অনিতার চোখ বেয়ে নেমে এল জলের ধারা। সকালটা এভাবে শুরু হোক একেবারেই সে এটা চায়নি। তবু অনিমেষের কথাগুলো তাকে শুনতে হল।

নিতা, তুমি খুব ভালো করেই জানো কোম্পানিতে আমি একটা বড়ো দায়িত্বে আছি। ছোটো ছোটো কাজের জন্য বসের কাছে সবসময় ছুটির কথা বলাটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তোমার সঙ্গে সব জায়গায় যাওয়ার আমার কি খুব দরকার আছে? তুমি তো একলাও যেতে পারো। তোমাকে গাড়ি, ড্রাইভার সবই তো দিয়ে রেখেছি। আর কী চাও আমার থেকে?

কী চাই? তোমার ব্যস্ত শেডিউল থেকে খুব সামান্য একটু সময় এবং মনের কোণায় খুব অল্প একটু জায়গা পেলেই আমি খুশি।

ব্যস, শুরু হয়ে গেল তোমার দর্শনশাস্ত্র! সত্যি নিতা, তুমি একটা কথাকে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাও।

অনিমেষ, অন্য সকলের জন্য তোমার কাছে অফুরন্ত সময় অথচ আমার বাপের বাড়ি যেতে বললেই তোমার কাছে সময় থাকে না, অনিতার চোখে জল চলে এল।

তুমি কি ভাবছ আমি মিথ্যা বলছি? কোম্পানির দোহাই দিচ্ছি? তোমার বাপের বাড়ির কোন অনুষ্ঠানটায় আমি যাইনি বলতে পারো? আমাকে দোষ দেওয়াটা তোমার স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে।

অনিতা ঝাঁঝিয়ে ওঠে, তুমি যাওয়াতে আমার মা-বাবা উদ্ধার হয়ে গেছে। তোমার এই অবদান আমি ভুলতে পারি?

অনিতার এই কটাক্ষ অনিমেষকে আরও রাগিয়ে দেয়, তোমার মতো ইডিয়েটের সঙ্গে কথা বলারই কোনও মানে হয় না।

মা-বাবার নিত্যদিনের এই ঝগড়ায় তিন্নিও বিরক্ত হয়ে উঠেছিল। আজ আর ও নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারল না। মায়ের সামনে এসে একটু চেঁচিয়ে বলল, হোয়াট দ্য হেল ইজ দিস মাম্মা? সকাল-সন্ধে কিছুই তোমরা দ্যাখো না। ব্যস ঝগড়া করা চাই-ই?

হ্যাঁ, তুইও আমাকেই দোষ দে। আমি নরম মাটি কিনা! আবার জল গড়িয়ে পড়ে অনিতার চোখ দিয়ে৷

বাবা ততক্ষণে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে। তাই মা-কে সামনে পেয়ে নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করতে বাধ্য হয় তিন্নি।

মুড ঠিক করতে রান্নাঘরে ঢুকে তিন্নি নিজের জন্য কফি বানায়। কফির মাগ হাতে নিয়ে নিজের ঘরের জানলার সামনে দাঁড়ায়। সামনেই রাস্তা। রাস্তার দুই ধারে সারিবদ্ধ গাছের মিতালি। রাতে বোধহয় কয়েক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। গাছের পাতাগুলো থেকে তখনও টুপটাপ জল ঝরে পড়ছে। মাটি ভিজে। রাস্তার গর্তগুলো জলে ভরা। সামনের গাছটায় একটা পাখির বাসা নজরে পড়ে তিন্নির। হয়তো কাক বাসা বেঁধেছে ওখানে। গাছের শাখাপ্রশাখা ভেদ করে মিঠে রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়েছে প্রকৃতির কোলে। বড়ো ভালো লাগছিল তিন্নির বাইরের প্রকৃতির রূপ দেখতে। ভুলেই গিয়েছিল ওর মতো, সময় এক জায়গায় আটকে নেই। দেয়ালে ঘড়ির দিকে তাকাল। ৭টা বেজে গেছে। আর দাঁড়ালে চলবে না। কফির মাগ রান্নাঘরে রেখে এসে তাড়াতাড়ি করে স্নান সেরে স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে নিল। ব্যাগ গুছিয়ে কাঁধে তুলে নিল। ঘরের বাইরে বেরোতেই বসার ঘরে বাবার সঙ্গে মুখোমুখি হল তিন্নি।

খবরের কাগজ থেকে চোখ তুলে অনিমেষ তাকাল তিন্নির দিকে, ওঃ তুমি রেডি হয়ে গেছ, গুড!

তিন্নি ঠান্ডা স্বরে গুড মর্নিং বলে বেরিয়ে যাচ্ছিল, মা পিছন থেকে ডাক দিল।

কী রে, বেরিয়ে যাচ্ছিস, জলখাবারটা তো খেয়ে যা।

না মাম্মা। তোমার আর বাবার ঝগড়াতেই আমার পেট ভরে গেছে। তাছাড়া আমার স্কুলেরও দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাই, বলে তিন্নি বেরিয়ে গেল।

অনিতা তাকিয়ে রইল দরজার দিকে। মেয়ের রাগ হয়েছে বুঝতে পেরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

রাস্তায় স্কুলের পথে যেতে যেতে তিন্নির বারবার মা-বাবার কথাই মনে হচ্ছিল। ও খুব ভালো করেই জানে, এখন বাড়িতে ওর অনুপস্থিতিতে ওদের মধ্যে আবার তর্কাতর্কি শুরু হয়ে গেছে। এবারের বিষয়টা সকালের ঝগড়াটার জন্য দায়ী কে, সেটা নিয়ে৷ এ বিষযে তিন্নি একেবারে শিয়োর।

সন্ধেবেলায় তিন্নি একটু দেরিতেই বাড়ি ফিরল। বাড়ি যাওয়ার থেকে লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা করতে তিন্নির বেশি ভালো লাগে। এমনিতেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ও খুবই ইন্ট্রোভার্ট হয়ে পড়ছে। একা থাকতেই বেশি পছন্দ করে। খুব সহজে কারও সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারে না।

কতবার মাকে বলেছে তিন্নি, আমার কেন কোনও ছোটো ভাই বা বোন নেই? আমার সব বন্ধুদের ভাই-বোন আছে। আর ওরা কত মজা করে। আর, আমাকে দ্যাখো সবসময় একা একা।

আমি তো তোর বেস্ট ফ্রেন্ড, হেসে প্রতিবারই উত্তর দিয়েছে মেয়ে প্রশ্নের। তখনকার মতো চুপ করে থেকেছে তিন্নি। নিজের ভিতরেই শূন্যতা আর চোখের জল লুকোতে ঘরের প্রিয় জানলাটা দিয়ে বাইরে চেয়ে থেকেছে। সময়ের খেয়ালই করেনি।

স্কুল থেকে সন্ধেবেলায় বাড়ি ঢুকতেই মা জিজ্ঞেস করল, কী রে আজ এত দেরি? বাবাও কখন বাড়ি এসে গেছে। ফোন করছিলাম, ধরিসনি কেন? প্রচণ্ড টেনশন হচ্ছিল, বলে অনিতা তিন্নির কাঁধ থেকে স্কুলের ব্যাগটা নিয়ে টেবিলে নামিয়ে রেখে, ওর জন্য জল আনতে রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।

অনিমেষ এতক্ষণ চুপ করে ছিল। অনিতাকে রান্নাঘরের দিকে যেতে দেখে মেয়েকে জিজ্ঞেস করল, কী রে উত্তর নেই কেন? দ্যাখ আমার আর তোর মা-র ঝগড়ার জন্য তুই কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস? উঠে এসে মেয়ের মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলল, এমন একটা বাড়ি দেখা তিন্নি, যেখানে মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া হয় না।

কিন্তু বাবা, তোমার আর মায়েরর ঝগড়া আর সব বাড়ির সাধারণ ঝগড়ার মতো নয়। মাঝে মাঝে তো আমার মনে হয় তোমরা খুব কষ্ট করে এই সম্পর্কটাকে বয়ে বেড়াচ্ছ। সম্পর্কটাই তোমাদের কাছে এখন বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরও তো সবাই আছে দাদুরা,কাকু-কাকিমা, পিসিরা… কই কাউকে তো তোমাদের মতো ঝগড়া করতে দেখি না।

তিন্নির চোখের দিকে তাকিয়ে অনিমেষ একটা কথাও আর বলতে পারল না।

এর মধ্যে অনিতা এসে তিন্নির হাতে এক গেলাস শরবত ধরিয়ে দিয়ে আবার ভেতরে চলে গেল।

অনিমেষ এবার মুখ খুলল, এমনও তো হতে পারে তিন্নি, তুই আমাদের রিলেশনটা নিয়ে একটু বেশিই সংবেদনশীল হয়ে পড়ছিস।

তিন্নি উত্তরটা এড়িয়ে গেল, আচ্ছা বাবা দাদু-দিদা কি তোমাকে জোর করেছিল মা-কে বিয়ে করার জন্য?

অনিমেষের মনে পড়ে গেল ২০ বছর আগেকার কথা। যৌথ পরিবার ছিল তাদের। দাদু, ঠাকুমা, পিসি, জেঠু, কাকু– সকলকে নিয়ে অনিমেষদের বেশ বড়ো পরিবার। দাদু আর জেঠু দুজনেই গিয়ে অনিতাকে পছন্দ করে এসেছিলেন। বনেদি বাড়ির মেয়ে পড়াশোনা জানা, বাড়ির সকলেরই সম্মতি পেতে দেরি লাগেনি। কিন্তু অনিমেষ প্রথমটায় বিয়ের জন্য পরিষ্কারই না বলে দিয়েছিল। দাদুই বকলমে অনিমেষকে শেষ পর্যন্ত রাজি করিয়ে ছেড়েছিলেন।

আজ এত বছর পর মেয়ের প্রশ্নে সামান্য থতমত খেলেও, অনিমেষ নিজেকে সামলে নিল। সামান্য হেসে উত্তর দিল, না রে মা, এরকম কিছুই ঘটেনি। অনেকগুলো বছর তো পার করলাম। কী বা বয়স ছিল আমাদের, আমার কুড়ি আর তোর মায়ের ঊনিশ।

কিন্তু তুমি যেরকম হাবভাব করো তাতে মনে হয় তুমি ছোটো আর মা তোমার থেকে বড়ো, বলে তিন্নি হেসে ফেলে।

অনিমেষ আলতো করে মেয়ের গালটা টিপে দেয়, হ্যাঁ, তুই তো বলবিই। মায়ের এক নম্বরের চামচা।

সেদিন তিন্নির জন্মদিনের পার্টিতে বাড়ি ভর্তি লোকজন। অনিতা অতিথিদের জন্য প্রচুর রান্নাবান্না করেছিল, আর সবই তিন্নির পছন্দের। বাবাও অফিস থেকে ফেরার সময় বড়ো একটা কেক কিনে এনেছিল তিন্নির নাম লেখা। সারাটা দিন হইহই করে কাটিয়ে বেশ ভালো মুড ছিল তিন্নির। রাতে সব অতিথিরা চলে যেতেই তিন্নি বায়না ধরল, মাম্মা, আজ আমি তোমার আর বাবার কাছে শোব। নিজের ঘর থেকে বালিশ আর চাদর তুলে এনে তিন্নি মায়ের খাটে উঠে এল। আজ সত্যিই মনটা খুব ভালো ছিল। এরকম করেই দিনগুলো কাটুক সেটাই তিন্নি চাইত। এগারো ক্লাসের ছাত্রী তিন্নির সমবয়সিরা যেখানে মোবাইল, বয়ফ্রেন্ড, স্টইলিশ জামাকাপড় নিয়ে বেশি মাথা ঘামাত, সেখানে তিন্নি হেসে খেলে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর-ই স্বপ্ন দেখত। মনে মনে সবসময় চাইত মা-বাবার মধ্যে ঝগড়া বন্ধ হোক।

অনিমেষ হাতে রিমোট নিয়ে আধশোয়া অবস্থায় টিভিতে নিউজ দেখছিল, তিন্নি এসে ঘরে ঢুকল। মা রান্নাঘরে তিনজনের জন্য কফি বানাতে ব্যস্ত, এমন সময় অনিমেষের মোবাইলটা বেজে উঠল।

অনিমেষ তাকিয়ে দেখল, আমেরিকা থেকে প্রতিমার ফোন। নিশ্চয়ই প্রিয় ভাইজির জন্মদিনে উইশ করতেই ফোন করেছে। ওদের ওখানে এখন সকাল। নিজে না ধরে তিন্নিকেই ফোনটা ধরিয়ে দিল পিসির কলটা রিসিভ করতে।

হ্যালো, পিপি…, তিন্নির গলায় আনন্দ ঝরে পড়ল।

হ্যালো মাই ডার্লিং, মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্য ডে।

তিন্নি আর অনিমেষের সঙ্গে ভিডিও কলের মাধ্যমে কথা হতে হতেই অনিতা কফি নিয়ে ঘরে ঢুকল। তিন্নি মা-কে ফোনটা ধরিয়ে দিল। অনিতা আর প্রতিমা কিছুক্ষণ কথা বলে ফোন রেখে দিল।

দিদির কানের হিরের দুলটা দেখেছ অনিমেষ? কী সুন্দর! বেস মজাতেই আছে দিদি ওখানে।

দিদি উচ্চশিক্ষিত, আধুনিকা। বড়ো মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে উঁচু পদে রয়েছে। নিজে রোজগার করে আর খরচও সেরকম করে।

প্রতিমার কথা উঠলেই অনিমেষ একটু বেশিই দিদির হয়ে কথা বলে। দিদিকে নিয়ে অনিমেষের গর্বের শেষ নেই।

তুমি আমাকে কথা শোনাচ্ছ অনিমেষ? প্রতিবাদ করে ওঠে অনিতা।

নিতা, এটা কথা শোনানো নয়, যা ফ্যাক্ট তাই বলছি।

কিন্তু তোমার বলাটাই ওইরকম। আমিও তো তিন্নি আর তোমার জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি, কেরিয়ার নিয়ে ভাবিনি।

তুমি তোমার চাকরির সঙ্গে দিদির চাকরির তুলনা করছ? দিদি সিইও-র পদে রয়েছে আর তুমি স্কুলে পড়াতে। দুটোর তুলনা কোনওভাবেই করা যায় না।

অনিমেষের ব্যঙ্গ-মাখানো কথাগুলো শুনে অনিতা রাগ সামলাতে পারল না।

তোমার নিজেকে নিয়ে আর দিদিকে নিয়ে খুব গর্ব, তাই না? আমার বাপের বাড়ি কোনও কিছু লুকিয়েচুরিয়ে আমার বিয়ে দেয়নি। ইতিহাস নিয়ে পোস্ট
গ্র্যাজুয়েশন করেছি, বাবা স্পষ্ট তোমাদের জানিয়েছিলেন। আমরা তোমাদের পায়ে পড়িনি বিয়ে দেবার জন্য, বরং তোমার দাদু আর জেঠুই আমাদের বনেদি পরিবার দেখে বিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিলেন৷তখন তো বুঝিনি এ আসলে ছোটোলোকের পরিবার…! এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে অনিতা হাঁপাতে থাকে।

অনিতা মুখ সামলে কথা বলো নয়তো…

প্রথমবার তিন্নি বাবাকে মায়ের গায়ে হাত তুলতে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেল। এর আগে বাবা কখনও মায়ের গায়ে হাত তোলেনি।

বাবা, তুমি মায়ের গায়ে হাত তুলতে পারো না। তুমিও অদ্ভুত,মা-কে কষ্ট দেওয়াটা কি খুব দরকার ছিল?

তুই এখনও মায়ের হয়েই কথা বলবি?যে আমার পরিবারকে অপমান করে!তোর মা বাংলা মিডিয়ামের মেয়ে৷ ইংলিশে দুটো শব্দও ঠিকমতো বলতে পারে না, অনিমেষের গলার তিক্ততা তিন্নিকে ভিতর থেকে নাড়িয়ে দিয়ে গেল।

তিন্নিও চুপ করে থাকতে পারল না, বাবা, তুমি মায়ের ইংরেজি না বলতে পারাটাকে সবসময় এত কেন গুরুত্ব দাও? মায়ের মধ্যে এমন অনেক গুণ আছে যা, আমার কোনও বন্ধুর মায়ের মধ্যে নেই।

মুহূর্তের মধ্যে তিন্নির সব আনন্দ মাটি হয়ে গেল। জল ভরা চোখে তিন্নি বালিশ, চাদর নিয়ে আবার নিজের ঘরে ফিরে গেল।

অনিমেষ অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করেছিল আর অনিতা বর্ধমান ইউনিভার্সিটি থেকে ইতিহাসে এমএ। হয়তো এই শিক্ষাগত যোগ্যতার তফাতই তাদের দুজনের মধ্যে প্রাচীর হয়ে উঠেছিল।

তিন্নি খেয়াল করত, বাবা রেগে গেলে মা-কে অন্য নামে ডাকে। এমনিতে অনিমেষ নিতা বলেই সম্বোধন করত। কিন্তু অতিরিক্ত রেগে গেলে অনিতা-ই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে। এছাড়াও ইডিয়েট, গবেট, গাঁইয়া, এগুলোর ব্যবহারও বেড়ে যায়। ছোটোবেলায় বাবার মা-কে ডাকা থেকেই, তিন্নি বুঝে যেত বাবার মুড আজ কীরকম।

মার্চ মাসেই প্রচণ্ড গরম, সকলের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠছিল। পরীক্ষার টেনশন গরমের অস্বস্তি দ্বিগুন করে তুলেছিল। বারো ক্লাসের বোর্ডের পরীক্ষার জন্য তিন্নি সারা দিনরাত পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকত। সকালে কোচিং ক্লাস শেষ করে, টিউশন নিয়ে বিকেল হয়ে যেত বাড়ি ফিরতে। জলখাবার খেয়ে আবার বই মুখে পড়তে বসা। মা-বাবার সঙ্গেও সময় কাটাতে পারত না তিন্নি।

রবিবার দিন একটু সকাল সকাল ঘুম ভাঙতে তিন্নি উঠে সোজা ডাইনিং হলে চলে এল। লক্ষ্য করল ডাইনিং টেবিলের উপর থার্মোমিটারটা রাখা।

মাম্মা, থার্মোমিটার কীসের জন্য? কার আবার কী হল? চিন্তিত স্বরে মাকে প্রশ্ন করল তিন্নি।

তোর বাবার কাল রাত থেকে প্রচণ্ড জ্বর। সারারাত প্রচণ্ড কাশি। রাত্রে এক ফোঁটাও কেউ আমরা ঘুমোতে পারিনি।

সে-কী এত কাশি কীভাবে বেড়ে গেল? ডাক্তারকাকুকে ফোন করেছ? চলো একবার, আমরাই পাড়ার ডাক্তারখানায় নিয়ে যাই।

তোর বাবা কী বাচ্চা, যে-কোলে করে নিয়ে গেলে তবে যাবে? অনেকবার বলেছি যাওয়ার কথা, কানে তুললে তো, অনিতা মেয়ের কাছে অভিযোগ করে।

মা তুমিও! এই সময় বাবার এত জ্বর আর তুমি… মানছি সারা রাত তোমার টেনশনে কেটেছে। তাও সব কথার একটা সময় থাকে। এখন এসব ছাড়ো, বাবাকে আগে ডাক্তার দেখানো দরকার৷ কথা শেষ করে তিন্নি বাবাকে দেখতে শোবার ঘরে চলে যায়।

তিন্নির অবস্থাটা অনেকটা পেন্ডুলামের মতো। কখনও মাকে সাপোর্ট করতে হয় তো কখনও বাবার হয়ে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া করতে হয়। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি বদলালেও, তিন্নির মনে হতো ওর বাড়ির পরিবেশ সেই একই। ঝগড়া আর ডিপ্রেশনে ভরা। ও বেশ বুঝতে পারত ওর জন্যই মা-বাবার সম্পর্কটা আজও জোড়াতালি দিয়ে চলছে।

সেদিন তিন্নির বোর্ডের লাস্ট পেপার। খুব হালকা লাগছিল নিজেকে। প্রায় চার মাস পরে একটু স্বস্তি। রেজাল্ট নিয়ে এতটুকুও টেনশন ছিল না ওর। অনেকদিন পর মা-বাবার সঙ্গে ডিনার টেবিলে মুখোমুখি হল তিন্নি। অনিতাও মেয়ের পছন্দের প্রতিটি রান্না নিজের হাতে করেছিল।

বাবার দিকে তাকাল তিন্নি, বাবা, আমি তোমাদের কিছু বলতে চাই, তিন্নির গম্ভীর মুখ দেখে অনিতা এবং অনিমেষ দুজনেই একটু শঙ্কাবোধ করল।

হ্যাঁ, কী বলবি মা বল, অনিমেষ ধীর কণ্ঠে মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু নিজে কী ভাবছে তা মেয়েকে বুঝতে দেয় না।

তিন্নি নিজেকে কিছুটা গুছিয়ে নেয়। অনেক দিন ধরেই এটা নিয়ে অনেক ভাবনা-চিন্তা করেছে ও। আজ সামনাসামনি বলার সময় হয়েছে। খুব আস্তে গলায় তিন্নি বলল, বাবা, আমি কলকাতার বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করতে চাই। হায়ার স্টাডিজ-এর জন্য দিল্লি কিংবা মুম্বই যেতে চাই।

কিন্তু এখানেও তো ভালো ভালো কলেজ আছে। তুই যদি চাস ইঞ্জিনিয়ারিং আর ডাক্তারির পরীক্ষাগুলোতেও বসতে পারিস, অনিমেষ মেয়েকে বোঝাবার চেষ্টা করে।

হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছ বাবা। কিন্তু দিল্লি, মুম্বইয়ে কলেজগুলোর মান আরও ভালো।

কিন্তু তুই-ই তো বলেছিলি গ্র্যাজুয়েশন এখান থেকে পাশ করে পরে বিদেশে গিয়ে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করবি। হঠাত্ মাইন্ড চেঞ্জ করার কারণটা জানতে পারি?

অনিমেষের জিজ্ঞাসায় দুশ্চিন্তা স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠল। শত চেষ্টাতেও সে সেটা লুকোতে পারল না।

হঠাত্ সবাই চুপ করে খাওয়ায় মন দিল। সারা ঘরে নিস্তব্ধতা ছেয়ে গেল। তিন্নির মনে হল মা-বাবার ঝগড়ার পরেও, বাড়ি এরকমই নিঃঝুম হয়ে পড়ে, কিন্তু আজ রাতের এই স্তব্ধতা একেবারেই যেন অন্যরকম। শুধু দেয়াল ঘড়ির টিকটিক শব্দটাই কানে আসছিল তিন্নির।

মা-বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছুতেই গলা দিয়ে খাবার নামাতে পারল না তিন্নি। পৃথিবীতে এই দুজন ছাড়া আর কেই বা আছে ওর। টেবিল থেকে উঠে থালা নামিয়ে রাখল। ওয়াশবেসিনে হাত ধোয়ার বাহানায় চোখের জলও মুছে নিল তিন্নি। আয়নায় চোখ রেখে দেখল মা-বাবা ওর দিকেই তাকিয়ে রয়েছে। চোখে গভীর অনুনয়,আকুতি।

আজ বুঝতে পারছি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী কোথায় এগিয়ে গেছে। এমনকী আমাদের একমাত্র মেয়ে এই স্রোতে গা ভাসানো থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারল না, অনিমেষের গলা ধরে এল।

অনিমেষ, এই সবই হয়েছে মেয়েকে অতিরিক্ত মাথায় তোলার জন্য। আরও ওর সঙ্গে বসে তোমার হস্টেল লাইফের গল্প শেয়ার করো। তুমি তো এটাই চেয়েছিলে, তোমার মেয়ে তোমার মতো স্মার্ট হোক। ভালোই হল তিন্নি সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে নিজের স্বাধীনতাকেই গুরুত্ব দিল, আমাদের কথা একবার ভেবেও দেখল না, অনিতা নিজেকে আর সামলাতে পারল না। চোখের জল গড়িয়ে পড়ল তার দুই গাল বেয়ে৷

অনিতা আর অনিমেষের কিছু কথা তিন্নি-রও কানে ঢুকেছিল। অনিতার দুটো চোখ ফুলে উঠেছিল কাঁদতে কাঁদতে। কিন্তু কিছুই করার ছিল না ওদের। তিন্নির পুরো ভবিষ্যত্ এটার উপরেই নির্ভর করছিল।

তিন্নি সেদিন বেরিয়েছিল বাড়ি থেকে ক্লাস টেন আর টুয়েলভ-এর রেজাল্ট, মার্কশিট সব ফটোকপি করার জন্য। দোকানে গিয়ে খেয়াল করল ক্লাস টেনের মার্কশিট-টা আনা হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে ফোন করতেই অনিতা ফোন ধরল, মা, আমার আলমারির থার্ড তাকে দ্যাখো একটা ব্রাউন রঙের ফাইল রয়েছে। ওটাতে আমার ক্লাস টেনের মার্কশিট-টা রাখা আছে। ওটার ছবি তুলে এক্ষুনি পাঠাও।

ছবি তুলে মেয়েকে পাঠিয়ে দিয়ে অনিতা খেয়াল করল, সযত্নে একটি গোলাপি রঙের ডায়ারি রাখা আছে কাগজপত্রের সঙ্গে। হাতে নিয়ে পাতা ওলটাতেই তিন্নির মুক্তোর মতো হাতের লেখা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল।

অনেক চেষ্টা করলাম সুন্দর স্বপ্নটাকে বাস্তব রূপ দিতে কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই স্বপ্নটা ভেঙে চুরমার হয়ে চোখের সামনে গুঁড়িয়ে গেল হয়তো আমি এখান থেকে চলে গেলেই মাবাবার একাকিত্বই ওদের দুজনকে একে অপরের কাছে নিয়ে আসবে শত কষ্ট হলেও আমি এই ডিসিশন নিতে বাধ্য হয়েছি আমি জানি মাবাবা কষ্ট পাবে, তবুও আমাকে শক্ত থাকতেই হবে এছাড়া আমার কাছে আর অন্য কোনও রাস্তা খোলা নেই

লেখার শেষে তিন্নি নিজের নাম লিখে রেখেছে আর তারিখটা হল ১৫ জুন অর্থাত্ তিন্নির জন্মদিনের তারিখ।

সঙ্গে সঙ্গে অনিতার মনে পড়ে গেল সে রাতের কথা। সত্যি নিজেকে বড়ো নির্দয় মনে হল অনিতার। মা হয়ে সন্তানের কষ্টটা বুঝল না সে। নিজের ইগো-র জন্য স্বামীর সঙ্গে সবসময় তর্ক চালিয়ে গেছে অথচ একবারও ভাবেনি মেয়ের উপর এর কী এফেক্ট হচ্ছে।

অন্য আর একটি পাতায় তার নজর আটকাল। সেখানে তিন্নি লিখেছে, আজ কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ঘুমোবার আগে টয়লেট যেতেও ভুলে গিয়েছিলাম। সকালে ঘুম ভাঙতে দেখি বিছানা ভিজে। এবার মা-কে কী উত্তর দেবো?

পড়ে অনিতা অবাক হয়ে গেল। তিন্নির কষ্ট, চোখের জল ডায়ারির প্রত্যেকটা পাতায় ফুটে উঠেছে। যে-বয়সে মেয়েদের রোমান্টিক কবিতা, নভেল ইত্যাদি পড়ার কথা, সেই বয়সে তিন্নির প্রতিটা লেখায় গভীর দুঃখ। আজ যদি ডায়ারিটা তার হাতে না পড়ত, তাহলে কোনও দিন অনিতা জানতেও পারত না, মেয়ে বাইরে ভিন্ন শহরে পড়তে যাওয়ার আসল কারণটা।

অনিতা তিন্নির জিনিস আলমারিতে তুলে রেখে সঙ্গে সঙ্গে অনিমেষকে ফোন করে, শুনছ, আজ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরো। তিন্নি ফিরবে পাঁচটা নাগাদ, তুমি তার আগে এসে যেও। দরকারি কথা আছে, বলে ফোন কেটে দেয়।

চারটের আগেই অনিমেষ ফিরে এল। কেন এত জরুরি তলব? অনিতার মুখোমুখি হতেই অনিমেষ বলল, আমি জানি অনিতা, তুমি নতুন একটা ফ্রিজ কিনতে চাও। কিন্তু এই মুহূর্তে, সবথেকে জরুরি হল তিন্নির কলেজে অ্যাডমিশন।

ফ্রিজ পরে হবে, চলো ধীরে সুস্থে বসে কথা বলি। আমিও তিন্নিকে নিয়েই কিছু বলতে চাই, ধীর কণ্ঠে অনিতা বলে।

অনিমেষ একটু অবাক হয়। জীবনে এই প্রথমবার অনিতার সঙ্গে তার মতের মিল হল। অনিমেষ এসে চেয়ারে বসতেই, অনিতা তিন্নির ডায়ারিটা অনিমেষের হাতে দেয়। দ্যাখো পড়ে, এটা তিন্নির ডায়ারি।

অনিমেষ একটার পর একটা পাতা ওলটাতে শুরু করে। তিন্নির মনটা খোলা পাতা হয়ে অনিমেষের চোখের সামনে উঠে আসে। কবে মেয়ে এত বড়ো হয়ে গেল! অনিমেষ ভাবতে থাকে। তার মুখের ভাব পরিবর্তন অনিতারও চোখ এড়াল না।

আমরা তিন্নি সম্পর্কে কতটা ভুল ভাবছিলাম। এরকম দুঃখ নিয়ে আমরা কখনওই ওকে বাইরে যেতে দিতে পারব না। অনিমেষ নিজের মোবাইল বার করে তিন্নিকে মেসেজ পাঠায়, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য।

কী ব্যাপার বাবা, তুমি আজ এত তাড়িাতাড়ি বাড়ি ফিরে এলে। আমাকেও দেখলাম মেসেজ করেছ, তিন্নি উত্তেজিত স্বরে বলে বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে।

হ্যাঁ রে, দ্যাখ এই কবিতাটা তোকে নিয়ে লিখেছি। নাম দিয়েছি রঙিন প্রজাপতি। কেমন হয়েছে একটু দেখ তো। তোর মা-তো বলল, আমার লেখার হাত বেশ ভালোই।

তুমি আবার কবে থেকে কবিতা লেখা শুরু করলে বাবা? আগে কখনও তো তোমাকে কবিতার বইও খুলে পড়তে দেখিনি, লেখা তো অনেক দূরের ব্যাপার। হাসতে হাসতে বাবাকে জড়িয়ে ধরে তিন্নি। অনিতাও পিছন থেকে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে। তিন্নি উই আর ভেরি সরি,আজ আমাদের কারণেই তুই বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিস৷ কথাটা বলতে গিয়ে অনিতার গলা ধরে আসে।

তিন্নি এক মুহূর্ত চুপ করে থাকে৷ তারপর চোখে দুষটুমির হাসি নিয়ে বলে,এ মা না না, ক্ষমা তো আমার চাওয়া উচিত। আমিই বোকা বানিয়েছি তোমাদের।

তার মানে? অনিতা আর অনিমেষ একসঙ্গে বলে ওঠে।

মানে সোজা রাস্তায় কাজ না হলে, বাঁকা রাস্তা ধরতে বাধ্য হতে হয়। এত সহজে তোমরা আমার থেকে মুক্তি পাচ্ছ না। হ্যাঁ একটাই আফশোস যে, আমার পার্সোনাল ডায়ারি তোমাদের সঙ্গে শেয়ার করতে হল। তবে কিছু পেতে গেলে হারাতেও তো হয় কিছু, তাই না মা?

ওঃ! তাহলে তোর বাইরে গিয়ে পড়ার ব্যাপারটা পুরোটাই নাটক ছিল? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করে।

সরি বাবা, তোমাকে আর মা-কে কাছাকাছি আনার জন্য এই একটাই রাস্তা আছে বলে আামার মনে হয়েছিল, নিজের কান ধরে বলে তিন্নি।

অনিমেষ বোধহয় এই প্রথমবার নিজের ভুল বুঝতে পারেন৷ বলেন, না-রে মা, দোষ তোর নয়। আমরাই অন্যায় করেছি, তাই কান আমাদেরই ধরা উচিত, অনিমেষ হেসে বলে।

চলো তাহলে এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের স্মৃতি ক্যামেরাবন্দি করা যাক, বলে তিন্নি নিজের মোবাইলে মা-বাবার সঙ্গে সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আজ এই ছবিটা সে বন্ধুদের সঙ্গে ইনস্টাগ্রাম-এ শেয়ার করবে আর ক্যাপশন দেবে ‘রঙিন প্রজাপতি’।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...