অলকানন্দার জলে

অলকানন্দা,

প্রথম দর্শনে মানুষ প্রেমিকার প্রেমে পড়ে। আমি প্রথম দর্শনে তোমাকে চরিত্রহীন ভেবে বসি। তাছাড়া তোমার শরীরটাও বেশ পুরুষ্ট। সালোয়ারের ভেতর থেকে দুটো পুষি বিড়াল সবসময় উঁকি দেয়। প্রতি মুহূর্তে মনে হতো হাত লেগে গেলে ম্যাও করে ডেকে উঠবে। পরে বুঝেছি হুলোই। এসব অবশ্য শাহিনকে বলিনি। তোমার স্তন দুটোর দুটো নাম দিয়ে ছিলাম তুমি জানো? দোয়েল আর কোয়েল। মনে রাখার সুবিধার জন্য। আসলে আমি মনে মনে দুটোকেই হুলো বেড়াল বলতাম। অত সেজে বাড়িতে কেউ থাকে! থাকে হয়তো। আমার জানা ছিল না। তোমাকেই প্রথম দেখেছিলাম বাড়িতে অত সেজে থাকতে। অবশ্য তোমার থেকে প্রথম দেখা প্রথম শেখা জিনিস আমার জীবনে অনেক। অথচ তুমি আমি কেউ কারও প্রথম প্রেমিক বা প্রেমিকা ছিলাম না।

তোমার খিদিরপুরের যে-অঞ্চলে বাড়ি, সেটা মারদাঙ্গা, খুনখারাপি, রাহাজানির জন্য এক সময়ে কুখ্যাত ছিল। তখন থেমে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু বদনামটা এখনও রয়ে গেছে। বিশেষ করে আমার মতো মফস্সলের ছেলের কাছে তো বটেই। অবশ্য পৃথিবীর যে-কোনও বন্দর শহরের সে বদনাম একটু আধটু থাকেই। তাই বলে কি সেখানে সুন্দরী থাকে না! জলপরিদেরও তো জল থেকে উঠে আসতে বন্দর লাগে। লাগে না? না লাগলে তুমি ওখানে গেলে কী করে?

বদনামটার ভয়ে সেদিন শাহিনকে সঙ্গে নিয়েছিলাম। ও বেচে গাড়ি আর আমি গাড়ির ইনসিওরেন্স। সেদিন ওর ওদিকে কোনও দরকারই ছিল না। ওকে বলেছিলাম তোমরা একটা নতুন প্রাইভেট কার নেবে। আমরা দুজনেই গুড্‌স ভেহিকেলস মানে মালবাহী বড়ো বড়ো লরির এক্সপার্ট। কিন্তু তোমরা তখন সবে চবিবশটা লরির ফ্লিট্ নিচ্ছ। শাহিন আপশোশ করছিল, লিডটা আগে পেলে ও ডিলটা ডান করতে পারত। মার্কেটে চাপা খবর ছিল, তাই ওকে কারের টোপটা দিই। মার্কেটিং লাইনে এসব টুকটাক মিথ্যে কথা চলতেই থাকে। শাহিনও হয়তো মিথ্যেটা বুঝেছিল, কিন্তু ও একবার তোমাদের সঙ্গে আলাপ করতে চাইছিল যদি পরে কখনও গাড়ি কেনার সময় ওকে ডাকো।

খিদিরপুর অঞ্চলে তোমাদের অনেকগুলো বাড়ি। গলি, তার ভেতরে গলি, কখনও কখনও কানা গলিতে ধাক্বা মেরেছি বাইক নিয়ে। তোমাদের ব্যাবসার তখনও অফিস ছিল না। সবে সবে ব্যাবসায় নেমেছ। বাড়ির ঠিকানা একটা ছিল। কিন্তু ঠিকানা থাকলেও কলকাতাতে বাড়ি খুঁজে পাওয়া যে এত কঠিন, সেদিন প্রথম বুঝেছিলাম। গলিগুলোর কত বাহারি নাম। হরিমঞ্চলেন, রামবাবু গুপ্তা রোড, এডেন ভিলা রোড! বললাম না তোমার থেকে কত কী প্রথম শিখেছি। অথচ সেল্সে কয়েক বছর কাজ করার সুবাদে কলকাতায় এ-মাথা ও-মাথা করেছি, কখনও কখনও বাড়ির নাম্বার, রাস্তার নাম না জেনে কিছু ল্যান্ডমার্ক জেনে নিয়েই ঠিক পৌঁছে গেছি।

অনেকটা গলির ভেতর তোমাদের প্রথম বাড়িতে পৌঁছে শুনলাম ঋষি রাজা লেনের বাড়িতে গেলে মালিককে এখন পাওয়া যাবে। গলির ভেতরে গাড়ি ঘোরানো কী যে কষ্টের তোমাকে বোঝানো যাবে না। ওই রকম সরু গলির ভেতর অত লোক যাতায়াত করে সব সময়, বাইক ঘোরাতে গেলেই বোঝা যায়। দু-দিক দিয়ে হইহট্টগোল। জলদি কিজিয়ে, জলদি কিজিয়ে! আরে বাবা জলদিই তো করছি। জলদিরও তো একটা সময় লাগে নাকি!

তবে তোমাদের প্রথম বাড়িটা গলির অনেক ভেতরে হলে কী হবে, ঢুকেই বুঝেছিলাম অর্থের বৈভব। একটা ছাবিবশ-সাতাশ বছর বয়সি ছেলে, পরে তুমি বলেছিলে তোমার ভাই, হিন্দিতে খুব রোয়াবে ঠিকানাটা বলেছিল। অর্ধেক বুঝিনি। শাহিন চট করে ধরে নিয়েছিল ঠিকানাটা। ওর মামার বাড়ি ওই অঞ্চলেই। ছোটো বেলায় খুব থাকত। পার্ক সার্কাস লোহাপুলের বাড়ি থেকে খিদিরপুর কার্ল মার্ক্স সরণিতে সাইকেল নিয়েই যাতায়াত করত তখন। এখন রয়েল এন্ডফিল্ড। যাকে তুমি বুলেট বলো। তোমার বরের তো বুলেট ছিল, বলেছিলে।

দ্বিতীয় বাড়িটায় পৌঁছোলাম চট করে। রাস্তাটা শাহিন চিনত। ওর বাল্যবন্ধুর বাড়ি। আর বাড়িটাও চওড়া রাস্তার ধারে। অথচ দেখো চওড়া রাস্তার নামে লেনের পদবি আর গলিগুলোর রোড, স্ট্রিট। পরে এই নিয়ে দুজনে খুব হাসাহাসি করেছিলাম তোমার মনে আছে? কিন্তু দ্বিতীয় বাড়িতে গিয়ে শুনলাম মালিকের শরীর খারাপ, তাই জিতেন সিং স্ট্রিটের বাড়িতে রেস্ট নিচ্ছেন। এ লোকটা তোমাদের ভাড়াটে। খুব বাবু বাবু করছিল।

দুপুর ঢিঢি করছে চারিদিকে। গরমকাল ছিল মনে আছে। সেল্স-এর লোকেদের অবশ্য এসব অভ্যাস আছে। আমরা মনে মনে নাছোড়বান্দা যে-কোনও সেল্স কলেই। বিশেষ করে এক সাথে চবিবশটা গাড়ির ইনসিওরেন্স মানে আমার বাঁধা ইনসেন্টিভ সে মাসে! অনেকদিন ধরে বউ একটা বালা চাইছিল। সেটা মাথায় ছিল। ফিরে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই ছিল না। তবু একটা তো মানসিক ক্লান্তি আসে। দুই বন্ধুতে রাস্তার পাশের গুমটি থেকে দুটো দামি ব্র্যান্ডের মেন্থল সিগারেট কিনে ধরাই। আমাদের টিফিন বলো, রেস্ট বলো সবই ওই সাদা কাঠির সুখ টান আর ধোঁয়া ভর্তি গালের জাবর কাটা। অবশেষে তৃতীয় বাড়িতে তোমাদের পেলাম। না তোমাকে তো খুঁজতে যাইনি। চবিবশটা ফ্লিটের মালিকের সন্ধান পেলাম।

খিদিরপুর অঞ্চলের গলির ভেতর গলি, তার ভেতরে বাড়ি যে এত বৈভবের হতে পারে ধারণা ছিল না। তৃতীয় বাড়িটা ফ্ল্যাট টাইপের। প্রথম বাড়িটার থেকেও বেশি সাজানো। বাড়িগুলো বাইরে থেকে ইট বালির কঙ্কাল লাগে কিন্তু ভেতরের আসবাব, মেঝে, দেয়ালের কারুকাজ সব অন্যরকম। ওই ঘিঞ্জির মাঝেও যে ইটালিয়ান মার্বেলের মেঝে দেখব ভাবিনি। পুরো ফ্ল্যাটটাই সেন্ট্রালি এসি। গরম থেকে বাড়িতে ঢুকতেই এক রাশ স্বস্তি। যতটা না এসির কৃত্রিম ঠান্ডার জন্য, তার থেকেও বেশি অবশেষে চবিবশটা ফ্লিটের মালিকের কাছে পৌঁছোতে পারার জন্য। দুজনের দুটো ভালো পদ-নাম ছিল। আমি সেল্স ম্যানেজারের তকমা নিয়ে ঘুরি আর শাহিন ব্রাঞ্চ ডেভেলপমেন্ট ম্যানেজার। আসলে আমরা বেচুবাবু। মাল বেচাই কাজ। আমরা যা পাই বেচে দেবার সুযাগ খুঁজি।

অনেক বার বলেছি, তোমাদের ফ্ল্যাটটার নকশা ভালো নয়। কোনও প্রাইভেসি নেই। অতবড়ো ফ্ল্যাট অথচ উদোম। প্রথমে তোমাকে দেখার কথাটা বলি। চবিবশটা ফ্লিটের মালিকের নাম সতীশবাবু, টাইটেল জানি না। আধজানা ঠিকানায় পৌঁছে দেখলাম বড়ো ফ্ল্যাট। নিঃশব্দ। বয়স্ক কাজের মহিলা দরজা খুলে ড্রইংরুমে বসতে দিয়েছে। সোফাটা দামি। বসতেই ডুবে গেলাম। বসেছি ভেতরের দিকে মুখ করে। অপেক্ষা করছি। বেশ অনেকক্ষণ। মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছি বিমাকথা। যে-কোনও ভাবে তুলতেই হবে চেকটা। বউ যে নতুন ডিজাইনের বালা দেখেছে, এক জোড়া না একটাই বানাবে বলেছে। ইনসিওরেন্স ইজ আ সাবজেক্ট ম্যাটার অফ সলিসিটেশন। গুলি মার সলিসিটেশনের। যে করে হোক চেকটা আমার চাই।

আমি বা শাহিন কেউ কথা বলছি না। কাস্টমারের বাড়িতে আমরা একদম শান্ত ভদ্র। চোখে চোখে কথা হচ্ছে। ঠোঁটের অল্প নড়াচড়াতে দুজনে দুজনের ভাষা বুঝতে পারি। দু-একবার পর্দার আড়ালে তোমাকে দেখলাম। নিঃশব্দে নড়াচড়া করছ। আমি আর শাহিন চোখাচোখি করলাম। আবছা অবয়ব। শরীরের বর্ণনা দেব না। প্রেমিকার শরীর নিয়ে কথা বলা নোংরামি। কিন্তু দুজনে তোমাদের সোফায় বসে চোখ দিয়ে নোংরামিই করছিলাম। ওসব ছেলে ছেলেতে হয়ে থাকে। রাগ কোরো না। আর তখন কি জানতাম যে তোমার সাথে ওরকম দুনিয়া ভোলানো প্রেম হবে। আমি দেখতে শুনতে ভালো, লোকে স্মার্ট বলে। বেশ লম্বা চওড়া। ফর্মাল ড্রেসে সবাইকেই ভালো লাগার কথা। তাই বলে তোমার মত মারকাটারি সুন্দরী, সেক্সি বলব না। প্রেমিকাকে সেক্সি বলতে নেই, আমার সাথে প্রেম করবে ভাবতেই পারিনি।

মিনিট কুড়ি মানে অনেকক্ষণ। নতুন জায়গায় এসে বসে আছি অথচ কেউ কোনও কথা বলছে না। কোনও শব্দ নেই। নিঝুম। শুধু তুমি হেঁটেছ কয়েক বার খসখস করে। ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ হওয়ার পরেই বাইরের রোদ, তাপ, কোলাহল থেকে বহুদূরে চলে এসেছি। অন্য একটা শহর মনে হতে শুরু করেছে। ঘরের আসবাব সব অন্যরকম। একবার সদর স্ট্রিটের একটা অ্যাংলো ইন্ডিয়ানের বাড়িতে ঢুকে এরকম মনে হয়েছিল। যেন অন্য শহরের বাড়ি। সে বাড়িটা অবশ্য কেমন পড়ো শহর মনে হয়েছিল। আর এ বাড়িটা খুব উজ্জ্বল। মনে হচ্ছে কোনও অন্তরীপ শহরের আসবাব।

সেল্সম্যানদের ধৈর্য অকল্পনীয়। তবু অস্বস্তি হতে শুরু করেছে। বাইরে বাইকটা পড়ে আছে। এ অঞ্চলের বদনাম ভয় ধরাচ্ছে। চুরি গেলে ইনসিওরেন্সের ফুল ক্লেম পেলেও নতুন বাইক হবে না। আর ক্লেম পেতেও বেশ সময় লাগবে। ততদিন চলবে কী করে! তখনই তুমি বাইরে এলে, এক বৃদ্ধকে প্রায় জাপটে ধরে বাথরুমে নিয়ে যাচ্ছ। একজন পুরুষ আর নারীর প্রকাশ্যে জাপটে থাকা সব সময়ই অশোভন। আর তোমার সেজে থাকা! নেল পালিশ, লিপস্টিক, টিপ। সব কিছু গুলিয়ে দিচ্ছিল তোমার ফেটে পড়া শরীর। অনেক সুন্দরী দেখেছি কিন্তু তোমার মতো যৌবনবতী সুন্দরী আর দেখা হয়নি। তাছাড়া সতীশবাবু বৃদ্ধ হলেও বৃষস্কন্ধ, বয়সের তুলনায় সুঠাম। আমার দোষ কী বলো!

শাহিনও তো তোমাকে ভুল বুঝেছিল। আমি ও শাহিন তোমাকে নিয়ে কত কী ভেবেছি। তৃতীয় পক্ষের বউ, বউমা, নাতনি এমনকী রক্ষিতাও। সেই জন্যই তোমাকে বললাম না, প্রথম দর্শনেই তোমাকে চরিত্রহীন ভাবি। তোমাকে নিয়ে কত গবেষণা করেছি দুজনে। তবু বাপ-মেয়ে একবারও ভাবতে পারিনি। ওরকম জাপটে থাকলে কেউ ভাবতে পারে না। তুমি পরে বলেছিলে বাবা অসুস্থ ছিল। সরি অলকা। বাথরুম থেকে বেরিয়ে তুমি সতীশবাবুকে আমাদের কাছে সোফায় বসিয়ে দিয়ে গেলে। বসাতে গেলে ঝুঁকতেই হয়। আর ঝুঁকতেই তোমার সালোয়ারের ভেতর থেকে দুটো পুষি বিড়াল উঁকি দিয়ে গেল।

কাজের কথা বিশেষ কিছু হল না। তুমিও ওই যে সতীশবাবুকে বসিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকে গেলে আর বেরোলে না। সতীশবাবুর সামনে থেকে তো আর ঘরের পর্দার দিকে তাকিয়ে তোমাকে খোঁজা যায় না। তবু মনে মনে খুঁজছিলাম, যদি আর একবার দেখা যায় সুন্দরীকে। সতীশবাবু জাহাজে কাজ করতেন। আর জাহাজি মানুষের গল্পের শেষ নেই। সমুদ্র বৈচিত্র্যহীন কিন্তু বন্দরের তো গল্প অনেক। তখনই বুঝলাম তোমাদের বাড়ির অঙ্গসজ্জায় কেন বিদেশি সুবাস। বুঝলাম তোমার বাবা আর সমুদ্রে যেতে চায় না, এবার স্থলপথে আয় চায়। অনেক কষ্টে মুক্তি পেলাম। গল্প শুনতে ভালোই লাগছিল। কিন্তু কাজের তাড়া সেল্স-এর লোকেদের তাড়িয়ে বেড়ায়। এডেন বন্দর, তাহিতি, সুয়েজ ক্যানাল এসব গল্প কার না ভালো লাগে। আমার ভূগোলে জ্ঞান খারাপ, তবু ভালো লাগছিল। কানের মধ্যে একটা নতুন পৃথিবী তৈরি হয়ে পৌঁছে যাচ্ছিল হূদয়ে। শুধুমাত্র সতীশবাবুর মোবাইল নাম্বারটাই পেয়েছিলাম সেদিন। কবে আসব ইন্সিওরেন্সের জন্য জিজ্ঞাসা করতে নাম্বারটা দিয়ে বলেছিলেন, আসক্ মি ওভার টেলিফোন অ্যান্ড গিভ মি দ্য কোটেশন! তোমার বাবা ইংরেজি ছাড়া প্রায় কথাই বলতে পারে না।

চিঠিটা খুব বড়ো হয়ে যাচ্ছে জানি। আসলে আমারও তো বয়স বেড়েছে আরও দু-বছর, তোমারও। তোমার আমার গল্পও জমে গেছে অনেক। খুব স্মৃতি জমে গেলে রোমন্থন করেই আনন্দ। এসব কথা ফোনে হয় না। তুমি পড়লে আনন্দ পাবে ভেবেই লেখা। গতকাল আর আগামীকাল দুটোই আমাদের জীবনে দুটো গুরুত্বপূর্ণ দিন। তাই লিখছি আনন্দে আর বিষাদে।

শাহিনের কাছে সতীশবাবু নেগেটিভ কাস্টমার। আমার কাছে ইনসেন্টিভ, বউ-এর গয়না গড়িয়ে দেওয়া প্রত্যাশা। আমি ফলো আপ করব ঠিক করেই সতীশবাবুর থেকে বিদায় নিলাম। তোমাকে নিয়ে বেশি কথা ভাবার ছিল না। শাহিনের সাথে দেখা হলেই ও তোমার রূপ, রূপসজ্জা অথবা রূপটান নিয়ে বলে। তার বেশি কিছু না। আমিই শরীরের বেশি বর্ণনা দিতাম। শাহিন শুনত। তবে তোমাকে নিয়ে আমরা অন্য কোনও লোকের কাছে কথা বলতাম না। যেন আমাদের গোপন অভিযানে পাওয়া সম্পত্তি। জানাজানি হলে অংশীদারের ভয়।

তিনদিন পরে সতীশবাবুকে ফোন করলাম। তোমার বাবা কোটেশন চাইল। কোটেশন তো তৈরিই ছিল। আমি বললাম এখুনি দিয়ে আসছি। এবার আর শাহিনকে নিলাম না। চেনা হয়ে গেছে। সোজা চলে গেলাম জিতেন সিং স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে। যে-ফ্ল্যাটে তোমাকে প্রথম তোমার বাবার সাথে দেখেছিলাম। একবারও ভাবিনি অন্য কোনও বাড়ির কথা।

তোমার একটা অমোঘ টান তো ছিলই। দরজা খুললে তুমি নিজেই। খুব অবাক হলাম তোমাকে দেখে। বিষণ্ণতার ঘন কুয়াশা তোমায় যেন মুড়ে রেখেছে। সেই প্রথম তোমার উপর মায়া হল। ধনীকে হঠাৎ গরিব দেখলে যেমন মায়া লাগে তার অস্বাচ্ছন্দ্যর কথা ভেবে, তেমনি। ভুল ভাঙল একটু পরেই। তুমি ভেতরে বসালে, যেন বাবাকে ডাকতে গেলে। বেশ কিছুক্ষণ আমি একাই সোফায়। খুব অস্বস্তিকর সময়। বাড়িতে একটাও বই নেই। টিভিও নেই যে চোখ মেলে সময় কাটাব। তোমার বাবা এল না। তুমিই এলে। আমার সামনের সোফায় বসলে। বসেই আমাকে সপাটে প্রশ্ন করলে, হ্যাংলার মতো আগের দিন তাকিয়ে ছিলেন কেন? আমি কী উত্তর দেব! লম্বায় ছয় ছুঁই ছুঁই কিন্তু লজ্জায় তখন জল ছুঁই ছুঁই। সেল্স লাইনে আমাকে সবাই ড্যাম স্মার্ট বলে। আমি বেচুবাবু হিসাবে যথেষ্ট কৃতি। গত তিনবছরে আমার মাইনে বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে, প্রোমোশন আর কোম্পানি পালটে। সেই আমি এসির ঠান্ডায় ঘামতে শুরু করি। এক গেলাস জল হলে ভালো হতো। ভাবি, একটা কমপ্লেন দিলেই চাকরিটা যাবে। আর এ-লাইনে চাকরি পাওয়া যাবে না। বউ বাচ্চা খাবে কী!

আমার অবস্থা দেখে তুমি নিজেই হেসে উঠলে। ছোটোবেলায় কুলগাছ নাড়িয়ে যেমন পাকা কুল পাড়তাম, কুল কুল করে তেমনি তুমি হেসে উঠলে। কোটেশন এনেছেন? দিন। বাবাকে দিয়ে দেব। এটা আমার বাড়ি। বাবার বাড়ি নয়। হাসতে হাসতে শুরু করে গম্ভীর হয়ে শেষ করলে কথাগুলো। পরে জেনেছি তুমি নাকি জানতে আমি আসব ওই ফ্ল্যাটেই। তুমি নাকি জানতে আমি ভালোবাসবই।

২৮ মার্চ, রবিবার ৮.১০ সকাল

জামদানীপুর।

রাজেন্দ্রনন্দিনী অলকানন্দা,

বাজার করতে গিয়েছিলাম। তুমি অবশ্য বাজার করা ব্যাপারটা বুঝবে না। নিজের হাতে বাজার করাটা খুব মজার ব্যাপার। টাটকা সবজি বেছে কেনা বা বড়ো হাঁসের ডিমটা খুঁজে নেওয়া। তোমরা ধনী। তোমাদের নিজস্ব বাজার সরকার আছে। সে-ই বাজার করে আনে। তিন বাড়িতে ভাগ করে দেয় বাজার। তুমি অবশ্য বেশির ভাগ দিন হোটেল থেকে খাবার কিনে আনাও বলেছ। তুমি ঝাল খেতে ভালোবাসো। লুকিয়ে দেখা করতে এসে দু-একবার তোমার বাড়িতে রান্না করা খাবার, টিফিন বাক্সে এনেছ। কী ঝাল, কী ঝাল! ঝালে আমি মরে যাই অবস্থা। আমি ভাবলাম তোমার জিভ থেকে ঠান্ডা নেব কিন্তু তোমার জিভও অত ঝাল কে জানত! তুমি ওই ঝাল চিলি চিকেন খেয়েই বেরিয়েছ বাড়ি থেকে। আমাকে বলোনি কেন? সেদিন তোমাকে বিষকন্যার মতো লাগছিল। সেদিন সেজেও ছিলে পাকা লংকা রঙের শাড়িতে।

প্রথম থেকেই তোমাদের ব্যাপারগুলো কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে ছিল। তোমার বাবার ইংরেজি আর ভাইয়ের হিন্দি শুনে ভেবেছিলাম তোমরা অবাঙালি হবে। ‘সতীশ সিং’ তোমার বাবার নাম লিখেছিলাম ইন্সিওরেন্স কভার নোটে মনে আছে। পরে তুমি বললে, তোমরা মুঙ্গেরের প্রবাসী বাঙালি। সিনহা, সিংহ হয়ে সিং-এ পৌঁছেছে। বারুইপুরে তোমাদের আদি শিকড়। বারুইপুর থেকে কয়েক পুরুষ আগে ভাগ্য অন্বেষণে মুঙ্গের। আবার ফেরা কলকাতায়। তোমার সাথে না আলাপ হলে জানতাম না, বারুইপুরে তোমার বাবার বিশাল অট্টালিকার কথা। অবশ্য তোমার সাথে আমার যেটা হয়েছে সেটা আলাপ নয়, দুকূল ছাপানো প্রেম। বারুইপুরের উঁচু পাঁচিল দেওয়া বাগানবাড়িতে একটা যৌবনবতী মহিলা কী করে বালিকাবেলায় ফিরে যেতে পারে সেদিন দেখেছিলাম। সেই প্রথম তোমাকে অযৌনতায় দেখি। খালি পায়ে মেক্সিকান ঘাসের উপর দৌড়োতে দৌড়োতে ক্লান্ত হয়ে আমার কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়েছিলে। আমি ঘাসে বসে তোমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম, যেমন বাড়িতে তিন বছরের মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিই।

আমার মেয়ে তিন্নি খুব আদর খেতে চায়। খুব বায়না। এটা আনবে ওটা আনবে। আজ ক্যাডবেরি তো কাল খেলনা গাড়ি। ওর বায়না মেটাই বলে আমার বউ খুব রাগ করে। মানসী স্কুল মাস্টারের মেয়ে। ওর কাছে আদর্শ ব্যাপারটা সহজাত। পয়সা একদমই নষ্ট করতে চায় না। নিজে দামি পরবে না, মেয়েকেও পরাতে দেবে না। আমার ওইটুকু মেয়ের সাজার খুব শখ। ঠিক তোমার মতো। মাঝে মাঝে মনে হয় তিন্নি তোমার মেয়ে। মানসীর সম্পূর্ণ বিপরীত চরিত্র তোমার ও তিন্নির। মানসী অপ্রয়োজনে সাজে না। বাড়িতে টিপ পরতে বললেও লজ্জা অথচ মানসী দেখতে ভালোই। মুখশ্রী সুন্দর। তোমাকে তো আমাদের বিয়ের ফটো দেখিয়েছি। বাড়ি থেকে লুকিয়ে অ্যালবাম নিয়ে গেছি আমাদের বিয়ের। তুমি বহুবার আমাকে বলেছ তুমি মানসীকে খুব পছন্দ করো। আর তিন্নিকে তোমার খুব ভালো লাগে বলে সেই পছন্দটা এসেছে। তিন্নিকে তুমি বহুবার দেখতে চেয়েছ কিন্তু তিন বছরের মেয়েকে কী করে দেখাই বলো? আরও একটু বড়ো হোক কলকাতায় তোমাকে দেখাতে নিয়ে যাব। এই মফস্সল থেকে এখনই নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। মানসী এখন তিন্নিকে আমার সাথে একা ছাড়বেও না।

আমার মেয়ের কথা, বউয়ের কথা সব বলেছি। আমার বাড়ির সব কথাও। বাবা ঠাকুরদার গরিব জীবনের কথা। বিয়ে করার কথা। অথচ তুমি নিজের কথা ছাড়া বিশেষ কিছু বলতে চাও না। তোমার বাবার কথা মায়ের কথা প্রায় কিছুই বলোনি। যেটুকু জেনেছি তাও আমার অনন্ত প্রশ্নের আগ্রহে শোনা। তোমার মা দুটো বলেছিলে। তারা দুজনেই বেঁচে আছে না মরে গেছে কোনওদিন বলোনি। তোমার ভাই যাকে আমি প্রথমদিনই শাহিনের সাথে প্রথম বাড়িতে দেখি, সে কি তোমার সৎ ভাই? জিজ্ঞাসা করলে তুমি এড়িয়ে যাও। এই সব ব্যক্তিগত প্রশ্ন করলেই তুমি শরীর দেখাও আর আমাকে জাগিয়ে দাও শরীরে। আমি রম্ভার শরীর দেখি, মাখি, ছানি, অসম্ভব সব বক্রতা থেকে আমার মনের মতো যৌনতা খুঁজি। আমাকে তুমি এত শরীরী-সুখ দিয়েছ মাঝে মাঝে মনে হয় তুমিই স্বর্গ অথবা চরম সত্য। অথচ তোমার সাথে যৌনসম্ভোগ তখনও হয়নি। চূড়ান্ত সম্ভোগের কোনও সম্ভাবনাও ছিল না। তুমি কিছুতেই রাজি ছিলে না। তুমি আমাকে শরীরে মাখতে কিন্তু শরীরে নিতে রাজি ছিলে না।

আজ রবিবার। বাজার করে এনে দিয়েছি। এখন খাবার সময় হয়ে এসেছে। মুড়িঘণ্ট ডাল আর খাসির মাংস। স্নান করতে হবে এবার। অথচ কিছুতেই স্নান করতে ইচ্ছা করছে না। গত দু-বছর আমাদের সম্পর্ক। দু-বছরে অনেক কথা হয়েছে। তুমি ভালোবাসবে না শুধু বন্ধুত্ব রাখতে চেয়েছ। সেখান থেকে অনেক কষ্টে তুমি স্বীকার করেছ ভালোবাসো। ভালোবাসা ছাড়া সম্পর্কটা টিকত না। ‘ভালোবাসি’ কথাটা তোমার মুখ থেকে শুনতে চেয়েছিলাম। একটা অন্য রকম স্বীকৃতি। তুমি বললে, সেই অমোঘ শব্দরাশি ভালোবাসি, ভালোবাসি। আমাকে বললে পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে ভালোবাসো। আমি জিজ্ঞাসা করলাম বরের থেকেও? তুমি থমকে গেলে। তারপর আবার সময় চাইলে। তোমার বর কী করে, কোথায় থাকে জানি না। পরে বলেছ সেও বাবার মতো জাহাজি। বাবার দেখে দেওয়া পাত্র। সেও নীল সমুদ্রে ঘুরে বেড়ায়। নীল আকাশে সমুদ্র-পাখি খোঁজে। আমি বলেছিলাম নাবিকের সংসার তো বন্দরে বন্দরে। তুমি কোনও উত্তর দাওনি। আমার মুখের মধ্যে গুঁজে দিয়েছিলে অসম্ভব যৌনতা। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে যাই তোমার কৌশলে। আমার সমস্ত প্রশ্ন হারিয়ে যায়। আমি তখন শিশুর মত পৃথিবী ভুলে মায়ের কোল খুঁজি নির্মল আনন্দে। আমার নিবাস, আবাস, পরবাস, সুবাস তখন তোমার মধ্যে। তুমি নিতেও পারো আমাকে অসম্ভব। যেন তুমিও আমার মধ্যে খুঁজতে অন্য পৃথিবী। একটা দুরন্ত বালকের মাতৃত্ব সামলানোর মতো আমায় তৃপ্ত করতে, দৃপ্ত করতে, দৃঢ় করতে।

আজ কিছুতেই স্নান করতে ইচ্ছা করছে না। গত দু-বছরে আমরা দুজনে দুজনকে কাল প্রথম সম্পূর্ণ পেলাম। তুমি স্বীকার করেছ আমাকেই সব থেকে বেশি ভালোবাসো। আমিই তোমাকে সব থেকে বেশি বুঝি অথবা তুমি আমার সঙ্গেই সময় কাটিয়ে সব থেকে বেশি সুখ পাও। তোমার কোনও সন্তান নেই। তবু তুমি আমার সাথে পালাতে পারবে না। আমার সংসার তুমি ভাঙতে চাও না। আর আমিও যতই তোমাকে ভালোবাসি, মানসীকে বা তিন্নিকে ছাড়তে চাই না। তোমার মতো উদ্ভিন্ন যৌবনা মেয়ে আমার মধ্যে কী দেখেছে জানি না কিন্তু কাল প্রথম যখন অনেক দূরের একটা হোটেলে আমাকে শরীরে নিলে, আমার মনে হয়েছিল তুমিও আমাতে তৃপ্ত। শুধু একবার চরম তৃপ্তির আগের মুহূর্তে দ্বিতীয় দিনে দেখা বিষণ্ণতা কয়েক পলের জন্য ফিরে এসেছিল। কাল আমাকে যেতেই হবে। কোম্পানি আমাকে সেল্স ম্যানেজার থেকে অসমের তিনসুকিয়ায় ব্রাঞ্চ ম্যানেজার করে পাঠাচ্ছে। এটাও সম্ভব হয়েছে তোমাদের চবিবশটা গাড়ির ইন্সিওরেন্স পাবার জন্য। তুমি আমার চলে যাওয়ার ব্যাপারে কোনও মতামত দাওনি। তুমি কি চাইছ আমি দূরে চলে যাই? না হলে একবারও কেন বললে না থেকে যেতে? কালই তোমাকে পুরোপুরি পেলাম আর আজ আমাকে চলে যেতে হবে ভাবলেই কষ্ট হচ্ছে। তুমি অবশ্য কথা দিয়েছ তিনসুকিয়ায় আসবে। থাকবে বেশ কিছুদিন। খুব মজা হবে পাহাড়ি ঝরনার নীচে জলপরিকে পেলে! এখন যাই। স্নান করি। না হলে মানসী রাগারাগি করবে। শরীরে তোমার সুবাস নিয়ে আবার আজ শাওয়ারের নীচে দাঁড়াব শুধু আজ পাশে তোমাকে, রতিক্লান্ত তোমাকে পাব না।

২৮ মার্চ, ১.৫৫ দুপুর,

জামদানীপুর।

অলকানন্দা,

চিঠিগুলো পোস্ট করা হয়নি। ভেবেছিলাম পরিষ্কার করে আবার লিখে তোমাকে তিনসুকিয়া থেকে পোস্ট করব। কিন্তু এখানে এসে চার্জ নিয়ে সব কাজকর্ম বুঝে নিতেই দিন দশেক হয়ে গেল। তোমাকে এখানের ফোন নাম্বার আগেই দিয়ে এসেছিলাম। আমি অফিসে এসেও তোমাকে ফোন করেছিলাম দু-দুবার। দুবারই তোমার মোবাইল বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল। তুমি বলেছিলে কোনও বিপদ বা জানাজানি হয়ে গেলে চুপচাপ হয়ে যেতে। ছ-মাস পর সব ঠান্ডা হয়ে গেলে আবার যোগাযোগ করা হবে। আমি ভয় পেলাম বোধহয় জানাজানি হয়ে গেছে! তোমার কথা ভেবেই আমার কলকাতার মোবাইল নাম্বার চালু রেখেছি। কলকাতার কাস্টমাররা বিরক্ত করছে, ইনকামিং টাকা কাটছে, তবুও তোমার কথা ভেবে চালু আছে আজও। আমি ধীরে ধীরে কাজের মধ্যে ডুবে যাই। এখানে অনেক দায়িত্ব। তবু রোজ রাতে তোমাকে ফোন করতে চাইতাম। এখানে একা থাকি। ফোন করলে বউয়ের কাছে ধরা পড়ার ভয় নেই। ফোনটা বুকে চেপে ঘুমিয়ে পড়তাম। ভাবতাম এই বুঝি তুমি ফোন করবে। তবু তোমার বিপদের কথা ভেবে কোনও দিন ফোন করতাম না। তুমি বলেছিলে তোমার বাবা জানতে পারলে অনার কিলিং-এ তোমার নাম উঠবে। আমি স্রেফ ভয়ে ফোন করিনি। চিঠি পোস্ট করার প্রশ্নই ওঠে না।

গত কয়েকদিন থেকে মনে হচ্ছে ধনীর মেয়ে, বড়োলোকের বউ। বর বিদেশে থাকে! শরীরের চাহিদায় তুমি আমার কাছে এসেছিলে। শরীর যখন পেলে তখনই আমাকে বহুদূরে চলে আসতে হল। তাই আমার প্রতি আর কোনও টান নেই। হয়তো এরকমই করো তুমি। বা সব নাবিকের ঘরনিই এরকম ভাবে সময় কাটায়। আবার মনে হচ্ছিল তুমি বুঝি সত্যিই ভালো। যেমন দেখেছি তেমনই ভালো। শরীর চাইলে পাঁচতারা হোটেলে শরীর খেলাতে পারতে। সব রকমই ভাবছি। সন্ধে থেকে একা এবং অফুরান সময়। ভাবনারাও খেলে বেড়ায় বামদিক ডানদিক, দুদিক। ভাবছি চূড়ান্ত তৃপ্তির আগের মুহূর্তের বিষাদ ব্যাধ কী তির মারল যে, তুমি এক পলকের জন্য উদাস হয়ে গেলে! বরের কথা মনে পড়েছিল? অথবা ব্যভিচারের সূক্ষ্ম পাপবোধ?

সব ভাবনাই শুধু ভাবার জন্য। উত্তর পাওয়ার কোনও উপায় নেই। কেউ জানে না আমাদের গোপন সম্পর্ক। কেউ না। শুধু শাহিন হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পারে। শাহিনকে জিজ্ঞাসা করব কিনা কয়েকদিন মরিয়া চিন্তায় আছি। হঠাৎ কাল অনেক রাতে শাহিন ফোন করে। আমি তোমার ব্যাপারে জানতে যাব, শাহিনই তুলল তোমার কথা। জানো বস্ খিদিরপুরের সতীশ সিং-এর বাড়ির সেই সুন্দরী মেয়েটা উত্তরাখণ্ডের একটা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সুইসাইড করেছে। নদীটার নাম নাকি মেয়েটার নামেই ছিল। মেয়েটাকে মনে পড়ে তোমার?

১২ এপ্রিল সকাল ৮টা

বক্স রোড তিনসুকিয়া, অসম।

 

প্রিয়জন

রাত দুটোর সময় হঠাৎ মোবাইলের শব্দে ধড়ফড় করে উঠে বসল দীপ্ত। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ছোড়দির কল। ধড়াস করে ওঠে বুকটা, মায়ের কিছু হয়নি তো? না হলে এত রাতে ফোন? কোনওমতে ফোন অন করে বলল,  ‘হ্যা ছোড়দি দীপ বলছি। এত রাতে ফোন করলি? সব ভালো তো?’

ও-প্রান্ত থেকে উত্তর এল, ‘সরি ভাই এতরাতে তোদের ডিস্টার্ব করার জন্য। চিন্তা করিস না, মা-র কিছু হয়নি। তোদের অসুবিধা না থাকলে এক মিনিট কথা বলতে পারব কি?’

ছোড়দি সুপ্রিয়ার কথা বলার ধরন দেখে দীপ আরও ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘না না অসুবিধা কেন হবে?  বল না কি হয়েছে? এনি প্রবলেম?’

‘শোন তোকে আর তোতলাতো হবে না। মিতার নিশ্চয় ঘুমটা ভেঙে গেছে। ফোনটা স্পিকারে রাখ, তাহলে দুজনেই শুনতে পারবি। এবার শোন আমাদের রুমা এখন বিয়ে করতে চলেছেন। বুঝতে পারছিস রুমা বিয়ে করবে? সম্ভব হলে সামনের মাসেই।’

একটা ছোট্ট হাই তুলতে তুলতে দী৫ বলল, ‘ও… এই কথা, এর জন্য এত রাতে–’

দীপ্তকে তার কথা শেষ করতে না দিয়ে পাশ থেকে ঘুম জড়ানো চোখে, গলায় যথা সম্ভব উদ্বেগ ঢেলে দিয়ে মিতা বলে উঠল, ‘সে কি? তুমি কী করে জানলে ছোড়দিভাই? রুমা কি নিজে বলেছে তোমাকে? ছেলেটা কে? কী করে হল?

‘জানি না রে মিতা। কী করে হল? কবে হল? কিচ্ছু জানি না। কিন্তু এর পর কী হবে তা নিয়ে ভীষণ চিন্তায় আছি।’

‘বড়দি জানেন?’ মিতা জানতে চাইল

‘হ্যাঁ বড়দিই তো আমাকে মেসেজ করে জানাল। আমি তক্ষুনি ফোন করাতে জানলাম তিনি রোগী নিয়ে ব্যস্ত আছেন, পরে কথা বলবেন। তাই তোদের ফোন করলাম। সরি রে তোদের ঘুম নষ্ট করলাম। তোরা শুয়ে পড়। সম্ভব হলে সন্ধে সাতটার পরে ফোন করিস। অলোচনা করে কিছু তো একটা ব্যবস্থা করতে হবে।

দীপ তখনও বুঝতে পারছিল না রাত দুটোর সময় হাজার মাইল দূরে ঘুমিয়ে থাকা ভাইকে ছোড়দি ঘুম থেকে তুলল এই খবরটা দেবার জন্য। এটা তো মেসেজ বা ইমেইল করেও জানাতে পারত। কিংবা দিনের বেলাতেও ফোন করতে পারত। তা না, দিল ঘুমের বারোটা বাজিয়ে। এবার জোর করে একটা হাইকে বুক থেকে টেনে মুখ দিয়ে বের করে দিতে দিতে চোখ বুজে দীপ নিদ্রাদেবীকে আহ্বান জানাল। কিন্তু পেছন থেকে তখনই মিতা একটা ছোট্ট গুঁতো মারল, ‘কি হল ঘুমিয়ে পড়লে? বুঝতে পারছ এবার কী হবে?’

‘না ব্যাপারটা ঠিক বুঝলাম না। তবে রুমা বিয়ে করবে –এই তো? হয়তো কিছু টাকা পয়সা চাইবে। দ্যটস্ ওকে। সি ইজ লাইক আ ফ্যামিলি মেম্বার।’

দী৫ আবার ওপাশ ফিরে শোবার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখল অদ্ভুত কায়দায় মিতা শোয়া অবস্থা থেকে তড়াক করে উঠে বসল। দীপ ভাবল জিমটিম গিয়ে মিতা ভীষণ ভাবে ফিট হয়ে গেছে।

কিন্তু দীপ্তকে আর ভাবার সুযোগ না দিয়ে মিতা বলল, ‘সত্যি তোমার বুদ্ধির বলিহারি। তুমি টাকা দিলে আর রুমা বিয়ে করে ড্যাং ড্যাং করে নাচতে নাচতে শ্বশুরবাড়ি চলে গেল। ব্যস তোমার মতে সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। আরে বাবা সমস্যার শুরু তো তখন হবে যখন রুমা তোমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।’

অন্ধকার ঘরে দীপ্তর মগজের টিউবলাইট তখন জ্বলে উঠল। তাই তো গত বারো তেরো বছর ধরে রুমা মায়ের কাছে আছে। যখন এসেছিল তখন ওর বয়স বোধহয় বছর তিরিশ হবে। বিয়ের পরে বাচ্চা না হবার জন্য শ্বশুরবাড়িতে অনেক গঞ্জনা সহ্য করতে হচ্ছিল। শেষে আর সহ্য করতে না পেরে মিউচুয়াল ডিভোর্স নিয়ে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে আসে। দাদা-বৌদির সংসারে হয়তো ঠাঁই হতো কিন্তু সেটা খুব একটা সম্মানের হতো না। তাই মায়ের এক প্রাক্তন সহকর্মীর কাছে খবর পেয়ে মায়ের কাছে কাজের খোঁজে আসে।

মা তার দুবছর আগে শিক্ষকতার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন। সেই সময় দীপ অনেক কষ্ট করে তার স্বপ্নের দেশ আমেরিকা-তে এসে পৌঁছেছে। বড়দি আর কৃষ্ণনদা তখন তিথিকে নিয়ে বেঙ্গালুরুতে, ছোড়দি আর সমীরদা উত্তরবঙ্গের কোনও এক শহরে। মা শ্রীরামপুরে তার নিজের বাড়িতেই থাকবার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। এ রকম অবস্থায় রুমা যখন মায়ের কাছে আশ্রয় চাইল মা তাকে না বলেননি। মনে একটু কিন্তু কিন্তু থাকলেও তারা তিন

ভাই-বোন ব্যাপারটা মেনে নেয় এই ভেবে যে, মায়ের জন্য একটা চবিবশ ঘন্টার কাজের লোক পাওয়া গেল।

রুমা থাকাতে মায়ের যে কত সুবিধা হয়েছে তা দু-বছর পরে দেশের বাড়িতে গিয়ে বুঝল দীপ্ত। দেখল মা সংসারটা রুমার হাতেই ছেড়ে দিয়েছে। রুমা সকাল থেকে সন্ধে অবধি ছুটে বেড়াচ্ছে। সকালে দীপ্তর জন্য ডালপুরি আলুর দম বানাচ্ছে তো দুপুরে মিতার পছন্দের পটলের দোলমা। তারই মধ্যে মায়ের জন্য একাদশীর ফলাহার। দীপ্তর মেয়ে দিঘি যেবার দেশের বাড়িতে গিয়ে ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ল রুমাই তখন রাত বারোটার সময় ওষুধের দোকান খুলিয়ে ওষুধ নিয়ে আসে। রুমা যে কবে কাজের লোক থেকে বাড়ির লোক হয়ে গেল বোঝাই গেল না।

শুধু যে মায়ের সংসারে সে অপরিহার্য হয়ে গেল তা নয়,পাড়া-প্রতিবেশীদের ছোটো খাটো প্রয়োজনেও রুমারই ডাক পড়ে আগে। সামনের বাড়ির মাসিমার টিউবলাইট-টা কাজ করছে না! রুমা দেখে যা তো বাবা, পাশের বাড়ির বউদির বাড়িতে হঠাৎ করে বাপের বাড়ির লোকজন এসেছে– ‘রুমা চট করে মোড়ের দোকান থেকে এগ রোল নিয়ে আয় তো সোনা।’

এ হেন রুমা-কে নিয়ে সুতপা সেনের সংসার ভালোই চলছিল।শুরু শুরু-তে যে ভয় ছিল কোথাও কোনও গন্ডগোল না বাঁধিয়ে বসে রুমা! সেটাও ধীরে ধীরে চলে গেল। এখন হঠাৎ করে চল্লিশোর্ধ রুমা বিয়ে করে চলে গেলে অসুবিধা তো হবেই। মা কার কাছে থাকবে? দিদিরা নিশ্চয়ই দীপ্তকে বলবে না মা-কে নিয়ে এসে নিজের কাছে রাখতে। তাও দু-তিন মাস কোনওমতে হয়তো ম্যানেজ করা যাবে কিন্তু তার বেশি তো কোনও ভাবেই সম্ভব নয়।

হঠাৎ দীপ্তর মাথায় একটা সম্ভাবনা এল। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে যে রুমা বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি না গিয়ে ওর স্বামীকে নিয়ে মায়ের কাছে থেকে গেল। তাহলে ওরা দুজনে মিলে মায়ের দেখভাল করতে পারবে। সময়ে অসময়ে একজন পুরুষমানুষ বাড়িতে থাকলে সুবিধাই হয়! প্রয়োজন হলে দীপ না হয় আরেকটু বেশি টাকা পাঠাবে। সমস্যার এমন ভালো সমাধান পেয়ে দীপ শান্তমনে আবার ঘুমের চেষ্টায় চোখ বুজল।

দুই

সুচিত্রা বেশ খুশি মনে তার চেম্বারে ঢুকল। যদিও বেশ টায়ার্ড লাগছে কিন্তু মনটা তার প্রসন্ন। সবাই বলেছিল ওই পঁয়ত্রিশ বছরের রুগ্ন তিন বাচ্চার মা পেশেন্টের সিজারিয়ান সেকশন করতে, কারণ সে একদম পুশ করতে পারছিল না আর বাচ্চাটাও বেশ বড়ো ছিল। সুচিত্রা কিছুটা জেদ করেই ফরসেপস ডেলিভারি করিয়েছে। সি-সেকশনের পরে যেরকম যত্ন নেওয়া উচিত তা এই চার সন্তানের মায়ের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই সে চাইছিল যথা সম্ভব অপারেশনটা না করতে। যাক এখন সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে। বাচ্চাটা তো প্রায় সাড়ে তিন কিলো ওজনের।

সুচিত্রা অবাক হয়ে ভাবে এত রুগ্ন মায়ের পেটে এত হেল্দি বেবি কী করে হয়? আর তার মতো গাইনিকোলজিস্টকে ইনফারটাইল তকমা নিয়ে থাকতে হয়। যাকগে এই সব আজে বাজে কথা ভেবে সুচিত্রা আজকের এত ভালো দিনটা নষ্ট করবে না। সে তো এখন মা হয়েছে। অ্যাডপ্ট করা হলেও কী হবে, তিথি তো ওকে মা হবার সুযোগ দিয়েছে। নিজের ভালো হওয়া মনটাকে খারাপ হবার সুযোগ না দিয়ে চট করে ঘড়ি দেখে নিয়ে কৃষ্ণনকে মোবাইলে ফোন করল, ‘খাওয়া হয়ে গেছে?’

‘না তোর?’

‘না এক্ষুনি ওটি থেকে বেরোলাম। যে-পেশেন্টটা নিয়ে চিন্তায় ছিলাম ওর ফরসেপস ডেলিভারি করিয়েছি।। মাদার অ্যান্ড বেবি বোথ ওকে, ফিলিং স্যাটিসফায়েড।’

‘তাহলে চলে আয় আমার চেম্বারে, সেলিব্রেট করব।’ হই হই করে কৃষ্ণন বলল।

‘কী করে?’ সুচিত্রা জিজ্ঞেস না করে পারল না।

‘লুচি আর বোঁদে দিয়ে।’

কৃষ্ণনকে নিয়ে এই এক মুশকিল। ও খেতে খুব ভালোবাসে।

যে-কোনও সময় যা খুশি খেতে পারে, তা সে বিরিয়ানি দিয়ে ব্রেকফাস্ট হোক বা লস্যি দিয়ে লাঞ্চ।

চট করে ওটির জামাকাপড় চেঞ্জ করে নিয়ে কৃষ্ণনের চেম্বারে যেতে যেতে সুচিত্রা ঠিক করে ফেলল খাবার পরেই সুপ্রিয়াকে একবার ফোন করে নেবে। কাল রাতে ফোনে মায়ের কাছ থেকে রুমার বিয়ের কথাটা জেনেছিল। সকালে সুপ্রিয়াকে মেসেজ করেছিল। সরাসরি ফোন করেনি কারণ সুপ্রিয়া অল্পতেই নার্ভাস হয়ে যায়। তাই ভেবেছিল মেসেজ পড়ে কিছুটা ধাতস্থ হবার পরে ফোন করবে। কিন্তু সুপ্রিয়া সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে এত প্রশ্ন করছিল আর তার সঙ্গে নিজের মন্তব্য ছুড়ে দিচ্ছিল যে সুচিত্রা তার রোগীর অজুহাত দেখিয়ে ওকে কোনওমতে থামাতে বাধ্য হয়। সঙ্গে এটাও প্রমিস করিয়ে নিয়েছিল যে, ও কোনওমতেই মা বা রুমাকে ফোন করে এ ব্যাপারে কোনও আলোচনা করবে না।

কৃষ্ণনের চেম্বারের দরজায় দুবারটোকা দিয়ে ভিতরে ঢুকে দেখল গাল ভরা হাসি নিয়ে কৃষ্ণন টেবিলে পুরি আর বোঁদে সাজিয়ে তারই অপেক্ষায় বসে আছে।

‘তোকে কে বলেছে এগুলো লুচি? এগুলো তো পুরি!’ সুচিত্রা ভ্রু কুঁচকে বলল।

‘লুচি আর পুরি একই হয়। বাংলার জামাই হয়ে লুচিকে আমি পুরি বলব?’

লুচি আর পুরির তর্কে না গিয়ে সুচিত্রা খেতে বসে গেল। তারপর জিজ্ঞেস করল ‘বোঁদে কোত্থেকে পেলি?’

অর্ধ নিমিলিত চোখে লুচি আর বোঁদে চিবোতে চিবোতে কৃষ্ণনের উত্তর, ‘আমার এক পেশেন্ট দিয়ে গেছে। হারনিয়া রিপেয়ার করেছিলাম। কলকাতার পেশেন্ট!’

‘কলকাতা থেকে হারনিয়া অপারেশন করাতে বেঙ্গালুরুতে এল। স্ট্রেঞ্জ, ওখানেই তো করাতে পারত।’ পুরির টুকরো ভেঙে মুখে দিতে দিতে সুচিত্রা বলল, ‘এখানে আসা-যাওয়া, থাকা-খাওয়া, অহেতুক পয়সা খরচ করে কী যে স্যাটিসফ্যাকশন পায় কে জানে?’

কৃষ্ণনের তখন খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞেস করল, ‘অ্যাই সত্যি করে বল তো তুই আমার বউ নাকি শত্রু? কলকাতা থেকে পেশেন্ট আসছে, আমি দুটো পয়সা কামাচ্ছি, তা বুঝি তোর সহ্য হচ্ছে না।’ তারপর কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ‘আসলে আমার মনে হয় এটা হিউম্যান সাইকোলজি। যেটা হাতের কাছে পাই তার ভ্যালু আমরা বুঝি না। ওরা হয়তো ভাবে সাউথ ইন্ডিয়ান ডাক্তাররা ভালো, আর সেই ডাক্তার যদি বিশাল লম্বা সাউথ ইন্ডিয়ান নাম নিয়ে রোগীর সঙ্গে বাংলায় কথা বলে তাহলে তো আর কথাই নেই।’

কৃষ্ণন হয়তো আরও কিছু বলত কিন্তু তার আগেই ফোন এল– ‘অপারেশন থিয়েটার রেডি’।

চট করে উঠে চেম্বার থেকে বেরোতে বেরোতে বলল, ‘চলি রে, দুটো অপারেশন বাকি আছে। তোর তো বিকেলে চেম্বার নেই আজকে, দ্যাখ যদি সাতটার মধ্যে বাড়ি আসতে পারিস তাহলে দুজনে মিলে একটা সিনেমা দেখা যেতে পারে। আর শোন ভাবছি উইক এন্ডে তিথিকে একবার সারপ্রাইজ ভিজিট দিয়ে আসব। তুই প্ল্যান কর, আমি চলি।’

কৃষ্ণনের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে সুচিত্রা ভাবল– ও সত্যি কত ভালো আছে। বিয়ের আগে সবাই কত ভয় দেখিয়েছিল। অবাঙালি ছেলে, মাছ মাংস খায় না, তার মধ্যে মায়ের একমাত্র ছেলে ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এখন দেখছে কৃষ্ণনের মতো স্বামী পাওয়া, নিজের গর্ভে জন্ম না দিলেও তিথির মতো মেয়ে পাওয়া, সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার কিন্তু তাদের এই লাইফ স্টাইলের সাথে মা কি একটা দিনও মানাতে পারবে? নাকি মা এলে ওরা মা-কে বাড়িতে একা রেখে বাইরে এভাবে সময় কাটাতে পারবে? সকালে প্রিয়া ফোন করে এজাতীয় একটা প্রস্তাব রেখেছিল যেটা সুচিত্রার কাছে সম্পূর্ণ অবাস্তব মনে হয়েছিল।

সুচিত্রার চিন্তার জাল ছিঁড়ে মোবাইলটা বেজে উঠল। দেখল সুপ্রিয়ার কল… ‘হ্যাঁ প্রিয়া বল। না না শোন তুই মাথা গরম করিস না, আমি পরের সপ্তাহে শনিবার কলকাতা যাব। তুইও চলে আয়। তখন বসে কথা হবে। তুই প্লিজ মা বা রুমার সঙ্গে রাগারাগি করিস না। তুই ভাবিস না। আমি দীপ্তর সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি। আমি বুঝি রে তুই কত ব্যস্ত। তাহলে এখন রাখি? ভালো থাকিস।’

তিন

সুপ্রিয়ার কাজের অন্ত নেই। সকাল আটটার মধ্যে দশ বছরের যমজ দুই ছেলেকে তৈরি করে স্কুল পাঠাও। তার মধ্যে বেড টি নিয়ে ছেলেদের বাবাকে ঘুম থেকে তোলো। তারপর নিজে তৈরি হয়ে কোনওমতে নাকে মুখে খাবার গুঁজে সময়মতো কলেজ পৌঁছাও। ভাগ্য ভালো তার রান্নার মাসিটা খুব ভালো পেয়েছে। সে বেশ সকাল সকাল চলে আসে বলে সুপ্রিয়া রক্ষা পেয়েছে। কামাইও করে না। তবে সুপ্রিয়াও মাসিকে যথেষ্ট তোয়াজ করে রাখে। শনিবার আধা বেলা আর রবিবার তো ওর পুরো ছুটি!

শাশুড়ি মায়ের সকালের চা থেকে শুরু করে খাবার-দাবার সব তো মাসিই করে দেয়। উনি তো আমিষের ছোঁয়া খাবেন না, তাই মাসি আগে নিরামিষ রান্না করে তার পর আমিষ রান্নাগুলো করে। এর জন্য সুপ্রিয়াকে দুটো গ্যাস আভেন রাখতে হয়েছে। তারই মধ্যে ছেলে দুটো কখনও কখনও রান্না ঘরে ঢুকে কী রান্না হয়েছে দেখতে গিয়ে ছোঁয়াছুঁয়ি করে ফেলল তো আর দেখতে হবে না। বাড়িতে তুলকালাম কান্ড বেধে যাবে, আর সব দোষ সুপ্রিয়ার উপর পড়বে। কী যে জ্বালা! আর এখন এই ডামাডোলের মধ্যে মা-কে নিয়ে চিন্তা করতে হচ্ছে।

রুমা এখন বিয়াল্লিশ-তেতাল্লিশ বছর বয়সে ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে বিয়ে করতে চলল। রুমা না থাকলে মায়ের পুরো দায়িত্ব সুপ্রিয়ার ঘাড়ে এসে পড়বে। হাতের কাছে তো সেই আছে। মাকে যে এখানে এনে রাখবে তারও উপায় নেই। শাশুড়িমা তার নিয়মের বেড়াজালে সংসারটাকে এমন করে বেঁধে রেখেছেন যে সুপ্রিয়ারই দমবন্ধ লাগে।

মঙ্গল আর শুক্রবারে কোনও পোড়া খেতে নেই তো বৃহস্পতি ও শনিবারে আমিষ খেতে নেই। এইমাসে লাউ খেতে নেই তো ওই মাসে কুমড়ো খেতে নেই।। আজকে সবার মাথায় তেল লাগাও তো কালকে গায়ে হলুদ লাগাও। শুরু শুরুতে তো পাগল পাগল লাগত। এখন সময়ের সাথে সবকিছু মানিয়ে নিয়েছে!

শাশুড়িমায়ের নিয়ম আছে তো সুপ্রিয়ার কাছে তার সহজ উপায় আছে। যেমন তেল বা হলুদ গোলা জল বাথরুমে রাখাই থাকে। প্রয়োজনে কপালে এক ফোঁটা ঘষে নিলেই হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মাঝেমধ্যে খটাখটি লাগে। শাশুড়িমায়ের বদ্ধমূল ধারণা, মায়ের প্ররোচনায় দিদি আর কৃষ্ণনদা তাদের ব্যাচমেট সমীরের ঘাড়ে সুপ্রিয়াকে চাপিয়ে দিয়েছে। যদিও সমীর প্রায় দুবছর রীতিমতো সুপ্রিয়ার সঙ্গে কোর্টশিপ করার পর তার মায়ের অনুমতি নিয়ে বিয়ে করেছে। কিন্তু কে কাকে বোঝাবে?

সমীরকে বলে লাভ নেই। সে তার চাকরি নিয়ে সব সময় এত টেনশনে থাকে যে সুপ্রিয়া ওকে আর সংসারের অসুবিধার কথা বলে ব্যতিব্যস্ত করতে চায় না। দুবছর আগে পাওয়া কলেজের এই লেকচারারের চাকরিটা সুপ্রিয়া-কে বাঁচিয়ে দিয়েছে। বাড়ি থেকে কলেজটা একটু দূরে বলে যাতায়াতের সময়টা বেশি লাগে কিন্তু সেই সময়টাই ওর একান্ত নিজস্ব। ওই সময়টায় ও নিজের মনের সঙ্গে অনেক কথা বলে। কল্পনায় কখনও একা কখনও বা সমীরের আর ছেলেদের সঙ্গে দুরে কোথাও বেড়াতে চলে যায়। এমন কোনও জায়গা যেখানে কোনও সমস্যা নেই কোনও অভিযোগ অনুযোগ নেই। যেখানে মন খুলে হাসা যায়, গান গাওয়া যায়। সুপ্রিয়া জানে না, সেদিন সত্যি তার জীবনে আসবে কিনা।

চার

আজ সকাল থেকে বাড়িতে বেশ হইচই লেগেছে। সুতপা গত এক সপ্তাহ থেকে অপেক্ষায় ছিল এই দিনটার জন্য। গত সপ্তাহে তার তিন ছেলেমেয়ে জানাল– ওরা আসবে সব একসাথে। চিত্রা আর প্রিয়া-রা দুদিন থেকে চলে যাবে, তবে দীপ্ত, বৗমা আর নাতনিকে নিয়ে এক সপ্তাহ থাকবে। তারপর ওরা মুম্বই-এ দিঘির মামার বাড়িতে কয়েকদিন থেকে আমেরিকা ফেরত যাবে।

সুতপা ভালো করেই বুঝতে পারছে ওরা কেন আসছে! তাহলেও খুব ভালো লাগছে সবাইকে একসাথে দেখতে পাবে বলে। দীপ্তরা কাল রাতেই এসে পৌঁছেছে। কিন্তু অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল বলে ভালো করে কথা হয়নি। তবে দী৫ আজ কাকভোরে উঠেই চলে এসেছে মায়ের ঘরে। মায়ের খাটে মশারির মধ্যে ঢুকে বাবু হয়ে বসে কত যে বকবক করল তার ঠিক নেই। এরই মধ্যে তাদের কথাবার্তার আওয়াজ পেয়ে রুমা চা বানিয়ে নিয়ে এসেছিল। দীপ্তর জোরাজুারিতে সুতপাকে দাঁত না মেজেই চা খেতে হল খাটে বসে। এতে নাকি চায়ের আসল স্বাদ পাওয়া যায়।

আসলে সুতপার মনে হল বাকি সবাই এসে যাবার আগেই দী৫ সুতপার সঙ্গে সময় কাটাতে চাইছিল। সুতপার সেই ছোটোবেলার দীপ্তকে মনে পড়ে যায়। সবসময় মায়ের সঙ্গে লেগে লেগে থাকত। বড়ো হবার পর সেটা কমলেও সব সময় ও সুতপার দিকে নজর রাখত। ওদের বাবা মারা যাবার পর তো আরও বেশি করে। মা সময়মতো খাচ্ছে কিনা, শরীরের খেয়াল রাখছে কিনা। চোখ দেখিয়ে চশমার পাওয়ার চেঞ্জ করা হয়েছে কিনা! এমনকী পুজোতে মায়ের কটা নতুন শাড়ি হল তাও খেয়াল রাখত।

সুতপার জীবনগাছের দী৫ ছিল এক বলিষ্ঠ ডাল। তারপর সেই ডাল আমেরিকায় গিয়ে নিজে গাছ হয়ে গেছে। শুধু কি দী৫ নাকি, চিত্রা, প্রিয়া সবাই এক একটা গাছ হয়ে নিজেদের সংসারের মাটিতে শিকড় ছড়িয়ে দিয়েছে। সত্যি সুতপার ভাবতে খুব ভালো লাগে যে, তার তিন ছেলে মেয়ে সবাই জীবনে সুপ্রতিষ্ঠ। অজান্তে তার দৃষ্টি চলে গেল দেয়ালে বড়ো ফ্রেমে টাঙানো গৗতমের ছবির দিকে।

ব্যাংকে সামান্য চাকরি করা গৌতমের এক মাত্র লক্ষ্য ছিল তিন ছেলে মেয়েকে মানুষ করা। সংসারের একটু স্বাচ্ছল্য বাড়াবার জন্য সুতপা স্কুলে চাকরি নিয়েছিল। সুতপার মনে আছে সিনেমাপাগল গৗতম তার সন্তানদের নাম সিনেমার তারকাদের নামে রাখতে চেয়েছিল। দুই মেয়ের পরে ছেলের নামের সময় সুতপা বেঁকে বসেছিল শুভেন্দু নয় সুদীপ্ত রাখতে হবে।

হঠাৎ ড্রয়িংরুম থেকে হা হা করে হাসির শব্দ সুতপার ভাবনাটাকে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। তার মুখেও একটা ছোট্ট হাসি খেলে গেল। সকালে বিছানায় বসে দীপ্তর সঙ্গে গল্প করার মধ্যেই প্রিয়া আর সমীর দুই ছেলে-সহ চলে এসেছিল। আর কিছুক্ষণের মধ্যে বোধহয় চিত্রারাও চলে আসবে। আবার জোর হাসির আওয়াজ এল, সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়ার গলা ‘মা, মা তুমি এখানে এসো তো, এরা সবাই আমাকে যা তা বলছে তখন থেকে।’

ড্রয়িংরুমে যাবার বদলে সুতপা রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। তার তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে প্রিয়া চলনে বলনে অনেকটা ওদের বাবার মতো ছিল। গান গাইত ভালো, সিনেমার পোকা ছিল, ছবি-টবিও অাঁকত। চিত্রা আর প্রিয়া প্রায় পিঠোপিঠি বোন হলেও চিত্রা অনেক বেশি যত্ন পেয়েছে। চিত্রা ছিল চুপচাপ শান্ত গোছের, প্রিয়া ছিল তার উলটো। সংসার নিয়ে প্রিয়া এত ব্যস্ত থাকে যে সুতপা জানে না– ও গান গাইবার বা সিনেমা দেখার সুযোগ পায় কিনা।

‘ও ঠাম্মা তুমি এখানে কী করছ? চলো না সবাই তোমাকে ও ঘরে ডাকছে’ দিঘি সুতপার হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে জিজ্ঞেস করল।

দিঘির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সুতপা বললেন, ‘একটু কাজ আছে, তুমি যাও আমি আসছি।’

‘না তোমাকে এখনই যেতে হবে।’ দুপাশ থেকে দুই নাতি বাবুন আর টাবুন একরকম টানতে টানতে ড্রয়িংরুমে নিয়ে এল।

‘দেখলে তো কেমন পেয়াদা পাঠিয়ে তোমাকে ধরে আনলাম’ প্রিয়া বলল।

‘না রে জলখাবারের ব্যবস্থা করতে হবে তো, তাই রান্নাঘরে গিয়েছিলাম’ সুতপা জবাবদিহি করতে গেলেন।

‘ব্রেকফাস্ট তো সিঙারা জিলিপি দিয়ে হবে। দিদি আর কৃষ্ণনদা এই এল বলে ওগুলো নিয়ে। এয়ারপোর্টে নেমেই কৃষ্ণনদা জানতে চাইলেন, আমরা এরকম ব্রেকফাস্টে রাজি আছি কিনা, অ্যান্ড উই অল এগ্রিড।’

‘তা হলে বাচ্চাগুলো?’ সুতপা মিতার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন।

‘ওরাও তাই খাবে’ মিতা জবাব দেবার আগেই সুপ্রিয়া তড়বড়িয়ে বলে উঠল।

‘আপনি চিন্তা করবেন না মা। আমি ইউএস থেকে ওট্‌স আর কর্নফ্লেক্সের প্যাকেট নিয়ে এসেছি, দিঘির সঙ্গে বাবুন টাবুনরাও খেতে পারে’ সেটা মিতা মিষ্টি করে জানিয়ে দিল তারপর সুপ্রিয়ার ভুরু কুঁচকানো গম্ভীর মুখের দিকে এক ঝলক দেখে নিয়ে বলল, ‘আসলে দিঘির পেটে তো সব কিছু সহ্য হয় না, তাই আমাকে ব্যবস্থা রাখতেই হয়।

ড্রয়িংরুমের আবহাওয়াটা একটু যেন থমথমে হয়ে গেল। কিন্তু পর মুহূর্তেই গেটের বাইরে থেকে কৃষ্ণনের আওয়াজ এল ‘ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল’ পাশ থেকে চিত্রার ধমক– ‘চ্যাঁচাস না, পুরো পাড়া দরজা খুলে তোকে তাড়া করবে।’

পাঁচ

দুপুরে খাওয়ার সময় আরেক চোট জমাটিয়া আড্ডা হল। তারপর সুপ্রিয়া ঘোষণা করল ‘অনেক গল্প হয়েছে এবার কাজের কথায় আসা যাক। তোমরা ভুলে যেও না যে তোমরা কলেজ রি-ইউনিয়নে আসোনি বরং একটা পারিবারিক সমস্যার সমাধানের খোঁজে এসেছ। সুতরাং বাচ্চারা বাদে সবাই বসবার ঘরে গিয়ে বসো, আমি বাবুন টাবুনকে ওদের হোমওয়ার্ক করতে বসিয়ে আসছি। রুমা তুই তোর কোনও কাজ থাকলে তাড়াতাড়ি সেরে নে। আমরা তোর সঙ্গেও কথা বলতে চাই।’

দুই ছেলেকে সুপ্রিয়া সুতপার ঘরে পড়তে বসিয়ে দরজা বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিয়ে ড্রয়িংরুমে এসে দেখল সবাই আবার গল্পে মেতেছে। মা শুধু সকালের খবরের কাগজটা চোখের সামনে ধরে পড়বার চেষ্টা করছেন। ওরা সবাই জানে মায়ের চোখের অসুখের কথা। দুবার অপারেশন করিয়েও কোনও লাভ হয়নি। ভালো করে দেখতে পায় না আর সেই জন্যেই তো সুপ্রিয়ার অত চিন্তা হয় মাকে নিয়ে।

সুপ্রিয়াকে দেখে সবাই নড়ে চড়ে বসল। এর মধ্যে রুমাও শাড়ির অাঁচলে হাত মুছতে মুছতে মায়ের পাশে মাথা নিচু করে বসল। কেউ কিছু বলছে না দেখে সুপ্রিয়াই শুরু করল– রুমা আমরা শুনলাম তুই নাকি বিয়ে করবি। এটা কি সত্যি?

রুমা ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলাতেও আবার জিজ্ঞেস করল– ছেলেটা কে? কী করে? তোরা কবে এসব ঠিকা করলি?

রুমাকে কিছু বলতে না দিয়ে সুতপাদেবী মুখ খুললেন, ‘ছেলেটাকে আমি দেখেছি। ভালো ছেলে। আগে অটোরিক্সা চালাত এখন টোটো চালায়। রুমাকে ভালোই রাখবে।’

সুপ্রিয়া প্রায় অাঁতকে উঠল– রিক্সাওয়ালা? মানে ভাড়াতে চালায়? কী করে চিনলি ওকে? আই মিন বিয়ের ব্যাপার তো তাই জিজ্ঞেস করছি। এসব সিদ্ধান্ত ভালো করে ভেবে চিন্তে নেওয়া উচিত।

এবারেও সুতপা রুমার হয়ে উত্তর দিলেন– রিক্সা নয় অটোরিক্সা চালাত, এখন টোটো চালায়। কাছেই থাকে। ওর মা এক সময় এ বাড়িতে কাজও করেছে। তোরা হয়তো কখনও দেখেও থাকতে পারিস।

‘তার মানে রুমার উড বি মাদার ইন ল ইজ এ ঠিকে ঝি, অ্যান্ড সি ইউজড টু ওয়ার্ক ইন দিস হাউস। আই হোপ দিস ইজ নট এ প্ল্যান টু গেট সাম ফিন্যান্সশিয়াল বেনিফিট’ মিতা ইচ্ছে করে ইংরেজিতে কথাগুলো বলল যাতে রুমা বুঝতে না পারে। তারপর রুমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ‘রুমা আমরা সবাই তোমার ভালো চাই, তাই বার বার বলছি তুমি সবদিক দেখে শুনে ভালো ভাবে চিন্তা ভাবনা করে ডিসিশন নিও, বিয়ের ব্যাপারে তাড়াহুড়ো কোরো না।’

দ্যাখো তুমি এখানে যেভাবে আছো একজন অটোরিক্সাওয়ালাকে বিয়ে করে তার বাড়িতে কি তুমি সেভাবে থাকতে পারবে? হয়তো কোনও কারণে তোমার তাকে এখন ভালো লাগছে কিন্তু যখন দেখবে সংসারে অভাব অনটন আসছে তখন এই ভালোবাসা মনের জানলা দিয়ে উড়ে যাবে, পড়ে থাকবে শুধু শরীরটা। তুমি একবার কষ্ট পেয়েছ জীবনে, তাই আমরা চাই না আবার সেরকম কিছু স্লকটা হোক।’

নিজের বক্তব্য শেষ করে মিতা দেখল সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে তারিফের দৃষ্টিতে! ব্যতিক্রম একমাত্র মা আর রুমা। মিতার কথার পিঠে কথা বসিয়ে সুচিত্রাও রুমাকে বোঝাবার চেষ্টা করল, ‘মিতার কথা আমিও মানছি। আমি এত পেশেন্ট দেখি তো, সব জায়গায় একই ব্যাপার। ছেলেরা বউ-এর কাছ থেকে শরীর, সন্তান আর সেবা এটাই আশা করে। বিনিময়ে মেয়েরা কি সেভাবে আদৗ কিছু পায় স্বামীর কাছ থেকে? রুমা ভালো করে ভেবে নিয়ে বিয়ে করিস বাবা।’

‘যা বাবা হঠাৎ করে আমাদের পেছনে পড়লি কেন চিত্রা? এবার তো আমার বউ আমার উদাহরণ দিয়ে সমস্ত পুরুষজাতিকে তুলোধনা করবে’ সমীর সুচিত্রাকে কথার খোঁচা দিল। তোমার বউ পাগল নয় যে কাজের কথা থেকে সরে গিয়ে অন্য কথা বলে সময় নষ্ট করবে! সুপ্রিয়া সমীরের পাশ থেকে উঠে এসে রুমার পেছনে দাঁড়িয়ে ওর পিঠে হাত রেখে বলল, ‘রুমা তুই প্রাক্টিক্যালি ভাবার চেষ্টা কর –একজন অটোরিক্সাওয়ালা এত বছর বিয়ে না করে এখন একজন তেতাল্লিশ বছর বয়সি মহিলাকে বিয়ে করতে চাইছে কেন? শুনলাম তোর

দাদা-বউদিরও নাকি মত নেই এ বিয়েতে। তাহলে তুই বিয়েটা করছিস কেন?’

রুমা সবার দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওদেরকে একবার বোঝাবার শেষ চেষ্টা করল, ‘যতিন টোটো আর ভাড়াতে চালায় না। গত মাসে ওটা ও কিনে নিয়েছে। আর বাড়িতে খালি ওর মা আছে। আমার কাজ করা নিয়েও যতিনের কোনও আপত্তি নেই। দাদা-বউদির থেকে মাসিমাই আমাকে ভালো বোঝেন, তাই বলছিলাম’ রুমার কথা শেষ করতে না দিয়েই সুচিত্রা বলে উঠল, ‘তাহলে তুই মায়ের কাজ ছাড়বি না তো? বাবা বাঁচালি।’

দেখা গেল যারা এতক্ষণ রুমার বিয়ে নিয়ে চিন্তিত ছিল তাদের চিন্তার বিষয় হঠাৎ করে বদলে গেল। কৃষ্ণন সুচিত্রাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘বাট সি হ্যাজ নট সেইড দ্যাট। ডিড সি সে দ্যাট সি উইল ওয়ার্ক হিয়ার?’ তারপর রুমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘বিয়ের পরেও কি তুমি তোমার মাসিমার কাছে থেকে তার সুবিধা অসুবিধার খেয়াল রাখতে পারবে রুমা?’

‘দ্যাট ইজ পসিবল ওনলি ইফ সি লিভস্ ইন দিস হাউস অ্যান্ড দ্যাট অলসো উইথ হার হ্যাজবেন্ড’ দীপ তার মনের কথাটা বলে দিল।

‘আর যতিনের মা? তিনি কি তার ছেলেকে ছেড়ে দেবেন। তিনিও সবার সঙ্গে চলে আসবেন। রিক্সাওয়ালা হোক বা ডাক্তার,বাঙালি মায়েরা ছেলেদের তাদের মুঠো ছাড়া করেন না। তারপর যিনি ছিলেন বাড়ির ঝি তিনিই হয়ে যাবেন মালকিন, আর আমার মা হয়তো তখন বাড়ির ঠিকে ঝির কাজটা করবে।’ সুপ্রিয়া রাগের বশে কথাগুলো বলে ফেলে বুঝতে পারল কাজটা ঠিক করেনি কারণ ততক্ষণে জলভরা চোখ নিয়ে রুমা দৗড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে!

কোনওমতে পিরস্থিতি সামাল দিতে সমীর বলল, ‘আচ্ছা আমরা তো যতিনের সঙ্গে কথা বলে দেখতে পারি। এমনও তো হতে পারে সকালে এসে সারাদিন এখানে থেকে রুমা রাতে যতিনের বাড়ি চলে গেল। মায়ের কাছে রাতে থাকার জন্য আমরা কোনও আয়ার ব্যাবস্থা করে দেব। অথবা রুমার বদলে অন্য কোনও চবিবশ ঘন্টার কাজের লোকও খোঁজা যেতে পারে।’

কিন্তু আমরা যদি রুমার সঙ্গে যতিনকেও এখানে রাখতে পারতাম তাহলে কিন্তু আমাদেরই সুবিধা হতো। রাত-বিরেতে বাড়িতে একজন পুরুষমানুষ থাকলে সুবিধাই হয়।’ দী৫ আরেকবার নিজের মতটা সবার ওপর চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করল।

‘দী৫ ব্যাপারটা বোঝবার চেষ্টা কর। যতিন একটা রিক্সাওয়ালা সরি টোটো-রিক্সাওয়ালা। তাকে বাড়িতে রাখাটা মোটেই প্রেস্টিজিয়াস নয়। ও এখানে থাকলে দুদিন পরে ওর লেভেলের বন্ধু-বান্ধবরাও এখানে আসা যাওয়া করবে। তুই কি মনে করিস আমাদের এই সফিস্টিকেটেড পাড়াতে লোকে সেটা অ্যালাউ করবে? যেখানে সবার বাড়ির সামনে দামি-দামি গাড়ি থাকে সেখানে আমাদের বাড়ির সামনে টোটো দাঁড়িয়ে থাকবে। ‘উফ্ আমি আর ভাবতে পারছি না।’ সুপ্রিয়ার গলায় হতাশার ছোঁয়া যেন। সে কোনও মতেই রুমার বিয়ে মানতে পারছে না।’

সুতপার শরীরটা কেমন যেন করছিল। কোনওমতে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমার তো দুপরে খাবার পর একটু শোবার অভ্যাস, তোরা কথা-বার্তা বল, আমি ও-ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিই।’ নিজের ঘরে গিয়ে দেখলেন তছনছ অবস্থা। নাতিদের বইপত্র, বিছানার বালিশ, চাদর সব মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। তোশকটা খাট থেকে অর্ধেক ঝুলে আছে আর খাটের ওপর বাবুন টাবুন মারামারি করছে। দরজা বন্ধ করে কোনওমতে গেস্টরুমে এসে দিঘির পাশেই শুয়ে পড়লেন। চোখ বুজে শুয়ে পড়লেও ঘুমাতে পারলেন না কারণ তখন ড্রয়িংরুমে জোর চ্যাঁচামেচি চলছে।

সুপ্রিয়া বলছে, ‘দ্যাখ দিদি, বাবা মারা যাবার পর মায়ের যখন দরকার ছিল কাউকে নিজের পাশে পাবার, তখন তুই বা দী৫ কেউ মায়ের কথা ভাবিসনি। তোরা কি পারতিস না এখানে সেটল করতে? তা না তোরা রওনা দিলি দক্ষিণ ভারতে, ফর ব্রাইটার ফিউচার। নার্সিংহোম তো এখানেও করতে পারতিস কিন্তু করিসনি জাস্ট টু অ্যাভয়েড রেসপন্সিবিলিটিজ।’

সুচিত্রার উত্তর যেন তৈরি ছিল, বলল, ‘সেকি কিছুক্ষণ আগে তুই বললি না যে বাঙালি মায়েরা ছেলেদের হাতের মুঠোর মধ্যে রাখে। ছেলেদের সংসারের মালকিন হয়ে থাকে, তাহলে মায়ের রেসপন্সিবিলিটি তো দীপ্তর নেওয়া উচিত। দীপ এখানে থাকতে পারত অথবা মা ইউএস চলে যেতে পারত ছেলেকে মুঠোর মধ্যে নিয়ে।’ দী৫ চুপ করে বসে রইল, তারপর লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে বলল, কলকাতা ছেড়ে আমরা চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম তিথির জন্য। ওকে অ্যাডপ্ট করার পাঁচ বছর পরেও কোথাও দেখা হলেই চেনা পরিচিত লোকজনেরা বলত, এই বুঝি আপনাদের দত্তক নেওয়া মেয়ে। বেশ ভালো রেখেছেন তো। কোথা থেকে নিয়েছিলেন যেন। মা বাবার কোনও খোঁজ পেয়েছেন কি? ইত্যাদি ইত্যাদি। তিথি তখন বুঝতে শিখেছিল, দুঃখ পেত। আমাদের মনে হয়েছিল দূরে কোথাও চলে যাওয়াটাই ভালো।’

‘ঠিক আছে তখন প্রবলেম ছিল চলে গেছিস এখন তো তিথি দিল্লিতে হস্টেলে আছে। কৃষ্ণনদার মাও বেঁচে নেই, যে ওনার অজুহাত দেখাবি। তোরা তাহলে এখন ওখানকার পাঠ চুকিয়ে কলকাতা চলে আয়। যেখানে পড়াশোনা করলি সেখানকার লোকেদেরও কিছু সেবা যত্ন কর সঙ্গে সঙ্গে মায়ের খেয়ালও রাখতে পারবি!’ সুপ্রিয়া স্লকপ্রকার চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল সুচিত্রা আর কৃষ্ণনের দিকে।

‘যেটা হয় না তা নিয়ে তর্ক করিস না ছোড়দি।’ দীপ সুপ্রিয়াকে থামাবার চেষ্টা করে।

‘তুই তো দিদির পক্ষ নিয়ে কথা বলবিই ভাই। দিদি যদি সাউথ ইন্ডিয়ায় গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরছে তাহলে তুই তো আরেক কাঠি ওপরে– আমেরিকায় মহানন্দে বিরাজমান এনআরআই। তোরা সব দায়িত্ব আমার ঘাড়ে চাপিয়ে যে যার মতো নিজেদের লাইফ এনজয় করছিস।’

সুচিত্রা এবার প্রায় চেঁচিয়ে উঠে ধমক দিল সুপ্রিয়াকে, ‘তুই চুপ করবি প্রিয়া? তখন থেকে খালি ঝগড়া করছিস। তুই এমন কী করেছিস যে তখন থেকে আমাদের দোষারোপ করে যাচ্ছিস।

‘করিনি আমি? মায়ের চোখ অপারেশন গত দুবছরে দুবার হল। কে এসে থাকল মায়ের কাছে? এ বছর যখন ভাইরাল ইনফেকশন থেকে মায়ের মারাত্মক জ্বর হল, কাকে দৗড়ে আসতে হল? আমেরিকার সাহেব টাকা পাঠিয়ে দিয়ে বললেন– ভালো নার্সিংহোমে ভর্তি কর আর বেঙ্গালুরুর ম্যাডাম দিনে দুবার ফোন করে জ্ঞান বিতরণ করলেন। সুপ্রিয়া কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল। তোরা সব বড়ো বড়ো ডিগ্রি নিয়ে নিজেদের ফিউচার ভালো থেকে আরও ভালো করার জন্য দৗড়োচ্ছিস আর আমি সকাল থেকে রাত অবধি দৗড়ে মরছি তোদের খুশি করার জন্য। আমি আর পারছি না।

হঠাৎ করে পুরো বাড়িটা যেন ভীষণ ভাবে নিস্তব্ধ হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরে কৃষ্ণন বলল, ‘একটু চা খেলে বোধহয় ভালো হতো, কি বলিস সমীর?

সুচিত্রা উঠতে যাচ্ছিল চায়ের বন্দোবস্ত করতে, কিন্তু মিতা বলল, ‘তুমি বসো বড়দিভাই। আমি চায়ের ব্যবস্থা করছি।’

তারপর ঘর থেকে বেরোবার আগে থমকে দাঁড়িয়ে সবার দিকে ঘুরে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘জাস্ট ইট কেম টু মাই মাইন্ড।’ এ বছরের শুরুতে রুমা একদিনের জন্য কোনও হসপিটালে বা নার্সিংহোমে ভর্তি হয়েছিল না? একটু চিন্তা করে সুচিত্রা বলল, ‘হ্যাঁ ভাইরাল গ্যাসট্রোএনটেরাইটিস হয়ে ডিহাইড্রেশন হয়েছিল। স্যালাইন নিতে হয়েছিল। কিন্তু কেন জানতে চাইছিস এসব এখন?’

‘সত্যি কি তাই হয়েছিল, নাকি প্রেগনেন্সি টারমিনেশন? ইউ নেভার নো।’

হংসীনির মতো গ্রিবা উঁচু করে মিতা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল সবার মনে এক সন্দেহের কাটা গুঁজে দিয়ে।

ছয়

তিন মাস পরে দীপ একটা ইমেইল পেল সুতপার কাছ থেকে। চোখের অসুবিধাটা বাড়াবাড়ি হবার আগে মা নিয়মিত কম্পিউটার ব্যবহার করতেন। ইদানীংকালে সেভাবে না হলেও মাঝেমধ্যে মায়ের ইমেইল পায় সে আর তাছাড়াও মাসে দুবার করে ভিডিও চ্যাটও করে। তাই ইমেইলটা পেয়ে সে মোটেই অবাক হয়নি। কিন্তু সকালে কাজের তাড়া থাকায় সেটা পড়ে উঠতে পারেনি। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে ইমেইল খুলে দেখল মায়ের হাতে লেখা একটা চিঠি অ্যাটাচড করে পাঠানো হয়েছে।

চিঠিতে মা লিখেছেন–

আমার প্রিয়জনেরা,

আশাকরি তোমরা সবাই ভালো আছো। আমি ইমেইলটা দীপ্তকে পাঠাচ্ছি আর আশা করব এটা পড়বার পর দীপ চিত্রা ও প্রিয়াকে পাঠিয়ে দেবে। তোমরা হয়তো ভাববে মা ফোন না করে কেন চিঠি লিখছে। কারণ আমি সেকেলে মানুষ। মনের দ্বিধা সরিয়ে সব কথা চিঠিতে যেভাবে লেখা যায় তা বোধহয় ভিডিও চ্যাট বা ফোনে হয় না।

আসলে একটা খবর দেবার জন্য তোমাদের বিরক্ত করছি। আমি আর আধ ঘন্টার মধ্যে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ভয় পেও না, নিরুদ্দেশে যাত্রা করছি না। বরং রুমা আর যতিনের সঙ্গে ওদের বাড়িতে থাকতে যাচ্ছি। যতিনের মায়ের কোনও আপত্তি নেই ছেলের বউ-এর সঙ্গে তার মাসিমাকেও বাড়িতে আশ্রয় দিতে। আমি রুমাকে বলেছিলাম– ওদের দেড় খানা ঘরের বাড়িতে আমাকে নিয়ে গেলে অসুবিধা হবে, কিন্তু ওরা শুনল না।

যতিন বারাসতের দিকে একটা জমি দেখেছে। পাকা বাড়ি বানাবার জন্য। আমি বলেছিলাম কিনে দিই, কিন্তু ও কিছুতেই আমাকে কিনতে দিল না। ছেলেটার আত্মসম্মান বোধটা প্রবল, তাই আমি জোর করিনি। যতিনের এ বাড়িতে ইন্টারনেট নেই তাই আর ইমেইল করতে পারব না যদি না দোকানে গিয়ে করি। সেইজন্য ভাবলাম কাজের কথা এখনই সেরে নিই।

একটা উইল এর কপি পাঠালাম। বাড়িটা তোমাদের তিনজনের নামে করে দিয়েছি। পাড়ার অনেকেই কিনতে ইচ্ছুক। বিক্রি করে তোমরা টাকাটা ভাগ করে নিও অথবা কোনও আশ্রমে দান করে দিও। আমার মোবাইলটা সঙ্গে আছে, যখন খুশি কথা বলতে পারো আমার সঙ্গে।

তোমাদের মা তোমাদেরই আছে খালি আমার নতুন ঠিকানাটা তোমাদের জানালাম না। তোমরা এখানে এলে ওরা অস্বস্তিতে পড়বে আর তোমাদেরও হয়তো ভালো লাগবে না। কিন্তু আমি জানি, আমি সত্যি ভালো থাকব ওদের সাথে!

ওহো তোমাদের আসল কথাটা জানাতে তো ভুলেই গেলাম। গত রবিবার যতিন আর রুমার বিয়ে দিয়েছি আমরা। তোমাদের কাছ থেকে নব বরবধুর জন্য আশীর্বাদ কামনা করি।

ইতি

তোমাদের মা–

ইমেইলটা পড়ে দীপ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে।

নীলমাধবের চাঁদ

হাতে স্বর্গ পেল নীলমাধব। আজ তার সরকারের দেওয়া ৩৫ বছরের জীবনের শেষ দিন। একটু আগেভাগেই অফিস যাবে। প্রতিদিনের মতো শুধু নিজের চেয়ার টেবিল মুছে, টেবিলের কাচের নীচে রাখা কালি ঠাকুরকে পেন্নাম ঠুকে, এক গেলাস জল ঢক ঢক করে গলায় ঢালা শুধু নয়, আজ তার অফিসের চেয়ারের চারটে পায়ে প্রণাম করবে। টেবিলে খানিকটা মাথা ঠুকবে। ভেবে রেখেছে একটু কাঁদবেও। চোখের জল দিলে দেবতা খুশি হন।

ওই চেয়ার-টেবিল তো তার ভগবান। অফিসের লোকজন আসার আগেই সেসব আচার করে ফেলতে হবে। লোকজনের সামনে করলে হাসাহাসি হবে। এ জীবনে তার জন্য তো আর কোনও চেয়ার অপেক্ষা করে থাকবে না। কত মায়া ছিল ওই কাঠের চেয়ারটার। ডেলি-রেটেড মজদুর হিসেবে ঢুকে নিজের অধ্যবসায় আর মিষ্টি ব্যবহার দিয়ে সকলের মন জয় করে আজ ক্লার্ক হয়ে রিটায়ার করছে।

হ্যাঁ, সকাল সকাল অফিস যাবে বলে একটু আগেই চানঘরে ঢুকে গেছে নীলমাধব। সঙ্গে অভ্যাসমতো খবরের কাগজ। কমোডের উপরে বসে খবরের কাগজ পড়া তার অন্যতম বিলাসিতা। ভাঁজ খুলতেই হলুদ কাগজের একটা ছোটো প্যামফ্লেট সড়সড় করে নেমে মেঝেয় পড়ে গেল। না ভেজেনি। নীলমাধব ঝুঁকে কাগজের টুকরাটো হাতে নিয়ে চোখ বোলাতেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল। কয়েকদিন ধরে মনের ভেতর ঢুকে আসতে থাকা অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছে যেন। নগ্ন, নির্মেদ প্রায় ছয় ফিটের শ্যামবর্ণ শরীর নিজের অক্ষের উপর চরকি মারল। তার চোখে পড়েছে। প্যামফ্লেটের একেবারে নীচের দুটি লাইন– একটিমাত্র ফোন আপনার জীবনের পরিবর্তন আনতে পারে। রত্না ঘোষ, ফোন- ৯৭৬৮৫৫৪২৭২।

বউ ঘোষণা করে দিয়েছিল অনেক আগেই, ‘সারাদিন বাড়িতে বসে ট্যাঙস ট্যাঙস করে কথার ফোড়ন কাটবে, সেটি হবেনি। হাত-পা মজবুত আছে, কাজ-কাম করোগে যাও।’

নীলমাধব জানে, ওই ঘোষণা মানে আদেশ। সত্যি সত্যি সারাটা দিন তাকে সইতে পারবে না বউ। এ-কথার পিঠে সে-কথা, তারপর তো বাড়ি মাথায় করে কুরুক্ষেত্র। আর সেসব এড়াতে রাস্তায় রাস্তায় উদ্দ্যেশ্যহীন কতদিন আর ঘুরে বেড়াতে পারবে! সে এবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্যামফ্লেট পড়তে থাকে। হ্যাঁ হ্যাঁ আলো।

লেখা আছে, ‘ইউ এস মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানি কলকাতায় তাদের ব্যাবসা বাড়াবার জন্য চাকরির অফার দিচ্ছে।’

নীলমাধব আতিপাতি করে খুঁজল কোনও শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা বলেছে কিনা। সেখানে সে আটকে যেতে পারে। সে তো মাত্র উচ্চ মাধ্যমিক পাস। আর এখন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করার জন্য সোনার টুকরো সব ছেলেমেয়েরা বসে আছে। অফিসের বড়োবাবুর ছেলে তো বেঙ্গালুরু থেকে পাশ করেই ইনফোসিস না কি কোম্পানিতে চাকরি করতে চলে গেল, সে-ও মাল্টিন্যাশনাল।

পেট ও মনের যুগপত আরাম হয়ে এসময় নীলমাধবের চোখে পড়ল প্যামফ্লেট-এর দুই নম্বর খোপটিতে লেখা আছে গৃহবধূ, রিটায়ার্ড ব্যক্তি, ভিআরএস।

তার যোগ্যতা রিটায়ার্ড ব্যাক্তি। মানে কাল থেকে সে এই কোম্পানিতে কাজ করার যোগ্য। তবে কালকের জন্য নীলমাধব অপেক্ষা করবে না। আজকেই ফোন করে জেনে রাখবে সব। যাতে কালই বউয়ের কথা মেনে অফিসের সময়েই ঘরের বাইরে পা দেয়া যায়।

অফিসটা কেমন হবে! শুনেছে সে, এসব অফিস খুব সাজানো গোছানো হয়। সরকারি অফিসের মতো নোংরা আর অন্ধকার যেখানে সেখানে জমে থাকে না। ঝাঁ চকচকে, সেন্ট্রালি এসি। আর সেখানে কাঠের চেয়ার টেবিলের বালাই নেই, খোপে খোপে ডেস্ক আর গদি দেওয়া রিভল্ভিং স্টিলের চেয়ার।

একটা লম্বা করে শ্বাস নেয় নীলমাধব। কমোডে বসে থেকেই তার মনে হল এসব অফিসের ড্রেস কোডের কথা। অসীম-দার বউ কাজ করে ‘বোম্বাই প্রেস অ্যান্ড অ্যাডভার্টাইসমেন্ট -এর কলকাতা অফিস ১১১ পার্ক স্ট্রিটে। একদিন কী একটা কাজ নিয়ে অসীমদার সাথে সেই অফিসে গিয়েছিল। ওয়েটিং-এ তাদের জন্য যে মেয়েটি দামি ট্রেতে করে কফির কাপ, জলের গেলাস এনে দিল, তার দিকে চেয়ে তো বুকে কাঁপন ধরে গেছিল। সাদা ধবধবে পা হাঁটুর উপর পর্যন্ত যেন মাখন দিয়ে গড়া। লাল স্কার্ট, লাল হাই হিল আর টকটকে লাল ঠোঁট-ই যথেষ্ট, মাথা ঘুরিয়ে দিতে। তার উপর জামার উপরের একটা বোতাম খোলা আর কফির কাপ নামিয়ে রাখার সময় ঝুঁকে পড়তেই দুটি সোনার ফসলের অনেকটা চোখের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল যেন। মেয়েটা চলে যেতেই অসীমদা ফিসফিস করে বলেছিল, ‘কী রে একেবারে ফিদা হয়ে গেছিস?’

নীলমাধব ধরা পড়ে যাবার বিড়ম্বনায়, তো তো করে অজুহাত খুঁজতে যেতেই অসীমদা চোখে মুখে হাসি ছড়িয়ে বলেছিল, ‘ঝানু ঝানু পার্টিকে এভাবেই আতিথেয়তার প্রথম মুহূর্ত থেকেই বধ করে ফেলে। মতামতকে নিজেদের অনুকূলে নিয়ে যাবার জন্য এটা একটা প্রাচীনতম হিপনোটাইজিং ফ্যাক্টর।’

অসীমদাকে সিনিয়র হিসেবে শুধু নয়, তার নানা বিষয়ে জানাশোনার জন্য নীলমাধব মনে মনে শ্রদ্ধা করে। অসীমদা বেশ ইন্টেলেকচুয়াল। শুনেছে কফি হাউসে নাকি আড্ডা আছে তার। চাকরি ছাড়াও সংবর্ত নামে নাটকের দলে নাটক করে।

অসীমদা আবার কানের কাছে মুখটি নিয়ে ফিসফিস করে, ‘ওই যে মেয়েটার চলকে ওঠা বুকের উপর থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলি না…।’

‘না না কী যে বলো তুমি…।’ নীলমাধব নিজেকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে।

অসীমদা বলে, ‘শোনই না, এদের অধিকাংশেরই নিজের বুক না, লিফট করা বুক। আর এরা মুখের সঙ্গে সঙ্গে ক্রিম, রং বুকেও মাখে। দেখলি না কেমন গলা মোমের মতো লাবণ্য ঝরছিল সেখানে!’

‘যাঃ, তুমি না বাজে কথার জাদুকর।’

‘আরে আমি না জেনে বলছি নাকি! আমার বউ এলে দেখবি, তার-ও বুক ফেটে পড়ছে মনে হবে। কিন্তু দুটো দামড়া দামড়া ছেলের মা অমন ঢাউস বুক পাবে কোথায়! সবই নিউ মার্কেটের প্যাডেড ব্রা-র কেরামতি। আমি তো জানি, এই এতটুকু।’বলে অসীমদা হাতের আঙুল পাঁচটি দিয়ে একটা কমলালেবুর আকৃতি করল।

নীলমাধব ভাবনার ভালোলাগায় তলিয়ে ছিল। সে একটু নিজত্বে এসে ভাবল, তাহলে নিজেকেও তো সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে হবে। অনেকদিন থেকেই নন্দিনী বলছে ভালো এক সেট জামা কাপড় কিনতে। এই ক্যাবলাকান্তপনা জামা কাপড়ে চলছে না। দামি কোনও শোরুমে নিয়ে গিয়ে সে-ই কিনে দেবে সব। কিন্তু নীলমাধব তানা নানা করে ঠেকিয়ে রেখেছে।

নন্দিনী নীলমাধবের ফুসফুস। সংসারে খরখরে গ্রীষ্মযাপনের মধ্যে নন্দিনী তার মরুদ্যান। না না বাড়িয়ে বলা নয়। আহিরিটোলা ঘাটের কাঠের জেটিতে কম দামের বুট ঠুকে সন্ধ্যার অল্প আলোয় কচুরিপানার স্রোতকে ভাটার টানে ছুটে যেতে দিয়ে নন্দিনীর গায়ে গা ঘেঁষে থেকে সে মাঝে মধ্যেই বলে, ‘বেঁচে থাকার সুখটুকু তোমার জন্যই পাচ্ছি, বিশ্বাস করো আর না-ই করো।’

অফিসে-বাড়িতে ইঁদুরের মতো থাকতে অভ্যস্ত নীলমাধব এই একটুকু সময় নদীর উদারতার সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ায়। গঙ্গার হাওয়া নন্দিনীর শরীরের গন্ধ নিয়ে তার বুকের ভেতর ঢোকে। আবার তাকে একটা দিন বাঁচার প্রেরণা দেয়। হেরে যাওয়া জীবনে এই একজনই তাকে সমর্থন করে। শুধু তো সমর্থন নয়, এই একজনই যে নিজেকে তার কাছে সমর্পণ করে বসে আছে।

দুই

বউ বলেছে দাদাকে ফোন করে দিচ্ছে, দাদা ঠিক একটা জুটিয়ে দেবে। বলেছে, বাসন্তীতে ১৫০ দিনের কাজে তার দাদা যে কত লোককে কাজে ঢুকিয়ে দিয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মাটি-কাটার কাজ আছে। চিংড়ির মীন ধরে আড়তে দেবার লোক – একটা না একটা জুটে যাবে। তবে কাজের আগে পাত্তিটাত্তি ছাড়তে হতে পারে। তার দাদা, বোনের বর বলে ছেড়ে দেবে না।

নীলমাধব থ মেরে যায় বউয়ের কথায়। এখন সে মাটি-কাটার কাজ করতে পারবে! ওদের গাঁয়ের মেয়েবউদের সাথে লুঙ্গি পরে জলে নেমে মীন ধরবে! সারাজীবন অফিসে চেয়ার-টেবিলে কাজ করার পর এই এত বয়সে লেবারের কাজ করতে যাবে! মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে বউয়ের। কিন্তু বউয়ের যা গোঁ, কিছু একটা না করলে যদি ধরে-বেঁধে বাসন্তীতে পাঠিয়ে দেয়!

নীলমাধব চান শুরু করার আগে প্যামফ্লেটের শেষ অংশটুকুও পড়ে নিল, ‘বাড়ি থেকে অথবা অফিসে বসে কাজ।’

হ্যাঁ হ্যাঁ অফিসে বসেই কাজ করতে চায়। বাড়িতে বসে কাজ করতে বললে সে করবে না। মনে মনে ঠিক করে, পার্ট টাইম বা ফুল টাইম-এর মধ্যে, সে ফুল টাইমই নেবে।

একজন জহরকোট গায়ে দেওয়া ভদ্রলোক, মুখে ও হাতে শ্বেতির দাগ, প্রোজেক্টরের আলো এড়িয়ে এসে দাঁড়ালেন। কল টাইম ছিল বেলা তিনটে। ছোটো হল ঘরটা ভর্তি হয়ে গেছে। নীলমাধব থার্ড রো-তে মাঝামাঝি বসেছে। মাঝামাঝি থাকার নানা সুবিধে সে জানে। তার বাঁদিকে বসা পৃথুলা মেয়েটি অযথা কনুই দিয়ে চাপছে।

‘আমার নাম পি আচারিয়া।’ জহরকোট বলে উঠল। জহরকোট আরও বলল, ‘আসুন আমরা একসাথে তাল দি, প্রজেক্টরে একটা বিট বাজছিল।

নীলমাধব দেখল উপস্থিত সবাই ওই ভদ্রলোককে অনুসরণ করে হাততালি দিচ্ছে। এবং সে নিজেও।

‘এই কোম্পানির নাম হার্বলাইফ।’

পাওয়ার-পয়েন্টে প্রেজেন্টেশন পড়ছে পর্দায় আর মিঃ আচারিয়া নামে ওই জহরকোট বলে চলেছে, ‘এই কোম্পানির বয়স ৩৪ বছর। মানে যুবক এখন। এখন তার এক্সপ্যানশনের সময়। বিশ্বের ৯৬টা দেশে এই কোম্পানি কাজ করছে। সাড়ে দশ কোটি লোক এই কোম্পানির প্রোডাক্ট ইউজ করে।’

একমাথা লম্বা চুল যেন তাকে বিব্রত করছে, এরকম ভঙ্গিতে মাঝে মাঝে সে হাত দিয়ে মাথার চুল সরিয়ে দিলেও আবার সেসব চোখে মুখের উপর নেমে আসছে। নীলমাধবের মনে হল, পি আচারিয়া নামে ওই লোকটা তার চুলের অবিন্যস্ত অবস্থানটি নিশ্চই উপভোগ করে।

‘আমাদের প্রোডাক্ট উপভোক্তাদের কথা বলছিলাম, পর্দায় দেখুন, রোনাল্ডো, ওই যে ঢকঢক করে খেয়ে খেলায় নেমে গেল। গোল করল। বিরাট কোহলির জামায় দেখুন, লেখা রয়েছে হার্বলাইফ। ওই যে দেখুন, সাইক্লিস্টরা হার্বলাইফ-এর ড্রিংক খেয়ে নেমে পড়ছে রেসে।’

মাঝে মাঝে তিনি নেক্সট বলছেন, আর পাওয়ার-পয়েন্টে ছবি পালটে যাচ্ছে। একটা ছবিতে দেখানো হল একজন মোটা মেয়ে এই হেলথড্রিংক নিয়ে কীভাবে রোগা হয়েছে। ছবি থেকে দর্শক ও শ্রোতাদের দৃষ্টি সরিয়ে দিয়ে কমেন্ট্রেটর ভদ্রলোক একজন গৃহবধূকে সামনে ডেকে নিয়ে তার হাতে মাইক্রোফোন ধরিয়ে দিলেন। সেই বধূটি স্কিন টাইট পোশাকে স্ফিত বক্ষদেশের নীচে নিজের ক্ষীণ কোমরে হাত দেখিয়ে এবং বুক দুলিয়ে বললেন, এই ড্রিংক খেয়েই তিনি এরকম সিনেমার নায়িকার মতো শরীর তৈরি করতে পেরেছেন আর তিনি নাকি এই কোম্পানির একজন মার্কেটিং ম্যানেজার হয়ে মাসে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করেন এবং দেশে-বিদেশে কোম্পানির হয়ে ঘুরে বেড়াতে পারেন।

নীলমাধব মাথা ঠান্ডা রেখেছিল। পাশের মেয়েটি নোট নেবার সময়, হাততালির সময় যেন ইচ্ছে করেই ছুঁয়ে দিচ্ছিল। খুব ছোটো ছোটো চেয়ার। ডানদিকের হাতলে রাইটিং স্পেস। মেয়েটা একসময় তার শরীরের উপরের অংশ এতটা ঝুঁকিয়ে দিয়েছে যে, নীলমাধবের বাহুতে তার বুকের ভারী অংশ ঘষা লাগছে।

কী চায় মেয়েটি! নীলমাধব জানে চেহারায় তাকে চল্লিশোর্ধ মনে হয়। এই মেয়েটা ফাঁসাবে নাকি! ও কি জেনে গেছে রিটায়ারমেন্ট বেনিফিটের অনেক টাকা তার হাতে আসতে চলেছে! নীলমাধব আরও কুণ্ডলী পাকায়। নিজের ছোট্ট চেয়ারে। আর যুবতির শরীরের নরম  অংশের ছোঁয়ায় উত্তেজিত বোধ করলে ভাবনাকে অন্য দিকে গড়িয়ে দিয়ে নিষ্কৃতি পেতে চায়।

অন্য কি বা তার আছে নন্দিনী ছাড়া! নন্দিনী পই পই করে বলেছে চাকরি খুঁজতে গিয়ে ভুলভাল জায়গায় যেন না যায়।

গত বছর একটা ভুল জায়গায় সে চলে গিয়েছিল। অবশ্য সেটা নন্দিনীর সাথেই। নন্দিনীর সাথে চলতে তার কোনও ভাবনা হয় না। সব ভাবনা নন্দিনীর। নন্দিনী সঙ্গে থাকলে সে ফুরফুর করে ওড়ে। মেপে কথা বলা, মেপে চলা, কিচ্ছুটি করতে হয় না। কিন্তু অন্য সময় নীলমাধব শংকিত, সঙ্কুচিত থাকে, এই বুঝি কেউ তাকে ঠকাল, এই বুঝি কেউ তাকে অপমান করতে আসছে।

গত বছর নন্দিনী-ই নিয়ে গেল। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। তাকে কিচ্ছুটি করতে হয়নি। শুধু কথামতো অফিস কেটে পৌনে দশটায় হাওড়া স্টেশনে বড়ো ঘড়ির নীচে নন্দিনী টিকিট কেটে দাঁড়িয়েছিল। দশটার কাটোয়া লোকাল।

‘আমার না খুব থ্রিল হচ্ছে জানো, এই প্রথম কলকাতার বাইরে কোথাও যাচ্ছি, তোমার সাথে। তোমার ভালো লাগছে তো! না কি আমি জোর করেছি বলে তুমি এলে?’

নন্দিনী জানালার পাশে বসেছে, হাওয়ায় তার কথা ভেসে যেতে পারে ভেবে সে অনেকখানি নীলমাধবের গায়ের ভেতর ঢুকে এসে কথা বলছে। তার ৩১ বছরের মাখন শরীর নীলমাধবের ছোঁয়া পেতে ব্যাকুল যেন। নীলমাধবের স্বপ্নে জড়ানো দুটি চোখের উপর থেকে চোখ সরাচ্ছে না। কামরার দু-একজন তো নন্দিনীর সৌন্দর্য থেকে চোখ ফেরাতেই পারছে না।

নীলমাধব নন্দিনীর কথার উত্তরে শুধু বলতে পেরেছিল, ‘স্বপ্ন যে সত্যি হয়, তা আমি বুঝতে পারছি আজ। কতদিন মনে মনে ভেবেছি, তোমার সাথে দূরে কোথাও বেড়াতে গেলে বেশ হয়। দূরের ট্রেনে পাশাপাশি যাওয়ার যে কি আনন্দ তা এই লোকাল ট্রেনেই টের পাচ্ছি।’

সোমড়াবাজার স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে মাঝদুপুরে নেমেছে মাত্র পাঁচ-সাতজন। নীলমাধব প্ল্যাটফর্মে নেমে ডাবের কাঁদি দেখে লোভে পড়ে কিনে ফেলল দুটি। বেশ মিষ্টি জল। ডাব খেতে খেতেই জেনে নিয়েছে নন্দিনী সবুজদ্বীপের টোটো কোথায় মিলবে, কত ভাড়া।

সুবল হালদারের ডিঙিনৌকায় উঠে নন্দিনী প্রায় কিশোরীর মতো আচরণ শুরু করে। জলের ভেতর হাত দিয়ে জলে শব্দ তোলে। নীলমাধবের কোলে শুয়ে ভর দুপুরে নিজের প্রিয় গানটা গুনগুন করে, ‘নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে।’ কবে যেন একবার নীলমাধব নন্দিনীর রূপের প্রশংসা করতে গিয়ে বাঁকা চাঁদ বলেছিল তাকে। সেই থেকে সুযোগ পেলেই নন্দিনী গীতা দত্তকে নকল করে দু’কলি শুনিয়ে দেয়।

বেহুলা নদীর বয়স্ক মাঝি এসব দেখতে অভ্যস্ত। সে গা করে না। শহরের মানুষজনের আদেখলাপনা সে জানে। বদলে সে গল্প করে এমন ভাবে যেন নীলমাধবদের ওই শারীরিক খুনসুটি কিছুই নয়। মাঝি জানে বাবু খুশি হলে ফেরার সময় ভাড়া ১০০-র জায়গায় ১৫০ করতে ভাববে না।

বেহুলা নদীর বাঁক ঘুরতেই চওড়া জলরাশির গঙ্গা। মাঝি জানায় উলটোদিকে নবদ্বীপ। নীলমাধবের চোখে পড়ে খানিকটা দূরে জলের উপর মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে বনরাজি। এই তবে দ্বীপ। সবুজদ্বীপ।

অর্জুন গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে নদী দেখছিল নীলমাধব। নন্দিনী হঠাৎ পিঠ জাপটে ধরে ইশারা করল। শুকনো ঘাসের ঝোপের পাশে খসখস শব্দ। একটু ভয় পায় নীলমাধব। তবে কি সাপ! নন্দিনীর চোখ অনুসরণ করে নীলমাধব দেখল এক জোড়া ছেলে-মেয়ে শরীরী প্রেম করছে। ছেলেটা মেয়েটার ব্লাউজ খুলে ফেলেছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মেয়েটার ধবধবে বুক। নীলমাধব নন্দিনীর বাহু ধরে টেনে নিয়ে আসে। এখানে থাকা ঠিক হবে না। নন্দিনী ওই দৃশ্যে উত্তেজিত। সে একটু সরে এসে নীলমাধবের ঠোঁট কামড়ে রক্ত বের করে দিয়েছিল। সে চাইছিল ওই ছেলে-মেয়েটির মতো বন্যতা।

‘এই যে মশাই, মেয়ে নিয়ে এসে বেশ ফুর্তি-ফার্তা করছেন। কিছু মালকড়ি ছাড়ুন তো, আমরাও একটু মস্তি করি।’যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এল তিন-চারটে ছেলে। নীলমাধব ভয় পেয়ে গেছে। তার মুখ থেকে কথা সরছে না। সে ভাবছে এইসব মাস্তানেরা মেরে ধরে সব কেড়েকুড়ে নিয়ে, তারপর হয়তো আরও ঘন বনের মধ্যে নন্দিনীকে টেনে নিয়ে গিয়ে গ্যাং রেপ করে দেবে।

নন্দিনী হঠাৎ কোমরে শাড়ি জড়িয়ে রানি লক্ষ্মীবাই হয়ে যায়। সে গলা সপ্তমে তুলে একেবারে বস্তির মেয়ের মতো অভিনয় করে দেয়। ‘আমি ওকে চুমু খেয়েছি, তোর বাপের কীরে? তুই যখন ওইদিকে ঝোপের আড়ালে একটা মেয়েকে ন্যাংটো করে মাটিতে ফেলে ঠাসছিলি, তখন আমি বলতে গেছি?’

চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে সে খপ করে ছেলেটির হাতের কবজি ধরে খানিকটা টেনে নিয়ে যায়। ‘চল, গার্ডের কাছে। গিয়ে বল, ওই মেয়েটা তোর বউ কিনা! আর যদি বউ হয়, দিনে-দুপুরে লোকজনের মাঝে চিত করেছিলি কেন!’

ছেলেটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। অন্য ছেলেগুলোও কেমন অবাক চোখ করে তাদের পান্ডাকে রেখেই গুটিগুটি কেটে পড়ে। নন্দিনী ছেলেটার কবজি কিছুতেই ছাড়ে না।

‘না না, তেমন কিছু করিনি।’ ছেলেটা তোতলাতে থাকে।

নীলমাধবই ছাড়াতে চায়, ‘দাও ছেড়ে দাও।’

‘অমনি অমনি ছাড়ব, পুলিশের হাতে দেব না! বেড়ানোর জায়গা কি দুষ্কৃতীদের স্বর্গ হবে, শুধোতে হবে না গেটের পুলিশ ভাইকে?’

ছেলেটা এবার পরিত্রাহি মুখ খোলে, ‘না না, এবার ছেড়ে দিন, আর কোনওদিন হবে না এরকম।’

তিন

কিছুতেই ছাড়তে চাইছে না। নীলমাধবের পাশের সেই পৃথুলা মেয়েটির স্বর কাঁদো কাঁদো। সে বলছে, ‘না, নেই তো, আমার কাছে কোনও টাকা নেই।’

‘টাকা না নিয়ে এসেছ কেন? সামান্য ১০০০ টাকা থাকে না ব্যাগে!’ কোম্পানির সুন্দরী মেয়েটির ডাকাতে মুর্তি। তার কলেই অনেকে এসেছে এখানে। চাকরি পাবার শর্ত হিসেবে একটা পরীক্ষায় বসতে হবে। ফিজ ১০০০ টাকা। নিজের নিজের কনসালটেন্সির সময় এই টাকা নিয়ে নেওয়া হচ্ছে।’

সেই সুন্দরী আবার দাঁত-মুখ খিঁচোয়, ‘ব্যাগে এটিএম কার্ড নেই? যাও আমাদের লোক দিচ্ছি সঙ্গে, টাকা তুলে নিয়ে এসো।’

ভিড়ের চাপে নীলমাধব দরজার কাছেই এসে পড়েছিল। সে কাউন্সিলিং-এর ডাক আসার আগেই কাউকে না বলে সটকে পড়ে। সিঁড়ি দিয়ে নেমে ব্রড স্ট্রিটে পা রেখে হাঁফ ছাড়ে। চাকরি না-পাবার বিষণ্ণতায় গ্রাস হতে দেয় না ওই ১০০০ টাকা বাঁচিয়ে ফেলার আনন্দ। সন্ধেবেলায় গড়িয়াহাটে চায়ের দোকানে বসার আগে ভেবে নিল, নতুন কাজ জুটিয়ে ফেলার আগে শ্যালকের কাছে না হয় ঢুঁ মেরে আসবে খন। তাতে বউকেও খুশি করা যাবে আর যদি হিল্লে একটা হয়েই যায়। তবে হ্যাঁ, হাজার টাকার উপরে সে উঠবে না। শ্যালককে হাজার টাকাই দেবে।

হাজারেই হল। কিন্তু অত সকালে যেতে হবে! পারবে কি নীলমাধব! নীলমাধব নিজের মনে ভাবে কী এমন কাজ! সকালে পুরসভার গাড়ি নিয়ে অনেকেই বাঁশি বাজিয়ে ময়লা নিয়ে চলে যায়। ওই নোংরা কাজ করতে হবে না তো!

স্বস্তি পেয়েছে নীলমাধব। না নোংরা ফেলার কাজ নয়। মাছের সার ছড়ানোর কাজ। জায়গা পালটে পালটে যেতে হয়। বাসন্তীর কাজ শেষ করে, হেড়োভাঙায় করেছে, সাতজালিয়ায় করেছে। এমাসের দশ দিন গোসাবায় কাজ।

একটা জলঢোঁড়া খপ করে একটা মোটা চিংড়িকে বাগে নিয়ে নিল। অন্ধকার আর আবছা আলোর মিশেলে চোখে পড়েছে ঠিক। নীলমাধব দু-পা পিছিয়ে আসে। পঞ্চনাগ মনসাকে স্মরণ করে। আকাশের কোণটা লাল লাল লাগছে। ব্যাগের ভেতর এখনও অনেকটা মাছের খাবার। এত বড়ো বড়ো পুকুর যে এক পাক খেতেই ঘণ্টাখানেক সময় লেগে যায়। ঘুঘু চেপে, মানে ডিঙিনৌকোয় করে জলের মাঝখানে খানিক ছড়াতে হয়। কিন্তু জলে শব্দ তোলা বারণ, তাই বেশিটাই পাড় ধরে। সুশান্তদা পইপই করে বলেছে, জলের কোনও কোণ যেন ফাঁকা না থাকে। ছেলেবেলায় স্কুল-স্পোর্টসে যেমন চুনের দাগ টানতে হতো সমান করে, তেমনি। নীলমাধব হাত আর পা দুটোতেই গতি আনতে চায়।

হু হু করে টাকা আসছে। কিন্তু কাঁচা টাকা পেয়ে নীলমাধবের মাথা ঘুরে যায়নি। কাজ করতে করতে তার মনে প্রশ্ন জেগেছে। সে প্রশ্ন সুশান্তদাকে করবে, সে সাহস নেই তার। তবে ছক্বাকে অনেকবার শুধিয়েছে, ‘হ্যারা ভাইডি, এই যে আমরা মাছের চাষে সাহায্য করি, মানে জলায় জলায় মাছের সার দিই ভূতির মতো রাত থাকতি, তা দিনির বেলা দিলি কী ক্ষেতি?’ কলকাতায় থাকতে থাকতে দক্ষিণের ভাষা চলে গিয়েছিল। এই মাস তিনেক এদের সঙ্গে থেকে তা আবার ফিরে এসেছে। খুবই মিষ্টি, আর প্রাণের ভাষা।

ছক্বা বাইকের ধোঁয়া সুর্যের লাল-পানা মুখটার উপর ছড়িয়ে যেতে দিয়ে বলল, ‘তা অতো কতা আমি জানি! তবে শুনিছি সারারাত ঘুমনোর পর পোভাত কালে মাছের দেবতাদের খুব খিদে পায়, ত্যাকোন খাতি পালি তারা ধাই ধাই করে লম্বা হতি পারে।’

বাইকের পেছনে বসে বিড়ি ধরিয়ে ছক্বার মুখে গুঁজে দিতে দিতে নীলমাধব ভাবে, হ্যাঁ সে-ও তো শুনেছে বাগদা মাছের মীনগুলো অ্যান্টিবাওটিক পেলে ধা করে বড়ো হয়ে যায়। বালিগঞ্জের স্টেশন বাজারে দেখেছে বেশ বড়ো বড়ো চিংড়ি। দাম-ও তেমন নয়, ৩০০/৩৫০। সাধ্যের মধ্যে।

এপ্রিল মাস। মাঠ-ঘাঠ শুকিয়ে যাচ্ছে রোজ। সুশান্তদা, ইসমাইল ভাই গত সপ্তাহে বাজারের ক্লাব ঘরে ডেকেছিল নীলমাধবকে। শ্যালক-ও ছিল সেখানে। সে-ই ডেকে নিয়ে গেছে। বলেছে, দাদা নাকি নীলমাধবের কাজে খুব খুশি। এবার টাকা-পয়সা বাড়ায়ে দেবানে।

‘আর কত বাড়াবে!’ মুখ থেকে বেরিয়ে গেছল কথা। নিজের মুখে হাত চাপা দিয়ে নীলমাধব কথার বদলে জব্বর করে একটা হাই তোলে। শ্যালকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে জানে, যে কথা পেড়েছে সে-ই পুরোটা কবে আনে, না ক’লি তার শান্তি নাই।।

বড়ো শ্যালক বলল, ‘নীলু, এতদিন মাছের কাজ করিছ, এবার চাষের কাজ। প্রাণ-মন দিয়ে করতি হবে। আর আরও একটু রাত থাকতি টেমি জ্বালায়ে কাজ শেষ করতি হবে। ভেড়ির বাঁধ কাটেকুটে চাষের মাঠে জল ঢোকাতি হবে রাতারাতি, যাতে দিনেরবেলায় ট্রাক্টর চালায়ে ভেজা মাটি উল্টি দেয়া যায়।’

খাটনি একটু বেশি হচ্ছে বটে, কিন্তু নীলমাধব প্রতিদিনই তিনটি হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরছে সকাল ১০টার মধ্যে। তারপর দুপুরে খেয়ে দেয়ে জম্পেস করে ঘুম। রাতের শেষ ট্রেনে ক্যানিং। সেখানে খানিকটা সময় ক্লাব ঘরে চা আর বিড়ি-টিড়ি খেয়ে বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড়া ছক্বার বাইকে। কোন কোন বাঁধ কাটতে হবে তার লিস্ট থাকে ছক্বার কাছে।

আজ বেশি কষ্ট হয়নি। এই বাঁধের উপর দিয়ে লোক চলাফেরা করে না বলে মাটি নরম। তাড়াতাড়ি কেটে দেয়া গেছে। জল হুড়মুড় করে ঢুকছে জমিতে। নীলমাধব সেই জলের তোড়ে কোদালে লাগা মাটি ধুয়ে নেয়। নিজের হাত-পা ধুয়ে নেয়। এসময় ভেড়ির উলটো দিকে কয়েকটা আলোর ফুটকির নড়া-চড়া দেখে অবাক হয়। ছক্বা ছুটে এসে বলে, ‘নীলুদা, এক মুহূর্ত দেরি কোরো না। ওই দ্যাখো আলোগুলো ছুটি আসতিছে এদিকপানে।’

এক হ্যাঁচকা টান দেয় ছক্বা। ‘ওঠো, ওঠোদিনি, বাইকের পেছনে ওঠো।’

ছুটন্ত আলোগুলোর সাথে এবার পায়ের শব্দও কাছাকাছি। ছক্বা বাইকে ঝড় তুলে দেয়। সে ক্যানিং স্টেশনে যায় না। গলি-ঘুজি রাস্তা দিয়ে একেবারে বাইপাসে। হাফ-প্যান্ট, গেঞ্জি পরে আর কোদাল-সাবল হাতে নীলমাধবের মাথা ফাঁকা হয়ে গেছে। বাইকের আয়নার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ ছক্বা বলে, কুদাল আর সাফল ফেলি দাও ওই ডোবার ভেতরে নীলুদা। সামনে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়াতিছি, সেখানে চা-খেতি খেতি তুমি ব্যাগ থেকে জামাপ্যান্ট বের করি পরি নাও। না হলে যমের কাছ থেকে ছাড়া পেয়ে, যমের অরুচির হাতে, মানে পুলিশের হাতে গিয়ে পড়বানে।’

নীলমাধব কিচ্ছুটি বুঝে ওঠেনি। ঘটনার ল্যাজা-মুড়ো সে কিচ্ছুটি জানে না। নীলমাধবের চোখ জোড়া প্রশ্ন অনেক আগেই পড়তে পেরেছে ছক্বা। সে চায়ের গেলাসে চুমুক দিয়ে একটা বিড়ি ধরাল। এই বয়স্ক মানুষটাকে কেন যেন বিপদের ভেতর ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করছে না। নিজের বিপদটা আজ চোখের উপরে নেমে আসতে দেখেছে। দু’জন মেয়েছেলেকে বাঁধের উপরে অত ভোরে ঘোরাঘুরি করতে দেখে সন্দেহ আগেই হয়েছিল। তবে প্রথমে ভেবেছিল অন্ধকারে মেয়েছেলেরা মাঠকাজ সারতে এসেছে। কিন্তু খানিক বাদেই ওদের শঙ্খ বাজানো আর দূরে আলোর ফুটকিগুলোর নড়াচড়া ছক্বাকে বিপদের গন্ধ টের পাইয়ে দিয়েছে। প্রায় ধরে ফেলেছিল আর কি! আর ধরা পড়লে এতক্ষণে গণপিটুনিতে কী যে হতো, ভাবলেও শিউরে উঠছে। গতবছরে মেহতাব-এর তালগোল পাকানো লাশ পড়ে থাকতে দেখেছিল বাসন্তী বাজারে। মেহতাব-এর নামে পুলিশও কাঁপত, তার লাশ।

‘ভাইডি, কোনও পব্লেম আছে?’

নীলমাধব ছক্বার পাশে বসে তার বন্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে শুধোয়। ভোরের মিঠে হাওয়ায় বিড়ির তীব্র গন্ধ প্রকট হয়ে উঠেছে।

‘নীলুদা, তোমার মতো গেঁয়োলোক আমি দেকিনি। তুমি ক্যানো বুজতি চাওনা বহুৎ বেইমানির কাজ এডা।’

‘কেন কেন! এই যে সুশান্ত-দা কলো, এডা হলো গে সমাজসেবার কাজ। সুন্দরবনের ডেভলপমেন্ট নিয়ে এই এনজিও কাজ করতিছে। দেশ-বিদেশ থেকে নাকি ট্যাকা আসে!’

‘মিছে কতা। সাধারণ মানষির পেটে লাথি মারি সুশান্তদার মতো কয়ডা মানষির উন্নতি হতিছে এহানে।’

‘কিন্তু, এই যে আমারে এত ট্যাকা দিতিছে, তা পাতিছে কোত্থেকে!’ নীলমাধব কিছুতেই অবিশ্বেস করতে চায় না।

‘তোমারে দিতিছে, আমারে দিতিছে, আরো কয়েকজনকে। যেখানে যেখানে প্রণামি দিলি নিঃশব্দে রাতের অন্ধকারে সবকিছু হতি পারে, সেখানে দিতিছে। সব দিয়ে থুয়েও ওদের হাতে বিস্তর ট্যাকা। এত ট্যাকা যে একটা নতুন দ্বীপ কিনতি পারবে, সেখানে শহর গড়তি পারবে।’

নীলমাধবের শরীরে কাঁপুনি এসেছে, সে ছক্বার হাতটা ধরে কাঁপুনি থামাতে চায়। মনের ভেতরের অপাপভূমি থেকে সমর্থনের ইশারা পেতে চায়। ‘কিন্তু ছ্যামড়া, আমি তো কোনও অন্যায় কাজ করি নাই, আমি গায়ে খেটে ট্যাকা নিছি, হারামের কিছুডি নিই নাই। নিজের গতর নিংড়ে মাছের গতর গড়ছি।’

মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসল ছক্বা। লোকজনের নজরে পড়তে চায় না। সে ফিসফিস করে, ‘ছাই! তোমার ওষুধে মাছ বাড়ত না, মরত।’

তা কেন, আমি তো আমাদের রেলবাজারে গিয়ে শুনছি, মাছের ফলন বাড়িছে, তা-ই দাম কম মাছের। আমার তো বেশ ভালো লাগত। সাধারণ মানুষ এই যে কম দামে মাছ পাতিছে, সিকেনে আমার ভূমিকা আছে।’

‘আছেই তো।’ছক্বার গলার স্বর কেমন ধাতব। সে হিসহিসায়, ‘বাসন্তীতে এত বেকার পোলাপান থাকতি তোমারে ক্যান কাজে নিল, তা কি একবারও ভাবিছ!’

নীলমাধব কাঁচুমাচু মুখে কথা ফেলে, ‘হাদুই শোন দিন, তা তো কই ভাবি নাই। ভাবছি শউড়ের পো কয়েছে তাই শান্তনুদা কাজটা দেছে।’

হ্যাঁ, শান্তনুদা তোমার মতো একটা সাদাসিদে লোক খুঁজতিছিল, যে বেশি খপর রাহে না। এলাকার বাইরের লোক হলি সুবিধা। পাঁচকান হবার ভয় নাই।’

‘ক্যান, কীসের ভয়?’ নীলমাধবের অবাক গলা।

ছক্বা নীলমাধবের কাছে আরো ঝুঁকে আসে। হ্যাঁ, সবটা জানিয়ে দেওয়া ঠিক হবে। মাস খানেক ধরেই তার মনে হচ্ছিল, বড়ো বিপদ আসতে চলেছে। আসলাম সানিকে অত লোকের মাঝে অপমান করেছিল শান্তনুদা। সেটা ঠিক হয়নি। গত সাত-আট বছর একসাথে রাজনীতি করে শান্তনুদার ঘাঁত-ঘোঁত সব জানে আসলাম। বাসন্তী, গোসাবা, কুলতলির প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষ মুসলিম। সন্দেশখালির দিকে এক একটা গাঁ তো পুরোটাই। আসলাম এই সব জায়গার ভোট জড়ো করত নানা কৌশলে। সে কি সহজে হজম করবে! গত সপ্তাহে শান্তনুদার এক স্যাঙাত উদয় মণ্ডলকে সোনারপুরে কুপিয়েছে আসলামের ছেলেরা। মাটি-কাটা নিয়ে বিবাদ। ছক্বা এতদিন এদের সাথে থেকে দেখেছে, পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া বাধিয়ে শত্রু নিকেশ করত শান্তনু-আসলাম জুটি। এখন আসলাম বুড়ো আঙুল চুষবে!

ছক্বা বলল, ‘নীলুদা, তুমি জালায় মাছের সার দিতে না, বিষ দিতে।’

‘অ্যাঁ কী কতিছিস ছ্যমড়া! আমি তো নিজের চোখে দেখিছি, মাছেরা ডাঙার কাছে এসে মুখ চিবোয়।’

‘ঠিক দেখিছ নীলুদা। তবে মাছে যে খাচ্ছে, তা ঠিক না। তোমার ছড়ানো সারে এমন অল্প করে বিষ থাকত, যে মাছ জলের ভেতর থাকতি না পেরে ছটফট করতি করতি ডাঙার কাছ ঘেঁষে সব মুখ বাড়ায়, আঁকুপাঁকু করে নিশ্বাস নেয়। মরে না। ঝুড়ি ঝুড়ি মাছ। কুইন্টল কুইন্টল মাছ। একসঙ্গে এত মাছ কিনবে কে! ভেড়ির মালিক জলের দরে তুলে দেয় নন্দীবাবু, দাসবাবু, ইমতিয়াজদের হাতে। এরা সবাই উঁচু উঁচু মান্যি জনের লোক। কাঁটায় যে দাম এরা হাঁকে, সেই দামেই ছাড়ি দিতি হয়। লাভের ট্যাকার মোটা অংশ শান্তনুদার ঘরে ঢোকে।’

নীলমাধব কথা হারিয়ে ফেলেছে। সে ছক্বার কবজি শক্ত করে ধরে আছে। সে তোতলায়, ‘কি কিন্তু আজ তো মাছে বিষ দিতি যাই নাই, সিকেনে আজ অত মানষি তাড়া করল, ক্যান?’

‘আজ কী করছিলে বলো?’

‘কেন, আজ তো কোনও দোষ করি নাই, মাঠে চাষের জন্য জল দিতিছিলাম।’

ছক্বার গলায় শ্লেষ, ‘কেন, তুমি কি সেচ দফতরের কর্মী নাকি, যে শ্যালো চালায়ে জল তুলে দেবা চাষিদের!’

ছক্বা থামে না, সে বলে চলে, ‘মাঠে কী জল ছাড়ছিলে?’

‘মীনের ভেড়ির জল।’

‘চিংড়ির মীন কোন জলে চাষ হয়? মিঠা জলে না নোনা জলে?’

‘নোনা জলে।’

‘ধান, পটল চাষের জন্যি কী জল লাগে?’

নীলমাধব মুখ চুন করে বলে ‘কেন, মিঠা জল।’

‘তালে বলো নীলুদা, তুমি ভেড়ির নোনা জল চাষের মাঠে ঢুকিয়ে চাষির কোন উপকারটা করলে!’

‘ভাইডি, আমারে যে কলো, রুখা জমি চাষের জন্যি বানাতি হবে। ভোর ভোর জল ঢুকালে চাষের সুবিধা। জমি নরম হবেনে। রোদ ওঠার আগে চাষ দিতি পারবে চাষি।’

‘তুমি বড্ড কাঁচা লোক গো নীলুদা। কিচ্ছু খপর রাখো না। এখন শহরের লাগোয়া আর জমিন নাই যে ঘরবাড়ি আর ফ্ল্যাট বানান যায়। সক্বলেই তাই জলা জমি, চাষের জমির দিকে হাত বাড়ায়ে আচে।’

নীলমাধবের গলা শুকিয়ে এসেছে। তাহলে সে এতদিন একটাও ভালো কাজ করেনি! নীলমাধবের পায়ের তলা থেকে ঝুরঝুর করে মাটি সরে সমুদ্রের নোনা জলের দিকে চলে যাচ্ছে। তার বুকে এখন হাউ হাউ করছে কান্না। কান্না চেপে সে অস্ফুট আওয়াজ বের করল, ‘কিন্তু চাষের জমিনে ভেড়ির নোনা জল ঢুকায়ে প্রামোটারের কী লাভ?’

‘আছে নীলুদা। সব সময় লাভ চোখের উপর দেখতি পাবা না। একটু তলায় থেকে সময় হলেই সে ভুস করে মাথা তোলে।’ চায়ের গেলাসে শেষ লম্বা চুমুক দিয়ে আবার বিড়িতে টান দেয় ছক্বা। তারপর বিড়ির টুকরোর উপর সব রাগ ঝেড়ে মাটিতে আছাড় মেরে থক করে একগাদা থুতু ফেলে।

‘ফ্ল্যাট বাড়ি বানানো দেহিছ নীলুদা? ফাঁকা জমিতে মাটি কেটে  ইট-বালি-সিমেন্ট সব মাটির ভেতর সেঁধোয়। পেত্থমে মনে হয় রাশি রাশি ট্যাকা মাটির বুকি ঢুকি যাতিছে। কিন্তু খানিক বাদে দেখবানে লকলক করি ধানের চারার মতো মাথা তুলি দাঁড়াতিছে এক একটা ফ্লোর, মানে লাখে লাখে ট্যাকা। তেম্বায়, ঠিক তেম্বায় শান্তনুদা চাষের জমিতে নোনা জল ঢুকোয়ে চাষিরে বাধ্য করে ভেড়ি বানাতে। জমিতে নোনা লেগে গেলে আর যে ফসল হবে না গো।’

ছক্বা কথা থামায়। সে দেখে নীলমাধব ঝরঝর করে কাঁদছে। ‘কী হল, কাঁদতিছ ক্যান?’

‘ভাইডি, তালে তো আমি কত লোকের ক্ষেতি করে দিলাম, না! কত চাষির কপাল খালাম, হায় হায় রে।’

ছক্বা ধমকাল, ‘কী ন্যাকামিটা করতিছ! এখানে লোকজন জড়ো করি সব জানায়ে দেবা বুঝি! হাড়গোড় একখানাও আস্ত থাকবেআনে ভাবিছ? চুপটি করে বাইকের পেছনে ওঠোদিন। তোমারে আজ বাড়িতে ছেড়ে দে আসতিছি। কেলো ফোনে খপর দেছে শ’দুয়েক লোক শান্তনুদার বাড়ি ঘিরে ফেলিছে। কী হয় কে জানে! আমারে তো কলো, ডুব মারতি।’

খুবই বিধবস্ত দেখাচ্ছে বাসন্তীর রুস্তম ছক্বাকে। সে সুশান্তদার নানা কারবারে জড়িত। নিজে কিছুই করে না, কিন্তু বাইকবাহনে চেপে নজরদারি করে। ভালো চেহারা। চোখে কালো চশমা, কানে দুল। গ্রামের গরিব মানুষেরা সমীহ করে। একটু থাকা, একটু কড়া চোখে তাকানো, তাতেই অনেকটা কাজ হয়ে যায়। সুশান্তদা বদলে মাস গেলে ৩০ হাজার দেয়।

এখন ছক্বার মনে হচ্ছে, দাদার গোলামিটা না করে, মানে জমি দখল করা, অন্যদলের মানুষের ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া, বাজার থেকে তোলা আদায় করা, মাটি বিক্রি করা –মানে হাজার একটা সুশান্তদার বেআইনি কাজে নিজেকে না জড়িয়ে, যদি এরকম একটা চায়ের দোকানও করত, শান্তিতে দু-মুঠো ভাত খেতে পারত। এতক্ষণে হয়তো গণ ধোলাইতে সুশান্তদা-র নাড়িভুড়ি বেরিয়ে গেছে। এখন পুলিশে গুঁতোলেও গুঁতোবে, নয়তো ওই আসলামের লোকজন মেরে পেট চিরে মাতলায় ভাসিয়ে দেবে। মরণ তার বাঁধা।

ভাবতে ভাবতে বাইকে স্টার্ট দেয় ছক্বা। বাইকের পেছনে বসা এক নিতান্ত ভালোমানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে আনা তার এ জীবনের একমাত্র ভালো কাজ। রুবির মোড়ে এসে ছক্বার হঠাৎ মনে হল, নীলমাধবদার বাড়িতে তো কিছুদিন সে লুকিয়ে থাকতে পারে। সেসময় ছক্বার মুখের উপর ভোরের সূর্য এসে বসেছে। তক্ষুনি বাইকের পেছনে বসা ভেঙে-চুরে যাওয়া নীলমাধবের চোখে পড়ল বড়োই ফ্যাকাশে এক বাঁকা চাঁদ পশ্চিমের আকাশে শুয়ে আছে। আর ছুটন্ত বাইকের পেছনে সোঁ সোঁ হাওয়ার ভেতর তার কানে এসে যেন বাজল নন্দিনীর গলা, ‘নিশি রাত বাঁকা চাঁদ আকাশে।’

 

 

সারপ্রাইজ

অভিজিতের সঙ্গে পুনায় তার কর্মস্থলে চলে যাচ্ছে নন্দিনী। স্টেশনে তাদের দুজনকে সি-অফ করতে এসেছেন অভিজিতের বাবা-মা এবং বোন সীমা। মাত্র একমাস হল অভিজিতের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে নন্দিনীর। বিয়ের পর এই কটা দিন যেন সুখের স্রোতে ভেসে কেটে গেছে। অভিজিতের পরিবারের সদস্যরা মাত্র একদিনেই ভালোবেসে ফেলেছেন মাতৃহারা মেয়েটিকে।

আজ ছেলে-বউমাকে বিদায় জানাতে এসে সে-কথাটি বিলক্ষণ বুঝছেন সুরমা। তার দুচোখ জলে ভরে এসেছে। নন্দিনীর চিবুক ধরে আদর করে বলে উঠলেন, ‘মন চাইছে না তোকে ছেড়ে দিতে নন্দিনী। কিন্তু কী করব বল! ছেলেটা বিদেশবিভুঁইয়ে একা থাকবে, এটাই বা মা হয়ে কী করে সহ্য করি বল! জানি, তোর মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মন খারাপ করিস না মা। যখন ইচ্ছে করবে চলে আসবি। আর ফোন তো রইলই!’

সুরমার কথা শুনতে শুনতে মনটা ভিজে উঠল নন্দিনীরও। সুরমার কাঁধে মাথা রেখে সে ফুঁপিয়ে উঠল। নিজের মায়ের স্মৃতি, সময়ের ব্যবধানে আর খুব বেশি উজ্জ্বল নয় তার কাছে। সুরমার মধ্যে, তার দেওয়া স্নেহের মধ্যে, সে তার নিজের মায়ের ছায়া দেখতে পেয়েছিল।

সীমা এগিয়ে এসে কানেকানে বলল, ‘বউদি, তুমি কী গো? আজকালকার মেয়েরা ভাবে, কতক্ষণে শ্বশুর-শাশুড়ির কড়া শাসনের বাইরে বের হবে। তোমার কাছে বিনা আয়াসে সেই সুযোগ যখন এসেইছে, তখন তুমি কাঁদছ? সত্যি তোমার দ্বারা কিস্যু হবে না!’

সীমার কথা শুনে সুরমার কাঁধ থেকে মাথা তুলে নন্দিনী ম্লান হাসি নিয়ে তাকাল।

পুনেতে একটা ফ্ল্যাট কিনেছে অভিজিৎ। তবে এখনও গৃহপ্রবেশ করেনি। একেবারে নন্দিনীকে নিয়ে সেই বাড়িতে গিয়ে উঠবে, ঠিক করেছে। ফার্নিচারগুলো অবশ্য বিয়ে উপলক্ষ্যে কলকাতায় ছুটি নিয়ে আসার আগেই নতুন ফ্ল্যাটে রেখে দিয়ে এসেছে সে। আর, চাকুরেদের যে-মেসটায় থাকত এতদিন, বকেয়া মিটিয়ে ছেড়ে দিয়ে এসেছে সেটা।

ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে আসতে, ওরা নিজেদের কামরায় উঠে পড়ল। একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কেবিন ভাড়া নিয়েছে অভিজিৎ। ভারী স্লাইডিং দরজাটা টেনে দিলে কেবিনটা একেবারে ব্যাক্তিগত হয়ে যায়। জানলার বাইরে গাঢ় অন্ধকার নেমেছে। কাচের বাধা ভেদ করে বাইরে কিছুই দেখা যায় না। রাত নটা নাগাদ ট্রেনের প্যান্ট্রি কার থেকে খাবার দিয়ে গেল। খেয়েদেয়ে দশটা নাগাদ উপরের বাংকে শুতে চলে গেল অভিজিৎ।

নন্দিনীও হাতে একটা পেপারব্যাক নিয়ে আধশোয়া হল। কিন্তু তার ঘুম আসছিল না। পরিচিত পরিবেশ ছেড়ে বেরিয়ে হঠাৎই তার নিজেকে খুব একা মনে হতে লাগল। আর মনে পড়ে যেতে থাকল পুরোনো স্মৃতিগুলো।

মনে পড়ল, অমরশংকর কত চিন্তিত ছিলেন মেয়ের বিয়ে দেওয়া নিয়ে! নন্দিনী সুন্দরী, উচ্চশিক্ষিতা। বাধাটা সেদিক থেকে নয়। কিন্তু, পারিবারিক ইতিবৃত্তটি শোনার পর পাত্রপক্ষেরা পিছিয়ে যায়। আর, অমরশংকর তো সে কাহিনি না বলে মেয়ের বিয়ে দেবেন না। একসময় পাত্রপক্ষের সামনে সেজেগুজে বসতে বসতে ক্লান্ত নন্দিনী তো বাবাকে বলেই ফেলেছিল, ‘তুমি আর চেষ্টা করো না। বিয়ে করাটাই তো জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়! আমি পড়ব। আরও পড়ব। ভালো একটা কেরিয়ার তৈরি করব।’

অমরশংকরও হতাশ হয়ে পড়ছিলেন ক্রমশ। এইসময়েই হঠাৎ দেবদূতের মতো হাজির হলেন সুরমা আর জয়ন্ত। সব শুনেও ওরা ওদের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন।

অথচ সেই ইতিহাসের জন্য নন্দিনী কোনওভাবেই দায়ী ছিল না। নন্দিনীর মা বিনতা খুবই অর্ন্তমুখী স্বভাবের মহিলা ছিলেন। এমনকী কষ্টের কথাও তাকে কেউ কখনও মুখ ফুটে বলতে শোনেনি।

অমরশংকর সবে কলেজ পাশ করে চাকরি পেয়েছেন, এই সময়টায় বাড়িরঅমতে বিয়ে করেছিলেন বিনতাকে। বিয়ে করে আর দক্ষিণ কলকাতার সাবেকি বাড়িতে ওঠেননি ওরা। অন্যত্র বাসা নিয়েছিলেন। নন্দিনীরও জন্ম এখানেই। সমস্যার শুরু তার পরে।

নন্দিনীর খুব আবছা ভাবে মনে পড়ে শীতকালের এক দুপুরের কথা। স্কুল ছুটি ছিল। তাই বাড়িতেই ছিল সেদিন নন্দিনী। অমরশংকর যথারীতি অফিসে গেছিলেন। বাইরের বারান্দায় একা বসে, পুতুল এবং খেলনাবাটি নিয়ে সংসার পেতেছিল নন্দিনী। এইসময় সহসা বেজে উঠেছিল ফোনের ঘণ্টিটা। বিনতা ফোন ধরে কথা বলছিলেন। হঠাৎ খুট করে একটা শব্দ হতে কৗতূহলী হয়ে মায়ের ঘরের দরজায় ছুটে এসে দাঁড়িয়েছিল নন্দিনী। তারপর ভিতরের দৃশ্য দেখে সে যেন পাথর হয়ে গেছিল।

ফোনের রিসিভারটা ঝুলছে। বিনতা উপুড় হয়ে পড়ে আছেন মেঝের উপর। চুলগুলো খোলা। হাওয়ায় উড়ছে। থরথর করে কাঁপছে বিনতার শরীরটা। মুখ দিয়ে একটা গোঙানির আওয়াজ বের হচ্ছে। উন্মত্তের মতো মাথাটাকে এপাশে-ওপাশে দোলাচ্ছেন বিনতা।

নন্দিনীর বুকের মধ্যেটা শুকিয়ে গিয়েছিল। সে কী করবে প্রথমে বুঝে পেল না। তারপর নিজেই দরজা খুলে পাশের বাড়ি থেকে ডেকে এনেছিল দীপা কাকিমাকে। দীপাও ঘাবড়ে গিয়ে অমরশংকরকে ফোন করেছিল তাঁর অফিসে। দ্রুত বাড়িতে চলে এসেছিলেন অমরশংকর।

খানিকক্ষণ পরে ডাক্তার এসেছিলেন। বিনতাকে ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। ক’দিনের মধ্যে বেশ সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন বিনতা। কিন্তু ডাক্তারবাবু সতর্কবাণী শুনিয়ে গেলেন। হিস্টিরিয়ার লক্ষণ দেখা দিচ্ছে বিনতার মধ্যে।

বিনতা সেই সময়ের মতো সুস্থ হয়ে গেলেও ক”দিন পরে আবার তার মধ্যে ফের একইরকম বৈকল্য দেখা দিল। তারপর থেকে বারবারই এমন হতে থাকল। উন্মত্তের মত আচরণ করতে লাগলেন বিনতা। এমনকী এসময় বিনতার কাছাকাছি যেতে ভয় পেতেন অমরশংকর নিজেও। ভয়টা যতটা তার নিজের জন্য, তার ঢের বেশি বিনতার জন্য।

বিনতা যখন পাগলের মতো আচরণ করেন, তখন কেউ তার দিকে এগোলেই তিনি ভাবতে থাকেন তাকে বুঝি মারতে আসছে। তার এই রোগটা ক্রমেই বাড়তে লাগল। কেবল প্রকোপের সময়টুকুতেই নয়, তার বাইরেও তিনি অসংলগ্ন আচরণ করতে শুরু করলেন।

অমরশংকর যেন মনের দিকে থেকে ভেঙেচুরে গেলেন। তার কাছের বন্ধুরা তাকে পরামর্শ দিলেন, বাড়িতে না রেখে বিনতাকে কোনও মেন্টাল অ্যাসাইলামে রাখতে। তাদের আসলে ভয় ছিল নন্দিনীকে নিয়ে। ডাক্তারবাবুও বলেছিলেন, ‘বিনতা যেরকম ভায়োলেন্ট হয়ে পড়ছে, তাতে করে আপনার নন্দিনীর কথাটা বোধহয় একটু ভাবা উচিত অমরবাবু। শুধু শারীরিক ক্ষতির ভয়ই নয়, বাচ্চা মেয়ে, তাই মনের উপরেও বিশ্রী চাপ পড়ার ভয় থেকেই যায়।’

অমরশংকর স্ত্রীকে খুবই ভালোবাসতেন। কিন্তু ডাক্তারবাবুর পরামর্শ শোনার পর আর ঝুঁকি নিতে রাজি হলেন না। সবচেয়ে নামি ও খরচবহুল একটি মেন্টাল অ্যাসাইলামে বিনতাকে রেখে এলেন তিনি। মাস-মাস মোটা টাকা ডোনেশন দিতে হতো সেখানে। বিনিময়ে বিনতা পেতেন সেরা যত্ন এবং দেখভাল।

নন্দিনীর মনে আছে, সপ্তাহে দুবার বিনতার সঙ্গে দেখা করতে যেতেন অমরশংকর। ঘণ্টাখানেক বিনতার পাশে বসে কাটিয়ে আসতেন। বিনতা বেশি কথা তো বলতেন না। অমরশংকরও চুপ করে তার পাশে বসে থাকতেন। মাঝেমধ্যে নন্দিনীর কথা আলোচনা করতেন।

এক সোমবার সকালে অ্যাসইলাম থেকে ফোন এল। বিনতা নেই। ফোনটা রেখে বাবা গুম মেরে বসে রইলেন। তারপর নন্দিনীকে ডেকে বললেন, ‘আমাদের এক্ষুনি একবার মেন্টাল অ্যাসাইলামে যেতে হবে। তুমি তৈরি হয়ে নাও।’ কী ঘটেছে, তা টেলিফোনের কথোপকথন শুনেই বুঝতে পেরেছিলন নন্দিনী। আলদা করে বলতে হয়নি।

বিনতার ক্রিয়াকর্মে যোগ দিতে নন্দিনীর দাদু-ঠাকুমাও এলেন। নন্দিনী তখন দশ বছরের বালিকা। প্রতিমা– অমরশংকরের মাকে এই প্রথম সে দেখল। ভদ্রমহিলার চোখেমুখে একটা অস্বাভাবিক কাঠিন্য আছে। কাজকর্ম মিটে যেতে প্রতিমা ছেলেকে বললেন, ‘তুমি তো ও বাড়িতে ফিরবে না। সে প্রত্যাশাও আমি বা তোমার বাবা করি না। কিন্তু নন্দিনীর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তোমার উচিত ওকে আমাদের কাছে রেখে মানুষ করা।’

অমরশংকর শুনে, গলায় শ্লেষ ঢেলে বললেন, ‘বেঁচে থাকতে বিনতাকে কোনওদিন তোমরা মেনে নাওনি। এখন তার মেয়েকে নিয়ে যেতে চাও?’

প্রতিমার ঠোঁটের চারপাশ আর চোখের তলার চামড়াটা আশ্চর্য ভাবে কুঁচকে গেল। কর্কশ স্বরে বললেন, ‘বিনতা তোকে আমাদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেছিল অমর। ওকে কোনওদিন ক্ষমা করতে পারব না আমরা।’

‘বিনতা নয়, তোমরা। তেমারাই আমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছিলে।’ অমরশংকর রুখে উঠলেন, ‘সেখানেই শেষ নয়। আজ আমি ভালোই জানি, কার ফোন পেয়ে বিনতা অমন পাগলের মতো আচরণ করত।’

প্রতিমা চুপ করে গিয়েছিলেন। নন্দিনীর অতিসংবেদী শিশুমন তখনই স্পষ্ট করে বুঝে গিয়েছিল, সেদিন দুপুরে আসা ফোনটার অন্য প্রান্তে কে ছিল। ঘৃণায় ভরে গিয়েছিল তার মন। সে ঘৃণা আজও মোছেনি মন থেকে। কিন্তু এই কদর্য ছবিটার উলটো দিকে একটা সদর্থক ছবিও ছিল। যার জন্য অমরশংকরের জন্য নন্দিনীর মনে শ্রদ্ধার ভাবটা বেড়ে গিয়েছিল বহু শতগুণ। নিজের মনে একাকী হয়ে পড়েছিলেন তিনি। রাতে তার চোখে ঘুম আসতে চাইত না। সবটাই লুকিয়ে দেখেছিল নন্দিনী। বাবার পাশে দাঁড়ানোর বয়স বা সাহস কোনটিই তার ছিল না। কেবল অমরশংকরের জন্য অদ্ভুত এক কষ্ট তাকে পীড়িত করত।

অথচ অন্য সময় অমরশংকর যেন অন্য মানুষ। নন্দিনীকে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছেন, দুপুরে সে বাড়ি ফেরার পর নিয়ম করে নির্দিষ্ট সময়ে ফোনে খবর নিচ্ছেন, আয়াকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিচ্ছেন, পার্টি এড়িয়ে চলছেন, কারণ তাঁকে সন্ধেয় দ্রুত বাড়িতে ফিরে নন্দিনীকে সঙ্গ দিতে হবে। দেখতে দেখতে দশটা বছর কোথা দিয়ে যেন কেটে গেল। পলক ফেলতে না ফেলতে।

অমরশংকর এবার নন্দিনীর বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন। দ্রুত জবাব আসতে লাগল। পাত্রপক্ষের খুব পছন্দও হয় নন্দিনীকে। কিন্তু অমরশংকর যেই বিনতার কথা খুলে বলেন, তারা পিছিয়ে যায়। অমরশংকরের বন্ধুবান্ধবরা পরামর্শ দেন, ‘এত বিস্তারিত ভাবে পাত্রপক্ষকে সবকথা জানানোর কী আছে? ওরা কি মেয়েটাকে ঘরে নেবে, না তোমার বংশপরিচয়কে?’

অমরশংকর সব শুনেও নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। আর পাত্রপক্ষ শুকনো মুখে জানায়, ‘মেয়েকে তো আমাদের খুবই পছন্দ ছিল অমরবাবু। কিন্তু ভয় পাচ্ছি। মেয়ের মা পাগল। শেষে মেয়েও যদি কোনওদিন…!’

অমরশংকর ম্লান হাসেন।

নন্দিনীও ক্লান্ত হয়ে গেছিল প্রায় সন্ধ্যাতেই সেজেগুজে পাত্রপক্ষের সামনে হাজিরা দিতে দিতে। শেষে একদিন  মরিয়া হয়ে মুখ ফুটে বলে উঠেছিল, ‘বাবা তুমি কি মনে করো বিয়েই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য? এখন মেয়েরা নিজেদের কেরিয়ারটাই আগে গড়তে চায়। আমিও কি সেরকম হতে পারি না?’

অমরশংকর বলেছিলেন, ‘অবশ্যই পারিস। কিন্তু কেরিয়ারের সঙ্গে বিয়ের তো বিরোধ নেই কোনও।’

এই সময়েই অকস্মাৎ একটা যোগাযোগ হয়ে গেল। অমরশংকরের সঙ্গে তার বন্ধু সুবিমলের ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠানে গেছিল নন্দিনী। সেখানেই সুরমা তাকে প্রথম দেখেন। আর তারপরই খোঁজখবর নিয়ে ছেলে অভিজিতের জন্য সম্বন্ধ নিয়ে আসেন। মাল্টিন্যাশনাল ফার্মে মোটা মাইনের চাকরি করে অভিজিৎ। পারিবারিক কৗলিন্যও রয়েছে। অমরশংকরের ‘না’ বলার কোনও প্রশ্নই ছিল না। এবং কী আশ্চর্য, অমরশংকর পুরোনো সব কথা বলার পরেও সুরমা এবং জয়ন্তকে তাদের সিদ্ধান্ত থেকে টলানো গেল না।

জয়ন্ত বললেন, ‘মায়ের একটা মানসিক অসুস্থতা ছিল বলে ওরও থাকবে, এটা এ ক্ষেত্রে তেমন যুক্তিযুক্ত বোধহয় নয়।’

সুরমা বললেন, ‘আমাদের ভাগ্যে যদি সেটা থাকেই, তাহলে ঘটবে–!’

অমরশংকর ভারি নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে গেল অভিজিৎ আর নন্দিনীর। কিন্তু বাস্তবের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে নন্দিনী সেভাবে নিশ্চিন্ত হতে পারল না। বিয়ের কয়েকদিন পরেই কোনও এক দুর্বল মুহূর্তে চোখের জল ফেলে অভিজিতের কাছে সে জানতে চেয়েছিল, ‘আমিও যদি কোনওদিন মায়ের মতো অসুস্থ হয়ে পড়ি?’

জানলা দিয়ে ভোরের আলো ঢুকে এসে চোখের পাতায় বসতেই ঘুম ভেঙে গেল নন্দিনীর। সকালে হালকা ব্রেকফাস্ট করে অফিসে চলে যায় অভিজিৎ। কাজেই তার অফিসে বেরোনোর আগে অবধি, রান্নার তেমন ব্যস্ততা থাকে না। সেটা শুরু হয় পরে। অভিজিৎ বেরিয়ে যাওয়ার পর।

অভিজিতের অফিস তাদের ফ্ল্যাটের খুব কাছে হওয়ার জন্য, লাঞ্চের অবসরে অভিজিৎ ঘণ্টাখানেকের জন্য বাড়িতে আসে। তখন ওরা দুজনে একসঙ্গে খেতে বসে।

বিছানা থেকে নেমে নন্দিনী ঠিক করল, রেসিপির বইটা দেখে আজ কিছু আনকোরা রান্না তৈরি করবে। ভাবতে ভাবতেই ফোনটা বেজে উঠল। রিসিভার তুলেই নন্দিনী বুঝল, ফোনের অন্য প্রান্তে রয়েছেন অমরশংকর।

প্রথমেই বললেন, ‘শুভ জন্মদিন নন্দিনী! কেমন আছিস মা?’

‘ভালো আছি বাবা। তোমার শরীর ঠিক আছে?’

‘শরীর ঠিক আছে। তবে সত্যি বলতে কি, তুই শ্বশুর বাড়িতে চলে যাওয়ার পর বাড়িটা বড়ো ফাঁকা লাগে।’

নন্দিনীর বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে।

অমরশংকর বলেন, ‘তোর জন্য একটা উপহার কিনে গতকালই কুরিয়র কোম্পানিকে দিয়ে দিয়েছি। আজই পেয়ে যাবি। পছন্দ হয়েছে কিনা জানাস–!’

অমরশংকর ফোনটা ছেড়ে দিলেন। অভিজিৎ বাথরুমে ঢুকেছে। চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কে ফোন করেছিল নন্দিনী?’

‘বাবা!’

অভিজিৎ নিজের মনেই বলল, ‘ও!’

কিচেনের দিকে যেতে গিয়ে আবার থমকে যেতে হল নন্দিনীকে। আবার ফোনের ঘণ্টি বাজছে। এবার সীমা।

ফোন তুলতেই কলকল করে উঠল, ‘শুভ জন্মদিন বউদি। তা, দাদা আজ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেলিব্রেট করতে?’

‘সেলিব্রেশন? তোমার দাদা?’ বলতে বলতে নন্দিনীর বুকে একটা অভিমান দলা পাকিয়ে ওঠে, ‘এখনও অবধি উইশ করেনি জানো? বোধহয় ভুলেই গেছে।’

‘ভুলে গেছে?’ সীমা স্পষ্টতই অবাক হয়, কিন্তু প্রসঙ্গ পালটে বলে, ‘আচ্ছা, আমি এখন কলেজে যাচ্ছি, কেমন বউদি? বাবা-মা তোমার সঙ্গে কথা বলবে। আমি রাতে ফোন করব আবার। হিহি!’

সুরমা ও জয়ন্তর সঙ্গে কথা বলে ফোনটা রেখে পিছন ফিরতেই নন্দিনী দেখল, অভিজিতের স্নান হয়ে গেছে। তোয়ালেতে মাথা মুছতে মুছতে সে বাথরুমের বাইরে বেরিয়ে নিজের মনে গুনগুন করছে।

নন্দিনীকে দেখে উদাসীন গলায় বলল, ‘বাব্বা! আজ দেখছি একের পর এক ফোন আসছে তোমার। ব্যাপারখানা কী?’

ক্লিষ্ট হেসে সরে যেতে যেতে নন্দিনী বলল, ‘হয় এক-একদিন এরকম!’

কিন্তু মনটা তার ভেঙে দুমড়ে যাচ্ছে। অভিজিৎ কী করে বউয়ের জন্মদিনের কথাটা ভুলে যেতে পারে? কিন্তু আচরণ দেখে মনে হচ্ছে বিষয়টা মাথাতেই নেই ওর।

টেবিলে ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে সে অভিজিৎকে ডাকল। কোনও কথা না বলে ওরা খাচ্ছে। নীরবতা ভেঙে অভিজিৎ সহজ গলায় জানতে চাইল, ‘তোমার কি মন খারাপ নন্দিনী?’

‘না তো! কেন?’– নন্দিনীর চোখদুটো জ্বালা করে উঠল।

‘না, তোমাকে অন্যমনস্ক দেখে ভাবলাম, হয়তো বাবার জন্য মন কেমন করছে। সেক্ষেত্রে কয়েকদিন তোমার বাবার ওখান থেকে আমরা ঘুরেও আসতে পারি।’

নন্দিনীর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। খাওয়া শেষ হয়ে গেছে অভিজিতের। গলার টাইটা বেঁধে নিতে নিতে বলল, ‘ও। শোনো, একটা কথা তো তোমায় বলাই হয়নি। আমার একবন্ধুর জন্মদিন আজ। হোটেলে পার্টি থ্রো করেছে। যেতেই হবে। তুমি সন্ধেয় সেজেগুজে তৈরি থেকো।’

অভিজিৎ চলে যাওয়ার পর বন্ধ দরজাটায় পিঠ ঠেকিয়ে নন্দিনী ভাবতে থাকল, বন্ধুর জন্মদিন মনে রাখতে পারে অভিজিৎ। কেবল তার বেলাতেই ফাঁকি। এমন নয় যে, অভিজিৎ জানে না আজ তার জন্মদিন। কিন্তু কত সহজে সে সে-কথা ভুলে গেছে! প্রচণ্ড অভিমানে নন্দিনীও ঠিক করল, অভিজিৎকে কক্ষনও সে তার জন্মদিনের কথাটা মনে করিয়ে দেবে না। এমনকী সীমা বা সুরমার কাছ থেকে জানতে পেরে সে যদি কোনও উপহার কিনেও আনে, সে নেবে না। ফিরিয়ে দেবে।

মনের মধ্যে চিনচিনে একটা ব্যথা সত্ত্বেও সে অনেকক্ষণ ধরে সাজল। ভোটশিপের সময়, অভিজিতের পছন্দ করে কিনে আনা শাড়িটা পরে, সে অনেকক্ষণ ধরে নিজেকে ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখল আয়নায়।

অফিস থেকে বাড়িতে ফিরে নন্দিনীকে দেখে চমকে গেল অভিজিৎ। মুগ্ধ চোখ ফেরাতে পারল না। যদিও তেমন উৎসাহ দেখাল না নন্দিনী। মনটা অশান্ত হয়ে আছে। সুরমা হয়তো এরকম কোনও দিনের আগাম কল্পনা করেই, চলে আসবার দিন নন্দিনীকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলেছিলেন, ‘কখনও কখনও খুব ছোটো ছোটো ঘটনাও বড়োসড়ো ঝগড়ার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। একটু বুদ্ধি দিয়ে ব্যাপারগুলোকে সামলালে দেখবি, সব ঠিক হয়ে গেছে। কোনও কথা যদি খারাপ লাগে, তাহলে তক্ষুনি জবাব না দিয়ে ঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।…’

নিজেও দ্রুত তৈরি হয়ে নিয়ে অভিজিৎ ব্যস্ততার সঙ্গে বলল, ‘চলো, দেরি হয়ে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় আবার একটা ছোটোখাটো প্রেজেন্টেশনও কিনে নিতে হবে।’

সন্ধে নেমে এসেছে। চর্তুপাশ ঝলমল করছে আলোয়। গাড়ির ঢল নেমেছে। একটা বড়ো গয়নার দোকান দেখে তার সামনে গাড়ি থামাল অভিজিৎ। বলল, ‘তোমাকে বলা হয়নি নন্দিনী। আমার এই বন্ধুটি একজন ভদ্রমহিলা। অল্প দিন হয়েছে, তার সঙ্গে আমার আলাপ।’

দোকানের সুবেশ ছেলেটিকে হিরের আংটি দেখাতে বলল অভিজিৎ। নানা ডিজাইনের আংটি চলে এল। বেশ কয়েকটা পছন্দসই মনে হল অভিজিতের। সবকটাই একে একে নন্দিনীর আঙুলে পরিয়ে শেষপর্যন্ত একটিকে চূড়ান্ত বাছাই করল সে। আংটিটা সত্যিই খুব সুন্দর দেখতে। নন্দিনীকে জিজ্ঞেস করতে সেও মাথা হেলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল।

আংটির দাম পঁচিশ হাজার টাকা। সব দেখে নন্দিনী যেন মনে মনে আরও বেশি করে নিভে যাচ্ছিল। বন্ধুর জন্য এত দামের উপহার, আর নিজের স্ত্রীর জন্য কিছুই না! কী অসম্ভব পরিহাস লুকিয়ে আছে গোটা ঘটনাটার মধ্যে।

গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। অনেকটা পথ পেরিয়ে এবার এসে থামল এক বিরাট পাঁচতারা হোটেলের নীচে। গাড়িটা পার্ক করে, চোখের ইশারায় তাকে অনুসরণ করার কথাই বলল অভিজিৎ। সে হাঁটতে লাগল হোটেলের রেস্তোরাঁটির দিকে। চারপাশে তাকাতে তাকাতে। যদি নিমন্ত্রিত বন্ধুবান্ধবদের কারও সঙ্গে দেখা হয়ে যায়!

রেস্তোরাঁর মধ্যেটা নরম আলোর ঠান্ডা স্রোতে ভেসে যাচ্ছে। খুব হালকা ভল্যুমে কোনও চেনা সুর বাজছে। টেবিলে টেবিলে ছায়ার মতো নারী-পুরুষ। সেদিক না মাড়িয়ে অভিজিৎ একটু নিরালা থাকা দামি কেবিনগুলোর একটার দিকে এগেল।

কেবিনের ভারী পর্দাটা সরিয়ে অভিজিৎ বলল, ‘ওয়েলকাম ম্যাম!’

নন্দিনী একটু অবাক হয়। বলে, ‘কই গো, তোমার হোস্ট কই? আমরাই কি প্রথম এলাম নাকি?’

আবছায়ায় অভিজিৎ একটু হাসল। কখন আরও দুটি ছায়ামূর্তি কেবিনের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের পরনে হোটেলের কর্মীদের ইউনিফর্ম। হাতে ফুলের বোকে। দুজনে দুপাশ থেকে নন্দিনীর হাতে বোকে-দুটো তুলে দিতেই কেবিন মধ্যে হঠাৎ লাল-নীল নানা রঙের আলো জ্বলে উঠল। সেইসঙ্গে আলোয় লেখা ফুটে উঠল, ‘শুভ জন্মদিন, নন্দিনী’।

নন্দিনীর মনে হচ্ছিল সে যেন স্বপ্ন দেখছে। বিহ্বল মুখটা ফেরাতেই, সে আর লাল জামা পরা লোক দুজনকে দেখতে পেল না। বদলে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অভিজিৎ। নন্দিনীর ডানহাতের অনামিকা তুলে ধরে সযত্নে হিরের আংটিটি পরিয়ে দিল অভিজিৎ।

নন্দিনী জানতে চায়, ‘এসব কী অভিজিৎ? তোমার বান্ধবী কই?’

‘বান্ধবী! তোমার চেয়েও ভালো ও কাছের বান্ধবী আর কেউ আছে নাকি আমার?’

নন্দিনীর গালদুটি নিজের বাড়িয়ে ধরা করতলে নিয়ে অভিজিৎ বলে ওঠে।

এত সুখ নন্দিনীকে যেন মাতাল করে দিচ্ছে। অভিজিৎ হাতে তালি দিতেই দুটি লোক হাতে খাবারদাবার নিয়ে এসে, টেবিলভর্তি করে সাজিয়ে দিয়ে চলে গেল।

অভিজিৎ নিজেই, তার আর নন্দিনীর প্লেটে খাবার তুলে দেয় চামচ দিয়ে। আর নিজের মনেই বলতে থাকে, ‘আমি কী ভাবছিলাম জানো নন্দিনী? সকাল থেকে তোমায় উইশ করিনি একবারও। তার উপর বান্ধবীর নাম করে দামি হিরের আংটি কিনেছি, তোমায় দিইনি– এতকিছুর পরে তুমি নিশ্চয়ই আমার উপর বেজায় খেপে যাবে। অভিমান করবে। কথা বলবে না। কিন্তু ঘটনা হল, কাছের মানুষজনকে সারপ্রাইজ দিতে আমার খুব ভালো লাগে। কোনও জিনিস স্বাভাবিক ভাবে হাতে এলে যত আনন্দ, আকস্মিক ভাবে এলে মজাটা তার বেশ কয়েকগুন হয়ে যায়। তাই নয় কি?’

অনেকক্ষণ পরে তার মনে হল, সে একাই বকবক করে যাচ্ছে, অথচ নন্দিনী কিছু বলছে না। তাই সে চোখ তুলে ডাকতে গেল, ‘নন্দিনী!’ কিন্তু তার মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হল না। সে দেখতে পেল চেয়ারে অদ্ভূত ভাবে এলিয়ে পড়ে আছে নন্দিনী। চুলটা খোলা। এলোমেলো। শাড়িটাও বিস্রস্ত। যেন একটা ঝড় বয়ে গেছে নন্দিনীর উপর দিয়ে।

উদ্বিগ্ন অভিজিৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে নন্দিনীর কাছে গিয়ে তার কাঁধদুটো ধরে ঝাঁকিয়ে ডেকে উঠল, ‘নন্দিনী, নন্দিনী, কী হয়েছে তোমার?’ পাছে আওয়াজটা বাইরে গিয়ে লোকের মনে কৗতূহল সৃষ্টি করে, তাই যথেষ্ট চাপা গলায় সে প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে।

নন্দিনী চোখদুটো খুলল হঠাৎ। ভয় পেয়ে গেল অভিজিৎ। কেবিনের আলো-আঁধারিতে তার চোখদুটো অসম্ভব ঘোলাটে দেখাচ্ছে। দৃষ্টিটা যেন এ পৃথিবীর নয়। রঙিন ঠোঁট ভীষণ ছড়িয়ে হাসল নন্দিনী। এ তো স্বাভাবিক হাসি নয়। বুকে কাঁপন ধরানো এমন হাসি সে আগে কখনও দেখেনি।

দু-পা পিছিয়ে এল অভিজিৎ। তার মনে পড়ে, নন্দিনীই একদিন জিজ্ঞেস করেছিল তাকে, ‘আমার মায়ের মানসিক অসুস্থতা ছিল। আমার আবার সেরকম কিছু হবে না তো?’

সময় নষ্ট না করে, সে নিজের মনেই বিড়বিড় করল, ‘ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে হবে–!’

বলে, ঘুরে দাঁড়াতেই কেউ যেন তার জামা ধরে টানল। ফিরে তাকিয়ে চমকে গেল অভিজিৎ। নন্দিনী হাসছে। সহজ, স্বাভাবিক, সরল, মজা-পাওয়া হাসি।

উদভ্রান্ত অভিজিৎ তার মুখটা নিজের করতলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কেমন আছো নন্দিনী?’

‘আমার কিছু হয়ইনি।’

‘তাহলে?’

নন্দিনী হাসতে হাসতেই জবাব দিল, ‘সারপ্রাইজ!’

পরকীয়া

 

অমিতের হাত দুটো শক্ত করে ধরল রত্না। ওর চোখেমুখে ভয় স্পষ্ট। এখন কী হবে অমিত?

কিচ্ছু হবে না, আমি আছি তো। তুমি চিন্তা কোরো না। খুব তাড়াতাড়ি তোমার পায়ে চোট সেরে যাবে। তুমি হাঁটতে পারবে। বলেই রত্নার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল অমিত। কিন্তু অমিতের আশ্বাসেও ভয় কাটল না রত্নার। পরিস্থিতি বুঝে রত্নার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল অমিত। তারপর রত্নাকে পায়ে ব্যথা নিরাময়ে ওষুধ খাওয়াল।

ওষুধ খাওয়ার কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়ল রত্না। আর তার পাশে আধশোওয়া থেকে আনমনা হয়ে পড়ল অমিত। তার চোখের সামনে তখন ভেসে উঠল সপ্তাহখানেক আগের ঘটনাটা অফিসের কাজে যাচ্ছি এই অজুহাতে কলকাতা থেকে বোলপুর পেঁছেছিল অমিত এবং রত্না। স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে চেনাজানা একটি হোটেলে উঠেছিল দুজনে। দুদিনের জন্য বুকিং করে, বরাদ্দ ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করেছিল ওরা। যেন এই সময়টার অপেক্ষায় ছিল দুজনে। তাই, আলিঙ্গন, চুম্বনের পর চড়ান্ত শরীরী উষ্ণতা উপভোগ করতে অমিত এবং রত্না কেউই সময় নষ্ট করেনি। তবে এ ব্যাপারে রত্না একটু বেশি সক্রিয় ছিল। যেন ক্ষুধার্ত বাঘিনির মতো। দীর্ঘদিন অর্ধাহারে কিংবা অনাহারে থাকার পর যেন সে ক্ষুধা নিবারণ করল। তাই, অমিত তাকে বাইরে বেরোনোর প্রস্তাব দিলেও, প্রথমে সে রাজি হয়নি। কারণ, বন্ধ ঘরে আরও কিছুটা সময় সে অমিতকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে চেয়েিল। কিন্তু একঘেয়েি কাটানোর জন্য অমিত-ই প্রায় জোরাজুরি করে বাইরে বের করেছিল রত্নাকে। আর তারপরই ঘটেছিল বিপত্তি। সোনাঝুরির জঙ্গলে অমিতের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে কখন যে গর্তে একটা পা পড়ে গিয়েিল, তা বুঝতে পারেনি রত্না।

হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে এক্স-রে করানোর পর চিকিত্সক জানিয়েিলেন, রত্নার ডান পায়ে হাড়ে হালকা চিড় ধরেছে, ক্রেপ ব্যান্ডেজের পর অন্তত পনেরো দিন বিশ্রামে থাকতে হবে।

পায়ে ক্রেপ ব্যান্ডেজ নিয়ে হোটলের বিছানায় এক সপ্তাহ কাটিয়ে ফেলেছে রত্না। দুদিনের হোটেল বুকিং বাড়িয়ে কুড়ি দিন করেছে অমিত। এখনও অনেক দিন থাকার পর বাড়ি ফিরতে পারবে দুজনে। অফিসের কাজ বেড়েছে বলে দুজনেই বাড়িতে বার্তা পাঠিয়েে। কিন্তু অমিতের স্ত্রী সেই বার্তা বিশ্বাস করে নিলেও, রত্নার হ্যাজব্যান্ড সুনীল যে সন্দেহের বাইরে রাখেনি, কথা বলে তা বেশ বুঝতে পেরেছে রত্না। যাইহোক, রত্নার পাশে শুয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই অমিতের ঘোর কাটল ওর মোবাইল ফোনটা বেজে ওঠায়।

অমিত দেখল ওর বউ নীলিমার ফোন। ফোন কাটল অমিত। তারপর, বিজি অ্যাট প্রেজেন্ট, আই উইল কল ব্যাক লেটার লিখে পাঠিয়ে দিল। ওকে রিপ্লাই পাওয়ার পর শান্তিতে চোখ বন্ধ করল অমিত।

ঘুম ভাঙার পর রত্না দেখল অমিত ঘুমোচ্ছে। বিশ্রাম নিচ্ছে দেখে অমিতকে আর বিরক্ত করল না রত্না। বরং, চুপচাপ শুয়ে থেকে ভাবতে লাগল, অমিতের সঙ্গে পুনর্মিলনের সেই মুহূর্তটির কথা।

বছরখানেক আগের এক বিকেল। রত্না যে-এডুকেশনাল ইন্সটিটিউট-এর ফ্যাকাল্টি, সেই ইন্সটিটিউট-এর স্টুডেন্টস ওয়ার্কশপ ছিল ধর্মতলায় অবস্থিত একটি পাঁচতারা হোটেলে। ওয়ার্কশপ শেষ হওয়ার পর রত্না হল থেকে বেরিয়ে হাঁটছে লিফ্ট-এর দিকে। হঠাত্ একজনকে দেখে খুব চেনা মনে হল।

লিফট-এর একটু দূরে ঘুরে ফিরে কথা বলছিল অমিত। তাই, অমিত কিনা তা নিশ্চিত হতে রত্না দাঁড়িয়ে পড়ল।

এরই মধ্যে রত্নার মনে পড়ে গেল, বছর পাঁচেক আগের বিশ্ববিদ্যালয়ে দিনগুলির কথা। অমিত ওর মনের মানুষ ছিল। তাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখত রত্না। কিন্তু ইউনির্ভাসিটির পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর, অমিত হঠাত্ কেন যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল, তার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ দর্শাতে পারেনি। অনেক অপেক্ষার পর তাই মা-বাবার পছন্দের পাত্র সুনীলকে বিয়ে করে রত্না। শুধু তাই নয়, বিয়ে পর রত্না সুনীলের সন্তানের মা-ও হয়েে নির্দিষ্ট সময়ে কিন্তু, সুনীলের বদমেজাজ আর অমিতের প্রতি সুপ্ত ভালোবাসার কারণে, রত্না ভালো স্ত্রী হতে পারেনি। যাইহোক, এসব ভাবতে ভাবতেই অমিতের মুখোমুখি হল রত্না। অমিত একবারেই রত্নাকে চিনতে পারল। ফোন ছেড়ে, এক মুখ হাসি নিয়ে রত্নাকে জিজ্ঞেস করল

আরে রত্না, তুমি এখানে!

আমার ইন্সটিটিউট-এর স্টুডেন্ট ওয়ার্কশপ ছিল। কিন্তু তুমি এখানে কী করছ?

আমার কোম্পানির প্রোডাক্ট লঞ্চ ছিল এখানে। বাই দ্য ওয়ে কেমন আছো রত্না?

আছি একপ্রকার, মণিহারা ফণির মতো।

কথাটা বলেই হাসতে হাসতে অমিতের চোখের দিকে তাকাল রত্না। যেন সে অমিতের মনের কথা বোঝার চেষ্টা করছে। এর ঠিক কয়ে সেকেন্ড পরে রত্না অমিতকে বলল, তুমি কেমন আছো?

ওই চলছে একপ্রকার।

ব্যস্ত মানুষ। তা এখন হাতে একটু সময় আছে? খুব বেশি সময় নষ্ট করব না। এতদিন বাদে দেখা, তাই একসঙ্গে বসে একটু কফি খাওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।

সেদিন রত্নার কফি খাওয়ার অনুরোধ রক্ষা করে, নিজেও খুশি হয়েিল অমিত। আড্ডা জমেছিল অনেক রাত পর্যন্ত। দুজনের বিবাহিত জীবন কেমন চলছে, একে অপরকে না পেয়ে কতটা দুখি, সবই সেদিন শেয়ার করেছিল পরস্পরকে। আর সেদিনের জন্য যখন একে অপরের থেকে বিদায় নিয়েিল, তখন দুটো শরীর যেন চুম্বক আর লোহার রূপ নিয়েিল। রাত বাড়ছে, বাড়ি ফিরতে হবে, ভেবেই হয়তো বাহুমুক্ত হতে বাধ্য হয়েিল তারা।

এরপর প্রতি মুহূর্তে দুজনে দুজনকে চোখে হারিয়েে। সময় পেলেই ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, কিংবা ম্যাসেঞ্জারে দীর্ঘ সময় ধরে মনের ঝাঁপি খুলে ধরেছে।

রত্না এবং অমিত অফিস আওয়ার্স-এ বেশি কথা বলত। কারণ দুজনে যেহেতু অন্যের সঙ্গে ঘর বেঁধেছে, তাই ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে বাড়ি থেকে খুব কম কথা বলত তারা। তবে সংসার এবং কর্মক্ষেত্রের জন্য ওই দিনের পর আর দেখা করতে না পারলেও, মনের টান বাড়তে লাগল উভয়ে। এ ব্যাপারে বেশি কাছে আসতে চাইত রত্না। একবার দূরভাষে রত্না অমিতকে জীবনসঙ্গী হিসাবে না-পাওয়ার জন্য এতটাই আক্ষেপ করতে শুরু করেছিল যে, অমিত জিজ্ঞেস করল বিয়ে করে তুমি কি খুশি নও?

অমিতের কথার উত্তরে রত্না সেদিন বলেছিল, আজ নয়, সময় এলে তোমার এই প্রশ্নের উত্তর আমি অন্য ভাবে দিতে চাই।

একটু থেমে রত্না আবার অমিতকে আবেগভরা গলায় বলল, আমরা যে পরস্পরকে আজও ভালোবাসি, এটা তো সত্যি।

ভালোবাসা ছিল, আছে, থাকবে। কিন্তু এর বেশি আর কীই-বা করতে পারি আমরা? আমরা তো এক বিছানা শেয়ার করতে পারব না। কেউ কি সমর্থন করবে আমাদের এই সম্পর্ককে? কেউ কি বুঝবে যে, আমরা বিয়ে করেছি একজনকে আর ভালোবাসি অন্য কাউকে?

অমিতের আবেগ দ্বিগুন হল। আবারও সে বলতে শুরু করল, তুমি-ই বলো রত্না, কী করা উচিত আমাদের?

উত্তরে রত্না সেদিন জানিয়েিল, বিয়ে এবং ভালোবাসা দুটি ভিন্ন বিষয় আমার কাছে। যাদের আমরা বিয়ে করেছি, তাদের জায়গায় রেখেও তো আমরা আমাদের দুজনের ভালোবাসাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি, নতুন করে আমাদের যা মন চায় তাই করতে পারি।

মানলাম আমরা দুজনে যা মন চাই তাই করলাম, কিন্তু আমাদের বাড়তি চাওয়ার ফলে তো সংসার থেকে মনও উঠে যাবে। আমাদের জীবনসঙ্গীরা তো কোনও অন্যায় করেনি, আমাদের সন্তানরা তো কোনও অন্যায় করেনি। তাহলে তারা অকারণে কেন শাস্তি পাবে?

অমিতের কথা কেড়ে নিয়ে রত্না বলেছিল, আমি কাউকে শাস্তি দিতে বলছি না, শুধু আমাদের চাহিদা পূরণের কথা বলছি। তাছাড়া আমরা তো ওদেরকে খুশি রেখেছি এতদিন। আজ যদি ভালোবাসার মানুষকে আমরা নতুন করে পেতে চাই, তাহলে অন্যায়টা কোথায় অমিত?

সেদিন আর কথা বাড়ায়নি অমিত। কিন্তু দূরভাষে এভাবেই মাঝেমধ্যে কাছে আসার জন্য উতলা করে তুলত রত্না। অমিতও রত্নাকে কাছে পাওয়ার একটা অদ্ভুত টান অনুভব করত। কিন্তু বউ-বাচ্চার কথা ভেবে আবার পিছিয়ে যেত। এভাবেই রত্নাকে এবং নিজের মনকে বহুবার সামাল দিয়ে এসেছিল অমিত। কিন্তু ওদের পুনর্মিলনের এক বছর যখন পূর্ণ হতে চলেছিল, তখন রত্না জানাল, অমিত, আমি আর পারছি না, অন্তত দুটো দিন তোমার সঙ্গে একান্তে কাটাতে চাই। আগামী মাসের চার তারিখ আমাদের দেখা হওয়ার এক বছর পূর্ণ হবে। ওই দিন আমরা বোলপুরে গিয়ে দুদিন কাটাব। ব্যস, এটুকুই আমার চাওয়া। ওই দুদিনের স্মৃতি নিয়ে আমি বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব। তুমি রাজি হয়ে যাও প্লিজ।

রত্নার অনুরোধে দুদিন পর ভেবেচিন্তে বোলপুরে আসার সম্মতি জানিয়েিল অমিত। কিন্তু সেই সুখ কপালে সইল না। হোটেলের বিছানায় অমিতের পাশে শুয়ে রত্না তাই ভাবছিল, কী যে হয়ে গেল! বেশ ছিলাম হোটেলে, কেন যে মরতে বাইরে বেরোলাম, আরও এক সপ্তাহ পর কীভাবে যে সুনীলের মুখোমুখি হব বাড়ি গিয়ে এভাবেই ভাবনা আর অনুভবে পাশাপাশি থাকতে থাকতে অমিত ও রত্না কাটিয়ে দিয়েে আরও এক সপ্তাহ। এখন অমিতের কাঁধে ভর করে কিছুটা হাঁটতেও পারছে রত্না। ওর পায়ে ব্যান্ডেজ খুলে দিয়েেন ডক্টর। এবার ওদের বাড়ি ফেরার পালা।

হোটেল ছাড়ার আগে রত্না অমিতকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরে রয়েে। মিনিটখানেক ওভাবে থাকার পর রত্না অমিতের চোখে চোখ রেখে জানাল, আমার মনের দরজা সারা জীবন শুধু তোমার জন্য খোলা থাকবে। তুমি যখন খুশি আসতে পারো, আমি তোমার কাছে আত্মসমর্পন করে আনন্দ পাব।

রত্না এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি। স্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে পারছিল না। তা দেখে অমিত কিছুতেই রত্নাকে একা বাড়ি ফিরতে দিল না। আরও কিছুটা সময় যাওয়ার পথে অমিতকে কাছে পাবে, তাই রত্নাও আর বাধা দেয়নি।

ফেরার পথে ওরা আর ট্রেন ধরল না। বোলপুর থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে রওনা দিল কলকাতার বালিগঞ্জের উদ্দেশে। ওখানেই রত্নার শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু অমিত থাকে উত্তর চব্বিশ পরগণার ব্যারাকপুরে। তাই, রত্নাকে অমিত জানিয়েিল, ওর শ্বশুরবাড়ির কিছুটা আগে ওকে রিকশোতে তুলে দেবে। কিন্তু রত্না জানাল, না, তুমি আমাকে বাড়িতে পেঁছে দিয়ে আসবে। আমি সুনীলকে ম্যানেজ করব, আলাপ করিয়ে দেব তোমার সঙ্গে।

বাড়ি পেঁছোনোর আগে সুনীলকে ফোন করে তাকে রিসিভ করার কথা জানিয়েিল রত্না। সেইমতো রাস্তায় এসে ছেলেকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়েিল সুনীল।

গাড়ি থেকে নেমেই রত্না প্রথমে ছেলেকে কোলে তুলে নিল। কারণ, বিগত পনেরো দিন সে শুধু দূরভাষে ছেলের খবর নিয়েিল, টুকটাক কথা বলেছিল। ছেলের জন্য রত্নার বেশি চিন্তা ছিল না, কারণ রত্না জানত, ওর শাশুড়ি নাতিকে খুব ভালোবাসেন, তাই সামলে নেবেন।

সোনা বাবা, তুমি কেমন আছো? ঠাকুমা তোমায় আদর করেছিল তো? ছেলের গালে চুমু দিতে দিতে কথাগুলো বলতে থাকে রত্না।

ঠাকুমা আমায় অনেক গল্প শুনিয়েে। সদ্য কথা বলতে শেখা ছেলেটি তার মাকে জানায়।

রত্নাকে নামিয়ে অমিত গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যেতে চেয়েিল, তখনই রত্না গাড়ির ড্রাইভারকে থামতে বলে এবং অমিতকে নামতে বলে ইশারায়।

সুনীল, এদিকে এসো, আলাপ করিয়ে দিই আমার বন্ধু অমিতের সঙ্গে। মনে কোনও দ্বিধা-সংশয় না রেখে, খুব স্বাভাবিক ভাবে অমিতের সঙ্গে সুনীলের আলাপ করিয়ে দেয় রত্না।

অমিতের সঙ্গে আলাপ পর্বে সুনীল কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি ঠিকই, কিন্তু হতবাক হয়েিল হঠাত্ এমন একটি অভাবনীয় ঘটনার মুখোমুখি হয়ে তাই অমিত চলে যাওয়ার পর, একাধিক প্রশ্নবাণে বিদ্ধ করেছিল কিছুটা উত্তেজিত হয়ে কিন্তু রত্নাকে নিরুত্তাপ দেখে, সামযিক ভাবে ঘাবড়ে গিয়েিল সুনীল।

সময় এগিয়ে চলে তার নিজস্ব গতিতে। কাজের ব্যস্ততায় সুনীলের মাথা থেকেও বেরিয়ে যায় অমিতের বিষয়টা। পায়ে ব্যথা সেরে গিয়ে স্বাভাবিক হাঁটাচলা করতে পারার পর রত্নাও আবার কাজে যোগ দেয়। সময় পেলেই অমিতকে ফোনও করতে থাকে নিয়মিত। এভাবেই চলছিল সবকিছু, কিন্তু দিনের পর দিন বিছানায় রত্নাকে আর আগের মতো না পেয়ে নতুন করে আষাঢ়ের মেঘ ঘনীভত হতে শুরু করে সুনীলের মনে।

রাত দশটা। ডিনার সেরে নিয়েে রত্না। ছেলেকে খাইয়ে ওর ঠাকুমার ঘরে দিয়ে এসেছে। ঠাকুমার সঙ্গেই এখন ঘুমোনোর অভ্যাস ছেলের। রত্না তাই এখন একা। সুনীলের ফিরতে এখনও ঘন্টাখানেক বাকি। তাই এই ফাঁকা সময়ে অমিতের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে হল রত্নার।

অমিত সেই রাতে অফিসের কাজে উত্তরবঙ্গে ছিল। কাজ সেরে হোটেলের ঘরে বসে টিভি দেখছিল। রত্নার ফোন রিসিভ করে টিভি বন্ধ করে দেয়। তারপর বেশ নিশ্চিন্তে কথোপকথন চালাতে থাকে অমিত এবং রত্না।

আবেগে চোখ বন্ধ রেখে কথা বলছিল রত্না। তাই, সুনীল কখন ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে ওর প্রেমালাপ শুনছিল, বুঝতেই পারেনি। হঠাত্ ঘরে কারওর উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খোলে রত্না। আচমকা সুনীলকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ফোন কেটে দেয় সে।

ফোনের ওপারে কে ছিল? ওই লোকটা যে তোমাকে পেঁছোতে এসেছিল? কর্কশ ভাবে প্রশ্নগুলো রত্নার দিকে ছুড়ে দেয় সুনীল।

হ্যাঁ, আমিতই ছিল, তো কী হয়েে?

প্রেম তো বেশ জমে উঠেছে দেখছি। এইজন্যই ভাবছিলাম, রাতে এখন শরীরে তোমার প্রাণ থাকে না কেন?

বাজে কথা রাখো। রাত হয়েে, আমার ঘুম পাচ্ছে, ফালতু বকবক করতে পারব না।

তা পারবে কেন! সব এনার্জি তো ওই লোকটার সঙ্গে বকবক করে শেষ করে ফেলেছ। লজ্জা করে না। বাচ্চার মা তুমি। আমি কী অভাব রেখেছি তোমার?

তুমি আমার শরীরের খবর রেখেছ, মনের খবর রেখেছ কি?

বাহ্, ভালো বলেছ। এখন অনেক কথাই তুমি বলবে। ওই ইতরটার সান্নিধ্য পেয়ে না। এখন তো আমার সবই তোমার কাছে মূল্যহীন মনে হবে। যাইহোক, একটা কথা স্পষ্ট জানিয়ে রাখছি, আর যদি ওই লোকটার সঙ্গে যোগাযোগ রাখো, তাহলে তোমার সঙ্গে আমার ফাটাফাটি হবে বলে দিলাম। আমার সম্মান নষ্ট করলে আমি ছাড়ব না।

তোমার যা করার আছে তুমি করে নাও। অমিত আমার বন্ধু, আমি যোগাযোগ রাখবই।

ওহঃ তাই? দেখাচ্ছি মজা…

বলেই রত্নার হাত থেকে ওর মোবাইল ফোনটা কেড়ে নিয়ে মাটিতে আছাড় মারে সুনীল। ভেঙে ছড়িয়ে পড়ে ফোনের যন্ত্রাংশ। ভাঙা ফোনটা থেকে সিম কার্ডটা খুলে নিয়ে সুনীলের গালে সপাটে একটা চড় মেরে, অফিসের ব্যাগটা কাঁধে তুলে নেয় রত্না। ঘর থেকে বেরোনোর আগে সুনীলকে ধাক্কা মেরে ঠেলে ফেলে দেয় এবং বাইরে থেকে দরজা আটকে দিয়ে রাস্তায় আসে। তারপর একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা হাতিবাগানে মায়ে বাড়িতে ওঠে।

অমিত সেদিন ওর মাকে ফোন করে দরজা খুলিয়ে উদ্ধার হয়েিল ঘর থেকে। রাগের মাথায় সুনীল সেদিন রত্নার বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিতে চেয়েিল কিন্তু ওর মা নিতে দেননি।

ওই ঘটনার পর কেটে গেছে এক সপ্তাহ। রত্নার কোনও খবর নেই। ছেলের খোঁজটুকুও নেয়নি। এদিকে ছোট্ট ছেলেটিকে ঠাকুমা আগলে রাখলেও, মাঝেমধ্যে মা-র জন্য কান্নাকাটি করতে থাকে। ওই দৃশ্য দেখে সুনীল আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। মনকে বুঝিয়ে রত্নার খোঁজ শুরু করে। রত্নার অফিস থেকে কোনও খবর পায় না। এক আত্মীয়ে মাধ্যমে জানতে পারে রত্না ওর মায়ে বাড়িতে আছে।

ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আর পরিবারের সামাজিক সম্মান বাঁচানোর তাগিদে, শ্বশুরবাড়ি গিয়ে রত্নার মুখোমুখি হয় সুনীল। শাশুড়িকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আর রত্নার হাত ধরে অনেক অনুনয়, বিনয়ে পর, রত্নাকে বাড়ি ফেরাতে সক্ষম হয় সে। কিন্তু সুনীলকে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়, অমিত-রত্নার সম্পর্কের ব্যাপারে আর কখনও সে নাক গলাবে না।

ফিরে এসো মলি

ভাইয়ের জ্বর কমছে না কিছুতেই। ওই ১০৪ ডিগ্রিতে আটকে রয়েছে। মলয়ের কপালে হাত রেখে থার্মোমিটার-টায় আর একবার চোখ বুলিয়ে নিল হিমানী। তারপর আবার কাপড় ভিজিয়ে মলয়ের কপালে রাখল।

নিজের মনে মনেই বিড়বিড় করতে থাকল হিমানী, কেন যে জ্বর নামছে না কে জানে? কতবার ভাইকে ডাক্তারের কাছে যেতে বললাম, কিন্তু সেই এক জেদ… ঠিক হয়ে যাবে।

দিদি চিন্তা করিস না, ডাক্তার দেখিয়ে বা কী হতো ক্ষীণ স্বরে মলয় হিমানীকে বোঝাবার চেষ্টা করে।

আমি আর তোর এই অবস্থা দেখতে পারছি না। চোখের তলায় কে যেন কালি ঢেলে দিয়েে মনে হচ্ছে! এত দুর্বল শরীর। আমি জানি মলির চলে যাওয়াটাকে তুই কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিস না। তুই নিজেই তো কাণ্ডটা বাঁধিয়েিস। কাউকে কিছু না বলে ডিভোর্স নিয়ে নিলি? সাতবছর একসঙ্গে সংসার করলি। সন্তান হয়নি তো কী হয়েে? আমি জানি মলির দুবার মিসক্যারেজ হয়েে কিন্তু বাচ্চা দত্তক নিতেই বা কী অসুবিধা ছিল? মা-বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন বলার কেউ ছিল, এখন তো তোদের স্বাধীন জীবন।

আমি কিছুতেই বুঝতে পারি না মলি কী করে এতটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ল? তুই চিরকালই কম কথা বলিস। বেচারা মলি নিঃসঙ্গতা কাটাবার জন্য স্কুলে পড়াবার চাকরি-টা নিল আর বাড়িতে টিউশন করা আরম্ভ করেছিল। ওর দুটো কাজই তুই মেনে নিতে পারলি না। তোর মনে হল টাকার জন্য ও কাজ করছে। তোর অহংকারে লাগল। ভাই, আমি ভালো করেই জানি, তুই আজও পুরোনো বস্তাপচা সংস্কার আঁকড়ে ধরে চলার চেষ্টা করিস। তুই শুধু যে মা-বাবাকে হারিয়েিস তা তো নয়, মলিও দ্বিতীয়বার মা-বাবার স্নেহের আঁচল থেকে বঞ্চিত হয়েছে। জানিস-ই তো কী প্রচণ্ড ভালোবাসত ও মা-বাবাকে।

মলয় চুপ করে থাকে। হিমানী কথাগুলো না বলেও থাকতে পারে না। ও জানে দোষ মলয়ের তাই দোষটা চোখে আঙুল দিয়ে ওকে দ্যাখানো দরকার। হিমানী আবার বলে, তোর রাগ তো আমি জানি ভাই। নিশ্চয়ই চ্যাঁচামেচি করতিস মেযোর উপরে। একটা ভালো পড়াশোনা জানা মেয়ে একা সে করবেটাই বা কী? কারও সঙ্গে ওকে মিশতে দিবি না, বাড়িতেও কেউ আসা-যাওয়া করবে না। এখন ও চলে গেছে তাতেও তোর শান্তি নেই।

ও-বেচারারই বা কী অবস্থা কে জানে!

দিদি, প্লিজ চুপ কর, যন্ত্রণায় মাথা ফেটে যাচ্ছে। তুই যা ভাবছিস তা মোটেই নয়। আমার কোনও সমস্যা হচ্ছে না! যার সঙ্গে খুশি ও থাকতে পারে, আমার কী? আমাকে বলেছে, আমি মরলেও জিজ্ঞেস করার কেউ থাকবে না আমার কাছে। ও এটাই চায়। তুই কী করে মলিকে সাপোর্ট করছিস? বেশি আর কী হবে মরেই যাব, এই তো?

তোর একটু শরীর খারাপ হলেই কান্নাকাটি করে একশা করত। তোর আঘাত লাগলে মুখ চুন করে ঘুরত। মায়ে অপারেশনের সময় কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞানই হয়ে পড়েছিল। ও যা মায়ে সেবা করেছে, আমিও হয়তো করতে পারতাম না। সেই মেয়ে সব ছেড়েছুড়ে সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে চলে গেল বিশ্বাস হয় না!

ওকে কনট্যাক্ট করার কোনও তো নম্বর হবে, আমাকে প্লিজ দে ভাই। একবার কথা বলতে চাই। ওর বান্ধবী শুভ্রার নম্বর তোর কাছে আছে? হিমানী নিজেই মলয়ের মোবাইলটা খাটের পাশ থেকে তুলে নিয়ে নম্বর খুঁজতে থাকে।

এখন আর কিছুই করার নেই দিদি। মলি নিজে বলেছে ও শশাঙ্ক-কে বিয়ে করে কানাডা চলে গেছে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে মলয়।

হিমানী মলয়ের থেকে চার বছরের বড়ো। হিমানীর বিয়ে পাঁচ বছর বাদে মলয়ের বিয়ে হয়। স্বভাবে মলয় আর মলি একেবারে বিপরীত দুটো মানুষ। মলয় অন্তর্মুখী আর মলি উচ্ছল ঝরনাধারার মতো। বিয়ে হয়ে এসেই মলয়ের মা-বাবাকে আপন করে নিয়েছিল মলি নিজের ব্যবহারে। হঠাত্-ই মলয়ের মা মারা যান স্ট্রোক-এ। বাবাও আর বেশিদিন বাঁচেননি। সুগারের রুগি ছিলেন।

মা-বাবার মৃত্যু মলয় মানতে পারেনি। ডিপ্রেসড থাকতে শুরু করে। মলিও কিছুতেই ওকে এই অবসাদ থেকে টেনে বের করতে পারে না। ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়া শুরু হয়।

অথচ মলি নিজের শ্বশুর-শাশুড়ির যত্নের কোনও অবহেলা কোনওদিন করেনি। বাড়ির সব কাজ সেরে মাঝেমধ্যে বাইরে ঘুরে আসত মলি। বাইরের কাজ থাকলে সেটা করে পাড়া-প্রতিবেশীদের খবরাখবর নিত। তাদের বাড়ি যেত, তাদের বাড়িতে ডাকত। সকলের সঙ্গে সঙ্গে শ্বশুর-শাশুড়িরও আদরের ছিল সে। সকলেই তাকে ভালোবাসত। কিন্তু তাঁরা মারা যাওয়ার পর থেকেই, লোকজনের বাড়িতে আসা-যাওয়াটা মলয়ের কাছে অসহ্য হয়ে উঠল। অল্পেতেই মলয বিরক্ত হতো। কখনও মায়ে মতো রান্নায় স্বাদ হয়নি বলে, মলিকে বকাবকি করত। আবার কখনও ওর এত বাইরে যাওয়া নিয়ে অশান্তি আরম্ভ করে দিত।

শশাঙ্ক মলির ছোটোবেলার বন্ধু। ক্লাস টুয়েভ অবধি একসঙ্গে পড়েছে। সবসময় হাসিমুখ, অন্যের প্রযোজনে পাশে দাঁড়ানো, লোকের বিপদে আগু-পিছু না ভেবে ঝাঁপিয়ে পড়া এই সব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য সবার কাছেই খুব পপুলার ছিল শশাঙ্ক। স্কুল শেষ হওয়ার পর আর যোগাযোগ ছিল না, হঠাত্ই রাস্তায় একদিন মুখোমুখি দেখা। সেই একই রকম চেহারা রয়েে। মুখে দুষ্টু-মিষ্টি হাসিটা লেগে রয়েে। চোখদুটো যেন কথা বলছে। শুধু তফাত, আগের থেকে চেহারা খানিকটা ভারিক্কি হয়েে আর মুখের ফ্রেঞ্চকাট দাড়িটা।

আরে, শশাঙ্ক তুই, এখানে! চিনতে পারছিস? মলি খপ করে ওর হাতটা ধরে ফেলে।

হ্ঁযা। তুই মলি? বিশ্বাস হচ্ছে না। মলি মানেই সেই স্কার্ট-ব্লাউজ পরা, দুটো বিনুনি ঝোলানো, রুমাল দিয়ে নাক মুছতে থাকা মেযোকেই মনে পড়ে। শাড়ি পরে মাথায় সিঁদুর, না রে আমি কিছুতেই মেলাতে পারছি না! হা হা করে রাস্তার মাঝেই হাসতে আরম্ভ করে শশাঙ্ক।

আর তুই এখনও বিয়ে করিসনি? হেসেই জিজ্ঞেস করে মলি।

ঝটপট উত্তরও পেয়ে যায়, পাগল! এখনও আমি স্বাধীন। কষ্ট করে পড়াশোনা করেছি, ভালো একটা চাকরিও জোগাড় করেছি। এত সহজে হাড়িকাঠে মাথা দেব ভেবেছিস? একটু তো প্রাণখুলে নিঃশ্বাস নিই। মলির মনে হয় শশাঙ্ককেই মানায় এই প্রাণখোলা হাসিটায়।

কী করছিস? কিছু কেনাকাটা করার আছে নাকি? নয়তো চল বাইক সঙ্গে আছে, কোথাও বসে একটু আড্ডা মারি, শশাঙ্ক বলে।

না রে, সারাদিন বাড়িতে থেকে হাঁপিয়ে উঠলে সন্ধেবেলায় একটু ঘুরে আসি। প্রযোজনে টুকিটাকি জিনিসও মাঝেমধ্যে কিনে নিই। সেটাই কিনতে যাচ্ছি এখন, হাসে মলি।

কেন রে, তোর পতিদেব বাইরের হাওয়া খেতে ভালোবাসে না! নাকি বউয়ে হাত ধরে বেরোনো তার পছন্দ নয়? নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ওঠে শশাঙ্ক। লক্ষ্য করে না ওর এটা বলার সঙ্গে সঙ্গে, মলির মুখে একটা ছায়া পড়ে, আবার মিলিয়ে যায়।

ঠিক আছে, চল না, জিনিসগুলো কিনে নে। তারপর কোথাও একটু চা খেয়ে তোকে না হয় আমি বাইকে ছেড়ে দিয়ে আসব।

খানিক্ষণের মধ্যে বাইকের পিছনে বসে যেতে যেতে মলি শশাঙ্কের বলে যাওয়া জোক্সগুলো একটার পর একটা শুনতে শুনতে, অনেকটা হালকা বোধ করল। মনের উপর থেকে একটা ভারী পাথর যেন সরে গেছে। শশাঙ্কটা কিছুতেই গম্ভীর হয়ে থাকতে দেয় না। খিলখিলিয়ে হেসে উঠল মলি এবার। বহুদিন বাদে এভাবে মনখুলে মলি হাসতে পারল। শশাঙ্কর দ্বারা বোধহয় কিছুই অসম্ভব নয়। শশাঙ্ক এবার প্লিজ থামবি। হাসতে হাসতে পেট ব্যথা করছে, কপট রাগ প্রকাশ করল মলি। মলির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে দুজনের কথা হচ্ছিল।

উফ্, মলি তুই কি বোরিং হয়ে গেছিস। কোথায় বরের সঙ্গে ঘুরবি, মুভি দেখতে যাবি, রেস্টুরেন্টে খাবি তা না করে

দোকান-বাজার করছিস। বিয়ে কেন করেছিস? চল তোর বরের জন্য সিঙাড়া কিনে দিই। কী করে না খায় দেখব। বাড়ি ঢুকে আগে গরম গরম চা কর। আশ্চর‌্য মলিকে বাড়িতে ছাড়তে অথবা বাড়িতে এসে মলির বরের সঙ্গে আলাপ করতে, এতটুকুও সঙ্কোচ বোধ ছিল না শশাঙ্কর। বরং মলি একটু বিব্রত বোধ করছিল। শশাঙ্কর উপস্থিতি মলয় কীভাবে নেবে, সেটা মলি বুঝে উঠতে পারছিল না।

দ্বিধা নিয়ে মলি শশাঙ্ককে নিয়ে বাড়িতে ঢুকল। মলয়ের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে শশাঙ্ককে বসিয়ে মলি চা করতে চলে গেল। চা-সিঙাড়া ট্রে-তে সাজিয়ে ঘরে ঢুকে দেখল মলয় চুপচাপ বসে, শশাঙ্ক একাই কথা বলে যাচ্ছে। শশাঙ্কর অনেকবার অনুরোধ করায় সিঙাড়ার একটা কোণ ভেঙে একটু মুখে দিয়ে প্লেট সরিয়ে রাখল। শশাঙ্কর মজার মজার কথাতেও মলয়ের মুখের কোনও পরিবর্তন হল না। মলয়ের মতে একটা বয়সের পর মানুষকে গম্ভীর হয়ে যেতে হয়। বাচ্চাদের মতন আচরণ তখন মানায় না। এর জন্য় কত বকা যে শুনতে হয় মলিকে, তার গুনতি করাই অসম্ভব।

ওদের কথার মাঝেই মলয় উঠতে চাইলে শশাঙ্ক উঠে দাঁড়ায়, আপনি বসুন, আমি এখন উঠব। অনেক বোর করলাম কিন্তু শিগগির আবার আসব। তৈরি থাকবেন।

গেট পর‌্যন্ত এসে মলির কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে শশাঙ্ক বলল, এই লোকটাকে মানুষ বানিয়ে তবে ছাড়ব। আমি সহজে হার মানছি না। একে কী করে তুই বিয়ে করেছিস মলি! কাল সন্ধেবেলায় দেখা হচ্ছে। বাই, দিয়ে স্পিডে বেরিয়ে গেল।

পরের দিন সন্ধে ছটার সময় শশাঙ্ক মলির বাড়ির দরজায় কড়া নাড়ল। মলি দরজা খুলতেই পকেট থেকে তিনটে গোলাপি রঙের সিনেমার টিকিট চোখের সামনে নাচিয়ে শশাঙ্ক বলল, তাড়াতাড়ি তৈরি হ। তোর ব্যাজারমুখো বরটা কোথায়? ওটাকেও তৈরি হতে বল। আটটার শো। একটা ভালো কমেডি ছবি এসেছে।

তোকে তো বলেছিলাম মলয় সিনেমা দেখা পছন্দ করে না। বিশেষ করে কমেডি তো একেবারেই নয়। আরে ডাক না তোর বরকে। ওর পছন্দের ব্ল্যাক কফি খাওয়াব। রাতের ডিনারটাও না হয় আমার তরফ থেকেই। দ্যাখ এদিকটায় নতুন নতুন এসেছি কাউকে এখনও সেরকম চিনি না। ভাগ্যিস তোর সঙ্গে দেখা হয়েিল! নে নে তাড়াতাড়ি কর। কুড়ি মিনিট পর ক্যাব পেঁছে যাবে, শশাঙ্ক অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে।

মলয় না করা সত্ত্বেও জোর করে ধরে নিয়ে যায় শশাঙ্ক সিনেমা দেখাতে। সারাটা সন্ধে আর বিশেষ কথা বলে না মলয়। চুপচাপ ডিনার খাওয়া শেষ করে শশাঙ্ক ওদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যায়। বাড়ি এসেই মলির উপর রাগ উগরে দেয় মলয়।

মলি, তোমার বন্ধু খুব বেশি বাড়াবাড়ি করছে। ওকে আমার পছন্দ-অপছন্দগুলো বলে দিও। এরপর যদি করে, আমি কিন্তু যা-তা বলতে বাধ্য হব। ওর ফালতু রসিকতা তোমার মতো বেকারের পছন্দ, আমার নয়। মলিকে সাবধান করে দেয় মলয়।

শ্বশুর-শাশুড়ি মারা যেতে স্নেহভরা পরিবেশ মলিও হারিয়েিল। কুড়ি বছর বয়সে নিজের বাবাকে হারিয়েিল সে। চারপাশটা কেমন শূন্য মনে হয় মলির। চরম বিষাদেও নিজেকে অন্ধকারে হারিয়ে যেতে দেয়নি মলি। ভাঙা মন জোড়া লাগিয়ে আবার নতুন উদ্যমে বাড়ির পরিবেশটাকে খুশিতে ভরিয়ে তুলেছিল।

কিন্তু মলয়ের ক্ষেত্রে পুরোপুরি হেরে গেছে মলি। দুবছর কেটে গেছে, মা-বাবার মৃতু্যর শোক আজও ভুলতে পারেনি মলয়। অবসাদের পরিবেশ কাটিয়ে উঠতে, কাছেই একটা স্কুলে চাকরি নিয়েিল মলি। সেখানে সারাদিন বাচ্চা পড়িয়ে মনটা ভালো থাকত। এরপর বাড়িতেও বাচ্চাদের পড়াতে আরম্ভ করে সে। কিন্তু শনিবারগুলো মলয় বাড়ি থাকত। এছাড়া যেদিন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরত, সেদিন বাড়িতে চার-পাঁচটা বাচ্চার হাসি, কথাবার্তা, সবেতেই বিরক্ত হয়ে উঠত মলয়। তাই, মলয়কে খুশি করতে সপ্তাহান্তে বাচ্চা পড়ানো বন্ধ করে দিয়েিল মলি।

মলির ব্যস্ততার কারণে আর মলয়ের অপছন্দ করার ফলে, শশাঙ্কও মলির বাড়ি আসা-যাওয়া কমিয়ে দিয়েিল। মাঝেমধ্যে শনিবার এলেও, মলির সঙ্গে গল্প করেই চলে যেত। মলয় একদিনও ওদের সঙ্গে বসে আড্ডায় যোগ দিত না। শশাঙ্কর মজা করার অভ্যাস কিছুটা প্রাণ ফিরিয়ে আনত মলির।

একদিন একটু তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরতেই, মলয় দেখল বাড়িতে হইহই হচ্ছে। বাড়িতে কেক কাটা চলছে। মলির কোনও ছাত্রের জন্মদিন পালন করা হচ্ছে। কিছু না বলে চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল মলয়।

বাড়ি খালি হতেই মলয় একপ্রকার ঝাঁপিয়ে পড়ল মলির উপর, তোমাকে বলেছি না, বাড়ি ফিরে আমার একটু শান্তি চাই। এইসব ড্রামা আমার একদম পছন্দ নয়। কাল থেকে কোনও বাচ্চা যেন আমার বাড়িতে পড়তে না আসে। পড়াবার ইচ্ছে থাকলে কোথাও ঘর ভাড়া করে পড়াও। আমার খুশি তো তুমি কখনওই দ্যাখো না, যা ইচ্ছে তাই করো। আমি এটা বরদাস্ত করব না, বলে আবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

ধৈর‌্যের শেষ বাঁধটুকুও ভেঙে গেল মলির। মলয়ের কথাগুলো ছুরির আঘাত ওর কোমল হৃদয়টাকে রক্তাক্ত করে তুলল। মলয়ের ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় ধাক্কা মেরে জোর করে দরজা খুলিয়ে প্রথমবার মলয়ের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল।

তুমি কী বলছিলে? তোমার বাড়ি? তোমার খুশি? আমি তো বিয়ে পর এটাকেই নিজের বাড়ি বলে ভেবে এসেছি। তোমার হুকুম শোনার জন্য আমি বিয়ে করিনি। আমি তোমার চাকর নই। তুমি শুধু নিজের খুশির চিন্তা করো, বউয়ে খুশি নিয়ে একদিনও ভেবেছ?

আমিও আদরে মানুষ হয়েি। একটা বাড়ি ছেড়ে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে মেযো সেটাকেই নিজের বাড়ি ভেবে নেয়, ওই বাড়ির নিয়মে নিজেকে আবার নতুন করে ঢেলে সাজায়। আর তুমি এক নিমেষে আমাকে বাইরের রাস্তা দেখিয়ে দিলে? তোমার যদি এরকমই মেয়ে পছন্দ ছিল তাহলে অনাথ, গরিব, অশিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করলেই পারতে। হাত জোড় করে তোমার আজ্ঞা পালন করত। কিন্তু তা তো হবার নয়। বিয়ে করতে হবে শিক্ষিত, সুন্দরী, ভালো ঘরের মেয়েে। যাতে সবার কাছে সম্মানটা বজায় থাকে, রাগে কাঁপতে কাঁপতে এক নিশ্বাসে মলি কথাগুলো বলে হাঁপাতে থাকে। মলয় বিস্ফারিত চোখে চেয়ে থাকে মলির দিকে, মুহূর্তে কোনও উত্তর জোগায় না মুখে।

পুরুষ মানুষ, বউয়ে কাছে হেরে যাওয়া লজ্জার কথা। সুতরাং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে মলয় বলে উঠল, এতই যদি দম্ভ, বড়োলোক দেখে বিয়ে করলে না কেন? শশাঙ্কই তো ছিল। ওর সঙ্গে সময় কাটাবার জন্য তোমার মন কাঁদে সব সময়। কেন, আগে ও ভালো চাকরি করত না বলে বিয়ে করনি?

খবরদার মলয়, একটা বাজে কথা মুখ থেকে আর বার করবে না। তোমার নোংরা মনের পরিচয় আমি আগেই পেয়েি। আমি শশাঙ্কর কাছেই চলে যাচ্ছি। একটাই শান্তি, ও তোমার মতো নীচ মনের মানুষ নয়। ওর সঙ্গে আমি অনেক ভালো থাকব, বলে রাগের মাথায় শশাঙ্ককে ফোন করল মলি।

অফিস ফেরত শশাঙ্ক সোজা মলিদের বাড়ি এল। মলিকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করল। মলয়ও অনেক অনুনয়-বিনয় করল কিন্তু মলি মন ঠিক করে নিয়েিল। কেউই কিছু বোঝাতে পারল না মলিকে। অগত্যা শশাঙ্ক বলল, ঠিক আছে, তুই আমাকে মাসিমার নম্বরটা দে। আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি। এলাহাবাদে গিয়ে কয়ে দিন কাটিয়ে আয়। আমি টিকিট কেটে দিচ্ছি।

না রে, মা শুধু শুধু চিন্তায় পড়ে যাবে। সত্যিটা জানতে পারলে কিছুতেই সহ্য করতে পারবে না, জলে ভেসে যেতে থাকে মলির দুচোখ।

সত্যিটা বলবি কেন? বলবি এমনি ঘুরতে এসেছিস। ধীরে ধীরে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। দুজনেরই রাগ ঠান্ডা হয়ে এসেছে। ঠিক আছে কালই আমি টিকিট কিনে নিচ্ছি।

মলিকে বুঝিয়েসুঝিয়ে শশাঙ্ক সবে বড়ো রাস্তায় পড়েছে। হঠাৎ-ই রং সাইড থেকে একটা ট্রাক এসে ধাক্কা মারল শশাঙ্কর বাইককে। ছিটকে পড়ল শশাঙ্ক। হেলমেট থাকা সত্ত্বেও বুঝতে পারল মাথায় চোট লেগেছে, পা-টাও নাড়াতে পারছে না। মলির মুখটা মনে পড়ল। ধীরে ধীরে জ্ঞান হারাল সে। ততক্ষণে ভিড় জমে গেছে। পুলিশ এসে অ্যাম্বুল্যান্স করে হাসপাতালে পেঁছোল শশাঙ্ককে। ততক্ষণে অনেক সময় পার হয়ে গেছে। শশাঙ্ক তখন কোমায়। মোবাইলটাও ভেঙে রাস্তায় ছিটকে পড়েছিল।

তিনদিনের পরও যখন শশাঙ্ক এল না বা ওর ফোনও পাওয়া গেল না, মলয় পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে মলিকে ব্যঙ্গ করতে ছাড়ল না, তোমার ভালোবাসার মানুষ ভয় পেয়ে পালিয়েে।

সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। অন্যের সঙ্গে চলে যাব সেই ভয়ে কি ডিভোর্স দিচ্ছ না? বিরক্ত হয়ে মলি জিজ্ঞেস করে।

ভয় কাকে করব? শশাঙ্ককে? একটা উজবুক। কালই চলো ভালো কোনও উকিলের সঙ্গে কথা বলব।

ঠিক আছে, আবার অবস্থান বদলে ফেল  না, রাগের মাথাতেই নিশ্চিত হতে চাইল মলি।

সত্যি বলতে কী, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াল। শেষমেশ ডিভোর্সের পর সাহস করে মলি এলাহাবাদে মায়ে কাছে গিয়ে দাঁড়াতে, মলিনাদেবী শোকে পাথর হয়ে গেলেন। মলি ধীরে ধীরে তাঁকে আবার সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারলেও, নিজে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারল না। শরীর ভাঙতে আরম্ভ করল। মলয়েরও মন আত্মগ্লানিতে ভরে উঠল। নিজের

অংহবোধ-এর জন্য মলির সঙ্গে ডিভোর্স নিয়েিল ঠিকই কিন্তু মনে মনে জানত ওদের সংসারের জন্য, ওর বুড়ো মা-বাবার জন্য মলি কতটা আত্মত্যাগ করেছে। মলি মিষ্টি ব্যবহার দিয়ে পাড়া-প্রতিবেশী সকলের মন জয় করে নিয়েিল। সকলেই জিজ্ঞেস করত মলি কেন চলে গেল? কিন্তু এর কোনও উত্তর ছিল না মলয়ের কাছে।

এ বাড়িতে আর কেউই আসত না। খালি বাড়িটা যেন গিলে খেতে আসত মলয়কে। আগে সামান্য চ্ঁযাচামেচি হলে রেগে উঠত, আর এখন খালি মনে হতো বাড়িতে কেউ তো আসুক। প্রায়শ্চিত্তের আগুনে জ্বলতে জ্বলতে শয্যাশাযী হয়ে গিয়েিল মলয়। জল এগিয়ে দেওয়ারও কেউ ছিল না। ভাগ্যিস, হিমানীকে কেউ খবর দিয়েিল। দিদি না এলে এতদিনে প্রাণটুকুও হয়তো হারাতে হতো।

শুভ্রাকে ফোন করে হিমানী জানতে পারল, শুভ্রা ইদানীং আর এলাহাবাদে থাকে না। দিল্লি চলে গেছে। ও সোজাসুজি হিমানীকে বলল, এখন আর কী হবে দিদি। ডিভোর্স হয়ে গেছে। মলয় ওর জীবন নরক করে তুলেছিল। ওর দুঃখ সহ্য করতে না পেরে মাসিমাও মারা গেলেন। এখন মলি শশাঙ্ককে বিয়ে করে কানাডায় সেটেলড। ওরা ভালো আছে। আপনারা আর ওর চিন্তা করবেন না।

এটা কিছুতেই হতে পারে না শুভ্রা।

মলয়ের সঙ্গে ডিভোর্স হয়ে গেছে মলির, শশাঙ্ককে বিয়ে করায় অসুবিধা কোথায়…, জোরের সঙ্গে বলল শুভ্রা। সেটাই তো। আমি জানি ওই বাড়ির সঙ্গে ও কতটা ক্লোজ ছিল। এই বাড়ি, এই বাড়ির মানুষগুলোর সঙ্গেও। ভাইয়ে বউ ছিল ও, কিন্তু আমাদের বন্ধুত্বও কিছু কম ছিল না। মলি ডিভোর্স করে বিয়ে করে নিল, মন কিছুতেই মানতে চাইছে না। শুভ্রা ঠিক করে বলো। একবার বলো তুমি যা বলছ সব মিথ্যা। মাত্র দেড় বছর হল আমরা নিউজিল্যান্ডে শিফ্ট করেছি, আর এর মধ্যে এত কাণ্ড! প্লিজ শুভ্রা ওর কনট্যাক্ট নম্বরটা একবার দাও। আমি ওর মুখ থেকে নিজের কানে শুনতে চাই, হিমানী করুণ স্বরে রিকোযে্ট করে শুভ্রাকে।

দিদি, ও নম্বর দিতে বারণ করেছে। আর কী করবেই বা তুমি? হাড় কটা রয়ে গেছে শরীরে। ওর অবস্থা চোখে দেখতে পারবে না। কেউ ওর কথা জিজ্ঞেস করলে এগুলোই সবাইকে বলতে বলেছে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে শুভ্রা। হিমানীর অনুরোধ কিছুতেই ফেলতে পারে না, হেরে গিয়ে মলির নতুন নম্বরটা হিমানীকে দিয়ে দেয় শুভ্রা।

শুভ্রা, এটা তো ইন্ডিয়ারই নম্বর, আশ্চর‌্য হয় হিমানী।

দিদি মলি শশাঙ্ককেও বিয়ে করেনি, কানাডাও যায়নি। শশাঙ্ক আমার পিসির ছেলে। কলকাতায় গিয়ে সাংঘাতিক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। চারমাস কোমাতে পড়ে ছিল। তারপর জ্ঞান ফিরলেও নানা সমস্যা হচ্ছিল। পিসিরা ওকে দিল্লিতে নিয়ে এসে চিকিত্সা করায়। এখন ভালো হয়ে ওরা সবাই এলাহাবাদ ফিরে গেছে। শশাঙ্কই আমাকে মলির খবরাখবর দিতে থাকে। শুভ্রা বিস্তারিত খুলে বলে হিমানীকে।

 

হিমানী, শুভ্রার ফোন ছেড়েই মলির নম্বর ডায়াল করে।

হ্যালো… সেই মিষ্টি গলা কিন্তু আজ তাতে আর যেন প্রাণ নেই।

মলি, আমি তোর হিমানীদি। এতটা পর করে দিলি আমাদের! কাউকে কিছু জানালি না। কী করলি তোরা? তোরা কি পাগল!

ওদিকে কোনও উত্তর নেই দীর্ঘশ্বাসের মৃদু আওয়াজ ছাড়া।

তোদের দুজনকে ভালোমতন জানি। তোর যা অবস্থা, মলয়েরও তাই। মলয়ও বিছানায় পড়ে রয়েে। এত ভালোবাসা কিন্তু এত ইগো কেন? মলয় প্রচুর ভুল করেছে। প্রিয়জনদের হারিয়ে ওর মাথায় ভত চেপেছিল যার জন্য তোকে ও হারিয়েে। আজ নিজের আচরণের জন্য ও লজ্জিত। প্রতি মুহূর্তে তোকে মিস করছে। মলি, মলয় আজও তোকেই ভালোবাসে।

মলি নিশ্চুপ।

এই ভাবে চললে দুজনের কেউই বাঁচবি না। অনেক তো লুকোবার চেষ্টা করলি। শুভ্রা আমাকে সব সত্যিটা বলেছে। ফিরে আয় মলি। আমি আসছি তোর কাছে, ভাইটাকেও কান ধরে নিয়ে আসব। আগে তো ক্ষমা চাইবে তোর কাছে। এরপর কখনও যদি তোকে দুঃখ দেয়, তোকে কাঁদায় তাহলে ও আমায় জীবিত পাবে না, এই আমি ওকেও জানিয়ে রাখলাম।

হিমানীর কথা শেষ হওয়ার আগেই মলয় বিছানা থেকে উঠে বসে দিদির মুখটা হাত দিয়ে চেপে ধরল, দিদি আর কোনও দিন এই কথাটা বলবি না।

তাহলে দুজনেই কান ধরে ক্ষমা চা আমার কাছে, মৃদু হেসে হিমানী বলল, যেটা মলয় ছাড়াও ফোনের ওপাশে মলির কানে গিয়ে পেঁছোল। মলি এমন একটা মেয়ে যে পুরো বাড়ি মাথায় করে রেখেছিল, সবাইকে আপন করে নিয়েিল তার সঙ্গে তুই অ্যাডজাস্ট করতে পারলি না ভাই, কেন? মানছি তোর কিছু পছন্দ, অভ্যাস, সংস্কার আছে, সেরকম মলিরও তো কিছু চাহিদা আছে… তাই না কি? অ্যাডজাস্ট খালি ওই করে যাবে? আমি কি প্রথম থেকে এরকম ছিলাম? রানার জন্য অনেক নিজেকে বদলেছি। রানাও নিজেকে কম বদলায়নি। তাই আজ আমরা সুখী দম্পতি। তোকেও ভাই বদলাতে হবে, কিছু ত্যাগ করতে হবে মলির জন্য। পারবি না মলির জন্য নিজেকে বদলাতে? আশা নিয়ে মলয়কে জিজ্ঞেস করে হিমানী।

হ্ঁযা দিদি, তুই যা বলছিস আমি শুনব, আশ্বাস দেয় মলয়।

তাহলে কথা বল ওর সাথে। নম্বর-টা ডায়াল করে হিমানী ভাইয়ে হাতে ফোনটা দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল।

মলি, কোন মুখ নিয়ে আমি কথা বলব তোমার সাথে। আমি অপরাধী, আমাকে পারো তো ক্ষমা করে দাও। বিয়ে পর থেকে বাড়ির সব দাযিত্ব তুমি পালন করেছ। হনিমুন কেন কখনও কোথাও তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাইনি। নিজের ইচ্ছে শুধু তোমার উপর চাপিয়ে গিয়েি। তোমার সঙ্গে পা মিলিয়ে দুপা হাঁটতেও কখনও চেষ্টা করিনি আমি। বাচ্চা দত্তক নিতে চেয়ে, আমি মত দিইনি। বাড়িতে টিউশন আরম্ভ করেছিলে, সেখানেও আমি তোমাকে অপমান করেছি। তোমার বন্ধু সম্পর্কে যা নয় তাই বলেছি। তোমাকে পাঁকে নামাতেও আমি দ্বিধা করিনি। এতটা নীচে নামতে পেরেছি আমি। মলি এতদিন আমি যা করে এসেছি সব ভুল করেছি! তুমি কেন কেউই সহ্য করতে পারত না। প্লিজ কিছু বলো মলি। আমাকে থাপ্পড় মারো, গালাগালি দাও, বাজে কথা বলো কিন্তু প্লিজ কথা বলো, কথা না বললে আমি ওখানে চলে আসব।, মলয় অনুনয় বিনয় করতে থাকে।

ফোনের ওপাশ থেকে মলির কান্না মলয়ের বুকের গভীরে ক্ষত আরও বাড়িয়ে তোলে।

আমি আসছি মলি তখন মন ভরে আমাকে  মেরে নিও কিন্তু তুমি আমার প্রাণ। আমাকে আমার প্রাণ ফিরিয়ে দাও। দিদিকে দিচ্ছি আমি বলে হিমানীকে ফোন ধরায় মলয়।

আর কাঁদিস না মলি, অনেক কেঁদেছিস তোরা দুজন। তুই আসার জন্য তৈরি থাকিস। মলয় ফিট হলেই ওকে নিয়ে যাচ্ছি, হিমানী বলে। ওপাশে কান্না বন্ধ হয়ে গিয়েিল, কিছু বলবি না মলি! হেসে জিজ্ঞেস করে হিমানী। না দিদি তোমরা এসো, ক্ষীণ স্বরে মলি উত্তর দেয়।

তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে নে, আমরা আসছি। বিয়ে দিয়ে নতুন বউ ঘরে তুলব। দুর্গাপুজো এবার কলকাতায় একসঙ্গে কাটাব ঠিক করেই রেখেছি। রানা তোদের নিয়ে অসম্ভব চিন্তায় রয়েে। ওকেও আনন্দের খবরটা জানাতে হবে। দিদির উপর বিশ্বাস রাখ মলি। তোর সংসার তোর প্রতীক্ষায় রয়েে। ব্যস শুধু নিজের বাড়ি ফিরে আয় মলি।

ঠিক আছে দিদি। তোমরা যা চাও তাই হবে, মলির স্বরে প্রাণ ফিরে এসেছে হিমানী ঠিকই ধরতে পেরেছিল।

নে ভাই, এবার তুইও সুস্থ হয়ে নে, তাড়াতাড়ি আমরা সবাই একসঙ্গে এলাহাবাদ যাব, হিমানী মলয়ের কপালের জলপট্টিটা বদলাতে বদলাতে মৃদু হেসে বলে।

মলয়কে ওষুধ খাইয়ে হিমানী উঠে গিয়ে স্বামীকে ফোন করল, মলি আর মলয়ের সুসংবাদটা দেবে বলে।

নতুন রাস্তা

অনেকদিন পরে সেদিন বাজারে হঠাৎই রেণুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। দুহাতে দুটো ভারী থলে। খুবই বিধবস্ত মুখচোখ। বাজার করার পরিশ্রম আর অফিসে যাওয়ার তাড়া– এই দুটো মিলেজুলেই নিশ্চয় মুখে অমন ঘর্মাক্ত ও পর্যুদস্ত ছাপটা পড়েছে।

রেণু আমাদেরই প্রতিবেশী। একই পাড়ায় আমাদের দীর্ঘকালের বসবাস। আমাদের উত্তর কলকাতার এই পাড়াগুলোয় পারস্পরিক সম্পর্কগুলো এখনও যান্ত্রিক হয়ে পড়েনি। দেখা হলে কেবল সৌজন্যের হাসি হেসে আমরা সরে পড়ি না, বরং দু-দণ্ড দাঁড়িয়ে কথা বলে মনের ভার হালকা করি।

রেণুর সঙ্গে আমার চেনাজানা, এ পাড়ার বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই। আমরা প্রায় সমবয়সি। তবে আমারও বছর দুই আগে ওর বিয়ে হয়। মফস্সলের মেয়ে। আমার মতোই। তবে খাস কলকাতায় এসেও দিব্যি মানিয়েগুছিয়ে নিয়েছে। মনে আছে, আমার বিয়ের সময় স্বেচ্ছাসেবা দেওয়ার জন্য পাড়ার যে ব্যাটেলিয়ান তৈরি ছিল, তার পুরোভাগে ছিল রেণু। হালকা পাখির মতো পায়ে কতবার তাকে একতলা-দোতলা করতে দেখেছি। খলবল করে গোটা অনুষ্ঠানবাড়িটা যেন মাতিয়ে রেখেছিল।

অতএব, প্রাণোচ্ছ্বল রেণুকে যথেষ্ট বিষণ্ণ দেখে আমি কৌতূহল চাপতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী হয়েছে গো?’

আমার প্রশ্নটাও শেষ হতে পায়নি, রেণু যেন উছলে পড়ল, ‘আর বোলো না কল্পনা। আমি খুব ঝামেলার মধ্যে আছি।’

‘কী ঝামেলা?’ আমি এবার সত্যি অবাক হই।

‘কী ঝামেলা, কী বলব! আমার শাশুড়ি একেবারে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছেন ভাই। হাড়মাস কয়লা হয়ে গেল। এখন অফিস করব, নাকি এইসব ঝামেলা সামলাব, তাই বুঝতে পারছি না!’

রেণুর শাশুড়ির ছবিটা তক্ষুণি চোখের সামনে ভেসে উঠল। ভদ্রমহিলা বিধবা। কিন্তু ষাটের কোঠা পেরিয়ে গিয়েও বেশ সুস্থ, সুঠাম। আর ভদ্রমহিলার ব্যাপারে সেটাই প্রথমে নজর কাড়ে।

বছরপাঁচেক আগে রেণুর স্বামী রজতদা হঠাৎ-ই তার মাকে বর্ধমানে দেশের বাড়ি থেকে শহরে নিয়ে আসেন। তখন একসঙ্গে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছিল আসলে। তার কিছুদিন আগেই রজতদার পিতৃবিয়োগ হয়েছে। ফলে দেশের বাড়িতে তার মা একেবারেই একা হয়ে পড়েছেন। আবার এদিকেও দুই ছেলে সামান্য বড়ো হয়ে যেতে রেণু চাকরি করার তাল ঠুকছে। অর্থাৎ উভয়েরই তখন পরস্পরকে প্রয়োজন।

সেই থেকে রজতদার মা এই পাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেলেন। বর্ধমানে সকলে ওকে বড়োমা বলে ডাকত। আগেকার যৌথ পরিবারে এ ধরনের প্রথা ছিল। পাড়াতেও সেই নামটাই স্থায়ী হয়ে গেল। অন্তত দুটো ভিন্ন প্রজন্ম এখন রজতদার মাকে ওই নামেই ডাকে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘বড়ো-মার কথা বলছ? বড়ো-মা কী করেছে?’

‘সেসব নিজের চোখে না দেখলে তুমি বিশ্বাস করবে না কল্পনা,’ রেণু বলল, ‘বরং নিজেই এসে একদিন দেখে যাও। সমীরদাকেও সঙ্গে এনো। আমি চলি, আমার আবার ওদিকে অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। সব দিকেই তো বিপদ–!’

নিজের মনে গজগজ করতে করতে লম্বা পা ফেলে বাজারের বাইরে চলে গেল রেণু। আমি ওর থলে হাতে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে পড়া শরীরের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলাম।

সংসার থাকলে তার নিজস্ব এক ব্যস্ততা থাকবেই। সেই জীবনে আমিও ব্যস্ত। ব্যস্ততা শুরু হয় ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই। মাথার পাশের বেডসাইড টেবিলের উপর মোবাইল ফোনে অ্যালার্ম দেওয়া থাকে। কেবল আমারটাতেই নয়, সমীরেরটাতেও। পাছে একবারের অ্যালার্মে পাকা ঘুম না ভাঙে, তাই এই ব্যবস্থা।

অ্যালার্ম বেজে উঠলে আমিও ধড়ফড় করে উঠে বসি। সমীর অবশ্য তারপরও আধঘণ্টা বিছানা ছাড়ে না। ওর চাই জ্যান্ত এবং প্রহারকারী অ্যালার্ম। অর্থাৎ আমি। কিচেনে সকালের ভাতটা চাপিয়ে, আঁচলে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে আমি যতক্ষণ না মশারি তুলে গলা ঝাঁঝিয়ে দুহাতে ঠেলা দিয়ে তাকে জাগাব, ততক্ষণ ওঠার নামও নেবে না সে। আমাদের ছেলেকে তামিলনাড়ুর এক আবাসিক স্কুলে দিয়েছি। ফলে কাউকে স্কুলের বাসে উঠিয়ে দেওয়ার ঝঞ্ছাট থেকে আমরা মুক্ত। কিন্তু দুজনেই অফিস যাই। ফলে সেজন্য প্রস্তুতিও নিতে সময় লাগে। শুধু সকালের খাবার তৈরি করলেই তো কাজ ফুরিয়ে যায় না। দুজনের লাঞ্চ তৈরি করে টিফিন বক্সে ভরার ব্যাপার আছে। তারই মধ্যে সবজিওলা এসে দরজায় হাঁকডাক করবে। ছুটির দিন ছাড়া বাজারে যাওয়া হয় না, ফলে এরাই ভরসা। প্রায় একই সময়ে চলে আসবে টুনির মা। সে প্রায় দশহাতে গোটা বাড়িতে দাপিয়ে বেড়ায় পরবর্তী পৌনে একঘণ্টা। একটা সাইক্লোন যেন ফোঁসফোঁস করে তোলপাড় তুলে দরজা খুলে অন্য কোনও বাড়ির দিকে উড়ে যায়। সকালটা যেন অগ্নিগর্ভ হয়ে থাকে।

এতকিছু সামলে বড়ো-মার কথাটা মন থেকে বেমালুম যেন উবে গেছিল। কোনও কোনও ছুটির দিনে বা সন্ধের অবসরে, টেলিভিশনে কোনও একঘেয়ে অনুষ্ঠান দেখতে দেখতে হঠাৎ করে মনে পড়ে গেলেও শরীর জোড়া ক্লান্তি দূরতিক্রম্য হয়ে দাঁড়াত।

রেণুদের বাড়ি আমাদের গলিটার ঠিক মুখে। খুব বেশি হলে হেঁটে আমাদের বাড়ি থেকে দু-মিনিটের রাস্তা। তবু আলস্য যেন দু-পা চেপে ধরত, অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর। রেণুকেও তারপর অনেকদিন বাজারে দেখিনি। আগে মাঝেমধ্যে সকালে অফিসযাত্রীদের বাসে ওকে দেখতে পেতাম। এখন বোধহয় রেণু অন্য কোনও ব্রাঞ্চে ট্রান্সফার হয়ে গেছে। কাজেই রুট বদল হয়ে গেছে তার।

পাকেচক্রে রেণুর কথাগুলো আমি হয়তো ভুলেই যেতাম। কিন্তু এক সন্ধ্যাবেলার একটা ঘটনা আমাকে আবার রেণু ও বড়ো-মার প্রসঙ্গ মনে পড়িয়ে দিল।

আমাদের বাড়ির কাছেই থাকে সোহিনীরা। পাশের পাড়ার মেয়ে। বিয়ে হয়ে আমাদের পাড়ার বাসিন্দা হয়। ছোটো ছোটো দুটি বাচ্চা আছে। ইংরেজিতে এমএ করার পর বাড়িতেই কিছু ছাত্রছাত্রীকে টিউশন দিত। কিন্তু দেখা হলেই বলত, ‘আমার চাকরি করার কী ভীষণ ইচ্ছা, জানো কল্পনাদি! কত অফার পাচ্ছি, ভাবতে পারবে না। কিন্তু নিতে সাহস হচ্ছে না। বাচ্চাদুটো তো ছোটো! কী করি বলো তো?’

ওর আগ্রহ আর হতাশার কথা শুনে চুপ করে থাকা ছাড়া আমার আর কিছু করার থাকত না। মেয়েদের জীবনটাই যে একছাঁচে গড়া। যেখানে আমার জীবন, সোহিনীর জীবন, আর-একটা মেয়ের জীবন মিলেমিশে একাকার।

শেষে সোহিনী নিজেই বলত, ‘ভাবছি কত তাড়াতাড়ি ছেলেদুটো একটু বড়ো হয়ে যাবে। কষ্ট করে লেখাপড়া শিখলাম, সে কি শুধু

সংসারের হেঁসেল ঠেলা আর বাচ্চাদের মানুষ করার জন্য? তুমিই বলো কল্পনাদি!’

আমি ম্লান হেসে ওকে স্ত্বান্না দিতাম, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখিস!’

তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। বাচ্চাদুটি এতদিনে নিশ্চয় একটু বড়ো হয়েছে। যদিও এখনও স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়নি ওদের। এইসময় হঠাৎ একদিন দুপুরে সোহিনী আমাদের বাড়িতে এল।

বেশ খুশি-খুশি দেখাচ্ছে ওকে। হাতের বড়ো ঝোলায় একটা কিছু আছে বলে মনে হচ্ছে। সম্ভবত কোনও বাক্স। আমাকে ধরে, ‘কল্পনাদি, ও কল্পনাদি, সুখবর আছে’ বলে একপাক নেচে নিল সোহিনী। তারপর ঝোলা থেকে বেশ বড়োসড়ো একটা মিষ্টির প্যাকেট বের করে ঢাকনা খুলে আমার সামনে ধরে বলল, ‘নাও মিষ্টি খাও–!’

আমি নিচ্ছি না দেখে ও ফের বলল, ‘কী হল কী, নাও–!

ইতস্তত করে একটা হাতে নিই, কিন্তু আমার ভুরুর ভাঁজ মেলায় না। চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করি, ‘ব্যাপারটা কী’ আমায় খুলে বল তো! তোরা কত্তা-গিন্নিতে মিলে আবার কোনও তৃতীয় জনকে পৃথিবীতে আনার মতলব কষেছিস নাকি? পরিবার পরিকল্পনার এ যুগেও? তোদের তো সাহস খুব!’

সেইসঙ্গে আমার মেয়েলি সন্ধানী চোখ সোহিনীর শরীরে হেঁটে বেড়ায়। এখনও গর্ভধারণের কোনও চিহ্ন ওর শরীরে দৃশ্যমান নয়।

ডাইনিং টেবিলের উপর মিষ্টির প্যাকেটটা সযত্নে রেখে দিয়ে সোহিনী ঘুরে দাঁড়াল। তারপর বিচিত্র এক মুখভঙ্গি করে বলল, ‘দেখেছ? এই হচ্ছে তোমাদের মতো নিপাট হাউসওয়াইফের দোষ। ওইটা ছাড়া আর অন্য কিছু ভাবতে পারো না। হরাইজনটা আসলে ছোটো হয়ে আসে।’

বিরক্ত মুখে বললাম, ‘যা, যা, মেলা বকিসনি। কী খবর, সেটাই খোলসা করে বল ঢং না করে–!’

আমার দু-কাঁধে চাপ দিয়ে সোফায় বসিয়ে সোহিনী আদুরে গলায় বলল, ‘বলছি, বলছি দাঁড়াও।’

তারপর আমার পাশে বসে পড়ে বলল, ‘তুমি তো জানো, আমার একটাই স্বপ্ন ছিল। চাকরি করব।’

‘ও, চাকরি পেয়েছিস বুঝি?’

‘আলবত। হেঁজিপেঁজি চাকরি নয় গো। মালটিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি। ভালো মাইনে দেবে। এবার আমিও সকালবেলা নাকেমুখে কোনওরকমে গুঁজে বড়োরাস্তার দিকে ছুটব। ঠিক নটায় বাসস্ট্যান্ডে কোম্পানির বাস এসে দাঁড়াবে। এসি বাস। আমায় তুলে নিয়ে হুস করে…!’

হাতের মুদ্রায় সোহিনী ‘হুস’ করে চলে যাওয়াটা কেমন, সেটা দেখায়। নতুন প্রাণস্ফূর্তিতে ও যেন মত্ত হয়ে আছে। দু-চোখ জুড়ে স্বপ্নপূরণের আনন্দ ঝিলিক দিচ্ছে।

হঠাৎ-ই বলল, ‘জানো কল্পনাদি, চাকরিটা হয়ে যাবে বলে কনফার্মেশনটা যে-মুহূর্তে পেয়েছি, অমনি শপিং মলে গিয়ে এক্বেবারে নতুন ডিজাইনের পাঁচটা চুড়িদার-কামিজ কিনে এনেছি। শাড়ি পরে তো আর এত দৌড়ঝাঁপ করা যায় না। মাঝেমধ্যে শাড়ি পরব। অফিসের কোনও অনুষ্ঠানে। কিংবা ধরো চুড়িদার পরতে পরতে একঘেয়ে লাগলে তখন। স্বাদবদলের জন্য।’

আমি কী বলি তা শোনার জন্য একগাল হিরের টুকরো ছড়ানো হাসি নিয়ে সোহিনী আমার দিকে চেয়ে রইল।

আমি গম্ভীর স্বরে বললাম, ‘সবই তো ঠিক আছে। কিন্তু বাচ্চারা? ওদের কি প্রেপ স্কুলে ভর্তি করে দিলি, নাকি কোনও ক্রেশ?’

সোহিনী হাসি ধরে রেখে বলল, ‘ক্রেশ কেন? বড়ো-মা আছে তো!’

নামটা শুনে আমি চমকে উঠলাম। ‘বড়ো-মা? বড়ো-মা এর মধ্যে আসছে কী করে?’

সোহিনীর মুখ থেকে হাসি মুছে গেল এইবার। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ওমা, তুমি জানো না?’

আমি অবাক হওয়া মুখ দুপাশে নেড়ে জবাব দিলাম, ‘না!’

সোহিনী বোধহয় আমার চেয়েও বেশি অবাক হল।

অবিশ্বাসীর হাসি হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘সত্যিই জানো না? তুমি কী গো? তুমি কি এ পাড়ায় থাকো?’

আমার মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করছিল। অনেকদিন আগে বাজারে দেখা রেণুর উদভ্রান্ত মুখটা মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল, প্রতিশ্রুতি দিয়েও শেষ পর্যন্ত রেণুদের বাড়িতে যাওয়া হয়নি ব্যস্ততার জন্য। আমি কৌতূহল দমন করে বললাম, ‘হ্যাঁ, বাজারে একদিন রেণুর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। ও তাড়ায় ছিল। সবটা খুলে বলতে পারল না। আমিও আর পরে জানতে চাইনি। মনে হল, বড়ো-মাকে নিয়ে ওরা খুবই ব্যতিব্যস্ত।’

‘দূর! রেণুদির কথা ছাড়ো তো! ওদের বড্ড বাড়াবাড়ি! আরে বড়ো-মা যা করছেন তাতে, আমাদের মতো মেয়েরা ওর কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে। রেণুদি এত কথা বলছে তো! রেণুদির নিজের কত সুবিধা হয়েছে বড়ো-মা এখানে থাকায়, সে-কথা কি একবারও রেণুদি স্বীকার করে?’

সোহিনী রীতিমতো ফোঁস করে ওঠে। মনে হল যেন, বড়ো-মার বিরুদ্ধে রেণুর অভিযোগ, সরাসরি সোহিনীর গায়ে গিয়েই লেগেছে। ফলে বেরিয়ে পড়েছে পাড়াতুতো রাজনীতির দাঁত-নখ। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘বড়ো-মার কথাটাই বল। উনি তোকে কীভাবে…!’

সোহিনী আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘রেণুদিদের বাড়িটা তো ফাঁকাই পড়ে থাকে সারাদিন। ওরা তো কত্তাগিন্নি দুজনেই অফিসে যায়। বড়ো-মা পাড়ার বাচ্চাদের সে সময়টা সামলান। সকলেই এ-পাড়ার বা পাশের পাড়ার চাকরি করা মহিলাদের সন্তান। শুনেছি, বাচ্চাদের পাল্সটা উনি খুব ভালো বোঝেন। প্রচুর যত্নআত্যি করেন। এখন তো সকলেই বাচ্চাদের রাখার জন্য ওঁর কাছে দৌড়োচ্ছে।’

বড়ো-মার কীর্তিকলাপের কথা শুনে আমার তো চোখ কপালে উঠেছে। রেণুর অভিযোগটা তাহলে নিতান্ত অন্যায্য নয়।

সোহিনীর কথা তখনও শেষ হয়নি। সে খুব রুষ্ট মুখে বলল, ‘বড়ো-মা আর নতুন কাউকে নিচ্ছে না জানো! ডিমান্ড তো খুব! আমি নেহাত পাড়ার বউ। তাই না করতে পারল না।’

সোহিনী বেশ খানিকক্ষণ গল্প করে চলে গেল। কিন্তু আমার ভাবনায় বড়ো-মা ঢুকে পড়লেন। রেণু এবং ওর স্বামী রজত– দুজনেই ভালো চাকরি করে। বড়ো-মাকেও যে তারা অবহেলা করে, এমন নয়। তাহলে বড়ো-মার কী উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে এহেন কার্যকলাপের মাধ্যমে? কী প্রমাণ করতে চান উনি? ছেলে আর বউমাকে সকলের চোখে এমন খাটো করে দেখানোর ভাবনাই বা তার মাথায় চেপে বসল কেন হঠাৎ?

সন্ধেয় সমীর বাড়ি ফিরতে ওকে প্রথমেই সোহিনীর জানানো কথাগুলো বলেছি। শুনে প্রথমে সে অবাক হল। তারপর মুখটা বিকৃত করল একটু। শেষে ভুরুতে সেই যে ভাঁজ পড়ল, সে ভাঁজ আর সিধে হল না।

খানিকক্ষণ গুম মেরে বসে থেকে সমীর বলল, ‘আমায় তুমি তো খুব চিন্তায় ফেলে দিলে কল্পনা। ছোটোবেলায় আমি আর রজত হরিহর আত্মা ছিলাম। এখনও আমাদের মধ্যে যথেষ্ট বন্ধুত্ব। তাই ওর ব্যথাটা আমার বুকে বড়ো লাগছে!’

আমি চুপ করে আছি দেখে, সমীর আমাকেই পালটা প্রশ্ন করল, ‘কী দরকার ছিল বলো তো বড়ো-মার এমন সব পাগলামো করার? এতে সমাজের সমালোচনার আঙুল যে ওরই ছেলে-বউমার দিকে উঠবে, একথা কি একবারও উনি ভাবলেন না?’

‘আমার কী মনে হয় জানো?’ আমি বলি, ‘আমাদের দুজনের একবার ওদের বাড়িতে যাওয়া উচিত। বড়ো-মাকে বোঝানো উচিত। উনি যেটা করছেন, সেটা ঠিক করছেন না। তুমি বোঝালে হয়তো উনি তার মূল্য দেবেন!’

সমীর মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল, ‘দেখা যাক।’

সেই সপ্তাহেই একদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে সমীর অন্য কোনও কারণে। সম্ভবত শরীরটা তার ভালো ছিল না সেদিন। দুপুরবেলা খাওয়াদাওয়ার পর বলল, ‘চলো বড়ো-মার কাছ থেকে ঘুরে আসি।’

দুপুর দুটো বাজে। সদর দরজা খোলাই ছিল। আমরা দোতলায় উঠতেই বাচ্চাদের নানারকম গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম। রেণুদের ড্রয়িংরুমের সামনে এসে দাঁড়তেই একঝলকে গোটা ছবিটা পরিষ্কার হয়ে গেল। ঘর জুড়ে দশটি প্রায় একই বয়সি বাচ্চা। কেউ ঘুমোচ্ছে। কেউ বা দুষ্টুমি করছে। খেলনা নিয়ে খেলছে কেউ। খোদ বড়ো-মা একটি বাচ্চাকে কোলে নিয়ে, দুধের বোতল থেকে দুধ পান করাচ্ছেন। আর-এক মধ্যবয়সিনি অন্য বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত।

বড়ো-মাকে দেখতে অদ্ভুত লাগছে। মুখ থেকে যেন একটা জ্যোতি বের হচ্ছে। স্নেহের বিভা। আমরা থতোমতো খেয়ে দরজার গোড়ায় দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ মুখ তুলে আমাদের দেখতে পেয়েই বড়ো-মা উদার আমন্ত্রণ জানালেন।

‘আরে, সমীর? বউমা? এসো, এসো ভিতরে এসো। বাইরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? মালতী একে ধর। দেখিস দুধটা যেন পুরোটা খায়।’

মালতীর হাতে কোলের বাচ্চাটিকে তুলে দিয়ে বড়ো-মা উঠে দাঁড়ালেন।

‘ও হল মালতী। সাতকুলে কেউ নেই ওর। তাই জুটে গেল। একা একা এতগুলো বাচ্চাকে সামলানোর বয়স কি আর আছে?’

বড়ো-মা আমাদের ভিতরের ঘরে নিয়ে গেলেন। সমীর সোফায় বসে বলল, ‘আপনি তো রীতিমতো ক্রেশ চালু করে দিয়েছেন দেখছি বড়ো-মা!’

বড়ো-মা তৃপ্তির হাসি হাসলেন। মালতীকে ডেকে বললেন, ‘তোমার হাত খালি হলে ফ্রিজ থেকে মিষ্টি নিয়ে এসো তো মালতী!’ তারপরই আমাদের দিকে ফিরলেন, ‘খুব ভালো লাগে জানো। মনটা পবিত্র হয়ে যায়। বয়স তো হল। পরমার্থের সন্ধান করার এখনই তো প্রকৃষ্ট সময়।’

আমি জানতে চাইলাম, ‘আপনি হাঁফিয়ে পড়েন না? এতগুলো বাচ্চাকে সামলানো তো মুখের কথা নয়। তাই না?’

‘দ্যাখো, নিজের নাতি-নাতনিদের জন্যও কি কম দৗড়ঝাঁপ করেছি? এক-একটার আবদার শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যায়। এখন তবু মালতী আছে। তখন তো আমি একা। ওরা দুজন চলে যেত অফিসে, সারাদিনের মতো। এখন নিজের নাতি-নাতনি বড়ো হয়ে গেছে। তাই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ করছি আর কী! এদেরকেই নাতি-নাতনি বানিয়ে ফেলেছি। জানো, ওদের মায়েরা বলে, বাচ্চাদের অনেকে নাকি রাতেও বায়না ধরে, বড়ো-মার কাছে শোবো। বোঝো অবস্থা!’

বড়ো-মার মুখটা একথা বলতে গিয়ে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

সমীর জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা-মায়েরা এদের নিয়ে যায় কখন?’

‘সন্ধে ছটার মধ্যে গোটা তল্লাট ফাঁকা হয়ে যায়। মালতী সব গুছিয়ে নীচে ওর ঘরে চলে যায় বিশ্রাম করতে। রেণু আর রজতও ফিরে আসে আধঘণ্টার মধ্যে। বাচ্চারা অবশ্য তার অনেক আগেই স্কুল থেকে ফেরে।’

আমি ক্রমশ অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম এরকম অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা শুনে। ভাবছিলাম, কেন এতক্ষণেও আসল বক্তব্যে আসতে পারছে না সমীর। অফিসে সে সপ্তাহে দশটা মিটিং করে। তার তো মূল বক্তব্যে আসতে এত সময় লাগারই কথা নয়।

আমিই শেষে অসহিষ্ণুতাটা প্রকাশ করলাম। বললাম, ‘কিন্তু বড়ো-মা… আপনার তো এখন বিশ্রাম নেওয়ার বয়স। কী দরকার ছিল বলুন তো এসব ঝামেলা নেওয়ার? পৃথিবীতে আপনার বয়সি অনেক দুর্ভাগা নারী আছেন। যাদের ছেলেমেয়ে, বউমারা তাদের দেখে না। তারা যদি এরকম ক্রেশ খোলেন, তবু মানা যায়। তাই বলে আপনি?’

আমি একটানা ক্ষোভ উগরে দিয়ে হতাশায় মাথা নাড়ি।

তাকিয়ে দেখি, বড়ো-মার মুখ থেকে তখনও হাসি লোপ পায়নি। হ্যাঁ, ভুুরুদুটো একটু বেঁকেছে। কিন্তু ওটুকুই।

শেষে বললেন, ‘এবার তাহলে তোমায় একটা প্রশ্ন করি মা?’

আমি বিরক্ত মুখে বললাম, ‘করুন।’

‘তোমার বাবা-মা তো তোমার দাদা-বউদির সঙ্গে থাকেন। ওঁরা সুখী?’

একটা ধাক্বা লাগল ওর প্রশ্নে। মনটা নিমেষে বিষণ্ণ হয়ে গেল। আমার বৃদ্ধ বাবা ও মায়ের মুখটা ভেসে উঠল চোখের পর্দায়। ‘মা কেমন আছো’, জিজ্ঞেস করলে মা করুণ মুখটা তুলে যেভাবে বলে ‘ভালো আছি’, সেই স্তোক দেওয়ার ছবিটা মনে পড়ল। আমি জানি, মা-বাবা ভালো নেই দাদা-বউদির সংসারে। দুজনেই প্রাণপণে চেষ্টা করে চলেছেন বাস্তবের সঙ্গে আপস করার। আমি বুঝতে পারি ওরা ভালো নেই। আমরা কখনও গেলে বউদি ওদের সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করার চেষ্টা করে। কিন্তু সেটা চেষ্টাই। কোনও কোনও প্রসঙ্গে, ছিটকে বের হয় বাবা-মায়ের প্রতি বউদির অশ্রদ্ধা আর নৈরাশ্য। আমরা সামনে আছি বলে বউদি দ্রুত সামলে নেয় নিজেকে, কিন্তু বাবা ও মায়ের বেদনাটা তাতে চাপা পড়ে না। বিয়ের পর সব মেয়েই বাপের বাড়ির অতিথি। অসহায় হয়ে হাত কামড়ানো ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না তখন আমার।

বাপের বাড়িতে মেয়েরা আনন্দ করতে যায়। আমি ফিরে এসে বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদি।

এই মুহূর্তে বিষণ্ণতায় আমার মনটা দ্রব হয়ে যায়। চোখদুটিও নত হয়ে আসে। মনের গভীরে কোনওমতে কান্না সামলাই।

বড়ো-মা হয়তো বোঝেন। মৃদু হেসে মাথায় হাত রাখেন। চমকে উঠে তাকাই বড়ো-মার দিকে।

শান্ত গলায় বড়ো-মা বললেন, ‘যতই লুকোনোর চেষ্টা করো, চোখের জলকে লুকোবে কী করে? বয়স্ক মানুষদের অবস্থাটা এখন এরকমই। একটা কথা বলি। তোমার নিজের উপরে যখন এরকম বৃদ্ধবৃদ্ধাদের দায় পড়বে, তখন এই চোখের জলের কথা মনে রেখো মা!’

সমীর কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বড়ো-মা তখনই তার দিকে ফিরে বললেন, ‘আসলে কী জানো বাবা, স্বামীর উপার্জন কিংবা তার মনের উপর স্ত্রীর যতটা অধিকার, ততটা অধিকার মায়ের আর থাকে না। সেইজন্যেই আমার মনে হয়, তাদের আত্মনির্ভর হওয়াটা খুব জরুরি। আর, পরিশ্রমের কথাই যদি বলো, সেটাও অতটা গায়ে লাগে না। বাড়িতে বসে বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটানো– এই তো কাজ! অথচ দ্যাখো, আমার বউমা কত খাটাখাটনি করে–!’

বড়ো করে শ্বাস নিলেন বড়ো-মা।

জিজ্ঞেস করলাম, ‘আর কেউ ভর্তি করতে চাইছে না বাচ্চাদের?’ ‘চাইছে তো! রোজই কত মানুষ আসে। অনেককে তো চিনিই না। এসে বলে, বড়ো-মা আমাদের বাচ্চাকেও রাখুন। মোড়ের রিকশাস্ট্যান্ডে বড়ো-মার ক্রেশে যাব বললেই, রিকশাওলা নাকি পৗঁছে দেয় এ বাড়িতে। কিন্তু আমি আর অন্য কাউকে নিতে পারব না কল্পনা। আমার তো অর্থের খুব চাহিদা নেই!’

আমরা দুজনেই প্লেট থেকে একটা করে সন্দেশ তুলে মুখে ফেলেছিলাম। মালতী দু-গ্লাস ঠান্ডা জল এনে দিল।

বড়ো-মা বললেন, ‘এবার শীতের ছুটিতে আমরা ক’জন বেড়াতে যাচ্ছি। একটা টুরিস্ট কোম্পানির সঙ্গে। তোমার বাবা-মাকেও বলো না কল্পনা। যদি ওরা আমাদের সঙ্গে যান, খুব ভালো লাগবে।’

আমি বিব্রত হওয়ার মতো চোখ করে সমীরের দিকে তাকাই। দাদা-বউদি যে মা-বাবাকে ছাড়তে রাজি হবেন না, সেকথা আমি যেমন জানি, সমীরও জানে।

তবু ও হঠাৎ বলে উঠল, ‘আমি কথা দিচ্ছি। ওরা যাবেন। আমি শিগগিরি ওদের সঙ্গে কথা বলব বড়ো-মা। আপনি পুরোনো যুগের মানুষ। কিন্তু আজ আমার চোখ খুলে দিয়েছেন।’

সমীর আবেগে আমার হাত চেপে ধরল।

——-

মূল্যায়ন

সৌগত তাড়াতাড়ি সব কাজ শেষ করে তৈরি হয়ে বেরোতে যাবে, কেট জিজ্ঞেস করল, এখনই যাচ্ছ? জুতো পায়ে গলাতে গলাতে সৌগত উত্তর দিল, হ্যাঁ, আর কী, দুঘন্টা তো এয়ারপোর্ট পেঁছোতেই লেগে যাবে।

সৌগত কিছুতেই উত্তেজনা চেপে রাখতে পারছে না। সামনেই সোফাতে ওর দুই ছেলে-মেয়ে চুপচাপ বসে বাবাকে লক্ষ্য করেলেমেয়ে কারওকেই বাবার এই উত্তেজনা স্পর্শ করেছে বলে মনে হল না। পাথরের মতো দুজনে বসে রইল।

সৌগত ইশারায় স্ত্রীর কাছে, ছেলে-মেয়ে চুপ করে থাকার কারণ জানতে চাইল। কেটও ইশারাতেই জানাল চিন্তা না করে, এয়ারপোর্টের জন্য রওনা হতে। সৌগত-র মধ্যে দ্বিধার ভাব লক্ষ্য করে আশ্বাসের সুরে বলল, দেরি কোরো না। মা বাবাকে যতক্ষণে নিয়ে বাড়ি ফিরবে, তার মধ্যে আমরা সবাই চানটান করে রেডি হয়ে থাকব।

একুশ বছর হয়ে গেছে, এই প্রথম শোভনবাবু আর গৌরীদেবী একমাত্র সন্তান সৌগতর গোছানো সংসার একবার চোখের দেখা দেখতে লন্ডন আসছেন। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সেই যে চাকরি নিয়ে বিদেশ এসেছে, আর ফিরে যায়নি সৌগত।

প্রথম এসেই লন্ডনের রিচমন্ড এলাকায় এক কামরার একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিল সে। নীচে বাড়িওয়ালারা থাকতেন আর উপরের একটা ওয়ান রুম কিচেন বাথরুম নিয়ে সৌগত ভাড়াতে থেকে গিয়েছিল। ঘরটা ভারি পছন্দ হয়ে গিয়েছিল তার। ঘরের এক দিকটায় বড়ো বড়ো কাচের জানলা ছিল, যেখানে দাঁড়ালে টেমস নদীটা নজরে পড়ত।

সেসময় ভাড়াও খুব বেশি ছিল না। বাড়িওয়ালার একমাত্র মেয়ে কেট দিব্যি ভাব জমিয়ে ফেলেছিল সৌগতর সঙ্গে। যেদিন অফিস থেকে ফিরতে একটু বেশি দেরি হয়ে যেত সৌগতর, কেট এসে মেন গেট খুলে দিত। গুছিযে রাতের খাবারটা হাতে ধরিযে দিত যাতে, রাত্রে আর সৌগতকে হাত পুড়িয়ে রান্না না করতে হয়।

বিদেশে যেখানে দুটো মনের কথা বলার জন্য মানুষ ব্যাকুল হয়ে ওঠে, সেখানে কেটের মিষ্টি স্বভাব, অপরকে সাহায্য করার মানসিকতা সহজেই সৌগত-র হৃদযে জায়গা করে নেয়। দুজনেই একে অপরের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ বোধ করতে থাকে। কেট মুখে কিছু না বললেও, তার চোখের ভাষা পড়তে সৌগতর ভুল হয় না।

কেটকে বিয়ে করায় মনস্থ করলে, সব থেকে বড়ো চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় সৌগতর কাছে নিজের মা-বাবা। ব্রাহ্মণ পরিবারের ছেলে হয়ে বিদেশিনি খ্রিস্টান মেয়েে বিয়ে করার অনুমতি বাবা কখনও দেবেন না বলেই সৌগত ভেবে নিয়েছিল। পুরোনো দিনের মানুষ তাঁরা। কেটের মা-বাবা সৌগতর মতো জামাই পাবেন বলে আপত্তি করেননি। কিন্তু নিজের মা-বাবাকে কী বলবে সেটাই ভাবতে তিনদিন সময় নিয়েছিল সৌগত।

শেষে মনে সাহস সঞ্চয় করে কলকাতায় নিজের বাড়িতে ফোন করেছিল সে। সোজাসুজি তখন ফোন করার অসুবিধা ছিল। ট্রাংক কল বুক করতে হয়েছিল। বাবা ফোন ধরতেই বিয়ে প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছিল সৌগত। কিছুক্ষণ চুপ করেছিলেন শোভনবাবু। তারপর মাযে সঙ্গে কথা বলে জানাবেন বলে ফোন ছেড়ে দিয়েছিলেন।

তারপরের দশটা দিন সৌগতর কী যে অস্থিরতায় কেটে ছিল, আজ ভাবলে হাসি পায়। কিন্তু ফোন করেননি শোভনবাবু বরং মাযে লেখা চিঠি পেয়েছিল সৌগত। ওনাদের শুধু একটাই শর্ত, মেয়ে এবং মেয়ে বাড়ির লোককে কলকাতায় আসতে হবে। বিয়ে কলকাতাতেই হবে। সৌগত শর্তে রাজি হয়ে গিয়েছিল। কলকাতাতেই ধুমধাম করে কেটের সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেন শোভনবাবু আর গৌরীদেবী।

বিয়ে দুবছর পর অন্বেষার জন্ম আর পাঁচ বছরের মাথায় অনির্বাণের। ছেলে সংসারে মন দিয়েছে, বিদেশে ছেলেকে দেখাশোনা করার জন্য লক্ষ্মীসম বউমা রয়েছে ভেবেই গৌরীদেবীর মন আনন্দে ভরে উঠত। এর মধ্যে নাতি-নাতনি হওয়ার সুখবর তাঁদের স্বামী স্ত্রী দুজনকেই নতুন করে খুশির সীমাহীন জগতে নিয়ে গিয়ে ফেলে। নাতি-নাতনীর মুখ দেখার জন্য উৎসুক হয়ে ওঠেন। ছেলের আসার অপেক্ষায় দুজনে দিন গুনতে থাকেন।

এরই মধ্যে চাকরি ছেড়ে সৌগত কেটের বাবার প্রকাশনা ব্যাবসায় ঢুকেছে তাঁরই অনুরোধে। দিনরাত খেটে ব্যাবসাকে এমন পর্যায়ে দাঁড় করিযেছে সৌগত, যেখানে লন্ডনের মান্যগণ্যদের মধ্যে সৌগতকে চেনে না এমন কেউ নেই। বাড়ি আলাদা করে আর কিনতে হয়নি তাকে। একমাত্র মেয়েজামাইকে উইল করে বাড়ি লিখে দিয়েছেন কেটের বাবা। তিনি আর তাঁর স্ত্রী অবসর জীবনযাপন করছেন সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়ে। ব্যাবসার দাযিত্ব পুরোটাই সামলাচ্ছে সৌগত।

সময় পেলেই কেট আর বাচ্চাদের নিয়ে কলকাতায় ঘুরে যাওয়াটাও এতদিন দাযিত্ব মনে করেই পালন করেছে সৌগত। কখনও তাঁদের অবহেলা করেনি। লন্ডনে থেকেও নিজে এবং কেট প্রায় প্রতিদিন ফোনে খবরাখবর নিতে ভোলেনি শোভনবাবুর আর গৌরীদেবীর। কিন্তু বাচ্চারা যখন থেকে বড়ো হয়েছে ওদের পড়াশোনা, অন্য কোথাও ছুটি কাটাবার আগ্রহ ইত্যাদি নানা কারণে কলকাতায় যাওয়া-আসাটা অনেকটাই কমিয়ে ফেলতে হয়েছে সৌগতকে।

গতবছর পুজোর আগে কেট কলকাতার খবরাখবর নেওয়ার জন্য ফোন করলে, গৌরীদেবী মনের ইচ্ছেটা প্রকাশই করে ফেলেন কেটের কাছে, কেট অনেকদিন হয়ে গেল তোমরা ইন্ডিয়া আসোনি। এবার শীতে কিছুদিনের জন্য ঘুরে যাও। তোমাদের সকলকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

কেট কিছুটা ইতস্তত করে জবাব দেয়, না মা এখন কিছুতেই আসা সম্ভব নয়। বাচ্চাদের ক্লাস এখন একেবারেই মিস করানো যাবে না।

ওপারের স্তব্ধতা কেটকে বিচলিত করে। একটু ভেবে হঠাৎই বলে, মা আপনারা বরং এখানে চলে আসুন। সকলকে দেখা হবে আর একটু ঘোরাও হয়ে যাবে। কলকাতা ছেড়ে আপনারা তো কোথাওই যান না। চলে আসুন। আপনার ছেলেকে বলব সব ব্যবস্থা করে দেবে।

ব্যস তারপর দৌড়োদৌড়ি, ভিসার কাগজপত্র জমা দেওয়া, আরও যা কিছু করণীয়। সবশেষে আজ শোভনবাবু আর গৌরীদেবী সুদূর লন্ডনে পা রাখতে চলেছেন। প্রথম বিলেত সফর সুতরাং উত্তেজনায় দুজনেই প্লেনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গহ্বরেও ঘেমে নেয়ে উঠছেন।

 

সৌগত অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল, প্লেন কখন ল্যান্ড করবে। দূর থেকে বাবাকে আগে দেখতে পেয়ে হাত নাড়ল সৌগত। শোভনবাবু একটু স্বস্তি বোধ করলেন। এই দূর অচেনা মাটিতে তাঁর আসার ইচ্ছে একবিন্দুও ছিল না। কী করবেন, স্ত্রীর জোরাজুরিতে আর ছেলে-বউমার বারবার অনুরোধে তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতেই হল।

ভিড় ঠেলে সৌগত এগিয়ে এল। বাবার হাত থেকে ব্যাগেজের ট্রলিটা জোর করে নিজের হাতে নিতেই মা এসে জড়িয়ে ধরলেন ছেলেকে। চোখের জল বাঁধ মানল না। একমাত্র সন্তানকে কাছে পাওয়ার আনন্দ অশ্রু হয়ে গড়িয়ে পড়ল গৌরীদেবীর দুচোখ বেযে সৌগতও চোখের ভেজা ভাবটা অনুভব করল। পরিস্থিতি হালকা করতে মা-কে জড়িয়ে ধরে মুখে হাসি টেনে বলল, মা, তুমি সবে এসেছ। তোমার কান্না দেখে সবাই ভাববে তোমাকে সব কিছু ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে।

বাড়ির পথে অবাক হয়ে তাকিযে রইলেন শোভনবাবু আর গৌরীদেবী গাড়ির কাচে চোখ রেখে। হুহু করে পেরিযে যাচ্ছে রাস্তা। চারিদিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, রাস্তায় কুকুর বেড়াল চোখে পড়ে না। সর্বত্র অনুশাসনের ছাপ স্পষ্ট। রাস্তার ধারে ধারে সবুজের সমারোহ মন কেড়ে নেয়। হর্নের কান ফাটানো আওয়াজ, ট্র‌্যাফিকের ভিড় নেই কোথাও।

অন্যমনষ্কতা ভাঙল সৌগতর কথাতে। হাঁ করে কী দেখছ তোমরা? আজ তোমাদের ভাগ্য ভালো যে রোদ উঠেছে নয়তো বেশিরভাগ সময়ই বৃষ্টির আবহাওয়া থাকে এখানে।

গেটের কাছে দাঁড়িয়ে কেট ওনাদের আসার অপেক্ষা করছিল। গাড়ি এসে দাঁড়াতেই সানন্দে গেট খুলে কেট ওনাদের বাড়ির ভিতরে স্বাগত জানাল। সৌগত গাড়ি থেকে সুটকেস নামিয়ে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেল। নীচের তলাতেই একটা বড়ো ঘরে কেট ওনাদের থাকার ব্যবস্থা করে রেখেছিল। সুটকেসগুলো ওই ঘরে দিয়ে ওনাদের ফ্রেশ হতে বলে কেট চা-জলখাবার আনতে কিচেনে চলে গেল।

সৌগত বাথরুমে গরমজলের ব্যবস্থা সব দেখিযে বাইরে এসে বসল। দুজনে হাত-মুখ ধুযে ঘাড়ে মাথায় সামান্য গরমজল বুলিযে নিলেন। তাতে ধকলটা একটু কম মনে হল। বাইরের পোশাক ছেড়ে সুটকেস খুলে পরিষ্কার জামা-কাপড় বার করে পরে বাইরে এলেন।

সৌগত সোফাতেই বসে ছিল। কেট জলখাবারের ট্রে হাতে নিয়ে ঢুকে টেবিলে নামিয়ে ওনাদের সামনে খাবার আর চায়ের কাপটা এগিয়ে দিল।

কী ব্যাপার অন্বেষা আর অনির্বাণকে দেখছি না কেন? ওরা কোথায়? গৌরীদেবী আর শোভনবাবুর চোখ আদরের নাতি-নাতনিকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল।

সৌগত ওদের নাম ধরে ডাকতেই দুজনে উপর থেকে নীচে নেমে এল। চোখের ইশারায় ওদের ঠাকুমা-ঠাকুরদাকে প্রণাম করার কথা বলতে, দুজনে প্রণাম করে দাঁড়াতেই ওদের বুকে টেনে নিলেন দাদু-ঠাকুমা।

অন্বেষা আর অনির্বাণ তোমরা কত বড়ো হয়ে গেছ! কলকাতায় শেষ যখন এসেছিলে তখন বেশ ছোটো ছিলে। কতদিন হয়ে গেছে তোমাদের দেখিনি। বলতে বলতে চোখে জল চলে আসে গৌরীদেবীর।

অথচ এই ইমোশন যেন ছুঁতে পারে না বিদেশের মাটিতে বড়ো হওয়া অন্বেষা আর অনির্বাণ-কে। পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকে দুজনে, মুখে ফুটে ওঠে বিরক্তির ভাব। দুজনের ব্যবহারে মনে মনে বিরক্ত বোধ করে সৌগত। ভিতরে ভিতরে রাগ বাড়তে থাকে তার। কুশল বিনিময়টুকু করতে ভুলে গেছে কী করে তার সন্তানেরা। কেট মুহূর্তে পড়ে ফেলে সৌগতর মন। পরিস্থিতি সামাল দিতে ছেলেমেয়ে দিকে তাকিযে কেট বলে, তোমরা এখন যাও, পড়াশোনা শেষ করো।

ছোটো থেকেই কেট ভারতীয় সংস্কৃতিকে ভালোবেসে এসেছে। বাড়ির আশেপাশে বহু ভারতীয় পরিবারকে খুব কাছের থেকে দেখেছে। সৌগতর সঙ্গে বিয়ের পর সেই ভালোবাসা আরও গাঢ় হয়েছে। ফলে সৌগতর মা-বাবাকে আপন করে নিতে এতটুকু অসুবিধা হয়নি কেটের। শ্বশুর-শাশুড়ির থেকেও পেয়েছে স্নেহের উষ্ণতা। সবাইকে নিয়ে সুন্দর সংসার গড়ে তোলার পরিকল্পনা সবসমযে কেটের মনের মধ্যে লালিত হয়েছে। কিন্তু এই একটা জায়গায় এসে সে হেরে গেছে। দুই সন্তানকে যেমনটা চেযেছে তেমন করে মানুষ করতে পারেনি। সে নিজেও এই বিদেশের মাটিতে জন্মেছে কিন্তু বড়োদের অসম্মান করার মানসিকতা কখনও তার হয়নি।

পাশ্চাত্য দেশের ছেলেমেয়েরা অনেকটাই আলাদা। নিজের শিকড়কে অস্বীকার করে বিদেশের সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরার মানসিকতা প্রবল তাদের মধ্যে। অন্বেষা এখন আঠারো বছরের আর অনির্বাণ পনেরো। কিন্তু বিদেশের আদব-কায়দা তাদের রক্তের ভিতর ঢুকে গেছে। কেটের ক্ষমতা নেই তাদের সেখান থেকে বার করে নিয়ে আসে।

শোভনবাবু আর গৌরীদেবী কিছুটা পরিবেশের সঙ্গে ধাতস্থ হলে, সৌগত আর কেট ওনাদের নিয়ে উইক-এন্ডে সারা লন্ডন ঘুরিযে ঘুরিযে দেখিযে নিয়ে এল। লন্ডনের মিউজিয়াম দেখে শোভনবাবু একটাই মন্তব্য করলেন, এই ব্রিটিশরা শুধু ভারতবর্ষকে নয়, সমগ্র বিশ্বকে লুঠ করে নিজের দেশকে ধনী বানিয়েছে।

 

শোভনবাবুদের আসার তিন সপ্তাহ পার হয়ে গেছে। সৌগতর সময় না হলেও কেট ওনাদের নানা জায়গায় ঘুরিযে এনেছে। ভারতীয় সংস্কৃতির তুলনায় লন্ডনের সংস্কৃতি যে সম্পূর্ণ ভিন্ন, তা এতদিনে বেশ বুঝতে পেরেছেন শোভনবাবুরা। এখানে সবাই ব্যস্ত। কারও জন্যই কারও কাছে সময় নেই। সন্তানদের নিজেদের জীবন নিয়ে ভাবার স্বাধীনতা দেওয়া আছে। মা-বাবার সেখানে কিছু বলা চলবে না। বিয়ে আগে একসঙ্গে থাকা বা পছন্দ না হলে ছেড়ে চলে যাওয়াটা এখানে কেউ গুরুত্ব দিয়ে দেখেই না। অদ্ভুত এক মিশ্র সংস্কৃতির বাড়-বাড়ন্ত। যা-কিনা গৌরীদেবী বা শোভনবাবু কেউই মন থেকে মেনে নিতে পারছিলেন না কিছুতেই।

প্রথমে এসেই গৌরীদেবী খেযাল করেছিলেন, সৌগত আর কেট কেউই সকালে অফিস যাওয়ার সময় খেযে বেরোয় না। একদিন না থাকতে পেরে বলেই ফেললেন, তোদের সময় না থাকে, আমি সকালে কিছু একটা বানিয়ে দেব। এভাবে না খেযে সারাদিনের জন্য বেরোনো উচিত নয়।

এতে সৌগত হেসে উত্তর দিয়েছিল, মা তুমি মিথ্যা চিন্তা করছ। আমরা রাস্তা থেকে স্যান্ডউইচ আর কফি কিনে খেযে নিই। দুপুরেও অফিসে আর সবার মতো পাশেই একটা রেস্তোরাঁ থেকে খাবার নিয়ে এসে অফিসেই খেযে নিই। কেট-ও তাই করে। বাবা আর তুমি টিভি দ্যাখো, এনজয় করো। আমাদের নিয়ে ভেবো না। এই লাইফে আমরা অভ্যস্ত।

আর কিছু বলেননি গৌরীদেবী। ছেলের সংসার যেমন চলছিল তেমনিই চলতে লাগল। বাচ্চারা স্কুল, কলেজ বেরিযে যেত, সৌগত নিজের ব্যাবসা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল আর কেট বাড়ি আর অফিস একসাথে সামলাতো।

কিছুদিন ধরে গৌরীদেবী দেখছিলেন অন্বেষা যখন কলেজ থেকে ফেরে, একটা কালো মতন ছেলে ওকে ছেড়ে দিয়ে যায়। অন্বেষার থেকে বয়সে অনেকটাই বড়ো মনে হল ছেলেটিকে। একদিন সন্ধেবেলা জানলায় দাঁড়িয়ে বাইরের শোভা দেখছিলেন গৌরীদেবী। হঠাৎ-ই খেযাল হল রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা একটা গাড়ির আড়ালে, অন্বেষা আর ছেলেটি গভীর চুম্বনে ব্যস্ত।

পায়ে তলার মাটি কেঁপে উঠল তাঁর। কী বয়স অন্বেষার আর এখনই এইসব করে বেড়াচ্ছে! তারপরেই মনে হল যে-দেশে বড়ো হচ্ছে বাচ্চারা, সেখানকার সংস্কৃতিকেই ওরা আপন করে নেবে, এতে দোষটা কোথায়? ওরা তো যেমন দেখবে তেমনই শিখবে। অগত্যা চুপ করে গেলেন, কাউকে কিছু বলা উচিত মনে করলেন না।

শুধু নিজের স্বামীকে না জানিয়ে পারলেন না, এই তো একটা বাচ্চা মেয়ে, কোনও ভুল পথে পা দেবে না তো? শোভনবাবু স্ত্রীকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, এত চিন্তা কোরো না, কিছু একটা উপায় বার করতে হবে! আমি দেখছি কী করা যায়।

 

সকাল সকাল চায়ের কাপ হাতে নিয়ে গৌরীদেবী ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। দূর পর‌্যন্ত বিস্তৃত রিচমন্ড হিল এবং টেম্স নদীর সৌন্দর‌্য এক মনে অবলোকন করছিলেন। সেন্ট পিটারস্ চার্চ-টা এখান থেকেই চোখে পড়ে আর তার চারপাশে মনোরম সবুজ ঘাসের গালিচা মুহূর্তে মন উদাস করে দেয়।

কিন্তু প্রকৃতির এই অপরূপ শোভা কিছুতেই গৌরীদেবীর মনকে শান্ত করতে পারছিল না। গত সন্ধের দৃশ্যটা বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। মনে মনে উদ্বিগ্ন বোধ করছিলেন। খানিক পরে কেটও চায়ের কাপ নিয়ে গৌরীদেবীর পাশে এসে দাঁড়াল। কিছুটা সংকোচ কাটিযে সন্ধের ঘটনাটা খুলেই বললেন কেটকে, তোমাকে না বলে পারলাম না তুমি মা। ও আমাদের বাড়ির সন্তান। ঘটনাটা এড়িয়ে তো যেতে পারি না।

তুমি ঠিক বলেছ মা। তোমার চিন্তা করাটাই স্বাভাবিক। অন্বেষা যেটা করেছে অন্যায়, আমি সেটা বুঝি। কিন্তু এখানে আমরা কিছুই বলতে পারব না কারণ এটা ওর জীবন। এখানকার সংস্কৃতি ভারতীয় সংস্কৃতির থেকে অনেক আলাদা। ছোটো থাকতেই এখানে ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়ে যায়। অনেক সময় সেটা বিয়ে অবধিও গড়ায়। আবার কখনও সম্পর্ক ভেঙেও যায়। এটা ওদের সম্পূর্ণ নিজস্ব ডিসিশন। এটা আমাদের হাতের বাইরে। খুব অল্প শব্দের মধ্যে কেট ওযে্টার্ন সংস্কৃতির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ শাশুড়িকে পরিষ্কার করে বুঝিযে দিল ঠিকই কিন্তু গৌরীদেবী কিছুতেই এটা মন থেকে মেনে নিতে পারলেন না।

কলেজের জন্য তৈরি হতে হতে মা আর ঠাকুমার কথাবার্তা সবই অন্বেষার কানে এসেছিল। সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুমার এই অনাবশ্যক নাক গলানো ওর কাছে অসহ্য মনে হল। অন্বেষা ব্যালকনিতে এসে কেটকে লক্ষ্য করে বেশ জোর দিয়ে বলল, মম, আজ সন্ধে বেলায় ফিরতে আমার দেরি হবে। আমি আমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে একটা পার্টি-তে যাব। আমার ফেরার অপেক্ষা কোরো না, বলে ব্যাগ নিয়ে বেরিযে গেল।

সবাই সবার মতো কাজে বেরিযে গেলে শোভনবাবু খবরের কাগজ নিয়ে বসতেন। খবরের কাগজের নানা ঘটনা নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করতেন। তাতেই গৌরীদেবী আরও বেশি করে ওখানকার কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে নানা ধরনের মানসিক সমস্যা বাড়তে থাকার ঘটনাগুলো সম্পর্কে জানতে পারতেন। ওখানকার ছেলেমেযো অল্প বয়সেই অবসাদের শিকার, কিশোরাবস্থায় গর্ভধারণ, হিংসাত্মক প্রবৃত্তি, অসামাজিক ব্যবহার, ছোটো থেকেই ড্রাগ ও মাদকদ্রব্যে আসক্তি বাড়া ইত্যাদি নানা খবর গৌরীদেবীকে আরও বেশি করে চিন্তাগ্রস্ত করে তুলতে লাগল।

একদিন যখন শোভনবাবু স্ত্রীর সঙ্গে বসে এগুলো নিয়ে আলোচনা করছেন, সৌগত এসে হাজির হল সেখানে। মন দিয়ে বাবার কথা শুনতে শুনতে বলে উঠল, বাবা, এখানে বাচ্চাদের মুখে বলে বোঝাতে পারো তো খুব ভালো। যদি তোমার কথা মেনে নিল তাহলে তোমার ভাগ্য! তুমি কোনও ভাবেই ওদের উপর জোর ফলাতে পারবে না।

কিন্তু এটা তো ভুল শিক্ষা। মা-বাবা, বাড়ির বড়োরা, শিক্ষকেরা সন্তানের ভালো চান বলেই না তাদের বকাবকি করেন, শাসনে রাখেন। তারা তো ছেলেমানুষ, এটাই তো শেখার বয়স। সঠিক শিক্ষা দিতে হবে, বোঝাতে হবে তবেই না ওরা শিখবে। শোভনবাবু নিজের মতামত জোরের সঙ্গে ব্যক্ত করলেন ছেলের কাছে।

তোমার কথা ঠিক, আমি মানছি বাবা। এখানেও এখন এই পয়েন্টগুলো অনেকেই তুলছেন। তোমার মতোই তাদেরও একই মত। কিন্তু কী করা যাবে, এখানকার আইন তো অন্যরকম। সৌগতর কথা শেষ হওয়ার আগেই অন্বেষা এসে ঘরের মধ্যে দাঁড়াল। ওহ… কাম অন ড্যাড, তুমি কাকে কী বোঝাবার চেষ্টা করছ? এখানে শুধু জেনারেশন গ্যাপ-ই নয় সংস্কৃতিরও একটা বিরাট পার্থক্য আছে।

অন্বেষা যবে থেকে মা আর ঠাকুমার কথাগুলো শুনেছিল, তবে থেকেই ঠাকুরমার প্রতি একটা অসন্তোষ ওর মনের মধ্যে জমা হচ্ছিল। ঠাকুমার সঙ্গে কথা বলা একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছিল। চোখের দৃষ্টিতে সুযোগ পেলেই মনের ভাব প্রকাশ করে ফেলতে দ্বিধা করত না অন্বেষা। কথার মাঝে কটুক্তি করে সোজা নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিত।

সৌগত আর কেটের মধ্যে কথা হচ্ছিল। সৌগত বলছিল কেটকে, কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছি, অন্বেষা অনেক বদলে গেছে। অনির্বাণও। তুমি কি কিছু জানো?

না, তবে ওদের এখন পিউবার্টি-র সময় যাচ্ছে। চারিত্রিক একটু পরিবর্তন তো হবেই। তোমাকে বলা হয়ে ওঠেনি সৌগত, অনির্বাণ একটা স্কলারশিপ পেয়েছে। ঠিক কলেজে বলব না, অন্য ইউনিভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য কোনও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়েছিল। সেরকম একটা কলেজ থেকে ডাক এসেছে, যারা কমপ্লিট স্কলারশিপ দেবে বলেছে। দুই বছরের কোর্স আর কলেজটা পাকিস্তানের লাহোরে।

চমকে ওঠে সৌগত, পাকিস্তান? পাকিস্তান কেন, লন্ডন ছেড়ে কেউ পাকিস্তান যায়?

অনির্বাণ পাকিস্তানে গিয়ে পড়তে চায়। অনেক বুঝিযেছি কিন্তু মনে হচ্ছে ব্রেনওয়াশ করেছে কেউ। কেটের মনের সন্দেহ কণ্ঠে ফুটে ওঠে।

এই সময় শোভনবাবুও ঘরে এসে ঢোকেন। ছেলে-বউমার কথাবার্তা কিছুটা ওনার কানে গিয়ে পৌঁছোয়। নিজেই এগিয়ে এসে বলেন, কিন্তু কেট তোমাদের ওকে এতদূরে পাকিস্তানে পাঠানো ঠিক হবে বলে মনে হয় না। বাচ্চা ছেলে এত দূরের শহর বাছার কী দরকার ছিল। তার ওপর তোমরা ওখানে কাউকে চেনো না। বিপদ-আপদ ঘটলে কী করবে?

বাবা, জানোই তো আমরা বললেও কিছুতেই শুনবে না অনির্বাণ। ও মনস্থির করে ফেলেছে, হতাশ শোনায় কেটের স্বর।

সৌগত আর কেটের মত আছে শুনে আর কথা বাড়ালেন না শোভনবাবু। কিন্তু মনটা অনির্বাণের জন্য খচখচ করতে লাগল। লন্ডনে জন্ম, বড়ো হওয়াও এখানে। এসব ছেড়ে লাহোর গিয়ে কেন ও পড়াশোনা করতে চাইছে? আসতে হলে ভারতে আসতে ক্ষতি কী ছিল? এখানে ওর আপনজনেরা রয়েছে, নিজের দেশ সেটা। এইসব ঘটনাচক্র ধীরে ধীরে শোভনবাবু আর গৌরীদেবীর মন ভারাক্রান্ত করতে লাগল।

একদিন সবাই বাইরে কাজে বেরিযে যাওয়ার পর, গৌরীদেবী কযেদিন ধরে বহন করা মনের কথাটা স্বামীর কাছে তুলে ধরলেন, অনেক তো হল, চলো এবার আমরা দেশে ফিরে যাই। ছেলে কেমন সংসার করছে নিজের চোখে একবার দেখার ইচ্ছে ছিল, দেখা হয়ে গেছে। এক মাসের ওপর আমরা এখানে রয়েছি। আর ভালো লাগছে না।

কলকাতার জন্য খুব মন কেমন করছিল গৌরীদেবীর। অনেক পুরোনো বাসিন্দা ওনারা। আশেপাশের বহু প্রতিবেশী খোঁজখবর নিতে আসে শোভনবাবুর কাছে। বিজয়ার সময় সকলে এসে পায়ে হাত দিয়ে দুজনকে প্রণাম করে যায়। তাদের ভালোমন্দের খবরটুকু তারাই কেউ না কেউ এসে নিয়ে যায় প্রায়দিনই। বিশেষ প্রযোজনে তারাই সবসময় এগিয়ে আসে। কতদিন হয়ে গেছে, তাদের কাউকে দেখতে পাচ্ছেন না। ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে পড়েন গৌরীদেবী।

শোভনবাবু স্ত্রীকে ভালোমতোই জানেন, তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয় না এতটুকুও। তাঁর নিজেরও আর ভালো লাগছে না। অগত্যা উঠে শোভনবাবু সৌগতর ঘরের দিকে চললেন ছেলেকে ইন্ডিযা ফেরার টিকিট কেটে দেওয়ার জন্য বলতে। অনির্বাণের ঘরের সামনে দিয়ে যেতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। অনির্বাণের ঘর থেকে ভেসে আসছে ওরই গলা। ও নিজেকে কারও কাছে খালিদ হাসান বলে দাবি করছে।

দরজায় কান পাতলেন শোভনবাবু। অনির্বাণ এটা কী বলছে? সে নিজেকে কেন খালিদ হাসান বলছে? ওর স্বর ভেসে এল বন্ধ দরজার বাইরে, হ্যাঁ, ওমর শরিফের কথা আমিও শুনেছি। তিনিও এখানকার কিংস কলেজ থেকে পড়াশোনা করেছেন। তিনজন ব্রিটিশ এবং একজন আমেরিকানকে কিডন্যাপ করার জন্য ভারতে ধরা পড়েন। এর পর

যাত্রী-সহ এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেন হাইজ্যাক করেন, আমেরিকান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বোমা মেরে উড়িয়ে দেন এবং ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের ড্যানিয়ে পার্লকেও কিডন্যাপ করে হত্যা করেন। আমার ওনার জন্য গর্ব হয়। জানি অনেকগুলো বছর আমরা পেরিযে এসেছি তবুও। হ্যাঁ আমি জানি, সিরিযাতে হাজারের বেশি ব্রিটিশ ছেলে-মেয়ে জিহাদের জন্য লড়াই করছে। আমি ওদের জন্য গর্ব অনুভব করি।

এরপর সব চুপচাপ। শোভনবাবু বুঝলেন ফোনের ওপার থেকে অনির্বাণ কারও কথা শুনছে। খানিক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। আবার অনির্বাণের গলা শুনতে পেলেন। ও বলছে, আপনি চিন্তা করবেন না। অন্বেষা আগে যাবে, কযেদিনের মধ্যে আমি আসছি। নেটওয়ার্কিং সাইটে দেখে নিয়েছি পুরো ব্যবস্থা করা হবে। যখন আপনারা আমাদের সব সুবিধার খেযাল রাখছেন তখন আমরাও পিছু হটব না।

যে-লক্ষ্য নিয়ে যাব সেটা সম্পূর্ণ করেই আসব। কথা দিচ্ছি শেষ নিশ্বাস পর‌্যন্ত জিহাদের জন্য লড়ব। কেউ বাধা দিতে চাইলে পৃথিবী থেকে তাকে সরিযে দেব।

শোভনবাবুর হাত-পা কাঁপছিল। দাঁড়িয়ে থাকতে পারছিলেন না। পনেরো বছরের ছোট্ট ছেলেটা এসব কী বলছে? কোনওমতে শরীরটাকে টেনে এনে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। চিন্তা করার ক্ষমতাও লোপ পেয়েছে। ভিতর থেকে একটা শূন্যতা যেন পাক দিয়ে দিয়ে উঠে শোভনবাবুর গলা চেপে ধরেছে।

খানিক্ষণ সেভাবেই পড়ে রইলেন। ভাবলেশহীন শুধু একটা শরীর। অনেক কষ্টে নিজেকে টেনে তুললেন। এই জন্যই কি অন্বেষা আর অনির্বাণ লন্ডন ছেড়ে পাকিস্তান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে? ওরা কি কোনও সন্ত্রাসবাদী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে? ওরা কি ধর্মান্তরিত হয়েছে? তাঁর নিজের পরিবার শেষে এভাবে ভাঙতে চলেছে? এসব নানা প্রশ্নের কোনও উত্তর খুঁজে পাচ্ছিলেন না শোভনবাবু। একটা নিঃশব্দ বেদনা, অস্থিরতা, তাঁকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। কী করবেন তিনি? বাচ্চাদের শাসন করবেন? ভালোবেসে লজিক দিয়ে বোঝাবার চেষ্টা করবেন? চিন্তায় চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছিল শোভনবাবুর।

এতদিন খবরের কাগজেই পড়ছিলেন, লন্ডনের রাস্তায় জিহাদের কালো ঝান্ডা তুলে বুক ফুলিযে সব ঘুরে বেড়াচ্ছে। অক্সফোর্ড স্ট্রিট, আরও অনেক জায়গায় আইএস-এর মতো সন্ত্রাসবাদী গ্রুপের সমর্থনকারীদের দেখা গেছে। কিন্তু কে জানত তাঁর নিজের পরিবারেও সন্ত্রাস তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করছে? কে ভাবতে পারে একটা শিক্ষিত, সম্পন্ন, সাংস্কৃতিক পরিবারের ছেলেমেয়ে সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন ছেড়ে এভাবে জীবন নষ্ট করতে গর্ব অনুভব করবে!

কিন্তু হেরে গেলে চলবে না। মন শক্ত করেন শোভনবাবু। একসময় দেশের জন্য লড়েছেন। দুচোখ ভরে দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন দেখেছেন। আর এ তো নিজের পরিবার বলে কথা। মন শক্ত করে উঠে দাঁড়ান। পরিস্থিতি কীভাবে সামলাবেন একটা ছক কষেন মনে মনে।

 

সেদিন সকালে একটু তাড়াতাড়ি ঘুম ভেঙে যাওয়াতে গৌরীদেবী চোখে-মুখে জল দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। বড়ো প্রিয় এই জায়গাটা ওনার। সবে আলো ফুটতে আরম্ভ করেছে। খেযাল করলেন এক পাশে চুপ করে কেট দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টি সুদূর প্রসারী। এত তাড়াতাড়ি উঠে কী করছে মেযো চিন্তিত হলেন! ডাকলেন, কেট।

ওঃ তুমি উঠে পড়েছ, চমকে ফিরে তাকাল কেট। কেটের চোখ-মুখের বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে গৌরীদেবী কাছে এসে দাঁড়ালেন, এ কী অবস্থা, সারা রাত ঘুমোওনি? কী হয়েছে?

কেটের মুখ থেকেই জানলেন, অন্বেষা গর্ভবতী। কালো ছেলেটি ওর সঙ্গেই কলেজে পড়ত। হঠাৎই কলেজ ছেড়ে কোথাও চলে গেছে। ফোন করেও কোনও লাভ হচ্ছে না। সুইচ অফ। অগত্যা নিরুপায় হয়ে গত রাতে মা-র কাছে সবকিছু খুলে বলেছে অন্বেষা।

নিজের মেয়ে হলে হয়তো গাযে হাত তুলে দিতেন গৌরীদেবী কিন্তু একটা মাত্র নাতনি, বড়ো মায়া ওর উপর। রাগ দমন করে কেট-কে শান্ত করলেন। বেলা বাড়লে কেট এবং অন্বেষার সঙ্গে ডাক্তারের কাছে গেলেন। সেখান থেকে গর্ভপাত করাবার জন্য ওনাদের হাসপাতালে পাঠানো হল। এক সেকেন্ড-ও অন্বেষার বিছানার পাশ থেকে উঠলেন না গৌরীদেবী। শক্ত করে অন্বেষার হাত ধরে রইলেন। বাড়ি ফেরা না অবধি সেই হাত আর ছাড়লেন না।

অ্যানি বলে কোনওদিনই গৌরীদেবী নাতনিকে ডাকেননি। অন্বেষাই বলে এসেছেন বরাবর। অন্বেষার এটা একেবারেই পছন্দ ছিল না। কিন্তু ঠাকুমার এই ডাকে এখন আর তার বিরক্ত লাগে না। ওর মধ্যে এই পরিবর্তনটা দেখে আর কেউ না হোক, কেট সবথেকে খুশি হয়েছিল। গৌরীদেবী কত গল্প বলেছেন কেট-কে। যে-গ্রামে গৌরীদেবী জন্মেছেন, বড়ো হয়েছেন সেখানকার গল্প। কলকাতায় বিয়ে হয়ে এসে শহুরে পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। শ্বশুরবাড়ির একান্নবর্তী পরিবারে সকলের মন জিতে নেওয়া সব শুনিয়েছেন কেট-কে। কেটও নিজের দেশ ছেড়ে ভারতীয় সংস্কৃতির উপর অসম্ভব একটা টান অনুভব করে।

 

এখন অন্বেষাও বাড়ি এলেই ঠাকুমার সঙ্গে সঙ্গে ঘোরে। কলকাতার গল্প শুনতে চায়। অবাক হয়ে শোনে। এত গুরুত্ব দেওয়া হয় মানুষের সম্পর্ককে যে, ও নিজের জন্মস্থানকে তুলনা করে ভারতের সঙ্গে। সম্পর্ক শব্দটা যে এত দামি, ধীরে ধীরে এখন বুঝতে শিখেছে অন্বেষা।

অন্বেষাকে নিয়ে আর কোনও চিন্তা ছিল না শোভনবাবুদের কিন্তু অনির্বাণকে নিয়ে কী করা যাবে তা ভেবে কূল পাচ্ছিলেন না।

সন্ধেবেলায় অন্বেষা আর গৌরীদেবী বারান্দায় বসে কেটের দেওয়া গরম গরম সু্প খেতে খেতে গল্পে মেতেছিলেন। সৌগত তখনও বাড়ি ফেরেনি। অনির্বাণ-কে, বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঢুকতে দেখে শোভনবাবু এগিয়ে এলেন, অ্যান, আজকের খবরটা শুনেছ? ফ্রান্সের নিস শহরে সন্ত্রাসবাদী হামলার? এরা এত অমানুষ যে, ওখানকার সাধারণ নাগরিকদের মেরে ফলতে ওদের হাত কাঁপে না। আর এরাই মুখে শান্তির কথা বলে বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়েছের নিজেদের জালে ফাঁসায়। ভগবান এদের ঠিক শাস্তি দেবেনই।

শোভনবাবু যেটা চাইছিলেন, সেটাই হল। তির লক্ষ্যভেদ করল। সন্ত্রাসবাদীদের সাপোর্ট করে অনির্বাণ মুখ খুলল, তুমি কি জানো ওদের বিষযে ওদের উদ্দেশ্য আর আইডিযালিজম আমাদের থেকে অনেক বেশি উন্নত। আমরা শুধু নিজেদের কথা ভাবি আর ওরা দেশ, ধর্ম সবকিছুকে বাঁচাবার লক্ষ্যে লড়ছে। এটা সন্ত্রাস নয়, জেহাদ। জেহাদের বিষযে কখনও শুনেছ তুমি?

অ্যান, আমার জন্ম ভারতে। সেখানকার মাটি আজ কত বছর ধরে সন্ত্রাসের শিকার। তুমি যে-জেহাদের কথা বলছ, সেটা আমি মন থেকে মানি না। জেহাদের মাধ্যমে যদি স্বর্গের রাস্তা খুলে যায়, তাহলে বড়ো বড়ো পলিটিশিযান, ধনী ব্যক্তিদের ছেলেমেযো দূর বিদেশে গিয়ে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আরামদায়ক জীবন যাপন করছে কেন? কেন তারাও আর-চারটে সাধারণ ছেলেমেয়ে মতোই, জেহাদের জন্য নিজেদের হাতে বন্দুক তুলে নিচ্ছে না? আর যারা সন্ত্রাসের বাণী দিচ্ছে, তারা সামনে না এসে সোশ্যাল মিডিয়ার পর্দার আড়ালে লুকিযে অপরকে নির্দেশ দিচ্ছে আর মরবার জন্য অন্যের বাড়ির ছেলে-মেয়েদের বোকা বানাচ্ছে!

তোমরা এখনকার প্রজন্ম, ইন্টারনেট গুলে খেয়েছ। নেটে গিয়ে দ্যাখো যাদের বাড়ির জোয়ান ছেলে সন্ত্রাসে নাম লিখিযে মারা গেছে, তাদের কী হাল? এরা গরিবকে অর্থের লোভ দেখিযে সন্ত্রাসবাদী বানায় আর অর্থের প্রযোজন নেই যাদের, তাদের ব্রেনওয়াশ করে। বাড়ির এক ছেলে মারা গেলে অন্য ছেলেদেরও এরা দলে টানার চেষ্টা করে। এভাবে একটা প্রজন্ম থেকে আরেকটা প্রজন্মের ছেলেমেয়ে জীবনও নষ্ট করে, বাধ্য করে সন্ত্রাসে নাম লেখাতে।

শোভনবাবু, সরাসরি অনির্বাণকে কথায় আক্রমণ না করে আশেপাশের পরিস্থিতির উদাহরণ দিয়ে ওকে বোঝাতে সফল হচ্ছেন, সেটা অনির্বাণের মুখ দেখেই বুঝতে পারছিলেন। ভযে ওর মুখ শুকিয়ে এসেছিল। লন্ডনের ঠান্ডাতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছিল অনির্বাণের কপালে। শোভনবাবুর কথাগুলো যে কতটা সত্যি, সেটা মনে মনে অস্বীকার করার জায়গা ছিল না অনির্বাণের।

পরের তিনদিন ঘর থেকে কোথাও বেরোল না অনির্বাণ। ভেতরে ফোনে মাঝেমধ্যেই কথা বলার আওয়াজ খালি কানে আসত বন্ধ ঘরের দরজা ভেদ করে। শোভনবাবু ছাড়া কেউই এর নেপথ্যের ঘটনা কিছু জানত না, তাই কেউই অনির্বাণের এই ব্যবহারে চিন্তিত হল না।

একমাত্র শোভনবাবুই মাঝে মাঝে নাতির ঘরের সামনে এসে দাঁড়াতেন। ঘরের ভিতর ঢোকার প্রবল ইচ্ছেটাকে দমন করে আবার ফিরে আসতেন। নিজের উপর এবং নিজের রক্তের উপর একবারের জন্যও বিশ্বাস হারাতে দেননি।

তিনদিনের দিন দরজা খুলে অনির্বাণ যখন বাইরে এল, শোভনবাবু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। অনির্বাণের দুচোখে শুধু হাজারো প্রশ্নের ভিড়। শোভনবাবু ওর হাত ধরে বাইরের ঘরে এসে বসলেন। সামনে কেট-কে দেখে অনির্বাণ শোভনবাবুর দিকে তাকিযে সামান্য হেসে বলল, মা, আমি পাকিস্তান যাচ্ছি না। আমি খোঁজ নিয়েছি কোর্সটা এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়।

 

সপ্তাহের শেষে ছুটির দিন দেখে সৌগত, মা-বাবার ইন্ডিযা ফেরত যাওয়ার টিকিট বুক করার জন্য, ইন্টারনেটে বসে তারিখ জিজ্ঞেস করছিল শোভনবাবুকে। সে সময় অন্বেষা ঘরে ঢোকে, দাদা, আমি তোমাদের সঙ্গে ভারতে যেতে পারি? শোভনবাবুকে জিজ্ঞেস করে অন্বেষা।

ওটা তোমার নিজের বাড়ি। অবশ্যই তুমি আমাদের সঙ্গে যেতে পারো, আর যতদিন ইচ্ছে থাকতে পারো।

আর দিদি চলে গেলে আমি বুঝি এখানে একা থাকব? অনির্বাণও ঘরে এসে ঢোকে।

প্লেনের জানলা দিয়ে টুকরো টুকরো মেঘগুলোর ইতিউতি ভেসে বেড়ানো দেখছিলেন শোভনবাবু আর গৌরীদেবী। ওই একই সময় অন্বেষা আর অনির্বাণ মোবাইলে মা-বাবার সঙ্গে নানা পোজে সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

আলো আঁধারির গপ্পো

সাউথ ফেসিং অ্যাপার্টমেন্ট। জি-প্লাস ফোর ফ্ল্যাট। সুনন্দের ফ্লাটটা ঠিক মাঝখানে। ব্যালকনিটাও সাউথ ফেসিং। সামনে ছোটো একটা মাঠ। তারপরে সবুজ বনানী। আগাছা জঙ্গল ভরা নয়। নানা রকম বাহারি ফুল, বাহারি জঙ্গল। বনানি দেখভালের জন্য একজন মালিও নিয়োজিত। তারও ওপারে একটা দিঘি। কাচের মতো স্বচ্ছ তার জল। সুইমিং, বোটিং। গোটা কতক দশাসই আমগাছ তুলে এনে ‘ইনস্টল’ করা হয়েছে। নতুন নাম ‘মাঝের গাঁ’। এ সবই খদ্দের পটানোর বন্দোবস্ত।

একটা লম্বা হাই তুলে সুনন্দ ব্যালকনির ইজি চেয়ারটাতে বসেছে। দুপুরের ভাত ঘুম। পাতলা ঘুম। পাতলা ঘুম অতল স্পর্শ করে না। অগভীর ঘুমে মনের সুখ বাসনাগুলি ছেঁড়া ছেঁড়া পেঁজা তুলার মতো ভাসতে থাকে। বাসনার বিপরীত মুখী হয়ে অবচেতন মনের সামনে বিরক্তি ঘটায়। না পাওয়ার অস্বস্তিতে হতাশা আসে। বাইরে প্রকৃতির অনাবিল রূপের ডালি! সুনন্দর নজর সেদিকে নেই। আকাশে মেঘ নেই। সুনন্দর মুখে আছে। এক রাশ ঘনীভূত আষাঢ়ের মেঘ। ঝরব ঝরব করছে। ঝরেনি। বাইরে অসহায়ের মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে।

পড়ন্ত বিকেল। সূর্য এক অত্যাচারী শাসক। সারাদিন রক্তচক্ষু দিয়ে জগৎ শাসন করেছে। বসুন্ধরার রক্তরস ছিবড়ে করে নিজেই ক্লান্ত। বিশ্রামের জন্য পশ্চিমে রওনা হয়েছে।

হাতে এক কাপ চা। মধুছন্দা দেবী ব্যালকনির দরজায় দাঁড়িয়ে। টের পায়নি। –কী দেখছিস ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে? ব্যাবসার কথা ভাবছিস? ভাবিস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে –নাঃ তেমন কিছু না। মাথা তুলতেই মায়ের দৃষ্টি এড়ায় না।

–ও মা এ কি! চোখ দুটো অমন লাল কেন? মুখ খানাও কেমন গোমড়া। ব্যাবসায় আরও কিছু ক্ষতি হ’ল নাকি?

–না সেসব কিছু না। একটা আজেবাজে স্বপ্ন দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মায়ের মন অস্থির হয়ে ওঠে।

–ও মা সে কি? কী বাজে স্বপ্ন? কু-স্বপ্ন মনে চেপে রাখতে নেই। বলে দে। মায়ের পীড়াপীড়ি এড়াতে পারে না।

মেঘমুক্ত আকাশ। পশম মেঘ। বুনো মেঘ। গোটা আকাশে কিছু নেই। হঠাৎ কোথা থেকে কচিকাঁচা মেঘেরা মুক্ত আকাশে খেলতে নেমেছে। আমাকে হাত ধরে টানাটানি। আমি বললাম– আরে আমি কি তোদের সাথে খেলতে পারব?

–এসো না। খুব পারবে।

ওদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে লাগলাম। তারপর যা হওয়ার তাই। অল্প সময়েই হাঁপিয়ে পড়লাম। ওরা বলল– এসো তবে কিছু জলযোগ করে নিই। বলে আমাকেও চাট্টি মুড়ি দিল। আমি পরমানন্দে খেতে লাগলাম। তারপরই হঠাৎ ঘুমটা ভেঙে গেল।

–ওহ, এটা আবার দুঃস্বপ্ন কীসের?মুড়ি তো ভালো জিনিস। এতে মুখ গোমড়া করে বসে থাকার কি হয়েছে?

–না আমি ভাবছি অন্য কথা। তারপরই মাকে প্রশ্ন করে –আচ্ছা মা, মেঘেদের খাবার কিনতে শুধু খাবার কেন কোনও কিছুই জোগাড় করতে তো পয়সা লাগে না। এত ভালো ভালো খাবার থাকতে শুধু মুড়ি। তাই ভাবছি বাকি জীবনটা কি তাহলে আমাকে মুড়ি…।

–ছিঃ বাবা অমন কথা বলতে নেই। ঘুমটা ভালো হয়নি তো! পাতলা ঘুমে ওরকম হিজিবিজি স্বপ্ন দেখে মানুষ। ওসব কথা মনে করে কষ্ট পেতে নেই।

ড. ডি কে বাসু! এটা কেতাবি নাম! বাপ-মায়ের দেওয়া নাম দিলীপ কুমার বোস। বিদেশে গিয়ে সাহেবি নাম হয়েছে। প্রথম নামটি। বার্কিংহাম ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির প্রফেসরের পাশাপাশি গোটা ইউরোপ ঘুরে জ্ঞানের ঝুলিটা ফুলে ফেঁপে লাউ। জ্ঞানের ঝুলিটা যত ভারী, দাম্ভিকতার তবলা সমপরিমাণে টিউনিং। মুখে লেগে থাকে নেটিভ ইন্ডিয়ান। ইন্ডিয়ান কালচারটা একেবারে বস্তাপচা। জ্ঞানের ভান্ডার দিয়ে ইউরোপকে সমৃদ্ধ করেছে, মাতৃভূমিকে ছড়িয়েছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস।

কৌতুকবশত সুনন্দ বলেছিল– মামা, তুমি গেঞ্জিটা উলটো পরেছ।

ড. বাসু একগাল তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলে– আসলে কি জানিস, ইন্ডিয়ানরা কমফর্ট ব্যাপারটা ঠিক বোঝে না। সেলাইয়ের দিকটা ভেতরে থাকলে কমফর্ট ব্যাপারটা ডিসটার্ব হয়। এ গল্পে ড. বাসুর প্রবল আত্মকেন্দ্রিকতা, মাতৃভূমির উপর ঘৃণা, ইউরোপিয়ান আদব-কায়দা ইত্যাদি বিশ্লেষণ করা। এসব একান্তই অনাবশ্যক ছিল! যদি না দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর দেশের মাটিতে পদার্পণ ঘটিয়ে, বোনের বাড়িতে সটান এসে স্বঘোষিত অভিভাবক হয়ে না উঠত।

সুনন্দের হাতে এখন অঢেল সময়। ডিমনিটাইজেশনের জেরে ট্রাভেলিং-এর ব্যাবসা যত তলানিতে ঠেকছে বিশ্রামের সময় ততই বাড়ছে। ব্যাবসা এখন চড়ায় আটকে যাওয়া নৗকার মতো। পরিশ্রম কম হলে ঘুম আসে না। পায়চারি করে।

ব্যালকনির কর্নারে একটা টব। গোলাপ গাছ। বেচারা। অনাদরে অবহেলায় শুকিয়ে কঙ্কাল। সময় আছে যথেষ্ট। উৎসাহে গলগ্রহ। সেই গলগ্রহে গাছটার অকাল প্রয়াণ। পাশ দিয়ে আরও এক অবহেলিত অনাহুত গাছ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। পথ শিশুদের আদর যত্নের প্রয়োজন হয় না।

জাত ধর্ম সবারই আছে। গাছেরও আছে। শুধু অনাহুত গাছটা শনাক্ত কেউ করতে পারল না। কৗতুহলটা ঘরের চৗকাঠ পেরিয়ে দোতলা তিনতলা। গোটা অ্যাপার্টমেন্টময় ছড়িয়ে পড়ে।

অবশেষে এলেন পরান হালদার। উড়িষ্যার জঙ্গল। আদিবাসীপাড়া। ঝাড়ফুক। তুকতাক। ঘরবন্ধন। ভূত ছাড়ানো। এসবে হাত যশ আছে। সব ছাড়িয়ে পয়সার ঝোলাটা আরও ভারী।

পরান হালদার গাছটা দেখেই অাঁতকে ওঠে। কি সর্বনাশ! এ-তো এক ভয়ংকর বিপদের ইঙ্গিত। গাছটা তোমরা চিনতে পারলে না? –সুনন্দের কৗতুহল বাড়তে থাকে।

–কেন কি গাছ?

–আরে, এ-তো ভূতের বাসস্থান।

–সেটাই তো জানতে চাইছি। এটা কি গাছ? ভূতেরা আবার আলাদা গাছে থাকে না কি?

–থাকে বাবা থাকে। তোমরা শিক্ষিত। এ যুগের ছেলে। ওসব বুঝবে না।

–না, বলছি গাছটার একটা নাম তো আছে?

–আছে বাবা আছে। এটা শ্যাওড়া গাছ। বলে দাঁড়ায় না। পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখে চাপা দিয়ে হন্ হন্ করতে করতে বের হয়ে যায়। পরানবাবু ভয় পেয়েছে। নাক মুখ দিয়ে সুরুৎ করে ভুতের বাচ্চা শরীরে ঢুকে গেলে আর রক্ষে নেই।।

সুনন্দ ভাবছে। নোট জেলে বন্দি। কবে ছাড়া পাবে কে জানে। ট্যুরিস্টেরের পকেটে নেই টাকা। তাই গাড়ির ঘোরেও না চাকা। নোট বন্দি। না বাক্বন্দি। বাক্বন্দি না জীবনবন্দি। ধ্যাৎ! যত্তসব! ঘরের ভিতরটা কেমন গুমোট হয়ে আসছে। মাথার পেছনটা কেমন ভারী ভারী লাগছে। কোন আগন্তুকের পদশব্দ! সুনন্দ চমকে ওঠে।

একটা কিশোর। বয়স বছর বারো তেরো। খালি গা। পরনে ছেঁড়া হাফ প্যান্ট। গায়ে খড়ি উঠে গেছে। তেল সাবান বহুদিন পড়েনি বোধ হয়। মাথায় শেষ কবে চিরুনি পড়েছিল কে জানে! চোখ দুটো অস্বাভাবিক রকম জ্বল জ্বল করছে। তবু কেমন নিরীহ নিরীহ লাগে।

সুনন্দ ধড়মড় করে উঠে বসে। –আরে রে রে। তুই কোথা থেকে এলি? দরজা তো বন্ধ।

–ওই তো দরজা খুলে।

সুনন্দ ভাবছে বাঁ দিকে ব্যালকনির দরজাটা খোলা। কিন্তু সেদিক থেকে দোতলা উঠবে কি করে! আরও এক ঝলক ভাবে– ডানদিকের দরজা এখনও বন্ধ। লক করা ছিল না হ্যান্ডেল লকটা খুলল। ঢুকল। আবার বন্ধ করল। আমি কিছুই টের পেলাম না। সে যাক্।

–এখানে এসেছিস কেন?

–একটু থাকতে দেবে দাদাভাই?

–তোর বাড়ি কোথায়? নামটাই বা কি?

–জন্ম উড়িষ্যায়। এখন থাকি ফুটপাথে। আর নাম লালু! লালু নায়েক ছিল। এখন যে যা বলে তাই।

–কী করে চলে? মানে খাস কি?

–ভিক্ষা করে। তা-ও ঠিক হচ্ছে না।

তারপরেই লালু পা-দু’টো ধরে বলে– দাও না দাদাভাই একটু থাকতে। আমি তোমাদের সব কাজ করে দেব। এই ধরো হাট বাজার। ঘরের কাজ সব কিছু পারি। ছেলেটার কথায় একটা মাদকতা আছে। সুনন্দ নরম হয়। তারপরই বলে– সবই তো বুঝলাম। কিন্তু তুই এখন যা বাপু! আমার এখন কাজের লোক রাখার সামর্থ্য নেই। আর তা ছাড়া থাকবিই বা কোথায়? আমাদের তো মাত্র তিনটে বেডরুম। লালু মনের ভাব বুঝতে পারে। বলে, –দাদাভাই তোমাদের এঁটো কাঁটা যা দেবে তাতেই আমার হবে। আর থাকার কথা বলছ, সে তোমাদের স্টোররুমেই চলে যাবে। থাকতাম তো ফুটপাথে।

সুনন্দ বিরক্ত হয়। ভাবছে, আচ্ছা মুশকিলে ফেলল তো ছেলেটা। ওকে বোঝাই কি করে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে খাওয়ার মতো অবস্থাতেও আমি নেই।

কথার শব্দে মধুছন্দার ভাত ঘুমটা ভাঙে। হাঁটুর আড়ষ্ঠতা কাটিয়ে সুনন্দর ঘরে ঢুকে বলে, ‘ও মা এ ছেলেটা কে? কী চায়?’

লালু মধুছন্দার পা জড়িয়ে বলে, – মা, ওমা, একটু থাকতে দাও। দাদাভাইকে একটু বলো না। মায়ের মন। ‘মা’ সম্বোধনে গলে জল!

সুনন্দ বিরক্ত হয়ে বলে– আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল তো। কোথা থেকে এসে কাঙালিপনা করছে। একে কীভাবে বিদায় করি বলো তো?

–থাক। থাক। মা বলে ডেকেছে। ও আমি সামলে নেব। দু’মুঠো কম খেলে আমার কিছু হবে না। তাছাড়া ঘরের কাজ সামলে বাজার হাট করা। এখন শরীর দেয় না। হাঁটুর ব্যথাটাও ইদানীং বড্ড বেড়েছে।

মধুছন্দা আঁচলের খুট থেকে পঞ্চাশ টাকার নোটটা দিয়ে লালুকে বলে– যা তো বাবা এক কেজি চাল আর এই শিশিতে একটু সরষের তেল নিয়ে আয়। লালু কাগজের ঠোঙায় চাল আর তেলের শিশিটা ধরিয়ে দিয়ে কোথায় ফুড়ুত করে হাওয়া। আপতত আর দেখা গেল না।

কাজ কম তাই হিজিবিজি ভাবনাটা বেশি। সুনন্দ ভাবছে। ঘরটা কেমন নির্জন নীরব মনে হচ্ছে কেন? তিন জনের সংসারে এখন চারজন। মামা থেকেও নেই। দুপুরে বেরোয়। গভীর রাতে দুলে দুলে ঘরে ফেরে। অশীতিপর বৃদ্ধ। চলাফেরায় এখন আর বলিষ্ঠতা নেই। লালুটা কখন যে কোথায় থাকে বোঝা ভার। অথচ ডাকলেই হাজির। গোটা ঘরটা এক অদ্ভূত রকমের রহস্যময় লাগছে।

জ্যৈষ্ঠের দুপুর। দূরে একটা তৃষ্ণার্ত কাকের ‘কা’ ‘কা’ শব্দে সুনন্দের গলা শুকিয়ে আসছে। টেবিলের উপর বোতলগুলো সার সার খালি। মাকে বিরক্ত করতে মন সায় দেয় না। ডাকে– লালু একটু আয় তো। সাড়া নেই। এবার তৃতীয় স্বরে– লালু। নিস্তব্ধ। এবার সপ্তমে চড়িয়ে ডাকে– লালু। নাঃ ছেলেটা গেল কোথায় এই ভরদুপুরে। ছেলেটা মনে হয় ঘুমোচ্ছে। স্টোর রুমের দরজাটা খুলতেই আঁতকে ওঠে। উফ্। এ-কি দেখলাম। ক্যাম্প খাটে যেটা শুয়ে আছে সেটা কি? একটা কঙ্কাল! গোটা শরীরটা হিম হয়ে আসছে। পা দুটো অসাড়। কোনওরকমে মাতালের মতো টলতে টলতে নিজের ঘরে ঢুকতেই লালু বলে– দাদাভাই ডাকছিলে? একটু বাইরে গেছিলাম।

সুনন্দের ঠোট দুটো তখনও কাঁপছে। অনেক কষ্টে স্বর বেরোয় –তোর ঘরের খাটে ওটা কী?

–কী?

–একটা কঙ্কাল। ওটা কোথা থেকে এল?

তুই এনেছিস?

–কই না-তো।

চল তো দেখি! পা দুটো তখনও কাঁপছে। সাহসের ভাঁড়ার শূন্য। লালু হাতটা ধরে জোর করেই নিয়ে গেল। দরজা খোলাই ছিল। ক্যাম্প খাটের দিকে তাকাতেই তাজ্জব।

–একি! বিছানা শূন্য। ছাপা বেডশিট পরিপাটি করে সাইড মোড়া। এ বিছানায় আজ কেন, দু’চার দিনেও কেউ গা দিয়েছে বলে মনে হয় না। তাহলে তখন…। বার বার চোখ কচলে নেয় সুনন্দ। অদ্ভুত! সুনন্দ স্তম্ভিত। সমস্ত জমাট বাঁধা রক্ত যেন ঝরঝর করে নীচে নেমে যাচ্ছে। লালু হাতটা ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে– হি হি, হি হি। দাদাভাই তুমি ভুল দেখেছিলে। কাল রাতে মনে হয় ভূতের স্বপ্ন দেখেছ।

মধুছন্দার বয়স বেড়েছে। নানা কাজে ভুল হচ্ছে। রান্না ঘরে ঢুকে অাঁচলের খুট খুলতে গিয়ে কী মনে হয়, চালের টিন খুলেই তাজ্জব! টিন প্রায় ভর্তি চাল। ষোলো কিলোর টিন। তিন দিন খেয়েও টিন প্রায় ভর্তি। তেলের শিশির দিকে তাকিয়ে দেখে সামান্য খালি। কি হচ্ছে এসব! মাথাটা আমার গেছে! এত দিন সংসার করছি…।

লালুকে ডেকে বলে– তোকে কবে চাল আনতে বলেছি, আর ক’কেজি?

–কেন পরশু। এক কেজি চাল এনে দিলাম। দুশো সরষের তেল। মনে নেই মা? কেন?

–তা-তো ঠিক। কিন্তু টিন ভর্তি চাল। তেলের শিশি ভর্তি…।

–তাহলে চাল, তেল সব আগে থেকেই ছিল। তুমি ভুল করেই আবার আনতে দিয়েছ।

–হবেও হয়তো। মধুছন্দা ভাবে। নাই ঘরে চাহিদা বেশি। শুধু নাই নাই মন।

আওয়াজটা প্রথমে মধুছন্দাই পেয়েছে। দাদার ঘর থেকে একটা গোঙানির শব্দ। দৗড়ে গিয়ে দেখে গলা দিয়ে কেমন ঘড় ঘড় আওয়াজ। মুখ দিয়ে কালো রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। উদভ্রান্ত মধুছন্দা সুনন্দকে ফোন করে। সুনন্দ শিগগির ঘরে আয়। তোর মামার শরীর খুব খারাপ।

সুনন্দ বিভ্রান্ত। তর তর করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে ছুটোছুটি করতে থাকে। যাকে দেখছে বলছে– দাদা একটা অ্যাম্বুল্যান্স জোগাড় করে দিতে পারেন? আচমকাই সুনন্দের নজরে পড়ে গলি দিয়ে এমার্জেন্সি হর্ন বাজিয়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স তীব্র গতিতে এগিয়ে আসছে। বাঁদিকের জানালা দিয়ে একটা কচি হাত বার করে ইশারা করছে। সুনন্দ বুঝতে পারছে না। সামনে আসতেই গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল লালু। বলে– দাদাভাই আমি রাস্তাতেই খবর পেয়েছি। তাই অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে এলাম।

নার্সিংহোমে যখন পৗঁছোল রাত দশটা। ডাক্তার এস দত্ত বললেন– পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রেডি থাকুন।

ভোর রাতে সুনন্দকে ডাক্তার বলে– কে হন ইনি?

– আমার মামা।

– সরি। উই আর কমপ্লিটলি হেল্পলেস।

অনেকদিন পর আজ সুনন্দ ঘুমিয়েছে। যাকে বলে একেবারে সাউন্ডস্লিপ। সেই ঘুমে সুনন্দের সামনে এক ছায়ামূর্তি। ছায়ামূর্তি বলছে – দাদাভাই আমি চলে যাচ্ছি। আমার কাজ শেষ। তবে বিশ্বাস করো। মামাবাবুকে আমি মারিনি। শুধু আমার স্বরূপ দেখিয়েছি। বোধহয় তাতেই…। সেটা তুমি স্টোররুমেই সেদিন দেখেছ। আমি তোমাকে হ্যালুসিনেশনের লেবেল সেঁটে দিয়েছিলাম। এছাড়া আমার কোনও গতি ছিল না। তোমার মামাবাবুর অঢেল টাকা। কলকাতায় দু’টো ফ্ল্যাট, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিয়ে আনুমানিক প্রায় দশ কোটি। তোমরা হয়তো জানো না। মামাবাবু দুপুরে বেরিয়ে কোথায় যেতেন! রেসের মাঠে। অঢেল টাকা ওড়াতেন। আরও অনেক বাজে অভ্যেস ছিল। অথচ তোমাদের এই সংকটে পাশে দাঁড়াননি। আমি জানি তোমার ব্যাবসা এখন ডুবন্ত নৗকা। অবশ্য একটা মহৎ কাজ তিনি করেছেন। সেটা পরে বুঝবে। আর একটা কথা। টবের গাছেই আমি থাকতাম। টবটা এখুনি ফেলে দাও। গাছটা আমি নিয়ে গেলাম। ভালো থেকো।

সুনন্দ খাটে শুয়ে আছে। ভাবছে। বিষয়- লালুর আগমন নিঃস্্ক্রমণের হেতু। কলিং বেলটা ডিং ডং আওয়াজ। সুনন্দ দরজা খুলতেই কালো কোট প্যান্ট পরা এক অপরিচিত মানুষ। হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। নীরবতা নব আগন্তুকই ভাঙে।

–নমস্কার। আমি অ্যাডভোকেট পার্থ সান্যাল। বারাসাত কোর্টে প্র্যাকটিস করি। এসেছি মধুছন্দা দেবীর কাছে। যদি ভুল না করি আপনি…।

– একমাত্র ছেলে সুনন্দ ঘোষ।

–একটু বসতে পারি?

– ওহ, নিশ্চই।

তাহলে মাকে একটু ডেকে দিন।

অ্যাডভোকেট বলছে– ড. ডি কে বাসু আমার ক্লায়েন্ট। উনি একটা উইল করে গেছেন। ওর সমস্ত সম্পত্তি দান করেছেন। সম্পত্তির আনুমানিক মূল্য প্রায় দশ কোটি। অবশ্য কিছু শর্ত সাপেক্ষে। ওর শেষ জীবনে যে বা যারা দেখভাল করবে সে সম্পত্তি তারই প্রাপ্য। এ-ও উল্লেখ করেছেন বর্তমানে তার বোন শ্রীমতী মধুছন্দা ঘোষ-এর বাড়িতেই বসবাস করছেন। ডিটেলসটা পরে নেবেন। সম্মতি থাকলে প্রসিডিংস-টা স্টার্ট করি?

সুনন্দ ধড়মড় করে উঠে পড়ে। ছুটে যায় ব্যালকনিতে। আশ্চর্য! কালকেও দক্ষিণা হাওয়ায় গাছটার পাতাগুলো পত পত করে দোল খাচ্ছিল। এখন গাছটা শুকিয়ে দড়ি হয়ে আছে। সুনন্দের চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়ে গাছের গোড়াটা সিক্ত করে দিল।

শুধু একটু ভালোবাসা

বড়দার কাছে মাকে পৌঁছে দিয়ে কিছুটা স্বস্তি বোধ করল শিউলি। এখানে কাজের লোকের সমস্যায় জেরবার হয়ে উঠেছিল। অথচ সে কথাটা কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছিল না ওদের, বিশেষ করে বড়োবউদিকে। বড়োবউদির ধারণা এটা শিউলির একটা চাল। কথাটা এরমধ্যেই কানেও এসেছে শিউলির। অদ্ভুত! শিউলি অবাক হয়ে ভাবে, যখনই ও কোনও অসুবিধার কথা বলেছে তখনই এই ধরনের প্রতিক্রিয়া দিয়েছে বড়োবউদি। একা থাকে বলে মাকে দেখার দায়িত্বটা নিতে হয় শিউলিকেই। অথচ এটা তো ওদেরই করার কথা। তবুও করে শিউলি। কারণ মা ওর কাছে এলে একটু প্রাণ খুলে বাঁচতে পারে, দুটো মনের কথা বলতে পারে। মা ওদের কাছে এখন উচ্ছিষ্ট বস্তু, নেহাত ফেলে দিতে পারে না তাই রেখেছে।

মায়ের অবদান ওরা মানে না। বড়দার ডাক্তারি পড়া প্রায় বন্ধ হতে বসেছিল। মা নিজের গয়না বন্ধক রেখে বাবার হাতে টাকা তুলে দিয়ে বলেছিল, আমরা আধপেটা খেয়ে থাকব, কিন্তু ওর পড়া বন্ধ করতে দেব না। বড়দা ডাক্তারি পাশ করল। ধীরে ধীরে যত ওর পসার বাড়তে লাগল, একটা চমকপ্রদ বিলাসবহুল জীবন নাগালের মধ্যে ধরা দিল, বড়দা তত বেশি করে অতীতটাকে ঝেড়ে ফেলতে চাইল। অতীত যেন একটা সিঁড়ি, শুধু ওপরে ওঠার কাজে লাগে। এ কেমন ওপরে ওঠা! ভেবে পায়নি শিউলি।

বখাটে, বাউন্ডুলে মেজদা যখন বন্ধু-বান্ধব আর রাজনীতির চক্বরে পড়ে উচ্ছন্নে যেতে বসেছিল, বাবা হাল ছেড়ে দিলেও মা কিন্তু বুক চিতিয়ে লড়েছিল। একটু একটু করে তুলে এনেছিল ডুবন্ত ছেলেকে। পায়ের তলায় মাটি দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল শক্ত ভূমিতে। মেজদা এখন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে রয়েছে ওর কারবার। সুযোগ পেলেই উপদেশ দেয়, মানুষ নিজেই নিজের ভাগ্যের নির্মাতা। অর্থাৎ ওর ভাগ্যের বাড়বাড়ন্তের মাঝখানে কেউ নেই, কেউ কোনও দিন ছিল না। কত বড়ো বেইমান! ওদের জীবন কাহিনি তো শিউলির জানা। কী করে পারে এত বড়ো মিথ্যে বলতে?

শিউলির ডিভোর্স নিয়েও কম কথা বলেনি ওরা। বড়দা তো সুযোগ পেলে এখনও শোনায়– ডিসিশনটা একটু বেশি তাড়াতাড়ি নিয়ে ফেললি বুড়ি… আর একটু ভাবতে পারতিস।

বড়দার সাথে সমান ভাবে তাল মিলিয়ে গেছে বড়োবউদি, মেজদা, মেজবউদি। আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী সবাইকে বলে বেড়িয়েছে, দোষটা আসলে শিউলির-ই। সুযোগ বুঝে দেবদাস নিজেকে দেবদূত প্রতিপন্ন করার সব চেষ্টাই করে যাচ্ছে। ওদের সাথে দেবদাসের এখনও যোগাযোগ আছে, জানে শিউলি। পর হয়ে গেছে শিউলিই। বড়দা, মেজদা কেউই দরকার ছাড়া কথা বলে না শিউলির সাথে। দরকার বলতে অবশ্য একটাই, সেটা হল মা। মায়ের জন্য ওদের ফরেন টুর আটকে যায়, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার ভীষণ ক্ষতি হয়। স্বাভাবিক আনন্দ উৎসবে একটা বিষাদের ছায়া হয়ে সব আনন্দটাকে শুষে নেয় মা। সেই বিষাদমূর্তিকে শিউলির ঘাড়ে চাপিয়ে ওরা মাঝেমধ্যে একটু আনন্দ উপভোগের অবকাশ পায়। মায়ের মৃত্যুর সাথে সাথে শিউলির এই কদর এক লহমায় ধূলিসাৎ হবে জানে শিউলি।

বলার কিছুই নেই, তবুও বড়ো বউদি খোঁটা দিতে ছাড়ল না– ‘মা ছেলের কাছে আসবে, থাকবে, এ তো ভালো কথা। এই কর্তব্য তো করতেই হবে। তোমার দাদাও সে কথা বলে। কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি শিউলি, তোমার মায়েরও কিছু দোষ আছে গো। সব ব্যাপারে নাক না গলিয়ে উনি থাকতে পারেন না। সংসারটা আমাকে সামলাতে হয়। হঠাৎ করে উনি মাঝখানে না বুঝেশুনে মন্তব্য করে বসলে কেমন লাগে বলো তো?’

শিউলি জবাব দিতে গিয়েও থেমে গেল। মাকে ভালো করেই চেনে শিউলি। একসময় স্কুলের দিদিমণি ছিল। যথেষ্ট ব্যক্তিত্বময়ী মহিলা। সেই তুলনায় বিদ্যে ও ব্যক্তিত্বের দৗড়ে অনেক পিছিয়ে বড়োবউদি ও মেজবউদি দুজনেই। আর এখানেই বউদি-দের সমস্যা। মায়ের ব্যক্তিত্বের মোকাবিলা করতে না পেরে এভাবে বদনাম করে বেড়ায়।

বড়োবউদির পক্ষ নিয়ে বড়দা বলল– ‘কথাটা সত্যি রে। মা আজকাল কেমন জানি হয়ে গেছে। সব কিছুতেই বড্ড বেশি রিআ্যক্ট করে। আরে বাবা, তোমার বয়স হয়েছে, খাও দাও, রেস্ট করো। সব কথার মাঝখানে যাওয়ার কী দরকার? যাইহোক যাওয়ার আগে সেই কথাটা মাকে একটু ভালো করে বুঝিয়ে দিয়ে যাস।’

এসব কথা মাকে বলার প্রয়়োজন বোধ করেনি শিউলি। বলা মানে ওদের মিথ্যেটাকে প্রশ্রয় দেওয়া। কেন বলবে এসব?

প্রণাম করে বেরিয়ে আসার সময় মায়ের সজল চোখের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতর কেমন জানি করে উঠল। কোনওরকমে বলল– ‘লেখাটা থামিও না মা। আমি পৌঁছে ফোন করব।’

শিউলির স্কুলটা কলকাতা থেকে ঘণ্টা তিনেকের পথ। এমন একটা দূরত্ব, না ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করা যায়, না ওখানকার গ্রাম্য পরিবেশে থাকা যায়। শেষপর্যন্ত স্কুলের কাছাকাছি একটা গঞ্জ এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়েছে দুজনে মিলে। ইচ্ছে করলেই ছুটির দিনগুলোতে কলকাতায় আসতে পারে। কিন্তু আসে না। উঠবে কোথায়? ডিভোর্সের পর নিজের ঘর বলতে তো আর কিছু নেই। বড়দা বা মেজদার বাড়িতে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। ওরাও সেটা বোধহয় চাইবে না। সব মিলিয়ে শিউলি এখন কলকাতা থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন বলা যায়।

সুধাদেবী ব্যালকনিতে দাঁড়িয়েই রইলেন যতক্ষণ না শিউলির গাড়ি গলি পেরিয়ে বড়ো রাস্তায় অদৃশ্য হল। মেয়েটা চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ একটা অসীম শূন্যতা গ্রাস করে রাখল সুধাদেবী-কে। মেয়েটা তার অন্য রকম। ছেলে দুটোর মতো স্বার্থপর, বিবেকহীন নয়। তবু মেয়ে তো ! ওর কাছে থাকতে মন চাইলেও উপায় থাকে না। ওর দিকটাও দেখতে হয়। ওর অসুবিধাগুলো নিজের চোখে দেখে এসেছেন সুধাদেবী। স্থায়ী কোনও কাজের লোক নেই। ঠিকে কাজের মেয়েটা অসম্ভব কামাই করে। এই অবস্থায় শিউলি চাকরি সামাল দেবে, না মায়ের সেবা করবে? তবুও ওর মধ্যেই যথাসাধ্য করে যাচ্ছিল। কিন্তু সুধাদেবীরই ভালো লাগছিল না। জেদটা তিনিই ধরেছিলেন। নিজের সুখের জন্য ওকে কষ্টে রাখতে মোটেও ভালো লাগছিল না।

একসময় অলস পায়ে ঘরে এসে ঢুকলেন। কিছুই ভালো লাগছিল না। বারবার শিউলি আর মণিদীপার কথা মনে পড়ছিল। ওর স্কুলের আর এক দিদিমণি। ওরা দুজনে মিলেই একটা বাড়ির দুটো পার্টে ভাড়া নিয়েছে। মণিদীপা শিউলির চেয়ে বছর তিন চারেকের বড়ো। ভারি আন্তরিক স্বভাবের মেয়ে। ওর বাড়ি ঘর, স্বামী, সন্তান সবই আছে। কিন্তু দূরত্বের কারণে ভাড়া নিতে হয়েছে। ছুটির দিনগুলো বাড়িতে কাটিয়ে আসে। ওই মেয়েটা-কেও ভালোবেসে ফেলেছেন সুধাদেবী। আসার সময় কান্না চেপে রাখতে পারেননি। মণিদীপাও কাঁদছিল।

এখন আর বেশি কথা বলেন না সুধাদেবী। অবসর সময় লেখালেখি করেন। একটা সময় লেখার অভ্যাস ছিল। মাঝখানে ছেদ পড়ে গিয়েছিল। শিউলির তাগিদেই আবার শুরু। সেসব সত্যিকারের সাহিত্য হয়ে ওঠে কিনা বুঝতে পারেন না। তবে লিখতে ভালো লাগে। মনের জমে থাকা কথাগুলো একটা পথ খুঁজে পায় যেন। শিউলি পড়ে। পড়ে বলে, দারুণ লিখেছ মা, আরও লিখে যাও। হয়তো মন জোগানোর জন্য বলে। তবুও সুধাদেবী খুশি হন।

সুধাদেবীর এই পরিবর্তন দেখে তার বড়োবউমা তো হেসেই অস্থির! ছেলেরাও…

–খাতা ভর্তি করে এসব হিজিবিজি কী লিখছেন মা?

সুধাদেবী হাসেন– ওসব তুমি বুঝবে না মা। আমিও কী সব বুঝি? মন বলে, আমি লিখে যাই। সব সময় বকবক করার চেয়ে তো ভালো। এই জগতের মধ্যেই এ এক আলাদা জগৎ যেন। চাইলে তুমিও পড়তে পারো।

–দূর… ওসব পড়ার সময় কোথায় আমার?  ওতে আপনি কী লিখবেন সেটা তো বুঝতেই পারছি। নিশ্চয়ই আমাদের নিন্দা দিয়ে ভরিয়ে রেখেছেন। আমরা আপনাকে কতভাবে কষ্ট দিই এই সবই তো?

–তোমাদের নিন্দা গাথা লিখে আবার তোমাদেরকে সেটা পড়তে দেব… এটুকু বোধও তোমার কাজ করল না? না পড়েই তুমি অদ্ভুত একটা মন্তব্য করে দিলে। ওসব কথা আমি লিখিনি। কেন লিখব? তোমাদের নিন্দে করা মানে তো আমার নিজেকেই নিন্দে করা। এই বয়সে এসে আর জীবনটাকে নীচে নামাতে ইচ্ছে করে না। যদি কোনওদিন মনে হয়, একটু পড়ে দেখো। আসলে আমার লেখার মধ্যে দিয়ে আবার একবার নিজেকে দেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। পুরোনো আমিটাকে দেখতে গিয়ে দেখছি, সারা জীবনে কত না ভুল করেছি!

–বাববা… এইটুকু লিখেই তো দেখছি আপনার মাথা ঘুরে গেছে। এসব পোকা কী শিউলি আপনার মাথায় ঢুকিয়েছে?

–যদি ঢুকিয়েই থাকে অন্যায় তো কিছু করেনি। সবদিক থেকেই ভালো হয়েছে। মাঝখানে আমি কেমন জানি হয়ে গেছিলাম! তোমাদের অহেতুক বিরক্ত করতাম। তখন বুঝতাম না, এখন একটু একটু করে তফাতটা বুঝতে পারছি। ভালো করে বেঁচে থাকতে হলে নিজস্ব একটা জগৎ তৈরি করে নিতে হয়। শিউলি সেটাই শিখিয়েছে আমাকে। শিউলির জায়গায় তুমিও হতে পারতে সেটা। সব সময় মা-ই যে শেখাবে এমন তো কোনও কথা নেই। কখনও কখনও মেয়েরাও মাকে অনেক কিছু শিখিয়ে দিতে পারে।

–আপনারা দুজনেই স্কুলের দিদিমণি, কত কিছু জানেন। আমরা তো আবার ওসব হতে পারিনি। ঘরদোর, সংসার, ছেলে-পুলে এসব নিয়েই কাটিয়ে দিলাম। শিউলি একদিক থেকে ভালোই করেছে। একটা মুক্ত, স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারছে। নিজের মতো যেমন খুশি চলতে পারছে। বাধা দেওয়ার কেউ নেই।

ইঙ্গিতটা ধরতে অসুবিধা হল না সুধাদেবীর। নোংরা ঘেঁটে যার আনন্দ, তার মন সব কিছুতেই নোংরা দেখে। সুধাদেবী কোনও কথা বললেন না। এসব কথার কোনও প্রতিবাদ হয় না। প্রতিবাদ করতে গেলে সেটার অন্য ব্যাখ্যা করে এক্ষুনি কাদার মধ্যে নামিয়ে আনা হবে, জানেন সুধাদেবী। হয়তো সেটাই চাইছে তার বড়োবউমা। কিন্তু সতর্ক সুধাদেবী আজ সেই সুযোগটা দিলেন না।

দেবদাস এখন এ বাড়িতে নিয়মিত আসা যাওয়া করছে।

খাওয়া-দাওয়া, হই-হুল্লোড়, সবকিছুতেই ওর ডাক পড়ে। সুধাদেবীর কয়েক মাস অনুপস্থিতির সুযোগে ওরা এটা নিয়ম বানিয়ে ফেলেছে। সুধাদেবী অবাক হন। কেমন ভাই তোরা? যে-ছেলেটা তোদের বোনকে অপমান করে ডিভোর্স দিল, তার সাথেই তোরা এভাবে মেলামেশা করছিস? বোনের মনে কতটা কষ্ট হবে একবারও ভেবে দেখলি না? বউমাদের আদিখ্যেতা দেখলে মনে হয় ওরা ইচ্ছে করেই আরও বেশি করে এসব করছে।

সুধাদেবী ওদের পাতা ফাঁদে পা দিলেন না। এখন কিছু বলতে যাওয়া মানেই ওদের হাতে ঝগড়ার উপাদান তুলে দেওয়া এবং সবশেষে সবার কাছে ‘দজ্জাল বুড়ি’ হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করার সুযোগ করে দেওয়া। হঠাৎ সুধার মনে হল, শিউলি কী এসব জানে? আজ না জানলেও একদিন তো ঠিক জানতে পারবে। তখন? সেদিন অসম্ভব কষ্ট পাবে মেয়েটা। বউদিরা না হয় পরের মেয়ে, কিন্তু নিজের দাদারা কী করে এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে? এমন ছেলেদের পেটে ধরেছিলেন তিনি? কেমন জানি অসহায় লাগে সুধাদেবীর।

কিন্তু সহ্যের তো একটা সীমা থাকে। সেটারই বাঁধ ভেঙে গেল একদিন। শিউলিকে নিয়ে ওরা সেদিন ওনার সামনেই যা নয় তাই শুরু করে দিল। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না সুধাদেবী। নিজের ছেলে বউমাদের না ধরে সরাসরি দেবদাসকেই ধরলেন। –তুমি কেমন ধরনের ছেলে বাবা! লজ্জা শরম বলে কী কিছুই নেই তোমার শরীরে? এভাবে এই বাড়িতে তোমার আসাটা কি ঠিক বলে মনে করো তুমি? কোন সম্পর্কের ভিত্তিতে তুমি এখানে আসো? একসময় তুমি আমাদের জামাই ছিলে, এখন তো নেই তাই না?

দেবদাস রাগ দেখাল না। খুব শান্ত ভাবে মাথাটাকে হেলিয়ে ঠোঁটের কোণে একটা দুষ্টু হাসি খেলিয়ে বলল– ‘এসব কথা আমাকে না বলে ওনাদের-কে বলুন না। বড়দাই তো আমাকে ডেকে আনেন। আমি যে ইচ্ছে করে আসি তা কিন্তু নয়।’

সুধাদেবী বড়োছেলে তথাগতের দিকে তাকালেন।

তথাগত ভীষণ অপ্রস্তুত। বড়োবউমা সুতপা অবস্থা বেগতিক দেখে ড্যামেজ কন্ট্রোলে নেমে পড়ল। –আপনি বোধহয় ভুলে গেছেন মা, দেবদাস একজন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ। ডাক্তারদের সাথে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ-দের একটা সম্পর্ক থাকে। বিজনেস ফিল্ডে দেবদাসের খুব নাম। আপনার মেয়ে ওর সাথে সম্পর্ক রাখতে পারেনি। তার দায় আপনি সবার ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। দেবদাস তবুও নানা ভাবে আপনার ছেলেকে হেল্প করে। নেহাত ওর বড়ো মন তাই।

সুধাদেবী ভীষণ অবাক হন। বিজনেসের সম্পর্ক আর পারিবারিক সম্পর্ক এক হল! কথাগুলো শিউলিকে আর না জানিয়ে পারলেন না। অন্য লোকের মুখে শোনার চেয়ে নিজের মায়ের মুখেই শুনুক নির্মম সত্যটা। ফোনে সবটাই খুলে বললেন।

সব শুনে শিউলি হেসে বলল– ‘আমি সব জানি মা। তুমি এসব নিয়ে মন খারাপ কোরো না। কাউকে কিছু বলতেও যেও না।’

সুধাদেবী অবাক হয়ে বলেন– ‘কার মুখে শুনলি তুই এসব? কে বলল?’

–বড়োবউদিই বলেছে। বলে অনেক আনন্দও পেয়েছে। আসলে দেবদাস ওদের কোম্পানি থেকে বড়দাকে একটা ইউরোপ টুরের বন্দোবস্ত করে দিচ্ছে। পুরো ফ্যামিলি সমেত। সমস্ত খরচা ওরাই দেবে। তার জন্যেই এত খাতির যত্ন। হয়তো মেজদাও কিছু সুযোগ পাবে। শুধু তাই নয়, ওরা সবাই মিলে দেবদাসের জন্য একটা পাত্রীরও সন্ধান করেছে। বড়োবউদি যে-পাত্রীর খবর দিয়েছে, ঘটনাক্রমে মেয়েটি আমার চেনা। ওরা অবশ্য সেটা জানে না। ওই মেয়েটাই ফোনে আমার সাথে যোগাযোগ করেছিল। গল্পের ছলে জানতে চাইছিল, ডিভোর্সটা কেন হয়েছিল।

–তুই কী বললি? সত্যিটাই বলে দিয়েছিলি তো…?

–আমি শুধু বলেছি, এসব প্রশ্ন আমাকে কোরো না, কারণ আমার উত্তর তোমার কাছে একতরফা লাগবে। ওর সাথে কথা বলে যেটুকু বুঝলাম তাতে বড়দা, বড়োবউদি ডিভোর্সের সমস্ত দায় আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে ভালো রকমের ব্রেন ওয়াশ করে দিয়েছে। তারপরে অবশ্য আর কোনও প্রশ্ন করেনি। তবুও বিয়েটা যদি কোনও ভাবে ভেঙে যায়, দোষটা ঘুরেফিরে আমার ঘাড়েই এসে পড়বে জানি। আমার কপালটাই বোধহয় এমন!

কিছুক্ষণ কোনও কথা বলতে পারলেন না সুধাদেবী। ফোনের ওপার থেকে ক্লিষ্ট হাসি হেসে শিউলি বলল– ‘বুঝতে পারছি এসব দেখেশুনে তুমি খুব কষ্ট পাচ্ছ। কিন্তু এটাই তো সত্যি মা। সত্যি নির্মম হলেও তাকে মেনে নিতেই হয়। তোমার মেয়ের ভাগ্যটাই যে এমন! তবে বেশি ভাবার কিছু নেই। আমি তো একেবারে জলে পড়ে নেই। দু-মুঠো অন্ন সংস্থানের ব্যবস্থা তো আছে। কেউ তোমার মেয়েকে মাটিতে ফেলে পিষে অন্তত মারতে পারবে না। লতানো গাছেরাও পৃথিবীতে বেঁচে থাকে মা।’

সুধাদেবী অসহায় ভাবে বললেন– ‘কিন্তু একটা অবলম্বন লাগে তাদের… বাড়তে, ফুল দিতে, ফল দিতে। আমি বলি কি, তুই একটা বিয়ে করে নে মা। দেবদাস যদি করতে পারে, তবে তুই কেন পারবি না?’

শিউলি হেসে বলল– ‘তুমি কী আমাকে প্রতিযোগিতায় নামাতে চাইছ?’

তারপরেই অন্যমনস্ক ভাবে বলল– ‘বিয়ে মানে তো দেবদাসের মতো পুরুষের সাথে একটা বন্দোবস্ত। যে-বন্দোবস্তে একতরফা ভাবে কতকগুলি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পরাজিত পক্ষের মতো মেয়েদের-কেই সব সময় চুক্তির সমস্ত শর্ত মেনে নিতে হয়। না মানলেই শর্ত লঙঘনের দায় চাপিয়ে চলে পেষণ। তবে এটাও মানি, সহমর্মী পুরষেরাও এই পৃথিবীতেই থাকে। যদি কখনও তেমন কারও সাথে দেখা হয়ে যায়… অবশ্যই বিয়ে করব।’

সুধাদেবী আর কোনও কথা বললেন না। অদ্ভুত একটা অনুভূতি খেলে গেল তার মস্তিষ্কে। তার মনে হল, আর একটা সুধা যেন তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে নিঃশব্দে চলে গেল বহু দূরে শিউলির ঘরে। শিউলির মাথায় হাত রেখে সে পরম মমতায় বলল, ‘অন্তরের টান থাকলে মানুষ সব পায়। অন্তরের শক্তিই তাকে সব এনে দেয়। টাকা, গাড়ি, বাড়ি নয়… তুই শুধু একটু ভালোবাসা চেয়েছিস। ঠিক পাবি মা! এ আমার আশীর্বাদ। মায়ের আশীর্বাদ কখনও বিফলে যায় না।’

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব