চিকিৎসা পরিভাষায় মূত্রনালির সংক্রমণ-কে ইউরিনারি ট্র্যক্ট ইন্ফেকশন বা ইউটিআই বলা হয়। পুরুষদের তুলনায় মহিলারা বেশি আক্রান্ত হন এই অসুখে। অনেক সময় অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে হয়তো এই রোগের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড়ো কথা, একবারও মূত্রনালির সংক্রমণ হয়নি, এমন মহিলার সংখ্যা খুবই কম। তবে, কতটা সচেতন থাকলে এই সংক্রমণ এড়ানো যায়, কিংবা কীভাবে এই রোগের সঠিক চিকিৎসা করা হয়, সেই সম্পর্কে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর দিলেন ডা. সুদর্শন কান্তি বৈশ্য।

মূত্রনালি সংক্রমিত হয় কীভাবে?

এ হল এক ধরনের (ই-কোলি এবং অন্যান্য) ব্যাকটেরিয়াঘটিত সংক্রমণ। এর ফলে মূত্রনালি আংশিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক্ষেত্রে যদি মূত্রনালির নিম্নাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে চিকিৎসা পরিভাষায় বলা হয় সিস্টাইটিস এবং যদি মূত্রনালির ঊধর্বাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে বলা হয় পায়েলোনেফ্রাইটিস। এই পায়েলোনেফ্রাইটিস আসলে কিডনির সংক্রমণ। মহিলারাই বেশি আক্রান্ত হন এই অসুখে। পুরুষরা অনেক সময় বাহক হন এই রোগের। মহিলাদের শারীরিক গঠন এবং অসুরক্ষিত যৗনমিলন-ই এই ধরনের সংক্রমণের প্রধান কারণ। সেইসঙ্গে অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, অপরিচ্ছন্ন পাবলিক টয়লেট ব্যবহার, ডায়াবেটিস মেলিটাস, ইউরিনারি ইন্সট্রুমেন্টেশন, ট্রমা, ক্যাথেটারাইজেশন-এর কারণেও ঘটতে পারে সংক্রমণ।

মূত্রনালি সংক্রমণের উপসর্গগুলি কী কী এবং কীভাবে রোগ নির্ণয় করা হয় এই ক্ষেত্রে?

মূত্রনালির নিম্নাংশের সংক্রমণের ক্ষেত্রে যেসব উপসর্গগুলি দেখা যায়, তার মধ্যে রয়েছে বারবার প্রস্রাবের বেগ পাওয়া এবং প্রস্রাবের পরে জ্বালা হওয়া আর ঊধর্বাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে পেটে ব্যথা এবং জ্বর আসতে পারে। বয়স্ক এবং শিশুদের ক্ষেত্রে উপসর্গগুলি প্রকট হয় না অনেক সময়। তাই, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে গেলেই মূত্র পরীক্ষা করে রোগ নির্ণয় করা উচিত। এ প্রসঙ্গে আরও জানিয়ে রাখা প্রয়োজন, ভ্যাজাইনাল ডিসচার্জ না হওয়া এবং অসহ্য মাথা যন্ত্রণাও এই ধরনের সংক্রমণের নীরব উপসর্গ হতে পারে। এছাড়া, রক্তাভ প্রস্রাব এবং পিউবিক বোন-এর উপরের অংশে ব্যথা কিংবা লোয়ার ব্যাক পেইন-ও উপসর্গ হতে পারে এই রোগে। শিশুদের ক্ষেত্রে বমিভাব, বেশি সময় ধরে ঘুম, ক্লান্তি এবং প্রস্রাব ধরে রাখতে না পারার সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

মূত্রনালি সংক্রমণের ঝুঁকিগুলি কী কী?

বারবার মূত্রনালি সংক্রমিত হলে কিডনি ইনফেকশন, সেপসিস (পচন) ও সেপটিসেমিয়া-র (রক্ত দূষণ) দিকে মোড় নিতে পারে। শুধু তাই নয়,

প্রি-ম্যাচিওর ডেলিভারি কিংবা কম ওজনের শিশুর জন্ম দেওয়ার সমস্যাও দেখা দিতে পারে।

মূত্রনালি সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায় কোন ক্ষেত্রে?

মাত্রাতিরিক্ত যৌনক্রিয়ার ফলে মূত্রনালি সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে প্রায় ৭৫ থেকে ৯০ শতাংশ। বিশেষ করে অল্পবয়সি যৗন-সক্রিয় মেয়েদের মূত্রনালির সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে অনেকটাই। চিকিৎসা পরিভাষায় একে বলে ‘হনিমুন সিস্টাইটিস’। ভ্যাজাইনা উন্মুক্ত অবস্থায় বাইরের আবহে বেশি সময় থাকা এবং যৗনসুরক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করা, হস্তমৈথুন, লেহন প্রভৃতি, ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। আর মেনোপজ-এর পর মহিলাদের শরীরে যখন ইস্ট্রোজেন-এর মাত্রা কমতে থাকে, তখনও এই ঝুঁকি বাড়ে।

মূত্রনালির সংক্রমণ এড়ানোর জন্য কী ধরনের সতর্কতা আবশ্যক?

সতর্কতা যে-কোনও সমস্যা থেকে মানুষকে মুক্ত করে। এক্ষেত্রেও সতকর্তার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা। যেমন পরিষ্কার জলে বিশুদ্ধ স্নান করা, ভ্যাজাইনা পরিষ্কার রাখা, পরিচ্ছন্ন অন্তর্বাস (নিম্নাংশে) ব্যবহার করা, সঙ্গমের সময় উন্নতমানের কন্ডোম এবং ঋতুকালীন উন্নত স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করা। সেইসঙ্গে, পরিমাণ মতো জলপান করতে হবে। এছাড়া, ব্যবহার করতে হবে পরিষ্কার শৌচালয়।

মূত্রনালি সংক্রমণের চিকিৎসা কীভাবে করা হয়?

প্রথমে রোগ নির্ণয় করতে হবে। অর্থাৎ, ইউটিআই বা মূত্রনালির সংক্রমণ হয়েছে কিনা কিংবা কোন পর্যায়ে আছে, তা বুঝে নিতে হবে উপসর্গ জেনে এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে। এরজন্য রুটিন এগ্জামিনেশন এবং ইউরিন কালচার করা প্রয়োজন। যদি পজিটিভ হয়, তাহলে প্রথাগত চিকিৎসা, অর্থাৎ, অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। এতে রুগির অবস্থার উন্নতি হলে, নিয়মিত ব্যবধানে ফলো-আপ চলবে। আর যদি রুগির অবস্থার উন্নতি না হয়, তাহলে ‘ইমেজিং’, করতে হতে পারে। এছাড়া, ইউরিনারি ট্র্যাক্ট-এ অন্য কোনও সমস্যা থাকলে অস্ত্রোপচারও করতে হতে পারে।

চিকিৎসকের সঙ্গে কথোপকথনেঃ সুরঞ্জন দে   

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...