পাবলিশারের দফতর থেকে এক কপি একটুকরো আকাশ সবেমাত্র হাতে পেল আঁচল। বইটা নাড়াচাড়া করতে করতে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিল। কবি তোর্সা বসু নামটা ছাপার অক্ষরে দেখে চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে। নিউ সার্কুলার রোডের নতুন সাজানো ফ্ল্যাটটা যতই আপন হোক, সে আর সুতীর্থ বিয়ের পর প্রথম সংসার পেতেছিল মালিনী নিবাস-এই। ভাড়া বাড়ি হলেও আজও কেন জানি বড্ড নিজের!
মালিনী রায়চৌধুরী বছর ষাটের ডাকসাইটে সুন্দরী। স্বামী বেণুলাল রায়চৌধুরী অবসরপ্রাপ্ত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মী। ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে হাতে খবরের কাগজ নিয়ে তাঁর দিন কাটে। এক গেলাস জল গড়িয়ে খাবার অভ্যাস কোনও কালেই নেই। সারাজীবনে, যা কিছু সঞ্চয় করেছেন, তার রক্ষনাবেক্ষণের দাযিত্ব স্ত্রী মালিনীদেবীর হাতে ন্যস্ত করে তিনি নিশ্চিন্ত। এসব মাথায় রাখা মানেই তো উর্বর মস্তিষ্ককে কষ্ট দেওয়া। অতএব, জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই সামলাতে হয় মালিনীদেবীকেই। নিন্দুকেরা বলে, মালিনীদেবীর শ্যেন দৃষ্টি এড়িয়ে একটি পিঁপড়েরও প্রবেশাধিকার নেই মালিনী নিবাস-এ। যদি বা আচমকা প্রবেশ করে ফেলে, তত্ক্ষণাৎই মালিনীদেবীর সম্মার্জনী আঘাতে তার ভবলীলা সাঙ্গ হয়।
বেশ মনে পড়ে আঁচলের, যারা মালিনী নিবাস-এ বাসন সাফাই আর কাপড় ধোয়ার দাযিত্বে বহাল হতো, তাদের মুখগুলো দিন কুড়ি পর পর বদলাতে থাকত। কারও তেল চিটচিটে বাসন ধোয়া তো কেউ কাপড় নিংড়ানোর কোনও ছিরি জানত না। মাঝে একবার মালিনীদেবীর তীব্র হাঁটু ব্যথার দরুন, একমাসের জন্য যে-কজন রন্ধনশিল্পী বহাল হয়েছিল তাদের কারওরই মালিনীদেবীর মাপ করা তেল-মশলায় রান্নার পারদর্শিতা ছিল না।
মালিনী নিবাস-এ দুটি প্রাণী। কর্তা ও গিন্নী। অনেক যত্ন নিয়ে বড়ো করেছেন একমাত্র ছেলে অবিনাশকে। সে-ও বদলি নিয়ে ভিনরাজ্যের বাসিন্দা। তার স্ত্রী তিতির সাফ জানিয়েছে, মালিনী নিবাস-কে ধুলোমুক্ত করার জন্য সে পৃথিবীতে জন্মায়নি। তার করার মতো অনেক কাজ রয়েছে।
মাঝে মাঝে ছুটিছাটায় একবেলার জন্য অবিনাশ আসত। কিন্তু স্ত্রী, পুত্র শ্বশুরালয়ে থাকায় অবিনাশের বিশেষ থাকা হতো না। এতে মালিনীদেবীর বিশেষ ভ্রুক্ষেপ নেই।
তেল-নুন-লকড়ি নিয়ে তিনি দিব্যি আছেন। বরং এ যেন একদিকে ভালোই। অন্যের আজেবাজে কাজ তার বরাবরই না-পসন্দ। খালি মাঝে মাঝে এক মাত্র নাতি তাতানের জন্য ভেতরটা হু হু করে এই যা! সাধ করে জিভেগজা, খুরমা, আচার বয়ম ধরে বানিয়ে রোদে দেন। সংরক্ষণ করেন, যদি কখনও তার দাদুভাই আসে! কিন্তু কালের নিয়মে একসময় তাতে ছাতা ধরে। তবু মালিনীদেবী প্রাণে ধরে কাউকে দিতে পারেন না।
মালিনী নিবাস-এর একমাত্র ভাড়াটে সুতীর্থ বসু আর তার ছোট্ট ছেলে বাবিনের প্রতি মালিনীদেবী বরাবরই স্নেহশীলা। কিন্তু সুতীর্থর বাউন্ডুলে লেখিকা বউ, আঁচলের উড়নচণ্ডী স্বভাব দেখে রেগে গজগজ করে বলতেন, মেযোনুষের অত সংসার ফেলে বাউন্ডুলেপনা ভালো লাগে না বাপু! বলি পাতাকে পাতা হিজিবিজি লিখলে সংসারের কোনও উপকার হয়? তার চেয়ে ঝুলগুলো তো একটু ঝাড়তে পারে? নেহাৎ পড়েছিল অমন ভালো ছেলেটার হাতে! আহা গো, বাচ্চাটা কেমন শুকনো মুখে ঘুরে বেড়ায়!
প্রতিদিনের মতোই একদিন মালিনী নিবাস-কে ধুলোমুক্ত করতে করতে, সেরিব্রাল অ্যাটাকের শিকার হয়ে শয্যাশাযী হলেন মালিনীদেবী। বাঁ দিকটা কোনও জোর নেই। ভাগ্যিস আঁচল এসে ধরেছিল, নইলে সে যাত্রা ফিরতেন না। সবই অদৃষ্ট নইলে কে ভেবেছিল, তার মতো দাপুটে মহিলাকেও কাজের মাসি আর আয়াদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে।
এদিকে পিঁপড়ে, আরশোলা, ছুঁচো মনের সুখে বাসা বেঁধেছে মালিনী নিবাস-এ। বেণুলাল খুব একটা এদিকে আসেন না। রোগীর ঘরে আসতে তাঁর গা ঘিনঘিন করে। পরিচিত কেউ যদি জিজ্ঞেস করত, মাঝে মাঝে ভুলেই যান, ডান না বাঁ কোন দিকে অসাড় মালিনীদেবীর। না এসব করলেও বেণুবাবু যথেষ্ট কর্তব্যবান। কারণ চিকিৎসা ও পরিচর্যার যাবতীয় আর্থিক ভার তো তাঁরই। শুধু শুধু খোঁজ নিতে গিয়ে নিজের সুস্থ শরীরকে অসুস্থ করে বিপদ বাড়ানো বই-তো নয়!
বিশেষ কেউ আসে না মালিনীদেবীর ঘরে। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মৃত্যু তাঁর কাছে অনেক স্বস্তির। অবিনাশ একবেলার জন্য এসেছিল। চোখ ফেটে জল আসে মালিনীদেবীর। সামনে আলমারীর ওপরে তাঁদের বিয়ে ছবি। আজ পঁয়ত্রিশ বছর ধরে বেঢপ বেণুলালের সঙ্গে নিজের জুটিটাকে মানানসই করতে, নিজেকে ভেঙেচুরে ফেলেছেন সেই কবেই! এই পুতুল খেলার নেশার মতো সংসারের নেশায় বুঁদ হয়ে সব কষ্ট ভুলেছেন। নয়তো এই স্বার্থপর, বাতিকগ্রস্ত, বদমেজাজি লোকটার সঙ্গে থাকতেন কীভাবে? মাঝে মাঝে বিভিন্ন মহিলা কলিগের সঙ্গে মাখোমাখো গল্প কানে এসেছে। শুনেও শোনেননি, বুঝেও বোঝেননি। সব কষ্ট থেকে পালানোর একটাই জায়গা ছিল। আজ আর সেটাও রইল না।
ও মাসি আমি কিন্তু ফল, হরলিক্স আনিনি, এই দ্যাখো বকুল ফুল। খুশি? বলেই হেসে ওঠে আঁচল। আঁচলের চুলের শ্যাম্পু আর পারফিউমের গন্ধে সতেজ লাগে মালিনীর। পর্দা সরাতেই ঘরে একরাশ রোদ্দুর হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল।
এই দ্যাখো মাসি আমার মোবাইলে, একি! মাসি তুমি কাঁদছ?
চাঁপা কলির মতো আঙুল দিয়ে চোখ মুছিয়ে দিয়ে আঁচল স্বভাবসুলভ ভাবে বলে চলে, এটা ওয়ে ম্যাগাজিন। আমি এডিটর। সেদিন কাগজওয়ালার পুরোনো খবরের কাগজের স্তূপে, তোমার কবিতার খাতাগুলো পাই। মেসো মনে হয় বোঝেননি। আমি কিন্তু আরও ছাপব মাসি! আসলে তুমি যতই খিটখিট করো, আলমারী ঠাসা রবীন্দ্র রচনাবলীর সম্পূর্ণ সেট আর ঝাড়ু দিতে দিতে রবিবাসরীয় পড়া দেখেই বুঝেছিলাম।
ফ্যালফ্যাল করে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন মালিনীদেবী। আঁচল বলে চলে, বারীন সেনের মতো লেখক তোমার বন্ধু? উনি পড়ে নিজে আমায় ফোন করেছেন। ভাবতেই পারছি না! কত বেস্টসেলার লিখেছেন উনি।
ঈষৎ বেঁকে যাওয়া, বলিরেখায় ভরা মুখটায় কে যেন আবির ছড়িয়ে দিল। লাজুক হেসে একটু জড়ানো স্বরে বলে চলেন, এক কালে বারীনদার সাথে কত চিঠি, কবিতা দেওয়া-নেওয়া হয়েছে। মামার সংসারে মানুষ তো! বারীনদা তখনও প্রতিষ্ঠা পায়নি। তোর মেসোর ভালো চাকরি। (একটু থেমে) আচ্ছা আঁচল আমি কি আর আগের মতো জোর ফিরে পাব না রে? শুয়ে বসে খুব কষ্ট হয়। আমাকে একটু তোর মতো ফোন দিয়ে টাইপ শিখিয়ে দে না। নতুন করে লিখি।
খুব কষ্ট হয় আঁচলের। জোর করে হেসে বলে, একটু ভালো হও তারপর। এখনও তো অসুস্থ তুমি।
ধুর! আর ভালো হব নাকি! শোন না, আমার এই সোনার চুড়ি দুটো রাখ।
এ মা! কেন?
আরে সে লোক এখন টাকা পয়সা নিজের হাতে করে নিয়েছে। সময় থাকতে সরিয়ে রাখিনি আমিও যেমন! শোন না, কবিতাগুলোর একটা বই করে দিবি মা! এটা দিয়ে হবে তো? আর একটা কথা, কবির নাম দিবি তোর্সা বসু। আমার বাপের দেওয়া ডাকনাম। বাপের পদবী।
তুমি ওটা রাখো মাসি, আমি নিজে করে দেব। চাকরি করি তো না কি! একটু সময় দাও।
শোন না যাবার আগে বাবিন সোনার জন্য আমের আচার নিয়ে যাস কিন্তু।
চোখটা মুছে মোবাইলের গ্যালারি থেকে মালিনী মাসিমার ছবিটা বের করে আঁচল আপন মনেই বলে, আজ বইমেলার ৪ নম্বর স্টলে তোমার এক টুকরো আকাশ থাকবে। তোমার কথা ভুলিনি মাসি, একটু দেরি হয়ে গেল! গুছিয়ে নিতে সময় লেগে গেল।