হ্যালো, অ্যাম আই টকিং টু মিস্টার মৃণাল সোম? একটি মিষ্টি সুরেলা নারীকণ্ঠ ভেসে এল ফোনের ভিতর থেকে।
ইয়েস, স্পিকিং, মৃণালও বিনম্র স্বরে প্রত্যুত্তর দিল।
স্যার, দিস ইজ নিশা ফ্রম হোটেল সানস্টার। উই ফাউন্ড আ ওয়ালেট হ্যাভিং সাম মানি, এটিএম কার্ড অ্যান্ড আদার ইমপর্টেন্ট কার্ডস উইথ ইযোর আইডেন্টিটি ইন আওয়ার কনফারেন্স হল। ইউ আর রিকোযে্টেড টু কালেক্ট ইট ফ্রম রিসেপশন, থ্যাংক ইউ।
লাইন কেটে গেল। এই অপ্রত্যাশিত আনন্দে ঠিক কী রিঅ্যাক্ট করা দরকার ভেবে পেল না মৃণাল। চেয়ারটা টেনে বসে পড়ল। রাতের সমস্ত টেনশন এক মুহূর্তে ছু-মন্তর হয়ে যেতে শারীরিক ভাবে যেন কিছুটা নিজেকে দুর্বল মনে হল মৃণালের। রাতের ঘটনাটা মনে পড়ল। গতকাল রাতে অফিসেরই একটা সেমিনার অ্যাটেন্ড করতে ওই হোটেলে গিয়েছিল সে। রাতে বাড়ি ফিরে একটা কাগজ পার্স থেকে বার করতে গিয়ে খেয়াল হয়, প্যান্টের পকেট তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখেছে মৃণাল। কোথাও নেই। সেই থেকে টেনশন শুরু হয়েছে তার। সকালে উঠে পার্স পাওয়া গেছে জেনে স্বস্তি অনুভব করল সে।
তাড়াতাড়ি স্নান, ব্রেকফাস্ট সেরে সে সোজা হোটেলের রাস্তা ধরল। হোটেলের সামনে যখন পেঁছোল তখন ঘড়িতে প্রায় দশটা বাজতে চলেছে। হোটেলে ঢুকে মৃণাল সোজা রিসেপশনের দিকে পা বাড়াল। রিসেপশনে বসে থাকা মেয়েটিকে দেখে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল মৃণাল। লক্ষ্য করল মেয়েটি সুন্দরী এবং স্মার্ট। মৃণালকে দেখে এক মুখ হাসি নিয়ে মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ স্যার?
আই অ্যাম মৃণাল, মৃণাল সোম। ইউ আর নিশা আই থিংক। ইউ কলড মি ইন দ্য মর্নিং।
ও… ও… ইয়া…, বলতে বলতেই মেয়েটি কাউন্টারের নীচে রাখা মৃণালের পার্স-টা বার করে মৃণালের ছবিটা দেখে শিওর হয়ে পার্স-টা মৃণালের হাতে ধরিয়ে দিল।
থ্যাংকস এগেন নিশা। ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড ক্যান উই হ্যাভ আ কাপ অফ কফি টুগেদার প্লিজ। নিশাকে থ্যাংক ইউ জানাবার একটা রাস্তা খুঁজছিল মৃণাল।
সরি, ইটস ডিউটি টাইম, ক্যাচ ইউ লেটার, বলে মিষ্টি হেসে নিশা অন্য কাজে মন দিল।
চলে যাওয়ার স্পষ্ট ইশারা সত্ত্বেও মৃণাল নড়ল না। মুখে হাসি টেনে বলল, অ্যাজ ইউ উইশ। বাই দ্য ওয়ে ক্যান আই হ্যাভ ইযোর কনট্যাক্ট নাম্বার প্লিজ?
সরাসরি এবার নিশা তাকাল মৃণালের দিকে। মৃণাল একটু ইতস্তত করে আবার বলল, আপনাকে কফির জন্য ইনভাইট করতে চাই, তাই কনট্যাক্ট নাম্বারটা থাকলে সুবিধা হবে।
নিশা একটা ভিজিটিং কার্ড মৃণালকে দিতেই মৃণাল একবার চোখ বুলিয়ে সেটা পার্সে ঢুকিয়ে নিল। থ্যাংক্স জানিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়াল।
গতকাল সেমিনারের পর আজ মৃণালের ছুটি ছিল অফিসের। তাই হোটেল থেকে সোজা বাড়িতে ফিরে এল। বাড়ি ঢুকে ঊষাকে চা তৈরি করতে বলে জামাকাপড় বদলাতে ঘরে ঢুকে গেল সে। মেজাজটা বেশ ফুরফুরে মনে হচ্ছিল, তাই নিজের অজান্তেই একটা গানের কলি গুনগুনিয়ে উঠল। সেই মুহূর্তে ঊষা চা নিয়ে ঘরে ঢুকতেই, মৃণালকে দেখে একটু অবাক হল। কী ব্যাপার হঠাৎ এত রোমান্টিক হয়ে উঠলে? গান গাইতে তো কখনও শুনি না। কাউকে নতুন মনে ধরল নাকি?
কেন গান গাওয়াটা কি দোষের? বিরক্ত হয়ে জবাব দিল মৃণাল।
গান গাওয়াটা দোষের সেটা তো আমি একবারও বলিনি। তোমার সঙ্গে কথা বলাটাই আমার দোষ হয়েছে, ঝাঁঝিয়ে ওঠে ঊষা।
বাইরে যতক্ষণ থাকো ততক্ষণ ফুল এনার্জি। আর বাড়িতে ঢুকলেই, কী হয় কে জানে, খুশির বেলুন চুপসে গেছে মনে হয়, বলে বিড়বিড় করতে করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় ঊষা।
চা খেয়ে মৃণাল নিশার কার্ডটা পার্স থেকে বার করে মোবাইল নম্বরটা নিজের মোবাইলে সেভ করে নেয়। হোয়াটস অ্যাপে একটা মেসেজ লেখে, হাই… দিস ইজ মৃণাল। সকালে হোটেলে আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ইউ রিটার্নড মাই পার্স। আশা করি ভবিষ্যতেও আমরা আবার দেখা করব।
সারা রাত অপেক্ষা করার পর সকালে মোবাইলে চোখ পরতেই নিশার পাঠানো গুড মর্নিং সঙ্গে স্মাইলি দেখে মৃণাল খুশিতে ডগমগ হয়ে উঠল। সঙ্গে একটা উত্তেজনাও অনুভব করল।
রোজকার মতো তৈরি হয়ে অফিস চলে গেল মৃণাল। কিন্তু সারাটা দিন কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারল না। চোখের সামনে নিশার টানা দুটো চোখের লুকিয়ে থাকা অভ্যর্থনা খালি তাকে আকর্ষিত করতে থাকল।
কোনওক্রমে অফিসে বিকেল অবধি কাটিয়ে বাইরে এসে নিশাকে ফোন করল মৃণাল। তার মধুর কণ্ঠস্বর শোনার জন্য ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে উঠেছিল সে। সাধারণ কিছু কথাবার্তা হওয়ার পর নিশা জানাল, সে এখনও ডিউটিতে রয়েছে।
ঠিক আছে সময় হলে প্লিজ একটা ফোন করবেন, বলে মৃণাল ফোন ছেড়ে দিল।
নিশাও ভিতরে ভিতরে একটা দুর্বার আকর্ষণ বোধ করছিল মৃণালের প্রতি। হোটেলের কাজে রোজই নতুন নতুন পুরুষের সঙ্গে তার কথা হয়, কখনও সেটা আলাপ পর্যন্ত গড়ায়। কিন্তু মৃণালের জন্য আলাদা করে একটা টান, উত্তেজনা বোধ করে নিশা। সুতরাং আটটায় ডিউটি শেষ হতেই মৃণালকে, কল করে সে বলে, এই এতক্ষণে ছাড়া পেলাম।
আমি তো ভাবলাম আপনি ভুলেই গেছেন আমার কথা, মৃণাল একটু অভিমান ভরা স্বরে বলে। কিন্তু নিশার কথার জাদুতে উপলব্ধি করে, বাস্তব থেকে অনেক দূরে সরে যাচ্ছে সে। নিশার জগতে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে।
