেয়, সেটা এই প্রথমবার নিজের চোখে দেখার দুর্ভাগ্য হল তাঁর।

মাঝে মাঝে শ্যামলের বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যেত। একদিন বাড়ি এসে মায়ের প্রচণ্ড জ্বর দেখে রূপাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, ‘ডাক্তার ডেকেছিলে?’

‘সামান্য তো জ্বর, ডাক্তারের কী দরকার?’

তর্ক না করে, হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে শ্যামল মা-কে দুধ গরম করে ওষুধ খাওয়াল। মাথায় জলপট্টি করে জ্বর সামান্য কমলে মায়ের আরামের সব ব্যবস্থা করে নিজের ঘরে গেল। রূপা শুয়ে পড়েছিল। শ্যামলকে দেখে বিছানায় উঠে বসল, ‘সারারাত মায়ের সেবা করে কাটালেই তো পারতে। ঘরে আসার কী দরকার ছিল?’

‘তুমিও তো মায়ের কাছে বসে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারতে।’

‘তোমার মায়ের যদি সেবারই দরকার হয় লোক রাখো, সে-ই সারাদিন সেবা করবে।’

‘প্লিজ, তুমি তোমার মুখ বন্ধ রাখো। আমার তোমার সঙ্গে কথা বলতে এখন ইচ্ছে করছে না।’

‘তোমার তো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, আর আমার এক মুহূর্তও তোমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করছে না। চার মাস বিয়ে হয়েছে, সংসারে শুধু নেই, নেই শুনে আসছি। কী কুক্ষণে যে তোমাকে বিয়ে করেছিলাম, জানি না।’

‘আমি তো তোমাকে মানাই করেছিলাম। তুমিই আমার কথা শোনোনি।’

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতে শ্যামল দেখল রূপা সুটকেস গুছিয়ে রেডি। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই জবাব এল, ‘বাপের বাড়ি যাচ্ছি। যদি মনে করো তোমার জীবনে আমার প্রয়োজন আছে তাহলে ওখানেই চলে এসো। আমি এই বাড়িতে আর ফিরতে চাই না।’

শ্যামলেরও জেদ চেপে গিয়েছিল, রূপাকে ফেরাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও সে করল না।

রূপার জীবনের সবথেকে বড়ো ভুল ছিল বাপের বাড়ি ফিরে যাওয়াটা। রূপার বাবা মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে কোনও ভাবেই রাজি ছিলেন না, শুধু স্ত্রীয়ের পীড়াপীড়িতে রূপাকে বাড়িতে স্থান দিয়েছিলেন। প্রথম পাঁচ-ছয় মাস রূপার আগের মতোই হাসি, গল্প আনন্দে দিন কাটতে লাগল। মাঝেমধ্যে শ্যামলের খেয়াল আসত, কিন্তু রূপা মনে করেছিল তার টানে শ্যামল ঘরজামাই হতে আপত্তি করবে না। কিন্তু সেই আশার আলোটা ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করল। বাড়িতে আসা দূরে থাক, একটা ফোন পর্যন্ত করল না শ্যামল। ধীরে ধীরে মা-বাবা, ভাই-ভাইয়ের বউরাও রূপাকে কথা শোনাতে আরম্ভ করল। রাতদিন রূপার সঙ্গে সঙ্গে শ্যামলের কথা তুলেও তারা অপমান করতে ছাড়ত না। বাড়ির বাইরেও একই অবস্থা হল রূপার। বন্ধুদের বাড়িও যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কারণ সেখানেও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো রূপাকে।

দেখতে দেখতে শ্যামলকে ছেড়ে আসার এক বছর হয়ে গেল। রূপা বুঝতে পারছিল শ্যামলকে ওভাবে ছেড়ে চলে এসে ও কত বড়ো ভুল করেছে। কিন্তু শ্যামলের কাছে ফিরে যাওয়ার রাস্তাও তো ও বন্ধ করে এসেছে। ক্ষমা যেমন করেই হোক ওকে চাইতেই হবে, কিন্তু কী করে? সবথেকে আগে দরকার নিজের পায়ে দাঁড়ানো।

ফেসবুক খুঁজে শ্যামলের প্রোফাইল বার করল। দেখল শ্যামল এবং ওর আর এক বন্ধু অর্ণব মিলে একটা অ্যাডভারটাইজিং কোম্পানি শুরু করেছে। বিভিন্ন কোম্পানিতে নিজের প্রোফাইল দিয়ে চাকরির দরখাস্ত করল রূপা। কিছুদিন চেষ্টা করার পর একটা কোম্পানিতে এইচআর-এ একটা পদে বহাল হল। রূপা বুঝেই গিয়েছিল বাপের বাড়িতে তার থাকা চলবে না, পদে পদে সেখানে অপমান সহ্য করতে হবে। মা-বাবাকে বলে একটা মেয়েদের হস্টেলে এসে উঠল।

প্রথম প্রথম একটা একা থাকার ভয় রূপার মধ্যে কাজ করত কারণ একা আগে কোনওদিন রূপাকে থাকতে হয়নি। ধীরে ধীরে হস্টেল এবং চাকরি জীবনে রূপা নিজেকে সেট্ল করে নিল। স্মিতা নামে ফেসবুকে নতুন অ্যাকাউন্ট খুলল। প্রথমে শ্যামলের কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল। শ্যামল অ্যাকসেপ্ট করাতে শুরু হল চ্যাট্ করা। ছোটোখাটো অসুবিধায় পড়লে রূপা চ্যাটেই শ্যামলের কাছে মৌখিক সাহায্য চেয়ে নিত। একদিন চ্যাটে নানা কথায় কথায় রূপা শ্যামলকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, আপনার কোনও বন্ধু যদি কোনও ভুল করে, আপনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন?’

‘ও কী ভুল করেছে তার ওপর ক্ষমা করা নির্ভর করে। কিন্তু আপনি হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন জিজ্ঞাসা করছেন আমাকে?’

‘জাস্ট এমনি। জানতে ইচ্ছে হল।’

শ্যামল অনেকবারই স্মিতা মনে করে রূপার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে। রূপাই কোনও না কোনও বাহানায় দেখা করতে রাজি হয়নি। ওর মনে সবসময় ভয় রয়েছে শ্যামল ওকে যদি ক্ষমা না করে তাহলে। একটাই প্রশ্ন খালি ওর মনে ঘুরপাক খায় কীভাবে ও শ্যামলের কাছে ক্ষমা চাইবে? কী ভাবে শ্যামলকে বিশ্বাস করাবে যে ও পুরোপুরি বদলে গেছে? আগের ব্যবহারের জন্যে ও আজ সত্যিই লজ্জিত।

একদিন সন্ধেবেলা রূপা সিসিডি-তে বসে কফি খাচ্ছিল হঠাৎ দেখতে পেল কয়েকটা টেবিল ছেড়ে শ্যামলও বসে রয়েছে একা। ওর হাতেও কফির কাপ। রূপার দিকে চোখ পড়তেই কফির কাপ নামিয়ে রেখে শ্যামল তাড়াতাড়ি দরজার দিকে পা বাড়াল। রূপা এসে শ্যামলের রাস্তা আটকে দাঁড়াল। ‘শ্যামল।’

‘তুমি এখানে? একা এসেছে?’

‘হ্যাঁ। অফিস থেকে ফেরার পথে একটু কফি খেয়ে যেতে ইচ্ছে হল।’

‘ভালো কথা। আচ্ছা আমার একটু তাড়া আছে। আমি চলি।’

‘শ্যামল, প্লিজ। আমাকে একটু সময় দাও, আমার কিছু কথা আছে তোমার সঙ্গে।’

‘আমাদের মধ্যে আর কিছু কথা বাকি রয়েছে বলে আমার মনে হয় না।’ শ্যামল দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

রূপা শ্যামলের হাত চেপে ধরে, ‘প্লিজ, আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি পুরো বদলে গিয়েছি। আমাকে একটা সুযোগ দাও প্লিজ।’ রূপার চোখ জলে ভরে আসে।

‘না রূপা, আর তা হয় না। তুমি অনেক দেরি করে ফেলেছ। আমি এখন অন্য একটি মেয়েকে ভালোবাসি।’

‘কী নাম?’

‘স্মিতা। ও আমার জীবনে বিশেষ একটা জায়গা বানিয়ে নিয়েছে।’

মৃদু একটা সলজ্জ হাসিতে রূপার চোখদুটো চিকচিক করে ওঠে। শ্যামল বিরক্ত হয়, ‘এর মধ্যে হাসির কী দেখলে?’

রূপা বাঁ হাত দিয়ে শ্যামলের হাতটা জড়িয়ে ধরে, ‘তুমি এখনও সেই বোকাই রয়ে গেলে। আরে ফেসবুকে আমিই স্মিতা নাম দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলেছিলাম কারণ সোজাসুজি তোমার সঙ্গে কথা বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না।’

সেদিন হস্টেল ছেড়ে দিয়ে রূপা চলে এসেছিল শ্যামলের সঙ্গে, শ্যামলের বাড়িতে। হঠাৎই অ্যালার্মের আওয়াজে রূপা অতীত থেকে ফিরে আসে বর্তমানে। ঘুমের আবেশে শ্যামল জড়িয়ে ধরে রূপাকে কাছে টেনে নেয়। অতীত বর্তমান মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় রূপার।

সম্পর্কের সমীকরণ

সময় কারও জন্য থেমে থাকে না রাহুল। সে তার নিয়মেই বয়ে চলে। মানুষ বর্তমান নিয়েই বাঁচে। কাল কে দেখেছে বলতো?’

‘ফিলোজফি ঝেড়ো না তো অরিদা। যখনই দেখা হয়, তোমার সেই একই কথা। সবসময় মানুষের মনে আঘাত দিতে ভালো লাগে? তোমাদের মতো করে যারা ভাবে তাদের জন্যই আমাদের মতো কষ্টে জর্জরিত মানুষগুলো বাঁচার আশাই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।’

‘বাঁচার আশা ছাড়বে না, বরং আরও ভালো করে বাঁচতে শিখবে! কখনও কারও মনে দুঃখ দেবে না, আর কেউ কষ্টে থাকলে তাকে মাঝ দরিয়ায় ছেড়েও দেবে না। আমরা মানুষ রাহুল। সমাজে বাস করি। রোজ না জানি কত লোকের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়, তাদের সকলের সঙ্গেই যে আমরা ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে পারি এমনটা তো সম্ভব নয়। কখনও কখনও তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে ফেলি। কটু কথাও বলে ফেলি। সেক্ষেত্রে তৎক্ষনাৎ একটা ‘সরি’ বললেই প্রবলেম সলভড্। কোনও কিছু কালের উপর না ছাড়াই ভালো, কারণ কাল কখনও আসে না।’

‘গতকাল দেরি করে অফিসে আসার জন্য আমি আমার চাপরাশিকে দু-চার কথা শুনিয়েছি। তাই বলে আমি তার কাছে ক্ষমা চাইব নাকি?’

‘ওনার দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করেছিস একবারও? যদি তিনি রোজই দেরি করে অফিস পৌঁছন তাহলে আলাদা কথা। কিন্তু যদি তিনি আগে কোনওদিন দেরি না করে থাকেন, শুধুমাত্র সেইদিনই… তাহলে নিশ্চয়ই কোনও বিশেষ কারণ থাকবে। ওই ভদ্রলোক তোর বাবার বয়সি। সারাদিনে সকলের সঙ্গে কত তো কথা বলিস। তার থেকে যদি দু-চারটি বাক্য ওই মানুষটার জন্য ব্যয় করিস, তাতে তোর জাত যাবে? যদি একটা ‘সরি’ বলিস, কী হবে তাতে? মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?’

‘কী বলতে চাইছ বলোতো? তোমার কথা অনুযায়ী আমাকে তাহলে সুগার কোটেড ট্যাবলেট-এর মতো করে বাঁচতে হবে। বাইরে থেকে মিষ্টি আর ভিতরে তেতো।’

‘বাইরে মিষ্টি ভিতরে তেতো কেন হবে? তাহলে তো ভিতরে ভিতরে নিজেকেই জ্বলতে হবে। আমরা নিজেকেও জ্বালাব না আর কাউকে কষ্টও পেতে দেব না।’

রবিবার। কোথায় রাহুল ভেবেছিল আজ একটু বেশি ঘুমোবে, এগারোটার আগে কোনও মতেই বিছানা ছাড়বে না। রোজই তো সকাল সাতটায় উঠে কোনওরকমে নাকে-মুখে গুঁজে অফিস ছুটতে হয় তাকে। যদিও তার দুশ্চিন্তা তাকে কতটা শান্তিতে ঘুমোতে দেয় কে জানে! সে ছুটে বেড়ায় শান্তির খোঁজে। আজকাল বাড়িতেও ভালো লাগে না রাহুলের। সংসারে মোটে তিনটে প্রাণী। মা-বাবা আর সে। তারা কেউ কথা বলে না রাহুলের সঙ্গে। রাহুলও কথা বলার সাহস পায় না।

ঘড়িতে তখন সবে আটটা দশ। কানের কাছে বেজে উঠল মোবাইল ফোনটা। ঘুম চোখে বিরক্তিমাখা মুখে ফোনটা কানে দেয় রাহুল—

‘হ্যালো, কে বলছেন?’

‘আরে অরিজিৎ বলছি রে।’

‘আরে হ্যাঁ। বলো বলো। হঠাৎ কী মনে করে এত সকালে ফোন করলে? সিরিয়াস কিছু?’

‘না রে তেমন সিরিয়াস না হলেও তোর সঙ্গে কিছু দরকারি কথা আছে। তাছাড়া অনেকদিন দেখাও তো হয়নি। আজ বিকালে আমাদের বাড়িতে আয়, তখনই সব কথা হবে। তোর বউদিও বাপের বাড়ি গেছে। তুই এলে আমারও কম্প্যানি হবে।’

‘এই কথাগুলো একটু বেলায় বললে খুব অসুবিধা হতো? শুধুশুধু আমার ঘুমটা মাটি করে দিলে। আচ্ছা ঠিক আছে, কখন যেতে হবে বলো?’

‘এক কাজ কর সকালেই চলে আয়। একসঙ্গে লাঞ্চ করব। দুজনে মিলে যা হোক একটা কিছু বানিয়ে নেওয়া যাবেখন।’

‘ঠিক আছে, আমি ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আসছি।’

অরিজিৎ, অতুলের বেস্ট ফ্রেন্ড। লম্বা, চওড়া, সুঠাম দেহ তার। দেখতেও বেশ সুদর্শন। কলকাতারই একটি নামিদামি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চিফ্ অ্যাকাউন্ট্যান্ট, মাত্র সাত মাস বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে সে।

অতুলদের বাড়িতে নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল অরিজিতের। সে প্রায় বাড়িরই একজন হয়ে উঠেছিল। বাড়িতে হইহুল্লোড়, আনন্দ, হাসি-ঠাট্টা, মজা, সুখ-দুঃখ সবেতেই সামিল হতো সে। অতুলের মতো অরিজিৎও হয়ে উঠেছিল রাহুলের অরিদা। অতুলের অকাল মৃত্যুতে তার আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল রাহুলদের বাড়িতে।

আজ সেই সম্পর্কের টানেই একটা ফোন পেয়ে অরিদার বাড়িতে ছুটে আসা রাহুলের। এর আগেও বহুবার এখানে এসেছে সে অতুলদার সঙ্গে। চার মাস আগে যখন এসেছিল তখন বারান্দায় বসানো বেলফুলের চারাগুলি সবে ডানা মেলছিল। আজ তাতে ফুল ভরে গেছে। পুরো বারান্দা গন্ধে ম ম করছে। কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল রাহুল।

— ‘কী রে শুনছিস কী বললাম? কোথায় হারিয়ে গেলি?’ অরিজিতের কথায় চমকে উঠল রাহুল।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, কী যেন বলছিলে? মাঝে মাঝে কী যে হেঁয়ালি করে কথা বলো না, কিছুই বুঝি না। মাথার উপর দিয়ে যায়। লোককে ভুরিভুরি উপদেশ দেওয়ার রসদ কোথা থেকে পাও বলো তো। কপালে একটা বড়ো লাল তিলক আর গেরুয়া বস্ত্র গায়ে চড়িয়ে বসে যাও। প্রচুর টাকা কামাবে।’

‘দ্যাখ, ভগবানের দয়ায় টাকার অভাব নেই আমার। আর গেরুয়া বস্ত্র কেন পরব বলতো? যারা সংসার ত্যাগ করে তাদের ওই পোশাক মানায়। তাদের মতো আমি তো মহামানব নই, আর ভবিষ্যতেও সংসার ত্যাগ করার কোনও পরিকল্পনাও আমার নেই। আমি সংসারী মানুষ। সারাজীবন সংসার নিয়েই সুখে-দুঃখে কাটাতে চাই। দায়িত্ব থেকে পিছপা হওয়ার মতো ছেলে আমি নই। আর অতটা দয়িত্বজ্ঞানহীনও হতে পারব না।’ অরিজিৎ বেশ উত্তেজিত হয়েই কথাগুলি বলল।

‘কোথা থেকে কোথায় চলে এলে অরিদা? কী বলছ কিছুই বুঝলাম না। আর হঠাৎ করে এত উত্তেজিতই বা হয়ে গেলে কেন?’

‘এত ছোটো তো তুই নোস, যে আমার কথা বুঝতে পারছিস না। কী করছিস ভেবে দেখেছিস একবারও। নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছিস? মেয়েটার কী হবে বলতো?’

এতক্ষণে রাহুলের বোধগম্য হল যে অরিদা কী বলতে চাইছে। তার আর মৌসুমির সম্পর্ককে ঘিরেই এত জল্পনা। সেই সম্পর্ক যেটা না রাহুল বহন করতে পারে আর না সহন করতে পারে।

‘তুমি আমার জায়গায় থাকলে কী করতে?’

‘হয়তো আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতাম। দাদার মৃত্যুর পর কখনও তার বিধবা স্ত্রীকে গ্রহণ করতাম না। মা-বাবা যতই চ্যাঁচামেচি করুক, অন্যায় আবদার করুক, না বলে কাটিয়ে দিতাম। অন্তত তাদের রোজ তিল তিল করে মরার জন্য ছেড়ে দিতাম না। যদি সম্পর্ক রাখারই না ছিল তাহলে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলি কেন? আমি এরকম সম্পর্কে কখনও আবদ্ধ হতাম না যেটা আমার নিজের এবং অন্যের জীবনের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াবে।’

‘যদি এই সম্পর্ক ওর মৃত্যুর কারণ হয়, তাহলে আমিও তো ক্রমশ সেই দিকেই এগোচ্ছি। না পারছি গিলতে, না পারছি ফেলতে। আমিও যে ভালো নেই অরিদা।’

‘ভালো থাকবি কী করে বলতো? চার মাস ধরে মেয়েটা বাপের বাড়িতে পড়ে আছে। অতুলের মৃত্যুর পর একবারও তাকে চোখের দেখা দেখতে যাসনি। এখনও সময় আছে রাহুল, সব দ্বিধা কাটিয়ে যা ওর কাছে। দায়িত্ব যখন নিয়েছিস ওকে ওর মর্যাদা দিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আন ভাই।’

চুপ করে থাকে রাহুল। এর কী জবাব দেবে সে নিজেই জানে না। বোধহয় সেই উত্তর খোঁজার জন্যই হারিয়ে যায় তার উদাসীন মন।

মৌসুমি বাবা-মায়ের আদরের একটিই মাত্র মেয়ে। লম্বা, ফর্সা, ছিপছিপে চেহারা। টানা টানা চোখ, টিকালো নাক, ছোট্ট কপাল–যাকে বলে প্রকৃত সুন্দরী। বিএ পড়তে পড়তেই বান্ধবীর সূত্রে অতুলের সঙ্গে আলাপ। তারপর প্রেম এবং পরে বিবাহ। অতুল সরকারি কর্মচারী এবং সৎ হওয়ার কারণেই মৌসুমিদের বাড়ি থেকে কোনও আপত্তি ওঠেনি।

শ্বশুর, শাশুড়ি, দেওর আর স্বামীকে নিয়েই ছিল তার সুখের সংসার। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সে সুখ তার কপালে বেশিদিন সইল না। বিয়ের সাত মাস পরেই ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট-এ মারা গেল অতুল। সেদিন মৌসুমির জন্মদিন ছিল। মৌসুমিকে উপহার দেওয়ার জন্য একটা লাল রঙের জরিপাড় শাড়ি এবং একতোড়া গোলাপফুল কিনেছিল সে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়েই এই দুর্ঘটনা। খবর পেয়ে তারা যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছল, তখনও লাল টুকটুকে শাড়ি আর গোলাপের তোড়া সেইখানেই পড়ে ছিল। শাড়িটা হাতে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল মৌসুমি। একটা সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল সে।

তিনদিনে সমস্ত কাজ মিটে যাওয়ার পর অখিলেশবাবু তার মেয়ে মৌসুমিকে পাকাপাকি ভাবে সঙ্গে করে নিয়ে চলে যেতে চাইলেন তাদের বেহালার বাড়িতে।

সেকথা শোনা মাত্রই রাহুলের মা-বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এমনিতেই পুত্রশোকে তারা মৃতপ্রায়, তার উপর আবার তাদের স্নেহের বউমার বাড়ি থেকে চলে যাওয়াটা তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তারা কাঁদতে কাঁদতে শুধু অখিলেশবাবুর পায়ে ধরতে বাকি রেখেছেন। কত অনুনয়-বিনয় করেছেন মৌসুমিকে এ বাড়িতে রাখার জন্য। কিন্তু তাঁর একটাই কথা, এখানে থেকে সে কী করবে। কী পরিচয়ে থাকবে? অতুলের বিধবার পরিচয়ে! সেটা তিনি কিছুতেই হতে দেবেন না। আবার তিনি অন্যত্র মেয়েকে পাত্রস্থ করবেন।

এ সমস্তকিছুই লক্ষ্য করছিল রাহুল। এমন সময় তাকে দেখে মা মীনাদেবী ছুটে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তার হাত দুটি ধরে পীড়াপীড়ি শুরু করে দেন। একমাত্র সে-ই পারে মৌসুমিকে এ বাড়িতে রাখতে। সে যদি মৌসুমিকে বিয়ে করে তাহলে মৌসুমি এ বাড়িতে বউয়ের সম্মান নিয়েই চিরজীবন থেকে যেতে পারে।

কিন্তু সেটা রাহুলের পক্ষে কীভাবে সম্ভব? যাকে সে এতদিন বউদি বলে ডেকে এসেছে, বন্ধুর মতো মিশেছে তার সঙ্গে, তাকে সে কীভাবে নিজের স্ত্রী হিসাবে মেনে নেবে? শুধু তার কেন, কারওর পক্ষেই কি এটা সম্ভব?

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এই প্রস্তাবটা নিয়ে কোনও জোরালো প্রতিবাদ করলেন না অখিলেশবাবু। শেষ পর্যন্ত শত চেষ্টা করেও মা-বাবার এই শোকার্ত আবেদন এড়িয়ে যেতে পারেনি রাহুল। সে বাধ্য হয়েছিল মৌসুমির মাথায় সিঁদুর তুলে দিতে। কিন্তু হায়, ভাগ্যের কী পরিহাস! যাকে নিয়ে এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত, সে স্থানুবত এক পুতুল। অতুলের নয়, রাহুলের স্ত্রী, হিসাবে জীবনটা অতিবাহিত করতে তার আপত্তি আছে কিনা তা নিয়ে কোনও মতামত চাওয়া হয়নি মৌসুমির।

এরপর অখিলেশবাবু প্রায় জোরাজুরি করেই পনেরো দিনের জন্য মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের বাড়িতে। তারপর কেটে গেছে চার চারটি মাস। এবাড়ির কেউ মৌসুমিকে আনেওনি, এমনকী ফোন পর্যন্ত করে খবর নেয়নি। এই নিয়েই যত অশান্তি। বাবা-মা রাগে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছেন রাহুলের সঙ্গে। তাদের রাগ বাড়ির বউ আর কতদিন বাপের বাড়িতে পড়ে থাকবে।

সহসা কলিং বেল-এর আওয়াজে চমকে ওঠে রাহুল। দুধওয়ালা দুধ দিয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে আবার বলতে শুরু করল রাহুল। ‘সময় মানুষকে কখন কোন পরিস্থিতিতে দাঁড় করাবে আগে থেকে তা কে বলতে পারে অরিদা? মানছি ওর দায়িত্ব আমি নিয়েছি। দায়িত্ব এড়াতেও চাই না। ভেবেছিলাম যে, সমস্যা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা আরও জটিলাকার ধারণ করল। সব থেকে বড়ো সমস্যা হল আগে একরকম করতাম আর এখন অন্যরকম ব্যবহার। মৌসুমির সঙ্গে নতুন সম্পর্ক তো দূর, পুরোনো সম্পর্কটাই কীভাবে সামলাব বুঝতে পারছি না। ও ছিল আমার বউদি কাম বেস্ট ফ্রেন্ড। সমস্ত আলোচনাই করতাম ওর সঙ্গে। এমনকী কবে কোন মেয়ের পিছনে লাগলাম, কার প্রেমে পড়লাম সমস্ত কিছুই। মাঝেমধ্যে দাদা আমাকে বলত, ‘কখনও তোর বউদিকে আমার সঙ্গেও একটু-আধটু সময় কাটাতে দে।’

একদিন তো এমনও হয়েছে, ‘বউদি বউদি’ করে ডেকেই যাচ্ছি। বউদির কোনও সাড়া নেই। যে-বউদিকে ডাক দিলেই সমস্ত হাতের কাজ ফেলে ছুটে আসে, তার আজ কী হল! আবার ডাকলাম, – এল না। ‘বউদি একবার এসো, তোমাকে কিছু দেখানোর আছে।’ খেতে বসেও সেই একই ব্যাপার। সকলের সঙ্গে কথা বলছে, শুধু আমার সঙ্গে বলছে না।

এইসব দেখে মা ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করার কারণ। সেদিন কোনও উত্তর দিতে পারেনি সে। উত্তরের পরিবর্তে শুধু মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে ও।

পুরো ব্যাপারটাই বুঝতে পেরেছিল দাদা। বসে বসে মুচকি হাসি হাসছিল। পরে দাদার থেকে জানতে পারি দাদা নাকি ইয়ার্কি করে ওকে বলেছে, ও দাদার থেকে আমাকেই বেশি ভালোবাসে। তাই সারাদিন মুখ গোমড়া করে রেখেছিল।

কথাটা যে আমিও ভালোভাবে নিতে পেরেছিলাম তা কিন্তু নয়। আমারও কেমন যেন একটা খটকা লেগেছিল। শুধু মনের কোণে একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল, আমাদের দেওর-বউদির সম্পর্ককে দাদা অন্যরকম ভাবে নিচ্ছে না তো?

বাড়িতে বেশ একটা গুরুগম্ভীর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। মৌসুমির মুখের হাসি ফিরিয়ে আনতে দাদা যখন ওকে আমার ঘরে নিয়ে এসেছিল, তখনও কাঁদছিল ও। আমাকে দেখে আরও বেশি করে কাঁদতে শুরু করেছিল। সেদিন প্রথম আমি ওর মাথায় হাত রেখেছিলাম।

সব শুনে অরিজিৎ বলল, ‘মৌসুমিকে ভালো যে বাসিস তা তোর কথায় স্পষ্টই বোঝা যায়। তবে এটা ঠিক যে তোর ভালোবাসার ধরনটা ছিল আলাদা। এখন তোদের সম্পর্কের সমীকরণটা বদলেছে। মানছি এক সম্পর্ক থেকে হঠাৎ করে অন্য সম্পর্কে যাওয়াটা খুব সোজা নয়। কিন্তু অসম্ভবও তো নয়। এই সংসারে কত লোকই তো আছে যারা এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, তারা কি সুখে ঘর করছে না বল?’

অতীত ভুলে যা ভাই, বর্তমানে ফিরে আয়। আমার বিশ্বাস তুই পারবি।’

‘কী করে বলো?’

‘আজ বিকেলে মৌসুমিদের বাড়িতে যা। ওর সঙ্গে কথা বল। আগের মতো ওর ভালো বন্ধু হয়ে যা। পাশে বস। তুই যেমন তোর ভাইকে হারিয়েছিস ও-ও তো স্বামীকে হারিয়েছে, তাই না?’

‘ওর স্বামী নাকি বন্ধু কোন পরিচয়ে গিয়ে দাঁড়াব ওর কাছে? তুমি যাবে আমার সঙ্গে?’

‘অবশ্যই যাব। এক কাজ করি আমি মৌসুমিকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি। তখন কথা বলে নিস।’

‘না অরিদা। প্লিজ ওকে এনো না।’

রাহুল হঠাৎই থামিয়ে দিয়েছিল অরিজিৎকে। সে ভয় পেতে শুরু করেছিল। কীভাবে সে মৌসুমির সামনে গিয়ে দাঁড়াবে?

রাতে বাড়ি ফিরে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ে রাহুল। মনে মনে ভাবতে থাকে তার সমস্ত সুখশান্তি দাদা কেড়ে নিয়ে গেছে। অরিদা ঠিকই বলেছে, কতদিন আর এরকম চলবে? কিছু তো একটা ডিসিশন নিতেই হবে। কিন্তু তার আগে এটাও তো জানা দরকার মৌসুমি তার ব্যাপারে কী ভাবে? সে কী চায়? এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে রাহুল।

পরদিন সকাল সাতটায় অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙে রাহুলের। কোনও রকমে নাকে মুখে গুঁজে রওনা দেয় অফিসে। পথটাও অনেকটা। সেক্টর ফাইভ। প্রায় দশ কিলোমিটার। ভালো পোস্টে আছে রাহুল। বেতনও পায় বেশ মোটা অঙ্কের।

অফিস শেষ করে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয় রাহুল। চড়ে বসে গাড়িতে। কিন্তু আশ্চর্যের কথা বাড়ি না গিয়ে এ কোথায় এল সে! তার অবচেতন মন তাকে কোথায় নিয়ে এল? এ যে মৌসুমিদের দরজার সামনে এসে গেছে সে! মৌসুমির মা-বাবা তাকে দেখতে পেয়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন। তাদের কাছ থেকে সে জানতে পারে মৌসুমি অসুস্থ। অতুলের মৃত্যুর পর থেকেই সে অবসাদে ভুগছে।

মৌসুমির ঘরে ঢোকা মাত্রই চমকে উঠল রাহুল-এ কী অবস্থা তার। চোখে-মুখে কালি পড়ে গেছে, চুল উশকোখুশকো, জরাজীর্ণ চেহারা। ফর্সা টুকটুকে রং একেবারে কালো হয়ে গেছে।

অতুল মৌসুমিকে খুব ভালোবাসত। বলত ‘এই পাগলিটাকে নিয়ে কী করি বলতো? এই যুগে এত সহজ, সরল হলে সমাজে বাঁচবে কী করে। কী করে সামলাব এই মেয়েকে আমি?’

রাহুল বলতো, ‘ভালোই তো, আসল সোনা পেয়েছ, তাতে খাদ মেশানোর চেষ্টা করছ কেন?’

‘আমি মরে গেলে কী হবে ওর? বাঁচবে কেমন করে? সমাজে বাস করতে হলে একটু চালাক-চতুর হতে হয়।’

‘কেন বাজে কথা বলো, বলো তো। ভালো কথা বলতে পারো না।’ সেদিন দাদার এই কথায় চেঁচিয়ে উঠেছিল রাহুল। কী জানি, দাদা কী তার মৃত্যুর কিছু পূর্বাভাস পেয়েছিল, নাকি এমনিই! মৌসুমিকে দেখে রাহুলের মনে পড়ে গেল কথাগুলো।

মনে মনে ভাবতে থাকল বাবা-মা বিশ্বাস করে তার হাতে সঁপে দিয়েছিল মৌসুমিকে। আর সে কী করছে। তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। তার এই অবস্থার জন্য নিজেকেই দূষতে থাকে সে।

এমন সময় মৌসুমির বাবা বলেন, ‘মউ দ্যাখ মা আমার, কে এসেছে তোর সঙ্গে দেখা করতে। দ্যাখ রাহুল এসেছে। রাহুলের সঙ্গে কথা বল মা। কতটা দূর থেকে এসেছে তোর সঙ্গে দেখা করতে।’

চুপ করে বসেছিল মৌসুমি। আর কী কথাই বা বলবে? কী-ই বা বলার আছে? তাদের দুজনেরই ভবিষ্যৎ অন্ধকারে আর অতীত তো চিরজীবনের মতো দিশাহীন করে দিয়ে গেছে। রাহুলের দিকে দেখল সে। সেই নিশ্চল চোখ। রাহুলের চোখে জল এসে যায়। দাদার মুখটা চোখের উপর ভেসে ওঠে। যেন আসল সোনা তার হাতে তুলে দিয়ে দাদা বলছে ‘দেখিস ভাই আমার মৌসুমির দায়িত্ব এবার তোর। তুই ছাড়া আর কাকেই বা এই গুরুদায়িত্ব দিতাম বল। বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যা রাহুল। বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যা।’

রাহুলের চোখ জলে ভরে গিয়েছিল। সহসা নিজের হাতের উপর একটা স্পর্শ অনুভব করার সঙ্গে সঙ্গে কানে এল, ‘কেমন আছো রাহুল?’

উত্তর দিতে না পেরে হাউহাউ করে কেঁদেই ফেলল রাহুল। মনে হচ্ছিল যেন দাদার দাহ সংস্কার করে সবে ফিরেছে সে। দাদা মরে গিয়ে বেঁচে আছে, আর তারা বেঁচেও মরে আছে।

‘রাহুল। কাঁদছ কেন?’

অল্পক্ষণেই রাহুলের মনে হল যেন তার দেহ-মনের জ্বালা একেবারে জুড়িয়ে গেছে। কোথা থেকে যেন শান্তি ফিরে এসেছে। মৌসুমি তার আঁচল দিয়ে রাহুলের চোখ মুছিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।

মৌসুমির বাবা রাহুলকে ঘরে দিয়েই চলে গিয়েছিলেন। কেউ থাকলে মৌসুমিকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথাটা অন্তত পাড়তে পারত সে।

মৌসুমি বলে ওঠে, ‘সোজা অফিস থেকে এসেছ না? কিছু তো খাওয়াও হয়নি মনে হয়। তুমি বসো। আমি কিছু নিয়ে আসি।’ এই বলে কোনওরকমে দেয়াল ধরে ওঠার চেষ্টা করে সে।

‘না খেতে ইচ্ছে করছে না’, বলে মাথা নাড়ায় রাহুল।

‘সবাই কেমন আছে? আমার কথা বাবা-মায়ের মনে পড়ে?’

‘আগে বলো বাড়ি যাবে আমার সাথে? সবাই তোমাকে খুব মিস করে।’ সাহস করে বলেই ফেলে রাহুল।

‘এখন আর ওখানে গিয়ে কী করব, কে আছে আমার?’

‘কেন এরকম বলছ?’

‘তুমি খুব ভালো করে জানো রাহুল, ওখানে আর আমার আপন বলতে কেউ নেই, তবুও…।’

কথাগুলি শুনে দম বন্ধ হয় আসে রাহুলের। তাহলে কি মৌসুমি মনে করতে চাইছে না তাদের সম্পর্কটা এখন কী? হতবাক দৃষ্টি নিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে রাহুল। যদি তাকে সাহায্য করার জন্য কেউ আসে। ওর মা-বাবা যে কেউ একজন।

‘কী হল রাহুল? তোমাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?’ মৌসুমি তার হাত দুটি ধরে বলল।

‘তুমি আমার সঙ্গে বাড়িতে চলো। তোমাকে ছাড়া কিছু ভালো লাগে না। বাড়ি যেন গিলতে আসে। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায়। কেউ কারওর সঙ্গে কথা বলে না’, বলতে বলতে আবার কেঁদে ফেলে রাহুল।

‘আমি গিয়ে কী করব বলো তো? ভগবান ও বাড়িতে ওই পর্যন্ত অন্ন মেপেছিল আমার জন্য।’

‘বারবার অতীতটাকে ফিরিয়ে আনতে চাইছ কেন? যে গেছে সে কি আর ফিরে আসবে?’ বেশ চিৎকার করেই কথাগুলো বলল রাহুল। কথাগুলো যেন নিজের কানেই বড়ো বাজল রাহুলের।

চিৎকার শুনে ছুটে এল মৌসুমির মা-বাবা। কখন যে তার মধ্যে অধিকারবোধ জন্মাল সে নিজেই জানে না।

রেগেমেগে তার মা-বাবার উদ্দেশ্যে রাহুল বলতে থাকে, ‘আপনারা কেন সবকিছু জানাননি ওকে। আপনারাই তো জোর করেছিলেন। তাহলে ওকে বলেননি কেন? চুপ করে আছেন কেন? আমাকে মাটির পুতুল ভেবেছেন, যখন যা খুশি তখন তাই করাবেন। বোঝান ওকে সত্যটা কী। আমি আর পারছি না মৌসুমি। তুমি কি কিছুই বুঝতে পারছ না, নাকি আমাকে যাচাই করছ? প্লিজ দয়া করো আমাকে, চলো বাড়ি চলো। আমি মানছি আমার ভুল হয়ে গেছে, বিগত চার মাসে একবারও তোমার খোঁজ নিইনি। কিন্তু সঙ্গে এটাও তো সত্যি একটা মুহূর্তের জন্যও তোমাকে ভুলতে পারিনি।’ বলতে বলতে সকলের সামনেই মৌসুমিকে জড়িয়ে ধরে সে।

এতদিন রাহুল-যে সম্পর্কটাকে বোঝা ভাবত, সেটা যে তার কাছে কী তা সে আজ টের পাচ্ছে। মৌসুমির তাকে অস্বীকার করা, সেটা কোনওভাবেই মানতে পারছে না সে।

‘আবার কাঁদে। আরে কাঁদছ কেন? কী হয়েছে তোমার রাহুল? আমি তো ভলোই আছি এখানে। এখানে আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না।’

এমন সময় মৌসুমির বাবা অখিলেশবাবু রাহুলকে অন্য ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ‘চার মাস একটা খবর পর্যন্ত নাওনি। আমার মেয়ে আমার কাছে বোঝা নয়। তাকে দুবেলা খেতে দেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। ঘাড় থেকে বোঝা নামাব বলে তোমার উপর মেয়ের দায়িত্ব দিইনি রাহুল। ভেবেছিলাম আমরা বুড়ো-বুড়ি আর ক’দিন। তারপর অন্তত মেয়েটাকে দেখার কেউ থাকবে।’

‘বাবা, তুমি রাহুলের সঙ্গে এইভাবে কথা বলছ কেন?’ কোনওরকম ভাবে মৌসুমি উঠে এসেছিল তাদের কাছে।

‘দাদার মৃত্যুর পর আমাদের এই আকস্মিক বিয়ে। তারপর থেকে আমিও তো ভালো নেই। শুধু ভেবেছি কী করব? ওর কী হবে? ও কীভাবে নেবে। প্রতিদিন একটু একটু করে মরছি। আর আপনারা ভাবছেন আমি চিন্তা করি না।’

‘রাহুল তুমি কি সত্যি কথা বলছ? তুমি মন থেকে মেনে নিতে পেরেছ এই বিয়ে? বলো আমাকে।’

‘ঘরে চলো তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার।’, হয়তো বাবা-মায়ের জুড়ে দেওয়া সেই অধিকারের জোরেই মৌসুমির হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে রাহুল নিয়ে যায় পাশের ঘরে। দরজা বন্ধ করে দেয়। অল্পক্ষণের জন্য দুজনেই চুপ করে যায়।

জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় মৌসুমি। কাছে যায় রাহুল। বলতে থাকে—‘খুব কষ্ট দিয়েছি না তোমাকে? আচ্ছা তুমিও কি তাই মনে করো? আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই তোমার খোঁজ নিইনি? কিন্তু বিশ্বাস করো একটা মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারিনি তোমার উপস্থিতির কথা। তখন বুঝতেই পারিনি তুমি আসলে আমার কী? দাদা চলে গেছে কিন্ত আমি তো বেঁচে আছি। তোমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাব না। সারাজীবন তোমার সঙ্গেই থাকব। যেদিন তোমার মাথায় সিদুঁর দিয়েছিলাম সেদিন যে-শপথ নিইনি আজ তা নিলাম।’

কথাটা শোনা মাত্রই চিৎকার করে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে মৌসুমি। বাইরে থেকে মেয়ের কান্না শুনে পড়িমরি করে দরজা খুলে ছুটে আসেন মৌসুমির মা-বাবা। মেয়েকে চুপ করানোর জন্য এগিয়ে আসতেই হাত দেখিয়ে বাধা দেয় রাহুল। হাত জোড় করে বলে ‘দয়া করে আপনারা যান আমি সামলে নেব।’

‘মৌসুমি শোনো, আমার কথা শোনো। দ্যাখো আমার দিকে একবার দ্যাখো।’

তাকে কিছুতেই সামলাতে পারছে না রাহুল। একপ্রকার জোর করেই মৌসুমিকে চেপে জড়িয়ে ধরে রেখেছে কোনওমতে। ‘অভিমান হয়েছে? রাগ হয়েছে? বলো তুমি সত্যিই বোঝো না তোমার আমার সম্পর্ক?’

মৌসুমি শুধু একটা কথাই বলে চলে–‘না এটা হতে পারে না। আমি তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিতে পারি না।’

রাহুল বাহুবলে আরও কাছে টেনে নেয় মৌসুমিকে। একেবারে বুকের কাছে। এতটাই কাছে যে তার প্রতিটি হূদয়ের স্পন্দন অনুভব করে সে। সে এক আলাদা অনুভূতি, যেটা সে আগে কোনওদিন অনুভব করেনি।

রাহুল বলতে থাকে-‘কে বলেছে তুমি আমার জীবন নষ্ট করেছ? তুমি জানো না তুমি আমাদের কাছে কী সোনা–বলতে বলতে মৌসুমির কপালে চুমু খায় রাহুল। যাকে গলার কাঁটা ভাবতাম সেটাই যে গলার হার হয়ে দাঁড়াবে তা কি আগে জানতাম? বুঝলামই যখন তখন…’

চুপ করে রাহুলের বুকে মাথা দিয়ে থাকে মৌসুমি। এখন সে অনেকটা শান্ত।

দুই হাত দিয়ে মৌসুমির মুখটি তুলে ধরে বলে, ‘যাবে তো আমার সঙ্গে, যাবে না? কিছু বলবে না? আচ্ছা ঠিক আছে বলতে হবে না।’

রাহুল বুঝে যায় মৌসুমির নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ।

 

মাউথ অর্গান

ছুটতে ছুটতে ট্রেনটা ধরল অভীক। দিনের শেষ ট্রেন। এটা ধরতে না পারলে ফিরতে পারত না সে। সকালে বাবার শরীরটা খারাপ দেখে এসেছে। হার্টের রোগী বাবা। হঠাৎ কিছু হলে মায়ের পক্ষে একা সামলানো মুশকিল। অন্যদিন হলে এতটা ঝুঁকি নিত না। ছেলেবেলার বন্ধু তাপসের কোয়ার্টারেই থেকে যেত।

তাপস বর্ধমান স্টেশনের রেলপুলিশের বড়োবাবু। সে একাই থাকে এখানে। ওর কাছে থাকলে ছেলেবেলা কিছুটা ফেরত পাওয়া যায়। শেষ কামরায় খুব ভিড়। ভেতরে ঢোকা যাচ্ছে না। শরীরের অনেকটা কামরার বাইরে। একটু ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই কাঁধের ব্যাগ খুলে প্ল্যাটফর্মে। গাড়ির যথেষ্ট গতি এখন। চলন্ত অবস্থায় নামা আত্মহত্যার সামিল। মুখ ঘুরিয়ে ব্যাগটার দিকে তাকাল অভীক। স্টেশনের বোতল কুড়োনো একটা ছেলে ব্যাগটা তুলছে।

ছেলেটাকে ভালো করে লক্ষ্য করল ও। গায়ে চেক জামা, নীল হাফ প্যান্ট, মাথায় কোঁকড়া চুল। গবেষণার কিছু কাগজপত্র, বই, নতুন কেনা দামি মোবাইল, পাঁচশো টাকা ও তার সাধের মাউথ অর্গানটা আছে ব্যাগের মধ্যে। পাবে তো ব্যাগটা? বিশেষ করে ওর মাউথ অর্গানটার জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

বছর তিনেক আগে ওরা চার বন্ধু মিলে ব্যাঙ্কক-পাটায়া বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানেই কিনেছিল ওটা। বেশ দামি। ওর অনেক দিনের শখ ছিল বিদেশি মাউথ অর্গানের। সাংহাই কোম্পানির চেঞ্জার অর্গানটা। দুটো দিকেই বাজানো যায়। এত সুরেলা আওয়াজ হয় যে, আশপাশে একটা ভালো লাগার পরিবেশ তৈরি হয় সুরের ঝরনাধারায়।

ভিড় ঠেলে একটু ভেতরে ঢুকল ও। তাপসকে ফোন করে সব জানাল। ব্যাগটার বিষয়ে আশ্বাস দিল তাপস। ও এখনি যাচ্ছে বলল। তবে চলন্ত ট্রেনে ওঠার জন্য খুব বকাবকি করল ওকে। মশাগ্রাম স্টেশনে ও জানলার ধারে বসার জায়গা পেল একটা। চোখ বুজে হাওয়ার আদর খেতে লাগল।

অভীক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করছে। বিষয়- গ্রামীণ উন্নয়নে ক্ষুদ্র ঋণের প্রভাব। স্বনির্ভর গোষ্ঠী বিষয়টায় জুড়ে গেছে বলে বিগত তিন বছর হুগলি জেলার গ্রামগুলোতে চষে বেড়িয়েছে তথ্য সংগ্রহের জন্য। ঘোড়ার মুখের তথ্য সমৃদ্ধ করেছে ওর লেখা। সবই প্রাথমিক তথ্য নির্ভর লেখা। কোনও গৌণ তথ্যের ওপর নির্ভর করেনি। এতে গবেষণার বিষয় আরও বাস্তবোচিত ও গ্রহণযোগ্য হবে। এটা ওর বিশ্বাস।

প্রতি শনিবার স্কুল করে ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে চলে আসে। স্যারের সাথে সারা সপ্তাহের কাজ নিয়ে আলোচনা করে। গ্রন্থাগারে যায়। নোটস নেয়। এসব করতে করতে একদম শেষ ট্রেন হয়। আজ ও স্যারের কাছে এসেছিল অন্য শনিবারের মতোই। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল! মনখারাপের কালো মেঘ ওর সারা হৃদয় জুড়ে।

পরদিন আরামবাগের একটা গ্রামে ফিল্ড ভিজিট সেরে ও বর্ধমানে পৌঁছোল প্রায় সন্ধেয। তাপস অফিসেই ছিল। হারানো ব্যাগটা এগিয়ে দিল তাপস। অভীক দেখল সব ঠিক আছে। শুধু মাউথ অর্গানটা নেই। চা টিফিন করে ওরা বের হল হারানো অর্গান উদ্ধারে। যদি বুঝিয়ে ফেরত পাওয়া যায়! বড়ো ব্যথা ওর বুকের ভেতর। ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল ওটা। বন্ধু বিচ্ছেদের কষ্ট যেন সারা মন জুড়ে।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা গিয়ে পৌঁছোল ছেলেটার আস্তানায়। হঠাৎ কানে এল সুর। সি শার্প-এ অগোছালো সুর। কিছু রিড মিস হচ্ছে। তবুও এক অদ্ভুত ভালোলাগা আছে সুরটায়। শুনেই বোঝা যায় কত ভালোবাসা নিয়ে বাজাচ্ছে। অভীক বুঝল সব। উৎসের দিকে একটু এগোতেই নজরে এল, সেই কালকের ছেলেটা চোখ বুজে তন্ময় হয়ে বাজিয়ে চলেছে অভীকের প্রিয় মাউথ অর্গানটা। আধো অন্ধকারে যেন আত্মমগ্ন ও। ওর সারা শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক আনন্দ খেলা করছে। মুখে যেন সব পাওয়ার আলপনা। বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল অভীকের। অদ্ভুত এক ভালোলাগায় মনটা ছেয়ে গেল ওর। অনেক না-পাওয়ার মাঝে ছেলেটা একটা বাঁচার অবলম্বন খুঁজে পেয়েছে যেন। ওর এই পাওয়াটুকু আর কেড়ে নিতে চায় না অভীক । বাজাক মাউথ অর্গান ওর প্রাণের সুরে সুখের অঞ্জলিতে। তাপসের হাত ধরে ফেরার পথ ধরল অভীক মাউথ অর্গানের সুর পিছনে ফেলে।

 

অ-সমকাম

বিয়ের সাত বছর পর রনিতা বুঝতে পেরেছিল অসম্ভব! যদিও বিয়ে ফুলশয্যা, মধুচন্দ্রিমার আবেশ কাটতেই অনুভব করেছিল অন্যরকম কিছু একটা। তবু আশায় বুক বেঁধে ছিল। হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। সংসারের কঠোর বন্ধনে বেঁধে ফেলতে চেয়েছিল কর্পোরেট সেক্টরের অফিসার স্বামী অনিন্দ্যকে। আশা করেছিল, একবার বেঁধে ফেলতে পারলেই হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। সাত তাড়াতাড়ি সন্তানের জন্য বায়না ধরেছিল রনিতা।

–এখনই সন্তানের প্রয়োজন কী!

অনেকেই অনিন্দ্যকে সমর্থন করেছিল।

–সত্যিই তো! সবে বিয়ে হয়েছে। কয়েকটা দিন যাক। এনজয় করুক জীবনটাকে। বাচ্চাকাচ্চা হলেই তো সব শেষ!

অনিন্দ্যর যুক্তি ছিল অবশ্য অন্যরকম। তার যেটুকু উপার্জন, সন্তান এলে তাতে তাদের ঠিকমতো চলবে না।

প্রথম প্রথম রনিতা রাতে শুতে গিয়ে তাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। সন্তান হচ্ছে দাম্পত্যে ভালোবাসার সেতু। কিন্তু অনিন্দ্য কিছুতেই সে কথা মানতে নারাজ। একটু একটু করে রনিতাও বুঝতে পারছিল, অনিন্দ্যকে বোঝানো তার সাধ্যের অতীত। তবু হাল ছেড়ে দিয়েছিল, এমন নয়। সুযোগ পেলেই অনিন্দ্যর দুর্বলতম অনুভূতিগুলোর গায়ে নক করত রনিতা।

কিন্তু সেদিন ঘরে ঢুকেই রনিতা বুঝতে পেরেছিল, অন্যরকম কিছু একটা। অনেক দিনই রাত করে বাড়ি ফেরে অনিন্দ্য। কোনও দিন হয়তো ফেরেও না। তাই নিয়ে অনেকবার অভিযোগও করেছে অনিন্দ্যর কাছে। অনিন্দ্যর একটাই জবাব, রুটিনে বাঁধা জীবন তার ভালো লাগে না। তাও মেনে নিয়েছিল রনিতা।

আজ রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে অন্য দিনের মতোই ঘরে ঢুকতেই, খটকা লাগল রনিতার। তাকে দেখেই তড়িঘড়ি সেলফোনে কলটা কেটে দিল অনিন্দ্য। উন্মত্ত বাঘিনির মতোই রনিতা ঝাঁপিয়ে পড়ল অনিন্দ্যর উপর। হ্যাঁচকা টানে কেড়ে নিল মুঠোবন্দি সেলফোনটি। লক খুলতেই চোখের উপর ভেসে উঠল একের পর এক আপত্তিকর ছবি আর মেসেজ।

সেলফোনের স্ক্রিনের তীব্র আলোয় রনিতার মুখ তখন ঝলসে যাচ্ছে। অথচ কেমন নিস্পৃহ দেখাচ্ছে অনিন্দ্যকে। ভাবলেশহীন, যেন অত্যন্ত স্বাভাবিক সে। কোনও কিছুরই হিসাব মেলাতে পারছে না রনিতা। যেন এক অথৈ সমুদ্রে একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে সে।

–এসব কী অনিন্দ্য! আমি কি সত্যি দেখছি! বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে স্পষ্ট অনুভব করল রনিতা। তার তীব্র নীল আলো এসে পড়ছে জানলার কাছে। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রনিতা। নিস্পৃহ অনিন্দ্য।

–সত্যি! আমি শুধু পুরুষের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করি। কোনও নারী আমাকে তা দিতে পারে না!

দূরে কোথাও কর্কশ শব্দে বাজ পড়ল। রনিতা নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠল একবার। তারপর অনুভব করল বাইরে অঝোর ধারায় শুরু হয়েছে বৃষ্টি। ইচ্ছে করেই খুলে দিল জানলার কাচের শার্শিগুলো।

বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি কণা জমে উঠছে এখন রনিতার কপালে, চিবুকে, চোখের পাতায়। একা এবং একা নিথর বসে রইল ভোরের প্রতীক্ষায়।

 

 

শান্তি

আরও চাই, আরও, আরও। টাকাপয়সা, সম্মান, ক্ষমতা, জনপ্রিয়তা সব কিছুই হিসেবে কম পড়ছে। তাই আরও বেশি বেশি করে চাই। এই সুখে হবে না, আরও সুখ চাই। এই পরিমাণ শান্তিতে চলবে না, নিরবচ্ছিন্ন শান্তি চাই। যেটুকু আয়ত্তের বাইরে আছে সেটুকুকে পেতে আয়ত্তের মধ্যে থাকা জিনিসকেও বাজী ধরতে রাজি আছি।

গোপালের বিয়ে দেবার জন্য ওর মা-বোন-দিদি সব উঠে পড়ে লেগেছে। বিয়ের জন্য গোপাল নিজে যত না আগ্রহী, উদ্যোগী ওর বাড়ির লোকজন তার হাজারগুণ। গোপালের মা বলেন, ‘মেয়েগুলোর বিয়ে হয়ে যাবার পর বাড়িটা কীরকম যেন খাঁখাঁ করে। একটা চুড়ির রিনিঝিনি নেই, একটা নূপুরের নিক্বণ নেই। যেন ভূতের বাড়ি। নাতি-নাতনির মুখ বোধহয় আর দেখে যেতে পারব না।’

গোপাল বলে, ‘দাঁড়াও না মা, আর একটু সবুর করো না, আমার আর একটা পদোন্নতি হোক তারপর না হয়…’

গোপালের মা ওর মুখের কথা ছোঁ মেরে কেড়়ে নিয়ে বলে, ‘পদ বাড়ানোর প্রস্তুতি আর বিয়ের প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলুক না, ক্ষতি কি? তোর পদোন্নতি হতে হতে আমাদেরও মেয়ে রেডি হয়ে যাবে। আরও দেরি করে মেয়ে দেখতে বেরোলে, তোর বিয়ের বয়স পার হয়ে যাবে।’

সুতরাং প্রায় প্রত্যেকটা ছুটির দিনেই মা-দিদি-বোনেরা একজোট হয়ে একটা না একটা মেয়ে দেখতে যাওয়া চাই-ই। এটা যেন ওদের কাছে একটা সাপ্তাহিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। সকাল থেকেই সাজোসাজো রব। ইতিমধ্যে নয় নয় করে তেরোটা মেয়ে দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু পছন্দ যেন আর হয় না। এদেরই মধ্যে একজনকে গোপালের মনেও ধরেছিল কিন্তু মা-দিদি-বোনের যুক্তফ্রন্ট সেটাকে পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়েছে।

দেখতে দেখতে গোপালের বিয়ে হয়ে গেল। এলাহি আয়োজন হল, প্রচুর লোক খেল। বাড়িতে এখন দিনরাত হইচই লেগেই আছে। দিদি, বোন প্রায়ই আসে। নতুন বউকে নিয়ে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বাজার কিংবা সিনেমা হলে যায়। গোপালও যায় মাঝে মাঝে। শাশুড়ি-বউমার যুগলমূর্তি প্রায়ই চোখে পড়ে এখানেওখানে। বাড়িতে হাসাহাসি, দাপাদাপি, হুটোপাটি, লুটোপুটি লেগেই আছে। নতুন বউমা নতুন মাকে পেয়ে সেকি উচ্ছ্বসিত। তার চেয়েও বেশি উচ্ছ্বসিত নতুন মা তার নতুন মেয়েকে খুঁজে পেয়ে। যেন আক্ষরিক অর্থেই জন্মজন্মান্তরের পর আকস্মিক ভাবেই কোনও এক অজানা গ্রহের ফেরে মা-মেয়ের দেখা। বউমা ‘মা’ ‘মা’ বলতে অজ্ঞান। শাশুড়িও একই রকম বউমা ভক্ত। দুজনে যেন একে-অপরকে কিছুতেই চোখের আড়াল করতে পারে না। গোপালের বাড়ি এখন সুখের হাট। লোকে দেখে হিংসে করে।

সস্তার জিনিস যেমন প্রথম দর্শনে চেনা যায় না, দুদিন ব্যবহারেই তার আসল রূপ প্রকাশ পায়, তার চাকচিক্যের অবসান ঘটে, তেমনি শাশুড়ি-বউমার চিরন্তন স্বাভাবিক সম্পর্ক ধরা পড়ল মাসখানেক বাদে।

এখন কাক, চিল, আদি পক্ষীকুল গোপালের বাড়ির ছাদ, পাঁচিল এড়িয়ে চলে। মফসসলের এই মধ্যবিত্ত পাড়াটার আপাত শান্ত চেহারাটা হঠাৎই বড়ো অশান্ত হয়ে ওঠে শাশুড়ি-বউয়ের নিত্য কলহে। অশান্তি, চিৎকার, চ্যাঁচামেচি লেগেই আছে। কান পাতা দায়। কী নিয়ে যে অশান্তি তা বোধগম্য নয়। কোনও ইস্যু নেই। শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়া না, দুই সতিনের ঝগড়া তাও চট করে বোঝার উপায় নেই। সেই একমেবদ্বিতীয়ম ছেলে-স্বামীর ওপর আধিপত্য বিস্তারের গল্প, যা প্রতিদিন হাজার হাজার ঘর ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। শাশুড়ি ভাবে, যে-ছেলেকে, যে-গোপালকে এই সেদিন জন্ম দিলাম বত্রিশটা নাড়ি ছিঁড়ে, মাসের পর মাস বুকের দুধ খাইয়ে মানুষ করলাম, আধপেটা খেয়ে না খেয়ে পুজোয় নিজের জামাকাপড় না কিনে লেখাপড়া শেখালাম, সেই গোপাল আমার শেষ পর্যন্ত কিনা পর হয়ে গেল! হতচ্ছাড়া অলক্ষুনে মাগিটা আমার অমন মাতৃভক্ত, গোবেচারা গোপালটাকে ছিনতাই করে নিল! দিনরাত অত গুজুর গুজুর, ফুসুর ফুসুর কীসের? আমার ভোলাভালা ছেলেটার মাথা খাচ্ছে! দিনরাত কুযুক্তি দিচ্ছে, আমার বিরুদ্ধে সব সময় নালিশ করছে! ছেলের বিয়ের আগে বাড়িতে আমার কত শান্তি ছিল! ওই মাগিটা আসার পর থেকে ছেলেও আমার বিগড়ে গেল, বাড়ি থেকেও শান্তি উধাও!

চেহারা কিংবা শিক্ষার পালিশ গোপালের মায়ের কোনওদিনই ছিল না। তাই চিন্তার ও ভাষাদৈন্য অচিরেই প্রকট হয়ে ওঠে। বউমা সম্পর্কে তার তিক্ত ভাবনাটাই মুখের কদর্য ভাষায় বেরিয়ে পড়ে মাঝেমধ্যেই। ‘বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা হতচ্ছাড়ি মাগি! গোপালের আবার বিয়ে দেব আমি। খাল কেটে আমিই ঘরে কুমির এনেছি! বলি সংসারটা কি শুধু স্বামীটাকে নিয়ে? আরে মূর্খ, স্বামীটাকে পেলি কোত্থেকে? তুই জন্ম দিয়েছিস? আমি কি বাইরের লোক? তোর বাপ-মায়ের সঙ্গে কি তুই এইরকম আচরণ করতিস? পাঠাবার সময় বাপ-মা শিখিয়ে দেয়নি শ্বশুরবাড়িতে কীরকম ভাবে থাকতে হয়, শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করতে হয়? আমরা তো জীবনে শ্বশুর-শাশুড়ির মুখের ওপর কোনওদিন কথা বলিনি, কোনও কথার প্রতিবাদ করিনি, চিরটাকাল তাদের দাসী হয়ে থেকেছি। আমারই ভিটেয় থেকে আমাকেই অপমান? ছেলে মানুষ করলাম শেষ বয়সে এসে বউয়ের লাথিঝাঁটা খাবার জন্য! এর চেয়ে তো মরণও ভালো ছিল আমার!’

মায়ের সঙ্গে উপযুক্ত সঙ্গত করে ননদেরা, ‘মা, একি চেহারা হয়েছে তোমার? সেই কাঁচা সোনার বরন কোথায় গেল? ওই ডাইনি বউটার কীর্তি নিশ্চয়ই! তাড়াও হতচ্ছাড়িকে।’

ভাইয়ের বউয়ের দিকে আঙুল তুলে বলে, ‘তুই এই বাড়ির নখের যুগ্যি নস, দূর হয়ে যা এখনই, নইলে গলা ধাক্বা দিয়ে বের করে দেব, এই বলে দিলাম। চিরকালের জন্য এবাড়ির ভাত খাওয়া ঘুচিয়ে দেব।’

ছেলে-বউ একসঙ্গে বেশিক্ষণ কাটালে, গল্প করলে বা হাসাহাসি করলে শাশুড়ি সহ্য করতে পারেন না। কোনও না কোনও ছুতোয় ছেলেকে অন্য কোনও কাজে ব্যস্ত করে তোলেন অথবা নিজেই দুজনের মাঝে বসে পড়ে অপ্রয়োজনীয় গল্প জুড়ে দেন। রসভঙ্গ করেন। ছেলে-বউ সব বুঝেও কিছু বলতে পারে না।

ছেলে-বউ কোথাও বেড়াতে যাবে শুনলেই শাশুড়ির গাত্রদাহ ও রক্তচাপ হাজারগুন বেড়ে যায়। শরীর খারাপ বা অন্য কোনও ছুতোয় তিনি তা বানচাল করার চেষ্টা করেন। এই করেই সেবারে ওদের দীঘা যাওয়া ক্যানসেল হয়ে গেল। বাড়ি থেকে বেরোবার ঘণ্টাখানেক আগে শাশুড়িমা বুকে হাত দিয়ে শুয়ে পড়লেন। ছোটাছুটি, ডাক্তার ডাকাডাকি সবই করতে হল বেচারা গোপালকে। দীঘা যাওয়া মাথায় উঠে গেল। ডাক্তার এসে বললেন আশ্বাসের কথা, ‘তেমন কিছুই হয়নি… একটু বিশ্রাম।’

ততক্ষণে দীঘার বাস ডায়মন্ডহারবার পৌঁছে গেছে। গোপালের মধুচন্দ্রিমা উচ্ছেচন্দ্রিমায় রূপান্তরিত হয়েছে।

গোপালের মা, বউয়ের দিক থেকে ছেলের মন একশো আশি ডিগ্রি ঘোরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন। গোপাল চা করতে গেলে, জামাকাপড় কাচতে গেলে বা এঁটো বাসনপত্র তুলতে গেলে অর্থাৎযে-কাজগুলোকে সচরাচর অন্যায়ভাবে শুধুমাত্র মেয়েলি কাজ বলে মনে করা হয়, সেগুলো করতে গেলে মা বাধা দেন। বলেন, ‘তুই এসব কাজ করছিস কেন? এগুলো তো মেয়েদের কাজ, তোর বউয়ের কাজ! এতে তো তোর বউ আরও প্রশ্রয় পেয়ে যাবে, মেয়েদের কাজ ছেলেদের করতে নেই। তুই বোকাসোকা ভালোমানুষ বলে তোকে দিয়ে হাবিজাবি কাজগুলো করিয়ে নিচ্ছে। একদিন ওর কাজ করে দিলে দ্বিতীয় দিন আর ও সেই কাজ করতে চাইবে না। সারাজীবন ধরেই তোকে বউয়ের গোলামি করে যেতে হবে।’

গোপাল মায়ের কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। মায়ের কথা মেনে নিতে ওর বড়ো কষ্ট হয়। অথচ তীব্র প্রতিবাদও করতে পারে না। ছোটোবেলা থেকেই ও জেনে এসেছে বড়োরা বিশেষ করে মা-বাবা কখনও সন্তানের অমঙ্গল চান না। তাঁরা যা বলেন বা করেন সবই সন্তানের ভালোর জন্যই। তাঁদের মুখের ওপর কথা বলতে নেই। অথচ ও বেশ বুঝতে পারে স্ত্রীর ক্ষেত্রে মা যা যা বলেন তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেঠিক, চরম বিদ্বেষপূর্ণ, শত্রুতাপূর্ণ। সে কী করবে, তার কী করা উচিত কিছুতেই ঠিক করতে পারে না। এক চরম নিষ্ঠুর তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বে ভোগে সে। সে দেখেছে বিয়ের আগে পর্যন্ত মা যা যা বলে এসেছে বা করে এসেছে সবই তার স্বার্থের অনুকূলে। তাই রাতারাতি মায়ের এই ভোলবদল সে কিছুতেই নিজের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারে না। যদিও শাশুড়ি-বউ-এর সম্পর্কের চিরকালীন কূটনৈতিক জটিলতা ও পরিপক্ব সাংসারিক বুদ্ধির অভাবই তিক্ততার জন্য দায়ী।

ভালো কথায় কাজ হচ্ছে না দেখে মা এবার অন্য রাস্তা ধরেন। গোপালকে দিনরাত কথায় কথায় তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অপমান করেন। বলেন, ‘বউকে প্রশ্রয় দিচ্ছিস। তোর প্রশ্রয়েই বউ এত বাড় বেড়েছে। বউকে শাসন করার ক্ষমতা নেই, স্ত্রৈণ কোথাকার! বউয়ের কথায় ওঠবোস করিস। মনে রাখিস, বউ গেলে বউ আসবে, মা গেলে মা আসবে না। যে মা তোকে জন্ম দিল, এই এতটুকু থেকে মানুষ করল, দুদিনের বউকে পেয়ে সেই মাকে ভুলে গেলি? নেমকহারাম কোথাকার! একেই বলে কলিকাল। এমন ছেলে থাকার চেয়ে বাঁজা হওয়াও ভালো ছিল। জন্মের পরই যে কেন তোকে গলায় নুন দিয়ে মেরে ফেলিনিরে হতভাগা!’

গোপালের ওপর মায়ের এই মানসিক অত্যাচারের কারণ হল যে, তিনি চান এসব অপমানের মাধ্যমে গোপালকে এমন মানসিক অশান্তির মধ্যে ফেলা যে, সে যেন ভাবে এসবের জন্য বউ-ই দায়ী, কারণ, বিয়ের আগে মা তার সঙ্গে ভালো ব্যবহারই করত কিন্তু বিয়ের পর মায়ের আচরণ পালটে গেল। এই কথা ভেবে গোপাল যাতে মায়ের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে বউয়ের ওপর অত্যাচার করে, মায়ের মনে এমনই আশা। কিন্তু গোপাল মায়ের এই কৌশল বুঝে ফেলে। তাই সে মায়ের কৌশলের ফাঁদে পা দেয় না।

কম যায় না গোপালের বউ-ও। শাশুড়িমাকে সে সতিন জ্ঞান করে। তাকে মন্দ ভাষা বলতেও বউয়ের বুক কাঁপে না। তিরিশ বছরের বড়ো এক মহিলার সঙ্গে সমানে টক্বর দেবার বা তাকে ওই ভাষায় গালাগাল করার সাহস কোত্থেকে আসে তা ভেবে গোপাল অবাক হয়ে যায়। গোপাল মাঝে মাঝে ভাবে, ‘এ নিজের মায়ের সঙ্গেও কেমন আচরণ করে!’

