কত তাড়াতাড়ি দিন বয়ে গেল। এই সেদিনের কথা, বিডিওর চাকরিতে জয়েন করতে গিয়েছিল অতনু কর, বাঁকুড়া শহরে। সেখান থেকে আরও দূরে এক পাহাড়ি এলাকা ন’পাহাড়িতে। জায়গাটা ছবির মতো ভাসে চোখের সামনে। পাহাড়, টিলা, বনভূমি, দিগন্তবিস্তৃত লাল মাটির ঢেউখেলানো প্রান্তর। ব্লক অফিসের বড়ো বাবুর দুই মেয়ে, বিশাখা ও ঐশিকা। তারা ছিল যমজ কিন্তু আলাদা। একজন গৌরী, অন্যজন শ্যামলা। শ্যামলা মেয়ে ঐশিকার চোখের রং ছিল আবছা বাদামি। বিনবিন করে অতনু নিজের সঙ্গে, বিশাখা, ঐশিকা, দুজনেই আমার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল এক সঙ্গে। দুটি চিঠিই আমার কাছে এসে পড়েছিল ওদের ছোটো ভাই দেবুর হাত দিয়ে। দুজনের কী আশ্চর্য প্রেম নিবেদন। তারা তখন কৈশোর পার করে যুবতি হয়ে উঠছে সবে। তাদের একজন বিশাখা খুব হাসত, আর ঐশিকা ছিল অর্ন্তমুখী। কথা বলত কম। দুজনে যে দু’রকম তা তাদের দুই চিঠি পড়ে বোঝা গিয়েছিল। দুই বোন আলাদা আলাদা হয়ে ঘুরে বেড়াত। সেই বিশাখা, ঐশিকা দুই বোন এত বছর বাদে আমার কাছে ফিরে এসেছে বন্ধু হয়ে। দুজন কুড়ি। তাদের একজন কথা বলে গম্ভীর হয়ে। সব বিষয়ে সুচিন্তিত মতামত দেয়। আর একজন, যার নাম রুহু, সে শুধু হাসে, হা হা হা। আমাদের কথা বলার ইন-বক্সে হা হা হা, হাসির প্লাবন বয়ে যায়। অন্যজন তার নাম কুহু, সে আমাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি গড অফ স্মল থিংস পড়েছ বন্ধু?
অতনু তখন জিজ্ঞেস করে, তুমি কি খুব বই পড়ো?
হ্যাঁ, তুমি বই পড়ো না?
পড়ি পড়ি, ওই বইটাও পড়েছি, কিন্তু তা দশ বছর আগে।
এই তুমি কি চেতন ভগত পড়়ো?
না, কেন?
আমিও না বন্ধু, শ্যালো, ওর ভিতরে কিছু নেই পাওয়ার মতো।
কী সুন্দর তুমি বললে, পাওয়ার মতো, বই পড়তে হয় কিছু পেতে, তাই না?
হুম, বলে অতনুর ওই বন্ধু কুহু একটি হৃদয় এঁকে দিল আগে, তারপর লিখল, বাই, পরে কথা হবে।
অন্য বন্ধু রুহু বলল, কী করছ তুমি?
কী করব, বসে আছি পথ চেয়ে।
আহা, তুমি খুব দুষ্টু, কেষ্টবাবু, তা তোমার বংশীটি কই?
হারিয়ে গেছে।
বাঁশি হারান কৃষ্ণ, হা কৃষ্ণ হা কৃষ্ণ, হা হা হা।
অতনু কর নিজে নিজে কথা বলে, এই আমার দুই বন্ধু। তাদের দুজনই একরকম মুখ দিয়েছে প্রোফাইল পিকচারে। সে হল সাদা কালোর যুগের হিরোইন মধুবালা। আমার মনে হয় রুহু-কুহু দুটি নামই ফেক নাম। হয়তো ওদের ডাক নাম। দুজনে একদিনেই আমার বন্ধু হয়েছিল। কিন্তু রুহু বলে সে কুহু বলে কাউকে চেনে না। কুহু বলে, সে রুহুকে দেখেছে বটে, এমনকী একটি ফোটোই তাদের প্রোফাইল পিকচার, কিন্তু কুহু তার বন্ধু নয়। তাহলে হয়তো এমন হতে পারে রুহু-কুহু একজন, তারা দুই নামে দুইজন। একজন রুহু আমার কাছে আসে সকাল দশটা নাগাদ, অন্যজন আসে সন্ধে সাতটা নাগাদ। রুহু হা হা হাসে, অন্যজন কুহু গম্ভীর হয়ে গড অফ স্মল থিংস, বিভূতিভূষণের ইছামতী উপন্যাসের কথা বলে। কী অদ্ভূত, এরা কি তাহলে সেই বিশাখা ঐশিকাদের কেউ?
