চোখের জল মুছতে মুছতে শিঞ্জিনি সেদিন সোহম সেনকে জানাল, আমার এই যন্ত্রণার কথা আমি কাকে বলব! আমার যখন মাত্র দশ বছর বয়স, তখন এক কঠিন অসুখে ভুগে আমার মা মারা যান। মা মারা যাওয়ার পরে, বাবা কেমন যেন নৈরাশ্যের শিকার হয়ে পড়লেন। আমাদের মারোয়াড়ি যৌথ ব্যবসায়ী পরিবার। আসানসোলে জিটি রোড লাগোয়া আমাদের বাড়ি। মার্বেল টাইলস-এর ব্যাবসা আমাদের। আসানসোলে রাঠোড়-টাইলস ফ্যাক্টরির নাম সবাই এক-ডাকে চেনে। বাবার ওইরকম অবস্থার পরে কাকারা পারিবারিক ব্যাবসার হাল ধরার সঙ্গে সঙ্গে, আমার সব দায়ভারও তাদের ঘাড়ে তুলে নিয়েছিলেন। এখানে কলকাতায় আমার মাসির বাড়িতে থেকে ইঞ্জিনিয়রিং পড়ছিলাম কিন্তু কোত্থেকে যে কী…!

সোহম সেন সেদিন শিঞ্জিনিকে কেবলমাত্র সান্ত্বনাই দেননি, গ্রাফোলজির পাঠ প্রদানের পাশাপাশি দিনের পর দিন গ্রাফোথেরাপির মাধ্যমে শিঞ্জিনির হাতের লেখা সংশোধন করে দিয়ে ওকে সুস্থ-সবল ব্যক্তিত্ত্ব সম্পন্ন একজন মানুষ হিসাবে গড়ে দিয়েছিলেন। গ্রাফোলজি কোর্স শেষ হওয়ার পরেই শিঞ্জিনি সেক্টর ফাইভের নতুন চাকরিতে জয়েন্ট করেছিল। নতুন কোম্পানিতে বছর খানেক চাকরি করার পরে, কোম্পানি শিঞ্জিনিকে তাদের বেঙ্গালুরু অফিসে ট্রান্সফার করে দিল। তার আগে অবশ্য তারা ওকে ছয় মাসের জন্য ক্যালিফোর্নিয়া থেকে ট্রেনিং দেওয়ারও ব্যবস্থা করেছিল।

আজ প্রায় তিনবছর বাদে, শিঞ্জিনি এই গ্রাফোলজি ইন্সটিটিউটে পা দিল। ওকে বসতে বলে সোহম সেন ওর কাছে জানতে চাইলেন, তারপরে কেমন আছো বলো! তুমি এখন আসছ কোত্থেকে? বেঙ্গালুরু না, আসানসোল? হ্যান্ডরাইটিং প্র‌্যাকটিস চলছে?

সোহম সেনের পরপর এতগুলো প্রশ্ন শোনার পরেও শিঞ্জিনি নির্বাক। সোহম সেন ফিরে প্রশ্ন করলেন, কী হল! তুমি চুপ করে আছো কেন! ইজ দেয়ার এনিথিং রং?

এবার শিঞ্জিনি ঘাড় তুলে, চোখের কোণে আঙুল ঠেকাল। তারপরে খুব নীচু গলায় জানাল, আমি আজই সকালের ফ্লাইটে বেঙ্গালুরু থেকে কলকাতায় এসেছি। আজই বিকেলে ভলভো ধরে আমার আসানসোল যাওয়ার কথা।

—তা এর জন্য এত মন খারাপ করার কী আছে!

—বেঙ্গালুরুর সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়ে এসেছি। গতকাল চাকরি ছাড়ার জন্য পেপার ডাউন করেছি। সিক্সটি ডেজের অ্যাডভান্স নোটিশ পিরিয়ড।

—চাকরি ছেড়ে তুমি কোথায় জয়েন্ট করছ? আর ইউ গোইং অ্যাব্রড! সোহম সেনের এই কথায় শিঞ্জিনির সব আবেগের বাঁধ ভাঙল।

হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে শিঞ্জিনি জানাল, আমার জীবনটা আবার একটা কানা গলির মুখে এসে আটকে গেল স্যার। আমার বাড়ি থেকে বিয়ে ঠিক করেছে। বাবার অক্ষমতার সুযোগ নিয়ে কাকারা আমার সঙ্গে কোনও আলোচনা না করে, আমাকে ছেলেটার সঙ্গে কোনওরকম কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। ছেলেটাকে কেমন দেখতে সেটা পর্যন্ত আমি জানি না। শুধু একটা জিনিসই আমি জানি যে, আমার শ্বশুরবাড়ি বিশাল ধনী।

জয়পুরের একটা কর্পোরেট হাউসের মালিক ওই পরিবার। নাম বললে সবাই চিনবে— বনসল হাউস। বনসল স্টিল, বনসল ফার্মাসিউটিকাল, বনসল ফার্মাসিউটিকাল সফ্টওয্যার কী ব্যাবসা নেই তাদের! কাকারা বাবার মানসিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে বাবাকে এমন ভাবে বুঝিয়েছে যে, বাবাকে এই ভাবনা থেকে বের করে আনা আমার কর্ম নয়।

বাবাকে কড়াভাবে কিছু বললে, বাবা এমনভাবে রিঅ্যাক্ট করছে যে, তা দেখলে আমার ভয় লাগছে। আমার কারণে বাবার যদি কিছু হয়ে যায়! মা-কে তো সেই কবেই হারিয়েছি, এরপরে বাবাকেও যদি হারাতে হয়, তাহলে আমার বাকি জীবনটা…! কথা শেষ করতে পারে না শিঞ্জিনি। মাথা নীচু করে, দু-হাতে মুখ চাপা দেয় সে।

ক্রমশ…

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...