দোকান বন্ধ করে ফিরতে ফিরতে রোজই প্রায় দশটা বেজে যায় বিমলের। ফিরে স্নান সেরে একেবারে খাবার টেবিলে। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা এই রুটিনের বড়ো একটা হেরফের হয় না। এই সময়ে বাড়ির সকলকে তিনি একসঙ্গে দেখতে চান। এটা ওনার কড়া অনুশাসন-ই হোক বা হুকুম, ওনার মতে দিনের একটা সময়ে অন্তত একত্রিত হয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটানো, নিজেদের সুখ-দুঃখ শেয়ার করে নেওয়াটা ভীষণ জরুরি। এতে পরিবারের সঙ্গে জুড়ে থাকা যায়।

আজ খাবারের মেনু দেখেই মনটা বেশ ভালো হয়ে যায় বিমলের। তার পছন্দের নতুন গুড়ের পায়েস, তাও আবার ঠিক সেই ভাবেই বানানো, যেভাবে সে ছোটোবেলায় পছন্দ করত। ধিকি ধিকি আঁচে মরে আসা দুধে তৈরি পরমান্ন কোথাও যেন একটা মায়ের ছোঁয়া। মুখে প্রকাশ না করলেও মনে মনে বেশ অবাকই হয় বিমল। শ্রদ্ধা এতবছর ধরে চেষ্টা করেও এই ফ্লেভার আনতে পারেনি। উসখুশ শুরু করে বিমল। বাবার অবস্থা দেখে ছেলেমেয়েরা মুখে হাতচাপা দিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে শুরু করে। চোখ এড়ায়নি বিমলেরও। শ্রদ্ধাও নেই খাবার টেবিলে। ঘিয়ের গন্ধে ঘর ম-ম করছে। বিমল ধরেই ফেলেছিল শ্রদ্ধা পরোটা ভাজছে। আর তর সইতে না পেরে টেবিলে রাখা আলুর দম চামচে করে মুখে পুরে নেয় বিমল। মুখের গ্রাস শেষ হতে না হতেই সামনে বসে থাকা ছেলেমেয়েদের প্রশ্ন করে,  ‘অদিতি এসেছে নারে?’ কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই রান্নাঘর থেকে পরোটার প্লেট হাতে করে স্ত্রী শ্রদ্ধা ডাইনিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়ায়। সঙ্গে আসে বোন অদিতি, বোনের মেয়ে তানিয়া। সকলে নড়েচড়ে বসে। অদিতি দাদার সামনে এসে দাঁড়াতেই বিমল বলে ওঠে, ‘আমি ঠিক বুঝেছি। এ জিনিস তুই না হয়ে যায় না। কখন এলি? অন্তত একটা খবর তো দিতিস। আর শ্রদ্ধা তোমার-ই বা কী বুদ্ধি বলো তো, একটু জানাতে তো পারতে। ওদের জন্য কিছু নিয়ে আসতাম।’

‘আরে দাঁড়াও দাঁড়াও এত ব্যস্ত হোয়ো না। বউদিকে আমি-ই বলতে মানা করেছিলাম। ভাবলাম তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দিলে কেমন হয়?’

‘ওহ্ তুইও এই বিচ্ছুগুলোর চক্বরে পড়ে ওদের ষড়যন্ত্রে…’ কথা শেষ হওয়ার আগেই অদিতি দাদার উদ্দেশ্যে বলে, ‘ক্ষতি কী দাদা, কোনও কিছু করে যদি কাউকে আনন্দ দেওয়া যায়!’

‘কী মামা সারপ্রাইজ-টা কেমন লাগল?’

‘সত্যি বলতে কী মাঝে মাঝে এরকম সারপ্রাইজ পেলে ভালোই লাগে। তবে আগে জানলে পরশুরাম থেকে তোদের পছন্দের বালুশাই আনতাম, এই আর কী। এত রাতে তো আর অত দূর যাওয়াও যাবে না।’ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ভাগ্নির মাথায় স্নেহের হাত রেখে জবাব দেয় বিমল।

বরাবরই বোনকে একটু বেশিই ভালোবাসে বিমল। বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকে সেটাই অপত্যস্নেহে পরিণত হয়েছে। সেই কারণেই নিয়ম করে বোনের খবর নেওয়া। বোন এলে তার পছন্দমতো জিনিস আনা। রান্নাবান্না। বাড়ির পরিবেশে বেশ একটা আলাদা মাত্রা যোগ হয়। নয় নয় করে তেইশটা বছর বিমলের সঙ্গে ঘর করছে শ্রদ্ধা। পরিবারের সকলের পছন্দ-অপছন্দ সবই তার নখদর্পনে। আর ননদের বালুশাই প্রীতির খবরও তার অজানা নয়।

‘আরে বাবা অদিতি তোমার আদরের বোন হতে পারে, আমারও তো ননদিনি নাকি? তাও আবার একমাত্র। তার অনাদর কী করে করি বলো তো?’ বলে মুচকি হেসে ননদের গালটা টিপে দেয় শ্রদ্ধা। তারপর স্বামীর দিকে ফিরে, ‘অত ভাবতে হবে না তোমাকে। ও আসবে শুনেই ঋজুকে দিয়ে দু-কেজি বালুশাই আনিয়ে রেখেছিলাম। অদিতি এতক্ষণে সেখান থেকে খানিকটা সাফও করে দিয়েছে।’ শ্রদ্ধা আর অদিতি প্রায় পিঠোপিঠি। দু-এক বছরের ছোটো-বড়ো। বিয়ের পর থেকেই ননদ-ভাজের বেশ ভালো সম্পর্ক।

শ্রদ্ধার কথা শুনে খুশি হয় বিমল। কিন্তু প্রকাশ করে না। শ্রদ্ধার কথাতে ছেলেমেয়েদের সামনে অপ্রস্তুতে পড়ে যায় বিমল। তাই একটু গম্ভীর থাকার চেষ্টা করে সে।

খাবার পরে দেদার আড্ডা। হাসি, মজা। শুতে শুতে অনেক রাত। ছেলেমেয়েরাও পিসিকে নিয়ে মশগুল হয়ে পড়ে। ঠান্ডায় গল্প আরও জমে ওঠে। মেতে ওঠে বিমল শ্রদ্ধাও। অদিতি গল্প শোনাতে থাকে। ছোটোবেলার গ্রামের বাড়ির হরদয়াল কাকার গল্প। কোনও এক সন্ধ্যায় জলে পড়ে গিয়ে কাকার কী অবস্থা হয়েছিল… ইত্যাদি ইত্যাদি। বাচ্চারা হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেতে থাকে। বিমলের চোখে পড়ে গল্প, ইয়ার্কির মাঝে মাঝে বাচ্চারা তাদের পিসিকে গা-টিপে কিছু ইশারা করছে। অদিতিও তৎপর হয়ে চোখের ইশারাতেই কিছু বলার চেষ্টা করছে তাদের। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই অদিতি দাদার দিকে তাকিয়ে, ‘ওহ্ দাদা, ভাবছি কাল বাচ্চাদের বেড়াতে নিয়ে যাব। ভাবলাম এমনিতে তো আর সময় হয় না। এখন বাচ্চাদের ছুটি। পড়াশোনারও তেমন চাপ নেই। পঁচিশে ডিসেম্বর সবাই আনন্দ করবে, ওরাই বা কেন ঘরে বসে থাকবে। তাই ঠিক করেছি কাল সারাদিন আমরা বাইরে কাটাব। খাবদাব, ঘুরব, শপিং করব, মাল্টিপ্লেক্সে সিনেমা দেখব। ব্যাপারটা বেশ জমে যাবে। এখন তোমার পারমিশন পেলেই হল।’

বিমল লক্ষ্য করছিল তার দুই ছেলে আর মেয়ে মাথা নীচু করে বসে আছে। তারা হয়তো ভাবছে পিসির এই প্রস্তাব তাদের বাবা সরাসরি নাকচ করে দেবে।

‘ঠিক আছে তোরা ঘুরবি ফিরবি এতে আপত্তির কী আছে। আমি বরং পুরো দিনের জন্য একটা গাড়ি বুক করে দেব এখন।’

‘তোরা ঘুরবি ফিরবি মানে? তুমি?’ দাদাকে থামিয়ে প্রশ্ন করে অদিতি।

‘কী করে যাব বল, দোকান খুলতে হবে না? এখন একেবারে পিক সিজন।’

তিন ছেলেমেয়েই আশ্চর্য হয়ে তাকিয়েছিল বাবার দিকে। বাবার থেকে এতটা আশা করেনি তারা। ছোটোবেলা থেকে তারা যেভাবে বাবাকে চিনে এসেছে, দেখে এসেছে, তাতে সবার মনে ওনার একটা আলাদা ইমেজ তৈরি হয়েছে। তাদের বাবা ভীষণ হাতভারী গোছের মানুষ। অন্যান্য বন্ধুরা নিত্যদিন যেভাবে পোশাক বদলায়, ফোনের মডেল বদলায়, শপিং করতে যায়, সপ্তাহে অন্তত দু-দিন রেস্তোরাঁতে খেতে যায়– বাবার কার্পণ্যের কারণে তাদের কাছে সে-সব ভাবনার অতীত।

তার সম্পর্কে বাচ্চাদের মনোভাবের কথাও অজানা নয় বিমলের। বয়সটা তো আর কম হল না। জীবনের তিপান্নটা বছর পার করে এসেছে সে। চুলে তো আর এমনি এমনি পাক ধরেনি। কত ওঠাপড়ার সম্মুখীন হতে হয়েছে তাকে। জীবনের বোধ থেকেই হয়তো তার মনে হয়েছে বাস্তব কতটা কঠিন সেটা ওদেরও জানা দরকার। প্রয়োজনের অতিরিক্ত পেয়ে গেলেই সন্তান বিগড়ে যাবে। তাদের সংযমী মানসিকতা গড়ে উঠবে না। সুতরাং তারাও জানুক-বুঝুক। আস্তে আস্তে তো তারাও বড়ো হচ্ছে। এরপর তাদেরও সমাজে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। সাতপাঁচ ভাবছিল বিমল। কী মনে হওয়াতে হঠাৎই বোনকে প্রশ্ন করে বসল, ‘হ্যাঁ রে বুড়ি, বেড়ানোর আইডিয়াটা বাচ্চাদের ছিল, না রে?’

বাচ্চাদের সাথে খুনশুটি করতে ব্যস্ত ছিল অদিতি। হঠাৎই দাদার এই অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে ঘাবড়ে যায় অদিতি। কোনওমতে নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। তারপর বলে, ‘বাচ্চারা ভেবেছিল তুমি একেবারেই রাজি হবে না। তাই আমিও মনে মনে জেদ ধরবার জন্য প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। কিন্তু তুমি তো সেই সুযোগই দিলে না। শোনামাত্রই হ্যাঁ করে দিলে।’

বোনের কথা শোনা মাত্রই ঈষৎ হাসার চেষ্টা করে বিমল। তারপর এক-এক করে সকলের মুখের দিকে দেখে খুব সহজভাবে বলে, ‘আসলে তুই হয়তো জানিস না বাচ্চাদের এরকম বলার কারণটা কী? জানতে চাস? ওরা ভাবে ওদের বাবা কঞ্জুস। বাবার হাত দিয়ে এক পয়সাও গলে না।’

এতবড়ো কঠিন সত্যটা বাবার মুখে শোনামাত্রই মাথা নত করে নেয় বাচ্চারা। লজ্জায় রাঙা হয়ে ওঠে তাদের মুখ। তাদের মনের কথা তাদের বাবা কীভাবে যেন বুঝে ফেলেছে। আর সবার সামনে এমনভাবে বলাতে চোখ পর্যন্ত তুলতে পারে না তারা। বিমলও হয়তো কোনও কারণে এরকম একটা সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। তাই সুযোগটা কাজেও লাগিয়ে নেয় সে।

‘তবে এটাও ঠিক, এর জন্য বাচ্চাদেরও পুরোপুরি দোষ দেওয়া যায় না। আমি-ই আজকালকার এই লাইফস্টাইলের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে পারি না। অকারণে বাইরে খেতে যাওয়া, ঘোরাফেরা করা, প্রয়োজন ছাড়াই শপিং করা, রোজ রোজ মোবাইল ফোন বদলানো এগুলোতে আমি একেবারেই অভ্যস্ত নই। তার মানে এই নয় যে, আজকালকার প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা যা করছে, সেগুলো সবই ভুল বা আমি এগুলোর বিরুদ্ধে, তা কিন্তু নয়। আসলে আমার এটাই অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। আমি এমনি এমনি এরকম হইনি। এর পিছনে অনেক কারণ রয়েছে। আজ তোমাদের সব কিছু খুলে বলব।’

বিস্মিত হয়ে সকলে বিমলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। বিমল তার নিজের মতো করে বলতে থাকে। মনের মধ্যে জমে থাকা কষ্টগুলো বেরিয়ে আসতে চায় তীব্র গতিতে।

‘বুড়ি তোর ছোটোবেলার কথা মনে আছে?’

‘হ্যাঁ, অল্পবিস্তর।’

‘এমন অনেক কিছুই আছে যা তুই জানিস না বা বলতে পারিস তোকে জানানো হয়নি। সেই সময় আমরা কীভাবে যে কাটিয়েছি, আমাদের উপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে গেছে, মনে পড়লে আজও গায়ে কাঁটা দেয়। তখন তুই বছর পাঁচেকের। তোর মনে থাকার কথাও নয়।’ দাদার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়েছিল অদিতি। আবেগরুদ্ধ বিমল তার ছোটোবেলার কাহিনি বলতে শুরু করে।

বিমলের বাবা প্রশান্ত মৈত্রর ব্যবসায়ী সমাজে বেশ একটা প্রতিপত্তি ছিল। পাইকারি বাজারে এককথায় সবাই চিনত তাকে। বিমলও ছোটোবেলাটা বেশ বৈভবের মধ্যে কাটিয়েছে। বাড়িতে সেই সময়কার আমোদ-প্রমোদের সমস্ত জিনিস মজুদ ছিল তাদের। পাড়ায় প্রথম টেলিভিশন আসে তাদের বাড়িতেই। রবিবার আর বুধবার হলেই ছায়াছবি আর চিত্রহার দেখার জন্য আশপাশের লোকের ভিড়। আশপাশে থাকা মানুষজনদের প্রয়োজনীয় ফোনও আসত তাদের বাড়িতে। তার উপর বাড়ির দুর্গাদালানে ধুমধাম করে বছরের চারটে দিন পুজো। খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে হইহুল্লোড় এগুলো থেকেই তার বেশ একটা আলাদা অনুভূতি হতো। সবার থেকে সে আলাদা, এমনকী স্কুলেও ফার্স্ট বেঞ্চ-এর আসনটাও সবসময় তার জন্য বরাদ্দ থাকত। বংশপরম্পরায় দান-দক্ষিণা বা চাঁদা দেওয়ার ব্যাপারেও তারা যে মুক্তহস্ত এটা সকলেই জানত। কোনও অনুষ্ঠানে গেলেও তাদের পরিবারের প্রতি আলাদা খাতির যত্ন নজরে পড়ত তার।

সমাজের উঁচু স্তরের লোকেরা নিজেদের শো-অফ করতে ভালোবাসে। চিরকাল এটাই হয়ে এসেছে। স্ট্যাটাস মেনটেন করতে নয়তো প্রভাবপ্রতিপত্তি জাহির করতে কিছু একটা করার নেশা পেয়ে বসে তাদের। বন্ধুর হাত ধরে কেউ যায় রেসের মাঠে, কেউ যায় মদের ঠেকে, কেউ আবার জুয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে সর্বস্ব খুইয়ে বসে। কারও কারও মাথায় আবার জাঁকিয়ে বসে নারীসঙ্গ করার নেশা। কোনও অসৎ মহিলার চক্বরে না পড়লেও প্রশান্ত মৈত্র-র মদ-রেস কোনওকিছুই বাদ ছিল না।

বিমল তখন বেশ ছোটো তাই কিছু বোঝেনি। বুঝল সেদিন যেদিন প্রথম তার মাকে বাবার সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলতে দেখেছিল। প্রত্যুত্তরে তার বাবাও মার গায়ে হাত তুলতে দ্বিধা করেনি। তখন বিমলের ক্লাস নাইন। ততদিনে যা হওয়ার হয়ে গেছে। জুয়াতে একের পর এক দান হেরে সর্বস্ব খুইয়ে বসেছে। এমনকী প্রশান্তবাবু তার স্ত্রী-র গয়না পর্যন্ত ছাড়েনি। বাজারে দেনার পাহাড়। দিনরাত বাড়িতে পাওনাদারদের আনাগোনা। দেনার দায়ে বাড়িটা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে যায় তার চোখের সামনে। দেখাশোনার অভাবে ততদিনে ব্যাবসারও পড়তি অবস্থা। থাকার মধ্যে রয়েছে শুধু রাস্তার ধারের দশ ফুট বাই আট ফুটের ওই দোকানঘরটা। বাধ্য হয়েই পাশের কলোনিতে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে হয়েছিল তাদের। সমস্ত দেনা মেটানোর পর হাতে যেটুকু অর্থ ছিল তাই দিয়েই পুনরায় ব্যাবসাটাকে দাঁড় করাবে ভেবেছিল বিমলের বাবা। কিন্তু তার আগেই হার্ট অ্যাটাকে সব শেষ। হয়তো এতটা ধাক্বা সামলাতে পারেনি প্রশান্তবাবু।

সমস্ত শুনে অদিতির দু-চোখ জলে ভরে যায়। গলাটাও যেন রুদ্ধ হয়ে আসে তার। কোনও মতে নিজেকে সামলে নেয় অদিতি। তারপর ধীর কন্ঠে বলে, ‘আমার আজও একটু একটু মনে আছে দাদা কত রাত করে বাড়ি ফিরত। মা ঠায় মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকত দাদার অপেক্ষায়। আর কাঁদতে কাঁদতে বলত ‘ওইটুকু ছেলে কোথায়

ঘুরবে-ফিরবে, পড়াশোনা করবে তা নয় দায়িত্বের ভারে ছেলেটার ভবিষ্যৎ শেষ হয়ে যাচ্ছে।’ তখন বুঝিনি, আজ বুঝতে পারছি মা ওই সমস্ত কথা কেন বলত। বড়ো হবার পরেও বোঝার উপায় ছিল না। তখন তো আমাদের বেশ স্বচ্ছল অবস্থা।’ বোনের মাথায় স্নেহের হাত রেখে দুঃখ ভাগ করে নেয় বিমল।

‘আমার পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়াটা মা মানতে পারেনি। ওটাই মায়ের বড়ো কষ্টের জায়গা ছিল। কিন্তু তোকে একা রেখে মা-র পক্ষে কোনও কিছু করাটাও সম্ভব ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে আমি ব্যাবসাটা শুরু করেছিলাম। সেটাও পেরেছি শুধুমাত্র সুরজিত কাকুর জন্য। আজ আমি যা কিছু সবই ওনার দয়ায়। উনি না থাকলে এই চারটে জেনারেল স্টোরের…’ বলতে বলতে কেমন যেন থমকে যায় বিমল। বোধকরি চারটে জেনারেল স্টোরের মালিক কথাটা বলতে আজও সাবলীল নয় সে। তাই এখনও দোকানই বলে থাকে।

খানিক সময়ের মধ্যেই নিজেকে ধাতস্থ করে তোলে বিমল। তারপর আবার বলতে শুরু করে, ‘সেই সময় ওই সুরজিত কাকুই, হয়তো টাকা দিয়ে সাহায্য করতে পারেননি, ভরসা করে আমাকে বেশ কিছু মালপত্র দিয়েছিলেন ব্যাবসা শুরু করার জন্য। ওটাই ছিল শুরুয়াত। তারপর একটু একটু করে লোকের ভরসা অর্জন করার পর তাদের থেকে ধার নিয়ে জিনিস বিক্রি করে ধার মিটিয়েছি। টাকার জন্য লোকের হাতে-পায়ে পর্যন্ত ধরেছি। এখন ভাবলে অবাক হয়ে যাই কী করে এইসব সামলেছিলাম। ব্যাবসা থেকে উপার্জিত যৎসামান্য

লভ্যাংশ থেকেই একটু একটু করে জমিয়ে আগে কলোনি থেকে শিফ্ট করলাম অন্য একটা ভাড়া বাড়িতে।’

সকলের চোখে মুখে বিস্ময়ের সঙ্গে সঙ্গে কষ্টের স্পষ্ট ছাপ ফুটে ওঠে। বিশেষত বিমলের ছেলেমেয়ে আর স্ত্রী শ্রদ্ধার। শ্রদ্ধা তো প্রশ্ন করেই বসে, ‘এতবছর তোমার সাথে সংসার করছি। কই ভুল করেও তো এসব কোনওদিন বলোনি?’

‘কী হবে বলে। কষ্টের কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো। আমি এসব জানিয়ে তোমাকে বিব্রত করতে চাইনি। সবসময় মনে হয়েছে তোমাদের কীভাবে ভালো রাখা যায়। কোনও কিছুতে অভাব রাখিনি। তবে হ্যাঁ…,’ থেমে যায় বিমল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে।

দাদাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে চোখ মোছে অদিতি। খুব ধীর কণ্ঠে প্রশ্ন করে, ‘তারপর, তারপর কী হল দাদা?’

‘বাবার জুয়া খেলা, বাড়ি নিলাম হয়ে যাওয়ার খবরটা আগুনের ফুলকির মতো দ্রুত গতিতে লোকের মুখে মুখে ছড়াতে শুরু করেছিল। এতে কী হয় জানিস, আর্থিক লোকসান তো হয়ই, তার থেকেও বড়ো হয়ে দাঁড়ায় পারিবারিক মানসম্মান খুইয়ে ফেলাটা। হাজারো লোকের হাজারো রকম প্রশ্ন। চতুর্দিকে কৗতূহলী নজর। সেই নজর এড়িয়ে এগিয়ে চলাটা ভীষণ কষ্টকর। টাকাপয়সার কী আছে, আজ গেলে কাল চলে আসবে। কিন্তু সেই সম্মান কী আর ফিরে পাওয়া যায়? কয়েকটা বছর বাদ দিলে অন্যান্য বন্ধুদের মতো নিয়মানুযায়ী ছোটোবেলাটা যেভাবে কাটা উচিত, সেটা তো আমি পাইনি। এই ক্ষতটা সারাজীবনেও কভার করা সম্ভব নয়।’ বিমলের প্রতিটি কথায় ঝরে পড়ে তীব্র আর্তনাদ। ঘরের পরিবেশ আরও গম্ভীর হয়ে ওঠে। এতদিনের বুকে চেপে থাকা পাথরগুলো আস্তে আস্তে সরাতে থাকে বিমল।

‘কিন্তু কখনওই এটা ভেবো না যে শুধুমাত্র আর্থিক অভাবের কারণেই এমনটা হয়, মান সম্মান একবার খুইয়ে ফেললে মাথা উঁচু করে বাঁচাটা খুবই কঠিন। আমার এখনও মনে আছে কোনও বন্ধুর মুখোমুখি হতেও ভয় পেতাম আমি। নিজেকে ভীষণ ছোটো মনে হতো। লজ্জায় মা-ও ঘরের বাইরে বেরোনো বন্ধ করে দিয়েছিল। ডিপ্রেশনের কারণে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছিল মা। সবসময় নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রাখত। এই আঘাত আমার মনে আজও দগদগে ঘা হয়ে রয়ে গিয়েছে। আজ আমি প্রতিটি পদে পদে অনুভব করতে পারি যে, একটা মানুষের বেপরোয়া, দায়িত্বজ্ঞানহীন মনোভাবের মাশুল তার পরিবারের প্রতিটি মানুষকে বছরের পর বছর গুনতে হয়। এখনও পর্যন্ত পূর্বপরিচিত কারওর সাথে দেখা হলেই লজ্জায় একেবারে গুটিয়ে যেতে হয়।’ বলতে বলতে গলাটা শুকিয়ে গিয়েছিল বিমলের। সামনের টেবিলে রাখা জল খানিকটা ঢকঢক করে খেয়ে নেয় সে। তারপর আবার বলা শুরু করে।

‘উদয়াস্ত কঠিন পরিশ্রম করেছি, তবে গিয়ে দুটো পয়সার মুখ দেখতে পেয়েছি। ধীরে ধীরে একটু একটু করে টাকাপয়সা জমিয়ে ডেয়ারি প্রোডাক্ট, নানাবিধ প্রয়োজনীয় জিনিস দিয়ে দোকানটা সাজাতে শুরু করেছি। কঠিন পরিশ্রম আর ন্যায় নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করলে সাফল্য আসতে বাধ্য– কথাটা ভীষণরকম সত্যি। তাই বোধহয় একটার পর একটা স্টোর কিনতে পেরেছি। আর এর থেকেই আমার বাড়িঘর সব কিছু। শ্রদ্ধা তো তবুও আমার মুখে কিছুটা হলেও কষ্টের কথা শুনেছে কিন্তু বাচ্চারা শুরু থেকেই দেখছে তার বাবার চার-চারটে জেনারেল স্টোর। ওরা হয়তো ভাবে ওদের বাবা আগাগোড়াই ধনী লোক, পূর্বপুরুষদের থেকে পাওয়া বিজনেস-ই সামলাচ্ছে। ওরা কী করে জানবে যে কত সংঘর্ষ করে তবে আমি এই জায়গায় পৗঁছেছি।

বিস্ময়ের জাল ছিঁড়ে বেরোতে পারে না কেউ-ই। বিশেষত বাচ্চারা। এতদিন ধরে তারা তাদের বাবার সম্পর্কে কী কী না ভেবে এসেছে। মানুষটা কতই না কষ্ট করেছে জীবনে। পড়াশোনা তো দূর অস্ত, ওই খেলাধূলার সময়ে সমস্ত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে নিরন্তর একা লড়ে গেছে। তবে গিয়ে আজ এই জায়গায় পৗঁছেছে। জীবনে এমন সংঘর্ষের কথা তো তারা কখনও কল্পনাও করতে পারে না।

ঝড়ের পরে যেমন ডালপালা, শুকনো পাতা, ধুলোবালি, এদিক-ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে, চতুর্দিকে ছেয়ে থাকে নীরবতা, ঘরের মধ্যে নিস্তব্ধতা ঠিক তেমনই যেন জমাট বেঁধে গিয়েছিল। কেউ কোনও সাড়া করছে না দেখে পরিস্থিতি বদলানোর দায়ভার কাঁধে তুলে নেয় শ্রদ্ধা-ই। স্বামীকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে আসে।

‘আচ্ছা ছাড়ো। কষ্টের দিন শেষ হয়ে গেছে। এখন তো আমরা ভালো আছি। কোনও অভাব নেই আমাদের। তোমার কঠোর পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। তুমি থাকতে আমাদের চিন্তা কী?’

‘শ্রদ্ধা, সেই কারণেই তো আমি আজও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, যাতে আমাদের বাচ্চাদের কোনওরকম অভাব, অনটনের মধ্যে না কাটাতে হয়। আর-পাঁচটা বাচ্চার মতো তারাও যেন জীবনটা সুখে, নির্দ্বিধায় কাটাতে পারে। কোনওদিন যেন লোকের কাছে ছোটো না হতে হয়। সেই কারণেই তো আমার দিনরাত খাটা।’ বলতে বলতে ছেলেমেয়েদের দিকে সস্নেহে তাকায় বিমল। তারপর তাদের উদ্দেশ্যে বলে, ‘তোরা একটুও ভাববি না, শুধু মন দিয়ে পড়াশোনাটা কর। তোদের কোনওদিনও কোনও অভাব হতে দেব না। তোদের স্বপ্নপূরণের জন্য আমি সবকিছু করতে পারি।’

‘ব্যস আর কী চাই? কালকের প্রোগ্রাম তাহলে পাক্বা। বাচ্চারা এবার শুতে যাও। কাল সকাল সকাল বেরোতে হবে।’ পিসির কথা শুনে সকলেই খুশি হয়ে যে-যার মতো শোওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। কিন্তু বিমলের বড়ো ছেলে বছর পনেরোর ঋজু গম্ভীর হয়ে সেখানেই বসে থাকে।

‘কী হল রে ঋজু? কী চিন্তা করছিস? শুতে যাবি না? অমন করে বসে আছিস যে বড়ো!’

‘না ভাবছি এককালে হয়তো বাবাকে ভীষণ কষ্ট করতে হয়েছে কিন্তু এখন তো আমাদের কোনও অভাব নেই। তাহলে বাবা এখনও কেন এভাবে চলবে? এখন তো নিজের ইচ্ছেগুলো পূরণ করতে পারে, যেগুলো থেকে ছোটোবেলায় বাবা বঞ্চিত হয়েছে।’

নিজেদের ঘরে শুতে যাওয়ার জন্য সবেমাত্র পা বাড়িয়েছিল বিমল। আকস্মিক ছেলের এই প্রশ্নে থমকে দাঁড়িয়ে যায় সে। তারপর বলে, ‘বাবু, তুই যে এতটা ভেবেছিস, এতেই আমি খুশি। আসলে কী জানিস তো একটা সময় বুঝেছি টাকার মর্মটা কী! এটা না থাকলে কেউ তোকে তোর প্রাপ্য সম্মানটুকুও দেবে না। ওই বয়সে এমন কষ্ট সয়েছি, যে আজ অহেতুক এক টাকাও খরচ করতে মন চায় না। অতীতের কথা মনে পড়ে যায়। বাবার ভুলের জন্য যে মাশুল আমি গুনেছি, আমি চাই না তোরাও সেই কষ্ট পাস। আর্থিক অসুরক্ষার ভয়, অপমানজনক সেই পরিস্থিতি চাইলেও মন থেকে মুছে ফেলা যায় না। কিন্তু হ্যাঁ তার মানে এই নয় যে তোমাদের প্রয়োজনীয় জিনিস  আমি তোমাদের দিইনি। হয়তো রোজ রোজ চাহিদামাফিক নতুন নতুন হালফ্যাশনের মোবাইল তোমাদের দিইনি, হয়তো বাইরের খাবার খেতে মানা করি। কেন বলি জানো এগুলো একেবারেই স্বাস্থ্যকর নয় তাই। এগুলো কিন্তু কোনও কৃপণতা নয়, ভালোর জন্যই করা। বাজারের সবথেকে দামি ল্যাপটপটাও কিনে দিয়েছি তোমাকে। তোমাদের স্বাস্থ্যের কথা ভেবে সবসময় সেরাটা নেওয়া হয়েছে তোমাদের জন্য। সে জামাকাপড়-ই বলো বা খাওয়াদাওয়া। আজ তোমাকে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে একটা কথা বলছি এটা মেনে চলো, জীবনে এগোতে সাহায্য করবে। যে ব্যক্তি নিজের আয় অনুসারে ব্যয় আর সঞ্চয় করে, ভবিষ্যতে তাকে কখনও আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না। কাজেই পারলে বাবার কথা মনে রেখো। অনেক জ্ঞানের কথা বলে ফেললাম। অনেক রাত হয়ে গেছে শুয়ে পড়ো,’ বলে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় বিমল আর তার অর্ধাঙ্গিনি শ্রদ্ধা।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...