ঐশিকা একদিন অতনুকে বলল, আপনি যদি না বলেন, না বলবেন, হ্যাঁ বলতে হবে এমন তো কোনও কথা নেই, আমার ভাল লাগে তাই জানিয়েছিলাম, পৃথিবীতে কত প্রেমপ্রস্তাব কতজন কতজনের কাছে পাঠিয়েছে, তার সব প্রেম কি স্বার্থক হয়েছে, এ তেমন কোনও চিঠি ভেবে নেবেন, চিঠি লিখতে আমার ভালো লাগে।
বিশাখা তাকে বলেছিল, আমি তোমারে ভালবেসেছি, যদি তুমি সাড়া না দাও অখিল, আমি দূর হতে ভালবেসে যাব, হয়তো কিছুই নাহি পাব।
বিশাখার চিঠির ভিতরে উত্তম সুচিত্রার সিনেমার গানের কলি ছিল। তখন সেই মফস্সলে সবে টেলিভিশন ঢুকেছে, কিন্তু তার ভিতরে কেবল লাইন, হরেক রকম চ্যানেলের কোনও ব্যাপার ছিল না। ভিডিও ক্যাসেট আর ভিসিপি ছিল সেই মফস্সলে সিনেমা দেখার উপায়। টেলিভিশন সেট আর ওই দিয়ে সেই গঞ্জে ভিডিও হলে সিনেমা দেখান হতো। ওখানে কোনও সিনেমা হল ছিল না। সদর বাঁকুড়ায় গিয়ে লোকে সিনেমা দেখে আসত। আর কোনও মেলা পাব্বনে প্রোজেক্টর ভাড়া করে এনে দেখানো হতো সিনেমা। সেই সময় টেলিভিশন সেট ভাড়া পাওয়া যেত ভিসিপি আর ভিডিও ক্যাসেট সমেত। পাওয়া যেত নীল ছবির ক্যাসেট। মফস্সলে সেই প্রথম নীল ছবি ঢুকতে আরম্ভ করে। ভিডিয়ো হলের রাতের শো-তে চলত। অতনুর মনে আছে তাদের এক কলিগ নৃসিংহ পাল আমাকে এক রাতের শো-এ নিয়ে গিয়েছিল, ভিতরে ঢুকে দ্যাখে সব ষোলো-সতেরো-আঠেরো। লজ্জায় মাথা কাটা গেল। হলের মালিক ছেলেটি অতনুকে এসে বলল, স্যার আপনারা থাকলে আমার খদ্দের সব বেরিয়ে যাবে, যদি দেখতে চান, আমি বাড়িতে গিয়ে দেখিয়ে আনব। সে বেরিয়ে এসেছিল প্রায় মুখ ঢেকে। নৃসিংহ থেকে গিয়েছিল। সে নিয়মিত দর্শক। অতনু তো তা নয়। তাকে জোর করে নিয়ে গিয়ে ঠিক করেনি নৃসিংহ।
নীল ছবিতে আমার গা গুলোয়। মনে হয় রবারের পুতুল নর-নারী কুস্তি করছে। কুহু, তার ইন্টারনেট-ফেসবুকের বন্ধু একদিন কথায় কথায় বলে, নীল ছবিতে মেয়েদের কত ছোটো করা হয় বলো তুমি, আমি এর বিরুদ্ধে প্রচার করব, তুমি আমার সঙ্গে থাকবে তো।
থাকব, কিন্তু এর পিছনে কত বিলিয়ন ডলার খাটে তা জানো তুমি?
জানি বন্ধু, কিন্তু সেই সুরক্ষিত প্রাসাদের জানলায় একটা ঢিল কি মারতে পারব না? ঝুর ঝুর করে ভেঙে পড়ুক কাচ।
ঐশিকা প্রায় এমন কি বলত না?
বড়োবাবু, ওদের বাবার জ্বর, মনে হল দেখে আসি। হ্যাঁ, বিশাখা ছিল না। সে গিয়েছিল পিসির বাড়ি, ফিরতে তিন দিন। হা হা হাসি, খিল খিল হাসি হাসতে হাসতে পিসতুতো দাদার সঙ্গে সে গেছে পিসির বাড়ি বর্ধমান। ঐশিকা যায়নি। বাবার জ্বর। আসলে অতনুর মনে হয়েছিল, সে যাবে, তা যেন মনে মনে জেনে গিয়েছিল বাদামি চোখের সেই মেয়ে। দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল যেন তারই জন্য। তার জন্যই পথের দিকে তাকিয়ে। তাদের মা ছিল না। মা তাদের ছেড়ে চলে গেছে তা শুনেছিল অতনু কানাঘুষোয়। দুই মেয়েকে নিয়েই বড়বাবু অম্বিকাপ্রসাদ গুন ন’পাহাড়িতে বদলি হয়ে এসেছিলেন। তখন দুই মেয়ে পাঁচ-পাঁচ। আর ফিরে যাননি।
অতনু মনে মনে বলে, আমি যখন যাই মেয়েরা তখন কুড়ি-কুড়ি। এও জানতাম ঐশিকা আর বিশাখার ভিতরে বনিবনা কম। কিন্তু তা এমনিতে ধরা যায় না। আমি যেতে ঐশিকা বলল, বাবা ঘুমিয়ে আছেন, আপনি কি বসবেন, না আবার আসবেন?
কোথায় যাব?
তা বটে, তাহলে বসুন, আপনি বাবার ঘরে বসবেন না অন্য ঘরে?
আমি কি বলব?
ঐশিকা বলল, বিশাখাও নেই কিন্তু।
আমি কি দরজায় দাঁড়িয়ে থাকব?
সরি, ভেতরে আসুন।
বিশাখার চিঠির উত্তর আমি না দিলেও সে আমাকে চিঠি পাঠানোর পর থেকেই তুমি সম্বোধন করতে শুরু করেছিল। আর তা ঐশিকার সামনে। বা কখনও একা দেখা হয়ে গেলে। ঐশিকার সামনে সে যেন প্রমাণ করতে চাইত অতনু করের সঙ্গে তার কোথাও একটা সেতু তৈরি হয়েছে। সেই সেতু পার হয়ে সে অতনুর ভিতরে প্রবেশ করতে পারে। কতকাল আগের কথা এসব। রুহু-কুহু আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই যৌবনকাল। আমার মনে হয় সেই দুই বোন, দুই যমজ, হা হা হাসি আর বাদামি চোখের নীরব আমন্ত্রণ আবার ফিরে এসেছে।
রুহু, হাউ ওল্ড আর ইউ? অতনু লেখে বার্তা।
আমি একটা বুড়ি স্যার।
তার মানে কুড়ি?
ওয়ান্ডারফুল স্যার, কুড়িতে কি বুড়ি নয় স্যার?
পাগল না ফাগল।
হা হা হা হা, ফাগল ফাগল ফাগল স্যার, হামি এক ফাগল হ্যায়।
অতনু বলল, কুহুকে চেন?
আমার বোন হতে পারে, বাট আই ডোন্ট নো।
তোমার বোন হতে পারে কেন?
রুহুর বোন তো কুহুই হবে স্যার।
উঁহু।
হা হা হা, তুমি যা বলো না, আমার বোন উঁহুই অতনু স্যার, আমার কোনও ভগিনী নাই, অনলি ডটার।
তাহলে কুহু কে?
কে বলো দেখি, আমি মধুবালার যে সাদা কালো ছবি লাগিয়েছি প্রোফাইল পিকচারে, ওরও সেই পিকচার, ভেরি ব্যাড, ঠিকানা এটা, ও আমার ফ্রেন্ড লিস্টে নেই।
এই কথা তো কুহুও বলল, ওর ফোটো তুমি নিয়েছ, ও মধুবালা, নারগিস, তাদেরও আগের সুরাইয়ার ফ্যান, শি লাইক্স দোজ হিরোইন্স।
হা হা হা, আমি দেখেছি, বাট আই লাইক ক্যাটরিনা কইফ, করিনা কাপুর, দীপিকা পাড়ুকোন, ব্রেভ সানি লিয়ন, বাট মধুবালা ইজ নট ব্যাড, এটা আমি নেটে পেয়েছি। তোমার নিজের ফোটো নেই কেন?
না গো নিজের ফোটো দিলে আমাকে প্রত্যেকদিন দুটো করে প্রস্তাব নিতে হচ্ছিল, আই লাভ ইউ, লাভ ইউ, প্লিজ ইন-বক্সে এসো, প্রেমের হাল কি বোঝো, হা হা হা, কী করি, ফেসবুক ছেড়ে কি পালাব?
রুহুর কথা যা কুহুর কথা তা নয়। সন্ধেয় কুহু বলল, আরে এই জগৎটাই ভারচুয়াল, এখানে আসলই বা কী নকলই বা কী, কারোর সঙ্গে তো কারোর দেখা হয় না, তাই আর নিজের ছবি দিলাম না। আর মধুবালার চেয়ে তো আমি সুন্দর নই স্যার, ডু ইউ নো, মধুবালার হার্ট-এ একটা ছিদ্র ছিল, কত কম বয়সে সে মারা গেল। শি ওয়াজ অ্যান অ্যানজেল, অ্যানজেলঃ এই পোলিউটেড পৃথিবীতে কতদিন থাকবে।
অতনু কর তখন বলল, তুমি গৌরী না শ্যামলা মাই অ্যানজেল?
কেন বলো দেখি?
অসুবিধে থাকলে বোলো না।
যদি বলি শ্যামলা মেয়ে আমি।
অতনু কর বলল, শ্যামল বরণী মেয়ে বলো কার পথ চেয়ে আঁখি দুটি ওঠে জলে ভরিয়া।
এর মানে?
এটা একটা গান।
সে আমি জানি স্যার, কিন্তু এই কথা বললেন যে?
এমনি বললাম।
আই আম নট ওয়েটিং ফর এনি ওয়ান, প্রত্যাখ্যান আমার ভালো লাগে, আই লাইক টু রিফিউজ।
বুক কেঁপে উঠেছিল তার, সে কোনও রকমে বলে, তোমার চোখের রং কি বাদামি?
উফ, আমি বলব কেন?
না বললে না বলবে, আমি শুনব না।
অতনু, তুমি কি কোনও ফেক আইডি নিয়ে আছ, তুমি কি অতনু কর নও, তুমি কি ওল্ড ম্যান নও?
অতনু বলল, তোমার কি তাই মনে হয়?
না হয় না, বাট তোমার কথা আমাকে ডাউটফুল করে তুলছে।
কেন?
তুমি বুঝে নাও, আমার মনে হয় তুমি আমার চেনা কেউ।
না। অতনু বলল। বলে একটু থমকে থাকে। তখন নিঃশব্দে কুহু অন্তর্ধান করল। অতনু হিসেব কষল। তেত্রিশ বছর কেটে গেছে তারপর। তারা পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। পঞ্চাশ পেরোনো নারী কি এই ভাবে কথা বলতে পারবে, প্রত্যাখ্যান তার ভাল লাগে, পুরুষ মানুষ বুুঝুক প্রত্যাখ্যান কী?
যে-ঘরটিতে অতনু বসেছিল, সে ঘরে বুঝি ভাসছিল বিরল এক বাদামি রঙের চোখের মণি। ঐশিকা বলল, চা করি?
উনি কখন উঠবেন?
উঠবেন, ঘুম ভাঙলে উঠবেন।
চা করতে গেল সে। শ্যামল বরণ স্বাস্থ্যবতী কন্যা চা এনে বলল, কাগজ পড়বেন স্যার।
আমি কি তোমার স্যার?
বললে কি দোষ হবে, বাবা তো স্যার বলে, তাই না।
অতনু বলল, ও তো অফিসিয়াল স্ট্যাটাস, তুমি কি চাকরি করো।
ঐশিকা বলেছিল, কী জানি।
তুমি চিঠি দিয়েছিলে তো।
ও কিছু না, এমনি।
কেন দিয়েছিলে?
আপনি তো জবাব দেননি, আবার কথা কেন।
বিশাখাও চিঠি দিয়েছে।
আমি জানি, আমাকে বলেছে।
তারপর?
ও জানে একদিন ও সাড়া পাবে, প্রপোজ করতে ওর খুব ভালো লাগে, এর ভিতরে চারজনকে প্রপোজ করেছে ও, আরও করবে।
তুমি, তোমার ভালো লাগে না প্রস্তাব দিতে?
না।
তুমি তাহলে কী চিঠি দিয়েছ?
ঐশিকা বলেছিল, আমি লিখলাম আপনাকে আমার ভালো লাগে, যা মনে হয়েছে তাই লিখেছি, ওটা প্রপোজ নয়।
অতনু কর চুপ করে গিয়েছিল। ঐশিকার ছিল হালকা হলুদ শাড়ি, হলুদ ব্লাউজ, মাথার চুলে এলো খোঁপা। সেই খোঁপা ভেঙে আবার বাঁধল সে। কী অনায়াস। সেই খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে ঘাড় বাঁকিয়ে সে তার বাদামি চোখের মণি ঘুরিয়ে নিল অতনুর উপর থেকে। কী ধারাল ছিল সেই দৃষ্টিপাত। বলল, আমরা দুই বোন খুব খেলো, তাই না?
জানি না, মনে হয়নি।
হয়নি তো সেদিন আমার সামনে ওকে বললেন কেন, তোমার হাতের লেখা খুব সুন্দর।
সুন্দর তো।
আপনি খুব নিষ্ঠুর, একটা মেয়ে প্রপোজ করল, তাকে এই ভাবে ফেরালেন, উত্তর না দিতে পারতেন, ছিঃ, একজনকে সাক্ষী রেখে রিফিউজ করলেন, গোপন চিঠির গোপনীয়তা থাকল না।
আমি তো বলেছি।
অতনুকে কথা শেষ করতে দেয় না ঐশিকা। বলে, মুখ অন্ধকার করে ঘুরছিল, আমি ওকে বললাম পিসির বাড়ি যেতে, আপনার খুব অহংকার, তাই না স্যার?
তোমার চিঠির কথা তো বলিনি।
আমি কি ছেড়ে দিতাম, আমি তো প্রপোজ করিনি কাউকে।
আমি কি চলে যাব? অতনু বলেছে।
ধ্যাত, চলে যাবেন কেন, থাক আর বলছি না।
তুমি কি প্রপোজ করোনি?
মোটেই না।
না, ওটা তাই। উঠে দাঁড়িয়েছিল অতনু কর।
হতে পারে না, আমি তো জানতাম বিশাখা আপনাকে ভালোবেসেছে, অবশ্যই তা এক তরফা।
চিঠি কে লিখে দিয়েছিল?
তা জেনে করবেন কী?
তুমি কি জানতে না, সে রিফিউজড হবে?
কী করে জানব?
হাতের লেখা সুন্দর, কিন্তু বানান সব ভুল, আমার নামের বানানেও দীর্ঘ ঊ কার বসিয়েছে।
ও লিখেছিল।
মনে হয় কপি করেছিল, তাই তো।
আমি বলব না।
তোমার কোনও বানানে ভুল নেই, আরম্ভ করেছ কী সুন্দর।
ঐশিকা বিনবিন করল, ‘শরীর শরীর তোমার মন নেই কুসুম,’ ওতো পুতুল নাচের ইতিকথা।
তুমি ভুল বানানে ড্রাফট করেছিলে ওর চিঠি।
চিঠিটা ওর লেখা।
কপি করেছিল।
না। ঘুরে গিয়েছিল ঐশিকা, বলেছিল, এ সব কথা বলছেন কেন?
তুমি তারপর চিঠিটা পাঠালে।
ওহ, ভগবান, এই কথা বলতে এলে।
হ্যাঁ।
বলা হয়ে গেছে, এবার কি যাবে?
না। বলেই অতনু কর তার হাত ধরে ফেলেছিল। নিজের দিকে টেনেছিল। বুকের উপর আছড়ে ফেলেছিল বাদামি চোখের কন্যাকে। ঠোঁটে ঠোঁট, মুখের ভিতর জিভ সাপের মতো খেলা করে। এসো, এসো অহংকারী যুবক, তোমার অহংকার ভাঙবে বাদামি চোখের মেয়ে। ঐশিকা তাকে দু’হাতে অাঁকড়ে ধরেছিল। তারপর সেই এক অনন্ত চুমু। সে যেন এক জীবন পার হয়ে আর-এক জীবনে প্রবেশ। বাদামি চোখের টানে পাগল হল অতনু। ঐশিকা ডাক দিলে সে সব ফেলে সব তুচ্ছ করে ছুটে যায়। শরীর শরীর ছাড়া আর কিছু নাই শশী। কুসুমের মুখে এই সংলাপ ছিল না নিশ্চয়, কিন্তু এই ভাবেই তার কানে যেন কুহু দেয় বাদামি চোখ। কী ছিল তার বন্যতা। ঐশী ওয়াইল্ড। নিজের ভিতরে তাকে নিতেও বুঝি সে-ই প্রধান। শরীরে শরীর যোগ হয়। তারপর একদিন আচমকা কী হল, বলল, তুমি আর এসো না অতনু।
কেন, কী হয়েছে?
না, তুমি আর আসবে না।
ঐশী!
না না না, আই ডু নট লাভ ইউ, আমি তোমাকে ভালোবাসি না।
মিথ্যে বলছ।
না সত্যি, বিশাখা তো ইচ্ছে করে সব বানান ভুল করেছিল, যাতে আমার ডাকে তুমি সাড়া দাও। ও ত্যাগ করেছিল। তুমি একটি লোভী পুরুষ, অত ভুল কি কেউ লিখতে পারে, কী নির্বোধ পুরুষেরা সবাই। আর তুমি মিথ্যেও বলেছিলে, নাউ, দিজ ব্রাউন আইজ ডু নট লাইক ইউ, ডোন্ট টাচ মি, চলে যাও।
এর পর ন’পাহাড়ি থেকে তার বিদায়। বিশাখা ত্যাগ করেছিল, না ঐশিকা? এখনও জানে না অতনু কর। অথচ কিছুই তো ভোলেনি। ঊরুতে জড়ুল চিহ্নটি পর্যন্ত। যে মেয়ে কোনও পুরুষের কাছে সব নিবেদন করে, সে কি তাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে? পারে। প্রত্যাখ্যান করে, মিলনের সময় বিপরীত বিহারে গিয়ে সে পুরুষের চেয়ে বড়ো হয়ে উঠতে পারে। তাই-ই যেন হয়েছিল। এত বছর সব ভুলে থেকে আবার ফিরে এল সব, সেই ন’পাহাড়ি, বন-টিলা, ধু ধু প্রান্তর, মস্ত ছাতিম, তমাল, বিশাখা ঐশিকাঃ বিশাখা কোনও বানান ভুল করতে পারে না। অতনু কর তার দিকে ঝুঁকেছিল আগে, গৌরী কন্যা যে। বাদামি চোখের কন্যাকে সে পেয়েছিল গৌরী কন্যার বদলে। বিশাখা না দিলে ঐশিকাকে পেত না সে। আর ঐশিকা তাকে ফেরাল ওই বিশাখার জন্য। বিশাখাকে রেখে সে অতনু করের হাত ধরে কলকাতা চলে আসবে কী করে?
এই যে ফাগুন এল শহরে। কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ফেস বুক সব রঙে রঙে ভরে গেল প্রায়। কোথায় কোন মাঠে, কোন প্রান্তরে, নদীতীরে শিমুল-মাদার-পলাশ ফুটেছে আগুন হয়ে, বাগানে আমের মুকুলে বসেছে ভ্রমর, লেবু ফুল ফুটেছে কোথায় কত দূরে, সব জেনে গেল সবাই। কুহু সন্ধেয় এল, হ্যালো স্যার।
বল।
তুমি এখন কী করছ?
তোমার জন্য বসে আছি।
স্যার, মিঃ অতনু কর, স্যার, টু ডে ইজ দ্য ডে ফর রিফিউজাল, আয়াম লিভিং ইউ টু ডে, তুমি ভালো থেকো।
হোয়াই, তুমি কি ফেস বুক থেকে সরে যাচ্ছ ব্রাউনি?
আই ডোন্ট নো স্যার, বাট আয়াম লিভিং ইউ, আমার আর ভালো লাগছে না তোমাকে।
কেনরে বালিকা, আমি কি কোনও অন্যায় করেছি?
নো নো, তুমি খুব ভালো, কিন্তু আমি আজ তোমাকে প্রথমে আনফেন্ড্র করব, তারপর ব্লক করব।
কেন?
তুমি রুহুর সঙ্গে থাকো, ওই মধুবালাকে নিয়ে থাক, বাই স্যার, রুহুর সঙ্গে থাকলে কুহু থাকে না।
কেন রে ব্রাউনি, আমি খুব খারাপ?
তুমি খুব ভালো, ভালো থেকো, কিন্তু একটু পর থেকে তুমি আমাকে দেখতে পাবে না।
অতনু কর লিখল, ঐশিকা, বিশাখা কি তোমায় বলেছিল, আমি শেষ পর্যন্ত তার চিঠির উত্তর দিয়েছিলাম, তাই ফিরিয়ে দিয়েছিলে আমায়, অতনু কর লোকটা ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ায়? কিন্তু তা নয়, তা নয় সত্যি।
মেসেজ গেল না। হ্যাং হয়ে অন্ধকারে ভেসে রইল মহাব্রহ্মান্ডের কোথাও।