বাবা যশোদা দুলাল দাস ছিলেন তাঁর গানের প্রথম গুরু। পরবর্তী কালে শাস্ত্রীয় সংগীতের পাঠ নেন সঙ্গীত রিসার্চ আকাদেমি থেকে। জয়পুর ঘরানা এবং কিরানা ঘরানায় শিক্ষা সম্পূর্ণ করে ঠুংরি, দাদরা ও কাজরি শেখেন দীর্ঘদিন। শেখার কোনও শেষ নেই এমনই বিপুল এই সংগীত সমুদ্র, এমনটাই মনে করেন আজকের অন্যতম সফল সংগীতশিল্পী শুভমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বললেন তার জীবনের নানা অনুভবের কথা।
একসময় আপনি তো মালদা থেকে কলকাতায় গান শিখতে আসতেন। সেই সময়ে স্ট্রাগল বা ডেডিকেশনের বিষয়ে কিছু বলুন।
আমার গুরুজি ছিলেন পণ্ডিত উল্লাস কোশলকর। মালদায় বাবার কাছেই আমার গানের হাতেখড়ি। তারপর কলকাতায় শিখতে আসা। হায়ার সেকেন্ডারির পর সংগীত রিসার্চ আকাদেমিতে পরীক্ষা দিয়ে পাস করে ঢুকলাম। তখন থেকেই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে তালিম নিই গুরুজির কাছে। কম্পিটিশনে গাওয়া বা অন্য প্রোগ্রামে, তার অনুমতি দিতেন না তখন গুরুজিরা। ফলে স্ট্রাগল করা বা কেরিয়ার তৈরির কথা তখনও ভাবিনি। শেখার জন্যই পুরোপুরি ডেডিকেশনটা ছিল।
সংগীত শিল্পী হয়ে ওঠার পটভমিকাটা কেমন ছিল?
আসলে ছোটো থেকেই গান শুনতাম। নানা শিল্পীর গান। কমার্শিয়াল গান গাইতে গেলে যে ক্লাসিক্যাল বেসটা থাকা দরকার, সেটা ছোটো থেকেই বুঝতে পারতাম।তারপর ‘সা থেকে সা’ অনুষ্ঠান জয়েন করলাম। নচিদা (নচিকেতা চক্রবর্তী) ওটার অ্যাংকর ছিলেন। ওনার আমার গান ভালো লাগল। উনিই প্রথম আমার অ্যালবাম করলেন। ওঁর করা দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘সাঁঝবেলার গান’ হিট করে গেল। সেই থেকেই চাকা ঘুরতে আরম্ভ করল। জয় সরকার এবং দেবজ্যোতি মিশ্রর সঙ্গে আলাপ হল। তারপর যেভাবে হয় আর কী, কম্পোজার-রা নতুন গানের গলা খোঁজেন, এদিকে শিল্পীরাও চান কারও সুরে অ্যালবাম হোক। এভাবেই পরের পর অ্যালবামগুলো হতে লাগল।
‘সখী হম’ গানটার সময় ঋতুপর্ণ ঘোষের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ হয়েছিল কি? ওই গান তৈরির গল্পটা একটু বলুন।
আসলে ওই গানটা শুরুতে scratch (ডামি) গাওয়াবেন বলে ডেকেছিলেন আমায় দেবুদা (দেবজ্যোতি মিশ্র)। সেটা অবশ্য তখনও আমি জানতাম না। ওটা আশা ভোঁসলে গাইবেন বলে ঠিক ছিল। কিন্তু রেকর্ডিংটা শুনে ঋতুদার (ঋতুপর্ণ ঘোষ) এত ভালো লাগে, ঋতুদা সিদ্ধান্ত নেন যে, এটা আমাদের কলকাতার শিল্পী শুভমিতার গলাতেই থাকবে। তখন দেবুদা ওই গানটার আবার একটা ফাইনাল রেকর্ডিং করান আমাকে দিয়ে তখনই আমি জানতে পেরেছিলাম, প্রথমটা ডামি হিসাবে গাওয়ানো হয়েছিল।
আপনার গলার সঙ্গে লতাজির গলার এত মিল। অনুরাগীরা তো বলেনই– আপনি নিজে কী বলেন?
না না, অনুরাগীরা যা-ই বলুন, লতাজির মতো ওরকম ক্ষমতাসম্পন্ন গলা আর হবে না। আর আমার প্রশংসা আমায় খুব একটা প্রভাবিত করে না, কারণ আমি সামনে থেকে প্রচুর বড়ো বড়ো শিল্পীদের দেখেছি। রবিশঙ্কর-কে দেখেছি, জাকির হুসেনকে দেখেছি, আলি আকবর খাঁ সাহেবকে দেখেছি। বাড়ির সাংগীতিক পরিবেশই বলুন বা সঙ্গীত রিসার্চ আকাদেমিতে ওঁদের অসাধারণ ডেডিকেশন– ওই অত রেওয়াজ, চর্চা, সে সব তো কিছুই করি না আমরা।
আমি তো শুনেছি বড়ো শিল্পীরা নাকি মোমবাতি জ্বালিয়ে ১২ ঘন্টা ধরে রেওয়াজ করতেন। মোমবাতি যতক্ষণ না গলে শেষ হতো, রেওয়াজ চলত। সুতরাং আমাদের বুক বাজিয়ে অহংকার করা সাজে না। ওঁদের নামেই তো উজ্জ্বল হয়েছে দেশ। আমাদের কোনও তুলনাই চলে না ওঁদের সঙ্গে।
বাণিজ্যিক গানের ক্ষেত্রটাতে আমরা এত বেশি মুম্বইয়ের মুখাপেক্ষী কেন? আমাদের এখানে ট্যালেন্ট–এর কি কোনও অভাব আছে বলে আপনার মনে হয়?
আঞ্চলিক ভাষার কারণে আমাদের সর্বভারতীয় স্তরে পাত্তা পেতে অসুবিধা হয়। বাঙালিরা পরস্পরের পাশে দাঁড়ায় না। দক্ষিণী ভাষার শিল্পীদের মধ্যে কিন্তু অসম্ভব জাত্যাভিমান রয়েছে। ওঁরা হিন্দিকে পাত্তাই দেন না। ইল্লায়া রাজার যে ওই অত অত কম্পোজিশন, সে তো দক্ষিণী ভাষাতেই আছে। ওঁরা নিজেদের সংস্কৃতি নিয়ে খুবই গর্বিত। সাউথ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিটা অত্যন্ত সমৃদ্ধ, কোটি কোটি টাকার ট্রানজাকশন হয় ওখানে। ফলে মুম্বই নিয়ে ওঁদের মাথাব্যথা নেই।
এদিকে দেখুন, বাংলায় যত রিয়ালিটি শো হচ্ছে, সেখানেও আমরা হিন্দি গানই বেছে নিচ্ছি। এটা আমাদের ড্র ব্যাক বলেই আমি মনে করি। আমরা হিন্দিটাকেই গ্লোরিফাই করতে ভালোবাসি।
স্বর্ণযুগের শিল্পীদের তুলনায়, এখন আপনাদের কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়?
আমাদের সমস্যাগুলো একটু আলাদা৷ সত্যি বলতে কী, স্বর্ণযুগের শিল্পীরা বাংলা ছবিতে প্রচুর প্লেব্যাক করার সুযোগ পেয়েছেন। বম্বের শিল্পীদের তুলনায় আরতিদি, সন্ধ্যাদি, অরুন্ধতিদি, হৈমন্তীদি, প্রতিমাদি, এঁরা প্রচুর প্লেব্যাক করেছেন এখানে। এসময়ে আর একটা সমস্যা কী বলুন তো? এখন প্রতিটি অকেশন-এ নতুন গান রিলিজ হয়। নববর্ষ, সরস্বতি পুজো, রবীন্দ্রজয়ন্তী, দুর্গাপুজো কিছুই বাদ যায় না। সবেতেই নতুন গান৷ মানুষ কত শুনবে! একটা গান কানে বসার আগেই অন্য গান এসে পড়ে। স্বর্ণযুগে তো আর তা হতো না। শিল্পীরা পুজোতেই গান গাইতেন। এছাড়া শিল্পীদের ওভার এক্সপোজারও জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়ার একটা কারণ।
তৃতীয়ত গান গাওয়াটাকে অনেকেই খুব সহজ মনে করেন। যেন গান গাইতে কোনও শিক্ষা, পরিশ্রম, মনন কিছুই লাগে না। ফলে গানের মান পড়ে যাচ্ছে।
আমাদের শিল্পীদের মধ্যেও একটা কনফিডেন্স-এর অভাব রয়েছে যে, যদি হারিয়ে যাই? এই ইনসিকিউরিটি থেকে কোয়ান্টিটি বাড়াতে সকলে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন।
রিয়ালিটি শো–গুলো থেকে কি সত্যিই ট্যালেন্ট বেরোয়, নাকি ক্ষণিকের চমক?
চমকই বলব, কারণ এরা তো শেষ অবধি হারিয়ে যায়। এদের নিজেদের কোনও গান তো তৈরি হয় না। সুনীধি বা শ্রেয়াও বেশ কিছু বছর আগে রিয়ালিটি শো থেকেই এসেছিলেন। কিন্তু ওঁরা প্লেব্যাক-এর সুযোগটা পেয়েছিলেন। আর এখন এই রিয়ালিটি শো-এর সিঙ্গারদের নিজস্ব গান তৈরি হচ্ছে কোথায়? এরা কণ্ঠী হয়েই থেকে যাচ্ছে। আসলে তৈরি হয়ে তো এরা আসছে না। কিছুদিনের জন্য জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, তারপর হারিয়ে যাচ্ছে।