হাঁটুতে খুব ব্যথা বুঝি! খুব কষ্ট হল! আর আমাদের সিঁড়িও একদম স্বর্গের মতো খাড়া। চড়তে খুব কষ্ট হয়। দেখুন না, আমার স্ত্রীরও দুটো হাঁটুই একবারে অকেজো হয়ে গেছে। ডাক্তার রিপ্লেসমেন্টের কথা বলেছে। টাকা পয়সার ঝুঁকি নিয়ে না হয় পালটেই দিলাম, কিন্তু সেরে যাবার গ্যারান্টি কেউই দিচ্ছে না। বাজারের জড়িবুটির তেল-টেল তো সব টেস্ট করা হয়ে গেছে। কিচ্ছুটি কমেনি ব্যথা। এক গেলাস জল খাবেন? হরিহরবাবু, এঁদের একটু জল খাওয়ান তো। খান, জল খেলে শরীরে, মনে বল পাবেন। জানেন তো শরীরের ব্যথা ব্যথাই নয়, মনের জোর যদি বহাল থাকে।
না না, আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি ঠিক আছি একদম। এতক্ষণ মনীশবাবু কথা বলছিলেন না। মানে বেশ হতচকিত হয়ে বেহালা থানার মেজোবাবুর গড়গড় করে বয়ে যাওয়া কথার পানসির সামনে নিজের খড়কুটোর অবস্থানটি নিজে নিজে লক্ষ্য করছিলেন। কিন্তু এক্ষণে মাস্টারমশাই দেখলেন কথা না বললে নয়। কথা না বললে, কয়েকদিনের এঁটো, নোংরা গ্লাসের সত্তর রকমের জীবাণুবাহিত জল নির্ঘাত খেয়ে নিতে হবে। তিনি মেজোবাবুর সিনের ভেতরেই কুণ্ঠিত পায়ে এন্ট্রি নিলেন।
মনীশবাবুর অপ্রতিভতার থেকে তার মেয়ে, আঠাশ বছরের হেমন্তিকার অবস্থা আরও খারাপ। সে মনে মনে প্রস্তুত হয়ে এসেছিল। খ্যাঁ খ্যাঁ করে হাসির পান-দোক্তা কবলিত ক্ষয়াটে দাঁতের কোনও ভুঁড়ি উসকানো মাঝারি বয়সের পুলিসের খপ্পরে দিনটাকে বরবাদ করতে হবে। মনে মনে একটা প্রতিরোধের বাতাবরণ তৈরি করেই পা রেখেছিল বেহালা থানার সিঁড়িতে। বুড়ো একাত্তর বছরের বাবাকে তো এমনি এমনি আনেনি, এতটা পথ! আনতে বাধ্য হয়েছে। মানসিক দিক থেকে অন্তত কিছুটা সিকিউরিটি আপলোড করা যাবে।
কিন্তু এই হ্যান্ডসাম, বছর পঞ্চাশের সুশ্রী পুলিস আর তার মাখন দিয়ে মাখা স্বরের বৈপরীত্য, সাজানো চিত্রনাট্যে চিড় ধরাল। হিসেব মেলে না। পাসপোর্টের জন্য পুলিস ভেরিফিকেশন দরকার। চাকরির শর্তের মধ্যে আছে, ড্রাইভিং লাইসেন্স আর আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট দেখাতে হবে কল ডেটে। ফলে হেমন্তিকা এই ক’দিন ঝড়ের গতিতে ছুটেছে। আর একটি সপ্তাহ হাতে। ভেরিফিকেশনের গেরোটা টপকালেই আপৎকালীন পাসপোর্ট-এর সাথে তার নতুন জীবনের দরজা হাতের কাছে এসে যাবে। এই এমএনসি-র কাজটাই গোটা পৃথিবী জুড়ে। রিটায়ার্ড স্কুল মাস্টারের বারান্দায় রাখা সাইকেলের উপর দিয়ে, মানে মাথার খুব উঁচু দিয়ে তখন ঘন ঘন প্লেনের উড়ে যাওয়ার আওয়াজ হবে।
কিন্তু এত ভালো পুলিস তো হেমন্তিকার ধারণার ভেতরেই ছিল না। অন্যান্য জায়গায় দৌড়ঝাঁপ, তদবির – সব তো বয়ফ্রেন্ড করে দিয়েছে। কিন্তু এখানে পাড়ায়, থানায়, তো বয়ফ্রেন্ড নিয়ে আসা যায় না। গার্জিয়ান চাই। তাই-ই তো অত কষ্ট করে বাবাকে রিক্সায় করে টেনে আনতে হয়েছে। বুক টিপ্ টিপ্ করেছে, শেষ মুহুর্তে এসে কাজটা কেঁচিয়ে না যায়। বিশেষ করে পুলিসটি তার বাবার পায়ের ব্যথার প্রতি এতটা সমব্যথা জানাচ্ছে দেখে মনটা ভরে উঠল। আছে আছে সমাজে ভালো মানুষও আছে, ভালো পুলিস আছে, না হলে সমাজটা টিকে থাকত না। ভেঙেচুরে ছত্রাখান হয়ে যেত।
কপালের অনাবশ্যক ঘাম সেসময়ে ছোট্ট রুমাল দিয়ে মুছে ফেলেছে হেমন্তিকা। আর ঘাম জমে ওঠার দরকার নেই। কাঠের চেয়ারে বসে পুলিশ অফিসারটি সাদা কাগজের উপরে বলপেনে, অল্প অল্প লিখতে লিখতে কথা বার্তা চালিয়ে যাচ্ছে। ভেরিফিকেশনের জন্য ওটুকু লিখতে হয়। আর তার, হেমন্তিকার যে-কোনও ক্রিমিনাল রেকর্ড থাকবে না, তা তার মুখমন্ডলের মতো ধবধবে পরিষ্কার। শুধু তো ধবধবে সাদা নয়, হেমন্তিকার চেহারায় একটা জ্যোতির্ময়তাও ঘুরঘুর করে।
অফিসার লোকটি একেবারে ধার কাছ দিয়েই গেলেন না। অন্যান্য বন্ধুদের ভেরিফিকেশনের কোশ্চেন-আনসার কণ্ঠস্থ করে এসেছিল হেমন্তিকা। সে বলবে, না, পড়াশোনার জন্য মুখ তুলে ভালো করে সংবাদপত্র পড়ার সময়ই পাইনি তো রাজনীতি করব কি! বাংলায় কী কী দল চলেটলে তাই-ই তো তেমন করে জানি না। আর ছাত্র অবস্থায় রাজনীতি করা উচিতও না, তাই না! ভেবেছিল, উত্তরের সাথে এরকম কোশ্চেন ঠুকে দেবে পুলিসের দিকে। কিন্তু সেসব চেনা কোশ্চেনের কিচ্ছুটি করছেন না পুলিস লোকটি। তেমন করে তাকাচ্ছেনও না পর্যন্ত তার দিকে। যেমনটি ভেবে এসেছিল, যে চোখে চেটে পুলিস তো তার বাপের সামনে তাকে ফালাফালা করে দেবে। নাহ! এই লোকটার এলেম আছে। বাবাকে নিয়েই পড়ে আছে মিনিট পনেরো ধরে।
মেয়ের বিয়েটা দেখে যেতে সাধ হয় না মাস্টারমশাই? খুব ক্যাজুয়াল আর খুব আন্তরিকতা এক সঙ্গে মিক্সিতে পেস্ট করে যে টোনটা আসে, তাতেই একটা দান ফেললেন অফিসার। কারো মুখের দিকে তাকাননি। টেবিলের উপরে রাখা কাগজটির উপর নোট নিতে নিতে বলা।
খুব হয়। কিন্তু ওই তো সিঙ্গল থাকবে বলে বেঁকে বসে আছে।
কথাটা বলে ফেলার পর মনীশবাবু মনে মনে হাত কামড়ালেন। না না, বলাটা উচিত হয়নি। বাড়ি থেকে আসার সময় বাতের ব্যথায় কাবু তাঁর স্ত্রী পই পই করে বলে দিয়েছিলেন, অযথা গল্প-গাছা করে ঘরের কথা পরের কানে তুলে দেয়াতে তোমার তো জুড়ি নেই, তা থানায় গিয়েও সেই কম্মটি করতে বোসো না। মুখে একদম কুলুপ এঁটে থাকবে। কোথা দিয়ে কী বেফাঁস বলে বসবে, কে জানে ….। পুলিসে ছুঁলে তো শুনেছি ৩৬ ঘা।
সহধর্মিণীর কথাটাকে এট্টুসখানিকের জন্য তিনি মান্যতা দিতে পারলেন না ভেবে মরমে মরে যাননি, কিন্তু উলটো দিকে গল্পের দরজা খুলে গেছে। প্রায় শেষ করে ফেলেছিল অফিসারটি ফর্ম ফিল আপ করা। আর একটা দুটো পয়েন্ট লিখে, সই করিয়ে ছেড়ে দেবার কথা। কিন্তু কী থেকে কী যে হয়ে গেল। খোলা কলম টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে মেজোবাবু মনীশবাবুর ঘোলাটে চশমার উপর নিজের চোখ ফেলে বললেন, সেকি! একা একা একটা মেয়ে কি সমাজে বাঁচতে পারে। তার হাটবাজার, হাসপাতাল-ডাক্তার, রাত-বিরেত কে সামলাবে! আরে আপনি তো আর মেয়েকে সারা জীবন পাহারা দেবার জন্য উবু হয়ে বসে থাকবেন না। না, না না, না মাস্টারমশাই, আপনার এই কথাটাতো শিক্ষকসুলভ হল না।
যেন এটা মাস্টারমশাইয়ের সিদ্ধান্ত। যেন মাস্টারমশাই সারাজীবন বিয়ে না করে বসে আছেন। তাই তাকে বোঝাতে লেগে পড়েছেন অফিসারটি।
তাছাড়া দিনকাল যা পড়েছে, দেখছেনই তো। আর এই বেহালা এলাকাটা তো নচ্ছারতম প্রদেশ। রোজ খুন-খারাবির খবর পাবেন-ই পাবেন। এখানকার লোকজনও নতুন নতুন করে বাড়ছে।
মনীশবাবুর এই সময় নিজেকে একটু দুর্বল লাগল। অনেকদিন হয়েছে রিটায়ার করেছেন, তবুও সফল মাস্টারমশাই হিসেবে এই অঞ্চলের হাটে-ঘাটে এখনও তাঁর জন্য কুশল জিজ্ঞাসা, দাঁড়িয়ে দু’দন্ড কথাবার্তা বলার লোকজন কমে যায়নি। আর ছাত্ররা তো অনেকেই এখন এখানে আছে, যারা প্রতিষ্ঠিত। এটা ওঁর জোরের জায়গা। নাহলে একা একা এখনও এই একাত্তর বছর বয়সে বাজারে যান।
পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করলেন। মুখটা মুছলেন, গলা মুছলেন। অফিসার এটাই চেয়েছিলেন যেন। টেবিলের উলটোদিকের লোকজনকে অ্যাকিউস্ড হিসেবে দেখা তার অভ্যেস। কিন্তু বাপ-বেটির কাউকেই তেমন ম্লান লাগছিল না। তার অভ্যস্ত চোখে এবার ধরা পড়ল মনীশবাবুর মেজাজি মনের এক চিলতে ঠুনকো প্রদেশ। হঠাৎ তৈরি হওয়া এই চাপটা তিনি মেয়েটার দিকেও চারিয়ে দিতে চাইলেন।
কী কোনও কেস আছে নাকি? এই প্রথম হেমন্তিকার চোখে চোখ রাখলেন অফিসার। হেমন্তিকা বাবার ঘাম মোছা বিবর্ণ মুখের দিকে চেয়ে হঠাৎ একটু শঙ্কা টের পেল। কিন্তু কথাটা তেমন করে ধরতে পারেনি। কয়েক মুহূর্ত বোবা চোখে তাকাতেই অফিসার বলে উঠলেন, আরে এ বয়সে একশোটার মধ্যে সাড়ে নিরানববইটারই কেস থাকে। তা সেই বয়ফ্রেন্ডকেই….
মেয়েটার ধবধবে সাদা মুখে রঙের লাল ছোঁয়া জেগে উঠতে দেখে অফিসার গলার স্বরে অদ্ভূত একটা মায়া সম্পাত করে বলে উঠলেন, জানো মা, আমারও একটা মেয়ে ছিল, তোমার মতোই। মানে এসময় তোমার বয়সি হতে পারত।
মানে, ছিল মানে! মনীশবাবুর শিক্ষকতার অভ্যেস যায়নি। আর থানার আবহে তিনি আছেন যে, সেটা দিব্যি ভুলে মেরে দিয়েছেন।
অফিসার ম্লান এবং অহংকার দুরকম ভঙ্গি ঠিকঠাক পেশ করলেন। তার থাকা না-থাকার অবস্থানটি এই সময়ে আমার কাছে অপ্রাসঙ্গিক বলেই আমি ছিল কথাটি বলেছি। ওই একটা দিনের পর আমার কাছে সে পাস্ট টেন্স।
মনীশবাবুর হাঁ-করা মুখের উপর তিনি বলতে লাগলেন, গল্পটা এরকম মাস্টারমশাই, গানের মাস্টার গান শিখিয়ে চলে গেছে। থানা থেকে বাড়ি ফিরেছি। ধড়াচূড়া ছাড়তে ছাড়তে স্ত্রীর সাথে কথা হচ্ছিল। স্ত্রী বলছিলেন কিছু টাকার দরকার, গিফ্ট কিনতে হবে। সুমন চ্যাটার্জীর মেয়ে, আইটিও, মানে ইনকাম ট্যাক্স অফিসার, নাকি রেজিস্ট্রি করে বর নিয়ে ঘরে ঢুকেছে।
তা বরটা কে?
আরে আমাদের প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার প্রশান্ত দুলের ছেলে। কলকাতায় ফার্স্ট ডিভিসনে না কি ফুটবল খেলে।
আমি বলেছিলাম, অমন মেয়ে আমার হলে আমি গলা টিপে মেরে ফেলতাম। জাত-বেজাত দেখবে না! শিক্ষিত-অশিক্ষিত দেখবে না! প্রেম করলেই হল! ছ্যাঃ ছ্যা!
তার পরদিনই আমার মেয়ে ঘর ছেড়েছিল। মেয়ে নাকি আগেরদিন পাশের ঘর থেকে আমার কথা শুনতে পেয়েছিল। যাবার সময় মাকে বলেছে, এমন বাবার পয়সায় খেতে তার নাকি ঘেন্না হয়। কোথায় যেন গানের স্কুল খুলে দিয়েছে সেই গানের মাস্টার। জুটিতে বেশ পসার-টসারও হয়েছে। কিন্তু আমার কাছে তার থাকা না-থাকার কোনও মূল্য নেই।
হেমন্তিকা এই নিপাট ভদ্রগোছের চেহারার লোকটির ভেতরের আস্ফালন দেখে কেঁপে উঠল মনে মনে। মনীশবাবুও থ মেরে গেছেন। অফিসার কলমের পেছন দিকটা দিয়ে টেবিলে ঠুকে চলেছেন। হেমন্তিকার মনে হচ্ছে এক একটা হাতুড়ির ঘা পড়ছে তার বুকের ভেতর। যন্ত্রণা হচ্ছে। বাবার মলিন মুখের উপর চোখটা ঘুরিয়ে নিয়ে এসে চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিল। এইমাত্র তার মনে হল, তরবারির এক কোপে তার গলাটি কেটে নিয়ে চুলের মুঠি ধরে টেবিলের উপর ঠুকছে ওই অফিসার। হেমন্তিকার চেতনা গুলিয়ে যাচ্ছে।
আরে, হামিদুর কোথায়! দেখতে পাচ্ছি না। হামিদুর হামিদুর…। ওকেও কি মেরে ফেলেছে এই অফিসারের দল! একেই কি বলে অনার কিলিং! কুলকুল করে ঘামছে হেমন্তিকা। ওরা দুজনে টেকনো ইন্ডিয়ায় একই ব্যাচের। ক্যাম্পাসিং-এ একই এমএনসি-তে সিলেক্টেড। ঢাকার ছেলে হামিদুর রহমান। কলকাতায় ইঞ্জিনিয়ারিং করতে এসে সেই প্রথম বছর থেকেই মিষ্টি শান্ত স্বভাবের ছেলেটি হেমন্তিকার বুকের ভেতর ঢুকে আছে। যতটা সম্ভব লুকিয়ে রেখেছে তাকে হেমন্তিকা। কাউকে কিছুই বুঝে উঠতে দেয়নি। ভটচাজ ব্রাহ্মণের সাথে মুসলমান ছেলের বিয়ে কিছুতেই মেনে নেবে না আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী। তা হেমন্তিকার বাবা যতই উদারমনস্ক শিক্ষক হোন না কেন, পরিপার্শ্ব বলে তো একটা কথা আছে। হামিদুর আর হেমন্তিকার সম্পর্কের শিলমোহরের হাইফেনটুকুর জন্য গত ছবছর বড়ো কম সময় নয়। এখন পড়ে পাওয়া চৗদ্দো আনার মতো এই চাকরিটা ওদের সামনে মসিহা হয়ে এসেছে। প্রথম পোস্টিং স্টেটস-এ। দুজনেরই। ওখানে গিয়ে হিন্দু বা মুসলিম যে-কোনও একটা মতে বিয়েটা সেরে নেবে।
কী হয়েছে মা? শরীর খারাপ লাগছে? মনীশবাবু হেমন্তিকার কাঁধে হাত রাখলেন। কী বিড়বিড় করছিস? একটু জল খাবি?
হেমন্তিকা মাথা উপর-নীচ করল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। ভয়ে, যেন একটা মৃতের ভেতরে সে এতক্ষণ বসেছিল। তার সাদা চুড়িদার ভিজে সপসপ হয়ে গেছে। ঘামের ঝরনার ভেতর ভিজে যাচ্ছে হেমন্তিকা।
দরজায় থ্রি নট থ্রি সামনে রেখে কনস্টেবলের দাঁড়ানোর ভঙ্গি এখন বাঁকা শ্যামের মতো। সে যতটা সম্ভব ট্যারা হয়ে হেমন্তিকাকে অপাঙ্গে চাটছে। তার চোখ হেমন্তিকার ঘামে ভেজা সাদা চুড়িদারের ভেতর থেকে ফুটে ওঠা কালো অন্তর্বাসে আঘাত হানছে। আর তখনও অফিসার বল পেনের পেছন দিকটা ঠুকে চলেছেন টেবিলে। মানে তখনও মেয়ের অপকর্মের আঘাত ওইভাবে ফিরিয়ে দিচ্ছেন।
মনীশবাবু কঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে, কাঁপা হাতে ছিপি খুলে হেমন্তিকার দিকে এগিয়ে দিলেন। স্যার একটু তাড়াতাড়ি করা যায় না! মেয়েটার শরীর খারাপ করছে।
হাঁ, হাঁ, হয়ে এসেছে। অফিসার নিজের মেয়ের স্মৃতি ঝেড়ে ফেলে কলমের পজিশন ঘুরিয়ে নিলেন। তারপর মুখ তুলে বললেন, আচ্ছা মাস্টারমশাই, আপনি যে পরিবারের ডিটেলস দিলেন, তাতে তো দেখছি মেয়ে চাকরি নিয়ে বিদেশে চলে গেলে বুড়োবুড়ি একলা হয়ে পড়বেন। এই বয়সে পারবেন তো নিজেদের সামলাতে! আজকালকার ছেলে-মেয়েরা শুধু নিজের কেরিয়ারের কথা ভাবে। বাপ-মা-র কথা, তাদের বাঁচা-মরায় তেমন হেলদোল নেই।
মনীশবাবু শশব্যস্ত হয়ে বললেন, না না, আমাদের তেমন কোনও অসুবিধা নেই। আমার দাদার ছেলেমেয়েরা থাকে রবীন্দ্রনগরে। ওরা মাঝেমধ্যে এসে দেখে যায়।
কিন্তু এই দশকাঠা জায়গা নিয়ে আপনার বিরাট বাড়ি – একা একা সামলে উঠতে পারবেন তো সব?
হ্যাঁ, চলে তো যাচ্ছে। ঠিক চলে যাবে।
মনীশবাবু জানেন খুব কষ্ট হয়, হবে। পাড়ায় শক্ত চোয়ালের নতুন নতুন ছেলেদের আবির্ভাব হয়েছে। তারা বাইক সহ মাঝেমধ্যেই গেটের বাইরে দু-তিনজন এসে ভিড় করে, ফিসফাস করে। প্রোমোটিং-এর থাবা। যেভাবে এগোচ্ছে যে-কোনওদিন গেটের ভেতরে ঢুকে এসে প্রস্তাব দেবে। একবগ্গায় এতখানি জায়গা এতল্লাটে আর নেই। মেট্রো রেলের কাজ থমকে গেলেও, ওই কাঠামো দেখিয়ে হু হু করে দাম বাড়িয়ে নিয়েছে প্রোমোটারেরা। বেহালা অঞ্চলে এখন ছ’হাজারের নীচে স্কোয়ারফিট নেই।
অফিসার আবার কথা বাজালেন, হু হু করে পালটে যাচ্ছে সব। দিনকাল আর আগের মতো নেই মনীশবাবু। আমরাই চিনতে পারি না কার কোমরে কী গোঁজা রয়েছে। এখন আবার একটু সম্পন্ন ছোকরারা পাড়ায় পাড়ায় শুধু বাইক আর মোবাইল নিয়ে ঘুরতে পছন্দ করে না, আগ্নেয়াস্ত্র রাখাটা স্টেটাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাঁচ-সাত বছর আগেও একখানা মুঙ্গেরের ওয়ান শর্টার থাকলে যারা দর পেত, তারা সবাই আজ জার্মান, আমেরিকান, তা না পারলে চিনের মাল রাখছে, পাঁচঘরার নীচে নয়।
অফিসার ভদ্রলোকের ওই এক রোগ, কথা বলা শুরু করলে থামতে জানেন না। মনীশবাবু অব্যাহতি পাবার জন্য ছটফট করলেও অফিসার বলে যেতে থাকেন, কী করব বলুন, আমরা তো ঠুঁটো জগন্নাথ, এদের সবারই দাদা ধরা আছে। রাজনৈতিক দাদা। পুলিস এদের ধরতে গেলে ওই দাদা ঘন্টা বাজিয়ে দেবে পুলিসের। মানে নির্ঘাত সুন্দরবন বা জঙ্গলমহলে শান্টিং করে দেবে।
জলটল খেয়ে হেমন্তিকার নার্ভাস ব্রেক ডাউনটা নর্মাল হয়ে এসেছে। সে একটু গলা খাঁকারি দিয়ে গল্পের গতিতে লাগাম পরাতে গিয়ে বলে, স্যার যদি একটু তাড়াতাড়ি সেরে ফেলা যায়…। মানে, আমার আরও অনেকগুলি কাজ পড়ে আছে। ইউনিভার্সিটি থেকে সার্টিফিকেট তুলতে হবে…।
পরিস্থিতি একটু গম্ভীর হয়ে আছে দেখে, হেমন্তিকার দিকে ফিরে জিভ কেটে, অল্প করে মুচকি হেসে বলে উঠলেন, হ্যাঁ দেখছই তো মা, তোমার কাজটাই তো করছি। প্রায় শেষ করে ফেলেছি। ভেরিফিকেশন আর চোর-ডাকাতদের ইন্টারোগেশন তো এক নয় মা!
চোর-ডাকাতদের কাছ থেকে কথা বের করতে অনেক সহজে হয়ে যায়, এত হ্যাঁদাতে হয় না।
হেমন্তিকা বেশ বুঝতে পারছে নিজে নিজেই কৈফিয়ত দিচ্ছেন। কিছুটি করার নেই তার, শুনতে হবে। বাবার দিকে ফিরে সে-ও অপ্রতিভ না হওয়ার ভান করে অল্প হাসল, সমর্থনের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। কিন্তু অফিসার হঠাৎ গলার স্বরে হিংস্র শার্দুলতা ঢুকিয়ে বলে যেতে থাকেন, গারদের ওই পারে ঢুকিয়ে দিলে না, জাঁহাবাজ অনেকেরই কাপড়ে-চোপড়ে হয়ে যায়। তারপর তো কপালে যা নাচে বোঝেনই তো…।
অফিসার স্বরের এলোকোয়েন্সির তারতম্য করে আবার আন্তরিকতা ফুটিয়ে তুললেন গলায়, জ্বালাটা জানেন তো, আমাদের দশা মারিচের মতো। রামে মারলেও মারবে, রাবণে মারলেও মারবে। পুলিসে চাকরি করছি মশাই, গণৎকার তো নই। কী করে জানব সাধাসিধে গোবেচারারা সব বিদেশে গিয়ে আইএস-এর জঙ্গী হয়ে যাবে! আমাকে তো আর ছেলেমেয়েরা কোম্পানির অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দেখায় না! আর দেখাবেই বা কেন! পাসপোর্টের জন্য পুলিস ভেরিফিকেশনের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের কী সম্পর্ক।
হেমন্তিকা দাঁতে দাঁত চেপে ওই ইঙ্গিত সহ্য করে নিল। ধরণী দ্বিধা করে নেওয়ার ত্রেতা যুগের থিয়োরি এই ঘোর কলিতে অবসলিট। তবে কাজে লাগতে পারে ভেবে স্পিড পোস্টে আসা কোম্পানির অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাম কল লেটার হেমন্তিকা তার হাত ব্যাগেই রেখেছিল। সে ব্যাগের ভেতর চোখ অল্প নামিয়েই লেটারটি হাতে পেয়ে অফিসারের দিকে বাড়িয়ে দেয়।
পুলিশ অফিসার একটু খুঁটিয়ে দেখে এবার আকর্ণ হাসলেন। কনগ্রাচুলেশন্স মাই ডিয়ার। খুব বড়ো চাকরি, খুব বড়ো চাকরি। না না বাম হাতে নয় মা, বাম হাত শিষ্টাচারের বিরোধী, অশুভ হাত। ডান হাতেই সব শুভকর্ম যোগ।হেমন্তিকা নিজেকে লজ্জিত দেখিয়ে বাঁ হাত গুটিয়ে ডান হাতেই চিঠিটা ফেরত নিল।
অফিসার স্বরে এবার ফিসফিসানি এনে, মানে যাতে এই কথা ঘরের বাইরে না পৌঁছোয়, মায় গেটে দাঁড়িয়ে থাকা কনস্টেবলের কানেও না যায়, সেরকম নিশ্চিন্ততায় বললেন, তা মা মিষ্টি-টিষ্টি খাওয়াবে না আমাদের! তোমার সাফল্যে তো এই অঞ্চলের মানুষজনের মতো আমরাও গর্বিত! আর পুলিস ভেরিফিকেশনের কথাবার্তা বলতে এসে সবাই খুশিতে আমাদের মিষ্টি-টিষ্টি খাইয়েই যায়। এটাই রেওয়াজ, বুঝলে মা।
মনীশবাবু চটপট বুঝে ফেললেন কেন এতক্ষণ ফেনিয়ে চলেছেন অফিসারমশাই। তিনি তার ঝোলা ব্যাগের ভেতরে রাখা ওয়ালেট থেকে পাঁচশো টাকার একটা নোট বের করে এগিয়ে দিতেই তথাকথিত একটি অশিষ্ট বাঁহাত টেবিলের অন্য প্রান্ত থেকে এসে এই দিকের ডানহাতের নোটটিকে আত্যস্থ করে নিল ।