পুষ্টিকর তত্ত্বে ভরপুর বেসন আমরা নানা উপাদেয় খাদ্যসামগ্রী বানাতে সাধারণত ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু এটা হয়তো অনেকরই অজানা যে, বেসন যাকে আমরা গ্রাম ফ্লোর বলে থাকি সেটা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য কতটা উপকারী। প্রোটিনে ভরপুর বেসন আমাদের স্বাস্থ্যের পরিপূর্ণ খেয়াল রাখে এবং নানা ভাবে আমাদের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। এটি যে খালি শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনীয়তার খেয়াল রাখে এমন নয়, রূপচর্চায়ও এটি ব্যবহৃত হয়।

শীতের মরশুমে ত্বকের রুক্ষতা দূর করে ত্বকের কমনীয়তা বজায় রাখে। সুতরাং শরীরের, বাহ্যিক সৌন্দর্যের পুরোপুরি খেয়াল রাখার সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ স্বাস্থ্য বজায় রাখতে বেসন আমরা ব্যবহার করে থাকি। এক কথায় বলা চলে শরীর ফিট এবং সৌন্দর্য ধরে রাখতে বেসন সাহায্য করে। আসুন জেনে নেওয়া যাক কেন ডায়েটে বেসন রাখা জরুরি।

ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে

আধুনিক জীবনশৈলীর কারণে আগের তুলনায় এখন আরও বেশি করে স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। নিউট্রিশনিস্টরাও পরামর্শ দেন যে, ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে ডায়েটে ফাইবার এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার রাখাটা অত্যন্ত প্রয়োজন। এতে শরীরের প্রয়োজনীয়তারও পুরো খেয়াল রাখা যাবে এবং দীর্ঘ সময় খিদে পাওয়ার সমস্যাও রোধ করা যাবে। প্রোটিন এমন একটি তত্ত্ব যা মাংসপেশিকে মেইনটেন করার কাজে লাগে। একই ভাবে বেসন হাই ফাইবার এবং প্রোটিন রিচ হওয়ার জন্য খুব তাড়াতাড়ি ওজন কন্ট্রোল করতে সাহায্য করে।

ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচারাল দ্বারা করা পরিসংখ্যান অনুযাযী ১০০ গ্রাম বেসনে ২২ গ্রাম প্রোটিন এবং ১১ গ্রাম ফাইবার থাকে। এতে কোলেস্টেরল একেবারেই নেই এবং প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম, আয়রন, ভিটামিন বি৬ এবং ম্যাগ্নেশিয়াম রয়েছে। পুষ্টিকর আহারের ভালো বিকল্প হল বেসন।

ডায়াবেটিক ফ্রেন্ডলি

যদি পরিবারে কারও ডায়াবিটিজ থেকে থাকে অথবা বংশানুক্রমে অসুখটি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে রয়েছে তাহলে ডায়েটে বেসন যুক্ত করাটা অত্যন্ত আবশ্যক। কারণ এতে রয়েছে কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেটস এবং লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স। সুগারের রোগীদের জন্য এই দুটি-ই অত্যন্ত লাভদায়ক। এছাড়াও এতে রয়েছে ফাইবার এবং ম্যাগ্নেশিয়াম, যেটা কিনা শরীরের ইন্সুলিন রেসপন্স-কে বাড়াতে সাহায্য করে। শরীরে যখন ম্যাগ্নেশিয়াম-এর মাত্রা খুব কম হয়ে যায় তখন অগ্ন্যাশয়, প্রয়োজনীয় মাত্রাতে ইন্সুলিন তৈরি করতে পারে না। এর ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। বেসন এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে।

 হার্ট-এর স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখে

ভারতে প্রতি বছর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। এটি এখন ধীরে ধীরে মৃত্যুর প্রাথমিক কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৬-তে গ্লোবাল বার্ডেন অফ ডিজিজ-এর রিপোর্ট অনুসারে ভারতে হৃদরোগে মৃত্যুর সংখ্যা ১৭ লক্ষ এবং বিশ্বে এই সংখ্যাটি হল ১.৭৩ কোটি। এই পরিস্থিতিতে হার্টের বিশেষ যত্ন নেওয়া খুবই প্রয়োজন। হার্ট হেলদি রাখতে হলে ডায়েটে বেসনের পরিমাণ বাড়ান কারণ এতে সলিউবল ফাইবার থাকায় হার্টের জন্য খুবই উপকারী। এটি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখার সঙ্গে সঙ্গে পেটজ্বালা এবং অ্যাসিডিটির সমস্যাতেও আরাম এনে দেয়। বেসনে যে ফাইবার থাকে সেটি কোলেস্টেরল লেভেলকে কন্ট্রোলে রেখে ব্লাড সার্কুলেশন উন্নত করে হার্টের স্বাস্থ্যের সম্পূর্ণ খেয়াল রাখতে সহায়ক। এর ফলে হার্টের সঙ্গে যুক্ত যে-কোনও অসুখ থেকে সুরক্ষিত থাকা যায়।

অ্যালার্জির ভয় থাকে না

অনেকেরই নানা খাদ্যসামগ্রী থেকে অ্যালার্জির সমস্যা হয়ে থাকে। ডাক্তাররা সাধারণত নানা ধরনের শস্যদানা খেতে বারণ করে দেন বিশেষ করে যাদের অ্যালার্জি হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। শস্যদানায় গ্লুটোন থাকার ফলে অনেকেরই এগুলো সহ্য হয় না। এটাও এক ধরনের প্রোটিন, যেটা সাধারণত সবরকম শস্যদানায় পাওয়া যায়।

বেসন একমাত্র গ্লুটোন ফ্রি হয়। তাই বেসন খেলে অ্যালার্জি হওয়ার ভয় থাকে না। সুতরাং যাদের গ্লুটোন সমস্যা রয়েছে তারা বেসনের রুটি বা চিলা বানিয়ে খেয়ে আটার রুটি খাওয়ার ইচ্ছাটাকে পূরণ করতে পারেন। এতে শরীরের ওজনও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও বেসন সাহায্য করে এবং শরীরকে সবরকম নিউট্রিযে্ন্তস-এর পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ করতেও সহায়তা করে।

ব্রেস্ট ক্যান্সার হওয়ার ভয় কমে যায়

ভারতে গ্রাম, মফস্সল কিংবা শহর, সর্বত্রই ক্যান্সারের প্রকোপ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ততীয় কিংবা চতুর্থ স্তরে গিয়ে ক্যান্সার যখন ধরা পড়ে তখন চিকিৎসার জন্য অনেকটাই দেরি হয়ে যায়। ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন-এর একটি সমীক্ষা অনুসারে ২০১৮-তে ৬ লক্ষেরও বেশি মহিলার ব্রেস্ট ক্যান্সারে মৃত্যু হয়েছে। এই সংখ্যা যথেষ্ট চমকে দেবার মতো। সচেতনতা বাড়াবার সঙ্গে সঙ্গে ডায়েটে পরিবর্তন নিয়ে এসে এই মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কম করা যেতে পারে।

ঘুমোতে সাহায্য করে

ভালো শরীর স্বস্থ্যের সঙ্গে ভালো ঘুম হওয়ার একটা নিবিড় সংযোগ আছে। কারণ পর্যাপ্ত ঘুম হলে মনও ভালো থাকে, কাজেও মন বসে। আমাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে ঘুমের সরাসরি যোগ থাকার ফলে কাজের প্রোডাক্টিভিটি-তেও তার প্রতিফলন ঘটে। সেজন্য ৮ ঘন্টার ঘুম খুবই দরকার। ভালো ঘুমের সঙ্গে সঙ্গে ডায়েটেও এমন জিনিস শামিল করা উচিত যেটা আমাদের ভালো ঘুম হতে সাহায্য করবে।

১০০ গ্রাম বেসনে নিউট্রিশন ভ্যালু

এনার্জি      ৩৭২ ক্যালোরিজ

প্রোটিন      ২০.৮ গ্রাম

আয়রন      ৫.৬ গ্রাম

কার্বোহাইড্রেট  ৫৯.৮ গ্রাম

ফাইবার      ৮.৩ গ্রাম

সোডিয়াম    ৬৪ মিলিগ্রাম

পটাশিয়াম    ৬৪১ মিলিগ্রাম

ফ্যাট       ৫.৬ গ্রাম

ম্যাগ্নেশিয়াম   ১৬২ মিলিগ্রাম

ভিটামিন বি৬ ০.৪৯ মিলিগ্রাম

পুষ্টিগুণে ভরপুর বেসনও ভালো ঘুম হতে সাহায্য করে। এতে অ্যামিনো অ্যাসিড, ট্রিপটোফ্যান, সেরোটোনিন তত্ত্বগুলি রয়েছে যেগুলি কিনা ভালো ঘুমের জন্য জরুরি তত্ত্ব বলে মনে করা হয়। ট্রিপটোফ্যান শান্ত থাকতে সহায়তা করে এবং সেরোটোনিন ভালো ঘুমের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

গর্ভাবস্থায় অত্যন্ত উপকারী

বেসনে ভরপুর মাত্রায় ফলেট, আয়রন এবং ভিটামিন বি৬ থাকে যেগুলি শিশুর গ্রোথ-এর জন্য কার্যকারী। গর্ভের সন্তানের সম্পূর্ণ বিকাশের জন্য ফলেট ভিটামিন অত্যন্ত জরুরি। এতে থাকা ক্যালসিয়াম, গর্ভবতী মহিলাদের হাড় মোটা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাকে কম করে। বহু সমীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে গর্ভাবস্থাকালীন যদি মহিলারা সঠিক মাত্রায় ভিটামিন বি৬ খেতে থাকেন তাহলে গর্ভস্থ শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ এবং ইমিউন সিস্টেম স্ট্রং হয়। এছাড়াও মহিলাদের মধ্যে বমির ভাব কম হয়ে আসে। সুতরাং প্রেগন্যান্ট মহিলাদের ডায়েটে রোজ ৪০ গ্রাম করে বেসন অবশ্যই রাখা উচিত। এটি শরীরকে প্রয়োজনীয় নিউট্রিযে্ন্তস দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গর্ভপাত হওয়ার সম্ভাবনাকেও কম করে।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...