প্রায় দশদিন ফোনেই চলল বার্তালাপ। কিন্তু এই কটা দিনে, তারা আরও পরস্পরের মনের কাছাকাছি চলে এল। আরও ভালো করে একে অপরকে জানল। একদিন মৃণাল সাহস করে নিশাকে কফি খেতে যাওয়ার প্রস্তাব দিল। নিশাও মৃণালের সান্নিধ্য পেতে চাইছিল। এর পর প্রায়শই নিশাকে মৃণালের অফিসে আবার কখনও মৃণালকে নিশার হোটেলে দেখা যেতে লাগল।
নিশার সঙ্গে আলাপের দুমাস কেটে যাওয়ার পরও মৃণাল কিছুতেই এই সম্পর্কটা থেকে, নিজেকে নিশার আকর্ষণ থেকে মুক্ত করতে পারল না। হয়তো মনে মনে সে এটাই চাইছিল। তার বোরিং জীবনে নিশার উপস্থিতি মৃণালকে মুক্ত বাতাসের অনুভতি এনে দিত। নিশার প্রেমে নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিল সে। একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে বলে মনে হতো মৃণালের। কিন্তু বাইরে বেরিয়ে আসার ইচ্ছেটাও ধীরে ধীরে ক্ষীণতর হয়ে যাচ্ছিল মৃণালের মনে।
আগে আট দশদিনের মধ্যে একবার হলেও শারীরিক প্রয়োজন মেটাতে ঊষার দ্বারস্থ হতে হতো তাকে। তার জন্যে ঊষার গঞ্জনা সহ্য করতে হতো মৃণালকে। কিন্তু নিশার সঙ্গে আলাপের পর, ঊষার প্রতি, এই দাম্পত্যের প্রতি একটা বিতৃষ্ণার মনোভাব তাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে বুঝতে পারল মৃণাল। কল্পনার জগতে সেই প্রয়োজন মেটাতে নিশাকেই বেছে নিয়েছিল সে। শুধু অপেক্ষায় দিন গুনছিল কবে এই স্বপ্নের জগত বাস্তবে রূপান্তরিত হবে।
মৃণাল কখনও কখনও নিশাকে রোমান্টিক কবিতা লিখেও পাঠাত। নিশা উত্তর দিতে দেরি করত না। শোবার ঘরের বন্ধ দরজার আড়ালে মেসেজগুলো পড়তে পড়তে মৃণালের মুখে হাসি ফুটে উঠত। ল্যাম্পের মৃদু আলোয় নিশার বিবস্ত্র দেহটা পাশেই অনুভব করত। ভিতরে ভিতরে কামনার আগুনে জ্বলতে থাকত মৃণাল।
নিশার প্রতি আকর্ষণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, ঊষার সঙ্গে সম্পর্কটা আরও শীতল হয়ে উঠল। এক বিছানায় শুয়ে থাকলেও নিজেদের মধ্যে হাজার মাইলের দূরত্ব অনুভব করত তারা দুজনেই। মৃণালের যেন দমবন্ধ হয়ে আসত বাড়িতে ঢুকলে। কথাতেই আছে ভালোবাসা আর সুগন্ধ লুকোনো যায় না। মৃণালের চরিত্রের পরিবর্তনও ঊষাকে সন্দিগ্ধ করে তুলছিল। একদিন মৃণাল যখন বাথরুমে ঢুকেছে, ঊষা ওর মোবাইল চেক করতে গিয়ে নিশার পাঠানো মেসেজগুলো এক এক করে পড়তে লাগল। সবকিছু তার চোখের সামনে উন্মোচিত হল।
রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে মনে হল, তখনই মৃণালকে বাথরুম থেকে টেনে বের করে জিজ্ঞেস করে এসবের মানে কী? কিন্তু কী ভেবে ঊষা নিজেকে সামলে নিল। আরও মজবুত প্রমাণের অপেক্ষায় সেদিনের মতো নিজেকে নিরস্ত করল। ফোন সঠিক জায়গায় রেখে দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করার জন্য ঘর ছেড়ে রান্নাঘরে কাজ সারতে চলে গেল, যেন কিছুই হয়নি।
সেদিন মৃণালের অফিসের বার্ষিক গেট-টুগেদার পার্টি ছিল। মৃণালের সঙ্গে ঊষাও এসেছিল পার্টিতে। ঊষাকে একা দেখতে পেয়ে মৃণালের কলিগ মৃদুলা ঊষার কাছে এসে দাঁড়াল, কী বউদি, কেমন আছেন?
মৃদু হেসে ঊষা জবাব দিল, ভালো। আপনি?
মৃদুলা, ঊষার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে চারপাশ দেখে ঊষার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে প্রশ্ন করল, বউদি এতদিন ধরে আপনাদের দেখছি, এখন মনে হচ্ছে আপনি দাদাকে একটু বেশিই স্বাধীনতা দিয়ে ফেলেছেন। দাদা তো দেখি সবসময় আকাশে উড়ছেন।
কেন কী হয়েছে? আমার তো এই ব্যাপারে কোনও আইডিয়া নেই। বরং অফিসে সারাটা দিন কী হচ্ছে সেটা আপনিই ভালো বলতে পারবেন। কী হয়েছে?
ঊষা, মৃদুলার মনের কথা পড়ার চেষ্টা করে।
খুব বেশি কিছু জানি না, তবে লাঞ্চ টাইমে প্রায়ই দেখি একটা ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে দাদা বাইরে চলে যান। একদিন দেখেছিলাম একটি সুন্দরী মেয়ে নীচে অপেক্ষা করছিল দাদার জন্য। বুঝতে পারলাম কারণ দাদা ওর হাত ধরে কথা বলতে বলতে অফিস থেকে কিছুটা এগিয়ে গেলেন, মৃদুলার বর্ণনায় ঊষা ভিতরে ভিতরে দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে কিন্তু মুখে কিছু প্রকাশ করে না।
পার্টিতে ঊষার মন ছিল না, তাই মৃণাল বাড়ি ফেরার প্রস্তাব দিতেই সঙ্গে সঙ্গে ঊষা রাজি হয়ে গেল। বাড়ি ঢুকতেই নিজেকে আর চেপে রাখতে পারল না ঊষা। সোজা মৃণালের মুখোমুখি হল সে, মৃদুলা একটি মেয়ে কথা বলছিল, মেয়েটি কে?
মৃণাল একটুও অবাক না হয়ে বলে, আমার একজন বান্ধবী, এনি প্রবলেম?
আমার কেন প্রবলেম হবে? যার স্বামী বাইরে প্রেম করে বেড়াচ্ছে, তার স্ত্রীয়ের জন্য সেটা তো খুব গর্বের। তাই না! খোঁচা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে ঊষা।
কখনও নিজেকে আয়নায় দেখেছ? যে-কোনও ভালো লোকেরও মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে তোমায় দেখলে। নিশার সঙ্গ যদি আমার ভালো লাগে, তাতে তোমার কী ক্ষতি হচ্ছে? তোমার সব প্রয়োজন মেটানোর ব্যবস্থা তো আমি করেই রেখেছি, মৃণাল ধৈর্য হারিয়ে ফেলে।
আমার কোনও উপকারে কোনও দিন লেগেছ যে, আজ আমার নতুন করে কোনও ক্ষতি হবে? আমার নিজের কপাল যেখানে খারাপ সেখানে অন্য কাউকে দোষ দিয়ে কী হবে? বলে ঊষা চোখের জল চাপতে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল।
আসছে শনিবার নিশার জন্মদিন মৃণাল জেনে নিয়েছিল। সেই দিনটায় তিন-চার ঘন্টা সময় শুধু নিজের জন্য চেয়ে নিয়েছিল মৃণাল নিশার কাছে। রাজিও হয়ে গিয়েছিল নিশা।
কথামতো নির্ধারিত সময়ে কিছু আগেই মৃণাল সানস্টার হোটেলে পৌঁছে গেল। অদ্ভুত এক উৎসাহ আর উত্তেজনায় শিহরিত হচ্ছিল মৃণালের শরীর। নিশা তাকে একটা ভিআইপি রুমে নিয়ে গেল। ঘরে ঢুকে ফুলের বোকেটা নিশার হাতে দিতে দিতে, নিশাকে হ্যাপি বার্থ ডে উইশ করল মৃণাল। একটু ইতস্তত করে নিশার গালে একটা হালকা চুম্বন এঁকে দিল।
