কালো রংয়ের পালিশ দরজায় সোনালি নেমপ্লেট। বিজয় পাণিগ্রাহী। তার নীচে সবিতা পাণিগ্রাহী। আর একবার নিজের মনের প্রস্তুতিটা সেরে নিল নীলমণি পরিদা। কলিংবেলে তর্জনী রাখতেই পাখি ডাকার শব্দ ভেসে এল বাইরে।
—আপনাকে ঠিক চিনলাম না। যদি নামটা বলেন…
—আমি নীলমণি পরিদা। আগন্তুক বটে, কিন্তু আততায়ী কিংবা প্রতারক নই।
—আরে না না, আপনি ওসব কেন হতে যাবেন। তাছাড়া বেলা এগারোটার সময় আবাসনের সিকিউরিটি চেক টপকে ওসব লোকেদের আসার কোনও প্রশ্নই নেই। আসুন ভিতরে আসুন। সবিতা পাণিগ্রাহী নীলমণি পরিদাকে আহ্বান জানালেন। থ্যাঙ্ক ইউ। আসলে আমি এসেছি আমার নিজের একটা প্রয়োজনে।
—আশ্চর্য, আমার কাছে আবার কীসের প্রয়োজন? আপনি জল খাবেন?
—হ্যাঁ, তা একটু খেতে পারি। ভদ্রমহিলা ঘরে যেতেই নীলুর চোখ চলে গেল দেয়ালে অয়েল পেইন্টিং-এর দিকে। ঠিক এইরকম একটা পেইন্টিং মাস চারেক আগে অলকানন্দা এনেছে।
—এই নিন জল।
আধ গেলাস জল খাওয়ার পর রুমাল দিয়ে মুখটা মুছে নিল নীলু পরিদা।
—পেইন্টিংটা খুব সুন্দর।
—হ্যাঁ, ওটা আমার স্বামী প্রায় মাসচারেক আগে দিল্লির একটা এক্সিবিশন থেকে কিনে এনেছেন। ঘর সাজানোর জিনিস সাধারণত আমিই কিনে থাকি। জীবনে এই প্রথম তিনি এই শৌখিন কাজটা করলেন। ভালোই লেগেছে তাঁর পছন্দটা। আপনি কী একটা বলছিলেন নিজের প্রয়োজনের কথা ।
—আসলে আমার স্ত্রী অলকানন্দা আর আপনার স্বামী একই কোম্পানিতে কাজ করেন। তাই কিছু কথা বলতে এসেছি। বিজয়বাবু নিশ্চয়ই অফিসে গেছেন?
—না, কোম্পানির কাজে বাইরে মানে কানপুরে গেছেন তিনদিন আগে। পরশু ফিরবেন।
—জানেন অলকানন্দাকেও ঠিক তিনদিন আগেই কোম্পানি তার কাজে ট্যুরে পাঠিয়েছে। আর ওরও পরশু ফেরার কথা। কি আশ্চর্য তাই না?
—এতে আশ্চর্যের কী আছে? দু’জনেই হয়তো একই প্রোজেক্টে আছে। তাই…
—সে হতে পারে। আমি কিন্তু সিওর নই যে প্রোজেক্টটা পাঁচদিনেরই।
—আপনি কী বলতে চাইছেন?
—আমি শুধু অনুমান করছি। নাও হতে পারে। আজকাল আমার স্ত্রী সব কথা সঠিক বলে না। এমনকী জায়গার নামও ভুল বলে। এই তো মাসছয়েক আগে ভুবনেশ্বর যাওয়ার নাম করে বেরিয়েছিল। কিন্তু সে ভুবনেশ্বর যায়নি।
—আপনি তো আপনার স্ত্রীর বিরুদ্ধে গোয়েন্দাগিরি করছেন। কী করে বুঝলেন যে, উনি ভুবনেশ্বর না গিয়ে অন্য কোথাও গিয়েছিলেন?
—তাহলে শুনুন, ও ভুবনেশ্বর থেকে একটা শাড়ি কিনে এনেছিল। ভুল করে শাড়িটা আমার জামাকাপড়ের তাকে রেখেছিল। অবশ্য প্যাকেট ছাড়াই। শান্তিপুরের তাঁতের শাড়ি। আচ্ছা বলুন তো, ভুবনেশ্বরে তাঁতের শাড়ি কেউ কেনে?
—এখানে আমার স্বামীর ভূমিকা কোথায়?
—আপনার স্বামী হয়তো তাঁতের কিংবা গরদের শাড়ি ভালোবাসেন। কিন্তু আপনার হয়তো সিল্ক, জর্জেট শাড়ি ভালো লাগে। তাছাড়া আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে,আপনি শাড়ির পরিবর্তে সালোয়ার কামিজ কিংবা জিন্স টপেই অনেক বেশি স্বচ্ছন্দ।
—কোনও কিছুর বিনিময়েই আমি আমার স্বাধীনতা ছাড়তে রাজি নই। আমি আমার পছন্দ নিয়ে থাকতেই ভালোবাসি। কারও পছন্দ মতো চলব কেন?
—জানেন, আমার স্ত্রী-কে আমি ‘অলকা’ নামেই ডাকি, কিন্তু ও কখনও আমার পছন্দের মূল্য দেয়নি। একসময় স্মিতা পাতিল ছিলেন আমার প্রিয় নায়িকাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর মার্জিত পোশাক আর বাইরের একটা পেলব আবরণ আমাকে ভীষণ আকৃষ্ট করত। একবার আমি আমার পছন্দের হালকা নীল রঙের সম্বলপুরী তাঁতের শাড়ি এনেছিলাম। সেই শাড়ি একদিনও ওকে পরতে দেখিনি। কিন্তু হঠাৎ করেই আটমাস যাবৎ ও তাঁত কিংবা সুতির শাড়ি পরা ধরেছে। এখন আর চলাফেরা করতে কোনও অসুবিধা হয় না।
—তাহলে তো বলতে হয়, উনি দেরিতে হলেও আপনার পছন্দের সম্মান আর মর্যাদা দিচ্ছেন। কী বলেন?
—না, আমার মনে হয় ওর এই পরিবর্তনের পিছনে অন্য কারও উৎসাহ কিংবা পছন্দ আছে।
—আচ্ছা, এখন আপনার স্বামী নিশ্চয়ই খুব কম কথা বলেন, তাই না? আগের মতো ছোটো ছোটো বিষয় নিয়ে কথায় কথায় ঝগড়াও করেন না।
হয়তো কাজের চাপ আছে তাই। দেখি তো, রাতে খাওয়াদাওয়ার পর এক কাপ কোল্ড কফি নিয়ে ল্যাপটপে কাজ সারেন অনেক রাত পর্যন্ত।
—এই অভ্যাসটা কি ওনার বরাবরের?
—না, এই অভ্যাসের বয়স ছয় থেকে আট মাস হবে। কেন বলুন তো? আপনি তো দেখছি, সিআইডি সিরিয়ালের এসিপি প্রদ্যুম্ন স্যারের মতো জেরা করছেন।
—আসলে আমি আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে যাবতীয় প্রমাণ জোগাড় করতে চাইছি। অলকানন্দা বরাবর রাতে শোওয়ার আগে কোল্ড কফি খায়। এই নিয়ে আমার সঙ্গে প্রথমদিকে অনেক কথা কাটাকাটি হতো।
—এখনও হয়?
একদম না। আপনার স্বামীর কোম্পানিতে যোগ দেওয়ার আগে পর্যন্ত অলকা আমাকেও মেনে নিয়েছিল। আমি সুগার মিলের একজন সাধারণ কর্মী। মাস গেলে স্যালারি আর বছরে একটা করে ইনক্রিমেন্ট— এই হল আমার স্ট্যাটাস। আপনার স্বামীর সঙ্গে পরিচয়ের পর ও যেন খাঁচা ভেঙে উড়তে চাইল। এখন আর এসব নিয়ে ভাবি না। না, আর আপনাকে বিরক্ত করব না। আপনি স্বীকার করুন আর নাই করুন, আমার যেটুকু জানার ছিল জেনে নিয়েছি। এখন আমি উঠব।
—যাওয়ার আগে আমি একটা কথা জানতে চাইছি, আপনি কি এই সম্পর্ক ভেঙে দিতে চান?
—গায়ের জোরে কোনও সম্পর্ক বিশেষ করে বিবাহিত জীবনের, ধরে রাখা সম্পূর্ণ অর্থহীন।
—আর একবার ভেবে দেখলে হয় না?
—প্রশ্নই ওঠে না।
—যাওয়ার আগে আমার কিছু কথা শুনবেন না?
—আপনার কাছ থেকে কিছু শোনার জন্যই তো এতগুলো কথা বললাম।
—আপনি এতক্ষণ ধরে আমার স্বামী আর আপনার স্ত্রীকে জড়িয়ে যে কথাগুলো বললেন, তার সবটাই সত্যি। বছরখানেক আগেই আমি বুঝেছি, বিজয় আর আমার কাছে নেই। অনেক দূরে সরে গেছে। আপনি পুরুষ মানুষ, আপনার পক্ষে যে-কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো যতটা সহজ, আমাদের মেয়েদের একটু ভাবতে হয়। তাছাড়া আমাদের ছেলেটা বড্ড ছোটো। ও বাবাকে খুব ভালোবাসে। এখন যদি আমি সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যাই, তাহলে ওর মনের উপর ভীষণ চাপ পড়বে। এতদিন আমি মেয়েটার নামধাম, পরিচয় এসব কিছুই জানতাম না। অফিসে গিয়ে অনুসন্ধান করতে নিজের আত্মসম্মানবোধে লেগেছিল। বাইরের কারও কাছে হেয় হতে কার ভালো লাগে? কী আশ্চর্য, আজ আপনি যেচে তার সন্ধান আনলেন। মিস্টার পরিদা, আজ আপনি আমার বড়ো উপকার করলেন। এতক্ষণ পর সবিতা পাণিগ্রাহীর ঝলমলে মুখের উপর ঘন কুয়াশা ছড়িয়ে পড়ল। বুকের ভিতর এতদিনের জমে থাকা মেঘগুলো এইবার বুঝি ঝরে পড়বে তার অস্তিত্বের উঠোনে, কার্নিশে আর ব্যালকনিতে।