প্রতীক্ষার দিন

অন্ধকারের মধ্যে দ্রুত গতিতে পিছিয়ে যাচ্ছে কিছু আলো। গ্রাম অথবা শহরের। এছাড়া দেখার মতো কিছু নেই। ট্রেনটার ডিপারচারই ছিল হাওড়া থেকে রাত আটটায়। কিছু দেখা যাবে না, জেনেও জানলার পাশের সিটটা দখল নিয়েছে ইমন। বাকি তিনবন্ধু ওকে আটকায়নি। কোনও এক আশ্চর্য কারণে ওরা ইমনকে বাড়তি অ্যাডভান্টেজটুকু দেয়। অন্তত হাওয়া খাওয়ার লোভে ওদের কেউ একজন ইমনকে জানলার সিটে বসতে বাধা দিতে পারত, দেওয়ার কথা ভাবেইনি। চারজনের মধ্যে ইমনের অধিকার যেন সবচেয়ে আগে। যদিও শুধু হাওয়ার কারণে ইমন এখানে বসেনি, হাওয়ার চরিত্র বুঝতে বসেছে। সে জানত এই টুরে হাওয়ার ধরনটা আলাদা হবে।

তাই হয়েছে, অন্য টুরের তুলনায় হাওয়ার ওজন প্রায় অর্ধেক। বাইরের অন্ধকারটাও তত নিরেট নয়, গাছপালা, পুকুর ঘাট, খেত-জমি, কুঁড়েঘর, পাকাবাড়ি সবই দিব্যি আন্দাজ করা যাচ্ছে। এমনকী মনোনিবেশ একটু গভীর করলেই কুঁড়েঘরে দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করা কিশোরীটিকেও যেন পাচ্ছে দেখতে। ফ্ল্যাটবাড়ির ইন্টারনেটে বুঁদ তরুণও নজর এড়াতে পারছে না। এসব দেখার চোখ বা আগ্রহ কোনওটাই নেই ইমনের তিনবন্ধুর, পার্থ, জয়দীপ, কৌশিকের। না থাকাটা অপরাধের নয় মোটেই। ওদেরও যে যার মতো নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। তবে চারবন্ধুর বন্ধুত্ব কিন্তু খুব নিবিড়।

কলেজে এই চারজন একটা কোর গ্রুপ। এরা কেউই একে অপরের স্কুলের বন্ধু নয়। আলাপ হয়েছে কলেজে এসে। সম্পর্ক গাঢ় হয়েছে গত তিনবছর ধরে। ঘটনাচক্রে ইমনের স্কুলের কোনও বন্ধুই এই কমার্সখ্যাত কলেজটায় ভর্তি হয়নি। স্কুলেও ইমনদের একটা কোর গ্রুপ ছিল, সেটা কলেজের থেকে অনেক বড়ো। সেখানেও ইমনকে অজানা কারণে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। উদাহরণ হিসেবে যেমন বলা যায়, ইন্টার-স্কুল ফুটবল ম্যাচে কোনও বন্ধু চার পাঁচজন প্লেয়ারকে কাটিয়ে গোল করার সময় ইমনের উদ্দেশে বলটা বাড়িয়ে দিত। অন্যদের তুলনায় দুর্বল প্লেয়ার হওয়া সত্ত্বেও ম্যাচের পর ম্যাচ গোল পেয়ে টিমে টিঁকে যেত ইমন। এই ফেভার করাটা সোজাসাপটা ভালোবাসা নয়, ইমনকে সাফল্য এনে দিতে পেরে খুশি হয় বন্ধুরা।

স্কুল পেরিয়ে কলেজ শেষেও এই ধারা অব্যাহত রয়ে গেছে। অথচ বন্ধুরা গেছে পালটে। এমন নয় যে ইমনের মধ্যে লিডারশিপ কোয়ালিটি আছে, আবার ইমনকে দেখে মায়া বা করুণা জাগারও কোনও সম্ভাবনা নেই। সেরকম ঢিলে ব্যক্তিত্ব তার নয়। তবুও বন্ধুরা কেন যে এই ট্রিটমেন্টটা করে, আজও আবিষ্কার করতে পারল না। এর ফলস্বরূপ বন্ধুত্ব যতই নিবিড় হোক না কেন, বন্ধুদের সঙ্গে নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব রয়েই যায় ইমনের। যেমন ট্রেনের জানলার পাশে বসে সে উপলব্ধি করছে, এ টুরের বাতাস ওজনে হালকা, অন্ধকার তত নিরেট নয়, এটা তিন বন্ধুকে বলতে পারবে না। বললেও বুঝবে না তারা। না বুঝে ইমনের কথায় সায় দিয়ে দেবে। আঁতেল বলে ইমনের লেগ পুলও করবে না।

এবারের বেড়াতে যাওয়াতে তিন বন্ধুর আচরণেও অনেক বদল দেখা দিয়েছে। সেটা আদৌ তারা টের পাচ্ছে কিনা, কে জানে! একটু বেশিই হুল্লোড় করছে। সমগ্র এ বদলের মূল উৎস হচ্ছে, চারজন বন্ধু জীবনে প্রথমবার কোনও গার্জেন ছাড়া বেড়াতে যাচ্ছে বেশ কয়েক দিনের জন্য। পুরী যাচ্ছে। বাড়িতে বলেই রেখেছিল, ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার পর আমরা চারজন কোথাও একটা বেড়াতে যাব। ‘না’ করতে পারবে না। এদের বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠতা চার বাড়িতেই অজানা নয়। পরস্পরের গার্জেনদের মধ্যেও আলাপ আছে। সেই বিশ্বস্ততা থেকে ছাড়া হয়েছে চার মূর্তিকে। জয়দীপ, পার্থর বাবা এসেছিল সি-অফ করতে। দুজনেই নিজের নিজের বাবাকে ফেরত পাঠাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। বলছিল, আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে! ট্রেন ছাড়তে দেরি আছে। ছাড়লে ফোন করে দেব। আসলে ‘বাবা ছাড়তে এসেছে’ ব্যাপারটা ট্রেনের অন্য প্যাসেঞ্জারদের কাছে লুকোতে চাইছিল। নিজেদের অ্যাডাল্টহুড খাটো হয়ে যাচ্ছিল যে এখন অবশ্য বড়ো হয়ে যাওয়াটা সদম্ভে প্রকাশ করছে।

ইমন কৌশিককে জিজ্ঞেস করেছিল, তোর বাড়ি থেকে কেউ এল না! নাকি আড়াল থেকে লক্ষ্য রাখছে?

–  না। যখন মানা করে দিয়েছি আসতে, কেউ আসবে না। বেশ কনফিডেন্স নিয়ে বলেছিল কৌশিক।

ইমন বলে, তোর কথার তার মানে একটা ওয়েট আছে বাড়িতে।

– তা আছে তেমনি আমিও বাড়ির কথা সব মেনে চলি। এই টুরে যেমন যা যা করতে আমায় বারণ করা হয়েছে কোনওটাই করব না।

কৌশিকের বলা শেষ হতেই ইমন জানতে চেয়েছিল, কী কী বারণ আছে?

– মদ খাওয়া আর সমুদ্রে চান করা। মাকে প্রণাম করে যখন বেরিয়ে আসছি, এই দুটো কথা বলে দিয়েছে।

ইমন অবাক গলায় বলেছিল, মদ না হয় নাই খেলি। সমুদ্রে যদি চান না করিস, তাহলে পুরী আসার মজাটাই তো পাবি না।

– কিছু করার নেইরে ভাই। চোখের আড়ালে থাকছি, তবু মা যখন আমায় বিশ্বাস করছে, তার মর্যাদা আমাকে দিতেই হবে। শুকনো মুখে বলেছিল কৌশিক। ওর মাতৃভক্তি যে এতটা গভীর, জানত না ইমন, দেখা যাক গোটা টুরে সেটা কতটা অটুট থাকে।

ইমনের মা-বাবাকে নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। রাতে খাওয়ার টেবিলে কথাটা যখন পেড়েছিল ইমন, মা সামান্য আঁতকে বলে উঠেছিল, তোরা একা একা যাবি! সঙ্গে কোনও বড়ো কেউ থাকবে না?

ইমনের হয়ে উত্তর দিয়েছিল বাবা। খেতে খেতে বলেছিল, ‘তোরা’ আবার ‘একা একা’ কী করে হল! যথেষ্ট বড়ো হয়েছে ওরা। তোমার ভাগ্য ভালো যে, ছেলে বাড়ির খাবার খেয়ে কলেজ করেছে। আজকাল তো বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে হিল্লিদিল্লির কলেজে চলে যাচ্ছে পড়তে।

মা আর কিছু বলতে পারেনি। আকাঙক্ষাও পুরোপুরি মোছেনি মুখ থেকে। এরপর বাবা ইমনের উদ্দেশ্যে বলেছিল, কলেজের পর থেকে চাকরিতে ঢোকার আগে পর্যন্ত বেড়াতে যাওয়াগুলো খুব ইন্টারেস্টিং হয়। জীবনে ভুলতে পারবি না এর স্বাদ। আমিও ভুলিনি। কোনও খারাপ অভিজ্ঞতা, বাজে স্মৃতি, বদ অভ্যাস নিয়ে ফিরবি না। যা সংগ্রহ করে আনবি, সব যেন ভালো হয়। সকলের জন্য গিফ্ট কিনবি, আলাদা করে টাকা দিয়ে দেব।

 

– নুলিয়া নিয়ে যেন সমুদ্রে চান করে, সেটা বলে দাও। বলেছিল মা।

 

বাবা বলল, ওর বয়সে নুলিয়ার হাত ধরে চান করা প্রেস্টিজের ব্যাপার। নেবে না জানি। তবে একটা কথা বলে দিই, সামনের দুসারি সাহসী লোকের পরে স্নান করবি। জানবি, সমুদ্রস্নানে সাহস দেখানোটা বোকামি, একই সঙ্গে সাহসের অপচয়ও বটে। ওই এনার্জিটা সমাজের কাজে খরচ করা উচিত।

 

বাবার কথাবার্তার ধরন কলেজের প্রফেসারদের মতো। আসলে কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানির অ্যাকাউন্টস ক্লার্ক। মা মেয়েদের স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। বাবার কথাগুলোর মধ্যে আপাত ভাবে প্রশ্রয় থাকলেও, ছোট্ট একটা নিষেধও ছিল, ‘বদ অভ্যাস নিয়ে ফিরবি না’ মানে হার্ড ড্রিংক-এর কথা বলেছে বাবা। ইমন যে মাঝে মাঝে সিগারেট খায়, টের পেয়েছে আগে। দেয়ালকে শোনানোর মতো করে একদিন বলল, স্ট্রেসের কারণে মানুষ নেশার কবলে পড়ে। একসময় স্ট্রেস ঠিক মরে যায়। নেশা মানুষকে ছেড়ে যেতে চায় না। যেমন আমার ক্ষেত্রে যায়নি। পড়াশোনার চাপে কলেজ লাইফে ধরেছিলাম। ভালো কোনও এফেক্ট পড়েনি রেজাল্টে।

বাবা যতই বলুক, এই টুরে মদ খাবেই ইমন। কৌশিকের মতো অত সতী সে নয়, মাকে কথা দিয়েছে সমুদ্রে চান করবে না তো, করবেই না। ভাগ্যিস ওর মা মদ খেতে বারণ করেনি। ইতিমধ্যেই চারবন্ধু একসঙ্গে কয়েকবার মদ খেয়েছে। দারুণ মস্তি হয়। তবে রোজ খাওয়ার ইচ্ছে জাগেনি। পার্থ, জয়দীপ অবশ্য সিগারেটে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। স্মোকিংটা এই টুরে রেস্ট্রিক্ট করে চলবে ইমন, কোনও বদঅভ্যাস নিয়ে বাড়ি ফিরবে না। বাবার সিগারেট খাওয়া নিয়ে মা দিনরাত খিটখিট করে। অপরাধবোধের চিলতে সংকোচ লেগে থাকে বাবার মুখে।

– নাও, শান্ত ছেলে, চা-টা ধরো।

উলটোদিকের বার্থে বসে থাকা বউদির ডাকে চিন্তা ছেঁড়ে ইমনের। কাগজের কাপ বাড়িয়ে ধরেছে ট্রেনে সদ্য আলাপ হওয়া বউদি। লাজুক হেসে কাপটা নেয় ইমন। চাওয়ালাকে দাম মেটাচ্ছে বউদির হাজব্যান্ড। লোকটার মধ্যে বউ-গদগদ ভাব। উনি রীতিমতো বাচাল। এই কুপের ছটা বার্থে বউদিরা দুজন, বাকি চারটেতে ইমনরা। ছাব্বিশ, সাতাশের সুশ্রী বউদিকে নিজেদের কুপে দেখে খুবই উৎসাহিত হয়েছিল ইমনের তিনবন্ধু। ভেবেছিল, জমিয়ে বউদিবাজি করবে। সেই স্কোপ ওরা পায়নি। বউদি আগ বাড়িয়ে আলাপ করে নিল সবার সঙ্গে। তারপর থেকে চুটিয়ে চ্যাংড়ামি করে যাচ্ছে। তবে শ্লীলতার মাত্রা রেখে। ইমনদের গ্রুপও ওপেনলি

নোংরা ঠাট্টাইয়ার্কি করতে পছন্দ করে না। এই কম্পার্টমেন্টে আরও একটি আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্য আবিস্কার করেছে ইমনের তিন সাগরেদ, একদম লাস্ট কুপে নাকি দারুণ এক সুন্দরী ট্র্যাভেল করছে তার ফ্যামিলির সঙ্গে। পর্যায়ক্রমে তিনবন্ধু মেয়েটাকে দেখে আসছে, চেষ্টা করছে নজর কাড়ার। এখনও পর্যন্ত পাত্তা পায়নি। এখন যেমন কৌশিক এই কুপে নেই। মেয়েটার কুপের কাছে গেছে। এটা নিয়ে তিনবার ট্রাই মারতে গেল। কে বলবে কৌশিকের স্টেডি গার্লফ্রেন্ড আছে! সুছন্দা, ওর পাড়াতেই থাকে। ছোটোবেলার প্রেম। জানলার পাশে বসে বন্ধুদের সমস্ত গতিবিধি টের পাচ্ছে ইমন, মেয়েটাকে দেখতে যাওয়ার কৌতূহল হয়নি। সুন্দর মেয়ে দেখার আগ্রহ ইমনেরও আছে, এই মুহূর্তে তার চেয়েও বেশি উপভোগ করছে জানলার পাশে বসে প্রথম স্বাধীনভাবে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ।

চা শেষ করে কাপ জানলার বাইরে ফেলে ইমন। ফের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে। কৌশিক ফিরে এসেছে, এমন ভাবে হাঁপাচ্ছে, যেন একশো মিটার দৌড়ে এল। বলছে, নাঃ, কোনও চান্স নেই। হেভি ঘ্যাম। প্রথমবার তো তাকায়নি। এখন এমন ভাবে দেখছে, আমি বুঝি জেল পালানো আসামি। গতকালই ছবি বেরিয়েছে কাগজে।

বাকিরা তো সবাই হাসছেই, ইমনও হেসে ফেলে। কৌশিক এসে বসে তার পাশে, বউদি সান্ত্বনা দেওয়ার মতো করে বলে, দেখতে ভালো মেয়েরা ঘ্যাম একটু নিয়েই থাকে। এর জন্য ধৈর্য দেখাতে হয়।

দাদা বলে ওঠে, আরে, আমারও কি টাইম কম লেগেছে তোমাদের বউদিকে পটাতে! পাক্বা একবছর পিছন পিছন ঘুরেছি। তবে গিয়ে…

ইমন ভেবেছিল, বউদি বুঝি লজ্জা পাবে এই কথায়। তার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। কমপ্লিমেন্টটা নির্দ্বিধায় গিলে নিয়ে জয়দীপকে বলল, তোমাদের শান্ত বন্ধুটি তো একবারও মেয়েটাকে দেখতে গেল না। ওকে পাঠাও।

জয়দীপ ইমনের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বউদিকে বলল, ও ভীষণ মুডি। জোর করে কিছু করানো যাবে না। যদি ইচ্ছে হয় নিজেই যাবে।

– নাকি রিফিউজ্যালের ভয়। কথাটা বলে বাঁকা হাসি সমেত ইমনের মুখের ওপর চোখ রাখল বউদি।

উত্তর দিল পার্থ। বলল, বার খাইয়ে লাভ নেই। এসব ওর গায়ে লাগে না। ও চিজই আলাদা।

জয়দীপ গা ঝাড়া দিয়ে সিট থেকে উঠল। বলল, দেখি, আর একবার ট্রাই মারি। এত কীসের অহংকার রে বাবা!

পার্থ আর দাদা সমস্বরে বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার। একেবারে ফিট করে ফিরতে হবে।

কুপ ছেড়ে বেরিয়ে গেল জয়দীপ। ওরও বোধহয় তিনবার হল। ইমন কিন্তু একটু অবাকই হচ্ছে। জয়দীপ তাদের মধ্যে সবচেয়ে ম্যানলি দেখতে। ছ’ফুটের ওপর হাইট। নিয়মিত জিমে যায়। চারবন্ধু হেঁটে যায় রাস্তায়, মেয়েরা জয়দীপের দিকে তাকায় প্রথমে। তবে জয় কথাবার্তায় তেমন চৌকশ নয়। কিন্তু মেয়েটা যে তাকাচ্ছেই না, কথা তো অনেক পরের ব্যাপার। মেয়েটাকে কি একবার দেখে আসবে ইমন? মনে হচ্ছে একটু অন্যরকম মেয়ে। একই সঙ্গে ভীষণ আলস্য লাগছে দেখতে যেতে। কী হবে দেখে? তিনটে ছেলেকে পাত্তা না দিয়ে মেয়েটা যে বিরাট কিছু করে ফেলেছে, তা তো নয়। এত গুরুত্ব দেওয়ার কোনও মানে হয় না।

একটু আগে ট্রেনটা বেশ স্লো চলছিল। ফের স্পিড নিয়েছে। আবার ছিটকে ছিটকে সরে যাচ্ছে গ্রাম, শহরের আলো। মেয়েদের ব্যাপারে ইমনের আলস্যটা বরাবরের। এই কারণেই দু’চারটে প্রেম জমে ওঠার আগেই কেটে গেছে। আসলে চেতনায় নাড়া দেওয়ার মতো সর্বক্ষণ আকর্ষণ জাগিয়ে রাখার মতো মেয়ের দেখা পায়নি সে।

– এই যে হ্যালো! কার কথা ভাবছ এত মন দিয়ে?

আবার বউদির ডাক। শান্তিতে চিন্তা-ভাবনা করতে দেবে না। ঘাড় ফেরায় ইমন। বলতে ইচ্ছে করছে, ক্যাটরিনা কইফের কথা ভাবছি। আপনার জায়গায় সে বসে থাকলে ভালোলাগত।

ইংরেজি, হিন্দি দুটোই ফ্লুয়েন্টলি বলতে পারি না। বেশি বকতে হতো না। কথাগুলো না বলে ইমন আপন-হাসি হাসে। বউদির ভ্রূদুটো কাছাকাছি চলে এসেছে। বলে, ওরকমভাবে হাসছ যে বড়ো! কী বোঝাতে চাইছ, কেউ নেই?

– ওর কাছে অনেক আসে। টেঁকে না। ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। বলল পার্থ।

– কে ছাড়ে? ঠোঁটের কোলে হাসি সমেত জানতে চাইল পলা বউদি। নাম-ঠিকানা আদানপ্রদান হয়ে গেছে অনেক আগে।

নির্বিকার ভঙ্গিতে ইমন উত্তর দিল, মেয়েরা। মাথা নাড়িয়ে প্রতিবাদের ঢঙে বউদি বলতে লাগল, হতেই পারে না। তোমার মতো লাভার বয় মার্কা দেখতে ছেলেদের ছেড়ে যেতেই চাইবে না মেয়েরা। ভালো চাকরিবাকরি যদি না পাও, তা হলে অবশ্য আলাদা কথা। এব্যাপারে বেশির ভাগ মেয়েই ভীষণ প্র্যাকটিকাল।

– ‘লাভার বয় মার্কা দেখতে’ ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না! বলল ইমন।

পলা বউদি বলে, মানে, ‘প্রেমিক প্রেমিক’ দেখতে। যাদের সঙ্গে হাঁটলে, সিনেমায় গেলে অন্য মেয়েরা হিংসের চোখে দেখবে।

এবারও ব্যাপারটা ঠিক ক্লিয়ার হল না ইমনের কাছে। বউদি যেন তাকে নতুন

রং করা ম্যাটাডোরের সঙ্গে তুলনা করছে। যে-গাড়ির পিছনে লেখা আছে, দেখবি আর জ্বলবি লুচির মতো ফুলবি।

ফিরে এল জয়দীপ। চেহারায় হতাশা। দু’বাংক-এ দু’হাত রেখে, ঘাড় ঝুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে বলল, হল না। করিডোরে অনেক ঘুরঘুর করলাম, মাঝে মাঝে তাকিয়ে রইলাম ঠায়, একবারই তাকাল এমন বিরক্তির চোখে, আমার শার্টে যেন নর্দমার কাদা লেগে আছে।

কৌশিক জয়দীপের টি-শার্ট ধরে টেনে পাশে বসাতে বসাতে বলল, জানে দে ইয়ার, মেয়েটার বোধহয় কোনও প্রবলেম আছে।

– কী প্রবলেম? অবাক গলায় জিজ্ঞেস করে রঞ্জনদা।

কৌশিক বলল, কত কিছু হতে পারে। মেয়েটা হয়তো লেসবি।

‘লেসবি’ শব্দটায় সিঁটিয়ে গেল মন। পলা বউদির সামনে এই প্রথম ‘নীল’ মার্কা কথা বলে ফেলল তারা।

বউদির কোনও হেলদোল দেখা গেল না। রীতিমতো তর্ক জুড়ে দিল। বলতে লাগল, মেয়েটা যেহেতু তোমাদের পাত্তা দেয়নি অমনি সমকামী হয়ে গেল! নিজেদের ফেলিওর মানতে পারছ না।

হতাশ জয়দীপ ইমনের দিকে তাকিয়ে মিনতির সুরে বলল, বস্, তুই একবার যা। আমাদের মানটা রাখ।

– কোনও ইন্টারেস্ট নেই আমার বলে ইমন মুখ ফেরায় চলন্ত ট্রেনের জানলার বাইরে। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ফের বলতে থাকে, এ অপমানটা তোদের প্রাপ্য। মেয়ে দেখলেই খালি ছোঁকছোঁকানি। অথচ তোদের তিনজনের মধ্যে দু’জনের গার্ল ফ্রেন্ড আছে। তাদের প্রতি কমিটেড তোরা।

জয়দীপ আর রা কাড়ে না। শ্রেয়ার সঙ্গে ওর পাঁচবছর ধরে প্রেম। প্রায় রোজই দেখা করে। শ্রেয়ার স্কুল ছুটির সময় দাঁড়িয়ে থাকে চৌমাথায়। দু’দিন যদি না দাঁড়ায়, শ্রেয়া ফোন না করে সোজা চলে আসে কলেজে। সারপ্রাইজ ভিজিট, নিজেদের রিলেশনটা জয়দীপের কলেজ বান্ধবীদের কাছে এস্ট্যাবলিশ করে দিয়ে যায়।

– প্রেম করি বলে কি অন্য মেয়ে দেখব না? ওই মেয়েটারও বয়ফ্রেন্ড থাকতে পারে। তাতে আমাদের দিকে তাকালে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে। এটুকু ঝাড়ি সকলেই মেরে থাকে। বলল কৌশিক। সমর্থনে পলা বউদি বলে ওঠে, এটা একেবারে ঠিক বলেছে কৌশিক। তোমাদের রঞ্জনদাও এ ব্যাপারে কিছু কম যায় না।

বলার পর নিজের বরের দিকে কপট শাসনের দৃষ্টিতে তাকাল বউদি। চোখ নামিয়ে লজ্জা পাওয়া হাসি হাসছে রঞ্জনদা।

পার্থ বলে ওঠে, এই ইমন, আমার তো কোনও প্রেম নেই। তুই আমার হয়ে যা না।

ইমন বিস্ময়ের দৃষ্টি নিয়ে পার্থর দিকে তাকায়। বলে তাতে তোর কী সুবিধে হবে?

কথাটা ভেবে বলেনি পার্থ, ফলে চুপ করে যায়। ওর হয়ে পলা বউদি বলতে থাকে, আসলে তোমরা হলে একটা ইউনিট। তোমাদের কারুর জিত হলে সকলের জয়।

– আমি ঠিক এই কথাটাই বলতে চাইছিলাম। বলার পর পার্থ বলে। যা না ইমন। তুই পারবি। একটু আগে বউদি ঠিকই বলছিল, তুই ‘লাভার বয়’ মার্কা আছিস। আমরা দেখেছি মেয়েরা সবসময়ই দামি চকোলেট দেখার মতো তোর দিকে একবার আড়েঠাড়ে দেখে নেয়। তুই এমন বেভুল হয়ে থাকিস, মেয়েরা ভাবে তোর হেভি পার্সোনালিটি। ঘাঁটাতে ভয় পায় তোকে।

বার খায় না জেনেও পার্থ কথাগুলো কেন যে বলছে! ইমন ফের মুখ ঘুরিয়ে নেয় জানলার বাইরে। এখন শুধু ট্রেনের ঘটা ঘং, ঘটা ঘং শব্দ। দুপাশে বোধহয় ধু ধু প্রান্তর, আলোটালো কিছু দেখা যাচেচ্ছ না।

কুপের সবাই খানিকক্ষণ চুপ করে ছিল। কৌশিক শুরু করল কথা। বলল, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে মেয়েটা খোঁড়া। বহুদিন আগে একটা গল্পে পড়েছিলাম, অনুবাদ না

বাংলার কোনও লেখকের মনে পড়ছে না। একটা ছেলে জানলায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ের প্রেমে পড়ল। রোজ দেখত তাকে। ঘটনাচক্রে একদিন তাকে দেখল রাস্তায়। মেয়েটার একটা পা নেই। প্রচন্ড মানসিক ধাক্বা খেয়েছিল প্রেমিক। প্রেমের শেষ পরিণতি কী হয়েছিল এখন আর মনে নেই।

কৌশিক থামার পর কেউ কিছু বলল না। ট্রেনের স্পিড বুঝি একটু কমল। হুইসেল দিচ্ছে। এক্সপ্রেস ট্রেন এমনিতে মিতভাষী, হুইসেল টুইসেল বড়ো একটা দেয় না। অন্ধকারে ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে কাউকে যেন ডাকছে ট্রেনটা।

নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে পড়ে ইমন। বলে, যাই, দেখে আসি। কার জন্য তোরা এত লাফাচ্ছিস।

ইমনের ডিসিশনে তিনবন্ধু এতটাই চমকেছে, একজন বাক্যহারা হলেও, দু’জন একসঙ্গে সবিস্ময়ে বলে ওঠে, সত্যিই যাবি!

করিডোরে পা দিয়ে লাস্ট কুপের দিকে তাকাতেই মেজাজ খিঁচড়ে যায় ইমনের। পরিস্থিতি মোটেই অনুকূল নয়। টিটি চেক করছে টিকিট। চেকারের গায়ে সেঁটে আছে দুটো প্যাসেঞ্জার। এরা নিশ্চয়ই আরএসি অথবা ওয়েটিং লিস্ট। বার্থ কনফার্ম করতে চাইছে। টিটি লাস্ট কুপের টিকিট চেক করতে ব্যস্ত। কোনও একটা ব্যাপারে টিটির সঙ্গে লাস্ট কুপের বচসা চলছে। ইমন পায়ে পায়ে পৌঁছে যায় কুপটার সামনে। প্রথমেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে মেয়েটাকে, সবে হয়তো মাধ্যমিক দিয়েছে। বাস্তবিকই পরীক্ষাটা শেষ হয়েছে দু’দিন আগে। তবে সৌন্দর্যকে যেন ডমিনেট করছে ওর আভিজাত্য। খাড়াই নাক, চওড়া কপাল, পাতলা ঠোঁট, না ফোলানো সিল্কি কালো লম্বা চুল, গায়ের রং গোলাপি ফরসা। মেয়েটার এই মুহূর্তের মুখের অভিব্যক্তি চেহারার সঙ্গে মানানসই নয়। কিছুটা বিরক্ত আর হেল্পলেস ভাব। ইমনের উপস্থিতিটাও সে এখনও লক্ষ্য করেনি। কারণ, তার সমস্ত মনোযোগ টিটির ওপর। ইমনও বুঝে নিয়েছে টিকিট চেকার এখন যে-ক্যাচালটা করছে মেয়েটার ফ্যামিলির সঙ্গে, স্রেফ পয়সা খাওয়ার ধান্দা।

মেয়েটার বাবার সঙ্গে চেকারের তর্ক চলছে, ভদ্রলোক নিশ্চয়ই ওর বাবা, মুখের অনেক মিল। কেসটা হচ্ছে এই, মেয়েটার ফ্যামিলির দু’জন সিনিয়র সিটিজেন, একজন মহিলা অন্যজন পুরুষ। খুব বুড়ো না হলেও, দু’জনেই ষাট ক্রস করেছেন, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়। টিকিটের দামে ছাড় পেয়েছেন তাঁরা। নিয়ম অনুযায়ী টিটি ওই দু’জনের বয়সের প্রমাণপত্র দেখতে চাইছে। সেরকম কোনও আইকার্ড তাঁদের কাছে নেই। নিয়মটা তাঁরাও জানেন, বাড়ি থেকে বেরোনোর শেষ মুহূর্তে বার করে রাখা ভোটার কার্ডটা লাগেজে রাখতে ভুলে গেছেন। এ সমস্ত কিছুই কনফেস করা হয়েছে টিটিকে। কোনও কথা শুনবে না টিটি। বিশাল অঙ্কের ফাইন আর নানান নিয়মকানুন শোনাচ্ছে। টিটির গায়ে সেঁটে থাকা বার্থ কনফার্ম না হওয়া দুই প্যাসেঞ্জার নিজেদের সমস্যার কথা তুলতেই পারছে না এই তর্কবিতর্কের মাঝে।

ঝামেলাটা দেখতে আরও দু’চারজন প্যাসেঞ্জার ইমনের পাশে, ঘাড়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সিনে এবার এন্ট্রি নেয় ইমন। বলে, একটা কথা বলি?

চশমার ওপর দিয়ে ইমনকে একবার মেপে নিল চেকার। বলল, বলো।

কুপে বসা বৃদ্ধ, বৃদ্ধার দিকে একবার চোখ-নির্দেশ করে নিয়ে ইমন চেকারকে বলল, ওঁদের দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে ষাট পেরিয়েছেন, আর ভুলে যাওয়া একটা স্বাভাবিক ঘটনা। আপনি ইচ্ছে করলেই আইকার্ডের ব্যাপারটা ইগনোর করতে পারেন।

– আমি চাকরির রুল অনুযায়ী কাজ করছি। তুমি কে এ ব্যাপারে বলার? বলল টিটি।

ইমন চটজলদি জবাব দেয়, আমি এ দেশের একজন নাগরিক। আমার কর্তব্য সিনিয়র সিটিজেনকে হেল্প করা। আমি সেটাই করছি।

টিকিট চেকার একটু ধস খেল মনে হচ্ছে। চোখ নামিয়েছে নিজের হাতে ধরা লিস্টে, পেন ঠেকিয়ে পড়ার ভান করছে। প্রতিপক্ষ দুর্বল হয়ে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাটাকে যেতে হয়। ইমন বলে ওঠে, যদি ওঁদের বয়স আন্দাজ করতে আপনার অসুবিধে হয়, আমাদের গ্রুপ তো আছেই, কম্পার্টমেন্টের আরও অনেক প্যাসেঞ্জারকে ডেকে ওঁদের দু’জকে দেখাতে পারি। দেখুন তারা কী বলে। মেজরিটি তো মানবেন?

চেকারের দম শেষ। হেরে যাওয়া দৃষ্টি নিয়ে তাকায় ইমনের দিকে। হাসি পেয়ে যাচ্ছে ইমনের, সে যে যুক্তিটা দিয়েছে, এগেনস্টে আরও অনেক পয়েন্ট তোলা যায়। বোঝা যাচ্ছে টিটির স্টকে সে সব নেই। মাথা নিচু করে লোকটা গজগজ করতে থাকে, আইন ইজ আইন। যখন একবার পাস হয়ে গেছে মেনে চলতে হবে আমাদের। আমরা তো চাকরি করি…

কথাগুলো বলছে বটে টিটি, গ্রুপ টিকিটটা ফেরত দিয়ে দিয়েছে মেয়েটির বাবার হাতে। ইমন ক্রেডিট নেওয়ার জন্য মেয়েটির দিকে একবার তাকায়, ভীষণ বিস্মিত হয়, মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে হাসছে! ঠোঁটে নয়, চোখে জ্বলজ্বল করছে হাসির আভা। লজ্জায় চোখ সরিয়ে নেয় ইমন, এগিয়ে যায় সামনে। এখানে ট্রেনের দরজা। দুটোই বন্ধ। বাঁদিকের দরজাটা খুলে দাঁড়়ায় ইমন। হাওয়ার ঝাপট এসে লাগছে গায়ে, উড়ছে চুল। সামনে অন্ধকার প্রান্তর।

মেয়েটার হাসি ভেঙে দিল ওর নিজেরই আভিজাত্যের মোড়ক, সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ল শরীরের কানায় কানায়। সম্পূর্ণ সাদা ড্রেস পরেছে মেয়েটা, আপারটা কুর্তি, নীচেরটা ফুল লেংথ কিছু একটা হবে। বাবু হয়ে বসেছিল বলে বোঝা যায়নি। সব মিলিয়ে মেয়েটার মধ্যে একটা ইতিহাসের রাজকন্যা টাইপ ভাব এসেছে। চোখের হাসি দিয়ে ইমনকে ভালোলাগাটা সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতে পেরেছে। ইমনের দারুণ ভালো লেগেছে মেয়েটাকে। বুকটা কেমন যেন জ্বালা জ্বালা করছে, সেইজন্যই দাঁড়িয়েছে হাওয়ায়। কারওকে ভালো লাগলে বুক জ্বালা করে, এই প্রথম জানল ইমন। আসলে এত ভালো আগে তো কোনও মেয়েকে দেখেনি সে।

ঘাড় তোলা উটের নাকের ডগায় ডুবন্ত সূর্য। ডিজিটাল ক্যামেরার সি্্ক্রনে ফোটোটা ফ্রেম করেও শাটার টিপল না ইমন। ফোটোটার মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। পুরী ফেরত চেনা-পরিচিতদের কাছে এই ছবি হামেশাই দেখা যায়। তালুর সাইজের ক্যামেরাটা প্যান্টের পকেটে পুরে ইমন ফের হাঁটতে থাকে স্বর্গদ্বারের রাস্তা ধরে। বিকেল থেকে এই রাস্তায় পায়চারি করে চলেছে। একবার মেরিন ড্রাইভ রোডের দিকে চলে গিয়েছিল, ফিরে এসেছে তড়িঘড়ি। ওদিকে বড়োলোক টুরিস্টদের বিচরণক্ষেত্র। দামি ঝকঝকে সব হোটেল।ঞ্জট্রেনের মেয়েটার ফ্যামিলি ওদিকের হোটেলে উঠবে না। মেয়েটার চেহারায় যে-আভিজাত্য দেখা গিয়েছিল, সেটা জিনগত। ওই গ্রুপের হাবেভাবে, পোশাকেআশাকে টাকাপয়সার উদাসীন ঔদ্ধত্য ছিল না। নেহাতই মিডলক্লাস ফ্যামিলি। খানিকটা ভীরুও বটে, টিটির সঙ্গে গুছিয়ে ঝগড়াও করে উঠতে পারছিল না। ট্রাভেল করছিল স্লিপার ক্লাসে, এসিতে নয়। ওরা স্বর্গদ্বারের আশপাশের কোনও হোটেল বা হলিডে হোমেই উঠেছে। হলিডে হোমের সম্ভাবনাই বেশি। মেয়েটি ছাড়া বাকিদের বয়স এবং বডিল্যাঙ্গোয়েজ দেখে বোঝা যায়, এরা হলিডে হোমেই স্বচ্ছন্দ।

ইমনরাও হলিডে হোমে উঠেছে। পার্থর বাবার ব্যাংক-এর হলিডে হোম। উনিই অ্যারেঞ্জ করে দিয়েছেন। বাজেটের কারণেই ব্যাংকটা বেছে নেওয়া। ইমনরা কেউ তো রোজগার করে না। তবে পার্থ যেমনটা বলেছিল, হলিডে হোমের ঘর থেকেই সমুদ্র দেখা যায়, মোটেই তা নয়। ছাদে বা ব্যালকনিতে যেতে হচ্ছে। সমুদ্র আড়াল করে আছে হলিডে হোমের সামনে বিশাল এক হোটেল। পার্থ বলছে, বছর চারেক আগে ও যখন বাবা, মা-র সঙ্গে হলিডে হোমটায় এসে উঠেছিল হোটেলটা ছিল না। কথাটা কোনও বন্ধুই বিশ্বাস করেনি। চার বছর বয়স হতেই পারে না হোটেলটার। হয় পার্থ মিথ্যে বলছে অথবা কোথাও একটা ভুল করছে। চারবছর আগে অন্য কোনও জায়গায় উঠেছিল হয়তো। হলিডে হোমের রুম অবশ্য বেশ ভালো। স্পেসিয়াস, মোজাইক ফ্লোর। চারতলা বাড়ি পুরোটই হলিডে হোমের।

ইমনরা আছে দোতলায়। সেখানে তিনটে রুম, অ্যাটাচড বাথ। তিনটে ইউনিট থাকতে পারে। ঘরগুলোর ডবল সাইজের এরিয়ায় কমন কিচেন কাম ডাইনিং। ইমনদের নিয়ে দোতলায় এখন দুটো ইউনিট। একটা ঘরে বুকিং নেই, তালা দেওয়া। অন্য যে-ইউনিট আছে দোতলায়, তিনজন মেম্বার, বৃদ্ধ বৃদ্ধা আর কাজের মেয়ে নমিতা। মেয়েটার নামটা জেনে যাওয়ার কারণ, বুড়োবুড়ি কিছুক্ষণ অন্তর ওই নাম ধরে ডাকছে, কিছু না কিছু ফরমাশ করতে ডাকা। ইমন বুড়োবুড়িকে এখনও চাক্ষুস করেনি, মেয়েটাকে দেখেছে। খানিকটা কৌতুহল বশেই দেখা।

ট্রেন কাকভোরে পৌঁছে গিয়েছিল পুরী স্টেশনে। অটোরিক্সায় হলিডে হোমে পৌঁছে একঘণ্টা অপেক্ষা করতে হল ভিতরে ঢুকতে। গেটে তালা। হাঁকডাক করে কারওর সাড়া পাওয়া গেল না। ভোরের দিকে ঘুম গাঢ় হয়, কেয়ারটেকার তেড়ে ঘুম লাগিয়েছে। কাঁধে লাগেজ নিয়ে ইমনরা চারবন্ধু গিয়েছিল গলির মুখে চায়ের দোকানে। অত ভোরে চায়ের দোকান কিন্তু খুলে গেছে। হয়তো বুঝেশুনে খুলে রেখেছে। ভ্যানে, অত ভোরে হোটেল, হলিডে হোমে ঢুকতে পারবে না টুরিস্টরা।

হলিডে হোমের গেট খুলেছিল ভোর ছটায়। মুশকো চেহারার নিদ্রালু চোখের কেয়ারটেকারকে কৌশিক ঝাঁঝিয়ে বলে উঠেছিল, ভোরের দিকে যখন এরকম একটা ইম্পর্ট্যান্ট ট্রেন আছে, কত টুরিস্ট আসে, গেট খোলা রাখেন না কেন? লাগেজ নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি একঘণ্টার ওপর।

পোড় খাওয়া মস্তানের মতো কৌশিকের দিকে তাকিয়ে ছিল লোকটা। যেন বলতে চাইল, সস্তায় থাকতে এসেছ, কাঁচাঘুম থেকে উঠে গেট খুলে দিচ্ছি এই ঢের। বাড়াবাড়ি করলে ঘাড় ধরে বার করে দেব।

ওই তাকনোতেই ধস খেয়ে গিয়েছিল চারবন্ধু। কেয়ারটেকারের থেকে চাবি নিয়ে গুটিগুটি পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নিজেদের রুমের তালা খোলে। তখনই কানে এসেছিল ‘নমিতা’ নামটা। বৃদ্ধ অশক্ত গলায় মেয়েটার নাম ধরে ডেকে কিছু একটা দিতেটিতে বলছিলেন।

ইমনরা ঘরে ঢুকে প্রথমেই দুটো ডবলবেড এক জায়গায় করে নিল। চারজন একসঙ্গে শোবে। টয়লেটের কাজ সেরে ওরা তৈরি হচ্ছিল সমুদ্রে স্নান করতে যাবে বলে, সকলেরই মধ্যেই বেশ তাড়া। হলিডে হোমে আসার পথে সমুদ্রকে দেখেছিল প্রায় অন্ধকারের মধ্যে। ফসফরাসের মুকুট মাথায় দিয়ে ধেয়ে আসছিল ঢেউগুলো। ধীরে ধীরে ফরসা হয়েছে চারপাশ, সমুদ্র তাদের যেন ডাকছিল। ঢেউয়ের গর্জন আবছা হয়ে এসে পৌঁছোচ্ছিল কানে। সেইসময় কৌশিক এসে খবর দিল, পাশের মেয়েটা একেবারে ঝক্বাস জিনিস! ডাইনিং-এ চা বানাচ্ছে, একবার দেখে আয়।

পার্থ, জয়দীপ লাফিয়ে চলে গিয়েছিল দেখতে। ফিরে এসে বলেছিল, নাঃ, সত্যিই হেভি জিনিস!

ওদের কথা শুনে কৌতূহলী হয়েছিল ইমন, গরিব পরিবার থেকে আসা কাজের মেয়ে কত ভালো দেখতে হতে পারে! ইমন গিয়েছিল যাচাই করতে। ডাইনিং কাম কিচেনে পা রাখতেই ঘুরে তাকিয়েছিল বছর তেরো চোদ্দোর মেয়েটা। শ্যামলা রং, একমাথা কোঁকড়া চুল, চোখে কোনও ভাষা নেই। পরনে জংলা ছাপ ফ্রিল দেওয়া ফ্রক। শরীরে সদ্য যৌবনের অবশ্যম্ভাবী লাবণ্য। হবেইবা না কেন? অবস্থাপন্নের বাড়িতে কাজ করার সুবাদে খেতে পরতে পায় ভালো। মোদ্দা কথা মেয়েটার মধ্যে অসাধারণ কিছু দেখেনি ইমন। হতাশ লেগেছিল বন্ধুদের রুচির কথা ভেবে। ট্রেনের মেয়েটিকে দেখেও বলেছিল, দারুণ দেখতে! এই মেয়েটার ক্ষেত্রেও তাই। দু’মেয়ের চেহারায় আভিজাত্যের বিশাল ফারাকটা চোখেই পড়ছে না!

হলিডে হোম থেকে বেরোনোর আগে জয়দীপ আলাপ সেরে এল বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সঙ্গে। ওঁরা একমাসের জন্য বুক করেছেন ঘর। অবসর জীবনের ছুটি কাটাচ্ছেন। নিজেদের দেখভালের জন্য বাড়ির কাজের মেয়েটিকে নিয়ে এসেছেন সঙ্গে করে। ইতিমধ্যে পুরীতে সাতদিন কাটিয়ে ফেলেছেন ওঁরা। বৃদ্ধ বাজার করে আনছেন, নমিতা রান্না করে খাওয়াচ্ছে। ইমনরা রান্না করতে জানে না, লোকাল কারওকে দিয়ে করানোর কথাও ভাবেনি। বাইরে খেয়ে নেবে ঠিক করেছে।

আজ সমুদ্রে নামার আগে খাবার দোকানে ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়েছিল ইমনরা। সি-বিচের বালিতে পা দিয়েই চারবন্ধু ভুলে গিয়েছিল অনেক কিছুই, রুদ্ধশ্বাসে দৌড়েছিল জলের দিকে। মা সমুদ্রে নামতে বারণ করেছে, ভুলে গিয়েছিল কৌশিক। ইমন ভুলে মেরে দিয়েছিল বাবার কথা, সামনে দু’সারি সাহসী মানুষের পরের সারিতে স্নান করতে বলেছিল বাবা। ইমনরা যেখানে ঢেউয়ের সঙ্গে ওস্তাদি করছিল, সামনে কোনও সারি ছিল না, সাহসী দু’চারটে মানুষ আরও দুটো ব্রেকের পর গিয়ে স্নান করছিল। সি বিচে এসে ট্রেনের দাদা-বউদিকে খুঁজে নেওয়ার কথা ছিল চরবন্ধুর। স্নানের মজায় সেসব ভাবনা উড়ে গিয়েছিল মাথা থেকে।

ইমন বাদে ট্রেনের সেই মেয়েটার কথাও ভুলে গিয়েছিল তিনজন। জলের সঙ্গে হুটোপাটির মধ্যেও ইমন এপাশ ওপাশ তাকাচ্ছিল, যদি দেখা যায় তাকে। জলে দাপাদাপি করা ভেজা পোশাকের টুরিস্টদের মধ্যে যদি বিদ্যুতের মতো ঝলকে ওঠে সাদা ড্রেসের সেই মেয়ে! পরক্ষণেই মনে হয়েছিল, কী বোকা আমি! ট্রেনের ড্রেসটা পরেই স্নান করতে আসবে তার কী মানে আছে! নানান পোশাকের ভিড়ে মেয়েটাকে চিনে নিতে হবে। তার মুখোমুখি আর একবার অন্তত হবেই ইমন। দেখে নেবে মেয়েটি বিশেষ পছন্দের যে-দৃষ্টিতে ইমনের দিকে তাকিয়ে ছিল, তা কতটা গভীর? টুরে কিংবা কোনও অনুষ্ঠানে টাইম পাসের জন্য আলগা ভালো লাগা ছিল না তো সেটা? এখানে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে সে যদি না চেনার ভান করে, ইমন মোটেই ধাওয়া করবে না। রিলেশন একতরফা হয় না কখনও। সাদা ড্রেসের রাজকুমারী লুকের মেয়েটা স্মৃতিতে থেকে যাবে সারাজীবন। কেননা এতদিন পর্যন্ত সত্যিকারের ভালোলাগা বলতে এই মেয়েটাকেই লেগেছে ইমনের। মেয়েটা তার দিকে হাসির আভা সমেত তাকানোর পর ইমন নিজেকে সামলাতে গিয়ে দাঁড়়িয়েছিল ট্রেনের দরজায়। অদ্ভুত একটা রি-অ্যাকশন হচ্ছিল বুক জুড়ে। হয়তো একেই বলে প্রথম প্রেমে পড়ার অনুভূতি!

সুখের মুহূর্তটা খানিকবাদেই হোঁচট খেয়েছিল। ইমনের সন্দেহ হচ্ছিল নিজেকে, আমি ঠিক দেখলাম তো? মেয়েটার এক্সপ্রেশন রিড করতে ভুল হয়নি কোনও? নাকি নিজের বাসনাটা মেয়েটির মুখে বসিয়ে দিয়েছি? যেহেতু ওকে খুব পছন্দ হয়েছে আমার। ব্যাপারটা নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য দরজা থেকে সরে এসে করিডোর ধরে ফিরছিল ইমন, মেয়েটির কুপের সামনে এসে হাঁটা স্লো করে নিয়েছিল। দৃষ্টি কেড়ে নিল যেন মেয়েটিই, তখন আর চোখের ভাষায় হাসছিল না, হাসি চলকে এসেছিল ঠোঁটেও। দু’টো বিট মিস করেছিল ইমনের হার্ট। হাসি বিনিময়ের চেষ্টা না করে বাড়িয়ে দিয়েছিল হাঁটার স্পিড। জানত, হাসতে গেলেই ভীষণ ক্যাবলা দেখাত তাকে।

অতিরিক্ত আনন্দে কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গিয়েছিল ইমন। এমনটাই হয়, অপ্রত্যাশিত সুসংবাদে যেমন কেঁদে ফেলে মানুষ। ইমন গম্ভীরমুখে ফিরেছিল নিজেদের কুপে। বন্ধুরা সোৎসাহে জানতে চেয়েছিল, কী হল রে? দেখলাম, টিটির সঙ্গে আর্গুমেন্ট করে ওদের ফ্যামিলিতে এন্ট্রি নিচ্ছিস। জানলার ধারে ইমনের ছেড়ে যাওয়া জায়গাটা ফাঁকাই ছিল। সেখানে গিয়ে বসতে বসতে ইমন বলেছিল, তাকিয়েছে, হেসেছেও।

‘সে-এ-এ-এ কী-ই-ই-ই রে-এ-এ-এ’ বলে এত জোরে চেঁচিয়ে উঠেছিল তিনবন্ধু, কম্পার্টমেন্টের সব প্যাসেঞ্জার নিশ্চয়ই একবার চমকে উঠেছিল। লাস্ট কুপে ওই মেয়েটার কানেও অবশ্যই আওয়াজটা গেছে। কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছিল ইমনের। পলা বউদি বলেছিল, তা এত বড়ো একটা অ্যাচিভমেন্টের পর মুখটা ওরকম গোমড়াথেরিয়াম করে বসে আছো কেন?

– এত এক্সাইটেড হওয়ারইবা কী আছে! দুনিয়ায় প্রতি মিনিটে কোটিকোটি ইয়ং ছেলেমেয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে প্রথমবার হাসছে!

ইমনের কথায় উৎসাহে ভাঁটা পড়েছিল পলা বউদির। জয়দীপ ছোট্ট করে ফুট কেটেছিল, ম্যাথে ওর মাথা চিরকালই ভালো।

পলা বউদি হেসে জানতে চেয়েছিল, কী গো, সত্যিই হেসেছে তো। নাকি পাত্তা দেয়নি বলে রেগে আছো?

– ক্যালি নেওয়ার জন্য ঢপ মারার ছেলে ও নয়। তবে মালটা একটু বেরসিক। বলেছিল পার্থ। তারপর ধীরে ধীরে ঘুরে গিয়েছিল অন্য প্রসঙ্গে। ইমনের দায় থেকে গেল ঘটনা সত্যি প্রমাণ করার। বন্ধুরা তাকে বহুদিন ধরে চেনে, মেয়েটা যে তার প্রতি ইন্টারেস্ট দেখিয়েছে বিশ্বাস করেছে সহজেই। চ্যালেঞ্জটা রয়ে গেল রঞ্জনদা, পলা বউদির কাছে।

রাত গড়াতে বাড়ি থেকে আনা খাবার খেয়ে যে যার বাংকে শুয়ে পড়ল। ঘুম আসতে দেরি হয়েছিল ইমনের, মনের চোখে ভাসছিল মেয়েটার হাসিমুখের ছবি। শেষ রাতে গাঢ় হয়েছিল ঘুম। ধাক্বা মেরে তুলে দিল পার্থ, এরে ওঠ ওঠ, প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে গাড়ি।

ধড়মড় করে উঠে বসে লাগেজ প্যাক করতে শুরু করেছিল ইমন। কামরার অনেকেরই ইমনের মতো অবস্থা, হুড়োহুড়ি করে ব্যাগ গোছাচ্ছে। রাত থাকতে গন্তব্যে পৌঁছে গেলে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। ইমনের তাড়া একটু বেশি, মেয়েটা না চোখের আড়ালে চলে যায়। আর হয়তো দেখা হবে না। পুরীতে যা ভিড় থাকে টুরিস্টের! দেখা হওয়াটা কো-ইন্সিডেন্স নির্ভর। প্ল্যাটফর্মেই চোখাচোখি হওয়াটা দরকার। পলা বউদি, রঞ্জনদা পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি, মেয়েটা ইমনের ব্যাপারে ইন্টারেস্ট দেখিয়েছে।

দেখা হল। দাদা, বউদি সমেত ইমনরা যখন ব্যাগ কাঁধে ট্রেন থেকে নামল, দেখেছিল প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় মেয়েটা ফ্যামিলির সঙ্গে এক্সিট-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পরনে সেই সাদা ড্রেস। বারবার পিছন ফিরছে মেয়েটা।

ইমনের পাশে হাঁটতে থাকা কৌশিক বলেছিল, তোকে খুঁজছে। হাত নাড়, হাত নাড়…

হাত তুলতে হয়নি। মেয়েটা খুঁজে নিয়েছিল ইমনকে। ফ্যামিলি মেম্বারদের থেকে ইচ্ছাকৃত পিছিয়ে পড়ে হাত নেড়েছিল ইমনকে লক্ষ্য করে। তারপর লজ্জা পেয়ে হারিয়ে গেল ভিড়ে।

‘জিও ওস্তাদ!’ বলে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠেছিল ইমনের বন্ধুরা। পার্থ একটা ডিগবাজি মারার প্রয়াস নিয়েছিল, ইমন তাকে আটকায়। ডিগবাজি মারার প্রবণতা পার্থর বরাবরের। আনন্দ-স্ফূর্তির ঘটনা ঘটলেই যেখানে সেখানে ডিগবাজি খেয়ে নেয়।

প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েই বন্ধুরা শপথ নিল, এই ট্রিপেই মেয়েটার সঙ্গে ইমনের প্রেমের পাকা একটা সম্পর্ক করিয়ে ছাড়বে। চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে খুঁজে বার করবে মেয়েটার ফ্যামিলি পুরীতে কোথায় উঠেছে।

সকালে সমুদ্রস্নানে গিয়ে সমস্ত প্রতিশ্রুতি ভুলে গেল ওরা। রঞ্জনদা, পলা বউদির খোঁজও করেনি। দাদা-বউদি বলে দিয়েছিল তারা স্বর্গদ্বারের কাছেই থাকবে, কোনও এক কোম্পানির গেস্ট হাউসে। কোম্পানির নামটা ভুলে গেছে ইমন। বাকি তিনবন্ধু দাদা-বউদির নামই নিচ্ছে না। সমুদ্রে ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে ইমনরা হা-ক্লান্ত হয়ে ফিরেছিল হলিডে হোমে। সমুদ্রের নোনাজল, বালি ধুতে ফের আর-এক প্রস্থ স্নান করল বাথরুমে গিয়ে। হলিডে হোম থেকে বেরিয়ে ভাতের হোটেলে লাঞ্চ সারল। ফিরে এসে টানা ঘুম। যখন উঠল, বেলা গড়িয়ে গেছে অনেক। জানলার বাইরে হলুদ আলো দেখে ইমন বন্ধুদের তাড়া দিয়েছিল, চ চ, বেরোবি তো!

ওদের মধ্যে কোনও উৎসাহ দেখা গেল না।ঞ্জজয়দীপ বলেছিল, তুই ঘুরে আয়। সকাল থেকে যা গেল, হেভি টায়ার্ড লাগছে, এই বেলাটা রেস্ট নেওয়া ভালো।

পার্থ, কৌশিকেরও দেখা গেল একই মত। বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইছে না। ড্রেস চেঞ্জ করে পকেটে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল ইমন। তারও টায়ার্ড থাকার কথা, কোন এনার্জিতে বেরিয়ে পড়ল, বন্ধুরা বোধহয় খেয়াল করেনি। বিচ-এর দিকে তাকিয়ে পাকারাস্তা ধরে সেই কখন থেকে হাঁটাচলা করল ইমন, ট্রেনের মেয়েটা চোখে পড়ল না। ওরাও কি রেস্ট নিচ্ছে? নেওয়ার কথা কিন্তু নয়। ইমনদের মতো সকালে নিশ্চয়ই সমুদ্রে দু’ঘণ্টা দাপাদাপি করেনি। তাছাড়া ইমনের তিনবন্ধু যতটা না ক্লান্তির কারণে বিশ্রাম করছে, তার চেয়ে বেশি আলস্য উপভোগ করছে। যতদূর মনে হচ্ছে মেয়েটার ফ্যামিলি উঠেছে চক্রতীর্থ রোডের দিকে। ওই রাস্তায় যায়নি ইমন, এখান থেকে অনকটাই দূর। কাল একবার ট্রাই নেবে।

সানসেট দেখতে বিচ-এ প্রচুর ভিড় হয়েছিল। সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ। টুরিস্টরা সিলুয়েট হয়ে গেছে। সি-বিচের স্থায়ী মেলায় জ্বলে উঠছে লম্প, হ্যাজ্যাক, রঙিন টুনিবাল্বের মালা। সমুদ্রের এলোপাথারি বাতাস কিছু যেন বলতে চাইছে ইমনকে! মেয়েটা এখন কোথায়, বলছে হয়তো সেটাই। বাতাসের গতিবিধি যেহেতু অবাধ, জানে মেয়েটার হদিশ। ইমন অনুবাদ করতে পারছে না বাতাসের ভাষা। নিজের আস্তানায় ফিরতে থাকে ইমন।

সিঁড়ি ভেঙে হলিডে হোমের দোতলায় এসে ইমন থমকে দাঁড়াল। তাদের রুমের দরজা আর তালাবন্ধ রুমটা মুখোমুখি। তারপরই করিডোরের টিমটিমে আলোয় দাঁড়িয়ে গল্প করছে কৌশিক আর বুড়োবুড়ির কাজের মেয়ে নমিতা। কৌশিক কথা বলছে বেশি, দেয়ালে ঠেসান দেওয়া নমিতা সলজ্জ হাসি ধরে রেখেছে মুখে। কৌশিক একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল ইমনের দিকে। ফের মেয়েটার সঙ্গে কথায় মেতে গেল।

ইমন বড়োবড়ো পায়ে ঢুকল নিজেদের রুমে। কৌশিকের কান্ড দেখে মাথা গরম হয়ে গেছে তার। জয়দীপ, পার্থ বিছানায় ড্রিংক্স সাজিয়ে বসেছে। ওদের উদ্দেশ্যে ইমন রাগের সঙ্গে বলে ওঠে, কৌশিক এটা কী করছে!

পার্থ গ্লাসে এক সিপ মেরে বলল, কী আবার করবে! ওর যা স্বভাব, মেয়ে দেখলেই লাইন মারার ধান্দা…

– তোদের বারণ করা উচিত ছিল। গরিব ঘরের মেয়ে, লেখাপড়া জানে না, কৌশিককে তো বিশ্বাস করে বসবে।

ইমনের কথা গ্রাহ্যে না এনে জয়দীপ বলে, ওইসব মেয়ে লেখাপড়া না জানলেও কাকে কতটা বিশ্বাস করবে, তার হিসেব ভালোই করতে পারে। তুই চাপ নিস না। মাল খাবি আয়।

– আমার ইচ্ছে করছে না। বলে নিজের লাগেজ ব্যাগের দিকে এগিয়ে যায় ইমন, একটা গল্পের বই এনেছে পড়ার জন্য। পিছন থেকে ফের জয়দীপ বলে উঠল, দেখা পেলি ট্রেনের মেয়েটার। মেজাজ দেখে মনে হচ্ছে তো পাসনি।

ঘুরে দাঁড়ায় ইমন। সন্ধানী দৃষ্টি রাখে জয়দীপের ওপর। কী বলতে চাইল জয়? মেয়েটার সঙ্গে দেখা না হওয়ার কারণেই ইমনের ঈর্ষা হচ্ছে কৌশিককে। ও যেহেতু একটা মেয়ে পেয়ে গেছে!  ইমনকে বুঝতে এত ভুল করছে বন্ধুরা! এদের সঙ্গে বেড়াতে না এলেই ভালো হতো। কাল যদি পুরী ছেড়ে চলে যায় ইমন, কোনও আপশোশ হবে না।… এতদূর ভেবে হোঁচট খায় ইমন, না, এই ট্রিপে না এলে রাজকন্যা টাইপের মেয়েটার সঙ্গে তার দেখাই হতো না। মেয়েটাকে যে করে হোক খুঁজে বার করবে কাল।

এবারটা নিয়ে চারবার পুরী আসা হল ইমনের। প্রথমবার খুবই ছোটো ছিল, যাকে বলে জ্ঞান হয়নি। বাবা, মায়ের থেকে গল্প শুনেছে। দ্বিতীয়বার এসেছিল ক্লাস সিক্সে। লাস্ট মাধ্যমিক দেওয়ার পর। তার মানে বছর পাঁচেক আগে। সেই স্মৃতির সঙ্গে এখনকার পুরীর পরিবেশের কোনও মিল নেই। তখনও ভিড় ছিল আবার প্রতিটি মানুষের গা-লাগোয়া নির্জনতাকেও লক্ষ্য করা যেত। সকলের হাঁটাচলার মধ্যে ঢিলেঢালা আয়েসি ভাব। এখন ছবিটা উলটো, ভিড় তো বেড়েইছে, সবার মধ্যে কেমন একটা হুড়োহুড়ি ভাব। যেন অফিসের বাস ধরার তাড়া। সমুদ্রে স্নান করতেও দৌড়োচ্ছে সেইভাবেই।

ইমনরাও স্নান করতে এসেছে বিচে। কালকের মতো এসেই জলে নেমে পড়েনি। হলিডে হোম থেকে বেরিয়ে দোকানে ব্রেকফাস্ট করতে করতে ঠিক করে নিয়েছে স্নানের আগে বিচের এদিক ওদিক ঘুরে ট্রেনের মেয়েটা এবং পলা বউদি-রঞ্জনদার খোঁজ করবে তারা। বিচে এসে একটা জায়গা মিটিং পয়েন্ট হিসেবে নির্দিষ্ট করল চারবন্ধু। সেখানে একহাত মতো বালি খুঁড়ে দু’জন করে বিপরীত দিকে হাঁটা শুরু করেছে। ইমনের সঙ্গে ছিল কৌশিক, কখন যে সে সরে পড়েছে টের পাওয়া যায়নি। ইমন এখন একাই বিচ ধরে হেঁটে চলেছে, দৃষ্টি স্নানরত টুরিস্টদের ওপর। কথা হয়েছে দশমিনিট হাঁটার পর বালি খুঁড়ে রাখা জায়গায় দু’দল মিট করবে। তার মধ্যে যদি যাদের খোঁজা হচ্ছে, পাওয়া যায় ভালো, না পেলে ফের বিকেলে চেষ্টা করা হবে।

দশ মিনিটের অনেক বেশিই হেঁটে ফেলেছে ইমন। আশা করে বসে আছে দেখা পাবে ট্রেনের মেয়েটার। এমনটা নাও হতে পারে, ইমন যেদিকে চলেছে হয়তো দেখা হয়ে গেল রঞ্জনদা-পলা বউদির সঙ্গে। জয়দীপ, পার্থ যে-ডিরেকশন-এ গেছে সেখানেই পাওয়া গেল ট্রেনের মেয়েটাকে। সেই হিসেবে ইমন মেয়েটার থেকে অনেকটাই দূরে চলে এসেছে। এবার বোধহয় ফেরা উচিত। হাঁটা থামিয়ে দেয় ইমন। বিচ-এ দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে প্যানারমিক ভিউ দেয় সমুদ্রে স্নানরতদের ওপর। মেয়েটার আভাসমাত্র নেই, ফ্যামিলিরও কারওকে চোখে পড়ছে না। দেখা নেই রঞ্জনদা-পলা বউদিরও। থিকথিকে ভিড়ের ভিতর থেকে ওদের শনাক্ত করাটাও দুঃসাধ্য কাজ। কৌশিক যদি ছেড়ে না পালাত ইমনকে, দু’জনে মিলে খোঁজাটা আরও জোরালো হতো। কৌশিকের সরে পড়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কাল সন্ধেবেলা কৌশিককে প্রচুর কথা শুনিয়েছে ইমন। বুড়োবুড়ির কাজের মেয়েটার সঙ্গে যখন গল্প করে ফিরল কৌশিক, ইমন চার্জ করেছিল, ওর সঙ্গে কী কথা হল তোর এতক্ষণ?

কৌশিক দাঁত বার করে বলেছিল, কিছুই না। ওই কোথায় থাকেটাকে জিজ্ঞেস করলাম। সিনেমার কোন হিরোর ফ্যান? এইসব আটভাট।

– আটভাটগুলোও একটু শুনি। এতটা সময় কাটালি কী কী কথায়? বলে কৌশিককে চেপে ধরেছিল ইমন।

তখনও আহ্লাদ কাটেনি কৌশিকের, ইমনকে আগ্রাহ্য করে বোকাবোকা হেসে জয়দীপকে বলেছিল, কীরে, আমার জন্য বানা ড্রিংক্স!

জয়দীপ গ্লাসে ওর জন্য মদ, জল মিশিয়ে এগিয়ে দিয়েছিল। ইমন কৌশিককে ছাড়েনি, ফের জিজ্ঞেস করেছিল, কী হল, বল। আর কী কথা হল?

গ্লাসে চুমুক মেরে কৌশিক বলেছিল, বললাম, তোমাকে অনেকটা শুভশ্রীর মতো লাগে দেখতে। নায়িকার সঙ্গে তুলনা করাতে খুব খুশি হল।

কৌশিককে কোণঠাসা করার জন্য ইমন জানতে চেয়েছিল, মেয়েটা কোথায় থাকে বলল?

– কোথায় আবার, বুড়োবুড়ির কাছে, টালিগঞ্জে।

– ওর নিজের বাড়ি কোথায়?

– ক্যানিং-এর দিকে। গ্রামের নাম কী বলল, এখন আর মনে নেই।

– ক্যানিং-এর গন্ডগ্রামের মেয়েটা পরিবারের অভাবের তাড়নায় এই অল্পবয়সে শহরে লোকের বাড়ি এসে কাজ করছে। তোর কথায় বিশ্বাস করে ও যদি নিজেকে শুভশ্রী ভাবতে শুরু করে এবং তোর মতো ভদ্রবাড়ির ছেলের পিছনে ঘুরতে থাকে, বারংবার ঠকবে। তুইও ওকে নিজের বাড়িতে কাজের মেয়ের চেয়ে বেশি মর্যাদ দিবি না। এইভাবে মেয়েটার মনে মিথ্যে আশা জুগিয়ে দেওয়া কি ঠিক? ইমনের কথা আর ওড়াতে পারেনি কৌশিক, থতমত খেয়ে গিয়েছিল। বাকি দুই বন্ধুও ছিল চুপ করে। ইমন কথা শেষ করেছিল এই বলে, তোর কাছে অবশ্য এসব কথার কোনও মূল্য নেই। মায়ের পা ছুঁয়ে করা প্রমিস তুই রাখতে পারিস না, মদও খেলি, চানও করলি সমুদ্রে। একটা কোথাকার কোন মেয়ের জন্য তুই ভাবতে যাবি কেন! তোর যে একটা প্রেম আছে সেটাও হয়তো ভুলে গেছিস!

ডোজটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। গুম মেরে যায় তিনবন্ধু। মদের গ্লাস ধরে রেখেছিল হাতে, মুখে তুলছিল না। ওদের রিলিফ দিতে ইমন উঠে গিয়েছিল হলিডে হোমের ছাদে। তারা জ্বলা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে সমুদ্রের সাদা ঢেউ দেখছিল। একা লাগছিল বড্ড। মনে পড়ছিল বাড়ির কথা। মোবাইল থেকে ফোন করে কথা বলল মায়ের সঙ্গে। মাকে অবশ্য বুঝতে দেয়নি মনের অবস্থা, ‘বেড়াতে দারুণ লাগছে’ এমনটাই বলেছিল। পুরী এসেই পৌঁছোন

সংবাদ দিয়েছিল ফোনে, সেদিনই আবার ফোন করাতে মায়ের খটকা লাগে। জিজ্ঞেস করেছিল, সত্যিই ভালো আছিস তো? থাকার জায়গাটায়গা মনের মতো হয়েছে?

– হ্যাঁরে বাবা, হ্যাঁ। দারুণ আছি। এইমাত্র ছাদে এলাম। কী হাওয়া! সমুদ্রও দেখা যাচ্ছে। বাড়তি উচ্ছ্বাস দেখিয়ে মাকে আশ্বস্ত করেছিল ইমন।

রাতে যখন বাইরে খেতে যাওয়া হল, তিনবন্ধু সহজ হওয়ার চেষ্টা করছিল ইমনের সঙ্গে। জয়দীপ, পার্থর সঙ্গে কথা বললেও, কৌশিককে এড়িয়ে থেকেছে ইমন। দূরত্বটা বজায় ছিল সি-বিচে স্নান করতে আসা অবধি। জয়দীপ ব্যাপারটা নোটিশঞ্জকরেই ইমন-কৌশিক জুটি বানিয়ে এদিকে পাঠাল। কিন্তু কিন্তু করছিল কৌশিক। জয়দীপ কোনও কথা শোনেনি।

ইমন, কৌশিক একসঙ্গে হাঁটা শুরু করলেও, ইমন কথা বলা তো দূরে থাক, ঘুরেও দেখছে না দেখে কৌশিক চুপচাপ কেটে পড়েছে। অপরাধ বোধে ভুগছে বলে যেচে কথাও বলতে পারেনি।

– এই যে, তোমাকেই খুঁজছিলাম।

কাঁধে হাত রেখে কে যেন বলে উঠল কথাটা। চমকে ঘাড় ফেরায় ইমন। আবারও চমকায়, এবার ভিতরে। কাঁধে হাত রেখেছেন ট্রেনের সেই ভদ্রলোক, মেয়েটার বাবা। গায়ে গামছা, ফোল্ড করা লুঙ্গি পরনে। মেয়েটা পরিবারের সকলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে খানিক দূরে। রোদের চোটে কপাল কুঁচকে থাকলেও ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি। পরনে ট্রেনের পোশাকটাই, সাদা পাতিয়ালা-কামিজ।

কাঁধ থেকে হাত ফিরিয়ে নিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ট্রেনে তোমায় থ্যাংক্স জানানো হয়নি। গিন্নি খুব রাগ করছিল। এখানে এসে থেকে তোমায় খুঁজছি। জোর বাঁচিয়েছ টিটির হাত থেকে।

ইমন কথাগুলো শুনছে ঠিকই, দৃষ্টি চলে যাচ্ছে মেয়েটার দিকে। পায়ের তলার বালি ক্রমশ নরম হয়ে যাচ্ছে যেন। মেয়েটিও চোখ সরাচ্ছে না। ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, কোথায় উঠেছ? বন্ধুদের সঙ্গে এসেছ দেখলাম মনে হল ট্রেনে।

ইমন ঘাড় হেলিয়ে নিজেদের হলিডে হোমের নামটা বলে। তারপর জানতে চাইল, আপনারা কোথায় উঠেছেন?

মেয়েটার বাবা পিছন ঘুরে আঙুল তুলে বলল, ওই হোটেলটার পাশের গলিতে একটা হলিডে হোমেই উঠেছি আমরা।

‘কোন হলিডে হোম’ জিজ্ঞেস করতে

সংকোচ হচ্ছে ইমনের। সেই ফাঁকে ভদ্রলোক বলে উঠলেন, চলি। আমরা স্নান করতে এসেছি। পরে আবার দেখা হয়ে যাবে।

ভদ্রলোক এগিয়ে যাচ্ছেন জলের দিকে। পরিবারের বাকিরাও এগোল। সকলের অলক্ষে মেয়েটা এবার ইমনের দিকে তাকিয়ে হাসল, যেন একরাশ মুক্তো ঝিকিয়ে উঠল সমুদ্রতটের রোদে। তারপর সাদা রাজহংসীর মতো সে ভেসে পড়ল জলে।

মেয়েটার দেখা পাওয়াতে বন্ধুদের প্রতি সমস্ত বিরূপতা কেটে গেছে ইমনের। মনে মনে কৌশিককেও ক্ষমা করে দিয়েছে। সুখবরটা বন্ধুদের দিতে সে এখন দৌড়োচ্ছে সিবিচ ধরে। মিটিং পয়েন্টে পৌঁছোনোর আগে দৌড় থেমে যায়। মজার একটা ব্যাপার দেখে দাঁড়িয়ে গিয়ে ফের হাঁটতে থাকে ইমন। মিটিং স্পটের যে-গর্তটা খোঁড়া হয়েছিল সেখানে এখন পোঁতা হয়েছে পলা বউদিকে। মানে বালি চাপা দেওয়া হয়েছে। শুধু মুণ্ডুটা উপরে। কাজটাকে নিখুঁত করতে এখনও লাস্ট মিনিট টাচ দিচ্ছে জয়দীপ, পার্থ। কৌশিককে আশপাশে দেখা  যাচ্ছে না। রঞ্জনদাকেও না। দাদা-বউদির খোঁজ তার মানে এরা অনেক আগেই পেয়েছে। পলা বউদির গোটা বডিটা বালিতে চাপা দেওয়া যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।

ঘটনাটা দূর থেকে যতটা মজার মনে হয়েছিল, কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই আশাভঙ্গ হল ইমনের। কপালে ভাঁজ নিয়ে সে দেখল, পলা বউদির বুকের অংশের বালির ওপর আঙুল মাপের অনেকটা ফুটো। বদমাইশিটা করছে পার্থ। দু’হাতের লম্বা আঙুলটা বুকের দিকে রেখে বালি চাপা দিচ্ছে। পলা বউদির বুক ছোঁওয়ার ফিকির। এখনও ছুঁতে পেরেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। পলা বউদি খুশির হাসি হাসছে। সেটা খেলার আনন্দে না যৌন সুড়সুড়িতে, আন্দাজ করা কঠিন! ইমনের টেনশন হচ্ছে রঞ্জনদার কথা ভেবে। এসে যদি দেখে বউয়ের বুকের ওপর বালিতে ভীমরুলের চাকের মতো ফুটো, মধুলোভীদের অভিপ্রায় টের পেয়ে যাবে। ইমনদের গ্রুপটাকে চিনবে ছোটোলোকের দল হিসেবে।

হাঁটু মুড়ে বালিতে বসে পড়ে ইমন, হাতের ঝটকায় সরিয়ে দেয় পার্থর হাত। জয়দীপ পলা বউদির পেটের দিকে বালির ফিনিশিং টাচ দিচ্ছে। ইমনের চোখ চলে যায় জলের দিকে, স্নান সেরে উঠে আসছে রঞ্জনদা। তড়িঘড়ি বউদির বুকের ওপর বালির গর্তগুলো চাপা দিতে থাকে ইমন।

রঞ্জনদা চলে এসেছে কাছে। বলে উঠল, আরেঃ, তোমরা তো দেখছি আমার বউটাকে ভ্যানিশ করে দিয়েছ।

জয়দীপ, পার্থ বোকাবোকা হাসছে। ইমন চেষ্টা করেও হাসতে পারছে না। বন্ধুর অপকর্মের চিহ্ন অবশ্য মুছে ফেলতে পেরেছে। পলা বউদি বলে ওঠে, ভিতরটা কী ঠান্ডা গো! পুরো এসিতে আছি মনে হচ্ছে।

রঞ্জনদা সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল। বলল, বউয়ের পাশটিতে আমাকেও সমাধি দিয়ে দাও।

পূর্ণ উদ্যোমে রঞ্জনদার জন্য বালি খুঁড়তে লাগল জয়দীপ, পার্থ। রঞ্জনদাও খুঁড়ছে, ইমন হঠাৎ দেখতে পায় কৌশিককে। তডিঘড়ি পায়ে এগিয়ে আসছে, চেহারায় কেমন যেন ভয় আতঙ্কের ভাব!

ইমন উঠে দাঁড়ায়। কী হয়েছে কৌশিকের? উৎকণ্ঠিত ইমনের দিকে না তাকিয়ে কৌশিক, দাদা-বউদির মাথার কাছে গিয়ে জয়দীপকে ডাকে। বালি লাগা হাত ঝেড়ে উঠে যায় জয়দীপ। ইমন শুনতে পায় কৌশিক বলছে, মেয়েটা মাইরি সিবিচে চলে এসেছে। পিছন ছাড়ছে না। আমি শালা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কী করি বল তো?

– খেয়েছে রে। কেসটা এতটা পাকিয়ে ফেলেছিস! না বুঝেশুনে কেন যে লাইন মারতে যাস। উদ্বেগ, বিরক্তি একসঙ্গে জানায় জয়দীপ। তারপর হাঁক দেয়, ইমন একবার এদিকে শুনে যা প্লিজ। কঠিন প্যাঁচে পড়লে এই বন্ধুরা বরাবরই ইমনের শরণাপন্ন হয়।ঞ্জবিবেচনাবোধ ইমনের বেশি। বন্ধুরা খানিকটা সমীহ করে চলে সেই কারণেই। ইমন পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় জয়দীপ, কৌশিকের কাছে। কৌশিক সমস্যাটা আবার করে বলতে যাচ্ছিল, ইমন বলল শুনেছি। তোর কাছে কী আশা করছে মেয়েটা?

– আশা করলে তবু হতো। পূরণের জন্য টাইম দেয় মানুষ। এ তো সময়ই দিচ্ছে না। সারাক্ষণ সেঁটে থাকতে চাইছে। তুই ঠিকই বলেছিলি, বার খাওয়ানো ভুল হয়ে গেছে মেয়েটাকে। ও সত্যিই ধরে নিয়েছে, আমি ওকে লাইক করেছি।

কৌশিকের কথা শুনতে শুনতে চারপাশে চোখ বোলাচ্ছিল ইমন, খানিক দূরে ভিড়ের মধ্যে দেখতে পায় শ্যামলা, ঝাঁকড়়া চুলের নমিতাকে। মেলায় হারিয়ে যাওয়ার মতো মেয়েটা এলোমেলো ঘুরে খুঁজছে অবশ্যই কৌশিককেই। ইমন এগিয়ে যায় নমিতাকে লক্ষ্য করে। কৌশিককে আড়াল করার জন্য কিছু একটা করতে হবে।ঞ্জনিজের ভুল বুঝতে পেরেছে কৌশিক।

যেন হঠাৎ দেখতে পেয়েছে, এইভাবে নমিতার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ইমন। বলল, আরেঃ, তুমি একা! বড়োরা কোথায়?

– দাদু, দিদা আসেনি। হোটেলেই আছে।

মেয়েটার গলা প্রথম শুনল ইমন। কণ্ঠস্বরে ‘বালিকা’ভাব এখনও কাটেনি। হলিডে হোম যে হোটেল নয়, শেখায়নি মালিক, মালকিন। অথচ নিজেদের দাদু-দিদা বলে ডাকতে শিখিয়েছে। যাতে কাজ আদায় করতে সুবিধে হয়। ইমন বলে, একা একা সি-বিচে ঘোরা তোমার ঠিক হচ্ছে না। এখানে অনেক খারাপ লোকজন ঘুরঘুর করে।

– আমি চান করতে এসেছিলাম। কৌশিকদা বলেছিল করিয়ে দেবে। এখানে এসে একবার দেখলাম কৌশিকদাকে। তারপর কোথায় যে চলে গেল! আপনি দেখেছেন আপনার বন্ধুকে?

যেন ভীষণ মজার কোনও জোক শুনল ইমন, সেরকমই হেসে বলল, কৌশিক তোমাকে চান করাবে! ও ব্যাটা নিজেই ভীতুর ডিম। ইয়ার্কি মেরেছে তোমার সঙ্গে।

এত রোদ সত্ত্বেও ছায়া নেমে এল নমিতার মুখে। বলল, এখানে এসে থেকে একদিনও সমুদ্রে চান করিনি। দাদু-দিদা করবে না বলে দিয়েছে। আপনি একটু জলে গিয়ে আমাকে ধরবেন? দু’তিনটে ডুব দিয়েই চলে আসব।

– আমি কৌশিকের চেয়েও বেশি ভয় পাই সমুদ্রে নামতে। নুলিয়া খুঁজতে বেরিয়েছি। দেখাও পাচ্ছি না তাদের।

ইমনের সাহায্য পাবে না বুঝে নিয়ে ফের ঘাড় ঘুরিয়ে কৌশিককে খুঁজতে থাকে নমিতা। ইমন বোঝানোর সুরে বলে, দাদু-দিদাকে সঙ্গে নিয়ে একদিন এসো। নুলিয়ার হেল্প নিয়ে তবেই চান কোরো। দুমদাম কারওর ওপর ভরসা করা উচিত হবে না।

ঘুরিয়ে কৌশিকের থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিল ইমন। ডবল মিনিং ধরার শিক্ষা মেয়েটার নেই। ইন্সটিঙ্কট্ থেকে যদি কিছু বুঝতে পারে ভালো। ইমনের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ফেরার পথে এগোল নমিতা। নিরাশ ভঙ্গিতে বালি ভেঙে হেঁটে যাচ্ছে মেয়েটা। মায়া লাগে ইমনের। বেচারিকে ধরে থেকে একবার চান করিয়ে দিলে হতো। ঝুঁকিটা নিতে পারল না ইমন। ঢেউয়ের ভয়ে নমিতা যদি জাপটে ধরত ইমনকে, তিনবন্ধু আওয়াজ দিতে ছাড়ত না। বলত, তোরও তো লোভ কম নয়!

সকাল থেকে সন্ধে কনডাক্টেড টুর করে কাটল আজ। কোনারক, চন্দ্রভাগা বিচ, নন্দনকানন, উদয়গিরি খণ্ডগিরিঃ সব ঘুরে বিকেল উতরে হলিডে হোমে ফিরেছে চারবন্ধু। প্রত্যেকেই অত্যন্ত ক্লান্ত, তাই বিচে না গিয়ে ঘরেই রেস্ট নিচ্ছে। ট্রেনের মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা বন্ধুদের বলেছে ইমন। আজ আর তাকে খোঁজা হল না। ইমনের ইচ্ছে থাকলেও, বাকিদের মতো তারও এনার্জি অবশিষ্ট নেই। কাল চেষ্টা করে দেখা যাবে। যদিও সেটাই হবে যোগাযোগের শেষ চেষ্টা।ঞ্জকাল রাত আটটার ট্রেনে ফিরে যাবে ইমনরা।

টুর করে যতই টায়ার্ড থাকুক, সন্ধের মুখে তো ঘুমিয়ে পড়া যায় না। ইমন তাই বিছানায় শুয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা গল্পের বইটা পড়ছে। বাকি তিনজনের বই পড়ার ঝোঁক প্রায় নেই বললেই চলে। ওরা তাস খেলছে বিছানাতেই। ব্রে খেলছে। পার্থ খেলতে খেলতে উঠে গেছে অনেকক্ষণ হল। এখন জয়দীপ আর কৌশিক খেলছে। পার্থর না-ফেরা নিয়ে দু’জনের কোনও হঁশ নেই। কোথায় গেল পার্থ? হলিডে হোমের বাইরে বেরিয়ে গেল কী? কিছু বলে গেল না তো! উপুড় হয়ে বই পড়া অবস্থা থেকে ঘাড় ফেরায় ইমন। দুই বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে, পার্থ কোথায় গেল রে? এখনও ফিরছে না!

দু’জনেই মন দিয়ে তাস খেলছে। পার্থর অ্যাবসেন্স নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। এক রাউন্ড শেষ হল। হাতের তাস ফেলে কৌশিক বলল, যাই, দেখে আসি। কোথায় গেল ব্যাটা।

কৌশিক বেরিয়ে যাওয়ার খানিক বাদেই ফিরে এল পার্থ। কোনও একটা কাজ সমাধা করে আসার ভঙ্গি। বসল কৌশিকের ছেড়ে যাওয়া জায়গায়। কোথায় গিয়েছিল, তা নিয়ে জয়দীপ ওকে কোনও প্রশ্নই করল না। দু’জনে মিলে তাস খেলতে লাগল। ইমনের খটকা লাগে, মনে হয় জয়দীপ জানে, পার্থ গিয়েছিল কোথায়। আন্দাজ খুব ভুল না হলে, কৌশিক গেছে সেখানেই। তিনজনের মধ্যে কোনও একটা গটআপ চলছে। ব্যাপারটা ইমনের কাছে গোপন করছে ওরা। ইমন পার্থকে জিজ্ঞেস করে, কোথায় ছিলি এতক্ষণ?

কথাটা যেন শুনতেই পেল না পার্থ, একমনে তাস খেলে যাচ্ছে। দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে কোনও লাভ হবে না বুঝতে পারে ইমন। তিনজন মিলে গোলমাল পাকাচ্ছে কিছু। গ্রুপের মেম্বার হিসেবে যার দায়ভার ইমনের ওপরেও বর্তাবে। বিষয়টা সরেজমিনে দেখতে হবে। বই মাথার কাছে উলটে রেখে বিছানা থেকে নেমে আসে ইমন। পায়ে পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

চৌকাঠ ডিঙোনোর পর ইমন করিডোরের বাঁদিকটা দেখে, ওদিকে নীচে যাওয়ার সিঁড়ি। কৌশিক কি ওইদিকেই গেল? না কি বুড়ো-বুড়ির পোর্শনে? আগে ভিতরদিকটা দেখে নেওয়া যাক, ভেবে ইমন বুড়ো-বুড়ির রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। আলো-অন্ধকার কিচেন কাম ডাইনিং-এর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় অন্যরকম একটা চাপা ঝটাপটির শব্দে ঘাড় ফেরায়, মুহূর্তের মধ্যে সারা শরীর যেন বরফের চাঁই হয়ে যায় ইমনের। কিচেন-ডাইনিং-এর ফ্লোরে প্রায় অনাবৃত দুটো শরীর দমচাপা ধস্তাধস্তি করে সেক্স-এ মেতেছে! একজন কৌশিক, অন্যজন নমিতা।…

আপ্রাণ প্রয়াসে নিজের জড়ত্ব কাটিয়ে ইমন দৌড়ে রুমে ফিরে আসে। নির্বিকার চিত্তে তাস খেলারও দুই বন্ধুর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলতে চায়, এ সব কী হচ্ছে! গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না। ভিতরটা রাগে উত্তেজনায় কাঁপছে। বিছানার কাছে এগিয়ে আসে ইমন। জয়দীপের কাঁধ ধরে নিজের দিকে ফেরানোর টান দেয়। গড়গড়ানির গলায় বলে, এগুলো নোংরামি, অন্যায়। তুই সব জেনেও কিছু বলছিস না!

জয়দীপকে একথা বলার কারণ আছে। বাকি দু’জনের মতো লাইট হার্টেড ও নয়। লম্বা চওড়া চেহারার মধ্যে একটা পার্সোনালিটি আছে। শ্রেয়ার সঙ্গে ওর রিলেশনটাও খুব স্টেডি। জয়দীপ কিন্তু প্রত্যাশা মতো উত্তর দিল না। ইমনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কীসের নোংরামি, কীসেরইবা অন্যায়? কোনারক মন্দিরের গায়ে যেগুলো দেখে এলি, সেসব তাহলে কী? মেয়েটা দিচ্ছে, তাই নিচ্ছে। জোর তো কিছু করছে না।

ইমনের বলতে ইচ্ছে করে, মেয়েটা কী খোয়াচ্ছে নিজেই জানে না। জানার বয়স বা বুদ্ধি কোনওটাই ওর হয়নি। ইমন জানে কথাগুলো স্বর হয়ে বেরোবে না গলা দিয়ে। গলা চোক্ড হয়ে গেছে তার। মাথাটাও ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। প্রায় টলতে টলতে ফিরে আসে, যেখানে শুয়েছিল। দু’হাতে মাথা রেখে বসে থাকে। চিন্তাশক্তি ক্রমশ লোপ পাচ্ছে ইমনের। কিছুই ভাবতে পারছে না।

এরই মাঝে কানে আসে এই ফ্লোরের বৃদ্ধের গলা। অসহায় গলায় ডাকছেন, নমিতা! নমিতা! কোথায় গেলি! নমিতা… টেনশন হতে থাকে ইমনের, বৃদ্ধ কি ঘর থেকে বেরিয়ে নমিতাকে খুঁজতে বেরোবেন? ধরা পড়ে যাবে কৌশিক? ফাঁস হয়ে যাবে ইমনদের গ্রুপটার কদর্য রূপ!

…থেমে গেছে বৃদ্ধের ডাক। আরও খানিকক্ষণ পর কৌশিকের গলা পাওয়া গেল। ফিরে এসেছে রুমে। বলল, জয়দীপ, যা এবার।

অবশ চেতনাতেও ধাক্বা লাগে ইমনের। বাকি দু’জনের চেয়ে একটু হলেও জয়দীপ বেশি ক্লোজ তার। জয়দীপের সঙ্গে শ্রেয়ার স্কুলে গেছে ইমন। জয়দীপই নিয়ে গেছে বেশ কয়েকবার। ইমনের মনের চোখে বারবার ভেসে উঠছে শ্রেয়ার সহজ সুন্দর হাসিহাসি মুখটা। জয়দীপকে কিছুতেই এই নোংরামির মধ্যে যেতে দেওয়া যাবে না। আটকাতেই হবে। ইমন ঘুরে গিয়ে জয়দীপের হাতটা ধরবে ভাবে, তার অনেক আগেই উঠে গেছে জয়দীপ। ঘরের চৌকাঠ ডিঙোচ্ছে।

ইমন আবার মাথা রাখে হাতের তালুতে। আরও ঘোলাটে হয়ে গেছে মাথা। অন্ধকার সমুদ্রের ঢেউ ধেয়ে আসছে চেতনায়। এই ঢেউ নিকষ কালো, ফসফরাসের আলো নেই এতে।

কতটা সময় কেটে গেল, কে জানে! রুমে ফিরে এল জয়দীপ। বলল, ইমন, যাবি তো যা। এক্সপিরিয়েন্স করে নে। এরকম হাতে-কলমে সুযোগ সহজে পাবি না।

কথাগুলো কোনও প্রভাব ফেলতে পারল না ইমনের মনে। যেন তার উদ্দেশ্যে বলা হয়নি। বন্ধুদের থেকে কেমন এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা বোধ করছে সে। রুমটা যেন একটা ডরমেটরি, বাকি তিন আবাসিকের সঙ্গে কোনও পূর্ব পরিচয় নেই তার।

ইমন বিছানা ছেড়ে উঠে পাঞ্জাবির পকেটে পার্স, মোবাইল নেয়। এগিয়ে যায় দরজার দিকে। করিডোরে এসে সিঁড়ির দিকে ঘুরতে যাবে, স্লিপার ছেড়ে বাইরে বেরোনোর চটি পরে নিয়েছে, একবার বাঁদিকটা দেখে, ম্যাক্সি পরা নমিতা দাঁড়িয়ে আছে। চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি, আহ্বান নেই। আছে বোবা অপেক্ষার আকুলতা। আহ্বানের ছলনা জানার বয়স হয়নি মেয়েটার।

স্বর্গদ্বারের মোড়ে জমজম করছে মার্কেট। রাত বেশি হয়নি, সবে আটটা। রাস্তায় এত আলো, লোক, কেনাকাটা… এসব দেখে বিশ্বাসই হবে না, কিছু সময় আগে এখানকারই এক হলিডে হোমের আলো-অন্ধকার ঘরে কত বড়ো অন্যায় ঘটে গেছে।

মার্কেট ঘুরতে ঘুরতে ঘটনার অভিঘাত অনেকটাই কাটিয়ে ফেলেছে ইমন। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে এই তিনবন্ধুর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখবে না। কাল সকালে যে-কোনও ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরে যাবে সে। উইদাউট রিজার্ভেশনে কষ্ট করেই যাবে। আজ রাতেই যেতে পারত। সাড়ে দশটায় এক্সপ্রেস আছে একটা। বাড়ির জন্য কিছুই কেনাকাটা হয়নি, এমনকী পুরীর বিখ্যাত খাজাও কেনেনি। বাবা বলেছিল ঘনিষ্ঠ পরিচিতজনদের জন্য কিছু না কিছু নিতে। তার জন্য আলাদা টাকাও দিয়েছে। সেই কারণেই সঙ্গে পার্স নিয়ে বেরিয়েছে ইমন। কিন্তু এতক্ষণ ঘোরাঘুরির পর এখনও ঠিক করতে পারছে না, কার জন্য কী কিনবে।

একা একা এধরনের শপিং আগে তো কখনও করেনি। বড়ো কারওর গাইডেন্স পেলে ভালো হতো। এখানে রঞ্জনদা-পলা বউদি হেল্পটা করতে পারে, দেখা হয়ে গেলে খুবই সুবিধে হয়। ভাবনা হোঁচট খায় খানিক দূরে একটা কাপড়-জামার দোকানের সামনে চোখ যেতে। ট্রেনের মেয়েটা না? হ্যাঁ, ট্রেনের মেয়েটাই। বেশি চেনা যাচ্ছে সাদা ড্রেসের জন্য। এখন চুড়িদার। মেয়েটা শুধু সাদা পোশাকই পছন্দ করে কেন?

কোনও জড়তা ছাড়াই ইমন মেয়েটাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যায়। যে করে হোক আলাপ করতে হবে। জেনে নিতে হবে ঠিকানা। পুরীতে এসে ওই মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটা ইমনের একমাত্র প্রাপ্তি। ওর পাহাড়ি ঝরনার মতো হাসিটাই ভুলিয়ে দিতে পারবে পুরীর গ্লানিময় অভিজ্ঞতা।

পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সামান্য চমকে ঘাড় ফেরায় মেয়েটা। ইমন বলে, বাড়ির আর সবাই কোথায়?

চোখের ইশারায় দোকানের ভিতরটা দেখায়। বলে, বড্ড গরম। বাইরে চলে এসেছি।

– নাম? জিজ্ঞেস করে ইমন।

দোকানের ভিতরে বাড়ির লোকের দিকে খেয়াল রেখে মেয়েটা বলে, নাম জেনে কী লাভ হবে? জপ করবে?

স্মার্ট আছে মেয়েটা। সত্যিই তো শুধু নাম জেনে তো আর যোগাযোগ রাখা যাবে না। নিজেকে শুধরে নিয়ে ইমন বলল, ফোন নাম্বার দাও।

– নিজের ফোন সেটটা বার করো তাড়াতাড়ি। দশটা ডিজিট বলার মতো টাইম পাব না, মনে হচ্ছে। নিশ্চয়ই রাখতে পারবে না মনে?

না, পারবে না ইমন। অন্য সময় হলে তবু চেষ্টা করা যেত। হঠাৎই এখন ভীষণ নার্ভাস ফিল করছে। কাঁপা হাতে পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোনসেট বার করে ইমন। মেয়েটা বলতে শুরু করেছে, নাইন এইট… দোকানের ভিতর থেকে মহিলা কণ্ঠ ডাকে, তুলতুল, এদিকে আয় একবার। কী হল আয়!

ইমনের দিকে না তাকিয়ে মেয়েটা বলল, মা ডাকছে। কাল রাতের ট্রেনে ফিরছি। আমাদের হলিডে হোমের দিকেও আসতে পারো দিনের বেলা।

দোকানে ঢুকে গেল তুলতুল। বাড়ির আদরের নাম নিশ্চয়ই এটা। আসল নামটা জনা হল না। কন্ট্যাক্ট রাখারও ব্যবস্থা করা গেল না কোনও। আবার কালকের দিনটার জন্য প্রতীক্ষা।

তুলতুল রাতের ট্রেনে ফিরবে বলে ইমন সকালের ট্রেন ধরে কলকাতায় ফিরে যায়নি। রয়ে গেছে পুরীতে। ওই ঘটনার পর তিনবন্ধুর সঙ্গে একটা কথাও বলেনি, নিজের মতো থেকেছে। বন্ধুরাও ওকে ঘাঁটায়নি। সকালে ওরা স্নান করতে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইমন বেরিয়েছে। সি-বিচে একা ঘুরেঘুরে খুঁজেছে তুলতুলকে। পায়নি। স্নান করেছে একাই। বন্ধুদের সঙ্গে লাঞ্চও করেনি। বাইরে গিয়ে নিজের মতো খেয়ে নিয়েছে। দুপুরে ঘণ্টা তিনেক রেস্ট নিল। তারপর বেরিয়ে পড়েছে তুলতুলের খোঁজে। তিনবন্ধু অকাতরে ঘুমোচ্ছিল দুপুরে। নমিতার জন্য ছোঁকছোঁক করতে দেখা যায়নি। ইমনের অ্যাটিটিউড দেখেই ওরা একটু সমঝে গেছে। তবে ইমনের অবর্তমানে এখন কী করছে কে জানে। যাই করুক, ইমন এসব নিয়ে মাথা ঘামাবে না। নিজের জীবন থেকে ওদের ছেঁটে ফেলেছে।

এদিকে ইমন যে-উদ্দেশ্যে বিকেলে বেরোল, তা সফল হয়নি। দেখা পাওয়া যায়নি তুলতুলের। মেয়েটার বাবা সি-বিচে দাঁড়িয়ে যেদিকে আঙুল তুলে বলেছিল, ওই হোটেলের পিছনে হলিডে হোমে আছিঃ সেখানে পরপর অনেকগুলো হলিডে হোম। ইমন ক্রমান্বয়ে পাক খেয়ে তুলতুলের হদিশ পায়নি। তারপর আন্দাজ করেছে, হয়তো মার্কেটে গেছে ওরা। ফ্যামিলি নিয়ে আসা বাঙালি টুরিস্টরা শেষবেলায় আরও একবার শপিং করবেই। প্রথমবার কিছু জিনিস কিনব ভেবেও কেনা হয়নি, মনে পড়েনি দু’একজন নিকটজনের কথা, সেই সব মিটিয়ে তবেই বাড়ি ফেরার জন্য প্যাকিং করবে।

মার্কেটেও ওদের দেখা পেল না ইমন। বাড়ি এবং আত্মীয়স্বজনের জন্য নিজেই কিছু কিনল। আগের সন্ধেতে কেনা হয়নি। দু’হাতে প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ ঝুলিয়ে ইমন এখন হলিডে হোমে ফিরছে। ভীষণভাবে দমে আছে মনটা। এতটা হতাশ হওয়ার কারণ, তুলতুল জানিয়েছিল রাতের ট্রেনে ফিরবে। কোন ট্রেনে ফিরবে বলেনি। রাতের দিকে দুটো এক্সপ্রেস ট্রেন, একটা আটটায়, যেটাতে রিজার্ভেশন আছে ইমনদের। অন্যটা সাড়ে দশটায়। তুলতুলরা যদি পরের ট্রেনে ফেরে, ইমনের সঙ্গে কোনওদিন আর দেখাই হবে না। মেয়েটা ফেসবুকে আছে কিনা, কে জানে! থাকলেও কী নামে আছে, নিজের ছবি দেয়নি হয়তো, খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। মেয়েটাকে এভাবে হারিয়ে ফেলাটা কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছে না ইমন। তুলতুল হল সেই মেয়ে, যাকে দেখে ইমনের প্রথমবার মনে হয়েছে, আমি তো এর অপেক্ষাতেই ছিলাম।

একটা কাজ করা যেতে পারে। ইমন লাগেজ নিয়ে নিজেদের ট্রেনের টাইমেই স্টেশনে পৌঁছোল, যদি দেখে তুলতুলরা উঠল না সেই ট্রেনে, ইমনও যাবে না। সাড়ে দশটার এক্সপ্রেসটা ধরবে। তুলতুলরা যাবে ওই ট্রেনেই। ইমন জেনারেল কম্পার্টমেন্টে উঠবে। হাওড়া স্টেশনে নেমে তুলতুলদের ফলো করে চিনে নেবে ওদের বাড়ি। মেয়েটা যেরকম রেসপন্স দিয়েছে, ইমনের প্রতি যে আগ্রহী, তাতে সন্দেহ থাকার কথা নয়… এত দূর ভাবতে পেরে নিশ্চিন্ত হয় ইমন। এই প্ল্যানটাই একেবারে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট।

হলিডে হোমে পৌঁছে গেছে ইমন। দু’হাতে প্যাকেট নিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে। লাগেজ মোটামুটি গুছিয়ে রেখেছে। এই গিফ্টগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে নেবে। এখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা, বন্ধুরা বলাবলি করছিল, ট্রেন ধরতে হলিডে হোম থেকে বেরোবে সাড়ে ছ’টা নাগাদ। ইমন ওদের সঙ্গে বেরোবে না। আগে পরে বেরিয়ে যাবে।

রুমে ঢুকে থমকে গেল ইমন। তিনবন্ধু ভীষণরকম গম্ভীরমুখে বিছানার তিনপ্রান্তে বসে আছে। পা মাটিতে নামানো। পরনে বাইরে বেরোনোর পোশাক। ওদের লাগেজগুলোও প্যাক করে রাখা চেন টানা অবস্থায়। ওরা ইমনের অপেক্ষা না করে ট্রেন ধরতে বেরিয়ে যাচ্ছিল, বোঝাই যাচ্ছে। কোনও একটা খবর শুনে মুলতুবি রেখেছে যাওয়া। সুখবর নয়, ওদের মুখ দেখেই আন্দাজ করা যায়। এত আগেই-বা স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিল কেন? কিছুই মাথায় ঢুকছে না ইমনের। বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে, এনি থিং রং?

নার্ভাস গলায় জয়দীপ বলে ওঠে, হেভি ক্যাচাল হয়ে গেছে রে। মেয়েটা আমাদের সঙ্গে যেতে চাইছে।

ইমন এক চান্স-এ বুঝতে পারে কোন মেয়েটার কথা বলা হচ্ছে। আর একটু ক্লিয়ার হয়ে নিতে জিজ্ঞেস করে, আমাদের সঙ্গে যেতে চাইছে মানে?

– বুড়ো-বুড়িকে না জানিয়ে আমাদের সঙ্গে পালাবে। থাকবে আমাদের কাছেই। দুপুর থেকেই কথাটা বলছিল। আমরা ঘরে এনে অনেক বুঝিয়েছি। বোঝেনি। আমরা একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ার তাল করছিলাম। দেখি, সে-ও ব্যাগ গুছিয়ে রেডি। টানা কথা বলে থামল কৌশিক।

এবার খেই ধরল পার্থ। বলল, যতবার মাইরি ব্যাগ নিয়ে বাইরে বেরোতে যাচ্ছি, দরজা আগলে দাঁড়াচ্ছে। ওকে না নিলে যেতে দেবে না।

ইমন ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ঠিক হয়েছে। মেয়েটার সঙ্গে যা করেছিস তোরা, এরকমটাই হওয়ার কথা ছিল। এখন ঠ্যালা সামলা।

জয়দীপ বলে, মাথা গরম করিস না ইমন। ব্যাপারটা ঠান্ডা মাথায় ভাব। মেয়েটাকে আমরা সঙ্গে নিয়ে যেতেই পারি। পুরী স্টেশনে হয়তো সম্ভব হবে না, হাওড়া স্টেশনের ভিড়ে ওকে ফেলে পালাতেই পারি চারজনে। সমস্যা অন্য জায়গায়, মেয়েটা পালিয়েছে টের পেলেই বুড়ো-বুড়ি যাবে লোকাল থানায়। তারপর মেয়ে পাচারকারী হিসেবে পুলিশ আমাদের অ্যারেস্ট করবে, আজ না হয় কাল। চারজনের কারওকেই ছাড়বে না।

পিঠ বেয়ে হিমস্রোত নেমে যায় ইমনের। সে নোংরামির মধ্যে না থাকলেও, পুলিশ তাকে রেহাই দেবে না। যাত্রাপথে ধরতে না পারলে, বাড়িতে গিয়ে অ্যারেস্ট করবে। বাবা-মা দৌড়োদৌড়ি করবে উকিল, আদালতে, এসব সে ভাবতেই পারে না। যে করে হোক এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে তাকে।

গিফটের প্যাকেটগুলো ফ্লোরে নামিয়ে রেখে ইমন দরজার দিকে ঘুরে যায়। বাইরে বেরোতেই দেখে, করিডোরের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে নমিতা। পরনে স্কার্ট, টপ। পায়ের কাছে পুরোনো লাগেজ ব্যাগ। অভিমান আর জেদে থমথম করছে ওর মুখ। ইমনের দিকে তাকাল, চোখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে, ও একেবারে মরিয়া।

ইমন নমিতার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। একটু সময় নিয়ে বলে, তুমি আমাদের সঙ্গে যেতে চাইছ?

মাথা ওপর নীচ করে ‘হ্যাঁ’ জানায় নমিতা। ইমন বলে, তোমার সঙ্গে ওরা যা করেছে, তুমি যেতে চাইতেই পারো। কিন্তু কার বাড়িতে গিয়ে থাকবে? একসঙ্গে তিনজনের বাড়িতে তো থাকা যায় না।

কোনও উত্তর দেয় না নমিতা। মাথা নীচু করে আছে। ইমন ফের বলে, ওই তিনজনের মধ্যে কাকে তুমি বেশি ভালবাসো? তাহলে তাকে গিয়ে আমি বলতে পারি তোমার দায়িত্ব নিতে।

এখনও কোনও উত্তর নেই। প্রেমের কীই-বা বোঝে মেয়েটা। ভালোবাসা, কামকে আলাদা করতে শেখেনি। দুটোকে একই মনে করে। যাকে ভালোবাসবে, তাকেই যে নিজের সমস্ত কিছু দেওয়া উচিত, সেই জ্ঞানটুকু নেই। তথাকথিত তিন ভদ্রঘরের ছেলের আদর পেয়ে ভেবেছে, এটাই বুঝি ভালোবাসা। বড়োঘরের এমনটাই রেওয়াজ। ইমন আবার বলে, কী হল, বলো একজনের নাম। কাকে তুমি ভালোবাসো? সমাজ পরিবার তো একসঙ্গে তিনজনকে ভালোবাসাটা মেনে নেবে না। একজনকে বেছে নিতেই হবে তোমায়।

মুখ তোলে নমিতা। চোখ থেকে জল গড়িয়ে নেমেছে গালে। ইমনের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে। হতচকিত হয়ে পড়ে ইমন। ভীষণ রকম ফোঁপাচ্ছে নমিতা। ফুলে ফুলে কাঁদছে। এখন করণীয় কী, মেয়েটাকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে কিছুই বুঝতে পারছে না ইমন। বুকে রাখা নমিতার মাথা আর পিঠে হাত রেখে ইমন ভাষাহীন সহমর্মিতা প্রকাশ করে।মেয়েটা কেঁদেই চলেছে। সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে গেছে ওর। এসবের মধ্যেই ইমন আড়চোখে দেখে নিয়েছে তিনবন্ধু একে একে কেটে পড়ল তার পিছন দিয়ে। ফাঁকিটা টের পেল না নমিতা। এবার বেশ শব্দ করেই কাঁদছে সে, ইমনের টেনশন হচ্ছে, কান্নার আওয়াজে বুড়ো-বুড়ি না চলে আসে।

ফোন বেজে ওঠে ইমনের। সেটা কানে নিতেই ওপ্রান্ত থেকে জয়দীপ বলে আমরা অটো নিয়ে ওয়েট করছি। তাড়াতাড়ি কেটে আয়। তোর লাগেজ নিয়ে এসেছি।

লাইনটা কেটে মোবাইলটা পকেটে রাখে ইমন। খানিকটা জোর খাটিয়ে নমিতাকে বুক থেকে সরিয়ে বলে, দেখেছ কান্ড! ওরা তো বেরিয়ে গেল। দাঁড়াও ধরে নিয়ে আসি। একটা বিহিত তো করতেই হবে।

ছিটকে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় ইমন। অসম্ভব দ্রুততায় নামতে থাকে নীচে। রাস্তায় এসে দেখে স্টার্ট নেওয়া অটোরিক্সা থেকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে জয়দীপ। বলছে, কুইক, কুইক হারি আপ।

ট্রেন ছাড়ার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে প্ল্যাটফর্মে এল ইমনরা। এতটা সময় অটো করে পুরীর এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়েছে। নমিতাকে এড়ানোর জন্য এই সতর্কতা। চারজনকে ধরার জন্য প্ল্যাটফর্মে এসে বসে থাকে যদি ওই মেয়ে!

নিজেদের মধ্যে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে ভিড়ের মধ্যে মিশে ইমনরা এগোচ্ছে তাদের কামরার দিকে। সন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে দেখে নিচ্ছে, মেয়েটা সত্যিই চলে এল কিনা?

নির্দিষ্ট কম্পার্টমেন্টের দরজায় পৌঁছে গেছে চারবন্ধু। জয়দীপ, পার্থ, কৌশিক সেঁদিয়ে গেল ভিতরে। সবশেষে ইমন, দরজার মুখে পা দিয়ে ট্রেনের পিছন দিকটা একবার দেখতে যেতেই বিদ্যুৎ খেলে গেল সারা শরীরে, নমিতা! উদভ্রান্তের মতো এপাশ ওপাশ তাকিয়ে খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে আসছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, ওর পরনে তুলতুলের সাদা ড্রেস!

ভিতরে ঢুকে এসেছে ইমন। থরথর করে কাঁপছে। বন্ধুদের বলে, মেয়েটা চলে এসেছে। খুঁজছে আমাদের।

– কী বলছিস তুই। বলে কৌতূহল সামলাতে না পেরে দরজার বাইরে মুখ বাড়ায় জয়দীপ, কারওকেই চোখে পড়ে না। ভিতরে ঢুকে এসে জয়দীপ বলল, কই, দেখলাম না তো!

– আছে, আছে। ড্রেস বদলে নিয়েছে। চিনতে পরিসনি। আমাদের বার্থে চল তাড়াতাড়ি। বলে ইমনই এগোতে থাকে প্রথমে।

পার্থ, কৌশিকের দিকে তাকায় জয়দীপ। তার মনে খটকা লেগেছে, মেয়েটা আসতেই পারে, ড্রেস চেঞ্জ করবে কেন? বাইরে বেরোনোর ড্রেস পরে সে তো রেডি হয়ে গিয়েছিল।

বার্থে পৌঁছে ইমন সেঁদিয়ে গেল একদম কোণায়। মাথা নীচু করে দু’হাতে মুখ আড়াল করেছে। গড়াতে শুরু করল ট্রেন। জয়দীপ বলল, অ্যাই ইমন, তুই কেন এমন করছিস! আমি তো দেখলাম না ওকে। ওটা তোর চোখের ভুল। ড্রেস চেঞ্জ করে সময় নষ্ট করতে যাবে কেন মেয়েটা!

ইমন কোনও উত্তর দেয় না। একই ভঙ্গিতে বসে থাকে। পোশাকটা হচ্ছে তুলতুলের সুখস্মৃতি, কঠিন বাস্তব হচ্ছে নমিতা। যে ধাওয়া করেছে ইমনকে। কিছুতেই ছাড়বে না। তিন ব্যভিচারীকে মেয়েটা পাহারায় রেখেছিল, ইমনের ওপর ভরসা করে আশ্রয়ের খোঁজ করেছিল সে। জানত না ইমনের সহমর্মীতা আসলে একটা চক্রান্ত। ফাঁকি দিয়ে চলে গেল তিন লম্পট। শর্ত, বিনিময়হীন যে বিশ্বাস ইমনের ওপর করেছিল নমিতা, তাতে আঘাত লাগলে সরাসরি আত্মা ক্ষতবিক্ষত হয়। ইমনকে সহজে ছাড়বে না নমিতা, জবাব চাইবে।

ট্রেন থামল পরবর্তী স্টেশনে। ফের চালু হয়েছে। ইমনের দেহভঙ্গিতে কোনও বদল নেই দেখে বন্ধুরা বলাবলি করছে, এরকম পাগলের মতো করছে কেন বল তো? কাকু-কাকিমাকে কী জবাব দেব?

মা-বাবাকে নিয়ে ইমনও ভাবছে। নমিতা তাকে ধাওয়া করে বাড়ি অবধি পৌঁছে যাবেই। বাবা বলেছিল, ‘কোনও বাজে স্মৃতি, খারাপ অভিজ্ঞতা নিয়ে বাড়ি ফিরবি না।’ শরীর জোড়া গ্লানি নিয়ে ফিরছে ইমন। নমিতা ট্রেনে উঠে পড়ছে, খুঁজছে ইমনকে। হাওড়া স্টেশনের ভিড়েও ওকে হারিয়ে ফেলা যাবে না। এতটাই একরোখা হয়ে উঠেছে সে। ইমনের তো এমনও মনে হচ্ছে, নমিতা যদি ট্রেনে উঠতে না-ও পারে, মুখ তুললেই ইমন দেখতে পাবে, জানলার বাইরে তুলতুলের সাদা পোশাক পরে ট্রেনের সঙ্গে দৌড়োচ্ছে মেয়েটা। তাকিয়ে আছে ইমনের দিকে। হাওড়া স্টেশনে নামাটা বোধহয় ঠিক হবে না ইমনের।

সাতদিন পর বেশ ক’টা খবরের কাগজে ‘নিরুদ্দেশের প্রতি’ বিজ্ঞাপনে ইমনের ছবি বেরোল। পুরী থেকে বাড়ি ফেরেনি ইমন। মাঝে কোনও স্টেশনে নেমে গেছে। বাড়ির লোক, আত্মীয়স্বজন সবাই ওকে খুঁজছে। ওই তিনবন্ধুও খুঁজছে, পুরীর ঘটনাটা চেপে গেছে সবার কাছে।

অনেক কাগজে বেরোনোর দরুন তুলতুল, নমিতার চোখেও নিশ্চয়ই পড়েছে বিজ্ঞাপনে ইমনের ছবিটা। দু’জনেই অস্থির হয়েছে খুব। দুই মেয়ে দু’রকম ভাবে বিশ্বাস করেছিল ইমনকে। আশপাশে ভরসা করার মতো যুবক দিনদিন দুর্লভ হয়ে যাচ্ছে। ইমনের মতো ছেলের হারিয়ে যাওয়াটা দু’জনেই মানতে পারবে না। বিজ্ঞাপনে ইমনদের বাড়ির ফোন নম্বর দেওয়া আছে। অনেক ফোন আসার মাঝে হয়তো বা দুই কণ্ঠস্বরের ফোন আসবে। কখনও তুলতুল, কখনও নমিতার। ওরা জানতে চাইবে, ইমন ফিরেছে?

সিদ্ধান্ত

‘তুমি কি তবে সম্বন্ধটা ভেঙে দেওয়ার কথা বলছ? জয়ের কথাটাতো একবার ভাবো। আর এটা যে সত্যি, তার প্রমাণই বা কী আছে?’ অনামিকাদেবী বেশ আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞাসা করলেন।

‘যা কিছু বলছি, তার সবটাই সত্যি। সমস্ত খোঁজখবর নিয়ে তবেই বলছি। যে-মেয়েটিকে তোমরা মা-ছেলে মিলে এবাড়ির পুত্রবধূ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ, তার মায়ামাখা মুখের পেছনে রয়েছে এক কালিমাময় অতীত।’

এবার যেন ধাঁধায় পড়ে গেলেন অনামিকাদেবী। স্বামীকে প্রায় ধমকের সুরে বলে উঠলেন, ‘কী বলছ কি তুমি?’

একটু থেমে সুপ্রকাশ উত্তর দিলেন, ‘কথাগুলো শুনে আমিও আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কিন্তু বাস্তবটা বাস্তবই। ওই মেয়েটি মুর্শিদাবাদের গগনেন্দ্র চৌধুরির ভাগনি ঠিকই কিন্তু ও যে বলেছিল ওর বাবা-মা দুজনেই মৃত, এটা একেবারে ডাহা মিথ্যে। ওর বাবার কথা বলতে পারব না, তবে ওর মা কোনও নামজাদা ব্যক্তির রক্ষিতা।’

‘কোথাও কোনও ভুল হচ্ছে না তো?’

‘কেন বিশ্বাস করছ না… মুর্শিদাবাদে ওর মামার সঙ্গে কথা বলে বিয়ের সমস্ত কথাবার্তা ফাইনাল করে ফেরার পথেই ট্রেনে সুবিমলের সঙ্গে দেখা। ওর-ও তো মুর্শিদাবাদেই বাড়ি। জুঁইদের আশেপাশেই কোথায় যেন একটা! ওখানে যাওয়ার কারণ বলতে গিয়েই জানতে পারি, জুঁইয়ের মায়ের এই কুকীর্তির কথা। উনিই ওনার কুপথে অর্জিত টাকায় মেয়ের ভরণ-পোষণের সব দায়িত্ব সামলান। তাই প্রতি মাসেই বেশ মোটা অঙ্কের টাকা পাঠান মেয়েকে। গগনেন্দ্র চৌধুরী তো শুধু শিখন্ডী মাত্র।’

‘কী বলছ কী তুমি, আমি তো ভাবতেই পারছি না,’ বিস্মিত স্বরে বলে ওঠেন অনামিকাদেবী।

কিছুক্ষণের জন্য চুপ থেকে জয়ের বাবা সুপ্রকাশ আবার অনামিকাদেবীকে বলতে শুরু করেছিলেন। ‘কী জানি কেন, তবু সত্যিটা ঠিক মানতে পারছিলাম না। কেমন যেন একটা খটকা লাগছিল।  আর সেই কারণেই সেদিন বাড়ি ফিরে তোমাদের কিছু জানাইনি। মনে মনে ঠিক করেছিলাম, সঠিক জেনে তবেই তোমাদের বলব। সুবিমলের থেকে জানতে পেরেছিলাম যে, জুঁইয়ের মা এখন দেরাদুনে থাকেন। ঠিক করেছিলাম সেখানেই যাব। সেইমতো অফিসের টুর-এর নাম করে তিনদিন পরেই তৎকাল টিকিটে চলে গিয়েছিলাম দেরাদুন। ওখানে গিয়ে একটু খোঁজখবর করতেই জানতে পারি দেরাদুনে একটা প্রাইভেট সংস্থাতে টাইপিস্টের কাজ করতেন জুঁইয়ের মা বন্দনাদেবী। বর্তমানে তিনি ওই কোম্পানির মালিক রঞ্জন বাসুর রক্ষিতা।’

অনামিকাদেবী দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কেবল বোকার মতো তাকিয়ে থাকলেন সুপ্রকাশের মুখের দিকে। ‘এবার কী হবে? জয় যে ওকে খুব ভালোবাসে। আমার সুখের সংসারে এ কার নজর পড়ল? ও যে জুঁইকে নিয়ে কত স্বপ্ন সাজিয়ে রেখেছে। ওর এই স্বপ্ন বুনতে আমি যে নিজেই ওকে সাহায্য করেছি, আনন্দের সঙ্গে ওদের সম্পর্কের স্বীকৃতি দিয়েছি। এসব জানতে পারলে জয় যে একেবারে ভেঙে পড়বে।’

এমনিতে জয় আর জুঁইয়ের ভালোবাসার ব্যাপারে আলাদা করে বাড়িতে কিছুই জানাতে হয়নি জয়কে। কারণ কোনও কিছু বলার আগেই সবকিছু বুঝে গিয়েছিলেন অনামিকাদেবী। বছর চারেক আগে ছেলের জন্মদিনের পার্টি-তে হাজির ছিল ছেলের কলেজের বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব। তাদের মধ্যে জুঁইও ছিল। সকলের থেকে আলাদাভাবেই নজর কাড়ছিল প্রাণোচ্ছল, ফুটফুটে মেয়েটি। তার উপর অন্যান্যদের তুলনায় ছেলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতাই প্রমাণ করছিল তাদের সম্পর্কের অন্তরঙ্গতা।

জুঁইকে অপছন্দের কোনও জায়গাই ছিল না অনামিকাদেবীর। সুন্দরী তো বটেই, তার ব্যবহারটিও ছিল ফুলের মতো মিষ্টি। তার উপর আবার তার পিতৃমাতৃহীন হওয়াটা তাকে আরও অনামিকাদেবীর স্নেহের পাত্রী করে তুলেছিল।

কলকাতার নামিদামি স্কুল-কলেজে পড়ার কারণে ছোটো থেকেই সে হস্টেলে থেকেছে। শুধুমাত্র ছুটির দিনগুলোতে মুর্শিদাবাদে মামার বাড়ি ফিরত। ওই মামাই নাকি ভাগনিকে আদর-আহ্লাদে বড়ো করে তুলেছে। জুঁইয়ের অতীতের এইটুকু সংক্ষিপ্ত ইতিহাসই জানা ছিল তাদের।

অফিস থেকে ফিরে বাবাকে গম্ভীর দেখে কিছু বলার সাহস পেল না জয়। সোজা মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘মা, বাবার কী হয়েছে? ঝগড়া করেছ নাকি? কেমন একটা গুরুগম্ভীর মুখ করে যেন বসে আছে। ভয়ে কিছু বলারই সাহস পেলাম না। কিছু বললেই তো বলবে, তুই সবসময় আমারই দোষ দেখিস, তোর মা তো কোনও অন্যায়ই করতে পারে না। কেন ঝগড়া করো বাবা, মিটিয়ে নাও না।’

‘না রে, তুই যেটা ভাবছিস ব্যাপারটা তা নয়।’

‘তাহলে কী? বাবার অফিসের কিছু প্রবলেম?’

‘না রে। তোকে যে কীভাবে বলি?’

‘কী হয়েছে এত হেজিটেট করছ কেন? সকালে যখন অফিস গেলাম তখনও তো সব ঠিক ছিল। বাবাও তো বোধহয় অফিস টুর থেকে সন্ধেবেলাই ফিরেছে। তাহলে এইটুকু সময়ের মধ্যে কী এমন ঘটে গেল, যে আমাকে বলতে পারছ না। কী হয়েছে মা? প্লিজ, আমাকে বলো।’

‘কী বলব বলতো। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না যে, জুঁই তোর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এমনও তো হতে পারে ও হয়তো ওর অতীত সম্পর্কে নিজেই কিছু জানে না। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতেও পারছি না আর মানতেও পারছি না। কিন্তু তোর বাবা যে নিজে সমস্ত খোঁজখবর নিয়ে তবেই বলছে। সে যে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে।’

‘কী যা তা বলছ! স্পষ্ট করে বলো। হেঁয়ালি কোরো না। আমি আর নিতে পারছি না।’

অনামিকাদেবী সমস্ত কিছু খুলে বললেন ছেলে জয়কে। কথাগুলো শোনার পরে বিস্ময়বিমূঢ়তা যেন তাকে একেবারে ঘিরে ধরল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে শান্তস্বরে মাকে বলল, ‘জুঁই জ্ঞানত ইচ্ছা করে আমার থেকে কিছু লুকিয়েছে, এটা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয় মা। অন্তত আমি এটা বিশ্বাস করতে পারছি না। চার-চারটে বছর ধরে আমাদের সম্পর্ক, ও আজ পর্যন্ত কোনও কিছু বলেনি বা লুকিয়েছে এরকম কোনওদিন হয়নি।’

‘ঠিক তোর মতো আমি ওকে জানি বলেই তো ব্যাপারটা মানতে পারছি না বাবু। কিন্তু তোর বাবা…।’

‘সব বুঝছি কিন্তু তুমি তো জানো মা ও কতটা ইনোসেন্ট, সহজ, সরল প্রকৃতির মেয়ে। আজ পর্যন্ত কারওর সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলেছে বলেও মনে হয় না। যে জীবনের কোনও জট-জটিলতা বোঝেই না, সে এত বড়ো একটা মিথ্যে– কিছু মনে কোরো না মা আমার মানতে কষ্ট হচ্ছে। বাবার বোধহয় কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। আর ওর মায়ের ব্যাপারটা যদি সত্যি হয়েও থাকে, তাহলেও আমার কিছু এসে যায় না। তবু বলছি, তারপরেও যদি তোমার মনে হয় জুঁই আমাদের বাড়ির অনুপযুক্ত, ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক রাখাটা ঠিক নয়– তাহলে তোমার কথা ভেবে আমি ওর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দিতে রাজি। কিন্তু আমি জানি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার মা কখনও নিরপরাধ কাউকে শাস্তি দিতে পারে না। এখন সবকিছুই তোমার হাতে,’ বলেই উদ্ভ্রান্তের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সুপ্রকাশ ও অনামিকাদেবীর একমাত্র আদরের সন্তান জয়।

জয় বেরিয়ে গেলেও অনামিকাদেবী বেশ কিছুক্ষণ সেই জায়গাতেই বসে রইলেন। অহরহ শুধু ছেলের মুখটা তার চোখের সামনে ভাসতে থাকল। কথাগুলো বলার সময় কীভাবে বুকে পাথর চেপেছিল সে, তার সমস্তটাই ধরা পড়ছিল মায়ের চোখে। ছেলে কতটা কষ্ট পাচ্ছে, তা ভালোভাবেই অনুভব করতে পারছিলেন। ছেলে বলে হয়তো কাঁদতে পারেনি, মেয়ে হলে…।

সেদিন রাত্রে একটুও ঘুমোতে পারেননি অনামিকাদেবী। শুধু ছটফট করেছেন আর ভেবেছেন, কীভাবে এই রহস্যের শিকড়ে পৌঁছোনো যায়। সারারাত চিন্তা করে একটা সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। সেইমতো পরদিন সকালে সুপ্রকাশবাবুকে জানান নিজের দেরাদুন যাওয়ার কথা।

প্রত্যুত্তরে সুপ্রকাশবাবু বলেন, ‘অনামিকা তুমি যাবে যখন ভেবেছ যাও। কিন্তু গিয়ে কোনও লাভ হবে বলে মনে হয় না।’

‘তবু যদি কিছু আশার আলো দেখা যায়।’

‘ঠিক আছে দু-তিন দিন বাদে যেও। আমি আজই দত্ত-দা-কে বলে টিকিটের ব্যবস্থা করছি। তবে তৎকালে গেলে খুব কষ্ট হবে তোমার।’

‘হোক কষ্ট। এই কষ্ট আমার ছেলের কষ্টের থেকে বেশি নয়। ওর জন্য আমাকে সবকিছু জানতেই হবে।’

পাশেই ডাইনিং টেবিলে বসে চা খাচ্ছিল জয়। মার কথা শুনে ধীরে ধীরে মাকে বলল, ‘মা তুমি দেরাদুন যাচ্ছ, আমি যাব তোমার সঙ্গে?’

‘না, আমি একাই যাব। আর হ্যাঁ, জুঁইকে এখনই এসব ব্যাপারে কিছু জানাবার দরকার নেই। আগে আমি ফিরি। তারপর…।’

নির্ধারিত দিন অনুযায়ী রওনা দেন অনামিকাদেবী। দীর্ঘ সফর শেষ করে যখন স্বামীর দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছোলেন, তখন তাঁর বিধ্বস্ত অবস্থা।

সামনে ছোট্ট সুন্দর একটা বাংলো, যার সামনের দিকটায় সুন্দর সুন্দর বিভিন্ন ধরনের বাহারি ফুলগাছের বাগান। গেট খুলে বাগান পেরিয়ে বাংলোর কলিংবেল বাজাতেই, একজন অল্পবয়সি যুবতি দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকে চাই?’

‘বন্দনাদেবী আছেন?’

‘হ্যাঁ আছেন। আপনি ভিতরে বসুন, আমি ডেকে দিচ্ছি’, বলে চলে যাচ্ছিল সে, কী ভেবে আবার ফিরে এসে বলল, ‘কিন্তু দিদিমণি যদি জিজ্ঞাসা করে কে, কোথা থেকে এসেছেন, তাহলে কী বলব?’

‘দিদিমণিকে বলো কলকাতা থেকে অনামিকা চ্যাটার্জী এসেছে দেখা করতে, বিশেষ কিছু প্রয়োজনে।’

‘ঠিক আছে আপনি বসুন। আমি এক্ষুনি ডেকে দিচ্ছি।’

মিনিট দুয়েকের মধ্যে উপর থেকে নেমে এলেন বছর পঁয়তাল্লিশের একজন মহিলা। দেখতেও বেশ সুন্দর, এমনকী তার দেহের বাঁধন-টাঁধনও এই বয়সে অটুট।

‘হ্যাঁ বলুন। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক…।’

‘আমি কলকাতা থেকে আসছি। আমার পরিচয় দিলে হয়তো চিনলেও চিনতে পারেন। জয় আমার ছেলে…’ বাকি কথা বলার আর অবকাশই পেলেন না অনামিকাদেবী। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই বন্দনাদেবী বলে উঠলেন, ‘জানি, আমার মেয়ে জুঁই আপনার ছেলেকে ভালোবাসে, শুধু তাই নয় বর্তমানে ওদের বিবাহও স্থির হয়ে গেছে, তাইতো?

কথার মাঝেই থামিয়ে দেওয়ার জন্য মাফ করবেন। কিন্তু এখন আপনারা কোনওভাবে জানতে পেরেছেন জুঁইয়ের অতীতের কথা, আর তাই ছুটে এসেছেন আমার কাছে। কী জানি কেন আমার মনটা ক’দিন ধরেই বলছিল, এরকম কিছু একটা ঘটতে পারে। গত সপ্তাহেই আমার দাদার ফোনে জানতে পারি কলকাতাতে জুঁইয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বাদ দিন এসব, এখন বলুন কী জানতে চাইছেন?’

জুঁইয়ের মায়ের কথাগুলো কেমন কেমন শুনতে লাগলেও অনামিকার কিছু করার ছিল না। তাকে সমস্ত কিছু জানতেই হবে। এটা তার ছেলের জীবনের ব্যাপার বলে কথা।

‘জুঁই শুধু আমার ছেলেরই নয় আমার এবং আমার স্বামীরও পছন্দের পাত্রী। ও আমাদের বলেছিল ছোটোবেলাতেই ওর মা-বাবা মারা গেছে। মামার কাছেই মানুষ। আমার স্বামী মুর্শিদাবাদ গিয়ে বিয়ের দিন পর্যন্ত ঠিক করে ফেলেছিলেন কিন্তু তার পরেই জানা গেল…।’

‘ওর মা বেঁচে আছে তাইতো? আপনি যা কিছু শুনেছেন সব সত্যি। আপনাকে শুধু এইটুকু বলতে পারি জুঁই এ সম্পর্কে সত্যিই কিছু জানে না। সুতরাং এর সঙ্গে ওকে জড়াবেন না। ও নিরপরাধ। জানি ও হয়তো আর আপনার ঘরের পুত্রবধূ হতে পারবে না। মা-বাবার কৃতকর্মের ফল সন্তানদেরই ভোগ করতে হয়। এর থেকে আর বেশি কী বলব!’

‘আমরা জুঁইকে কখনও দোষী ভাবিনি, কিন্তু আপনি এইরকম কাজ কেন করলেন? ক্ষমা করবেন, এটা আমার ছেলের জীবনের প্রশ্ন, তাই আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হলাম।’

‘আমি তো আপনাকে নিঃসংকোচে সমস্ত কিছু বলতেই পারি, কিন্তু তাতে কি কোনও লাভ হবে? আমার জীবনের সেই ভয়ংকর সত্যিটা শুনলেও, আপনার মন থেকে আমার প্রতি জন্মানো ঘৃণা-বিতৃষ্ণা বদলাবে না। তাহলে আর শুধুশুধু অতীতের এই বিষাদ ঘেঁটে লাভ কী বলুন। আমার মেয়েটা তো আর…’ করুণভাবে বলে ওঠেন বন্দনাদেবী।

‘লাভ হোক আর না হোক, এই সম্পর্ক ভাঙার পিছনে একটা সঠিক কারণ তো জয়কে জানাতে হবে। শুধু তাই নয় নিজের মনকে স্ত্বান্না দেওয়ারও একটা ব্যাপার আছে। ছেলের দৃঢ় বিশ্বাস তার মা কোনও অন্যায় করতে পারে না, কোনও নিরপরাধীকে শাস্তি দিতে পারে না, তাই তার এই বিশ্বাস আমি ভাঙতে চাই না। প্লিজ বন্দনাদেবী চুপ করে থাকবেন না। দয়া করে সত্যিটা বলুন। আপনাকে কথা দিচ্ছি, জুঁই, এর বিন্দুবিসর্গও জানবে না,’ বেশ উত্তেজিত হয়েই বলেন অনামিকাদেবী।

‘তাহলে শুনুন, আজ থেকে অনেক বছর আগেকার কথা। একদিন আমি আর আমার স্বামী দুজনেই ভাইপোর জন্মদিন সেরে মুর্শিদাবাদ থেকে শ্বশুরবাড়ি কলডোঙায় ফিরছিলাম। সেই সময় জুঁই ছোটো ছিল। আমার দাদার তিন ছেলে জবরদস্তি করে জুঁইকে রেখে দিল কয়েকদিনের জন্য। দাদাও ভাগনিকে খুব ভালোবাসত। তাই বাধ্য হলাম জুঁইকে কয়েকদিনের জন্য রেখে আসতে।

ফেরার পথে মাঝরাস্তাতেই যত বিপত্তি। হঠাৎই বেশ কয়েকজন দুষ্কৃতীর অতর্কিত আক্রমণে, বাসের সমস্ত যাত্রীই শিউরে উঠি। বাসের সিটে বসে থরথর করে কাঁপতে থাকি আমরা। সেই বিভীষিকাময় দিনটার কথা কোনওদিন বোধহয় ভোলা সম্ভব নয়। বাসের মধ্যে সর্বসাকুল্যে আট-দশ জন মহিলা ছিলাম। প্রথমেই মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে চলল লুঠতরাজ।’ বলতে বলতে হঠাৎই থেমে গিয়েছিলেন বন্দনাদেবী। অনামিকাদেবী লক্ষ্য করছিলেন কথাগুলো বলতে বলতে বন্দনাদেবীর চোখ-মুখ একেবারে ভয়ে লাল হয়ে উঠছিল।

‘তারপর? তারপর কী হল?’ বলে ওঠেন অনামিকাদেবী।

‘তারপর? তারপর শুরু হল মহিলাদের উপর নির্মম অত্যাচার। পুরুষদের চোখের সামনেই এক এক করে সব ক’টি মহিলাকে ধর্ষণ করতে থাকল ওই দুষ্কৃতীরা। আর পুরুষরা, অবশ্য পুরুষ কি কাপুরুষ জানি না, তারা তাদের প্রাণের ভয়ে চুপচাপ বসে বসে দেখল তাদের মা, বোন, স্ত্রীর সতীত্ব হরণ হতে। অবশ্য যে-দুজন এর প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন, তাদের একেবারে সেইখানেই সারাজীবনের মতো মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে একজন ছিলেন আমার স্বামী। এরকম লজ্জাজনক ঘটনার পরেও সেদিন যে কেন পৃথিবী ফাঁক হয়ে ধরাতলে মিশে যাইনি, সেটাই আশ্চর্যের।

একের পর এক দুষ্কৃতীদের পাশবিক অত্যাচারে কখন যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজেও জানি না। যখন জ্ঞান ফিরল তখন চারিদিকে কান্নার রোল। মনে পড়ে গেল পরিমল মানে আমার স্বামীর কথা। কোনওরকমে উঠে বসলাম। তারপর স্বামীর খোঁজ করতে জানতে পারলাম, যে-দু’জন ব্যক্তি দুষ্কৃতীদের হাতে মারা গিয়েছিল, দুষ্কৃতীরা যাবার আগে তাদের ভাগীরথীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে গেছে। অসহায়ের মতো হাউহাউ করে কাঁদতে থাকলাম। মনে হতে থাকল ভোগ-লালসার শিকার হওয়া ঘৃণ্য এই দেহ শেষ করে দেব। নিজেও ভেসে যাব ওই ভাগীরথীর জলে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল জুঁইয়ের কথা। বাবা তো গেলই, যদি আমিও চলে যাই তাহলে ওকে দেখবে কে?’ বলতে বলতে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে জুঁইয়ের মা।

লজ্জায় মাথা হেঁট করে নেন অনামিকাদেবী। নিজের মনে বলে ওঠেন, ‘বাসের সমস্ত পুরুষরা যদি সকলেই একসঙ্গে প্রতিবাদ করত তাহলে হয়তো এধরনের ঘটনা ঘটত না। যারা চোখের সামনে নিজের মা, বোন, স্ত্রীর সম্মানহানি চুপচাপ মেনে নিতে পারে, তাদের এ পৃথিবীতে থাকাটাই গর্হিত অপরাধ। আদতে তারাই এ পৃথিবীর বোঝা।

এই ধরনের ঘটনার পর সমস্ত মানুষ প্রশাসনের নিন্দায় মুখর হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষে কি দেশের সমস্ত মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব? তাহলে তো প্রত্যেক নাগরিকের সুরক্ষার্থে একটি করে বন্দুকধারী নিরাপত্তারক্ষী দিতে হয়, যাতে তারা বিপদের সময় তাদের উপর নির্ভর করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে। নিজেকে বন্দনার জায়গায় কল্পনা করে নিয়ে ওই বিপর্যয়ের কথা ভাবতে চেষ্টা করলেন অনামিকদেবী।

মিনিট পাঁচেক পরে বন্দনাদেবী একটু শান্ত হতে অনামিকাদেবী আবার জিজ্ঞাসা করেন, ‘তারপরে কী করলেন?’

‘কোনওমতে পৌঁছোই দাদার কাছে। ভেবেছিলাম সবাই ফেলে দিলেও দাদা ফেলবে না। দাদার আশ্রয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। কিন্তু হায়। যে-দাদা বোন বলতে অজ্ঞান ছিল, সেই দাদাই সমস্ত কিছু শুনে, স্ত্বান্না দেওয়ার বদলে, আমাকে তক্ষুনি সেখান থেকে চলে যেতে বলল।

দাদার এই পরিবর্তন দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। প্রশ্ন শুধুমাত্র আমার একার নয়, আমার ফুলের মতো ছোট্ট মেয়েটারও ভবিষ্যৎও জুড়ে ছিল এর সঙ্গে।

যে-ভাগনিকে আদরের ঠেলায় অস্থির হতো তার মামা, সেদিন সেই ভাগনিই কাঁটা হয়ে গলায় বিঁধছিল তার। বহু অনুনয়-বিনয় করে কিছুতেই রাখতে চাইছিল না তাকে। অবশেষে কতকগুলো প্রতিজ্ঞা করিয়ে তবেই জুঁইকে আশ্রয় দিয়েছিল।

এক, আমার এই মুখ কখনও যেন তাকে আর দেখতে না হয়।

দুই, প্রতিমাসে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জুঁইয়ের যাবতীয় খরচ যেন তার অ্যাকাউন্টে জমা করে দেওয়া হয়।

আর তিন, সেদিন থেকেই সবাই জানবে যে ওই দুর্ঘটনায় আমি এবং আমার স্বামী দুজনেই মৃত। এমনকী আমার মেয়েও কোনওদিন জানবে না যে আমি জীবিত।

আমার মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সবকিছু মেনে নিয়ে মাথা নত করে বেরিয়ে এলাম। মেয়ের জন্য কষ্ট হলেও, উপায়ও তো আর কিছু ছিল না।’

‘এবার কিছুটা হলেও অাঁচ করতে পারছি, একজন একা সমর্থ মেয়ের সঙ্গে কী কী ঘটতে পারে। তবু আপনার মুখ থেকেই শুনি, দাদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে কী করলেন? কোথায় গেলেন?’ বেশ কুণ্ঠিতভাবেই বলেন অনামিকাদেবী।

প্রত্যুত্তরে বন্দনাদেবী বলতে থাকেন, ‘কী আর করব ভাই, দাদার শর্ত মতো তখন আমি মৃত। তাই আমাকে শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে। সেই ফরমান অনুযায়ী হাতে হাজার তিনেক টাকা গুঁজে দিয়ে চিরতরে বিদায় দিয়েছিল আমাকে। সঙ্গে এও বলেছিল হাওড়া থেকে দূরপাল্লার কোনও ট্রেন ধরে নিতে। সেইমতো স্টেশনে পৌঁছে দেরাদুনগামী ট্রেনে চড়ে বসলাম। চলে এলাম এই শহরে। কত যে ঠোক্বর খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। পদে পদে অপমান, অভাব, অনটন কতই না সয়েছি। তার উপর মার রূপই আমার কাছে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অপরদিকে জুঁইয়ের খরচ পাঠানোরও ব্যাপার ছিল। তখন ওকে মানুষ করাটাই ছিল আমার প্রধান লক্ষ্য। আর সেই জন্য আমি যে-কোনও কাজ করতেই রাজি ছিলাম।

একজন সুন্দরী মহিলার থেকে সমাজ কাজের বদলে টাকা নয়, পরিবর্তে অন্য কিছু চাইত। কীভাবে যে ওই হিংস্র জন্তুগুলোর থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছি, তা বলার নয়। এভাবেই কেটে গেল একটা বছর। ধীরে ধীরে জুঁইও বড়ো হতে থাকল। ওর পড়ার খরচও বাড়তে থাকল। সেই সময়েই রঞ্জনবাবুর সঙ্গে পরিচয়।

আমার প্রয়োজনের কথা শুনে ওনার অফিসে টাইপিস্ট-এর পদে নিয়োগ করেন আমাকে। বোঝেনই তো সুরূপা একটি মহিলা, তার উপর আবার বাবুর নিয়োগ করা লোক হওয়ার কারণে সবসময়েই অফিসের অন্যান্য স্টাফদের থেকে নানা ধরনের নোংরা নোংরা কথা শুনতে হতো আমাকে। এক-এক সময় মনে হতো রঞ্জনবাবুকে সব জানাব, কিন্তু পরক্ষণেই জুঁইয়ের মুখটা ভেসে উঠত মুখের সামনে। জানাতে গিয়ে যদি উলটো ফল হয়, যদি কোনও কারণে চাকরিটা চলে যায়, তাই মুখ বুজে সব সহ্য করতাম।

একদিন কেবিনে বসে বসে রঞ্জনবাবু সবকিছু শুনে আমাকে ডেকে পাঠালেন। বিগত এক বছরে আমি কামাতুর পুরুষ ছাড়া কিছুই দেখিনি। হঠাৎই ওই মানুষটির সহানুভূতি পেয়ে ওনাকে আমার পূর্বের সব ইতিহাস খুলে বলি। তখন থেকেই উনি আমাকে বিশেষ স্নেহের চোখেই দেখেন।

একদিন উনি আমাকে ওনার বাড়িতে নিয়ে গেলেন, সেখানে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত ওনার স্ত্রী বহুদিন ধরেই শয্যাশায়ী। আর কোনও দিন সুস্থ হবেন না জেনেই স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তখনই আমি একটা কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে আমার অন্য কোনও খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। শুধুমাত্র নিজেকে এই সমাজের মুখোশধারী ব্যক্তিদের থেকে বাঁচানো আর মেয়ের উচ্চশিক্ষার অভিপ্রায়েই থেকে গেলাম ওনার বাড়িতে। মনে মনে এই ভেবে খুশি হয়েছিলাম যে, এতে অন্তত জুঁইকে তো ভালোভাবে মানুষ করতে পারব।

রঞ্জনবাবুর স্ত্রীর স্বীকৃতিতেই সম্মানের সঙ্গে থেকে গিয়েছিলাম ওখানে। যতদিন তিনি বেঁচেছিলেন ততদিন ওনাকে বড়োদিদির মতোই সেবা শুশ্রূষা করেছি। সুরক্ষা বলুন আর ভালোবাসাই বলুন তা তো কেবল ওনাদের থেকেই পেয়েছি। না হলে লোকে তো বেশ্যা বা রক্ষিতা কোনওটাই বলতে বাকি রাখে না। আপনিও একজন মহিলা, আপনি বলুন তো লোকে যে-যে ভাষায় আমাকে গালিগালাজ করে, আমি কি সত্যিই তার অধিকারী?’

‘মাফ করবেন বন্দনাদেবী। আমি কিছু না জেনেই আপনাকে ভুল ভেবেছি।’ ‘আবেগাপ্লুত হয়ে বন্দনাদেবীর হাত দুটো ধরে বলেন অনামিকাদেবী, ‘এবার আমি উঠব, দেখছি কত দূর কী করতে পারি!’

‘সব কিছু শোনার পরেও কি…’ কোথায় যেন আশার আলো দেখতে পায় জুঁইয়ের মা।

‘হ্যাঁ এখনই তো কিছু করার সময়। আচ্ছা খুব তাড়াতাড়ি দেখা হচ্ছে,’ এই বলে অনামিকাদেবী যে-গাড়িতে এসেছিলেন, তাতে করেই স্টেশনে ফিরে গেলেন।

কলকাতায় ফিরে সমস্ত কিছু জানান স্বামীকে অনামিকাদেবী। সঙ্গে সিদ্ধান্তও নেন যে জুঁই-ই তাদের বাড়ির পুত্রবধূ হবার যোগ্য, অন্য কেউ নয়।

‘তুমি যেটা বলছ মানছি। কিন্তু লোকে কী বলবে?’ বলে ওঠে সুপ্রকাশ।

‘লোকের কথা বাদ দাও তো। মানুষের কাজই তো শুধু অন্যের বদনাম করে বেড়ানো। জুঁই নিরপরাধ। ওর কোনও দোষ নেই। শুধু ওই কেন ওর মা-ও নির্দোষ। রঞ্জনবাবু যদি ওনাকে নিজের করে নিতে পারেন, নিজের স্ত্রীর মর্যাদায় রাখতে পারেন, তাহলে আমরা জুঁইকে ঠেলে সরিয়ে রাখব কেন? কোন অপরাধের সাজা মা-মেয়েকে দেব বলতে পার?’ উত্তেজিত হয়েই কথাগুলো বলেন উঠল জয়ের মা।

‘আমি কখন বলছি যে ওরা দোষী? কিন্তু…’

‘কিন্তু কীসের? প্রবল বর্ষণে বড়ো বড়ো কংক্রিটের অট্টালিকা পর্যন্ত বয়ে চলে যাচ্ছে, নদীর গতিপথ বদলে যাচ্ছে, সেখানে তো উনি একজন অসহায় নারী, ভাগ্যের পরিহাসে যাকে জীবনে নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তিনি নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও ভগবান তাকে চরম দণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। তার নিরপরাধ সন্তান কেন সেই সাজা ভোগ করবে?’

অনামিকাদেবীর গম্ভীর স্বর বাবা-ছেলের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। বাবার কাছ থেকে উঠে গিয়ে মার কাঁধে মাথা রাখে জয়। তার মা শুধু তার বিশ্বাসই বজায় রাখেনি, তাকে তার প্রাণাধিক প্রিয় ভালোবাসাও ফিরিয়ে দিয়েছে।

পাপ

বোতলের অনেকটা তরল একসঙ্গে গলায় ঢালে বাচ্চু। আজ আর কিছুই ভালো লাগছে না। দুদিন ভালো করে খাওয়া হয়নি। সিগারেট খেলে বুকের ভেতরটা জ্বালা করে আজকাল। চলতে গেলে পা কাঁপে। অথচ বাচ্চুর চেহারা বেশ ভালোই ছিল। আগে নিয়মিত ব্যায়াম করত। পঞ্চাশ ইঞ্চি বুক ছিল। এখন সেসব স্বপ্ন মনে হয়। বাবা মারা যাওয়ার পর অভাব আর দারিদ্র্য যেন ওর জীবনের সঙ্গী হয়ে গেছে। পড়াশোনাটা ভালো করে করলে হয়তো একটা চাকরি পাওয়া যেত। একসময়ে স্বাস্থ্যের গৌরবে সে অচিরেই হয়ে উঠেছিল পাড়ার হিরো। কিন্তু এই হিরোই একসময় হয়ে উঠল এক চলমান ত্রাস। একজন অ্যান্টি সোশ্যাল। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই বাচ্চুকে ভয় পেত। আর পাড়ার মেয়েদের তো নিশ্চিন্তে ঘোরাফেরা করার উপায়ই ছিল না। অথচ জীবনটা কীরকম বদলে গেল। মা সেই কোন ছোটোবেলায় মারা গেছে। তারপর বাবাও চলে গেল। একটা ছোটো বোনকে রেখে গেল বাচ্চুর জিম্মায়। রোজগারের কোনও নিশ্চয়তা নেই। কোনওমতে দিন চলে। কখনও রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করে। আবার কখনও হয় বড়ো ব্যবসাদারের ভাড়া করা গুণ্ডা। দুবার জেলও খেটেছে বাচ্চু। বোনটা পাড়ার এক বুড়ি পিসিমার কাছেই মানুষ। এখন শরীরটাও চলে না। ক্ষমতায় এখন অন্য রাজনৈতিক দল। স্বাভাবিক কারণেই এখন বাচ্চুর রোজগারও কম হয়। বোনটা তো অসুখে ভুগে ভুগে কঙ্কালের রূপ নিয়েছে।

নেশার পাত্রটা শেষ করে চোখদুটো খুলল সে। রোখ চেপে যাওয়া গলায় বলল ‘ওঠ’। পাশে বসা মনু বলল, ‘গুরু বোতলটা শেষ করে গেলে হতো না?’

ক্লান্তস্বরে বাচ্চু বলল, ‘না ওটা ফেলে দে। আজ একবার শেঠ বাজোরিয়ার কাছে যেতে হবে। কিছু টাকার দরকার বুঝলি? বোনটাকে ওষুধপত্র না দিলে ও মরে যাবে।’

‘কাজ ছাড়া কি শেঠ টাকা দেবে?’

‘ওর বাপ দেবে। ওর জন্য আমি কম খুন, জখম করেছি?’

‘ওর তো এখন পেয়ারের লোক বিল্লে, যাকে তুমি হাতে ধরে বানিয়েছ।’ প্যান্টের পকেটে রাখা রামপুরী চাকুটা একবার অনুভব করল বাচ্চু। চোখদুটো লাল। দাঁতে দাঁত চেপে রাগে গর্জন করে উঠল। তারপর বলল, ‘আমি যদি টাকা না পাই তবে দুটোকে সাফ করে দেব।’

‘গুরু তার চেয়ে চামেলির ওখানে চলো। ও যদি কিছু টাকা দিতে পারে।’

‘ওই ভোগলালসার টাকা আমি ছুঁই না। তার থেকে কাঁচড়াপাড়ায় চল দেখি আমার ছোটো মামার থেকে কিছু পাই কিনা।’

স্বপনলালের চায়ের দোকানের পিছনে ওরা এতক্ষণ বসে ছিল। দোকান থেকে বেরোতে বেরোতে কী যেন একটু ভেবে নিয়ে মনুকে বলল, ‘তুই এখন যা, আমাকে একটু একা থাকতে দে।’

নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে চামেলির বস্তির সামনে এসে দাঁড়াল বাচ্চু। রাস্তার কলের জলে দু’চার জন মেয়েমানুষ বুকে গামছা জড়িয়ে স্নান করছিল। ফুটপাথের ওপর দু’চারটে বাচ্চা খেলা করছে। অদ্ভুত এদের জীবন। দুঃখটা কেমন সহজ করে মেনে নিয়েছে। কোনও আশা নেই প্রত্যাশা নেই শুধু কোনও রকমে বেঁচে থাকা। চামেলির ঘরের বাইরে টুলের ওপর ওর স্বামী বসে চা খাচ্ছিল। একটু হেসে বলল, ‘কি খবর বাচ্চুদা?’

বাচ্চু সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, ‘চামেলি কোথায়?’

‘ঘরেই আছে। একটু ব্যস্ত আছে।’

চামেলির এই দেহদান বাচ্চুর একটুও ভালো লাগে না। পয়সার জোর থাকলে বড়ো বড়ো উপদেশ দেওয়া যায়। চামেলির চারটে বাচ্চা, তার ওপর ওর স্বামীর কোনও রোজগার নেই। মাঝে মাঝে ভাবে বাচ্চু, জীবনটা কি এতই সুন্দর যা কোনওভাবে বাঁচিয়ে রাখতেই হয়।

একটা সিগারেট ধরাল বাচ্চু। মাথাটা খুব ধরেছে। কী করবে সে। তারপর বলল, ‘আমি ঘুরে আসছি।’

চামেলির স্বামী বলল, ‘সেই ভালো, জানি না তো কতক্ষণ লাগবে।’

রাত বারোটার পর যখন চামেলির ঘরে ঢুকল বাচ্চু, চামেলি তখন ক্লান্ত। বড়ো বড়ো হাই উঠছে। বাচ্চাগুলো জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে আছে তেলচিটে বিছানাটাতে। চামেলি বলল, ‘হঠাৎ পথ ভুল করে এখানে?’

চৌকির ওপর বসতে বসতে বাচ্চু বলল, ‘বোনটার খুব অসুখ। তাই বেরিয়েছিলাম টাকার সন্ধানে।’

‘কী হয়েছে নীতার?’ অনেক জানার আগ্রহ চামেলির মুখে।

‘জানি না। তবে আজ ক’দিন ধরে কিছু খাচ্ছে না।’

‘ডাক্তার দেখিয়েছ?’

‘হ্যাঁ, ছোটোখাটো ডাক্তার দেখিয়েছি, কিছুই ধরতে পারছে না।’

‘কোনও বড়ো ডাক্তার দেখাও।’

একটু হাসল বাচ্চু, বলল, ‘খাবার পয়সা নেই ডাক্তার দেখাব!’

‘আমি পয়সা দেব, তুমি নীতাকে বাঁচাও।’

‘সে হয় না চামেলি। তোমার রোজগারের লজ্জা আমাকে দিনরাত কুরে কুরে খাবে।’

‘তবুও তুমি না কোরো না। আমি যদি আমার সমস্ত লজ্জা, ঘৃণা ত্যাগ করে আমার বাচ্চাদের বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তবে নীতাকেও বাঁচাতে পারব। আমি বড়ো বড়ো শেঠের কাছে যাব। অনেক টাকা আনব।’

বাচ্চু হঠাৎ চামেলির মুখ চেপে ধরে, রাগে ওর শরীর জ্বলছে। বলে, ‘না। ওই পয়সাওয়ালা লোকদের ভোগের সামগ্রী হতে দেব না তোকে। এবার, যদি না পাই তবে ছিনিয়ে নেব। ওইসব বাড়ির মেয়েদের লাজলজ্জা আছে, আমাদের মা-বোনেদের নেই?’ চামেলির ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে পড়ল বাচ্চু। মাথাটা কেমন ঘুরছে, কান গরম।

দুদিন পর বাড়ি ফিরল বাচ্চু। নীতার অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। ঘরের এককোণে নেতিয়ে পড়ে আছে মেয়েটা। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। চারদিন কিছু খায়নি। পাড়ার ডাক্তার জীবেনবাবু কোনও বড়ো ডাক্তারকে দেখাতে বলেছেন।

‘এখন কী করবে করো।’ পিসিমা রাগে গজগজ করতে করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বাচ্চু নীতার মাথায় হাত দিল। জ্বরটা এখনও আছে। চোখের দু’ধারে শুকনো জলের দাগ। অচৈতন্যের মতো পড়ে আছে। কষ্টের ছাপ ওর মুখে।

বাচ্চু ডাকল, ‘নীতা’।

নীতা চোখ খুলে চেয়ে রইল।

‘খুব কষ্ট হচ্ছে না রে?’

নীতা কিছু বলল না।

‘একটু ফলের রস খাবি?’

নীতা মাথা নাড়ল।

‘একটু কিছু খেয়ে নে,’ মাথায় হাত বোলাল বাচ্চু।

‘ভীষণ কষ্ট হচ্ছে দাদা।’

‘কোথায় কষ্ট হচ্ছে বল।’

নীতা নিজের পেটের ওপর দৃষ্টি নামাল।

আবার বাচ্চু বলল, ‘খুব ব্যথা হচ্ছে নীতা?’

‘হ্যাঁ দাদা, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা দাদা তুই বাড়ি আসিস না কেন? আমার কথা তোর একটুও মনে পড়ে না?’

বাচ্চুর চোখ ফেটে জল এল। ওর পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘তোর জন্য বড়ো ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। অনেক টাকার দরকার তাই কাজ করি।’

‘তুই কত রোগা হয়ে গেছিস দাদা। আমার জন্য তোর কত পরিশ্রম।’

‘কথা বলিস না নীতা, ব্যথা বাড়বে।’

‘আমার একটুও ভালো লাগছে না দাদা, ব্যথাটা বাড়ছে। আমি মা-বাবার কাছে যাব। মা আমাকে কত ভালোবাসবে, আদর করবে। কত সুন্দর বই কিনে দেবে। আমি বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাব। কত মজা হবে।’

জ্বরের ঘোরে ভুল বকতে থাকে নীতা। পিসিমা ঘরে ঢুকে বলল, ‘ব্যথাটা বাড়ল বুঝি? কী যে হল। আমি একটু গরম তেল মালিশ করে দেখি।’

বাচ্চু হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। নীতার অসহ্য কষ্ট আর দেখতে পারছে না। সমস্ত শরীরের ভেতর ওর অক্ষমতার জন্য একটা যন্ত্রণা বয়ে গেল। নীতাকে বাঁচতেই হবে। ওকে এরকম ভাবে মরতে দেবে না বাচ্চু। যে করেই হোক টাকা চাই।

শেঠ বাজোরিয়ার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল বাচ্চু। গেটের দারোয়ান বাধা দিতেই বলল, ‘সাহেব ডেকেছে।’

আরও কয়েকবার বাচ্চু এবাড়িতে এসেছে। বাড়ির ভেতরে ঢুকেই চাকরকে বলল, ‘শেঠ সাহেবকে বল আমি এসেছি।’

চাকর ফিরে এসে জানাল, ‘সাহেব এখন বাইরে যাবে এখন দেখা হবে না।’ বাচ্চুর মাথায় তখন খুন চেপে গেছে। চাকরকে হাত দিয়ে সরিয়ে জোরে জোরে পা ফেলে সোজা বাজোরিয়ার বেডরুম-এ ঢুকল। শেঠ বাজোরিয়া তখন পোশাক বদলাচ্ছিল। ওকে দেখেই বলল, ‘তুই বেডরুম-এ কেন এলি?’

সারা শরীরে এক প্রচণ্ড হিংস্রতা ঘিরে আছে বাচ্চুর। বলল, ‘শেঠ আমার কিছু টাকার দরকার।’

‘রুপিয়া কি এমনিই আসে যে বললেই দিয়ে দেব!’

‘আমার বোনের খুব অসুখ শেঠ, কিছু টাকা দাও। হাতজোড় করছি।’

‘বোনের অসুখ তো আমি কী করব? যা না সরকারি হাসপাতালে।’

‘তোমার অনেক কাজ করেছি শেঠ, আমি আবার কাজ করে শোধ করে দেব।’

‘না তোকে আমার দরকার নেই। আমি তোর মতো কুত্তাকে আর ডাকব না। বেরিয়ে যা আমার ঘর থেকে।’

বাচ্চু আর থাকতে পারল না। মাথায় খুন চেপে গেছে। পকেট থেকে রামপুরী চাকুটা বার করল। তারপর চিৎকার করে উঠল, ‘টাকা আমার চাই।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুই বস আমি আসছি।’ বাজোরিয়া বারান্দায় রাখা টেলিফোন তুলে বলল, ‘হ্যালো লালবাজার আমি…’ আর বলা হল না। প্রচণ্ড শক্তিতে বাচ্চু তখন ওর গলা টিপে ধরেছে। একটা গোঙানি ভেসে এল বাজোরিয়ার মুখ দিয়ে। তারপর বাচ্চুর হাতের রামপুরী চাকুর আঘাতে লুটিয়ে পড়ল বাজোরিয়ার দেহ। বাজোরিয়ার দেহটা নিথর হয়ে যেতেই বাচ্চুর হুঁশ এল। এটা সে কি করল! লোকটাকে সে মেলে ফেলল! এতটা যে খুন চেপে যাবে ও আগেও ভাবেনি। কিন্তু আর এখন কিছু ভাবার নেই। দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে রুদ্ধশ্বাসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল বাচ্চু।

রাত অনেক হয়ে গেছে চারিদিক নিঃস্তব্ধ, রাস্তার কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে। শীতের রাত্রি লোক চলাচলও কম। বাচ্চু চামেলির ঘরের দরজার কড়া নাড়ল। চামেলি জেগেই ছিল। খুব সেজেছে আজ চামেলি। ভালো নাইলন শাড়ি, কপালে লাল টিপ। চামেলির স্বামী ঘরে নেই। মাল টেনে কোথাও পড়ে আছে বোধহয়, বাচ্চাগুলো এককোণে শুয়ে ঘুমুচ্ছে।

দরজা খুলেই চামেলি জিজ্ঞেস করল, ‘এত রাতে কী ব্যাপার?’

বাচ্চু বলল, ‘আমাকে একটু জল দাও চামেলি। অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি।’ বাচ্চু তখনও হাঁপাচ্ছে।

চামেলি বলল, ‘বসো আমি জল আনছি।’

জল খেয়ে বাচ্চু বলল, ‘আজকে একটা খারাপ কাজ করে ফেলেছি।’

‘আবার মারামারি করেছ? না তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না। তুমি না থাকলে নীতার কি হবে ভেবে দেখেছ একবার?’

চিৎকার করে উঠল বাচ্চু– ‘ওকথা বোলো না চামেলি। ওকথা বোলো না।’

তারপর চামেলির হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুমি না একদিন বলেছিলে– নীতাকে বাঁচাবে।’

‘হ্যাঁ বলেছিলাম।’

‘তবে তুমি ওকে বাঁচাও চামেলি। আমার একান্ত অনুরোধ, বলো তুমি রাখবে?’

‘হ্যাঁ, সেই ভেবেই তো…। এখুনি বাজোরিয়া শেঠের গাড়ি আসবে, আমাকে নিয়ে যাবে ওর বাগান বাড়িতে দিন সাতেক থাকতে হবে, কিন্তু অনেক টাকা দেবে, জানো!’

বাচ্চুর শিরা দুটো দবদব করছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। এখন সে কী করবে? কোথায় পালাবে। কিছু কূলকিনারা পাচ্ছে না।

বাজোরিয়ার নামটা যেন তার বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটছে। ওকেই তো কিছুক্ষণ আগে নিজের হাতে খুন করে এসেছে সে। ওতো আর কোনওদিন আসবে না চামেলিকে নিতে।

চামেলি পান খেতে খেতে বলল, ‘ও এখনও এল না লোকটা। টাকাটা পেয়ে নিই, তারপর দেখো আমি নীতাকে বাঁচাবই।’

বাচ্চুর মাথা ঘুরছে। এ কী করল সে! ওই টাকাও আর পাওয়া যাবে না। শুধু বাজোরিয়ার নয়, সে যে নীতারও প্রাণ নিয়ে ফেলেছে। সমস্ত পৃথিবী কাঁপছে। হাত মুঠি করে নিজের ভেতরের সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে সে বলল, ‘ওই শেঠ আর আসবে না চামেলি। আমি বাজোরিয়াকে খুন করে এসেছি নিজের হাতে।’ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বাচ্চু।

‘এ তুমি কি করলে বাচ্চুদা। আমি যে অনেক কষ্টে এ টাকার বন্দোবস্ত করেছিলাম।’

‘আর বোলো না চামেলি। আমি নিজের হাতে দুটো প্রাণ নষ্ট করে দিলাম, আমাকে তুমি ক্ষমা করো।’

রাত্রির মধ্যম যাম। অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে বসে থাকে। তারপর উদভ্রান্তের মতো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় বাচ্চু। বড়ো রাস্তা পেরোলে ওপারেই সরকারি হাসপাতাল। আরও একটু এগোলেই মোড়ের মাথায় থানা।

 

বেলাশেষের বাসনা

সত্যি, পাণ্ডুলিপিটা যে কোথায় গেল!

শুভায়ু বারবার চিন্তা করে। ওর চেন-আঁটা শান্তিনিকেতন ব্যাগটা তন্নতন্ন করে খোঁজে। সবমিলে পনেরোটা গল্পের পাণ্ডুলিপি ছিল একসঙ্গে।

সবগুলোই জেরক্স কপি। শুধুমাত্র একটাই হাতে লেখা… আর সেটাই হারিয়ে গেছে।

আসলে একটা ফাইল নেওয়া হয়নি সেটাই ভুল হয়ে গেছে। বড়ো একটা বাদামি রঙের প্যাকেট বা বড়ো খাম, তাতে ঠাসাঠাসি করে কাগজগুলি ছিল। প্যাকেটের মুখ একটা জেমস্ ক্লিপ দিয়ে আঁটা ছিল।

অথচ কী করে যে পড়ে গেল— আশ্চর্য!

শুভায়ুর একটা ইচ্ছা ছিল। বেশ পুরোনো ইচ্ছা। সেটা হল একটা গল্প সংকলন প্রকাশ করা। এটা ও অনেকদিন থেকে ভেবে আসছে।

শুভায়ু যে একজন নামকরা সাহিত্যিক, তা নয়। লেখক হিসেবে মফসসল শহরে দু-চারটে পত্রপত্রিকায় গল্প ছাপিয়ে আর আসরে এক-আধটা গল্প পাঠ করে যে বিরাট কিছু হওয়া যায় না— তা সে জানে।

তবে যাচ্ছ কেন বই ছাপাতে? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করে বসে শুভায়ু। আর উত্তরগুলো একইসঙ্গে আউড়ে যায়। আসলে ছড়ানো ছিটানো গল্পগুলোকে একত্রিত করে পাঁচজনের হাতে দেওয়া। আর এই লেখালেখির মধ্যে দিয়ে জীবনটাকে একটু কর্পূর সুবাসিত করা।

এছাড়া গতানুগতিক আটপৌরে জীবনে আর কী-ই বা করার আছে?

আরে— আসল কথাটাই বলতে ভুলেছে ও। সেটা হল ও’র অবসরপ্রাপ্ত জীবনে— জীবনবিমার সামান্য কিছু টাকা ম্যাচিওর করেছে। যেটাকে ও সংগোপনে বাড়ির খরচা থেকে খুব কৌশলে সরিয়ে রেখেছে। টাকার অঙ্কটাও সামান্য। ওই সংকলন বের করার মতোই— হাজার ষোলো টাকা। সেটাকেই ও ইদানীং ব্যাঙের আধুলির মতো সম্বল করে প্রকাশনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে পড়েছে।

এতক্ষণে শুভায়ুর মনে পড়ল – কাল ভোরে ও যখন সবকিছু গোছাচ্ছিল কলকাতা যাওয়ার প্রস্ততি হিসেবে, তখনই তৃষা মন্তব্য করেছিল, ‘দ্যাখো বাপু, সব ঠিকঠাক গোছগাছ করে নিলে তো? তোমার আবার রাস্তাঘাটে মাথার ঠিক থাকে না।’

কথাটা অবশ্য মিথ্যে বলেনি। সেদিন গোছগাছ করে ও হাওড়া লোকাল ধরেছিল… উদ্দেশ্য কলেজ স্ট্রিট-এ কোনও প্রকাশকের দ্বারস্থ হওয়া।

নতুন লেখকদের বেশিরভাগ বই-ই গ্যাঁটের পয়সা দিয়ে ছাপাতে হয়। এটাই প্রায় দস্তুর হয়ে গেছে। তবু কত রকমের বাহানা – ‘লেখাগুলোর জেরক্স কপি দিয়ে যান— পড়াব, এক্সপার্ট-দের দেখাব।’

শুভায়ু বলেছিল ‘টাকাটা তো আমার। তবে আপনাদের অতশত বাহানা বা খুঁতখুঁতানি কেন?’ প্রকাশকের গদিতে বসে ওর ছোটো ছেলে — যে সবেমাত্র গ্র্যাজুয়েশন করেছে, সে বিজ্ঞের মতো উত্তর করে, ‘খুঁতখুঁত করি কি সাধে? মালটা তো আমাদের ব্যানার-এ বেরোচ্ছে। আমাদের গুডউইল ওর সঙ্গে জড়িত থাকছে যে। তাই আমাদের একটু মাথা ঘামাতে হয় বই-কি!’

শুভায়ু মনে মনে বলে তোমাদের আবার গুডউইল বলে কিছু আছে নাকি? পয়সা— আসলে পয়সা হলেই হল। বড়ো বড়ো প্রকাশকরা পর্যন্ত নামিদামি লেখকদের সঙ্গে দু’চারটে অনামি লেখককেও এক আসনে বসাচ্ছে।

যাকগে ওসব কথা। ওর সব লেখাগুলোই রয়েছে কেবল শেষেরটা নেই— তার কোনও কপিও নেই— । বেশ ঝঞ্ঝাট হল বই-কি!

কী ব্যাপার তবে কি ফেরার পথে ট্রেনেই মিস করল? ওই ‘বাসনা বিসর্পিল নদী’ গল্পটাই হারিয়ে গেছে…

বড়ো টেন্সড ফিল করে শুভায়ু। গুনে গুনে লেখাগুলো নিয়ে গেল অথচ…

আচ্ছা প্রকাশককে ফোন করে জানলে হয় না? যদি সেখানে পড়ে থেকে থাকে—।

ব্যাপারটা প্রায় সপ্তাহখানেক হয়ে গেল আর নিশ্চয়ই ফেরত পাওয়া যাবে না। ওটা তাহলে গেল? ওই বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা যেতে পারে কিন্তু তেমনটি হবে কি?

এরই মাঝে তৃষা মন্তব্য করে, ‘অত মনমরা হলে চলবে! আবার নতুন করে লিখতে কি তোমার গায়ে জ্বর আসছে নাকি?’

শুভায়ু বলে, ‘থামো তো তুমি! হাজার হোক লেখা তো আমার সৃষ্টি। লেখা খোয়া গেলে শোক হতেই পারে। লেখা হচ্ছে আত্মজ। সন্তানের মতো… ও সব তুমি বুঝবে না!’

তৃষা উত্তর করে, ‘কী জানি ওসব বাতিক আমার নেই—তাই বুঝি না।’

এবার শুভায়ু রেগে যায়— ‘যা বোঝো না তা নিয়ে তক্বো কোরো না চুপ থাকো!’

পরের শনিবার আবার কলেজ স্ট্রিট যেতে হয়েছিল। প্রকাশক বললেন— ‘নাহ এখানে কোনও পাণ্ডুলিপি ফেলে যাননি। কী আশ্চর্য কোথায় গেল!’

ফেরার পথে বাস থেকে তাড়াতাড়ি নেমে— সাবওয়ের মুখে পৌঁছল। কিন্তু হঠাৎ একি দেখছে ও! সামনের মেয়েটি অমন করে তাকাচ্ছে কেন? একদম কাছাকাছি এসেই মেয়েটি থমকে যায়।

‘স্যার একটু দাঁড়াবেন…’ শুভায়ু থমকে যায়।

‘মনে করতে পারেন স্যার? চিনতে পারেন…’ তারপর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে।

শুভায়ু হকচকিয়ে যায়। প্রশ্ন করে, ‘কে তুমি?’

‘স্যার আমি শ্রাবণী। আপনার ছাত্রী ছিলাম দেউলগ্রাম হাইস্কুলে। আর আপনার সঙ্গে ছিটেফোঁটা আত্মীয়তাও ছিল। আপনার মা বীণাপানি দেবী আমার দূর সম্পর্কের মাসি… আপনি কেমন আছেন?’

শুভায়ু লেন্স-এর ফাঁকে ওকে ভালো করে দেখে।

‘ভালো আছি… ওহ্ সেই শ্রাবণী!… কোথায় চলেছ? আমি কিন্তু বর্ধমান যাব।’

‘হ্যাঁ… দাদা। মানে স্যার…’

‘অত ইতস্তত করছ কেন? আমাকে দাদা বলেই ডেকো… তুমি তো বেশ বড়ো হয়ে গেছ। দেউলগ্রাম স্কুলের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থিনী হিসাবে শেষ দেখেছিলাম কিন্তু তোমার সেই চেহারা একদম ভেঙে গেছে… আমি তো চিনিয়ে না দিলে ধরতেই পারতাম না। তারপর সব কেমন আছ? কী করছ? তোমার সেই ভাই সুপ্রকাশ কী করে?’

শ্রাবণী মাথা চুলকোয়।

‘বাব্বা! আপনার সব মনে আছে দেখছি— খবর ভালোই… আমি তো বড়ো… আমার পরে সুপ্রকাশ। আমি অনার্স পাশ করে ট্রেনিং নিয়ে বসে আছি… এমএসসি দিচ্ছি। ভাইও বেকার, ইন্টারভিউ দিচ্ছে। বাবার সেই প্রাইভেট ফিন্যান্স কোম্পানি উঠে গেছে। স্টাফ-দের কিছু কিছু পয়সা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।’

একটু থেমে আবার শুরু করে…

‘কিন্তু দাদা সত্যি বলতে কী, বেশ দুর্দিন যাচ্ছে আমাদের। সে কথা আপনাকে লুকিয়ে লাভ নেই… বরং চলুন না কর্ড লাইনে এই সামনেই বেলানগরে নেমে শিউলিবাগান কলোনি। যাবেন দাদা? বাবা আপনাকে দেখলে খুশি হবেন। আর দেউলগ্রামের লোকজন তো আসে না। তার কারণও আছে, গেলে সবকিছু জানবেন।’

একটু যেন বিমনা হয়ে যায় শুভায়ু।

‘চলুন না দাদা— অসুবিধে হবে না।’ অনুরোধটা বারবার আসতে থাকাতে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে ও—

‘কিন্তু আমার তো রিটার্ন কাটা আছে।’

শ্রাবণী বেশ গুছিয়ে বলতে থাকে। ‘টিকিটটা সামান্য, তবে যদি বাড়িতে অসুবিধে থাকে, বউদি চিন্তাভাবনা করে— সে কথা আলাদা।’

হঠাৎই শুভায়ু মনস্থির করে ফেলে।

‘চলো তাই যাই… তোমাদের আস্তানাটা চিনে আসি, কলকাতা আসা যাওয়ার পথে কাজে লাগবে। বুথ থেকে বাড়িতে জানিয়ে দিলেই চলবে।’

‘ভালোই হল কাল তো রবিবার, সকালেই ফেরার তাড়া নেই।’

ট্রেনে চড়ে সামান্য রাস্তা। যাত্রাপথে নানান চিন্তা… এসে পড়ে।

লেখাটা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে কেমন খচখচ করে মনটা। গল্পটার নায়িকা ছিল অতসী… ভ্যান চালাত সুবলসখা। তার সঙ্গে অতসীর ঘনিষ্ঠতা… শেষে বাড়ির অমতে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হয়। মা-বাবা ক্ষুণ্ণ হয়, সুবল-রা অন্য জাত। অতসীদের তুলনায় ওদের বাড়ির অবস্থা তেমন ভালো নয়।

এরমধ্যে অতসীর মা মারা যেতে বাড়ির একটা ছন্নছাড়া হাল হয়ে যায়। মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে স্ত্রীহারা হয়ে বাবা বেশ ভেঙে পড়ে। অতসী তার স্বামীকে বারবার কাছে এসে থাকতে বলে। ওরা একদিন এসেও যায়। কিন্তু পরস্থিতি ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করে। এক প্রত্যুষে ওদের খামারবাড়ি থেকে সাদা পোশাকে এক নারী মূর্তিকে ওরা বের হতে দেখে… তবে কি ওটা ওর মার অশরীরী আত্মা?

শেষ পর্যন্ত রহস্যের কিনারা হয়। আত্মা আর অশরীরী থাকে না, তার শরীরী রূপ ধরা পড়ে। সে অতসীর ছোটো মাসি… অল্প বয়সে বিধবা হয়ে পাশের গ্রামে বাপের বাড়িতে থাকত। সে ছুটে আসে কীসের টানে। সেও এক বাসনার শিকার। বাসনার এক বিসর্পিল নদী ওকে টানে।

যাক এটা শুধুমাত্র কাঠামোটা…।

রক্তমাংসের গল্পটা তো নেই। শুভায়ু কী করে শুধু মুখের কথায় বাসনার বিসর্পিল রূপটা বিশ্বাস্য করে তুলবে…!

স্টেশন থেকে শিউলিবাগান কলোনি সামান্যই রাস্তা। সেখানে শ্রাবণীদের একতলা ঘর— মাত্র দুটো কুঠরি। ছাদের সিঁড়ি, চিলেকোঠা। সুপ্রকাশ কম্পিউটার ট্রেনিং নিচ্ছে, রাতে বিকম পড়ে।

ওদের বাবা সরকারবাবু কথা শুরু করেন।

‘তাহলে শুভবাবু আমাকে চিনতে পারছেন তো… দেউল গ্রামে থাকতে মাত্র একবারই গিয়েছিলেন আমাদের বাড়ি… সে তো আটবছর আগে।’

শুভায়ু তাকিয়ে দেখে সরকারবাবুর দোহারা চেহারা সামনের দিকে কিছু পাকা চুল, কেমন যেন পোড়খাওয়া।

‘আরে দেখুন না শ্রাবণী ধরে নিয়ে এল। আর আমাকে নতুন জায়গা দেখার নেশায় কেমন যেন পেয়ে বসল।’

সরকারবাবু বলেন, ‘আরে মশাই এসে অন্যায় কিছু করেননি।’

‘অন্যায় আর কী, এসেছি এই বোনটির টানে। সত্যি শ্রাবণী মেয়েটি বড়োই ভালো। আর মেশোমশাই আমাকে আর ‘আপনি’ সম্বোধনে লজ্জা দেবেন না। আমি তো আর এখন দেউল গ্রামের প্রধান শিক্ষক পদে নেই… তাছাড়া আপনি বয়সে বড়োই হবেন।’

‘তাই হবে বাবা! শ্রাবণী মাঝেমধ্যে এখনও তোমার কথা বলে। ওই তো সবকিছু দেখাশোনা করে, ঘরের কাজ বাইরের কাজ সামলায়। ওরাই তো ভাই-বোনে ঠেলা গোঁজা দিয়ে চালাচ্ছে সংসারটাকে। নিজেরা পড়ছে, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াচ্ছে। আমি তো যেটুকু ছাঁটাইয়ের আগে পেলাম সেটা— সেই সঙ্গে কিছু দেনা করে মাথা গোঁজার জায়গাটুকু করতে পেরেছি।’

সুবর্ণা মাসি মানে শ্রাবণীর মা’র প্রসঙ্গ উঠতে সবাই মুখে তালা এঁটে দিল। কেউ কোনও কথা বলে না।

একটা থমথমে গুমোট ভাব হঠাৎ যবনিকাপতনের মতো ঝুলে রইল…

শেষে শ্রাবণী নীরবতা ভঙ্গ করল। ‘দাদা খাওয়াদাওয়া হোক, তারপর রাতে ধীরেসুস্থে সব কথা বলব। না বললে আমাদের চলবে না। আর আপনিও ঠিক বুঝবেন না। এই বলে আশ্বস্ত করল শুভায়ুকে।

সুবর্ণা মাসির সঙ্গে শুভায়ু’র মা’র একটা দূর সম্পর্কের আত্মীয়তা ছিল। খানিকটা লতায়-পাতায় গোছের। শুভায়ু সেটা সঠিক বুঝত না। থাক সে কথা।

রাতে শ্রাবণীর কথা শুরু হল।

‘দাদা! আপনাকে সবকথা খুলে বলতে আমার লজ্জা ছাড়াও— কেমন একটা তিক্ত বিস্বাদ ভাব এসে যাচ্ছে। কথা বলতে যাচ্ছি, না আকাশে থুতু ছুড়তে যাচ্ছি, সেটাই ভাববার বিষয়। মাকে নিয়ে কথা বলা বা মা’র কেচ্ছা আলোচনা করা সন্তানের পক্ষে কতখানি নির্লজ্জতার নজির তা নিশ্চয়ই উল্লেখের দরকার নেই। একজনের ভুলের মাশুল গুনছে গোটা সংসার…। সমস্ত সংসারটাতে যেন অলক্ষ্মীর ছায়া। বাবা এখন আমাদের অভিভাবক, আমাদের ভরসা স্থল। তাঁর মুখের দিকে তাকানো যায় না। কে যেন কালি লেপে দিয়েছে। তবু ভালো শিউলিবাগান কলোনির লোকজন সব কিছু স্পষ্ট করে জানে না। কারণ ঘটনাটা এখানে ঘটেনি।’

একটু থেমে আবার বলতে থাকে শ্রাবণী, আমরা তখন ডানলপের দিকে ভাড়া ছিলাম। নতুন বাড়িতে শিফট করার পর মা’র সম্পর্কে সবরকম কৌতূহল মেটাতে তৎপর হলাম। মা’র একটা পুরোনো নেগেটিভ-কে কায়দা করে এনলার্জ করা হল— সেটাকেই বাঁধিয়ে ফুলের মালা দিয়ে দেয়ালে টাঙানো হল। বলা হল— সুদূর দেশের বাড়িতে মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন আর সেখানেই মারা যান। এখানকার লোক আমাদের সম্পর্কে তত উৎসাহী নয় যে বাঁকুড়ার দেউল গ্রামের খবর নিতে যাবে। সবচেয়ে বড়ো কথা হল কলকাতার শহরতলিতে ছাপোষা এক সরকারবাবুর স্ত্রী আদৌ মারা গেছেন কিনা, সে নিয়ে গবেষণা করতে কারও বয়ে গেছে। তাদের ভাববার জন্য বহু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে।’

শুভায়ু মাঝখানে শ্রাবণীকে থামিয়ে দেয়।

‘শ্রাবণী, আমার কাছে ব্যাপারটা ধোঁয়াশা হয়ে রইল। আচ্ছা বলো তো, সুবর্ণা মাসি কোথায় চলে গেলেন? সঙ্গে কে ছিলেন?’

শ্রাবণী দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছু বিরতির পর কথা বলতে থাকে।

‘শুভদাদা! কিছু মনে করবেন না… আমি এতখানি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি যে কথাসূত্রর ঠিকঠিক সঙ্গতি রাখতে পারছি না। তাই কোথায় এ কাহিনি শুরু করতে হবে তাই ভুলে বসে আছি। আমাদের দুঃখকষ্ট, মনের জ্বালাযন্ত্রণা আজ পর্যন্ত কাউকে স্পষ্টভাবে বলতেই পারলাম না। আসলে সেরকম পারিবারিক বন্ধুই পেলাম না – যার কাছে নিজেদের কথা বলে হালকা হতে পারি। আপনাকে টেনে এনেছি মনের কথা শোনাব বলে। এবার শুনুন –

মা’র বাপের বাড়ির অবস্থা যাইহোক, ওঁর মধ্যে একটা বিলাসী সুখস্বপ্নে বিভোর সত্তা ছিল। আমার জন্মের পর থেকেই নানানভাবে আঘাত পেতে থাকেন। বাবা সামান্য চাকরি করতেন প্রাইভেট ফিন্যান্স কোম্পানি-তে। তাও সেটা বড়ো প্রতিষ্ঠান ছিল না। মায়ের মতো সুন্দরী একটা মেয়ের এমন একটা দৈন্যপীড়িত সংসারে কেন যে বিয়ে হল – সেটাই বিরাট রহস্য। যাক ওসব প্রসঙ্গ। তবু মাকে সুখস্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার জন্য বাবার নিরন্তর চেষ্টার অন্ত ছিল না। কিন্তু মা’র কাছে, এই সংসার… ভাড়া বাড়ি… বাবার আর্থিক টানাটানিগুলো বড়োই ঘৃণা ও বিরক্তির বিষয় ছিল…।

‘আমরা কত কষ্ট করেছি পড়াশোনা করতে গিয়ে। অন্যের বাড়ি থেকে নোটবই চেয়ে এনেছি, রাত জেগে নোটকপি কিংবা ছুটোছুটি করে অথবা জেরক্স সংগ্রহ করে বহু কষ্ট স্বীকার করে লেখাপড়া করেছি। মা’র কাছে এসব মূল্যহীন ছিল! মা-কে বলতে শুনেছি, জানো বইপত্র কিনতে হয়, ওরকম চেয়েমেগে বিরাট কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখে লাভ নেই।

সে তো অনেক পয়সার দরকার— আমার উত্তর। মা ভ্রূকুটি করে হেসেছে – হ্যাঁ টাকাপয়সার দরকার বই-কি! আর বেশি দাম দিয়ে সেই বই কেনার মতো স্বচ্ছলতা বা সামর্থ্য আমাদের নেই। স্বচ্ছলতা আনতে যে যোগ্যতা দরকার তা তোমার বাবার নেই।

ছলেবলে কৌশলে যেভাবেই হোক বাবার আর্থিক দৈন্যকে ব্যঙ্গ করাই মার লক্ষ্য ছিল।

– কী বলছ তুমি! তুমি তো সবই জানো বাবার অবস্থা।

– জানি বই-কি। আর এও জানি তোমার বাবা নানা অজুহাত যাই দেখান, তিনি আর্থিক সাফল্যের পরীক্ষায় অকৃতকার্য বলেই প্রতিপন্ন।

শ্রাবণী বড়োই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে এ ক’টি কথা বলতে পারল।

আমার মা’র কথাবার্তা শুনলে মনে হতো, মার ভাগ্যে এক সচ্ছল সুন্দর গোছালো সংসার অপেক্ষা করছিল, আমার বাবা হঠাৎ তাঁর জীবনে এসে পড়ে সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে।

আমি মাঝে মাঝে অনুমান করতে চেষ্টা করতাম – মায়ের সেই ঈপ্সিত পুরুষ কি সুরঞ্জন মামা? কে জানে!

তবে সুরঞ্জন সান্যালকে দু’একবার এ বাড়িতে আসতে দেখেছি। ছোটোবেলায় তাঁর দেওয়া মুঠোমুঠো টফি আমরা ভাইবোনে ভাগ করে খেয়েছি। শুনেছি মা’র মামার বাড়ির দেশে ওঁর বাড়ি ছিল। মানুষ হয়েছিলেন উত্তরবঙ্গের কোথায় যেন! প্রথম যখন আমাদের বাড়ি আসেন তখন উনি বেকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ধাপ পার হয়ে স্কুল-কলেজে চাকরির ধান্দায় ঘুরছেন। বিষ্ণুপুরের কাছে একটা কলেজে সাক্ষাৎকারে এসে হঠাৎই মা’র সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আমার বাবা শিবতোষ সরকারকে বলেন, শিব জামাইবাবু, এদিকে একটা চাকরি পেলে দিব্যি থেকে যাব। সুবর্ণার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যাবে…

চাকরি পাওয়ার পর ছুটিছাটায় দেউল গ্রামের বাড়িতে এসেছেন সুরঞ্জন মামা। দু’চারদিন বেশ হইচই করেছেন। আমাদের সঙ্গে হালকা হাসিমস্করা হুটোপাটি করেছেন, এসব বেশ মনে পড়ে। আমাকে খুবই আদর করতেন। মা-কে বলতেন সুবর্ণা! তোমার এই মেয়েটাকে ভালোভাবে লেখাপড়া শিখিও, বেশ বুদ্ধিমতী হবে। ওর দৌড়ঝাঁপ দেখে মনে হয় স্পোর্টস-এ বেশ ভালো করবে। ওর কোন নামটা ফাইনাল করলে, শ্রাবণী?

শুনে মা’র মুখে হাসির ছ’টা। মা বলেই ফেলল, আর সব নাম তো চাপা পড়ে গেল। তোমার দেওয়া ওই নামটাই রীতিমতো চালু হয়ে গেল দেখছি। কার দেওয়া নাম দেখতে হবে তো?

মা’র মুখে সুরঞ্জন মামার নাম তখন সব সময় শোনা যেত, প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

এমনিতর একটা প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি। বাঁকুড়া জেলার একটা সামান্য কলেজে চাকরি করছে। সেটাই মা’র আপশোশের কারণ। অবশ্য তখন সোনামুখি কলেজ ছোট্ট কলেজই ছিল…

দেউল গ্রামের দিনগুলি এমনিভাবেই পার হচ্ছিল। মাসে অন্তত একবার সুরঞ্জন মামা এসে যেতেন। জুলজি বোটানি-র লোক যে কবি-শিল্পী মনের হতে পারে, আমার ধারণা ছিল না।

একবার দ্বারকেশ্বর নদীর পাড়ে শীতের সময় আমরা ‘পৌষলা’ করেছিলাম। তখন আমি সবে মাধ্যমিক পাশ করেছি। তখন সুরঞ্জন মামার ভরাট গলায় শুনেছি রবীন্দ্রসংগীত – ‘যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ… আসিতে তোমার দ্বারে…’

মা-ও ভালো গাইত, একটু চাপা গলায় গেয়েছিল—‘যখন প্রথম ধরেছে কলি আমার মল্লিকা বনে…’

তখন ভালো বুঝতাম না। মনে হতো কেমন একটা কুয়াশা ঘেরা অন্ধকার, তারই মধ্য দিয়ে আমাদের সংসারটা চলেছে।

এইচএস পড়ার সময় থেকে আমার মনে হল— কোথায় যেন একটা অন্য স্রোত বইছে। চোরাস্রোত ফল্গুধারার মতো। সে ছুটে চলেছে হয়তো বা কোনও অজানা সর্বনাশা পথে। সুপ্রকাশ-এর চোখ ছেলেদের চোখ আর তরুণের চোখ। ওর তখন বয়স অল্প। ও ঠিক ধরতে পারেনি। ধোঁয়াটে হলেও আমি অনেকটা বুঝতাম। দেখতাম, সুরঞ্জন মামা এলে মা’র চোখে একটা খুশি চিকচিক করে উঠত।

ওদিকে বাবা, সুরঞ্জন মামা সম্পর্কে কোনও না কোনও মন্তব্য করলেই মা রেগে যেত।

একদিন বাবা বললেন, সে কি সুবর্ণা তুমি ওঁর সঙ্গে সোনামুখি যাবে?

– কেন তোমার আপত্তি আছে?

– না মানে সুরঞ্জনবাবু মেসে থাকেন তাই বলছিলাম।

মা ব্যঙ্গ হাসি হেসেছে, তুমি তো অমনি বলবে জানতাম। ওদের অধ্যক্ষ ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন। আমি সেখানে থাকব। এখন সুরঞ্জনদা ওখানকার ভাইস প্রিন্সিপাল জানো তো!

বাবা চুপ করে যেতেন বাধ্য হয়ে। মা বলেছিল, দুটো দিন রান্নাবান্না শ্রাবণীই সামলে নিতে পারবে।

কলেজে সুরঞ্জন মামার নামডাক ছিল। ওঁর দু’চারটে বই ডিগ্রি কোর্স-এ চালু ছিল। এরপর বেশ কিছুদিন সুরঞ্জন মামা আর আসছিলেন না। দেউল গ্রামে যে ঢিঢি পড়ে গেছিল শিবতোষ সরকারের স্ত্রীকে কেন্দ্র করে, তা কিছুটা স্থিমিত হয়ে গিয়েছিল।

ইতিমধ্যে বাবাকে সঞ্চয়ন ফিন্যান্স বদলি করল হাওড়ার দিকে। বাবা সবকিছু গুটিয়ে ডানলপের দিকে চলে গেলেন। সেখানে নানান টানাটানির মধ্যে দিয়ে সুপ্রকাশ আর আমার পড়াশোনা চলতে থাকে।

শেষের ঘটনাটা ঘটল বছর দুই আগে। ইতিমধ্যে মা’র নামে চিঠিপত্র আসত, কিন্তু সুরঞ্জন মামা আর আসেননি। মাঝ্যেমধে মা’র মুখটা দেখতাম বেশ থমথমে। মাঝে মাঝে ভীষণ রেগে যেত বেশি প্রশ্ন করলে।

– চালাও তোমাদের সংসার, আমি আর পারছি না। শুধু নাই নাই রব। এত অভাব আর দেখতে পারছি না। আমারই কপাল দোষে জুটেছে ক’টা দুষ্টগ্রহ।

শুভদা। এরপর গল্প শেষ হয়ে আসছে। আমরা ঘটনায় যাচ্ছি। একদিন ভোরে বাবা উঠেছেন। অনেক খোঁজাখুজি করে মাকে কোথাও দেখা গেল না। আমি, ভাই অনেক খুঁজলাম। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বাবা একদিন সুপ্রকাশকে সোনামুখি পাঠালেন। পরের দিন সুপ্রকাশ খবর আনল, সুরঞ্জন সান্যাল প্রায় ছ’মাস আগে সোনামুখি ছেড়ে অসমের দিকে কোনও কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দিয়েছেন।

এরপর থেকে আমরা তিনজন সমানে লড়াই করে যাচ্ছি। ভাঙা হাল ছেঁড়া পাল তবুও…’

শুভায়ু শ্রাবণীর পিঠে হাত দিয়ে বলে ‘সোজা হয়ে হাঁটবে— এতটুকু ভেঙে পড়বে না। ভয় কী? তোমরা তো কিছু অন্যায় করোনি। শুধু ফটোতে নয় বাস্তবে সুবর্ণা মাসি মৃত বই-কি! অন্তত তোমাদের কাছে। শক্ত হও, তোমার কাছ থেকেই তো সুপ্রকাশ জীবন সংগ্রামের ভাষা আয়ত্ব করবে।’

অনেক দেরিতে শুভায়ু কিছুক্ষণের জন্য বিছানায় গড়াতে যায়। আর মনে মনে ভাবে ‘বাসনা বিসর্পিল নদী’র পাণ্ডুলিপিটা হারিয়েছে বটে কিন্তু গল্পটা তো হারিয়ে যায়নি।

 

বন্ধন

ভোলা, এক কাপ চা দিয়ে যা বাবা’। কথাগুলো বলেই প্রশান্ত আরামকেদারায় দেহ এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। মিনিট দশেক আগেই অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে।

সামনেই মেয়ের বিয়ে। একা একটা মানুষের পক্ষে সবদিক সামলানো প্রায় যুদ্ধেরই সমান। খুঁটিনাটি সব বিষয়েই বাড়তি খেয়াল রাখতে হয়। অন্যথায় একটু এদিক-ওদিক হলেই মেয়েকে সারাজীবন কথা শুনতে হবে। একদিকে বিয়ের পর মেয়ের অন্যত্র চলে যাওয়ার কথা ভেবেই মরমে মরছে প্রশান্ত। তার উপর তার জীবনে এক মর্মস্পর্শী ঘটনা তো রয়েছেই। যার সমাধান করার জন্য অনুতপ্ত প্রশান্ত মেয়ের বিয়ের এই সময়টাকেই বেছে নিয়েছিল।

‘বাবু চা’, ভোলার আওয়াজ শুনে প্রশান্ত চোখ খোলে।

‘হ্যাঁরে বউদিমণি আসেনি এখনও?’ চায়ের কাপ নিতে নিতে প্রশান্ত, ভোলাকে জিজ্ঞাসা করে।

‘না বাবু। বলেই গেছেন, দেরি করে ফিরবেন।’

‘আর প্রমিত, রশ্মি কোথায়?’

‘দিদি মনে হয় বন্ধুদের সঙ্গে পার্লারে গেছে। আর দাদা কী যেন একটা কাজের জন্য বেরোল।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে তুই যা।’

 

ভোলা এবাড়ির কাজের লোক। দীর্ঘদিন ধরে এবাড়িতে কাজ করে। প্রায় কুড়ি-একুশ বছর ধরে। বাড়ি গোসাবায়। বিয়ে-থা করেনি। সংসারে কেউ না থাকায় পাকাপাকিভাবে এখানেই থেকে গেছে। এবাড়ির সংসারের যাবতীয় সে-ই দেখাশোনা করে।

সংসারে মানুষ বলতে ছটা প্রাণী। প্রশান্ত, প্রশান্তের স্ত্রী রিমা, ছেলে প্রমিত, মেয়ে রশ্মি। আর প্রশান্তের মা উমাদেবী। সাত বছর হল বাবা কমলাপ্রসাদ গত হয়েছেন। এছাড়া সংসারের সর্বময় কর্তা ভোলা তো রয়েছেই।

ভোলা ছাড়া এই সংসার অন্ধকার। বিগত কুড়ি বছরে রিমা যে কতবার হেঁশেলে ঢুকেছে তা হাতে গুনে বলা সম্ভব। যতদিন উমাদেবী সুস্থ ছিলেন ততদিন তিনি মাঝেমধ্যেই ছেলে, নাতি-নাতনির পছন্দের খাবার বানাতেন। কিন্তু এখন আর পেরে ওঠেন না। আর বউমা রিমাও পছন্দ করে না যে বাড়ির কাজের লোক থাকতে শাশুড়ি রান্না করুক। এতে তার স্টেটাস মেনটেন হবে না। এবাড়িতে পয়সা-কড়ি থেকে শুরু করে একে-অপরের প্রতি ভালোবাসা অঢেল কিন্তু তবু কোথাও যেন, কিছু একটা ফাঁক থেকে গেছে।

কড়া চা বরাবরই প্রশান্তর পছন্দের। চায়ে চুমুক দিতে দিতে প্রশান্ত বলে ওঠে, ‘মাথাটা ছাড়ানোর জন্য এটা একেবারে পারফেক্ট রে। তোর হাতে সত্যিই জাদু আছে রে। আচ্ছা তোকে যে যেতে বললাম, যাচ্ছিস না কেন? কী অভিপ্রায়ে দাঁড়িয়ে আছিস বলতো? কিছু বলবি?’

‘আজ্ঞে বাবু, বলছি একটু জলখাবার বানিয়ে দেব?’

‘না রে আজ আর ভালো লাগছে না। তুই যা, আমি একটু রেস্ট নিই।’ বলে কাপটা টেবিলের উপর রেখে দিয়ে আবার আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে আগের মতোই চোখ বন্ধ করে নেয় প্রশান্ত। কিন্তু তার অস্থির মন ছুটে চলে পুরোনো স্মৃতি রোমন্থনে, যেটা সে এতদিন খনিকটা সংসারের চাপে খানিকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুলে থেকেছে। এটা তখনকার ঘটনা যখন সে ধাপে ধাপে কেরিয়ারের শিখরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে একের পর এক সফলতা অর্থনৈতিক দিক থেকে তাকে আরও সুদৃঢ় হতে সাহায্য করছে।

পরিবারে দুই বোন আর চার ভাইয়ের মধ্যে সবথেকে বড়ো ভাইয়ের একমাত্র সন্তান সে। যার কারণে পরিবারে অন্যান্য ভাইবোনদের থেকে তার আদর অনেকটাই বেশি। তার উপরে পড়াশোনায় খুব ভালো হওয়ায় পরিবারের সকলেরই নয়নের মণি।

চার ভাই আর দুই বোনের মধ্যে দারুণ ভাব। সবাই যেন একে অপরের জন্য বেঁচে থাকে। সত্যিই উদাহরণ দেওয়ার মতো একটি আদর্শ পরিবার। সম্পর্কের গুরুত্ব, বড়োদের সম্মান, আদর, ছোটোদের শ্রদ্ধা ভালোবাসা সবকিছুই যেন পরিবারটির আবহাওয়ায় ওতপ্রোত ভাবে মিশে ছিল। চার জায়ের মধ্যেও ছিল অসম্ভব মিল, সেই কারণেই বাড়ির ছোটোদেরও আর আলাদা করে কিছুই শেখাতে হয়নি। বাড়ির বড়োদের একে-অপরের প্রতি ভালোবাসা দেখেই তাদের খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো ভাইবোনেদের মধ্যেও পারস্পরিক ভালোবাসার বীজবপন হয়ে গিয়েছিল।

যেখানে দুই ভাইয়ের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা মুশকিল, সেখানে এত বড়ো একটি পরিবারের এমন সুমধুর সম্পর্ক। কীভাবে সম্ভব? পাড়াপড়শিদের কাছে এটাই প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কর্মসূত্রে সকলেই সকলের থেকে দূরে থাকে, অথচ কারওর জন্মদিন, পুজোপার্ব্বন, বিবাহবার্ষিকী, অসুখ-বিসুখ এমনকী ছোটো থেকে ছোটো ব্যাপারেও একত্রিত হতো তারা। এছাড়া নিয়ম করে একে-অপরের খোঁজখবর নেওয়া, একে-অপরের বাড়ি যাওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

প্রশান্তর মেধা আর বুদ্ধির কারণে সবার ধারণা ছিলই যে বড়ো হয়ে সে পরিবারের নাম উজ্জ্বল করবেই। ঠিক সেইমতোই যখন সে আইআইটি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তখন বাড়িতে প্রায় উৎসবের আমেজ। পুরো পরিবার পিসি, কাকা-কাকি, ভাই-বোন একত্রে সকলের হইহুল্লোড়, কলরব। তার উপর কথায় কথায় ভাই-বোনেদের উদ্দ্যেশে বাড়ির বড়োদের উপদেশ–‘দাদার মতো হয়ে দেখাও’–এসব প্রশান্তর বেশ ভালোই লাগত। প্রথমবার তার দাড়ি রাখা, প্রথমবার সুট পরা, প্রথমবার গাড়ি কেনা–তার সমস্ত কিছুই পরিবারের সকলের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, এতটাই সে সকলের হৃদয়ের কাছে।

আইআইটি পাশ করার পর প্রশান্ত বছরদেড়েক প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করার পর তার প্রাইভেট কোম্পানির প্রতি আস্থাই উঠে যায়। অথচ বেশ উঁচু পোস্টেই মোটা মাইনের চাকরিই করত সে। কিন্তু তবু না জানি কেন তার মাথায় ভূত চাপল যে সে আর প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করবে না। তাই হঠাৎই একদিন চাকরি ছেড়ে দিল। ঠিক করল সরকারি কোনও প্রশাসনিক পদের জন্য আলাদা করে কোনও কোচিং-এ ভর্তি হবে। সেই অনুযায়ী আইএএস পরীক্ষার জন্য শুধু কোচিং-এই নয় কঠিন অধ্যাবসায়ও শুরু করেছিল সে।

এত ভালো একটা চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারটা প্রশান্তর মা-বাবা প্রথমে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। কিন্তু বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের সহায়তায় সে সমস্যাও দূর হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির অন্যান্যদের মতো তারাও বুঝেছিল যে প্রশান্তের মতো ব্রিলিয়ান্ট, ট্যালেন্টেড ছেলেকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। তার অধ্যাবসায়ই তাকে তার যথোপযুক্ত স্থানে পেৌঁছে দেবে। প্রথমবারের পরীক্ষাতেই আইএএস-এর জন্য নির্বাচিত হল প্রশান্ত। পুরো বাড়িতে উৎসবের সমারোহ বেধে গেল। কাকা-কাকি, পিসি, ভাই-বোন সব মিলে একেবারে চাঁদের হাট। যেন বড়দার ছেলে নয়, তাদের ছেলেরাই আইএএস অফিসার হয়েছে। গর্বে তাদের বুক ভরে গেল।

ছেলে বড়ো হয়েছে, আর্থিক দিক থেকেও সে যথেষ্ট স্টেবল। সুতরাং এবার তার বিয়ে দেওয়ার সময় এসে গেছে। ঠিক সেইমতো ঘটা করে পাত্রী দেখারও কাজ শুরু করে দেয় বাড়ির বড়োরা। পাত্র সরকারি আইএএস অফিসার বলে কথা, তার উপযুক্ত পাত্রী খোঁজা তো আর চারটিখানি কথা নয়। প্রায় খান সাতেক মেয়ে দেখার পর অবশেষে রিমাকে পছন্দ হয় তাদের। বরানগরের মজুমদারবাড়ির একমাত্র কন্যা সে। পিএইচডি কমপ্লিট করে তখন সে কলেজের অধ্যাপনা করে। দেখতেও একেবারে ডানাকাটা পরির মতো। প্রশান্তরও এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে যায় তাকে। তাই প্রশান্তও এই বিয়ে অমত করেনি।

মাসদুয়েক পরে ধুমধাম করে বিবাহ সম্পন্ন হল। বাড়ির প্রতিটি সদস্যের কাছেই রিমা খুব প্রিয়পাত্রী ছিল। দেওর, ননদরা বউদি বলতে অজ্ঞান। কাকা-কাকিমারা তো নতুন এক মিষ্টি অনুভূতি, শ্বশুর, শাশুড়ি হওয়ার আনন্দে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। সকলে আলাদা আলাদা জায়গায় থেকেও কেউ তার বউদিমণিকে আবার কেউ তার বউমাকে ফোন করে প্রায় রোজই খোঁজখবর নিত।

নতুন নতুন বিয়ে হওয়ার কারণে রিমা প্রথম প্রথম এগুলো মানিয়ে নিলেও, পরে অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করল। প্রত্যেকদিন সময়ে-অসময়ে কারওর না কারওর ফোন আসা, নিয়মকরে প্রত্যেক মাসে শ্বশুরবাড়ির কারওর না কারওর উপস্থিতি। তার উপর পুজোপার্বণ, অনুষ্ঠানে বাড়ির বড়ো ছেলে হওয়ার কারণে সকলের তাদের বাড়িতে হাজির হওয়াটা একেবারেই মানতে পারছিল না রিমা। আর সেটাই বোধহয় স্বাভাবিক। ছোটোবেলা থেকে বাবা-মা আর রিমা এই ছিল ওদের সংসার। সুতরাং জয়েন্ট ফ্যামিলি যে কী জিনিস তার বোধগম্য হওয়ার কথাও নয়। এত লোকের ভিড়ে সে তো আগে কখনও হারিয়ে যায়নি। এদের দেখে মনে মনে ভাবত সকলের শ্বশুর-শাশুড়ি একটাই হয়, তার চার-চারটে শ্বশুর-শাশুড়ি, অসংখ্য ননদ দেওর–সব মিলে একেবারে ফৌজ ব্যাটেলিয়ান।

এত জনের ভালোবাসার ভারবহণ করার ক্ষমতা ছিল না রিমার। প্রশান্ত আর তার জীবনে ঘটে যাওয়া সুখ-দুঃখের সমস্ত কথাও শাশুড়ি খবর হয়ে পৌঁছে যেত ফ্যামিলির অন্যান্য সদস্যদের কাছে। আর তার পরেই উঠত ফোনের ঝড়। যার উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যেত রিমা। মনে মনে ভাবত তার স্বামী আইএএস অফিসার হওয়ায়, সমস্ত রকম সুবিধা নেওয়ার জন্যই ওদের এহেন আচরণ। তাই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে এই বাড়তি আদিখ্যেতা। ধীরে ধীরে ফ্যামিলির প্রতি রিমার এই, বীতশ্রদ্ধ মনোভাব ধরা পড়ে প্রশান্তের কাছে। প্রথম প্রথম প্রশান্ত বোঝানোর সবরকম চেষ্টা করেছে, ‘রিমা, ওদের ভুল বুঝো না। ওরা ভালোবাসার কাঙাল। ওরা আমাদের থেকে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই চায় না। পরিবারে তুমি একমাত্র বউ হওয়ার জন্যই ওরা তোমাকে একটু বেশিই ভালোবাসে। ব্যস তাছাড়া আর কিছু নয়। ধীরে ধীরে অন্যান্য ভাই-বোনরাও চাকরি পাবে। তাদেরও বিয়ে হবে। তখন এমনিতেই এই ভালোবাসাও সবার মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। আমরা সবাই সবাইকে হৃদয় থেকে ভালোবাসি। কারওর মনে কোনও অভিসন্ধি লুকিয়ে নেই। একটু বোঝার চেষ্টা করো। এখন সবাইকে তোমার পর মনে হলেও কয়েকদিন বাদে দেখবে তুমিই এদের ভালো না বেসে পারবে না। প্লিজ আমার কথা ভেবে একটু অ্যাডজাস্ট করো।’

কিন্তু বুঝিয়ে লাভের লাভ কিছু হয়নি। আর কতদিনই বা বোঝাত, সেটারও তো একটা সীমা অবধি আছে। উলটে বরং রিমার নেতিবাচক কথাবার্তায় ধীরে ধীরে প্রশান্ত প্রভাবিত হতে থাকে। যেই ছেলে মাকে কোনও কথা না বলে থাকতে পারত না, সেই ছেলেই তখন মায়ের কাছ থেকে ছোটো থেকে ছোটো কথাও লুকোতে শুরু করল। অন্যদিকে ছেলের এই স্বভাববিরুদ্ধ আচরণে মা-ও অনুভব করতে পারছিলেন যে তার ছেলে বদলাচ্ছে।

আজ এই বয়সে এসে প্রশান্ত ফিল করতে পারে তখন তার ব্যবহারে মা কতটা কষ্ট পেয়ে থাকবেন। কাকা-কাকিমা, ভাই-বোন মায়ের কতটা কাছের, তাদেরকে দূরে সরিয়ে রাখাটা কতটা বেদনাদায়ক। কিন্তু তবু ছেলে তো ছেলেই, তার থেকে কাছের তো আর কেউ হয় না। তাই ছেলের মন রাখার জন্য বুকে পাথর চাপা দিয়েই উমাদেবী বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে নিজেকে গোটাতে শুরু করেছিলেন।

অপরদিকে পরিবারের সকলে কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারছিল। আর যার কারণেই জায়েরা বহুবার উমাদেবীকে প্রশ্নও করেছেন, ‘দিদি কিছু হয়েছে নাকি গো? কেমন যেন আড়োআড়ো-ছাড়োছাড়ো ভাব। আর আগের মতো ফোনও করো না, ফোন করলে… কী জানি মনে হয় যেন তুমি কিছু লুকোচ্ছ, মনে মনে কষ্ট পাচ্ছ! প্রশান্ত, রিমাও যেন… যাক ছাড়ো। ভালো থাকলেই ভালো। অনেকদিন আসোনি। তোমার দেওরকে পাঠাব, আসবে এখানে?’

উমাদেবী সমস্ত কিছু লুকিয়ে রাখার অভিপ্রায়ে বলে উঠতেন, ‘আরে নারে সবকিছু ঠিক আছে। ওরা দুজনেই সারাদিন পরে কাজ থেকে ক্লান্ত হয়ে ফেরে। আর পেরে ওঠে না। আর আমারও তো বয়স হচ্ছে বল। শরীরটাও খুব একটা..’

তাদের এই বদ্ধমূল ধারণা যে কতটা ঠিক, তা রিমার ব্যবহারেই ধরা পড়ত। ফোন করলে ঠিক করে কথা না বলা, বিরক্তি প্রকাশ করা, কোনও কাজের বাহানা করে ফোন কেটে দেওয়া এই সমস্তই সম্পর্কের মধ্যে একটা প্রাচীর গড়ে তুলল। প্রথমে আস্তে আস্তে সকলের ফোন আসা বন্ধ হল, তারপর বাড়িতে আসাও বন্ধ করে দিল সকলে। শুধুমাত্র প্রশান্তর মা-ই দূরত্ব বজায় রেখেও ফোনের মারফত যেটুকু সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখা যায় সেইটুকুই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। পরিবারের সকলে ভালো মতোই বুঝতে পারছিলেন উমাদেবীর অসমর্থতার কথা। তাই তারা আসা-যাওয়া বন্ধ করে দিলেও বড়দা, বড়োবউদির প্রতি তাদের টান কিন্তু এতটুকুও কমেনি। অপরদিকে প্রশান্তর বাবা-মার ও ঠিক তাই।

এইভাবেই কেটে গেল আরও দুটো বছর। প্রমিতের জন্ম হল। পরিবারের সবাই সব রাগ, অভিমান, দূরে ঠেলে নতুন অতিথি আসার আনন্দে মেতে উঠল। কেউ নাতিকে হার, কেউ বালা, কেউ কোমরের বিছে, কেউ পায়ের মল, কাকা-পিসিরা নানারকম খেলনা দিয়ে অভ্যর্থনা জানাল নবজাতক-কে, কিন্তু কোনও কিছুতেই যেন রিমা সন্তুষ্ট নয়। রিমার ব্যবহার তাদের একেবারেই ভালো লাগল না। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেককিছুই পরিবর্তন হয়েছে, পরিবারে নতুন বউমারা এসেছে, প্রশান্ত-রিমার মেয়ে রশ্মির জন্ম হয়েছে, নতুন বউ-রা তাদের ভালোবাসা দিয়ে সংসারটাকে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। যেটা বদলায়নি সেটা শুধুমাত্র প্রশান্ত-রিমার সঙ্গে পরিবারের জোড়াতালি দেওয়া সম্পর্ক।

সেইসময় প্রশান্তও এতটা ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে যে তার নিজের দোষ-ত্রুটি তার নজরে আসে না। বাড়ির বড়োরা রিমাকে উপেক্ষা করে অন্যান্য বউদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে, বেশিমাত্রায় ভালোবাসছে। এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। তার উপরে প্রশান্তর মনে পরিবারের আর-পাঁচটা মানুষের প্রতি বিষ ঢালার জন্য রিমার উসকানিমূলক কথাবার্তা তো আছেই, যে তারা তাদের সফলতাকে হিংসা করে। সে নিজে কলেজে অধ্যাপনা করে, প্রশান্ত একজন বড়ো মাপের সরকারি অফিসার। সুতরাং তারা কেন তাদের কাছে যাবে, দরকার হলে তারা ছুটতে ছুটতে আসবে। এই অহং আর চাকরি বদলির কারণেই সম্পর্ক একেবারে নিঃশেষের পথেই। সমস্ত পরিবারই প্রশান্তের কাছে বিস্মৃত এক অতীত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বৈভব আর সুখ-দুঃখের সঙ্গে একলাই থেকে গিয়েছিল তারা। ফ্যামিলির টুকটাক খবর পেত মার থেকে। দম্ভের কারণে ভাই-বোনেদের বিয়েতে পর্যন্ত যায়নি তারা।

সময়-তো থেমে থাকে না, সে তার নিয়মেই বয়ে চলে। দেখতে দেখতে কেটে গেছে তেইশটা বছর। প্রশান্তর ছেলে এখন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে রেলে কর্মরত। আর মেয়ে রশ্মিও গ্র্যাজুয়েশন পাশ করেছে। বর্তমানে তারই বিয়ের তোড়জোড় চলছে। বিভিন্ন জায়গায় বদলির পর অবশেষে আবার নিজের জন্মস্থান কলকাতার মাটিতে ফেরা। রিটায়ার হওয়ারও আর মোটে আড়াই বছর বাকি। জীবনের এই প্রান্তে এসে পিছনে ফেলে আসা সম্পর্কগুলো হঠাৎই যেন প্রশান্তর মন ভারাক্রান্ত করে তোলে।

প্রশান্তর বাবা কমলাপ্রসাদবাবুও গত হয়েছেন বেশ কয়েকবছর আগে। তারপর থেকেই উমাদেবী যেন নিজেকে আরও গুটিয়ে ফেলেছেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটাও কথা বলেন না। দিনের বেশিরভাগ সময়টাই ঠাকুরঘরে কাটিয়ে দেন। অন্যদিকে বাকি পুরো পরিবারের একতা তখনও সমানভাবে বজায়, কেবলমাত্র প্রশান্তর পরিবার ব্যতিক্রম।

অবসর জীবন কীভাবে কাটবে–এটা প্রশান্তর খুব চিন্তার বিষয় ছিল। ছেলে কর্মসূত্রে মুম্বইতে থাকে। মাঝেমধ্যে ছুটিতে আসে, এখন মেয়েও চলে যাবে। অফিসে তৈরি হওয়া সম্পর্কগুলোও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারের বদল হওয়া ক্ষমতার মতোই ধুয়েমুছে যাবে। কর্মসূত্রে যে-কজন ভালো বন্ধু হয়েছিল তারাও আজ কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় সেটেলড্। আর ট্রান্সফার নিয়ে আসার পর রিমাও তার নতুন কলেজ নিয়েই ব্যস্ত। প্রত্যেকদিনই ফেরার সময় কলেজের কিছু না কিছু না সঙ্গে নিয়ে আসে। খেয়েদেয়ে একটু রেস্ট নিয়েই আবার সেটা নিয়ে লেগে পড়ে। ইদানীং প্রশান্তর মনে হয় রিমা বোধহয় তাকে এড়িয়ে যাবার জন্যই ইচ্ছাকৃতভাবেই এইসমস্ত করে। একাকিত্ব বোধ থেকেই প্রশান্তর মনে এরকম ভাবনার উদয় হয়।

আজ সে বুঝতে পারে সম্পর্ক কী? ভালোবাসার ছত্রছায়ায় থাকতে গেলে আগে অন্যদের ভালোবাসতে হয়, তবেই ভালোবাসা পাওয়া সম্ভব। কয়েকবছর ধরেই এই চিন্তা তাকে কুরেকুরে খাচ্ছে। অতীতে করা ভুল প্রতিটি পদক্ষেপেই খোঁচা দেয় তাকে। স্ত্রীর মিথ্যে অহংকার, পরিবারের প্রতি তাদের অপরিচিতদের মতো আচরণই সম্পর্ক ভাঙনের মূল কারণ।

মনে মনে ভাবে, আর নয়, এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। মেয়ের বিয়েকে উপলক্ষ্য করেই ভেঙে যাওয়া পরিবার আবার জোড়া দিতে হবে। এই সুযোগেই সকলের মান-অভিমান মিটিয়ে দিতে হবে। তার দৃঢ় বিশ্বাস তার পরিবারের সকলে এতটাই ভালো, যে সে একটু এগোলেই তারা সবকিছু ভুলে তাকে আবার আগের মতো কাছে টেনে নেবে।

এমন সময় ছেলেকে ওইভাবে একা বসে থাকতে দেখে উমাদেবী এগিয়ে এসে বলেন, ‘চোখ বন্ধ করে কী ভাবছিস বাবা? তোর শরীর ঠিক আছে তো?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ…’ মায়ের কথায় আচমকা হকচকিয়ে ওঠে প্রশান্ত।

‘কিছু না মা, একটু চোখ লেগে গিয়েছিল। শরীর ঠিকই আছে, একটু ক্লান্ত লাগছে এই যা। তুমি ঘুমোচ্ছিলে দেখে তোমাকে আর ডাকিনি।’

‘কিছু খেয়েছিস? নাকি ভোলাকে বলব কিছু দিয়ে যেতে। রশ্মির বিয়ের জন্য তোর যা খাটাখাটনি হচ্ছে, এই সময় একটু নিজের দিকে খেয়াল রাখ বাবা। তুই পড়ে গেলে দেখাশোনার তো আর সেইভাবে কেউ নেই। প্রমিত ছোটো ছেলে ও আর বিয়ের ব্যাপারে কী বোঝে বল?। তার উপর তুই যা ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করছিস।’ উমাদেবী উৎকণ্ঠিত হয়েই কথাগুলি বলেন ছেলেকে।

‘হ্যাঁ, ভোলা চা-বিস্কুট দিয়ে গেছে। জলখাবারের কথাও বলেছিল, আমিই না বলেছি। পেটটা বেশ ভারভার লাগছে। যাক এসব ছাড়ো। মা অনেকদিন ধরেই একটা কথা তোমাকে বলব বলব করে বলতে পারছি না।’

‘কী এমন কথা রে যে আমাকে বলতে পারছিস না?’ বলে ওঠেন উমাদেবী।

‘আজ না বললে বোধহয় আর কোনওদিন বলতেও পারব না। বলছি মা, ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু মা বাড়ির আর সবাই না থাকলে সত্যিই কি ধুমধাম সম্ভব? মন থেকে কি মানতে পারছ সেটা?’ একেবারে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে প্রশান্ত।

‘কী বললি বাবা, আর একবার বল। আমি কি ঠিক বুঝলাম!’ বেশ উৎকণ্ঠিত হয়েই বলে ওঠেন উমাদেবী।

‘হ্যাঁ মা তুমি ঠিকই ধরেছ।’

ছেলের উদাসীন স্বর শুনে উমাদেবী অনুভব করতে পারছিলেন এতদিনে বোধহয় ছেলের মনের বন্ধ দরজা উন্মুক্ত হয়ে সম্পর্কের নির্মল বাতাস বইতে শুরু করেছে। সেটা যে কতটা আন্তরিক তা আর বুঝতে বাকি রইল না উমাদেবীর।

এতদিনের চেপে রাখা ব্যথা উমাদেবীর আনন্দাশ্রু হয়ে চোখ বেয়ে নামতে থাকে। স্নেহভরা দৃষ্টিতে প্রশান্তকে বলেন, ‘আমি এতদিন এই দিনটার অপেক্ষাতেই ছিলাম বাবা। এখনও দেরি হয়নি। তুই একটু চেষ্টা করলেই আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। সবার রাগ-অভিমান মেটানোর এটাই সবথেকে ভালো সময়। তুই যদি ওদের বলিস রশ্মির বিয়ে, ওরা নাতনির বিয়েতে মুখ ঘুরিয়ে থাকতেই পারবে না।’ আবেগাপ্লুত উমাদেবী কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎই থেমে যায়। পরমুহূর্তেই উদাসীন মুখ করে বলেন, ‘কিন্তু বউমা?।’

‘তুমি চিন্তা কোরো না মা, ওকে আমি আর মাথায় চড়তে দেব না। অবশ্য পরিবার ভাঙার পিছনে শুধু ও একা দায়ী নয়, আমিও সমানভাবে দোষী। আমিও তো বুদ্ধি-বিবেক সমস্ত বিসর্জন দিয়ে ওদেরই ভুল বুঝেছিলাম। তাই এই সম্পর্ক পুনরায় গড়ে তোলার দায় আমার উপরেও বর্তায়। মা, তোমার কাছে সবার ফোন নম্বর আছে না?’

‘হ্যাঁ, সবার নম্বর আছে। এখুনি নিয়ে আসছি’ বলে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে নিজের ঘর থেকে ডায়ারি নিয়ে এলেন।

মায়ের হাত থেকে ডায়ারিটা নেওয়ার সময় তার মনে হল যেন বংশপরম্পরায় কোনও সম্পত্তি তার হাতে তুলে দেওয়া হল। প্রত্যেক মা-বাবাই বংশপরম্পরায় কিছু না কিছু তুলে দেন সন্তানের হাতে। তাকেও তার বাবা-মা বংশপরম্পরায় ভালোবাসা দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সে গ্রহণ করতে পারেনি। ডায়ারিটা প্রশান্ত এমনভাবে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখেছিল, ঠিক যেন ফেলে আসা সম্পর্কগুলোকে কাছে টেনে নিয়েছে সে।

‘মা আমি সবাইকে ফোন করে নিমন্ত্রণ করব। সবার থেকে তাদের ঠিকানা নিয়ে কার্ড পাঠাব। সবাই আসবে তো মা?’

‘হ্যাঁ বাবা সবাই আসবে। তুই যে তোর ভুল বুঝে হৃদয় থেকে সবাইকে ডাকছিস, সবাই সেটা বুঝবে বাবা, বুঝবে। তুই সবার থেকে দূরে সরে গেলেও তারা কেউ তোর থেকে দূরে সরে যায়নি বাবা।’ ছলছলে চোখে বলেন উমাদেবী।

প্রশান্ত ডায়ারি খুলে প্রথম নাম্বার ডায়াল করল। ‘হ্যালো’, অপরপ্রান্ত থেকে বড়োকাকার গলার স্বর শুনতে পেল প্রশান্ত।

‘কাকা, আমি প্রশান্ত’ একপ্রকার জোর করেই বলল সে।

মনে মনে ভাবতে থাকল কাকা কী ভাবছে, কাকার কী প্রতিক্রিয়া হবে কে জানে?

প্রশান্তর গলার স্বর শুনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপ করে ছিলেন প্রশান্তর কাকা।

প্রশান্ত আবার বলে ওঠে, ‘কাকা আমি প্রশান্ত, তোমার বড়ো ছেলে বলছি।’ এতটাই করুণ ছিল সে স্বর যে উলটোদিকের মানুষটাও বোধহয় তার অন্তরের ব্যথা অনুভব করতে পারছিল। একজন অপরজনকে মন থেকে ডাকলে অপরজন সাড়া না দিয়ে পারে না।

এবার উলটোদিক থেকে বেশ ভারাক্রান্ত স্বরে জবাব আসে, ‘কেমন আছিস?’

‘আমি ভালো আছি। কাকিমা কেমন আছে? ভাই-বোনেরা ভালো আছে? আর বাড়ির অন্যান্যরা?’ কাকার স্বর শুনেই প্রশান্ত বুঝেছিল, তারাও বোধহয় তার মায়ের মতোই এই দিনটারই অপেক্ষায় ছিল।

‘সবাই ভালো আছে। আগে বল তুই কোথায় আছিস এখন? বউদি, রিমা, বাচ্চারা কেমন আছে?’

‘সবাই ঠিক আছে। সামনের মাসেই তোমার নাতনির বিয়ে। তোমাদের সবাইকে আসতে হবে। তোমরা না এলে  তোমার নাতনির বিয়েই ক্যানসেল করে দেব।’ প্রশান্ত এমনভাবে জোর খাটাতে লাগল, যেন কিছু হয়ইনি, সবই আগের মতোই আছে।

‘এমন অলক্ষুণে কথা বলতে নেই বাবা। আমরা সবাই আসব। তুই তোর কাকা-কাকি, পিসি সবাইকে একটা করে ফোন করে দে।’

‘তোমাদের ঠিকানা দাও। কার্ড পাঠিয়ে দেব।’

‘আমার নাতনির বিয়েতে তুই আমাকে কার্ড পাঠাবি তবে আমি যাব। খুব বড়ো হয়ে গেছিস না। তুই শুধু সকলকে ফোন করে দে, বাকিটা আমি দেখে নেব।’

‘ঠিক আছে। তুমি যা বলবে তাই হবে।’ বলে ফোন রেখে দিল প্রশান্ত। হয়তো তাদের অনেক কথাই বাকি থেকে গেল।

এতক্ষণ চুপচাপ ছেলের কাছে বসেছিলেন উমাদেবী। ফোন কেটে দিতেই ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাকা কী বলল বাবা, ওরা আসবে তো?’

প্রত্যুত্তরে প্রশান্ত আনন্দের সঙ্গে বলে উঠল, ‘কত সোজা একটা ব্যাপারকে কত জটিল ভাবছিলাম না মা। আর দ্যাখ্যো কত সহজে সবকিছু মিটে গেল। এতবছর ধরে চেষ্টা করেও ফোন করতে পারিনি। কোথাও যেন একটা দ্বিধা, একটা ইগো কাজ করত। সবাই আসবে মা সবাই আসবে।’

সত্যি বলছিস বাবা?’ আনন্দে উমাদেবীর চোখ জলে ভরে গেল। পাছে ছেলে দেখে ফেলে তাই সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন নিজের ঘরে।

এক এক করে প্রশান্ত পরিবারের সকলকে ফোন করে। সকলের থেকে প্রায় একই ধরনের উত্তরই পায় সে। নিজেকে আর সামলে রাখতে না পেরে কখন যে তার চোখ জলে ভরে গিয়েছিল সে নিজেও জানে না। কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার পর আবার আগের মতো আরামকেদারায় দেহ এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইল।

ঠিক সেই সময়েই রিমার ছোঁয়ায় প্রশান্ত চোখ খোলে। বলে, ‘তুমি কখন ফিরলে?’

প্রশ্নের উত্তরে রিমা বলে, ‘তুমি আর মা যখন বসার ঘরে বসে কথা বলছিলে তখনই এসেছি। তোমরা কথা বলছ দেখে তোমাদের ডাকিনি। সোজা উপরের ঘরে চলে গিয়েছিলাম।

‘ঠিক আছে বসো। তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।’

‘বলো কী বলবে?’

‘আমি অনেক কষ্টে পরিবারের সবাইকে বিয়েতে আসার জন্য রাজি করেছি রিমা। আশা করি এইবার তুমি কোনও গন্ডগোল বাঁধাবে না। পরিবারের সকলের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে। আমরা দুজনে যে ভুল করেছি, সেই ভুল শুধরে নিতে তুমিও আমাকে সাহায্য করবে।’

‘তুমি কি কিছুই বোঝো না গো? তোমার থেকে কেন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই? নিজেকে সারাদিন কাজে কেন ব্যস্ত রাখি? তোমার আর মার কষ্টটা যখন বুঝতে পারি, তখনই একটা অপরাধবোধ তাড়া করে বেড়ায় আমাকে। আমি নিজেও এটাই চাইছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দাও প্রশান্ত। তুমি দেখো আমি আবার সকলের মন জয় করে নেব।’ প্রশান্তর হাতদুটো ধরে একটু কাছে ঘেঁষে আসে রিমা।

বিগত কয়েক বছরে রিমার স্বভাবে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সবসময় নিজের বাচ্চাদের ও মিলেমিশে থাকার পরামর্শ দিত। তার ছেলে মেয়ের সম্পর্ক-ও যদি ভবিষ্যতে কোনও মেয়ের কারণে নষ্ট হয় সে আর প্রশান্ত কী সেটা মেনে নিতে পারবে। যে-ভুলটা সে এতদিন করে এসেছে, কাকা-কাকি, পিসি, ভাই-বোন সবার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে প্রশান্তকে সেই জিনিস তো আবার ঘটতে পারে, এই ভয়টাই বাসা বেঁধেছিল রিমার মনে। এমনিতেই আজকাল সম্পর্কের বাঁধন খুব আলগা। সেখানে শুধুমাত্র তার শ্বশুরবাড়ির পরিবারটিই ব্যতিক্রম মাত্র। যেখানে সে নিজেই ছেদ ঘটিয়েছিল। তাই বোধহয় সে নিজেও আজ তার ভুলটা শোধরাতে চায়।

অবশেষে বিয়ে প্রায় আসন্ন। দিন-দুয়েক মাত্র বাকি। এক এক করে হাজির হল সমস্ত পরিবার। বাড়ির সকলকে দেখে হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছিল রিমা। সত্যিই বড়োদের আপ্যায়নে কোনও ত্রুটি রাখেনি সে। নিজে হাতে সেবা করেছে সকলের। আগের মতো সকলে তাকে কাছেও টেনে নিয়েছে। আজ প্রশান্তর সংসার একেবারে পরিপূর্ণ। সবাই একেবার আনন্দে আটখানা। প্রশান্তর বাড়ি একেবারে চাঁদের হাট।

এইসব দেখে প্রশান্ত মনে মনে ভাবে আজ তার ভালোবাসার বাগান একেবারে ফুলে, ফুলে, সুগন্ধে ভরে গেছে। একেই বোধহয় বলে রক্তের টান। আনন্দে তার চোখ জলে ভরে যায়।

চ্যাঁচানি পিসি

দালাল যেদিন আমায় ঘর দেখাতে নিয়ে যায়, সেই দিনই আমি চ্যাঁচানি পিসিকে দেখি। টাইমকল থেকে ছ্যারছ্যার করে জল পড়ছে। পাশে উবু হয়ে বসে তিনি বাসন মাজছেন। চটা উঠে যাওয়া সিমেন্টের চাতাল। একদিকে ডাঁই করা কাঠের ভাঙা তক্তা, প্লাস্টিকের বস্তা, মরচে ধরা আধখানা টিন, বইয়ের একগোছা ছেঁড়া পাতা, আরও কত কী। চাতালটার এখানে সেখানে ছিটিয়ে ছেতরে পড়ে রয়েছে পায়রার গু। দেখেই মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

বাড়িটার বয়েস একশো বছর তো হবেই। যেখানে সেখানে পুলটিস মারা। দরজা দিয়ে ঢুকেই চোখেমুখে অন্ধকার জড়িয়ে যায়। সরু গলি। খানিকটা গিয়ে ডানহাতে সিঁড়ি। তার মুখে একটা বইয়ের দোকান। সেখানে আলো জ্বলছে। বাঁদিকের দোকানেও আলো। কিন্তু অন্ধকার এত বেশি যে মনে হয় যেন দোকানের ভেতরে মশারি খাটানো আছে। সেখানে আলো একেবারে জবুথবু অবস্থায় পড়ে আর বেরোনোর পথ পায়নি।

বাঁহাতি মোড় নিয়ে ডানদিকে ঘুরলেই ওই চাতাল। তার তিন কোণে তিনটে দোকান। বাসন মাজতে মাজতে পিসি চোখ তুলে আমাদের দিকে তাকিয়েছিলেন। ট্যারা চোখ। তার চেয়েও ধাক্বা লেগেছিল যেটা তা হল ওর পরনে একটা শুধু ফ্যাকাশে কামিজ। নীচে কিছু নেই। উবু হয়ে বসার ফলে কামিজের অনেকটা খসে গিয়ে রোগা পা দাবনা অব্দি দেখা যাচ্ছে। চোখ সরিয়ে নিতে নিতে খেয়াল হল একদম কিছু নেই তা নয়। একটা লাল রঙের ইজেরের খানিকটা উঁকি মারছে।

চাতালের পাশে সরু হাঁটাচলার জায়গাটা একটা খোলা কোলাপসিবল গেট টপকে আর একটা গলির রূপ ধারণ করেছে। আবার অন্ধকার। আরও একটা সিঁড়ি। কাঠের রেলিং ঘুরে ওপরে উঠেছে। এই ছোট গলিটা পেরিয়ে একফালি ফাঁকা জায়গা। সেখানে পাশাপাশি দুটো দোকানঘর। তার মধ্যে যেটা বন্ধ তার সামনে আমাকে ফেলে দালাল বলেছিল, দাঁড়ান, তালাটা খুলি।’

আমি বললাম, ‘এ কোথায় নিয়ে এলেন বলুন তো!’

সে ঘটাং ঘটাং করে ঠুকে তালা খুলে হড়হড় করে শাটার তুলতে তুলতে বলল, ‘বইপাড়ায় ঘর নিয়ে ব্যাবসা করতে গেলে ওসব ভাবলে চলবে? আপনার যা বাজেট তাতে এ যা দিচ্ছি, রাজা জিনিস বুঝলেন। যদি টিকে যেতে পারেন তাহলে এখান থেকেই মা লক্ষ্মী হাত ঝেড়ে দেবে। একটুকরো জায়গার জন্যে লোকে মাথা খুঁড়ছে। একবার নোঙর ফেলতে পারলেই হল। দোকানের ভেতরটা ভালো করে দেখুন। আশি স্কোয়ার ফুট। ফলস সিলিং করা আছে, ওপরে বই রাখতে পারবেন। সলিড একেবারে। ভাড়া কম, সেলামি কম, আর কী চাই?’

‘না আসলে এত ভেতরে তো, তাই।’

‘সামনে নিতে গেলে তো আপনার পড়তায় আসবে না দাদা। ফুটপাতের ধারের গুমটিগুলো দেখেছেন? পঞ্চাশ-ষাট স্কোয়ার ফুট– স্টাটিংই আছে সাত-আট লাখ থেকে। এখান থেকে লাগান না। কত এঁদো গলি থেকে বেরিয়ে রাজা-উজির হয়ে গেল সব। পঁচিশ বচ্ছর ধরে কলেজ স্ট্রিটে ব্রোকারি করছি। কম তো দেখলাম না।’

এদিকেও একটা সিঁড়ি আছে লাল সিমেন্টের। উঁচুতে তাকালাম। দোতলায় কতগুলো সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে। তার মানে ওখানেও দোকান বা গোডাউন আছে। তিনতলার এদিকটায় জাল দিয়ে ঘেরা। বারান্দা হতে পারে। তার ওপরে আশি স্কোয়ার ফুটেরও কম মাপের আকাশ। দমচাপা লাগছিল সব মিলিয়ে। বললাম, ‘এখানে কি কোনও কাস্টমার আসবে? জায়গাটা যেন কেমন। ঢোকার মুখে আলো নেই, একজন কলতলায় বসে বাসন ধুচ্ছে–।’

দালাল এমন হাসল যেন আমি ছেলেমানুষি কথা বলছি। ‘ওঃ, চ্যাঁচানি পিসি? ওকে নিয়ে ভাববেন না। স্ক্রু ঢিলে আছে। ওই কলটা ওর। কলের পাশে যে-তিনটে দোকান– ওগুলো ওর ভাগে। যা ভাড়া পায় তাই দিয়ে চলে। বেশি পায় না যদিও। কবেকার ভাড়াটে সব। পিসি থাকে গলির ভেতরের দোতলায়। এ বাড়ির তিন শরিক। কারও সাথে কারও সম্পক্ব নেই। সামনের দিকেরগুলো যাদের তারা ওদিকেই তিনতলায় থাকে। এই বাড়িওলা থাকে এদিকের ওপরে। ঘর পছন্দ হলে বলুন, ডাইরেক্ট কথা বলিয়ে দিচ্ছি।’

ঘরটা নিয়ে নিয়েছিলাম। বাবার একটা বইয়ের দোকান ছিল। বইয়ের সঙ্গে লেখাপড়ার কাজে আসে এমন সব জিনিসও বিক্রি হতো। যেমন হয় আর কী। বয়েস হয়ে গিয়েছে, আর বসতে ভালো লাগছে না, এসব বলে বাবা আমাকে সেখানে ভিড়িয়ে দিল। সাত বছর ধরে আমি সেটাই চালিয়েছি। তবে এত ছোট ব্যাপারে মনটা আটকে থাকতে চাইছিল না। বই ঘাঁটতে আমার ভালো লাগে। ভাবলাম বই বানালে কেমন হয়। বছর দেড়েক হল নিজে একটা পাবলিকেশন খুলেছি। গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনি ছেপেছি, প্রবন্ধের বইও। কয়েকটা বইয়ের, কাগজে রিভিউ বেরোল। প্রকাশনার নাম জানল লোকে। কলেজ স্ট্রিট থেকে ফোনে অর্ডার হলে বই পৌঁছে দিতাম। ছোটদের বইয়ের কাটতি ভালো জেনে সেদিকেও যাব ভাবছিলাম। বাবাকে অনেক বলেকয়ে, বুঝিয়ে দোকানটা বিক্রি করে দিলাম। বাবার হাতে খানিকটা রেখে আমার হাতে কিছুটা পুঁজি এল। বিয়ে করেছি। ছেলে-বউ আছে। বউ একটা মন্টেসরি স্কুলে পড়ায়। আমার বেলায় পঁয়ত্রিশ পেরিয়ে পাল্লাটা ঝুঁকির দিকেই চলে গেল বেশি, কিন্তু তখনই ঠিক করেছিলাম এই ব্যাবসাটা কলেজ স্ট্রিটে বসেই করতে হবে। দালালের পিছন পিছন ঘুরে শেষে এই বাড়ি।

এখানে চ্যাঁচানি পিসির সঙ্গে আমার কথা হওয়ার কোনও দরকার ছিল না। দালাল বলেছিল ওকে নিয়ে ভাববেন না। কিন্তু না ভেবে রেহাই নেই। সত্যি বলতে কী ওকে দেখলেই হাত-পা চিড়বিড় করে। বারোটায় যখন দোকানে আসি তখন তিনি খাওয়াদাওয়া শেষ করে বাসন ধুচ্ছেন কলতলায়। বিকেল চারটেয় আবার জল আসে। পিসি থালা বাটি গেলাস হাঁড়ি কড়াই নিয়ে সেখানে হাজির। বাসন ধুচ্ছেন কলতলায়। শুধু বাসন নয়, নিজেকেও রগড়ে ধোবেন। একজন পঞ্চাশ-পঞ্চান্নর হাড়সর্বস্ব মহিলা সর্ব অঙ্গ ভিজিয়ে বইয়ের দোকানের মাঝখানের চাতালে বসে চান করছেন এ দৃশ্য যে কী শুকনো হতে পারে, তা টের পাই। যাওয়া আসার পথে দেখে মনে হয় আড়াল করে দাঁড়াই। কোনও খদ্দের যদি আসে এখন? কিংবা লেখক কেউ? লজ্জার একশেষ হবে। তখন ওরই ভাড়াটে এক দোকানদারের স্টাফ পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলে যায়– ‘আহা মন্দাকিনী। রাজ কাপুর দেখে যেতে পেল না রে। রাম তেরি গঙ্গা মইলি হো গয়ি…।’

চ্যাঁচানি তো কারও নাম হতে পারে না। পিসির আসল নাম যে কী সেটা ওরই ভাড়াটে ডিএম পাবলিশার্সের মালিকের সঙ্গে একবার কথা বলতে গিয়ে জানলাম। বললেন, ‘ওর নাম লাবণি, লাবণি দত্ত। ভাড়ার রসিদে ওই নামেই সই করে। এখানকার ছেলেছোকরারা বলে চ্যাঁচানি পিসি। বলবে নাই বা কেন। অষ্টপ্রহর কিছু না কিছু নিয়ে চ্যাঁচাচ্ছে।’

সাবধানে বললাম, ‘উনি তো আপনাদের বাড়িওয়ালি। কিছু বলেন না কেন?’

‘কী আর বলব। যবে থেকে এসেছি তবে থেকে তো এই দেখছি।’

আমি চুপ করে গেলাম। এখানে আরও যারা আছে তারাও পুরোনো। পিসিকে কেউ সামনাসামনি কিছু বলে না। বলতে গেলেই চিৎকার। কেউ গলির ভেতরে ধপাস করে বইয়ের বস্তা নামাল। পিসি সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠবে– ‘অ্যাই কে? কে রে? গায়ের জোরে বস্তা ফেলেছিস! আস্তে আস্তে নামানো যায় না? এটা তোর বাবার বাড়ি নয় বুঝলি! একেই ওখানকার মেঝেটা ফেটে রয়েছে, তার মধ্যে ইচ্ছে করে বদমাইশি। সারাতে গেলে তুই পয়সা দিবি?’

আমি সব শুনি। তবে খেয়াল করে দেখেছি গলির মেঝের একটা জায়গা সত্যিই অনেকটা বসে গিয়েছে। পুরোনো বাড়ি। ধেড়ে ধেড়ে ইঁদুর ঘুরঘুর করে। ওরাই ফাঁকফোকর থেকে মাটি তুলে আলগা করে দিয়েছে। গলিটায় কোনও আলো নেই। অন্ধকারে কেউ কোনওদিনও পড়ে পা মচকাবে।

ডিএমের মালিক বলেছিলেন, ‘আপনার বাড়িওয়ালা প্রভাত দত্ত হল ওর দাদা, জ্যাঠার বড়ো ছেলে। বাড়ি ভাগাভাগি হয়েছে অনেকদিন। শুনেছি আগে থেকেই ঝামেলা চলছিল। যে যার অংশ বুঝে নেওয়ার পর থেকে তিন শরিকের মধ্যে কথাবার্তা বন্ধ। কেউ কারও খোঁজও নেয় না। এই চ্যাঁচানি পিসির বাপ-মা তো কবেই স্বর্গে রওনা দিয়েছে। থাকার মধ্যে আছে এক দিদি-জামাইবাবু। বছরে বারদুয়েক আসে ব্যারাকপুর থেকে। আসবেই বা কী করতে। সেখানে তারা সুখেই রয়েছে। দয়া যেটুকু করে, এর ভাগের দোকানগুলোর ভাড়ায় হাত দেয় না। বয়েসকালে বিয়ে-থা হয়নি। বিয়ে হওয়ার কথাও নয়। ওই তো চেহারার ছিরি। আগেও ভালো কিছু ছিল বলে মনে হয় না। একাই রাঁধেবাড়ে, খায়। একা থেকে থেকে মাথাটা গেছে আর কী। কথা বলার লোক পায় না। চ্যাঁচায়!’

আমি ভাবছিলাম ভাগ্যিস এই মহিলা আমার বাড়িওয়ালি নয়।

আমার দোকানে কোনও কর্মচারী নেই এখনও। এই কোম্পানিতে আমিই মালিক, আমিই শ্রমিক। বিক্রিবাটা তেমন জমেনি। তবু রিটেল কোনও কাউন্টার থেকে বইয়ের নাম লেখা স্লিপ এলে বই দিই। ফোনে বললে দৌড়ে গিয়ে বই পৌঁছে দিয়ে আসি। চালান লিখি, বিল কাটি, টাকা তুলে আনি। বিজ্ঞাপন দেখে, খুঁজেপেতে কাস্টমার আসে খুব কম। ওই কালো ঝুল গলি পেরিয়ে যারা এসে পৌঁছোয়, দেবতাজ্ঞানে তাদের সামলাই। যাদের বই রয়েছে সেই লেখকদের মধ্যে কেউ কেউ এসে পড়েন কখনও। আর টাকা নিয়ে বই ছাপিয়ে দেব কিনা জানতে বা কথা বলতেও আসেন দু-একজন। হ্যাঁ বলে দিয়েছি কয়েকজনকে। নইলে তো প্রেসে ধার ধারালো হয়ে উঠবে। আমি ধরে নিই যারা টাকা দেবে তারা আমার টেম্পোরারি পার্টনার। বাইরে চায়ের দোকান আছে। লোকজন এলে সেখানে গিয়ে বললে চা দিয়ে যায়, কিন্তু কেউ জল চাইলেই আমি সিঁটিয়ে যাই।

পাশের দোকানটা বর্ণলিপি পাবলিকেশন। মাঝবয়েসি কর্মচারী বসে থাকেন একজন। তিনিই বলেছিলেন, ‘খাওয়ার জল ওই কল থেকেই আপনাকে ভরতে হবে তমালবাবু। তবে খবরদার। পিসি যতক্ষণ কলতলায় থাকবে ততক্ষণ ওদিকের ধারও মাড়াবেন না। খালি দেখলেই বোতল নিয়ে দৌড়ুবেন। আমরাও তাই করি। নাহলে ও চিল্লিয়ে মাত করে দেবে একেবারে।’

তাও টের পেয়েছি অনেক দিন আগেই। বিকেলে কেউ জলের বোতল কলের মুখে বসালেই হল। সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার– ‘অ্যাই, জল ভরছে কে? কার এত আস্পদ্দা! আমার এখনও বাসন ধোয়া বাকি।’

আসলে বাসন মাজা হয়ে গেছে। শুচিবাই থাকার ফলে উনি একই বাসন বারবার ধুতে থাকেন। এই সময় পিসিকে দেখা যায় না। শুধু তার কন্ঠস্বরটি দোতলার সিঁড়ি থেকে এমন করে নামতে থাকে যে ঝনঝনিয়ে বাসন গড়ালে তার চেয়ে মধুর শোনাত। কোনও কোনও দিন কলের সামনেই ওই চিৎকারে পায়রারা ভয় পেয়ে উড়ে যায় ঘুলঘুলি কী কার্নিশ থেকে। ঝগড়ার রেওয়াজি গলা ছাড়া এ সম্ভব নয়।

আমার দোকানঘরের সামনে দাঁড়িয়ে একজন একদিন আঁতকে উঠলেন। চুঁচড়ো থেকে বই নিতে এসেছেন। কখনওসখনও মফসসলের দোকানিরা বা তাদের লোক আসে আমার এখানে। পিসিকে তাদের চেনার কথা নয়। তিনি বললেন, ‘কোথাও কি গোলমাল হচ্ছে কিছু? দেখে আসবেন একবার?’

আমি বললাম, ‘তেমন কিছু নয়। ওই জল ভরা নিয়ে–।’

‘সে কী! কাজের জায়গায় এরকম চ্যাঁচামেচি হলে তো মুশকিল। বিজনেস করবেন কী করে? একে তো বাড়ির বাইরে আপনাদের কোনও সাইনবোর্ড নেই, খুঁজে খুঁজে টাইম কাবার। তার ওপর–। আর জায়গা পেলেন না!’

চুপ করে থাকি। হাসি দিয়ে বিজনেস সামলাবার চেষ্টা করি। তবে এও দেখেছি, পিসি যখন কলতলায় গিয়ে বসে, সেই সময়টি বেছে নিয়ে এখানকার দোকানের কয়েকজন আধ ডজন বোতল হাতে হাজির হয়। তারা পিসির ওই গলাবাজির চোটপাট চেটে চেটে খেতে চায়। হ্যা হ্যা করে হাসে। বোতল বসানোর ছুতোয় বাসন ছুঁয়ে দিতে চায়, বোতলের তলানি জল ছুড়ে দিতে চায় পিসির গায়ে। তিনিও চ্যাঁচাতে থাকেন– ‘যাও, যাও বলছি, দূর হয়ে যাও এখান থেকে। জেনেশুনে পেছনে লাগা, না! আবার দাঁত ক্যালানো হচ্ছে? শয়তান বদমাইশের দল, মেরে হাত ভেঙে দোব একদম বলে দিচ্ছি।’

আমার বাড়িওলা পীযূষ দত্তকে দেখেছি কখনও এরকম ঘটনার মধ্যে পড়ে গেলেও তিনি পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছেন। বোনের হয়ে দুটো কথা বললে হয়তো থামত। থামে না।

একদিন জল ভরতে গিয়ে দেখলাম কলে লাল বালতি, বাসনের পাঁজা। না বলে জল নেওয়া যাবে না। পিসি দোতলায় তার ঘরে আছে ভেবে ওপরে উঠলাম।

একটা পাঁচিল গেঁথে আমাদের ওদিকটা থেকে এদিকটা আলাদা করা আছে। লালচে ইটের দাঁতকপাটি বেরিয়ে পড়েছে সে পাঁচিলের। পাশে সিমেন্টের একটা খিলানের অর্ধেক। বৃষ্টির জল পড়ে শ্যাওলায় আঁকা নকশা ফুটেছে তার শরীরে। কত কাণ্ড করে যে বাড়িটা ভেঙে ভাগ করেছে এরা। সিঁড়ির যেখানে আমি দাঁড়িয়ে তাতে আমার নাকের প্রায় ডগায় শোয়ানো একটা মেঝে। লোহার শিক লাগানো কাঠের রেলিং। অর্থাৎ এটা দোতলার ভেতরের বারান্দা। একটা বেড়াল থাবায় মুখ নামিয়ে বসে আছে। এককোণে একটা স্টোভ, কেরোসিন তেলের জার, কাঠের ডাঁটির একটা বড়ো ছাতা দেয়ালে হেলান দিয়ে, সিলিঙের কড়িবরগা থেকে দড়ি বাঁধা একটা হ্যারিকেন ঝুলছে, রেলিঙের খুঁটি থেকে দেয়ালের পেরেকে টাঙানো আর একটা দড়িতে এলিয়ে রয়েছে কয়েকটা ময়লা কাপড়, সেই দেয়ালেই লোহার ব্র্যাকেটে বাল্ব, দরজার পাশের দেয়ালে বাঁধানো ছবিতে উলটে আঁচড়ানো চুলে এক পুরুষ। চৌকো চোয়াল। সাদা-কালো ছবি হলদেটে হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল সব মিলিয়ে মৃণাল সেনের সিনেমার কোনও স্টিল ফ্রেম দেখছি। এমন সময় সেই ফ্রেমের ভেতর থেকে বেড়ালটা মুখ তুলে ডেকে উঠল– মিঁউ।

‘কী ব্যাপার? এখানে এসেছেন কেন?’

দরজায় আধময়লা কামিজ উঁকি দিয়েছে। বললাম, ‘আমার ওখানে একদম জল নেই। একটা বোতল যদি ভরে নেওয়া যেত।’

‘আপনি কি আমার পারমিশন নিতে এসছেন?’

‘হ্যাঁ।’

খোলা ঠোঁটদুটো টপ করে নেমে এসে কেমন গুম ধরে গেল মুখে। উনি কামিজের দু’পাশের চেরা জায়গা দু’হাতে চেপে ধরলেন। তারপর বললেন, ‘যান, নিয়ে নিন জল।’

‘আপনার জিনিসপত্র সব ওখানে রয়েছে। সরাতে গেলে হাত ছোঁয়াতে হবে।’

‘বললাম তো ভরে নিন। সরিয়ে দিন ওগুলো।’

কী মনে হল, সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘ওটা কি আপনার বাবার ছবি?’

‘হ্যাঁ, কেন?’

‘না এমনি। তাই মনে হচ্ছিল। ঘরের ভেতরে রাখলে পারতেন।’

‘ঘরে অন্ধকার।’

অদ্ভুত যুক্তি। আমি আর কিছু না বলে ফিরে আসছিলাম। তখন উনি বললেন, ‘জল নেওয়ার জন্য আমাকে বলতে আসতে হবে না। আপনার যখন দরকার নিয়ে নেবেন।’

আমি নেমে জল ভরে নিয়ে এসে কাউন্টারে বসি। বাইরে কত লোক, বই বোঝাই রিকশা ভ্যান, দোকান উপচে রাস্তায় বই, হাঁকাহাঁকি, হাত ধরে টানাটানি– কী বই লাগবে বলুন। আর এই জায়গাটা ঘুমন্ত পুরী। এরকম রোজই। বৃষ্টিতে, রোদ্দুরে, শীতে ভিজে ভিজে।

এক একদিন বসে বসে ঝিম ধরে যায়, চোখের পাতা নেমে আসে। তখন ওই রাজকন্যের চিৎকারে চটকা ভাঙে। সিগারেট ধরাই। ভাবি আরও কয়েকটা কাউন্টারে বই বিক্রির ব্যবস্থা করতে হবে, লাইব্রেরিতে ক্যাটালগ পাঠাতে হবে, বাংলাদেশের অর্ডার পেতে হবে। পারব কি আমি? দোকানের ভাড়া, সেই সাউথ থেকে মেট্রোয় যাওয়া-আসার খরচ, ইলেকট্রিকের বিল। মাত্র তেরোটা বই নিয়ে এখানে জায়গা হাঁকিয়ে বসাটা বোধহয় ঠিক হয়নি। এই বাড়িটায় সব টেক্সট বইয়ের দোকান। সেখানে আমার পাবলিকেশনের বই মেলানো যাবে না। যাদের সঙ্গে মেলানো যায় তারা তো রথী-মহারথী। কম্পিটিশন তো দূরের কথা, টিকে থাকতে পারব কিনা সেই সন্দেহই চোঁয়া ঢেকুর হয়ে উঠে আসছে এই কয়েক মাসে। বড়ো লেখকদের বই পেতে গেলে অনেক টাকা দিতে হয়। বই ভালো করে ছাপতে গেলেও খরচ বেশি। বেশি ছাপলে খরচ কমে কিন্তু আমার দৌড় তিনশো কী পাঁচশো। লাইব্রেরি নামি প্রকাশকদের বই কেনে, বাংলাদেশের অর্ডারও তাই, কলকাতার বাইরে থেকে কদাচিৎ কেউ কিনতে আসে। এত কিছু আগে বুঝিনি। এখানে এসে মালুম হচ্ছে। আমার বউয়ের স্কুলে পড়ানোর ভরসায় তো এখানে আসিনি আমি। নিজেই নিজের দোকানের ছোট্ট সাইনবোর্ডটার দিকে তাকিয়ে থাকি। কায়দা করে পাবলিকেশনের নাম দিয়েছি ‘সোনার তরী’। শেষে ডুববে না তো?

এসব ভাবতে ভাবতে কোনও দিন ঘটাং করে আওয়াজ শুনে পিছন ফিরে দেখি পাশের গোডাউন থেকে বই বের করতে এসেছে কেউ। দুটো ছেলে। এরা যে– দোকানে কাজ করে সেটা রাস্তার ওপরে। ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। বলছে মানে প্রত্যেক কথার আগে পরে একটা করে খিস্তি। বাংলা ভাষাকে উদার প্রমাণ করতে এসব আমরা আপন করে নিয়েছি। কোনও শ্রেণিবৈষম্য নেই। বলার স্বাধীনতা আছে, না শোনার স্বাধীনতা নেই। তাই খিস্তি হজম করছিলাম। ঠিক তখন ওপর থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন পিসি। ‘অ্যাই কে রে? তপন, না? এখানে দাঁড়িয়ে আবার নোংরা কথা বলছিস! ওসব এখানে চলবে না।’

তপন ছেলেটি মুখ তুলে বারান্দায় তাকাল। ‘তোমার ওখানে তো নেই পিসি আমি। এ তো আমাদের বাড়িওলার এরিয়া। আমি এপারে রয়েছি।’

এবার আরও জোরে চিৎকার ধেয়ে এল। ‘খারাপ কথার আবার এপার-ওপার কী অ্যাঁ! বেশি ওস্তাদ হয়েছ, না। বই বিক্রি করিস, সে তো বিদ্যের জিনিস রে, গালাগাল দিতে লজ্জা করে না!’

তপন পাশের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে হাসল। গলা নামিয়ে বলল, ‘বহুত ঢেমনি এই বুড়িটা, দেখবি একটা মজা?’

মোবাইলে খুটখাট করছে তপন। একবার আড়চোখে আমাকে দেখল। তারপর গান বেজে উঠল ফোনে। ও মধু… ও মধু… আই লাভ ইউ… আই লাভ ইউ…। সঙ্গে তপনের খিক খিক হাসি।

আমি ভাবছিলাম, পিসির তো এতদিনে জেনে যাওয়া উচিত ছিল যে বই বিক্রি হয় বলেই বইপাড়ায় সকলে সাধুভাষায় কথা বলবে না। হতে পারে একদিন বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজের প্রিন্সিপালের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কলেজ স্ট্রিটেই বইয়ের দোকান খুলে বসেছিলেন। কিন্তু এখন বই এখানে একটা প্রোডাক্ট। বাংলা ভাষায় যাকে বলে মাল।

হঠাৎ চমকে উঠলাম আমি। তপন ও অন্য ছেলেটিও অবাক হয়ে গেছে। দোতলায় অন্ধকার বারান্দা থেকে আর চিৎকার নয়, গান ভেসে আসছে। ‘দূরদেশি সেই রাখাল ছেলে… আমারে বাটের বটের ছায়ায়… সারাটা দিন গেল খেলে…।’ গলা খ্যানখ্যানে, সুর কিছু এলোমেলো কিন্তু ওটা গানই।

তপন কাঁধ ঝাঁকাল। ‘কী গো পিসি, এ আবার কী শুরু করলে?’

গান থামল। ‘কেন, তুই গান বাজাচ্ছিস, আমি গান গাইছি। কী অসুবিধে?’

‘আরে আমারটা শোনো, শরীর চাঙ্গা হয়ে যাবে।’

‘আরে তুই আমারটা শোন, তোর মন ভাল হয়ে যাবে। দূরদেশি সেই রাখাল ছেলে…।’

অন্য ছেলেটি এবার তপনকে বলল, ‘চল চল মাল ওঠা। সব পাগলের কারবার এখানে।’

লাবণি দত্ত থামেননি। পুরোটাই গাইলেন।

অনেক দিন পর গানটা শুনতে পেলাম। মাঠে ফুটবল পিটিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সন্ধেবেলা কাদের বাড়িতে যেন হারমোনিয়ামে বাজত এই গান। আজ এই পুরনো ভাঙা ছায়াময় বাড়িটাতে যেন ঘুরে ঘুরে ভেসে ভেসে একটা কোনও ঝরা পাতা হয়ে গানটা নেমে আসে।

পরের মাসে বাড়িওলার কাছে ভাড়া দিতে গিয়ে বললাম, ‘আমাদের দোকানের আগে যে– প্যাসেজটা, সেটা বড্ড অন্ধকার। অনেকে ওটা দেখে ওখান থেকেই ফিরে যায়, একটা আলো লাগানো গেলে…।’

পীযূষ দত্ত টাকা গুনতে গুনতে বললেন, ‘ও বাবা, ও ব্যাপারে আমি কিছু করতে পারব না। আপনি লাবুকে, মানে আমার বোনকে বলে দেখতে পারেন। ওটা তো ওর অংশ। যদি রাজি হয়–। তবে আপনার পাশের বর্ণলিপি আগে বলেছিল শুনেছি, হয়নি।’

আমি নেমে এলাম। আলোটা লাগানো খুবই দরকার। ন’মাস হয়ে গেল এখানে এসেছি। কাউকে বলে দিলেও জায়গাটা চিনে আসতে পারে না। সন্ধে নেমে এলে তো কথাই নেই, দিনের বেলাতেও এরকম ঘটে। এ তল্লাটের অনেক বাড়ির ভেতরেই খুপরি দোকানঘর আর অফিস রয়েছে। তারা কী করে ম্যানেজ করে জানি না। আমাকে আমার ব্যাবসার কথা ভাবতে হবে।

খাওয়া শেষে, বাসন ধোওয়ার পর, দুপুর একটা নাগাদ পিসি বাড়ির একেবারে বাইরের দরজার মুখে রোয়াকটায় গিয়ে বসে থাকেন। রোজকার ব্যাপার। ভাবলাম তখনই গিয়ে আলোর কথাটা বলব। গিয়েছিলাম, কিন্তু বলা হল না। দেখি পিসি ডান হাতে চড় তোলার ভঙ্গিতে খালি পায়ে রাস্তায় নেমে ছুটছেন। সামনে দু-তিনটে দামড়া লোকও খ্যাক খ্যাক করে হাসতে হাসতে এঁকেবেঁকে ছুটে পালাচ্ছে। তাদের কেউই এ বাড়ির কোনও দোকানের লোক নয়। বাইরের। হয়তো কাস্টমার নেই কোনও, কাজ নেই অন্য, তাই সময় কাটাতে পিসিকে বেছে নিয়েছে ওরা। পিসি চেঁচাচ্ছেন– ‘এক চড়ে মাথা ভেঙে দোব। অসভ্য কোথাকার। বাড়িতে মা-বোন নেই তোমাদের?’

টানা রিকশাওলা, অন্য দোকানদার, রাস্তার লোক, ভ্যানওলারা রগড় দেখছে। আমি পা চালিয়ে পিসির সামনে গিয়ে রাস্তা আটকালাম। খানিকটা ধমকেই বলে ফেললাম, ‘এটা কী করছেন আপনি? কেন দৌড়াচ্ছেন এভাবে?’

পিসি থতমত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। হাতটা নামিয়ে নিয়ে বললেন, ‘কী বাজে বাজে কথা বলছে ওরা, জানেন না আপনি। কাউকে কিছু বলি না, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, তাও ইচ্ছে করে আমায় খোঁচাবে। পিছনে লাগবে।’

বললাম, ‘ওরা তো চায় আপনিও রেগে গিয়ে ওদের বাজে কথা বলুন। তাতেই মজা। আপনিও সব ভুলে ওদের পিছনে ছুটবেন! চলুন, এক্ষুনি ফিরে চলুন। আসুন আমার সঙ্গে। আপনিই না সেদিন গান গাইছিলেন!’

ট্যারা চোখ রাস্তার দিকে রেখে, কামিজটা সেই দু’হাতে চেপে ধরে আমার সামনে সামনে হেঁটে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়লেন তিনি। আরও কিছুটা ধমক দিয়ে বললাম, ‘এটা কী পরে থাকেন আপনি! আর কিছু নেই আপনার?’

বোধহয় চ্যাঁচাতে গিয়ে কষ জমেছিল। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার মুখে পিসি হাত দিয়ে ঠোঁট মুছলেন। আমি দোকানে বসতে যাচ্ছিলাম। উনি বললেন, ‘আপনি ওখানে কেন গেছিলেন?’

মাথা নাড়ালাম। ‘আমি আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। আর সেকথা বলে কী হবে।’

‘কী কথা? বলুন।’

‘এই প্যাসেজটায় যদি একটা আলো লাগাতে দিতেন। লোকজন আসা-যাওয়ায় সুবিধে হতো একটু। আপনার ভাড়াটেদের তো এই সমস্যা ভোগ করতে হয় না।’

গলার স্বর হালকা হয়ে উঠে যাচ্ছে ওপরে। শুনতে পেলাম উনি বলছেন, ‘লাইট কিনে নিয়ে আসুন। লাগাবে কে? মিস্ত্রিকে ডাকুন। জানেন কোথায় পাবেন? বেরিয়ে দেখুন ভারবি পাবলিশার্স কোথায়। ওই বাড়ির একদম শেষমাথায় বাপ-ছেলে থাকে, ইলেকট্রিকের কাজ করে। বলবেন চ্যাঁচানি পিসির বাড়ি। ঠিক চলে আসবে।’

আলো লাগানো হল। গলির অন্ধকারটা ছিঁড়ে গেল। যদিও তাতে আমার কতদূর কী সুবিধে হবে বোঝা যাচ্ছিল না। বাড়িতে বউয়ের সঙ্গে কথা বললাম কয়েকদিন পর। শ্রাবন্তী বলল, ‘বাবার বইয়ের দোকানটা তবু ছিল, সেটাও বিক্রি করলে। কী যে তোমার মাথায় চাপল! বাবা-মাও এই নিয়ে বলতে ছাড়ছে না। বলারই কথা। এখন যদি ব্যাবসাটা না দাঁড়ায় তাহলে কী হবে?’

বললাম, ‘সেই তো ভাবছি। আমি তো খারাপ বই করিনি। কিন্তু বিক্রি তেমন হচ্ছে না। এ ব্যাবসায় ইনভেস্টমেন্ট বেশি, রিটার্ন এত স্লো! আরও যে বই করব, ফান্ডই তো জমছে না। কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে না পড়ে তো বুঝতে পারিনি। তাছাড়া বাজারও খুব খারাপ। দেখি। তেমন বুঝলে সব বিক্রি করে চলে আসতে হবে।’

শ্রাবন্তী আবার বলল, ‘মাস গেলে টাকা তো লাগে সংসারে। সেটা যদি না আসে, চলবে কী করে?’

দোকানে বসে শ্রাবন্তীর কথাগুলোই ভাবছিলাম। তিন-চারজন এসে দাঁড়াল কাউন্টারের সামনে। ‘এটা নতুন হয়েছে, না? মালিক কোথায়?’

চিনি না এদের, তবে কাস্টমার যে নয় তা বোঝাই যাচ্ছে। বললাম, ‘বলুন কী ব্যাপার?’

‘ব্যাপার কিছু না, দুর্গা পুজোর ডোনেশান। এই পাশের গলি। পাশশো টাকা।’

‘পাঁচশো!’ চমকে উঠি। ‘এত তো আমি পারব না দাদা।’

‘না বলবেন না। নতুন বলেই দিতে হবে, পুরানো হলে দেখবেন অ্যামাউন্টটা কমে ফিক্স হয়ে গেছে।’

‘অ্যাই কে রে? চাঁদা চাইতে এসেছে কারা? কোন পুজো?’

একজন মুখ তুলে জায়গামতোই তাকাল। ‘আমরা পিসি। মুখটা বাড়াও। চিনতে পারবে।’

পিসি তরতর করে নেমে এলেন। ‘ওনার কাছে বেশি নিতে পারবে না তোমরা। একশো টাকা নিয়ে বিদেয় হও।’

‘কী বলছ পিসি! একশো টাকায় কী হয়?’

‘যা বলছি শোনো। ওতে যা হয় তাই হওয়াও।’ বলে তিনি চোখ দুটো আমার দিকে রাখার চেষ্টা করছিলেন। ‘আপনি এর বেশি দেবেন না কিন্তু।’

‘আঃ পিসি, এমন কেলোর কীত্তি করো না মাঝে মাঝে। কিছু বলতে গেলেই তো আবার চ্যাঁচাবে।’ বলতে বলতে ওরা বিলের পাতা ছিঁড়ল। ‘আর কী হবে, দিন ওই একশো। সিনিয়র সিটিজেনের কথা রাখলাম।’

ওরা চলে যাওয়া অবধি পিসি দাঁড়িয়েই রইলেন। তারপর আমায় বললেন, ‘কলেজ স্ট্রিটে ব্যাবসা করতে এসেছেন তো। অনেক কিছু দেখতে হবে।’

চেয়ারে বসে পড়েছি। ভালো লাগছিল না এসব। তবু বললাম, ‘ব্যাবসাটা যদি ঠিকঠাক হতো, তাও না হয় দেখতাম। এখন তো ভাবছি কেন এলাম।’

পিসি মুখটা গলির দিকে ফিরিয়ে নিলেন। ‘এই বই ছাপার ব্যাবসা তো আপনার বাপ-ঠাকুদ্দার নয়।’

‘না, কেন বলুন তো?’

‘আমি সেই জ্ঞান হওয়া থেকে এসব দেখছি বুঝলেন। কত পাবলিশার এ বাড়িতে এল আর গেল। আমার বাবাও প্রকাশক ছিল, জানেন? পড়ার বই নয়, গল্প-উপন্যাস-কবিতা এসব ছাপত। কত লেখক এসেছেন তখন। পয়লা বৈশাখে বই বেরোত। কিন্তু বাবা শেষ অবধি পেরে ওঠেনি। এখন যেটা যূথিকা প্রকাশনীর ঘর, ওটাই আমাদের কাউন্টার ছিল। পরে তিনটে ঘরই এক এক করে ভাড়া দিয়ে দিল। বাবা বলত ছোটো প্রকাশকের ব্যাবসা করা খুব কঠিন। পাট তুলে দিল। বইগুলো উইয়ে খেল। আপনি পারবেন তো?’

আমি বললাম, ‘এত ভেতরে বসে বসে কী করতে পারব তাই ভাবছি। বাইরে একটা বোর্ড অবধি নেই যে কেউ নাম দেখে ঢুকবে?’

পিসি বললেন, ‘আপনার খুব চিন্তা হচ্ছে, না? থাকতে থাকতে লোকে জেনে যাবে ঠিক। খুঁজে খুঁজে আসবে দেখবেন। এই তো গলিতে আলো লাগালেন, সামনের দিকে আমাদের যে শরিক থাকে ওরা আপনাকে বোর্ড দিতে দেবে না। আমি তো দুপুরবেলা আর সন্ধেবেলা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকি, কেউ জিজ্ঞেস করলে দেখিয়ে দেব– এই দিকে সোনার তরী। আপনি ভালো ভালো বই করুন। বিক্রি বাড়ানোর বুদ্ধি বের করুন। আমার বাবার মতো হবেন না। পালিয়ে গেলে কিছু করতে পারবেন না। আর শুনুন, আমার আর এবেলা কলে কাজ নেই। যান জল ভরে নিন।’

আমি অবাক হওয়াটা ঝেড়ে ফেলতে পারছিলাম না। তার মধ্যেই পিসি চলে গেলেন। একটু পরেই শুনতে পেলাম দোতলার সেই বারান্দা থেকে ভাঙা গলার গান ভেসে আসছে। ‘এই আকাশে… আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…।’

আমি কাউন্টার ছেড়ে দোকানের সামনের ছোট্ট জায়গাটায় দাঁড়াই। ওপরে তাকিয়ে ফালি আকাশটা দেখি। একঝলক চোখে পড়ে, একটা পায়রা পাকসাট দিচ্ছে। ওখান থেকে কোনও পক্ষীরাজ ঘোড়া উড়ে এসে নামবে না আমার জন্য। কিন্তু আমি যতটুকু দেখতে পাচ্ছি আকাশ তো ততটুকু নয়। খামোখা পালাতে যাব কেন?

 

দেব ও কার্তিক

একটু আগেই রংচটা ক্ষয়াটে মোবাইলটায় কেসের খবর এল। শেষ টানটা দিয়ে ভসভস করে নাকমুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল কার্তিক। চোখ বুজে কয়েক মিনিট বসে রইল। ধুনকিটা মাথায় ঠেলছে। বেশ আরাম। এবার ওঠা যেতে পারে। কলকেটা উপুড় করে ছাইটুকু মাটিতে ফেলল, তারপর পেল্লায় একটা হাই তুলে রয়েসয়ে নিজের সাইকেল ভ্যানটার কাছে গেল। ভ্যানের চেহারাও কার্তিকের মতোই। একেবারে খ্যাঁচাখোঁচা। মাঝরাস্তায় ফেলে দিয়ে আসলে চোরেও ছুঁয়ে দেখবে না, উলটে সারানোর পয়সা রেখে যেতে পারে। মাডগার্ড নেই, ঢিলে চেন বারবার পড়ে যায়। চাকার টায়ারে কার্তিকের বয়েসের থেকে বেশি গ্যাটিস মারা। তিনটে রিঙেই টাল রয়েছে। লগবগ করতে থাকে চালানোর সময়। মনে হয় বুঝি চাকাগুলো খসে গেল। ব্রেক নামকা ওয়াস্তে। ইচ্ছে হলে ধরে, কখনও ধরে না। হর্নের আওয়াজ ডিম ফুটে বেরোনো চড়ুইয়ের মতো। ভ্যানের তক্তাগুলো সব ঢিলে হওয়ার কারণে হর্ন দিতে লাগে না। গাড়ি চললে তার বিচিত্র আওয়াজে লোকে এমনিই বুঝতে পারে পিছন থেকে কিছু একটা আসছে। তার সঙ্গে কার্তিক মাঝেমধ্যেই মুখে হুই হুইইইইই করে শব্দ করে হর্নের বদলে। কিন্তু এই ভ্যানটা আছে বলেই না কার্তিকের গাঁজার পয়সা ছাড়াও পেটে কিছুটা চাল, ডাল, তেল পড়ার পয়সা জোটে।

আসলে কার্তিকের বুদ্ধি কম। আর যাদের বুদ্ধি কম, তাদের অনুভূতিও কম। সুতরাং কার্তিকের অনুভূতিটুতি সেই ছোটোবেলা থেকেই একটু ফিকে। বাবা-মা, ভাই-বোন, বেয়াই, মুনাই, জগাই-মাধাই সব হারিয়ে বত্রিশ বছর বয়েসের কার্তিক একেবারেই একা। হদিশপুরের ফরালপট্টি নামের একটা আধা গ্রাম মার্কা মফসসল পাড়ার একেবারে শেষপ্রান্তে, বাঁশবাগান শুরুর মুখে ও থাকে। ওর সঙ্গে থাকে শুধু এই ভ্যানটা আর একচিলতে জমির ওপর টালির ছাউনি দেওয়া ছিটেবেড়ার এক ঘুপচি ঘর। ঘরের এককোণে একটা নড়বড়ে পায়ার খাটিয়া, খাটিয়ার তেলচিটে বালিশের তলায় রগরগে ল্যাংটো মেয়ের ছবিওলা খাস্তা হয়ে যাওয়া দুটো ছবির বই। নারকোলের দড়িতে ঝোলানো কয়েকটা জামা প্যান্ট, লুঙ্গি। অন্য কোণে জনতা স্টোভ, কুচকুচে কালো হাঁড়ি, কড়াই, বাটি, খুন্তি আর থালা। ব্যস কার্তিকের সংসার কমপ্লিট।

উঠোন থেকে ভ্যানটা বাইরে এনে সিটে চেপে বসে লগবগ করতে করতে চলল কার্তিক। ওর গন্তব্য এখন হদিশপুর রেলস্টেশন। আজ আবার একটা কেস ঘটেছে। কেস শব্দটা কার্তিক শিখেছে জিআরপি-র কাছ থেকে। এখন শব্দটা ওর মনেও সেঁটে গেছে। কারণ কেস মানেই পয়সা। বেশ ভালো পয়সা।

আসলে হদিশপুর, মোল্লাবাজার আর ভাঙনহাটি এই তিনটে রেলস্টেশনের মধ্যে যদি কেউ লাইনে কাটা পড়ে কিংবা গলা দেয় তাহলে সেই বডি হদিশপুর মর্গে পৌঁছানোর দায়িত্ব কার্তিকের। জিআরপি-র লোক বডি কাপড়, প্লাস্টিক দিয়ে মুড়ে দেয়। তারপর সেটাকে ভ্যানে চাপিয়ে মর্গে জমা দেওয়া পর্যন্ত কার্তিকের কাজ। সাত বচ্ছর হয়ে গেল এই কাজে। তার আগে ওই ভ্যানে করেই পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে কাঁচাসবজি বেচত। কিন্তু বুদ্ধি কম থাকলে আর যাই হোক ব্যাবসা হয় না। কার্তিকেরও হল না। খদ্দেররা প্রায় সবাই ঠকাত কিংবা পরে দাম দেব বলে আর কেউ দিত না। ব্যাবসা লাটে। তারপর কিছুদিন স্টেশনের সামনে নাড়ুর মুরগির দোকানে মুরগি ছাড়ানোর কাজ করল। সেটাও হল না, একদিন তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে মুরগির গলার সঙ্গে নিজের ডানহাতের আঙুলটাও নামিয়ে ফেলল বটিতে। ছেড়ে দিল কাজ। শেষে পাড়ার বন্ধু শ্যামল বাঁচাল। বলল, ‘দেখ ভাই, ভগবান তোর ঘটে ছাগলের নাদির সাইজেরও ঘি দেয়নি। সুতরাং ওসব ব্যাবসা ফ্যাবসা তোর দ্বারা হবে না। বরং আমার খোঁজে একটা কাজ আছে করবি?’

এই কাজ প্রথম দিকে করতে জান বেরিয়ে যেত, ঘেন্নায়, ভয়ে। ভেবেছিল ছেড়ে দেবে। কিন্তু শালা খিদের ভয় এত মারাত্মক যে…। শ্যামল বলল, ‘খবরদার কাজটা ছাড়িস না। এটা কিন্তু হাফ সরকারি চাকরি। তোকে কেউ কোনওদিনও ছাড়াবে না। আর ঠাকুরের আশীর্বাদে কাটা পড়া, গলা দেওয়ার কেস তো দিনে দিনে বাড়ছে বৈ কমছে না। তুই না খেয়ে থাকলে কেউ দুবেলা ভাত দেবে না। প্রথমদিকে এট্টু চাপ যাবে, তারপর সয়ে যাবে দেখবি। আরেকটা জিনিস শিখিয়ে দিচ্ছি। সেটা করে বেরোবি, একটুও পবলেম হবে না আর। সেই জিনিসটা হল মহাদেবের প্রসাদ। মাথায় ঠেকিয়ে টানতে হয়।’

কার্তিক শিখে নিল কীভাবে কলকে ধরতে হয়, মশলা ঠুসতে হয়, ছিলিম টানতে হয়। বুকের খাঁচায় আপ্রাণ ধোঁয়া নিয়ে বমকে চেপে রেখে তারপর ভুসভুস করে ছাড়তে হয়। সত্যি সত্যি,

চার-পাঁচ টান দিয়ে কাজে নামলে আর কোনও ঘেন্না, ভয় লাগত না। তবে নেশাটা বেড়ে গেল অনেকটাই। ফলে শরীরটা দড়ি পাকিয়ে দু-টাকা প্যাকেটের কালো আমলকির মতো হয়ে গেল। সে হোক গে। যে ক’দিন বাঁচতে হবে দুবেলা খেতে পেলেই হল, শরীর দিয়ে কী হবে? বিয়ে থা তো আর এজন্মে হবে না।

টিপিকাল গেঁয়ো মফসসলের ঘেয়ো রাস্তার ওপর দিয়ে লটবহর নিয়ে ভ্যান চালাতে চালাতে আকাশের দিকে দেখল কার্তিক। ভাদ্র মাসের বিকেল চারটে। আজ সারাদিন খুব গুমোট। দরদরিয়ে ঘাম হচ্ছে। বৃষ্টি হলে ভালো হয়। হবে কি?

আরও খানিকটা এগোনোর পর মেন রাস্তাতেই চলচিত্রম সিনেমা হলের সামনে ভ্যান সমেত থমকে গেল ও। হেব্বি চমকে গেল। উরেশশাললাহ– গুরুর বই চলছে! প্রায় মাসখানেক হল ভাঙনহাটিতে কোনও কেস হয়নি বলে আসা হয়নি। তাই জানাও ছিল না যে গুরুর বই দিয়েছে এখন। দেবকে মনে মনে গুরু মানে কার্তিক। শালা যেমন ফিগার আর তেমনি ঝাড়পিট করতে পারে। মিঠুনের পর এমন ঝাড়পিট আর কেউ পেরেছে? সিনেমা হলের দেয়ালে বিশাল বড়ো দেবের পোস্টার। রক্তমাখা দেব একটা মেয়েছেলের বডি কোলে নিয়ে চিৎকার মারছে। মেয়েছেলেটা কি নায়িকা? মরে গেছে? হেব্বি অ্যাকশন হবে নিশ্চয়ই। ইশশ কতদিন গুরুর বই দেখা হয়নি। কাউন্টারের সামনে তেমন ভিড় নেই। তার মানে হপ্তাখানেক নিশ্চয়ই পেরিয়ে গেছে বইটা।

দেবের প্রচুর বই দেখেছে কার্তিক। আর যেদিনই দেখেছে সেদিনই ওর গাঁজার ধোঁয়ামাখানো ঘিলুতে রাত্তিরে ভর করেছে দেব। ঘরের এককোণে বাঁশের খুঁটিতে ঝোলানো এই টুকুন একটা ঘষা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে লম্পর আলোয় একা একা দেব সেজে কম ঝাড়পিট করেছে গুন্ডাদের সঙ্গে? কচুকাটা করেছে সবক’টাকে। কখনও দুহাতে বন্দুক ঘুরিয়ে কখনও তলোয়ার ঘুরিয়ে। তারপর কোয়েল, শ্রাবন্তী, মুমতাজ, নুসরতের সঙ্গে নেচেছে। নাচতে নাচতে কিংবা অ্যাকশন করতে করতে কখন যে মাটিতে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেরও খেয়াল থাকেনি। বাংলার একনম্বর হিরো হল দেব। ওর ঘরের ছিটেবেড়ার দেয়ালে একটা দেবের পোস্টারও রয়েছে।

খুব খুঁটিয়ে পোস্টারের এদিক-ওদিক দেখে নেহাৎ অনিচ্ছায় প্যাডেলে আবার চাপ দিল কার্তিক। বইটা দেখা হল না। খুব আপশোশ লাগছে। মন পড়ে রইল চলচিত্রম হলের দেয়ালে আর মিনিট পনেরোর মধ্যে কার্তিক পৌঁছে গেল হদিশপুর জিআরপি অফিসে। ঢোকামাত্র বড়োবাবুর পেল্লায় ধমক। ‘শুয়োরের বাচ্চা, আসতে ইচ্ছে করে না নাকি রে তোর? এইটুকু রাস্তা আসতে কতক্ষণ লাগে? সেই বিকেল থেকে বডি পড়ে রয়েছে।’

এই খিস্তিটুকুতে জলখাবারও হয় না কার্তিকের। পেটভরা তো দূরের কথা। সামান্য বিগলিত হাসল।

‘তোকে তো বলেও কিছু লাভ নেই। সবসময় ধুনকিতে রয়েছিস।’ বড়োবাবুর কথায় আশপাশের কনস্টেবলগুলো হেসে উঠল।

‘দে বডিটা তুলে দে।’ বড়োবাবুর আদেশমাত্র অফিসের বাইরের ঘরটা থেকে প্লাস্টিক মোড়া বডিটা দুজন জমাদার ধরাধরি করে তুলে দিল কার্তিকের ভ্যানে।

‘তাড়াতাড়ি পৌঁছে দিস। আবার রাস্তায় বডি সমেত লাট খেয়ে পড়ে থাকিস না। আজ বৃষ্টি হতে পারে,’ বলে একটা একশো টাকার নোট আর একটা কাগজ ধরিয়ে দিল ছোটোবাবু। টাকাটা কার্তিকের ভ্যানভাড়া আর কাগজটা মর্গে বডির সঙ্গে জমা করতে হবে। এসব মুখস্ত হয়ে গেছে কব্বে…। মেয়েছেলের বডি, জেনে নিয়েছে কার্তিক।

ফেরার পথে আবার ঠিক সেইখানেই থেমে পড়ল কার্তিক। চলচিত্রমের সামনে। সেই পোস্টারটার গায়ে এখন দুটো বাম্পার চোখ ঝলসানো লাইট ফেলা রয়েছে। আরও ফাটাফাটি লাগছে গুরুকে। বইটা সত্যিই দেখা হবে না! কথাটা মনে আসতেই মেজাজটা খিঁচড়ে গেল। শালা কপালটাই খারাপ।

দু-তিনবার মেঘ ডাকল চাপা স্বরে। সন্ধে নেমে গেছে। এখনও ভাঙনহাটি মর্গ মেন রাস্তা ধরে অনেকটা। প্রায় ঘন্টাখানেক তো বটেই। ভাবতে ভাবতে গায়ে দুফোঁটা জল পড়ল আকাশ থেকে। আর বৃষ্টির সঙ্গে কয়েকফোঁটা বুদ্ধিও এসে টুপ করে পড়ল কার্তিকের মাথায়। ভ্যান থেকে নেমে শোয়ানো বডিটার সামনে এল ও। আগাপাশতলা প্লাস্টিক দিয়ে মোড়া। তার ওপর আবার একটা প্লাস্টিক টানটান করে তার কোণাগুলো দড়ি দিয়ে এমন করে বাঁধা রয়েছে যে, বাইরে থেকে কারও বোঝার উপায় নেই ভেতরে কী রয়েছে। এইভাবেই বরাবর বডি নিয়ে যায় কার্তিক, নইলে রাস্তায় লোকে ডিস্টার্ব করে। দুনিয়ার প্রশ্ন লোকের।

খুব ধীরেসুস্থে সাবধানে ভ্যানটাকে হাতে ঠেলে সিনেমা হলের চত্বরে ঢুকিয়ে নিল কার্তিক। চত্বরটা ফাঁকা। হলের সামনেও লোকজন কেউ প্রায় নেই। বই শুরু হয়ে গেছে বোধহয়। নাকি শেষ? ভ্যানটাকে এককোণে রেখে গুটিগুটি পায়ে টিকিট কাউন্টারের কাছে গেল। মুখ নামিয়ে বলল, ‘দাদা বই শুরু হয়ে গেছে?’

‘এই একটু আগে হল। কটা চাই?’

‘একটা দিন।’ লুঙ্গির গেঁজ থেকে একশো-র ভাঁজ দেওয়া নোটটা আরও ভাঁজ করে শেষ পর্যন্ত গলিয়েই দিল কার্তিক। সত্তর টাকা আর একটা লাল রঙের টিকিট ফেরত এল হাতে। টিকিট হাতে নিয়ে ভেতরে ঢোকার আগে আরেকবার পিছন ফিরে ভ্যানটাকে দেখল কার্তিক। চুপ করে দাঁড়িয়ে রয়েছে ওটা, আর সামনে একটা নেড়িকুকুর ওটার দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়ছে।

আবার মেঘ ডাকল। প্ল্যান মনে মনে ছকা হয়ে গেছে। বই দেখে তারপর বডি নিয়ে মর্গে যাবে। দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করলে বলতে হবে বৃষ্টিতে রাস্তায় আটকে গেছিলাম। ব্যস। জয়গুরু বলে অন্ধকার হলে ঢুকে পড়ল কার্তিক। এই হলে আগেও অনেকবার বই দেখেছে ও। সিট নাম্বার বলে কিছু নেই। যে আগে ঢুকবে তার নিজের পছন্দের মতো সিটে বসে পড়বে। ঘষা ধোঁয়াটে স্ক্রিন। সামনের দিকের বেশ কিছু চেয়ার ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়ে রয়েছে। বোঝাই যায় এই অবদান দর্শকদের। আসলে এই হলটায় কিছুদিন আগেও তেড়ে পানু চলত। বাইরে পোস্টার থাকত আশির দশকের কিছু সস্তার হিন্দি ছবির। সেই ছবি শুরুও হতো, কিন্তু চলার কিছুক্ষণ পরেই চালু হয়ে যেত সাউথ ইন্ডিয়ান ব্লু। মাঝেমধ্যেই সেই ছবি অদ্ভুত ভাবে উলটে যেত কিংবা পুরোটা অন্ধকার হয়ে যেত। তখনই দর্শকের অশ্রাব্য খিস্তি। চেয়ারে লাথি। অনেক সময়ে দর্শকের হুকুমে একই সিন দুবার করেও চালাতে হতো প্রজেক্টরদের। এইসব ছবির দর্শক ছিল সব ভ্যানওলা, রিকশাওলা কিংবা সবজিওলা, মিস্তিরি আর স্কুলকলেজে পড়া কিছু উঠতি বয়েসের ছেলে। পুলিশকে প্রতি সপ্তাহে নমস্কারি দিয়ে আসতে হতো হল কর্তৃপক্ষকে।

তবু মাঝেমধ্যে রেড পড়ত আচমকা। যেসব দর্শকরা পিছনের দরজা দিয়ে পালাতে পারত না, ধরা পড়ত। হলের লোকের সঙ্গে পুলিশ ভ্যানে উঠতে হতো তাদেরও। বেশ কয়েকদিন বন্ধ থাকত হলটা। তারপর আবার যেই কে সেই। কিছুদিন আগে একটা বড়োসড়ো কেস খাওয়ার পর হলটা এখন পানু ছেড়ে বাংলা বই চালাচ্ছে। হল ভরতি নয়। সিটে বসে পড়ল কার্তিক। ওই তো গুরু… উহ্ কী দেখাচ্ছে দেবকে। পাশে একজন লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে সিটের ওপর পা তুলে বিড়ি টানছিল, তাকে জিজ্ঞেস করল কার্তিক। ‘কখন শুরু হল?’

‘এই তো এট্টু আগে।’

‘যাক তার মানে বেশি লস হয়নি।’ খানিকক্ষণের মধ্যেই ডুবে গেল ছবিতে।  মারকাটারি বই। উহহ না দেখলে যে কী লস হতো…। হেব্বি অ্যাকশন। দেবের নায়িকাটাকে অনেকগুলো গুন্ডা মিলে ছিঁড়েখুঁড়ে খাওয়ার জন্য তুলে নিয়ে পালাচ্ছিল। পাহাড়ের ধারে একটা জায়গায় শুইয়ে দিয়ে সবে জামাকাপড় ছিঁড়তে শুরু করেছে তখনই বাইকে করে গুরু এসে গেল। হাতে একটা লোহার রড। তারপর পনেরো-ষোলোটা গুন্ডার সঙ্গে একা ঝাড়পিট করল গুরু। রডের বাড়িতে, লাথিতে, ঘুসিতে সবকটাকে শুইয়ে দিল। কিন্তু লাস্টে তবু পারল না হিরোয়িনকে বাঁচাতে। আসলে ভিলেন দেবকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছিল। নায়িকাটা সামনে চলে আসায় দেব বেঁচে গেল কিন্তু মেয়েছেলেটার বুকে গুলি লাগল। মরে গেল মেয়েটা।

নায়িকাকে বুকে জড়িয়ে দেব এমন চিৎকার করে কাঁদছিল যে কার্তিকের চোখেও জল চলে এসেছিল। ইচ্ছে করছিল ভিলেনটাকে নিজের হাতে ক্যালাতে। তারপর দেব স্রেফ মুঠো পাকিয়ে একটা ঘুসি মারল ভিলেনটাকে। মালটা সেই ঘুসিতেই পাহাড় থেকে পুরো খাদে। সব্বাই হাততালি দিল। কার্তিকও। কিন্তু মনের ভেতর থেকে কষ্টের দলাটা নামল না। এত সুন্দর মেয়েটা মরেই গেল শালা। নায়িকাটার নাম জানে না কার্তিক। কিন্তু দেবের মতোই কাঁদতে ইচ্ছে করছিল ওর। খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। খুব কষ্ট নিয়ে হলের বাইরে আসতেই তুমুল চমক।

ওর ভ্যানটার সামনে ভিড়ে ভিড়। কয়েকটা কুকুর বিটকেল চিল্লাচ্ছে। আর ওর ভ্যানে শুইয়ে রাখা বডিটাকে টেনে নামানোর জন্য প্লাস্টিকটাকে সবকটা মিলে এমনভাবে টানাটানি করছে যে, প্রায় ছিঁড়ে ফালাফালা হয়ে গেছে ওটা। বডির বেশ খানিকটা দেখা যাচ্ছে এখন। সামনে দাঁড়ানো সবকটা লোকও বেজায় চিৎকার করছে। চুপ করে কিছুক্ষণ দাঁড়াল কার্তিক। এবার কী করা উচিত ভাবার চেষ্টা করল। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হচ্ছে। ‘কোন শুয়োরের বাচ্চা রেখে গেছে আমরা কী করে জানব?’ একজন চিল্লাল।

‘আরে কেউ বুঝতে পারত নাকি? কুকুরগুলো টানাটানি করে প্লাস্টিকটা ছিঁড়ল বলেই তো বোঝা গেল ভেতরে বডি রয়েছে। কী ঝামেলা বলুন তো এখন পুলিশের ঠেলা…।’

কার্তিক একবার ভাবল বডি ছেড়ে কেটে পড়বে। কিন্তু কুকুরগুলো এমনভাবে বডিটার পা ধরে কামড়ে নামাতে চাইল যে আর নিজের মাথার ঠিক রাখতে পারল না কার্তিক। আর দেরি করলে মেয়েছেলেটাকে সবার সামনে খুবলে খাবে ওগুলো।

আই সা..ল..লা..হ বলে দুহাত ছড়িয়ে দিগ্বিদিগ্ জ্ঞান হারিয়ে কুকুরগুলোর দিকে ছুটে গেল কার্তিক। কুকুরগুলো কার্তিকের এমন মারমুখী চেহারা দেখে একটু থমকাল, তারপর আবার বডিটার এদিক-ওদিক কামড়ে ভ্যান থেকে নামানোর চেষ্টা করল। সামনে দাঁড়ানো লোকগুলো যেন তামাশা দেখছে। সামনে পড়ে থাকা একটা কাঠের টুকরো তুলে এলোপাতাড়ি ঘোরাতে শুরু করল, দমাদ্দম পেটাতে শুরু করল যেটাকে সামনে পেল, অবিকল…

মিনিট কয়েকের মধ্যে রণে ভঙ্গ দিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে চেল্লাতে থাকল কুকুরগুলো। আর কার্তিক বড়ো বড়ো নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ভ্যানে শোয়ানো শরীরটাকে আবার গুছিয়ে নিয়ে ভ্যান টেনে চুপচাপ চলে যেতে গেল, ঠিক তখনই ওকে আটকাল ভিড়ের কয়েকটা লোক।

‘এই ভাই এই, এটা কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?’

‘মর্গে।’ মেজাজ নিয়ে উত্তর দিল কার্তিক। কুকুরগুলোর হাত থেকে মেয়েছেলেটাকে বাঁচাতে পেরে মনটা ফুলে উঠেছে। ভাগ্যিস ঠিক সময়ে এসে পড়েছিল। নইলে…

‘মানে?’ সবাই তাকাল ওর দিকে।

‘বই দেখতে ঢুকেছিলাম। এই বডি আর ভ্যান আমার। এই যে আমার কাছে জিআরপি-র কাগজ রয়েছে। বডিটা মর্গে…’

আর কথা শেষ হল না। কারও একটা সলিড থাপ্পড় এসে পড়ল কার্তিকের গালে। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে গেল কার্তিক।

শুরু হল অবিরাম লাথি, ঘুসি… আর খিস্তি। ‘শালা বাইরে লাশ রেখে সিনেমা মারাতে এসেছ… পাতাখোর…তোর রস বার করছি…’ মার খেতে খেতে বারবার দেবের কথা মনে পড়ছিল কার্তিকের। হেব্বি ইচ্ছে করছিল গুরুর মতো ইয়াআআ করে দুহাত ছড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে সবকটাকে ক্যালাতে। একটু আগে যেভাবে কুকুরগুলোকে…। পারল না। মাটিতে কুঁকড়ে বসে একবার চোখ মেলল কার্তিক। তাকাতেই দেখল ওর পাশে বসা সেই লুঙ্গি পরা লোকটাও পা তুলছে ওকে লাথি মারবে বলে… আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল।

অনেক রাত্তির। বৃষ্টি পড়ছে অঝোরে। বারবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হু হু ফাঁকা রাস্তার এক ধারে থুবড়ে শুয়ে ছিল কার্তিক। জবজবে ভিজে। নড়াচড়া করতেও কষ্ট হচ্ছে। গোটা গায়ে অসহ্য ব্যথা।

বাঁ-চোখে কিছুই প্রায় দেখতে পাচ্ছে না। চোখটা পাবলিকের মারের চোটে গেছে বোধ হয়। অনেক উঁচুতে ল্যাম্পপোস্টের হলদেটে আলোটা বৃষ্টির ধোঁয়ায় ঝাপসা। হামাগুড়ি দিয়ে ভ্যানের চাকা ধরে কোনও মতে উঠে দাঁড়াল। এমন ক্যালানি বাপের জন্মে খায়নি ও। উহহ্…। মুখ ফুলে ঢোল। ঠোঁটের কষে রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। একেবারে গুরুর মতো অবস্থা। বিদ্যুতের আলোয় ওর মুখটা অদ্ভুত লাগছে। হঠাৎ দাঁত কিড়মিড় করে বাঁহাতের তর্জনী তুলে কাউকে তীব্র শাসাল কার্তিক। তারপর রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়াল। তুমুল বৃষ্টি পড়ছে। ছেঁড়াখোঁড়া প্লাস্টিকটা দিয়েই কোনওমতে ঢাকা দেওয়া ভ্যানের ওপর শোওয়ানো বডিটা। আজ আর মর্গে পৌঁছোতে পারেনি ও। শরীরে কুলোয়নি। তুমুল ক্যালানি খাওয়ার পর ভ্যান চালিয়ে খানিকটা যাওয়ার পরেই রাস্তার একধারে কেতরে পড়েছিল। মোবাইলটাও হারিয়েছে বলে কাউকে খবর দিতে পারেনি। কাল কপালে অশেষ দুঃখ আছে। কাজটা আর থাকবে না নিশ্চয়ই। কিন্তু কিছু করার ছিল না। শরীরে দিচ্ছিল না অত দূর ভ্যান টেনে যাওয়ার।

ভ্যানটার দিকে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে থাকল কার্তিক। মাথার ভেতর অনেক ভাবনা আসছে। ঝিমঝিম করছে মাথাটা। বারবার ক্যালানি খাওয়ার দৃশ্যটা মনে পড়ছে আর ভেতরটা রাগে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে। রাগটা বাড়তে বাড়তে একসময় প্রায় ঘোর লাগিয়ে দিল কার্তিকের সরষের দানার সাইজের ঘিলুতে। আস্তে আস্তে ভ্যানের চারদিকটায় পাক দিল। তারপর বেঘোরেই ভ্যানের সামনে এসে দড়িগুলো খুলে একটানে প্লাস্টিকটা সরিয়ে দিল ও। বডিতে জড়ানো কাপড়টা খুলতে এই জীবনে প্রথমবার খানিকটা যেন চমকালো কার্তিক। মুখ ঝুঁকিয়ে মেয়েটার মুখ খুব সামনে থেকে দেখল। চোখদুটো খোলা। মুখের কোথাও আঘাতের চিহ্ন নেই। কী সুন্দর মুখটা! হয়তো সুইসাইড নয়, ট্রেনে ধাক্বা খেয়ে দূরে ছিটকে পড়েছিল। আবার বিদ্যুৎ চমকানোয় মুখটা একঝলক দেখতে পেল। খুব চেনা মুখ… কোথায় যেন… দেবের নায়িকাটার মতো…?

হঠাৎ যেন মাথাটা পুরো এলোমেলো হয়ে গেল কার্তিকের। একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তাকিয়ে রইল মেয়েটার শরীরের দিকে। বুকের খাঁচা বেলুনের মতো ফুলছে নামছে উত্তেজনায়। শুয়োরের বাচ্চা… ইয়ায়ায়ায়ায়া… করে

দু-হাত ছড়িয়ে উঠে দাঁড়াল একবার, অবিকল দেবের স্টাইলে। তারপরেই মেয়েটার সামনে হাঁটু গেড়ে দুমড়ে নেতিয়ে বসে পড়ল। আকাশের দিকে মুখ তুলে করুণ কুকুরের মতো সুর করে বিকৃত কান্নার আওয়াজ তুলল। দু-হাত ছড়িয়ে কান্নার অভিনয় করতে করতে হঠাৎ সত্যি সত্যিই একটা মোচড় দেওয়া দুঃখ হল সামনে শুয়ে থাকা অচেনা মেয়েটার জন্য। নিজের বেখেয়ালেই কয়েক ফোঁটা জল বেরিয়ে এল ওর চোখ থেকে, অকারণে। কিন্তু নায়কদের সত্যি সত্যি কাঁদতে নেই বলেই বোধ হয় বৃষ্টির জল সঙ্গে সঙ্গে ধুইয়ে দিল সেই কান্না। বারবার বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। কার্তিক চোখ বুজে বসে রইল সেই বৃষ্টিতে। আর মৃত মেয়েটার অবাক খোলা চোখের ভেতর বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়তে থাকল অবিরাম।

 

জ্যামিতিক

‘একটা চতুষ্কোণ মাটি দরকার, বুঝলেন?’ নীলাভ মাংকি-ক্যাপটাকে কপালের নীচে আকর্ষণ করল। অসম্ভব ঠান্ডা পড়েছে। বাতাস ভারী হয়ে আছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। তাছাড়া, মর্নিংওয়াক শব্দটায় যতটা আরাম এবং স্বাস্থ্যচর্চা মিশে আছে, বাস্তব অবশ্য অন্য কথা বলে। এই হাত, পা, এই শরীর এতটাই জড় যে, সামান্য নড়াচড়াও ভীতিকর। মানস হাতের রুপো বাঁধানো লাঠিটা জোরে ঠুকল মাটিতে, ‘কী হল? দাঁড়িয়ে পড়লেন যে।’

‘আসলে, ভাবছি। ক’দিন যাবৎ একটা কথাই ভাবছি’ নীলাভ মানসের চোখের দিকে তাকায় ‘একটা বাড়ি করতে পারিনি এখনও! আমার একটু মাটি চাই। দেড়-দুকাঠা হলেও হবে। খোঁজ আছে নাকি?’

‘বাড়ি? সাতকুলে কেউ নেই আপনার, বাড়ি করবেন কার জন্য?’

মানস থমকে গেল।‘আমার জন্যই। একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখছি। খুব লোভ হচ্ছে জানেন! ভাবতেও ভালো লাগে! নিজের বাড়ি!’ নীলাভ অপ্রস্তুত হাসি লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করে।

মানস হেসে ফেলে। ‘এটা আবার ব্যাপার নাকি? হয়ে যাবে। ঠিক আছে। জানা রইল।’ মানস ভিজে ঘাসের উপর ফের লাঠি ঠুকল। শব্দ হল না। ভেজা মাটি কোনও শব্দ করে না। লাঠিটা দেখতে দেখতে বাস্তবের মাটিতে পা রাখছিল নীলাভ– ‘আচ্ছা! আজ দেখছি লেঠেল হয়ে বেরিয়েছেন! শখ?নাকি প্রয়োজন?’‘আরে, প্রয়োজন ছাড়া কি আর…! বুড়ো হতে কার ভালো লাগে বলুন? ক’দিন ধরেই যন্ত্রণা হচ্ছে পায়ে। তো, গিন্নি লাঠিটা এগিয়ে দিলেন, সঙ্গে রাখো। আরাম হবে। দেখছি কথাটা মিথ্যে নয়। আসলে, ভারটা অন্যের উপর রাখলে স্বস্তি মেলে।’ মানসের হাসি দেখতে দেখতে নীলাভর ঠোঁটও প্রসারিত হতে থাকে। স্থির লক্ষ্যে পৌঁছোনোর আগেই অবশ্য থেমে যায় নীলাভ। সত্যিই কি বার্ধক্য এসে গেছে? তাই কি চট করে ঠান্ডা লেগে যায়?

‘সব কিছু পালটে গেল কীরকম। এই শহরে তেত্রিশ বছর কাটিয়ে দিলাম। যখন এসেছিলাম চব্বিশ পঁচিশের টগবগে ঘোড়া!’ নীলাভ কুয়াশার ভেতর দৃষ্টি নিক্ষেপ করার চেষ্টা করে।

‘আমি যে পাঁচবছর ধরে আছি, আমারই তাই মনে হয়। পড়শি পর্যন্ত পালটে যায় মশাই। শহর একেই বলে।’ হা-হা শব্দে হাসে মানস। নীলাভ মনে মনে হাসে। মানস ভাড়াটের কথা বলছে। পাঁচ বছরের মধ্যে বাড়ি বানিয়েছে। ভাড়াটে বসিয়েছে। সারাদিন খ্যাঁচম্যাচ্! ধুর! নিজের বাড়িতে নিজের সঙ্গে বাস করার আনন্দ বুঝবে না মানস। বাড়ির সঙ্গে গৃহস্থের যা সম্পর্ক, ভাষার সঙ্গে বর্ণমালার সেই সম্পর্ক।

মানসের হাসির শব্দে জগিং-এ ব্যস্ত তরুণী চমকে তাকাল। দু-একজন স্বাস্থ্য অন্বেষণকারী ওঁদের দেখছে বুঝে লজ্জিত হয় নীলাভ– ‘আস্তে! আস্তে!’

‘ওঃ! ভাষার সঙ্গে বর্ণমালা আর গৃহস্থের সঙ্গে বাড়ি? দারুণ!’

‘কথাটা চুরি করেছি। গণিতশাস্ত্রবিদ ইউক্লিডের কথা এটা। অবশ্য একটু অন্যভাবে বলা।

‘তো, কী বলছিলেন? গৃহস্থ আর বর্ণমালা…?’

নীলাভ হাসল। ‘দেখুন, এসব তত্ত্বের জন্য যুক্তিতর্ক দরকার হয় না। একে স্বতঃসিদ্ধ মেনে নিতে পারেন। সত্য বলে ভাববেন।’

‘না না! তা বলছি না। তবে, কথাটা বেশ।’ মানস লাঠিখানা মাটির উপর থেকে তুলে নেয়। নীলাভ একটু দাঁড়াল। ইদানীং হাঁপ ধরে যাচ্ছে সহজেই। দুপাক হাঁটতেই মাঠটাকে বিশাল এবং ভয়ংকর বলে মনে হচ্ছে। যেন বিরাট শূন্যতা গিলে খেতে আসছে। যেন হারিয়ে যাবে নীলাভ এই মহাশূন্যতায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক ও মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। কেন পালটে যাচ্ছে শরীর, বা কেন মানসিক অবস্থা পরিবর্তিত হয়ে যায় তার কোনও যুক্তিতর্ক নেই। প্রশ্ন নেই। এসব হল স্বতঃসিদ্ধ।। এলিমেন্টস নামক বইতে ইউক্লিড একথা বলেছেন।

মানস গিন্নির দেওয়া লাঠিখানাকে ফের ভেজা মাটির উপর বসিয়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। একটা লাঠি তো নীলাভরও দরকার ছিল। কিন্তু কে এগিয়ে দেবে সেই স্বস্তি-দণ্ড? মানস জানে সাতকুলে কেউ নেই নীলাভর। যদি থাকত, তবে এই কুয়াশাভরা মাঠে রুপোর লাঠি আজ নীলাভর হাতেও থাকত।

এখনও কুয়াশা ছড়িয়ে আছে মাঠ জুড়ে। দূরে দূরে দু-একটা ধোঁয়ামূর্তি নজরে আসে। শুদ্ধ বাতাস শহরে নেই। চারপাশে কি কুয়াশা? নাকি ধোঁয়াশা?

‘আজ মেয়ে-জামাই আসছে গোরখপুর থেকে। ওখান থেকে নেপালে গেছিল। মায়ের জন্য নানাবিধ গিফ্ট আসছে। ওর মা-তো গত কাল থেকেই টেনশনে… কী আনবে ওরা…!’ মানসের সুখী মুখে লালচে গোলাপ ফুটেছে। এই তো জীবন! সুখ নিয়ে বেঁচে থাকা। মানস হাসিহাসি মুখ করে, ‘গিন্নি বায়না ধরেছেন জামাইকে মালাই চিংড়ি খাওয়াবেন। নারগিসি কোফতা বানাবেন! হই হই কান্ড। বুঝেছেন?’

বুঝল নীলাভ। মানস এখন ফিরতে চাইছে। কাজ আছে বাড়িতে। ফিরে আসতে গিয়ে শর্টকাট করতে চাচ্ছিল মানস। নীলাভ কথাবার্তায় ভুলিয়ে সোজাপথে নিয়ে এল মানসকে। শর্টকাট অপছন্দ নয়। তবে, ওই পথটা বড়ো কঠিন পথ। একটা অস্বস্তিকর অবস্থা তৈরি হয়। মাস ছয়েক আগে একদিন অবশ্য গেছিল। আজ আর গেল না। একদিন গেলে কদিন যাবৎ অস্বস্তিটা জাপটে থাকে শরীর-মনে। বড্ড কষ্ট হয়। ভয় হয়। যেন স্বপ্নে দেখা নিঃসঙ্গ পথ। আলো নেই। আশ্রয় নেই। শূন্যতা কেবল। ভালো লাগে না। আবার, ভুলেও থাকা যায় না।

বাজারের রাস্তা ধরল মানস। বাজার ছাড়িয়ে ডানদিকের সরু গলিতে ঢুকে পড়ল নীলাভ। এবার শর্টকাট। তার আস্তানাটা আবার কাছে নয়। সোজাপথে সময় লাগবে।

বাসার কাছাকাছি আসতেই সীমন্তর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মেসবাড়ির মেস-ম্যানেজার সে-ই। বাজার সেরে ফিরছে। নীলাভকে দেখে দাঁড়াল। ‘নীলাভদা যে! আজ বিফোর টাইমে!’

হাসে নীলাভ। ‘কী আনলে। কী মাছ?’

‘মাছ নয়। মাংস। সবাই ধরে বসল।’

‘কেন? কোনও ব্যাপার আছে বুঝি?’

‘না, মানে ওই আর কী…!’ সীমন্ত এদিক-ওদিক তাকায়।

ছেলেটা স্পষ্ট হল না। অথচ ভেতরে একটা কথা আছে ঠিক। বেশ। খেতে বসে জানা যাবে।

বারান্দায় টিনের চেয়ার টেনে বসল নীলাভ। কাগজফুল গাছে অনেক ফুল ফুটেছে। আসলে বোগেনভিলিয়া। তারা ছেলেবেলায় কাগজফুল বলেই জানত। এমন প্রাণময় গাছটার এমন একটা জড় নাম কেন ছিল? লিপ্তা বলেছিল, এই ফুলে পুজো হয় না। কেন হয় না? লিপ্তা জবাব দিতে পারেনি। অবশ্য অনেক কথারই জবাব দিতে পারেনি লিপ্তা। কখনও পারেনি। ভরাট ঠোঁট টিপে দাঁড়িয়েছিল মাত্র। যুগলপ্রসাদ রোদে দাঁড়িয়ে খবরের কাগজ পড়ছিল। ছেলেটা চমৎকার বাংলা বলে। মাঝে মধ্যে তৎসম শব্দও ব্যবহার করে। ডাকল নীলাভ ‘এই যে যুগল!

ঠান্ডা কীরকম?’

‘ঠান্ডা?’ যুগল পেছন ফিরে তাকাল ‘উত্তরোত্তর বেড়ে চলেছে। আর কদিন পর শৈত্যপ্রবাহ শুরু হবে।’

কিছু বলতে মুখ খুলেছে নীলাভ, দীপংকর চ্যাঁচাল– ‘খাবার রেডি। ফটাফট এসে পড়ুন সবাই।’

খেতে বসে আসল কথাটা জানা গেল। সীমন্তর ছেলে হয়েছে। আজই। সকালে ফোন এসেছে। আগামিকাল সীমন্ত যাচ্ছে বালুরঘাটে শ্বশুরবাড়িতে। ছেলেকে দেখতে।

খুশি হওয়ারই কথা। খুশিই হল নীলাভ। সীমন্তর চনমনে মুখের দিকে তাকিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল ও। বারান্দায় কে জল ফেলে রেখেছে। পড়তে পড়তে বেঁচে গেল। যে-যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। একমাত্র ওর কোনও কাজ নেই। ধীরেসুস্থে স্নান সেরে খবরের কাগজ নিয়ে বসবে। কাগজফুল গাছটা বাতাসে ফুলপাতা দুলিয়ে চলেছে খসখস শব্দে। যেন বই-এর পৃষ্ঠা উলটে যাচ্ছে নিজে থেকে। কত ঘটনা কত মিলন-বিচ্ছেদের কাহিনি লেখা আছে সেইসব পৃষ্ঠায়।

আজ সবাই খুশি। সীমন্তর ছেলে এল। মানসের মেয়ে-জামাই এল। চিংড়ি রেঁধেছে মানসের বউ। স্বাভাবিক। খুশি হওয়ারই কথা। একটা জ্যামিতিক কোণ পুরো হল।

বাইকের শব্দে চটকা ভেঙে গেল। যুগলপ্রসাদ অফিসে গেল। দিবাকর সাইকেল বের করে আনছে বারান্দায়। ভূদেবের অফিস কাছেই। জিৎ, দেবনাথ ব্যাগ ঝুলিয়ে মেট্রো ধরতে দৌড়োচ্ছে। এই লোকটা কখনও হাসে না। ঠিক এইরকম একটা স্কুটার ছিল নীলাভর। এটা কার? সজীবের। সজীব স্কুটার ঠেলে নামাচ্ছে। নীলাভ হাটবাজার, অফিস… সর্বত্র স্কুটার নিয়ে চলত। অবশ্য লিপ্তা ছিল। পিছনে বসে জাপটে ধরে থাকত। জীবনটা বেহিসেবি হয়ে গেল নীলাভর! হিসেব করে চলতে শেখা হল না!’

অন্যদিন সন্ধে রাতে শুয়ে পড়ে। আজ ইচ্ছে হল না। নানা ভাবনায় মাথাটা গরম। প্রেশারটা চেকআপ করাতে হবে। একটু শুয়ে থাকলে হয়তো ভালো লাগবে। নাঃ! বসে থাকাই ভালো। অস্থির নীলাভ ফের শুয়ে পড়ে। কে ডাকে? অর্ণব স্যার? চার পাঁচজন ছেলেকে ডেকে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে কী বোঝাচ্ছে?

‘দ্যাখ, একটা সরলরেখা অন্য দুটো সরলরেখাকে ছেদ করলে, একপাশের দুই কোণের সমষ্টি যদি একশো আশি ডিগ্রির কম হয়, তাহলে সরলরেখা দুটোকে দুই পাশে বাড়ালে কোথাও না কোথাও মিলবেই।’ চক দিয়ে খসখস শব্দে সরলরেখা টানে অর্ণব স্যার! সেই শব্দে চোখ মেলে তাকায় নীলাভ। স্বপ্ন দেখছিল! আর ঘুম হবে না। উঠে জল খেল নীলাভ। কনকনে ঠান্ডাজল গলা কেটে ফেলল ধারালো অস্ত্রের মতো। মধুমিতা ঠান্ডা জল খেতে দিত না। ফ্লাস্ক রাখত টেবিলে। গরম জলের ফ্লাস্ক। কিন্তু এতদিন পর ছেলেবেলার স্যার কেন এল স্বপ্নের ভেতর? কী শেখাল এতক্ষণ ধরে? কেন বলল না নীলাভর জীবনের খামতির কথাটা? কেন নীলাভর জীবনের দুটো কোণের সমষ্টি একশো আশি ডিগ্রি হয়নি? একটা চতুষ্কোণ মাটি পাওয়া হল না। তার ভিতরে ঘর। তার ভিতরে সংসার। মধুমিতাও কি এভাবেই ভাবে? হয়তো ভাবে, হয়তো ভাবে না। সে তো সাহিত্যের ছাত্রী! একটু নরম, একটু লাজুক। স্কুটারের পেছনে বসতে ভয় পেত। মুকুন্দপুরে বন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছিল। সিল্কের শাড়ি পিছলে মধুমিতা…! লজ্জায় কেঁদে ফেলেছিল। বন্ধুর বউ বকুনি দিয়েছিল। ‘বউ পড়ে গেল, আপনি হাসছেন?’

বাড়িতে ফিরেও রাগ পড়েনি মধুমিতার। অনেক কষ্টে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হয়েছে। অঝোর বৃষ্টি পড়ছিল সে রাতে। মধুমিতা বিরহের গান গেয়েছিল। ভালো গাইত ও। নীলাভ চেয়েছিল মধু গানের চর্চা রাখুক। ভালো গাইত।

দু-চারজন ছাত্রীও জুটে গেল। সে সময়ই এল লিপ্তা।

গাঢ় অন্ধকারের দিকে জোনাকি খুঁজল নীলাভ। টর্চটা কোথায়? এত অন্ধকার কেন? আজ কি অমাবস্যা? এই যে টর্চ…! লিপ্তার চটক ছিল। স্মার্টনেসও। গুছিয়ে শাড়ি পরত লং কোটের সঙ্গে। মনে মনে কি এমনই একটা অন্বেষণ ছিল? নিজের মনকে বুঝতে পারেনি নীলাভ!

চোখ বুজে ফেলল। ভালো লাগছে না। বরং বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে ভালো লাগবে। …নাঃ! খুব ঠান্ডা বাইরে। অসুখ হলে কে দেখবে? অথচ প্রবল ঠান্ডা বলে কিস্যু ছিল না। আগুন জ্বলত শরীর-মনে। দাউদাউ আগুন। লিপ্তার হাজব্যান্ড তখন চণ্ডীগড়ে। কোয়ার্টার পায়নি। টু বিএইচকে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চার বন্ধু থাকত। লিপ্তাকে সেখানে নেওয়ার সুবিধে ছিল না। এদিকে লিপ্তার তখন অখন্ড অবসর। গান শিখতে আসত মধুমিতার কাছে। আর নীলাভ? কী করে যেন সব ভুলে যেতে থাকল। এমনকী গোল্ডিকেও!

মধুমিতা যখন সব বুঝল, তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ততদিনে মুক্তির সন্ধান করছে নীলাভ। মধুমিতার হাত থেকে মুক্তি। প্রথম প্রথম ঝগড়াঝাঁটি। তারপর স্পষ্টভাষায় মুক্তি চাইল নীলাভ। লিপ্তাকে ছাড়া ওর আর পৃথিবী বলতে কিছুই কি ছিল?

উঃ! কী মশা বাইরে! নীলাভ ফের মশারির ভেতরে ঢুকে পড়ে। কখন ভোর হবে।… স্তব্ধ হয়ে গেছিল মধুমিতা। তারপর জড়তা ভেঙেছিল। ‘মুক্তি চাইছ যখন, যাও। একদিন বুঝবে কত কঠিন কাজ করলে আজ। কিন্তু আরও কঠিন কাজ রয়ে গেল। আর কখনও ফিরে আসতে পারবে না।’

ইচ্ছেও ছিল না ফিরে আসার। বাড়িটা তো মধুমিতার। উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া। সে বাড়ি কখনও নীলাভর ছিল না। খোলামেজাজে বেরিয়ে এসেছিল। মুক্তি! আবার বাঁধা পড়ার জন্য মুক্ত!

মাত্র সাতদিন আগেই শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড় থেকে লিপ্তার পছন্দমতো জাংক জুয়েলারি সেট কিনে দিয়েছিল নীলাভ। ফেডেড জিন্সের সঙ্গে দারুণ মানিয়েছিল লিপ্তাকে।

‘একি? ঘুমোননি এখনও?’ দিবাকর বাথরুমে যাচ্ছে।

‘ক’টা বাজল দিবাকর?’

‘মর্নিং ওয়াক? দেরি আছে। সবে আড়াইটে। ঘুমোন।’

বাথরুমে জলের শব্দ। ছলছল শব্দে বয়ে যাচ্ছে জল। এভাবে বয়ে গেল একটা জীবন। মধুমিতা কখনও কিছু দাবি করেনি। ওর এতটা আত্মসম্মানজ্ঞানের সন্ধান আগে পায়নি নীলাভ। বুঝতেই পারেনি। এখনও কি মধু আগের মতই আছে? আর লিপ্তা? ভয় পেয়ে গেছিল নীলাভর পাগলামিতে। অথচ বুঝতে দেয়নি। বর চণ্ডীগড়ে নাকি ফ্ল্যাট কিনেছে। লিপ্তা চলে গেল সংসারের খোঁজে। সেই চতুষ্কোণ মাটির গল্প। নাকি নীলাভকে বিশ্বাস করতে পারেনি? যে লোক অতি সহজে চতুষ্কোণ মাটি ভেঙে ফেলে বেরিয়ে আসতে পারে তাকে বিশ্বাস করেনি লিপ্তা। মানস কী যেন বলছিল? সাতকুলে কেউ নেই, মাটি দিয়ে কী করবে? সত্যি! কী করবে তুমি? কে থাকবে তোমার মাটিতে? বৃত্তাকার ঘেরাটোপে তুমি এক স্বতন্ত্র নিঃসঙ্গ সত্তা নীলাভ!

ওফ্! এত মশা! মশারির গায়ে আটকে গুনগুন করে চলেছে। ওর দিকে আঙুল তুলছে মশারা। অভিযোগের বাণ ছুড়ছে! মাথা ধরে যায়!

শেষ রাতে ঘুমিয়ে পড়ল নীলাভ। মানস ডাকতে এসেছে। উঠে গরম পোশাক চাপিয়ে কুয়াশার ভেতরে নেমে গেল ওরা। বকবক করছিল মানস।

‘নাতনিটি বুঝলেন, পাকা দি গ্রেট। পটপট কথা বলে। খুদে ঠাকুমা। বলে, একা একা বের হবে না কিন্তু। পড়ে গেলে কে ধরবে? ভাবুন!’ হাঃ হাঃ শব্দে হাসে মানস। সেই হাসিতে সুখের গন্ধ ওড়ে।

মানস জোরে হাঁটতে পছন্দ করে। পায়ের যন্ত্রণাটা হয়তো নেই। আজ তো লাঠিও আনেনি। নীলাভ তাল রাখতে পারছিল না। শরীর বশে নেই। হাঁটু যেন ভেঙে পড়ছে।

‘শরীর ভালো নয় নাকি? চলুন, ফিরে যাই। আমার বাড়ি চলুন। গরম চা হয়ে যাবে এক রাউন্ড।’

না। আর কেন। লোভ হয় ঠিকই। কিন্তু সামলাতে জানতে হয়। সেটা জানা ছিল না বলেই হয়তো জ্যামিতিটা সম্পূর্ণ হল না। মানস বার তিনেক কথা চালাতে চেষ্টা করল। কিন্তু নীলাভর তরফ থেকে প্রত্যুত্তর না পেয়ে নীরব হয়ে গেল। ধীর পায়ে হাঁটছিল নীলাভ। মানস অবাক হল। নীলাভ আজ সোজা পথ ধরছে না। শর্টকাট করবে নাকি? গতকালও যেতে চায়নি। আজ নিজে থেকে….? কিছু বলছিল মানস। নীলাভ শুনতে পায়নি। বিষম উত্তেজনায় ধড়ফড় করছিল বুক। কেন যাচ্ছে এপথে? অদৃশ্য এক সুতো যেন প্রবল আকর্ষণে নিয়ে যাচ্ছে ওকে। ছ-মাস আগে একবার এই রাস্তায় ঢুকেছিল। তাকাতে পারেনি। আজ তাকাবে। পূর্ণ দৃষ্টি মেলে দেখবে।

বাড়ির চেহারাটা অন্যরকম হয়ে গেছে! দোতলাই আছে অবশ্য। গোল্ডিকে দেখেছে একদিন। সঙ্গে গোল্ডির বউ ছিল। কেনাকাটা করছিল। মধু এখন শাশুড়ি। ছেলে, ছেলের বউ নিয়ে মধুমিতা সুখী? সবটাই হল মানিয়ে নেওয়া। সুখ তো সোজা পথেই আসে। শর্টকাটে তাকে পাওয়া যায় না।

‘কী ভাবছেন?’

‘কিছু বললেন?’

‘বলছি, এসব জায়গায় কত বাড়ি উঠেছে। ক’মাস আগেও ফাঁকা ছিল। প্রোমোটর-রাজ শুরু হয়ে গেছে।’

ঠিক। ফাঁকা ছিল এদিকটা। বারান্দায় দাঁড়ালে অনেকটা দেখা যেত। পাড়ার দোকানি, পাশের বাড়ির বকুল, পলাশ… চিনে ফেলবে কি নীলাভকে? কেন চিনবে না? নিশ্চয়ই ওরা দেখেছে ওকে। একই জায়গায় যখন বসবাস!

‘মশাই, প্রোমোটররা যা সব হয়েছে…’ মানস বকবক চালিয়ে যাচ্ছে।

এক ঝলকের জন্য তাকাল নীলাভ! বাড়িটার সামনে দিয়ে চলে যেতে যেতে একবার চোখ তুলল ও। কেউ কি ছিল জানলায়? পর্দাটা নড়ছে না? না। কেউ নেই! কাকে আশা করেছিল নীলাভ!

‘ওই বাড়িটা’ আঙুল তুলে দেখাল নীলাভ ‘ওই যে হলদে… দোতলা বাড়িটা… ওই বাড়িতে… আমার…!’

‘রিলেটিভ? চেনা লোক?’

রিলেটিভ? কি জানি! রিলেশন না থাকলে রিলেটিভ হয়? বলা যায়? নীলাভ আঙুলটা নামাতে ভুলে যায়।

‘আগে সাদা রং ছিল। হাতির দাঁতের মতো রং। দোতলার বারান্দায় জাফরি ছিল।’

‘ও।’

‘ছেলেটা খুব ছোটো তখন। বছর পাঁচেক। খুব হাসত। একটা দাঁত পড়েছিল। ফোকলা। বললে বিশ্বাস করবেন না কোলে নিলে কাঁধের কাছটা লালা ফেলে ফেলে ভিজিয়ে দিত।’ হাঃ হাঃ শব্দে হাসতে থাকে নীলাভ। এই ঘটনার মধ্যে অবিশ্বাস্য ব্যাপারের অন্বেষণ করতে নীলাভর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকায় মানস।

‘এত পরিচিত যখন, গেলেই পারেন, সময়ও কাটে।’ গলায় মাফলার জড়াতে জড়াতে পরামর্শ দেয় মানস।

‘যাব? যাওয়া যায়?’ ভীষণ বিস্ময়ে মানসকে দেখে নীলাভ। মধুমিতা বলেছিল এ কাজটা আরও কঠিন। সত্যি কথা। গেট খুলে ডোরবেলে আঙুল রাখা যাবে? কে খুলবে দরজা? কে দাঁড়াবে দরজা খুলে? গোল্ডি? গোল্ডির বউ? নাকি…

কে যেন বলেছিল শূণ্যস্থানে কোনও বস্তু থাকলে তা তার চারপাশের জায়গাটাকে দুমড়ে মুচড়ে দেয়। বাঁকিয়ে দেয়। কোথায় যাবে নীলাভ? ওর জন্য কোনও সহজ পথ নেই। কোনও সরলরেখা নেই। সবটাই বক্ররেখা! কতদিন শূণ্যস্থানে থাকবে নীলাভ? চারপাশ যে দুমড়ে মুচড়ে গেল! কেন এত দেরি হল সবকিছু বুঝতে? অর্ণব স্যার তো কবেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। বুঝেও ছিল। কিন্তু বুঝেছিল কি সত্যি? তাহলে প্রয়োগ করতে পারেনি কেন? কেন লিপ্তার দিকে অমন প্রবলবেগে ভেসে যাচ্ছিল ও?

হঠাৎই শীত করে ওঠে নীলাভর। এতক্ষণে যেন টের পেল শীতকাল এসে গেছে! জল বরফ হয়ে যাচ্ছে! প্রবল শৈত্যপ্রবাহের মধ্যে দুঃসহ ভীতি এসে হাত পা নখ বের করে তাড়া করে। বিশাল ফাঁকা মাঠ হুহু শূণ্যতার মধ্যে টেনে নিতে থাকে নীলাভকে।

মানস কিছু বলছিল। শুনতে পেল না নীলাভ।

মানসের পাশে পাশে হেঁটে যায় এক উদ্বাস্তু। একা নিঃসঙ্গ!

 

জন্মভিটে

প্রণয় বহু বছর গ্রামের বাড়ি থেকে বাইরে। প্রণয়ের বদলির চাকরি। ষ্টেট ব্যাংক-এর ম্যানেজার। দুবছর বিহারে তো দুবছর আন্দামানে। বদলির চাকরির জন্য ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ঘুরে বেড়িয়েছে। পুজোর সময় ও শীতের সময় এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে বাড়ি আসে। এছাড়া সুযোগ সুবিধা পেলে অফিসের কাজ নিয়ে কলকাতায় আসলেই দুদিন গ্রামের বাড়িতে থেকে যেত। গ্রামের বাড়িটা ছিল প্রণয়ের জন্মভিটে ও ভালোবাসার বাড়ি। এই গ্রামের বাড়িতেই তার জন্ম, ফলে যেখানেই থাকুক সুযোগ পেলেই বাড়ি আসার জন্য মুখিয়ে থাকটা

প্রণয় ভারতের সমস্ত রাজ্য ঘুরে ঘুরে যখন কলকাতায় এসে পাকাপাকি ভাবে চাকরিতে থেকে গেল, তখন কলকাতায় একটা ফ্ল্যাট কিনে নিল। আর এদিকে প্রণয়ের বাবা স্কুলের শিক্ষকতা থেকে রিটায়ার করেছেন। দেখাশোনার সুবিধার্থে বয়স্ক বাবা-মাকে কলকাতায় নিজের ফ্ল্যাটে রাখতে চেয়েছিল। প্রণয়ের বাবা ও মায়ের অতি প্রিয় ছিল এই গ্রামের বাড়ি ও গ্রামের মানুষজন। আর এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও গিয়ে থাকার কথা মনেও করতেন না।

প্রণয়রা তিন ভাইবোন। প্রণয়ের দাদা বিদেশে থাকে এবং বছর পাঁচেক পর একবার গ্রামের বাড়িতে আসে। বোনেরও বিয়ে হয়ে গেছে। প্রণয়ের বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন পাকাপাকি ভাবে প্রণয়ের কাছে গিয়ে থাকেননি। মাঝেমধ্যে গিয়ে কিছুদিনের জন্য প্রণয়ের কাছে থেকে আসতেন।

গ্রামের বাড়িতে ফুলের বাগান, সবজির বাগান আছে। এছাড়া নারকেল, সুপুরি গাছ দিয়ে ঘেরা। একটি ছোটো পুকুরও আছে। পুকুরে অনেক মাছ আছে। ফাল্গুন, চৈত্র ও বৈশাখ মাসে পুকুর থেকে মাছ তুলে গ্রামের সবাইকে দিত এবং নিজেরা সবাই খেত। গ্রামের পাকাবাড়ি বলতে প্রণয়দের বাড়ি আর কয়েকটা পাকাবাড়ি ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে এছাড়া বেশির ভাগ বাড়ি বেড়া দিয়ে ঘেরা ও টালির চাল।

গ্রামের লোকেরা প্রণয়ের বাবাকে খুব সম্মান করত। প্রণয়দের গ্রামের প্রত্যেক মানুষের মধ্যে ছিল প্রচুর আন্তরিকতা। পুজোর সময় প্রণয়দের গ্রামে একটিমাত্র দুর্গাপূজা হতো, আর সেখানে গ্রামের সবাই একসাথে মিলে কাজ করা, খাওয়া, হইচই করে খুব আনন্দ হতো। তবে গ্রামের রাস্তা মাটির ছিল বলে বর্ষাকালে জল জমে রাস্তায় কাদা হয়ে যেত।

একসময় গ্রামের সবাই মিলে ঠিক করা হয়েছিল রাস্তায় ইট ফেলে পাকা রাস্তা তৈরি করা হবে। পাকা রাস্তা তৈরির ব্যাপারে প্রণয়ের বাবা অজয় মাস্টারমশাইয়ের সাথে গ্রামের বড়োরা সবাই আলোচনা করেছিল। মাস্টারমশাইকে এতটাই সম্মান করত যে, গ্রামের কোনও কাজই মাস্টারমশাইয়ের মতামত ছাড়া করা হতো না।

বেশ কয়েক বছর বাদে গ্রামের রাস্তা পাকা হল ঠিকই কিন্তু অজয় মাস্টারমশাইয়ের আর দেখে যাওয়া হয়নি। কেন-না তার আগেই মাস্টারমশাই নার্ভের অসুখ হয়ে এক বছর কষ্ট পেয়ে সবাইকে ছেড়ে স্বর্গে চলে গেলেন।

দাদা ও বোন দূরে থাকে আর বাবা মারা যাওয়ার পর মা একা হয়ে গেল, ফলে মা-র অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রণয় মাকে কলকাতার ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতে বাধ্য হল। বাড়ি, বাগান, পুকুর ফেলে এমনকী গ্রামের মানুষজনকে ছেড়ে যেতে খুব কষ্ট হয়েছিল প্রণয়ের মা-র। তবে প্রণয় অফিসের ছুটি দেখে মাসে একবার করে মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে এসে দুদিন থেকে যেত। আর তখন বাগানের সবজি ও পুকুরের মাছ তুলে গ্রামের সবাইকে দিয়ে নিজেরা কিছু নিয়ে যেত কলকাতায়। ক্রমশ অফিসের কাজের চাপে এছাড়া ছুটির দিনে অন্যান্য কাজের ব্যস্ততায় গ্রামের বাড়িতে প্রণয়ের মাকে নিয়ে আসা হয়ে ওঠে না।

পাশের বাড়ির লাল্টু-কে বাড়িটা দেখশোনার জন্য বলা হয়েছিল। লাল্টু ভালোই দেখেশুনে রাখছিল। মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়ি থেকে ফসল ও মাছ নিয়ে কলকাতার ফ্ল্যাট বাড়িতে দিয়ে আসত। আর প্রণয়ের মা নারকেল, সুপুরি, লিচু ও আমগাছগুলি এবং গেটের সামনে মাধবীলতা ও শিউলি গাছ কেমন আছে সবকিছুর খবর নিতেন লাল্টুর কাছ থেকে। এইভাবে দশবছর পার হয়ে গেল। একসময় লাল্টু জানাল ও নিজের কাজের চাপে বাড়িটা ভালো করে দেখাশোনা করতে পারছে না। ফলে বাড়িটা জঙ্গলে ভরে গেছে, পুকুরটা আগাছায় ভরে গেছে। অনেকটা জীর্ণ পোড়ো বাড়িতে পরিণত হয়েছে। লাল্টু বাড়িটাকে হয় বিক্রি করতে, নাহলে প্রমোটারের কাছে ফ্ল্যাট তৈরির জন্য দিতে বলল।

লাল্টুর কথা শুনে প্রণয় গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ভাবল। মা-র সাথে কথা বলে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওনাও হল প্রণয়। প্রায় দশ বছর বাদে প্রণয় গ্রামের বাড়িতে ফিরছে। গ্রামে ঢুকতে ঢুকতে চারিদিক দেখছে আর প্রণয়ের মনে হচ্ছে অন্য কোনও নতুন গ্রামে ঢুকছে। গ্রামের এখন পিচের রাস্তা হয়েছে, বেড়া ও টালির চালের বাড়িগুলোর জায়গায় ইটের দালান বাড়ি উঠেছে। রাস্তার পাশে যে-পুকুরগুলি ছিল সেই পুকুরগুলি মাটি দিয়ে বুজিয়ে মাঠ তৈরি করে তাতে চার পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ি উঠেছে। গ্রামের দুর্গামন্দির ও শিবমন্দির পাকা হয়েছে। খেলার মাঠগুলো সুন্দর পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে। একপাশে বাচ্চাদের জন্য পার্ক তৈরি করা হয়েছে।

 

গ্রামে ঢুকতে ঢুকতে প্রণয় তার ছোটোবেলার পাড়াটাকে চিনতে পারছিল না। পথের দুধারের গাছগুলিকে কেটে রাস্তাটাকে চওড়া করা হয়েছে। প্রণয়দের বাড়িতে নানারকমের ফুল ও ফলের গাছ আছে আর সেই গাছগুলোতে সকাল হতেই কত রঙের ও কত রকমের পাখি এসে বসত। আর সেইসব পাখিদের ডাক শুনতে খুব ভালো লাগত। প্রণয়দের বাড়ির পুকুরটায় দুপুরবেলা পাড়ার অনেকে স্নান করতে আসত আর পুকুরের চারপাশে পেয়ারা ও কুল গাছ থেকে ফল পেড়ে খেত। অনেকে মিলে পুকুরে সাঁতার কাটা, বঁড়শি দিয়ে পুকুর থেকে মাছ ধরা, কী যে আনন্দ হতো। তারপর পাড়ার বন্ধুরা একসাথে ঘুড়ি ওড়ানো, ফুটবল খেলা, জলকাদা মেখে বাড়ি ফেরা সে যে কী মজা ভাবা যায় না। এখন সেই খেলার মাঠগুলোতে পার্ক হয়েছে, তাতে দোলনা, ঢেঁকি ও স্লিপার বসেছে।

প্রণয়দের সামনের বাড়িটা প্রদীপদের বাড়ি। প্রদীপ প্রণয়ের বন্ধু। প্রদীপদের ছোটো টিনের চালের বাড়িটার জায়গায় সুন্দর পাকাবাড়ি উঠেছে। রাস্তায় ভ্যানগাড়ি, রিকশা খুব কম চলে তার পরিবর্তে বাইক, ট্যাক্সি ও টোটো গাড়ির শব্দ দিনরাত কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। পাশে মহামায়াদের বাড়ির আম বাগানটার কথা খুব মনে পড়ছে। ঝড়বৃষ্টি হলে প্রচুর আম পড়ত আর গ্রামের বাচ্চারা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে ঝড়ের মধ্যে আম কুড়াত। সেই আমবাগান আর নেই। আম গাছ কেটে পরিষ্কার করে ক্লাবঘর বানিয়েছে। সেখানে নানারকমের পুজো ও অনুষ্ঠান হয়।

গ্রামের পথে আসতে আসতে যাদের সাথে দেখা হচ্ছিল তারা সবাই প্রণয়ের বাবার কথা জিজ্ঞাসা করছিল। মাস্টারমশাই নেই শুনে সবাই দুঃখ প্রকাশ করছিল। আর সবাই একই কথা বলছে, কী ভালো মনের মানুষ ছিলেন। গ্রামের কত ছেলেমেয়েকে এমনিই পড়িয়ে দিতেন। তারা সবাই এখন ভালো চাকরি করছে, কেউ বা ব্যাবসা করছে। প্রণয় ওদের বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দেখছে, নিজেদের বাড়ি নিজেই চিনতে পারছে না। সমস্ত বাড়ি জঙ্গলে ভরে গেছে, দরজা জানলায় কোথাও কোথাও উইপোকা উঠেছে। ঘরের চারপাশ ধুলো বালি ময়লায় ভরে গেছে। ফুলগাছগুলি ও সবজি গাছগুলি অযত্নে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রণয় আসার সময় লাল্টু-কে খবর দিয়ে এসেছিল। প্রণয় বাড়িতে আসার পর পরই লাল্টু এসে হাজির হল আর বলল নিজের কাজের চাপে দেখভাল করতে পারেনি। বাড়িটার খুব খারাপ অবস্থা।

প্রণয় বলল, হ্যাঁ তা তো দেখতেই পাচ্ছি গ্রামের খুব উন্নতি হয়েছে কিন্তু আমাদের বাড়িটার অবস্থা জীর্ণ হয়ে এসেছে।

লাল্টু বলল, গ্রামের উন্নতি হয়েছে তো মলয়ের জন্য। মলয় ভোটে জিতে পার্টির নেতা হয়েছে। ও-ই গ্রামের রাস্তা মেরামত করেছে। এছাড়া গ্রামের যত উন্নতি দেখছ সব মলয়ের জন্য হয়েছে। মলয় তোমাদের বাড়িটার কথা বলছিল। যদি তুমি বাড়িটা বিক্রি করতে চাও বা ফ্ল্যাট তুলতে চাও তাহলে মলয় বলেছে তোমার সাথে দেখা করবে। কিন্তু এখন তোমাদের বাড়িটা থাকার অবস্থায় নেই। তুমি আমাদের বাড়িতে দুদিন থেকে সব ঠিকঠাক করে যাও।

প্রণয় বলল, একটা লোক দেখে দাও আমাদের বাড়ির একটা ঘর পরিষ্কার করে দেবে। তাহলে আমি আমাদের বাড়িতেই থাকব ভাবছি। আর আমি মা-র সাথে কথা বলে নেব। মা যা বলবে সেইমতো বাড়িটাকে নিয়ে ভাবব।

ঠিক আছে আমি লোক এনে তোমার জন্য একটা ঘর পরিষ্কার করে দিচ্ছি কিন্তু খাবার আমাদের বাড়ি থেকে দিয়ে যাব কেমন? প্রণয় বলল, তাই হবে। মাকে ফোনে সব কথা বলে মা-র মতামত জানতে চাইল প্রণয়।

মাস্টারমশাই মারা যাওয়ার পর প্রণয়ের মা ছেলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন। তাই উনি ছেলেকে বলেই দিলেন তুই যা করবি তাতেই আমার মত আছে। মায়ের কথা শুনে একটু নিশ্চিন্ত হল প্রণয়। তারপর ঘরে ঢুকে দেখল আলো জ্বলছে না। লাল্টুকে ডাকল। লাল্টু এসে বললে ইলেকট্রিকের লোক এসে লাইন কেটে দিয়েছে। আমি তোমাকে মোমবাতি ও দেশলাই দিয়ে যাচ্ছি।

কিছুক্ষণ পরে লাল্টুর পাঠানো লোক এসে ঘর পরিষ্কার করে দিয়ে গেল। ঘরে তেমন কিছু ছিল না। একটি খাট ও আলমারি ছিল তাতে ধুলো পড়ে আছে। চারদিকে উইপোকা বাসা করে আছে। তবে বাড়ির চাপাকলটা ভালো আছে। কেন-না পাড়ার সবাই এই কল থেকেই খাবার জল নেয়। একটু বাদে লাল্টু এসে মোমবাতি, দেশলাই, জল, খাবার, একটি বালিশ ও একটি চাদর দিয়ে গেল।

সন্ধে হতেই প্রণয় মোমবাতি জ্বেলে দিল। ঘরে বসে প্রণয়ের ছোটোবেলা থেকে বাইরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সব কথা একে একে মনে পড়ছে। ছোটোবেলায় বাবার হাত ধরে স্কুলে যাওয়া, কত মজা হতো, মা তার পছন্দের টিফিন বানিয়ে দিত। আর স্কুলের বন্ধুদের সাথে সেই টিফিন ভাগ করে খাওয়া। স্কুল ছুটির দিনে পাড়ার বন্ধুদের সাথে মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলা, বন্ধুরা মিলে সবার গাছ থেকে ফল পেড়ে খাওয়া, সেসব ছিল খুব মজার দিন।

প্রণয়দের বাড়ির সামনে প্রদীপদের বাড়ির সকলের সাথে খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। মাসিমা মা-র অনেক কাজে সাহায্য করে দিত। এখন মাসিমা ও মেসোমশাই কেউ বেঁচে নেই। প্রদীপ ও পরিতোষ দুই ভাই একসাথে ভালোই আছে। নানা স্মৃতির কথা ভাবতে ভাবতে রাত আটটা বেজে গেল। প্রণয় খাবার ও জল খেয়ে খাটের উপর চাদর বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু সারারাত প্রণয়ের ভালো ঘুম হল না। যখনই চোখে ঘুম আসছে তখনই মা বাবা ও তিন ভাইবোনের একসাথে থাকার কথা মনে আসছে।

সবাই মিলে পুজোর জন্য জামাকাপড় কেনা, ভাইফোঁটার দিন কত আয়োজন হতো বাড়িতে। বোন কত আদরের ছিল। এখন বিয়ে পর বোন অনেক দূরে থাকে। দাদাও বিদেশে থাকে। সবাই মিলে আগের মতো একসাথে আর আনন্দ করা হয় না। এরকম নানাকথা ভাবতে ভাবতে শেষ রাতে চোখে যেই না ঘুম জড়িয়ে আসছে, স্বপ্নের মধ্যে দেখতে পেল বাবা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলছে, কী রে ভালো আছিস খোকা? বাড়িতে এসে পুরোনো সব কথা মনে পড়ছে জানি। জানিস তো এই বাড়িটা আমার আর তোর মায়ের খুব সখের এবং ভালোবাসার বাড়ি। আর এটা যে তোদের জন্মভিটে। খোকা বাড়িটা বিক্রি করিস না। বাড়িটা মেরামত করে মাকে নিয়ে এসে মাঝেমধ্যে থাকবি। দেখবি তোর মায়ের খুব ভালো লাগবে আর আমিও খুব শান্তি পাব।

প্রণয়ের ঘুম ভেঙে গেল আর খাটের উপর বসে স্বপ্নে দেখা বাবার কথাগুলো ভাবতে লাগল। কিছুক্ষণ পরেই সকাল হলে ফ্রেশ হয়ে ড্রেস পরে নিল। লাল্টু চা বিস্কুট দিয়ে গেল। আর জঙ্গল পরিষ্কার করার জন্য লোক আসবে বলে গেল। বেলা ১১টার সময় জঙ্গল পরিষ্কারের লোক এলে, প্রণয় বলে দিল কোনও গাছ না কেটে শুধু বাড়ি পরিষ্কার করে দিলেই হবে।

প্রণয়ের মাথার মধ্যে স্বপ্নে দেখা বাবার কথাগুলো ঘুরপাক খেতে লাগল। আর এদিকে বাড়ি পরিষ্কার হচ্ছে দেখে পাড়ার অনেকে এসে বলতে লাগল, প্রণয় শুনলাম তোমাদের বাড়িটা নাকি বিক্রি করে দেবে?

না ঠিক সেরকম কিছু ভাবিনি, তবে কী করব সেই নিয়ে চিন্তা ভাবনা করছি।

আমরা বলছি কি বাড়িটা তোমার বাবা অনেক কষ্ট করে বানিয়েছিলেন এবং তোমার মা-বাবার খুব সখের বাড়ি। বাড়িটা বিক্রি না করে যদি মেরামত করে মাকে নিয়ে এসে মাঝেমাঝে থেকে যাও, তাহলে আমাদের খুব ভালো লাগবে।

ঠিক আছে, মা-র সাথে কথা বলে দেখি কী করা যায়।

 

প্রণয় মনে মনে ভাবতে লাগল যে গ্রামের মানুষজন এখনও ওদের এত ভালোবাসে। সত্যি প্রমোটারের কাছে বাড়িটা দিলে বাগানের গাছপালা কিছুই আস্ত থাকবে না আর এত সুন্দর বাড়িটাকে ভেঙে ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি করবে। অবশ্য মা, দাদা ও বোন সবাই একই কথা বলেছে যে, আমি যা করব তাই হবে। এরকম নানা কথা ভাবতে ভাবতে দুপুরের খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বিকেলে বাড়ির বাগানটা ঘুরে দেখতে লাগল প্রণয়।

মা-র হাতে লাগানো স্থলপদ্ম গাছটায় কত ফুল ফুটে আছে, আর বাবার হাতে লাগানো বাতাবি লেবু গাছটায় কত বাতাবি লেবু হয়ে আছে দেখে প্রণয়ের খুব ভালো লাগছে। কিন্তু বাগানের ভিতর ঢুকতেই প্রণয়ের মনে হতে লাগল গাছগুলি ওকে দেখে যেন খুশিতে ডালপালা নাড়তে লাগল আর গাছের ফুলগুলো যেন হাসতে হাসতে বলছে, আমরা খুব আনন্দ পেয়েছি তুমি এসেছ বলে। আমাদের কেটে নষ্ট করে দিও না। বেলা পড়তেই সন্ধে হয়ে এল। প্রণয় হাত পা ধুয়ে ঘরে এসে মোমবাতি জ্বেলে খাটের উপর বসল। কিছুক্ষণ পরেই লাল্টু রাতের খাবার ও জল দিয়ে গেল। কিছুক্ষণ মা-র সাথে ফোনে কথা বলে ৯টার সময় খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকাল হতেই প্রণয় দেখল লাল্টু চা আর সঙ্গে করে দুজনকে নিয়ে এসেছে। প্রণয় জিজ্ঞাসা করল, কাদের নিয়ে এসেছ?

গ্রামের দুটো ছেলেকে নিয়ে এসেছি, তোমাদের বাগানের গাছগুলোকে কাটার জন্য। বড়ো গাছগুলোকে বেচলে ভালো টাকা পাওয়া যাবে, ফলে তোমারও লাভ হবে আর আমরাও কিছু পাব।

প্রণয় একটু মুচকি হেসে বলল, সব বুঝতে পারছি তবে এখনই কোনও গাছ কাটার দরকার নেই কেমন?

ঠিক আছে দাদা তুমি যা বলবে তাই হবে। তাহলে আমরা আসছি, দুপুরবেলা এসে খাবার দিয়ে যাব।

প্রণয় ভাবছে পাড়াপ্রতিবেশীরা এখনও তাদের বাড়িটাকে ও তাদেরকে এত ভালোবাসে। না এলে বুঝতে পারত না। তাই বাড়িটাকে বিক্রি করা বা প্রোমোটারের হাতে দেওয়া কোনওটাই প্রণয়ের পছন্দ হচ্ছে না। রাতে ঘুমোতে গিয়ে প্রণয় ভেবে নিল বাড়িটা সে বিক্রি করবে না। বাড়িটাকে মেরামত করে মাকে নিয়ে মাঝে মাঝে এসে থেকে যাবে। মা, বাবা ও ভাই-বোনেদের প্রচুর স্মৃতি আছে বাড়িটাতে। আর মা গ্রামের বাড়িতে এসে আবার থাকতে পারবেন জানলে খুব খুশি হবেন। এইসব ভাবতে ভাবতে প্রণয় ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রণয় সব গুছিয়ে নিল কেন না অফিসের ছুটি শেষ। কলকাতায় ফিরেই অফিসে যেতে হবে। হঠাৎ দেখল লক্ষ্মী এসে হাজির। লক্ষ্মী প্রণয়দের বাড়িতে অনেক বছর কাজ করেছে। প্রণয়ের মা ও বাবাকে মা-বাবা বলে ডাকত আর সবাইকে নিজের মনে করে ভালোবাসত। বাবা নেই শুনে লক্ষ্মীর চোখে জল চলে এসেছে। প্রণয়কে বলল, দাদা শুনলাম বাড়িটা নাকি বিক্রি করে দেবে তোমরা।

না রে লক্ষ্মী এখনও কিছু কথা হয়নি।

তোমাদের বাড়ির সাথে অনেক দিনের সম্পর্ক। এই বাড়ি ও তোমাদের ওপর খুব মায়া আমার। তাই বলছি বাড়িটা বিক্রি না করে ঠিকঠাক করে মাকে নিয়ে মাঝেমধ্যে এসে থেকে যেও। দেখবে আমি এসে মা-র সব কাজ করে দেব।

ঠিক আছে লক্ষ্মী তোর কথা রাখার চেষ্টা করব। আজ আমি কলকাতায় ফিরে যাচ্ছি। আমি মাকে নিয়ে এলে তোকে জানাব।

লক্ষ্মী চলে যাবার পর লাল্টু খাবার নিয়ে এল আর বলল, বিকেলে মলয় আসবে তোমার সাথে বাড়ি বিক্রি নিয়ে কথা বলার জন্য।

প্রণয় বলল, আজ আমি কলকাতায় ফিরে য়াচ্ছি। মলয়কে বলে দিস বাড়ি বিক্রি করব না। বাড়িটা মেরামত করে ও রং করে নিয়ে মাঝেমধ্যে এসে থাকব। তুই বাড়িটা একটু দেখে রাখিস। কেউ যেন গাছগুলোকে না কাটে।

লাল্টু অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, কলকাতায় থাকার পর তোমরা গ্রামে এসে থাকতে পারবে? তোমাদের অসুবিধে হবে না?

নিশ্চয় এসে থাকব। এটা যে আমাদের ভাই-বোনের জন্মভিটে। আর আমাদের ছোটোবেলার সব স্মৃতি যে এই বাড়িতে। আমার মা ও বাবার প্রাণের বাড়ি। এমনকী এই গ্রামের বাতাস ও মানুষের ভালোবাসা আমাদের অনেকদিন বাঁচতে সাহায্য করবে।

 

জন্মের গল্প

বছর তিনেক ধরে আমার স্বভাবে একটা উল্লেখযোগ্য বদল এসেছে, অন্যমনস্কতা বেড়েছে ভীষণ ভাবে। বিশেষ করে অফিস ছুটির পর। কখন যে বাস, ট্রেন ধরে আমাদের স্টেশনের কাছাকাছি চলে আসি, হুঁশ থাকে না। সম্বিৎ ফেরে লোকাল ট্রেনটা যখন ব্রিজের ওপর এসে পড়ে। গমগম আওয়াজ শুনে এগিয়ে যাই গেটের দিকে। ব্রিজ পার হলেই দেবনগর স্টেশন, জন্মাবধি এই অঞ্চলেই আমার বসবাস।

আজ আমাকে অন্যমনস্কতা সেভাবে গ্রাস করতে পারেনি। ডাউন লোকাল প্ল্যাটফর্মে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে পড়েছি, এটাই আপ-এ যাবে। কামরায় তাড়াতাড়ি ওঠার সুবাদে পেয়েছি জানলার পাশের সিট। অন্যমনস্ক হওয়ার জন্য আদর্শ বসার জায়গা। কিন্তু হতে পারছি কই! মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা কাজ করছে, চাপা টেনশন। উদ্বেগটা গল্পের প্লট খুঁজে পাওয়া নিয়ে। গত তিনবছর ধরে আমার একটা বিশেষ পরিচয় তৈরি হয়েছে, আমি একজন লেখক। নামি বাণিজ্যিক পত্রপত্রিকায় আমার লেখা নিয়মিত ছাপা হয়। এখন অবধি গল্পকার। উপন্যাসে হাত দিইনি। কবিতা আমার ঠিক আসে না। প্রবন্ধ লেখার মতো পাণ্ডিত্য আমার নেই। গল্প লেখা শুরু করেছিলাম কলেজবেলায়, কয়েকজন সাহিত্যপ্রেমী বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে। দু’তিনটের বেশি লিখিনি। বন্ধুরা ভালো বলেছিল। তবে চর্চাটা আর এগিয়ে নিয়ে যাইনি। কারণ আমাদের নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার। বাবা বড়োবাজারের এক ওষুধের হোলসেলারের খাতা লেখে। দাদার লেখাপড়ায় আগ্রহ ছিল না। হায়ার সেকেন্ডারি-র পর বিভিন্ন বিজনেস ট্রাই করে যাচ্ছিল। পুঁজির জোর নেই, ফেল করছিল বিজনেসগুলো। বাড়িতে মা, শ্বশুরবাড়ি ফেরত পিসি আর বোন, তখন স্কুলে পড়ে সে। একার রোজগারে ছ’জনের খাওয়াপরা চালাতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিল বাবা। এরপর বোনের কলেজে পড়া, বিয়ে দেওয়া এসব আছে।

গল্প লেখার শৌখিনতা সরিয়ে রেখে পড়াশোনায় মন দিয়েছিলাম। কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে বেরিয়েই ঢুকে গিয়েছিলাম এখনকার চাকরিতে। একটা কেমিক্যাল ফ্যাক্টরির ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট আমি। আমার চাকরির টাকায় একটু স্বস্তির বাতাস বইতে শুরু করেছিল সংসারে। এদিকে দাদাও ফুড প্রোডাক্ট সাপ্লাইয়ের বিজনেসে মোটামুটি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তার সুফল অবশ্য সংসারের গায়ে তেমন লাগেনি, দাদা দ্রুত বিয়ে করে নিয়েছিল বহুদিন অপেক্ষায় থাকা প্রেমিকাকে। তবু বলব দুই ভাই দাঁড়িয়ে যাওয়াতে আমাদের পরিবার নিত্যদিনের আর্থিক অনটন থেকে অনেকটাই মুক্ত হতে পেরেছিল।

ছুটির দিনগুলো সত্যিকারের অবসরের দিন মনে হতো। তখনই আমার মাথায় আবার গল্প লেখার পোকাটা নড়ে উঠেছিল। ভাবলাম, ছুটির সময়টা পাড়ায় আড্ডা না মেরে ভালো কাজে লাগাই। লিখে ফেললাম একটা গল্প। কাকে পড়াই? কেমন হয়েছে জানতে হবে তো। কলেজের সেই সব সাহিত্য অনুরাগী বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। কাউকে খুঁজে নিয়ে পড়ানোর চেয়ে একটা সহজ কাজ করে ফেলা যাক, গল্পটা পাঠিয়ে দিলাম সবচেয়ে নামি পত্রিকা ‘প্রিয়ভাষা’-র ঠিকানায়। আমি যে পাঠিয়েছি, কেউ তো জানতে যাচ্ছে না। মনোনীত না হলে লজ্জার কিছু নেই।

আমাকে অবাক করে গল্পটা ছাপা হয়ে গেল। লেখাটা পাঠানোর পর থেকেই প্রিয়ভাষার প্রতিটি সংখ্যার ওপর নজর রাখতাম।

যে-সংখ্যায় বেরোল আমার গল্প, দু’কপি কিনে ফিরলাম বাড়ি। এক কপি বাবার হাতে দিয়ে বলেছিলাম, এতে আমার লেখা একটা গল্প বেরিয়েছে।

সূচিপত্র ঘেঁটে গল্পের প্রথম পাতাটা বার করে ফেলল বাবা। তারপর আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে ছিল, যেন অচেনা কেউ! মুখে কিছু বলল না, পত্রিকাটা হাতে নিয়ে উঠে গিয়েছিল রান্নাঘরের দিকে। মায়ের উদ্দেশ্যে বলেছিল, মাধবী, তোমার ছেলে কী কান্ড ঘটিয়েছে দ্যাখো!

আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে গলাটা সামান্য কেঁপে গিয়েছিল বাবার। আসলে আমাদের বংশে এতবড়ো কান্ড কেউই ঘটায়নি। একেবারেই সাদামাটা গৌরবহীন বংশ।

বাবাকে যে-কপিটা দিয়েছিলাম, কদিনের মধ্যেই দুমড়ে-মুচড়ে একসা করে ফেলল। চেনাপরিচিতদের ধরে ধরে দেখাচ্ছে, পড়াচ্ছে ছেলের গল্প। এমনটা হবে আন্দাজ করেই আমি দু’কপি পত্রিকা কিনেছিলাম। প্রিয়ভাষার মতো বড়ো পত্রিকায় গল্পটা বেরোনোর ফলে চেনা, অচেনা মানুষের থেকে প্রচুর ফিডব্যাক পেলাম। কলেজের সেইসব সাহিত্য অনুরাগী বন্ধুরাও আমার ফোন নাম্বার জোগাড় করে নিজেদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল। উৎসাহিত হয়ে শুরু করে দিলাম একের পর এক গল্প লেখা। ছোটো, বড়ো, মাঝারি সব ধরনের কমার্শিয়াল পত্রপত্রিকায় ছাপা হতে লাগল। আমাদের এলাকার শিক্ষিত, বিদগ্ধ মহলে যথেষ্ট গুরুত্ব পেতে লাগলাম।

গত তিনবছর ধরে জাগ্রত অবস্থায় আমি গল্প নিয়ে ভেবে যাই। কখনও গভীর ভাবে, অফিসে কাজের সময় আলতো ভাবে। অফিস ছুটির পর ভাবনাটা সবচেয়ে বেশি জমাট বাঁধে। টানা আটঘণ্টার ডিউটি শেষ হওয়ার ফলে মনটা থাকে উৎফুল্ল, আইডিয়াগুলো দৌড়ে দৌড়ে এসে ঢুকে পড়ে মাথায়।

আমি যেহেতু কোম্পানির ল্যাবে আছি, তাই শিফটিং ডিউটি। ছ’টা দু’টো, দু’টো দশটা। সপ্তাহন্তর ডিউটির শিফট বদলে যায়। জেনারেল ডিউটি নয় বলে বাস, ট্রেন মোটামুটি ফাঁকা পাই। ভাবনায় বিশেষ বিঘ্ন ঘটে না। কিন্তু আজ এখন অবধি গল্প নিয়ে ভাবা শুরু করতে পারিনি। ইতিমধ্যে দু’টো স্টেশন পার করেছে ট্রেন। ক’দিন ধরেই এমনটা হচ্ছে। আসলে হয়েছে কি, এ বছরই প্রথমবার আমি পুজোসংখ্যায় গল্প লেখার আমন্ত্রণ পেয়েছি। ‘প্রিয়ভাষা’ থেকে নয়, প্রায় ওরকমই নামি একটি ম্যাগাজিনের সম্পাদক চিঠি দিয়ে লেখা চেয়ে পাঠিয়েছেন। গল্পটা কত তারিখের মধ্যে দিতে হবে লেখা আছে তাতে। চিঠি দিয়ে লেখা চাওয়াটাও আমার জীবনে প্রথমবার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমি যেচে পাঠিয়েছি, কয়েকবার মৌখিক আবেদনে দু’একজন সম্পাদক লেখা চেয়েছেন। ‘চিঠি’ মানে তো রীতিমতো অফিশিয়াল ব্যাপার! আর তাতেই বিরাট চাপে পড়ে গেছি আমি। কেমন যেন নার্ভাস লাগছে, সময় মতো যদি না দিতে পারি গল্পটা! আর তো কোনওদিন লিখতে বলবেন না সম্পাদক। পুজোসংখ্যায় লেখার সুযোগ হারানোর মানে, এক লাফে অনেকটা বিখ্যাত হওয়ার চান্স মিস করা। এমনটা কিছুতেই হতে দেওয়া যায় না।

কোনও গল্প লেখার প্রাথমিক পর্যায়টা আমার কাছে এই রকম, চার পাঁচটা প্লট মনের চারপাশে ঘুরঘুর করে। সবই অপূর্ণ, অস্পষ্ট। বলতে পারা যায় প্রায় বিষয়ের আকার। শুধুমাত্র গল্প হয়ে ওঠার ইঙ্গিতটুকু আছে সেখানে। যে-কোনও একটাকে বেছে নিয়ে মনে মনে পূর্ণতা দেওয়ার চেষ্টা করি। গল্পটা কোথা থেকে শুরু করব, এগোবে কেমন ভাবে, শেষ করব কোথায়… ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভাবতে থাকি। যদি দেখি বেছে নেওয়া প্লটটাকে গল্প হিসেবে ঠিকঠাক দাঁড় করাতে পারছি না, সেটাকে তখনকার মতো সরিয়ে রেখে অন্য একটা প্লটকে নিয়ে আসি সামনে। ভাবনার এই প্রক্রিয়ায় হঠাৎই, বলতে গেলে আমার অজান্তে একটা প্লট পূর্ণতা পেয়ে যায়। লিখতে বসে যাই গল্পটা। কিন্তু এই প্রসেস কাজ করছে না পুজোসংখ্যার গল্পটা লিখতে গিয়ে। বাড়তি উত্তেজনা আর লিখিত আকারে দেওয়া সম্পাদকের ডেডলাইন আমার ভাবনার ধরনটাকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। মনে মনে প্রণাম জানাচ্ছি সেই সব লেখকদের, যাঁরা বহুবছর ধরে ডেডলাইন মেনটেইন করে লিখে চলেছেন। আমার বোধহয় বড়ো লেখক হওয়া হল না।

ব্রিজের ওপর উঠে পড়ল ট্রেন। ছোটো খালব্রিজ। রোজকার সেই গমগম শব্দ আজ যেন আরও বেশি গম্ভীর শোনাচ্ছে। যেন ব্রিজটা বলছে, সময় পেরিয়ে যাচ্ছে তরুণ লেখক। নিজেকে প্রমাণ করার জন্য হাতে মাত্র পাঁচটা দিন।

প্ল্যাটফর্মে নেমে খেয়াল করি বেশ মেঘ করেছে আকাশে! ট্রেন হাওড়া ছাড়ার সময় এত মেঘ ছিল না। বিকেল চারটেতেই দেবনগরে সকাল সন্ধে। গা-ছাড়া ভাব নিয়ে প্ল্যাটফর্ম পার হচ্ছি, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে কী হবে! লিখতে বসা হবে না। সাদা পাতার সামনে বসে ভাবতে হবে। ইদানীং আবার না লিখে চুপচাপ বসে থাকতে দেখলে বউদি তাড়া দেয়। বলে, কী এত ভাবছ বলো তো! তোমার বড্ড খুঁতখুঁতানি বাই। আরে বাবা, তোমার লেখাটাই এত সুন্দর, যা লিখবে লোকে গোগ্রাসে পড়বে। …বলার পর বউদি আমার জন্য চা বানানোর উদ্যোগ নেবে। মানা করলে বলবে, তুমি খেলে আমারও একটু খাওয়া হয় আর কি। আমার লেখা নিয়ে বউদির এই যে এত উৎসাহ, এর একটা কিঞ্চিৎ বাস্তব দিকও আছে। লিখে টুকটাক রোজগার হয় আমার। সেই টাকাটা বোন, বউদি কিছুতেই আমার মূল রোজগারের সঙ্গে মেশাতে দেবে না। লেখা ছাপা হয়েছে দেখলেই, দু’জনেই নানান বায়না করতে থাকে। শৌখিনতার বায়না। লিপস্টিক, পারফিউম, ঝুটোগয়না ইত্যাদি। মা, বাবা, দাদার জন্যেও কিছু কিনে আনে, আমার জন্যেও। এই খাতে খরচ করতে আমারও ভালো লাগে। পুজোসংখ্যায় গল্পটা লিখতে পারলে টাকা অনেক বেশি পাব। শুনেছি পুজোর লেখায় বেশি দেয়। সম্পাদকের চিঠিতে অবশ্য অ্যামাউন্টের উল্লেখ নেই।

প্ল্যাটফর্মের শেড পেরোতে চলেছি, চোখ গেল সিমেন্টের বেঞ্চের নীচে, একটা বাচ্চাকে শুইয়ে রাখা আছে। ছ’সাত মাসের বাচ্চাদের আলাদা করে চেনা যায় না, তা সত্ত্বেও এই বাচ্চাটা কার, বুঝতে আমার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। জবার পুত্রসন্তান। বাচ্চাটার পিঠের কাঁথা, গায়ের জামা আমি চিনি। কারণ, জবা এঁটুলির মতো করে কোলে নিয়ে ঘোরে। কখনওই কাছছাড়া করে না। বাচ্চাটা এখানে এইভাবে পড়ে আছে কেন? জবা গেল কোথায়? প্ল্যাটফর্ম প্রায় ফাঁকা। দূরে দূরে এক দু’জন প্ল্যাটফর্মবাসীকে দেখা যাচ্ছে। প্যাসেঞ্জার বলতে আমি এখন একাই। লোকাল ট্রেনটা থেকে আরও যারা নেমেছিল, পা চালিয়ে বাড়ির পথ ধরেছে। গল্প মাথায় না আসার হতাশায় আমি শ্লথ হয়ে পড়েছিলাম। এখন বাচ্চাটাকে এই অবস্থায় দেখে চলে যেতে মন চাইছে না। একটা আশঙ্কা ঘিরে ধরেছে আমাকে, বাচ্চাটাকে কেউ যদি চুরি করে পালিয়ে যায়! প্ল্যাটফর্ম থেকে কিছু তুলে নিয়ে চম্পট দেওয়া খুবই সহজ। লোকাল ট্রেন এসে দাঁড়াবে, ছাড়ার মুখে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে কেউ যদি উঠে পড়ে কামরায়, চট করে চলে যাবে নাগালের বাইরে। জবাপাগলি ফিরে এসে বাচ্চাটাকে না দেখতে পেয়ে যে কী মূর্তি ধারণ করবে, কল্পনা করতেই ভয় পাচ্ছি আমি।

আপাতত বাড়ি যাওয়া স্থগিত রেখে বেঞ্চটায় গিয়ে বসলাম। জবার বাচ্চার পাহারায় বহাল হলাম আর কি! পায়ের খানিক দূরেই কাঁথার ওপর শান্ত হয়ে শুয়ে আছে বাচ্চাটা। হাত-পা একটু আধটু নাড়ছে। মুখটায় হাসিহাসি ভাব। পরিস্থিতি মোটামুটি স্থিতিশীল। হঠাৎ যদি কান্নাকাটি শুরু করে দেয়, কী করব জানি না। বাচ্চাটাকে কোলে তুলে ভোলানোর প্রবৃত্তি আমার নেই। জবাপাগলি স্নানটান করে বলে তো মনে হয় না। শুধুমাত্র বৃষ্টিতে ভিজলে অথবা মাছ চুরি করতে পুকুরে নামলে স্নান করা হয় ওর। এই যার স্বভাব সে তার বাচ্চাকে তেলটেল মাখিয়ে স্নান করাবে, আশা করাই বৃথা। বাচ্চাটার গায়ের কাঁথা, জামা ছ’মাস ধরে এই একটাই দেখে আসছি। কাঁথা, জামা, বাচ্চাটা মিলিয়ে সাক্ষাৎ একটা উৎকট গন্ধের মণ্ড। যতই কাঁদুক ওকে আমি হাতে নিতে পারব না।

জবার এই অপরিষ্কার থাকার কারণেই লোকে ওকে পাগলি বলে। মাথায় অল্পবিস্তর ছিট থাকলেও, পুরো পাগলি সে নয়। যথেষ্ট সেয়ানা। বিশেষ করে পাওনাগণ্ডা বুঝে নেওয়ার ক্ষেত্রে। জবাকে নিয়ে একটা গল্প লিখেছি। তখন বাচ্চাটা হয়নি। বাচ্চা সমেত জবাকে নিয়ে আরও একটা দারুণ গল্প হতে পারে। তবে সে ঝুঁকি আমি নিচ্ছি না। আগের গল্পটা লিখে বিরাট ফেঁসে গেছি। সন্তানের প্রতি জবার নিরেট অবসেশন, এটাই আমার জবাকে নিয়ে পরের গল্পের মেন থিম হওয়ার কথা। ওকে খুঁটিয়ে খেয়াল করেই বিষয়টা আমার মাথায় এসেছে। সেই অবজার্ভেশন থেকেই আমি আন্দাজ করতে পারছি, খুব বেশি সময় বাচ্চাটাকে পাহারা দিতে হবে না, জবা এল বলে।

আমার এখন অদ্ভুত দশা! কয়েকহাত দূরে পড়ে রয়েছে গল্পের প্লট, পাহারা দিচ্ছি, কিন্তু এক লাইনও লেখা যাবে না। জবাকে নিয়ে লেখা আগের গল্পের আফটার শক এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। এরকম হেনস্থা আগেও আর একজনের বেলায় হয়েছে, তার নাম সাধন। আসলে আমাদের এই মফসসলে সাধন, জবার মতো বিচিত্র চরিত্ররাই আমার লেখার রসদ। পুরোটা বানিয়ে লিখতে পারি না। এই বিচিত্রদের মধ্যে যারা শিক্ষিত, তাদের নিয়ে সমস্যা কম। আমাকে খুব একটা বিব্রত করে না। মুখোমুখি দেখা হয়ে গেলে অর্থপূর্ণ হেসে হয়তো বলল, অমুক পত্রিকায় তোমার গল্পটা পড়লাম (মানে যে গল্পটা তাকে নিয়ে লেখা)। আমার চোখে পড়েনি লেখাটা, দু’চারজন পড়ে আমাকে পড়তে বলল। কেউ হয়তো আর একটু এগিয়ে বলল, সবই তো বোঝা যাচ্ছে, আমার নাম পালটে দিয়েও তুমি কিছু আড়াল করতে পারোনি। তবে ভালোই হয়েছে গল্পটা।

যে সব শিক্ষিত চরিত্রদের অবলম্বনে গল্প লিখি আমি, তারা জানে গল্পে সত্যির মিশেল না থাকলে লেখা প্রাণ পায় না। তাছাড়া চরিত্রের নাম, ঘটনাস্থল সবই তো পালটে দিই, সরাসরি অভিযোগ করারও সুযোগ থাকে না তাদের। কিন্তু সে দলে তো সাধন, জবারা পড়ে না। বই বা সাহিত্য থেকে যোজন দূরত্ব দু’জনের। সাধন তবু খানিকটা স্কুলবেলা কাটিয়েছে। জবা স্কুলের চৌকাঠ ডিঙোয়নি। সাধনের মা হসপিটালের আয়া। ছেলের লেখাপড়া হল না বলে একটা চায়ের দোকান করে দিয়েছে। দোকানে নিয়ম করে বসে না সাধন। তার নেশা নাচ। পাতি হিন্দি সিনেমার নাচ। কলোনি এলাকার জলসায়, বিয়ের অনুষ্ঠানে লাউড স্পিকারে মিউজিক সহযোগে নাচে। সাধনের বিয়ে দিয়েও ঘরমুখী করতে পারল না মা। বউটির স্বভাবগুণ ভালো, বরকেও ভীষণ ভালোবাসে।

সাধন একদিন স্টেজে নাচতে উঠেছে, খবর এল অন্তঃসত্ত্বা বউ ভীষণ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি। নাচ বন্ধ করল না সাধন। পারফর্মেন্স শেষ করে ছুটল হাসপাতালে। বউ চোখ বুজে শুয়ে আছে, যেন মরেই গেছে! আকুল আশায় সাধন কান রাখে বউয়ের বুকে। হার্টবিট শুনতে পায়। খুশি ছড়িয়ে পড়ে সাধনের মুখে। নিজের অজান্তেই বউয়ের হার্টবিটের সঙ্গে আলতো করে তাল দিতে থাকে পায়ে। …মোটামুটি এই রকম ছিল গল্পটা। নামি পত্রিকায় বেরিয়েছিল। আমাদের এলাকার পাঠকদের সাধনকে আইডেন্টিফাই করতে অসুবিধে হয়নি। সাধনের মতো অখ্যাতর জীবনের গল্প বেরিয়েছে বিখ্যাত কাগজে! এই আবেগের উত্তেজনা কন্ট্রোল করতে না পেরে জনৈক পাঠক খবরটা তুলে দিল সাধনের কানে, লেখক পরিচয়সহ।

একদিন সাধনের দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, ছিটকে বেরিয়ে এসেছিল সে। আমার হাত আঁকড়ে ধরে বলেছিল, গুরু, তুমি শুনলাম আমাকে নিয়ে একটা স্টোরি লিখেছ বইয়ে! চট করে ব্যাপারটা স্বীকার করিনি। গম্ভীর মুখে জানতে চেয়েছিলাম, তুমি কি গল্পটা পড়েছ? এমনটা জিজ্ঞেস করার কারণ, সাধন যদি অভিযোগ তোলে গল্পে ওকে ছোটো করা হয়েছে, তখন বলতে হবে, ও গল্প তোমাকে নিয়ে নয়। দেখছ না, ছেলেটার নাম আলাদা, থাকেও অন্য জায়গায়। ওই রাস্তায় গেল না সাধন। সে তখন আনন্দে আত্মহারা। বলেছিল, না, আমি পড়িনি। একজন দিদিমণি আমাকে বলল। স্কুলে পড়ায়, সে তো আর ঢপ দেবে না। তুমি মাইরি ‘সাজন’ সিনেমার সঞ্জয় দত্তর মতো। আমার সঙ্গে আড্ডা মারতে আসতে, কত গল্প করেছি, ধরতেই পারিনি তুমি রাইটার। চলো চলো, চা খাবে চলো।

সেই যে আমাকে খাতির করা শুরু করল সাধন, আজও উৎসাহে ভাটা পড়েনি। রাস্তাঘাটে আমাকে দেখতে পেলেই হাঁকডাক করে এগিয়ে আসে। চকরাবকরা ড্রেস, ভাবভঙ্গি, কথাবার্তায় ফিল্মি স্টাইল। আশপাশের মানুষজন বেশ অবাক হয়। বিশেষ করে যারা আমার লেখক পরিচয় জানে। ভাবে, লুচ্চা টাইপের ছেলেটার কী করে এই সাহস হয়, এরকম একজন মানী ব্যক্তির সঙ্গে এভাবে কথা বলতে? সাধনের অবশ্য সে সবের কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই। যেখানেই দেখা হোক, গল্প জুড়ে দেয়। নিজের জীবনের গল্প। জোরজার করে চা, সিগারেট খাওয়ায়। আমি টের পাই ওর মনোবাসনা, সাধন চায় ওকে নিয়ে আরও একটা গল্প লিখি আমি। ওর তুচ্ছ জীবন নিয়ে অসাধারণ কোনও গল্প। একজন দিদিমণি এসে সেই গল্পের খোঁজ দেবে ওকে। বেচারি জানে না ওর জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশটা আগের গল্পে লেখা হয়ে গেছে আমার। বাকি যা পড়ে আছে, সমস্তটাই বোরিং। পরিচিত। পাঠক ওই গল্প জানে। সাধনকে ইদানীং এড়িয়ে চলি। দূর থেকে যদি দেখতে পাই, ধরে নিই অন্য রাস্তা।

জবাকে নিয়ে আমার সমস্যা আরও মারত্মক। মেয়েটা তিনবার সরকারি হোম থেকে পালিয়ে এসেছে। কোনও এক অদ্ভুত কারণে আমাদের দেবনগর জায়গাটাই জবার পছন্দ। শেষবার হোমের কর্মচারীরা ওকে নিতে আসেনি। ভীষণ বিরক্ত হয়েছিল জবার ওপর। প্রথমদিকে এই প্ল্যাটফর্মই ছিল জবার স্থায়ী ঠিকানা। ট্রেন থেকে নেমে প্যাসেঞ্জার হয়তো কুলি খুঁজে পাচ্ছে না, জবা লাগেজ তুলে নিয়ে রিকশা স্ট্যান্ডে দিয়ে আসে। বিনিময়ে টাকা নেয়। কখনও এর বাগানের ফল, ওর পুকুরের মাছ, খেত থেকে চুরি করে আনা সবজি ঘুরে ঘুরে বিক্রি করে স্টেশন লাগোয়া বাজারে। কখনও আবার কেটারিং-এর কাজে যায়। দোকান পরিষ্কার কিংবা রং করাতেও ওকে হাত লাগাতে দেখা গেছে। এভাবেই নিজের পেট চালায়। তবে যেটাকে ‘চুরি’ বললাম, সেটা ‘ডাকাতি’ বলাই বোধহয় ভালো। চুরিতে বাধা দিতে এলে এমন খিস্তি খেউড় করে, ইট-পাটকেল ছোড়ে, মালিক ভয়ে চুপ করে যায়।

ওকে নিয়ে যে-গল্পটা লিখেছিলাম, তাতে একটা ভয়ংকর ঘটনার কথা ছিল। সত্যিই ঘটেছিল জবার জীবনে। লাস্ট লোকাল থেকে কিছু ছেলে নেমে প্ল্যাটফর্মে ঘুমন্ত জবাকে রেপ করতে গিয়েছিল। ছেলেগুলো জানত না জবা রেললাইনের পাথর থলেতে পুরে তার ওপর কাপড় জড়িয়ে মাথার বালিশ করে শোয়। পাথর ভরা থলে দিয়ে এইসান মার মেরেছিল ছেলেগুলোকে, একজন হসপিটালে, বাকিরা প্রাণ হাতে করে পালিয়েছিল। এই ঘটনা সম্বলিত গল্পটা পড়ে সাধনের দিদিমণির মতো কোনও এক পাঠক জবাকে জানায়, চিনিয়ে দেয় লেখককে। এক সকালে বাজার করছি, সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল জবা। কোমরে গিঁট বেঁধে উঁচু করা পরা রংজ্বলা ম্যাক্সি, গামছাও বাঁধা কোমরে, চুলে চিরুনির চলাচল নেই বহুদিন। এটাই রোজকারের ড্রেস। সেদিন একমুখ হেসে বলেছিল, তুই নাকি কাগজে আমার নামে খবর লিখেছিস!

আমি ‘হ্যাঁ, মানে, না, ইয়ে, আসলে’ বলে পাশ কাটিয়ে তাড়াতাড়ি পা চালিয়েছিলাম। জবা গল্প, উপন্যাস, কবিতা, কাকে বলে জানে না। ছাপার অক্ষরে যা কিছু বেরোয়, ‘খবর’ বলেই মনে করে। আরও একটা বড়ো সমস্যা, জবার ভোকাবুলারিতে ‘তুমি’ সম্বোধন প্রয়োগ হয় না। যেসব রাশভারী কাস্টমারকে চুরি করে আনা মাছ, সবজি বিক্রি করে, তাদের আর মালিকশ্রেণির লোককে ‘আপনি’ ডাকে। বাকি সবাইকে তুই। যেহেতু ওকে নিয়ে লিখেছি, জবা ধরেই নিয়েছে আমি আপনজন। ‘তুই’ বলে তো ডাকবেই।

আপনজন হওয়ার যে কত ঝক্বি, বুঝতে পারলাম তারপর থেকে। দু’টো দশটার ডিউটি থাকলে সকালের বাজারটা আমি করি। একবার যদি জবার চোখে পড়ে যাই, সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসে। মুঠোতে বা গামছার কোঁচড়ে যা থাকে, মাছ, পেয়ারা, লেবু, ধনেপাতা, কলমি শাক… যেদিন যেমন চুরি করতে পারে, আমাকে অন্যদের তুলনায় সস্তায় দিতে চায়। বলে, নে না বাবু, পুরোটাই নে। কুড়িটাকা দিবি। তুই আমার চেনা লোক বলেই এত কমে দিচ্ছি।

‘বাবু’ সম্বোধনটা সম্মান জানানোর জন্য করছে, নাকি আমার নতুন নামকরণ করেছে জবা, বলার ধরন দেখে বুঝতে পারি না। জবার জিনিস না নেওয়ার থাকলেও, অনেক সময় নিতে হয়। একগাদা অদরকারি সবজিপাতি নিয়ে এলে মা রাগ করে। নিজের অসহায়তার কথা বলতে পারি না। বললেও বুঝবে না মা। কখনও দেখা যায় নিজের জিনিসপত্র সব বেচে ফেলে বাজারে এমনিই ঘুরঘুর করছে জবা, অথবা কোনও মাছওলা, সবজিওলাকে হেল্প করছে কাজে। আমাকে দেখতে পেলে মাঝে মাঝে উঠে আসে। পাশে হাঁটতে থাকে ডিঙি মেরে মেরে। এটাই ওর হাঁটার স্টাইল। নানা রাজ্যের গল্প বলে। সাধনের মতো ওকে নিয়ে আর একটা গল্প লিখিয়ে নেওয়ার প্রত্যাশায় বলে না। জবার সেই বোধ নেই। নিজের জীবনটাকে তুচ্ছও মনে করে না। আমাকে নিজের লোক মনে করে গল্পগুলো বলে। বেশিরভাগ চুরির গল্প। মালিক বাধা দেওয়াতে কী কী খিস্তি করেছে সেগুলো শোনায়। আমি আতঙ্কে মরি, এই বুঝি পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকটা ওর কথাগুলো শুনে ফেলল! আমাদের একসঙ্গে হেঁটে যেতে দেখলে লোকজন ঘুরে ঘুরে তাকায়। সাধনের সঙ্গে হাঁটতে দেখলে যতটা অবাক হয়, জবার বেলায় তার চেয়ে অনেক বেশি। কারণ, জবার পোশাক-আশাক পাগলির মতো তো বটেই, ডিঙি মেরে হাঁটাটাও পিকিউলিয়ার, রাস্তায় যারা হাঁটছে, সবার থেকে আলাদা। পায়ে আবার চটি পরে না।

ওর চুরির বিবরণের মধ্যেই আমাকে একদিন জানিয়েছিল, প্ল্যাটফর্মে আর থাকছে না। ঘর ভাড়া নিয়েছে স্টেশন ধারে। আমি বলেছিলাম, এবার একটা বিয়ে করে ফেল। লজ্জা পেয়ে হেসেছিল জবা, ভঙ্গিটা আর-পাঁচটা স্বাভাবিক মেয়ের মতোই। পাগলামির ছিঁটেফোটা নেই তাতে। মাঝে কিছুদিন যাবৎ খেয়াল করি বাজারে, রেলের প্ল্যাটফর্মে, আশপাশের কোনও এলাকাতেই জবাকে দেখা যাচ্ছে না। গেল কোথায় মেয়েটা? প্রশ্নটা বাজারের কাউকে করিনি। এখান থেকে বিদেয় হলে বাঁচা যায়। বেশ কয়েক মাস বাদে দেখি জবা কোলে বাচ্চা নিয়ে ঘুরছে। চেহারায় বিয়ের কোনও সাক্ষর নেই, মানে সিঁদুর, শাঁখা, পলা… আমি সামনে দিয়ে হেঁটে গেলাম, খেয়ালই করল না। বাচ্চাটার দিকেই সমস্ত মনোযোগ!

মাছওলা রবিনের কাছে মাছ কেনার সময় জিজ্ঞেস করলাম, জবা কার বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘুরছে? কেন, ওর নিজের? বলেছিল রবিন।

জানতে চেয়েছিলাম, বিয়ে করল কবে? বাচ্চার জন্য ওদের আবার বিয়ে করতে লাগে নাকি! তাচ্ছিল্যের গলায় বলেছিল রবিন। ব্যাপারটা কিন্তু তুচ্ছ মনে হয়নি আমার। হাইফাই সোসাইটিতে আজকাল ‘সিঙ্গল মাদার’ প্রায়ই শোনা যায়। সেলিব্রিটিরা ‘সিঙ্গল মাদার’ হলে লেখালিখি হয় কত! সাহসিনীর সম্মান পায় নারীটি। এর উলটো দিকে, সমাজের প্রান্তসীমায় থাকা জবা একই রকম কাজ করে ফেলল, কোনও শাবাশি নেই! শুধুই তাচ্ছিল্য আর অবজ্ঞা! রবিনের থেকে মাছ নিয়ে রাস্তায় এসে দেখি, জবা বসে আছে রেলের ইলেকট্রিক পোস্টের বেদিতে। ওর সামনে গিয়ে বলি, কী রে, তোর বাচ্চা? ছেলে না মেয়ে?

একগাল হেসে জবা বলেছিল, ছেলে।

ওর বাবা কোথায়? একটু ঝুঁকি নিয়ে কথাটা জিজ্ঞেস করেছিলাম। খেঁচিয়ে উঠতেই পারত। কেন-না, এই প্রশ্ন নিশ্চয়ই অনেকেই ওকে করেছে। ক্ষেপে যায়নি। শান্ত গলায় বলেছিল, ওর বাবা নেই। বাবার কী দরকার!

দরকার নেই কেন বলছিস? আমার প্রশ্নের কোনও উত্তর দেয়নি জবা। মুখে নানারকম আওয়াজ করে বাচ্চাটাকে আদর করতে লেগেছিল।

দিন যায়। জবাকে আর আগের মতো বাজারের এপ্রান্ত-ওপ্রান্ত করতে দেখা যায় না। হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ে, কোলে সবসময় বাচ্চা। একদিন একদম সামনে থেকে দেখলাম, জবার চেহারা খুব খারাপ হয়ে গেছে। শরীরে ঝিমানো ভাব। হাঁটাচলায় আগের সেই চনমনে ব্যাপারটা নেই। কোলে বাচ্চাটা ঠিক আছে। একটু বড়োও লাগছে। মা কিন্তু অতীব শীর্ণ।

ফের রবিনকেই জিজ্ঞেস করলাম, জবার কোনও রোগভোগ হল নাকি? চেহারা তো বেশ ভেঙে গেছে দেখছি। আর বোলো না, অতিরিক্ত আদরে পাগলিটা বোধহয় বাচ্চাটাকে মেরেই ফেলবে। ছেলেটা হওয়ার পর থেকে সারাক্ষণ কোলে নিয়ে ঘুরছে। এক মুহূর্ত কাছছাড়া করে না। নিজের কাজ কারবারও বন্ধ করে দিয়েছে। আর ওকে দেখতে পাও বাজারে কিছু বিক্রি করতে?

মাথা নেড়ে ‘না’ বুঝিয়ে ছিলাম আমি। রবিন ফের বলেছিল, নিজে কী খায়, কতটুকু খেতে পায়, কে জানে? ও না খেলে বুকের দুধও তো হবে না। বাচ্চাটা খাবে কী? এ নিয়ে তুমি যদি কিছু বলতে যাও, টাকা দিয়ে সাহায্য করতে চাও, তক্ষুনি তেড়ে আসবে। টাকাপয়সার জন্য কোনওদিনই কারুর কাছে হাত পাতে না জবা, বিরাট প্রেস্টিজ জ্ঞান! বাচ্চাটার ভালোর জন্য কিছু বলতে গেলে গালাগাল শুনতে হবে। ইতিমধ্যেই শুনেছে অনেকে। ও বোঝে উলটো। মনে করে বাচ্চার ওপর নজর দেওয়া হচ্ছে। নজর কাটাতে নানান ঠাকুরের থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাদুলি, তাবিজ পরিয়ে যাচ্ছে বাচ্চাটাকে। …রবিন আরও অনেক কিছু বলে যাচ্ছিল। মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার। মাছবাজার থেকে উঠে এসে ফের রেলের পোস্টের নীচে বাচ্চা কোলে বসে থাকতে দেখেছিলাম উশকোখুশকো চুলের জবাকে। একেবারে প্রেতিনীর চেহারা! মুখের ‘মা মা’ হাসিতে অবশ্য কোনও অন্ধকার লেগে নেই। বাচ্চাটার সঙ্গে আদরের খুনশুটি করে যাচ্ছে। সেদিন আর ওকে কিছু বলতে ইচ্ছে করেনি। সরে গিয়েছিলাম সামনে থেকে।

দিন দুয়েক বাদে ছ’টা দু’টোর ডিউটি সেরে বাড়ি ফিরছি, স্টেশনরাস্তায় দেখি আমার সামনে হাঁটছে জবা। মন্থর হাঁটা। বাচ্চাটা তো কোলে আছেই। পা চালিয়ে ওর পাশে চলে গিয়েছিলাম। জবাকে বলেছিলাম, কী রে, কেমন আছিস? বাচ্চা মানুষ করতে গিয়ে চেহারাটা তো একেবারেই গেছে দেখছি! ওর বাবা খোঁজটোজ নেয়?

কেন নেবে? সে তো বাবা হতে চায়নি। আমি মা হতে চেয়েছিলাম। বলেছিল জবা।

আমি বললাম, তবু সে লোকটা তো বাবা। তার কোনও দায়দায়িত্ব নেই? গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াবে, তুই বাচ্চাটাকে মানুষ করতে গিয়ে হাড্ডিসার হয়ে যাবি! নিজেকে দেখেছিস আয়নায়?

ও সব ঠিক হয়ে যাবে। বাচ্চাটা একটু বড়ো হয়ে গেলেই কাজে নেমে পড়ব। এখন তো কোথাও রেখে যেতে পারি না। কারুর কাছে দিতেও পারি না, সবাই নজর দেয়।

বাচ্চার প্রতি জবার যা অন্ধ বাৎসল্য, ওকে বোঝালেও বুঝবে না, বাচ্চাটা বড়ো হওয়ার আগেই জবা মরে যেতে পারে। ও কথায় না গিয়ে জবাকে বলেছিলাম, মা হওয়ার যখন ইচ্ছেই হয়েছিল তোর, বিয়েটা করে নিতে পারতিস। তাহলে লোকটা এইভাবে পালিয়ে বেড়াতে পারত না। বাচ্চা মানুষ করতে মা-বাবা দু’জনকেই লাগে। উত্তরে জবা বলেছিল, বিয়ে ফিয়ে বহুত ঝামেলার ব্যাপার, আমার মা হওয়ার ইচ্ছে হয়েছিল, হয়ে গেছি ব্যস। মা হওয়ার ইচ্ছেটা কখন, কীভাবে এল তোর মনে? জিজ্ঞেস করেছিলাম জবাকে। আসলে অশিক্ষিত মেয়েটা মাতৃত্বের আকাঙক্ষাটা কীভাবে প্রকাশ করে, সেটাই দেখতে চাইছিলাম। শিক্ষিতরা তো অনেক গুরুগম্ভীর ব্যাখ্যা দেয়। কিন্তু জবা যা বলল, বোধবুদ্ধি গুলিয়ে গিয়েছিল আমার।

একটা ঘটনার কথা বলেছিল জবা, মহাদেবের কেটারিং-এর হয়ে কাজে গিয়েছিল চাপাডাঙায়। বিয়ের কাজ। রাত হয়ে গিয়েছিল ফিরতে, পেটে ভালোমন্দ খাবার, ম্যাটাডোরে বাসনপত্রের মাঝে বসে ঢুলছিল জবা। মাকালতলায় এসে বিগড়ে গেল গাড়ি। ড্রাইভার চেষ্টা করছিল সারানোর। জবা ম্যাটাডোর থেকে নেমে মাঠের ধারে শিরীষগাছের নীচে গিয়ে বসেছিল। সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে। রাতে স্বপ্ন দেখে, গাছটা তাকে যেন বলছে জবা রে, এবার মা হ। মা হয়ে যা জবা। মেয়েমানুষ যখন হয়েছিস, মা হবি না কেন? মা হওয়ায় দারুণ সুখ, খুব আনন্দ… ঘুম ভাঙতে জবা দেখেছিল ভোর হয়ে গেছে। তাকে ফেলে চলে গেছে কেটারিং কোম্পানির গাড়ি। তাতে রাগ হয়নি জবার, মা হওয়ার ইচ্ছেতে মন তখন টইটুম্বুর। গাছটাকে প্রণাম করে পায়ে হেঁটে মাকালতলা থেকে ফিরেছিল দেবনগরে।

জবার ভাষায়, কিছু হারামি সবসময় ওঁত পেতে বসে থাকে ওকে পাওয়ার জন্য, তাদেরই একটাকে ঘরে তুলেছিল জবা। কিছুদিন পর যখন বুঝল বাচ্চা এসে গেছে পেটে, হারামিটাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। …ঘটনাটা অবান্তর, কিন্তু চিত্তাকর্ষক। বিষয়টাকে নিয়ে গল্প লেখাই যায়। দ্রুত বাসনাটাকে আমি ত্যাগ করেছিলাম। সাধন, জবা এদের নিয়ে দ্বিতীয় গল্প লিখে ঝামেলা বাড়াতে চাই না। একটা করে লেখাতেই রাস্তাঘাটে বিরক্ত করে মারে। দু’টো লিখলে আমাকে এতটাই আপনজন ভাববে, চলে আসতে পারে বাড়িতে।

নাঃ, এবার কিন্তু বেশ চিন্তাই হচ্ছে। এখনও কেন ফিরছে না জবা? আকাশে যা মেঘ করেছে, বৃষ্টি নামল বলে। তবু ভালো, বাচ্চাটা এখনও কেঁদে ওঠেনি। যতবারই চোখ যাচ্ছে ওর দিকে, দেখছি, মুখে নানারকম আওয়াজ তুলে নিজের মনে হাত-পা নেড়ে যাচ্ছে। …বৃষ্টি এসেই গেল। জোর কদমে শুরু হয়েছে। শেডের শেষের দিকে আছি বলে প্ল্যাটফর্মে বৃষ্টি পড়ে ছিটকে আসছে জল। একটু বাদে প্ল্যাটফর্মও ভাসবে। শেডে অনেক ফুটোফাটা আছে, ওপর থেকে জল নামার পাইপও ভাঙা। বাচ্চাটাকে এবার তুলে আনতেই হবে, নয়তো ভিজে যাবে পুরোপুরি। বেঞ্চ থেকে নেমে বাচ্চাটাকে দু’হাতে তুলে ধরি, উৎকট গন্ধটা আছে ঠিকই, তবে শিশুর গায়ের সেই অদ্ভুত ঘোরলাগা গন্ধটা পুরোপুরি চাপা পড়ে যায়নি।

আমাকে চমকে দিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল জবা। ভিজে একেবারে সপসপে হয়ে গেছে। খুব হাসছে, নুয়ে পড়ে হাসছে। আমাকে দেখেই ওর হাসি। বলে ওঠে, তোকেই তো ওর বাপের মতো লাগছে! জবা যেন একদলা কাদা ছুড়ে মারল আমার গায়ে। রাগ হচ্ছে ভীষণ। ওকে কিছু বলেও তো লাভ নেই। কাকে কী বলতে হয় জানে না। বাচ্চাটাকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, কোথায় থাকিস? বাচ্চাটা তো এক্ষুনি ভিজে যেত।

বাচ্চাকে কোলে নিল জবা। বলতে থাকল, আর বলিস না মাইরি, বাচ্চাটাকে রেখে একটা প্যাসেঞ্জারের মাল তুলে দিতে গেছি রিকশায়, পুলিশ আটকে রেখে দিল। বাজারে হারানদার সোনার দোকানে চুরি হয়েছে, আমার কাছে এটা ওটা জানতে চাইছে পুলিশ। বলছি, বাচ্চাকে রেখে এসেছি স্টেশনে, কথা কানেই নিচ্ছে না!

অঝোরে বৃষ্টি সত্ত্বেও শেড থেকে বেরিয়ে বাড়ির উদ্দেশে হাঁটা দিলাম। খেয়াল করলাম জবার ছোড়া কাদাটা আলকাতরার মতোন নাছোড়! এত বৃষ্টিতেও ধুয়ে যাচ্ছে না।

পরের দিন ঘুম ভাঙল একদম ভোরে। অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম। মাকালতলার যে শিরীষ গাছটার কথা বলেছিল জবা, গাছটা আমি চিনি। পিছনে মাঠ। অল্প বয়সে ম্যাচ খেলতে গেছি। স্বপ্নে দেখছি, সেই গাছতলায় শুয়ে আছি আমি। গাছটা বলছে, বাচ্চাটাকে নিয়ে গল্প লেখ। গল্পটা তো এসে গেছে মাথায়। কেন দেরি করছিস? গল্পটা যে মাথাতেই মরে যাবে…

ধড়মড় করে উঠে বসলাম বিছানায়। হাতে মাত্র চারটে দিন। পুজোসংখ্যায় গল্পটা দিতে হবে। বাথরুম ঘুরে এসে বসে পড়েছি লেখার টেবিলে। প্রথম লাইনটা লিখলাম, বছর তিনেক ধরে আমার স্বভাবে একটা উল্লেখযোগ্য বদল এসেছে…

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব