স্বর্ণাভর মস্কো থেকে ফেরার দিন চলে এল। পূর্ব নির্ধারিত সময়মতো সন্ধ্যা ছটায় ফ্লাইট ল্যান্ড করার কথা। নম্রতা হাতে একগোছা গোলাপ নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে পৌনে পাঁচটায় মৃগাঙ্ককে সঙ্গে নিয়ে এয়ারপোর্টে এল। নির্দিষ্ট সময়মতো ফ্লাইট ল্যান্ড করল। একে একে সব যাত্রীরা চলে গেল। কিন্তু নম্রতার চোখ স্বর্ণাভকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। সে সংশয়পূর্ণ গলায় মৃগাঙ্ককে বলল, মৃগাঙ্কদা, সব যাত্রী তো চলে গেল। স্বর্ণাভ কোথায়! ও কি ফ্লাইট মিস করল!

সব যাত্রী চলে যাবার পরও নম্রতা বেশ কিছুক্ষণ স্বর্ণাভর জন্য অপেক্ষা করল। তার সে অপেক্ষা অপেক্ষাই থেকে গেল। স্বর্ণাভ ফিরল না। মৃগাঙ্ক বলল, বাড়ি ফিরে চলো। স্বর্ণাভ আজ আসবে না। হয়তো পরের কোনও ফ্লাইটে ফিরবে। ফোনও তো করা যাবে না। স্বর্ণাভ নিজে থেকে নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবে। ও জানে তুমি ওর জন্য চিন্তা করবে। দেখো, ঠিকই সময় করে কাল ফোন করে নেবে।

প্রবহমান সময় বয়ে গেল। সময় করে স্বর্ণাভর কোনও ফোন নম্রতার কাছে এল না। তারপর বিদেশ থেকে কত ফ্লাইট দেশে ল্যান্ড করল। নম্রতার অপেক্ষার পথ ধরে স্বর্ণাভ ফিরে এল না। মৃগাঙ্ক দুএকবার নম্রতাকে অনুরোধ করল তার বাবার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু বাবার মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো নম্রতার মুখ ছিল না। বেশ কয়েক মাস তার ছন্নছাড়া জীবন কাটল। সে মানসিক দিক থেকে খুবই ভেঙে পড়ল। এর প্রতিফলন তার শরীরে এবং বাহ্যিক চেহারায় পড়ল। এরই মধ্যে জীবন গতিপথ বদলাল।

এক রাতে নম্রতা মদ্যপ অবস্থায় ট্যাক্সি থেকে নেমে বাড়ি ফেরার রাস্তায় হাঁটছিল। নেশার ঘোরে তার দুপা টলছিল। সে আপন মনেই বলে উঠল, আজ ডিস্কোয় ড্রিংকটা খুব বেশি হয়ে গেল। এতটা না খেলেই হতো। ট্যাক্সির ড্রাইভারও বাজে। সবে এগারোটা বাজে। গভীর রাত আমাকে বুঝিয়ে বাড়ি পর‌্যন্ত এল না। সব বেইমান। পৃথিবীতে সব বেইমান। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে একজন ভদ্রলোকের সামনে টাল সামলাতে না পেরে সে পড়ে গেল। সে ভদ্রলোক অপরিচিত কেউ নন। নম্রতার বাবা প্রভাসবাবু। নম্রতা চোখটা ঈষৎ খুলে প্রভাসবাবুকে অস্ফুট কণ্ঠে ডাকল, বাবা। তারপরই সে জ্ঞান হারাল।

সকালে যখন নম্রতার হুঁশ ফিরল তখন দেখল সে বাবার কাছে। নিজের বাড়িতে বাবার সেবা শুশ্রূষায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠল। প্রভাসবাবু সব ভুলে মেয়েে ক্ষমা করে দিলেন। তিনি নম্রতাকে এটাও জানিয়ে দিলেন যে, এক মাসের মধ্যে নম্রতার বিয়ে দেবেন। বাবার কথার উপর কথা বলার ক্ষমতা নম্রতার ছিল না। স্বর্ণাভ যেন তার সমস্ত ক্ষমতা নিংড়ে নিয়ে চলে গেছে। একরকম পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এমডি ধ্রুব অধিকারীকে নম্রতা বিয়ে করে।

বিয়ে দীর্ঘ পনেরো বছর স্বর্ণাভর খোঁজ পাওয়ার বহু চেষ্টা সে করেছে। কিন্তু প্রতিবার ব্যর্থই হয়েছে। আজ না চাইতেই নম্রতার ভালোবাসার মানুষ স্বর্ণাভ তার দুহাতের নাগালে এসেছে। কিন্তু পূর্বের পরিচিত স্বর্ণাভ আর যে-মানুষটা আজ নম্রতার সামনে দাঁড়িয়ে তাদের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। দূর নক্ষত্রের মতো আজকের এই স্বর্ণাভ নম্রতার কাছে ভীষণ অপরিচিত।

নম্রতার গলায় কান্না দলা পাকিয়ে এসেছিল। সে সামলে নিয়ে বলল, সময় কারওর জন্য অপেক্ষা করে না ঠিকই। একটা মানুষ তার ভালোবাসার মানুষের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে পারে। তোমার আসার জন্য আমি আজও অপেক্ষা করে আছি।

—তুমি ভীষণ বোকা আর ছেলেমানুষ। আমি অপেক্ষা করিনি তোমার জন্য। অতীত সবসময় অতীত, বর্তমানটাই জীবন। আমার বর্তমান আমার নাম, যশ, খ্যাতি, অর্থ এনে দিয়েছে। ওই দ্যাখো আমার স্ত্রী, আমার বর্তমান।

স্বর্ণাভর প্রসারিত হাতের দিকে নম্রতা চেয়ে দেখল একটু দূরে কাঠের বেঞ্চে একজন ভদ্রমহিলা বসে আছেন। স্বর্ণাভ নম্রতার হাত ধরে বলল, চলো তোমার সঙ্গে আমার স্ত্রী অ্যাবেলার পরিচয় করিয়ে দিই।

নম্রতার মুখচোখ রাগে বিরক্তিতে লাল হয়ে উঠল। সে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে স্বর্ণাভকে বলল, ছি! ছি! তোমার মতো বিশ্বাসঘাতকের জন্য আমি এতদিন অপেক্ষা করেছি। এটা ভাবলে আমার নিজের উপরে ঘৃণা হচ্ছে। তোমার জন্য আমি আমার স্বামী ধ্রুবকে আঘাত করেছি প্রতিটা মুহূর্তে। নাম, যশ, খ্যাতি, অর্থের এত লোভ তোমার স্বর্ণাভ যে, সব অতীত ভুলে বিদেশিনিকে ঘরে তুলে স্ত্রীর মর‌্যাদা দিতে হয়েছে। আমার বাবাই ঠিক ছিল। আমি সবটাই ভুল করেছি। নম্রতা কথা শেষ করে কাঁদতে কাঁদতে একটা চড় মারল স্বর্ণাভর গালে। তারপর লন ছেড়ে ছুটতে ছুটতে হোটেলের ঘরের দিকে পা বাড়াল। কিছুটা পথ গিয়ে ধ্রুবর সঙ্গে তার সজোরে ধাক্কা লাগল। ধ্রুবও হোটেলের রুম থেকে নম্রতাকে খুঁজতে বেরিয়েছিল।

ধ্রুবর প্রতি নম্রতা স্বভাবিক আড়ষ্টতাবশত নিজেকে সামলে নিল। ধ্রুব বলল, জীবনে চলার পথে অসতর্ক হতে নেই নম্রতা। সাবধানে দেখে পা ফেলতে হয়। আজ তোমার চোখ মুখ দেখে আমি জিজ্ঞাসা করব না যে তোমার কী হয়েছে। কারণ তোমার চোখ মুখ তা বলে দিচ্ছে। তোমার সঙ্গে যা হয়েছে তা ভালো হয়নি। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সস্ত্রীক স্বর্ণাভকে দেখে ধ্রুব হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ল।

নম্রতা ধ্রুবর বুকে মাথা রেখে জ্যাকেটটা দুহাতে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি তোমার সঙ্গে যা করেছি ভুল করেছি। জানি এই ভুলের কোনও ক্ষমা হয় না। পারলে আমাকে ক্ষমা কোরো।

ধ্রুব নম্রতার মুখটা একটু তুলে বলল, চলো রুমে। আশা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। তোমার চোখে আমি জল দেখতে চাই না। তোমাকে সারাজীবন হাসিখুশি দেখতে চাই। যার জন্য তুমি জল ফেলছ মনে রেখো সে তোমার চোখের জলের যোগ্যই নয়। ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে ক্ষমার সম্পর্ক হয় না। আর তুমি আমাকে না ভালোবাসলেও আমি তো তোমাকে ভালোবাসি। আমার বর্তমান-ভবিষ্যৎ সবকিছুই তোমাকে ঘিরে। আর ভাগ্যিস তুমি এখানে বেড়াতে এলে নাহলে বাকি জীবনটাও আমি তোমার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হতাম। হোল্ড মি টাইট নম্রতা। জ্যাকেটের কলারটা আর একবার ধরো প্লিজ।

ধ্রুবর কথা শুনে নম্রতা হাসতে হাসতে তাকে জড়িয়ে ধরল। ধ্রুবও নম্রতাকে সজোরে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘ চুম্বন করল। মনে হল নির্জনতার বুকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল নম্রতা। ধ্রুবর বুকে মাথা রেখে সে অদূর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখল।

ধীর পায়ে সন্ধ্যা নামছে হিমালয়ে কোল জুড়ে। ঠান্ডা হাওয়ায় ভেসে আসছে পাহাড়ি ফুলের গন্ধ। ঠান্ডায় প্রায় জনমানবশূন্য হয়ে গেল হোটেলের বাইরের লন। ঝিঁঝি পোকার ডাক, অদূরে ঝরনার শব্দ কানে আসছে। আকাশ, বাতাস, একটা পাহাড়ি-সন্ধ্যা সাক্ষী থাকল ধ্রুব-নম্রতার ভবিষ্যৎ স্বপ্নের।

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...