ক্রমাগত প্রযুক্তির বিকাশ, নানা ক্ষেত্রে কম্পিটিশন এবং জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির কারণে মা-বাবা Parents হওয়াটাই এখন বিশাল দায়িত্বের কাজ। তার ওপর পরিবর্তিত জীবনশৈলী, অভিভাবক এবং সন্তানের সম্পর্ককে এক নতুন আঙ্গিকে পৌঁছে দিয়েছে। আগেকার থেকে আজকাল মা-বাবার দায়িত্ব সামলানো আরও বেশি কঠিন হয়ে গেছে।
বেশিরভাগ অভিভাবকই এখন চাকুরিরত। যারা আগে বাড়ি সামলাতেন তারা আজ প্রায় সকলেই নিজের কেরিয়ার নিয়ে ব্যস্ত। সন্তান ছোটো হলেও, মায়ের পুরো সময় সন্তানের সঙ্গে কাটাবার উপায় নেই। সংসারে অর্থের যোগান দেওয়াটাও খুবই জরুরি হয়ে গেছে। সারাদিন বাইরে কাজে ব্যস্ত মায়েদের, সন্তানদের দেখাশোনার জন্যে নির্ভর করতে হচ্ছে ডে’কেয়ার সেন্টার, ক্রেশ অথবা কোনও পরিচারকের উপর।
আজকাল বাচ্চাদের গ্যাজেট অথবা টেকনিক স্যাভি বলাটা বোধহয় ভুল নয়। বেড়ে ওঠার পুরো প্রক্রিয়াটাতেই দেখা যায় এদের হাতে মোবাইল, ল্যাপটপের আনাগোনা। ৫০ শতাংশের বেশি সংখ্যক বাচ্চা, কম্পিউটার ছাড়া চলতেই পারে না, সকলের বাড়িতেই কম্পিউটার রয়েছে। না থাকলেও অসুবিধে নেই, সাইবার কাফে, স্কুলকলেজ, বন্ধুদের বাড়ি তো রয়েইছে।
মডার্ন মায়েদেরও বক্তব্য যে, সময়ের চাহিদার জন্যে বাচ্চাদের কম্পিউটার জানাটা খুবই জরুরি। তাই কম্পিউটারে বসতে বাচ্চাদের বাধা দেওয়া যেমন উচিত নয়। তেমনই লক্ষ্য রাখাও উচিত যে তারা কম্পিউটারে কী করছে। ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহারও অভিভাবকদের শেখানো উচিত সন্তানকে। নেটের ব্যবহার আজ সকলের জীবনকে এতটাই গ্রাস করেছে যে, প্রত্যেক মা-বাবারই চিন্তা থাকে কীভাবে অশ্লীল সাইটগুলি থেকে শিশুর ইনোসেন্স-কে আড়াল করা যায়। কাজের নাম করে কম্পিউটারে বসলে, সর্বদা লক্ষ্য রাখতে হয় যে কম্পিউটারে কোনও পর্ণ-সাইট সেই সন্তান খুলেছে কিনা অথবা সোশ্যাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কোনও খারাপ লোকের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব বাড়ছে কিনা। এই সাইটগুলি খুবই সহজে খোলা যায় এবং এগুলি জানারও একটা সুপ্ত বাসনা শিশুমনে কাজ করে।
এই বিষয়ে একটি সমীক্ষা করা হয়েছিল ১,৫০০ ভারতীয় অভিভাবক Parents এবং কিশোরের উপর। তাতে ২০ শতাংশ টিন এজার স্বীকার করেছে যে, সারাদিনে একবারের বেশিই তারা পর্ণ সাইট ভিজিট করে। ৭০ শতাংশ অভিভাবকরা দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়েছেন যে তাদের সন্তানরা সারাদিনে ইন্টারনেটে কী কী সাইট ভিজিট করছে তার পুরো তথ্য মা-বাবাকে তারা জানায়। অথচ এরই মধ্যে ৫৮ শতাংশ কিশোর-কিশোরীরা জানিয়েছে যে তারা খুব ভালো করেই জানে মা-বাবার কাছে সত্যিটা কীভাবে লুকোনো যায়।
সাইবার বুলিং
সোশ্যাল নেটওয়ার্কগুলির ব্যবহার যত বাড়ছে ততই সাইবারের মাধ্যমে অশ্লীল কমেন্ট, অশ্লীল ছবি পাঠিয়ে বুলিং করার ঘটনাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। খবরের কাগজে মাঝেমধ্যেই চোখে পড়ছে নেটের মাধ্যমে বুলিং-এর জন্য বেশ কিছু আত্মহত্যার ঘটনার বিবরণ। বেশিরভাগ অভিভাবকই জানিয়েছেন তাদের সন্তানরা কখনও না কখনও এই সাইবার বুলিং-এর শিকার হয়েছে। ফেসবুকে, কখনও মেল হ্যাক করে এই ধরনের অপরাধমূলক কাজকর্ম অনেকে চালিয়ে যায়। চিন এবং সিঙ্গাপুরের পর বুলিং-এর ঘটনা সবথেকে বেশি ভারতে।
শুধুমাত্র কম্পিউটার অথবা মোবাইলের নয়, মনোরঞ্জনের আরও অন্যান্য মাধ্যম যেমন টিভি, ফিল্ম-এ অশ্লীল দৃশ্য, অকথ্য গালিগালাজ, খুনের দৃশ্য, ষড়যন্ত্র, অপরাধের নানা দৃশ্য বাচ্চাদের অপরাধের রাস্তায় নিয়ে যেতে প্ররোচিত করে। বাচ্চারা প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে পড়ে। স্কুলকলেজেও এমন অনেক শিশু পড়ে, যাদের সঙ্গে মিশলেও অন্যান্য বাচ্চারা অপরাধের পথে পা বাড়াতে পারে।
কিশোরাবস্থায় অপরাধের ঘটনা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ধর্ষণ, খুন, রাহাজানি মামলায় যেমন কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে, কিশোরীরাও অপরাধের গ্রাস থেকে বাঁচতে পারছে না। প্রতি বছর প্রায় ৩৪ হাজার কিশোর অপরাধী আইনের হাতে ধরা পড়ে, যার মধ্যে ৩২ হাজার ছেলে এবং ২ হাজার মেয়ে।
সন্তানকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায়
যদি মা-বাবা জানতে পারেন যে তাদের সন্তান লুকিয়ে পর্ন মুভি অথবা কম্পিউটারে অশ্লীল সাইটগুলি ভিজিট করছে, সোশ্যাল সাইটে বুলিং-এর শিকার হচ্ছে– তাহলে তাদের বকাঝকা করার বদলে অন্য কোনও কাজে ব্যস্ত রাখার প্রয়াস করা উচিত। মনস্তত্ত্ববিদের সঙ্গেও পরামর্শ করা যায়। ওয়েবের মাধ্যমে পর্ন ভিডিও দেখা থেকে বাচ্চাদের দূরে রাখতে ইন্টারনেট ফিলটারিং ব্যবস্থার সুযোগ নেওয়া উচিত। ইন্টারনেট এক্সপ্লোরার অপেরা, ক্রোম ইত্যাদি বিভিন্ন ব্রাউজারে, আপত্তিজনক ওয়েব পেজ যাতে চট্ করে খোলা না-যায়, তার ব্যবস্থা দেওয়া রয়েছে। সুতরাং তার প্রয়োগ করুন।
আজকাল অভিভাবকদের জন্য সবথেকে জরুরি হল নিজের সন্তানদের সঙ্গে সবসময় ইন্টার্যাক্ট করা। ওদের সঙ্গে সবসময় সব বিষয়ে আলোচনা করা। ড্রাগ, অ্যালকোহলের অপকারিতা যেমন সন্তানের সঙ্গে মা-বাবা আলোচনা করেন, তেমনই মডার্ন টেকনোলজির খারাপ দিকটাও তাদের বোঝানো উচিত। দৈনন্দিন প্রতিটি কাজের প্রতি অভিভাবকদের লক্ষ্য রাখা উচিত। সন্তান কাদের সঙ্গে মেলামেশা করছে সেটার প্রতিও দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
ভালো অভিভাবক হবেন কীভাবে
এখন নিউক্লিয়ার ফ্যামিলির যুগ। বাবা-মা এবং ম্যাক্সিমাম দুটি সন্তান। সুতরাং মা-বাবার দৃষ্টি সর্বদাই বাচ্চাদের উপর নিবন্ধ, আবার ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দুও তারা। মা-বাবার Parents সন্তানের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ এখন অনেক লঘু। ভালোবাসার অর্থ শুধুমাত্র টাকা দিয়ে জিনিস কিনে দেওয়া নয়। বরং মা-বাবা নিজের কতটা সময় সন্তানের সঙ্গে কাটাচ্ছেন সেটা অনেক বেশি ইম্পরট্যান্ট। এমন অ্যাক্টিভিটিজ-এ তাদের ব্যস্ত রাখা উচিত যেখানে তাদের এনার্জির পূর্ণপ্রয়োগ হতে পারে। ল্যাপটপ, মোবাইলের বদলে বাচ্চাদের বই পড়ার অভ্যাস করান। এতে মস্তিষ্কের বিকাশ যেমন ঘটবে তেমনই কল্পনাশক্তি এবং রচনাশক্তিও বাড়বে। সবথেকে প্রয়োজনীয় হল যে মা-বাবার, সন্তানদের, নিজেদের ইচ্ছেমতো সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সৎসাহস দেওয়া উচিত।
অভিভাবকদের জন্য কিছু টিপস
১) নিজের বাচ্চাকে বোঝার জন্য তাদের বন্ধু হয়ে উঠুন তবেই ওদের মতো ভাবতে পারবেন। ওদের সম্পর্কে ডিসিশন নেবার সময় ওদের বয়স এবং দৃষ্টিকোণের প্রতি সতর্ক থাকাটা জরুরি।
২) শাসন প্রয়োজন, তবে অবস্থা বিশেষে ভালোবেসে বোঝালে অনেক বেশি রেজাল্ট পাওয়া যায়।
৩) সন্তানের ফ্রেন্ড সার্কেল-এ কারা আছে সেই খবর রাখুন। কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে খেয়াল রাখুন। যাদের সঙ্গে বেশি মেশে, তাদের ফোন নম্বর নিজের কাছে নোট করে রাখুন।
৪) ল্যাপটপের বদলে ডেস্কটপ কম্পিউটার দিন এবং লক্ষ্য রাখুন কম্পিউটারে আপনার সন্তান কী করছে।
৫) সন্তানের প্রশংসা তার সামনে করবেন না।
৬) বড়োদের সম্মান করতে শেখান এবং ‘থ্যাংক ইউ’, ‘সরি’ ইত্যাদি শব্দগুলি বলতে শেখান।
৭) বাচ্চাদের প্রতিটি কথার নঞর্থক মানে বার করবেন না। বন্ধুদের সামনে বকবেন না।
১০) কখনও কখনও তাদের জেদের প্রশ্রয় দিন।
১১) অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে নিজের সন্তানের তুলনা করবেন না।
১২) ছোটো থেকেই শেয়ার করতে শেখান।
১৩) পারিবারিক অথবা বড়োদের ঝগড়ার মধ্যে বাচ্চাকে ঢোকাবেন না অথবা দাবার ঘুঁটি হিসেবেও তাকে ব্যবহার করবেন না।
১৪) খুব বেশি আশা ওদের ওপর রাখবেন না। অনুশাসন শেখান কিন্তু অনুশাসনের বেড়ায় তাদের বন্ধ করে রাখবেন না।
১৫) ওদের সামনে খারাপ ভাষা ব্যবহার করবেন না।
১৬) যে-কোনও অনুষ্ঠানে, পারিবারিক গেট-টুগেদার-এ সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে যান। যাতে সে সোশ্যাল হতে পারে।
১৭) এতটাও স্বাধীনতা বাচ্চাকে দেবেন না যাতে সেটার ভুল অর্থ তার কাছে পৌঁছোয়।
১৮) আত্মনির্ভর হতে শেখান সন্তানকে।