এই প্রথম মৃণাল নিশাকে স্পর্শ করল। দ্বিধা একটু ছিলই কারণ এতে নিশার কী প্রতিক্রিয়া হবে সেটা মৃণালের জানা ছিল না। কিন্তু নিশা মৃণালকে কোনও বাধা দিল না। এতে মৃণালের সাহস আর একটু বাড়ল। সে নিশাকে হাত দিয়ে টেনে নিয়ে আরও অন্তরঙ্গ হতে চাইল। নিশার তরফে কোনও বাধা এবারও এল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাইরের জগতটা ভুলে গিয়ে দুজনে একে অপরের কাছে আত্মসমর্পণ করল।
রুমের ইন্টারকমটা বেজে উঠতেই দুজনের সম্বিৎ ফিরে এল। বিকেলে এই ঘরটার বুকিং আছে, তাই তক্ষুণি রুম ছাড়তে হবে। মৃণালের কিছুতেই ইচ্ছে করছিল না নিশার সঙ্গে কাটানো এই মুহূর্তটা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। দশ বছরের বিবাহিত জীবনে মৃণালের কাছে যা-কিছু অধরা ছিল, তার দ্বিগুন সে আজ নিশার কাছে পেয়ে তৃপ্তি বোধ করছিল। জামাকাপড় পরে তৈরি হয়ে বেরোবার আগে মৃণাল ভালোবাসার প্রমাণ-স্বরূপ নিজের সোনার আংটি-টা নিশার আঙুলে পরিয়ে দিল।
সারাদিন ফোনে কথা, মেসেজ, হোয়াটস অ্যাপ, চ্যাটিং এই নিয়ে মৃণালের ব্যস্ততা দিন দিন বাড়তে শুরু করল। এমন হয়ে দাঁড়াল পরিস্থিতি প্রায় পাগলামির পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছল। অফিসের কাজে মন বসানো দায় হয়ে উঠল। অস্থিরতা যেদিন সহ্যের বাইরে চলে যেত, কাজ ছেড়ে মৃণাল, নিশার সঙ্গে দেখা করতে ছুটত। নিশার ডিউটি থাকলে, নিজেই হোটেলে গিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করত। মাসে দুতিনবার হোটেলের রুম সারাদিনের জন্য বুক করে, একসঙ্গে সময় কাটিয়ে রাত করে বাড়ি ঢুকত মৃণাল।
প্রতি মাসে স্যালারির একটা বড়ো অংশ নিশার জন্য খরচ করে ফেলত সে। ফলে সংসারে টাকা দেওয়াটা ধীরে ধীরে কমতে লাগল। প্রথম প্রথম ঊষা অনেক বোঝাবার চেষ্টা করল মৃণালকে। সমাজে থাকতে হলে কিছু নিয়ম মেনে চলার জন্য অনুরোধ করল কিন্তু এই মৃণাল যেন একেবারে অন্য মানুষ। কাউকেই তোয়াক্কা করে না। অগত্যা ঊষাও কিছু বলা ছেড়ে দিল। এটাই নিজের ভবিতব্য মেনে নিল সে। কারণ ঊষারও কোথাও যাওয়ার উপায় ছিল না। পাছে পরিস্থিতি ডিভোর্স অবধি পৌঁছোয়, এই ভেবে সে মুখে কুলুপ আঁটল। মৃণাল ছাড়া তার আর কে আছে যার কাছে গিয়ে বাকি জীবনটা কাটাতে পারে? ভেবে দেখল কেউই নেই! এই তার নিয়তি, সুতরাং ভরসা যদি করতেই হয়, তাহলে সময়ের উপরেই করা ভালো।
এই ভাবেই বহমান নদীর ধারার মতোই দিনগুলো হাসি-কান্না নিয়ে বয়ে যেতে থাকল। প্রায় এক বছর হতে চলল নিশার সঙ্গে মৃণালের পরিচয় হয়েছে। মৃণাল মনে মনে ঠিক করে রাখল এক বছর যেদিন পূর্ণ হবে, সেদিনটা নিশার সঙ্গে খুব এনজয় করবে। লং ড্রাইভে কোথাও যাওয়ার প্ল্যানিং করে রাখল। বেশ কদিন হল মৃণালের খালি মনে হচ্ছে নিশা যেন অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত। মৃণালের ফোন কখনও কখনও ধরছে না। কারণ জিজ্ঞেস করলে এটা-সেটা বলে এড়িয়ে যাচ্ছে। বেশির ভাগ সময়ে নিশার ফোন ব্যস্ত থাকছে।
একদিন প্রথম চেষ্টাতেই নিশাকে ফোনে পেয়ে গেল মৃণাল, নিশা আজ প্লিজ সন্ধেবেলায় দেখা করো। জরুরি আলোচনা আছে, কাকুতি স্পষ্ট হয়ে ওঠে মৃণালের গলায়।
মৃণাল প্লিজ, আজ কিছুতেই হবে না। ডিউটির পর আমার অন্য কাজ রয়েছে। ওয়েট ফর নেক্সট টাইম ডার্লিং, নিশার লাইন কেটে যায়।
আজ প্রথমবার নয়, মৃণাল এই নিয়ে সাত-আটবার তাকে দেখা করার জন্য অনুরোধ করেছে। প্রতিবারই নিশা কিছু না কিছু অজুহাত দেখিয়ে মৃণালকে এড়িয়ে গেছে। আজ প্রথম মৃণালের খটকা লাগল, তাহলে কি ইচ্ছে করেই মৃণালের সঙ্গে দেখা করতে চাইছে না নিশা? সন্দেহটা পাকাপাকি ভাবে মৃণালের মনে গেঁথে বসল।
হঠাৎই পরের দিন নিশাকে কিছু না জানিয়ে, মৃণাল তার হোটেলে গিয়ে উপস্থিত হল। রিসেপশনে নিশাকে দেখতে না পেয়ে একজন ওযেটারকে দেখে দাঁড় করাল মৃণাল। নিশা কোথায়, জিজ্ঞেস করতেই লোকটি জানাল, ম্যাডাম একজন অতিথির সঙ্গে ডাইনিং হলে রয়েছেন।
মৃণাল হোটেলের ডাইনিং হলের দিকে পা বাড়াল। হলের দরজায় আসতেই চোখে পড়ল, দরজার দিকে পিঠ করে নিশা সোফায় বসে। পাশে একজন পুরুষ যার কাঁধে মাথা রেখে দুজনে নিজেদের মধ্যে মৃদুস্বরে কথোপকথনে ব্যস্ত। দরজার দিকে দুজনের পিঠ থাকায় মৃণালের উপর কারওরই নজর পড়ল না।
চুপচাপ মৃণাল রিসেপশনে ফিরে এল। ওখানে সোফায় বসে নিশার জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। প্রায় আধঘন্টা পর দেখল নিশা, পুরুষবন্ধুটির হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে আসছে। মৃণালের দিকে চোখ পড়তেই নিশার মুখ-চোখ ফ্যাকাশে হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি হাত ছেড়ে দিয়ে বন্ধুটিকে দরজা অবধি পৌঁছে দিয়ে এসে, মৃণালের সামনে এসে দাঁড়াল।
এসব কী নিশা? ছেলেটি কে? রাগ সামলে কোনও মতে জিজ্ঞেস করল মৃণাল।
কেন কী হয়েছে? আমার কোনও বন্ধু থাকতে পারে না? তোমার চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন সপ্তম আশ্চর্যের একটা তুমি হঠাৎ দেখে ফেলেছ। এত উত্তেজিত হওয়ার কী আছে? অবহেলার স্বরে কথাগুলো বলে নিশা মুখ বিকৃতি করল।
দ্যাখো নিশা এসব আমার একদম পছন্দ নয়। তোমরা যেভাবে হাত ধরেছিলে তাতে এটা স্পষ্ট যে, ছেলেটি তোমার বন্ধু নয়। কে ছেলেটি? গলার জোরে প্রকাশ পায় মৃণাল নিজের রাগ চেপে রাখতে পারছে না।
বললাম তো আমার বন্ধু। গলার স্বর নামিয়ে কথা বলো। আমি তোমার কেনা সম্পত্তি নই যে, আমার উপর অধিকার ফলাচ্ছ, নিশাও অধৈর্য হয়ে ওঠে।
মৃণাল নীচু গলায় বলে, কিন্তু তুমি তো আমাকে ভালোবাসো নিশা। তুমিই বলেছিলে আমিই তোমার প্রথম ভালোবাসা। হতাশ শোনায় মৃণালের কণ্ঠস্বর!
হ্যাঁ, তখন বলেছিলাম। কিন্তু বইতে কি কোথাও লেখা আছে, মানুষের জীবনে ভালোবাসা একবারই আসে? দ্বিতীয় কিংবা ততীয়বারও তো মানুষ অপর কাউকে ভালোবাসতেই পারে। দ্যাখো মৃণাল এটা আমার জীবন। এতে অন্য কেউ নাক গলাক আমি চাই না। তুমি আমার ভালো বন্ধু, এর বেশি কিছু নও। বন্ধু হয়ে যদি থাকতে পারো… ওয়েল অ্যান্ড গুড আর নয়তো, তুমি সম্পূর্ণ স্বাধীন, যেখানে খুশি যেতে পারো। এই বলে নিমেষে মৃণালের মুখ বন্ধ করে দেয় নিশা।
কিন্তু আমাদের সম্পর্ক, সেটার কী হবে? আমাদের এত দিনের মেলামেশা, স্বপ্ন দেখা, তোমাকে আংটি পরানো এই সব কিছু এত সহজে এক ঝটকায় শেষ করে ফেলতে চাইছ তুমি, তোমার বিবেক তোমাকে প্রশ্ন করবে না? মৃণাল কিছুতেই বাস্তব-টাকে মেনে নিতে পারছিল না।
মৃণাল বিবেকের দংশন কি আমি একাই সহ্য করব? তুমি যখন ঊষাকে ছেড়ে আমার কাছে এসেছিলে তখন তোমার বিবেক কোথায় ছিল? একবারও কি ঊষার কথা তোমার মনে হয়েছিল? বাঃ মৃণাল! তুমি করলে সেটা ভালোবাসা, আর আমি করলে সেটা ঠকানো। এ কী রকম পরস্পরবিরোধী চিন্তাধারা তোমার? নিজের খুশি খুঁজে নেওয়ার অধিকার কি কেবল তোমাদের পুরুষদেরই আছে? আমাদের মেয়েদের কি কোনও অধিকারই নেই? ওদের সম্পর্কের রসায়ন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে নিশা মৃণালকে একা বসিয়ে রেখে, ঝড়ের গতিতে হোটেল ছেড়ে বেরিয়ে এল।
আজ এতদিন পর মৃণাল উপলব্ধি করল, ঊষাকে সে কতবড়ো আঘাত দিয়েছিল। এই সম্পর্কের ভরাডুবি, ঊষা হয়তো অনেক আগেই উপলব্ধি করে ফেলেছে। নিজের ব্যথার থেকেও আজ ঊষার মনের ব্যথাটা মৃণালকে বেশি ভারাক্রান্ত করে তুলল। কোনওমতে নিজেকে টেনে তুলল মৃণাল, মন্থর গতিতে হোটেল ছেড়ে রাস্তায় পা বাড়াল। এখুনি বাড়ি ফিরতে হবে। হয়তো এখনও খুব বেশি দেরি হয়নি। ঊষা হয়তো রোজের মতো আজও জানলায় চোখ রেখে তার ফেরার অপেক্ষা করছে।