ফিরে এসো মলি

ভাইয়ের জ্বর কমছে না কিছুতেই। ওই ১০৪ ডিগ্রিতে আটকে রয়েছে। মলয়ের কপালে হাত রেখে থার্মোমিটার-টায় আর একবার চোখ বুলিয়ে নিল হিমানী। তারপর আবার কাপড় ভিজিয়ে মলয়ের কপালে রাখল।

নিজের মনে মনেই বিড়বিড় করতে থাকল হিমানী, কেন যে জ্বর নামছে না কে জানে? কতবার ভাইকে ডাক্তারের কাছে যেতে বললাম, কিন্তু সেই এক জেদ… ঠিক হয়ে যাবে।

দিদি চিন্তা করিস না, ডাক্তার দেখিয়ে বা কী হতো ক্ষীণ স্বরে মলয় হিমানীকে বোঝাবার চেষ্টা করে।

আমি আর তোর এই অবস্থা দেখতে পারছি না। চোখের তলায় কে যেন কালি ঢেলে দিয়েে মনে হচ্ছে! এত দুর্বল শরীর। আমি জানি মলির চলে যাওয়াটাকে তুই কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিস না। তুই নিজেই তো কাণ্ডটা বাঁধিয়েিস। কাউকে কিছু না বলে ডিভোর্স নিয়ে নিলি? সাতবছর একসঙ্গে সংসার করলি। সন্তান হয়নি তো কী হয়েে? আমি জানি মলির দুবার মিসক্যারেজ হয়েে কিন্তু বাচ্চা দত্তক নিতেই বা কী অসুবিধা ছিল? মা-বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন বলার কেউ ছিল, এখন তো তোদের স্বাধীন জীবন।

আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না মলি কী করে এতটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল? তুই চিরকালই কম কথা বলিস। বেচারা মলি নিঃসঙ্গতা কাটাবার জন্য স্কুলে পড়াবার চাকরি-টা নিল আর বাড়িতে টিউশন করা আরম্ভ করেছিল। ওর দুটো কাজই তুই মেনে নিতে পারলি না। তোর মনে হল টাকার জন্য ও কাজ করছে। তোর অহংকারে লাগল। ভাই, আমি ভালো করেই জানি, তুই আজও পুরোনো বস্তাপচা সংস্কার আঁকড়ে ধরে চলার চেষ্টা করিস। তুই শুধু যে মা-বাবাকে হারিয়েিস তা তো নয়, মলিও দ্বিতীয়বার মা-বাবার স্নেহের আঁচল থেকে বঞ্চিত হয়েছে। জানিস-ই তো কী প্রচণ্ড ভালোবাসত ও মা-বাবাকে।

মলয় চুপ করে থাকে। হিমানী কথাগুলো না বলেও থাকতে পারে না। ও জানে দোষ মলয়ের তাই দোষটা চোখে আঙুল দিয়ে ওকে দ্যাখানো দরকার। হিমানী আবার বলে, তোর রাগ তো আমি জানি ভাই। নিশ্চয়ই চ্যাঁচামেচি করতিস মেযোর উপরে। একটা ভালো পড়াশোনা জানা মেয়ে একা সে করবেটাই বা কী? কারও সঙ্গে ওকে মিশতে দিবি না, বাড়িতেও কেউ আসা-যাওয়া করবে না। এখন ও চলে গেছে তাতেও তোর শান্তি নেই।

ও-বেচারারই বা কী অবস্থা কে জানে!

দিদি, প্লিজ চুপ কর, যন্ত্রণায় মাথা ফেটে যাচ্ছে। তুই যা ভাবছিস তা মোটেই নয়। আমার কোনও সমস্যা হচ্ছে না! যার সঙ্গে খুশি ও থাকতে পারে, আমার কী? আমাকে বলেছে, আমি মরলেও জিজ্ঞেস করার কেউ থাকবে না আমার কাছে। ও এটাই চায়। তুই কী করে মলিকে সাপোর্ট করছিস? বেশি আর কী হবে মরেই যাব, এই তো?

তোর একটু শরীর খারাপ হলেই কান্নাকাটি করে একশা করত। তোর আঘাত লাগলে মুখ চুন করে ঘুরত। মায়ে অপারেশনের সময় কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞানই হয়ে পড়েছিল। ও যা মায়ে সেবা করেছে, আমিও হয়তো করতে পারতাম না। সেই মেয়ে সব ছেড়েছুড়ে সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে চলে গেল বিশ্বাস হয় না!

ওকে কনট্যাক্ট করার কোনও তো নম্বর হবে, আমাকে প্লিজ দে ভাই। একবার কথা বলতে চাই। ওর বান্ধবী শুভ্রার নম্বর তোর কাছে আছে? হিমানী নিজেই মলয়ের মোবাইলটা খাটের পাশ থেকে তুলে নিয়ে নম্বর খুঁজতে থাকে।

এখন আর কিছুই করার নেই দিদি। মলি নিজে বলেছে ও শশাঙ্ক-কে বিয়ে করে কানাডা চলে গেছে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মলয়।

হিমানী মলয়ের থেকে চার বছরের বড়ো। হিমানীর বিয়ে পাঁচ বছর বাদে মলয়ের বিয়ে হয়। স্বভাবে মলয় আর মলি একেবারে বিপরীত দুটো মানুষ। মলয় অন্তর্মুখী আর মলি উচ্ছল ঝরনাধারার মতো। বিয়ে হয়ে এসেই মলয়ের মা-বাবাকে আপন করে নিয়েছিল মলি নিজের ব্যবহারে। হঠাত্-ই মলয়ের মা মারা যান স্ট্রোক-এ। বাবাও আর বেশিদিন বাঁচেননি। সুগারের রুগি ছিলেন।

মা-বাবার মৃত্যু মলয় মানতে পারেনি। ডিপ্রেসড থাকতে শুরু করে। মলিও কিছুতেই ওকে এই অবসাদ থেকে টেনে বের করতে পারে না। ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়া শুরু হয়।

অথচ মলি নিজের শ্বশুর-শাশুড়ির যত্নের কোনও অবহেলা কোনওদিন করেনি। বাড়ির সব কাজ সেরে মাঝেমধ্যে বাইরে ঘুরে আসত মলি। বাইরের কাজ থাকলে সেটা করে পাড়া-প্রতিবেশীদের খবরাখবর নিত। তাদের বাড়ি যেত, তাদের বাড়িতে ডাকত। সকলের সঙ্গে সঙ্গে শ্বশুর-শাশুড়িরও আদরের ছিল সে। সকলেই তাকে ভালোবাসত। কিন্তু তাঁরা মারা যাওয়ার পর থেকেই, লোকজনের বাড়িতে আসা-যাওয়াটা মলয়ের কাছে অসহ্য হয়ে উঠল। অল্পেতেই মলয বিরক্ত হতো। কখনও মায়ে মতো রান্নায় স্বাদ হয়নি বলে, মলিকে বকাবকি করত। আবার কখনও ওর এত বাইরে যাওয়া নিয়ে অশান্তি আরম্ভ করে দিত।

শশাঙ্ক মলির ছোটোবেলার বন্ধু। ক্লাস টুয়েভ অবধি একসঙ্গে পড়েছে। সবসময় হাসিমুখ, অন্যের প্রযোজনে পাশে দাঁড়ানো, লোকের বিপদে আগু-পিছু না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়া এই সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য সবার কাছেই খুব পপুলার ছিল শশাঙ্ক। স্কুল শেষ হওয়ার পর আর যোগাযোগ ছিল না, হঠাত্ই রাস্তায় একদিন মুখোমুখি দেখা। সেই একই রকম চেহারা রয়েে। মুখে দুষ্টু-মিষ্টি হাসিটা লেগে রয়েে। চোখদুটো যেন কথা বলছে। শুধু তফাত, আগের থেকে চেহারা খানিকটা ভারিক্কি হয়েে আর মুখের ফ্রেঞ্চকাট দাড়িটা।

আরে, শশাঙ্ক তুই, এখানে! চিনতে পারছিস? মলি খপ করে ওর হাতটা ধরে ফেলে।

হ্ঁযা। তুই মলি? বিশ্বাস হচ্ছে না। মলি মানেই সেই স্কার্ট-ব্লাউজ পরা, দুটো বিনুনি ঝোলানো, রুমাল দিয়ে নাক মুছতে থাকা মেযোকেই মনে পড়ে। শাড়ি পরে মাথায় সিঁদুর, না রে আমি কিছুতেই মেলাতে পারছি না! হা হা করে রাস্তার মাঝেই হাসতে আরম্ভ করে শশাঙ্ক।

আর তুই এখনও বিয়ে করিসনি? হেসেই জিজ্ঞেস করে মলি।

ঝটপট উত্তরও পেয়ে যায়, পাগল! এখনও আমি স্বাধীন। কষ্ট করে পড়াশোনা করেছি, ভালো একটা চাকরিও জোগাড় করেছি। এত সহজে হাড়িকাঠে মাথা দেব ভেবেছিস? একটু তো প্রাণখুলে নিঃশ্বাস নিই। মলির মনে হয় শশাঙ্ককেই মানায় এই প্রাণখোলা হাসিটায়।

কী করছিস? কিছু কেনাকাটা করার আছে নাকি? নয়তো চল বাইক সঙ্গে আছে, কোথাও বসে একটু আড্ডা মারি, শশাঙ্ক বলে।

না রে, সারাদিন বাড়িতে থেকে হাঁপিয়ে উঠলে সন্ধেবেলায় একটু ঘুরে আসি। প্রযোজনে টুকিটাকি জিনিসও মাঝেমধ্যে কিনে নিই। সেটাই কিনতে যাচ্ছি এখন, হাসে মলি।

কেন রে, তোর পতিদেব বাইরের হাওয়া খেতে ভালোবাসে না! নাকি বউয়ে হাত ধরে বেরোনো তার পছন্দ নয়? নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ওঠে শশাঙ্ক। লক্ষ্য করে না ওর এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে, মলির মুখে একটা ছায়া পড়ে, আবার মিলিয়ে যায়।

ঠিক আছে, চল না, জিনিসগুলো কিনে নে। তারপর কোথাও একটু চা খেয়ে তোকে না হয় আমি বাইকে ছেড়ে দিয়ে আসব।

খানিক্ষণের মধ্যে বাইকের পিছনে বসে যেতে যেতে মলি শশাঙ্কের বলে যাওয়া জোক্সগুলো একটার পর একটা শুনতে শুনতে, অনেকটা হালকা বোধ করল। মনের উপর থেকে একটা ভারী পাথর যেন সরে গেছে। শশাঙ্কটা কিছুতেই গম্ভীর হয়ে থাকতে দেয় না। খিলখিলিয়ে হেসে উঠল মলি এবার। বহুদিন বাদে এভাবে মনখুলে মলি হাসতে পারল। শশাঙ্কর দ্বারা বোধহয় কিছুই অসম্ভব নয়। শশাঙ্ক এবার প্লিজ থামবি। হাসতে হাসতে পেট ব্যথা করছে, কপট রাগ প্রকাশ করল মলি। মলির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দুজনের কথা হচ্ছিল।

উফ্, মলি তুই কি বোরিং হয়ে গেছিস। কোথায় বরের সঙ্গে ঘুরবি, মুভি দেখতে যাবি, রেস্টুরেন্টে খাবি তা না করে

দোকান-বাজার করছিস। বিয়ে কেন করেছিস? চল তোর বরের জন্য সিঙাড়া কিনে দিই। কী করে না খায় দেখব। বাড়ি ঢুকে আগে গরম গরম চা কর। আশ্চর‌্য মলিকে বাড়িতে ছাড়তে অথবা বাড়িতে এসে মলির বরের সঙ্গে আলাপ করতে, এতটুকুও সঙ্কোচ বোধ ছিল না শশাঙ্কর। বরং মলি একটু বিব্রত বোধ করছিল। শশাঙ্কর উপস্থিতি মলয় কীভাবে নেবে, সেটা মলি বুঝে উঠতে পারছিল না।

দ্বিধা নিয়ে মলি শশাঙ্ককে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। মলয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে শশাঙ্ককে বসিয়ে মলি চা করতে চলে গেল। চা-সিঙাড়া ট্রে-তে সাজিয়ে ঘরে ঢুকে দেখল মলয় চুপচাপ বসে, শশাঙ্ক একাই কথা বলে যাচ্ছে। শশাঙ্কর অনেকবার অনুরোধ করায় সিঙাড়ার একটা কোণ ভেঙে একটু মুখে দিয়ে প্লেট সরিয়ে রাখল। শশাঙ্কর মজার মজার কথাতেও মলয়ের মুখের কোনও পরিবর্তন হল না। মলয়ের মতে একটা বয়সের পর মানুষকে গম্ভীর হয়ে যেতে হয়। বাচ্চাদের মতন আচরণ তখন মানায় না। এর জন্য় কত বকা যে শুনতে হয় মলিকে, তার গুনতি করাই অসম্ভব।

ওদের কথার মাঝেই মলয় উঠতে চাইলে শশাঙ্ক উঠে দাঁড়ায়, আপনি বসুন, আমি এখন উঠব। অনেক বোর করলাম কিন্তু শিগগির আবার আসব। তৈরি থাকবেন।

গেট পর‌্যন্ত এসে মলির কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে শশাঙ্ক বলল, এই লোকটাকে মানুষ বানিয়ে তবে ছাড়ব। আমি সহজে হার মানছি না। একে কী করে তুই বিয়ে করেছিস মলি! কাল সন্ধেবেলায় দেখা হচ্ছে। বাই, দিয়ে স্পিডে বেরিয়ে গেল।

পরের দিন সন্ধে ছটার সময় শশাঙ্ক মলির বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল। মলি দরজা খুলতেই পকেট থেকে তিনটে গোলাপি রঙের সিনেমার টিকিট চোখের সামনে নাচিয়ে শশাঙ্ক বলল, তাড়াতাড়ি তৈরি হ। তোর ব্যাজারমুখো বরটা কোথায়? ওটাকেও তৈরি হতে বল। আটটার শো। একটা ভালো কমেডি ছবি এসেছে।

তোকে তো বলেছিলাম মলয় সিনেমা দেখা পছন্দ করে না। বিশেষ করে কমেডি তো একেবারেই নয়। আরে ডাক না তোর বরকে। ওর পছন্দের ব্ল্যাক কফি খাওয়াব। রাতের ডিনারটাও না হয় আমার তরফ থেকেই। দ্যাখ এদিকটায় নতুন নতুন এসেছি কাউকে এখনও সেরকম চিনি না। ভাগ্যিস তোর সঙ্গে দেখা হয়েিল! নে নে তাড়াতাড়ি কর। কুড়ি মিনিট পর ক্যাব পেঁছে যাবে, শশাঙ্ক অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে।

মলয় না করা সত্ত্বেও জোর করে ধরে নিয়ে যায় শশাঙ্ক সিনেমা দেখাতে। সারাটা সন্ধে আর বিশেষ কথা বলে না মলয়। চুপচাপ ডিনার খাওয়া শেষ করে শশাঙ্ক ওদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। বাড়ি এসেই মলির উপর রাগ উগরে দেয় মলয়।

মলি, তোমার বন্ধু খুব বেশি বাড়াবাড়ি করছে। ওকে আমার পছন্দ-অপছন্দগুলো বলে দিও। এরপর যদি করে, আমি কিন্তু যা-তা বলতে বাধ্য হব। ওর ফালতু রসিকতা তোমার মতো বেকারের পছন্দ, আমার নয়। মলিকে সাবধান করে দেয় মলয়।

শ্বশুর-শাশুড়ি মারা যেতে স্নেহভরা পরিবেশ মলিও হারিয়েিল। কুড়ি বছর বয়সে নিজের বাবাকে হারিয়েিল সে। চারপাশটা কেমন শূন্য মনে হয় মলির। চরম বিষাদেও নিজেকে অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেয়নি মলি। ভাঙা মন জোড়া লাগিয়ে আবার নতুন উদ্যমে বাড়ির পরিবেশটাকে খুশিতে ভরিয়ে তুলেছিল।

কিন্তু মলয়ের ক্ষেত্রে পুরোপুরি হেরে গেছে মলি। দুবছর কেটে গেছে, মা-বাবার মৃতু্যর শোক আজও ভুলতে পারেনি মলয়। অবসাদের পরিবেশ কাটিয়ে উঠতে, কাছেই একটা স্কুলে চাকরি নিয়েিল মলি। সেখানে সারাদিন বাচ্চা পড়িয়ে মনটা ভালো থাকত। এরপর বাড়িতেও বাচ্চাদের পড়াতে আরম্ভ করে সে। কিন্তু শনিবারগুলো মলয় বাড়ি থাকত। এছাড়া যেদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরত, সেদিন বাড়িতে চার-পাঁচটা বাচ্চার হাসি, কথাবার্তা, সবেতেই বিরক্ত হয়ে উঠত মলয়। তাই, মলয়কে খুশি করতে সপ্তাহান্তে বাচ্চা পড়ানো বন্ধ করে দিয়েিল মলি।

মলির ব্যস্ততার কারণে আর মলয়ের অপছন্দ করার ফলে, শশাঙ্কও মলির বাড়ি আসা-যাওয়া কমিয়ে দিয়েিল। মাঝেমধ্যে শনিবার এলেও, মলির সঙ্গে গল্প করেই চলে যেত। মলয় একদিনও ওদের সঙ্গে বসে আড্ডায় যোগ দিত না। শশাঙ্কর মজা করার অভ্যাস কিছুটা প্রাণ ফিরিয়ে আনত মলির।

একদিন একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরতেই, মলয় দেখল বাড়িতে হইহই হচ্ছে। বাড়িতে কেক কাটা চলছে। মলির কোনও ছাত্রের জন্মদিন পালন করা হচ্ছে। কিছু না বলে চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল মলয়।

বাড়ি খালি হতেই মলয় একপ্রকার ঝাঁপিয়ে পড়ল মলির উপর, তোমাকে বলেছি না, বাড়ি ফিরে আমার একটু শান্তি চাই। এইসব ড্রামা আমার একদম পছন্দ নয়। কাল থেকে কোনও বাচ্চা যেন আমার বাড়িতে পড়তে না আসে। পড়াবার ইচ্ছে থাকলে কোথাও ঘর ভাড়া করে পড়াও। আমার খুশি তো তুমি কখনওই দ্যাখো না, যা ইচ্ছে তাই করো। আমি এটা বরদাস্ত করব না, বলে আবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

ধৈর‌্যের শেষ বাঁধটুকুও ভেঙে গেল মলির। মলয়ের কথাগুলো ছুরির আঘাত ওর কোমল হৃদয়টাকে রক্তাক্ত করে তুলল। মলয়ের ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় ধাক্কা মেরে জোর করে দরজা খুলিয়ে প্রথমবার মলয়ের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল।

তুমি কী বলছিলে? তোমার বাড়ি? তোমার খুশি? আমি তো বিয়ে পর এটাকেই নিজের বাড়ি বলে ভেবে এসেছি। তোমার হুকুম শোনার জন্য আমি বিয়ে করিনি। আমি তোমার চাকর নই। তুমি শুধু নিজের খুশির চিন্তা করো, বউয়ে খুশি নিয়ে একদিনও ভেবেছ?

আমিও আদরে মানুষ হয়েি। একটা বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে মেযো সেটাকেই নিজের বাড়ি ভেবে নেয়, ওই বাড়ির নিয়মে নিজেকে আবার নতুন করে ঢেলে সাজায়। আর তুমি এক নিমেষে আমাকে বাইরের রাস্তা দেখিয়ে দিলে? তোমার যদি এরকমই মেয়ে পছন্দ ছিল তাহলে অনাথ, গরিব, অশিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করলেই পারতে। হাত জোড় করে তোমার আজ্ঞা পালন করত। কিন্তু তা তো হবার নয়। বিয়ে করতে হবে শিক্ষিত, সুন্দরী, ভালো ঘরের মেয়েে। যাতে সবার কাছে সম্মানটা বজায় থাকে, রাগে কাঁপতে কাঁপতে এক নিশ্বাসে মলি কথাগুলো বলে হাঁপাতে থাকে। মলয় বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকে মলির দিকে, মুহূর্তে কোনও উত্তর জোগায় না মুখে।

পুরুষ মানুষ, বউয়ে কাছে হেরে যাওয়া লজ্জার কথা। সুতরাং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মলয় বলে উঠল, এতই যদি দম্ভ, বড়োলোক দেখে বিয়ে করলে না কেন? শশাঙ্কই তো ছিল। ওর সঙ্গে সময় কাটাবার জন্য তোমার মন কাঁদে সব সময়। কেন, আগে ও ভালো চাকরি করত না বলে বিয়ে করনি?

খবরদার মলয়, একটা বাজে কথা মুখ থেকে আর বার করবে না। তোমার নোংরা মনের পরিচয় আমি আগেই পেয়েি। আমি শশাঙ্কর কাছেই চলে যাচ্ছি। একটাই শান্তি, ও তোমার মতো নীচ মনের মানুষ নয়। ওর সঙ্গে আমি অনেক ভালো থাকব, বলে রাগের মাথায় শশাঙ্ককে ফোন করল মলি।

অফিস ফেরত শশাঙ্ক সোজা মলিদের বাড়ি এল। মলিকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করল। মলয়ও অনেক অনুনয়-বিনয় করল কিন্তু মলি মন ঠিক করে নিয়েিল। কেউই কিছু বোঝাতে পারল না মলিকে। অগত্যা শশাঙ্ক বলল, ঠিক আছে, তুই আমাকে মাসিমার নম্বরটা দে। আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি। এলাহাবাদে গিয়ে কয়ে দিন কাটিয়ে আয়। আমি টিকিট কেটে দিচ্ছি।

না রে, মা শুধু শুধু চিন্তায় পড়ে যাবে। সত্যিটা জানতে পারলে কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না, জলে ভেসে যেতে থাকে মলির দুচোখ।

সত্যিটা বলবি কেন? বলবি এমনি ঘুরতে এসেছিস। ধীরে ধীরে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। দুজনেরই রাগ ঠান্ডা হয়ে এসেছে। ঠিক আছে কালই আমি টিকিট কিনে নিচ্ছি।

মলিকে বুঝিয়েসুঝিয়ে শশাঙ্ক সবে বড়ো রাস্তায় পড়েছে। হঠাৎ-ই রং সাইড থেকে একটা ট্রাক এসে ধাক্কা মারল শশাঙ্কর বাইককে। ছিটকে পড়ল শশাঙ্ক। হেলমেট থাকা সত্ত্বেও বুঝতে পারল মাথায় চোট লেগেছে, পা-টাও নাড়াতে পারছে না। মলির মুখটা মনে পড়ল। ধীরে ধীরে জ্ঞান হারাল সে। ততক্ষণে ভিড় জমে গেছে। পুলিশ এসে অ্যাম্বুল্যান্স করে হাসপাতালে পেঁছোল শশাঙ্ককে। ততক্ষণে অনেক সময় পার হয়ে গেছে। শশাঙ্ক তখন কোমায়। মোবাইলটাও ভেঙে রাস্তায় ছিটকে পড়েছিল।

তিনদিনের পরও যখন শশাঙ্ক এল না বা ওর ফোনও পাওয়া গেল না, মলয় পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মলিকে ব্যঙ্গ করতে ছাড়ল না, তোমার ভালোবাসার মানুষ ভয় পেয়ে পালিয়েে।

সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। অন্যের সঙ্গে চলে যাব সেই ভয়ে কি ডিভোর্স দিচ্ছ না? বিরক্ত হয়ে মলি জিজ্ঞেস করে।

ভয় কাকে করব? শশাঙ্ককে? একটা উজবুক। কালই চলো ভালো কোনও উকিলের সঙ্গে কথা বলব।

ঠিক আছে, আবার অবস্থান বদলে ফেল  না, রাগের মাথাতেই নিশ্চিত হতে চাইল মলি।

সত্যি বলতে কী, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াল। শেষমেশ ডিভোর্সের পর সাহস করে মলি এলাহাবাদে মায়ে কাছে গিয়ে দাঁড়াতে, মলিনাদেবী শোকে পাথর হয়ে গেলেন। মলি ধীরে ধীরে তাঁকে আবার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারলেও, নিজে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারল না। শরীর ভাঙতে আরম্ভ করল। মলয়েরও মন আত্মগ্লানিতে ভরে উঠল। নিজের

অংহবোধ-এর জন্য মলির সঙ্গে ডিভোর্স নিয়েিল ঠিকই কিন্তু মনে মনে জানত ওদের সংসারের জন্য, ওর বুড়ো মা-বাবার জন্য মলি কতটা আত্মত্যাগ করেছে। মলি মিষ্টি ব্যবহার দিয়ে পাড়া-প্রতিবেশী সকলের মন জয় করে নিয়েিল। সকলেই জিজ্ঞেস করত মলি কেন চলে গেল? কিন্তু এর কোনও উত্তর ছিল না মলয়ের কাছে।

এ বাড়িতে আর কেউই আসত না। খালি বাড়িটা যেন গিলে খেতে আসত মলয়কে। আগে সামান্য চ্ঁযাচামেচি হলে রেগে উঠত, আর এখন খালি মনে হতো বাড়িতে কেউ তো আসুক। প্রায়শ্চিত্তের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে শয্যাশাযী হয়ে গিয়েিল মলয়। জল এগিয়ে দেওয়ারও কেউ ছিল না। ভাগ্যিস, হিমানীকে কেউ খবর দিয়েিল। দিদি না এলে এতদিনে প্রাণটুকুও হয়তো হারাতে হতো।

শুভ্রাকে ফোন করে হিমানী জানতে পারল, শুভ্রা ইদানীং আর এলাহাবাদে থাকে না। দিল্লি চলে গেছে। ও সোজাসুজি হিমানীকে বলল, এখন আর কী হবে দিদি। ডিভোর্স হয়ে গেছে। মলয় ওর জীবন নরক করে তুলেছিল। ওর দুঃখ সহ্য করতে না পেরে মাসিমাও মারা গেলেন। এখন মলি শশাঙ্ককে বিয়ে করে কানাডায় সেটেলড। ওরা ভালো আছে। আপনারা আর ওর চিন্তা করবেন না।

এটা কিছুতেই হতে পারে না শুভ্রা।

মলয়ের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে মলির, শশাঙ্ককে বিয়ে করায় অসুবিধা কোথায়…, জোরের সঙ্গে বলল শুভ্রা। সেটাই তো। আমি জানি ওই বাড়ির সঙ্গে ও কতটা ক্লোজ ছিল। এই বাড়ি, এই বাড়ির মানুষগুলোর সঙ্গেও। ভাইয়ে বউ ছিল ও, কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বও কিছু কম ছিল না। মলি ডিভোর্স করে বিয়ে করে নিল, মন কিছুতেই মানতে চাইছে না। শুভ্রা ঠিক করে বলো। একবার বলো তুমি যা বলছ সব মিথ্যা। মাত্র দেড় বছর হল আমরা নিউজিল্যান্ডে শিফ্ট করেছি, আর এর মধ্যে এত কাণ্ড! প্লিজ শুভ্রা ওর কনট্যাক্ট নম্বরটা একবার দাও। আমি ওর মুখ থেকে নিজের কানে শুনতে চাই, হিমানী করুণ স্বরে রিকোযে্ট করে শুভ্রাকে।

দিদি, ও নম্বর দিতে বারণ করেছে। আর কী করবেই বা তুমি? হাড় কটা রয়ে গেছে শরীরে। ওর অবস্থা চোখে দেখতে পারবে না। কেউ ওর কথা জিজ্ঞেস করলে এগুলোই সবাইকে বলতে বলেছে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে শুভ্রা। হিমানীর অনুরোধ কিছুতেই ফেলতে পারে না, হেরে গিয়ে মলির নতুন নম্বরটা হিমানীকে দিয়ে দেয় শুভ্রা।

শুভ্রা, এটা তো ইন্ডিয়ারই নম্বর, আশ্চর‌্য হয় হিমানী।

দিদি মলি শশাঙ্ককেও বিয়ে করেনি, কানাডাও যায়নি। শশাঙ্ক আমার পিসির ছেলে। কলকাতায় গিয়ে সাংঘাতিক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। চারমাস কোমাতে পড়ে ছিল। তারপর জ্ঞান ফিরলেও নানা সমস্যা হচ্ছিল। পিসিরা ওকে দিল্লিতে নিয়ে এসে চিকিত্সা করায়। এখন ভালো হয়ে ওরা সবাই এলাহাবাদ ফিরে গেছে। শশাঙ্কই আমাকে মলির খবরাখবর দিতে থাকে। শুভ্রা বিস্তারিত খুলে বলে হিমানীকে।

 

হিমানী, শুভ্রার ফোন ছেড়েই মলির নম্বর ডায়াল করে।

হ্যালো… সেই মিষ্টি গলা কিন্তু আজ তাতে আর যেন প্রাণ নেই।

মলি, আমি তোর হিমানীদি। এতটা পর করে দিলি আমাদের! কাউকে কিছু জানালি না। কী করলি তোরা? তোরা কি পাগল!

ওদিকে কোনও উত্তর নেই দীর্ঘশ্বাসের মৃদু আওয়াজ ছাড়া।

তোদের দুজনকে ভালোমতন জানি। তোর যা অবস্থা, মলয়েরও তাই। মলয়ও বিছানায় পড়ে রয়েে। এত ভালোবাসা কিন্তু এত ইগো কেন? মলয় প্রচুর ভুল করেছে। প্রিয়জনদের হারিয়ে ওর মাথায় ভত চেপেছিল যার জন্য তোকে ও হারিয়েে। আজ নিজের আচরণের জন্য ও লজ্জিত। প্রতি মুহূর্তে তোকে মিস করছে। মলি, মলয় আজও তোকেই ভালোবাসে।

মলি নিশ্চুপ।

এই ভাবে চললে দুজনের কেউই বাঁচবি না। অনেক তো লুকোবার চেষ্টা করলি। শুভ্রা আমাকে সব সত্যিটা বলেছে। ফিরে আয় মলি। আমি আসছি তোর কাছে, ভাইটাকেও কান ধরে নিয়ে আসব। আগে তো ক্ষমা চাইবে তোর কাছে। এরপর কখনও যদি তোকে দুঃখ দেয়, তোকে কাঁদায় তাহলে ও আমায় জীবিত পাবে না, এই আমি ওকেও জানিয়ে রাখলাম।

হিমানীর কথা শেষ হওয়ার আগেই মলয় বিছানা থেকে উঠে বসে দিদির মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরল, দিদি আর কোনও দিন এই কথাটা বলবি না।

তাহলে দুজনেই কান ধরে ক্ষমা চা আমার কাছে, মৃদু হেসে হিমানী বলল, যেটা মলয় ছাড়াও ফোনের ওপাশে মলির কানে গিয়ে পেঁছোল। মলি এমন একটা মেয়ে যে পুরো বাড়ি মাথায় করে রেখেছিল, সবাইকে আপন করে নিয়েিল তার সঙ্গে তুই অ্যাডজাস্ট করতে পারলি না ভাই, কেন? মানছি তোর কিছু পছন্দ, অভ্যাস, সংস্কার আছে, সেরকম মলিরও তো কিছু চাহিদা আছে… তাই না কি? অ্যাডজাস্ট খালি ওই করে যাবে? আমি কি প্রথম থেকে এরকম ছিলাম? রানার জন্য অনেক নিজেকে বদলেছি। রানাও নিজেকে কম বদলায়নি। তাই আজ আমরা সুখী দম্পতি। তোকেও ভাই বদলাতে হবে, কিছু ত্যাগ করতে হবে মলির জন্য। পারবি না মলির জন্য নিজেকে বদলাতে? আশা নিয়ে মলয়কে জিজ্ঞেস করে হিমানী।

হ্ঁযা দিদি, তুই যা বলছিস আমি শুনব, আশ্বাস দেয় মলয়।

তাহলে কথা বল ওর সাথে। নম্বর-টা ডায়াল করে হিমানী ভাইয়ে হাতে ফোনটা দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল।

মলি, কোন মুখ নিয়ে আমি কথা বলব তোমার সাথে। আমি অপরাধী, আমাকে পারো তো ক্ষমা করে দাও। বিয়ে পর থেকে বাড়ির সব দাযিত্ব তুমি পালন করেছ। হনিমুন কেন কখনও কোথাও তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাইনি। নিজের ইচ্ছে শুধু তোমার উপর চাপিয়ে গিয়েি। তোমার সঙ্গে পা মিলিয়ে দুপা হাঁটতেও কখনও চেষ্টা করিনি আমি। বাচ্চা দত্তক নিতে চেয়ে, আমি মত দিইনি। বাড়িতে টিউশন আরম্ভ করেছিলে, সেখানেও আমি তোমাকে অপমান করেছি। তোমার বন্ধু সম্পর্কে যা নয় তাই বলেছি। তোমাকে পাঁকে নামাতেও আমি দ্বিধা করিনি। এতটা নীচে নামতে পেরেছি আমি। মলি এতদিন আমি যা করে এসেছি সব ভুল করেছি! তুমি কেন কেউই সহ্য করতে পারত না। প্লিজ কিছু বলো মলি। আমাকে থাপ্পড় মারো, গালাগালি দাও, বাজে কথা বলো কিন্তু প্লিজ কথা বলো, কথা না বললে আমি ওখানে চলে আসব।, মলয় অনুনয় বিনয় করতে থাকে।

ফোনের ওপাশ থেকে মলির কান্না মলয়ের বুকের গভীরে ক্ষত আরও বাড়িয়ে তোলে।

আমি আসছি মলি তখন মন ভরে আমাকে  মেরে নিও কিন্তু তুমি আমার প্রাণ। আমাকে আমার প্রাণ ফিরিয়ে দাও। দিদিকে দিচ্ছি আমি বলে হিমানীকে ফোন ধরায় মলয়।

আর কাঁদিস না মলি, অনেক কেঁদেছিস তোরা দুজন। তুই আসার জন্য তৈরি থাকিস। মলয় ফিট হলেই ওকে নিয়ে যাচ্ছি, হিমানী বলে। ওপাশে কান্না বন্ধ হয়ে গিয়েিল, কিছু বলবি না মলি! হেসে জিজ্ঞেস করে হিমানী। না দিদি তোমরা এসো, ক্ষীণ স্বরে মলি উত্তর দেয়।

তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে নে, আমরা আসছি। বিয়ে দিয়ে নতুন বউ ঘরে তুলব। দুর্গাপুজো এবার কলকাতায় একসঙ্গে কাটাব ঠিক করেই রেখেছি। রানা তোদের নিয়ে অসম্ভব চিন্তায় রয়েে। ওকেও আনন্দের খবরটা জানাতে হবে। দিদির উপর বিশ্বাস রাখ মলি। তোর সংসার তোর প্রতীক্ষায় রয়েে। ব্যস শুধু নিজের বাড়ি ফিরে আয় মলি।

ঠিক আছে দিদি। তোমরা যা চাও তাই হবে, মলির স্বরে প্রাণ ফিরে এসেছে হিমানী ঠিকই ধরতে পেরেছিল।

নে ভাই, এবার তুইও সুস্থ হয়ে নে, তাড়াতাড়ি আমরা সবাই একসঙ্গে এলাহাবাদ যাব, হিমানী মলয়ের কপালের জলপট্টিটা বদলাতে বদলাতে মৃদু হেসে বলে।

মলয়কে ওষুধ খাইয়ে হিমানী উঠে গিয়ে স্বামীকে ফোন করল, মলি আর মলয়ের সুসংবাদটা দেবে বলে।

নতুন রাস্তা

অনেকদিন পরে সেদিন বাজারে হঠাৎই রেণুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দুহাতে দুটো ভারী থলে। খুবই বিধবস্ত মুখচোখ। বাজার করার পরিশ্রম আর অফিসে যাওয়ার তাড়া– এই দুটো মিলেজুলেই নিশ্চয় মুখে অমন ঘর্মাক্ত ও পর্যুদস্ত ছাপটা পড়েছে।

রেণু আমাদেরই প্রতিবেশী। একই পাড়ায় আমাদের দীর্ঘকালের বসবাস। আমাদের উত্তর কলকাতার এই পাড়াগুলোয় পারস্পরিক সম্পর্কগুলো এখনও যান্ত্রিক হয়ে পড়েনি। দেখা হলে কেবল সৌজন্যের হাসি হেসে আমরা সরে পড়ি না, বরং দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলে মনের ভার হালকা করি।

রেণুর সঙ্গে আমার চেনাজানা, এ পাড়ার বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই। আমরা প্রায় সমবয়সি। তবে আমারও বছর দুই আগে ওর বিয়ে হয়। মফস্সলের মেয়ে। আমার মতোই। তবে খাস কলকাতায় এসেও দিব্যি মানিয়েগুছিয়ে নিয়েছে। মনে আছে, আমার বিয়ের সময় স্বেচ্ছাসেবা দেওয়ার জন্য পাড়ার যে ব্যাটেলিয়ান তৈরি ছিল, তার পুরোভাগে ছিল রেণু। হালকা পাখির মতো পায়ে কতবার তাকে একতলা-দোতলা করতে দেখেছি। খলবল করে গোটা অনুষ্ঠানবাড়িটা যেন মাতিয়ে রেখেছিল।

অতএব, প্রাণোচ্ছ্বল রেণুকে যথেষ্ট বিষণ্ণ দেখে আমি কৌতূহল চাপতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে গো?’

আমার প্রশ্নটাও শেষ হতে পায়নি, রেণু যেন উছলে পড়ল, ‘আর বোলো না কল্পনা। আমি খুব ঝামেলার মধ্যে আছি।’

‘কী ঝামেলা?’ আমি এবার সত্যি অবাক হই।

‘কী ঝামেলা, কী বলব! আমার শাশুড়ি একেবারে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছেন ভাই। হাড়মাস কয়লা হয়ে গেল। এখন অফিস করব, নাকি এইসব ঝামেলা সামলাব, তাই বুঝতে পারছি না!’

রেণুর শাশুড়ির ছবিটা তক্ষুণি চোখের সামনে ভেসে উঠল। ভদ্রমহিলা বিধবা। কিন্তু ষাটের কোঠা পেরিয়ে গিয়েও বেশ সুস্থ, সুঠাম। আর ভদ্রমহিলার ব্যাপারে সেটাই প্রথমে নজর কাড়ে।

বছরপাঁচেক আগে রেণুর স্বামী রজতদা হঠাৎ-ই তার মাকে বর্ধমানে দেশের বাড়ি থেকে শহরে নিয়ে আসেন। তখন একসঙ্গে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছিল আসলে। তার কিছুদিন আগেই রজতদার পিতৃবিয়োগ হয়েছে। ফলে দেশের বাড়িতে তার মা একেবারেই একা হয়ে পড়েছেন। আবার এদিকেও দুই ছেলে সামান্য বড়ো হয়ে যেতে রেণু চাকরি করার তাল ঠুকছে। অর্থাৎ উভয়েরই তখন পরস্পরকে প্রয়োজন।

সেই থেকে রজতদার মা এই পাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেলেন। বর্ধমানে সকলে ওকে বড়োমা বলে ডাকত। আগেকার যৌথ পরিবারে এ ধরনের প্রথা ছিল। পাড়াতেও সেই নামটাই স্থায়ী হয়ে গেল। অন্তত দুটো ভিন্ন প্রজন্ম এখন রজতদার মাকে ওই নামেই ডাকে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘বড়ো-মার কথা বলছ? বড়ো-মা কী করেছে?’

‘সেসব নিজের চোখে না দেখলে তুমি বিশ্বাস করবে না কল্পনা,’ রেণু বলল, ‘বরং নিজেই এসে একদিন দেখে যাও। সমীরদাকেও সঙ্গে এনো। আমি চলি, আমার আবার ওদিকে অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। সব দিকেই তো বিপদ–!’

নিজের মনে গজগজ করতে করতে লম্বা পা ফেলে বাজারের বাইরে চলে গেল রেণু। আমি ওর থলে হাতে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে পড়া শরীরের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলাম।

সংসার থাকলে তার নিজস্ব এক ব্যস্ততা থাকবেই। সেই জীবনে আমিও ব্যস্ত। ব্যস্ততা শুরু হয় ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই। মাথার পাশের বেডসাইড টেবিলের উপর মোবাইল ফোনে অ্যালার্ম দেওয়া থাকে। কেবল আমারটাতেই নয়, সমীরেরটাতেও। পাছে একবারের অ্যালার্মে পাকা ঘুম না ভাঙে, তাই এই ব্যবস্থা।

অ্যালার্ম বেজে উঠলে আমিও ধড়ফড় করে উঠে বসি। সমীর অবশ্য তারপরও আধঘণ্টা বিছানা ছাড়ে না। ওর চাই জ্যান্ত এবং প্রহারকারী অ্যালার্ম। অর্থাৎ আমি। কিচেনে সকালের ভাতটা চাপিয়ে, আঁচলে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে আমি যতক্ষণ না মশারি তুলে গলা ঝাঁঝিয়ে দুহাতে ঠেলা দিয়ে তাকে জাগাব, ততক্ষণ ওঠার নামও নেবে না সে। আমাদের ছেলেকে তামিলনাড়ুর এক আবাসিক স্কুলে দিয়েছি। ফলে কাউকে স্কুলের বাসে উঠিয়ে দেওয়ার ঝঞ্ছাট থেকে আমরা মুক্ত। কিন্তু দুজনেই অফিস যাই। ফলে সেজন্য প্রস্তুতিও নিতে সময় লাগে। শুধু সকালের খাবার তৈরি করলেই তো কাজ ফুরিয়ে যায় না। দুজনের লাঞ্চ তৈরি করে টিফিন বক্সে ভরার ব্যাপার আছে। তারই মধ্যে সবজিওলা এসে দরজায় হাঁকডাক করবে। ছুটির দিন ছাড়া বাজারে যাওয়া হয় না, ফলে এরাই ভরসা। প্রায় একই সময়ে চলে আসবে টুনির মা। সে প্রায় দশহাতে গোটা বাড়িতে দাপিয়ে বেড়ায় পরবর্তী পৌনে একঘণ্টা। একটা সাইক্লোন যেন ফোঁসফোঁস করে তোলপাড় তুলে দরজা খুলে অন্য কোনও বাড়ির দিকে উড়ে যায়। সকালটা যেন অগ্নিগর্ভ হয়ে থাকে।

এতকিছু সামলে বড়ো-মার কথাটা মন থেকে বেমালুম যেন উবে গেছিল। কোনও কোনও ছুটির দিনে বা সন্ধের অবসরে, টেলিভিশনে কোনও একঘেয়ে অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে হঠাৎ করে মনে পড়ে গেলেও শরীর জোড়া ক্লান্তি দূরতিক্রম্য হয়ে দাঁড়াত।

রেণুদের বাড়ি আমাদের গলিটার ঠিক মুখে। খুব বেশি হলে হেঁটে আমাদের বাড়ি থেকে দু-মিনিটের রাস্তা। তবু আলস্য যেন দু-পা চেপে ধরত, অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর। রেণুকেও তারপর অনেকদিন বাজারে দেখিনি। আগে মাঝেমধ্যে সকালে অফিসযাত্রীদের বাসে ওকে দেখতে পেতাম। এখন বোধহয় রেণু অন্য কোনও ব্রাঞ্চে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। কাজেই রুট বদল হয়ে গেছে তার।

পাকেচক্রে রেণুর কথাগুলো আমি হয়তো ভুলেই যেতাম। কিন্তু এক সন্ধ্যাবেলার একটা ঘটনা আমাকে আবার রেণু ও বড়ো-মার প্রসঙ্গ মনে পড়িয়ে দিল।

আমাদের বাড়ির কাছেই থাকে সোহিনীরা। পাশের পাড়ার মেয়ে। বিয়ে হয়ে আমাদের পাড়ার বাসিন্দা হয়। ছোটো ছোটো দুটি বাচ্চা আছে। ইংরেজিতে এমএ করার পর বাড়িতেই কিছু ছাত্রছাত্রীকে টিউশন দিত। কিন্তু দেখা হলেই বলত, ‘আমার চাকরি করার কী ভীষণ ইচ্ছা, জানো কল্পনাদি! কত অফার পাচ্ছি, ভাবতে পারবে না। কিন্তু নিতে সাহস হচ্ছে না। বাচ্চাদুটো তো ছোটো! কী করি বলো তো?’

ওর আগ্রহ আর হতাশার কথা শুনে চুপ করে থাকা ছাড়া আমার আর কিছু করার থাকত না। মেয়েদের জীবনটাই যে একছাঁচে গড়া। যেখানে আমার জীবন, সোহিনীর জীবন, আর-একটা মেয়ের জীবন মিলেমিশে একাকার।

শেষে সোহিনী নিজেই বলত, ‘ভাবছি কত তাড়াতাড়ি ছেলেদুটো একটু বড়ো হয়ে যাবে। কষ্ট করে লেখাপড়া শিখলাম, সে কি শুধু

সংসারের হেঁসেল ঠেলা আর বাচ্চাদের মানুষ করার জন্য? তুমিই বলো কল্পনাদি!’

আমি ম্লান হেসে ওকে স্ত্বান্না দিতাম, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখিস!’

তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। বাচ্চাদুটি এতদিনে নিশ্চয় একটু বড়ো হয়েছে। যদিও এখনও স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি ওদের। এইসময় হঠাৎ একদিন দুপুরে সোহিনী আমাদের বাড়িতে এল।

বেশ খুশি-খুশি দেখাচ্ছে ওকে। হাতের বড়ো ঝোলায় একটা কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে। সম্ভবত কোনও বাক্স। আমাকে ধরে, ‘কল্পনাদি, ও কল্পনাদি, সুখবর আছে’ বলে একপাক নেচে নিল সোহিনী। তারপর ঝোলা থেকে বেশ বড়োসড়ো একটা মিষ্টির প্যাকেট বের করে ঢাকনা খুলে আমার সামনে ধরে বলল, ‘নাও মিষ্টি খাও–!’

আমি নিচ্ছি না দেখে ও ফের বলল, ‘কী হল কী, নাও–!

ইতস্তত করে একটা হাতে নিই, কিন্তু আমার ভুরুর ভাঁজ মেলায় না। চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করি, ‘ব্যাপারটা কী’ আমায় খুলে বল তো! তোরা কত্তা-গিন্নিতে মিলে আবার কোনও তৃতীয় জনকে পৃথিবীতে আনার মতলব কষেছিস নাকি? পরিবার পরিকল্পনার এ যুগেও? তোদের তো সাহস খুব!’

সেইসঙ্গে আমার মেয়েলি সন্ধানী চোখ সোহিনীর শরীরে হেঁটে বেড়ায়। এখনও গর্ভধারণের কোনও চিহ্ন ওর শরীরে দৃশ্যমান নয়।

ডাইনিং টেবিলের উপর মিষ্টির প্যাকেটটা সযত্নে রেখে দিয়ে সোহিনী ঘুরে দাঁড়াল। তারপর বিচিত্র এক মুখভঙ্গি করে বলল, ‘দেখেছ? এই হচ্ছে তোমাদের মতো নিপাট হাউসওয়াইফের দোষ। ওইটা ছাড়া আর অন্য কিছু ভাবতে পারো না। হরাইজনটা আসলে ছোটো হয়ে আসে।’

বিরক্ত মুখে বললাম, ‘যা, যা, মেলা বকিসনি। কী খবর, সেটাই খোলসা করে বল ঢং না করে–!’

আমার দু-কাঁধে চাপ দিয়ে সোফায় বসিয়ে সোহিনী আদুরে গলায় বলল, ‘বলছি, বলছি দাঁড়াও।’

তারপর আমার পাশে বসে পড়ে বলল, ‘তুমি তো জানো, আমার একটাই স্বপ্ন ছিল। চাকরি করব।’

‘ও, চাকরি পেয়েছিস বুঝি?’

‘আলবত। হেঁজিপেঁজি চাকরি নয় গো। মালটিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি। ভালো মাইনে দেবে। এবার আমিও সকালবেলা নাকেমুখে কোনওরকমে গুঁজে বড়োরাস্তার দিকে ছুটব। ঠিক নটায় বাসস্ট্যান্ডে কোম্পানির বাস এসে দাঁড়াবে। এসি বাস। আমায় তুলে নিয়ে হুস করে…!’

হাতের মুদ্রায় সোহিনী ‘হুস’ করে চলে যাওয়াটা কেমন, সেটা দেখায়। নতুন প্রাণস্ফূর্তিতে ও যেন মত্ত হয়ে আছে। দু-চোখ জুড়ে স্বপ্নপূরণের আনন্দ ঝিলিক দিচ্ছে।

হঠাৎ-ই বলল, ‘জানো কল্পনাদি, চাকরিটা হয়ে যাবে বলে কনফার্মেশনটা যে-মুহূর্তে পেয়েছি, অমনি শপিং মলে গিয়ে এক্বেবারে নতুন ডিজাইনের পাঁচটা চুড়িদার-কামিজ কিনে এনেছি। শাড়ি পরে তো আর এত দৌড়ঝাঁপ করা যায় না। মাঝেমধ্যে শাড়ি পরব। অফিসের কোনও অনুষ্ঠানে। কিংবা ধরো চুড়িদার পরতে পরতে একঘেয়ে লাগলে তখন। স্বাদবদলের জন্য।’

আমি কী বলি তা শোনার জন্য একগাল হিরের টুকরো ছড়ানো হাসি নিয়ে সোহিনী আমার দিকে চেয়ে রইল।

আমি গম্ভীর স্বরে বললাম, ‘সবই তো ঠিক আছে। কিন্তু বাচ্চারা? ওদের কি প্রেপ স্কুলে ভর্তি করে দিলি, নাকি কোনও ক্রেশ?’

সোহিনী হাসি ধরে রেখে বলল, ‘ক্রেশ কেন? বড়ো-মা আছে তো!’

নামটা শুনে আমি চমকে উঠলাম। ‘বড়ো-মা? বড়ো-মা এর মধ্যে আসছে কী করে?’

সোহিনীর মুখ থেকে হাসি মুছে গেল এইবার। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ওমা, তুমি জানো না?’

আমি অবাক হওয়া মুখ দুপাশে নেড়ে জবাব দিলাম, ‘না!’

সোহিনী বোধহয় আমার চেয়েও বেশি অবাক হল।

অবিশ্বাসীর হাসি হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যিই জানো না? তুমি কী গো? তুমি কি এ পাড়ায় থাকো?’

আমার মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছিল। অনেকদিন আগে বাজারে দেখা রেণুর উদভ্রান্ত মুখটা মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল, প্রতিশ্রুতি দিয়েও শেষ পর্যন্ত রেণুদের বাড়িতে যাওয়া হয়নি ব্যস্ততার জন্য। আমি কৌতূহল দমন করে বললাম, ‘হ্যাঁ, বাজারে একদিন রেণুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ও তাড়ায় ছিল। সবটা খুলে বলতে পারল না। আমিও আর পরে জানতে চাইনি। মনে হল, বড়ো-মাকে নিয়ে ওরা খুবই ব্যতিব্যস্ত।’

‘দূর! রেণুদির কথা ছাড়ো তো! ওদের বড্ড বাড়াবাড়ি! আরে বড়ো-মা যা করছেন তাতে, আমাদের মতো মেয়েরা ওর কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। রেণুদি এত কথা বলছে তো! রেণুদির নিজের কত সুবিধা হয়েছে বড়ো-মা এখানে থাকায়, সে-কথা কি একবারও রেণুদি স্বীকার করে?’

সোহিনী রীতিমতো ফোঁস করে ওঠে। মনে হল যেন, বড়ো-মার বিরুদ্ধে রেণুর অভিযোগ, সরাসরি সোহিনীর গায়ে গিয়েই লেগেছে। ফলে বেরিয়ে পড়েছে পাড়াতুতো রাজনীতির দাঁত-নখ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘বড়ো-মার কথাটাই বল। উনি তোকে কীভাবে…!’

সোহিনী আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘রেণুদিদের বাড়িটা তো ফাঁকাই পড়ে থাকে সারাদিন। ওরা তো কত্তাগিন্নি দুজনেই অফিসে যায়। বড়ো-মা পাড়ার বাচ্চাদের সে সময়টা সামলান। সকলেই এ-পাড়ার বা পাশের পাড়ার চাকরি করা মহিলাদের সন্তান। শুনেছি, বাচ্চাদের পাল্সটা উনি খুব ভালো বোঝেন। প্রচুর যত্নআত্যি করেন। এখন তো সকলেই বাচ্চাদের রাখার জন্য ওঁর কাছে দৌড়োচ্ছে।’

বড়ো-মার কীর্তিকলাপের কথা শুনে আমার তো চোখ কপালে উঠেছে। রেণুর অভিযোগটা তাহলে নিতান্ত অন্যায্য নয়।

সোহিনীর কথা তখনও শেষ হয়নি। সে খুব রুষ্ট মুখে বলল, ‘বড়ো-মা আর নতুন কাউকে নিচ্ছে না জানো! ডিমান্ড তো খুব! আমি নেহাত পাড়ার বউ। তাই না করতে পারল না।’

সোহিনী বেশ খানিকক্ষণ গল্প করে চলে গেল। কিন্তু আমার ভাবনায় বড়ো-মা ঢুকে পড়লেন। রেণু এবং ওর স্বামী রজত– দুজনেই ভালো চাকরি করে। বড়ো-মাকেও যে তারা অবহেলা করে, এমন নয়। তাহলে বড়ো-মার কী উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে এহেন কার্যকলাপের মাধ্যমে? কী প্রমাণ করতে চান উনি? ছেলে আর বউমাকে সকলের চোখে এমন খাটো করে দেখানোর ভাবনাই বা তার মাথায় চেপে বসল কেন হঠাৎ?

সন্ধেয় সমীর বাড়ি ফিরতে ওকে প্রথমেই সোহিনীর জানানো কথাগুলো বলেছি। শুনে প্রথমে সে অবাক হল। তারপর মুখটা বিকৃত করল একটু। শেষে ভুরুতে সেই যে ভাঁজ পড়ল, সে ভাঁজ আর সিধে হল না।

খানিকক্ষণ গুম মেরে বসে থেকে সমীর বলল, ‘আমায় তুমি তো খুব চিন্তায় ফেলে দিলে কল্পনা। ছোটোবেলায় আমি আর রজত হরিহর আত্মা ছিলাম। এখনও আমাদের মধ্যে যথেষ্ট বন্ধুত্ব। তাই ওর ব্যথাটা আমার বুকে বড়ো লাগছে!’

আমি চুপ করে আছি দেখে, সমীর আমাকেই পালটা প্রশ্ন করল, ‘কী দরকার ছিল বলো তো বড়ো-মার এমন সব পাগলামো করার? এতে সমাজের সমালোচনার আঙুল যে ওরই ছেলে-বউমার দিকে উঠবে, একথা কি একবারও উনি ভাবলেন না?’

‘আমার কী মনে হয় জানো?’ আমি বলি, ‘আমাদের দুজনের একবার ওদের বাড়িতে যাওয়া উচিত। বড়ো-মাকে বোঝানো উচিত। উনি যেটা করছেন, সেটা ঠিক করছেন না। তুমি বোঝালে হয়তো উনি তার মূল্য দেবেন!’

সমীর মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, ‘দেখা যাক।’

সেই সপ্তাহেই একদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে সমীর অন্য কোনও কারণে। সম্ভবত শরীরটা তার ভালো ছিল না সেদিন। দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পর বলল, ‘চলো বড়ো-মার কাছ থেকে ঘুরে আসি।’

দুপুর দুটো বাজে। সদর দরজা খোলাই ছিল। আমরা দোতলায় উঠতেই বাচ্চাদের নানারকম গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। রেণুদের ড্রয়িংরুমের সামনে এসে দাঁড়তেই একঝলকে গোটা ছবিটা পরিষ্কার হয়ে গেল। ঘর জুড়ে দশটি প্রায় একই বয়সি বাচ্চা। কেউ ঘুমোচ্ছে। কেউ বা দুষ্টুমি করছে। খেলনা নিয়ে খেলছে কেউ। খোদ বড়ো-মা একটি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে, দুধের বোতল থেকে দুধ পান করাচ্ছেন। আর-এক মধ্যবয়সিনি অন্য বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত।

বড়ো-মাকে দেখতে অদ্ভুত লাগছে। মুখ থেকে যেন একটা জ্যোতি বের হচ্ছে। স্নেহের বিভা। আমরা থতোমতো খেয়ে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ মুখ তুলে আমাদের দেখতে পেয়েই বড়ো-মা উদার আমন্ত্রণ জানালেন।

‘আরে, সমীর? বউমা? এসো, এসো ভিতরে এসো। বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? মালতী একে ধর। দেখিস দুধটা যেন পুরোটা খায়।’

মালতীর হাতে কোলের বাচ্চাটিকে তুলে দিয়ে বড়ো-মা উঠে দাঁড়ালেন।

‘ও হল মালতী। সাতকুলে কেউ নেই ওর। তাই জুটে গেল। একা একা এতগুলো বাচ্চাকে সামলানোর বয়স কি আর আছে?’

বড়ো-মা আমাদের ভিতরের ঘরে নিয়ে গেলেন। সমীর সোফায় বসে বলল, ‘আপনি তো রীতিমতো ক্রেশ চালু করে দিয়েছেন দেখছি বড়ো-মা!’

বড়ো-মা তৃপ্তির হাসি হাসলেন। মালতীকে ডেকে বললেন, ‘তোমার হাত খালি হলে ফ্রিজ থেকে মিষ্টি নিয়ে এসো তো মালতী!’ তারপরই আমাদের দিকে ফিরলেন, ‘খুব ভালো লাগে জানো। মনটা পবিত্র হয়ে যায়। বয়স তো হল। পরমার্থের সন্ধান করার এখনই তো প্রকৃষ্ট সময়।’

আমি জানতে চাইলাম, ‘আপনি হাঁফিয়ে পড়েন না? এতগুলো বাচ্চাকে সামলানো তো মুখের কথা নয়। তাই না?’

‘দ্যাখো, নিজের নাতি-নাতনিদের জন্যও কি কম দৗড়ঝাঁপ করেছি? এক-একটার আবদার শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। এখন তবু মালতী আছে। তখন তো আমি একা। ওরা দুজন চলে যেত অফিসে, সারাদিনের মতো। এখন নিজের নাতি-নাতনি বড়ো হয়ে গেছে। তাই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ করছি আর কী! এদেরকেই নাতি-নাতনি বানিয়ে ফেলেছি। জানো, ওদের মায়েরা বলে, বাচ্চাদের অনেকে নাকি রাতেও বায়না ধরে, বড়ো-মার কাছে শোবো। বোঝো অবস্থা!’

বড়ো-মার মুখটা একথা বলতে গিয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

সমীর জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা-মায়েরা এদের নিয়ে যায় কখন?’

‘সন্ধে ছটার মধ্যে গোটা তল্লাট ফাঁকা হয়ে যায়। মালতী সব গুছিয়ে নীচে ওর ঘরে চলে যায় বিশ্রাম করতে। রেণু আর রজতও ফিরে আসে আধঘণ্টার মধ্যে। বাচ্চারা অবশ্য তার অনেক আগেই স্কুল থেকে ফেরে।’

আমি ক্রমশ অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম এরকম অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা শুনে। ভাবছিলাম, কেন এতক্ষণেও আসল বক্তব্যে আসতে পারছে না সমীর। অফিসে সে সপ্তাহে দশটা মিটিং করে। তার তো মূল বক্তব্যে আসতে এত সময় লাগারই কথা নয়।

আমিই শেষে অসহিষ্ণুতাটা প্রকাশ করলাম। বললাম, ‘কিন্তু বড়ো-মা… আপনার তো এখন বিশ্রাম নেওয়ার বয়স। কী দরকার ছিল বলুন তো এসব ঝামেলা নেওয়ার? পৃথিবীতে আপনার বয়সি অনেক দুর্ভাগা নারী আছেন। যাদের ছেলেমেয়ে, বউমারা তাদের দেখে না। তারা যদি এরকম ক্রেশ খোলেন, তবু মানা যায়। তাই বলে আপনি?’

আমি একটানা ক্ষোভ উগরে দিয়ে হতাশায় মাথা নাড়ি।

তাকিয়ে দেখি, বড়ো-মার মুখ থেকে তখনও হাসি লোপ পায়নি। হ্যাঁ, ভুুরুদুটো একটু বেঁকেছে। কিন্তু ওটুকুই।

শেষে বললেন, ‘এবার তাহলে তোমায় একটা প্রশ্ন করি মা?’

আমি বিরক্ত মুখে বললাম, ‘করুন।’

‘তোমার বাবা-মা তো তোমার দাদা-বউদির সঙ্গে থাকেন। ওঁরা সুখী?’

একটা ধাক্বা লাগল ওর প্রশ্নে। মনটা নিমেষে বিষণ্ণ হয়ে গেল। আমার বৃদ্ধ বাবা ও মায়ের মুখটা ভেসে উঠল চোখের পর্দায়। ‘মা কেমন আছো’, জিজ্ঞেস করলে মা করুণ মুখটা তুলে যেভাবে বলে ‘ভালো আছি’, সেই স্তোক দেওয়ার ছবিটা মনে পড়ল। আমি জানি, মা-বাবা ভালো নেই দাদা-বউদির সংসারে। দুজনেই প্রাণপণে চেষ্টা করে চলেছেন বাস্তবের সঙ্গে আপস করার। আমি বুঝতে পারি ওরা ভালো নেই। আমরা কখনও গেলে বউদি ওদের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করার চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা চেষ্টাই। কোনও কোনও প্রসঙ্গে, ছিটকে বের হয় বাবা-মায়ের প্রতি বউদির অশ্রদ্ধা আর নৈরাশ্য। আমরা সামনে আছি বলে বউদি দ্রুত সামলে নেয় নিজেকে, কিন্তু বাবা ও মায়ের বেদনাটা তাতে চাপা পড়ে না। বিয়ের পর সব মেয়েই বাপের বাড়ির অতিথি। অসহায় হয়ে হাত কামড়ানো ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না তখন আমার।

বাপের বাড়িতে মেয়েরা আনন্দ করতে যায়। আমি ফিরে এসে বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদি।

এই মুহূর্তে বিষণ্ণতায় আমার মনটা দ্রব হয়ে যায়। চোখদুটিও নত হয়ে আসে। মনের গভীরে কোনওমতে কান্না সামলাই।

বড়ো-মা হয়তো বোঝেন। মৃদু হেসে মাথায় হাত রাখেন। চমকে উঠে তাকাই বড়ো-মার দিকে।

শান্ত গলায় বড়ো-মা বললেন, ‘যতই লুকোনোর চেষ্টা করো, চোখের জলকে লুকোবে কী করে? বয়স্ক মানুষদের অবস্থাটা এখন এরকমই। একটা কথা বলি। তোমার নিজের উপরে যখন এরকম বৃদ্ধবৃদ্ধাদের দায় পড়বে, তখন এই চোখের জলের কথা মনে রেখো মা!’

সমীর কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বড়ো-মা তখনই তার দিকে ফিরে বললেন, ‘আসলে কী জানো বাবা, স্বামীর উপার্জন কিংবা তার মনের উপর স্ত্রীর যতটা অধিকার, ততটা অধিকার মায়ের আর থাকে না। সেইজন্যেই আমার মনে হয়, তাদের আত্মনির্ভর হওয়াটা খুব জরুরি। আর, পরিশ্রমের কথাই যদি বলো, সেটাও অতটা গায়ে লাগে না। বাড়িতে বসে বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটানো– এই তো কাজ! অথচ দ্যাখো, আমার বউমা কত খাটাখাটনি করে–!’

বড়ো করে শ্বাস নিলেন বড়ো-মা।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর কেউ ভর্তি করতে চাইছে না বাচ্চাদের?’ ‘চাইছে তো! রোজই কত মানুষ আসে। অনেককে তো চিনিই না। এসে বলে, বড়ো-মা আমাদের বাচ্চাকেও রাখুন। মোড়ের রিকশাস্ট্যান্ডে বড়ো-মার ক্রেশে যাব বললেই, রিকশাওলা নাকি পৗঁছে দেয় এ বাড়িতে। কিন্তু আমি আর অন্য কাউকে নিতে পারব না কল্পনা। আমার তো অর্থের খুব চাহিদা নেই!’

আমরা দুজনেই প্লেট থেকে একটা করে সন্দেশ তুলে মুখে ফেলেছিলাম। মালতী দু-গ্লাস ঠান্ডা জল এনে দিল।

বড়ো-মা বললেন, ‘এবার শীতের ছুটিতে আমরা ক’জন বেড়াতে যাচ্ছি। একটা টুরিস্ট কোম্পানির সঙ্গে। তোমার বাবা-মাকেও বলো না কল্পনা। যদি ওরা আমাদের সঙ্গে যান, খুব ভালো লাগবে।’

আমি বিব্রত হওয়ার মতো চোখ করে সমীরের দিকে তাকাই। দাদা-বউদি যে মা-বাবাকে ছাড়তে রাজি হবেন না, সেকথা আমি যেমন জানি, সমীরও জানে।

তবু ও হঠাৎ বলে উঠল, ‘আমি কথা দিচ্ছি। ওরা যাবেন। আমি শিগগিরি ওদের সঙ্গে কথা বলব বড়ো-মা। আপনি পুরোনো যুগের মানুষ। কিন্তু আজ আমার চোখ খুলে দিয়েছেন।’

সমীর আবেগে আমার হাত চেপে ধরল।

——-

মূল্যায়ন

সৌগত তাড়াতাড়ি সব কাজ শেষ করে তৈরি হয়ে বেরোতে যাবে, কেট জিজ্ঞেস করল, এখনই যাচ্ছ? জুতো পায়ে গলাতে গলাতে সৌগত উত্তর দিল, হ্যাঁ, আর কী, দুঘন্টা তো এয়ারপোর্ট পেঁছোতেই লেগে যাবে।

সৌগত কিছুতেই উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছে না। সামনেই সোফাতে ওর দুই ছেলে-মেয়ে চুপচাপ বসে বাবাকে লক্ষ্য করেলেমেয়ে কারওকেই বাবার এই উত্তেজনা স্পর্শ করেছে বলে মনে হল না। পাথরের মতো দুজনে বসে রইল।

সৌগত ইশারায় স্ত্রীর কাছে, ছেলে-মেয়ে চুপ করে থাকার কারণ জানতে চাইল। কেটও ইশারাতেই জানাল চিন্তা না করে, এয়ারপোর্টের জন্য রওনা হতে। সৌগত-র মধ্যে দ্বিধার ভাব লক্ষ্য করে আশ্বাসের সুরে বলল, দেরি কোরো না। মা বাবাকে যতক্ষণে নিয়ে বাড়ি ফিরবে, তার মধ্যে আমরা সবাই চানটান করে রেডি হয়ে থাকব।

একুশ বছর হয়ে গেছে, এই প্রথম শোভনবাবু আর গৌরীদেবী একমাত্র সন্তান সৌগতর গোছানো সংসার একবার চোখের দেখা দেখতে লন্ডন আসছেন। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সেই যে চাকরি নিয়ে বিদেশ এসেছে, আর ফিরে যায়নি সৌগত।

প্রথম এসেই লন্ডনের রিচমন্ড এলাকায় এক কামরার একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিল সে। নীচে বাড়িওয়ালারা থাকতেন আর উপরের একটা ওয়ান রুম কিচেন বাথরুম নিয়ে সৌগত ভাড়াতে থেকে গিয়েছিল। ঘরটা ভারি পছন্দ হয়ে গিয়েছিল তার। ঘরের এক দিকটায় বড়ো বড়ো কাচের জানলা ছিল, যেখানে দাঁড়ালে টেমস নদীটা নজরে পড়ত।

সেসময় ভাড়াও খুব বেশি ছিল না। বাড়িওয়ালার একমাত্র মেয়ে কেট দিব্যি ভাব জমিয়ে ফেলেছিল সৌগতর সঙ্গে। যেদিন অফিস থেকে ফিরতে একটু বেশি দেরি হয়ে যেত সৌগতর, কেট এসে মেন গেট খুলে দিত। গুছিযে রাতের খাবারটা হাতে ধরিযে দিত যাতে, রাত্রে আর সৌগতকে হাত পুড়িয়ে রান্না না করতে হয়।

বিদেশে যেখানে দুটো মনের কথা বলার জন্য মানুষ ব্যাকুল হয়ে ওঠে, সেখানে কেটের মিষ্টি স্বভাব, অপরকে সাহায্য করার মানসিকতা সহজেই সৌগত-র হৃদযে জায়গা করে নেয়। দুজনেই একে অপরের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ বোধ করতে থাকে। কেট মুখে কিছু না বললেও, তার চোখের ভাষা পড়তে সৌগতর ভুল হয় না।

কেটকে বিয়ে করায় মনস্থ করলে, সব থেকে বড়ো চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় সৌগতর কাছে নিজের মা-বাবা। ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে হয়ে বিদেশিনি খ্রিস্টান মেয়েে বিয়ে করার অনুমতি বাবা কখনও দেবেন না বলেই সৌগত ভেবে নিয়েছিল। পুরোনো দিনের মানুষ তাঁরা। কেটের মা-বাবা সৌগতর মতো জামাই পাবেন বলে আপত্তি করেননি। কিন্তু নিজের মা-বাবাকে কী বলবে সেটাই ভাবতে তিনদিন সময় নিয়েছিল সৌগত।

শেষে মনে সাহস সঞ্চয় করে কলকাতায় নিজের বাড়িতে ফোন করেছিল সে। সোজাসুজি তখন ফোন করার অসুবিধা ছিল। ট্রাংক কল বুক করতে হয়েছিল। বাবা ফোন ধরতেই বিয়ে প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিল সৌগত। কিছুক্ষণ চুপ করেছিলেন শোভনবাবু। তারপর মাযে সঙ্গে কথা বলে জানাবেন বলে ফোন ছেড়ে দিয়েছিলেন।

তারপরের দশটা দিন সৌগতর কী যে অস্থিরতায় কেটে ছিল, আজ ভাবলে হাসি পায়। কিন্তু ফোন করেননি শোভনবাবু বরং মাযে লেখা চিঠি পেয়েছিল সৌগত। ওনাদের শুধু একটাই শর্ত, মেয়ে এবং মেয়ে বাড়ির লোককে কলকাতায় আসতে হবে। বিয়ে কলকাতাতেই হবে। সৌগত শর্তে রাজি হয়ে গিয়েছিল। কলকাতাতেই ধুমধাম করে কেটের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেন শোভনবাবু আর গৌরীদেবী।

বিয়ে দুবছর পর অন্বেষার জন্ম আর পাঁচ বছরের মাথায় অনির্বাণের। ছেলে সংসারে মন দিয়েছে, বিদেশে ছেলেকে দেখাশোনা করার জন্য লক্ষ্মীসম বউমা রয়েছে ভেবেই গৌরীদেবীর মন আনন্দে ভরে উঠত। এর মধ্যে নাতি-নাতনি হওয়ার সুখবর তাঁদের স্বামী স্ত্রী দুজনকেই নতুন করে খুশির সীমাহীন জগতে নিয়ে গিয়ে ফেলে। নাতি-নাতনীর মুখ দেখার জন্য উৎসুক হয়ে ওঠেন। ছেলের আসার অপেক্ষায় দুজনে দিন গুনতে থাকেন।

এরই মধ্যে চাকরি ছেড়ে সৌগত কেটের বাবার প্রকাশনা ব্যাবসায় ঢুকেছে তাঁরই অনুরোধে। দিনরাত খেটে ব্যাবসাকে এমন পর্যায়ে দাঁড় করিযেছে সৌগত, যেখানে লন্ডনের মান্যগণ্যদের মধ্যে সৌগতকে চেনে না এমন কেউ নেই। বাড়ি আলাদা করে আর কিনতে হয়নি তাকে। একমাত্র মেয়েজামাইকে উইল করে বাড়ি লিখে দিয়েছেন কেটের বাবা। তিনি আর তাঁর স্ত্রী অবসর জীবনযাপন করছেন সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়ে। ব্যাবসার দাযিত্ব পুরোটাই সামলাচ্ছে সৌগত।

সময় পেলেই কেট আর বাচ্চাদের নিয়ে কলকাতায় ঘুরে যাওয়াটাও এতদিন দাযিত্ব মনে করেই পালন করেছে সৌগত। কখনও তাঁদের অবহেলা করেনি। লন্ডনে থেকেও নিজে এবং কেট প্রায় প্রতিদিন ফোনে খবরাখবর নিতে ভোলেনি শোভনবাবুর আর গৌরীদেবীর। কিন্তু বাচ্চারা যখন থেকে বড়ো হয়েছে ওদের পড়াশোনা, অন্য কোথাও ছুটি কাটাবার আগ্রহ ইত্যাদি নানা কারণে কলকাতায় যাওয়া-আসাটা অনেকটাই কমিয়ে ফেলতে হয়েছে সৌগতকে।

গতবছর পুজোর আগে কেট কলকাতার খবরাখবর নেওয়ার জন্য ফোন করলে, গৌরীদেবী মনের ইচ্ছেটা প্রকাশই করে ফেলেন কেটের কাছে, কেট অনেকদিন হয়ে গেল তোমরা ইন্ডিয়া আসোনি। এবার শীতে কিছুদিনের জন্য ঘুরে যাও। তোমাদের সকলকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

কেট কিছুটা ইতস্তত করে জবাব দেয়, না মা এখন কিছুতেই আসা সম্ভব নয়। বাচ্চাদের ক্লাস এখন একেবারেই মিস করানো যাবে না।

ওপারের স্তব্ধতা কেটকে বিচলিত করে। একটু ভেবে হঠাৎই বলে, মা আপনারা বরং এখানে চলে আসুন। সকলকে দেখা হবে আর একটু ঘোরাও হয়ে যাবে। কলকাতা ছেড়ে আপনারা তো কোথাওই যান না। চলে আসুন। আপনার ছেলেকে বলব সব ব্যবস্থা করে দেবে।

ব্যস তারপর দৌড়োদৌড়ি, ভিসার কাগজপত্র জমা দেওয়া, আরও যা কিছু করণীয়। সবশেষে আজ শোভনবাবু আর গৌরীদেবী সুদূর লন্ডনে পা রাখতে চলেছেন। প্রথম বিলেত সফর সুতরাং উত্তেজনায় দুজনেই প্লেনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গহ্বরেও ঘেমে নেয়ে উঠছেন।

 

সৌগত অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল, প্লেন কখন ল্যান্ড করবে। দূর থেকে বাবাকে আগে দেখতে পেয়ে হাত নাড়ল সৌগত। শোভনবাবু একটু স্বস্তি বোধ করলেন। এই দূর অচেনা মাটিতে তাঁর আসার ইচ্ছে একবিন্দুও ছিল না। কী করবেন, স্ত্রীর জোরাজুরিতে আর ছেলে-বউমার বারবার অনুরোধে তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতেই হল।

ভিড় ঠেলে সৌগত এগিয়ে এল। বাবার হাত থেকে ব্যাগেজের ট্রলিটা জোর করে নিজের হাতে নিতেই মা এসে জড়িয়ে ধরলেন ছেলেকে। চোখের জল বাঁধ মানল না। একমাত্র সন্তানকে কাছে পাওয়ার আনন্দ অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ল গৌরীদেবীর দুচোখ বেযে সৌগতও চোখের ভেজা ভাবটা অনুভব করল। পরিস্থিতি হালকা করতে মা-কে জড়িয়ে ধরে মুখে হাসি টেনে বলল, মা, তুমি সবে এসেছ। তোমার কান্না দেখে সবাই ভাববে তোমাকে সব কিছু ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে।

বাড়ির পথে অবাক হয়ে তাকিযে রইলেন শোভনবাবু আর গৌরীদেবী গাড়ির কাচে চোখ রেখে। হুহু করে পেরিযে যাচ্ছে রাস্তা। চারিদিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, রাস্তায় কুকুর বেড়াল চোখে পড়ে না। সর্বত্র অনুশাসনের ছাপ স্পষ্ট। রাস্তার ধারে ধারে সবুজের সমারোহ মন কেড়ে নেয়। হর্নের কান ফাটানো আওয়াজ, ট্র‌্যাফিকের ভিড় নেই কোথাও।

অন্যমনষ্কতা ভাঙল সৌগতর কথাতে। হাঁ করে কী দেখছ তোমরা? আজ তোমাদের ভাগ্য ভালো যে রোদ উঠেছে নয়তো বেশিরভাগ সময়ই বৃষ্টির আবহাওয়া থাকে এখানে।

গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কেট ওনাদের আসার অপেক্ষা করছিল। গাড়ি এসে দাঁড়াতেই সানন্দে গেট খুলে কেট ওনাদের বাড়ির ভিতরে স্বাগত জানাল। সৌগত গাড়ি থেকে সুটকেস নামিয়ে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেল। নীচের তলাতেই একটা বড়ো ঘরে কেট ওনাদের থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছিল। সুটকেসগুলো ওই ঘরে দিয়ে ওনাদের ফ্রেশ হতে বলে কেট চা-জলখাবার আনতে কিচেনে চলে গেল।

সৌগত বাথরুমে গরমজলের ব্যবস্থা সব দেখিযে বাইরে এসে বসল। দুজনে হাত-মুখ ধুযে ঘাড়ে মাথায় সামান্য গরমজল বুলিযে নিলেন। তাতে ধকলটা একটু কম মনে হল। বাইরের পোশাক ছেড়ে সুটকেস খুলে পরিষ্কার জামা-কাপড় বার করে পরে বাইরে এলেন।

সৌগত সোফাতেই বসে ছিল। কেট জলখাবারের ট্রে হাতে নিয়ে ঢুকে টেবিলে নামিয়ে ওনাদের সামনে খাবার আর চায়ের কাপটা এগিয়ে দিল।

কী ব্যাপার অন্বেষা আর অনির্বাণকে দেখছি না কেন? ওরা কোথায়? গৌরীদেবী আর শোভনবাবুর চোখ আদরের নাতি-নাতনিকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।

সৌগত ওদের নাম ধরে ডাকতেই দুজনে উপর থেকে নীচে নেমে এল। চোখের ইশারায় ওদের ঠাকুমা-ঠাকুরদাকে প্রণাম করার কথা বলতে, দুজনে প্রণাম করে দাঁড়াতেই ওদের বুকে টেনে নিলেন দাদু-ঠাকুমা।

অন্বেষা আর অনির্বাণ তোমরা কত বড়ো হয়ে গেছ! কলকাতায় শেষ যখন এসেছিলে তখন বেশ ছোটো ছিলে। কতদিন হয়ে গেছে তোমাদের দেখিনি। বলতে বলতে চোখে জল চলে আসে গৌরীদেবীর।

অথচ এই ইমোশন যেন ছুঁতে পারে না বিদেশের মাটিতে বড়ো হওয়া অন্বেষা আর অনির্বাণ-কে। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে দুজনে, মুখে ফুটে ওঠে বিরক্তির ভাব। দুজনের ব্যবহারে মনে মনে বিরক্ত বোধ করে সৌগত। ভিতরে ভিতরে রাগ বাড়তে থাকে তার। কুশল বিনিময়টুকু করতে ভুলে গেছে কী করে তার সন্তানেরা। কেট মুহূর্তে পড়ে ফেলে সৌগতর মন। পরিস্থিতি সামাল দিতে ছেলেমেয়ে দিকে তাকিযে কেট বলে, তোমরা এখন যাও, পড়াশোনা শেষ করো।

ছোটো থেকেই কেট ভারতীয় সংস্কৃতিকে ভালোবেসে এসেছে। বাড়ির আশেপাশে বহু ভারতীয় পরিবারকে খুব কাছের থেকে দেখেছে। সৌগতর সঙ্গে বিয়ের পর সেই ভালোবাসা আরও গাঢ় হয়েছে। ফলে সৌগতর মা-বাবাকে আপন করে নিতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি কেটের। শ্বশুর-শাশুড়ির থেকেও পেয়েছে স্নেহের উষ্ণতা। সবাইকে নিয়ে সুন্দর সংসার গড়ে তোলার পরিকল্পনা সবসমযে কেটের মনের মধ্যে লালিত হয়েছে। কিন্তু এই একটা জায়গায় এসে সে হেরে গেছে। দুই সন্তানকে যেমনটা চেযেছে তেমন করে মানুষ করতে পারেনি। সে নিজেও এই বিদেশের মাটিতে জন্মেছে কিন্তু বড়োদের অসম্মান করার মানসিকতা কখনও তার হয়নি।

পাশ্চাত্য দেশের ছেলেমেয়েরা অনেকটাই আলাদা। নিজের শিকড়কে অস্বীকার করে বিদেশের সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরার মানসিকতা প্রবল তাদের মধ্যে। অন্বেষা এখন আঠারো বছরের আর অনির্বাণ পনেরো। কিন্তু বিদেশের আদব-কায়দা তাদের রক্তের ভিতর ঢুকে গেছে। কেটের ক্ষমতা নেই তাদের সেখান থেকে বার করে নিয়ে আসে।

শোভনবাবু আর গৌরীদেবী কিছুটা পরিবেশের সঙ্গে ধাতস্থ হলে, সৌগত আর কেট ওনাদের নিয়ে উইক-এন্ডে সারা লন্ডন ঘুরিযে ঘুরিযে দেখিযে নিয়ে এল। লন্ডনের মিউজিয়াম দেখে শোভনবাবু একটাই মন্তব্য করলেন, এই ব্রিটিশরা শুধু ভারতবর্ষকে নয়, সমগ্র বিশ্বকে লুঠ করে নিজের দেশকে ধনী বানিয়েছে।

 

শোভনবাবুদের আসার তিন সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। সৌগতর সময় না হলেও কেট ওনাদের নানা জায়গায় ঘুরিযে এনেছে। ভারতীয় সংস্কৃতির তুলনায় লন্ডনের সংস্কৃতি যে সম্পূর্ণ ভিন্ন, তা এতদিনে বেশ বুঝতে পেরেছেন শোভনবাবুরা। এখানে সবাই ব্যস্ত। কারও জন্যই কারও কাছে সময় নেই। সন্তানদের নিজেদের জীবন নিয়ে ভাবার স্বাধীনতা দেওয়া আছে। মা-বাবার সেখানে কিছু বলা চলবে না। বিয়ে আগে একসঙ্গে থাকা বা পছন্দ না হলে ছেড়ে চলে যাওয়াটা এখানে কেউ গুরুত্ব দিয়ে দেখেই না। অদ্ভুত এক মিশ্র সংস্কৃতির বাড়-বাড়ন্ত। যা-কিনা গৌরীদেবী বা শোভনবাবু কেউই মন থেকে মেনে নিতে পারছিলেন না কিছুতেই।

প্রথমে এসেই গৌরীদেবী খেযাল করেছিলেন, সৌগত আর কেট কেউই সকালে অফিস যাওয়ার সময় খেযে বেরোয় না। একদিন না থাকতে পেরে বলেই ফেললেন, তোদের সময় না থাকে, আমি সকালে কিছু একটা বানিয়ে দেব। এভাবে না খেযে সারাদিনের জন্য বেরোনো উচিত নয়।

এতে সৌগত হেসে উত্তর দিয়েছিল, মা তুমি মিথ্যা চিন্তা করছ। আমরা রাস্তা থেকে স্যান্ডউইচ আর কফি কিনে খেযে নিই। দুপুরেও অফিসে আর সবার মতো পাশেই একটা রেস্তোরাঁ থেকে খাবার নিয়ে এসে অফিসেই খেযে নিই। কেট-ও তাই করে। বাবা আর তুমি টিভি দ্যাখো, এনজয় করো। আমাদের নিয়ে ভেবো না। এই লাইফে আমরা অভ্যস্ত।

আর কিছু বলেননি গৌরীদেবী। ছেলের সংসার যেমন চলছিল তেমনিই চলতে লাগল। বাচ্চারা স্কুল, কলেজ বেরিযে যেত, সৌগত নিজের ব্যাবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল আর কেট বাড়ি আর অফিস একসাথে সামলাতো।

কিছুদিন ধরে গৌরীদেবী দেখছিলেন অন্বেষা যখন কলেজ থেকে ফেরে, একটা কালো মতন ছেলে ওকে ছেড়ে দিয়ে যায়। অন্বেষার থেকে বয়সে অনেকটাই বড়ো মনে হল ছেলেটিকে। একদিন সন্ধেবেলা জানলায় দাঁড়িয়ে বাইরের শোভা দেখছিলেন গৌরীদেবী। হঠাৎ-ই খেযাল হল রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ির আড়ালে, অন্বেষা আর ছেলেটি গভীর চুম্বনে ব্যস্ত।

পায়ে তলার মাটি কেঁপে উঠল তাঁর। কী বয়স অন্বেষার আর এখনই এইসব করে বেড়াচ্ছে! তারপরেই মনে হল যে-দেশে বড়ো হচ্ছে বাচ্চারা, সেখানকার সংস্কৃতিকেই ওরা আপন করে নেবে, এতে দোষটা কোথায়? ওরা তো যেমন দেখবে তেমনই শিখবে। অগত্যা চুপ করে গেলেন, কাউকে কিছু বলা উচিত মনে করলেন না।

শুধু নিজের স্বামীকে না জানিয়ে পারলেন না, এই তো একটা বাচ্চা মেয়ে, কোনও ভুল পথে পা দেবে না তো? শোভনবাবু স্ত্রীকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, এত চিন্তা কোরো না, কিছু একটা উপায় বার করতে হবে! আমি দেখছি কী করা যায়।

 

সকাল সকাল চায়ের কাপ হাতে নিয়ে গৌরীদেবী ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। দূর পর‌্যন্ত বিস্তৃত রিচমন্ড হিল এবং টেম্স নদীর সৌন্দর‌্য এক মনে অবলোকন করছিলেন। সেন্ট পিটারস্ চার্চ-টা এখান থেকেই চোখে পড়ে আর তার চারপাশে মনোরম সবুজ ঘাসের গালিচা মুহূর্তে মন উদাস করে দেয়।

কিন্তু প্রকৃতির এই অপরূপ শোভা কিছুতেই গৌরীদেবীর মনকে শান্ত করতে পারছিল না। গত সন্ধের দৃশ্যটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। মনে মনে উদ্বিগ্ন বোধ করছিলেন। খানিক পরে কেটও চায়ের কাপ নিয়ে গৌরীদেবীর পাশে এসে দাঁড়াল। কিছুটা সংকোচ কাটিযে সন্ধের ঘটনাটা খুলেই বললেন কেটকে, তোমাকে না বলে পারলাম না তুমি মা। ও আমাদের বাড়ির সন্তান। ঘটনাটা এড়িয়ে তো যেতে পারি না।

তুমি ঠিক বলেছ মা। তোমার চিন্তা করাটাই স্বাভাবিক। অন্বেষা যেটা করেছে অন্যায়, আমি সেটা বুঝি। কিন্তু এখানে আমরা কিছুই বলতে পারব না কারণ এটা ওর জীবন। এখানকার সংস্কৃতি ভারতীয় সংস্কৃতির থেকে অনেক আলাদা। ছোটো থাকতেই এখানে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। অনেক সময় সেটা বিয়ে অবধিও গড়ায়। আবার কখনও সম্পর্ক ভেঙেও যায়। এটা ওদের সম্পূর্ণ নিজস্ব ডিসিশন। এটা আমাদের হাতের বাইরে। খুব অল্প শব্দের মধ্যে কেট ওযে্টার্ন সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ শাশুড়িকে পরিষ্কার করে বুঝিযে দিল ঠিকই কিন্তু গৌরীদেবী কিছুতেই এটা মন থেকে মেনে নিতে পারলেন না।

কলেজের জন্য তৈরি হতে হতে মা আর ঠাকুমার কথাবার্তা সবই অন্বেষার কানে এসেছিল। সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুমার এই অনাবশ্যক নাক গলানো ওর কাছে অসহ্য মনে হল। অন্বেষা ব্যালকনিতে এসে কেটকে লক্ষ্য করে বেশ জোর দিয়ে বলল, মম, আজ সন্ধে বেলায় ফিরতে আমার দেরি হবে। আমি আমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে একটা পার্টি-তে যাব। আমার ফেরার অপেক্ষা কোরো না, বলে ব্যাগ নিয়ে বেরিযে গেল।

সবাই সবার মতো কাজে বেরিযে গেলে শোভনবাবু খবরের কাগজ নিয়ে বসতেন। খবরের কাগজের নানা ঘটনা নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতেন। তাতেই গৌরীদেবী আরও বেশি করে ওখানকার কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে নানা ধরনের মানসিক সমস্যা বাড়তে থাকার ঘটনাগুলো সম্পর্কে জানতে পারতেন। ওখানকার ছেলেমেযো অল্প বয়সেই অবসাদের শিকার, কিশোরাবস্থায় গর্ভধারণ, হিংসাত্মক প্রবৃত্তি, অসামাজিক ব্যবহার, ছোটো থেকেই ড্রাগ ও মাদকদ্রব্যে আসক্তি বাড়া ইত্যাদি নানা খবর গৌরীদেবীকে আরও বেশি করে চিন্তাগ্রস্ত করে তুলতে লাগল।

একদিন যখন শোভনবাবু স্ত্রীর সঙ্গে বসে এগুলো নিয়ে আলোচনা করছেন, সৌগত এসে হাজির হল সেখানে। মন দিয়ে বাবার কথা শুনতে শুনতে বলে উঠল, বাবা, এখানে বাচ্চাদের মুখে বলে বোঝাতে পারো তো খুব ভালো। যদি তোমার কথা মেনে নিল তাহলে তোমার ভাগ্য! তুমি কোনও ভাবেই ওদের উপর জোর ফলাতে পারবে না।

কিন্তু এটা তো ভুল শিক্ষা। মা-বাবা, বাড়ির বড়োরা, শিক্ষকেরা সন্তানের ভালো চান বলেই না তাদের বকাবকি করেন, শাসনে রাখেন। তারা তো ছেলেমানুষ, এটাই তো শেখার বয়স। সঠিক শিক্ষা দিতে হবে, বোঝাতে হবে তবেই না ওরা শিখবে। শোভনবাবু নিজের মতামত জোরের সঙ্গে ব্যক্ত করলেন ছেলের কাছে।

তোমার কথা ঠিক, আমি মানছি বাবা। এখানেও এখন এই পয়েন্টগুলো অনেকেই তুলছেন। তোমার মতোই তাদেরও একই মত। কিন্তু কী করা যাবে, এখানকার আইন তো অন্যরকম। সৌগতর কথা শেষ হওয়ার আগেই অন্বেষা এসে ঘরের মধ্যে দাঁড়াল। ওহ… কাম অন ড্যাড, তুমি কাকে কী বোঝাবার চেষ্টা করছ? এখানে শুধু জেনারেশন গ্যাপ-ই নয় সংস্কৃতিরও একটা বিরাট পার্থক্য আছে।

অন্বেষা যবে থেকে মা আর ঠাকুমার কথাগুলো শুনেছিল, তবে থেকেই ঠাকুরমার প্রতি একটা অসন্তোষ ওর মনের মধ্যে জমা হচ্ছিল। ঠাকুমার সঙ্গে কথা বলা একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছিল। চোখের দৃষ্টিতে সুযোগ পেলেই মনের ভাব প্রকাশ করে ফেলতে দ্বিধা করত না অন্বেষা। কথার মাঝে কটুক্তি করে সোজা নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিত।

সৌগত আর কেটের মধ্যে কথা হচ্ছিল। সৌগত বলছিল কেটকে, কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি, অন্বেষা অনেক বদলে গেছে। অনির্বাণও। তুমি কি কিছু জানো?

না, তবে ওদের এখন পিউবার্টি-র সময় যাচ্ছে। চারিত্রিক একটু পরিবর্তন তো হবেই। তোমাকে বলা হয়ে ওঠেনি সৌগত, অনির্বাণ একটা স্কলারশিপ পেয়েছে। ঠিক কলেজে বলব না, অন্য ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য কোনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়েছিল। সেরকম একটা কলেজ থেকে ডাক এসেছে, যারা কমপ্লিট স্কলারশিপ দেবে বলেছে। দুই বছরের কোর্স আর কলেজটা পাকিস্তানের লাহোরে।

চমকে ওঠে সৌগত, পাকিস্তান? পাকিস্তান কেন, লন্ডন ছেড়ে কেউ পাকিস্তান যায়?

অনির্বাণ পাকিস্তানে গিয়ে পড়তে চায়। অনেক বুঝিযেছি কিন্তু মনে হচ্ছে ব্রেনওয়াশ করেছে কেউ। কেটের মনের সন্দেহ কণ্ঠে ফুটে ওঠে।

এই সময় শোভনবাবুও ঘরে এসে ঢোকেন। ছেলে-বউমার কথাবার্তা কিছুটা ওনার কানে গিয়ে পৌঁছোয়। নিজেই এগিয়ে এসে বলেন, কিন্তু কেট তোমাদের ওকে এতদূরে পাকিস্তানে পাঠানো ঠিক হবে বলে মনে হয় না। বাচ্চা ছেলে এত দূরের শহর বাছার কী দরকার ছিল। তার ওপর তোমরা ওখানে কাউকে চেনো না। বিপদ-আপদ ঘটলে কী করবে?

বাবা, জানোই তো আমরা বললেও কিছুতেই শুনবে না অনির্বাণ। ও মনস্থির করে ফেলেছে, হতাশ শোনায় কেটের স্বর।

সৌগত আর কেটের মত আছে শুনে আর কথা বাড়ালেন না শোভনবাবু। কিন্তু মনটা অনির্বাণের জন্য খচখচ করতে লাগল। লন্ডনে জন্ম, বড়ো হওয়াও এখানে। এসব ছেড়ে লাহোর গিয়ে কেন ও পড়াশোনা করতে চাইছে? আসতে হলে ভারতে আসতে ক্ষতি কী ছিল? এখানে ওর আপনজনেরা রয়েছে, নিজের দেশ সেটা। এইসব ঘটনাচক্র ধীরে ধীরে শোভনবাবু আর গৌরীদেবীর মন ভারাক্রান্ত করতে লাগল।

একদিন সবাই বাইরে কাজে বেরিযে যাওয়ার পর, গৌরীদেবী কযেদিন ধরে বহন করা মনের কথাটা স্বামীর কাছে তুলে ধরলেন, অনেক তো হল, চলো এবার আমরা দেশে ফিরে যাই। ছেলে কেমন সংসার করছে নিজের চোখে একবার দেখার ইচ্ছে ছিল, দেখা হয়ে গেছে। এক মাসের ওপর আমরা এখানে রয়েছি। আর ভালো লাগছে না।

কলকাতার জন্য খুব মন কেমন করছিল গৌরীদেবীর। অনেক পুরোনো বাসিন্দা ওনারা। আশেপাশের বহু প্রতিবেশী খোঁজখবর নিতে আসে শোভনবাবুর কাছে। বিজয়ার সময় সকলে এসে পায়ে হাত দিয়ে দুজনকে প্রণাম করে যায়। তাদের ভালোমন্দের খবরটুকু তারাই কেউ না কেউ এসে নিয়ে যায় প্রায়দিনই। বিশেষ প্রযোজনে তারাই সবসময় এগিয়ে আসে। কতদিন হয়ে গেছে, তাদের কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না। ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে পড়েন গৌরীদেবী।

শোভনবাবু স্ত্রীকে ভালোমতোই জানেন, তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয় না এতটুকুও। তাঁর নিজেরও আর ভালো লাগছে না। অগত্যা উঠে শোভনবাবু সৌগতর ঘরের দিকে চললেন ছেলেকে ইন্ডিযা ফেরার টিকিট কেটে দেওয়ার জন্য বলতে। অনির্বাণের ঘরের সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। অনির্বাণের ঘর থেকে ভেসে আসছে ওরই গলা। ও নিজেকে কারও কাছে খালিদ হাসান বলে দাবি করছে।

দরজায় কান পাতলেন শোভনবাবু। অনির্বাণ এটা কী বলছে? সে নিজেকে কেন খালিদ হাসান বলছে? ওর স্বর ভেসে এল বন্ধ দরজার বাইরে, হ্যাঁ, ওমর শরিফের কথা আমিও শুনেছি। তিনিও এখানকার কিংস কলেজ থেকে পড়াশোনা করেছেন। তিনজন ব্রিটিশ এবং একজন আমেরিকানকে কিডন্যাপ করার জন্য ভারতে ধরা পড়েন। এর পর

যাত্রী-সহ এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেন হাইজ্যাক করেন, আমেরিকান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বোমা মেরে উড়িয়ে দেন এবং ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ড্যানিয়ে পার্লকেও কিডন্যাপ করে হত্যা করেন। আমার ওনার জন্য গর্ব হয়। জানি অনেকগুলো বছর আমরা পেরিযে এসেছি তবুও। হ্যাঁ আমি জানি, সিরিযাতে হাজারের বেশি ব্রিটিশ ছেলে-মেয়ে জিহাদের জন্য লড়াই করছে। আমি ওদের জন্য গর্ব অনুভব করি।

এরপর সব চুপচাপ। শোভনবাবু বুঝলেন ফোনের ওপার থেকে অনির্বাণ কারও কথা শুনছে। খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। আবার অনির্বাণের গলা শুনতে পেলেন। ও বলছে, আপনি চিন্তা করবেন না। অন্বেষা আগে যাবে, কযেদিনের মধ্যে আমি আসছি। নেটওয়ার্কিং সাইটে দেখে নিয়েছি পুরো ব্যবস্থা করা হবে। যখন আপনারা আমাদের সব সুবিধার খেযাল রাখছেন তখন আমরাও পিছু হটব না।

যে-লক্ষ্য নিয়ে যাব সেটা সম্পূর্ণ করেই আসব। কথা দিচ্ছি শেষ নিশ্বাস পর‌্যন্ত জিহাদের জন্য লড়ব। কেউ বাধা দিতে চাইলে পৃথিবী থেকে তাকে সরিযে দেব।

শোভনবাবুর হাত-পা কাঁপছিল। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। পনেরো বছরের ছোট্ট ছেলেটা এসব কী বলছে? কোনওমতে শরীরটাকে টেনে এনে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। চিন্তা করার ক্ষমতাও লোপ পেয়েছে। ভিতর থেকে একটা শূন্যতা যেন পাক দিয়ে দিয়ে উঠে শোভনবাবুর গলা চেপে ধরেছে।

খানিক্ষণ সেভাবেই পড়ে রইলেন। ভাবলেশহীন শুধু একটা শরীর। অনেক কষ্টে নিজেকে টেনে তুললেন। এই জন্যই কি অন্বেষা আর অনির্বাণ লন্ডন ছেড়ে পাকিস্তান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে? ওরা কি কোনও সন্ত্রাসবাদী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে? ওরা কি ধর্মান্তরিত হয়েছে? তাঁর নিজের পরিবার শেষে এভাবে ভাঙতে চলেছে? এসব নানা প্রশ্নের কোনও উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না শোভনবাবু। একটা নিঃশব্দ বেদনা, অস্থিরতা, তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। কী করবেন তিনি? বাচ্চাদের শাসন করবেন? ভালোবেসে লজিক দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করবেন? চিন্তায় চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছিল শোভনবাবুর।

এতদিন খবরের কাগজেই পড়ছিলেন, লন্ডনের রাস্তায় জিহাদের কালো ঝান্ডা তুলে বুক ফুলিযে সব ঘুরে বেড়াচ্ছে। অক্সফোর্ড স্ট্রিট, আরও অনেক জায়গায় আইএস-এর মতো সন্ত্রাসবাদী গ্রুপের সমর্থনকারীদের দেখা গেছে। কিন্তু কে জানত তাঁর নিজের পরিবারেও সন্ত্রাস তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছে? কে ভাবতে পারে একটা শিক্ষিত, সম্পন্ন, সাংস্কৃতিক পরিবারের ছেলেমেয়ে সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন ছেড়ে এভাবে জীবন নষ্ট করতে গর্ব অনুভব করবে!

কিন্তু হেরে গেলে চলবে না। মন শক্ত করেন শোভনবাবু। একসময় দেশের জন্য লড়েছেন। দুচোখ ভরে দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছেন। আর এ তো নিজের পরিবার বলে কথা। মন শক্ত করে উঠে দাঁড়ান। পরিস্থিতি কীভাবে সামলাবেন একটা ছক কষেন মনে মনে।

 

সেদিন সকালে একটু তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যাওয়াতে গৌরীদেবী চোখে-মুখে জল দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। বড়ো প্রিয় এই জায়গাটা ওনার। সবে আলো ফুটতে আরম্ভ করেছে। খেযাল করলেন এক পাশে চুপ করে কেট দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টি সুদূর প্রসারী। এত তাড়াতাড়ি উঠে কী করছে মেযো চিন্তিত হলেন! ডাকলেন, কেট।

ওঃ তুমি উঠে পড়েছ, চমকে ফিরে তাকাল কেট। কেটের চোখ-মুখের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে গৌরীদেবী কাছে এসে দাঁড়ালেন, এ কী অবস্থা, সারা রাত ঘুমোওনি? কী হয়েছে?

কেটের মুখ থেকেই জানলেন, অন্বেষা গর্ভবতী। কালো ছেলেটি ওর সঙ্গেই কলেজে পড়ত। হঠাৎই কলেজ ছেড়ে কোথাও চলে গেছে। ফোন করেও কোনও লাভ হচ্ছে না। সুইচ অফ। অগত্যা নিরুপায় হয়ে গত রাতে মা-র কাছে সবকিছু খুলে বলেছে অন্বেষা।

নিজের মেয়ে হলে হয়তো গাযে হাত তুলে দিতেন গৌরীদেবী কিন্তু একটা মাত্র নাতনি, বড়ো মায়া ওর উপর। রাগ দমন করে কেট-কে শান্ত করলেন। বেলা বাড়লে কেট এবং অন্বেষার সঙ্গে ডাক্তারের কাছে গেলেন। সেখান থেকে গর্ভপাত করাবার জন্য ওনাদের হাসপাতালে পাঠানো হল। এক সেকেন্ড-ও অন্বেষার বিছানার পাশ থেকে উঠলেন না গৌরীদেবী। শক্ত করে অন্বেষার হাত ধরে রইলেন। বাড়ি ফেরা না অবধি সেই হাত আর ছাড়লেন না।

অ্যানি বলে কোনওদিনই গৌরীদেবী নাতনিকে ডাকেননি। অন্বেষাই বলে এসেছেন বরাবর। অন্বেষার এটা একেবারেই পছন্দ ছিল না। কিন্তু ঠাকুমার এই ডাকে এখন আর তার বিরক্ত লাগে না। ওর মধ্যে এই পরিবর্তনটা দেখে আর কেউ না হোক, কেট সবথেকে খুশি হয়েছিল। গৌরীদেবী কত গল্প বলেছেন কেট-কে। যে-গ্রামে গৌরীদেবী জন্মেছেন, বড়ো হয়েছেন সেখানকার গল্প। কলকাতায় বিয়ে হয়ে এসে শহুরে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। শ্বশুরবাড়ির একান্নবর্তী পরিবারে সকলের মন জিতে নেওয়া সব শুনিয়েছেন কেট-কে। কেটও নিজের দেশ ছেড়ে ভারতীয় সংস্কৃতির উপর অসম্ভব একটা টান অনুভব করে।

 

এখন অন্বেষাও বাড়ি এলেই ঠাকুমার সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। কলকাতার গল্প শুনতে চায়। অবাক হয়ে শোনে। এত গুরুত্ব দেওয়া হয় মানুষের সম্পর্ককে যে, ও নিজের জন্মস্থানকে তুলনা করে ভারতের সঙ্গে। সম্পর্ক শব্দটা যে এত দামি, ধীরে ধীরে এখন বুঝতে শিখেছে অন্বেষা।

অন্বেষাকে নিয়ে আর কোনও চিন্তা ছিল না শোভনবাবুদের কিন্তু অনির্বাণকে নিয়ে কী করা যাবে তা ভেবে কূল পাচ্ছিলেন না।

সন্ধেবেলায় অন্বেষা আর গৌরীদেবী বারান্দায় বসে কেটের দেওয়া গরম গরম সু্প খেতে খেতে গল্পে মেতেছিলেন। সৌগত তখনও বাড়ি ফেরেনি। অনির্বাণ-কে, বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঢুকতে দেখে শোভনবাবু এগিয়ে এলেন, অ্যান, আজকের খবরটা শুনেছ? ফ্রান্সের নিস শহরে সন্ত্রাসবাদী হামলার? এরা এত অমানুষ যে, ওখানকার সাধারণ নাগরিকদের মেরে ফলতে ওদের হাত কাঁপে না। আর এরাই মুখে শান্তির কথা বলে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েছের নিজেদের জালে ফাঁসায়। ভগবান এদের ঠিক শাস্তি দেবেনই।

শোভনবাবু যেটা চাইছিলেন, সেটাই হল। তির লক্ষ্যভেদ করল। সন্ত্রাসবাদীদের সাপোর্ট করে অনির্বাণ মুখ খুলল, তুমি কি জানো ওদের বিষযে ওদের উদ্দেশ্য আর আইডিযালিজম আমাদের থেকে অনেক বেশি উন্নত। আমরা শুধু নিজেদের কথা ভাবি আর ওরা দেশ, ধর্ম সবকিছুকে বাঁচাবার লক্ষ্যে লড়ছে। এটা সন্ত্রাস নয়, জেহাদ। জেহাদের বিষযে কখনও শুনেছ তুমি?

অ্যান, আমার জন্ম ভারতে। সেখানকার মাটি আজ কত বছর ধরে সন্ত্রাসের শিকার। তুমি যে-জেহাদের কথা বলছ, সেটা আমি মন থেকে মানি না। জেহাদের মাধ্যমে যদি স্বর্গের রাস্তা খুলে যায়, তাহলে বড়ো বড়ো পলিটিশিযান, ধনী ব্যক্তিদের ছেলেমেযো দূর বিদেশে গিয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আরামদায়ক জীবন যাপন করছে কেন? কেন তারাও আর-চারটে সাধারণ ছেলেমেয়ে মতোই, জেহাদের জন্য নিজেদের হাতে বন্দুক তুলে নিচ্ছে না? আর যারা সন্ত্রাসের বাণী দিচ্ছে, তারা সামনে না এসে সোশ্যাল মিডিয়ার পর্দার আড়ালে লুকিযে অপরকে নির্দেশ দিচ্ছে আর মরবার জন্য অন্যের বাড়ির ছেলে-মেয়েদের বোকা বানাচ্ছে!

তোমরা এখনকার প্রজন্ম, ইন্টারনেট গুলে খেয়েছ। নেটে গিয়ে দ্যাখো যাদের বাড়ির জোয়ান ছেলে সন্ত্রাসে নাম লিখিযে মারা গেছে, তাদের কী হাল? এরা গরিবকে অর্থের লোভ দেখিযে সন্ত্রাসবাদী বানায় আর অর্থের প্রযোজন নেই যাদের, তাদের ব্রেনওয়াশ করে। বাড়ির এক ছেলে মারা গেলে অন্য ছেলেদেরও এরা দলে টানার চেষ্টা করে। এভাবে একটা প্রজন্ম থেকে আরেকটা প্রজন্মের ছেলেমেয়ে জীবনও নষ্ট করে, বাধ্য করে সন্ত্রাসে নাম লেখাতে।

শোভনবাবু, সরাসরি অনির্বাণকে কথায় আক্রমণ না করে আশেপাশের পরিস্থিতির উদাহরণ দিয়ে ওকে বোঝাতে সফল হচ্ছেন, সেটা অনির্বাণের মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলেন। ভযে ওর মুখ শুকিয়ে এসেছিল। লন্ডনের ঠান্ডাতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছিল অনির্বাণের কপালে। শোভনবাবুর কথাগুলো যে কতটা সত্যি, সেটা মনে মনে অস্বীকার করার জায়গা ছিল না অনির্বাণের।

পরের তিনদিন ঘর থেকে কোথাও বেরোল না অনির্বাণ। ভেতরে ফোনে মাঝেমধ্যেই কথা বলার আওয়াজ খালি কানে আসত বন্ধ ঘরের দরজা ভেদ করে। শোভনবাবু ছাড়া কেউই এর নেপথ্যের ঘটনা কিছু জানত না, তাই কেউই অনির্বাণের এই ব্যবহারে চিন্তিত হল না।

একমাত্র শোভনবাবুই মাঝে মাঝে নাতির ঘরের সামনে এসে দাঁড়াতেন। ঘরের ভিতর ঢোকার প্রবল ইচ্ছেটাকে দমন করে আবার ফিরে আসতেন। নিজের উপর এবং নিজের রক্তের উপর একবারের জন্যও বিশ্বাস হারাতে দেননি।

তিনদিনের দিন দরজা খুলে অনির্বাণ যখন বাইরে এল, শোভনবাবু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। অনির্বাণের দুচোখে শুধু হাজারো প্রশ্নের ভিড়। শোভনবাবু ওর হাত ধরে বাইরের ঘরে এসে বসলেন। সামনে কেট-কে দেখে অনির্বাণ শোভনবাবুর দিকে তাকিযে সামান্য হেসে বলল, মা, আমি পাকিস্তান যাচ্ছি না। আমি খোঁজ নিয়েছি কোর্সটা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়।

 

সপ্তাহের শেষে ছুটির দিন দেখে সৌগত, মা-বাবার ইন্ডিযা ফেরত যাওয়ার টিকিট বুক করার জন্য, ইন্টারনেটে বসে তারিখ জিজ্ঞেস করছিল শোভনবাবুকে। সে সময় অন্বেষা ঘরে ঢোকে, দাদা, আমি তোমাদের সঙ্গে ভারতে যেতে পারি? শোভনবাবুকে জিজ্ঞেস করে অন্বেষা।

ওটা তোমার নিজের বাড়ি। অবশ্যই তুমি আমাদের সঙ্গে যেতে পারো, আর যতদিন ইচ্ছে থাকতে পারো।

আর দিদি চলে গেলে আমি বুঝি এখানে একা থাকব? অনির্বাণও ঘরে এসে ঢোকে।

প্লেনের জানলা দিয়ে টুকরো টুকরো মেঘগুলোর ইতিউতি ভেসে বেড়ানো দেখছিলেন শোভনবাবু আর গৌরীদেবী। ওই একই সময় অন্বেষা আর অনির্বাণ মোবাইলে মা-বাবার সঙ্গে নানা পোজে সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

আলো আঁধারির গপ্পো

সাউথ ফেসিং অ্যাপার্টমেন্ট। জি-প্লাস ফোর ফ্ল্যাট। সুনন্দের ফ্লাটটা ঠিক মাঝখানে। ব্যালকনিটাও সাউথ ফেসিং। সামনে ছোটো একটা মাঠ। তারপরে সবুজ বনানী। আগাছা জঙ্গল ভরা নয়। নানা রকম বাহারি ফুল, বাহারি জঙ্গল। বনানি দেখভালের জন্য একজন মালিও নিয়োজিত। তারও ওপারে একটা দিঘি। কাচের মতো স্বচ্ছ তার জল। সুইমিং, বোটিং। গোটা কতক দশাসই আমগাছ তুলে এনে ‘ইনস্টল’ করা হয়েছে। নতুন নাম ‘মাঝের গাঁ’। এ সবই খদ্দের পটানোর বন্দোবস্ত।

একটা লম্বা হাই তুলে সুনন্দ ব্যালকনির ইজি চেয়ারটাতে বসেছে। দুপুরের ভাত ঘুম। পাতলা ঘুম। পাতলা ঘুম অতল স্পর্শ করে না। অগভীর ঘুমে মনের সুখ বাসনাগুলি ছেঁড়া ছেঁড়া পেঁজা তুলার মতো ভাসতে থাকে। বাসনার বিপরীত মুখী হয়ে অবচেতন মনের সামনে বিরক্তি ঘটায়। না পাওয়ার অস্বস্তিতে হতাশা আসে। বাইরে প্রকৃতির অনাবিল রূপের ডালি! সুনন্দর নজর সেদিকে নেই। আকাশে মেঘ নেই। সুনন্দর মুখে আছে। এক রাশ ঘনীভূত আষাঢ়ের মেঘ। ঝরব ঝরব করছে। ঝরেনি। বাইরে অসহায়ের মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।

পড়ন্ত বিকেল। সূর্য এক অত্যাচারী শাসক। সারাদিন রক্তচক্ষু দিয়ে জগৎ শাসন করেছে। বসুন্ধরার রক্তরস ছিবড়ে করে নিজেই ক্লান্ত। বিশ্রামের জন্য পশ্চিমে রওনা হয়েছে।

হাতে এক কাপ চা। মধুছন্দা দেবী ব্যালকনির দরজায় দাঁড়িয়ে। টের পায়নি। –কী দেখছিস ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে? ব্যাবসার কথা ভাবছিস? ভাবিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে –নাঃ তেমন কিছু না। মাথা তুলতেই মায়ের দৃষ্টি এড়ায় না।

–ও মা এ কি! চোখ দুটো অমন লাল কেন? মুখ খানাও কেমন গোমড়া। ব্যাবসায় আরও কিছু ক্ষতি হ’ল নাকি?

–না সেসব কিছু না। একটা আজেবাজে স্বপ্ন দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মায়ের মন অস্থির হয়ে ওঠে।

–ও মা সে কি? কী বাজে স্বপ্ন? কু-স্বপ্ন মনে চেপে রাখতে নেই। বলে দে। মায়ের পীড়াপীড়ি এড়াতে পারে না।

মেঘমুক্ত আকাশ। পশম মেঘ। বুনো মেঘ। গোটা আকাশে কিছু নেই। হঠাৎ কোথা থেকে কচিকাঁচা মেঘেরা মুক্ত আকাশে খেলতে নেমেছে। আমাকে হাত ধরে টানাটানি। আমি বললাম– আরে আমি কি তোদের সাথে খেলতে পারব?

–এসো না। খুব পারবে।

ওদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে লাগলাম। তারপর যা হওয়ার তাই। অল্প সময়েই হাঁপিয়ে পড়লাম। ওরা বলল– এসো তবে কিছু জলযোগ করে নিই। বলে আমাকেও চাট্টি মুড়ি দিল। আমি পরমানন্দে খেতে লাগলাম। তারপরই হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল।

–ওহ, এটা আবার দুঃস্বপ্ন কীসের?মুড়ি তো ভালো জিনিস। এতে মুখ গোমড়া করে বসে থাকার কি হয়েছে?

–না আমি ভাবছি অন্য কথা। তারপরই মাকে প্রশ্ন করে –আচ্ছা মা, মেঘেদের খাবার কিনতে শুধু খাবার কেন কোনও কিছুই জোগাড় করতে তো পয়সা লাগে না। এত ভালো ভালো খাবার থাকতে শুধু মুড়ি। তাই ভাবছি বাকি জীবনটা কি তাহলে আমাকে মুড়ি…।

–ছিঃ বাবা অমন কথা বলতে নেই। ঘুমটা ভালো হয়নি তো! পাতলা ঘুমে ওরকম হিজিবিজি স্বপ্ন দেখে মানুষ। ওসব কথা মনে করে কষ্ট পেতে নেই।

ড. ডি কে বাসু! এটা কেতাবি নাম! বাপ-মায়ের দেওয়া নাম দিলীপ কুমার বোস। বিদেশে গিয়ে সাহেবি নাম হয়েছে। প্রথম নামটি। বার্কিংহাম ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির প্রফেসরের পাশাপাশি গোটা ইউরোপ ঘুরে জ্ঞানের ঝুলিটা ফুলে ফেঁপে লাউ। জ্ঞানের ঝুলিটা যত ভারী, দাম্ভিকতার তবলা সমপরিমাণে টিউনিং। মুখে লেগে থাকে নেটিভ ইন্ডিয়ান। ইন্ডিয়ান কালচারটা একেবারে বস্তাপচা। জ্ঞানের ভান্ডার দিয়ে ইউরোপকে সমৃদ্ধ করেছে, মাতৃভূমিকে ছড়িয়েছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস।

কৌতুকবশত সুনন্দ বলেছিল– মামা, তুমি গেঞ্জিটা উলটো পরেছ।

ড. বাসু একগাল তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে– আসলে কি জানিস, ইন্ডিয়ানরা কমফর্ট ব্যাপারটা ঠিক বোঝে না। সেলাইয়ের দিকটা ভেতরে থাকলে কমফর্ট ব্যাপারটা ডিসটার্ব হয়। এ গল্পে ড. বাসুর প্রবল আত্মকেন্দ্রিকতা, মাতৃভূমির উপর ঘৃণা, ইউরোপিয়ান আদব-কায়দা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করা। এসব একান্তই অনাবশ্যক ছিল! যদি না দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর দেশের মাটিতে পদার্পণ ঘটিয়ে, বোনের বাড়িতে সটান এসে স্বঘোষিত অভিভাবক হয়ে না উঠত।

সুনন্দের হাতে এখন অঢেল সময়। ডিমনিটাইজেশনের জেরে ট্রাভেলিং-এর ব্যাবসা যত তলানিতে ঠেকছে বিশ্রামের সময় ততই বাড়ছে। ব্যাবসা এখন চড়ায় আটকে যাওয়া নৗকার মতো। পরিশ্রম কম হলে ঘুম আসে না। পায়চারি করে।

ব্যালকনির কর্নারে একটা টব। গোলাপ গাছ। বেচারা। অনাদরে অবহেলায় শুকিয়ে কঙ্কাল। সময় আছে যথেষ্ট। উৎসাহে গলগ্রহ। সেই গলগ্রহে গাছটার অকাল প্রয়াণ। পাশ দিয়ে আরও এক অবহেলিত অনাহুত গাছ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। পথ শিশুদের আদর যত্নের প্রয়োজন হয় না।

জাত ধর্ম সবারই আছে। গাছেরও আছে। শুধু অনাহুত গাছটা শনাক্ত কেউ করতে পারল না। কৗতুহলটা ঘরের চৗকাঠ পেরিয়ে দোতলা তিনতলা। গোটা অ্যাপার্টমেন্টময় ছড়িয়ে পড়ে।

অবশেষে এলেন পরান হালদার। উড়িষ্যার জঙ্গল। আদিবাসীপাড়া। ঝাড়ফুক। তুকতাক। ঘরবন্ধন। ভূত ছাড়ানো। এসবে হাত যশ আছে। সব ছাড়িয়ে পয়সার ঝোলাটা আরও ভারী।

পরান হালদার গাছটা দেখেই অাঁতকে ওঠে। কি সর্বনাশ! এ-তো এক ভয়ংকর বিপদের ইঙ্গিত। গাছটা তোমরা চিনতে পারলে না? –সুনন্দের কৗতুহল বাড়তে থাকে।

–কেন কি গাছ?

–আরে, এ-তো ভূতের বাসস্থান।

–সেটাই তো জানতে চাইছি। এটা কি গাছ? ভূতেরা আবার আলাদা গাছে থাকে না কি?

–থাকে বাবা থাকে। তোমরা শিক্ষিত। এ যুগের ছেলে। ওসব বুঝবে না।

–না, বলছি গাছটার একটা নাম তো আছে?

–আছে বাবা আছে। এটা শ্যাওড়া গাছ। বলে দাঁড়ায় না। পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখে চাপা দিয়ে হন্ হন্ করতে করতে বের হয়ে যায়। পরানবাবু ভয় পেয়েছে। নাক মুখ দিয়ে সুরুৎ করে ভুতের বাচ্চা শরীরে ঢুকে গেলে আর রক্ষে নেই।।

সুনন্দ ভাবছে। নোট জেলে বন্দি। কবে ছাড়া পাবে কে জানে। ট্যুরিস্টেরের পকেটে নেই টাকা। তাই গাড়ির ঘোরেও না চাকা। নোট বন্দি। না বাক্বন্দি। বাক্বন্দি না জীবনবন্দি। ধ্যাৎ! যত্তসব! ঘরের ভিতরটা কেমন গুমোট হয়ে আসছে। মাথার পেছনটা কেমন ভারী ভারী লাগছে। কোন আগন্তুকের পদশব্দ! সুনন্দ চমকে ওঠে।

একটা কিশোর। বয়স বছর বারো তেরো। খালি গা। পরনে ছেঁড়া হাফ প্যান্ট। গায়ে খড়ি উঠে গেছে। তেল সাবান বহুদিন পড়েনি বোধ হয়। মাথায় শেষ কবে চিরুনি পড়েছিল কে জানে! চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকম জ্বল জ্বল করছে। তবু কেমন নিরীহ নিরীহ লাগে।

সুনন্দ ধড়মড় করে উঠে বসে। –আরে রে রে। তুই কোথা থেকে এলি? দরজা তো বন্ধ।

–ওই তো দরজা খুলে।

সুনন্দ ভাবছে বাঁ দিকে ব্যালকনির দরজাটা খোলা। কিন্তু সেদিক থেকে দোতলা উঠবে কি করে! আরও এক ঝলক ভাবে– ডানদিকের দরজা এখনও বন্ধ। লক করা ছিল না হ্যান্ডেল লকটা খুলল। ঢুকল। আবার বন্ধ করল। আমি কিছুই টের পেলাম না। সে যাক্।

–এখানে এসেছিস কেন?

–একটু থাকতে দেবে দাদাভাই?

–তোর বাড়ি কোথায়? নামটাই বা কি?

–জন্ম উড়িষ্যায়। এখন থাকি ফুটপাথে। আর নাম লালু! লালু নায়েক ছিল। এখন যে যা বলে তাই।

–কী করে চলে? মানে খাস কি?

–ভিক্ষা করে। তা-ও ঠিক হচ্ছে না।

তারপরেই লালু পা-দু’টো ধরে বলে– দাও না দাদাভাই একটু থাকতে। আমি তোমাদের সব কাজ করে দেব। এই ধরো হাট বাজার। ঘরের কাজ সব কিছু পারি। ছেলেটার কথায় একটা মাদকতা আছে। সুনন্দ নরম হয়। তারপরই বলে– সবই তো বুঝলাম। কিন্তু তুই এখন যা বাপু! আমার এখন কাজের লোক রাখার সামর্থ্য নেই। আর তা ছাড়া থাকবিই বা কোথায়? আমাদের তো মাত্র তিনটে বেডরুম। লালু মনের ভাব বুঝতে পারে। বলে, –দাদাভাই তোমাদের এঁটো কাঁটা যা দেবে তাতেই আমার হবে। আর থাকার কথা বলছ, সে তোমাদের স্টোররুমেই চলে যাবে। থাকতাম তো ফুটপাথে।

সুনন্দ বিরক্ত হয়। ভাবছে, আচ্ছা মুশকিলে ফেলল তো ছেলেটা। ওকে বোঝাই কি করে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে খাওয়ার মতো অবস্থাতেও আমি নেই।

কথার শব্দে মধুছন্দার ভাত ঘুমটা ভাঙে। হাঁটুর আড়ষ্ঠতা কাটিয়ে সুনন্দর ঘরে ঢুকে বলে, ‘ও মা এ ছেলেটা কে? কী চায়?’

লালু মধুছন্দার পা জড়িয়ে বলে, – মা, ওমা, একটু থাকতে দাও। দাদাভাইকে একটু বলো না। মায়ের মন। ‘মা’ সম্বোধনে গলে জল!

সুনন্দ বিরক্ত হয়ে বলে– আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল তো। কোথা থেকে এসে কাঙালিপনা করছে। একে কীভাবে বিদায় করি বলো তো?

–থাক। থাক। মা বলে ডেকেছে। ও আমি সামলে নেব। দু’মুঠো কম খেলে আমার কিছু হবে না। তাছাড়া ঘরের কাজ সামলে বাজার হাট করা। এখন শরীর দেয় না। হাঁটুর ব্যথাটাও ইদানীং বড্ড বেড়েছে।

মধুছন্দা আঁচলের খুট থেকে পঞ্চাশ টাকার নোটটা দিয়ে লালুকে বলে– যা তো বাবা এক কেজি চাল আর এই শিশিতে একটু সরষের তেল নিয়ে আয়। লালু কাগজের ঠোঙায় চাল আর তেলের শিশিটা ধরিয়ে দিয়ে কোথায় ফুড়ুত করে হাওয়া। আপতত আর দেখা গেল না।

কাজ কম তাই হিজিবিজি ভাবনাটা বেশি। সুনন্দ ভাবছে। ঘরটা কেমন নির্জন নীরব মনে হচ্ছে কেন? তিন জনের সংসারে এখন চারজন। মামা থেকেও নেই। দুপুরে বেরোয়। গভীর রাতে দুলে দুলে ঘরে ফেরে। অশীতিপর বৃদ্ধ। চলাফেরায় এখন আর বলিষ্ঠতা নেই। লালুটা কখন যে কোথায় থাকে বোঝা ভার। অথচ ডাকলেই হাজির। গোটা ঘরটা এক অদ্ভূত রকমের রহস্যময় লাগছে।

জ্যৈষ্ঠের দুপুর। দূরে একটা তৃষ্ণার্ত কাকের ‘কা’ ‘কা’ শব্দে সুনন্দের গলা শুকিয়ে আসছে। টেবিলের উপর বোতলগুলো সার সার খালি। মাকে বিরক্ত করতে মন সায় দেয় না। ডাকে– লালু একটু আয় তো। সাড়া নেই। এবার তৃতীয় স্বরে– লালু। নিস্তব্ধ। এবার সপ্তমে চড়িয়ে ডাকে– লালু। নাঃ ছেলেটা গেল কোথায় এই ভরদুপুরে। ছেলেটা মনে হয় ঘুমোচ্ছে। স্টোর রুমের দরজাটা খুলতেই আঁতকে ওঠে। উফ্। এ-কি দেখলাম। ক্যাম্প খাটে যেটা শুয়ে আছে সেটা কি? একটা কঙ্কাল! গোটা শরীরটা হিম হয়ে আসছে। পা দুটো অসাড়। কোনওরকমে মাতালের মতো টলতে টলতে নিজের ঘরে ঢুকতেই লালু বলে– দাদাভাই ডাকছিলে? একটু বাইরে গেছিলাম।

সুনন্দের ঠোট দুটো তখনও কাঁপছে। অনেক কষ্টে স্বর বেরোয় –তোর ঘরের খাটে ওটা কী?

–কী?

–একটা কঙ্কাল। ওটা কোথা থেকে এল?

তুই এনেছিস?

–কই না-তো।

চল তো দেখি! পা দুটো তখনও কাঁপছে। সাহসের ভাঁড়ার শূন্য। লালু হাতটা ধরে জোর করেই নিয়ে গেল। দরজা খোলাই ছিল। ক্যাম্প খাটের দিকে তাকাতেই তাজ্জব।

–একি! বিছানা শূন্য। ছাপা বেডশিট পরিপাটি করে সাইড মোড়া। এ বিছানায় আজ কেন, দু’চার দিনেও কেউ গা দিয়েছে বলে মনে হয় না। তাহলে তখন…। বার বার চোখ কচলে নেয় সুনন্দ। অদ্ভুত! সুনন্দ স্তম্ভিত। সমস্ত জমাট বাঁধা রক্ত যেন ঝরঝর করে নীচে নেমে যাচ্ছে। লালু হাতটা ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে– হি হি, হি হি। দাদাভাই তুমি ভুল দেখেছিলে। কাল রাতে মনে হয় ভূতের স্বপ্ন দেখেছ।

মধুছন্দার বয়স বেড়েছে। নানা কাজে ভুল হচ্ছে। রান্না ঘরে ঢুকে অাঁচলের খুট খুলতে গিয়ে কী মনে হয়, চালের টিন খুলেই তাজ্জব! টিন প্রায় ভর্তি চাল। ষোলো কিলোর টিন। তিন দিন খেয়েও টিন প্রায় ভর্তি। তেলের শিশির দিকে তাকিয়ে দেখে সামান্য খালি। কি হচ্ছে এসব! মাথাটা আমার গেছে! এত দিন সংসার করছি…।

লালুকে ডেকে বলে– তোকে কবে চাল আনতে বলেছি, আর ক’কেজি?

–কেন পরশু। এক কেজি চাল এনে দিলাম। দুশো সরষের তেল। মনে নেই মা? কেন?

–তা-তো ঠিক। কিন্তু টিন ভর্তি চাল। তেলের শিশি ভর্তি…।

–তাহলে চাল, তেল সব আগে থেকেই ছিল। তুমি ভুল করেই আবার আনতে দিয়েছ।

–হবেও হয়তো। মধুছন্দা ভাবে। নাই ঘরে চাহিদা বেশি। শুধু নাই নাই মন।

আওয়াজটা প্রথমে মধুছন্দাই পেয়েছে। দাদার ঘর থেকে একটা গোঙানির শব্দ। দৗড়ে গিয়ে দেখে গলা দিয়ে কেমন ঘড় ঘড় আওয়াজ। মুখ দিয়ে কালো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। উদভ্রান্ত মধুছন্দা সুনন্দকে ফোন করে। সুনন্দ শিগগির ঘরে আয়। তোর মামার শরীর খুব খারাপ।

সুনন্দ বিভ্রান্ত। তর তর করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে ছুটোছুটি করতে থাকে। যাকে দেখছে বলছে– দাদা একটা অ্যাম্বুল্যান্স জোগাড় করে দিতে পারেন? আচমকাই সুনন্দের নজরে পড়ে গলি দিয়ে এমার্জেন্সি হর্ন বাজিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স তীব্র গতিতে এগিয়ে আসছে। বাঁদিকের জানালা দিয়ে একটা কচি হাত বার করে ইশারা করছে। সুনন্দ বুঝতে পারছে না। সামনে আসতেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল লালু। বলে– দাদাভাই আমি রাস্তাতেই খবর পেয়েছি। তাই অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এলাম।

নার্সিংহোমে যখন পৗঁছোল রাত দশটা। ডাক্তার এস দত্ত বললেন– পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রেডি থাকুন।

ভোর রাতে সুনন্দকে ডাক্তার বলে– কে হন ইনি?

– আমার মামা।

– সরি। উই আর কমপ্লিটলি হেল্পলেস।

অনেকদিন পর আজ সুনন্দ ঘুমিয়েছে। যাকে বলে একেবারে সাউন্ডস্লিপ। সেই ঘুমে সুনন্দের সামনে এক ছায়ামূর্তি। ছায়ামূর্তি বলছে – দাদাভাই আমি চলে যাচ্ছি। আমার কাজ শেষ। তবে বিশ্বাস করো। মামাবাবুকে আমি মারিনি। শুধু আমার স্বরূপ দেখিয়েছি। বোধহয় তাতেই…। সেটা তুমি স্টোররুমেই সেদিন দেখেছ। আমি তোমাকে হ্যালুসিনেশনের লেবেল সেঁটে দিয়েছিলাম। এছাড়া আমার কোনও গতি ছিল না। তোমার মামাবাবুর অঢেল টাকা। কলকাতায় দু’টো ফ্ল্যাট, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিয়ে আনুমানিক প্রায় দশ কোটি। তোমরা হয়তো জানো না। মামাবাবু দুপুরে বেরিয়ে কোথায় যেতেন! রেসের মাঠে। অঢেল টাকা ওড়াতেন। আরও অনেক বাজে অভ্যেস ছিল। অথচ তোমাদের এই সংকটে পাশে দাঁড়াননি। আমি জানি তোমার ব্যাবসা এখন ডুবন্ত নৗকা। অবশ্য একটা মহৎ কাজ তিনি করেছেন। সেটা পরে বুঝবে। আর একটা কথা। টবের গাছেই আমি থাকতাম। টবটা এখুনি ফেলে দাও। গাছটা আমি নিয়ে গেলাম। ভালো থেকো।

সুনন্দ খাটে শুয়ে আছে। ভাবছে। বিষয়- লালুর আগমন নিঃস্্ক্রমণের হেতু। কলিং বেলটা ডিং ডং আওয়াজ। সুনন্দ দরজা খুলতেই কালো কোট প্যান্ট পরা এক অপরিচিত মানুষ। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। নীরবতা নব আগন্তুকই ভাঙে।

–নমস্কার। আমি অ্যাডভোকেট পার্থ সান্যাল। বারাসাত কোর্টে প্র্যাকটিস করি। এসেছি মধুছন্দা দেবীর কাছে। যদি ভুল না করি আপনি…।

– একমাত্র ছেলে সুনন্দ ঘোষ।

–একটু বসতে পারি?

– ওহ, নিশ্চই।

তাহলে মাকে একটু ডেকে দিন।

অ্যাডভোকেট বলছে– ড. ডি কে বাসু আমার ক্লায়েন্ট। উনি একটা উইল করে গেছেন। ওর সমস্ত সম্পত্তি দান করেছেন। সম্পত্তির আনুমানিক মূল্য প্রায় দশ কোটি। অবশ্য কিছু শর্ত সাপেক্ষে। ওর শেষ জীবনে যে বা যারা দেখভাল করবে সে সম্পত্তি তারই প্রাপ্য। এ-ও উল্লেখ করেছেন বর্তমানে তার বোন শ্রীমতী মধুছন্দা ঘোষ-এর বাড়িতেই বসবাস করছেন। ডিটেলসটা পরে নেবেন। সম্মতি থাকলে প্রসিডিংস-টা স্টার্ট করি?

সুনন্দ ধড়মড় করে উঠে পড়ে। ছুটে যায় ব্যালকনিতে। আশ্চর্য! কালকেও দক্ষিণা হাওয়ায় গাছটার পাতাগুলো পত পত করে দোল খাচ্ছিল। এখন গাছটা শুকিয়ে দড়ি হয়ে আছে। সুনন্দের চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়ে গাছের গোড়াটা সিক্ত করে দিল।

শুধু একটু ভালোবাসা

বড়দার কাছে মাকে পৌঁছে দিয়ে কিছুটা স্বস্তি বোধ করল শিউলি। এখানে কাজের লোকের সমস্যায় জেরবার হয়ে উঠেছিল। অথচ সে কথাটা কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছিল না ওদের, বিশেষ করে বড়োবউদিকে। বড়োবউদির ধারণা এটা শিউলির একটা চাল। কথাটা এরমধ্যেই কানেও এসেছে শিউলির। অদ্ভুত! শিউলি অবাক হয়ে ভাবে, যখনই ও কোনও অসুবিধার কথা বলেছে তখনই এই ধরনের প্রতিক্রিয়া দিয়েছে বড়োবউদি। একা থাকে বলে মাকে দেখার দায়িত্বটা নিতে হয় শিউলিকেই। অথচ এটা তো ওদেরই করার কথা। তবুও করে শিউলি। কারণ মা ওর কাছে এলে একটু প্রাণ খুলে বাঁচতে পারে, দুটো মনের কথা বলতে পারে। মা ওদের কাছে এখন উচ্ছিষ্ট বস্তু, নেহাত ফেলে দিতে পারে না তাই রেখেছে।

মায়ের অবদান ওরা মানে না। বড়দার ডাক্তারি পড়া প্রায় বন্ধ হতে বসেছিল। মা নিজের গয়না বন্ধক রেখে বাবার হাতে টাকা তুলে দিয়ে বলেছিল, আমরা আধপেটা খেয়ে থাকব, কিন্তু ওর পড়া বন্ধ করতে দেব না। বড়দা ডাক্তারি পাশ করল। ধীরে ধীরে যত ওর পসার বাড়তে লাগল, একটা চমকপ্রদ বিলাসবহুল জীবন নাগালের মধ্যে ধরা দিল, বড়দা তত বেশি করে অতীতটাকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল। অতীত যেন একটা সিঁড়ি, শুধু ওপরে ওঠার কাজে লাগে। এ কেমন ওপরে ওঠা! ভেবে পায়নি শিউলি।

বখাটে, বাউন্ডুলে মেজদা যখন বন্ধু-বান্ধব আর রাজনীতির চক্বরে পড়ে উচ্ছন্নে যেতে বসেছিল, বাবা হাল ছেড়ে দিলেও মা কিন্তু বুক চিতিয়ে লড়েছিল। একটু একটু করে তুলে এনেছিল ডুবন্ত ছেলেকে। পায়ের তলায় মাটি দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল শক্ত ভূমিতে। মেজদা এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে রয়েছে ওর কারবার। সুযোগ পেলেই উপদেশ দেয়, মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যের নির্মাতা। অর্থাৎ ওর ভাগ্যের বাড়বাড়ন্তের মাঝখানে কেউ নেই, কেউ কোনও দিন ছিল না। কত বড়ো বেইমান! ওদের জীবন কাহিনি তো শিউলির জানা। কী করে পারে এত বড়ো মিথ্যে বলতে?

শিউলির ডিভোর্স নিয়েও কম কথা বলেনি ওরা। বড়দা তো সুযোগ পেলে এখনও শোনায়– ডিসিশনটা একটু বেশি তাড়াতাড়ি নিয়ে ফেললি বুড়ি… আর একটু ভাবতে পারতিস।

বড়দার সাথে সমান ভাবে তাল মিলিয়ে গেছে বড়োবউদি, মেজদা, মেজবউদি। আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সবাইকে বলে বেড়িয়েছে, দোষটা আসলে শিউলির-ই। সুযোগ বুঝে দেবদাস নিজেকে দেবদূত প্রতিপন্ন করার সব চেষ্টাই করে যাচ্ছে। ওদের সাথে দেবদাসের এখনও যোগাযোগ আছে, জানে শিউলি। পর হয়ে গেছে শিউলিই। বড়দা, মেজদা কেউই দরকার ছাড়া কথা বলে না শিউলির সাথে। দরকার বলতে অবশ্য একটাই, সেটা হল মা। মায়ের জন্য ওদের ফরেন টুর আটকে যায়, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার ভীষণ ক্ষতি হয়। স্বাভাবিক আনন্দ উৎসবে একটা বিষাদের ছায়া হয়ে সব আনন্দটাকে শুষে নেয় মা। সেই বিষাদমূর্তিকে শিউলির ঘাড়ে চাপিয়ে ওরা মাঝেমধ্যে একটু আনন্দ উপভোগের অবকাশ পায়। মায়ের মৃত্যুর সাথে সাথে শিউলির এই কদর এক লহমায় ধূলিসাৎ হবে জানে শিউলি।

বলার কিছুই নেই, তবুও বড়ো বউদি খোঁটা দিতে ছাড়ল না– ‘মা ছেলের কাছে আসবে, থাকবে, এ তো ভালো কথা। এই কর্তব্য তো করতেই হবে। তোমার দাদাও সে কথা বলে। কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি শিউলি, তোমার মায়েরও কিছু দোষ আছে গো। সব ব্যাপারে নাক না গলিয়ে উনি থাকতে পারেন না। সংসারটা আমাকে সামলাতে হয়। হঠাৎ করে উনি মাঝখানে না বুঝেশুনে মন্তব্য করে বসলে কেমন লাগে বলো তো?’

শিউলি জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেল। মাকে ভালো করেই চেনে শিউলি। একসময় স্কুলের দিদিমণি ছিল। যথেষ্ট ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা। সেই তুলনায় বিদ্যে ও ব্যক্তিত্বের দৗড়ে অনেক পিছিয়ে বড়োবউদি ও মেজবউদি দুজনেই। আর এখানেই বউদি-দের সমস্যা। মায়ের ব্যক্তিত্বের মোকাবিলা করতে না পেরে এভাবে বদনাম করে বেড়ায়।

বড়োবউদির পক্ষ নিয়ে বড়দা বলল– ‘কথাটা সত্যি রে। মা আজকাল কেমন জানি হয়ে গেছে। সব কিছুতেই বড্ড বেশি রিআ্যক্ট করে। আরে বাবা, তোমার বয়স হয়েছে, খাও দাও, রেস্ট করো। সব কথার মাঝখানে যাওয়ার কী দরকার? যাইহোক যাওয়ার আগে সেই কথাটা মাকে একটু ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে যাস।’

এসব কথা মাকে বলার প্রয়়োজন বোধ করেনি শিউলি। বলা মানে ওদের মিথ্যেটাকে প্রশ্রয় দেওয়া। কেন বলবে এসব?

প্রণাম করে বেরিয়ে আসার সময় মায়ের সজল চোখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতর কেমন জানি করে উঠল। কোনওরকমে বলল– ‘লেখাটা থামিও না মা। আমি পৌঁছে ফোন করব।’

শিউলির স্কুলটা কলকাতা থেকে ঘণ্টা তিনেকের পথ। এমন একটা দূরত্ব, না ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করা যায়, না ওখানকার গ্রাম্য পরিবেশে থাকা যায়। শেষপর্যন্ত স্কুলের কাছাকাছি একটা গঞ্জ এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়েছে দুজনে মিলে। ইচ্ছে করলেই ছুটির দিনগুলোতে কলকাতায় আসতে পারে। কিন্তু আসে না। উঠবে কোথায়? ডিভোর্সের পর নিজের ঘর বলতে তো আর কিছু নেই। বড়দা বা মেজদার বাড়িতে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। ওরাও সেটা বোধহয় চাইবে না। সব মিলিয়ে শিউলি এখন কলকাতা থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন বলা যায়।

সুধাদেবী ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েই রইলেন যতক্ষণ না শিউলির গাড়ি গলি পেরিয়ে বড়ো রাস্তায় অদৃশ্য হল। মেয়েটা চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ একটা অসীম শূন্যতা গ্রাস করে রাখল সুধাদেবী-কে। মেয়েটা তার অন্য রকম। ছেলে দুটোর মতো স্বার্থপর, বিবেকহীন নয়। তবু মেয়ে তো ! ওর কাছে থাকতে মন চাইলেও উপায় থাকে না। ওর দিকটাও দেখতে হয়। ওর অসুবিধাগুলো নিজের চোখে দেখে এসেছেন সুধাদেবী। স্থায়ী কোনও কাজের লোক নেই। ঠিকে কাজের মেয়েটা অসম্ভব কামাই করে। এই অবস্থায় শিউলি চাকরি সামাল দেবে, না মায়ের সেবা করবে? তবুও ওর মধ্যেই যথাসাধ্য করে যাচ্ছিল। কিন্তু সুধাদেবীরই ভালো লাগছিল না। জেদটা তিনিই ধরেছিলেন। নিজের সুখের জন্য ওকে কষ্টে রাখতে মোটেও ভালো লাগছিল না।

একসময় অলস পায়ে ঘরে এসে ঢুকলেন। কিছুই ভালো লাগছিল না। বারবার শিউলি আর মণিদীপার কথা মনে পড়ছিল। ওর স্কুলের আর এক দিদিমণি। ওরা দুজনে মিলেই একটা বাড়ির দুটো পার্টে ভাড়া নিয়েছে। মণিদীপা শিউলির চেয়ে বছর তিন চারেকের বড়ো। ভারি আন্তরিক স্বভাবের মেয়ে। ওর বাড়ি ঘর, স্বামী, সন্তান সবই আছে। কিন্তু দূরত্বের কারণে ভাড়া নিতে হয়েছে। ছুটির দিনগুলো বাড়িতে কাটিয়ে আসে। ওই মেয়েটা-কেও ভালোবেসে ফেলেছেন সুধাদেবী। আসার সময় কান্না চেপে রাখতে পারেননি। মণিদীপাও কাঁদছিল।

এখন আর বেশি কথা বলেন না সুধাদেবী। অবসর সময় লেখালেখি করেন। একটা সময় লেখার অভ্যাস ছিল। মাঝখানে ছেদ পড়ে গিয়েছিল। শিউলির তাগিদেই আবার শুরু। সেসব সত্যিকারের সাহিত্য হয়ে ওঠে কিনা বুঝতে পারেন না। তবে লিখতে ভালো লাগে। মনের জমে থাকা কথাগুলো একটা পথ খুঁজে পায় যেন। শিউলি পড়ে। পড়ে বলে, দারুণ লিখেছ মা, আরও লিখে যাও। হয়তো মন জোগানোর জন্য বলে। তবুও সুধাদেবী খুশি হন।

সুধাদেবীর এই পরিবর্তন দেখে তার বড়োবউমা তো হেসেই অস্থির! ছেলেরাও…

–খাতা ভর্তি করে এসব হিজিবিজি কী লিখছেন মা?

সুধাদেবী হাসেন– ওসব তুমি বুঝবে না মা। আমিও কী সব বুঝি? মন বলে, আমি লিখে যাই। সব সময় বকবক করার চেয়ে তো ভালো। এই জগতের মধ্যেই এ এক আলাদা জগৎ যেন। চাইলে তুমিও পড়তে পারো।

–দূর… ওসব পড়ার সময় কোথায় আমার?  ওতে আপনি কী লিখবেন সেটা তো বুঝতেই পারছি। নিশ্চয়ই আমাদের নিন্দা দিয়ে ভরিয়ে রেখেছেন। আমরা আপনাকে কতভাবে কষ্ট দিই এই সবই তো?

–তোমাদের নিন্দা গাথা লিখে আবার তোমাদেরকে সেটা পড়তে দেব… এটুকু বোধও তোমার কাজ করল না? না পড়েই তুমি অদ্ভুত একটা মন্তব্য করে দিলে। ওসব কথা আমি লিখিনি। কেন লিখব? তোমাদের নিন্দে করা মানে তো আমার নিজেকেই নিন্দে করা। এই বয়সে এসে আর জীবনটাকে নীচে নামাতে ইচ্ছে করে না। যদি কোনওদিন মনে হয়, একটু পড়ে দেখো। আসলে আমার লেখার মধ্যে দিয়ে আবার একবার নিজেকে দেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। পুরোনো আমিটাকে দেখতে গিয়ে দেখছি, সারা জীবনে কত না ভুল করেছি!

–বাববা… এইটুকু লিখেই তো দেখছি আপনার মাথা ঘুরে গেছে। এসব পোকা কী শিউলি আপনার মাথায় ঢুকিয়েছে?

–যদি ঢুকিয়েই থাকে অন্যায় তো কিছু করেনি। সবদিক থেকেই ভালো হয়েছে। মাঝখানে আমি কেমন জানি হয়ে গেছিলাম! তোমাদের অহেতুক বিরক্ত করতাম। তখন বুঝতাম না, এখন একটু একটু করে তফাতটা বুঝতে পারছি। ভালো করে বেঁচে থাকতে হলে নিজস্ব একটা জগৎ তৈরি করে নিতে হয়। শিউলি সেটাই শিখিয়েছে আমাকে। শিউলির জায়গায় তুমিও হতে পারতে সেটা। সব সময় মা-ই যে শেখাবে এমন তো কোনও কথা নেই। কখনও কখনও মেয়েরাও মাকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিতে পারে।

–আপনারা দুজনেই স্কুলের দিদিমণি, কত কিছু জানেন। আমরা তো আবার ওসব হতে পারিনি। ঘরদোর, সংসার, ছেলে-পুলে এসব নিয়েই কাটিয়ে দিলাম। শিউলি একদিক থেকে ভালোই করেছে। একটা মুক্ত, স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারছে। নিজের মতো যেমন খুশি চলতে পারছে। বাধা দেওয়ার কেউ নেই।

ইঙ্গিতটা ধরতে অসুবিধা হল না সুধাদেবীর। নোংরা ঘেঁটে যার আনন্দ, তার মন সব কিছুতেই নোংরা দেখে। সুধাদেবী কোনও কথা বললেন না। এসব কথার কোনও প্রতিবাদ হয় না। প্রতিবাদ করতে গেলে সেটার অন্য ব্যাখ্যা করে এক্ষুনি কাদার মধ্যে নামিয়ে আনা হবে, জানেন সুধাদেবী। হয়তো সেটাই চাইছে তার বড়োবউমা। কিন্তু সতর্ক সুধাদেবী আজ সেই সুযোগটা দিলেন না।

দেবদাস এখন এ বাড়িতে নিয়মিত আসা যাওয়া করছে।

খাওয়া-দাওয়া, হই-হুল্লোড়, সবকিছুতেই ওর ডাক পড়ে। সুধাদেবীর কয়েক মাস অনুপস্থিতির সুযোগে ওরা এটা নিয়ম বানিয়ে ফেলেছে। সুধাদেবী অবাক হন। কেমন ভাই তোরা? যে-ছেলেটা তোদের বোনকে অপমান করে ডিভোর্স দিল, তার সাথেই তোরা এভাবে মেলামেশা করছিস? বোনের মনে কতটা কষ্ট হবে একবারও ভেবে দেখলি না? বউমাদের আদিখ্যেতা দেখলে মনে হয় ওরা ইচ্ছে করেই আরও বেশি করে এসব করছে।

সুধাদেবী ওদের পাতা ফাঁদে পা দিলেন না। এখন কিছু বলতে যাওয়া মানেই ওদের হাতে ঝগড়ার উপাদান তুলে দেওয়া এবং সবশেষে সবার কাছে ‘দজ্জাল বুড়ি’ হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করার সুযোগ করে দেওয়া। হঠাৎ সুধার মনে হল, শিউলি কী এসব জানে? আজ না জানলেও একদিন তো ঠিক জানতে পারবে। তখন? সেদিন অসম্ভব কষ্ট পাবে মেয়েটা। বউদিরা না হয় পরের মেয়ে, কিন্তু নিজের দাদারা কী করে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে? এমন ছেলেদের পেটে ধরেছিলেন তিনি? কেমন জানি অসহায় লাগে সুধাদেবীর।

কিন্তু সহ্যের তো একটা সীমা থাকে। সেটারই বাঁধ ভেঙে গেল একদিন। শিউলিকে নিয়ে ওরা সেদিন ওনার সামনেই যা নয় তাই শুরু করে দিল। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না সুধাদেবী। নিজের ছেলে বউমাদের না ধরে সরাসরি দেবদাসকেই ধরলেন। –তুমি কেমন ধরনের ছেলে বাবা! লজ্জা শরম বলে কী কিছুই নেই তোমার শরীরে? এভাবে এই বাড়িতে তোমার আসাটা কি ঠিক বলে মনে করো তুমি? কোন সম্পর্কের ভিত্তিতে তুমি এখানে আসো? একসময় তুমি আমাদের জামাই ছিলে, এখন তো নেই তাই না?

দেবদাস রাগ দেখাল না। খুব শান্ত ভাবে মাথাটাকে হেলিয়ে ঠোঁটের কোণে একটা দুষ্টু হাসি খেলিয়ে বলল– ‘এসব কথা আমাকে না বলে ওনাদের-কে বলুন না। বড়দাই তো আমাকে ডেকে আনেন। আমি যে ইচ্ছে করে আসি তা কিন্তু নয়।’

সুধাদেবী বড়োছেলে তথাগতের দিকে তাকালেন।

তথাগত ভীষণ অপ্রস্তুত। বড়োবউমা সুতপা অবস্থা বেগতিক দেখে ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে পড়ল। –আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন মা, দেবদাস একজন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। ডাক্তারদের সাথে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ-দের একটা সম্পর্ক থাকে। বিজনেস ফিল্ডে দেবদাসের খুব নাম। আপনার মেয়ে ওর সাথে সম্পর্ক রাখতে পারেনি। তার দায় আপনি সবার ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। দেবদাস তবুও নানা ভাবে আপনার ছেলেকে হেল্প করে। নেহাত ওর বড়ো মন তাই।

সুধাদেবী ভীষণ অবাক হন। বিজনেসের সম্পর্ক আর পারিবারিক সম্পর্ক এক হল! কথাগুলো শিউলিকে আর না জানিয়ে পারলেন না। অন্য লোকের মুখে শোনার চেয়ে নিজের মায়ের মুখেই শুনুক নির্মম সত্যটা। ফোনে সবটাই খুলে বললেন।

সব শুনে শিউলি হেসে বলল– ‘আমি সব জানি মা। তুমি এসব নিয়ে মন খারাপ কোরো না। কাউকে কিছু বলতেও যেও না।’

সুধাদেবী অবাক হয়ে বলেন– ‘কার মুখে শুনলি তুই এসব? কে বলল?’

–বড়োবউদিই বলেছে। বলে অনেক আনন্দও পেয়েছে। আসলে দেবদাস ওদের কোম্পানি থেকে বড়দাকে একটা ইউরোপ টুরের বন্দোবস্ত করে দিচ্ছে। পুরো ফ্যামিলি সমেত। সমস্ত খরচা ওরাই দেবে। তার জন্যেই এত খাতির যত্ন। হয়তো মেজদাও কিছু সুযোগ পাবে। শুধু তাই নয়, ওরা সবাই মিলে দেবদাসের জন্য একটা পাত্রীরও সন্ধান করেছে। বড়োবউদি যে-পাত্রীর খবর দিয়েছে, ঘটনাক্রমে মেয়েটি আমার চেনা। ওরা অবশ্য সেটা জানে না। ওই মেয়েটাই ফোনে আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল। গল্পের ছলে জানতে চাইছিল, ডিভোর্সটা কেন হয়েছিল।

–তুই কী বললি? সত্যিটাই বলে দিয়েছিলি তো…?

–আমি শুধু বলেছি, এসব প্রশ্ন আমাকে কোরো না, কারণ আমার উত্তর তোমার কাছে একতরফা লাগবে। ওর সাথে কথা বলে যেটুকু বুঝলাম তাতে বড়দা, বড়োবউদি ডিভোর্সের সমস্ত দায় আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে ভালো রকমের ব্রেন ওয়াশ করে দিয়েছে। তারপরে অবশ্য আর কোনও প্রশ্ন করেনি। তবুও বিয়েটা যদি কোনও ভাবে ভেঙে যায়, দোষটা ঘুরেফিরে আমার ঘাড়েই এসে পড়বে জানি। আমার কপালটাই বোধহয় এমন!

কিছুক্ষণ কোনও কথা বলতে পারলেন না সুধাদেবী। ফোনের ওপার থেকে ক্লিষ্ট হাসি হেসে শিউলি বলল– ‘বুঝতে পারছি এসব দেখেশুনে তুমি খুব কষ্ট পাচ্ছ। কিন্তু এটাই তো সত্যি মা। সত্যি নির্মম হলেও তাকে মেনে নিতেই হয়। তোমার মেয়ের ভাগ্যটাই যে এমন! তবে বেশি ভাবার কিছু নেই। আমি তো একেবারে জলে পড়ে নেই। দু-মুঠো অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা তো আছে। কেউ তোমার মেয়েকে মাটিতে ফেলে পিষে অন্তত মারতে পারবে না। লতানো গাছেরাও পৃথিবীতে বেঁচে থাকে মা।’

সুধাদেবী অসহায় ভাবে বললেন– ‘কিন্তু একটা অবলম্বন লাগে তাদের… বাড়তে, ফুল দিতে, ফল দিতে। আমি বলি কি, তুই একটা বিয়ে করে নে মা। দেবদাস যদি করতে পারে, তবে তুই কেন পারবি না?’

শিউলি হেসে বলল– ‘তুমি কী আমাকে প্রতিযোগিতায় নামাতে চাইছ?’

তারপরেই অন্যমনস্ক ভাবে বলল– ‘বিয়ে মানে তো দেবদাসের মতো পুরুষের সাথে একটা বন্দোবস্ত। যে-বন্দোবস্তে একতরফা ভাবে কতকগুলি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরাজিত পক্ষের মতো মেয়েদের-কেই সব সময় চুক্তির সমস্ত শর্ত মেনে নিতে হয়। না মানলেই শর্ত লঙঘনের দায় চাপিয়ে চলে পেষণ। তবে এটাও মানি, সহমর্মী পুরষেরাও এই পৃথিবীতেই থাকে। যদি কখনও তেমন কারও সাথে দেখা হয়ে যায়… অবশ্যই বিয়ে করব।’

সুধাদেবী আর কোনও কথা বললেন না। অদ্ভুত একটা অনুভূতি খেলে গেল তার মস্তিষ্কে। তার মনে হল, আর একটা সুধা যেন তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে চলে গেল বহু দূরে শিউলির ঘরে। শিউলির মাথায় হাত রেখে সে পরম মমতায় বলল, ‘অন্তরের টান থাকলে মানুষ সব পায়। অন্তরের শক্তিই তাকে সব এনে দেয়। টাকা, গাড়ি, বাড়ি নয়… তুই শুধু একটু ভালোবাসা চেয়েছিস। ঠিক পাবি মা! এ আমার আশীর্বাদ। মায়ের আশীর্বাদ কখনও বিফলে যায় না।’

আবার আমরা বন্ধুরা

ছোটোবেলার বন্ধুরা এক এক করে সবাই দূরে সরে যাচ্ছে। ছুটির দিনের আড্ডাটা এখন আর বসে না। দিনে দিনে নিঃসঙ্গতা চেপে ধরছে সুজনকে। অনির্বাণ, ব্রজেশ সেই কবেই দূরে সরে গিয়েছে। বছর দুই হল ফারুকও আর আড্ডায নেই। পুরোনো বন্ধুদের কথা, একসঙ্গে কাটানো দিনগুলোর কথা, আজকাল খুব মনে পড়ে সুজনের।

পুরুলিযার অযোধ্যা পাহাড়, বাগমুন্ডি, চড়িদা, সুন্দরবনের ধুচুনিখালি, কোরাকাটি, সন্দেশখালি, মরিচঝাঁপি, কিংবা ডুযার্সের চালসা, সামসিং, সান্তালেখোলা কত জাযগায যৌবনের দস্যিপনায চষে বেড়িয়েছে একসঙ্গে। সব যেন মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা। দেখতে দেখতে বযসটা যে আটান্নতে পৌঁছে গিয়েছে, খেযালই হয়নি!

প্রায় আটত্রিশ বছর আগে বন্ধুত্বের শুরু। হোস্টেল-এর দিনগুলো কেমন যেন জুম ইন করে চোখের সামনে চলে আসে। একটুও ফিকে হয়নি সেই সুখের মুহূর্তগুলো। রং-বেরঙের খুশি, দুষ্টুমি ভরা ঘটনা, সব মনের পর্দায চলচ্ছবি হয়ে এসে সুখের অনুভতিতে ভরিযে দেয়। একাকী অন্ধকার ঘরে চোখ বুজলেই, অতীত স্মৃতিগুলো নড়েচড়ে বসে বন্ধুদের কাছে নিয়ে আসে। অনির্বাণ, ব্রজেশ, ফারুক সবাই তখন তার চারপাশে ঘিরে এসে বসে। হোস্টেল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি শেষে চাকরি জীবন, কত না ঘটনা গল্পে জুড়ে যায়।

বন্ধুদের মধ্যে অনির্বাণ ছিল সবথেকে হ্যান্ডসাম। ছয ফুট এক ইঞ্চি লম্বা, সুন্দর পেটানো স্বাস্থ্য। সুন্দর মুখে উজ্জ্বল হয়ে থাকা হাসি। অনির্বাণই সবার আগে চাকরি পেয়েছিল। সেরিকালচার অফিসার, কালিম্পং-এ পোস্টিং। ছুটি পেলেই চলে আসত বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। অফিসের নেপালি সুন্দরী সহকর্মীর সঙ্গে প্রেমের গল্প শোনাত বন্ধুদের। তার ওখানে বেড়াতে যাওযার আমন্ত্রণ জানাত। শুনে শুনে বন্ধুদের বুক জ্বলত। বেকারদের হাতে তখন পযসা কোথায! কারওরই স্টাডি কমপ্লিট হয়নি, ফারুক ছাড়া আর কারওর গার্লফ্রেন্ডও নেই।

অনির্বাণ সাযে্নস-এর পাস কোর্সে পড়ত, ফারুকও তাই। ওরা একই ক্লাসের কলেজ-পড়ুযা ছিল। ব্রজেশের কেমিস্ট্রি অনার্স আর সুজনের ছিল বোটানি অনার্স। ওদের মধ্যে ফারুক ছিল সব থেকে প্রাণবন্ত। নিয়ম ভাঙার সব কিছু ওর কাছেই শেখা। সেই সমযে ও ছিল অন্যদের থেকে অনেকটা এগিয়ে সবার আগে কোরিযান জিনস ওই কিনেছিল ফ্যান্সি মার্কেট থেকে। আর জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ওর ছিল অগুনতি গার্লফ্রেন্ড।

(দুই)

পুরোনো স্মৃতিটা উস্কে দেয ব্রজেশ। মনে আছে সেই ঘটনাটা ফারুকের কোনও এক বান্ধবীর বাবা নেভিতে চাকরি করতেন। সেই বান্ধবী এক বোতল বিদেশি হুইস্কি প্রেজেন্ট করেছিল। অতি যত্নে ফারুক একটা ছোটো ব্রিফকেস-এ ঢুকিযে তালাবন্দি করে লুকিযে রেখেছিল সেটা। হুইস্কির ঘটনাটা সবাই জানত কিন্তু জিনিসটা যে কোথায লুকানো আছে, জানত না কেউ। কোনও এক বিশেষ দিনেই নাকি সেটা খোলা হবে! কিন্তু ব্রজেশ আর অনির্বাণের দেরি সহ্য হচ্ছিল না।

ফারুকের অনুপস্থিতিতে সুযোগ পেলেই অন্য বন্ধুরা সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করত। এক শীতের রাতে ফারুক তখন ডিনারে গিয়েছে, এদিক ওদিক খুঁজতে খুঁজতে সুজন ফারুকের বেডের নীচে লম্বা ড্রযারের মধ্যে বইপত্র, জামা কাপড়ের পিছনে খুঁজে পেল খবরের কাগজে মোড়া ব্রিফকেসটা। হাতে নিয়ে নাড়িযে তার মধ্যে হুইস্কির বোতলের উপস্থিতি প্রায় নিশ্চিত হল। ফারুক ঘরে ফেরার আগেই সুজন আর ব্রজেশ ব্রিফকেস নিয়ে দিল চম্পট। খবর পেযে ফারুক আর অনির্বাণ ধাওযা করেছে ওদের। শীতের কনকনে ঠান্ডায মাঝরাত্রিতে হোস্টেল-এর সামনের ফুটবল মযদানে, এপাশ থেকে ওপাশ ব্রিফকেস বুকে জড়িযে ছুটছে সুজন। সাথে সাথে ছুটছে ব্রজেশ। তাদের পিছনে পিছনে অনির্বাণ আর ফারুক। এক সময ফারুক ধরেই ফেলল ব্রিফকেসের হ্যান্ডেলটা। সেই অবস্থাতেই ছুটছে সুজন। টানাটানি জোরাজুরিতে হ্যান্ডেল খুলে চলে এল ফারুকের হাতে, আর সে সজোরে আছড়ে পড়ল মযদানে। অনির্বাণ তাড়াতাড়ি টেনে তোলে ফারুককে।

আবার ছুট… দৌড়াতে দৌড়াতে হাঁপিযে উঠেছে সুজন-ব্রজেশ। দাঁড়িযে পড়ে ওরা। এবার ব্রিফকেস নিয়ে টানাটানি, একদিকে ব্রজেশ-সুজন অন্যদিকে অনির্বাণ-ফারুক। টানাটানিতে ব্রিফকেস খুলে, পড়ে ভেঙে গেল হুইস্কির বোতল। সবাই চুপ, যেন দোষীরা সব কাঠগড়ায দাঁড়িযে ফারুকের কি সে ভীষণ মন খারাপ! তার মধ্যেই আবার সকলে মিলে টর্চ জ্বেলে মযদান থেকে একটা একটা করে ভাঙা কাচের টুকরো তুলে পরিষ্কার করতে হল। সকাল হলেই যে এই মাঠেই দৌড়াতে, খেলতে হবে সকলকে।

এরপর ফারুক দুদিন কথা বলেনি কারও সঙ্গে। সুজন ফারুকের ঘরে গিয়ে কান ধরে উঠ-বস করে এসেছে, তা-ও না। ফারুকের পচ্ছন্দের হরিদার দোকানের মোগলাই পরোটা এনে খাওযানোর পর রাগ কমেছিল। আবার সম্পর্ক স্বাভাবিক। হোস্টেল-এর নেড়া ছাদে উঠে চারজনে মিলে জমিযে তাস খেলা। এমনই ছিল বন্ধুত্ব। ওরা কেউই কিন্তু মদ্যপানে আসক্ত ছিল না। এটা একটা অনাস্বাদিত বস্তুর প্রতি কৌতূহলী আকর্ষণ। যাক বোতলটা পড়ে ভেঙে ভালোই হয়েছিল।

(তিন)

হোস্টেল জীবনটা ছিল একটা স্বঅভিভাবকত্বের সংসার। এখানে ছিল না কোনও হোস্টেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট, না ছিল কোনও অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এর নজরদারি। ছাব্বিশটা ঘরের দোতলা হোস্টেল। বাহান্নজনের বাস, সকলেই স্বঅভিভাবক। হোস্টেল-এর বাহান্নজনের সকলেই এসেছে ১৯৭৮-৭৯ তে। ব্রজেশ আর কযেজন মিলে ১৯৭৮-এ প্রথম হোস্টেলকে নতুন ভাবে চালু করেছিল। ওদের বন্ধুবান্ধবরাই পরে এসে একে একে সংখ্যা বাড়িয়েছে।

সুজন এসেছিল ব্রজেশের যোগাযোগে, ওরা হাযার সেকেন্ডারিতে এক সঙ্গে পড়ত। শুনেছে, ১৯৭১-এর রাজনৈতিক অস্থিরতার সমযে কোনও এক ভোরবেলায কেযারটেকার পাম্প চালাতে গিয়ে দেখে, হোস্টেল-এর পিছনের দিকে পাম্প হাউসের পাশে এদিকে ওদিকে ছড়িযে পড়ে রয়েছে পাঁচটা ডেডবডি। রাত্রিতে কোথাও মার্ডার করে ওদের ওখানে ফেলে রেখে গিয়েছে। অন্ধকার না কাটা ভোরে খবর পৌঁছে গেল ঘরে ঘরে। পুলিশি ঝামেলার ভযে আতঙ্কিত হয়ে তখনই যে-যার মতো ঘর খালি করে পালাল হোস্টেল ছেড়ে। ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে, পাখা চলছে।  পোড়ো হোস্টেলটায় কেউ আর পা মাড়াযনি সাত-আট বছর। কলেজ অফিসিযাল বা ইলেক্ট্রিক অফিসের কেউ-ই আর আসেনি এদিকে।

রাজনৈতিক পালা বদলের পরে শান্ত সময়ে ১৯৭৮-এর শেষ দিকে ব্রজেশ আর অন্য কযেজন কলেজের দূরের ছাত্র, সাহস করে হোস্টেল খুলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিযে থাকতে শুরু করে। হোস্টেল ফিস দিতে হয় না, কোনও ইলেকট্রিক বিল আসে না তাই তাও দিতে হয় না। নিজেদের খাওযার খরচাটাই একমাত্র খরচা। এমন মজার জাযগা কার না পছন্দ!

ব্রজেশ প্রথমে হোস্টেল-এ এসেছিল বলে এলাকার লোকজনের সঙ্গে ভালো পরিচিতি তার। তাছাড়া ডাকাবুকো ব্রজেশের মধ্যে একটা দাদা দাদা ভাবও ছিল। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান-এর ফুটবল খেলা টিভিতে দেখার জন্য ব্রজেশের সঙ্গে ফুটবল মাঠের শেষ কোণায মোহনদার বাড়ি যেত সুজনরা। মোহনদার বাড়ির সকলে মোহনবাগান-এর সমর্থক আর হোস্টেল-এর ওরা ইস্টবেঙ্গল সমর্থক।

খেলা শুরু হতেই দুপক্ষের চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু। মোহনদার মা ছিলেন বড়ো ভালো মানুষ। সকলকে আদর করে বসিযে মুড়ি চানাচুর খাওযাতেন। সুজনের মনে পড়ে, মোহনদাদের বাড়িতে একটা বড়ো লিচুগাছ ছিল। লিচুর সময লিচুর থোকাগুলো কাপড় দিযে বেঁধে রাখত, যাতে পাখিতে বা বাদুড়ে না খেতে পারে।

এরকম সমযে একদিন সকালে দেখা গেল ফারুক-অনির্বাণ ব্যাগ ভর্তি লিচু নিয়ে হোস্টেল-এর সকলকে লিচু বিতরণ করছে। কেউ জিজ্ঞাসা করতে ফারুক বলল, কাল মামারবাড়ি থেকে দিয়ে গিয়েছে। রাত্রিতে সময পাইনি, তাই সকালে…। লিচু পেযে তো সকলেই বেশ খুশি। কিন্তু সে খুশি বেশিক্ষণ স্থাযী হল না।

সেদিনই বিকেলে সুজনরা সাত-আট জন মিলে মোহনদার বাড়ি গিয়েছে খেলা দেখতে। সেই দলে ফারুক, অনির্বাণও আছে। মোহনদাও সেদিন বাড়িতেই ছিল কিন্তু মেজাজটা যেন ঠিক ভালো নেই। মোহনদার মা মন খারাপ করে এসে বললেন, জানো তো বাবা, কাল একদল বদমাইশ ছেলে মাঝরাত্রিতে সব লিচু চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। ভেবেছিলাম তোমাদের সকলকে এবার লিচু খাওযাব, সে আর পারলাম না।

সুজন মুখ ফসকে বলেই ফেলছিল, না মাসিমা আজই তো লিচু খেয়েছি। ফারুক পিছন থেকে জোরে চিমটি কাটে। সুজন পিছন ঘুরতে ইশারায চুপ করতে বলে। সেদিন হস্টেলে ফিরে সুজন, ব্রজেশ-এর সঙ্গে ফারুক আর অনির্বাণ-এর হেভি ঝামেলা। শালা যার বাড়িতে প্রতিদিন টিভি দেখতে যাচ্ছিস তার বাড়িতেই চুরি। নিমক হারাম। আরও কত কী খারাপ খারাপ কথা।

অনির্বাণ বলে, সে গাছে চড়েনি, নীচে টর্চ হাতে দাঁড়িযে ছিল।

ব্রজেশ প্রশ্ন করে, তবে লিচুগুলো কুড়োল কে?

ফারুক মিনমিনে গলায় বলে, জগন্নাথ আর মাধব ছিল সাথে।

ব্রজেশ আরও ক্ষেপে যায়, দলটা বেশ বড়োই বানিয়েছিস। এবার তাহলে ডাকাতি করতে নেমে পড়। মোহনদাকে সব বলব আমি, তোদের টিভি দেখার পাট চুকাব।

ফারুক, অনির্বাণ, ব্রজেশের হাতে পাযে ধরে মিনতি করে, না বলার জন্য। ব্রজেশ শর্ত দেয, সব ঘর ঘুরে ঘুরে যার কাছে যতগুলো লিচু বেঁচে আছে সেগুলো জোগাড় করে নিয়ে আসতে হবে। ওগুলো সে মোহনদাদের বাড়িতে গিয়ে দিযে আসবে। বলবে, চোরেরা একটা লিচুর ব্যাগ হোস্টেল-এর পিছন দিকে ফেলে গিয়েছিল, সেটা নিয়ে এসেছে। সে রকমই হল। কিন্তু মোহনদা বোধহয় কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিল।

পরের দিন দলশুদ্ধ খেলা দেখতে গেলে বলে দিল, খেলা দেখা যাবে না, টিভি খারাপ। তারপর আর টিভি ঠিক হল কিনা খবর পাওয়া গেল না। টিভি তে খেলা দেখার পাটও উঠল।

(চার)

কলেজ পাশ করার পর সবাই আলাদা হয়ে গেল হাযার স্টাডিজের জন্য। মাঝেমধ্যে চিঠিতে যোগাযোগ হতো। তবে পুজোর ছুটিতে, বড়োদিন আর নিউ ইযারের ছুটিতে সকলে মিলে নির্ঘণ্ট মেনে আড্ডা দেওয়াটা ছিল অনিবার্য। একসঙ্গে ঘোরা, খাওয়া, আড্ডা সব মিলিযে পুরোনো হোস্টেল-এর দিনগুলো যেন আবার ফিরে আসত তখন। অনেক কিছু পরিবর্তনের মধ্যেও ওদের বন্ধুত্বটা ছিল সেই আগেরই মতন।

এর মধ্যে সুজন ব্যাংক-এ চাকরি পেযে হুটপাট বিযে করে ফেলল বাড়ির অমতে। কালিম্পং থেকে ট্রান্সফার হওযার পর, অনির্বাণের আগের প্রেম কেটে গেছে, এখন আবার সিঙ্গেল। বাড়ির দেখা মেয়েছেই বিযে করবে মত দিয়েছে, দেখাশোনা চলছে। ব্রজেশ চাকরি-বাকরির ইঁদুর দৌড়ে নাম না লিখিযে পারিবারিক ব্যবসাতেই ঢুকে গিয়েছে। সুজন চাকরি পাওযার বছর খানেক পর ফারুকও চাকরি পেয়েছে, সিবিআই অফিসার-এর। বন্ধুদের মধ্যে ওর এখন ভাও বেশী।

বছরগুলোর এগিয়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুত্বের বযসও গড়িযে গিয়েছে বছর ত্রিশ। এখন সকলের সংসার হয়েছে। নিয়ম করে বছরে দুবার চার বন্ধু পরিবারের সকলকে নিয়ে ঘুরে আসে কাছে দূরে কোথাও। সুজন আর ফারুক কাছাকাছি থাকে। সেজন্য দুজনের নিযমিত যোগাযোগ আছে, মন করলেই এ ওর বাড়ি পৌঁছে যায়।

ফারুকের দেশের বাড়ির পাশের গ্রামে অনির্বাণ-এর বাড়ি। ছুটির দিনে ফারুক নিয়ম করে দেশের বাড়ি যায়, সে সময অনির্বাণ-এর বাড়ির খোঁজখবরও পায। সেই রবিবার দেশের বাড়ি গিয়ে খবরটা পেয়েছিল, গতকালই অনির্বাণ মারা গিয়েছে, লাং ক্যান্সার হয়েছিল। হঠাৎ বেশি অসুস্থ হয়ে কয়েক দিন আগে হসপিটালে ভর্তি হয়েছিল।

ফারুকের সামনেই অনির্বাণ-এর ডেডবডি এল। বাড়ির লোকজন, আত্মীয-স্বজন কাউকেই এতদিন জানায়নি নিজের অসুস্থতা। বন্ধুরাও কেউ জানত না ওর অসুস্থতার কথা। এত কষ্ট নিজের বুকে চেপে রেখেছিল ও, সে কষ্টের ছোঁযা যেন না লাগে নিকট কারও। ফারুকের মুখে খবরটা শুনে আঁতকে ওঠে সুজন, বিশ্বাস হয় না। পরদিন সুজন আর ফারুক কারওরই অফিস যাওয়া হল না।

বুকের মাঝে যেন একটা গভীর ক্ষত অনবরত ব্যথা জাগিয়ে তুলছে। হোস্টেল-এর নেড়া ছাদে বসে লুকিযে তাস খেলার চার সঙ্গীর একজন কেটে পড়ল। স্টেশনের বেঞ্চে দুই বন্ধু হাতে হাত রেখে অনেকক্ষণ বসে থাকে। একটার পর একটা ট্রেন আসছে, থামছে আবার তার গন্তব্যে চলে যাচ্ছে। স্টেশনে নামা মানুষজন ভীড় ভেঙে যে-যার মতো চলে যাচ্ছে। ওদের দুনিযাটা যেন থমকে দাঁড়িযে গিয়েছে। ফারুক-ই প্রস্তাব রাখে, চল। ব্রজেশের কাছে যাই।

সে-রাতটা ব্রজেশের বাড়িতে কাটিয়ে পরদিন সকালে বনগাঁ থেকে ট্রেন ধরে অফিস করেছিল সুজন আর ফারুক। কোনও কোনও সময সবকিছু যেন কেমন দ্রুত বদলে যায়। নাটকের শেষ দৃশ্যে পেঁছোনোর জন্য খুব তাড়াহুড়ো।

অনির্বাণের মৃত্যুর পর বছর ঘুরতে না ঘুরতে, একদিন ব্রজেশও টেলিভিশন, খবরের কাগজে খবর হয়ে এল। মহালয়া সবে পার হয়েছে, চারিদিকে পুজো পুজো ভাব। অফিস যাওযার আগে সকালে টিভিতে খবর দেখতে গিয়ে সেই নিদারুণ কষ্টের খবরটা পেল সুজন। সঙ্গে সঙ্গে ফারুককে জানায়।

ব্রজেশদের বাড়ি বাংলাদেশ সীমান্তের শহর বনগাঁয়ে। সেখানে ওদের অনেক রকম ব্যাবসা। মেডিসিন, শাড়ি, রেডিমেড পোশাক, জুযোরির ব্যাবসা ছাড়াও, আরও অনেক রকমের ব্যাবসা। এলাকার প্রভাবশালী ব্যবসাযী পরিবার ওরা। এলাকার নব্য তোলাবাজদের দাবিমতো দুর্গাপুজোর জন্য ধার্য এক লাখ টাকা চাঁদা না দেওযায়, সন্ধের অন্ধকারে বেশ কযেজন এসে দোকানের মধ্যেই, ব্রজেশকে পয়েন্ট ব্ল্যাংক থেকে গুলি করে মার্ডার করেছে।

আবার দলছুট একজন! দুর্গার যেন কিছু করার নেই, এখন সব ক্ষমতা অসুরের। এখন যে অসুররাজ চলছে! সুজন-ফারুক যেন নিজেরাও মনে মনে মরে যাচ্ছে একটু একটু করে। এক একটা মৃত্যু যেন, বন্ধুত্বের গুচ্ছ ফুলের তোড়া থেকে খসে পড়া এক একটা ফুল। তোড়াটাকে দিন দিন হালকা করে ফেলছে।

দুই বন্ধুকে হারানোর পর শূন্যতা ভুলে থাকতে দুই বন্ধু যেন আরও কাছের হয়েছে। আর সেই বৃত্তে সামিল হয়েছে দুই বন্ধুর পরিবার। বছর পাঁচেক হল ব্রজেশ নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধু হারানোর ক্ষতটা এখন অনেকটা নরম হয়েছে। কিন্তু সব তো মানুষের মর্জিতে চলে না!

জীবন নাটকের এক অঙ্কের পর, অন্য অঙ্ক লেখা হচ্ছে অন্য কোনও নাট্যকারের মর্জিতে। তার নাটকের একটি দৃশ্যও পরিবর্তনের ক্ষমতা নেই অন্য কারও। সে-ই নাট্যকার, সে-ই পরিচালক।

(পাঁচ)

অফিসে কাজের মাঝে হঠাৎ ফোনটা পেল সুজন। ফারুকের স্ত্রী সানা ফোন করেছে মুম্বই থেকে। চেনা গলা কেমন যেন অচেনা লাগছে। ওরা দুদিন আগে মুম্বই গিয়েছিল এলএফসি টুরে। মুম্বই-গোয়া ঘুরে দিন সাতেক পরে ফেরার কথা। সানা বলল, টাটা ক্যান্সার সেন্টার থেকে বলছে। কালকে খুব অসুস্থ হওযায় ফারুকের কথামতো ওই হসপিটালে ভর্তি করিয়েছিল। হসপিটাল থেকে বলেছে, ওখানে নাকি ও আগে থেকেই ট্রিটমেন্ট করাত, বাড়িতে কাউকে কিছু বলেনি। আজ কিছুক্ষণ আগেই মারা গিয়েছে ফারুক।

খবরটা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় সুজন। এত সিরিযাস খবরটা সে জানত না! তেমন হলে সেও তো সঙ্গে যেতে পারত। খবর পেযে ফারুকের মুম্বই অফিসের কযেকজন কলিগ সানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তারাই ডেথ সার্টিফিকেট নিয়েছে, কফিন জোগাড় করেছে, ফ্লাইট-এর টিকিটের ব্যবস্থা করেছে। কফিনবন্দি ফারুকের মৃতদেহ নিয়ে একাই ফিরছে সানা। এযারপোর্টে ফ্লাইট আসার অনেক আগে থেকেই সস্ত্রীক উপস্থিত সুজন। ফারুকের বাড়ির লোকজনও সেখানে উপস্থিত। এই এযারপোর্টে সুজন আগেও এসেছে ফারুকের সঙ্গে দেখা করতে, আড্ডা দিতে। তখন সে এখানে ইমিগ্রেশন অফিসার হিসাবে পোস্টেড ছিল।

খেযালি ঝোড়ো হাওযা স্মৃতির পাতাগুলো উড়িযে দিযে দাঁড় করায রুক্ষ বাস্তবের সামনে। এযারলাইন্সের দুজন কর্মী ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে ফারুকের কফিন বযে নিয়ে আসছে। সাথে পা মিলিযে এগিয়ে আসছে বিধ্বস্ত, ক্লান্ত, নিঃসঙ্গ এক মহিলা! ফারুকের স্ত্রী সানা, দেখে মনে হচ্ছে এই কদিনে সে যেন কযেটা বছর পার করে এসেছে।

দূর থেকে দেখে সুজন এগিয়ে যায় গেটের কাছে। নিরাপত্তারক্ষীরা গেটের সামনে থেকে ঠেলে সরাতে গেলে, সুজন ব্যালেন্স হারিযে পড়ে যায় পাশের লোহার রেলিং-এর উপর। চোট লাগে মাথায়। লোকজন ধরে উঠিযে জল দেয় মাথায়। এযারপোর্ট থেকে ফেরার পথে সারাটা পথ শববাহী গাড়িতে কফিনের পাশেই বসে ছিল সুজন।

কবরে মাটি দেওযার পর থেকে কেমন যেন নির্বাক, নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছে সে। দিন-মাস এগিয়ে যায়, সুজন যেন আরও একাকিত্ব অনুভব করে। মাথার ভিতর টিশটিশ ব্যথাটা যেন তার মধ্যে মিলন সুখের বাসনা জাগায়। অফিস শেষে কোথাও আড্ডা না মেরে সোজা বাড়ি ফেরে। রবিবার আর ছুটির দিনে সকালের আড্ডাও এখন বন্ধ, আড্ডার সঙ্গীই যে নেই!

অনেক দিনই রাত্রিতে বাড়ির ছাদে উঠে আকাশের তারাদের দিকে তাকিযে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। হয়তো ওদের মাঝেই খোঁজে অনির্বাণ, ব্রজেশ এবং ফারুককে। মেঘেদের বাধা সরিযে কখনও দিনের আলোয়, কখনও বা তারাদের আলোর পথ বেয়ে দেশ-পৃথিবীর এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘুরে আসে, অনির্বাণ-ব্রজেশ-ফারুক-সুজন-এর উত্তরসূরিদের আকাশযান।

ওদের কি কখনও দেখা হয় আকাশ পথে বা আকাশ জুড়ে ছড়ানো বন্ধুত্বের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে? ওদের বুকেও কি বয়ে যায় পাহাড়ি নদীর মতো নুড়ি পাথরের মধ্যে দিযে বয়ে চলা বন্ধুত্বের স্রোত? সুজন মাথার উপর ঝোলানো তারার শামিইয়ানা ছেড়ে নেমে আসে ছাদ থেকে নিজের অন্ধকার ঘরে।

মাথার ভিতরের টিশটিশ করা ব্যথাটা যেন ঘুমের দেশে ডেকে নিয়ে যায়। বিছনাতে শুয়ে আলতো করে চোখের পাতা বন্ধ করতেই যেন অনির্বাণ-ব্রজেশ-ফারুক এসে তার চারপাশ ঘিরে দাঁড়ায। হাসতে হাসতে বলে, একা একা কী করছিস? মন খারাপ, বোর হচ্ছিস? চল আমাদের সঙ্গে। আবার আমরা বন্ধুরা সবাই মিলে একসঙ্গে হুল্লোড় করব, মজা করব।

ওরা সুজনের হাত ধরে টানতে থাকে! মাথার মধ্যে জেগে থাকা টিশটিশ ব্যথাটা হঠাৎ শান্ত হয়ে যায়। সুজন ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা টেনে দুহাত বাড়িয়ে দেয়।

 

 

অপেক্ষা

এটাই লাস্ট সেমিস্টার। সিদ্ধার্থ কিছুটা অধৈর্য হয়ে উঠছিল ধীরে ধীরে। বিবিএ পাশ করে ইচ্ছে ছিল এমবিএ-টা করে নেবে কিন্তু টাকা কোথায়? বাবা চাকরি থেকে রিটায়ার করেছেন। চাকরি থাকতেই বড়ো দুই দিদির বিয়ে শুধু বাবা দিতে পেরেছিলেন, তাও পিপিএফ থেকে বড়ো একটা অঙ্কের টাকা বার করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। ছোড়দির বিয়ে দুমাস পরেই মা-ও হঠাৎই মারা যান।

বাবার পেনশনের টাকায় ওদের দুজনের ভালোমতোই চলে যায় সেটা সিদ্ধার্থ জানে। বাবার কথাতেই বিবিএ পড়তে ও রাজি হয়ে গিয়েছিল। সিদ্ধার্থ ভেবেছিল বিবিএ করে ব্যাবসার কিছু কিছু ও জেনে যাবে। সুতরাং চাকরি না পেলেও ক্ষতি নেই, কিছু একটা ব্যাবসা শুরু করবে। টাকা রোজগার করতে আরম্ভ করলে এমবিএ-টাও করে নেবে। বাবা অবশ্য সিদ্ধার্থকে বলে রেখেছেন, ওর প্রয়োজন পড়লে পড়াশোনার জন্য বাড়িটা বন্ধক রাখতেও রাজি আছেন। ওদের এই একটাই সম্বল, ঠাকুরদার বাবা এই বাড়িটা তৈরি করে গিয়েছিলেন।

এইসব নানা কথা ভাবতে ভাবতেই সিদ্ধার্থ বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ-ই তার চোখে মুখে, কিছুটা জলের ছিটে এসে স্বপ্নভঙ্গ করল। বর্ষাকাল নয়, আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিটেফোঁটা মেঘও সে দেখতে পেল না। আবার একটু জলের ছিটে তার মাথায় আর মুখে এসে লাগল। উপরের দিকে তাকাতে গিয়ে নজর পড়ল যেখানে ও দাঁড়িয়ে ঠিক তার পাশের বাড়ির দোতলায় দাঁড়িয়ে একটি মেয়ে বারান্দায় তোয়ালে দিয়ে নিজের ভিজে চুল ঝাড়ছে।

চোখাচোখি হতেই মেয়েটির মুখে লজ্জিত হাসি ফুটে উঠল। ধীর স্বরে কিছু একটা বলল, যেটা সিদ্ধার্থর কানে এসে পেঁছোল না। তবে ওর মনে হল মেয়েটি সরি বলছে। সিদ্ধার্থর মাথায় একটু দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল। সে হাত তুলে মেয়েটিকে আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে বলল, না না ঠিক আছে তবে আপনার হাসিটা কিন্তু বড়ো অমায়িক। আর একবার প্লিজ হেসে দিন।

সিদ্ধার্থের কথা শুনে মেয়েটি জোরে হেসে উঠল। তারপর হঠাৎই নিজের ব্যবহারে লজ্জিত হয়ে ভিতরে চলে গেল। সিদ্ধার্থও নিজের মুগ্ধতা কাটিয়ে আবার হাঁটা শুরু করল।

এই ঘটনার দুদিন পর ওই একই রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে নিজের অজান্তেই সিদ্ধার্থর চোখ চলে গেল আগের দিনের মেয়েটি যে-বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল, সেই বারান্দার দিকে। দেখল মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আজ চুল বাঁধা আছে বলেই মনে হল সিদ্ধার্থর। হঠাৎই মেয়েটির চোখ পড়ল সিদ্ধার্থর উপর আর সঙ্গে সঙ্গে ওর সুন্দর মুখশ্রী মৃদু হাসিতে ঝলমল করে উঠল। অদ্ভুত এক ভালোলাগায় সিদ্ধার্থর বুক ভরে উঠল। এই অনুভূতি আগে কোনওদিন সিদ্ধার্থ অনুভব করেনি। এরপর প্রায় দুই সপ্তাহ মেয়েটিকে দেখতে পেল না সে।

হঠাৎই একদিন বাজারে গিয়ে আবার মেয়েটির মুখোমুখি হল। মেয়েটি সবজি কিনতে ব্যস্ত ছিল, ফলে সিদ্ধার্থকে দেখতে পায়নি। সিদ্ধার্থ-ই সাহস করে এগিয়ে গিয়ে প্রথম কথা বলল, কযেদিন আপনাকে দেখতে পাইনি, কোথাও গিয়েছিলেন বুঝি?

চমকে তাকাতেই সিদ্ধার্থর দিকে চোখ পড়ল মেয়েটির। সঙ্গে সঙ্গে একমুখ হাসি নিয়ে সে জবাব দিল,হ্যাঁ , ছুটি ছিল। দিদির কাছে বেড়াতে গিয়েছিলাম। গতকালই ফিরেছি।

সিদ্ধার্থ ভাবতেই পারেনি মেয়েটি ওর প্রশ্নের উত্তর এত সাবলীল ভঙ্গিতে দেবে। মেয়েটির হাতে দুটো ব্যাগ-ভর্তি সবজিপাতি ছিল। মেয়েটি দুই হাতে ব্যাগদুটো ভাগ করে নিয়ে সিদ্ধার্থের সঙ্গে হাঁটতে শুরু করল। সিদ্ধার্থ ওর হাত থেকে ব্যাগ নেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু মেয়েটি কিছুতেই রাজি হল না, না না আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমার দুটো ব্যাগ নিতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। বাড়ি তো কাছেই আর অসুবিধা বোধ করলে একটা রিকশা নিয়ে নেব।

মেয়েটির কথায় সিদ্ধার্থ আমল না দিয়ে ওর হাত থেকে একটা ব্যাগ একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে নিজের হাতে নিল, আরে এতে কষ্টের কী আছে? আর রিক্শার পয়সা বাঁচিযে রাখুন, চা খাওয়া যাবে।

বলতে বলতেই সামনে চায়ের দোকান দেখে সিদ্ধার্থ বেঞ্চের উপর সবজির ব্যাগ নামিয়ে রেখে দুটো স্পেশাল চায়ের অর্ডার দিল। চা খেতে খেতে দুজনে নিজেদের মধ্যে পরিচয় আদান-প্রদান করে নিল। মেয়েটি জানাল তার নাম সুলগ্না। মায়ের সঙ্গে থাকে। বাবা অনেকদিন হল মারা গেছেন। কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা করে একটি প্রাইভেট স্কুলে কর্মরতা। সিদ্ধার্থও নিজের পড়াশোনা আর ভবিষ্যতের ইচ্ছের কথা মন খুলে মেয়েটিকে জানাল। চায়ের পয়সা দেওয়ার জন্য পার্স বের করতেই মেয়েটি সিদ্ধার্থের হাত চেপে ধরল, রিকশার টাকা বেঁচে গেছে সুতরাং চায়ের টাকা আমি দেব।

সুলগ্নার চায়ের টাকা দিয়ে দেওয়াটা সিদ্ধার্থর ভালো লাগল না। তবুও সে আর কিছু বলল না। দাম মিটিয়ে বাড়ির পথ ধরল ওরা। প্রথমে সুলগ্নার বাড়ি। বাড়ির দরজায় এসে সিদ্ধার্থর হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ওকে থ্যাংকস জানিয়ে সুলগ্না বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল। সিদ্ধার্থ নিজের বাড়ির দিকে পা চালাল।

এরপর প্রায়শই সুলগ্না আর সিদ্ধার্থ বাড়ির বাইরে দেখা করতে শুরু করল। সুলগ্নার ভালো চাকরি ছিল ঠিকই কিন্তু সিদ্ধার্থ কিছুতেই মনের মতো চাকরি পাচ্ছিল না। বিবিএ-র রেজাল্ট তার ভালো হওয়া সত্ত্বেও যে-চাকরিগুলো পাচ্ছিল সেগুলো কম মাইনের। ব্যাবসা শুরু করার কথাও মাথাতে ছিল সিদ্ধার্থর। সুলগ্নাও সবসময় ওকে উৎসাহ জোগাতে থাকত, নানা লোকের উদাহরণ দিত, যারা জীবনের প্রথমে কঠিন সংঘর্ষ করলেও পরে তারা সকলেই জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

সিদ্ধার্থ দিনের অনেকটা সময় ল্যাপটপে কাটিয়ে দিত চাকরি খুঁজতে আর নয়তো বিকল্প কোনও ব্যাবসার সন্ধানে। মাঝেমধ্যে সুলগ্নার সঙ্গে ওর বাড়িতেও যেত সিদ্ধার্থ। সুলগ্নার মা ওকে খুবই স্নেহ করতেন। একদিন সুলগ্না এসে জানাল যে, ওদের স্কুলে প্রাইভেটে কম্পিউটার ক্লাস খোলার কথা চলছে, যার জন্য অনেক কম্পিউটার একসঙ্গে স্কুল কিনবে। এই সংক্রান্ত একটা প্রোজেক্ট রিপোর্ট আর টেন্ডার তৈরি করতে বলে, সুলগ্না।

সিদ্ধার্থর কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনের কোর্স করাই ছিল এবং পড়ার সময় টেন্ডার, মার্কেটিং বিষয়ে অনেক কিছু শিখেও ছিল। সিদ্ধার্থর বাবা ছেলেকে এই সুযোগ না ছাড়ার পরামর্শ দিলেন।

সিদ্ধার্থ টেন্ডার ভরল। ভাগ্যও ওর সহায় ছিল। জীবনে প্রথম সুযোগ পেল ভালো কিছু করে দেখানোর। সিদ্ধার্থর টেন্ডার পাস হয়ে গেল। সুলগ্নাদের স্কুলের অনেকগুলো ব্রাঞ্চ ছিল সারা রাজ্যজুড়ে এবং এই কম্পিউটার প্রোজেক্টটার প্রধান ইনচার্জ ছিলেন সুলগ্নার স্কুলের প্রিন্সিপাল। প্রিন্সিপাল সিদ্ধার্থ-কে ডেকে জানালেন, তিনি সিদ্ধার্থর কাজে খুশি হলে রাজ্যের বাইরে তাঁদের যতগুলি স্কুল আছে সেখানেও সিদ্ধার্থর নাম রেকমেন্ড করবেন। যখন তাদের স্কুলেও একই প্রোজেক্ট নিয়ে কাজ শুরু হবে, তখন সিদ্ধার্থর কাজের আরও সম্ভাবনা বাড়বে।

সুলগ্নার সঙ্গে দেখা হলে সিদ্ধার্থ ওকে জানাল, সুলগ্না, আমি কিন্তু টিচার হতে চাই না। আমি একটা কাজ করে দিতে পারি, সেটা হচ্ছে কম্পিউটারগুলো ইন্সটল করে নেটওয়ার্কিং ইত্যাদি। এরপর বেসিক-টা না হয় একজন টিচার এবং কযেজন স্টুডেন্টকে শিখিয়ে দেব। তারপর তোমরা কী করে এগোবে সেটা কিন্তু সম্পূর্ণ তোমাদের দায়িত্ব। এই নিয়ে তোমার স্কুলের সঙ্গে কোনও কথা হয়নি।

ঠিক আছে, তুমি আমাকে পুরোটা শিখিয়ে দিও। আমারও কম্পিউটার নিয়ে অল্প পড়াশোনা আছে সেটা তুমি ভালো করেই জানো।

এই প্রথম কাজটাতেই সিদ্ধার্থ আশাতীত সাফল্য পেল। সিদ্ধার্থর কাজে প্রিন্সিপাল এতটাই খুশি হলেন, তিনি সিদ্ধার্থকে বাকি বারোটা স্কুলের টেন্ডার জমা দিতে বললেন। সুযোগটা পেয়ে সিদ্ধার্থর আনন্দের সীমা থাকল না। খবরটাতে সিদ্ধার্থর বাবাও অত্যন্ত খুশি হলেন। তিনি ছেলেকে ডেকে বললেন, মেয়েটি তোর জন্য অত্যন্ত শুভ। ওর সঙ্গে আলাপ হতে না হতেই এত বড়ো কাজটা হাতে পেলি। আমার মনে হয় সিদ্ধার্থ তোরা দুজনে একসঙ্গে মিলে কাজটা কর। একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, সিদ্ধার্থ, এটা আমার মনের কথা, মেয়েটাকে বড়ো পছন্দ আমার। তোর সঙ্গে ওকে মানাবে ভালো।

সুলগ্নার মায়েরও মনে এই ইচ্ছেটাই শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছিল। সিদ্ধার্থ, সুলগ্নাকে নিজের করে পাওয়ার ইচ্ছে অনেকদিন ধরেই মনের মধ্যে সুপ্ত রেখেছিল, কাউকেই বুঝতে দেয়নি। সে জানত আগে তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, তবেই চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর যোগ্য হয়ে উঠবে।

বাবার আশীর্বাদ আর ব্যাবসায় সাফল্য পেযে সিদ্ধার্থ নিজের বাড়ি থেকেই, নতুন কোম্পানির উদ্বোধন করল, সিদ্ধার্থ ডট কম। বাকি স্কুলের টেন্ডারগুলো আগেই সিদ্ধার্থ ভরে জমা দিয়ে দিয়েছিল। ওই কাজগুলোও সে পেল। ছেলেকে ব্যাবসায় প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে তার বাবা সুলগ্নার মায়ের সঙ্গে দেখা করে, ওদের দুজনের বিয়ের কথা পাকা করে ফেললেন। শুভদিন দেখে ওদের বিয়ের ভালোমতো ব্যবস্থা করলেন। ধুমধাম করে বিয়ে দিয়ে সুলগ্নাকে বাড়ির বউ করে বাড়িতে নিয়ে এলেন।

বিয়ের পর দিনগুলো ভালোই কাটতে লাগল সিদ্ধার্থর। প্রচুর কাজও পেতে আরম্ভ করল সে। কাজের চাপ এতটাই বেড়ে গেল, একা আর সবদিক দেখা তাদের পক্ষে সম্ভবপর হল না। দুজন লোক রাখতে সিদ্ধার্থ বাধ্য হল। বাড়ি থেকে অফিস শিফট করে একটু বড়ো জায়গা নিল ভাড়ায়। বাইরের ঘরটায় দুজন স্টাফের বসার বন্দোবস্ত করল আর ভিতরের ঘরটায় নিজের বসার। প্রয়োজনমতো অফিসটাকে কাজের জন্য গুছিয়ে সাজাল। সুলগ্নাও সময় করতে পারলে মাঝেমধ্যেই সিদ্ধার্থর অফিসে চলে আসত তার কাজে সাহায্য করতে। বেশ সুখেই কাটতে লাগল তদের দাম্পত্য জীবন।

দুবছর এ ভাবেই কাটার পর সুলগ্না সন্তানসম্ভবা হল। সিদ্ধার্থর জীবনে নতুন করে আনন্দর জোয়ার সব বাধা অতিক্রম করে গেল। কাজের চাপে বাড়িতে আগে বেশি সময দিতে পারত না সে। এখন সেই সিদ্ধার্থই কাজ ফেলে সুলগ্নার কাছাকাছি সবসময় থাকার চেষ্টা করতে লাগল, যাতে সুলগ্নার যত্নের কোনও ত্রুটি না হয়। বরং সুলগ্নাই বকাবকি করত সিদ্ধার্থর এই অবুঝ ব্যবহারের জন্য, আমি কি পালিযে যাচ্ছি নাকি আমি নিজের যত্ন ঠিক করে নিতে পারব না? তুমি কাজ ফেলে বাড়িতে সময বেশি দিচ্ছ, এটা ঠিক হচ্ছে না। এতে তোমার কাজের ক্ষতি হবে।

সিদ্ধার্থও বুঝত এতে কাজের ক্ষতি হচ্ছে। বাজারে একবার বদনাম হয়ে গেলে কেউ তাকে আর কাজ দেবে না। কিন্তু তাও নিজেকে শোধরাবার চেষ্টা করল না সে। এরই মধ্যে সুলগ্নার মা হঠাৎই মারা গেলেন। সুলগ্না শোকে যেন পাথর হয়ে গেল। দুর্ভাগ্যবশত গর্ভাবস্থা চারমাসে পড়তেই সুলগ্নার মিসক্যারেজ হয়ে গেল। এই ঘটনার পর সে পুরোপুরি ডিপ্রেশনে ডুবে যেতে থাকল।

এমন দুঃসময়ে সিদ্ধার্থ আরও বেশি করে সুলগ্নার কাছে থাকতে শুরু করল। সুলগ্না চেষ্টা করত নিজে থেকেই ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠতে। সিদ্ধার্থকেও বোঝাবার চেষ্টা করত কাজে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সিদ্ধার্থর সেই এক গোঁ, তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাও, তারপরেই আমি কাজে যাব।

সিদ্ধার্থ কারও কথা শুনল না। এই করে তার প্রোজেক্টগুলোও ডেডলাইন মিস করতে লাগল। নতুন কাজ আসা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। পুরোনো ক্লায়েন্টরাও আর তার উপর ভরসা রাখতে পারল না। সুলগ্নার শরীর ধীরে ধীরে ঠিক হতে আরম্ভ করলেও সিদ্ধার্থর ব্যাবসার ভরাডুবি ঘটল।

দুজন স্টাফকে ছাঁটাই করতে বাধ্য হল সিদ্ধার্থ। ভাড়ার অফিস ছেড়ে দিয়ে আবার বাড়ি থেকেই কাজ করা আরম্ভ করল সে। তবে কাজ বলতে, এখন নতুন কাজের অনুসন্ধান। কারণ সিদ্ধার্থর হাতে কোনও কাজই ছিল না। সুলগ্নাও তাকে নতুন কাজ খোঁজার জন্য চাপ দিতে শুরু করল। এটা সিদ্ধার্থর কিছুতেই সহ্য হতো না, সম্মানে বাধত। এতদিন সে সবাইকে কাজ দিয়ে এসেছে, এখন লোকের দরজায় কড়া নেড়ে কাজ খুঁজতে যাওয়াটায় তার অপমান বোধ হতো। মনে হতো এটা নিয়ে সুলগ্নার সঙ্গে ওদের যত দ্বন্দ্বের সূত্রপাত।

একদিন কাজের সন্ধানে বেরিয়ে বাড়িতে ফিরে সিদ্ধার্থ দেখল সুলগ্না বাড়িতে নেই। টেবিলে তার লেখা একটা কাগজ পড়ে আছে। তাতে লেখা, আমি তোমাকে ছেড়ে, এমনকী এই শহর ছেড়েও চলে যাচ্ছি। আমাকে নিয়ে চিন্তা করা ছেড়ে দাও। আমি তোমার জীবনে ফিরে আসব কিনা এখনই বলতে পারছি না। তবে প্রতি মুহূর্তে তোমার কথা আমার মনে পড়বে এবং এটাই আমার বেঁচে থাকার জন্য যথেষ্ট। একটা কথা মনে রেখো সিদ্ধার্থ জীবন কাটানো খুব সহজ কাজ নয়। লড়াই ছাড়া কেউ প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না। সোনাকেও আগুনে পুড়িয়ে হাতুড়ির বাড়ি মেরে তবেই আকার দেওয়া যায়। তুমিও চেষ্টা ছেড়ো না। পরিশ্রম করে যাও, ফল একদিন পাবেই, এই আমার বিশ্বাস। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি যাতে জীবনে তুমি সফল হও। তোমার জন্য রইল আমার শুভকামনা।

এত বড়ো আঘাতের জন্য সিদ্ধার্থ প্রস্তুত ছিল না। সুলগ্না কেন এই সিদ্ধান্ত নিল কিছুতেই বোধগম্য হল না সিদ্ধার্থর। বাবাকেও জিজ্ঞেস করল, সুলগ্না কিছু বলেছে কিনা কিন্তু বাবাও মাথা নাড়লেন। সিদ্ধার্থর মতো তিনিও সম্পূর্ণ অন্ধকারে।

আঘাতের উপর আঘাত। খড়কুটোর মতো একমাত্র বাবাকেই আঁকড়ে ধরল সিদ্ধার্থ, ডুবন্ত জাহাজের নাবিকের মতো। সুলগ্নার স্কুলে খোঁজ করেও তার কোনও ঠিকানা জোগাড় করতে পারল না। তার মনে আশা ছিল অন্য শহরের ব্রাঞ্চে হয়তো সে ট্রান্সফার নিয়েছে। কিন্তু সেখানেও আশাহত হতে হল। কাজে কিছুতেই মন বসাতে পারছিল না সিদ্ধার্থ। বাবা পরামর্শ দিলেন, এক কাজ কর সিদ্ধার্থ, কাজের ব্যাপারে এখন ভাবা ছেড়ে দে, বরং ম্যানেজমেন্ট-টা করেনে। গ্র‌্যাজুয়েশন তো করাই আছে, মাস্টার্স কমপ্লিট কর। তাহলে মাস্টার্সের পর অনেক দিক তোর কাছে খুলে যাবে। আমি, বাড়ি বন্ধক রেখে তোর পড়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।

পড়াশোনায় বরাবরই সিদ্ধার্থ ভালো ছিল। সুতরাং কটা মাস প্রচণ্ড পরিশ্রম করার পর পরীক্ষা দিয়ে আহমেদাবাদে আইআইএম-এ ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেল। নিজেকে পড়াশোনার মধ্যে ডুবিয়ে দিল সে। পড়তে পড়তেই দ্বিতীয় বছরেই একটা নামি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে ভালো প্লেসমেন্ট পেয়ে গেল সিদ্ধার্থ। পড়া শেষ হতেই ছয় মাসের জন্য কোম্পানি তাকে লন্ডন পাঠাল ট্রেনিংয়ের জন্য। কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী ট্রেনিংয়ের পর ইচ্ছেমতো বিদেশে ওদের যতগুলো অফিস আছে, সেখান থেকে বেছে কোনও একজায়গায় সিদ্ধার্থ চাকরি করার সুযোগ পাবে।

লন্ডনে তিন বছর চাকরি করে সে আরও অনেক জায়গায় পোস্টিং পেল। দুই-তিন বছর পর পরই ওকে জার্মানি, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া পোস্টিং দেওয়া হল আর সঙ্গে প্রতিবারই প্রোমোশন। এভাবেই দশ-দশটা বছর কাটিয়ে ফেলল সিদ্ধার্থ। প্রথম প্রথম সুলগ্নার কথা খুবই মনে পড়ত। কিন্তু প্রোমোশনের সঙ্গে সঙ্গে টার্গেট পুরণ করার চাপে সিদ্ধার্থ তার নিজের জীবন সম্পর্কে ভাবার আর সময় পেত না। বাবার সঙ্গে ফোনে মাঝেমধ্যে কথা হতো।

দু-তিন বছর পর পর সময় করে বাবাকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে দেখে যেত। মনের মধ্যে শুধু একটা ক্ষীণ আশা বেঁচে ছিল যে, হযতো কোনও এক দিন সুলগ্না আবার তার জীবনে ফিরে আসবে।

সিদ্ধার্থদের কোম্পানি মুম্বইতে একটা নতুন ব্রাঞ্চ খোলার পরিকল্পনা নিলে, ঠিক হয় সিদ্ধার্থকে ওই অফিসের চিফ করে পাঠানো হবে। অফিস পুরো সেট-আপ হয়ে গেলে সিদ্ধার্থর এক জুনিয়র কলিগকে মুম্বই পাঠায় কোম্পানি, ওখানকার সব কাজ সুষ্ঠু ভাবে তদারকি করার জন্য। নতুন অফিসের জন্য কিছু সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়রের প্রয়োজন ছিল। এটার জন্য সিদ্ধার্থর জুনিয়র কলিগই প্রথম রাউন্ড ইন্টারভিউ নিয়ে তার সম্পূর্ণ ডিটেলস সিদ্ধার্থকে পাঠিয়েরাখত। ফোন এবং ভিডিও কনফারেন্সে ফাইনাল ইন্টারভিউ করার দায়িত্ব সিদ্ধার্থর উপরে ছিল।

মোট বারো জনের লিস্ট তৈরি করে সিদ্ধার্থকে পাঠানো হলে, লিস্ট দেখে ও চমকে উঠল। প্রথম নামটাই সুলগ্নার। বারোজনের মধ্যে সাতজনকে সিলেক্ট করার দায়িত্ব তার কাঁধে। প্রথমে সন্দেহ ছিল অন্য কোনও সুলগ্না হবে হয়তো কিন্তু সিভি দেখার পর সে নিশ্চিত হয়ে গেল, এ তারই সুলগ্না। সে এমসিএ করে গত ছবছর ধরে একটি কোম্পানিতে সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়র হিসেবে কাজ করছে।

সিদ্ধার্থ ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সুলগ্নার ফাইনাল ইন্টারভিউ নিল। এই দশ বছরে সিদ্ধার্থ দাড়ি রাখতে আরম্ভ করেছিল, চোখে চশমা উঠেছিল। কানের পাশের চুলগুলো সব সাদা হয়ে গিয়েছিল। আগের সিদ্ধার্থকে চেনার কোনও উপায় ছিল না। অফিসকেও ইন্সট্রাকশন দেওয়া ছিল যেন সিদ্ধার্থের নাম প্রকাশ না পায়। শুধু চিফ এগজিকিউটিভ বলেই সুলগ্নাকে জানানো হয়।

বহুদিন পর সুলগ্নাকে দেখে সিদ্ধার্থ চোখের জল লুকোতে পারল না। সুলগ্না আগের মতোই সুন্দর আছে। নিজেকে খুব ভালো মেইনটেন করেছে। সিদ্ধার্থও সিলেকশন লিস্টের প্রথমে সুলগ্নার নামটাই রাখল। ওকে এখনও ভালোবাসে বলে নয় বরং পোস্টটার জন্য ওর যোগ্যতাই সবচেয়ে বেশি বলে।

মুম্বই অফিস সেট করার জন্য সিদ্ধার্থের যে-কলিগ গিয়েছিল, সে কোম্পানিতে জুনিয়র হলেও সিদ্ধার্থর অতীত সম্পর্কে সে সবই জানত। অফিসের বাইরে ওরা বন্ধুই ছিল। ওকে সিদ্ধার্থ জানাল যে, এই সুলগ্নাই তার এক সময়ের স্ত্রী। ভাগ্য আজ আবার দুজনকে মুখোমুখি এনে ফেলেছে।

তাকে অনুরোধ করল সিদ্ধার্থ, সুলগ্নার মনের কথা যদি কোনও ভাবে জানতে পারে, তাহলে যেন অবশ্যই তাকে জানায়। কিন্তু কাজটা এমন ভাবে করতে হবে যাতে সুলগ্নার মনে কোনও সন্দেহ না জাগে।

কিছুদিন পরেই সিদ্ধার্থ জানতে পারল, সুলগ্না আজও সিংগল। ওর ফ্যামিলি বলতে ও একাই। তবে সুলগ্না আজও নিজেকে বিবাহিতাই মনে করে। যদিও দশ বছরের উপর হয়ে গেছে স্বামীর সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। সে নাকি আজও সিদ্ধার্থকেই সম্মান করে, ভালোবাসে। সে চেয়েছিল সিদ্ধার্থ জীবনে অনেক উন্নতি করুক, যেটা তার জন্যই সম্ভব হচ্ছিল না। সে সিদ্ধার্থর উন্নতির পথে কাঁটা হয়ে উঠেছিল। তাই ভালোর জন্যই সিদ্ধার্থকে ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু এই দশ-বারো বছরে দূরত্ব এতটাই বেড়ে গেছে যে, সিদ্ধার্থ কোথায় আছে, কী করছে জানার কোনও উপায়ই তার ছিল না,কারণ ততদিনে সিদ্ধার্থরা বাসস্থান বদলে ফেলেছে।

সুলগ্না শুধু এটুকুই জেনেছিল মুম্বই-তে তার যে ইন্টারভিউ নিয়েছে সেই ভদ্রলোক সিদ্ধার্থর পুরোনো বন্ধু। সুলগ্নাকে জিজ্ঞেস করেছিল সে, আমার বন্ধুর সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায় তাহলে আপনি কি তার কাছে ফিরে যাবেন? তাতে সুলগ্না বলেছে, আমার ছেড়ে যাওয়াতে যদি সিদ্ধার্থ নিজের পথ খুঁজে পেয়ে জীবনে সফল হয়ে থাকে, তাহলে বুঝব আমার এই ত্যাগ স্বীকারই সত্যি করে একজন মানুষের জীবন তৈরি করে দিতে পেরেছে। আমি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করব।

কিন্তু সে কোথায় রয়েছে আজকাল? আমি শুনেছিলাম যে, এমবিএ করে বিদেশ চলে গেছে? সুলগ্না জানতে চেয়েছিল।

বন্ধুটির উত্তর ছিল, আমিও ঠিক জানি না। তবে কোনও খবর জানতে পারলে আপনাকে নিশ্চয়ই জানাব কথা দিচ্ছি। এরপর জয়েনিং লেটার তৈরি করে সুলগ্নার হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল।

আজ শুক্রবার, আপনি সোমবার থেকে কাজে জয়েন করুন। আমাদের চিফ-ও উইক-এন্ডে মুম্বই পৌঁছোবেন। সোমবার থেকে উনিও এখানে অফিস জয়েন করবেন। শেষ অবধি এই কথাই হয়েছিল ওদের দুজনের মধ্যে।

সোমবার সিদ্ধার্থ নিজের কেবিনে বসেছিল।  তার পিএ ফোনে জানাল, স্যার, সুলগ্না ম্যাম হ্যাজ কাম। শি ইজ গোয়িং টু রিপোর্ট ইউ।

প্লিজ সেন্ড হার ইন।

গুড মর্নিং স্যার। দিস ইজ সুলগ্না, ইয়োর কোম্পানিজ নিউ সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়র, সুলগ্না জানাল।

ওয়েলকাম ইন আওয়ার ফ্যামিলি।

আমার কোম্পানিই আমার এখনকার ফ্যামিলি।

সুলগ্না এখনও সিদ্ধার্থকে চিনতে পারল না, এতটাই পরিবর্তন হয়েছিল তার চেহারায়। সিদ্ধার্থই বলল, আপনি আপনার কেবিনে গিয়ে বসুন। আপনাকে কাজ বুঝিযে দেওয়া হবে। কাল সকালে যখন আসবেন, আমি বাকি সব কাজ বুঝিযে দেব।

পরের দিন সিদ্ধার্থ কেবিনের সামনে নিজের নেমপ্লেট সিদ্ধার্থ সেন ঝুলিয়ে  দিয়ে চেয়ারে এসে বসল। আজ সে ক্লিন শেভ হয়ে অফিস এসেছে। সুলগ্না নক করে কেবিনে ঢুকতেই সিদ্ধার্থকে দেখে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। আজ আর সিদ্ধার্থকে চিনতে কোনও অসুবিধাই হচ্ছে না। অস্ফুটে সুলগ্না বলে উঠল, সিদ্ধার্থ তুমি?

দরজার বাইরে নেমপ্লেট দ্যাখোনি?

ঠিক খেয়াল করিনি।

সুলগ্না, এটাই আমার কোম্পানি, আমার ফ্যামিলি। আজ থেকে তুমিও এই ফ্যামিলির একজন বিশিষ্ট সদস্য। আমার আশা ছিল একদিন না একদিন তুমি নিশ্চয়ই ফিরে আসবে। তোমাকে ছাড়া অন্য কারও কথা আমি কোনওদিন ভাবতেই পারিনি।

কিন্তু তুমি… সুলগ্না থেমে যায়।

হ্যাঁ সুলগ্না, আমার এই বন্ধুই তোমার সম্পর্কে সব জানায় আমাকে, বিশেষ করে আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কারণ। তোমার আত্মত্যাগের জন্যই আজ আমি সাফল্যের চূড়া, ছুঁতে পেরেছি। এর পুরো ক্রেডিট তোমার প্রাপ্য।

সিদ্ধার্থ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সুলগ্নাকে কাছে টেনে নিয়ে ওর চুলে মুখ রাখে। কাচের দরজার বাইরে কলিগের সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সিদ্ধার্থ আর ওর বন্ধুর মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে। হাতে থামস আপ সাইন দেখিয়ে সিদ্ধার্থের কলিগ দুজনকে একটু একা থাকার সুযোগ দিয়ে ওই ঘরটা ছেড়ে চলে যায়।

ফিরে এসো পিউ

‘তোর একটা কবিতায় দেখলাম লিখেছিস, ‘সাদা তালের মতো তুলতুলে। তুই দেখেছিস কোনও সাদা তাল?’

‘না, মানে…’ তো তো করতে থাকে পথিক।

‘তোকে বলেছি না, যা দেখিসনি তা নিয়ে লিখবি না, ভুল লিখবি…’

একমুখ ধোঁয়া হতভম্ব পথিকের মুখের উপর দিয়ে আকাশে ছুড়ে দেয় লেনাদি। বয় কাট চুল, টিকালো নাক, ধারালো মুখ, সাদা শার্ট আর নীল ফেডেড জিন্স পরা লেনাদি, কলেজের মারকাটারি সুন্দরীদের মধ্যে একজন।

‘দেখিসনি তো…?’ গলার স্বর খাদে নামিয়ে লেনাদি বলল, ‘আমি দেখাব তোকে…।’ বলেই স্কুটিতে চড়ে সাঁ করে বেরিয়ে গেল কলেজ থেকে।

হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পথিক!

একদিন এতটা লাজুক ছিল সে, মুখে ভালোবাসার কথাও কাউকে বলতে পারেনি। তখন ইলেভেন চলছে। সে এক নভেম্বরের সকালবেলা। পিউ টিউশানি যাচ্ছে। পথিক পিছু পিছু হাঁটছে। আর তার বুকের মধ্যে ধুকপুকুনি। হাতে রাখা চিরকুট ঘামে ভিজছে। নির্জন জায়গার অপেক্ষায়।

ফলো করে কিছুটা যাবার পর পিউ বুঝতে পারে পথিক ওকে অনুসরণ করছে। ও ঘুরে দাঁড়ায়।

‘কী রে পথিক, তুই এই রাস্তায়…কোথায় যাবি?’

‘তোর সাথে একটা কথা ছিল…’

‘ওহ, হ্যাঁ, বল…’

চিঠিটা হাত বাড়িয়ে এগিয়ে দেয় পথিক। ‘এটা একটু পড়ে দ্যাখ।’

পথিক মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল দুরুদুরু বুকে। এভাবে আগে কেউ কাউকে প্রোপোজ করেছে কি না তার জানা নেই। চিঠিতে লেখা ছিল ‘আই লভ ইউ, পিউ’ ব্যস, এতটুকুই।

‘তুই এই কথাটা তো আমাকে মুখেও বলতে পারতিস…’

প্রায় তিরিশ সেকেন্ড পর স্তব্ধতা ভেঙে বলেছিল পিউ।

ওদিকে তখন পথিকের বুকে অবিরাম হাতুড়ি পেটা চলেছে। তার পরের শব্দগুলো শোনার জন্য।

‘দ্যাখ, আমি তোকে বন্ধুর মতো দেখি। তোর সাথে আমার সম্পর্কটা বন্ধুর মতো থাকলেই ভালো!’

হিমালয়ের চূড়া থেকে কোন অতল খাদের গভীরে যেন তলিয়ে যেতে লাগল পথিক। শরীর যেন ভারশূন্য পালকের মতো ভাসছে। যে-কোনও দিকেই উড়ে চলে যেতে পারে। শহরের সব শব্দ, সব কোলাহল যেন তার কানের তিন ফুট দূরে এসে থমকে গেছে। আর কিছুই শুনতে পাচ্ছে না পথিক। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে ছিল সে, জানে না। আবার সম্বিত ফেরে পিউ-এর কথায়। ‘সরি, কিছু মনে করিস না। টিউশনির দেরি হচ্ছে, চলি…’

চলে গেছিল পিউ। আর তখনই মুখ তুলে তাকিয়ে ছিল পথিক। নাহ, পিউ আর পিছন ফিরে তাকায়নি। মেয়েরা সত্যিই কখনও পিছন ফিরে তাকায় না…

‘কী রে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অত কী ভাবছিস?’ দূর থেকে হাঁক দেয় সঞ্জয়দা ‘ইউনিয়ন রুমে আয়, কথা আছে।’

লেনাদির আহ্বানে মশগুল থাকা পথিক চমকে ওঠে। লেনাদির সাথে পথিকের পরিচয়ও ইউনিয়ন রুমেই। তখন ওরা সদ্য ঢুকেছে। ফ্রেশারস ওয়েলকাম হয়নি তখনও।

দুই

কলেজ শুরুর প্রথম দিনই পিউকে দেখেছিল পথিক। ও উইমেন্স এ ভর্তি না হয়ে বিবেকানন্দে ভর্তি হয়েছে, জেনে ভিতরে ভিতরে খুশিই হয়েছিল। তবে পিউ কে সিগারেট খেতে দেখে খুব অবাক হয়েছিল।

 

কলেজে গিয়ে তার মনে হয়েছিল পুকুর থেকে যেন সমুদ্রে এসে পৗঁছেছে। গার্জেনদের চোখ রাঙানি নেই, মাস্টারমশাইদের শাসন নেই। হঠাৎ এতটা স্বাধীনতা পেয়ে গিয়ে বেশ মজাই লাগছিল পথিকের।

 

পথিক ভেবেছিল পড়াশোনার সাথে হালকা করে থাকবে ছাত্র রাজনীতিতে। আর সবাই যেমন থাকে। কিন্তু ইউনিয়ন রুমের মোহ ক্রমশ বাড়তে থাকে তার কাছেও। কারণ পিউও সেখানে যাতায়াত শুরু করেছে ততদিনে। স্কুলের রাজনীতি-নির্বোধ ছেলেগুলো এখানে এসে কীভাবে তুখোড় নেতা হয়ে ওঠে, সে দেখতে থাকে চোখের সামনে।

 

সঞ্জয়দা তখন নতুন ব্যাচকে সমাজতন্ত্রে দীক্ষিত করতে উন্মুখ। কলেজ শুরুর দু’একদিনের মধ্যেই ফাঁকা ক্লাসগুলোয় গিয়ে শুরু করল রুম মিটিং। তারপর ইউনিয়ন রুমে নিরন্তর দীক্ষাদান তো আছেই।

 

‘শোন, সেকেন্ড ইয়ার, থার্ড ইয়ারে অলরেডি আমাদের তৈরি ছেলেরা আছে। সে নিয়ে চিন্তা নেই। এই যে ফ্রেশ মাইন্ডগুলো স্কুল পেরিয়ে কলেজে এল, এদের মাথায় কোনও পলিটিক্যাল থট নেই। অন্য কেউ চষে দেবার আগে রাজনীতির বীজটা আমাদের পুঁতে দিতে হবে। দেখতে হবে আমাদের ছেড়ে কেউ অন্যদিকে চলে না যায়…’

 

সিগারেট ধরিয়ে নিজের মার্ক করা চেয়ারে বসে ধোঁয়া ছাড়ল সঞ্জয়দা। বাকিরা উলটো দিকের সারি সারি চেয়ারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা। কয়েকজন নীচে পাতা ম্যাট্রেসের উপর গোল হয়ে বসে ওয়াল ম্যাগাজিনের ছবি অাঁকছে।

 

‘আয় লেনা…আয়…এই এদের একটু ক্লাস নিচ্ছিলাম।’

 

লেনা নাম্নি ফরসা, লম্বা, সুন্দরী, জিন্স পরিহিত সঞ্জয়দার সহপাঠিনী কমরেড ইউনিয়ন রুমে ঢুকল। তার সাথে পাঁচটা মেয়ে। সব ফাস্ট ইয়ারের। যাদের মধ্যে পিউ একজন।

 

তাদের দেখিয়ে বলল, ‘এই যে আমার লেডি ব্রিগেড… কী বলছিলি বল, এরাও শুনুক…’

 

‘তোমাদের ক’জনের উপরেই আমরা ভরসা করছি। তোমাদের যে যার নিজের নিজের ক্লাসকে নেতৃত্ব দিতে হবে। তাছাড়াও সার্বিক ভাবে কলেজে পার্টির স্বার্থটা দেখতে হবে।’ সিগারেটে টান দেওয়ার ফাঁকে ফাঁকে যথেষ্ট পজ দিয়ে কথাগুলো আমাদের সবার দিকে ছুড়ে দিল সঞ্জয়দা।

 

ম্যাগাজিনের কাজ করতে থাকা সেকেন্ড ইয়ারের একজন পকেট থেকে বের করে একটা সিগারেট ধরাল। দু’টান দিয়েই পাশের জনকে ধরিয়ে দিল। তারপর এল ফার্স্ট ইয়ারের হাতে। দু’একজন টান দিয়েই কেশে ফেলল। বাকিরা তাই দেখে হাসতে লাগল।

 

দীপাঞ্জন তার কানে কানে বলল, ওটা সিগারেট নয় শালা, ব্যাগড়া ভরা আছে। তাই দু’টান করে দিচ্ছে…’

 

পথিক তখনও ‘ব্যাগড়া’ মানে শোনেনি। পরে জানল গাঁজা ভরা আছে। কলেজের গেটেই ছাত্রদের জন্য নাকি গাঁজা ভরা সিগারেট বিক্রি করা হয়। ছাত্ররা তো আর ক্যাম্পাসে কলকে মুখে দিয়ে গাঁজা টানতে পারে না!

 

কথা শেষ করে সঞ্জয়দা আর লেনাদি ভিতরের কেবিনে গিয়ে বসল। বাইরের ঘরে নতুন পুরোনো ইউনিয়নপন্থী ছাত্র ছাত্রীরা গল্প, গান, কবিতায় মশগুল হয়ে গেল।

 

পথিক যেন সেদিন নতুন করে মানুষ চিনল। মানুষ যে এত ক্যালকুলেশন করে অন্য মানুষের সঙ্গে মেশে, তা ওর অজানা ছিল। কমরেডদের কথা বলা, গল্প করার পিছনেও যে পার্টি তথা সমাজতন্ত্রকে এগিয়ে নিয়ে যাবার তাগিদ থাকে, সে তখনই জানতে পারল।

 

পথিক বারবার পিউয়ের দিকে তাকাচ্ছিল। পিউয়ের কোনও হেলদোল নেই। ও কী অনায়াসে তার এতদিনের সহপাঠী, তার প্রেমে প্রত্যাখ্যাত ছেলেটাকে অগ্রাহ্য করছে! মেয়েরা পারেও বটে!

 

তিন

 

পথিকের কাছে কলেজ আর ইউনিয়ন রুমের আকর্ষণটাই ছিল পিউয়ের জন্য। সারাক্ষণ ক্লাসে মন বসত না। শুধু বসে বসে ওর কথা ভাবত। আর ক্যান্টিন, ইউনিয়ন রুম, লাইব্রেরি, কলেজের মাঠ, শালজঙ্গল যেখানেই ওর দেখা পেত পথিকের শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে যেত।

 

দু’এক বার সামান্য দলবদ্ধ হাই হ্যালো ছাড়া অন্য কথাই বলেনি আজ পর্যন্ত। বর্ধমান শহরের অন্য আর পাঁচটা অচেনা মেয়ের মতোই শীতল সম্পর্কটা। কিন্তু কেন হবে? নিজেকে প্রশ্ন করে পথিক, কিন্তু উত্তর খুঁজে পায় না। ওর সাথে ছ’টা বছর একসাথে পড়ার কোনও রেখাপাতই নেই! পথিকও নাছোড়…। সে নিজেকে বলে এর শেষ দেখবই…কী এমন রহস্য আছে, যে বন্ধু বন্ধুই রয়ে যাবে? প্রেমিক হতে পারবে না!

 

সেদিন ওদের কবিতা পত্রিকার নতুন সংখ্যাটা ইউনিয়ন রুমে কয়েকজন বন্ধুকে দিচ্ছিল পথিক। লেনাদি বলল, ‘পথিক তুই নাকি ‘ভূমি’তে, লিখিস!’

 

‘ওই আর কি…’ মৃদু হেসে জবাব দেয় পথিক।

 

পত্রিকার পাতা ওলটাতে ওলটাতে তার প্রেমের কবিতাটা দেখে বলল, ‘ও! এটা তোর লেখা…?’

 

পথিক ঘাড় নাড়ে।

 

পড়া শেষ করে তার দিকে চেয়ে হাসে লেনাদি। সিগারেটে টান মেরে বলে, ‘উমম্….কী লিখেছিস যেন… ‘তারপর লঘু অথচ গম্ভীর পদক্ষেপে হেঁটে চলে গেলে তুমিয একবারও পিছন ফিরে তাকালে নায সত্যি, মেয়েরা কখনও পিছন ফিরে তাকায় না…!’

 

‘তুই মেয়েদের কী জানিস? অ্যাঁ? এর আগে কটা প্রেম করেছিস? আর এখন তোর কটা গার্লফ্রেন্ড আছে, বল শুনি….’ তর্জনি আর মধ্যমার মাঝে চেপে ধরা সিগারেট নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে লেনাদি।

 

‘এর আগে একটাও প্রেম করেনি’, বলল দীপাঞ্জন।

 

‘আর একটাও গার্লফ্রেন্ড নেই বেচারির’, যোগ করেছিল গণেশ।

 

‘একটাই সরু লাইন করতে গেছিল, মেয়েটি প্রথম দিনই ভাই না বন্ধু কী একটা বলে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছিল।’ হি হি করে হাসে আলতাফ।

 

‘হুম… তোর ক্লাস নিতে হবে রোজ। না হলে মেয়েদেরকে না জেনেই প্রেমের কবিতা লিখতে যাবি, দিয়ে হোঁচট খাবি। আই মিন, ভুলভাল লিখবি। কাল থেকে অফ পিরিয়ডে আমার কাছে আসবি, রোজ আধঘন্টা করে মেয়েরা কী করে, কী চায় তোকে শেখাব…’

 

‘হা হা হি হি…।’ লেনাদির সাথে সবাই যোগ দেয় হাসিতে।

 

ইউনিয়ন রুমে সেদিন অনেকক্ষণ ধরে গান, কবিতা, গল্প হল। পিউ কী রকম একটা গম্ভীর হয়ে বসে রইল। সঞ্জয়দা তার সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন আমাদের চোখে একটু পর পর মাখিয়ে দিতে থাকল।

 

‘শোন, শোন… হো চি মিন বলেছিলেন, ‘পোয়েট্রি মাস্ট বি ক্ল্যাড ইন স্টিল। আ পোয়েট শুড নো হাউ টু ফাইট।’ তোদের ওই শান্তনু রায় এর ছেলে ভোলানো কবিতায় শুধু ‘আমি-তুমি’… এই তো…? এর বাইরে খেটে খাওয়া মানুষের কথা কোথায়! যত বোগাস কবিতা সব!’

 

‘আরে কী বলছ? জানো তুমি লোকটার কী বিশাল ফ্যান

 

ফলোয়িং?’

 

‘রাখ তোর ফ্যান। আগে ভাতের কথা ভাব, তারপর ফ্যান নিয়ে ভাববি। আমার সব ভালো করে পড়া আছে। মানুষে মানুষে সম্পর্ক বলতে উনি বোঝেন প্রেম, অবৈধ প্রেম, ভাই বোনে প্রেম…তোরাও তাই গিলছিস, আর নিজেরাও তেমন লিখছিস…’

 

সেদিন ইউনিয়ন রুম থেকে বেরিয়ে একা একা হাঁটছে পথিক। দ্রুত পা চালিয়ে পাশাপাশি এল পিউ। ‘তুই খবরদার লেনাদির কাছে যাবি না। ফরসা কচি ছেলেদের খুব পছন্দ করে ডাইনিটা। আর ব্যাগে সবসময় কন্ডোম নিয়ে ঘোরে…’ দাঁড়ায় না পিউ, পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে কথাগুলো ছুড়ে দিয়ে হনহনিয়ে হেঁটে চলে যায়।

 

চার

 

‘কী, আমার কাছে ক্লাস করতে এলি না তো?’ সিগারেটে টান দিতে দিতে বলল লেনাদি।

 

দিন পনেরো পর বাইক শেডের সামনে মুখোমুখি দেখা। ইউনিয়ন রুমে এর মধ্যে বারকতক দেখা হলেও কিছু বলেনি লেনাদি। পথিক সেদিনের কথাটাকে ঠাট্টাই ভেবেছিল।

 

তাই কী উত্তর দেবে পখিক ভাবছিল।

 

‘না, মানে…’ তো তো করতে থাকে ঊনিশ বছরের পথিক।

 

‘তোকে বলেছি না, যা দেখিসনি তা নিয়ে লিখবি না, ভুল লিখবি…। আমার কাছে আসিস, দেখাব…’ বলে স্কুটিতে চড়ে সাঁ করে চলে যায় লেনাদি।

 

সাতপাঁচ ভাবছিল পথিক। সত্যি-মিথ্যা, রোমাঞ্চ, পিউয়ে-র সাবধানবাণী…। তার মাঝে হাঁক দিয়ে গেল সঞ্জয়দা। তবু ইউনিয়ন রুমে গেল না পথিক।

 

পাঁচ মিনিট পর তার মোবাইলে একটা মেসেজ ঢুকল। ন্তুপ্প ২ প্পম্ভ ব্জপ্প ্ত্রব্ধ ন্সন্ধ্রুন্ন্স্ত্র, ্ত্রন্দ্রব্ধব্জ ন্ধ্রচ্ঞন্দ্র ু ন্ধ্রব্জ, ঢঅচ্ঞচ্ঞ ব্দন্ধ্রভ্র ব্ভ ভ্রন্ধ্রব্ধ হ্মব্জপ্সপ্পব্দস্তু.

 

বুক ধড়ফড় করতে থাকে পথিকের। ও মাঠের ঘাসে বসে পড়ে। পা কাঁপছে, দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। ভাগ্যিস আশেপাশে কেউ নেই এখন। ঘাসের উপর পিঠ এলিয়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। উত্তেজনায় তার নিঃশ্বাস ক্রমশ গরম হয়ে উঠছে, বুঝতে পারে পথিক। সে কলেজের আনাড়ি ছোকরা। সদ্যাগত, তাকে ‘সাদা তাল’ দেখতে আমন্ত্রণ করছে কলেজের হার্টথ্রব ইউনিয়ন নেত্রী থার্ড ইয়ারের লেনাদি! নিষিদ্ধ ফলের আকর্যণ পথিককে চুম্বকের মতো টানতে থাকে।

 

আবার মনে পড়ে পিউয়ে-র কথা। ভীষণ রাগ হয় পিউয়ে-র উপর। মনে হয় কেন শুনবে সে ওর কথা? সবাই কত হাসি গল্প করে তাদের বান্ধবীদের সাথে। ফোন করে, মেসেজ করে। ঘুরতে যায়… আরও কত কী… সে কেন বঞ্চিত থাকবে এই সুখ থেকে…

 

এক অপ্রতিরোধ্য রোমাঞ্চ তাড়িয়ে নিয়ে যায় পথিককে। কলেজের খেলার মাঠ, শাল জঙ্গল ছাড়িয়ে, বাজারের শেষে ছাতার দিঘির পাড়ে ছোট্ট অতিথিনিবাস, ক্ষণিকা। হাফ প্যান্ট আর ফিনফিনে গেঞ্জিতে অপেক্ষা করছিল লেনাদি…

 

সেদিন লেনাদি আরও অনেক কিছু দেখিয়েছিল। এক প্রকার হাতে ধরে শিখিয়েছিল শরীরের কোন ভাঁজে লুকিয়ে আছে কতটা সুখ, দুগ্ধফেননিভ ফর্সা নরম তাল তাল মাংসের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে পথিকের প্রথমবারের জন্য মনে হয়েছিল জীবনটা সত্যিই সুন্দর…।

 

লেনাদি আলস্য জড়ানো চোখে বিড়বিড় করছিল, ‘হোয়াই ইউ পিপল ডোন্ট ডু ইট ফর আওয়ারস!

 

পাঁচ

 

সেদিন মাথায় একটা কবিতা ঘুর ঘুর করছিল পথিকের। একটা অফ পিরিয়ড পেতেই ও ভাবল কবিতাটা নামিয়ে ফেলতে হবে। সাদা কাগজ আর পেন তার পকেটেই থাকে। বই খাতা ক্লাস রুমে রেখে ও হাঁটতে লাগল। খেলার মাঠ, শাল জঙ্গল পেরোলে কলেজের পাঁচিল। পাঁচিলের ওপারেই ছোট্ট ক্যানেল। কুলকুল জলের শব্দ। দূরে তাকালে দেখা যায় ছাতার দিঘির বিস্তৃত জলরাশি। ভিতরের দিকের প্রাচীরের গায়ে একজায়গায় পুরানো ইট ঢিবি হয়ে আছে। তাতে পা দিয়ে অনায়াসে সীমানা প্রাচীরের উপর বসে সৗন্দর্যে বিভোর হয়ে কবিতার কথা ভাবা যায়। জায়গাটা খুব পছন্দ পথিকের। সেদিকেই হাঁটছিল ও। হঠাৎ জঙ্গলের ভিতর খুক খুক কাশির শব্দে থমকে দাঁড়াল সে। পিউ আর কেমিস্ট্রির রুষা। রুষার হাতে একটা কল্কে, যা থেকে দু’জনেই একবার করে টান মারছে। পথিককে দেখে পিউ ডাকে, ‘এই গুড বয়, শোন শোন, এদিকে আয়, একা একা কোথায় যাচ্ছিস? তোর সখীরা কই?’

 

পথিক বুঝতে পারে পিউয়ে-র নেশা হয়ে গেছে। এই কারণে ও সব ক্লাস করে না আজকাল।

 

‘তোরা কল্কে নিয়ে…’

 

‘সিগারেটে পুরে হয় না রে মাইরি। গাঁজা খেলে কল্কেতে ফেলেই খাওয়া উচিত…উঁহ…কী স্বাদ । মাইরি! দু’টান মেরে দ্যাখ…’

 

‘আমি গাঁজা খাই না, নট ইভন বিড়ি, সিগারেট, চা…’

 

‘চা খাস না… হি হি… চা খায় না…দুধ তো খাস…’

 

‘না, তাও খাই না।’ নাকের পাটা ফুলিয়ে জবাব দেয় পথিক।

 

‘অলে বাবা… কচি ছেলে দুদুও খায় না…।’ হঠাৎ তড়াক করে রুষার গায়ের হেলান ছেড়ে উঠে বসে পিউ। ‘সেদিন তাহলে লেনাদির ঘরে গিয়ে কী খেয়ে এলি?’

 

পিউ আর রুষা দুজনেই হাসতে থাকে হো হো করে।

 

চমকে ওঠে পথিক। তার লেনাদির ঘরে গোপন অভিসারের কথা এরা জানল কী করে!

 

‘শালা ভাবছিস চুপি চুপি করে গেলাম, এরা জানল কী করে?

 

হা-হা-হা… এমন অভিসারের কথা এই মফস্সলে চাপা থাকে না সোনা…। গেছিলি তো একা একা…পায়ে হেঁটে। আসার সময় যে স্কুটিতে চড়ে একেবারে কলেজের গেট পর্যন্ত চলে এলি…হি হি… কচি ছেলেটার খিদে পেয়েছে রে রুষা, একটু দুদু খাওয়া…’

 

মাথা ঘুরতে থাকে পথিকের। সময়টা বড়ো দ্রুত বদলে যাচ্ছে। তার সাথে তাল রেখে হাঁটতে পারে না সে… ছোট্ট থেকেই দেখেছে তার শিক্ষক বাবা সমাজতন্ত্রের আদর্শে বিশ্বাসী। তাদের ঘরে রুশ দেশের বাংলা পত্র-পত্রিকা, বই-সাহিত্য ছিল ঠাসা। সেগুলো ছোটো থেকে গোগ্রাসে গিলেছে সে। তাদের মতাদর্শের অনুসারী এই অঙ্গরাজ্যের হাত ধরে সারা দেশে একদিন সমাজতন্ত্র আসবে এমন স্বপ্ন ছিল বাবার, যা ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে। এখন ভোটে জিতে ক্ষমতায় টিকে থাকাই আসল। কলেজগুলোতেও ভোটে জেতার জন্য কী সুবিশাল আয়োজন! বাবা যে কমিউন গড়ার গল্প শোনাতেন তা আজ প্রলাপ বা বিলাপের মতন শোনায়…

 

‘উরুর তিলটা দেখেছিস… লেনাদির উরুর সেই বিখ্যাত তিল…’

 

‘বিদ্যুতের শক খাওয়ার মতো চমকে ওঠে পথিক। লেনাদির ডান দিকের ফরসা উরুর মাঝ বরাবর কপালের বড়ো টিপের সাইজের একটা ঘোর কালো তিল…সেদিন হাত বুলিয়ে দেখেছিল সে…’

 

তার কান গরম হতে থাকে…কী করে সম্ভব…

 

‘তুইও যেমন… শালা একটা প্রসের সাথে শুতে গেছিস…গোটা কলেজ জানে ওর সারা শরীরের কোথায় ক’টা তিল আছে…’ ভক ভক করে গাঁজার ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে রুষা।

 

মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকা কবিতাটা কোথায় চলে যায়… শাল জঙ্গলের মধ্যে ধপ করে বসে পড়ে পথিক।

 

ছয়

 

পরদিন তার কবিতা আশ্রমে যাবার পথে পিউকে একা বসে থাকত দেখল পথিক। খেলার মাঠের শেষে। শাল জঙ্গলের শুরুতেই। টান মারার জন্য জাস্ট আড়াল নেওয়া আর কি!

 

‘আসতে পারিস। কোনও পরিশ্রম করাব না… নেশালু কণ্ঠে বলে পিউ।’

 

বিনা বাক্যব্যয়ে পাশে গিয়ে বসে পথিক। বুঝতে পারে আগে থেকেই টান দিচ্ছে পিউ। তাই ক্লাসে যায়নি।

 

‘তোদের তো ভালোই হল…’ জড়ানো গলায় বলে পিউ।

 

‘কেন?’

 

‘শুনিসনি?

 

‘না তো, কী?’

 

‘তোদের কিছু ক্যান্ডিডেট পারচেজ করতে চাইছে বিপ্লব বাবুদের দল। দু’হাতের উপর পিঠ হেলিয়ে বিড়বিড় করে পিউ।

 

এরকম কথা আগে একবার শুনেছিল পথিক।।

 

‘সেজন্য নমিনেশন জমা দেবার পরই তোদের গাড়ি করে নিয়ে চলে যাওয়া হবে মাইথনের একটা হোটেলে। চারবেলা খাওয়া,

 

মউজ-মস্তি। তোদের পাহারায় থাকবে সঞ্জয়দা, লেনাদি। কটা দিন লেনাদির কাছাকাছি থাকবি…’

 

‘বেশ করব থাকব।’ রাগ দেখিয়ে বলে পথিক। ‘আমারও একটা গার্ল ফ্রেন্ড-এর দরকার আছে…’

 

‘মাই গড, লেনাদি তোর গার্ল ফ্রেন্ড! থার্ড ইয়ারে তিনবছর ড্রপ… পার্টির নির্দেশে ও আর সঞ্জয়দা কলেজ দেখছে। ছাত্র না থাকলে ‘বহিরাগত’ হয়ে যাবে, তাই…’

 

‘হোক ছ’বছরের বড়ো, তবু তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে পারব আমি।’

 

রাগ দেখিয়ে বলে পথিক। পিউ-র প্রত্যাখানের জ্বালা মেটাতে। কিন্তু সে জানে আর তার লেনাদিকে চুমু খাওয়া হবে না। চারদিন আগেই সে দেখেছে সেকেন্ড ইয়ারের লম্বা বীরুকে। স্কুটি চড়ে লেনাদির সাথে ক্ষণিকায় যেতে। তখনই সে বুঝতে পারে, কেন ক’দিন ধরে কাছাকাছি ঘুর ঘুর করলেও তাকে আর ডাকছে না লেনাদি, তার সফেন সমুদ্রের জোয়ারের জলে নামতে। এদিকে জীবনের প্রথম নারী সঙ্গমের পর পথিকের তখন পাগলের মতো অবস্থা। চোখ বুজলেই সফেন সমুদ্র… কালো টিপের মতো তিল। তাল তাল নরম মাংসের মধ্যে স্বর্গের সমস্ত সুখ। অথচ লেনাদি কী নিস্পাপ ভাবে কবিতার কথা, ইউনিয়ন ভোটের কথা, সমাজবাদের কথা আওড়ে যায়! যেন তাদের মধ্যে কিছুই হয়নি কোনওদিন! লেনাকে জানার ইচ্ছা তাকে পাগল করে দিয়েছিল। সেই ইচ্ছাই তাকে জানিয়েছে কলেজের লেকচারার জাহিরবাবুর ভাড়া বাড়িতে প্রায়ই রাত কাটায় সে। আর কলেজের লালটুস দেখতে জুনিয়র, সিনিয়র অনেকেই চেনে তার শরীরের ঘাত প্রতিঘাত, চড়াই উতরাই। সেদিনের জড়নো গলায় বলা কথাটার মানে এদ্দিনে বুঝতে পারে পথিক, ‘হোয়াই ইউ পিপল ডোন্ট ডু ইট ফর আওয়ারস!’

 

লেনাদি এক পুরুষে তৃ৫ হবার মতো মেয়েই নয়। তবে তার এই আবিষ্কার সে পিউ-র কাছে চেপে যায়।

 

‘খা শালা, কত চুমু খাবি পিসিমাকে, ফ্রি তে খেয়ে নে…হা-হা-হা-হা, হাসির দমকে কাশতে থাকে পিউ।

 

‘হাসির কী হল?’ জিজ্ঞেস করে পথিক।

 

‘আমার সেই দিনটার কথা মনে পড়ছে। মুখে ‘আই লাভ ইউ’ বলতে না পারা সেই ছেলেটার কথা…. একটা চিরকুট কাগজ নিয়ে আমার পিছু পিছু ঘুরে বেড়াচ্ছিল…’

 

হঠাৎ ধবক করে জ্বলে ওঠে যেন পিউর চোখ। কিড়মিড় করে দাঁত। পথিকের বুকের কাছের জামা খামচে ধরে বলে ওঠে, ‘ক্যান ইউ ব্রিং দ্যাট গাই ব্যাক টু মি…?’

 

‘ছাড়…বোতাম ছিঁড়ে যাবে…’

 

‘পারবি না বল? জানতাম…’ শিথিল হয়ে যায় পিউ এর হাত।

 

একটা সিগারেট বের করে লাইটার জ্বালায় পিউ। টান দিতে দিতে বলে, ‘ডু ইউ নো, হু ইজ মাই ফার্স্ট ক্রাশ?’

 

পথিক কিছু না বলে চুপ করে থাকে।

 

‘ইউ… ব্লাডি শিলি ইউ… পথিক রায়… মাই ক্লোজ কম্পিটিটর ইন দ্য ক্লাস। বাট দেয়ার ইন দ্য ভিলেজ ইজ নো অ্যাটমোস্ফিয়ার ফর আওয়ার লাভ। নাইদার ইউ কুড টেল মি এনিথিং, নর আই…’

 

শূন্যে ক’বার ধোঁয়া ছাড়ে পিউ।

 

‘তখন রাতদিন পড়ছি জয়েন্টের জন্য। স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হব।

 

যে-স্যারের কাছে টিউশন নিতাম… বায়োলজির সুনীল স্যার…তাঁর ছেলে উদ্দী৫ তখন ডাক্তারির সেকেন্ড ইয়ারের স্টুডেন্ট। মাঝে মাঝে ছুটিতে বাড়ি আসত… জয়েন্ট অ্যাস্পিরান্ট আমাদের কাছেও তখন হিরো। ওই শালা আমাকে বলেছিল রাতে ঘুম পেলে সিগারেট খাবে…। সেই থেকে…’

 

পথিক অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে পিউয়ে-র দিকে।

 

‘আর কী বোকা ছিলাম আমি! ওর বাবা মা দু’জনেই টিচার। ফাঁকা বাড়িতে একদিন ডাকল। আমিও গেলাম গাইডেন্স-এর লোভে। বাঁধভাঙা ভালোবাসার কথা শুনতে শুনতে নিজেকে হারিয়ে ফেলল একটা সতেরো বছরের মেয়ে। টোটালি আন প্রিপেয়ার্ড অবস্থায় একটা আন প্রোটেক্টেড সেক্স। সব মিটে গেলে নিজের ভুল বুঝতে পারলাম। ও তখন ডেট-ফেট কী সব হিসেব করে বলল আমার সেফ পিরিয়ড চলছে… ওরিড হবার কিছু নেই। তারপরও ওর ডাকে সাড়া দিয়ে পাঁচবার মিলিত হয়েছি। তবে প্রত্যেকবার উইথ প্রোটেকশন। কিন্তু দেড়মাসের মাথায় আমি বুঝতে পারলাম আই ওজ মিসিং মাই পিরিয়ড…’

 

‘ওই টার্মিনেশনের জন্য অ্যারেঞ্জ করেছিল একটা নার্সিংহোমে। তারপর কুড়ি দিন বাড়ি থেকে বেরোতে পারিনি। মা-কে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যা বলেছি। আর তারপর থেকেই ওর সুইচ অফ। সারাদিন শুধু অঝোরে কেঁদেছি। এমন সময় একটা মেয়ের মনের অবস্থা কী হয়… সেসময় কাকে পাশে দরকার হয়…। তোর ওই ‘মেয়েরা যেমন হয়’ কবিতা পড়ে বোঝা যাবে না কোনওদিনও, রাস্কেল…’

 

হঠাৎ কেঁদে ফেলে পিউ। আই ওয়াজ টোটালি ডিভাস্টেটেড। অ্যাট দ্যাট টাইম ইউ কেম টু টেল মি ‘আই লাভ ইউ’। ইট ওয়াজ আ লেট কল, পথিক…’

 

‘স্যারের কাছে একদিন সব বলে কান্নায় ভেঙে পড়ি। স্ত্বান্নার জন্য তাঁর হাতের স্পর্শ মাথা থেকে নেমে ক্রমশ আমার সারা শরীর ঘুরতে শুরু করে… ছেলের সাথে শুয়েছি শুনেই ওঁর চাউনি কেমন যেন বদলে গেল। ভাবছিলাম… সেদিন ওই বাস্টার্ডের মুখে থুতু ছিটিয়ে বেরিয়ে আসি। জয়েন্টের স্বপ্ন ফিনিশড…’

 

‘যে-ছেলেটা মুখে বলতে পারে না ‘আই লভ ইউ’, তার হাতে একটা অ্যাবরশন হওয়া মেয়েকে তুলে দিতে মন চায়নি সেদিন। তাই ফিরিয়ে দিয়েছিলাম।’

 

‘কিন্তু সে যদি আজও চায়?’ পিউয়ে-র একটা হাত খপ করে নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে প্রশ্ন করে পথিক। ‘সেও তো একটা ভুল তোরই মতো করে বসেছে? তোকে একজন পুরুষ ব্যবহার করেছিল, আমাকে একজন নারী। যে-দুটোর কোনওটার মধ্যে ভালোবাসা ছিল না…’

 

‘তোকে ফিরিয়ে দিয়ে কতরাত কেঁদেছি জানিস, রাস্কেল…।’ তারপর ডিপ্রেশন শুরু হয়। বন্ধুদের কাছ থেকে মদ গাঁজা সব খাওয়া আস্তে আস্তে শিখে যাই।’

 

‘এখনও কি ফিরে আসা যায় না?’

 

‘কে ফেরাবে তারে… সব স্বপ্ন লুঠিত হয়ে গেছে যার, সবার অগোচেরে…’

 

‘আছে একজন।’

 

‘সে ইউনিয়নের পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত।’

 

‘ছেড়ে দেবে সে ইউনিয়ন।’

 

‘বেট?’

 

‘বেট।’

 

ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে পিউ।

 

পিউয়ে-র হাতে ধরা রুমাল নিয়ে চোখের জল মুছিয়ে দেয় পথিক। নির্জন চরাচরে দু’জন মানব মানবী দু’জনকে নতুন করে দেখতে থাকে। চার চোখের মুগ্ধতায় তখন ভর করে হাঁটতে থাকে ভাষাহীন শব্দেরা। অনেক না বলা কথা যেন বলা হয়ে যায় মুহর্তে। একে অপরকে পরম আশ্লেষে বুকে জড়িয়ে ধরে ওরা। পিউ-র কাঁধে পথিক-এর মাথা। তার হাতে ধরা রুমালে একটা মৗমাছি এসে বসে। পথিক ফিসফিস করে বলে, ‘পিউ তোর রুমালে মৗমাছি…’

 

পিউ নেশা ধরানো গলায় প্রশ্নের স্বরে আওয়াজ দেয়, ‘উমমম…’

 

পথিক পিউ এর কানের কাছে মাথা রেখে অস্ফুটে বলতে থাকে,

 

‘দুহাতে কোনও কাজ ছিল না, দুটোই মারকুটে

 

দুহাত ভরে সেলাই এলো নাইন-টেনে উঠে

 

এহাতে এল রান্নাঘর, ওটায় তানপুরা

 

হাতের কথা জেনেও গেল দাদার বন্ধুরা

 

দুহাতে আজ ভরা সেলাই, আঙুলে সুতো কাঁচি

 

টেবিল ক্লথে ভ্রমর এলো, রুমালে মৗমাছি…’

 

আরও গভীর ভাবে পথিককে চোখ বুজে জড়িয়ে ধরল পিউ। শালের পাতায় পাতায় তখন লুটোপুটি খাচ্ছে শীতের রোদ। দূরে কোথাও একটা সুখপাখি ডেকে উঠল। তিনবার।

(কবিতার ঋণছ ‘সেলাই খাতার নকশা’ –শিবাশিস মুখোপাধ্যায়)

শিল্পী

আমার শ্যালক সুজয়কুমার শিল্পী। শিল্পীরা একটু খামখেয়ালি হয়। আর শিল্পী মানেই বড়ো মাপের প্রেমিক। সবকিছু ঠিকঠাক চললে তার প্রেমের নিদর্শন এতদিনে দৃষ্টান্ত হতো। অন্তর্ঘাতের জন্যে হয়নি। নিজেকে প্রমাণ করতে না পারার ব্যর্থতা তাকে আজও কষ্ট দেয়। বাড়িতে নতুন কেউ এলে যে-কোনও অজুহাতে ছাদে নিয়ে যায়, যেখানে খোদাই করে লিখেছিল ‘দোলনচাঁপা’। পাশে পায়রার ফাঁকা বাক্স। এখানে দাঁড়িয়ে দোলনচাঁপাদের বাড়ির ছাদ এবং ওর ঘরের জানালা দেখা যায়। প্রথম পরিচয় থেকে শুরু করে দোলনচাঁপার বিয়ে পর্যন্ত সবটাই শ্রোতাকে ধৈর্য ধরে শুনতে হয়। কেবল ব্যাগ চুরির ঘটনাটা চেপে যায়। হয়তো দোলনচাঁপার থেকেও গৃহত্যাগ করতে না পারার ঘটনা তাকে বেশি কষ্ট দেয়। আরও কষ্ট হয় যখন বাড়ির মানুষগুলো উপহাস করে। যেন প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার থেকে হাস্যকর আর কিছু হয় না।

কাউকে বিশ্বাস করে না সুজয়। না বাড়ির, না বাড়ির বাইরে কারওকে। একমাত্র আমাকে যা একটু ভরসা করে। হতে পারে একসময় আমি শিল্পচর্চা করতাম বলে, এখনও খোঁজখবর রাখি বলে। তার চেয়েও বড়ো কথা সুজয়ের ছবির সমঝদার। দ্বিতীয় কারণটি পারিবারিক। সুজয়ের দিদিকে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছি। বাড়ির অমতে, পালিয়ে। সুজয়দের বাড়ি থেকে মেনে নিয়েছে বছরখানেক পরে। সেখানে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে বড়ো ভূমিকা ছিল সুজয়ের। এখন সকলের সাথে ভালো সম্পর্ক। একমাত্র শ্বশুরমশাই এখনও সেভাবে মেনে নিতে পারেননি। কথা বলেন প্রয়োজনে।

আমার শ্বশুরবাড়ি এখনও একান্নবর্তী। শ্বশুরমশায়ের পাঁচ মেয়ে চার ছেলে, আমি বলি নবরত্ন। জ্যাঠতুতো ভাইবোন ধরলে পনেরো। ভাগ্যিস কাকাশ্বশুর বিয়ে করেননি। করলে সংখ্যাটা কোথায় যেত সন্দেহ! সব পিঠোপিঠি ভাইবোন। বন্ধুর মতো সম্পর্ক। দল বেঁধে ফুটবল খেলছে, সিনেমায় যাচ্ছে, এ ওর পেছনে লাগছে, হৈ-হুল্লোড় লেগে আছে সবসময়। সবচেয়ে বেশি পেছনে লাগে সুজয়ের। সুজয়ের খ্যাপাটে আচরণ, গোলমেলে কথাবার্তা আর আজব কাজকর্মের জন্যই হয়তো।

শিল্পী সুজয়ের কদর কেউ না বুঝুক সুজয় জানে, এই সময়ের সে ব্যতিক্রমী প্রতিভা। ছবির বিষয়, আঙ্গিক এবং উপস্থাপন সবেতেই স্বতন্ত্র। তবে চিত্রকলা নয়, ভাস্কর্যে তার আগ্রহ বেশি। কিছু দিন মূর্তি নির্মাণ শিখেছিল। ইচ্ছা আছে শুশুনিয়া পাহাড়কে ভবিষ্যতে সাধনপীঠ হিসাবে বেছে নেবে। দেশে হিমালয়ের মতো পাহাড় থাকতে শুশুনিয়া কেন? কারণ শুশুনিয়া চুনা পাথরের। চুনা পাথরই বিবর্তনের ফলে মার্বেল পাথরে রূপান্তরিত হয়। শুশুনিয়া এখন মাঝামাঝি অবস্থায়। অপেক্ষাকৃত নরম চুনা পাথর কুঁদে মূর্তি বানানোয় কষ্ট কম, ভবিষ্যতে সেই মূর্তি মার্বেল মূর্তিতে পরিণত হবে। কয়েক হাজার বছর সময় লাগবে হয়তো। মহাকালের নিরিখে এটা এমন কিছু সময় নয়। কেবল সে থাকবে না তখন। না থাকুক, তার শিল্প থাকবে। আর শিল্প থাকলেই শিল্পীর অমরত্ব। কাজটা সময়সাপেক্ষ। প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। সুজয় পয়সা জমাতে শুরু করেছিল।

একসময় তার জীবনে প্রেম এল।

বাড়ির উলটো দিকে ফাঁকা জায়গাটা কিনে বাড়ি বানালেন একজন মাস্টারমশাই। স্বামী-স্ত্রী আর তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে ছোটো সংসার। ছেলেটি ছোটো। বড়ো মেয়ে দোলনচাঁপা প্রথমবর্ষের ছাত্রী। সুজয়ের ঘরের জানলা দিয়ে বাড়িটা দেখা যায়, ছাদে উঠলে দোলনচাঁপার ঘরের জানলা। কিছু দিনের মধ্যে সুজয়ের বোনেরা আবিষ্কার করল, সুজয়ের ক্যানভাস জুড়ে দোলনচাঁপার মুখ। ততদিনে দুই পরিবারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা হয়েছে, সুজয়ের বোনদের সাথে দোলনচাঁপার বন্ধুত্ব হয়েছে, বিকালের দিকে সুজয়দের বাড়ি আসে গল্পগুজব করতে। কথাটা তার কানেও উঠল এবং সুজয়ের বোনদের সাথে হাসিতে মাতল। আড়াল থেকে লক্ষ্য করল সুজয়, খারাপ লাগল তার। অপমানটা জমে থাকল ভেতরে।

দুদিন বাদে কলেজ থেকে ফেরার সময় দোলনচাঁপার পথ আটকাল সে, আপনার সাথে কথা আছে।

দোলনচাঁপা জানত সুজয়ের দুর্বলতা, এমন কিছু যে ঘটতে পারে সে আশঙ্কাও ছিল। মানসিক ভাবে একরকম প্রস্তুত ছিল। তবু না বোঝার ভান করল, ওমা এখানে কেন! বাড়িতে বললেই তো পারতেন।

–সব কথা বাড়িতে বলা যায় না। আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে।

–তাহলে তো আমার মা-কে জানানো উচিত। একদিন আসুন না আমাদের বাড়ি। মা-র সাথে আলাপ করিয়ে দেব।

–সেদিন অমন বিশ্রী ভাবে হাসলেন কেন? আপনার ছবি অাঁকা অন্যায় না হাস্যকর? আপনি আপনাকে হাস্যকর ভাবতে পারেন, আমি ভাবি না। আমার জীবনে আপনি…

–এমা ছিছি, এ তো আমার সৗভাগ্য। আপনার মতো গুণী শিল্পী…

সুজয় খুশি হল, আপনি দেখেছেন?

–দেখেছি। আপনার অনুমতি না নিয়েই আপনার ঘরে ঢুকেছিলাম।

–ভালো লেগেছে?

–ভীষণ।

–আসলে ছবির আপনি তো শুধু আপনি নন, কল্পনায় আপনাকে যেভাবে দেখি… কথাটা কীভাবে বলব ঠিক বুঝতে পারছি না। আপনি ভুল বুঝলে…

দোলনচাঁপা বিষম খেতে খেতে সামলে নেয়, বুঝেছি। সত্যিই অন্যায় হয়ে গেছে। আপনার অনুমতি ছাড়া ঘরে ঢোকা উচিত হয়নি।

–আমি সে কথা বলছি না। আপনার যখন খুশি যাবেন, যতক্ষণ খুশি থাকবেন, চাইলে সারা জীবন…

এবার আর সামলাতে পারল না, বিষম খেল। একটু ধাতস্থ হলে বলল, ফুচকা খাবেন? আমার ফেভারিট।

–আমারও।

–চলুন।

–পয়সা কিন্তু আমি দেব।

–অফার আমি করেছি, আপনি কেন দেবেন?

–আমার ইচ্ছা।

–পরের দিন কিন্তু আমি দেব।

পরের দিন ফুচকা নয়, রেস্টুরেন্ট। ফিস কবিরাজির ভিতর কাঁটা চামচ চালাতে চালাতে আসল কথাটা বলে ফেলল সুজয়, কিছু বুঝতে পারছেন?

–কী?

–আমি আপনার প্রেমে পড়েছি।

টকাস করে এক টুকরো ফিস কবিরাজি মুখে পুরে দোলনচাঁপা বলল, থ্যাংক য়ু।

সুজয় থতমত খেল। এই কথায় এই উত্তর! তালগোল পাকিয়ে যায় কেমন। কথা খুঁজে পায় না। দোলনচাঁপা মুখ নামিয়ে হাসি চাপার চেষ্টা করছিল। মুখের খাবার শেষ হলে সোজা তাকাল সুজয়ের দিকে। স্বাভাবিক ভাবে বলল, কেউ ভালোবাসে শুনলে কার না ভালো লাগে বলুন। এই একটা ব্যাপারে আমি কিন্তু ভাগ্যবান, অনেকের মুখেই কথাটা শুনেছি। তবে আপনার মতো শিল্পী যখন বলে…

–আমি বোধহয় আপনাকে বোঝাতে পারছি না।

–পেরেছেন। সত্যি কথা বলতে কী, এ ব্যাপারে আমি অসহায়। দোলনচাঁপা এবার সিরিয়াস হয়, মেঘ করে আসে মুখে। দমধরা গলায় বলে, সাধ থাকলেও সাধ্য নেই। বাবার আবদার তার পছন্দে বিয়ে করতে হবে, না হলে আত্মহত্যা করবে। বাবাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি, সে আঘাত পায় এমন কোনও কাজ করতে পারব না।

–বিষয়টা আমার উপর ছেড়ে দাও। তোমার বাবাকে রাজি করানোর দায়িত্ব আমার। আমি তোমার মতামত জানতে চাইছি।

–বললাম তো, বাবার ইচ্ছাই আমার ইচ্ছা।

সুজয় খুশি হয়। দোলনচাঁপা তাকে হতাশ করেনি, বরং আশার আলো দেখিয়েছে। এই ছোট্ট আলোকবিন্দু একদিন দাবানলে পরিণত হবে।

সুজয় পক্ষীরাজ হয়ে ওড়ে, পিঠে দোলনচাঁপা। কখনও ভিক্টোরিয়া, রবীন্দ্রসদন, কখনও সিনেমা, নাটক। দেদার পয়সা ওড়ে। জমানো টাকায় হাত পড়ে একসময়। তবে এসব প্রসঙ্গ গৗণ। ভালোবাসার কাছে পৃথিবীর সমস্ত অর্থও কিছু না। তার শিল্পকর্মেও জোয়ার আসে। একটার পর একটা দোলনচাঁপার পোর্টেট। কখনও ওয়াটার কালার, কখনও অয়েল পেইন্টিং, কখনও স্রেফ পেন্সিল স্কেচ। ততদিনে দোলনচাঁপাদের বাড়ির দরজাও খুলে গেছে। দোলনের মা তাকে পছন্দ করে। সুজয় ডাকে মাসিমা। মাসিমার এটা-ওটা ফাইফরমাস খেটে দিতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করে।

বছর দুই কেটে যায় এভাবে উড়তে উড়তে। দোলনচাঁপা বিএ ফাইনাল দেয়। সুজয়ের মনে হয় এবার দোলনের বাবাকে জানানো উচিত। অথচ বলি বলি করেও বলা হয় না।

মাসখানেক বাদে একদিন অসময়ে সুজয়ের ঘরে এসে হাজির হয় দোলনচাঁপা। অপরাধী অপরাধী ভঙ্গিতে একটা বিয়ের কার্ড সুজয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, বাবা হঠাৎ ঠিক করে ফেলল।

আচমকা আঘাতে সুজয় হতভম্ব। কার্ডটা মুঠো করে ধরে চুপচাপ বসে রইল। কিছু বলতে পারল না।

কাছে এগিয়ে এল দোলনচাঁপা, সুজয়ের ডানহাতটা চেপে ধরে অনুনয় করল, বিয়েতে থেকো কিন্তু। না হলে বুঝব… শিল্পীর ভালোবাসার কোনও মূল্য নেই। সব মিথ্যে…

সাচ্চা প্রেমের প্রমাণ দিতে বিয়ের দিন আর পাঁচজন নিমন্ত্রিতের মতো সেও উপস্থিত থাকল। কিছু কিছু দায়িত্ব পালন করল। সাতপাকের সময় পিঁড়ি ধরল। শুভদৃষ্টির সময় প্রত্যাশা করল এক বারের জন্য হলেও তার দিকে তাকাবে। শেষপর্যন্ত না তাকালেও দুঃখ পেল না। ভাবল সংকোচে…

পরদিন সন্ধ্যায় চাকুরীজীবী বরের হাত ধরে শ্বশুরঘরে যাওয়ার পর সবার অলক্ষ্যে ছাদে উঠে এল সুজয়। বিয়ের চিঠি হাতে পেয়ে দুঃখে ছাদ খোদাই করে সেখানে দোলনচাঁপার নাম লিখেছিল। পাশে পায়রার বাক্স। পায়রা পোষার শখ সুজয়ের ছোটোবেলা থেকে। বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় গোটা তিরিশেক পায়রা এই মুহূর্তে তার জিম্মায়। দরজা খুলে সবগুলোকে উড়িয়ে দিল। অনেক রাত অবধি চোখের জল ফেলল। চাঁদ তারা সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করল, শিল্পীর ভালোবাসায় খাদ থাকে না। প্রমাণ আমি করবই। কেবল তোমার কাছে না, তামাম দুনিয়ার কাছে…

এরপর থেকে সময় পেলেই ছাদে আসে। বিশেষ করে রাতের দিকে। দোলনচাঁপা-র সামনে। ফাঁকা পায়রার খোপের দিকে তাকিয়ে থাকে। দোলনচাঁপাদের বাড়ির দিকে তাকায় না। দিনেরবেলা যতক্ষণ ঘরে থাকে দরজা বন্ধ করে রাখে। বোনেদের কারও কারও সন্দেহ হওয়ায় গোয়েন্দাগিরি শুরু করে দিল। বিশেষ কিছু উদ্ধার করতে না পারলেও এটুকু বুঝছে, রহস্যের মূলে আছে একটা বড়ো ব্যাগ। সাধারণত টুরে যাওয়ার সময় যে-ধরনের ব্যাগ ব্যবহার হয়। তবে কি সুজয় কোথাও যাচ্ছে! বাড়ি থেকে বেরনোর সময় দরজায় তালা লাগিয়ে বেরোয়। কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞাসা করলে বলে না। তবু খবর আসে বাড়িতে। বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়-স্বজন পরিচিত সকলের কাছ থেকে টাকা ধার করছে। কারও কারও কাছে অনুদান হিসাবেও নিয়েছে। কারণ হিসাবে বলেছে, বাড়িতে আর ভালো লাগছে না। গৃহত্যাগী হয়ে পাহাড়ে যাবে।

বাড়ির লোকজন ভয় পায়। এবার আর সুজয়ের আচরণে হাসে না। সুজয়ের অনেক বিপজ্জনক ক্ষ্যাপামির স্মৃতি এখনও তারা ভুলতে পারেনি। সুজয়ের বাবাও চিন্তায় পড়েন। ছেলের জেদ তিনি জানেন। কারও কথায় সিদ্ধান্ত বদলাবে না। একমাত্র তার এই অপ্রিয় জামাইটি চেষ্টা করলে হয়তো পারতে পারে। এই একটি মানুষকেই সে যা একটু সমীহ করে। তাই জরুরি তলব পাঠালেন।

গেলাম। প্রথমে দেখা করলাম সুজয়ের সাথে। দোলনচাঁপার বিয়ের খবর আগেই পেয়েছিলাম। স্ত্বান্না দিলাম ভুলে যাওয়ার জন্যে। নতুন করে জীবন শুরু করার পরামর্শ দিলাম। সুজয় উত্তর দিল না। চুপচাপ শুনল। বুঝলাম আমার কথা ভালো লাগছে না। বাধ্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, গৃহত্যাগী হচ্ছ শুনলাম?

–হু।

–দোলনচাঁপার মতো একটা ফালতু মেয়ের জন্য?

-না, আমার প্রেমের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে।

–কোথায় যাচ্ছ?

–শুশুনিয়া।

–তোমার সেই প্রোজেক্ট?

–হ্যাঁ।

–বিষয় ঠিক হয়েছে?

–আমার প্রেম। দোলনচাঁপা। দোলনচাঁপার মূর্তি বানাব।

ব্যাখ্যা যাই হোক রোগের নাম দোলনচাঁপা। শিল্পী মেয়ে। ও মেয়ে যে দাগা দেবে প্রথমবার দেখেই মনে হয়েছিল। বাড়ির সবাই বুঝত। যে কারণে কেউ মাথা ঘামায়নি। কিন্তু তার পরিণতি এমন হবে কেউ কল্পনাও করেনি।

বললাম, গুড আইডিয়া। কবে যাচ্ছ?

–সামনের বুধবার। কিছু ছেনি ছিল, কিছু বানাতে দিয়েছি। ওগুলো পেতে পেতে মঙ্গলবার। বিভিন্ন মাপের গোটা দশেক হাতুড়ি কিনেছি।

–আমার কোনও সাহায্য লাগলে বোলো। সাধ্যমতো চেষ্টা করব।

–দেখবেন বাড়ির কেউ না জানে। আটকাতে পারবে না জেনেও দল বেঁধে ঝামেলা পাকাবে। শুভকাজে যাওয়ার আগে ঝামেলা ভালো লাগে না।

–বেশ, তুমি যা চাও তাই হবে।

সুজয়ের পর শ্বশুরমশাই। সে অর্থে এই প্রথমবার মুখোমুখি। প্রথমবার কোনও সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলোচনা। এর আগে কুশল বিনিময় ছাড়া কোনও কথা হয়নি। বেশ অসহায় আর উৎকণ্ঠিত মনে হল ভদ্রলোককে। জানতে চাইলেন, কিছু জানতে পারলে?

–জেনেছি। আমাকে বিশ্বাস করে বলেছে। কাউকে বলতে বারণ করেছে। তবু আপনাকে বলব, বলা প্রয়োজন তাই…। কাউকে বলতে পারবেন না। কথা দিতে হবে।

–বিশ্বাস করতে পারো।

শ্বশুরমশাইকে সব কথা বললাম। শুনে তাঁর কপালের ভাঁজ আরও গভীর হল। চুপচাপ ভাবলেন কিছুক্ষণ, তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, কী মনে হয়, সত্যিই যাবে?

–আপনার ছেলেকে আপনি জানেন। যেভাবে ক্ষেপে উঠেছে মনে হয় না আটকানো যাবে।

–কত দিনের প্রোগ্রাম?

–বলা কষ্ট। দু বছর হতে পারে, পাঁচ বছর হতে পারে আবার সারা জীবনের জন্যও হতে পারে।

–অসম্ভব। এ হতে দেওয়া যায় না। ওকে আটকাও। একাজ একমাত্র তুমি পারবে। তোমার কথা শুনবে।

–কারও কথা শোনার মতো মানসিকতা ওর নেই।

–তোমার উপর আমার ভরসা আছে।

খুশি হই। উপভোগ করি ভদ্রলোকের অসহায়তা। আনন্দ হয় আমার শরণাপন্ন হওয়ায়। গত দশ বছর ধরে নিঃশব্দে আমাকে অপমান করে চলেছে। এখন বিপদে পড়ে…

আমি চুপ করে থাকি।

এক ভোরে বাড়িসুদ্ধ মানুষের ঘুম ভাঙল সুজয়ের চিৎকারে। সবাই ছুটে এল। ঘটনা গুরুতর, টাকাপয়সা ছেনি-হাতুড়ি সহ পুরো ব্যাগটাই গায়েব। অথচ দরজা জানলা যেমন বন্ধ ছিল তেমনই আছে। পড়ে আছে কেবল একটা বাটালির আছার। রসিকতা করতে ইচ্ছে করে ফেলে গেছে। বাড়ির সবাইকে উদ্দেশ্য করে হুংকার ছাড়ল, একাজ তোমরা করেছ। ভালো চাও তো ফেরত দাও।

এ ওর মুখের দিকে চাইল। কথা বলল না। এত বড়ো বুকের পাটা কার আছে ভাবার চেষ্টা করল সবাই। সবাই সবাইকে সন্দেহ করল। সিদ্ধান্তে পৌঁছোতে না পেরে আবার প্রথম থেকে ভাবতে শুরু করল…। সবাই সবাইকে জিজ্ঞাসা করল। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছোল, ব্যাগটা চোরেই নিয়েছে।

সুজয়ের হম্বিতম্বিতে চোরের বিশেষ কিছু এসে গেল বলে মনে হল না।

সর্বস্ব খুইয়ে সব দিক থেকেই ভেঙে পড়ল সুজয়। সারাদিন বাড়িতে থাকে। ঘর থেকে বেরোয় না। দরকার ছাড়া কথা বলে না। ভাইবোনেরাও তার পেছনে লাগে না। তবে চোখে চোখে রাখে। অসঙ্গতি কিছু দেখলে নজরদারি আরও বাড়িয়ে দেয়।

স্বাভাবিক হতে অনেকদিন সময় লেগেছিল সুজয়ের।

এর পরের গল্পে কোনও বৈচিত্র্য নেই। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় পাত্রী খুঁজে বছরখানেকের মধ্যে সুজয়ের বিয়ে দিলেন শ্বশুরমশাই। বছর দেড়েকের মাথায় একটি কন্যাসন্তান হল। এখন সেই মেয়ের বয়স আড়াই বছর। পাঁচ বছরের ব্যবধানে দোলনচাঁপার শোক এখন ফল্গুধারায়, আলাদা করে কোনও বহিঃপ্রকাশ নেই। দোলন বাপের বাড়ি ঘুরতে এলেও মুখোমুখি হয় না। তবু কোনও কোনও তারাভরা রাতে ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়। লেখাটা এখনও একইরকম আছে, একটু যা ছ্যাতলা পরেছে। পায়রার খোপগুলো ফাঁকা।

দোলনচাঁপার ঘরে এখন তার ছোটোভাই থাকে।

কেবল খোয়া যাওয়া ব্যাগটার দুঃখ এখনও ভুলতে পারেনি। সুজয়ের বিশ্বাস, তার সাথে অন্তর্ঘাত হয়েছিল। বাড়িরই কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। ব্যাগটার প্রসঙ্গ উঠলে এখনও সে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। সারাজীবনের সমস্ত স্বপ্ন ওই ব্যাগটায় গচ্ছিত ছিল। প্রেমিকা তো গেছেই, ব্যাগটার সাথে প্রেমও গেল। গ্রীষ্মের দুপুরে কিংবা শীতের ভোরে, বর্ষার মেঘে কিংবা বসন্তের পলাশে-মাদলে শুশুনিয়ার নেড়া মাথায় তা দীর্ঘশ্বাস হয়ে ঘোরে।

আর কোনওদিনও শুশুনিয়া যাবে না সুজয়।

সুজয় এখন আর ছবি অাঁকে না।

গত পাঁচ বছরে শ্বশুরবাড়ির সাথে আমার সম্পর্কের আরও উন্নতি হয়েছে। গুরুত্ব বেড়েছে। গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। সামান্য পারিবারিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেও আমার পরামর্শ নিতে ভোলেন না আমার শ্বশুরমশাই। তাঁর সাথেও সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে। এখন আমি তাঁর প্রিয় জামাই।

ব্যাগটা শুধু অণুঘটকের কাজ করেছে।

ফান্ড রেইজিং

বুদ্ধিটা প্রথমে দিগন্তর মাথায় এসেছিল। রাহুলকে নিয়ে যদি একটা তিন চার মিনিটের ভিডিও বানিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় দেওয়া যায় তাহলে হয়তো কিছু একটা করা যেতে পারে। তিন্নি শুরুতে মোটেই রাজি হচ্ছিল না। কিন্তু ওর বাকি বন্ধুরাও ব্যাপারটাতে সায় দিল। বলল রাহুলের জন্য ফান্ড রেইজিং… এরচেয়ে ভালো উপায়ে আর করা যাবে না। ওদের জোরাজুরিতে নিমরাজি হলেও তিন্নি বলল রাহুলের সঙ্গে কথা বলে ও দু তিন দিনের মধ্যে ওদেরকে জানাবে।

দীপা, অরুণাভ আর সুপর্ণা নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করে তিন্নিকে আবার বোঝাবার চেষ্টা করতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই দিগন্ত বলে উঠল, ‘দেখ তিন্নি, রাহুল যেমন আমাদের বন্ধু তেমনই তুইও। গত চার পাঁচ মাস থেকে তোর ওপর দিয়ে কেমন ঝড় ঝাপটা যাচ্ছে আমরা সবাই সেটা দেখতে পাচ্ছি। সত্যি বলতো আর কত দিন তুই এভাবে টানতে পারবি? তোর ফিজিক্যাল স্ট্রেন, মেন্টাল স্ট্রেস তো আমরা শেয়ার করতে পারব না কিন্তু বন্ধু হিসেবে যদি ফিন্যানশিয়াল প্রবলেম কিছুটা লাঘব করতে পারি তো তাহলে আমাদেরও ভালো লাগবে। তুই চিন্তা করে রাহুলের সঙ্গে কথা বলে আমাদের তাড়াতাড়ি জানাস।’

দিগন্তর গলার আওয়াজটা বোধহয় সামান্য উঁচুর দিকে ছিল, তিন্নি ওকে ইশারাতে আস্তে কথা বলতে বলল তারপর চট করে উঠে গিয়ে ওদের এই বাড়ির একমাত্র বেডরুমের দরজাটা আলতো করে খুলে দেখে নিল রাহুল জেগে আছে কিনা। রাহুলকে চোখ বন্ধ করে ঘুমোতে দেখে দরজাটা সাবধানে টেনে দিয়ে বসার ঘরে এসে দেখল ওর বন্ধুরা ভিডিও বানাবার আলোচনায় মগ্ন।

তিন্নির মনে পড়ে যায় মাত্র সাত বছর আগে ওদের জীবনটা কত অন্যরকম ছিল। এমএসসি-র রেজাল্ট বেরোবার পরে ওরা সবাই যখন সেলিব্রেট করতে গিয়েছিল সেখানেই রাহুল হাটে হাঁড়িটা ভাঙল যে ও আর অপরাজিতা মানে তিন্নি ডেটিং করছে আর খুব তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চলেছে। সবাই ভীষণ ভাবেই চমকে উঠেছিল। চোখে মোটা পাওয়ারের চশমা পরা গুড বয় রাহুল আর দুই বেনি ঝুলিয়ে শাড়ি পরে শহরতলি থেকে কলকাতার কলেজে পড়তে আসা সাধাসিধে মেয়ে তিন্নির মধ্যে তলে তলে প্রেম চলছে।

তিন্নির বাড়ি থেকে এই বিয়েতে মত থাকলেও রাহুলের বাড়ি থেকে ছিল না। রাহুলের মা বাবা না থাকাতে দিদি জামাইবাবু-ই ছিলেন ওর অভিভাবক। তারা প্রথমে রাজি না হলেও পরে মেনে নেন আর পাঁচ বছর আগে তিন্নি, অপরাজিতা চৗধুরী থেকে মিসেস সেন হয়ে এই ওয়ান বিএইচকে ফ্ল্যাটে প্রবেশ করে। রাহুলকে নিয়ে নিজের সংসার সাজাতে তিন্নি এতই ব্যস্ত ছিল যে ওর মনেই হয়নি বাকি বন্ধুদের মতো ওরও একটা চাকরি করা দরকার। এমনকী রাহুল বার বার বলা সত্ত্বেও পিএইচডি করার কথাও ভাবেনি। তিন্নি জানত রাহুল সবসময় ওর সাথে আছে বড়ো একটা গাছ হয়ে, যার ছায়ায় তিন্নি নিরাপদে থাকবে। বছরে একবার দুবার দূরে কোথাও বেড়াতে যাওয়া ছাড়াও টুকটাক উইক এন্ডে কাছাকাছি কোথাও যাওয়া বা বন্ধুদের বাড়িতে গিয়ে গল্পগুজব করা, মাসে একবার বা দুবার উত্তরপাড়ায় গিয়ে মাকে দেখে আসা এসব নিয়ে তিন্নির পাঁচটা বছর যে কীভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারল না।

রাহুলের অসুখের ব্যাপারটা প্রথম প্রকাশ পেল গত বছর উটিতে বেড়াতে গিয়ে। একদিন একটু চড়াই রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে রাহুল পড়ে গেল। তারপর কোনওমতে দাঁড়িয়ে হাঁটতে গিয়ে দেখল ওর ডান পা-টায় তেমন জোর পাচ্ছে না। কোনওমতে হোটেলে ফিরে এসে ডাক্তার দেখাবার কথা বলাতে রাহুল প্রস্তাবটা হেসে উড়িয়ে দিল। পরেরদিন আবার সব ঠিকঠাক।

কলকাতায় ফিরে তিন্নি আর রাহুল ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভুলেই গিয়েছিল। কিন্তু সপ্তাহ দুয়েক পরে রাহুল একদিন অফিসের সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গেল। অফিসের লোকজন ওকে নিয়ে কাছাকাছি একটা হাসপাতালে দেখিয়ে কিছু ওষুধপত্র দিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিল। পরদিন তিন্নি রাহুলকে অফিস যেতে দিল না। বন্ধুবান্ধবরা বাড়ি এসে একচোট হইচই করে গেল। বলল রাহুলের পদস্খলন হয়েছে– সব সময় বউ-এর কথা চিন্তা করে তাই  আশে পাশে চোখ রেখে চলতে পারে না, এর একমাত্র চিকিৎসা সংসারে তৃতীয় জনের আগমন।

তিন্নির মা আর বড়ো ননদ একই কথা অন্য ভাবে তিন্নিকে বলেছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু ও যখনই রাহুলকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে গেছে রাহুল বলেছে, ‘আরে আগে লাইফটাকে এনজয় করো। ছেলে-মেয়ে মানুষ করার জন্য তো সারা জীবন পড়ে আছে, কথা দিচ্ছি পঁয়ত্রিশ হবার আগেই বাবা হয়ে যাব।’

তিন্নি আঁতকে উঠে বলেছিল, ‘তোমার পঁয়ত্রিশ মানে তো আমারও পঁয়ত্রিশ। বাচ্চা বড়ো হবার আগেই তো আমি বুড়ি হয়ে যাব।’

‘ভেব না তুমি বুড়ি হলেও আমি অত সহজে বুড়ো হব না। আমি তোমাদের সবার খেয়াল রাখব’, তিন্নিকে স্ত্বান্না দিয়ে রাহুল বলেছিল। কিন্তু সেই রাহুল আজ গত দু-মাস থেকে সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী। অফিস যাওয়া বন্ধ করেছিল পাঁচমাস আগে। বার কয়েক যেখানে সেখানে পড়ে যাবার পর তিন্নি ওকে বেশ কিছু ডাক্তার দেখিয়ে নানা রকম পরীক্ষা করিয়ে যেদিন জানল, রাহুলের মোটর নিউরন ডিজিজ হয়েছে– ওর জীবনের সব আলোগুলো হঠাৎ করে নিভে গিয়েছিল।

শহরের বিখ্যাত নিউরোলজিস্ট যখন ওদের ওই অসুখ সম্বন্ধে বিভিন্ন রকম তথ্য দিচ্ছিলেন তখন তিন্নির মাথায় কিছু না ঢুকলেও, রাহুল কিন্তু আগ্রহ নিয়ে ডাক্তারের সব কথা শুনেছে, প্রশ্ন করেছে, চিকিৎসা সম্বন্ধে জানতে চেয়েছে। তারপর বাড়িতে এসে তিন্নিকে বলেছে, ‘এবার তোমাকে একটা চাকরি জোগাড় করতে হবে তিন্নি। আমি হয়তো কিছুদিনের মধ্যেই গৃহবন্দি হব। হাঁটতে চলতে এমনকী হয়তো কথা বলতেও পারব না। তোমার জন্য কিছুই করতে পারব না। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমার একটা চাকরি মানে সোর্স অফ ইনকাম জোগাড় করা খুবই দরকার।’

তিন্নি বোঝাবার চেষ্টা করেছিল, ‘ডাক্তারবাবু তো বললেন কত রকমের চিকিৎসা আছে এই অসুখের। তুমি এখনই ভেঙে পড়ছ কেন?’

একটা বিষাদভরা হাসি হেসে রাহুল বলেছিল, ‘তিন্নি এটা সাধারণ অসুখ নয় যে ওষুধ খেলাম আর অসুখ সেরে গেল। এটা মোটর নিউরন ডিজিজ, যেখানে আমাদের ব্রেনের আর স্পাইনাল কর্ডের নার্ভগুলো ড্যামেজ হয়ে যায়, যার ফলে আমাদের শরীরের পেশিগুলো কাজ করতে পারে না, কমজোর আর ক্ষয় হয়ে যায়। মজার কথা কি জানো– আমি দেখতে পারব, শুনতে পারব, কে কি করছে বা বলছে, বুঝতে পারব কিন্তু রিঅ্যাক্ট করতে পারব না।’

তিন্নি রাহুলের মুখে হাত চাপা দিয়ে বলেছিল, ‘চুপ করো, একদম বলবে না ওসব কথা। আমরা কাল থেকেই ডাক্তারবাবুর কথা মতো চিকিৎসা শুরু করব।’

তিন্নিকে জড়িয়ে ধরে রাহুল বলেছিল, ‘আই লভ ইউ তিন্নি। কিন্তু একটা সময় আসবে যখন আমি এই কথাগুলো বলতে পারব না। ট্রিটমেন্ট আমি করাব কিন্তু জানি এই অসুখ সারানো যায় না, শুধু অসুখের লক্ষণগুলোকে বিলম্বিত করা যায়।’

পরেরদিন রাহুল তার অফিসে অসুস্থতার কথা জানিয়ে ছুটির দরখাস্ত করে। তার সঙ্গে আরও জিজ্ঞেস করে যদি সে কর্মক্ষম না থাকে তাহলে ওর স্ত্রী তিন্নির ওখানে কোনও চাকরি পাবার সম্ভাবনা আছে কিনা। ওদের কোয়ালিফিকেশন তো একই। অফিস থেকে রাহুলের ছুটি মঞ্জুর হলেও তিন্নির ব্যাপারে ম্যানেজমেন্ট পরিষ্কার জানিয়ে দেয় তিন্নির কোনও জব এক্সপিরিয়েন্স না থাকাতে দুর্ভাগ্যবশত ওরা ওকে কোনও চাকরি দিতে পারবে না। এই প্রাইভেট কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী ওদের ব্যাপারটা ‘কম্প্যাশনেট জব অফারের’ এক্তিয়ারে পড়ে না, তাই ম্যানেজমেন্ট চাইলেও কিছু করতে পারছে না, –যদিও ওরা সব সময়ে রাহুলের পাশে আছে আর ওর দ্রুত আরোগ্য কামনা করছে।

এদিকে রাহুলের চিকিৎসা আর ওদিকে তিন্নির জন্য নানা জায়গায় চাকরির দরখাস্ত করা, দুটোই একসাথে চলতে থাকল কিন্তু কোনওটাতেই কিছু করা গেল না। যথাসম্ভব চিকিৎসা চললেও রাহুলের শরীরের দ্রুত অবনতি হতে থাকল। প্রথমে ডান-পা তারপর বাঁ-পা তারপর কোমরের নীচে থেকে পুরোটাই প্যারালিসিস হয়ে যায়। তিন্নি খোঁজখবর নিয়ে একটা মোটর অপারেটেড হুইল চেয়ার নিয়ে আসে যাতে রাহুল অন্তত ঘরের মধ্যে চলা ফেরা করতে পারে।

কিন্তু মাস খানেকের মধ্যে রাহুলের শরীরের উপর অংশ-ও কমজোর হতে হতে সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়। তখন থেকে তিন্নি

সকাল-দুপুর-সন্ধে-রাত্রি শুধু রাহুলের সেবা-শুশ্রুষায় নিজেক ব্যস্ত রাখল। শুরুতে অনেকে নার্স রাখতে বলেছিল, কিন্তু আর্থিক অবস্থার কথা ভেবে তিন্নি নার্স বা রাতে একজন আয়া রাখার পরিকল্পনাও ত্যাগ করল। প্রতিদিনের ঠিকে কাজের মাসিকেও ছাড়িয়ে দিল। ধীরে ধীরে তিন্নির সাধের বাড়ি, সাধের সংসারে দৈন্যতা গ্রাস করল।

তিন্নি আজ সকাল সকাল উঠে পড়েছে। অবশ্য রাতে তাকে তিন চার বার এমনিতেই উঠতে হয় রাহুলের জন্য। কিন্তু আজকে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে না উঠলে চলত না। বাড়ি-ঘরদোর পরিষ্কার করে ওদের জন্য কিছু খাবার-দাবারও তো বানাতে হবে। রাহুলকেও তৈরি করতে হবে। দিগন্তর কথামতো তিন্নি গতকাল রাহুলের দাড়ি কামিয়ে দিয়েছিল। দিগন্ত বলেছিল একদম ক্লিনশেভ হলে অসুস্থ মনে হবে না আবার চার পাঁচ দিনের বেড়ে যাওয়া দাড়িতে ভীষণ অপরিচ্ছন্ন লাগবে তাই ভিডিও তোলার সময় যেন রাহুলের গালে একদিনের দাড়ি থাকে।

এই ভিডিও তোলার ব্যাপারে রাহুলের সেরকম সায় ছিল না। কিন্তু রাহুল আজকাল ভালো করে কথা বলতেও পারে না। দুটো তিনটে শব্দ বললেই হাঁপিয়ে যায়। তাই তিন্নির কাছে ফান্ড রেইজিং-এর ব্যাপারটা শুনেও নিজের অপরাগতার কথাটাও বলতে পারেনি। তিন্নি রাহুলের মনের কথাটা বুঝতে পেরেও না বুঝতে চাইছিল। সত্যিই তো তিন্নির থেকে কে আর ভালো জানে যে ওদের আর্থিক অবস্থা কতটা খারাপ। আর বন্ধুরা তার জন্য এতটা ভাবছে তারও তো একটা মুল্য আছে।

সুপর্ণার পিসতুতো বোন কৃপা এসেছে আমেরিকা থেকে। সুপর্ণার কথায় সেও রাজি হয়েছে ভিডিওতে থাকতে, যাতে ও ওর আমেরিকার বন্ধুদের কাছেও ভিডিওটা শেয়ার করে ফান্ড রেইজিং এ অ্যাপিল করতে পারে এবং আশা করা যায় সেক্ষেত্রে রেসপন্স ভালো পাওয়া যাবে।

ঠিক দশটার সময় ওরা মানে দিগন্ত, দীপা, অরুণাভ, সুপর্ণা আর কৃপা চলে এল। বেশ গল্প করার মতো করে একটা তিন চার মিনিটের ভিডিও তুলল দিগন্ত। রাহুলের চার পাশে বসে তিন্নি আর বাকি বন্ধুরা কিছুটা বাংলায় কিছুটা ইংরেজিতে রাহুলের ব্রাইট পাস্ট ও স্ট্রাগলিং প্রেজেন্ট সম্বন্ধে বলল। তারপর সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিল, ‘আমরা কি কিছুই করতে পারি না রাহুলের জন্য।’

ওরা চলে যাবার পর তিন্নি বেশ হাসি মুখে রাহুলের কাছে এসে বলল, ‘কি কেমন লাগছে? এখন কত লোক তোমার ভিডিও দেখবে, তোমার কথা জানবে। কৃপা তো বলছিল অনেক দেশে নাকি এমএনডি সোসাইটি বলে সংস্থান আছে, যারা এমএনডি পেশেন্ট নিয়ে রিসার্চ করে, ওদের নানা ভাবে সাহায্য করে এমনকী ওদের বাড়ির লোকেদেরও নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে বলে, মানে শেয়ারিং দ্য এক্সপিরিয়েন্স আর কি।’ তিন্নিকে খুশি দেখে রাহুলেরও খুব ভালো লাগছিল। ও তিন্নির চোখে চোখ রেখে হাসবার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না।

তিন্নি এগিয়ে এসে রাহুলের মাথাটা নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলল, ‘আর চিন্তা কোরো না। আজকে রাতের মধ্যে ভিডিওটা সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড হয়ে যাবে। দিগন্ত ওর ব্যাংকে আমার নামে তোমার জন্য একটা অ্যাকাউন্ট খুলে দিচ্ছে। ও তো বলছিল প্রচুর ডোনেশন আসবে। এমন কি বাইরের দেশ থেকেও কেউ হয়তো তোমার চিকিৎসার জন্য স্পনসরও করতে পারে। আমি তো বলেছি ওদের যে আমাদের পাসপোর্ট তৈরি করা আছে।’

তিন্নি হয়তো আবেগের বশে আরও কিছু বলত কিন্তু তার আগেই রাহুলের চোখের জলে ওর কামিজের বুকের কাছটা ভিজে যাওয়ায় ও চুপ করে যায়। তারপর নিজের চোখের জল চেপে রেখে রাহুলের চোখ দুটো পরম আদরে মুছিয়ে দেয়।

তিন

আজ পুরো এক মাস হয়ে গেল রাহুলের ভিডিওটা সোশ্যাল মিডিয়ায় আসার পর। আগে থেকে করা প্ল্যানমতো ওরা বন্ধুরা একে অন্যকে ট্যাগ করে শেয়ার করছিল যাতে ওটা বেশ কিছুদিন মিডিয়াতে থাকে। এই এক মাসে প্রচুর লোকে প্রচুর কমেন্ট করেছে , চোখের জল ফেলেছে, এমএনডি-র চিকিৎসা নিয়ে কথা বলেছে, তিন্নির প্রশংসা করেছে, পুরোনো বন্ধু-বান্ধবরা ফোন করেছে। ফুলের তোড়া, ফলের ঝুড়ি নিয়ে দেখা করে উঁহু-আহা করে গেছে কিন্তু তার নতুন খোলা অ্যাকাউন্টে মাত্র সাড়ে চোদ্দো হাজার টাকা জমা পড়েছে। আর তার মধ্যে আত্মীয়স্বজনরা এই নিয়ে খোঁটা দিতেও ছাড়ছে না।

ওর নিজের বউদি তো সেদিন বাড়ি বয়ে এসে শুনিয়ে গেল, ‘তোর তো অনেক বুদ্ধিরে তিন্নি, কি মর্মস্পর্শী ভিডিও বানিয়েছিস নিজের স্বামীকে নিয়ে। তা এখন অবধি কত পেলি ওটা থেকে?’ তারপর তিন্নি কোনও উত্তর দিচ্ছে না দেখে নিজে থেকেই আবার বলে উঠল, ‘আর আমাদের দ্যাখ, তোর দাদার একার রোজগারে আমাকে পাঁচজনের

সংসার চালাতে হয়। মায়ের ওষুধের জন্যই তো কত টাকা খরচা হয়ে যায়, কিন্তু তা বলে তো লোকের কাছে হাত পাততে পারব না। তোর দাদার সন্মানটারও তো খেয়াল রাখতে হবে।’

তিন্নি জানে মায়ের টুকটাক অসুখবিসুখ প্রায়ই হয়। আগে তিন্নি গিয়ে মাকে ডাক্তার দেখানো বা ওষুধ কেনা এগুলো করত। কিন্তু এখন সেটা করতে পারছে না। এমনকী আগে মাকে যে হাত খরচের টাকা দিত সেটাও গত দুমাস দেয়নি, দাদাই মানা করেছিল। কিন্তু বউদি যে পাঁচজনের সংসার বলল তার মধ্যে চারজন তো ওরাই , তাহলে সব অসুবিধা মা-কে নিয়েই। তিন্নি যে মা-কে নিয়ে এসে এখানে রাখবে তাও তো সম্ভব নয়, তাই সেদিন বউদির কথাগুলো চুপচাপ শুনে যাওয়া ছাড়া তিন্নির আর কিছু করার ছিল না।

তিন্নির চিন্তার জালটা ভেঙে হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল। ফোনটা চালু করে বলল, ‘হ্যালো।’ ও-প্রান্ত থেকে এক মহিলা কণ্ঠস্বর, ‘হ্যালো অ্যাই অ্যাম সারা কলিং ফ্রম মুম্বই। অ্যাম অ্যাই স্পিকিং টু মিসেস অপরাজিতা সেন?’

অপরিচিত আওয়াজে অন্যরকম উচ্চারণে নিজের নামটা শুনে তিন্নি বেশ ঘাবড়ে গিয়ে কোনওমতে বলল, ‘ইয়েস আমি তিন্নি মানে, অ্যাই অ্যাম অপরাজিতা সেন।’

‘দ্যটস্ গুড! ইয়োর ফ্রেন্ড কৃপা গেভ মি ইয়োর ডিটেলস্ অ্যাজ উই আর ডুইং রিসার্চ অন এমএনডি। ওয়ান অফ আওয়ার ক্লায়েন্ট হ্যাজ পাসড্ অ্যাওয়ে ডে বিফোর ইয়েস্টারডে সো উই আর লুকিং ফর আনাদার পার্শন হু ক্যান হেল্প আস টু ফিনিশ আওয়ার রিসার্চ। ডু ইউ থিংক ইয়োর হ্যাজবেন্ড উইল লাইক টু গেট ইনভলভড ইন দিস রিসার্চ?’

হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো করে তিন্নি বলল, ‘ইয়েস ইয়েস উই আর রেডি।’

‘নো ইট ইজ নট ফর ইউ বাট ফর ইয়োর হাজবেন্ড। উই নিড হিজ কনসেন্ট আনলেস ইউ হ্যাভ দ্য মেডিকেল পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি ফর হিম। ইউ নো উই হ্যাভ টু কাম ফ্রম মুম্বই সো উই ডোন্ট ওয়ান্ট এনি লিগ্যাল হ্যাসেল।’

‘ইয়েস হি ইজ উইলিং টু পার্টিসিপেট, ইউ ক্যান টক টু হিম’ বলে দৗড়ে গিয়ে রাহুলের কাছে গিয়ে বলল, ‘ওরা ফোন করেছে ফরেন থেকে– মানে এখন মুম্বই থেকে, তোমার সঙ্গে কথা বলবে, মানে কনসেন্ট না কি যেন নেবে, তুমি কিন্তু হ্যাঁ বলবে।’

রাহুল ফোনে এক দুবার ‘ইয়েস’ আর ‘ওকে’ বলার পর ফোনটা তিন্নিকে দিল। সারা জানাল ও আর শ্যাম, ওর রিসার্চ পার্টনার কাল বা পরশু রাহুলকে দেখতে আসবে, হয়তো দু তিন দিন লাগবে ওদের কাজ শেষ করতে। তিন্নির মুষড়ে পড়া মনটা আবার একটা আশার আলো দেখতে পেল। শোবার ঘরে গিয়ে রাহুলের পাশে শুয়ে পড়ে দেখল রাহুল টিভি-টার দিকে তাকিয়ে থাকলেও যেন অন্য কিছু ভাবছে। জিগ্যেস করল, ‘কী হল তুমি কি ভাবছ?’

বড়ো একটা শ্বাস টেনে রাহুল বলল, ‘কত দেবে?’

‘কি কত দেবে?’

‘টাকা কত দেবে?’

তিন্নি অবাক হয়ে উঠে বসে বলল, ‘টাকা কেন দেবে? ওরা তো রিসার্চ করবে, আমরা কত লাকি বলো যে ওরা আসছে আমাদের এখানে।’

‘গিনিপিগ-রা লাকি হয় না’ রাহুল হাঁপাতে হাঁপাতে বলল ‘রেমিউনিরেশন দেওয়া নিয়ম, টাকাটা অবশ্য নিও।’

তিন্নি আর কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি রাহুলকে অক্সিজেন মাস্কটা দিল।

রাহুলের মাস্কটা লাগিয়ে তিন্নি ভাবল, দিগন্তকে ফোন করে খবরটা দেবে। কিন্তু এরই মধ্যে কলিংবেল বেজে উঠল, কেউ এসেছে। দরজার আইহোল দিয়ে দেখল এক মধ্য তিরিশের ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন দরজার সামনে, দেখে মোটেই সেলসম্যান মনে হচ্ছে না। দরজাটা সামান্য খুলে তিন্নি জানতে চাইল, ‘কাকে চাইছেন?’ হাতজোড় করে নমস্কার করে ভদ্রলোক বললেন, ‘নমষ্কার বউদি আমি মৃদুল, বাবলুদা-র কাছ থেকে আসছি।’ তারপর তিন্নিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে আবার বলল, ‘বাবলুদা মানে অনুপম সিকদার যাকে আপনারা ভোট দিয়ে জেতালেন এবার। আমাকে বাবলুদা পাঠালেন আপনাদের মানে রাহুলবাবুর খোঁজখবর নেবার জন্য। উনি নিজেই আসতেন কিন্তু একটা বিশেষ কাজে ওনাকে দিল্লি যেতে হল হঠাৎ তাই–’

নিজের অজান্তেই থতোমতো খেতে খেতে তিন্নি কখন যে দরজাটা খুলে দিয়েছিল তা সে নিজেই বুঝতে পারেনি। তারপর খেয়াল হতেই হাত জোড় করে নমস্কার করে বলল, ‘দেখুন আপনাকে তো আমি ঠিক চিনি না, তাছাড়া আমি তো অনুপমবাবুকে কিছু বলিনি রাহুলের সম্বন্ধে। এখন একটু ব্যস্ত আছি, তাই–’

‘না না বউদি আমি আপনার সময় নষ্ট করব না, আমি জানি আপনি রাহুলদাকে নিয়ে কতটা ব্যস্ত, বাবলুদা কিছু ফল টল পাঠিয়ে ছিল সেটা যদি আপনি নিতেন তাহলে বাবলুদার ভালো লাগত। তারপর তিন্নিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ঘাড় ঘুড়িয়ে হাঁক দিল, ‘অ্যাই বিশু ওটা বউদির ঘরে রেখে দে।’

এতক্ষণে তিন্নির নজরে পড়ল আরেকটি বেঁটে, গাঁট্টা-গোট্টা ছেলে সিঁড়ির একধাপ নীচে দাঁড়িয়ে ছিল। সে পায়ের কাছে রাখা পেল্লাই একটা ঝুড়ি তুলে নিয়ে তিন্নিকে প্রায় ধাক্বা দিয়ে সরিয়ে ঘরে ঢুকে টেবিলে ঝুড়িটা রেখে ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে যেতে বলল– ‘চললাম মৃদুলদা,আমার ব্যাপারটা ভুলো না কিন্তু। কাল ক্লাবে আসব।’

হতবাক তিন্নিকে কথা বলা থেকে রেহাই দিয়ে মৃদুল নিজেই বলে চলল, ‘কি আশ্চর্য দেখুন আমরা প্রায় একই পাড়ায় থাকি অথচ রাহুলদার ব্যাপারটা জানতেই পারিনি। ক্লাবের একটা ছেলে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ওনার অসুস্থতার কথাটা জানতে পেরে আমাদের বলল! আসলে বুঝলেন তো সারাদিন এত ব্যস্ত থাকি। বাবার বয়স হয়েছে তাই পারিবারিক ব্যাবসাটাও দেখতে হয় তার ওপর অনুপমদার-ও টুকটাক বেশ কিছু কাজ থাকে। সেগুলো করতে হয়, উনি আমাকে ছোটোভাই-এর মতো দেখেন। মা-তো বলেন আমি ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াই। কিন্তু বলুন বউদি বনের মোষ তাড়াবার জন্যও তো উপযুক্ত লোক দরকার।’ মৃদুল হয়তো আরও কিছু বলে যেত কিন্তু ঘরের ভিতর থেকে রাহুলের আওয়াজ পেয়ে তিন্নি তাড়াতাড়ি বলল, ‘রাহুল বোধহয় কিছু চাইছে। আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে পরে কথা বলব– বুঝতেই পারছেন তো।’

মৃদুল অমায়িক হাসি হেসে পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে তিন্নির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘না না মনে করব কেন। আমি তো জানি আপনি কত ব্যস্ত। মনে রাখবেন আজ থেকে আপনি একা নন আপনার সঙ্গে আমরা আছি। আমার কার্ডটা রাখুন, প্রয়োজন হলে জাস্ট একটা ফোন করে নেবেন, আমি চলে আসব।’

তিন্নির হাতে কার্ড ধরিয়ে হাত জোড় করে নমস্কার করে মৃদুল যখন সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেল তিন্নি বুঝতে পারল না মৃদুলের আঙুলগুলো কি ইচ্ছাকৃত ভাবেই তিন্নির আঙুলগুলোকে একটু অন্যরকম ভাবে ছুঁয়ে গেল নাকি ওর বুঝতে ভুল হল।

ওরা মানে শ্যাম আর সারা প্রায় আধ ঘন্টা আগে চলে গেছে। ছিল প্রায় ঘন্টাখানেক। তিন্নি ভাবেইনি এতো তাড়াতাড়ি ওদের কাজ হয়ে যাবে। শুরুতে ওদের সাথে রাহুলের কাছে মিনিট দশেক ছিল তারপর ওরা যখন রক্ত আর স্যালাইভা স্যাম্পল নেওয়া শুরু করল তখন তিন্নি আর ওখানে বসে থাকতে পারেনি। ওদেরকে বলেই শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বসার ঘরটায় বসেছিল। কাল রাতে এমনিতেই ঘুম হয়নি।

মৃদুলবাবু চলে যাবার পর তিন্নি যখন দিগন্তকে ফোন করে আজকে রাহুলের অ্যাপয়েন্টমেন্টের কথাটা বলে ছোট্ট করে মৃদুলের কথাটাও বলেছিল, তখন মনে হল দিগন্ত যেন ওর কথাগুলো শুনেও শুনছে না। তিন্নি তো সময়টা দেখেই ফোন করেছিল যাতে দিগন্ত বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিতে পারে। তিন্নি ভেবেছিল দিগন্তকে আজকে আসতে বলবে কারণ ও যদি সারাদের সঙ্গে ঠিকঠাক কথা বলতে না পারে। কিন্তু দিগন্তর কেমন গা ছাড়া ভাব দেখে তিন্নি আর কিছু বলে উঠতে পারেনি। পরে বেশ রাতে সুপর্ণার ফোন পেয়ে তিন্নির কান্না পেয়ে গিয়েছিল। অত রাতে সুপর্ণার ফোন পেয়ে তিন্নি বেশ অবাক হয়ে গিয়েছিল।

রাহুলের পাশ থেকে উঠে গিয়ে বসার ঘরে ঢুকে সুপর্ণার সঙ্গে কথা বলে তিন্নি যা বুঝল সেটা হল সোশ্যাল মিডিয়ায় রাহুলের

ভিডিওটা-তে কেউ একজন গত মাসে তিন্নির প্রেগন্যান্সি টারমিনেশনের কথাটা পোস্ট করেছে আর সেই নিয়ে বেশ কিছু খারাপ মন্তব্য আসছে। কোনওমতে কথাটা শেষ করে সুপর্ণা বলেছিল, ‘দ্যাখ তিন্নি কাউকে প্লিজ বলিস না যে আমি তোর সঙ্গে গিয়েছিলাম তোর টারমিনেশন করাতে। জানিস তো আমাদের জয়েন্ট ফ্যামিলি। যাতে কেউ জানতে না পারে তাই সবাই ঘুমোবার পর তোকে ফোন করছি। আমার শ্বশুরবাড়ি ভীষণ রক্ষণশীল, আমি এর মধ্যে আছি জানলে আর রক্ষা নেই!’

সুপর্ণার সঙ্গে কথা বলার পর তিন্নি বাকি রাতটা আর ঘুমোতে পারেনি, এমনকী ভিডিওটায় পোস্ট করা কমেন্টগুলো পড়বার সাহসও পায়নি। তিন্নি যখন তার প্রেগন্যান্সির কথা জানতে পেরেছিল ততক্ষণে রাহুলের অসুখ অনেক অ্যাডভানস্ড স্টেজে পৗঁছে গিয়েছিল, তাই রাহুলকে ব্যাপারটা বলে ওর কষ্ট আর বাড়াতে চায়নি। দোনামনা করে একটু সময় নিয়েই টারমিনেশন করাবার সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল কারণ ওদের পক্ষে সত্যি করে বাচ্চা রাখা সম্ভব ছিল না। তিন্নি আর কী করতে পারত? ওর নিজের মনে যে কত কষ্ট জমে আছে তা কি লোকে বুঝতে পারছে না?

পড়ন্ত বিকেলের দিকে তাকিয়ে তিন্নি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল, রাহুলের বিকেলের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। রাহুল তো ভালো করে চিবিয়ে খেতে পারে না, আর আজকে অনেকটা ধকল গেছে ওর ওপর দিয়ে। তাই ভাবল আজকে একটু নরম করে নোনতা সুজি বানিয়ে দেবে। রাহুলের বেশ পছন্দের খাবার এটা। রাতের জন্য চিকেন স্যুপটা পরে না হয় চটপট বানিয়ে নেবে।

রান্নাঘরে ঢোকা মাত্র ওর ফোনটা বেজে উঠল, দেখল দিগন্তর ফোন।

‘কি রে কেমন আছিস? রাহুলের কি খবর? ওরা এসেছিল?’ দিগন্ত জানতে চাইল।

‘হ্যাঁ একটু আগে কাজ শেষ করে ওরা গেল।’ তিন্নির ছোট্ট উত্তর।

ওপাশ থেকে দিগন্ত কিছু বলছে না দেখে তিন্নি জিজ্ঞেস করল, ‘তোর কী খবর? কোনও কারণে আপসেট আছিস মনে হচ্ছে?’

‘একটু আপসেট আছি রে। বাড়িতে প্রবলেম হচ্ছে।’

‘কেন রে? কী হল হঠাৎ? সংগীতা ঠিক আছে তো?’ তিন্নি উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল।

‘জানিস তো সংগীতা প্রেগন্যান্ট– সিক্স মান্থ চলছে। তোর ব্যাপারে কিছু লোক উলটো-পালটা কথা লিখছে আর এদিকে আমার বউ আমাকে সন্দেহ করছে। কাল তোর সঙ্গে কথাও বলতে পারলাম না সেইজন্য। ভাবলাম অফিসে এসে তোকে বুঝিয়ে বলব।’

তিন্নি বুঝতে পারছিল না এর থেকে আর কী খারাপ হতে পারে। কোনওমতে বলল, ‘তুই কি চাইছিস আমি সংগীতার সঙ্গে কথা বলি? ওকে আমার অবস্থাটা বুঝিয়ে বলব।’

‘না না প্লিজ ওকে ফোন করিস না। তোর সঙ্গে আমি কথা বলেছি জানলে আরও ঝামেলা হবে। আমার এত খারাপ লাগছে যে কী বলব। তোর এই বিপদে তোর পাশে থাকব বন্ধুর মতো তা নয়, আমি এখন আমার ঘর সামলাতে ব্যস্ত। শোন প্লিজ আমাকে ভুল বুঝিস না। আমার মোবাইলে বা বাড়িতে ফোন না করে প্রয়োজন হলে তুই আমার অফিসের নাম্বারে ফোন করিস। তা ছাড়া আমি তোকে রেগুলার ফোন করব অফিস থেকে।’

‘আচ্ছা, ভালো থাকিস।’ দিগন্তকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিন্নি ফোন অফ করে দিল।

নিজেকে যতটা পারে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও রাহুলের কাছে তিন্নি বোধহয় ধরা পড়ে গেল। যখন ওকে সুজিটা খাওয়াতে গেল রাহুল প্রথমে চোখের ইশারায় বার কয়েক জানতে চাইল কী হয়েছে? তারপর তিন্নি এড়িয়ে যাচ্ছে দেখে মুখ ফুটে জিগ্যেসই করে ফেলল, ‘কী হয়েছে?’

তিন্নি একটু শুকনো হাসি হেসে বলল, ‘কী আবার হবে? কিছু হয়নি। একটু টায়ার্ড লাগছে। আজ একটু তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ব। কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি।’

তিন্নি যখন রাহুলের চোখকে ফাঁকি দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে তখন ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি তার জন্য আরও কী অপেক্ষা করছে।

সন্ধ্যাবেলায় রাহুলের সঙ্গে বসে ঘন্টাখানেক টিভি দেখার পর সবে চিকেন স্যুপটা বানাতে গেছে, দরজায় ঘন্টির আওয়াজ পেল।

দরজার সামনে রাহুলের দিদি আর জামাইবাবুকে দেখে বেশ ঘাবড়ে গিয়ে দরজা খোলামাত্র দিদি ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে সোজা রাহুলের কাছে গিয়ে কেঁদে বলল, ‘তুই আমাদের কি নিজের বলে ভাবিস না ভাই? কেন এটা করলি?’

রাহুলের থতোমতো ভাব দেখে দিদি আবার বলে উঠল, ‘তোরা একবার তো আমাদের জিগ্যেস করতে পারতিস, তোরা না পারলেও তোদের বাচ্চার দায়িত্ব না হয় আমরা নিতাম। কেন ওকে পৃথিবীতে আসতে দিলি না?’

রাহুল লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, ‘কার বাচ্চা? কী বলছ?’

‘তোদের বাচ্চা। আজকেই তো জানলাম যে তিন্নি গতমাসে টারমিনেশন করিয়েছে। কেন করলি তিন্নি? রাহুল বললেই কি তোকে মানতে হবে?তোর তো বাচ্চা, তুই তো আটকাতে পারতিস।’

‘রাহুল এ ব্যাপারে কিছু জানে না দিদিভাই। ওকে আমি জানাইনি। যা করার আমিই করেছি।’ তিন্নি শান্ত স্বরে প্রতিটা কথা কেটে কেটে বলল।

দিদি তার কান্না ভুলে রাহুলের পাশ থেকে সরে এসে তিন্নির সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ‘কি বললি ভাই জানতই না তোর প্রেগন্যান্সির কথা। তার মানে তুই টারমিনেশন করিয়েছিস সেটাও জানে না। তুই কী করে এত নিষ্ঠুর হতে পারলি তিন্নি?’

রাহুলের দিকে না তাকিয়েও তিন্নি বুঝতে পারছিল যে ওর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ও খুব জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। তাড়াতাড়ি ওকে অক্সিজেন মাস্কটা দিতে গেল কিন্তু রাহুল বার বার মাথা সরিয়ে নিল। কিছুতেই মাস্ক পরাতে দিল না।

তিন্নি সামান্য হেসে বলল, ‘দিদিভাই আমি একটা বাচ্চা নিয়েই খুব ভালো আছি– আরেকটা নিয়ে কি করতাম? রাহুলই আমার সবকিছু দিদিভাই। আমার যে আর কিছুর দরকার নেই।’

তিন্নির গলার আওয়াজে হয়তো এমন কিছু ছিল যে, দিদি একটু থমকে গেল কিন্তু তার পরেই আবার বলল, ‘তুই এসব কথা বলে রাহুলকে চুপ করাতে পারবি তিন্নি কিন্তু আমাকে নয়। তোর একবারও মনে হল না যে, রাহুল না থাকলেও ওর একটা অংশ তোর সঙ্গে থাকতে পারত। তোর একবারও মনে হল না বাচ্চাটা থাকলে আমাদের বংশটা এখানেই শেষ হতো না? তুই নিজে হাতে আমাদের বংশটাকে শেষ করে দিলি তিন্নি।’

তিন্নি চোখের জল চেপে ছুটে রান্নাঘরে যাবার চেষ্টা করতেই দিদি পিছন থেকে ওর হাতটা টেনে ধরে বলল, ‘কোথায় যাচ্ছিস? তোকে বলতে হবে কার পারমিশন নিয়ে তুই এটা করালি?’

দিদি হয়তো আরও কিছু বলত কিন্তু জামাইবাবু বসার ঘর থেকে উঠে এসে দিদিকে ধমক দিয়ে বলল, ‘কী আরম্ভ করেছ রেখা? চ্যাঁচামিচি কোরো না। রাহুল অসুস্থ এটা ভুলে যেও না।’

দিদিও ফোঁস করে উঠল, আমার ভাই যে ভীষণ অসুস্থ সেটা আমি ভালো করেই জানি। আর তাই তো বলছি ভাইয়ের শেষ চিহ্নটাও তিন্নি মুছে ফেলল। মানুষ কী করে এত নিষ্ঠুর হতে পারে? নাকি লোকে যা বলছে সেটাই সত্যি! –ওটা আদৗ ভাই এর ছিল না।’

তিন্নি ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়াল, তারপর দিদির চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘একটু আগেই তুমি বললে না বাচ্চাটা আমারও ছিল। হ্যাঁ, এটা আমার বাচ্চাই ছিল তাই যেটা উচিত মনে হয়েছে আমি করেছি। বাচ্চার বাবার বা বাড়ির লোকের পারমিশন নেবার দরকার মনে করিনি।’

‘তা করবি কেন? এটা তো তোর পাপ তিন্নি। রাহুল তো কবে থেকেই–’

‘চুউপ, চুউ’ দিদির কথা শেষ হবার আগেই রাহুল বীভৎস চিৎকার করে উঠল।

রাহুলকে নিয়ে ওরা যখন চলে গেল তখনও তিন্নি কাঁদতে পারল না। রাহুলের শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে ওর মনে অজস্র প্রশ্ন একের পর এক জমা হচ্ছিল। তাহলে সবার মতো রাহুলও ওকে ভুল বুঝল। রাহুলের জন্য ওর ভালোবাসা, ওকে ভালো করে তোলার এত প্রচেষ্টা, এত কষ্ট সহ্য করা সব বিফলে গেল, শুধুমাত্র একটা সিদ্ধান্ত নিজে নেবার জন্য! রাহুল যদি জানত তাহলে কি তিন্নিকে টারমিনেশন করাতে দিত? যদি বাচ্চাটা আসত। পৃথিবীতে তাহলে তিন্নি কী ওকে একা মানুষ করতে পারত? রাহুল ছাড়া তিন্নি নিজেকে কী করে সামলাবে তাই জানে না সেখানে একটা বাচ্চা না নিয়ে ও কি খুব ভুল করেছে? সারা জীবন প্ল্যান করে চলা রাহুল কেন তাদের আনপ্ল্যান্ড প্রেগন্যান্সি নিয়ে তিন্নিকে ভুল বুঝল? না কি কারওর অনুমতি না নিয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই তার অপরাধ?

রাহুলের এভাবে চলে যাবার জন্য কি তিন্নি দায়ী?

তিন্নির এইসব আকাশ-পাতাল চিন্তার মাঝে বাড়ি ধীরে ধীরে খালি হয়ে গেল। কাল রাতে বাড়ি চলে যাবার পর দিদি খবর শুনে আজ সকালেই আবার চলে এসেছিল, অনেক কান্নাকাটি করেছে কিন্তু তিন্নির দিকে ঘুরেও তাকায়নি কথা বলা তো দুরের ব্যাপার। জামাইবাবু যতটা সম্ভব সব কিছু সামলেছেন। দিদি কাঁদতে কাঁদতে কয়েকবার অজ্ঞান হয়ে যাবার পর তাকে ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি পৗঁছে দিয়ে আবার ফেরত এসেছেন। বন্ধুদের কয়েকজন রাহুলের সঙ্গে গেছে। দিগন্ত কোনও কাজে আটকা পড়ে এখানে আসতে পারেনি বলেছে সোজা ওখানে চলে যাবে রাহুলকে শেষবারের মতো দেখতে।

দাদা গেছে বউদিকে উত্তরপাড়ায় রেখে আসতে। ছেলে দুটোর পরীক্ষা তাই বউদি ওদের পাশের বাড়িতে রেখে এসেছিল। দাদা বলেছে যত রাতই হোক বউদিকে বাড়ি পৌঁছিয়ে ও এখানে ফেরত আসবে। থাকবে ক’দিন তিন্নির কাছে। এখন বাড়িতে শুধু তিন্নি আর মা রয়েছে। এমন সময় হঠাৎ করে শ্যাম হাজির। ও গতকালই বলেছিল যে আজ বিকেলে আসবে রাহুলের আরও কয়েকটা টেস্ট করার জন্য। এত কিছুর মধ্যে তিন্নি ওকে ফোন করতে ভুলেই গিয়েছিল। শ্যাম চটপট ব্যাপারটা বুঝে যথা সম্ভব দুঃখ প্রকাশ করে যখন বেরিয়ে যাচ্ছে, সে সময়ে দরজায় মৃদুলবাবু আর তার সেদিনের সাকরেদের আবির্ভাব। তিন্নি চটপট শ্যামকে বলল,  শ্যাম কুড ইউ প্লিজ স্টে হিয়ার ফর সাম টাইম। আই নিড টু ডিসকাস সামথিং উইথ ইউ।’

তারপর মৃদুলবাবুর মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলল, ‘আমি দুঃখিত মৃদুলবাবু। শুনেছেন বোধহয় যে আজ ভোরে রাহুল চলে গেছে। বাড়ি-তে এখন কেউ নেই তাই যদি পরে আসতেন তো ভালো হতো।’

মুখে কোনওমতে একটা সহানুভূতির ভাব এনে মৃদুল বলল, ‘হ্যাঁ খবরটা একটু আগেই পেলাম আর শুনেই তাই ছুটে এসেছি। জানেন তো সারাদিন এতো কাজে ব্যস্ত থাকি তাই হয়তো খবরটা পেতে দেরি হল। ভাবলাম বাড়িতে হয়তো একা আছেন একটা কথা বলার লোক পেলে হয়তো ভালো লাগবে। তাই খবরটা শোনা মাত্রই কাজ ফেলে ছুটে এলাম, বলেই ঘাড় ঘুড়িয়ে হাঁক দিল, অ্যাই বিশু ফুলগুলো রাহুলবাবুর ঘরে রেখে আয়।

বিশু একপা এগোবার আগেই তিন্নি দরজা আগলে দাঁড়িয়ে বলল, ‘অতগুলো ফুল রাখার জায়গা তো নেই আমার বাড়িতে। কিন্তু আপনারা কষ্ট করে এনেছেন বলে একটা মালা খালি আমি নিচ্ছি আর শুনুন আমি এখন ব্যস্ত আছি আপনার সঙ্গে এখন কথা বলার সময় পাব না। কিছু মনে করবেন না যেন।’

‘না না ঠিক আছে। দেখতেই পারছি আপনি ব্যস্ত আছেন। পরে কখনও না হয় আবার আসব।’ শ্যামের দিকে একঝলক তাকিয়ে মুখটা স্বাভাবিক রেখে মৃদুল কথাগুলো বললেও তার আওয়াজে মনের রাগটা সহজেই বোঝা গেল।

মৃদুলবাবু সিঁড়ি দিয়ে নামার আগেই তিন্নি শুনতে পেল ফিচেল স্বরে বিশু বলছে– ‘শ্যাম এসেছে রাধার কাছে, গুরু তুমি কি আর নাগাল পাবে?’

সকাল চারটে– ঠিক চব্বিশ ঘন্টা আগে রাহুল চলে গেছে। হয়তো অভিমান নিয়ে, তিন্নির ওপর রাগ করেই রাহুল চলে গেছে। এই চব্বিশ ঘন্টায় তিন্নি অনেক ভেবেছে, নিজের জীবনটাকে ফালা ফালা করে চিরে দেখেছে, নিজেকে আসামির কাঠগোড়ায় দাঁড় করিয়ে নিজেই সওয়াল জবাব করেছে। এখন তার মন অনেকটা শান্ত হয়েছে। ধীরে ধীরে মায়ের পাশ থেকে উঠে রান্নাঘরে ঢুকে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ল্যাপটপটা খুলল। ভিডিওতে যত সব মন্তব্য এসেছে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ল তারপর টাইপ করতে লাগল–

‘কাল ভোর রাতে রাহুল চলে গেল। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আপনারা নানাভাবে আমার মনোবল বাড়িয়েছেন। আপনাদের সহানুভূতি, বক্রোক্তি, কটূক্তি সব কিছুই আমাকে নিজেকে খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে। আমি নিজের নারীসত্ত্বাকে চিনতে পেরেছি, আর তাই আমি মাথা উঁচু করে কোনওরকম দ্বিধা না রেখেই বলছি, আমি আমাদের পরিস্থিতি চিন্তা করেই আমার বাচ্চাকে সরিয়ে নিয়েছি পৃথিবী থেকে। এব্যাপারে আমি মনে করি না যে আমার কারওর থেকে অনুমতি নেবার দরকার ছিল বা আমাকে কারওর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। আর কয়েক ঘন্টা পরে ভিডিয়োটা তুলে নেওয়া হবে। কিন্তু আপনাদের কাছে অনুরোধ আমাকে বা আমার মতো অন্য হতভাগ্যাদের-কে নিজের মতো করে বাঁচতে দিন।’

তার কমেন্টটা পোষ্ট করে দিয়ে তিন্নি কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিল। তারপর যখন চোখ খুলল দেখল রান্নাঘরের পুব দিকের একমাত্র জানলা দিয়ে ভোরের সূর্য উঁকি মারছে।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব