বাইশ বছর বয়সের এই বিকেলকে আমি কী নামে ডাকব? এই তো সেই পশ্চিম আকাশে সূর্য-ডুবুরির শেষ ডুবের আলো। এই তো, এখানে, স্মৃতিতে কিংবা ভুলে যাওয়া এক গতকাল-এ মফস্সল শহরের গা ঘেঁষে, আধা-শহর আধা-গ্রামের বিবর্ণ এই ইস্কুলবাড়ি ছাড়িয়ে, পথের রেখায়, ছাড়া ছাড়া ঘরবাড়ির নকশা সমেত জংলা ঘুপচিতে-বাঁশঝাড়ের ভুলভুলাইয়া, মাদুর কাঠির খেত বা বিরহী শীতের শিনশিনে দুখ-জাগানিয়া হাওয়ায় দাঁড়িয়ে আছে সেই বিকেল, যেন অকাল বিধবাটি, জীবনপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে আসা যাওয়ার পথের ধারে।

এমনই এক বিকেলে আমরা পালাব ঠিক করেছিলাম। আমাদের চারদিকে ছিল সতর্ক পাহারা। রাস্তার ধারের ঝুপড়ি দোকানের বুড়িটিকে বলা হয়েছিল আমরা পালাতে পারি এবং সে যেন ঝটিতি খবরটা জানিয়ে দেয়। যাকে জানাবে সেও তৈরি হয়ে ছিল। আমাদের ধরে যার হাতে তুলে দেওয়া হবে সেও তৈরি থাকত। সে এক ঝানু পাহারাদার। বলা যেতে পারে মাস মাইনের পাহারাদার।

আজ, পরিণত বয়সে সেই বিকেলের দিকে ফিরে তাকাবার সাহস আমার নেই। আবার না তাকিয়ে অবহেলায় চলে যাবার সাহসও আমি রাখি না। এ যেন ভূতপূর্ব দুঁদে খুনির খুনের জায়গায় বারবার ফিরে আসার গল্প। তা সেই বিকেলে আমি আমার জীবনের প্রথম পাপটি করেছিলাম। আর এই বিকেলে সেই পাপের কথা লিখছি। কী পাপ করেছিলাম আমি?

আজ মনে পড়ে বা গতকাল তারও গতকালে মনে পড়েছিল ভয়ংকর সেই ঘটনার কথা। আমি ঘটনার সিঁড়ি বেয়ে যেন এক পোড়ো মন্দিরের একেবারে ওপরে উঠে যাচ্ছি। ওপরে মানে আরও পেছনে। হিলহিলে হাওয়া দিচ্ছে। মাদুর কাঠির খেতের বুক চিরে এক অষ্টাদশী দউড়োচ্ছে আমার দিকে। সন্ত্রস্ত, তার চোখ আতঙ্কে নীল, পাছে কেউ দেখে ফেলে আমাদের।

তারপর? দেখা হল দুজনায়। মাদুর কাঠির খেত হাঁ হয়ে দেখল। কাছের বাঁশঝাড়ে বুঝি বা তক্ষক ডেকে উঠল। কোথায় ছিল একটা ঘুঘু, এই শেষ শীতের কামড় উপেক্ষা করে গেয়ে উঠল কৃষ্ণগোকুল। আর লাল ঘেরের চমৎকার একটা ফ্রক পরে এক অষ্টাদশী, যে দু’বিঘে  জমিনের মাদুর কাঠির খেত সাঁতরিয়ে এসেছে চুরি করা পাঁচ মিনিট সময়ে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য… সে হাঁপাচ্ছে, তার চোখে মুখে কী একটা তেষ্টা, কী এক অনির্দেশ যাত্রার উদাসীনতা… অথচ তার চিবুকে এক আকাশ মুক্তির নীলিমা। তারপর সে আমার সামনে। কিছুই বলে না শুধু চুপচাপ আমার দিকে চেয়ে থাকে। আমি, বাইশ বছরের তরতরে যুবা, সবেমাত্র ইংরেজির শিক্ষক হয়ে তার বাবার ইস্কুলে পড়াতে এসেছি, তা প্রায় মাস ছয়েক হবে তখন। আমি স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে। কিছু যে বলব, কিছু যে… মনে মনে ফুটছি, বিকেলের পড়ন্ত রোদ্দুরে ওর লাল ফ্রক জ্বলে জ্বলে উঠছে, আমি ভয়ে কাঠ, ঘনঘন শ্বাস পড়ছে ওর আর আমার… তারপর, কে যেন বলে উঠল আমায়, এই ছোকরা, ও কী বলছে শোন!

তারপর কী যে হয়ে গেল, প্রতি অঙ্গ প্রতি অঙ্গের জন্য এমনভাবে কেঁদে উঠল যে আনাড়ি ছোঁড়া আমি, এক ঝটকায় ওর অশান্ত বুক, ওর উড়ন্ত খোলা চুল ওর ততোধিক লজ্জা রাঙা লাল ফ্রক, ওর ফুলে ওঠা নাকের পাটা, ওর হরিণ চোখ– সববাইকে চমকে দিয়ে জীবনের প্রথম পাপটি করে বসলাম। তারপর হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেয়ে পেছন দিক থেকে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শুনে ভয় কাতর নিজেকে যখন থাবড়িয়ে সোজা করলাম, ততক্ষণে লাল ফ্রক বিদ্যুল্লেখার মতো অদৃশ্য হয়ে গেছে। বিরক্ত মাদুর কাঠির সংসারে তখন নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার পালা। ঘাড় সোজা করে উঠে দাঁড়াচ্ছে ওরা।

তার নাম ইতি। বাস রাস্তার পাশে উদাসীন দাঁড়িয়ে-থাকা ওই উচ্চমাধ্যমিক ইস্কুলটায় ও বারো ক্লাসে পড়ত। ছিপছিপে, মাঝারি লম্বা, ফুলো ফুলো সুখী মুখ। দেখে মনে হতো ‘আহ্লাদি’! চোখ দুটো বড়ো বড়ো, কিছুটা গোরুর ড্যাবড্যাবা ভাবও ছিল। কিন্তু এক অনিবার্য আকর্ষণ ছিল তার। ও তাকালে ওর চোখ দুটোতে কোথা থেকে যেন এসে জড়ো হতো রাজ্যের মায়া। ওকে দেখলে কঠিন সন্ন্যাসীও হঠাৎ মাটির দিকে তাকাতে বাধ্য হবে। কোনও কারণে যদি কেউ ওর শরীরে চোখ দেয় তাহলে দেখতে পাবে এক অপরূপ ভাস্কর্য। রামায়ণের মতো সে বিড়বিড় করে বলবে, ‘মুনিঋষিও এই ভাস্কর্যে মাথা কুটে মরবে’। আমার যেমন প্রথম দর্শনেই মনে হয়েছিল খাজুরাহোর গুহাগাত্রের কোনও ছবি জ্যান্ত হয়ে আমার সামনে এসেছে। আমি অবাক। এই আধা-গাঁ আধা-গঞ্জে এলেবেলে বিনুনি-দোলানো তেল জবজবে মাথায় বসানো বাক্সখোঁপাটি বেশ দেখতে ছিল। সব মিলে ও ছিল আলাদা।

ইতি পড়াশোনায় তেমন ভালো ছিল না। হয়তো বড়োলোক বাবার লাডলি বলে, হয়তো এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো পরিবহণ ব্যবসায়ীর মেয়ে বলে। বা পড়াশোনা করার তেমন কোনও ইচ্ছে ওর মধ্যে কেউ চারিয়ে দেয়নি বলে। প্রথম দিনই, অর্থাৎ যেদিন আমি এই ইস্কুলে

ইংরেজির শিক্ষক হয়ে এলাম, পড়াশোনার ব্যাপারে ওর দুর্বল জায়গাটায় ঘা দিলাম। একচোট জ্ঞান গিলে ও মাথা নীচু করে বসে রইল। আমার মনে আছে, প্রথম দিনের ক্লাসেই ‘কী পড়া আছে’ জিজ্ঞেস করতে ক্লাসের অর্ধপক্ব সবজান্তা ছাত্ররা আমাকে এনে ধরিয়ে দিল পোয়েট্রি এবং ড্রামা সিলেকশনের একটা একাঙ্ক নাটক– দি ডেথ ট্র্যাপ বাই এইচ এইচ মানরো বা সাকী। রামকৃষ্ণ মিশনে, সায়েব অধ্যাপকের নিরলস প্রচেষ্টায় ইংরেজি উচ্চারণটা আমার কিছুটা সায়েবি হয়ে উঠেছিল। আমি চোস্ত উচ্চারণে এক ঘণ্টা ধরে একাঙ্ক নাটক পড়ালাম। অভিনয় করে দেখালাম। ছাত্রছাত্রীরা তেমন ভাবে স্বরটা না বুঝলেও আমাতে মুগ্ধ হয়ে গেল। আমি তখন আমার মোক্ষম অস্ত্রটি প্রয়োগ করলাম। আমি বলি ‘মোটিভেশন’। ওদের মধ্যে আমি কেরিয়ারের স্বপ্ন বুনে দিলাম। বললাম, স্বপ্ন দেখতে শেখো। পৃথিবীর সফলতম মানুষটিও একদিন স্বপ্ন দেখত। যে মানুষ স্বপ্ন দেখতে জানে না, সে মৃত।

তারপর শুরু হল আমার মজা তৈরি করার কসরত। জিজ্ঞেস করলাম, তোমাদের জন্ম হয়েছে কীসের জন্য? উত্তর হল বড়ো হবার জন্য। আমি মেয়েদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম এবং বললাম, তোমাদের এক বন্ধু বলেছে বড়ো হওয়ার জন্য। তা মেয়েরা, তোমরা আবার এমন বড়ো হোয়ো না যাতে বড়োলোকের হেলেদেলে ছেলের হেলেদেলে ইয়া-মোটা বউ হয়ে কাঁঠাল গাছ হয়ে গেলে।

ক্লাসে বিপুল হাসি। ইতিও তখন হাসতে হাসতে নদী হয়ে গেছে।

একটা ছেলে বেশ জোরে জোরেই জিজ্ঞেস করল, ও স্যার, ‘কাঁঠাল গাছ’ কথাটার মানে বুঝলাম না।

হুঁ, মেলায় যাও তো, দেখতে পাও না, গণ্ডাকয়েক কাচ্চা-বাচ্চা নিয়ে মায়েরা আসছে। আর সেই মায়েদের গা থেকে ঝুলছে কত্ত কাঁঠাল।

আবার হাসির তুফান।

আমি আড়চোখে ইতিকে দেখছি– মনে হল ইতি বা তার নাম ঋতি হোক না, সে কেমন নিজের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে, এই বিবর্ণ ক্লাসরুম ছাড়িয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছে। তার চোখে শ্রদ্ধাবিগলিত এক অদ্ভুত আবেগ। আমি আবার যোগ করলাম, ওঠো, জাগো, এগিয়ে চলো। তা না হলে তুমি অন্ধকারে ফুটবে, অন্ধকারেই ঝরে পড়বে। আর দুঃখে কাদা হয়ে নজরুলের মতো গাইবে– আমি পথমঞ্জরি, ফুটেছি অাঁধার রাতে। তুমি চঞ্চল হও, সুদূরের পিয়াসী হও।

ছাত্রছাত্রীরা বেশ খেয়ে গেল।

দিন পনেরো বাদে একদিন হেডমাস্টারমশাই তাঁর ঘরে ডেকে নিলেন। থাকবার কোনও ঘর না পেয়ে তখন আমি বোর্ডিং-এ আছি।

হেডমাস্টারমশাই তাঁর কাজে ব্যস্ত থেকেও বললেন, আপনার স্টুডেন্ট ফিডব্যাক ভালো। আপনাকে একটা দায়িত্ব নিতে হবে। হায়ার সেকেন্ডারির ইংলিশটা এবার থেকে আপনি নেবেন।

কিন্তু ওটা তো স্যার কে কে নিচ্ছেন? (কে কে, মানে কমল কিশোরবাবু, অর্থনীতির শিক্ষক, ওনার ধারণা, উনি ইংরেজিটা সবথেকে ভালো জানেন। আমি অনার্স গ্র্যাজুয়েট, উনি মাস্টার্স। কারণ তখনও আমার মাস্টার্স হয়নি)।

আমি কে কে কে বলব। কোনও অপ্রীতিকর কিছু ঘটবে না। দায়িত্ব আমার। আমার ওপর ছেড়ে দিন।

আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসছিলাম। উনি আবার ডাকলেন।

আর একটা কথা। আপনার তো থাকবার জায়গা নেই। আপনি এক কাজ করুন না– আপনি আজ থেকেই সেক্রেটারির বাড়িতে থাকুন। ওঁরা অনুরোধ করেছেন। বিশেষ করে ইতির হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষা নিয়ে ওঁরা খুব উদ্বিগ্ন। আরও দুচারটে ছেলে-মেয়ে ওঁদের আছে, একটু গাইড করে দেবেন।

আমি ঠিক রাজি ছিলাম না, কিন্তু ঠিক তখনই ইতি এসে উপস্থিত। ইতি যেন সেই জেবড়ে বসে থাকা মেয়েটি নয়। উত্তেজনায় ফুটছে টগবগ করে। মনে হল ঝড় ঠেলে চলে এসেছে।

স্যার, আজকে আমার বাড়িতে আসছেন তো?

আমি গলে গেলাম।

আমি ঝরণার শব্দ শুনলাম। নদীর কলকল শুনলাম। পাতার ফাঁকে কোকিলের ডাক শুনলাম। আমতা আমতা করেও রাজি হলাম।

পরদিন থেকে ইতির রুটিন বদলে গেল। আমার জীবনে একটা অধ্যায় যুক্ত হল। ইতি বাধ্য ছাত্রীর মতো পড়াশোনা করে। আমার বকুনি শুনলে চোখ দিয়ে হাসে। আমি শরীরচর্চা করি, ও বোধহয় লুকিয়ে দ্যাখেট্যাখে। ইতি-ও শরীরচর্চা শুরু করে দেয়। আমি ওকে একটা মেয়েদের ব্যায়ামের বই এনে দিই। কাছাকাছি শহরে গিয়ে ডায়েট চার্ট এনে দিই। ও পরিমিত খায়, পরিমিত কথা বলে। নিজেকে ছুরির মতো ধারালো করতে চেষ্টা করে। ওর মায়ের চোখ এড়ায় না। সারাক্ষণ তিনি ভুরু কুঁচকে থাকেন।

আর আমি? আমার শরীরচর্চায় কবিতার ছন্দ। পেশিতে পাখি এসে বাসা বাঁধে। আমি উড়ানে যাই। আকাশটা হঠাৎ আরও নীল। আমি খরগোশের মতো ক্ষিপ্র। ওদের বড়ো পুকুরটায় সাঁতার কাটি। দুবার এপার ওপার করার জায়গায় চার বার করি। ওদের বাড়ির পশ্চিমে দিগন্তবিস্তৃত মাঠ। আমি ক্ষুদে ছাত্রছাত্রী বা একটু ডাঁসা আভাকে নিয়ে মাঠে দৗড়োতে যাই। ইতি যন্ত্রচালিতের মতো পায়ে পায়ে আমাদের পেছনে। ওকে দেখে আমার বুকের ভেতরের দম বেড়ে যায়। অনেক দূরের মাঠে ছুটছি আমি, ইতি দূর থেকে অস্পষ্ট ছায়া হয়ে গিয়েছে। আবার ফিরতি রাউন্ডে এসেছি, ইতি সোনালি রোদ্দুর মেখে সিল্যুয়েট ছবি। তার খোলাচুল উড়ছে হাওয়ায়। আমরা ক্লান্ত ঘর্মাক্ত হয়ে বাড়ি ফিরছি, ইতি দাঁড়িয়ে রয়েছে অভিবাদনের ভঙ্গিমায়। আমি পড়াচ্ছি– ইওর এইম ইন লাইফ। বলছি হালবিহীন নৗকো আর লক্ষ্য বা গন্তব্যহীন মানুষ দুয়ে এক।

ইতি মুগ্ধ হয়ে শুনছে।

আমি বলছি – গন্তব্যে নিয়ে চলো জীবনের নৌকো।

ইতি প্রশ্ন করে, যদি ঝড়ে পড়ে যাই?

আমি ধাক্বা খাই। ধীরে ধীরে বলি, নেপোলিয়নের সৈন্যবাহিনী তাদের সামনে আল্পস পর্বতমালা দেখে চমকে দাঁড়িয়েছে, তাদের গতি রূদ্ধ। নেপোলিয়ন তাদের বললেন, দেয়ার ইজ নো আল্পস! এগিয়ে চলো, চরৈবেতি।

তুমিও এগোবে ইতি, চারপাশকে অস্বীকার করে, সমস্ত বাধাকে তুচ্ছ করে। নিজের ওপর বিশ্বাস বাড়াও। তোমার স্থান হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে। কোনও কিছুর সঙ্গে কম্প্রোমাইজ নয়, কোনও সমঝোতা নয়। ইতি মুগ্ধ। আমি বলে চলি, ওই দ্যাখো, সামনে লাইটহাউস। ওই আলোকস্তম্ভ দেখে দেখে দাঁড় বেয়ে চলো। কোলরিজের অ্যালবেট্রস-এর মতো কেউ না কেউ তোমাকে পথ দেখাবে। ইতির চোখ লাইটহাউসের দিকে। চোখের পলক পড়ছে না। চা দিতে আসা ওর মায়ের চোখ কিন্তু ছোটো ছোটো হয়ে গেল। একবার আমার দিকে, একবার ওর দিকে তাকালেন। তারপর তাঁর চোখে অসহায় রাগ দেখতে পেলাম।

এরপর যা শুরু হল তাতে বলা যেতে পারে নিশ্ছিদ্র পাহারা। আমি যেখানেই যাই, যেদিকেই যাই, কোনও না কোনও ফেউ লেগে থাকত। আমার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার দশা।

মেয়েকে তাঁরা কী কী বলেছিলেন, কোনওদিন জানতে পারিনি। তবে সে মেয়ে জেদি, একরোখা হয়ে উঠল। আমার সঙ্গে তার কথাবার্তা স্বাভাবিক, ভেতরে কোথায় কী হচ্ছে, বাড়ি থেকে তাকে কোনও চাপ দিচ্ছে কিনা, কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। মাঝে মাঝে দেখতাম আভাও, বারো তেরো বছরের পুঁচকে মেয়ে, আমার দিকে কেমন চোখে যেন দেখছে। আমি ভ্রূক্ষেপ করতাম না। ইতির পড়াশোনা আগের থেকে ভালো হচ্ছে, এটাই আমার প্লাস পয়েন্ট।

ওদের বাড়ির বেশ লম্বাচওড়া দাওয়ায় ধানের মস্ত বড়ো মরাই। বাড়ির দেয়াল থেকে মরাইয়ের মাঝখানে একটা ছোট্ট চৗকোণা জায়গা। ঘর বললে ঘর। ওটাই ছিল আমার অস্থায়ী শোবার জায়গা। এখনও আমি ছবির মতো দেখতে পাই সেই ঘরটাকে। ওটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত না স্মৃতি।

পরীক্ষার আগে, অন্তত মাসখানেক ধরে, আমার কড়া নির্দেশ ছিল ছেলেমেয়েরা রাত তিনটে থেকে উঠে পড়াশোনা করবে। ওদের বাড়িতেও দেখলাম আমার নির্দেশ মান্যতা পেল। ওরা পড়াশোনা শুরু করবে, লম্বা মাদুর পেতে, সামনে জলচৗকি নিয়ে বসতে যাবে– এমন সময় প্রথম চৗকিটা অধিকার করল ইতি। ঠিক আমার বিছানার পাশটিতে। আমি মাটিতে বিছানা পেতে শুতাম। আমাকে আড়াল করে থাকত জববর এক মশারি। প্রথমদিন থেকেই ওদের দিদি বসবে প্রথমে। তারপরে ওরা। এর কোনও ব্যতিক্রম হতো না। ইতি হতে দিত না। আমার কাজ ছিল ওদের পড়াশোনার তদারকি করা। কেউ ভুল পড়লে মশারির ভেতর থেকেই ‘অ্যায়’– বলে শুধরে দেওয়া। কেউ ঢুলছে দেখলে তাকে হাসি মশকরা করে জাগিয়ে দেওয়া। তবে এবার একটা মজার ব্যাপার ঘটল। এবারে পাহারায় এলেন ইতির কাকা– হূষ্টপুষ্ট, গর্দান-বিশিষ্ট দৈত্যের মতো একটি লোক। বেচারিও রাত তিনটে থেকে উঠে একটা গোটা চওড়া বেঞ্চ জুড়ে শুয়ে থেকে, আমাকে নজর রাখতে শুরু করলেন। আমার কিন্তু বেশ লাগত ওঁদের এই বাড়তি তৎপরতা। একধরনের চোর-পুলিশ খেলা।

ইতির ওখানে বসে পড়াশোনা করাটা আমার কাছে যেন উৎসবের মতো ছিল।

ও এসে বসলেই আমার শেষ রাতটা অন্যরকম হয়ে যেত। মনে হতো হাজার হাজার কোকিল আমার চারপাশে ডাকতে শুরু করেছে। আলাদা একটা ঘ্রাণ রাতের খাঁজে খাঁজে ছড়িয়ে যেত। আমার সারা শরীর জুড়ে উৎসব শুরু হয়ে যেত। আমি বিছানায় জেগে জেগে মশারির ফাঁক দিয়ে ইতিকে দেখতাম। ইতিও মাঝে মাঝেই চমকে উঠত আমার মশারির সামান্য খসখস শব্দে। ওর কাকার ঝিমোনো চোখে মাঝেমধ্যেই অস্থির ইতি ধরা পড়ে যেত। কিন্তু ও কম চালাকি করত না, সামনের জলচৗকি তুলে নিজের বসবার জায়গাটা মিথ্যে মিথ্যে ঢুঁড়ে ফেলে দেখত, যেন কোনও পোকামাকড় হঠাৎ এসে পড়ে হাঁটছে।

একদিন দেখি ওর কাকা নাক ডাকছে, পেছন ফিরে দেয়ালের দিকে মুখ করে বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। সেদিন কী তিথি ছিল মনে নেই। গোটা পৃথিবীটা চাঁদের আলোয় ভাসছে। উঠোনের আমগাছটা ভিজছে রুপোর তরল স্রোতে। চমৎকার হাওয়া দিচ্ছে। সামান্য গরম ছিল, হাওয়ায় ভেসে গিয়েছে। আমি মশারির ভেতর থেকে ইতিকে দেখতে গিয়ে দেখি ও আমার দিকে মগ্ন হয়ে তাকিয়ে রয়েছে।

আমার কী হল আমি জানি না, সমস্ত নিষেধকে তুড়ি মেরে বেপরোয়া হয়ে উঠলাম। মশারির বাইরে আমার অশান্ত হাত। আমি ওর বাঁহাতের আঙুল ভয়ে ভয়ে আলতো ছুঁয়ে দিলাম। ও কেঁপে কেঁপে উঠল।

তারপর হঠাৎই উঠে ঘরের ভেতর চলে গেল। আমি প্রমাদ গুনলাম। এবার বুঝি আমার মান সম্মান কেরিয়ার সব যাবে। চরিত্রে কালির দাগ পড়বে। চাকরিটা যাবে। হাড়গোড় আস্ত থাকবে না। খুনও হয়ে যেতে পারি। কিন্তু তেমন কিছু ঘটল না।

মিনিট দুয়েক বাদে ও ফিরে এল। কেমন ওলট-পালট হয়ে গিয়েছে। এসে বসল একেবারে আমার মশারির গা ঘেঁষে। ওর থেকে আমার দূরত্ব মাত্র এক ইঞ্চি। আমি নিজের সাহস (বা দুঃসাহস) ফিরে পাচ্ছি। ক্রমশ দুঃসাহসী হচ্ছি। নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছি না। আমার ভেতরে এক অশান্ত যুবকের উত্থান হচ্ছে। আমি ভুলে গেলাম আমার বাস্তব।

আমার হাত একটু একটু করে এগোল। এগোতে এগোতে ওর কোমর ছুঁল, প্রতিরোধহীন মসৃণ এই যাত্রায় আমি আরও এগোলাম। আমার উদগ্রীব আঙুল কিলবিল করে ওপরে উঠছে এবং… ও গড, ওর সম্পূর্ণ মুক্ত বক্ষ, ব্রা বিহীন, অপরূপ দুটি অমৃতভান্ড টানটান হয়ে উঠেছে এবং এই প্রথম, এই অমৃতভাণ্ডের স্বাদ গ্রহণ করলাম আমি… ও থরথর করে কাঁপতে লাগল। ওর প্রহরী কাকার নাক তখনও ডেকে চলেছে।

এভাবে ভয়ে আতঙ্কে, নিষিদ্ধ আনন্দের শিহরণে, নেশায় আমাদের দুজনের দিনগুলি ব্রহ্মানন্দে কেটে যাচ্ছিল। আমি সতর্ক, কিছুটা সংযত থাকি। আমি জানি নিয়ন্ত্রণ রেখার এপারে থাকাই এখন শ্রেয়। আমার চাকরি বাঁচল, ওর পরীক্ষা। দুজনে দূরে থাকি কিন্তু হূদয়ের কাছে, যেন এই মাত্র ওর উষ্ণ শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ শুনলাম। ওর শাড়ির খসখস, চটির শব্দ, হাসির উচ্ছ্বাস বা বুকের ওঠানামায় আমার আত্মা প্রাণিত হচ্ছে গভীর ভাবে, বেঁচে আছি আমি। হঠাৎ বজ্রাঘাত।

একদিন ইস্কুলে যাচ্ছি। ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা ছোট্ট জংলা ভুলভুলাইয়া পার হয়ে ইস্কুলে যেতে হতো। এই জায়গাটা ছিল আমাদের চকিত দেখা, চকিত চলে যাওয়ার মঞ্চ। হঠাৎ পেছন থেকে চটির শব্দ। পেছন ফিরে দেখি একজোড়া লম্বা বিনুনি, সাদা ফিতে, সাদা শাড়ি, হালকা প্রসাধনে ইতি। ইতি অনেক বড়ো হয়ে গেছে। অনেক সপ্রতিভ। আমার হাতে ঝটপট একটা চিরকুট… গুঁজে দিয়ে হরিণীর মতো দ্রুত চলে গেল।

‘কাল বিকেলে পালাব বাড়ি থেকে। ওরা আমাকে টর্চার করতে শুরু করেছে। পরশু ওরা কোন এক ব্যবসায়ীর ছেলেকে নিয়ে আসছে আমাকে দেখানোর জন্য। পরীক্ষার পরে বিয়ে। পাকা কথা হয়ে থাকবে। আমি তোমার সঙ্গে পাতালে যেতেও রাজি। আমি এই জীবনকে অস্বীকার করতে চাই। আমি কলেজ-ইউনিভার্সিটি-পোস্ট গ্রাজুয়েট-গবেষণা… অনেকটা ধাপ এগোতে চাই। গাড়ি ব্যবসায়ী, মাতালদের বউ হয়ে কাঁঠালগাছ হওয়ার জন্য আমার জন্ম হয়নি। তুমি আমাকে এখান থেকে নিয়ে কলকাতা পালাবে। টাকা-পয়সা, ভবিষ্যৎ কোনওকিছুই চিন্তা করবে না। ও চিন্তার ভার আমার। ঠিক বিকেল তিনটেয়, আমি রেডি হয়ে ইস্কুল থেকেই উড়ে যেতে চাই। আমি বাসস্টপে, বুড়িমাসির পানের দোকানে দাঁড়িয়ে ওর সঙ্গে গল্প করতে থাকব। তুমি ওখানে আসবে পান খাওয়ার আছিলায়। তিনটে কুড়িতে একটা এক্সপ্রেস বাস আসে। তুমি হঠাৎই পেছনের গেটে উঠে পড়বে, আমি সামনের গেটে। জীবন-মরণের ব্যাপার। আশাকরি মনে থাকবে।’

ক্লাসে মন বসাতে পারলাম না। বারবার অন্যমনস্ক হলাম।

সারারাত চিন্তা করেও কূলকিনারা খুঁজে পেলাম না। এক মুহূর্তের জন্যও ওকে কাছে পেলাম না যে কিছু জিজ্ঞেস করব। শেষরাতে সিদ্ধান্তে এলাম, জীবনে ঝুঁকি না নিলে কিচ্ছু হবে না। আমি পাপ করছি না। নাবালিকা হরণও করছি না। কোর্টে দাঁড়িয়ে যা বলার বলব দুজনে। পরের দিন। শতাব্দী পেরিয়ে যেন বিকেল এল। আমি অন্যমনস্কতার ভান করে বাসস্টপের দিকে এগোচ্ছি। ওকে দেখলাম দূর থেকে বুড়িমাসির সঙ্গে গল্প করছে আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কিন্তু হা হতোস্মি! হঠাৎ কোথা থেকে এসে পড়লেন তার দৈত্য কাকা।

এই, এখানে কী করছিস?

চকোলেট কিনছি।

ঠিক আছে। চকোলেট-এর পয়সা দিয়ে দে। বাইকে ওঠ। আমি তো বাড়ি যাচ্ছি।

না– আমি –

না– আমি, কী? চল চল। দেরি হচ্ছে।

বাইকে চলে গেল। আমি মাঝপথে আটকে রইলাম।

পরের পরের দিন ছেলেটি এল ওকে দেখতে। বাড়িতে সাজো সাজো রব। কিন্তু ইতি তার বিছানা ছেড়ে উঠল না। ওর ধুমজ্বর।

এই উঠতি-আধুনিক-হওয়া গ্রামে বসন্ত এল। কোকিল-কূজনে ভরে গেল বাতাস। পলাতক ঘুঘুরা ঘরে ফিরল। রাস্তার দুপাশের ন্যাড়া গাছগুলো নতুন পোশাক পরে সেজে উঠল। বকুল-শিরিষ-অর্জুন-বয়েড়া এমনকী বাঁশ ঝাড়েও ফুটে উঠল আহ্লাদ। ফাল্গুনে আম্রমুকুল বিকশিত হল কিন্তু আমাদের দুজনের মধ্যে ফুটে ওঠা জীবনমুকুল বুঝিবা শুকোতে লাগল। আমি নিজেকে কঠিন করে ভেতরের নিজেকে চাবকাতে লাগলাম। বারবার বললাম, এই খুচরো খেলায় নিজেকে ধিকিধিকি জ্বলতে দেওয়া উচিত নয়।

কিন্তু যতই কঠিন হতে যাই ততই ইতির স্নিগ্ধ প্রত্যয়ী চোখ আমাকে নরম করে দেয়। এদের বাড়ির পাহারা এখন আরো আঁটওসাঁটও।

যে বসন্তের কথা বলছি, সেই বসন্তকালে দুটি ঘটনা ঘটল। একটি ভেতরে আরেকটি বাইরে।

আমি প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছি ইতির সঙ্গে একটিবারের জন্য দেখা করতে। নির্জনতা খুঁজছি কিন্তু নির্জনতা নির্বাসিত তখন জীবন থেকে। এখন ইস্কুলে পৗঁছিয়ে দিয়ে আসেন ইতির মা আর নিয়ে আসেন সেই দৈত্যকাকা।

হঠাৎ একদিন ইতি, ইতির বাবা মা এবং কাকা বাড়ি থেকে উধাও। আমার প্রবল কৗতূহল কিন্তু পরিবারের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোটা আমার মতো সামান্য ‘মাস্টার’ এর উচিত নয়। দগ্ধাতে লাগলাম। আমার এক পূজনীয় বাংলার মাস্টারমশাই যখন ‘রাবণের রণশয্যা’ পড়াতেন তখন একটা বর্ণনা দিতেন পুত্রশোকাতুর রাবণের মনের বেদনা বোঝাতে।

মাস্টারমশাই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বলতো দেখি কেমন সে ব্যথা?

আমি বলেছিলাম হুতাশনের মতো তাঁর বুকের ভেতর জ্বলছে শোক।

ইয়েস মাই বয়, ইউ আর কারেক্ট। এটা স্রেফ আগুন নয়, এটা হুতাশন। গভীর থেকে গুমরনো আগ্নেয়গিরি!

এই টেস্ট পরীক্ষার আগে ইতি কোথায় গেল? নাকি ইতির এখানেই ইতি হয়ে গেল?

কেউ একজন বললেন, আজ মনে নেই, ইতিকে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে টাটায়। আমার মনে খটকা, এত ভালো ভালো ডাক্তার কলকাতায় থাকতে টাটায়?

চারদিন পরে ইতি একা ফিরে এল বিধবস্ত চেহারা নিয়ে। একেবারে ইস্কুলের আগে। আমি ইস্কুলে বেরোচ্ছি, ইতিকে একা ফিরতে দেখে চমকে গেলাম। ইতি কোনও উত্তর না দিয়ে ইস্কুল যাওয়ার জন্য তৈরি হতে গেল।

আমার বুক ফেটে যাচ্ছিল কিছু জানার জন্য, কিন্তু ক্লাসে খাতা দেখতে গিয়ে ওর খাতার দুলাইন পেলাম। ‘জোর করে টাটায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আরও একটা সম্বন্ধের জন্য। আজ ছেলের আমাকে দেখতে আসার কথা। আমি বাবা মাকে পুরোপুরি চুক্বি দিয়ে পালিয়ে এসেছি। আজ রাতে আমার মৃত্যু লেখা আছে। ওরা ফিরলেই আমি শেষ।’

আমি লিখলাম একটা লাইন, ‘রাতে একবার দেখা কোরো।’

কিন্তু পরীক্ষার ঠিক আগে বলেই বোধহয় ইতিকে কেউ ঘাঁটাল না। সব চুপচাপ হয়ে গেল। সন্ধে থেকেই আমার অপেক্ষা। ঘন্টা… মিনিট…. সেকেণ্ড… অনন্তকাল অপেক্ষা করে আছি। ইতি, একবারটি এসো… ইতি, প্লিজ…।

রাত ন’টা নাগাদ আমার মাথা ধরল। মাথা তুলতে পারছিলাম না। মরাইয়ের একেবারে শেষ প্রান্তে গিয়ে একটা মাদুর পেতে শুয়ে রইলাম মাথায় রুমাল বেঁধে।

ইতি আসছে না। একটু বাদেই তো খেতে ডাকবে। তারপরে রাত। রাতের পরে দিন। ক্লাস… কী হল ইতির?

ঘুমিয়ে পড়লাম ক্লান্তিতে।

ইতি কখন এল টের পাইনি। টের পেলাম যখন দুটি দরদি হাত আমার কপালের রুমাল খুলে দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

আমার মধ্যে অনেকদিনের আগল খুলে নির্গত হতে লাগল আবেগ। আমি কী করব ভেবে না পেয়ে ওর মুখটা যত্নে নামিয়ে আনলাম আমার মুখের ওপর। আনাড়ির মতো চুমুতে চুমুতে ওকে পাগল করে দিলাম। কিন্তু কয়েক সেকেণ্ড মাত্র। হঠাৎ ছিটকে চলে গেল অন্ধকারে। আসরে এসে গেলেন ওর মা, একটা হ্যারিকেন নিয়ে। আমি চোখ বন্ধ করে পড়ে আছি। উনি কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন তারপর চলে গেলেন বিফল হয়ে।

পরেরদিন গৃহকর্তা ঠাণ্ডা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, এবার আপনাকে একটু বোর্ডিং-এ থাকতে হবে। আমার আত্মীয়রা আসছে। তাদের জায়গা দিতে পারছি না, বেশ কয়েক মাস থাকবে ওরা। আমার ছেলেমেয়েদের আপনি যেরকম গাইড করতেন সেরকমই করবেন। ওরা গিয়ে ওখানে পড়ে আসবে। মাসে মাসে মাইনেটা পাঠিয়ে দেব। আমার মুখে এসে গিয়েছিল, কিন্তু এখন যে পরীক্ষা। এখন কোনরকম ডিসপ্লেসমেন্ট হলে ওদের মনের ওপর চাপ পড়বে। কিন্তু বলতেই পারলাম না। নাহ্, ওদেরকে কোনও সুযোগ নয়। আমাকে সংযত হতে হবে। কিন্তু এখন যে আমি মুগ্ধ বালক। ভূতগ্রস্ত বা আলেয়াগ্রস্ত। আলেয়া কী? ঠিক বুঝতেও পারি না এসব ধনবান ব্যক্তিদের আহ্লাদী কন্যার মতিগতি। কিন্তু ইতি তো আর পাঁচটা মেয়ের মতো নয়? ওর অনুরাগ শ্রদ্ধা-ভালোবাসার মধ্যে তো কোনও খাদ নেই?

ইতিতে মগ্ন আমি এক উদ্ভ্রান্ত পথিক। বোর্ডিং-এর এই খাঁ খাঁ জীবনে শূন্য হয়ে যাই।

বারো ক্লাসের টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেল। এতদিন ইতি নামক একটি মেয়ে চলমান ছবির মতো আমার সামনে দিয়ে যেত আসত। তার চোখ আমাকে খুঁজত। নানান ছুতোনাতায় আমরা নিঃশব্দে কাছাকাছি হতাম। ওর শরীরের ঘ্রাণ নিতাম। ও হাসত পূর্ণতার হাসি।

কিন্তু এখন কী হবে? জয় করে তবু ভয় যায় না যে!

একদিন বাদে হেডমাস্টারমশাই আবার তাঁর ঘরে একা আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন।

আপনার ওপর অনেকটাই ভরসা করেছিলাম।

ভরসা হারানোর তো কোনও কারণ দেখছি না স্যার।

কালকের ছোকরা আপনি। সামনে এতবড়ো জীবন পড়ে আছে। এমন ভাবে জীবনটাকে একটা ছোট্ট গণ্ডির মধ্যে বেঁধে ফেলে নষ্ট করছেন কেন?

মানে, বুঝলাম না স্যার।

আপনার সঙ্গে ইতির কোনও সম্পর্ক তৈরি হয়েছে?

এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার স্যার। এর সঙ্গে ইস্কুলের ভূমিকার কোন ক্ল্যাশ হওয়া উচিত নয়।

যা জিজ্ঞেস করছি সরাসরি উত্তর দিন। ব্যক্তিগত অনেক সময় সমষ্টির জান-মান নিয়ে টানাটানি করে। বেঘোরে প্রাণটা দিতে চান না নিশ্চয়ই?

অবশ্যই না।

তাহলে শুনুন, এসব ভুলে গিয়ে নিজের কাজে মন দিন।

আমার কাজে কি আপনি অসন্তুষ্ট?

না, একেবারেই না। তবে কাজের লোককে অকাজে নষ্ট হতে দেওয়া আমার কাজ নয়।

আমি তো স্যার কোনও অকাজ করিনি। কোনো অভিযোগ আছে আমার বিরুদ্ধে?

আছে। আপনি বোধ হয় জানেন, এক সপ্তাহ ধরে ইতি আপনার পাশের ঘরে শুত এবং ওর বাবা মায়ের রিপোর্ট অনুযায়ী ওর ঘরের দরজা ভেজানো থাকত সাতদিন ধরে।

স্ট্রেইঞ্জ! আই নো নাথিং অফ ইট!

ভান করবেন না। আপনাদের মধ্যে কোনও শারীরিক সম্পর্ক হয়েছে?

না স্যার, একেবারেই না।

ঠিক বলছেন তো? এটার ওপর কিন্তু অনেক কিছু নির্ভর করছে।

হান্ড্রেড টেন পার্সেন্ট স্যার। বিলিভ মি।

অবাঞ্ছিত কোনওকিছু ঘটলে আপনার কেরিয়ার শেষ। ফিজিক্যাল অ্যাসল্টও হতে পারে। আমি কিন্তু আপনাকে বাঁচাতে পারব না।

রেস্ট অ্যাসিওর্ড স্যার।

ডিসগাস্টিং। নিজের ওপর, সারা দুনিয়ার ওপর রাগ হচ্ছে।

ইতির মুখটা ভুলে যেতে চেষ্টা করলাম। বোর্ডিং-এ, নিজের বিছানায় মুখ খুঁজে পড়ে রইলাম। জানালা দিয়ে আকাশটা বিষণ্ণ দেখাচ্ছে। গাছপালাগুলো ধূসর। পাখির ডাক বিস্বাদ। ইস্কুল বিল্ডিংটা অন্ধকারে ডুবে আছে। সন্ধের আগেই সন্ধে ঘনিয়ে এসেছে। জানালা দিয়ে একটা দলা পাকানো কাগজ এসে পড়ল আমার ওপর। চকিতে সরে গেল সান্ধ্য অবয়ব।

এর মধ্যে মামাতো দাদা আরেকজন পাত্র নিয়ে এসেছিল। সেদিনও আমার ধুমজ্বর এল। ওরা আমার খেলা ধরে ফেলেছে। ওরা বড়োসড়ো কিছু ঘটিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পরই আমার জারিজুরি শেষ। কিন্তু আমি এত সহজে হার মেনে যাবার পাত্রী নই। তুমি আমায় বলেছিলে না, আলোর দিকে যেতে হবে? তুমি আমার হাত ধরলে আমি কাউকে ভয় পাই না। পরীক্ষা যেদিন শেষ হবে, তার পরের দিনই আমি পালাব। আমি মরিয়া। মনে মনে প্রস্তুতি নিয়ে নাও। পরের পরিকল্পনা পরে জানাব। পালিয়ে আমি যাবই। ওরা কেউ আমাকে ধরে রাখতে পারবে না।

টিউশন পড়তে এসে ইতি কোনও টাস্ক দিল না। পড়া শেষ হয়ে গেলে ওঠার সময় বলল, স্যার, আমার এই এসে-টা একটু দেখে দেবেন? খাতাটা রইল, পরে নিয়ে নেব। ওর চোখ আমাকে কিছু বলতে চাইল।

আমি কিছুক্ষণ পরে খাতার ভেতর থেকে আর একটা চিরকুট নিয়ে টয়লেট-এ গিয়ে পড়লাম ‘পরীক্ষার পরের দিনই ঠিক রইল। এখানে নয়, পরের বাসস্টপে গিয়ে আমি দাঁড়াব। তুমি, যে বাসটার কথা বলেছি, তাতেই উঠবে এখান থেকে। পরের বাসস্টপে একটু নেমেই তুমি আমাকে দেখতে পাবে। টুক করে উঠে পড়বে বাসে। কেউ যেন না দেখে।’

আমি প্ল্যান মতো পরের বাসস্টপে নেমে গেলাম। ইতিকে খুঁজলাম। ইতি নেই। অনেকগুলি বাসে উঠলাম। একটি ছাত্র আমাকে দেখে ফেলল। স্যার, কোথাও যাবেন?

না, আমার এক বন্ধু আসার কথা আছে, তাই-ই।

ওহ্, স্যার, পরীক্ষা ভালো হয়েছে আমার।

আমার কানে কিছুই ঢুকছিল না। হ্যাঁ, হু করে গেলাম।

ব্যর্থ, পরাজিত মানুষের মতো ফিরে এলাম বোর্ডিং-এ।

ইতি এল কয়েকদিন পরে। স্যার, খাতাটা নিতে এলাম। আর একটা খাতা দেব স্যার। এর পরে আর জ্বালাতন করব না। ওকে দেখে মনে হল এক বিপন্ন ত্রস্ত মানুষের মতো। ও চলে গেল।

আমি ওর দিকে তাকাতেও পারলাম না। অভিমান, ক্ষোভ, রাগ অনেক কিছু আমাকে আটকে দিল নিজের ভেতরে।

খাতাটা খুলেই ধপ করে বসে পড়লাম বিছানায়।… তারিখে আমার বিয়ে।

আমি তলিয়ে যাচ্ছি। ডুবে যাচ্ছি। আমার হাতটা ধরে রাখুন না…!

ভোরবেলা উঠে একটা ছোট্ট চিঠি লিখে ওর খাতায় আটকে দিলাম, ‘আমি এখনও তোমার হাত ধরে আছি। কিন্তু তুমি কি পারো না– আর একটু সাহস দেখিয়ে মুখোমুখি রুখে দাঁড়াতে? বিয়ের মালাটা লোহার বেড়ি নয়। পারো না ওটাকে ছুড়ে ফেলতে? তাহলে এতদিন এই মারণ খেলায় মেতেছ কেন? পালিয়ে বেড়ানোটা কোনও কাজের কথা নয়!’

এই প্রথম ব্যতিক্রম হল। ওর বোন এসে খাতাটা নিয়ে গেল। আমার চিঠিটা আমি আঠা দিয়ে এমন ভাবে আটকে দিয়েছি যে কেউ তার হদিস পাবে না।

আমি ওর বোনকে বলে দিলাম, খাতাটা অবশ্যই যেন দিদিকে গিয়ে দিয়ে দেয়। আমি কারেক্ট করে দিয়েছি।

আজ ওর বিয়ে। আমি কীভাবে নিজের বর্ণনা দেব? দেবদাস? নিজেকে নানান প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত করছি আমি। হঠাৎ দেখি বাস রাস্তা থেকে কাঁদো কাঁদো মুখে কীসব বলতে বলতে ওর দাদা এবং কিছু লোক ছুটে আসছে ইস্কুলের দিকে। বুকটা ছাঁৎ করে উঠল।

একজন সিনিয়র টিচার আমার কাছে দ্রুত এসে গেলেন।

শোনো, এই গলি রাস্তা দিয়ে, মেঠো পথ ধরে, পালিয়ে যাও। দৌড়োও। এক মুহূর্তও দেরি কোরো না।

যাও–

কী হয়েছে স্যার?

ইতি সুইসাইড করেছে। যাও, পালাও !

আমি পালিয়ে গেলাম।

সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত, যখনই ইতির মুখ মনে পড়ে যায়, আমি নিজের থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই। কত দূরের পথ আমি জানি না, কিন্তু পালানো ছাড়া আর যে কিছুই করার নেই আর আমার!

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...