সাতকোশিয়া গর্জ অভয়ারণ্যে পর্ব -১

গত দুদিন ধরেই আবহাওয়া বেশ খারাপ। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট একের পর এক নিম্নচাপে পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব ভারতের উপকূলবর্তী বহু এলাকায় চলছে প্রকৃতির তাণ্ডব। এহেন পরিস্থিতিতে সাতকোশিয়া গর্জ অভয়ারণ্যে বেড়াতে যাবার চিন্তা মাথায় থাকলেও, মনে অস্বস্তি কমছে না। ভোর ৫টা ২০তে রাউরকেলা স্টেশন থেকে ধরতে হবে ভুবনেশ্বরগামী ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস।

গাড়ি ছাড়ল ঠিক সাড়ে ৫টায়। এসি চেয়ার কারের জানলা দিয়ে দেখছি, বাইরে বৃষ্টি হয়ে চলেছে। মেঘে ঢাকা প্রকৃতিতে ভোরের স্তিমিত আলো। সবুজ গাছগুলো বৃষ্টিস্নাত। আম, খেজুর, নারকেল ও কৃষ্ণচূড়া গাছেরই প্রাধান্য। বাঁ-পাশে সবুজ ধানখেত, দূরে ছোটো ছোটো পাহাড়। বৃষ্টি থেমেছে। সূর্য‌্যের নরম আলো মেখে ট্রেন ঝাড়সুগুদা পৌঁছলো সকাল ৭টার আগেই।

ট্রেন সম্বলপুর সিটি স্টেশনে পৌঁছোলে যোগ দিল আমার সহকর্মী। আমরা নামব অঙ্গুল স্টেশনে। সেখান থেকে ছোটো গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে টিকরপাড়া নেচার ক্যাম্প-এ পেঁছানোর জন্য। আকাশ আবার মেঘলা হয়েছে। দিগন্তে সবুজ পূর্বঘাটের কিছু অংশ চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছে। দুপাশেই সবুজের মেলা তাল, খেজুর, নারকোল এবং সঙ্গে শাল, মহুয়া, আম ও ইউক্যালিপটাস। ট্রেন অঙ্গুল স্টেশনে পৌঁছোল সকাল ১০টায়। আকাশ মেঘলা।

স্টেশনের বাইরে এসে অটোয় চেপে চলে এলাম বাস/কার স্ট্যান্ডে। একজন হাসিখুশি যুবক এগিয়ে এল। তার সঙ্গেই কথা বলে ঠিক করে নিলাম, সুইফ্ট ডিজায়ার-এ টিকরপাড়া যাওয়া-আসার ভাড়া, গাড়ির নাইট হল্ট চার্জ এবং জঙ্গল সাফারি সমেত কত টাকা দিতে হবে। খরচ খুব বেশি নয়, ৪২০০ টাকা! দেরি না করে বসে পড়লাম গাড়িতে।

ড্রাইভার বিজয় কুমার দাস জানাল, ৬২ কিমি দূরে অবস্থিত টিকরপাড়া পৌঁছোতে সময় লাগবে ঘণ্টা দেড়েক। প্রায় ১৫ মাইল পেরিয়ে এসেছি। সুন্দর রাস্তা, দুপাশেই হালকা জঙ্গল। বাঁ-দিকে দূরে ছোটো ছোটো পাহাড়। মাঝে মাঝে সবুজ ধান খেত, আর ছোটো ছোটো গ্রাম। করাটপাতা চক পেরিয়েছি একটু আগে। গাড়ি চলেছে এনএইচ-৫৫ হয়ে বদাকেড়া-টিকরপাড়া রোড ধরে। ড্রাইভার দেখাল, পথের পাশে ইলেকট্রিক পোলগুলিতে নির্দিষ্ট দূরত্বে কাঁটা লাগানো। কারণ জিজ্ঞেস করাতে সে জানাল, ওই ব্যবস্থা হাতির পিঠ চুলকানির উপশমের জন্য। নাহলে, হাতি অনেক সময় অস্বস্তিতে ইলেকট্রিক পোলকেই ভেঙে ফেলে।

রাস্তার দুপাশেই এখন ঘন জঙ্গল। দারুণ ভালো লাগছে এই যাত্রা। ৩৩ কিমি দূরত্ব পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম পম্পাসর। এখানেই টিকরপাড়া অভয়ারণ্যের প্রবেশ দ্বার। ড্রাইভার গাড়ি থামাল রাস্তার পাশে। গাড়ি থেকে নেমে নেচার ক্যাম্প বুকিং-এর কাগজপত্র নিয়ে টিকিট ঘরের দিকে এগোলাম। ওএফডিসি-র ওয়ে সাইট থেকে বুক করা কাগজপত্র পরীক্ষা করা হল। গাড়ির নাম্বারও নথিভুক্ত হল। শুধু ড্রাইভারের দুদিনের প্রবেশ কর বাবদ আরও ৮০ টাকা জমা দিতে হল। আমরা গাড়িতে এসে বসতেই গাড়ি গেট পেরিয়ে প্রবেশ করল টিকরপাড়া ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারিতে।

দুপাশে ঘন জঙ্গল শাল, সেগুন ও শিমূলের। গাড়ি চলছে মধ্যম গতিতে। প্রায় ৩-৪ কিমি এগোনোর পর এল নন্দিনী নালার ওপর তৈরি এক পোল, যেখান থেকে টিকরপাড়ার দূরত্ব ২৯ কিমি। পুরুনাকোট পেঁছোলাম দুপুর সোয়া ১২টায়। অঙ্গুল থেকে ৫৩ কিমি দূরত্বে অবস্থিত পুরুনাকোট বন-বাংলোটা ভারি সুন্দর। আমাদের গাড়ি অবশেষে মহানদীর তীরে অবস্থিত টিকরপাড়া নেচার ক্যাম্পে এসে পৌঁছোল দুপুর ১টা নাগাদ।

বনদফতরের পরীক্ষিত কাগজপত্র নিয়ে সোজা পেঁছোলাম নেচার ক্যাম্প-এর অফিসে। সেখানে তখন ডিউটিতে ছিল মি. সামিম চৌহান। আমাদের জন্য বরাদ্দ হল ৫ নম্বর টেন্ট, যাতে রয়েছে অ্যাটাচ বাথরুম। টেন্ট-এ ব্যবস্থা ভালোই। দুজনের জন্য পরিষ্কার বিছানা, স্ট্যান্ড ফ্যান, দুটি চেয়ার, একটি ছোটো টেবিল এবং জামা-কাপড় রাখার সুব্যবস্থা। অ্যাটাচ বাথরুম ও টয়লেট পরিষ্কার। সবচেয়ে ভালো লাগল, টেন্ট সংলগ্ন বারান্দায় একটি সেন্টার টেবিল ও দুটি চেয়ার রাখা। প্রকৃতির মাঝে চা পান করার সুন্দর ব্যবস্থা। আমরা হাত-মুখ ধুয়ে ও পোশাক পালটে পৌঁছে গেলাম অদূরে অবস্থিত ডাইনিং হলে।

ডাইনিং হলটি বেশ পরিপাটি করে সাজানো। বুফে সিস্টেমে খাওয়ার ব্যবস্থা। ভাত, রুটি, ডাল, আলুচোখা, ভেন্ডি ভাজা, মহানদীর টাটকা মাছের ঝোল এবং কার্ড স্যালাডে ভালোই হল লাঞ্চ। টেন্টে না ফিরে বিজয়কে সঙ্গে নিয়ে হাঁটতে বার হলাম। টিকরপাড়া গ্রামের মাঝ দিয়ে কিছুদূর হেঁটে পেঁছোলাম এক গাছের কাছে, যেখানে দেখি আরও ২-৩ জন মোবাইল কানে লাগিয়ে ব্যস্ত। এর কারণ জিজ্ঞেস করতে বিজয় জানাল, ওই গাছের কাছে বিএসএনএল ও এয়ারটেল-এর কানেক্শন টাওয়ার পাওয়া যায়। এই আপাত অচেনা গাছটির নাম জিজ্ঞেস করে জানলাম, পানিগাম্বারি। কিছুটা নীচে বয়ে চলেছে মহানদী আপন ছন্দে। নদীর বুকে ভেসে রয়েছে তিনটি মাছ ধরার ডিঙি আর দুটি মোটর বোট যার একটি আবার সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশন-এর। কয়েকটি ছবি তুলে ফিরে এলাম ক্যাম্পে।

আমি বলি, থোড়া দের পহলে তুম বতায়া থা আম দোনো কো নদী অউর নালা কা সঙ্গম দিখাযে্গে। চলো, ওহি দেখনা হ্যায় হমে।

আমরা এবার বিজয়ে পিছন পিছন ক্যাম্পের অন্যদিক দিয়ে হালকা জঙ্গল পেরিয়ে কিছুটা নেমে পৌঁছোলাম মহানদীর তীরে। অপূর্ব সুন্দর রূপ মহানদীর। পূর্বঘাট পর্বতমালার বুক চিরে মহানদী এখানে সাত কোশ (চোদ্দো মাইল বা সাড়ে বাইশ কিমি) দীর্ঘ গর্জ সৃষ্টি করেছে। সাতকোশিয়া গর্জ পূর্বঘাট থেকে পৃথক করেছে ছোটোনাগপুর মালভমিকে। দুচোখ ভরে দেখতে লাগলাম মহানদীর প্রেক্ষাপটে সজীব পূর্বঘাটের ছোটো ছোটো পাহাড়গুলিকে। ডানদিকে তাকাতে দেখি, অদূরেই মহানদীতে এসে মিশেছে প্রশস্থ নন্দিনী নালা। যাকে সাতকোশিয়া অরণ্যের মাঝে একাধিক বার দেখেছি। বিজয় বলল, সঙ্গমস্থল থেকে মাইলখানেক দূরে নালার পাশে জঙ্গলে সুন্দরী (কানহার জঙ্গল থেকে নিয়ে আসা) নামক বাঘিনীটি এক গ্রামবাসীকে হত্যা করে। নিস্তব্ধ জায়গাটিকে দেখে হঠাৎই গা ছমছম করে উঠল।

বাদশাহি লখনউ পর্ব-১

সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টি ফেলুদার হাত ধরে পাঠক লখনউ এর স্বাদ নিয়েছে ‘বাদশাহি আংটি’ রহস্যোপন্যাসের মাধ্যমে। লখনউ শহর নিশ্চয়ই সত্যজিৎ রায়ের অত্যন্ত প্রিয় ছিল, না হলে আবার কেন তিনি আর-একটি রহস্য কাহিনিরও পটভূমি নির্বাচন করবেন এই শহরকেই? ‘শকুন্তলার কণ্ঠহার’ কাহিনির ব্যাকড্রপ-ও এই লখনউ শহর। সত্যজিৎ রায়ের মনোভাব ফেলু মিত্তিরের মুখেই না হোক শোনা যাক– কেন লখনউ তাঁর এত প্রিয়! ‘…আমারও লখনউ’র কথা হলেই মনটা চনমন করে ওঠে। এত সুন্দর শহর ভারতবর্ষে কমই আছে। শহরের মাঝখান দিয়ে নদী বয়ে গেছে, এরকম ক’টা শহর পাবেন আপনি? ব্রিজের একদিকে শহরের অর্ধেক, বাকি অর্ধেক অন্যদিকে। এছাড়া নবাবি আমলের গন্ধটা এখনও যায়নি। চারিদিকে তাদের কীর্তির চিহ্ন ছড়ানো। তার উপর সেপাই বিদ্রোহের চিহ্ন। নাঃ আপনার কথাই শিরোধার্য। কদিন থেকে ভাবছি কোথায় যাওয়া যায় এবার পুজোয়। লখনউ-ই চলুন…।’ এই ছিল লালমোহনবাবুর প্রশ্নে ফেলুদার জবাব। এমন দৃষ্টিনন্দন জায়গাটি চাক্ষুস করার প্রলোভনে আমরাও লখনউ ভ্রমণে উদ্যোগী হই– কে বলতে পারে আমরাও বাদশাহি লখনউ র রূপ রস গন্ধ উপভোগ করতে করতে একটু রহস্যের স্বাদ পাব না!

লখনউ চলেছি অমৃতসর এক্সপ্রেস ধরে। ট্রেনে যেতে যেতেই বইয়ের পাতা উলটে লখনউ শহরের ইতিহাস সম্পর্কে একটা হদিশ পাওয়ার চেষ্টা করি। কারণ বেড়ানোর কোনও জায়গার ইতিহাস না থাকলে ভ্রমণ একেবারেই সম্পূর্ণ হয় না। বিশেষত যদি সে স্থানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থাকে তাহলে তো কথাই নেই!

উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের রাজধানী লখনউ। শুধু রাজ্যের নয়, সারা ভারতবর্ষের এক অন্যতম সাংস্কৃতিক পীঠস্থান এই লখনউ। পুরাণের গল্প বলে রামচন্দ্র বনবাস থেকে ফিরে গোমতী নদীর দুধারে বিস্তৃত এলাকা উপহার দিয়ে ছিলেন ভ্রাতা লক্ষ্মণকে। তাই এই স্থানের নাম হয়েছিল লক্ষ্মণপুর। এই লক্ষ্মণপুর ছিল অযোধ্যা রাজ্যের এক ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। এই লক্ষ্মণপুর তথা লখনপুর থেকে হয়তো লখনউ নামের উৎপত্তি। নানা উত্থানপতনের সাক্ষী হয়ে আছে লখনউ-এর ইতিহাস।

অবধ তথা অযোধ্যা একাদশ শতকে গজনীর মামুদের হাতে আক্রান্ত হয়, তবে তার কিছুদিনের মধ্যে রাজপুতরা লখনউ-সহ পার্শ্ববর্তী অঞ্চল দখল করে নেয়। এরপর মুসলমান শাসকেরা লখনউয়ের ইতিহাস গড়ে তোলে– ক্রমান্বয়ে বখতিয়ার খিলজি, নাসিরুদ্দিন মহম্মদ শাহ, কামারুদ্দিন করণ, ফরহাত খান প্রভৃতি শাসকের হাতে গড়ে ওঠে লখনউ। লোদী বংশের শাসনকালে লখনউ দিল্লি সুলতানের আয়ত্তে আসে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে মোগল সম্রাট, অযোধ্যার নবাব হিসাবে নিযুক্ত করেন সদত আলি খানকে। এই বংশের চতুর্থ নবাব আসফ-উদ্-দৌল্লা  ফৈজাবাদ থেকে রাজধানী লখনউতে স্থানান্তরিত করেন। ধীরে ধীরে লখনউ বিকশিত হতে থাকে নবাবি স্টাইলে। আসফ-উদ-দৌল্লার পর গাজিউদ্দিন হায়দর, মহম্মদ আলি শাহ, ওয়াজেদ আলি শাহ প্রমুখের রাজত্বকালে লখনউ তার খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছোয়। নবাবি আদবকায়দা ও পরিশীলিত ব্যবহারের জন্য খ্যাতি লখনউয়ের অধিবাসীদের।

প্রায় আট নয় ঘণ্টা দেরিতে অমৃতসর এক্সপ্রেস লখনউ স্টেশনে এসে দাঁড়ায় রাত এগারোটারও পরে।

পরের দিন সকালেই লখনউ দর্শনে বের হওয়া যেত কিন্তু দিন চারেক লখনউতে থাকব অতএব কোনও তাড়াহুড়োর মধ্যে গেলাম না। রসিয়ে রসিয়ে উপভোগ করতে হবে লখনউয়ের গরিমা। লখনউ বেড়াতে এলে অবশ্যই যা দেখা উচিত, সেগুলি হল বড়ো আর ছোটো ইমামবাড়া, ভুলভুলাইয়া, রুমি দরওয়াজা, জামা মসজিদ, ক্লক টাওয়ার, রেসিডেন্সি প্রভৃতি।

বস্তুত লখনউয়ের নবাবরা প্রায় সকলেই ছিলেন শিল্পসংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ও বিলাসপ্রিয়। একদিকে যেমন শিল্পসংস্কৃতিতে তথা গানবাজনা হস্তশিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করে গেছেন অন্যদিকে সুদৃশ্য প্রাসাদ, বাগিচা, মসজিদ ইত্যাদি নির্মাণে এগিয়ে দিয়েছেন অর্থের ভাণ্ডার। শতরঞ্জ (দাবা)-কবুতর (পায়রা)-গজল-শায়েরি ঘেরা মোহময় স্বপ্নে ভাসতে থাকে লখনউ। সংগীত, নৃত্য, কাব্য, শিল্পকলায় আগ্রহী, খাদ্য-পানীয় বিলাসী নবাবদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে সংগীত-বাদ্য-নৃত্যকলার বিশিষ্ট লখনউ ঘরানা। সে ঘরানার সুর হয়তো এখনও বিরাজ করে প্রাচীন ঐতিহ্যের অনুসারী লখনউ শহরে। শাম-এ-আওধ অর্থাৎ লখনউয়ের সন্ধ্যা তখন যেন স্বর্গসুখ। তবে এই স্বর্গসুখ হয়ে ওঠে ক্ষণস্থায়ী। গান-বাজনায় পারদর্শী হলেও নবাব ওয়াজেদ আলি শাহ নিজের রাজ্য পরিচালনায় ব্যর্থ হন ও ইংরেজ দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হন। ইংরেজদের হাতে পরাজিত ও রাজ্যচ্যুত হওয়ার পর লখনউয়ের নবাবদের প্রতিপত্তি লুপ্ত হয়। হারিয়ে যেতে থাকে নবাবি বৈভব। সেই ক্রমবিলুপ্ত নবাবি ঐতিহ্যের স্বাদ নিতে বেরিয়ে পড়ি পথে। লখনউয়ের প্রধান আকর্ষণ বড়ো ও ছোটো ইমামবাড়া। প্রথমে বড়ো ইমামবাড়া। গেট দিয়ে প্রবেশ করলেই চোখে পড়ে সবুজ লন, তার পাশ দিয়ে পিচের রাস্তা চলে গেছে ইমামবাড়ার প্রবেশপথ পর্যন্ত। টিকিট কাটতে হবে ভিতরে প্রবেশ করার জন্য। বড়ো ইমামবাড়ার টিকিটঘর থেকে বড়ো ও ছোটো ইমামবাড়া, ভুলভুলাইয়া, বাওলি, রুমি দরওয়াজা, পিকচার গ্যালারির একত্রে টিকিট কাটা যায়। সব স্পটই যখন দেখা হবে, তখন একত্রে টিকিট কাটাই সুবিধা। ভুলভুলাইয়া দর্শনের জন্য গাইডের ব্যবস্থা আছে– আগে শুনেছি রেট নিয়ে খুব অশান্তি হতো এখন সরকার নির্দিষ্ট করে দিয়েছে গাইড-চার্জ। গাইড-চার্জ আগেই মিটিয়ে দিয়ে জুতো জমা করে এবার বড়ো ইমামবাড়ায় প্রবেশ।

প্রথমেই মনে প্রশ্ন জাগে ‘ইমামবাড়া’ কথাটির অর্থ কী? গাইডের উত্তর থেকে যা দাঁড়াল তা হল– ইমামবাড়া বা ইমামবর্গা হল এমনই এক উৎসর্গীকৃত সৌধ যেখানে ইমাম হোসেনের স্মৃতিতে শ্রদ্ধা জানানো হয়। কারবালার ময়দানে সত্যের জয়ধবজা তুলতে গিয়ে ইমাম হুসেন ও তার আত্মীয় পরিজন-সহ জ্জর জন শহিদ হন। সেই ইমাম হোসেনের স্মৃতির উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত সৌধটি নবাব আসফ-উদ-দৌল্লার উদ্যোগে নির্মিত হয়। এই ইমামবাড়া নির্মাণের কারণও ছিল অত্যন্ত মহৎ।  দুর্ভিক্ষের সময় প্রজাদের রোজগারের বন্দোবস্ত ও পরবর্তী সময়ে আশ্রয় দেওয়ার জন্য এই সৌধটি নির্মিত হয়। ইমামবাড়ার একতলায় হলঘরটির বিশেষত্ব এই যে, ছাদের ভার নেওয়ার জন্য হলের মধ্যে কোনও স্তম্ভ নেই। বলা হয় এটিই পৃথিবীর বৃহত্তম স্তম্ভহীন কক্ষ। দোতলার চারদিক ঘোরানো বারান্দা থেকে দেখা যায় এই কক্ষের অনুষ্ঠান। আশ্চর্য স্থাপত্যরীতির কারণে বারান্দার একদিকে সামান্য দেশলাই জ্বালানোর শব্দও পৌঁছে যায় কক্ষের অন্য প্রান্তের বারান্দায়।

দুশো বছরেরও আগে নবাব আসাফ-উদ্-দৌল্লা তৈরি করেছিলেন এই প্রাসাদ– হয়তো ভেবেছিলেন আগ্রা-দিল্লির সৌধগুলির সমকক্ষ একটি সৌধ নির্মাণ করবেন। ইরানি স্থপতি খিফায়াতুল্লার নকশার উপর ভিত্তি করে তৈরি হল এই প্রাসাদ। মোগল আমলের তৈরি প্রাসাদের সমকক্ষ না হলেও, ভারতের ইসলামি স্থাপত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই ইমামবাড়া।

ইমামবাড়ার উপর তলায় রয়েছে ভুলভুলাইয়া। আধো-অন্ধকারে অসংখ্য গলিপথে একবার হারিয়ে গেলে ফিরে আসা কঠিন। নবাব নাকি বেগমদের নিয়ে প্রদীপের আলোয় লুকোচুরি খেলতেন এই ভুলভুলাইয়ার অন্দরে। একইরকম দেখতে অসংখ্য খুপরি ও ঢাকা বারান্দা নিয়ে এই ভুলভুলাইয়া। অনেকগুলি পথ এখন বন্ধ তবুও গাইডের সাহায্য ছাড়া এ পথ চিনে বেরোনো সত্যিই মুশকিল। কয়েকবার চেষ্টা করেও বার বার ভুল পথে পড়তে হয় আর গাইড সঠিক পথ দেখায়। এ যেন এক দারুণ খেলা!

ভুলভুলাইয়ার পথে গাইডের নির্দেশ অনুযায়ী সিঁড়ি ভেঙ্গে একেবারে ভুলভুলাইয়ার ছাদে পৌঁছে গেলাম। ছাদ থেকে লখনউয়ের এক অনন্য ছবি ফুটে ওঠে। ছাদ থেকে দেখা যায় ইমামবাড়ার প্রাঙ্গণে বাঁদিকে আসাফ-উদ-দৌল্লা মসজিদের অনন্য রূপ আর ডানদিকে প্ত তলা বাওলি তথা কূপের স্থাপত্য। ইমামবাড়া তথা ভুলভুলাইয়ার ছাদে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে এবার নেমে আসা।

এবার বাওলি দর্শন। বাওলি হল এক বিশেষ ধরনের কূপ। পাঁচ তলা এই কূপ একদিকে গোমতী নদীর সঙ্গে যুক্ত করা আছে তেমনি নাকি মসজিদের সঙ্গেও যুক্ত। মহরমের সময় মিছিল বেরোয় এই বড়ো ইমামবাড়া থেকে। সাজসজ্জার জৌলুসও তখন চোখে পড়ার মতো। বড়ো ইমামবাড়ার চত্বরের মধ্যেই ইমামবাড়ার বাঁদিকে আসফ-উদ-দৌল্লা মসজিদ। যার প্রকাণ্ড মিনার দুটি ইমামবাড়ার শোভা বাড়িয়েছে। তবে এই মসজিদে মুসলমান ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রবেশাধিকার নেই।

বড়ো ইমামবাড়া থেকে ছোটো ইমামবাড়ার পথে যেতে পড়ে রুমি দরওয়াজা। নবাব আসফ-উদ-দৌল্লা, রাস্তার উপর উঁচু এই দরওয়াজা নির্মাণ করান। ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় ত্রাণকার্যের অঙ্গ হিসাবে নবাব এটি নির্মাণ করান। কনস্টানটিনোপলের একটি দরওয়াজার অনুকরণে নির্মিত প্রবেশপথটির গায়ে রয়েছে অপূর্ব কারুকার্য। তুর্কি শৈলী অনুসৃত হয়েছে এই কারুকাজে। সিপাহি বিদ্রোহের সময় এই রুমি দরওয়াজা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে এখনও তার রূপ দৃষ্টি আকর্ষণের পক্ষে যথেষ্ট।

রুমি দরওয়াজা ছাড়িয়ে পিচ রাস্তা ধরে পশ্চিম দিকে এগিয়ে চলি ছোটো ইমামবাড়ার উদ্দেশ্যে। ছোটো ইমামবাড়ার আর-এক নাম হুসেনাবাদ ইমামবাড়া। লখনউয়ের পথে চলতে চলতে সব সময়েই চোখে পড়ে এক পুরোনো ঐতিহ্যের রেশ। সিপাহি বিদ্রোহের সময় সিপাহিদের হাতে আর পরে ইংরেজদের হাতে অনেক অট্টালিকা, প্রাসাদ ধবংস হয় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিছু কিছু বাড়ি পুনর্নির্মিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে স্কুল, কলেজ, হসপিটাল বা সরকারি অফিস হিসাবে।

কিছু ঐতিহ্যময় স্থাপত্য পুরাতত্ত্ব বিভাগ দ্বারা সংরক্ষিত হচ্ছে আবার অনেকগুলি পরিত্যক্ত হয়ে ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে বিস্মৃতির অতলে।

নাসির-উদ-দৌল্লা প্রবীণ বয়সে ইংরেজদের সাহায্যে লখনউয়ের সিংহাসন পুনরুদ্ধার করে মহম্মদ আলি শাহ নামে রাজত্ব শুরু করেন। তিনি ব্যাবিলন শহরের অনুকরণে লখনউকে সাজিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তারই দৃষ্টান্ত হিসাবে নির্মিত এই ছোটা ইমামবাড়া– যা তিনি নিজের সমাধিস্থল হিসাবে নির্মাণ করান।  এই ছোটা ইমামবাড়া তৈরি হয় অর্থাৎ বড়া ইমামবাড়া নির্মাণের পরে। সৌধ প্রাঙ্গণ বেশ সাজানো গোছানো– সামনে বাগান, মাঝখানে চতুষ্কোণ জলাধার, তার দুধারে তাজমহলের দুটি ক্ষুদ্র অনুকৃতি। এখানেই তাঁর কন্যা ও জামাতার সমাধিস্থল। ছোটো ইমামবাড়ার প্রধান সৌধটি গম্বুজাকৃতি, তার সঙ্গে রয়েছে অনেকগুলি ছোটো ছোটো মিনারের সমন্বয়।

ছোটো হলেও স্থাপত্যে অভিনবত্ব রয়েছে। জনশ্রুতি বলে দুর্ভিক্ষের সময় এই ইমামবাড়া নির্মাণ মাধ্যমে শ্রমিকের রুটিরুজির ব্যবস্থা করেন নবাব। এই নির্মাণের বিশেষত্ব ছিল দেয়ালে ক্যালিগ্রাফি স্টাইলে লেখা কোরানের বাণী ও মাথায় সোনার গম্বুজ ও অনবদ্য অলংকরণ। ইমামবাড়ার অন্দরে রয়েছে রুপোর সিংহাসন ও নানা সাজের তাজিয়া। বাহারি ঝাড়লণ্ঠনের সংগ্রহ এই ইমামবাড়ার এক সম্পদ। মহরমের সময় এই ঝাড়লণ্ঠণগুলি প্রজ্জ্বলিত হয়ে উঠলে সৌধটি সেজে ওঠে এক অন্য রূপে। তাজিয়াগুলিতে আরশির কাজ, রঙিন নকশা, চন্দন কাঠ, মোম, নানা রঙের কাগজ ও জরির কাজে সজ্জিত।

ছোটো ইমামবাড়ার পশ্চিম দিকে, ঢিল ছোড়া দূরত্বে জুমা মসজিদ। নবাব মহম্মদ আলি শাহ এই মসজিদ নির্মাণে উদ্যোগী হন। নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগে তাঁর মৃত্যু ঘটে– ফলে নির্মাণ কাজ শেষ করান মলিকা জহান বেগম। তিনটি গম্বুজ ও দুটি মিনার সমন্বিত বিশাল এই মসজিদটিতে মুসলমান ছাড়া প্রবেশ নিষিদ্ধ।

আমাদের পরবর্তী দ্রষ্টব্য উঁচু ক্লক টাওয়ার। দিকে নবাব নাসিরুদ্দিন হায়দার এটি তৈরি করান ইউনাইটেড প্রভিন্সের প্রথম গভর্নর জর্জ কুপারের লখনউ আসা উপলক্ষ্যকে কেন্দ্র করে। টাওয়ারের লাগোয়া হুসেনাবাদ জলাশয়। আট-কোনা এই জলাশয় বর্তমানে বেশ মলিন অবস্থায় রয়েছে। হুসেনাবাদ ট্রাস্টের অফিস এই জলাশয়ের ধারেই। তবে ক্লক টাওয়ারের বিশেষত্ব অনস্বীকার্য। এটিকে দেশের উচ্চতম ঘড়িঘর বলা হয়। জ্জ বছর ধরে এটির নির্মাণকার্য চলেছিল।

একদম কাছেই আর-এক দ্রষ্টব্য– পিকচার গ্যালারি বা চিত্রশালা। এর মূল ভবনটি ছিল নবাব আলি শাহের গ্রীষ্মাবাস। বর্তমানে এর দ্বিতলে অযোধ্যার নবাবদের চিত্রশালা। অয্যেধ্যার নবাবদের পূর্ণদৈর্ঘ্যের বিশাল প্রতিকৃতিগুলি আজও যেন তাদের শৌর্যবীর্যের কাহিনি শোনায়।

মন ভরে দেওঘরে

একটা ‘হ-য-ব-র-ল’ পাকিয়ে দিনটা শুরু। আপ মজফ্ফরপুর ফার্স্ট প্যাসেঞ্জারে টিকিট। উঠব ব্যান্ডেল জংশন থেকে। অনেক আগে থেকেই অপেক্ষা করছি। লেট না খাইয়ে ট্রেনটা প্ল্যাটফর্মে ইন করল। কিন্তু এমাথা-ওমাথা ছুটোছুটি করেও, সংরক্ষিত কামরার অস্তিত্বই পেলাম না। পিছোতে বলে কেউ, তো অন্যরা সামনে। যাক, সামনে চলে এসে পিছোতে যাব, ট্রেন ছেড়ে দিল। নিখুদাকে বললাম, বুদ্ধি খাটাও এতগুলো লোক ছুটোছুটি করব যশিডি পর্যন্ত। আউট না দেওয়া আম্পায়ারের মতো নিখুদা দাঁড়িয়ে রইল। কী মনে হল আমার, রুকস্যাকের সাইড পকেট থেকে টিকিটটা বার করে ঝাঁপিয়ে পড়লাম। ওই কামরাতেই সিট মিলিয়ে-মিলিয়ে জায়গা করে নিলাম। কোনও ক্ষেত্রে লোকজনদের তুলে আবার কোনও-কোনও ক্ষেত্রে সাইড করে। তারা তো বুঝতেই পারছে না, কোথা থেকে এই কামরা রিজার্ভ হল? খুব খারাপ লাগছিল ছলনার আশ্রয় নিয়ে এভাবে জায়গা দখল। এই হয়রানির জন্য কি অভিযোগের আঙুল তোলা যায় না, ভারতীয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের দায়বদ্ধতার প্রতি?

যশিডিতে ট্রেন থেকে নেমে মনের খচখচানিটা দূর হল। বারবেলা পার না করে ফুড প্লাজায় ঢুকে পড়লাম। তারপর নিখুদা’র সঙ্গে দুটো অটোওয়ালার কি অর্থচুক্তি স্বাক্ষরিত হল বলতে পারব না, তবে কালকের লোকাল সাইট সিয়িং-এর ব্যাপারটা নিশ্চিত হল।

দেওঘরের ল্যান্ডমার্ক ক্লকটাওয়ার। হোটেলের অবস্থান তার আশেপাশেই। আমরা বাজারের হৈ-হট্টগোল এড়াতে টাওয়ার চকের আগেই হোটেল নিলাম। একটু ফ্রেশ হয়েই চক্বর কাটলাম প্যাঁড়া গলি দিয়ে। ধাক্বাধাক্বি হয়েও গেল কলকাতা বাবু-বিবিদের সঙ্গে।

আলো ফুটতেই হাজির মন্দিরে। যাঁর নামে খ্যাত এই শহর সেই বৈদ্যনাথ শিবের মন্দির ও সংলগ্ন চত্বরটি বিশাল। এই সাত-সকালেই পুণ্যার্থীদের ভিড় উপচে পড়ছে। পান্ডার সাহায্য ছাড়া এখানে পুজো দেওয়া অসম্ভব। তুলনামূলক বয়স্ক এবং অর্থের চাহিদা কম এমন একজন পান্ডাকে সন্ধান করে বার করা হল। কিন্তু মন্দির চত্বরে বসে পুজোপর্ব ও মন্দির অভ্যন্তরে বিগ্রহ দর্শন সব মিলিয়ে– তিনি যা দাবি করলেন, তা শুনে আমাদের চক্ষু চড়কগাছ। ধর্মের নামে এই অর্থদণ্ড দিতে আমরা নারাজ। তবে তিরুপতি মন্দিরের কথা ভাবলে, এই অর্থদণ্ড যৎসামান্যই বলা যায়।

শ্রাবণ মাসে এই শহর হয়ে ওঠে গেরুয়া শহর। লক্ষ লক্ষ পুণ্যার্থীর চাপে মন্দির চত্বরে প্রবেশ অসম্ভব হয়ে ওঠে। পুণ্যার্থীরা সুলতানগঞ্জের গঙ্গা থেকে জল নিয়ে ১০৫ কিমি রাস্তা অতিক্রম করে এখানে হাজির হন। মনস্কামনা পূরণের আশায় তাঁরা বাবার মাথায় জল ঢালেন। পুরাণে আছে রাক্ষসরাজ রাবণের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে, মহেশ্বর তাকে শর্ত সাপেক্ষে বর দেন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে রাবণ শিবলিঙ্গ-সহ লঙ্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। কিন্তু শর্তের মারপ্যাঁচে বাধ্য হন দেওঘরে এই শিবলিঙ্গ ফেলে যেতে। পরে বৈজু নামক এক ভিলের হাত ধরে জনসম্মুখে আসে এই শিবলিঙ্গ। তাই বৈজনাথ শিব। শ্রাবণের গেরুয়ার গুঁতো এখন নেই। কিন্তু ভিড়ের মাঝেও চোখে পড়ছে বাঁকবাহিত বহু গেরুয়া ভক্তদের।

দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম বৈদ্যনাথ বাবার পুণ্যভূমি শক্তিপীঠ হিসাবেও খ্যাত। এখানে সতীর হৃদয় পড়েছিল। অতএব টানাপোড়েন, রাজনীতি আর প্রধান মন্দির ছাড়াও একই চত্বরে অন্নপূর্ণা, পার্বতী, গণেশ, সরস্বতী, হনুুমান, মনসা প্রভৃতি কুড়িটি মন্দির বিরাজমান। মন্দিরের উত্তরে আছে ১৫০ টি সিঁড়ি বিশিষ্ট রাবণতাল বা ক্ষীরগঙ্গা পুকুর। এই পুকুরে স্নান করে পুজো দেওয়ার নিয়ম। নিয়ম আরও আছে। পুণ্যার্থীরা দেওঘরের সাথে সাথে বাসুকিনাথেও জল নিয়ে যান। যার দূরত্ব দেওঘর থেকে ১৮ কিমি। উভয়স্থানে পুজো দিলেই টোটাল পুজোর সার্কিট কমপ্লিট হয়।

ফুরফুরে সকাল। কালকের অটো দুটো নির্ধারিত সময়ের আগেই এসে হাজির। কচুরি, জিলিপি আর চা-পর্ব মিটতেই যাত্রা শুরু। প্রথমেই সকালের শান্ত-স্নিগ্ধ পরিবেশের সঙ্গে সাযুজ্য রাখতে রামকৃষ্ণ মিশন। উইলিয়ামস্ টাউনের অবস্থান। অন্যান্য শাখার মতো এখানেও বিশাল কমপাউন্ড। গেট পেরিয়ে ঢুকতেই রাস্তার দু’দিকে কেয়ারি করা বাগান। তাতে মরসুমি ফুল আর বাহারি গাছের সারি। অনতিদূরে মিশনের প্রতীক নিয়ে দাঁড়িয়ে শ্বেতশুভ্র মন্দির ও প্রার্থনাগৃহ। লাগোয়া স্কুল, হোস্টেল, অফিসরুম। জুতো খুলে প্রবেশ করলাম ভিতরে। ভাবগম্ভীর স্নিগ্ধ মিষ্টি বাতাবরণের মাঝে রামকৃষ্ণ, সারদামণি ও বিবেকানন্দের বহুদর্শিত মূর্তি। ধ্যানে মগ্ন বেশ কিছু মানুষজন। আমরাও বসে পড়লাম। ছড়িয়ে যাওয়া মনকে একবিন্দুতে এনে যখন চোখ বুজতে যাচ্ছি, নিখুদা তাগাদা লাগায়। বাধ্য হই উঠতে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সকালের মনটা পরিপূর্ণতায় ভরে গেল এই মধুর পরিবেশে। স্বাস্থ্য, চরিত্র ও শিক্ষার ব্রতে গড়ে ওঠা এই আশ্রমিক পরিবেশ ছেড়ে যেতেই মন চাইছিল না। এখানে ছবি তোলা মানা। অতএব ক্যামেরা বার করেও, ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলাম।

পশ্চিমের হাওয়া বদলের এখন আমরা চলেছি দেওঘরের পশ্চিমে। এখানে আছে নন্দনপাহাড়। শহর থেকে মাত্র চার কিমি দূরে এর অবস্থান। ছায়াঘেরা তরুবৃক্ষের মাঝে অটো এসে দাঁড়াল। উপরে ওঠার সিঁড়িপথ অনতিদূরে। একেবারেই নীচু পাহাড়। ধাপ সিঁড়ির মুখে টিকিটঘর। পার্কের প্রবেশমূল্য ব্যক্তিপ্রতি পাঁচ টাকা। সোজা সিঁড়িটা যেখানে শেষ হয়েছে, তারপরই আকাশকে মাথায় রেখে একটা বড়ো প্রাঙ্গণ। তাকে বেষ্টন করে রামসীতা-সহ কয়েকটি ছোটো ছোটো মন্দির। কিছু স্থানীয় মানুষজন ভক্তিভরে পুজো দিচ্ছে। সিঁড়ির কয়েকধাপ নীচে ডানদিকের সিঁড়ি পথটাই ঢুকেছে পার্কে। এই অ্যামিউজমেন্ট পার্কে সব ধরনের রাইডই চোখে পড়ছে। উলটোদিকের ধাপ পাহাড়ের শেষে এক বড়ো জলাশয়। সেখানে জলবিহারের ব্যবস্থা আছে। পাহাড়ের এই প্রান্তে দেখি এক ভোজপুরি সিনেমার শুটিং চলছে। একটা গানের সিচুয়েশনে নায়ক-নায়িকা ও সহশিল্পীরা নেচে চলেছেন। খুব চটকদার সে গান ও গানের দৃশ্য। নৃত্যের সাথে গান চলতেই থাকল। চলতে থাকল ক্যামেরা। আমরা ফিরে চললাম। কানে তখনও আসছে কোরিওগ্রাফারের প্যারেড ভঙ্গিতে টেকনিক্যালি নির্দেশ– এক-দুই-স্টার্ট। নীচে নেমে অটোওয়ালাদের এই সিচুয়েশন ব্যক্ত করতেই ছেলেদুটো ছুটল শুটিং দেখতে। সেই ফাঁকে গাছপালার মাঝে এক চায়ের দোকানে চা খেতে বসে গেলাম।

‘লেটস্ গো’ বলে এবার ত্রিকূটের পথে। প্রায় ১২ কিমি দূরে এই পাহাড়। চলার রাস্তাটা এক কথায় ফাটাফাটি। চারিদিকে সবুজের সমারোহ। প্রবল হাওয়ায় ‘ধানের ক্ষেতের রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা’। দূরে দূরে গাছপালা জড়ানো গ্রামের বাড়িঘর। ল্যান্ডস্কেপে রকমারি পাথুরে কোলাজ। পথপার্শ্বে বৃক্ষও অজস্র। চেনার তালিকায় শাল, মহুয়া, পলাশ ও ইউক্যালিপ্টাস। হুসহাস ছুটে যাচ্ছে দুমকাগামী বাস। বাসুকিনাথে যাত্রীদেরও পথে দেখা যাচ্ছে। দল বেঁধে ক্লান্ত, অবসন্ন শরীরে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। দিগন্তরেখায় এবার পাহাড়ের উঁকিঝুঁকি। দূরে দৃশ্যমান তিনটে মাথাওয়ালা পাহাড়ই ত্রিকূট। ক্রমেই তার ব্যাপ্তি ফুটে উঠছে। যত এগোচ্ছি মনে হচ্ছে আর বুঝি বেশি দেরি নেই পৌঁছোতে। কিন্তু বাস্তবিক তখনও তাকে ছুঁতে পথ ভাঙতে হবে অনেকটা।

অটো যেখানে আপাত বিরতি টানল, দেখি সেখানে বসেছে বিরাট বাজার। খাবারের দোকানই বেশি। খাবার চোখের সামনে দেখলেই পেট সাধারণত কান্নাকাটি শুরু করে। তবে বেলা তো অনেকটাই গড়াল। তাই ওর দোষ দিয়ে লাভ নেই। মশলামুড়ি কেনা হল প্রত্যেকের জন্য। এখানে হনুমান ও বাঁদরদের উৎপাতের গল্পও শোনা ছিল। দেখি আমাদের পূর্বপুরুষরা খাদ্য সংগ্রাহকের জীবিকা ছেড়ে এতটুকু বার হতে পারেনি। আমাদের হাত থেকে মুড়ি মশলার প্যাকেট খোয়া গেল। তাদের বেঁচে থাকার তাগিদে এইটুকু ত্যাগ তো আমাদের করতেই হবে। এখানে এখন আর ট্রেক পথ ধরে হাঁটাহাঁটি নয়। হয়েছে রোপ-ওয়ে রুট। টিকিট কেটে চড়ে বসলাম তাতে। রাজগিরের চেয়েও ভয়ঙ্কর লাগল শেষ চড়াইটা অতিক্রম করতে।

উপরে উঠে দেখি চওড়া পাথুরে জমিতে চা, চিপস্ কোল্ড-ড্রিংকসের বেশ কয়েকটা দোকান। পাহাড় কিনারায় দাঁড়িয়ে শহরটাকে লাগছে অসাধারণ। চোখের সামনে প্রকৃতির ক্যানভাস জুড়ে অসাধারণ রঙের কারিকুরি। ইচ্ছা করলেই যেন ছোঁয়া যাবে নীলরঙ করা আকাশটা। ঘোর কাটিয়ে এবার চা-পর্ব। দল বেঁধে এবার চললাম জঙ্গলের ফালি রাস্তায়। এই পথের ধারেও দোকানের সারি। তবে খাবার বা পোশাকের নয়, বিকিকিনির অধিকাংশ পসরাই জড়িবুটির। কত ধরনের গাছগাছড়া যে বিক্রি হচ্ছে, তার ইয়ত্তা নেই। কিনছেও বহু লোকজন। স্থানীয়দের বিশ্বাস, রামায়ণে বর্ণিত গন্ধমাদন পর্বত প্রকৃতপক্ষে এইটাই। এখান থেকেই সংগৃহীত হয়েছিল বিশল্যকরণী। যদিও এই মতের সপক্ষে-বিপক্ষে আছে হাজার যুক্তি।

জঙ্গলঘেরা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি সকলে। রাস্তাটা যেখানে আপাত সমাপ্ত হয়েছে, সেখানেই দেখলাম রাবণগুহা। দুটো নাতিদীর্ঘ পাহাড়ের মাঝখানে এই গুহার অবস্থান। এক শিবলিঙ্গ দেখি গুহা প্রাঙ্গণে। কয়েকজন জটাধারী সাধুও গুহাকন্দরে। গুহা এলাকায় এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করে ফিরে চলি। ফেরার পথে চললাম জঙ্গলের বেপথে। এক চটান পাথরে উঠে প্রকৃতির পাগল করা রূপ দেখে মুগ্ধ হলাম। কিছুক্ষণ এইভাবেই কাটল– প্রকৃতির রূপের হাটে। আবার ভয়ঙ্কর সেই রোপওয়ে পথে নীচে অবতরণ।

খিদের চোটে কথা বলাই বন্ধ হয়ে গেছে সকলের। একবার প্রস্তাব হয়েছিল ছোলা, ছাতু আর মুড়ি-সহ লাঞ্চের। কিন্তু বাঙালির দুপুরে ভাত না হলে চলে? অতএব ভরদুপুরে ভাতের খোঁজে ছুটল গাড়ি। কিন্তু মিলল না কোনও হোটেল। অগত্যা ধাবা। কিন্তু এত লোকের খাবার রেডি করতে, সেই ধাবার ম্যানেজার সময় চেয়ে নিল কিছুটা। তাই সই। এই সময় কেবল বসে বসে প্রকৃতির জাবরকাটা। ধাবাটার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ অসাধারণ। দু’পাশে সবুজের আঁচল ছড়ানো ধানখেত। ডানদিকে পাহারারত তালগাছের হাতধরাধরি বৃক্ষশৃঙ্খল। অনতিদূরে ত্রিকূটের মনোমুগ্ধকর হাতছানি। খাওয়াদাওয়ার পরও গালে হাত দিয়ে অনেকক্ষণ বসে রইলাম। প্রকৃতির রূপে বিভোর হলে এইরকমই হয়।

চলে এসেছি সৎসঙ্গনগর। ক্লকটাওয়ার থেকে রেলস্টেশনমুখী রাস্তায় কিমি তিনেক গেলেই মিলবে এই নগর। দেওঘরের এক উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থান। এখানে আছে অনুকূল ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত আশ্রম। যে-আশ্রমের শাখা ছড়িয়ে আছে সারা ভারতজুড়ে। বিশাল এলাকা জুড়ে এই আশ্রমের ব্যাপ্তি। ভিতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে স্কুল, হাসপাতাল, পাওয়ার স্টেশন, প্রার্থনাগৃহ, সমাধিক্ষেত্র, চিড়িয়াখানা, অফিসঘর ইত্যাদি। যা ভালোভাবে দেখতে একটা গোটা দিন ব্যয় করতে হবে। সব মিলিয়ে দেখার মতো এক বিরাট কর্মকাণ্ড। যদিও আশ্রমের চিড়িয়াখানার অবস্থা সংকীর্ণ। উল্লেখযোগ্য পশুপাখি নিয়ে গিয়েছে বন দফতর। পড়ে রয়েছে শূন্য সব খাঁচা। এই আশ্রমের এক প্রান্তে ঠাকুর শ্রীশ্রী অনুকূল চন্দ্রের বড়দা’র বাড়ি। ঠাকুরের সমাধি দেখতে কেয়ারি করা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে হল কিছুটা। অতি যত্নে পালিত হাজার-হাজার গাছপালা দিয়ে ঘেরা এই আশ্রম যেন মর্ত্যের নন্দনকানন।

ঘুরতে ঘুরতে চলে এসেছি প্রার্থনাকক্ষের সামনে। প্রেয়ার হল অবশ্য একাধিক। নীচে কার্পেট বিছোনো। শূণ্য হল জুড়ে পাতা বিছানায় সাদা কাপড়ের আধিক্য। এখানেই একটা ঘরে অনুকূল ঠাকুর ও তাঁর স্ত্রীর পূর্ণাবয়ব মূর্তি। পাশেই ঠাকুরের ব্যবহৃৎ নানান জিনিসপত্র। ঠাকুরের বাণী আশ্রমের ঘরে-বাইরে, রাস্তার ধারে, প্রার্থনাকক্ষে, অফিসঘরে সর্বত্র। শ্বেতশুভ্র পোশাকে ভক্তদের আশ্রমজুড়ে উপস্থিতি একটা শুদ্ধ, সরল, রুচিশীল মানসিকতার পরিচয় বহন করে।

পরবর্তী ডেস্টিনেশন তপোবন। নানা মুনিঋষিদের তপস্যাস্থল হিসাবে খ্যাত এই তপোবন। আটো যেখানে এসে স্ট্যান্ড করল, তার কাছেই এক জমজমাট বাজার। বাজারকে লম্বোচ্ছেদ করে পাহাড়ের ওপরে উঠে গেছে এক রাস্তা। যদিও এই পাহাড়ের পরিধিকে পরখ করতে কোনও বাধাই সম্মুখে উপস্থিত নেই। তবে উৎরাই-এর সিঁড়ি জুড়ে হনুমানের উৎপাত মাত্রাতিরিক্ত। এখানে স্থানীয় কিছু যুবক ‘হনুমানের খাবার’ বিক্রি করছে দেখলাম। সে খাবার আসলে, আটা বা ময়দার ছোটো ছোটো পাকানো মণ্ড। তারা ইচ্ছাকৃত ভাবে হনুমানদের প্রলোভিত করে বাধ্য করাচ্ছে ওই প্যাকেট ভ্রমণার্থীদের কেনাতে। এভাবে জবরদস্তি ভাবে হনুমানের খাবার কিনতে অনেকেই বিরক্ত হচ্ছেন। অরিন্দমের সাথে এইরকম এক বাঁদর ছেলের বাঁদরামিটা মাত্রাতিরিক্ত জায়গায় উপস্থিত হয়। শেষমেশ সিঁড়ি ভেঙে যেখানে হাজির হলাম, দেখি ছোটো-বড়ো অজস্র পাথরের কোলাজ। পরিবেশ দেখে ছবি তোলার হিড়িক পড়ে গেল। নীচে বিকালের নরম আলোতে ল্যাণ্ডস্কেপ অসাধারণ। এখানে আছে ছোটো-বড়ো অনেক গুহা। যেখানে প্রাচীনকাল থেকেই বহু সন্ন্যাসী ডেরা করে থাকতেন। তপস্যা করার আদর্শ ঠিকানা যে এটাই, তা বোধহয় কাউকে বলে দিতে হবে না। জানলাম বালানন্দ ব্রহ্মচারী এরকমই কোনও গুহায় তপস্যা করেছিলেন। এখান থেকে আরও ওপরে উঠলে মিলবে তপোবন শিবের মন্দির। কিন্তু সময়াভাবে আর উপরে ওঠা হয়নি। ফেরার পথে একটা ব্রেক নেওয়া হল চায়ের দোকানে। যে দোকানে জুতো জোড়া জমা রেখে হাঁটতে শুরু করেছিলাম আমরা। একটা কানা হনুমানের সঙ্গে আলাপ হল। মানুষঘেঁষা হনুমানটা নিখুদার কাছে হাত পেতে চেয়ে নিল খানকতক বিস্কুট। আমিও চা খাইয়ে আলাপটা গাঢ় করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মুখপোড়ার চায়ে মুখ পুড়লে, আমার যে কি হাল হবে এই ভেবে আর এগোনোর সাহস পায় নি।

এখন বিকাল ফুরোচ্ছে। চোখধাঁধানো রঙের খেলায় মেতে অস্ত যাচ্ছে সূর্য। খুশির রঙ আমাদের মনেও। শেষ আলোটুকু সঙ্গে নিয়েই হাজির হলাম নওলক্ষা মন্দিরে। রানি চারুশিলা তাঁর গুরু বালানন্দ ব্রহ্মচারীর আদেশে এই অনুপম মন্দিরটি নির্মাণ করেন। তৎকালীন দিনে এর নির্মাণ খরচ নয় লক্ষ টাকা হলেও, বর্তমান অর্থমূল্য দিয়ে বিচার করা যাবে না। মন্দিরের মূল বিগ্রহ শ্বেতপাথরের বালানন্দ ব্রহ্মচারী। উচ্চচূড়া ও বারান্দা বিশিষ্ট মিশ্র স্থাপত্যের নিদর্শন মেলে এই মন্দিরে।

ফিরে এলাম হোটেলে। সারাদিনের ক্লান্তি মেটাতে চায়ের অর্ডার দিলাম। সারাদিনের দেখা-না-দেখা দ্রষ্টব্যগুলিই ঘুরে-ফিরে এল নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনায়। ক্লক টাওয়ারের কাছে এক হোটেলে গেলাম রাত-আহার সারতে। নিখুদা দেখি তখনও কেনাকাটা করছেন। অন্য সদস্যরাও গৃহস্থালির টুকিটাকি জিনিসে ভর্তি করছে ব্যাগ। আমিও ব্যতিক্রম নয়। কিনলাম দেওঘরের বিখ্যাত প্যাঁড়া। ঠিক আছে কাল সকালের জনশতাব্দীতে ফিরব কলকাতায়।

গৌরবময় দিল্লি পর্ব-১

দিল্লির গৌরবময় ইতিহাস আজও পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। মহাভারতে ইন্দ্রপ্রস্থের স্থাপনা থেকে শুরু করে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সূচনা, বিভিন্ন বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির একের পর এক আক্রমণ, দিল্লির মাটিতে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার– এসবই দিল্লির পটভূমিকে রক্তাক্ত করেছে ঠিকই কিন্তু ঐতিহাসিক গুরুত্ব দিয়েছে অনেক বেশি। বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে ভারতের আজকের রাজধানী।

মহাকাব্যের যুগের ইতিহাস খুললে পাওয়া যায় যুধিষ্ঠির তাঁর স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইন্দ্রপ্রস্থে। তার কিছু নিদর্শনও সংরক্ষিত হয়ে আছে ‘পুরোনো কেল্লা’ বা ‘ওল্ড ফোর্টের’ কক্ষগুলিতে। এইসময়েই শ্রীকৃষ্ণের তত্ত্বাবধানে পাণ্ডব ও কৌরবদের মধ্যে যে-ধর্মযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল, সেই  কুরুক্ষেত্রও কিন্তু দিল্লিরই অন্তর্ভুক্ত। আজ এই দুটি স্থানই পর্যটকদের একটি প্রধান আকর্ষণের জায়গা।

পৌরাণিক যুগের অবসানে দিল্লির মাটিতে রাজত্ব করতে আসে মৌর্য, গুপ্ত, রাজপুত, আফগান, খিলজি, তুঘলক, সৈয়দ, লোধি, মোগল এবং সবশেষে ইংরেজরা। সর্বধর্ম সমন্বয়ে ভারতের রাজধানী আজ ধর্মনিরপেক্ষ শহর হিসেবে প্রসিদ্ধ। বিড়লা লোটাস টেম্পল, অক্ষরধামের মতো মন্দির যেখানে আছে– সেখানেই পাশাপাশি সেন্ট স্টিফেন্স চার্চ, মজনু কা টিলা, জুম্মা মসজিদও মাথা উঁচিয়ে রয়েছে।

শিল্পকলার অমূল্য উদাহরণ

পর্যটকদের কাছে দিল্লির প্রধান আকর্ষণ হল এখানকার ঐতিহাসিক সমৃদ্ধি। লালকেল্লা, সিরি ফোর্ট, তুঘলকাবাদ দুর্গ আজও পুরোনো স্মৃতি বহন করে চলেছে। দিল্লি পর্যটকদের কাছে চাঁদনির বিপরীতে লালকেল্লার আকর্ষণ অপরিসীম। মোগল সম্রাট শাহজাহান দ্বারা নির্মিত এই শাহি মহলের নির্মাণ। এক কোটি টাকা খরচের বিনিময়ে এর নির্মাণকার্য শেষ হয়। লালকেল্লার ভিতরে দিওয়ান-এ আম, দিওয়ান-এ খাস, মুমতাজ মহল, হামাম খানা এবং রংমহল দেখতেই পর্যটকদের ভিড় বেশি হয়। লাল পাথর দ্বারা অষ্টকোণের আকারে নির্মিত হওয়ার কারণে, ভারতীয় ইসলামিক ভবন নির্মাণ কলাশিল্পের এটি একটি উজ্জ্বল অমূল্য দৃষ্টান্ত।

এছাড়াও লালকেল্লার প্রধান দরজার সামনেই মিনা বাজার বহু পর্যটকদের বিশেষ ভাবে আকর্ষণ করে। এরই উত্তরে মোগল শাহজাদা সালিমের নামে সালিমগড় কেল্লা রয়েছে যেটি পিকনিক স্পট হিসেবে দিল্লিবাসীর কাছে খুবই প্রিয়।

লালকেল্লার সামনেই রয়েছে জুম্মা মসজিদ। এটির নির্মাণকার্যও শাহজাহান করেছিলেন। মোগলযুগে লালকেল্লা, জুম্মা মসজিদ, দিল্লি গেট এবং চাঁদনি চকের আশেপাশের অঞ্চলটিকে বলা হতো শাহজাহনাবাদ। এখন এই পুরো জায়গাটার নামকরণ হয়েছে দিল্লি। শাহজাহান কন্যা জাহানারা বেগমের হাতে গড়া ইতিহাসখ্যাত চাঁদনি চক আজ দিল্লির অন্যতম বাণিজ্যিক এলাকা। কেল্লার কিছুটা দূরত্বে রয়েছে দিগম্বর জৈন মন্দির। সুন্দর কারুকার্যমণ্ডিত মন্দিরের দেবতা জৈন তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথস্বামী।

দেশবাসীর মুক্তি আন্দোলনকে সমর্থন করায় রুষ্ট ঔরঙ্গজেবের বিধানে নবম শিখগুরু তেগ বাহাদুরের শিরচ্ছেদ হয় কদলীবৃক্ষ তলে, শিশগঞ্জে। স্মারকরূপে তৈরি করা হয় শিশগঞ্জ গুরুদ্বারা।

দিল্লির আর-একটি প্রিয় পর্যটক স্থান হল কুতব মিনার। মেহেরৌলি গ্রামে স্থিত কুতুব মিনার কুতব-উদ-দিনের হাতে নির্মাণ শুরু, শেষ হয় কুতউদ্দিনের জামাতা ইলতুৎমিশের হাতে। ভারতে উচ্চতম স্থাপত্যে অনুপম কুতব মিনারটি পাঁচতলায় গড়ে উঠেছে। অনেকের মতে মিনারটি শেষ করেছিলেন কুতবের উত্তরপুরুষ ফিরোজ শাহ তুঘলক। প্রতিটি তলায় রয়েছে ব্যালকনি। কুতবের উত্তর পশ্চিম লাগোয়া ভারতের প্রাচীনতম কুওয়াত-উল ইসলাম মসজিদ। কুতবের হাতে মহম্মদের মদিনার বাড়ির অনুকরণে, হিন্দু মন্দিরের উপর এটি গড়ে উঠেছে। স্থাপত্যে ও শিল্পকলায় তৎকালীন ভারতীয় নিপুণতার এ এক আশ্চর্য নিদর্শন।

আকর্ষণীয় লৌহ স্তম্ভ

মেহেরৌলিতেই রয়েছে গুপ্তকালীন শাসক চন্দ্রবর্মার তৈরি উঁচু লৌহ মিনার। মরচেহীন মিনারটির সংস্কৃত উদ্ধৃতিটি আজও অবিকৃত। স্তম্ভটির ঐতিহাসিক গুরত্ব রয়েছে ঠিকই কিন্তু বৈজ্ঞানিকদের কাছেও এটি একটি বিস্ময়। এটির নির্মাণে যে বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া ব্যবহৃৎ হয়েছিল তা আজও বিজ্ঞানীদের কাছে অজানা রয়ে গেছে।

উঁচু ইন্ডিয়া গেট বা ভারত তোরণকে নতুন দিল্লিতে ঢোকার প্রবেশদ্বার বলা হয়। ব্রিটিশের পক্ষে মিত্রশক্তির হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও আফগান যুদ্ধে নিহত ভারতীয় ও ব্রিটিশ সেনার স্মৃতির উদ্দেশ্যে তৈরি ওয়ার মেমোরিয়াল আর্চ।

শ্রদ্ধাঞ্জলির স্মারকস্তম্ভ ইন্ডিয়া গেট

ইন্ডিয়া গেটের নির্মাণ করেছিলেন আধুনিক দিল্লির নির্মাতা স্যার এডউইন ল্যুথিয়েনস। এরপর শিলান্যাস করেন ডিয়ুক অফ কনট। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় অনেক সৈনিকের মৃত্যু হয়েছিল, সেই ভারতীয় ও ব্রিটিশ সৈন্যদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পিত করার জন্যই এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এরই নিচে প্রজ্জ্বলিত  ভারত-পাক যুদ্ধে নিহত ভারতীয় জওয়ানদের স্মারকরূপে গড়া  শাশ্বত শিখা ‘অমর জওয়ান জ্যোতি’ অতুলনীয় করে তুলেছে একে।

ইন্ডিয়া গেট জনপথের কিছুটা দূরত্বেই অবস্থিত। যেসব পর্যটকরা দিল্লির আকর্ষণে শহরে আসেন তারা জনপথের দু’দিকের দোকানগুলিতে ফ্যাশনদুরস্ত পোশাকের আকর্ষণে ভিড় করেন পথের দু’পাশে।

জনপথ থেকে কিছুটা দূরে দিল্লি গেটের সন্নিকটে রিং রোডে যমুনার ধারে গড়ে উঠেছে আধুনিক ভারতের অবিস্মরণীয় জাতীয় মন্দির। জাতির জনক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির শেষকৃত্য এখানে সম্পন্ন করা হয়। তাঁরই স্মৃতিতে কালো মর্মরের সমাধিবেদি তৈরি হয় এই রাজঘাটে। জনসাধারণ, দেশিবিদেশি দিল্লি ভ্রমণার্থীরা শ্রদ্ধা জানাতে আসেন জাতির পিতাকে। পাশেই গান্ধি স্মারক সংগ্রহালয়।

রাজঘাটের লাগোয়া শান্তিবন। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর শেষকৃত্য হয় এখানে। গড়ে তোলা হয় সমাধিবেদি। পাশেই বিমান দুর্ঘটনায় নিহত নাতি সঞ্জয় গান্ধির সমাধিবেদি। ইন্দিরা গান্ধির স্মৃতিতেও এক জাতীয় মন্দির গড়ে উঠেছে রাজঘাট আর শান্তিবনের মাঝে শক্তিস্থলে। ইন্দিরা-তনয় ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধির স্মরণে তৈরি হয় বীরভূমি। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী চরণ সিং-এর স্মরণে কিষাণঘাট এবং দলিত নেতা আর এক প্রধানমন্ত্রী বাবু জগজীবন রামের স্মরণে সমাধি সমতা স্থল। পর্যটকরা এই স্থানটির সৌন্দর্যে সহজেই আকর্ষিত হয়ে সারাদিনটা এখানে অতিবাহিত করেন।

দিল্লির নেহরু প্লেস-এ অবস্থিত লোটাস টেম্পল বাহাই ধর্মের জন্যে সমর্পিত। ‘এক জাতি এক প্রাণ’-এ একতার মূলমন্ত্রকে রূপ দিতে, পারস্যে উন্মেষ ঘটেছে বিশ্বের কনিষ্ঠতম ধর্ম বাহাই-এর। মনোরম বাগিচার মাঝে জলাশয়ের ফোয়ারার মাঝ দিয়ে,  রাস্তা দিয়ে যাওয়া যায় উঁচু না-ফোটা পদ্ম অর্থাৎ বাহাই মন্দিরে। ভিতরে ভক্তদের বসার ব্যবস্থা। কোনও দেবদেবীর মূর্তি নেই। ভাস্কর্যশিল্পের এক অপূর্ব নিদর্শন এই লোটাস টেম্পল। এছাড়াও আছে অক্ষরধাম মন্দির। গুজরাতের অক্ষরধাম মন্দিরের অনুকরণে এটির নির্মাণ হয়েছে। প্রতিদিন বহু পর্যটক এখানে এসে মন্দির দর্শন করেন।

দিল্লির সংসদ মার্গে অবস্থিত যন্তরমন্তর জয়পুরের মহারাজা সওয়াই জয় সিং দ্বিতীয়র সৃষ্টি। সেকালের পঞ্জিকা অর্থাৎ মানমন্দির সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, নক্ষত্রের গতিবিধি ও সময় পরিমাপক যন্ত্র। বিশালাকার প্রিন্স ডায়ালটি অনবদ্য।

প্রগতি ময়দানের মেট্রো স্টেশন থেকে মথুরা রোড-এর দিকে যেতে পড়ে পুরোনো কেল্লা। এটি বাচ্চাদের বেড়ানোর খুব প্রিয় জায়গা।

কিরিবুরু মেঘাতুবুরু সারান্ডা

শীতের রোদ গায়ে মেখে বেড়ানোর মজাই আলাদা। এবার পা বাড়ালেই পৌঁছোনো যায়, এমন জায়গা বেছেছি আমরা। কিরিবুরু ও লাগোয়া মেঘাতুবুরু। কিরি মানে হাতি আর বুরু মানে বন। আর মেঘাতু হল মেঘে ঢাকা বন যাকে বলে ‘রেন ফরেস্ট’। তাই এই অঞ্চলে বৃষ্টিও বেশি। কাছেই রাউরকেল্লা স্টিল প্লান্ট– ফলে বোঝাই যায় এখানে মাটিতে লৌহের পরিমাণ বেশি। মিশে আছে নানা খনিজ পদার্থও। এ জায়গার আরও এক টান হল সারান্ডার জঙ্গল।

পাশাপাশি জায়গা হলেও Travel spot কিরিবুরু আর মেঘাতুবুরু দুটি ভিন্ন রাজ্যে। সিংভূম অঞ্চলের কিরিবুরু আসলে ওরিশায় আর মেঘাতুবুরু ঝাড়খন্ডে। কিন্তু মালভূমি বলেই দুটির সৌন্দর্য অতুলনীয়। হাওড়া থেকে ইস্পাত এক্সপ্রেস-এ মনোহরপুর পৌঁছে দুপুর দেড়টার বাস ধরে পৌঁছোনো যায় মেঘাতুবুরু। ঘন্টা দুয়েকের পথ পেরোলেই পৌঁছে যাওয়া যায় গন্তব্যে। বাসের কনডাক্টরকে বলে রাখায় সে-ই সযত্নে থামিয়ে দিল সেইল-এর গেস্টহাউসের দোরগোড়ায়।

স্টিল অথরিটির গেস্টহাউসে অতিথি হয়ে নিকটবর্তী সানসেট পয়েন্টে যাবার লোভ সামলানো গেল না। মেঘাতুবুরু যারাই আসেন তারা এই সানসেট পয়েন্টে অবশ্যই যান। চারপাশে টিলা, পাহাড় আর সেখানে হাতি, হরিণ, ভাল্লুক ও নানা প্রজাতির সাপের বাস। আরণ্যক পরিবেশে এক নিরিবিলি উইক-এন্ড ডেস্টিনেশন হতে পারে কিরিবুরু। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হওয়ার এক আদর্শ জায়গা। এ অঞ্চলে একসময় থালকোবাদ বাংলো ও কুমডি বন-বাংলোয় থাকা যেত। মাওবাদী হামলায় সেসব জায়গা এখন আর বাসযোগ্য নয়।

দ্বিতীয় দিনে সেইল-এর বড়োকর্তার অনুমতিক্রমে আমরা খনি দেখে এলাম। তারপর একটি গাড়ি ঠিক করে বেড়িয়ে নিলাম কিরিবুরু। ছোটোছোটো ঝরনা আর জঙ্গুলে পথ অচিরেই মন কেড়ে নেয় কিরিবুরু।

পরদিন আমাদের বুকিং রয়েছে সারান্ডা গেস্টহাউস-এ। মনোহরপুর-কে বলা হয় সারান্ডার প্রবেশদ্বার। কোয়েল, কোয়েনা আর কারো এই তিন নদী পাড় ছুঁয়ে যায় মনোহরপুরের। মাইনস্ এরিয়া ছাড়িয়ে পথ চলে গেছে সারান্ডার জঙ্গলে। রাজনৈতিক সমস্যায় জায়গাটির সুনাম অনেকটাই খণ্ডিত হয়েছে। তবু জায়গাটার সৌন্দর্য অপরিসীম। মূলত শাল জঙ্গলে ঘেরা সারান্ডা। এক-দুপুরের-পিকনিকের জন্য আদর্শ। আমাদের গন্তব্য হল সারান্ডার পুণ্ডুল ফলস। আর জঙ্গলের মধ্যে স্বপ্নেশ্বর মন্দির নামের এক শিবমন্দির।

ড্রাইভার বলল সন্ধে না করাই ভালো। হাতির উৎপাত তো আছেই, আছে অন্য সমস্যাও। তাই রোদ পড়ার আগেই আমরা গেস্টহাউসের পথ ধরলাম।

পরদিন আমরা গাড়িতে বেরিয়ে পড়লাম দুটি অসাধারণ ঝরনা দেখতে। প্রথমটি হল Travel spot খন্ডধারা ফলস। প্রায় ১৫০ কিলোমিটার পথ। প্রায় ৮০০ ফিট উচ্চতা থেকে জলরাশি স্পর্শ করছে মাটি। অপূর্ব এক পিকনিক স্পট। ফেরার পথে আরও একটি ঝরনার সঙ্গে দেখা হল। এর নাম বড়াঘাঘরা। ঘাঘরা নদী থেকে এর উৎপত্তি, জলধারা নামছে ২০০ ফিট উচ্চতা থেকে। ঝরনা দেখে ফিরে এলাম আস্তানায়।

রাতে ক্যাম্প ফায়ার আর ঝলসানো মুর্গি দিয়ে হইহই সন্ধে। ‘সারান্ডা’–সাতশো জঙ্গলের দেশের সৌন্দর্যে বুঁদ হয়ে কেটে গেল রাতটা। পরদিন বারবিল থেকে জনশতাব্দী এক্সপ্রেসে আমাদের কলকাতায় ফেরা।

 

Travel-pack আরণ্যক (প্রথম পর্ব)

আমরা তখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ি। আমাদের বাংলা বই-এ পাঠ্য ছিল বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় আরণ্যক উপন্যাসের অংশবিশেষ। আমার এক বন্ধু আমার সঙ্গেই পড়ত, একই ক্লাসে। তার আবার লাইন বাই লাইন মুখস্থ ছিল। আরণ্যক থেকে কিছু জিজ্ঞেস করলেই পাতার নম্বর আর পুরো অনুচ্ছেদ মুখস্থ বলে দিত। আমি বুঝতে পারতাম না, ওই দোবরু পান্না বীরবর্দি আর জংলী দেবতা টাঁরবাড়ো-র মধ্যে কি এমন লুকিয়ে ছিল যে এত আগ্রহ! টীকা লেখার সময়ে টের পেতাম যে, এ এক স্বযংসম্পূর্ণ ঐতিহ্য যার বহির্জগতে কোনও সামাজিক মর্যাদা নেই। বিভূতিভূষণের হাত ধরে তা যেন আমাদের হাতে এক আয়না ধরিয়ে দেয়। যত বয়েস বেড়েছে, বুঝেছি কী রহস্য নিহিত ছিল ওই শালবনে।

সবে তখন কোভিডের প্রথম ঢেউ শেষ হয়েছে। নিজের বাড়ি যেন গিলে খাচ্ছে সবাইকে। এক একটা দিন নিয়ে এক একটা একাঙ্ক নাটক হয়ে যাবে। আইসোলেশন আর কোয়ারেন্টিনে থাকতে থাকতে দম বন্ধ হয়ে উঠেছে। মানসিক স্থৈর্য ফেরাতে কোথাও একটা যেতে হবে। হোটেল-রিসর্ট আবার খুলেছে সবেই। কিন্তু ট্রেন চালু হয়নি তখনও। গাড়িটা কাজ দিল। চললাম Jhargram। গাড়িতে করে যাত্রা সেখানে দু-দিন-এক-রাতের জন্য। কলকাতা থেকে একশো সত্তর কিলোমিটার পথ। ভাগ্যক্রমে রাতারাতি বুকিং পাওয়া গিয়েছিল একটি নতুন রিসর্টে, একদম জঙ্গলের গায়ে, শুনেছি রিসর্টের মধ্যে তাঁবু-ও আছে। ঘরের থেকে ভাড়া একটু বেশি।

সক্কাল বেলায় দুটি পরিবার, ছয়জন, বেরিয়ে পড়লাম। রাস্তা খুবই সুন্দর। শুধু খড়গপুরের কাছের অংশের রাস্তা সত্যিই মালভূমির মতো। তারপর সোজা লোধাশুলি। সেখান থেকে আর ফ্লাইওভারে না উঠে, সেটিকে ডানদিকে রেখে বাঁদিকের গাঁয়ে রাস্তা ধরে দ্বিতীয় মোড় থেকে ব্রিজের নীচ দিয়ে ডানদিকে বাঁক নিলাম। এবার গন্তব্য ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ির আগে রিসর্ট।

রাস্তার দু-পাশে শুধু দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। তারপর আস্তে আস্তে যে, টাঁরবাড়ো-র রাজ্যে ঢুকছি মালুম হতে লাগল চারপাশের শালবন দেখে। বিশাল বিশাল শালগাছের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ফুঁড়ে চলে গিয়েছে রাস্তা। যেন ঘন সবুজ চুলের মধ্যে একফালি কালো সিঁথি। মনে হতে লাগল, সেই গানের লাইন এই পথ যদি না শেষ হয়…!

রিসর্টে পৌঁছে জানা গেল আমাদের তখনও ঘর পাওয়ার সময় হয়নি, কারণ আমরা একটু বেশি আগে পৌঁছে গিয়েছি। তাই রিসেপশনে লাগেজ রেখে ব্রেকফাস্ট সেরে ঘুরতে বেরোলাম আশেপাশে। প্রথমেই গন্তব্য কাছের, ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি। হিসেবে আদর্শ এই  Jhargram  জায়গাটা৷

ছায়া ঘনাইছে বনে বনে…। প্রকৃতি-ই যেন মহুয়া, এমন নেশা ধরানো। দু-পাশের জঙ্গলে রাস্তার মাঝখানে উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে এক জায়গায় থামতেই হল। বিশাল বিশাল শালের বন, লাল মাটি, উই-এর ঢিবি। তারা যেন এই বনাঞ্চলে পিকনিক করতে এসেছে, সংখ্যায় এতই বেশি। দু-পা অন্তর উই-এর ঢিবি। অনেকগুলো বেশ বড়ো। আবার তাদের মধ্যে বেশ কিছু পরিত্যক্ত। শঙ্কা হল, তাদের পেট থেকে না বিশাল কোনও বিষধর সাপ বেরিয়ে আসে! উই-এর বাসা শুনেছি সাপেদের দারুণ ভালো লাগার আস্তানা। কিন্তু সে রকম কিছু ঘটল না। আমরা মন দিয়ে ছবি তুলতে লাগলাম। ছবির প্রাণ হল গিয়ে আলো। অত সুন্দর আলো সত্যি-ই আমাদের প্রকৃতির বুকে অনেকটাই সুন্দর করে তুলল, ক্যামেরার চোখে।

মানুষের চোখ মিথ্যে বলে, ক্যামেরা মিথ্যে বলে না। কিন্তু ওই আলোছায়া সেদিন আমাদের যাত্রাপথে যে-মায়াবী মিথ তৈরি করে দিল, সেখানে আর কিছু গভীরে গেলেই দবরু পান্না বীরবর্দি-র কাছে পৌঁছে গেলে আশ্চর্য হব না। এমন সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। বন্ধুর উৎসাহে প্রথম চেষ্টা করা হল ব্লগিং-এর, যা আজকাল ট্রেন্ডিং। Travelogue বা ভ্রমণবৃত্তান্ত আউটডেটেড নাকি। কিন্তু আমার খুব ভরসা লেখাতেই। অন্ধের মতো বিশ্বাস করি যে-কোনও লিখিত রূপ-কে। নতুন যা-ই আসুক না কেন। যে-কোনও লিখিত রূপ এক চিরকালীন দলিল হিসেবে মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে অমর ছাপ রেখে চলে যায় বলে আমার বিশ্বাস। সঙ্গে শব্দসজ্জা এমন এক দৃশ্যকল্প তৈরি করে যে, আমরা তাতেই একাত্ম হয়ে যাই।

আমি লেখার রসদ চোখ দিয়ে গিলতে গিলতে মাথায় ছেপে নিচ্ছিলাম। তারপর পনেরো মিনিটের মধ্যে পৌঁছোলাম ঝাড়গ্রাম রাজবাড়িতে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার অধিকৃত এই রাজকীয় সম্পত্তি আমাদের মতো অতি সাধারণ মানুষ-ও ভোগ করতে পারেন। ফোন ও অনলাইনে বুক করা যায়। ভাড়া রিসর্টের থেকে কম। হেরিটেজ হোটেল হিসেবে উন্নীত হওয়ার দরুন মূল ফটকেই আটকে যেতে হল। আমদের থাকার বুকিং থাকলে তবেই অন্দরমহলে প্রবেশের অধিকার নতুবা ওই গেট থেকেই বিদায়। আমরা এ বারের মতো ভিতরে প্রবেশ করতে পারলাম না। ইচ্ছে রইল, এই রাজবাড়ি ঘিরে যা ইতিহাস আছে তা আমাদের ওই প্রাসাদে প্রবেশের ইচ্ছাপূরণের সঙ্গে সঙ্গে একসাথে মাননীয় পাঠককুলের কাছে নিবেদন করব। না হলে ব্যাপারটা খুব খাপছাড়া হয়ে যাবে।

Jha

দরদর করে ঘামছি সবাই। ভরা নভেম্বরেও। লাঞ্চ টাইম ছিল দুপুর একটা। সেরকমই বলা ছিল। কিন্তু এ কোন অরণ্য যা আমাদের নেশাগ্রস্তের মতো ধাবিত করছে তাতে সমাহিত হতে! আমরা কেউ টায়ার্ড হচ্ছি না। এমনকী আমাদের সঙ্গে থাকা দুই নেটিজেন বলছে না, এসব কী বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছ! চলো আমাদের কী খিদে পেয়েছে বা ওহ মাই গড, হোয়াট আ টেরিবল প্লেস! দেয়ার ইজ নো ডেটা নেট অল অ্যারাউন্ড। দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে, কোনও অভিযোগ নেই। শুধু ঠান্ডা জল চাইছে মাঝে মাঝে। সে ব্যবস্থা আমি করেই রেখেছিলাম, চিলড বোতলে পানীয় জল কিনে তোয়ালে দিয়ে মুড়ে খবরের কাগজ দিয়ে ডিকি-তে ঢাকা দিয়ে রেখেছিলাম। কাজে লেগে গেল।

যাই হোক, রাজবাড়ি থেকে এবার আমরা যাব কনকদুর্গার মন্দিরে। কী যে অসাধারণ রাস্তা আবার! মাঝে মাঝে ধানখেত, আবার মাঝে মাঝে বনানী। মূল রাস্তা থেকে বাঁদিকে আরও পাঁচ কিলোমিটার যেতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ধানখেতের গায়ে ডানদিকে একটি তোরণ। সেখান দিয়ে গাড়ি নিয়ে প্রবেশ করে খানিকটা যেতেই পার্কিং। মন্দিরে পৌঁছোতে হলে শপাঁচেক মিটার পদব্রজে যেতে হবে। পাকা রাস্তা, ঘন বনের মধ্যে দিয়ে রাস্তার দুধারে পুরোটাই জাল দিয়ে ঢাকা। বন্য প্রাণীদের আনাগোনা আছে নাকি, তাই।

আর এই জঙ্গল শালবনের মতো নয়। আমি জীবনে লতাগুল্মের এত দুর্ভেদ্য জঙ্গল কাছ থেকে দেখিনি। সব থেকে বড়ো কথা, রাস্তার দু’ধারে যত রকমের গাছ আছে, ঠিক বোটানিক্যাল গার্ডেনের মতো প্রতিটির গায়ে নাম লেখা। তেলাকুচো গাছ ভর্তি। ভাবলাম নিশ্চয়ই অনেক টিয়া পাখি আসে সেই লোভে। কিন্তু পাখি খুব একটা দেখলাম না, কোনও রকমেরই, ওই রাস্তায় ধানখেতের মাঝে চলে যাওয়া হাই-টেনশন বিদ্যুতের তারে সার দিয়ে বসে থাকা ফিঙে পাখি ছাড়া। সে যেন সংগীতের স্টাফ নোটেশন-এর লাইন। যাই হোক বোর্ড দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখে পড়ল তিনটি দাঁতাল হাতি। আশেপাশে কেউ নেই। বুক শুকিয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড। তারপর বুঝলাম ওগুলো নকল। কিন্তু এমন অবিকল তৈরি করে এমন স্বাভাবিক ভাবে তাদের বসানো হয়েছে যে, দেখে বোঝার উপায় নেই।

গুল্ম এখানে এত মোটা, পোক্ত ও ঘন যে, চলাই কঠিন হয়ে পড়বে যদি কেউ চেষ্টা করে এই জঙ্গল ভেঙে এগোনোর। প্রথম চাক্ষুষ করলাম, আসল দুর্ভেদ্য জঙ্গল বলতে কী বোঝায়। শালের জঙ্গল বেশ ঘন, রোদ্দুর প্রায় ঢোকে না বললেই চলে। কিন্তু তা দুর্ভেদ্য নয়। কিন্তু কনক অরণ্য আক্ষরিক অর্থেই দুর্ভেদ্য। সব লতা-গুল্ম-বৃক্ষের মধ্যে খুব প্যাঁচালো আর অজগরের মতো মোটা একটি গুল্ম অনেকক্ষণ ধরেই লক্ষ্য করছিলাম। কিন্তু কিছুতেই তার নাম পাচ্ছিলাম না। অবশেষে পেলাম রক্তপিতা।

শব্দের ধাঁধা নিয়ে মনের মধ্যে খেলা শুরু হল। রক্তপিতা কী এর অর্থ? ব্যাসবাক্যে ভাঙলে অনেক কিছু দাঁড়ায়। এক, রক্ত এবং পিতা (ঠিক মনে ধরল না)। দুই, রক্ত রূপ পিতা (কিন্তু লালের কোনও চিহ্ন নেই)। তিন, তাহলে কি রক্ত পিতা যাহার বা সেরকম কিছু, নাকি বাংলা-হিন্দি মিশিয়ে রক্ত পান করেন যিনি (এটা আমার কাছে সব থেকে গ্রহণযোগ্য নামকরণের সার্থকতা বলে মনে হয়েছে)!

এইসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে হঠাৎ এসে পড়লাম একটা বিশাল উঠোনের মতো প্রায় গোলাকৃতি ফাঁকা জায়গায়। ডানদিকে আধুনিক মন্দির। ঠিক মাঝখানে একটি বিশাল অশ্বত্থ গাছ। গোড়াটা চাতাল করে বাঁধানো যাতে মানুষ শুয়ে বসে বিশ্রাম করতে পারে। ঠিক প্রবেশদ্বারের ডানহাতে কোনাকুনি একটি পোড়ো মন্দির জরাজীর্ণ। তার পাশে সন্ন্যাসীদের থাকার ব্যবস্থা। আর পোড়ো মন্দিরের পাশ দিয়ে নেমে গিয়েছে সিঁড়ি।

আমার মনে ভক্তি-শ্রদ্ধা একটু কম, কিন্তু কারুবাসনা চিরজাগ্রত। নতুন নয় ভাঙা মন্দিরটা আমাকে টানল। অনবদ্য সে মন্দির। মন্দিরের চড়ো থেকে ভিত পর্যন্ত আপাদমস্তক ইঞ্চি ছয়েক চওড়া ফাটল। এই ফাটল যেন নিখুঁত ভাবে গোটা মন্দিরটাকে কেক-এর মতো দু’টো আলাদা টুকরো করে দিয়েছে। ফাটলের দাগ এমনই নিখুঁত যে, দরজার পাল্লাদুটোও যেন দু-ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছে। হাসি পেল দেখে যে, এমতাবস্থায় সেখানে দরজার দুটো প্রায় কব্জাবিহীন পাল্লা পেল্লায় একটা তালা দিয়ে জোড়াতালি দেওয়ার প্রচেষ্টাকে। প্রশ্ন হল, এমন ফাটল হল কী করে। জানা গেল ভূমিকম্প নয়, বাজ পড়ে। এই আদিমন্দির নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলেই নবমন্দিরের প্রতিষ্ঠা। সত্যি বলতে নতুন মন্দির আমাকে আর টানলই না!

সাপ-হাতি-ভাল্লুক ইত্যাদি বন্য জন্তু চাক্ষুষ না হলেও এখানে ঢুকেই হঠাৎ যাঁদের সাথে সাক্ষাৎ ঘটে, তাঁরা হলেন কালোমুখো হনুমান। বাঁদর নয়। পুরো জায়গাটা জুড়ে তাঁদের আধিপত্য। আমি যখন পুরোনো সেই শ্যাওলা পড়া মন্দিরের স্থাপত্যকীর্তিকে ক্যামেরায় ফ্রেমবন্দি করার চেষ্টা করছি, অশ্বত্থ গাছের নীচ থেকে একটি সরু গলায় চিৎকার। দেখলাম এক ভদ্রমহিলা স্থানুর মতো দাঁড়িয়ে আছেন, আর সামনে একটি গোদা হনুমান হাতের দানাদারটিকে তারিয়ে তারিয়ে খাচ্ছে। তার মুখের অভিব্যক্তি ভাবলেশহীন। আর মহিলার মুখ, রক্তশূন্য। এগিয়ে গেলাম নির্ভয়ে জানলাম, মহিলা মন্দিরে পুজো দিয়ে অশ্বত্থতলে নিজের সারাদিনের উপোস ভেঙে ওই বাক্স থেকে মিষ্টি খেয়ে জল খেয়ে আবার ওই বাক্স নিজের কাঁধের চেনটানা ঝোলা ব্যাগে রেখে বিশ্রামে রত ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ কিঞ্চিৎ ব্যাগের দিকের কাঁধে টান পড়ায় ফিরে দেখেন, অবাক কাণ্ড। ব্যাগের চেন খোলা। মিষ্টির বাক্স যথাস্থানে স্থানান্তরিত হয়েছে। কিন্তু একটি খোয়া গিয়েছে এবং তা তার পাশে বসা হনুমানটির হাতে। সবটা শুনে বুঝলাম বুদ্ধিবৃত্তির দিক থেকে কেন তারা আমাদের থেকে কম নন, রাম কেনই বা তাদের নিজের সহযোদ্ধা করেছিলেন এবং কেনই বা ওদেরকে আমাদের আদি পূর্বপুরুষ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে!

আমার বন্ধু আর তার মেয়ে ততক্ষণে উধাও। ফোন করে জানা গেল ওরা ভাঙা মন্দিরের পাশের সিঁড়ি দিয়ে নেমে কোথাও একটা চলে গিয়েছে। আমিও ধাবিত হলাম সেই পথে। পুরো রাস্তা বাঁধানো ও নিম্নমুখী। সোনার কেল্লার ভাষায় বললে, পুরো রাস্তাই মাঙ্কি ইনফেস্টেড। পাঁচ মিনিট হন্টনের পরে উপনীত হলাম চরম বিস্ময়ে সম্মুখে একটি ভাঙা বাঁধানো ঘাট পেরিয়ে নদীগর্ভ। শীতে হাঁটুজল, যেখানে যেখানে গভীর, ডান আর বাঁ দিকে, সেখানে দুপুরে স্নান করছেন একদিকে স্থানীয় পুরুষ আর অন্যদিকে নারীরা। প্রায় একশো মিটার দূরে দুদিকেই।

নদীগর্ভে ছোটো বড়ো পাথর। ক্যামেরা নিয়ে ছবি তোলা বিপজ্জনক, কারণ স্নানরতা মহিলাদের অনেকেই বস্ত্রহীনা। কী থেকে কী হয়। তাই ক্যামেরার সব খাপ গুটিয়ে রাখতে হল। কিন্তু এমন সুন্দর জায়গায় ছবি না তুলে কি থাকা যায়! আমাদের সহায় হলেন আমাদের স্ত্রী-রা। ওনারা আসতে আর লেন্সের লাজ লজ্জা থাকল না, না থাকল ভয়। ফ্রেমে বন্দি হল খুব সূক্ষ্মও কিন্তু বিশদে। লেন্সের খিদে মেটানোর পরে চোখের-টা মেটাতে হবে। আর পেটের-টা সম্পর্কে তখনও বেলা আড়াইটের সময়ে কারও কোনও হুঁশ নেই। সব খিদে মিটে যাচ্ছে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে। অপূর্ব সেই দৃশ্যের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অনুভত হতে লাগল আমিই যেন বিভতিভষণ… বই-এর পাতা ছেড়ে এসে দাঁড়িয়েছি সেই বিরাট অভিজ্ঞতার মাঝে।

ক্রমশ…

ছবি সৌজন্য: অরিন্দম তিওয়ারী

ঋতুপর্ণার ট্রাভেল অ্যালবাম পর্ব ৪

অভিনয়-পেশার সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, দেশ-বিদেশে যাওয়ার সুযোগটা তাঁরা পেয়ে যান অনায়াসে। তবে শুটিংয়ের ব্যস্ততার কারণে বেড়ানোর ষোলোআনা আনন্দের সুযোগ তাঁরা পান না সবসময়। তাই তাঁদের অল্পে সন্তুষ্ট থাকতে হয়। কিন্তু যাঁরা সত্যিই বেড়াতে ভালোবাসেন, তাঁরা বেড়ানোর সুযোগ করে নেবেনই। অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তও এমনই একজন ভ্রমণপিপাসু। অবশ্য, দেশের থেকে বিদেশে বেড়াতেই বেশি ভালোবাসেন তিনি।

জার্মানির রাজধানী শহরের ঐতিহাসিক গুরুত্ব কম নয়। বার্লিন ওয়াল দেখার ইচ্ছে এবং সুযোগের রাজযোটক যখন হয়েই গেল, ঋতুপর্ণা তা হাতছাড়া করেন কী করে!

এদিকে মেডিটেরানিয়ান সাগরের কোল ঘেঁষা টার্কিও বরাবর আকর্ষণ করত ঋতুপর্ণাকে। একদিকে ইস্তামবুলের প্রাসাদোপম অট্টালিকা ও মিনারের ঐশ্বর্য, অন্যদিকে অপূর্ব ল্যান্ডস্কেপ– যে কোনও রোমান্টিক পর্যটকের আদর্শ ডেস্টিনেশন।

একইভাবে ব্যাংককের অ্যাডভেঞ্চার টুরিজম আর ভিয়েনার বর্ণাঢ্যতার হাতছানিও কম আকর্ষণীয় নয়। তাই কখনও শুটিংয়ের ফাঁকে, কখনওবা বিদেশের চলচ্চিত্র উৎসবের অতিথি হয়ে, কখনও নিজের অভিনীত ছবির প্রদর্শনীর শরিক হতে, কখনও আবার বিনা কারণে শুধু বেড়ানোর তাগিদ থেকেই তিনি পূরণ করেছেন মনের ইচ্ছে। আর এই ইচ্ছেডানায় ভর করে কখনও ব্যাংকক, কখনও বার্লিন, কখনও টার্কি, কখনও আবার ভিয়েনা ঘুরে তিনি উপভোগ করেছেন আনন্দ। তাঁর ট্রাভেল অ্যালবাম থেকে বাদ পড়েনি টরেন্টো এবং কানও। রেশমি মিত্রের ‘মুক্তি’-র প্রিমিয়ার শো-এর জন্য টরেন্টো এবং শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়ের ‘অলীক সুখ’-এর প্রদর্শনীর জন্য কানও ঘুরে নিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি তিনি শেয়ার করলেন তাঁর সেরা চারটি ভ্রমণকাহিনি এবং একগুচ্ছ আলোকচিত্র।আজ শেষ পর্ব।

ভায়া ভিয়েনা

ভিয়েনা শহরটার সঙ্গে ইতিহাস যেন ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। পরিচ্ছন্ন পথঘাট, ব্যস্ত জনপদে আধুনিক জীবনের উচ্ছ্বাস থাকলেও, প্রতি পদে অনুভব করা যায় এর প্রাচীনত্ব ও রাজকীয় বর্ণাঢ্যতা। মনে হবে এখুনি বুঝি ইতিহাসের গর্ভ থেকে বেরিয়ে এলেন ফ্রিল্ড গাউন আর রাজকীয় ওভারকোট পরা সেইসব না-দেখা সময়ের মানুষজন।

‘তেরে আনে সে’ এই হিন্দি ছবিটিতে অভিনয় করতে পোল্যান্ড যেতে হয়েছিল ঋতুপর্ণাকে। ফ্লাইট ভায়া ভিয়েনা যাবে এবং ভিয়েনায় অনেকটা সময় পাওয়া যাবে জেনে, ভিয়েনা ঘোরার সুযোগ হাতছাড়া করেননি তিনি। প্রথমেই তাঁর মন কেড়ে নেয় ভিয়েনা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। ভিয়েনায় দ্রষ্টব্য অনেক। স্কনবার্ন প্যালেস, হফবার্গ প্যালেস, সেন্ট স্টিফেন ক্যাথিড্রাল, কে এইচ মিউজিয়াম, অলাবার্টিনা, লিয়েপাল্ড মিউজিয়াম, ভিয়েনা স্টেট অপেরা, মুমোক, ডরেলিয়াম প্রভৃতি। কিন্তু সময়াভাবে এর সবগুলি দেখা সম্ভব হয়নি অভিনেত্রীর, প্যালেস দেখার স্মৃতি সঙ্গে নিয়েই এযাত্রায় বিমানে উঠতে হল তাঁকে।

অনেকের মুখেই শুনেছিলেন ভিয়েনার হোটেল সাচের ‘রোটে বার’-এর কথা। এই পানশালাটি পুরোনো ভিয়েনার যেন একখণ্ড ইতিহাসকে আজও আগলে রেখেছে। ‘রোটে’ মানে লাল। পানশালা জুড়ে এ-রঙেরই আধিক্য। অপেরা আঙ্গিকের অন্দরসজ্জায় সজ্জিত এই বার। পুরোনো আভিজাত্যিক পর্দা, ঝাড়বাতি থেকে পেইন্টিং– সবই মজুত এখানে। খাবারের স্বাদ নিতে নিতে পিয়ানোর সুরে ডুব দেন অতিথিরা। ফেলে আসা সময়ের অনুষঙ্গে মিশে যায় একাল-সেকাল। এ দফায় এটি দেখা হয়নি ঋতুর। তবে সুযোগ পেলে আবার যাবেন ভিয়েনা, এটাই ইচ্ছে তাঁর।

পৃথিবীর অদ্ভুত কিছু হোটেল পর্ব ৬

আমাদের অনেকেরই বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর শখ আছে। অনেকেরই শখ আছে বরফের ঘরে রাত কাটানোর বা আরামদায়ক বিছানায় শুয়ে আকাশের তারা খসা বা তুষারপাত দেখা। এরকম ইচ্ছে থাকলে আপনাদের সে ইচ্ছেও পূরণ হয়ে যাবে। কারণ আমাদের এই পৃথিবীতে এমন কিছু হোটেল আছে যা আপনার মনের ইচ্ছে পূরণ করতে পারবে। সেরকম দুটি হোটেলের সন্ধান রইল এখানে। আজ ষষ্ঠ পর্ব।

দ্য কমার্শিয়াল স্পেস স্টেশন : জানা গেছে রাশিয়াও মহাশূন্যে হোটেল বানানোর পরিকল্পনা করছে। দ্য কমার্শিয়াল স্পেস স্টেশন নামের এই হোটেলটি হয়তো এতদিনে চালু হয়ে গিয়ে থাকবে। নভোযান আকৃতির রাশিয়ার এই হোটেলটির তৈরির পরিকল্পনা রাশিয়ান কোম্পানি অরবিটাল টেকনোলজিস নামে একটি সংস্থার। তাদের পরিকল্পনা অনুসারে তাতে চারটি কেবিন থাকবে এবং সাতজন পর্যটক থাকতে পারবেন। তবে খাওয়ার জিনিস পৃথিবী থেকে নিয়ে যেতে হবে। আরও একটি জরুরি কথা, এই হোটেলে অ্যালকোহল ও নেশাজাতীয় দ্রব্য সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।

পসাইডন আন্ডার ওয়াটার রিসর্ট : বিজ্ঞানের কল্পকাহিনিকেও হার মানিয়ে বিভিন্ন হোটেল তৈরি হয়েছে জলের তলায়। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশে এসব আন্ডার ওয়াটার হোটেল তৈরি হয়েছে। তবে বৈচিত্র‌্যে ও বিলাসিতার দিক দিয়ে ফিজির পসাইডন আন্ডার ওয়াটার রিসর্ট অন্যান্য হোটেলগুলো থেকে আলাদা। এই হোটেলে থাকলে বোর্ডাররা বিছানায় শুয়ে শুয়ে সমুদ্রের নীচে যেসব জলের প্রাণীরা ঘুরে বেড়ায়, তাদের দেখতে পাবেন। অর্থাৎ ডলফিন, হাঙর, জেলিফিশ ইত্যাদির চলাফেরা দেখতে পাবেন। কখন দিন আর কখন রাত হল কিছুই বোঝা যায় না।

ফিজির এই হোটেলে থাকতে হলে দু’মাস আগে থেকে বুকিং করতে হয়। কারণ সারা বছরই থাকে পর্যটকের চাপ। বিশেষ করে ইউরোপের গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে উপচেপড়া ভিড় দেখা যায় এখানে। প্রত্যেকটি কক্ষের আয়তন ১২ বর্গমিটার। আর উচ্চতা মাত্র আট ফুট। অর্থাত্ যখন কেউ বিছানায় ঘুমিয়ে থাকেন তার আট ফুট উপর দিয়ে জলে ভেসে বেড়ায় বিভিন্ন মাছ ও জলজ প্রাণী।

পৃথিবীর অদ্ভুত কিছু হোটেল পর্ব ৫

আমাদের অনেকেরই বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর শখ আছে। অনেকেরই শখ আছে বরফের ঘরে রাত কাটানোর বা আরামদায়ক বিছানায় শুয়ে আকাশের তারা খসা বা তুষারপাত দেখা। এরকম ইচ্ছে থাকলে আপনাদের সে ইচ্ছেও পূরণ হয়ে যাবে। কারণ আমাদের এই পৃথিবীতে এমন কিছু হোটেল আছে যা আপনার মনের ইচ্ছে পূরণ করতে পারবে। সেরকম কয়েকটি হোটেলের সন্ধান রইল এখানে। আজ পঞ্চম পর্ব।

জাম্বো স্টে হোটেল : সুইডেনের রাজধানি স্টকহোমের আরল্যান্ডা এয়ারপোর্ট-এ গেলে এক অদ্ভুত বিলাসবহুল হোটেল আপনার চোখে পড়বে। দেখবেন ককপিটের ওপর দাঁড়িয়ে আছে একটি প্লেন। যেটি আগে ৭৪৭ বিমান হিসেবে ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে সেটিকে একটি হোটেলে রূপান্তরিত করা হয়েছে, নাম জাম্বো স্টে হোটেল। এই হোটেলে ২৫টি কামরা আছে। আছে অক্সিজেন মাস্কের ব্যবস্থাও। দূর থেকে দেখলে অনেকেরই বিশ্বাস হবে না আসলে এটি একটি হোটেল বলে।

 

ডেথস্টার হোটেল : আজারবাইজানের বেকু শহরের ডেথস্টার হোটেলকে দূর থেকে দেখলে মনে হবে বিশালাকায় দুটি ব্ল্যাকহোল যেন ঝুলে আছে বাতাসে। এই বিচিত্র নকশাই আর-দশটি হোটেল থেকে আলাদা করে ডেথস্টার হোটেলকে। নামে মৃতদের তারকা হিসেবে পরিচিত হলেও, রহস্যময়তা ও সৌন্দর্যের নিরিখে ব্ল্যাকহোলের মতো মৃত্যুকেই যেন নান্দনিক ভাবে উপস্থাপন করে হোটেলটি। কাস্পিয়ান সমুদ্রের দিকে মুখ ফেরানো এই হোটেলটিকে সমুদ্রের গভীরে পূর্ণিমার চাঁদের মুখ ভেবে ভুল হয় অনেকের। পূর্ণ চাঁদের কলঙ্কের মতোই বিশালাকার কালো গর্তটি ফুটে ওঠে অন্যরকম শূন্যতা নিয়ে দূর থেকে এই ব্ল্যাকহোল দেখে জাহাজের যাত্রীরা আঁতকে ওঠেন। ব্ল্যাকহোলের মতোই দৃশ্যমান হয় এই হোটেল। ব্ল্যাকহোল যেমন নিজের বুকের দিকে সবকিছুকেই টেনে নিয়ে নিঃশেষ করে দেয়, ডেথস্টার হোটেলের বুকের এই কালো গর্তটি ঠিক তেমনই অজানা আতঙ্কের মুগ্ধতায় ফেলে সমুদ্রের ভেসে চলা জাহাজীদের।

পৃথিবীর অদ্ভুত কিছু হোটেল পর্ব ৪

আমাদের অনেকেরই বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর শখ আছে। অনেকেরই শখ আছে বরফের ঘরে রাত কাটানোর বা আরামদায়ক বিছানায় শুয়ে আকাশের তারা খসা বা তুষারপাত দেখা। এরকম ইচ্ছে থাকলে আপনাদের সে ইচ্ছেও পূরণ হয়ে যাবে। কারণ আমাদের এই পৃথিবীতে এমন কিছু হোটেল আছে যা আপনার মনের ইচ্ছে পূরণ করতে পারবে। সেরকম কয়েকটি হোটেলের সন্ধান রইল এখানে। আজ চতুর্থ পর্ব।

হেভেনলি হল্যান্ড : নেদারল্যান্ডসের প্রথম আইস হোটেল এটি। সে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর জৌলে দেশের প্রথম বরফের হোটেল তৈরি করা হয়েছে। বরফের ভাস্কর্য তৈরির একটি উৎসবের অংশ হিসেবে হিমায়িত এক গুদামের ভেতর তৈরি হয়েছে তিন কক্ষ বিশিষ্ট এই হোটেলটি। শুধু নেদারল্যান্ডস নয় ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চলে বরফের হোটেল এটাই প্রথম। বিছানা, ছোটো আকারের পানশালা, স্নানের পর পরার পোশাক, দুই জোড়া স্যান্ডেল-সহ টুকিটাকি সব ব্যবস্থাই আছে এই ছোট্ট হোটেলটিতে। কিন্তু আর-দশটা হোটেলের সঙ্গে এর পার্থক্য কেবল ভেতরের আবহাওয়ায়। ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডায় কারও হাড়ে কাঁপন ধরে যেতে পারে। কারণ হোটেলটি বরফের তৈরি। তবে এর ভেতরের তাপমাত্রা অবশ্যই শূন্য ডিগ্রির কিছুটা ওপরে।

অন্যদিকে সুইডেনে কয়েক বছর আগে ৪৭ কক্ষের একটি বরফের হোটেল তৈরি করা হয়। কিন্তু সুযোগসুবিধার দিক দিয়ে সেই হোটেলটি অনেক পিছিয়ে জানা গেছে, নেদারল্যান্ডসের হোটেলটির তাপমাত্রাই শুধু কৃত্রিম ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। দর্শনার্থীর সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে তাপমাত্রা ছয় থেকে আট ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ওঠানামা করানো হয়। স্থানীয় একটি হোটেল এর তত্ত্বাবধানের দাযিত্বে রয়েছে। প্রায় এক মিটার পুরু বরফ কেটে হোটেলের কক্ষগুলোর দেয়াল তৈরি করা হয়েছে।

বিশালাকৃতির একটি শঙ্খ রেখে একটি কক্ষের পরিবেশে সামুদ্রিক আবহ তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে। দরজায় ভারী পর্দা ঝুলিয়ে আড়াল তৈরি হয়েছে। তবে এই রুমটির সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ হচ্ছে গোলাপি, নীল ও সবুজ আলোয় আলোকিত একটি বিছানা। বরফ কেটে তৈরি বিছানার ভেতরে আলোগুলো স্থাপন করা হয়েছে। এখানে থাকতে হলে ঘুমোনোর আগে আপনি স্নান করতে পারবেন না। কারণ চুল ভেজা থাকলে সেগুলো বরফ হয়ে যাবে। পেটভরে খাওয়াও যাবে না। রুমে ঢোকার আগেই কাপড় বদলে নিতে হবে।

স্বাস্থ্য ভালো থাকলে সেখানে অবস্থানের বিষয়টি মোটেও বিপজ্জনক হবে না কারও জন্যই। তবে হাতমোজা, টুপি, সোয়েটার ও কয়েকটা মোটা প্যান্ট নিয়ে যেতে হবে। যারা ঠান্ডাজনিত রোগে ভোগেন বা যাদের ঠান্ডা সহ্য হয় না, তাদের জন্য এই হোটেলে থাকা নিষেধ।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব