বাড়িতে কিছু অতিথি এসেছিলেন। সঙ্গে তাঁদের ৬ বছরের একটি ছেলে। শীতকাল অথচ ছেলেটির জেদ, রোজ ওকে আইসক্রিম কিনে দিতেই হবে। দু-তিনদিন ওর মা-বাবা আইসক্রিম কিনে দিলেও, পরের দিন আমি ধৈর্য হারিয়ে বাচ্চাটিকে শাসন করলাম। আইসক্রিম সেদিন ও পাবে না। এতে বাচ্চাটি রেগে গিয়ে, টেবিলে খাবার সার্ভ করে রাখা কাচের প্লেট তুলে মাটিতে ফেলে ভেঙে দিল।

এতে প্লেট-টাও ভাঙল আর খাবারও চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। রাগে আমার মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোল না। মনে মনে জানতাম, বাচ্চাটি যদি আমার সন্তান হতো, অবশ্যই আমার হাতে ও এখন মার খেত। অতিথি, তাই কিছু বলার উপায় নেই। সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার, বাচ্চাটির মা, ছেলের ব্যবহারকে শৈশবের দুষ্টুমি বলে হাসতে শুরু করলেন!

আমি বলতে বাধ্য হলাম, বাচ্চাকে এতটা স্বাধীনতা দেওয়া যুক্তিসঙ্গত নয়। তাতে বাচ্চার মা উলটে বললেন, একটা প্লেট-ই তো ভেঙেছে! আমরা চাইলে আমার স্বামী একডজন প্লেট কিনে এনে দেবেন। একটি মাত্র সন্তান, ওর জন্যই তো তার বাবা রোজগার করছেন।

বুঝতে পারলাম আসলে বাচ্চাটির নয়, মা-বাবাই তার জেদি Stubbornness ব্যবহারের জন্য দাযী। আমাদের সমাজে এমন অনেক অভিভাবকেরা আছেন, যাদের কাছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিজের সন্তান। যার ফলে তাদের কোনও দোষই মা-বাবার চোখে ধরা পড়ে না। বরং বাচ্চার হয়ে প্রিয়জনদের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়তেও তারা দ্বিধাবোধ করেন না।

বাচ্চাও এইক্ষেত্রে অনুচিত চাহিদা পূর্ণ হতে দেখে, ভিতরে ভিতরে স্বেচ্ছাচারী হতে আরম্ভ করে। যার পরিণতি দাঁড়ায় বাচ্চার মধ্যে রাগ, জেদ ইত্যাদি বাড়তে থাকা। বাচ্চার স্বভাব নষ্ট হয়ে যাওয়ার পিছনে প্রধান ভমিকা মা-বাবার। বাচ্চাকে মানুষ করার পিছনে মা-বাবার অসফলতার উদাহরণ এক এক পরিবারের এক একরকম হয়ে থাকে।

খেয়াল রাখা জরুরি

যে-বাচ্চারা ছোটো থেকেই জেদি হয়ে ওঠে, তারা ভবিষ্যতেও নিজেদের ব্যবহার বদলাতে পারে না। কোনওরকম শাসন ছাড়াই, তাদের অন্যায় আবদার মিটিয়ে অভিভাবকেরা সন্তানদের মানুষ করেন। কিন্তু সমাজে এরা যখন নিজেদের পরিচিতি প্রতিষ্ঠা করতে চায়, তখন সমাজে এদের জায়গা হয় না। এইসব বাচ্চারা বড়ো হয়ে রাগি, অসহিষ্ণু, বিবাদের মানসিকতা নিয়ে বড়ো হয়। সুতরাং মা-বাবা যদি সন্তানের ভবিষ্যতের চিন্তা সময় থাকতেই করেন, স্বভাব সংশোধন করতে চান, তাহলে শৈশব থেকেই সঠিক রাস্তায় পরিচালিত করতে হবে। যাতে করে ভবিষ্যতে বাচ্চা জেদি স্বভাবের না হয়ে ওঠে।

সাধারণত মা-বাবা ভেবে নেন, বাচ্চা যা চাইছে সেটা না দিলে সে রেগে যাবে। এই ভেবে তারা সন্তানের চাহিদা পূরণ করে দেন। ধীরে ধীরে এই অভ্যাসেই বাচ্চা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। কেঁদে-কেটে, রাগ দেখিয়ে যেনতেন প্রকারেণ তারা নিজেদের Stubbornness মা-বাবাকে মানতে বাধ্য করে। উদাহরণস্বরূপ সত্যেন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে তিন সন্তানের জন্য তিনটি চকোলেট কিনে বাড়ি ফিরলেন। প্রত্যেকের জন্য এক একটি করে। কিন্তু ছেলে, দুটো নেওয়ার জন্য এমন চ্যাঁচামেচি কান্নাকাটি আরম্ভ করে দিল যে, বাধ্য হয়ে ছেলেকে দুটি দিয়ে একটি চকোলেট মেয়েদের মধ্যে ভাগ করে দিলেন। ছেলেও বুঝল মা-বাবাকে জোর করে রাজি করানোর এটি একটি সহজ উপায়। অথচ ভাই-বোনে ভাগ করে খাওয়ার মতো শিক্ষাটা কিন্তু ওর শেখাই হল না। এবং মা-বাবার দুর্বলতার জায়গা-টাও ওর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।

মা-বাবার কর্তব্য

সুদেষ্ণা ৫ বছরের ছেলেকে নিয়ে বান্ধবী রুনার বাড়ি সারাদিন স্পেনড করতে এসেছিল। বাচ্চা ছেলেটি রুনার মেয়ের সাইকেল নিয়ে সারাদিন কাটিয়ে দিল। সন্ধেবেলা যখন বাড়ি ফেরার সময়, তখন ছেলে বায়না ধরল রুনার মেয়ের সাইকেলটা ও নিজের বাড়ি নিয়ে যাবে। সুদেষ্ণা ওর জেদের তোয়াক্কা না করে স্পষ্ট কঠিন স্বরে জানিয়ে দিল, কোনও সাইকেল নিয়ে ওর যাওয়া চলবে না। ও যদি জেদ না ছাড়ে, তাহলে ওকে ওখানেই রেখে দিয়ে সুদেষ্ণা চলে যাবে। ওকে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যাবে না। বাধ্য হয়ে সাইকেল ছেড়ে ছেলে সুদেষ্ণার সঙ্গে বাড়ি গেল।

বাচ্চা যাতে জেদি না তৈরি হয়, তার জন্য মা-বাবার উচিত তাদের শাসন করা। বাচ্চাকে অভ্যস্ত করে তোলার জন্য ওর অন্যায়, অপ্রযোজনীয় জেদগুলো মেনে নেওয়া উচিত নয়। বাচ্চাকে শৈশব থেকেই বুঝিয়ে দেওয়া উচিত বেশি জেদ করলে বড়োদের থেকে মার, বকাও খেতে হতে পারে।

জেদি বাচ্চার মানসিকতাও বোঝার চেষ্টা করতে হবে

নিজের সন্তানকে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। বাচ্চারা মনে মনে ধরে নেয় যেটা ওরা মা-বাবাকে বলতে চায়, তার উত্তর বাবা-মা কী দিতে পারেন? বাবা এবং মায়ের প্রতিক্রিয়া আলাদা হবেই সেটা ওরা ধরেই নেয়। অতীতে যা যা দুষ্টুমি, শয়তানি বাচ্চা করে এসেছে এবং তার কী পরিণাম তাকে ভুগতে হয়েছে সেসব মনের মধ্যে রেখেই বাচ্চা নতুন বদমায়েসি করার সিদ্ধান্ত নেয়।

বড়োদের ক্ষেত্রেও, আগেকার কোন শাসন কার্যকরী হয়েছে, সেটা মাথাতে রেখে তবেই বাচ্চাকে কীভাবে শেখাবেন বা বোঝাবেন তা মনস্থির করতে হবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মায়ের কাছেই বাচ্চা বেশি জেদ করে অথবা অতিথিদের সামনে। কারণ বাচ্চা বোঝে ওই সময়ে তার জেদ বড়োদের মেনে নেওয়ার সম্ভাবনাই বেশি!

বাইরের লোকের সামনে বাচ্চার অন্যায় নিয়ে বেশি চ্যাঁচামেচি করা উচিত নয়। এমনকী মারা বা খুব বকাবকি করাও কাম্য নয়। বাচ্চা হলেও তারও সম্মান রাখাটা অবশ্য কর্তব্য, নয়তো জেদের বশে একই অন্যায় দ্বিতীয়বার করার সাহস তার বেড়ে যেতে পারে। বাড়িতে আলাদা করে ভুলটা বুঝিয়ে বলতে হবে।

জেদি বাচ্চাকে সামলাবার উপায়

বিশেষজ্ঞদের মতে জেদি বাচ্চারা খুবই সংবেদনশীল হয়। তার প্রতি মা-বাবার ব্যবহার কীরকম, সেই বিষয়ে সংবেদনশীলতা তাদের বেশি থাকে। বড়োদের উচিত সন্তানের সঙ্গে কথা বলার সময় টোন, বডি ল্যাংগুয়েজ এবং শব্দ চয়নের উপর বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখা। সন্তান যদি ভয় বা দ্বিধা ছাড়াই অভিভাবকদের সঙ্গে কমফর্টেবল হয়ে কথা বলতে পারে, তাহলে তাদের ব্যবহারে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটতে পারে।

সন্তানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য সন্তানের কথা মন দিয়ে শুনুন। তার বিপদে তাকে দোষ না দিয়ে তার পাশে দাঁড়ান। কারও তার বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে অভিযোগকারী এবং আপনার সন্তান দুজনকে সামনে রেখে সমস্যার সমাধান বার করার চেষ্টা করুন। বাইরের লোকের কথায় পুরো দোষ, সন্তানের উপর চাপিয়ে দেবেন না।

সন্তানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে কোনও কাজ করাবেন না। বরং কাজটা করার ইচ্ছা না থাকলে সন্তানকে কয়েকটি বিকল্প রাস্তা দিতে পারেন, যাতে কাজটা করতে তার ইচ্ছা জন্মায়। যেমন সোজা শুয়ে পড়তে বললে তার সেটা করতে ইচ্ছে না-ও করতে পারে। বরং বলুন, শুলে ওকে আপনি একটা গল্প শোনাবেন বা ও নিজেও খানিক্ষণ গল্পের বই পড়ে ঘুমোতে যেতে পারে। তাছাড়াও বাচ্চার জেদ কমাতে, বাড়ির পরিবেশও এমন রাখা বাঞ্ছনীয়, যাতে বাচ্চাও সহজে বুঝতে পারে বড়োদের কথা শোনা বাচ্চাদের কর্তব্য।

 

আরো গল্প পড়তে ক্লিক করুন...