সময়

‘রূপা, দেরি হয়ে যাচ্ছে, তাড়াতাড়ি করো।’

‘এক মিনিট অপেক্ষা করো প্লিজ।’

শ্যামলের ঘন ঘন পায়চারি এবং মাঝেমধ্যে ‘রূপা, রূপা’ বলে হাঁক পাড়া দেখেই নীলিমা বুঝে গিয়েছিলেন, ছেলে আর ধৈর্য রাখতে পারছে না। টেনশন কাটাবার জন্যে সামান্য হেসে ছেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন, ‘এত অস্থির হলে চলবে? এখন তুই একা নোস। বাড়িতে বউ এসেছে। জানিসই তো। মেয়েদের সাজতেগুজতে একটু সময় বেশি লাগে।’

‘মা, রাস্তায় যা ট্রাফিক। যদি একবার গাড়ি ফেঁসে যায় তাহলে হয়তো দেখা যাবে, হোস্ট যে, সেই সবথেকে দেরিতে পৌঁছোচ্ছে। সেটা কি ভালো দেখাবে?’

‘চলো আমি রেডি।’ কথার মাঝে দুজনের কেউ-ই খেয়াল করেননি কখন রূপা ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রয়িং রুমে এসে ঢুকেছে।

শ্যামল প্রশংসার চোখে রূপার দিকে একবার তাকিয়েই মা আর বউকে নিয়ে গাড়িতে এসে বসে। শ্যামল নিজেই ড্রাইভ করতে পছন্দ করে তাই ড্রাইভারও রাখেনি। গাড়ি চালাতে চালাতেই রূপার পুরো চোহারাটা ওর চোখের সামনে মুহূর্তের জন্যে ভেসে ওঠে। লাল শাড়ি আর লাল সিঁদুরের টিপে ও যেন আরও সুন্দরী হয়ে উঠেছে। রূপার চেহারাটা চোখের সামনে থেকে সরাবার চেষ্টা করে শ্যামল। নিজেকেই নিজে সতর্ক করে। শহরের ব্যস্ততম রাস্তায় ও গাড়ি চালাচ্ছে। চোখ কান সজাগ না রাখলে চলবে কী করে! আধা ঘন্টা পার করে গাড়ি এসে দাঁড়ায় হোটেলের সামনে। হোটেলের যে-ঘরটা, ঘর বলা অবশ্য ভুল, যে-হলটা শ্যামলের কোম্পানি বুক করেছিল গেস্টদের জন্যে, সেখানে অতিথিদের আনাগোনা তখন শুরু হয়ে গেছে।

শহরের পাঁচ তারা হোটেলে পার্টির আয়োজনটা করা হয়েছিল। শ্যামলের অ্যাডভারটাইজিং কোম্পানির বার্ষিক সম্মেলন। সঙ্গে রূপাকেও অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার এটাই মস্ত সুযোগ। দুটোই শ্যামলের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ব্যবস্থা করাই ছিল। শ্যামল এসে সোজা এক পাশে রাখা মাইকের সামনে এসে দাঁড়ায়। ‘মাই ডিয়ার ফ্রেন্ডস্, আজকে এখানে উপস্থিত হওয়ার জন্যে সকলকে জানাই আমার শুভেচ্ছা। আপনারা হয়তো সকলেই জানেন, আজ আপনাদের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি শুধুমাত্র আমার বন্ধু এবং ভাই অর্ণবের জন্যে। বাঁচার সব রাস্তা যখন আমার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখন একমাত্র ও-ই আমাকে আশার আলো দেখিয়েছিল। নিরাশায় যখন আমি ডুবে গিয়েছিলাম তখন একমাত্র অর্ণবই আমাকে সাহায্য করেছিল এই কোম্পানিটাকে আবার নতুন করে শুরু করতে। ওর চেষ্টায় এবং আপনাদের সকলের সহযোগিতায় আজ আমি এই জায়গায় পৌঁছোতে সফল হয়েছি, এটা আজ আর কারও অজানা থাকার কথা নয়।’

হাত বাড়িয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রূপাকে মাইকের সামনে টেনে নেয় শ্যামল, ‘আর আমি পরিচয় করিয়ে দিই, আমার স্ত্রী রূপার সঙ্গে। পার্টি উপলক্ষে রূপাকে সকলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সুযোগটা আমি একেবারেই হাতছাড়া করতে চাইনি।’

কোম্পানির সিনিয়র ম্যানেজার মিস্টার বিশ্বাস এগিয়ে আসেন শ্যামলের সঙ্গে করমর্দন করতে। হেসেই জিজ্ঞেস করেন, ‘কী ব্যাপার শ্যামল? লুকিয়ে লুকিয়ে বিয়েটা তাহলে সেরেই ফেললে? ঘুণাক্ষরেও কাউকে জানতে দিলে না!’

শ্যামলের বন্ধু হিমাংশুও পার্টিতে উপস্থিত ছিল। রূপার সৌন্দর্য তার মনে সামান্য ঈর্ষার অনুভূতি জাগিয়ে তুলেছিল শ্যামলের প্রতি, ‘ভগবান বেছে বেছে তোকেই সবকিছু ঢেলে দিয়েছে। ফুলে ফেঁপে ওঠা ব্যাবসা, সঙ্গে পরমা সুন্দরী বউ। হিংসা না করে পারছি না ভাই তা তুই যাই মনে করিস না কেন।’ শ্যামল হেসে উত্তর এড়িয়ে যায়। লক্ষ্য করে পার্টি সফল করে তুলতে যা কিছু ব্যবস্থা নেওয়া দরকার তার কিছুই অর্ণব বাদ দেয়নি। অতিথিদের সেবা যত্নে যাতে কোনও ত্রুটি থেকে না-যায় একা দাঁড়িয়ে সেসব সামলাচ্ছে অর্ণব। এমনকী রূপার মা-বাবাকে নিমন্ত্রণ করতে পর্যন্ত সে ভোলেনি।

আজকের দিনটা রূপার কাছে খুব আনন্দের। এই রকমই তো সে শ্যামলকে দেখতে চেয়েছিল। আজকে মা-বাবা, ভাই, ভাইয়ের বউ সকলেই নিজের চোখে দেখতে পেল শ্যামল কোথা থেকে কোথায় পৌঁছেছে। রূপা মনে গর্ব অনুভব করে, যে সে শ্যামলের মতো স্বামী পেয়েছে। অথচ একসময় এই স্বামীর উপরেই কত মানসিক অত্যাচার সে করেছে। আজ ভাবলে লজ্জায় তার মাথা নীচু হয়ে আসে।

হোটেল থেকে বেশ রাত করেই বাড়ি ফেরে রূপারা। নীলিমা সোজা নিজের ঘরে চলে যান। শ্যামল রূপাকে জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন লাগল, আমার বন্ধুদের সঙ্গে আর অফিসের সকলের সঙ্গে পরিচয় করে?’

‘ভীষণ ভালো। তোমার সঙ্গে পার্টিতে গিয়ে আমি সত্যিই খুব আনন্দ পেয়েছি। একটা কথা বলব শ্যামল?’ একটু আমতা আমতা করে বলেই ফেলে রূপা। ‘আমি সত্যিই সরি যে একসময় আমি তোমাকে মানসিক ভাবে নির্যাতন করেছি। আজ মনে পড়লে নিজেকে খুব ছোটো মনে হয়।’

‘চুপ করো, পুরোনো কথা ভুলে গিয়ে নতুন করে জীবনটাকে এনজয় করো।’ শ্যামল রূপার ঠোঁটে আঙুল রেখে ওকে চুপ করিয়ে দেয়।

সারাদিনের পরিশ্রমের পর, শোবার ঘরে ঢুকে শ্যামল হাত মুখ ধুয়ে বিছানায় এসেই গভীর ঘুমে ঢলে পড়ে। কিন্তু পাশে শুয়ে ঘুম আসে না রূপার। অতীতের স্মৃতিগুলো এক এক করে সামনে ভেসে উঠতে থাকে।

রূপা সবে সবে তখন এমবিএ ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। ফ্রেশার্স পার্টিতে শ্যামলের সঙ্গে ওর প্রথম পরিচয়। বন্ধুদের অনুরোধে শ্যামলকে গান গাইতে হয়েছিল। গলাটা সত্যিই মনে রাখার মতো। এর পরে কলেজের কোনও ফাংশনই শ্যামলকে বাদ দিয়ে হতো না। রূপার সঙ্গে পার্টিতে শ্যামলের আলাপ হলেও, শ্যামল রূপাকে এড়িয়েই চলত। সামনা-সামনি দেখা হলে ওই একটা দুটো কথা হতো শুধু। এদিকে শ্যামলের ব্যবহারে রূপার মধ্যেও জেদ চেপে যায় ছেলেটিকে শায়েস্তা করার, কারণ কখন যে নিজের অজান্তেই ধীরে ধীরে ছেলেটি রূপার মনের মধ্যে জায়গা বানিয়ে নিয়েছিল সেটা রূপাও নিজে প্রথমে বুঝতে পারেনি।

কলেজে বেশ কিছুদিন কেটে যাওয়ার পর একদিন রূপা নিজে থেকেই শ্যামলের কাছে গেল। শ্যামল বই খুলে সবে পড়াতে মন দিয়েছে, রূপা পাশে এসে দাঁড়াল, ‘চলো, কোথাও বসে একটু কফি খাওয়া যাক। অনেকক্ষণ লাইব্রেরিতে এসেছি। পড়াশোনার মাঝে একটু রিক্রিয়েশনও দরকার। চলো, ওঠো ওঠো।’ অগত্যা উপায় কী? শ্যামলকে উঠতেই হল। কফিশপে বসে একটু কফি খাওয়া আর গল্পগুজব। ব্যাপারটা এখানেই থেমে থাকল না। কফিশপ থেকে সিনেমা হল, রেস্তোরাঁয় গিয়ে বসা। রূপার ধীরে ধীরে মনে হতে শুরু করল, শ্যামলকে ছাড়া ওর জীবন শূন্য। একটা অদ্ভুত পাগলামি রূপাকে গ্রাস করতে আরম্ভ করল। শ্যামলকে একান্ত আপন করে পাওয়ার পাগলামি।

এমবিএ কোর্সের ফাইনাল সেমিস্টারের দিন এগিয়ে আসছিল। ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পর শ্যামল রূপাকে ডেকে কলেজের বাইরে নিয়ে গেল, ‘শোনো, এখন কিছুদিন আমাদের দেখাসাক্ষাৎ বন্ধ করা খুব দরকার। কিছুদিন পরেই ফাইনাল পরীক্ষা। যেমন করে হোক আমাকে ভালোভাবে পাশ করতেই হবে ভালো চাকরি পাওয়ার জন্য।’

‘ও তোমারি বুঝি খালি পরীক্ষা? আমি যেগুলো বুঝতে পারছি না সেগুলো আমাকে কে পড়াবে শুনি?’

‘দ্যাখো, তোমার নম্বর সামান্য খারাপ হলেও তোমার বাড়িতে কেউ কিছু বলবে না কারণ কেরিয়ার নিয়ে তোমার বাবা-মা বা তুমি ভাববে না। ধনী পরিবারে তোমার জন্ম। কোনও বড়োলোকের ছেলে দেখে তোমার বাবা তোমার বিয়ে দিয়ে দেবেন। কিন্তু ক্যাম্পাস সিলেকশনে যদি আমি চাকরি না পাই তাহলে মা খুব ভেঙে পড়বেন। ছোটোবেলায় বাবা মারা গেছে। মা চাকরি করে আমাকে এতদূর পড়াশোনা করিয়েছেন। মায়ের প্রতি আমার একটা কর্তব্যও তো আছে। সুতরাং কিছুদিনের জন্য আমাকে একটু কনসেন্ট্রেট করতে দাও।’ এরপর শ্যামল রূপাকে ছেড়ে হনহন করে হাঁটা লাগিয়েছিল।

কিন্তু এর পরেও রূপা শ্যামলকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিতে পারেনি। সেটা অবশ্য খানিকটা জেদের বশেও বটে। ছোটো থেকে যা চেয়েছে, সেটা খুব সহজে রূপা পেয়েছে। আর যে-ছেলেটিকে রূপা নিজের সবটুকু দিতে প্রস্তুত, সে-ই কিনা রূপার জীবন থেকে সরে যেতে চাইছে, এটা রূপা সহজে কীভাবে মেনে নিত। শুরু হল নীলিমার অনুপস্থিতিতে শ্যামলের বাড়িতে যাওয়া-আসা শ্যামলের মানা করা সত্ত্বেও। সকাল দশটার মধ্যে নীলিমা চাকরিতে বেরিয়ে যান, রূপা সেটা জানত। পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করতে সময় নিল না রূপা। সুতরাং শ্যামলের ভয়টাই সত্যি হল। আগুন আর ঘিয়ের সমন্বয় দুজনকেই দগ্ধ করল কামনার আগুনে।

পরীক্ষার পর বেশ কিছুদিন কেটে গেল। একদিন সকালেই শ্যামল শুনল রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। সাইবার কাফেতে গিয়ে নেটে নিজের রেজাল্ট দেখল। কোনওরকমে জাস্ট পাশ করেছে। ক্যাম্পাস সিলেকশনে ভাগ্যে চাকরিও জুটল না শ্যামলের। রূপার কাছে জানল সে পাশ করতে পারেনি।

ভালো চাকরির সন্ধানে শ্যামল সব জায়গায় দরখাস্ত দিল। কোথাও থেকে ডাক না আসাতে শ্যামল আরও ভেঙে পড়ল। মাঝে শুনল, কোনও এক বড়োলোকের ছেলের সঙ্গে রূপার বিয়ে স্থির হয়েছে।

নিজের চিন্তাতে শ্যামল এতটাই মশগুল ছিল, ফোন কতক্ষণ ধরে বেজে চলেছে তা ও বুঝতেই পারেনি। হঠাৎই আওয়াজ কানে যেতে ও ফোনটা তুলে নিল, ‘হ্যালো?’

‘শ্যামল, প্লিজ ফোনটা নামিয়ে দিও না। শোনো আমার বাড়ি থেকে আমার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। কিন্তু আমি তোমাকে ছাড়া কাউকে বিয়ে করতে পারব না। এছাড়াও একটা কথা বলি বলি করেও এতদিন বলতে পারিনি। আমি তোমার সন্তানের মা হতে চলেছি। তাই তাড়াতাড়ি আমাদের বিয়েটা হয়ে যাওয়া উচিত। চলো আমরা মন্দিরে গিয়ে বিয়ে করে নিই।’

‘কিন্তু রূপা এক্ষুনি আমি কী করে বিয়ে করব? আমি অত্যন্ত সাধারণ বাড়ির ছেলে তার ওপর আমার এখন চাকরিও নেই।’ শ্যামলের স্বর করুণ শোনায়। ও কিছুতেই রূপার কথা বিশ্বাস করতে পারছিল না। ঘটনার মোড় যে ওকে এই পর্যায় এনে ফেলতে পারে সেটা শ্যামল কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। মায়ের মুখখানা খালি চোখের সামনে ওর ভেসে উঠছিল।

‘আমরা এত দূর এগিয়ে এসেছি যে আমাদের আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই। আমি বাড়ি ছেড়ে কিছুক্ষণের মধ্যে তোমার কাছে চলে আসছি,’ এই বলে রূপা ফোনটা কেটে দিল।

শ্যামলের বাড়ি যখন রূপা পৌঁছোল, দেখল শ্যামল বেশ দিশাহারা। ‘এভাবে বসে কী লাভ? মুড টা ঠিক করো। মা অফিস থেকে ফিরলে তুমি না পারো, আমিই মা-কে সবকিছু বুঝিয়ে বলব। উনি কিছুতেই মানা করতে পারবেন না।’

উত্তরে শ্যামল কী বলবে বুঝে পেল না। মায়ের জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় তো কিছু নেই।

অফিস থেকে ফিরে একটি অচেনা মেয়েকে শ্যামলের সঙ্গে দেখে নীলিমা একটু অবাকই হলেন। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রূপা ওনার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম সেরে হাত ধরে ওনাকে চেয়ারে বসান। জিজ্ঞেস করার আগেই রূপা বলে উঠল, ‘মা আমি আর শ্যামল একে অপরকে ভালোবাসি। আমরা দুজনে বিয়ে করতে চাই অথচ আমার বাড়ি থেকে অন্য একটি ছেলের সঙ্গে আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আমি পালিয়ে এখানে চলে এসেছি।’

নীলিমার মাথায় যেন বাজ পড়ল। ‘বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছ মানে? সেকি। না, না, এত তাড়াহুড়োর কী আছে। তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো, বিয়ে করতে চাও, সে তো ভালো কথা। আমিই না হয় যাব তোমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। কিন্তু আগে শ্যামলকে স্বাবলম্বী হতে দাও।’

‘আমার হাতে যে অত সময় নেই মা!’ বলেই নীলিমাকে হতচকিত করে কান্নায় ভেঙে পড়ল রূপা।

নীলিমা তাকে একটু সামলাতে যে কথাটা রূপার মুখ থেকে বেরোল, তাতে যেন পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে গেল নীলিমার। ‘আমি প্রেগন্যান্ট মা। শ্যামলের সন্তান আমার পেটে। এদিকে বাড়ির লোক আমার অন্য জায়গায় বিয়ের ঠিক করেছে।’

নীলিমার ইচ্ছে করছিল ছেলের গালে সজোরে থাপ্পড় কষিয়ে দিতে। ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে এই প্রতিদান ছেলে দিল? লজ্জায় সমাজে মাথা তুলে দাঁড়াবার আর জো রইল না। কিন্তু সেসব কিছু না করে রূপাকে বললেন চেয়ারে গিয়ে বসতে। জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোমার বাড়ির লোকেরা যদি এখানে এসে ঝামেলা করে? কী বলবে তাদের?’

‘আমি ঠিক সামলিয়ে নেব।’

পরের দিন রূপার বাবা আর ভাই এসে শ্যামলের বাড়িতে হাজির হল। মেয়েকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে অনেক চেষ্টা চালাল কিন্তু রূপার মুখে একটাই কথা, ‘আমি এখন প্রাপ্তবয়স্ক। গতকালই আমরা বিয়ে করে নিয়েছি সুতরাং শ্যামল এখন আমার স্বামী।’ বিয়ের কথাটা মিথ্যা হলেও শ্যামলকে সত্যিই রূপা ভালোবাসতে শুরু করেছিল।

এই পুরো ঘটনায় শ্যামলের মুখ থেকে একটাও কথা বেরোয়নি। অপ্রত্যাশিত ঘটনাক্রম শ্যামলকে বোবা করে দিয়েছিল। দুদিন পর নীলিমা পাঁচ-ছয়জন আত্মীয়কে সঙ্গে করে নিয়ে মন্দিরে গিয়ে শ্যামল আর রূপার বিয়ে দিলেন।

রূপা বড়োলোকের আদুরে মেয়ে। নিজের বাড়িতে জল গড়িয়ে কোনওদিন খায়নি। সে এসে শ্বশুরবাড়িতে কাজ করবে এটা নীলিমা আশাও করেননি। শুধু ছেলের স্বপ্ন তাঁর চোখে লেগে থাকত যে শ্যামল একটা ভালো চাকরি নিশ্চই পাবে।

গতানুগতিক সংসারটা চলতেই থাকে নীলিমার। চোখের সামনে ছেলেকে চাকরির জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরতে দেখেও কোনওভাবেই সাহায্য করার রাস্তা খুঁজে পান না। একদিন শ্যামল এসে মা কে জানায় অনেক কষ্টে কল সেন্টারে একটা চাকরি জোগাড় করা গেছে অবশ্য মাইনে অত্যন্ত সামান্য।

রূপাও খুশি হয় শ্যামলের চাকরির খবর শুনে। বাড়িতে বসে বসে ওর দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল। সুযোগ বুঝে একদিন সন্ধেবেলা শ্যামল বাড়ি ফিরলে, রূপা ওর গলা জড়িয়ে ধরে, ‘চলো না, আজকে বাইরে থেকে খেয়ে আসি। সেই বিয়ের পর থেকে কোথাও তো আমাকে নিয়ে যাওনি।’

‘কিন্তু রেস্তোরাঁয় বসে খাওয়া মানে বিশাল খরচ।’

‘টাকার চিন্তা তুমি কোরো না। বিয়ের আগে ব্যাংকে আমার একটা অ্যাকাউন্ট করা হয়েছিল সেটাতে বাবা মাসে মাসে টাকা ফেলতেন। ওটা থেকেই টাকা তুলে খরচ করব।’

‘তোমার বাবার টাকায় আমি হাত দিতে পারব না।’

‘এত তোমার কীসের অহঙ্কার? মাইনে তো ওই কটা টাকা। বিয়ের আগে একদিনে ওই পরিমাণ টাকা আমি একসঙ্গে খরচ করেছি।’

‘এই কথাটা বিয়ের আগেই তোমার ভাবা উচিত ছিল। আমি তোমাকে আগেই এটা বোঝাবার চেষ্টা করেছিলাম।’

টাকাপয়সা নিয়ে ঝগড়া, রোজকার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রূপার ধৈর্য তলানিতে এসে ঠেকেছে সেটা নীলিমার অভিজ্ঞ চোখ ধরতে পেরে গিয়েছিল। একদিন শ্যামল বেরিয়ে যাওয়ার পর রূপাকে ডেকে বললেন, ‘রূপা, তোমার বিয়ের প্রায় চার মাস হতে চলল। শ্যামল কে নিয়ে একদিনও তোমাকে ডাক্তারের কাছে যেতে দেখলাম না। তোমার চেহারারও তো কোনও পরিবর্তন চোখে পড়ছে না। অথচ বিয়ের আগে তুমিই তো আমাদের তোমার প্রেগনেন্সির কথা জানিয়েছিলে।’

‘আমি মিথ্যে বলেছিলাম। কোনওরকম ভাবে শ্যামলকে বিয়ের জন্যে রাজি করাতে চেয়েছিলাম। এটা না বললে ও কিছুতেই বিয়েতে রাজি হতো না।

রূপার কথা শুনে নীলিমা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। কোনও মেয়ে যে নিজের কাজ গোছাবার জন্যে নিজের সম্মানেকে এভাবে জলাঞ্জলি দেয়, সেটা এই প্রথমবার নিজের চোখে দেখার দুর্ভাগ্য হল তাঁর।

মাঝে মাঝে শ্যামলের বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যেত। একদিন বাড়ি এসে মায়ের প্রচণ্ড জ্বর দেখে রূপাকে ডেকে জিজ্ঞেস করল, ‘ডাক্তার ডেকেছিলে?’

‘সামান্য তো জ্বর, ডাক্তারের কী দরকার?’

তর্ক না করে, হাত-মুখ ধুয়ে নিয়ে শ্যামল মা-কে দুধ গরম করে ওষুধ খাওয়াল। মাথায় জলপট্টি করে জ্বর সামান্য কমলে মায়ের আরামের সব ব্যবস্থা করে নিজের ঘরে গেল। রূপা শুয়ে পড়েছিল। শ্যামলকে দেখে বিছানায় উঠে বসল, ‘সারারাত মায়ের সেবা করে কাটালেই তো পারতে। ঘরে আসার কী দরকার ছিল?’

‘তুমিও তো মায়ের কাছে বসে একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে পারতে।’

‘তোমার মায়ের যদি সেবারই দরকার হয় লোক রাখো, সে-ই সারাদিন সেবা করবে।’

‘প্লিজ, তুমি তোমার মুখ বন্ধ রাখো। আমার তোমার সঙ্গে কথা বলতে এখন ইচ্ছে করছে না।’

‘তোমার তো কথা বলতে ইচ্ছে করছে না, আর আমার এক মুহূর্তও তোমার সঙ্গে থাকতে ইচ্ছে করছে না। চার মাস বিয়ে হয়েছে, সংসারে শুধু নেই, নেই শুনে আসছি। কী কুক্ষণে যে তোমাকে বিয়ে করেছিলাম, জানি না।’

‘আমি তো তোমাকে মানাই করেছিলাম। তুমিই আমার কথা শোনোনি।’

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতে শ্যামল দেখল রূপা সুটকেস গুছিয়ে রেডি। জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই জবাব এল, ‘বাপের বাড়ি যাচ্ছি। যদি মনে করো তোমার জীবনে আমার প্রয়োজন আছে তাহলে ওখানেই চলে এসো। আমি এই বাড়িতে আর ফিরতে চাই না।’

শ্যামলেরও জেদ চেপে গিয়েছিল, রূপাকে ফেরাবার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও সে করল না।

রূপার জীবনের সবথেকে বড়ো ভুল ছিল বাপের বাড়ি ফিরে যাওয়াটা। রূপার বাবা মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে কোনও ভাবেই রাজি ছিলেন না, শুধু স্ত্রীয়ের পীড়াপীড়িতে রূপাকে বাড়িতে স্থান দিয়েছিলেন। প্রথম পাঁচ-ছয় মাস রূপার আগের মতোই হাসি, গল্প আনন্দে দিন কাটতে লাগল। মাঝেমধ্যে শ্যামলের খেয়াল আসত, কিন্তু রূপা মনে করেছিল তার টানে শ্যামল ঘরজামাই হতে আপত্তি করবে না। কিন্তু সেই আশার আলোটা ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করল। বাড়িতে আসা দূরে থাক, একটা ফোন পর্যন্ত করল না শ্যামল। ধীরে ধীরে মা-বাবা, ভাই-ভাইয়ের বউরাও রূপাকে কথা শোনাতে আরম্ভ করল। রাতদিন রূপার সঙ্গে সঙ্গে শ্যামলের কথা তুলেও তারা অপমান করতে ছাড়ত না। বাড়ির বাইরেও একই অবস্থা হল রূপার। বন্ধুদের বাড়িও যাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল কারণ সেখানেও নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো রূপাকে।

দেখতে দেখতে শ্যামলকে ছেড়ে আসার এক বছর হয়ে গেল। রূপা বুঝতে পারছিল শ্যামলকে ওভাবে ছেড়ে চলে এসে ও কত বড়ো ভুল করেছে। কিন্তু শ্যামলের কাছে ফিরে যাওয়ার রাস্তাও তো ও বন্ধ করে এসেছে। ক্ষমা যেমন করেই হোক ওকে চাইতেই হবে, কিন্তু কী করে? সবথেকে আগে দরকার নিজের পায়ে দাঁড়ানো।

ফেসবুক খুঁজে শ্যামলের প্রোফাইল বার করল। দেখল শ্যামল এবং ওর আর এক বন্ধু অর্ণব মিলে একটা অ্যাডভারটাইজিং কোম্পানি শুরু করেছে। বিভিন্ন কোম্পানিতে নিজের প্রোফাইল দিয়ে চাকরির দরখাস্ত করল রূপা। কিছুদিন চেষ্টা করার পর একটা কোম্পানিতে এইচআর-এ একটা পদে বহাল হল। রূপা বুঝেই গিয়েছিল বাপের বাড়িতে তার থাকা চলবে না, পদে পদে সেখানে অপমান সহ্য করতে হবে। মা-বাবাকে বলে একটা মেয়েদের হস্টেলে এসে উঠল।

প্রথম প্রথম একটা একা থাকার ভয় রূপার মধ্যে কাজ করত কারণ একা আগে কোনওদিন রূপাকে থাকতে হয়নি। ধীরে ধীরে হস্টেল এবং চাকরি জীবনে রূপা নিজেকে সেট্ল করে নিল। স্মিতা নামে ফেসবুকে নতুন অ্যাকাউন্ট খুলল। প্রথমে শ্যামলের কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাল। শ্যামল অ্যাকসেপ্ট করাতে শুরু হল চ্যাট্ করা। ছোটোখাটো অসুবিধায় পড়লে রূপা চ্যাটেই শ্যামলের কাছে মৌখিক সাহায্য চেয়ে নিত। একদিন চ্যাটে নানা কথায় কথায় রূপা শ্যামলকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, আপনার কোনও বন্ধু যদি কোনও ভুল করে, আপনি তাকে ক্ষমা করে দেবেন?’

‘ও কী ভুল করেছে তার ওপর ক্ষমা করা নির্ভর করে। কিন্তু আপনি হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন জিজ্ঞাসা করছেন আমাকে?’

‘জাস্ট এমনি। জানতে ইচ্ছে হল।’

শ্যামল অনেকবারই স্মিতা মনে করে রূপার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছে। রূপাই কোনও না কোনও বাহানায় দেখা করতে রাজি হয়নি। ওর মনে সবসময় ভয় রয়েছে শ্যামল ওকে যদি ক্ষমা না করে তাহলে। একটাই প্রশ্ন খালি ওর মনে ঘুরপাক খায় কীভাবে ও শ্যামলের কাছে ক্ষমা চাইবে? কী ভাবে শ্যামলকে বিশ্বাস করাবে যে ও পুরোপুরি বদলে গেছে? আগের ব্যবহারের জন্যে ও আজ সত্যিই লজ্জিত।

একদিন সন্ধেবেলা রূপা সিসিডি-তে বসে কফি খাচ্ছিল হঠাৎ দেখতে পেল কয়েকটা টেবিল ছেড়ে শ্যামলও বসে রয়েছে একা। ওর হাতেও কফির কাপ। রূপার দিকে চোখ পড়তেই কফির কাপ নামিয়ে রেখে শ্যামল তাড়াতাড়ি দরজার দিকে পা বাড়াল। রূপা এসে শ্যামলের রাস্তা আটকে দাঁড়াল। ‘শ্যামল।’

‘তুমি এখানে? একা এসেছে?’

‘হ্যাঁ। অফিস থেকে ফেরার পথে একটু কফি খেয়ে যেতে ইচ্ছে হল।’

‘ভালো কথা। আচ্ছা আমার একটু তাড়া আছে। আমি চলি।’

‘শ্যামল, প্লিজ। আমাকে একটু সময় দাও, আমার কিছু কথা আছে তোমার সঙ্গে।’

‘আমাদের মধ্যে আর কিছু কথা বাকি রয়েছে বলে আমার মনে হয় না।’ শ্যামল দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

রূপা শ্যামলের হাত চেপে ধরে, ‘প্লিজ, আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি, আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি পুরো বদলে গিয়েছি। আমাকে একটা সুযোগ দাও প্লিজ।’ রূপার চোখ জলে ভরে আসে।

‘না রূপা, আর তা হয় না। তুমি অনেক দেরি করে ফেলেছ। আমি এখন অন্য একটি মেয়েকে ভালোবাসি।’

‘কী নাম?’

‘স্মিতা। ও আমার জীবনে বিশেষ একটা জায়গা বানিয়ে নিয়েছে।’

মৃদু একটা সলজ্জ হাসিতে রূপার চোখদুটো চিকচিক করে ওঠে। শ্যামল বিরক্ত হয়, ‘এর মধ্যে হাসির কী দেখলে?’

রূপা বাঁ হাত দিয়ে শ্যামলের হাতটা জড়িয়ে ধরে, ‘তুমি এখনও সেই বোকাই রয়ে গেলে। আরে ফেসবুকে আমিই স্মিতা নাম দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলেছিলাম কারণ সোজাসুজি তোমার সঙ্গে কথা বলতে সাহস পাচ্ছিলাম না।’

সেদিন হস্টেল ছেড়ে দিয়ে রূপা চলে এসেছিল শ্যামলের সঙ্গে, শ্যামলের বাড়িতে। হঠাৎই অ্যালার্মের আওয়াজে রূপা অতীত থেকে ফিরে আসে বর্তমানে। ঘুমের আবেশে শ্যামল জড়িয়ে ধরে রূপাকে কাছে টেনে নেয়। অতীত বর্তমান মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় রূপার।

সম্পর্কের সমীকরণ

সময় কারও জন্য থেমে থাকে না রাহুল। সে তার নিয়মেই বয়ে চলে। মানুষ বর্তমান নিয়েই বাঁচে। কাল কে দেখেছে বলতো?’

‘ফিলোজফি ঝেড়ো না তো অরিদা। যখনই দেখা হয়, তোমার সেই একই কথা। সবসময় মানুষের মনে আঘাত দিতে ভালো লাগে? তোমাদের মতো করে যারা ভাবে তাদের জন্যই আমাদের মতো কষ্টে জর্জরিত মানুষগুলো বাঁচার আশাই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।’

‘বাঁচার আশা ছাড়বে না, বরং আরও ভালো করে বাঁচতে শিখবে! কখনও কারও মনে দুঃখ দেবে না, আর কেউ কষ্টে থাকলে তাকে মাঝ দরিয়ায় ছেড়েও দেবে না। আমরা মানুষ রাহুল। সমাজে বাস করি। রোজ না জানি কত লোকের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়, তাদের সকলের সঙ্গেই যে আমরা ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে পারি এমনটা তো সম্ভব নয়। কখনও কখনও তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে ফেলি। কটু কথাও বলে ফেলি। সেক্ষেত্রে তৎক্ষনাৎ একটা ‘সরি’ বললেই প্রবলেম সলভড্। কোনও কিছু কালের উপর না ছাড়াই ভালো, কারণ কাল কখনও আসে না।’

‘গতকাল দেরি করে অফিসে আসার জন্য আমি আমার চাপরাশিকে দু-চার কথা শুনিয়েছি। তাই বলে আমি তার কাছে ক্ষমা চাইব নাকি?’

‘ওনার দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করেছিস একবারও? যদি তিনি রোজই দেরি করে অফিস পৌঁছন তাহলে আলাদা কথা। কিন্তু যদি তিনি আগে কোনওদিন দেরি না করে থাকেন, শুধুমাত্র সেইদিনই… তাহলে নিশ্চয়ই কোনও বিশেষ কারণ থাকবে। ওই ভদ্রলোক তোর বাবার বয়সি। সারাদিনে সকলের সঙ্গে কত তো কথা বলিস। তার থেকে যদি দু-চারটি বাক্য ওই মানুষটার জন্য ব্যয় করিস, তাতে তোর জাত যাবে? যদি একটা ‘সরি’ বলিস, কী হবে তাতে? মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?’

‘কী বলতে চাইছ বলোতো? তোমার কথা অনুযায়ী আমাকে তাহলে সুগার কোটেড ট্যাবলেট-এর মতো করে বাঁচতে হবে। বাইরে থেকে মিষ্টি আর ভিতরে তেতো।’

‘বাইরে মিষ্টি ভিতরে তেতো কেন হবে? তাহলে তো ভিতরে ভিতরে নিজেকেই জ্বলতে হবে। আমরা নিজেকেও জ্বালাব না আর কাউকে কষ্টও পেতে দেব না।’

রবিবার। কোথায় রাহুল ভেবেছিল আজ একটু বেশি ঘুমোবে, এগারোটার আগে কোনও মতেই বিছানা ছাড়বে না। রোজই তো সকাল সাতটায় উঠে কোনওরকমে নাকে-মুখে গুঁজে অফিস ছুটতে হয় তাকে। যদিও তার দুশ্চিন্তা তাকে কতটা শান্তিতে ঘুমোতে দেয় কে জানে! সে ছুটে বেড়ায় শান্তির খোঁজে। আজকাল বাড়িতেও ভালো লাগে না রাহুলের। সংসারে মোটে তিনটে প্রাণী। মা-বাবা আর সে। তারা কেউ কথা বলে না রাহুলের সঙ্গে। রাহুলও কথা বলার সাহস পায় না।

ঘড়িতে তখন সবে আটটা দশ। কানের কাছে বেজে উঠল মোবাইল ফোনটা। ঘুম চোখে বিরক্তিমাখা মুখে ফোনটা কানে দেয় রাহুল—

‘হ্যালো, কে বলছেন?’

‘আরে অরিজিৎ বলছি রে।’

‘আরে হ্যাঁ। বলো বলো। হঠাৎ কী মনে করে এত সকালে ফোন করলে? সিরিয়াস কিছু?’

‘না রে তেমন সিরিয়াস না হলেও তোর সঙ্গে কিছু দরকারি কথা আছে। তাছাড়া অনেকদিন দেখাও তো হয়নি। আজ বিকালে আমাদের বাড়িতে আয়, তখনই সব কথা হবে। তোর বউদিও বাপের বাড়ি গেছে। তুই এলে আমারও কম্প্যানি হবে।’

‘এই কথাগুলো একটু বেলায় বললে খুব অসুবিধা হতো? শুধুশুধু আমার ঘুমটা মাটি করে দিলে। আচ্ছা ঠিক আছে, কখন যেতে হবে বলো?’

‘এক কাজ কর সকালেই চলে আয়। একসঙ্গে লাঞ্চ করব। দুজনে মিলে যা হোক একটা কিছু বানিয়ে নেওয়া যাবেখন।’

‘ঠিক আছে, আমি ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে আসছি।’

অরিজিৎ, অতুলের বেস্ট ফ্রেন্ড। লম্বা, চওড়া, সুঠাম দেহ তার। দেখতেও বেশ সুদর্শন। কলকাতারই একটি নামিদামি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চিফ্ অ্যাকাউন্ট্যান্ট, মাত্র সাত মাস বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে সে।

অতুলদের বাড়িতে নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল অরিজিতের। সে প্রায় বাড়িরই একজন হয়ে উঠেছিল। বাড়িতে হইহুল্লোড়, আনন্দ, হাসি-ঠাট্টা, মজা, সুখ-দুঃখ সবেতেই সামিল হতো সে। অতুলের মতো অরিজিৎও হয়ে উঠেছিল রাহুলের অরিদা। অতুলের অকাল মৃত্যুতে তার আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল রাহুলদের বাড়িতে।

আজ সেই সম্পর্কের টানেই একটা ফোন পেয়ে অরিদার বাড়িতে ছুটে আসা রাহুলের। এর আগেও বহুবার এখানে এসেছে সে অতুলদার সঙ্গে। চার মাস আগে যখন এসেছিল তখন বারান্দায় বসানো বেলফুলের চারাগুলি সবে ডানা মেলছিল। আজ তাতে ফুল ভরে গেছে। পুরো বারান্দা গন্ধে ম ম করছে। কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল রাহুল।

— ‘কী রে শুনছিস কী বললাম? কোথায় হারিয়ে গেলি?’ অরিজিতের কথায় চমকে উঠল রাহুল।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, কী যেন বলছিলে? মাঝে মাঝে কী যে হেঁয়ালি করে কথা বলো না, কিছুই বুঝি না। মাথার উপর দিয়ে যায়। লোককে ভুরিভুরি উপদেশ দেওয়ার রসদ কোথা থেকে পাও বলো তো। কপালে একটা বড়ো লাল তিলক আর গেরুয়া বস্ত্র গায়ে চড়িয়ে বসে যাও। প্রচুর টাকা কামাবে।’

‘দ্যাখ, ভগবানের দয়ায় টাকার অভাব নেই আমার। আর গেরুয়া বস্ত্র কেন পরব বলতো? যারা সংসার ত্যাগ করে তাদের ওই পোশাক মানায়। তাদের মতো আমি তো মহামানব নই, আর ভবিষ্যতেও সংসার ত্যাগ করার কোনও পরিকল্পনাও আমার নেই। আমি সংসারী মানুষ। সারাজীবন সংসার নিয়েই সুখে-দুঃখে কাটাতে চাই। দায়িত্ব থেকে পিছপা হওয়ার মতো ছেলে আমি নই। আর অতটা দয়িত্বজ্ঞানহীনও হতে পারব না।’ অরিজিৎ বেশ উত্তেজিত হয়েই কথাগুলি বলল।

‘কোথা থেকে কোথায় চলে এলে অরিদা? কী বলছ কিছুই বুঝলাম না। আর হঠাৎ করে এত উত্তেজিতই বা হয়ে গেলে কেন?’

‘এত ছোটো তো তুই নোস, যে আমার কথা বুঝতে পারছিস না। কী করছিস ভেবে দেখেছিস একবারও। নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছিস? মেয়েটার কী হবে বলতো?’

এতক্ষণে রাহুলের বোধগম্য হল যে অরিদা কী বলতে চাইছে। তার আর মৌসুমির সম্পর্ককে ঘিরেই এত জল্পনা। সেই সম্পর্ক যেটা না রাহুল বহন করতে পারে আর না সহন করতে পারে।

‘তুমি আমার জায়গায় থাকলে কী করতে?’

‘হয়তো আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতাম। দাদার মৃত্যুর পর কখনও তার বিধবা স্ত্রীকে গ্রহণ করতাম না। মা-বাবা যতই চ্যাঁচামেচি করুক, অন্যায় আবদার করুক, না বলে কাটিয়ে দিতাম। অন্তত তাদের রোজ তিল তিল করে মরার জন্য ছেড়ে দিতাম না। যদি সম্পর্ক রাখারই না ছিল তাহলে সম্পর্কে আবদ্ধ হয়েছিলি কেন? আমি এরকম সম্পর্কে কখনও আবদ্ধ হতাম না যেটা আমার নিজের এবং অন্যের জীবনের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়ে দাঁড়াবে।’

‘যদি এই সম্পর্ক ওর মৃত্যুর কারণ হয়, তাহলে আমিও তো ক্রমশ সেই দিকেই এগোচ্ছি। না পারছি গিলতে, না পারছি ফেলতে। আমিও যে ভালো নেই অরিদা।’

‘ভালো থাকবি কী করে বলতো? চার মাস ধরে মেয়েটা বাপের বাড়িতে পড়ে আছে। অতুলের মৃত্যুর পর একবারও তাকে চোখের দেখা দেখতে যাসনি। এখনও সময় আছে রাহুল, সব দ্বিধা কাটিয়ে যা ওর কাছে। দায়িত্ব যখন নিয়েছিস ওকে ওর মর্যাদা দিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে আন ভাই।’

চুপ করে থাকে রাহুল। এর কী জবাব দেবে সে নিজেই জানে না। বোধহয় সেই উত্তর খোঁজার জন্যই হারিয়ে যায় তার উদাসীন মন।

মৌসুমি বাবা-মায়ের আদরের একটিই মাত্র মেয়ে। লম্বা, ফর্সা, ছিপছিপে চেহারা। টানা টানা চোখ, টিকালো নাক, ছোট্ট কপাল–যাকে বলে প্রকৃত সুন্দরী। বিএ পড়তে পড়তেই বান্ধবীর সূত্রে অতুলের সঙ্গে আলাপ। তারপর প্রেম এবং পরে বিবাহ। অতুল সরকারি কর্মচারী এবং সৎ হওয়ার কারণেই মৌসুমিদের বাড়ি থেকে কোনও আপত্তি ওঠেনি।

শ্বশুর, শাশুড়ি, দেওর আর স্বামীকে নিয়েই ছিল তার সুখের সংসার। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাসে সে সুখ তার কপালে বেশিদিন সইল না। বিয়ের সাত মাস পরেই ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট-এ মারা গেল অতুল। সেদিন মৌসুমির জন্মদিন ছিল। মৌসুমিকে উপহার দেওয়ার জন্য একটা লাল রঙের জরিপাড় শাড়ি এবং একতোড়া গোলাপফুল কিনেছিল সে। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য চলন্ত ট্রেনে উঠতে গিয়েই এই দুর্ঘটনা। খবর পেয়ে তারা যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছল, তখনও লাল টুকটুকে শাড়ি আর গোলাপের তোড়া সেইখানেই পড়ে ছিল। শাড়িটা হাতে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল মৌসুমি। একটা সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল সে।

তিনদিনে সমস্ত কাজ মিটে যাওয়ার পর অখিলেশবাবু তার মেয়ে মৌসুমিকে পাকাপাকি ভাবে সঙ্গে করে নিয়ে চলে যেতে চাইলেন তাদের বেহালার বাড়িতে।

সেকথা শোনা মাত্রই রাহুলের মা-বাবার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এমনিতেই পুত্রশোকে তারা মৃতপ্রায়, তার উপর আবার তাদের স্নেহের বউমার বাড়ি থেকে চলে যাওয়াটা তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তারা কাঁদতে কাঁদতে শুধু অখিলেশবাবুর পায়ে ধরতে বাকি রেখেছেন। কত অনুনয়-বিনয় করেছেন মৌসুমিকে এ বাড়িতে রাখার জন্য। কিন্তু তাঁর একটাই কথা, এখানে থেকে সে কী করবে। কী পরিচয়ে থাকবে? অতুলের বিধবার পরিচয়ে! সেটা তিনি কিছুতেই হতে দেবেন না। আবার তিনি অন্যত্র মেয়েকে পাত্রস্থ করবেন।

এ সমস্তকিছুই লক্ষ্য করছিল রাহুল। এমন সময় তাকে দেখে মা মীনাদেবী ছুটে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তার হাত দুটি ধরে পীড়াপীড়ি শুরু করে দেন। একমাত্র সে-ই পারে মৌসুমিকে এ বাড়িতে রাখতে। সে যদি মৌসুমিকে বিয়ে করে তাহলে মৌসুমি এ বাড়িতে বউয়ের সম্মান নিয়েই চিরজীবন থেকে যেতে পারে।

কিন্তু সেটা রাহুলের পক্ষে কীভাবে সম্ভব? যাকে সে এতদিন বউদি বলে ডেকে এসেছে, বন্ধুর মতো মিশেছে তার সঙ্গে, তাকে সে কীভাবে নিজের স্ত্রী হিসাবে মেনে নেবে? শুধু তার কেন, কারওর পক্ষেই কি এটা সম্ভব?

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এই প্রস্তাবটা নিয়ে কোনও জোরালো প্রতিবাদ করলেন না অখিলেশবাবু। শেষ পর্যন্ত শত চেষ্টা করেও মা-বাবার এই শোকার্ত আবেদন এড়িয়ে যেতে পারেনি রাহুল। সে বাধ্য হয়েছিল মৌসুমির মাথায় সিঁদুর তুলে দিতে। কিন্তু হায়, ভাগ্যের কী পরিহাস! যাকে নিয়ে এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত, সে স্থানুবত এক পুতুল। অতুলের নয়, রাহুলের স্ত্রী, হিসাবে জীবনটা অতিবাহিত করতে তার আপত্তি আছে কিনা তা নিয়ে কোনও মতামত চাওয়া হয়নি মৌসুমির।

এরপর অখিলেশবাবু প্রায় জোরাজুরি করেই পনেরো দিনের জন্য মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের বাড়িতে। তারপর কেটে গেছে চার চারটি মাস। এবাড়ির কেউ মৌসুমিকে আনেওনি, এমনকী ফোন পর্যন্ত করে খবর নেয়নি। এই নিয়েই যত অশান্তি। বাবা-মা রাগে কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিয়েছেন রাহুলের সঙ্গে। তাদের রাগ বাড়ির বউ আর কতদিন বাপের বাড়িতে পড়ে থাকবে।

সহসা কলিং বেল-এর আওয়াজে চমকে ওঠে রাহুল। দুধওয়ালা দুধ দিয়ে গেল। কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে আবার বলতে শুরু করল রাহুল। ‘সময় মানুষকে কখন কোন পরিস্থিতিতে দাঁড় করাবে আগে থেকে তা কে বলতে পারে অরিদা? মানছি ওর দায়িত্ব আমি নিয়েছি। দায়িত্ব এড়াতেও চাই না। ভেবেছিলাম যে, সমস্যা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা আরও জটিলাকার ধারণ করল। সব থেকে বড়ো সমস্যা হল আগে একরকম করতাম আর এখন অন্যরকম ব্যবহার। মৌসুমির সঙ্গে নতুন সম্পর্ক তো দূর, পুরোনো সম্পর্কটাই কীভাবে সামলাব বুঝতে পারছি না। ও ছিল আমার বউদি কাম বেস্ট ফ্রেন্ড। সমস্ত আলোচনাই করতাম ওর সঙ্গে। এমনকী কবে কোন মেয়ের পিছনে লাগলাম, কার প্রেমে পড়লাম সমস্ত কিছুই। মাঝেমধ্যে দাদা আমাকে বলত, ‘কখনও তোর বউদিকে আমার সঙ্গেও একটু-আধটু সময় কাটাতে দে।’

একদিন তো এমনও হয়েছে, ‘বউদি বউদি’ করে ডেকেই যাচ্ছি। বউদির কোনও সাড়া নেই। যে-বউদিকে ডাক দিলেই সমস্ত হাতের কাজ ফেলে ছুটে আসে, তার আজ কী হল! আবার ডাকলাম, – এল না। ‘বউদি একবার এসো, তোমাকে কিছু দেখানোর আছে।’ খেতে বসেও সেই একই ব্যাপার। সকলের সঙ্গে কথা বলছে, শুধু আমার সঙ্গে বলছে না।

এইসব দেখে মা ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল আমার সঙ্গে কথা বন্ধ করার কারণ। সেদিন কোনও উত্তর দিতে পারেনি সে। উত্তরের পরিবর্তে শুধু মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছে ও।

পুরো ব্যাপারটাই বুঝতে পেরেছিল দাদা। বসে বসে মুচকি হাসি হাসছিল। পরে দাদার থেকে জানতে পারি দাদা নাকি ইয়ার্কি করে ওকে বলেছে, ও দাদার থেকে আমাকেই বেশি ভালোবাসে। তাই সারাদিন মুখ গোমড়া করে রেখেছিল।

কথাটা যে আমিও ভালোভাবে নিতে পেরেছিলাম তা কিন্তু নয়। আমারও কেমন যেন একটা খটকা লেগেছিল। শুধু মনের কোণে একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছিল, আমাদের দেওর-বউদির সম্পর্ককে দাদা অন্যরকম ভাবে নিচ্ছে না তো?

বাড়িতে বেশ একটা গুরুগম্ভীর পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। মৌসুমির মুখের হাসি ফিরিয়ে আনতে দাদা যখন ওকে আমার ঘরে নিয়ে এসেছিল, তখনও কাঁদছিল ও। আমাকে দেখে আরও বেশি করে কাঁদতে শুরু করেছিল। সেদিন প্রথম আমি ওর মাথায় হাত রেখেছিলাম।

সব শুনে অরিজিৎ বলল, ‘মৌসুমিকে ভালো যে বাসিস তা তোর কথায় স্পষ্টই বোঝা যায়। তবে এটা ঠিক যে তোর ভালোবাসার ধরনটা ছিল আলাদা। এখন তোদের সম্পর্কের সমীকরণটা বদলেছে। মানছি এক সম্পর্ক থেকে হঠাৎ করে অন্য সম্পর্কে যাওয়াটা খুব সোজা নয়। কিন্তু অসম্ভবও তো নয়। এই সংসারে কত লোকই তো আছে যারা এই পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, তারা কি সুখে ঘর করছে না বল?’

অতীত ভুলে যা ভাই, বর্তমানে ফিরে আয়। আমার বিশ্বাস তুই পারবি।’

‘কী করে বলো?’

‘আজ বিকেলে মৌসুমিদের বাড়িতে যা। ওর সঙ্গে কথা বল। আগের মতো ওর ভালো বন্ধু হয়ে যা। পাশে বস। তুই যেমন তোর ভাইকে হারিয়েছিস ও-ও তো স্বামীকে হারিয়েছে, তাই না?’

‘ওর স্বামী নাকি বন্ধু কোন পরিচয়ে গিয়ে দাঁড়াব ওর কাছে? তুমি যাবে আমার সঙ্গে?’

‘অবশ্যই যাব। এক কাজ করি আমি মৌসুমিকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসি। তখন কথা বলে নিস।’

‘না অরিদা। প্লিজ ওকে এনো না।’

রাহুল হঠাৎই থামিয়ে দিয়েছিল অরিজিৎকে। সে ভয় পেতে শুরু করেছিল। কীভাবে সে মৌসুমির সামনে গিয়ে দাঁড়াবে?

রাতে বাড়ি ফিরে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ে রাহুল। মনে মনে ভাবতে থাকে তার সমস্ত সুখশান্তি দাদা কেড়ে নিয়ে গেছে। অরিদা ঠিকই বলেছে, কতদিন আর এরকম চলবে? কিছু তো একটা ডিসিশন নিতেই হবে। কিন্তু তার আগে এটাও তো জানা দরকার মৌসুমি তার ব্যাপারে কী ভাবে? সে কী চায়? এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ে রাহুল।

পরদিন সকাল সাতটায় অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙে রাহুলের। কোনও রকমে নাকে মুখে গুঁজে রওনা দেয় অফিসে। পথটাও অনেকটা। সেক্টর ফাইভ। প্রায় দশ কিলোমিটার। ভালো পোস্টে আছে রাহুল। বেতনও পায় বেশ মোটা অঙ্কের।

অফিস শেষ করে বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয় রাহুল। চড়ে বসে গাড়িতে। কিন্তু আশ্চর্যের কথা বাড়ি না গিয়ে এ কোথায় এল সে! তার অবচেতন মন তাকে কোথায় নিয়ে এল? এ যে মৌসুমিদের দরজার সামনে এসে গেছে সে! মৌসুমির মা-বাবা তাকে দেখতে পেয়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন। তাদের কাছ থেকে সে জানতে পারে মৌসুমি অসুস্থ। অতুলের মৃত্যুর পর থেকেই সে অবসাদে ভুগছে।

মৌসুমির ঘরে ঢোকা মাত্রই চমকে উঠল রাহুল-এ কী অবস্থা তার। চোখে-মুখে কালি পড়ে গেছে, চুল উশকোখুশকো, জরাজীর্ণ চেহারা। ফর্সা টুকটুকে রং একেবারে কালো হয়ে গেছে।

অতুল মৌসুমিকে খুব ভালোবাসত। বলত ‘এই পাগলিটাকে নিয়ে কী করি বলতো? এই যুগে এত সহজ, সরল হলে সমাজে বাঁচবে কী করে। কী করে সামলাব এই মেয়েকে আমি?’

রাহুল বলতো, ‘ভালোই তো, আসল সোনা পেয়েছ, তাতে খাদ মেশানোর চেষ্টা করছ কেন?’

‘আমি মরে গেলে কী হবে ওর? বাঁচবে কেমন করে? সমাজে বাস করতে হলে একটু চালাক-চতুর হতে হয়।’

‘কেন বাজে কথা বলো, বলো তো। ভালো কথা বলতে পারো না।’ সেদিন দাদার এই কথায় চেঁচিয়ে উঠেছিল রাহুল। কী জানি, দাদা কী তার মৃত্যুর কিছু পূর্বাভাস পেয়েছিল, নাকি এমনিই! মৌসুমিকে দেখে রাহুলের মনে পড়ে গেল কথাগুলো।

মনে মনে ভাবতে থাকল বাবা-মা বিশ্বাস করে তার হাতে সঁপে দিয়েছিল মৌসুমিকে। আর সে কী করছে। তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। তার এই অবস্থার জন্য নিজেকেই দূষতে থাকে সে।

এমন সময় মৌসুমির বাবা বলেন, ‘মউ দ্যাখ মা আমার, কে এসেছে তোর সঙ্গে দেখা করতে। দ্যাখ রাহুল এসেছে। রাহুলের সঙ্গে কথা বল মা। কতটা দূর থেকে এসেছে তোর সঙ্গে দেখা করতে।’

চুপ করে বসেছিল মৌসুমি। আর কী কথাই বা বলবে? কী-ই বা বলার আছে? তাদের দুজনেরই ভবিষ্যৎ অন্ধকারে আর অতীত তো চিরজীবনের মতো দিশাহীন করে দিয়ে গেছে। রাহুলের দিকে দেখল সে। সেই নিশ্চল চোখ। রাহুলের চোখে জল এসে যায়। দাদার মুখটা চোখের উপর ভেসে ওঠে। যেন আসল সোনা তার হাতে তুলে দিয়ে দাদা বলছে ‘দেখিস ভাই আমার মৌসুমির দায়িত্ব এবার তোর। তুই ছাড়া আর কাকেই বা এই গুরুদায়িত্ব দিতাম বল। বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যা রাহুল। বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যা।’

রাহুলের চোখ জলে ভরে গিয়েছিল। সহসা নিজের হাতের উপর একটা স্পর্শ অনুভব করার সঙ্গে সঙ্গে কানে এল, ‘কেমন আছো রাহুল?’

উত্তর দিতে না পেরে হাউহাউ করে কেঁদেই ফেলল রাহুল। মনে হচ্ছিল যেন দাদার দাহ সংস্কার করে সবে ফিরেছে সে। দাদা মরে গিয়ে বেঁচে আছে, আর তারা বেঁচেও মরে আছে।

‘রাহুল। কাঁদছ কেন?’

অল্পক্ষণেই রাহুলের মনে হল যেন তার দেহ-মনের জ্বালা একেবারে জুড়িয়ে গেছে। কোথা থেকে যেন শান্তি ফিরে এসেছে। মৌসুমি তার আঁচল দিয়ে রাহুলের চোখ মুছিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।

মৌসুমির বাবা রাহুলকে ঘরে দিয়েই চলে গিয়েছিলেন। কেউ থাকলে মৌসুমিকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথাটা অন্তত পাড়তে পারত সে।

মৌসুমি বলে ওঠে, ‘সোজা অফিস থেকে এসেছ না? কিছু তো খাওয়াও হয়নি মনে হয়। তুমি বসো। আমি কিছু নিয়ে আসি।’ এই বলে কোনওরকমে দেয়াল ধরে ওঠার চেষ্টা করে সে।

‘না খেতে ইচ্ছে করছে না’, বলে মাথা নাড়ায় রাহুল।

‘সবাই কেমন আছে? আমার কথা বাবা-মায়ের মনে পড়ে?’

‘আগে বলো বাড়ি যাবে আমার সাথে? সবাই তোমাকে খুব মিস করে।’ সাহস করে বলেই ফেলে রাহুল।

‘এখন আর ওখানে গিয়ে কী করব, কে আছে আমার?’

‘কেন এরকম বলছ?’

‘তুমি খুব ভালো করে জানো রাহুল, ওখানে আর আমার আপন বলতে কেউ নেই, তবুও…।’

কথাগুলি শুনে দম বন্ধ হয় আসে রাহুলের। তাহলে কি মৌসুমি মনে করতে চাইছে না তাদের সম্পর্কটা এখন কী? হতবাক দৃষ্টি নিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে দেখে রাহুল। যদি তাকে সাহায্য করার জন্য কেউ আসে। ওর মা-বাবা যে কেউ একজন।

‘কী হল রাহুল? তোমাকে এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?’ মৌসুমি তার হাত দুটি ধরে বলল।

‘তুমি আমার সঙ্গে বাড়িতে চলো। তোমাকে ছাড়া কিছু ভালো লাগে না। বাড়ি যেন গিলতে আসে। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায়। কেউ কারওর সঙ্গে কথা বলে না’, বলতে বলতে আবার কেঁদে ফেলে রাহুল।

‘আমি গিয়ে কী করব বলো তো? ভগবান ও বাড়িতে ওই পর্যন্ত অন্ন মেপেছিল আমার জন্য।’

‘বারবার অতীতটাকে ফিরিয়ে আনতে চাইছ কেন? যে গেছে সে কি আর ফিরে আসবে?’ বেশ চিৎকার করেই কথাগুলো বলল রাহুল। কথাগুলো যেন নিজের কানেই বড়ো বাজল রাহুলের।

চিৎকার শুনে ছুটে এল মৌসুমির মা-বাবা। কখন যে তার মধ্যে অধিকারবোধ জন্মাল সে নিজেই জানে না।

রেগেমেগে তার মা-বাবার উদ্দেশ্যে রাহুল বলতে থাকে, ‘আপনারা কেন সবকিছু জানাননি ওকে। আপনারাই তো জোর করেছিলেন। তাহলে ওকে বলেননি কেন? চুপ করে আছেন কেন? আমাকে মাটির পুতুল ভেবেছেন, যখন যা খুশি তখন তাই করাবেন। বোঝান ওকে সত্যটা কী। আমি আর পারছি না মৌসুমি। তুমি কি কিছুই বুঝতে পারছ না, নাকি আমাকে যাচাই করছ? প্লিজ দয়া করো আমাকে, চলো বাড়ি চলো। আমি মানছি আমার ভুল হয়ে গেছে, বিগত চার মাসে একবারও তোমার খোঁজ নিইনি। কিন্তু সঙ্গে এটাও তো সত্যি একটা মুহূর্তের জন্যও তোমাকে ভুলতে পারিনি।’ বলতে বলতে সকলের সামনেই মৌসুমিকে জড়িয়ে ধরে সে।

এতদিন রাহুল-যে সম্পর্কটাকে বোঝা ভাবত, সেটা যে তার কাছে কী তা সে আজ টের পাচ্ছে। মৌসুমির তাকে অস্বীকার করা, সেটা কোনওভাবেই মানতে পারছে না সে।

‘আবার কাঁদে। আরে কাঁদছ কেন? কী হয়েছে তোমার রাহুল? আমি তো ভলোই আছি এখানে। এখানে আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না।’

এমন সময় মৌসুমির বাবা অখিলেশবাবু রাহুলকে অন্য ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ‘চার মাস একটা খবর পর্যন্ত নাওনি। আমার মেয়ে আমার কাছে বোঝা নয়। তাকে দুবেলা খেতে দেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে। ঘাড় থেকে বোঝা নামাব বলে তোমার উপর মেয়ের দায়িত্ব দিইনি রাহুল। ভেবেছিলাম আমরা বুড়ো-বুড়ি আর ক’দিন। তারপর অন্তত মেয়েটাকে দেখার কেউ থাকবে।’

‘বাবা, তুমি রাহুলের সঙ্গে এইভাবে কথা বলছ কেন?’ কোনওরকম ভাবে মৌসুমি উঠে এসেছিল তাদের কাছে।

‘দাদার মৃত্যুর পর আমাদের এই আকস্মিক বিয়ে। তারপর থেকে আমিও তো ভালো নেই। শুধু ভেবেছি কী করব? ওর কী হবে? ও কীভাবে নেবে। প্রতিদিন একটু একটু করে মরছি। আর আপনারা ভাবছেন আমি চিন্তা করি না।’

‘রাহুল তুমি কি সত্যি কথা বলছ? তুমি মন থেকে মেনে নিতে পেরেছ এই বিয়ে? বলো আমাকে।’

‘ঘরে চলো তোমার সঙ্গে কথা আছে আমার।’, হয়তো বাবা-মায়ের জুড়ে দেওয়া সেই অধিকারের জোরেই মৌসুমির হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে রাহুল নিয়ে যায় পাশের ঘরে। দরজা বন্ধ করে দেয়। অল্পক্ষণের জন্য দুজনেই চুপ করে যায়।

জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় মৌসুমি। কাছে যায় রাহুল। বলতে থাকে—‘খুব কষ্ট দিয়েছি না তোমাকে? আচ্ছা তুমিও কি তাই মনে করো? আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই তোমার খোঁজ নিইনি? কিন্তু বিশ্বাস করো একটা মুহূর্তের জন্যও ভুলতে পারিনি তোমার উপস্থিতির কথা। তখন বুঝতেই পারিনি তুমি আসলে আমার কী? দাদা চলে গেছে কিন্ত আমি তো বেঁচে আছি। তোমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাব না। সারাজীবন তোমার সঙ্গেই থাকব। যেদিন তোমার মাথায় সিদুঁর দিয়েছিলাম সেদিন যে-শপথ নিইনি আজ তা নিলাম।’

কথাটা শোনা মাত্রই চিৎকার করে হাউহাউ করে কেঁদে ওঠে মৌসুমি। বাইরে থেকে মেয়ের কান্না শুনে পড়িমরি করে দরজা খুলে ছুটে আসেন মৌসুমির মা-বাবা। মেয়েকে চুপ করানোর জন্য এগিয়ে আসতেই হাত দেখিয়ে বাধা দেয় রাহুল। হাত জোড় করে বলে ‘দয়া করে আপনারা যান আমি সামলে নেব।’

‘মৌসুমি শোনো, আমার কথা শোনো। দ্যাখো আমার দিকে একবার দ্যাখো।’

তাকে কিছুতেই সামলাতে পারছে না রাহুল। একপ্রকার জোর করেই মৌসুমিকে চেপে জড়িয়ে ধরে রেখেছে কোনওমতে। ‘অভিমান হয়েছে? রাগ হয়েছে? বলো তুমি সত্যিই বোঝো না তোমার আমার সম্পর্ক?’

মৌসুমি শুধু একটা কথাই বলে চলে–‘না এটা হতে পারে না। আমি তোমার জীবনটা নষ্ট করে দিতে পারি না।’

রাহুল বাহুবলে আরও কাছে টেনে নেয় মৌসুমিকে। একেবারে বুকের কাছে। এতটাই কাছে যে তার প্রতিটি হূদয়ের স্পন্দন অনুভব করে সে। সে এক আলাদা অনুভূতি, যেটা সে আগে কোনওদিন অনুভব করেনি।

রাহুল বলতে থাকে-‘কে বলেছে তুমি আমার জীবন নষ্ট করেছ? তুমি জানো না তুমি আমাদের কাছে কী সোনা–বলতে বলতে মৌসুমির কপালে চুমু খায় রাহুল। যাকে গলার কাঁটা ভাবতাম সেটাই যে গলার হার হয়ে দাঁড়াবে তা কি আগে জানতাম? বুঝলামই যখন তখন…’

চুপ করে রাহুলের বুকে মাথা দিয়ে থাকে মৌসুমি। এখন সে অনেকটা শান্ত।

দুই হাত দিয়ে মৌসুমির মুখটি তুলে ধরে বলে, ‘যাবে তো আমার সঙ্গে, যাবে না? কিছু বলবে না? আচ্ছা ঠিক আছে বলতে হবে না।’

রাহুল বুঝে যায় মৌসুমির নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ।

 

ফেরা

বদলির চাকরি অনুজার। রিটায়ারমেন্ট-এর আর বছর ছয়েক বাকি। তার মধ্যে আবার নাগপুরে ট্রান্সফারের অর্ডার। চাকরির সুবাদে প্রায় তিরিশটা বছর ঘরসংসার, স্বামী-সন্তান ছেড়ে থাকতে হয়েছে তাকে। তিনবছর আগে কলকাতায় পোস্টিং হওয়ার সময়তেই ঠিক করেছিল এবার কলকাতার বাড়িতেই পাকাপাকিভাবে থেকে যাবে। হাজার হোক এখানেই তার পরিবার। ভিআরএস নেওয়ার ডিসিশন নিয়েই ফেলেছিল। সেইমতো আজ কদিন যাবৎ-ই অফিস আর ব্যাংক-এ ছুটোছুটি করতে হচ্ছে তাকে। স্বামী অলোক ইউনিভার্সিটি যাওয়ার পথেই তাকে ব্যাংক-এ ড্রপ করে দিয়ে গেছে। কাজ শেষ করে বাইরে বেরোতেই অনুজার চোখে পড়ে আকাশের ভয়ংকর করাল রূপ। রাশি রাশি কালো মেঘ সূর্যকে একেবারে গ্রাস করে ফেলেছে। মেঘ ভেদ করে বিদ্যুত্যের তীব্র ঝলকানি যেন মেঘের বুক চিরে বেরিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে এক লহমায় আকাশটা ভেঙ্গে পড়বে মাটিতে।

আর এক মুহূর্তও দেরি না করে একটা রিকশা ধরে সোজা বাড়ির পথে রওনা দেয় অনুজা। মাঝপথেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। সঙ্গে হাওয়ার ভীষণ রকম দাপট। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই রিকশা কোনওরকমে এগিয়ে চলে বাড়ির দিকে। ততক্ষণে ভিজে একেবারে কাকস্নান অবস্থা। রিকশা থেকে নেমে কোনওরকমে তালাটা খুলে সোজা বাথরুমে ঢুকে যায় অনুজা। তখনই কলিং-বেল-এর আওয়াজ কানে যায় তার। একবার নয় একাধিকবার। যেনতেনপ্রকারে শাড়িটা জড়িয়ে আইহোলে চোখ রাখতেই নজর পড়ে দরজায় পাশের বাড়ির মায়া। বেশ অবাকই লাগল অনুজার। এরকম ঝড়-জল মাথায় করে… কিছু ঘটল নাকি…!

দরজা খুলতেই হাঁফাতে হাঁফাতে ঘরে ঢুকে আসে মায়া। তার শরীরের বেশ খানিকটা অংশ ভিজে গেছে। চোখ একেবারে রক্তবর্ণ। কোনও কিছু বলার আগেই সামনে থাকা একটা তোয়ালে মায়ার দিকে এগিয়ে দেয় অনুজা। ‘কী হয়েছে এরকম অবস্থা কেন তোমার?’

‘রিনিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না অনুজা।’ শুনেই বুকটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে অনুজার।

‘কী যা-তা বলছ?’

‘সেই কোন সকালে বাজার যাচ্ছি বলে বেরিয়েছে, আড়াইটে বাজতে চলল এখনও ফেরেনি। ফোনেও পাচ্ছি না, লাগাতার সুইচড্ অফ আসছে। আমি একা মানুষ কী করি বলোতো?’

মায়ার স্বামী অনেক বছর আগেই গত হয়েছেন।

সংসার বলতে ছেলে নীহার আর ওই বউমা রিনি। ছেলে মাস ছয়েক হল কর্মসূত্রে দুবাইতে। ওখানে সেটেল করেই বউকে নিয়ে যাওয়ার কথা। তার মাঝেই এই বিপত্তি।

‘দাঁড়াও দাঁড়াও এখনি এত ঘাবড়িয়ো না। ঝড়জলে কোথাও আটকে পড়েছে হয়তো। বৃষ্টি থামলেই চলে আসবে।’ সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে অনুজা।

‘না গো প্রসূনরা পর্যন্ত খুঁজে এসেছে। আমি নিজে দু-বার বাজারের দিকটা দেখে এসেছি।’

‘কিন্তু বাজারের উপর দিয়ে তো একটু আগে আমি-ই ফিরলাম। কই কিছু চোখে তো পড়ল না। তবে বিশুর দোকানে একদল ছেলে কী যেন একটা বলা-বলি করছিল, কানে এল… কার বউ? কার বউ এরকম কিছু একটা… বৃষ্টির মাঝে ওইটুকু সময়ের মধ্যে আমিও ঠিক বুঝতে পারিনি।’ চোখেমুখে বিস্ময়ের স্পষ্ট ছাপ ফুটে ওঠে মায়ার। অনুজার মুখের দিকে হতভম্বের মতো তাকিয়ে থাকে মায়া। যেন ও-ই একমাত্র অবলম্বন। পারলে ও-ই পারবে তাকে উদ্ধার করতে। ফ্ল্যাট কালচারে অভ্যস্ত ব্যস্ত মানুষজন কেউ কারওর খোঁজ না রাখলেও এই তিন বছরে বেশ বন্ধুত্ব হয়েছে তাদের দুটির। তাই মায়ার আশার পারদটাও বোধকরি একটু বেশিই।

কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকার পরে অনুজা আবার প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা রিনির বন্ধুবান্ধবদের ফোন করে খোঁজ নিয়েছিলে?’

‘এখানে ওর বন্ধুবান্ধব কে-ই বা আছে। এই তো কটাদিন হল বিয়ে হয়েছে।’

‘হ্যাঁ, সেটাও ঠিক। ঝগড়া-টগড়া কিছু হয়েছিল নাকি?’

‘তুমি তো জানো, আমি ওকে কীভাবে আগলে আগলে রাখি। নীহার থাকে না বলে উঁচু গলায় কথা পর্যন্ত বলি না। পাছে মেয়েটা কষ্ট পায়।’ বলতে বলতে থেমে যায় মায়া। কী যেন ভাবতে শুরু করে। হঠাৎই চমকে উঠে অনুজার হাতদুটো চেপে ধরে, ‘কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি তো?’ মুখে একরাশ যন্ত্রণা নিয়ে সামনে রাখা চেয়ারে সজোরে বসে পড়ে মায়া। দুচোখ দিয়ে অনবরত জল গড়িয়ে পড়ে তার।

‘না না বাজার তো মোটে মিনিট দশেকের রাস্তা। সেরকম কিছু ঘটলে এতক্ষণে খবর পাওয়া যেত। তাছাড়া আমি তো ওখান দিয়েই এলাম, কিছু ঘটলে অ্যাটলিস্ট কানে তো আসত।’

রাত পর্যন্ত রিনির কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না। দশটা নাগাদ অনুজার স্বামী অলোকের সাথে মায়া থানায় একটা ডায়ারি লিখিয়ে এল। সেখানেও এক বিপত্তি, যিনি ডায়ারি লিখবেন তাঁর হাজারো রকম প্রশ্ন, ‘ছেলে-বউ কেন আলাদা থাকত? নিশ্চয়ই কোনও গড়বড় কেস… পণ দিতে পারেনি তাই বোধহয় আপনারা অত্যাচার করতেন? দেখুন কোনও ইয়ারের সঙ্গে পাত্তাড়ি গুটিয়ে বেমালুম ফুর্তিতে আছে। আপনারা অযথাই টেনশন করছেন আর রাতবিরেতে আমাদেরও টেনশন দিচ্ছেন।’

সকাল থেকে কেঁদে কেঁদে মায়ার বেহাল অবস্থা, তার উপর ওনার এইধরনের অপ্রত্যাশিত প্রশ্নবাণে যেন আরও ভেঙে পড়ে মায়া। এই নিয়ে পুলিশ অফিসারের সঙ্গে অলোকের প্রায় বচসা বাধতে বসেছিল।

‘এক্সকিউজ মি অফিসার। একজন মহিলার সঙ্গে আপনি এভাবে কথা বলতে পারেন না।’

‘আপনি কে মশাই? আপনি আমাকে বলে দেবেন আমি কার সাথে কীভাবে কথা বলব?’

‘অফকোর্স। প্রয়োজন পড়লে তা-ও করব।’ চ্যাঁচামেচি শুনে ভিতর থেকে আর এক উচ্চপদস্থ অফিসার সামনে আসতেই ব্যাপারটা সহজ হয়ে যায়। মেয়ের কলেজের প্রফেসার বলে কথা। ব্যাপারটা সেখানেই গুটিয়ে যায়। ওনাকে পার্সোনালি এই কেসটা দেখার জন্য অনুরোধও করে আসে অলোক।

বছর ঘুরে গেলেও এই কেসের কোনও সুরাহা করতে পারে না পুলিশ। এই ঘটনার পরে পরেই দুবাই থেকে মায়ার ছেলে এসে চার-পাঁচ মাস থানা-পুলিশ করে করে অবশেষে নিরাশ হয়ে সেও পুলিশের অনুমতি নিয়ে কাজের জগতে ফিরে যায়। রিনির বাপের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে মায়াদের ভীষণ ভালো সম্পর্ক। তারাও খুব ভালো করেই জানত রিনির অন্তর্ধানের পিছনে অন্তত তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিলক্ষণ কোনও হাত নেই। প্রথম প্রথম সকলে ভেবেছিল অপহরণ হলেও হতে পারে। কিন্তু কয়েকদিন পরেই সে ভুল ভেঙে যায় সকলের। কারণ অপহরণ হলে অন্ততপক্ষে অপহরণকারীরা টাকার দাবি করত। সেরকম কিছু ঘটেনি।

এতদিনে তাদের বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে হয়তো অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে মারা গেছে মেয়েটা। ট্রেস না পেয়ে হয়তো মর্গ থেকে বার করে আর-পাঁচটা বডির সাথে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আর নয়তো দুষ্কৃতীদের হাতে…।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খোঁজখবর করা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল সকলেই। এমনকী পুলিশও হাত গুটিয়ে নিয়েছিল এই কেসটা থেকে। মায়া-ই মেয়েটার আত্মিক বন্ধন ছিঁড়ে বেরোতে পারেনি। মাঝে মাঝেই রিনিকে নিয়ে তার কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠত। রিনির বাবা-মা তো কবেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ওই একরত্তি মেয়েটাকে দাদা-বউদির ভরসায় ছেড়ে গিয়েছিল সেই দাদা-বউদিও বোধকরি মেয়েটাকে নিয়ে অত ভাবে না, যতটা মায়া। কথা বলতে বলতে কোনও না কোনও কারণে রিনির প্রসঙ্গে ঠিক টেনে আনবেই। ‘কত শখ করে বাড়ির বউ করে এনেছিলাম মেয়েটাকে। নিজের পছন্দ নিয়ে কত গর্ব ছিল আমার। কোনওদিন একা কোথাও যেত না, সবসময় আমাকে সঙ্গে নিয়ে…। কী যে হয়ে গেল…’ অনুজা বোঝানোর আপ্রাণ চেষ্টা করলেও মনে মনে খুব ভালো করেই জানত এই ঘা সারাজীবনেও যাওয়ার নয়।

একদিন বিকেলে অনুজা আর মায়ার কথা হচ্ছিল। ‘দ্যাখো মায়া, মনে হয় না রিনি আর কোনওদিন ফিরে আসবে। দেখতে দেখতে তো অনেকগুলো দিন-ই কেটে গেল। এবার ছেলের একটা বিয়ের বন্দোবস্ত করো। ওর তো সারা লাইফটা পড়ে রয়েছে। এভাবে তো আর একা একা…’ অনুজার কথাগুলো শুনেই মুহুর্তে মায়া-র চোখমুখ কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেল। কিছুক্ষণ স্থির থাকার পর একটা ক্ষীণ স্বর কানে গেল অনুজার। ‘রিনির জায়গায় অন্য কেউ….?’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়া, ‘জানি নীহারের কথাও তো ভাবতে হবে। এখন ও যা ভালো বোঝে।’ মায়ার কথা শুনে একটুও অবাক হয়নি অনুজা। বরং মনে মনে ভেবেছে একটা মানুষকে কতটা ভালোবাসলে তবে তার থেকে এই ধরনের উত্তর আশা করা যায়। মায়ার মনের অবস্থা বুঝে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যায় অনুজা। এদিক-ওদিককার নানারকম কথায় ব্যস্ত করে তোলে মায়াকে।

‘ওহ্ পাওলির বিয়ের গিফট-টা তোমাকে দেখানো হয়নি না?’

‘দেখেছ, একদম মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল, পাওলি-র বিয়েতে তোমার আবার দিল্লি যাওয়ার আছে না। কবে যেন বলেছিলে। ছাব্বিশ না সাতাশ কী যেন একটা…’ মনে করতে পারে না মায়া।

‘আরে সামনের সপ্তাহেই তো। বুধবার রাতে ট্রেন। দাঁড়াও তোমাকে জিনিসটা দেখাই।’ বলে মিনিট খানেকের মধ্যেই জিনিসটা নিয়ে এসে মায়ার হাতে ধরিয়ে দেয় অনুজা।

‘বাহ্, সেট-টা খুব সুন্দর হয়েছে। খুব ভালো মানাবে ওকে।’

সময়ের চাকা কখন যে কোনদিকে ঘোরে তা বোধকরি স্বয়ং উপরওয়ালারও বোধগম্যের বাইরে। অনুজার বড়দির ওই একমাত্র মেয়ে পাওলি। বাঙালি পরিবার হলেও বিগত বাইশ বছর দিল্লিতে থেকে ওখানকার রঙেই রাঙিয়ে নিয়েছে নিজেদের। অনুজারা দু’দিন আগেই বড়দির বাড়ি পৌঁছে গিয়েছে। আলাদা করে একটা মেহেন্দির অনুষ্ঠানও রাখা হয়েছে। ডিজে-র তালে তালে সকলে মেতে উঠেছে। অনুজারও বেশ ভালো লাগছিল। এমন সময় জনাকয়েক রব তুলল, ‘পাম্মি গেল কোথায়? এখনও এসে পৌঁছোয়নি? ও না এলে কী মেহেন্দির অনুষ্ঠান জমে?’

‘এই পাম্মি-টা আবার কে রে? বিশেষ কেউ?’ দিদি অনুভাকে প্রশ্ন করে অনুজা।

‘আরে না-না, দিল্লি, মুম্বইতে আজকাল মেহেন্দির অনুষ্ঠানে লাইভ গানের বেশ একটা চল হয়েছে। পাম্মি ওই একটা অর্কেস্ট্রা সেটের সঙ্গে গান করে। বেশ ভালো গলা মেয়েটার। একটা শোয়ের জন্য তিন হাজার টাকা করে নেয়।’ হাসতে হাসতে জবাব দেয় দিদি অনুভা।

মিনিট দশ বাদে বেশ একটা সুরেলা, মধুর কণ্ঠ কানে আসে অনুজার। সেই সুরকে লক্ষ্য করে দৃষ্টিনিক্ষেপ করতেই এক ঝটকায় মাথাটা ঘুরে যায় অনুজার। অনায়াসেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, ‘রিনি’!

অনুভা মেহেন্দি লাগাতে লাগাতেই মুখটা ঘুরিয়ে বলে, ‘রিনি! সেটা আবার কে?’

‘এযে অবিকল রিনি। আমার পাশের বাড়িতে মায়া আছে না। তুই তো দেখেছিস। ওর বউমা, বছরখানেক হল নিখোঁজ। তারপর আর…’ অর্ধেক কথা মনের মধ্যেই চাপা রয়ে গেল অনুজার। সকলে মেহেন্দি আর গানবাজনার মধ্যে ডুবে রয়েছে। পাম্মিও গাইতে গাইতে পাওলির পরিবারের একএকজনকে স্টেজে ডেকে নিয়ে বেশ জমিয়ে নাচাচ্ছে। অনুজার দিকে এগিয়ে আসতেই পাম্মির অমন চাঁদপানা মুখটা কেমন যেন তামাটে হয়ে গেল।

অনুজার মুহূর্তও লাগেনি ব্যাপারটা আঁচ করতে। রিনি নিশ্চয়ই তাকে চিনে ফেলেছে। কিন্তু ও যদি সত্যি সত্যি রিনি-ই হয়ে থাকে, তাহলে এখানে কী করছে? ছোটোখাটো এরকম একটা অর্কেস্ট্রা গ্রুপ-এ…? এটা কীভাবে সম্ভব? এমন হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে অনুজার মনে। মনে মনে ঠিক করে যে ভাবেই হোক একবার মেয়েটার মুখোমুখি হতেই হবে। আসল ব্যাপারটা কী, তাকে জানতেই হবে। সেই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল অনুজা। মেহেন্দি লাগাতে বসেও চোখ আটকে রইল সেই পাম্মির দিকেই।

মেহেন্দির পরেই খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। খাওয়ার ফাঁকেই মেয়েটা কোথায় যেন সরে পড়েছে। মেয়েটার খোঁজে অনুজার চোখ নিরন্তর এদিক-ওদিক করতে থাকে। অনুষ্ঠান শেষে যে-যার বাড়ির দিকেও রওনা দিয়েছে। এমন সময় হঠাৎ-ই দিদি অনুভাকে হন্তদন্ত হয়ে ঘোরাফেরা করতে দেখে অনুজা। ‘কি হল এভাবে এদিক-ওদিক করছ কেন?’

‘আর বলিস না। পাম্মিকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। ওর টাকাটাও তো দেওয়ার ছিল। কত কাজ ওদিকে।’

‘ঠিক আছে তুমি যাও। আমি থাকছি এখানে। টাকা নিতে এলে দিয়ে দেব।’

কিছুক্ষণ পর একটা পায়ের শব্দ কানে আসে অনুজার। ধীর পায়ে কেউ এগিয়ে আসছে সেই ঘরের দিকেই। ধারণা একদম ঠিক।

‘ম্যাডাম, আমার টাকাটা।’

‘রিনি, টাকাটা আমার কাছে আছে। ভিতরে এসে নিয়ে যাও।’

একটু সাহস সঞ্চয় করে ঘরে ঢুকে পাম্মি জবাব দেয়, ‘আপনি বোধহয় ভুল করছেন, আমার নাম পাম্মি।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু তবু কেন জানি না মনে হচ্ছে তুমি আমাদের সেই রিনি-ই। যার জন্য তার শাশুড়ি আজও পথ চেয়ে বসে আছে। যদি কখনও তার আদরের বউমা…’

‘এসব শোনার সময় আমার নেই। টাকাটা দিন তাড়া আছে।’ একটু কঠোর হওয়ার চেষ্টা করে পাম্মি। অনুজার হাত থেকে টাকার খামটা নিয়ে উদভ্রান্তের মতো বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।

পাম্মি চলে যাওয়ার পরও অনুজা সেখানে দীর্ঘক্ষণ বসে রইল। মাথায় কতকিছু যে ঘুরপাক খাচ্ছে তার। মনটা কেমন যেন ভার ভার লাগছে। রাতেও ঠিক করে ঘুমোতে পারেনি অনুজা। চোখ বুজলেই সেই সরল সাধাসিধে মুখটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। বারবার যেন কেউ কানের কাছে বলে চলেছে, ‘ওর জায়গায় অন্য কেউ?’

সকালে একদম আলাদা পরিবেশ। বিয়ের দিন বলে কথা। চতুর্দিকে হইহুল্লোড়, ব্যস্ততা। সাজো সাজো রব। তার উপর সানাইয়ের সুর। মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠেছিল অনুজার। সব ভুলে সেও বিয়েতে মেতে উঠেছিল। মেক-আপ করাতে বিউটিশিয়ানের পাশে বসতেই সে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে উঠল, ‘দিদি ম্যায় রশ্মি। আপনি-ই অনুজা দিদি আছেন, না?’

অনুজা বেশ চমকে গেল, তাকে কী করে চিনল রে বাবা? এর আগে কোথাও। দেখতেও বেশ। বাঙালির সঙ্গে থেকে থেকে বাংলা হিন্দি মিশিয়ে একটা আলাদাই ভাষা তৈরি করেছে এরা। সাঁতপাঁচ ভাবতে থাকে অনুজা। এমন সময় সে আবার বলে ওঠে, ‘দিদি কাল দোপহর কো কুছক্ষণ কে লিয়ে বাহার আসতে পারেন কী? আপসে জরুরি কাম হ্যায়।’

‘আমার সাথে, মেরা মতলব হ্যায় কে মুঝ সে? ম্যায় তো ইহা রহতি ভি নেহি অউর কিসি কো পহচানতি ভি নেহি…’

‘দিদি উয়ো পাম্মি আছে না ও আপনার সাথে দেখা করতে চায়। উয়ো ভি আকেলে মে। একদম আমার পাশেই থাকে, আপনি যাবেন দিদি?’

মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায় অনুজা। মনে মনে ভাবে পাম্মি দেখা করতে চেয়েছে মানেই– সে ঠিক তার অনুজা আন্টিকে চিনতে পেরেছে।

পরের দিন সময়মতো রশ্মির সাথে বেরিয়ে পড়ে অনুজা। এই নিয়ে আগে থেকেই দিদি অনুভার সঙ্গে সাঁট করে রেখেছিল সে। কথাই ছিল তারা বেরোনো মাত্রই ড্রাইভার সদানন্দ গাড়ি নিয়ে তাদের পিছু পিছু যাবে। যদি কিছু বেগতিক দেখে সদানন্দ সামলে নেবে। রশ্মির অটোতে ওঠার কথা বলতেই বেশ ভয় ভয় করছিল অনুজার, পাম্মি-র সাথে দেখা করতে যাওয়ার চক্বরে যদি কোনও ঝামেলায় ফেঁসে যায়। পরে সদানন্দের কথা ভেবে ভয় কেটে যায়। অটোতে উঠে বসে। মিনিট দশ পরে অটোটা একটা বস্তির সামনে এসে দাঁড়াতেই মুখে রুমাল চাপা দিয়েই রশ্মিকে জিজ্ঞাসা করে অনুজা, ‘তোমরা এখানে থাকো?’ রশ্মি ধীর গলায় জবাব দেয়, ‘দিদি, আমাদের মতো….’

‘ঠিক আছে।’ আরও কিছু বলার আগেই রশ্মিকে থামিয়ে দেয় অনুজা। অটো থেকে নেমে মিনিট পাঁচেক ভিতরে গিয়েই একটা দরজা ধাক্বায় রশ্মি। দরমার বাড়ি। একেবারে হাইড্রেনের গা ঘেঁষে রয়েছে। খানিকটা হেলেও পড়েছে। রাস্তার দুপাশে থরে থরে হাইড্রেন থেকে নোংরা তুলে রাখা। দুর্গন্ধে গা ঘিনঘিন করে ওঠে অনুজার। কোনওরকমে সামলে নেয় নিজেকে। অভিজ্ঞ চোখ পরখ করতে থাকে সবকিছু। ঠিক তখনই দরজাটা খুলে দেয় পাম্মি। হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গিয়ে একটা ভাঙা চেয়ারে বসতে দেয়।

‘তাহলে আমার ধারণাই ঠিক। কী রিনি তাই তো?’ কোনও জবাব দিতে পারে না পাম্মি। মাথা নীচু করে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে অনুজার সামনে। চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। রিনির হাতটা ধরে সামনের চৌকিতে বসায় অনুজা। মিনিট কয়েক এভাবেই কেটে যায়। কাঁদলে খানিক হালকা হবে এই ভেবে অনুজাও বাধা দেয়নি। এর মাঝে চা নিয়ে ঢুকে পড়ে রশ্মি। দু-জনকে দু-ভাঁড় চা দিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে। চা খেতে খেতে ঘরের ভিতরটায় ভালো করে চোখ বুলিয়ে নেয় অনুজা। আসবাব বলতে এই একটা চৌকি আর একটা আলনা। এক কোনায় রাখা রয়েছে একটা স্টোভ আর কয়েকটা বাসনপত্র। অনুজা তার ক্ষুরধার দৃষ্টি দিয়েই রিনির অবস্থাটা খানিক আঁচ করে ফেলে। চেহারাতেও দৈন্যতার ছাপ ফুটে উঠেছে। চোখের নীচে কালি পড়েছে। পরনের কামিজটাও দু-এক জায়গায় ছেঁড়া। নিজের মনটা ঘোরায় অনুজা। চায়ে চুমুক দিতে দিতেই প্রশ্ন করে, ‘এবার বলো তো এখানে কী করে এলে? কেউ কি জবরদস্তি…?’

ততক্ষণে পাম্মি নিজেকে খানিক সামলে নিয়েছে। খুব ধীরভাবে বলে ওঠে, ‘না কেউ জবরদস্তি করেনি। আমি স্ব-ইচ্ছায় চলে এসেছি।’

রিনির কথা শুনে অবাক হয়ে যায় অনুজা। বোকার মতো তাকিয়ে থাকে ওর মুখের দিকে। মেয়েটা এসব কী বলছে নিজের ইচ্ছায়…! মাথাটা গুলিয়ে যাচ্ছিল অনুজার। তাকে এতদিন সে যেভাবে চিনত, জানত– মেলাতে পারছিল না কিছুতেই। ওদিকে এতদিন পরে কাছের একজনকে পেয়ে জমাট বাঁধা আবেগগুলো ঝড়ের গতির মতো বেরিয়ে আসছিল রিনির মুখ দিয়ে। ‘ছোটো থেকেই ইচ্ছে ছিল বড়ো গায়িকা হব। স্কুলকলেজেও সবাই আমার গানের গলার খুব তারিফ করত। যতদিন বাবা-মা ছিল ততদিন একরকম ছিলাম, তারপর দাদা-বউদি একপ্রকার জোর করেই আমার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়েটা দিয়ে দিল। ধরেই নিয়েছিলাম আর-পাঁচটা মেয়ের মতো আমার এত দিনের সাজিয়ে রাখা স্বপ্নটাও চারদেয়ালের মধ্যে আটকে রয়ে যাবে। ভাবলেই দম বন্ধ হয়ে আসত। কেমন যেন একটা জেদ চেপে বসেছিল। নিজেকে প্রমাণ করবার। সুযোগও পেয়ে গেলাম। বিয়ের পাঁচ মাস পরে নীহার দুবাই চলে গেল। সংসারে তখন মা আর আমি। তখনও ভাবিনি এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে বসব। ও যাওয়ার পর শূন্যতা যেন আরও ঘিরে ধরল আমায়। একাকীত্ব কাটাতে আঁকড়ে ধরলাম গানকে। দিনরাত ওই নিয়েই পড়ে থাকতাম। সময় তো কাটাতে হবে। ঠিক ওই সময়েই স্বাতীর সাথে আলাপ।’

‘স্বাতীটা কে?’

‘ওই যে দিনকতকের জন্য প্রসূনদাদের বাড়িতে এসেছিল না। মা তখন নিয়ে গিয়েছিল ওদের বাড়িতে। ওনার মুখেই শুনেছিলাম দিল্লিতে কোনও একটা বড়ো চ্যানেলে নাকি গানের অডিশন শুরু হচ্ছে। একবার সিলেক্ট হতে পারলেই আর পিছন ফিরে তাকাতে হবে না। টিভিতেও সেই অডিশনের সম্পর্কে জানতে পারি। আর ধরে রাখতে পারিনি নিজেকে। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস দেখুন, দুদিন ধরে দীর্ঘ লম্বা লাইনে অপেক্ষা করতে করতে হঠাৎই একজন অসুস্থ হয়ে পড়ে যাওয়াতেই বিপত্তি ঘটে গেল। উত্তেজিত জনতার মারামারি, পুলিশের লাঠিচার্জ– অডিশনটাই আর দেওয়া হল না।’ ঘরটার মধ্যে কেবল একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল।

এতক্ষণ মন দিয়ে শুনছিল অনুজা। এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, ‘তোমার গানের গলা খুব সুন্দর, এটা অস্বীকার করার জায়গা নেই। কিন্তু তাই বলে তুমি যে পদক্ষেপ নিয়েছ সেটা কি ঠিক? তুমি তো শ্বশুরবাড়িতে থেকেও তোমার স্বপ্নপূরণ করতে পারতে। মায়াকে আমি যতদূর চিনি-জানি, ও কোনওদিন বাধা দিত না।’

‘তখন বুঝিনি, কতবড়ো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে চলেছি। আমার জীবনটাই নষ্ট হতে বসেছে। কী যে হল সেদিন… না হলে ওইরকম স্বামীকে ছেড়ে মাকে ছেড়ে চলে আসি কখনও। নীহারও কতবার ফোনে বলেছে ‘আর ক’টা দিন একটু কষ্ট করো। আমি যত তাড়াতাড়ি পারি তোমাকে আমার কাছে নিয়ে চলে আসব।’ তবুও কেন যে… শুধু মনে হতো সংসারে থাকলে আমি জীবনে কিছু করতে পারব না। আমাকে এখান থেকে বেরোতেই হবে। আসলে সবই আমার নিয়তি।’

‘বুদ্ধিবিভ্রম বলো বা নিয়তি-ই বলো ভুল তো তুমি করেইছ। আচ্ছা একটা কথা বলো তো শুধুমাত্র অডিশন দেওয়ার জন্য একটা অজানা-অচেনা শহরে কোনও চেনাপরিচিতি ছাড়াই হুট করে চলে এলে? এটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য মনে হল না!’

‘আমার কলেজের এক বান্ধবী থাকে এখানে। ওর ঠিকানা সম্বল করেই বেরিয়ে পড়ি। এখানে এসে দেখি ওরাই একটা ঘরে কোনওরকমে দিন গুজরান করছে। সেখানে আবার বাড়তি আমি।

কষ্ট করে কটাদিন থেকে গেলাম ওখানে। একটু সুযোগের জন্য এই স্টুডিয়ো থেকে সেই স্টুডিয়ো– পাগলের মতো ঘুরে বেড়িয়েছি। তখনই বুঝেছি এই দিল্লি, মুম্বইয়ের মতো শহরে কিছু না দিলে কিছু পাওয়া যায় না। আর নয়তো নামিদামি বাবা-মায়ের ট্যাগ-টা গায়ে লেগে থাকতে হবে। তবেই এখানকার মাটিতে টিকে থাকা সম্ভব। যা টাকাপয়সা এনেছিলাম ততদিনে সব শেষ হয়ে গেছে। মাঝে সুনীতার থেকেও বারকয়েক টাকা ধার করেছি। আর কোনও রাস্তা না দেখে বারে গান গাওয়া শুরু করি। ওখান থেকেই অর্কেস্ট্রা গ্রুপ-এর সঞ্জয়ের সঙ্গে আলাপ। তারপর থেকে এভাবেই চলছে। এখন এটাই আমার ঠিকানা।’ নিরাশা ঘিরে ধরে রিনিকে।

‘এই জীবন তো স্বেচ্ছায় বেছেছ। এখন আর আপশোশ করে লাভ কী?’ জবাব দিতে পারে না রিনি। জবাব দেওয়ার মতো আছেটাই বা কী! তার ভুলের মাশুল যে তাকেই গুনতে হবে। মনে মনে ভাবে এখন শহরের প্রান্তে এই নোংরা বস্তি-ই তার ঠিকানা। জীবনের শেষ দিনটা পর্যন্ত এখানেই কাটাতে হবে তাকে। রিনির মনের অবস্থা বুঝে রাগ সংবরণ করে খানিক নরম হওয়ার চেষ্টা করে অনুজা। গলা নামিয়ে ধীর ভাবে বলে, ‘অডিশনের পরেও তো ফিরে যেতে পারতে?’

‘কোন মুখে যেতাম আন্টি, সব পথ যে আমি নিজে বন্ধ করে এসেছি। একবার অবশ্য বাড়িতে ফোন করেছিলাম। ফোনটা বেজে বেজে কেটে গেল। আর সাহস হয়নি করার।’

‘তা এবার কী করবে ভেবেছ?’

রিনির ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি লক্ষ্য করে অনুজা। সে হাসি আনন্দের নয়, বিদ্রুপের। ‘ব্যস বাঁচা-মরা সব এখন এখানেই। আর কোনও রাস্তাও তো খোলা নেই আমার কাছে। মা আমার জন্য এখনও অপেক্ষা করে আছে জেনে, মনটা আনন্দে ভরে গেল। এ পৃথিবীতে কেউ তো আছে, যে আজও আমাকে মনে রেখেছে। তাতেই আমার শান্তি। মা-র কথা শোনার পর থেকেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। প্লিজ আন্টি, এব্যাপারে ওনাকে কিছু জানাবেন না। আমি চাই না ওনার কাছে আমার ছবিটা বদলে যাক। জানেন আন্টি মাকেও দু-বার ফোন করেছি। কিন্তু সাহস হয়নি কথা বলার। মা হ্যালো বলতেই ভয়ে ফোনটা রেখে দিয়েছি। ভয় লেগেছে, মা যদি বলে দেয় মায়ের কাছে আমি মৃত…। নীহারকেও…শুধু একটু গলা শোনার জন্য… কতবার ভেবেছি সবকিছু খুলে বলি ওকে, সেই সৎসাহস দেখাতে পারিনি। ভয়ে আঁতকে উঠেছি, আমার গলা শুনলেই যদি আমার অস্তিত্বকেই অস্বীকার করে বসে। সহ্য করতে পারতাম না। একদিন তো ধরা পড়তে পড়তে বেঁচে ছিলাম। ফোন করি অথচ কথা বলি না। এতেই ও ধরে ফেলেছিল, ওটা আমি, তারপর থেকে আর…’, বলতে বলতে কেঁপে কেঁপে উঠছিল রিনি। অপরাধবোধের স্পষ্ট ছাপ তার চোখেমুখে ছেয়ে যায়। সান্ত্বনা দিতে রিনির হাতদুটো চেপে ধরে অনুজা। কী যেন চিন্তা করে বলে, ‘আর একবার চেষ্টা করে দ্যাখো না। হতে পারে ওরা তোমাকে গ্রহণ করবে না বা হয়তো… … কিছুই জানি না আমি। কিন্তু তবু বলছি এই আপশোশ তো অন্তত থাকবে না ‘ইস্ যদি একবার চেষ্টা করে দেখতাম।’ কাঁপা গলায় রিনি কোনওরকমে তার অনুজা আন্টিকে জিজ্ঞাসা করে, ‘ফিরে যেতে বলছেন আমাকে? কিন্তু কোন্ মুখে যাব?’

‘ঠিক যেমন করে বাড়ি ছেড়ে এসেছিলে, সেইভাবেই’ এইবার একটু রুক্ষ্ম শোনায় অনুজাকে। কেঁদে ফেলে রিনি। ‘রোজ যে তিলতিল মরছি, এটা তারই সাজা আন্টি।’

রিনিকে কাঁদতে দেখে তার মাথায় হাত রাখে অনুজা। ‘আমার কথাটা হয়তো শুনতে খারাপ লাগছে তোমার। কিন্তু আমি তোমার ভালোর জন্যই বলছি, ফিরে যাও। গিয়ে সব সত্যিটা খুলে বলো ওদের। তারপর সবই ভগবানের ইচ্ছে। অন্তত ভুল শোধরানোর একটা চেষ্টা তো করো। তোমাদের প্রতি একটা আন্তরিক টান আছে বলেই বলছি’, বলতে বলতে উঠে পড়ে অনুজা। তারও চোখে জল ভর্তি। ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে গাড়িতে উঠে পড়ে। সদানন্দ গাড়ি ঘুরিয়ে নেয় বাড়ির দিকে। মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে যায় তার। সারাক্ষণ মনের মধ্যে ঘুরতে থাকে, ‘মেয়েটা কী করবে, কে জানে।’ মিনিট দশেক পর বাড়ি ফিরলে সবাই তার উদাসীনতার কারণ জিজ্ঞেস করে। এড়িয়ে যায় সে।

বিয়ের পরেও আরও কয়েকটা দিন দিল্লিতে থাকার কথা ছিল অনুজার। তারপর ওখান থেকে গোয়া। কোথাও গিয়ে যেন শান্তি পাচ্ছে না সে। সারাক্ষণ ওই একই চিন্তা। কথাবার্তার মাঝে ফোন নাম্বার-টাও নিতে ভুলে গেছে। নিজেকেই দূষতে থাকে সে। নাম্বারটা নিলে অন্তত যোগাযোগ তো করা যেত। অবশ্য দিদির থেকে নিতে পারত। কিন্তু কাউকে আর ঘাঁটাতে চায়নি সে।

দিন পনেরো পর গোয়া থেকে বাড়ি ফিরে আসে অনুজা। ফিরেছে একেবারে কাকভোরে। তখনও কেউ ওঠেনি। বাড়িতে তেমন বাজার-দোকান না থাকায় প্রয়োজনীয় কয়েকটা জিনিস নিতে বেলার দিকে বেরোতেই মায়াকে দেখতে পেল সে। বাজার সেরে ফিরছে। বেশ হাসিখুশি লাগছে মায়াকে। অনুজাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে আসে তার দিকে। ‘ঘোরা হল তোমার? তুমি জানো এর মাঝে কী হয়েছে? আমার বউমা গত পরশু বাড়ি ফিরে এসেছে।’ এক মুহুর্তে মনটা ভীষণ রকম ভালো হয়ে যায় অনুজার। মনে মনে ভাবে তার বোঝানো তাহলে বিফলে যায়নি। রিনি তার আন্টি-র কথা রেখেছে। সে পেরেছে জীবনের মূল স্রোতে ফিরে আসতে।

ভাবনায় বাধ সাধে মায়া। কানে কানে বলে ওঠে, ‘তুমি তো ঘরের লোক অনুজা, তোমার কাছে আর কী লুকোব। এমন মেয়ে, কাউকে কিছু না জানিয়ে চলে গিয়েছিল দিল্লি, গানের অডিশন দিতে। এরকম ভুল কেউ করে বলো? ছোটো মেয়ে। যদি কিছু একটা অঘটন ঘটে যেত, তাহলে তখন তুই কী করতিস! বাবুও আসছে। ও-ও বলেছে গান-টান যা করার সব এখান থেকেই করতে হবে। একা একা কোথাও যাওয়া চলবে না। তুমি বলো কী দুঃসাহস! একা একা…’ থেমে যায় মায়া। কী যেন ভেবে নেয়। তারপর আবার বলতে শুরু করে, ‘কিন্তু পাড়াপড়শিদের তো আর এসব বলা যায় না। এমনিতেই তো কম কুৎসা রটায়নি তারা। কানপাতা দায় হয়ে গিয়েছিল। ওদের সকলকে বলেছি অ্যাক্সিডেন্ট-এ স্মৃতিশক্তি চলে গিয়েছিল। মারাঠি একটি পরিবারের দয়ায় হাসপাতালে ছিল। সবকিছু মনে পড়তেই ফিরে এসেছে।’ অনুজা আশ্চর্যান্বিত হয়ে তাকিয়েছিল মায়ার মুখের দিকে।

আকাশটা আজ অনেক পরিষ্কার। ঝড়-ঝঞ্ঝা-মেঘ কাটিয়ে সূর্য যেন মাথার উপর আবার জ্বলজ্বল করছে।

 

অনুভব

এক

বট গাছটার শিকড়ের কিছু অংশ নদীর গর্ভে, বাদবাকি মাটিকে ধরে রেখেছে। নদীর জল আছড়ে পড়ে আঘাত করছে সেই মাটিকে প্রতিটি জলের তোড় দিয়ে। মাটির বুকের প্রাণকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে চলেছে। বট গাছটার পিছনে ফাঁকা মাঠটার ওপর কালীথান। দরজাবিহীন টিনের দোচালা মন্দির, তার মাঝখানে বিরাট শ্যামাকালী। আবছা অন্ধকারে তাকে দেখলে, গায়ের রক্তের তাপ কিছুটা কমে যায়। মন্দিরের ফাঁকা মাঠটা পেরিয়ে বিরাট বাঁশঝাড়, তারপর জেলেদের গ্রাম ছাতিয়াতে ঢোকবার মাটির রাস্তা। গ্রামের গা ঘেঁষে টাঙ্গন একটু বৃত্তাকারে ঘুরে এই মহানন্দাতে এসে মিশেছে। মোহনার কাছেই আইহো হাট, ঝকমকে কাচের চুড়ি, শয়ে শয়ে ধান পাটের গরুর গাড়ি ভর্তি হয়ে থাকে।

মহানন্দার ওপারে বাংলাদেশের রাজশাহি জেলা। আর ছাতিয়া, কালীথান, টাঙ্গন, মহানন্দার এপার-সব মালদহ। ওপারের বাস্তুভিটা হারানো মানুষ এপারে। আর এপারের প্রায় তীরের কাছাকাছি মহানন্দার বুকে বিএসএফ-এর প্রাচীর।

ছাতিয়া গ্রামে অন্ধকার ভোর রাত থেকেই ব্যস্ততা। সার সার মাছ ট্রাকে করে আইহো গ্রামের হাটের বুক চিরে, চওড়া পাকা পিচের রাস্তা দিয়ে টাঙ্গনের উপর পাকা সেতুকে ছুঁয়ে, চলে যায় মালদা টাউনে।

কালীথানকে একটু পিছনে ফেলে, মাধো, ভাইয়ের হাত ধরে টাঙ্গনের পাশে দাঁড়ায়, চিৎকার করে ডাকে, ‘ওবাপ স্যারা রেত তো, বাঁশের খড়া গেড়ে শরীর কালি করলা, তা ওনারা জ্যালে পড়ল?’

মাধোর বাবার মুখ হাসিতে ভরে ওঠে ‘ওরে মাখাকি। সারা রেত লৌকার মধ্যি জেগি কি আমি এ্যাকাশের তারা দ্যাখলাম, নাওয়ে আয়ঃ দ্যাখ।’

মাধো তর তর করে নেমে আসে নৌকার কাছে। নাওয়ে ভর্তি মাছ দেখে, আনন্দে তার চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে। আনন্দের উচ্ছ্বাসে বলে ওঠে, ‘আমি লয় মাখাকি, বলি তোর ম্যাথার কুনো বুদ্ধি লেই। তা তুই তো, দশ বুছরেই বাপখেয়ি বুদ্ধিটার শোকনো মোরভূমি কইরি ফেলছিস। ম্যাথায় কি তোর কিছু লেই? আগি না গেলে মহাজনের লুড়ি তো সব লিয়ে যাবে।’

মাধোর বাবা অস্বস্তি বোধ করে বলে, ‘আমি কি সুত্যি সুত্যি গাল দিই। ভালোবেইসে

একটু ডাকি।’

‘নে নে আর কাঁদতি হবে না। মা মইরে গেলি তুই যে আবার বে না করি কোনও অভাগি মাগিকে বছর বছর বিয়াতে দেস্নি এই আমাদির ভাগ্যি।’

মাধোর বাবা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ক্ষেপে ওঠে তার মেয়ে, ‘কিগো বাবা, তুমার ক্যানে গাঙের মাটি সাধাইছে নাকি যে কিছু শুনবার পারো না?’

মাধো আর তার ভাই নৌকায় উঠে বসতেই তাদের বাবা খড়ার পোতা বাঁশের থেকে দড়ি খুলে দেয়। নৌকা এগিয়ে যায় আইহো হাটের দিকে। হঠাৎ পেছন ফিরতেই মাধোর খেয়াল পড়ে, খড়ার জাল জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়নি। কাছের পারে সে নৌকা থেকে নেমে পড়ে, ‘বাপরে তুই চাইলো যা। আমি খড়ার জ্যাল জলে ডুইবে দে, হাটে যাবুখন।’

খড়ার বাঁশের দড়ি আস্তে আস্তে সে ছাড়তে শুরু করে। ধীরে ধীরে দুই বাঁশের মাঝে ত্রিকোণাকৃতি বাঁধা জাল জলের ভেতর ডুবে যায়। দূরে তার বাবার নৌকা নদীর বাঁকের মুখটা দিয়ে বেঁকে যাচ্ছে। এক্ষুনি ওটা হারিয়ে যাবে।

মাধো পারের ওপরে উঠে আসে। তার দু’পা কাদায় ভর্তি। জেলের মেয়ের কাছে এটাই সোনার সাজের মতো প্রিয়। সে সযত্নে ও সস্নেহে দেখে কাদার রং। হাঁটতে হাঁটতে আসে কালীথানের কাছে, মাটিতে হাঁটুগেড়ে বসে, মাথা ছোঁয়ায়। তার মুখে হাসি, মনে মনে গত রাতের স্বপ্নকে একটু ঝালিয়ে নেয়। গতরাতে থানের কালী তাদের হোগলা দেয়ালের মাটি নিকোনো ঘরে গিয়ে তাকে বর দিয়ে এসেছে, ‘তুই কুনো দিন বেধবা হবি না মেধো।’

মাধো চারিদিকে দেখে নেয়, না চারপাশে কেউ নেই। মনে মনে ভাবে, পুজো দেওয়া, মানত করা ছাড়া কে আর আসবে। কিন্তু সে প্রতিদিন এখানে আসে, নিস্তব্ধ মাঠে মাটির বিশাল কালীমূর্তির সঙ্গে কথা বলে। উত্তরটাও নিজেই আশা করে নেয়।

সে সোজাসুজি কালীমূর্তির চোখের দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে। তারপর লজ্জায় চোখ নামিয়ে বলে ওঠে, ‘মা, তুই দ্যাখছি, আমার মতো বেহায়া। নুজ্জা শরমের মাথা খেইয়ে বসে আছিস।’

মাধো আর মূর্তির দিকে না তাকিয়ে দৌড়ে মাঠটা পার হয়ে যায়। বাঁশবনে ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। কালীথানের দিকে তাকায়। নদীর জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ কানে আসছে, বটগাছের কয়েকটা শেকড় অসহায়ের মতো জলের দাপট সহ্য করছে। সে থানের দেবতার উদ্দেশ্যে বলে, ‘তুই থাক মা আমি হাটে যাই। না গেলি, বুড়ো বাপ বেটা এ্যাকা গাইড়ে পইরে না যায়।’ বলেই তাড়াহুড়ো করে বাঁশঝাড়ের ভেতর দিয়ে শুকনো পাতার উপর দিয়ে ‘মরমর’ শব্দ তুলে, বাঁদিকে কোনাকুনি ভাবে এগিয়ে যায়। ভোরের হাওয়ায় বাঁশঝাড়ের ভেতর, বাঁশের পারস্পরিক ঘর্ষণের এক অপার্থিব শব্দ তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে থাকে।

মাধো কোনও দিকে খেয়াল না করে, তাড়াতাড়ি হাঁটতে হাঁটতে প্রায় পৌঁছে যায়, আইহো হাটের কাছে। দূর থেকে হাটের মানুষের শব্দ তার কানে আসে।

শহুরে মহাজনরা আসবার পর থেকে, আইহো হাট এখন এই মঙ্গল, শনিবার ছাড়াও অন্যান্য দিন বসে এবং একমাত্র এই জেলেদের মাছের জন্যেই। দরদাম নিয়ে কথাবার্তায় ভর্তি হয়ে থাকে হাটের প্রতিটি আনাচ-কানাচ।

মাধো ভিড়ের মাঝখান থেকে খুঁজে বার করে তার বাবাকে। তার বাবা এক মহাজনের সঙ্গে যে দরদাম ঠিক করে ফেলেছে, তা বাজার চলতি দরের থেকে কম নয়। মাধো মনে মনে বাবার প্রশংসায় গর্ববোধ করে। হঠাৎ খেয়াল পড়়ে টাকা ধুতির খোটে গুঁজে একদৃষ্টে তার বাবা, তাকেই দেখছে।

মাধোর বাবা একদৃষ্টে মাধোকে দেখেই চলেছে, মেয়ের মুখের হাসি দেখতে দেখতে মাধোর মার কথা মনে পড়ে যায়। মেয়েটা পুরোপুরি মায়ের মতন আদল পেয়েছে, যদি তার মতো স্থির হতো।

মাধো তার বাবার বুকে হাত রেখে বলে, ‘বাপরে’ বাড়ি চল। ক্ষিদিতে প্যাটে যান্ আগুন জ্বলছে।’

মাধোর বাবা ধাতস্থ হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই বলে, ‘মাধো তোর বে না দিতি পারলি, আমার আর নিশ্চিন্তি নেইরে।’

‘তোর খালি এ্যাক কথা, এহন্ চল।’

‘কালু হালদারের ছাওয়াল সোদরের সাথে তোর মা’র পাদানো বেডা দিতি পারলি…’

তার কথা শেষ করবার আগেই ঝাঁঝিয়ে ওঠে মাধো, ‘কালু জেঠ্যার ব্যাটার নাম সোদর নয়, সোন্দর। একডা কুথা বলতি পারনা, তবুও বলতি হবে।’

মাধোর বাবার হাসি পায়, মিষ্টি হাসির রেশ মুখে নিয়ে হাঁটতে শুরু করে মহানন্দার দিকে। নদীর পারে এসে দাঁড়ায় মাধো। ভরাবর্ষায় নদীর বুকে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে তার মুখে পড়ে, মুখটা জল শালুক ফুলের মতো চকচক করছে।

নৌকাতে উঠে বসে মাধো আর তার বাবা। নৌকা একপাশে একটু নীচু হয়ে দুলে ওঠে।

দুই

আজকের খড়ার জাল পোতা হচ্ছে, মোহনার কাছে। মোহনায় এসে মিশে একাকার হয়ে গেছে টাঙ্গন, মহানন্দার বুকে। মাধোর বাবা বিড়ি ধরাবার চেষ্টা করে চলেছে, ‘বুইঝলি মেধো আইজকাল শালার পোগুলো, বিড়িতে পর্যন্ত ভেজাল দিচ্ছে। হারামজাদাগুলো, একডু লেশা পর্যন্ত করতি দ্যাবে না।’

‘লেশা না করি কাম কর। জ্যালটা ট্যানান হলি না, কিছু না। বাপ আমার সাহেব হইয়ি লেসার অভাবে বেবাগী হয়ে বুক ভাসাচ্ছি।’

‘থাম তো। তুর ওই এক খ্যাঁকখ্যাঁকানি সুভাব ধরিছে। তুর মা তো এ্যামনডা ছেল না।’

মাধো ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘আহারে আমার বউ সোহাগি বাপরে। মা’র যদি তুর পেতি ট্যান থাকত তোবে তুর কপালে নাথি মেরি যেতি পারত?’

‘ওরে মাখাকি মাগি থামবি’, উত্তেজিত মাধোর বাবা হাঁপাতে থাকে।

দূর থেকে ছোটো নৌকা করে কে যেন একজন আসছে। কাছে আসতেই মাধোর বাবা বুঝতে পারে সুন্দর।

‘ও সোদর ইধার পানি একবার আয় দেখিন।’

মাধোর মধ্যে অস্বস্তি এসে উপস্থিত হয়। ‘হেই বাপঃ আবার সোন্দর কেনে?’

সামনে চলে আসে সুন্দর, ‘কি গো কাকা। ইধার পানি, খড় পুতলি ক্যানে গো, জল দ্যাবতা এখ্যানি কেরপা করে না।’

‘আমার কি বাপ। মাছ ধরতি-ধরতি দাড়িতে পাক ধরি গেল। আমি কি জানি না কুথায় ত্যানারা ধরা দেন। কিন্তুক বাপ, ওই যে এ্যাকখ্যান কুথা আছে না, ‘মাগির কুথায় মাগ চলে সে সংসারে আগুন জ্বলে’ আমার হইছি তাই।’

মাধোর বাবা ও সুন্দর হো হো করে হেসে ওঠে। জলের বুকে হাসির শব্দ প্রতিফলিত হয়ে মাধোর বুকে ধাক্বা মারে। নকল গাম্ভীর্যে সে গম্ভীর হয়ে ওঠে। সুন্দরের চওড়া বুকে অল্প লোমস আভা। মুখে অল্প খোঁচা খোঁচা না কামানো দাড়ির হাসি মুখে নদীর জলের প্রতিফলিত আলো পড়ছে, মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে এই অপরূপ শোভা দেখতে থাকে মাধো। হঠাৎ, তার সংবিৎ ফিরে আসতে, সে লজ্জা পেয়ে বলে ওঠেঃ

‘বাপ, আমি যাইরে’

‘ক্যান। এ্যাখনি যাবার তাড়া লাগল ক্যানে? সোদরের সাথে বসে, বে’র ব্যাপারে দু’দণ্ড কুথা বললি হতো না?’

‘তর আর মুখে কিছু আটক্যায় না। তুইনা বাপ, আমি তোর ম্যাইয়া।’

মাধোর বাবা আবার হো হো করে হাসতে থাকে। এবার তার সঙ্গে তাল মেলায় না সুন্দর। একটা না বলা লজ্জা তার মুখ আলো করে তোলে। একবারের জন্যে মাধোর সাথে তার চোখে চোখ স্থির হয়ে যায়।

মাধো মৎস্যকন্যা হয়ে সাঁতার কেটে উঠে আসে তার ডিঙি নৌকায়। একটা সুদীর্ঘ চুম্বন এঁকে দেয় তার প্রশস্ত বুকে। মাধোর গায়ের মাছোয়ালি গন্ধে এক অপূর্ব শিহরণ তার সারা শরীরে খেলে যায়। জলের ধাক্বায় নৌকা দুলে ওঠে। সুন্দরের মৎস্যকন্যা সেই ধাক্বায় এক্বেবারে মানুষ মাধো হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তাৎক্ষণিক স্বপ্নভঙ্গের জন্যে, সুন্দর একটু চমকে যায়।

মাধো তার বাবার উদ্দেশ্যে চিৎকার করে, ওই হাবাগবারে মালা দেবার আগি গাঙের জল প্যাটে ঢুকিয়ে মরা ভ্যালোরে বাপ, দৌড়ে উঠে পড়ে পাড়ে। তারপর নদীর ধার ধরে এগোতে থাকে কালীথানের দিকে।

আইহো ব্রিজের কাছে একটু দাঁড়ায় মাধো। হঠাৎ কি খেয়াল হয়, সে পার থেকে আসে জলের কাছে, তারপর গিয়ে দাঁড়ায় ব্রিজের তলায়। নরম মাটিতে তার পায়ের পাতা ঢুকে গেছে, মাথার উপর দিয়ে সিমেন্টের ঢালাই পথ দিয়ে চলে যাচ্ছে গাড়ি। মাধো চারপাশ দেখেঃ কেউ ধারে কাছে নেই। তারপর আস্তে করে ডেকে ওঠে, ‘সোন্দব…’। ব্রিজের উলটানো ঢালু তলে। সোন্দর নাম বার বার প্রতিধবনিত হতে থাকে। মাধো জোরে ডেকে ওঠে, ‘সোন্দর…’। ব্রিজের উলটানো ঢালু তলে। সোন্দর নাম বার বার প্রতিধবনিত হতে থাকে। মাধো জোরে ডেকে ওঠে ‘সোন্দর…’। সোন্দর নামটা জোরালো প্রতিধবনিত হতে হতে, এসে মিশে যায় মাধোর বুকে। সে ভীষণভাবে লজ্জা পায়। আস্তে আস্তে সুন্দর নামের ভেতর নিজেকে হারিয়ে ফেলে। নদীর জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দে মাধো আবার নিজেকে খুঁজে পেয়ে, উঠে আসে পাড়ে। বাঁশবাগানের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যায় কালীথানের দিকে।

কালীমূর্তির দিকে তাকিয়ে মাধো ভীষণ লজ্জা পায়। তার মুখ দিয়ে শুধু বেরিয়ে আসে ‘মা সোন্দর’।

থানের উপর চারপাশের গাছের পাতা পড়ে একাকার হয়ে আছে। সে ঝাড়তে শুরু করে দেয়। তার কাজ শেষ হলে, টাঙ্গন নদীর জলে হাত ধুয়ে, একটা শুকনো খড়ি নিয়ে থানের বুকে কয়েকটা বিচিত্র রকমের কাটাকুটির মতো দাগ কেটে, নিশ্চিন্ত হয়ে প্রণাম করতে করতে বিড়বিড় করে চলেছে

‘থানের বুকে এ্যাইকা দিলাম ফাঁড়াকাঠি, ক্যাইটা গেল জেবনের ঝুঁকি-ঝাঁকি জানি মাগো তুমি থাকতে সোন্দরের বেপদটা কি।’

এক সময় তার দীর্ঘ প্রণামের পালা চুকিয়ে সে উঠে পড়ে, থানের উদ্দেশ্যে ‘আসিরে মা’ বলে হাঁটা শুরু করে ঘরের দিকে।

তিন

বর্ষার ধূসর মেঘ আজকাল আর দেখা যায় না। শরতের পেঁজা তুলোর মতো স্তূপ স্তূপ মেঘ, স্বচ্ছনীল আকাশের বুকে প্রেমিকের মন নিয়ে খেলা করে বেড়ায়। মাঝে মাঝে সূর্যরশ্মি সেই মেঘের মুখে চুম্বন করে। লজ্জায় স্বর্ণাভ হয়ে যায় দেহ। প্রাণ-মন-দেহ ভরা না-বলা আনন্দের স্পর্শ উপচিয়ে পড়ে মেঘের কোল থেকে মাটির বুকে। একটা না বোঝাতে পারা প্রাণের আনন্দ খেলা করে সবার হৃদয়ে।

প্রতিটি দিনের মতো, আজকের দিনটি নয়। হঠাৎ অফুরন্ত আনন্দের মাঝখানে সাময়িক বিরহের ছোঁয়া। এই বিরহই জেলেদের আগাম আনন্দের উৎস।

গতকাল মাঝরাত থেকে মাঝে মাঝে ঝিরঝির বৃষ্টি পড়ছে। জেলেরা অন্ধকার থেকেই ফারাক্বার জলে ইলিশ মাছ ধরবার ছোটো নৌকা নিয়ে মাছের ঝাঁকের দিকে ছুড়ে মারছে হাত-জাল।

মেঘলা আকাশে মাঝে মাঝে মেঘের বুক বিদীর্ণ করে দিচ্ছে বিদ্যুতের চমক। নদীর জল ফুলে ফুলে উঠছে, দুলছে ইলিশ ধরবার ছোটো ছোটো নৌকাগুলি।

মহিম একদৃষ্টে দেখে প্রকৃতির এই বিচিত্র ক্রোধ। সে অভিজ্ঞতার স্মৃতির বুকে মুখ রেখে ভয়ে আঁতকে ওঠে। ‘শুনো গো ভাইসব। গাঙের পানিতে অপদ্যাবতা ভর কইরেছে, রাগে ফুঁইসছে পানি, স্যাবধান, ম্যাঘের পানে চোখ মেলি দ্যাহঃ বেপদ।’

ঝড়, জল, বৃষ্টি জেলের জীবনের নিত্যসঙ্গী, জলের উত্তাল বিদ্রোহের বুকে জেলে খুঁজে পায় জীবনমৃত্যুর চিরন্তন ছন্দ। বিচিত্র পরিবেশের বুকে ঝালিয়ে নেয় পুরোনো অভিজ্ঞতা কিংবা নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে।

জীবনমৃত্যুর এই কঠিন মুহূর্তে ও চরম বাস্তবতার ছোঁয়ায় হাত-জালগুলো ছড়িয়ে পড়ছে নদীর বুকে। উঠে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ। নৌকার অপরিসর পরিবেশে, আধো-অন্ধকারকে শেষ তিন সাক্ষী রেখে চিরদিনের জন্যে ঘুমিয়ে পড়ছে মাছগুলো।

হাত-জালের ভারে, সুন্দরের পেশিবহুল হাত বারবার ফুলে উঠছে। গামছা দিয়ে শক্ত করে চুল বাঁধা যুবকমুখ, কঠিনতার ছোঁয়া পেয়ে গম্ভীর হয়ে উঠছে। উত্তাল জলের দাপটে বারবার দুলে উঠছে, তার ছোটো নৌকা। ঝোড়ো হাওয়ায় বিচিত্র গতিতে, নদীর জলেতে ধরছে ঘূর্ণির পাক। ধোঁয়ার মতো পাকিয়ে ওঠা ঢেউ, কেউটের মতো রাগে গজরাচ্ছে। অন্ধকারের মধ্যে জেলেদের বিরুদ্ধে প্রকৃতির এই স্বঘোষিত যুদ্ধেঃ কিছু বোঝা যাচ্ছে না।

চার

সারাদিন ঝড়-ঝঞ্ঝার পর, এখন থেমে আসছে তার দাপট। তবুও ঝিরিঝিরি শিশিরের মতো অনবরত ঝরে পড়ছে বৃষ্টি। একে শীতকাল তার ওপর ঝঞ্ঝা। যেন বিকেল পাঁচটার সময়েই ঘনিয়েঞ্জআসছে, প্রথম রাতের গভীরতা। চারিদিক নিস্তব্ধ। এই নিস্তব্ধতাকে সাক্ষী রেখে, টাঙ্গনের বুক দিয়ে ফিরে আসছে জেলেদের বিষণ্ণ নিশ্চল নৌকাগুলি।

মাধো কালীথানের কাছে উদ্গ্রীব দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে, ফিরে আসা নৌকাগুলিকে। জেলের মেয়ে, সে জানে, বিচিত্র ক্ষুব্ধ এই অস্বাভাবিক প্রকৃতি জেলের জীবন না নিয়ে থামে না। সারাটা দিন, অগুনতি মানত আর খড়িকাঠ দিয়ে বিপদমুক্তি মন্ত্র বলতে বলতে তার গলা ধরে গেছে। সে আর থাকতে না পেরে চীৎকার করে ওঠে, ‘ও মহিম চাচাঃ সব লৌকা কই গো?’

তার ডাক নদীর ওপার থেকে প্রতিধবনিত হয়ে ফিরে এসে কালীথানের বিচিত্র পরিবেশের মধ্যে প্রতিঘাত পেয়ে অশরীরী হয়ে যায়। এই অশরীরী অনুভূতি, মাধোর সারা দেহে মনে এনে দেয় এক অলক্ষুনে চিন্তা। কোনও উত্তর না পেয়ে সে আর থাকতে না পেরে পাগলের মতো বারবার ডেকে চলে ‘সোন্দরের লৌকা কইঃ’

জেলেদের ফিরে আসা সারি সারি নৌকা, মাধোর ভয়ে তার থেকে দূরে দূরে সরে যায়। নৌকার বুকে লণ্ঠনের অল্প দুলে চলা আলোয় মাঝিদের বিষণ্ণ মুখ দেখতে দেখতে মাধো কঠিন হয়ে ওঠে। নদীর ধার থেকে উপরে উঠে এসে, সোজাসুজি থানের কালীর মূর্তির দিকে তাকায়। তার চোখে এক অস্বাভাবিক ক্রোধ জেগে উঠছে। হঠাৎ, সে কালীথানের থমথমে পরিবেশের উপর চীৎকার করে বলে চলে ‘ মাগো তুই বল। আগুন সাক্ষী করি মন্ত্র না পড়লিই কি বে হয় না। তুই তো জানিস সোন্দর আমার বর। হ্যাঁ—আমার। কারুর সাধ্যি লাই তারে আমার কাছ থিকা ক্যাইরা লায়।’

মাধো পাগলের মতো এক কথা বারবার বলতে থাকে। তারপর একটু শান্ত হয়ে আবার তাকায় থানের মূর্তির দিকে।

‘তুই শুন রক্তখাকিঃ আমারে তুই কেছুতেই বেধবা করতি পারবি না।’ বলে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে মাঠ ছাড়িয়ে বাঁশবনের দিকে। বনের ভিতর ঢুকে কালীথানের দিকে মুখ করে থমকে দাঁড়ায়। সে চোখের ভিতর সহস্র ক্রোধ মেশানো দৃষ্টিতে শেষবারের মতো তাকায় থানের দিকে।

সন্ধ্যার পড়ন্ত অন্ধকার থানকে আস্তে আস্তে গিলে ফেলছে। মাধো একদৃষ্টিতে সেই দিকে তাকিয়ে আছে। এই রকম ভাবে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে সে দেখতে পায়, সন্ধ্যার শেষ আবেশের অন্ধকারের বুকে এক সময় হারিয়ে যায় থান।

বাঁশঝাড়ের বুকে জোনাকির আলো আর হিমেল হাওয়ার টান, নদীর জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শুনতে শুনতে সে হঠাৎ বলে ওঠে, ‘বাপরে, তুই ঠিক বলিস বাপ আমি মাখাকি একডা বোকা ম্যাইয়া। যে-নদী জেবন দেয়, তারে না বেশ্বাস করি,  আমি বেশ্বাস করছিলাম একটা মাটির ডেলারে।’

তার কথাগুলো বনের মধ্যে কোনও জাগরণ তোলে না। কিন্তু মনে হয় যেন কিছু অপার্থিব মানুষের ফিশফিশানির শব্দ। মাধো বাঁদিক ধরে কোনাকুনি এগিয়ে যায় হাটের দিকে।

সন্ধে চলে যাওয়া প্রথম রাতের অন্ধকার হাটকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। একটা জন-মনিষ্যি পর্যন্ত নেই। একা হাটের মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে ভাবে, ‘এ্যাই হ্যাট আইজ থিকা, আমার কাছে স্বগ্গো।’

মাধো হাটের মাটিতে ধানের মতো মাথা ঠুকে প্রণাম করে। হাটের ধারের মহানন্দার পারে এসে দাঁড়ায়। ওপারের বাংলাদেশ এখন দেখা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে সব মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। নদীর বুকে ভেসে যাওয়া নৌকার হ্যারিকেনের আলো— জলের বুকে মৃদুতালে আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। মাধো একদৃষ্টে সব কিছু তাকিয়ে দেখতে থাকে। এক সময় তার মনে হয়—‘এ্যাই গাঙের বুকেই জাইলার জেবন। সোন্দর তুই বেঁইচে আছিস সোন্দর। এ্যাই দ্যাখ— আমি তোর বউ মেধো, তোরে অ্যামার বুকের কাইছে থিকা, গাঙের জলের কাছ থিকা, কেউ কুনদিন ক্যাইরা নিতে পারব না।’

নদীর পারে কিছুক্ষণ দাঁড়াবার পর মাধো স্বাভাবিকভাবে ধীরে ধীরে গ্রামের পথ ধরে তার ঘরের দিকে হেঁটে চলে।

মাউথ অর্গান

ছুটতে ছুটতে ট্রেনটা ধরল অভীক। দিনের শেষ ট্রেন। এটা ধরতে না পারলে ফিরতে পারত না সে। সকালে বাবার শরীরটা খারাপ দেখে এসেছে। হার্টের রোগী বাবা। হঠাৎ কিছু হলে মায়ের পক্ষে একা সামলানো মুশকিল। অন্যদিন হলে এতটা ঝুঁকি নিত না। ছেলেবেলার বন্ধু তাপসের কোয়ার্টারেই থেকে যেত।

তাপস বর্ধমান স্টেশনের রেলপুলিশের বড়োবাবু। সে একাই থাকে এখানে। ওর কাছে থাকলে ছেলেবেলা কিছুটা ফেরত পাওয়া যায়। শেষ কামরায় খুব ভিড়। ভেতরে ঢোকা যাচ্ছে না। শরীরের অনেকটা কামরার বাইরে। একটু ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই কাঁধের ব্যাগ খুলে প্ল্যাটফর্মে। গাড়ির যথেষ্ট গতি এখন। চলন্ত অবস্থায় নামা আত্মহত্যার সামিল। মুখ ঘুরিয়ে ব্যাগটার দিকে তাকাল অভীক। স্টেশনের বোতল কুড়োনো একটা ছেলে ব্যাগটা তুলছে।

ছেলেটাকে ভালো করে লক্ষ্য করল ও। গায়ে চেক জামা, নীল হাফ প্যান্ট, মাথায় কোঁকড়া চুল। গবেষণার কিছু কাগজপত্র, বই, নতুন কেনা দামি মোবাইল, পাঁচশো টাকা ও তার সাধের মাউথ অর্গানটা আছে ব্যাগের মধ্যে। পাবে তো ব্যাগটা? বিশেষ করে ওর মাউথ অর্গানটার জন্য মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল।

বছর তিনেক আগে ওরা চার বন্ধু মিলে ব্যাঙ্কক-পাটায়া বেড়াতে গিয়েছিল। সেখানেই কিনেছিল ওটা। বেশ দামি। ওর অনেক দিনের শখ ছিল বিদেশি মাউথ অর্গানের। সাংহাই কোম্পানির চেঞ্জার অর্গানটা। দুটো দিকেই বাজানো যায়। এত সুরেলা আওয়াজ হয় যে, আশপাশে একটা ভালো লাগার পরিবেশ তৈরি হয় সুরের ঝরনাধারায়।

ভিড় ঠেলে একটু ভেতরে ঢুকল ও। তাপসকে ফোন করে সব জানাল। ব্যাগটার বিষয়ে আশ্বাস দিল তাপস। ও এখনি যাচ্ছে বলল। তবে চলন্ত ট্রেনে ওঠার জন্য খুব বকাবকি করল ওকে। মশাগ্রাম স্টেশনে ও জানলার ধারে বসার জায়গা পেল একটা। চোখ বুজে হাওয়ার আদর খেতে লাগল।

অভীক বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করছে। বিষয়- গ্রামীণ উন্নয়নে ক্ষুদ্র ঋণের প্রভাব। স্বনির্ভর গোষ্ঠী বিষয়টায় জুড়ে গেছে বলে বিগত তিন বছর হুগলি জেলার গ্রামগুলোতে চষে বেড়িয়েছে তথ্য সংগ্রহের জন্য। ঘোড়ার মুখের তথ্য সমৃদ্ধ করেছে ওর লেখা। সবই প্রাথমিক তথ্য নির্ভর লেখা। কোনও গৌণ তথ্যের ওপর নির্ভর করেনি। এতে গবেষণার বিষয় আরও বাস্তবোচিত ও গ্রহণযোগ্য হবে। এটা ওর বিশ্বাস।

প্রতি শনিবার স্কুল করে ও বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে চলে আসে। স্যারের সাথে সারা সপ্তাহের কাজ নিয়ে আলোচনা করে। গ্রন্থাগারে যায়। নোটস নেয়। এসব করতে করতে একদম শেষ ট্রেন হয়। আজ ও স্যারের কাছে এসেছিল অন্য শনিবারের মতোই। কিন্তু কী থেকে কী হয়ে গেল! মনখারাপের কালো মেঘ ওর সারা হৃদয় জুড়ে।

পরদিন আরামবাগের একটা গ্রামে ফিল্ড ভিজিট সেরে ও বর্ধমানে পৌঁছোল প্রায় সন্ধেয। তাপস অফিসেই ছিল। হারানো ব্যাগটা এগিয়ে দিল তাপস। অভীক দেখল সব ঠিক আছে। শুধু মাউথ অর্গানটা নেই। চা টিফিন করে ওরা বের হল হারানো অর্গান উদ্ধারে। যদি বুঝিয়ে ফেরত পাওয়া যায়! বড়ো ব্যথা ওর বুকের ভেতর। ওর সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল ওটা। বন্ধু বিচ্ছেদের কষ্ট যেন সারা মন জুড়ে।

হাঁটতে হাঁটতে ওরা গিয়ে পৌঁছোল ছেলেটার আস্তানায়। হঠাৎ কানে এল সুর। সি শার্প-এ অগোছালো সুর। কিছু রিড মিস হচ্ছে। তবুও এক অদ্ভুত ভালোলাগা আছে সুরটায়। শুনেই বোঝা যায় কত ভালোবাসা নিয়ে বাজাচ্ছে। অভীক বুঝল সব। উৎসের দিকে একটু এগোতেই নজরে এল, সেই কালকের ছেলেটা চোখ বুজে তন্ময় হয়ে বাজিয়ে চলেছে অভীকের প্রিয় মাউথ অর্গানটা। আধো অন্ধকারে যেন আত্মমগ্ন ও। ওর সারা শরীর জুড়ে অদ্ভুত এক আনন্দ খেলা করছে। মুখে যেন সব পাওয়ার আলপনা। বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠল অভীকের। অদ্ভুত এক ভালোলাগায় মনটা ছেয়ে গেল ওর। অনেক না-পাওয়ার মাঝে ছেলেটা একটা বাঁচার অবলম্বন খুঁজে পেয়েছে যেন। ওর এই পাওয়াটুকু আর কেড়ে নিতে চায় না অভীক । বাজাক মাউথ অর্গান ওর প্রাণের সুরে সুখের অঞ্জলিতে। তাপসের হাত ধরে ফেরার পথ ধরল অভীক মাউথ অর্গানের সুর পিছনে ফেলে।

 

অ-সমকাম

বিয়ের সাত বছর পর রনিতা বুঝতে পেরেছিল অসম্ভব! যদিও বিয়ে ফুলশয্যা, মধুচন্দ্রিমার আবেশ কাটতেই অনুভব করেছিল অন্যরকম কিছু একটা। তবু আশায় বুক বেঁধে ছিল। হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। সংসারের কঠোর বন্ধনে বেঁধে ফেলতে চেয়েছিল কর্পোরেট সেক্টরের অফিসার স্বামী অনিন্দ্যকে। আশা করেছিল, একবার বেঁধে ফেলতে পারলেই হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। সাত তাড়াতাড়ি সন্তানের জন্য বায়না ধরেছিল রনিতা।

–এখনই সন্তানের প্রয়োজন কী!

অনেকেই অনিন্দ্যকে সমর্থন করেছিল।

–সত্যিই তো! সবে বিয়ে হয়েছে। কয়েকটা দিন যাক। এনজয় করুক জীবনটাকে। বাচ্চাকাচ্চা হলেই তো সব শেষ!

অনিন্দ্যর যুক্তি ছিল অবশ্য অন্যরকম। তার যেটুকু উপার্জন, সন্তান এলে তাতে তাদের ঠিকমতো চলবে না।

প্রথম প্রথম রনিতা রাতে শুতে গিয়ে তাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। সন্তান হচ্ছে দাম্পত্যে ভালোবাসার সেতু। কিন্তু অনিন্দ্য কিছুতেই সে কথা মানতে নারাজ। একটু একটু করে রনিতাও বুঝতে পারছিল, অনিন্দ্যকে বোঝানো তার সাধ্যের অতীত। তবু হাল ছেড়ে দিয়েছিল, এমন নয়। সুযোগ পেলেই অনিন্দ্যর দুর্বলতম অনুভূতিগুলোর গায়ে নক করত রনিতা।

কিন্তু সেদিন ঘরে ঢুকেই রনিতা বুঝতে পেরেছিল, অন্যরকম কিছু একটা। অনেক দিনই রাত করে বাড়ি ফেরে অনিন্দ্য। কোনও দিন হয়তো ফেরেও না। তাই নিয়ে অনেকবার অভিযোগও করেছে অনিন্দ্যর কাছে। অনিন্দ্যর একটাই জবাব, রুটিনে বাঁধা জীবন তার ভালো লাগে না। তাও মেনে নিয়েছিল রনিতা।

আজ রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে অন্য দিনের মতোই ঘরে ঢুকতেই, খটকা লাগল রনিতার। তাকে দেখেই তড়িঘড়ি সেলফোনে কলটা কেটে দিল অনিন্দ্য। উন্মত্ত বাঘিনির মতোই রনিতা ঝাঁপিয়ে পড়ল অনিন্দ্যর উপর। হ্যাঁচকা টানে কেড়ে নিল মুঠোবন্দি সেলফোনটি। লক খুলতেই চোখের উপর ভেসে উঠল একের পর এক আপত্তিকর ছবি আর মেসেজ।

সেলফোনের স্ক্রিনের তীব্র আলোয় রনিতার মুখ তখন ঝলসে যাচ্ছে। অথচ কেমন নিস্পৃহ দেখাচ্ছে অনিন্দ্যকে। ভাবলেশহীন, যেন অত্যন্ত স্বাভাবিক সে। কোনও কিছুরই হিসাব মেলাতে পারছে না রনিতা। যেন এক অথৈ সমুদ্রে একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে সে।

–এসব কী অনিন্দ্য! আমি কি সত্যি দেখছি! বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে স্পষ্ট অনুভব করল রনিতা। তার তীব্র নীল আলো এসে পড়ছে জানলার কাছে। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রনিতা। নিস্পৃহ অনিন্দ্য।

–সত্যি! আমি শুধু পুরুষের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করি। কোনও নারী আমাকে তা দিতে পারে না!

দূরে কোথাও কর্কশ শব্দে বাজ পড়ল। রনিতা নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠল একবার। তারপর অনুভব করল বাইরে অঝোর ধারায় শুরু হয়েছে বৃষ্টি। ইচ্ছে করেই খুলে দিল জানলার কাচের শার্শিগুলো।

বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি কণা জমে উঠছে এখন রনিতার কপালে, চিবুকে, চোখের পাতায়। একা এবং একা নিথর বসে রইল ভোরের প্রতীক্ষায়।

 

 

বিন্তি উদ্ধার কাহিনি

পুঁটিকুমার আমার সামনে ভাতের থালাটা খটাস করে নামিয়ে লম্বা করে নাক টানল।

এগারো বছরের পুঁটিকুমার সবসময়েই নাক টানে। তার বারোমাসই সর্দি। এই কারণে তার আর-একটা নাম হল সর্দিকুমার। অবশ্য পুঁটিকুমার বা সর্দিকুমার কোনওটাই এই ছেলের ওরিজিনাল নাম নয়। ওরিজিনাল নাম কান্তি। রেস্টুরেন্টে বয় বেয়ারার এই কাজ পাওয়ার পর সে নতুন নাম পেয়েছে। এই রেস্টুরেন্টে এরকমই নিয়ম। যারা কাজ করতে আসে তারা একটা করে নতুন নাম পায়। কর্মচারীরা সবাই মিলে এই কাণ্ড করে। বলতে লজ্জা করছে, গত কয়েক বছর হল নামকরণের গুরুদায়িত্ব আমার ঘাড়ে পড়েছে। কী ঝামেলা! আমি কি এদের কর্মচারী? একেবারেই না। আমি এদের খদ্দের। কাস্টমার। তাও জেন্টলম্যান কাস্টমার নয়, ধারবাকির কাস্টমার। তবু কোনও এক রহস্যময় কারণে এখানকার কর্মচারীরা আমাকে অতিরিক্তরকম পছন্দ করে। সম্ভবত ওদের সঙ্গে প্রাণখুলে মেলামেশার কারণে। কে জানে। জেনে বিশেষ লাভ নেই।

অর্থনীতির নানান ধরনের মডেল আছে। কেইন্স মডেল, মার্কস মডেল, সেনস্ মডেল। কিন্তু ভালোবাসার ব্যাপারে কোনও মডেল নেই। কে কেন ভালোবাসে বোঝা দূরূহ। আমার বিশ্বাস একটা দিন আসবে যখন, নিশ্চয় এই বিষয়েও ফর্মুলা তৈরি হবে। সেই ফর্মুলাতে লাগিয়ে বুঝতে পারব রাঁধুনি, জোগানদার, বয়-বেয়ারা, বাজারসরকার, গ্যাস সাপ্লাইয়ের ছেলে, সাফাইকর্মী এমনকী গড়িয়াহাটা মোড়ের যে- ভিখিরি পরদিন গুছিয়ে বাসি এঁটোকাঁটা নিয়ে যায় তারা সকলে কেন আমাকে পছন্দ করে?

এরা একদিন আমাকে চেপে ধরল।

‘সাগরদা, নাম ঠিক করবার ভার এবার থেকে আপনার। না বললে হবে না। আমাদের দেওয়া নাম মোটেও জুতের হচ্ছে না। বক্বাস, ফক্বাস, খট্টাসে গিয়ে আটকে যাচ্ছি। এগুলো কোনও নাম হল? ভদ্রলোকদের সামনে বলা যায়? আমরা তাই ঠিক করেছি, এবার থেকে আপনি এই কাজ করবেন।’

আমার মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। বললাম, ‘সে কী! আমি কী করে করব! আমি কি তোমাদের এখানে কাজ করি?’

‘কাজ করতে হবে না। কাজ না করলেও আপনি আমাদের লোক।’

আমি কাতর ভাবে বললাম, ‘নাম দিতে গেলে লেখাপড়া জানতে হয়। পণ্ডিত হতে হয়। নিদেনপক্ষে কবি সাহিত্যিক তো বটেই। তোমরা বরং স্কুল কলেজের মাস্টারমশাইদের ধরো। বাংলার মাস্টারমশাইরা নাম দেওয়ার ব্যাপারে ভারি দক্ষ হন। আমি একজন মাস্টারমশাইকে চিনি যিনি বছরে এক ডজন করে নাম সাপ্লাই দেন। হাসপাতাল,

নার্সিংহোমের সঙ্গে তার কনট্রাক্ট আছে। যদি বলো ঠিকানা জোগাড় করে দিতে পারি।’

এদের বাংলার মাস্টারমশাইয়ের কথা বললেও আমার নামের বেলায় ঘটনা অন্যরকম ঘটেছিল। সে এক কেলেঙ্কারি ঘটনা। বড়ো হয়ে আমি শুনেছি। আমার নাম দিয়েছিলেন পতিপাবন সমাজদার। তিনি বয়েজ স্কুলে বাংলা পড়িয়েছেন টানা সতেরো বছর। আমার জন্মের পর বাবা তার কাছে গিয়ে অনুরোধ করলেন, ‘মাস্টারমশাই, অনুগ্রহ করে আমার ছেলের একটা নাম ঠিক করে দিন। আপনার মতো বাংলা ভাষার পণ্ডিতের হাতে নামকরণ হলে আমার পুত্র ধন্য হবে।’

পতিতপাবনবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘এ তো তোমরা বিরাট ঝামেলা করো হে। দু-পাতা বেঙ্গলি লিটারেচার নিয়ে লেখাপড়া করেছি বলে আজীবন ছেলেমেয়েদের নাম দিয়ে বেড়াতে হবে? উফ্ বাংলায় বিএ, এমএ পাশ করাটাই দেখছি ঝকমারি হয়েছে। এমন হবে জানলে আমি ভূগোল পড়াতাম। যারা ভুগোল পড়ায় তাদের এসব ঝামেলা নেই।’

বাবা ধমক খেয়েও হাত কচলাতে লাগলেন। বাবা বিশ্বাস করতেন, মূর্খের ধমকে ক্ষতি আছে, পণ্ডিতের ধমকে ক্ষতি নেই। তার ওপর তিনি পুত্রের নাম সংগ্রহে বেরিয়েছেন। দু-একটা ধমকধামক তো শুনতেই হবে।

মাস্টারমশাই রাগ রাগ গলায় বললেন, ‘ঠিক আছে দেখব’খন। সাতদিন পরে এসো।’

সাতদিন পরে বাংলা ভাষার পণ্ডিত পতিতপাবন সমাজদার আমার নাম রাখলেন। সাগর। বাবা তো বিরাট খুশি। সাগর নামের জন্য খুশি নন, বাংলা ভাষার একজন পণ্ডিত তার ছেলের নাম রেখেছেন এই কারণে খুশি। সবাইকে ডেকে ডেকে তিনি বলতে লাগলেন। বাংলায় গভীর বুৎপত্তি এবং অধ্যয়ন না থাকলে এ জিনিস সম্ভব নয়। পরে কেলেঙ্কারি ফাঁস হল। জানা গেল, বুৎপত্তি, অধ্যয়ন তো দূরের কথা পতিতপাবনবাবু বাংলা নিয়ে পড়াশোনাই করেননি। তিনি বাংলার মাস্টারমশাইও নন। তিনি ভূগোলের মাস্টারমশাই। বয়েজ স্কুলে

বাংলার শিক্ষকের পদ দীর্ঘদিন শূন্য থাকার কারণে তিনি প্রক্সি দেন। গোলমালের আশঙ্কায় ঘটনা কেউ প্রকাশ করে না। পাছে চাকরি চলে যায়। শুনেছি, ঘটনা জানার পর বাবা খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। একজন ভূগোল শিক্ষককে দিয়ে পুত্রের নাম রাখা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। সবাই বলল, ‘তাতে কী হয়েছে? উনি তো লেখাপড়া জানাই মানুষ।’

বাবা বললেন, ‘প্রশ্নটা লেখাপড়ার নয়, প্রশ্নটা সাবজেক্টের। ভূগোলের পণ্ডিত জায়গার নাম দেবেন, মানুষের নাম দেবেন কেন? আমি কোনও কলম্বাস নই যে নতুন জায়গা আবিষ্কার করে তার কাছে গেছি।’

যুক্তি ঠিক নয়। নড়বড়ে। কিন্তু বিশ্বাস বলে একটা কথা আছে। তাকে কে টলায়? তবে আমি কিন্তু খুব খুশি। সাগর নাম পেয়ে গর্বিত। চমৎকার নাম। ভূগোলের টাচ আছে, আবার সাহিত্যের টাচও আছে। সাগর নিয়ে কত গান কবিতা লেখা হয়েছে। ভূগোল মাস্টারমশাই তো আমার নাম কর্কটক্রান্তি রেখা বা মৌসুমি বায়ু রাখেননি। যাই হোক, আমি এ গল্প রেস্টুরেন্টের কর্মীদের বলিনি। শুধু নিজে সরে পড়তে চেয়েছিলাম। ওরা কিছুতেই ছাড়ল না।

‘আমরা শুনব না। আমরা আপনাকেই চাই সাগরদা। এবার থেকে যে নতুন লোক এখানে কাজ করতে আসবে আপনি তার নাম ঠিক করে দেবেন। আপনিই আমাদের পণ্ডিত, আপনিই আমাদের কবি।’

হেসে ফেললাম। আমি পণ্ডিত! ফাঁকিবাজ এবং গাধা ছাত্রদের লেখাপড়ার বই দেখলে হাই ওঠে। আমি ছিলাম হাইয়ের থেকে এক ডিগ্রি বেশি। বই দেখলে হাইয়ে সময় নষ্ট না করে আগে ভাগে ঘুমিয়েই পড়তাম। ছাত্রাবস্থায় আমার শ্লোগান ছিল, ‘আগে ঘুম পরে হাই’।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নে যেটুকু পড়বার পড়ে কলেজ পাশ করেছি। তারপর বেকার। নর্ম্যাল বেকার নয়, স্বেচ্ছাবেকার। স্বেচ্ছাবেকার হল স্বেচ্ছা অবসরের মতো। চাকরি পাইনি বলে চাকরি করি না এমন নয়। নিজের ইচ্ছে হয়েছে তাই চাকরি করি না। বেলা পর্যন্ত ঘুমোই। ঘুম ভেঙে গেলে আরও বেলা পর্যন্ত বিছানায় গড়াই। গড়ানো পর্ব শেষ হলে আরও আরও বেলা পর্যন্ত বিছানা ছাড়ব কিনা ভাবি। ভাবা কমপ্লিট হলে আরও আরও আরও বেলা পর্যন্ত ভাবি, এতক্ষণ যা ভাবলাম সবই তো ভুল ভাবলাম। নতুন করে ভাবতে হবে। জীবন হল ভাবার ভেলা। সেই ভেলায় শুয়ে উথালপাতাল সমুদ্রে ভেসে বেড়ানোই জীবনযাপন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে এই দার্শনিক চিন্তার তুলনা হয়? সামান্য রোজগার আর বেশিটাই ধারবাকিতে একার চমৎকার জীবন কাটিয়ে নেওয়া।

আমার কাছে চাকরি হল খাদের মতো। হাতির মতো বড়ো মানুষরা যখন ওই খাদে পড়ে, ব্যাঙের মতো অকিঞ্চিৎকররা লাথি কষায়। হাতিকে মরমে মরতে হয়। কিন্তু হায়রে! তখন আর করবারও কিছু থাকে না। ততক্ষণে বউ, ছেলেমেয়ে, সংসার, বাড়ির লোন, দুধের বিল, গ্যাসের দাম, অম্বলের ওষুধ নিয়ে ল্যাজে গোবরে সিচুয়েশন। তাই খাদ এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের। বহু হাতছানি, বহু হুমকির পরও ওদিকে পা বাড়াইনি আমি। টিউশন, কলেজ স্ট্রিটের প্রুফ মাঝেমধ্যে হাবিজাবি দু-একটা উদ্ভট কাজ এবং ধারবাকি– এই আমার উপার্জন। এতেই সকাল-রাতে খাওয়া, এক কামরার বাসার ভাড়া জোগাড় হয়ে যায়। কখনও আবার হয়ও না। ব্যস্, আর কী চাই? আমি যেমন পণ্ডিত নই, তেমন কবি সাহিত্যিকও নই। আমার লেখালিখি বলতে চিঠি। চিঠিও না, চিরকুট। তার বেশিরভাগই বন্ধু তমালের কাছে ধার সংক্রান্ত।

‘ভাই তমাল, তুই শুনলে সবিশেষ দুঃখিত হবি। গত তিনদিন যাবৎ, ছোটো একটা সমস্যার মধ্যে আছি। সমস্যার নাম দারিদ্র্য। পকেটে একটিও পয়সা নেই। চিরকুটপাঠ আমাকে শ দুয়েক টাকা পাঠিয়ে নিজেকে দুশ্চিন্তামুক্ত কর।’

সাধারণত এই ধরনের চিরকুটের উত্তর আসে কড়া।

‘সাগর, তোর টাকাপয়সা নিয়ে আমার কোনও দুশ্চিন্তা, সুচিন্তা কিছুই নেই। অলস, ছন্নছাড়া, কোনও আহাম্মককে নিয়ে আমি কোনও ধরনের চিন্তা করতেই রাজি নই। গত এক বছরে আমার বলে দেওয়া তিনটে চাকরির একটাতেও তুই জয়েন করিসনি। গো টু হেল।’

এই উত্তর পাওয়ার পর আমি নিশ্চিত হই। এই গালির অর্থ পরদিনই টাকা চলে আসা। ‘বন্ধু’ এমনই হয়। তারা ভালোবাসার কথা গালি দিয়ে বলে।

যাইহোক, লেখালিখির এই বিদ্যে দিয়ে আমাকে কবি সাহিত্যিক বলা যায়? কখনওই না। এরপরেও পুঁটিকুমার, ওরা নাছোড়বান্দা। বাধ্য হয়ে নামকরণের দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নিতে হয়েছে।

যেহেতু সকলেই রেস্টুরেন্টের কর্মী তাই আমার নামও আনাজপাতি, মাছ, ডাল, তরিতরকারির মধ্যে ঘোরাফেরা করে। তবে নামকরণে কাউকে ছোটো করার ব্যাপার নেই। কেউ যাতে দুঃখ না পায় তার জন্য শ্রী, শ্রীমান, কুমার, মহাশয়, মাননীয় যুক্ত করে দিই। কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথের ‘নাথ’, অতুলপ্রসাদের ‘প্রসাদ’, শরৎচন্দ্রের ‘চন্দ্র’ও লাগাই। যেমন এখানকার হেড রাঁধুনির নাম দিয়েছি লংকা মহাশয়। যোগানদার শ্রীমান উচ্ছে। একজন বেয়ারা পটলনাথ, আর-একজন, মুসুর প্রসাদ। একই ভাবে কান্তি নাম পেয়েছে পুঁটিমাছের। পুঁটিকুমার।

পুঁটিকুমার আবার নাক টানল। মাথা নামিয়ে খেলেও এবার আমার কানে লাগল। এতো ঠিক সর্দি ধরনের নাক টানা নয়।

গত তিন বছর ধরে আমি এই ‘ভাত ডাল’ রেস্টুরেন্টের কাস্টমার। বেশ কয়েকবার রেস্টুরেন্টের মালিক বদলেছে। আমি বদলাইনি। আমার হল বাই মান্থলি সিস্টেম। দু’মাস অন্তর বিল মেটাই। দু’মাস অন্তর খাওয়ার বিল মেটানোর ব্যবস্থা ভূ-ভারতে আর কোথাও আছে বলে জানা নেই। পুরোনো মালিককে এই সিস্টেমে রাজি করিয়েছিলাম। এখন এসেছে অভয়পদবাবু। বয়স্ক মানুষ। নাকের ওপর চশমা পরেন। চশমার ফ্রেম গোল এবং সোনালি। ডাঁটি তামার। একপাশে লাল রঙের সুতো ঝুলছে। সেটা টেবিল ফ্যানের বাতাসে ফর্ফর করে ওড়ে। এই সুতো চশমার, না বাইরে থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা বলতে পারব না। অনেক সময় চাদর টাদর থেকে চশমার খোঁচায় সুতো আটকে থাকে। আর খোলা হয় না। নতুন মালিকের চরিত্র হল তিনি সারাক্ষণ একটা ‘মালিক, মালিক’ ভঙ্গির মধ্যে থাকবার চেষ্টা করেন। হাবেভাবে অহংবোধের মতো মালিকবোধ। সম্ভবত এটাই ওর প্রথম ব্যাবসা। মালিক হয়ে তিনি গর্বিত। মানুষটাকে আমি এড়িয়ে চলি। সেদিন ধরা পড়ে গেলাম।

আমি খাওয়া শেষ করে ক্যাশ কাউন্টার থেকে মৌরি তুলতে গিয়েছিলাম। অভয়পদবাবু এক গাল হেসে বললেন, ‘বসুন সাগরবাবু। আছেন কেমন?’

প্রমাদ গুনলাম। লক্ষ্য করে দেখেছি, যারা আমাকে খাতির যত্ন করে বসতে বলে, কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা আমাকে ধমক দেয়, বিপদে ফেলে। এটা প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতি এক একজনকে এক একটা বিষয়ের জন্য তৈরি করেছে। কাউকে লাথি ঝাঁটার জন্য তৈরি করেছে কাউকে বসিয়ে জল-বাতাসা খাইয়ে যত্নের জন্য তৈরি করেছে। লাথি ঝাঁটার মানুষকে জল-বাতাসা দিয়ে যত্ন করলে প্রকৃতির প্রেস্টিজে লাগে। সে প্রথমে চুপ করে থাকে। নিয়মের বাইরে খেলতে দেয়। কিন্তু কিছুটা পরেই প্রতিবাদ করে। আমার বেলাতেও তাই হয়। খাতিরের পরই গলাধাক্বা।

চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, ‘আমি ভালোই আছি। আপনি?’

অভয়পদবাবু চোখের চশমা নাকের ওপর আরও খানিকটা নামিয়ে অন্যমনস্ক গলায় বললেন, ‘ভালো তো ছিলাম ভাই, খানিক আগে থেকে বিগড়ে গেছি।’

আমি সহানুভূতির গলায় বললাম, ‘কেন? হলটা কী?’

ভদ্রলোক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘মালিক হিসেবে এখানকার নতুন দায়িত্ব পেয়েছি। বোঝেনই তো মালিকের দায়িত্ব কত কঠিন। মালিক না হলে সবদিকে নজর রাখার দরকার নেই, কিন্তু মালিক হয়ে গেলে আপনি খতম, তখন সবদিকে নজর দিতে হবে। এখন সব আমার। এই দোকান আমার, চেয়ার টেবিল আমার, কর্মচারীরা আমার, হিসেব খাতা আমার, লাভ লোকসান আমার। সবের ওপর শুধু আমার দখলদারি। ঠিক কিনা?’

আমি সবিনয় বললাম, ‘ঠিকই স্যার।’

অভয়পদবাবুকে ‘স্যার’ সম্বোধনের কারণ ধারবাকি। এ ব্যাপারে আমি কোনও ঝুঁকি নিই না।

অভয়পদবাবু আমার সম্মতি চাইলেন বটে, কিন্তু পেয়ে খুশি হলেন বলে মনে হল না। একই রকম বিরক্ত গলায় বললেন, ‘সেই নজর দিতে গিয়েই চমকে উঠেছি। হিসেবের খাতা ঘাঁটতে গিয়ে দেখি আপনার নামের মাসে লেখা দ্বিমাসিক। সাগরবাবু, দু’মাসের ধার বলে তো আমি কখনও কিছু শুনিনি। ধার খুব বেশি হলে একদিন, দুদিন। বড়োজোর হপ্তাখানেক। খাবার রেস্টুরেন্ট কোনও মুদিখানা নয় যে সেখানে মাসকাবারি খাতা থাকবে। ধারবাকি নিয়ে এসব কী চলছে! এতো ব্যাবসা লাটে উঠবে! মালিক হিসেবে আমি কি তা মেনে নিতে পারি?’

যা আঁচ করেছিলাম তাই ঘটল। বিপদ শুরু হয়ে গেল। নিজেকে সামলে হাসলাম। এই লোককে গুলিয়ে দিতে হবে। আমার ধারবাকির সিস্টেম বন্ধ হলে জলে পড়ব। না খেয়ে থাকতে হবে। বললাম, ‘কী যে বলেন স্যার ধারবাকিতে কখনও ব্যাবসা লাটে ওঠে! ধার বাকিই তো এখন ব্যাবসা। যত ধার তত লাভ। ধার শোধের কত নতুন নতুন প্যাটার্ন বেরিয়েছে। মান্থলি, বাই মান্থলি, হাফ ইয়ারলি, ইয়ারলি। ব্যাংক আর ক্রেডিট কার্ডগুলো মাথায় ঝুড়ি নিয়ে ধার নেবেন গো, ধার নেবেন গো বলে গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের ধার শোধের ব্যবস্থাপনা শুনলে মাথা ঘুরে যাবে স্যার। কোনও, কোনও স্কিমে আবার ধার নিয়ে শোধ দিতেও হয় না। শুধু নিলেই হয়।’

নতুন মালিক আমার চোখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইলেন। এই তাকানো যেমন ভালো তেমন আবার বিপজ্জনকও। পলকহীন চোখে মানুষ যেমন ভালোবাসার কথা বলে, তেমন আবার খুনও করতে পারে। রেস্টুরেন্টের মালিক নিশ্চই আমাকে ভালোবাসার কথা বলবে না।

‘সাগরবাবু, আমি ব্যাংক নই, ক্রেডিট কার্ডও নই। সামান্য ভাত-ডাল বেচে খাই। আমি এই ধারবাকির ব্যাবসা আর করব না বলে স্থির করেছি। এবার আপনার সিদ্ধান্ত। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। দুদিন ভাববার সময় নিন। আচ্ছা, দুদিন নয়, তিনদিনই সময় দিলাম। আপনি পুরোনো লোক। এখানে যদি খেতে হয়, তিনদিন পরেই টাকাপয়সা যা বাকি আছে মিটিয়ে দেবেন। তারপর আমরা রোজকার রোজ হিসেবে যাব। ফ্যালো কড়ি খাও তেল সিস্টেম। খাও তেল কেন বুঝতে পারলেন? খাবার দোকান বলে। আমার এই অনুরোধ কি মনে থাকবে সাগরবাবু?’

আমি হাসলাম। চিন্তায় পড়ে গেছি বুঝতে দিলে চলবে না। তিনটে দিন তো চলবে। তারপর একটা কিছু ভাবা যাবে। আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘খুব মনে থাকবে।’

অভয়পদবাবু ঠোঁটের কোণায় মুচকি হাসলেন। গোল চশমা নিজেই খানিকটা ঝুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘না থাকবে না। ভুলে যাবেন। কঠিন কথা মানুষ সহজে মনে রাখতে চায় না। ধারবাকি শোধের কথা তো একেবারেই না। মালিক হলে জানতেন। সেই কারণে আমি একটা পথ ভেবেছি।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘পথ! কী পথ? পুলিশে দেবেন?’

অভয়পদবাবু হাসলেন। গোল চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘ছি ছি ও কী বলছেন! পুলিশে ধরিয়ে দিলে আপনি তো ফুড়ুত করে গারদে ঢুকে যাবেন সাগরবাবু। তাতে আমার লাভ কী হবে? গারদ থেকে আপনি কি আমার ধার শোধ করতে পারবেন? পারবেন না। যদি চেষ্টাও করেন, মাঝপথে পুলিশ কমিশন খাবে।’

আমি হালকা ঘাবড়ে গেলাম। বললাম, ‘তবে কি মারধোর ভাবছেন?’

‘না, আপনার মতো মানুষকে মেরে লাভ নেই। মার তো দূরের কথা। নিংড়োলেও টাকাপয়সা পড়বে না। আমার সব খোঁজ খবর নেওয়া হয়ে গেছে সাগরবাবু। আপনি হলেন ব্যাড ফর এভরিথিং ধরনের মানুষ। মারধোরের জন্যও ব্যাড। গালমন্দের জন্যও ব্যাড। আমি ছেলেদের বলে দিয়েছি, কাল থেকে আপনার ওপর ধাপে ধাপে অ্যাকশন শুরু হবে। কারণ আপনি আমাদের পুরোনো খদ্দের। ব্যাবসা যদি লক্ষ্মী হয়, পুরোনো খদ্দের তার বাহন। প্যাঁচা। তাই পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা। আপনার খাবার মেনু থেকে একটা একটা করে আইটেম স্টপ করতে বলেছি। বড়ো কোনও আইটেম দিয়ে শুরু করব না। শুরু হবে ছোটো খাটো কিছু দিয়ে। ধীরে ধীরে ‘বড়ো’তে যাব। কেমন হবে?’

আমার চোখ কপালে। এই মানুষ তো বিরাট খেলোয়াড়। খেলা চট করে বুঝতে দেয় না। আমি বললাম, ‘ঠিক ধরতে পারলাম না।’

‘পারবেন। ব্যবস্থা শুরু হলেই ধরতে পারবেন। ভালো চিকিৎসারই এই নিয়ম। চট করে ধরা যায় না। ধীরে ধীরে যায়। কাল থেকে ভাতের পাতে আপনার জন্য লেবু দেওয়া বন্ধ করতে বলেছি। লেবু বড়ো কিছু না। একটা ইঙ্গিত। তিনদিন পর বন্ধ হবে নুন। সল্ট। লেবু, নুনের পর আসবে মাছের ঝোল। দেন ডাল। তারপর সবজি। ধার না মেটালেও ভাত চলবে কয়েকদিন। ওনলি ভাত। আমরা কাউকে ভাতে মারতে চাই না। তবে এরপরেও যদি টাকা দেবার কথা ভুলে যান সাগরবাবু, আমাদের কিছু করার থাকবে না। বাধ্য হয়ে ভাতটুকুও বন্ধ করে দিতে হবে।’

আমি অভিভূত। আমি চমৎকৃত। ধার আদায়ের এই অভিনব পদ্ধতি আমাকে মুগ্ধ করল। বললাম, ‘আচ্ছা, ভাত বন্ধ হলে কি আমি খালি থালা নিয়ে বসতে পারব?’

‘আপনি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন?’

আমি মুচকি হেসে আড়মোড়া ভাঙলাম। চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললাম, ‘স্যার, আপনার চশমাটা কি ইংরেজ আমলের? মনে হচ্ছে, চার্লস টেগারের ফটোতে এরকম একটা চশমা দেখেছিলাম।’

আমার ওপর ধাপে ধাপে অ্যাকশন শুরু হয়েছে। আজ তৃতীয় দিন। ভাতের পাতে লেবু বন্ধ।

আমি থালা সামনে টানলাম। থালার ওপর ঢিবি করা ভাত। ভাতের গা ঘেঁষে দুটো বাটি। তাতে ডাল আর মাছের ঝোল। মাছের ঝোল নয়, মাছের জল। বাটির দিকে তাকালে মনে হবে, কিছুক্ষণের মধ্যে চকোলেট সাইজের পোনা মাছের টুকরো প্রাণ পাবে এবং বাটির জলে মহানন্দে সাঁতার কাটবে। আমায় যদি ছিপ দেওয়া হয়, আমি বাটিতে সেই ছিপ ফেলে পোনা মাছের টুকরো শিকার করব। থালার কোণায় নুন, ভাতের আড়াল থেকে উঁকি মারছে টসটসা লেবুর টুকরো। পাতিলেবু। মালিকের ব্যবস্থা অনুযায়ী লেবু আমার প্রাপ্য নয়। পুঁটিকুমার স্মাগল করে দিয়েছে। রান্নাঘর থেকে হাতসাফাই। গতকাল আমি আপত্তি করেছিলাম।

‘পুঁটিকুমার কাজটা ঠিক হচ্ছে না।’

পুঁটিকুমার নাক টেনে বলল, ‘কোন কাজটা?’

‘এই যে তুই আমাকে লেবু চুরি করে দিস এই কাজটা। ধার মেটাতে পারিনি বলে তো আমার লেবু বন্ধ থাকার কথা। আমি তো আর লেবুর জন্য এনটাইটেলড্ নই। এনটাইটেলড্ মানে জানিস? এনটাইটেলড্ মানে হল…।’

পুঁটিকুমার আমাকে থামিয়ে ধমক দেওয়ার ঢঙে বলল, ‘ইংরাজি শেখাবেন না। আমি লেবু চুরি করি না। চোরাপথে আপনার থালায় চালান করি।’

এই কথায় আমি থ’ মেরে যাই। বলি, ‘চোরাপথে চালান করিস মানে!’

‘তরিতরকারি কাটাকুটির পর পাতিলেবু আর পাঁচটা আনাজের খোসামোসার সঙ্গে দরজা দিয়ে রান্নাঘরের বাইরে চলে যায়। একটু পরেই আবার হাত ঘুরে জানলা দিয়ে ফিরে আসে।’

আমি চমকে উঠি। এতো রীতিমতো স্মাগলিং! আমার জন্য এরা এতটা ভাবে! আমার পুঁটিকুমার আবার নাক টানল। এই আওয়াজ আমার কেমন যেন ঠেকল! অন্যরকম। ঠিক সর্দির মতো তো নয়! আমি ডাল মাখা ভাতে লেবু কচলাতে গিয়ে থমকে গেলাম। মুখ তুললাম। হাফ প্যান্ট, ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জি পরে আমার টেবিলের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সর্দিকুমার। সে কাঁদছে।

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কীরে কাঁদছিস নাকি?’

পুঁটিকুমার উত্তর না দিয়ে নাক টানল। আমি বললাম, ‘কীরে কেউ মেরেছে? মালিক? অন্য কেউ?’

পুঁটিকুমার দু’পাশে মাথা নাড়াল।

‘তাহলে!’

পুঁটিকুমার ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জির ভেতর থেকে একটা ঘামে ভেজা পোস্ট-কার্ড বের করল। এগিয়ে দিল আমার দিকে। পোস্ট-কার্ডে মেয়েলি হাতে মাত্র একটা লাইন লেখা–

‘ভাই, আমি ঠিক করেছি, বিষ খাব। আমার দিব্যি একথা তুই কাউকে জানাবি না। মা-বাবা কাউকে না। ইতি তোর প্রাণের দিদি।’

মেয়েলি হলেও হাতের লেখা সুন্দর এবং একটা বানানও ভুল নেই।

আমি আর পুঁটিকুমার বসে আছি ফুটপাথের ধারে। একটা চকচকে শহিদবেদির ওপর। পুঁটিকুমার পা দোলাচ্ছে। তার পা দোলানোর কায়দা অদ্ভুত। বসে বসে লেফ্ট রাইট। প্রথমে বাঁ, পরে ডান, শেষে ডান-বাঁ দুটো একসঙ্গে।

কলকাতা শহরে শহিদবেদির চেহারা বদলে গেছে। আগে হতো কালো, লম্বাটে। আখাম্বা দাঁড়িয়ে থাকত। গায়ে সাদা মার্বেল পাথরে খোদাই থাকত ‘শহিদ’-এর নাম। এখন কালো রং উঠে গেছে। বিভিন্ন রঙের মোজাইক দিয়ে মোড়া বেদিতে কারুকার্য এসেছে। বেদির আকারও বদলেছে। লম্বার জায়গায় হয়েছে চওড়া। চৌবাচ্চা ধরনের। চৌবাচ্চা মাটি দিয়ে ভর্তি। তাতে ফুলের গাছ। নেতারা যেদিন বেদি ‘উদ্বোধন’ করতে আসেন সেদিন ফুল শুদ্ধু গাছ এনে লাগিয়ে দেওয়া হয়। সেই গাছ কিছুদিনের মধ্যে ভ্যানিশ। হয় গরু ছাগল খায়, নয় তো জলের অভাবে শুকিয়ে মরে। সবথেকে বড়ো কথা, শহিদবেদিতে এখন আর শহিদের নাম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হয় না। ছোটো করে কোথাও একটা লেখা হয়। চোখে পড়তে পারে, আবার নাও পারে। অসুবিধে নেই। যিনি শহিদ হয়েছেন তার থেকে বেদি যিনি ‘উদ্বোধন’ করেন সেই নেতার নাম থাকে বড়ো আকারে। ঠিকই হয়। মরে যাওয়া মানুষের দাম কী? কিছুই না।

এই বেদিরও অবস্থা তাই। শহিদের নাম বোঝা যাচ্ছে না। পাথরের লেখা ঘষে গেছে। শুধু পড়া যাচ্ছে–

‘তিনি ছিলেন নারী মুক্তির প্রজ্জ্বলিত শিখা…।’

আমি সহজ ভাবে বললাম, ‘তোর দিদির নাম কী?’

পুঁটিকুমার নাক টানছে, কিন্তু কান্নার নাক টানা নয়। তাকে নিয়ে আমি যে বেড়াতে বেরিয়েছি, এতে সে খুশি। কান্না বন্ধ হয়ে গেছে। ভাত ডালের দোকানে বিকেলের দিকে ঘণ্টা খানেকের ছুটি। নতুন মালিকের নিয়ম। আমার কর্মচারীকে আমি ছুটি দেব, কার কী?

‘দিদির নাম বিন্তি।’

‘বাঃ, ভাইয়ের নাম কান্তি, বোনের নাম বিন্তি। ভারি সুন্দর অন্তমিল আছে। আমি যদি ছড়া লিখতে পারতাম তাহলে লিখতাম কান্তি বিন্তি ভাই বোনযদুজনেরই একটা মন।’

পুঁটিকুমার বলল, ‘সাগরদা, তুমি আমার দিদির একটা নাম দাও।’

আমি অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, ‘তা কী করে হবে! আমি তো শুধু খাওয়ার দোকানের লোকদের নাম দিই। তোর দিদি তো আর সেখানে কাজ করে না।’

পুঁটিকুমার বলল, ‘না করলেও দাও। দিদি খুব মজা পাবে।’

আমি একটু ভেবে বললাম, ‘সে না হয় দেওয়া যাবে, কিন্তু পুঁটিকুমার, তোমার দিদি নাম নিয়ে করবেটা কী? সে তো বিষ খেতে চায়। বিষ খেলেই ফিনিশ।’

পুঁটিকুমার চুপ করে রইল। আমিও চুপ করে রইলাম। যদি বেশি উৎসাহ দেখাই এই ছেলে গুটিয়ে যেতে পারে। তারওপর চিঠিতে দিদি ‘দিব্যি’ কেটে রেখেছে। তার আত্মহত্যার পরিকল্পনা যেন ফাঁস না হয়। আমরা যতই হাইফাই জীবনে ঢুকি, আমেরিকা, লন্ডন করি, ভাইবোনের এইসব দিব্যি-টিব্যি খুব সিরিয়াস ব্যাপার। লেখাপড়া করলে দিব্যির কথা মুখে বলতে লজ্জা করে, মনে মনে বলে। মুখেও বলে। আমি এক বোনকে চিনি, বিয়ের পর মিশর চলে গেছে। কেমিষ্ট্রিতে তুখোড় ছাত্রী। মমির ওপর গবেষণা করছে। মৃতদেহ মমি করে রাখতে কোন ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়েছিল তাই নিয়ে গবেষণা। নিউইয়র্কের ‘পাস্ট অ্যান্ড ফিউচার’ নামের অতি বিখ্যাত সায়েন্স জার্নালে এই মেয়ের লেখা ফটো দিয়ে বেরিয়েছে। আমি শুনেছি, কিছুদিন আগে এই মেয়ে তার হরিদেবপুরের ভাইকে ফোন করে বলেছে– ‘এবার ভাইফোঁটায় তোর কাছে যাবই যাব। কেউ ঠেকাতে পারবে না। ফ্যারাওয়ের দিব্যি কাটছি।’

পুঁটিকুমার বলল, ‘সাগরদা, আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে।’

আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম, ‘আমারও করছে। চল দুজনে মিলে আইসক্রিমওয়ালা খুঁজে বের করি। কতদিন কাঠি আইসক্রিম খাওয়া হয় না।’

পুঁটিকুমার বলল, ‘খুঁজতে যাব না। রাস্তা দিয়ে যখন যাবে ডেকে খাব।’

‘ঠিক বলেছিস। আইসক্রিম, ঝালমুড়ি, ঝুরিভাজা খুঁজে খেতে মজা নেই। টেস্ট কমে যায়। ডেকে খেতে মজা।’

পুঁটিকুমার একটু চুপ করে থেকে খানিকটা অন্যমনস্ক ভাবে বলল, ‘আমার দিদির কী হয়েছে তুমি কি শুনতে চাও?’

আমি উদাসীন ভাব দেখিয়ে বললাম, ‘বলতে পারিস, আবার না বলতেও পারিস। তোর ইচ্ছে।’

‘দিদি যে বারণ করেছে।’

‘আমার কী মনে হয় জানিস পুঁটিকুমার…।’ আমি চুপ করে গেলাম।

পুঁটিকুমার আমার দিকে ফিরে বলল, ‘কী মনে হয় সাগরদা?’

আমি ইচ্ছে করেই চুপ করেছিলাম। দেখছিলাম পুঁটিকুমার নিজে শোনার জন্য আগ্রহ দেখায় কিনা। বললাম, ‘সব বারণ শোনার জন্য নয়। এই যে তোদের অভয়পদবাবু, ধার শোধের জন্য আমার ওপর ধাপে ধাপে চাপ বাড়াচ্ছে, তোরা কি শুনছিস? তুই নিজেই তো লেবু পাচারের ব্যবস্থা করেছিস। বল, করিস নি?’ পুঁটিকুমার মাথা কাত করল। আমি বললাম, ‘আবার আর-একরকম বারণ আছে যার মানে উলটো ধরতে হয়। ধর, তুই রাগ করে বললি, আইসক্রিম খাব না। আমি তার মানে বুঝব, তুই আসলে আইসক্রিম খেতেই চাস। তেমন তোর দিদিও হয়তো তোকে বারণ করে উলটো কিছু বলতে চাইছে। নইলে এতক্ষণে চুপচাপ বিষ খেয়ে নিত। কষ্ট করে পোস্টকার্ড কিনে তোকে চিঠি লিখতে যাবে কেন?’

পুঁটিকুমার অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি হাসলাম। ছেলেটাকে প্রভাবিত করতে পেরেছি। বিন্তি কেন বিষ খেতে চায় আমায় জানতে হবে। পুঁটিকুমারের কান্না আমি পছন্দ করিনি।

পুঁটিকুমার বিড়বিড় করে ঘটনা বলতে শুরু করল। আমি চুপ করে শুনতে থাকলাম। এর মাঝখানে আমরা আইসক্রিমওয়ালার দর্শন পেয়েছি। বাক্সগাড়ি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল ফুটপাথ ঘেঁষে। গাড়ির গায়ে রংচং দিয়ে লেখা ‘আইজ এণ্ড কোল্ট’ দুটো বানানই ভুল। এটাই ভালো। ভুল বানানের আইসক্রিম খেতে বেশি মজা। আমরা গোলাপি আর সবুজ রঙের দুটো কাঠি কিনেছি। পুঁটিকুমার সবুজ খাবে না। তার সবুজে নাকি অ্যালার্জি। গায়ে চিড়বিড় লাগে। সে নিয়েছে গোলাপি। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল, গোলাপি নেওয়া সত্ত্বেও অল্পক্ষণের মধ্যেই পুঁটিকুমারের মুখের রং সবুজ হয়ে গেছে। আমার হয়েছে গোলাপি! অদ্ভুত না?

কান্তি-বিন্তিদের গ্রামের নাম মন্দিরতলা। পোস্ট অফিস বাণীপুর, জেলা উত্তর চব্বিশ পরগণা, থানা হাবড়া। কান্তির বয়স দশ, বিন্তির বয়েস পনেরো। হতদরিদ্র পরিবারে এই ছেলেমেয়েদুটি জন্মের পর থেকেই বাবা-মায়ের কাছে ‘শাকের আঁটি’। শাকের আঁটি শুনে ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। বাবা-মায়ের নিজেদের জীবন চালানোই এতদিন ছিল বোঝার মতো। তারওপর ছেলমেয়েরা চাপলে তাকে শাকের আঁটি ছাড়া আর কী বলা হবে? সব মিলিয়ে বোঝার ওপর শাকের আঁটি।

এই সব পরিবারে শাকের আঁটি ঝেড়ে ফেলবার জন্য বাবা-মায়ের কসরতের শেষ থাকে না। নতুন কিছু নয়। আমাদের দেশে এমনটাই স্বাভাবিক। সবথেকে আদরের জনকে পেটের কারণে সবথেকে বড়ো দায় বলে মনে হয়। দায়মুক্ত হবার জন্য বাবা-মা অনায়াসে ছেলেমেয়ের গলা টিপে, বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে পারে। ফেলেও। পেট খুব কঠিন জিনিস। স্নেহ, মায়া, মমতা তার কাছে ধুলিকণাসম। ফুঃ দিয়ে উড়িয়ে দিতে মুহূর্তমাত্র।

মেয়েদেরবেলায় তো আরও সহজ। জন্মালেই আস্তাকুঁড়ে ফেলে দাও। খবরের কাগজে এইসব খবর আজকাল ছাপা হয় না। কত ছাপা হবে? মেয়ে মারা এখন জলভাত। গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে খবরের কাগজ কিনে পাবলিক জলভাত খেতে চায় না। কুড়মুড়ে জিনিস খেতে চায়। বিন্তিকে যে তার বাবা-মা জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে কাপড়ে মুড়ে পুকুরের জলে ফেলে দেয়নি সেটাই অনেক। আমি ওই পরিবারের পয়সাকড়ির অবস্থা যা শুনলাম তাতে সেটাই উচিত ছিল। তবে কান্তি-বিন্তির বাবা-মা পুঁটিকুমারকে পাঠিয়ে দিয়েছে কলকাতায়। সেও একরকম জলে ফেলাই হল। হাবুডুবু খাও। পুঁটিকুমারও হাবুডুবু খাচ্ছে। সে হয়েছে বালক শ্রমিক। মেয়েকে কলকাতায় পাঠানো সম্ভব হয়নি। মেয়ে গ্রামে। ঘর সংসারে কাজ করে। বাবা-মা অপেক্ষা করে মেয়ে কবে বড়ো হবে। হলেই বিয়ে।

ঘটনা এই পর্যন্ত সাধারণেরও সাধারণ। বলার মতো নয়, শোনবার মতোও নয়। পাড়়াগাঁয়ে এমন মেয়ে আছে অজস্র। পিতা মাতার অনুপ্রেরণায় তারা আধপেটা খেয়ে না খেয়ে সেজেগুজে বিয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। স্বপ্ন একটাই, শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে আর চিন্তা থাকবে না। দু’বেলা পেট ভরবে। সন্ধের পর স্বামী কাজ সেরে বাড়ি ফিরলে গা ধুয়ে, কপালে বড়ো করে টিপ দিয়ে বসবে পাশে। গুজুরগুজুর করে গল্প হবে। সেই গল্পে যেমন সুখ থাকবে তেমন দুঃখও থাকবে। একসময় স্বামীর কাঁধে মেয়ে মাথা রাখবে আনমনে। কষ্টের সংসারও সুখের মনে হবে। নিজের মনে হবে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তেমনটা হয় না। শ্বশুরবাড়িতে আধপেটা খাবার জোটানোও কঠিন হয়ে পড়ে। তার থেকে অনেক সহজে গায়ে আগুন দেওয়ার জন্য কেরোসিন পাওয়া যায়। রান্নাঘর থেকে গোয়ালঘর, খাটের তলা থেকে সিঁড়িরতলা, শাশুড়ি-ননদ-বর যত্ন করে শিশি সাজিয়ে রাখে। নতুন বউয়ের যেন অসুবিধে না হয়। হাত বাড়ালেই বন্ধুর মতো, হাত বাড়ালেই কেরোসিন। যাক সে আলাদা গল্প। আমরা বিন্তিতে ফিরি।

আর-পাঁচটা গরিব ঘরের মেয়ের মতো আমাদের বিন্তিরও বিয়ের অপেক্ষা চলতে লাগল। একই ঘটনা। হেরফের নেই। ঘটনায় হেরফের হল হঠাৎই। ঘর সংসারের কাজের ফাঁকে বিন্তি গিয়ে একদিন নাম লিখিয়ে এলও গ্রামের স্কুলে। এই ভয়ংকর খবর জানার পর মা চুলের মুঠি চেপে ধরল। বিন্তি বলল, ‘ওরা দুপুরে খেতে দেয়। পয়সাকড়ি কিছু লাগে না।’ বিন্তির মা আর আপত্তি করেনি। সংসারের একটা পাত তো কমল। মিড ডে মিলে বিন্তি কোনওদিন খিচুড়ি খায়, কোনওদিন ভাত, কোনওদিন আবার রুটি, আলুর দম। খায় আর এলোমেলো ভাবে স্কুল থেকে পাওয়া বই খাতা নিয়ে নাড়াচাড়া করে। খাবার পেতে হলে হাতে বই লাগে। একসময় বিন্তি খেয়াল করল, বই নাড়াচাড়া করতে তার মজা লাগছে! দুনিয়ায় এত কিছু জানার আছে! রাতে ঘরে আলো নেই। তাই দিনেরবেলা সঙ্গে বই নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বিন্তি। ফাঁক পেলে খুলে বসে। ধীরে ধীরে স্কুলের দিদিমণিদের নজরে পড়ে। তারা বুঝতে পারে, এই মেয়ে লেখাপড়ায় ভালো। গড়পড়তা ভালো নয়, বেশি ভালো। এই মেয়ের মাথায় বুদ্ধি আছে। গড়পড়তা বুদ্ধি নয়, বেশি বুদ্ধি।

পরীক্ষায় বিন্তি ক্লাসের সবাইটে টপকে যেতে লাগল। এইভাবে ক্লাস টেন পর্যন্ত চলেছে। এরপরই শুরু হয়েছে গোলমাল। বিন্তির জন্য পাত্র পেয়েছে তার বাবা। পাত্র অতি ভালো। একই গ্রামে বাড়ি। মন্দিরতলা। শক্তপোক্ত চেহারা। পাকা কাজকর্ম নেই বটে কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। গভর্নমেন্টের একশো দিনের স্কিম চালু হলে কাজ জুটে যায়। পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ আছে। পার্টি থেকে কাজ পায়, তবে বাকি সময় ছেলে যে বাড়িতে বসে ল্যাজ নেড়ে থাকে, এমন নয়। রোজের ভাড়ায় ডাকাতি খাটে। যেমন ডাক পায়। দু-তিনদিন বাইরে বাইরে থাকে। মাঝেমধ্যে পুলিশ এসে ধরেও নিয়ে যায়। তবে রাখে না বেশিদিন। জেলখানায় অত চোর ডাকাত রাখবার জায়গা নেই। সব মিলিয়ে ছেলে রোজগেরে। ছেলের মা এবার লক্ষ্মীমন্ত বউ চায়।

বিন্তির বাবা-মা হাতে পাত্র তো নয়, চাঁদ পেয়েছে। এমন পাত্রের হাতে মেয়েকে তুলে দেওয়া বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার। জামাই সাহসী না হলে চলে? আতুপুতু জামাই হল পাড়াগাঁয়ের ভাঙা স্কুলের ভাঙা মাস্টার। চোপ্ বললে প্যান্টে ইয়ে। বিন্তি বোকাটা লেখাপড়া শিখলে হয়তো ওই দিকেই চলে যাবে। ল্যাগব্যাগে একটা মাস্টার জুটিয়ে ভাঙা সংসার করবে। ডাকাত পাত্র তার থেকে ঢের ভালো। সে যদি দু-পাঁচ মাস জেলে থাকে তাতেই বা ক্ষতি কীসের? বাড়ি তো আর ফাঁকা থাকবে না। শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, ভাসুর সবাই থাকবে। ভয় কীসের?

বিন্তির বাবা-মা ফুল ভল্যুমে বিয়ের গোছগাছ শুরু করেছে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। তারা ভালো করেই দিতে চায়। যতটা সাধ্য ততটাই করবে। এমনকী পুঁটিকুমারকে পর্যন্ত খবর পাঠিয়েছে, মালিককে সে যেন ছুটির কথা বলে রাখে। পারে যদি মাইনের টাকা কিছু অ্যাডভান্স চায় যেন। পুঁটিকুমারও তৈরি হচ্ছিল। অভয়পদবাবুকে ছুটি এবং মাইনের কথা বলব বলব করছিল। এমন সময়েই বিপদ হল। বেঁকে বসল বিন্তি। বিন্তি তার বাবা-মাকে জানিয়েছে, বিয়ে করবে না সে। লেখাপড়া শিখবে। আরও পড়বে। স্কুল পাশ হবে। কলেজেও নাকি যেতে চায়! বামন হয়ে চাঁদ ধরতে চেয়েছে গাধাটা। সরি, গাধা নয়, গাধি। তিনদিন হল বাবা-মা কঠিন মার দিয়ে মেয়েকে ঘরে আটকে রেখেছে। একেবারে বিয়ের পর ডাকাত বর এসে মুক্ত করবে। এর ফাঁকে বিন্তি তার স্কুলের কোন এক বন্ধুকে দিয়ে ভাইয়ের কাছে পোস্টকার্ড পাঠিয়েছে একটা। বিয়ে দিলে সে বিষ খাবে।

ঘটনা বলা শেষ করে পুঁটিকুমার নাক টানল। আমি মুখ না ঘুরিয়ে বললাম, ‘পুঁটিকুমার, তুই কি কাঁদছিস?’

‘না।’

‘গুড। পুরুষমানুষের কথায় কথায় কান্নাকাটি ভালো নয়। কান্নার ঠাকুর রাগ করেন। কান্নার ঠাকুরের নাম জানিস?’

‘না।’

আমি বললাম, ‘আমি জানি, এখন মনে পড়ছে না। মনে হয়, আইসক্রিম খেয়েছি বলে ঠান্ডায় বুদ্ধি জমে গেছে।’

পুঁটিকুমার বলল, ‘সাগরদা, দিদি কি সত্যি বিষ খাবে?’

আমি একটু ভেবে নির্লিপ্ত গলায় বললাম, ‘মনে হচ্ছে না। গাধারা কখনও বিষ খেয়েছে বলে শুনিনি। তোর দিদি অবশ্য গাধা নয়, গাধি। পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া গাধি।’

পুঁটিকুমার আমার দিকে ঘুরে কটমট করে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি আমার দিদিকে গাধি বললে!’

‘তাছাড়া আর কী বলব? অমন সু-পাত্রকে বিয়ে না করে যে লেখাপড়া চালাতে চায়, তার মাথায় কোনও বুদ্ধি আছে বলে মনে করিস? ক’জনের কপালে ডাকাত বর জোটে? তুই সবাইকে বুক ঠুকে বলতে পারবি, আমার জামাইবাবু কে জানো…হু হু…যদি চাস জামাইবাবুকে ধরে এনে তোর মালিককে দুটো ধমকও খাওয়াতে পারিস। বেটার মালিক মালিক করা বেরিয়ে যাবে। হ্যাঁরে, ওই ছেলে কি মাথায় ফেট্টি, কপালে টিপ, কানে জবাফুল গুঁজে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে?’

পুঁটিকুমার একটু গুম মেরে থেকে বলল, ‘দিদির এখনও বিয়ের বয়স হয়নি।’

আমি চমকে উঠলাম। পুঁটিকুমার এসব জানল কী করে!

‘তোকে কে বলল?’

সন্ধে নামছে। সন্ধে নামবে শান্ত ভঙ্গিতে। আকাশের আলো আবার আকাশে ফিরে যাবে চুপিচুপি। গাছ ডালপাতা নামিয়ে বিশ্রামে যাবে নীরবে। ঘর হারানো পাখি ক্লান্ত ভঙ্গিতে উড়ে যাবে আরও ভুল পথে। ধানখেত, মাঠ, পথঘাট ও শাপলা দিঘির পাড় মুড়ি দেবে জোনাকি আঁকা আঁধার অথবা কুয়াশার ফুলছাপ কাঁথায়। সারাদিন পর চাঁদের আলোয় লম্বা ছায়া ফেলে হেঁটে যাবে মানুষ। হেঁটে যাবে প্রিয়জনের কাছে। মনে মনে বলবে, এবার তুমি। এবার তুমি। এবার তুমি। এই শান্ত স্নিগ্ধভাব বড়়ো মায়াবী লাগবে। ভালো লাগবে খুব। অথচ কলকাতায় সন্ধে নামে হই হই করে। চারপাশ ঝলসে ওঠে ঝলমলে আলোয়। চকচকে রাস্তা ধরে গাড়ি ছুটতে থাকে। পাল্লা দিয়ে ছুটতে থাকে মানুষ। সেই দৌড় দেখলে ভয় লাগে।

পুঁটিকুমার বলল, ‘আমি জানি। আমি অনেক কিছুই জানি।রেস্টুরেন্টে টেবিল মুছি বলে কি কিছুই জানি না মনে করো? আঠেরো বছর বয়স না হলে বিয়ে ঠিক নয়। আমাদের দোকানে একদিন দুটো লোক এসব বলাবলি করছিল। তার মধ্যে একটা ছিল হোৎকা, অন্যটা চিমসে। চিমসেটা বোধহয় পুলিশের লোক। তবে গোঁফ মোটা। ডালের বাটিতে চুমুক দিতে গিয়ে গোঁফে ডাল লাগিয়ে ফেলল। হোৎকাটাকে এসব বলছিল।’

আমি বললাম, ‘কী বলছিল।’

‘বলছিল, মেলা ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ কোরো না। তোমার মেয়ের বয়স কত? হোৎকা বলল সতেরো বছর তিন মাস। না না তিন মাস নয়, পাঁচ মাস। চিমসেটা এক ধমক দিয়ে বলল, মেয়ের বয়স জানো না? যাই হোক আঠেরো বছর তো হয়নি। আঠেরো বছরের আগে বিয়ে করা যায় না, বিয়ে করলে হাজতে থাকতে হয়। ছোকরাকে থানায় আনার আগে আমাকে একটা ফোন করে দিও। এমন ডান্ডা মারব…। হি হি।’

পুঁটিকুমারের হাসি দেখে খুব ভালোলাগল। বেটা জোর পেয়েছে, মজাও। কম বয়সে দিদির বিয়ে হলে সে যেন নিজেই ডান্ডা মারবে। কাকে মারবে এইটা খালি বুঝতে পারছে না। আমি খানিকটা দমিয়ে দেবার জন্য বললাম, ‘ওসব আইনকানুন সবার জন্য নয়। আইন একেক জনের জন্য একেকরকম। তোদের মতো গরিবদের একরকম, আবার ওই যে দেখছিস গাড়ি নিয়ে সুঁই করে চলে গেল, তার জন্য আর-একরকম। এত জানিস এই আসল কথাটাও জেনে রাখ। তোর দিদির কম বয়েসে বিয়ে হলে কেউ ডান্ডা খাবে না। তাছাড়া বিয়ে না হলে তোর দিদি খাবে কী? তখনও তো বিষ খেতে হবে। বিষ আর বিয়ের মধ্যে বিয়েটাই তো ভালো অপশন। অপশন বুঝিস? অপশন হল পথ। তোর দিদির উচিত বিয়ের পথটাই বেছে নেওয়া।’

আমার কথায় পুঁটিকুমারের ভুরু কুঁচকে গেল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘দিদি লেখাপড়া করতে চায়।’

আমি শহিদবেদি থেকে নেমে পড়লাম। এবার ফিরতে হবে। এই ছেলে মূল জায়গায় ঢুকে পড়েছে। তাহলে আর একটু বাজিয়ে দেখা যাক।

‘পুঁটিকুমারবাবু, ওটাও গরিব মানুষদের জন্য নয়। দেখিস না, গরিব মানুষ লেখাপড়া শিখলে কেমন ঢাক পেটানো হয়। টিভিতে দেখানো হয়, কাগজে ছাপা হয়। অভাবী অথচ মেধাবী। ভাবটা এমন যেন অভাবে থাকলে জ্ঞানগম্যি হওয়াটা বিরাট কোনও ব্যাপার।’

আমার এই লেকচার পুঁটিকুমার গা করল না। মনে হয় বুঝতে পারেনি। বললাম, ‘তোর দিদির লেখাপড়া শিখে হবেটা কী বল তো? বরং স্কুল-টুল পার হয়ে গেলে বিপদ হবে। তখন আর বিয়ের জন্য ছেলে পাওয়া যাবে না। তার থেকে এই ভালো। চল, এবার ফিরবি। অভয়পদবাবু তোকে না দেখলে খেঁচামেচি লাগাবে। মালিক বলে কথা।’

পুঁটিকুমার চুপ করে আমার পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। সে নীল রঙের চেক একটা হাফ শার্ট পরেছে। তাকে বেশ দেখাচ্ছে। নাক টেনে বলল, ‘সাগরদা, তুমি আমাকে কী করতে বলো।’

‘দিদিকে, চিঠি লেখ। হয় বাবা-মায়ের কথা মতো বিয়ে করো, নয়তো বিষ খাও।’

পুঁটিকুমার থমকে দাঁড়াল। আমি বললাম, ‘কী হল?’

‘আমি দিদিকে বিষ খেতে বলব! সাগরদা, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’

আমি পুঁটিকুমারের কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘মাথা খারাপ হবে কেন! বিন্তি তো নিজেই বিষ খেতে চেয়েছে। আমার কী দোষ?’

পুঁটিকুমার মাথা নামিয়ে ব্যথিত গলায় বলল, ‘ছি ছি।’

আমি মনে মনে হাসলাম। মুখে চিন্তার ভাব নিয়ে বললাম, ‘তুই কী চাস?’

পুঁটিকুমার হনহন করে হাঁটতে শুরু করল। বলল, ‘আমি কিছু চাই না। আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতেও চাই না।’

আমি এই রাগটাই চাইছিলাম। এই ছেলের বয়স যতই কম হোক, ভেতরে আগুন আছে। আমাকে লেবু পাচার করে দেবার ঘটনাতেই আঁচ পেয়েছিলাম। যত কথা বলছি, ছেলের ভেতরের আগুন সম্পর্কে নিশ্চিত হচ্ছি। আমার একটাই দায়িত্ব এই আগুন আরও বাড়িয়ে দেওয়া।

‘আচ্ছা, পুঁটিকুমার একটা কাজ করলে কেমন হয়?’

পুঁটিকুমার এতটাই রেগে আছে সে আমার দিকে তাকাল না।

‘তুই নিজে গিয়ে যদি বিন্তিকে খানিকটা বিষ পৌঁছে দিয়ে আসিস?’

পুঁটিকুমার আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। চারপাশের দোকানের আলো তার চোখে এসে পড়েছে। মনে হচ্ছে, জ্বলছে। আমি খানিকটা থতমত খাওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, ‘না মানে, তুই তো জানিস কলকাতায় তোদের গ্রামের থেকে অনেক ভালো বিষ পাওয়া যাবে। টক করে খেয়ে ফট করে মরে যাওয়া যায়। তাছাড়া রকমারিও পাবি। বেছেবুছে কিনতে পারবি। শুনেছি শিয়ালদার কোনও দোকানে যেন বিষের হোলসেল হয়। হোলসেল জানিস? পাইকারি। দুপুরের দিকে কাজ কম থাকলে চলে যাবি না হয়। একেকটা কারণে একেকরকম বিষ কাজ করে। খেতে না পাওয়ার কারণে মরতে চাইলে একরকম বিষ, শ্বশুরবাড়িতে মারধোর করলে একরকম বিষ, মা বকলে একরকম, পরীক্ষায় ফেল করলে অন্যরকম। আমার মনে হয় লেখাপড়া করতে না পেরে যেসব মেয়ে কষ্ট পায়, মরতে চায় তাদের জন্যও আলাদা জিনিস পাওয়া যাবে।’

আমি বলছি আর আড়চোখে পুঁটিকুমারের চোখের দিকে বারবার তাকাচ্ছি। চোখ জ্বলছে ধক্ধক্ করে। পুঁটিকুমার ঘন ঘন নাক টানছে। না সর্দি, না কান্না। এখন সে নাক টানছে রাগে। বাঃ রাগেও নাক টানা যায়! জানতাম না তো। পুঁটিকুমার তাহলে এখন রাগকুমার। আমি এই রাগ পাত্তা দিলাম না। মুচকি হেসে বললাম, ‘যদি বলিস, ওই দোকানে আমিও তোকে নিয়ে যেতে পারি। চল কালই নিয়ে যাব।’

পুঁটিকুমার আমার দিকে সরু চোখে তাকাল। তারপর হাফপ্যান্টের দুটো পকেট হাতড়িয়ে খানিকটা খুচরো পয়সা বের করল। এগিয়ে ধরে বলল, ‘এটা ধরেন।’

আমি নার্ভাস হেসে বললাম, ‘কী এটা!’

জবাব না দিয়ে পুঁটিকুমার গোঁ দেখিয়ে মুখ নামিয়ে থাকল। আমি আবার বললাম, ‘আরে বাপু, বলবি তো পয়সাগুলো কেন দিচ্ছিস! আচ্ছা ফ্যাচাং তো।’

পুঁটিকুমার নাক টেনে বলল, ‘আপনার আইসক্রিমের দাম। আপনার পয়সায় আইসক্রিম খাওয়াটাই আমার ভুল হয়েছে। গুনে দেখেন, কম পড়লে কাল যখন দোকানে খেতে আসবেন দিয়ে দেব।’

আমি খুশি হয়ে পয়সা গুনতে শুরু করলাম। আমি পেরেছি। বারো বছরের এই বালকের ভেতর যে-ধিকধিকি আগুন জ্বলছিল, তাকে দাউ দাউ করে দিতে পেরেছি। আমার শুধু ছোট্ট একটা কাজ বাকি রইল।

‘পুঁটিকুমার, আমি কি তোর সঙ্গে যেতে পারি।’

‘না।’

পুঁটিকুমার হন হন করে হেঁটে এগিয়ে গেল। পিছন থেকে আমার মনে হল, বেটা হাঁটছে না। ঘোড়ায় চেপে ছুটছে। আমি হলফ করে বলতে পারি, সে যাচ্ছে মন্দিরতলা। তার দিদির কাছে।

‘রেবা, কেমন আছ?’

‘তুমি আবার ফোন করেছ!’

‘রাগ করছ কেন?’

‘তোমার ওপর আমার যে রাগ বা খুশি কোনওটাই হয় না, তা তুমি ভালো করেই জানো।’

‘বাঃ তোমার অবস্থা তো দেখছি শঙ্খ ঘোষের কবিতার মতো রেবা। ওই যে কবিতাটা আছে না? কোনও গুপ্তঘর নেই। অজ্ঞাতবাসেও নিরাশ্রয়।য দেয়ালে দেয়ালে লেগে বারে বারে ফিরে আসে স্বর।’

রেবা চুপ করে রইল। সে এরকমই। মাঝে মাঝেই চুপ করে যায়। যখন কলকাতায় ছিল তখনও কথা বলতে বলতে থেমে যেত, অন্যমনস্ক হয়ে যেত। সম্ভবত যে বহু কারণে আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম, তার একটা এই হঠাৎ থেমে যাওয়া স্বভাব। আজও তার এই স্বভাব। আর তাই আজও তাকে ভালোবাসি। আমার সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারেও সে হঠাৎ থেমে গেছে। আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ‘না’ শুনেছিল। শুনে ভেঙে পড়েনি। আমাকে দোষ দেয়নি মোটে। বরং খুশিই হয়েছিল।বলেছিল, ‘আমি জানতাম, তুমি না বলবে। সাগর তুমি বাঁধা পড়বার মানুষ নও। আর সেই কারণে তোমাকে আমি এত ভালোবাসি।’

রেবা তার রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার বাবার সঙ্গে লামডিং চলে গেছে। জঙ্গল আর কুয়াশা নিয়ে থাকে। বাবার তৈরি করা ফার্মে ম্যানেজারি করে। সেখানে দুঃস্থ, অসহায় মেয়েরা কাজ করে। ছোটো ছোটো পাহাড়ি ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুলও খুলেছে। মাসে দু-মাসে আমায় ফোন করে, চিঠি লেখে। মাঝে মাঝে আবার স্বভাবমতো চুপ করে যায় দিনের পর দিন। আমি ফোন করলে কেটে দেয়। চিঠি পাঠালে ছিঁড়ে ফেলে দেয় কুচি কুচি করে।

কোনও কোনও ঝড়ের বিকেলে রেবার জন্য মন কেমন করে। গড়িয়াহাটার কংক্রিটে বোনা মোড়ে দাঁড়িয়ে শুনতে পাই কে যেন বলছে– আকাশতলে দলে দলে মেঘ যে ডেকে যায় আয় আয় আয়য জামের বনে আমের বনে রব উঠেছে তাই– যাই যাই যাই।’ ইচ্ছে করে, ছুটে চলে যাই। আমি রেবাকে কয়েকবার বলেওছি।

‘আমি যদি তোমার কাছে যাই তুমি রাগ করবে? খুব মন কেমন করছে রেবা।’

রেবা গাঢ় গলায় বলে, ‘রাগ করব না। তবে তুমি এসো না। আমার জন্য তোমার মন কেমন, তোমার আসার থেকেও আমার কাছে অনেক বেশি দামি। প্লিজ, তুমি এসো না।’

রেবাকে ফোন করতে একবারেই ধরল। আসকারা দেওয়া গলায় বলল, ‘কবিতা না বলে, কেন ফোন করেছ বলো। শঙ্খ ঘোষ, জয় গোস্বামী শুনিয়ে আমাকে মুগ্ধ করতে পারবে না। ওই স্টেজ আমি পার করে এসেছি।’

‘তাহলে কি আমি অন্য কারও কবিতা শোনাব? আজকাল অনেকেই খুব সুন্দর কবিতা লিখছে। যদি বলো শোনাতে পারি। সেদিন কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে শুনলাম এদের নাকি শূন্য দশকের কবি বলা হয়।’

রেবা বলল, ‘তুমি আমাকে এইসব হাবিজাবি বলতে ফোন করেছ?’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। তুমি ছাড়া আমার হাবিজাবি কে শুনবে?’

রেবা হেসে বলল, ‘আচ্ছা আমিই শুনব। দাঁড়াও এক কাপ কফি নিয়ে আসি। আজ এখানে খুব ঠান্ডা পড়েছে। কাল রাত থেকে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে।’

আমি হলফ করে বলতে পারি, কফি আনবার নাম করে আজকের মতো বিদায় নেবে রেবা। আমি সারাদিন মোবাইল কানে নিয়ে বসে থাকলেও তাকে পাব না। মোবাইল ছেড়ে যদি ল্যান্ড ফোনে ধরতে চেষ্টা করি তাতেও লাভ হবে না। ফোন বেজে যাবে সে ধরবে না। একাজ রেবা আগেও করেছে। পরে যখন জিজ্ঞেস করেছি বলেছে, ‘তোমার কথা খুব শুনতে ইচ্ছে করছিল। তাই ফোন রেখে পালিয়ে গেলাম। মনে হল, কথা শোনার থেকে কথা শোনবার ইচ্ছে অনেক বড়ো। কথা বারবার শোনা যায়, ইচ্ছে বারবার আসে না। ভালো করিনি?’

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, ‘ভালো করেছ। ফিলজফি হিসেবে চমৎকার। রিয়েলিটির বদলে ইচ্ছে।’

তবে আজ ফিলজফি করলে চলবে না। আজ আমি সত্যি সত্যি কাজের জন্য ফোন করেছি। সুতরাং ওকে আটকাতে হবে।

‘দাঁড়াও রেবা, পরে কফি খাবে। জরুরি একটা দরকারে তোমাকে ফোন করেছি।’

রেবা একটু থমকাল। আমি প্রমাদ গুনলাম। এই রে, পুরো চুপ করে না যায়। হড়বড় করে বললাম, ‘একটা চোদ্দো পনেরো বছরের মেয়ে বিষ খেতে চলেছে…।’

রেবা এক মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে বলল, ‘কী হয়েছে? মেয়েটা কে?’

‘মেয়েটার নাম বিন্তি। চমৎকার মেয়ে। আমার ধারণা এই মেয়ে বিষ না খেয়ে যদি বেঁচে যায়, তাহলে একদিন তোমার বাবার মতো মস্ত বড়ো পুলিশ অফিসার হবে।’

রেবা অবাক গলায় বলল, ‘পুলিশ অফিসার! কেন পুলিশ অফিসার কেন?’

‘বুদ্ধি আর সাহস দুটোই এই মেয়ের আছে। সাময়িক ভাবে সেই সাহসে চিড় খেয়েছে। ঘাবড়ে গেছে বলতে পারো। ওর সাহস যদি ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে দেখতে হবে না, বিন্তি অনেক দূর যাবে।’

‘এবার ঘটনাটা বলো। আমি কী করতে পারি সেটা বলো।’

আমি সংক্ষেপে এবং দ্রুত কান্তি-বিন্তির ঘটনা বললাম। কীভাবে মেয়েটা লেখাপড়া শিখেছে, কীভাবে মেয়েটাকে বিয়ের জাঁতাকলে ফেলে পিষে মারবার প্ল্যান হয়েছে।

‘কদিনের জন্য তোমার ওখানে মেয়েটাকে পাঠিয়ে দিলে কেমন হয় রেবা? লামডিং-এ থাকবে হপ্তাখানেক। কিছুদিন থাকার পর এদিকটা যখন শান্ত হবে, তখন না হয় ফিরিয়ে আনা গেল। হস্টেলে রেখে কোনও স্কুলটুলে যদি ভর্তি করে দেওয়া যায়। তমালের এক মামাতো না মাসতুতো বোন বারাসতে এরকম একটা স্কুল বানিয়েছে। গরিব মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর স্কুল।’

রেবা একটু ভেবে বলল, ‘আমার এখানে পাঠানো ঠিক হবে বলে মনে হয় না। মেয়ের বাবা-মা বা ভাবী বর কিডন্যাপিং আর পাচারের অভিযোগ করতে পারে। বলবে গ্রাম থেকে নাবালিকা অপহরণ করে পাচার করে দিয়েছে।’

এবার আমি হাসলাম। বললাম, ‘সেটা সম্ভব নয়। তাহলে ভাইয়ের বিরুদ্ধে দিদিকে অপহরণের মামলা করতে হবে। সেই কারণেই তো আমি নিজে গেলাম না। পুঁটিকুমারকে রাগিয়ে, তাতিয়ে পঠিয়ে দিচ্ছি। আমি জানি ও ঠিক দিদিকে নিয়ে চলে আসবে। আমি সঙ্গে গেলে এত সহজে হতো না। অনেক ঝামেলা করতে হতো।’

রেবা বিরক্ত হল। গলায় সামান্য ঝাঁঝ নিয়ে বলল, ‘কী ঝামেলা হতো? হলে হতো। ওই গ্রামে তোমার নিজের যাওয়া উচিত ছিল। তুমি যে এত ভীতু হয়ে গেছো আমি জানতাম না। এত বড়ো একটা অন্যায় হচ্ছে… একটা মেয়ে লেখাপড়া করতে চায়, অথচ বয়স হয়ে যাবার আগেই তাকে বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দেবে? তোমার পুলিশে যাওয়া উচিত ছিল। বাবা-মায়ের নামে ডায়ারি করা উচিত ছিল।’

আমি একটু ভেবে, বানিয়ে হাই তোলার আওয়াজ করে বললাম, ‘ওসবে বড্ড পরিশ্রম রেবা।’

‘কী বলছ! পরিশ্রম? ছি ছি। এটা তুমি কী বলছ? একটা মেয়ে বিষ খেতে চলেছে, জেনেও তুমি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে।’

আমি মিথ্যে অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, ‘হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলাম কোথায়! পুঁটিকুমারকে যে উত্তেজিত করলাম।’

‘এসব তোমার ফাঁকিবাজির কথা। ওইটুকু ছেলেকে এরকম একটা সিরিয়াস বিষয়ে উত্তেজিত করে লাভ কী? আমি হলে নিজে চলে যেতাম।’

আমি মুখ দিয়ে তাচ্ছিল্যের আওয়াজ করে বললাম, ‘তারপর আমি গেলাম আর ওই মেয়ে বলল, আপনি কে? আপনি কি আমার বিয়ে দিচ্ছেন? নাকি আপনি আমায় বিয়ে করবেন? মেয়ে যদি পালটি খায়? আমার কী হতো একবার ভেবে দেখেছ?’

রেবা আর সহ্য করতে পারল না। এবার ধমকে উঠল।

‘স্টপ ইট। মেয়েদের সম্পর্কে এই ধরনের বিশ্রী কথা বলবে না। বিন্তি মত বদলাবে কেন? আজকাল প্রায়ই খবরের কাগজে বেরোয়, মেয়েরা রুখে দাঁড়িয়েছে। বিন্তিও তাই করত। সাপোর্ট পেলে রুখে দাঁড়াত।’

রেবার এই রাগ, এই তেজ আমার দারুণ লাগল। আরও খোঁচা মারলাম।

‘আমি সাপোর্ট দেবার কে? আমাকেই কেউ সাপোর্ট দেয় না।’

রেবা বলল, ‘চুপ কর তো, আমাকে ভাবতে দাও।’

আমার উদ্দেশ্য সফল। একজন দুঃখী মেয়ের ভাবনার দায়িত্ব একজন দুঃখী মেয়ে নিয়ে নিয়েছে। এর থেকে খুশির খবর আর কী আছে? এবার দুঃখে দুঃখে আনন্দ হবে।

আমি গলা নরম করে বললাম, ‘শান্ত হও রেবা। তুমি ঠিকই বলেছ, এই মেয়ের বাবা-মাকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু তারপর? দুদিন খবরের কাগজে বিন্তির ছবিটবি না হয় বেরোবে। বাবা-মাকে জেলে পুরে সাহসিনী পুরস্কারও জুটে যেতে পারে। কিন্তু তারপর? সে কার কাছে থাকবে? কোথায় পড়বে? কীভাবে বড়ো হবে? একটা অলটারনেটিভ ব্যবস্থা করতে হবে না? আর একটা সত্যি কথা বলব, আমি বিন্তির বাবা-মায়ের কোনও দোষ দেখি না। হতদরিদ্র এই পরিবার মেয়ের বিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারে? দোষটা আমাদের সকলের। তাই দায়িত্ব আমাদের। তাৎক্ষণিক কোনও সমাধানে লাভ হবে না।’

রেবা মনে হয় আমার লেকচারে সামান্য শান্ত হল। বলল, ‘আজকাল এরকম তো হচ্ছে। মেয়েরাই প্রতিবাদ করছে।’

‘বললাম তো। এই মুহূর্তে বিন্তির প্রতিবাদ করার সাহস নেই। সে নিজে পুলিশের কাছে যেতে পারবে না। সেই কারণেই বিষ খাবার পরিকল্পনা করেছে। অন্তত ঘটনা শুনে আমার তো সেরকমই মনে হয়েছে। যদি বা এখন কিছু না করে, বিয়ের পর করবেই।’

রেবা একটু চুপ করে থেকে চিন্তিত গলায় বলল, ‘তুমি ওর ভাইকে পাঠালে কেন? ওইটুকু ছেলে কি পারবে?’

‘আমি তো পাঠাইনি। সে নিজেই যাবে। আমি পাঠালে না হয় একটা কথা ছিল। যে নিজের জোরে যুদ্ধে যায় তার পরাজিত হবার সম্ভবনা কম থাকে।’

কথা শেষ করে আমি হাসলাম। রেবা বলল, ‘আমার টেনশন হচ্ছে। মেয়েটা এর মধ্যে কিছু করে না বসে। এই বয়েসে ছেলেমেয়েরা খুব সেনসেটিভ হয়। মেয়েরা বিশেষ করে।’

আমি শেষ খোঁচাটা মারলাম। বললাম, ‘তুমি বিষ খাওয়ার কথা বলছ? অত চিন্তার কি আছে? খেলে খাবে। ধেড়ে মেয়ে। তাছাড়া বললাম তো, এখন না খেলে, পরে খাবে। আমাদের যতটুকু করবার করলাম। এর বাইরে যা ঘটবার তাই ঘটবে। আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই।’

রেবা ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘তুমি আবার কী করলে? কিছু তো করোনি। একটা এগারো-বারো বছরের ছেলেকে উসকে দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছ। গ্রামের নাম কী, কোন থানা? দাঁড়াও কাগজ পেন নিয়ে এসে টুকি।’

আমি অবাক গলায় বললাম, ‘গ্রাম, থানার নাম জেনে কী করবে রেবা? তুমি যাবে?’

রেবা থমথমে গলায় বলল, ‘হ্যাঁ। যাব।’

রেবা কাগজ পেন আনতে গেল। আমি নিশ্চিন্তে অপেক্ষা করতে লাগলাম। রেবা ফিরে আসবে। কাগজে গ্রামের নাম লিখে নেবে। সুদূর লামডিং-এ বসে সে মন্দিরতলার কান্তি- বিন্তিদের দুঃখের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। যে বহু কারণে রেবাকে এত ভালোবাসি তার একটা আগেই বলেছি। আর-একটা হল, অসহায়ের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া। এত ভালোবাসা কি শুধু মেয়েদেরই থাকে।

অভয়পদবাবু তার গোল চশমা নাকের ওপর আরও নামিয়ে বললেন, ‘আপনি সত্য বলছেন!’

আমি খনিকটা মউরি মুখে দিয়ে বললাম, ‘অবশ্যই সত্যি বলছি স্যার। আপনি খোঁজ নিন। আপনার পুঁটিকুমারকে ওরা ঘরের মধ্যে বেঁধে রেখেছে।’

অভয়পদবাবুর সোজা হয়ে বসে বললেন, ‘এতবড়ো সাহস! আমার পুঁটিকুমারকে বেঁধে রেখেছে! ওরা কে বাঁধবার? যদি বাঁধবারই হয় আমি বাঁধব। কে ওরা বলুন তো সাগরবাবু। আমার কর্মচারীকে বাঁধছে! মারছে! হারামজাদাদের দাঁত ভেঙে দেব।’

আমি তাচ্ছিল্যের ভাব দেখিয়ে বললাম, ‘যতদূর খবর পাচ্ছি, একটাঞ্জভাড়া খাটা ছেঁদো ডাকাত আর তার কিছু চেলাচামুণ্ডা এই ব্যাপারে জড়িয়ে আছে।’

অভয়পদবাবু গলায় হুংকার দিলেন, ‘ডাকাত! আমার কর্মচারীকে ডাকাত ঘরে বন্দি করে রাখে কোন সাহসে?’

আমি হাই তোলার ভান করে বললাম, ‘কোন সাহসে সে আপনি জানেন স্যার। আজকাল তো এমনই হয়। ভালো লোককে ডাকাত বন্দি করে রাখে, আর ডাকাতরা ট্যাং ট্যাং করে ঘুরে বেড়ায়। আপনার মতো ভদ্রলোকরা পাত্তাও পায় না। কালে কালে দেশটার পজিশন খুবই খারাপ দিকে যাচ্ছে। আপনার কি মনে হয় রসাতলে যেতে আর কত দেরি?’

আমার কথা শুনে অভয়পদবাবু মুখে ‘হুম্মম…’ শব্দে চাপা গর্জনের মতো করলেন।

খাওয়াদাওয়ার পর আমি একটা চান্স নিয়েছিলাম। ঢিল ছুড়েছিলাম বলা যায়। পুঁটিকুমারের মালিককে খেপিয়ে তুলতে পারলে কেমন হবে? খেপিয়ে যদি ঘটনায় জড়িয়ে নেওয়া যায়? ভেবেছিলাম, হবে না, তবু ভাবলাম, ট্রাই নিতে দোষ কী? কোনও দোষ নেই। মানুষের গোটা জীবনটাই তো ট্রাই, ট্রাই এবং ট্রাই। লেবু ছাড়া ডাল-ভাত খেতে খেতে প্ল্যান করছিলাম। এর আগেই অন্য কর্মচারীদের কাছ থেকে খবর নিয়ে নিয়েছি।ঞ্জপুঁটিকুমার দিদির বিয়ের নাম করে ছুটি নিয়ে গ্রামে চলে গেছে কাল রাতেই। যাবার আগে তার মুখ ছিল থমথমে। কে যেন আমার নাম করে তাকে কী একটা বলতে গিয়েছিল, পুঁটিকুমার তাকে বলেছে, খবরদার, ওই লোকের নাম তার সামনে যেন কেউ না করে। শুধু ভাত খেতে এলে পাচার করা লেবুর টুকরো যেন পাতে দেওয়া হয়। লেবুর টুকরো যেন বড়ো সাইজের হয়।

সেই লেবু মেখে ডাল-ভাত খেতে খেতে প্ল্যান ঠিক করে নিলাম। অভয়পদবাবুর মালিকানা বোধে টোকা মারতে হবে। মালিকানাবোধ একটা স্পর্শকাতর বিষয়। যারা মালিক তারাই কেবল বুঝতে পারে। খাওয়া শেষ করে হাসি মুখে নিয়ে অভয়পদবাবুর সামনে গিয়ে বসলাম। তারপর টকাস্…। ঢিলটা যে এত সহজে লেগে যাবে ভাবতে পারিনি। আসলে যাবতীয় লক্ষ্যভেদের এটাই নিয়ম। ফিফটি ফিফটি চান্স। অর্জুন যে মাছের চোখে তীর মেরেছিল তাও একই তত্ত্বে। আচ্ছা, লক্ষ্যভেদ ফিফটির বদলে যদি লক্ষ্যভ্রষ্ট ফিফটি কাজ করত? তাহলে মহাভারত কি অন্যভাবে লেখা হতো?

চশমার লাল সুতো উড়িয়ে অভয়পদবাবু আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এলেন। বললেন, ‘আচ্ছা, আমার কী করা উচিত বলে আপনার মনে হয় সাগরবাবু?’

আমি পায়ের উপর পা তুলে বসলাম। চেয়ারে হেলান দিলাম আয়েস করে।

‘সেটা নির্ভর করছে আপনি কতটা মালিক তার উপরে। যদি হাফ মালিক হন তাহলে একরকম কথা। তখন আপনি শুধু ধার বাকি নিয়ে ভাববেন। যেমন ধরুন আমার এক মামা ছিলেন, তিনি সারাক্ষণ বাড়ির সেপটিক ট্যাংক নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকতেন। তার ভয় হতো, এই বুঝি ট্যাংক উপচে কেলেঙ্কারি ঘটবে। বাড়ির অন্য কোনও সমস্যায় তার মনই ছিল না। মামি রেগে গিয়ে বলতেন, তুমি কি শুধু বাড়ির গু’য়ের মালিক? বাড়ির অন্য কিছুর মালিক নও? আসল ব্যাপারটা হল তাই। মালিক যদি স্যার, আপনি শুধু গু’য়ের হন, তাহলে একরকম কথা, আর যদি গোটা বাড়ির হন তালে আর-একরকম কথা। যদি ওনলি গুয়ের হন তাহলে স্যার খুব একটা মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আমার মতো কোনও ছ্যাঁচড়া ধারবাকিতে চাট্টি ভাত-ডাল খায়, তাই নিয়ে মাথা ঘামালেই চলবে, আর যদি গোটা বাড়ির হন, তাহলে স্যার আপনাকে নিজের কর্মচারী পুঁটিকুমারকে নিয়েও ভাবতে হবে। তাকে কেউ আটকে রাখলে গিয়ে উদ্ধার করতে হবে।’

কথা শেষ করে আমি দু’হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙলাম।অভয়পদবাবুর অবস্থা ঢিলা। সুতো চশমা নিজে থেকেই ঝুলে গেছে। ইয়ের মতো অমন একটা শব্দ যে কেউ এমন অবলীলায় বারবার উচ্চারণ করতে পারে তাতেই তিনি বিহ্বল। অপমানিতও বটে। আমি দু’হাত মাথার ওপর তুলে আড়মোড়া ভাঙলাম। অভয়পদবাবু পিঠ সোজা করে বসলেন। চোখ দেখে মনে হচ্ছে, মানুষটার রাগ বাড়ছে। বাড়ারই কথা। মালিকানার প্রশ্ন খুব কঠিন প্রশ্ন। এড়ানো মুশকিল।

অভয়পদবাবু বিড়বিড় করে বললেন, ‘আমি যাব। আমি এখনই যাব। দেখব কোন হারামজাদা আমার কর্মচারীর গায়ে হাত দেয়।’

আমি উঠে পড়ে বললাম, ‘সাবধানে যাবেন স্যার। আজকাল চোর ডাকাতরা ভদ্রলোক দেখলেই পেটাচ্ছে।’

অভয়পদবাবু চোখ কটমট করে বললেন, ‘পেটালে পেটাবে। আমাকে ওসব ভয় দেখাবেন না। আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আপনিও আমার সঙ্গে যাবেন।’

আমি আঁতকে উঠে বললাম, ‘খেপেছেন? আমি এসবে নেই। বিয়ে ভাংচির কেসে ঢুকে মরব নাকি? তাছাড়া আমাকে আপনার ধারবাকির টাকা জোগাড় করতে হবে না?’

অভয়পদবাবু হুংকার দিয়ে উঠলেন, ‘আমাকে ধারবাকির ভয় দেখাবেন না সাগরবাবু। খবরদার ভয় দেখাবেন না। আপনার মতো ফুটো পার্টিকে আমি সারাজীবন বসিয়ে খাওয়াতে পারি।আমাকে বলে কিনা গুয়ের মালিক! এত বড়ো সাহস। অ্যাই কে আছিস, ট্যাক্সি ডাক…।’

অভয়পদবাবুর হম্বিতম্বির মধ্যেই আমি গুটিগুটি বেরিয়ে এলাম। আমার ডিউটি শেষ। বিন্তি উদ্ধারের কর্মকাণ্ডে বারো বছরের পুঁটিকুমার, লামডিংবাসী রহস্যময়ী রেবা, সুতো বাঁধা চশমা পরা অভয়পদবাবু (সঙ্গে হোটেলের কর্মীবৃন্দ) নেমে পড়েছে। আমার কাজ ছিল একটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে খানিকটা ক্রোধ ছড়িয়ে দেওয়া। আশাকরি আমি তা পেরেছি। এর বেশি আমি কী করব? কী বা পারি আমি? অলস, বেকার, অকর্মণ্য এক যুবক। সাহসও নেই, ক্ষমতাও নেই। চেহারাও রোগা পটকা। শুধু অনেকটা ধারবাকি আর খানিকটা বিশ্বাস নিয়ে টিকে আছি। যেমন বিশ্বাস করি বিন্তির মতো মেয়েদের বাঁচাতে হলে জ্ঞানগর্ভ লেকচার, পত্রপত্রিকার মুখ টেপা প্রবন্ধ, টিভি চ্যানেলের পাউডারের থেকে আগে দরকার ‘রাগ’। গনগনে রাগ। সেই রাগ বিন্তিদের বাঁচবার পথ আগুনে পুড়িয়ে শুদ্ধ করে দেবে। আমি পুঁটিকুমার, রেবা, অভয়পদবাবু সবাইকে রাগাতে পেরেছি। ওরা মাঠে নেমে পড়েছে। সমস্যা একটাই। ওরা সবাই আমার ওপর রেগে গেছে। তাতে কোনও ক্ষতি নেই। রাগে আমার অভ্যেস আছে। বরং রাগ না দেখলেই কেমন যেন অস্বস্তি হয়।

দপুরের খাওয়াটা একটু বেশির দিকে হয়ে গেছে। বেটারা ডবল ভাত খাইয়ে দিয়েছে। একটু গড়িয়ে নিলে ভালো হতো। গড়াব কোথায়? আমার জন্য খাট পালঙ্ক কে সাজিয়ে রেখেছে? আচ্ছা আজ যদি…।

শুয়ে আছি চৌবাচ্চা শহিদবেদির ওপর। বেদির গায়ে অস্পষ্ট ভাবে লেখা ‘তিনি ছিলেন নারী মুক্তির প্রজ্জ্বলিত শিখা…।’ কে তিনি? যে-ই হোন, আমার ঘুম পাচ্ছে। আহা! শহিদবেদিতে ঘুমোতে এত আরাম!

ঘুমের মধ্যে বড়ো সুন্দর স্বপ্ন দেখলাম। লামডিং-এর পাহাড়ের ধারে আমি আর রেবা দাঁড়িয়ে আছি মুখোমুখি। আমাদের পিছনে পাহাড় উঠে গেছে। সামনে গিরিখাদ। রেবা আমার ওপর রেগে আছে খুব। বলছে, ‘ছি ছি, বিন্তিকে উদ্ধার না করে তুমি আমার কাছে চলে এলে! ছি ছি।’

ফিসফিস করে বললাম, ‘আমি কি চলে যাব?’

‘হ্যাঁ, চলে যাবে। এখনই চলে যাবে। যাবার আগে আমার কাছ থেকে শাস্তি নিয়ে যাবে। পানিশমেন্ট।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘শাস্তি! পানিশমেন্ট! কী শাস্তি রেবা?’

রেবা এগিয়ে এসে গাঢ় স্বরে বলে, ‘আমি তোমাকে চুমু খাব। অনেক লম্বা একটা চুমু। যতক্ষণ আমি চুমু খাব তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি দেখতে চাই মেঘ আর কুয়াশার মধ্যে একজন মানুষকে চুমু খেতে কেমন লাগে।’

পরিশিষ্ট

গল্পের পরিশিষ্ট হয় না। যেহেতু এটা কোনও গল্প নয়, এটা সত্যি কথা, তাই মনে হয়, পরিশিষ্ট লিখলে কোনও অন্যায় হবে না।

মন্দিরতলা গ্রামে পুঁটিকুমারকে কেউ বেঁধে রাখেনি ঠিকই, কিন্তু তাকে আটকে রেখেছিল। আটকে রেখেছিল তার বাবা-মা। আটকে রাখাটাই স্বাভাবিক। যে-বালক তার কিশোরী দিদিকে বিয়ের মুখ থেকে ছিনিয়ে রাতের অন্ধকারে কলকাতা পালিয়ে আসতে চেষ্টা করে, তাকে আটকে রাখা ছাড়া আর কী বা পথ থাকে। অভয়পদবাবু তার রেস্টুরেন্টের লংকা মহাশয়, শ্রীমান উচ্ছে, পটলনাথ, মুসুরপ্রসাদকে নিয়ে মন্দিরতলা পৌঁছোলে বড়ো গোলমাল শুরু হয়। বিন্তির ভাবী ডাকাত বর লাঠি সোঁটা নিয়ে আক্রমণ করে। লামডিং থেকে রেবা তার রিটায়ার্ড পুলিশ বাবাকে দিয়ে আগেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। হাবড়া থানার পুলিশ ঠিক সময় ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে যায়।

বিন্তিকে উদ্ধার করা হয়েছে। এই মুহূর্তে বিন্তি তার ভাই এবং বাবা-মায়ের সঙ্গে লামডিং, রেবার ওখানে বেড়াতে গেছে। বিন্তিকে রেবার খুব মনে ধরেছে। ঠিক হয়েছে আপাতত সে ওখানে থেকেই লেখাপড়া করবে। গোটা ফ্যামিলির যাতায়াতের খরচ দিয়ছে রেবা। শুধু পুঁটিকুমার বাদ। শুনলে বিশ্বাস হবে না, পুঁটিকুমারের খরচ ভাতডাল হোটেলের মালিক অভয়পদবাবু রেবার কাছ থেকে নিতে দেননি। বলেছেন, ‘আমার কর্মচারী, আমি যাতায়াতের ভাড়া দেব। আমার কর্মচারীর বেড়াতে যাবার পয়সা অন্য কেউ দেবার কে? মনে রাখবেন আমি মালিক। কী ভাবেন আমাকে, আমি কি শুধু ইয়ের মালিক?’

আমি বেরাকে ফোন করে খুব বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমি কি বিন্তিদের সঙ্গে লামডিং যেতে পারি? অনেকদিন কলকাতার বাইরে যাওয়া হয় না। পকেটে পয়সা নেই। তোমার খরচে বেড়িয়ে আসতাম।’

রেবা বলেছে, ‘না, আসবে না। তোমাকে দেখার থেকে, না দেখতে পাওয়ার মনকেমন আমার কাছে অনেক বেশি দামি। তুমি আসবে না।’

শান্তি

আরও চাই, আরও, আরও। টাকাপয়সা, সম্মান, ক্ষমতা, জনপ্রিয়তা সব কিছুই হিসেবে কম পড়ছে। তাই আরও বেশি বেশি করে চাই। এই সুখে হবে না, আরও সুখ চাই। এই পরিমাণ শান্তিতে চলবে না, নিরবচ্ছিন্ন শান্তি চাই। যেটুকু আয়ত্তের বাইরে আছে সেটুকুকে পেতে আয়ত্তের মধ্যে থাকা জিনিসকেও বাজী ধরতে রাজি আছি।

গোপালের বিয়ে দেবার জন্য ওর মা-বোন-দিদি সব উঠে পড়ে লেগেছে। বিয়ের জন্য গোপাল নিজে যত না আগ্রহী, উদ্যোগী ওর বাড়ির লোকজন তার হাজারগুণ। গোপালের মা বলেন, ‘মেয়েগুলোর বিয়ে হয়ে যাবার পর বাড়িটা কীরকম যেন খাঁখাঁ করে। একটা চুড়ির রিনিঝিনি নেই, একটা নূপুরের নিক্বণ নেই। যেন ভূতের বাড়ি। নাতি-নাতনির মুখ বোধহয় আর দেখে যেতে পারব না।’

গোপাল বলে, ‘দাঁড়াও না মা, আর একটু সবুর করো না, আমার আর একটা পদোন্নতি হোক তারপর না হয়…’

গোপালের মা ওর মুখের কথা ছোঁ মেরে কেড়়ে নিয়ে বলে, ‘পদ বাড়ানোর প্রস্তুতি আর বিয়ের প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলুক না, ক্ষতি কি? তোর পদোন্নতি হতে হতে আমাদেরও মেয়ে রেডি হয়ে যাবে। আরও দেরি করে মেয়ে দেখতে বেরোলে, তোর বিয়ের বয়স পার হয়ে যাবে।’

সুতরাং প্রায় প্রত্যেকটা ছুটির দিনেই মা-দিদি-বোনেরা একজোট হয়ে একটা না একটা মেয়ে দেখতে যাওয়া চাই-ই। এটা যেন ওদের কাছে একটা সাপ্তাহিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। সকাল থেকেই সাজোসাজো রব। ইতিমধ্যে নয় নয় করে তেরোটা মেয়ে দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু পছন্দ যেন আর হয় না। এদেরই মধ্যে একজনকে গোপালের মনেও ধরেছিল কিন্তু মা-দিদি-বোনের যুক্তফ্রন্ট সেটাকে পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়েছে।

দেখতে দেখতে গোপালের বিয়ে হয়ে গেল। এলাহি আয়োজন হল, প্রচুর লোক খেল। বাড়িতে এখন দিনরাত হইচই লেগেই আছে। দিদি, বোন প্রায়ই আসে। নতুন বউকে নিয়ে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বাজার কিংবা সিনেমা হলে যায়। গোপালও যায় মাঝে মাঝে। শাশুড়ি-বউমার যুগলমূর্তি প্রায়ই চোখে পড়ে এখানেওখানে। বাড়িতে হাসাহাসি, দাপাদাপি, হুটোপাটি, লুটোপুটি লেগেই আছে। নতুন বউমা নতুন মাকে পেয়ে সেকি উচ্ছ্বসিত। তার চেয়েও বেশি উচ্ছ্বসিত নতুন মা তার নতুন মেয়েকে খুঁজে পেয়ে। যেন আক্ষরিক অর্থেই জন্মজন্মান্তরের পর আকস্মিক ভাবেই কোনও এক অজানা গ্রহের ফেরে মা-মেয়ের দেখা। বউমা ‘মা’ ‘মা’ বলতে অজ্ঞান। শাশুড়িও একই রকম বউমা ভক্ত। দুজনে যেন একে-অপরকে কিছুতেই চোখের আড়াল করতে পারে না। গোপালের বাড়ি এখন সুখের হাট। লোকে দেখে হিংসে করে।

সস্তার জিনিস যেমন প্রথম দর্শনে চেনা যায় না, দুদিন ব্যবহারেই তার আসল রূপ প্রকাশ পায়, তার চাকচিক্যের অবসান ঘটে, তেমনি শাশুড়ি-বউমার চিরন্তন স্বাভাবিক সম্পর্ক ধরা পড়ল মাসখানেক বাদে।

এখন কাক, চিল, আদি পক্ষীকুল গোপালের বাড়ির ছাদ, পাঁচিল এড়িয়ে চলে। মফসসলের এই মধ্যবিত্ত পাড়াটার আপাত শান্ত চেহারাটা হঠাৎই বড়ো অশান্ত হয়ে ওঠে শাশুড়ি-বউয়ের নিত্য কলহে। অশান্তি, চিৎকার, চ্যাঁচামেচি লেগেই আছে। কান পাতা দায়। কী নিয়ে যে অশান্তি তা বোধগম্য নয়। কোনও ইস্যু নেই। শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়া না, দুই সতিনের ঝগড়া তাও চট করে বোঝার উপায় নেই। সেই একমেবদ্বিতীয়ম ছেলে-স্বামীর ওপর আধিপত্য বিস্তারের গল্প, যা প্রতিদিন হাজার হাজার ঘর ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। শাশুড়ি ভাবে, যে-ছেলেকে, যে-গোপালকে এই সেদিন জন্ম দিলাম বত্রিশটা নাড়ি ছিঁড়ে, মাসের পর মাস বুকের দুধ খাইয়ে মানুষ করলাম, আধপেটা খেয়ে না খেয়ে পুজোয় নিজের জামাকাপড় না কিনে লেখাপড়া শেখালাম, সেই গোপাল আমার শেষ পর্যন্ত কিনা পর হয়ে গেল! হতচ্ছাড়া অলক্ষুনে মাগিটা আমার অমন মাতৃভক্ত, গোবেচারা গোপালটাকে ছিনতাই করে নিল! দিনরাত অত গুজুর গুজুর, ফুসুর ফুসুর কীসের? আমার ভোলাভালা ছেলেটার মাথা খাচ্ছে! দিনরাত কুযুক্তি দিচ্ছে, আমার বিরুদ্ধে সব সময় নালিশ করছে! ছেলের বিয়ের আগে বাড়িতে আমার কত শান্তি ছিল! ওই মাগিটা আসার পর থেকে ছেলেও আমার বিগড়ে গেল, বাড়ি থেকেও শান্তি উধাও!

চেহারা কিংবা শিক্ষার পালিশ গোপালের মায়ের কোনওদিনই ছিল না। তাই চিন্তার ও ভাষাদৈন্য অচিরেই প্রকট হয়ে ওঠে। বউমা সম্পর্কে তার তিক্ত ভাবনাটাই মুখের কদর্য ভাষায় বেরিয়ে পড়ে মাঝেমধ্যেই। ‘বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা হতচ্ছাড়ি মাগি! গোপালের আবার বিয়ে দেব আমি। খাল কেটে আমিই ঘরে কুমির এনেছি! বলি সংসারটা কি শুধু স্বামীটাকে নিয়ে? আরে মূর্খ, স্বামীটাকে পেলি কোত্থেকে? তুই জন্ম দিয়েছিস? আমি কি বাইরের লোক? তোর বাপ-মায়ের সঙ্গে কি তুই এইরকম আচরণ করতিস? পাঠাবার সময় বাপ-মা শিখিয়ে দেয়নি শ্বশুরবাড়িতে কীরকম ভাবে থাকতে হয়, শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করতে হয়? আমরা তো জীবনে শ্বশুর-শাশুড়ির মুখের ওপর কোনওদিন কথা বলিনি, কোনও কথার প্রতিবাদ করিনি, চিরটাকাল তাদের দাসী হয়ে থেকেছি। আমারই ভিটেয় থেকে আমাকেই অপমান? ছেলে মানুষ করলাম শেষ বয়সে এসে বউয়ের লাথিঝাঁটা খাবার জন্য! এর চেয়ে তো মরণও ভালো ছিল আমার!’

মায়ের সঙ্গে উপযুক্ত সঙ্গত করে ননদেরা, ‘মা, একি চেহারা হয়েছে তোমার? সেই কাঁচা সোনার বরন কোথায় গেল? ওই ডাইনি বউটার কীর্তি নিশ্চয়ই! তাড়াও হতচ্ছাড়িকে।’

ভাইয়ের বউয়ের দিকে আঙুল তুলে বলে, ‘তুই এই বাড়ির নখের যুগ্যি নস, দূর হয়ে যা এখনই, নইলে গলা ধাক্বা দিয়ে বের করে দেব, এই বলে দিলাম। চিরকালের জন্য এবাড়ির ভাত খাওয়া ঘুচিয়ে দেব।’

ছেলে-বউ একসঙ্গে বেশিক্ষণ কাটালে, গল্প করলে বা হাসাহাসি করলে শাশুড়ি সহ্য করতে পারেন না। কোনও না কোনও ছুতোয় ছেলেকে অন্য কোনও কাজে ব্যস্ত করে তোলেন অথবা নিজেই দুজনের মাঝে বসে পড়ে অপ্রয়োজনীয় গল্প জুড়ে দেন। রসভঙ্গ করেন। ছেলে-বউ সব বুঝেও কিছু বলতে পারে না।

ছেলে-বউ কোথাও বেড়াতে যাবে শুনলেই শাশুড়ির গাত্রদাহ ও রক্তচাপ হাজারগুন বেড়ে যায়। শরীর খারাপ বা অন্য কোনও ছুতোয় তিনি তা বানচাল করার চেষ্টা করেন। এই করেই সেবারে ওদের দীঘা যাওয়া ক্যানসেল হয়ে গেল। বাড়ি থেকে বেরোবার ঘণ্টাখানেক আগে শাশুড়িমা বুকে হাত দিয়ে শুয়ে পড়লেন। ছোটাছুটি, ডাক্তার ডাকাডাকি সবই করতে হল বেচারা গোপালকে। দীঘা যাওয়া মাথায় উঠে গেল। ডাক্তার এসে বললেন আশ্বাসের কথা, ‘তেমন কিছুই হয়নি… একটু বিশ্রাম।’

ততক্ষণে দীঘার বাস ডায়মন্ডহারবার পৌঁছে গেছে। গোপালের মধুচন্দ্রিমা উচ্ছেচন্দ্রিমায় রূপান্তরিত হয়েছে।

গোপালের মা, বউয়ের দিক থেকে ছেলের মন একশো আশি ডিগ্রি ঘোরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন। গোপাল চা করতে গেলে, জামাকাপড় কাচতে গেলে বা এঁটো বাসনপত্র তুলতে গেলে অর্থাৎযে-কাজগুলোকে সচরাচর অন্যায়ভাবে শুধুমাত্র মেয়েলি কাজ বলে মনে করা হয়, সেগুলো করতে গেলে মা বাধা দেন। বলেন, ‘তুই এসব কাজ করছিস কেন? এগুলো তো মেয়েদের কাজ, তোর বউয়ের কাজ! এতে তো তোর বউ আরও প্রশ্রয় পেয়ে যাবে, মেয়েদের কাজ ছেলেদের করতে নেই। তুই বোকাসোকা ভালোমানুষ বলে তোকে দিয়ে হাবিজাবি কাজগুলো করিয়ে নিচ্ছে। একদিন ওর কাজ করে দিলে দ্বিতীয় দিন আর ও সেই কাজ করতে চাইবে না। সারাজীবন ধরেই তোকে বউয়ের গোলামি করে যেতে হবে।’

গোপাল মায়ের কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। মায়ের কথা মেনে নিতে ওর বড়ো কষ্ট হয়। অথচ তীব্র প্রতিবাদও করতে পারে না। ছোটোবেলা থেকেই ও জেনে এসেছে বড়োরা বিশেষ করে মা-বাবা কখনও সন্তানের অমঙ্গল চান না। তাঁরা যা বলেন বা করেন সবই সন্তানের ভালোর জন্যই। তাঁদের মুখের ওপর কথা বলতে নেই। অথচ ও বেশ বুঝতে পারে স্ত্রীর ক্ষেত্রে মা যা যা বলেন তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেঠিক, চরম বিদ্বেষপূর্ণ, শত্রুতাপূর্ণ। সে কী করবে, তার কী করা উচিত কিছুতেই ঠিক করতে পারে না। এক চরম নিষ্ঠুর তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বে ভোগে সে। সে দেখেছে বিয়ের আগে পর্যন্ত মা যা যা বলে এসেছে বা করে এসেছে সবই তার স্বার্থের অনুকূলে। তাই রাতারাতি মায়ের এই ভোলবদল সে কিছুতেই নিজের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারে না। যদিও শাশুড়ি-বউ-এর সম্পর্কের চিরকালীন কূটনৈতিক জটিলতা ও পরিপক্ব সাংসারিক বুদ্ধির অভাবই তিক্ততার জন্য দায়ী।

ভালো কথায় কাজ হচ্ছে না দেখে মা এবার অন্য রাস্তা ধরেন। গোপালকে দিনরাত কথায় কথায় তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অপমান করেন। বলেন, ‘বউকে প্রশ্রয় দিচ্ছিস। তোর প্রশ্রয়েই বউ এত বাড় বেড়েছে। বউকে শাসন করার ক্ষমতা নেই, স্ত্রৈণ কোথাকার! বউয়ের কথায় ওঠবোস করিস। মনে রাখিস, বউ গেলে বউ আসবে, মা গেলে মা আসবে না। যে মা তোকে জন্ম দিল, এই এতটুকু থেকে মানুষ করল, দুদিনের বউকে পেয়ে সেই মাকে ভুলে গেলি? নেমকহারাম কোথাকার! একেই বলে কলিকাল। এমন ছেলে থাকার চেয়ে বাঁজা হওয়াও ভালো ছিল। জন্মের পরই যে কেন তোকে গলায় নুন দিয়ে মেরে ফেলিনিরে হতভাগা!’

গোপালের ওপর মায়ের এই মানসিক অত্যাচারের কারণ হল যে, তিনি চান এসব অপমানের মাধ্যমে গোপালকে এমন মানসিক অশান্তির মধ্যে ফেলা যে, সে যেন ভাবে এসবের জন্য বউ-ই দায়ী, কারণ, বিয়ের আগে মা তার সঙ্গে ভালো ব্যবহারই করত কিন্তু বিয়ের পর মায়ের আচরণ পালটে গেল। এই কথা ভেবে গোপাল যাতে মায়ের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে বউয়ের ওপর অত্যাচার করে, মায়ের মনে এমনই আশা। কিন্তু গোপাল মায়ের এই কৌশল বুঝে ফেলে। তাই সে মায়ের কৌশলের ফাঁদে পা দেয় না।

কম যায় না গোপালের বউ-ও। শাশুড়িমাকে সে সতিন জ্ঞান করে। তাকে মন্দ ভাষা বলতেও বউয়ের বুক কাঁপে না। তিরিশ বছরের বড়ো এক মহিলার সঙ্গে সমানে টক্বর দেবার বা তাকে ওই ভাষায় গালাগাল করার সাহস কোত্থেকে আসে তা ভেবে গোপাল অবাক হয়ে যায়। গোপাল মাঝে মাঝে ভাবে, ‘এ নিজের মায়ের সঙ্গেও কেমন আচরণ করে!’

গোপালকেও বউ ছেড়ে কথা বলে না। শাশুড়ি-ননদের হাতে হেনস্তার জন্য সে সর্বদা গোপালকেই দায়ী করে।

‘তুমিই তো যত নষ্টের গোড়া! বিয়ে করে এনেছিলে কি মাকে দিয়ে পদে পদে অপমান করাবে বলে? বউয়ের সম্মান রাখতে পার না, কী ধরনের স্বামী তুমি? অমন স্বামী থাকার থেকে না থাকা ঢের ভালো ছিল। এর চেয়ে আইবুড়ি হয়ে সারাজীবন কাটানো অনেক সুখের হতো। ব্যক্তিত্বহীন নপুংসক কোথাকার! মায়ের ন্যাওটা হয়েই তো সারাজীবন থাকতে পারতে। বিয়ে করার শখ হল কেন? অতই যদি মাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট, তাহলে রাতটাও তো মায়ের সঙ্গেই কাটাতে পারতে!’

বউ আরও বলে, ‘এখানে তোমার মায়ের সঙ্গে আমি থাকতে পারব না। অন্য কোথাও চলো, বাড়ি ভাড়া করো, ফ্ল্যাট কেনো, নইলে বাপের বাড়ি চলে যাব, পুলিশের কাছে তোমার নামে বধূ নির্যাতনের অভিযোগ করব। মহিলা সমিতিতে অভিযোগ করব, কোর্টে নারী নির্যাতনের মামলা করব। জেলের খাবার খাওয়াব তোমায়, এই বলে দিলাম!’

ইতিমধ্যে বউয়ের বাপ আর তিন দাদা এসে চমকে দিয়ে গেছে গোপালকে। তিন দাদা তিনটে আলাদা আলাদা রাজনৈতিক দলের ঘাটে নোঙর বেঁধেছে। সে কী তড়পানি! ‘অনেক খরচা করে বোনের বিয়ে দিয়েছি পড়ে পড়ে লাথিঝাঁটা খাবার জন্য নয়। অমন মা থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। দরকার হলে বুড়িটাকে লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দাও। আমাদের আদরের একমাত্র বোনের ওপর কোনওরকম অত্যাচার সহ্য করব না। মাকে যদি শায়েস্তা করতে না পারো তাহলে তোমাকে কীভাবে শায়েস্তা করতে হয় তা আমরা বুঝে নেব!’

মা, বউ দুজনেই দিনরাত আত্মহত্যা করার ভয় দেখায়। বউ যদি সকালে আত্মহত্যা করার ভয় দেখায় তাহলে মা দেখায় বিকেলে, মা যদি দিনের বেলায় তো বউ রাতে। এ যেন একদলের মিছিল বা বন্ধের ডাকের বদলে অন্য দলের পালটা ডাক। আত্মহত্যা করার ভয় দেখিয়ে দুজনেই এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চায়– গোপালকে চাপের মধ্যে রেখে নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধি করা এবং অপর পক্ষের আত্মহত্যার হুমকিকে নস্যাৎ করে দেওয়া। কিন্তু মনস্তত্ত্বের এই সূক্ষ্ম ও জটিল উপধারাগুলো উপলব্ধি করার মতো সূক্ষ্মতর বুদ্ধি উচ্চশিক্ষিত গোপালের থাকলেও তা এখন কাজ করে না।

ইতিমধ্যে মা একদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে বউয়ের শাড়ি গলায় পেঁচিয়ে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেও চরম ব্যর্থ হয়েছেন। বাইরে থেকে গোপাল দরজায় দমাদ্দম লাথি মারতে থাকে আর চিৎকার করতে থাকে, ‘বাঁচাও বাঁচাও’। পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা দৌড়ে আসে, আশেপাশের বাড়ির লোকেরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। সকলের ঠেলাঠেলি, লাথালাথিতে দরজা ভেঙে যায়। দেখা যায় গোপালের মা গলায় গোপালের বউয়ের শাড়ি বেঁধে ‘অজ্ঞান’ অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। ‘মা মা’ বলে ককিয়ে চিৎকার করে ওঠে গোপাল। সকলে মিলে কেউ ফ্রিজ থেকে, কেউ বাথরুম থেকে জল এনে মায়ের চোখে মুখে ঝাপটা মারতে থাকে। আস্তে আস্তে জ্ঞান ফেরে মায়ের।

পালটা হিসেবে পরের দিনই বউ কেরোসিন তেলের জ্যারিকেন খুলে সারা গায়ে ঢেলে আগুন লাগাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও চরম ব্যর্থ হয়। পরপর চারচারটে দেশলাই কাঠি জ্বেলেও শাড়িতে ঠেকাবার আগেই নিভে যায়। এই বিশাল পরিমাণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে গোপাল ছাড়ে না। দৌড়ে গিয়ে ছোঁ মেরে দেশলাই কেড়ে নিয়ে সে যাত্রা বউ ও নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়। বলাবাহুল্য এ দুটো ঘটনাই বাড়িতে গোপালের উপস্থিতিতে ঘটেছিল। মন্দজনে বলাবলি করে দুটোই নাকি চিৎপুরের কোনও এক হিট যাত্রা পালার অংশ থেকে ধার নেওয়া।

গোপাল দিনরাত আতঙ্কে থাকে, এই বুঝি কিছু একটা হয়ে গেল। এই বুঝি মা আবার ঝুলে পড়ল, এই বুঝি বউ নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিল। অফিসে কাজে মন দিতে পারে না, ক্লাবে আড্ডা দিতে যেতে পারে না, না জানি বাড়ি গিয়ে কী দেখবে! ঘনঘন মোবাইল চেক করে, কোনও দুঃসংবাদ এল কিনা। মনে শান্তি নেই, চোখে ঘুম নেই, কাজে মন নেই। চব্বিশ ঘণ্টা তাকে একটাই আতঙ্ক তাড়া করে বেড়ায়– এই বুঝি, এই বুঝি… মনে মনে সে দুজনের যে-কোনও একজনের মৃত্যু কামনা করে– মা অথবা বউ, বউ অথবা মা, যে-কোনও একজনকে যেতেই হবে, তা না-হলে সে নিজে বাঁচবে না। অথচ দুজনের কেউ একজন আত্মহত্যা করেছে ভাবলেই সে শিউরে ওঠে, কী অস্বাভাবিক অন্তর্দ্বন্দ্ব! এক এক সময় ভাবে, দরকার নেই দুজনের কাউকেই, দুজনেই চরম স্বার্থপর, যে যার নিজেরটাই শুধু বোঝে, তার কথা কেউ ভাবে না, ভাবলে এই রকম আচরণ করত না। কেউ তাকে ভালোবাসে না।

গোপাল ঠিক বুঝতে পারে না কার দোষ। মায়ের কথা শুনলে মনে হয় সব দোষ বউয়ের। আবার বউয়ের সব কথা শুনলে মনে হয় যত নষ্টের গোড়া ওই মা। মা না বউ, বউ না মা, মা না বউ, বউ না মা। ওঃ, গোপাল আর পারে না, ও কি পাগল হয়ে যাবে? এখন ও সবসময় ভাবে, কেন যে মরতে বিয়ে করতে গেলাম!

বন্ধুরা অনেকেই বলে, ‘গোপাল, শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়া নিত্যসত্য, জীবনের অঙ্গ, আমাদের জীবনেও আছে বা ছিল, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ কেউবা বলে, ‘যদি সত্যিই বাঁচতে চাস তবে বউকে নিয়ে আলাদা হয়ে যা। কিন্তু বউকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেলে বৃদ্ধা মাকে দেখবে কে? বাবা মারা গেছেন মায়ের কোলে আড়াই বছরের গোপালকে রেখে। তারপর থেকে মা-ই বাবা, মা-ই মা।

জ্ঞানবয়সে বাবার স্বাদ পায়নি গোপাল। বাবা কি জিনিস সে জানে না। স্কুলে বন্ধুবান্ধবদের কাছে যখন তাদের বাবাদের গল্প শুনত, তখন ওর খুব দুঃখ হতো। ওদের বাবারা অফিস থেকে ফেরবার সময় টফি, চকোলেট, ক্যাডবেরি, আইসক্রিম, নতুন নতুন খেলনা নিয়ে আসে। অফিস থেকে ফিরে কত আদর করে বাবারা। ছুটির দিনে ওদের সঙ্গে ফুটবল, ক্রিকেট খেলে। কার বাবা কাকে কত ভালোবাসে এই নিয়ে ওর বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। গোপাল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত সেই দিকে। ওর শিশুমন কল্পনা করার চেষ্টা করত ফোটোর বাবা অফিস থেকে ফিরে জামাকাপড় না ছেড়েই ওকে কোলে তুলে নিল। চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিল ওর মুখচোখ। তারপর পকেট থেকে বার করল মুঠো মুঠো চকোলেট, লজেন্স, ক্যাডবেরি।

ছোটোবেলায় গোপাল প্রায়ই স্বপ্ন দেখত বাবা ওকে পার্কে বেড়াতে নিয়ে গেছে। নাগরদোলা চড়াচ্ছে, ওকে ওপরে ছুড়ে দিয়ে লুফছে, ওর সঙ্গে ফুটবল, ক্রিকেট, লুকোচুরি খেলছে, ওকে বকছে, শাসন করছে, পড়াচ্ছে। সকালে ঘুম ভাঙার পর বাবার ওপর ওর খুব রাগ, অভিমান হতো। বাবা কেন ওকে ফেলে, মাকে ফেলে ‘তারা’ হয়ে গেল, বাবা খুব দুষ্টু!

বাবার অকাল মৃত্যুর পর মা-ই ওদের তিন ভাইবোনকে অতিকষ্টে মানুষ করেছে, লেখাপড়া শিখিয়েছে। সমাজে পরিচয় দেবার মতো করে তৈরি করেছে। বাবা বেসরকারি অফিসে চাকরি করতেন। তাই বাবার অফিসে অনেক চেষ্টা করেও মায়ের কোনও চাকরি হয়নি। তবে অফিসেরই কেউ কেউ বাঁকা পথে চাকরি পেতে সাহায্য করার বদলে টাকাপয়সা এবং আরও অনেক কিছুই চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কয়েকটা টিউশনি আর রান্নার কাজ ধরে মা নড়বড়ে সংসারটাকে কোনওরকমে দাঁড় করায়।

মা যে লোকের বাড়ি রান্নার কাজ করত তা মা কাউকে কোনওদিন বলত না। বাড়িতেও কেউ জানত না, গোপালও না। ‘পড়াতে যাচ্ছি’ বলে গোপালের মা বাড়ি থেকে বেরোত। একদিন গোপালের মামা হঠাৎ অফিস থেকে গোপালদের বাড়িতে এসে হাজির। মামার বাড়ির দাদুর খুব শরীর খারাপ, দাদুর ইচ্ছা এখনই মাকে নিয়ে যেতে হবে। তাই মামা নিজেই এসে হাজির। গোপালকে পাঠানো হল মায়ের ছাত্রীর বাড়ি। সেখানে গিয়ে গোপাল শুনল, ‘তোর মা রান্না করে চলে গেছে’। গোপাল ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল মা ভালো রান্না করতে পারে বলে হয়তো আবদার করে মাকে দিয়ে কিছু রান্না করিয়ে নিয়েছে। পরে একদিন মাকে জিজ্ঞেস করাতে মা ওর মুখে হাত দিয়ে চেপে ধরেছিল। বলেছিল, ‘আর কাউকে ওসব কথা কোনওদিন বলিসনি’। নাঃ, গোপাল আর কোনওদিন ও কথা মুখেও আনেনি। বাড়িতেও কাউকে বলেনি। যদিও কথাটার অন্তর্নিহিত অর্থের মাথামুন্ডু সে তখন কিছুই বোঝেনি।

সেই মাকে একা অসহায় ভাবে ফেলে রেখে সে কেমন করে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সুখের সন্ধানে ফ্ল্যাট কিনে চলে যাবে?

ঘাড়টা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। জিভটা মাকালীর মতো আধফুটের মতো বেরিয়ে এসেছে। চোখদুটো কোটর ঠেলে প্রায় বাইরে বেরিয়ে এসেছে। যেন ড্যাবডেবিয়ে গোপালের দিকেই তাকিয়ে আছে, বলছে, তুমিই, হ্যাঁ হ্যাঁ তুমিই দায়ী। বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। এটা মফসসল এলাকা। এখানে কেউ খুন হলে বা আত্মহত্যা করলে এখনও জমাট ভিড় হয়। সবাই ফিসফিসিয়ে গোপালের বউ সীমার আত্মহত্যার সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করছে। এরকম একটা পরিণতির ধারণা যে অনেকের মধ্যেই ছিল তার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এরই মধ্যে হুড়মুড়িয়ে পুলিশ এসে হাজির।

আচমকাই গোপালের ঘুমটা ভেঙে যায়। এই শীতেও তার সারা শরীরে ঘামের স্রোত বয়ে যায়। ও ভাবে, ওঃ সীমা তাহলে আত্মহত্যা করেনি। বিছানায় শুয়ে শুয়েই ও ভাবতে চেষ্টা করে, এটা সত্যিই স্বপ্ন তো!

এর আগেও একদিন গোপাল স্বপ্ন দেখেছে ওর মা বিষ খেয়ে হ্যাঁচোড়প্যাচোড় করছে আর পাড়া মাথায় করে চ্যাঁচাচ্ছে, ‘গোপাল আমি বিষ খেয়েছি, আমি চললাম, তুই বউকে নিয়ে সুখে থাকিস।’

গোপাল, ‘আর হবে না মা, আর কখনও হবে না, এবারের মতো ক্ষমা করে দাও’ বলে কান্নাকাটি করছে। হঠাৎ মা দুম করে মাটিতে পড়ে গেল আর চমকে উঠে গোপালেরও ঘুম ভেঙে গেল।

গোপাল নিখোঁজ। আগের দিন রাতে মা-বউতে তুলকালাম হয়েছে। মুখের সীমান্ত পেরিয়ে গতকাল যুযুধান দুইপক্ষে তুমুল হাতাহাতি হল। শেষ পর্যন্ত তা রক্তারক্তিতে গড়াল। শাশুড়ি গ্যাস আভেনে রুটি সেঁকতে সেঁকতে গরম খুন্তি দিয়ে বউকে ঘা কতক দিতেই বউ মড়াকান্না জুড়ে দিয়ে শাশুড়ির মাথায় সাঁড়াশির বাড়ি দমাদ্দম লাগিয়ে দিল। দুপক্ষই রক্তারক্তি। প্রবল চিৎকার চ্যাঁচামেচিতেও পাড়ার কেউ এল না। কারণ এটা এ বাড়ির নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। দুর্গাপুজোয় ভিড় হয়, ট্রাফিক জ্যাম হয়, নিত্যপুজোয় ওসব কিছু হয় না। রাতবিরেতে ডাক্তার, হাসপাতাল সবই হল। হাতে, মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে দুপক্ষ মাঝরাতে বাড়ি ফিরল।

স্বভাবতই পরের দিন শাশুড়ি, বউ উভয়েরই ঘুম ভাঙল বেশ দেরিতে। উঠে দেখল, গোপাল নেই। ভাবল, হয়তো দোকান বাজার গেছে, এখনই ফিরবে। কিন্তু বেলা গড়ায়, গোপালের দেখা নেই। ভাবল, রাগ করে বেরিয়ে গেছে, রাগ পড়লেই ফিরে আসবে। সকাল গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে, সন্ধে গড়িয়ে রাত হল, কিন্তু গোপালের দেখা নেই। খবরটা সারা পাড়া ছড়িয়ে পড়েছে। গোপালের শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত খবর পৌঁছে গেছে। বন্ধুবান্ধব, পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে তন্নতন্ন করে খোঁজ করে গোপালের। কিন্তু না, কোনও হদিশই নেই।

– গোপাল কি মা-বউয়ের ওপর রাগ করে বিবাগি হয়ে গেল?

– গোপাল কি বাড়িতে দিনরাত অশান্তির জেরে দু-চার দিনের জন্য কোথাও আত্মগোপন করল?

গোপালের অন্তর্ধানে কিন্তু বাড়ির অশান্তি থেমে থাকল না, বরং তা অন্য মাত্রা নিল। মা-বউকে বলল, ‘তুই আমার ছেলেকে খেয়েছিস!’ আর বউ মাকে বলল, ‘তোর জন্যই ও বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।’

তিন দিনের দিন– আশেপাশের এলাকা দুর্গন্ধে ভরে যায়। মানুষজন নাকে রুমাল দিয়ে হাঁটতে থাকে, ভাবে বেড়াল বা রাস্তার কুকুর মরেছে। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে দুর্গন্ধের তীব্রতা। পুলিশ আসে। গোপালের বাড়ির উলটোদিকে একটা পরিত্যক্ত কারখানা থেকে উদ্ধার হয় গোপালের পচাগলা ঝুলন্ত দেহ।

‘বউকে দুলাখ টাকা দিয়ে গেলাম। টাকাটা কো-অপারেটিভ ব্যাংকে আছে। বউ যেন টাকাটা পায়। মা, তুমি আমাকে ক্ষমা কোরো। তোমাকে খুব ভালোবাসি। দিদিকে, বোনকেও খুব ভালোবাসি। সবাইকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বাঁচার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারলাম না, হেরে গেলাম। পুলিশ যেন কাউকে না ধরে। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।’ পরের দিন বালিশের ওয়াড়ের ভেতর থেকে উদ্ধার হল গোপালের সুইসাইড নোট।

গোপালের বাড়িতে এখন চরম ‘শান্তি’ বিরাজ করছে। গোপাল তো এটাই চেয়েছিল! তাই না?

 

রুহু কুহু

কত তাড়াতাড়ি দিন বয়ে গেল। এই সেদিনের কথা, বিডিওর চাকরিতে জয়েন করতে গিয়েছিল অতনু কর, বাঁকুড়া শহরে। সেখান থেকে আরও দূরে এক পাহাড়ি এলাকা ন’পাহাড়িতে। জায়গাটা ছবির মতো ভাসে চোখের সামনে। পাহাড়, টিলা, বনভূমি, দিগন্তবিস্তৃত লাল মাটির ঢেউখেলানো প্রান্তর। ব্লক অফিসের বড়ো বাবুর দুই মেয়ে, বিশাখা ও ঐশিকা। তারা ছিল যমজ কিন্তু আলাদা। একজন গৌরী, অন্যজন শ্যামলা। শ্যামলা মেয়ে ঐশিকার চোখের রং ছিল আবছা বাদামি। বিনবিন করে অতনু নিজের সঙ্গে, বিশাখা, ঐশিকা, দুজনেই আমার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল এক সঙ্গে। দুটি চিঠিই আমার কাছে এসে পড়েছিল ওদের ছোটো ভাই দেবুর হাত দিয়ে। দুজনের কী আশ্চর্য প্রেম নিবেদন। তারা তখন কৈশোর পার করে যুবতি হয়ে উঠছে সবে। তাদের একজন বিশাখা খুব হাসত, আর ঐশিকা ছিল অর্ন্তমুখী। কথা বলত কম। দুজনে যে দু’রকম তা তাদের দুই চিঠি পড়ে বোঝা গিয়েছিল। দুই বোন আলাদা আলাদা হয়ে ঘুরে বেড়াত। সেই বিশাখা, ঐশিকা দুই বোন এত বছর বাদে আমার কাছে ফিরে এসেছে বন্ধু হয়ে। দুজন কুড়ি। তাদের একজন কথা বলে গম্ভীর হয়ে। সব বিষয়ে সুচিন্তিত মতামত দেয়। আর একজন, যার নাম রুহু, সে শুধু হাসে, হা হা হা। আমাদের কথা বলার ইন-বক্সে হা হা হা, হাসির প্লাবন বয়ে যায়। অন্যজন তার নাম কুহু, সে আমাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি গড অফ স্মল থিংস পড়েছ বন্ধু?

অতনু তখন জিজ্ঞেস করে, তুমি কি খুব বই পড়ো?

হ্যাঁ, তুমি বই পড়ো না?

পড়ি পড়ি, ওই বইটাও পড়েছি, কিন্তু তা দশ বছর আগে।

এই তুমি কি চেতন ভগত পড়়ো?

না, কেন?

আমিও না বন্ধু, শ্যালো, ওর ভিতরে কিছু নেই পাওয়ার মতো।

কী সুন্দর তুমি বললে, পাওয়ার মতো, বই পড়তে হয় কিছু পেতে, তাই না?

হুম, বলে অতনুর ওই বন্ধু কুহু একটি হৃদয় এঁকে দিল আগে, তারপর লিখল, বাই, পরে কথা হবে।

অন্য বন্ধু রুহু বলল, কী করছ তুমি?

কী করব, বসে আছি পথ চেয়ে।

আহা, তুমি খুব দুষ্টু, কেষ্টবাবু, তা তোমার বংশীটি কই?

হারিয়ে গেছে।

বাঁশি হারান কৃষ্ণ, হা কৃষ্ণ হা কৃষ্ণ, হা হা হা।

অতনু কর নিজে নিজে কথা বলে, এই আমার দুই বন্ধু। তাদের দুজনই একরকম মুখ দিয়েছে প্রোফাইল পিকচারে। সে হল সাদা কালোর যুগের হিরোইন মধুবালা। আমার মনে হয় রুহু-কুহু দুটি নামই ফেক নাম। হয়তো ওদের ডাক নাম। দুজনে একদিনেই আমার বন্ধু হয়েছিল। কিন্তু রুহু বলে সে কুহু বলে কাউকে চেনে না। কুহু বলে, সে রুহুকে দেখেছে বটে, এমনকী একটি ফোটোই তাদের প্রোফাইল পিকচার, কিন্তু কুহু তার বন্ধু নয়। তাহলে হয়তো এমন হতে পারে রুহু-কুহু একজন, তারা দুই নামে দুইজন। একজন রুহু আমার কাছে আসে সকাল দশটা নাগাদ, অন্যজন আসে সন্ধে সাতটা নাগাদ। রুহু হা হা হাসে, অন্যজন কুহু গম্ভীর হয়ে গড অফ স্মল থিংস, বিভূতিভূষণের ইছামতী উপন্যাসের কথা বলে। কী অদ্ভূত, এরা কি তাহলে সেই বিশাখা ঐশিকাদের কেউ?

ঐশিকা একদিন অতনুকে বলল, আপনি যদি না বলেন, না বলবেন, হ্যাঁ বলতে হবে এমন তো কোনও কথা নেই, আমার ভাল লাগে তাই জানিয়েছিলাম, পৃথিবীতে কত প্রেমপ্রস্তাব কতজন কতজনের কাছে পাঠিয়েছে, তার সব প্রেম কি স্বার্থক হয়েছে, এ তেমন কোনও চিঠি ভেবে নেবেন, চিঠি লিখতে আমার ভালো লাগে।

বিশাখা তাকে বলেছিল, আমি তোমারে ভালবেসেছি, যদি তুমি সাড়া না দাও অখিল, আমি দূর হতে ভালবেসে যাব, হয়তো কিছুই নাহি পাব।

বিশাখার চিঠির ভিতরে উত্তম সুচিত্রার সিনেমার গানের কলি ছিল। তখন সেই মফস্সলে সবে টেলিভিশন ঢুকেছে, কিন্তু তার ভিতরে কেবল লাইন, হরেক রকম চ্যানেলের কোনও ব্যাপার ছিল না। ভিডিও ক্যাসেট আর ভিসিপি ছিল সেই মফস্সলে সিনেমা দেখার উপায়। টেলিভিশন সেট আর ওই দিয়ে সেই গঞ্জে ভিডিও হলে সিনেমা দেখান হতো। ওখানে কোনও সিনেমা হল ছিল না। সদর বাঁকুড়ায় গিয়ে লোকে সিনেমা দেখে আসত। আর কোনও মেলা পাব্বনে প্রোজেক্টর ভাড়া করে এনে দেখানো হতো সিনেমা। সেই সময় টেলিভিশন সেট ভাড়া পাওয়া যেত ভিসিপি আর ভিডিও ক্যাসেট সমেত। পাওয়া যেত নীল ছবির ক্যাসেট। মফস্সলে সেই প্রথম নীল ছবি ঢুকতে আরম্ভ করে। ভিডিয়ো হলের রাতের শো-তে চলত। অতনুর মনে আছে তাদের এক কলিগ নৃসিংহ পাল আমাকে এক রাতের শো-এ নিয়ে গিয়েছিল, ভিতরে ঢুকে দ্যাখে সব ষোলো-সতেরো-আঠেরো। লজ্জায় মাথা কাটা গেল। হলের মালিক ছেলেটি অতনুকে এসে বলল, স্যার আপনারা থাকলে আমার খদ্দের সব বেরিয়ে যাবে, যদি দেখতে চান, আমি বাড়িতে গিয়ে দেখিয়ে আনব। সে বেরিয়ে এসেছিল প্রায় মুখ ঢেকে। নৃসিংহ থেকে গিয়েছিল। সে নিয়মিত দর্শক। অতনু তো তা নয়। তাকে জোর করে নিয়ে গিয়ে ঠিক করেনি নৃসিংহ।

নীল ছবিতে আমার গা গুলোয়। মনে হয় রবারের পুতুল নর-নারী কুস্তি করছে। কুহু, তার ইন্টারনেট-ফেসবুকের বন্ধু একদিন কথায় কথায় বলে, নীল ছবিতে মেয়েদের কত ছোটো করা হয় বলো তুমি, আমি এর বিরুদ্ধে প্রচার করব, তুমি আমার সঙ্গে থাকবে তো।

থাকব, কিন্তু এর পিছনে কত বিলিয়ন ডলার খাটে তা জানো তুমি?

জানি বন্ধু, কিন্তু সেই সুরক্ষিত প্রাসাদের জানলায় একটা ঢিল কি মারতে পারব না? ঝুর ঝুর করে ভেঙে পড়ুক কাচ।

ঐশিকা প্রায় এমন কি বলত না?

বড়োবাবু, ওদের বাবার জ্বর, মনে হল দেখে আসি। হ্যাঁ, বিশাখা ছিল না। সে গিয়েছিল পিসির বাড়ি, ফিরতে তিন দিন। হা হা হাসি, খিল খিল হাসি হাসতে হাসতে পিসতুতো দাদার সঙ্গে সে গেছে পিসির বাড়ি বর্ধমান। ঐশিকা যায়নি। বাবার জ্বর। আসলে অতনুর মনে হয়েছিল, সে যাবে, তা যেন মনে মনে জেনে গিয়েছিল বাদামি চোখের সেই মেয়ে। দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল যেন তারই জন্য। তার জন্যই পথের দিকে তাকিয়ে। তাদের মা ছিল না। মা তাদের ছেড়ে চলে গেছে তা শুনেছিল অতনু কানাঘুষোয়। দুই মেয়েকে নিয়েই বড়বাবু অম্বিকাপ্রসাদ গুন ন’পাহাড়িতে বদলি হয়ে এসেছিলেন। তখন দুই মেয়ে পাঁচ-পাঁচ। আর ফিরে যাননি।

অতনু মনে মনে বলে, আমি যখন যাই মেয়েরা তখন কুড়ি-কুড়ি। এও জানতাম ঐশিকা আর বিশাখার ভিতরে বনিবনা কম। কিন্তু তা এমনিতে ধরা যায় না। আমি যেতে ঐশিকা বলল, বাবা ঘুমিয়ে আছেন, আপনি কি বসবেন, না আবার আসবেন?

কোথায় যাব?

তা বটে, তাহলে বসুন, আপনি বাবার ঘরে বসবেন না অন্য ঘরে?

আমি কি বলব?

ঐশিকা বলল, বিশাখাও নেই কিন্তু।

আমি কি দরজায় দাঁড়িয়ে থাকব?

সরি, ভেতরে আসুন।

বিশাখার চিঠির উত্তর আমি না দিলেও সে আমাকে চিঠি পাঠানোর পর থেকেই তুমি সম্বোধন করতে শুরু করেছিল। আর তা ঐশিকার সামনে। বা কখনও একা দেখা হয়ে গেলে। ঐশিকার সামনে সে যেন প্রমাণ করতে চাইত অতনু করের সঙ্গে তার কোথাও একটা সেতু তৈরি হয়েছে। সেই সেতু পার হয়ে সে অতনুর ভিতরে প্রবেশ করতে পারে। কতকাল আগের কথা এসব। রুহু-কুহু আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই যৌবনকাল। আমার মনে হয় সেই দুই বোন, দুই যমজ, হা হা হাসি আর বাদামি চোখের নীরব আমন্ত্রণ আবার ফিরে এসেছে।

রুহু, হাউ ওল্ড আর ইউ? অতনু লেখে বার্তা।

আমি একটা বুড়ি স্যার।

তার মানে কুড়ি?

ওয়ান্ডারফুল স্যার, কুড়িতে কি বুড়ি নয় স্যার?

পাগল না ফাগল।

হা হা হা হা, ফাগল ফাগল ফাগল স্যার, হামি এক ফাগল হ্যায়।

অতনু বলল, কুহুকে চেন?

আমার বোন হতে পারে, বাট আই ডোন্ট নো।

তোমার বোন হতে পারে কেন?

রুহুর বোন তো কুহুই হবে স্যার।

উঁহু।

হা হা হা, তুমি যা বলো না, আমার বোন উঁহুই অতনু স্যার, আমার কোনও ভগিনী নাই, অনলি ডটার।

তাহলে কুহু কে?

কে বলো দেখি, আমি মধুবালার যে সাদা কালো ছবি লাগিয়েছি প্রোফাইল পিকচারে, ওরও সেই পিকচার, ভেরি ব্যাড, ঠিকানা এটা, ও আমার ফ্রেন্ড লিস্টে নেই।

এই কথা তো কুহুও বলল, ওর ফোটো তুমি নিয়েছ, ও মধুবালা, নারগিস, তাদেরও আগের সুরাইয়ার ফ্যান, শি লাইক্স দোজ হিরোইন্স।

হা হা হা, আমি দেখেছি, বাট আই লাইক ক্যাটরিনা কইফ, করিনা কাপুর, দীপিকা পাড়ুকোন, ব্রেভ সানি লিয়ন, বাট মধুবালা ইজ নট ব্যাড, এটা আমি নেটে পেয়েছি। তোমার নিজের ফোটো নেই কেন?

না গো নিজের ফোটো দিলে আমাকে প্রত্যেকদিন দুটো করে প্রস্তাব নিতে হচ্ছিল, আই লাভ ইউ, লাভ ইউ, প্লিজ ইন-বক্সে এসো, প্রেমের হাল কি বোঝো, হা হা হা, কী করি, ফেসবুক ছেড়ে কি পালাব?

রুহুর কথা যা কুহুর কথা তা নয়। সন্ধেয় কুহু বলল, আরে এই জগৎটাই ভারচুয়াল, এখানে আসলই বা কী নকলই বা কী, কারোর সঙ্গে তো কারোর দেখা হয় না, তাই আর নিজের ছবি দিলাম না। আর মধুবালার চেয়ে তো আমি সুন্দর নই স্যার, ডু ইউ নো, মধুবালার হার্ট-এ একটা ছিদ্র ছিল, কত কম বয়সে সে মারা গেল। শি ওয়াজ অ্যান অ্যানজেল, অ্যানজেলঃ এই পোলিউটেড পৃথিবীতে কতদিন থাকবে।

অতনু কর তখন বলল, তুমি গৌরী না শ্যামলা মাই অ্যানজেল?

কেন বলো দেখি?

অসুবিধে থাকলে বোলো না।

যদি বলি শ্যামলা মেয়ে আমি।

অতনু কর বলল, শ্যামল বরণী মেয়ে বলো কার পথ চেয়ে আঁখি দুটি ওঠে জলে ভরিয়া।

এর মানে?

এটা একটা গান।

সে আমি জানি স্যার, কিন্তু এই কথা বললেন যে?

এমনি বললাম।

আই আম নট ওয়েটিং ফর এনি ওয়ান, প্রত্যাখ্যান আমার ভালো লাগে, আই লাইক টু রিফিউজ।

বুক কেঁপে উঠেছিল তার, সে কোনও রকমে বলে, তোমার চোখের রং কি বাদামি?

উফ, আমি বলব কেন?

না বললে না বলবে, আমি শুনব না।

অতনু, তুমি কি কোনও ফেক আইডি নিয়ে আছ, তুমি কি অতনু কর নও, তুমি কি ওল্ড ম্যান নও?

অতনু বলল, তোমার কি তাই মনে হয়?

না হয় না, বাট তোমার কথা আমাকে ডাউটফুল করে তুলছে।

কেন?

তুমি বুঝে নাও, আমার মনে হয় তুমি আমার চেনা কেউ।

না। অতনু বলল। বলে একটু থমকে থাকে। তখন নিঃশব্দে কুহু অন্তর্ধান করল। অতনু হিসেব কষল। তেত্রিশ বছর কেটে গেছে তারপর। তারা পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। পঞ্চাশ পেরোনো নারী কি এই ভাবে কথা বলতে পারবে, প্রত্যাখ্যান তার ভাল লাগে, পুরুষ মানুষ বুুঝুক প্রত্যাখ্যান কী?

যে-ঘরটিতে অতনু বসেছিল, সে ঘরে বুঝি ভাসছিল বিরল এক বাদামি রঙের চোখের মণি। ঐশিকা বলল, চা করি?

উনি কখন উঠবেন?

উঠবেন, ঘুম ভাঙলে উঠবেন।

চা করতে গেল সে। শ্যামল বরণ স্বাস্থ্যবতী কন্যা চা এনে বলল, কাগজ পড়বেন স্যার।

আমি কি তোমার স্যার?

বললে কি দোষ হবে, বাবা তো স্যার বলে, তাই না।

অতনু বলল, ও তো অফিসিয়াল স্ট্যাটাস, তুমি কি চাকরি করো।

ঐশিকা বলেছিল, কী জানি।

তুমি চিঠি দিয়েছিলে তো।

ও কিছু না, এমনি।

কেন দিয়েছিলে?

আপনি তো জবাব দেননি, আবার কথা কেন।

বিশাখাও চিঠি দিয়েছে।

আমি জানি, আমাকে বলেছে।

তারপর?

ও জানে একদিন ও সাড়া পাবে, প্রপোজ করতে ওর খুব ভালো লাগে, এর ভিতরে চারজনকে প্রপোজ করেছে ও, আরও করবে।

তুমি, তোমার ভালো লাগে না প্রস্তাব দিতে?

না।

তুমি তাহলে কী চিঠি দিয়েছ?

ঐশিকা বলেছিল, আমি লিখলাম আপনাকে আমার ভালো লাগে, যা মনে হয়েছে তাই লিখেছি, ওটা প্রপোজ নয়।

অতনু কর চুপ করে গিয়েছিল। ঐশিকার ছিল হালকা হলুদ শাড়ি, হলুদ ব্লাউজ, মাথার চুলে এলো খোঁপা। সেই খোঁপা ভেঙে আবার বাঁধল সে। কী অনায়াস। সেই খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে ঘাড় বাঁকিয়ে সে তার বাদামি চোখের মণি ঘুরিয়ে নিল অতনুর উপর থেকে। কী ধারাল ছিল সেই দৃষ্টিপাত। বলল, আমরা দুই বোন খুব খেলো, তাই না?

জানি না, মনে হয়নি।

হয়নি তো সেদিন আমার সামনে ওকে বললেন কেন, তোমার হাতের লেখা খুব সুন্দর।

সুন্দর তো।

আপনি খুব নিষ্ঠুর, একটা মেয়ে প্রপোজ করল, তাকে এই ভাবে ফেরালেন, উত্তর না দিতে পারতেন, ছিঃ, একজনকে সাক্ষী রেখে রিফিউজ করলেন, গোপন চিঠির গোপনীয়তা থাকল না।

আমি তো বলেছি।

অতনুকে কথা শেষ করতে দেয় না ঐশিকা। বলে, মুখ অন্ধকার করে ঘুরছিল, আমি ওকে বললাম পিসির বাড়ি যেতে, আপনার খুব অহংকার, তাই না স্যার?

তোমার চিঠির কথা তো বলিনি।

আমি কি ছেড়ে দিতাম, আমি তো প্রপোজ করিনি কাউকে।

আমি কি চলে যাব? অতনু বলেছে।

ধ্যাত, চলে যাবেন কেন, থাক আর বলছি না।

তুমি কি প্রপোজ করোনি?

মোটেই না।

না, ওটা তাই। উঠে দাঁড়িয়েছিল অতনু কর।

হতে পারে না, আমি তো জানতাম বিশাখা আপনাকে ভালোবেসেছে, অবশ্যই তা এক তরফা।

চিঠি কে লিখে দিয়েছিল?

তা জেনে করবেন কী?

তুমি কি জানতে না, সে রিফিউজড হবে?

কী করে জানব?

হাতের লেখা সুন্দর, কিন্তু বানান সব ভুল, আমার নামের বানানেও দীর্ঘ ঊ কার বসিয়েছে।

ও লিখেছিল।

মনে হয় কপি করেছিল, তাই তো।

আমি বলব না।

তোমার কোনও বানানে ভুল নেই, আরম্ভ করেছ কী সুন্দর।

ঐশিকা বিনবিন করল, ‘শরীর শরীর তোমার মন নেই কুসুম,’ ওতো পুতুল নাচের ইতিকথা।

তুমি ভুল বানানে ড্রাফট করেছিলে ওর চিঠি।

চিঠিটা ওর লেখা।

কপি করেছিল।

না। ঘুরে গিয়েছিল ঐশিকা, বলেছিল, এ সব কথা বলছেন কেন?

তুমি তারপর চিঠিটা পাঠালে।

ওহ, ভগবান, এই কথা বলতে এলে।

হ্যাঁ।

বলা হয়ে গেছে, এবার কি যাবে?

না। বলেই অতনু কর তার হাত ধরে ফেলেছিল। নিজের দিকে টেনেছিল। বুকের উপর আছড়ে ফেলেছিল বাদামি চোখের কন্যাকে। ঠোঁটে ঠোঁট, মুখের ভিতর জিভ সাপের মতো খেলা করে। এসো, এসো অহংকারী যুবক, তোমার অহংকার ভাঙবে বাদামি চোখের মেয়ে। ঐশিকা তাকে দু’হাতে অাঁকড়ে ধরেছিল। তারপর সেই এক অনন্ত চুমু। সে যেন এক জীবন পার হয়ে আর-এক জীবনে প্রবেশ। বাদামি চোখের টানে পাগল হল অতনু। ঐশিকা ডাক দিলে সে সব ফেলে সব তুচ্ছ করে ছুটে যায়। শরীর শরীর ছাড়া আর কিছু নাই শশী। কুসুমের মুখে এই সংলাপ ছিল না নিশ্চয়, কিন্তু এই ভাবেই তার কানে যেন কুহু দেয় বাদামি চোখ। কী ছিল তার বন্যতা। ঐশী ওয়াইল্ড। নিজের ভিতরে তাকে নিতেও বুঝি সে-ই প্রধান। শরীরে শরীর যোগ হয়। তারপর একদিন আচমকা কী হল, বলল, তুমি আর এসো না অতনু।

কেন, কী হয়েছে?

না, তুমি আর আসবে না।

ঐশী!

না না না, আই ডু নট লাভ ইউ, আমি তোমাকে ভালোবাসি না।

মিথ্যে বলছ।

না সত্যি, বিশাখা তো ইচ্ছে করে সব বানান ভুল করেছিল, যাতে আমার ডাকে তুমি সাড়া দাও। ও ত্যাগ করেছিল। তুমি একটি লোভী পুরুষ, অত ভুল কি কেউ লিখতে পারে, কী নির্বোধ পুরুষেরা সবাই। আর তুমি মিথ্যেও বলেছিলে, নাউ, দিজ ব্রাউন আইজ ডু নট লাইক ইউ, ডোন্ট টাচ মি, চলে যাও।

এর পর ন’পাহাড়ি থেকে তার বিদায়। বিশাখা ত্যাগ করেছিল, না ঐশিকা? এখনও জানে না অতনু কর। অথচ কিছুই তো ভোলেনি। ঊরুতে জড়ুল চিহ্নটি পর্যন্ত। যে মেয়ে কোনও পুরুষের কাছে সব নিবেদন করে, সে কি তাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে? পারে। প্রত্যাখ্যান করে, মিলনের সময় বিপরীত বিহারে গিয়ে সে পুরুষের চেয়ে বড়ো হয়ে উঠতে পারে। তাই-ই যেন হয়েছিল। এত বছর সব ভুলে থেকে আবার ফিরে এল সব, সেই ন’পাহাড়ি, বন-টিলা, ধু ধু প্রান্তর, মস্ত ছাতিম, তমাল, বিশাখা ঐশিকাঃ বিশাখা কোনও বানান ভুল করতে পারে না। অতনু কর তার দিকে ঝুঁকেছিল আগে, গৌরী কন্যা যে। বাদামি চোখের কন্যাকে সে পেয়েছিল গৌরী কন্যার বদলে। বিশাখা না দিলে ঐশিকাকে পেত না সে। আর ঐশিকা তাকে ফেরাল ওই বিশাখার জন্য। বিশাখাকে রেখে সে অতনু করের হাত ধরে কলকাতা চলে আসবে কী করে?

এই যে ফাগুন এল শহরে। কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ফেস বুক সব রঙে রঙে ভরে গেল প্রায়। কোথায় কোন মাঠে, কোন প্রান্তরে, নদীতীরে শিমুল-মাদার-পলাশ ফুটেছে আগুন হয়ে, বাগানে আমের মুকুলে বসেছে ভ্রমর, লেবু ফুল ফুটেছে কোথায় কত দূরে, সব জেনে গেল সবাই। কুহু সন্ধেয় এল, হ্যালো স্যার।

বল।

তুমি এখন কী করছ?

তোমার জন্য বসে আছি।

স্যার, মিঃ অতনু কর, স্যার, টু ডে ইজ দ্য ডে ফর রিফিউজাল, আয়াম লিভিং ইউ টু ডে, তুমি ভালো থেকো।

হোয়াই, তুমি কি ফেস বুক থেকে সরে যাচ্ছ ব্রাউনি?

আই ডোন্ট নো স্যার, বাট আয়াম লিভিং ইউ, আমার আর ভালো লাগছে না তোমাকে।

কেনরে বালিকা, আমি কি কোনও অন্যায় করেছি?

নো  নো, তুমি খুব ভালো, কিন্তু আমি আজ তোমাকে প্রথমে আনফেন্ড্র করব, তারপর ব্লক করব।

কেন?

তুমি রুহুর সঙ্গে থাকো, ওই মধুবালাকে নিয়ে থাক, বাই স্যার, রুহুর সঙ্গে থাকলে কুহু থাকে না।

কেন রে ব্রাউনি, আমি খুব খারাপ?

তুমি খুব ভালো, ভালো থেকো, কিন্তু একটু পর থেকে তুমি আমাকে দেখতে পাবে না।

অতনু কর লিখল, ঐশিকা, বিশাখা কি তোমায় বলেছিল, আমি শেষ পর্যন্ত তার চিঠির উত্তর দিয়েছিলাম, তাই ফিরিয়ে দিয়েছিলে আমায়, অতনু কর লোকটা ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ায়? কিন্তু তা নয়, তা নয় সত্যি।

মেসেজ গেল না। হ্যাং হয়ে অন্ধকারে ভেসে রইল মহাব্রহ্মান্ডের কোথাও।

টিরিং

চল ফুলি, তোর নামে ব্যাংক-এ একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিই। তোর ভালো নামটা কীরে?

মেয়েটা লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলেছিল ফুলেশ্বরী।

– ফুলেশ্বরী? কী সুন্দর নামটা রে তোর। তোকে নিয়েই তাহলে সিনেমাটা হয়েছিল। সন্ধ্যা রায় ছিল না? স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন রজতকান্তি।

রজতকান্তির স্ত্রীর নাম চন্দ্রিমা। সায় দিলেন।

রজতকান্তি বললেন– মেয়েটা এতদিন আছে, ভালো নামটাই জানি না। ফুলি নামে ডাকি।

ফুলি বলে, না, আমার নামে ব্যাংক-এ বই খুলতে হবে না। আপনার কাছে টাকা আছে, ওটাই ঠিক আছে।

রজতকান্তি বলে, মোটেই ঠিক নেই। আমি মরে গেলে?

ধুর, খালি বাজে কথা।

মানুষ চিরকাল বাঁচে নাকি? একবার তো হার্ট অ্যাটাক হয়েই গেল। তোর সব টাকা তোর অ্যাকাউন্ট-এ রেখে দেব।

কিন্তু অ্যাড্রেস প্রুফ? আইডেনটিটি প্রুফ? ওর তো ভোটার কার্ডই নেই। গত ভোটের আগে একবার ভোটার কার্ড করার চেষ্টা করেছিলেন রজতকান্তি, হয়নি। ওরা চেয়েছিল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, পাসপোর্ট, প্যান কার্ড এসব কত কিছু।

তোর রেশন কার্ড আছে না একটা?

জানি না।

জানি না মানে? ছিল তো নিশ্চয়ই।

ঠোঁট উলটে ফুলি মাথা নাড়ায়। মানে জানে না।

তার মানে ফুলির ভারতের নাগরিকত্বের কোনও প্রমাণ নেই।

ফুলি কবে থেকে এখানে? মামণি যখন মাধ্যমিক দিল। ফুলির মা বলেছিল, মেয়েটাকে আপনারা রাখুন। বারো বছর বয়স হ’ল ওর। ওর উপর কুনজর পড়েছে। সকালে চলে আসি, ঘরে একা থাকে মেয়ে। ওকে খাওয়া পরায় রেখে দিন। তার মানে বারো বছর হয়ে গেল এ বাড়িতে।

আগেকার সময় হলে চেষ্টা চরিত্র করে একটা রেশন কার্ড করে নেওয়া যেত। এখন শহুরে মধ্যবিত্তরা রেশন-এর চাল খায় না। রেশন দোকান থেকে গম নিয়ে চাকিতে দিয়ে আটা ভাঙানোর দিনও আর নেই। এখন সবাই আটাই কেনে। রেশন-এর দোকানে আজকাল মুদি দোকানের মতোই মশলা, সাবান, এমনকি প্রসাধন সামগ্রীও বিক্রি হয়। রজতদেরও রেশন কার্ড আছে। মাসে একবার গিয়ে যা হোক কিছু নিয়ে আসা হয়। রেশন কার্ড করাতে গেলে বলবে আগের কার্ডখানা নিয়ে আসুন, যদি বলা হয় আগে কার্ড ছিল না– তখন বলবে এত বছর বয়সেও কার্ড নেই? ঠিকানার প্রমাণ, বয়সের প্রমাণ, ভোটার কার্ড…। ফুলির তো কিচ্ছু নেই। এই যে চব্বিশটা বছর ধরে পৃথিবীতে রয়েছে, তার কোনও প্রমাণ নেই। ফুলিকে কেউ চিঠিও দেয় না।

দেশের বাড়িতে ফুলি ক্লাস ফাইভ অবধি পড়েছিল। এ বাড়িতে আসার পর চন্দ্রিমা মাঝেমধ্যে পড়াতে বসত। দোকানের নাম পড়তে পারে, মুদির হিসেব পড়তে পারে, টিভির সিরিয়ালগুলোর নাম পড়তেও অসুবিধে হয় না তার– এমনকী যুক্তাক্ষর দিয়ে লেখা কঠিন কঠিন নাম যেমন স্বয়ংসিদ্ধা, অগ্নিপরীক্ষা এসবও পড়তে পারে। ওকে কেউ চিঠি দিলে, ও পড়তে পারবে। উত্তরও দিতে পারবে। একদিন বলেছিল দিদিকে। দিদি মানে এ বাড়ির মেয়ে। রজত-চন্দ্রিমা ওকে মামণি ডাকে, ওর আসল নামটা খুব কঠিন, মন্দাক্রান্তা। মামণি তো আদরের ডাক। ফুলি তো সেটা বলতে পারে না, আবার মন্দাক্রান্তাকে ছোটো করে মন্দ দিদি বলা যায় নাকি? জেঠিমা-ই বলে দিয়েছে মিষ্টি দিদি ডাকতে। ফুলি একদিন বলেছিল ও মিষ্টি দিদি, আমাকে একটা চিঠি দেবে?

কী চিঠি?

এমনি চিঠি। আমার নামে আসবে বেশ…

কী লিখব?

যা খুশি…।

তার চে বরং তোকে একটা মেল আইডি বানিয়ে দিচ্ছি, চ্যাট করবি বেশ।

আসলে পাত্তাই দেয়নি।

ঝন্টুদাকে ও বলেছিল একটা চিঠি দেবেন আমাকে? এমনি চিঠি।

ঝন্টুদা দিয়েছিল।

রজতকান্তি বলেছিল ফুলি, তোর নামে আলাদা পাসবই বোধহয় হবে না, আমি তোর টাকাটা আমার নামেই রাখছি, তোকে নমিনি করে দিচ্ছি, আমার কিছু হয়ে গেলে তুই সেটা পাবি। আমার নামে হলেও ওটা তোরই টাকা। তোর মা বলেছিল খাওয়া-পরায় রাখতে। আমি কিন্তু তোকে মাইনেও দিচ্ছি। হিসেব করে দেখলাম তোর তিরিশ হাজার টাকার উপর পাওনা হয়ে গেছে। বলে রাখলাম এগুলো তোর টাকা। তুই এখন তিরিশ হাজার টাকার মালিক। এই টাকায় আমি হাত দেব না। তোর যা খুশি, যেভাবে ইচ্ছে খরচ করবি। তোর বিয়েতেও এই টাকা খরচ করব না ফুলি। তোর বিয়ের খরচ আমাদের। মামণির বিয়েটা মিটে যাক, তারপর তোর জন্য পাত্র দেখা শুরু করব। তোকে বিয়ে দিয়ে আমরা দুজন কোনও বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাব।

মিষ্টি দিদির বিয়েটা ঠিক হয়ে গেছে। ঠিক হয়ে গেছে মানে দিনটা। বিয়েটা তো আগেই ঠিক ছিল। মিষ্টি দিদির বরকে তো ফুলি কবে থেকেই চেনে। পার্থদা। এ বাড়িতে আসে। মিষ্টিদির ঘরে বসে গল্প করে। তখন ওঘরে কেউ যায় না। ঘরের বাইরে থেকে জিজ্ঞাসা করে, এবার চা দিয়ে যাব? কখনও মিষ্টি দিদি নিজে এসে চা আর জলখাবার নিয়ে যায়। খুব বড়ো চাকরি করে পার্থদা। মিষ্টিদিও তো চাকরি করে। কম্পুটারি চাকরি। পরশু দিন বিয়ে। বাড়ি রং করা হয়েছে। ইলেকট্রিকের কাজ করা হয়েছে, বাড়িতে অনেক লাইট লাগানো হয়েছে। ছাদেও লাইটের ব্যবস্থা হয়েছে। বিয়েটা এবাড়িতে হবে না। বিয়েবাড়ি ঠিক করা হয়েছে। কাল থেকেই লোকজন আসবে। মামা-মামি আসবে। দু’জন কাকু আসবে। ওরা সবাই মিষ্টি দিদির মামা-মামি। মিষ্টি দিদির কাকা-কাকু। ফুলিরও। ফুলির কে আছে? কেউ নেই। মা মরে গেছে, ব্যস, হয়ে গেল। কেউ নেই। শুধু ঝন্টুদা আছে।

ঝন্টুদা এবাড়ির সব ইলেকট্রিক-এর কাজকর্ম করে। ফ্যান খটখট, টিউব লাইটে ভোঁ ভোঁ, গিজার খারাপ– সব ঝন্টুদা করে। ফোন করে দিলেই চলে আসে। ঝন্টুদাকে চা করে দেয় ফুলি। চায়ে চুমুক দিতে দিতে মিটিমিটি তাকায় ফুলির দিকে।

ঝন্টুদা প্রথম আদর করেছিল ছাদে। সরস্বতী পুজোর প্যান্ডেল করার সময়। পুজোর আগের দিন। বাড়িতে সরস্বতী পুজো হয়। ছাদে ছোটো করে প্যান্ডেল হয়। খিচুড়ি হয়। দিদিমণির বইপত্তর আর ল্যাপটপ না কি যেন বলে, সেটা রাখে। ওখানে ফুল চন্দন পড়ে। পাড়ার অনেকে আসে। আদরের সময় ফুলি বলেছিল– এমা, এখানে না, ঠাকুর দেখে ফেলছে। ঝুন্টদা বলেছিল ঠাকুরের এখন চোখ ঢাকা। কেউ ছিল না ছাদে। বাড়ির পাম্পের কাজ করতেও ছাদে যেতে হয়। চৌবাচ্চায় ওঠার মই ধরতে হয় ফুলিকে। পাম্পটা তো প্রায়ই খারাপ হয়। ঝন্টুদা বলে পাম্পটা কি ভালো বল, তোকে আর আমায় ছাদে এনে দেয়।

ঝন্টু ফুলির কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল-এ বাড়ির কে কোথায় শোয়। দোতলায় তিনটে ঘর। একটা ঘরে মিষ্টি দিদি। একটা ঘরে জ্যাঠা-জেঠি আর একটা ঠাকুরঘর।

একতলায় রান্না খাওয়া। একটা ড্রইংরুম। কেন যে ড্রইংরুম বলে কে জানে। ওখানে কোনও ড্রইং হয় না। ওখানে গদিওলা চেয়ার আছে। একটা টিভিও আছে। আর একটা ঘরে ফুলি থাকে। ফুলির ভয় করে না। ওর নীচে থাকতেই ভালোলাগে। বারবার দরজা খোলা-বন্ধ করা ফুলিকেই তো করতে হয়।

ঝন্টুদা বলেছিল ফুলি, তুই দারুণ। খুব মিষ্টি। তোকে ছুঁলে আমার গায়ে ইলকট্রিক শট্ লাগে। তোর লাগে? ফুলি মাথা নীচু করে বলেছিল দুষ্টু কোথাকার। এটা কিন্তু ওর নয়, হাসিরাশি সিরিয়ালের হাসির ডায়লগ। ঝন্টুদা বলেছিল তোকে আমি একদিন অনেকটা পেতে চাই। অনেকক্ষণ ধরে।

ওমা! সেকি কথা। নানা… এটা কোনও সিরিয়ালের নয়, ফুলির নিজের।

ঝন্টুদা বলেছিল– না করিস না ফুলি। তোকে আমি স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নে আদর করি। আমার বোনটাকে বিয়ে দিয়ে তোকে আমি বিয়ে করে তোর সঙ্গে সংসার করব। তোর কেউ নেই, আমারও কেউ নেই। একদিন ফুলি, আমি রাতে তোর ঘরের জানালায় টোকা দেব…।

না– এমন কথা বলে না, বলে পালিয়ে গিয়েছিল ফুলি সেদিন।

তারপর ঝন্টুর ওই কথাগুলো তোলপাড় করেছে ফুলিকে। স্বপ্ন। স্বপ্নে স্ক্রু, নাটবল্টু আর তারের মালা জড়ানো ঝন্টুদা বলছে সংসার! সংসার।

পার্থদা আর মিষ্টি দিদি যে একসঙ্গে থেকেছে! পর্দা ফেলা, কখনও দরজা বন্ধ। তার বেলা?

এখন না হয় বিয়ে হবে। কিন্তু এর আগেও তো কতদিন…

রাস্তায় দেখা হতে ঝন্টুদা বলল, কিরে ফুলি। কতদিন দেখি না। তোদের বাড়ির কিছু খারাপও হচ্ছে না দেখছি। তোকে না দেখে আমার তো মেনসুইচ খারাপ হয়ে গেল। ফুলি, মাইরি বলছি, তোকে যেদিন ফার্স্ট দেখেছিলাম না, আমার ফিউজ উড়ে গিয়েছিল। প্লিজ মাইরি, একদিন ব্যবস্থা কর। আমি তোর ঘরে আজ রাতে টোকা দেব।

ফুলি বলেছিল– না-না, টোকা নয়, টোকা নয়, কেউ শুনে ফেলবে।

ঝন্টু বলেছিল– তুই তো বলেছিলি তোর জ্যাঠা-জেঠি দশটার সময় শুয়ে পড়ে। দিদি মনে কানে ছিপি গুঁজে কম্পুটারি করে। কে শুনবে?

ফুলি বলেছিল– না না, টোকা দেওয়া খুব খারাপ। শুনে ফেলবে।

ঝন্টু বলেছিল তাহলে সাইকেলের বেল বাজাব। টিরিং। রাস্তায় তো সাইকেল চলতেই পারে। আজ ঠিক রাত সাড়ে এগারোটায় টিরিং, কেমন!

রাত্রে টিরিং। ঝন্টুদার হাতে একটা সাইকেল বেল। খুব আস্তে দরজা খুলে গেল। ফুলির ঘরে ঝন্টু। ঝন্টু বলেছিল কোনও ভয় নেই ডার্লিং, সব ব্যবস্থা নিয়ে এসেছি।

ঝন্টুদা এক ঘণ্টা বাদে চলে গিয়েছিল। রাস্তার আলোয় তখন শ্যামাপোকা, কার্তিকের কুয়াশা। নিমগাছের পাতায় পাতায় – না যেও না… রজনীর তখনও বাকি।

এরকম টিরিং হয়ে গেছে আট দশ বার। প্রতিবারই ফুলি ঝন্টুর কানে ফিসফিস করে বলেছে আর নয় কেমন, বিয়ের পরে আবার।

একমাসের উপর কোনও টিরিং হয়নি। আজ হ’ল। হ’তে পারে এটা সত্যিসত্যি সাইকেলের টিরিং। কান খাড়া করে শুনল। চলমান সাইকেলের একটা আলাদা টিরিং ধবনি থাকে। রাত্রির অন্ধকারে আবার ছোট্ট একটা টিরিং।

দু’দিন পর বিয়ে। মেয়ে চলে যাবে। বড়িতে এখন এসব ঠিক নয়। তাছাড়া বাড়িতে এ সময়ে ঘুম কমে যায়। কাল সকালেও এসেছিল ঝন্টুদা। ছাদে লাইট লাগাতে। কোনও কথা হয়নি। কিচ্ছু বলেনি ঝন্টুদা। যাবার সময় শুধু বলে গেল ছাদের দরজাটা বড্ড পলকা জ্যাঠামশাই, ঠিক করিয়ে নেবেন। জ্যাঠামশাই বলেছিলেন মিস্তিরিগুলোর বড্ড ডাঁট বেড়েছে। বললে আসে না। একটা মিস্তিরি পাঠিয়ে দিও কাল। দেখছি, বলে চলে গেল। একটি বারের জন্যও ফুলির দিকে তাকাল না। অভিমান হয়েছিল। একমাস হয়ে গেল বলে ঝন্টুদার খুব কষ্ট হচ্ছে।

আস্তে আস্তে দরজার ছিটকিনিটা খুলল ফুলি।

ছিটকিনি খুলতেই একজন লোক ফুলির মুখ চেপে ধরল। অন্য একজন ফুলির দুটো হাত পিছনে নিয়ে বেঁধে দিল। মুখের উপর আঠালো কী একটা জিনিস চেপে দিল। তারপর একটা কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে দিল। একজন ফুলির মুখটা খামছে ধরল। গলাটাও। বুকের কাছেও হাত দিয়ে খামচে দিল। বলল চুপ করে এখানে দাঁড়িয়ে থাক।

ফুলি উপরে উঠে যাবার পায়ের শব্দ শুনল।

ফুলির তো পা বাঁধা ছিল না। ফুলি উপরে উঠতে গেল ওদের পেছন পেছন। একজন ওকে ধাক্বা দিয়ে ফেলে দিল। ফুলি দেখল ওরা চারজন। না। ওদের মধ্যে ঝন্টুদা ছিল না।

ফুলি উপরে গেল না। নীচে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পরই দরজা ধাক্বানোর শব্দ শুনল। একটা প্রচন্ড আওয়াজ যেন কিছু ভেঙে পড়ল। জেঠিমার গলার আওয়াজ শুনল– কী? কী হয়েছে রে ফুলি?

ফুলি শুনল– একটা পুরুষ কণ্ঠ– কোনও আওয়াজ করবেন না। একদম চুপচাপ। চ্যাঁচামিচি করলে আপনার মেয়েকে রেপ করব সবাই মিলে। চাবিটা দিন।

পাঁচ মিনিটও নয়। ওরা চলে গেল। একজন বলে গেল– আমরা ছাদের পলকা দরজাটা ভেঙে ফেলেছি। পুলিশ এলে বলবি ছাদের দরজা ভেঙে ঢুকেছিলাম আমরা। তুই দরজা খুলেছিস বললে ফেঁসে যাবি। ওদের হাতে একটা লাল ব্যাগ আর একটা কালো ব্যাগ। আর কিচ্ছু নেই।

ওরা চারজন চলে গেল। ওদের মধ্যে ঝন্টুদা ছিল না।

ফুলি উপরে উঠল। ঘরে আলো জ্বলছে। আলমারির দরজা হাট করে খোলা। আলমারির ভিতরে লকারের খোপটাও খোলা। খাটের উপর বসে আছে জ্যাঠামশাই, মুখের উপর সাদা রঙের কী একটা আটকানো, মুখ থেকে অদ্ভুত কিছু আওয়াজ বের হচ্ছে। ফুলিও চিৎকার করছে, কোনও আওয়াজ পাচ্ছে না। জ্যাঠামশাইয়ের হাত পিছনে বাঁধা। জেঠিমাকে দেখতে পাচ্ছে না। বাথরুম থেকে দরজা ধাক্বা দেবার শব্দ। পাশের ঘর থেকেও দরজা ধাক্বানোর শব্দ। ফুলি দেখল দিদিমণির ঘর এবং বাথরুমের বাইরের ছিটকিনি বন্ধ। ফুলি ওর বাঁধা হাত দিয়ে পিছন ফিরে বাথরুমের দরজাটা খুলে দিতে পারে। জেঠিমা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমেই বলল মামণি কোথায়, মামণির কিছু হয়নি তো? জেঠিমা দিদিমণির ঘর থেকে দরজা ধাক্বানোর শব্দ পায়। বাইরে থেকে লাগানো দরজাটার ছিটকিনি খুলে দেয়। দিদিমণিও বেরিয়ে আসে। ওর বাবার মুখের আঠা লাগানো সাদা জিনিস খুলে দেয়। জ্যাঠামশাই এতক্ষণ ধরে কিছু বলার চেষ্টা করছিল। ওটা খুলে দেবার পর শব্দহীন ফুলির মুখটাও খোলা হল। কান্না এল দলা দলা।

পিছনে বাঁধা হাতটা কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করছে।

কী হয়েছিল বল?

ফুলিকে জিজ্ঞাসা করল মন্দাক্রান্তা।

আমি জানি না, আমি জানি না…। ও নিজের মুখটা ঢাকতে চায়, কিন্তু হাত বাঁধা।

পুলিশ বলল যে-মেয়েটা আপনাদের কাছে থাকে, ওর ভোটার কার্ড আছে?

রজতকান্তি মাথা নাড়ায়।

এনি অ্যাড্রেস প্রুফ?

মাথা নাড়ায় রজতকান্তি।

মেয়েটা কে তবে?

মেয়েটা ভালো। এর মা এখানে কাজ করত। মা মরা মেয়ে…

ফুলি শুনছে ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

পুলিশ বলছে– লকার থেকে গয়না তুলে এনেছেন এটা আর কে জানত?

আমি, আমার স্ত্রী আর মেয়ে।

ওই মেয়েটা?

ও কী করে জানবে?

যারা চুরি করেছে ওরা তো জানত। চিন্তা করে দেখুন কখনও মেয়েটাকে বলেছেন কিনা।

না। বলিনি।

ক’জন ছিল?

চারজন। নাকি আরও বেশি…

কীভাবে এল?

ছাদের দরজা ভেঙে।

দরজা ভাঙার শব্দ পেয়েছিলেন?

পেয়েছিলাম।

মেয়েটা কোথায় ছিল তখন?

মেয়েটা বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল। ওর গলায় ঘাড়ে নখের আঁচড়। ভাগ্যিস আর কিছু করেনি।

আপনার মেয়েকে কিছু করেনি তো? গায়ে-টায়ে…

না-না-না, আমার মেয়ের গায়ে ওরা হাত দেয়নি। একদম হাত দেয়নি। আমার মেয়ে যে-ঘরে শোয় সেই ঘরের দরজাটা প্রথমেই ওরা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছিল। আমার মেয়ে আনটাচড, আমার মেয়ে আনটাচড।

মেয়েটাকে ডাকুন। পুলিশ অফিসার বলে।

ফুলির বুকের ভিতরে কীরকম বিচ্ছিরি টিরিং টিরিং টিরিং। ওর বুকের ভিতরের শিরাগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। ছলাৎ ছলাৎ রক্ত ছিলিক দিচ্ছে প্রতিটি টিরিং, তার চেয়ে আমাকে রেপ করে মেরে ফেললেই তো পারত ঝন্টুদা। আমাকে বলতে হবে পৃথিবীতে কোনও টিরিং নেই। কোনও টিরিং হয়নি কখনও। কোনও টিরিং শুনিনি জীবনে। আমাকে দেখাতে হবে আমার গলার, আমার ঘাড়ের, বুকে লেগে থাকা নখের আঁচড়। বাধা দেওয়ার প্রমাণ। প্রমাণ রেখে গেছ, ঝন্টুদা কত দয়া তোমার। ভুল ভাবছি, ভুল। ঝন্টুদা ছিল না। উপরে কাঠের দরজাটাও ভেঙে দিয়ে গেছে। তোমরা তো উপর থেকেই এসেছিলে। দরজা ভেঙে। দরজাটা তো পলকাই ছিল। ছিটকিনিও পুরোনো। ঝন্টুদা, তুমি তো আগেই বলে দিয়েছিলে– দরজাটা ভালো নেই।

ফুলি… কোথায় রে তুই… পুলিশ সাহেব ডাকছেন। যা দেখেছিস বলবি…।

পুলিশের গলা শোনা যায়– এখন এই মেয়েটা নয়। আপনার মেয়েকে ডাকুন। এক এক করে সবাইকে জিজ্ঞাসা করব। আপনারা বাইরে যান। একদম বাইরে। যখন বেল বাজাব এক জন করে আসবেন, দরজা বন্ধ থাকবে।

বন্ধ দরজার এপারে খাবার টেবিলে বসে আছে ওরা। ড্রইংরুমে পুলিশের দুজন লোক। দিদিমণি ভিতরে গেল। দরজা বন্ধ। বাইরের টেবিলে এক বৃদ্ধ, এক বৃদ্ধা এবং মেয়েটা।

ফুলি দেখল ওরা দুজন ফুলির দিকে তাকিয়ে আছে।

ফুলি বলল কী হবে জ্যেঠু?

রজতকান্তি বলল, কী আর হবে? আরও কত খারাপ হতে পারত। ভগবানের দয়ায় আমাদের মেয়ে দুটো বেঁচে গেছে। গয়না না হয় গেছে। গয়না ছাড়াই বিয়ে দেব…।

ফুলি বলল আপনি যে বলেছিলেন, আমার টাকা আছে আপনার কাছে, ওই টাকা দিয়ে মিষ্টি দিদির গয়না কিনে নিন।

ওতে আর কী গয়না হবে? সেসব তোকে ভাবতে হবে না।

জেঠিমা বলল– পুলিশের ঝামেলা এখন না করলেই হতো। এখনই তো লোকজন আসবে।

তারপর আর কোনও কথা নেই ঘরে।

এতক্ষণ কী জিজ্ঞাসা করছে পুলিশ? রজতকান্তি স্বগতোক্তি করে। তারপর আবার নিশ্চুপ সবাই। চেনালোকই এর পিছনে আছে। যারা সব জানে। ছাদের দরজাটা যে পলকা সেটাও তো জানে। কে হতে পারে ফুলি? ঝন্টু?

জোরে মাথা নাড়ায় ফুলি।

ঝন্টুদা, তোমার চিঠিটা সকালবেলায় বাথরুমে নিয়ে গিয়েছিলাম। যেসব ভালোবাসার কথা লিখেছিলে, সব কুচি কুচি করে ছিঁড়েছি, তারপর পায়খানার প্যানে ফেলে দিয়ে জল ঢেলে দিয়েছি। আমি তো জানি, তুমি ছাড়া আর কেউ টিরিং শব্দ জানে না। তুমি আর আমি। সেই টিরিং তুমি অন্যদের বলেছ। আর আমি, এই শব্দের গোলোক আমি কোথাও ভাঙবনা। এই কৌটোবন্দি শব্দের ঢাকনা কোথাও খুলব না। পুলিশ যদি মারে, তবুও না। যদি জেলে ভরে দেয়, তবুও না।

তুমি কি সত্যি সত্যি তোমার বোনের বিয়ে দেবে? বিয়েতে টাকার দরকার। জানি তো। ওর বিয়ে হয়ে গেলে যদি তুমি আমাকে চাও? আমার সঙ্গে সংসার চাও? তাহলে কী করব? কী বলব? তোমায় আমি?

দিদিমণি চলে এল।

পুলিশের কঠিন স্বর– এবার কাজের মেয়েটাকে পাঠান।

ওঘর থেকে শব্দ আসছে টিরিং… টিরিং… টিরিং…।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব