‘সন্তানের ঠিক মতো জন্ম দিতে পারব তো? খুব কষ্ট পাব না তো? বাঁচব তো?’– মনের মধ্যে এমন হাজারও প্রশ্ন এবং দুঃশ্চিন্তা নিয়ে দিন কাটান অনেক গর্ভবতী মহিলা। এখন পরিবার ভেঙে অণু পরিবার হয়েছে। তাই প্রথম মা হতে যাওয়া তরুণীর ভয়-ভ্রান্তিগুলো কাটিয়ে দেওয়ার মতো অভিজ্ঞ পরামর্শদাত্রীর (শাশুড়ি) অভাব রয়েছে। এই সময় অর্থাৎ প্রেগন্যান্সি পিরিয়ডে কী খেতে হয়, কীভাবে শুতে হয়, কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয়, সমস্যা কিংবা কষ্ট হলে কীভাবে তা লাঘব করতে হবে প্রভৃতি বিষয়ে পরামর্শ দেওয়ার কেউ থাকে না পরিবারে। অবশ্য শুধু প্রি-ডেলিভারি পর্বেই নয়, পোস্ট ডেলিভারি পর্বেও নানারকম সমস্যা তৈরি হয়। সন্তান এবং নিজেকে (সদ্য হওয়া মা) সুস্থ এবং স্বাভাবিক রাখার জন্যও নির্দিষ্ট জ্ঞান এবং পরামর্শের প্রয়োজন। আর তাই মা হতে যাওয়া তরুণীর চাইল্ড বার্থ-এডুকেশন নেওয়া ভীষণ জরুরি। এখন প্রশ্ন, কী এই চাইল্ড বার্থ-এডুকেশন? কোথায়, কারা-ই বা দেন এই এডুকেশন?
চাইল্ড বার্থ-এডুকেশনের কনসেপ্ট চিন, জাপান, আমেরিকায় বেশ পুরোনো হলেও, আমাদের দেশে এই কনসেপ্ট বেশিদিনের নয়। দিল্লি, মুম্বইয়ে এই ধরনের এডুকেশন কিংবা ওয়ার্কশপ কিছুদিন আগে চালু হলেও, কলকাতায় একেবারে নতুন। প্রসঙ্গত ডা. ইন্দ্রাণী লোধ জানালেন, তাঁর ‘উর্বরা আইভিএফ সেন্টার’-এ সম্প্রতি তিনি কমপ্লিট চাইল্ড বার্থ-এডুকেশন চালু করেছেন। আসলে, পেশাগত অভিজ্ঞতায় ডা. লোধ এই ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চাহিদার বিষয়টি অনুভব করেছিলেন। তিনি দেখেছেন, অজ্ঞতার কারণে অনেক গর্ভবতী মহিলা নিজের এবং তার গর্ভস্থ শিশুর অনেক ক্ষতি করে শেষ মুহূর্তে তাঁর কাছে এসেছেন চিকিৎসার জন্য। কেউ হয়তো শোওয়া-বসায় গন্ডগোল করেছেন, কেউ-বা গর্ভাবস্থায় সেনসেটিভ পিরিয়ড-এ সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে সমস্যা তৈরি করেছেন, আবার কেউ হয়তো না জেনে গর্ভাবস্থায়ও জেনারেল মেডিসিন খেয়ে ক্ষতি করেছেন। কলকাতার আরও এক গাইনিকোলজিস্ট ডা. গৌতম খাস্তগীরও প্রসঙ্গত জানালেন, তাঁর ক্লিনিক-এ চাইল্ড বার্থ এডুকেশন চালু করেছেন, তবে তা নর্মাল প্রেগন্যান্ট মহিলাদের জন্য নয়, হাই-রিস্ক প্রেগন্যান্টদের জন্য। অর্থাৎ, যে-সব গর্ভবতীরা কোনও কম্প্লিকেসি নিয়ে চিকিৎসার জন্য আসেন, তাদেরকে চিকিৎসার পাশাপাশি চাইল্ড বার্থ এডুকেশন দেওয়া হয়। তবে ভবিষ্যতে সাধারণ গর্ভবতীদের জন্যও বার্থ এডুকেশন চালু করার কথা ভেবেছেন বলে জানিয়েছেন ডা. খাস্তগীর।
ডা. লোধ এবং ডা. খাস্তগীরের ক্লিনিক ছাড়াও, চাইল্ড বার্থ এডুকেশন ক্লাস-এর ব্যবস্থা রয়েছে বেলভিউ মেডিকেল সেন্টারে। তবে এখানে অ্যাডভান্সড স্টেজ-এ অর্থাৎ ডেলিভারির ঠিক আগে দেওয়া হয় এই ধরনের শিক্ষা। কিন্তু যারা ‘ন্যাচারাল’ বার্থ-এর প্ল্যান করেছেন, তারা চাইলে গর্ভধারণের ঠিক পর থেকেই যোগ দিতে পারেন এই চাইল্ডবার্থ এডুকেশন ক্লাস-এ। মোট ছয় সপ্তাহ অর্থাৎ প্রায় দেড় মাস হাতে-কলমে দেওয়া হয় এই শিক্ষা। ব্রিদিং, রিলাক্সেশন, প্রি অ্যান্ড পোস্ট ডেলিভারি অ্যাক্টিভিটির বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ, এক্সারসাইজ প্রভৃতি ব্যবহারিক শিক্ষা খুব যত্ন সহকারেই দেওয়া হয় এই হেল্থ সেন্টার-এ। প্রতি মঙ্গলবার সন্ধে সাড়ে ছ’টা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত চালু থাকে ক্লাস। এছাড়া দুটি শনিবার সকাল আটটা থেকে দুটো পর্যন্ত দুটি স্পেশাল ক্লাস নেন চাইল্ডবার্থ এডুকেটর-রা। সেইসঙ্গে, পোস্ট ডেলিভারি পর্বে ব্রেস্টফিডিং-এর বিষয়েও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সদ্য-মায়েদের।
আসলে, আধুনিক জীবনধারায় প্রেগন্যান্ট মহিলাদের রিস্ক ফ্যাক্টর ক্রমশ বাড়ছে। ধুলো-ধোঁয়ায় ভরা দূষিত পরিবেশে বসবাস, অতিরিক্ত ফার্স্ট ফুড খাওয়া, ধূমপান, মদ্যপান, ওবেসিটি প্রভৃতি কারণে প্রেগন্যান্ট মহিলাদের কমপ্লিকেসি বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতি আটচল্লিশজন গর্ভবতীর মধ্যে একজন মহিলা, ঝুঁকি বা শারীরিক জটিলতার শিকার হন। তাই, প্রত্যেক গর্ভবতীরই চাইল্ড বার্থ এডুকেশন নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন ডা. অনিতা রায়। বিশেষকরে যারা ওবেসিটির শিকার কিংবা যারা দীর্ঘদিন ধূমপান ও মদ্যপান করার পর প্রেগন্যান্ট হয়েছেন, তাদের কমপ্লিকেসি এবং রিস্ক থাকার চান্স বেশি।
তবে শুধু ঝুঁকির বিষয়টিই নয়, পেনলেস ডেলিভারি, বেবির সুস্থতা প্রভৃতির জন্যও কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক নিয়ম এবং প্রক্রিয়া শিখে নেওয়া লাভদায়ক। যেমন– এরমধ্যে ভদ্রাসন অন্যতম। প্রতিদিন সঠিক পদ্ধতিতে ভদ্রাসন করলে পেটের সন্তানও যেমন সুস্থ-স্বাভাবিক থাকে, তেমনই প্রসবকালীন কষ্ট থেকেও রেহাই পাওয়া যায়। তাছাড়া শুধু প্রিডেলিভারি এডুকেশনই নয়, পোস্ট ডেলিভারি এডুকেশন নেওয়াও প্রয়োজন। কারণ সন্তান প্রসবের পর নিজের বিশ্রাম, খাওয়া এবং বাচ্চার সঠিক যত্ন এবং সেবার বিষয়েও জ্ঞানার্জন জরুরি। শুধু তাই নয়, ডেলিভারির কিছুদিন পর ক্লান্তি এবং অবসাদ যাদের গ্রাস করে, সেইসব মায়েদের কী করা উচিত, তাও চাইল্ডবার্থ এডুকেশন-এর সিলেবাস-এ রয়েছে। অতএব, অনভিজ্ঞ এবং অসহায় গর্ভবতীদের চাইল্ডবার্থ এডুকেশন নেওয়া অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন আজকের গাইনিকোলজিস্টরা।