আলোর উৎসব দীপাবলি। ঈশ্বরীয় আবেশে ভরা দীপান্বিতা। এ নামের মধ্যে রয়েছে ইতিহাস ও পুরাণের অভিবন্দনা। উচ্ছ্বাস নেই, আছে হৃদয় থেকে উৎসারিত অফুরন্ত আনন্দের প্রজ্বলিত আলোকমালা। অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, অশুভর বিরুদ্ধে শুভর এ এক চিরন্তন লড়াই। অজ্ঞানতাকে সরিয়ে জ্ঞানের এবং শুভবুদ্ধির এক প্রতীকী উৎসব হয়ে উঠুক Diwali।
দীপাবলি পালিত হয় হিমেল কার্তিকের অন্ধকারতম রাতে। এই আলোর উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন দেবীর পূজা। মহা সমারোহে কোথাও লক্ষ্মী, কোথাও কালীর আরাধনা করা হয়। ভূত চতুর্দশীতে আবার পূর্বজদের প্রেতেদের স্বর্গে ফেরত পাঠানোর জন্য বাতি দেওয়ার রীতির প্রচলন।
উত্তর ভারতের অনেক জায়গায় শীতকালে আগাছা জ্বালানোর জন্য জমিতে বা জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার রীতি প্রচলিত আছে। চতুর্দশী থেকে প্রতিপদ অবধি নানা কারণে অগুন্তি ছোটো ছোটো আগুন জ্বালিয়ে বর্ষার শেষ থেকে বেড়ে ওঠা পোকামাকড়কে যথাসম্ভব আত্মাহুতিতে প্ররোচিত করা প্রয়োজন। এরপর পাকতে শুরু করবে আমন ধান। গোলাবন্দী করতে হবে সম্বচ্ছরের ফসল। অত পোকার পেট ভরানোর পর মানুষের জন্য থাকবে কী? ঘর-উঠোন সাফ করে রাখাও জরুরি– উৎসব, ধান আর স্বাস্থ্যের কারণে। উৎসবের সঙ্গেও পরিচ্ছন্নতার একটা যোগসূত্র আছে।সহজ কথায়, উৎসবটির একটি লোকায়ত দিক আছে, যা ঘরদোর, পোকামাকড়, পরিচ্ছন্নতা, খাদ্য ইত্যাদির সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে যুক্ত। সঙ্গে আছে দীপাবলিতে শুভাশুভর কথা ভেবে, ঘর আলোকিত করার দিকটিও।
কিন্তু শুধু আলোটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকে না এই উৎসব, এটাই দুর্ভাগ্যের। ভয়াবহ ভাবে বাড়ে দূষণ আর ধোঁয়া। কিছু আঞ্চল জুড়ে বেড়ে চলে শব্দের দাপটও। করোনার এই আবহে বাজি না পোড়ানো তাই অত্যন্ত ন্য়ায়সংগত এক সিদ্ধান্ত। যে -সময়ে আমাদের ফুসফুস -কে সুস্থ রাখা আবশ্যক, সেখানে বাজি বর্জিত দীপাবলিই কাম্য। নাহলে ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।
বারুদ ও বাজির ব্যবহারে কী ক্ষতি হয় ?
দীপাবলিতে আজকাল প্রদীপ বা মোমবাতি ছাড়াও ব্যবহৃত হয় বিপুল পরিমাণে বারুদ এবং নানা ধরনের রাসায়নিক মশলা। নানা ধরনের বাজি থেকে ঘটে চলে বিভিন্নরকম দূষণ। মানুষের বসতি অঞ্চলে শরীরের খুব কাছে বাজি পোড়ানো হয় বলে, স্বাস্থ্যের ওপর এর ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে সরাসরি এবং ব্যাপক ভাবে।
প্রথমেই আসি শব্দবাজির কথায়। এর বিরুদ্ধে গত কয়েক বছরে সরকারি স্তরে নানা ঘোষনা এবং বেশ কিছু সামাজিক আন্দোলনও হয়েছে। এর ফলে আদালতের নিষেধাজ্ঞা জারিও হয়েছে।কিন্তু আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এখনও বেশ কিছু পাড়ায় চলে শব্দবাজির জয়জয়কার।শব্দবাজি বায়ুদূষণ ছাড়াও, যে বিশেষ ধরণের দূষণ ছড়ায়, তা হলো শব্দদূষণ। সহসা প্রাণ কাঁপানো শব্দ। আপনার প্রিয় চকোলেট বোমাটির কারণে আপনার পরমাত্মীয় হয়তো হৃদরোগ বা বধিরতায় আক্রান্ত হতে পারেন। জোরালো শব্দবাজি মাইকের জোরালো বাজনার চেয়েও বেশি ক্ষতিকারক, কারণ এর শব্দ আকস্মিক এবং অপ্রত্যাশিত।এর ফলে শরীর কোনও ভাবেই শব্দটির সঙ্গে ধাতস্থ হতে পারে না বা শব্দটি আসবে বুঝে তার জন্য প্রস্তুতও হতে পারে না। এমন শব্দের কুপ্রভাব পড়ে কানে, স্নায়ুতন্ত্রে এবং হৃদপিণ্ডে।
শব্দ উৎপন্ন হয় কম্পন থেকে, এবং তা প্রবাহিত হয় তরঙ্গের আকারে। হঠাৎ খুব জোরে শব্দ হলে যে পরিমাণ কম্পনের সৃষ্টি হয়, তার ফলে আশেপাশের বাতাসে প্রবল আলোড়নের সৃষ্টি হয়, যার প্রভাব প্রায় বিস্ফোরণের মতো। কানের খুব কাছে দুম করে এরকম বিস্ফোরণ হলে তার তরঙ্গের অভিঘাতে কানের ভেতরের বাতাস থেকে হাড়গোড়, সবকিছু কেঁপে ওঠে। এর ফলে কানের পর্দা পর্যন্ত ফেটে যেতে পারে। আরও মারাত্মক ক্ষতি হয়, যদি পর্দা না ফেটে তরঙ্গটি মধ্যকর্ণের তিনটি ক্ষুদ্র অস্থিকে প্রবল ভাবে আন্দোলিত করে তোলে। এর ফলে অন্তঃকর্ণের ‘কক্লিয়া’ নামক মূল শ্রবণযন্ত্রটি মারাত্মকরকম ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে এভাবে স্থায়ী এবং চিকিৎসার অযোগ্য বধিরতার শিকার হতে পারেন ভুক্তভোগী।
কক্লিয়ার পাশেই থাকে শরীরের ভারসাম্য বজায় রাখার যন্ত্র, যার মধ্যে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হল একেক কানে তিনটে করে সেমিসার্কুলার ক্যানাল। এদের গঠনতন্ত্রের সঙ্গে কক্লিয়ার বহু মিল এবং এরাও শব্দবাজির দ্বারা একইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর ফলে তাৎক্ষণিকভাবে চরম মাথা ঘোরা অথবা শরীরের ভারসাম্য বজায় রেখে হাঁটাচলায় স্থায়ী সমস্যা হতে পারে।
বারবার চমকে যাওয়ার ফলে স্নায়ুতন্ত্রে এবং হরমোনের মধ্যে বিভিন্ন পরিবর্তনের সৃষ্টি হয়। এসবের কারণে মাথাব্যথা, শারীরিক অবসাদ থেকে শুরু করে প্রাণঘাতী রোগও হতে পারে।কুকুররা এই ধরনের উৎকট অপ্রাকৃত শব্দে অভ্যস্ত নয়। তাই তারা এরকম শব্দকে ভয় পায়। গৃহপালিত পশুরা দীপাবলির রাতে ভয়ে কুঁকড়ে থাকে।
শব্দ হয় না, এমন বাজিও একান্ত নিরীহ নয়। সবরকম বাজি থেকেই বেরোয় বিষাক্ত ধোঁয়া। তার দ্বারা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মূলত চোখ ও ফুসফুস। রাসায়নিকের প্রভাবে ক্ষতি হতে পারে অন্যান্য অঙ্গেরও। বাজির ধোঁয়ায় কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাইওক্সাইড জাতীয় বিষাক্ত গ্যাস থাকে। বিভিন্ন বাজির মধ্যে কার্বন ও সালফার যৌগ ছাড়াও গুঁড়ো লোহা, ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম অক্সালেট, আর্সেনিক ও অ্যালুমিনিয়াম যৌগ, বেরিয়াম নাইট্রেট, পটাসিয়াম পারক্লোরেট ইত্যাদি বিভিন্ন রাসায়নিক থাকে। এগুলির বিক্রিয়ায় রঙ, বিচিত্র স্ফুলিঙ্গ ইত্যাদি যেমন সৃষ্টি হয়, তেমনই তৈরি হয় স্বাস্থ্যনাশা ধোঁয়াও। সেসব ধোঁয়া ফুসফুসে প্রবেশ করলে বিশেষত হাঁপানি বা ব্রংকাইটিস রোগীদের প্রবল শ্বাসকষ্ট হতে পারে। হৃদরোগের সম্ভাবনাও থাকে।
অনেকক্ষণ এই ধোঁয়ার মধ্যে থাকলে কোষে অক্সিজেনের ঘাটতিজনিত সমস্যা হবে, মাথা ধরবে। অনেকটা ধোঁয়া ফুসফুসে গেলে কিছু ক্ষেত্রে পরবর্তী দুই-তিন দিনের মধ্যে অ্যাকিউট রেসপিরেটরি ডিস্ট্রেস সিন্ড্রোম নামক প্রাণঘাতী ফুসফুসের রোগ হতে পারে, যার দরুন রোগীর কৃত্রিম শ্বাসযন্ত্র (ভেন্টিলেটর) প্রয়োজন হতে পারে।এইসব রাসায়নিক বাষ্প চোখে লাগলে চোখ জ্বালা করে এবং চোখের জলের ওপরের স্নেহজাতীয় পদার্থের স্তরটি নষ্ট হবার ফলে চোখ শুকনো ও লাল হয়ে যায়। এমন হলে পরিষ্কার জল বা কৃত্রিম চোখের জল ড্রপ দিয়ে চোখ ধোয়া যেতে পারে। ধোঁয়া জনিত Pollution থেকে মুখ-চোখ দূরে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ।
সতর্কতা জরুরি
বাজির আগুনে পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও নেহাৎ কম নয়। হাত-পা, মুখ, এমনকী চোখ পুড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে। খুব সাবধানে শরীর থেকে দূরে রেখে বাজি পোড়ানো উচিত। পোশাকে আগুন ধরে গেলে অনেক বড়ো মাপের ক্ষতি হতে পারে, তাই সিল্কের পোশাক, ঢিলে বড়ো ঝুলওয়ালা পোশাক পরে বাজি না পোড়ানোই ভালো। কোনো জায়গা পুড়ে গেলে তৎক্ষনাৎ কলের জলের তলায় সেই অংশটিকে রেখে কিছুক্ষণ ধোয়া উচিত। এতে জায়গাটির উত্তাপ জলের ছোঁয়ায় কমতে থাকে এবংক্ষতি কম হয়।
পোশাকে আগুন লাগলেও জল ঢেলে নেভানোই ভালো। দেহের অনেকটা পুড়ে গেলে আগুন সম্পূর্ণ নিভে যাবার পর কম্বল চাপা দেওয়া উচিত, নইলে রোগীর দেহের তাপমাত্রা দ্রুত কমে যাওয়ার ভয় থাকে। বড়োদের শরীরের কুড়ি শতাংশ এবং বাচ্চাদের দশ শতাংশ পুড়ে গেলে অবশ্যই হাসপাতালে ভর্তি করা কর্তব্য।
মনে রাখুন উৎসবের আনন্দ ততক্ষণই বজায় থাকবে যতক্ষণ না কোনও দুর্ঘটনা ঘটছে। ফলে নিজে সতর্ক হোন, অন্যকে সতর্ক করুন। দীপাবলির আলোয় আমরা আমাদের মনের অজ্ঞানতা দূর করতে পারি। শিখতে পারি নিজের, অপরের এবং পরিবেশের স্বাস্থ্য সম্বন্ধে সচেতন থেকে উৎসবের আনন্দে মেতে ওঠার পদ্ধতি। বাজি না হয় এক বছর না-ই পুড়ল। চারিদিক আলোয় আলো হোক। আমার আলোর আগুনে কারো ঘর যেন অন্ধকার না হয়, সেটা মনে রাখা প্রতিটি শিক্ষিত মানুষেরই কর্তব্য।