বৃষ্টিটা জোর নামল। মেট্রো থেকে বেরিয়ে ব্যাগ হাতড়ে ছাতা বের করেছে দীঘল। স্টেশন থেকে অটোতে উঠতে উঠতে ভিজে গেল খানিকটা। মাস্ক লাগিয়েও পাশেরজনের থেকে আর কত ডিস্ট্যান্স রাখা যায়? লকডাউন আছি আছি করেও কেমন গা ছাড়া ভাব। দীঘল ভাবল, এভাবে কতদিন বেঁচে থাকতে পারবে, কে জানে! সোহা সেদিন ডিমের পোচ খেতে খেতে মুচকি হেসেছে, ‘পুষ্টি দিয়ে আর কী হবে? বাঁচব না জানি। একদিন দমসে ফুচকা খেয়ে নেব। চরম ঝাল দিয়ে।”
দীঘল হেসেছে, ‘মানে, করোনা না পারলেও ফুচকা যেন মারতে পারে, এই তো ইচ্ছে? মরার ইচ্ছে হচ্ছে কেন? তোমার বুটিক এখন না খুললেও তোমার চলবে, এটা কনফার্মড। তাহলে আর ভয় কী? ভয় হল আমাদের মতো প্রাইভেট কোম্পানির অনাথ শিশুদের। কখন ছাঁটাই হয়ে যাই, হু নোজ৷’
পাশের লোকটি কেন যেন বড্ড উসখুস করছে। বিরক্ত লাগল দীঘলের। চেপেচুপে প্যাসেঞ্জার তুলেছে অটোর পাইলট। আরে, দুটো দিন ওয়েট কর না ভাই। এখন একটু ডিসট্যান্স মেনে দ্যাখ, যদি বাঁচতে পারিস, বাঁচাতে পারিস। দীঘল গলা কোনমওতে সামান্য বাড়িয়ে দেখে নিল কদূর এসেছে অটো। পাশের লোকটা এমন করছে কেন? হাঁচবে নাকি? মাই গড! মাস্কটা টেনে যতদূর ঢাকা যায়, ঢেকে নিল দীঘল। এই মাস্ক-ফাস্কে কত আর কাজ করবে? যাক, কোনওরকমে বাড়িতে পৌঁছোতে পারলে স্বস্তি। স্টে হোম, স্টে সেফ। কথাটা কতটা স্বস্তিদায়ক, দীঘল জানে।
কতদূর হেঁটে আজ একটা টু-বিএইচকে ফ্ল্যাটের মালিক হয়েছে দীঘল! তিনদিক খোলা আলো হাওয়ায় ভরপুর ফ্ল্যাট-এ ওয়াল হ্যাংগিং ওয়ার্ডরোব থাকাতে স্পেস প্রচুর। দীঘল গ্রামের ছেলে। খোলামেলা থাকতেই তো চেয়েছে বরাবর। তবে সোহা ফ্ল্যাট সাজিয়েছে প্রাণ ভরে। দেয়ালের রং লাইটের শেড, সোফার কুশন, ফ্লাওয়ার ভাস — ছোটো ছোটো বিষয় ভালো বোঝে। অ্যাকাডেমিক জ্ঞান না থাকলেও ওর মধ্যে একটা ক্রিয়েটিভিটি রয়েছে। দু-কামরার ভাড়ার ঘরে বাবা, মায়ের সঙ্গে জীবনের অনেকগুলো দিন কাটিয়েছে ও। এখন একটু হাঁপ ছড়িয়ে থাকতে চাইলে সেটা দোষের নয়। বলতে গেলে সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘরের সোহা একটা নিজস্ব ফ্ল্যাটের জন্য হন্যে হয়ে গিয়েছিল। অবশেষে হয়েছে।
অফিস থেকে ফিরে নিজের প্রাইভেট স্পেসটুকুর জন্য অসীম আগ্রহ নিয়ে ডোর বেল-এ আঙুল রাখে দীঘল। আঙুল রাখতে রাখতে ওয়াশরুমের দরজার কাছাকাছি রাখা ওয়াশিং মেশিনটার কথা ভাবল ও। করোনা পরিস্থিতিতে বাড়ির নিয়ম হচ্ছে, বাইরে থেকে এসে পুরো পোশাক ওয়াশিং মেশিনে রেখে ওয়াশরুম থেকেই সোপ অপেরা সেরে নিতে হবে। তারপর কিচেনে গিয়ে কফি বানাবে দীঘল দু’জনের জন্য। কফির কাপ নিয়ে ছোটো বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাস্তার লোকদের দেখবে। মনে মনে বলবে, “আহা, ইস, কী ভিজে ভিজে যাচ্ছে সবাই। একটা ছাতা তো নিতে পারিস। আর বাইরে এতক্ষণ থাকাই বা কেন? ঘরে থাক, ওরে ঘরে থাক।’
ইচ্ছে করে কফির কাপে শব্দ করে চুমুক দেয় দীঘল। সোহা হেসে হেসে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টি ধরার চেষ্টা করে। দীঘল জানে এবারে দীঘলের গায়ে বৃষ্টি ছিটিয়ে দেবে সোহা, আর দীঘলকে তখন মুখে মেঘ ডেকে আনতে হবে। তবেই সোহার আনন্দ তীব্র হয়ে উঠবে। সোহা মেঘের দাপট বাড়াতে বাড়াতে একসময় দু’জনেই মেঘে বৃষ্টিতে একাকার হয়ে যাবে। তখন কোথায় কফির কাপ, কোথায় কে ভিজে যাচ্ছে, তা দেখা আর হয় নাকি? আসলে ফুল তো বৃষ্টির মধ্যেই ফুটে ওঠে। এই সময়ে ওরা বাইরের কাউকে অ্যালাউ করে না। সোহার কড়া নির্দেশ। ডোর বেলে আঙুল রেখেই কথাটা ফের ভাবল দীঘল। স্টে হোম শব্দটা খুব সুন্দর। দরজা খুলতে একটু দেরি করল সোহা। কিন্তু খুলেই হাসিমুখে তাকাল, ‘সারপ্রাইজ!’
সারপ্রাইজ মানে ইউটিউব দেখে কাঁঠালের আমসত্ত্ব বা ওইরকম কিছু বানিয়েছে সোহা। দীঘল এত সহজে শান্তি বিসর্জন দিয়ে সব মাটি করতে চায় না। ও দাঁত বের করল, “ইয়াপ্পি। বলো, বলো কী?’
—উঁহু, আগে ঘরে ঢোকো। সাবানকেলি সেরে তারপরে…! ভয় নেই, পালাবে না সারপ্রাইজ। দরজা ছেড়ে ওয়াশরুমের আলোর সুইচে আঙুল দিল সোহা। শব্দ হল, টিক। দীঘল সোহার লম্বাটে তর্জনীতে মুক্তোর আংটিটা দেখল। এটা সোহাকে কে যেন পরতে বলেছিল। মাথা ঠান্ডা থাকে বোধহয় মুক্তোয়। তা কাজ হয়েছে মনে হয়। নইলে লকডাউনের মধ্যে দরজা খুলে এমন নরম চাঁদের মতো আলো ছড়িয়ে বউ হাসতে পারে? কোন অ্যাস্ট্রোলজার? একবার দেখালে হয়। দীঘলের অবশ্য মাথা গরম নয়। আচ্ছা ওর কোন রত্ন চাই?
ফ্ল্যাটে ঢুকেই বাঁদিকে লিভিংরুম লাগোয়া ওয়াশরুমেই তিনমাস ধরে করোনা তাড়ানোর যাবতীয় ব্যবস্থা রয়েছে। টুক করে ঢুকেই সাফসুতরো হতে হতে বাইরে বৃষ্টির জমকালো শব্দের তাণ্ডব শুনতে পেল দীঘল। শাওয়ার নিতে নিতে গলায় মেঘ মল্লার খেলতে লাগল, “গহন ঘন ছাইল গগন ঘনাইয়া…! কী হবে, কে জানে…!’ বৃষ্টির গন্ধ ছেলেবেলায় নিয়ে যায় দীঘলকে। এক মেঘের বিকেলে কৃষ্ণাপিসিদের বাড়িতে গিয়েছিল দিদির সঙ্গে। কী বৃষ্টি! কী বৃষ্টি! সরু তত্তোপোশের উপরে বসে হারমোনিয়াম বাজিয়ে কৃষ্ণাপিসি গান গেয়েছিল, “এ গানের প্রজাপতির পাখায় পাখায় …!” পিসির পিছনের খোলা জানলা দিয়ে ভেজা গন্ধরাজ ফুলের গন্ধ আসছিল। এখনও হঠাৎ করে সেই গন্ধ নাকে এলেই সেদিনের বিকেলে চলে যায় দীঘল। এখন যেমন হল। গন্ধরাজ ফুলের গন্ধ নাকে এল। আহহ! এই আবাসনে কি গন্ধরাজ ফুটেছে?
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে জোরে চেঁচাল দীঘল, “মেমসাব, কফি লাউ ক্যা?’
সোহা ছুটে এসে ঠোঁটে সেই মুক্তোখচিত তজনী ঠেকাল, ‘ডোন্ট শাউট।’
—মানে? দীঘল থমকে গেল। সোহার মধ্যে কেমন একটা গুপি গুপি ভাব। কী ব্যাপার ?
—সারপ্রাইজ। ও ঘরে যাও। দেখো।
( ক্রমশ…)