গোপালকেও বউ ছেড়ে কথা বলে না। শাশুড়ি-ননদের হাতে হেনস্তার জন্য সে সর্বদা গোপালকেই দায়ী করে।

‘তুমিই তো যত নষ্টের গোড়া! বিয়ে করে এনেছিলে কি মাকে দিয়ে পদে পদে অপমান করাবে বলে? বউয়ের সম্মান রাখতে পার না, কী ধরনের স্বামী তুমি? অমন স্বামী থাকার থেকে না থাকা ঢের ভালো ছিল। এর চেয়ে আইবুড়ি হয়ে সারাজীবন কাটানো অনেক সুখের হতো। ব্যক্তিত্বহীন নপুংসক কোথাকার! মায়ের ন্যাওটা হয়েই তো সারাজীবন থাকতে পারতে। বিয়ে করার শখ হল কেন? অতই যদি মাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট, তাহলে রাতটাও তো মায়ের সঙ্গেই কাটাতে পারতে!’

বউ আরও বলে, ‘এখানে তোমার মায়ের সঙ্গে আমি থাকতে পারব না। অন্য কোথাও চলো, বাড়ি ভাড়া করো, ফ্ল্যাট কেনো, নইলে বাপের বাড়ি চলে যাব, পুলিশের কাছে তোমার নামে বধূ নির্যাতনের অভিযোগ করব। মহিলা সমিতিতে অভিযোগ করব, কোর্টে নারী নির্যাতনের মামলা করব। জেলের খাবার খাওয়াব তোমায়, এই বলে দিলাম!’

ইতিমধ্যে বউয়ের বাপ আর তিন দাদা এসে চমকে দিয়ে গেছে গোপালকে। তিন দাদা তিনটে আলাদা আলাদা রাজনৈতিক দলের ঘাটে নোঙর বেঁধেছে। সে কী তড়পানি! ‘অনেক খরচা করে বোনের বিয়ে দিয়েছি পড়ে পড়ে লাথিঝাঁটা খাবার জন্য নয়। অমন মা থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। দরকার হলে বুড়িটাকে লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দাও। আমাদের আদরের একমাত্র বোনের ওপর কোনওরকম অত্যাচার সহ্য করব না। মাকে যদি শায়েস্তা করতে না পারো তাহলে তোমাকে কীভাবে শায়েস্তা করতে হয় তা আমরা বুঝে নেব!’

মা, বউ দুজনেই দিনরাত আত্মহত্যা করার ভয় দেখায়। বউ যদি সকালে আত্মহত্যা করার ভয় দেখায় তাহলে মা দেখায় বিকেলে, মা যদি দিনের বেলায় তো বউ রাতে। এ যেন একদলের মিছিল বা বন্ধের ডাকের বদলে অন্য দলের পালটা ডাক। আত্মহত্যা করার ভয় দেখিয়ে দুজনেই এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চায়– গোপালকে চাপের মধ্যে রেখে নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধি করা এবং অপর পক্ষের আত্মহত্যার হুমকিকে নস্যাৎ করে দেওয়া। কিন্তু মনস্তত্ত্বের এই সূক্ষ্ম ও জটিল উপধারাগুলো উপলব্ধি করার মতো সূক্ষ্মতর বুদ্ধি উচ্চশিক্ষিত গোপালের থাকলেও তা এখন কাজ করে না।

ইতিমধ্যে মা একদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে বউয়ের শাড়ি গলায় পেঁচিয়ে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেও চরম ব্যর্থ হয়েছেন। বাইরে থেকে গোপাল দরজায় দমাদ্দম লাথি মারতে থাকে আর চিৎকার করতে থাকে, ‘বাঁচাও বাঁচাও’। পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা দৌড়ে আসে, আশেপাশের বাড়ির লোকেরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। সকলের ঠেলাঠেলি, লাথালাথিতে দরজা ভেঙে যায়। দেখা যায় গোপালের মা গলায় গোপালের বউয়ের শাড়ি বেঁধে ‘অজ্ঞান’ অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। ‘মা মা’ বলে ককিয়ে চিৎকার করে ওঠে গোপাল। সকলে মিলে কেউ ফ্রিজ থেকে, কেউ বাথরুম থেকে জল এনে মায়ের চোখে মুখে ঝাপটা মারতে থাকে। আস্তে আস্তে জ্ঞান ফেরে মায়ের।

পালটা হিসেবে পরের দিনই বউ কেরোসিন তেলের জ্যারিকেন খুলে সারা গায়ে ঢেলে আগুন লাগাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও চরম ব্যর্থ হয়। পরপর চারচারটে দেশলাই কাঠি জ্বেলেও শাড়িতে ঠেকাবার আগেই নিভে যায়। এই বিশাল পরিমাণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে গোপাল ছাড়ে না। দৌড়ে গিয়ে ছোঁ মেরে দেশলাই কেড়ে নিয়ে সে যাত্রা বউ ও নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়। বলাবাহুল্য এ দুটো ঘটনাই বাড়িতে গোপালের উপস্থিতিতে ঘটেছিল। মন্দজনে বলাবলি করে দুটোই নাকি চিৎপুরের কোনও এক হিট যাত্রা পালার অংশ থেকে ধার নেওয়া।

গোপাল দিনরাত আতঙ্কে থাকে, এই বুঝি কিছু একটা হয়ে গেল। এই বুঝি মা আবার ঝুলে পড়ল, এই বুঝি বউ নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিল। অফিসে কাজে মন দিতে পারে না, ক্লাবে আড্ডা দিতে যেতে পারে না, না জানি বাড়ি গিয়ে কী দেখবে! ঘনঘন মোবাইল চেক করে, কোনও দুঃসংবাদ এল কিনা। মনে শান্তি নেই, চোখে ঘুম নেই, কাজে মন নেই। চব্বিশ ঘণ্টা তাকে একটাই আতঙ্ক তাড়া করে বেড়ায়– এই বুঝি, এই বুঝি… মনে মনে সে দুজনের যে-কোনও একজনের মৃত্যু কামনা করে– মা অথবা বউ, বউ অথবা মা, যে-কোনও একজনকে যেতেই হবে, তা না-হলে সে নিজে বাঁচবে না। অথচ দুজনের কেউ একজন আত্মহত্যা করেছে ভাবলেই সে শিউরে ওঠে, কী অস্বাভাবিক অন্তর্দ্বন্দ্ব! এক এক সময় ভাবে, দরকার নেই দুজনের কাউকেই, দুজনেই চরম স্বার্থপর, যে যার নিজেরটাই শুধু বোঝে, তার কথা কেউ ভাবে না, ভাবলে এই রকম আচরণ করত না। কেউ তাকে ভালোবাসে না।

গোপাল ঠিক বুঝতে পারে না কার দোষ। মায়ের কথা শুনলে মনে হয় সব দোষ বউয়ের। আবার বউয়ের সব কথা শুনলে মনে হয় যত নষ্টের গোড়া ওই মা। মা না বউ, বউ না মা, মা না বউ, বউ না মা। ওঃ, গোপাল আর পারে না, ও কি পাগল হয়ে যাবে? এখন ও সবসময় ভাবে, কেন যে মরতে বিয়ে করতে গেলাম!

বন্ধুরা অনেকেই বলে, ‘গোপাল, শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়া নিত্যসত্য, জীবনের অঙ্গ, আমাদের জীবনেও আছে বা ছিল, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ কেউবা বলে, ‘যদি সত্যিই বাঁচতে চাস তবে বউকে নিয়ে আলাদা হয়ে যা। কিন্তু বউকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেলে বৃদ্ধা মাকে দেখবে কে? বাবা মারা গেছেন মায়ের কোলে আড়াই বছরের গোপালকে রেখে। তারপর থেকে মা-ই বাবা, মা-ই মা।

জ্ঞানবয়সে বাবার স্বাদ পায়নি গোপাল। বাবা কি জিনিস সে জানে না। স্কুলে বন্ধুবান্ধবদের কাছে যখন তাদের বাবাদের গল্প শুনত, তখন ওর খুব দুঃখ হতো। ওদের বাবারা অফিস থেকে ফেরবার সময় টফি, চকোলেট, ক্যাডবেরি, আইসক্রিম, নতুন নতুন খেলনা নিয়ে আসে। অফিস থেকে ফিরে কত আদর করে বাবারা। ছুটির দিনে ওদের সঙ্গে ফুটবল, ক্রিকেট খেলে। কার বাবা কাকে কত ভালোবাসে এই নিয়ে ওর বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। গোপাল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত সেই দিকে। ওর শিশুমন কল্পনা করার চেষ্টা করত ফোটোর বাবা অফিস থেকে ফিরে জামাকাপড় না ছেড়েই ওকে কোলে তুলে নিল। চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিল ওর মুখচোখ। তারপর পকেট থেকে বার করল মুঠো মুঠো চকোলেট, লজেন্স, ক্যাডবেরি।

ছোটোবেলায় গোপাল প্রায়ই স্বপ্ন দেখত বাবা ওকে পার্কে বেড়াতে নিয়ে গেছে। নাগরদোলা চড়াচ্ছে, ওকে ওপরে ছুড়ে দিয়ে লুফছে, ওর সঙ্গে ফুটবল, ক্রিকেট, লুকোচুরি খেলছে, ওকে বকছে, শাসন করছে, পড়াচ্ছে। সকালে ঘুম ভাঙার পর বাবার ওপর ওর খুব রাগ, অভিমান হতো। বাবা কেন ওকে ফেলে, মাকে ফেলে ‘তারা’ হয়ে গেল, বাবা খুব দুষ্টু!

বাবার অকাল মৃত্যুর পর মা-ই ওদের তিন ভাইবোনকে অতিকষ্টে মানুষ করেছে, লেখাপড়া শিখিয়েছে। সমাজে পরিচয় দেবার মতো করে তৈরি করেছে। বাবা বেসরকারি অফিসে চাকরি করতেন। তাই বাবার অফিসে অনেক চেষ্টা করেও মায়ের কোনও চাকরি হয়নি। তবে অফিসেরই কেউ কেউ বাঁকা পথে চাকরি পেতে সাহায্য করার বদলে টাকাপয়সা এবং আরও অনেক কিছুই চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কয়েকটা টিউশনি আর রান্নার কাজ ধরে মা নড়বড়ে সংসারটাকে কোনওরকমে দাঁড় করায়।

মা যে লোকের বাড়ি রান্নার কাজ করত তা মা কাউকে কোনওদিন বলত না। বাড়িতেও কেউ জানত না, গোপালও না। ‘পড়াতে যাচ্ছি’ বলে গোপালের মা বাড়ি থেকে বেরোত। একদিন গোপালের মামা হঠাৎ অফিস থেকে গোপালদের বাড়িতে এসে হাজির। মামার বাড়ির দাদুর খুব শরীর খারাপ, দাদুর ইচ্ছা এখনই মাকে নিয়ে যেতে হবে। তাই মামা নিজেই এসে হাজির। গোপালকে পাঠানো হল মায়ের ছাত্রীর বাড়ি। সেখানে গিয়ে গোপাল শুনল, ‘তোর মা রান্না করে চলে গেছে’। গোপাল ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল মা ভালো রান্না করতে পারে বলে হয়তো আবদার করে মাকে দিয়ে কিছু রান্না করিয়ে নিয়েছে। পরে একদিন মাকে জিজ্ঞেস করাতে মা ওর মুখে হাত দিয়ে চেপে ধরেছিল। বলেছিল, ‘আর কাউকে ওসব কথা কোনওদিন বলিসনি’। নাঃ, গোপাল আর কোনওদিন ও কথা মুখেও আনেনি। বাড়িতেও কাউকে বলেনি। যদিও কথাটার অন্তর্নিহিত অর্থের মাথামুন্ডু সে তখন কিছুই বোঝেনি।

সেই মাকে একা অসহায় ভাবে ফেলে রেখে সে কেমন করে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সুখের সন্ধানে ফ্ল্যাট কিনে চলে যাবে?

ঘাড়টা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। জিভটা মাকালীর মতো আধফুটের মতো বেরিয়ে এসেছে। চোখদুটো কোটর ঠেলে প্রায় বাইরে বেরিয়ে এসেছে। যেন ড্যাবডেবিয়ে গোপালের দিকেই তাকিয়ে আছে, বলছে, তুমিই, হ্যাঁ হ্যাঁ তুমিই দায়ী। বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। এটা মফসসল এলাকা। এখানে কেউ খুন হলে বা আত্মহত্যা করলে এখনও জমাট ভিড় হয়। সবাই ফিসফিসিয়ে গোপালের বউ সীমার আত্মহত্যার সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করছে। এরকম একটা পরিণতির ধারণা যে অনেকের মধ্যেই ছিল তার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এরই মধ্যে হুড়মুড়িয়ে পুলিশ এসে হাজির।

আচমকাই গোপালের ঘুমটা ভেঙে যায়। এই শীতেও তার সারা শরীরে ঘামের স্রোত বয়ে যায়। ও ভাবে, ওঃ সীমা তাহলে আত্মহত্যা করেনি। বিছানায় শুয়ে শুয়েই ও ভাবতে চেষ্টা করে, এটা সত্যিই স্বপ্ন তো!

এর আগেও একদিন গোপাল স্বপ্ন দেখেছে ওর মা বিষ খেয়ে হ্যাঁচোড়প্যাচোড় করছে আর পাড়া মাথায় করে চ্যাঁচাচ্ছে, ‘গোপাল আমি বিষ খেয়েছি, আমি চললাম, তুই বউকে নিয়ে সুখে থাকিস।’

গোপাল, ‘আর হবে না মা, আর কখনও হবে না, এবারের মতো ক্ষমা করে দাও’ বলে কান্নাকাটি করছে। হঠাৎ মা দুম করে মাটিতে পড়ে গেল আর চমকে উঠে গোপালেরও ঘুম ভেঙে গেল।

গোপাল নিখোঁজ। আগের দিন রাতে মা-বউতে তুলকালাম হয়েছে। মুখের সীমান্ত পেরিয়ে গতকাল যুযুধান দুইপক্ষে তুমুল হাতাহাতি হল। শেষ পর্যন্ত তা রক্তারক্তিতে গড়াল। শাশুড়ি গ্যাস আভেনে রুটি সেঁকতে সেঁকতে গরম খুন্তি দিয়ে বউকে ঘা কতক দিতেই বউ মড়াকান্না জুড়ে দিয়ে শাশুড়ির মাথায় সাঁড়াশির বাড়ি দমাদ্দম লাগিয়ে দিল। দুপক্ষই রক্তারক্তি। প্রবল চিৎকার চ্যাঁচামেচিতেও পাড়ার কেউ এল না। কারণ এটা এ বাড়ির নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। দুর্গাপুজোয় ভিড় হয়, ট্রাফিক জ্যাম হয়, নিত্যপুজোয় ওসব কিছু হয় না। রাতবিরেতে ডাক্তার, হাসপাতাল সবই হল। হাতে, মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে দুপক্ষ মাঝরাতে বাড়ি ফিরল।

স্বভাবতই পরের দিন শাশুড়ি, বউ উভয়েরই ঘুম ভাঙল বেশ দেরিতে। উঠে দেখল, গোপাল নেই। ভাবল, হয়তো দোকান বাজার গেছে, এখনই ফিরবে। কিন্তু বেলা গড়ায়, গোপালের দেখা নেই। ভাবল, রাগ করে বেরিয়ে গেছে, রাগ পড়লেই ফিরে আসবে। সকাল গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে, সন্ধে গড়িয়ে রাত হল, কিন্তু গোপালের দেখা নেই। খবরটা সারা পাড়া ছড়িয়ে পড়েছে। গোপালের শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত খবর পৌঁছে গেছে। বন্ধুবান্ধব, পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে তন্নতন্ন করে খোঁজ করে গোপালের। কিন্তু না, কোনও হদিশই নেই।

– গোপাল কি মা-বউয়ের ওপর রাগ করে বিবাগি হয়ে গেল?

– গোপাল কি বাড়িতে দিনরাত অশান্তির জেরে দু-চার দিনের জন্য কোথাও আত্মগোপন করল?

গোপালের অন্তর্ধানে কিন্তু বাড়ির অশান্তি থেমে থাকল না, বরং তা অন্য মাত্রা নিল। মা-বউকে বলল, ‘তুই আমার ছেলেকে খেয়েছিস!’ আর বউ মাকে বলল, ‘তোর জন্যই ও বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।’

তিন দিনের দিন– আশেপাশের এলাকা দুর্গন্ধে ভরে যায়। মানুষজন নাকে রুমাল দিয়ে হাঁটতে থাকে, ভাবে বেড়াল বা রাস্তার কুকুর মরেছে। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে দুর্গন্ধের তীব্রতা। পুলিশ আসে। গোপালের বাড়ির উলটোদিকে একটা পরিত্যক্ত কারখানা থেকে উদ্ধার হয় গোপালের পচাগলা ঝুলন্ত দেহ।

‘বউকে দুলাখ টাকা দিয়ে গেলাম। টাকাটা কো-অপারেটিভ ব্যাংকে আছে। বউ যেন টাকাটা পায়। মা, তুমি আমাকে ক্ষমা কোরো। তোমাকে খুব ভালোবাসি। দিদিকে, বোনকেও খুব ভালোবাসি। সবাইকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বাঁচার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারলাম না, হেরে গেলাম। পুলিশ যেন কাউকে না ধরে। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।’ পরের দিন বালিশের ওয়াড়ের ভেতর থেকে উদ্ধার হল গোপালের সুইসাইড নোট।

গোপালের বাড়িতে এখন চরম ‘শান্তি’ বিরাজ করছে। গোপাল তো এটাই চেয়েছিল! তাই না?

 

টিরিং

চল ফুলি, তোর নামে ব্যাংক-এ একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিই। তোর ভালো নামটা কীরে?

মেয়েটা লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলেছিল ফুলেশ্বরী।

– ফুলেশ্বরী? কী সুন্দর নামটা রে তোর। তোকে নিয়েই তাহলে সিনেমাটা হয়েছিল। সন্ধ্যা রায় ছিল না? স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন রজতকান্তি।

রজতকান্তির স্ত্রীর নাম চন্দ্রিমা। সায় দিলেন।

রজতকান্তি বললেন– মেয়েটা এতদিন আছে, ভালো নামটাই জানি না। ফুলি নামে ডাকি।

ফুলি বলে, না, আমার নামে ব্যাংক-এ বই খুলতে হবে না। আপনার কাছে টাকা আছে, ওটাই ঠিক আছে।

রজতকান্তি বলে, মোটেই ঠিক নেই। আমি মরে গেলে?

ধুর, খালি বাজে কথা।

মানুষ চিরকাল বাঁচে নাকি? একবার তো হার্ট অ্যাটাক হয়েই গেল। তোর সব টাকা তোর অ্যাকাউন্ট-এ রেখে দেব।

কিন্তু অ্যাড্রেস প্রুফ? আইডেনটিটি প্রুফ? ওর তো ভোটার কার্ডই নেই। গত ভোটের আগে একবার ভোটার কার্ড করার চেষ্টা করেছিলেন রজতকান্তি, হয়নি। ওরা চেয়েছিল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, পাসপোর্ট, প্যান কার্ড এসব কত কিছু।

তোর রেশন কার্ড আছে না একটা?

জানি না।

জানি না মানে? ছিল তো নিশ্চয়ই।

ঠোঁট উলটে ফুলি মাথা নাড়ায়। মানে জানে না।

তার মানে ফুলির ভারতের নাগরিকত্বের কোনও প্রমাণ নেই।

ফুলি কবে থেকে এখানে? মামণি যখন মাধ্যমিক দিল। ফুলির মা বলেছিল, মেয়েটাকে আপনারা রাখুন। বারো বছর বয়স হ’ল ওর। ওর উপর কুনজর পড়েছে। সকালে চলে আসি, ঘরে একা থাকে মেয়ে। ওকে খাওয়া পরায় রেখে দিন। তার মানে বারো বছর হয়ে গেল এ বাড়িতে।

আগেকার সময় হলে চেষ্টা চরিত্র করে একটা রেশন কার্ড করে নেওয়া যেত। এখন শহুরে মধ্যবিত্তরা রেশন-এর চাল খায় না। রেশন দোকান থেকে গম নিয়ে চাকিতে দিয়ে আটা ভাঙানোর দিনও আর নেই। এখন সবাই আটাই কেনে। রেশন-এর দোকানে আজকাল মুদি দোকানের মতোই মশলা, সাবান, এমনকি প্রসাধন সামগ্রীও বিক্রি হয়। রজতদেরও রেশন কার্ড আছে। মাসে একবার গিয়ে যা হোক কিছু নিয়ে আসা হয়। রেশন কার্ড করাতে গেলে বলবে আগের কার্ডখানা নিয়ে আসুন, যদি বলা হয় আগে কার্ড ছিল না– তখন বলবে এত বছর বয়সেও কার্ড নেই? ঠিকানার প্রমাণ, বয়সের প্রমাণ, ভোটার কার্ড…। ফুলির তো কিচ্ছু নেই। এই যে চব্বিশটা বছর ধরে পৃথিবীতে রয়েছে, তার কোনও প্রমাণ নেই। ফুলিকে কেউ চিঠিও দেয় না।

দেশের বাড়িতে ফুলি ক্লাস ফাইভ অবধি পড়েছিল। এ বাড়িতে আসার পর চন্দ্রিমা মাঝেমধ্যে পড়াতে বসত। দোকানের নাম পড়তে পারে, মুদির হিসেব পড়তে পারে, টিভির সিরিয়ালগুলোর নাম পড়তেও অসুবিধে হয় না তার– এমনকী যুক্তাক্ষর দিয়ে লেখা কঠিন কঠিন নাম যেমন স্বয়ংসিদ্ধা, অগ্নিপরীক্ষা এসবও পড়তে পারে। ওকে কেউ চিঠি দিলে, ও পড়তে পারবে। উত্তরও দিতে পারবে। একদিন বলেছিল দিদিকে। দিদি মানে এ বাড়ির মেয়ে। রজত-চন্দ্রিমা ওকে মামণি ডাকে, ওর আসল নামটা খুব কঠিন, মন্দাক্রান্তা। মামণি তো আদরের ডাক। ফুলি তো সেটা বলতে পারে না, আবার মন্দাক্রান্তাকে ছোটো করে মন্দ দিদি বলা যায় নাকি? জেঠিমা-ই বলে দিয়েছে মিষ্টি দিদি ডাকতে। ফুলি একদিন বলেছিল ও মিষ্টি দিদি, আমাকে একটা চিঠি দেবে?

কী চিঠি?

এমনি চিঠি। আমার নামে আসবে বেশ…

কী লিখব?

যা খুশি…।

তার চে বরং তোকে একটা মেল আইডি বানিয়ে দিচ্ছি, চ্যাট করবি বেশ।

আসলে পাত্তাই দেয়নি।

ঝন্টুদাকে ও বলেছিল একটা চিঠি দেবেন আমাকে? এমনি চিঠি।

ঝন্টুদা দিয়েছিল।

রজতকান্তি বলেছিল ফুলি, তোর নামে আলাদা পাসবই বোধহয় হবে না, আমি তোর টাকাটা আমার নামেই রাখছি, তোকে নমিনি করে দিচ্ছি, আমার কিছু হয়ে গেলে তুই সেটা পাবি। আমার নামে হলেও ওটা তোরই টাকা। তোর মা বলেছিল খাওয়া-পরায় রাখতে। আমি কিন্তু তোকে মাইনেও দিচ্ছি। হিসেব করে দেখলাম তোর তিরিশ হাজার টাকার উপর পাওনা হয়ে গেছে। বলে রাখলাম এগুলো তোর টাকা। তুই এখন তিরিশ হাজার টাকার মালিক। এই টাকায় আমি হাত দেব না। তোর যা খুশি, যেভাবে ইচ্ছে খরচ করবি। তোর বিয়েতেও এই টাকা খরচ করব না ফুলি। তোর বিয়ের খরচ আমাদের। মামণির বিয়েটা মিটে যাক, তারপর তোর জন্য পাত্র দেখা শুরু করব। তোকে বিয়ে দিয়ে আমরা দুজন কোনও বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাব।

মিষ্টি দিদির বিয়েটা ঠিক হয়ে গেছে। ঠিক হয়ে গেছে মানে দিনটা। বিয়েটা তো আগেই ঠিক ছিল। মিষ্টি দিদির বরকে তো ফুলি কবে থেকেই চেনে। পার্থদা। এ বাড়িতে আসে। মিষ্টিদির ঘরে বসে গল্প করে। তখন ওঘরে কেউ যায় না। ঘরের বাইরে থেকে জিজ্ঞাসা করে, এবার চা দিয়ে যাব? কখনও মিষ্টি দিদি নিজে এসে চা আর জলখাবার নিয়ে যায়। খুব বড়ো চাকরি করে পার্থদা। মিষ্টিদিও তো চাকরি করে। কম্পুটারি চাকরি। পরশু দিন বিয়ে। বাড়ি রং করা হয়েছে। ইলেকট্রিকের কাজ করা হয়েছে, বাড়িতে অনেক লাইট লাগানো হয়েছে। ছাদেও লাইটের ব্যবস্থা হয়েছে। বিয়েটা এবাড়িতে হবে না। বিয়েবাড়ি ঠিক করা হয়েছে। কাল থেকেই লোকজন আসবে। মামা-মামি আসবে। দু’জন কাকু আসবে। ওরা সবাই মিষ্টি দিদির মামা-মামি। মিষ্টি দিদির কাকা-কাকু। ফুলিরও। ফুলির কে আছে? কেউ নেই। মা মরে গেছে, ব্যস, হয়ে গেল। কেউ নেই। শুধু ঝন্টুদা আছে।

ঝন্টুদা এবাড়ির সব ইলেকট্রিক-এর কাজকর্ম করে। ফ্যান খটখট, টিউব লাইটে ভোঁ ভোঁ, গিজার খারাপ– সব ঝন্টুদা করে। ফোন করে দিলেই চলে আসে। ঝন্টুদাকে চা করে দেয় ফুলি। চায়ে চুমুক দিতে দিতে মিটিমিটি তাকায় ফুলির দিকে।

ঝন্টুদা প্রথম আদর করেছিল ছাদে। সরস্বতী পুজোর প্যান্ডেল করার সময়। পুজোর আগের দিন। বাড়িতে সরস্বতী পুজো হয়। ছাদে ছোটো করে প্যান্ডেল হয়। খিচুড়ি হয়। দিদিমণির বইপত্তর আর ল্যাপটপ না কি যেন বলে, সেটা রাখে। ওখানে ফুল চন্দন পড়ে। পাড়ার অনেকে আসে। আদরের সময় ফুলি বলেছিল– এমা, এখানে না, ঠাকুর দেখে ফেলছে। ঝুন্টদা বলেছিল ঠাকুরের এখন চোখ ঢাকা। কেউ ছিল না ছাদে। বাড়ির পাম্পের কাজ করতেও ছাদে যেতে হয়। চৌবাচ্চায় ওঠার মই ধরতে হয় ফুলিকে। পাম্পটা তো প্রায়ই খারাপ হয়। ঝন্টুদা বলে পাম্পটা কি ভালো বল, তোকে আর আমায় ছাদে এনে দেয়।

ঝন্টু ফুলির কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল-এ বাড়ির কে কোথায় শোয়। দোতলায় তিনটে ঘর। একটা ঘরে মিষ্টি দিদি। একটা ঘরে জ্যাঠা-জেঠি আর একটা ঠাকুরঘর।

একতলায় রান্না খাওয়া। একটা ড্রইংরুম। কেন যে ড্রইংরুম বলে কে জানে। ওখানে কোনও ড্রইং হয় না। ওখানে গদিওলা চেয়ার আছে। একটা টিভিও আছে। আর একটা ঘরে ফুলি থাকে। ফুলির ভয় করে না। ওর নীচে থাকতেই ভালোলাগে। বারবার দরজা খোলা-বন্ধ করা ফুলিকেই তো করতে হয়।

ঝন্টুদা বলেছিল ফুলি, তুই দারুণ। খুব মিষ্টি। তোকে ছুঁলে আমার গায়ে ইলকট্রিক শট্ লাগে। তোর লাগে? ফুলি মাথা নীচু করে বলেছিল দুষ্টু কোথাকার। এটা কিন্তু ওর নয়, হাসিরাশি সিরিয়ালের হাসির ডায়লগ। ঝন্টুদা বলেছিল তোকে আমি একদিন অনেকটা পেতে চাই। অনেকক্ষণ ধরে।

ওমা! সেকি কথা। নানা… এটা কোনও সিরিয়ালের নয়, ফুলির নিজের।

ঝন্টুদা বলেছিল– না করিস না ফুলি। তোকে আমি স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নে আদর করি। আমার বোনটাকে বিয়ে দিয়ে তোকে আমি বিয়ে করে তোর সঙ্গে সংসার করব। তোর কেউ নেই, আমারও কেউ নেই। একদিন ফুলি, আমি রাতে তোর ঘরের জানালায় টোকা দেব…।

না– এমন কথা বলে না, বলে পালিয়ে গিয়েছিল ফুলি সেদিন।

তারপর ঝন্টুর ওই কথাগুলো তোলপাড় করেছে ফুলিকে। স্বপ্ন। স্বপ্নে স্ক্রু, নাটবল্টু আর তারের মালা জড়ানো ঝন্টুদা বলছে সংসার! সংসার।

পার্থদা আর মিষ্টি দিদি যে একসঙ্গে থেকেছে! পর্দা ফেলা, কখনও দরজা বন্ধ। তার বেলা?

এখন না হয় বিয়ে হবে। কিন্তু এর আগেও তো কতদিন…

রাস্তায় দেখা হতে ঝন্টুদা বলল, কিরে ফুলি। কতদিন দেখি না। তোদের বাড়ির কিছু খারাপও হচ্ছে না দেখছি। তোকে না দেখে আমার তো মেনসুইচ খারাপ হয়ে গেল। ফুলি, মাইরি বলছি, তোকে যেদিন ফার্স্ট দেখেছিলাম না, আমার ফিউজ উড়ে গিয়েছিল। প্লিজ মাইরি, একদিন ব্যবস্থা কর। আমি তোর ঘরে আজ রাতে টোকা দেব।

ফুলি বলেছিল– না-না, টোকা নয়, টোকা নয়, কেউ শুনে ফেলবে।

ঝন্টু বলেছিল– তুই তো বলেছিলি তোর জ্যাঠা-জেঠি দশটার সময় শুয়ে পড়ে। দিদি মনে কানে ছিপি গুঁজে কম্পুটারি করে। কে শুনবে?

ফুলি বলেছিল– না না, টোকা দেওয়া খুব খারাপ। শুনে ফেলবে।

ঝন্টু বলেছিল তাহলে সাইকেলের বেল বাজাব। টিরিং। রাস্তায় তো সাইকেল চলতেই পারে। আজ ঠিক রাত সাড়ে এগারোটায় টিরিং, কেমন!

রাত্রে টিরিং। ঝন্টুদার হাতে একটা সাইকেল বেল। খুব আস্তে দরজা খুলে গেল। ফুলির ঘরে ঝন্টু। ঝন্টু বলেছিল কোনও ভয় নেই ডার্লিং, সব ব্যবস্থা নিয়ে এসেছি।

ঝন্টুদা এক ঘণ্টা বাদে চলে গিয়েছিল। রাস্তার আলোয় তখন শ্যামাপোকা, কার্তিকের কুয়াশা। নিমগাছের পাতায় পাতায় – না যেও না… রজনীর তখনও বাকি।

এরকম টিরিং হয়ে গেছে আট দশ বার। প্রতিবারই ফুলি ঝন্টুর কানে ফিসফিস করে বলেছে আর নয় কেমন, বিয়ের পরে আবার।

একমাসের উপর কোনও টিরিং হয়নি। আজ হ’ল। হ’তে পারে এটা সত্যিসত্যি সাইকেলের টিরিং। কান খাড়া করে শুনল। চলমান সাইকেলের একটা আলাদা টিরিং ধবনি থাকে। রাত্রির অন্ধকারে আবার ছোট্ট একটা টিরিং।

দু’দিন পর বিয়ে। মেয়ে চলে যাবে। বড়িতে এখন এসব ঠিক নয়। তাছাড়া বাড়িতে এ সময়ে ঘুম কমে যায়। কাল সকালেও এসেছিল ঝন্টুদা। ছাদে লাইট লাগাতে। কোনও কথা হয়নি। কিচ্ছু বলেনি ঝন্টুদা। যাবার সময় শুধু বলে গেল ছাদের দরজাটা বড্ড পলকা জ্যাঠামশাই, ঠিক করিয়ে নেবেন। জ্যাঠামশাই বলেছিলেন মিস্তিরিগুলোর বড্ড ডাঁট বেড়েছে। বললে আসে না। একটা মিস্তিরি পাঠিয়ে দিও কাল। দেখছি, বলে চলে গেল। একটি বারের জন্যও ফুলির দিকে তাকাল না। অভিমান হয়েছিল। একমাস হয়ে গেল বলে ঝন্টুদার খুব কষ্ট হচ্ছে।

আস্তে আস্তে দরজার ছিটকিনিটা খুলল ফুলি।

ছিটকিনি খুলতেই একজন লোক ফুলির মুখ চেপে ধরল। অন্য একজন ফুলির দুটো হাত পিছনে নিয়ে বেঁধে দিল। মুখের উপর আঠালো কী একটা জিনিস চেপে দিল। তারপর একটা কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে দিল। একজন ফুলির মুখটা খামছে ধরল। গলাটাও। বুকের কাছেও হাত দিয়ে খামচে দিল। বলল চুপ করে এখানে দাঁড়িয়ে থাক।

ফুলি উপরে উঠে যাবার পায়ের শব্দ শুনল।

ফুলির তো পা বাঁধা ছিল না। ফুলি উপরে উঠতে গেল ওদের পেছন পেছন। একজন ওকে ধাক্বা দিয়ে ফেলে দিল। ফুলি দেখল ওরা চারজন। না। ওদের মধ্যে ঝন্টুদা ছিল না।

ফুলি উপরে গেল না। নীচে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পরই দরজা ধাক্বানোর শব্দ শুনল। একটা প্রচন্ড আওয়াজ যেন কিছু ভেঙে পড়ল। জেঠিমার গলার আওয়াজ শুনল– কী? কী হয়েছে রে ফুলি?

ফুলি শুনল– একটা পুরুষ কণ্ঠ– কোনও আওয়াজ করবেন না। একদম চুপচাপ। চ্যাঁচামিচি করলে আপনার মেয়েকে রেপ করব সবাই মিলে। চাবিটা দিন।

পাঁচ মিনিটও নয়। ওরা চলে গেল। একজন বলে গেল– আমরা ছাদের পলকা দরজাটা ভেঙে ফেলেছি। পুলিশ এলে বলবি ছাদের দরজা ভেঙে ঢুকেছিলাম আমরা। তুই দরজা খুলেছিস বললে ফেঁসে যাবি। ওদের হাতে একটা লাল ব্যাগ আর একটা কালো ব্যাগ। আর কিচ্ছু নেই।

ওরা চারজন চলে গেল। ওদের মধ্যে ঝন্টুদা ছিল না।

ফুলি উপরে উঠল। ঘরে আলো জ্বলছে। আলমারির দরজা হাট করে খোলা। আলমারির ভিতরে লকারের খোপটাও খোলা। খাটের উপর বসে আছে জ্যাঠামশাই, মুখের উপর সাদা রঙের কী একটা আটকানো, মুখ থেকে অদ্ভুত কিছু আওয়াজ বের হচ্ছে। ফুলিও চিৎকার করছে, কোনও আওয়াজ পাচ্ছে না। জ্যাঠামশাইয়ের হাত পিছনে বাঁধা। জেঠিমাকে দেখতে পাচ্ছে না। বাথরুম থেকে দরজা ধাক্বা দেবার শব্দ। পাশের ঘর থেকেও দরজা ধাক্বানোর শব্দ। ফুলি দেখল দিদিমণির ঘর এবং বাথরুমের বাইরের ছিটকিনি বন্ধ। ফুলি ওর বাঁধা হাত দিয়ে পিছন ফিরে বাথরুমের দরজাটা খুলে দিতে পারে। জেঠিমা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমেই বলল মামণি কোথায়, মামণির কিছু হয়নি তো? জেঠিমা দিদিমণির ঘর থেকে দরজা ধাক্বানোর শব্দ পায়। বাইরে থেকে লাগানো দরজাটার ছিটকিনি খুলে দেয়। দিদিমণিও বেরিয়ে আসে। ওর বাবার মুখের আঠা লাগানো সাদা জিনিস খুলে দেয়। জ্যাঠামশাই এতক্ষণ ধরে কিছু বলার চেষ্টা করছিল। ওটা খুলে দেবার পর শব্দহীন ফুলির মুখটাও খোলা হল। কান্না এল দলা দলা।

পিছনে বাঁধা হাতটা কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করছে।

কী হয়েছিল বল?

ফুলিকে জিজ্ঞাসা করল মন্দাক্রান্তা।

আমি জানি না, আমি জানি না…। ও নিজের মুখটা ঢাকতে চায়, কিন্তু হাত বাঁধা।

পুলিশ বলল যে-মেয়েটা আপনাদের কাছে থাকে, ওর ভোটার কার্ড আছে?

রজতকান্তি মাথা নাড়ায়।

এনি অ্যাড্রেস প্রুফ?

মাথা নাড়ায় রজতকান্তি।

মেয়েটা কে তবে?

মেয়েটা ভালো। এর মা এখানে কাজ করত। মা মরা মেয়ে…

ফুলি শুনছে ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

পুলিশ বলছে– লকার থেকে গয়না তুলে এনেছেন এটা আর কে জানত?

আমি, আমার স্ত্রী আর মেয়ে।

ওই মেয়েটা?

ও কী করে জানবে?

যারা চুরি করেছে ওরা তো জানত। চিন্তা করে দেখুন কখনও মেয়েটাকে বলেছেন কিনা।

না। বলিনি।

ক’জন ছিল?

চারজন। নাকি আরও বেশি…

কীভাবে এল?

ছাদের দরজা ভেঙে।

দরজা ভাঙার শব্দ পেয়েছিলেন?

পেয়েছিলাম।

মেয়েটা কোথায় ছিল তখন?

মেয়েটা বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল। ওর গলায় ঘাড়ে নখের আঁচড়। ভাগ্যিস আর কিছু করেনি।

আপনার মেয়েকে কিছু করেনি তো? গায়ে-টায়ে…

না-না-না, আমার মেয়ের গায়ে ওরা হাত দেয়নি। একদম হাত দেয়নি। আমার মেয়ে যে-ঘরে শোয় সেই ঘরের দরজাটা প্রথমেই ওরা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছিল। আমার মেয়ে আনটাচড, আমার মেয়ে আনটাচড।

মেয়েটাকে ডাকুন। পুলিশ অফিসার বলে।

ফুলির বুকের ভিতরে কীরকম বিচ্ছিরি টিরিং টিরিং টিরিং। ওর বুকের ভিতরের শিরাগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। ছলাৎ ছলাৎ রক্ত ছিলিক দিচ্ছে প্রতিটি টিরিং, তার চেয়ে আমাকে রেপ করে মেরে ফেললেই তো পারত ঝন্টুদা। আমাকে বলতে হবে পৃথিবীতে কোনও টিরিং নেই। কোনও টিরিং হয়নি কখনও। কোনও টিরিং শুনিনি জীবনে। আমাকে দেখাতে হবে আমার গলার, আমার ঘাড়ের, বুকে লেগে থাকা নখের আঁচড়। বাধা দেওয়ার প্রমাণ। প্রমাণ রেখে গেছ, ঝন্টুদা কত দয়া তোমার। ভুল ভাবছি, ভুল। ঝন্টুদা ছিল না। উপরে কাঠের দরজাটাও ভেঙে দিয়ে গেছে। তোমরা তো উপর থেকেই এসেছিলে। দরজা ভেঙে। দরজাটা তো পলকাই ছিল। ছিটকিনিও পুরোনো। ঝন্টুদা, তুমি তো আগেই বলে দিয়েছিলে– দরজাটা ভালো নেই।

ফুলি… কোথায় রে তুই… পুলিশ সাহেব ডাকছেন। যা দেখেছিস বলবি…।

পুলিশের গলা শোনা যায়– এখন এই মেয়েটা নয়। আপনার মেয়েকে ডাকুন। এক এক করে সবাইকে জিজ্ঞাসা করব। আপনারা বাইরে যান। একদম বাইরে। যখন বেল বাজাব এক জন করে আসবেন, দরজা বন্ধ থাকবে।

বন্ধ দরজার এপারে খাবার টেবিলে বসে আছে ওরা। ড্রইংরুমে পুলিশের দুজন লোক। দিদিমণি ভিতরে গেল। দরজা বন্ধ। বাইরের টেবিলে এক বৃদ্ধ, এক বৃদ্ধা এবং মেয়েটা।

ফুলি দেখল ওরা দুজন ফুলির দিকে তাকিয়ে আছে।

ফুলি বলল কী হবে জ্যেঠু?

রজতকান্তি বলল, কী আর হবে? আরও কত খারাপ হতে পারত। ভগবানের দয়ায় আমাদের মেয়ে দুটো বেঁচে গেছে। গয়না না হয় গেছে। গয়না ছাড়াই বিয়ে দেব…।

ফুলি বলল আপনি যে বলেছিলেন, আমার টাকা আছে আপনার কাছে, ওই টাকা দিয়ে মিষ্টি দিদির গয়না কিনে নিন।

ওতে আর কী গয়না হবে? সেসব তোকে ভাবতে হবে না।

জেঠিমা বলল– পুলিশের ঝামেলা এখন না করলেই হতো। এখনই তো লোকজন আসবে।

তারপর আর কোনও কথা নেই ঘরে।

এতক্ষণ কী জিজ্ঞাসা করছে পুলিশ? রজতকান্তি স্বগতোক্তি করে। তারপর আবার নিশ্চুপ সবাই। চেনালোকই এর পিছনে আছে। যারা সব জানে। ছাদের দরজাটা যে পলকা সেটাও তো জানে। কে হতে পারে ফুলি? ঝন্টু?

জোরে মাথা নাড়ায় ফুলি।

ঝন্টুদা, তোমার চিঠিটা সকালবেলায় বাথরুমে নিয়ে গিয়েছিলাম। যেসব ভালোবাসার কথা লিখেছিলে, সব কুচি কুচি করে ছিঁড়েছি, তারপর পায়খানার প্যানে ফেলে দিয়ে জল ঢেলে দিয়েছি। আমি তো জানি, তুমি ছাড়া আর কেউ টিরিং শব্দ জানে না। তুমি আর আমি। সেই টিরিং তুমি অন্যদের বলেছ। আর আমি, এই শব্দের গোলোক আমি কোথাও ভাঙবনা। এই কৌটোবন্দি শব্দের ঢাকনা কোথাও খুলব না। পুলিশ যদি মারে, তবুও না। যদি জেলে ভরে দেয়, তবুও না।

তুমি কি সত্যি সত্যি তোমার বোনের বিয়ে দেবে? বিয়েতে টাকার দরকার। জানি তো। ওর বিয়ে হয়ে গেলে যদি তুমি আমাকে চাও? আমার সঙ্গে সংসার চাও? তাহলে কী করব? কী বলব? তোমায় আমি?

দিদিমণি চলে এল।

পুলিশের কঠিন স্বর– এবার কাজের মেয়েটাকে পাঠান।

ওঘর থেকে শব্দ আসছে টিরিং… টিরিং… টিরিং…।

 

বেলাশেষের বাসনা

সত্যি, পাণ্ডুলিপিটা যে কোথায় গেল!

শুভায়ু বারবার চিন্তা করে। ওর চেন-আঁটা শান্তিনিকেতন ব্যাগটা তন্নতন্ন করে খোঁজে। সবমিলে পনেরোটা গল্পের পাণ্ডুলিপি ছিল একসঙ্গে।

সবগুলোই জেরক্স কপি। শুধুমাত্র একটাই হাতে লেখা… আর সেটাই হারিয়ে গেছে।

আসলে একটা ফাইল নেওয়া হয়নি সেটাই ভুল হয়ে গেছে। বড়ো একটা বাদামি রঙের প্যাকেট বা বড়ো খাম, তাতে ঠাসাঠাসি করে কাগজগুলি ছিল। প্যাকেটের মুখ একটা জেমস্ ক্লিপ দিয়ে আঁটা ছিল।

অথচ কী করে যে পড়ে গেল— আশ্চর্য!

শুভায়ুর একটা ইচ্ছা ছিল। বেশ পুরোনো ইচ্ছা। সেটা হল একটা গল্প সংকলন প্রকাশ করা। এটা ও অনেকদিন থেকে ভেবে আসছে।

শুভায়ু যে একজন নামকরা সাহিত্যিক, তা নয়। লেখক হিসেবে মফসসল শহরে দু-চারটে পত্রপত্রিকায় গল্প ছাপিয়ে আর আসরে এক-আধটা গল্প পাঠ করে যে বিরাট কিছু হওয়া যায় না— তা সে জানে।

তবে যাচ্ছ কেন বই ছাপাতে? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করে বসে শুভায়ু। আর উত্তরগুলো একইসঙ্গে আউড়ে যায়। আসলে ছড়ানো ছিটানো গল্পগুলোকে একত্রিত করে পাঁচজনের হাতে দেওয়া। আর এই লেখালেখির মধ্যে দিয়ে জীবনটাকে একটু কর্পূর সুবাসিত করা।

এছাড়া গতানুগতিক আটপৌরে জীবনে আর কী-ই বা করার আছে?

আরে— আসল কথাটাই বলতে ভুলেছে ও। সেটা হল ও’র অবসরপ্রাপ্ত জীবনে— জীবনবিমার সামান্য কিছু টাকা ম্যাচিওর করেছে। যেটাকে ও সংগোপনে বাড়ির খরচা থেকে খুব কৌশলে সরিয়ে রেখেছে। টাকার অঙ্কটাও সামান্য। ওই সংকলন বের করার মতোই— হাজার ষোলো টাকা। সেটাকেই ও ইদানীং ব্যাঙের আধুলির মতো সম্বল করে প্রকাশনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে পড়েছে।

এতক্ষণে শুভায়ুর মনে পড়ল – কাল ভোরে ও যখন সবকিছু গোছাচ্ছিল কলকাতা যাওয়ার প্রস্ততি হিসেবে, তখনই তৃষা মন্তব্য করেছিল, ‘দ্যাখো বাপু, সব ঠিকঠাক গোছগাছ করে নিলে তো? তোমার আবার রাস্তাঘাটে মাথার ঠিক থাকে না।’

কথাটা অবশ্য মিথ্যে বলেনি। সেদিন গোছগাছ করে ও হাওড়া লোকাল ধরেছিল… উদ্দেশ্য কলেজ স্ট্রিট-এ কোনও প্রকাশকের দ্বারস্থ হওয়া।

নতুন লেখকদের বেশিরভাগ বই-ই গ্যাঁটের পয়সা দিয়ে ছাপাতে হয়। এটাই প্রায় দস্তুর হয়ে গেছে। তবু কত রকমের বাহানা – ‘লেখাগুলোর জেরক্স কপি দিয়ে যান— পড়াব, এক্সপার্ট-দের দেখাব।’

শুভায়ু বলেছিল ‘টাকাটা তো আমার। তবে আপনাদের অতশত বাহানা বা খুঁতখুঁতানি কেন?’ প্রকাশকের গদিতে বসে ওর ছোটো ছেলে — যে সবেমাত্র গ্র্যাজুয়েশন করেছে, সে বিজ্ঞের মতো উত্তর করে, ‘খুঁতখুঁত করি কি সাধে? মালটা তো আমাদের ব্যানার-এ বেরোচ্ছে। আমাদের গুডউইল ওর সঙ্গে জড়িত থাকছে যে। তাই আমাদের একটু মাথা ঘামাতে হয় বই-কি!’

শুভায়ু মনে মনে বলে তোমাদের আবার গুডউইল বলে কিছু আছে নাকি? পয়সা— আসলে পয়সা হলেই হল। বড়ো বড়ো প্রকাশকরা পর্যন্ত নামিদামি লেখকদের সঙ্গে দু’চারটে অনামি লেখককেও এক আসনে বসাচ্ছে।

যাকগে ওসব কথা। ওর সব লেখাগুলোই রয়েছে কেবল শেষেরটা নেই— তার কোনও কপিও নেই— । বেশ ঝঞ্ঝাট হল বই-কি!

কী ব্যাপার তবে কি ফেরার পথে ট্রেনেই মিস করল? ওই ‘বাসনা বিসর্পিল নদী’ গল্পটাই হারিয়ে গেছে…

বড়ো টেন্সড ফিল করে শুভায়ু। গুনে গুনে লেখাগুলো নিয়ে গেল অথচ…

আচ্ছা প্রকাশককে ফোন করে জানলে হয় না? যদি সেখানে পড়ে থেকে থাকে—।

ব্যাপারটা প্রায় সপ্তাহখানেক হয়ে গেল আর নিশ্চয়ই ফেরত পাওয়া যাবে না। ওটা তাহলে গেল? ওই বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা যেতে পারে কিন্তু তেমনটি হবে কি?

এরই মাঝে তৃষা মন্তব্য করে, ‘অত মনমরা হলে চলবে! আবার নতুন করে লিখতে কি তোমার গায়ে জ্বর আসছে নাকি?’

শুভায়ু বলে, ‘থামো তো তুমি! হাজার হোক লেখা তো আমার সৃষ্টি। লেখা খোয়া গেলে শোক হতেই পারে। লেখা হচ্ছে আত্মজ। সন্তানের মতো… ও সব তুমি বুঝবে না!’

তৃষা উত্তর করে, ‘কী জানি ওসব বাতিক আমার নেই—তাই বুঝি না।’

এবার শুভায়ু রেগে যায়— ‘যা বোঝো না তা নিয়ে তক্বো কোরো না চুপ থাকো!’

পরের শনিবার আবার কলেজ স্ট্রিট যেতে হয়েছিল। প্রকাশক বললেন— ‘নাহ এখানে কোনও পাণ্ডুলিপি ফেলে যাননি। কী আশ্চর্য কোথায় গেল!’

ফেরার পথে বাস থেকে তাড়াতাড়ি নেমে— সাবওয়ের মুখে পৌঁছল। কিন্তু হঠাৎ একি দেখছে ও! সামনের মেয়েটি অমন করে তাকাচ্ছে কেন? একদম কাছাকাছি এসেই মেয়েটি থমকে যায়।

‘স্যার একটু দাঁড়াবেন…’ শুভায়ু থমকে যায়।

‘মনে করতে পারেন স্যার? চিনতে পারেন…’ তারপর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে।

শুভায়ু হকচকিয়ে যায়। প্রশ্ন করে, ‘কে তুমি?’

‘স্যার আমি শ্রাবণী। আপনার ছাত্রী ছিলাম দেউলগ্রাম হাইস্কুলে। আর আপনার সঙ্গে ছিটেফোঁটা আত্মীয়তাও ছিল। আপনার মা বীণাপানি দেবী আমার দূর সম্পর্কের মাসি… আপনি কেমন আছেন?’

শুভায়ু লেন্স-এর ফাঁকে ওকে ভালো করে দেখে।

‘ভালো আছি… ওহ্ সেই শ্রাবণী!… কোথায় চলেছ? আমি কিন্তু বর্ধমান যাব।’

‘হ্যাঁ… দাদা। মানে স্যার…’

‘অত ইতস্তত করছ কেন? আমাকে দাদা বলেই ডেকো… তুমি তো বেশ বড়ো হয়ে গেছ। দেউলগ্রাম স্কুলের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থিনী হিসাবে শেষ দেখেছিলাম কিন্তু তোমার সেই চেহারা একদম ভেঙে গেছে… আমি তো চিনিয়ে না দিলে ধরতেই পারতাম না। তারপর সব কেমন আছ? কী করছ? তোমার সেই ভাই সুপ্রকাশ কী করে?’

শ্রাবণী মাথা চুলকোয়।

‘বাব্বা! আপনার সব মনে আছে দেখছি— খবর ভালোই… আমি তো বড়ো… আমার পরে সুপ্রকাশ। আমি অনার্স পাশ করে ট্রেনিং নিয়ে বসে আছি… এমএসসি দিচ্ছি। ভাইও বেকার, ইন্টারভিউ দিচ্ছে। বাবার সেই প্রাইভেট ফিন্যান্স কোম্পানি উঠে গেছে। স্টাফ-দের কিছু কিছু পয়সা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।’

একটু থেমে আবার শুরু করে…

‘কিন্তু দাদা সত্যি বলতে কী, বেশ দুর্দিন যাচ্ছে আমাদের। সে কথা আপনাকে লুকিয়ে লাভ নেই… বরং চলুন না কর্ড লাইনে এই সামনেই বেলানগরে নেমে শিউলিবাগান কলোনি। যাবেন দাদা? বাবা আপনাকে দেখলে খুশি হবেন। আর দেউলগ্রামের লোকজন তো আসে না। তার কারণও আছে, গেলে সবকিছু জানবেন।’

একটু যেন বিমনা হয়ে যায় শুভায়ু।

‘চলুন না দাদা— অসুবিধে হবে না।’ অনুরোধটা বারবার আসতে থাকাতে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে ও—

‘কিন্তু আমার তো রিটার্ন কাটা আছে।’

শ্রাবণী বেশ গুছিয়ে বলতে থাকে। ‘টিকিটটা সামান্য, তবে যদি বাড়িতে অসুবিধে থাকে, বউদি চিন্তাভাবনা করে— সে কথা আলাদা।’

হঠাৎই শুভায়ু মনস্থির করে ফেলে।

‘চলো তাই যাই… তোমাদের আস্তানাটা চিনে আসি, কলকাতা আসা যাওয়ার পথে কাজে লাগবে। বুথ থেকে বাড়িতে জানিয়ে দিলেই চলবে।’

‘ভালোই হল কাল তো রবিবার, সকালেই ফেরার তাড়া নেই।’

ট্রেনে চড়ে সামান্য রাস্তা। যাত্রাপথে নানান চিন্তা… এসে পড়ে।

লেখাটা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে কেমন খচখচ করে মনটা। গল্পটার নায়িকা ছিল অতসী… ভ্যান চালাত সুবলসখা। তার সঙ্গে অতসীর ঘনিষ্ঠতা… শেষে বাড়ির অমতে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হয়। মা-বাবা ক্ষুণ্ণ হয়, সুবল-রা অন্য জাত। অতসীদের তুলনায় ওদের বাড়ির অবস্থা তেমন ভালো নয়।

এরমধ্যে অতসীর মা মারা যেতে বাড়ির একটা ছন্নছাড়া হাল হয়ে যায়। মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে স্ত্রীহারা হয়ে বাবা বেশ ভেঙে পড়ে। অতসী তার স্বামীকে বারবার কাছে এসে থাকতে বলে। ওরা একদিন এসেও যায়। কিন্তু পরস্থিতি ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করে। এক প্রত্যুষে ওদের খামারবাড়ি থেকে সাদা পোশাকে এক নারী মূর্তিকে ওরা বের হতে দেখে… তবে কি ওটা ওর মার অশরীরী আত্মা?

শেষ পর্যন্ত রহস্যের কিনারা হয়। আত্মা আর অশরীরী থাকে না, তার শরীরী রূপ ধরা পড়ে। সে অতসীর ছোটো মাসি… অল্প বয়সে বিধবা হয়ে পাশের গ্রামে বাপের বাড়িতে থাকত। সে ছুটে আসে কীসের টানে। সেও এক বাসনার শিকার। বাসনার এক বিসর্পিল নদী ওকে টানে।

যাক এটা শুধুমাত্র কাঠামোটা…।

রক্তমাংসের গল্পটা তো নেই। শুভায়ু কী করে শুধু মুখের কথায় বাসনার বিসর্পিল রূপটা বিশ্বাস্য করে তুলবে…!

স্টেশন থেকে শিউলিবাগান কলোনি সামান্যই রাস্তা। সেখানে শ্রাবণীদের একতলা ঘর— মাত্র দুটো কুঠরি। ছাদের সিঁড়ি, চিলেকোঠা। সুপ্রকাশ কম্পিউটার ট্রেনিং নিচ্ছে, রাতে বিকম পড়ে।

ওদের বাবা সরকারবাবু কথা শুরু করেন।

‘তাহলে শুভবাবু আমাকে চিনতে পারছেন তো… দেউল গ্রামে থাকতে মাত্র একবারই গিয়েছিলেন আমাদের বাড়ি… সে তো আটবছর আগে।’

শুভায়ু তাকিয়ে দেখে সরকারবাবুর দোহারা চেহারা সামনের দিকে কিছু পাকা চুল, কেমন যেন পোড়খাওয়া।

‘আরে দেখুন না শ্রাবণী ধরে নিয়ে এল। আর আমাকে নতুন জায়গা দেখার নেশায় কেমন যেন পেয়ে বসল।’

সরকারবাবু বলেন, ‘আরে মশাই এসে অন্যায় কিছু করেননি।’

‘অন্যায় আর কী, এসেছি এই বোনটির টানে। সত্যি শ্রাবণী মেয়েটি বড়োই ভালো। আর মেশোমশাই আমাকে আর ‘আপনি’ সম্বোধনে লজ্জা দেবেন না। আমি তো আর এখন দেউল গ্রামের প্রধান শিক্ষক পদে নেই… তাছাড়া আপনি বয়সে বড়োই হবেন।’

‘তাই হবে বাবা! শ্রাবণী মাঝেমধ্যে এখনও তোমার কথা বলে। ওই তো সবকিছু দেখাশোনা করে, ঘরের কাজ বাইরের কাজ সামলায়। ওরাই তো ভাই-বোনে ঠেলা গোঁজা দিয়ে চালাচ্ছে সংসারটাকে। নিজেরা পড়ছে, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াচ্ছে। আমি তো যেটুকু ছাঁটাইয়ের আগে পেলাম সেটা— সেই সঙ্গে কিছু দেনা করে মাথা গোঁজার জায়গাটুকু করতে পেরেছি।’

সুবর্ণা মাসি মানে শ্রাবণীর মা’র প্রসঙ্গ উঠতে সবাই মুখে তালা এঁটে দিল। কেউ কোনও কথা বলে না।

একটা থমথমে গুমোট ভাব হঠাৎ যবনিকাপতনের মতো ঝুলে রইল…

শেষে শ্রাবণী নীরবতা ভঙ্গ করল। ‘দাদা খাওয়াদাওয়া হোক, তারপর রাতে ধীরেসুস্থে সব কথা বলব। না বললে আমাদের চলবে না। আর আপনিও ঠিক বুঝবেন না। এই বলে আশ্বস্ত করল শুভায়ুকে।

সুবর্ণা মাসির সঙ্গে শুভায়ু’র মা’র একটা দূর সম্পর্কের আত্মীয়তা ছিল। খানিকটা লতায়-পাতায় গোছের। শুভায়ু সেটা সঠিক বুঝত না। থাক সে কথা।

রাতে শ্রাবণীর কথা শুরু হল।

‘দাদা! আপনাকে সবকথা খুলে বলতে আমার লজ্জা ছাড়াও— কেমন একটা তিক্ত বিস্বাদ ভাব এসে যাচ্ছে। কথা বলতে যাচ্ছি, না আকাশে থুতু ছুড়তে যাচ্ছি, সেটাই ভাববার বিষয়। মাকে নিয়ে কথা বলা বা মা’র কেচ্ছা আলোচনা করা সন্তানের পক্ষে কতখানি নির্লজ্জতার নজির তা নিশ্চয়ই উল্লেখের দরকার নেই। একজনের ভুলের মাশুল গুনছে গোটা সংসার…। সমস্ত সংসারটাতে যেন অলক্ষ্মীর ছায়া। বাবা এখন আমাদের অভিভাবক, আমাদের ভরসা স্থল। তাঁর মুখের দিকে তাকানো যায় না। কে যেন কালি লেপে দিয়েছে। তবু ভালো শিউলিবাগান কলোনির লোকজন সব কিছু স্পষ্ট করে জানে না। কারণ ঘটনাটা এখানে ঘটেনি।’

একটু থেমে আবার বলতে থাকে শ্রাবণী, আমরা তখন ডানলপের দিকে ভাড়া ছিলাম। নতুন বাড়িতে শিফট করার পর মা’র সম্পর্কে সবরকম কৌতূহল মেটাতে তৎপর হলাম। মা’র একটা পুরোনো নেগেটিভ-কে কায়দা করে এনলার্জ করা হল— সেটাকেই বাঁধিয়ে ফুলের মালা দিয়ে দেয়ালে টাঙানো হল। বলা হল— সুদূর দেশের বাড়িতে মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন আর সেখানেই মারা যান। এখানকার লোক আমাদের সম্পর্কে তত উৎসাহী নয় যে বাঁকুড়ার দেউল গ্রামের খবর নিতে যাবে। সবচেয়ে বড়ো কথা হল কলকাতার শহরতলিতে ছাপোষা এক সরকারবাবুর স্ত্রী আদৌ মারা গেছেন কিনা, সে নিয়ে গবেষণা করতে কারও বয়ে গেছে। তাদের ভাববার জন্য বহু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে।’

শুভায়ু মাঝখানে শ্রাবণীকে থামিয়ে দেয়।

‘শ্রাবণী, আমার কাছে ব্যাপারটা ধোঁয়াশা হয়ে রইল। আচ্ছা বলো তো, সুবর্ণা মাসি কোথায় চলে গেলেন? সঙ্গে কে ছিলেন?’

শ্রাবণী দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছু বিরতির পর কথা বলতে থাকে।

‘শুভদাদা! কিছু মনে করবেন না… আমি এতখানি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি যে কথাসূত্রর ঠিকঠিক সঙ্গতি রাখতে পারছি না। তাই কোথায় এ কাহিনি শুরু করতে হবে তাই ভুলে বসে আছি। আমাদের দুঃখকষ্ট, মনের জ্বালাযন্ত্রণা আজ পর্যন্ত কাউকে স্পষ্টভাবে বলতেই পারলাম না। আসলে সেরকম পারিবারিক বন্ধুই পেলাম না – যার কাছে নিজেদের কথা বলে হালকা হতে পারি। আপনাকে টেনে এনেছি মনের কথা শোনাব বলে। এবার শুনুন –

মা’র বাপের বাড়ির অবস্থা যাইহোক, ওঁর মধ্যে একটা বিলাসী সুখস্বপ্নে বিভোর সত্তা ছিল। আমার জন্মের পর থেকেই নানানভাবে আঘাত পেতে থাকেন। বাবা সামান্য চাকরি করতেন প্রাইভেট ফিন্যান্স কোম্পানি-তে। তাও সেটা বড়ো প্রতিষ্ঠান ছিল না। মায়ের মতো সুন্দরী একটা মেয়ের এমন একটা দৈন্যপীড়িত সংসারে কেন যে বিয়ে হল – সেটাই বিরাট রহস্য। যাক ওসব প্রসঙ্গ। তবু মাকে সুখস্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার জন্য বাবার নিরন্তর চেষ্টার অন্ত ছিল না। কিন্তু মা’র কাছে, এই সংসার… ভাড়া বাড়ি… বাবার আর্থিক টানাটানিগুলো বড়োই ঘৃণা ও বিরক্তির বিষয় ছিল…।

‘আমরা কত কষ্ট করেছি পড়াশোনা করতে গিয়ে। অন্যের বাড়ি থেকে নোটবই চেয়ে এনেছি, রাত জেগে নোটকপি কিংবা ছুটোছুটি করে অথবা জেরক্স সংগ্রহ করে বহু কষ্ট স্বীকার করে লেখাপড়া করেছি। মা’র কাছে এসব মূল্যহীন ছিল! মা-কে বলতে শুনেছি, জানো বইপত্র কিনতে হয়, ওরকম চেয়েমেগে বিরাট কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখে লাভ নেই।

সে তো অনেক পয়সার দরকার— আমার উত্তর। মা ভ্রূকুটি করে হেসেছে – হ্যাঁ টাকাপয়সার দরকার বই-কি! আর বেশি দাম দিয়ে সেই বই কেনার মতো স্বচ্ছলতা বা সামর্থ্য আমাদের নেই। স্বচ্ছলতা আনতে যে যোগ্যতা দরকার তা তোমার বাবার নেই।

ছলেবলে কৌশলে যেভাবেই হোক বাবার আর্থিক দৈন্যকে ব্যঙ্গ করাই মার লক্ষ্য ছিল।

– কী বলছ তুমি! তুমি তো সবই জানো বাবার অবস্থা।

– জানি বই-কি। আর এও জানি তোমার বাবা নানা অজুহাত যাই দেখান, তিনি আর্থিক সাফল্যের পরীক্ষায় অকৃতকার্য বলেই প্রতিপন্ন।

শ্রাবণী বড়োই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে এ ক’টি কথা বলতে পারল।

আমার মা’র কথাবার্তা শুনলে মনে হতো, মার ভাগ্যে এক সচ্ছল সুন্দর গোছালো সংসার অপেক্ষা করছিল, আমার বাবা হঠাৎ তাঁর জীবনে এসে পড়ে সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে।

আমি মাঝে মাঝে অনুমান করতে চেষ্টা করতাম – মায়ের সেই ঈপ্সিত পুরুষ কি সুরঞ্জন মামা? কে জানে!

তবে সুরঞ্জন সান্যালকে দু’একবার এ বাড়িতে আসতে দেখেছি। ছোটোবেলায় তাঁর দেওয়া মুঠোমুঠো টফি আমরা ভাইবোনে ভাগ করে খেয়েছি। শুনেছি মা’র মামার বাড়ির দেশে ওঁর বাড়ি ছিল। মানুষ হয়েছিলেন উত্তরবঙ্গের কোথায় যেন! প্রথম যখন আমাদের বাড়ি আসেন তখন উনি বেকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ধাপ পার হয়ে স্কুল-কলেজে চাকরির ধান্দায় ঘুরছেন। বিষ্ণুপুরের কাছে একটা কলেজে সাক্ষাৎকারে এসে হঠাৎই মা’র সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আমার বাবা শিবতোষ সরকারকে বলেন, শিব জামাইবাবু, এদিকে একটা চাকরি পেলে দিব্যি থেকে যাব। সুবর্ণার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যাবে…

চাকরি পাওয়ার পর ছুটিছাটায় দেউল গ্রামের বাড়িতে এসেছেন সুরঞ্জন মামা। দু’চারদিন বেশ হইচই করেছেন। আমাদের সঙ্গে হালকা হাসিমস্করা হুটোপাটি করেছেন, এসব বেশ মনে পড়ে। আমাকে খুবই আদর করতেন। মা-কে বলতেন সুবর্ণা! তোমার এই মেয়েটাকে ভালোভাবে লেখাপড়া শিখিও, বেশ বুদ্ধিমতী হবে। ওর দৌড়ঝাঁপ দেখে মনে হয় স্পোর্টস-এ বেশ ভালো করবে। ওর কোন নামটা ফাইনাল করলে, শ্রাবণী?

শুনে মা’র মুখে হাসির ছ’টা। মা বলেই ফেলল, আর সব নাম তো চাপা পড়ে গেল। তোমার দেওয়া ওই নামটাই রীতিমতো চালু হয়ে গেল দেখছি। কার দেওয়া নাম দেখতে হবে তো?

মা’র মুখে সুরঞ্জন মামার নাম তখন সব সময় শোনা যেত, প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

এমনিতর একটা প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি। বাঁকুড়া জেলার একটা সামান্য কলেজে চাকরি করছে। সেটাই মা’র আপশোশের কারণ। অবশ্য তখন সোনামুখি কলেজ ছোট্ট কলেজই ছিল…

দেউল গ্রামের দিনগুলি এমনিভাবেই পার হচ্ছিল। মাসে অন্তত একবার সুরঞ্জন মামা এসে যেতেন। জুলজি বোটানি-র লোক যে কবি-শিল্পী মনের হতে পারে, আমার ধারণা ছিল না।

একবার দ্বারকেশ্বর নদীর পাড়ে শীতের সময় আমরা ‘পৌষলা’ করেছিলাম। তখন আমি সবে মাধ্যমিক পাশ করেছি। তখন সুরঞ্জন মামার ভরাট গলায় শুনেছি রবীন্দ্রসংগীত – ‘যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ… আসিতে তোমার দ্বারে…’

মা-ও ভালো গাইত, একটু চাপা গলায় গেয়েছিল—‘যখন প্রথম ধরেছে কলি আমার মল্লিকা বনে…’

তখন ভালো বুঝতাম না। মনে হতো কেমন একটা কুয়াশা ঘেরা অন্ধকার, তারই মধ্য দিয়ে আমাদের সংসারটা চলেছে।

এইচএস পড়ার সময় থেকে আমার মনে হল— কোথায় যেন একটা অন্য স্রোত বইছে। চোরাস্রোত ফল্গুধারার মতো। সে ছুটে চলেছে হয়তো বা কোনও অজানা সর্বনাশা পথে। সুপ্রকাশ-এর চোখ ছেলেদের চোখ আর তরুণের চোখ। ওর তখন বয়স অল্প। ও ঠিক ধরতে পারেনি। ধোঁয়াটে হলেও আমি অনেকটা বুঝতাম। দেখতাম, সুরঞ্জন মামা এলে মা’র চোখে একটা খুশি চিকচিক করে উঠত।

ওদিকে বাবা, সুরঞ্জন মামা সম্পর্কে কোনও না কোনও মন্তব্য করলেই মা রেগে যেত।

একদিন বাবা বললেন, সে কি সুবর্ণা তুমি ওঁর সঙ্গে সোনামুখি যাবে?

– কেন তোমার আপত্তি আছে?

– না মানে সুরঞ্জনবাবু মেসে থাকেন তাই বলছিলাম।

মা ব্যঙ্গ হাসি হেসেছে, তুমি তো অমনি বলবে জানতাম। ওদের অধ্যক্ষ ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন। আমি সেখানে থাকব। এখন সুরঞ্জনদা ওখানকার ভাইস প্রিন্সিপাল জানো তো!

বাবা চুপ করে যেতেন বাধ্য হয়ে। মা বলেছিল, দুটো দিন রান্নাবান্না শ্রাবণীই সামলে নিতে পারবে।

কলেজে সুরঞ্জন মামার নামডাক ছিল। ওঁর দু’চারটে বই ডিগ্রি কোর্স-এ চালু ছিল। এরপর বেশ কিছুদিন সুরঞ্জন মামা আর আসছিলেন না। দেউল গ্রামে যে ঢিঢি পড়ে গেছিল শিবতোষ সরকারের স্ত্রীকে কেন্দ্র করে, তা কিছুটা স্থিমিত হয়ে গিয়েছিল।

ইতিমধ্যে বাবাকে সঞ্চয়ন ফিন্যান্স বদলি করল হাওড়ার দিকে। বাবা সবকিছু গুটিয়ে ডানলপের দিকে চলে গেলেন। সেখানে নানান টানাটানির মধ্যে দিয়ে সুপ্রকাশ আর আমার পড়াশোনা চলতে থাকে।

শেষের ঘটনাটা ঘটল বছর দুই আগে। ইতিমধ্যে মা’র নামে চিঠিপত্র আসত, কিন্তু সুরঞ্জন মামা আর আসেননি। মাঝ্যেমধে মা’র মুখটা দেখতাম বেশ থমথমে। মাঝে মাঝে ভীষণ রেগে যেত বেশি প্রশ্ন করলে।

– চালাও তোমাদের সংসার, আমি আর পারছি না। শুধু নাই নাই রব। এত অভাব আর দেখতে পারছি না। আমারই কপাল দোষে জুটেছে ক’টা দুষ্টগ্রহ।

শুভদা। এরপর গল্প শেষ হয়ে আসছে। আমরা ঘটনায় যাচ্ছি। একদিন ভোরে বাবা উঠেছেন। অনেক খোঁজাখুজি করে মাকে কোথাও দেখা গেল না। আমি, ভাই অনেক খুঁজলাম। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বাবা একদিন সুপ্রকাশকে সোনামুখি পাঠালেন। পরের দিন সুপ্রকাশ খবর আনল, সুরঞ্জন সান্যাল প্রায় ছ’মাস আগে সোনামুখি ছেড়ে অসমের দিকে কোনও কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দিয়েছেন।

এরপর থেকে আমরা তিনজন সমানে লড়াই করে যাচ্ছি। ভাঙা হাল ছেঁড়া পাল তবুও…’

শুভায়ু শ্রাবণীর পিঠে হাত দিয়ে বলে ‘সোজা হয়ে হাঁটবে— এতটুকু ভেঙে পড়বে না। ভয় কী? তোমরা তো কিছু অন্যায় করোনি। শুধু ফটোতে নয় বাস্তবে সুবর্ণা মাসি মৃত বই-কি! অন্তত তোমাদের কাছে। শক্ত হও, তোমার কাছ থেকেই তো সুপ্রকাশ জীবন সংগ্রামের ভাষা আয়ত্ব করবে।’

অনেক দেরিতে শুভায়ু কিছুক্ষণের জন্য বিছানায় গড়াতে যায়। আর মনে মনে ভাবে ‘বাসনা বিসর্পিল নদী’র পাণ্ডুলিপিটা হারিয়েছে বটে কিন্তু গল্পটা তো হারিয়ে যায়নি।

 

চ্যাঁচানি পিসি

দালাল যেদিন আমায় ঘর দেখাতে নিয়ে যায়, সেই দিনই আমি চ্যাঁচানি পিসিকে দেখি। টাইমকল থেকে ছ্যারছ্যার করে জল পড়ছে। পাশে উবু হয়ে বসে তিনি বাসন মাজছেন। চটা উঠে যাওয়া সিমেন্টের চাতাল। একদিকে ডাঁই করা কাঠের ভাঙা তক্তা, প্লাস্টিকের বস্তা, মরচে ধরা আধখানা টিন, বইয়ের একগোছা ছেঁড়া পাতা, আরও কত কী। চাতালটার এখানে সেখানে ছিটিয়ে ছেতরে পড়ে রয়েছে পায়রার গু। দেখেই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

বাড়িটার বয়েস একশো বছর তো হবেই। যেখানে সেখানে পুলটিস মারা। দরজা দিয়ে ঢুকেই চোখেমুখে অন্ধকার জড়িয়ে যায়। সরু গলি। খানিকটা গিয়ে ডানহাতে সিঁড়ি। তার মুখে একটা বইয়ের দোকান। সেখানে আলো জ্বলছে। বাঁদিকের দোকানেও আলো। কিন্তু অন্ধকার এত বেশি যে মনে হয় যেন দোকানের ভেতরে মশারি খাটানো আছে। সেখানে আলো একেবারে জবুথবু অবস্থায় পড়ে আর বেরোনোর পথ পায়নি।

বাঁহাতি মোড় নিয়ে ডানদিকে ঘুরলেই ওই চাতাল। তার তিন কোণে তিনটে দোকান। বাসন মাজতে মাজতে পিসি চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকিয়েছিলেন। ট্যারা চোখ। তার চেয়েও ধাক্বা লেগেছিল যেটা তা হল ওর পরনে একটা শুধু ফ্যাকাশে কামিজ। নীচে কিছু নেই। উবু হয়ে বসার ফলে কামিজের অনেকটা খসে গিয়ে রোগা পা দাবনা অব্দি দেখা যাচ্ছে। চোখ সরিয়ে নিতে নিতে খেয়াল হল একদম কিছু নেই তা নয়। একটা লাল রঙের ইজেরের খানিকটা উঁকি মারছে।

চাতালের পাশে সরু হাঁটাচলার জায়গাটা একটা খোলা কোলাপসিবল গেট টপকে আর একটা গলির রূপ ধারণ করেছে। আবার অন্ধকার। আরও একটা সিঁড়ি। কাঠের রেলিং ঘুরে ওপরে উঠেছে। এই ছোট গলিটা পেরিয়ে একফালি ফাঁকা জায়গা। সেখানে পাশাপাশি দুটো দোকানঘর। তার মধ্যে যেটা বন্ধ তার সামনে আমাকে ফেলে দালাল বলেছিল, দাঁড়ান, তালাটা খুলি।’

আমি বললাম, ‘এ কোথায় নিয়ে এলেন বলুন তো!’

সে ঘটাং ঘটাং করে ঠুকে তালা খুলে হড়হড় করে শাটার তুলতে তুলতে বলল, ‘বইপাড়ায় ঘর নিয়ে ব্যাবসা করতে গেলে ওসব ভাবলে চলবে? আপনার যা বাজেট তাতে এ যা দিচ্ছি, রাজা জিনিস বুঝলেন। যদি টিকে যেতে পারেন তাহলে এখান থেকেই মা লক্ষ্মী হাত ঝেড়ে দেবে। একটুকরো জায়গার জন্যে লোকে মাথা খুঁড়ছে। একবার নোঙর ফেলতে পারলেই হল। দোকানের ভেতরটা ভালো করে দেখুন। আশি স্কোয়ার ফুট। ফলস সিলিং করা আছে, ওপরে বই রাখতে পারবেন। সলিড একেবারে। ভাড়া কম, সেলামি কম, আর কী চাই?’

‘না আসলে এত ভেতরে তো, তাই।’

‘সামনে নিতে গেলে তো আপনার পড়তায় আসবে না দাদা। ফুটপাতের ধারের গুমটিগুলো দেখেছেন? পঞ্চাশ-ষাট স্কোয়ার ফুট– স্টাটিংই আছে সাত-আট লাখ থেকে। এখান থেকে লাগান না। কত এঁদো গলি থেকে বেরিয়ে রাজা-উজির হয়ে গেল সব। পঁচিশ বচ্ছর ধরে কলেজ স্ট্রিটে ব্রোকারি করছি। কম তো দেখলাম না।’

এদিকেও একটা সিঁড়ি আছে লাল সিমেন্টের। উঁচুতে তাকালাম। দোতলায় কতগুলো সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। তার মানে ওখানেও দোকান বা গোডাউন আছে। তিনতলার এদিকটায় জাল দিয়ে ঘেরা। বারান্দা হতে পারে। তার ওপরে আশি স্কোয়ার ফুটেরও কম মাপের আকাশ। দমচাপা লাগছিল সব মিলিয়ে। বললাম, ‘এখানে কি কোনও কাস্টমার আসবে? জায়গাটা যেন কেমন। ঢোকার মুখে আলো নেই, একজন কলতলায় বসে বাসন ধুচ্ছে–।’

দালাল এমন হাসল যেন আমি ছেলেমানুষি কথা বলছি। ‘ওঃ, চ্যাঁচানি পিসি? ওকে নিয়ে ভাববেন না। স্ক্রু ঢিলে আছে। ওই কলটা ওর। কলের পাশে যে-তিনটে দোকান– ওগুলো ওর ভাগে। যা ভাড়া পায় তাই দিয়ে চলে। বেশি পায় না যদিও। কবেকার ভাড়াটে সব। পিসি থাকে গলির ভেতরের দোতলায়। এ বাড়ির তিন শরিক। কারও সাথে কারও সম্পক্ব নেই। সামনের দিকেরগুলো যাদের তারা ওদিকেই তিনতলায় থাকে। এই বাড়িওলা থাকে এদিকের ওপরে। ঘর পছন্দ হলে বলুন, ডাইরেক্ট কথা বলিয়ে দিচ্ছি।’

ঘরটা নিয়ে নিয়েছিলাম। বাবার একটা বইয়ের দোকান ছিল। বইয়ের সঙ্গে লেখাপড়ার কাজে আসে এমন সব জিনিসও বিক্রি হতো। যেমন হয় আর কী। বয়েস হয়ে গিয়েছে, আর বসতে ভালো লাগছে না, এসব বলে বাবা আমাকে সেখানে ভিড়িয়ে দিল। সাত বছর ধরে আমি সেটাই চালিয়েছি। তবে এত ছোট ব্যাপারে মনটা আটকে থাকতে চাইছিল না। বই ঘাঁটতে আমার ভালো লাগে। ভাবলাম বই বানালে কেমন হয়। বছর দেড়েক হল নিজে একটা পাবলিকেশন খুলেছি। গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি ছেপেছি, প্রবন্ধের বইও। কয়েকটা বইয়ের, কাগজে রিভিউ বেরোল। প্রকাশনার নাম জানল লোকে। কলেজ স্ট্রিট থেকে ফোনে অর্ডার হলে বই পৌঁছে দিতাম। ছোটদের বইয়ের কাটতি ভালো জেনে সেদিকেও যাব ভাবছিলাম। বাবাকে অনেক বলেকয়ে, বুঝিয়ে দোকানটা বিক্রি করে দিলাম। বাবার হাতে খানিকটা রেখে আমার হাতে কিছুটা পুঁজি এল। বিয়ে করেছি। ছেলে-বউ আছে। বউ একটা মন্টেসরি স্কুলে পড়ায়। আমার বেলায় পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে পাল্লাটা ঝুঁকির দিকেই চলে গেল বেশি, কিন্তু তখনই ঠিক করেছিলাম এই ব্যাবসাটা কলেজ স্ট্রিটে বসেই করতে হবে। দালালের পিছন পিছন ঘুরে শেষে এই বাড়ি।

এখানে চ্যাঁচানি পিসির সঙ্গে আমার কথা হওয়ার কোনও দরকার ছিল না। দালাল বলেছিল ওকে নিয়ে ভাববেন না। কিন্তু না ভেবে রেহাই নেই। সত্যি বলতে কী ওকে দেখলেই হাত-পা চিড়বিড় করে। বারোটায় যখন দোকানে আসি তখন তিনি খাওয়াদাওয়া শেষ করে বাসন ধুচ্ছেন কলতলায়। বিকেল চারটেয় আবার জল আসে। পিসি থালা বাটি গেলাস হাঁড়ি কড়াই নিয়ে সেখানে হাজির। বাসন ধুচ্ছেন কলতলায়। শুধু বাসন নয়, নিজেকেও রগড়ে ধোবেন। একজন পঞ্চাশ-পঞ্চান্নর হাড়সর্বস্ব মহিলা সর্ব অঙ্গ ভিজিয়ে বইয়ের দোকানের মাঝখানের চাতালে বসে চান করছেন এ দৃশ্য যে কী শুকনো হতে পারে, তা টের পাই। যাওয়া আসার পথে দেখে মনে হয় আড়াল করে দাঁড়াই। কোনও খদ্দের যদি আসে এখন? কিংবা লেখক কেউ? লজ্জার একশেষ হবে। তখন ওরই ভাড়াটে এক দোকানদারের স্টাফ পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলে যায়– ‘আহা মন্দাকিনী। রাজ কাপুর দেখে যেতে পেল না রে। রাম তেরি গঙ্গা মইলি হো গয়ি…।’

চ্যাঁচানি তো কারও নাম হতে পারে না। পিসির আসল নাম যে কী সেটা ওরই ভাড়াটে ডিএম পাবলিশার্সের মালিকের সঙ্গে একবার কথা বলতে গিয়ে জানলাম। বললেন, ‘ওর নাম লাবণি, লাবণি দত্ত। ভাড়ার রসিদে ওই নামেই সই করে। এখানকার ছেলেছোকরারা বলে চ্যাঁচানি পিসি। বলবে নাই বা কেন। অষ্টপ্রহর কিছু না কিছু নিয়ে চ্যাঁচাচ্ছে।’

সাবধানে বললাম, ‘উনি তো আপনাদের বাড়িওয়ালি। কিছু বলেন না কেন?’

‘কী আর বলব। যবে থেকে এসেছি তবে থেকে তো এই দেখছি।’

আমি চুপ করে গেলাম। এখানে আরও যারা আছে তারাও পুরোনো। পিসিকে কেউ সামনাসামনি কিছু বলে না। বলতে গেলেই চিৎকার। কেউ গলির ভেতরে ধপাস করে বইয়ের বস্তা নামাল। পিসি সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠবে– ‘অ্যাই কে? কে রে? গায়ের জোরে বস্তা ফেলেছিস! আস্তে আস্তে নামানো যায় না? এটা তোর বাবার বাড়ি নয় বুঝলি! একেই ওখানকার মেঝেটা ফেটে রয়েছে, তার মধ্যে ইচ্ছে করে বদমাইশি। সারাতে গেলে তুই পয়সা দিবি?’

আমি সব শুনি। তবে খেয়াল করে দেখেছি গলির মেঝের একটা জায়গা সত্যিই অনেকটা বসে গিয়েছে। পুরোনো বাড়ি। ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুর ঘুরঘুর করে। ওরাই ফাঁকফোকর থেকে মাটি তুলে আলগা করে দিয়েছে। গলিটায় কোনও আলো নেই। অন্ধকারে কেউ কোনওদিনও পড়ে পা মচকাবে।

ডিএমের মালিক বলেছিলেন, ‘আপনার বাড়িওয়ালা প্রভাত দত্ত হল ওর দাদা, জ্যাঠার বড়ো ছেলে। বাড়ি ভাগাভাগি হয়েছে অনেকদিন। শুনেছি আগে থেকেই ঝামেলা চলছিল। যে যার অংশ বুঝে নেওয়ার পর থেকে তিন শরিকের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ। কেউ কারও খোঁজও নেয় না। এই চ্যাঁচানি পিসির বাপ-মা তো কবেই স্বর্গে রওনা দিয়েছে। থাকার মধ্যে আছে এক দিদি-জামাইবাবু। বছরে বারদুয়েক আসে ব্যারাকপুর থেকে। আসবেই বা কী করতে। সেখানে তারা সুখেই রয়েছে। দয়া যেটুকু করে, এর ভাগের দোকানগুলোর ভাড়ায় হাত দেয় না। বয়েসকালে বিয়ে-থা হয়নি। বিয়ে হওয়ার কথাও নয়। ওই তো চেহারার ছিরি। আগেও ভালো কিছু ছিল বলে মনে হয় না। একাই রাঁধেবাড়ে, খায়। একা থেকে থেকে মাথাটা গেছে আর কী। কথা বলার লোক পায় না। চ্যাঁচায়!’

আমি ভাবছিলাম ভাগ্যিস এই মহিলা আমার বাড়িওয়ালি নয়।

আমার দোকানে কোনও কর্মচারী নেই এখনও। এই কোম্পানিতে আমিই মালিক, আমিই শ্রমিক। বিক্রিবাটা তেমন জমেনি। তবু রিটেল কোনও কাউন্টার থেকে বইয়ের নাম লেখা স্লিপ এলে বই দিই। ফোনে বললে দৌড়ে গিয়ে বই পৌঁছে দিয়ে আসি। চালান লিখি, বিল কাটি, টাকা তুলে আনি। বিজ্ঞাপন দেখে, খুঁজেপেতে কাস্টমার আসে খুব কম। ওই কালো ঝুল গলি পেরিয়ে যারা এসে পৌঁছোয়, দেবতাজ্ঞানে তাদের সামলাই। যাদের বই রয়েছে সেই লেখকদের মধ্যে কেউ কেউ এসে পড়েন কখনও। আর টাকা নিয়ে বই ছাপিয়ে দেব কিনা জানতে বা কথা বলতেও আসেন দু-একজন। হ্যাঁ বলে দিয়েছি কয়েকজনকে। নইলে তো প্রেসে ধার ধারালো হয়ে উঠবে। আমি ধরে নিই যারা টাকা দেবে তারা আমার টেম্পোরারি পার্টনার। বাইরে চায়ের দোকান আছে। লোকজন এলে সেখানে গিয়ে বললে চা দিয়ে যায়, কিন্তু কেউ জল চাইলেই আমি সিঁটিয়ে যাই।

পাশের দোকানটা বর্ণলিপি পাবলিকেশন। মাঝবয়েসি কর্মচারী বসে থাকেন একজন। তিনিই বলেছিলেন, ‘খাওয়ার জল ওই কল থেকেই আপনাকে ভরতে হবে তমালবাবু। তবে খবরদার। পিসি যতক্ষণ কলতলায় থাকবে ততক্ষণ ওদিকের ধারও মাড়াবেন না। খালি দেখলেই বোতল নিয়ে দৌড়ুবেন। আমরাও তাই করি। নাহলে ও চিল্লিয়ে মাত করে দেবে একেবারে।’

তাও টের পেয়েছি অনেক দিন আগেই। বিকেলে কেউ জলের বোতল কলের মুখে বসালেই হল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার– ‘অ্যাই, জল ভরছে কে? কার এত আস্পদ্দা! আমার এখনও বাসন ধোয়া বাকি।’

আসলে বাসন মাজা হয়ে গেছে। শুচিবাই থাকার ফলে উনি একই বাসন বারবার ধুতে থাকেন। এই সময় পিসিকে দেখা যায় না। শুধু তার কন্ঠস্বরটি দোতলার সিঁড়ি থেকে এমন করে নামতে থাকে যে ঝনঝনিয়ে বাসন গড়ালে তার চেয়ে মধুর শোনাত। কোনও কোনও দিন কলের সামনেই ওই চিৎকারে পায়রারা ভয় পেয়ে উড়ে যায় ঘুলঘুলি কী কার্নিশ থেকে। ঝগড়ার রেওয়াজি গলা ছাড়া এ সম্ভব নয়।

আমার দোকানঘরের সামনে দাঁড়িয়ে একজন একদিন আঁতকে উঠলেন। চুঁচড়ো থেকে বই নিতে এসেছেন। কখনওসখনও মফসসলের দোকানিরা বা তাদের লোক আসে আমার এখানে। পিসিকে তাদের চেনার কথা নয়। তিনি বললেন, ‘কোথাও কি গোলমাল হচ্ছে কিছু? দেখে আসবেন একবার?’

আমি বললাম, ‘তেমন কিছু নয়। ওই জল ভরা নিয়ে–।’

‘সে কী! কাজের জায়গায় এরকম চ্যাঁচামেচি হলে তো মুশকিল। বিজনেস করবেন কী করে? একে তো বাড়ির বাইরে আপনাদের কোনও সাইনবোর্ড নেই, খুঁজে খুঁজে টাইম কাবার। তার ওপর–। আর জায়গা পেলেন না!’

চুপ করে থাকি। হাসি দিয়ে বিজনেস সামলাবার চেষ্টা করি। তবে এও দেখেছি, পিসি যখন কলতলায় গিয়ে বসে, সেই সময়টি বেছে নিয়ে এখানকার দোকানের কয়েকজন আধ ডজন বোতল হাতে হাজির হয়। তারা পিসির ওই গলাবাজির চোটপাট চেটে চেটে খেতে চায়। হ্যা হ্যা করে হাসে। বোতল বসানোর ছুতোয় বাসন ছুঁয়ে দিতে চায়, বোতলের তলানি জল ছুড়ে দিতে চায় পিসির গায়ে। তিনিও চ্যাঁচাতে থাকেন– ‘যাও, যাও বলছি, দূর হয়ে যাও এখান থেকে। জেনেশুনে পেছনে লাগা, না! আবার দাঁত ক্যালানো হচ্ছে? শয়তান বদমাইশের দল, মেরে হাত ভেঙে দোব একদম বলে দিচ্ছি।’

আমার বাড়িওলা পীযূষ দত্তকে দেখেছি কখনও এরকম ঘটনার মধ্যে পড়ে গেলেও তিনি পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন। বোনের হয়ে দুটো কথা বললে হয়তো থামত। থামে না।

একদিন জল ভরতে গিয়ে দেখলাম কলে লাল বালতি, বাসনের পাঁজা। না বলে জল নেওয়া যাবে না। পিসি দোতলায় তার ঘরে আছে ভেবে ওপরে উঠলাম।

একটা পাঁচিল গেঁথে আমাদের ওদিকটা থেকে এদিকটা আলাদা করা আছে। লালচে ইটের দাঁতকপাটি বেরিয়ে পড়েছে সে পাঁচিলের। পাশে সিমেন্টের একটা খিলানের অর্ধেক। বৃষ্টির জল পড়ে শ্যাওলায় আঁকা নকশা ফুটেছে তার শরীরে। কত কাণ্ড করে যে বাড়িটা ভেঙে ভাগ করেছে এরা। সিঁড়ির যেখানে আমি দাঁড়িয়ে তাতে আমার নাকের প্রায় ডগায় শোয়ানো একটা মেঝে। লোহার শিক লাগানো কাঠের রেলিং। অর্থাৎ এটা দোতলার ভেতরের বারান্দা। একটা বেড়াল থাবায় মুখ নামিয়ে বসে আছে। এককোণে একটা স্টোভ, কেরোসিন তেলের জার, কাঠের ডাঁটির একটা বড়ো ছাতা দেয়ালে হেলান দিয়ে, সিলিঙের কড়িবরগা থেকে দড়ি বাঁধা একটা হ্যারিকেন ঝুলছে, রেলিঙের খুঁটি থেকে দেয়ালের পেরেকে টাঙানো আর একটা দড়িতে এলিয়ে রয়েছে কয়েকটা ময়লা কাপড়, সেই দেয়ালেই লোহার ব্র্যাকেটে বাল্ব, দরজার পাশের দেয়ালে বাঁধানো ছবিতে উলটে আঁচড়ানো চুলে এক পুরুষ। চৌকো চোয়াল। সাদা-কালো ছবি হলদেটে হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল সব মিলিয়ে মৃণাল সেনের সিনেমার কোনও স্টিল ফ্রেম দেখছি। এমন সময় সেই ফ্রেমের ভেতর থেকে বেড়ালটা মুখ তুলে ডেকে উঠল– মিঁউ।

‘কী ব্যাপার? এখানে এসেছেন কেন?’

দরজায় আধময়লা কামিজ উঁকি দিয়েছে। বললাম, ‘আমার ওখানে একদম জল নেই। একটা বোতল যদি ভরে নেওয়া যেত।’

‘আপনি কি আমার পারমিশন নিতে এসছেন?’

‘হ্যাঁ।’

খোলা ঠোঁটদুটো টপ করে নেমে এসে কেমন গুম ধরে গেল মুখে। উনি কামিজের দু’পাশের চেরা জায়গা দু’হাতে চেপে ধরলেন। তারপর বললেন, ‘যান, নিয়ে নিন জল।’

‘আপনার জিনিসপত্র সব ওখানে রয়েছে। সরাতে গেলে হাত ছোঁয়াতে হবে।’

‘বললাম তো ভরে নিন। সরিয়ে দিন ওগুলো।’

কী মনে হল, সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ওটা কি আপনার বাবার ছবি?’

‘হ্যাঁ, কেন?’

‘না এমনি। তাই মনে হচ্ছিল। ঘরের ভেতরে রাখলে পারতেন।’

‘ঘরে অন্ধকার।’

অদ্ভুত যুক্তি। আমি আর কিছু না বলে ফিরে আসছিলাম। তখন উনি বললেন, ‘জল নেওয়ার জন্য আমাকে বলতে আসতে হবে না। আপনার যখন দরকার নিয়ে নেবেন।’

আমি নেমে জল ভরে নিয়ে এসে কাউন্টারে বসি। বাইরে কত লোক, বই বোঝাই রিকশা ভ্যান, দোকান উপচে রাস্তায় বই, হাঁকাহাঁকি, হাত ধরে টানাটানি– কী বই লাগবে বলুন। আর এই জায়গাটা ঘুমন্ত পুরী। এরকম রোজই। বৃষ্টিতে, রোদ্দুরে, শীতে ভিজে ভিজে।

এক একদিন বসে বসে ঝিম ধরে যায়, চোখের পাতা নেমে আসে। তখন ওই রাজকন্যের চিৎকারে চটকা ভাঙে। সিগারেট ধরাই। ভাবি আরও কয়েকটা কাউন্টারে বই বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে, লাইব্রেরিতে ক্যাটালগ পাঠাতে হবে, বাংলাদেশের অর্ডার পেতে হবে। পারব কি আমি? দোকানের ভাড়া, সেই সাউথ থেকে মেট্রোয় যাওয়া-আসার খরচ, ইলেকট্রিকের বিল। মাত্র তেরোটা বই নিয়ে এখানে জায়গা হাঁকিয়ে বসাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। এই বাড়িটায় সব টেক্সট বইয়ের দোকান। সেখানে আমার পাবলিকেশনের বই মেলানো যাবে না। যাদের সঙ্গে মেলানো যায় তারা তো রথী-মহারথী। কম্পিটিশন তো দূরের কথা, টিকে থাকতে পারব কিনা সেই সন্দেহই চোঁয়া ঢেকুর হয়ে উঠে আসছে এই কয়েক মাসে। বড়ো লেখকদের বই পেতে গেলে অনেক টাকা দিতে হয়। বই ভালো করে ছাপতে গেলেও খরচ বেশি। বেশি ছাপলে খরচ কমে কিন্তু আমার দৌড় তিনশো কী পাঁচশো। লাইব্রেরি নামি প্রকাশকদের বই কেনে, বাংলাদেশের অর্ডারও তাই, কলকাতার বাইরে থেকে কদাচিৎ কেউ কিনতে আসে। এত কিছু আগে বুঝিনি। এখানে এসে মালুম হচ্ছে। আমার বউয়ের স্কুলে পড়ানোর ভরসায় তো এখানে আসিনি আমি। নিজেই নিজের দোকানের ছোট্ট সাইনবোর্ডটার দিকে তাকিয়ে থাকি। কায়দা করে পাবলিকেশনের নাম দিয়েছি ‘সোনার তরী’। শেষে ডুববে না তো?

এসব ভাবতে ভাবতে কোনও দিন ঘটাং করে আওয়াজ শুনে পিছন ফিরে দেখি পাশের গোডাউন থেকে বই বের করতে এসেছে কেউ। দুটো ছেলে। এরা যে– দোকানে কাজ করে সেটা রাস্তার ওপরে। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। বলছে মানে প্রত্যেক কথার আগে পরে একটা করে খিস্তি। বাংলা ভাষাকে উদার প্রমাণ করতে এসব আমরা আপন করে নিয়েছি। কোনও শ্রেণিবৈষম্য নেই। বলার স্বাধীনতা আছে, না শোনার স্বাধীনতা নেই। তাই খিস্তি হজম করছিলাম। ঠিক তখন ওপর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন পিসি। ‘অ্যাই কে রে? তপন, না? এখানে দাঁড়িয়ে আবার নোংরা কথা বলছিস! ওসব এখানে চলবে না।’

তপন ছেলেটি মুখ তুলে বারান্দায় তাকাল। ‘তোমার ওখানে তো নেই পিসি আমি। এ তো আমাদের বাড়িওলার এরিয়া। আমি এপারে রয়েছি।’

এবার আরও জোরে চিৎকার ধেয়ে এল। ‘খারাপ কথার আবার এপার-ওপার কী অ্যাঁ! বেশি ওস্তাদ হয়েছ, না। বই বিক্রি করিস, সে তো বিদ্যের জিনিস রে, গালাগাল দিতে লজ্জা করে না!’

তপন পাশের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে হাসল। গলা নামিয়ে বলল, ‘বহুত ঢেমনি এই বুড়িটা, দেখবি একটা মজা?’

মোবাইলে খুটখাট করছে তপন। একবার আড়চোখে আমাকে দেখল। তারপর গান বেজে উঠল ফোনে। ও মধু… ও মধু… আই লাভ ইউ… আই লাভ ইউ…। সঙ্গে তপনের খিক খিক হাসি।

আমি ভাবছিলাম, পিসির তো এতদিনে জেনে যাওয়া উচিত ছিল যে বই বিক্রি হয় বলেই বইপাড়ায় সকলে সাধুভাষায় কথা বলবে না। হতে পারে একদিন বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপালের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলেজ স্ট্রিটেই বইয়ের দোকান খুলে বসেছিলেন। কিন্তু এখন বই এখানে একটা প্রোডাক্ট। বাংলা ভাষায় যাকে বলে মাল।

হঠাৎ চমকে উঠলাম আমি। তপন ও অন্য ছেলেটিও অবাক হয়ে গেছে। দোতলায় অন্ধকার বারান্দা থেকে আর চিৎকার নয়, গান ভেসে আসছে। ‘দূরদেশি সেই রাখাল ছেলে… আমারে বাটের বটের ছায়ায়… সারাটা দিন গেল খেলে…।’ গলা খ্যানখ্যানে, সুর কিছু এলোমেলো কিন্তু ওটা গানই।

তপন কাঁধ ঝাঁকাল। ‘কী গো পিসি, এ আবার কী শুরু করলে?’

গান থামল। ‘কেন, তুই গান বাজাচ্ছিস, আমি গান গাইছি। কী অসুবিধে?’

‘আরে আমারটা শোনো, শরীর চাঙ্গা হয়ে যাবে।’

‘আরে তুই আমারটা শোন, তোর মন ভাল হয়ে যাবে। দূরদেশি সেই রাখাল ছেলে…।’

অন্য ছেলেটি এবার তপনকে বলল, ‘চল চল মাল ওঠা। সব পাগলের কারবার এখানে।’

লাবণি দত্ত থামেননি। পুরোটাই গাইলেন।

অনেক দিন পর গানটা শুনতে পেলাম। মাঠে ফুটবল পিটিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সন্ধেবেলা কাদের বাড়িতে যেন হারমোনিয়ামে বাজত এই গান। আজ এই পুরনো ভাঙা ছায়াময় বাড়িটাতে যেন ঘুরে ঘুরে ভেসে ভেসে একটা কোনও ঝরা পাতা হয়ে গানটা নেমে আসে।

পরের মাসে বাড়িওলার কাছে ভাড়া দিতে গিয়ে বললাম, ‘আমাদের দোকানের আগে যে– প্যাসেজটা, সেটা বড্ড অন্ধকার। অনেকে ওটা দেখে ওখান থেকেই ফিরে যায়, একটা আলো লাগানো গেলে…।’

পীযূষ দত্ত টাকা গুনতে গুনতে বললেন, ‘ও বাবা, ও ব্যাপারে আমি কিছু করতে পারব না। আপনি লাবুকে, মানে আমার বোনকে বলে দেখতে পারেন। ওটা তো ওর অংশ। যদি রাজি হয়–। তবে আপনার পাশের বর্ণলিপি আগে বলেছিল শুনেছি, হয়নি।’

আমি নেমে এলাম। আলোটা লাগানো খুবই দরকার। ন’মাস হয়ে গেল এখানে এসেছি। কাউকে বলে দিলেও জায়গাটা চিনে আসতে পারে না। সন্ধে নেমে এলে তো কথাই নেই, দিনের বেলাতেও এরকম ঘটে। এ তল্লাটের অনেক বাড়ির ভেতরেই খুপরি দোকানঘর আর অফিস রয়েছে। তারা কী করে ম্যানেজ করে জানি না। আমাকে আমার ব্যাবসার কথা ভাবতে হবে।

খাওয়া শেষে, বাসন ধোওয়ার পর, দুপুর একটা নাগাদ পিসি বাড়ির একেবারে বাইরের দরজার মুখে রোয়াকটায় গিয়ে বসে থাকেন। রোজকার ব্যাপার। ভাবলাম তখনই গিয়ে আলোর কথাটা বলব। গিয়েছিলাম, কিন্তু বলা হল না। দেখি পিসি ডান হাতে চড় তোলার ভঙ্গিতে খালি পায়ে রাস্তায় নেমে ছুটছেন। সামনে দু-তিনটে দামড়া লোকও খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে এঁকেবেঁকে ছুটে পালাচ্ছে। তাদের কেউই এ বাড়ির কোনও দোকানের লোক নয়। বাইরের। হয়তো কাস্টমার নেই কোনও, কাজ নেই অন্য, তাই সময় কাটাতে পিসিকে বেছে নিয়েছে ওরা। পিসি চেঁচাচ্ছেন– ‘এক চড়ে মাথা ভেঙে দোব। অসভ্য কোথাকার। বাড়িতে মা-বোন নেই তোমাদের?’

টানা রিকশাওলা, অন্য দোকানদার, রাস্তার লোক, ভ্যানওলারা রগড় দেখছে। আমি পা চালিয়ে পিসির সামনে গিয়ে রাস্তা আটকালাম। খানিকটা ধমকেই বলে ফেললাম, ‘এটা কী করছেন আপনি? কেন দৌড়াচ্ছেন এভাবে?’

পিসি থতমত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। হাতটা নামিয়ে নিয়ে বললেন, ‘কী বাজে বাজে কথা বলছে ওরা, জানেন না আপনি। কাউকে কিছু বলি না, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, তাও ইচ্ছে করে আমায় খোঁচাবে। পিছনে লাগবে।’

বললাম, ‘ওরা তো চায় আপনিও রেগে গিয়ে ওদের বাজে কথা বলুন। তাতেই মজা। আপনিও সব ভুলে ওদের পিছনে ছুটবেন! চলুন, এক্ষুনি ফিরে চলুন। আসুন আমার সঙ্গে। আপনিই না সেদিন গান গাইছিলেন!’

ট্যারা চোখ রাস্তার দিকে রেখে, কামিজটা সেই দু’হাতে চেপে ধরে আমার সামনে সামনে হেঁটে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লেন তিনি। আরও কিছুটা ধমক দিয়ে বললাম, ‘এটা কী পরে থাকেন আপনি! আর কিছু নেই আপনার?’

বোধহয় চ্যাঁচাতে গিয়ে কষ জমেছিল। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মুখে পিসি হাত দিয়ে ঠোঁট মুছলেন। আমি দোকানে বসতে যাচ্ছিলাম। উনি বললেন, ‘আপনি ওখানে কেন গেছিলেন?’

মাথা নাড়ালাম। ‘আমি আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। আর সেকথা বলে কী হবে।’

‘কী কথা? বলুন।’

‘এই প্যাসেজটায় যদি একটা আলো লাগাতে দিতেন। লোকজন আসা-যাওয়ায় সুবিধে হতো একটু। আপনার ভাড়াটেদের তো এই সমস্যা ভোগ করতে হয় না।’

গলার স্বর হালকা হয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে। শুনতে পেলাম উনি বলছেন, ‘লাইট কিনে নিয়ে আসুন। লাগাবে কে? মিস্ত্রিকে ডাকুন। জানেন কোথায় পাবেন? বেরিয়ে দেখুন ভারবি পাবলিশার্স কোথায়। ওই বাড়ির একদম শেষমাথায় বাপ-ছেলে থাকে, ইলেকট্রিকের কাজ করে। বলবেন চ্যাঁচানি পিসির বাড়ি। ঠিক চলে আসবে।’

আলো লাগানো হল। গলির অন্ধকারটা ছিঁড়ে গেল। যদিও তাতে আমার কতদূর কী সুবিধে হবে বোঝা যাচ্ছিল না। বাড়িতে বউয়ের সঙ্গে কথা বললাম কয়েকদিন পর। শ্রাবন্তী বলল, ‘বাবার বইয়ের দোকানটা তবু ছিল, সেটাও বিক্রি করলে। কী যে তোমার মাথায় চাপল! বাবা-মাও এই নিয়ে বলতে ছাড়ছে না। বলারই কথা। এখন যদি ব্যাবসাটা না দাঁড়ায় তাহলে কী হবে?’

বললাম, ‘সেই তো ভাবছি। আমি তো খারাপ বই করিনি। কিন্তু বিক্রি তেমন হচ্ছে না। এ ব্যাবসায় ইনভেস্টমেন্ট বেশি, রিটার্ন এত স্লো! আরও যে বই করব, ফান্ডই তো জমছে না। কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে না পড়ে তো বুঝতে পারিনি। তাছাড়া বাজারও খুব খারাপ। দেখি। তেমন বুঝলে সব বিক্রি করে চলে আসতে হবে।’

শ্রাবন্তী আবার বলল, ‘মাস গেলে টাকা তো লাগে সংসারে। সেটা যদি না আসে, চলবে কী করে?’

দোকানে বসে শ্রাবন্তীর কথাগুলোই ভাবছিলাম। তিন-চারজন এসে দাঁড়াল কাউন্টারের সামনে। ‘এটা নতুন হয়েছে, না? মালিক কোথায়?’

চিনি না এদের, তবে কাস্টমার যে নয় তা বোঝাই যাচ্ছে। বললাম, ‘বলুন কী ব্যাপার?’

‘ব্যাপার কিছু না, দুর্গা পুজোর ডোনেশান। এই পাশের গলি। পাশশো টাকা।’

‘পাঁচশো!’ চমকে উঠি। ‘এত তো আমি পারব না দাদা।’

‘না বলবেন না। নতুন বলেই দিতে হবে, পুরানো হলে দেখবেন অ্যামাউন্টটা কমে ফিক্স হয়ে গেছে।’

‘অ্যাই কে রে? চাঁদা চাইতে এসেছে কারা? কোন পুজো?’

একজন মুখ তুলে জায়গামতোই তাকাল। ‘আমরা পিসি। মুখটা বাড়াও। চিনতে পারবে।’

পিসি তরতর করে নেমে এলেন। ‘ওনার কাছে বেশি নিতে পারবে না তোমরা। একশো টাকা নিয়ে বিদেয় হও।’

‘কী বলছ পিসি! একশো টাকায় কী হয়?’

‘যা বলছি শোনো। ওতে যা হয় তাই হওয়াও।’ বলে তিনি চোখ দুটো আমার দিকে রাখার চেষ্টা করছিলেন। ‘আপনি এর বেশি দেবেন না কিন্তু।’

‘আঃ পিসি, এমন কেলোর কীত্তি করো না মাঝে মাঝে। কিছু বলতে গেলেই তো আবার চ্যাঁচাবে।’ বলতে বলতে ওরা বিলের পাতা ছিঁড়ল। ‘আর কী হবে, দিন ওই একশো। সিনিয়র সিটিজেনের কথা রাখলাম।’

ওরা চলে যাওয়া অবধি পিসি দাঁড়িয়েই রইলেন। তারপর আমায় বললেন, ‘কলেজ স্ট্রিটে ব্যাবসা করতে এসেছেন তো। অনেক কিছু দেখতে হবে।’

চেয়ারে বসে পড়েছি। ভালো লাগছিল না এসব। তবু বললাম, ‘ব্যাবসাটা যদি ঠিকঠাক হতো, তাও না হয় দেখতাম। এখন তো ভাবছি কেন এলাম।’

পিসি মুখটা গলির দিকে ফিরিয়ে নিলেন। ‘এই বই ছাপার ব্যাবসা তো আপনার বাপ-ঠাকুদ্দার নয়।’

‘না, কেন বলুন তো?’

‘আমি সেই জ্ঞান হওয়া থেকে এসব দেখছি বুঝলেন। কত পাবলিশার এ বাড়িতে এল আর গেল। আমার বাবাও প্রকাশক ছিল, জানেন? পড়ার বই নয়, গল্প-উপন্যাস-কবিতা এসব ছাপত। কত লেখক এসেছেন তখন। পয়লা বৈশাখে বই বেরোত। কিন্তু বাবা শেষ অবধি পেরে ওঠেনি। এখন যেটা যূথিকা প্রকাশনীর ঘর, ওটাই আমাদের কাউন্টার ছিল। পরে তিনটে ঘরই এক এক করে ভাড়া দিয়ে দিল। বাবা বলত ছোটো প্রকাশকের ব্যাবসা করা খুব কঠিন। পাট তুলে দিল। বইগুলো উইয়ে খেল। আপনি পারবেন তো?’

আমি বললাম, ‘এত ভেতরে বসে বসে কী করতে পারব তাই ভাবছি। বাইরে একটা বোর্ড অবধি নেই যে কেউ নাম দেখে ঢুকবে?’

পিসি বললেন, ‘আপনার খুব চিন্তা হচ্ছে, না? থাকতে থাকতে লোকে জেনে যাবে ঠিক। খুঁজে খুঁজে আসবে দেখবেন। এই তো গলিতে আলো লাগালেন, সামনের দিকে আমাদের যে শরিক থাকে ওরা আপনাকে বোর্ড দিতে দেবে না। আমি তো দুপুরবেলা আর সন্ধেবেলা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি, কেউ জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দেব– এই দিকে সোনার তরী। আপনি ভালো ভালো বই করুন। বিক্রি বাড়ানোর বুদ্ধি বের করুন। আমার বাবার মতো হবেন না। পালিয়ে গেলে কিছু করতে পারবেন না। আর শুনুন, আমার আর এবেলা কলে কাজ নেই। যান জল ভরে নিন।’

আমি অবাক হওয়াটা ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। তার মধ্যেই পিসি চলে গেলেন। একটু পরেই শুনতে পেলাম দোতলার সেই বারান্দা থেকে ভাঙা গলার গান ভেসে আসছে। ‘এই আকাশে… আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…।’

আমি কাউন্টার ছেড়ে দোকানের সামনের ছোট্ট জায়গাটায় দাঁড়াই। ওপরে তাকিয়ে ফালি আকাশটা দেখি। একঝলক চোখে পড়ে, একটা পায়রা পাকসাট দিচ্ছে। ওখান থেকে কোনও পক্ষীরাজ ঘোড়া উড়ে এসে নামবে না আমার জন্য। কিন্তু আমি যতটুকু দেখতে পাচ্ছি আকাশ তো ততটুকু নয়। খামোখা পালাতে যাব কেন?

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব