গভীর খাদের গা ঘেঁষে এগিয়ে চলা, পদে পদে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ হাঁটার রোমাঞ্চ! বর্ষাকালে পাহাড় দর্শনের ঝুঁকি নেন না অনেকে। কিন্তু প্রকৃতি-প্রেমিকরা ঝুঁকি নিয়েই পাড়ি জমান পাহাড়ে। ভয়ংকরের মধ্যে খুঁজে পান অপরূপ সৌন্দর্য। হঠাৎ এমনই এক ইচ্ছে জেগেছিল মনে। আর এই ইচ্ছেকে আরও উসকে দিয়েছিল গুজরাত পর্যটন দফতর। গুজরাত সরকারের পক্ষ থেকে সপুতারা মনসুন ফেস্টিভ্যাল উপভোগ করার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম।তাই এবারের গন্তব্য Gujrat-এর একমাত্র Hill station Saputara.

পোরবন্দর এক্সপ্রেস (কবিগুরু সুপারফাস্ট) ধরে তৃতীয় দিনে সকালে নামলাম সুরাট স্টেশনে। কথামতো আমাদের জন্য ইন্ডিকা গাড়ি নিয়ে স্টেশনের বাইরে অপেক্ষা করছিল চালক ভবানী সিংহ। রাজস্থানি যুবক। মাতৃভাষা ছাড়াও, গুজরাতি এবং হিন্দিতে সমান সাবলীল।

গাড়ি স্টার্ট দিল চালক ভবানী। আট নং ন্যাশনাল হাইওয়ে ধরে, নিয়ে চলল সপুতারার তোরণ হিল রিসর্ট-এর উদ্দেশে। হিরে এবং পোশাকের জন্য বিখ্যাত সুরাটের ‘বম্বে মার্কেট’-কে বাঁদিকে রেখে, ছিমছাম রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল গাড়ি। মাত্র দশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতেই, সুরাট শিল্পনগরী পড়ে রইল পিছনে।

দু-রাতের ট্রেন জার্নির ধকল কাটাতে, রোডসাইড ধাবায় নেমে, প্রাতরাশ এবং চা-পান করে আবার উঠলাম গাড়িতে। সাঁইবাবার মন্দির ছাড়াতেই শুরু হল শাল-সেগুনের জঙ্গল। বৃষ্টিস্নাত গাছ-গাছালির সতেজ সবুজ রূপ আর রাস্তার দু’দিকে ফুটে থাকা দোপাটি ফুলের সৌন্দর্য, চোখকে আরাম দিতে শুরু করল। পথে যেতে যেতেই ভবানী জানাল সপুতারা-র মর্মার্থ।

আসলে একসময় নাগরাজাদের বাসভূমি ছিল এই পাহাড়ি অঞ্চল Saputara। সেই থেকেই স্থানীয় ভাষায় ‘সপুতারা’(মতান্তরে সাপুতারা) নামকরণ।কথা বলতে বলতেই ভবানী গাড়ি থামাল বাঁশদা ন্যাশনাল পার্কের গেটের সামনে। হাতে সময় কম থাকায় পার্কের গভীরে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। অবশ্য তার মধ্যেই লোহার উঁচু জালের ওপারে চোখ রাখতেই নজরে এল ময়ূর-ময়ূরী, হরিণ, বানর, সজারু প্রভৃতি। গাছের ডালে দেখা মিলল নানা জানা-অজানা পাখিরও।

আবার গাড়ি এগিয়ে চলল পাহাড়ি জঙ্গলের বুক চিরে। বৃষ্টিস্নাত পাহাড়ি রাস্তার সোঁদা গন্ধ নিয়ে এগিয়ে চলতে চলতেই, রুপোলি ঝরনার জল গায়ে লাগল। আবেগে উল্লাসে মাঝেমধ্যে গাড়ি থেকে নেমে, সপুতারার অপরূপ দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করার সুযোগ নিচ্ছিলাম। তবে শুধু ছোটোবড়ো ঝরনাই নয়, সুরাট থেকে সপুতারামুখী ১৮০ কিলোমিটার পথে, চোখে পড়েছে অসংখ্য নদ-নদীও। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সর্পগঙ্গা এবং অম্বিকা নদী। জঙ্গল, ঝরনা আর নদীকে পিছনে রেখে, ঘন্টা তিনেক বাদে পৌঁছোলাম তিন হাজার ফুট উঁচুতে অবস্থিত তোরণ হিল রিসর্ট-এ।

আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল সপুতারা পাহাড়ি বাংলোয়। আনন্দে থাকার এক অসাধারণ বাসস্থান। বাংলো থেকে তিন হাজার ফুট নীচে অবস্থিত পাহাড়ি গ্রামে আলোছায়ার খেলা ছিল দারুণ উপভোগ্য।

বাংলোর অনতিদূরে অবস্থিত তোরণ রেস্তোরাঁয় সারলাম মধ্যাহ্নভোজ। পিজ পোলাও, ঘি মাখানো তরেলা রুটি, ভুন্ডি (ভেন্ডি), রায়তা, উন্দিয়া, পুরাণপুরি, দই দিয়ে তৈরি কাধি, দই ও ফলের মিশ্রণে তৈরি শ্রীখন্ড, দুধজাত মিঠাই দুধা পাক বা সেভ, সেমাইয়ের মিষ্টান্ন সুতেরফেনি, বাদাম শেক, লস্যি, কাঁচা আমের আচার প্রভৃতি দারুণ সব খাবার ছিল মেনুতে। ভেজ খাবারেরও যে এত রকমফের আছে, এত সুস্বাদু, তারই প্রমাণ পেলাম তোরণ রেস্তোরাঁয় খেয়ে। মধ্যাহ্নভোজের পর খানিক বিশ্রাম নিয়েই বেরিয়ে পড়লাম ভ্যালি ভিউ পয়েন্ট-এ। প্রায় পাঁচ হাজার ফুট উঁচু এই লোকেশন থেকে সূর্যাস্তে পাহাড় দর্শন সত্যিই অবর্ণনীয়।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...