আমাদের কল্পনায় মনের ভিতরে স্বর্গের একটা অজানা রূপ গড়া আছে। সেই স্বর্গ যেন শ্বেতপাথর ছেনে তৈরি। তবে আমি কিন্তু শ্বেতপাথরের যে সমারোহ দেখে এলাম, তাকে স্বর্গরাজ্য বলাই যায়। আমাদের কাছে যার পরিচিত নাম মার্বেল-রক। খুব বেশি দূরে নয়। ট্রেনে মাত্র এক রাতের যাত্রাপথ৷ তিন-চার দিনের ছুটি পেলেই দিব্যি ঘুরে আসা যায়। আমিও তেমন-ই এক সপ্তাহান্তে বন্ধুর সঙ্গে বেরিয়ে পড়েছিলাম সেই স্বর্গ দেখার লোভে। বন্ধুকে নেওয়ার আমার একমাত্র উদ্দেশ্য, ওর ক্যামেরা যেন রং তুলি দিয়ে ছবি আঁকে মনের ক্যানভাসে।

জব্বলপুরে যদিও বিমানবন্দর আছে, তবুও আমি কোথাও ঘুরতে গেলে খুব নিরুপায় না হলে সাধারণত বিমানে যাই না। কারণ ট্রেনে বেশি সময় ধরে গেলে কিছুটা সময়ের অপচয় হয় বটে, তবে চারপাশটা অনেক বেশি উপভোগ করা যায়। পাঁচটি রাজ্য পেরিয়ে এক্ষেত্রে ভ্রমণের অনুভূতিটা বেশ চমকপ্রদই হল। ঠিক সেই কারণেই হাওড়া থেকে দুপুর একটা চল্লিশে উঠে পড়লাম, শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেসে। গন্তব্য একেবারে শেষ স্টেশন, জব্বলপুর।

পরদিন দুপুর প্রায় আড়াইটে নাগাদ জব্বলপুরে নেমে পড়লাম। স্টেশনটি ছবির মতো সুন্দর এবং অত্যাধুনিক। ফাঁকে একটা কথা বলে রাখা জরুরি যে, শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেসের খাবারের মান কিন্তু বেশ ভালো। আমিষ, নিরামিষ দু’রকমই যথেষ্ট সুস্বাদু। আমাকে আরও বেশি মুগ্ধ করেছিল ট্রেনের পরিচ্ছন্নতা। স্টেশনের কাছাকাছি প্রচুর বিভিন্ন মানের হোটেল আছে। একটি বাঙালি খাওয়ার হোটেলের পাশেই আমরা উঠলাম। উদ্দেশ্য ক’দিন বিভুঁইয়ে বাঙালি খাবারের স্বাদ। ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নিলাম, যাতে ট্রেন-যাত্রার ধকলটা কাটে। কারণ সন্ধের মুখেই আবার বেরব। আসলে একদম সময় নষ্ট করা নেই।

হোটেলের সামনে থেকেই একটি অটো রিজার্ভ করে নিলাম আড়াইশো টাকায় ‘কাচনার সিটি’ যাতায়াতের জন্য। কী আছে ওখানে! ভারতের সবচেয়ে বড়ো শিব মূর্তি স্থাপিত এক স্বর্গীয় উদ্যানে। ঠিক সন্ধে সাতটায় আরতি হয়। উদ্দেশ্য অনবদ্য সেই দৃশ্য উপভোগ করা। পরদিন আমাদের গন্তব্য আসল আকর্ষণ মার্বেল রক ও ধুঁয়াধার ফলস, সঙ্গে আরও কিছু উপরি দ্রষ্টব্য স্থান।

হোটেলের সামনেই গাড়ির স্ট্যান্ড। আমি মূল দু’টি দ্রষ্টব্য স্থান ছাড়াও আরও দু’টি জায়গা বেছে নিলাম। একটি হল চৌষট্টি যোগিনী মন্দির, অপরটি মদনমহল ফোর্ট ও তৎসংলগ্ন ব্যালেন্সিং রক। যাওয়া আসা চুক্তি হল দেড় হাজার টাকায়। মোটামুটি সব মিলিয়ে পঞ্চাশ কিলোমিটার ভ্রমণ। আমরা প্রাতঃরাশ সেরে বেরোলাম সকাল ন’টা নাগাদ। প্রথম গন্তব্য মার্বেল-রক। জব্বলপুর শহর ছাড়াতেই রাস্তার দু’পাশে জঙ্গল ফুঁড়ে মাথা উঁচু করতে লাগল ছোটো বড়ো টিলা। সময় গড়াতেই সেগুলো পাহাড়ের রূপ নিল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম মার্বেল-রক গাড়ি স্ট্যান্ডে। সেখান থেকে মার্বেল-রক নদীপথে কাছ থেকে উপভোগ করার জন্য বোটিং ঘাট প্রায় পাঁচশো সিঁড়ি নীচে। যাওয়ার পথের দু’ধারে হরেকরকম মার্বেলের দ্রব্যের পসরার দোকান। নিজের সংগ্রহ করার ইচ্ছেকে অতি কষ্টে দমন করে নামতে লাগলাম বোটিং ঘাটের দিকে। ঘাটের পাশেই পাঁচমাথার মন্দির। মাথাপিছু একশো টাকা টিকিট কেটে আমরা উঠে পড়লাম বোটে।

নৌকা ছাড়ল নর্মদা নদীর স্বচ্ছ সবুজাভ জলে। জলের নীচের পাথর, মাছ সব দৃশ্যমান। তবে আসল চমক নদীর দু’পাশে। এই সুন্দর যাত্রাপথে নৌকার যিনি চালক, তিনিই সাধারণত গাইডের কাজ করেন। বুঝিয়ে দিতে লাগলেন কোন স্থানে কোন সিনেমার কী গানের শুটিং হয়েছিল। চারপাশে শ্বেতপাথরের পর্বতমালা। আর তার শ্বেতশুভ্র দেয়ালে সূর্যের রামধনু রঙের নৃত্যনাট্য। নামেই শ্বেতপাথর, তার মধ্যে রয়েছে পীতাভ, নীলাভ, গোলাপি, বাদামি, সবুজের আভাযুক্ত কত রঙের মার্বেল! আরও একটি বিষয় মুগ্ধ করল, মার্বেলের খাঁজে নীল ডানার সোয়ালো পাখির বাসা। কোনও জায়গায় দু’ধারের পাথরের দেয়াল এত সরু হয়ে এসেছে, যেন লাফ দিয়ে চলে যাওয়া যাবে। আবার পরক্ষণেই তার বিপুল ফারাক।

এরকমই এক সংকীর্ণ জায়গার নাম ‘বান্দনি লাফ’। এখানে সত্যিই বাঁদর এ-মাথা থেকে ও-মাথা লাফালাফি করে। তার মাঝে খরস্রোতা নদী কোথাও সংকীর্ণ আবার কোনওখানে বিস্তৃত। ঘণ্টাখানেকের সফর, তবু মনে দাগ কেটে গেল আজীবনের মতো। এবার আবার নীচে থেকে গাড়ির কাছে উঠে আসার পালা। কিন্তু যাওয়ার সময়ের দু’পাশের লোভনীয় দ্রব্যাদি সংগ্রহের আগ্রহ আর সংবরণ করা গেল না। যথারীতি কেনাকাটা বেশ ভালোই হল। আর দামও তুলনামূলক অনেক সস্তা। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য মধ্যপ্রদেশ পর্যটনের বিস্ময় ধুঁয়াধার ফলস। প্রসঙ্গত বলে রাখি এই দ্রষ্টব্যস্থানগুলি সবই ভেড়াঘাট বা তার আশেপাশেই। যদি কেউ গাড়ির অর্থ বাঁচিয়ে বাসে আসতে চান, তাহলে তাকে নামতে হবে ভেড়াঘাট বাস স্টপে।

(ক্রমশ…)

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...