অ-সমকাম

বিয়ের সাত বছর পর রনিতা বুঝতে পেরেছিল অসম্ভব! যদিও বিয়ে ফুলশয্যা, মধুচন্দ্রিমার আবেশ কাটতেই অনুভব করেছিল অন্যরকম কিছু একটা। তবু আশায় বুক বেঁধে ছিল। হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। সংসারের কঠোর বন্ধনে বেঁধে ফেলতে চেয়েছিল কর্পোরেট সেক্টরের অফিসার স্বামী অনিন্দ্যকে। আশা করেছিল, একবার বেঁধে ফেলতে পারলেই হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। সাত তাড়াতাড়ি সন্তানের জন্য বায়না ধরেছিল রনিতা।

–এখনই সন্তানের প্রয়োজন কী!

অনেকেই অনিন্দ্যকে সমর্থন করেছিল।

–সত্যিই তো! সবে বিয়ে হয়েছে। কয়েকটা দিন যাক। এনজয় করুক জীবনটাকে। বাচ্চাকাচ্চা হলেই তো সব শেষ!

অনিন্দ্যর যুক্তি ছিল অবশ্য অন্যরকম। তার যেটুকু উপার্জন, সন্তান এলে তাতে তাদের ঠিকমতো চলবে না।

প্রথম প্রথম রনিতা রাতে শুতে গিয়ে তাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল। সন্তান হচ্ছে দাম্পত্যে ভালোবাসার সেতু। কিন্তু অনিন্দ্য কিছুতেই সে কথা মানতে নারাজ। একটু একটু করে রনিতাও বুঝতে পারছিল, অনিন্দ্যকে বোঝানো তার সাধ্যের অতীত। তবু হাল ছেড়ে দিয়েছিল, এমন নয়। সুযোগ পেলেই অনিন্দ্যর দুর্বলতম অনুভূতিগুলোর গায়ে নক করত রনিতা।

কিন্তু সেদিন ঘরে ঢুকেই রনিতা বুঝতে পেরেছিল, অন্যরকম কিছু একটা। অনেক দিনই রাত করে বাড়ি ফেরে অনিন্দ্য। কোনও দিন হয়তো ফেরেও না। তাই নিয়ে অনেকবার অভিযোগও করেছে অনিন্দ্যর কাছে। অনিন্দ্যর একটাই জবাব, রুটিনে বাঁধা জীবন তার ভালো লাগে না। তাও মেনে নিয়েছিল রনিতা।

আজ রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে অন্য দিনের মতোই ঘরে ঢুকতেই, খটকা লাগল রনিতার। তাকে দেখেই তড়িঘড়ি সেলফোনে কলটা কেটে দিল অনিন্দ্য। উন্মত্ত বাঘিনির মতোই রনিতা ঝাঁপিয়ে পড়ল অনিন্দ্যর উপর। হ্যাঁচকা টানে কেড়ে নিল মুঠোবন্দি সেলফোনটি। লক খুলতেই চোখের উপর ভেসে উঠল একের পর এক আপত্তিকর ছবি আর মেসেজ।

সেলফোনের স্ক্রিনের তীব্র আলোয় রনিতার মুখ তখন ঝলসে যাচ্ছে। অথচ কেমন নিস্পৃহ দেখাচ্ছে অনিন্দ্যকে। ভাবলেশহীন, যেন অত্যন্ত স্বাভাবিক সে। কোনও কিছুরই হিসাব মেলাতে পারছে না রনিতা। যেন এক অথৈ সমুদ্রে একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে সে।

–এসব কী অনিন্দ্য! আমি কি সত্যি দেখছি! বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে স্পষ্ট অনুভব করল রনিতা। তার তীব্র নীল আলো এসে পড়ছে জানলার কাছে। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে রনিতা। নিস্পৃহ অনিন্দ্য।

–সত্যি! আমি শুধু পুরুষের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ অনুভব করি। কোনও নারী আমাকে তা দিতে পারে না!

দূরে কোথাও কর্কশ শব্দে বাজ পড়ল। রনিতা নিজের অজান্তেই কেঁপে উঠল একবার। তারপর অনুভব করল বাইরে অঝোর ধারায় শুরু হয়েছে বৃষ্টি। ইচ্ছে করেই খুলে দিল জানলার কাচের শার্শিগুলো।

বিন্দু বিন্দু বৃষ্টি কণা জমে উঠছে এখন রনিতার কপালে, চিবুকে, চোখের পাতায়। একা এবং একা নিথর বসে রইল ভোরের প্রতীক্ষায়।

 

 

বিন্তি উদ্ধার কাহিনি

পুঁটিকুমার আমার সামনে ভাতের থালাটা খটাস করে নামিয়ে লম্বা করে নাক টানল।

এগারো বছরের পুঁটিকুমার সবসময়েই নাক টানে। তার বারোমাসই সর্দি। এই কারণে তার আর-একটা নাম হল সর্দিকুমার। অবশ্য পুঁটিকুমার বা সর্দিকুমার কোনওটাই এই ছেলের ওরিজিনাল নাম নয়। ওরিজিনাল নাম কান্তি। রেস্টুরেন্টে বয় বেয়ারার এই কাজ পাওয়ার পর সে নতুন নাম পেয়েছে। এই রেস্টুরেন্টে এরকমই নিয়ম। যারা কাজ করতে আসে তারা একটা করে নতুন নাম পায়। কর্মচারীরা সবাই মিলে এই কাণ্ড করে। বলতে লজ্জা করছে, গত কয়েক বছর হল নামকরণের গুরুদায়িত্ব আমার ঘাড়ে পড়েছে। কী ঝামেলা! আমি কি এদের কর্মচারী? একেবারেই না। আমি এদের খদ্দের। কাস্টমার। তাও জেন্টলম্যান কাস্টমার নয়, ধারবাকির কাস্টমার। তবু কোনও এক রহস্যময় কারণে এখানকার কর্মচারীরা আমাকে অতিরিক্তরকম পছন্দ করে। সম্ভবত ওদের সঙ্গে প্রাণখুলে মেলামেশার কারণে। কে জানে। জেনে বিশেষ লাভ নেই।

অর্থনীতির নানান ধরনের মডেল আছে। কেইন্স মডেল, মার্কস মডেল, সেনস্ মডেল। কিন্তু ভালোবাসার ব্যাপারে কোনও মডেল নেই। কে কেন ভালোবাসে বোঝা দূরূহ। আমার বিশ্বাস একটা দিন আসবে যখন, নিশ্চয় এই বিষয়েও ফর্মুলা তৈরি হবে। সেই ফর্মুলাতে লাগিয়ে বুঝতে পারব রাঁধুনি, জোগানদার, বয়-বেয়ারা, বাজারসরকার, গ্যাস সাপ্লাইয়ের ছেলে, সাফাইকর্মী এমনকী গড়িয়াহাটা মোড়ের যে- ভিখিরি পরদিন গুছিয়ে বাসি এঁটোকাঁটা নিয়ে যায় তারা সকলে কেন আমাকে পছন্দ করে?

এরা একদিন আমাকে চেপে ধরল।

‘সাগরদা, নাম ঠিক করবার ভার এবার থেকে আপনার। না বললে হবে না। আমাদের দেওয়া নাম মোটেও জুতের হচ্ছে না। বক্বাস, ফক্বাস, খট্টাসে গিয়ে আটকে যাচ্ছি। এগুলো কোনও নাম হল? ভদ্রলোকদের সামনে বলা যায়? আমরা তাই ঠিক করেছি, এবার থেকে আপনি এই কাজ করবেন।’

আমার মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল। বললাম, ‘সে কী! আমি কী করে করব! আমি কি তোমাদের এখানে কাজ করি?’

‘কাজ করতে হবে না। কাজ না করলেও আপনি আমাদের লোক।’

আমি কাতর ভাবে বললাম, ‘নাম দিতে গেলে লেখাপড়া জানতে হয়। পণ্ডিত হতে হয়। নিদেনপক্ষে কবি সাহিত্যিক তো বটেই। তোমরা বরং স্কুল কলেজের মাস্টারমশাইদের ধরো। বাংলার মাস্টারমশাইরা নাম দেওয়ার ব্যাপারে ভারি দক্ষ হন। আমি একজন মাস্টারমশাইকে চিনি যিনি বছরে এক ডজন করে নাম সাপ্লাই দেন। হাসপাতাল,

নার্সিংহোমের সঙ্গে তার কনট্রাক্ট আছে। যদি বলো ঠিকানা জোগাড় করে দিতে পারি।’

এদের বাংলার মাস্টারমশাইয়ের কথা বললেও আমার নামের বেলায় ঘটনা অন্যরকম ঘটেছিল। সে এক কেলেঙ্কারি ঘটনা। বড়ো হয়ে আমি শুনেছি। আমার নাম দিয়েছিলেন পতিপাবন সমাজদার। তিনি বয়েজ স্কুলে বাংলা পড়িয়েছেন টানা সতেরো বছর। আমার জন্মের পর বাবা তার কাছে গিয়ে অনুরোধ করলেন, ‘মাস্টারমশাই, অনুগ্রহ করে আমার ছেলের একটা নাম ঠিক করে দিন। আপনার মতো বাংলা ভাষার পণ্ডিতের হাতে নামকরণ হলে আমার পুত্র ধন্য হবে।’

পতিতপাবনবাবু বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘এ তো তোমরা বিরাট ঝামেলা করো হে। দু-পাতা বেঙ্গলি লিটারেচার নিয়ে লেখাপড়া করেছি বলে আজীবন ছেলেমেয়েদের নাম দিয়ে বেড়াতে হবে? উফ্ বাংলায় বিএ, এমএ পাশ করাটাই দেখছি ঝকমারি হয়েছে। এমন হবে জানলে আমি ভূগোল পড়াতাম। যারা ভুগোল পড়ায় তাদের এসব ঝামেলা নেই।’

বাবা ধমক খেয়েও হাত কচলাতে লাগলেন। বাবা বিশ্বাস করতেন, মূর্খের ধমকে ক্ষতি আছে, পণ্ডিতের ধমকে ক্ষতি নেই। তার ওপর তিনি পুত্রের নাম সংগ্রহে বেরিয়েছেন। দু-একটা ধমকধামক তো শুনতেই হবে।

মাস্টারমশাই রাগ রাগ গলায় বললেন, ‘ঠিক আছে দেখব’খন। সাতদিন পরে এসো।’

সাতদিন পরে বাংলা ভাষার পণ্ডিত পতিতপাবন সমাজদার আমার নাম রাখলেন। সাগর। বাবা তো বিরাট খুশি। সাগর নামের জন্য খুশি নন, বাংলা ভাষার একজন পণ্ডিত তার ছেলের নাম রেখেছেন এই কারণে খুশি। সবাইকে ডেকে ডেকে তিনি বলতে লাগলেন। বাংলায় গভীর বুৎপত্তি এবং অধ্যয়ন না থাকলে এ জিনিস সম্ভব নয়। পরে কেলেঙ্কারি ফাঁস হল। জানা গেল, বুৎপত্তি, অধ্যয়ন তো দূরের কথা পতিতপাবনবাবু বাংলা নিয়ে পড়াশোনাই করেননি। তিনি বাংলার মাস্টারমশাইও নন। তিনি ভূগোলের মাস্টারমশাই। বয়েজ স্কুলে

বাংলার শিক্ষকের পদ দীর্ঘদিন শূন্য থাকার কারণে তিনি প্রক্সি দেন। গোলমালের আশঙ্কায় ঘটনা কেউ প্রকাশ করে না। পাছে চাকরি চলে যায়। শুনেছি, ঘটনা জানার পর বাবা খুবই ভেঙে পড়েছিলেন। একজন ভূগোল শিক্ষককে দিয়ে পুত্রের নাম রাখা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। সবাই বলল, ‘তাতে কী হয়েছে? উনি তো লেখাপড়া জানাই মানুষ।’

বাবা বললেন, ‘প্রশ্নটা লেখাপড়ার নয়, প্রশ্নটা সাবজেক্টের। ভূগোলের পণ্ডিত জায়গার নাম দেবেন, মানুষের নাম দেবেন কেন? আমি কোনও কলম্বাস নই যে নতুন জায়গা আবিষ্কার করে তার কাছে গেছি।’

যুক্তি ঠিক নয়। নড়বড়ে। কিন্তু বিশ্বাস বলে একটা কথা আছে। তাকে কে টলায়? তবে আমি কিন্তু খুব খুশি। সাগর নাম পেয়ে গর্বিত। চমৎকার নাম। ভূগোলের টাচ আছে, আবার সাহিত্যের টাচও আছে। সাগর নিয়ে কত গান কবিতা লেখা হয়েছে। ভূগোল মাস্টারমশাই তো আমার নাম কর্কটক্রান্তি রেখা বা মৌসুমি বায়ু রাখেননি। যাই হোক, আমি এ গল্প রেস্টুরেন্টের কর্মীদের বলিনি। শুধু নিজে সরে পড়তে চেয়েছিলাম। ওরা কিছুতেই ছাড়ল না।

‘আমরা শুনব না। আমরা আপনাকেই চাই সাগরদা। এবার থেকে যে নতুন লোক এখানে কাজ করতে আসবে আপনি তার নাম ঠিক করে দেবেন। আপনিই আমাদের পণ্ডিত, আপনিই আমাদের কবি।’

হেসে ফেললাম। আমি পণ্ডিত! ফাঁকিবাজ এবং গাধা ছাত্রদের লেখাপড়ার বই দেখলে হাই ওঠে। আমি ছিলাম হাইয়ের থেকে এক ডিগ্রি বেশি। বই দেখলে হাইয়ে সময় নষ্ট না করে আগে ভাগে ঘুমিয়েই পড়তাম। ছাত্রাবস্থায় আমার শ্লোগান ছিল, ‘আগে ঘুম পরে হাই’।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্নে যেটুকু পড়বার পড়ে কলেজ পাশ করেছি। তারপর বেকার। নর্ম্যাল বেকার নয়, স্বেচ্ছাবেকার। স্বেচ্ছাবেকার হল স্বেচ্ছা অবসরের মতো। চাকরি পাইনি বলে চাকরি করি না এমন নয়। নিজের ইচ্ছে হয়েছে তাই চাকরি করি না। বেলা পর্যন্ত ঘুমোই। ঘুম ভেঙে গেলে আরও বেলা পর্যন্ত বিছানায় গড়াই। গড়ানো পর্ব শেষ হলে আরও আরও বেলা পর্যন্ত বিছানা ছাড়ব কিনা ভাবি। ভাবা কমপ্লিট হলে আরও আরও আরও বেলা পর্যন্ত ভাবি, এতক্ষণ যা ভাবলাম সবই তো ভুল ভাবলাম। নতুন করে ভাবতে হবে। জীবন হল ভাবার ভেলা। সেই ভেলায় শুয়ে উথালপাতাল সমুদ্রে ভেসে বেড়ানোই জীবনযাপন। বিছানায় শুয়ে শুয়ে এই দার্শনিক চিন্তার তুলনা হয়? সামান্য রোজগার আর বেশিটাই ধারবাকিতে একার চমৎকার জীবন কাটিয়ে নেওয়া।

আমার কাছে চাকরি হল খাদের মতো। হাতির মতো বড়ো মানুষরা যখন ওই খাদে পড়ে, ব্যাঙের মতো অকিঞ্চিৎকররা লাথি কষায়। হাতিকে মরমে মরতে হয়। কিন্তু হায়রে! তখন আর করবারও কিছু থাকে না। ততক্ষণে বউ, ছেলেমেয়ে, সংসার, বাড়ির লোন, দুধের বিল, গ্যাসের দাম, অম্বলের ওষুধ নিয়ে ল্যাজে গোবরে সিচুয়েশন। তাই খাদ এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের। বহু হাতছানি, বহু হুমকির পরও ওদিকে পা বাড়াইনি আমি। টিউশন, কলেজ স্ট্রিটের প্রুফ মাঝেমধ্যে হাবিজাবি দু-একটা উদ্ভট কাজ এবং ধারবাকি– এই আমার উপার্জন। এতেই সকাল-রাতে খাওয়া, এক কামরার বাসার ভাড়া জোগাড় হয়ে যায়। কখনও আবার হয়ও না। ব্যস্, আর কী চাই? আমি যেমন পণ্ডিত নই, তেমন কবি সাহিত্যিকও নই। আমার লেখালিখি বলতে চিঠি। চিঠিও না, চিরকুট। তার বেশিরভাগই বন্ধু তমালের কাছে ধার সংক্রান্ত।

‘ভাই তমাল, তুই শুনলে সবিশেষ দুঃখিত হবি। গত তিনদিন যাবৎ, ছোটো একটা সমস্যার মধ্যে আছি। সমস্যার নাম দারিদ্র্য। পকেটে একটিও পয়সা নেই। চিরকুটপাঠ আমাকে শ দুয়েক টাকা পাঠিয়ে নিজেকে দুশ্চিন্তামুক্ত কর।’

সাধারণত এই ধরনের চিরকুটের উত্তর আসে কড়া।

‘সাগর, তোর টাকাপয়সা নিয়ে আমার কোনও দুশ্চিন্তা, সুচিন্তা কিছুই নেই। অলস, ছন্নছাড়া, কোনও আহাম্মককে নিয়ে আমি কোনও ধরনের চিন্তা করতেই রাজি নই। গত এক বছরে আমার বলে দেওয়া তিনটে চাকরির একটাতেও তুই জয়েন করিসনি। গো টু হেল।’

এই উত্তর পাওয়ার পর আমি নিশ্চিত হই। এই গালির অর্থ পরদিনই টাকা চলে আসা। ‘বন্ধু’ এমনই হয়। তারা ভালোবাসার কথা গালি দিয়ে বলে।

যাইহোক, লেখালিখির এই বিদ্যে দিয়ে আমাকে কবি সাহিত্যিক বলা যায়? কখনওই না। এরপরেও পুঁটিকুমার, ওরা নাছোড়বান্দা। বাধ্য হয়ে নামকরণের দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নিতে হয়েছে।

যেহেতু সকলেই রেস্টুরেন্টের কর্মী তাই আমার নামও আনাজপাতি, মাছ, ডাল, তরিতরকারির মধ্যে ঘোরাফেরা করে। তবে নামকরণে কাউকে ছোটো করার ব্যাপার নেই। কেউ যাতে দুঃখ না পায় তার জন্য শ্রী, শ্রীমান, কুমার, মহাশয়, মাননীয় যুক্ত করে দিই। কখনও কখনও রবীন্দ্রনাথের ‘নাথ’, অতুলপ্রসাদের ‘প্রসাদ’, শরৎচন্দ্রের ‘চন্দ্র’ও লাগাই। যেমন এখানকার হেড রাঁধুনির নাম দিয়েছি লংকা মহাশয়। যোগানদার শ্রীমান উচ্ছে। একজন বেয়ারা পটলনাথ, আর-একজন, মুসুর প্রসাদ। একই ভাবে কান্তি নাম পেয়েছে পুঁটিমাছের। পুঁটিকুমার।

পুঁটিকুমার আবার নাক টানল। মাথা নামিয়ে খেলেও এবার আমার কানে লাগল। এতো ঠিক সর্দি ধরনের নাক টানা নয়।

গত তিন বছর ধরে আমি এই ‘ভাত ডাল’ রেস্টুরেন্টের কাস্টমার। বেশ কয়েকবার রেস্টুরেন্টের মালিক বদলেছে। আমি বদলাইনি। আমার হল বাই মান্থলি সিস্টেম। দু’মাস অন্তর বিল মেটাই। দু’মাস অন্তর খাওয়ার বিল মেটানোর ব্যবস্থা ভূ-ভারতে আর কোথাও আছে বলে জানা নেই। পুরোনো মালিককে এই সিস্টেমে রাজি করিয়েছিলাম। এখন এসেছে অভয়পদবাবু। বয়স্ক মানুষ। নাকের ওপর চশমা পরেন। চশমার ফ্রেম গোল এবং সোনালি। ডাঁটি তামার। একপাশে লাল রঙের সুতো ঝুলছে। সেটা টেবিল ফ্যানের বাতাসে ফর্ফর করে ওড়ে। এই সুতো চশমার, না বাইরে থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসা বলতে পারব না। অনেক সময় চাদর টাদর থেকে চশমার খোঁচায় সুতো আটকে থাকে। আর খোলা হয় না। নতুন মালিকের চরিত্র হল তিনি সারাক্ষণ একটা ‘মালিক, মালিক’ ভঙ্গির মধ্যে থাকবার চেষ্টা করেন। হাবেভাবে অহংবোধের মতো মালিকবোধ। সম্ভবত এটাই ওর প্রথম ব্যাবসা। মালিক হয়ে তিনি গর্বিত। মানুষটাকে আমি এড়িয়ে চলি। সেদিন ধরা পড়ে গেলাম।

আমি খাওয়া শেষ করে ক্যাশ কাউন্টার থেকে মৌরি তুলতে গিয়েছিলাম। অভয়পদবাবু এক গাল হেসে বললেন, ‘বসুন সাগরবাবু। আছেন কেমন?’

প্রমাদ গুনলাম। লক্ষ্য করে দেখেছি, যারা আমাকে খাতির যত্ন করে বসতে বলে, কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা আমাকে ধমক দেয়, বিপদে ফেলে। এটা প্রকৃতির নিয়ম। প্রকৃতি এক একজনকে এক একটা বিষয়ের জন্য তৈরি করেছে। কাউকে লাথি ঝাঁটার জন্য তৈরি করেছে কাউকে বসিয়ে জল-বাতাসা খাইয়ে যত্নের জন্য তৈরি করেছে। লাথি ঝাঁটার মানুষকে জল-বাতাসা দিয়ে যত্ন করলে প্রকৃতির প্রেস্টিজে লাগে। সে প্রথমে চুপ করে থাকে। নিয়মের বাইরে খেলতে দেয়। কিন্তু কিছুটা পরেই প্রতিবাদ করে। আমার বেলাতেও তাই হয়। খাতিরের পরই গলাধাক্বা।

চেয়ারে বসতে বসতে বললাম, ‘আমি ভালোই আছি। আপনি?’

অভয়পদবাবু চোখের চশমা নাকের ওপর আরও খানিকটা নামিয়ে অন্যমনস্ক গলায় বললেন, ‘ভালো তো ছিলাম ভাই, খানিক আগে থেকে বিগড়ে গেছি।’

আমি সহানুভূতির গলায় বললাম, ‘কেন? হলটা কী?’

ভদ্রলোক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘মালিক হিসেবে এখানকার নতুন দায়িত্ব পেয়েছি। বোঝেনই তো মালিকের দায়িত্ব কত কঠিন। মালিক না হলে সবদিকে নজর রাখার দরকার নেই, কিন্তু মালিক হয়ে গেলে আপনি খতম, তখন সবদিকে নজর দিতে হবে। এখন সব আমার। এই দোকান আমার, চেয়ার টেবিল আমার, কর্মচারীরা আমার, হিসেব খাতা আমার, লাভ লোকসান আমার। সবের ওপর শুধু আমার দখলদারি। ঠিক কিনা?’

আমি সবিনয় বললাম, ‘ঠিকই স্যার।’

অভয়পদবাবুকে ‘স্যার’ সম্বোধনের কারণ ধারবাকি। এ ব্যাপারে আমি কোনও ঝুঁকি নিই না।

অভয়পদবাবু আমার সম্মতি চাইলেন বটে, কিন্তু পেয়ে খুশি হলেন বলে মনে হল না। একই রকম বিরক্ত গলায় বললেন, ‘সেই নজর দিতে গিয়েই চমকে উঠেছি। হিসেবের খাতা ঘাঁটতে গিয়ে দেখি আপনার নামের মাসে লেখা দ্বিমাসিক। সাগরবাবু, দু’মাসের ধার বলে তো আমি কখনও কিছু শুনিনি। ধার খুব বেশি হলে একদিন, দুদিন। বড়োজোর হপ্তাখানেক। খাবার রেস্টুরেন্ট কোনও মুদিখানা নয় যে সেখানে মাসকাবারি খাতা থাকবে। ধারবাকি নিয়ে এসব কী চলছে! এতো ব্যাবসা লাটে উঠবে! মালিক হিসেবে আমি কি তা মেনে নিতে পারি?’

যা আঁচ করেছিলাম তাই ঘটল। বিপদ শুরু হয়ে গেল। নিজেকে সামলে হাসলাম। এই লোককে গুলিয়ে দিতে হবে। আমার ধারবাকির সিস্টেম বন্ধ হলে জলে পড়ব। না খেয়ে থাকতে হবে। বললাম, ‘কী যে বলেন স্যার ধারবাকিতে কখনও ব্যাবসা লাটে ওঠে! ধার বাকিই তো এখন ব্যাবসা। যত ধার তত লাভ। ধার শোধের কত নতুন নতুন প্যাটার্ন বেরিয়েছে। মান্থলি, বাই মান্থলি, হাফ ইয়ারলি, ইয়ারলি। ব্যাংক আর ক্রেডিট কার্ডগুলো মাথায় ঝুড়ি নিয়ে ধার নেবেন গো, ধার নেবেন গো বলে গলিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের ধার শোধের ব্যবস্থাপনা শুনলে মাথা ঘুরে যাবে স্যার। কোনও, কোনও স্কিমে আবার ধার নিয়ে শোধ দিতেও হয় না। শুধু নিলেই হয়।’

নতুন মালিক আমার চোখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইলেন। এই তাকানো যেমন ভালো তেমন আবার বিপজ্জনকও। পলকহীন চোখে মানুষ যেমন ভালোবাসার কথা বলে, তেমন আবার খুনও করতে পারে। রেস্টুরেন্টের মালিক নিশ্চই আমাকে ভালোবাসার কথা বলবে না।

‘সাগরবাবু, আমি ব্যাংক নই, ক্রেডিট কার্ডও নই। সামান্য ভাত-ডাল বেচে খাই। আমি এই ধারবাকির ব্যাবসা আর করব না বলে স্থির করেছি। এবার আপনার সিদ্ধান্ত। তাড়াহুড়োর কিছু নেই। দুদিন ভাববার সময় নিন। আচ্ছা, দুদিন নয়, তিনদিনই সময় দিলাম। আপনি পুরোনো লোক। এখানে যদি খেতে হয়, তিনদিন পরেই টাকাপয়সা যা বাকি আছে মিটিয়ে দেবেন। তারপর আমরা রোজকার রোজ হিসেবে যাব। ফ্যালো কড়ি খাও তেল সিস্টেম। খাও তেল কেন বুঝতে পারলেন? খাবার দোকান বলে। আমার এই অনুরোধ কি মনে থাকবে সাগরবাবু?’

আমি হাসলাম। চিন্তায় পড়ে গেছি বুঝতে দিলে চলবে না। তিনটে দিন তো চলবে। তারপর একটা কিছু ভাবা যাবে। আমি মাথা নেড়ে বললাম, ‘খুব মনে থাকবে।’

অভয়পদবাবু ঠোঁটের কোণায় মুচকি হাসলেন। গোল চশমা নিজেই খানিকটা ঝুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘না থাকবে না। ভুলে যাবেন। কঠিন কথা মানুষ সহজে মনে রাখতে চায় না। ধারবাকি শোধের কথা তো একেবারেই না। মালিক হলে জানতেন। সেই কারণে আমি একটা পথ ভেবেছি।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘পথ! কী পথ? পুলিশে দেবেন?’

অভয়পদবাবু হাসলেন। গোল চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘ছি ছি ও কী বলছেন! পুলিশে ধরিয়ে দিলে আপনি তো ফুড়ুত করে গারদে ঢুকে যাবেন সাগরবাবু। তাতে আমার লাভ কী হবে? গারদ থেকে আপনি কি আমার ধার শোধ করতে পারবেন? পারবেন না। যদি চেষ্টাও করেন, মাঝপথে পুলিশ কমিশন খাবে।’

আমি হালকা ঘাবড়ে গেলাম। বললাম, ‘তবে কি মারধোর ভাবছেন?’

‘না, আপনার মতো মানুষকে মেরে লাভ নেই। মার তো দূরের কথা। নিংড়োলেও টাকাপয়সা পড়বে না। আমার সব খোঁজ খবর নেওয়া হয়ে গেছে সাগরবাবু। আপনি হলেন ব্যাড ফর এভরিথিং ধরনের মানুষ। মারধোরের জন্যও ব্যাড। গালমন্দের জন্যও ব্যাড। আমি ছেলেদের বলে দিয়েছি, কাল থেকে আপনার ওপর ধাপে ধাপে অ্যাকশন শুরু হবে। কারণ আপনি আমাদের পুরোনো খদ্দের। ব্যাবসা যদি লক্ষ্মী হয়, পুরোনো খদ্দের তার বাহন। প্যাঁচা। তাই পর্যায়ক্রমে ব্যবস্থা। আপনার খাবার মেনু থেকে একটা একটা করে আইটেম স্টপ করতে বলেছি। বড়ো কোনও আইটেম দিয়ে শুরু করব না। শুরু হবে ছোটো খাটো কিছু দিয়ে। ধীরে ধীরে ‘বড়ো’তে যাব। কেমন হবে?’

আমার চোখ কপালে। এই মানুষ তো বিরাট খেলোয়াড়। খেলা চট করে বুঝতে দেয় না। আমি বললাম, ‘ঠিক ধরতে পারলাম না।’

‘পারবেন। ব্যবস্থা শুরু হলেই ধরতে পারবেন। ভালো চিকিৎসারই এই নিয়ম। চট করে ধরা যায় না। ধীরে ধীরে যায়। কাল থেকে ভাতের পাতে আপনার জন্য লেবু দেওয়া বন্ধ করতে বলেছি। লেবু বড়ো কিছু না। একটা ইঙ্গিত। তিনদিন পর বন্ধ হবে নুন। সল্ট। লেবু, নুনের পর আসবে মাছের ঝোল। দেন ডাল। তারপর সবজি। ধার না মেটালেও ভাত চলবে কয়েকদিন। ওনলি ভাত। আমরা কাউকে ভাতে মারতে চাই না। তবে এরপরেও যদি টাকা দেবার কথা ভুলে যান সাগরবাবু, আমাদের কিছু করার থাকবে না। বাধ্য হয়ে ভাতটুকুও বন্ধ করে দিতে হবে।’

আমি অভিভূত। আমি চমৎকৃত। ধার আদায়ের এই অভিনব পদ্ধতি আমাকে মুগ্ধ করল। বললাম, ‘আচ্ছা, ভাত বন্ধ হলে কি আমি খালি থালা নিয়ে বসতে পারব?’

‘আপনি কি আমার সঙ্গে ঠাট্টা করছেন?’

আমি মুচকি হেসে আড়মোড়া ভাঙলাম। চেয়ার ছেড়ে উঠতে উঠতে বললাম, ‘স্যার, আপনার চশমাটা কি ইংরেজ আমলের? মনে হচ্ছে, চার্লস টেগারের ফটোতে এরকম একটা চশমা দেখেছিলাম।’

আমার ওপর ধাপে ধাপে অ্যাকশন শুরু হয়েছে। আজ তৃতীয় দিন। ভাতের পাতে লেবু বন্ধ।

আমি থালা সামনে টানলাম। থালার ওপর ঢিবি করা ভাত। ভাতের গা ঘেঁষে দুটো বাটি। তাতে ডাল আর মাছের ঝোল। মাছের ঝোল নয়, মাছের জল। বাটির দিকে তাকালে মনে হবে, কিছুক্ষণের মধ্যে চকোলেট সাইজের পোনা মাছের টুকরো প্রাণ পাবে এবং বাটির জলে মহানন্দে সাঁতার কাটবে। আমায় যদি ছিপ দেওয়া হয়, আমি বাটিতে সেই ছিপ ফেলে পোনা মাছের টুকরো শিকার করব। থালার কোণায় নুন, ভাতের আড়াল থেকে উঁকি মারছে টসটসা লেবুর টুকরো। পাতিলেবু। মালিকের ব্যবস্থা অনুযায়ী লেবু আমার প্রাপ্য নয়। পুঁটিকুমার স্মাগল করে দিয়েছে। রান্নাঘর থেকে হাতসাফাই। গতকাল আমি আপত্তি করেছিলাম।

‘পুঁটিকুমার কাজটা ঠিক হচ্ছে না।’

পুঁটিকুমার নাক টেনে বলল, ‘কোন কাজটা?’

‘এই যে তুই আমাকে লেবু চুরি করে দিস এই কাজটা। ধার মেটাতে পারিনি বলে তো আমার লেবু বন্ধ থাকার কথা। আমি তো আর লেবুর জন্য এনটাইটেলড্ নই। এনটাইটেলড্ মানে জানিস? এনটাইটেলড্ মানে হল…।’

পুঁটিকুমার আমাকে থামিয়ে ধমক দেওয়ার ঢঙে বলল, ‘ইংরাজি শেখাবেন না। আমি লেবু চুরি করি না। চোরাপথে আপনার থালায় চালান করি।’

এই কথায় আমি থ’ মেরে যাই। বলি, ‘চোরাপথে চালান করিস মানে!’

‘তরিতরকারি কাটাকুটির পর পাতিলেবু আর পাঁচটা আনাজের খোসামোসার সঙ্গে দরজা দিয়ে রান্নাঘরের বাইরে চলে যায়। একটু পরেই আবার হাত ঘুরে জানলা দিয়ে ফিরে আসে।’

আমি চমকে উঠি। এতো রীতিমতো স্মাগলিং! আমার জন্য এরা এতটা ভাবে! আমার পুঁটিকুমার আবার নাক টানল। এই আওয়াজ আমার কেমন যেন ঠেকল! অন্যরকম। ঠিক সর্দির মতো তো নয়! আমি ডাল মাখা ভাতে লেবু কচলাতে গিয়ে থমকে গেলাম। মুখ তুললাম। হাফ প্যান্ট, ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জি পরে আমার টেবিলের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সর্দিকুমার। সে কাঁদছে।

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কীরে কাঁদছিস নাকি?’

পুঁটিকুমার উত্তর না দিয়ে নাক টানল। আমি বললাম, ‘কীরে কেউ মেরেছে? মালিক? অন্য কেউ?’

পুঁটিকুমার দু’পাশে মাথা নাড়াল।

‘তাহলে!’

পুঁটিকুমার ছেঁড়া স্যান্ডো গেঞ্জির ভেতর থেকে একটা ঘামে ভেজা পোস্ট-কার্ড বের করল। এগিয়ে দিল আমার দিকে। পোস্ট-কার্ডে মেয়েলি হাতে মাত্র একটা লাইন লেখা–

‘ভাই, আমি ঠিক করেছি, বিষ খাব। আমার দিব্যি একথা তুই কাউকে জানাবি না। মা-বাবা কাউকে না। ইতি তোর প্রাণের দিদি।’

মেয়েলি হলেও হাতের লেখা সুন্দর এবং একটা বানানও ভুল নেই।

আমি আর পুঁটিকুমার বসে আছি ফুটপাথের ধারে। একটা চকচকে শহিদবেদির ওপর। পুঁটিকুমার পা দোলাচ্ছে। তার পা দোলানোর কায়দা অদ্ভুত। বসে বসে লেফ্ট রাইট। প্রথমে বাঁ, পরে ডান, শেষে ডান-বাঁ দুটো একসঙ্গে।

কলকাতা শহরে শহিদবেদির চেহারা বদলে গেছে। আগে হতো কালো, লম্বাটে। আখাম্বা দাঁড়িয়ে থাকত। গায়ে সাদা মার্বেল পাথরে খোদাই থাকত ‘শহিদ’-এর নাম। এখন কালো রং উঠে গেছে। বিভিন্ন রঙের মোজাইক দিয়ে মোড়া বেদিতে কারুকার্য এসেছে। বেদির আকারও বদলেছে। লম্বার জায়গায় হয়েছে চওড়া। চৌবাচ্চা ধরনের। চৌবাচ্চা মাটি দিয়ে ভর্তি। তাতে ফুলের গাছ। নেতারা যেদিন বেদি ‘উদ্বোধন’ করতে আসেন সেদিন ফুল শুদ্ধু গাছ এনে লাগিয়ে দেওয়া হয়। সেই গাছ কিছুদিনের মধ্যে ভ্যানিশ। হয় গরু ছাগল খায়, নয় তো জলের অভাবে শুকিয়ে মরে। সবথেকে বড়ো কথা, শহিদবেদিতে এখন আর শহিদের নাম নিয়ে বাড়াবাড়ি করা হয় না। ছোটো করে কোথাও একটা লেখা হয়। চোখে পড়তে পারে, আবার নাও পারে। অসুবিধে নেই। যিনি শহিদ হয়েছেন তার থেকে বেদি যিনি ‘উদ্বোধন’ করেন সেই নেতার নাম থাকে বড়ো আকারে। ঠিকই হয়। মরে যাওয়া মানুষের দাম কী? কিছুই না।

এই বেদিরও অবস্থা তাই। শহিদের নাম বোঝা যাচ্ছে না। পাথরের লেখা ঘষে গেছে। শুধু পড়া যাচ্ছে–

‘তিনি ছিলেন নারী মুক্তির প্রজ্জ্বলিত শিখা…।’

আমি সহজ ভাবে বললাম, ‘তোর দিদির নাম কী?’

পুঁটিকুমার নাক টানছে, কিন্তু কান্নার নাক টানা নয়। তাকে নিয়ে আমি যে বেড়াতে বেরিয়েছি, এতে সে খুশি। কান্না বন্ধ হয়ে গেছে। ভাত ডালের দোকানে বিকেলের দিকে ঘণ্টা খানেকের ছুটি। নতুন মালিকের নিয়ম। আমার কর্মচারীকে আমি ছুটি দেব, কার কী?

‘দিদির নাম বিন্তি।’

‘বাঃ, ভাইয়ের নাম কান্তি, বোনের নাম বিন্তি। ভারি সুন্দর অন্তমিল আছে। আমি যদি ছড়া লিখতে পারতাম তাহলে লিখতাম কান্তি বিন্তি ভাই বোনযদুজনেরই একটা মন।’

পুঁটিকুমার বলল, ‘সাগরদা, তুমি আমার দিদির একটা নাম দাও।’

আমি অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, ‘তা কী করে হবে! আমি তো শুধু খাওয়ার দোকানের লোকদের নাম দিই। তোর দিদি তো আর সেখানে কাজ করে না।’

পুঁটিকুমার বলল, ‘না করলেও দাও। দিদি খুব মজা পাবে।’

আমি একটু ভেবে বললাম, ‘সে না হয় দেওয়া যাবে, কিন্তু পুঁটিকুমার, তোমার দিদি নাম নিয়ে করবেটা কী? সে তো বিষ খেতে চায়। বিষ খেলেই ফিনিশ।’

পুঁটিকুমার চুপ করে রইল। আমিও চুপ করে রইলাম। যদি বেশি উৎসাহ দেখাই এই ছেলে গুটিয়ে যেতে পারে। তারওপর চিঠিতে দিদি ‘দিব্যি’ কেটে রেখেছে। তার আত্মহত্যার পরিকল্পনা যেন ফাঁস না হয়। আমরা যতই হাইফাই জীবনে ঢুকি, আমেরিকা, লন্ডন করি, ভাইবোনের এইসব দিব্যি-টিব্যি খুব সিরিয়াস ব্যাপার। লেখাপড়া করলে দিব্যির কথা মুখে বলতে লজ্জা করে, মনে মনে বলে। মুখেও বলে। আমি এক বোনকে চিনি, বিয়ের পর মিশর চলে গেছে। কেমিষ্ট্রিতে তুখোড় ছাত্রী। মমির ওপর গবেষণা করছে। মৃতদেহ মমি করে রাখতে কোন ধরনের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়েছিল তাই নিয়ে গবেষণা। নিউইয়র্কের ‘পাস্ট অ্যান্ড ফিউচার’ নামের অতি বিখ্যাত সায়েন্স জার্নালে এই মেয়ের লেখা ফটো দিয়ে বেরিয়েছে। আমি শুনেছি, কিছুদিন আগে এই মেয়ে তার হরিদেবপুরের ভাইকে ফোন করে বলেছে– ‘এবার ভাইফোঁটায় তোর কাছে যাবই যাব। কেউ ঠেকাতে পারবে না। ফ্যারাওয়ের দিব্যি কাটছি।’

পুঁটিকুমার বলল, ‘সাগরদা, আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে।’

আমি আগ্রহ নিয়ে বললাম, ‘আমারও করছে। চল দুজনে মিলে আইসক্রিমওয়ালা খুঁজে বের করি। কতদিন কাঠি আইসক্রিম খাওয়া হয় না।’

পুঁটিকুমার বলল, ‘খুঁজতে যাব না। রাস্তা দিয়ে যখন যাবে ডেকে খাব।’

‘ঠিক বলেছিস। আইসক্রিম, ঝালমুড়ি, ঝুরিভাজা খুঁজে খেতে মজা নেই। টেস্ট কমে যায়। ডেকে খেতে মজা।’

পুঁটিকুমার একটু চুপ করে থেকে খানিকটা অন্যমনস্ক ভাবে বলল, ‘আমার দিদির কী হয়েছে তুমি কি শুনতে চাও?’

আমি উদাসীন ভাব দেখিয়ে বললাম, ‘বলতে পারিস, আবার না বলতেও পারিস। তোর ইচ্ছে।’

‘দিদি যে বারণ করেছে।’

‘আমার কী মনে হয় জানিস পুঁটিকুমার…।’ আমি চুপ করে গেলাম।

পুঁটিকুমার আমার দিকে ফিরে বলল, ‘কী মনে হয় সাগরদা?’

আমি ইচ্ছে করেই চুপ করেছিলাম। দেখছিলাম পুঁটিকুমার নিজে শোনার জন্য আগ্রহ দেখায় কিনা। বললাম, ‘সব বারণ শোনার জন্য নয়। এই যে তোদের অভয়পদবাবু, ধার শোধের জন্য আমার ওপর ধাপে ধাপে চাপ বাড়াচ্ছে, তোরা কি শুনছিস? তুই নিজেই তো লেবু পাচারের ব্যবস্থা করেছিস। বল, করিস নি?’ পুঁটিকুমার মাথা কাত করল। আমি বললাম, ‘আবার আর-একরকম বারণ আছে যার মানে উলটো ধরতে হয়। ধর, তুই রাগ করে বললি, আইসক্রিম খাব না। আমি তার মানে বুঝব, তুই আসলে আইসক্রিম খেতেই চাস। তেমন তোর দিদিও হয়তো তোকে বারণ করে উলটো কিছু বলতে চাইছে। নইলে এতক্ষণে চুপচাপ বিষ খেয়ে নিত। কষ্ট করে পোস্টকার্ড কিনে তোকে চিঠি লিখতে যাবে কেন?’

পুঁটিকুমার অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি হাসলাম। ছেলেটাকে প্রভাবিত করতে পেরেছি। বিন্তি কেন বিষ খেতে চায় আমায় জানতে হবে। পুঁটিকুমারের কান্না আমি পছন্দ করিনি।

পুঁটিকুমার বিড়বিড় করে ঘটনা বলতে শুরু করল। আমি চুপ করে শুনতে থাকলাম। এর মাঝখানে আমরা আইসক্রিমওয়ালার দর্শন পেয়েছি। বাক্সগাড়ি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল ফুটপাথ ঘেঁষে। গাড়ির গায়ে রংচং দিয়ে লেখা ‘আইজ এণ্ড কোল্ট’ দুটো বানানই ভুল। এটাই ভালো। ভুল বানানের আইসক্রিম খেতে বেশি মজা। আমরা গোলাপি আর সবুজ রঙের দুটো কাঠি কিনেছি। পুঁটিকুমার সবুজ খাবে না। তার সবুজে নাকি অ্যালার্জি। গায়ে চিড়বিড় লাগে। সে নিয়েছে গোলাপি। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল, গোলাপি নেওয়া সত্ত্বেও অল্পক্ষণের মধ্যেই পুঁটিকুমারের মুখের রং সবুজ হয়ে গেছে। আমার হয়েছে গোলাপি! অদ্ভুত না?

কান্তি-বিন্তিদের গ্রামের নাম মন্দিরতলা। পোস্ট অফিস বাণীপুর, জেলা উত্তর চব্বিশ পরগণা, থানা হাবড়া। কান্তির বয়স দশ, বিন্তির বয়েস পনেরো। হতদরিদ্র পরিবারে এই ছেলেমেয়েদুটি জন্মের পর থেকেই বাবা-মায়ের কাছে ‘শাকের আঁটি’। শাকের আঁটি শুনে ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। বাবা-মায়ের নিজেদের জীবন চালানোই এতদিন ছিল বোঝার মতো। তারওপর ছেলমেয়েরা চাপলে তাকে শাকের আঁটি ছাড়া আর কী বলা হবে? সব মিলিয়ে বোঝার ওপর শাকের আঁটি।

এই সব পরিবারে শাকের আঁটি ঝেড়ে ফেলবার জন্য বাবা-মায়ের কসরতের শেষ থাকে না। নতুন কিছু নয়। আমাদের দেশে এমনটাই স্বাভাবিক। সবথেকে আদরের জনকে পেটের কারণে সবথেকে বড়ো দায় বলে মনে হয়। দায়মুক্ত হবার জন্য বাবা-মা অনায়াসে ছেলেমেয়ের গলা টিপে, বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে পারে। ফেলেও। পেট খুব কঠিন জিনিস। স্নেহ, মায়া, মমতা তার কাছে ধুলিকণাসম। ফুঃ দিয়ে উড়িয়ে দিতে মুহূর্তমাত্র।

মেয়েদেরবেলায় তো আরও সহজ। জন্মালেই আস্তাকুঁড়ে ফেলে দাও। খবরের কাগজে এইসব খবর আজকাল ছাপা হয় না। কত ছাপা হবে? মেয়ে মারা এখন জলভাত। গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে খবরের কাগজ কিনে পাবলিক জলভাত খেতে চায় না। কুড়মুড়ে জিনিস খেতে চায়। বিন্তিকে যে তার বাবা-মা জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গে কাপড়ে মুড়ে পুকুরের জলে ফেলে দেয়নি সেটাই অনেক। আমি ওই পরিবারের পয়সাকড়ির অবস্থা যা শুনলাম তাতে সেটাই উচিত ছিল। তবে কান্তি-বিন্তির বাবা-মা পুঁটিকুমারকে পাঠিয়ে দিয়েছে কলকাতায়। সেও একরকম জলে ফেলাই হল। হাবুডুবু খাও। পুঁটিকুমারও হাবুডুবু খাচ্ছে। সে হয়েছে বালক শ্রমিক। মেয়েকে কলকাতায় পাঠানো সম্ভব হয়নি। মেয়ে গ্রামে। ঘর সংসারে কাজ করে। বাবা-মা অপেক্ষা করে মেয়ে কবে বড়ো হবে। হলেই বিয়ে।

ঘটনা এই পর্যন্ত সাধারণেরও সাধারণ। বলার মতো নয়, শোনবার মতোও নয়। পাড়়াগাঁয়ে এমন মেয়ে আছে অজস্র। পিতা মাতার অনুপ্রেরণায় তারা আধপেটা খেয়ে না খেয়ে সেজেগুজে বিয়ের জন্য অপেক্ষা করছে। স্বপ্ন একটাই, শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে আর চিন্তা থাকবে না। দু’বেলা পেট ভরবে। সন্ধের পর স্বামী কাজ সেরে বাড়ি ফিরলে গা ধুয়ে, কপালে বড়ো করে টিপ দিয়ে বসবে পাশে। গুজুরগুজুর করে গল্প হবে। সেই গল্পে যেমন সুখ থাকবে তেমন দুঃখও থাকবে। একসময় স্বামীর কাঁধে মেয়ে মাথা রাখবে আনমনে। কষ্টের সংসারও সুখের মনে হবে। নিজের মনে হবে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তেমনটা হয় না। শ্বশুরবাড়িতে আধপেটা খাবার জোটানোও কঠিন হয়ে পড়ে। তার থেকে অনেক সহজে গায়ে আগুন দেওয়ার জন্য কেরোসিন পাওয়া যায়। রান্নাঘর থেকে গোয়ালঘর, খাটের তলা থেকে সিঁড়িরতলা, শাশুড়ি-ননদ-বর যত্ন করে শিশি সাজিয়ে রাখে। নতুন বউয়ের যেন অসুবিধে না হয়। হাত বাড়ালেই বন্ধুর মতো, হাত বাড়ালেই কেরোসিন। যাক সে আলাদা গল্প। আমরা বিন্তিতে ফিরি।

আর-পাঁচটা গরিব ঘরের মেয়ের মতো আমাদের বিন্তিরও বিয়ের অপেক্ষা চলতে লাগল। একই ঘটনা। হেরফের নেই। ঘটনায় হেরফের হল হঠাৎই। ঘর সংসারের কাজের ফাঁকে বিন্তি গিয়ে একদিন নাম লিখিয়ে এলও গ্রামের স্কুলে। এই ভয়ংকর খবর জানার পর মা চুলের মুঠি চেপে ধরল। বিন্তি বলল, ‘ওরা দুপুরে খেতে দেয়। পয়সাকড়ি কিছু লাগে না।’ বিন্তির মা আর আপত্তি করেনি। সংসারের একটা পাত তো কমল। মিড ডে মিলে বিন্তি কোনওদিন খিচুড়ি খায়, কোনওদিন ভাত, কোনওদিন আবার রুটি, আলুর দম। খায় আর এলোমেলো ভাবে স্কুল থেকে পাওয়া বই খাতা নিয়ে নাড়াচাড়া করে। খাবার পেতে হলে হাতে বই লাগে। একসময় বিন্তি খেয়াল করল, বই নাড়াচাড়া করতে তার মজা লাগছে! দুনিয়ায় এত কিছু জানার আছে! রাতে ঘরে আলো নেই। তাই দিনেরবেলা সঙ্গে বই নিয়ে ঘুরে বেড়ায় বিন্তি। ফাঁক পেলে খুলে বসে। ধীরে ধীরে স্কুলের দিদিমণিদের নজরে পড়ে। তারা বুঝতে পারে, এই মেয়ে লেখাপড়ায় ভালো। গড়পড়তা ভালো নয়, বেশি ভালো। এই মেয়ের মাথায় বুদ্ধি আছে। গড়পড়তা বুদ্ধি নয়, বেশি বুদ্ধি।

পরীক্ষায় বিন্তি ক্লাসের সবাইটে টপকে যেতে লাগল। এইভাবে ক্লাস টেন পর্যন্ত চলেছে। এরপরই শুরু হয়েছে গোলমাল। বিন্তির জন্য পাত্র পেয়েছে তার বাবা। পাত্র অতি ভালো। একই গ্রামে বাড়ি। মন্দিরতলা। শক্তপোক্ত চেহারা। পাকা কাজকর্ম নেই বটে কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। গভর্নমেন্টের একশো দিনের স্কিম চালু হলে কাজ জুটে যায়। পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ আছে। পার্টি থেকে কাজ পায়, তবে বাকি সময় ছেলে যে বাড়িতে বসে ল্যাজ নেড়ে থাকে, এমন নয়। রোজের ভাড়ায় ডাকাতি খাটে। যেমন ডাক পায়। দু-তিনদিন বাইরে বাইরে থাকে। মাঝেমধ্যে পুলিশ এসে ধরেও নিয়ে যায়। তবে রাখে না বেশিদিন। জেলখানায় অত চোর ডাকাত রাখবার জায়গা নেই। সব মিলিয়ে ছেলে রোজগেরে। ছেলের মা এবার লক্ষ্মীমন্ত বউ চায়।

বিন্তির বাবা-মা হাতে পাত্র তো নয়, চাঁদ পেয়েছে। এমন পাত্রের হাতে মেয়েকে তুলে দেওয়া বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার। জামাই সাহসী না হলে চলে? আতুপুতু জামাই হল পাড়াগাঁয়ের ভাঙা স্কুলের ভাঙা মাস্টার। চোপ্ বললে প্যান্টে ইয়ে। বিন্তি বোকাটা লেখাপড়া শিখলে হয়তো ওই দিকেই চলে যাবে। ল্যাগব্যাগে একটা মাস্টার জুটিয়ে ভাঙা সংসার করবে। ডাকাত পাত্র তার থেকে ঢের ভালো। সে যদি দু-পাঁচ মাস জেলে থাকে তাতেই বা ক্ষতি কীসের? বাড়ি তো আর ফাঁকা থাকবে না। শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, ভাসুর সবাই থাকবে। ভয় কীসের?

বিন্তির বাবা-মা ফুল ভল্যুমে বিয়ের গোছগাছ শুরু করেছে। একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা। তারা ভালো করেই দিতে চায়। যতটা সাধ্য ততটাই করবে। এমনকী পুঁটিকুমারকে পর্যন্ত খবর পাঠিয়েছে, মালিককে সে যেন ছুটির কথা বলে রাখে। পারে যদি মাইনের টাকা কিছু অ্যাডভান্স চায় যেন। পুঁটিকুমারও তৈরি হচ্ছিল। অভয়পদবাবুকে ছুটি এবং মাইনের কথা বলব বলব করছিল। এমন সময়েই বিপদ হল। বেঁকে বসল বিন্তি। বিন্তি তার বাবা-মাকে জানিয়েছে, বিয়ে করবে না সে। লেখাপড়া শিখবে। আরও পড়বে। স্কুল পাশ হবে। কলেজেও নাকি যেতে চায়! বামন হয়ে চাঁদ ধরতে চেয়েছে গাধাটা। সরি, গাধা নয়, গাধি। তিনদিন হল বাবা-মা কঠিন মার দিয়ে মেয়েকে ঘরে আটকে রেখেছে। একেবারে বিয়ের পর ডাকাত বর এসে মুক্ত করবে। এর ফাঁকে বিন্তি তার স্কুলের কোন এক বন্ধুকে দিয়ে ভাইয়ের কাছে পোস্টকার্ড পাঠিয়েছে একটা। বিয়ে দিলে সে বিষ খাবে।

ঘটনা বলা শেষ করে পুঁটিকুমার নাক টানল। আমি মুখ না ঘুরিয়ে বললাম, ‘পুঁটিকুমার, তুই কি কাঁদছিস?’

‘না।’

‘গুড। পুরুষমানুষের কথায় কথায় কান্নাকাটি ভালো নয়। কান্নার ঠাকুর রাগ করেন। কান্নার ঠাকুরের নাম জানিস?’

‘না।’

আমি বললাম, ‘আমি জানি, এখন মনে পড়ছে না। মনে হয়, আইসক্রিম খেয়েছি বলে ঠান্ডায় বুদ্ধি জমে গেছে।’

পুঁটিকুমার বলল, ‘সাগরদা, দিদি কি সত্যি বিষ খাবে?’

আমি একটু ভেবে নির্লিপ্ত গলায় বললাম, ‘মনে হচ্ছে না। গাধারা কখনও বিষ খেয়েছে বলে শুনিনি। তোর দিদি অবশ্য গাধা নয়, গাধি। পরীক্ষায় ফার্স্ট হওয়া গাধি।’

পুঁটিকুমার আমার দিকে ঘুরে কটমট করে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি আমার দিদিকে গাধি বললে!’

‘তাছাড়া আর কী বলব? অমন সু-পাত্রকে বিয়ে না করে যে লেখাপড়া চালাতে চায়, তার মাথায় কোনও বুদ্ধি আছে বলে মনে করিস? ক’জনের কপালে ডাকাত বর জোটে? তুই সবাইকে বুক ঠুকে বলতে পারবি, আমার জামাইবাবু কে জানো…হু হু…যদি চাস জামাইবাবুকে ধরে এনে তোর মালিককে দুটো ধমকও খাওয়াতে পারিস। বেটার মালিক মালিক করা বেরিয়ে যাবে। হ্যাঁরে, ওই ছেলে কি মাথায় ফেট্টি, কপালে টিপ, কানে জবাফুল গুঁজে বিয়ের পিঁড়িতে বসবে?’

পুঁটিকুমার একটু গুম মেরে থেকে বলল, ‘দিদির এখনও বিয়ের বয়স হয়নি।’

আমি চমকে উঠলাম। পুঁটিকুমার এসব জানল কী করে!

‘তোকে কে বলল?’

সন্ধে নামছে। সন্ধে নামবে শান্ত ভঙ্গিতে। আকাশের আলো আবার আকাশে ফিরে যাবে চুপিচুপি। গাছ ডালপাতা নামিয়ে বিশ্রামে যাবে নীরবে। ঘর হারানো পাখি ক্লান্ত ভঙ্গিতে উড়ে যাবে আরও ভুল পথে। ধানখেত, মাঠ, পথঘাট ও শাপলা দিঘির পাড় মুড়ি দেবে জোনাকি আঁকা আঁধার অথবা কুয়াশার ফুলছাপ কাঁথায়। সারাদিন পর চাঁদের আলোয় লম্বা ছায়া ফেলে হেঁটে যাবে মানুষ। হেঁটে যাবে প্রিয়জনের কাছে। মনে মনে বলবে, এবার তুমি। এবার তুমি। এবার তুমি। এই শান্ত স্নিগ্ধভাব বড়়ো মায়াবী লাগবে। ভালো লাগবে খুব। অথচ কলকাতায় সন্ধে নামে হই হই করে। চারপাশ ঝলসে ওঠে ঝলমলে আলোয়। চকচকে রাস্তা ধরে গাড়ি ছুটতে থাকে। পাল্লা দিয়ে ছুটতে থাকে মানুষ। সেই দৌড় দেখলে ভয় লাগে।

পুঁটিকুমার বলল, ‘আমি জানি। আমি অনেক কিছুই জানি।রেস্টুরেন্টে টেবিল মুছি বলে কি কিছুই জানি না মনে করো? আঠেরো বছর বয়স না হলে বিয়ে ঠিক নয়। আমাদের দোকানে একদিন দুটো লোক এসব বলাবলি করছিল। তার মধ্যে একটা ছিল হোৎকা, অন্যটা চিমসে। চিমসেটা বোধহয় পুলিশের লোক। তবে গোঁফ মোটা। ডালের বাটিতে চুমুক দিতে গিয়ে গোঁফে ডাল লাগিয়ে ফেলল। হোৎকাটাকে এসব বলছিল।’

আমি বললাম, ‘কী বলছিল।’

‘বলছিল, মেলা ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ কোরো না। তোমার মেয়ের বয়স কত? হোৎকা বলল সতেরো বছর তিন মাস। না না তিন মাস নয়, পাঁচ মাস। চিমসেটা এক ধমক দিয়ে বলল, মেয়ের বয়স জানো না? যাই হোক আঠেরো বছর তো হয়নি। আঠেরো বছরের আগে বিয়ে করা যায় না, বিয়ে করলে হাজতে থাকতে হয়। ছোকরাকে থানায় আনার আগে আমাকে একটা ফোন করে দিও। এমন ডান্ডা মারব…। হি হি।’

পুঁটিকুমারের হাসি দেখে খুব ভালোলাগল। বেটা জোর পেয়েছে, মজাও। কম বয়সে দিদির বিয়ে হলে সে যেন নিজেই ডান্ডা মারবে। কাকে মারবে এইটা খালি বুঝতে পারছে না। আমি খানিকটা দমিয়ে দেবার জন্য বললাম, ‘ওসব আইনকানুন সবার জন্য নয়। আইন একেক জনের জন্য একেকরকম। তোদের মতো গরিবদের একরকম, আবার ওই যে দেখছিস গাড়ি নিয়ে সুঁই করে চলে গেল, তার জন্য আর-একরকম। এত জানিস এই আসল কথাটাও জেনে রাখ। তোর দিদির কম বয়েসে বিয়ে হলে কেউ ডান্ডা খাবে না। তাছাড়া বিয়ে না হলে তোর দিদি খাবে কী? তখনও তো বিষ খেতে হবে। বিষ আর বিয়ের মধ্যে বিয়েটাই তো ভালো অপশন। অপশন বুঝিস? অপশন হল পথ। তোর দিদির উচিত বিয়ের পথটাই বেছে নেওয়া।’

আমার কথায় পুঁটিকুমারের ভুরু কুঁচকে গেল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, ‘দিদি লেখাপড়া করতে চায়।’

আমি শহিদবেদি থেকে নেমে পড়লাম। এবার ফিরতে হবে। এই ছেলে মূল জায়গায় ঢুকে পড়েছে। তাহলে আর একটু বাজিয়ে দেখা যাক।

‘পুঁটিকুমারবাবু, ওটাও গরিব মানুষদের জন্য নয়। দেখিস না, গরিব মানুষ লেখাপড়া শিখলে কেমন ঢাক পেটানো হয়। টিভিতে দেখানো হয়, কাগজে ছাপা হয়। অভাবী অথচ মেধাবী। ভাবটা এমন যেন অভাবে থাকলে জ্ঞানগম্যি হওয়াটা বিরাট কোনও ব্যাপার।’

আমার এই লেকচার পুঁটিকুমার গা করল না। মনে হয় বুঝতে পারেনি। বললাম, ‘তোর দিদির লেখাপড়া শিখে হবেটা কী বল তো? বরং স্কুল-টুল পার হয়ে গেলে বিপদ হবে। তখন আর বিয়ের জন্য ছেলে পাওয়া যাবে না। তার থেকে এই ভালো। চল, এবার ফিরবি। অভয়পদবাবু তোকে না দেখলে খেঁচামেচি লাগাবে। মালিক বলে কথা।’

পুঁটিকুমার চুপ করে আমার পাশে পাশে হাঁটতে লাগল। সে নীল রঙের চেক একটা হাফ শার্ট পরেছে। তাকে বেশ দেখাচ্ছে। নাক টেনে বলল, ‘সাগরদা, তুমি আমাকে কী করতে বলো।’

‘দিদিকে, চিঠি লেখ। হয় বাবা-মায়ের কথা মতো বিয়ে করো, নয়তো বিষ খাও।’

পুঁটিকুমার থমকে দাঁড়াল। আমি বললাম, ‘কী হল?’

‘আমি দিদিকে বিষ খেতে বলব! সাগরদা, তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’

আমি পুঁটিকুমারের কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘মাথা খারাপ হবে কেন! বিন্তি তো নিজেই বিষ খেতে চেয়েছে। আমার কী দোষ?’

পুঁটিকুমার মাথা নামিয়ে ব্যথিত গলায় বলল, ‘ছি ছি।’

আমি মনে মনে হাসলাম। মুখে চিন্তার ভাব নিয়ে বললাম, ‘তুই কী চাস?’

পুঁটিকুমার হনহন করে হাঁটতে শুরু করল। বলল, ‘আমি কিছু চাই না। আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতেও চাই না।’

আমি এই রাগটাই চাইছিলাম। এই ছেলের বয়স যতই কম হোক, ভেতরে আগুন আছে। আমাকে লেবু পাচার করে দেবার ঘটনাতেই আঁচ পেয়েছিলাম। যত কথা বলছি, ছেলের ভেতরের আগুন সম্পর্কে নিশ্চিত হচ্ছি। আমার একটাই দায়িত্ব এই আগুন আরও বাড়িয়ে দেওয়া।

‘আচ্ছা, পুঁটিকুমার একটা কাজ করলে কেমন হয়?’

পুঁটিকুমার এতটাই রেগে আছে সে আমার দিকে তাকাল না।

‘তুই নিজে গিয়ে যদি বিন্তিকে খানিকটা বিষ পৌঁছে দিয়ে আসিস?’

পুঁটিকুমার আবার দাঁড়িয়ে পড়ল। চারপাশের দোকানের আলো তার চোখে এসে পড়েছে। মনে হচ্ছে, জ্বলছে। আমি খানিকটা থতমত খাওয়ার ভঙ্গিতে বললাম, ‘না মানে, তুই তো জানিস কলকাতায় তোদের গ্রামের থেকে অনেক ভালো বিষ পাওয়া যাবে। টক করে খেয়ে ফট করে মরে যাওয়া যায়। তাছাড়া রকমারিও পাবি। বেছেবুছে কিনতে পারবি। শুনেছি শিয়ালদার কোনও দোকানে যেন বিষের হোলসেল হয়। হোলসেল জানিস? পাইকারি। দুপুরের দিকে কাজ কম থাকলে চলে যাবি না হয়। একেকটা কারণে একেকরকম বিষ কাজ করে। খেতে না পাওয়ার কারণে মরতে চাইলে একরকম বিষ, শ্বশুরবাড়িতে মারধোর করলে একরকম বিষ, মা বকলে একরকম, পরীক্ষায় ফেল করলে অন্যরকম। আমার মনে হয় লেখাপড়া করতে না পেরে যেসব মেয়ে কষ্ট পায়, মরতে চায় তাদের জন্যও আলাদা জিনিস পাওয়া যাবে।’

আমি বলছি আর আড়চোখে পুঁটিকুমারের চোখের দিকে বারবার তাকাচ্ছি। চোখ জ্বলছে ধক্ধক্ করে। পুঁটিকুমার ঘন ঘন নাক টানছে। না সর্দি, না কান্না। এখন সে নাক টানছে রাগে। বাঃ রাগেও নাক টানা যায়! জানতাম না তো। পুঁটিকুমার তাহলে এখন রাগকুমার। আমি এই রাগ পাত্তা দিলাম না। মুচকি হেসে বললাম, ‘যদি বলিস, ওই দোকানে আমিও তোকে নিয়ে যেতে পারি। চল কালই নিয়ে যাব।’

পুঁটিকুমার আমার দিকে সরু চোখে তাকাল। তারপর হাফপ্যান্টের দুটো পকেট হাতড়িয়ে খানিকটা খুচরো পয়সা বের করল। এগিয়ে ধরে বলল, ‘এটা ধরেন।’

আমি নার্ভাস হেসে বললাম, ‘কী এটা!’

জবাব না দিয়ে পুঁটিকুমার গোঁ দেখিয়ে মুখ নামিয়ে থাকল। আমি আবার বললাম, ‘আরে বাপু, বলবি তো পয়সাগুলো কেন দিচ্ছিস! আচ্ছা ফ্যাচাং তো।’

পুঁটিকুমার নাক টেনে বলল, ‘আপনার আইসক্রিমের দাম। আপনার পয়সায় আইসক্রিম খাওয়াটাই আমার ভুল হয়েছে। গুনে দেখেন, কম পড়লে কাল যখন দোকানে খেতে আসবেন দিয়ে দেব।’

আমি খুশি হয়ে পয়সা গুনতে শুরু করলাম। আমি পেরেছি। বারো বছরের এই বালকের ভেতর যে-ধিকধিকি আগুন জ্বলছিল, তাকে দাউ দাউ করে দিতে পেরেছি। আমার শুধু ছোট্ট একটা কাজ বাকি রইল।

‘পুঁটিকুমার, আমি কি তোর সঙ্গে যেতে পারি।’

‘না।’

পুঁটিকুমার হন হন করে হেঁটে এগিয়ে গেল। পিছন থেকে আমার মনে হল, বেটা হাঁটছে না। ঘোড়ায় চেপে ছুটছে। আমি হলফ করে বলতে পারি, সে যাচ্ছে মন্দিরতলা। তার দিদির কাছে।

‘রেবা, কেমন আছ?’

‘তুমি আবার ফোন করেছ!’

‘রাগ করছ কেন?’

‘তোমার ওপর আমার যে রাগ বা খুশি কোনওটাই হয় না, তা তুমি ভালো করেই জানো।’

‘বাঃ তোমার অবস্থা তো দেখছি শঙ্খ ঘোষের কবিতার মতো রেবা। ওই যে কবিতাটা আছে না? কোনও গুপ্তঘর নেই। অজ্ঞাতবাসেও নিরাশ্রয়।য দেয়ালে দেয়ালে লেগে বারে বারে ফিরে আসে স্বর।’

রেবা চুপ করে রইল। সে এরকমই। মাঝে মাঝেই চুপ করে যায়। যখন কলকাতায় ছিল তখনও কথা বলতে বলতে থেমে যেত, অন্যমনস্ক হয়ে যেত। সম্ভবত যে বহু কারণে আমি তার প্রেমে পড়েছিলাম, তার একটা এই হঠাৎ থেমে যাওয়া স্বভাব। আজও তার এই স্বভাব। আর তাই আজও তাকে ভালোবাসি। আমার সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারেও সে হঠাৎ থেমে গেছে। আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ‘না’ শুনেছিল। শুনে ভেঙে পড়েনি। আমাকে দোষ দেয়নি মোটে। বরং খুশিই হয়েছিল।বলেছিল, ‘আমি জানতাম, তুমি না বলবে। সাগর তুমি বাঁধা পড়বার মানুষ নও। আর সেই কারণে তোমাকে আমি এত ভালোবাসি।’

রেবা তার রিটায়ার্ড পুলিশ অফিসার বাবার সঙ্গে লামডিং চলে গেছে। জঙ্গল আর কুয়াশা নিয়ে থাকে। বাবার তৈরি করা ফার্মে ম্যানেজারি করে। সেখানে দুঃস্থ, অসহায় মেয়েরা কাজ করে। ছোটো ছোটো পাহাড়ি ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুলও খুলেছে। মাসে দু-মাসে আমায় ফোন করে, চিঠি লেখে। মাঝে মাঝে আবার স্বভাবমতো চুপ করে যায় দিনের পর দিন। আমি ফোন করলে কেটে দেয়। চিঠি পাঠালে ছিঁড়ে ফেলে দেয় কুচি কুচি করে।

কোনও কোনও ঝড়ের বিকেলে রেবার জন্য মন কেমন করে। গড়িয়াহাটার কংক্রিটে বোনা মোড়ে দাঁড়িয়ে শুনতে পাই কে যেন বলছে– আকাশতলে দলে দলে মেঘ যে ডেকে যায় আয় আয় আয়য জামের বনে আমের বনে রব উঠেছে তাই– যাই যাই যাই।’ ইচ্ছে করে, ছুটে চলে যাই। আমি রেবাকে কয়েকবার বলেওছি।

‘আমি যদি তোমার কাছে যাই তুমি রাগ করবে? খুব মন কেমন করছে রেবা।’

রেবা গাঢ় গলায় বলে, ‘রাগ করব না। তবে তুমি এসো না। আমার জন্য তোমার মন কেমন, তোমার আসার থেকেও আমার কাছে অনেক বেশি দামি। প্লিজ, তুমি এসো না।’

রেবাকে ফোন করতে একবারেই ধরল। আসকারা দেওয়া গলায় বলল, ‘কবিতা না বলে, কেন ফোন করেছ বলো। শঙ্খ ঘোষ, জয় গোস্বামী শুনিয়ে আমাকে মুগ্ধ করতে পারবে না। ওই স্টেজ আমি পার করে এসেছি।’

‘তাহলে কি আমি অন্য কারও কবিতা শোনাব? আজকাল অনেকেই খুব সুন্দর কবিতা লিখছে। যদি বলো শোনাতে পারি। সেদিন কলেজ স্ট্রিটে গিয়ে শুনলাম এদের নাকি শূন্য দশকের কবি বলা হয়।’

রেবা বলল, ‘তুমি আমাকে এইসব হাবিজাবি বলতে ফোন করেছ?’

আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। তুমি ছাড়া আমার হাবিজাবি কে শুনবে?’

রেবা হেসে বলল, ‘আচ্ছা আমিই শুনব। দাঁড়াও এক কাপ কফি নিয়ে আসি। আজ এখানে খুব ঠান্ডা পড়েছে। কাল রাত থেকে টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে।’

আমি হলফ করে বলতে পারি, কফি আনবার নাম করে আজকের মতো বিদায় নেবে রেবা। আমি সারাদিন মোবাইল কানে নিয়ে বসে থাকলেও তাকে পাব না। মোবাইল ছেড়ে যদি ল্যান্ড ফোনে ধরতে চেষ্টা করি তাতেও লাভ হবে না। ফোন বেজে যাবে সে ধরবে না। একাজ রেবা আগেও করেছে। পরে যখন জিজ্ঞেস করেছি বলেছে, ‘তোমার কথা খুব শুনতে ইচ্ছে করছিল। তাই ফোন রেখে পালিয়ে গেলাম। মনে হল, কথা শোনার থেকে কথা শোনবার ইচ্ছে অনেক বড়ো। কথা বারবার শোনা যায়, ইচ্ছে বারবার আসে না। ভালো করিনি?’

আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, ‘ভালো করেছ। ফিলজফি হিসেবে চমৎকার। রিয়েলিটির বদলে ইচ্ছে।’

তবে আজ ফিলজফি করলে চলবে না। আজ আমি সত্যি সত্যি কাজের জন্য ফোন করেছি। সুতরাং ওকে আটকাতে হবে।

‘দাঁড়াও রেবা, পরে কফি খাবে। জরুরি একটা দরকারে তোমাকে ফোন করেছি।’

রেবা একটু থমকাল। আমি প্রমাদ গুনলাম। এই রে, পুরো চুপ করে না যায়। হড়বড় করে বললাম, ‘একটা চোদ্দো পনেরো বছরের মেয়ে বিষ খেতে চলেছে…।’

রেবা এক মুহূর্তখানেক চুপ করে থেকে বলল, ‘কী হয়েছে? মেয়েটা কে?’

‘মেয়েটার নাম বিন্তি। চমৎকার মেয়ে। আমার ধারণা এই মেয়ে বিষ না খেয়ে যদি বেঁচে যায়, তাহলে একদিন তোমার বাবার মতো মস্ত বড়ো পুলিশ অফিসার হবে।’

রেবা অবাক গলায় বলল, ‘পুলিশ অফিসার! কেন পুলিশ অফিসার কেন?’

‘বুদ্ধি আর সাহস দুটোই এই মেয়ের আছে। সাময়িক ভাবে সেই সাহসে চিড় খেয়েছে। ঘাবড়ে গেছে বলতে পারো। ওর সাহস যদি ফিরিয়ে আনা যায় তাহলে দেখতে হবে না, বিন্তি অনেক দূর যাবে।’

‘এবার ঘটনাটা বলো। আমি কী করতে পারি সেটা বলো।’

আমি সংক্ষেপে এবং দ্রুত কান্তি-বিন্তির ঘটনা বললাম। কীভাবে মেয়েটা লেখাপড়া শিখেছে, কীভাবে মেয়েটাকে বিয়ের জাঁতাকলে ফেলে পিষে মারবার প্ল্যান হয়েছে।

‘কদিনের জন্য তোমার ওখানে মেয়েটাকে পাঠিয়ে দিলে কেমন হয় রেবা? লামডিং-এ থাকবে হপ্তাখানেক। কিছুদিন থাকার পর এদিকটা যখন শান্ত হবে, তখন না হয় ফিরিয়ে আনা গেল। হস্টেলে রেখে কোনও স্কুলটুলে যদি ভর্তি করে দেওয়া যায়। তমালের এক মামাতো না মাসতুতো বোন বারাসতে এরকম একটা স্কুল বানিয়েছে। গরিব মেয়েদের লেখাপড়া শেখানোর স্কুল।’

রেবা একটু ভেবে বলল, ‘আমার এখানে পাঠানো ঠিক হবে বলে মনে হয় না। মেয়ের বাবা-মা বা ভাবী বর কিডন্যাপিং আর পাচারের অভিযোগ করতে পারে। বলবে গ্রাম থেকে নাবালিকা অপহরণ করে পাচার করে দিয়েছে।’

এবার আমি হাসলাম। বললাম, ‘সেটা সম্ভব নয়। তাহলে ভাইয়ের বিরুদ্ধে দিদিকে অপহরণের মামলা করতে হবে। সেই কারণেই তো আমি নিজে গেলাম না। পুঁটিকুমারকে রাগিয়ে, তাতিয়ে পঠিয়ে দিচ্ছি। আমি জানি ও ঠিক দিদিকে নিয়ে চলে আসবে। আমি সঙ্গে গেলে এত সহজে হতো না। অনেক ঝামেলা করতে হতো।’

রেবা বিরক্ত হল। গলায় সামান্য ঝাঁঝ নিয়ে বলল, ‘কী ঝামেলা হতো? হলে হতো। ওই গ্রামে তোমার নিজের যাওয়া উচিত ছিল। তুমি যে এত ভীতু হয়ে গেছো আমি জানতাম না। এত বড়ো একটা অন্যায় হচ্ছে… একটা মেয়ে লেখাপড়া করতে চায়, অথচ বয়স হয়ে যাবার আগেই তাকে বাড়ি থেকে জোর করে বিয়ে দেবে? তোমার পুলিশে যাওয়া উচিত ছিল। বাবা-মায়ের নামে ডায়ারি করা উচিত ছিল।’

আমি একটু ভেবে, বানিয়ে হাই তোলার আওয়াজ করে বললাম, ‘ওসবে বড্ড পরিশ্রম রেবা।’

‘কী বলছ! পরিশ্রম? ছি ছি। এটা তুমি কী বলছ? একটা মেয়ে বিষ খেতে চলেছে, জেনেও তুমি হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে।’

আমি মিথ্যে অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, ‘হাত পা গুটিয়ে বসে থাকলাম কোথায়! পুঁটিকুমারকে যে উত্তেজিত করলাম।’

‘এসব তোমার ফাঁকিবাজির কথা। ওইটুকু ছেলেকে এরকম একটা সিরিয়াস বিষয়ে উত্তেজিত করে লাভ কী? আমি হলে নিজে চলে যেতাম।’

আমি মুখ দিয়ে তাচ্ছিল্যের আওয়াজ করে বললাম, ‘তারপর আমি গেলাম আর ওই মেয়ে বলল, আপনি কে? আপনি কি আমার বিয়ে দিচ্ছেন? নাকি আপনি আমায় বিয়ে করবেন? মেয়ে যদি পালটি খায়? আমার কী হতো একবার ভেবে দেখেছ?’

রেবা আর সহ্য করতে পারল না। এবার ধমকে উঠল।

‘স্টপ ইট। মেয়েদের সম্পর্কে এই ধরনের বিশ্রী কথা বলবে না। বিন্তি মত বদলাবে কেন? আজকাল প্রায়ই খবরের কাগজে বেরোয়, মেয়েরা রুখে দাঁড়িয়েছে। বিন্তিও তাই করত। সাপোর্ট পেলে রুখে দাঁড়াত।’

রেবার এই রাগ, এই তেজ আমার দারুণ লাগল। আরও খোঁচা মারলাম।

‘আমি সাপোর্ট দেবার কে? আমাকেই কেউ সাপোর্ট দেয় না।’

রেবা বলল, ‘চুপ কর তো, আমাকে ভাবতে দাও।’

আমার উদ্দেশ্য সফল। একজন দুঃখী মেয়ের ভাবনার দায়িত্ব একজন দুঃখী মেয়ে নিয়ে নিয়েছে। এর থেকে খুশির খবর আর কী আছে? এবার দুঃখে দুঃখে আনন্দ হবে।

আমি গলা নরম করে বললাম, ‘শান্ত হও রেবা। তুমি ঠিকই বলেছ, এই মেয়ের বাবা-মাকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু তারপর? দুদিন খবরের কাগজে বিন্তির ছবিটবি না হয় বেরোবে। বাবা-মাকে জেলে পুরে সাহসিনী পুরস্কারও জুটে যেতে পারে। কিন্তু তারপর? সে কার কাছে থাকবে? কোথায় পড়বে? কীভাবে বড়ো হবে? একটা অলটারনেটিভ ব্যবস্থা করতে হবে না? আর একটা সত্যি কথা বলব, আমি বিন্তির বাবা-মায়ের কোনও দোষ দেখি না। হতদরিদ্র এই পরিবার মেয়ের বিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারে? দোষটা আমাদের সকলের। তাই দায়িত্ব আমাদের। তাৎক্ষণিক কোনও সমাধানে লাভ হবে না।’

রেবা মনে হয় আমার লেকচারে সামান্য শান্ত হল। বলল, ‘আজকাল এরকম তো হচ্ছে। মেয়েরাই প্রতিবাদ করছে।’

‘বললাম তো। এই মুহূর্তে বিন্তির প্রতিবাদ করার সাহস নেই। সে নিজে পুলিশের কাছে যেতে পারবে না। সেই কারণেই বিষ খাবার পরিকল্পনা করেছে। অন্তত ঘটনা শুনে আমার তো সেরকমই মনে হয়েছে। যদি বা এখন কিছু না করে, বিয়ের পর করবেই।’

রেবা একটু চুপ করে থেকে চিন্তিত গলায় বলল, ‘তুমি ওর ভাইকে পাঠালে কেন? ওইটুকু ছেলে কি পারবে?’

‘আমি তো পাঠাইনি। সে নিজেই যাবে। আমি পাঠালে না হয় একটা কথা ছিল। যে নিজের জোরে যুদ্ধে যায় তার পরাজিত হবার সম্ভবনা কম থাকে।’

কথা শেষ করে আমি হাসলাম। রেবা বলল, ‘আমার টেনশন হচ্ছে। মেয়েটা এর মধ্যে কিছু করে না বসে। এই বয়েসে ছেলেমেয়েরা খুব সেনসেটিভ হয়। মেয়েরা বিশেষ করে।’

আমি শেষ খোঁচাটা মারলাম। বললাম, ‘তুমি বিষ খাওয়ার কথা বলছ? অত চিন্তার কি আছে? খেলে খাবে। ধেড়ে মেয়ে। তাছাড়া বললাম তো, এখন না খেলে, পরে খাবে। আমাদের যতটুকু করবার করলাম। এর বাইরে যা ঘটবার তাই ঘটবে। আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই।’

রেবা ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘তুমি আবার কী করলে? কিছু তো করোনি। একটা এগারো-বারো বছরের ছেলেকে উসকে দিয়ে হাত-পা গুটিয়ে বসে আছ। গ্রামের নাম কী, কোন থানা? দাঁড়াও কাগজ পেন নিয়ে এসে টুকি।’

আমি অবাক গলায় বললাম, ‘গ্রাম, থানার নাম জেনে কী করবে রেবা? তুমি যাবে?’

রেবা থমথমে গলায় বলল, ‘হ্যাঁ। যাব।’

রেবা কাগজ পেন আনতে গেল। আমি নিশ্চিন্তে অপেক্ষা করতে লাগলাম। রেবা ফিরে আসবে। কাগজে গ্রামের নাম লিখে নেবে। সুদূর লামডিং-এ বসে সে মন্দিরতলার কান্তি- বিন্তিদের দুঃখের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। যে বহু কারণে রেবাকে এত ভালোবাসি তার একটা আগেই বলেছি। আর-একটা হল, অসহায়ের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া। এত ভালোবাসা কি শুধু মেয়েদেরই থাকে।

অভয়পদবাবু তার গোল চশমা নাকের ওপর আরও নামিয়ে বললেন, ‘আপনি সত্য বলছেন!’

আমি খনিকটা মউরি মুখে দিয়ে বললাম, ‘অবশ্যই সত্যি বলছি স্যার। আপনি খোঁজ নিন। আপনার পুঁটিকুমারকে ওরা ঘরের মধ্যে বেঁধে রেখেছে।’

অভয়পদবাবুর সোজা হয়ে বসে বললেন, ‘এতবড়ো সাহস! আমার পুঁটিকুমারকে বেঁধে রেখেছে! ওরা কে বাঁধবার? যদি বাঁধবারই হয় আমি বাঁধব। কে ওরা বলুন তো সাগরবাবু। আমার কর্মচারীকে বাঁধছে! মারছে! হারামজাদাদের দাঁত ভেঙে দেব।’

আমি তাচ্ছিল্যের ভাব দেখিয়ে বললাম, ‘যতদূর খবর পাচ্ছি, একটাঞ্জভাড়া খাটা ছেঁদো ডাকাত আর তার কিছু চেলাচামুণ্ডা এই ব্যাপারে জড়িয়ে আছে।’

অভয়পদবাবু গলায় হুংকার দিলেন, ‘ডাকাত! আমার কর্মচারীকে ডাকাত ঘরে বন্দি করে রাখে কোন সাহসে?’

আমি হাই তোলার ভান করে বললাম, ‘কোন সাহসে সে আপনি জানেন স্যার। আজকাল তো এমনই হয়। ভালো লোককে ডাকাত বন্দি করে রাখে, আর ডাকাতরা ট্যাং ট্যাং করে ঘুরে বেড়ায়। আপনার মতো ভদ্রলোকরা পাত্তাও পায় না। কালে কালে দেশটার পজিশন খুবই খারাপ দিকে যাচ্ছে। আপনার কি মনে হয় রসাতলে যেতে আর কত দেরি?’

আমার কথা শুনে অভয়পদবাবু মুখে ‘হুম্মম…’ শব্দে চাপা গর্জনের মতো করলেন।

খাওয়াদাওয়ার পর আমি একটা চান্স নিয়েছিলাম। ঢিল ছুড়েছিলাম বলা যায়। পুঁটিকুমারের মালিককে খেপিয়ে তুলতে পারলে কেমন হবে? খেপিয়ে যদি ঘটনায় জড়িয়ে নেওয়া যায়? ভেবেছিলাম, হবে না, তবু ভাবলাম, ট্রাই নিতে দোষ কী? কোনও দোষ নেই। মানুষের গোটা জীবনটাই তো ট্রাই, ট্রাই এবং ট্রাই। লেবু ছাড়া ডাল-ভাত খেতে খেতে প্ল্যান করছিলাম। এর আগেই অন্য কর্মচারীদের কাছ থেকে খবর নিয়ে নিয়েছি।ঞ্জপুঁটিকুমার দিদির বিয়ের নাম করে ছুটি নিয়ে গ্রামে চলে গেছে কাল রাতেই। যাবার আগে তার মুখ ছিল থমথমে। কে যেন আমার নাম করে তাকে কী একটা বলতে গিয়েছিল, পুঁটিকুমার তাকে বলেছে, খবরদার, ওই লোকের নাম তার সামনে যেন কেউ না করে। শুধু ভাত খেতে এলে পাচার করা লেবুর টুকরো যেন পাতে দেওয়া হয়। লেবুর টুকরো যেন বড়ো সাইজের হয়।

সেই লেবু মেখে ডাল-ভাত খেতে খেতে প্ল্যান ঠিক করে নিলাম। অভয়পদবাবুর মালিকানা বোধে টোকা মারতে হবে। মালিকানাবোধ একটা স্পর্শকাতর বিষয়। যারা মালিক তারাই কেবল বুঝতে পারে। খাওয়া শেষ করে হাসি মুখে নিয়ে অভয়পদবাবুর সামনে গিয়ে বসলাম। তারপর টকাস্…। ঢিলটা যে এত সহজে লেগে যাবে ভাবতে পারিনি। আসলে যাবতীয় লক্ষ্যভেদের এটাই নিয়ম। ফিফটি ফিফটি চান্স। অর্জুন যে মাছের চোখে তীর মেরেছিল তাও একই তত্ত্বে। আচ্ছা, লক্ষ্যভেদ ফিফটির বদলে যদি লক্ষ্যভ্রষ্ট ফিফটি কাজ করত? তাহলে মহাভারত কি অন্যভাবে লেখা হতো?

চশমার লাল সুতো উড়িয়ে অভয়পদবাবু আমার দিকে খানিকটা ঝুঁকে এলেন। বললেন, ‘আচ্ছা, আমার কী করা উচিত বলে আপনার মনে হয় সাগরবাবু?’

আমি পায়ের উপর পা তুলে বসলাম। চেয়ারে হেলান দিলাম আয়েস করে।

‘সেটা নির্ভর করছে আপনি কতটা মালিক তার উপরে। যদি হাফ মালিক হন তাহলে একরকম কথা। তখন আপনি শুধু ধার বাকি নিয়ে ভাববেন। যেমন ধরুন আমার এক মামা ছিলেন, তিনি সারাক্ষণ বাড়ির সেপটিক ট্যাংক নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকতেন। তার ভয় হতো, এই বুঝি ট্যাংক উপচে কেলেঙ্কারি ঘটবে। বাড়ির অন্য কোনও সমস্যায় তার মনই ছিল না। মামি রেগে গিয়ে বলতেন, তুমি কি শুধু বাড়ির গু’য়ের মালিক? বাড়ির অন্য কিছুর মালিক নও? আসল ব্যাপারটা হল তাই। মালিক যদি স্যার, আপনি শুধু গু’য়ের হন, তাহলে একরকম কথা, আর যদি গোটা বাড়ির হন তালে আর-একরকম কথা। যদি ওনলি গুয়ের হন তাহলে স্যার খুব একটা মাথা ঘামানোর কিছু নেই। আমার মতো কোনও ছ্যাঁচড়া ধারবাকিতে চাট্টি ভাত-ডাল খায়, তাই নিয়ে মাথা ঘামালেই চলবে, আর যদি গোটা বাড়ির হন, তাহলে স্যার আপনাকে নিজের কর্মচারী পুঁটিকুমারকে নিয়েও ভাবতে হবে। তাকে কেউ আটকে রাখলে গিয়ে উদ্ধার করতে হবে।’

কথা শেষ করে আমি দু’হাত তুলে আড়মোড়া ভাঙলাম।অভয়পদবাবুর অবস্থা ঢিলা। সুতো চশমা নিজে থেকেই ঝুলে গেছে। ইয়ের মতো অমন একটা শব্দ যে কেউ এমন অবলীলায় বারবার উচ্চারণ করতে পারে তাতেই তিনি বিহ্বল। অপমানিতও বটে। আমি দু’হাত মাথার ওপর তুলে আড়মোড়া ভাঙলাম। অভয়পদবাবু পিঠ সোজা করে বসলেন। চোখ দেখে মনে হচ্ছে, মানুষটার রাগ বাড়ছে। বাড়ারই কথা। মালিকানার প্রশ্ন খুব কঠিন প্রশ্ন। এড়ানো মুশকিল।

অভয়পদবাবু বিড়বিড় করে বললেন, ‘আমি যাব। আমি এখনই যাব। দেখব কোন হারামজাদা আমার কর্মচারীর গায়ে হাত দেয়।’

আমি উঠে পড়ে বললাম, ‘সাবধানে যাবেন স্যার। আজকাল চোর ডাকাতরা ভদ্রলোক দেখলেই পেটাচ্ছে।’

অভয়পদবাবু চোখ কটমট করে বললেন, ‘পেটালে পেটাবে। আমাকে ওসব ভয় দেখাবেন না। আপনি কোথায় যাচ্ছেন? আপনিও আমার সঙ্গে যাবেন।’

আমি আঁতকে উঠে বললাম, ‘খেপেছেন? আমি এসবে নেই। বিয়ে ভাংচির কেসে ঢুকে মরব নাকি? তাছাড়া আমাকে আপনার ধারবাকির টাকা জোগাড় করতে হবে না?’

অভয়পদবাবু হুংকার দিয়ে উঠলেন, ‘আমাকে ধারবাকির ভয় দেখাবেন না সাগরবাবু। খবরদার ভয় দেখাবেন না। আপনার মতো ফুটো পার্টিকে আমি সারাজীবন বসিয়ে খাওয়াতে পারি।আমাকে বলে কিনা গুয়ের মালিক! এত বড়ো সাহস। অ্যাই কে আছিস, ট্যাক্সি ডাক…।’

অভয়পদবাবুর হম্বিতম্বির মধ্যেই আমি গুটিগুটি বেরিয়ে এলাম। আমার ডিউটি শেষ। বিন্তি উদ্ধারের কর্মকাণ্ডে বারো বছরের পুঁটিকুমার, লামডিংবাসী রহস্যময়ী রেবা, সুতো বাঁধা চশমা পরা অভয়পদবাবু (সঙ্গে হোটেলের কর্মীবৃন্দ) নেমে পড়েছে। আমার কাজ ছিল একটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে খানিকটা ক্রোধ ছড়িয়ে দেওয়া। আশাকরি আমি তা পেরেছি। এর বেশি আমি কী করব? কী বা পারি আমি? অলস, বেকার, অকর্মণ্য এক যুবক। সাহসও নেই, ক্ষমতাও নেই। চেহারাও রোগা পটকা। শুধু অনেকটা ধারবাকি আর খানিকটা বিশ্বাস নিয়ে টিকে আছি। যেমন বিশ্বাস করি বিন্তির মতো মেয়েদের বাঁচাতে হলে জ্ঞানগর্ভ লেকচার, পত্রপত্রিকার মুখ টেপা প্রবন্ধ, টিভি চ্যানেলের পাউডারের থেকে আগে দরকার ‘রাগ’। গনগনে রাগ। সেই রাগ বিন্তিদের বাঁচবার পথ আগুনে পুড়িয়ে শুদ্ধ করে দেবে। আমি পুঁটিকুমার, রেবা, অভয়পদবাবু সবাইকে রাগাতে পেরেছি। ওরা মাঠে নেমে পড়েছে। সমস্যা একটাই। ওরা সবাই আমার ওপর রেগে গেছে। তাতে কোনও ক্ষতি নেই। রাগে আমার অভ্যেস আছে। বরং রাগ না দেখলেই কেমন যেন অস্বস্তি হয়।

দপুরের খাওয়াটা একটু বেশির দিকে হয়ে গেছে। বেটারা ডবল ভাত খাইয়ে দিয়েছে। একটু গড়িয়ে নিলে ভালো হতো। গড়াব কোথায়? আমার জন্য খাট পালঙ্ক কে সাজিয়ে রেখেছে? আচ্ছা আজ যদি…।

শুয়ে আছি চৌবাচ্চা শহিদবেদির ওপর। বেদির গায়ে অস্পষ্ট ভাবে লেখা ‘তিনি ছিলেন নারী মুক্তির প্রজ্জ্বলিত শিখা…।’ কে তিনি? যে-ই হোন, আমার ঘুম পাচ্ছে। আহা! শহিদবেদিতে ঘুমোতে এত আরাম!

ঘুমের মধ্যে বড়ো সুন্দর স্বপ্ন দেখলাম। লামডিং-এর পাহাড়ের ধারে আমি আর রেবা দাঁড়িয়ে আছি মুখোমুখি। আমাদের পিছনে পাহাড় উঠে গেছে। সামনে গিরিখাদ। রেবা আমার ওপর রেগে আছে খুব। বলছে, ‘ছি ছি, বিন্তিকে উদ্ধার না করে তুমি আমার কাছে চলে এলে! ছি ছি।’

ফিসফিস করে বললাম, ‘আমি কি চলে যাব?’

‘হ্যাঁ, চলে যাবে। এখনই চলে যাবে। যাবার আগে আমার কাছ থেকে শাস্তি নিয়ে যাবে। পানিশমেন্ট।’

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘শাস্তি! পানিশমেন্ট! কী শাস্তি রেবা?’

রেবা এগিয়ে এসে গাঢ় স্বরে বলে, ‘আমি তোমাকে চুমু খাব। অনেক লম্বা একটা চুমু। যতক্ষণ আমি চুমু খাব তুমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি দেখতে চাই মেঘ আর কুয়াশার মধ্যে একজন মানুষকে চুমু খেতে কেমন লাগে।’

পরিশিষ্ট

গল্পের পরিশিষ্ট হয় না। যেহেতু এটা কোনও গল্প নয়, এটা সত্যি কথা, তাই মনে হয়, পরিশিষ্ট লিখলে কোনও অন্যায় হবে না।

মন্দিরতলা গ্রামে পুঁটিকুমারকে কেউ বেঁধে রাখেনি ঠিকই, কিন্তু তাকে আটকে রেখেছিল। আটকে রেখেছিল তার বাবা-মা। আটকে রাখাটাই স্বাভাবিক। যে-বালক তার কিশোরী দিদিকে বিয়ের মুখ থেকে ছিনিয়ে রাতের অন্ধকারে কলকাতা পালিয়ে আসতে চেষ্টা করে, তাকে আটকে রাখা ছাড়া আর কী বা পথ থাকে। অভয়পদবাবু তার রেস্টুরেন্টের লংকা মহাশয়, শ্রীমান উচ্ছে, পটলনাথ, মুসুরপ্রসাদকে নিয়ে মন্দিরতলা পৌঁছোলে বড়ো গোলমাল শুরু হয়। বিন্তির ভাবী ডাকাত বর লাঠি সোঁটা নিয়ে আক্রমণ করে। লামডিং থেকে রেবা তার রিটায়ার্ড পুলিশ বাবাকে দিয়ে আগেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। হাবড়া থানার পুলিশ ঠিক সময় ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে যায়।

বিন্তিকে উদ্ধার করা হয়েছে। এই মুহূর্তে বিন্তি তার ভাই এবং বাবা-মায়ের সঙ্গে লামডিং, রেবার ওখানে বেড়াতে গেছে। বিন্তিকে রেবার খুব মনে ধরেছে। ঠিক হয়েছে আপাতত সে ওখানে থেকেই লেখাপড়া করবে। গোটা ফ্যামিলির যাতায়াতের খরচ দিয়ছে রেবা। শুধু পুঁটিকুমার বাদ। শুনলে বিশ্বাস হবে না, পুঁটিকুমারের খরচ ভাতডাল হোটেলের মালিক অভয়পদবাবু রেবার কাছ থেকে নিতে দেননি। বলেছেন, ‘আমার কর্মচারী, আমি যাতায়াতের ভাড়া দেব। আমার কর্মচারীর বেড়াতে যাবার পয়সা অন্য কেউ দেবার কে? মনে রাখবেন আমি মালিক। কী ভাবেন আমাকে, আমি কি শুধু ইয়ের মালিক?’

আমি বেরাকে ফোন করে খুব বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আমি কি বিন্তিদের সঙ্গে লামডিং যেতে পারি? অনেকদিন কলকাতার বাইরে যাওয়া হয় না। পকেটে পয়সা নেই। তোমার খরচে বেড়িয়ে আসতাম।’

রেবা বলেছে, ‘না, আসবে না। তোমাকে দেখার থেকে, না দেখতে পাওয়ার মনকেমন আমার কাছে অনেক বেশি দামি। তুমি আসবে না।’

শান্তি

আরও চাই, আরও, আরও। টাকাপয়সা, সম্মান, ক্ষমতা, জনপ্রিয়তা সব কিছুই হিসেবে কম পড়ছে। তাই আরও বেশি বেশি করে চাই। এই সুখে হবে না, আরও সুখ চাই। এই পরিমাণ শান্তিতে চলবে না, নিরবচ্ছিন্ন শান্তি চাই। যেটুকু আয়ত্তের বাইরে আছে সেটুকুকে পেতে আয়ত্তের মধ্যে থাকা জিনিসকেও বাজী ধরতে রাজি আছি।

গোপালের বিয়ে দেবার জন্য ওর মা-বোন-দিদি সব উঠে পড়ে লেগেছে। বিয়ের জন্য গোপাল নিজে যত না আগ্রহী, উদ্যোগী ওর বাড়ির লোকজন তার হাজারগুণ। গোপালের মা বলেন, ‘মেয়েগুলোর বিয়ে হয়ে যাবার পর বাড়িটা কীরকম যেন খাঁখাঁ করে। একটা চুড়ির রিনিঝিনি নেই, একটা নূপুরের নিক্বণ নেই। যেন ভূতের বাড়ি। নাতি-নাতনির মুখ বোধহয় আর দেখে যেতে পারব না।’

গোপাল বলে, ‘দাঁড়াও না মা, আর একটু সবুর করো না, আমার আর একটা পদোন্নতি হোক তারপর না হয়…’

গোপালের মা ওর মুখের কথা ছোঁ মেরে কেড়়ে নিয়ে বলে, ‘পদ বাড়ানোর প্রস্তুতি আর বিয়ের প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলুক না, ক্ষতি কি? তোর পদোন্নতি হতে হতে আমাদেরও মেয়ে রেডি হয়ে যাবে। আরও দেরি করে মেয়ে দেখতে বেরোলে, তোর বিয়ের বয়স পার হয়ে যাবে।’

সুতরাং প্রায় প্রত্যেকটা ছুটির দিনেই মা-দিদি-বোনেরা একজোট হয়ে একটা না একটা মেয়ে দেখতে যাওয়া চাই-ই। এটা যেন ওদের কাছে একটা সাপ্তাহিক উৎসবে পরিণত হয়েছে। সকাল থেকেই সাজোসাজো রব। ইতিমধ্যে নয় নয় করে তেরোটা মেয়ে দেখা হয়ে গেছে। কিন্তু পছন্দ যেন আর হয় না। এদেরই মধ্যে একজনকে গোপালের মনেও ধরেছিল কিন্তু মা-দিদি-বোনের যুক্তফ্রন্ট সেটাকে পত্রপাঠ নাকচ করে দিয়েছে।

দেখতে দেখতে গোপালের বিয়ে হয়ে গেল। এলাহি আয়োজন হল, প্রচুর লোক খেল। বাড়িতে এখন দিনরাত হইচই লেগেই আছে। দিদি, বোন প্রায়ই আসে। নতুন বউকে নিয়ে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, বাজার কিংবা সিনেমা হলে যায়। গোপালও যায় মাঝে মাঝে। শাশুড়ি-বউমার যুগলমূর্তি প্রায়ই চোখে পড়ে এখানেওখানে। বাড়িতে হাসাহাসি, দাপাদাপি, হুটোপাটি, লুটোপুটি লেগেই আছে। নতুন বউমা নতুন মাকে পেয়ে সেকি উচ্ছ্বসিত। তার চেয়েও বেশি উচ্ছ্বসিত নতুন মা তার নতুন মেয়েকে খুঁজে পেয়ে। যেন আক্ষরিক অর্থেই জন্মজন্মান্তরের পর আকস্মিক ভাবেই কোনও এক অজানা গ্রহের ফেরে মা-মেয়ের দেখা। বউমা ‘মা’ ‘মা’ বলতে অজ্ঞান। শাশুড়িও একই রকম বউমা ভক্ত। দুজনে যেন একে-অপরকে কিছুতেই চোখের আড়াল করতে পারে না। গোপালের বাড়ি এখন সুখের হাট। লোকে দেখে হিংসে করে।

সস্তার জিনিস যেমন প্রথম দর্শনে চেনা যায় না, দুদিন ব্যবহারেই তার আসল রূপ প্রকাশ পায়, তার চাকচিক্যের অবসান ঘটে, তেমনি শাশুড়ি-বউমার চিরন্তন স্বাভাবিক সম্পর্ক ধরা পড়ল মাসখানেক বাদে।

এখন কাক, চিল, আদি পক্ষীকুল গোপালের বাড়ির ছাদ, পাঁচিল এড়িয়ে চলে। মফসসলের এই মধ্যবিত্ত পাড়াটার আপাত শান্ত চেহারাটা হঠাৎই বড়ো অশান্ত হয়ে ওঠে শাশুড়ি-বউয়ের নিত্য কলহে। অশান্তি, চিৎকার, চ্যাঁচামেচি লেগেই আছে। কান পাতা দায়। কী নিয়ে যে অশান্তি তা বোধগম্য নয়। কোনও ইস্যু নেই। শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়া না, দুই সতিনের ঝগড়া তাও চট করে বোঝার উপায় নেই। সেই একমেবদ্বিতীয়ম ছেলে-স্বামীর ওপর আধিপত্য বিস্তারের গল্প, যা প্রতিদিন হাজার হাজার ঘর ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছে। শাশুড়ি ভাবে, যে-ছেলেকে, যে-গোপালকে এই সেদিন জন্ম দিলাম বত্রিশটা নাড়ি ছিঁড়ে, মাসের পর মাস বুকের দুধ খাইয়ে মানুষ করলাম, আধপেটা খেয়ে না খেয়ে পুজোয় নিজের জামাকাপড় না কিনে লেখাপড়া শেখালাম, সেই গোপাল আমার শেষ পর্যন্ত কিনা পর হয়ে গেল! হতচ্ছাড়া অলক্ষুনে মাগিটা আমার অমন মাতৃভক্ত, গোবেচারা গোপালটাকে ছিনতাই করে নিল! দিনরাত অত গুজুর গুজুর, ফুসুর ফুসুর কীসের? আমার ভোলাভালা ছেলেটার মাথা খাচ্ছে! দিনরাত কুযুক্তি দিচ্ছে, আমার বিরুদ্ধে সব সময় নালিশ করছে! ছেলের বিয়ের আগে বাড়িতে আমার কত শান্তি ছিল! ওই মাগিটা আসার পর থেকে ছেলেও আমার বিগড়ে গেল, বাড়ি থেকেও শান্তি উধাও!

চেহারা কিংবা শিক্ষার পালিশ গোপালের মায়ের কোনওদিনই ছিল না। তাই চিন্তার ও ভাষাদৈন্য অচিরেই প্রকট হয়ে ওঠে। বউমা সম্পর্কে তার তিক্ত ভাবনাটাই মুখের কদর্য ভাষায় বেরিয়ে পড়ে মাঝেমধ্যেই। ‘বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা হতচ্ছাড়ি মাগি! গোপালের আবার বিয়ে দেব আমি। খাল কেটে আমিই ঘরে কুমির এনেছি! বলি সংসারটা কি শুধু স্বামীটাকে নিয়ে? আরে মূর্খ, স্বামীটাকে পেলি কোত্থেকে? তুই জন্ম দিয়েছিস? আমি কি বাইরের লোক? তোর বাপ-মায়ের সঙ্গে কি তুই এইরকম আচরণ করতিস? পাঠাবার সময় বাপ-মা শিখিয়ে দেয়নি শ্বশুরবাড়িতে কীরকম ভাবে থাকতে হয়, শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে কীরকম ব্যবহার করতে হয়? আমরা তো জীবনে শ্বশুর-শাশুড়ির মুখের ওপর কোনওদিন কথা বলিনি, কোনও কথার প্রতিবাদ করিনি, চিরটাকাল তাদের দাসী হয়ে থেকেছি। আমারই ভিটেয় থেকে আমাকেই অপমান? ছেলে মানুষ করলাম শেষ বয়সে এসে বউয়ের লাথিঝাঁটা খাবার জন্য! এর চেয়ে তো মরণও ভালো ছিল আমার!’

মায়ের সঙ্গে উপযুক্ত সঙ্গত করে ননদেরা, ‘মা, একি চেহারা হয়েছে তোমার? সেই কাঁচা সোনার বরন কোথায় গেল? ওই ডাইনি বউটার কীর্তি নিশ্চয়ই! তাড়াও হতচ্ছাড়িকে।’

ভাইয়ের বউয়ের দিকে আঙুল তুলে বলে, ‘তুই এই বাড়ির নখের যুগ্যি নস, দূর হয়ে যা এখনই, নইলে গলা ধাক্বা দিয়ে বের করে দেব, এই বলে দিলাম। চিরকালের জন্য এবাড়ির ভাত খাওয়া ঘুচিয়ে দেব।’

ছেলে-বউ একসঙ্গে বেশিক্ষণ কাটালে, গল্প করলে বা হাসাহাসি করলে শাশুড়ি সহ্য করতে পারেন না। কোনও না কোনও ছুতোয় ছেলেকে অন্য কোনও কাজে ব্যস্ত করে তোলেন অথবা নিজেই দুজনের মাঝে বসে পড়ে অপ্রয়োজনীয় গল্প জুড়ে দেন। রসভঙ্গ করেন। ছেলে-বউ সব বুঝেও কিছু বলতে পারে না।

ছেলে-বউ কোথাও বেড়াতে যাবে শুনলেই শাশুড়ির গাত্রদাহ ও রক্তচাপ হাজারগুন বেড়ে যায়। শরীর খারাপ বা অন্য কোনও ছুতোয় তিনি তা বানচাল করার চেষ্টা করেন। এই করেই সেবারে ওদের দীঘা যাওয়া ক্যানসেল হয়ে গেল। বাড়ি থেকে বেরোবার ঘণ্টাখানেক আগে শাশুড়িমা বুকে হাত দিয়ে শুয়ে পড়লেন। ছোটাছুটি, ডাক্তার ডাকাডাকি সবই করতে হল বেচারা গোপালকে। দীঘা যাওয়া মাথায় উঠে গেল। ডাক্তার এসে বললেন আশ্বাসের কথা, ‘তেমন কিছুই হয়নি… একটু বিশ্রাম।’

ততক্ষণে দীঘার বাস ডায়মন্ডহারবার পৌঁছে গেছে। গোপালের মধুচন্দ্রিমা উচ্ছেচন্দ্রিমায় রূপান্তরিত হয়েছে।

গোপালের মা, বউয়ের দিক থেকে ছেলের মন একশো আশি ডিগ্রি ঘোরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন। গোপাল চা করতে গেলে, জামাকাপড় কাচতে গেলে বা এঁটো বাসনপত্র তুলতে গেলে অর্থাৎযে-কাজগুলোকে সচরাচর অন্যায়ভাবে শুধুমাত্র মেয়েলি কাজ বলে মনে করা হয়, সেগুলো করতে গেলে মা বাধা দেন। বলেন, ‘তুই এসব কাজ করছিস কেন? এগুলো তো মেয়েদের কাজ, তোর বউয়ের কাজ! এতে তো তোর বউ আরও প্রশ্রয় পেয়ে যাবে, মেয়েদের কাজ ছেলেদের করতে নেই। তুই বোকাসোকা ভালোমানুষ বলে তোকে দিয়ে হাবিজাবি কাজগুলো করিয়ে নিচ্ছে। একদিন ওর কাজ করে দিলে দ্বিতীয় দিন আর ও সেই কাজ করতে চাইবে না। সারাজীবন ধরেই তোকে বউয়ের গোলামি করে যেতে হবে।’

গোপাল মায়ের কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। মায়ের কথা মেনে নিতে ওর বড়ো কষ্ট হয়। অথচ তীব্র প্রতিবাদও করতে পারে না। ছোটোবেলা থেকেই ও জেনে এসেছে বড়োরা বিশেষ করে মা-বাবা কখনও সন্তানের অমঙ্গল চান না। তাঁরা যা বলেন বা করেন সবই সন্তানের ভালোর জন্যই। তাঁদের মুখের ওপর কথা বলতে নেই। অথচ ও বেশ বুঝতে পারে স্ত্রীর ক্ষেত্রে মা যা যা বলেন তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বেঠিক, চরম বিদ্বেষপূর্ণ, শত্রুতাপূর্ণ। সে কী করবে, তার কী করা উচিত কিছুতেই ঠিক করতে পারে না। এক চরম নিষ্ঠুর তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বে ভোগে সে। সে দেখেছে বিয়ের আগে পর্যন্ত মা যা যা বলে এসেছে বা করে এসেছে সবই তার স্বার্থের অনুকূলে। তাই রাতারাতি মায়ের এই ভোলবদল সে কিছুতেই নিজের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারে না। যদিও শাশুড়ি-বউ-এর সম্পর্কের চিরকালীন কূটনৈতিক জটিলতা ও পরিপক্ব সাংসারিক বুদ্ধির অভাবই তিক্ততার জন্য দায়ী।

ভালো কথায় কাজ হচ্ছে না দেখে মা এবার অন্য রাস্তা ধরেন। গোপালকে দিনরাত কথায় কথায় তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অপমান করেন। বলেন, ‘বউকে প্রশ্রয় দিচ্ছিস। তোর প্রশ্রয়েই বউ এত বাড় বেড়েছে। বউকে শাসন করার ক্ষমতা নেই, স্ত্রৈণ কোথাকার! বউয়ের কথায় ওঠবোস করিস। মনে রাখিস, বউ গেলে বউ আসবে, মা গেলে মা আসবে না। যে মা তোকে জন্ম দিল, এই এতটুকু থেকে মানুষ করল, দুদিনের বউকে পেয়ে সেই মাকে ভুলে গেলি? নেমকহারাম কোথাকার! একেই বলে কলিকাল। এমন ছেলে থাকার চেয়ে বাঁজা হওয়াও ভালো ছিল। জন্মের পরই যে কেন তোকে গলায় নুন দিয়ে মেরে ফেলিনিরে হতভাগা!’

গোপালের ওপর মায়ের এই মানসিক অত্যাচারের কারণ হল যে, তিনি চান এসব অপমানের মাধ্যমে গোপালকে এমন মানসিক অশান্তির মধ্যে ফেলা যে, সে যেন ভাবে এসবের জন্য বউ-ই দায়ী, কারণ, বিয়ের আগে মা তার সঙ্গে ভালো ব্যবহারই করত কিন্তু বিয়ের পর মায়ের আচরণ পালটে গেল। এই কথা ভেবে গোপাল যাতে মায়ের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে বউয়ের ওপর অত্যাচার করে, মায়ের মনে এমনই আশা। কিন্তু গোপাল মায়ের এই কৌশল বুঝে ফেলে। তাই সে মায়ের কৌশলের ফাঁদে পা দেয় না।

কম যায় না গোপালের বউ-ও। শাশুড়িমাকে সে সতিন জ্ঞান করে। তাকে মন্দ ভাষা বলতেও বউয়ের বুক কাঁপে না। তিরিশ বছরের বড়ো এক মহিলার সঙ্গে সমানে টক্বর দেবার বা তাকে ওই ভাষায় গালাগাল করার সাহস কোত্থেকে আসে তা ভেবে গোপাল অবাক হয়ে যায়। গোপাল মাঝে মাঝে ভাবে, ‘এ নিজের মায়ের সঙ্গেও কেমন আচরণ করে!’

গোপালকেও বউ ছেড়ে কথা বলে না। শাশুড়ি-ননদের হাতে হেনস্তার জন্য সে সর্বদা গোপালকেই দায়ী করে।

‘তুমিই তো যত নষ্টের গোড়া! বিয়ে করে এনেছিলে কি মাকে দিয়ে পদে পদে অপমান করাবে বলে? বউয়ের সম্মান রাখতে পার না, কী ধরনের স্বামী তুমি? অমন স্বামী থাকার থেকে না থাকা ঢের ভালো ছিল। এর চেয়ে আইবুড়ি হয়ে সারাজীবন কাটানো অনেক সুখের হতো। ব্যক্তিত্বহীন নপুংসক কোথাকার! মায়ের ন্যাওটা হয়েই তো সারাজীবন থাকতে পারতে। বিয়ে করার শখ হল কেন? অতই যদি মাকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট, তাহলে রাতটাও তো মায়ের সঙ্গেই কাটাতে পারতে!’

বউ আরও বলে, ‘এখানে তোমার মায়ের সঙ্গে আমি থাকতে পারব না। অন্য কোথাও চলো, বাড়ি ভাড়া করো, ফ্ল্যাট কেনো, নইলে বাপের বাড়ি চলে যাব, পুলিশের কাছে তোমার নামে বধূ নির্যাতনের অভিযোগ করব। মহিলা সমিতিতে অভিযোগ করব, কোর্টে নারী নির্যাতনের মামলা করব। জেলের খাবার খাওয়াব তোমায়, এই বলে দিলাম!’

ইতিমধ্যে বউয়ের বাপ আর তিন দাদা এসে চমকে দিয়ে গেছে গোপালকে। তিন দাদা তিনটে আলাদা আলাদা রাজনৈতিক দলের ঘাটে নোঙর বেঁধেছে। সে কী তড়পানি! ‘অনেক খরচা করে বোনের বিয়ে দিয়েছি পড়ে পড়ে লাথিঝাঁটা খাবার জন্য নয়। অমন মা থাকার চেয়ে না থাকা ভালো। দরকার হলে বুড়িটাকে লাথি মেরে বাড়ি থেকে বের করে দাও। আমাদের আদরের একমাত্র বোনের ওপর কোনওরকম অত্যাচার সহ্য করব না। মাকে যদি শায়েস্তা করতে না পারো তাহলে তোমাকে কীভাবে শায়েস্তা করতে হয় তা আমরা বুঝে নেব!’

মা, বউ দুজনেই দিনরাত আত্মহত্যা করার ভয় দেখায়। বউ যদি সকালে আত্মহত্যা করার ভয় দেখায় তাহলে মা দেখায় বিকেলে, মা যদি দিনের বেলায় তো বউ রাতে। এ যেন একদলের মিছিল বা বন্ধের ডাকের বদলে অন্য দলের পালটা ডাক। আত্মহত্যা করার ভয় দেখিয়ে দুজনেই এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চায়– গোপালকে চাপের মধ্যে রেখে নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধি করা এবং অপর পক্ষের আত্মহত্যার হুমকিকে নস্যাৎ করে দেওয়া। কিন্তু মনস্তত্ত্বের এই সূক্ষ্ম ও জটিল উপধারাগুলো উপলব্ধি করার মতো সূক্ষ্মতর বুদ্ধি উচ্চশিক্ষিত গোপালের থাকলেও তা এখন কাজ করে না।

ইতিমধ্যে মা একদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে বউয়ের শাড়ি গলায় পেঁচিয়ে সিলিং ফ্যান থেকে ঝুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেও চরম ব্যর্থ হয়েছেন। বাইরে থেকে গোপাল দরজায় দমাদ্দম লাথি মারতে থাকে আর চিৎকার করতে থাকে, ‘বাঁচাও বাঁচাও’। পাড়ার ক্লাবের ছেলেরা দৌড়ে আসে, আশেপাশের বাড়ির লোকেরা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। সকলের ঠেলাঠেলি, লাথালাথিতে দরজা ভেঙে যায়। দেখা যায় গোপালের মা গলায় গোপালের বউয়ের শাড়ি বেঁধে ‘অজ্ঞান’ অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। ‘মা মা’ বলে ককিয়ে চিৎকার করে ওঠে গোপাল। সকলে মিলে কেউ ফ্রিজ থেকে, কেউ বাথরুম থেকে জল এনে মায়ের চোখে মুখে ঝাপটা মারতে থাকে। আস্তে আস্তে জ্ঞান ফেরে মায়ের।

পালটা হিসেবে পরের দিনই বউ কেরোসিন তেলের জ্যারিকেন খুলে সারা গায়ে ঢেলে আগুন লাগাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেও চরম ব্যর্থ হয়। পরপর চারচারটে দেশলাই কাঠি জ্বেলেও শাড়িতে ঠেকাবার আগেই নিভে যায়। এই বিশাল পরিমাণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে গোপাল ছাড়ে না। দৌড়ে গিয়ে ছোঁ মেরে দেশলাই কেড়ে নিয়ে সে যাত্রা বউ ও নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়। বলাবাহুল্য এ দুটো ঘটনাই বাড়িতে গোপালের উপস্থিতিতে ঘটেছিল। মন্দজনে বলাবলি করে দুটোই নাকি চিৎপুরের কোনও এক হিট যাত্রা পালার অংশ থেকে ধার নেওয়া।

গোপাল দিনরাত আতঙ্কে থাকে, এই বুঝি কিছু একটা হয়ে গেল। এই বুঝি মা আবার ঝুলে পড়ল, এই বুঝি বউ নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে দিল। অফিসে কাজে মন দিতে পারে না, ক্লাবে আড্ডা দিতে যেতে পারে না, না জানি বাড়ি গিয়ে কী দেখবে! ঘনঘন মোবাইল চেক করে, কোনও দুঃসংবাদ এল কিনা। মনে শান্তি নেই, চোখে ঘুম নেই, কাজে মন নেই। চব্বিশ ঘণ্টা তাকে একটাই আতঙ্ক তাড়া করে বেড়ায়– এই বুঝি, এই বুঝি… মনে মনে সে দুজনের যে-কোনও একজনের মৃত্যু কামনা করে– মা অথবা বউ, বউ অথবা মা, যে-কোনও একজনকে যেতেই হবে, তা না-হলে সে নিজে বাঁচবে না। অথচ দুজনের কেউ একজন আত্মহত্যা করেছে ভাবলেই সে শিউরে ওঠে, কী অস্বাভাবিক অন্তর্দ্বন্দ্ব! এক এক সময় ভাবে, দরকার নেই দুজনের কাউকেই, দুজনেই চরম স্বার্থপর, যে যার নিজেরটাই শুধু বোঝে, তার কথা কেউ ভাবে না, ভাবলে এই রকম আচরণ করত না। কেউ তাকে ভালোবাসে না।

গোপাল ঠিক বুঝতে পারে না কার দোষ। মায়ের কথা শুনলে মনে হয় সব দোষ বউয়ের। আবার বউয়ের সব কথা শুনলে মনে হয় যত নষ্টের গোড়া ওই মা। মা না বউ, বউ না মা, মা না বউ, বউ না মা। ওঃ, গোপাল আর পারে না, ও কি পাগল হয়ে যাবে? এখন ও সবসময় ভাবে, কেন যে মরতে বিয়ে করতে গেলাম!

বন্ধুরা অনেকেই বলে, ‘গোপাল, শাশুড়ি-বউয়ের ঝগড়া নিত্যসত্য, জীবনের অঙ্গ, আমাদের জীবনেও আছে বা ছিল, সব ঠিক হয়ে যাবে।’ কেউবা বলে, ‘যদি সত্যিই বাঁচতে চাস তবে বউকে নিয়ে আলাদা হয়ে যা। কিন্তু বউকে নিয়ে আলাদা হয়ে গেলে বৃদ্ধা মাকে দেখবে কে? বাবা মারা গেছেন মায়ের কোলে আড়াই বছরের গোপালকে রেখে। তারপর থেকে মা-ই বাবা, মা-ই মা।

জ্ঞানবয়সে বাবার স্বাদ পায়নি গোপাল। বাবা কি জিনিস সে জানে না। স্কুলে বন্ধুবান্ধবদের কাছে যখন তাদের বাবাদের গল্প শুনত, তখন ওর খুব দুঃখ হতো। ওদের বাবারা অফিস থেকে ফেরবার সময় টফি, চকোলেট, ক্যাডবেরি, আইসক্রিম, নতুন নতুন খেলনা নিয়ে আসে। অফিস থেকে ফিরে কত আদর করে বাবারা। ছুটির দিনে ওদের সঙ্গে ফুটবল, ক্রিকেট খেলে। কার বাবা কাকে কত ভালোবাসে এই নিয়ে ওর বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া হতো। গোপাল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত সেই দিকে। ওর শিশুমন কল্পনা করার চেষ্টা করত ফোটোর বাবা অফিস থেকে ফিরে জামাকাপড় না ছেড়েই ওকে কোলে তুলে নিল। চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিল ওর মুখচোখ। তারপর পকেট থেকে বার করল মুঠো মুঠো চকোলেট, লজেন্স, ক্যাডবেরি।

ছোটোবেলায় গোপাল প্রায়ই স্বপ্ন দেখত বাবা ওকে পার্কে বেড়াতে নিয়ে গেছে। নাগরদোলা চড়াচ্ছে, ওকে ওপরে ছুড়ে দিয়ে লুফছে, ওর সঙ্গে ফুটবল, ক্রিকেট, লুকোচুরি খেলছে, ওকে বকছে, শাসন করছে, পড়াচ্ছে। সকালে ঘুম ভাঙার পর বাবার ওপর ওর খুব রাগ, অভিমান হতো। বাবা কেন ওকে ফেলে, মাকে ফেলে ‘তারা’ হয়ে গেল, বাবা খুব দুষ্টু!

বাবার অকাল মৃত্যুর পর মা-ই ওদের তিন ভাইবোনকে অতিকষ্টে মানুষ করেছে, লেখাপড়া শিখিয়েছে। সমাজে পরিচয় দেবার মতো করে তৈরি করেছে। বাবা বেসরকারি অফিসে চাকরি করতেন। তাই বাবার অফিসে অনেক চেষ্টা করেও মায়ের কোনও চাকরি হয়নি। তবে অফিসেরই কেউ কেউ বাঁকা পথে চাকরি পেতে সাহায্য করার বদলে টাকাপয়সা এবং আরও অনেক কিছুই চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কয়েকটা টিউশনি আর রান্নার কাজ ধরে মা নড়বড়ে সংসারটাকে কোনওরকমে দাঁড় করায়।

মা যে লোকের বাড়ি রান্নার কাজ করত তা মা কাউকে কোনওদিন বলত না। বাড়িতেও কেউ জানত না, গোপালও না। ‘পড়াতে যাচ্ছি’ বলে গোপালের মা বাড়ি থেকে বেরোত। একদিন গোপালের মামা হঠাৎ অফিস থেকে গোপালদের বাড়িতে এসে হাজির। মামার বাড়ির দাদুর খুব শরীর খারাপ, দাদুর ইচ্ছা এখনই মাকে নিয়ে যেতে হবে। তাই মামা নিজেই এসে হাজির। গোপালকে পাঠানো হল মায়ের ছাত্রীর বাড়ি। সেখানে গিয়ে গোপাল শুনল, ‘তোর মা রান্না করে চলে গেছে’। গোপাল ব্যাপারটা বুঝতে পারেনি। ভেবেছিল মা ভালো রান্না করতে পারে বলে হয়তো আবদার করে মাকে দিয়ে কিছু রান্না করিয়ে নিয়েছে। পরে একদিন মাকে জিজ্ঞেস করাতে মা ওর মুখে হাত দিয়ে চেপে ধরেছিল। বলেছিল, ‘আর কাউকে ওসব কথা কোনওদিন বলিসনি’। নাঃ, গোপাল আর কোনওদিন ও কথা মুখেও আনেনি। বাড়িতেও কাউকে বলেনি। যদিও কথাটার অন্তর্নিহিত অর্থের মাথামুন্ডু সে তখন কিছুই বোঝেনি।

সেই মাকে একা অসহায় ভাবে ফেলে রেখে সে কেমন করে শুধুমাত্র ব্যক্তিগত সুখের সন্ধানে ফ্ল্যাট কিনে চলে যাবে?

ঘাড়টা সামনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। জিভটা মাকালীর মতো আধফুটের মতো বেরিয়ে এসেছে। চোখদুটো কোটর ঠেলে প্রায় বাইরে বেরিয়ে এসেছে। যেন ড্যাবডেবিয়ে গোপালের দিকেই তাকিয়ে আছে, বলছে, তুমিই, হ্যাঁ হ্যাঁ তুমিই দায়ী। বাড়িতে লোকে লোকারণ্য। এটা মফসসল এলাকা। এখানে কেউ খুন হলে বা আত্মহত্যা করলে এখনও জমাট ভিড় হয়। সবাই ফিসফিসিয়ে গোপালের বউ সীমার আত্মহত্যার সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা করছে। এরকম একটা পরিণতির ধারণা যে অনেকের মধ্যেই ছিল তার ইঙ্গিত দিচ্ছে। এরই মধ্যে হুড়মুড়িয়ে পুলিশ এসে হাজির।

আচমকাই গোপালের ঘুমটা ভেঙে যায়। এই শীতেও তার সারা শরীরে ঘামের স্রোত বয়ে যায়। ও ভাবে, ওঃ সীমা তাহলে আত্মহত্যা করেনি। বিছানায় শুয়ে শুয়েই ও ভাবতে চেষ্টা করে, এটা সত্যিই স্বপ্ন তো!

এর আগেও একদিন গোপাল স্বপ্ন দেখেছে ওর মা বিষ খেয়ে হ্যাঁচোড়প্যাচোড় করছে আর পাড়া মাথায় করে চ্যাঁচাচ্ছে, ‘গোপাল আমি বিষ খেয়েছি, আমি চললাম, তুই বউকে নিয়ে সুখে থাকিস।’

গোপাল, ‘আর হবে না মা, আর কখনও হবে না, এবারের মতো ক্ষমা করে দাও’ বলে কান্নাকাটি করছে। হঠাৎ মা দুম করে মাটিতে পড়ে গেল আর চমকে উঠে গোপালেরও ঘুম ভেঙে গেল।

গোপাল নিখোঁজ। আগের দিন রাতে মা-বউতে তুলকালাম হয়েছে। মুখের সীমান্ত পেরিয়ে গতকাল যুযুধান দুইপক্ষে তুমুল হাতাহাতি হল। শেষ পর্যন্ত তা রক্তারক্তিতে গড়াল। শাশুড়ি গ্যাস আভেনে রুটি সেঁকতে সেঁকতে গরম খুন্তি দিয়ে বউকে ঘা কতক দিতেই বউ মড়াকান্না জুড়ে দিয়ে শাশুড়ির মাথায় সাঁড়াশির বাড়ি দমাদ্দম লাগিয়ে দিল। দুপক্ষই রক্তারক্তি। প্রবল চিৎকার চ্যাঁচামেচিতেও পাড়ার কেউ এল না। কারণ এটা এ বাড়ির নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। দুর্গাপুজোয় ভিড় হয়, ট্রাফিক জ্যাম হয়, নিত্যপুজোয় ওসব কিছু হয় না। রাতবিরেতে ডাক্তার, হাসপাতাল সবই হল। হাতে, মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধে দুপক্ষ মাঝরাতে বাড়ি ফিরল।

স্বভাবতই পরের দিন শাশুড়ি, বউ উভয়েরই ঘুম ভাঙল বেশ দেরিতে। উঠে দেখল, গোপাল নেই। ভাবল, হয়তো দোকান বাজার গেছে, এখনই ফিরবে। কিন্তু বেলা গড়ায়, গোপালের দেখা নেই। ভাবল, রাগ করে বেরিয়ে গেছে, রাগ পড়লেই ফিরে আসবে। সকাল গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে, সন্ধে গড়িয়ে রাত হল, কিন্তু গোপালের দেখা নেই। খবরটা সারা পাড়া ছড়িয়ে পড়েছে। গোপালের শ্বশুরবাড়ি পর্যন্ত খবর পৌঁছে গেছে। বন্ধুবান্ধব, পাড়াপড়শি, আত্মীয়স্বজন সবাই মিলে তন্নতন্ন করে খোঁজ করে গোপালের। কিন্তু না, কোনও হদিশই নেই।

– গোপাল কি মা-বউয়ের ওপর রাগ করে বিবাগি হয়ে গেল?

– গোপাল কি বাড়িতে দিনরাত অশান্তির জেরে দু-চার দিনের জন্য কোথাও আত্মগোপন করল?

গোপালের অন্তর্ধানে কিন্তু বাড়ির অশান্তি থেমে থাকল না, বরং তা অন্য মাত্রা নিল। মা-বউকে বলল, ‘তুই আমার ছেলেকে খেয়েছিস!’ আর বউ মাকে বলল, ‘তোর জন্যই ও বাড়ি ছেড়ে চলে গেল।’

তিন দিনের দিন– আশেপাশের এলাকা দুর্গন্ধে ভরে যায়। মানুষজন নাকে রুমাল দিয়ে হাঁটতে থাকে, ভাবে বেড়াল বা রাস্তার কুকুর মরেছে। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে দুর্গন্ধের তীব্রতা। পুলিশ আসে। গোপালের বাড়ির উলটোদিকে একটা পরিত্যক্ত কারখানা থেকে উদ্ধার হয় গোপালের পচাগলা ঝুলন্ত দেহ।

‘বউকে দুলাখ টাকা দিয়ে গেলাম। টাকাটা কো-অপারেটিভ ব্যাংকে আছে। বউ যেন টাকাটা পায়। মা, তুমি আমাকে ক্ষমা কোরো। তোমাকে খুব ভালোবাসি। দিদিকে, বোনকেও খুব ভালোবাসি। সবাইকে নিয়ে সুখে শান্তিতে বাঁচার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু পারলাম না, হেরে গেলাম। পুলিশ যেন কাউকে না ধরে। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।’ পরের দিন বালিশের ওয়াড়ের ভেতর থেকে উদ্ধার হল গোপালের সুইসাইড নোট।

গোপালের বাড়িতে এখন চরম ‘শান্তি’ বিরাজ করছে। গোপাল তো এটাই চেয়েছিল! তাই না?

 

রুহু কুহু

কত তাড়াতাড়ি দিন বয়ে গেল। এই সেদিনের কথা, বিডিওর চাকরিতে জয়েন করতে গিয়েছিল অতনু কর, বাঁকুড়া শহরে। সেখান থেকে আরও দূরে এক পাহাড়ি এলাকা ন’পাহাড়িতে। জায়গাটা ছবির মতো ভাসে চোখের সামনে। পাহাড়, টিলা, বনভূমি, দিগন্তবিস্তৃত লাল মাটির ঢেউখেলানো প্রান্তর। ব্লক অফিসের বড়ো বাবুর দুই মেয়ে, বিশাখা ও ঐশিকা। তারা ছিল যমজ কিন্তু আলাদা। একজন গৌরী, অন্যজন শ্যামলা। শ্যামলা মেয়ে ঐশিকার চোখের রং ছিল আবছা বাদামি। বিনবিন করে অতনু নিজের সঙ্গে, বিশাখা, ঐশিকা, দুজনেই আমার দিকে ঝুঁকে পড়েছিল এক সঙ্গে। দুটি চিঠিই আমার কাছে এসে পড়েছিল ওদের ছোটো ভাই দেবুর হাত দিয়ে। দুজনের কী আশ্চর্য প্রেম নিবেদন। তারা তখন কৈশোর পার করে যুবতি হয়ে উঠছে সবে। তাদের একজন বিশাখা খুব হাসত, আর ঐশিকা ছিল অর্ন্তমুখী। কথা বলত কম। দুজনে যে দু’রকম তা তাদের দুই চিঠি পড়ে বোঝা গিয়েছিল। দুই বোন আলাদা আলাদা হয়ে ঘুরে বেড়াত। সেই বিশাখা, ঐশিকা দুই বোন এত বছর বাদে আমার কাছে ফিরে এসেছে বন্ধু হয়ে। দুজন কুড়ি। তাদের একজন কথা বলে গম্ভীর হয়ে। সব বিষয়ে সুচিন্তিত মতামত দেয়। আর একজন, যার নাম রুহু, সে শুধু হাসে, হা হা হা। আমাদের কথা বলার ইন-বক্সে হা হা হা, হাসির প্লাবন বয়ে যায়। অন্যজন তার নাম কুহু, সে আমাকে জিজ্ঞেস করে, তুমি গড অফ স্মল থিংস পড়েছ বন্ধু?

অতনু তখন জিজ্ঞেস করে, তুমি কি খুব বই পড়ো?

হ্যাঁ, তুমি বই পড়ো না?

পড়ি পড়ি, ওই বইটাও পড়েছি, কিন্তু তা দশ বছর আগে।

এই তুমি কি চেতন ভগত পড়়ো?

না, কেন?

আমিও না বন্ধু, শ্যালো, ওর ভিতরে কিছু নেই পাওয়ার মতো।

কী সুন্দর তুমি বললে, পাওয়ার মতো, বই পড়তে হয় কিছু পেতে, তাই না?

হুম, বলে অতনুর ওই বন্ধু কুহু একটি হৃদয় এঁকে দিল আগে, তারপর লিখল, বাই, পরে কথা হবে।

অন্য বন্ধু রুহু বলল, কী করছ তুমি?

কী করব, বসে আছি পথ চেয়ে।

আহা, তুমি খুব দুষ্টু, কেষ্টবাবু, তা তোমার বংশীটি কই?

হারিয়ে গেছে।

বাঁশি হারান কৃষ্ণ, হা কৃষ্ণ হা কৃষ্ণ, হা হা হা।

অতনু কর নিজে নিজে কথা বলে, এই আমার দুই বন্ধু। তাদের দুজনই একরকম মুখ দিয়েছে প্রোফাইল পিকচারে। সে হল সাদা কালোর যুগের হিরোইন মধুবালা। আমার মনে হয় রুহু-কুহু দুটি নামই ফেক নাম। হয়তো ওদের ডাক নাম। দুজনে একদিনেই আমার বন্ধু হয়েছিল। কিন্তু রুহু বলে সে কুহু বলে কাউকে চেনে না। কুহু বলে, সে রুহুকে দেখেছে বটে, এমনকী একটি ফোটোই তাদের প্রোফাইল পিকচার, কিন্তু কুহু তার বন্ধু নয়। তাহলে হয়তো এমন হতে পারে রুহু-কুহু একজন, তারা দুই নামে দুইজন। একজন রুহু আমার কাছে আসে সকাল দশটা নাগাদ, অন্যজন আসে সন্ধে সাতটা নাগাদ। রুহু হা হা হাসে, অন্যজন কুহু গম্ভীর হয়ে গড অফ স্মল থিংস, বিভূতিভূষণের ইছামতী উপন্যাসের কথা বলে। কী অদ্ভূত, এরা কি তাহলে সেই বিশাখা ঐশিকাদের কেউ?

ঐশিকা একদিন অতনুকে বলল, আপনি যদি না বলেন, না বলবেন, হ্যাঁ বলতে হবে এমন তো কোনও কথা নেই, আমার ভাল লাগে তাই জানিয়েছিলাম, পৃথিবীতে কত প্রেমপ্রস্তাব কতজন কতজনের কাছে পাঠিয়েছে, তার সব প্রেম কি স্বার্থক হয়েছে, এ তেমন কোনও চিঠি ভেবে নেবেন, চিঠি লিখতে আমার ভালো লাগে।

বিশাখা তাকে বলেছিল, আমি তোমারে ভালবেসেছি, যদি তুমি সাড়া না দাও অখিল, আমি দূর হতে ভালবেসে যাব, হয়তো কিছুই নাহি পাব।

বিশাখার চিঠির ভিতরে উত্তম সুচিত্রার সিনেমার গানের কলি ছিল। তখন সেই মফস্সলে সবে টেলিভিশন ঢুকেছে, কিন্তু তার ভিতরে কেবল লাইন, হরেক রকম চ্যানেলের কোনও ব্যাপার ছিল না। ভিডিও ক্যাসেট আর ভিসিপি ছিল সেই মফস্সলে সিনেমা দেখার উপায়। টেলিভিশন সেট আর ওই দিয়ে সেই গঞ্জে ভিডিও হলে সিনেমা দেখান হতো। ওখানে কোনও সিনেমা হল ছিল না। সদর বাঁকুড়ায় গিয়ে লোকে সিনেমা দেখে আসত। আর কোনও মেলা পাব্বনে প্রোজেক্টর ভাড়া করে এনে দেখানো হতো সিনেমা। সেই সময় টেলিভিশন সেট ভাড়া পাওয়া যেত ভিসিপি আর ভিডিও ক্যাসেট সমেত। পাওয়া যেত নীল ছবির ক্যাসেট। মফস্সলে সেই প্রথম নীল ছবি ঢুকতে আরম্ভ করে। ভিডিয়ো হলের রাতের শো-তে চলত। অতনুর মনে আছে তাদের এক কলিগ নৃসিংহ পাল আমাকে এক রাতের শো-এ নিয়ে গিয়েছিল, ভিতরে ঢুকে দ্যাখে সব ষোলো-সতেরো-আঠেরো। লজ্জায় মাথা কাটা গেল। হলের মালিক ছেলেটি অতনুকে এসে বলল, স্যার আপনারা থাকলে আমার খদ্দের সব বেরিয়ে যাবে, যদি দেখতে চান, আমি বাড়িতে গিয়ে দেখিয়ে আনব। সে বেরিয়ে এসেছিল প্রায় মুখ ঢেকে। নৃসিংহ থেকে গিয়েছিল। সে নিয়মিত দর্শক। অতনু তো তা নয়। তাকে জোর করে নিয়ে গিয়ে ঠিক করেনি নৃসিংহ।

নীল ছবিতে আমার গা গুলোয়। মনে হয় রবারের পুতুল নর-নারী কুস্তি করছে। কুহু, তার ইন্টারনেট-ফেসবুকের বন্ধু একদিন কথায় কথায় বলে, নীল ছবিতে মেয়েদের কত ছোটো করা হয় বলো তুমি, আমি এর বিরুদ্ধে প্রচার করব, তুমি আমার সঙ্গে থাকবে তো।

থাকব, কিন্তু এর পিছনে কত বিলিয়ন ডলার খাটে তা জানো তুমি?

জানি বন্ধু, কিন্তু সেই সুরক্ষিত প্রাসাদের জানলায় একটা ঢিল কি মারতে পারব না? ঝুর ঝুর করে ভেঙে পড়ুক কাচ।

ঐশিকা প্রায় এমন কি বলত না?

বড়োবাবু, ওদের বাবার জ্বর, মনে হল দেখে আসি। হ্যাঁ, বিশাখা ছিল না। সে গিয়েছিল পিসির বাড়ি, ফিরতে তিন দিন। হা হা হাসি, খিল খিল হাসি হাসতে হাসতে পিসতুতো দাদার সঙ্গে সে গেছে পিসির বাড়ি বর্ধমান। ঐশিকা যায়নি। বাবার জ্বর। আসলে অতনুর মনে হয়েছিল, সে যাবে, তা যেন মনে মনে জেনে গিয়েছিল বাদামি চোখের সেই মেয়ে। দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল যেন তারই জন্য। তার জন্যই পথের দিকে তাকিয়ে। তাদের মা ছিল না। মা তাদের ছেড়ে চলে গেছে তা শুনেছিল অতনু কানাঘুষোয়। দুই মেয়েকে নিয়েই বড়বাবু অম্বিকাপ্রসাদ গুন ন’পাহাড়িতে বদলি হয়ে এসেছিলেন। তখন দুই মেয়ে পাঁচ-পাঁচ। আর ফিরে যাননি।

অতনু মনে মনে বলে, আমি যখন যাই মেয়েরা তখন কুড়ি-কুড়ি। এও জানতাম ঐশিকা আর বিশাখার ভিতরে বনিবনা কম। কিন্তু তা এমনিতে ধরা যায় না। আমি যেতে ঐশিকা বলল, বাবা ঘুমিয়ে আছেন, আপনি কি বসবেন, না আবার আসবেন?

কোথায় যাব?

তা বটে, তাহলে বসুন, আপনি বাবার ঘরে বসবেন না অন্য ঘরে?

আমি কি বলব?

ঐশিকা বলল, বিশাখাও নেই কিন্তু।

আমি কি দরজায় দাঁড়িয়ে থাকব?

সরি, ভেতরে আসুন।

বিশাখার চিঠির উত্তর আমি না দিলেও সে আমাকে চিঠি পাঠানোর পর থেকেই তুমি সম্বোধন করতে শুরু করেছিল। আর তা ঐশিকার সামনে। বা কখনও একা দেখা হয়ে গেলে। ঐশিকার সামনে সে যেন প্রমাণ করতে চাইত অতনু করের সঙ্গে তার কোথাও একটা সেতু তৈরি হয়েছে। সেই সেতু পার হয়ে সে অতনুর ভিতরে প্রবেশ করতে পারে। কতকাল আগের কথা এসব। রুহু-কুহু আমাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই যৌবনকাল। আমার মনে হয় সেই দুই বোন, দুই যমজ, হা হা হাসি আর বাদামি চোখের নীরব আমন্ত্রণ আবার ফিরে এসেছে।

রুহু, হাউ ওল্ড আর ইউ? অতনু লেখে বার্তা।

আমি একটা বুড়ি স্যার।

তার মানে কুড়ি?

ওয়ান্ডারফুল স্যার, কুড়িতে কি বুড়ি নয় স্যার?

পাগল না ফাগল।

হা হা হা হা, ফাগল ফাগল ফাগল স্যার, হামি এক ফাগল হ্যায়।

অতনু বলল, কুহুকে চেন?

আমার বোন হতে পারে, বাট আই ডোন্ট নো।

তোমার বোন হতে পারে কেন?

রুহুর বোন তো কুহুই হবে স্যার।

উঁহু।

হা হা হা, তুমি যা বলো না, আমার বোন উঁহুই অতনু স্যার, আমার কোনও ভগিনী নাই, অনলি ডটার।

তাহলে কুহু কে?

কে বলো দেখি, আমি মধুবালার যে সাদা কালো ছবি লাগিয়েছি প্রোফাইল পিকচারে, ওরও সেই পিকচার, ভেরি ব্যাড, ঠিকানা এটা, ও আমার ফ্রেন্ড লিস্টে নেই।

এই কথা তো কুহুও বলল, ওর ফোটো তুমি নিয়েছ, ও মধুবালা, নারগিস, তাদেরও আগের সুরাইয়ার ফ্যান, শি লাইক্স দোজ হিরোইন্স।

হা হা হা, আমি দেখেছি, বাট আই লাইক ক্যাটরিনা কইফ, করিনা কাপুর, দীপিকা পাড়ুকোন, ব্রেভ সানি লিয়ন, বাট মধুবালা ইজ নট ব্যাড, এটা আমি নেটে পেয়েছি। তোমার নিজের ফোটো নেই কেন?

না গো নিজের ফোটো দিলে আমাকে প্রত্যেকদিন দুটো করে প্রস্তাব নিতে হচ্ছিল, আই লাভ ইউ, লাভ ইউ, প্লিজ ইন-বক্সে এসো, প্রেমের হাল কি বোঝো, হা হা হা, কী করি, ফেসবুক ছেড়ে কি পালাব?

রুহুর কথা যা কুহুর কথা তা নয়। সন্ধেয় কুহু বলল, আরে এই জগৎটাই ভারচুয়াল, এখানে আসলই বা কী নকলই বা কী, কারোর সঙ্গে তো কারোর দেখা হয় না, তাই আর নিজের ছবি দিলাম না। আর মধুবালার চেয়ে তো আমি সুন্দর নই স্যার, ডু ইউ নো, মধুবালার হার্ট-এ একটা ছিদ্র ছিল, কত কম বয়সে সে মারা গেল। শি ওয়াজ অ্যান অ্যানজেল, অ্যানজেলঃ এই পোলিউটেড পৃথিবীতে কতদিন থাকবে।

অতনু কর তখন বলল, তুমি গৌরী না শ্যামলা মাই অ্যানজেল?

কেন বলো দেখি?

অসুবিধে থাকলে বোলো না।

যদি বলি শ্যামলা মেয়ে আমি।

অতনু কর বলল, শ্যামল বরণী মেয়ে বলো কার পথ চেয়ে আঁখি দুটি ওঠে জলে ভরিয়া।

এর মানে?

এটা একটা গান।

সে আমি জানি স্যার, কিন্তু এই কথা বললেন যে?

এমনি বললাম।

আই আম নট ওয়েটিং ফর এনি ওয়ান, প্রত্যাখ্যান আমার ভালো লাগে, আই লাইক টু রিফিউজ।

বুক কেঁপে উঠেছিল তার, সে কোনও রকমে বলে, তোমার চোখের রং কি বাদামি?

উফ, আমি বলব কেন?

না বললে না বলবে, আমি শুনব না।

অতনু, তুমি কি কোনও ফেক আইডি নিয়ে আছ, তুমি কি অতনু কর নও, তুমি কি ওল্ড ম্যান নও?

অতনু বলল, তোমার কি তাই মনে হয়?

না হয় না, বাট তোমার কথা আমাকে ডাউটফুল করে তুলছে।

কেন?

তুমি বুঝে নাও, আমার মনে হয় তুমি আমার চেনা কেউ।

না। অতনু বলল। বলে একটু থমকে থাকে। তখন নিঃশব্দে কুহু অন্তর্ধান করল। অতনু হিসেব কষল। তেত্রিশ বছর কেটে গেছে তারপর। তারা পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। পঞ্চাশ পেরোনো নারী কি এই ভাবে কথা বলতে পারবে, প্রত্যাখ্যান তার ভাল লাগে, পুরুষ মানুষ বুুঝুক প্রত্যাখ্যান কী?

যে-ঘরটিতে অতনু বসেছিল, সে ঘরে বুঝি ভাসছিল বিরল এক বাদামি রঙের চোখের মণি। ঐশিকা বলল, চা করি?

উনি কখন উঠবেন?

উঠবেন, ঘুম ভাঙলে উঠবেন।

চা করতে গেল সে। শ্যামল বরণ স্বাস্থ্যবতী কন্যা চা এনে বলল, কাগজ পড়বেন স্যার।

আমি কি তোমার স্যার?

বললে কি দোষ হবে, বাবা তো স্যার বলে, তাই না।

অতনু বলল, ও তো অফিসিয়াল স্ট্যাটাস, তুমি কি চাকরি করো।

ঐশিকা বলেছিল, কী জানি।

তুমি চিঠি দিয়েছিলে তো।

ও কিছু না, এমনি।

কেন দিয়েছিলে?

আপনি তো জবাব দেননি, আবার কথা কেন।

বিশাখাও চিঠি দিয়েছে।

আমি জানি, আমাকে বলেছে।

তারপর?

ও জানে একদিন ও সাড়া পাবে, প্রপোজ করতে ওর খুব ভালো লাগে, এর ভিতরে চারজনকে প্রপোজ করেছে ও, আরও করবে।

তুমি, তোমার ভালো লাগে না প্রস্তাব দিতে?

না।

তুমি তাহলে কী চিঠি দিয়েছ?

ঐশিকা বলেছিল, আমি লিখলাম আপনাকে আমার ভালো লাগে, যা মনে হয়েছে তাই লিখেছি, ওটা প্রপোজ নয়।

অতনু কর চুপ করে গিয়েছিল। ঐশিকার ছিল হালকা হলুদ শাড়ি, হলুদ ব্লাউজ, মাথার চুলে এলো খোঁপা। সেই খোঁপা ভেঙে আবার বাঁধল সে। কী অনায়াস। সেই খোঁপা বাঁধতে বাঁধতে ঘাড় বাঁকিয়ে সে তার বাদামি চোখের মণি ঘুরিয়ে নিল অতনুর উপর থেকে। কী ধারাল ছিল সেই দৃষ্টিপাত। বলল, আমরা দুই বোন খুব খেলো, তাই না?

জানি না, মনে হয়নি।

হয়নি তো সেদিন আমার সামনে ওকে বললেন কেন, তোমার হাতের লেখা খুব সুন্দর।

সুন্দর তো।

আপনি খুব নিষ্ঠুর, একটা মেয়ে প্রপোজ করল, তাকে এই ভাবে ফেরালেন, উত্তর না দিতে পারতেন, ছিঃ, একজনকে সাক্ষী রেখে রিফিউজ করলেন, গোপন চিঠির গোপনীয়তা থাকল না।

আমি তো বলেছি।

অতনুকে কথা শেষ করতে দেয় না ঐশিকা। বলে, মুখ অন্ধকার করে ঘুরছিল, আমি ওকে বললাম পিসির বাড়ি যেতে, আপনার খুব অহংকার, তাই না স্যার?

তোমার চিঠির কথা তো বলিনি।

আমি কি ছেড়ে দিতাম, আমি তো প্রপোজ করিনি কাউকে।

আমি কি চলে যাব? অতনু বলেছে।

ধ্যাত, চলে যাবেন কেন, থাক আর বলছি না।

তুমি কি প্রপোজ করোনি?

মোটেই না।

না, ওটা তাই। উঠে দাঁড়িয়েছিল অতনু কর।

হতে পারে না, আমি তো জানতাম বিশাখা আপনাকে ভালোবেসেছে, অবশ্যই তা এক তরফা।

চিঠি কে লিখে দিয়েছিল?

তা জেনে করবেন কী?

তুমি কি জানতে না, সে রিফিউজড হবে?

কী করে জানব?

হাতের লেখা সুন্দর, কিন্তু বানান সব ভুল, আমার নামের বানানেও দীর্ঘ ঊ কার বসিয়েছে।

ও লিখেছিল।

মনে হয় কপি করেছিল, তাই তো।

আমি বলব না।

তোমার কোনও বানানে ভুল নেই, আরম্ভ করেছ কী সুন্দর।

ঐশিকা বিনবিন করল, ‘শরীর শরীর তোমার মন নেই কুসুম,’ ওতো পুতুল নাচের ইতিকথা।

তুমি ভুল বানানে ড্রাফট করেছিলে ওর চিঠি।

চিঠিটা ওর লেখা।

কপি করেছিল।

না। ঘুরে গিয়েছিল ঐশিকা, বলেছিল, এ সব কথা বলছেন কেন?

তুমি তারপর চিঠিটা পাঠালে।

ওহ, ভগবান, এই কথা বলতে এলে।

হ্যাঁ।

বলা হয়ে গেছে, এবার কি যাবে?

না। বলেই অতনু কর তার হাত ধরে ফেলেছিল। নিজের দিকে টেনেছিল। বুকের উপর আছড়ে ফেলেছিল বাদামি চোখের কন্যাকে। ঠোঁটে ঠোঁট, মুখের ভিতর জিভ সাপের মতো খেলা করে। এসো, এসো অহংকারী যুবক, তোমার অহংকার ভাঙবে বাদামি চোখের মেয়ে। ঐশিকা তাকে দু’হাতে অাঁকড়ে ধরেছিল। তারপর সেই এক অনন্ত চুমু। সে যেন এক জীবন পার হয়ে আর-এক জীবনে প্রবেশ। বাদামি চোখের টানে পাগল হল অতনু। ঐশিকা ডাক দিলে সে সব ফেলে সব তুচ্ছ করে ছুটে যায়। শরীর শরীর ছাড়া আর কিছু নাই শশী। কুসুমের মুখে এই সংলাপ ছিল না নিশ্চয়, কিন্তু এই ভাবেই তার কানে যেন কুহু দেয় বাদামি চোখ। কী ছিল তার বন্যতা। ঐশী ওয়াইল্ড। নিজের ভিতরে তাকে নিতেও বুঝি সে-ই প্রধান। শরীরে শরীর যোগ হয়। তারপর একদিন আচমকা কী হল, বলল, তুমি আর এসো না অতনু।

কেন, কী হয়েছে?

না, তুমি আর আসবে না।

ঐশী!

না না না, আই ডু নট লাভ ইউ, আমি তোমাকে ভালোবাসি না।

মিথ্যে বলছ।

না সত্যি, বিশাখা তো ইচ্ছে করে সব বানান ভুল করেছিল, যাতে আমার ডাকে তুমি সাড়া দাও। ও ত্যাগ করেছিল। তুমি একটি লোভী পুরুষ, অত ভুল কি কেউ লিখতে পারে, কী নির্বোধ পুরুষেরা সবাই। আর তুমি মিথ্যেও বলেছিলে, নাউ, দিজ ব্রাউন আইজ ডু নট লাইক ইউ, ডোন্ট টাচ মি, চলে যাও।

এর পর ন’পাহাড়ি থেকে তার বিদায়। বিশাখা ত্যাগ করেছিল, না ঐশিকা? এখনও জানে না অতনু কর। অথচ কিছুই তো ভোলেনি। ঊরুতে জড়ুল চিহ্নটি পর্যন্ত। যে মেয়ে কোনও পুরুষের কাছে সব নিবেদন করে, সে কি তাকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে? পারে। প্রত্যাখ্যান করে, মিলনের সময় বিপরীত বিহারে গিয়ে সে পুরুষের চেয়ে বড়ো হয়ে উঠতে পারে। তাই-ই যেন হয়েছিল। এত বছর সব ভুলে থেকে আবার ফিরে এল সব, সেই ন’পাহাড়ি, বন-টিলা, ধু ধু প্রান্তর, মস্ত ছাতিম, তমাল, বিশাখা ঐশিকাঃ বিশাখা কোনও বানান ভুল করতে পারে না। অতনু কর তার দিকে ঝুঁকেছিল আগে, গৌরী কন্যা যে। বাদামি চোখের কন্যাকে সে পেয়েছিল গৌরী কন্যার বদলে। বিশাখা না দিলে ঐশিকাকে পেত না সে। আর ঐশিকা তাকে ফেরাল ওই বিশাখার জন্য। বিশাখাকে রেখে সে অতনু করের হাত ধরে কলকাতা চলে আসবে কী করে?

এই যে ফাগুন এল শহরে। কম্পিউটার নেটওয়ার্ক ফেস বুক সব রঙে রঙে ভরে গেল প্রায়। কোথায় কোন মাঠে, কোন প্রান্তরে, নদীতীরে শিমুল-মাদার-পলাশ ফুটেছে আগুন হয়ে, বাগানে আমের মুকুলে বসেছে ভ্রমর, লেবু ফুল ফুটেছে কোথায় কত দূরে, সব জেনে গেল সবাই। কুহু সন্ধেয় এল, হ্যালো স্যার।

বল।

তুমি এখন কী করছ?

তোমার জন্য বসে আছি।

স্যার, মিঃ অতনু কর, স্যার, টু ডে ইজ দ্য ডে ফর রিফিউজাল, আয়াম লিভিং ইউ টু ডে, তুমি ভালো থেকো।

হোয়াই, তুমি কি ফেস বুক থেকে সরে যাচ্ছ ব্রাউনি?

আই ডোন্ট নো স্যার, বাট আয়াম লিভিং ইউ, আমার আর ভালো লাগছে না তোমাকে।

কেনরে বালিকা, আমি কি কোনও অন্যায় করেছি?

নো  নো, তুমি খুব ভালো, কিন্তু আমি আজ তোমাকে প্রথমে আনফেন্ড্র করব, তারপর ব্লক করব।

কেন?

তুমি রুহুর সঙ্গে থাকো, ওই মধুবালাকে নিয়ে থাক, বাই স্যার, রুহুর সঙ্গে থাকলে কুহু থাকে না।

কেন রে ব্রাউনি, আমি খুব খারাপ?

তুমি খুব ভালো, ভালো থেকো, কিন্তু একটু পর থেকে তুমি আমাকে দেখতে পাবে না।

অতনু কর লিখল, ঐশিকা, বিশাখা কি তোমায় বলেছিল, আমি শেষ পর্যন্ত তার চিঠির উত্তর দিয়েছিলাম, তাই ফিরিয়ে দিয়েছিলে আমায়, অতনু কর লোকটা ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ায়? কিন্তু তা নয়, তা নয় সত্যি।

মেসেজ গেল না। হ্যাং হয়ে অন্ধকারে ভেসে রইল মহাব্রহ্মান্ডের কোথাও।

টিরিং

চল ফুলি, তোর নামে ব্যাংক-এ একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিই। তোর ভালো নামটা কীরে?

মেয়েটা লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলেছিল ফুলেশ্বরী।

– ফুলেশ্বরী? কী সুন্দর নামটা রে তোর। তোকে নিয়েই তাহলে সিনেমাটা হয়েছিল। সন্ধ্যা রায় ছিল না? স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন রজতকান্তি।

রজতকান্তির স্ত্রীর নাম চন্দ্রিমা। সায় দিলেন।

রজতকান্তি বললেন– মেয়েটা এতদিন আছে, ভালো নামটাই জানি না। ফুলি নামে ডাকি।

ফুলি বলে, না, আমার নামে ব্যাংক-এ বই খুলতে হবে না। আপনার কাছে টাকা আছে, ওটাই ঠিক আছে।

রজতকান্তি বলে, মোটেই ঠিক নেই। আমি মরে গেলে?

ধুর, খালি বাজে কথা।

মানুষ চিরকাল বাঁচে নাকি? একবার তো হার্ট অ্যাটাক হয়েই গেল। তোর সব টাকা তোর অ্যাকাউন্ট-এ রেখে দেব।

কিন্তু অ্যাড্রেস প্রুফ? আইডেনটিটি প্রুফ? ওর তো ভোটার কার্ডই নেই। গত ভোটের আগে একবার ভোটার কার্ড করার চেষ্টা করেছিলেন রজতকান্তি, হয়নি। ওরা চেয়েছিল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, পাসপোর্ট, প্যান কার্ড এসব কত কিছু।

তোর রেশন কার্ড আছে না একটা?

জানি না।

জানি না মানে? ছিল তো নিশ্চয়ই।

ঠোঁট উলটে ফুলি মাথা নাড়ায়। মানে জানে না।

তার মানে ফুলির ভারতের নাগরিকত্বের কোনও প্রমাণ নেই।

ফুলি কবে থেকে এখানে? মামণি যখন মাধ্যমিক দিল। ফুলির মা বলেছিল, মেয়েটাকে আপনারা রাখুন। বারো বছর বয়স হ’ল ওর। ওর উপর কুনজর পড়েছে। সকালে চলে আসি, ঘরে একা থাকে মেয়ে। ওকে খাওয়া পরায় রেখে দিন। তার মানে বারো বছর হয়ে গেল এ বাড়িতে।

আগেকার সময় হলে চেষ্টা চরিত্র করে একটা রেশন কার্ড করে নেওয়া যেত। এখন শহুরে মধ্যবিত্তরা রেশন-এর চাল খায় না। রেশন দোকান থেকে গম নিয়ে চাকিতে দিয়ে আটা ভাঙানোর দিনও আর নেই। এখন সবাই আটাই কেনে। রেশন-এর দোকানে আজকাল মুদি দোকানের মতোই মশলা, সাবান, এমনকি প্রসাধন সামগ্রীও বিক্রি হয়। রজতদেরও রেশন কার্ড আছে। মাসে একবার গিয়ে যা হোক কিছু নিয়ে আসা হয়। রেশন কার্ড করাতে গেলে বলবে আগের কার্ডখানা নিয়ে আসুন, যদি বলা হয় আগে কার্ড ছিল না– তখন বলবে এত বছর বয়সেও কার্ড নেই? ঠিকানার প্রমাণ, বয়সের প্রমাণ, ভোটার কার্ড…। ফুলির তো কিচ্ছু নেই। এই যে চব্বিশটা বছর ধরে পৃথিবীতে রয়েছে, তার কোনও প্রমাণ নেই। ফুলিকে কেউ চিঠিও দেয় না।

দেশের বাড়িতে ফুলি ক্লাস ফাইভ অবধি পড়েছিল। এ বাড়িতে আসার পর চন্দ্রিমা মাঝেমধ্যে পড়াতে বসত। দোকানের নাম পড়তে পারে, মুদির হিসেব পড়তে পারে, টিভির সিরিয়ালগুলোর নাম পড়তেও অসুবিধে হয় না তার– এমনকী যুক্তাক্ষর দিয়ে লেখা কঠিন কঠিন নাম যেমন স্বয়ংসিদ্ধা, অগ্নিপরীক্ষা এসবও পড়তে পারে। ওকে কেউ চিঠি দিলে, ও পড়তে পারবে। উত্তরও দিতে পারবে। একদিন বলেছিল দিদিকে। দিদি মানে এ বাড়ির মেয়ে। রজত-চন্দ্রিমা ওকে মামণি ডাকে, ওর আসল নামটা খুব কঠিন, মন্দাক্রান্তা। মামণি তো আদরের ডাক। ফুলি তো সেটা বলতে পারে না, আবার মন্দাক্রান্তাকে ছোটো করে মন্দ দিদি বলা যায় নাকি? জেঠিমা-ই বলে দিয়েছে মিষ্টি দিদি ডাকতে। ফুলি একদিন বলেছিল ও মিষ্টি দিদি, আমাকে একটা চিঠি দেবে?

কী চিঠি?

এমনি চিঠি। আমার নামে আসবে বেশ…

কী লিখব?

যা খুশি…।

তার চে বরং তোকে একটা মেল আইডি বানিয়ে দিচ্ছি, চ্যাট করবি বেশ।

আসলে পাত্তাই দেয়নি।

ঝন্টুদাকে ও বলেছিল একটা চিঠি দেবেন আমাকে? এমনি চিঠি।

ঝন্টুদা দিয়েছিল।

রজতকান্তি বলেছিল ফুলি, তোর নামে আলাদা পাসবই বোধহয় হবে না, আমি তোর টাকাটা আমার নামেই রাখছি, তোকে নমিনি করে দিচ্ছি, আমার কিছু হয়ে গেলে তুই সেটা পাবি। আমার নামে হলেও ওটা তোরই টাকা। তোর মা বলেছিল খাওয়া-পরায় রাখতে। আমি কিন্তু তোকে মাইনেও দিচ্ছি। হিসেব করে দেখলাম তোর তিরিশ হাজার টাকার উপর পাওনা হয়ে গেছে। বলে রাখলাম এগুলো তোর টাকা। তুই এখন তিরিশ হাজার টাকার মালিক। এই টাকায় আমি হাত দেব না। তোর যা খুশি, যেভাবে ইচ্ছে খরচ করবি। তোর বিয়েতেও এই টাকা খরচ করব না ফুলি। তোর বিয়ের খরচ আমাদের। মামণির বিয়েটা মিটে যাক, তারপর তোর জন্য পাত্র দেখা শুরু করব। তোকে বিয়ে দিয়ে আমরা দুজন কোনও বৃদ্ধাশ্রমে চলে যাব।

মিষ্টি দিদির বিয়েটা ঠিক হয়ে গেছে। ঠিক হয়ে গেছে মানে দিনটা। বিয়েটা তো আগেই ঠিক ছিল। মিষ্টি দিদির বরকে তো ফুলি কবে থেকেই চেনে। পার্থদা। এ বাড়িতে আসে। মিষ্টিদির ঘরে বসে গল্প করে। তখন ওঘরে কেউ যায় না। ঘরের বাইরে থেকে জিজ্ঞাসা করে, এবার চা দিয়ে যাব? কখনও মিষ্টি দিদি নিজে এসে চা আর জলখাবার নিয়ে যায়। খুব বড়ো চাকরি করে পার্থদা। মিষ্টিদিও তো চাকরি করে। কম্পুটারি চাকরি। পরশু দিন বিয়ে। বাড়ি রং করা হয়েছে। ইলেকট্রিকের কাজ করা হয়েছে, বাড়িতে অনেক লাইট লাগানো হয়েছে। ছাদেও লাইটের ব্যবস্থা হয়েছে। বিয়েটা এবাড়িতে হবে না। বিয়েবাড়ি ঠিক করা হয়েছে। কাল থেকেই লোকজন আসবে। মামা-মামি আসবে। দু’জন কাকু আসবে। ওরা সবাই মিষ্টি দিদির মামা-মামি। মিষ্টি দিদির কাকা-কাকু। ফুলিরও। ফুলির কে আছে? কেউ নেই। মা মরে গেছে, ব্যস, হয়ে গেল। কেউ নেই। শুধু ঝন্টুদা আছে।

ঝন্টুদা এবাড়ির সব ইলেকট্রিক-এর কাজকর্ম করে। ফ্যান খটখট, টিউব লাইটে ভোঁ ভোঁ, গিজার খারাপ– সব ঝন্টুদা করে। ফোন করে দিলেই চলে আসে। ঝন্টুদাকে চা করে দেয় ফুলি। চায়ে চুমুক দিতে দিতে মিটিমিটি তাকায় ফুলির দিকে।

ঝন্টুদা প্রথম আদর করেছিল ছাদে। সরস্বতী পুজোর প্যান্ডেল করার সময়। পুজোর আগের দিন। বাড়িতে সরস্বতী পুজো হয়। ছাদে ছোটো করে প্যান্ডেল হয়। খিচুড়ি হয়। দিদিমণির বইপত্তর আর ল্যাপটপ না কি যেন বলে, সেটা রাখে। ওখানে ফুল চন্দন পড়ে। পাড়ার অনেকে আসে। আদরের সময় ফুলি বলেছিল– এমা, এখানে না, ঠাকুর দেখে ফেলছে। ঝুন্টদা বলেছিল ঠাকুরের এখন চোখ ঢাকা। কেউ ছিল না ছাদে। বাড়ির পাম্পের কাজ করতেও ছাদে যেতে হয়। চৌবাচ্চায় ওঠার মই ধরতে হয় ফুলিকে। পাম্পটা তো প্রায়ই খারাপ হয়। ঝন্টুদা বলে পাম্পটা কি ভালো বল, তোকে আর আমায় ছাদে এনে দেয়।

ঝন্টু ফুলির কাছ থেকে জেনে নিয়েছিল-এ বাড়ির কে কোথায় শোয়। দোতলায় তিনটে ঘর। একটা ঘরে মিষ্টি দিদি। একটা ঘরে জ্যাঠা-জেঠি আর একটা ঠাকুরঘর।

একতলায় রান্না খাওয়া। একটা ড্রইংরুম। কেন যে ড্রইংরুম বলে কে জানে। ওখানে কোনও ড্রইং হয় না। ওখানে গদিওলা চেয়ার আছে। একটা টিভিও আছে। আর একটা ঘরে ফুলি থাকে। ফুলির ভয় করে না। ওর নীচে থাকতেই ভালোলাগে। বারবার দরজা খোলা-বন্ধ করা ফুলিকেই তো করতে হয়।

ঝন্টুদা বলেছিল ফুলি, তুই দারুণ। খুব মিষ্টি। তোকে ছুঁলে আমার গায়ে ইলকট্রিক শট্ লাগে। তোর লাগে? ফুলি মাথা নীচু করে বলেছিল দুষ্টু কোথাকার। এটা কিন্তু ওর নয়, হাসিরাশি সিরিয়ালের হাসির ডায়লগ। ঝন্টুদা বলেছিল তোকে আমি একদিন অনেকটা পেতে চাই। অনেকক্ষণ ধরে।

ওমা! সেকি কথা। নানা… এটা কোনও সিরিয়ালের নয়, ফুলির নিজের।

ঝন্টুদা বলেছিল– না করিস না ফুলি। তোকে আমি স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নে আদর করি। আমার বোনটাকে বিয়ে দিয়ে তোকে আমি বিয়ে করে তোর সঙ্গে সংসার করব। তোর কেউ নেই, আমারও কেউ নেই। একদিন ফুলি, আমি রাতে তোর ঘরের জানালায় টোকা দেব…।

না– এমন কথা বলে না, বলে পালিয়ে গিয়েছিল ফুলি সেদিন।

তারপর ঝন্টুর ওই কথাগুলো তোলপাড় করেছে ফুলিকে। স্বপ্ন। স্বপ্নে স্ক্রু, নাটবল্টু আর তারের মালা জড়ানো ঝন্টুদা বলছে সংসার! সংসার।

পার্থদা আর মিষ্টি দিদি যে একসঙ্গে থেকেছে! পর্দা ফেলা, কখনও দরজা বন্ধ। তার বেলা?

এখন না হয় বিয়ে হবে। কিন্তু এর আগেও তো কতদিন…

রাস্তায় দেখা হতে ঝন্টুদা বলল, কিরে ফুলি। কতদিন দেখি না। তোদের বাড়ির কিছু খারাপও হচ্ছে না দেখছি। তোকে না দেখে আমার তো মেনসুইচ খারাপ হয়ে গেল। ফুলি, মাইরি বলছি, তোকে যেদিন ফার্স্ট দেখেছিলাম না, আমার ফিউজ উড়ে গিয়েছিল। প্লিজ মাইরি, একদিন ব্যবস্থা কর। আমি তোর ঘরে আজ রাতে টোকা দেব।

ফুলি বলেছিল– না-না, টোকা নয়, টোকা নয়, কেউ শুনে ফেলবে।

ঝন্টু বলেছিল– তুই তো বলেছিলি তোর জ্যাঠা-জেঠি দশটার সময় শুয়ে পড়ে। দিদি মনে কানে ছিপি গুঁজে কম্পুটারি করে। কে শুনবে?

ফুলি বলেছিল– না না, টোকা দেওয়া খুব খারাপ। শুনে ফেলবে।

ঝন্টু বলেছিল তাহলে সাইকেলের বেল বাজাব। টিরিং। রাস্তায় তো সাইকেল চলতেই পারে। আজ ঠিক রাত সাড়ে এগারোটায় টিরিং, কেমন!

রাত্রে টিরিং। ঝন্টুদার হাতে একটা সাইকেল বেল। খুব আস্তে দরজা খুলে গেল। ফুলির ঘরে ঝন্টু। ঝন্টু বলেছিল কোনও ভয় নেই ডার্লিং, সব ব্যবস্থা নিয়ে এসেছি।

ঝন্টুদা এক ঘণ্টা বাদে চলে গিয়েছিল। রাস্তার আলোয় তখন শ্যামাপোকা, কার্তিকের কুয়াশা। নিমগাছের পাতায় পাতায় – না যেও না… রজনীর তখনও বাকি।

এরকম টিরিং হয়ে গেছে আট দশ বার। প্রতিবারই ফুলি ঝন্টুর কানে ফিসফিস করে বলেছে আর নয় কেমন, বিয়ের পরে আবার।

একমাসের উপর কোনও টিরিং হয়নি। আজ হ’ল। হ’তে পারে এটা সত্যিসত্যি সাইকেলের টিরিং। কান খাড়া করে শুনল। চলমান সাইকেলের একটা আলাদা টিরিং ধবনি থাকে। রাত্রির অন্ধকারে আবার ছোট্ট একটা টিরিং।

দু’দিন পর বিয়ে। মেয়ে চলে যাবে। বড়িতে এখন এসব ঠিক নয়। তাছাড়া বাড়িতে এ সময়ে ঘুম কমে যায়। কাল সকালেও এসেছিল ঝন্টুদা। ছাদে লাইট লাগাতে। কোনও কথা হয়নি। কিচ্ছু বলেনি ঝন্টুদা। যাবার সময় শুধু বলে গেল ছাদের দরজাটা বড্ড পলকা জ্যাঠামশাই, ঠিক করিয়ে নেবেন। জ্যাঠামশাই বলেছিলেন মিস্তিরিগুলোর বড্ড ডাঁট বেড়েছে। বললে আসে না। একটা মিস্তিরি পাঠিয়ে দিও কাল। দেখছি, বলে চলে গেল। একটি বারের জন্যও ফুলির দিকে তাকাল না। অভিমান হয়েছিল। একমাস হয়ে গেল বলে ঝন্টুদার খুব কষ্ট হচ্ছে।

আস্তে আস্তে দরজার ছিটকিনিটা খুলল ফুলি।

ছিটকিনি খুলতেই একজন লোক ফুলির মুখ চেপে ধরল। অন্য একজন ফুলির দুটো হাত পিছনে নিয়ে বেঁধে দিল। মুখের উপর আঠালো কী একটা জিনিস চেপে দিল। তারপর একটা কাপড় দিয়ে মুখ বেঁধে দিল। একজন ফুলির মুখটা খামছে ধরল। গলাটাও। বুকের কাছেও হাত দিয়ে খামচে দিল। বলল চুপ করে এখানে দাঁড়িয়ে থাক।

ফুলি উপরে উঠে যাবার পায়ের শব্দ শুনল।

ফুলির তো পা বাঁধা ছিল না। ফুলি উপরে উঠতে গেল ওদের পেছন পেছন। একজন ওকে ধাক্বা দিয়ে ফেলে দিল। ফুলি দেখল ওরা চারজন। না। ওদের মধ্যে ঝন্টুদা ছিল না।

ফুলি উপরে গেল না। নীচে দাঁড়িয়ে রইল। একটু পরই দরজা ধাক্বানোর শব্দ শুনল। একটা প্রচন্ড আওয়াজ যেন কিছু ভেঙে পড়ল। জেঠিমার গলার আওয়াজ শুনল– কী? কী হয়েছে রে ফুলি?

ফুলি শুনল– একটা পুরুষ কণ্ঠ– কোনও আওয়াজ করবেন না। একদম চুপচাপ। চ্যাঁচামিচি করলে আপনার মেয়েকে রেপ করব সবাই মিলে। চাবিটা দিন।

পাঁচ মিনিটও নয়। ওরা চলে গেল। একজন বলে গেল– আমরা ছাদের পলকা দরজাটা ভেঙে ফেলেছি। পুলিশ এলে বলবি ছাদের দরজা ভেঙে ঢুকেছিলাম আমরা। তুই দরজা খুলেছিস বললে ফেঁসে যাবি। ওদের হাতে একটা লাল ব্যাগ আর একটা কালো ব্যাগ। আর কিচ্ছু নেই।

ওরা চারজন চলে গেল। ওদের মধ্যে ঝন্টুদা ছিল না।

ফুলি উপরে উঠল। ঘরে আলো জ্বলছে। আলমারির দরজা হাট করে খোলা। আলমারির ভিতরে লকারের খোপটাও খোলা। খাটের উপর বসে আছে জ্যাঠামশাই, মুখের উপর সাদা রঙের কী একটা আটকানো, মুখ থেকে অদ্ভুত কিছু আওয়াজ বের হচ্ছে। ফুলিও চিৎকার করছে, কোনও আওয়াজ পাচ্ছে না। জ্যাঠামশাইয়ের হাত পিছনে বাঁধা। জেঠিমাকে দেখতে পাচ্ছে না। বাথরুম থেকে দরজা ধাক্বা দেবার শব্দ। পাশের ঘর থেকেও দরজা ধাক্বানোর শব্দ। ফুলি দেখল দিদিমণির ঘর এবং বাথরুমের বাইরের ছিটকিনি বন্ধ। ফুলি ওর বাঁধা হাত দিয়ে পিছন ফিরে বাথরুমের দরজাটা খুলে দিতে পারে। জেঠিমা বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমেই বলল মামণি কোথায়, মামণির কিছু হয়নি তো? জেঠিমা দিদিমণির ঘর থেকে দরজা ধাক্বানোর শব্দ পায়। বাইরে থেকে লাগানো দরজাটার ছিটকিনি খুলে দেয়। দিদিমণিও বেরিয়ে আসে। ওর বাবার মুখের আঠা লাগানো সাদা জিনিস খুলে দেয়। জ্যাঠামশাই এতক্ষণ ধরে কিছু বলার চেষ্টা করছিল। ওটা খুলে দেবার পর শব্দহীন ফুলির মুখটাও খোলা হল। কান্না এল দলা দলা।

পিছনে বাঁধা হাতটা কাটা পাঁঠার মতো ছটফট করছে।

কী হয়েছিল বল?

ফুলিকে জিজ্ঞাসা করল মন্দাক্রান্তা।

আমি জানি না, আমি জানি না…। ও নিজের মুখটা ঢাকতে চায়, কিন্তু হাত বাঁধা।

পুলিশ বলল যে-মেয়েটা আপনাদের কাছে থাকে, ওর ভোটার কার্ড আছে?

রজতকান্তি মাথা নাড়ায়।

এনি অ্যাড্রেস প্রুফ?

মাথা নাড়ায় রজতকান্তি।

মেয়েটা কে তবে?

মেয়েটা ভালো। এর মা এখানে কাজ করত। মা মরা মেয়ে…

ফুলি শুনছে ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে।

পুলিশ বলছে– লকার থেকে গয়না তুলে এনেছেন এটা আর কে জানত?

আমি, আমার স্ত্রী আর মেয়ে।

ওই মেয়েটা?

ও কী করে জানবে?

যারা চুরি করেছে ওরা তো জানত। চিন্তা করে দেখুন কখনও মেয়েটাকে বলেছেন কিনা।

না। বলিনি।

ক’জন ছিল?

চারজন। নাকি আরও বেশি…

কীভাবে এল?

ছাদের দরজা ভেঙে।

দরজা ভাঙার শব্দ পেয়েছিলেন?

পেয়েছিলাম।

মেয়েটা কোথায় ছিল তখন?

মেয়েটা বাধা দেবার চেষ্টা করেছিল। ওর গলায় ঘাড়ে নখের আঁচড়। ভাগ্যিস আর কিছু করেনি।

আপনার মেয়েকে কিছু করেনি তো? গায়ে-টায়ে…

না-না-না, আমার মেয়ের গায়ে ওরা হাত দেয়নি। একদম হাত দেয়নি। আমার মেয়ে যে-ঘরে শোয় সেই ঘরের দরজাটা প্রথমেই ওরা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিয়েছিল। আমার মেয়ে আনটাচড, আমার মেয়ে আনটাচড।

মেয়েটাকে ডাকুন। পুলিশ অফিসার বলে।

ফুলির বুকের ভিতরে কীরকম বিচ্ছিরি টিরিং টিরিং টিরিং। ওর বুকের ভিতরের শিরাগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে। ছলাৎ ছলাৎ রক্ত ছিলিক দিচ্ছে প্রতিটি টিরিং, তার চেয়ে আমাকে রেপ করে মেরে ফেললেই তো পারত ঝন্টুদা। আমাকে বলতে হবে পৃথিবীতে কোনও টিরিং নেই। কোনও টিরিং হয়নি কখনও। কোনও টিরিং শুনিনি জীবনে। আমাকে দেখাতে হবে আমার গলার, আমার ঘাড়ের, বুকে লেগে থাকা নখের আঁচড়। বাধা দেওয়ার প্রমাণ। প্রমাণ রেখে গেছ, ঝন্টুদা কত দয়া তোমার। ভুল ভাবছি, ভুল। ঝন্টুদা ছিল না। উপরে কাঠের দরজাটাও ভেঙে দিয়ে গেছে। তোমরা তো উপর থেকেই এসেছিলে। দরজা ভেঙে। দরজাটা তো পলকাই ছিল। ছিটকিনিও পুরোনো। ঝন্টুদা, তুমি তো আগেই বলে দিয়েছিলে– দরজাটা ভালো নেই।

ফুলি… কোথায় রে তুই… পুলিশ সাহেব ডাকছেন। যা দেখেছিস বলবি…।

পুলিশের গলা শোনা যায়– এখন এই মেয়েটা নয়। আপনার মেয়েকে ডাকুন। এক এক করে সবাইকে জিজ্ঞাসা করব। আপনারা বাইরে যান। একদম বাইরে। যখন বেল বাজাব এক জন করে আসবেন, দরজা বন্ধ থাকবে।

বন্ধ দরজার এপারে খাবার টেবিলে বসে আছে ওরা। ড্রইংরুমে পুলিশের দুজন লোক। দিদিমণি ভিতরে গেল। দরজা বন্ধ। বাইরের টেবিলে এক বৃদ্ধ, এক বৃদ্ধা এবং মেয়েটা।

ফুলি দেখল ওরা দুজন ফুলির দিকে তাকিয়ে আছে।

ফুলি বলল কী হবে জ্যেঠু?

রজতকান্তি বলল, কী আর হবে? আরও কত খারাপ হতে পারত। ভগবানের দয়ায় আমাদের মেয়ে দুটো বেঁচে গেছে। গয়না না হয় গেছে। গয়না ছাড়াই বিয়ে দেব…।

ফুলি বলল আপনি যে বলেছিলেন, আমার টাকা আছে আপনার কাছে, ওই টাকা দিয়ে মিষ্টি দিদির গয়না কিনে নিন।

ওতে আর কী গয়না হবে? সেসব তোকে ভাবতে হবে না।

জেঠিমা বলল– পুলিশের ঝামেলা এখন না করলেই হতো। এখনই তো লোকজন আসবে।

তারপর আর কোনও কথা নেই ঘরে।

এতক্ষণ কী জিজ্ঞাসা করছে পুলিশ? রজতকান্তি স্বগতোক্তি করে। তারপর আবার নিশ্চুপ সবাই। চেনালোকই এর পিছনে আছে। যারা সব জানে। ছাদের দরজাটা যে পলকা সেটাও তো জানে। কে হতে পারে ফুলি? ঝন্টু?

জোরে মাথা নাড়ায় ফুলি।

ঝন্টুদা, তোমার চিঠিটা সকালবেলায় বাথরুমে নিয়ে গিয়েছিলাম। যেসব ভালোবাসার কথা লিখেছিলে, সব কুচি কুচি করে ছিঁড়েছি, তারপর পায়খানার প্যানে ফেলে দিয়ে জল ঢেলে দিয়েছি। আমি তো জানি, তুমি ছাড়া আর কেউ টিরিং শব্দ জানে না। তুমি আর আমি। সেই টিরিং তুমি অন্যদের বলেছ। আর আমি, এই শব্দের গোলোক আমি কোথাও ভাঙবনা। এই কৌটোবন্দি শব্দের ঢাকনা কোথাও খুলব না। পুলিশ যদি মারে, তবুও না। যদি জেলে ভরে দেয়, তবুও না।

তুমি কি সত্যি সত্যি তোমার বোনের বিয়ে দেবে? বিয়েতে টাকার দরকার। জানি তো। ওর বিয়ে হয়ে গেলে যদি তুমি আমাকে চাও? আমার সঙ্গে সংসার চাও? তাহলে কী করব? কী বলব? তোমায় আমি?

দিদিমণি চলে এল।

পুলিশের কঠিন স্বর– এবার কাজের মেয়েটাকে পাঠান।

ওঘর থেকে শব্দ আসছে টিরিং… টিরিং… টিরিং…।

 

প্রতীক্ষার দিন

অন্ধকারের মধ্যে দ্রুত গতিতে পিছিয়ে যাচ্ছে কিছু আলো। গ্রাম অথবা শহরের। এছাড়া দেখার মতো কিছু নেই। ট্রেনটার ডিপারচারই ছিল হাওড়া থেকে রাত আটটায়। কিছু দেখা যাবে না, জেনেও জানলার পাশের সিটটা দখল নিয়েছে ইমন। বাকি তিনবন্ধু ওকে আটকায়নি। কোনও এক আশ্চর্য কারণে ওরা ইমনকে বাড়তি অ্যাডভান্টেজটুকু দেয়। অন্তত হাওয়া খাওয়ার লোভে ওদের কেউ একজন ইমনকে জানলার সিটে বসতে বাধা দিতে পারত, দেওয়ার কথা ভাবেইনি। চারজনের মধ্যে ইমনের অধিকার যেন সবচেয়ে আগে। যদিও শুধু হাওয়ার কারণে ইমন এখানে বসেনি, হাওয়ার চরিত্র বুঝতে বসেছে। সে জানত এই টুরে হাওয়ার ধরনটা আলাদা হবে।

তাই হয়েছে, অন্য টুরের তুলনায় হাওয়ার ওজন প্রায় অর্ধেক। বাইরের অন্ধকারটাও তত নিরেট নয়, গাছপালা, পুকুর ঘাট, খেত-জমি, কুঁড়েঘর, পাকাবাড়ি সবই দিব্যি আন্দাজ করা যাচ্ছে। এমনকী মনোনিবেশ একটু গভীর করলেই কুঁড়েঘরে দুলে দুলে পড়া মুখস্থ করা কিশোরীটিকেও যেন পাচ্ছে দেখতে। ফ্ল্যাটবাড়ির ইন্টারনেটে বুঁদ তরুণও নজর এড়াতে পারছে না। এসব দেখার চোখ বা আগ্রহ কোনওটাই নেই ইমনের তিনবন্ধুর, পার্থ, জয়দীপ, কৌশিকের। না থাকাটা অপরাধের নয় মোটেই। ওদেরও যে যার মতো নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। তবে চারবন্ধুর বন্ধুত্ব কিন্তু খুব নিবিড়।

কলেজে এই চারজন একটা কোর গ্রুপ। এরা কেউই একে অপরের স্কুলের বন্ধু নয়। আলাপ হয়েছে কলেজে এসে। সম্পর্ক গাঢ় হয়েছে গত তিনবছর ধরে। ঘটনাচক্রে ইমনের স্কুলের কোনও বন্ধুই এই কমার্সখ্যাত কলেজটায় ভর্তি হয়নি। স্কুলেও ইমনদের একটা কোর গ্রুপ ছিল, সেটা কলেজের থেকে অনেক বড়ো। সেখানেও ইমনকে অজানা কারণে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো। উদাহরণ হিসেবে যেমন বলা যায়, ইন্টার-স্কুল ফুটবল ম্যাচে কোনও বন্ধু চার পাঁচজন প্লেয়ারকে কাটিয়ে গোল করার সময় ইমনের উদ্দেশে বলটা বাড়িয়ে দিত। অন্যদের তুলনায় দুর্বল প্লেয়ার হওয়া সত্ত্বেও ম্যাচের পর ম্যাচ গোল পেয়ে টিমে টিঁকে যেত ইমন। এই ফেভার করাটা সোজাসাপটা ভালোবাসা নয়, ইমনকে সাফল্য এনে দিতে পেরে খুশি হয় বন্ধুরা।

স্কুল পেরিয়ে কলেজ শেষেও এই ধারা অব্যাহত রয়ে গেছে। অথচ বন্ধুরা গেছে পালটে। এমন নয় যে ইমনের মধ্যে লিডারশিপ কোয়ালিটি আছে, আবার ইমনকে দেখে মায়া বা করুণা জাগারও কোনও সম্ভাবনা নেই। সেরকম ঢিলে ব্যক্তিত্ব তার নয়। তবুও বন্ধুরা কেন যে এই ট্রিটমেন্টটা করে, আজও আবিষ্কার করতে পারল না। এর ফলস্বরূপ বন্ধুত্ব যতই নিবিড় হোক না কেন, বন্ধুদের সঙ্গে নির্দিষ্ট একটা দূরত্ব রয়েই যায় ইমনের। যেমন ট্রেনের জানলার পাশে বসে সে উপলব্ধি করছে, এ টুরের বাতাস ওজনে হালকা, অন্ধকার তত নিরেট নয়, এটা তিন বন্ধুকে বলতে পারবে না। বললেও বুঝবে না তারা। না বুঝে ইমনের কথায় সায় দিয়ে দেবে। আঁতেল বলে ইমনের লেগ পুলও করবে না।

এবারের বেড়াতে যাওয়াতে তিন বন্ধুর আচরণেও অনেক বদল দেখা দিয়েছে। সেটা আদৌ তারা টের পাচ্ছে কিনা, কে জানে! একটু বেশিই হুল্লোড় করছে। সমগ্র এ বদলের মূল উৎস হচ্ছে, চারজন বন্ধু জীবনে প্রথমবার কোনও গার্জেন ছাড়া বেড়াতে যাচ্ছে বেশ কয়েক দিনের জন্য। পুরী যাচ্ছে। বাড়িতে বলেই রেখেছিল, ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষার পর আমরা চারজন কোথাও একটা বেড়াতে যাব। ‘না’ করতে পারবে না। এদের বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠতা চার বাড়িতেই অজানা নয়। পরস্পরের গার্জেনদের মধ্যেও আলাপ আছে। সেই বিশ্বস্ততা থেকে ছাড়া হয়েছে চার মূর্তিকে। জয়দীপ, পার্থর বাবা এসেছিল সি-অফ করতে। দুজনেই নিজের নিজের বাবাকে ফেরত পাঠাতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। বলছিল, আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে! ট্রেন ছাড়তে দেরি আছে। ছাড়লে ফোন করে দেব। আসলে ‘বাবা ছাড়তে এসেছে’ ব্যাপারটা ট্রেনের অন্য প্যাসেঞ্জারদের কাছে লুকোতে চাইছিল। নিজেদের অ্যাডাল্টহুড খাটো হয়ে যাচ্ছিল যে এখন অবশ্য বড়ো হয়ে যাওয়াটা সদম্ভে প্রকাশ করছে।

ইমন কৌশিককে জিজ্ঞেস করেছিল, তোর বাড়ি থেকে কেউ এল না! নাকি আড়াল থেকে লক্ষ্য রাখছে?

–  না। যখন মানা করে দিয়েছি আসতে, কেউ আসবে না। বেশ কনফিডেন্স নিয়ে বলেছিল কৌশিক।

ইমন বলে, তোর কথার তার মানে একটা ওয়েট আছে বাড়িতে।

– তা আছে তেমনি আমিও বাড়ির কথা সব মেনে চলি। এই টুরে যেমন যা যা করতে আমায় বারণ করা হয়েছে কোনওটাই করব না।

কৌশিকের বলা শেষ হতেই ইমন জানতে চেয়েছিল, কী কী বারণ আছে?

– মদ খাওয়া আর সমুদ্রে চান করা। মাকে প্রণাম করে যখন বেরিয়ে আসছি, এই দুটো কথা বলে দিয়েছে।

ইমন অবাক গলায় বলেছিল, মদ না হয় নাই খেলি। সমুদ্রে যদি চান না করিস, তাহলে পুরী আসার মজাটাই তো পাবি না।

– কিছু করার নেইরে ভাই। চোখের আড়ালে থাকছি, তবু মা যখন আমায় বিশ্বাস করছে, তার মর্যাদা আমাকে দিতেই হবে। শুকনো মুখে বলেছিল কৌশিক। ওর মাতৃভক্তি যে এতটা গভীর, জানত না ইমন, দেখা যাক গোটা টুরে সেটা কতটা অটুট থাকে।

ইমনের মা-বাবাকে নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। রাতে খাওয়ার টেবিলে কথাটা যখন পেড়েছিল ইমন, মা সামান্য আঁতকে বলে উঠেছিল, তোরা একা একা যাবি! সঙ্গে কোনও বড়ো কেউ থাকবে না?

ইমনের হয়ে উত্তর দিয়েছিল বাবা। খেতে খেতে বলেছিল, ‘তোরা’ আবার ‘একা একা’ কী করে হল! যথেষ্ট বড়ো হয়েছে ওরা। তোমার ভাগ্য ভালো যে, ছেলে বাড়ির খাবার খেয়ে কলেজ করেছে। আজকাল তো বেশির ভাগ ছেলেমেয়ে স্কুল থেকে বেরিয়ে হিল্লিদিল্লির কলেজে চলে যাচ্ছে পড়তে।

মা আর কিছু বলতে পারেনি। আকাঙক্ষাও পুরোপুরি মোছেনি মুখ থেকে। এরপর বাবা ইমনের উদ্দেশ্যে বলেছিল, কলেজের পর থেকে চাকরিতে ঢোকার আগে পর্যন্ত বেড়াতে যাওয়াগুলো খুব ইন্টারেস্টিং হয়। জীবনে ভুলতে পারবি না এর স্বাদ। আমিও ভুলিনি। কোনও খারাপ অভিজ্ঞতা, বাজে স্মৃতি, বদ অভ্যাস নিয়ে ফিরবি না। যা সংগ্রহ করে আনবি, সব যেন ভালো হয়। সকলের জন্য গিফ্ট কিনবি, আলাদা করে টাকা দিয়ে দেব।

 

– নুলিয়া নিয়ে যেন সমুদ্রে চান করে, সেটা বলে দাও। বলেছিল মা।

 

বাবা বলল, ওর বয়সে নুলিয়ার হাত ধরে চান করা প্রেস্টিজের ব্যাপার। নেবে না জানি। তবে একটা কথা বলে দিই, সামনের দুসারি সাহসী লোকের পরে স্নান করবি। জানবি, সমুদ্রস্নানে সাহস দেখানোটা বোকামি, একই সঙ্গে সাহসের অপচয়ও বটে। ওই এনার্জিটা সমাজের কাজে খরচ করা উচিত।

 

বাবার কথাবার্তার ধরন কলেজের প্রফেসারদের মতো। আসলে কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানির অ্যাকাউন্টস ক্লার্ক। মা মেয়েদের স্কুলের হেডমিস্ট্রেস। বাবার কথাগুলোর মধ্যে আপাত ভাবে প্রশ্রয় থাকলেও, ছোট্ট একটা নিষেধও ছিল, ‘বদ অভ্যাস নিয়ে ফিরবি না’ মানে হার্ড ড্রিংক-এর কথা বলেছে বাবা। ইমন যে মাঝে মাঝে সিগারেট খায়, টের পেয়েছে আগে। দেয়ালকে শোনানোর মতো করে একদিন বলল, স্ট্রেসের কারণে মানুষ নেশার কবলে পড়ে। একসময় স্ট্রেস ঠিক মরে যায়। নেশা মানুষকে ছেড়ে যেতে চায় না। যেমন আমার ক্ষেত্রে যায়নি। পড়াশোনার চাপে কলেজ লাইফে ধরেছিলাম। ভালো কোনও এফেক্ট পড়েনি রেজাল্টে।

বাবা যতই বলুক, এই টুরে মদ খাবেই ইমন। কৌশিকের মতো অত সতী সে নয়, মাকে কথা দিয়েছে সমুদ্রে চান করবে না তো, করবেই না। ভাগ্যিস ওর মা মদ খেতে বারণ করেনি। ইতিমধ্যেই চারবন্ধু একসঙ্গে কয়েকবার মদ খেয়েছে। দারুণ মস্তি হয়। তবে রোজ খাওয়ার ইচ্ছে জাগেনি। পার্থ, জয়দীপ অবশ্য সিগারেটে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। স্মোকিংটা এই টুরে রেস্ট্রিক্ট করে চলবে ইমন, কোনও বদঅভ্যাস নিয়ে বাড়ি ফিরবে না। বাবার সিগারেট খাওয়া নিয়ে মা দিনরাত খিটখিট করে। অপরাধবোধের চিলতে সংকোচ লেগে থাকে বাবার মুখে।

– নাও, শান্ত ছেলে, চা-টা ধরো।

উলটোদিকের বার্থে বসে থাকা বউদির ডাকে চিন্তা ছেঁড়ে ইমনের। কাগজের কাপ বাড়িয়ে ধরেছে ট্রেনে সদ্য আলাপ হওয়া বউদি। লাজুক হেসে কাপটা নেয় ইমন। চাওয়ালাকে দাম মেটাচ্ছে বউদির হাজব্যান্ড। লোকটার মধ্যে বউ-গদগদ ভাব। উনি রীতিমতো বাচাল। এই কুপের ছটা বার্থে বউদিরা দুজন, বাকি চারটেতে ইমনরা। ছাব্বিশ, সাতাশের সুশ্রী বউদিকে নিজেদের কুপে দেখে খুবই উৎসাহিত হয়েছিল ইমনের তিনবন্ধু। ভেবেছিল, জমিয়ে বউদিবাজি করবে। সেই স্কোপ ওরা পায়নি। বউদি আগ বাড়িয়ে আলাপ করে নিল সবার সঙ্গে। তারপর থেকে চুটিয়ে চ্যাংড়ামি করে যাচ্ছে। তবে শ্লীলতার মাত্রা রেখে। ইমনদের গ্রুপও ওপেনলি

নোংরা ঠাট্টাইয়ার্কি করতে পছন্দ করে না। এই কম্পার্টমেন্টে আরও একটি আকর্ষণীয় দ্রষ্টব্য আবিস্কার করেছে ইমনের তিন সাগরেদ, একদম লাস্ট কুপে নাকি দারুণ এক সুন্দরী ট্র্যাভেল করছে তার ফ্যামিলির সঙ্গে। পর্যায়ক্রমে তিনবন্ধু মেয়েটাকে দেখে আসছে, চেষ্টা করছে নজর কাড়ার। এখনও পর্যন্ত পাত্তা পায়নি। এখন যেমন কৌশিক এই কুপে নেই। মেয়েটার কুপের কাছে গেছে। এটা নিয়ে তিনবার ট্রাই মারতে গেল। কে বলবে কৌশিকের স্টেডি গার্লফ্রেন্ড আছে! সুছন্দা, ওর পাড়াতেই থাকে। ছোটোবেলার প্রেম। জানলার পাশে বসে বন্ধুদের সমস্ত গতিবিধি টের পাচ্ছে ইমন, মেয়েটাকে দেখতে যাওয়ার কৌতূহল হয়নি। সুন্দর মেয়ে দেখার আগ্রহ ইমনেরও আছে, এই মুহূর্তে তার চেয়েও বেশি উপভোগ করছে জানলার পাশে বসে প্রথম স্বাধীনভাবে বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ।

চা শেষ করে কাপ জানলার বাইরে ফেলে ইমন। ফের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকে। কৌশিক ফিরে এসেছে, এমন ভাবে হাঁপাচ্ছে, যেন একশো মিটার দৌড়ে এল। বলছে, নাঃ, কোনও চান্স নেই। হেভি ঘ্যাম। প্রথমবার তো তাকায়নি। এখন এমন ভাবে দেখছে, আমি বুঝি জেল পালানো আসামি। গতকালই ছবি বেরিয়েছে কাগজে।

বাকিরা তো সবাই হাসছেই, ইমনও হেসে ফেলে। কৌশিক এসে বসে তার পাশে, বউদি সান্ত্বনা দেওয়ার মতো করে বলে, দেখতে ভালো মেয়েরা ঘ্যাম একটু নিয়েই থাকে। এর জন্য ধৈর্য দেখাতে হয়।

দাদা বলে ওঠে, আরে, আমারও কি টাইম কম লেগেছে তোমাদের বউদিকে পটাতে! পাক্বা একবছর পিছন পিছন ঘুরেছি। তবে গিয়ে…

ইমন ভেবেছিল, বউদি বুঝি লজ্জা পাবে এই কথায়। তার কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। কমপ্লিমেন্টটা নির্দ্বিধায় গিলে নিয়ে জয়দীপকে বলল, তোমাদের শান্ত বন্ধুটি তো একবারও মেয়েটাকে দেখতে গেল না। ওকে পাঠাও।

জয়দীপ ইমনের দিকে তাকিয়ে নিয়ে বউদিকে বলল, ও ভীষণ মুডি। জোর করে কিছু করানো যাবে না। যদি ইচ্ছে হয় নিজেই যাবে।

– নাকি রিফিউজ্যালের ভয়। কথাটা বলে বাঁকা হাসি সমেত ইমনের মুখের ওপর চোখ রাখল বউদি।

উত্তর দিল পার্থ। বলল, বার খাইয়ে লাভ নেই। এসব ওর গায়ে লাগে না। ও চিজই আলাদা।

জয়দীপ গা ঝাড়া দিয়ে সিট থেকে উঠল। বলল, দেখি, আর একবার ট্রাই মারি। এত কীসের অহংকার রে বাবা!

পার্থ আর দাদা সমস্বরে বলে উঠল, হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার। একেবারে ফিট করে ফিরতে হবে।

কুপ ছেড়ে বেরিয়ে গেল জয়দীপ। ওরও বোধহয় তিনবার হল। ইমন কিন্তু একটু অবাকই হচ্ছে। জয়দীপ তাদের মধ্যে সবচেয়ে ম্যানলি দেখতে। ছ’ফুটের ওপর হাইট। নিয়মিত জিমে যায়। চারবন্ধু হেঁটে যায় রাস্তায়, মেয়েরা জয়দীপের দিকে তাকায় প্রথমে। তবে জয় কথাবার্তায় তেমন চৌকশ নয়। কিন্তু মেয়েটা যে তাকাচ্ছেই না, কথা তো অনেক পরের ব্যাপার। মেয়েটাকে কি একবার দেখে আসবে ইমন? মনে হচ্ছে একটু অন্যরকম মেয়ে। একই সঙ্গে ভীষণ আলস্য লাগছে দেখতে যেতে। কী হবে দেখে? তিনটে ছেলেকে পাত্তা না দিয়ে মেয়েটা যে বিরাট কিছু করে ফেলেছে, তা তো নয়। এত গুরুত্ব দেওয়ার কোনও মানে হয় না।

একটু আগে ট্রেনটা বেশ স্লো চলছিল। ফের স্পিড নিয়েছে। আবার ছিটকে ছিটকে সরে যাচ্ছে গ্রাম, শহরের আলো। মেয়েদের ব্যাপারে ইমনের আলস্যটা বরাবরের। এই কারণেই দু’চারটে প্রেম জমে ওঠার আগেই কেটে গেছে। আসলে চেতনায় নাড়া দেওয়ার মতো সর্বক্ষণ আকর্ষণ জাগিয়ে রাখার মতো মেয়ের দেখা পায়নি সে।

– এই যে হ্যালো! কার কথা ভাবছ এত মন দিয়ে?

আবার বউদির ডাক। শান্তিতে চিন্তা-ভাবনা করতে দেবে না। ঘাড় ফেরায় ইমন। বলতে ইচ্ছে করছে, ক্যাটরিনা কইফের কথা ভাবছি। আপনার জায়গায় সে বসে থাকলে ভালোলাগত।

ইংরেজি, হিন্দি দুটোই ফ্লুয়েন্টলি বলতে পারি না। বেশি বকতে হতো না। কথাগুলো না বলে ইমন আপন-হাসি হাসে। বউদির ভ্রূদুটো কাছাকাছি চলে এসেছে। বলে, ওরকমভাবে হাসছ যে বড়ো! কী বোঝাতে চাইছ, কেউ নেই?

– ওর কাছে অনেক আসে। টেঁকে না। ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। বলল পার্থ।

– কে ছাড়ে? ঠোঁটের কোলে হাসি সমেত জানতে চাইল পলা বউদি। নাম-ঠিকানা আদানপ্রদান হয়ে গেছে অনেক আগে।

নির্বিকার ভঙ্গিতে ইমন উত্তর দিল, মেয়েরা। মাথা নাড়িয়ে প্রতিবাদের ঢঙে বউদি বলতে লাগল, হতেই পারে না। তোমার মতো লাভার বয় মার্কা দেখতে ছেলেদের ছেড়ে যেতেই চাইবে না মেয়েরা। ভালো চাকরিবাকরি যদি না পাও, তা হলে অবশ্য আলাদা কথা। এব্যাপারে বেশির ভাগ মেয়েই ভীষণ প্র্যাকটিকাল।

– ‘লাভার বয় মার্কা দেখতে’ ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না! বলল ইমন।

পলা বউদি বলে, মানে, ‘প্রেমিক প্রেমিক’ দেখতে। যাদের সঙ্গে হাঁটলে, সিনেমায় গেলে অন্য মেয়েরা হিংসের চোখে দেখবে।

এবারও ব্যাপারটা ঠিক ক্লিয়ার হল না ইমনের কাছে। বউদি যেন তাকে নতুন

রং করা ম্যাটাডোরের সঙ্গে তুলনা করছে। যে-গাড়ির পিছনে লেখা আছে, দেখবি আর জ্বলবি লুচির মতো ফুলবি।

ফিরে এল জয়দীপ। চেহারায় হতাশা। দু’বাংক-এ দু’হাত রেখে, ঘাড় ঝুলিয়ে শ্বাস ছেড়ে বলল, হল না। করিডোরে অনেক ঘুরঘুর করলাম, মাঝে মাঝে তাকিয়ে রইলাম ঠায়, একবারই তাকাল এমন বিরক্তির চোখে, আমার শার্টে যেন নর্দমার কাদা লেগে আছে।

কৌশিক জয়দীপের টি-শার্ট ধরে টেনে পাশে বসাতে বসাতে বলল, জানে দে ইয়ার, মেয়েটার বোধহয় কোনও প্রবলেম আছে।

– কী প্রবলেম? অবাক গলায় জিজ্ঞেস করে রঞ্জনদা।

কৌশিক বলল, কত কিছু হতে পারে। মেয়েটা হয়তো লেসবি।

‘লেসবি’ শব্দটায় সিঁটিয়ে গেল মন। পলা বউদির সামনে এই প্রথম ‘নীল’ মার্কা কথা বলে ফেলল তারা।

বউদির কোনও হেলদোল দেখা গেল না। রীতিমতো তর্ক জুড়ে দিল। বলতে লাগল, মেয়েটা যেহেতু তোমাদের পাত্তা দেয়নি অমনি সমকামী হয়ে গেল! নিজেদের ফেলিওর মানতে পারছ না।

হতাশ জয়দীপ ইমনের দিকে তাকিয়ে মিনতির সুরে বলল, বস্, তুই একবার যা। আমাদের মানটা রাখ।

– কোনও ইন্টারেস্ট নেই আমার বলে ইমন মুখ ফেরায় চলন্ত ট্রেনের জানলার বাইরে। অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ফের বলতে থাকে, এ অপমানটা তোদের প্রাপ্য। মেয়ে দেখলেই খালি ছোঁকছোঁকানি। অথচ তোদের তিনজনের মধ্যে দু’জনের গার্ল ফ্রেন্ড আছে। তাদের প্রতি কমিটেড তোরা।

জয়দীপ আর রা কাড়ে না। শ্রেয়ার সঙ্গে ওর পাঁচবছর ধরে প্রেম। প্রায় রোজই দেখা করে। শ্রেয়ার স্কুল ছুটির সময় দাঁড়িয়ে থাকে চৌমাথায়। দু’দিন যদি না দাঁড়ায়, শ্রেয়া ফোন না করে সোজা চলে আসে কলেজে। সারপ্রাইজ ভিজিট, নিজেদের রিলেশনটা জয়দীপের কলেজ বান্ধবীদের কাছে এস্ট্যাবলিশ করে দিয়ে যায়।

– প্রেম করি বলে কি অন্য মেয়ে দেখব না? ওই মেয়েটারও বয়ফ্রেন্ড থাকতে পারে। তাতে আমাদের দিকে তাকালে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে। এটুকু ঝাড়ি সকলেই মেরে থাকে। বলল কৌশিক। সমর্থনে পলা বউদি বলে ওঠে, এটা একেবারে ঠিক বলেছে কৌশিক। তোমাদের রঞ্জনদাও এ ব্যাপারে কিছু কম যায় না।

বলার পর নিজের বরের দিকে কপট শাসনের দৃষ্টিতে তাকাল বউদি। চোখ নামিয়ে লজ্জা পাওয়া হাসি হাসছে রঞ্জনদা।

পার্থ বলে ওঠে, এই ইমন, আমার তো কোনও প্রেম নেই। তুই আমার হয়ে যা না।

ইমন বিস্ময়ের দৃষ্টি নিয়ে পার্থর দিকে তাকায়। বলে তাতে তোর কী সুবিধে হবে?

কথাটা ভেবে বলেনি পার্থ, ফলে চুপ করে যায়। ওর হয়ে পলা বউদি বলতে থাকে, আসলে তোমরা হলে একটা ইউনিট। তোমাদের কারুর জিত হলে সকলের জয়।

– আমি ঠিক এই কথাটাই বলতে চাইছিলাম। বলার পর পার্থ বলে। যা না ইমন। তুই পারবি। একটু আগে বউদি ঠিকই বলছিল, তুই ‘লাভার বয়’ মার্কা আছিস। আমরা দেখেছি মেয়েরা সবসময়ই দামি চকোলেট দেখার মতো তোর দিকে একবার আড়েঠাড়ে দেখে নেয়। তুই এমন বেভুল হয়ে থাকিস, মেয়েরা ভাবে তোর হেভি পার্সোনালিটি। ঘাঁটাতে ভয় পায় তোকে।

বার খায় না জেনেও পার্থ কথাগুলো কেন যে বলছে! ইমন ফের মুখ ঘুরিয়ে নেয় জানলার বাইরে। এখন শুধু ট্রেনের ঘটা ঘং, ঘটা ঘং শব্দ। দুপাশে বোধহয় ধু ধু প্রান্তর, আলোটালো কিছু দেখা যাচেচ্ছ না।

কুপের সবাই খানিকক্ষণ চুপ করে ছিল। কৌশিক শুরু করল কথা। বলল, আমার কেন জানি মনে হচ্ছে মেয়েটা খোঁড়া। বহুদিন আগে একটা গল্পে পড়েছিলাম, অনুবাদ না

বাংলার কোনও লেখকের মনে পড়ছে না। একটা ছেলে জানলায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা মেয়ের প্রেমে পড়ল। রোজ দেখত তাকে। ঘটনাচক্রে একদিন তাকে দেখল রাস্তায়। মেয়েটার একটা পা নেই। প্রচন্ড মানসিক ধাক্বা খেয়েছিল প্রেমিক। প্রেমের শেষ পরিণতি কী হয়েছিল এখন আর মনে নেই।

কৌশিক থামার পর কেউ কিছু বলল না। ট্রেনের স্পিড বুঝি একটু কমল। হুইসেল দিচ্ছে। এক্সপ্রেস ট্রেন এমনিতে মিতভাষী, হুইসেল টুইসেল বড়ো একটা দেয় না। অন্ধকারে ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে কাউকে যেন ডাকছে ট্রেনটা।

নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে পড়ে ইমন। বলে, যাই, দেখে আসি। কার জন্য তোরা এত লাফাচ্ছিস।

ইমনের ডিসিশনে তিনবন্ধু এতটাই চমকেছে, একজন বাক্যহারা হলেও, দু’জন একসঙ্গে সবিস্ময়ে বলে ওঠে, সত্যিই যাবি!

করিডোরে পা দিয়ে লাস্ট কুপের দিকে তাকাতেই মেজাজ খিঁচড়ে যায় ইমনের। পরিস্থিতি মোটেই অনুকূল নয়। টিটি চেক করছে টিকিট। চেকারের গায়ে সেঁটে আছে দুটো প্যাসেঞ্জার। এরা নিশ্চয়ই আরএসি অথবা ওয়েটিং লিস্ট। বার্থ কনফার্ম করতে চাইছে। টিটি লাস্ট কুপের টিকিট চেক করতে ব্যস্ত। কোনও একটা ব্যাপারে টিটির সঙ্গে লাস্ট কুপের বচসা চলছে। ইমন পায়ে পায়ে পৌঁছে যায় কুপটার সামনে। প্রথমেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে মেয়েটাকে, সবে হয়তো মাধ্যমিক দিয়েছে। বাস্তবিকই পরীক্ষাটা শেষ হয়েছে দু’দিন আগে। তবে সৌন্দর্যকে যেন ডমিনেট করছে ওর আভিজাত্য। খাড়াই নাক, চওড়া কপাল, পাতলা ঠোঁট, না ফোলানো সিল্কি কালো লম্বা চুল, গায়ের রং গোলাপি ফরসা। মেয়েটার এই মুহূর্তের মুখের অভিব্যক্তি চেহারার সঙ্গে মানানসই নয়। কিছুটা বিরক্ত আর হেল্পলেস ভাব। ইমনের উপস্থিতিটাও সে এখনও লক্ষ্য করেনি। কারণ, তার সমস্ত মনোযোগ টিটির ওপর। ইমনও বুঝে নিয়েছে টিকিট চেকার এখন যে-ক্যাচালটা করছে মেয়েটার ফ্যামিলির সঙ্গে, স্রেফ পয়সা খাওয়ার ধান্দা।

মেয়েটার বাবার সঙ্গে চেকারের তর্ক চলছে, ভদ্রলোক নিশ্চয়ই ওর বাবা, মুখের অনেক মিল। কেসটা হচ্ছে এই, মেয়েটার ফ্যামিলির দু’জন সিনিয়র সিটিজেন, একজন মহিলা অন্যজন পুরুষ। খুব বুড়ো না হলেও, দু’জনেই ষাট ক্রস করেছেন, এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ থাকার কথা নয়। টিকিটের দামে ছাড় পেয়েছেন তাঁরা। নিয়ম অনুযায়ী টিটি ওই দু’জনের বয়সের প্রমাণপত্র দেখতে চাইছে। সেরকম কোনও আইকার্ড তাঁদের কাছে নেই। নিয়মটা তাঁরাও জানেন, বাড়ি থেকে বেরোনোর শেষ মুহূর্তে বার করে রাখা ভোটার কার্ডটা লাগেজে রাখতে ভুলে গেছেন। এ সমস্ত কিছুই কনফেস করা হয়েছে টিটিকে। কোনও কথা শুনবে না টিটি। বিশাল অঙ্কের ফাইন আর নানান নিয়মকানুন শোনাচ্ছে। টিটির গায়ে সেঁটে থাকা বার্থ কনফার্ম না হওয়া দুই প্যাসেঞ্জার নিজেদের সমস্যার কথা তুলতেই পারছে না এই তর্কবিতর্কের মাঝে।

ঝামেলাটা দেখতে আরও দু’চারজন প্যাসেঞ্জার ইমনের পাশে, ঘাড়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। সিনে এবার এন্ট্রি নেয় ইমন। বলে, একটা কথা বলি?

চশমার ওপর দিয়ে ইমনকে একবার মেপে নিল চেকার। বলল, বলো।

কুপে বসা বৃদ্ধ, বৃদ্ধার দিকে একবার চোখ-নির্দেশ করে নিয়ে ইমন চেকারকে বলল, ওঁদের দেখেই তো বোঝা যাচ্ছে ষাট পেরিয়েছেন, আর ভুলে যাওয়া একটা স্বাভাবিক ঘটনা। আপনি ইচ্ছে করলেই আইকার্ডের ব্যাপারটা ইগনোর করতে পারেন।

– আমি চাকরির রুল অনুযায়ী কাজ করছি। তুমি কে এ ব্যাপারে বলার? বলল টিটি।

ইমন চটজলদি জবাব দেয়, আমি এ দেশের একজন নাগরিক। আমার কর্তব্য সিনিয়র সিটিজেনকে হেল্প করা। আমি সেটাই করছি।

টিকিট চেকার একটু ধস খেল মনে হচ্ছে। চোখ নামিয়েছে নিজের হাতে ধরা লিস্টে, পেন ঠেকিয়ে পড়ার ভান করছে। প্রতিপক্ষ দুর্বল হয়ে পড়লে সঙ্গে সঙ্গে অ্যাটাকে যেতে হয়। ইমন বলে ওঠে, যদি ওঁদের বয়স আন্দাজ করতে আপনার অসুবিধে হয়, আমাদের গ্রুপ তো আছেই, কম্পার্টমেন্টের আরও অনেক প্যাসেঞ্জারকে ডেকে ওঁদের দু’জকে দেখাতে পারি। দেখুন তারা কী বলে। মেজরিটি তো মানবেন?

চেকারের দম শেষ। হেরে যাওয়া দৃষ্টি নিয়ে তাকায় ইমনের দিকে। হাসি পেয়ে যাচ্ছে ইমনের, সে যে যুক্তিটা দিয়েছে, এগেনস্টে আরও অনেক পয়েন্ট তোলা যায়। বোঝা যাচ্ছে টিটির স্টকে সে সব নেই। মাথা নিচু করে লোকটা গজগজ করতে থাকে, আইন ইজ আইন। যখন একবার পাস হয়ে গেছে মেনে চলতে হবে আমাদের। আমরা তো চাকরি করি…

কথাগুলো বলছে বটে টিটি, গ্রুপ টিকিটটা ফেরত দিয়ে দিয়েছে মেয়েটির বাবার হাতে। ইমন ক্রেডিট নেওয়ার জন্য মেয়েটির দিকে একবার তাকায়, ভীষণ বিস্মিত হয়, মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে হাসছে! ঠোঁটে নয়, চোখে জ্বলজ্বল করছে হাসির আভা। লজ্জায় চোখ সরিয়ে নেয় ইমন, এগিয়ে যায় সামনে। এখানে ট্রেনের দরজা। দুটোই বন্ধ। বাঁদিকের দরজাটা খুলে দাঁড়়ায় ইমন। হাওয়ার ঝাপট এসে লাগছে গায়ে, উড়ছে চুল। সামনে অন্ধকার প্রান্তর।

মেয়েটার হাসি ভেঙে দিল ওর নিজেরই আভিজাত্যের মোড়ক, সৌন্দর্য ছড়িয়ে পড়ল শরীরের কানায় কানায়। সম্পূর্ণ সাদা ড্রেস পরেছে মেয়েটা, আপারটা কুর্তি, নীচেরটা ফুল লেংথ কিছু একটা হবে। বাবু হয়ে বসেছিল বলে বোঝা যায়নি। সব মিলিয়ে মেয়েটার মধ্যে একটা ইতিহাসের রাজকন্যা টাইপ ভাব এসেছে। চোখের হাসি দিয়ে ইমনকে ভালোলাগাটা সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতে পেরেছে। ইমনের দারুণ ভালো লেগেছে মেয়েটাকে। বুকটা কেমন যেন জ্বালা জ্বালা করছে, সেইজন্যই দাঁড়িয়েছে হাওয়ায়। কারওকে ভালো লাগলে বুক জ্বালা করে, এই প্রথম জানল ইমন। আসলে এত ভালো আগে তো কোনও মেয়েকে দেখেনি সে।

ঘাড় তোলা উটের নাকের ডগায় ডুবন্ত সূর্য। ডিজিটাল ক্যামেরার সি্্ক্রনে ফোটোটা ফ্রেম করেও শাটার টিপল না ইমন। ফোটোটার মধ্যে নতুনত্ব কিছু নেই। পুরী ফেরত চেনা-পরিচিতদের কাছে এই ছবি হামেশাই দেখা যায়। তালুর সাইজের ক্যামেরাটা প্যান্টের পকেটে পুরে ইমন ফের হাঁটতে থাকে স্বর্গদ্বারের রাস্তা ধরে। বিকেল থেকে এই রাস্তায় পায়চারি করে চলেছে। একবার মেরিন ড্রাইভ রোডের দিকে চলে গিয়েছিল, ফিরে এসেছে তড়িঘড়ি। ওদিকে বড়োলোক টুরিস্টদের বিচরণক্ষেত্র। দামি ঝকঝকে সব হোটেল।ঞ্জট্রেনের মেয়েটার ফ্যামিলি ওদিকের হোটেলে উঠবে না। মেয়েটার চেহারায় যে-আভিজাত্য দেখা গিয়েছিল, সেটা জিনগত। ওই গ্রুপের হাবেভাবে, পোশাকেআশাকে টাকাপয়সার উদাসীন ঔদ্ধত্য ছিল না। নেহাতই মিডলক্লাস ফ্যামিলি। খানিকটা ভীরুও বটে, টিটির সঙ্গে গুছিয়ে ঝগড়াও করে উঠতে পারছিল না। ট্রাভেল করছিল স্লিপার ক্লাসে, এসিতে নয়। ওরা স্বর্গদ্বারের আশপাশের কোনও হোটেল বা হলিডে হোমেই উঠেছে। হলিডে হোমের সম্ভাবনাই বেশি। মেয়েটি ছাড়া বাকিদের বয়স এবং বডিল্যাঙ্গোয়েজ দেখে বোঝা যায়, এরা হলিডে হোমেই স্বচ্ছন্দ।

ইমনরাও হলিডে হোমে উঠেছে। পার্থর বাবার ব্যাংক-এর হলিডে হোম। উনিই অ্যারেঞ্জ করে দিয়েছেন। বাজেটের কারণেই ব্যাংকটা বেছে নেওয়া। ইমনরা কেউ তো রোজগার করে না। তবে পার্থ যেমনটা বলেছিল, হলিডে হোমের ঘর থেকেই সমুদ্র দেখা যায়, মোটেই তা নয়। ছাদে বা ব্যালকনিতে যেতে হচ্ছে। সমুদ্র আড়াল করে আছে হলিডে হোমের সামনে বিশাল এক হোটেল। পার্থ বলছে, বছর চারেক আগে ও যখন বাবা, মা-র সঙ্গে হলিডে হোমটায় এসে উঠেছিল হোটেলটা ছিল না। কথাটা কোনও বন্ধুই বিশ্বাস করেনি। চার বছর বয়স হতেই পারে না হোটেলটার। হয় পার্থ মিথ্যে বলছে অথবা কোথাও একটা ভুল করছে। চারবছর আগে অন্য কোনও জায়গায় উঠেছিল হয়তো। হলিডে হোমের রুম অবশ্য বেশ ভালো। স্পেসিয়াস, মোজাইক ফ্লোর। চারতলা বাড়ি পুরোটই হলিডে হোমের।

ইমনরা আছে দোতলায়। সেখানে তিনটে রুম, অ্যাটাচড বাথ। তিনটে ইউনিট থাকতে পারে। ঘরগুলোর ডবল সাইজের এরিয়ায় কমন কিচেন কাম ডাইনিং। ইমনদের নিয়ে দোতলায় এখন দুটো ইউনিট। একটা ঘরে বুকিং নেই, তালা দেওয়া। অন্য যে-ইউনিট আছে দোতলায়, তিনজন মেম্বার, বৃদ্ধ বৃদ্ধা আর কাজের মেয়ে নমিতা। মেয়েটার নামটা জেনে যাওয়ার কারণ, বুড়োবুড়ি কিছুক্ষণ অন্তর ওই নাম ধরে ডাকছে, কিছু না কিছু ফরমাশ করতে ডাকা। ইমন বুড়োবুড়িকে এখনও চাক্ষুস করেনি, মেয়েটাকে দেখেছে। খানিকটা কৌতুহল বশেই দেখা।

ট্রেন কাকভোরে পৌঁছে গিয়েছিল পুরী স্টেশনে। অটোরিক্সায় হলিডে হোমে পৌঁছে একঘণ্টা অপেক্ষা করতে হল ভিতরে ঢুকতে। গেটে তালা। হাঁকডাক করে কারওর সাড়া পাওয়া গেল না। ভোরের দিকে ঘুম গাঢ় হয়, কেয়ারটেকার তেড়ে ঘুম লাগিয়েছে। কাঁধে লাগেজ নিয়ে ইমনরা চারবন্ধু গিয়েছিল গলির মুখে চায়ের দোকানে। অত ভোরে চায়ের দোকান কিন্তু খুলে গেছে। হয়তো বুঝেশুনে খুলে রেখেছে। ভ্যানে, অত ভোরে হোটেল, হলিডে হোমে ঢুকতে পারবে না টুরিস্টরা।

হলিডে হোমের গেট খুলেছিল ভোর ছটায়। মুশকো চেহারার নিদ্রালু চোখের কেয়ারটেকারকে কৌশিক ঝাঁঝিয়ে বলে উঠেছিল, ভোরের দিকে যখন এরকম একটা ইম্পর্ট্যান্ট ট্রেন আছে, কত টুরিস্ট আসে, গেট খোলা রাখেন না কেন? লাগেজ নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছি একঘণ্টার ওপর।

পোড় খাওয়া মস্তানের মতো কৌশিকের দিকে তাকিয়ে ছিল লোকটা। যেন বলতে চাইল, সস্তায় থাকতে এসেছ, কাঁচাঘুম থেকে উঠে গেট খুলে দিচ্ছি এই ঢের। বাড়াবাড়ি করলে ঘাড় ধরে বার করে দেব।

ওই তাকনোতেই ধস খেয়ে গিয়েছিল চারবন্ধু। কেয়ারটেকারের থেকে চাবি নিয়ে গুটিগুটি পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নিজেদের রুমের তালা খোলে। তখনই কানে এসেছিল ‘নমিতা’ নামটা। বৃদ্ধ অশক্ত গলায় মেয়েটার নাম ধরে ডেকে কিছু একটা দিতেটিতে বলছিলেন।

ইমনরা ঘরে ঢুকে প্রথমেই দুটো ডবলবেড এক জায়গায় করে নিল। চারজন একসঙ্গে শোবে। টয়লেটের কাজ সেরে ওরা তৈরি হচ্ছিল সমুদ্রে স্নান করতে যাবে বলে, সকলেরই মধ্যেই বেশ তাড়া। হলিডে হোমে আসার পথে সমুদ্রকে দেখেছিল প্রায় অন্ধকারের মধ্যে। ফসফরাসের মুকুট মাথায় দিয়ে ধেয়ে আসছিল ঢেউগুলো। ধীরে ধীরে ফরসা হয়েছে চারপাশ, সমুদ্র তাদের যেন ডাকছিল। ঢেউয়ের গর্জন আবছা হয়ে এসে পৌঁছোচ্ছিল কানে। সেইসময় কৌশিক এসে খবর দিল, পাশের মেয়েটা একেবারে ঝক্বাস জিনিস! ডাইনিং-এ চা বানাচ্ছে, একবার দেখে আয়।

পার্থ, জয়দীপ লাফিয়ে চলে গিয়েছিল দেখতে। ফিরে এসে বলেছিল, নাঃ, সত্যিই হেভি জিনিস!

ওদের কথা শুনে কৌতূহলী হয়েছিল ইমন, গরিব পরিবার থেকে আসা কাজের মেয়ে কত ভালো দেখতে হতে পারে! ইমন গিয়েছিল যাচাই করতে। ডাইনিং কাম কিচেনে পা রাখতেই ঘুরে তাকিয়েছিল বছর তেরো চোদ্দোর মেয়েটা। শ্যামলা রং, একমাথা কোঁকড়া চুল, চোখে কোনও ভাষা নেই। পরনে জংলা ছাপ ফ্রিল দেওয়া ফ্রক। শরীরে সদ্য যৌবনের অবশ্যম্ভাবী লাবণ্য। হবেইবা না কেন? অবস্থাপন্নের বাড়িতে কাজ করার সুবাদে খেতে পরতে পায় ভালো। মোদ্দা কথা মেয়েটার মধ্যে অসাধারণ কিছু দেখেনি ইমন। হতাশ লেগেছিল বন্ধুদের রুচির কথা ভেবে। ট্রেনের মেয়েটিকে দেখেও বলেছিল, দারুণ দেখতে! এই মেয়েটার ক্ষেত্রেও তাই। দু’মেয়ের চেহারায় আভিজাত্যের বিশাল ফারাকটা চোখেই পড়ছে না!

হলিডে হোম থেকে বেরোনোর আগে জয়দীপ আলাপ সেরে এল বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সঙ্গে। ওঁরা একমাসের জন্য বুক করেছেন ঘর। অবসর জীবনের ছুটি কাটাচ্ছেন। নিজেদের দেখভালের জন্য বাড়ির কাজের মেয়েটিকে নিয়ে এসেছেন সঙ্গে করে। ইতিমধ্যে পুরীতে সাতদিন কাটিয়ে ফেলেছেন ওঁরা। বৃদ্ধ বাজার করে আনছেন, নমিতা রান্না করে খাওয়াচ্ছে। ইমনরা রান্না করতে জানে না, লোকাল কারওকে দিয়ে করানোর কথাও ভাবেনি। বাইরে খেয়ে নেবে ঠিক করেছে।

আজ সমুদ্রে নামার আগে খাবার দোকানে ব্রেকফাস্ট সেরে নিয়েছিল ইমনরা। সি-বিচের বালিতে পা দিয়েই চারবন্ধু ভুলে গিয়েছিল অনেক কিছুই, রুদ্ধশ্বাসে দৌড়েছিল জলের দিকে। মা সমুদ্রে নামতে বারণ করেছে, ভুলে গিয়েছিল কৌশিক। ইমন ভুলে মেরে দিয়েছিল বাবার কথা, সামনে দু’সারি সাহসী মানুষের পরের সারিতে স্নান করতে বলেছিল বাবা। ইমনরা যেখানে ঢেউয়ের সঙ্গে ওস্তাদি করছিল, সামনে কোনও সারি ছিল না, সাহসী দু’চারটে মানুষ আরও দুটো ব্রেকের পর গিয়ে স্নান করছিল। সি বিচে এসে ট্রেনের দাদা-বউদিকে খুঁজে নেওয়ার কথা ছিল চরবন্ধুর। স্নানের মজায় সেসব ভাবনা উড়ে গিয়েছিল মাথা থেকে।

ইমন বাদে ট্রেনের সেই মেয়েটার কথাও ভুলে গিয়েছিল তিনজন। জলের সঙ্গে হুটোপাটির মধ্যেও ইমন এপাশ ওপাশ তাকাচ্ছিল, যদি দেখা যায় তাকে। জলে দাপাদাপি করা ভেজা পোশাকের টুরিস্টদের মধ্যে যদি বিদ্যুতের মতো ঝলকে ওঠে সাদা ড্রেসের সেই মেয়ে! পরক্ষণেই মনে হয়েছিল, কী বোকা আমি! ট্রেনের ড্রেসটা পরেই স্নান করতে আসবে তার কী মানে আছে! নানান পোশাকের ভিড়ে মেয়েটাকে চিনে নিতে হবে। তার মুখোমুখি আর একবার অন্তত হবেই ইমন। দেখে নেবে মেয়েটি বিশেষ পছন্দের যে-দৃষ্টিতে ইমনের দিকে তাকিয়ে ছিল, তা কতটা গভীর? টুরে কিংবা কোনও অনুষ্ঠানে টাইম পাসের জন্য আলগা ভালো লাগা ছিল না তো সেটা? এখানে হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে সে যদি না চেনার ভান করে, ইমন মোটেই ধাওয়া করবে না। রিলেশন একতরফা হয় না কখনও। সাদা ড্রেসের রাজকুমারী লুকের মেয়েটা স্মৃতিতে থেকে যাবে সারাজীবন। কেননা এতদিন পর্যন্ত সত্যিকারের ভালোলাগা বলতে এই মেয়েটাকেই লেগেছে ইমনের। মেয়েটা তার দিকে হাসির আভা সমেত তাকানোর পর ইমন নিজেকে সামলাতে গিয়ে দাঁড়়িয়েছিল ট্রেনের দরজায়। অদ্ভুত একটা রি-অ্যাকশন হচ্ছিল বুক জুড়ে। হয়তো একেই বলে প্রথম প্রেমে পড়ার অনুভূতি!

সুখের মুহূর্তটা খানিকবাদেই হোঁচট খেয়েছিল। ইমনের সন্দেহ হচ্ছিল নিজেকে, আমি ঠিক দেখলাম তো? মেয়েটার এক্সপ্রেশন রিড করতে ভুল হয়নি কোনও? নাকি নিজের বাসনাটা মেয়েটির মুখে বসিয়ে দিয়েছি? যেহেতু ওকে খুব পছন্দ হয়েছে আমার। ব্যাপারটা নিয়ে নিশ্চিত হওয়ার জন্য দরজা থেকে সরে এসে করিডোর ধরে ফিরছিল ইমন, মেয়েটির কুপের সামনে এসে হাঁটা স্লো করে নিয়েছিল। দৃষ্টি কেড়ে নিল যেন মেয়েটিই, তখন আর চোখের ভাষায় হাসছিল না, হাসি চলকে এসেছিল ঠোঁটেও। দু’টো বিট মিস করেছিল ইমনের হার্ট। হাসি বিনিময়ের চেষ্টা না করে বাড়িয়ে দিয়েছিল হাঁটার স্পিড। জানত, হাসতে গেলেই ভীষণ ক্যাবলা দেখাত তাকে।

অতিরিক্ত আনন্দে কেমন যেন বিষণ্ণ হয়ে গিয়েছিল ইমন। এমনটাই হয়, অপ্রত্যাশিত সুসংবাদে যেমন কেঁদে ফেলে মানুষ। ইমন গম্ভীরমুখে ফিরেছিল নিজেদের কুপে। বন্ধুরা সোৎসাহে জানতে চেয়েছিল, কী হল রে? দেখলাম, টিটির সঙ্গে আর্গুমেন্ট করে ওদের ফ্যামিলিতে এন্ট্রি নিচ্ছিস। জানলার ধারে ইমনের ছেড়ে যাওয়া জায়গাটা ফাঁকাই ছিল। সেখানে গিয়ে বসতে বসতে ইমন বলেছিল, তাকিয়েছে, হেসেছেও।

‘সে-এ-এ-এ কী-ই-ই-ই রে-এ-এ-এ’ বলে এত জোরে চেঁচিয়ে উঠেছিল তিনবন্ধু, কম্পার্টমেন্টের সব প্যাসেঞ্জার নিশ্চয়ই একবার চমকে উঠেছিল। লাস্ট কুপে ওই মেয়েটার কানেও অবশ্যই আওয়াজটা গেছে। কেমন জানি অস্বস্তি হচ্ছিল ইমনের। পলা বউদি বলেছিল, তা এত বড়ো একটা অ্যাচিভমেন্টের পর মুখটা ওরকম গোমড়াথেরিয়াম করে বসে আছো কেন?

– এত এক্সাইটেড হওয়ারইবা কী আছে! দুনিয়ায় প্রতি মিনিটে কোটিকোটি ইয়ং ছেলেমেয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে প্রথমবার হাসছে!

ইমনের কথায় উৎসাহে ভাঁটা পড়েছিল পলা বউদির। জয়দীপ ছোট্ট করে ফুট কেটেছিল, ম্যাথে ওর মাথা চিরকালই ভালো।

পলা বউদি হেসে জানতে চেয়েছিল, কী গো, সত্যিই হেসেছে তো। নাকি পাত্তা দেয়নি বলে রেগে আছো?

– ক্যালি নেওয়ার জন্য ঢপ মারার ছেলে ও নয়। তবে মালটা একটু বেরসিক। বলেছিল পার্থ। তারপর ধীরে ধীরে ঘুরে গিয়েছিল অন্য প্রসঙ্গে। ইমনের দায় থেকে গেল ঘটনা সত্যি প্রমাণ করার। বন্ধুরা তাকে বহুদিন ধরে চেনে, মেয়েটা যে তার প্রতি ইন্টারেস্ট দেখিয়েছে বিশ্বাস করেছে সহজেই। চ্যালেঞ্জটা রয়ে গেল রঞ্জনদা, পলা বউদির কাছে।

রাত গড়াতে বাড়ি থেকে আনা খাবার খেয়ে যে যার বাংকে শুয়ে পড়ল। ঘুম আসতে দেরি হয়েছিল ইমনের, মনের চোখে ভাসছিল মেয়েটার হাসিমুখের ছবি। শেষ রাতে গাঢ় হয়েছিল ঘুম। ধাক্বা মেরে তুলে দিল পার্থ, এরে ওঠ ওঠ, প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে গাড়ি।

ধড়মড় করে উঠে বসে লাগেজ প্যাক করতে শুরু করেছিল ইমন। কামরার অনেকেরই ইমনের মতো অবস্থা, হুড়োহুড়ি করে ব্যাগ গোছাচ্ছে। রাত থাকতে গন্তব্যে পৌঁছে গেলে এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। ইমনের তাড়া একটু বেশি, মেয়েটা না চোখের আড়ালে চলে যায়। আর হয়তো দেখা হবে না। পুরীতে যা ভিড় থাকে টুরিস্টের! দেখা হওয়াটা কো-ইন্সিডেন্স নির্ভর। প্ল্যাটফর্মেই চোখাচোখি হওয়াটা দরকার। পলা বউদি, রঞ্জনদা পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি, মেয়েটা ইমনের ব্যাপারে ইন্টারেস্ট দেখিয়েছে।

দেখা হল। দাদা, বউদি সমেত ইমনরা যখন ব্যাগ কাঁধে ট্রেন থেকে নামল, দেখেছিল প্ল্যাটফর্মের শেষ মাথায় মেয়েটা ফ্যামিলির সঙ্গে এক্সিট-এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পরনে সেই সাদা ড্রেস। বারবার পিছন ফিরছে মেয়েটা।

ইমনের পাশে হাঁটতে থাকা কৌশিক বলেছিল, তোকে খুঁজছে। হাত নাড়, হাত নাড়…

হাত তুলতে হয়নি। মেয়েটা খুঁজে নিয়েছিল ইমনকে। ফ্যামিলি মেম্বারদের থেকে ইচ্ছাকৃত পিছিয়ে পড়ে হাত নেড়েছিল ইমনকে লক্ষ্য করে। তারপর লজ্জা পেয়ে হারিয়ে গেল ভিড়ে।

‘জিও ওস্তাদ!’ বলে সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠেছিল ইমনের বন্ধুরা। পার্থ একটা ডিগবাজি মারার প্রয়াস নিয়েছিল, ইমন তাকে আটকায়। ডিগবাজি মারার প্রবণতা পার্থর বরাবরের। আনন্দ-স্ফূর্তির ঘটনা ঘটলেই যেখানে সেখানে ডিগবাজি খেয়ে নেয়।

প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়েই বন্ধুরা শপথ নিল, এই ট্রিপেই মেয়েটার সঙ্গে ইমনের প্রেমের পাকা একটা সম্পর্ক করিয়ে ছাড়বে। চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে খুঁজে বার করবে মেয়েটার ফ্যামিলি পুরীতে কোথায় উঠেছে।

সকালে সমুদ্রস্নানে গিয়ে সমস্ত প্রতিশ্রুতি ভুলে গেল ওরা। রঞ্জনদা, পলা বউদির খোঁজও করেনি। দাদা-বউদি বলে দিয়েছিল তারা স্বর্গদ্বারের কাছেই থাকবে, কোনও এক কোম্পানির গেস্ট হাউসে। কোম্পানির নামটা ভুলে গেছে ইমন। বাকি তিনবন্ধু দাদা-বউদির নামই নিচ্ছে না। সমুদ্রে ঘণ্টা দুয়েক কাটিয়ে ইমনরা হা-ক্লান্ত হয়ে ফিরেছিল হলিডে হোমে। সমুদ্রের নোনাজল, বালি ধুতে ফের আর-এক প্রস্থ স্নান করল বাথরুমে গিয়ে। হলিডে হোম থেকে বেরিয়ে ভাতের হোটেলে লাঞ্চ সারল। ফিরে এসে টানা ঘুম। যখন উঠল, বেলা গড়িয়ে গেছে অনেক। জানলার বাইরে হলুদ আলো দেখে ইমন বন্ধুদের তাড়া দিয়েছিল, চ চ, বেরোবি তো!

ওদের মধ্যে কোনও উৎসাহ দেখা গেল না।ঞ্জজয়দীপ বলেছিল, তুই ঘুরে আয়। সকাল থেকে যা গেল, হেভি টায়ার্ড লাগছে, এই বেলাটা রেস্ট নেওয়া ভালো।

পার্থ, কৌশিকেরও দেখা গেল একই মত। বিছানা ছেড়ে উঠতে চাইছে না। ড্রেস চেঞ্জ করে পকেটে ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল ইমন। তারও টায়ার্ড থাকার কথা, কোন এনার্জিতে বেরিয়ে পড়ল, বন্ধুরা বোধহয় খেয়াল করেনি। বিচ-এর দিকে তাকিয়ে পাকারাস্তা ধরে সেই কখন থেকে হাঁটাচলা করল ইমন, ট্রেনের মেয়েটা চোখে পড়ল না। ওরাও কি রেস্ট নিচ্ছে? নেওয়ার কথা কিন্তু নয়। ইমনদের মতো সকালে নিশ্চয়ই সমুদ্রে দু’ঘণ্টা দাপাদাপি করেনি। তাছাড়া ইমনের তিনবন্ধু যতটা না ক্লান্তির কারণে বিশ্রাম করছে, তার চেয়ে বেশি আলস্য উপভোগ করছে। যতদূর মনে হচ্ছে মেয়েটার ফ্যামিলি উঠেছে চক্রতীর্থ রোডের দিকে। ওই রাস্তায় যায়নি ইমন, এখান থেকে অনকটাই দূর। কাল একবার ট্রাই নেবে।

সানসেট দেখতে বিচ-এ প্রচুর ভিড় হয়েছিল। সূর্য ডুবে গেছে অনেকক্ষণ। টুরিস্টরা সিলুয়েট হয়ে গেছে। সি-বিচের স্থায়ী মেলায় জ্বলে উঠছে লম্প, হ্যাজ্যাক, রঙিন টুনিবাল্বের মালা। সমুদ্রের এলোপাথারি বাতাস কিছু যেন বলতে চাইছে ইমনকে! মেয়েটা এখন কোথায়, বলছে হয়তো সেটাই। বাতাসের গতিবিধি যেহেতু অবাধ, জানে মেয়েটার হদিশ। ইমন অনুবাদ করতে পারছে না বাতাসের ভাষা। নিজের আস্তানায় ফিরতে থাকে ইমন।

সিঁড়ি ভেঙে হলিডে হোমের দোতলায় এসে ইমন থমকে দাঁড়াল। তাদের রুমের দরজা আর তালাবন্ধ রুমটা মুখোমুখি। তারপরই করিডোরের টিমটিমে আলোয় দাঁড়িয়ে গল্প করছে কৌশিক আর বুড়োবুড়ির কাজের মেয়ে নমিতা। কৌশিক কথা বলছে বেশি, দেয়ালে ঠেসান দেওয়া নমিতা সলজ্জ হাসি ধরে রেখেছে মুখে। কৌশিক একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল ইমনের দিকে। ফের মেয়েটার সঙ্গে কথায় মেতে গেল।

ইমন বড়োবড়ো পায়ে ঢুকল নিজেদের রুমে। কৌশিকের কান্ড দেখে মাথা গরম হয়ে গেছে তার। জয়দীপ, পার্থ বিছানায় ড্রিংক্স সাজিয়ে বসেছে। ওদের উদ্দেশ্যে ইমন রাগের সঙ্গে বলে ওঠে, কৌশিক এটা কী করছে!

পার্থ গ্লাসে এক সিপ মেরে বলল, কী আবার করবে! ওর যা স্বভাব, মেয়ে দেখলেই লাইন মারার ধান্দা…

– তোদের বারণ করা উচিত ছিল। গরিব ঘরের মেয়ে, লেখাপড়া জানে না, কৌশিককে তো বিশ্বাস করে বসবে।

ইমনের কথা গ্রাহ্যে না এনে জয়দীপ বলে, ওইসব মেয়ে লেখাপড়া না জানলেও কাকে কতটা বিশ্বাস করবে, তার হিসেব ভালোই করতে পারে। তুই চাপ নিস না। মাল খাবি আয়।

– আমার ইচ্ছে করছে না। বলে নিজের লাগেজ ব্যাগের দিকে এগিয়ে যায় ইমন, একটা গল্পের বই এনেছে পড়ার জন্য। পিছন থেকে ফের জয়দীপ বলে উঠল, দেখা পেলি ট্রেনের মেয়েটার। মেজাজ দেখে মনে হচ্ছে তো পাসনি।

ঘুরে দাঁড়ায় ইমন। সন্ধানী দৃষ্টি রাখে জয়দীপের ওপর। কী বলতে চাইল জয়? মেয়েটার সঙ্গে দেখা না হওয়ার কারণেই ইমনের ঈর্ষা হচ্ছে কৌশিককে। ও যেহেতু একটা মেয়ে পেয়ে গেছে!  ইমনকে বুঝতে এত ভুল করছে বন্ধুরা! এদের সঙ্গে বেড়াতে না এলেই ভালো হতো। কাল যদি পুরী ছেড়ে চলে যায় ইমন, কোনও আপশোশ হবে না।… এতদূর ভেবে হোঁচট খায় ইমন, না, এই ট্রিপে না এলে রাজকন্যা টাইপের মেয়েটার সঙ্গে তার দেখাই হতো না। মেয়েটাকে যে করে হোক খুঁজে বার করবে কাল।

এবারটা নিয়ে চারবার পুরী আসা হল ইমনের। প্রথমবার খুবই ছোটো ছিল, যাকে বলে জ্ঞান হয়নি। বাবা, মায়ের থেকে গল্প শুনেছে। দ্বিতীয়বার এসেছিল ক্লাস সিক্সে। লাস্ট মাধ্যমিক দেওয়ার পর। তার মানে বছর পাঁচেক আগে। সেই স্মৃতির সঙ্গে এখনকার পুরীর পরিবেশের কোনও মিল নেই। তখনও ভিড় ছিল আবার প্রতিটি মানুষের গা-লাগোয়া নির্জনতাকেও লক্ষ্য করা যেত। সকলের হাঁটাচলার মধ্যে ঢিলেঢালা আয়েসি ভাব। এখন ছবিটা উলটো, ভিড় তো বেড়েইছে, সবার মধ্যে কেমন একটা হুড়োহুড়ি ভাব। যেন অফিসের বাস ধরার তাড়া। সমুদ্রে স্নান করতেও দৌড়োচ্ছে সেইভাবেই।

ইমনরাও স্নান করতে এসেছে বিচে। কালকের মতো এসেই জলে নেমে পড়েনি। হলিডে হোম থেকে বেরিয়ে দোকানে ব্রেকফাস্ট করতে করতে ঠিক করে নিয়েছে স্নানের আগে বিচের এদিক ওদিক ঘুরে ট্রেনের মেয়েটা এবং পলা বউদি-রঞ্জনদার খোঁজ করবে তারা। বিচে এসে একটা জায়গা মিটিং পয়েন্ট হিসেবে নির্দিষ্ট করল চারবন্ধু। সেখানে একহাত মতো বালি খুঁড়ে দু’জন করে বিপরীত দিকে হাঁটা শুরু করেছে। ইমনের সঙ্গে ছিল কৌশিক, কখন যে সে সরে পড়েছে টের পাওয়া যায়নি। ইমন এখন একাই বিচ ধরে হেঁটে চলেছে, দৃষ্টি স্নানরত টুরিস্টদের ওপর। কথা হয়েছে দশমিনিট হাঁটার পর বালি খুঁড়ে রাখা জায়গায় দু’দল মিট করবে। তার মধ্যে যদি যাদের খোঁজা হচ্ছে, পাওয়া যায় ভালো, না পেলে ফের বিকেলে চেষ্টা করা হবে।

দশ মিনিটের অনেক বেশিই হেঁটে ফেলেছে ইমন। আশা করে বসে আছে দেখা পাবে ট্রেনের মেয়েটার। এমনটা নাও হতে পারে, ইমন যেদিকে চলেছে হয়তো দেখা হয়ে গেল রঞ্জনদা-পলা বউদির সঙ্গে। জয়দীপ, পার্থ যে-ডিরেকশন-এ গেছে সেখানেই পাওয়া গেল ট্রেনের মেয়েটাকে। সেই হিসেবে ইমন মেয়েটার থেকে অনেকটাই দূরে চলে এসেছে। এবার বোধহয় ফেরা উচিত। হাঁটা থামিয়ে দেয় ইমন। বিচ-এ দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে প্যানারমিক ভিউ দেয় সমুদ্রে স্নানরতদের ওপর। মেয়েটার আভাসমাত্র নেই, ফ্যামিলিরও কারওকে চোখে পড়ছে না। দেখা নেই রঞ্জনদা-পলা বউদিরও। থিকথিকে ভিড়ের ভিতর থেকে ওদের শনাক্ত করাটাও দুঃসাধ্য কাজ। কৌশিক যদি ছেড়ে না পালাত ইমনকে, দু’জনে মিলে খোঁজাটা আরও জোরালো হতো। কৌশিকের সরে পড়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কাল সন্ধেবেলা কৌশিককে প্রচুর কথা শুনিয়েছে ইমন। বুড়োবুড়ির কাজের মেয়েটার সঙ্গে যখন গল্প করে ফিরল কৌশিক, ইমন চার্জ করেছিল, ওর সঙ্গে কী কথা হল তোর এতক্ষণ?

কৌশিক দাঁত বার করে বলেছিল, কিছুই না। ওই কোথায় থাকেটাকে জিজ্ঞেস করলাম। সিনেমার কোন হিরোর ফ্যান? এইসব আটভাট।

– আটভাটগুলোও একটু শুনি। এতটা সময় কাটালি কী কী কথায়? বলে কৌশিককে চেপে ধরেছিল ইমন।

তখনও আহ্লাদ কাটেনি কৌশিকের, ইমনকে আগ্রাহ্য করে বোকাবোকা হেসে জয়দীপকে বলেছিল, কীরে, আমার জন্য বানা ড্রিংক্স!

জয়দীপ গ্লাসে ওর জন্য মদ, জল মিশিয়ে এগিয়ে দিয়েছিল। ইমন কৌশিককে ছাড়েনি, ফের জিজ্ঞেস করেছিল, কী হল, বল। আর কী কথা হল?

গ্লাসে চুমুক মেরে কৌশিক বলেছিল, বললাম, তোমাকে অনেকটা শুভশ্রীর মতো লাগে দেখতে। নায়িকার সঙ্গে তুলনা করাতে খুব খুশি হল।

কৌশিককে কোণঠাসা করার জন্য ইমন জানতে চেয়েছিল, মেয়েটা কোথায় থাকে বলল?

– কোথায় আবার, বুড়োবুড়ির কাছে, টালিগঞ্জে।

– ওর নিজের বাড়ি কোথায়?

– ক্যানিং-এর দিকে। গ্রামের নাম কী বলল, এখন আর মনে নেই।

– ক্যানিং-এর গন্ডগ্রামের মেয়েটা পরিবারের অভাবের তাড়নায় এই অল্পবয়সে শহরে লোকের বাড়ি এসে কাজ করছে। তোর কথায় বিশ্বাস করে ও যদি নিজেকে শুভশ্রী ভাবতে শুরু করে এবং তোর মতো ভদ্রবাড়ির ছেলের পিছনে ঘুরতে থাকে, বারংবার ঠকবে। তুইও ওকে নিজের বাড়িতে কাজের মেয়ের চেয়ে বেশি মর্যাদ দিবি না। এইভাবে মেয়েটার মনে মিথ্যে আশা জুগিয়ে দেওয়া কি ঠিক? ইমনের কথা আর ওড়াতে পারেনি কৌশিক, থতমত খেয়ে গিয়েছিল। বাকি দুই বন্ধুও ছিল চুপ করে। ইমন কথা শেষ করেছিল এই বলে, তোর কাছে অবশ্য এসব কথার কোনও মূল্য নেই। মায়ের পা ছুঁয়ে করা প্রমিস তুই রাখতে পারিস না, মদও খেলি, চানও করলি সমুদ্রে। একটা কোথাকার কোন মেয়ের জন্য তুই ভাবতে যাবি কেন! তোর যে একটা প্রেম আছে সেটাও হয়তো ভুলে গেছিস!

ডোজটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল। গুম মেরে যায় তিনবন্ধু। মদের গ্লাস ধরে রেখেছিল হাতে, মুখে তুলছিল না। ওদের রিলিফ দিতে ইমন উঠে গিয়েছিল হলিডে হোমের ছাদে। তারা জ্বলা আকাশের তলায় দাঁড়িয়ে সমুদ্রের সাদা ঢেউ দেখছিল। একা লাগছিল বড্ড। মনে পড়ছিল বাড়ির কথা। মোবাইল থেকে ফোন করে কথা বলল মায়ের সঙ্গে। মাকে অবশ্য বুঝতে দেয়নি মনের অবস্থা, ‘বেড়াতে দারুণ লাগছে’ এমনটাই বলেছিল। পুরী এসেই পৌঁছোন

সংবাদ দিয়েছিল ফোনে, সেদিনই আবার ফোন করাতে মায়ের খটকা লাগে। জিজ্ঞেস করেছিল, সত্যিই ভালো আছিস তো? থাকার জায়গাটায়গা মনের মতো হয়েছে?

– হ্যাঁরে বাবা, হ্যাঁ। দারুণ আছি। এইমাত্র ছাদে এলাম। কী হাওয়া! সমুদ্রও দেখা যাচ্ছে। বাড়তি উচ্ছ্বাস দেখিয়ে মাকে আশ্বস্ত করেছিল ইমন।

রাতে যখন বাইরে খেতে যাওয়া হল, তিনবন্ধু সহজ হওয়ার চেষ্টা করছিল ইমনের সঙ্গে। জয়দীপ, পার্থর সঙ্গে কথা বললেও, কৌশিককে এড়িয়ে থেকেছে ইমন। দূরত্বটা বজায় ছিল সি-বিচে স্নান করতে আসা অবধি। জয়দীপ ব্যাপারটা নোটিশঞ্জকরেই ইমন-কৌশিক জুটি বানিয়ে এদিকে পাঠাল। কিন্তু কিন্তু করছিল কৌশিক। জয়দীপ কোনও কথা শোনেনি।

ইমন, কৌশিক একসঙ্গে হাঁটা শুরু করলেও, ইমন কথা বলা তো দূরে থাক, ঘুরেও দেখছে না দেখে কৌশিক চুপচাপ কেটে পড়েছে। অপরাধ বোধে ভুগছে বলে যেচে কথাও বলতে পারেনি।

– এই যে, তোমাকেই খুঁজছিলাম।

কাঁধে হাত রেখে কে যেন বলে উঠল কথাটা। চমকে ঘাড় ফেরায় ইমন। আবারও চমকায়, এবার ভিতরে। কাঁধে হাত রেখেছেন ট্রেনের সেই ভদ্রলোক, মেয়েটার বাবা। গায়ে গামছা, ফোল্ড করা লুঙ্গি পরনে। মেয়েটা পরিবারের সকলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে রয়েছে খানিক দূরে। রোদের চোটে কপাল কুঁচকে থাকলেও ঠোঁটের কোণে চাপা হাসি। পরনে ট্রেনের পোশাকটাই, সাদা পাতিয়ালা-কামিজ।

কাঁধ থেকে হাত ফিরিয়ে নিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ট্রেনে তোমায় থ্যাংক্স জানানো হয়নি। গিন্নি খুব রাগ করছিল। এখানে এসে থেকে তোমায় খুঁজছি। জোর বাঁচিয়েছ টিটির হাত থেকে।

ইমন কথাগুলো শুনছে ঠিকই, দৃষ্টি চলে যাচ্ছে মেয়েটার দিকে। পায়ের তলার বালি ক্রমশ নরম হয়ে যাচ্ছে যেন। মেয়েটিও চোখ সরাচ্ছে না। ভদ্রলোক জানতে চাইলেন, কোথায় উঠেছ? বন্ধুদের সঙ্গে এসেছ দেখলাম মনে হল ট্রেনে।

ইমন ঘাড় হেলিয়ে নিজেদের হলিডে হোমের নামটা বলে। তারপর জানতে চাইল, আপনারা কোথায় উঠেছেন?

মেয়েটার বাবা পিছন ঘুরে আঙুল তুলে বলল, ওই হোটেলটার পাশের গলিতে একটা হলিডে হোমেই উঠেছি আমরা।

‘কোন হলিডে হোম’ জিজ্ঞেস করতে

সংকোচ হচ্ছে ইমনের। সেই ফাঁকে ভদ্রলোক বলে উঠলেন, চলি। আমরা স্নান করতে এসেছি। পরে আবার দেখা হয়ে যাবে।

ভদ্রলোক এগিয়ে যাচ্ছেন জলের দিকে। পরিবারের বাকিরাও এগোল। সকলের অলক্ষে মেয়েটা এবার ইমনের দিকে তাকিয়ে হাসল, যেন একরাশ মুক্তো ঝিকিয়ে উঠল সমুদ্রতটের রোদে। তারপর সাদা রাজহংসীর মতো সে ভেসে পড়ল জলে।

মেয়েটার দেখা পাওয়াতে বন্ধুদের প্রতি সমস্ত বিরূপতা কেটে গেছে ইমনের। মনে মনে কৌশিককেও ক্ষমা করে দিয়েছে। সুখবরটা বন্ধুদের দিতে সে এখন দৌড়োচ্ছে সিবিচ ধরে। মিটিং পয়েন্টে পৌঁছোনোর আগে দৌড় থেমে যায়। মজার একটা ব্যাপার দেখে দাঁড়িয়ে গিয়ে ফের হাঁটতে থাকে ইমন। মিটিং স্পটের যে-গর্তটা খোঁড়া হয়েছিল সেখানে এখন পোঁতা হয়েছে পলা বউদিকে। মানে বালি চাপা দেওয়া হয়েছে। শুধু মুণ্ডুটা উপরে। কাজটাকে নিখুঁত করতে এখনও লাস্ট মিনিট টাচ দিচ্ছে জয়দীপ, পার্থ। কৌশিককে আশপাশে দেখা  যাচ্ছে না। রঞ্জনদাকেও না। দাদা-বউদির খোঁজ তার মানে এরা অনেক আগেই পেয়েছে। পলা বউদির গোটা বডিটা বালিতে চাপা দেওয়া যথেষ্ট সময় সাপেক্ষ ব্যাপার।

ঘটনাটা দূর থেকে যতটা মজার মনে হয়েছিল, কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই আশাভঙ্গ হল ইমনের। কপালে ভাঁজ নিয়ে সে দেখল, পলা বউদির বুকের অংশের বালির ওপর আঙুল মাপের অনেকটা ফুটো। বদমাইশিটা করছে পার্থ। দু’হাতের লম্বা আঙুলটা বুকের দিকে রেখে বালি চাপা দিচ্ছে। পলা বউদির বুক ছোঁওয়ার ফিকির। এখনও ছুঁতে পেরেছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। পলা বউদি খুশির হাসি হাসছে। সেটা খেলার আনন্দে না যৌন সুড়সুড়িতে, আন্দাজ করা কঠিন! ইমনের টেনশন হচ্ছে রঞ্জনদার কথা ভেবে। এসে যদি দেখে বউয়ের বুকের ওপর বালিতে ভীমরুলের চাকের মতো ফুটো, মধুলোভীদের অভিপ্রায় টের পেয়ে যাবে। ইমনদের গ্রুপটাকে চিনবে ছোটোলোকের দল হিসেবে।

হাঁটু মুড়ে বালিতে বসে পড়ে ইমন, হাতের ঝটকায় সরিয়ে দেয় পার্থর হাত। জয়দীপ পলা বউদির পেটের দিকে বালির ফিনিশিং টাচ দিচ্ছে। ইমনের চোখ চলে যায় জলের দিকে, স্নান সেরে উঠে আসছে রঞ্জনদা। তড়িঘড়ি বউদির বুকের ওপর বালির গর্তগুলো চাপা দিতে থাকে ইমন।

রঞ্জনদা চলে এসেছে কাছে। বলে উঠল, আরেঃ, তোমরা তো দেখছি আমার বউটাকে ভ্যানিশ করে দিয়েছ।

জয়দীপ, পার্থ বোকাবোকা হাসছে। ইমন চেষ্টা করেও হাসতে পারছে না। বন্ধুর অপকর্মের চিহ্ন অবশ্য মুছে ফেলতে পেরেছে। পলা বউদি বলে ওঠে, ভিতরটা কী ঠান্ডা গো! পুরো এসিতে আছি মনে হচ্ছে।

রঞ্জনদা সঙ্গে সঙ্গে বসে পড়ল। বলল, বউয়ের পাশটিতে আমাকেও সমাধি দিয়ে দাও।

পূর্ণ উদ্যোমে রঞ্জনদার জন্য বালি খুঁড়তে লাগল জয়দীপ, পার্থ। রঞ্জনদাও খুঁড়ছে, ইমন হঠাৎ দেখতে পায় কৌশিককে। তডিঘড়ি পায়ে এগিয়ে আসছে, চেহারায় কেমন যেন ভয় আতঙ্কের ভাব!

ইমন উঠে দাঁড়ায়। কী হয়েছে কৌশিকের? উৎকণ্ঠিত ইমনের দিকে না তাকিয়ে কৌশিক, দাদা-বউদির মাথার কাছে গিয়ে জয়দীপকে ডাকে। বালি লাগা হাত ঝেড়ে উঠে যায় জয়দীপ। ইমন শুনতে পায় কৌশিক বলছে, মেয়েটা মাইরি সিবিচে চলে এসেছে। পিছন ছাড়ছে না। আমি শালা পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কী করি বল তো?

– খেয়েছে রে। কেসটা এতটা পাকিয়ে ফেলেছিস! না বুঝেশুনে কেন যে লাইন মারতে যাস। উদ্বেগ, বিরক্তি একসঙ্গে জানায় জয়দীপ। তারপর হাঁক দেয়, ইমন একবার এদিকে শুনে যা প্লিজ। কঠিন প্যাঁচে পড়লে এই বন্ধুরা বরাবরই ইমনের শরণাপন্ন হয়।ঞ্জবিবেচনাবোধ ইমনের বেশি। বন্ধুরা খানিকটা সমীহ করে চলে সেই কারণেই। ইমন পায়ে পায়ে গিয়ে দাঁড়ায় জয়দীপ, কৌশিকের কাছে। কৌশিক সমস্যাটা আবার করে বলতে যাচ্ছিল, ইমন বলল শুনেছি। তোর কাছে কী আশা করছে মেয়েটা?

– আশা করলে তবু হতো। পূরণের জন্য টাইম দেয় মানুষ। এ তো সময়ই দিচ্ছে না। সারাক্ষণ সেঁটে থাকতে চাইছে। তুই ঠিকই বলেছিলি, বার খাওয়ানো ভুল হয়ে গেছে মেয়েটাকে। ও সত্যিই ধরে নিয়েছে, আমি ওকে লাইক করেছি।

কৌশিকের কথা শুনতে শুনতে চারপাশে চোখ বোলাচ্ছিল ইমন, খানিক দূরে ভিড়ের মধ্যে দেখতে পায় শ্যামলা, ঝাঁকড়়া চুলের নমিতাকে। মেলায় হারিয়ে যাওয়ার মতো মেয়েটা এলোমেলো ঘুরে খুঁজছে অবশ্যই কৌশিককেই। ইমন এগিয়ে যায় নমিতাকে লক্ষ্য করে। কৌশিককে আড়াল করার জন্য কিছু একটা করতে হবে।ঞ্জনিজের ভুল বুঝতে পেরেছে কৌশিক।

যেন হঠাৎ দেখতে পেয়েছে, এইভাবে নমিতার সামনে গিয়ে দাঁড়াল ইমন। বলল, আরেঃ, তুমি একা! বড়োরা কোথায়?

– দাদু, দিদা আসেনি। হোটেলেই আছে।

মেয়েটার গলা প্রথম শুনল ইমন। কণ্ঠস্বরে ‘বালিকা’ভাব এখনও কাটেনি। হলিডে হোম যে হোটেল নয়, শেখায়নি মালিক, মালকিন। অথচ নিজেদের দাদু-দিদা বলে ডাকতে শিখিয়েছে। যাতে কাজ আদায় করতে সুবিধে হয়। ইমন বলে, একা একা সি-বিচে ঘোরা তোমার ঠিক হচ্ছে না। এখানে অনেক খারাপ লোকজন ঘুরঘুর করে।

– আমি চান করতে এসেছিলাম। কৌশিকদা বলেছিল করিয়ে দেবে। এখানে এসে একবার দেখলাম কৌশিকদাকে। তারপর কোথায় যে চলে গেল! আপনি দেখেছেন আপনার বন্ধুকে?

যেন ভীষণ মজার কোনও জোক শুনল ইমন, সেরকমই হেসে বলল, কৌশিক তোমাকে চান করাবে! ও ব্যাটা নিজেই ভীতুর ডিম। ইয়ার্কি মেরেছে তোমার সঙ্গে।

এত রোদ সত্ত্বেও ছায়া নেমে এল নমিতার মুখে। বলল, এখানে এসে থেকে একদিনও সমুদ্রে চান করিনি। দাদু-দিদা করবে না বলে দিয়েছে। আপনি একটু জলে গিয়ে আমাকে ধরবেন? দু’তিনটে ডুব দিয়েই চলে আসব।

– আমি কৌশিকের চেয়েও বেশি ভয় পাই সমুদ্রে নামতে। নুলিয়া খুঁজতে বেরিয়েছি। দেখাও পাচ্ছি না তাদের।

ইমনের সাহায্য পাবে না বুঝে নিয়ে ফের ঘাড় ঘুরিয়ে কৌশিককে খুঁজতে থাকে নমিতা। ইমন বোঝানোর সুরে বলে, দাদু-দিদাকে সঙ্গে নিয়ে একদিন এসো। নুলিয়ার হেল্প নিয়ে তবেই চান কোরো। দুমদাম কারওর ওপর ভরসা করা উচিত হবে না।

ঘুরিয়ে কৌশিকের থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিল ইমন। ডবল মিনিং ধরার শিক্ষা মেয়েটার নেই। ইন্সটিঙ্কট্ থেকে যদি কিছু বুঝতে পারে ভালো। ইমনের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে ফেরার পথে এগোল নমিতা। নিরাশ ভঙ্গিতে বালি ভেঙে হেঁটে যাচ্ছে মেয়েটা। মায়া লাগে ইমনের। বেচারিকে ধরে থেকে একবার চান করিয়ে দিলে হতো। ঝুঁকিটা নিতে পারল না ইমন। ঢেউয়ের ভয়ে নমিতা যদি জাপটে ধরত ইমনকে, তিনবন্ধু আওয়াজ দিতে ছাড়ত না। বলত, তোরও তো লোভ কম নয়!

সকাল থেকে সন্ধে কনডাক্টেড টুর করে কাটল আজ। কোনারক, চন্দ্রভাগা বিচ, নন্দনকানন, উদয়গিরি খণ্ডগিরিঃ সব ঘুরে বিকেল উতরে হলিডে হোমে ফিরেছে চারবন্ধু। প্রত্যেকেই অত্যন্ত ক্লান্ত, তাই বিচে না গিয়ে ঘরেই রেস্ট নিচ্ছে। ট্রেনের মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা বন্ধুদের বলেছে ইমন। আজ আর তাকে খোঁজা হল না। ইমনের ইচ্ছে থাকলেও, বাকিদের মতো তারও এনার্জি অবশিষ্ট নেই। কাল চেষ্টা করে দেখা যাবে। যদিও সেটাই হবে যোগাযোগের শেষ চেষ্টা।ঞ্জকাল রাত আটটার ট্রেনে ফিরে যাবে ইমনরা।

টুর করে যতই টায়ার্ড থাকুক, সন্ধের মুখে তো ঘুমিয়ে পড়া যায় না। ইমন তাই বিছানায় শুয়ে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা গল্পের বইটা পড়ছে। বাকি তিনজনের বই পড়ার ঝোঁক প্রায় নেই বললেই চলে। ওরা তাস খেলছে বিছানাতেই। ব্রে খেলছে। পার্থ খেলতে খেলতে উঠে গেছে অনেকক্ষণ হল। এখন জয়দীপ আর কৌশিক খেলছে। পার্থর না-ফেরা নিয়ে দু’জনের কোনও হঁশ নেই। কোথায় গেল পার্থ? হলিডে হোমের বাইরে বেরিয়ে গেল কী? কিছু বলে গেল না তো! উপুড় হয়ে বই পড়া অবস্থা থেকে ঘাড় ফেরায় ইমন। দুই বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে, পার্থ কোথায় গেল রে? এখনও ফিরছে না!

দু’জনেই মন দিয়ে তাস খেলছে। পার্থর অ্যাবসেন্স নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। এক রাউন্ড শেষ হল। হাতের তাস ফেলে কৌশিক বলল, যাই, দেখে আসি। কোথায় গেল ব্যাটা।

কৌশিক বেরিয়ে যাওয়ার খানিক বাদেই ফিরে এল পার্থ। কোনও একটা কাজ সমাধা করে আসার ভঙ্গি। বসল কৌশিকের ছেড়ে যাওয়া জায়গায়। কোথায় গিয়েছিল, তা নিয়ে জয়দীপ ওকে কোনও প্রশ্নই করল না। দু’জনে মিলে তাস খেলতে লাগল। ইমনের খটকা লাগে, মনে হয় জয়দীপ জানে, পার্থ গিয়েছিল কোথায়। আন্দাজ খুব ভুল না হলে, কৌশিক গেছে সেখানেই। তিনজনের মধ্যে কোনও একটা গটআপ চলছে। ব্যাপারটা ইমনের কাছে গোপন করছে ওরা। ইমন পার্থকে জিজ্ঞেস করে, কোথায় ছিলি এতক্ষণ?

কথাটা যেন শুনতেই পেল না পার্থ, একমনে তাস খেলে যাচ্ছে। দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করে কোনও লাভ হবে না বুঝতে পারে ইমন। তিনজন মিলে গোলমাল পাকাচ্ছে কিছু। গ্রুপের মেম্বার হিসেবে যার দায়ভার ইমনের ওপরেও বর্তাবে। বিষয়টা সরেজমিনে দেখতে হবে। বই মাথার কাছে উলটে রেখে বিছানা থেকে নেমে আসে ইমন। পায়ে পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।

চৌকাঠ ডিঙোনোর পর ইমন করিডোরের বাঁদিকটা দেখে, ওদিকে নীচে যাওয়ার সিঁড়ি। কৌশিক কি ওইদিকেই গেল? না কি বুড়ো-বুড়ির পোর্শনে? আগে ভিতরদিকটা দেখে নেওয়া যাক, ভেবে ইমন বুড়ো-বুড়ির রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। আলো-অন্ধকার কিচেন কাম ডাইনিং-এর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় অন্যরকম একটা চাপা ঝটাপটির শব্দে ঘাড় ফেরায়, মুহূর্তের মধ্যে সারা শরীর যেন বরফের চাঁই হয়ে যায় ইমনের। কিচেন-ডাইনিং-এর ফ্লোরে প্রায় অনাবৃত দুটো শরীর দমচাপা ধস্তাধস্তি করে সেক্স-এ মেতেছে! একজন কৌশিক, অন্যজন নমিতা।…

আপ্রাণ প্রয়াসে নিজের জড়ত্ব কাটিয়ে ইমন দৌড়ে রুমে ফিরে আসে। নির্বিকার চিত্তে তাস খেলারও দুই বন্ধুর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলতে চায়, এ সব কী হচ্ছে! গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোয় না। ভিতরটা রাগে উত্তেজনায় কাঁপছে। বিছানার কাছে এগিয়ে আসে ইমন। জয়দীপের কাঁধ ধরে নিজের দিকে ফেরানোর টান দেয়। গড়গড়ানির গলায় বলে, এগুলো নোংরামি, অন্যায়। তুই সব জেনেও কিছু বলছিস না!

জয়দীপকে একথা বলার কারণ আছে। বাকি দু’জনের মতো লাইট হার্টেড ও নয়। লম্বা চওড়া চেহারার মধ্যে একটা পার্সোনালিটি আছে। শ্রেয়ার সঙ্গে ওর রিলেশনটাও খুব স্টেডি। জয়দীপ কিন্তু প্রত্যাশা মতো উত্তর দিল না। ইমনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কীসের নোংরামি, কীসেরইবা অন্যায়? কোনারক মন্দিরের গায়ে যেগুলো দেখে এলি, সেসব তাহলে কী? মেয়েটা দিচ্ছে, তাই নিচ্ছে। জোর তো কিছু করছে না।

ইমনের বলতে ইচ্ছে করে, মেয়েটা কী খোয়াচ্ছে নিজেই জানে না। জানার বয়স বা বুদ্ধি কোনওটাই ওর হয়নি। ইমন জানে কথাগুলো স্বর হয়ে বেরোবে না গলা দিয়ে। গলা চোক্ড হয়ে গেছে তার। মাথাটাও ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। প্রায় টলতে টলতে ফিরে আসে, যেখানে শুয়েছিল। দু’হাতে মাথা রেখে বসে থাকে। চিন্তাশক্তি ক্রমশ লোপ পাচ্ছে ইমনের। কিছুই ভাবতে পারছে না।

এরই মাঝে কানে আসে এই ফ্লোরের বৃদ্ধের গলা। অসহায় গলায় ডাকছেন, নমিতা! নমিতা! কোথায় গেলি! নমিতা… টেনশন হতে থাকে ইমনের, বৃদ্ধ কি ঘর থেকে বেরিয়ে নমিতাকে খুঁজতে বেরোবেন? ধরা পড়ে যাবে কৌশিক? ফাঁস হয়ে যাবে ইমনদের গ্রুপটার কদর্য রূপ!

…থেমে গেছে বৃদ্ধের ডাক। আরও খানিকক্ষণ পর কৌশিকের গলা পাওয়া গেল। ফিরে এসেছে রুমে। বলল, জয়দীপ, যা এবার।

অবশ চেতনাতেও ধাক্বা লাগে ইমনের। বাকি দু’জনের চেয়ে একটু হলেও জয়দীপ বেশি ক্লোজ তার। জয়দীপের সঙ্গে শ্রেয়ার স্কুলে গেছে ইমন। জয়দীপই নিয়ে গেছে বেশ কয়েকবার। ইমনের মনের চোখে বারবার ভেসে উঠছে শ্রেয়ার সহজ সুন্দর হাসিহাসি মুখটা। জয়দীপকে কিছুতেই এই নোংরামির মধ্যে যেতে দেওয়া যাবে না। আটকাতেই হবে। ইমন ঘুরে গিয়ে জয়দীপের হাতটা ধরবে ভাবে, তার অনেক আগেই উঠে গেছে জয়দীপ। ঘরের চৌকাঠ ডিঙোচ্ছে।

ইমন আবার মাথা রাখে হাতের তালুতে। আরও ঘোলাটে হয়ে গেছে মাথা। অন্ধকার সমুদ্রের ঢেউ ধেয়ে আসছে চেতনায়। এই ঢেউ নিকষ কালো, ফসফরাসের আলো নেই এতে।

কতটা সময় কেটে গেল, কে জানে! রুমে ফিরে এল জয়দীপ। বলল, ইমন, যাবি তো যা। এক্সপিরিয়েন্স করে নে। এরকম হাতে-কলমে সুযোগ সহজে পাবি না।

কথাগুলো কোনও প্রভাব ফেলতে পারল না ইমনের মনে। যেন তার উদ্দেশ্যে বলা হয়নি। বন্ধুদের থেকে কেমন এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা বোধ করছে সে। রুমটা যেন একটা ডরমেটরি, বাকি তিন আবাসিকের সঙ্গে কোনও পূর্ব পরিচয় নেই তার।

ইমন বিছানা ছেড়ে উঠে পাঞ্জাবির পকেটে পার্স, মোবাইল নেয়। এগিয়ে যায় দরজার দিকে। করিডোরে এসে সিঁড়ির দিকে ঘুরতে যাবে, স্লিপার ছেড়ে বাইরে বেরোনোর চটি পরে নিয়েছে, একবার বাঁদিকটা দেখে, ম্যাক্সি পরা নমিতা দাঁড়িয়ে আছে। চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি, আহ্বান নেই। আছে বোবা অপেক্ষার আকুলতা। আহ্বানের ছলনা জানার বয়স হয়নি মেয়েটার।

স্বর্গদ্বারের মোড়ে জমজম করছে মার্কেট। রাত বেশি হয়নি, সবে আটটা। রাস্তায় এত আলো, লোক, কেনাকাটা… এসব দেখে বিশ্বাসই হবে না, কিছু সময় আগে এখানকারই এক হলিডে হোমের আলো-অন্ধকার ঘরে কত বড়ো অন্যায় ঘটে গেছে।

মার্কেট ঘুরতে ঘুরতে ঘটনার অভিঘাত অনেকটাই কাটিয়ে ফেলেছে ইমন। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে এই তিনবন্ধুর সঙ্গে কোনও সম্পর্ক রাখবে না। কাল সকালে যে-কোনও ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরে যাবে সে। উইদাউট রিজার্ভেশনে কষ্ট করেই যাবে। আজ রাতেই যেতে পারত। সাড়ে দশটায় এক্সপ্রেস আছে একটা। বাড়ির জন্য কিছুই কেনাকাটা হয়নি, এমনকী পুরীর বিখ্যাত খাজাও কেনেনি। বাবা বলেছিল ঘনিষ্ঠ পরিচিতজনদের জন্য কিছু না কিছু নিতে। তার জন্য আলাদা টাকাও দিয়েছে। সেই কারণেই সঙ্গে পার্স নিয়ে বেরিয়েছে ইমন। কিন্তু এতক্ষণ ঘোরাঘুরির পর এখনও ঠিক করতে পারছে না, কার জন্য কী কিনবে।

একা একা এধরনের শপিং আগে তো কখনও করেনি। বড়ো কারওর গাইডেন্স পেলে ভালো হতো। এখানে রঞ্জনদা-পলা বউদি হেল্পটা করতে পারে, দেখা হয়ে গেলে খুবই সুবিধে হয়। ভাবনা হোঁচট খায় খানিক দূরে একটা কাপড়-জামার দোকানের সামনে চোখ যেতে। ট্রেনের মেয়েটা না? হ্যাঁ, ট্রেনের মেয়েটাই। বেশি চেনা যাচ্ছে সাদা ড্রেসের জন্য। এখন চুড়িদার। মেয়েটা শুধু সাদা পোশাকই পছন্দ করে কেন?

কোনও জড়তা ছাড়াই ইমন মেয়েটাকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যায়। যে করে হোক আলাপ করতে হবে। জেনে নিতে হবে ঠিকানা। পুরীতে এসে ওই মেয়েটার সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়াটা ইমনের একমাত্র প্রাপ্তি। ওর পাহাড়ি ঝরনার মতো হাসিটাই ভুলিয়ে দিতে পারবে পুরীর গ্লানিময় অভিজ্ঞতা।

পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই সামান্য চমকে ঘাড় ফেরায় মেয়েটা। ইমন বলে, বাড়ির আর সবাই কোথায়?

চোখের ইশারায় দোকানের ভিতরটা দেখায়। বলে, বড্ড গরম। বাইরে চলে এসেছি।

– নাম? জিজ্ঞেস করে ইমন।

দোকানের ভিতরে বাড়ির লোকের দিকে খেয়াল রেখে মেয়েটা বলে, নাম জেনে কী লাভ হবে? জপ করবে?

স্মার্ট আছে মেয়েটা। সত্যিই তো শুধু নাম জেনে তো আর যোগাযোগ রাখা যাবে না। নিজেকে শুধরে নিয়ে ইমন বলল, ফোন নাম্বার দাও।

– নিজের ফোন সেটটা বার করো তাড়াতাড়ি। দশটা ডিজিট বলার মতো টাইম পাব না, মনে হচ্ছে। নিশ্চয়ই রাখতে পারবে না মনে?

না, পারবে না ইমন। অন্য সময় হলে তবু চেষ্টা করা যেত। হঠাৎই এখন ভীষণ নার্ভাস ফিল করছে। কাঁপা হাতে পাঞ্জাবির পকেট থেকে ফোনসেট বার করে ইমন। মেয়েটা বলতে শুরু করেছে, নাইন এইট… দোকানের ভিতর থেকে মহিলা কণ্ঠ ডাকে, তুলতুল, এদিকে আয় একবার। কী হল আয়!

ইমনের দিকে না তাকিয়ে মেয়েটা বলল, মা ডাকছে। কাল রাতের ট্রেনে ফিরছি। আমাদের হলিডে হোমের দিকেও আসতে পারো দিনের বেলা।

দোকানে ঢুকে গেল তুলতুল। বাড়ির আদরের নাম নিশ্চয়ই এটা। আসল নামটা জনা হল না। কন্ট্যাক্ট রাখারও ব্যবস্থা করা গেল না কোনও। আবার কালকের দিনটার জন্য প্রতীক্ষা।

তুলতুল রাতের ট্রেনে ফিরবে বলে ইমন সকালের ট্রেন ধরে কলকাতায় ফিরে যায়নি। রয়ে গেছে পুরীতে। ওই ঘটনার পর তিনবন্ধুর সঙ্গে একটা কথাও বলেনি, নিজের মতো থেকেছে। বন্ধুরাও ওকে ঘাঁটায়নি। সকালে ওরা স্নান করতে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইমন বেরিয়েছে। সি-বিচে একা ঘুরেঘুরে খুঁজেছে তুলতুলকে। পায়নি। স্নান করেছে একাই। বন্ধুদের সঙ্গে লাঞ্চও করেনি। বাইরে গিয়ে নিজের মতো খেয়ে নিয়েছে। দুপুরে ঘণ্টা তিনেক রেস্ট নিল। তারপর বেরিয়ে পড়েছে তুলতুলের খোঁজে। তিনবন্ধু অকাতরে ঘুমোচ্ছিল দুপুরে। নমিতার জন্য ছোঁকছোঁক করতে দেখা যায়নি। ইমনের অ্যাটিটিউড দেখেই ওরা একটু সমঝে গেছে। তবে ইমনের অবর্তমানে এখন কী করছে কে জানে। যাই করুক, ইমন এসব নিয়ে মাথা ঘামাবে না। নিজের জীবন থেকে ওদের ছেঁটে ফেলেছে।

এদিকে ইমন যে-উদ্দেশ্যে বিকেলে বেরোল, তা সফল হয়নি। দেখা পাওয়া যায়নি তুলতুলের। মেয়েটার বাবা সি-বিচে দাঁড়িয়ে যেদিকে আঙুল তুলে বলেছিল, ওই হোটেলের পিছনে হলিডে হোমে আছিঃ সেখানে পরপর অনেকগুলো হলিডে হোম। ইমন ক্রমান্বয়ে পাক খেয়ে তুলতুলের হদিশ পায়নি। তারপর আন্দাজ করেছে, হয়তো মার্কেটে গেছে ওরা। ফ্যামিলি নিয়ে আসা বাঙালি টুরিস্টরা শেষবেলায় আরও একবার শপিং করবেই। প্রথমবার কিছু জিনিস কিনব ভেবেও কেনা হয়নি, মনে পড়েনি দু’একজন নিকটজনের কথা, সেই সব মিটিয়ে তবেই বাড়ি ফেরার জন্য প্যাকিং করবে।

মার্কেটেও ওদের দেখা পেল না ইমন। বাড়ি এবং আত্মীয়স্বজনের জন্য নিজেই কিছু কিনল। আগের সন্ধেতে কেনা হয়নি। দু’হাতে প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ ঝুলিয়ে ইমন এখন হলিডে হোমে ফিরছে। ভীষণভাবে দমে আছে মনটা। এতটা হতাশ হওয়ার কারণ, তুলতুল জানিয়েছিল রাতের ট্রেনে ফিরবে। কোন ট্রেনে ফিরবে বলেনি। রাতের দিকে দুটো এক্সপ্রেস ট্রেন, একটা আটটায়, যেটাতে রিজার্ভেশন আছে ইমনদের। অন্যটা সাড়ে দশটায়। তুলতুলরা যদি পরের ট্রেনে ফেরে, ইমনের সঙ্গে কোনওদিন আর দেখাই হবে না। মেয়েটা ফেসবুকে আছে কিনা, কে জানে! থাকলেও কী নামে আছে, নিজের ছবি দেয়নি হয়তো, খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। মেয়েটাকে এভাবে হারিয়ে ফেলাটা কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছে না ইমন। তুলতুল হল সেই মেয়ে, যাকে দেখে ইমনের প্রথমবার মনে হয়েছে, আমি তো এর অপেক্ষাতেই ছিলাম।

একটা কাজ করা যেতে পারে। ইমন লাগেজ নিয়ে নিজেদের ট্রেনের টাইমেই স্টেশনে পৌঁছোল, যদি দেখে তুলতুলরা উঠল না সেই ট্রেনে, ইমনও যাবে না। সাড়ে দশটার এক্সপ্রেসটা ধরবে। তুলতুলরা যাবে ওই ট্রেনেই। ইমন জেনারেল কম্পার্টমেন্টে উঠবে। হাওড়া স্টেশনে নেমে তুলতুলদের ফলো করে চিনে নেবে ওদের বাড়ি। মেয়েটা যেরকম রেসপন্স দিয়েছে, ইমনের প্রতি যে আগ্রহী, তাতে সন্দেহ থাকার কথা নয়… এত দূর ভাবতে পেরে নিশ্চিন্ত হয় ইমন। এই প্ল্যানটাই একেবারে অ্যাপ্রোপ্রিয়েট।

হলিডে হোমে পৌঁছে গেছে ইমন। দু’হাতে প্যাকেট নিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে। লাগেজ মোটামুটি গুছিয়ে রেখেছে। এই গিফ্টগুলো ব্যাগে ঢুকিয়ে নেবে। এখন বিকেল সাড়ে পাঁচটা, বন্ধুরা বলাবলি করছিল, ট্রেন ধরতে হলিডে হোম থেকে বেরোবে সাড়ে ছ’টা নাগাদ। ইমন ওদের সঙ্গে বেরোবে না। আগে পরে বেরিয়ে যাবে।

রুমে ঢুকে থমকে গেল ইমন। তিনবন্ধু ভীষণরকম গম্ভীরমুখে বিছানার তিনপ্রান্তে বসে আছে। পা মাটিতে নামানো। পরনে বাইরে বেরোনোর পোশাক। ওদের লাগেজগুলোও প্যাক করে রাখা চেন টানা অবস্থায়। ওরা ইমনের অপেক্ষা না করে ট্রেন ধরতে বেরিয়ে যাচ্ছিল, বোঝাই যাচ্ছে। কোনও একটা খবর শুনে মুলতুবি রেখেছে যাওয়া। সুখবর নয়, ওদের মুখ দেখেই আন্দাজ করা যায়। এত আগেই-বা স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছিল কেন? কিছুই মাথায় ঢুকছে না ইমনের। বাধ্য হয়ে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে, এনি থিং রং?

নার্ভাস গলায় জয়দীপ বলে ওঠে, হেভি ক্যাচাল হয়ে গেছে রে। মেয়েটা আমাদের সঙ্গে যেতে চাইছে।

ইমন এক চান্স-এ বুঝতে পারে কোন মেয়েটার কথা বলা হচ্ছে। আর একটু ক্লিয়ার হয়ে নিতে জিজ্ঞেস করে, আমাদের সঙ্গে যেতে চাইছে মানে?

– বুড়ো-বুড়িকে না জানিয়ে আমাদের সঙ্গে পালাবে। থাকবে আমাদের কাছেই। দুপুর থেকেই কথাটা বলছিল। আমরা ঘরে এনে অনেক বুঝিয়েছি। বোঝেনি। আমরা একটু তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ার তাল করছিলাম। দেখি, সে-ও ব্যাগ গুছিয়ে রেডি। টানা কথা বলে থামল কৌশিক।

এবার খেই ধরল পার্থ। বলল, যতবার মাইরি ব্যাগ নিয়ে বাইরে বেরোতে যাচ্ছি, দরজা আগলে দাঁড়াচ্ছে। ওকে না নিলে যেতে দেবে না।

ইমন ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ঠিক হয়েছে। মেয়েটার সঙ্গে যা করেছিস তোরা, এরকমটাই হওয়ার কথা ছিল। এখন ঠ্যালা সামলা।

জয়দীপ বলে, মাথা গরম করিস না ইমন। ব্যাপারটা ঠান্ডা মাথায় ভাব। মেয়েটাকে আমরা সঙ্গে নিয়ে যেতেই পারি। পুরী স্টেশনে হয়তো সম্ভব হবে না, হাওড়া স্টেশনের ভিড়ে ওকে ফেলে পালাতেই পারি চারজনে। সমস্যা অন্য জায়গায়, মেয়েটা পালিয়েছে টের পেলেই বুড়ো-বুড়ি যাবে লোকাল থানায়। তারপর মেয়ে পাচারকারী হিসেবে পুলিশ আমাদের অ্যারেস্ট করবে, আজ না হয় কাল। চারজনের কারওকেই ছাড়বে না।

পিঠ বেয়ে হিমস্রোত নেমে যায় ইমনের। সে নোংরামির মধ্যে না থাকলেও, পুলিশ তাকে রেহাই দেবে না। যাত্রাপথে ধরতে না পারলে, বাড়িতে গিয়ে অ্যারেস্ট করবে। বাবা-মা দৌড়োদৌড়ি করবে উকিল, আদালতে, এসব সে ভাবতেই পারে না। যে করে হোক এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে তাকে।

গিফটের প্যাকেটগুলো ফ্লোরে নামিয়ে রেখে ইমন দরজার দিকে ঘুরে যায়। বাইরে বেরোতেই দেখে, করিডোরের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে নমিতা। পরনে স্কার্ট, টপ। পায়ের কাছে পুরোনো লাগেজ ব্যাগ। অভিমান আর জেদে থমথম করছে ওর মুখ। ইমনের দিকে তাকাল, চোখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে, ও একেবারে মরিয়া।

ইমন নমিতার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। একটু সময় নিয়ে বলে, তুমি আমাদের সঙ্গে যেতে চাইছ?

মাথা ওপর নীচ করে ‘হ্যাঁ’ জানায় নমিতা। ইমন বলে, তোমার সঙ্গে ওরা যা করেছে, তুমি যেতে চাইতেই পারো। কিন্তু কার বাড়িতে গিয়ে থাকবে? একসঙ্গে তিনজনের বাড়িতে তো থাকা যায় না।

কোনও উত্তর দেয় না নমিতা। মাথা নীচু করে আছে। ইমন ফের বলে, ওই তিনজনের মধ্যে কাকে তুমি বেশি ভালবাসো? তাহলে তাকে গিয়ে আমি বলতে পারি তোমার দায়িত্ব নিতে।

এখনও কোনও উত্তর নেই। প্রেমের কীই-বা বোঝে মেয়েটা। ভালোবাসা, কামকে আলাদা করতে শেখেনি। দুটোকে একই মনে করে। যাকে ভালোবাসবে, তাকেই যে নিজের সমস্ত কিছু দেওয়া উচিত, সেই জ্ঞানটুকু নেই। তথাকথিত তিন ভদ্রঘরের ছেলের আদর পেয়ে ভেবেছে, এটাই বুঝি ভালোবাসা। বড়োঘরের এমনটাই রেওয়াজ। ইমন আবার বলে, কী হল, বলো একজনের নাম। কাকে তুমি ভালোবাসো? সমাজ পরিবার তো একসঙ্গে তিনজনকে ভালোবাসাটা মেনে নেবে না। একজনকে বেছে নিতেই হবে তোমায়।

মুখ তোলে নমিতা। চোখ থেকে জল গড়িয়ে নেমেছে গালে। ইমনের দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে বুকে। হতচকিত হয়ে পড়ে ইমন। ভীষণ রকম ফোঁপাচ্ছে নমিতা। ফুলে ফুলে কাঁদছে। এখন করণীয় কী, মেয়েটাকে কী বলে সান্ত্বনা দেবে কিছুই বুঝতে পারছে না ইমন। বুকে রাখা নমিতার মাথা আর পিঠে হাত রেখে ইমন ভাষাহীন সহমর্মিতা প্রকাশ করে।মেয়েটা কেঁদেই চলেছে। সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙে গেছে ওর। এসবের মধ্যেই ইমন আড়চোখে দেখে নিয়েছে তিনবন্ধু একে একে কেটে পড়ল তার পিছন দিয়ে। ফাঁকিটা টের পেল না নমিতা। এবার বেশ শব্দ করেই কাঁদছে সে, ইমনের টেনশন হচ্ছে, কান্নার আওয়াজে বুড়ো-বুড়ি না চলে আসে।

ফোন বেজে ওঠে ইমনের। সেটা কানে নিতেই ওপ্রান্ত থেকে জয়দীপ বলে আমরা অটো নিয়ে ওয়েট করছি। তাড়াতাড়ি কেটে আয়। তোর লাগেজ নিয়ে এসেছি।

লাইনটা কেটে মোবাইলটা পকেটে রাখে ইমন। খানিকটা জোর খাটিয়ে নমিতাকে বুক থেকে সরিয়ে বলে, দেখেছ কান্ড! ওরা তো বেরিয়ে গেল। দাঁড়াও ধরে নিয়ে আসি। একটা বিহিত তো করতেই হবে।

ছিটকে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায় ইমন। অসম্ভব দ্রুততায় নামতে থাকে নীচে। রাস্তায় এসে দেখে স্টার্ট নেওয়া অটোরিক্সা থেকে হাত বাড়িয়ে ডাকছে জয়দীপ। বলছে, কুইক, কুইক হারি আপ।

ট্রেন ছাড়ার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে প্ল্যাটফর্মে এল ইমনরা। এতটা সময় অটো করে পুরীর এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়েছে। নমিতাকে এড়ানোর জন্য এই সতর্কতা। চারজনকে ধরার জন্য প্ল্যাটফর্মে এসে বসে থাকে যদি ওই মেয়ে!

নিজেদের মধ্যে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে ভিড়ের মধ্যে মিশে ইমনরা এগোচ্ছে তাদের কামরার দিকে। সন্ধানী দৃষ্টি বুলিয়ে দেখে নিচ্ছে, মেয়েটা সত্যিই চলে এল কিনা?

নির্দিষ্ট কম্পার্টমেন্টের দরজায় পৌঁছে গেছে চারবন্ধু। জয়দীপ, পার্থ, কৌশিক সেঁদিয়ে গেল ভিতরে। সবশেষে ইমন, দরজার মুখে পা দিয়ে ট্রেনের পিছন দিকটা একবার দেখতে যেতেই বিদ্যুৎ খেলে গেল সারা শরীরে, নমিতা! উদভ্রান্তের মতো এপাশ ওপাশ তাকিয়ে খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে আসছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, ওর পরনে তুলতুলের সাদা ড্রেস!

ভিতরে ঢুকে এসেছে ইমন। থরথর করে কাঁপছে। বন্ধুদের বলে, মেয়েটা চলে এসেছে। খুঁজছে আমাদের।

– কী বলছিস তুই। বলে কৌতূহল সামলাতে না পেরে দরজার বাইরে মুখ বাড়ায় জয়দীপ, কারওকেই চোখে পড়ে না। ভিতরে ঢুকে এসে জয়দীপ বলল, কই, দেখলাম না তো!

– আছে, আছে। ড্রেস বদলে নিয়েছে। চিনতে পরিসনি। আমাদের বার্থে চল তাড়াতাড়ি। বলে ইমনই এগোতে থাকে প্রথমে।

পার্থ, কৌশিকের দিকে তাকায় জয়দীপ। তার মনে খটকা লেগেছে, মেয়েটা আসতেই পারে, ড্রেস চেঞ্জ করবে কেন? বাইরে বেরোনোর ড্রেস পরে সে তো রেডি হয়ে গিয়েছিল।

বার্থে পৌঁছে ইমন সেঁদিয়ে গেল একদম কোণায়। মাথা নীচু করে দু’হাতে মুখ আড়াল করেছে। গড়াতে শুরু করল ট্রেন। জয়দীপ বলল, অ্যাই ইমন, তুই কেন এমন করছিস! আমি তো দেখলাম না ওকে। ওটা তোর চোখের ভুল। ড্রেস চেঞ্জ করে সময় নষ্ট করতে যাবে কেন মেয়েটা!

ইমন কোনও উত্তর দেয় না। একই ভঙ্গিতে বসে থাকে। পোশাকটা হচ্ছে তুলতুলের সুখস্মৃতি, কঠিন বাস্তব হচ্ছে নমিতা। যে ধাওয়া করেছে ইমনকে। কিছুতেই ছাড়বে না। তিন ব্যভিচারীকে মেয়েটা পাহারায় রেখেছিল, ইমনের ওপর ভরসা করে আশ্রয়ের খোঁজ করেছিল সে। জানত না ইমনের সহমর্মীতা আসলে একটা চক্রান্ত। ফাঁকি দিয়ে চলে গেল তিন লম্পট। শর্ত, বিনিময়হীন যে বিশ্বাস ইমনের ওপর করেছিল নমিতা, তাতে আঘাত লাগলে সরাসরি আত্মা ক্ষতবিক্ষত হয়। ইমনকে সহজে ছাড়বে না নমিতা, জবাব চাইবে।

ট্রেন থামল পরবর্তী স্টেশনে। ফের চালু হয়েছে। ইমনের দেহভঙ্গিতে কোনও বদল নেই দেখে বন্ধুরা বলাবলি করছে, এরকম পাগলের মতো করছে কেন বল তো? কাকু-কাকিমাকে কী জবাব দেব?

মা-বাবাকে নিয়ে ইমনও ভাবছে। নমিতা তাকে ধাওয়া করে বাড়ি অবধি পৌঁছে যাবেই। বাবা বলেছিল, ‘কোনও বাজে স্মৃতি, খারাপ অভিজ্ঞতা নিয়ে বাড়ি ফিরবি না।’ শরীর জোড়া গ্লানি নিয়ে ফিরছে ইমন। নমিতা ট্রেনে উঠে পড়ছে, খুঁজছে ইমনকে। হাওড়া স্টেশনের ভিড়েও ওকে হারিয়ে ফেলা যাবে না। এতটাই একরোখা হয়ে উঠেছে সে। ইমনের তো এমনও মনে হচ্ছে, নমিতা যদি ট্রেনে উঠতে না-ও পারে, মুখ তুললেই ইমন দেখতে পাবে, জানলার বাইরে তুলতুলের সাদা পোশাক পরে ট্রেনের সঙ্গে দৌড়োচ্ছে মেয়েটা। তাকিয়ে আছে ইমনের দিকে। হাওড়া স্টেশনে নামাটা বোধহয় ঠিক হবে না ইমনের।

সাতদিন পর বেশ ক’টা খবরের কাগজে ‘নিরুদ্দেশের প্রতি’ বিজ্ঞাপনে ইমনের ছবি বেরোল। পুরী থেকে বাড়ি ফেরেনি ইমন। মাঝে কোনও স্টেশনে নেমে গেছে। বাড়ির লোক, আত্মীয়স্বজন সবাই ওকে খুঁজছে। ওই তিনবন্ধুও খুঁজছে, পুরীর ঘটনাটা চেপে গেছে সবার কাছে।

অনেক কাগজে বেরোনোর দরুন তুলতুল, নমিতার চোখেও নিশ্চয়ই পড়েছে বিজ্ঞাপনে ইমনের ছবিটা। দু’জনেই অস্থির হয়েছে খুব। দুই মেয়ে দু’রকম ভাবে বিশ্বাস করেছিল ইমনকে। আশপাশে ভরসা করার মতো যুবক দিনদিন দুর্লভ হয়ে যাচ্ছে। ইমনের মতো ছেলের হারিয়ে যাওয়াটা দু’জনেই মানতে পারবে না। বিজ্ঞাপনে ইমনদের বাড়ির ফোন নম্বর দেওয়া আছে। অনেক ফোন আসার মাঝে হয়তো বা দুই কণ্ঠস্বরের ফোন আসবে। কখনও তুলতুল, কখনও নমিতার। ওরা জানতে চাইবে, ইমন ফিরেছে?

সিদ্ধান্ত

‘তুমি কি তবে সম্বন্ধটা ভেঙে দেওয়ার কথা বলছ? জয়ের কথাটাতো একবার ভাবো। আর এটা যে সত্যি, তার প্রমাণই বা কী আছে?’ অনামিকাদেবী বেশ আশ্চর্য হয়েই জিজ্ঞাসা করলেন।

‘যা কিছু বলছি, তার সবটাই সত্যি। সমস্ত খোঁজখবর নিয়ে তবেই বলছি। যে-মেয়েটিকে তোমরা মা-ছেলে মিলে এবাড়ির পুত্রবধূ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছ, তার মায়ামাখা মুখের পেছনে রয়েছে এক কালিমাময় অতীত।’

এবার যেন ধাঁধায় পড়ে গেলেন অনামিকাদেবী। স্বামীকে প্রায় ধমকের সুরে বলে উঠলেন, ‘কী বলছ কি তুমি?’

একটু থেমে সুপ্রকাশ উত্তর দিলেন, ‘কথাগুলো শুনে আমিও আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কিন্তু বাস্তবটা বাস্তবই। ওই মেয়েটি মুর্শিদাবাদের গগনেন্দ্র চৌধুরির ভাগনি ঠিকই কিন্তু ও যে বলেছিল ওর বাবা-মা দুজনেই মৃত, এটা একেবারে ডাহা মিথ্যে। ওর বাবার কথা বলতে পারব না, তবে ওর মা কোনও নামজাদা ব্যক্তির রক্ষিতা।’

‘কোথাও কোনও ভুল হচ্ছে না তো?’

‘কেন বিশ্বাস করছ না… মুর্শিদাবাদে ওর মামার সঙ্গে কথা বলে বিয়ের সমস্ত কথাবার্তা ফাইনাল করে ফেরার পথেই ট্রেনে সুবিমলের সঙ্গে দেখা। ওর-ও তো মুর্শিদাবাদেই বাড়ি। জুঁইদের আশেপাশেই কোথায় যেন একটা! ওখানে যাওয়ার কারণ বলতে গিয়েই জানতে পারি, জুঁইয়ের মায়ের এই কুকীর্তির কথা। উনিই ওনার কুপথে অর্জিত টাকায় মেয়ের ভরণ-পোষণের সব দায়িত্ব সামলান। তাই প্রতি মাসেই বেশ মোটা অঙ্কের টাকা পাঠান মেয়েকে। গগনেন্দ্র চৌধুরী তো শুধু শিখন্ডী মাত্র।’

‘কী বলছ কী তুমি, আমি তো ভাবতেই পারছি না,’ বিস্মিত স্বরে বলে ওঠেন অনামিকাদেবী।

কিছুক্ষণের জন্য চুপ থেকে জয়ের বাবা সুপ্রকাশ আবার অনামিকাদেবীকে বলতে শুরু করেছিলেন। ‘কী জানি কেন, তবু সত্যিটা ঠিক মানতে পারছিলাম না। কেমন যেন একটা খটকা লাগছিল।  আর সেই কারণেই সেদিন বাড়ি ফিরে তোমাদের কিছু জানাইনি। মনে মনে ঠিক করেছিলাম, সঠিক জেনে তবেই তোমাদের বলব। সুবিমলের থেকে জানতে পেরেছিলাম যে, জুঁইয়ের মা এখন দেরাদুনে থাকেন। ঠিক করেছিলাম সেখানেই যাব। সেইমতো অফিসের টুর-এর নাম করে তিনদিন পরেই তৎকাল টিকিটে চলে গিয়েছিলাম দেরাদুন। ওখানে গিয়ে একটু খোঁজখবর করতেই জানতে পারি দেরাদুনে একটা প্রাইভেট সংস্থাতে টাইপিস্টের কাজ করতেন জুঁইয়ের মা বন্দনাদেবী। বর্তমানে তিনি ওই কোম্পানির মালিক রঞ্জন বাসুর রক্ষিতা।’

অনামিকাদেবী দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কেবল বোকার মতো তাকিয়ে থাকলেন সুপ্রকাশের মুখের দিকে। ‘এবার কী হবে? জয় যে ওকে খুব ভালোবাসে। আমার সুখের সংসারে এ কার নজর পড়ল? ও যে জুঁইকে নিয়ে কত স্বপ্ন সাজিয়ে রেখেছে। ওর এই স্বপ্ন বুনতে আমি যে নিজেই ওকে সাহায্য করেছি, আনন্দের সঙ্গে ওদের সম্পর্কের স্বীকৃতি দিয়েছি। এসব জানতে পারলে জয় যে একেবারে ভেঙে পড়বে।’

এমনিতে জয় আর জুঁইয়ের ভালোবাসার ব্যাপারে আলাদা করে বাড়িতে কিছুই জানাতে হয়নি জয়কে। কারণ কোনও কিছু বলার আগেই সবকিছু বুঝে গিয়েছিলেন অনামিকাদেবী। বছর চারেক আগে ছেলের জন্মদিনের পার্টি-তে হাজির ছিল ছেলের কলেজের বেশ কয়েকজন বন্ধুবান্ধব। তাদের মধ্যে জুঁইও ছিল। সকলের থেকে আলাদাভাবেই নজর কাড়ছিল প্রাণোচ্ছল, ফুটফুটে মেয়েটি। তার উপর অন্যান্যদের তুলনায় ছেলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতাই প্রমাণ করছিল তাদের সম্পর্কের অন্তরঙ্গতা।

জুঁইকে অপছন্দের কোনও জায়গাই ছিল না অনামিকাদেবীর। সুন্দরী তো বটেই, তার ব্যবহারটিও ছিল ফুলের মতো মিষ্টি। তার উপর আবার তার পিতৃমাতৃহীন হওয়াটা তাকে আরও অনামিকাদেবীর স্নেহের পাত্রী করে তুলেছিল।

কলকাতার নামিদামি স্কুল-কলেজে পড়ার কারণে ছোটো থেকেই সে হস্টেলে থেকেছে। শুধুমাত্র ছুটির দিনগুলোতে মুর্শিদাবাদে মামার বাড়ি ফিরত। ওই মামাই নাকি ভাগনিকে আদর-আহ্লাদে বড়ো করে তুলেছে। জুঁইয়ের অতীতের এইটুকু সংক্ষিপ্ত ইতিহাসই জানা ছিল তাদের।

অফিস থেকে ফিরে বাবাকে গম্ভীর দেখে কিছু বলার সাহস পেল না জয়। সোজা মায়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘মা, বাবার কী হয়েছে? ঝগড়া করেছ নাকি? কেমন একটা গুরুগম্ভীর মুখ করে যেন বসে আছে। ভয়ে কিছু বলারই সাহস পেলাম না। কিছু বললেই তো বলবে, তুই সবসময় আমারই দোষ দেখিস, তোর মা তো কোনও অন্যায়ই করতে পারে না। কেন ঝগড়া করো বাবা, মিটিয়ে নাও না।’

‘না রে, তুই যেটা ভাবছিস ব্যাপারটা তা নয়।’

‘তাহলে কী? বাবার অফিসের কিছু প্রবলেম?’

‘না রে। তোকে যে কীভাবে বলি?’

‘কী হয়েছে এত হেজিটেট করছ কেন? সকালে যখন অফিস গেলাম তখনও তো সব ঠিক ছিল। বাবাও তো বোধহয় অফিস টুর থেকে সন্ধেবেলাই ফিরেছে। তাহলে এইটুকু সময়ের মধ্যে কী এমন ঘটে গেল, যে আমাকে বলতে পারছ না। কী হয়েছে মা? প্লিজ, আমাকে বলো।’

‘কী বলব বলতো। আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না যে, জুঁই তোর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এমনও তো হতে পারে ও হয়তো ওর অতীত সম্পর্কে নিজেই কিছু জানে না। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতেও পারছি না আর মানতেও পারছি না। কিন্তু তোর বাবা যে নিজে সমস্ত খোঁজখবর নিয়ে তবেই বলছে। সে যে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে।’

‘কী যা তা বলছ! স্পষ্ট করে বলো। হেঁয়ালি কোরো না। আমি আর নিতে পারছি না।’

অনামিকাদেবী সমস্ত কিছু খুলে বললেন ছেলে জয়কে। কথাগুলো শোনার পরে বিস্ময়বিমূঢ়তা যেন তাকে একেবারে ঘিরে ধরল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে শান্তস্বরে মাকে বলল, ‘জুঁই জ্ঞানত ইচ্ছা করে আমার থেকে কিছু লুকিয়েছে, এটা একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নয় মা। অন্তত আমি এটা বিশ্বাস করতে পারছি না। চার-চারটে বছর ধরে আমাদের সম্পর্ক, ও আজ পর্যন্ত কোনও কিছু বলেনি বা লুকিয়েছে এরকম কোনওদিন হয়নি।’

‘ঠিক তোর মতো আমি ওকে জানি বলেই তো ব্যাপারটা মানতে পারছি না বাবু। কিন্তু তোর বাবা…।’

‘সব বুঝছি কিন্তু তুমি তো জানো মা ও কতটা ইনোসেন্ট, সহজ, সরল প্রকৃতির মেয়ে। আজ পর্যন্ত কারওর সঙ্গে উঁচু গলায় কথা বলেছে বলেও মনে হয় না। যে জীবনের কোনও জট-জটিলতা বোঝেই না, সে এত বড়ো একটা মিথ্যে– কিছু মনে কোরো না মা আমার মানতে কষ্ট হচ্ছে। বাবার বোধহয় কোথাও একটা ভুল হচ্ছে। আর ওর মায়ের ব্যাপারটা যদি সত্যি হয়েও থাকে, তাহলেও আমার কিছু এসে যায় না। তবু বলছি, তারপরেও যদি তোমার মনে হয় জুঁই আমাদের বাড়ির অনুপযুক্ত, ওর সঙ্গে আমার সম্পর্ক রাখাটা ঠিক নয়– তাহলে তোমার কথা ভেবে আমি ওর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দিতে রাজি। কিন্তু আমি জানি, আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার মা কখনও নিরপরাধ কাউকে শাস্তি দিতে পারে না। এখন সবকিছুই তোমার হাতে,’ বলেই উদ্ভ্রান্তের মতো ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সুপ্রকাশ ও অনামিকাদেবীর একমাত্র আদরের সন্তান জয়।

জয় বেরিয়ে গেলেও অনামিকাদেবী বেশ কিছুক্ষণ সেই জায়গাতেই বসে রইলেন। অহরহ শুধু ছেলের মুখটা তার চোখের সামনে ভাসতে থাকল। কথাগুলো বলার সময় কীভাবে বুকে পাথর চেপেছিল সে, তার সমস্তটাই ধরা পড়ছিল মায়ের চোখে। ছেলে কতটা কষ্ট পাচ্ছে, তা ভালোভাবেই অনুভব করতে পারছিলেন। ছেলে বলে হয়তো কাঁদতে পারেনি, মেয়ে হলে…।

সেদিন রাত্রে একটুও ঘুমোতে পারেননি অনামিকাদেবী। শুধু ছটফট করেছেন আর ভেবেছেন, কীভাবে এই রহস্যের শিকড়ে পৌঁছোনো যায়। সারারাত চিন্তা করে একটা সিদ্ধান্তও নিয়েছেন। সেইমতো পরদিন সকালে সুপ্রকাশবাবুকে জানান নিজের দেরাদুন যাওয়ার কথা।

প্রত্যুত্তরে সুপ্রকাশবাবু বলেন, ‘অনামিকা তুমি যাবে যখন ভেবেছ যাও। কিন্তু গিয়ে কোনও লাভ হবে বলে মনে হয় না।’

‘তবু যদি কিছু আশার আলো দেখা যায়।’

‘ঠিক আছে দু-তিন দিন বাদে যেও। আমি আজই দত্ত-দা-কে বলে টিকিটের ব্যবস্থা করছি। তবে তৎকালে গেলে খুব কষ্ট হবে তোমার।’

‘হোক কষ্ট। এই কষ্ট আমার ছেলের কষ্টের থেকে বেশি নয়। ওর জন্য আমাকে সবকিছু জানতেই হবে।’

পাশেই ডাইনিং টেবিলে বসে চা খাচ্ছিল জয়। মার কথা শুনে ধীরে ধীরে মাকে বলল, ‘মা তুমি দেরাদুন যাচ্ছ, আমি যাব তোমার সঙ্গে?’

‘না, আমি একাই যাব। আর হ্যাঁ, জুঁইকে এখনই এসব ব্যাপারে কিছু জানাবার দরকার নেই। আগে আমি ফিরি। তারপর…।’

নির্ধারিত দিন অনুযায়ী রওনা দেন অনামিকাদেবী। দীর্ঘ সফর শেষ করে যখন স্বামীর দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছোলেন, তখন তাঁর বিধ্বস্ত অবস্থা।

সামনে ছোট্ট সুন্দর একটা বাংলো, যার সামনের দিকটায় সুন্দর সুন্দর বিভিন্ন ধরনের বাহারি ফুলগাছের বাগান। গেট খুলে বাগান পেরিয়ে বাংলোর কলিংবেল বাজাতেই, একজন অল্পবয়সি যুবতি দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকে চাই?’

‘বন্দনাদেবী আছেন?’

‘হ্যাঁ আছেন। আপনি ভিতরে বসুন, আমি ডেকে দিচ্ছি’, বলে চলে যাচ্ছিল সে, কী ভেবে আবার ফিরে এসে বলল, ‘কিন্তু দিদিমণি যদি জিজ্ঞাসা করে কে, কোথা থেকে এসেছেন, তাহলে কী বলব?’

‘দিদিমণিকে বলো কলকাতা থেকে অনামিকা চ্যাটার্জী এসেছে দেখা করতে, বিশেষ কিছু প্রয়োজনে।’

‘ঠিক আছে আপনি বসুন। আমি এক্ষুনি ডেকে দিচ্ছি।’

মিনিট দুয়েকের মধ্যে উপর থেকে নেমে এলেন বছর পঁয়তাল্লিশের একজন মহিলা। দেখতেও বেশ সুন্দর, এমনকী তার দেহের বাঁধন-টাঁধনও এই বয়সে অটুট।

‘হ্যাঁ বলুন। কিন্তু আপনাকে তো ঠিক…।’

‘আমি কলকাতা থেকে আসছি। আমার পরিচয় দিলে হয়তো চিনলেও চিনতে পারেন। জয় আমার ছেলে…’ বাকি কথা বলার আর অবকাশই পেলেন না অনামিকাদেবী। তার কথা শেষ হওয়ার আগেই বন্দনাদেবী বলে উঠলেন, ‘জানি, আমার মেয়ে জুঁই আপনার ছেলেকে ভালোবাসে, শুধু তাই নয় বর্তমানে ওদের বিবাহও স্থির হয়ে গেছে, তাইতো?

কথার মাঝেই থামিয়ে দেওয়ার জন্য মাফ করবেন। কিন্তু এখন আপনারা কোনওভাবে জানতে পেরেছেন জুঁইয়ের অতীতের কথা, আর তাই ছুটে এসেছেন আমার কাছে। কী জানি কেন আমার মনটা ক’দিন ধরেই বলছিল, এরকম কিছু একটা ঘটতে পারে। গত সপ্তাহেই আমার দাদার ফোনে জানতে পারি কলকাতাতে জুঁইয়ের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। বাদ দিন এসব, এখন বলুন কী জানতে চাইছেন?’

জুঁইয়ের মায়ের কথাগুলো কেমন কেমন শুনতে লাগলেও অনামিকার কিছু করার ছিল না। তাকে সমস্ত কিছু জানতেই হবে। এটা তার ছেলের জীবনের ব্যাপার বলে কথা।

‘জুঁই শুধু আমার ছেলেরই নয় আমার এবং আমার স্বামীরও পছন্দের পাত্রী। ও আমাদের বলেছিল ছোটোবেলাতেই ওর মা-বাবা মারা গেছে। মামার কাছেই মানুষ। আমার স্বামী মুর্শিদাবাদ গিয়ে বিয়ের দিন পর্যন্ত ঠিক করে ফেলেছিলেন কিন্তু তার পরেই জানা গেল…।’

‘ওর মা বেঁচে আছে তাইতো? আপনি যা কিছু শুনেছেন সব সত্যি। আপনাকে শুধু এইটুকু বলতে পারি জুঁই এ সম্পর্কে সত্যিই কিছু জানে না। সুতরাং এর সঙ্গে ওকে জড়াবেন না। ও নিরপরাধ। জানি ও হয়তো আর আপনার ঘরের পুত্রবধূ হতে পারবে না। মা-বাবার কৃতকর্মের ফল সন্তানদেরই ভোগ করতে হয়। এর থেকে আর বেশি কী বলব!’

‘আমরা জুঁইকে কখনও দোষী ভাবিনি, কিন্তু আপনি এইরকম কাজ কেন করলেন? ক্ষমা করবেন, এটা আমার ছেলের জীবনের প্রশ্ন, তাই আপনাকে জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হলাম।’

‘আমি তো আপনাকে নিঃসংকোচে সমস্ত কিছু বলতেই পারি, কিন্তু তাতে কি কোনও লাভ হবে? আমার জীবনের সেই ভয়ংকর সত্যিটা শুনলেও, আপনার মন থেকে আমার প্রতি জন্মানো ঘৃণা-বিতৃষ্ণা বদলাবে না। তাহলে আর শুধুশুধু অতীতের এই বিষাদ ঘেঁটে লাভ কী বলুন। আমার মেয়েটা তো আর…’ করুণভাবে বলে ওঠেন বন্দনাদেবী।

‘লাভ হোক আর না হোক, এই সম্পর্ক ভাঙার পিছনে একটা সঠিক কারণ তো জয়কে জানাতে হবে। শুধু তাই নয় নিজের মনকে স্ত্বান্না দেওয়ারও একটা ব্যাপার আছে। ছেলের দৃঢ় বিশ্বাস তার মা কোনও অন্যায় করতে পারে না, কোনও নিরপরাধীকে শাস্তি দিতে পারে না, তাই তার এই বিশ্বাস আমি ভাঙতে চাই না। প্লিজ বন্দনাদেবী চুপ করে থাকবেন না। দয়া করে সত্যিটা বলুন। আপনাকে কথা দিচ্ছি, জুঁই, এর বিন্দুবিসর্গও জানবে না,’ বেশ উত্তেজিত হয়েই বলেন অনামিকাদেবী।

‘তাহলে শুনুন, আজ থেকে অনেক বছর আগেকার কথা। একদিন আমি আর আমার স্বামী দুজনেই ভাইপোর জন্মদিন সেরে মুর্শিদাবাদ থেকে শ্বশুরবাড়ি কলডোঙায় ফিরছিলাম। সেই সময় জুঁই ছোটো ছিল। আমার দাদার তিন ছেলে জবরদস্তি করে জুঁইকে রেখে দিল কয়েকদিনের জন্য। দাদাও ভাগনিকে খুব ভালোবাসত। তাই বাধ্য হলাম জুঁইকে কয়েকদিনের জন্য রেখে আসতে।

ফেরার পথে মাঝরাস্তাতেই যত বিপত্তি। হঠাৎই বেশ কয়েকজন দুষ্কৃতীর অতর্কিত আক্রমণে, বাসের সমস্ত যাত্রীই শিউরে উঠি। বাসের সিটে বসে থরথর করে কাঁপতে থাকি আমরা। সেই বিভীষিকাময় দিনটার কথা কোনওদিন বোধহয় ভোলা সম্ভব নয়। বাসের মধ্যে সর্বসাকুল্যে আট-দশ জন মহিলা ছিলাম। প্রথমেই মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে চলল লুঠতরাজ।’ বলতে বলতে হঠাৎই থেমে গিয়েছিলেন বন্দনাদেবী। অনামিকাদেবী লক্ষ্য করছিলেন কথাগুলো বলতে বলতে বন্দনাদেবীর চোখ-মুখ একেবারে ভয়ে লাল হয়ে উঠছিল।

‘তারপর? তারপর কী হল?’ বলে ওঠেন অনামিকাদেবী।

‘তারপর? তারপর শুরু হল মহিলাদের উপর নির্মম অত্যাচার। পুরুষদের চোখের সামনেই এক এক করে সব ক’টি মহিলাকে ধর্ষণ করতে থাকল ওই দুষ্কৃতীরা। আর পুরুষরা, অবশ্য পুরুষ কি কাপুরুষ জানি না, তারা তাদের প্রাণের ভয়ে চুপচাপ বসে বসে দেখল তাদের মা, বোন, স্ত্রীর সতীত্ব হরণ হতে। অবশ্য যে-দুজন এর প্রতিবাদ করতে গিয়েছিলেন, তাদের একেবারে সেইখানেই সারাজীবনের মতো মুখ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তার মধ্যে একজন ছিলেন আমার স্বামী। এরকম লজ্জাজনক ঘটনার পরেও সেদিন যে কেন পৃথিবী ফাঁক হয়ে ধরাতলে মিশে যাইনি, সেটাই আশ্চর্যের।

একের পর এক দুষ্কৃতীদের পাশবিক অত্যাচারে কখন যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম নিজেও জানি না। যখন জ্ঞান ফিরল তখন চারিদিকে কান্নার রোল। মনে পড়ে গেল পরিমল মানে আমার স্বামীর কথা। কোনওরকমে উঠে বসলাম। তারপর স্বামীর খোঁজ করতে জানতে পারলাম, যে-দু’জন ব্যক্তি দুষ্কৃতীদের হাতে মারা গিয়েছিল, দুষ্কৃতীরা যাবার আগে তাদের ভাগীরথীর জলে ভাসিয়ে দিয়ে গেছে। অসহায়ের মতো হাউহাউ করে কাঁদতে থাকলাম। মনে হতে থাকল ভোগ-লালসার শিকার হওয়া ঘৃণ্য এই দেহ শেষ করে দেব। নিজেও ভেসে যাব ওই ভাগীরথীর জলে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে গেল জুঁইয়ের কথা। বাবা তো গেলই, যদি আমিও চলে যাই তাহলে ওকে দেখবে কে?’ বলতে বলতে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে জুঁইয়ের মা।

লজ্জায় মাথা হেঁট করে নেন অনামিকাদেবী। নিজের মনে বলে ওঠেন, ‘বাসের সমস্ত পুরুষরা যদি সকলেই একসঙ্গে প্রতিবাদ করত তাহলে হয়তো এধরনের ঘটনা ঘটত না। যারা চোখের সামনে নিজের মা, বোন, স্ত্রীর সম্মানহানি চুপচাপ মেনে নিতে পারে, তাদের এ পৃথিবীতে থাকাটাই গর্হিত অপরাধ। আদতে তারাই এ পৃথিবীর বোঝা।

এই ধরনের ঘটনার পর সমস্ত মানুষ প্রশাসনের নিন্দায় মুখর হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রশাসনের পক্ষে কি দেশের সমস্ত মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব? তাহলে তো প্রত্যেক নাগরিকের সুরক্ষার্থে একটি করে বন্দুকধারী নিরাপত্তারক্ষী দিতে হয়, যাতে তারা বিপদের সময় তাদের উপর নির্ভর করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারে। নিজেকে বন্দনার জায়গায় কল্পনা করে নিয়ে ওই বিপর্যয়ের কথা ভাবতে চেষ্টা করলেন অনামিকদেবী।

মিনিট পাঁচেক পরে বন্দনাদেবী একটু শান্ত হতে অনামিকাদেবী আবার জিজ্ঞাসা করেন, ‘তারপরে কী করলেন?’

‘কোনওমতে পৌঁছোই দাদার কাছে। ভেবেছিলাম সবাই ফেলে দিলেও দাদা ফেলবে না। দাদার আশ্রয়েই বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। কিন্তু হায়। যে-দাদা বোন বলতে অজ্ঞান ছিল, সেই দাদাই সমস্ত কিছু শুনে, স্ত্বান্না দেওয়ার বদলে, আমাকে তক্ষুনি সেখান থেকে চলে যেতে বলল।

দাদার এই পরিবর্তন দেখে ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। প্রশ্ন শুধুমাত্র আমার একার নয়, আমার ফুলের মতো ছোট্ট মেয়েটারও ভবিষ্যৎও জুড়ে ছিল এর সঙ্গে।

যে-ভাগনিকে আদরের ঠেলায় অস্থির হতো তার মামা, সেদিন সেই ভাগনিই কাঁটা হয়ে গলায় বিঁধছিল তার। বহু অনুনয়-বিনয় করে কিছুতেই রাখতে চাইছিল না তাকে। অবশেষে কতকগুলো প্রতিজ্ঞা করিয়ে তবেই জুঁইকে আশ্রয় দিয়েছিল।

এক, আমার এই মুখ কখনও যেন তাকে আর দেখতে না হয়।

দুই, প্রতিমাসে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে জুঁইয়ের যাবতীয় খরচ যেন তার অ্যাকাউন্টে জমা করে দেওয়া হয়।

আর তিন, সেদিন থেকেই সবাই জানবে যে ওই দুর্ঘটনায় আমি এবং আমার স্বামী দুজনেই মৃত। এমনকী আমার মেয়েও কোনওদিন জানবে না যে আমি জীবিত।

আমার মেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সবকিছু মেনে নিয়ে মাথা নত করে বেরিয়ে এলাম। মেয়ের জন্য কষ্ট হলেও, উপায়ও তো আর কিছু ছিল না।’

‘এবার কিছুটা হলেও অাঁচ করতে পারছি, একজন একা সমর্থ মেয়ের সঙ্গে কী কী ঘটতে পারে। তবু আপনার মুখ থেকেই শুনি, দাদার বাড়ি থেকে বেরিয়ে কী করলেন? কোথায় গেলেন?’ বেশ কুণ্ঠিতভাবেই বলেন অনামিকাদেবী।

প্রত্যুত্তরে বন্দনাদেবী বলতে থাকেন, ‘কী আর করব ভাই, দাদার শর্ত মতো তখন আমি মৃত। তাই আমাকে শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে। সেই ফরমান অনুযায়ী হাতে হাজার তিনেক টাকা গুঁজে দিয়ে চিরতরে বিদায় দিয়েছিল আমাকে। সঙ্গে এও বলেছিল হাওড়া থেকে দূরপাল্লার কোনও ট্রেন ধরে নিতে। সেইমতো স্টেশনে পৌঁছে দেরাদুনগামী ট্রেনে চড়ে বসলাম। চলে এলাম এই শহরে। কত যে ঠোক্বর খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। পদে পদে অপমান, অভাব, অনটন কতই না সয়েছি। তার উপর মার রূপই আমার কাছে অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অপরদিকে জুঁইয়ের খরচ পাঠানোরও ব্যাপার ছিল। তখন ওকে মানুষ করাটাই ছিল আমার প্রধান লক্ষ্য। আর সেই জন্য আমি যে-কোনও কাজ করতেই রাজি ছিলাম।

একজন সুন্দরী মহিলার থেকে সমাজ কাজের বদলে টাকা নয়, পরিবর্তে অন্য কিছু চাইত। কীভাবে যে ওই হিংস্র জন্তুগুলোর থেকে নিজেকে বাঁচিয়েছি, তা বলার নয়। এভাবেই কেটে গেল একটা বছর। ধীরে ধীরে জুঁইও বড়ো হতে থাকল। ওর পড়ার খরচও বাড়তে থাকল। সেই সময়েই রঞ্জনবাবুর সঙ্গে পরিচয়।

আমার প্রয়োজনের কথা শুনে ওনার অফিসে টাইপিস্ট-এর পদে নিয়োগ করেন আমাকে। বোঝেনই তো সুরূপা একটি মহিলা, তার উপর আবার বাবুর নিয়োগ করা লোক হওয়ার কারণে সবসময়েই অফিসের অন্যান্য স্টাফদের থেকে নানা ধরনের নোংরা নোংরা কথা শুনতে হতো আমাকে। এক-এক সময় মনে হতো রঞ্জনবাবুকে সব জানাব, কিন্তু পরক্ষণেই জুঁইয়ের মুখটা ভেসে উঠত মুখের সামনে। জানাতে গিয়ে যদি উলটো ফল হয়, যদি কোনও কারণে চাকরিটা চলে যায়, তাই মুখ বুজে সব সহ্য করতাম।

একদিন কেবিনে বসে বসে রঞ্জনবাবু সবকিছু শুনে আমাকে ডেকে পাঠালেন। বিগত এক বছরে আমি কামাতুর পুরুষ ছাড়া কিছুই দেখিনি। হঠাৎই ওই মানুষটির সহানুভূতি পেয়ে ওনাকে আমার পূর্বের সব ইতিহাস খুলে বলি। তখন থেকেই উনি আমাকে বিশেষ স্নেহের চোখেই দেখেন।

একদিন উনি আমাকে ওনার বাড়িতে নিয়ে গেলেন, সেখানে পক্ষাঘাতে আক্রান্ত ওনার স্ত্রী বহুদিন ধরেই শয্যাশায়ী। আর কোনও দিন সুস্থ হবেন না জেনেই স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তখনই আমি একটা কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বললে হয়তো বিশ্বাস করবেন না, এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে আমার অন্য কোনও খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না। শুধুমাত্র নিজেকে এই সমাজের মুখোশধারী ব্যক্তিদের থেকে বাঁচানো আর মেয়ের উচ্চশিক্ষার অভিপ্রায়েই থেকে গেলাম ওনার বাড়িতে। মনে মনে এই ভেবে খুশি হয়েছিলাম যে, এতে অন্তত জুঁইকে তো ভালোভাবে মানুষ করতে পারব।

রঞ্জনবাবুর স্ত্রীর স্বীকৃতিতেই সম্মানের সঙ্গে থেকে গিয়েছিলাম ওখানে। যতদিন তিনি বেঁচেছিলেন ততদিন ওনাকে বড়োদিদির মতোই সেবা শুশ্রূষা করেছি। সুরক্ষা বলুন আর ভালোবাসাই বলুন তা তো কেবল ওনাদের থেকেই পেয়েছি। না হলে লোকে তো বেশ্যা বা রক্ষিতা কোনওটাই বলতে বাকি রাখে না। আপনিও একজন মহিলা, আপনি বলুন তো লোকে যে-যে ভাষায় আমাকে গালিগালাজ করে, আমি কি সত্যিই তার অধিকারী?’

‘মাফ করবেন বন্দনাদেবী। আমি কিছু না জেনেই আপনাকে ভুল ভেবেছি।’ ‘আবেগাপ্লুত হয়ে বন্দনাদেবীর হাত দুটো ধরে বলেন অনামিকাদেবী, ‘এবার আমি উঠব, দেখছি কত দূর কী করতে পারি!’

‘সব কিছু শোনার পরেও কি…’ কোথায় যেন আশার আলো দেখতে পায় জুঁইয়ের মা।

‘হ্যাঁ এখনই তো কিছু করার সময়। আচ্ছা খুব তাড়াতাড়ি দেখা হচ্ছে,’ এই বলে অনামিকাদেবী যে-গাড়িতে এসেছিলেন, তাতে করেই স্টেশনে ফিরে গেলেন।

কলকাতায় ফিরে সমস্ত কিছু জানান স্বামীকে অনামিকাদেবী। সঙ্গে সিদ্ধান্তও নেন যে জুঁই-ই তাদের বাড়ির পুত্রবধূ হবার যোগ্য, অন্য কেউ নয়।

‘তুমি যেটা বলছ মানছি। কিন্তু লোকে কী বলবে?’ বলে ওঠে সুপ্রকাশ।

‘লোকের কথা বাদ দাও তো। মানুষের কাজই তো শুধু অন্যের বদনাম করে বেড়ানো। জুঁই নিরপরাধ। ওর কোনও দোষ নেই। শুধু ওই কেন ওর মা-ও নির্দোষ। রঞ্জনবাবু যদি ওনাকে নিজের করে নিতে পারেন, নিজের স্ত্রীর মর্যাদায় রাখতে পারেন, তাহলে আমরা জুঁইকে ঠেলে সরিয়ে রাখব কেন? কোন অপরাধের সাজা মা-মেয়েকে দেব বলতে পার?’ উত্তেজিত হয়েই কথাগুলো বলেন উঠল জয়ের মা।

‘আমি কখন বলছি যে ওরা দোষী? কিন্তু…’

‘কিন্তু কীসের? প্রবল বর্ষণে বড়ো বড়ো কংক্রিটের অট্টালিকা পর্যন্ত বয়ে চলে যাচ্ছে, নদীর গতিপথ বদলে যাচ্ছে, সেখানে তো উনি একজন অসহায় নারী, ভাগ্যের পরিহাসে যাকে জীবনে নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তিনি নির্দোষ হওয়া সত্ত্বেও ভগবান তাকে চরম দণ্ডে দণ্ডিত করেছেন। তার নিরপরাধ সন্তান কেন সেই সাজা ভোগ করবে?’

অনামিকাদেবীর গম্ভীর স্বর বাবা-ছেলের হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হতে থাকল। বাবার কাছ থেকে উঠে গিয়ে মার কাঁধে মাথা রাখে জয়। তার মা শুধু তার বিশ্বাসই বজায় রাখেনি, তাকে তার প্রাণাধিক প্রিয় ভালোবাসাও ফিরিয়ে দিয়েছে।

পাপ

বোতলের অনেকটা তরল একসঙ্গে গলায় ঢালে বাচ্চু। আজ আর কিছুই ভালো লাগছে না। দুদিন ভালো করে খাওয়া হয়নি। সিগারেট খেলে বুকের ভেতরটা জ্বালা করে আজকাল। চলতে গেলে পা কাঁপে। অথচ বাচ্চুর চেহারা বেশ ভালোই ছিল। আগে নিয়মিত ব্যায়াম করত। পঞ্চাশ ইঞ্চি বুক ছিল। এখন সেসব স্বপ্ন মনে হয়। বাবা মারা যাওয়ার পর অভাব আর দারিদ্র্য যেন ওর জীবনের সঙ্গী হয়ে গেছে। পড়াশোনাটা ভালো করে করলে হয়তো একটা চাকরি পাওয়া যেত। একসময়ে স্বাস্থ্যের গৌরবে সে অচিরেই হয়ে উঠেছিল পাড়ার হিরো। কিন্তু এই হিরোই একসময় হয়ে উঠল এক চলমান ত্রাস। একজন অ্যান্টি সোশ্যাল। বাচ্চা থেকে বুড়ো সবাই বাচ্চুকে ভয় পেত। আর পাড়ার মেয়েদের তো নিশ্চিন্তে ঘোরাফেরা করার উপায়ই ছিল না। অথচ জীবনটা কীরকম বদলে গেল। মা সেই কোন ছোটোবেলায় মারা গেছে। তারপর বাবাও চলে গেল। একটা ছোটো বোনকে রেখে গেল বাচ্চুর জিম্মায়। রোজগারের কোনও নিশ্চয়তা নেই। কোনওমতে দিন চলে। কখনও রাজনৈতিক দলের হয়ে কাজ করে। আবার কখনও হয় বড়ো ব্যবসাদারের ভাড়া করা গুণ্ডা। দুবার জেলও খেটেছে বাচ্চু। বোনটা পাড়ার এক বুড়ি পিসিমার কাছেই মানুষ। এখন শরীরটাও চলে না। ক্ষমতায় এখন অন্য রাজনৈতিক দল। স্বাভাবিক কারণেই এখন বাচ্চুর রোজগারও কম হয়। বোনটা তো অসুখে ভুগে ভুগে কঙ্কালের রূপ নিয়েছে।

নেশার পাত্রটা শেষ করে চোখদুটো খুলল সে। রোখ চেপে যাওয়া গলায় বলল ‘ওঠ’। পাশে বসা মনু বলল, ‘গুরু বোতলটা শেষ করে গেলে হতো না?’

ক্লান্তস্বরে বাচ্চু বলল, ‘না ওটা ফেলে দে। আজ একবার শেঠ বাজোরিয়ার কাছে যেতে হবে। কিছু টাকার দরকার বুঝলি? বোনটাকে ওষুধপত্র না দিলে ও মরে যাবে।’

‘কাজ ছাড়া কি শেঠ টাকা দেবে?’

‘ওর বাপ দেবে। ওর জন্য আমি কম খুন, জখম করেছি?’

‘ওর তো এখন পেয়ারের লোক বিল্লে, যাকে তুমি হাতে ধরে বানিয়েছ।’ প্যান্টের পকেটে রাখা রামপুরী চাকুটা একবার অনুভব করল বাচ্চু। চোখদুটো লাল। দাঁতে দাঁত চেপে রাগে গর্জন করে উঠল। তারপর বলল, ‘আমি যদি টাকা না পাই তবে দুটোকে সাফ করে দেব।’

‘গুরু তার চেয়ে চামেলির ওখানে চলো। ও যদি কিছু টাকা দিতে পারে।’

‘ওই ভোগলালসার টাকা আমি ছুঁই না। তার থেকে কাঁচড়াপাড়ায় চল দেখি আমার ছোটো মামার থেকে কিছু পাই কিনা।’

স্বপনলালের চায়ের দোকানের পিছনে ওরা এতক্ষণ বসে ছিল। দোকান থেকে বেরোতে বেরোতে কী যেন একটু ভেবে নিয়ে মনুকে বলল, ‘তুই এখন যা, আমাকে একটু একা থাকতে দে।’

নানা জায়গায় ঘুরতে ঘুরতে চামেলির বস্তির সামনে এসে দাঁড়াল বাচ্চু। রাস্তার কলের জলে দু’চার জন মেয়েমানুষ বুকে গামছা জড়িয়ে স্নান করছিল। ফুটপাথের ওপর দু’চারটে বাচ্চা খেলা করছে। অদ্ভুত এদের জীবন। দুঃখটা কেমন সহজ করে মেনে নিয়েছে। কোনও আশা নেই প্রত্যাশা নেই শুধু কোনও রকমে বেঁচে থাকা। চামেলির ঘরের বাইরে টুলের ওপর ওর স্বামী বসে চা খাচ্ছিল। একটু হেসে বলল, ‘কি খবর বাচ্চুদা?’

বাচ্চু সে কথার জবাব না দিয়ে বলল, ‘চামেলি কোথায়?’

‘ঘরেই আছে। একটু ব্যস্ত আছে।’

চামেলির এই দেহদান বাচ্চুর একটুও ভালো লাগে না। পয়সার জোর থাকলে বড়ো বড়ো উপদেশ দেওয়া যায়। চামেলির চারটে বাচ্চা, তার ওপর ওর স্বামীর কোনও রোজগার নেই। মাঝে মাঝে ভাবে বাচ্চু, জীবনটা কি এতই সুন্দর যা কোনওভাবে বাঁচিয়ে রাখতেই হয়।

একটা সিগারেট ধরাল বাচ্চু। মাথাটা খুব ধরেছে। কী করবে সে। তারপর বলল, ‘আমি ঘুরে আসছি।’

চামেলির স্বামী বলল, ‘সেই ভালো, জানি না তো কতক্ষণ লাগবে।’

রাত বারোটার পর যখন চামেলির ঘরে ঢুকল বাচ্চু, চামেলি তখন ক্লান্ত। বড়ো বড়ো হাই উঠছে। বাচ্চাগুলো জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে আছে তেলচিটে বিছানাটাতে। চামেলি বলল, ‘হঠাৎ পথ ভুল করে এখানে?’

চৌকির ওপর বসতে বসতে বাচ্চু বলল, ‘বোনটার খুব অসুখ। তাই বেরিয়েছিলাম টাকার সন্ধানে।’

‘কী হয়েছে নীতার?’ অনেক জানার আগ্রহ চামেলির মুখে।

‘জানি না। তবে আজ ক’দিন ধরে কিছু খাচ্ছে না।’

‘ডাক্তার দেখিয়েছ?’

‘হ্যাঁ, ছোটোখাটো ডাক্তার দেখিয়েছি, কিছুই ধরতে পারছে না।’

‘কোনও বড়ো ডাক্তার দেখাও।’

একটু হাসল বাচ্চু, বলল, ‘খাবার পয়সা নেই ডাক্তার দেখাব!’

‘আমি পয়সা দেব, তুমি নীতাকে বাঁচাও।’

‘সে হয় না চামেলি। তোমার রোজগারের লজ্জা আমাকে দিনরাত কুরে কুরে খাবে।’

‘তবুও তুমি না কোরো না। আমি যদি আমার সমস্ত লজ্জা, ঘৃণা ত্যাগ করে আমার বাচ্চাদের বাঁচিয়ে রাখতে পারি, তবে নীতাকেও বাঁচাতে পারব। আমি বড়ো বড়ো শেঠের কাছে যাব। অনেক টাকা আনব।’

বাচ্চু হঠাৎ চামেলির মুখ চেপে ধরে, রাগে ওর শরীর জ্বলছে। বলে, ‘না। ওই পয়সাওয়ালা লোকদের ভোগের সামগ্রী হতে দেব না তোকে। এবার, যদি না পাই তবে ছিনিয়ে নেব। ওইসব বাড়ির মেয়েদের লাজলজ্জা আছে, আমাদের মা-বোনেদের নেই?’ চামেলির ঘর ছেড়ে রাস্তায় নেমে পড়ল বাচ্চু। মাথাটা কেমন ঘুরছে, কান গরম।

দুদিন পর বাড়ি ফিরল বাচ্চু। নীতার অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। ঘরের এককোণে নেতিয়ে পড়ে আছে মেয়েটা। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। চারদিন কিছু খায়নি। পাড়ার ডাক্তার জীবেনবাবু কোনও বড়ো ডাক্তারকে দেখাতে বলেছেন।

‘এখন কী করবে করো।’ পিসিমা রাগে গজগজ করতে করতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বাচ্চু নীতার মাথায় হাত দিল। জ্বরটা এখনও আছে। চোখের দু’ধারে শুকনো জলের দাগ। অচৈতন্যের মতো পড়ে আছে। কষ্টের ছাপ ওর মুখে।

বাচ্চু ডাকল, ‘নীতা’।

নীতা চোখ খুলে চেয়ে রইল।

‘খুব কষ্ট হচ্ছে না রে?’

নীতা কিছু বলল না।

‘একটু ফলের রস খাবি?’

নীতা মাথা নাড়ল।

‘একটু কিছু খেয়ে নে,’ মাথায় হাত বোলাল বাচ্চু।

‘ভীষণ কষ্ট হচ্ছে দাদা।’

‘কোথায় কষ্ট হচ্ছে বল।’

নীতা নিজের পেটের ওপর দৃষ্টি নামাল।

আবার বাচ্চু বলল, ‘খুব ব্যথা হচ্ছে নীতা?’

‘হ্যাঁ দাদা, ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা দাদা তুই বাড়ি আসিস না কেন? আমার কথা তোর একটুও মনে পড়ে না?’

বাচ্চুর চোখ ফেটে জল এল। ওর পেটে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, ‘তোর জন্য বড়ো ডাক্তারের কাছে যেতে হবে। অনেক টাকার দরকার তাই কাজ করি।’

‘তুই কত রোগা হয়ে গেছিস দাদা। আমার জন্য তোর কত পরিশ্রম।’

‘কথা বলিস না নীতা, ব্যথা বাড়বে।’

‘আমার একটুও ভালো লাগছে না দাদা, ব্যথাটা বাড়ছে। আমি মা-বাবার কাছে যাব। মা আমাকে কত ভালোবাসবে, আদর করবে। কত সুন্দর বই কিনে দেবে। আমি বাবার সঙ্গে বেড়াতে যাব। কত মজা হবে।’

জ্বরের ঘোরে ভুল বকতে থাকে নীতা। পিসিমা ঘরে ঢুকে বলল, ‘ব্যথাটা বাড়ল বুঝি? কী যে হল। আমি একটু গরম তেল মালিশ করে দেখি।’

বাচ্চু হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। নীতার অসহ্য কষ্ট আর দেখতে পারছে না। সমস্ত শরীরের ভেতর ওর অক্ষমতার জন্য একটা যন্ত্রণা বয়ে গেল। নীতাকে বাঁচতেই হবে। ওকে এরকম ভাবে মরতে দেবে না বাচ্চু। যে করেই হোক টাকা চাই।

শেঠ বাজোরিয়ার বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল বাচ্চু। গেটের দারোয়ান বাধা দিতেই বলল, ‘সাহেব ডেকেছে।’

আরও কয়েকবার বাচ্চু এবাড়িতে এসেছে। বাড়ির ভেতরে ঢুকেই চাকরকে বলল, ‘শেঠ সাহেবকে বল আমি এসেছি।’

চাকর ফিরে এসে জানাল, ‘সাহেব এখন বাইরে যাবে এখন দেখা হবে না।’ বাচ্চুর মাথায় তখন খুন চেপে গেছে। চাকরকে হাত দিয়ে সরিয়ে জোরে জোরে পা ফেলে সোজা বাজোরিয়ার বেডরুম-এ ঢুকল। শেঠ বাজোরিয়া তখন পোশাক বদলাচ্ছিল। ওকে দেখেই বলল, ‘তুই বেডরুম-এ কেন এলি?’

সারা শরীরে এক প্রচণ্ড হিংস্রতা ঘিরে আছে বাচ্চুর। বলল, ‘শেঠ আমার কিছু টাকার দরকার।’

‘রুপিয়া কি এমনিই আসে যে বললেই দিয়ে দেব!’

‘আমার বোনের খুব অসুখ শেঠ, কিছু টাকা দাও। হাতজোড় করছি।’

‘বোনের অসুখ তো আমি কী করব? যা না সরকারি হাসপাতালে।’

‘তোমার অনেক কাজ করেছি শেঠ, আমি আবার কাজ করে শোধ করে দেব।’

‘না তোকে আমার দরকার নেই। আমি তোর মতো কুত্তাকে আর ডাকব না। বেরিয়ে যা আমার ঘর থেকে।’

বাচ্চু আর থাকতে পারল না। মাথায় খুন চেপে গেছে। পকেট থেকে রামপুরী চাকুটা বার করল। তারপর চিৎকার করে উঠল, ‘টাকা আমার চাই।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে। তুই বস আমি আসছি।’ বাজোরিয়া বারান্দায় রাখা টেলিফোন তুলে বলল, ‘হ্যালো লালবাজার আমি…’ আর বলা হল না। প্রচণ্ড শক্তিতে বাচ্চু তখন ওর গলা টিপে ধরেছে। একটা গোঙানি ভেসে এল বাজোরিয়ার মুখ দিয়ে। তারপর বাচ্চুর হাতের রামপুরী চাকুর আঘাতে লুটিয়ে পড়ল বাজোরিয়ার দেহ। বাজোরিয়ার দেহটা নিথর হয়ে যেতেই বাচ্চুর হুঁশ এল। এটা সে কি করল! লোকটাকে সে মেলে ফেলল! এতটা যে খুন চেপে যাবে ও আগেও ভাবেনি। কিন্তু আর এখন কিছু ভাবার নেই। দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে রুদ্ধশ্বাসে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল বাচ্চু।

রাত অনেক হয়ে গেছে চারিদিক নিঃস্তব্ধ, রাস্তার কুকুরগুলো ঘেউ ঘেউ করছে। শীতের রাত্রি লোক চলাচলও কম। বাচ্চু চামেলির ঘরের দরজার কড়া নাড়ল। চামেলি জেগেই ছিল। খুব সেজেছে আজ চামেলি। ভালো নাইলন শাড়ি, কপালে লাল টিপ। চামেলির স্বামী ঘরে নেই। মাল টেনে কোথাও পড়ে আছে বোধহয়, বাচ্চাগুলো এককোণে শুয়ে ঘুমুচ্ছে।

দরজা খুলেই চামেলি জিজ্ঞেস করল, ‘এত রাতে কী ব্যাপার?’

বাচ্চু বলল, ‘আমাকে একটু জল দাও চামেলি। অনেকটা পথ হেঁটে এসেছি।’ বাচ্চু তখনও হাঁপাচ্ছে।

চামেলি বলল, ‘বসো আমি জল আনছি।’

জল খেয়ে বাচ্চু বলল, ‘আজকে একটা খারাপ কাজ করে ফেলেছি।’

‘আবার মারামারি করেছ? না তোমাকে নিয়ে আর পারা গেল না। তুমি না থাকলে নীতার কি হবে ভেবে দেখেছ একবার?’

চিৎকার করে উঠল বাচ্চু– ‘ওকথা বোলো না চামেলি। ওকথা বোলো না।’

তারপর চামেলির হাতদুটো জড়িয়ে ধরে বলল, ‘তুমি না একদিন বলেছিলে– নীতাকে বাঁচাবে।’

‘হ্যাঁ বলেছিলাম।’

‘তবে তুমি ওকে বাঁচাও চামেলি। আমার একান্ত অনুরোধ, বলো তুমি রাখবে?’

‘হ্যাঁ, সেই ভেবেই তো…। এখুনি বাজোরিয়া শেঠের গাড়ি আসবে, আমাকে নিয়ে যাবে ওর বাগান বাড়িতে দিন সাতেক থাকতে হবে, কিন্তু অনেক টাকা দেবে, জানো!’

বাচ্চুর শিরা দুটো দবদব করছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। এখন সে কী করবে? কোথায় পালাবে। কিছু কূলকিনারা পাচ্ছে না।

বাজোরিয়ার নামটা যেন তার বুকের ভেতর হাতুড়ি পিটছে। ওকেই তো কিছুক্ষণ আগে নিজের হাতে খুন করে এসেছে সে। ওতো আর কোনওদিন আসবে না চামেলিকে নিতে।

চামেলি পান খেতে খেতে বলল, ‘ও এখনও এল না লোকটা। টাকাটা পেয়ে নিই, তারপর দেখো আমি নীতাকে বাঁচাবই।’

বাচ্চুর মাথা ঘুরছে। এ কী করল সে! ওই টাকাও আর পাওয়া যাবে না। শুধু বাজোরিয়ার নয়, সে যে নীতারও প্রাণ নিয়ে ফেলেছে। সমস্ত পৃথিবী কাঁপছে। হাত মুঠি করে নিজের ভেতরের সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে সে বলল, ‘ওই শেঠ আর আসবে না চামেলি। আমি বাজোরিয়াকে খুন করে এসেছি নিজের হাতে।’ কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বাচ্চু।

‘এ তুমি কি করলে বাচ্চুদা। আমি যে অনেক কষ্টে এ টাকার বন্দোবস্ত করেছিলাম।’

‘আর বোলো না চামেলি। আমি নিজের হাতে দুটো প্রাণ নষ্ট করে দিলাম, আমাকে তুমি ক্ষমা করো।’

রাত্রির মধ্যম যাম। অনেকক্ষণ দুজনে চুপ করে বসে থাকে। তারপর উদভ্রান্তের মতো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যায় বাচ্চু। বড়ো রাস্তা পেরোলে ওপারেই সরকারি হাসপাতাল। আরও একটু এগোলেই মোড়ের মাথায় থানা।

 

বেলাশেষের বাসনা

সত্যি, পাণ্ডুলিপিটা যে কোথায় গেল!

শুভায়ু বারবার চিন্তা করে। ওর চেন-আঁটা শান্তিনিকেতন ব্যাগটা তন্নতন্ন করে খোঁজে। সবমিলে পনেরোটা গল্পের পাণ্ডুলিপি ছিল একসঙ্গে।

সবগুলোই জেরক্স কপি। শুধুমাত্র একটাই হাতে লেখা… আর সেটাই হারিয়ে গেছে।

আসলে একটা ফাইল নেওয়া হয়নি সেটাই ভুল হয়ে গেছে। বড়ো একটা বাদামি রঙের প্যাকেট বা বড়ো খাম, তাতে ঠাসাঠাসি করে কাগজগুলি ছিল। প্যাকেটের মুখ একটা জেমস্ ক্লিপ দিয়ে আঁটা ছিল।

অথচ কী করে যে পড়ে গেল— আশ্চর্য!

শুভায়ুর একটা ইচ্ছা ছিল। বেশ পুরোনো ইচ্ছা। সেটা হল একটা গল্প সংকলন প্রকাশ করা। এটা ও অনেকদিন থেকে ভেবে আসছে।

শুভায়ু যে একজন নামকরা সাহিত্যিক, তা নয়। লেখক হিসেবে মফসসল শহরে দু-চারটে পত্রপত্রিকায় গল্প ছাপিয়ে আর আসরে এক-আধটা গল্প পাঠ করে যে বিরাট কিছু হওয়া যায় না— তা সে জানে।

তবে যাচ্ছ কেন বই ছাপাতে? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করে বসে শুভায়ু। আর উত্তরগুলো একইসঙ্গে আউড়ে যায়। আসলে ছড়ানো ছিটানো গল্পগুলোকে একত্রিত করে পাঁচজনের হাতে দেওয়া। আর এই লেখালেখির মধ্যে দিয়ে জীবনটাকে একটু কর্পূর সুবাসিত করা।

এছাড়া গতানুগতিক আটপৌরে জীবনে আর কী-ই বা করার আছে?

আরে— আসল কথাটাই বলতে ভুলেছে ও। সেটা হল ও’র অবসরপ্রাপ্ত জীবনে— জীবনবিমার সামান্য কিছু টাকা ম্যাচিওর করেছে। যেটাকে ও সংগোপনে বাড়ির খরচা থেকে খুব কৌশলে সরিয়ে রেখেছে। টাকার অঙ্কটাও সামান্য। ওই সংকলন বের করার মতোই— হাজার ষোলো টাকা। সেটাকেই ও ইদানীং ব্যাঙের আধুলির মতো সম্বল করে প্রকাশনার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে পড়েছে।

এতক্ষণে শুভায়ুর মনে পড়ল – কাল ভোরে ও যখন সবকিছু গোছাচ্ছিল কলকাতা যাওয়ার প্রস্ততি হিসেবে, তখনই তৃষা মন্তব্য করেছিল, ‘দ্যাখো বাপু, সব ঠিকঠাক গোছগাছ করে নিলে তো? তোমার আবার রাস্তাঘাটে মাথার ঠিক থাকে না।’

কথাটা অবশ্য মিথ্যে বলেনি। সেদিন গোছগাছ করে ও হাওড়া লোকাল ধরেছিল… উদ্দেশ্য কলেজ স্ট্রিট-এ কোনও প্রকাশকের দ্বারস্থ হওয়া।

নতুন লেখকদের বেশিরভাগ বই-ই গ্যাঁটের পয়সা দিয়ে ছাপাতে হয়। এটাই প্রায় দস্তুর হয়ে গেছে। তবু কত রকমের বাহানা – ‘লেখাগুলোর জেরক্স কপি দিয়ে যান— পড়াব, এক্সপার্ট-দের দেখাব।’

শুভায়ু বলেছিল ‘টাকাটা তো আমার। তবে আপনাদের অতশত বাহানা বা খুঁতখুঁতানি কেন?’ প্রকাশকের গদিতে বসে ওর ছোটো ছেলে — যে সবেমাত্র গ্র্যাজুয়েশন করেছে, সে বিজ্ঞের মতো উত্তর করে, ‘খুঁতখুঁত করি কি সাধে? মালটা তো আমাদের ব্যানার-এ বেরোচ্ছে। আমাদের গুডউইল ওর সঙ্গে জড়িত থাকছে যে। তাই আমাদের একটু মাথা ঘামাতে হয় বই-কি!’

শুভায়ু মনে মনে বলে তোমাদের আবার গুডউইল বলে কিছু আছে নাকি? পয়সা— আসলে পয়সা হলেই হল। বড়ো বড়ো প্রকাশকরা পর্যন্ত নামিদামি লেখকদের সঙ্গে দু’চারটে অনামি লেখককেও এক আসনে বসাচ্ছে।

যাকগে ওসব কথা। ওর সব লেখাগুলোই রয়েছে কেবল শেষেরটা নেই— তার কোনও কপিও নেই— । বেশ ঝঞ্ঝাট হল বই-কি!

কী ব্যাপার তবে কি ফেরার পথে ট্রেনেই মিস করল? ওই ‘বাসনা বিসর্পিল নদী’ গল্পটাই হারিয়ে গেছে…

বড়ো টেন্সড ফিল করে শুভায়ু। গুনে গুনে লেখাগুলো নিয়ে গেল অথচ…

আচ্ছা প্রকাশককে ফোন করে জানলে হয় না? যদি সেখানে পড়ে থেকে থাকে—।

ব্যাপারটা প্রায় সপ্তাহখানেক হয়ে গেল আর নিশ্চয়ই ফেরত পাওয়া যাবে না। ওটা তাহলে গেল? ওই বিষয়বস্তু নিয়ে লেখা যেতে পারে কিন্তু তেমনটি হবে কি?

এরই মাঝে তৃষা মন্তব্য করে, ‘অত মনমরা হলে চলবে! আবার নতুন করে লিখতে কি তোমার গায়ে জ্বর আসছে নাকি?’

শুভায়ু বলে, ‘থামো তো তুমি! হাজার হোক লেখা তো আমার সৃষ্টি। লেখা খোয়া গেলে শোক হতেই পারে। লেখা হচ্ছে আত্মজ। সন্তানের মতো… ও সব তুমি বুঝবে না!’

তৃষা উত্তর করে, ‘কী জানি ওসব বাতিক আমার নেই—তাই বুঝি না।’

এবার শুভায়ু রেগে যায়— ‘যা বোঝো না তা নিয়ে তক্বো কোরো না চুপ থাকো!’

পরের শনিবার আবার কলেজ স্ট্রিট যেতে হয়েছিল। প্রকাশক বললেন— ‘নাহ এখানে কোনও পাণ্ডুলিপি ফেলে যাননি। কী আশ্চর্য কোথায় গেল!’

ফেরার পথে বাস থেকে তাড়াতাড়ি নেমে— সাবওয়ের মুখে পৌঁছল। কিন্তু হঠাৎ একি দেখছে ও! সামনের মেয়েটি অমন করে তাকাচ্ছে কেন? একদম কাছাকাছি এসেই মেয়েটি থমকে যায়।

‘স্যার একটু দাঁড়াবেন…’ শুভায়ু থমকে যায়।

‘মনে করতে পারেন স্যার? চিনতে পারেন…’ তারপর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে।

শুভায়ু হকচকিয়ে যায়। প্রশ্ন করে, ‘কে তুমি?’

‘স্যার আমি শ্রাবণী। আপনার ছাত্রী ছিলাম দেউলগ্রাম হাইস্কুলে। আর আপনার সঙ্গে ছিটেফোঁটা আত্মীয়তাও ছিল। আপনার মা বীণাপানি দেবী আমার দূর সম্পর্কের মাসি… আপনি কেমন আছেন?’

শুভায়ু লেন্স-এর ফাঁকে ওকে ভালো করে দেখে।

‘ভালো আছি… ওহ্ সেই শ্রাবণী!… কোথায় চলেছ? আমি কিন্তু বর্ধমান যাব।’

‘হ্যাঁ… দাদা। মানে স্যার…’

‘অত ইতস্তত করছ কেন? আমাকে দাদা বলেই ডেকো… তুমি তো বেশ বড়ো হয়ে গেছ। দেউলগ্রাম স্কুলের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থিনী হিসাবে শেষ দেখেছিলাম কিন্তু তোমার সেই চেহারা একদম ভেঙে গেছে… আমি তো চিনিয়ে না দিলে ধরতেই পারতাম না। তারপর সব কেমন আছ? কী করছ? তোমার সেই ভাই সুপ্রকাশ কী করে?’

শ্রাবণী মাথা চুলকোয়।

‘বাব্বা! আপনার সব মনে আছে দেখছি— খবর ভালোই… আমি তো বড়ো… আমার পরে সুপ্রকাশ। আমি অনার্স পাশ করে ট্রেনিং নিয়ে বসে আছি… এমএসসি দিচ্ছি। ভাইও বেকার, ইন্টারভিউ দিচ্ছে। বাবার সেই প্রাইভেট ফিন্যান্স কোম্পানি উঠে গেছে। স্টাফ-দের কিছু কিছু পয়সা দিয়ে ছেড়ে দিয়েছে।’

একটু থেমে আবার শুরু করে…

‘কিন্তু দাদা সত্যি বলতে কী, বেশ দুর্দিন যাচ্ছে আমাদের। সে কথা আপনাকে লুকিয়ে লাভ নেই… বরং চলুন না কর্ড লাইনে এই সামনেই বেলানগরে নেমে শিউলিবাগান কলোনি। যাবেন দাদা? বাবা আপনাকে দেখলে খুশি হবেন। আর দেউলগ্রামের লোকজন তো আসে না। তার কারণও আছে, গেলে সবকিছু জানবেন।’

একটু যেন বিমনা হয়ে যায় শুভায়ু।

‘চলুন না দাদা— অসুবিধে হবে না।’ অনুরোধটা বারবার আসতে থাকাতে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে ও—

‘কিন্তু আমার তো রিটার্ন কাটা আছে।’

শ্রাবণী বেশ গুছিয়ে বলতে থাকে। ‘টিকিটটা সামান্য, তবে যদি বাড়িতে অসুবিধে থাকে, বউদি চিন্তাভাবনা করে— সে কথা আলাদা।’

হঠাৎই শুভায়ু মনস্থির করে ফেলে।

‘চলো তাই যাই… তোমাদের আস্তানাটা চিনে আসি, কলকাতা আসা যাওয়ার পথে কাজে লাগবে। বুথ থেকে বাড়িতে জানিয়ে দিলেই চলবে।’

‘ভালোই হল কাল তো রবিবার, সকালেই ফেরার তাড়া নেই।’

ট্রেনে চড়ে সামান্য রাস্তা। যাত্রাপথে নানান চিন্তা… এসে পড়ে।

লেখাটা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে কেমন খচখচ করে মনটা। গল্পটার নায়িকা ছিল অতসী… ভ্যান চালাত সুবলসখা। তার সঙ্গে অতসীর ঘনিষ্ঠতা… শেষে বাড়ির অমতে রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হয়। মা-বাবা ক্ষুণ্ণ হয়, সুবল-রা অন্য জাত। অতসীদের তুলনায় ওদের বাড়ির অবস্থা তেমন ভালো নয়।

এরমধ্যে অতসীর মা মারা যেতে বাড়ির একটা ছন্নছাড়া হাল হয়ে যায়। মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে স্ত্রীহারা হয়ে বাবা বেশ ভেঙে পড়ে। অতসী তার স্বামীকে বারবার কাছে এসে থাকতে বলে। ওরা একদিন এসেও যায়। কিন্তু পরস্থিতি ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করে। এক প্রত্যুষে ওদের খামারবাড়ি থেকে সাদা পোশাকে এক নারী মূর্তিকে ওরা বের হতে দেখে… তবে কি ওটা ওর মার অশরীরী আত্মা?

শেষ পর্যন্ত রহস্যের কিনারা হয়। আত্মা আর অশরীরী থাকে না, তার শরীরী রূপ ধরা পড়ে। সে অতসীর ছোটো মাসি… অল্প বয়সে বিধবা হয়ে পাশের গ্রামে বাপের বাড়িতে থাকত। সে ছুটে আসে কীসের টানে। সেও এক বাসনার শিকার। বাসনার এক বিসর্পিল নদী ওকে টানে।

যাক এটা শুধুমাত্র কাঠামোটা…।

রক্তমাংসের গল্পটা তো নেই। শুভায়ু কী করে শুধু মুখের কথায় বাসনার বিসর্পিল রূপটা বিশ্বাস্য করে তুলবে…!

স্টেশন থেকে শিউলিবাগান কলোনি সামান্যই রাস্তা। সেখানে শ্রাবণীদের একতলা ঘর— মাত্র দুটো কুঠরি। ছাদের সিঁড়ি, চিলেকোঠা। সুপ্রকাশ কম্পিউটার ট্রেনিং নিচ্ছে, রাতে বিকম পড়ে।

ওদের বাবা সরকারবাবু কথা শুরু করেন।

‘তাহলে শুভবাবু আমাকে চিনতে পারছেন তো… দেউল গ্রামে থাকতে মাত্র একবারই গিয়েছিলেন আমাদের বাড়ি… সে তো আটবছর আগে।’

শুভায়ু তাকিয়ে দেখে সরকারবাবুর দোহারা চেহারা সামনের দিকে কিছু পাকা চুল, কেমন যেন পোড়খাওয়া।

‘আরে দেখুন না শ্রাবণী ধরে নিয়ে এল। আর আমাকে নতুন জায়গা দেখার নেশায় কেমন যেন পেয়ে বসল।’

সরকারবাবু বলেন, ‘আরে মশাই এসে অন্যায় কিছু করেননি।’

‘অন্যায় আর কী, এসেছি এই বোনটির টানে। সত্যি শ্রাবণী মেয়েটি বড়োই ভালো। আর মেশোমশাই আমাকে আর ‘আপনি’ সম্বোধনে লজ্জা দেবেন না। আমি তো আর এখন দেউল গ্রামের প্রধান শিক্ষক পদে নেই… তাছাড়া আপনি বয়সে বড়োই হবেন।’

‘তাই হবে বাবা! শ্রাবণী মাঝেমধ্যে এখনও তোমার কথা বলে। ওই তো সবকিছু দেখাশোনা করে, ঘরের কাজ বাইরের কাজ সামলায়। ওরাই তো ভাই-বোনে ঠেলা গোঁজা দিয়ে চালাচ্ছে সংসারটাকে। নিজেরা পড়ছে, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াচ্ছে। আমি তো যেটুকু ছাঁটাইয়ের আগে পেলাম সেটা— সেই সঙ্গে কিছু দেনা করে মাথা গোঁজার জায়গাটুকু করতে পেরেছি।’

সুবর্ণা মাসি মানে শ্রাবণীর মা’র প্রসঙ্গ উঠতে সবাই মুখে তালা এঁটে দিল। কেউ কোনও কথা বলে না।

একটা থমথমে গুমোট ভাব হঠাৎ যবনিকাপতনের মতো ঝুলে রইল…

শেষে শ্রাবণী নীরবতা ভঙ্গ করল। ‘দাদা খাওয়াদাওয়া হোক, তারপর রাতে ধীরেসুস্থে সব কথা বলব। না বললে আমাদের চলবে না। আর আপনিও ঠিক বুঝবেন না। এই বলে আশ্বস্ত করল শুভায়ুকে।

সুবর্ণা মাসির সঙ্গে শুভায়ু’র মা’র একটা দূর সম্পর্কের আত্মীয়তা ছিল। খানিকটা লতায়-পাতায় গোছের। শুভায়ু সেটা সঠিক বুঝত না। থাক সে কথা।

রাতে শ্রাবণীর কথা শুরু হল।

‘দাদা! আপনাকে সবকথা খুলে বলতে আমার লজ্জা ছাড়াও— কেমন একটা তিক্ত বিস্বাদ ভাব এসে যাচ্ছে। কথা বলতে যাচ্ছি, না আকাশে থুতু ছুড়তে যাচ্ছি, সেটাই ভাববার বিষয়। মাকে নিয়ে কথা বলা বা মা’র কেচ্ছা আলোচনা করা সন্তানের পক্ষে কতখানি নির্লজ্জতার নজির তা নিশ্চয়ই উল্লেখের দরকার নেই। একজনের ভুলের মাশুল গুনছে গোটা সংসার…। সমস্ত সংসারটাতে যেন অলক্ষ্মীর ছায়া। বাবা এখন আমাদের অভিভাবক, আমাদের ভরসা স্থল। তাঁর মুখের দিকে তাকানো যায় না। কে যেন কালি লেপে দিয়েছে। তবু ভালো শিউলিবাগান কলোনির লোকজন সব কিছু স্পষ্ট করে জানে না। কারণ ঘটনাটা এখানে ঘটেনি।’

একটু থেমে আবার বলতে থাকে শ্রাবণী, আমরা তখন ডানলপের দিকে ভাড়া ছিলাম। নতুন বাড়িতে শিফট করার পর মা’র সম্পর্কে সবরকম কৌতূহল মেটাতে তৎপর হলাম। মা’র একটা পুরোনো নেগেটিভ-কে কায়দা করে এনলার্জ করা হল— সেটাকেই বাঁধিয়ে ফুলের মালা দিয়ে দেয়ালে টাঙানো হল। বলা হল— সুদূর দেশের বাড়িতে মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন আর সেখানেই মারা যান। এখানকার লোক আমাদের সম্পর্কে তত উৎসাহী নয় যে বাঁকুড়ার দেউল গ্রামের খবর নিতে যাবে। সবচেয়ে বড়ো কথা হল কলকাতার শহরতলিতে ছাপোষা এক সরকারবাবুর স্ত্রী আদৌ মারা গেছেন কিনা, সে নিয়ে গবেষণা করতে কারও বয়ে গেছে। তাদের ভাববার জন্য বহু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আছে।’

শুভায়ু মাঝখানে শ্রাবণীকে থামিয়ে দেয়।

‘শ্রাবণী, আমার কাছে ব্যাপারটা ধোঁয়াশা হয়ে রইল। আচ্ছা বলো তো, সুবর্ণা মাসি কোথায় চলে গেলেন? সঙ্গে কে ছিলেন?’

শ্রাবণী দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছু বিরতির পর কথা বলতে থাকে।

‘শুভদাদা! কিছু মনে করবেন না… আমি এতখানি বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছি যে কথাসূত্রর ঠিকঠিক সঙ্গতি রাখতে পারছি না। তাই কোথায় এ কাহিনি শুরু করতে হবে তাই ভুলে বসে আছি। আমাদের দুঃখকষ্ট, মনের জ্বালাযন্ত্রণা আজ পর্যন্ত কাউকে স্পষ্টভাবে বলতেই পারলাম না। আসলে সেরকম পারিবারিক বন্ধুই পেলাম না – যার কাছে নিজেদের কথা বলে হালকা হতে পারি। আপনাকে টেনে এনেছি মনের কথা শোনাব বলে। এবার শুনুন –

মা’র বাপের বাড়ির অবস্থা যাইহোক, ওঁর মধ্যে একটা বিলাসী সুখস্বপ্নে বিভোর সত্তা ছিল। আমার জন্মের পর থেকেই নানানভাবে আঘাত পেতে থাকেন। বাবা সামান্য চাকরি করতেন প্রাইভেট ফিন্যান্স কোম্পানি-তে। তাও সেটা বড়ো প্রতিষ্ঠান ছিল না। মায়ের মতো সুন্দরী একটা মেয়ের এমন একটা দৈন্যপীড়িত সংসারে কেন যে বিয়ে হল – সেটাই বিরাট রহস্য। যাক ওসব প্রসঙ্গ। তবু মাকে সুখস্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার জন্য বাবার নিরন্তর চেষ্টার অন্ত ছিল না। কিন্তু মা’র কাছে, এই সংসার… ভাড়া বাড়ি… বাবার আর্থিক টানাটানিগুলো বড়োই ঘৃণা ও বিরক্তির বিষয় ছিল…।

‘আমরা কত কষ্ট করেছি পড়াশোনা করতে গিয়ে। অন্যের বাড়ি থেকে নোটবই চেয়ে এনেছি, রাত জেগে নোটকপি কিংবা ছুটোছুটি করে অথবা জেরক্স সংগ্রহ করে বহু কষ্ট স্বীকার করে লেখাপড়া করেছি। মা’র কাছে এসব মূল্যহীন ছিল! মা-কে বলতে শুনেছি, জানো বইপত্র কিনতে হয়, ওরকম চেয়েমেগে বিরাট কিছু হওয়ার স্বপ্ন দেখে লাভ নেই।

সে তো অনেক পয়সার দরকার— আমার উত্তর। মা ভ্রূকুটি করে হেসেছে – হ্যাঁ টাকাপয়সার দরকার বই-কি! আর বেশি দাম দিয়ে সেই বই কেনার মতো স্বচ্ছলতা বা সামর্থ্য আমাদের নেই। স্বচ্ছলতা আনতে যে যোগ্যতা দরকার তা তোমার বাবার নেই।

ছলেবলে কৌশলে যেভাবেই হোক বাবার আর্থিক দৈন্যকে ব্যঙ্গ করাই মার লক্ষ্য ছিল।

– কী বলছ তুমি! তুমি তো সবই জানো বাবার অবস্থা।

– জানি বই-কি। আর এও জানি তোমার বাবা নানা অজুহাত যাই দেখান, তিনি আর্থিক সাফল্যের পরীক্ষায় অকৃতকার্য বলেই প্রতিপন্ন।

শ্রাবণী বড়োই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে এ ক’টি কথা বলতে পারল।

আমার মা’র কথাবার্তা শুনলে মনে হতো, মার ভাগ্যে এক সচ্ছল সুন্দর গোছালো সংসার অপেক্ষা করছিল, আমার বাবা হঠাৎ তাঁর জীবনে এসে পড়ে সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে।

আমি মাঝে মাঝে অনুমান করতে চেষ্টা করতাম – মায়ের সেই ঈপ্সিত পুরুষ কি সুরঞ্জন মামা? কে জানে!

তবে সুরঞ্জন সান্যালকে দু’একবার এ বাড়িতে আসতে দেখেছি। ছোটোবেলায় তাঁর দেওয়া মুঠোমুঠো টফি আমরা ভাইবোনে ভাগ করে খেয়েছি। শুনেছি মা’র মামার বাড়ির দেশে ওঁর বাড়ি ছিল। মানুষ হয়েছিলেন উত্তরবঙ্গের কোথায় যেন! প্রথম যখন আমাদের বাড়ি আসেন তখন উনি বেকার। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ ধাপ পার হয়ে স্কুল-কলেজে চাকরির ধান্দায় ঘুরছেন। বিষ্ণুপুরের কাছে একটা কলেজে সাক্ষাৎকারে এসে হঠাৎই মা’র সঙ্গে দেখা করতে আসেন। আমার বাবা শিবতোষ সরকারকে বলেন, শিব জামাইবাবু, এদিকে একটা চাকরি পেলে দিব্যি থেকে যাব। সুবর্ণার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা যাবে…

চাকরি পাওয়ার পর ছুটিছাটায় দেউল গ্রামের বাড়িতে এসেছেন সুরঞ্জন মামা। দু’চারদিন বেশ হইচই করেছেন। আমাদের সঙ্গে হালকা হাসিমস্করা হুটোপাটি করেছেন, এসব বেশ মনে পড়ে। আমাকে খুবই আদর করতেন। মা-কে বলতেন সুবর্ণা! তোমার এই মেয়েটাকে ভালোভাবে লেখাপড়া শিখিও, বেশ বুদ্ধিমতী হবে। ওর দৌড়ঝাঁপ দেখে মনে হয় স্পোর্টস-এ বেশ ভালো করবে। ওর কোন নামটা ফাইনাল করলে, শ্রাবণী?

শুনে মা’র মুখে হাসির ছ’টা। মা বলেই ফেলল, আর সব নাম তো চাপা পড়ে গেল। তোমার দেওয়া ওই নামটাই রীতিমতো চালু হয়ে গেল দেখছি। কার দেওয়া নাম দেখতে হবে তো?

মা’র মুখে সুরঞ্জন মামার নাম তখন সব সময় শোনা যেত, প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

এমনিতর একটা প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি। বাঁকুড়া জেলার একটা সামান্য কলেজে চাকরি করছে। সেটাই মা’র আপশোশের কারণ। অবশ্য তখন সোনামুখি কলেজ ছোট্ট কলেজই ছিল…

দেউল গ্রামের দিনগুলি এমনিভাবেই পার হচ্ছিল। মাসে অন্তত একবার সুরঞ্জন মামা এসে যেতেন। জুলজি বোটানি-র লোক যে কবি-শিল্পী মনের হতে পারে, আমার ধারণা ছিল না।

একবার দ্বারকেশ্বর নদীর পাড়ে শীতের সময় আমরা ‘পৌষলা’ করেছিলাম। তখন আমি সবে মাধ্যমিক পাশ করেছি। তখন সুরঞ্জন মামার ভরাট গলায় শুনেছি রবীন্দ্রসংগীত – ‘যেন পেরিয়ে এলেম অন্তবিহীন পথ… আসিতে তোমার দ্বারে…’

মা-ও ভালো গাইত, একটু চাপা গলায় গেয়েছিল—‘যখন প্রথম ধরেছে কলি আমার মল্লিকা বনে…’

তখন ভালো বুঝতাম না। মনে হতো কেমন একটা কুয়াশা ঘেরা অন্ধকার, তারই মধ্য দিয়ে আমাদের সংসারটা চলেছে।

এইচএস পড়ার সময় থেকে আমার মনে হল— কোথায় যেন একটা অন্য স্রোত বইছে। চোরাস্রোত ফল্গুধারার মতো। সে ছুটে চলেছে হয়তো বা কোনও অজানা সর্বনাশা পথে। সুপ্রকাশ-এর চোখ ছেলেদের চোখ আর তরুণের চোখ। ওর তখন বয়স অল্প। ও ঠিক ধরতে পারেনি। ধোঁয়াটে হলেও আমি অনেকটা বুঝতাম। দেখতাম, সুরঞ্জন মামা এলে মা’র চোখে একটা খুশি চিকচিক করে উঠত।

ওদিকে বাবা, সুরঞ্জন মামা সম্পর্কে কোনও না কোনও মন্তব্য করলেই মা রেগে যেত।

একদিন বাবা বললেন, সে কি সুবর্ণা তুমি ওঁর সঙ্গে সোনামুখি যাবে?

– কেন তোমার আপত্তি আছে?

– না মানে সুরঞ্জনবাবু মেসে থাকেন তাই বলছিলাম।

মা ব্যঙ্গ হাসি হেসেছে, তুমি তো অমনি বলবে জানতাম। ওদের অধ্যক্ষ ফ্যামিলি নিয়ে থাকেন। আমি সেখানে থাকব। এখন সুরঞ্জনদা ওখানকার ভাইস প্রিন্সিপাল জানো তো!

বাবা চুপ করে যেতেন বাধ্য হয়ে। মা বলেছিল, দুটো দিন রান্নাবান্না শ্রাবণীই সামলে নিতে পারবে।

কলেজে সুরঞ্জন মামার নামডাক ছিল। ওঁর দু’চারটে বই ডিগ্রি কোর্স-এ চালু ছিল। এরপর বেশ কিছুদিন সুরঞ্জন মামা আর আসছিলেন না। দেউল গ্রামে যে ঢিঢি পড়ে গেছিল শিবতোষ সরকারের স্ত্রীকে কেন্দ্র করে, তা কিছুটা স্থিমিত হয়ে গিয়েছিল।

ইতিমধ্যে বাবাকে সঞ্চয়ন ফিন্যান্স বদলি করল হাওড়ার দিকে। বাবা সবকিছু গুটিয়ে ডানলপের দিকে চলে গেলেন। সেখানে নানান টানাটানির মধ্যে দিয়ে সুপ্রকাশ আর আমার পড়াশোনা চলতে থাকে।

শেষের ঘটনাটা ঘটল বছর দুই আগে। ইতিমধ্যে মা’র নামে চিঠিপত্র আসত, কিন্তু সুরঞ্জন মামা আর আসেননি। মাঝ্যেমধে মা’র মুখটা দেখতাম বেশ থমথমে। মাঝে মাঝে ভীষণ রেগে যেত বেশি প্রশ্ন করলে।

– চালাও তোমাদের সংসার, আমি আর পারছি না। শুধু নাই নাই রব। এত অভাব আর দেখতে পারছি না। আমারই কপাল দোষে জুটেছে ক’টা দুষ্টগ্রহ।

শুভদা। এরপর গল্প শেষ হয়ে আসছে। আমরা ঘটনায় যাচ্ছি। একদিন ভোরে বাবা উঠেছেন। অনেক খোঁজাখুজি করে মাকে কোথাও দেখা গেল না। আমি, ভাই অনেক খুঁজলাম। লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বাবা একদিন সুপ্রকাশকে সোনামুখি পাঠালেন। পরের দিন সুপ্রকাশ খবর আনল, সুরঞ্জন সান্যাল প্রায় ছ’মাস আগে সোনামুখি ছেড়ে অসমের দিকে কোনও কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগ দিয়েছেন।

এরপর থেকে আমরা তিনজন সমানে লড়াই করে যাচ্ছি। ভাঙা হাল ছেঁড়া পাল তবুও…’

শুভায়ু শ্রাবণীর পিঠে হাত দিয়ে বলে ‘সোজা হয়ে হাঁটবে— এতটুকু ভেঙে পড়বে না। ভয় কী? তোমরা তো কিছু অন্যায় করোনি। শুধু ফটোতে নয় বাস্তবে সুবর্ণা মাসি মৃত বই-কি! অন্তত তোমাদের কাছে। শক্ত হও, তোমার কাছ থেকেই তো সুপ্রকাশ জীবন সংগ্রামের ভাষা আয়ত্ব করবে।’

অনেক দেরিতে শুভায়ু কিছুক্ষণের জন্য বিছানায় গড়াতে যায়। আর মনে মনে ভাবে ‘বাসনা বিসর্পিল নদী’র পাণ্ডুলিপিটা হারিয়েছে বটে কিন্তু গল্পটা তো হারিয়ে যায়নি।

 

বন্ধন

ভোলা, এক কাপ চা দিয়ে যা বাবা’। কথাগুলো বলেই প্রশান্ত আরামকেদারায় দেহ এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। মিনিট দশেক আগেই অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছে।

সামনেই মেয়ের বিয়ে। একা একটা মানুষের পক্ষে সবদিক সামলানো প্রায় যুদ্ধেরই সমান। খুঁটিনাটি সব বিষয়েই বাড়তি খেয়াল রাখতে হয়। অন্যথায় একটু এদিক-ওদিক হলেই মেয়েকে সারাজীবন কথা শুনতে হবে। একদিকে বিয়ের পর মেয়ের অন্যত্র চলে যাওয়ার কথা ভেবেই মরমে মরছে প্রশান্ত। তার উপর তার জীবনে এক মর্মস্পর্শী ঘটনা তো রয়েছেই। যার সমাধান করার জন্য অনুতপ্ত প্রশান্ত মেয়ের বিয়ের এই সময়টাকেই বেছে নিয়েছিল।

‘বাবু চা’, ভোলার আওয়াজ শুনে প্রশান্ত চোখ খোলে।

‘হ্যাঁরে বউদিমণি আসেনি এখনও?’ চায়ের কাপ নিতে নিতে প্রশান্ত, ভোলাকে জিজ্ঞাসা করে।

‘না বাবু। বলেই গেছেন, দেরি করে ফিরবেন।’

‘আর প্রমিত, রশ্মি কোথায়?’

‘দিদি মনে হয় বন্ধুদের সঙ্গে পার্লারে গেছে। আর দাদা কী যেন একটা কাজের জন্য বেরোল।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে তুই যা।’

 

ভোলা এবাড়ির কাজের লোক। দীর্ঘদিন ধরে এবাড়িতে কাজ করে। প্রায় কুড়ি-একুশ বছর ধরে। বাড়ি গোসাবায়। বিয়ে-থা করেনি। সংসারে কেউ না থাকায় পাকাপাকিভাবে এখানেই থেকে গেছে। এবাড়ির সংসারের যাবতীয় সে-ই দেখাশোনা করে।

সংসারে মানুষ বলতে ছটা প্রাণী। প্রশান্ত, প্রশান্তের স্ত্রী রিমা, ছেলে প্রমিত, মেয়ে রশ্মি। আর প্রশান্তের মা উমাদেবী। সাত বছর হল বাবা কমলাপ্রসাদ গত হয়েছেন। এছাড়া সংসারের সর্বময় কর্তা ভোলা তো রয়েছেই।

ভোলা ছাড়া এই সংসার অন্ধকার। বিগত কুড়ি বছরে রিমা যে কতবার হেঁশেলে ঢুকেছে তা হাতে গুনে বলা সম্ভব। যতদিন উমাদেবী সুস্থ ছিলেন ততদিন তিনি মাঝেমধ্যেই ছেলে, নাতি-নাতনির পছন্দের খাবার বানাতেন। কিন্তু এখন আর পেরে ওঠেন না। আর বউমা রিমাও পছন্দ করে না যে বাড়ির কাজের লোক থাকতে শাশুড়ি রান্না করুক। এতে তার স্টেটাস মেনটেন হবে না। এবাড়িতে পয়সা-কড়ি থেকে শুরু করে একে-অপরের প্রতি ভালোবাসা অঢেল কিন্তু তবু কোথাও যেন, কিছু একটা ফাঁক থেকে গেছে।

কড়া চা বরাবরই প্রশান্তর পছন্দের। চায়ে চুমুক দিতে দিতে প্রশান্ত বলে ওঠে, ‘মাথাটা ছাড়ানোর জন্য এটা একেবারে পারফেক্ট রে। তোর হাতে সত্যিই জাদু আছে রে। আচ্ছা তোকে যে যেতে বললাম, যাচ্ছিস না কেন? কী অভিপ্রায়ে দাঁড়িয়ে আছিস বলতো? কিছু বলবি?’

‘আজ্ঞে বাবু, বলছি একটু জলখাবার বানিয়ে দেব?’

‘না রে আজ আর ভালো লাগছে না। তুই যা, আমি একটু রেস্ট নিই।’ বলে কাপটা টেবিলের উপর রেখে দিয়ে আবার আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে আগের মতোই চোখ বন্ধ করে নেয় প্রশান্ত। কিন্তু তার অস্থির মন ছুটে চলে পুরোনো স্মৃতি রোমন্থনে, যেটা সে এতদিন খনিকটা সংসারের চাপে খানিকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই ভুলে থেকেছে। এটা তখনকার ঘটনা যখন সে ধাপে ধাপে কেরিয়ারের শিখরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে একের পর এক সফলতা অর্থনৈতিক দিক থেকে তাকে আরও সুদৃঢ় হতে সাহায্য করছে।

পরিবারে দুই বোন আর চার ভাইয়ের মধ্যে সবথেকে বড়ো ভাইয়ের একমাত্র সন্তান সে। যার কারণে পরিবারে অন্যান্য ভাইবোনদের থেকে তার আদর অনেকটাই বেশি। তার উপরে পড়াশোনায় খুব ভালো হওয়ায় পরিবারের সকলেরই নয়নের মণি।

চার ভাই আর দুই বোনের মধ্যে দারুণ ভাব। সবাই যেন একে অপরের জন্য বেঁচে থাকে। সত্যিই উদাহরণ দেওয়ার মতো একটি আদর্শ পরিবার। সম্পর্কের গুরুত্ব, বড়োদের সম্মান, আদর, ছোটোদের শ্রদ্ধা ভালোবাসা সবকিছুই যেন পরিবারটির আবহাওয়ায় ওতপ্রোত ভাবে মিশে ছিল। চার জায়ের মধ্যেও ছিল অসম্ভব মিল, সেই কারণেই বাড়ির ছোটোদেরও আর আলাদা করে কিছুই শেখাতে হয়নি। বাড়ির বড়োদের একে-অপরের প্রতি ভালোবাসা দেখেই তাদের খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো ভাইবোনেদের মধ্যেও পারস্পরিক ভালোবাসার বীজবপন হয়ে গিয়েছিল।

যেখানে দুই ভাইয়ের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা মুশকিল, সেখানে এত বড়ো একটি পরিবারের এমন সুমধুর সম্পর্ক। কীভাবে সম্ভব? পাড়াপড়শিদের কাছে এটাই প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কর্মসূত্রে সকলেই সকলের থেকে দূরে থাকে, অথচ কারওর জন্মদিন, পুজোপার্ব্বন, বিবাহবার্ষিকী, অসুখ-বিসুখ এমনকী ছোটো থেকে ছোটো ব্যাপারেও একত্রিত হতো তারা। এছাড়া নিয়ম করে একে-অপরের খোঁজখবর নেওয়া, একে-অপরের বাড়ি যাওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

প্রশান্তর মেধা আর বুদ্ধির কারণে সবার ধারণা ছিলই যে বড়ো হয়ে সে পরিবারের নাম উজ্জ্বল করবেই। ঠিক সেইমতোই যখন সে আইআইটি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তখন বাড়িতে প্রায় উৎসবের আমেজ। পুরো পরিবার পিসি, কাকা-কাকি, ভাই-বোন একত্রে সকলের হইহুল্লোড়, কলরব। তার উপর কথায় কথায় ভাই-বোনেদের উদ্দ্যেশে বাড়ির বড়োদের উপদেশ–‘দাদার মতো হয়ে দেখাও’–এসব প্রশান্তর বেশ ভালোই লাগত। প্রথমবার তার দাড়ি রাখা, প্রথমবার সুট পরা, প্রথমবার গাড়ি কেনা–তার সমস্ত কিছুই পরিবারের সকলের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ, এতটাই সে সকলের হৃদয়ের কাছে।

আইআইটি পাশ করার পর প্রশান্ত বছরদেড়েক প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করার পর তার প্রাইভেট কোম্পানির প্রতি আস্থাই উঠে যায়। অথচ বেশ উঁচু পোস্টেই মোটা মাইনের চাকরিই করত সে। কিন্তু তবু না জানি কেন তার মাথায় ভূত চাপল যে সে আর প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করবে না। তাই হঠাৎই একদিন চাকরি ছেড়ে দিল। ঠিক করল সরকারি কোনও প্রশাসনিক পদের জন্য আলাদা করে কোনও কোচিং-এ ভর্তি হবে। সেই অনুযায়ী আইএএস পরীক্ষার জন্য শুধু কোচিং-এই নয় কঠিন অধ্যাবসায়ও শুরু করেছিল সে।

এত ভালো একটা চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারটা প্রশান্তর মা-বাবা প্রথমে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। কিন্তু বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের সহায়তায় সে সমস্যাও দূর হয়ে গিয়েছিল। বাড়ির অন্যান্যদের মতো তারাও বুঝেছিল যে প্রশান্তের মতো ব্রিলিয়ান্ট, ট্যালেন্টেড ছেলেকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। তার অধ্যাবসায়ই তাকে তার যথোপযুক্ত স্থানে পেৌঁছে দেবে। প্রথমবারের পরীক্ষাতেই আইএএস-এর জন্য নির্বাচিত হল প্রশান্ত। পুরো বাড়িতে উৎসবের সমারোহ বেধে গেল। কাকা-কাকি, পিসি, ভাই-বোন সব মিলে একেবারে চাঁদের হাট। যেন বড়দার ছেলে নয়, তাদের ছেলেরাই আইএএস অফিসার হয়েছে। গর্বে তাদের বুক ভরে গেল।

ছেলে বড়ো হয়েছে, আর্থিক দিক থেকেও সে যথেষ্ট স্টেবল। সুতরাং এবার তার বিয়ে দেওয়ার সময় এসে গেছে। ঠিক সেইমতো ঘটা করে পাত্রী দেখারও কাজ শুরু করে দেয় বাড়ির বড়োরা। পাত্র সরকারি আইএএস অফিসার বলে কথা, তার উপযুক্ত পাত্রী খোঁজা তো আর চারটিখানি কথা নয়। প্রায় খান সাতেক মেয়ে দেখার পর অবশেষে রিমাকে পছন্দ হয় তাদের। বরানগরের মজুমদারবাড়ির একমাত্র কন্যা সে। পিএইচডি কমপ্লিট করে তখন সে কলেজের অধ্যাপনা করে। দেখতেও একেবারে ডানাকাটা পরির মতো। প্রশান্তরও এক দেখাতেই পছন্দ হয়ে যায় তাকে। তাই প্রশান্তও এই বিয়ে অমত করেনি।

মাসদুয়েক পরে ধুমধাম করে বিবাহ সম্পন্ন হল। বাড়ির প্রতিটি সদস্যের কাছেই রিমা খুব প্রিয়পাত্রী ছিল। দেওর, ননদরা বউদি বলতে অজ্ঞান। কাকা-কাকিমারা তো নতুন এক মিষ্টি অনুভূতি, শ্বশুর, শাশুড়ি হওয়ার আনন্দে গা ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। সকলে আলাদা আলাদা জায়গায় থেকেও কেউ তার বউদিমণিকে আবার কেউ তার বউমাকে ফোন করে প্রায় রোজই খোঁজখবর নিত।

নতুন নতুন বিয়ে হওয়ার কারণে রিমা প্রথম প্রথম এগুলো মানিয়ে নিলেও, পরে অসন্তোষ প্রকাশ করতে শুরু করল। প্রত্যেকদিন সময়ে-অসময়ে কারওর না কারওর ফোন আসা, নিয়মকরে প্রত্যেক মাসে শ্বশুরবাড়ির কারওর না কারওর উপস্থিতি। তার উপর পুজোপার্বণ, অনুষ্ঠানে বাড়ির বড়ো ছেলে হওয়ার কারণে সকলের তাদের বাড়িতে হাজির হওয়াটা একেবারেই মানতে পারছিল না রিমা। আর সেটাই বোধহয় স্বাভাবিক। ছোটোবেলা থেকে বাবা-মা আর রিমা এই ছিল ওদের সংসার। সুতরাং জয়েন্ট ফ্যামিলি যে কী জিনিস তার বোধগম্য হওয়ার কথাও নয়। এত লোকের ভিড়ে সে তো আগে কখনও হারিয়ে যায়নি। এদের দেখে মনে মনে ভাবত সকলের শ্বশুর-শাশুড়ি একটাই হয়, তার চার-চারটে শ্বশুর-শাশুড়ি, অসংখ্য ননদ দেওর–সব মিলে একেবারে ফৌজ ব্যাটেলিয়ান।

এত জনের ভালোবাসার ভারবহণ করার ক্ষমতা ছিল না রিমার। প্রশান্ত আর তার জীবনে ঘটে যাওয়া সুখ-দুঃখের সমস্ত কথাও শাশুড়ি খবর হয়ে পৌঁছে যেত ফ্যামিলির অন্যান্য সদস্যদের কাছে। আর তার পরেই উঠত ফোনের ঝড়। যার উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে যেত রিমা। মনে মনে ভাবত তার স্বামী আইএএস অফিসার হওয়ায়, সমস্ত রকম সুবিধা নেওয়ার জন্যই ওদের এহেন আচরণ। তাই সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে এই বাড়তি আদিখ্যেতা। ধীরে ধীরে ফ্যামিলির প্রতি রিমার এই, বীতশ্রদ্ধ মনোভাব ধরা পড়ে প্রশান্তের কাছে। প্রথম প্রথম প্রশান্ত বোঝানোর সবরকম চেষ্টা করেছে, ‘রিমা, ওদের ভুল বুঝো না। ওরা ভালোবাসার কাঙাল। ওরা আমাদের থেকে ভালোবাসা ছাড়া আর কিছুই চায় না। পরিবারে তুমি একমাত্র বউ হওয়ার জন্যই ওরা তোমাকে একটু বেশিই ভালোবাসে। ব্যস তাছাড়া আর কিছু নয়। ধীরে ধীরে অন্যান্য ভাই-বোনরাও চাকরি পাবে। তাদেরও বিয়ে হবে। তখন এমনিতেই এই ভালোবাসাও সবার মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে। আমরা সবাই সবাইকে হৃদয় থেকে ভালোবাসি। কারওর মনে কোনও অভিসন্ধি লুকিয়ে নেই। একটু বোঝার চেষ্টা করো। এখন সবাইকে তোমার পর মনে হলেও কয়েকদিন বাদে দেখবে তুমিই এদের ভালো না বেসে পারবে না। প্লিজ আমার কথা ভেবে একটু অ্যাডজাস্ট করো।’

কিন্তু বুঝিয়ে লাভের লাভ কিছু হয়নি। আর কতদিনই বা বোঝাত, সেটারও তো একটা সীমা অবধি আছে। উলটে বরং রিমার নেতিবাচক কথাবার্তায় ধীরে ধীরে প্রশান্ত প্রভাবিত হতে থাকে। যেই ছেলে মাকে কোনও কথা না বলে থাকতে পারত না, সেই ছেলেই তখন মায়ের কাছ থেকে ছোটো থেকে ছোটো কথাও লুকোতে শুরু করল। অন্যদিকে ছেলের এই স্বভাববিরুদ্ধ আচরণে মা-ও অনুভব করতে পারছিলেন যে তার ছেলে বদলাচ্ছে।

আজ এই বয়সে এসে প্রশান্ত ফিল করতে পারে তখন তার ব্যবহারে মা কতটা কষ্ট পেয়ে থাকবেন। কাকা-কাকিমা, ভাই-বোন মায়ের কতটা কাছের, তাদেরকে দূরে সরিয়ে রাখাটা কতটা বেদনাদায়ক। কিন্তু তবু ছেলে তো ছেলেই, তার থেকে কাছের তো আর কেউ হয় না। তাই ছেলের মন রাখার জন্য বুকে পাথর চাপা দিয়েই উমাদেবী বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে নিজেকে গোটাতে শুরু করেছিলেন।

অপরদিকে পরিবারের সকলে কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারছিল। আর যার কারণেই জায়েরা বহুবার উমাদেবীকে প্রশ্নও করেছেন, ‘দিদি কিছু হয়েছে নাকি গো? কেমন যেন আড়োআড়ো-ছাড়োছাড়ো ভাব। আর আগের মতো ফোনও করো না, ফোন করলে… কী জানি মনে হয় যেন তুমি কিছু লুকোচ্ছ, মনে মনে কষ্ট পাচ্ছ! প্রশান্ত, রিমাও যেন… যাক ছাড়ো। ভালো থাকলেই ভালো। অনেকদিন আসোনি। তোমার দেওরকে পাঠাব, আসবে এখানে?’

উমাদেবী সমস্ত কিছু লুকিয়ে রাখার অভিপ্রায়ে বলে উঠতেন, ‘আরে নারে সবকিছু ঠিক আছে। ওরা দুজনেই সারাদিন পরে কাজ থেকে ক্লান্ত হয়ে ফেরে। আর পেরে ওঠে না। আর আমারও তো বয়স হচ্ছে বল। শরীরটাও খুব একটা..’

তাদের এই বদ্ধমূল ধারণা যে কতটা ঠিক, তা রিমার ব্যবহারেই ধরা পড়ত। ফোন করলে ঠিক করে কথা না বলা, বিরক্তি প্রকাশ করা, কোনও কাজের বাহানা করে ফোন কেটে দেওয়া এই সমস্তই সম্পর্কের মধ্যে একটা প্রাচীর গড়ে তুলল। প্রথমে আস্তে আস্তে সকলের ফোন আসা বন্ধ হল, তারপর বাড়িতে আসাও বন্ধ করে দিল সকলে। শুধুমাত্র প্রশান্তর মা-ই দূরত্ব বজায় রেখেও ফোনের মারফত যেটুকু সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখা যায় সেইটুকুই বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। পরিবারের সকলে ভালো মতোই বুঝতে পারছিলেন উমাদেবীর অসমর্থতার কথা। তাই তারা আসা-যাওয়া বন্ধ করে দিলেও বড়দা, বড়োবউদির প্রতি তাদের টান কিন্তু এতটুকুও কমেনি। অপরদিকে প্রশান্তর বাবা-মার ও ঠিক তাই।

এইভাবেই কেটে গেল আরও দুটো বছর। প্রমিতের জন্ম হল। পরিবারের সবাই সব রাগ, অভিমান, দূরে ঠেলে নতুন অতিথি আসার আনন্দে মেতে উঠল। কেউ নাতিকে হার, কেউ বালা, কেউ কোমরের বিছে, কেউ পায়ের মল, কাকা-পিসিরা নানারকম খেলনা দিয়ে অভ্যর্থনা জানাল নবজাতক-কে, কিন্তু কোনও কিছুতেই যেন রিমা সন্তুষ্ট নয়। রিমার ব্যবহার তাদের একেবারেই ভালো লাগল না। এরপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেককিছুই পরিবর্তন হয়েছে, পরিবারে নতুন বউমারা এসেছে, প্রশান্ত-রিমার মেয়ে রশ্মির জন্ম হয়েছে, নতুন বউ-রা তাদের ভালোবাসা দিয়ে সংসারটাকে দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে। যেটা বদলায়নি সেটা শুধুমাত্র প্রশান্ত-রিমার সঙ্গে পরিবারের জোড়াতালি দেওয়া সম্পর্ক।

সেইসময় প্রশান্তও এতটা ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে যে তার নিজের দোষ-ত্রুটি তার নজরে আসে না। বাড়ির বড়োরা রিমাকে উপেক্ষা করে অন্যান্য বউদের বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে, বেশিমাত্রায় ভালোবাসছে। এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। তার উপরে প্রশান্তর মনে পরিবারের আর-পাঁচটা মানুষের প্রতি বিষ ঢালার জন্য রিমার উসকানিমূলক কথাবার্তা তো আছেই, যে তারা তাদের সফলতাকে হিংসা করে। সে নিজে কলেজে অধ্যাপনা করে, প্রশান্ত একজন বড়ো মাপের সরকারি অফিসার। সুতরাং তারা কেন তাদের কাছে যাবে, দরকার হলে তারা ছুটতে ছুটতে আসবে। এই অহং আর চাকরি বদলির কারণেই সম্পর্ক একেবারে নিঃশেষের পথেই। সমস্ত পরিবারই প্রশান্তের কাছে বিস্মৃত এক অতীত হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বৈভব আর সুখ-দুঃখের সঙ্গে একলাই থেকে গিয়েছিল তারা। ফ্যামিলির টুকটাক খবর পেত মার থেকে। দম্ভের কারণে ভাই-বোনেদের বিয়েতে পর্যন্ত যায়নি তারা।

সময়-তো থেমে থাকে না, সে তার নিয়মেই বয়ে চলে। দেখতে দেখতে কেটে গেছে তেইশটা বছর। প্রশান্তর ছেলে এখন ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে রেলে কর্মরত। আর মেয়ে রশ্মিও গ্র্যাজুয়েশন পাশ করেছে। বর্তমানে তারই বিয়ের তোড়জোড় চলছে। বিভিন্ন জায়গায় বদলির পর অবশেষে আবার নিজের জন্মস্থান কলকাতার মাটিতে ফেরা। রিটায়ার হওয়ারও আর মোটে আড়াই বছর বাকি। জীবনের এই প্রান্তে এসে পিছনে ফেলে আসা সম্পর্কগুলো হঠাৎই যেন প্রশান্তর মন ভারাক্রান্ত করে তোলে।

প্রশান্তর বাবা কমলাপ্রসাদবাবুও গত হয়েছেন বেশ কয়েকবছর আগে। তারপর থেকেই উমাদেবী যেন নিজেকে আরও গুটিয়ে ফেলেছেন। প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটাও কথা বলেন না। দিনের বেশিরভাগ সময়টাই ঠাকুরঘরে কাটিয়ে দেন। অন্যদিকে বাকি পুরো পরিবারের একতা তখনও সমানভাবে বজায়, কেবলমাত্র প্রশান্তর পরিবার ব্যতিক্রম।

অবসর জীবন কীভাবে কাটবে–এটা প্রশান্তর খুব চিন্তার বিষয় ছিল। ছেলে কর্মসূত্রে মুম্বইতে থাকে। মাঝেমধ্যে ছুটিতে আসে, এখন মেয়েও চলে যাবে। অফিসে তৈরি হওয়া সম্পর্কগুলোও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারের বদল হওয়া ক্ষমতার মতোই ধুয়েমুছে যাবে। কর্মসূত্রে যে-কজন ভালো বন্ধু হয়েছিল তারাও আজ কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় সেটেলড্। আর ট্রান্সফার নিয়ে আসার পর রিমাও তার নতুন কলেজ নিয়েই ব্যস্ত। প্রত্যেকদিনই ফেরার সময় কলেজের কিছু না কিছু না সঙ্গে নিয়ে আসে। খেয়েদেয়ে একটু রেস্ট নিয়েই আবার সেটা নিয়ে লেগে পড়ে। ইদানীং প্রশান্তর মনে হয় রিমা বোধহয় তাকে এড়িয়ে যাবার জন্যই ইচ্ছাকৃতভাবেই এইসমস্ত করে। একাকিত্ব বোধ থেকেই প্রশান্তর মনে এরকম ভাবনার উদয় হয়।

আজ সে বুঝতে পারে সম্পর্ক কী? ভালোবাসার ছত্রছায়ায় থাকতে গেলে আগে অন্যদের ভালোবাসতে হয়, তবেই ভালোবাসা পাওয়া সম্ভব। কয়েকবছর ধরেই এই চিন্তা তাকে কুরেকুরে খাচ্ছে। অতীতে করা ভুল প্রতিটি পদক্ষেপেই খোঁচা দেয় তাকে। স্ত্রীর মিথ্যে অহংকার, পরিবারের প্রতি তাদের অপরিচিতদের মতো আচরণই সম্পর্ক ভাঙনের মূল কারণ।

মনে মনে ভাবে, আর নয়, এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবে না। মেয়ের বিয়েকে উপলক্ষ্য করেই ভেঙে যাওয়া পরিবার আবার জোড়া দিতে হবে। এই সুযোগেই সকলের মান-অভিমান মিটিয়ে দিতে হবে। তার দৃঢ় বিশ্বাস তার পরিবারের সকলে এতটাই ভালো, যে সে একটু এগোলেই তারা সবকিছু ভুলে তাকে আবার আগের মতো কাছে টেনে নেবে।

এমন সময় ছেলেকে ওইভাবে একা বসে থাকতে দেখে উমাদেবী এগিয়ে এসে বলেন, ‘চোখ বন্ধ করে কী ভাবছিস বাবা? তোর শরীর ঠিক আছে তো?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ…’ মায়ের কথায় আচমকা হকচকিয়ে ওঠে প্রশান্ত।

‘কিছু না মা, একটু চোখ লেগে গিয়েছিল। শরীর ঠিকই আছে, একটু ক্লান্ত লাগছে এই যা। তুমি ঘুমোচ্ছিলে দেখে তোমাকে আর ডাকিনি।’

‘কিছু খেয়েছিস? নাকি ভোলাকে বলব কিছু দিয়ে যেতে। রশ্মির বিয়ের জন্য তোর যা খাটাখাটনি হচ্ছে, এই সময় একটু নিজের দিকে খেয়াল রাখ বাবা। তুই পড়ে গেলে দেখাশোনার তো আর সেইভাবে কেউ নেই। প্রমিত ছোটো ছেলে ও আর বিয়ের ব্যাপারে কী বোঝে বল?। তার উপর তুই যা ধুমধাম করে বিয়ের আয়োজন করছিস।’ উমাদেবী উৎকণ্ঠিত হয়েই কথাগুলি বলেন ছেলেকে।

‘হ্যাঁ, ভোলা চা-বিস্কুট দিয়ে গেছে। জলখাবারের কথাও বলেছিল, আমিই না বলেছি। পেটটা বেশ ভারভার লাগছে। যাক এসব ছাড়ো। মা অনেকদিন ধরেই একটা কথা তোমাকে বলব বলব করে বলতে পারছি না।’

‘কী এমন কথা রে যে আমাকে বলতে পারছিস না?’ বলে ওঠেন উমাদেবী।

‘আজ না বললে বোধহয় আর কোনওদিন বলতেও পারব না। বলছি মা, ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু মা বাড়ির আর সবাই না থাকলে সত্যিই কি ধুমধাম সম্ভব? মন থেকে কি মানতে পারছ সেটা?’ একেবারে অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে প্রশান্ত।

‘কী বললি বাবা, আর একবার বল। আমি কি ঠিক বুঝলাম!’ বেশ উৎকণ্ঠিত হয়েই বলে ওঠেন উমাদেবী।

‘হ্যাঁ মা তুমি ঠিকই ধরেছ।’

ছেলের উদাসীন স্বর শুনে উমাদেবী অনুভব করতে পারছিলেন এতদিনে বোধহয় ছেলের মনের বন্ধ দরজা উন্মুক্ত হয়ে সম্পর্কের নির্মল বাতাস বইতে শুরু করেছে। সেটা যে কতটা আন্তরিক তা আর বুঝতে বাকি রইল না উমাদেবীর।

এতদিনের চেপে রাখা ব্যথা উমাদেবীর আনন্দাশ্রু হয়ে চোখ বেয়ে নামতে থাকে। স্নেহভরা দৃষ্টিতে প্রশান্তকে বলেন, ‘আমি এতদিন এই দিনটার অপেক্ষাতেই ছিলাম বাবা। এখনও দেরি হয়নি। তুই একটু চেষ্টা করলেই আবার সব ঠিক হয়ে যাবে। সবার রাগ-অভিমান মেটানোর এটাই সবথেকে ভালো সময়। তুই যদি ওদের বলিস রশ্মির বিয়ে, ওরা নাতনির বিয়েতে মুখ ঘুরিয়ে থাকতেই পারবে না।’ আবেগাপ্লুত উমাদেবী কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎই থেমে যায়। পরমুহূর্তেই উদাসীন মুখ করে বলেন, ‘কিন্তু বউমা?।’

‘তুমি চিন্তা কোরো না মা, ওকে আমি আর মাথায় চড়তে দেব না। অবশ্য পরিবার ভাঙার পিছনে শুধু ও একা দায়ী নয়, আমিও সমানভাবে দোষী। আমিও তো বুদ্ধি-বিবেক সমস্ত বিসর্জন দিয়ে ওদেরই ভুল বুঝেছিলাম। তাই এই সম্পর্ক পুনরায় গড়ে তোলার দায় আমার উপরেও বর্তায়। মা, তোমার কাছে সবার ফোন নম্বর আছে না?’

‘হ্যাঁ, সবার নম্বর আছে। এখুনি নিয়ে আসছি’ বলে আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে নিজের ঘর থেকে ডায়ারি নিয়ে এলেন।

মায়ের হাত থেকে ডায়ারিটা নেওয়ার সময় তার মনে হল যেন বংশপরম্পরায় কোনও সম্পত্তি তার হাতে তুলে দেওয়া হল। প্রত্যেক মা-বাবাই বংশপরম্পরায় কিছু না কিছু তুলে দেন সন্তানের হাতে। তাকেও তার বাবা-মা বংশপরম্পরায় ভালোবাসা দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সে গ্রহণ করতে পারেনি। ডায়ারিটা প্রশান্ত এমনভাবে বুকের মধ্যে জড়িয়ে রেখেছিল, ঠিক যেন ফেলে আসা সম্পর্কগুলোকে কাছে টেনে নিয়েছে সে।

‘মা আমি সবাইকে ফোন করে নিমন্ত্রণ করব। সবার থেকে তাদের ঠিকানা নিয়ে কার্ড পাঠাব। সবাই আসবে তো মা?’

‘হ্যাঁ বাবা সবাই আসবে। তুই যে তোর ভুল বুঝে হৃদয় থেকে সবাইকে ডাকছিস, সবাই সেটা বুঝবে বাবা, বুঝবে। তুই সবার থেকে দূরে সরে গেলেও তারা কেউ তোর থেকে দূরে সরে যায়নি বাবা।’ ছলছলে চোখে বলেন উমাদেবী।

প্রশান্ত ডায়ারি খুলে প্রথম নাম্বার ডায়াল করল। ‘হ্যালো’, অপরপ্রান্ত থেকে বড়োকাকার গলার স্বর শুনতে পেল প্রশান্ত।

‘কাকা, আমি প্রশান্ত’ একপ্রকার জোর করেই বলল সে।

মনে মনে ভাবতে থাকল কাকা কী ভাবছে, কাকার কী প্রতিক্রিয়া হবে কে জানে?

প্রশান্তর গলার স্বর শুনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য চুপ করে ছিলেন প্রশান্তর কাকা।

প্রশান্ত আবার বলে ওঠে, ‘কাকা আমি প্রশান্ত, তোমার বড়ো ছেলে বলছি।’ এতটাই করুণ ছিল সে স্বর যে উলটোদিকের মানুষটাও বোধহয় তার অন্তরের ব্যথা অনুভব করতে পারছিল। একজন অপরজনকে মন থেকে ডাকলে অপরজন সাড়া না দিয়ে পারে না।

এবার উলটোদিক থেকে বেশ ভারাক্রান্ত স্বরে জবাব আসে, ‘কেমন আছিস?’

‘আমি ভালো আছি। কাকিমা কেমন আছে? ভাই-বোনেরা ভালো আছে? আর বাড়ির অন্যান্যরা?’ কাকার স্বর শুনেই প্রশান্ত বুঝেছিল, তারাও বোধহয় তার মায়ের মতোই এই দিনটারই অপেক্ষায় ছিল।

‘সবাই ভালো আছে। আগে বল তুই কোথায় আছিস এখন? বউদি, রিমা, বাচ্চারা কেমন আছে?’

‘সবাই ঠিক আছে। সামনের মাসেই তোমার নাতনির বিয়ে। তোমাদের সবাইকে আসতে হবে। তোমরা না এলে  তোমার নাতনির বিয়েই ক্যানসেল করে দেব।’ প্রশান্ত এমনভাবে জোর খাটাতে লাগল, যেন কিছু হয়ইনি, সবই আগের মতোই আছে।

‘এমন অলক্ষুণে কথা বলতে নেই বাবা। আমরা সবাই আসব। তুই তোর কাকা-কাকি, পিসি সবাইকে একটা করে ফোন করে দে।’

‘তোমাদের ঠিকানা দাও। কার্ড পাঠিয়ে দেব।’

‘আমার নাতনির বিয়েতে তুই আমাকে কার্ড পাঠাবি তবে আমি যাব। খুব বড়ো হয়ে গেছিস না। তুই শুধু সকলকে ফোন করে দে, বাকিটা আমি দেখে নেব।’

‘ঠিক আছে। তুমি যা বলবে তাই হবে।’ বলে ফোন রেখে দিল প্রশান্ত। হয়তো তাদের অনেক কথাই বাকি থেকে গেল।

এতক্ষণ চুপচাপ ছেলের কাছে বসেছিলেন উমাদেবী। ফোন কেটে দিতেই ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাকা কী বলল বাবা, ওরা আসবে তো?’

প্রত্যুত্তরে প্রশান্ত আনন্দের সঙ্গে বলে উঠল, ‘কত সোজা একটা ব্যাপারকে কত জটিল ভাবছিলাম না মা। আর দ্যাখ্যো কত সহজে সবকিছু মিটে গেল। এতবছর ধরে চেষ্টা করেও ফোন করতে পারিনি। কোথাও যেন একটা দ্বিধা, একটা ইগো কাজ করত। সবাই আসবে মা সবাই আসবে।’

সত্যি বলছিস বাবা?’ আনন্দে উমাদেবীর চোখ জলে ভরে গেল। পাছে ছেলে দেখে ফেলে তাই সেখান থেকে উঠে চলে গেলেন নিজের ঘরে।

এক এক করে প্রশান্ত পরিবারের সকলকে ফোন করে। সকলের থেকে প্রায় একই ধরনের উত্তরই পায় সে। নিজেকে আর সামলে রাখতে না পেরে কখন যে তার চোখ জলে ভরে গিয়েছিল সে নিজেও জানে না। কিছুটা ধাতস্থ হওয়ার পর আবার আগের মতো আরামকেদারায় দেহ এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইল।

ঠিক সেই সময়েই রিমার ছোঁয়ায় প্রশান্ত চোখ খোলে। বলে, ‘তুমি কখন ফিরলে?’

প্রশ্নের উত্তরে রিমা বলে, ‘তুমি আর মা যখন বসার ঘরে বসে কথা বলছিলে তখনই এসেছি। তোমরা কথা বলছ দেখে তোমাদের ডাকিনি। সোজা উপরের ঘরে চলে গিয়েছিলাম।

‘ঠিক আছে বসো। তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।’

‘বলো কী বলবে?’

‘আমি অনেক কষ্টে পরিবারের সবাইকে বিয়েতে আসার জন্য রাজি করেছি রিমা। আশা করি এইবার তুমি কোনও গন্ডগোল বাঁধাবে না। পরিবারের সকলের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করবে। আমরা দুজনে যে ভুল করেছি, সেই ভুল শুধরে নিতে তুমিও আমাকে সাহায্য করবে।’

‘তুমি কি কিছুই বোঝো না গো? তোমার থেকে কেন পালিয়ে পালিয়ে বেড়াই? নিজেকে সারাদিন কাজে কেন ব্যস্ত রাখি? তোমার আর মার কষ্টটা যখন বুঝতে পারি, তখনই একটা অপরাধবোধ তাড়া করে বেড়ায় আমাকে। আমি নিজেও এটাই চাইছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দাও প্রশান্ত। তুমি দেখো আমি আবার সকলের মন জয় করে নেব।’ প্রশান্তর হাতদুটো ধরে একটু কাছে ঘেঁষে আসে রিমা।

বিগত কয়েক বছরে রিমার স্বভাবে অনেক পরিবর্তন এসেছে। সবসময় নিজের বাচ্চাদের ও মিলেমিশে থাকার পরামর্শ দিত। তার ছেলে মেয়ের সম্পর্ক-ও যদি ভবিষ্যতে কোনও মেয়ের কারণে নষ্ট হয় সে আর প্রশান্ত কী সেটা মেনে নিতে পারবে। যে-ভুলটা সে এতদিন করে এসেছে, কাকা-কাকি, পিসি, ভাই-বোন সবার থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে প্রশান্তকে সেই জিনিস তো আবার ঘটতে পারে, এই ভয়টাই বাসা বেঁধেছিল রিমার মনে। এমনিতেই আজকাল সম্পর্কের বাঁধন খুব আলগা। সেখানে শুধুমাত্র তার শ্বশুরবাড়ির পরিবারটিই ব্যতিক্রম মাত্র। যেখানে সে নিজেই ছেদ ঘটিয়েছিল। তাই বোধহয় সে নিজেও আজ তার ভুলটা শোধরাতে চায়।

অবশেষে বিয়ে প্রায় আসন্ন। দিন-দুয়েক মাত্র বাকি। এক এক করে হাজির হল সমস্ত পরিবার। বাড়ির সকলকে দেখে হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছিল রিমা। সত্যিই বড়োদের আপ্যায়নে কোনও ত্রুটি রাখেনি সে। নিজে হাতে সেবা করেছে সকলের। আগের মতো সকলে তাকে কাছেও টেনে নিয়েছে। আজ প্রশান্তর সংসার একেবারে পরিপূর্ণ। সবাই একেবার আনন্দে আটখানা। প্রশান্তর বাড়ি একেবারে চাঁদের হাট।

এইসব দেখে প্রশান্ত মনে মনে ভাবে আজ তার ভালোবাসার বাগান একেবারে ফুলে, ফুলে, সুগন্ধে ভরে গেছে। একেই বোধহয় বলে রক্তের টান। আনন্দে তার চোখ জলে ভরে যায়।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব