আপনারা জানলে অবাক হবেন যে, শিশুদের সঠিক মানসিক বিকাশে ওদের প্রিয় খেলনাগুলিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক্ষেত্রে যেটা প্রয়োজন তা হল, শিশুদের সঠিক বয়সে সঠিক খেলনা দিতে হবে। খেলনাগুলি এমন হওয়া উচিত যাতে ওগুলো নিয়ে খেলার সময় শিশুরা সম্পূর্ণরূপে খেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকতে পারে এবং খেলতে খেলতে শিশুদের ব্যক্তিত্বের বিকাশও ঘটবে।
রিমোট এবং ব্যাটারি-সহ যে খেলনাগুলি পাওয়া যায় সেগুলো নিয়ে খেলার পরিবর্তে, শিশুরা যদি নিজেরা শারীরিক সক্ষমতার সঙ্গে খেলতে পারে সেটা ওদের শেখার ক্ষেত্রে বেশি সহায়তা করে। এমন অনেক খেলনা আছে যেগুলো দামে সস্তা হওয়া সত্ত্বেও শিশুদের জন্য খুবই উপযোগী। এ ব্যাপারে অভিভাবকদেরও মনে রাখতে হবে যে, শিশুকে কত বেশি দামের খেলনা কিনে দিলেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, খেয়াল রাখুন ওগুলো বাচ্চাদের জন্য কতটা উপযোগী এবং ওরা তা কতটা পছন্দ করে।
আমরা যখনই বাচ্চাদের মনস্তত্ত্ব বোঝার চেষ্টা করি, আমাদের প্রচেষ্টা থাকে ওদের না-বলা কথাগুলোকে বোঝার। আমরা চেষ্টা করি কোনও না কোনও ভাবে ওদের ‘দুনিয়া’-তে পৌঁছানোর। ওদের দুনিয়ায় একটি দেশলাই বাক্সকে উড়োজাহাজ বলে মনে হয়। যেখানে সামান্য ছোটো ছোটো খেলনার মাধ্যমেও অনেক বড়ো বড়ো স্বপ্ন সাজানো যায়। যে দুনিয়ায় কখনও যানবাহনের চাকা দিয়ে আবার কখনও দেশলাই বাক্সগুলোকে পরপর সাজিয়ে প্রাসাদ নির্মাণ করা যায়। কোনও খেলনা ভেঙে গেলে বাচ্চারা ঘণ্টার পর ঘণ্টা চোখের জল ফেলে। আবার নতুন কোনও খেলনা হাতে পেলে এমন ভাবে আনন্দ প্রকাশ করে, যেন যক্ষের ধন খুঁজে পেয়েছে।
ভবিষ্যতের উন্নয়ন কৌশল
আমাদের প্রত্যেকেরই শৈশবের কোনও না কোনও খেলনার কথা আজও মনে আছে। কিন্তু আপনি কি জানেন যে, খেলনা দিয়ে খেলা শুধুমাত্র একটি কার্যকলাপ নয়, এটি একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের বিকাশের ভিত্তি তৈরি করে? খেলনা দিয়ে খেলতে খেলতে বাচ্চারা আত্ম-সচেতনতা, অন্যের সঙ্গে মেলামেশা, আত্মবিকাশের মতো বিষয়গুলো শিখতে পারে। যা সঠিক ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
মনোবিদ সোনাল গুপ্তা জানিয়েছেন, ‘অনেক সময় শিশুরা কিছু কিছু কথা তাদের বাবা-মাকে বলতে পারে না। কিন্তু সেটাই ওরা খেলনার মাধ্যমে বলতে পারে। তাই, শিশুর সঙ্গে খেলাধুলোর মাধ্যমে কিছুটা সময় কাটানো উচিত বড়োদের। এতে করে শিশুদের মনো-জগতের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন।’ মনোবিদরা এই ভাবে ‘প্লে থেরাপি’-র প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই শিশুদের মনের জগতে প্রবেশ করেন এবং তাদের অনেক সমস্যার সমাধানে সহায়তা করেন।
দামি খেলনার প্রয়োজন হয় না
সাধারণত অভিভাবকরা মনে করেন শিশুরা দামি খেলনা বেশি পছন্দ করে। এই ধারণা সঠিক নয়। অনেক সময় দেখা যায় শিশুরা সস্তার কোনও খেলনা দেখে বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। খেলনা কেনার সময় ওদের পছন্দের ব্যাপারে নজর দিন। বয়স অনুযায়ী বাচ্চাকে কী শেখানো যেতে পারে, তা মাথায় রেখে ওদের খেলনা কিনে দিন।
খেলনা শিশুদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস। তবে খেলনাটি যে ব্যয়বহুল হতে হবে এরকম মোটেই নয়। খেয়াল রাখুন যে, মনের বিকাশের পরিবর্তে খেলনাগুলি শিশুর জেদ এবং অহংবোধের দরজা যেন না খুলে দেয়। মনে রাখবেন, খেলনাগুলি হল বাচ্চাদের কল্পনার প্রতীক মাত্র। কাগজের নৌকা হোক বা শুকনো কাঠের তৈরি উড়োজাহাজ, কল্পনার এই জগতেই যেন ওরা বিচরণ করে।
খেলনার মাধ্যমেই শিশুর রুচি প্রকাশ পায়
সাইকোথেরাপিস্ট ডা. নেহা আনন্দ জানিয়েছেন, ‘একটি শিশু যখন খেলনা নিয়ে খেলে, তখন আমরা তার স্বভাব সম্পর্কে ধারণা করতে পারি। এই সময়েই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, শিশুটির কোন বিষয়ে আগ্রহ আছে। যে বাচ্চা ছোটো থেকেই ক্রিকেট খেলার প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, স্বভাবতই বড়ো হয়ে তার ক্রিকেটার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’
খেলার মধ্যে দিয়েই বাচ্চাদের স্বভাব ও আচরণ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। অনেক বাচ্চা খেলতে খেলতে প্রচণ্ড রেগে যায়। বুঝতে হবে এরা রাগী স্বভাবের। অভিভাবকদের চেষ্টা করতে হবে কীভাবে এদের রাগের স্বভাব দূর করা যায়। নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন বাচ্চারা মাঝেমাঝে বল নিয়ে লোফালুফি করে। এটি ওদের কাছে নিতান্তই একটি খেলা। কিন্তু একটু গভীর ভাবে দেখলে বুঝতে পারবেন, বলকে তালুবন্দি করার এই খেলার মাধ্যমে ওদের শুধু শারীরিক এক্সারসাইজ নয়, মানসিক এক্সারসাইজও হয়। বৃদ্ধি পায় একাগ্রতা। এর সঙ্গে ওরা বলের গতির অনুমান করতেও শেখে। এছাড়া কাগজ ছেঁড়া, পেন্সিল দিয়ে দেয়ালে আঁকিবুকি কাটা ওদের একপ্রকার খেলা। যদিও কোনও কোনও অভিভাবক এটা সন্তানদের খারাপ আচরণ মনে করেন। মনে রাখবেন, বাবা-মায়েরাও যদি ছোটো বাচ্চাদের সঙ্গে খেলার জন্য সময় দেন, তা ওদের সঠিক বিকাশে দারুণ কাজে আসে।
খেলনা শুধুমাত্র মন ভোলানোর জন্য নয়
বেশিরভাগ অভিভাবক মনে করেন যে, খেলনাগুলি তাদের বাচ্চাদের মন ভোলানোর একটি মাধ্যম। তাই তারা বাচ্চাদের জন্য সবচেয়ে দামি এবং সেরা খেলনা কিনে দেন। কিন্তু এগুলো তাদের বিকাশে মোটেই সাহায্য করে না। বরং বাবা-মায়ের এই আচরণের ফলে বাচ্চা জেদি হয়ে ওঠে। সে তখন নিজের জন্য দামি দামি খেলনা কেনার জন্য জেদ করে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, একটি শিশু যদি রিমোট-নিয়ন্ত্রিত এরোপ্লেন নিয়ে খেলে, তবে সে শিখবে বোতাম টিপলেই এরোপ্লেনটি উড়ে যায়। কিন্তু কোনও শিশু যদি সাধারণ এরোপ্লেন নিয়ে খেলে, তাহলে সে জানবে যে, এরোপ্লেন ওড়ার জন্য চাকা এবং ডানারও প্রয়োজন হয়। এমনকী ওড়ার আগে সমতল রাস্তারও প্রয়োজন হয়। তাই রিমোট-নিয়ন্ত্রিত খেলনার তুলনায় সাধারণ খেলনা নিয়ে খেললে শিশুরা বেশি শিখতে পারে।
বর্তমান সময়ে বাচ্চা যখনই কাঁদে তখন মা তাকে নিজের বা বাড়ির অন্য কারও মোবাইল দিয়ে দেন। বাচ্চাও সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল নিয়ে খেলা শুরু করে দেয়। ধীরে ধীরে এটাই বাচ্চার অভ্যাসে পরিণত হয়।
সাইকোথেরাপিস্ট ডা. নেহা আনন্দ জানিয়েছেন, ‘ব্লু স্ক্রিনের আসক্তি শিশুদের মনে কুপ্রভাব ফেলে। এটি শরীরে আসক্তিতে পরিণত হয়। এক্ষেত্রে মনে রাখবেন, স্ক্রিন বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এর কুপ্রভাবও বাড়তে থাকে। খেলনার পরিবর্তে শিশুদের মোবাইল ফোন কখনওই দেওয়া উচিত নয়। এর প্রভাব শিশুদের মনে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত থেকে যায়।
মেয়েদের জন্য আলাদা কোনও খেলনার যুগ নেই
কয়েক বছর আগেও খেলনা কেনার সময় মাথায় রাখা হতো সেটি ছেলের না মেয়ের। আমরা যখন ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে সমতার কথা বলছি, খেলনাগুলিতেও কোনও বৈষম্য করা উচিত নয়।
ডাক্তার নেহা আনন্দ বলেন, ‘স্কুলে কাউন্সেলিং করার সময় আমরা দেখি মেয়েদের লালন-পালনে কী ধরনের পার্থক্য রয়েছে। যেসব মেয়েরা ‘ছেলে-মেয়ে’-র ভেদাভেদের পরিবেশে বড়ো হয়, তাদের মনের মধ্যে হীনমন্যতা বাসা বাঁধে। আবার যাদের লালন-পালনে এই বৈষম্য থাকে না, তারা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়।’
খেলার জন্য বাচ্চাদের সব ধরনের খেলনা দিতে হবে। আরও ভালো হয়, যদি বাচ্চারা কাগজ বা অন্যান্য জিনিস থেকে নিজেরাই খেলার জন্য কিছু প্রস্তুত করে। এতে করে ওদের শেখার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। এই কারণেই বিভিন্ন স্কুলে কাগজের তৈরি খেলনা তৈরি করা শেখানো হয়।
শিশুদের বিকাশে বেশি সাহায্য করে সেইসব খেলা যেগুলো ওরা বাড়ির বাইরে মাঠে গিয়ে খেলে। ইনডোর হোক বা আউটডোর— খেলাধুলোর মাধ্যমে শিশুদের শুধু শারীরিক বিকাশই হয় না, মানসিক বিকাশও হয়। একইসঙ্গে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং একাগ্রতাও বৃদ্ধি পায়। এরফলে বাচ্চারা কখনওই মানসিক রোগের শিকার হয় না।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, বর্তমানে মাঠে গিয়ে খেলার প্রবণতা কমে যাচ্ছে। বিদ্যালয় হোক বা অভিভাবক— কেউই এ ব্যাপারে মনোযোগ দিচ্ছেন না। মাঠে খেলাধুলো করলে শিশুরা শারীরিক দিক থেকে বেশি শক্তপোক্ত হয়, যা তাদের ভবিষ্যৎ জীবনে কাজে লাগে। এর ফলে শিশু সামাজিক হয়ে ওঠে। পাশাপাশি মোবাইল গেমস বাচ্চার মধ্যে একা থাকার অভ্যাস তৈরি করে, যা তাকে অন্যদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখে।