হিস্ট্রি মিউজিয়ামের ঠিক উলটো দিকে রয়েছে বাটাভিয়া ক্যাফে। ১৮৩০ সালে তৈরি একটা আইকনিক বিল্ডিং-এ তৈরি হয়েছে এই ক্যাফে। বিকেল থেকেই শুরু হল ব্যান্ড পারফরমেন্স। দেখতে দেখতে ক্যাফে ভরে উঠল। আমরা উপরতলায় জানলার ধারে বসে বাইরের লোকজনের যাওয়া আসা দেখতে দেখতে ডিনার করলাম। ওল্ড জাকার্তার এই দিকটা ঘুরে আজ মনের মধ্যে কোথায় যেন একটা খটকা লেগে রইল। ডাচ শাসকরা এখান থেকে চলে গিয়েও যেন রেশটুকু রেখে গেছে। আমাদের যে দিন চলে যায়, সত্যিই কি একেবারে চলে যায়? নাকি আমরাই তাকে না দেখে থাকার ভান করি মাত্র? সারাদিন ওল্ড বাটাভিয়ার ইতিহাসে ডুবে থেকে সময় যে কোথা দিয়ে কেটে গেল বোঝার আগেই চারদিকে আলোর রোশনাই ফুটে উঠল। দিনের শেষে হোটেলে ফিরে মনে হল ইতিহাস আমাদের কত শিক্ষা দেয়। আমরাই হয়তো এর যথার্থ মূল্যায়ন করে উঠতে পারি না।

ইন্দোনেশিয়াতে আজই আমাদের শেষ দিন। রাতের ফ্লাইটে অস্ট্রেলিয়া ফিরতে হবে। সারাটা দিন হাতে রয়েছে। গাড়ির ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করলাম ও আজ সারাদিন আমাদের ঘুরিয়ে বিকেলে এয়ারপোর্টে নামিয়ে দেবে। বাইরের প্রকৃতি যেন সকাল থেকেই তেতে আছে। আর সেই সঙ্গে রয়েছে আর্দ্রতা। জলবায়ু খুব একটা আরামদায়ক নয়।

ইন্দোনেশিয়ার সাধারণ মানুষ যেখানে সারা জীবনের সঞ্চয় দিয়ে মাথার উপর একটা ছাদ তৈরি করতেই হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে ইন্দোনেশিয়ায় ছয়টি প্রেসিডেন্সিয়াল প্যালেস রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তাতে রয়েছে মারদেকা প্যালেস। মারদেকা স্কোয়ারের পাশেই এই প্যালেস। এটি জাকার্তার প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসস্থান। বিশাল উঁচু প্রাচীরে ঘেরা এই প্যালেস। সাধারণ মানুষের এখানে প্রবেশাধিকার নেই।

ডাচ গভর্নররা সারা জীবন নেদারল্যান্ডস-এর ঠান্ডা জলবায়ুতে থেকে বাটাভিয়ার উষ্ণ ও আর্দ্র জলবায়ুতে মানিয়ে নিতে পারছিলেন না। তাই ১৭৪৭ সালে তৈরি হয় ডাচ গভর্নরের গ্রীষ্মকালীন বাস ভবন, এখন যার নাম ‘বোগোর প্যালেস’। ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় যাকে বলা হয় “ইস্তানা বোগোর’। ওয়ার্ল্ড নিউ-এর দৌলতে অনেকেই হয়তো বোগোর প্যালেস দেখে থাকবে। কারণ এখানেই এখন বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতারা মিটিং করতে আসে। জাভা দ্বীপের পশ্চিমে জাকার্তা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে বোগোর শহরে তৈরি হয়েছে এই প্যালেস। জাকার্তা থেকে এত কাছে হওয়া সত্ত্বেও এখানকার জলবায়ু অনেকটাই মনোরম। চারদিকে ঘন জঙ্গল বলে এখানে তাপমাত্রা অনেকটাই কম। আর সমুদ্র উপকূল থেকে দূরে বলে বায়ুর আর্দ্রতাও কম। সব মিলিয়ে বিদেশি শাসকদের আদর্শ বাসস্থান ছিল এটি। ইউরোপীয় এবং ইন্দোনেশিয়ান স্থাপত্য শৈলীর মিশ্রণে প্রায় ২৮ হেক্টর জমি নিয়ে তৈরি এই প্রাসাদ। প্রাসাদের চারপাশে রয়েছে বাগান। ১৮০৮ সালে গভর্নর জেনারেল হারম্যান উইলিয়াম ডেনডেলস ইন্ডিয়া আর নেপাল থেকে কিছু হরিণ নিয়ে এসেছিলেন। আজও বোগোর প্যালেসের বাগানে সেই হরিণের বংশধর ঘুরে বেড়ায়, পর্যটকদের মনোরঞ্জন করে।

আমাদের ড্রাইভারের কাছে জানতে পারলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানিজ সৈনিকরা এই প্যালেসে এসেছিল। তারপর যুদ্ধে হেরে ইন্দোনেশিয়া থেকে যাওয়ার আগে এই প্যালেসের সব জিনিসপত্র লুট করে নিয়ে গেছে। তাতেও রক্ষা হয়নি, যাওয়ার আগে প্যালেসের একটা বড়ো অংশ আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে গেছে। তারপর প্রেসিডেন্ট সুকর্ণ আবার এই প্যালেসের মেরামত করেন। ১৯৬৮ সাল থেকে বোগোর প্যালেস জনসাধারণের ঘুরে দেখার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে আগে থেকে অনুমতি নিয়ে যেতে হয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ আমার এসব কিছুই জানা ছিল না। প্যালেসের সামনে দাঁড়ানো গার্ডদের অনেক অনুনয় বিনয় করেও কোনও কাজ হল না। শেষ পর্যন্ত বোগোর প্যালেসকে বাইরে থেকে দেখেই ফিরে আসতে হল।

তিনশো বছরের ইতিহাস জড়িয়ে আছে এই প্রাসাদের আনাচে কানাচে। এতদূর এসে প্যালেসের ভিতরে ঢুকতে পারলাম না বলে মনটা একটু খারাপ হল। প্যালেসের ভিতরের বিপুল আর্ট কালেকশন দেখতে না পারার দুঃখ নিয়ে যখন গাড়িতে এসে বসলাম তখন আমাদের ড্রাইভার বলল, ‘মন খারাপ না করে চলুন আপনাকে আরেকটা ভালো জায়গায় নিয়ে যাই।’

মনে মনে রাগ হল, ভাবলাম, ‘এর থেকে ভালো জায়গা বোগোর-এ আর কী থাকতে পারে?”

মুখে শুধু বললাম, “কোথায়?”

ড্রাইভার বলল, ‘বোগোর বোটানিকাল গার্ডেন।’

আগে থেকে প্ল্যান করে আসিনি বলে সব কিছুই অজানা। আমাদের আজ সারাদিন আর তেমন কিছু করার নেই, তাই ড্রাইভারের কথায় রাজি হয়ে গেলাম। পার্কিং লটে গাড়ি পার্ক করে ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে টিকিট কেটে বোটানিকাল গার্ডেনে ঢুকলাম। এখানকার শান্ত পরিবেশ বোগোর প্যালেসে ঢুকতে না পারার দুঃখটা সঙ্গে সঙ্গেই ভুলিয়ে দিল।

১৮১৭ সালে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ৮৭ হেক্টর জায়গা জুড়ে বোগোর বোটানিকাল গার্ডেন তৈরি করেছিল। এই বোটানিকাল গার্ডেনকে বিষয়ভিত্তিক ভাবে বিভিন্ন অংশে ভাগ করা হয়েছে। এখানে ইন্দোনেশিয়া-সহ সারা পৃথিবী থেকে সংগ্রহ করা বিরল প্রজাতির গাছপালা রয়েছে। ট্যুরিস্টদের জন্য এখানে হাঁটাপথ ও বিশেষ গাড়ির ব্যবস্থা আছে। বেশ কয়েকটি পিকনিক স্পট চোখে পড়ল। মনে হল স্থানীয় লোকেদের কাছে এটা বেশ জনপ্রিয়। ফটোগ্রাফির জন্যও বেশ সুন্দর জায়গা।

বোটানিকাল গার্ডেন আসলে বোগোর প্যালেসকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছিল। এর পিছনে হয়তো দুটো কারণ ছিল। বোটানিকাল গার্ডেনের গাছপালা একদিকে যেমন এখানকার জলবায়ুকে ঠান্ডা রাখত, তেমনই আবার গভর্নর ও তার পরিবারের লোকেদের জন্য নিরাপত্তা আর কিছুটা একান্ত পরিবেশ তৈরি করত। বছরের পর বছর ধরে এখানে নতুন গাছ লাগানো হচ্ছে। বোগোর বোটানিকাল গার্ডেন শুধুমাত্র ট্যুরিস্টদের জন্য নয়, এটি এখন একটি বিখ্যাত গবেষণা ও শিক্ষাকেন্দ্র। এখানে অনেক এনডেঞ্জারড বা বিপন্ন প্রজাতির গাছপালা সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাই দেশ-বিদেশ থেকে অনেকেই এখানে আসে রিসার্চ করার জন্য।

সারাদিন ধরে ঘুরে দেখলেও হয়তো মন ভরবে না। কিন্তু আমাদের তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। তাই বোগোর বোটানিকাল গার্ডেন থেকে বেরিয়ে কাছেই একটা রেস্তরাঁতে লাঞ্চ করা হল। ড্রাইভার জানাল এখান থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা লাগবে এয়ারপোর্ট পৌঁছোতে। তাই আর দেরি না করে রওনা দিলাম এয়ারপোর্টের পথে। গাড়িতে বসে বার বার মনে হল, আজকাল মিডিয়া শুধু জাকার্তার বায়ুদূষণ নিয়ে কথা বলতে ব্যস্ত। গত তিনশো বছরের যে ইতিহাস এর জন্য অনেকটাই দায়ী, সে ব্যাপারে কথা বলার সময় বা উৎসাহ কোনওটাই আজকের মিডিয়ার নেই। কিন্তু ইতিহাস না জানলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এর পুনরাবৃত্তি ঠেকাবে কী করে?

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...