রোবোট?

হাউ ফ্যানটাস্টিক,  উদীয়মান সূর্য‌্যের দিকে তাকিয়ে বলল জয়িতা।

মি. দাস বিরক্ত হয়ে দেশলাই বাক্সটা ছুড়ে ফেলে দিলেন। একটাও কাঠি জ্বলছে না। কুয়াশার জন্য? কি বিচ্ছিরি কুয়াশা বটে। একটু আগেও ছিল না, এখন আবার হুড়মুড়িয়ে এসে পড়েছে। সূর্য‌্যটাও ঢাকা পড়ে গেল। যাকগে। একটা সিগারেট কি খাওয়া যাবে না?

পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল সুমন। পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বার করে বলল, খাবেন নাকি একটা? ডু ইউ স্মোক?

ওঃ, অফ্ কোর্স।

দুজনেই সিগারেট ধরিয়ে আরাম করে টান দিল। সুমন বলল, আমাদের ভাগ্য কিন্তু ভালো, তাই না?

হোয়াই?

দেখলেন না কেমন কুয়াশা নেমে এল। আর একটু আগে নামলেই তো এই অসাধারণ দৃশ্যটা দেখা হতো না। কী বলেন?

কোন অসাধারণ দৃশ্যের কথা বলছ?

সানরাইজ মশাই!

হুঁ। তেমন অসাধারণ কিছু নয়। ম্যাল থেকেও এটা দেখা যায়।

দুটো কি এক হল?

প্রায় এক। সে যাই হোক। এটা দেখার জন্য এত ভোর ভোর উঠে এত দূরে ছুটে আসার কোনও মানেই হয় না।

তাহলে এলেন কেন?

মিসেস বলল,

খুব শোনেন বুঝি মিসেসের কথা।

একটু তো শুনতেই হয়।

আচ্ছা দেখি, আমার মিসেস আবার কোথায় গেল?

সুমন সরে পড়তে চাইছিল, কিন্তু ততক্ষণে মলি এগিয়ে এসেছে। মলি ওর নতুন বিয়ে করা বউ। দুজনে মিলে হনিমুনে এসেছে। সে এসেই সুমনের হাত ধরে বলল, তোমরা এখানে? ওঃ সিগারেট খাওয়া হচ্ছে। ফেলো ওটা। ওদিকটায় দ্যাখো খুব সুন্দর ভিউ পাওয়া যাচ্ছে। দেখেছ, কেমন পাগলের মতো ছবি তুলছে সবাই। তারপরেই মি. দাসের দিকে ফিরে তাকিয়ে সে বলল, আপনি কটা ছবি তুললেন?

একটাও না।

কেন?

কারণ আমি পাগল নই। তাছাড়া সূর্য‌্যদেবকে ক্যামেরাবন্দি করার ইচ্ছেও নেই।

হাসল মলি। কথাটা খারাপ বলেননি তো!

সুমনও হাসল। বলল, উনি বলছিলেন এই একটা সূর্যদয় দেখার জন্য এত দূর ছুটে আসার কোনও মানে হয় না।

মলি ভুরু কোঁচকাল। তারপরেই বলল, খুব ভুল বলেননি কিন্তু। হাতের কাছেই কত ভালো জিনিস আমরা দেখি না। ওই যে রবিঠাকুরও বলেছিলেন না, কত দেশ ঘুরে কত ক্রোশ দূরে তার পরের লাইনটা বলো না।

মনে নেই, আমার কিন্তু এখন অন্য একটা কবিতার কথা মনে পড়ছে। বেশ উঁচু গলায় আবৃত্তি করল সুমন,

আজি এ প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রাণের পর কবিতাটা পড়েছেন নিশ্চয়ই মি. দাস?

আমি কবিতা পড়ি না।

যাঃ, কিন্তু এই কবিতাটা তো সব বাঙালির-ই জানা।

তোমার সঙ্গে বুঝি সব বাঙালির পরিচয় আছে?

মলি হাসল। ওর সঙ্গে তুমি ক়থায় পারবে না।

হঠাৎই কী মনে হতে সুমন মলির হাত ধরে টানে, আচ্ছা মি. দাস। আমি একটু ওকে নিয়ে ওদিকটায় ঘুরে আসি। আপনি থাকুন বরং। ডোন্ট মাইন্ড।

মাইন্ড করব কেন? তুমি তোমার বউকে ঘোরাতে নিয়ে এসেছো। আমাকে তো নয়?

দুজনে এগিয়ে গেল।

জয়িতা ওখানে কী করছে?

মি. দাস এগিয়ে গেলেন।

জয়িতা, সরে এসো, খাদের পাশে দাঁড়িয়ো না।

সরে দাঁড়াল জয়িতা।

কী করছিলে ওখানে?

কুয়াশা দেখছিলাম। কত নীচ থেকে উঠে আসছে হামাগুড়ি দিয়ে, সুন্দর না?

কুয়াশা হামাগুড়ি দেয় না আর দাঁড়াবে না খাদের পাশে।

জয়িতা ঘাড় নাড়ায়, আচ্ছা।

গাড়ি নামছে টাইগার হিল থেকে। হঠাৎ করেই ব্রেক কষে। পাশেই একটা ভিড় জমেছে। অ্যাক্সিডেন্ট শব্দটা শোনা গেল।

সুমন ও মি. দাসরা একই গাড়িতে ফিরছিল। গাড়ির ড্রাইভার নেমে দেখতে গেল ব্যাপারটা। পেছন পেছন সুমনও নামল।

একটু পরেই ফিরে এসে সে বলল, হরিবল্ ব্যাপার বুঝলেন? মুখোমুখি দুটো গাড়ির ধাক্কা। ড্রাইভারটা স্পট ডেড। মাথা ছাতু হয়ে গেছে। আর একজন গুরুতর ভাবে জখম। একটা পা ছিঁড়ে বেরিয়ে গেছে। বাঁচবে কিনা সন্দেহ।

মলি শুনেই দেখতে ছুটল। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এল বিবর্ণ মুখে।

ইস্, লোকটার মাথার ঘিলু বেরিয়ে গেছে না দেখলেই ভালো করতাম।

দেখতেই তো গেছিলেন বিরস মুখে বললেন মি. দাস।

জয়িতা এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল। হঠাৎ বলল, আচ্ছা, লোকটাকে আমাদের গাড়িতে তুলে নিলে হয় তো।

তার মানে! চোয়াল ঝুলে গেছে সুমনের।

আপনি বললেন না জখম হয়েছে? ওকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে হয়তো বেঁচে যাবে।

সেটা হয় নাকি একটু অস্বস্তি নিয়ে যেন মাথা নাড়ে সুমন, এটা পুলিশের কেস্। আর স্থানীয় লোকেরা তো আছেই। দরকার পড়লে ওরাই নিয়ে যাবে নিশ্চয়ই।

মি. দাস আপন মনেই বিড়বিড় করলেন, বাইস্ট্যান্ডারস এফেক্ট।

কী বললেন?

কিছু না ড্রাইভার, গাড়ি স্টার্ট করো।

যেতে যেতে মলি বলল, জয়িতাদি কিন্তু ঠিকই বলেছিল। হাসপাতালে এক্ষুণি নিয়ে গেলে হয়তো…

মি. দাস জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললেন, সুমন বলছিল লোকটার পা চলে গেছে। এভাবে না বাঁচাই ভালো।

অদ্ভুত মানুষ আপনি, মলি ভুরু কোঁচকায়।

পথে তেনজিং পযে্ট দেখে একটা বড়ো গুম্ফার সামনে এসে দাঁড়ায় ওদের গাড়ি। ওরা নামে।

গুম্ফাটা একটা ছোটো টিলার ওপরে। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হল। সুন্দর জায়গাটা। গুম্ফার পাঁচিল থেকে অনেক দূর পর্য়ন্ত দেখা যায়। জয়িতা আরেকবার বলে ফেলল, ফ্যানটাস্টিক।

এর পরেই অবশ্য হতাশ হতে হল ওদের। মূল প্রার্থনা ঘরটা বন্ধ। বোধিসত্ত্বের মূর্তিটা দেখা যাবে না। দশটার আগে দরজা খোলে না। এখন সবে সাতটা বাজে।

পাঁচিলের কাছে দাঁড়িয়ে সুমনরা কয়েকটা ছবি তুলল। মি. দাসকে বলল, ওদের দুজনের ছবি তুলে দিতে।

প্রার্থনা-মন্দিরটার পাশেই একটা ফাঁকা উঠোনের মতো জায়গা। সেখানে কয়েকটা বাচ্চা লাল আলখাল্লা পরে ঘুরছে। একজন একটা ছোট্ট লোমওয়ালা কুকুরের সঙ্গে খেলা করছে।

জয়িতা জিজ্ঞেস করল, ওরা কারা?

দে আর লিটল্ লামা বুদ্ধিস্ট মংকস্।

সুমন হেসে বলল, ওদের সঙ্গে আলাপ করবেন নাকি? অবশ্য, আমাদের ভাষা ওরা বোধহয় বুঝবে না।

সো কিউট্ দে আর। ভুরু কোঁচকায় জয়িতা, এত ছোটো বয়সে সন্ন্যাসী হয়?

দেখছেনই তো হয়েছে। এটা কিন্তু ঠিক নয় বলুন?

কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায় জয়িতা। তার ভুরু দুটো আবার কুঁচকে গেছে। একদৃষ্টে সে তাকিয়ে আছে একটা বাচ্চার দিকে। এই বাচ্চাটাই একটু আগে কুকুরের সঙ্গে খেলছিল।

কী দেখছেন এত মন দিয়ে সুমনের গলায় কৌতূহল।

দেখুন না, ওর হাতে একটা পোকা বসে আছে, কামড়াচ্ছে মনে হয়। ও কিন্তু ওটা ফেলে দিচ্ছে না। চুপ করে দেখছে পোকাটাকে। অদ্ভুত না!

সুমনও ব্যপারটা দেখল। ততক্ষণে আর একটা বাচ্চা, এ একটু বড়ো, পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ছেলেটার। পোকাটাকে খুব সাবধানে, যেন সযত্নে তুলে সে পাশেই একটা উঁচু জায়গায় রেখে দিল।

ওঃ… এরা তো বৌদ্ধ, তাই বোধহয় সুমন বলল।

এখানে কী করছ? মি. দাস এসে দাঁড়িয়েছেন।

সুমন পুরো ঘটনাটা শুনিয়ে হাসতে হাসতে বলল, আপনার মিসেস কিন্তু বেশ ইনকুইজিটিভ। ছোটো ছোটো ব্যপারও ওঁনার চোখ এড়ায় না।

মেযোনুষ যে, ঘাড় ঝাঁকালেন মি. দাস। চলো এবার কিছু দেখার নেই এখানে।

বাচ্চাগুলোর সঙ্গে বোধহয় কথা বলার ইচ্ছে ছিল জয়িতার। কিন্তু আর কিছু না বলে ফেরার পথ ধরল।

হোটেলে ফিরে সুমন ও মলি রেস্ট নিচ্ছে। টিভি চালিয়েছে। হঠাৎ করেই মলি বলল, মি. দাস লোকটা যেন কেমন, তাই না?

হ্যাঁ, একটু অদ্ভুত বটে।

অ্যাক্সিডেন্টের কথাটা ভাবো। কোনও রিঅ্যাক্ট করলেন না!

সে তো সানরাইজটাই উনি ভালো করে দেখলেন না। অথচ লোকে ওটা দেখতেই… আমি সিগারেট খাওয়ালাম দুতিনবার কিন্তু উনি একবারও আমাকে অফার করলেন না। ভাবো!

আমরা এতক্ষণ একসঙ্গে ঘুরলাম, উনি নিজে থেকে একটা কথাও বলেননি। এটা খেয়াল করেছ? আমারাই শুধু যেচে আলাপ করেছি।

হ্যাঁ, ভদ্রলোক সামাজিকতার ধার ধারেন না। কাঠ কাঠ আচরণ।

হ্যাঁ, কেমন যেন রোবট রোবট।

হয়তো সত্যিই উনি একটা রোবট! হাসতে হাসতে বলে সুমন।

শোনো না স্বামীর পাশে ঘন হয়ে আসে মলি। আমারও কিন্তু তা-ই মনে হচ্ছে।

কী মনে হচ্ছে?

হাসি নয়। সেদিন খবরের কাগজে পড়লাম না রোবোট কোম্পানিগুলো এখন অবিকল মানুষের মতো দেখতে যান্ত্রিক এসকর্ট তৈরি করছে। কোনও সঙ্গীহীন লোক তাদের সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে যেতে পারে। যাচ্ছেও অনেকে। এই লোকটা নিশ্চয়ই সেরকম কিছু।

তোমার মাথায় আসেও বটে! রোবট কি সিগারেট খায়?

সিগারেট ধরাচ্ছিল কিন্তু ইন করছিল না আমি লক্ষ্য করেছি।

বাঃ, বেশ খুঁটিয়ে দেখেছ দেখি ওকে। মনে ধরেছে বুঝি?

ঠাট্টা কোরো না, ভদ্রমহিলার আই মিন জয়িতাদির দেখেছ মাথায় সিঁদুর নেই। স্বামী মারা গেছেন হয়তো।

আর তাই একটা রোবট ভাড়া করে দার্জিলিং ভ্রমণে এসেছেন, তুমি গল্প লেখা শুরু করে দাও বুঝলে। ভালো কল্পনাশক্তি আছে।

তুমি তো আমার কথা একেবারেই উড়িয়ে দিচ্ছ! হতে পারে না বুঝি এরকম?

পারে, পারে সব হতে পারে মলিকে কাছে টানে সুমন। তার রাগ রাগ মুখে একটা চকাস করে চুমু খেয়ে বলে,নতুন বউ চাইলে এই হোটেলটাও তাজমহল হতে পারে, আর আমি হতে পারি সম্রাট শাজাহান… ঠোঁটটা দাও না।

আঃ, আমার মুড নেই এখন নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় মলি। জয়িতাদির কথা ভেবে খারাপ লাগছে।

কেন? একটু ক্ষুণ্ণ সুরেই বলে সুমন, ভালোই তো আছেন মহিলা। সারাক্ষণ হাসছেন।

ওটা জোর করা হাসি। তোমরা ছেলেরা বুঝবে না। একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে মলি। বলে এত প্রাণবন্ত মহিলা, অনুভূতিপ্রবণ কিন্তু সঙ্গীহীন রোবট কি আর মানুষের একাকিত্ব ঘোচাতে পারে। তার ওপর ওরকম গম্ভীর একটা রোবট!

যাঃ, তুমি সত্যিই ভাবছ নাকি উনি একটা রোবট!

রোবট যদি না হয়, তাহলে তো লোকটাকে আরও-ই সহ্য করা যাবে না। রবিঠাকুরের কবিতাও লোকটা জীবনে পড়েনি। ভাবা যায়!

 

রাত দশটা। খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় এসে শুয়েছেন মি. দাস। জয়িতা ঘরে ঢুকল। একটা গোলাপি রঙের হাত কাটা নাইটি পরেছে। স্বচ্ছ পোশাকটার ভেতরে তার পরিপূর্ণ শরীর কুয়াশা ঢাকা চাঁদের মতো সুন্দর লাগছে।

মি. দাসের পাশে এসে জয়িতা বসল। মি. দাসের গায়ে হাত রেখে বলল, চলো ঘুমোই।

আর একটু পরে, মি. দাস বললেন।

জয়িতা একটু ঝুঁকে মি. দাসের ঠোঁটে একটা আলতো করে চুমু খেল। তারপর তার একটা হাত ধরে নিজের বুকের ওপর রাখল।

হাত ছাড়ো জয়িতা, আমার ভাল্লাগছে না।

জয়িতা হাতটা ছেড়ে দিল। মনোযোগ দিয়ে একটা একটা করে মি. দাসের জামার বোতাম খুলতে লাগল।

আঃ, কী করছ? এক ঝটকায় জয়িতার হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিলেন মি. দাস।

জয়িতা তাকিয়ে আছে। তার ভুরুটা একটু কুঁচকেছে। যেন কিছু একটা জিনিস তার বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে। একটু চুপ থেকে সে আবার হাত বাড়াল। মি. দাস একটা পাজামা-প্যান্ট পরেছিলেন, সেটা ধরে টেনে নামিয়ে দিল জয়িতা।

ইউ ডার্টি গার্ল, প্যান্ট টানতে টানতে উঠে দাঁড়ালেন মি. দাস। রাগ রাগ মুখে জয়িতার গলার পেছনে একটা বিশেষ অংশে দুই আঙ্গুল দিয়ে জোরে চাপ দিলেন। আর সঙ্গে সঙ্গেই বিছানার ওপর ঢলে পড়ল জয়িতা। তার চোখ বন্ধ হয়ে গেছে। নিঃসাড় শুয়ে আছে।

যেমন নিঃসাড় আমার এই পা টা, নিজের মনেই বললেন মি. দাস। পাজামার ওপর দিয়ে নিজের কৃত্রিম ডান পা-টার ওপর সস্নেহে ধীরে ধীরে হাত বোলালেন। জয়িতার দিকে তাকিয়ে একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললেন। বেচারি। ওর তো কোনও দোষ নেই। রাত হলেই ক্লায়েন্ট কে ও সেক্সুয়াল সার্ভিস দেবে। এভাবেই ওকে প্রোগ্রাম করা আছে।

নিজের মনেই একটু হাসলেন মি. দাস। সানরাইজ দেখে, কুয়াশা দেখে কেমন সুন্দর মুগ্ধ হবার ভান করে মেয়েটি। যেমন তিনি ভান করছেন একটি স্বাভাবিক সুস্থ, মানুষের মতো বাঁচার…

নীচু হয়ে জয়িতার কপালে একটা ছোট্ট চুমু দিলেন মি. দাস। তারপর পাশে এসে শুয়ে পড়লেন।

 

দস্তানা

হোয়্যার ইজ দ্য রিভার?

সকালে উঠেই সিঁড়ি বেয়ে সোজা নীচে। সে রিসেপশনে হামলে পড়ল। কেতাদুরস্ত (যেমন হয়) রিসেপশনিস্ট যুবকটিকে সামান্য সুপ্রভাত জানানোর সুযোগটাও দিল না। তার হাঁসফাঁসে চেহারাটা দেখে ছেলেটি নিজেকে সামলে নিল, হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল– দেয়ার ইউ হ্যাভ আ ব্যাক ডোর, ওপ্ন ইট, অ্যান্ড দেয়ার ইউ গো। বাট ইট্স অফুলি কোল্ড আউটসাইড, মর্নিং ইন জার্মানি ইজ ভেরি ভেরি চিলি। হোয়্যার ইজ ইওর ওভারকোট ম্যাম? ইট্স আ মাস্ট বিফোর ইউ থিংক অফ গোইং আউট।

রিমি এক মুহূর্ত ভাবল। নদী তার জন্য অপেক্ষা করবে না? সামান্য একটা শীতের পোশাক পরে বেরোতে? এই নদী তো আজন্ম তার, হ্যাঁ, তারই জন্য সে অপেক্ষা করেছে। যেমন সুদূর কলকাতায় তার জন্য অপেক্ষা করছে অভি।

সে সিঁড়ির রাস্তা ধরছিল। রিসেপশনিস্ট ছেলেটি তাকে আগের মতোই মধুর গলায় বলল– হ্যাভ আ লুক অ্যাট ইওর লেফট, দেয়ার ইজ আ লিফট।

রিমি লিফটে উঠল। উঠেই মনে হল, দয়ালু ছেলেটিকে সে একবারও ধন্যবাদ জানায়নি। লিফটের দরজা বন্ধ হওয়ার মুহূর্তে সে ফাঁক দিয়ে চেঁচিয়ে বলল– ডাঙ্কে, ডাঙ্কে শ্যুন।

জার্মানিতে আসার পর সে হাতে গোনা যে ক’টি জার্মান শব্দ শিখেছে তার মধ্যে এই একটা– ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ।

ওভারকোটটা পরে সে যখন রিসেপশন ডেস্কের পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে বেরোল, মুখে এসে ঝাপটা মারল তীক্ষ্ম তিরের মতো ঠান্ডা হাওয়া। কিন্তু রিমি তা আগ্রাহ্য করল। সামনে দিয়েই চলে গেছে একটা সোজা চকচকে রাস্তা, আর তার ওপারে… রিমি স্বপ্নেও ভাবেনি তার সঙ্গে রাইন-এর কোনওদিন দেখা হবে! কিন্তু না, দেখা তো হল! সত্যি! সে রাস্তাটা দৌড়ে পার হল। এরপর তার সামনে সেই নদী। রিমি প্রাণ ভরে তাকে দ্যাখে। ওভারকোটের পকেট থেকে ক্যামেরা বার করে। ছবির পর ছবি, তারও পর ছবি।

সে রাইন-এর ধার ধরে ধরে হাঁটতে শুরু করল। বিশ্বাস হচ্ছে না। পটাপট ছবি তুলছে। ছবি তুলতে গেলে দস্তানা পরলে একটু অসুবিধে হয়। কিন্তু ঠান্ডাটা বড্ড বেশি। সে ছবি তোলায় ক্ষান্ত দিয়ে ওভারকোটের পকেটে ক্যামেরাটা পুরে ফেলে দস্তানা হাতড়ায়। সর্বনাশ, সে দস্তানা না নিয়েই বেরিয়ে পড়েছে! এবার কী হবে!

এই ঠান্ডায়!

রিমি হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা চলে এসেছে। নদীর সঙ্গে প্রথম দেখা হওয়ার উচ্ছ্বাসে আর ছবি তোলার উৎসাহে এতক্ষণ দস্তানার অভাবটা মালুম পড়েনি। এখন পড়ছে। ওভারকোটের পকেটে দু’হাত ঢুকিয়ে সে ফেরার পথ ধরে। কিন্তু এতক্ষণ সে হেঁটেছে হাওয়ার দিক বরাবর। এবার হাঁটতে হচ্ছে হাওয়ার উলটোদিকে। আপাতত তার নাক বলে কিছু নেই, জমে পাথর হয়ে গেছে। একটা জায়গায় নদীর ধারে ছোট্ট একটা খাঁড়িতে কিছু হাঁস খেলা করছে, ওদের শীত লাগছে না? রিমি পকেট থেকে ক্যামেরা-সহ হাত বার করল, সঙ্গে সঙ্গে তার আঙুলগুলো যেন ঠান্ডায় বেঁকে গেল। সে দ্রুত হাত আর ক্যামেরা পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। যথেষ্ট হয়েছে, আর হাত বার করা যাবে না, শুধু চোখ দিয়ে প্রাণ ভরে দ্যাখো, দেখে যাও। কিন্তু সেখানেও কি শান্তি আছে! ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটায় চোখ জ্বালা করে জল পড়ছে। এত ঠান্ডা! বাপ রে বাপ!

রিমি জার্মানি এসেছে একটা প্রোজেক্টের কাজে। সে মানবীবিদ্যার ছাত্রী। যেসব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান নারী, সেখানকার নাগরিকেরা কেমন আছে, এই তার গবেষণার বিষয়। নানা শহর ঘুরে সে এসেছে এই বন শহরে। যা পূর্বতন পশ্চিম জার্মানির রাজধানী ছিল। ভারি সুন্দর সাজানো শহর। আর ওই নদী, যেন তার গলার হার। কিন্তু আপাতত কাব্যি করার চাইতে হোটেলের নিয়ন্ত্রিত উষ্ণতায় ঢুকে পড়া তার পক্ষে বিশেষ দরকারি।

হ্যাঁ, সে কবিতা লেখে। সেসব তেমন কিছু নয়। নিজের ল্যাপটপের এক কোণায় সেভ করে রাখা। তারা ওখানেই নিশ্চিন্তে ঘুমায়। তাদের বাইরে টানাটানি করাটা রিমির পোষায় না। ওসব তার একান্ত ব্যক্তিগত আবেগের প্রকাশ, কারও সঙ্গে সে তা ভাগ করে নিতে চায় না।

সে সোজা ডাইনিং হলে ঢুকে পড়ল। এখানে হোটেলের চার্জের সঙ্গে প্রাতরাশটাও মুফতে। সে পরে হবে’খন। আগে পরপর দু’কাপ কফি। তারপর অন্য সব। বাব্বা, ঠান্ডা কাকে বলে!

প্রাতরাশ সেরে সে যখন লিফটে উঠছে, রিসেপশনিস্ট ছেলেটির সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল। সুভদ্র হেসে বলল– হাউ ডিড ইউ লাইক ইট?

– হোয়াট? মাই ব্রেকফাস্ট?

– ও নো নো, দ্য রিভার।

– অ্যসাম বিউটি, অফুলি চিলি!

– আই টোল্ড ইউ। হোপ ইউ ওন্ট ক্যাচ কোল্ড।

– গড ব্লেস মি, আই হ্যাভ লোড্স অফ ওয়ার্ক টু ডু।

– ইউ উইল বি হিয়ার ফর থ্রি ডেজ, নো?

– ইয়াপ, মাই ওয়ার্ক ডিমান্ডস দ্যাট।

– ওকে, মাই বেস্ট উইশেস ফর ইওর ওয়ার্ক, হোয়াটেভার ইট মে বি।

– ডাঙ্কে, ডাঙ্কে শ্যুন।

– ওহ, ইউ গট ইট, হা হা হা, মোস্ট ওয়েলকাম!

রিমি ঘরে ঢুকল। এতক্ষণে সে একটু ধাতস্থ হয়েছে। কিন্তু গ্লাভ্সগুলো কোথায় গেল? তার তো ঘরে বসে থাকলে চলবে না। বেরোতে হবে, বাইরে ঘুরতে হবে। সে সম্ভাব্য সব জায়গায় খুঁজে দেখল, কোত্থাও নেই। তাহলে সে কি আগের কোনও শহরে ফেলে এল তাদের। তবে তো গ্লাভ্স একজোড়া কিনতেই হচ্ছে। রিসেপশনের ছেলেটিকেই জিজ্ঞেস করতে হবে কোথায় কোন দোকানে পাওয়া যেতে পারে।

সে ল্যাপটপ খুলে বসে। কিছু তথ্য সে সংগ্রহ করেছে। সেগুলো গোছাতে হবে। এমনিতে সে কাজের ক্ষেত্রে খুব গোছানো। ফেলে ছড়িয়ে কাজ তার পোষায় না। তবু… ওই দস্তানা জোড়া… ধ্যুৎ… কোথায় যে গেল।

হারিয়ে যাওয়া দস্তানা থেকে তার মনও যেন কোথায় হারিয়ে যেতে চাইছে। সে ল্যাপটপে নতুন একটা পাতা খুলল…

আমাকে একাকী ফেলে

কোথায় হারিয়ে গেলে

উষ্ণতা, এসো ফিরে

প্রিয় নদীটির তীরে

এরপর আর কাজ হয় না। সে রিসেপশনে একটা ফোন লাগাল।

– ইয়েস ম্যাম, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?

– লিসন, আই লস্ট মাই ওল্ড পেয়ার অফ গ্লাভ্স, আই নিড টু বাই আ নিউ ওয়ান। ক্যান ইউ সাজেস্ট মি আ মার্কেট অর আ শপিং মল হোয়াটেভার হোয়্যার আই ক্যান গেট দ্যাট?

– উপ্স, ইউ ওয়াক্ড বাই দ্য রিভার উইদাউট ইওর গ্লাভ্স!

– ইউ বেট!

– আর ইউ ফ্রি টুডে?

– ইন দ্য মর্নিং, ইয়েস। আফটার ওয়ান আই অ্যাম অকুপায়েড।

– ওকে, আই সার্টেনলি ক্যান ডু ওয়ান থিং, আয়্যাম গিভিং সামওয়ান টু অ্যাকম্পানি ইউ টু দ্য শপ ফ্রম হোয়্যার ইউ ক্যান বাই ইট, উইল দ্যাট বি ওকে?

– ও থ্যাংক ইউ, থ্যাংক্স ভেরি মাচ।

– ওহো, ইউ ডোন্ট রিয়েলি লাইক মাই সাজেশন।

– হোয়াট মেক্স ইউ থিংক লাইক দ্যাট!

– আদার ওয়াইজ ইউ উড হ্যাভ সেড ডাঙ্কে, ডাঙ্কে শ্যুন।

– ওহ্, হা হা হা …আই উইল সেভ দ্যাট ফর আ বেটার

মোমেন্ট, ওকে?

– ওকে! অ্যাজ ইউ উইশ ম্যাম!

এগারোটা নাগাদ ছেলেটি ফোন করল রুমে। তার পথপ্রদর্শক এসে গেছে। এবার গ্লাভ্স কিনতে বেরোতে হবে। রিমি ভালো দেখে বেছে এক জোড়া গ্লাভ্স কিনল। তাতে হাত গলিয়ে এমন আরাম হল, যেন হাত দু’টো গ্লাভ্সের মধ্যে ঘুমিয়েই পড়বে। কিন্তু ঘুমিয়ে পড়লে তো চলবে না। অনেক কাজ, সামনে অনেক কিছু করা বাকি।

সে তার সঙ্গের ছেলেটিকে ধন্যবাদ ও বিদায় জানিয়ে হোটেলে ফিরল। রিসেপশনের ছেলেটির দিকে তাকিয়ে একটা ধন্যবাদ

(ইংরেজিতেই) জানিয়ে সোজা চলে গেল রুমে। হাতগুলো দস্তানার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ছে। না, না, ওদের জাগাতে হবে, জাগাতে হবে।

সে ল্যাপটপটা খুলে রেখেই বেরিয়ে গেছিল। খোলা সাদাপাতা, তাতে চারটি পঙ্ক্তি, তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কি আরও কিছু বলতে চায়? সে দস্তানা জোড়া বিছানার ওপর ছুড়ে ফেলল, তারপর ল্যাপটপটা কোলে টেনে নিয়ে…

আমাকে একাকী ফেলে

কোথায় হারিয়ে গেলে

উষ্ণতা, এসো ফিরে

প্রিয় নদীটির তীরে…

আমার নগ্ন হাতে

ছোঁয়াছুঁয়ি কার সাথে

নদী, বলো তার নাম

কাকে ভালোবাসলাম…

দুপুরের পর থেকে রিমি খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একটু দেরিই হয়ে গেল বেরোতে। তারপর পাঁচ জায়গায় ঘোরাঘুরি। দস্তানা জোড়া সে খুব সাবধানে রাখল। আবার যেন না হারায়। হোটেলে ফিরতে ফিরতে সাতটা বাজল। এখন ভারতে রাত সাড়ে এগারোটা। অভি, তার প্রেমিক অভিমন্যু ফোন করবে। কিংবা সেও অভিকে ফোন করতে পারে। যে-কোনও একজন আগে করে ফেলতে পারে, এতে অত হিসেবের কিছু নেই। রুমে ঢুকে ল্যাপটপের ব্যাগ, কাগজপত্তরের আরেকটা ঢাউস ব্যাগ, ওভারকোট, মাফলার, আর হ্যাঁ, দস্তানা জোড়াও সে বিছানার ওপর ছড়িয়ে ফেলল। ডাবল বেড, কাজেই একপাশে তার শোওয়ার মতো জায়গা আছে। সে জুতো মোজা না খুলে হাত-পা ছড়াতে না ছড়াতেই রুমের ফোনটা বাজল। নিশ্চই অভি। মোবাইলে না পেলে হোটেলেও ফোন করে। রিমি এলিয়ে পড়েছিল, একটু কষ্ট করে উঠল

– হ্যালো!

– ইউ হ্যাভ আ কল ফ্রম ইন্ডিয়া ম্যাম। উড ইউ লাইক টু টেক ইট ইন ইয়োর রুম?

– ইয়েস, প্লিজ।

– রিমি, কখন ফিরলে?

– এই মাত্র। আজ খুব খাটনি গেছে। তোমার খবর বলো।

– আমি ঠিক আছি। আমিও একটু আগে ফিরলাম। শোনো, তুমি ওখানে থাকাটা আর বেশি বাড়িও না। মা খুব তাগাদা দিচ্ছে। তোমার মায়ের সাথে আজ কথা হল, উনিও চাইছেন না তুমি আর বাইরে থাকো।

রিমির ক্লান্ত লাগে। এই একটাই কথা অভি আজকাল প্রায়ই বলে। এটা নাকি দু’জনের বাড়ি থেকেই চাইছে। মা’ও সেদিন ফোনে একই কথা বলছিল। আশ্চর্য, সে কি মজা করার জন্য এই নির্বান্ধবপুরীতে একা একা খেটে মরছে! সেই হতাশাটাই তার উত্তরে প্রকাশ পেল – অভি, আমি কাজটা শেষ করি তুমি চাও না?

– নিশ্চই চাই, কিন্তু তাই বলে এতদিন বাইরে বাইরে থাকাটা… আমাদের বিয়েটা সেরে ফেললে হতো না?

– বিয়ে তো সারা হবেই, সোনা। তার আগে আমায় আরেকটু সময় দাও। প্লিজ। এই প্রোজেক্টটা সাকসেসফুল হলে তোমার আনন্দ হবে না? কত আর বেশি দেরি হবে? মাস তিন-চার? এর মধ্যে আমরা কি বুড়োবুড়ি হয়ে যাব?

– তা বলছি না, কিন্তু একা একা…

– একা বলেই তো তোমার কাছে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছি, তাড়াতাড়ি কাজটা শেষ করে নিয়েই এক লাফে তোমার পিঠে চেপে বসব, রাইট?

অভিমন্যু মানতে চায় না। রিমির আর কথা বলতে ইচ্ছে করে না। সে বাইরে থেকে খেয়ে এসেছে। এখন সে একটু বাথটবে গরমজল ভরে শোবে, শুয়ে শুয়ে একটু রেড ওয়াইন পান করবে, তারপর সোজা বিছানায়, লেপের তলায়। এর মধ্যে তার মনে হয় যত দিন যাচ্ছে অভি বড়ো ঘ্যানঘ্যান করছে। তার মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে।

– সরি অভি, আজ আর কথা বলতে পারছি না, সারাদিন বড্ড ঘোরাঘুরি হয়েছে, এবার একটু রিল্যাক্স করতে চাই।

– তোমার উড-বি-হাজব্যান্ডের সঙ্গে কথা বলাটা কি রিল্যাক্সেশনের মধ্যে পড়ে না? আর শোনো, আমিও আজ সারাদিন অফিস করেছি। বসের সঙ্গে ঝামেলা করেছি। ফেরার পথে আমার গাড়িটাকে একটা স্কর্পিও ফ্রম নো হোয়্যার এসে রিয়ার ভিউটা ঠুকে দিয়ে গেল। আমিও যথেষ্ট ক্লান্ত। তোমার সঙ্গে কখন কথা হবে সেই কথা সারাদিন ভাবি, আর তুমি আজকাল কথাই বলতে চাও না!

– ওহ্ না না অভি! কে বলেছে কথা বলতে চাই না? অন্যদিন তো বলি! আজ কেন কে জানে… শোনো, আমি শিগগিরি একটা ডিসিশন নিয়ে নেব ফেরার ব্যাপারে… আমার কাজটা তার মঝ্যে ঝটপট করে ফেলতে হবে… জাস্ট বিয়ার উইথ মি ফর সামটাইম… ঠিক আছে সোনা আমার? …লাভ ইউ লাভ ইউ লাভ ইউ…

– ওকে

– তুমি লাভ ইউ বললে না?

– হ্যাঁ, লাভ ইউ, ছাড়ছি।

– গুড নাইট বেবি!

ওদিক থেকে আর কোনও সাড়া এল না। অভিমন্যু লাইন কেটে দিয়েছে।

রিমির কেমন যেন একটা লাগে। উঠে বাথটাবের গরমজলের কলটা খুলে দিয়ে আসা দরকার। জল ভরতে ভরতেই কাগজপত্রগুলো গোছগাছ করে রাখা দরকার। জামাকাপড় ছাড়া দরকার। একা থাকার এই এক সুবিধা। ইচ্ছেমতো নগ্ন হওয়া যায়। কিন্তু সে কিছুই করল না। বিছানায় হামাগুড়ি দিয়ে ব্যাগ থেকে ল্যাপটপটা বার করল… কী যেন লেখা ছিল ওই পাতাটায়?

আমাকে একাকী ফেলে

কোথায় হারিয়ে গেলে

উষ্ণতা, এসো ফিরে

প্রিয় নদীটির তীরে…

আমার নগ্ন হাতে

ছোঁয়াছুঁয়ি কার সাথে

নদী, বলো তার নাম

কাকে ভালোবাসলাম…

রিমি তার ক্লান্ত আঙুল কি প্যাডে রাখতেই তারা কেমন আপনা থেকেই সচল হয়ে উঠল,

তাকে বলো, ভালোবাসি

বলো, তোমার কাছে আসি

পেতে এতটুকু ওম

কী নরম কী নরম!

এবার এখানে ঠান্ডা বেশি পড়েছে। আজ সকাল থেকে শহরে তুষারপাত হচ্ছে। জানলা দিয়ে সেই ঝরে পড়া ছোটোছোটো তুলোর বলের দিকে তাকিয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিতে ইচ্ছে করে। রিমির আজ কাজে বেরোতে মন চায় না। লেপের তলায় শুয়েই থাকে। কী একটা অবসাদ জড়িয়ে ধরেছে তার হৃদয়। তাকে আরও অনেকদিন এখানে থেকে যেতে হবে। তার দেশের থেকে দূরে, তার পরিবার থেকে দূরে, তার প্রেমিক, যে তার ভাবী স্বামী, তার থেকে দূরে। কিন্তু, ব্যাপার হল, তার মানসিক অবসাদ ঠিক এই জন্য নয়। কী জন্যে যে, সে নিজেই ভালো বোঝে না।

হ্যাঁ, একটা বিয়ে তার আশু কর্তব্য। কিন্তু কেন! তার যদি অভিকে আর ভালো না লাগে! এই অবধি ভেবে রিমি তার মনকে নিয়ন্ত্রণে আনল। ছি, এসব আবার কী কথা। সে কি চিরদিন একা একা এইখানে পড়ে থাকবে নাকি! সে দেশে ফিরবে, তার বহুদিনের প্রেমিক অভিকে বিয়ে করবে, তাদের একটি-দু’টি সন্তান হবে, সন্তানেরা বড়ো হবে, তাদের স্কুলে ভর্তি করতে হবে, তারা ভালো চাকরিবাকরি করবে, তাদের বিয়ে হবে, নাতিপুতি হবে… হা হা হা– মানুষের জীবনে এই গতানুগতিক সুখের চেয়ে বড়ো আর কিছু হয় কি?

অবসাদ… অবসাদ… এরকম একটা জীবনের কথা মনে আসতেই কেন কে জানে রিমির বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে। সে লেপের তলায় পাশ ফিরে শোয়।

তখনই তার রুমের ফোনটা বেজে ওঠে,

– হ্যালো!

– হ্যালো ম্যাম, গুড মর্নিং

– গুটেন মর্গেন

– হা হা হা গুটেন মর্গেন ইনডিড, বাট মর্নিং শোজ দ্য ডে। উই আর গোইং টু হ্যাভ আ মিজারেবল ডে।

– ইউ নো ইট বেটার।

– এনি ওয়ে, ম্যাম, হ্যাভ ইউ হ্যাড ইওর ব্রেকফাস্ট?

– নট ইয়েট। আয়্যাম স্টিল ইন বেড।

– ওহো, আয়্যাম সরি।

– নো নো, ইট্স অলরাইট, টেল মি।

– অ্যাকচুয়ালি… মাই ডিউটি আওয়ার ইজ ওভার। আই জাস্ট এনকোয়ার্ড হোয়েদার ইউ নিড সামথিং।

– ওহ, সো নাইস অফ ইউ। রাইট নাউ আই নিড সাম স্লিপ। দেয়ার মাস্ট বি সামওয়ান দেয়ার আফটার ইউ লিভ। আই উইল লেট হিম অর হার নো ইফ আই নিড এনিথিং।

– রাইট ম্যাম। আই অ্যাম লিভিং। হ্যাভ আ বেটার ডে।

– হা হা হা, ইউ বেট! ডাঙ্কে শ্যুন!

– মোস্ট ওয়েলকাম, ম্যাম!

ছেলেটি ফোন কেটে দিল। রিমি হঠাৎ দেখল তার মন ভালো হয়ে গেছে।

তুষারপাত হয়েই চলেছে। রিমি রেস্টুরেন্টে গিয়ে কাপুচিনোর মাগ নিয়ে বসল। সে মোবাইলে সর্বদা অনলাইন। কে একটা মেসেজ পাঠাল কোনও চেনা নাম নয়। অরূপ মহাজন। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে। রিমি তার প্রোফাইলে গেল। মনে হয় নতুন প্রোফাইল খুলেছে। কোনও ছবি নেই, ওয়ালপেপার নেই। কোনও কিছু আপলোড করা নেই। সে ইনবক্সে জিজ্ঞেস করল – আপনি কে?

কোনও উত্তর নেই। তারপর – ক্যান আই চ্যাট উইথ ইউ?

– নো, সরি, অ্যাট ফার্স্ট আই মাস্ট নো হু ইউ আর।

– আ নিউ ফ্রেন্ড।

– ফ্রেন্ডস নো ইচ আদার।

– ওকে, মে বি সাম আদার ডে। বাই।

রিমি বিরক্ত হয়ে ফোনটা টেবিলের ওপর রাখল। সে আজ কাজে বেরোয়নি ঠিকই, ভেবেছিল বিশ্রাম নেবে। কিন্তু তার মাথা গজগজ করছে চিন্তায়। তার কাজ আর অভিকে নিয়ে একটা টানাপোড়েন শুরু হয়েছে বেশ কয়েকদিন হল। সে কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। যে-প্রোজেক্টটা নিয়ে সে এখানে এসেছে, সেটা তার কাছে অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। তার আগাগোড়া মেধাবী কেরিয়ার এতে উজ্জ্বলতর হবে। অভি কেন বুঝতে চাইছে না? যদিও সে জানে, এই দীর্ঘদিনের অসাক্ষাৎ তাদের দু’জনের পক্ষেই বেদনাদায়ক। দু’মাস হয়ে গেল দু’জনের দেখা নেই। যদিও ওয়েব ক্যাম-এ পরস্পরকে দেখতে দেখতেই তারা চ্যাট করে। কিন্তু অভির মুখে বিরহের পরিবর্তে বিরক্তিই বেশি।

রিমির মাঝে মাঝে মনে হয়, ভৌগোলিক দূরত্ব কি তাদের মানসিক দূরত্ব সৃষ্টি করছে। এরকমটা হয় সে জানে। কিন্তু… না না না… তাদের ক্ষেত্রে অন্তত এটা সত্যি না। এই তো ক’দিন আগে এক বছরের ডেপুটেশনে অভিকে অফিস থেকে দিল্লি পাঠাল, তখনও তারা চ্যাট করত, ফোনে কথা বলত, রিমি যথেষ্ট ‘ভাল্লাগে না ভাল্লাগে না’-ও করত। কিন্তু এত চাপ সৃষ্টি করত না। হঠাৎ করে সে জার্মানিতে আসার পর থেকেই বিয়ের ছটফটানি শুরু হল কেন? তার ছাব্বিশ চলছে, অভির তিরিশ। এতে কি বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে!

কাপুচিনোটা শেষ হয়ে গেছে। রিমি রুমে এসে ওভারকোটটা গা’য়  চাপিয়ে মাথার হুডটা তুলে নিল। মাফলার, দস্তানা, ওয়াটারপ্রুফ জুতো জোড়া। তারপর রুমের ল্যাচটা টেনে লাগিয়ে বেরিয়ে পড়ল। তুষারপাতটা বেড়েছে। তবু সে রাইন নদীর ধার ধরে হাঁটতে লাগল। মুখে শানানো ছুরির মতো কনকনে ঠান্ডার আঘাত। সে হাঁটছে হাঁটছে হাঁটছে। কোথা থেকে? কোথায়? সে জানে না। মনে হয় সে সত্যিই অভির থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আর এটা হয়েছে জার্মানিতে আসার আগেই। শুধু বোঝা গেছে আসার পর।

এই শহরের বাকি যা কাজ, কালকের মধ্যে সেরে ফেলতে হবে। ব্যাপারটা চাপের হয়ে গেল, শুধু শুধু একটা দিন নষ্ট করল সে। পরশু সে কোলোন চলে যাবে। তবু, আজ যদি দিনটা সে রাইনের হাত ধরে অনেক দূর চলে যেতে পারে, সেও তো কম পাওয়া নয়।

ফোনটা কাঁপছে। সে পকেটের মধ্যে থেকে ফোন বার করল। অভি। অনলাইন।

– ওখানকার কাজ শেষ হল?

– নাহ্, আজ কোনও কাজ হল না, জানো! কালকে সব সারতে হবে, হয়ে যাবে। চিন্তার কিছু নেই।

– রুমে পেলাম না, কোথায় বেরিয়েছ?

– এই হাঁটছি, রাইনের ধার ধরে। বরফ পড়ছে, জানো! আর কী ঠান্ডা হাওয়া।

– শুধু শুধু ঠান্ডা লাগাচ্ছ কেন, হোটেলে ফিরে যাও।

রিমির মনে হল, অভি যদি তার সঙ্গে থাকত, সে বোধ হয় এভাবে এই কথাগুলো বলত না। বরং বলত – চলো আরও হাঁটি।সেই একসঙ্গে হাঁটার দিন কি তাদের ফুরিয়ে এল!

সারাদিন এদিক ওদিক উলটোপালটা ঘুরল সে। ভাগ্যিস তার কাছে দু’টো দরকারি জিনিস ছিল। এক – শহরের একটা ম্যাপ, দুই – হোটেলের ফোন নাম্বার। সন্ধে নাগাদ বরফ আর হাওয়ার দাপট বাড়ল। এবার হোটেলে ফিরতে হবে। বিরাট বিরাট শপিং প্লাজাগুলি আলো-ঝলমল, কিন্তু রাস্তায় কোনও লোক নেই, গাড়িও হাতেগোনা। রিমি হোটেলে ফিরে এল।

রুমে ফিরে বাঁ হাতের দস্তানাটা টেনে খুলবার জন্য ডান হাত বার করল। আশ্চর্য, ডানহাতের দস্তানাটা কোথায়! অভিকে মেসেজ করার সময় সে ডানহাতের দস্তানাটা খুলেছিল। তারপর নির্ঘাত পকেটে ঢোকাতে গিয়ে পড়ে গেছে। রিমির কান্না পায়। এই এক জোড়া গ্লাভ্স তাকে জ্বালিয়ে মারল। সে নীচে নেমে এল। রিসেপশনে একটি মেয়ে। তাকে এগিয়ে যেতে দেখে গম্ভীর মুখে বলল – ইয়েস ম্যাম?

– আই লস্ট মাই… এই অবধি বলেই রিমির মনে হল সেই ছেলেটি, যে তাকে গ্লাভ্সের দোকানে নিয়ে গিয়েছিল, সেরকম কাউকে তো মেয়েটি ঠিক করে দেবে না, আর সে নিজেও রাস্তা চিনে চিনে এই অন্ধকারে যেতে পারবে না। সে বাকি কথাটা গিলে নিল, বলল – আই থিংক আই লস্ট মাই রুম কি।

মেয়েটি চাবি ঝোলানো বোর্ডের দিকে তাকিয়ে বলল – ইয়োর রুম নাম্বার?

রিমি বলল। মেয়েটি গম্ভীর মুখেই বলল – নো, ইট্স দেয়ার। ইউ সাবমিটেড বিফোর গোইং আউট।

– ওঃহো, থ্যাংক্স আ লট।

কেন কে জানে মেয়েটিকে তার ডাঙ্কে শ্যুন বলতে ইচ্ছে করল না।

পরের দিন কাজে কাজেই সময় কেটে গেল। দস্তানা আর কেনা হল না। রাত্রিবেলা ঘরে ফিরে সে রিসেপশনের দিকে একবার তাকাল। না, পরিচিত ছেলেটি নেই। থাকলে সে একটু বিদায় নিত। কাল ভোর ভোর বেরিয়ে পড়তে হবে।

ভোরে বেরোনোর সময় লাগেজ নিয়ে নীচে নেমে রিমি রিসেপশনে চাবি জমা দিতে গেল। গিয়ে দেখল ছেলেটি আছে। রিমি খুশি হল। চেনা মানুষ দেখলে যেমন আনন্দ হয়। সে বলল – ইউ নো হোয়াট, আই লস্ট আ গ্ল্যাভ্স এগেন।

– ও মাই গড! হাউ?

– ডোন্ট রিমেমবার, মে বি আই ড্রপড ইট ফ্রম মাই পকেট। অ্যাকচুয়ালি আই ওয়াজ মেসেজিং মাই বয়ফ্রেন্ড, মাই উড-বি।

– ওহ, ওয়াও! ছেলেটি হঠাৎ আরও ভদ্র হয়ে গেল। – কনগ্র্যাটস অ্যান্ড গ্রিটিংস টু বোথ অফ ইউ।

– ডাঙ্কে, ডাঙ্কে শ্যুন।

– মোস্ট ওয়েলকাম!

রিমি হাত বাড়াল, তার দস্তানাবিহীন নগ্ন ডানহাত।

ছেলেটি হাতটা ধরল। উষ্ণ স্পর্শ। বলল – হ্যাভ আ ওয়ানডারফুল লাইফ। ফাইনালি, বিফোর উই পার্ট, মে উই ইনট্রোডিউস আওয়ারসেলভ্স আ বিট মোর পার্সোনালি?

– ও শিওর শিওর, ইউ আর সো হেল্পফুল, আই উইল রিমেমবার ইউ। প্লিজ টেল মি ইয়োর নেম।

– হ্যালো, দিস ইজ অরূপ মহাজন।

দু’মুহূর্ত দু’জনেই চুপ, তারপর দু’জনেই একসাথে হেসে উঠল। রিমি বলল

– বাট ফ্রম হোয়্যার দা হেল ইউ গট দ্যাট ইন্ডিয়ান নেম!

– উই হ্যাড আ বোর্ডার ফ্রম ইন্ডিয়া আ ফিউ ডেজ এগো।

– হা হা হা, হাউ ফানি। নাউ ইউ মাস্ট টেল মি ইয়োর রিয়েল নেম।

– অলিভার, অলিভার ম্যাথাউজ।

– হাই, আয়্যাম রিমি, রিমি বোস।

– হ্যালো রিমি, ইট ওয়াজ আওয়ার প্লেজার টু হ্যাভ ইউ হিয়ার ইন আওয়ার হোটেল।

– ওকে, নো ফর্মালিটিজ, বি জাস্ট দ্য ওয়ে ইউ আর, অ্যান্ড সেন্ড মি ইওর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট, আই উইল অ্যাকসেপ্ট। বাই।

রিমি খেয়াল করেনি তার ডান হাতটা তখনও ছেলেটির মুঠোতে ধরা।

তার দস্তানার অভাব এভাবে পূরণ হলে মন্দ কী?

প্রহেলিকা

( এক )

মেয়েটা আজও এসেছে। ওর ব্যাগ থেকে একে একে বার করে ফেলছে জাংক জুয়েলারি, নেলপলিশ, লিপস্টিক আর শিফনের সুন্দর সুন্দর স্কার্ফ। কমবয়সী টিচাররা হামলে পড়েছে সে সব কেনার জন্য। মেয়েটা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে, এমনিতেই কম কথা বলে। অহনা স্টাফরুমে ঢুকে জলের বোতল খুলে ঢকঢক করে কিছুটা জল খেল, ইলেভেনের ক্লাসে এত মেয়ের মধ্যে চিৎকার করে গলা শুকিয়ে গেছে। বড়দিকে বলতে হবে ইলেভেন, টুয়েভ-এর ক্লাস দুটিতে মাইক্রোফোনের ব্যবস্থা করতে।

জলের বোতল নামিয়ে রাখতেই মেয়েটার সঙ্গে চোখাচোখি হল। মেয়েটা অন্যদিনের মতোই তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত সেই দৃষ্টি। মেয়েটাকে এই জন্যই তার অপছন্দ এত। আর কারুকে না, শুধু তার দিকেই তাকিয়ে থাকে এইভাবে। প্রথমবার, অহনা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হেসেছিল। মেয়েটি কিন্তু না হেসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল শুধু। একটু পরে অহনার মুখের উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়েছিল।

লোপা লাফাতে লাফাতে এল, এই অহনাদি, স্কার্ফটা বেশ সুন্দর না? বেগুনির উপর সাদা ফুল ছাপ। হ্যাঁ দেখতে বেশ সুন্দর, আর দামটাও রিজনেবল। অহনার ইচ্ছা করে পিয়ার জন্য গোটা দুই স্কার্ফ নিতে। কিন্তু না, এই মেয়েটার কাছে সে একটাও জিনিস কিনবে না। ওকে দেখলেই তার আপাদমস্তক জ্বলে ওঠে।

তুমি এবার অনেকদিন পরে এলে, সব খবর ভালো তো? আভাদির কথায় মেয়েটি বলে, পরীক্ষা নিয়ে একটু ব্যস্ত ছিলাম।

কী সাবজেক্ট যেন তোমার?

মিউজিক নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করছি, সেকেন্ড ইয়ার।

মেয়েটিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে অহনা। খুব রোগা, কাগজের মতো ফর্সা। সাজগোজও কেমন অদ্ভুত! নীল রঙের কাজল আর রানি রঙের লিপস্টিক ওর কাগজের মতো ফর্সা শরীরে একটা বিভীষিকা বুনে দিচ্ছে। মেয়েটা কি বোঝে না, ওকে এইরকম সাজে জঘন্য লাগে!

লোপা কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করতেই থাকে, অহনাদি, কানের দুলগুলো দেখেছ, সব তোমার টাইপ, এসব জিনিস একমাত্র তুমিই ক্যারি করতে পারবে। অহনার দম বন্ধ হয়ে আসে। লোপা তাকে তোষামোদ করে বলছে না। আসলে এই চুয়াল্লিশেও অহনা হাঁটুর বয়সী মেয়েদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জিতে যাবার মতো স্টাইলিশ। অন্য সময় হলে এই প্রশংসাগুলো এনজয় করত সে। কিন্তু একটু আগেই লোপার কথা শুনে মেয়েটার ঠোঁটের রেখা যে-ভাবে বেঁকে উঠল, তা দেখেই অহনার মাথায় রক্ত উঠে গেছে। মেয়েটার বড্ড অহংকার, একদিন টিফিনের সময় অহনা সবার জন্য খাবার অর্ডার করেছিল, পিয়ার জন্মদিন উপলক্ষ্যে। নিজে প্লেট সাজিয়ে মেয়েটার হাতে তুলে দিতে গিয়েছিল, মেয়েটা অবহেলা ভরে সেসব সরিয়ে রেখে বিক্রিবাটা সেরে ওড়নার ঝাপটা তুলে গর্বিত ভঙ্গিতে বেরিয়ে গিয়েছিল, আর অহনার সারা শরীর চিড়বিড় করে উঠেছিল।

( দুই )

কী রে আবার বেরিয়েছিলি তুই দুপুরে?

গাঢ় সবুজ রঙের নেলপলিশের শিশিটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল মেহুলী। বাবার কথা শুনে একবার তাকিয়ে আবার শিশিটাতে মন দিল।

উত্তর দিচ্ছিস না যে, মালতী বলছিল তুই নাকি কলেজ বাংক করলি শরীর খারাপের বাহানায়, তারপর ব্যাগ নিয়ে কোথায় বেরিয়ে গিয়েছিলি! তোর ব্যাগে ওইসব হাবিজাবি সাজগোজের জিনিস কেন? কোথায় যাস ওসব নিয়ে?

টেবিলের উপর ঠকাস করে নেলপলিশের শিশিটা নামিয়ে রাখে মেহুলী। চিৎকার করে ডাকে মালতীকে, তোমায় না মটরশুঁটির কচুরি আর আলুরদম বানাতে বলেছিলাম? বাপির আর আমার দুজনেরই প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। মালতীকে বেশি ডাকাডাকি করতে হয় না, বড়ো ট্রেতে করে সে খাবার সাজিয়ে নিয়ে আসে। মেয়ের রকমসকম দেখে শ্যামল হেসে ওঠে। খাওয়াদাওয়ার মাঝে মেয়ের সঙ্গে টুকটাক কথা হয়, মেয়ের পড়াশানোর খবর নেয় শ্যামল। কিন্তু মাঝে মাঝেই ব্যাগ ভর্তি জিনিস নিয়ে মেয়েটা কোথায় যে যায়, থই পায় না শ্যামল।

( তিন )

অহনা ভাবে মেয়েটা অনেকদিন আসে না আর। লোপারা বলছিল কবে ম্যাট ফিনিশ লিপস্টিকের অর্ডার নিয়ে গেছে, এখনও এল না। কিছুদিন আগেই তো পরীক্ষা শেষ হয়েছে বলল, তাহলে কি মেয়েটা অসুখে পড়ল! অহনা দেখে মেয়েটার ওই কর্কশ অভিব্যক্তিই তার মনে বেশ ছাপ ফেলে গেছে। নিজের অজান্তেই বলে বসল, ফোন করে একটা খবর নিতে পারিস তো! তা কী আর করা হয়নি, সিমটা খুলে রেখেছে মেয়ে৷ অহনা আর কথা বাড়ায় না। লাস্ট পিরিয়ডে পড়াতে পড়াতেই দেখতে পায় কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে আকাশ। মেয়েরা উশখুশ করছে। পড়াতে পড়াতে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে যায় অহনা।

অহনা বড়ো রাস্তা অবধি পৌঁছোনোর আগেই মুষলধারায় বৃষ্টি নামল। কোনওরকমে একটা ভর্তি অটোতে নিজেকে ছুড়ে দিল। কুড়ি মিনিটের রাস্তা পৌঁছোনোর আগেই ভিজে চুপচুপে হয়ে যাবে। মাঝপথে গিয়ে অটোচালক জানিয়ে দিল রাস্তায় জল জমেছে, ইঞ্জিনে জল ঢুকে যাবে, সে আর যাবে না। সহযাত্রীরা যে যার মতো ব্যবস্থা করে নিয়েছে। অহনা আশেপাশে তাকিয়ে দেখে একটাও শেড নেই, অগত্যা ছোটো ছাতাটি ভরসা করে দাঁড়িয়ে থাকে। হাওয়ার দাপটে ছাতার অবস্থাও শোচনীয়। সেই মুহূর্তেই একটা গাড়ি ব্রেক কষে তার সামনেই দাঁড়াল।

-আপনি?

– উঠে আসুন প্লিজ, এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজলে তো বিপদ বাধাবেন।

চমকে তাকায় অহনা, সেই মেয়েটা, নামটা কিছুতেই মনে করতে পারে না।

আরেকবার বলতেই অহনা মন্ত্রমুগ্ধের মতো ওর পাশের সিটে বসে পড়ল। মেয়েটাকে অসহ্য লাগলেও তীব্র একটা আকর্ষণও যে বোধ করে সে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু ঝোলা-কাঁধের সেলস গার্ল মেয়েটা আর দামি গাড়ি ড্রাইভ করা মেয়েটাকে ঠিক মেলাতে পারে না অহনা। লক্ষ্য করে দেখে মেয়েটার ঠোঁট দুটো তাচ্ছিল্যে কেমন বেঁকে গেছে।

সামনেই আমার বাড়ি, গা মাথা মুছে নিয়ে কফি খেতে খেতে বৃষ্টি থেমে যাবে। অহনা জিজ্ঞেস করল, তুমি… মেয়েটি মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ আমিই আপনাদের স্কুলে যাই, ওটা বাপিকে লুকিয়ে পকেট মানির জন্য করি।

শুকনো তোয়ালেতে গা মাথা ভালো করে মুছে নেয় অহনা। মেয়েটি কিন্তু একবারও শাড়িটা পালটাবার কথা বলল না। কফির কাপ হাতে অহনা ঘুরে ঘুরে দেখছিল ইন্ডোর প্ল্যান্ট-এর কর্নারটা। মেয়েটির মুখোমুখি হতে জিজ্ঞেস করল, তোমার মা কি বাড়িতে নেই? স্থির দৃষ্টিতে অহনার মুখের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে মেয়েটি বলে, আসুন আমার সঙ্গে।

অহনা এখন বড়োসড়ো একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে৷ মেয়েটির মায়ের ছবি। ছাইছাই রঙা শাড়ি, রানি কালারের ব্লাউজ, রানি কালারের লিপস্টিক আর নীল কাজলরেখা। অত্যন্ত রোগা আর কাগজের মতো সাদা মুখ। ফটোতে শুকনো একটা মালা ঝুলছে।

মেয়েটি চিৎকার করে বলে ওঠে,

-মালতী মাসি কতদিন মায়ের ছবির মালাটা বদলাওনি, কাল একটা নতুন মালা কিনে এনো।

অহনা বেরিয়ে আসে। মেয়েটি বলে, আমার নাম টুপুর, এটাই মনে হয় জিজ্ঞেস করছিলেন তখন? সেই অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে মেয়েটা। অহনা পালিয়ে বাঁচে।

 

গভীর রাত্রে সুদীপের পাশ থেকে উঠে আসে অহনা। পুরোনো বইয়ের ভাঁজ থেকে একটা ছবি বার করে। ছাইছাই শাড়ি, রানি ব্লাউজ, রানি লিপস্টিক আর নীল কাজল পরা অহনা। টুপুর আর শ্যামলের কাছে সে মৃত। একরত্তি মেয়েটাকে ছেড়ে আসার বদলা এভাবে নিল টুপুর! গলার কাছে কষ্টটা দলা পাকিয়ে যায়।

গল্পকার হয়ে ওঠার গল্প

এক গাদা সাংবাদিকের ভিড় মানেই কানের কাছে আজকাল মশা-মৌমাছির ভোঁ ভোঁ শব্দ শুনতে পাই। প্রেস ক্লাবে পা রাখতেই ভনভনানিটা চারদিক দিয়ে ঘিরে ধরল। বইয়ের প্রকাশ আর বিক্রির মধ্যিখানে এখন একটা গুরুত্বপূর্ণ সালতামামি। খবরের কাগজ বা ম্যাগাজিনের লোকজন ছাড়াও প্রায় সবকটি বাংলা খবরের চ্যানেলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত। অথচ লেখিকা অপর্ণা ঘোষের এটি প্রথম গল্পগ্রন্থের প্রকাশ। কিন্তু এতে সবটা বলা হল না।

লেখিকা অপর্ণা ঘোষ মৃত স্বনামধন্য লেখক পঙ্কজ ঘোষের স্ত্রী। যার অন্তত তিনটি উপন্যাস আর দুটি গল্পগ্রন্থ দৈনিকের বেস্টসেলারের তালিকায় হামেশায়-ই দেখা যায়। অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রার কারণে বছর দুয়েক আগে এই লেখকের মৃত্যুতে গোটা বাংলার সাহিত্যকুলকেই প্রায় গেল গেল রব তুলতে দেখেছিলাম। সামনের মাসেই পঙ্কজ ঘোষের জন্মদিন। যে-কাগজে কাজ করি, তার রবিবারের সাপ্লিতে পঙ্কজ ঘোষ সংখ্যা হবার কথা হয়ে আছে। ঠিক এই সময় পঙ্কজ ঘোষের স্ত্রীর নিজের গল্পগ্রন্থ প্রকাশ সংবাদেরই বিষয় বটে।

প্রশ্ন-উত্তর পর্ব এখনও শুরু হয়নি। মনে হচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই আসরে প্রবেশ করবেন অপর্ণা ঘোষ। বেশ ব্যস্ত ভাবে এদিক সেদিক দৌড়োদৌড়ি করছে সুদীপ্ত মজুমদার। দীর্ঘদিন ধরে পঙ্কজ ঘোষকে আপ্তসহায়তা করে এসেছে এই সুদীপ্ত মজুমদার। ঘোষ পরিবারের বিশেষ স্নেহধন্য ছিল জানতাম। লেখকের স্ত্রী আবার ওকে নিজের জন্য পুনর্বহাল করলেন কি না ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না। কামানো মুখ আর পাট ভাঙা হলুদ পাঞ্জাবিতে নিজের মধ্যে প্রাণপনে একটা লেখক লেখক ভাব আনার চেষ্টা করছে সুদীপ্ত।

জেট নিউজের কৌশিকের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সামনের মুলোর মতো দাঁত দুটো বের করে মন ভুলিয়ে দেওয়া একটা এক্সপ্রেশন ঝাড়ল। যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রিত ভাবে হাসিটা ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করলাম। প্রিন্ট মিডিয়া থেকে সদ্য ইলেকট্রনিক্স-এ জয়েন করার পরে নিজের মধ্যে একটা হামবড়াই ভাব এনেছে কৌশিক। তবে ওর দেঁতো হাসির উপহার সবাই পায় না। সম্পাদকীয় বিভাগে থাকলে কেউ কেউ ওর এই হাসি উপহার পায়। যেমন আমি।

এতজন মানুষের উপস্থিতিতে কিনা জানি না এসি-র কনকনে ঠান্ডা ভাবটাও শরীরকে ছুঁয়ে যাচ্ছিল না, যে-শীতল অনুভূতিটা পেতে চাইছিলাম। অপর্ণা ঘোষের সাক্ষাৎকার পর্ব কয়েকটা পয়েন্ট-এর আকারে তুলে নিয়ে ছুটতে হবে আবার অফিসে। প্রতিবেদন আকারে সেটার পেজ সেটিং না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি নেই। দৈনন্দিন কাজের মধ্যে কেমন করে যেন একঘেয়েমি ঢুকে পড়ছে।

একটু গুঞ্জন, তারপরই অপর্ণা ঘোষের প্রবেশ। সাদামাটা, হালকা ঘি রঙের তাঁতের শাড়িতে বিধবাভাবকে লুকোনোর কোনও চেষ্টা নেই। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এবং কাটা মুখে চোখ দুটো আমার নজরে এল। দামি রিমলেস চশমার আড়ালে সে চোখ বেশ উজ্জ্বল এবং বুদ্ধিদীপ্ত মনে হচ্ছে। গরমের মধ্যে আসতে হয়েছে, তাই বোধহয় তৃষ্ণা দূর করতে টেবিলের উপর রাখা জলের গেলাসের অনেকটা জল এক নিঃশ্বাসে শেষ করে ফেললেন।

আমি ছাড়াও, অনেকেই প্রস্তুত। মনেই হচ্ছিল সোজাসুজি কাজের কথায় যেতে বিশ্বাসী লেখিকা।

অনন্ত বার্তা দৈনিকের বিকাশ সেন-ই প্রথম প্রশ্ন ছুড়লেন। অপর্ণাদি, পঙ্কজবাবুর মৃত্যুর বেশ কিছুদিন পর আপনার প্রথম গল্পগ্রন্থের প্রকাশ। বেশ অবাক ঘটনা নয় কি?

বেশ সাবলীল ভাবেই উত্তর বেরিয়ে এল লেখিকার মুখ থেকে, আসলে সংসারের আকর্ষণটা তখন অনেক বেশি করে কাজ করছিল ভিতরে। ওর হঠাৎ চলে যাওয়ায় বেশ কিছুটা দিশাহারা লেগেছিল। একসময় আবিষ্কার করলাম সংসারের সেই ভয়ানক আকর্ষণটা যেন পেনের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। বলতে পারেন পেন যেন সংসারকে প্রতিস্থাপন করল।

বিকাশদার পরবর্তী প্রশ্নের আগেই সান্ধ্য খবরের রমা ঘোষ ফায়ার করল, দিদি পঙ্কজবাবু বাংলা সাহিত্যের একজন স্বনামধন্য সাহিত্যিক। তাঁর লেখা ছোটো গল্প এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে টেক্সট বুকে স্থান পেয়েছে। তিনি বর্তমানে থাকলে আপনার এই বই প্রকাশ কতটা প্রাসঙ্গিক হতো?

অল্পক্ষণের জন্য লেখিকাকে স্মৃতিমেদুরতায় ডুবতে দেখলাম। কিছু বলবেন উনি। অপেক্ষা করছি আমরা। কার মোবাইল ফোন নিজের অস্তিত্ব জাহির করে বসল। পিছন ফিরে দু-একজন তাকাতে তড়িঘড়ি সেটি বন্ধ হয়। বাঁ হাতে রুমাল ধরে থাকা হাত নিজের মুখের ওপর একবার বুলিয়ে নিয়ে ব্যাখ্যা দিলেন উনি, অনেকটাই। উনি যে-মানসিকতার মানুষ ছিলেন তাতে তো মনে হয় এ ব্যাপারে উৎসাহ দেওয়াটাই ওনার পক্ষে ছিল স্বাভাবিক।

আবার প্রশ্ন উড়ে এল, আচ্ছা ম্যাডাম এ গল্পগ্রন্থে স্থান পাওয়া গল্পগুলি কি কোনও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত?

না-সূচক ঘাড় নাড়লেন অপর্ণা। না, লেখা অনেকদিন আগেই হয়ে গিয়েছিল। আসলে লেখাগুলোর কনস্ট্রাকশন সম্পর্কে একদম নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। তাই বারবার এডিট করতে হচ্ছিল। বই যে করতে হবে সে ব্যাপারে চাপটা অবশ্য সুদীপ্তর তরফেই আসে, তৃপ্তি মেশানো এক মায়াময় হাসি ছুটে যায় সহকারীর দিকে।

নড়েচড়ে উঠি আমি। অস্বস্তিকর গরমটা কিছুতেই যেন ছেড়ে যাচ্ছিল না। লেখিকা অপর্ণার সঙ্গে বারবার লেখক পঙ্কজের নামটা জুড়ে যাচ্ছিল। আমরা এখানে যারা এই বই প্রকাশ কভারেজ করতে এসেছি, ঠিক কার কাছে এসেছি! লেখিকা অপর্ণার সত্তাটা স্বাধীন কিনা দেখে নেবার ইচ্ছা জাগছিল। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে প্রশ্নটা এগিয়ে দিই, দিদি একটু অন্যরকম প্রসঙ্গ। লেখিকা অপর্ণা যদি পঙ্কজবাবুর স্ত্রী না হতেন তবে কি তাঁর বইপ্রকাশ ঘিরে সংবাদ মাধ্যমের এই উচ্ছ্বাস থাকত?

মুখে লেগে থাকা হাসিটা যেন ওনার একটু ম্লান হয়ে এল। ক্লান্তি মেশানো স্বরে বলে উঠলেন, কী মন্তব্য করি বলুন তো? সেটা আপনারাই ঠিক করুন না।

রাতে অফিস থেকে যখন বেরোলাম, তখনও ঘুরে ফিরে লেখিকা অপর্ণার মুখটা আমার মধ্যে ফিরে আসছিল।

দুই

একটা ঘোরের মধ্যে কাজ করে যাচ্ছিলাম। রোববারের পাতার জন্য ফিচার চেয়েছিলাম পরিচিত এক লেখকের কাছে। সাবধানি চোখ নিয়ে তার জমা দেওয়া লেখাটা পড়ছিলাম। লেখার বাঁধুনিটা ভীষণ ভালো। কিন্তু প্যারাগ্রাফের চেঞ্জগুলো একদম ঠিকঠাক করতে পারেননি। সেগুলিকেই সম্পাদকীয় দৃষ্টিতে যতটা সম্ভব দেখে নেবার চেষ্টা করছিলাম।

সামনে এসে দাঁড়াল অনিরূপা। বছর ২৭-এর মেয়েটি রবিবারের পাতার সম্পাদকীয় বিভাগে আছে প্রায় দেড় বছর। তারও আগের দু-বছর প্রথম শ্রেণির একটা দৈনিক ডেস্কে চাকরি করে এসেছে। বাংলা ভাষায় এত কম বয়সে এই জ্ঞান খুব কম মেয়ের মধ্যে দেখা যায় অথচ কোনওরকম আঁতলামো নেই, উলটে এক নম্বর ফক্কড়। সাহিত্যলোকের এ সপ্তাহতেই প্রকাশিত সংখ্যাটা আমার দিকে এগিয়ে ধরে চোখ দুটো বড়ো করে বলল, সৌম্যদা, এবার না তুমি খবর হয়ে যাবে।

নিজের হাতঘড়িটা কনুইয়ে দিকে একটু ঠেলে তুলে দিয়ে বলি, কেন রে!

অপর্ণা ঘোষের স্টোরিটা তুমি করেছিলে না?

হ্যাঁ, তো!

ভালো করে পড়ে দেখো এটা। চলে যায় অনিরূপা।

সাহিত্যলোকের বইয়ে আলোচনার বিভাগটা খুলে রেখে গেছে ও। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলি। বাজারে এই মুহূর্তে সাহিত্য পত্রিকার সংখ্যা অনেকগুলো। সদ্য প্রকাশিত বইগুলির আলোচনাও থাকে সে সমস্ত সংখ্যায়। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে সাহিত্যলোকের আলোচনা বিভাগটিকে অন্যরকম গুরুত্ব দিই। দীর্ঘদিন ধরে এই বিভাগটিতে লেখেন গণেশ মুখোপাধ্যায়। লোকটার পড়াশোনা, বিশ্লেষণ এবং তথ্য পেশ করার ক্ষমতা চমকে দেবার মতো। গণেশ মুখোপাধ্যায়ের মতো সমালোচক কোনও লেখক বা বই সম্পর্কে যে মন্তব্য করবে, সেটা আমার মতো অনেকের কাছেই আপ্তবাক্য। সবচেয়ে বড়ো কথা লোকটা সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার ক্ষমতা রাখে। সুতরাং, তার মতো ব্যক্তিত্ব যখন অপর্ণা ঘোষের লেখার সঙ্গে পঙ্কজ ঘোষের লেখার অত্যাশ্চর্য মিল খুঁজে পেয়েছে, সেটা আর যাই হোক ধান ছড়িয়ে বুলবুলিতে খাওয়ার মতো ঘটনা নয়।

স্টোরিটা করার সময় অপর্ণা ঘোষের বইয়ের দুএকটি গল্প পড়ে আমি কিছু মন্তব্যও করেছিলাম। সত্যি কথা বলতে গেলে কী, কোনও লেখিকার প্রথম গল্প গ্রন্থেরই ভাষা এত সাবলীল অথচ গভীর হতে পারে তা আমার কল্পনাতেও ছিল না। গোটা স্টোরিটাই তৈরি করেছিলাম একটু মুগ্ধ ভাব নিয়ে। গণেশ মুখোপাধ্যায়ের আলোচনার কোনও কোনও অংশ ব্যাঙ্গাত্মক তীর হয়ে যে আমার কাগজের রবিবারের স্টোরিটাকেও বিদ্ধ করেছে স্পষ্টই বুঝতে পারলাম। কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর লেখার ধরনের মধ্যে মিল থাকা কি খুব অস্বাভাবিক! দীর্ঘদিন একজনের সাথে থাকতে থাকতে তার অনেক কিছুই তো অজান্তেই আমাদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। তবে সাহিত্যলোকের আলোচনাটা যে অপর্ণা ঘোষের সদ্য শুরু হওয়া সাহিত্য জীবনকে অনেকটাই জটিল করে তুলবে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই নেই।

হাতের কাছে রাখা নিজের মোবাইল থেকে সান্ধ্য নিউজের রমাদি-কে ধরলাম। ভদ্রমহিলার লিটারেচার ফিল্ডের জ্ঞানটা যেমন গভীর তেমনি খবরও রাখেন নানারকম। প্রথমবার বেজে বেজে থেমে গেল। দ্বিতীয়বার ফোন করার সাথে সাথেই গম্ভীর অথচ সুরেলা গলা নিয়ে আমার কানের কাছে উঠে এলেন রমাদি। আমি সোজাসুজি আসল দরকারে আঘাত হানার চেষ্টা করলাম, দিদি, সেদিন তো অপর্ণা ঘোষের বইয়ের লঞ্চিং-এ আপনিও ছিলেন। সাহিত্যলোকে এবারে যে-আলোচনাটা বেরিয়েছে চোখে পড়েছে নাকি?

হ্যাঁ পড়েছে, সংক্ষিপ্ত, উদাসীন প্রতিক্রিয়া মনে হল আমার।

কী মনে হচ্ছে আপনার?

কী আবার! গণেশবাবু যখন লিখেছেন তখন একটা কিছু ব্যাপার তো রয়েছেই।

আপনার কী মনে হচ্ছে? ভেতরে ভেতরে অধৈর্য হয়ে উঠছিলাম।

কী বলি বলো তো! বেশ বিতর্কিত ব্যাপার। তবে আমার মনে হচ্ছে পঙ্কজদার কিছু লেখা অপ্রকাশিত পড়েছিল। সেগুলোকেই এখন নিজের নামে চালানোর চেষ্টা চলছে। অপর্ণা চিরকালই সংসারিক মেয়ে কোনও সাহিত্যের অনুষ্ঠানেও স্বামীকে সঙ্গ দিতে দেখিনি, অথচ পঙ্কজদা বরাবর নারীবাদের স্বপক্ষে কথা বলে এসেছেন।

সেন্ট্রাল এসি-র মধ্যে বসেও নিজের চারপাশে একটা গরম আবহাওয়ার বেষ্টনী পেলাম। ভেতরে ভেতরে বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম। কেন জানি না মনে হচ্ছিল, ব্যাপারটা আর একটু খুঁড়ে দেখা দরকার। ও প্রান্তে রমাদি অবশ্য আমার উত্তেজনায় ঠান্ডা জল ঢেলে দিলেন।

এটাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে কী হবে সৌম্য! বাংলা সাহিত্যে লেখালিখিতে এটা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ফোনটা কেটে দিয়ে কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে রইলাম। সুদীপ্তর ফোন নাম্বারটা যতদূর মনে হচ্ছে ফোন বুকে তোলা আছে। একটু খুঁজতে পেয়ে গেলাম। অনুরোধটা করতেই ওর মুখ থেকে যেন একরাশ বিরক্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল।

কেন কথা বলতে হবে, কেন? অপর্ণাদি তার মতো লিখেছেন। আপনারা যেটা লিখবেন সেটাকেই কেন সবচেয়ে বড়ো সত্যি বলে মেনে নিতে হবে!

দেখুন সুদীপ্তবাবু, কথাটা অনেকাংশে সত্যি। কিন্তু কথাটা বোধহয় আমার সম্পর্কে খাটে না। বইটা পড়েই অপর্ণাদি সম্পর্কে আমার একটু অন্যরকম ধারণা হয়েছিল। আমি একটু ওনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আপনি প্লিজ একটা অ্যাপয়েনটমেন্ট…

কথা দিতে পারছি না। চেষ্টা করে দেখছি।

সুদীপ্তর কন্ঠস্বরকে এতটুকু নরম মনে হল না!

তিন

মিনিট পনেরো হল চা-টা শেষ করেছি। দাঁত এবং মাড়ির আশেপাশে লেপটে থাকা বিস্কুটের স্তরটাকে জিভ চালিয়ে পরিষ্কার করে নেবার চেষ্টা করছিলাম। ফুল স্পিড-এ মাথার ওপরে পাখা ছাড়াও পাশে থাকা সুপার স্পিড-এর স্ট্যান্ডফ্যানটা মাথার চুলগুলোকে এলোমেলো করে যাচ্ছিল।

অপর্ণা ঘোষ উলটো দিকের সোফায় এসে বসেছেন বেশ কিছুক্ষণ কিন্তু এখনও অবধি মুখ খোলেননি। একই সোফার কোণে বসে আছে সুদীপ্ত। প্রশ্নগুলো মোটামুটি নিজের মনে সাজিয়ে রেখেছি। রিডিং লাইটের আধা আলো আঁধারিতে লেখিকার মুখের ভাব ও মনের তরঙ্গের ঠিক হদিশ মিলছিল না। ঘোর লাগা গলায় একসময় সূচনাহীন এবড়োখেবড়ো প্রবন্ধ পড়ার ভঙ্গিমায় ওনার হঠাৎ করে বলতে শুরু করাটা আমাকে সচকিত করে দেয়। নিজের উরুর ওপরে প্যাডটা খুলে রাখাই ছিল। ডট পেনের পিছনটা আঙুল চালিয়ে টিপে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো তুলে নেবার জন্য প্রস্তুত হই।

এত বছর পঙ্কজবাবুর সঙ্গে কাটানোর কারণেই কি তার অন্বয়রীতি, বাক্যবিস্তার, প্লট আপনার গল্পে গৃহীত হয়েছে? খুব ধীর গতিতে প্রশ্নটাকে ওনার সামনে রাখার চেষ্টা করলাম।

প্রশ্নটার সরাসরি জবাব দেবার কোনও তাগিদ লক্ষ করলাম না ওনার মধ্যে। স্মৃতির অতল গহ্বরে ডুবে পুনরায় ভেসে উঠতে চাইলেন তিনি। সত্যেন বোস লেনের মেসটাতে ও যখন থাকতে এল, তখনই ও ইউনিভার্সিটি ছেড়ে দিয়েছে। পড়াশোনায় কোনওদিনই সেভাবে মন ছিল না ওর। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার অফিসে নিয়মিত ঘোরাঘুরি করছিল বটে কিন্তু সেভাবে কলকে পাচ্ছিল না। বেশ হতাশ। এইরকম একটা সময়ে কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে ওর সঙ্গে আমার দেখা। ইংরাজি অনার্সের ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী আমি। প্রথম দেখাতেই উদ্দাম প্রেম আর তার মাস ছয়েকের মধ্যেই বিয়ে। একটি খবরের কাগজে যৎসামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে ও কলাম লিখত। একটু দম নেবার জন্য যেন থামতে চাইলেন অপর্ণা।

পরের প্রশ্নটা করব কিনা ভাবছি, এমন সময় পূর্ব প্রসঙ্গকে আরও টেনে বলতে শুরু করলেন অপর্ণা। তখন কাগজে ও যে-সব রিভিউগুলো লিখছে সেগুলোও সম্পাদকের ঠিকমতো পছন্দ হচ্ছে না। বেশ হতাশ ও। সংসার চলতে চাইছে না। সংসার ক্রমশ আমার কাছে বিভীষিকা তখন। এরই মধ্যে মোটামুটি একটি নামি পত্রিকায় আমার একটি গল্প বেরোয়। লেখাটি মোটামুটি প্রশংসিত হয়েছিল। আপনি ভাবছেন এসব কথা আপনাকেই বা কেন বলছি! আসলে এই মুহূর্তে অনেকেই যখন অফিসের ঠান্ডা ঘরে বসে আমার বিরুদ্ধে কলম চালাচ্ছে, তখন আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনি সত্যিকথার অনুসন্ধান করেন। আর এত বছরে আমারও তো কিছু বলার থাকতে পারে…।

সাদা সাংবাদিকতাকে কীভাবে হলুদ সাংবাদিকতা নিজের বশে এনে ফেলেছে তা এই কবছরে ভালোই উপলব্ধি করেছি। কিন্তু অপর্ণা ঘোষের শেষ বাক্যটি আমাকে রীতিমতো চমকে দিল। নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে ওনাকে বলি, বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমার কিন্তু কোথাও একটু গণ্ডগোল ঠেকছে। কোথাও একটা ফাঁক। একটা মস্ত বড়ো সত্যি যেন মেঘে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। আমার ধারণা এই ধোঁয়াশা আপনিই দূর করতে পারেন।

বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকলেন অপর্ণা। মুখ তুলে এরপর উনি সুদীপ্তর দিকে তাকাতে মুখে অল্প হাসি এনে সুদীপ্ত যেন ওনাকে কিছুর সম্মতি দেয়।

উনি বলতে শুরু করলে ওনার গলাটা আগের থেকে দৃঢ় শোনাচ্ছিল, ক্রিয়েটিভ রাইটিংটা কোনওদিন আপনাদের পঙ্কজদার আসত না। খেতে পাচ্ছি না অথচ রোজই ওর মুখে গালভরা স্বপ্ন শুনতাম। আর কখনও-কখনও রাতে বাড়ি ফিরে গায়ে হাত তুলত। অনেক বড়ো বড়ো সভায় গিয়ে সমাজে নারী স্বাধীনতার স্বপক্ষে অনেক বক্তৃতাই ও শুনিয়েছে। কিন্তু নিজের দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীর সঙ্গে কী ব্যবহার করত আপনাদের সংবাদমাধ্যম কি তার খবর রেখেছে? আমার গল্পটা প্রশংসিত হবার পর আরও একটি গল্প লিখি এবং একটি নামি দৈনিকের রবিবারের পাতায় গল্পটি ওর নামে পাঠিয়ে দিই। আমার স্বামীকে এর পর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এতদিন পঙ্কজ ঘোষের নামে যা যা বেস্টসেলার পাবলিক জেনে এসেছে তার প্রতিটি অক্ষর আসলে আমার সৃষ্টি। দুহাতে নিজের মুখ ঢাকলেন অপর্ণা।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো এতক্ষণ শুনে যাচ্ছিলাম। স্টোরিটা কীভাবে নিজের কাগজে প্লেস করব, এবার তার ভাবনা আমাকে ধাক্কা দেয়। খুব ধীর গলায় সুদীপ্ত বলে ওঠে, কিন্তু লেখার রীতিটা যে দিদির, সেটা বোধহয় প্রমাণ করা সম্ভব নয়, না?

মৃদু হেসে বলে উঠি, কেন নয়? পঙ্কজ ঘোষের প্রবন্ধের ভাষা ও গল্প-উপন্যাসের ভাষা পরীক্ষা করে, আমার ধারণা একজন ভাষাবিদ অবশ্যই বলতে পারবেন। আর তা ছাড়া সত্যিটা প্রকাশিত হলে জনগণের সামনে একটা দুটো গল্প একজন জাত লেখিকা লিখে দিতে পারে। এটা নিয়ে ভাবার দরকার আছে বলে মনে করি না।

ধীর পায়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়াই। এ বাড়িতে ঢোকার আগে সাক্ষাৎকার শিরোনাম কী দেব ভেবে পাচ্ছিলাম না। শিরোনামটা হঠাৎই মাথায় এসে যায়। নিজের ব্যাগ থেকে প্যাডটা বের করে ভুলে যাবার আগেই তা দ্রুত হাতে লিখে নিতে থাকি আমি…

 

আবার আসিব ফিরে

একদৃষ্টে সাগরের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল রাজীব। আরব সাগরের অশান্ত, উত্তাল ঢেউ সহজে চোখে পড়ে না। কিন্তু আজ কেন জানি না রাজীবের উত্তাল অশান্ত হৃদয়ের চেহারাই বারবার প্রতিফলিত হচ্ছিল সাগরের অন্তহীন বুক জুড়ে।

সঞ্জনার চেহারাটা বারবার ভেসে উঠছিল রাজীবের চোখের সামনে। কিছুই আর চিন্তা করতে পারছিল না সঞ্জনা ছাড়া। সারা পৃথিবীতে কী ঘটে চলেছে তার সঙ্গে রাজীবের কিছুমাত্র যোগাযোগ ছিল না। ও শুধু নিজের জগতেই নিজেকে বন্দি করে নিয়েছিল।

সঞ্জনা রাজীবের বিবাহিতা স্ত্রী। মা, বাবার দেখে দেওয়া পাত্রীকে এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল রাজীবের। তিন বছরের বিবাহিত জীবন ওদের। সঞ্জনা ছাড়া নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার কল্পনাও করতে পারত না রাজীব। এক স্বর্গীয় ভালোবাসায় নিজেকে উজাড় করে রাজীব তুলে ধরেছিল সঞ্জনার হাতে।

চাকরি এবং স্ত্রী সঞ্জনাকে নিয়ে রাজীব মুম্বই শহরে এসে পৌঁছেছিল। তিন বছর ওদের কোনও সন্তান হয়নি। এই নিয়ে কোনও দুঃখও ছিল না রাজীবের মনে। সঞ্জনাই ওর পুরোটা জুড়ে ছিল। সংসারে তৃতীয় ব্যক্তির আগমন নিয়ে কখনও মাথা ঘামায়নি রাজীব। সঞ্জনা ছাড়া ও কিছুই প্রত্যাশা করত না। তবুও দুজনের সংসারে তৃতীয়জনের আসার সংবাদ ডাক্তারের মুখে শুনে খুশি হয়েছিল রাজীব। বেশি খুশি হয়েছিল সঞ্জনার জন্য।

কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস স্বীকার করা ছাড়া আর কী-বা করতে পারল রাজীব? সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে চিরতরে রাজীবকে ত্যাগ করে সঞ্জনা কোথায় হারিয়ে গেল। রাজীব, কন্যাসন্তান, গোছানো সংসার সবই পড়ে থাকল শুধু গুছিয়ে রাখার মানুষটাই স্নেহ, মায়ার বন্ধন কাটিয়ে রাজীবের হৃদয়টাকে নিঃস্ব করে দিয়ে গেল।

বাড়িতে কিছুতেই মন বসাতে পারছিল না। চারিদিকে শুধু সঞ্জনার স্মৃতি। সবথেকে বেশি সঞ্জনার কথা মনে হতো সঞ্জনার ফেলে যাওয়া একরত্তি ওই মেয়েকে দেখলে। রাজীব যেন মনে মনে সঞ্জনার মৃত্যুর জন্য মেয়েকেই দাযী করে বসল। ওর দিকে তাকালেই মনটা আরও বেশি হুহু করে উঠত।

বেঙ্গালুরু থেকে রাজীবের মা-বাবা মুম্বই এসেছিলেন পুত্রবধূ বাড়ি ফিরলে সংসার সামলাতে যাতে কষ্ট না হয় সঞ্জনার ছোটো বাচ্চা নিয়ে কিন্তু সেই সঞ্জনাই ফিরল না। ঠাকুমা-ঠাকুরদাই নাতনিকে আপন করে নিলেন। স্নেহ মমতা দিয়ে ওইটুকু প্রাণকে আগলে রাখার চেষ্টা করে চললেন। ছেলেকে ওনারা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করলেন কিন্তু রাজীবের মন কিছুতেই ভিজল না। জীবন থেকে মেয়েকে দূরে সরিয়ে রাখল সে।

অগত্যা উপায়ান্তর না দেখে রাজীবের মা-বাবা একমাত্র নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে বেঙ্গালুরু ফিরে গেলেন। রাজীব মুম্বইতে একাই রয়ে গেল। তার জীবনে ভালোবাসা রূপকথা হয়ে রয়ে গেল।

সঞ্জনার মৃত্যুর প্রায় আট মাস হয়ে গেছে। যন্ত্রের মতো কেটে গেছে এই দীর্ঘ সময়টা। চারপাশে কী হচ্ছে কিছুরই খেয়াল করেনি রাজীব। তাহলে আজ হঠাৎ আবার সাগরের একের পর এক ভেঙে পড়া ঢেউ দেখতে দেখতে, কেন তার হৃদয় এতটা উদ্বেলিত হচ্ছে রাজীব বুঝতে পারছে না! সঞ্জনাকে দেখে তো এমনটা হতো কিন্তু সেই মুহূর্তটুকু তো জীবনে একবারই আসে। তাহলে আজ কীসের জন্য মন এতটা অশান্ত? তাহলে কারও প্রতি কি তার মন আকর্ষিত হচ্ছে? না না এ হতে পারে না। সঞ্জনার উপর কোনও অন্যায় অবিচার সে হতে দিতে পারে না। এ অন্যায়।

রাজীব স্বপ্নেও ভাবেনি এই মুহূর্তটুকু আবার তার জীবনে প্রবেশ করবে। মানসিক এই টানাপোড়েন অস্বস্তি বাড়িয়ে তুলছিল রাজীবের ভিতর। প্রতিবেশী মেয়েটির চেহারা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। একজন প্রতিবেশীর জন্য চিন্তা করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয় কিন্তু সবকিছুকে রাজীব কিছুতেই একটা সরলরেখায় ফেলতে পারছিল না।

ছয় মাসের হয়তো একটু বেশিই হবে সামনের খালি ফ্ল্যাট-টায় ওই মেয়েটি এসেছে। মেয়ে না বলে মহিলা বললেই হয়তো ঠিক হবে কারণ রাজীবের মনে হয়েছিল মহিলার বয়স তিরিশের আশেপাশে। বারান্দায় দাঁড়ালে রাজীবের ঠিক উলটো দিকে সেই ফ্ল্যাট। দুটো ফ্ল্যাটের মুখোমুখি বারান্দা।

রাজীবের প্রথম চোখে পড়ে যখন মেয়েটিকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে দেখে। এছাড়া খোলা বারান্দার দরজা দিয়ে চোখে পড়েছিল লোক দিয়ে বাড়ির জিনিসপত্র সব গুছিয়ে তুলছিল ওই মহিলা। ব্যস অতটুকুই।

অফিসে যাওয়া-আসার পথে, লিফট-এ প্রায়শই দেখা হতো। অনেকেরই সাথে তো রোজ দেখা হয়, তাহলে বিশেষ করে ওই একজনের প্রতি কেন আকর্ষণ অনুভব করত রাজীব, নিজেই বুঝতে পারত না। হয়তো একাকিত্ব বোধ থেকে অথবা শরীরের অপ্রতিরোধ্য চাহিদা থেকে, এর মধ্যে কোনটা সেটা রাজীবের কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছিল না।

একদিন লিফ্ট থেকে বেরোতে গিয়ে তাড়াহুড়োতে কোনও ভাবে পা মুচকে গিয়ে মহিলা প্রায় পড়ে যাচ্ছিল, রাজীব কোনওরকমে ধরে ফেলে। হাত ধরে বাইরে রাখা একটি চেয়ারে ওকে বসিয়ে দেয় রাজীব।

দেখি কোথায় লাগল আপনার, বলে নীচু হয়ে রাজীব আঘাতের জায়গাটা দেখার চেষ্টা করতেই এক ঝটকায় মহিলা পা-টা সরিয়ে নিল।

না না, আমি ঠিক আছি। একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে, বলতে বলতে মহিলা চেয়ারে বসেই পা-টাকে একটু নাড়াচাড়া করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

কোনও সাহায্য লাগলে বলুন…

না না ধন্যবাদ। ঠিক সামলে নেব…

কথা না বাড়িয়ে রাজীব অফিসের পথে পা বাড়াল। কিন্তু সারাটা দিন মুহূর্তের ওই স্পর্শটুকু কিছুতেই মাথা থেকে বার করতে পারল না।

দুতিন দিন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে দেখল মহিলাকে। এর মধ্যে দেখা হলে মৌখিক হাসি বিনিময় হতো আর মাঝেমধ্যে একটা দুটো করে কথা। মহিলা রাজীবের মনে চেপে বসে থাকা বরফের চাঁইটাকে একটু একটু করে গলাতে শুরু করল।

এর পর হঠাৎ করেই তিন-চারদিন আবার দেখা নেই। ভিতরে ভিতরে একটা অস্বস্তিতে ভুগতে লাগল রাজীব। বারান্দার দরজাও রাতদিন বন্ধ। অজানা আশঙ্কায় রাজীবের মন কেঁপে উঠল।

মহিলার ফ্ল্যাটে যাওয়া উচিত হবে কিনা কিছুতেই মনস্থির করতে পারছিল না রাজীব। হঠাৎ দরজায় কলিংবেল-এর আওয়াজ শুনে দরজা খুলতেই দেখল ওই মহিলার বাড়ির কাজের মাসি সামনে দাঁড়িয়ে

সাহাব, একবার ওই ফ্ল্যাটে চলো। মেমসাহেবের শরীর খুব খারাপ, কী করব আমি বুঝতে পারছি না। এক নিঃশ্বাসে হড়বড় করে বলে ওঠে মাসি।

রাজীব তত্ক্ষণাৎ মহিলার ফ্ল্যাটে এসে হাজির হয় মাসির সঙ্গে। বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে মহিলা, দেখে হুঁশ আছে বলে মনে হল না।

কোনও ডাক্তার দেখেছে? চিন্তিত হয়ে মাসিকেই জিজ্ঞেস করে রাজীব।

মাথা নাড়ায় মাসি।

সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারকে ফোন করে বাড়িতে আসতে বলে রাজীব। ডাক্তার এসে দেখে ওষুধপত্র সব লিখে দিয়ে যান। ওষুধগুলো মাসিকে দিয়ে আনিয়ে নেয় রাজীব। পালা করে মাসির সঙ্গে মাথায় জলপট্টি করতে থাকে যাতে জ্বরের পারদ একটু নামে। ডাক্তারবাবুর ওষুধগুলো একটা একটা করে খাইয়ে দেয় মহিলাকে। ধীরে ধীরে জ্বর কিছুটা কম হলে রাজীব নিজের ফ্ল্যাটে ফিরে আসে।

পরের দিন মহিলাকে একটু সুস্থ দেখে রাজীব জিজ্ঞেস করে, আপনার আত্মীয় কেউ আছেন যাকে খবর দিতে হবে? আপনি বললে আমি ফোন করে দিতে পারি। হালকা করে মাথা নেড়ে না বলে মহিলা। সুতরাং তার খাওয়াদাওয়া, সময়ে সময়ে ওষুধ খাওয়ানোর দাযিত্ব রাজীব নিজের উপরেই নিয়ে নেয়। রাজীব বুঝতে পারছিল এর ফলে মহিলা সংকোচ বোধ করছে। কিন্তু শরীর এতটাই দুর্বল যার জন্য কিছু বলতে পারছে না।

চারদিন পর রাজীব মহিলার ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখল, এতদিন পর বিছানায় উঠে বসেছে মহিলা। অনেক সুস্থ লাগছে ওকে। রাজীব ঘরে ঢুকতেই মহিলা বলে উঠল, আপনাকে এতদিন ধরে অনেক কষ্ট দিলাম। আমাকে ক্ষমা করবেন।

ক্ষমা কীসের জন্য? প্রতিবেশীই তো প্রতিবেশীর কাজে আসে। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠুন।

হ্যাঁ, ভাবছি কালকের দিনটা বিশ্রাম নিয়ে পরশু থেকে অফিস জয়েন করব। কোনও কিছুর দরকার আছে কিনা জেনে নিয়ে রাজীব অফিস বেরিয়ে পড়ে।

এর পর মেলামেশা আরও একটু গাঢ় হয়। একসঙ্গে ডিনার সারা, একসঙ্গে বসে গল্পগুজব করা ওদের দুজনের বন্ধুত্বকে আরও সুদৃঢ় করে তোলে।

জানলায় দাঁড়িয়ে বাইরের দৃশ্য দেখছিল রাজীব। আকাশ এত নীল আগে কখনও খেয়াল করেনি। হয়তো কখনও আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখার কথাই মনে হয়নি। হৃদয়ে যখন শূন্যতা জায়গা জুড়ে বসে তখন সবকিছুই কেমন অর্থহীন হয়ে পড়ে। এই কয়েক মাস হল আকাশে রঙের আনাগোনা লক্ষ্য করছে রাজীব।

আজ সন্ধেবেলা দুজনে ডিনারে যাওয়ার কথা আছে। এতদিন ধরে মেলামেশা করছে, রাজীবের মনে হল আজ পর্যন্ত সঙ্গিনীর নামটা পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করা হয়নি। অবশ্য দুজনের কেউই আজ পর্যন্ত নিজেদের অতীত নিয়ে কখনও কথা তোলেনি।

ডিনার টেবিলে মুখোমুখি বসে কথা বলা শুরু করলে রাজীবই প্রসঙ্গ তুলল, এতদিন হয়ে গেল, আপনার নামটাই এখনও জানা হল না।

অনসূয়া, হাসিতে ভরে গেল মহিলার মুখ।

বাঃ, ভারী সুন্দর আপনার নাম। অত্রি মুনির স্ত্রী ছিলেন সতীসাধ্বী অনসূয়াদেবী। রামায়ণে আমরা তাঁর বর্ণনা পাই, আপনিও নিশ্চয়ই পড়ে থাকবেন?

মায়ের মুখে এই গল্প বহুবার শুনেছি। হেসে উত্তর দেয় অনসূয়া।

কথা বলতে বলতেই খাবারের অর্ডারটা দিয়ে দেয় রাজীব।

আরও কিছু বলুন নিজের সম্পর্কে। আমরা কেউই একে অপরের সম্পর্কে কিছুই জানি না। অবশ্য আপনার যদি আপত্তি না থাকে তবেই বলুন! সামান্য দ্বিধা নিয়ে কথাগুলো বলে রাজীব।

অনসূয়া চোখ নামিয়ে হাতের নখ খুঁটতে থাকে।

ঠিক আছে, আপনাকে কিছু বলতে হবে না, ব্যস্ত কণ্ঠে রাজীব বলে ওঠে।

না না, সেরকম কিছু নয়। এতদিনে এইটুকু বন্ধুত্ব তো হয়ে গেছে। আমি নিজের কথা আপনাকে খুলে বলতে পারি। চলুন, খাওয়ার পর বাইরে বেরিয়ে সব বলব। চোখ নীচে নামিয়ে অনসূয়া কিছুটা সময় চেয়ে নিল নিজেকে গুছিয়ে নিতে।

খাওয়ার পর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল অনসূয়া তারপর ধীর স্বরে বলতে আরম্ভ করল, আমরা দুজনেই এমবিএ করছিলাম। ছেলেটিও আমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসত। আমরা লিভ ইন করতে শুরু করি। আমার মা-বাবা আমাকে অনেক বুঝিয়েছিল এই সম্পর্ক থেকে সরে আসার জন্য। প্রচুর বকাবকিও করেছিল। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল, ওকে ছাড়া আমি বাঁচব না। মা আমাকে বুঝিয়েছিল যে, বিয়ের পর আমরা একসঙ্গে থাকতে পারি কিন্তু আমিই শুনিনি।

আমার মনে হয়েছিল, যখন দুজনে দুজনকে ভালোবাসি তখন বিয়ের বন্ধনের দরকারটা কোথায়? এছাড়া তখন বিয়ে করা সম্ভবও ছিল না। মা-বাবা রাগ করে আমার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এর পর আমরাও চাকরি পেয়ে যাই। কিন্তু আলাদা আলাদা শহরে। চেষ্টা করছিলাম দুজনের চাকরি যাতে এক শহরে হয়।

আমার বয়ফ্রেন্ড কখনও ছুটি পেলে আমার কাছে চলে আসত, কখনও আমি ওর কাছে চলে যেতাম। এই ভাবে প্রায় একটা বছর কেটে যায়। তার পর হঠাৎই খেয়াল করি ও না আসতে পারার জন্য রোজ নতুন নতুন বাহানা দিচ্ছে। একটু জোর দিতেই ও স্বীকার করে নেয়, অন্য একটি মেয়েকে নাকি সে এখন ভালোবাসে। এটা কী করে সম্ভব? আমি তো জানতাম ভালোবাসার আনন্দ একবারই হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা যায়। দ্বিতীয়বার কি আর কখনও সেভাবে ভালোবাসা যায়? আপনিই বলুন…। কথা বলতে বলতে দু-হাতে মুখ ঢাকে অনসূয়া।

রাজীব অনসূয়ার হাত ধরে সামনে থাকা একটা বেঞ্চের উপর বসিয়ে দেয়।

না না আপনিই বলুন দ্বিতীয়বার কি আর ভালোবাসা আসে জীবনে? অশ্রুসজল নয়নে অনসূয়া প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করায় রাজীবকে।

উত্তর দেয় না রাজীব। দৃষ্টি মাটির দিকে নিবদ্ধ করে চুপচাপ বসে থাকে সে। অনসূয়া ধৈর্য হারিয়ে বলে ওঠে, তার মানে আপনি বলতে চান প্রথমটা ভালোবাসা ছিলই না। শুধুই শরীরী আকর্ষণ মাত্র!

না আমি সেরকম কিছু তো বলিনি, তবে ভালোবাসা…, চুপ করে যায় রাজীব।

হ্যাঁ, ভালোবাসা… কী বলতে চাইছেন পরিষ্কার করে বলুন। অনসূয়ার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছিল।

আমিও এতদিন এটাই বিশ্বাস করতাম, গভীর নিঃশ্বাস নেয় রাজীব। যে ভালোবাসা জীবনে একবারই আসে। আমিও প্রাণের থেকে স্ত্রীকে বেশি ভালোবাসতাম কিন্তু মেয়ে জন্ম দিতে গিয়ে ওর মৃত্যু হয়। তখন মনে হয়েছিল এটাই আমার জীবনে শেষ ভালোবাসা যতদিন না… বলতে বলতে রাজীব চুপ হয়ে যায়।

যতদিন না… একরাশ প্রশ্ন নিয়ে অনসূয়া রাজীবের দিকে তাকায়। রাজীব দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।

কী হল, বললেন না? তাহলে কি এখন অন্য কাউকে ভালোবাসেন? অনসূয়ার দৃষ্টির গভীরতা রাজীবকে বিদ্ধ করে।

হঠাৎ রাজীব তাড়া দেয় অনসূয়াকে, চলুন রাত হয়ে যাচ্ছে বাড়ি ফেরা যাক।

অনসূয়া রাজীবের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরে ফেলে, আগে কথা শেষ করুন।

অনেক রাত হল, এবার ফেরা যাক।

না, আগে আমাকে বলুন, অধীর হয়ে ওঠে অনসূয়া।

কী বলব। হ্যাঁ ভালোবাসি। তোমাকে ভালোবাসি অনসূয়া। উত্তেজিত হয়ে রাজীব বলে ওঠে, চোখের থেকে জল গড়িয়ে পড়ে তার।

না, না এ কিছুতেই হতে পারে না! অনসূয়া ছেড়ে দেয় রাজীবের হাত।

অনসূয়া শোনো, তোমার প্রতি আমার এই অনুভতি যে তোমারও থাকবে এই দাবি কখনও-ই করি না। আমার এই অনুভতি যে আমাদের বন্ধুত্বের উপর কোনও প্রভাব ফেলবে না সেটা আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি।

পরের দিন দুজনের দেখা হলেও কথা বলার খুব একটা সুযোগ হল না। রাজীবও নিজেকে সংযত করে নিয়েছিল।

দ্বিতীয় দিন অনসূয়া জানাল, তাকে পাঁচদিনের জন্য অফিসের কাজে শহরের বাইরে যেতে হচ্ছে।

এরই মধ্যে মায়ের শরীর খারাপের খবর আসাতে রাজীব ছুটি নিয়ে বেঙ্গালুরু চলে এল। মেয়েকে এই প্রথম নিজে থেকে কোলে তুলে নিল রাজীব। আজ এই প্রথমবার তার মনে হল না এই মেয়ের জন্যই সে সঞ্জনাকে হারিয়েছে চিরজীবনের মতো। মনে আজ আর কোনও বিদ্বেষ নেই, রাজীব মনে শান্তি অনুভব করল। সঞ্জনার স্মৃতি আজ দুঃখ দিল না। বরং তার মনে হল, সঞ্জনা জীবনে পুরো ভালোবাসা পেয়ে যেতে পেরেছে। এই সন্তান সঞ্জনার অস্তিত্ব নয় বরং রাজীবের জীবনের একটা অংশ এবং এই অংশকে কোনওদিন অবহেলা করার নয়, মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল রাজীব।

রাজীবের মা-ও ছেলের এই পরিবর্তন ভালো করেই বুঝতে পারছিলেন। পুরোনো আগের সেই রাজীবকে ফিরে পেয়ে উনিও তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠলেন। এক সপ্তাহ সকলের সঙ্গে হইহই করে কাটিয়ে রাজীব ফিরে এল মুম্বই।

সকালে অফিসের জন্য তৈরি হতে তাড়াতাড়ি স্নানে ঢুকেছিল রাজীব। তখনই টের পেল বারবার কেউ কলিংবেল বাজাচ্ছে। তাড়াতাড়ি করে বাথরোব পরে নিয়ে রাজীব বাইরে বেরিয়ে এল। যে-কেউই দরজায় থাক না কেন অপেক্ষা করতে রাজি নয় বেশ বুঝতে পারছিল।

দরজা খুলতেই দেখে অনসূয়া দাঁড়িয়ে, একপ্রকার রাজীবকে ঠেলেই ভিতরে ঢুকে এল সে। রাজীব দরজা বন্ধ করতেই চেঁচিয়ে উঠল রাজীবের উপর।

কোথায় চলে গিয়েছিলেন? বলেও যাননি কিছু? ফোন নম্বরও দিয়ে যাননি। আপনার কোনও আইডিয়া আছে, আমার অবস্থা কী হতে পারে? চিন্তা করে কোনও কুল পাচ্ছিলাম না। খালি মনে হচ্ছিল আপনিও আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন না তো? এমনিতে দাবি করেন আমাকে ভালোবাসেন অথচ একবারও আমার চিন্তা আপনার মাথায় এল না? বলতে বলতে কেঁদে ফেলে অনসূয়া।

সামান্য হেসে এগিয়ে এসে রাজীব অনসূয়াকে নিজের বুকে টেনে নেয়। এতদিনে ভালোবাসাও অনসূয়ার হৃদয়ের আঙিনায় জানান দিয়ে গেছে, আবার আসিয়াছি ফিরে।

 

শ্রাবণের ধারার মতো

‘জায়গাটা কেমন, আমায় একটু বলে দাও না।’

খুব আস্তে আস্তে দুলছে দোলনাটা। দু’হাতে দু’পাশের দড়ি ধরে রেখেছে বল্লরী। দোলার তালে গোড়ালির কাছে শাড়ির থোকা লুটিয়ে যাচ্ছে। তার পায়ের বুড়ো আঙুলও তখন আলতো করে মাটি ছুঁয়ে আবার উঠে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দু-একবার পাখির ডাক ছাড়া একফোঁটাও শব্দ নেই কোথাও। তাই ভালো লাগছে বল্লরীর। বেশি শব্দ তার মাথার ভেতরে যন্ত্রণা ছিটিয়ে দেয়।

মাটির দাওয়ায় তিন ধাপ সিঁড়ি। মাঝেরটিতে বসে ছিল প্রত্যুষ। বল্লরীর দিকে তাকাল সে। পিঠে পড়ে আছে লম্বা বেণি। এককুচি চুল কানের পাশ দিয়ে এসে গালের কাছে দুলছে। ফরসা, গোল ছাঁদের মুখে পাতলা ঠোঁট। বল্লরী তাকিয়ে রয়েছে সামনে। কিন্তু তার চোখের মণি স্থির।

প্রত্যুষ বলল, ‘বাড়িটা মাটির, বলেছি তো তোমায়। তবে ঘরের দুটো দিকের দেয়াল মাটির হলেও বাকি দু’দিকে কাচ লাগানো। সেখানে ছবি আঁকা, লতা-পাতা, ফুল, হরিণ। পিছনের আর বাঁদিকের বাগানটা দেখা যাচ্ছে কাচের ভেতর দিয়ে। ঘরের ছাদটা চুড়ো মতো, অনেক উঁচুতে। সেখানেও ছবি আছে, আদিবাসীদের ঘরের দেয়ালে যেমন থাকে, তেমন। বাইরের চালে খড়।’

বল্লরী বলল, ‘আমরা তাহলে গ্রামের বাড়িতে আছি বলো।’

‘বলতে পারো।’

‘আর সামনেটা?’

দাওয়ার খুব কাছে তিনটে চড়ুই আর দুটো শালিখ তুড়ুক তুড়ুক লাফাচ্ছে। মাঝে মাঝে ঘাসে মুখ ডুবিয়ে কী খুঁটে তুলছে, আবার এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে ছটফট করে। প্রত্যুষ সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে বলল, ‘এই তো, ছোটো ছোটো বাঁশের খুঁটি দিয়ে ঘেরা একটা পুকুর। জল থইথই করছে। শালুক ফুটে রয়েছে তাতে। পাশ দিয়ে একটা সরু রাস্তা। পুরো জায়গাটাই নীচুমতো মাটির পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। রাস্তাটা যেখানে শেষ সেখানে একটা কাঠের দরজা আছে। কালো রঙের। ওটা দিয়েই আমরা এখানে ঢুকেছি। তার বাইরে আরেকটা মাটির বাড়ি। তবে দোতলা। জানো, আমরা যেখানে আছি সেটার নাম এক্বা। আর ওই বাড়িটার নাম দোক্বা।’

‘বাঃ, ভালো নাম তো। একা আর দোকা। একজনে আর দুজনে।’

কথাটা খেয়াল করল প্রত্যুষ কিন্তু সেদিকে না গিয়ে বলল, ‘দোক্বার সামনে ছড়ানো জায়গা রয়েছে খানিকটা। তার পরে আরও একটা বড়ো গেট আছে লোহার। তারও ওপাশে লালমাটির রাস্তা। ওই রাস্তাটা দিয়েই গাড়িতে এসেছিলাম আমরা। অনেক গাছ চারদিকে। ডানদিকে খুব বড়ো একটা পুকুর। তাকে ঘিরে অনেক তালগাছ।’

বল্লরীর ঠোঁটে হালকা হাসি। সে বলল, ‘উঁহু, পুকুর নয়। দিঘি। দিঘি তার মাঝখানটিতে / তালবন তারি চারিভিতে / বাঁকা এক সরু গলি বেয়ে / জল নিতে আসে যত মেয়ে / বাঁশগাছ ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ে / ঝুরুঝুরু পাতাগুলি নড়ে। লালমাটির রাস্তাটার ধারে একটা বাঁশবন আছে না?’

প্রত্যুষ চমকে তাকাল বল্লরীর চোখের দিকে। ‘হ্যাঁ, আছে তো। তুমি কি কিছু…?’

এবার শব্দ করে হেসে উঠল বল্লরী। সেই হাসিতে এই মেঘলা দুপুরের ছায়া। ‘না, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না আমি। এমনিই বললাম। জায়গাটা খুব সুন্দর, না?’

প্রত্যুষ কোনও কথা বলল না। জায়গাটার হদিশ দিয়েছিল তার অফিসের বন্ধু সায়ন্তন। থাকার ব্যবস্থাও সে-ই করে দেয়। বলেছিল, ‘ঘুরে আয়। যাওয়া দরকার তোদের।’ বল্লরী যেতে চায় না কোথাও কিন্তু সেও রাজি হয়ে গেল। কেন যে হল তা এখনও জানে না প্রত্যুষ। তাদের দুজনের বাড়ি থেকেই আপত্তি ছিল। ভয়ও। তবু আসা হল।

প্রত্যুষের বাবা মারা গেছেন বছর আটেক হল। বোনের বিয়ে হয়েছে তার পর। এখন বাড়িতে শুধু মা। হাঁটুর ব্যথায় বলতে গেলে নড়াচড়াই করতে পারেন না। সঙ্গে আরও নানা অসুখ। একতলা ছেড়ে দোতলায় উঠতেও কষ্ট। এখানে আসার কথা শুনেই তিনি বলেছিলেন, ‘ওই মেয়েকে নিয়ে তুই যেতে পারবি? নিজে নিজে তো কিছুই করতে পারে না। বাড়িতে থাকলে সে একরকম। বাইরে নিয়ে গিয়ে সামলাবি কী করে? যাওয়ার দরকারটা কী?’

প্রত্যুষ বলেছিল, ‘কিছু ভেবো না। আমি পেরে যাব।’

সুব্রতা মনের আঁচ চেপে রাখতে পারেনি। ‘ভাবব না! ছ’ বছর হয়ে গেল বিয়ে হয়েছে, প্রথম বছরটাই যা একটু ভালো ছিলি। তারপর থেকে যা চলছে তাতে কেউ না ভেবে থাকতে পারে! ওর জীবনটা তো নষ্ট হয়েইছে, তোরটাও হচ্ছে।’

‘এখনই অত খারাপ ভাবছ কেন?’

‘যা ভাবছি, ঠিকই ভাবছি। এখানে থাকতেও পারল না, সংসারও করতে পারল না, ছেলেপুলেও হল না। হয়েই বা কী হবে? সামলাবে কে? আমি কি কিছুই আশা করব না বলিস? চোখে যে দেখতেই পাচ্ছে না একদম, তাকে নিয়ে তুই সারাজীবন কাটাতে পারবি? ওই বোঝা বয়ে বেড়াতে পারবি?’

‘আঃ মা।’ হালকা ধমকের মতো করে প্রত্যুষ বলেছিল, ‘বোঝা বলছ কেন? একটু দেখতে দাও। সময় তো চলে যাচ্ছে না।’

‘যাচ্ছে। তুইও জানিস সেটা। এরপর আর কিছুই হবে না। আমি যা বলছি, কষ্টে বলছি। নিজের ছেলেকে সুখী দেখতে চাওয়াটা অন্যায় তো নয়। মঞ্জুষা বলল আর আমিও রাজি হয়ে গেলাম। এইরকম দুর্ভাগ্যও যে কারও হয়–।’

বল্লরী আর প্রত্যুষের বিয়েটা দেখাশোনার হলেও খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখে নয়। মঞ্জুষা প্রত্যুষের মাসি। মায়ের নিজের বোন নয় তবে সম্পর্ক ভালোই ছিল। যাতায়াতও ছিল বেশ। বল্লরীর পরিবারের সঙ্গেও তারই যোগাযোগ। সেই সুতোতেই তিনি বাঁধতে চেয়েছিলেন ওদের। এখন তিনি প্রত্যুষদের বাড়িতে খুব কমই আসেন। যখন আসেন তখনই প্রত্যুষের মাকে বলেন, ‘আমি তো ভালোই চেয়েছিলাম। এত সুন্দর মেয়েটার এরকম হয়ে যাবে কী করে জানব বলো!’

কথাগুলো এড়িয়ে যায় প্রত্যুষ। মায়ের কথাও এড়িয়ে এখানে এসেছে সে।

আকাশে ঘনিয়ে আসছে মেঘ। হাওয়ায় হাওয়ায় গাছগুলোর মাথা এলোমেলো। শ্রাবণের শেষ। সকাল থেকেই বৃষ্টি ছুটোছুটি খেলছে। আসার সময়ে ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটছিল সে। মাঝে কিছুক্ষণ তার নিজেরই হাঁফ ধরে গিয়েছিল হয়তো। জিরিয়ে নিয়ে এখন সে আবার খেলা শুরু করতে চায়।

ওরা চুপ করে বসেছিল। প্রত্যুষ দেখতে পেল সামনের রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে বাসুদেব। ঘরের কাছে এসে সে দাঁড়াল। বলল, ‘আমাদের খাওয়ার জায়গাটা ওই দরজার বাইরে, দোক্বাবাড়ির পাশে। আপনারা কি ওখানে যাবেন? বলেন তো এখানেও দিয়ে যাওয়া যায়।’ বলতে বলতে লোকটি আড়চোখে বল্লরীকে দেখে নিল একবার।

বোলপুর স্টেশনের বাইরে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়েছিল এই বাসুদেব বিশ্বাস। বুকের কাছে ধরা প্ল্যাকার্ডে লেখা– আমার আকাশ। প্রত্যুষের হাত ধরে নড়বড়ে পায়ে বল্লরীকে আসতে থেকে অবাক হয়েছিল। তারপর বুঝতে পেরে দৌড়ে এসে প্রত্যুষের হাত থেকে ট্রলিব্যাগটা নিতে নিতে বলেছিল, ‘দিন, আমায় দিন।’ সে-ই এখানকার ম্যানেজার। এখনও নিশ্চয়ই বল্লরীর কথা ভেবেই খাবার দিয়ে যাওয়ার কথা বলছে।

প্রত্যুষ কিছু বলার আগেই বল্লরী বলল, ‘আমি ওখানে যেতে পারব। কিছু হবে না।’

বাসুদেব ঘাড় কাত করে বলল, ‘ওঃ, তাহলে তো ঠিকই আছে। বরঞ্চ রাতেরবেলা সাধুর বউকে বলব এখানে খাবার দিয়ে যেতে। ওই খাবার জায়গার কাছেই ওদের ঘর।’

প্রত্যুষ বাসুদেবের কাছে জানতে চাইল, ‘এখানে আর কেউ আসবে না? কারও বুকিং নেই?’

বাসুদেব বলল, ‘সারাবছরই লোক আসে, তবে এই বর্ষার সময়টায় কম। মাঝে মাঝে চলে এল হয়তো কেউ। কিন্তু এখন কারও আসার নেই। দোক্বাবাড়ি তো ফাঁকা আর এখানে শুধু আপনারা দুজন।’

খাবার জায়গায় একমানুষ সমান মাটির দেয়াল। কোনও জানলা নেই। খোলামেলা চারদিক। বসার জন্য কাঠের বেঞ্চ। সামনে কাঠের লম্বা টেবিল।

সাধু আর সাধুর বউ খুব যত্ন করে খাওয়াল তাদের। ভাত, ডাল, পোস্তর বড়া, পাঁচমিশেলি সবজির তরকারি আর রুই মাছের ঝোল। থালায় বেড়ে দেওয়ার পর বল্লরীকে পুরোটাই বলে দিতে যাচ্ছিল প্রত্যুষ। সাধুর বউ কনক মাথায় ঘোমটা টেনে এগিয়ে এল। সে-ই বলে দিল সব।

বল্লরীর থালায় মাছের কাঁটা বেছে দিচ্ছিল প্রত্যুষ। দেখতে দেখতে কনক বলল, ‘আমাদের এখানে মাত্তর কয়েকটা মাছ পাওয়া যায়। আগে জানলে– ।’

গলার স্বরে সাধুর বউয়ের দিকে মুখ ফেরাল বল্লরী। হেসে বলল, ‘ঠিক আছে, অসুবিধে হয়নি আমার।’

খেতে খেতে একবার মুখ তুলতেই খোড়ো চালের বাতায় গোঁজা আড়বাঁশিটা চোখে পড়ল প্রত্যুষের।

‘বাঁশি কে বাজায়?’

লাজুক হাসি সাধুর মুখে। ‘আমি বাজাই বাবু।’

‘কী বাজান?’

‘ওই, রবিঠাকুরের গান।’

এবার বল্লরী বলল, ‘কী করে জানলেন?’

‘যে দাদাবাবু এই জায়গাটা বানিয়েছেন তিনি তো ছবি আঁকেন। কলকাতায় থাকেন, আবার এখানেও এসে থাকেন। অনেকদিন আগে জমিটা কিনেছিলেন, আস্তে আস্তে ঘর তুলেছেন। তিনি যখন আসেন তখন ওই এক্বাবাড়ির দাওয়ায় বসে অনেক রাত পর্যন্ত গান করেন। আমি শুনে শুনে বাঁশিতে ধরেছি। কাজ শেষ করে রাতে বসে বসে বাজাই। ম্যানেজারবাবুর বাড়ি তো দূরে, গ্রামের ভেতর, চলে যায়। এখানে আমরা এই দুই বুড়োবুড়ি থাকি। আর তো কেউ নেই আমাদের।’

সারা দুপুর ধরে হাওয়ার সঙ্গে সাঁতার কেটে বিকেল প্রায় পার করে দিল বৃষ্টি। জলের স্মৃতি মেখে দাঁড়িয়ে চারপাশের সবুজ। রাঙামাটির রাস্তা নরম কাপড়ের পাড়। সেই রাস্তা ধরে ওরা হাঁটছিল। হাঁটতে হাঁটতে তালগাছে ঘেরা সেই দিঘিটা পেরিয়ে গেল। বাঁদিকে একটা উঁচু বাঁধমতো জায়গা রয়েছে। তার ওপাশে নিশ্চয়ই কোনও ঝিল। বুঝেও সেদিকে যেতে পারল না প্রত্যুষ। বল্লরীকে নিয়ে অতটা ওঠানামা করা যাবে না। দূর থেকে কোনও পাখির ডাক ভেসে আসছে। টি-টি-টি। মাথার ওপর দিয়ে আরও কতগুলো উড়ে গেল। কী পাখি জানে না প্রত্যুষ। আরও দূরে ধানখেত, মাঠ, গ্রামের ঝাপসা ছবি। দু’একজন মেঠো লোক ওদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ফিরে ফিরে দেখছে। বল্লরীকে নিয়ে তো বেরোতেই পারে না। প্রয়োজনে যতটুকু বেরোতে হয়েছে তখন এরকমই ঘটেছে। এতদিনে জেনে গেছে প্রত্যুষ। তবু যেন বুকের কোথায় খোঁচা লাগে।

বেরোনোর আগে বল্লরী জানতে চেয়েছিল, ‘তুমি নীল পাঞ্জাবিটা পরেছ, না?’

একটা পাঞ্জাবি বছর খানেক আগে বল্লরীর মা দিয়েছিলেন তাকে। বল্লরী তখন রঙের কথা জানতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটা তো নয়, অন্য পাঞ্জাবি পরেছে প্রত্যুষ। একবার ভেবেছিল হ্যাঁ বলে দেয়। তারপরেই থমকে গেল। বলল, ‘না, এটা পুরোনো। পেস্তা রঙের। তখন বলেছিলাম তোমায়।’

‘ও।’ হাসল বল্লরী। ‘ওটাও ভালো রং।’

বাইরে গিয়ে কিছুক্ষণ প্রত্যুষের হাত ধরে চলেছিল বল্লরী। শক্তসমর্থ হাত। ভাবতে চেষ্টা করছিল পেস্তা রঙের পাঞ্জাবিতে কেমন লাগছে প্রত্যুষকে। সেও তো ফরসা। কোঁকড়ানো চুল। কিন্তু ভালো দেখালেও সে ভালো বলতে পারবে না।

এখন প্রত্যুষের হাত ছেড়ে দিয়ে বল্লরী বলল, ‘শান্তিনিকেতন এখান থেকে কাছেই, না?’

‘হ্যাঁ, অন্যদিকে কিন্তু খুব দূরে নয়। যাবে?’

‘না। এখান থেকেই ফিরে যাব।’

‘তুমি তো কোথাও যেতে চাইতে না। এবার হঠাৎ এখানে এলে যে?’

বল্লরীর চোখ কাছে-দূরের কিছুই ছুঁতে পারছে না। ধীর পায়ে শুধু হেঁটে যাচ্ছে সে। বলল, ‘বাড়ি আর হাসপাতালই তো এখন আমার সবচেয়ে চেনা জায়গা। অসুবিধে হয় না। কিন্তু চারপাশের এসবও তো আমার জানা ছিল একদিন। ভাবলাম, দেখি, যদি আবার চিনতে পারি।’

বলতে বলতে নিজেকে থামাল বল্লরী। সত্যি বলছে না সে। প্রত্যুষের সঙ্গে এই শেষবার তার একসঙ্গে হাঁটা। অনেকদিন ধরেই যা মনে হচ্ছে এবার সেই কথাটা বলে দিতে হবে। এখন তার তেত্রিশ। প্রত্যুষ পঁয়ত্রিশ ছাড়িয়েছে। আর দেরি করা যায় না। এরপর হয়তো শুধু দয়া নিয়ে থাকতে হবে না হলে। বাবা আর মাকে কথাটা জানিয়ে এসেছে বল্লরী। শুনে গোপা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন। ‘তোর কেন এমন হল রে মা! আমাদের কি অপরাধ হয়েছে কোথাও?’

চোখে জল এসে পড়লে কষ্ট হল বল্লরীর। মনে হতে থাকে আবার মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়ে যাবে। এক একদিন ওইরকম যন্ত্রণায় মায়ের হাত চেপে ধরে বসে থাকতে হয়েছে তাকে। তাছাড়া যে চোখে দৃষ্টি নেই সেখানে জল আসা না আসায় কী হয়! মায়ের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বল্লরী বলেছে, ‘অপরাধ কেন হতে যাবে? ওরকম ভেবো না। বরং ভাবো যাতে কোথাও কারও প্রতি অন্যায় না হয়। আমিও সেটাই করতে চাইছি।’

বল্লরীর বাবা এসে তাকে ছুঁয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ‘আমার তোকে কিছু বলার নেই। অনেক কিছুই তো মেনে নিতে হচ্ছে। এরপর যা হবে সেটাও মেনে নেব।’

ছ’ বছর আগে যখন তাদের বিয়ে হয় তখন কত আনন্দ আর হাসি-গানের ভেতরে চোখে চোখ রেখেছে তারা। কত দমকা হাওয়ায় উড়েছে দুজনে। পুরীতে সমুদ্রস্নান। পাহাড়ে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের ছবির সঙ্গে এক ফ্রেমে দুজনে। জীবন যেন ঝলমলে রোদ্দুর। বিয়ের আগে থেকেই চাকরি করত বল্লরী। শ্বশুরবাড়ি, সংসার সামলে হাসিমুখেই সব করতে পেরেছে। দুজনে দুদিকে গেলেও সে আর প্রত্যুষ রোজ একসঙ্গে বেরোত। দুজনেরই সরকারি চাকরি। কম্পিউটার ইনচার্জ বল্লরী যেত আলিপুরের ট্রেজারি বিল্ডিংয়ে আর স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ার প্রত্যুষ সোনারপুরে। কিন্তু এক বছরের কিছু পরেই কাজ ছেড়ে দিতে হল বল্লরীকে। মাথায় যন্ত্রণা। হালকা ওষুধ খেয়ে যাচ্ছিল। কাজ হয়নি। যন্ত্রণা বাড়তে বাড়তে তারপর অবিরাম ডাক্তার, ইঞ্জেকশন, ছুটোছুটি ভেলোর। ডাক্তাররা বলল সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস হয়েছিল অনেকদিন আগেই। বল্লরী নাকি বুঝতেই পারেনি।

যন্ত্রণা কমাতে মাথায় অপারেশন হল। তবু বারবার রক্ত জমেছে মাথার ধমনিতে। কাটাছেঁড়া চলেছে চোখেও। কিছু হল না। আবছা দেখতে দেখতে আরও এক বছরের মধ্যেই সব নিভে গিয়ে একেবারে অন্ধকার। কর্নিয়া নষ্ট হয়ে গেছে ততদিনে। অপটিক নার্ভও কাজ করছে না যে নতুন চোখ দিলে দেখতে পাবে সে।

এখন পাঁচ-ছ মাস অন্তর বল্লরী ভেলোরে যায়। ভর্তি হয়। হাসপাতালে সাদা চাদরের বিছানা। বারবার টেস্ট। স্টেরয়েড। পালটে দেওয়া ওষুধ নিয়ে ফেরত আসে। সঙ্গে বাবা কিংবা মা যায় মাঝে মাঝে। তিনবার কাজের চাপে প্রত্যুষ যেতে পারেনি, বাকি সময়ে সে গিয়েছে। শ্বশুরবাড়িতে আর থাকতে পারে না বল্লরী। সেখানে কে দেখাশোনা করবে তার? চার বছর হয়ে গেল বাপের বাড়িতেই রয়েছে বল্লরী। কোনওদিন প্রত্যুষ সকালে নিজের বাড়ি থেকে বল্লরীর কাছে আসে। অফিসে যায়। কোনওদিন ফেরার পথে আসে। তখন বল্লরীর ঘরের দরজা ভেজানো থাকে। প্রত্যুষও উঠে গিয়ে ছিটকিনি তুলে দিতে পারে না।

আজ দুপুরে বল্লরী যখন শুয়ে, তখন তার ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়েছিল প্রত্যুষ। সে কিছু বলেনি। শুধু অন্য পাশে ফিরে গিয়েছিল। প্রত্যুষ ভেবেছিল তাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেবে। মুখ রাখবে তার বুকে। পারল না। গোলমাল হচ্ছে কোথাও। কেউ যেন ডেকে ফিরে যাচ্ছে। তারপর দরজা খুলেও আর দেখা যাচ্ছে না তাকে।

কটকট করে ব্যাঙের ডাক। সঙ্গে ঝিঁঝির আওয়াজ। মাঝে মাঝে থামছে। আবার শুরু হচ্ছে। ভেজা অন্ধকার ঘিরে রেখেছে চারপাশ। শুধু পুকুরপাড়ে বাঁশের খুঁটিতে ঝুলছে হলুদ ম্লান আলো।

খাবার সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছিল সাধুর বউ। খাওয়ার পর বল্লরীকে ইঞ্জেকশন দিয়েছে প্রত্যুষ। তারপরেই বল্লরী বলেছিল, ‘আলোটা নিভিয়ে দেবে?’

এখন ঘরের ভেতরের অন্ধকারে বল্লরী বলে উঠল, ‘ডাক্তার কী বলেছে তা তো তুমি জানো। মেনে নাও। আমি আর কোনওদিন দেখতে পাব না।’

হাত বাড়িয়ে বল্লরীর হাত চেপে ধরল প্রত্যুষ। ‘ভুল বলছ কেন? বলেছে অনেকদিন সময় লাগবে। আরও পাঁচ-সাত বছরও লাগতে পারে, দশ বছরও লাগতে পারে। কিন্তু অল্প হলেও আবার দেখতে পাবে তুমি।’

‘না, ওটা সান্ত্বনার কথা। তুমিও জানো সেটা। আমার চোখ আর ঠিক হবে না। তুমি এবার ভাবো।’

হেসে উঠল প্রত্যুষ। ‘কী ভাবব?’

‘আমি তোমাকে কোনও স্বাভাবিক জীবন দিতে পারব না প্রত্যুষ। আমাকে তুমি ছেড়ে দাও। মা-বাবার কাছেই থেকে যেতে পারব আমি। তারপর দেখব কী হয়।’

‘হাসপাতাল ছাড়া চার-পাঁচ বছরে একসঙ্গে আমরা আর কোথাও যাইনি। আসলে এই কথাটা বলবে বলে তুমি এখানে আসতে চেয়েছ, না বল্লরী?’

‘হ্যাঁ।’ বলে চুপ করে রইল বল্লরী। বাড়িতে নয়, কথাটা বলার জন্য সত্যিই তার একটা জায়গা দরকার ছিল। যেখান থেকে সে ফিরে যেতে পারবে। বাড়িতে প্রত্যুষ আসে। সেখান থেকে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া কঠিন। অনেক নয়, একটা কথা বলার জন্যই সে একটা জায়গা চাইছিল।

ঝিঁঝির আওয়াজ বন্ধ হয়ে গিয়ে এখন শুধু ব্যাঙের ডাকই শোনা যাচ্ছে। প্রত্যুষ বলল, ‘আমি যদি কোনও অন্ধ মেয়েকেই বিয়ে করতাম, তাহলে?’

‘তা তো হয়নি। আর তা হতোও না। এখন আমার এরকম হয়েছে বলে কথাটা তুমি বলছ। যে কোনওদিন কিছু দেখেনি সে একরকম। আমার তো তা নয়। আমি যে দেখেও দেখতে পারছি না।’

‘আমার এরকম হলে তুমি কি আমাকে ছেড়ে যেতে?’

‘একটা মেয়ের অন্ধ হয়ে যাওয়া মানে ভীষণ গোলমাল প্রত্যুষ।’

প্রত্যুষ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। কথাটা ভুল নয়। সে হঠাৎ অন্ধ হয়ে গেলে বল্লরী তাকে ঠিক সামলাতে পারত। সে কি পারবে? কিন্তু এরকম কি হয়ও না? হতে পারে না?

বল্লরী আবার বলল, ‘তুমি কি জানো না, তোমার-আমার বাড়ির লোকজনকে কতজনের কত কথা শুনতে হচ্ছে?’

‘জানি। কিন্তু যারা বলছে, আমি মনে করি তারা অন্ধ, বল্লরী।’

‘আমার সঙ্গে থাকতে থাকতে তুমিও যদি কোনওদিন অন্ধ হয়ে যাও!’

এই কথায় নিজের কথা হারিয়ে ফেলছিল প্রত্যুষ। যেন আচমকা কেউ একটা আলপিন ফুটিয়ে দিয়েছে আঙুলে।

বল্লরী আর কিছু বলছিল না। প্রত্যুষ কিছুটা সামলে নিতে পারল। বলল, ‘আমিও একটা কথা বলব বলে এখানে আসতে চেয়েছি। আমি অন্ধ না হয়ে তুমি আমার সঙ্গে থেকে আবার তো দেখতেও পেতে পারো বল্লরী।’

‘এভাবে কেউ জীবন কাটাতে পারে না। তোমার সময় পেরিয়ে যাচ্ছে প্রত্যুষ।’

‘তোমার আর আমার সময় কি আলাদা বল্লরী?’

‘হ্যাঁ। আলাদা ছিল না। হয়ে গেছে।’

‘না, হয়নি। ওই যে তুমি সকালে বললে, বাঁশগাছ ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ে, তখন আমারও খেয়াল হল। তার আগে তো আমি দেখেও দেখিনি। তোমার আর আমার সময় তখন এক হয়ে গেছিল বল্লরী।’

ঝিঁঝির শব্দ আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন ব্যাঙের ডাকটাও থেমে গেছে। বল্লরী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘বৃষ্টি হচ্ছে আবার।’

‘কই না তো।’

‘হ্যাঁ হচ্ছে। আমি দেখতে পাচ্ছি।’ বলতে বলতে বল্লরী নেমে পড়ল খাট থেকে। খাটের প্রায় পাশেই দরজা। বন্ধ করা হয়নি। প্রত্যুষ তার হাত ধরার আগেই সেই দরজা খুলে বল্লরী বেরিয়ে গেল বাইরে।

বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল প্রত্যুষ। সত্যি বৃষ্টি নেমেছে। অন্ধকারেও বোঝা যাচ্ছে– ঝিরঝিরে জলের গুঁড়ো উড়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। পুকুর পাড়ে বাঁশের খুঁটির আশেপাশে ছোটো বেঁটে গাছগুলোর পাতায় আলো পড়ে চকচক করে উঠছে বৃষ্টির জল। মাটির সিঁড়ি দিয়ে খালি পায়ে ঘাসজমিতে নেমে পড়েছে বল্লরী। কোনও কথা বলতে পারছিল না প্রত্যুষ। বল্লরী হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যাচ্ছে কী করে? দেখতে পাচ্ছে বল্লরী? এই অন্ধকারেও? যাক সে। দেখা না দেখায় কী যায় আসে!

বাতাসে ভেসে আসছে সুর। বাঁশি বাজাচ্ছে সাধু। হালকা অথচ গভীর। কী গান ধরেছে সে বাঁশিতে? যেন কার গলা মিশে যাচ্ছে এবার সেই সুরে। ও তো বল্লরী। গান গাইছে সে– ।

শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে পড়ুক ঝরে… তোমারি সুরটি আমার মুখের প’রে, বুকের প’রে… পূরবের আলোর সাথে পড়ুক প্রাতে দুই নয়ানে… নিশীথের অন্ধকারে গভীর ধারে পড়ুক প্রাণে… নিশিদিন এই জীবনের সুখের প’রে, দুখের প’রে… শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে…

 

বৃষ্টি থামার শেষে

কলেজ থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়েই সোজা বিছানা নিয়েছে কেয়া। আর পেরে উঠছে না। কয়েকদিন যাবৎ একটু বাড়তি খাটনি হয়ে যাচ্ছে তার। ছাত্র-ছাত্রীদের আবদার মেটাতে প্রায় রোজই কলেজের পরে তাদের ঘন্টা-দুয়েক করে এক্সট্রা টাইম দিতে হচ্ছে। সামনেই এক্সাম, তাই না করতে পারেনি কেয়া। বাচ্চাগুলোকে বড্ড ভালোবাসে সে। আর তারাও কেয়াদি বলতে অজ্ঞান। আসলে কেয়ার ব্যবহারটাই এত মিষ্টি। কলিগদের পছন্দের তালিকায় তার নামটা সবার আগে। সাইকোলজির ডিপার্টমেন্টে বেশ ফেমাস।

আজও বাড়ি ফিরতে প্রায় সাতটা হয়ে গেছে। ফেরার পথে খানিক সবজি নিয়ে ফিরেছে। সেগুলো টেবিলের উপরেই রাখা রয়েছে। ফ্রিজে তোলা হয়নি, শুয়ে শুয়ে এসবই সাতপাঁচ ভাবছিল কেয়া। এমন সময় কৌশানীর হাসির শব্দ কানে এল। সঙ্গে খুব চেনা একটা স্বর। বুঝতে একমিনিটও সময় লাগেনি কেয়ার। নিশ্চয়ই সুশোভন। মনে মনে বিরক্তই হয় কেয়া। আজকাল এ বাড়িতে তার যাতায়াত বড্ড বেড়ে গিয়েছে। সময় নেই, অসময় নেই যখন তখন চলে আসে। তাড়াতাড়ি উঠে হাউসকোট-টা চড়িয়ে নেয়। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই মেয়ে কৌশানীকে প্রশ্ন করে ‘কে রে কৌশী?’

‘শুভ অঙ্কল মা।’ হঠাৎই মেয়ের ‘সুশোভন আঙ্কল’-এর পরিবর্তে ‘শুভ আঙ্কল’ সম্বোধন মনটাকে যেন আরও সংকুচিত করে দেয় কেয়ার। ক’দিন যাবৎ কেয়া নোটিস করছে, কৌশী-র প্রতি একটু বাড়তি-ই স্নেহ দেখাচ্ছে সে। সুশোভন আঙ্কল থেকে শুভ আঙ্কলের অন্তরালে আরও কত কী রহস্য আছে কে জানে। ভেবেই শিউরে ওঠে কেয়া। মনে মনে ভাবতে থাকে অনেক আদর যত্ন আর শিক্ষার সঙ্গে মানুষ করেছে কৌশী আর কুশলকে। সেই কারণেই তো লোকে এত প্রশংসা করে বাচ্চাদের। কিন্তু যতই লালন-পালন ভালো হোক না কেন, বয়স– বয়স মানুষকে ভুল পথে চলতে বাধ্য করে। বিশেষত কৌশী-র বয়সি মেয়েদের। সবে স্কুলের গন্ডি পেরিয়েছে। তার আর কত বোধ তৈরি হবে। মেয়ের মা হওয়াটা যে কতবড়ো দায়িত্বের। না কিছুতেই মেয়েকে বিপথে চালিত হতে দেওয়া যাবে না। ধৈর্য আর বুদ্ধি দিয়ে বিষয়টা ট্যাকল করতে হবে।

ভাবনায় বাধ সাধে সুশোভন। ‘কেমন আছেন বউদি?’ বোধকরি এর আগেও বার কয়েক জিজ্ঞাসা করেছে? ‘কী ভাবছেন?’

চমকে ওঠে কেয়া। খানিক সহজ হওয়ার চেষ্টা করে। ‘ও হ্যাঁ হ্যাঁ। না না কিছু ভাবছি না তো।’

‘উঁহু, মনে হল।’

‘আরে না না, ওই একটু ক্লান্ত আর কী, জানেনই তো, সবকিছু।’ মনের মধ্যে বিতৃষ্ণা থাকলেও হাসার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে কেয়া। তারপর প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘তা, কী মনে করে?’

‘ওই আরকী, কাছেই একটা কাজ ছিল, তাড়াতাড়ি মিটে গেল, তাই ভাবলাম একটু খবর নিয়ে যাই। নইলে তো বন্ধুর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। ফিরে এসে বলবে তার অনুপস্থিতিতে আমি দায় এড়িয়ে গেছি।’

‘তা বটে, আমাদের ভালো থাকা না থাকাটা তো এখন আপনারই হাতে।’ কথাটা একটু আস্তে বললেও সুশোভনের কান পর্যন্ত ঠিকই পৌঁছোয়। কেয়ার কথার কী মানে করে কে জানে, একটু অপ্রতিভ হয়েই সুশোভন বলে, ‘এমন করে বলছেন কেন, এটা তো আমার কর্তব্য।’

‘চা খাবেন নিশ্চয়ই’– উত্তরের অপেক্ষা না করে, মেয়ের দিকে ফিরে বলে, ‘কৌশী দু-কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এসো তো।’

এর মিনিট পনেরো পর চা-খাইয়ে সুশোভনকে বিদায় করে বারান্দায় এসে বসে কেয়া। মন খারাপ হলে এখানেই এসে বসে সে। বাগানের গাছগুলো যেন কথা বলে তার সঙ্গে। আজ গাছেরাও যেন তার মন ভালো করতে অসমর্থ্য। খুব ভারাক্রান্ত লাগে কেয়ার। কুশীলব দেশে নেই। ছেলে ব্যাঙ্গালোরে। বাড়িতে মা আর মেয়ে। তার মাঝে এই দুশ্চিন্তা, তাকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। কখনও ভাবেনি কুশীলবের অনুপস্থিতিতে তাকে এরকম সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।

মাস ছয়েক আগেও সবকিছু ঠিক ছিল। যখন আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষি সম্পর্কিত বিশেষ জ্ঞান আর যোগ্যতার জন্য, ছাত্রদের সুবিধার্থে কুশীলবকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। ছেলেমেয়ে, স্ত্রী, সংসারের কথা ভেবে পিছিয়ে গিয়েছিল কুশীলব। এক বছর মানে তিনশো পঁয়ষট্টিটা দিন পরিবারকে ছেড়ে সুদূর আমেরিকায় থাকা সম্ভব নাকি? তাছাড়া ছেলেও পড়াশোনার কারণে বাড়ি থেকে দূরে ব্যাঙ্গালোরে থাকে। সে চলে গেলে বাড়িতে কেয়া আর কৌশী একা, ভাবতেই পারে না কুশীলব। কাছাকাছি তেমন কোনও রিলেটিভও নেই যাদের ভরসায় রেখে যাওয়া যায়। কুশীলবের মা-বাবা কবেই গত হয়েছেন। দুই দাদাও থাকে অ্যাব্রডে। কেয়ার বাপের বাড়িও বেশ ঘন্টা পাঁচেকের পথ। বিপদে-আপদে যে তারা পাশে এসে দাঁড়াবে সে উপায়ও নেই। এসব ভেবেই আরও পিছিয়ে যাচ্ছিল কুশীলব। তখন কেয়াই বুঝিয়ে সুঝিয়ে…।

‘মানছি এটা আমার জন্য খুবই গর্বের বিষয়। কিন্তু একবার ভেবে দেখেছ, তুমি একা এতগুলো দিন কীভাবে সামলাবে?’ কুশীলবের ভাবনাও অমূলক নয়।

‘কেন আমার উপর বিশ্বাস নেই তোমার?’ স্বামীর কাছ ঘেঁষে আসে কেয়া।

‘বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্ন আসছে না কেয়া, আমি জানি তুমি তোমার সামর্থ্য অনুযায়ী সবটুকু দিয়ে সামলে নেবে। কিন্তু তবুও…’। ভাবনাগুলো আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরে কুশীলবকে।

‘তুমি দেখো আমি সব সামলে নেব। এমন অপারচুনিটি বারবার আসে না কুশীলব। আর তাছাড়া তুমি এমন ভাবে রিঅ্যাক্ট করছ যেন আমি প্রথম গ্রাম থেকে শহরে এসেছি।’ কুশীলবকে চিন্তামুক্ত করার চেষ্টা করে কেয়া।

‘তোমাদের ছেড়ে একটা বছর’। চোখের কোণা চিকচিক করে ওঠে কুশীলবের। আবেগপ্রবণ হয়ে বুকে টেনে নেয় কেয়াকে। দূরে থাকার কথা ভেবে কেয়াও মুহূর্তের জন্য ইমোশনাল হয়ে পড়ে। আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে কুশীলবকে। চোখ জলে ভরে আসে। বেগতিক বুঝে কোনওমতে নিজেকে সামলে নেয় কেয়া। মনে মনে ভাবে… না, স্বামীর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য তাকে শক্ত হতেই হবে। তারপর নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কুশীলবের হাত দুটো ধরে দৃঢ় কণ্ঠে বলে, ‘একটা তো বছর। দেখতে দেখতে কেটে যাবে। তাছাড়া বদলে কী পাচ্ছ সেটাও তো দেখতে হবে। কিছু পেতে হলে কিছু তো ছাড়তেই হয়।’ হাসার চেষ্টা করে কেয়া।

‘কিন্তু…।’

‘আবার কিন্তু কীসের? আর কোনও কিন্তু নেই। তুমি যাচ্ছ, এটা ফাইনাল।’ শেষ পর্যন্ত কেয়ার কাছে হার মানতে হয় কুশীলবকে। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়পরিজনদের আশ্বাস পায় বটে, তবে খটকা থেকেই যায় তার। আসলে কুশীলব যে ধরনের মানুষ, তাতে তার বিচলিত না হওয়াটাই অস্বাভাবিক। ভীষণ দায়িত্বশীল। অন্যান্য বন্ধুবান্ধবদের মতো কলেজের পরে কোনওদিন আড্ডাতে বসেনি, পরিবার নিয়ে থাকতেই সে ভালোবাসে। কোথাও যাওয়ার থাকলে দুজনে একসাথে।

নির্ধারিত দিনে আমেরিকার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয় কুশীলব। বাড়িতে এখন শুধু কেয়া আর কৌশানী। কুশীলব যাওয়ার পর বাড়িটা বড়ো খালি খালি লাগে কেয়ার। সপ্তাহে তিনদিন সন্ধের দিকে কৌশীর টিউশন থাকে। তখন একাকীত্ব যেন আরও চেপে ধরে কেয়াকে। নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য গান শোনে। পুরোনো দিনের গান। এগুলো বরাবরই কেয়ার খুব পছন্দের। কিন্তু আজকাল আর এসবও শুনতে ইচ্ছে করে না। মনে পড়ে যায় গানের মাঝে কুশীলবের গলা ছেড়ে গান ধরা, ‘ওগো কাজল নয়না হরিণী…’ মনটা আরও ভারাক্রান্ত হয়ে যায় তার। কৌশী-র বন্ধুবান্ধবরা এলে অবশ্য ঘরটা গমগম করে, বেশ ভালো লাগে কেয়ার। তাদের আবদার মেটাতে মেটাতেই টাইম চলে যায় তখন।

দিনগুলো একরকম কাটছিল। তবে কৌশী বরাবরই একটু বাবা ঘেঁষা। বাবা পাশে থাকলেই যত খুনশুটি, যত আবদার। বাবাই ছিল সবথেকে বড়ো বন্ধু। বাবার অনুপস্থিতিতে কৌশী বেশ একা হয়ে গিয়েছিল। বাবাতে-মেয়েতে মিলে পুরো বাড়িটাকে মাতিয়ে রাখত। সঙ্গে মাঝেমধ্যেই কৌশীর বাবার বিরুদ্ধে অভিযোগ। ‘দ্যাখো না মা, বাবা যাবে না বলছে… এটা আনেনি… টিভির চ্যানেল ঘুরিয়ে দিয়েছে…’ হাজারো নালিশ। এখন বাড়িতে কৌশীর উপস্থিতি ফিল করতে পারে না কেয়া। এর মাঝে কুশীলবের বন্ধু কখনও একা, আবার কখনও পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে খোঁজখবর নিয়ে যেত। গল্পগুজব করে খানিকটা সময় কাটিয়ে যেত। কেয়ার বন্ধুরাও আসে মাঝে মাঝে। তবে কুশীলবের বন্ধু সুশোভন আর কেয়ার বন্ধু মীরার যাতায়াত ছিল অনেক বেশি। সুশোভন, কুশীলবের খুব কাছের বন্ধু। ওর সঙ্গে একই ডিপার্টমেন্টে রয়েছে। বিয়ে-থা করেনি। যাকে বলে, ঝাড়া হাত-পা আর কী। খুব সহজেই সকলের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। মন জিতে নিতে পারে। আকর্ষকও বটে। এই ক’দিনেই কৌশীর সঙ্গে বেশ ভাব জমেছিল সুশোভনের। আর মীরা কেয়ার কলিগ হলেও খুব ঘনিষ্ঠ। দুজনের ভাবনাচিন্তায় অদ্ভুত মিল থাকায় তাদের অন্তরঙ্গতা। একে-অপরের সঙ্গে সমস্ত কিছু শেয়ার করে তারা। মীরার বর ডাক্তার। দুই ছেলে অক্ষয় আর অভয়। এই বছরেই অক্ষয় পিসিএস-এর জন্য নির্বাচিত হয়েছে। আর অভয় বিএসসি ফাইনাল ইয়ার।

এর মাঝে ছেলে কুশলও কলকাতায় এসে দিন দশ-বারো কাটিয়ে গেছে। কুশলের আসাতে বাড়িতে বেশ একটা আনন্দের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। দুই ভাই-বোনের হাসি-ঠাট্টায় সামিল হতে হতো কেয়াকেও। কোনও প্ল্যানিং ছাড়াই তিনজনে হুট করে শপিং করা, খাওয়াদাওয়া করা, ঘোরা, সারাদিন পরে ঘরে ফেরা। সবকিছুর মাঝেও কুশীলবকে খুব মিস করছে কেয়া। এতগুলো বছর একসাথে থাকার একটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। কোনওদিন কেউ কাউকে ছেড়ে থাকেনি। এমনকী কুশল, কৌশী হবার সময়তেও কেয়াকে বাপের বাড়িতে পাঠায়নি কুশীলব। সেই নিয়ে কম ঠাট্টা শুনতে হয়নি কুশীলবকে বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে। হেসে উড়িয়ে দিয়ে বলেছে ‘বউকে ভালোবাসা কি অন্যায় নাকি?’ এতদিনের অভ্যাস বদলাতে একটু সময় তো লাগবেই। সপ্তাহে দু’দিন ফোন করে কুশীলব। সারা সপ্তাহ মুখিয়ে থাকে কেয়া ওই দিনটার জন্য। কুশীলবের সঙ্গে কথা বলার মুহূর্তটা নিয়েই বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দিত সে।

একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসের মধ্যেই মাথা ঘুরে একদম মাটিতে পড়ে গেল কেয়া। কলেজের ছাত্র আর কলিগদের তৎপরতায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় কেয়াকে। উচ্চরক্তচাপ, হার্টের সমস্যার কারণে লম্বাচওড়া প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে একমাস রেস্টে থাকতে বলে ছেড়ে দিলেন চিকিৎসক। সংসারের সমস্ত দায়িত্ব এসে পড়ে কৌশীর উপর। একাকী ছোট্ট একটা মেয়ের পক্ষে ঘর সামলে, অসুস্থ মায়ের দেখভাল করে কলেজে পৌঁছোনোটা খুব মুশকিল হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। তখন সুশোভন আর মীরাকে পাশে পেয়েছিল কেয়া। বাজার, দোকানপাট সমস্ত কিছুই করে দিত সুশোভন।

সেই সময় কেয়া অসুস্থ থাকায়, বাড়িতে অতিথি অভ্যাগতদের আপ্যায়ন কৌশীকেই করতে হতো। মীরা এলে কেয়ার পাশে দু-দণ্ড বসে গল্পগুজব করত, কিন্তু সুশোভন মায়ের থেকে বেশি মেয়ের সঙ্গেই সময় কাটাতে পছন্দ করত। অথচ আশ্চর্যরকম ভাবে কেয়ার উপস্থিতিতে দুজনের ব্যবহারেই কেমন যেন জড়তা লক্ষ্য করত কেয়া। তারা একাকী থাকলে যতটা উচ্ছল থাকে, কেয়ার উপস্থিতিতে সেটা বদলে যায়, এটা একাধিকবার খেয়াল করেছে কেয়া। আর এক অজানা ভয় ঘিরে ধরেছে তাকে। মনের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে আর ভেবেছে, সুশোভন আর কৌশী? দুজনের মধ্যে বয়সের কত তফাত। কুশীলবের থেকে দু-চার বছরের ছোটো হবে হয়তো সুশোভন। বাবার বয়সি একজন লোক এভাবে একটা কচি মেয়ের সঙ্গে ইনভল্ভড… ছিছি, মনটা বিষিয়ে ওঠে কেয়ার। সবথেকে আশ্চর্যের বিষয় কেয়ার সুস্থতার খবর নিতে এসে, তাকে ভুলে গিয়ে বেহায়ার মতো নীচ থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চ্যাঁচাতে থাকে, ‘কৌশী, বড়ো রাস্তার দিকে যাচ্ছি, যাবে নাকি? চলো একটু ঘুরে এলে মনটা ভালো লাগবে। আর তোমার যদি কিছু নেওয়ার থাকে নিয়ে নিও।’ কৌশীও ‘আসছি’ বলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই চেঞ্জ করে খটখটিয়ে বেরিয়ে যেত।

কৌশী তো না হয় ছোটো, ভালোমন্দ সেভাবে বুঝতে শেখেনি? কিন্তু সুশোভন। ও কী করে এই অন্যায়টা করছে। সরলতার সুযোগ নিয়ে একটা ছোট্ট মেয়েকে… আচ্ছা ওরা ফিজিকালি ইনভল্ভ নয় তো? দৈহিক ক্ষিদে কী ওর এতটাই বেড়ে গেছে যে বয়সের ব্যবধানও তার নজরে পড়ছে না। মনটা ভয়ে শিউরে ওঠে কেয়ার। কথায় কথায় কৌশীর জন্য গিফট আনাটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না কেয়া। শুধু একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল কেয়া। ভাগ্য আজ ক্লিকও করে গেছে। চুড়িদারের সেট-এর সঙ্গে ম্যাচিং অ্যাকসেসরি নিয়ে ফিরেছে কৌশী আর সুশোভন। ঘরে ঢুকেই হাসতে হাসতেই প্যাকেটটা মায়ের দিকে বাড়িয়ে দেয় কৌশী, ‘এই দ্যাখো মা, আমাকে এগুলো কিনে দিয়ে…’ মেয়েকে কথা শেষ করার সুযোগ দেয় না কেয়া। তার আগেই বলে বসে, ‘ঠিক আছে দেখছি। তার আগে তুই একটা কাজ করতো, উপরে ওষুধটা রয়ে গেছে, নিয়ে আয় তো মা। আর শোন প্রেসক্রিপশনটার সাথে একবার মিলিয়ে নিস। নাহলে কোনটা বলতে কোনটা খেয়ে নেব।’ তারপরেই মুখের চেহারা বদলে যায় কেয়ার। ‘এসবের কিন্তু কোনও দরকার ছিল না। রোজ রোজ এভাবে। ওর কিছু কমতি তো রাখিনি আমি।’, বেশ দৃঢ় শোনায় কেয়াকে।

‘কেন এভাবে বলছেন বউদি, আমি কি ওকে কিছু দিতে পারি না। এটুকু অধিকারও কি আমার নেই? স্নেহ করি বলেই তো…’ বলেই কৌশীর মুখের দিকে তাকায় সুশোভন। সে নজরে স্নেহ নেই, আছে শুধু কামনা। সেই দৃষ্টি চোখ এড়ায় না কেয়ার। আপ্রাণ চেষ্টা করে কেয়া একটু সংযত হবার, কিন্ত যেখানে মেয়ের সম্মানের প্রশ্ন সেখানে তাকে রুখে দাঁড়াতে হবেই।

‘সরি কিছু মনে করবেন না, জানি আপনি আমাদের জন্য অনেক করেছেন। তার জন্য অশেষ ধন্যবাদ। এর বেশি কিছু চাই না। আশা করি আপনি বুঝতে পারছেন, আমি কী বলতে চাইছি। এবার আপনি আসুন।’ মাথা নীচু করে বেরিয়ে যায় সুশোভন।

খানিক হালকা লাগে কেয়ার। কতদিন ভেবেছে কুশীলবকে সবকিছু খুলে বলবে। নাম্বার ডায়াল করেও ফোনটা কেটে দিয়েছে এই ভয়ে যে, সবকিছু শুনলে কুশীলব কিছুতেই আর বিদেশবিভুঁইয়ে পড়ে থাকবে না। সবকিছু উপেক্ষা করে ছুটে আসবে। আর তো ক’টা মাস। সে ঠিক সামলে নেবে। ছেলেকে পর্যন্ত বলেনি এই সমস্যার কথা। ফাইনাল ইয়ার। পড়াশোনার ক্ষতি হোক চায় না কেয়া। মেয়ের কথায় সম্বিৎ ফেরে কেয়ার। ‘মা, ও-মা প্রেসক্রিপশনটা কোথায় রেখেছে সেটাই তো খুঁজে পেলাম না। মেলাব কী করে?’ বলতে বলতে এদিক-ওদিক তাকিয়ে নেয় কৌশী। তারপর খুব সহজ ভাবে প্রশ্ন করে বসে, ‘শুভ আঙ্কল কোথায় গেল?’ মেয়ের মুখে সুশোভনের নাম শুনে যেন মুহূর্তেই জ্বলে উঠল কেয়া।

‘ওনার কী কোনও কাজ নেই যে, দিবারাত্রি এখানে পড়ে থাকবেন। যাও নিজের ঘরে যাও।’ হঠাৎই মায়ের ধমকে চমকে ওঠে কৌশী। মায়ের রাগের কারণ খুঁজে পায় না সে। ধীর পায়ে নিজের ঘরের দিকে এগোতে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই মায়ের সেই স্নেহমাখা ডাক, ‘শোনো কৌশী। এখন আর তুমি ছোট্টটি নও। বড়ো হয়েছ, কলেজে পড়ছ। নিজের ভালোমন্দগুলো নিজেকেই বুঝে নিতে হবে। আশপাশের মানুষগুলোকে চিনতে হবে। বুঝতে হবে, তারা কেমন। তারা তোমার থেকে ঠিক কী চাইছে। তারা কী সত্যিই তোমার শুভাকাঙক্ষী, নাকি…’ আর কথা বলতে পারে না কেয়া। মেয়ের মাথায় একবার হাতটা বুলিয়ে দেয়।

মায়ের কথার অর্থ আঁচ করতে পারে কৌশী। লজ্জায় সংকুচিত হতে থাকে সে। ‘ইস্ এতদিন তো সেভাবে ভাবেনি কখনও। তাহলে কি সত্যিই সে নিজের অজান্তে ভুল পথে পা বাড়িয়ে দিয়েছিল, নাকি সে শুধু বাবার বন্ধু হিসেবেই বাবার শুন্যস্থানটা পূরণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু মায়ের অভিজ্ঞ চোখ, তাহলে কি কাকুর খারাপ কোনও অভিসন্ধি রয়েছে।’ মুখে কোনও কথা বলতে না পারলেও মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে কৌশীর।

‘কী হল, যাও। এভাবে দাঁড়িয়ে রইলে কেন?’ মায়ের কথায় চমকে ওঠে কৌশী। মায়ের হাতদুটো চেপে ধরে। ‘বিশ্বাস করো মা, আমি জানি না কাকু আমাকে কী নজরে দেখে, কিন্তু আমি কখনও ওনাকে…’ কেঁদে ফেলে কৌশী।

‘আমিও তোমার থেকে ঠিক এটাই আশা করেছিলাম। ঠিক আছে যাও, ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নেবে এসো। কাল সকালে আবার তোমার কলেজ আছে।’

রাতটা খুব নিশ্চিন্তে কাটে কেয়ার। অনেকদিন পর ভালো করে ঘুমিয়েছে সে। বুকের উপর চেপে বসা পাথরটা সরে গিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছে সে। সকালে টিফিন সেরে আর এক কাপ চায়ে চুমুক দিতে যাবে, ঠিক তখনই মোবাইলটা বেজে উঠল। মীরা কল করেছে। ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে গলা ভেসে আসে মীরার, ‘শোন আজ আড্ডা মারার মুডে আছি, ভাবছি তোর বাড়িতে চলে যাই। তোর কোনও অসুবিধে নেই তো?’

‘অসুবিধের কী আছে, তুই এলে খুব ভালো লাগবে। জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে। কিন্তু তোর কলেজ?’

‘আরে মাঝে মাঝে তো আমাদেরও ফাঁকি দিতে ইচ্ছে করে নাকি’ বলে হেসে ওঠে মীরা।

বারোটা নাগাদ মীরা এসে হাজির হয়। কেয়ার হাতে হাতে সে-ও খানিক কাজ এগিয়ে দেয়। তারপর খাওয়াদাওয়ার পর হাজারো প্রসঙ্গের মাঝে এসে ঢুকে পড়ে কৌশী।

‘জানিস আজকাল মেয়েটাকে নিয়ে খুব টেনশন হয়। একদম চালাকচতুর নয়। খুব ভয় করে। কতদিন আর নিজের কাছে রাখব বল, একটা সময় তো বিয়ে দিতেই হবে। অন্যের হাতে তুলে দিতেই হবে, কী যে করবে কে জানে।’ চিন্তার ভাঁজ পড়ে কেয়ার কপালে।

‘কী বোকা বোকা কথা বলিস বলতো, কতই বা বয়স ওর। এখনই এই সমস্ত ভাবছিস। তুই বরং এক কাজ কর, তোর অসুবিধা থাকলে ওকে আমাকে দিয়ে দে, আমি আমার অক্ষয়ের বউ করে নিয়ে যাব।’

‘ভেবে বলছিস, এ-মেয়ে কিন্তু কিচ্ছু পারে না। পরে বলিস না যে, আমি বলিনি।’

‘ওসব আমার উপর ছেড়ে দে। তাছাড়া পারার আছেটা কী-রে। আজ অবধি আমি সংসারের ক’টা কাজ করেছি যে ও-কে বলব কাজ করতে। পড়াশোনা করবে, বাড়ির মেয়ের মতো থাকবে ঘুরবে-ফিরবে। ব্যস আর কী চাই। তাছাড়া অমন মেয়ে আমি চাইলেই পাব কোথা থেকে।’ বলেই হো-হো করে হেসে ওঠে দুজনে। কেয়া কিছু বলার আগে মীরা প্রস্তাব রাখে, ‘বরং আগামী রবিবার তুই তোর মেয়েকে নিয়ে আমাদের বাড়িতে চলে আয়।’

কথা কাটে কেয়া। ‘তার চেয়ে বরং সপরিবারে তোরাই চলে আয়। রাতের খাওয়াটা এখানে সারবি কিন্তু।’

‘শুধু আমরা কেন, যদি বলিস আরও দশ-বারো জনকে ডেকে নেব। শরীর একটু ভালো না হতে হতেই শুরু করে দিয়েছিস না।’

‘ইয়ার্কি ছাড় তো। বাড়িতে তো আমরা ওই মা আর মেয়ে। তোরা এলে ভালো লাগবে।’

‘ঠিক হ্যায় হুজুর। আপকে মনোরঞ্জন কে লিয়ে হাম আ জায়েঙ্গে’ বলেই আবার হো হো করে হেসে ওঠে মীরা। সঙ্গে কেয়াও।

এর মাঝে কুশীলবকে কিছুটা আভাস দিয়ে রাখে কেয়া। দু-বছর পরে হলেও, একমাত্র মেয়ের বিয়ের কথা ভেবেই মনটা ভিজে যায় কুশীলবের। কিন্তু মীরার পরিবারকে সে ভালোমতোই চেনে। এরকম পরিবারে সম্বন্ধ করার জন্য মা-বাবারা মুখিয়ে থাকে, সেখানে বাড়ি বয়ে এমন সম্বন্ধ এসেছে, এড়িয়ে যাওয়াটা বোকামো হবে। তাই আর কেয়ার প্রস্তাবে না করেনি কুশীলব।

আজ সকাল থেকেই মনটা বেশ ফুরফুরে কেয়ার। বাজার দোকান সমস্ত নিজের হাতে করেছে। তারপর থেকে চলছে রান্নার তোড়জোড়। এত আয়োজন দেখে কৌশী তো প্রশ্নই করে বসল, ‘কী ব্যাপার মা। এত তোড়জোড় কীসের? কেউ আসছে নাকি?’

‘এমনিই… অনেকদিন পর আজ শরীরটা ভালো আছে, তাই তোর মীরা আন্টিদের ডেকেছি। ওর ছেলে অক্ষয় এতদিন পর বাড়ি ফিরেছে, না ডাকলে খুব খারাপ লাগত রে। ও হ্যাঁ তুই-ও বাড়িতে থাকিস।’

‘কিন্তু মা, আমার তো টিউশন আছে।’

‘একটা দিন না গেলে কিছু হবে না। একবার ভেবে দ্যাখ, বাড়িতে লোক বলতে তো তুই আর আমি। ওদের ডাকলাম, এখন তুই যদি চলে যাস, ওদের খারাপ লাগবে না। তুই বরং তোর বন্ধুদের থেকে নোট নিয়ে নিস।’

‘ঠিক আছে মা।’

কথামতো সন্ধেবেলা মীরা, ডাক্তারসাহেব, অক্ষয়, অভয় সকলে এসে পৌঁছেছে কেয়াদের বাড়িতে। রসিক স্বভাবের ডাক্তারসাহেব ঢুকতে না ঢুকতেই বলেন, ‘কী ব্যাপার কেয়া, অসুস্থতার পরে মনে হচ্ছে আরও একটু বেশি সুন্দর লাগছে।’

‘এই বুড়ো বয়সে আমার বন্ধুর দিকে কেন নজর দিচ্ছ শুনি।’

‘কী করব বলো, সারাজীবন তো তোমাকে ছাড়া আর কাউকে দেখতেই দিলে না। এই বুড়ো বয়সে তো একটু ছাড়ো।’ সকলে মিলে হেসে ওঠে।

‘আগে ভিতরে তো আসুন। কথা তো আমারও আপনার সঙ্গে আছে।’

‘কী কথা, কী কথা, সবার সামনে বলা যায় নাকি, অন্য কোথাও যাবে…’

‘ও সত্যি পারেনও আপনি।’ মাকে অনেকদিন পর এভাবে হাসতে দেখে কৌশানীরও ভালো লাগে।

কৌশীও খুব তৎপরতার সঙ্গে সকলকে স্বাগত জানায়। স্ন্যাক্স আর কফি খেতে খেতে অক্ষয়-অভয়ের সঙ্গে বিভিন্ন কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে কৌশী।

কথার ফাঁকেই অক্ষয়কে লক্ষ্য করতে থাকে কেয়া। যেমন দেখতে তেমনি ব্যক্তিত্ব। টল, ডার্ক অ্যান্ড হ্যান্ডসাম যাকে বলে। আজকালকার ছেলেদের থেকে যেন একটু আলাদা। ব্যবহারের মধ্যেও একটা শালীন ব্যাপার রয়েছে তার। খুব মিশুকে, সবসময় মুখে হাসি লেগে রয়েছে। কেয়া যেমনটা চেয়েছিল ঠিক তেমনটাই। কৌশীর সাথে খুব ভালো মানাবে।

ডাক্তারসাহেব আর মীরা তো কৌশীকে ভালোমতো চেনে। আগাগোড়াই শান্ত স্বভাব আর ব্যবহারের কারণে কৌশী তাদের সুনজরে ছিলই। অক্ষয়কে দেখেও কেয়ার মনে হল তারও অমত হবে না। তবে এব্যাপারে কৌশীর কী প্রতিক্রিয়া হয় সেটাই দেখার।

গল্প করতে করতে হঠাৎই চোখ যায় ঘড়ির দিকে। কেয়া তৎপর হয়ে ওঠে। ‘দেখেছ, কথা বলতে বলতে বুঝতেই পারিনি দশটা বেজে গেছে। চলো চলো সবাই টেবিলে চলে এসো। এই যে ডাক্তারসাহেব আপনাকে কি আবার আদরআহ্লাদ করে নিয়ে যেতে হবে নাকি?’

‘সেই সৌভাগ্য কি আর আমার হবে?’

‘চলুন চলুন।’

‘হ্যাঁ, চলো।’

সকলে টেবিলে বসে পড়ে। কেয়া আর মীরা এক এক করে প্লেটে খাবার সার্ভ করতে থাকে। মায়ের কাজে হেল্প করে কৌশীও। খাবার শেষে অক্ষয় তারিফ না করে পারে না। ‘আন্টি, তোমার হাতের খাবার না, জাস্ট লাজবাব। মনে হচ্ছে তোমার হাতে খাওয়ার জন্য বারবার আসতে হবে তোমার কাছে।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, তোমার যখন মনে হবে চলে আসবে।’ হাসতে হাসতে জবাব দেয় কেয়া।

খাওয়াদাওয়ার পর্ব মেটার পর ফিরে যাবার সময় নিজের স্ত্রী-র উদ্দেশ্যে বলেন ডাক্তারসাহেব, ‘কী ম্যাডাম আপনি কি শুধু খেতে জানেন, নাকি খাওয়াতেও জানেন?’ মীরাও একবার বরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, ‘ওসব, আমাদের সারা হয়ে গেছে মশাই। ওরা আমাদের বাড়িতে রবিবার দিনই আসছে বুঝেছ।’

‘চলো তাহলে তো ঠিকই আছে। দুই বন্ধুতে মিলে যখন আগেই সেরে রেখেছ। বেশ বেশ, আসছি রে মা, ভালো থাকিস।’ ডাক্তারসাহেবের কথায় মাথা নাড়ে কৌশী। যাওয়ার সময়তে অক্ষয় একঝলক ভালো করে দেখে নেয় কৌশীকে। তারপর মুচকি হেসে গাড়িতে উঠে পড়ে।

ল্যান্ডফোনে সচরাচর এখন আর ফোন আসে না। মোবাইল হয়ে গিয়ে ওটা এখন খানিকটা শো-পিসের মতোই। কখনও-সখনও কোম্পানি থেকে ফোন আসে, কখনও আবার ফোনটা সচল রাখার জন্য কুশীলব ফোন করে। ল্যান্ডফোনের ব্যবহার বলতে এই। পরদিন সক্বালবেলাই ফোনটা হঠাৎ করে বেজে ওঠাতে চমকে ওঠে কেয়া। আগের দিনের খাটাখাটনির কারণে তখনও বিছানা ছেড়ে ওঠা হয়নি তার। ফোনের আওয়াজ পেয়ে উঠে পড়ে সে। সিঁড়ি বেয়ে নামার আগেই ফোনটা কেটে যায়। ফোনটা আবার বেজে ওঠে। কেয়া শুনতে পায় কৌশী ফোনটা ধরে বলছে, ‘দ্যাখো কাকু, আমার মা চায় না আমি তোমার সাথে কথা বলি। আর কী এমন প্রয়োজনীয় কথা যে, মোবাইল সুইচ অফ বলে ল্যান্ডে করতে হচ্ছে। মায়ের ধারণাই তাহলে ঠিক।’ রিসিভারটা নামিয়ে রাখে কৌশী। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সবটাই কানে আসে কেয়ার। একটু আশ্বস্ত হয়।

দেখতে দেখতে কেটে যায় আরও চারটে দিন। এর মাঝে মীরার সাথে বেশ কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে। অক্ষয়ের নাকি বেশ পছন্দ হয়েছে কৌশীকে। বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তে সে রাজি। আজও সকালে ফোন করেছে সক্বাল সক্বাল ওদের বাড়ি পৌঁছানোর জন্য। সেই মতো যাওয়ার তোড়জোড়ও শুরু করেছে কেয়া।

‘কৌশী আজ তুই ওই গোলাপি সালোয়ার-কামিজটা পরিস। ওটা তোকে খুব ভালো মানায়।’

‘কোনটা মা, গতবছর পুজোয় বাবা যেটা দিয়েছে।’

‘হ্যাঁ, ওটাই। চল চল তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে। ওদিকে তোর মীরা আন্টির তিনচারবার ফোন করা হয়ে গেছে।’

তৈরি হয়ে পৌঁছোতে পৌঁছোতে সোয়া বারোটা বেজে গেছে। পৌঁছে দেখে ডাক্তারসাহেব, অক্ষয় সকলে হাত মিলিয়েছে রান্নার কাজে। কেয়াও হাত লাগানোর জন্য এগিয়ে যায়।

‘আরে তুই বস তো। একটা দিন ওদের করতে দে। আজ ওদের পরীক্ষা। দেখি না কেমন টেস্টি খাবার বানাতে পারে। দেখছিস না বাবা-ছেলে কেমন কোমর বেঁধে নেমেছে।’ কথাগুলো বলতে বলতেই মীরার চোখ চলে যায় কৌশীর উপর। ‘ওমা তোকে কী মিষ্টি লাগছে রে।’ বলেই গালদুটো টিপে দেয় মীরা। তারপর ডাক্তারসাহেবের দিকে ফিরে বলে। ‘আরে ডাক্তারসাহেব একটু এদিকেও দ্যাখো। একে দেখে তোমার রান্না যদি একটু সুস্বাদু হয়।’

লজ্জা পেয়ে যায় কৌশী– ‘ও আন্টি তুমিও না।’

অক্ষয়ের চোখে চোখ পড়ে যায় কৌশীর। সে-ও একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছে তার দিকে। চোখ নামিয়ে অন্যদের সাথে ব্যস্ত হওয়ার ভান করে সে। এদিক-ওদিককার নানা কথা হওয়ার পর মীরা চা বানাবার জন্য উঠতে গেলে কৌশী বলে, ‘চা আমি বানাচ্ছি আন্টি, তোমরা কথা বলো।’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ মা, তাই কর। এরা যে কখন খেতে দেবে তার তো কোনও ঠিক নেই। ততক্ষণ না হয় একটু চা-ই খাই। তাছাড়া তোর আঙ্কল বানালে সে চা মুখে দেওয়া যাবে না।’ ডাক্তারসাহেবের বক্র দৃষ্টি দেখে সকলে হেসে ফেলে।

কৌশী চা বানাবার জন্য এগোতেই অক্ষয় তার দিকে এগিয়ে যায়– ‘চলো আমি তোমাকে হেল্প করছি।’

ততক্ষণে ডাক্তারসাহেবও রান্নার পরিসর ছেড়ে মীরার কাছে এসে বসেছে। দুজনকে একসাথে যেতে দেখে বলেন– ‘দুজনকে দারুণ মানাবে গিন্নি। কী বলো?’

‘সত্যিই মানাবে’ ডাক্তারসাহেবের কথায় সম্মতি প্রকাশ করে মীরা। তারপর কেয়ার উদ্দেশ্যে বলে, ‘কেয়া, ডাক্তারবাবুর আর আমার দুজনেরই কৌশীকে খুব পছন্দ। আমার মনে হয় অক্ষয়েরও মনে ধরেছে কৌশীকে। নাহলে অন্য সময় বিয়ের কথা বললে হাজারো বাহানা শুরু করে দেয়। কাল কৌশীর কথা বলতে হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দ্যাখ আমাকে তো ছেলের বিয়ে দিতেই হবে। এখন তুই যদি বলিস তাহলে কুশীলবদা ফিরলে আশীর্বাদটা সেরে রাখব। দু-বছর পর কৌশীর গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট হলে বিয়ে হবে, ক্ষতি কী। তুই বরং কৌশীর মতামতটা জেনে নে।’

আনন্দে চোখে জল চলে আসে কেয়ার। মীরা যে তার কত বড়ো উপকার করল, সেটা একমাত্র কেয়াই জানে। গলা ভারী হয়ে আসে তার। ‘আমার মেয়ের কপালে যে এত ভালো একটা সম্বন্ধ লেখা রয়েছে, ভাবতেও পারিনি। অক্ষয়ের মতো ছেলে, তোদের মতো শ্বশুর-শাশুড়ি, এত ভালো পরিবার,’ আর কথা বলতে পারে না কেয়া। গলা আরও বুজে আসে তার।

পরিবেশ হালকা করতে ডাক্তারসাহেব বলে বসেন, ‘আরে ভাই আমরাই কী ভেবেছি আমাদের বুদ্ধুটার কপালে…’ বলতে বলতে থেমে যান ডাক্তারসাহেব। কপালে রেখার ভাঁজগুলো আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।’ ‘আচ্ছা চা-টা কী দার্জিলিং থেকে আসছে।’ সত্যিই তো কথার মাঝে কেউ খেয়াল করেনি সময়তো অনেকটাই গড়িয়েছে। এতক্ষণে তো বোধহয় চারবার চা বানানো খাওয়া হয়ে যেত। তখন মীরা আর কেয়া কয়েক কদম এগিয়েই আবার পিছিয়ে আসে। সম্ভবত বিয়ের প্রসঙ্গেই কথা হচ্ছে তাদের। যতদূর তাদের কানে আসে, ‘বাড়ির সবার ইচ্ছে তোমার সাথে আমার বিয়ে হোক।’

‘আঙ্কল, আন্টি তো বুঝলাম। আর তোমার?’ ক্ষীণ স্বর কানে আসে অক্ষয়ের।

‘তোমার কী মনে হয়?’ কৌশীর হাতদুটো ধরে অক্ষয়।

‘জানি না যাও’ বলে মাথা নীচু করে নেয় কৌশী।

আর সেখানে দাঁড়ায় না মীরা আর কেয়া। ধীর পায়ে ড্রয়িংরুমে ফিরে দুজনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর একসাথে হেসে ওঠে।

 

বিজন ঘরে

সাই আর্কেড। মাথা তুলে অ্যাপার্টমেন্ট-এর নামটা আগে পড়ল পানসি। রট আয়রনে পেঁচিয়ে লেখা ইংলিশ হরফ। মানেটা প্রথমে বুঝতে অসুবিধা হলেও পরে মনে পড়েছিল, গুরুস্মরণাত্মক সাই এদেশে যে-কোনও বিনির্ম্মানের শীর্ষবন্ধ হয়ে যেতে পারে। আর্কেড-এও সেটা হয়েছে।

আড়াইঘণ্টার এয়ার-জার্নির পর এই ভিন প্রভিন্সের অনেক কিছুই ওর অদ্ভুত লেগেছিল। প্রথমত বে অফ বেঙ্গল-এর উপর দিয়ে উড়ে আসাটি তো ভোলার নয়। শঙ্খচিলের মতো ক্ষণকাল ভাইজাগে ডানা থামিয়েছিল এয়ার ডেকান। ফের যখন উড়ল, ক্রমশ ঝাপসা হয়ে হারিয়ে গেল সমতল।

অরিন্দম এয়ারপোর্টে ছিল। নতুন এয়ারপোর্ট-টা তখনও চালু হয়নি। লাগেজ আর পানসিকে ট্যাক্সিতে তুলে ফিরতে ফিরতে দুপুর। ভাড়া মিটিয়ে কাঁধে পিঠে ব্যাগ বোঝাই হয়ে উপরে উঠছে অরিন্দম, পানসি বলল, লিফ্ট নেই?

অরিন্দম আগেই জানিয়েছিল শহরতলির সদ্য তৈরি এইসব বাড়ির অনেক কিছুই ইনকমপ্লিট এখনও। মঞ্জিরা ওয়াটারের লাইন নিয়ে তো সবে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়েছে…।

তার মানে তো খাবার জল! পানসি চমকেছিল– তাহলে? অরিন্দম বলেছিল, সপ্তাহে দু’দিন মিউনিসিপ্যালিটির জলের গাড়ি আসে পাড়ায়। রাস্তায় নেমে কাড়াকাড়ি করে সেই জল তুলতে অসুবিধা যাদের, দোকানের মিনারেল-ডিব্বা তো রইলই…। অরিন্দম কোনও উত্তর দিল না এখন। তার পিছু পিছু উপরে উঠছে পানসি। সেই তিনতলার ব্লকে। লালিত এক আনুগত্য কাজ করছিল ভিতরে ভিতরে। জানা নেই, কেমন হবে আগামী। তবে সহযাত্রার তাগিদটা এ মুহুর্তে মিথ্যা নয়।

বারোশো স্কোয়্যার ফিটের এই ফ্ল্যাট। সামনে সাউথফেসিং ব্যালকনি। দাঁড়ালে গা শির শির করে ওঠে। মনে হয় শূন্যে ভাসমান একখণ্ড পা-দানি, দমকা বাতাস বুঝি হড়কে দেবে। লম্বা করিডরের পিছনেও একটা বারান্দা আছে। সেখানে দাঁড়ালে ছত্রখান ভাঙ্গা পাহাড় নজরে আসে। রাত্রির আবছায়ায় সেই খুবলানো পাহাড়গুলো ভূতের মতো দেখায়। ঝোপঝাড় আর জলাভূমির পাশ দিয়ে চলে গেছে রেলের লাইন। মাঝে মাঝে বিস্তৃত সমতল জুড়ে কবরের ফলক। বাজনা বাজিয়ে পরিজনের কাঁধে মৃতদেহ যায়। শব্দটা পানসির পরিচিত হয়ে গেছে।

জয়েনিং-এ এসে অরিন্দম কোম্পানির গেস্টহাউসে উঠেছিল। পরে হন্যে হয়ে অটোতে করে বাড়ি খুঁজতে বেরিয়ে, সাই আর্কেড-এর একটিমাত্র ব্লকে টু-লেট দেখেই বুক করে দেয়। দরাজ লিভিং রুম, উদ্দাম হাওয়া খেলছে। কিচেন, বাথ, বেডরুম সব মিলিয়ে চমৎকার পরিসর। ভাড়া আপাতত, মঞ্জিরা ওয়াটারের ব্যবস্থা নেই বলে দশে থেমে আছে। অসুবিধা বলতে, লাগোয়া ট্রেন লাইনের উৎকট আওয়াজ। ময়ালের মতো ট্রেন যায় হেলেদুলে– সিগনাল না পেলে ছোট্ট বাঁকে থমকে থাকে দীর্ঘসময়। বেগমপেট পর্যন্ত গিয়ে লাইন হায়দরাবাদ আর ফলকনামার দিকে দু’ভাগ হয়ে গেছে। চেন্নাই তিরুপতি এক্সপ্রেস কি হুসেন সাগরের মতো দূরপাল্লার পথ এটাই। গভীর রাতের ট্রেনগুলো, অরিন্দমের কথায়, যেন বুকের উপর দিয়েই ছুটে যাবে মনে হয়…।

অরিন্দম এখানে প্রমোশন নিয়ে এলেও পানসিকে আসতে হয়েছে চাকরির পাট চুকিয়ে। অরিন্দমকে তার কোম্পানি প্রশিক্ষণের জন্য লন্ডন পাঠাবার সিদ্ধান্ত কেন যেন ভেস্তে দেয়। পরিবর্তে প্রমোশন দিয়ে পাঠাল এই কুতুব শাহ্-র নগরীতে। এই প্রাপ্তি অরিন্দমের কাছে নাকের বদলে নরুন বলে মনে হয়েছে। অফিসে এখানে যাদের উপর তার কর্তৃত্বের দায়, তাঁদের অনেকেরই সমৃদ্ধ বায়োডাটায় গাল্ফ কী বাফেলো ঘুরে আসার সংযোজন আছে। সেই সমস্ত কেতায় কিছু বিব্রত, বিরক্ত ফলত সামান্য ডিপ্রেসড্ও অরিন্দম। পানসিকে অনেক ভেবে তার এই নতুন জায়গার জীবনটিকে অগ্রাধিকার দিতে নিজের চাকরি ছাড়তে হল।

অরিন্দম এখন তালা খুলে বেশ দরাজ মেজাজে বলল, কী ঠিক আছে তো? এবার খাওদাও রিল্যাক্স করো– বড়ো ফ্ল্যাট নিলাম…।

পানসি কৌতুক জুড়ল– এই ফাঁকে গোটা দুই ভূমিষ্ঠ করে ফ্ল্যাটটা ভরে দিলে কেমন হয়? পানসি হেসে গড়ালেও অরিন্দম আঁতকে উঠল, দোহাই। ওই সর্বনাশটা বাধিও না। মরে যাব। এখান থেকে নেক্সট ইয়ারে কোম্পানি চারজনকে বাইরে পাঠাচ্ছে, তারমধ্যে খুব সম্ভব–

কথা কেড়ে নিয়ে পানসি বলল, অরিন্দম চ্যাট, তাই তো?

– একা অসুবিধায় পড়বে…। অরিন্দম মোবাইল বের করল।

– কাউকে ডেকে নেব – তোমার বা আমার বাড়ি থেকে।

– তোমার মা হার্টের পেশেন্ট, আর জানোই তো আমার কেউ নেই।

পানসির চোখ সরু হল – কেউ-ই নেই?

– না, নেই। ওসবে হ্যাপা আছে।

– আছে তো আছে। তাই বলে সময়মতো ফ্যামিলি কমপ্লিট হবে না?

– এই জড়িয়ে পড়া পানসির জরুরি মনে হলেও অরিন্দম নারাজ। মোবাইল কানে তুলে সরে গেল সে।

পানসি এখানে ওর প্রতিদিনের প্রভাতগুলো তাজা রাখতে চায়। দিনটা পরে যেদিকে গড়ায় গড়াক। সল্টলেকে থাকতে চমৎকার বুলেভার্ড ধরে হাঁটত। সঙ্গতায় অরিন্দম নেই। তার নাকি স্মৃতি উসকে ওঠে। কী সেটা? শঙ্খরা যখন সার্ভেপার্কে থাকত, ছুটির দিনে ওদের কাছে গেলে, রাতে আর ফিরতে দিত না শঙ্খ। – ভোরে শঙ্খ আর আমি হাঁটতে হাঁটতে বাইপাস ধরে মুকুন্দপুর চলে যেতাম…।

– আর নলিনী?

অরিন্দম দূরমনস্ক গলায় বলেছিল, ওর তো তখন কোলে বাচ্চা!

পানসি চোখ নামিয়ে দুঃখটুকু শেয়ার করেছিল।

এখানে প্রাতর্ভ্রমণটা চালু করতে পায়ে শু পরছে পানসি, বেল বাজল। কামওয়ালি কাম কুক ভূলছ্মি। ডানদিকের নাকে ধ্যাবড়া নাকছাবি ঝিকোচ্ছে।

– কী হ’ল, দাঁড়িয়ে কেন? ভ্রূর ইঙ্গিতে পানসি সেটা জানাল। ভূলছ্মিরও স্রেফ আপন ভাষাটি পুঁজি। ফলত আকার-ইশারা একমাত্র কাজের মাধ্যম। চারখানা আঙ্গুল তুলে ম্যাডামের কাছে ছুটি’র আর্জি জানাল সে। পোঙ্গল পরবে নিজের গাঁও যাবে। পানসিও তার দু’টো আঙ্গুল দিয়ে খারিজ করল দুটো দিন। বাকি দু’দিনই লুফে নিয়ে চটপট নেমে গেল ভূলছ্মি।

গতকাল হিল্স এরিয়ায় পার্টি ছিল অরিন্দমের। লেট নাইটে আর ফেরেনি। রাতের খাবার একা একা খেয়েছিল পানসি। সেই বাসন পড়ে রইল সিঙ্কে। দুপুরের খাওয়া অরিন্দম ফিরলে হবে নাকি তার পছন্দের রেস্টুরেন্ট এপি মিল-এ একটা ফোন করে দিলেই চলবে– ভাবতে ভাবতেই দরজা নক করল পানসি।

এই ফ্ল্যাটের মালিক থাকেন সিটিতে। বন্ধু রমেশ রাও, যিনি কেয়ারটেকারও, এখানেই তার ফার্স্ট ফ্লোরে সপরিবারে বসবাস। নীচের তলা পুরোটা ডছ ছাঙ্গালওয়াল রেড্ডির কেনা। একদিকে তাঁর চেম্বার, অন্যদিকে ছোট্ট কটেজটি বিউটিশিয়ান স্ত্রীর পার্লার। দোতলার একটা দিক সদ্য খালি হ’ল। অন্যটা মেস গোছের। ভাইজাগ, কটক, কর্ণাটক থেকে আসা কেউ চাকুরে, কেউ পড়ুয়া, কেউ ভিসাগডের মন্দিরে পুজো চড়াচ্ছে, বিদেশ যাবে বলে। পানসি নীচে নেমে দেখল, সাই আর্কেড-এর সামনে আজ বর্ণময় আলপনা। কামওয়ালির খড়ির দায়সারা আঁকিবুঁকিবুকি নয়। যা সে রোজ ঝাঁট দেয়া পর্বেই চুকিয়ে দেয়। আজ মালকিনের যত্নে আঁকা ফুলের লতা, সবুজ খেত আর উপচে পড়া সূর্যোদয়ের আলোয় ছড়ানো মোহর ভরা কলস…। সুন্দরী মিসেস ছাঙ্গালওয়াল নেড়া মাথাটি হেলিয়ে হাসল। পুজো চড়িয়ে এসেছে প্রভু বালাজির পায়ে। প্রতিহাস্যে পানসিও ডিঙ্গিয়ে এল চিত্রিত বেসমেন্ট। সমস্ত বাড়িরই সদর আজ আলপনা রঞ্জিত। পোঙ্গল পরব এদের শস্য উৎসব। নিজের দেশে আজ মকর সংক্রান্তির পিঠেপায়েস খেয়েছিল পানসি সহকর্মী জয়েস-এর সঙ্গে, একটা উইন্টার ফেয়ার-এ।

আশেপাশে বাবলার ঝোপঝাড় আর পাথরের চাঁই ছড়ানো জমি। তারমধ্যেই হাইরাইজ উঠছে। দৈত্যাকার দু’খানা হাতের মতো দুটো ক্রেন কুচো পাথর তুলছে তো তুলছেই। পাহাড় ফাটিয়ে, জংলা কেটে বিস্তৃত করা হচ্ছে এঁদো গ্রাম। বাড়ছে সাইবারাবাদ। ডিনামাইট চার্জের সময় পুরো সেক্টর যখন লাফিয়ে ওঠে, অরিন্দম বলে, যেন ব্যারন দ্বীপের চূড়োয় বসে আছি…।

সামনে তারানগর। পাশেই চন্দা। এইটুকু হাঁটবে ভেবে পা বাড়াতেই রিংটোন এল। ফোনটা অরিন্দমের নয় ভেবে এড়াতে চাইছিল, কানে তুলতেই, ফিরতে দেরি হবে। ব্রেকফাস্ট সেরে নিও।

– কোথায় তুমি?

– এই আর কী…।

– আ-শ্চ-র্য! দাঁতে দাঁত ঘষল পানসি। – কাল বেরিয়েছ পার্টির নাম করে। এখনও বসে আছো?

– আহুজার মেসে আছি।

পানসি কানে মোবাইল চেপে একটা বাইকের ধাক্বা বাঁচাল। হাসছে অরিন্দম ফোনে– চিন্তা কী ডার্লিং। দুটো তো জীব, আর খাঁচা যখন একটাই।

মোবাইল পকেটে পুরেছে পানসি। হাত তুলে চন্দা নগরের অটো ধরে নিল। মর্নিং ওয়াকের পথে এখন যাওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু কিছু পত্রপত্রিকার খোঁজ খুব জরুরি ওর। বাড়িতে অনেকগুলো কাগজ এলেও একটা বাংলা কাগজের অভাব থেকেই যায়। নিত্য বিপত্তির কলকাতার খবরটা খুব টানে। এখানে সে কাগজের নাম শুনলে অবশ্য হকারের হাঁ বন্ধ হয় না।

দু’চারটে স্টলে হন্যে হয়ে কাগজপত্র ঘেঁটে না পেয়ে বিরক্ত হয়ে শেষে দু’প্যাকেট ধূপকাঠি কিনে ফের অটো ধরল।

সাই আর্কেড-এর সামনে অরিন্দমের ট্যাক্সি আর পানসির অটো প্রায় একই সঙ্গে থামল। পার্স বের করতেই বাধা দিল অরিন্দম।

সিঁড়িতে উঠতে উঠতে শিস্ দিচ্ছে অনেকদিন পর। মনটা খুশি করে দিল কি মেদিনীপুরের ফোন! পানসি তালা খুলল। ব্রেকফাস্ট হয়নি। ফ্রিজে দুধ আছে, বলল, ওটস করে দেব?

– নাক সিঁটকাল অরিন্দম, শেষে চাইল্ড ফুড?

– ওমলেট আর কফি দিই তাহলে? ভূলছমি তো ছুটি নিয়েছে। অরিন্দম জবাব দিল না। চিৎপাত হয়েছে ডিভানে। চোখ সরু করে বলল, ওটা কী?

আপন ভাষার স্বপক্ষে সুন্দর একটা শব্দ বলতে ইচ্ছা হল পানসির, বলল, গন্ধদীপ…।

– সেটা আবার কী?

– বলোই না!

দেখে নিয়ে মুখ ফেরাল অরিন্দম, ধূপের বিজনেস কখনও করতে হয়নি।

কথার ধরনটা রাগিয়ে দিল পানসিকে, বলল, কী ভাবো নিজেকে! কীসের এত তাচ্ছিল্য! ঘরে তিরুপতির ছবি থাকলে ধূপ আসতেই পারে।

– সেটা বললেই হয়! আগরবাতির নাম শুনেছি, গন্ধদীপ, সেটা কী?

– ধূপের অন্য নাম গন্ধদীপ, জানো না?

– না জানি না, আমার অত ফান্ডা নেই। কী হবে! এই ভাষাটার তেমন পরিণাম নেই। আগামী একশো বছরের মধ্যেই মরে যাবে।

– তাতে তোমার কী সুবিধা হবে?

অরিন্দম পাশ কেটে বলল, তোমার পেপারের ব্যবস্থা হল?

– হয়ে যাবে।

– আর হয়েছে। অরিন্দম আড়মোড়া ভাঙছে, এখানে ওসব বিকোয় না, তাই আসেও না।

পানসি বলেই ফেলল, তাই নাকি! তাহলে!

– ইন্টারনেট থেকে পড়ে নিলেই পার। বলেই কিছু মনে পড়ার উদ্ভাসে উঠে বসল অরিন্দম, বলল, আমার অফিসে সিন্ধুকা বলছিল, নাইনটিন সেভেনটি ফোর-এ ওর বাবাও নাকি এখানে চাকরি করতে এসে কাগজের জন্য হেদিয়েছিল। পরে তো জামাই হ’ল এদেশের। এখন তো পেল্লাই বাড়ির দরজায় সিঁদুর-লেপা চালকুমড়ো ঝুলছে। দু’পাশে ল্যাব্রেডর নিয়ে পেপার পড়ে। বাংলা কাগজের কথা আর মনে পড়ে না।

– তো! পানসি একাক্ষরী।

– এই আর কী! সবই সময়ের ব্যাপার।

পানসি বলল, তাই বলে তোমার সিন্ধুকার বাবার মতো আমি এখানে গেড়ে বসতে আসিনি।

হাসছে অরিন্দম, আরে, সেটা হয়তো কেউই আসে না। এদের ধারণায় বেঙ্গলের ছেলেরা পাত্র হিসেবে অনন্য। নারী নির্যাতন নাকি জানেই না। খুক খুক করে হাসছে অরিন্দম, ওরা তাই জামাইকে এসট্যাবলিশ্ড করে দিয়ে সব খেদ ভুলিয়ে দেয়। পানসি বলল, কী বোঝাতে চাইছ সিন্ধুকা তোমায় ব্যাচেলর ভেবেছে! বাবার দশা করবে!

– বলা যায় না। তবে আমার বস-এর যে নেকনজর আছে, এটা ঠিক। যদিও খুকুমণিটি সদ্য কনভেন্ট পেরোল।

– তবে আর কী। পানসি চুল ঠেলল আঙ্গুল ছড়িয়ে, বলল, তোমার লন্ডন যাওয়া ঠেকায় কে। তবে ডোবাতে যে তোমার একটি পানসি ভাসছে, সে খবরটা?

হা হা করে হাসছে অরিন্দম, হন্যে হয়ে বাসা খোঁজাই সব ম্যাসাকার করে দিল…।

দু’জনের একাকার হাসির ভিতর দিয়ে পানসি কিচেনে ঢুকল। গলায় গুনগুন। সকালের উজ্জ্বল নীলকান্তমণি আকাশখানা যেন জানলা গলে ঘরেই হাজির। দুদ্দাড় বাতাসে দোল খাচ্ছে টবের তরুলতা। দু’টো মানুষের মশকরায় ঝুনঝুন করে যেন বাজল ক’টা বাংলা শব্দ। ফ্রিজ খুলছে পানসি, অরিন্দম হেঁকে জানাল, আমি বার্গার খেয়ে এসেছি ক্যাফে থেকে…।

অরিন্দম বোধহয় তত পজেসিভ নয়, যতটা গুরুত্ব দিতে পানসির এখানে চাকরি ছেড়ে আসা। নিজস্ব খেয়ালের গ্রহণ ওর। আবার এমনও নয়, ভালো থাকার ইচ্ছেরা সব ডেকানের পাথরখণ্ড হয়ে গেছে। ভালো থাকবার প্রয়োজন সে মানে– কিন্তু সেই ভালো-র যে আগাম কোনও পূর্বাভাস নেই কিনা মানুষের, নিস্পৃহতা তাই থেকেই যায়…।

কথাটা ভাবতে সতর্ক হ’ল পানসিও। ভরসা যে একটু দরকার। সামান্য আস্থাবোধ। সম্পর্কের আয়ু রাখতে খুঁটিনাটি ওভারলুক করে চলা, হয়তো তারই নাম সহন। প্রশ্ন, তা কতদূর পর্যন্ত। যেখানে দু’টো মানুষ ধরেই নিয়েছে যে তারা যুযুধান। নেহাত টিকে থাকাটাই পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা।

মোবাইলটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল এতক্ষণ। কী ভেবে হঠাৎ ছাড় দিল একটা অভ্যাসের। রেখে দিল। হাইটেক সিটির যে কনসার্নে পানসি ইন্টারভিউ দিয়ে এল, দু’দুবার সিটিং দেওয়ার পরেও রেসপন্স মেলেনি এখনও। স্লো-ডাউনের কারণে কিনা কে জানে। রোপনকে জানাবে ভেবেছিল। সন্ধানটা যেহেতু ওর দেওয়া। পানসির ফোন রোমিং করা হয়নি। কল করেছে রোপন,

– কোথায় আছিস? কোটি, না নেকলেস রোডে?

রোপনের কথা মানেই কিছু পিন পেরেক। পানসির বাস কোনও পশ এলাকা না শহরতলি, সেটা জানতেই এই প্রশ্ন। উত্তরটা তেমনই হল, তোমার দমদম পার্ক যদি হয় উনিশ, তো এটা বিশ। উনিশ-বিশ আর কী! জায়গাটা যেখানেই হোক।

– ভালো আছিস তো?

– নো ডাউট। নেহাত কোনও জব নেই, তাই বোর লাগে…। লুফে নিল রোপন, বোর কেন, অরিন্দম কী আউটিং-এ?

– না না। নতুন জায়গা, ভাষার অসুবিধা – একা লাগে। না হলে অরিন্দমই তো আমার সারাদিনে একমাত্র প্রতীক্ষার মানুষ…।

– বাহ্। সারাদিন কেন, সারাজীবন প্রতীক্ষাটা ধরে রাখবি, তবেই না বোধোদয়।

– চালুনি করছে সূচের বিচার।

ওপার থেকে গান ভেসে এল, সহেলি… রূপ দেখালি… যেমন করে মন দেখালি না…। আমি যে তোর… মনের দোসর…।

– রাখছি, রোমিং কাটছে।

– কাটুক না! বরের তো পয়সার অভাব নেই!

– ওটা আমিও বলতে পারি।

– পারিস। কিন্তু রুনাই এখনও আমার ঘরে আসেনি। এলে তখন সব ভাবনাই ওর।

– বাবা হোটেল মালিক বলে?

– তাছাড়া রুনাই আমাকে মনটা আগে দেখিয়েছে।

– আবার সে-ই মন! ফোন কেটেছে পানসি। রোপনের এই রুনাই আস্থা, তাদের সেই আস্থাহীন দিনগুলো সামনে টেনে আনল পানসির। অযত্নের যৌথ-বাস। আগোছালো ঘরদোর আর ধূ ধূ বিছানা। ছেঁড়া হয়নি ক্যালেন্ডারের পাতা। টেবিলেই বাসি হচ্ছে রুটি। দিন শুরু মানে দুটো মানুষের দৌড়। ঘর আছে, তাড়া নেই। মানুষ আছে, প্রত্যাশা নেই। প্রতীক্ষা নেই। ঝুলছে পলকা সুতো। আর এখন কিনা গাইছে মন দেখালি না…।

ফোনটা রোমিং হলে নতুন নম্বর আর নয়। পানসি ভেবে রাখল। রিং হচ্ছে। ধরল না সে। বেজেই যাচ্ছে, ধরে দেখল অরিন্দম।

– খেয়ে নিলে নাকি?

– ভ্যানতাড়া না করে কী বলছ বলো।

– আমি বানজারা হিল্স-এর রেস্টুরেন্ট থেকে বলছি…। দু প্যাকেট বিরিয়ানি নিচ্ছি…।

– গাদা রান্না পচছে ফ্রিজে।

– ভূলছমির ফ্রেঞ্চ বিন্স-এর ঘ্যাঁট আর রোচে না।

– যা ইচ্ছা করো। আমার এখনও চানই হয়নি।

– ইন্টারনেটে বসেছিলে?

উত্তরটা পেয়েই গেল যখন, হাইটেকসিটির ইন্টারভিউর কথাটা চেপে গেল পানসি। বলল, কিছু একটা করতে হবে তো!

– তো তোমার কলকাতার খবর? বন্ধ-টন্ধ বহাল তো? ওদিক নিরুত্তর দেখে কথা গোটাল অরিন্দম, ঠিক আছে, তুমি চান সেরে নাও। আমি একটু…। হাসিটা অর্থবহ বলেই ফোন কেটে দিল পানসি। ওই গরল গিলে গিলেই একদিন মরবে লোকটা…। এসব কথা আর এখন বলা হয় না। বদলে যাওয়া অবস্থা থেকে কথার রদবদল চলে মাত্র। তাই অরিন্দম ফিরে যখন শুধোল, কোনও ফোন এসেছিল? পানসির হ’ল শুধু চকিত পলকপাত। তার নম্বরে যে সেটা আসা সম্ভব নয়, পরে বুঝে বলেছিল, না, মানে, তোমার নাম্বারটাও দেয়া আছে কিনা!

অরিন্দমের এটা নিজেকে স্বচ্ছ প্রমাণের চেষ্টা মাত্র। পানসি জানে, চেষ্টাটা চেষ্টাই। সত্যি হবার নয়।

সম্পর্ক রাখতেই সে মেদিনীপুরে টাকা পাঠায়। বাস্তবত বিপন্ন বিধবা। শিশু আছে। মানবিকতা মানানসম্মত। কিন্তু তাই কী? অরিন্দম নিজে মুখেই বলেছে, নলিনী একসময় ওকে বিস্তর বিচলিত করেছে। সেটা তার দুরবস্থা নাকি অনস্বীকার্য আকর্ষণ, কে বলবে? অরিন্দমের ছ’মাসের বড়ো খুড়তুতো ভাই শঙ্খ। বন্ধুর মতো। বউ নলিনী। সার্ভে পার্কে থাকতে বাইপাসে স্কুটার অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু হয় শঙ্খর। অরিন্দমের তখন এমসিএর ফাইনাল। শঙ্খর বাবা বাসা গুটিয়ে নলিনীকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে গেলেও নলিনী আসত কলকাতায় চাকরির খোঁজে। দেখা হ’ত দু’জনের। ঘনিষ্ঠতা না হলে কী করে ওঠে বিয়ের প্রস্তাব!

– হলে অসুবিধে কী ছিল?

পানসির কথা তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে দিয়েছে অরিন্দম, কেরিয়ার গড়ার সময় অন্যের বাচ্চাসমেত বিয়ে? পাগল নাকি! দুস্থকে দয়া করার মধ্যে বিয়ে এল কোত্থেকে?

দয়ার পর্ব তো মাসের প্রথমেই ক্যুরিয়ারে চুকে যায়। তবে কেন এ অবদমিত সংযোগ! গোপন বিষাদখিন্নতা! পানসি কখনও খোঁচায় না। যত্ন করে অতীত ভুলতে পারার নামই তো বাঁচা! দেখা যাক না।

যতটা উৎসাহে বিরিয়ানি এনেছিল অরিন্দম, চান সেরে সাজানো টেবিল থেকে খেল মাত্র দু’চামচ। খেয়ে ফেলল পানসি একাই অনেকটা।

– খাচ্ছ না যে!

চেয়ারে ঘাড় পেতেছে – রাতে খাব।

পানসি এবার হাত গুটিয়ে নিল। ওদিকের মনমরা মুখটা ওর খিদে কেড়ে নিয়েছে। হতে পারে নলিনীর খবর নেই। টাকা গেল, সংবাদ আসেনি। হতে পারে নলিনী মেদিনীপুরে নেই। শুধুমাত্র টাকার মাধ্যমে সম্পর্ক রাখা ইচ্ছা নয় হয়তো। এসব জানতে না পারার এক গুমোট কষ্ট আছে। পানসি বুঝলেও প্রশ্নটা অনধিকার চর্চা মনে করে। একসময় অরিন্দমই বলে উঠল, শঙ্খ আমাকে একটা কথা বলেছিল, অ্যাক্সিডেন্ট-এর দিন দুই আগে। পিঠ খাড়া হ’ল অরিন্দমের – দুর্ঘটনা তো বলেকয়ে আসে না, তবু কথাটা মিলে গিয়েছিল।

পানসি আঙ্গুল চাটছে। তার মানে নলিনীর কথাই ভাবছিল এতক্ষণ। শঙ্খ সাইড মাত্র।

অরিন্দম বলল, শঙ্খ বলেছিল, বউরা মাইরি এমন এক মেটিরিয়ালে তৈরি, বিয়ের পিঁড়ি থেকে ভাবতে শুরু করে, ঠিক কতটা গুছিয়ে নিতে পারলে বৈধব্যটা তেমন ফ্যাক্টর হবে না…। পানসির প্রতিক্রিয়া নজর করল অরিন্দম, আমি তখন আনাড়ি ব্যাচেলর। পরে জেনেছিলাম, নলিনী ওকে ইনশিওরেন্স-এর জন্য চাপ দিচ্ছিল।

– শঙ্খ সেটা করতে পেরেছিল?

– সময় পেল কই। ভারাক্রান্ত অরিন্দম। কিন্তু চাপমুক্তির ভাষা পানসির জানা নেই। সে শুধু নতমুখ, নিশ্চুপ রইল। অরিন্দম কী ভেবে হঠাৎই অন্য ভনিতায় বলে উঠল– তো শ্রীমতি পুণ্যশ্রী… কে রেখেছিল তোমার এমন সুন্দর নামটি?

এটা প্রশ্ন নয়, পানসি জানে। অরিন্দমও জানে ভূমিকা মাত্র। সেইভাবেই বলল, রাখল যদি, তো পানসি করে ছেড়ে দিল কেন?

স্থিরদৃষ্টি টান টান তার, বলল, পানসির মতো জলে ভেসে বেড়ালেই চলবে? আস্ত একটা জীবন, আমার সঙ্গে এসব শেয়ার করবে কে?

শেয়ার! একান্ত কিছু বেদনার শেয়ার হয় না অরিন্দম। সেটা তুমিও জান, আমিও জানি। কথাটা ভাবল মাত্র, বলা হ’ল না পানসির। আচমকা ধাঁ করে একটা শব্দ ছিটকে এল, ঢেম্নি! ক্যারেক্টার লেস উওম্যান…।

পানসির কানমাথা ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠবার আগেই হাত তুলে আশ্বস্ত করল অরিন্দম, বলল, নলিনী…।

পানসি বলল, আমাকে বা নয় কেন, আফটার অল সেকেন্ড হ্যান্ড তো। বলতে না বলতেই বুঝতে পারল, অরিন্দমের হ্যাঁচকা টানে হুমড়ি খাচ্ছে তার বুকে।

– আরে আ-রে, হাত এঁটো যে…।

অরিন্দম থামা জানে না। জাপটে লেপটে উঠিয়ে নিয়ে গেল বিছানায়।

হালকা অন্ধকার ঢুকছে ঘরে। দু’জনেই পড়ে আছে বিছানায়। ওদিকের রিং বেজেই গেল। এদিকেরটা যখন এল, কেটে দিল পানসি। দুদিকে ফেরানো ছিল মুখ, চিৎ হ’ল অরিন্দম, আমাদের কবে যেন রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল?

– টেনথ মার্চ।

– তখনও বাবা ছিল। ভাগ্যিস মা আগেই…।

– বিয়ে হতো না, তাই তো?

– আপত্তি আসতই। আমি ওনলি সন, পাত্রী ডিভোর্সি। পানসি বলল, বিয়ের দিন তুমি কিন্তু যথেষ্ট ফ্রেশ ছিলে অরিন্দম। তোমার বাবা যে এলেন না, আমার খারাপ লেগেছিল। অরিন্দম কথাটা পাত্তা না দিয়ে বলল, সেদিন আমাদের বিডি ব্লক-এর ফ্ল্যাটখানা নলিনী একাই সাজিয়ে গুছিয়ে দিয়েছিল বলো!

– না তো বলিনি। পানসি হাউসকোটের বোতাম আঁটছে। পানসিকে কনেচন্দন পরিয়ে সেদিন নিজেও একটা নীল টিপ পরেছিল চন্দনের বিন্দুবৃত্তে। এলা রঙের কাঞ্জিভরমের সঙ্গে খোঁপায় হলদে গোলাপ, নলিনীকে কিছু কম সুন্দর দেখাচ্ছিল না, পানসি জানে।

অরিন্দম একটা হাই তুলে বলল, ওই দিনটাকে আর সেলিব্রেট করা হ’ল না। উঠে বসে বালিশে ভর দিয়েছে অরিন্দম, বলল, কী করে হবে। যা স্ট্রেস চলছিল – বাবাকে এনে ট্রিটমেন্টের স্কোপ পেলাম না। তোমারও…। উহ্য কথাটার ভিতর দিয়ে মিসক্যারেজের ভ্রূণটা যেন খলবল করে উঠল পানসির চোখে। দিশাহীন সময় বয়েছে ঝড়ের মতো। ধবস্ত পায়ের তলার মাটি যেন যায় যায়। বিড়ম্বিত সময় থেকে দু’জনেই চেয়েছিল দূরে কোথাও সরে যেতে। পানসি দূরমনস্ক। অরিন্দম উঠে আলো জ্বালল। সিগারেট মুখে, ধোঁয়া উড়িয়ে বলল, শ্রীমতি পুণ্যশ্রী! এবার কিন্তু জমিয়ে অ্যানিভার্সারি করছি! রেডি থেকো।

– টেনথ মার্চ। সাই আর্কেড-এর সামনে দু’একটি গাড়ি থামল।

অরিন্দম বললেও, জমিয়ে ব্যবস্থায় নিমন্ত্রিতের সংখ্যা সীমিত রেখেছে। মেরুন ব্রোকেডের পোশাক ঝলমলিয়ে স্কুটি থামাল সবার আগে সিন্ধুকা। অরিন্দমের বস মিস্টার রেড্ডি এলেন নিজস্ব গাড়িতে সবার শেষে। পাশে মিসেস না থাকার জবাব যা-ই বলুন, অ্যাবোডস-এর বাড় বাড়ন্ত পার্লস-এর দোকান ছেড়ে তাঁর আসা হয় না। এসেছে অশ্বিনী। টিকোলো নাক চোখ আর দীর্ঘচুলের চমৎকার মেয়ে তাঁর।

পানসির আজ বড়ো খোঁপা লাল টিপ সোনার বালা, বেনারসিতে ট্রাডিশনাল সাজ।

– চুলে ফুল জড়ালে হতো!

– ভূলছমি? নাকছাবি আর পায়জোড়ও চাই তাহলে! অরিন্দম হেসেই অস্থির।

মূলত নিজেকে আজ নিবেদিত নৈবেদ্যর মতো রাখবে, মনস্থ করেছে পানসি।

কেটারিং-এর দু’জন ছেলে সার্ভ করছে। ভূলছমি আর তার মেয়েও রয়েছে সঙ্গে। ভারি মিষ্টি মেয়ে অশ্বিনী। পানসি নিজে হাতে তার পাত উপচে দিলেও বিনাবাক্যে শুধু হাসে সে মেয়ে।

– কিছুই যে খাচ্ছ না অশ্বিনী।

অরিন্দম গুনগুন করে জানাল, ভোক্যাল প্রবলেম আছে।

বালিকাটি খোঁনা গো…।

পানসিও কানে কানে জানাল, ওই জন্যই বস-এর নজর তোমার দিকে…। হাসি মশকরার উষ্ণতা ছিঁড়ে কার একটা মিসড কল এল। পানসি গা করল না দেখে অরিন্দম মজা পেল। ব্যালকনিতে বসে বিভোর গান ধরেছে সিন্ধুকা। দুদ্দাড় খেয়ালি বাতাসে উড়ছে তার দোপাট্টা। তারা-ছড়ানো আকাশটি যেন কাছেই। অজানা শব্দবন্ধের সুরের আবেদনটি কিন্তু একই ভালোলাগায় জড়িয়ে নিচ্ছে। পানসি ছুটে এসে বসল পাশে। সঙ্গে টেনে আনল অরিন্দমকেও। দুজনেই মুগ্ধ। মুঠিফোন বাজছে। বাজুক। এই মুহূর্তে সে আত্মমগ্ন, আত্মপর। সময় নেই। ইচ্ছা নেই। বেজে যায় ফোন… বেজেই যায়…।

অবশেষে – হ্যালো…

– শুভ ফাল্গুন!

– ঠিক আছে, রাখছি…।

– কেন রে… কী হ’ল?

– ব্যস্ত আছি। ঘরে লোকজন আছে…।

– আমিও তো লোক… উইশ করতে পারি না!

– এত শুভকামনা তোমার কোথায় ছিল…?

– হূদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাচ্ছিস! এটাই হয়। শেষ হয়েও হইল না শেষ…।

কেটে দিল পানসি। তবু বাজে… আবার… আবার…।

সরে গিয়েছে অরিন্দম। থম মেরে দাঁড়িয়ে থাকল পানসি। ওর কলিগ বন্ধু জয়েস বলত, বর্তমানের করিডর দিয়ে আমরা দৌড়োচ্ছি, খেয়াল থাকে না অতীতও এক ম্যাগনেট…। খামোকা গায়ে কাঁটা দিল পানসির। সিন্ধুকার গান শেষ হল কী, তাকে জাপটে ধরে অনুরোধ ছাড়াই গেয়ে উঠল পানসি, এসো গো জ্বেলে দিয়ে যাও প্রদীপখানি… বিজন ঘরের কোনে…। কিন্তু অন্তরা পৌঁছোবার আগেই দুম করে ছেড়ে দিয়ে হেসে উঠল, বলল, ধুরর্। আজ বিজন ঘর কোথায়! সব তো ফুলফিলড্। ওঠো ওঠো সিন্ধুকা…। খেতে হবে না! বন্ধ দরজার এপারে আপন ছন্দে ফিরল সাই আর্কেড-এর সেকেন্ড ফ্লোর। সবার চলে যাওয়ার পরে শুনশান। বোবা টিভি। রাতপোশাক পরে নিল দু’জনেই চুপচাপ। লিভিং রুমে পানীয় সজ্জার টেবিলটা কাছে টেনে নিয়েছে অরিন্দম। কিন্তু পেগ তৈরির আগেই পানসিকে টেনে নিজের হাঁটুর ওপর বসাল মুখোমুখি। বলল, যদি একবার মেদিনীপুর ঘুরে আসি, তোমার আপত্তি আছে পানসি?

– হঠাৎ? পানসি হাঁ জুড়তে ভুলে গেল।

– ওই আর কী! দেশ বাড়ি – বার্থ প্লেস – যাই একবার…!

– যে মানুষ দূর থেকে আরও দূরে যাবার জন্য পা বাড়িয়ে আছে, তার হঠাৎ পিছু ফেরা?

– এমনি। কতদিন যাইনি তো!

এই সঙ্গতায় পানসি বাদ কেন! কথাটা মনে এলেও বলল না। বলল, তাই বলে এতই হঠাৎ? বলেই যেন নিজের মনে নিজেকে ধমকাল। মেদিনীপুর মানে যে নলিনী, আর নলিনী মানেই এক গোপন সঙ্গসুখ, এমন সন্দেহ কেন আসে? নিজের আত্মীয়স্বজনদের কাছে যেতেই পারে সে। তবু তো একটা প্রশ্নের সৌজন্যবোধও দেখিয়েছে অরিন্দম, কিন্তু পানসি। তার দিক থেকে তো শুধুই সতর্ক গোপনতা। রোপন যে ওকে গত সপ্তাহে বলল, অফিসের কাজে সেকেন্দ্রাবাদ যেতে পারি। সময় জানালে লুম্বিনি পার্কে আসতে পারবি? অবশ্য তোর মর্জি– জোর কিছু নেই। প্রশ্নটি এড়িয়ে অন্য কথাবার্তা চালিয়েছিল পানসি। কিন্তু প্রস্তাবটি কি তাতে নাকচ হল?

জটিল এ শব্দজব্দের সমাধান মেলে না। জয়েসের কথাটা ম্যাগনেটের মতো টানল যেন। পানসি এখন অন্য কথায় এল, বলল, আজকের অনারে ড্রিংকসটা বাদ দিতে পারতে না অরিন্দম?

– পারতাম। অরিন্দম তাকিয়ে রইল পানসির দিকে– তোমার জন্য পারা উচিত আমার… কিন্তু… কী হবে! তুমি তো আমাকে তোমার পানসিতে স্থান দাওনি পানসি!

এ বড়ো সূচিমুখ সত্য। গায়ে বিঁধলে লঘুকরণও দরকার। পানসি অরিন্দমের নাকের ডগা টিপে দিল। বুকে হাত বোলাল পরম আদরে। বলল, বাহ্ রে! তুমি যে বলো পানসিতেই তোমার ভরাডুবি হ’ল। তা হলে?

– তাহলেও সেটা লিগাল ভরাডুবি– এ ভরাডুবি বাঁচার জন্যই…। বাঁচা! পানসি দীর্ঘশ্বাস চাপল। ঠিকই তো! সেই আবেগের উষ্ণতা ছিল এই একটু আগেও। তাহলে! তাহলে কোথা থেকে জমল এত গুমোট!

পরিপাশ উচ্চকিত করে মধ্যরাত্রির ট্রেন পেরোল। কাঁপা কাঁপা ধাতব শব্দটা কান্নার মতো ভেসে বেড়াল কিছুক্ষণ। অরিন্দমের হাঁটুর ওপর বসে হিম হচ্ছে পানসি। শিথিলতা আসছে। উঠে দাঁড়াবে, চেপে বসিয়ে দিল অরিন্দম। টেবিলের গ্লাস, বোতল, বরফভর্তি আয়োজনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, এসো, দু’জনেই আজ খেয়ে বুঁদ হই। ভুলে যাই সব। স-ব। আমাদের দু’জনেরই সবকিছু ভুলে যাওয়া দরকার। ঠিক কিনা! দু’হাতে পুতুলের মতো সে ঝাঁকাল পানসিকে – ফ্যাসফেঁসে গলার করুণ আর্তি শোনাল তাকে– ‘বড়ো একা লাগে, বড্ড একা লাগে গো…।’

দু’হাতে জাপটে মুখ গুঁজেছে পানসির বুকে, ফোঁপাচ্ছে। তোলপাড় জলতাড়সের দমকে ফুলে ফুলে উঠছে অরিন্দমের কাঁধ পিঠ মাথা। পানসি টের পায়, তার বুকের নাইটির সাদা ফ্রিলে অরিন্দমের চোখের জল জমেছে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াহীন পানসির চাহনি সামনের সাদা দেয়ালের দিকে। অদ্ভুত হিম জড়তায় নিস্পৃহ সে।

আসলে, শরীরে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো দৃশ্যত একান্ত আপন যে পুরুষটি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে তার বুকে, বেহাল এক নাবিকের মতো, সে কি সত্যিই পানসির? পানসির জন্য কাঁদছে? তাহলে কেন অতীত ভুলবার জন্য এই অ্যালকোহলিক রাতের প্রয়োজন? যা নিতান্তই অবচেতনে মিলিত হওয়া। এই মিলন। এই ক্ষণবন্ধনের ভবিষ্যৎ পানসি ও অরিন্দম কি জানে! নিজের মধ্যে ঘুরপাক খায় উদ্ভ্রান্ত প্রশ্ন আর যোজন দূরত্ব নিয়ে বসে থাকে অঙ্গাঙ্গী। কাঠের মতো শক্ত হয়ে দু’টো হাত ঝুলে থাকে দুদিকে। কোনও সান্ত্বনা, কোনও আশ্বাস নিয়ে সে হাত অরিন্দমের পিঠ ছোঁয় না – ছুঁতে পারে না। কেন, সম্ভবত সে নিজেও জানে না…।

 

নিউ ইয়ার গিফ্ট

শুভেন্দু ছিলেন এয়ার ফোর্স-এর পাইলট। এয়ার ফোর্স-এর একটি প্লেন দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান, কিন্তু সংসারের আবর্তে ছেড়ে যান স্ত্রী শান্তিপ্রিয়া এবং তিন বছরের মেয়ে ঈশিতাকে। এয়ার ফোর্স-এর তরফ থেকে যখন মরদেহ বাড়িতে পাঠানো হয়, তখন শান্তি তার মেয়ে ঈশিতাকে তার কাকা ক্ষিতিমোহনবাবুর বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। কারণ সে চায়নি এই বয়সেই তার ছোট্ট মেয়ে জানুক, যে সে পিতৃহারা।

তারপর কেটে গেছে দু-দুটি বছর। এখন ঈশিতা বছর পাঁচেকের। অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় একটু রোগাই, দুর্বলও বটে। পাশেই এয়ার ফোর্সের স্কুলে পড়ে সে। বাবাকে ঘিরেই তার যত প্রশ্ন।

ছবিটা ধোঁয়াটে হলেও তার আজও মনে আছে বাবা যখনই বাড়ি ফিরত, নানারকমের খেলনা আনত তার জন্য। এদিকে-ওদিকে কত বেড়াতে নিয়ে যেত। কতই না গল্প শোনাত তাকে।

এখন সে একটু একটু বুঝতে শিখেছে। তাই তার প্রশ্নও বেড়েছে অনেক। যার উত্তর দিতে প্রায়ই হিমশিম খেতে হয় শান্তিকে।

এরকমই একদিন সকালে ঈশিতা তার মাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘মাম্মা পাপা আসছে না কেন? কবে আসবে?’

উত্তরে শান্তি বলল, ‘সোনাই, তোমার পাপা যে ছুটি পাচ্ছে না। তাঁর নতুন বস ভীষণ শক্ত প্রকৃতির লোক, কিছুতেই তোমার পাপার ছুটি মঞ্জুর করছেন না। তাই পাপা তার দুষ্টু সোনাইয়ের কাছে আসতে পারছে না।ছুটি পেলেই উড়ে চলে আসবে তোমার কাছে।’

ঈশিতা তার পাপার বস-এর উপর বিদ্বেষ প্রকাশ করে বলল, ‘মাম্মা, পাপার বস খুব বাজে, খুব খারাপ।’

বছর একত্রিশের শান্তি, কলকাতারই একটি মিলিটারি ক্যাম্পাসের এয়ার ফোর্স স্কুলের টিচার। ফর্সা, লম্বা ছিপছিপে চেহারা তার। দেখতেও বেশ সুন্দরী। স্বামীর মৃত্যুর পর কর্তৃপক্ষকে বহু অনুনয়-বিনয় করে মেয়ের স্কুলেই ট্রান্সফার নিয়েছে সে। শান্তির বাবা-মা চেয়েছিলেন মেয়ে আবার বিয়ে করুক। কতই বা বয়স তার। মাত্র উনত্রিশ বছরেই বিধবা হয়েছে সে। কিন্তু তার একটাই কথা। ঈশিতা খুব কম বয়সে দুভার্গ্যক্রমে তার বাবাকে হারিয়েছে, তাই সে চায় না যে ঈশিতা তার মাকেও হারাক। সে নিজের চোখে দেখেছে মা-বাবা আবার অন্যত্র বিয়ে করলে বাচ্চারা কীভাবে অবহেলিত হয়। সিঙ্গল মাদার-ই হোক বা সিঙ্গল ফাদার- কারওর একার পক্ষেই বাচ্চা মানুষ করাটা খুব একটা সহজ ব্যাপার নয়। সেক্ষেত্রে একজনকেই মা-বাবা দুজনেরই ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। বিশেষ করে তার পাপাকে ঘিরে ছোট্ট ঈশিতার প্রশ্নবাণ, শান্তিকে বড়োই অসহায় করে তোলে।

প্রতিদিনই ঈশিতা, তার বাবার কথা জিজ্ঞাসা করে শান্তিকে, আর শান্তিও প্রতিদিনই একইভাবে মিথ্যে আশ্বাস দিতে থাকে। কিন্তু আর কতদিনই বা লুকিয়ে রাখতে পারবে সে? তার ভয় হতে থাকে যদি হঠাৎই অন্য কারওর থেকে ঈশিতা জানতে পারে যে, তার বাবা আর কোনওদিন তার কাছে ফিরে আসবে না, তাহলে ব্যাপারটা কীভাবে নেবে ও। মেয়ে যে বাবা বলতে অজ্ঞান।

শান্তি ভাবতেও পারেনি যে, এই মিথ্যে আশ্বাস তার মেয়ের জীবনে বয়ে আনবে এক বড়ো ধরনের সমস্যা। প্রতিদিন বাবার জন্য অপেক্ষা আর দিনের শেষে আশাহত হতে হতে ডিপ্রেশনগ্রস্ত হয়ে পড়েছে ঈশিতাও। এখন সে তার একটি আলাদা পৃথিবী গড়ে নিয়েছে। কারওর সঙ্গে কথা বলে না, সবসময় চুপচাপ থাকে, খেলা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছে। এমনকী এখন তার পাপার কথাও জিজ্ঞাসা করে না। তার উপর বেশ কয়েকদিন হল, খাওয়াদাওয়াও প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। এমতাবস্থায় অসুস্থ হওয়াটাই স্বাভাবিক। হলও তাই। তার উপর ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ডা. অরুন্ধতী আচার্যও বলে গেছেন, এই মুহূর্তে তার বাবা না ফিরলে ঈশিতার সেরে ওঠাটা মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। কী করে মেয়েকে সারিয়ে তুলবে ভেবে পাচ্ছিল না শান্তি। মেয়ের এই অবস্থার জন্য সে নিজেকেই দূষতে থাকে দিশেহারা হয়ে।

যখনই শান্তি খুব একাকি অনুভব করে, তখনই সোশ্যাল নেটওয়ার্ক-এ সিঙ্গল পেরেন্টদের একটি পেজ খুলে বসে। সেখানে নিসঙ্গতা কাটানোর পাশাপাশি নিজেদের প্রবলেম নিয়েও আলোচনা হয়। সেই পেজ-এ শান্তির বেশ কিছু বন্ধুও হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন কুশল দাস। তিনি ভারতীয়।কর্মসূত্রে ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকেন তাঁর আট বছরের ছেলে দেবের সঙ্গে। বছর চারেক আগে তাঁর স্ত্রী ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তারপর থেকে তিনিও একা। কখনও সোশ্যাল নেটওয়ার্ক আবার কখনও ওয়েব ক্যামেরায় একে অপরের সুখ-দুঃখ বিনিময় করতে করতে এখন কুশল আর শান্তি একে অপরের খুব ভালো বন্ধু।

সেদিনও শান্তি যখন ফেসবুক খুলে বসল, দেখল কুশল অনলাইন আছে।মেসেজ করেই ফেলল সে।

‘তোমাকেই দরকার ছিল আমার।’

‘কী হয়েছে? এত টেন্সড্ কেন?’

‘আমি কী করব ভেবে পাচ্ছি না। ঈশিতা ভীষণ অসুস্থ। ডাক্তার বলেছেন ওর বাবা না ফিরে এলে ও কিছুতেই সুস্থ হবে না। আমি দিশেহারা। কী করব? কোথায় যাব? কিছুই বুঝতে পারছি না। ওর এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। আমি রোজ মিথ্যে আশ্বাস না দিলে হয়তো আজ ও…’ বলতে থাকল শান্তি।

সমস্ত কিছু শুনে কুশল বলল, ‘দ্যাখো আমিও তোমার মতোই সিঙ্গল পেরেন্ট, সুতরাং তোমার সমস্যাটা আমি ভালো মতোই ফিল করতে পারছি, ভেঙে পোড়ো না। ওকে আবার স্বাভাবিক করে তোলার জন্য উই উইল ফাইন্ড আউট আ ওয়ে। একটু ভেবে আবার বলল, একটা পথ অবশ্য আছে, কিন্তু যদি তোমার কনসেন্ট থাকে তাহলে আমি হেল্প করতে পারি।’

‘কী সেই পথ?’ বেশ আগ্রহভরে জিজ্ঞাসা করল শান্তি।

‘তুমি ঈশিতাকে বলো ক্রিসমাসের দিন ওর বাবা বাড়িতে আসছে। আমি ক্রিসমাস-এর আগেই কলকাতায় পৌঁছে যাব। আমিই ওর বাবার পরিচয়ে ওর সঙ্গে দেখা করব।’

‘আবার একটা মিথ্যে? একটা মিথ্যে ঢাকতে আর কত মিথ্যের আশ্রয় নেব আমি।’ বলতে বলতে শান্তি কেঁদে ফেলে।

‘দ্যাখো, এই মুহূর্তে ঈশিতার রিকভার করাটাই সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট। অন্যকিছু পরে ভাবা যাবে।’ বেশ উত্তেজিত হয়েই বলল কুশল।

‘একটা জিনিস কিন্তু মনে রাখবে, ঈশিতা ওর বাবার মুখটা ভুলে গেলেও ও কিন্তু আজও মনে রেখেছে ওর বাবার শোনানো গল্পগুলোর কথা। ওর সবচেয়ে পছন্দের গল্প ছিল ‘ক্ষীরের পুতুল’। এত বছর দেশের বাইরে থেকে বাংলাটাই ঠিকমতো বলতে পারো না, হোঁচট খেতে থাকো তার উপর আবার ক্ষীরের পুতুল!’

শান্তির কথা শুনে কুশল বলল আরে চিন্তা কোরো না, আফটার অল বাঙালির ছেলে। বাংলা ভুলব কেমন করে? তবে হ্যাঁ লাস্ট বারো বছর ইউএসএ-তে থাকার ফলে একটু জড়তা চলে এসেছে। তুমি চিন্তা কোরো না ওটাও আমি ঠিক করে নেব। তুমি জানো আমি আমার ছেলেকেও বাংলা শিখিয়েছি। ও-ও বলতে পারে, তবে বোঝোই তো! আর ঈশিতার ক্ষীরের পুতুল আমি নেট-এ পড়ে নেব। ডোন্ট ওরি। যাও ঈশিতার কাছে যাও। বলো তার বাবা ক’দিন পরেই আসছে তার কাছে।’

কয়েকদিনের মধ্যেই কুশল বেশ ভালোমতোই অবন ঠাকুর-কে ঠোঁটস্থ করে ফেলল। মাঝেমধ্যে সেগুলি শান্তিকেও শোনাত।

অবশেষে সেই দিন হাজির। চব্বিশে ডিসেম্বর বিকালে বেজে উঠল ঈশিতার বাড়ির কলিংবেলটা– ঈশিতা দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেখল লম্বা-চওড়া চেহারার এক সান্তাক্লজ তার সামনে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে বেশ অবাক হল ঈশিতা। সান্তা কেন, তার মায়ের কথামতো তো এখন তার পাপার আসার কথা। তাহলে কী আবার…। মনে মনে ভাবতে থাকে ঈশিতা।

কোনও কিছু বোঝার আগেই সান্তা তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘উইশ ইউ আ মেরি ক্রিসমাস, মাই ডার্লিং! ভিতরে আসতে পারি কি? আমার কাছে তোমার জন্য দারুণ একটা গিফ্ট আছে!’ এই বলে বাড়ির ভিতরে ঢুকে সে আবার বলল, ‘এখনই আমি তোমাকে স্পেশাল গিফ্টটা দিতে চাই। কিন্তু তার জন্য একটা কন্ডিশন আছে! তোমাকে কিছুক্ষণের জন্য চোখ বন্ধ করতে হবে।’

ঈশিতা তার চোখদুটি বন্ধ করে নিল।

কুশল তাড়াতাড়ি করে সান্তার পোশাকটি খুলে দাঁড়াল ঈশিতার সামনে। একটু শ্যামলা হলেও বেশ লম্বা এবং প্রচন্ড স্মার্ট, ঠিক ঈশিতার বাবার মতোই।

‘এবার চোখ খুলতে পারো। দ্যাখো তো বাবাকে চিনতে পারো কিনা?’

ঈশিতা চোখ খুলে দেখল, সত্যিই তার বাবা তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। শেষবার দু’বছর আগে যখন সে তার বাবাকে দেখেছিল, তখন সে ছিল মাত্র তিন বছরের শিশু। স্বাভাবিক ভাবেই তার বাবার মুখটা মনে রাখাও তার পক্ষে সম্ভব নয়। সুতরাং সে খুব সহজেই কুশলকে বাবা বলে মেনে নিয়েছিল। কুশল তাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল, ‘ঈশিতা আমার উপর খুব রেগে আছো?’

প্রত্যুত্তরে ঈশিতা বলল, ‘হ্যাঁ, আছিই তো! তুমি আমাকে আগে দেখতে আসনি কেন? আমি তোমার সঙ্গে একটুও কথা বলব না।’

‘সরি, সোনাই। আমি যে কাজ থেকে ছুটিই পাচ্ছিলাম না। আমার বস খুব বাজে। কিছুতেই এখানে আসার জন্য ছুটি দিচ্ছিল না যে!’

ঈশিতা তার ছোট্ট ছোট্ট দুটি হাত দিয়ে কুশলের গলা জড়িয়ে ধরল। তারপর বলতে শুরু করল, ‘আই লাভ ইউ পাপা। আমি তোমাকে খুব মিস করেছি।’

ঈশিতার ছোট্ট হাতের ছোঁয়ায় আপ্লুত হয়ে উঠেছিল কুশল। তাকে কত রকমের খেলনা– বারবি সেট, ম্যাজিক সেট, জুয়েলারি সেট এবং হরেক রকমের চকোলেট দিতে দিতে বলল, ‘আমিও তোমাকে খুব মিস করেছি সোনাই।’

‘পাপা, তুমি আর আমাকে ছেড়ে যাবে না তো?’ জিজ্ঞাসা করল ঈশিতা।

‘পুরো ক্রিসমাস ভ্যাকেশন-টাই তোমার সঙ্গে আমি থাকব সোনাই। তারপর তো কাজে ফিরতেই হবে। কাজ না করলে তো টাকা পাব না, আর টাকা না পেলে যে তোমাকে খেলনাও কিনে দিতে পারব না’। বলল কুশল।

‘আমার খেলনা চাই না। আমার পাপা চাই।’

প্রত্যুত্তরে কুশল বলে, ‘দ্যাখো, আমি যদি না যাই তাহলে তোমার দাদাকে কে দেখবে?’

ঈশিতা, ‘আমার দাদা?’

কুশল, ‘হ্যাঁ, তোমার দাদা দেব!’

ঈশিতা বলল, ‘ঠিক আছে, দাদাকে এখানে নিয়ে চলে এসো আমরা একসঙ্গে সবাই মিলে থাকব।’

কুশল হেসে বলে, ‘দাদাকে কাল নিয়ে আসব।’

কীভাবে যে সন্ধে গড়িয়ে রাত হয়ে গেল তা টেরও পেল না কুশল। ‘ক্ষীরের পুতুল’ শুনতে শুনতে ঈশিতাও ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঠিক তখনই ঘড়িতে প্রায় ১১টা দেখে ধড়ফড় করে উঠে পড়ল কুশল। হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিল সে। সেখানে দেব যে একা রয়েছে। যাওয়ার আগে শুধু শান্তিকে এইটুকু বলে গিয়েছিল যে, চিন্তা করতে হবে না, ঈশিতা ঘুম থেকে ওঠার আগেই সে দেবকে নিয়ে ফিরে আসবে।

পরদিন ঈশিতা ঘুম থেকে ওঠার আগেই দেবকে নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিল কুশল। দেব আর ঈশিতা দুজনেই একটু ইনট্রোভার্ট প্রকৃতির। তারা একা একা থাকতেই অভ্যস্ত। ঈশিতা বাবার স্নেহ থেকে বঞ্চিত আর দেব মায়ের ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত ছিল। দেব তার বেশিরভাগ সময়টাই কাটাত স্কুল, নয়তো ডে-কেয়ার সেন্টার-এ। বন্ধুদের সঙ্গেও খেলত না। হয় কম্পিউটারে গেম নয়তো টিভি দেখেই বাকি সময়টা কাটাত সে। সেই দেবকেই ঈশিতার সঙ্গে খেলতে দেখে বেশ অবাকই হয়েছিল কুশল।

শান্তিও ভীষণ খুশি হয়ে উঠেছিল ঈশিতাকে আবার বহুদিন পরে হাসতে-খেলতে দেখে। সারাদিন ধরে তাদের খেলা আর শেষ হয় না।

এমনই একটা সময় শান্তি দেবের মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘দেব এখানে কেমন লাগছে তোমার?’

দীর্ঘদিন পরে, দেব যেন মায়ের স্পর্শ অনুভব করল।

সে বলল, ‘আমেরিকার বাড়িটা একদম ভালো নয় আন্টি, বড়ো ফাঁকা ফাঁকা।’

শুনে শান্তি বলল, ‘তোমার ভালো লাগছে এখানে? যখনই ইন্ডিয়া আসবে তখনই চলে আসবে এখানে। আচ্ছা ঠিক আছে তোমরা খেলা করো, আমি তোমাদের জন্য খাবার বানাই।’ এই বলে সে চলে যায়।

শান্তি, দেবের ফেভারিট ডিশ– লুচি, হালুয়া এবং ক্ষীর বানিয়েছিল সেদিন।

খাবারগুলি দেখে দেব শান্তিকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আন্টি, হাউ ডু ইউ নো দ্যাট দিজ আর মাই ফেভারিট ডিশেস? সরি, সরি, পাপা বেঙ্গলিতে কথা বলতে বলেছিল। তুমি কী করে জানলে যে এগুলো আমার ফেভারিট?’

শান্তি বলল, ‘আমি তোমার মায়ের মতোই। প্রত্যেক মা-ই তার বাচ্চাদের পছন্দের কথা বুঝতে পারে। বুঝলে?’

কথাগুলি শুনে দেব বেশ আপসেট হয়েই বলল, ‘ঈশিতা খুব লাকি যে ওর তোমার মতো একজন মা আছে। প্রত্যেকদিনই তুমি ওর পছন্দের কত কী খাবার বানাও। আমার তো মা নেই…!’

‘আমি তো আছি। আমি তোমার পছন্দের খাবার বানিয়ে দেব’, বলল শান্তি।

কিছুক্ষণের জন্য বাইরে গিয়েছিল কুশল। ফিরে এসে শান্তিকে বলল, ‘এক কাপ চা হলে ভালো হতো না?’

‘অফকোর্স।হোয়াই নট?’

চা খেতে খেতে শান্তি কুশলের উদ্দেশ্যে বলল, ‘জানো, এই ‘বড়োদিন’টা সত্যিই আমার মেয়ের জীবনের সবথেকে বড়ো দিন, আনন্দের দিন। ওকে গত দু’বছরে এত খুশি হতে কখনও দেখিনি। ও-ওর বাবাকে কাছে পেয়ে খুব খুশি হয়েছে। সত্যিই তোমাকে ধন্যবাদ দেওয়ার মতো ভাষা আমার নেই।’

‘শান্তি লক্ষ্য করেছ, আমাদের বাচ্চারা তাদের পেরেন্ট-দের ফিরে পেয়ে কতটা খুশি হয়েছে, ওদের দেখে এখন ফিল করতে পারছি সিঙ্গল পেরেন্ট-রা একসঙ্গে কখনও বাবা-মা দুজনেরই রেসপন্সিবিলিটি ফুলফিল করতে পারে না, কোথায় একটা ফাঁক থেকেই যায়! তুমি কি জানো, আমার স্বপ্নই ছিল আমার ঈশিতার মতো ফুটফুটে একটি মেয়ের? আজ ওর সঙ্গে আমি বাবার অভিনয় করলাম। জানি না কেন একটা অন্যরকম অনুভূতি হল! একবারও মনেই হয়নি যে ও আমার মেয়ে নয়। বরং উলটোটাই মনে হচ্ছিল।’ মনের গভীরতা থেকেই এই কথাগুলি বেরিয়ে আসছিল কুশলের।

‘ঠিক তোমার মতোই, আমার সখ ছিল আর একটি পুত্রসন্তানের’ বলল শান্তি।

প্রত্যুত্তরে হঠাৎই কুশল বলে উঠল, ‘আচ্ছা আমরা কি পারি না ঈশিতা আর দেবের সত্যিকারের মা-বাবা হয়ে উঠতে?’

তারা কিছুক্ষণের জন্য ভাষা হারিয়ে ফেললেও, তাদের চোখ কিন্তু ভাষা হারায়নি।

হঠাৎই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে শান্তি বলে ওঠে, ‘সেকেন্ড ম্যারেজ-এর প্রতি আমার কোনওদিনই আস্থা ছিল না। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি ঈশিতার জীবনে তার বাবার গুরুত্ব কতটা! তোমাকে দেখি আর ভাবি, সত্যিই তুমি আর-পাঁচজনের থেকে কতটা আলাদা। আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে স্বামী হিসাবে ভাবতে বোধহয় খুব একটা খারাপ লাগবে না। কি বলো?’

দেখতে দেখতে বছরটা কেটে গেল। হল নতুন বছরের আগমন। নতুন বছর তাদের জীবনে বয়ে আনল নতুন আশা, নতুন স্বপ্ন, নতুন সুখ, নতুন ভালোবাসা। শান্তির বাবা-মা এমনিতেই চেয়েছিলেন যে, তাঁদের মেয়ে আবার সংসার করুক। তাদের কথাই ছিল সমাজে একা একটি মেয়ে কখনও থাকতে পারে না। সুযোগ পেলেই কিছু লোক ছিঁড়ে খাওয়ার অভিপ্রায়ে থাকে। তৎসত্ত্বেও শান্তি দ্বিতীয়বার বিয়ে করতে চায়নি শুধুমাত্র ঈশিতার জন্য। যদি নতুন বিবাহে আবদ্ধ হওয়ার পর তার অথবা তার স্বামীর দ্বারা ঈশিতা অবহেলিত হয়– সেই ভয়েই। কুশলকে দেখার পর তার চিন্তাভাবনা বদলেছে। মনের মণিকোঠায় জন্মেছে তার জন্য ভালোবাসাও।

জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহেই কুশল আর শান্তির রেজিস্ট্রি। সাক্ষী হিসাবে উপস্থিত ছিলেন শান্তির তরফ থেকে শান্তির বাবা-মা আর কুশলের তরফ থেকে আমেরিকা থেকে আগত তার দুই বন্ধু সৃঞ্জয় আর ডেভিড। আর সবথেকে বড়ো সাক্ষী দুই নিষ্পাপ শিশু। ছোট্ট একটা গেট টুগেদার পার্টি হয়েছিল সেদিন। সেদিন রাতে তারা একে-অপরের কাছে শপথ করেছিল তারা দেব আর ঈশিতাকে সমান ভাবে ট্রিট করবে। কারওর প্রতি বাড়তি স্নেহ বা বাড়তি বকাঝকা করবে না তারা।

কয়েকদিন কলকাতায় থাকার পর শান্তি আর ঈশিতা ক্যালিফোর্নিয়ায় সেটল্ড হয়ে গেল। শীতের তুষার ধবল প্রকৃতিতে কুশলের অন্তরঙ্গটা যেন শান্তির জীবনে নতুন করে উষ্ণতার সঞ্চার করল। ক্যালিফোর্নিয়ার বাড়ির জানলা দিয়ে যতদূর চোখ যায় পত্রশূণ্য গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে সে ভাবে, জীবনটা বড়ো এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল যেন। আবার সব নতুন করে শুরু করতে হবে।

দেবের স্কুলেই ভর্তি করা হল ঈশিতাকে। দেব আর ঈশিতা তাদের বাবা-মাকে একসঙ্গে পেয়ে ভীষণ খুশি। শুধু তারা কেন, শান্তি আর কুশলও বোধহয় একে-অপরের জন্যই অপেক্ষা করছিল। তারাও তাদের নতুন জীবনকে আনন্দের সঙ্গে আলিঙ্গন করল।

শান্তি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, সে আর চাকরি করবে না। ঘরেই থাকবে। বাচ্চাদের স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে কোলে-পিঠে করে মানুষ করে তুলবে।

এভাবেই কেটে গেল ৪-টে মাস। সেদিন রোববার। শান্তি দেব আর ঈশিতাকে পড়াতে বসেছিল। টাস্ক দিয়ে তাদের স্কুলের ডায়ারি খুলে দেখল দেবের ডায়ারিতে হোম টাস্ক হিসাবে রয়েছে ‘আমার জীবনের স্মরণীয় দিন’ নিয়ে একটি প্রবন্ধ। তৎক্ষণাৎ শান্তি তাকে তার স্মরণীয় দিন নিয়ে লিখতে বলায়, সে ইংরেজিতে যা লিখল,বাংলায় তার সারমর্ম এই–

‘যেদিন আমি আমার মাকে ফিরে পেয়েছিলাম, সেদিনই আমার জীবনে সবথেকে স্মরণীয় দিন। সেই-ই হল পৃথিবীর বেস্ট মাম্মি। আমি মাকে ভীষণ ভালোবাসি। আমার মা আমাকে ভালোবাসার পাশাপাশি সবকিছুর জন্য অনুপ্রাণিত করেন। আমার ইচ্ছে সকলেই আমার মতো মা পাক।’

শান্তির চোখ জলে ভরে গেল। শান্তি উপর দিকে তাকিয়ে কপালে হাত ছুঁয়ে মনে মনে ভগবানকে ধন্যবাদ জানাতে থাকে, এত সুন্দর একটি পরিবার তাকে উপহার দেওয়ার জন্য।

বাইরের ঝকঝকে রোদে ধুয়ে যাচ্ছে সমস্ত প্রকৃতি। যতদূর সম্ভব দৃষ্টি প্রসারিত করে শান্তি। দূরের গাছগুলোর দিকে চোখ আটকাতে হঠাৎই যেন চমকে ওঠে সে। সেই পাতা ঝরে যাওয়া ন্যাড়া গাছগুলোতে হঠাৎই যেন সবুজের মায়াময় স্নিগ্ধতা। কচি পল্লবের নরম পেলব ছোঁয়াচ যেন হঠাৎই উদ্বেল করে তোলে তাকে। দুটি শিশুর নরম হাতের ছোঁয়ায় হঠাৎই বড়ো ভালোবাসতে ইচ্ছে করে জীবনটাকে।

সম্পর্কের সমীকরণ

সময় কারও জন্য থেমে থাকে না রাহুল। সে তার নিয়মেই বয়ে চলে। মানুষ বর্তমান নিয়েই বাঁচে। কাল কে দেখেছে বলতো?’

‘ফিলোজফি ঝেড়ো না তো অরিদা। যখনই দেখা হয়, তোমার সেই একই কথা। সবসময় মানুষের মনে আঘাত দিতে ভালো লাগে? তোমাদের মতো করে যারা ভাবে তাদের জন্যই আমাদের মতো কষ্টে জর্জরিত মানুষগুলো বাঁচার আশাই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।’

‘বাঁচার আশা ছাড়বে না, বরং আরও ভালো করে বাঁচতে শিখবে! কখনও কারও মনে দুঃখ দেবে না, আর কেউ কষ্টে থাকলে তাকে মাঝ দরিয়ায় ছেড়েও দেবে না। আমরা মানুষ রাহুল। সমাজে বাস করি। রোজ না জানি কত লোকের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়, তাদের সকলের সঙ্গেই যে আমরা ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে পারি এমনটা তো সম্ভব নয়। কখনও কখনও তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে ফেলি। কটু কথাও বলে ফেলি। সেক্ষেত্রে তৎক্ষনাৎ একটা ‘সরি’ বললেই প্রবলেম সলভড্। কোনও কিছু কালের উপর না ছাড়াই ভালো, কারণ কাল কখনও আসে না।’

‘গতকাল দেরি করে অফিসে আসার জন্য আমি আমার চাপরাশিকে দু-চার কথা শুনিয়েছি। তাই বলে আমি তার কাছে ক্ষমা চাইব নাকি?’

‘ওনার দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করেছিস একবারও? যদি তিনি রোজই দেরি করে অফিস পৌঁছন তাহলে আলাদা কথা। কিন্তু যদি তিনি আগে কোনওদিন দেরি না করে থাকেন, শুধুমাত্র সেইদিনই… তাহলে নিশ্চয়ই কোনও বিশেষ কারণ থাকবে। ওই ভদ্রলোক তোর বাবার বয়সি। সারাদিনে সকলের সঙ্গে কত তো কথা বলিস। তার থেকে যদি দু-চারটি বাক্য ওই মানুষটার জন্য ব্যয় করিস, তাতে তোর জাত যাবে? যদি একটা ‘সরি’ বলিস, কী হবে তাতে? মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?’

‘কী বলতে চাইছ বলোতো? তোমার কথা অনুযায়ী আমাকে তাহলে সুগার কোটেড ট্যাবলেট-এর মতো করে বাঁচতে হবে। বাইরে থেকে মিষ্টি আর ভিতরে তেতো।’

‘বাইরে মিষ্টি ভিতরে তেতো কেন হবে? তাহলে তো ভিতরে ভিতরে নিজেকেই জ্বলতে হবে। আমরা নিজেকেও জ্বালাব না আর কাউকে কষ্টও পেতে দেব না।’

রবিবার। কোথায় রাহুল ভেবেছিল আজ একটু বেশি ঘুমোবে, এগারোটার আগে কোনও মতেই বিছানা ছাড়বে না। রোজই তো সকাল সাতটায় উঠে কোনওরকমে নাকে-মুখে গুঁজে অফিস ছুটতে হয় তাকে। যদিও তার দুশ্চিন্তা তাকে কতটা শান্তিতে ঘুমোতে দেয় কে জানে! সে ছুটে বেড়ায় শান্তির খোঁজে। আজকাল বাড়িতেও ভালো লাগে না রাহুলের। সংসারে মোটে তিনটে প্রাণী। মা-বাবা আর সে। তারা কেউ কথা বলে না রাহুলের সঙ্গে। রাহুলও কথা বলার সাহস পায় না।

ঘড়িতে তখন সবে আটটা দশ। কানের কাছে বেজে উঠল মোবাইল ফোনটা। ঘুম চোখে বিরক্তিমাখা মুখে ফোনটা কানে দেয় রাহুল—

‘হ্যালো, কে বলছেন?’

‘আরে অরিজিৎ বলছি রে।’

‘আরে হ্যাঁ। বলো বলো। হঠাৎ কী মনে করে এত সকালে ফোন করলে? সিরিয়াস কিছু?’

‘না রে তেমন সিরিয়াস না হলেও তোর সঙ্গে কিছু দরকারি কথা আছে। তাছাড়া অনেকদিন দেখাও তো হয়নি। আজ বিকালে আমাদের বাড়িতে আয়, তখনই সব কথা হবে। তোর বউদিও বাপের বাড়ি গেছে। তুই এলে আমারও কম্প্যানি হবে।’

‘এই কথাগুলো একটু বেলায় বললে খুব অসুবিধা হতো? শুধুশুধু আমার ঘুমটা মাটি করে দিলে। আচ্ছা ঠিক আছে, কখন যেতে হবে বলো?’

‘এক কাজ কর সকালেই চলে আয়। একসঙ্গে লাঞ্চ করব। দুজনে মিলে যা হোক একটা কিছু বানিয়ে নেওয়া যাবেখন।’

‘ঠিক আছে, আমি ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আসছি।’

অরিজিৎ, অতুলের বেস্ট ফ্রেন্ড। লম্বা, চওড়া, সুঠাম দেহ তার। দেখতেও বেশ সুদর্শন। কলকাতারই একটি নামিদামি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চিফ্ অ্যাকাউন্ট্যান্ট, মাত্র সাত মাস বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে সে।

অতুলদের বাড়িতে নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল অরিজিতের। সে প্রায় বাড়িরই একজন হয়ে উঠেছিল। বাড়িতে হইহুল্লোড়, আনন্দ, হাসি-ঠাট্টা, মজা, সুখ-দুঃখ সবেতেই সামিল হতো সে। অতুলের মতো অরিজিৎও হয়ে উঠেছিল রাহুলের অরিদা। অতুলের অকাল মৃত্যুতে তার আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল রাহুলদের বাড়িতে।

আজ সেই সম্পর্কের টানেই একটা ফোন পেয়ে অরিদার বাড়িতে ছুটে আসা রাহুলের। এর আগেও বহুবার এখানে এসেছে সে অতুলদার সঙ্গে। চার মাস আগে যখন এসেছিল তখন বারান্দায় বসানো বেলফুলের চারাগুলি সবে ডানা মেলছিল। আজ তাতে ফুল ভরে গেছে। পুরো বারান্দা গন্ধে ম ম করছে। কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল রাহুল।

— ‘কী রে শুনছিস কী বললাম? কোথায় হারিয়ে গেলি?’ অরিজিতের কথায় চমকে উঠল রাহুল।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, কী যেন বলছিলে? মাঝে মাঝে কী যে হেঁয়ালি করে কথা বলো না, কিছুই বুঝি না। মাথার উপর দিয়ে যায়। লোককে ভুরিভুরি উপদেশ দেওয়ার রসদ কোথা থেকে পাও বলো তো। কপালে একটা বড়ো লাল তিলক আর গেরুয়া বস্ত্র গায়ে চড়িয়ে বসে যাও। প্রচুর টাকা কামাবে।’

‘দ্যাখ, ভগবানের দয়ায় টাকার অভাব নেই আমার। আর গেরুয়া বস্ত্র কেন পরব বলতো? যারা সংসার ত্যাগ করে তাদের ওই পোশাক মানায়। তাদের মতো আমি তো মহামানব নই, আর ভবিষ্যতেও সংসার ত্যাগ করার কোনও পরিকল্পনাও আমার নেই। আমি সংসারী মানুষ। সারাজীবন সংসার নিয়েই সুখে-দুঃখে কাটাতে চাই। দায়িত্ব থেকে পিছপা হওয়ার মতো ছেলে আমি নই। আর অতটা দয়িত্বজ্ঞানহীনও হতে পারব না।’ অরিজিৎ বেশ উত্তেজিত হয়েই কথাগুলি বলল।

‘কোথা থেকে কোথায় চলে এলে অরিদা? কী বলছ কিছুই বুঝলাম না। আর হঠাৎ করে এত উত্তেজিতই বা হয়ে গেলে কেন?’

‘এত ছোটো তো তুই নোস, যে আমার কথা বুঝতে পারছিস না। কী করছিস ভেবে দেখেছিস একবারও। নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছিস? মেয়েটার কী হবে বলতো?’

এতক্ষণে রাহুলের বোধগম্য হল যে অরিদা কী বলতে চাইছে। তার আর মৌসুমির সম্পর্ককে ঘিরেই এত জল্পনা। সেই সম্পর্ক যেটা না রাহুল বহন করতে পারে আর না সহন করতে পারে।

‘তুমি আমার জায়গায় থাকলে কী করতে?’

‘হয়তো আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতাম। দাদার মৃত্যুর পর কখনও তার বিধবা স্ত্রীকে গ্রহণ করতাম না। মা-বাবা যতই চ্যাঁচামেচি করুক, অন্যায় আবদার করুক, না বলে কাটিয়ে দিতাম। অন্তত তাদের রোজ তিল তিল করে মরার জন্য ছেড়ে দিতাম না। যদি সম্পর্ক রাখারই না ছিল তাহলে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলি কেন? আমি এরকম সম্পর্কে কখনও আবদ্ধ হতাম না যেটা আমার নিজের এবং অন্যের জীবনের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াবে।’

‘যদি এই সম্পর্ক ওর মৃত্যুর কারণ হয়, তাহলে আমিও তো ক্রমশ সেই দিকেই এগোচ্ছি। না পারছি গিলতে, না পারছি ফেলতে। আমিও যে ভালো নেই অরিদা।’

‘ভালো থাকবি কী করে বলতো? চার মাস ধরে মেয়েটা বাপের বাড়িতে পড়ে আছে। অতুলের মৃত্যুর পর একবারও তাকে চোখের দেখা দেখতে যাসনি। এখনও সময় আছে রাহুল, সব দ্বিধা কাটিয়ে যা ওর কাছে। দায়িত্ব যখন নিয়েছিস ওকে ওর মর্যাদা দিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আন ভাই।’

চুপ করে থাকে রাহুল। এর কী জবাব দেবে সে নিজেই জানে না। বোধহয় সেই উত্তর খোঁজার জন্যই হারিয়ে যায় তার উদাসীন মন।

মৌসুমি বাবা-মায়ের আদরের একটিই মাত্র মেয়ে। লম্বা, ফর্সা, ছিপছিপে চেহারা। টানা টানা চোখ, টিকালো নাক, ছোট্ট কপাল–যাকে বলে প্রকৃত সুন্দরী। বিএ পড়তে পড়তেই বান্ধবীর সূত্রে অতুলের সঙ্গে আলাপ। তারপর প্রেম এবং পরে বিবাহ। অতুল সরকারি কর্মচারী এবং সৎ হওয়ার কারণেই মৌসুমিদের বাড়ি থেকে কোনও আপত্তি ওঠেনি।

শ্বশুর, শাশুড়ি, দেওর আর স্বামীকে নিয়েই ছিল তার সুখের সংসার। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সে সুখ তার কপালে বেশিদিন সইল না। বিয়ের সাত মাস পরেই ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট-এ মারা গেল অতুল। সেদিন মৌসুমির জন্মদিন ছিল। মৌসুমিকে উপহার দেওয়ার জন্য একটা লাল রঙের জরিপাড় শাড়ি এবং একতোড়া গোলাপফুল কিনেছিল সে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়েই এই দুর্ঘটনা। খবর পেয়ে তারা যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছল, তখনও লাল টুকটুকে শাড়ি আর গোলাপের তোড়া সেইখানেই পড়ে ছিল। শাড়িটা হাতে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল মৌসুমি। একটা সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল সে।

তিনদিনে সমস্ত কাজ মিটে যাওয়ার পর অখিলেশবাবু তার মেয়ে মৌসুমিকে পাকাপাকি ভাবে সঙ্গে করে নিয়ে চলে যেতে চাইলেন তাদের বেহালার বাড়িতে।

সেকথা শোনা মাত্রই রাহুলের মা-বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এমনিতেই পুত্রশোকে তারা মৃতপ্রায়, তার উপর আবার তাদের স্নেহের বউমার বাড়ি থেকে চলে যাওয়াটা তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তারা কাঁদতে কাঁদতে শুধু অখিলেশবাবুর পায়ে ধরতে বাকি রেখেছেন। কত অনুনয়-বিনয় করেছেন মৌসুমিকে এ বাড়িতে রাখার জন্য। কিন্তু তাঁর একটাই কথা, এখানে থেকে সে কী করবে। কী পরিচয়ে থাকবে? অতুলের বিধবার পরিচয়ে! সেটা তিনি কিছুতেই হতে দেবেন না। আবার তিনি অন্যত্র মেয়েকে পাত্রস্থ করবেন।

এ সমস্তকিছুই লক্ষ্য করছিল রাহুল। এমন সময় তাকে দেখে মা মীনাদেবী ছুটে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তার হাত দুটি ধরে পীড়াপীড়ি শুরু করে দেন। একমাত্র সে-ই পারে মৌসুমিকে এ বাড়িতে রাখতে। সে যদি মৌসুমিকে বিয়ে করে তাহলে মৌসুমি এ বাড়িতে বউয়ের সম্মান নিয়েই চিরজীবন থেকে যেতে পারে।

কিন্তু সেটা রাহুলের পক্ষে কীভাবে সম্ভব? যাকে সে এতদিন বউদি বলে ডেকে এসেছে, বন্ধুর মতো মিশেছে তার সঙ্গে, তাকে সে কীভাবে নিজের স্ত্রী হিসাবে মেনে নেবে? শুধু তার কেন, কারওর পক্ষেই কি এটা সম্ভব?

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এই প্রস্তাবটা নিয়ে কোনও জোরালো প্রতিবাদ করলেন না অখিলেশবাবু। শেষ পর্যন্ত শত চেষ্টা করেও মা-বাবার এই শোকার্ত আবেদন এড়িয়ে যেতে পারেনি রাহুল। সে বাধ্য হয়েছিল মৌসুমির মাথায় সিঁদুর তুলে দিতে। কিন্তু হায়, ভাগ্যের কী পরিহাস! যাকে নিয়ে এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত, সে স্থানুবত এক পুতুল। অতুলের নয়, রাহুলের স্ত্রী, হিসাবে জীবনটা অতিবাহিত করতে তার আপত্তি আছে কিনা তা নিয়ে কোনও মতামত চাওয়া হয়নি মৌসুমির।

এরপর অখিলেশবাবু প্রায় জোরাজুরি করেই পনেরো দিনের জন্য মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের বাড়িতে। তারপর কেটে গেছে চার চারটি মাস। এবাড়ির কেউ মৌসুমিকে আনেওনি, এমনকী ফোন পর্যন্ত করে খবর নেয়নি। এই নিয়েই যত অশান্তি। বাবা-মা রাগে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছেন রাহুলের সঙ্গে। তাদের রাগ বাড়ির বউ আর কতদিন বাপের বাড়িতে পড়ে থাকবে।

সহসা কলিং বেল-এর আওয়াজে চমকে ওঠে রাহুল। দুধওয়ালা দুধ দিয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে আবার বলতে শুরু করল রাহুল। ‘সময় মানুষকে কখন কোন পরিস্থিতিতে দাঁড় করাবে আগে থেকে তা কে বলতে পারে অরিদা? মানছি ওর দায়িত্ব আমি নিয়েছি। দায়িত্ব এড়াতেও চাই না। ভেবেছিলাম যে, সমস্যা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা আরও জটিলাকার ধারণ করল। সব থেকে বড়ো সমস্যা হল আগে একরকম করতাম আর এখন অন্যরকম ব্যবহার। মৌসুমির সঙ্গে নতুন সম্পর্ক তো দূর, পুরোনো সম্পর্কটাই কীভাবে সামলাব বুঝতে পারছি না। ও ছিল আমার বউদি কাম বেস্ট ফ্রেন্ড। সমস্ত আলোচনাই করতাম ওর সঙ্গে। এমনকী কবে কোন মেয়ের পিছনে লাগলাম, কার প্রেমে পড়লাম সমস্ত কিছুই। মাঝেমধ্যে দাদা আমাকে বলত, ‘কখনও তোর বউদিকে আমার সঙ্গেও একটু-আধটু সময় কাটাতে দে।’

একদিন তো এমনও হয়েছে, ‘বউদি বউদি’ করে ডেকেই যাচ্ছি। বউদির কোনও সাড়া নেই। যে-বউদিকে ডাক দিলেই সমস্ত হাতের কাজ ফেলে ছুটে আসে, তার আজ কী হল! আবার ডাকলাম, – এল না। ‘বউদি একবার এসো, তোমাকে কিছু দেখানোর আছে।’ খেতে বসেও সেই একই ব্যাপার। সকলের সঙ্গে কথা বলছে, শুধু আমার সঙ্গে বলছে না।

এইসব দেখে মা ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করার কারণ। সেদিন কোনও উত্তর দিতে পারেনি সে। উত্তরের পরিবর্তে শুধু মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে ও।

পুরো ব্যাপারটাই বুঝতে পেরেছিল দাদা। বসে বসে মুচকি হাসি হাসছিল। পরে দাদার থেকে জানতে পারি দাদা নাকি ইয়ার্কি করে ওকে বলেছে, ও দাদার থেকে আমাকেই বেশি ভালোবাসে। তাই সারাদিন মুখ গোমড়া করে রেখেছিল।

কথাটা যে আমিও ভালোভাবে নিতে পেরেছিলাম তা কিন্তু নয়। আমারও কেমন যেন একটা খটকা লেগেছিল। শুধু মনের কোণে একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল, আমাদের দেওর-বউদির সম্পর্ককে দাদা অন্যরকম ভাবে নিচ্ছে না তো?

বাড়িতে বেশ একটা গুরুগম্ভীর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। মৌসুমির মুখের হাসি ফিরিয়ে আনতে দাদা যখন ওকে আমার ঘরে নিয়ে এসেছিল, তখনও কাঁদছিল ও। আমাকে দেখে আরও বেশি করে কাঁদতে শুরু করেছিল। সেদিন প্রথম আমি ওর মাথায় হাত রেখেছিলাম।

সব শুনে অরিজিৎ বলল, ‘মৌসুমিকে ভালো যে বাসিস তা তোর কথায় স্পষ্টই বোঝা যায়। তবে এটা ঠিক যে তোর ভালোবাসার ধরনটা ছিল আলাদা। এখন তোদের সম্পর্কের সমীকরণটা বদলেছে। মানছি এক সম্পর্ক থেকে হঠাৎ করে অন্য সম্পর্কে যাওয়াটা খুব সোজা নয়। কিন্তু অসম্ভবও তো নয়। এই সংসারে কত লোকই তো আছে যারা এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, তারা কি সুখে ঘর করছে না বল?’

অতীত ভুলে যা ভাই, বর্তমানে ফিরে আয়। আমার বিশ্বাস তুই পারবি।’

‘কী করে বলো?’

‘আজ বিকেলে মৌসুমিদের বাড়িতে যা। ওর সঙ্গে কথা বল। আগের মতো ওর ভালো বন্ধু হয়ে যা। পাশে বস। তুই যেমন তোর ভাইকে হারিয়েছিস ও-ও তো স্বামীকে হারিয়েছে, তাই না?’

‘ওর স্বামী নাকি বন্ধু কোন পরিচয়ে গিয়ে দাঁড়াব ওর কাছে? তুমি যাবে আমার সঙ্গে?’

‘অবশ্যই যাব। এক কাজ করি আমি মৌসুমিকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি। তখন কথা বলে নিস।’

‘না অরিদা। প্লিজ ওকে এনো না।’

রাহুল হঠাৎই থামিয়ে দিয়েছিল অরিজিৎকে। সে ভয় পেতে শুরু করেছিল। কীভাবে সে মৌসুমির সামনে গিয়ে দাঁড়াবে?

রাতে বাড়ি ফিরে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ে রাহুল। মনে মনে ভাবতে থাকে তার সমস্ত সুখশান্তি দাদা কেড়ে নিয়ে গেছে। অরিদা ঠিকই বলেছে, কতদিন আর এরকম চলবে? কিছু তো একটা ডিসিশন নিতেই হবে। কিন্তু তার আগে এটাও তো জানা দরকার মৌসুমি তার ব্যাপারে কী ভাবে? সে কী চায়? এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে রাহুল।

পরদিন সকাল সাতটায় অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙে রাহুলের। কোনও রকমে নাকে মুখে গুঁজে রওনা দেয় অফিসে। পথটাও অনেকটা। সেক্টর ফাইভ। প্রায় দশ কিলোমিটার। ভালো পোস্টে আছে রাহুল। বেতনও পায় বেশ মোটা অঙ্কের।

অফিস শেষ করে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয় রাহুল। চড়ে বসে গাড়িতে। কিন্তু আশ্চর্যের কথা বাড়ি না গিয়ে এ কোথায় এল সে! তার অবচেতন মন তাকে কোথায় নিয়ে এল? এ যে মৌসুমিদের দরজার সামনে এসে গেছে সে! মৌসুমির মা-বাবা তাকে দেখতে পেয়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন। তাদের কাছ থেকে সে জানতে পারে মৌসুমি অসুস্থ। অতুলের মৃত্যুর পর থেকেই সে অবসাদে ভুগছে।

মৌসুমির ঘরে ঢোকা মাত্রই চমকে উঠল রাহুল-এ কী অবস্থা তার। চোখে-মুখে কালি পড়ে গেছে, চুল উশকোখুশকো, জরাজীর্ণ চেহারা। ফর্সা টুকটুকে রং একেবারে কালো হয়ে গেছে।

অতুল মৌসুমিকে খুব ভালোবাসত। বলত ‘এই পাগলিটাকে নিয়ে কী করি বলতো? এই যুগে এত সহজ, সরল হলে সমাজে বাঁচবে কী করে। কী করে সামলাব এই মেয়েকে আমি?’

রাহুল বলতো, ‘ভালোই তো, আসল সোনা পেয়েছ, তাতে খাদ মেশানোর চেষ্টা করছ কেন?’

‘আমি মরে গেলে কী হবে ওর? বাঁচবে কেমন করে? সমাজে বাস করতে হলে একটু চালাক-চতুর হতে হয়।’

‘কেন বাজে কথা বলো, বলো তো। ভালো কথা বলতে পারো না।’ সেদিন দাদার এই কথায় চেঁচিয়ে উঠেছিল রাহুল। কী জানি, দাদা কী তার মৃত্যুর কিছু পূর্বাভাস পেয়েছিল, নাকি এমনিই! মৌসুমিকে দেখে রাহুলের মনে পড়ে গেল কথাগুলো।

মনে মনে ভাবতে থাকল বাবা-মা বিশ্বাস করে তার হাতে সঁপে দিয়েছিল মৌসুমিকে। আর সে কী করছে। তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। তার এই অবস্থার জন্য নিজেকেই দূষতে থাকে সে।

এমন সময় মৌসুমির বাবা বলেন, ‘মউ দ্যাখ মা আমার, কে এসেছে তোর সঙ্গে দেখা করতে। দ্যাখ রাহুল এসেছে। রাহুলের সঙ্গে কথা বল মা। কতটা দূর থেকে এসেছে তোর সঙ্গে দেখা করতে।’

চুপ করে বসেছিল মৌসুমি। আর কী কথাই বা বলবে? কী-ই বা বলার আছে? তাদের দুজনেরই ভবিষ্যৎ অন্ধকারে আর অতীত তো চিরজীবনের মতো দিশাহীন করে দিয়ে গেছে। রাহুলের দিকে দেখল সে। সেই নিশ্চল চোখ। রাহুলের চোখে জল এসে যায়। দাদার মুখটা চোখের উপর ভেসে ওঠে। যেন আসল সোনা তার হাতে তুলে দিয়ে দাদা বলছে ‘দেখিস ভাই আমার মৌসুমির দায়িত্ব এবার তোর। তুই ছাড়া আর কাকেই বা এই গুরুদায়িত্ব দিতাম বল। বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যা রাহুল। বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যা।’

রাহুলের চোখ জলে ভরে গিয়েছিল। সহসা নিজের হাতের উপর একটা স্পর্শ অনুভব করার সঙ্গে সঙ্গে কানে এল, ‘কেমন আছো রাহুল?’

উত্তর দিতে না পেরে হাউহাউ করে কেঁদেই ফেলল রাহুল। মনে হচ্ছিল যেন দাদার দাহ সংস্কার করে সবে ফিরেছে সে। দাদা মরে গিয়ে বেঁচে আছে, আর তারা বেঁচেও মরে আছে।

‘রাহুল। কাঁদছ কেন?’

অল্পক্ষণেই রাহুলের মনে হল যেন তার দেহ-মনের জ্বালা একেবারে জুড়িয়ে গেছে। কোথা থেকে যেন শান্তি ফিরে এসেছে। মৌসুমি তার আঁচল দিয়ে রাহুলের চোখ মুছিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।

মৌসুমির বাবা রাহুলকে ঘরে দিয়েই চলে গিয়েছিলেন। কেউ থাকলে মৌসুমিকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথাটা অন্তত পাড়তে পারত সে।

মৌসুমি বলে ওঠে, ‘সোজা অফিস থেকে এসেছ না? কিছু তো খাওয়াও হয়নি মনে হয়। তুমি বসো। আমি কিছু নিয়ে আসি।’ এই বলে কোনওরকমে দেয়াল ধরে ওঠার চেষ্টা করে সে।

‘না খেতে ইচ্ছে করছে না’, বলে মাথা নাড়ায় রাহুল।

‘সবাই কেমন আছে? আমার কথা বাবা-মায়ের মনে পড়ে?’

‘আগে বলো বাড়ি যাবে আমার সাথে? সবাই তোমাকে খুব মিস করে।’ সাহস করে বলেই ফেলে রাহুল।

‘এখন আর ওখানে গিয়ে কী করব, কে আছে আমার?’

‘কেন এরকম বলছ?’

‘তুমি খুব ভালো করে জানো রাহুল, ওখানে আর আমার আপন বলতে কেউ নেই, তবুও…।’

কথাগুলি শুনে দম বন্ধ হয় আসে রাহুলের। তাহলে কি মৌসুমি মনে করতে চাইছে না তাদের সম্পর্কটা এখন কী? হতবাক দৃষ্টি নিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে রাহুল। যদি তাকে সাহায্য করার জন্য কেউ আসে। ওর মা-বাবা যে কেউ একজন।

‘কী হল রাহুল? তোমাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?’ মৌসুমি তার হাত দুটি ধরে বলল।

‘তুমি আমার সঙ্গে বাড়িতে চলো। তোমাকে ছাড়া কিছু ভালো লাগে না। বাড়ি যেন গিলতে আসে। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায়। কেউ কারওর সঙ্গে কথা বলে না’, বলতে বলতে আবার কেঁদে ফেলে রাহুল।

‘আমি গিয়ে কী করব বলো তো? ভগবান ও বাড়িতে ওই পর্যন্ত অন্ন মেপেছিল আমার জন্য।’

‘বারবার অতীতটাকে ফিরিয়ে আনতে চাইছ কেন? যে গেছে সে কি আর ফিরে আসবে?’ বেশ চিৎকার করেই কথাগুলো বলল রাহুল। কথাগুলো যেন নিজের কানেই বড়ো বাজল রাহুলের।

চিৎকার শুনে ছুটে এল মৌসুমির মা-বাবা। কখন যে তার মধ্যে অধিকারবোধ জন্মাল সে নিজেই জানে না।

রেগেমেগে তার মা-বাবার উদ্দেশ্যে রাহুল বলতে থাকে, ‘আপনারা কেন সবকিছু জানাননি ওকে। আপনারাই তো জোর করেছিলেন। তাহলে ওকে বলেননি কেন? চুপ করে আছেন কেন? আমাকে মাটির পুতুল ভেবেছেন, যখন যা খুশি তখন তাই করাবেন। বোঝান ওকে সত্যটা কী। আমি আর পারছি না মৌসুমি। তুমি কি কিছুই বুঝতে পারছ না, নাকি আমাকে যাচাই করছ? প্লিজ দয়া করো আমাকে, চলো বাড়ি চলো। আমি মানছি আমার ভুল হয়ে গেছে, বিগত চার মাসে একবারও তোমার খোঁজ নিইনি। কিন্তু সঙ্গে এটাও তো সত্যি একটা মুহূর্তের জন্যও তোমাকে ভুলতে পারিনি।’ বলতে বলতে সকলের সামনেই মৌসুমিকে জড়িয়ে ধরে সে।

এতদিন রাহুল-যে সম্পর্কটাকে বোঝা ভাবত, সেটা যে তার কাছে কী তা সে আজ টের পাচ্ছে। মৌসুমির তাকে অস্বীকার করা, সেটা কোনওভাবেই মানতে পারছে না সে।

‘আবার কাঁদে। আরে কাঁদছ কেন? কী হয়েছে তোমার রাহুল? আমি তো ভলোই আছি এখানে। এখানে আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না।’

এমন সময় মৌসুমির বাবা অখিলেশবাবু রাহুলকে অন্য ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ‘চার মাস একটা খবর পর্যন্ত নাওনি। আমার মেয়ে আমার কাছে বোঝা নয়। তাকে দুবেলা খেতে দেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। ঘাড় থেকে বোঝা নামাব বলে তোমার উপর মেয়ের দায়িত্ব দিইনি রাহুল। ভেবেছিলাম আমরা বুড়ো-বুড়ি আর ক’দিন। তারপর অন্তত মেয়েটাকে দেখার কেউ থাকবে।’

‘বাবা, তুমি রাহুলের সঙ্গে এইভাবে কথা বলছ কেন?’ কোনওরকম ভাবে মৌসুমি উঠে এসেছিল তাদের কাছে।

‘দাদার মৃত্যুর পর আমাদের এই আকস্মিক বিয়ে। তারপর থেকে আমিও তো ভালো নেই। শুধু ভেবেছি কী করব? ওর কী হবে? ও কীভাবে নেবে। প্রতিদিন একটু একটু করে মরছি। আর আপনারা ভাবছেন আমি চিন্তা করি না।’

‘রাহুল তুমি কি সত্যি কথা বলছ? তুমি মন থেকে মেনে নিতে পেরেছ এই বিয়ে? বলো আমাকে।’

‘ঘরে চলো তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার।’, হয়তো বাবা-মায়ের জুড়ে দেওয়া সেই অধিকারের জোরেই মৌসুমির হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে রাহুল নিয়ে যায় পাশের ঘরে। দরজা বন্ধ করে দেয়। অল্পক্ষণের জন্য দুজনেই চুপ করে যায়।

জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় মৌসুমি। কাছে যায় রাহুল। বলতে থাকে—‘খুব কষ্ট দিয়েছি না তোমাকে? আচ্ছা তুমিও কি তাই মনে করো? আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই তোমার খোঁজ নিইনি? কিন্তু বিশ্বাস করো একটা মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারিনি তোমার উপস্থিতির কথা। তখন বুঝতেই পারিনি তুমি আসলে আমার কী? দাদা চলে গেছে কিন্ত আমি তো বেঁচে আছি। তোমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাব না। সারাজীবন তোমার সঙ্গেই থাকব। যেদিন তোমার মাথায় সিদুঁর দিয়েছিলাম সেদিন যে-শপথ নিইনি আজ তা নিলাম।’

কথাটা শোনা মাত্রই চিৎকার করে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে মৌসুমি। বাইরে থেকে মেয়ের কান্না শুনে পড়িমরি করে দরজা খুলে ছুটে আসেন মৌসুমির মা-বাবা। মেয়েকে চুপ করানোর জন্য এগিয়ে আসতেই হাত দেখিয়ে বাধা দেয় রাহুল। হাত জোড় করে বলে ‘দয়া করে আপনারা যান আমি সামলে নেব।’

‘মৌসুমি শোনো, আমার কথা শোনো। দ্যাখো আমার দিকে একবার দ্যাখো।’

তাকে কিছুতেই সামলাতে পারছে না রাহুল। একপ্রকার জোর করেই মৌসুমিকে চেপে জড়িয়ে ধরে রেখেছে কোনওমতে। ‘অভিমান হয়েছে? রাগ হয়েছে? বলো তুমি সত্যিই বোঝো না তোমার আমার সম্পর্ক?’

মৌসুমি শুধু একটা কথাই বলে চলে–‘না এটা হতে পারে না। আমি তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিতে পারি না।’

রাহুল বাহুবলে আরও কাছে টেনে নেয় মৌসুমিকে। একেবারে বুকের কাছে। এতটাই কাছে যে তার প্রতিটি হূদয়ের স্পন্দন অনুভব করে সে। সে এক আলাদা অনুভূতি, যেটা সে আগে কোনওদিন অনুভব করেনি।

রাহুল বলতে থাকে-‘কে বলেছে তুমি আমার জীবন নষ্ট করেছ? তুমি জানো না তুমি আমাদের কাছে কী সোনা–বলতে বলতে মৌসুমির কপালে চুমু খায় রাহুল। যাকে গলার কাঁটা ভাবতাম সেটাই যে গলার হার হয়ে দাঁড়াবে তা কি আগে জানতাম? বুঝলামই যখন তখন…’

চুপ করে রাহুলের বুকে মাথা দিয়ে থাকে মৌসুমি। এখন সে অনেকটা শান্ত।

দুই হাত দিয়ে মৌসুমির মুখটি তুলে ধরে বলে, ‘যাবে তো আমার সঙ্গে, যাবে না? কিছু বলবে না? আচ্ছা ঠিক আছে বলতে হবে না।’

রাহুল বুঝে যায় মৌসুমির নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব