মৃত্যু রহস্য

ঘরে ঢুকতেই দেব আশ্চর্য হয়ে গেল। নয়না আর রাজেন কিছু একটা আলোচনায় এতটাই মশগুল যে দেবের উপস্থিতি টেরই পেল না। দেব-ও এই দৃশ্য চোখের সামনে দেখবে একেবারেই ভাবেনি। দুজনের মুখোমুখি বসে কথা বলা সত্যি করেই এক অভাবনীয় দৃশ্য।

‘বাবাঃ কী এত আলোচনা চলছে? সারা বাড়িতে একটা পিন পড়লেও শোনা যাবে মনে হচ্ছে। এত কী গোপন কথোপকথন?’ দেব খানিক অপেক্ষা করে জিজ্ঞেস করল। দুইজনেই চমকে মাথা তুলল। দুজনকেই খুব চিন্তিত মনে হচ্ছিল।

‘সব ঠিকঠাক তো?’ দেব আবার প্রশ্ন করল।

‘হ্যাঁ রে ভাই, বাড়িতে তো সবকিছু

ঠিক-ঠাকই আছে…’

‘তাহলে তোদের এত চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন?’ রাজেনকে থামিয়ে দেব জিজ্ঞেস করল।

‘সেটা ঝুমার জন্য ভাই।’ নয়না উত্তর দেয়, ‘তাও বলতে পারিস প্রায় বিনা কারণে… বুঝতেই পারছি না কী করে ওকে সাহায্য করব।’

ঝুমা নয়নার সব থেকে কাছের বান্ধবী এবং রাজেনেরও যে ঝুমার প্রতি একটা বিশেষ দুর্বলতা রয়েছে এটাও দেবের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে অনেকবারই ধরা পড়ে গেছে।

‘খুলেই বল পুরোটা, আরাম করে সোফায় গা এলিয়ে বসল দেব, ‘এমনও হতে পারে যে আমি তোদের কিছুটা সাহায্য করতে পারব।’

রাজেনই মুখ খোলে, ‘আরে আগে তো সবই ঠিকঠাক ছিল, অলোকের দাদু খুন হওয়ার পর থেকেই যে দিদির কি হল, বিয়ে করতে কিছুতেই রাজি হচ্ছে না… দিদি… মানে ঝুমার দিদি সীমাদি।’

রাজেনের কথা শেষ হওয়ার আগেই নয়না বিরক্তি ভরা কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘খুনের সঙ্গে ঝুমা বেচারির কি লেনদেন? যাক গে, ঝুমার জন্য ভাই কিছু তো করতেই পারে, তারপর দেবের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তুই তো জানিস, ঝুমাও রাজেনের সঙ্গেই এমবিএ-র জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়েছে আর ও শিওর যে ভালো কোথাও ও চান্স পেয়েই যাবে। কিন্তু ওর বাড়ির লোকেরা চাইছে পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবার আগেই ওর বিয়ে দিয়ে দিতে। শ্বশুরবাড়ি যদি রাজি হয় তাহলে ওখান থেকেই ও পড়াশোনা চালাতে পারে। টাকাটা কোনও ব্যাপার নয়… ঝুমার বাবা-ই মেয়ের পড়ার সব খরচ দেবেন বলেছেন।’

‘বিয়ে কার সঙ্গে ঠিক হয়েছে?’ দেব জানতে চায়।

‘ঝুমা কাউকে বিয়ে করতে চায় কিনা ওরা জানতে চেয়েছে। এমনকী ছেলেটি যদি ছাত্র হয় তাহলেও ওদের আপত্তি নেই। পাত্রেরও পড়াশোনার সব খরচ দিতে রাজি ঝুমার বাবা। আর যদি ঝুমার নিজের পছন্দ কিছু না থাকে তাহলে ওরাই উপযুক্ত পাত্রের সন্ধান করবে ঝুমার জন্য।’

‘তার মানে কোনও ভাবে ঝুমার তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিতে চান ওনারা, কিন্তু কেন?’ দেব আশ্চর্য হয়।

দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে নয়না, ‘কারণ হল ঝুমার দিদি সীমাদি এবং ওর অদ্ভুত আচরণ। ঝুমাদের বাড়ির কাছেই অলোকের বাড়ি। ছোটো থেকেই সীমাদি আর অলোকের বন্ধুত্ব এবং পরে সেটা ভালোবাসায় পরিণত হয়। কারও বাড়িতেই বিয়ে নিয়ে আপত্তি ওঠেনি সুতরাং বিয়ের দিনও স্থির হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ-ই সীমাদি জানিয়ে দেয় ও অলোককে বিয়ে করবে না এমনকী অন্য কোনও ছেলেকেও বিয়ে করতে রাজি নয়। কারণ জিজ্ঞেস করলে জানায় ওর নাকি একটু সময় দরকার। মনস্থির করতে বাড়ির লোকেরা ওকে দুবছর সময় দিয়েছে, কিন্তু এখন সীমাদি আরও সময় চাইছে। বাড়ির লোকেরা পড়েছে মুশকিলে। ওদের ধারণা সীমাকে চাকরি করতে দিয়ে ওরা ভুল করেছে। এই একই ভুল ওরা ঝুমার বেলায় করতে চায় না।’

‘সীমার বিয়ে না করার কারণটা কী?’ জানতে চায় দেব।

‘এটাই তো কিছুতেই বলছে না ও। কারণ জানতে পারলে তো ঝুমাও সবাইকে নিজের দিকটা বোঝাতে পারত। পড়াশোনা শেষ করে ও বিয়ে করতে প্রস্তুত কিন্তু এখন এমবিএ-র জন্য পড়াশোনা আর বিয়ে দুটো একসঙ্গে করাটা একেবারেই অসম্ভব ওর পক্ষে।’

‘হ্যাঁ, এটা তো হল… কিন্তু খুনের ব্যাপারটা কী বলছিলি রাজেন?’

দেব, পুলিশকে নানা তথ্য দিয়ে সাহায্য করে এমনকী অনেক বড়ো মার্ডারের ঘটনায় পুলিশকে আসামী ধরিয়ে দিতেও যে দেবের অনেক অবদান আছে, ভাইয়ের এই গোপন পরিচয়টা রাজেনের অজানা ছিল না। তাই চিত্রটা পরিষ্কার করে তুলে ধরার জন্য দেবকে বলল রাজেন, ‘সীমা আর অলোকের বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার প্রায় আড়াই মাস পরে হঠাৎ-ই অলোকের দাদু খুন হন। খুনের কারণ এবং খুনির পরিচয় আজ পর্যন্ত অজানা।’

‘কিন্তু খুনের সঙ্গে সীমার বিয়েতে রাজি না হওয়ার কী সম্পর্ক, বিরক্ত হয়ে নয়না জানতে চায়।

‘হতেও পারে, সীমা আর অলোক নামটা খুব পরিচিত লাগছে, খানিকটা ভেবে দেব আবার বলে, ‘আচ্ছা এরা কি শকুন্তলা পার্কের কাছে একই পাড়ায় থাকে?’

‘হ্যাঁ, তো, নয়না বলে, ‘তুই জানলি কী করে?’

‘তুই আর রাজেন আমার থেকে এতটা ছোটো তবুও আমাকে তুই তোকারি করিস, গুরুত্ব দিতে চাস না আমাকে। সবাই কি আর তোদের মতো? সীমা আর অলোক কলেজে আমার দু’বছরের জুনিয়র ছিল। কলেজে থাকতে আমার নির্দেশনায় ওরা নাটকে অভিনয় করেছে। অখিল ভারতীয় নাটক প্রতিযোগিতা-তে আমার একটা নাটক একবার চান্স পেয়েছিল। সেটা মঞ্চস্থ করতে আমাকে অন্য শহরে যেতে হয়েছিল। সেই গ্রুপে ওরাও ছিল এবং তখন ওদের সঙ্গে আমার ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়। মনে আছে অলোককে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম সীমাকে ও বিয়ে করবে কিনা এবং তাতে ও সিরিয়াসলি জানিয়েছিল যে ও সীমাকে বিয়ে করবে।’

‘হ্যাঁ, অলোক নয়, সীমাদি বিয়ে করবে না বলেছে। মধ্যে অলোক-ও কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল, তাই বিয়ের কথা চাপা পড়ে গিয়েছিল কিন্তু এখন অলোক সীমার বাড়িতে জানিয়েছে যে ও বিয়ের জন্য প্রস্তুত। ভাই তুই যখন ওদের দুজনকেই চিনিস তাহলে অলোকের সঙ্গে একটা কথা বল না, আশার আলো দেখে নয়না।

‘সীমা যেখানে বিয়ে করবে না বলছে সেখানে অলোকের সঙ্গে কথা বলে কী হবে? বরং সীমার সঙ্গে দেখা করার একটা ব্যবস্থা করে দে।’

‘ঠিক আছে তুই যবে বলবি। বিয়ে ছাড়া আর কিছুতে ওর না নেই, নয়না বলে, ‘মানে কারও সঙ্গে দেখা করতে ওর কোনও অসুবিধা নেই। কাল বরং সন্ধেবেলায় আমি ঝুমাদের বাড়ি চলে যাব আর পরে তুই আমাকে ওখানে নিতে আসিস।’

‘তাহলে কাল অফিস থেকে বেরোবার আগে তোকে ফোন করে দেব যাতে তুই সীমার সঙ্গে কথা বলার একটা সুযোগ করে দিতে পারিস।’

পরের দিন দেব যখন নয়নাকে নিতে ওখানে পৌঁছোল তখন ড্রইংরুমে বসে সীমা, ঝুমার সঙ্গে নয়নার জোর আড্ডা চলছে।

দরজা খুলে দেব-কে দেখে সীমা আশ্চর্য হয়ে গেল, ‘স্যার আপনি?’

‘আরে সীমা যে, তুমি এখানে?’ দেবও আশ্চর্য হওয়ার ভান করে। তারপর নয়না আর ঝুমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘আরে সীমা আমার নাটকের পাত্রী। আমি যেহেতু নাটকের ডিরেক্টর এবং সিনিয়র, স্বাভাবিক ভাবে তাই ও-ও আমাকে ‘স্যার-ই সম্বোধন করে। ঝুমা তুই তো কখনও আমাকে বলিসনি যে তোর দিদি অখিল ভারতীয় নাটক প্রতিযোগিতার বিজেতা?’

‘নয়নাও কখনও আপনার সম্পর্কে কিছু বলেনি। এখনকার মেয়েগুলোর অন্যদের সম্বন্ধে কিছু বলার সময় কোথায়?’ সীমা কপট রাগ দেখায়, ‘স্যার ভালোই হয়েছে আপনার সঙ্গে দেখা হওয়াতে। আপনার মতামতের একটু দরকার ছিল। একটা দিন আমাকে একটু সময় দিতে পারবেন?’

‘একটা দিন কেন? আজ-ই এক্ষুনি কথা হতে পারে তবে এক কাপ চায়ের বদলে, বলে দেব মুচকি হাসে।

‘চা না খাইয়ে এমনিতেও আপনাকে ছাড়তাম না, বলে ঝুমা উঠে দাঁড়ায়, ‘দিদি তুই দেবদাকে নিয়ে ও-ঘরে বসে নিশ্চিন্তে কথা বল, আমি চা করে নিয়ে আসছি। মা-বাবার ফিরতে এখনও অনেক দেরি।’

সীমার ঘরে এসে বসতেই দেব জিজ্ঞেস করল, ‘অলোকের কী খবর? অনেকদিন ওর সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই।’

লম্বা নিঃশ্বাস টেনে সীমা উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ পাড়াতেই রয়েছে তবে দেখাসাক্ষাৎ হয় না বললেই চলে।’

‘কেন? ব্যস্ততার কারণে নাকি ঝগড়া হয়েছে?’

‘কোনওটাই নয় স্যার। আমারই হয়তো ভুল বোঝার কারণে এমনটা হয়েছে, একটু চুপ থাকে সীমা, তারপর আবার বলে, ‘ওই ব্যাপারেই আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আপনার সম্পর্কে কাগজে প্রায়শই লেখা দেখতে পাই। অনেকবার দেখা করার কথাও ভেবেছি কিন্তু কী করে সেটা বুঝতে পারিনি। আমার মনে হয় অলোক নিজের দাদুকে খুন করেছে।’

দেব মনে মনে চমকে ওঠে, তবে কি এটাই কারণ অলোককে বিয়ে না করার? কিন্তু মুখে গাম্ভীর্য বজায় রেখেই জিজ্ঞেস করে, ‘সন্দেহ করার কারণ?’

‘যে রাতে অলোকের দাদু খুন হন আমি একটা নেমন্তন্ন বাড়ি থেকে রাত করে বাড়ি ফিরেছিলাম। আমি অলোককে ওদের বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে গাছ ধরে পালাতে দেখেছি। কিন্তু অলোক বলছে ও তখন ওদের উলটো দিকের রাস্তার ওপারে বন্ধুর বিয়ের প্যান্ডেল-এ ব্যস্ত ছিল। ওখানেই ও দাদুর মৃত্যুর খবরটা পায়।’

‘কিন্তু তোমার মনে হয় যাকে তুমি পালাতে দেখেছ সে অলোক?’

‘হ্যাঁ স্যার। খুনের কারণ এখনও বোঝা যাচ্ছে না। বাড়ি থেকেও কিছু চুরি হয়নি আবার অলোকের দাদুর সঙ্গে কারও শত্রুতাও ছিল না।’

‘ওনার মৃত্যুতে কারও ব্যক্তিগত লাভের সম্ভাবনা আছে কি?’

‘একমাত্র অলোকেরই লাভ হতে পারে যতদূর আমি জানি। এমনিতে সকলেই জানে যে অলোককেই ওর দাদু নিজের সমস্ত সম্পত্তি লিখে দিয়ে গেছেন।’

‘সীমা তুমি যা কিছু জানো বা যা সন্দেহ করছ সব আমাকে পরিষ্কার করে খুলে বলো। কথা দিচ্ছি আমি যতটা পারব তোমাকে সাহায্য করব।’

‘মায়ের একদম ইচ্ছে ছিল না যে আমি কলেজে লেকচারারের কাজ করি। কারণ মায়ের মনে হয়েছিল লেকচারার হলে যেহেতু অলোক ওর দাদুর টিভি, ফ্রিজের শোরুমে বসে আর দাদুর ব্যাবসাটার দেখাশোনা করে সেহেতু আমি অলোককে বিয়ে করতে রাজি হব না। অলোক নিজেও টিভি ফ্রিজের ব্যাবসাটা চালাতে চাইছিল না। ওর ইচ্ছে ছিল বিদেশি কম্পিউটারের এজেন্সি নেওয়ার। বাবার সঙ্গেও আলোচনা হয়েছিল যে এজেন্সি নেওয়ার জন্য কোনওরকম আইনি বাধ্যবাধকতা পেরোতে হবে কিনা। পরে খবরাখবর নিয়ে জানা যায় এজেন্সি নেওয়ার জন্য আইনি কোনও জটিলতা নেই। আমার মা-ও নিশ্চিত হন যে লেকচারার মেয়ে কম্পিউটার বিক্রেতা-কে বিয়ে করতে রাজি হবে।

কিন্তু বেঁকে বসেন অলোকের দাদু। যদিও শোরুম অলোকের নামেই লিখে দিয়েছিলেন উনি কিন্তু ব্যাবসার চাবিকাঠি ওনার হাতেই ছিল। ওনার বক্তব্য ছিল টিভি, ফ্রিজের মতো কম্পিউটার, দৈনন্দিন প্রয়োজনীয়তার মধ্যে পড়ে না সুতরাং তার চাহিদাও সীমিত। তাই উনি জীবিত থাকতে অলোককে টিভি, ফ্রিজ বিক্রি করেই খুশি থাকতে হবে, ওনার মৃত্যুর পরই নতুন চিন্তাভাবনা করার স্বাধীনতা পেতে পারে অলোক।

দাদুর জন্যই অলোকের আইবিএম-এর এজেন্সি নেওয়ার স্বপ্ন ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। এই লোভেই ও ওর বাবা, দাদার মতো চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হতে চায়নি। ও কিছু না কিছু করে নিজের হাতখরচা ঠিকই চালিয়ে নিত, শোরুমের একটা টাকাও নিত না। দাদু মারা যাওয়ার আগেই ও আমাকে বলেছিল, কেরিয়ার তৈরি না করে ও কিছুতেই বিয়ে করবে না।’

‘অলোকের সঙ্গে কথা বলার পর তুমি কী ডিসাইড করলে?’ দেব প্রশ্ন করে।

‘আমারও স্যার, অলোকের সিদ্ধান্তই সঠিক মনে হয়েছিল। মনে মনে ভেবেই রেখেছিলাম, বিয়েটা যেমন করেই হোক পিছোতে হবে। কিন্তু বাড়িতে কিছু জানাবার আগেই অলোক আমাদের বাড়ি এল। ওকে খুব চিন্তামুক্ত দেখাচ্ছিল সেদিন। বাড়িতে আমাকে কিছু বলতে মানা করল, বলল কয়েকদিনেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কয়েকদিন পরেই আমাদের বন্ধু রঞ্জনের বিয়ে ছিল। আমরা বিয়েতে খুব মজা করেছিলাম। রাত্রে বন্ধুদের পীড়াপীড়িতে অলোক ওখানেই থেকে যায় আর আমি বাড়ির সকলের সঙ্গে নিজের বাড়ি ফিরে আসি।

অলোকের বাড়িটা আমাদের বাড়ির ঠিক পিছন দিকটায়। ওদের বাড়িতে একটা জাম গাছ আছে যেটা আমাদের ছাদের কিছুটা নিয়েও ডালপালা বিস্তার করেছে। আমি তখন ছাদের ঘরটায় থাকতাম। ওদের ছাদটাও অলোক আর ওর দাদুর ঘরের লাগোয়া ছিল। অনেকদিনই এমন হয়েছে যে ওর দাদু ঘুমিয়ে পড়ার পর অলোক জাম গাছের ডাল ধরে আমাদের ছাদে চলে এসেছে।’

দেব কথার মাঝেই সীমাকে থামিয়ে দেয়, ‘চলে এসেছে… মানে এখন আর আসে না?’

‘দাদুর খুন হওয়ার পর বাবা আমাকে একলা আর উপরের ঘরে শুতে দেয় না। হ্যাঁ স্যার যা বলছিলাম, সেদিন রাত্রে গাছের পাতার আওয়াজ হওয়াতে আমি ভেবেছিলাম বুঝি অলোক এসেছে। আমি বাইরে বেরিয়ে আসি। গাছের ডাল তখনও নড়ছিল কিন্তু ছাদে কেউ ছিল না। আমি কার্নিশ থেকে নীচে তাকিয়ে দেখি গাছ থেকে নেমে কেউ পালিয়ে যাচ্ছে। আর ঠিক তক্ষুনি দাদুর ঘর থেকে ওদের বাড়ির পুরোনো চাকর রমাদার আওয়াজ পাই যে দাদামশাইয়ের কিছু একটা হয়ে গেছে। আমি দৗড়ে নীচে এসে সবাইকে জাগিয়ে রমাদার চ্যাঁচাবার কথাটা বলি। সবাই যখন অলোকদের বাড়ি পৌঁছোই, দাদুর ঘরে গিয়ে দেখি ওনার মুখের উপর বালিশ চাপা দিয়ে কেউ ওনাকে খুন করেছে।

আমি কাউকেই বলতে পারিনি যে আমি স্বচক্ষে খুনিকে গাছ ধরে নীচে নেমে যেতে দেখেছি। মুখ দেখতে পাইনি ঠিকই কিন্তু খুনির পোশাক স্পষ্ট দেখেছিলাম রাস্তার আলোয়। অলোক বিয়েবাড়িতে সিল্কের যে কুর্তা-পাজামা পরেছিল একদম সেরকমই। বাবা আমার ছোটো ভাইকে পাঠায় অলোককে বিয়ে বাড়ি থেকে ডেকে আনার জন্য। কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম বিয়েবাড়িতে ভাই অলোককে পাবে না অথচ কিছুক্ষণ পরেই ভাই অলোককে নিয়ে আসে। আমি ভালো করে লক্ষ্য করি কিন্তু গাছে চড়া বা নামার কোনও দাগ অলোকের জামাকাপড়ে ছিল না। ও-ও সবার মতো হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল দাদুর ঘরে ঢুকে।’

‘তাহলে তোমার কেন সন্দেহ হচ্ছে যে অলোকই খুনটা করেছে?’

‘কারণ পরের দিনই পুলিশ এসে গাছের নীচে জুতোর দাগ দেখতে পায়। জুতোর দাগ দেখেই সনাক্ত করে যোধপুরী জুতোর ছাপ ওগুলি। ওই একই জুতো অলোকের পায়েতেও ছিল। অপরাধীর পালাবার তাড়া থাকাতে জুতোর পুরো ছাপ যেহেতু মাটিতে পড়েনি তাই জুতোর সঠিক সাইজ পুলিশ ধরতে পারেনি। অলোককে ওরা সন্দেহ করছিল কিন্তু ওই সময় ও যে বিয়েবাড়িতেই ছিল, বন্ধুদের সঙ্গে তোলা ছবি দিয়ে ও প্রমাণ করে দেখিয়ে দিয়েছে। পুলিশ ওকে ছেড়ে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু আমার মন বলছে ওটা অলোকই ছিল কারণ গাছ বেয়ে উপরে চড়া বা নীচে নামার রাস্তাটা ওই জানত আর দ্বিতীয়ত দাদুর মৃত্যুতে ওই সবথেকে লাভবান হল।’

‘দাদুর শ্রাদ্ধশান্তির কাজ মিটে যাওয়ার পরপরই অলোক এজেন্সি নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছিল। যেন বাড়িতে কিছুই হয়নি। আর যদি বিয়েবাড়ির ছবির কথাই বলেন, তাহলে সেই ছবি যখন খুশি তোলা হয়ে থাকতে পারে। খাবার খাওয়ার সময় থেকে বিয়েতে বসা পর্যন্ত কে আর সমানে ছবি তুলতে থাকে? ফোটোগ্রাফার-রাও তো খাবে। আর বিয়ের হল লাগোয়া খাবার জায়গা করা হয়েছিল বিয়েবাড়ির ঠিক উলটো রাস্তাতেই অলোকদের বাড়ি। লুকিয়ে একবার বেরিয়ে গিয়ে একটা বৃদ্ধ মানুষকে মুখে বালিশ দিয়ে মারতে কত আর সময় লেগে থাকবে?’

‘অলোকের সঙ্গে এটা নিয়ে কথা বলেছ?’

‘না স্যার, এই প্রথম আপনাকে সব খুলে বললাম।’

‘বিয়েটা কী বলে আটকালে?’

‘দাদুর মৃত্যুর পর সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে সম্ভবও ছিল না। অলোকও খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। বাড়িতে বাবার পরামর্শ নিতে প্রায়শই আসত কিন্তু আমি একা দেখা করাটা এড়িয়ে চলতাম। এরপর মা যখন বিয়ের জন্য তাড়া দেওয়া আরম্ভ করল, আমি পরিষ্কার বলে দিলাম যে বিয়ের জন্য আমার একটু সময় দরকার। তাছাড়া অলোকের ব্যস্ততা দেখে ওর বাড়ির সকলেও বিয়েটা পিছিয়ে দেওয়া যখন মনস্থ করল, তখন আমার বাড়ি থেকেও সকলে এটা মেনে নিল।’

‘অলোকের সঙ্গে দেখা করো না, এটা নিয়ে ও কিছু বলে না তোমাকে? দেব জানতে চায়। সীমা হেসে ফেলে বলে, ‘স্যার ওকে এটা বুঝিয়েছি যে মা আমাদের বেশি মেলামেশা করতে দেখলেই বিয়ের জন্য তাড়া দেবে। আপনিই বলুন স্যার যাকে আমি অপরাধী মনে করে সন্দেহ করি, তাকে আমি কী করে বিয়ে করব?’

‘না, না, সেটা কখনওই সম্ভব নয়। তুমি বরং দাদুর নাম আর মৃত্যুর তারিখটা বলো। আমি এই কেসটার ফাইলটা দেখি। আর সীমা, তুমি বিয়ের জন্য রাজি হয়ে যাও। বিয়ের গোছগাছ কমপ্লিট হতে হতে আশা করা যায় খুনি ধরা পড়বে। অলোক যদি অপরাধী হয় তাহলে বিয়ে এমনিই ভেঙে যাবে। আর অপরাধী যদি অন্য কেউ হয়ে থাকে তাহলে তোমার রাজি না হওয়ার বা বাড়ির লোকেদের মিথ্যা চিন্তা করাবার কি কোনও দরকার আছে?’

‘সেটা ঠিকই বলেছেন স্যার।’

রাস্তায় আসতে আসতে দেব নয়না-কে জানাল যে ও সীমাকে বিয়ে করতে রাজি করিয়েছে। সুতরাং ঝুমার আর কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

পরের দিন কমিশনারের সঙ্গে কথা বলে দেব কেসটার ফাইল বার করিয়ে নিল। যা তথ্য পাওয়া গেছে তাতে প্রায় কিছুই প্রমাণ হওয়া সম্ভব না। স্পেশাল পারমিশন নিয়ে পুলিশকে সাহায্য করার অছিলায় কেসটার দায়িত্বভার ও নিজের উপর নিয়ে নিল।

কেসটা নিয়ে আবার নতুন করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে শুনে অলোকের বাড়ির লোকেরা যেমন আশ্চর্য হল, তেমনি খুশিও হল। সবথেকে খুশি মনে হল অলোককে।

‘আমি ইচ্ছে করেই নিজেকে ব্যস্ত রাখি কারণ স্যার, সময় থাকলেই খালি মনে হয় দাদুকে কে খুন করে থাকতে পারে?’

‘এবং কেন খুন করেছে?’ দেব বাকিটা জুড়ে দেয়।

‘স্যার, দাদুর গলায় মোটা সোনার চেন, হাতের আঙুলে চারটে মোটা মোটা সোনার আংটি দামি পাথর বসানো, হাতে সোনার ঘড়ি, পাঞ্জাবিতে সোনার বোতাম লাগানো ছিল এছাড়াও আমার ল্যাপটপ, আইপ্যাড সবই টেবিলের উপর রাখা ছিল। আমার মনে হয় ওই সময় রমাদা দাদুর জন্য দুধ নিয়ে উপরে উঠছিল, ওরই পায়ের আওয়াজ পেয়ে চোর আর চুরি করার সময় পায়নি, পালিয়েছে। মধ্যিখান থেকে দাদুর প্রাণটা চলে গেল, অলোক বলে।

‘গাছে চড়া-নামার রাস্তাটা তো আর নতুন লোকের পক্ষে জানাটা সম্ভব নয়?’ সন্দেহ উঁকি মারে দেবের কথায়।

‘সেটাই তো সবথেকে আশ্চর্যের ব্যাপার। চেনাশোনার মধ্যেই কেউ খুনটা করেছে। গাছের নীচে মাটিতে জুতোর ছাপ দেখে পুলিশ প্রথমে আমাকেই সন্দেহ করেছিল। কিন্তু সেদিন আমার একটা বন্ধুর বিয়ে ছিল। ওখানে যত ছবি তোলা হয়েছে এবং প্রত্যেকটা ভিডিও ফ্রেমে আমার ছবি থাকাতে বা আমার উপস্থিতির কারণে আমি বেঁচে যাই।’

‘আমি ওই অ্যালবাম এবং ভিডিও দেখতে পারি?’

‘নিশ্চয়ই স্যার। আমি বন্ধুর বাড়ি থেকে অ্যালবাম আর ভিডিও ক্যাসেট-টা নিয়ে এসে আপনাকে ফোন করে দেব।’

প্রায় ঘন্টা দেড়েক বাদে অলোক দেব-কে ফোন করল, ‘স্যার অ্যালবামটা নিয়ে এসেছি কিন্তু ভিডিও ক্যাসেট-টা বারবার চালাবার জন্য জায়গায় জায়গায় ঘষে গেছে। তাই ওরা ওটা কোথাও রেখে দিয়েছে, এখন আর খুঁজে পাচ্ছে না। আমি অবশ্য ওদের খুঁজতে বলে দিয়েছি।’

‘ভালো করেছ। তুমি অ্যালবামটা আমার অফিসে পাঠিয়ে দাও।’

‘ঠিক আছে স্যার। আর কোনও দরকার হলে আমাকে ফোন করে দেবেন, আমি পৌঁছে যাব।’

অ্যালবাম দেখা শেষ করে দেব সীমাকে ফোন করল, ‘সীমা, সেদিন রাতে তুমি যাকে পালাতে দেখেছিলে তার কুর্তা-পাজামার রং কী ছিল বলতে পারবে?’

‘না স্যার… আলো খুবই কম ছিল। মেটেরিয়ালের শাইন আর কুর্তার লম্বাটা শুধু চোখে পড়েছিল।’

‘আচ্ছা ওই বিয়েতে অলোক ছাড়াও তো অনেকেই নিশ্চই কুর্তা-পাজামা পরেছিল। তাহলে যাকে পালাতে দেখেছিলে সেটা অলোক না হয়ে অন্য কেউ-ও তো হতে পারে।’

‘কুর্তা-পাজামা তো অনেকেই পরেছিল কারণ এখন এটাই ফ্যাশন কিন্তু ওটা অলোক-ই ছিল এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। কারণ পালাবার রাস্তাটা একমাত্র ওরই জানা এবং দাদু মারা যাওয়ায় ওরই লাভ হয়েছে সবথেকে বেশি।’

দেব তর্ক বাড়াল না কারণ সীমার কথাতে একটা জোর ছিল। কিন্তু দেবের মন সেটা মেনে নিতে পারছিল না। ছবিগুলো আবার ভালো করে দেখল। কী মনে হতে অলোককে ফোন করে ওর অফিসে আসতে বলল।

‘সব ছবিগুলোতে যে বর আর তোমরা যারা একসঙ্গে রয়েছ, সবাই তো কলেজ ফ্রেন্ড্‌স, তাই না অলোক?’ দেব জিজ্ঞেস করে।

‘হ্যাঁ স্যার, শুধু একজন ছাড়া। যে ছেলেটি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে শুধু কলেজের বন্ধু নয়।’

‘ও-ও হ্যাঁ। ও তো প্রায় প্রতিটা ছবিতেই তোমার গায়ের সঙ্গে ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে দেখছি।’

‘ও আমার বিজনেস পার্টনার স্যার, ওর নাম সৌম্য। আমেরিকা থেকে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এসেছে। আপনি নিশ্চই জানেন, আইবিএম-এর ডিলারশিপ নিতে গেলে কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ হওয়াটা মাস্ট। এছাড়াও ইলেক্ট্রনিক প্রোডাক্ট বিক্রি করার অভিজ্ঞতা এবং একই সঙ্গে এয়ারকন্ডিশনড্ শোরুম থাকাটাও জরুরি। আমরা দুজনে মিলে এই সব শর্তসাপেক্ষে জোনাল ডিস্ট্রিবিউটরশিপটা নিয়েছি।’

‘সৌম্যর সঙ্গে কতদিনের পরিচয়?’

‘ছোটো থেকে স্যার। আমাদের বাড়িতে একটা বড়ো জাম গাছ আছে। আমরা ছোটোবেলায় ওই গাছে চড়ে বসে থাকতাম। ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতাম। ওই গাছের মতোই বড়ো বড়ো স্বপ্ন। সৌম্য তো আমেরিকা চলে গেল। আমি দাদু আর সীমার জন্য যেতে পারলাম না কারণ ওদের না দেখে থাকতে পারতাম না। কিন্তু সৌম্য ছোটোবেলার বন্ধুত্ব আর স্বপ্ন কোনওটাই ভোলেনি। ফেরত এসে আমাকে দিয়ে এই বড়ো কাজটা করিয়েই নিল।’

‘অলোক এই কেসটা সল্ভ করতে হয়তো ছবিতে থাকা তোমার সব বন্ধুদেরকেই ডেকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করতে হতে পারে, দেব বলে।

‘আপনি বললেই আমি সবাইকে ডেকে আনব। কিন্ত আমার মনে হয় সবথেকে আগে আপনি সীমার সঙ্গে কথা বলুন। হয়তো ও এই কেস সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করতে পারে।’

‘কেমন করে?’

‘ঠিক বলতে পারব না স্যার, তবে কেন জানি না আমার মনে হচ্ছে ও কিছু একটা জানে। দাদুর মৃত্যুর পর থেকেই ও কেমন জানি চুপচাপ হয়ে গেছে। আগের সীমাকে আর খুঁজে পাই না।’

‘দাদুকে খুব ভালোবাসত নাকি সীমা?’

‘সে তো সকলেই দাদুকে ভালোবাসত কারণ মানুষটাই তো ভালোবাসার যোগ্য ছিলেন।’

‘দাদুর মৃত্যুর খবর পেয়ে তোমার সঙ্গে কতজন বন্ধু এসেছিল?’

‘কেউ আসেনি কারণ সীমার ভাইয়ের মুখে খবরটা শুনতেই আমি কাউকে কিছু না বলেই ওর স্কুটারে চেপে বাড়ি চলে আসি।’

‘তোমাকে খুঁজতে তোমার পিছনে পিছনে কেউ আসেনি?’

‘না স্যার, অলোক মাথা নাড়ায়। ‘আমার খুব ভালো করে মনে আছে সেদিন রাতে ডাক্তার আর পুলিশ ছাড়া আমাদের সঙ্গে সীমার বাড়ির সকলে ছিলেন। সকালবেলায় ওরাই সকলকে খবর দেন।’

পরের দিন দুপুরবেলা সীমা আর দেবকে একসঙ্গে শোরুমে আসতে দেখে অলোক অবাক হয়ে গেল, ‘সব ঠিক আছে?’

‘আপাতত তো সব ঠিক আছে, গা ঝাড়া দেয় দেব, ‘তুমি বলেছিলে সীমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে, তাই ওকে এখানে নিয়ে এসেছি। তোমার বিজনেস পার্টনার আসেনি?’

‘হ্যাঁ এসেছে, ওর নিজের কেবিনে রয়েছে।’

‘বেশ, তাহলে চলো ওর কেবিনে গিয়েই বসা যাক।’

অলোক ওদের দুজনকে নিয়ে সৌম্যর কেবিনে পৌঁছোল। দেবের সঙ্গে সৌম্যর পরিচয় করিয়ে দিল।

‘কী খাবেন, ঠান্ডা না গরম?’ আন্তরিকতার সঙ্গে সৌম্য জিজ্ঞেস করল।

‘সে-সব পরে হবে। এখন শুধু অলোকের দাদুর খুনের ব্যাপারে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দিন, ঠান্ডা গলায় দেব বলে। মুহূর্তে রক্তশূন্য হয়ে যায় সৌম্যর মুখ। তোতলাতে তোতলাতে কোনওরকমে বলে, ‘আমি… আমি এই সম্পর্কে কী বলব? আমি তো সীমার মুখ থেকে পরের দিন খুনের খবরটা জানতে পারি।’

‘সেটাই তো আমার প্রশ্ন সৌম্য। সারা বিয়েবাড়িতে আপনি সমানে অলোকের সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন অথচ অলোক সীমার ভাইয়ের সঙ্গে বাইকে উঠে চলে এল আর আপনি জানতেই পারলেন না?’

সৌম্য হকচকিয়ে গেল। অলোকই উত্তর দিল, ‘আসলে স্যার ওই সময় বিয়ের নিয়ম হিসেবে আংটি খেলা চলছিল। বন্ধুরা সকলে মিলে বরপক্ষকে সাপোর্ট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল।’

‘হ্যাঁ ঠিক তাই, আমিই সবাইকে ওখানে আটকে রেখেছিলাম যাতে আমরা আমাদের বন্ধুকে জেতাতে পারি’, সৌম্য নিঃশ্বাস ছেড়ে উত্তর দেয়।

‘কিন্তু আপনি নিজে তো ওই সময় ওখানে ছিলেন না…’

‘কী বলছেন আপনি?’ সৌম্য উত্তেজিত হয়ে দেবের কথার মধ্যেই বলে ওঠে, ‘আমি তন্ময়ের পাশে বসে ওর পিঠ চাপড়ে ওকে উৎসাহিত করছিলাম।’

‘তাহলে আপনাকে এই ছবিতে কেন দেখা যাচ্ছে না?’ দেব সৌম্যর দিকে অ্যালবামটা এগিয়ে দেয়। ‘এই ছবিটাতে আপনি নেই এবং এর পরের কোনও ছবিতেই আপনাকে দেখা যাচ্ছে না। না… না… আপনাকে শুধু শুধু কষ্ট করতে হবে না, আমিই বলে দিচ্ছি আপনি কোথায় ছিলেন?’

‘আমি বাথরুমে গিয়েছিলাম। খাওয়া-দাওয়াটা একটু বেশিই হয়ে গিয়েছিল, সৌম্যর স্বরে বিরক্তি ঝরে পড়ে।

‘না, ওই সময় আপনি অলোকের দাদুর ঘরে ছিলেন, দেব শান্ত কণ্ঠে বলে, ‘আপনি হয়তো ভেবেছিলেন দাদুকে খুন করে আপনি আবার বিয়েবাড়িতে ফিরে আসবেন কিন্তু তাড়াহুড়োতে গাছ থেকে নামতে গিয়ে নিশ্চয়ই আপনার জামাকাপড় খারাপ হয়ে গিয়ে থাকবে তাই বিয়েবাড়িতে ফিরে যাওয়াটা আপনি উচিত মনে করেননি।’

‘আপনি যা বলছেন তার কোনও প্রমাণ দেখাতে পারবেন?’ চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় সৗমেন।

‘দয়া করে আপনি একটু উঠে দাঁড়িয়ে দেয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ান। আর অলোক তুমিও সৌম্যর পাশে ওই একই ভাবে দাঁড়াও, এই বলে দেব সীমার দিকে তাকায়, ‘আচ্ছা এবার তুমি এই দুজনকে ভালো করে দ্যাখো। দুজনেরই শরীরের গঠন কাঁধের ব্যাপ্তি প্রায় একইরকম। অন্ধকারে ঢিলেঢালা জামাকাপড়ে কে অলোক আর কে সৌম্য বোঝাটা সত্যি মুশকিল।’

‘আপনি ঠিক বলেছেন স্যার, উত্তেজনায় সীমার স্বর কেঁপে যায়, ‘আমার আগে কেন এটা মনে হল না যে সৌম্যও অলোকের মতন একই রঙের পোশাক পরেছিল এবং অলোকের থেকেও ওর কাছে দাদুকে খুন করার আরও বড়ো কারণ রয়েছে। ও-তো আইবিএম-এর এজেন্সি নেওয়ার জন্য নিজের সবকিছু ইনভেস্ট করে ফেলেছিল। এমনকী আমেরিকার চাকরি ছেড়ে, গ্রিন কার্ডও ফেরত দিয়ে ও ইন্ডিয়ায় চলে আসে। দাদু বেঁচে থাকলে ডিস্ট্রিবিউটারশিপ-টা কিছুতেই নেওয়া হতো না কারণ অলোককে তো পাওয়া যেত না…’

অলোক হঠাৎ-ই জিজ্ঞেস করে, ‘এসব তুমি কী বলছ সীমা? আগে তো কখনও বলোনি যে, তুমি দাদুর খুনিকে পালাতে দেখেছ?’

‘কী করে বলত, ওর তো পুরো সন্দেহটাই তোমার উপর গিয়ে পড়েছিল আর বেচারি বিয়ে পিছোতে বাধ্য হয়েছিল। ওর সঙ্গে হঠাৎ-ই আমার দেখা হয়ে যায় আর আসল সত্যটা বেরিয়ে আসে… উঁহু, পালাবার চেষ্টা কোরো না সৌম্য কারণ পুলিশ শোরুমের বাইরে অপেক্ষা করছে। আমি চাই না তোমার কর্মচারীদের সামনে তোমাকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়া হোক, সুতরাং চুপচাপ আমার সঙ্গে বাইরে চলো। আর প্রমাণ, সে তো পুলিশ দাদুর ঘরের দরজা, খাট ইত্যাদি থেকে যে আঙুলের ছাপ সংগ্রহ করেছে তার সঙ্গে তোমার আঙুলের ছাপ যে ম্যাচ করবে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। এমনিতে সীমা খুনের কারণ কিছুটা বললেও বাকিটা পরিষ্কার করে বন্ধুকে বলো যে কেন এমনটা করলে,’ দেব বলে।

‘হ্যাঁ সৌম্য, তুই আমাকে ভরসা দিয়েছিলি যে লাভের পুরো টাকাটা তুই দাদুর হাতে তুলে দিয়ে দাদুকে রাজি করিয়ে নিবি আর নয়তো আর একটা শোরুম নেওয়ার ব্যবস্থা করবি, তাহলে তুই কেন এমনটা করলি?’ ব্যথিত কণ্ঠে বলে অলোক।

‘এছাড়া আমার আর কী বা করার ছিল? দাদু কিছু শুনতে বা শোরুমের জিনিস ছোটো শোরুমে শিফ্ট করত কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আর বড়ো শোরুম নেওয়ার মতো আমার আর্থিক অবস্থা ছিল না। তুই যখন আমায় জানালি যে দাদু তোর নামে শোরুম-টা লিখে দিয়েছেন, আমি আমার চাকরি আর গ্রিন কার্ড ছেড়ে দিয়ে নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করেই এখানে চলে এসেছিলাম। দাদু খুব ভালো করেই জানতেন কম্পিউটার বিক্রি করলে অনেক বেশি লাভ তবুও নিজের এই পুরোনো ব্যাবসা ছাড়তে রাজি ছিলেন না। ওনার এই জেদের জন্য আমি কেন সাফারার হতে যাব?’ তিক্ততা ঝরে পড়ে সৌম্যর কথায়।

‘ভালোই হল, সবকিছু ছবির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। তোমার জন্য একটা কাজ করতে পারি। জেলে বসে যাতে আরও কয়করকমের ব্যবসার ব্লু প্রিন্ট তৈরি করতে পারো, তার ব্যবস্থা করে দিতে পারি।’ দেবের পরিহাসে ওই মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যেও অলোক আর সীমা না হেসে পারে না।

আলমারি

–হ্যাঁ মা বলো।

–কোথায় আছিস রে? এতক্ষণ ধরে ফোন করেই যাচ্ছি কোনও রেসপন্স নেই।

–কেন আমি তো টিউশনে ছিলাম। তোমাকে তো বলেই এলাম, কলেজ ফিরতি টিউশন করে ফিরব। কিছু কি দরকার আছে? এতগুলো মিস্ কল!

–তোর বাবার ফোন অনেকক্ষণ ধরে বন্ধ আছে। তোকে কি কিছু বলে গেছে?

–না তো। দুটো নম্বরই বন্ধ?

–হ্যাঁ। অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করছি। সেই দুপুর থেকে।

–কোথাও গেছে হয়তো।

–আজ পর্যন্ত কোনও দিন তোর বাবা না বলে কোথাও গেছে? অফিসে দেরি হলেও ফোন করে জানিয়ে দেয়।

–তুমি চিন্তা কোরো না, আমি দেখছি। তুমি একবার বীরেনকাকুকে ফোন করে দ্যাখো।

–তিন্নি, অফিসে ফোন করেছিলাম। বলল, সেই দুপুরেই বেরিয়ে গেছে।

তিন্নি আর কথা না বাড়িয়ে ফোনটা কেটে বাবার নাম্বার ডায়াল করল। বাবা ওয়ান, বাবা টু। সুইচড অফ। মোবাইলে দেখল আটটা কুড়ি। স্ট্যান্ডে না গেলে অটো পেতে সমস্যা হবে। কিন্তু বাবা গেল কোথায়? একে একে ব্যাচের ছেলে মেয়েরা সব বাড়ির দিকে পা বাড়াল। তিন্নির সাথেও দুজন এল। একজন মাঝ রাস্তাতেই অটো পেয়ে গেল। তিন্নি অন্য আরেক ব্যাচমেটের সাথে কয়েকটা পা এগিয়ে এসে একটা এটিএম কাউন্টারের কাছে দাঁড়িয়ে সঙ্গীকে এগিয়ে যেতে বলে, নিজে এটিএম কাউন্টারের ভিতরে ঢোকে। টাকা তুলে স্ক্রীন-এ চোখ রাখতেই চমকে ওঠে। একি! এত টাকা! প্রিন্ট বের হল না। এই এক নতুন সমস্যা এসেছে, অর্ধেক কাউন্টারে প্রিন্ট বের হয় না। মেসেজটা বাবার মোবাইলে যাবে, তিন্নির নাম্বার ট্যাগ করেনি। কিন্তু এতগুলো টাকা হিসেব মিলছে না। কেউ কি, তাহলে ইচ্ছে করে এতগুলো টাকা ব্যাংকের আকাউন্টে ফেলে দিল? তাও আবার দু’লাখ। বাবার চিন্তার মাঝে আচমকা এই টাকার চিন্তাও পেয়ে বসল। এত সমস্যা এই ভাবে চলে আসবে ভাবেনি, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। বাবা এতক্ষণেও না ফিরলে মা এখন একা।

(২)

এক কথা বলতে বলতে প্রকাশের জিভে পলি পড়ে গেল। একেক সময় রেগে যায়, পরেক্ষণেই নিজেকে বোঝায়, বেচারা এরাই বা কোথায় যাবে, কয়েকদিন আগেই সেই টাক মাথার ভদ্রলোক এসে প্রকাশের ডেস্কে চেল্লাতে আরম্ভ করেছিলেন, ‘এর থেকে আমাকে একটু বিষ এনে দিন, খেয়ে সবাই মিলে বাঁচি। কোথায় ছিল আর কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে।’প্রকাশ সেদিন রাগেনি। ক্যাজুয়াল স্টাফ সমীরকে বলে, ‘এনাকে এক গেলাস ঠান্ডা জল দাও তো।’ জল পান করে ভদ্রলোক বেশ শান্ত স্বরেই বলেন, ‘বলুন তো ম্যানেজারবাবু, এভাবে ইন্টারেস্ট কমালে খাব কি? রাজ্য সরকারের চাকরি করতাম, রিটায়ার করে কতই বা পেয়েছি। এতে খাব, ডাক্তারকে দেব, না জমাব।’

ভদ্রলোকও সব বোঝেন, কিন্তু কী করা যাবে, নিয়ারেস্ট গায় দ্য গিলটি ওয়ান। এদিকে দিন দিন কাজের চাপটাও বাড়ছে। টিফিন খেতেই সময় পায় না। দুটো থেকে আড়াইটের সময় কিছু না কিছু কাজ এসে যায়। নিদেন পক্ষে লিংক ফেলিওর। একে ওকে ফোন করা তো আছেই। তবে কাস্টমাররা ভাবে এটা হয়তো ব্যাংকের লোকেদের ফাঁকিবাজির নতুন অস্ত্র। কথায় কথায় লিংক ফেলিওর। অর্ধেকজন বোঝে না এই ভার্চুয়াল ব্যাংকিং-এর যুগে অন্তর্জালই প্রধান স্তম্ভ। এত বোঝা সবার কম্ম নয়। ঘরের ভদ্রমহিলাই বোঝে না। কাজ করবার ফাঁকে একবার মোবাইলের স্ক্রীন-এ চোখ রাখল। না, এখনও পর্যন্ত মিস কল নেই। ভালোই আছে, দরকার হলে মিস্ কল দিয়ে ছেড়ে দেয়। কিছু বললে জবাব দেয়, ‘তুমি কেন্দ্রীয়, আমি রাজ্য। জানোই তো কতটাকা কম বেতন পাই।’ মায়ের দেখে মেয়েটাও হয়েছে ওইরকম। কথা বলতে না বলতেই, ‘বাপি কিছু ফান্ড ট্রান্সফার করে দেবে?’

–কত?

–বেশি নয়, হাজার পাঁচেক দিলেই হবে।

–হাজার পাঁচ! ভগবান, বাড়ি ভাড়া লাগে না নিজেরা রান্না করে খায়, তাও হাত খরচ হাজার পাঁচ, সেটা আবার শেষ মাসে। প্রথমে আরেক প্রস্থ পাঠানো হয়। মায়ের থেকে টাকা নেওয়া তো আছেই। প্রকাশ ঘড়িটার দিকে আরেকবার তাকাল। দুটো চল্লিশ। সিগারেট খেতে হবে। খিদেও পেয়েছে। কী টিফিন দিয়েছে কে জানে? প্রকাশ ব্যাগ খুলে টিফিন কন্টেনার বের করল। মুড়ি, একটুকরো শসা। প্রতিদিন এক। নিকুচি করেছে টিফিনের। উঠে ডাস্টবিনে পুরো টিফিনটা ফেলে সমীরকে বলল, ‘রায়বাবুকে বলবে খেতে যাচ্ছি। দেরি হবে একটু।’ম্যানেজার শোনে, কিন্তু রুমা শোনে না। ব্যাংকের দরজার বাইরে পা দেওয়া মাত্র মিস্ কল। একসাথে পাঁচবার। প্রকাশ একটু বিরক্তির সাথেই ফোন ডায়াল করে বলল, ‘কী হলটা কী? এত তাড়া কীসের?’

–কোথায় আছো?

–ভাগাড়ে। এইসময় কোথায় থাকি তুমি জানো না?

–শোনো আমি আজ বিকালেই তিন্নির কাছে যাচ্ছি। ওর শরীর খারাপ। তুমি এই কটা দিন একটু হোম ডেলিভারি থেকে আনিয়ে চালিয়ে নেবে। আমি কবে ফিরব জানি না।

–তিন্নির কী হয়েছে? চমকে ওঠে প্রকাশ।

–শরীর খারাপ বললাম না।

–শরীর খারাপ শুনলাম, কিন্তু কী হয়েছে সেটা তো জানতে হবে।

–তোমায় এইসব মেয়েলি ব্যাপারে নাক গলাতে হবে না।

–অদ্ভুত তো। মেয়েটা কি তোমার একার?

–শোনো অতো বকার সময় নেই। আমি রাখছি, আর হ্যাঁ কিছু টাকা ট্রান্সফার করে দেবে।

–কেন সিরিয়াস কিছু, ভর্তি করতে হবে?

–তুমি বড্ড ইনকুইজিটিভ হয়ে যাচ্ছ।

–এক কাজ করো কার্ড নিয়ে যাও সে রকম হলে কোথাও ভর্তি করে দেবে। ক্যাশলেস হয়ে যাবে।

–তোমাকে যা করতে বললাম তাই করো। এরকম বেসলেস কথা বোল না। আমি চিন্তা ভাবনা করে যেটা ভালো ভাবব, সেটাই করব। তোমাকে কিছু বলতে হবে না।

–ভালো। আমি টাকা দেব, কিন্তু কোনও আলোচনাতে থাকব না? আমার মেয়ে অথচ শরীর খারাপ হলে কী করবে সেটা বলবারও অধিকার নেই। এই না হলে বাবা। তা তুমি যাচ্ছ যে তোমার অফিস কী হবে?

–ইন্টিমেশন দিয়ে যাচ্ছি, ছুটি নিয়ে নেব। আর শোনো ডোন্ট বি সেন্টিমেন্টাল প্রকাশ। এখন ওসবের সময়ও নেই, লেট হার কিওর সুন।

প্রকাশ অনেকক্ষণ ধরে চেপে রাখা একটা শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলল, ‘আমি একবার তিন্নিকে ফোন করছি।’

– না না। রুমা প্রায় চমকে উঠল।

–না না মানে?

–ওকে এখন ফোন করতে হবে না। আমি পৗঁছে সব কিছু তোমাকে জানাব।

রুমার ফোনটা রাখবার সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ কিছুসময় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কী হল তিন্নির! আর খাবার মুখে উঠবে না। এক কাপ চা বলল। বিস্কুটটা ভিজিয়ে মুখে তোলার আগেই মাটিতে পড়ে গেল। এরা বড্ড বেশি চিন্তা দেয়। রুমার এই স্বভাবটা ইদানীং হয়েছে। আগে এরকম করত না! কথাবার্তা সমস্ত কিছু শেয়ার করত। এমনকী চাকরি পাওয়ার বছর দুই পরে আপার ডিভিশনের একটা ছেলেকে ভালো লাগত। সে কথাও গোপন করেনি। তিন্নির স্কুলে পড়বার সময় অঙ্কে রিপিটেড কম নম্বর পাওয়া, বা এক বন্ধুর বার্থডে পার্টিতে ড্রিংক করে বাড়ি আসা, সবই প্রকাশের থেকে রুমাই বেশি বলত। সেসময় বরং প্রকাশ বোঝাত, শান্ত করবার চেষ্টা করত। এইচএস পাস করবার পরেই সব হিসাব কেমন যেন গোলমাল হয়ে যেতে আরম্ভ করল। উলটে যেতে লাগল সব কিছু। তিন্নি কোনওরকমে ফাস্ট ডিভিশনে পাশ করল। প্রকাশ বলল, ‘শোনো ওর যা মেরিট তাতে সাধারণ লাইনে গ্র্যাজুয়েশন করুক। তারপরে না হয় কোনও একটা প্রফেশনাল কোর্স করানো যাবে। রুমা প্রথমে সব কথা শুনেও ছিল। প্রকাশের কথাতে রাজিও হল। কিন্তু বাধা এল রুমার দিদির কাছ থেকে। দিদির ছেলেটাও হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেছে। জামাইবাবু একটা সরকারি জীবনবিমা কোম্পানির ডেভেলপমেন্ট অফিসার। হাবেভাবে টাকা আছে জাহির করে। কথায় কথায় বলে, ‘বুঝলে ভায়া সন্ধেবেলা ঠিক জল খেতে ইচ্ছে করে না।’ ঘরে ড্রিংক ক্যাবিনেটও আছে। বছরে দু’একবার প্রকাশও যায়। তবে দুইবোনের সাথে কী সব কথা হয় কে জানে?

একদিন অফিস থেকে প্রকাশ বাড়ি ফিরতেই রুমা বলে, ‘তিন্নিকে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি করে দাও। রাকাও ভর্তি হচ্ছে।’

–কোথায়?

–কলকাতায়।

কথাগুলো শুনে প্রকাশ এক্বেবারে আকাশ থেকে পড়ল। রুমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘আরে দাঁড়াও, আমি সব কিছু আগে ভেবে দেখি। কোন কলেজ, কি তার ইনফ্রাস্ট্রাকচার, ক্যাম্পাসিং কী হচ্ছে, এই সব কিছু না দেখে শুনে তো আর ভর্তি করা যায় না। তাছাড়া এখন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বাজার ভালো নয়।’

–ও সব কিছু তোমাকে দেখতে হবে না। তুমি ও-সব বুঝবেও না, তার থেকে যে দেখছে তার ওপরেই সব কিছু ছেড়ে দাও।

–কার ওপর, তোমার জামাইবাবু? তা হলেই হয়েছে।

–সে তো হবেই দু দুটো ফ্ল্যাট, গাড়ি, সব তো তুমি কিনেছ তাই না?

– বাদ দাও।

–বাদ দেওয়ার কিছু নেই, জামাইবাবু সব কিছু দেখে এসেছে। খোঁজ খবরও নিয়েছে। রাকা তিন্নি দুজনেই ওখানে ভর্তি হবে।

–থাকবে কোথায়?

–কেন, গড়িয়াতে জামাইবাবু অতো বড়ো ফ্ল্যাট কিনেছে, ওখানেই থাকবে।

–শুধু দু’জন এই বয়সে এক সাথে! ব্যাপারটা ক্রুশিয়াল হয়ে যাবে না?

–তোমার কাছে হতে পারে, আমার কাছে নয়, ওদের কাছে তো নয়ই। তাছাড়া মাঝে মাঝে আমরা যাব, জামাইবাবুরা যাবে।

প্রকাশ আর কথা না বাড়িয়ে উত্তর দিল ‘ভালো। সবই যখন ঠিক করেই নিয়েছ তখন আর আমাকে বলবার কী আছে?’

রুমার কথামতোই তিন্নি ভর্তি হল। ক্লাসও চলল। সাত মাস কেটেও গেল। তারপরেই একদিন অফিসে ফোন করে রুমার এই সব কথা বলে, তিন্নির শরীর খারাপ নিয়ে এই রকম অদ্ভুত নাটক তৈরি করে, এই রকম আচমকা চলে যাওয়া।

রুমা ফোন করতে বারণ করলেও প্রকাশ তিন্নিকে ফোন করে। এক, দুই, তিন বার। না ফোন সুইচ অফ। রাকাকেও ফোন করে। বেজে গেল, ধরল না।

রুমার ফিরতে ফিরতে দিন দশ কেটে গেল। এর মাঝে প্রতিদিনই প্রকাশ ফোন করে যাওয়ার কথা বলতেই রুমা বলে ওঠে, ‘না না আমি যখন তোমাকে বারণ করেছি তখন তুমি আসবে না।’ একদিন অফিস ফেরত রাকাকেও ফোন করে এই ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল। রাকাও কোনও স্পষ্ট উত্তর না দিয়ে ফোন কেটে দিল। সীমা আবার নিজের বোন রুমাকে দোষ দিয়ে বলল, ‘আমার বোনটাই বাজে। সাধারণ একটা ঘটনাকে তাল বানিয়ে দিল।’ ভাইরাভাই আবার হাসতে হাসতে বলে উঠল, ‘আমি আবার ওসব মেয়েলি ব্যাপারে থাকি না।’

তিন্নি বাড়িতে ফিরে আসার পরেও প্রকাশ কিছুই জানতে পারেনি। তিন্নি সব সময় চুপ থাকে। রুমাকে কিছু প্রশ্ন করলেই রেগে রেগে উত্তরটা দেয়, ‘তুমি বড্ড বেশি মেয়েলি স্বভাবের হয়ে যাচ্ছ। মেয়ের গাইনিকোলজিক্যাল প্রবলেম, তোমাকে সব জানতে হবে? যেগুলো মেয়েলি ব্যাপার সেগুলো আমাদের মধ্যেই রাখতে দাও। তুমি ফল টল আনো। ওকে এখন বেশি করে ফল খেতে হবে। আর একটু সুস্থ হলে এখানকার কোনও একটা কলেজে ভর্তি করে দাও, ও আর ওখানকার কলেজে পড়বে না।’

এরপর প্রকাশ আর একবারের জন্যেও কাউকে কোনও প্রশ্ন করেনি। অফিস থেকে দেরি করে বাড়ি ফিরে খেয়ে শুয়ে পড়ে। ছুটির দিনে কোনও না কোনও কাজ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। রুমার কথা মতো তিন্নিকে একটা প্রাইভেট কলেজে একটু বেশি ফিজ দিয়ে ভর্তি করে দিয়েছে। এরপর শুধু ফল কেনা, টাকা পয়সা দেওয়ার কোনও রকম গাফিলতি করে না। প্রয়োজনের থেকে বেশিই কেনে। ফল পচে যায়, জামাকাপড় আলমারি ছাড়িয়ে যায়। কারওর সাথে কোনওরকম অতিরিক্ত কথা বলে না। একদিন শুধু একটা দরকারে তিন্নির আলমারি খুলে একটা ব্যাগ বের করে প্যান কার্ড আর আধার কার্ড বের করেছে, তাও অবশ্য তিন্নিকে বলেই। এর বেশি আর কিছু না।

(৩)

প্রকাশের নিরুদ্দেশ হওয়ার প্রায় মাস সাত হয়ে গেল। তিন্নি ও রুমা অনেক চেষ্টা করেও প্রকাশের কোনও ঠিকানা জোগাড় করতে পারল না। এমনকী মানুষটা বেঁচে আছে না মারা গেছে, প্রথম কয়েক দিন তো সেটাই বুঝতে  পারেনি। সাতদিন পরেই তিন্নির মোবাইলে ব্যাংকে দ্বিতীয়বারের জন্যে টাকা ক্রেডিট হওয়ার মেসেজ আসে। ব্র্যাঞ্চে গিয়ে শোনে ড্রপ বক্সের চেক থেকে ক্যাশ করা হয়েছে। যে ফেলেছে তার ঠিকানা বলা সম্ভব নয়। প্যান নম্বর দেওয়া থাকায় সমস্যা হওয়ারও কোনও কথা নয়। তবে ব্রাঞ্চের এক চেনাজানা কাকুকে প্রকাশের কথা জিজ্ঞেস করতে উনি বলেন, উনি তো ভিআরএস নিয়ে নিয়েছেন, এখন কোথায় আছেন কেউ জানে না। টাকা পাওয়ার আগে মাঝে মাঝেই আসতেন, সব টাকা পেয়ে যাওয়ার পরে আর তো আসেননি। এর মাঝে মা মেয়েতে অবশ্য অনেক জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব বাদ পড়েনি কেউই। সবার মুখে সেই এক কথা। মাঝে অবশ্য বেশ কয়েকবার তিন্নির মোবাইলে টাকা জমা পড়বার মেসেজ এসেছে। রুমা ও প্রকাশের জয়েন্ট আকাউন্টেও টাকা জমা পড়বার মেসেজ এসেছে। এই কয়েকমাসে দিদির সাথে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেলেও দিদি জামাইবাবু এমনকী রাকাও এসেছে। সব শুনে পাশে থাকবার আশ্বাস দিয়ে গেছে। প্রকাশকে খোঁজার চেষ্টা করবার কথাও বলেছে। কিন্তু সেখানে কিছুই লাভ হয়নি।

দিনদিন তিনকামরার ফ্ল্যাটের ভিতরের শূন্যতা দুটি মানুষকে গ্রাস করে ফেলেছে। সেই একাকিত্ব এতটা তীব্র, কষ্টদায়ক, এর আগে কোনওসময় কেউই বোঝেনি। অথবা বোঝবার চেষ্টাও করেনি। প্রয়োজনের আগেই প্রয়োজন মেটানোর যে দায় একজন কাঁধে চাপিয়ে নিয়েছিল, তার কাঁধের ব্যথা বা না ব্যথার কথাও কেউ জিজ্ঞেস করেনি। কিন্তু আচমকা কাঁধ অর্ধেকটা সরে যাওয়াতে ভূমিকম্পের আরম্ভ। সেখান থেকেই টালমাটাল অবস্থা। রুমা বা তিন্নিকে হাতে হাতে সব কাজ করা আরম্ভ করতে হল। সেই দোকান, বাজার, ইলেকট্রিক বিল এমনকী ব্যাংকে লাইন দিয়ে টাকা তোলা। দুজন এক সাথে এই প্রথম তৃতীয় আরেকজনের জন্যে অকাতরে কাঁদতে আরম্ভ করল। অবশ্য এই কান্না তৃতীয়জনের অলক্ষে।

রুমা এই কয়েকমাসে নিজের অফিস আর বাড়ির চাপে আরও অসুস্থ হয়ে গেল। কথায় কথায় রেগে যায়, তিন্নির ওপর তো এক্বেবারে খাপ্পা হয়ে থাকে। মাঝে মাঝে হাতও চালিয়ে দেয়। তিন্নিও গুম হয়ে থাকে। কিছু বলতে পারে না। কলেজেও নিয়মিত যায় না, টিউশনেও অনিয়মিত। নিজেকেই সব সময় দোষারোপ করে, মাঝে মাঝে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার কথাও ভাবে, পরেই আবার নিজেকে সামাল দেয়। মাকে মাঝে মাঝেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হয়। এমনি চেক আপ হলেও ডাক্তার বলেন, টেনশনের থেকে হাই সুগার ধরেছে, সঙ্গে প্রেশার, কোলেস্টেরল, রক্তে ক্রিয়েটিনিন বেশি থাকায় কিডনিও কিছুটা আক্রান্ত হয়ে গেছে। নিশ্চিন্তের বিশ্রাম দরকার, শারীরিক ও মানসিক। অফিস থেকে ছুটি নেয়, কিন্তু মানসিক বিশ্রাম?

আরও দুই মাস পরে এক দুপুরে খেতে বসে ভাতের থালাতে আঙুল দিয়ে নাড়াচাড়া করবার সময় দিদির ফোন পেয়ে রুমা চমকে ওঠে। ফোনটা রেখেই মাখা ভাত ফেলে তিন্নিকে বলে, ‘রেডি হয়ে নে, মাসিরা আসছে। তোর বাবাকে খুঁজে পাওয়া গেছে, তবে কোথায় জানি না, মেসো জানে।’

কলকাতা শহর ছাড়িয়ে গাড়ি ছুটে যায় উত্তর চবিবশ পরগণার বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে। রুমা, তিন্নি ছাড়াও দিদি জামাইবাবু এমনকী রাকাও সঙ্গে থাকে। অবশ্য রাকা আর তিন্নি দুজন বসে দু’প্রান্তে। একজন পিছনের সিটে  একজন সামনের সিটে। গ্রামের মেঠো রাস্তার বুক ধরে কিছুটা গিয়ে গাড়ি দাঁড়াল একটা ছোটোগাছ আর বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা জায়গায়। অনেকটা জায়গা। ভিতরে ছোটো ছোটো ঘর। গাড়িতে যেতে যেতে রুমা শুনল জামাইবাবু আগে একবার নিজে এসে সব খোঁজ খবর নিয়ে গেছে। প্রকাশের সাথেও দেখা করে সবাইকে নিয়ে আসবে কিনা জিজ্ঞেস করে গেছে। প্রকাশের একটা জীবনবিমার পলিসি ম্যাচিওর হয়ে যাওযার সূত্র ধরেই গোপনে খোঁজ খবর চালিয়ে প্রকাশের ডেরা খুঁজে পেয়েছে। গাড়ি থেকে নেমে দিদি জামাইবাবু, রুমা আর তিন্নিকে ভিতরে যেতে বলে নিজেরা বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। রুমা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিল, ‘তোমরা আগে যাও আমরা একটু পরে যাচ্ছি।’

বাইরে তখন পচা ভাদ্রের রোদ। শরীরে আছড়ে পড়া ঝলসানো আলো আর তাপ সহ্য করে রুমা আর তিন্নি এদিক ওদিক তাকিয়ে ঘেরা জায়গাটার ভিতরে ঢুকে এগিয়ে চলে। কিছুদূর যাওয়ার পরেই কমবয়সি একটা ছেলে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা কি কাউকে খুঁজছেন?’

রুমা একটু আমতা আমতা করে সব কিছু বলতেই সেই নাম না জানা ছেলেটি একটা ঘরের দিকে আঙুল তুলে দেখিয়ে বলে, ‘উনি এখন ওই ঘরে ক্লাস নিচ্ছেন।’

– ক্লাস নিচ্ছেন!

চাকরি পাওয়ার আগে প্রকাশ চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি টিউশন করত। চাকরি পাওয়ার পরেও প্রথম দিকে অভ্যাসটা চালিয়ে গেছিল। তারপর টুকটাক একে ওকে এমনি দেখিয়ে দিলেও আর টিউশন আরম্ভ করেনি। তিন্নিকে পড়াত। নিজেও অবসর সময়ে চাকরির বিভিন্ন বইপত্র নাড়াচাড়া করত। রুমা কিছু জিজ্ঞেস করলে বলত, ‘আপডেট থাকা যায়।’

কিন্তু সেদিন কথাগুলো শুনে দুজনেই অবাক হয়ে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে ছেলেটির দেখানো ওই ঘরটির দিকে এগিয়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়াল। ঘরের ভিতর তখন তিন্নির বয়সি বা ছোটো বড়ো, জনা কুড়ি ছেলেমেয়ের সামনে ক্লাস নিচ্ছে প্রকাশ। দরজার বাইরে দুজনকে আকস্মিক দেখে প্রথমে কেউ কোনও কথা বলতে পারল না। কিছু সময় পরে প্রকাশ বলল, ‘আমার ঘরে গিয়ে বোসো আমি আসছি।’ তারপরেই একজন ছাত্র এগিয়ে এসে রুমা আর তিন্নিকে প্রকাশের ঘরে বসিয়ে এল।

রুমা ও তিন্নি ঘরের ভিতরে একটা তক্তার ওপর বসে চারদিকটা দেখতে লাগল। সাদামাটা ছিটে বেড়ার ঘর। দুটো জানলা আছে। একটা টুলের ওপর রাখা রয়েছে একটা টেবিল ল্যাম্প। চারদিকে ঝোলানো রয়েছে কয়েকটা শার্ট, প্যান্ট কয়েকটা গেঞ্জি। এককোণে থাক থাক করে বেশ কয়েকটা বই। দরজার বাঁদিকের দেয়ালে টাঙানো রয়েছে রুমার শ্বশুর-শাশুড়ির একসাথে একটা ছবি। নতুন ঘরে আসার পরে ছবিটা স্টোররুমের স্ল্যাবে তোলা ছিল।

কিছুসময় পরে প্রকাশ ঘরের ভিতর আসতেই রুমা বেশ উত্তেজিত ভাবে বলে উঠল, ‘এর মানে কী? এরকম ভাবে কাউকে কিছু না বলে চাকরি বাকরি ছেড়ে, এই অজ গ্রামে এসে তুমি কী আরম্ভ করেছ?’

–চা খাবে? এই কয়েকমাসেই তো খুব রোগা হয়ে গেছ।

–যা জিজ্ঞেস করলাম উত্তর দাও।

প্রকাশ একটা শ্বাস নিয়ে বলল, ‘আমাকে আর তোমাদের দরকার নেই এই সত্য উপলব্ধি করেই চলে এলাম। তবে তোমাদের কাউকে ঠকাইনি। ব্যাংক থেকে একপয়সাও তুলিনি। যা টাকা পেয়েছি সব দিয়ে দিয়েছি।’

–বাবা সব কিছু কি টাকার হিসাবে মেলে, না চলে?

–ঠিক তো আজ তোরা বুঝেছিস, কিন্তু যেদিন আমার আপত্তি অগ্রাহ্য করে মায়ের কথা শুনে রাকার সাথে থাকতে গেলি, তারপর…। প্রকাশ একটা লম্বা শ্বাস ফেলে কথা বন্ধ করে দিল।

পাশ থেকে তিন্নি বলে উঠল, ‘থামলে কেন? বলো…’

–থাক। আমার কাছে তো সব কথাই গোপন করেছিলি, তাই না। খুব রাগ হয়ে ছিল, ভাবলাম এবার তোরা তোদের মতো করে থাক আমি আমার মতো। তবে এখন আর অতটা রাগ নেই, তোদের খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল।

প্রকাশের কথা শুনেই রুমা তিন্নি দুজন দুজনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুসময় পরে তিন্নি বলে, ‘আমি তো কিছু গোপন করিনি বাবা।’

প্রকাশ মুচকি হাসে, ‘সবাই খরগোশ নয় রে। তারপর আবার কিছুসময় চুপ থেকে বলে, ‘জানিস আমাদের সমাজ, শাস্ত্র, কাছের আত্মীয়দের সাথে বিয়ের অনুমতি দেয় না, তবে আগে দিত। মহাভারতে অনেক উদাহরণ আছে। আবার তুতেনখামেন তার নিজের বোন আনাক-সু-নামুনকে বিয়ে করেছিল। দক্ষিণ ভারতের কয়েকটি সম্প্রদায়ের মধ্যে এই বিয়ে এখনও প্রচলিত।’

–এসব আমাকে বলছ কেন? আমি জেনে কী করব?

প্রকাশ তিন্নির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, আসলে এখানে ক্লাস নেওয়ার ফাঁকে শুধু তোর কথাই ভেবেছি, ভেবেছি ভুল কার তোর, না আমার?’

–তুমি যে কী বলছ কিছুই বুঝতে পারছি না।

একটা লম্বা শ্বাস ফেলে প্রকাশ বলে উঠল, ‘তোরা কিছু না বললেও আমি কিছুটা আন্দাজ করেছিলাম। তোর মনে আছে একদিন তোর আলমারি খুলে তোর প্যান কার্ড বের করেছিলাম, সেদিন ব্যাগের মধ্যে নার্সিংহোমের একটা ফাইল পাই। প্রথমে ভয় লেগে গেছিল তারপর কয়েকটা পাতা পড়তেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হল। তাও রাকাকে ফোন করে ওর কলেজ গেলাম। প্রথমে রাকাও সব অস্বীকার করছিল, একটু জোর করতে হয়েছিল, বুঝলাম এত বড়ো ঘটনা যখন আমার কাছেই গোপন করা হল, তখন তোদের কাছে আমার কোনও মূল্যই নেই।’

রুমার গলাতে অবাক হয়ে যাওযার স্বর।

‘না শোনো তুমি ব্যাপারটা ওরকম ভাবে ভেব না। আসলে তিন্নির সাথে আমার নিজেরও খুব লজ্জা করছিল। তিন্নি যে এত বড়ো একটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে ভাবতে পারিনি।’

–এটা তোমার দূরদৃষ্টির অভাব রুমা। আমি কিন্তু প্রথমদিনেই বলেছিলাম। তুমি বিশ্বাস করোনি আমার ওপরেই রেগে উঠে বলেছিলে, ‘নোংরা হয়ে যাচ্ছ তুমি, ভাই বোন একসাথে থাকবে তাতে এরকম ভাবাটাই অন্যায়।’

–তুমি বিশ্বাস করো আমার খুব খারাপ লেগেছিল।

–খারাপ! কীসের খারাপ? সব কিছু হয়ে যাওয়ার পরে খারাপ? রুমা আমরা তো বুদ্ধি দিয়ে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করি। এখানে খারাপ ভালোর তো কোনও প্রশ্ন নেই। দুটো টিনএজ ছেলেমেয়ে এক সাথে এক ঘরে থাকলে অনেক কিছুই হতে পারে, সেখানে অনেক সম্পর্কই গৌণ হয়ে যায়। আবার একটা দুর্ঘটনাও ধরা যায়।

–তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, তুমি এখন সব সাপোর্ট করছ। এমনি ভাবে তুমি সবকিছু মেনে নেবে? তুমি এমন ভাবে বলছ যেন কোনও ব্যাপারই ঘটেনি। বিয়ে, মহাভারত সব কিছু নিয়ে আসছ।

–আমাদের এই বাংলার হিন্দু সমাজে এইরকম মাসতুতো ভাইবোনের মধ্যে বিয়ের প্রচলন নেই। তবে ওদের ক্ষেত্রে আমার মেনে নেবার বা না নেবার সাথে কি কিছু এসে যায়? যেটা ওরা ঠিক করবে সেটাই হবে। আমি অবশ্য এটাও জানি না ওদের এটা প্রেমশূন্য না অন্যকিছু?

–না, ওদের ঠিক করবার কিছু নেই। রাকার সাথে তিন্নি এখন আর মেশে না।

–বেশ ভালো তো। তবে বিপদের আগে সাবধান করতে হয়, কিন্তু বিপদে পড়লে তো সাহায্য করতেই হবে। প্রকাশ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল।

তিন্নি থামিয়ে বলে উঠল, ‘বাবা, তুমি কবে ফিরে আসবে বলো?’

প্রকাশ হালকা হেসে উঠল, ‘মা’ রে তোদের জন্যে মন খারাপ করলেও এখানে দিব্যি আছি। সকালে একটা স্কুল চলে বিকালের দিকে আশেপাশের ছেলে মেয়েদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার প্রস্তুতি হয়। আজকে অবশ্য স্কুল ছুটি তাই ওরা এই সময় ক্লাস করছে। এরা সবাই আমাকে খুব ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে। বেশ ভালো আছি বুঝলি, বেশ ভালো।’

–তাহলে আমরা কী করব? রুমা প্রকাশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।

–তোমার দিদি জামাইবাবু এসেছে তো?

–রুমা কিছুসময় চুপ থেকে উত্তর দিল, হ্যাঁ। কথাতে জড়িয়ে থাকা কান্নাটা প্রকাশের কানে গেল।

–ওদের ডাকো। তারপরেই তিন্নির দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ‘কিরে তুই কি করবি? রাকাকেও ডাকব?’

রুমা তখন সেই মাত্র উঠে বাইরে দিদি জামাইবাবুদের ডাকতে যাচ্ছিল। তিন্নি পিছন থেকে ডেকে বলে উঠল, ‘মা, দাঁড়াও। মাসিদের ডাকতে হবে না।’ তারপরেই প্রকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বাবা যেটা বেরিয়ে গেছে সেটা শুধু মাত্র একটা প্রাণ ছিল না। তাও বলছি সব দোষও আমার, ভুলও। আমাকে আর একটা সুযোগ দেবে না? আমি আর ওই সম্পর্কের কথা ভাবতেও চাই না। শুধু তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাই। তুমি বাড়ি ফিরে চলো।’

বাইরে তখন দারুণ রোদ। গরম হাওয়া দরমার ঘরে ঢুকলেও প্রকাশের বেশ শান্তি লাগল। তিন্নিকে কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠল, ‘খেপি একটা।’

ঠেলা

সামনের রোববার বিকেলে যেন কোনও কাজ রেখো না।

শ্রীদীপ্তা ড্রেসিং টেবিলের টুলটায় বসে মুখে ময়েশ্চারাইজার ঘষছিল। বাড়তি যত্ন চল্লিশ-এর দিকে ছুটে যাওয়া শরীর চায়। শ্রীদীপ্তা সে চাওয়া সারাদিনে না পারলেও রাতে মেটায়। কমপিউটার সি্্ক্রন থেকে মুখ তুলল না জয়। রীতিমতো উপেক্ষা মনে হয় শ্রীদীপ্তা’র। বেশ কিছু বছর ধরেই চলে আসছে এই ঘটনা। শুধু ছোট্ট একটা জবাব বুঝিয়ে দিল শোবার ঘরটায় শ্রীদীপ্তা একা নেই।

–আচ্ছা।

জয় এ রকমই। সবেতেই হ্যাঁ। অথচ থেকেও যেন নেই। সবার মতের বিপক্ষে বেরিয়ে আসা। ঘুপচি একটা ঘরে ভাড়া থেকে জীবন শুরু। তখন কিন্তু জয়ের মধ্যে তাপ পেয়েছে। দাঁতে-দাঁত চিপে দু’জনের লড়াই চালানো। জীবনের সিঁড়ি দিয়ে পাঁচজনের চেয়ে একটু দ্রুতই উঠেছে। রোজগার বেড়েছে। বেড়ে গেছে দু’জনের দূরত্ব। আগে রাগ হয়ে যেত। এখন সয়ে গেছে। এই ফ্ল্যাট, তার গোছগাছ, অর্পর স্কুলে ভর্তি হওয়া–সব ব্যাপারগুলোতেই যেন জয় নিজেকে কীভাবে আলগা করে নিয়েছে। শ্রীদীপ্তা মানে, একজন মাল্টিন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ-এর হাতে আজকাল খুব বেশি সময় থাকে না তার পরিবারের জন্য। তবুও যেখানটায় ন্যূনতম দায়িত্ব পালন বা সিদ্ধান্ত নিতে মতামত দেবার দরকার, তাও পাওয়া যায় না আজকাল ।

–শুনলে?

ল্যাপটপ বন্ধ হয়েছে এতক্ষণে।

–হ্যাঁ, শুনেছি। তুমি শনিবার সকালে একবার মনে করিয়ে দিও। সোমবার হেড অফিস রিপোর্টিং থাকলে, ক্যানসেল করাতে হবে ফ্লাইটের টিকিট।

চুপ আবার জয়। অসহ্য! ছেলেও ঠিক একই স্বভাবের হয়েছে। যত কম কথা বলা যায়! বাধ্য হয়ে শ্রীদীপ্তা বলে ওঠে, –জানতে চাইলে না, কেন?

–কেন?

বিছানায় শরীর এলিয়ে দিয়েছে জয়। বুঝতে পারল না শ্রীদীপ্তা, চুপ করে যাবে না কথাবার্তা আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। বলেই ফেলে শেষমেশ।

–তোমার ছেলে এবার চেস-এ ডিসট্রিক্ট চ্যাম্পিয়ন হয়েছে জুনিয়র লেভেলে। রোববার রবীন্দ্রভবনে ওরা প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশন সেরিমনিটা রেখেছে। কে একজন গ্রান্ড-মাস্টার আসছে। চিঠি দিয়ে ওরা ইনভাইট করেছে পেরেন্ট-দের।

আয়নায় নিজের ক্রিম ঘষা মুখটা ভালো করে দেখল শেষবার শ্রীদীপ্তা। এবার আলো নেভাবে। গর্ব না ক্রিম কীসে মুখ এত জ্বলজ্বল করছে, হদিস পেল না। কোনও কথা ভেসে এল না দেখে বিছানার দিকে ফিরে তাকায় শ্রীদীপ্তা।

অঘোরে ঘুমিয়ে পড়েছে মাল্টিন্যাশনালের এক্সিকিউটিভ।

দুই

বাইরে হর্ন-এর আওয়াজ। মানে, সাড়ে তিনটে। ফিরল ছেলে। ম্যাগাজিনটা কোল থেকে সরিয়ে সেন্টার টেবিলের উপর রেখে সোফা ছাড়ে শ্রীদীপ্তা।

দরজা খুলতেই হুড়মুড় করে ফ্ল্যাটে ঢুকল ছেলে। স্কুল ইউনিফর্মে যুদ্ধের চিহ্ন। একটা জুতোর ফিতে কখন খুলে গেছে। প্রায় নিজের ওজনের থেকেও ভারী একটা ব্যাগ পিঠে। খালি হয়ে যাওয়া ওয়াটার বটলটা বেসিনের নীচে প্রায় ছুড়ে ফেলে দিয়েই সোফায় বই-এর ব্যাগটাকে নামায় অর্প। সারাটাদিন স্কুলের ধকল সামলেও ছেলে যে এখনও কিছুটা তরতাজা, এতেই শান্তি পায় শ্রীদীপ্তা।

কতকগুলো বাঁধা প্রশ্ন থাকে ছেলের জন্য রোজ। আজকেও

একটা-একটা করে ছুড়ে দেবার জন্য তৈরি হল। অর্প এখন কিছু খুঁজছে সোফায়। টিভির রিমোটটা পেয়ে যেতেই সুইচ টিপে অন করে। চ্যানেল সার্ফ করতেই চোখের সামনে সব কিম্ভূতকিমাকার কার্টুন। বিস্ময় আর আনন্দ অর্পর মুখে। কিছু বলার নেই শ্রীদীপ্তার। ক্লাস সিক্সে পড়া তার ছেলে এখনই আওয়াল নাম্বার প্রায় সবেতেই। সেন্ট নিকোলাস-এর মতো স্কুলে ফার্স্ট বয়। কমপিউটার জিনিয়াস। ড্রয়িং-এ অন্তত ছ’টা জায়গার চ্যাম্পিয়ন। উপরি পাওনা, জেলা দাবা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছে কিছুদিন হল। স্কুল থেকে ফিরে এই আধঘন্টা তাই ছেলে কার্টুন নেটওয়ার্কে সময় ব্যয় করলেও খুব একটা আপত্তি থাকার কথা নয়।

ছেলের পাশে এসে বসে শ্রীদীপ্তা। চ্যানেলের আলো ছেলের চোখের মণি আর মুখটায় মেখে গেছে। বেশ মায়াবী। এলোমেলো চুলে সিঁথিটা সারাদিনের ধকলে কোথাও হারিয়েছে। মমতা মাখিয়ে প্রশ্ন ছোড়ে শ্রীদীপ্তা –টিফিন শেষ করেছ আজ?

–হুঁ।

ছেলের মনের বেশিরভাগ জায়গা জুড়েই এখন কার্টুনের দাপাদাপি। অবশ্য প্রশ্নটা না করলেও চলত। টিফিনে আজ মিক্সড চাউমিন করে দিয়েছিল। টিফিন ফেরত আসার কথা নয়। ভীষণ পছন্দ করে চাইনিজ অর্প।

–হোমওয়ার্ক কপি সব ঠিক আছে?

– হ্যাঁ।

এ প্রশ্নটাও না করলে চলত। শেষ কবে অর্প-র হোমওয়ার্ক কপিতে কারেকশান হয়েছে, মনে পড়ে না শ্রীদীপ্তার। ঘামের গন্ধ ভেসে আসছে ছেলের গা থেকে। স্কুলের ইউনিফর্মটাও বেশ নোংরা লাগছে। এবার বিরক্তি জন্মাচ্ছে শ্রীদীপ্তার ভেতর। প্যান্টের দু’পাশটা তো রীতিমতো কালো। কীসের যেন ছোপ লেগে রয়েছে। কালকেই ফ্রেশ ইউনিফর্ম দিয়েছে। অথচ আজকের মধ্যেই ড্রেসটার এই অবস্থা! কী করে অর্পটা স্কুলে! মারপিট না কি ধুলোয় গড়াগড়ি খায়! এতক্ষণে জুতসই প্রশ্ন খুঁজে পেয়েছে ছেলেকে করার মতো!

–কালকেই তো নতুন ড্রেস দিলাম। এর মধ্যেই এই অবস্থা! করোটা কী স্কুলে!

–স্কুলে নয়।

ছেলে পাত্তাই দিল না প্রশ্নটায় যেন। রাগে ভিজছে শ্রীদীপ্তা।

–তবে?

ফিরল ছেলে ওর দিকে। চোখে মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়েছে। নরম হচ্ছে শ্রীদীপ্তার রাগ।

–মাঝ রাস্তায় আজ পুলকার স্টপ হয়ে গিয়েছিল। ঠেলতে হল।

–মানে! কারা ঠেলল!

শ্রীদীপ্তা অবাক। মুখ দিয়ে বিরক্তিকর শব্দ বেরিয়ে আসে ছেলের। তারপর বলে– কারা? মনীষ, অঙ্কুর, জিৎ আর আমি।

কঠোর হতে চেষ্টা করে শ্রীদীপ্তা এবার।

–যা করেছ, করেছ। তুমি গাড়ি থেকে নামবে না। বলবে ড্রাইভার আঙ্কলকে– মা বারণ করেছে।

–কেন! ওরা একা-একা লেবার দেবে! নাঃ, স্কুলে ফাদার ব্রুজ সবসময় আমাদের টিম এফোর্ট দিতে বলেন।

শ্রীদীপ্তা চোখ পাকাতেই চুপ করে যায় ছেলে। অর্প আবার ওই একই কাজ করবে! কথা শুনবে না! শ্রীদীপ্তা জানে, তার ছেলে এরকম নয়!

তিন

বেস ফোনটা বেজে উঠতেই বিরক্ত হল শ্রীদীপ্তা। বাথরুমে চানে মগ্ন ছিল। ভেজা শরীর নিয়ে ড্রয়িং-এ আসতে ভালো লাগে না। মেঝেটা জলে জলময় হয়ে যায়। অথচ আসতেই হবে। অর্প স্কুলে, জয় অফিসে। জয়-এর ফোন করার হ্যাবিট বিয়ের বছরখানেক পরই চলে গেছে। দাদা কি! হতেও পারে। চুলে একটা তোয়ালে জড়িয়ে ভেজা শরীরেও একটা তোয়ালে জড়াল শ্রীদীপ্তা। বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল। ফোনটা তুলে হ্যালো বলতেই অপর প্রান্তে একটা গম্ভীর গলা সরব হয়।

– হ্যাঁ, এটা কি ৩ছছ…..?

– হ্যাঁ, বলুন।

শ্রীদীপ্তা সহজ হচ্ছিল। আবার প্রশ্ন। এবার শ্রীদীপ্তা সচকিত হয়ে ওঠে। –আসলে… একটা পুলকার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। একটু চুঁচুড়া হাসপাতালে আসুন।

মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল। নীচের তোয়ালেটা খুলে পড়ে গেল। গা-এর জল কখন শুকিয়ে গেছে শ্রীদীপ্তার।

–অ্যাঁ!

আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে গলাটা ওকে।

–না, দেখুন সবাইকেই হসপিটালাইজড করা হয়েছে। প্রত্যেকেই স্থিতিশীল। আমরা গাড়ির মধ্যে স্কুলের ব্যাগ সার্চ করে যাদের যাদের স্কুল ডায়ারি পেয়েছি, খবর দিচ্ছি।

হাত থেকে রিসিভার পড়ে যাচ্ছিল। তবুও সব শক্তিকে একত্রিত করল শ্রীদীপ্তা।

–আপনি কে বলছেন?

–আমি সন্দীপ নন্দী, ইনভেস্টিগেটিং অফিসার, লোকাল থানা।

আর কিছু বলার আগেই ফোন কেটে যায়।

চোখ জ্বালা করছে। কান-মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। দেয়ালে ঠেস দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে শ্রীদীপ্তা। কী করবে এখন! কেউ ইয়ার্কি মারল না তো!

হঠাৎ করে খেয়াল পড়ল ড্রাইভারের ঠিকানা আর ফোন নাম্বার। নোট করা আছে ডায়ারিতে। কোনওক্রমে একটা ম্যাক্সি গলিয়ে নিজেকে ঢাকল। তারপর ডায়ারি বের করে ফোন করল। নাঃ, সুইচ অফ। তাহলে কি সত্যি সত্যিই–? চোখ দিয়ে আপনা থেকেই জলের ধারা নোনতা স্বাদ নিয়ে মুখের গোড়ায় চলে আসছে। দু’বছর চেষ্টা করেও কনসিভ হয়নি অর্প। তারপর হঠাৎই একদিন ওর আসার অস্তিত্ব ধরা পড়া! কী আনন্দ, কী খুশি! এগারোটা বছর ধরে তিলে তিলে বেড়ে ওঠা…।

চোখের জল মুছে আবার কাঁপা-কাঁপা হাতে ডায়াল করল জয়-এর মোবাইলে। অফিস থেকে আসতেও ওর সময় লাগবে। রিং হচ্ছে। তুলল জয়।।

–হ্যালো-তুমি? শোনো, এই… এইমাত্র একটা ফোন এল থানা থেকে। বলছে, অর্পদের পুলকারটা নাকি অ্যাক্সি…।

কথা শেষ করতে পারল না শ্রীদীপ্তা। গলা ভিজে গেল। দম আটকে এল। জয়-এর গলা আশ্চর্য রকম শান্ত!

–কেউ ইয়ার্কি-ফিয়ার্কি–।

–না গো না। গলাটা ভীষণ সিরিয়াস লাগল। আর তাছাড়া অমিত-এর মোবাইলেও ট্রাই করলাম। সুইচ অফ। আমি কী করব! তুমি এখুনি…।

– হ্যাঁ, আসছি। আর এমনি কেমন আছে, কিছু বলল?

– স্টেবল, হসপিটালাইজড হয়েছে।

একটু চুপ থেকে জয় ভরসা জোগাল।

–তুমি একদম সোজা হসপিটালেই যাও। আর পারো তো, লোকাল থানায় যাচাই করে নাও। আমি আসছি। আর শোনো, সাবধানে।

মাল্টিন্যাশনাল এক্সিকিউটিভ-এর গলাকে অনেকদিন পর কেঁপে যেতে শুনল শ্রীদীপ্তা।

চার

হাসপাতালের সিঁড়িতেই বসে পড়েছে শ্রীদীপ্তা। একদিক থেকে চিন্তা মুক্ত হয়েছে। অন্যদিক থেকে চিন্তা শতগুণ বেড়ে গেছে। প্রাথমিক শোকের ধাক্বা কাটিয়ে এখন ও উদ্বেগের শিকার। একটু দূরে করিডরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন পুলিশ অফিসার আর কনস্টেবল-এর সঙ্গে কথা বলছে জয়।।

ঘন্টা দু’য়েক হয়েছে হসপিটালে এসেছে শ্রীদীপ্তা। জয় আসার আগেই পৗঁছে গিয়েছিল। খবর পেয়ে একে একে পৌঁছে গিয়েছিল অনিরুদ্ধ, জিৎ আর মনীষ-এর বাবা-মাও। প্রত্যেকেরই চোখে জলের রেখা। উদভ্রান্ত চেহারা। গোটা হসপিটালটায় ভিড়েভিড়াক্বার। বেশ কিছু পুলিশ। খবর পেয়ে দু-তিনজন সাংবাদিকও এসে গেছে। মৃত্যুর খবর বিক্রি করে ব্যাবসা– এখনকার সমাজের নতুন ট্রেন্ড। হাত-পা থর-থর করে কাঁপছিল। অপেক্ষা বাঁধ মানছিল না। হাসপাতাল চত্বরে আসতেই এবার নিজেকে একা লাগছে শ্রীদীপ্তার।

টুকরো টুকরো আলোচনা আর ইনভেস্টিগেটিং অফিসারের কথা থেকে কাহিনিটা খাড়া করল কোনওক্রমে শ্রীদীপ্তা। পুলকার কোনও কারণে আজ আবার জিটি রোডের উপর বিগড়োয় স্কুল যাবার পথে। কিছু ছেলে ঠেলতে নেমেছিল। গাড়ি স্টার্ট হতে তারা আবার উঠেও পড়ে। হঠাৎই উলটোদিক থেকে আসা একটা লরি পুলকারটাকে ধাক্বা দেয়। আন্দাজ তখন সাড়ে আটটা। চারপাশের সব দোকান খোলেওনি। রাস্তায় সেভাবে ভিড়ও ছিল না। ভিড় জমার আগেই লরিটা পালিয়ে যায়। ড্রাইভার স্পটেই শেষ। অন্তত ছ’টা বাচ্চা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে এখন।

খুব তাড়াতাড়ি বাকি বাবা-মা’র সাথে এর্মাজেন্সি ইউনিটে পৗঁছেছিল শ্রীদীপ্তা। প্রত্যেকেরই পেটে আর বুকে সিরিয়াস চোট ছিল। একজনের ব্রেনে। ব্লাডের ব্যাগ, স্যালাইনের বোতল, ব্যান্ডেজ আর ছোপ ছোপ রক্তের মধ্যে আলাদা করে অর্পকে খুঁজে পাচ্ছিল না মা’র চোখ। কাচের দরজার উলটোদিকে দাঁড়িয়ে কেবলই ভগবানকে ডাকছিল শ্রীদীপ্তা। মস্তিষ্কে চোটটা যেন অর্প’র না লাগে। ওর ব্রেনের অনেক দাম। মুহূর্তে ও যেন স্বার্থপর হয়ে উঠছিল। দু’জন তাদের ছেলেকে চিহ্নিত করে আসার পরই শ্রীদীপ্তাকে ইশারা করে একজন নার্স। থর থর করে কাঁপতে থাকা পা দুটো নিয়ে এগিয়ে যায় শ্রীদীপ্তা।

একইরকম স্কুলড্রেস, ব্যান্ডেজ, আর ওষুধের গন্ধে হারিয়ে যাচ্ছিল সবকিছু। চোখে জলের ধারা কখন বন্ধ হয়ে গেছে। বমি পেয়ে যাচ্ছে তার বদলে। বার বার চোখের দৃষ্টি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে চেনার চেষ্টা করছিল শ্রীদীপ্তা যুঝতে থাকা দেহগুলোর মধ্যে তার নিজের দেহের অংশটা কোথায়! ভীষণ অবাক হয়ে যাচ্ছিল ও। অন্য রকম অস্বস্তি গ্রাস করছিল ওকে। মা হয়েও চিনতে ভুল হবে!

জয় আসতে ও আবার ছুটেছে ওয়ার্ডে। জয়ও চেষ্টা করেছে। নাঃ, আহতদের মধ্যে অর্প নেই। পুলিশ ওদের কাছ থেকে সেইমতো স্টেটমেন্টও নিয়েছে। কিছুতেই শ্রীদীপ্তা বুঝতে পারছে না, ছেলেটা কোথায় গেল! গাড়িতে অর্পর ব্যাগ, বই, টিফিনবক্স, ডায়ারি– সবকিছুই রয়েছে। অ্যাটেন্ডিং ডাক্তার ওকে অ্যাসিওর করেছে, যে মারা গেছে সে ড্রাইভার-ই। তার বাড়ির লোক আইডেন্টিফাই-ও করেছে।

কথা বলা শেষ পুলিশের সাথে। জয় এগিয়ে আসছে। শ্রীদীপ্তা বলল, ‘কী বলছে ওরা?’

–ব্যাপারটা বেশ মিস্টিরিয়াস! ওরা বলছে, ব্যাগ গাড়িতে ছিল। গাড়ি ওরা মাইনুটলি সার্চ করেছে। আশে-পাশেও। বডি বা ইনজিওরড– কাউকেই ওরা পায়নি।

–টয়লেট করতে-টরতে–।

–মনে হয় না।

–আমাদের একবার গেলে হয় না!

–আমাদের থেকেও ওদের এসব সেন্স অনেক বেশি। এটা ওদের প্রফেশন। ওরা ঠিক যেটা দেখার দেখে নিয়েছে।

জয় বিপদেও মাথা ঠান্ডা রাখতে পারে। শ্রীদীপ্তা পারছে না। ছেলেটার মুখটা! উঃ! চোখে জলের ধারা বাঁধ মানছে না শ্রীদীপ্তার! মাতৃস্নেহ…।

–ওরা যে ঠিক বলছে, তার কী মানে?

সিঁড়িতে ওর পাশটাতেই বসে পড়ল জয় হঠাৎ। ফরসা মুখটা লাল। চোখেতে জল আসব আসব করেও উথলে ওঠেনি। বাবাদের কি কাঁদতে নেই! শ্রীদীপ্তার কাঁধে একটা হাত তুলে দিল।

–ভেবে দ্যাখো একবার। বেশ পাবলিক সিমপ্যাথি পেয়েছে ঘটনাটা। আর মিডিয়া তো এখন ঝাঁপিয়ে পড়েছে। পুলিশকে তার দায়িত্ব পালন করতেই হবে।

নরম জয়-এর গলা। এ গলার অাঁচ অনেকদিন পরে পাচ্ছে শ্রীদীপ্তা। ভালোবাসা বোধহয় মরে না। এতদিন পরে যেন খুব হালকা ছোঁয়া পাচ্ছে। অনেকটা দুধ কড়ায় ফোটালে পরিমাণে কমে যায়। তৈরি হওয়া সলিড ক্ষীরটা তখন বোধহয় আরও টেস্টি। এরকম বিপদে জয়কে পাশে পাচ্ছে। যেভাবে জয় ওর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে, এও তো একধরনের প্রেমই। এ রকম দুর্ঘটনাই বোধহয় মানুষের মধ্যে বোধশক্তিকে জাগিয়ে দেয়। শ্রীদীপ্তা নতুন করে জয়কে আবিস্কার করছে। জয় আর ও আবার একসাথে লড়ছে। ঠিক যেভাবে বেশ কিছু বছর আগে বাড়ি থেকে বেরিয়ে শুরু করেছিল। লড়াইটা সেবারও ওরা জিতেছিল। এবারও…

আপনি কি জয় ঘোষ?

সামনে খেঁকুড়েপনা একটা লোক এসে দাঁড়িয়েছে। করিডরে দাঁড়িয়ে থাকা বাকি বাবা-মা’র দিকে একবার তাকিয়ে নেয় শ্রীদীপ্তা। জয় উঠে দাঁড়িয়েছে।

– হ্যাঁ, বলুন।

– আপনার সঙ্গে একটা কথা ছিল। আপনার মোবাইল নাম্বার তো…জ্ঝজ্জ্ব্ব….।

– হ্যাঁ, হ্যাঁ বলুন না, কী ব্যাপার।

জয়-এর ভ্রু কুঁচকে গেছে। বুকে এবার হাতুড়ি পিটছে ওর। জয় এগিয়ে গেল লোকটার সাথে। শ্রীদীপ্তাও হাঁটা দিল পেছন পেছন। কথাগুলো ভেসে আসছিল ওর কানে।

–আমার একটা চা-এর দোকান আছে। যেখানে অ্যাক্সিডেন্টটা হয়েছে, সেখান থেকে একটুখানি।

শ্রীদীপ্তা পা চালিয়ে ওদের মধ্যে পৗঁছে গেছে। জয় দাঁড়িয়ে গেছে। ওরা এখন হসপিটাল মেন গেটের কাছাকাছি।

–হ্যাঁ, কিন্তু আমার মোবাইল নাম্বার কী করে আপনার কাছে –!

লোকটা চারদিক তাকিয়ে নেয়। তারপর হেসে বলে ওঠে– আপনার ছেলে দিল।

–মানে!

জয় চিৎকার করে উঠেছে। শ্রীদীপ্তার মনে নতুন শঙ্কা। শেষে কি ছেলে অপহরণ হল!

–কিন্তু ও কোথায়?

জয় দাঁতে দাঁত ঘষছিল। অজান্তেই খামছে ধরেছে

জয়-এর জামাটা ও।

–বাইরেই রিকশায় বসে আছে। ফোনই করতাম। একটু কিন্তু কিন্তু লাগল।

–ওর কাছে নিয়ে চলুন।

এবার শ্রীদীপ্তা মুখ খুলেছে।

–হ্যাঁ, আসুন না।

লোকটার ব্যবহারে এবার একটু একটু করে সন্দেহ কমছে শ্রীদীপ্তার।

– হ্যাঁ, ব্যাপারটা কী হল! যেতে যেতেই পুরো ব্যাপারটার রহস্য ভেদ করতে চাইছে জয়।

লোকটাও যেন তৈরিই ছিল বলার জন্য।

–আসলে অ্যাক্সিডেন্ট হবার সময় আপনার ছেলেও গাড়িটাকে বাইরে থেকে ঠেলছিল। কোনও কারণে গাড়ি বা ওর বন্ধুরা এগিয়ে যায়। আর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই ঘটনাটা ঘটে আপনার ছেলের চোখের সামনে। ভয়ে, আপনার ছেলে আমার দোকানে ঢুকে যায়। জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল শ্রীদীপ্তা। লোকটা থামতেই জয় বলে ওঠে, –তারপর?

–দোকানে তখন আমি আর আমার কর্মচারি ছিলাম। ওদিকে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিড় জমে গেল। এদিকে আপনার ছেলের এই অবস্থা। তখনও আমরা ভাবছি, ছেলেধরা-টরা হবে। দোকানের ঝাঁপ ফেলে দিলাম ভয়ে। দুধ খাইয়ে ওকে চাঙ্গা করতে আপনার নাম, ফোন নাম্বার পেলাম! খবর পেলাম, সব বাবা-মা’রা এখানেই আসছে। তাই…।

চোখে পড়েছে শ্রীদীপ্তা-র অর্পকে। চুপটি করে বসে আছে রিকশায়। দৗড়ে চলে যায় ছেলের কাছে। রিকশা থেকে ছেলে নেমে আসতেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরে। একদম অক্ষত ছেলে। এগিয়ে আসে জয় আর লোকটি। জয় লোকটার একটা হাতকে দু’মুঠোর মধ্যে ধরে নিয়েছে।

–কী বলে যে আপনাকে…।

– না, না। কোনও ব্যাপার নয়। আসলে ভয়ই লাগছিল নিজেরও। না কেস খাই! নতুন দোকান। কারওর ভালো করতে যাওয়াটাও আজকাল বিপদ!

শ্রীদীপ্তা ছেলের দিকে তাকায়। আর পুলকার নয়। এবার নিজেই।

নাম, ঠিকানা জানার পর ভদ্রলোককে একদিন বাড়িতে আসতে বলল জয়। হঠাৎই দিনটাকে আবার ভালো লাগতে শুরু করেছিল শ্রীদীপ্তা-র। সব রাতের শেষেই যেমন দিন, সব টেনশনের শেষে একটা স্বস্তি লুকিয়ে থাকে। শ্রীদীপ্তা’র সব টেনশন এখন যেমন আছড়ে পড়েছে হসপিটাল চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু বাবা-মা’র উপর।

শ্রীদীপ্তা হালকা ঝাঁকুনি দেয় অর্পকে।

–ওরা তো দৗড়ে ঢুকে পড়েছিল গাড়ির ভেতর। তুই কোথায় ছিলিস! অর্পর মুখ নীচু।

–জুতোর ফিতেটা খুলে গেল! বাঁধছিলাম আর ঠিক…তখনই…  ঞ্জ

অবনীবাবুর গ্রাম

জিনিসটা কাল থেকে খুঁজে পাচ্ছেন না অনুপমা। এত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কী করে যে হারিয়ে ফেললেন ভেবেই অবাক হচ্ছেন। অবশ্য একে হারিয়ে ফেলা বলা চলে না। ঘরের মধ্যেই হয়তো কোথাও রেখে ভুলে গিয়েছেন। কিন্তু কোথায়? সকাল থেকে এখনও অবধি সম্ভাব্য সমস্ত জায়গায় খুঁজে দেখেছেন।

ইদানীং ভুলে যাওয়ার সমস্যাটা চরমে গিয়ে পৗঁছেছে। কিছুদিন আগের ঘটনা। ঘুম থেকে উঠে চশমা খুঁজে পাচ্ছিলেন না। চোখের যা অবস্থা চশমা ছাড়া সমস্তটাই ঝাপসা লাগে। সেই ঝাপসা দৃষ্টি দিয়েই সকাল থেকে বাড়ি ওলটপালট করলেন। দুপুরে কাজে এসে চুন্নি চশমা পেল ডালের কৗটোর ভেতর। এরকম বহু ঘটনা আছে। তাই সেই গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলো টেবিলের উপর নির্দিষ্ট একটা বাক্সের মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল সুশান্ত।

ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে টর্চটা নিয়ে অনুপমা এবার খাটের তলায় আলো ফেললেন। স্তূপীকৃত ব্যাগ, বাসন, ট্রাঙ্কের ফাঁকফোকর দিয়ে আলো যতটুকু পৗঁছোল তাতে কোথাও সেই জিনিস নজরে এল না। অনুপমা ক্লান্ত বোধ করলেন। আজকাল একটুতেই ক্লান্ত হয়ে পড়েন। টর্চ অফ করে এসে বসলেন খাটের উপর।

বাতের ব্যথার জন্য শরীর নড়াচড়াতে কষ্ট। তবুও মরিয়া হয়ে খুঁজে যাচ্ছেন সকাল থেকে। নইলে সন্ধ্যার পর থেকে আর নিস্তার নেই। অনুপমা চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলেন। দিন চারেক আগে সুশান্ত এসে যখন জিনিসটা দিয়ে গেল তারপর ঠিক কোথায় রাখলেন…।

আচমকা মনে হল জিনিসটা চুরি হয়নি তো? কিন্তু চুরি কে করবে? চুন্নি? পাঁচ বছর ধরে কাজ করছে। ও ঘর মুছতে গিয়ে এক টাকার কয়েনও কুড়িয়ে পেলে ফেরত দেয়। আর থাকল রামলাল। রামলাল কবে এই ঘরে ঢুকল অনুপমা মনে করার চেষ্টা করলেন। ধুসস! যতসব আজেবাজে ভাবনা। প্রতিদিন বাজারটা পৗঁছে দিয়েই বেরিয়ে যায় ও। বাড়িতে বিশেষ কেউ আসে না। তাই চুরির প্রশ্নও আসে না। তাছাড়া এই জিনিস আদৌ কি চুরি হবার মতো..? ভাবনায় ছেদ পড়ল। পাশের ঘর থেকে বিকট এক চিৎকার ভেসে এল হঠাৎ।

‘ফুটো করে করে সব শেষ করে ফেলল। ভেঙে পড়বে এবার’ অবনীবাবু আর্তনাদ করে উঠলেন।

অনুপমা দরজার সামনে এসে বললেন ‘কী হল আবার?’

‘সব শেষ করে ফেলল।’

‘কে?’

‘শুনতে পাচ্ছ না নাকি? কখন থেকে ঠোকর মেরেই যাচ্ছে’

অনুপমা কান পেতে শুনলেন একটা কাঠঠোকরা পাখি অনবরত ঠোকর মারছে গাছে।

‘বাবার নিজে হাতে লাগানো গাছ। ঢিল মেরে তাড়াও ওটাকে।’

‘তাড়াচ্ছি দাঁড়াও। অত চিৎকার কোরো না’ বিরক্ত কণ্ঠে কথাটা বলে অনুপমা বেরিয়ে গেলেন বাইরে।

অবনীবাবু নিশ্চিন্ত হলেন। ঠোকরের আওয়াজ আর পাওয়া যাচ্ছে না। নিশ্চিন্তে আবার পা নাচানো শুরু করলেন। সব গাছ বাবার নিজে হাতে লাগানো। রোজ ঘন্টার পর ঘন্টা রোদ, বৃষ্টি, মাটি মেখে নিজের শখের বাগান বাড়িয়ে তুলতেন বাবা। সার সার সুপুরি বাগানের পেছনের জঙ্গলেই আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, নারকেলের ভিড়। বেলা বাড়লে অনেক চেনা-অচেনা পাখির ডাক শোনা যায়।

নারায়ণগঞ্জের পনেরো বিঘে জমি ঠাকুরদার নিজের কষ্টের পয়সায় কেনা। এত জায়গা এ তল্লাটে আর কারও নেই। সুপুরি, আর মাঠের ফসলের ব্যাবসায় টাকাও আসত ভালো। সেই টাকায় এলাকার সবচেয়ে প্রথম পাকা বাড়ি হল তালুকদার বাড়ি। পাকা বাড়ি হলেও বাবা ইচ্ছে করেই ছাদ দিতে দেননি।

ঝিরঝির করে বৃষ্টি শুরু হল। টিনের চালে বৃষ্টি আছড়ে পড়ার আলাদা একটা শব্দ আছে। সেই শব্দ শুনেই বোঝা যায় বৃষ্টির গতি। অবনীবাবু বুঝলেন জোরে নয়। হালকা, ঝিরঝিরে বৃষ্টি।

বর্ষার সময়। যখন তখন বৃষ্টি নামে। প্রতিবার রাস্তার ওপাশের ডোবাটা এই সময় জল, কচুরিপানায় টলমল করে। পিন্টুদের পুকুরের সাথে যুক্ত থাকায় প্রচুর মাছ আসে সেখানে। টাকি, রুই, খোলসা, কই। বিকেলে গ্রামের বাচ্চাগুলোর মাছ ধরার শব্দ স্পষ্ট শুনতে পান অবনীবাবু। কথাটা মনে হতেই চেঁচিয়ে উঠলেন ‘বাচ্চাগুলো এলে গোটা কয়েক মাছ দিয়ে যেতে বলো তো। অনেকদিন ভাজা খাই না। আগে আমি ধরতাম, আর মা ভাজত। ঘি, মাছ ভাজা…’ বলে অবনীবাবু হাসলেন। বেশ জোরেই। কিন্তু ও-ঘর থেকে কোনও প্রত্যুত্তর শোনা গেল না।

(দুই)

কথাটা অনুপমার কানে এসে পৌঁছোল না। সারাদিনই কিছু না কিছু বলতে থাকেন অবনীবাবু। আর সেই অনুযায়ী উত্তর দিয়ে যেতে হয় তাকে। কিন্তু আজ ও-ঘরে বসে থেকে উত্তর দেওয়ার মতো মানসিক অবস্থা নেই। জিনিসটা পাওয়া না গেলে আজ রাতেও ঘুমোতে পারবেন না।

ছালবাকল ওঠা মান্ধাতা আমলের ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ফোন থেকে নম্বর বের করে কারও সাথে কথা বলা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কানে ঠেসে না ধরলে কিছুই ঠিকঠাক শোনা যায় না। ছেলে অর্কপ্রভ অনেকবার বলেছিল টাচ ফোন কিনে দেবে। অনুপমা প্রত্যেকবারই প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলেছেন, ‘তিনকাল গিয়ে এককাল আছে। এখন আর টাচ ফোন দিয়ে কী করব?’

অর্ক মাকে বোঝানোর চেষ্টায় বলেছে, ‘অনেক সুবিধে হয় তাহলে। অ্যানড্রয়েড ফোন দিয়েই আজকাল সব কাজ হয়।’

অনুপমা প্রতিবারই প্রবল আপত্তি জানিয়ে না করে দিয়েছেন, ‘এর মাথা-মুন্ডু কিছুই বুঝব না। যেভাবে চলছে বরং সেভাবেই…’

অর্ক আর কথা বাড়ায়নি। সে কথা বাড়াতে পছন্দ করে না। ছোটোবেলা থেকে প্রখর বুদ্ধি সম্পন্ন গম্ভীর প্রকৃতির অর্কপ্রভ বাইরের নামি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বিটেক করেছে। এখন চাকরি সূত্রে বছর সাতেক ব্যাঙ্গালোরে বউ বাচ্চা নিয়ে সেটেলড। দেড় বছর আগে যখন ঘটনাটা ঘটল চাকরি ছেড়ে বাড়ি চলে আসতে চেয়েছিল। অনুপমা বাধা দিয়ে বলেছিলেন ‘বললাম তো আসতে হবে না। আমি সামলে নিতে পারব। তাছাড়া চুন্নি, রামলাল তো আছেই।’

অর্কপ্রভ আসেনি। ফোনের ওপাশ থেকেই যতটা পারা যায় দায়-দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করে।

অনুপমা লোহার মতো শক্ত কি-প্যাড গুঁতিয়ে ফোন লাগালেন। দু’বার রিং হয়ে কেটে গেল। তিন নম্বর বার অর্ক ফোন তুলে বলল, ‘মিটিং-এ আছি। বেরিয়েই কল ব্যাক করছি।‘ আর কিছু বলার সুযোগ পেলেন না অনুপমা।

ভেবেছিলেন ছেলেকে বলে যদি কিছু উপায় বের করা যায়। অনুপমা আবার চেষ্টা করলেন সুশান্তকে। সুইচড অফ। ওর দেওয়া দুটো নম্বরেই কাল থেকে অসংখ্যবার ট্রাই করেছেন। কোনওটাতেই পাচ্ছেন না। এসব ভাবতে ভাবতে আচমকা একটা বুদ্ধি খেলে গেল মাথায়। সুশান্তর ওখানে গিয়ে উপস্থিত হলে কেমন হয়? তাহলেই তো সমস্যা চুকে যায়। টেবিলের উপর রাখা কার্ডটা ভালো করে দেখলেন। কন্ট্যাক্ট নম্বরের নীচে ঠিকানা লেখা। ছয় মাস আগে অর্ক যখন এসেছিল তখন দু’বার গিয়েছিলেন তার সাথে। চিনতে অসুবিধে হবে না।

পরক্ষণেই মাথায় আসল অবনীবাবুর কথা। ঘরে একা রেখে যাবেন কীভাবে! আরেকটু পরেই চুন্নি কাজে আসবে। ওর উপর ভরসা করে রেখে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? এছাড়া আর উপায়ও বা কী! সুশান্তকে কবে ফোনে পাওয়া যাবে তার নেই ঠিক। অতদূর থেকে অর্কও মনে হয় না বিশাল কোনও সাহায্য করতে পারবে। এর চেয়ে ভালো সশরীরে নিজে গিয়ে নিয়ে আসা। তাহলে অন্তত কিছুদিনের জন্য রেহাই।

অনুপমা মনস্থির করলেন চুন্নিকে রেখেই বেরোবেন। ও সমস্তটাই জানে। তাও আরও একবার বলে যেতে হবে। বাসন মাজা, কাপড় কাচার সাথে ওর আজকের এক্সট্রা কাজ হবে দাদুর সাথে বসে গল্প করা। অ্যাক্সিডেন্টে চোখ দুটো খোয়ানোর পর থেকেই অবনীবাবু রোজ জানালার দিকে মুখ করে ইজিচেয়ারে বসে পা নাচান। আশপাশ থেকে ভেসে আসা গ্রামের এক একটা শব্দ খুব মন দিয়ে শোনেন। শুকনো পাতা মাড়িয়ে যাবার শব্দই হোক বা বর্ষাকালে কাদা মাখা স্যান্ডেলের চটচট শব্দ। কোনও কিছুই কান এড়ায় না তার। চোখে দেখতে না পারলেও শব্দ শুনেই চলমান গ্রাম অনুভব করেন।

সকালে মোরগের ডাকে ঘুম ভাঙার পরই অবনীবাবুকে ধরে ইজিচেয়ারে বসিয়ে দেন অনুপমা। তারপর চা নিয়ে এসে নিজেও বসেন পাশে। সেই থেকে শুরু হয় কথা। সুপুরির খোল পড়ার আওয়াজ পেলেই অবনীবাবু শুরু করেন ছোটোবেলায় কীভাবে সেটাকে টানা গাড়ি হিসেবে ব্যবহার করতেন সেই গল্প। ‘একজন খোলের উপর চড়ে বসত আর সামনের জন মাটিতে টেনে হিঁচড়ে এগিয়ে নিয়ে চলত’, বলে অবনীবাবু হাসেন। অনুপমাও হো হো করে হেসে ওঠেন।

সবচেয়ে মুশকিল হয় নারকেল পড়লে। ঝুপ করে নারকেল পড়া মাত্রই অবনীবাবু নাড়ু খাওয়ার হাজারটা গল্প জোড়েন। সাথে বারবার খাবার আবদার। অনুপমা ক্লান্ত বোধ করেন। শরীরের বয়স তেষট্টি হলেও তিনি আরও বেশি বুড়িয়ে গেছেন। মাথা ভর্তি পাকা চুল, কুঁচকে যাওয়া চামড়ার সাথে বাড়তি পাওনা বাতের ব্যথা। এত ধকল আর সইতে পারেন না। তবুও জান ঢেলে যতটা সম্ভব করার চেষ্টা করেন। একাত্তর বছরের এই বৃদ্ধ মানুষটার জন্য। এতগুলো বছর ধরে শুধু…

‘দিদা ঝাঁটা কোথায়?’ অনুপমা পেছন ফিরে দেখলেন চুন্নি এসে গেছে।

(তিন)

‘তোর দিদা বকুলদের বাড়ি থেকে কখন ফিরবে?’ অবনীবাবু প্রশ্ন করলেন।

‘বলেছে সন্ধ্যা হবে।’

‘কটা বাজে এখন?’

‘সাড়ে তিনটা’

‘শুনেই বুঝেছিলাম।’

‘কী?’ চুন্নি অবনীবাবুর দিকে তাকাল।

‘বালতির আওয়াজ। পটলার বাবা এই সময় মাঠ থেকে ফেরে। কুয়োর পারে বসে সাবান ঘষে ঘষে স্নান করে।’

কী কান রে বাবা! চুন্নি মনে মনে ভাবল।

‘আগে তো আমাকে আর পটলাকে এক সাথে বসিয়ে পিঠে সাবান ঘষে দিত। স্নান করাত, অবনীবাবু মুচকি হাসলেন। ঝগড়ার পর থেকে আর কথা বলে না। উঠোনে তো বেড়াও দিয়ে দিল।’

কিছুক্ষণ চুপ থেকে অবনীবাবু বললেন ‘যা মাড়টা ঢেলে দিয়ে আয়। গরুগুলো না খেয়ে আছে।’

‘দিচ্ছি’

‘অল্প পোয়ালও দিস।’

‘আচ্ছা’

আচমকা ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। টিনের চালে বৃষ্টি আছড়ে পড়ার তীব্র আওয়াজ। সাথে মেঘের ডাক।

‘জানালাগুলো আটকে দে’ অবনীবাবু চেঁচিয়ে বললেন।

এই সময় প্রচন্ড মনখারাপ হয়ে যায় অবনীবাবুর। বৃষ্টির জন্য অন্য কিছু শোনা যায় না। যদিও চুপচাপ চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির আওয়াজ শোনার মধ্যে একটা মজা লুকিয়ে আছে। ছোটোবেলায় মাটির বারান্দায় বসে কাগজের ছোটো ছোটো নৗকা ভাসিয়ে দেওয়ার খেলা চলত। বৃষ্টি থামলে দেখা হতো কারটা কতদূর পৗঁছেছে। প্রতিবারই জিতে যেত শিমুল। এত জলের মধ্যেও কীভাবে যেন শুধু তার নৗকাই ডুবত না। অনেক চেষ্টা করেও তাকে কোনওবারও হারানো যেত না। অবনীবাবু শিমুলের অস্পষ্ট মুখ দেখতে পেলেন।

সেবার ঘোর বর্ষা। শিলাবতি নদী ফুলে ফেঁপে উঠেছে। পাড় ঘেঁষে ইতিমধ্যে অনেক ঘর জলের তলায়। অনেক ফসল নষ্ট হয়েছে। প্রচুর লোকসান। নদী আয়তনে বেড়ে উপরে উঠে এসেছে অনেকটাই। গ্রাম জুড়ে সতর্কতা। পারে যাতে কেউ না যায়। শিমুলের বাবা সামান্য ভাগচাষি। তারও প্রচুর লোকসান হয়ে গেছে।

একদিন বিকেলে শিমূল এল। সঙ্গে ওমু আর টিটু। বলল মাছ ধরতে যাবে। শিলাবতির পাড়ে। বাড়িতে না জানিয়েই ভয়ে ভয়ে সেখানে পৌঁছোল ওরা। চারিদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। যেদিকেই চোখ যায় জল আর জল। পারের বট, ডুমুর সব কোমর জলে দাঁড়িয়ে। জলে ভেসে যাচ্ছে ভাঙা বাড়ি-ঘরের অবশিষ্টাংশ। নদীর এই ভয়ংকর রূপ দেখে ওরা তিনজন ঘাবড়ে গেলেও শিমুল ধার বরাবর আরও এগোতে থাকল। তখন অন্ধকার নেমে এসেছে। দূরের কিছু বাড়িতে দেখা যাচ্ছে কুপি, হ্যারিকেনের আলো। তিন বন্ধু বলল আর যাবে না। সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শিমুল তাদের বাড়ি চলে যেতে বলে ছিপ হাতে এগিয়ে যেতে থাকল সামনে।

পরদিন সকাল। তুমুল বৃষ্টি। বৃষ্টির শব্দে কানের পর্দা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। হঠাৎ দূর থেকে একটা হই হই শোনা গেল। অনেকেই ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল শিমুলের বাবা সেই প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে খালি গায়ে পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে ছুটে যাচ্ছে। পেছনে তার দাদা, মা, গ্রামের আরও কিছু লোক। দুপুরে শোনা গেল শিমুলের লাশ পাওয়া গেছে। আগেরদিন সন্ধ্যায় মাছ ধরতে গিয়ে পাড়ের মাটি ভেঙে জলে ডুবে যায় শিমুল। বর্ষায় ফুলে ওঠা শিলাবতি সেই দেহ টেনে নিয়ে চলে যায় অনেকদূর। মাঝিরা লাশ দেখে খবর দেয় গ্রামে।

প্রচন্ড বৃষ্টিতে মনখারাপ হয়ে যায় অবনীবাবুর। শিমুলের বাবার সেই অসহায় চিৎকার কানে বাজে।

‘একি! কাঁদছ কেন?’ চুন্নি অবাক হল।

অবনীবাবু নাক টেনে একটু কেশে নিয়ে বললেন ‘শিমুলটা মারা গেল। কেন যে আটকাইনি আমরা।’

চুন্নি কী বলবে ভেবে পেল না।

দেখল চোখের কোণ বেয়ে এক বিন্দু জল গড়িয়ে এসে পড়ল ইজিচেয়ারের হাতলে।

(চার)

লোকগুলো দৌড়োচ্ছে। অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন। হাসপাতালের করিডোর।

আশপাশে বসে থাকা সমস্ত পেশেন্টের ভিড়, নার্সদের কোলাহল কাটিয়ে লোকগুলো এগিয়ে যাচ্ছে অপারেশন থিয়েটারের দিকে। স্ট্রেচারে শোয়ানো মানুষটার চোখ বন্ধ। মাথার পেছনে বাঁধা কাপড়ের টুকরো শুষে নিচ্ছে বেরিয়ে যাওয়া রক্তের স্রোত। আর এক মুহূর্ত দেরি হলেই বাঁচানো যাবে না। লোকগুলো দৌড়োচ্ছে।

‘আরে দিদি চেপে বসুন না একটু। এত জায়গা থাকতে…’

পরের কথাটা অনুপমার কানে গেল না। সাইড দিয়ে সাইরেন বাজাতে বাজাতে প্রচন্ড গতিতে একটা অ্যাম্বুলেন্স বেরিয়ে গেল। তাই শোনা গেল না। অনুপমা জানলার ধারে চেপে গেলেন। মহিলাটি পাশে এসে বসল।

বাসে উঠে ঘুম এসেছিল একটু। তিনরাত ধরে ঘুমোতে না পারার ফল। একটা মানুষ অনবরত একই কথা বলে গেলে কে-ই বা শান্তিতে ঘুমোতে পারে। তাই শরীরে হাজার ব্যথা, কষ্ট নিয়েও আজ সুশান্তর কাছে যেতে হচ্ছে।

শান্তি শব্দটা অনুপমার অভিধান থেকে লুপ্ত হয়ে গেছে অনেকদিন। বাসে উঠে চোখ বন্ধ হওয়া মাত্র আবার সেই আজেবাজে স্বপ্ন!

পরশুদিন অর্ক ফোন করে জানিয়েছিল ওর কথা হয়েছে ডক্টর চৌধুরীর সাথে। পরের মাসে একবার চেক আপ করিয়ে আনতে বলল।

জানলা দিয়ে শোঁ শোঁ হাওয়া ঢুকে পেকে যাওয়া চুলগুলো ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। অনুপমা জানলার বাইরে চোখ রাখলেন। অনেকদিন আসা হয় না এদিকে। বাজার হাট সব রামলালই করে দেয়। তাই বাড়ি থেকে বের হতে হয় না বিশেষ। রামলাল কাজে ব্যস্ত। তাই দু’দিনের বাজার আগেই করে রেখে গেছে। নাহলে আজ ওকেই পাঠানো যেত। ক্ষয়ে যাওয়া শরীরটাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলতে হতো না।

অবনীবাবুকে বাড়িতে একা রেখে কোথাও বের হন না অনুপমা। একান্তই দরকারে চুন্নিকে রেখে…। গ্রামের ঠাকুর বকুল মাস্টারের বাড়িতে মনসা পুজোর নেমন্তন্ন আছে। কথাটা বলে বেরিয়ে আসতে হয়েছে। চুন্নি ঠিকঠাক সামলাতে পারছে তো? একরাশ দুশ্চিন্তা গ্রাস করল হঠাৎই। অনুপমা অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন।

‘থাকেন কোথায়?’ প্রশ্নটা পাশ থেকে এল। সেদিকে না তাকিয়েই অনুপমা উত্তর দিলেন ‘নারায়ণগঞ্জ’।

‘বাপরে! সে তো অনেকদূর।’

জানলা থেকে চোখ ফিরিয়ে অনুপমা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই…

‘ওখানে আমার মামাবাড়ি ছিল বলে’ মহিলাটি হাসলেন।

অনুপমা আর কিছু বললেন না।

‘সেই ছোট্টবেলা থেকে ওখানকার মাটি মেখে বড়ো হয়েছি। মামাবাড়ি গেলেই হ্যারিকেনের আলোয় গল্পের বই পড়তাম। এখন তো বোধহয় ইলেক্ট্রিসিটি এসেছে।’

মহিলাটির ঠোঁটে লেগে থাকা হাসি দেখে অনুপমা বুঝলেন অনেক পুরানো স্মৃতি মনে পড়ে গেছে তার। মানুষ স্মৃতিমেদুর হলেই এভাবে হাসে।

‘হ্যাঁ এসেছে।’

‘শেষ গিয়েছিলাম আট-ন বছর আগে। মামা মারা যাবার পর সব জায়গা জমি বিক্রি করে দাদারা শহরে চলে এল। তারপর আর যাওয়া হয়নি।’

‘ওহ’

অনুপমা সংক্ষেপে উত্তর দিলেন।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে মহিলাটি আবার বলল, ‘আচ্ছা গ্রামে কি এখনও সেই রেওয়াজটা আছে?’

‘কীসের?’

‘ওই যে জ্যৈষ্ঠের পূর্ণিমায় শিলাবতির পাড়ে খাওয়া-দাওয়া, রাত কাটানো। কী যে মজা হতো…’

কয়েক মুহূর্ত ভাবতেই বিদ্যুৎ ঝলকের মতো পরপর কিছু দৃশ্য ভেসে উঠল চোখের সামনে।

নারায়ণগঞ্জে বিয়ে হয়ে আসার মাত্র কয়েকমাস হয়েছে তখন। অনুপমা শহরের মেয়ে। প্রত্যন্ত গ্রাম নারায়ণগঞ্জে এসে প্রথম প্রথম বেশ অসুবিধে হতো। একদিন সন্ধ্যায় অবনীবাবু হাট থেকে বাড়ি ফিরে নদীর পাড়ে রাত কাটানোর কথা বললেন। সাথে জানালেন, খাওয়া-দাওয়া ওখানেই হবে। কথাটা অনুপমা ঠাট্টার সুরে নিলেও রাতে সত্যিই সেখানে বউ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন অবনী তালুকদার। অনুপমা পরে জেনেছেন বছরের একটা দিন জ্যৈষ্ঠের পূর্ণিমায় প্রতিবছরই গ্রামের লোক জড়ো হয় সেখানে। নদীর পাড় দিয়ে গিজগিজ করে মানুষ। জায়গায় জায়গায় আগুন জ্বেলে করা হয় রান্না।

সেদিন চারিদিকের হই হই কাটিয়ে অনুপমার চোখ গিয়ে ঠেকল মেঘহীন আকাশের থালার মতো গোল চাঁদটার গায়ে। নিজেকে উন্মুক্ত করে সমস্ত আলো ঢেলে দিচ্ছে পৃথিবীর বুকে। পূর্ণিমার পূর্ণাঙ্গ চাঁদকে এত কাছে দেখে অনুপমার মনে হয়েছিল এক্ষুণি বোধহয় ছুঁয়ে ফেলা যাবে!

মাঝরাতে আচমকাই ঘুম ভেঙে গেল বিকট এক জন্তুর আওয়াজে। নদীর পাড় দিয়ে সমস্ত মানুষ তখন ঘুমিয়ে পড়েছে ঘাসের নরম বিছানায়। প্রচন্ড ভয় পেয়ে অনুপমা উঠে চুপচাপ বসেছিলেন। নদীর কুলকুল শব্দ, ঝিঁঝির ডাকের মাঝে জেগে থাকা চাঁদটাকে অপূর্ব লাগছিল দেখতে। কিছুক্ষণ পর অবনীবাবু টের পেয়ে বললেন– ‘শেয়ালের ডাক এটা। দূরের জঙ্গলে আছে। ভয় পাবার কিছু নেই।’

কিন্তু ভয়টা পুরোপুরি কাটেনি। ভেতর ভেতর ছিলই। অনুপমা কাছে চেপে এলেন। অনেক কাছে। অবনীবাবুর স্পর্শে কেমন যেন একটা সাহস পাচ্ছিলেন ধীরে ধীরে।

খোলা আকাশের নীচে দুটো না-ঘুমোনো মানুষ জোৎস্নার আলো মেখে পড়ে রইল সারারাত। কিন্তু কেউ কোনও কথা বলল না। শুধু সেই স্পর্শ! অনুপমা চোখ বন্ধ করলে আজও টের পান।

‘কী হল বললেন না তো?’

মহিলাটির কথায় সম্বিৎ ফিরল।

‘হ্যাঁ এখনও মানে…’ অনুপমা কথাটা শেষ করতে পারলেন না।

‘দেখি ভাড়াটা করবেন’ কনডাক্টর এগিয়ে এল। অনুপমা ব্যাগ থেকে দুটো দশের নোট বের করে বললেন ‘একজন’।

‘কোত্থেকে?’

‘এভিনিউ রোড।’

কনডাক্টর থুথু লাগা টিকিট সমেত চার টাকা খুচরো ফেরত দিয়ে বললেন– ‘সামনের দিকে এগিয়ে যান’।

অনুপমা সিট ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় পেছনে না তাকালেও বুঝতে পারলেন সেই মহিলা ঠিক তার দিকেই তাকিয়ে আছে।

(পাঁচ)

‘মারা যাবে কেন? বললাম তো সব বেঁচে আছে।’ বেশ বিরক্ত হয়ে কথাটা বলে পাশ ফিরে শুল চুন্নি। এই নিয়ে চার বার একই কথার উত্তর দিতে দিতে মাথাটা চটে গেছে।

অবনীবাবু নম্র ভাবে বললেন– ‘এত বৃষ্টি হল কিন্তু একটা ব্যাঙেরও ডাক শুনতে পেলাম না।’

চুন্নি কোনও কথা বলল না। চোখের পাতা জুড়ে ঘুম ঘুম ভাব। এক হাত মাথার নীচে দিয়ে মেঝেতে শুয়ে আছে ও। ঘর অন্ধকার। অবনীবাবু খাটে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করে আছেন।

ঝিঁঝিগুলো একনাগাড়ে কিছুক্ষণ ডেকে কয়েক সেন্ডেকের বিরতিতে আবার ডেকে উঠছে। সেই শব্দ ভেসে বেড়াচ্ছে ঘরময়। বর্ষাকালে ঝিঁঝির ডাক আরও তীব্র হয়। রাত বাড়লে ডাকও বাড়ে অবনীবাবু মুচকি হাসলেন।

রাতের অন্ধকারে ঘরে বসে ঝিঁঝির ডাক শোনায় যে কী আনন্দ! পড়া ফাঁকি মেরে দুই ভাই, দিদি-বোন সবাই একসাথে লুকোচুরি খেলার কথা মনে পড়ল অবনীবাবুর। বাবা ওই সময় তনুদের বাড়ি যেত আড্ডা দিতে। বারান্দায় বসে মা উনুনে সবে ভাত চড়িয়েছে। সেই সুযোগেই দুরন্তপনা শুরু। ফুটন্ত ভাতের গন্ধ নাকে ধাক্বা মেরে বাড়িয়ে দিত খিদে। সেই জন্য আরও জোরে দৗড়। একবার গোয়ালঘরের পেছনে লুকোতে গিয়ে দাদাকে সাপে কাটল। সে কী চিৎকার! কোনওমতে জানে বেঁচে গিয়েছিল। দাদা সুস্থ হওয়ার পর বাবা সবক’টা ভাইবোনকে পরপর দাঁড় করিয়ে কাঁচা কঞ্চি দিয়ে পিটিয়েছিলেন। বাবা মারা যাবার পর কঞ্চিটা গোয়াল ঘরের বেড়াতে বেঁধে রাখা হয়েছিল। হঠাৎ করে সেই কঞ্চির কথা মনে পড়ল। খাটের থেকে উঠে মেঝেতে পা বাড়াতেই হাত লেগে কিছু একটা পড়ল। সেই শব্দে ঘুম ভেঙে গেল চুন্নির।

‘কী হল? কোথায় যাচ্ছ?’

‘গোয়াল ঘরে গিয়ে দেখতে কঞ্চিটা আছে কিনা। অনুপমা ফেলে দেয় যদি…’

‘তুমি বসো। আমি দেখে আসছি।’

অবনীবাবু আশ্বস্ত হয়ে খাটে হেলান দিলেন।

ক্লান্ত বিধবস্ত অনুপমা যখন ঘরে এসে লাইট জ্বালালেন ঘড়ির কাঁটা তখন আটটার ঘর ছুঁয়ে ফেলেছে। ভয়ংকর জ্যামের জন্য এত দেরি হল ফিরতে। সমস্ত শরীর টনটন করছে ব্যথায়। বাস যেখানে নামিয়ে দিয়েছিল সেখান থেকে আরও অনেকটা হাঁটতে হয়েছে। চুন্নিকে বিদায় দিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন। ধীর পায়ে এসে দেখলেন অন্ধকারে খাটের উপর হেলান দিয়ে বসে আছে এক ছায়ামূর্তি।

অনুপমা ধীর কণ্ঠে বললেন– ‘প্রসাদ খেয়ে আস্তে দেরি হয়ে গেল।’

অবনীবাবু তার কথায় ভ্রুক্ষেপ করলেন না ‘সব ব্যাঙগুলো কি মারা পড়ল নাকি? এত বৃষ্টি হল কিন্তু…’

অনুপমা পাশের ঘরে এসে ব্যাগ থেকে জিনিসটা বের করলেন। কয়েক সেকেন্ড উলটে পালটে দেখে গুঁজে দিলেন মেশিনটার ফুটোয়। ইউএসবি পোর্টে পেনড্রাইভটা ঢোকানো মাত্রই অসংখ্য ব্যাঙের ছন্দবদ্ধ ডাকে ভরে উঠল ঘর। অনুপমা দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখলেন সেই অন্ধকারের মধ্যেই অবনীবাবু হেসে যাচ্ছেন আপনমনে।

ক্লান্ত বিধবস্ত শরীরের উপর দিয়ে একটা শিহরণ বয়ে গেল আচমকা। ব্যাঙের ডাক লোড করা পেনড্রাইভটা কাল থেকে খুঁজে না পাওয়ার জন্যই আজ সুশান্তর কাছে যেতে হল। বেন্টিং স্ট্রিটে ওর বিশাল স্টুডিও। ওখানেই এডিটিং আর সাউন্ড ডিজাইনিং-এর কাজ করে। অনুপমা রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন।

নারায়ণগঞ্জ ছেড়ে এভিনিউ রোডের এই টুবিএইচকে ফ্ল্যাটে চলে আসার আটবছর হয়ে গেল। জায়গা জমির ভাগ নিয়ে ভাইবোনদের মধ্যে তুমুল অশান্তি। শেষে অনুপমাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন শহরে চলে আসার। অবনীবাবুকে একপ্রকার জোর করে নিয়ে এলেও বারবার ফিরে চলে যেতেন সেখানে। বিক্রি হয়ে যাওয়া সাতপুরুষের ভিটেটাকে ছুঁয়ে দেখতে চাইতেন। এভাবেই বেশকিছু বছর কাটল। কিন্তু দেড় বছর আগের সেই দুর্ঘটনা দুম করে বদলে দিল সব।

অনুপমা রান্নাঘরের লাইট জ্বাললেন। শেল্ফ থেকে একটা বাটি নিয়ে কিছু নাড়ু ঢাললেন তাতে। ফেরার সময় কিনেছিলেন। লাইট অফ করে বেরিয়ে এলেন বাইরে।

দুর্ঘটনায় চোখ খোয়ানোর সাথে ব্রেনেরও কিছু পার্ট ড্যামেজ হয়েছিল অবনীবাবুর। অপারেশনের পর কাউকেই ঠিকঠাক চিনতে পারতেন না। শুধু উন্মাদের মতো নারায়ণগঞ্জের বহু পুরোনো কথা আউড়ে যেতেন দিনরাত।

ডক্টর চৗধুরী বলেছিলেন– মেমরি ডিসঅর্ডার। নতুন কিছুই মনে থাকবে না। পুরোনো স্মৃতিই আঁকড়ে বেঁচে থাকবেন। এসব কেসে রিকভারির চান্স কম।

অবস্থা আরও খারাপ হল কিছুদিন পর। চোখের আড়াল হলেই রাস্তায় বেরিয়ে পড়তেন। ঘরে আটকে রাখা যেত না।

অবস্থা দেখে ডক্টর চৌধুরীই বুদ্ধিটা দিলেন। সাউন্ড থেরাপি। রিকভারি হবে না কিন্তু পাগলামিটা অনেকাংশেই কমতে পারে।

অর্ক খোঁজ লাগিয়ে সুশান্তকে পেল। বিভিন্নরকম সাউন্ড মেকিং, ডিজাইনিং, ফোলি নিয়ে ওর কারবার। টুবিএইচকে ফ্ল্যাট সাউন্ডপ্রুফ করার জন্য চার দেওয়ালে লাগানো হল অ্যাকুস্টিক ফোম প্যানেল। গাড়ির হর্ন, শহরের কোলাহল, লোকের চিৎকার কোনওকিছুই আর ঢুকতে পারল না ভেতরে।

নাড়ুর বাটিটা অবনীবাবুর হাতে ধরিয়ে অনুপমা বললেন– ‘সেদিন যেই নারকেলটা পড়ল। সেটা দিয়ে বানিয়েছি।’

অবনীবাবু কোনও উত্তর দিলেন না। মুচকি মুচকি হাসলেন।

ঘরের চারিদিকে সেট করা সাউন্ড সিস্টেম থেকে ছিটকে বেরোচ্ছে অজস্র ব্যাঙের ডাক, ঝিঁঝির আওয়াজ। থ্রিডি সাউন্ড এফেক্টে তা যেন আরও জীবন্ত হয়ে উঠেছে। যন্ত্রের কী অসীম ক্ষমতা! অনুপমা মনে মনে ভাবলেন।

পাঁচদিন ধরে বর্ষার সমস্ত আওয়াজ শোনানো হচ্ছে অবনীবাবুকে। এত বৃষ্টি অথচ ব্যাঙের ডাক নেই কথাটা বলে বলে মাথা খেয়ে ফেলেছিলেন। তাই শরীরে হাজার কষ্ট নিয়েও অনুপমা আজ বেরোলেন।

প্রতিদিন অবনীবাবুর সাথে গ্রাম নিয়ে হাজার হাজার মিথ্যে কথা বলা অভ্যেসে পরিণত হয়ে গেছে। চুন্নিও ব্যাপারটা জানে। সকাল হলেই পেনড্রাইভ পোর্টে গুঁজে দেন অনুপমা। এক একদিনের জন্য মার্ক করে রাখা এক একটা পেনড্রাইভ। সেগুলোই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে শোনাতে হয়। গ্রামের অনেক শব্দই নিপুণ ভাবে ডিজাইন করে দিয়েছে সুশান্ত। মোরগের ডাক, বৃষ্টির শব্দ, বালতির আওয়াজ, সাইকেলের বেল… এসব শুনতে শুনতে অনুপমার নিজেরও মাঝে মাঝে মনে হয় শহর নয়, এটা সত্যিই যেন সেই প্রত্যন্ত গ্রাম নারায়ণগঞ্জ। মুখ ফসকে অনেক সময় বেরিয়েও যায়। আজকে বাসের সেই মহিলাটার কথাগুলো মনে পড়ল অনুপমার।

অনেক রাত। অদ্ভুত একটা উত্তেজনায় ঘুম ভেঙে গেল। মাথার ভেতর অসংখ্য দৃশ্য চিলের মতো পাক খাচ্ছে। অনুপমা পাশ ফিরে দেখলেন অবনীবাবু নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন। হালকা ভলিউমে ঝিঁঝির ডাকে গমগম করছে ঘর। চাঁদের আলো ঠিকরে পড়ছে কাচের জানালায়।

অনুপমা টের পেলেন অস্বস্তিটা পুরো শরীর জুড়ে হচ্ছে। জানালার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে উঠে পাশের ঘরে গেলেন। তারপর কাঁপা হাতে টেবিলের উপর রাখা বাক্সের ভেতর শেয়ালের ডাকের পেনড্রাইভটা খোঁজা শুরু করলেন।

কৃষ্ণগহ্বর

‘ডিভোর্স! কিছুতেই নয়।’

কাঁপা গলায় সিদ্ধান্ত জানাল রূপম। সবে অষ্টমঙ্গলা পেরিয়েছে। উপহারের প্যাকেটগুলোও সব খোলা হয়নি। ফুরোয়নি আয়োজনের প্রশংসাও। তারই মধ্য ডিভোর্স? আজকাল অবশ্য ডিভোর্স নিয়ে মানুষের সংকোচ অনেকটাই কম। পাত্র-পাত্রীর বিজ্ঞাপনে তাই প্রচুর ডিভোর্সি। আধুনিকমনস্ক মানুষ হতাশা প্রশ্রয় দেয় না, ‘লেটস্ ট্রাই অ্যাগেন’-এ বিশ্বাসী। একবার ফেলিয়োর হয়েছে তো কী? পরের বার নিশ্চয়ই ক্লিক করবে। কিন্তু বাবার সামনে এসব যুক্তি অচল। নিজের পছন্দ করা পাত্রীর সঙ্গে ছেলের বিয়ে টিকল না, কিছুতেই মানতে পারবেন না। আসলে মানতে পারবেন না যে, নিজের সিদ্ধান্তে কোনও গলদ থাকতে পারে। লোকের চোখে জেদি একগুঁয়ে ঠেকলেও, রূপম জানে মানুষটার আত্মবিশ্বাস প্রবল। শুনলেই গুম মেরে যাবেন, আত্মগ্লানিতে জর্জরিত হবেন, তারপর অসুস্থ। দু’বার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গিয়েছে। আর ঝুঁকি নেওয়া যায়?

বিয়েটা হয়েছিল সম্বন্ধ করে, ঘটকমশাইয়ের সৗজন্য। পাত্রী বারাসতের। পালটি ঘর। ঠিকুজি ও রাজজোটক। চার হাত এক হতে দেরি হয়নি। বারাসত থেকে সাড়ম্বরে হাবড়ায় এসে উঠেছিল সালঙ্কারা মৃত্তিকা। তারপর রাজারহাটের ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাট বুকিংটা করেছিল বাবা-ই। স্কুল শিক্ষকের সামান্য মাইনেও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।   দূরদৃষ্টিতে বুঝেছিলেন, একসময় ছেলের কলকাতায় থাকার প্রয়োজন পড়বেই। তাই কষ্ট হলেও নিয়মিত মিটিয়েছেন কিস্তির টাকা। পড়াশুনায় রূপম বরাবরই ভালো। ক্লাসে ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড হয়নি কখনও। জয়েন্টও এক চান্সেই। তারপর সেক্টর ফাইভে সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়র। বিয়ের আগেই ছেলের নামে ফ্ল্যাট লিখে দিয়েছিলেন বাবা। বেশিরভাগের মতো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আঁকড়ে থাকেননি। নিজের জন্য হাবড়ার বাড়িই যথেষ্ট। এইরকম একজন আত্মত্যাগী মানুষ, যিনি সারাটা জীবন ব্যয় করলেন সন্তানের মঙ্গল কামনায়, তাঁকে কেমন করে বলবে ডিভোর্সের কথা? তাও বিয়ে মিটতে না মিটতেই!

প্রথমে রূপম, মৃত্তিকা, কেউই সমস্যাটা বুঝতে পারেনি। ফুলশয্যার রাত যেন ঘোর লাগা। দুজনেরই বিপরীত লিঙ্গের প্রথম সান্নিধ্য। স্বপ্ন, বাস্তব মিলেমিশে একাকার। আদরে, কথায়, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রাত কাবার। পরদিনও বুঝতে পারেনি। তারপরদিনও না। মনে হয়েছিল নতুন-নতুন বোধহয় এরকমই হয়। আনকোরা অভিজ্ঞতায় অনভ্যস্ত শরীর-মনকে বোঝাপড়ার সময় দিতে হয়! প্রথম বুঝল মৃত্তিকা, অষ্টমঙ্গলায় বাপের বাড়ি গিয়ে। বান্ধবীদের কাছে তাদের বিবাহোত্তর অভিজ্ঞতা শুনে আশঙ্কা জাগল। ফিরে এসেই লজ্জা, সংকোচ ত্যাগ করে রূপমকে বাধ্য করল আপ্রাণ প্রচেষ্টায়। একবার নয় বারবার। অবশেষে ক্লান্ত অনুনয়, ‘আমি ডিভোর্স চাই’।

ডিভোর্সে সন্মতি না দিলেও চিকিৎসায় সন্মতি দিল রূপম। মেনে নিল নিজের অক্ষমতা। স্বাভাবিক ভাবেই বাতিল হল হনিমুনের প্ল্যান। মৃত্তিকার মায়ের আচমকা শরীর খারাপ অজুহাতের সুবিধে করে দিল। রূপম একাই ফিরে এল রাজারহাটে। খামোখা অফিসের ছুটি নষ্ট করার কোনও মানে হয় না।এই ধরনের সংকটে সাধারণত বন্ধুরাই সহায় হয়। কিন্তু রূপমের এমন কোনও বন্ধু নেই যার কাছে অকপট হওয়া যায়। রাজারহাটে ভালো করে পরিচয়ই হয়নি কারও সঙ্গে। স্কুল-কলেজের বন্ধুদের সঙ্গেও যোগাযোগ নেই বহুদিন। হাবড়ার পাড়াতেও তেমনভাবে মেশেনি কখনও। স্কুল, লাইব্রেরি আর পড়ার টেবিলেই সময় কাটিয়েছে। বাবারও কড়া নির্দেশ ছিল পাড়ায় না মেশবার। সবাই নাকি অপগণ্ড, মিশলে ভবিষ্যৎ দফারফা। নইলে প্রায় সব পাড়াতেই একাধিক যৗন বিশেষজ্ঞ থাকে। রূপমদের পাড়াতেও হয়তো ছিল। তাদেরই কেউ না কেউ নিশ্চিত একটা উপায় বাতলাতো।

বাবাকে বলার প্রশ্ন নেই। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যেও তেমন ঘনিষ্ঠ কেউ নেই। থাকলেও নির্ঘাৎ ভ্রু কোঁচকাতো। এ আবার কী উটকো ঝামেলা? ছেলেমেয়ের বিয়ে হলে ক’দিন আমোদ-আাদ করবে, তারপর বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে নিশ্চিন্ত ঘরকন্না। এভাবেই ভাবতে অভ্যস্থ মধ্যবিত্ত আটপউরে মানসিকতা। সাহায্য তো মিলবেই না, অযথা উপদেশ সহানুভূতিতে প্রাণ ওষ্ঠাগত হবে। তাই ইন্টারনেটের সাহায্য নিল রূপম। অনেক খুঁজে-পেতে বিদেশি ডিগ্রিধারী একজন ডাক্তার নির্বাচন করল। শুরু হল চিকিৎসা। বিস্তর টেস্ট, ওষুধের সঙ্গে সপ্তাহে দু’দিন কাউন্সেলিং। ফল মিলবে মাসখানেক পর। শাশুড়ির শরীর খারাপ সারলেও মৃত্তিকাকে ফ্ল্যাটে আনল না রূপম। বিষাদ প্রতিমা দেখতে কারই বা ভালো লাগে? চিকিৎসার মেয়াদ পূর্ণ হতেই আকুল আহ্বান। সুখী দাম্পত্য সাকার করতে মৃত্তিকাও এগিয়ে এল। কিন্তু বারংবার চেষ্টাতেও সুখ ধরা দিল না কিছুতেই। এবার অনুনয়ের সঙ্গে কান্না, ‘আমার জীবনটা এভাবে নষ্ট কোরো না রূপম। আমাকে ছেড়ে দাও।’

হার না মানাটা বোধহয় কিছু মানুষের জন্মসিদ্ধ। পাশার দানে সর্বস্ব পণ রাখতেও দ্বিধা হয় না। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে মৃত্তিকাকে নিরস্ত করল রূপম। চাইল আরও কিছু সময়। সাময়িক আবেগে ধবংসের স্পৃহা জাগালেও, ঠান্ডা মাথায় স্থির পরিস্থিতি অস্থির করা সহজ কথা নয়। তাই রূপমের প্রস্তাবে রাজি হল মৃত্তিকা।

এবার নতুন ডাক্তার। ট্রিটমেন্ট প্রসিডিওর একেবারেই আলাদা। টেস্ট এবং ওষুধের সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই প্রয়োজন। দ্রুত সিদ্ধান্তে পৗঁছোনোর তাগিদে সঙ্গ দিল মৃত্তিকা। ডাক্তার ওষুধের সঙ্গে দিলেন সুখী দাম্পত্যের গাইডলাইন। মেনে চললে অব্যার্থ ফল। নিষ্ঠা সহকারে মানাও হল বেশ কিছুদিন। তবুও দাম্পত্য সুখ অধরাই। এবার গর্জে উঠল মৃত্তিকা, ‘কালই আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব।’

চলে গেলেও ফিরতে হল পরদিনই। বাবা নিজে এসে পৗঁছে দিয়ে গেলেন। বাড়ি ছাড়ার কারণটা একজন অপরিণত যুবতির পক্ষে অসামান্য হলেও, অভিজ্ঞ বাপ-মায়ের কাছে ততটা নয়। বাড়ির সন্মান, সমাজ, লোকলজ্জা, অনেক কিছুই ভাবতে হয়। এত সহজে রূপমের মতো পাত্র হাতছাড়া করাও কাজের কথা নয়। তা ছাড়া ডাক্তারি চিকিৎসাই তো একমাত্র উপায় নয়। ঈশ্বর আছেন, গুরুদেব আছেন, আছে শেকড়-কবচ-মহামূল্য রত্নও। পাড়ার গনশা প্রায় পাগলই হয়ে গিয়েছিল, সেরে উঠল তো তন্ত্র-মন্ত্রের জোরেই। বলাইবাবুরা দশ বছর সন্তানসুখ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। গুরুদেবের আশীর্বাদে কোল আলো করে ছেলে এল। তাই মেয়েকে ফেরত পাঠিয়ে মা হত্যে দিলেন ঠাকুরের থানে, গুরুদেবের আশ্রমে, জ্যোতিষদের চেম্বারে। মিরাকেল আজও ঘটে।

ভয়ে বা লজ্জায় মানুষ প্রথমে পিছোতে থাকে। কিন্তু দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে আক্রমণই স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। রূপম নিজের অক্ষমতা মেনে নিয়েছিল সাফল্যের বিশ্বাসে। আপাতত হেরে গেলেও, জিত সময়ের অপেক্ষামাত্র। কিন্তু নিরন্তর চেষ্টা করেও যখন ফল মিলল না, তখন রুখে দাঁড়াল। দায়ী করল মৃত্তিকাকে। মৃত্তিকার অসহযোগিতার জন্যই নাকি চিকিৎসার পূর্ণ ফল লাভ সম্ভব হচ্ছে না। মিথ্যে অনুযোগেও মৃত্তিকা নির্বিকার। ও-বাড়ি থেকে ফিরেই বিদ্রোহের আগুন নিভে গিয়েছে। জানা হয়ে গিয়েছে আজীবন গুমরে মরার ভবিতব্য। তাই রুপম চেষ্টা করতে চাইলে নির্দ্বিধায় সাড়া দেয়। অসাড় সাড়া। নগ্ন, শীতল দেহ এলিয়ে পড়ে থাকা। মৃত্তিকার নিস্পৃহভাব একসময় হিংস্র করে তুলল রুপমকে! কিছুতেই মানতে পারল না সামান্য এক নারীর কাছে পরাজয়ের গ্লানি। শুরু হল নির্যাতন। কখনও যৗন উৎপীড়ন। দু’বাড়ির কেউ জানতেও পারল না, ভরা নদীতে চর পড়ছে।

অত্যাচারে সাময়িক তৃপ্তি মিললেও, পরাজয়ের গ্লানি মোছে না। জেদ বাড়তে লাগল রূপমের। ইতিমধ্যে খান দশেক ডাক্তার পালটেছে। সকলেরই এক রা– স্ট্রেস, স্ট্রেন, অ্যাংজাইটি, টেনশনই মূল শত্রু। গুচ্ছের ওষুধ আর কাউন্সিলিংয়েই মুক্তি। কাউন্সিলিং তো নয়, যেন পুলিশি জেরা। মনটাকে নিয়ে ইচ্ছেমতো ফুটবল খেলা। একসময় বিরক্ত হল রূপম। তা ছাড়া টাকা, সময় নষ্টের ফল কী হচ্ছে, তাও জানার উপায় নেই। মৃত্তিকার মধ্যে সুখ খোঁজা অর্থহীন। মরা নদীতে জোয়ার আসে না।

কাগজে আজকাল নানারকম বন্ধুত্বের আহ্বান। তাদের মধ্যে থেকে কাউকে বেছে নিলেই হয়তো মিলতে পারে সুখের চাবিকাঠি। ভরসা পেল না রূপম। অজানা প্রলোভনে বিপদের সম্ভবনাও কম নয়। মাঝেমধ্যেই খবরের কাগজে স্পা, মাসাজ পার্লারের নানারকম কেচ্ছা বেরোয়। বাড়িতে জানাজানি হলে কেলেঙ্কারির একশেষ। সেদিক দিয়ে সোনাগাছি সুবিধেজনক। খোলা বাজারে ফেলো কড়ি মাখো তেল। আগে কখনও না গেলেও, জায়গাটা চেনা। কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েও গলির ভিতরে ঢোকেনি। প্ররোচনা, প্রলোভনও টলাতে পারেনি পিতৃদত্ত আদর্শ, নৈতিকতা। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে এবার বেপরোয়া হতেই হল। রোগের ভয় থাকলে, সুরক্ষাও আছে। দ্বিধা,  দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে পা বাড়াল সোনাগাছির দিকে।

সোনাগাছিতে ঢুকে চোখ ধাঁধিয়ে গেল রুপমের। একসঙ্গে এত মেয়ে জীবনে দেখেনি। রাস্তায় সার দিয়ে দাঁড়ানো মেয়ের দল। বিভিন্ন বয়সি। পোশোকও হরেকরকম। রুপমের অনভিজ্ঞতা ধরা পড়তে দেরি হল না ওদের অভিজ্ঞ চোখে। শুরু হল ইশারা, ইঙ্গিত, হাত ধরে টানাটানি। কেউ কেউ টোন-টিটকিরিও করল। কুঁকড়ে গেল রূপম। লজ্জা, ভয় যেন একসঙ্গে চেপে ধরতে চাইল। ফিরে যাবে কি যাবে না ভাবতে ভাবতেই, কে যেন কনুইয়ের পাশ দিয়ে হাত গলিয়ে দিল। অচেনা স্পর্শে শিউরে উঠল রূপম। দেখল লাল শাড়ি, লাল ব্লাউজ, খোলা চুলের একটি মেয়ে। ফরসা মুখে লাল লিপস্টিক। যেন লালপরি। লতার মতো জড়িয়ে ধরেছে। রুপম কিছু বুঝে ওঠার আগেই জাদুকণ্ঠে বলল, ‘চলো…’, যেন কতকালের চেনা।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো চলল রূপম। কোথায় যাবে, কত টাকা দিতে হবে, কিছুই জিজ্ঞাসা করার কথা মাথায় এল না। লালপরি নিয়ে চলল রূপকথার রাজবাড়িতে। ব্রিটিশ আমলের জীর্ণ বাড়ি। লোহার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হল দোতলায়। ছোট্ট একটা ঘরের তালা খুলে আলো জ্বালল মেয়েটি। তারপর যাদুকণ্ঠের আহ্বান, ‘ভেতরে এসো…’

নিশিতে পাওয়া মানুষের মতো এগিয়ে গেল রূপম।

‘জুতো বাইরে… জুতো বাইরে’, জাদুকণ্ঠে ইষৎ ভাটা।

বাইরে জুতো খুলে ঘরে ঢুকতেই দরজা বন্ধ।

‘টাকা বের করো’, জাদুকণ্ঠ উধাও হয়ে কেঠো ব্যাবসা।

ঘোর কাটল রূপমের। টাকা দিতে হবে জানত, কিন্তু সে প্রসঙ্গ যে প্রথমেই আসবে জানা ছিল না। ভেবেছিল সুখের চাবিকাঠি হাতে ধরিয়ে তারপর টাকা চাইবে। কাঁপা গলায় বলল, ‘কত?’

একটু থমকাল মেয়েটি। আপাদমস্তক রূপমকে জরিপ করে বলল, ‘সাতশো…’

মানিব্যাগ খুলে টাকা বের করে দিল রূপম। টাকা গুনতে গুনতে মেয়েটি বলল, ‘দাঁড়িয়ে রইলে কেন? তাড়াতাড়ি কাজ না সারলে আরও বেশি লাগবে কিন্তু…’

‘কাজ!’, অজান্তেই বলে ফেলল রূপম। বিষয়টা যে ‘কাজ’-এর পর্যায়ে পড়ে সেটা ওর কল্পনার অতীত।

‘ওরে আমার ন্যাকা চৈতন্য রে! কাজ করবে নাতো কী করবে? ওসব ছবি-টবি আমি তুলতে দিই না। কাজ করবে তো করো, নইলে কেটে পড়ো’, আচমকাই পরি যেন রাক্ষসী। ঠোঁটে সদ্য চোষা রক্ত।

দমে গেল রূপম। সুখের চাবিকাঠি যে এখানে মিলবে না নিশ্চিত হল।

বেরোতে গিয়েও বাধা। দরজা আগলে মেয়েটি বলল, ‘আরও শ’দুয়েক দাও। মেজাজ খিঁচড়ে গেছে, একটু মাল না টানলে মুড আসবে না’, মুরগি যখন মিলেইছে, তখন জবাই করতে দোষ কী? পরের খদ্দের নাও জুটতে পারে।

ন্যায্য যুক্তি মেনে আরও শ’দুয়েক খসাতেই হল রূপমকে।

নরম মাটি পেয়ে হালকা আঁচড় কাটল মেয়েটি। পিঠে হাত বুলিয়ে মোলায়েম আবদার, ‘পুরোপুরি হাজারই দাও…’

শরীর আর মন যেন হাত ধরাধরি করে চলে। শরীর খারাপ হলে মন খারাপ হয়, আবার মনের অসুখ শরীরকেও প্রভাবিত করে। মনের উত্তেজনা তো শরীরকে উসকে দেয়ই, শরীরও মাঝেমধ্যে মনকে উসকায়। রূপমের শরীর, মন কিছুতেই যেন একসঙ্গে চলতে চায় না। অথচ একটা সময় পর্যন্ত কিন্তু হাত ধরাধরি অটুটই থাকে। আগুন জ্বলে একসঙ্গেই। আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে করে মনের মানুষকে। কখন যে আবরণ খসে যায় হুঁশও থাকে না। তারপরেই ছাড়াছাড়ি। শরীর উলটো মুখে হাঁটা লাগায়। হাজার ডাকে সাড়া মেলে না।

কারণটা যে একেবারেই অজানা তা নয়। ভাবলেই লজ্জা, অনুশোচনায় কুঁকড়ে যায় মন। কদর্য অতীত যে মন-মস্তিষ্ককে এইভবে ছেয়ে ফেলবে ভাবতেও পারেনি। তবুও অস্বীকার করতে চেয়েছে, ভুলে যেতে চেয়েছে। আপ্রাণ চেষ্টা করেছে মনকে বোঝাতে যে, কোনওরকম অন্যায় ঘটেনি। বৃথা চেষ্টা। তবে সেই কারণেই এই অক্ষমতা কিনা সঠিক জানা নেই। শুধুই অনুমান। কিনারায় পৗঁছে দেওয়ারও কেউ নেই। ডাক্তারবাবুরাও নয়। ওঁরাও তো মানুষ। মানুষের কাছে মনুষ্যতর আচরণের কথা বলা যায় কখনও?

বিছানা এক থাকলেও, শোয়ার ভঙ্গি পালটেছে অনেকদিনই। দু’পাশ ফিরে দু’কোনায়। সারাদিনে কেজো কথা ছাড়া কথাও হয় না। তবুও আজকাল বউকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে রুপমের। সোনাগাছির অভিজ্ঞতার পরে বাইরের মেয়েমানুষে আর ভরসা নেই। সবাই লোভী, সুযোগসন্ধানী। কিন্তু বউকে কাছে পাবার উপায় আর নেই। মৃত্তিকা যেন ঘুমন্ত রাজকন্যা। রূপমের কাছে নেই জিওন কাঠি। তাই ফিরিয়ে নেয় প্রসারিত হাত। গুমরে কাটায় কালরাত্রি।

হঠাৎই এক হাকিমের সন্ধান পেল রূপম। মোগল আমলে হাকিমরা নাকি অসাধ্য সাধন করত। অন্তত প্রস্রাবগারের বিজ্ঞাপনে তেমনটাই দাবি করা হয়েছে। কয়েকজনের বাস্তব অভিজ্ঞতার বিবরণও রয়েছে। দেশি-বিদেশি ডিগ্রির পিছনে ছুটে লাভ কিছুই হয়নি, তাই মল্লিকবাজারের গলি-ঘুঁজি পেরিয়ে রূপম হাজির হল সেই হাকিমের কাছে। বৃদ্ধ হাকিমসাহেব মন দিয়ে সমস্যা শুনলেন, তারপর ওষুধ দিলেন। সপ্তাহ দুয়েক পরে আবার আসতে বললেন।

শ্বশুর-শাশুড়ি যেন গোদের উপর বিষফোড়া। রূপমের তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও মেয়ে-জামাই দুজনকেই গুরুদেবের কবচ, জ্যোতিষিদের রত্ন ধারণ করিয়েছেন। বার বার স্মরণ করিয়েছেন পেঁয়াজ, রসুন যেন কিছুতেই না খাওয়া হয়। তা হলে কবচের ফল মিলবে না। শনিবার অবশ্যই নিরামিষ। অগ্রাহ্য করারও উপায় নেই। মাঝেমাঝেই উজিয়ে এসে বিরক্তিকর তদারক। বাবা এত কিছু জানেন না। তবুও, রূপমরা হাবড়ায় গেলে ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোমরা ভালো আছো তো?’

দু’সপ্তাহ ওষুধ খাবার পর আবার মল্লিকবাজারে গেল রূপম। হাকিমসাহেব অনেকক্ষণ নাড়ি ধরে বসে রইলেন। তারপর গম্ভীর মুখে জানালেন, ওষুধের কাজ শুরু হয়েছে। তবে কতটা কাজ হয়েছে সেটা বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়েই বুঝতে হবে। ফ্যাসাদে পড়ল রুপম। মৃত্তিকার সঙ্গে আর এক্সপেরিমেন্ট সম্ভব নয়। এদিকে পরীক্ষা না করেও উপায় নেই। বলা যায় না, বিজ্ঞাপনের কথা হয়তো মিথ্যে নয়। সমাধান বাতলালেন হাকিমসাহেব।

আবার ও-পাড়ায় যেতে হল রূপমকে। এবার হাড়কাটা। হাকিমসাহেবের কথা মতো নির্দিষ্ট বাড়িতে গিয়ে চপলামাসির সঙ্গে দেখা করল। তিনিই নিয়ে এলেন বছর কুড়ির প্রতিমাকে। দেখেই পছন্দ হল রূপমের। ফরসা রং, গোল মুখ, টানা চোখ, অনেকটাই যেন আসল প্রতিমা। সারাক্ষণ মুখে হাসি লেগেই রয়েছে। রেটও কম, পাঁচশো। সানন্দে রাজি হয়ে গেল রূপম। ঠিক করল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে কিছু বকশিশও দেবে।

বেশ খাতির করেই ঘরে নিয়ে এল প্রতিমা। ঘর আহামরি কিছু না হলেও চলনসই। দুষ্টু হেসে বলল, ‘বিয়ার খাবে?’

‘আমি তো… মানে… মদ খাই না…’, বলতে যেন বাধল রূপমের।

‘ওমা বিয়ার আবার মদ নাকি! তা হলে একটা সিগারেট দাও’, প্রতিমার আদুরে আবদার।

‘সিগারেট মানে…আমি তো খাই না’, লজ্জায় যেন মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করল রুপমের।

‘তুমি তো ভালো ছেলে গো! তা এ পাড়ায় কেন? বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া?’, হাসিতে ঢলে পড়ল প্রতিমা।

রুপম উত্তর দিল না। প্রতিমার ব্যবহারে প্রথম থেকেই মুগ্ধ। প্রতিটা কথাই হাসিমাখা, আন্তরিক। টাকাও চায়নি। মনে মনে ধন্যবাদ জানাল হাকিমসাহেবকে। শরীরও জেগে উঠছে। নিশ্চিত সাফল্যর আশায় শিহরণ জাগল।

‘কী গো… চুপ করে রইলে যে? বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করেছ, না?’, প্রতিমা প্রায় মুখের কাছে। রূপমের ইচ্ছে করল জড়িয়ে ধরতে। তখনই ফোন। সামান্য ‘হ্যাঁ’, ‘হুঁ’ করেই ফোন ছাড়ল প্রতিমা। তারপর রূপমের গাল টিপে বলল, ‘তুমি একটুখানি বোসো, আমি এক্ষুনি আসছি।’ আপত্তি করল না রূপম। মানুষের দরকার থাকতেই পারে। তা ছাড়া মেওয়া ফলাতে গেলে একটু সবুর করতেই হয়। প্রতিমা দরজা ভেজিয়ে চলে গেলে বিছানায় আধশোয়া হল। মজে গেল সুখস্বপ্নে।

‘ওমা… তুমি একলা যে! প্রতিমা কোথায়?’

চমকে উঠল রূপম। দরজায় চপলামাসি, সঙ্গে মাঝবয়সি এক মহিলা। তড়াক করে উঠে দাঁড়াল। আমতা-আমতা করে বলল, ‘একটু বাইরে গেছে… দরকারে।’

‘দরকার না ছাই… গেছে ওই অটোওয়ালা কানুর খাঁই মেটাতে’, ঝাঁঝিয়ে উঠল সঙ্গের মহিলাটি।

‘তা বলে ঘরে খদ্দের বসিয়ে চলে যাবে?’, চপলা বিরক্ত।

‘যাবে না কেন? কানু যে বিয়ের লোভ দেখাচ্ছে’, মহিলার মুখ বিকৃতি।

‘থাক… আমায় আর শেখাস না মালতী। মাগি পাড়ার মেয়ে নিয়ে সংসার পাতবে ওই হারামজাদা? অত ধক আছে ওর?’ গর্জে উঠল চপলা। জীবনে পুরুষমানুষ কিছু কম দেখল না।

‘আমার অত জানার দরকার নেই মাসি। কাস্টমার দাঁড়িয়ে আছে। তোমার ঘর হবে, নাকি অন্য ঘর দেখব?’ মালতীর সাফ কথা।

বিচলিত হল চপলা। ভেবেছিল প্রতিমার ‘কাজ’ হয়ে গিয়েছে, মালতীকে ঘর দিতে সমস্যা হবে না। এখন মালতী অন্য ঘরে যাওয়া মানে সাধা লক্ষ্মী পায়ে ঠেলা। কিন্তু এই খদ্দের হেকিমসাহেবের পাঠানো। অবহেলা করলে অসন্তুষ্ট হবেন। আগে নিয়মিতই আসতেন। এখনও প্রয়োজন পড়লে আসেন, মেয়েদের চিকিৎসা করেন। ভালো মানুষটাকে চটাতে মন চাইল না। অথচ প্রতিমাও যে কতক্ষণে আসবে তারও কোনও ঠিক নেই। পরিস্থিতি সামলাতে রূপমকে বলল, ‘আমি বাইরে চেয়ার দিচ্ছি, তুমি একটু বোসো বাছা। প্রতিমা আসুক, তারপর…’

ছিটকে বেরিয়ে এল রূপম। অপমানে মাথা ঝাঁঝা করছে। হাকিমসাহেবের সুপারিশে এসেছে, তাও ঘর থেকে বের করে দিল? বললে নয় বেশি টাকাই দিত। সব রাগ গিয়ে পড়ল হাকিমসাহেবের উপর। ফোনে যাচ্ছেতাই গালাগাল করল। ওখানে যে আর কখনওই যাবে না, সেটাও জানিয়ে দিল। রাগে গজগজ করতে করতে আনমনেই চলে এল মেডিকেল কলেজের সামনে। তারপর ছানাপট্টির পাশের গলিটায়। হঠাৎই চোখে পড়ল, প্রসন্নময়ী ঔষধালয়। আয়ুর্বেদীয় প্রতিষ্ঠান। স্থাপিত ১৯২৫। প্রতিষ্ঠাতা – বৈদ্যনাথ কাব্যতীর্থ (যৗনরোগ বিশেষজ্ঞ)। ‘শালা… এটাই বা বাদ থাকে কেন?’, দপদপিয়ে ঢুকে পড়ল রূপম।

কবিরাজমশাই ষাটের কোঠায়। ফাঁকা দোকানে পেসেন্স খেলছিলেন। রূপম ঢুকতেই মুচকি হাসলেন। বাধ্য হয়েই প্রপিতামহের নামের তলায় বন্ধনির বাক্যটা জুড়েছেন। এলাকায় কদর পেতে সুবিধে। ছেলেটি যে ওইটির জন্যই ঢুকেছে বুঝতে অসুবিধে হয়নি। নইলে আজকাল আর বিশেষ কেউ কবিরাজি চিকিৎসায় ভরসা রাখে না। ইয়ং জেনারেশন তো নয়ই। রূপমকে বসতে ইশারা করলেন। তারপর মুখে এক খিলি পান ফেলে বললেন, ‘এ পাড়ায় এলে রোগ হবেই, বুঝলেন। শিবের বাপেরও সাধ্যি নেই আটকায়। তবে আমি যতক্ষণ আছি ততক্ষণ চিন্তা নেই। যত ইচ্ছে রোগ বাধান, ঠিক সারিয়ে দেব।’

‘এডস্ হলেও?’, গরম মাথায় হামবড়াভাব সহ্য হল না রূপমের। প্রশ্নটা করেই ফেলল।

‘হয়েছে নাকি?’, চশমার ফাঁক দিয়ে কবিরাজের কৗতূহল।

‘হয়নি… কিন্তু হলে সারাতে পারবেন?’, রূপম চ্যালেঞ্জের ভঙ্গিতে।

‘পরীক্ষা?… টেস্ট?’, ভ্রু কোঁচকালেন কবিরাজ। ‘শুনুন মশাই, আমরা পাঁচ পুরুষের কবিরাজ। যমেও ভয় পায় আমাদের।’

রূপম বুঝল কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। খামোখা ঝগড়া বাধবে। মাথা নেড়ে সায় দিল। খুশি হলেন কবিরাজ। ইশারায় পাশের চেম্বারে ডাকলেন। ঢুকতেই নিরুত্তাপ নির্দেশ, ‘নিন…খুলে ফেলুন।’

‘মানে?’, ঝাঁঝিয়ে উঠল রূপম। প্রথম থেকেই লোকটার হাবভাব কেমন যেন গা জ্বালানো।

‘প্যান্ট না খুললে রোগ বুঝব কী করে?’, ডাক্তারের মুখে মুচকি হাসি। ‘শালারা মাগিদের সামনে উদোম হবে, অথচ ডাক্তারের কাছে লজ্জা!’

‘না না… ওসব রোগের ব্যাপার নয়। আমার অন্য সমস্যা’, তাচ্ছিল্য ঝরাল রূপম। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস অসহ্য।

‘সমস্যাটা কী?’

বছর নয় কি দশ। গরমের ছুটিতে খাওয়া-দাওয়ার পর বিছানায় শুয়ে গল্পের বই পড়ছিল। পড়তে পড়তেই তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে। কারও নড়াচড়ার শব্দে আচমকাই ঘুম ভাঙল। চোখ মেলেই সঙ্গে-সঙ্গে বন্ধ। ততক্ষণে বুকের মধ্যে হাতুড়ি পেটা শুরু হয়েছে। খানিক বাদে চোখ খুলতেই হল। প্রথমে পিটপিট, তারপর ড্যাবড্যাব। দশ হাত তফাতেই মা কাপড় বদলাচ্ছে। ঘর একটাই, অন্য সময় হলে বাইরেই যেতে বলত। কিন্তু কচি ছেলের ঘুম ভাঙাতে বোধহয় মন চায়নি। মায়ের কাছে বয়স না বাড়লেও, মহিলাদের কাপড় বদলানোর দৃশ্য যে দেখা উচিত নয়, সে জ্ঞান তখন রূপমের হয়েছে। তবুও সংবরণ করতে পারল না। হয়তো অ-দেখার কৗতূহল অথবা নিষিদ্ধের স্বাদ আহরণ। একসময় আনমনেই ঘুরে দাঁড়াল মা। সন্মোহিত রূপম ভুলে গেল চোখ বন্ধ করতে। প্রথমে বিষ্ময় তারপর একরাশ ঘৃণা ঠিকরে উঠল মায়ের মুখে। কোনওরকমে কাপড় সামলে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। মাসখানেকের মধ্যেই গলায় দড়ি দিল মা। পাপ, অপরাধবোধ গ্রাস করল রূপমকে।

আসল ঘটনাটা জেনেছিল অনেক পরে। মা সংসারে সচ্ছলতা চেয়েছিল। দিনরাত বাবাকে তাগাদা দিত প্রাইভেট টিউশনের জন্য। বাবার বন্ধুরা অনেকেই করত। কিন্তু বাবা নীতিগত কারণে কিছুতেই প্রাইভেট টিউশন করবেন না। টিভি নেই, ফ্রিজ নেই, টেলিফোন নেই, ভালো শাড়ি বা গয়নাও নেই। নেই-রাজ্যে কিছুতেই মানাতে পারল না মা। তার উপর বাড়িটাও শেষ করলেন না বাবা। তার আগেই ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে রাজারহাটে ফ্ল্যাট বুক করে বসলেন। ইটের গাঁথনির উপর অ্যাসবেস্টসের চালে থাকতে মায়ের সন্মানে বাধত। রোজই ঝগড়া, অশান্তি। কিন্তু বাবা নিজ সিদ্ধান্তে অটল। ছেলেকে কিছুতেই হাবড়ার এঁদো পাড়ায় থাকতে দেবেন না। উচ্চশিক্ষিত করে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত করবেন। যদি কলকাতার বাইরেও যায়, তা হলেও তো ফ্ল্যাটটা ছেলের ইনভেস্টমেন্ট হয়ে থাকবে। এই সব যুক্তি মানতে মা নারাজ। বর্তমান ছেড়ে ভবিষ্যতের পিছনে ছোটে কোন আহম্মকে? অশান্তি চরমে পৗঁছোল যেদিন বাবা, মায়ের এক আত্মীয়ের বিয়েতে সোনার গয়না দিতে অস্বীকার করলেন। বাবার সরল যুক্তি, নিজের ক্ষমতায় সীমাবদ্ধ থাকা। এদিকে সোনার গয়না না দিলে বাপের বাড়িতে মায়ের মান থাকে না। সেদিন রাতেই আত্মহত্যা করল মা।।

‘আপনার মা বুঝি খুব সুন্দরী ছিলেন?’

উত্তর করল না রূপম। স্মৃতিতে নাড়াচাড়া পড়ায় বিহ্বল। যে কথা আজ পর্যন্ত কাউকে বলেনি আজ রাগের মাথায় কবিরাজকে উগরে দিয়েছে।

‘আমি বলছিলাম… আপনার মা নিশ্চয়ই ফরসা ছিলেন। মুখশ্রী সুন্দর, ফিগার দারুণ, তাই না? চুল কি মাঝারি ছিল, নাকি বড়ো?’, হঠাৎ করেই কবিরাজ যেন পিঁপড়ে। রসের সন্ধান পেয়েছে। একঘেয়ে জীবনে এরকম খোরাক বড়ো একটা জোটে না।

রূপমের বুঝতে অসুবিধে হয়নি কবিরাজের উদ্দেশ্য। তবুও আমল দিল না। বহু বছর বাদে মায়ের চেহারাটা ভাবতে চেষ্টা করল। আবছা ছেঁড়া-ছেঁড়া টুকরো মনপর্দায় ভেসে উঠলেও, সম্পূর্ণ অবয়বটা কিছুতেই গড়তে পারল না। নিজের জন্মদাত্রীকে ভুলে গেল! আশ্চর্য লাগল রূপমের। মায়ের মৃত্যুর পর বাবা ঘরে কোনও ছবি রাখেনি। হয়তো ইচ্ছে করেই। কুড়ি বছরের উপর না দেখা একটা চেহারা ভুলে যাওয়াই তো স্বাভাবিক। তবে চেহারাটা মনে করতে পারলে বোধহয় ভালোই হতো। একবার যদি মায়ের হাসি মুখের একটা ছবি দেখতে পেত, তা হলে হয়তো কিছুটা স্বস্তি মিলত। শত চেষ্টাতেও রূপম মায়ের কোনও ছবি আঁকতে পারল না।

কিন্তু চেহারা ভুলে গেলেও, রূপম ভুলতে পারেনি ছোটোবেলার সেই অবাঞ্ছিত ঘটনা। মায়ের আত্মহত্যার আসল কারণ জেনেও নিজেকে পুরোপুরি নির্দোষ ভাবতে পারেনি। কখন যে ভাবনাটা মনের গভীরে চারিয়ে গিয়েছে বুঝতেও পারেনি। পারল বিয়ের পর। মৃত্তিকা আবরিত থাকলে কোনও অসুবিধেই নেই। স্বাভাবিক মানুষের মতোই উত্তেজনা জাগে। কিন্তু আবরণহীন হলেই মনে পড়ে সেই অমার্জনীয় অপরাধ। জাগে পাপ, অপরাধবোধ। চোখের সামনে তখন নিকষ কালো অন্ধকার। বিদ্যুৎগতিতে শরীর ধাবিত হয় সেই অন্ধকারের দিকে। মনের কথা মনেও পড়ে না।

‘আপনার মা কী অভিনয়-টভিনয় করতেন? মানে ফিল্ম অ্যাকট্রেস বা…’, রসের নাগাল পেতে পিঁপড়ে মরিয়া।

‘আমার মা খুবই কুৎসিত ছিলেন’, নিস্পৃহ গলায় বলল রূপম। বুড়োর ভিমরতি না থামালেই নয়।

‘ও… আচ্ছা আচ্ছা…’, নিজেকে সামলে নিলেন কবিরাজ। খদ্দের চটলে লক্ষ্মীও বিরূপ হবেন। মোলায়েম হেসে বললেন, ‘তা… কী চান আমার কাছে?’

রূপম শেষভাগটাও বলল। সবটা শোনার পর কিছুক্ষণ থম মারলেন কবিরাজ। তারপর বললেন, ‘আপনাকে একটা ওষুধ দিচ্ছি। তিনদিন এক দাগ করে দু’বেলা খাবেন। যদি সমস্যা না মেটে ফোনে আমাকে জানাবেন।’

সেই এক গেরো। বউয়ের সহযোগিতা যে পাওয়া যাবে না, স্পষ্টই জানিয়ে দিল রূপম। কবিরাজ একগাল হেসে অভয় দিলেন, বেশ… সে দায়িত্বও নিলাম।’

ক’দিনের জন্য বারাসত যাব। মায়ের শরীরটা বিশেষ ভালো নয়। দিন চারেকের রান্না ফ্রিজে রাখা আছে, মাইক্রোতে গরম করে নিও।’ আপত্তি করল না রূপম। গুমোট পরিবেশে কারই বা ভালো লাগে? রাজারহাটের মতো নির্জন জায়গায় একা একা বেরনোও ভয়ের ব্যাপার। সারাদিন তাই ফ্ল্যাট বন্দি হয়েই কাটাতে হয় মৃত্তিকাকে। আগে রেস্টুরেন্ট বা শপিংমলে গেলেও, অনেকদিনই সে পাট চুকেছে। এক ছাদের তলায় থেকেও, দুজনে যেন ভিন গ্রহের বাসিন্দা।

প্রথমদিন খেয়েই রূপম বুঝল ওষুধটা অন্যরকম। কাজ হবার সম্ভবনা আছে। খাওয়ার কিছুক্ষণ পর থেকেই কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি। কেউ যেন শরীরময় সুড়সুড়ি দিচ্ছে, চিমটি কাটছে। মনও ফুরফুরে। দ্বিতীয়দিন আরও নিশ্চিত হল। তৃতীয়দিন পুরোপুরি আত্মবিশ্বাস তুঙ্গে, তাই কবিরাজকে আর ফোন করার প্রয়োজন বোধ করল না। আবার কী ফ্যাসাদে পড়তে হয় কে জানে! ছুটল শ্বশুরবাড়ি। আচমকা আগমনে মৃত্তিকা অবাক। গাঁইগুঁই করলেও, শাশুড়ি জোর করেই পাঠিয়ে দিলেন। বউ নিয়ে সোজা শপিংমলে। মৃত্তিকাকে একটা দামি শাড়ি কিনে দিল রূপম। তারপর রেস্টুরেন্টে খাওয়া। অবাক হলেও প্রকাশ করল না মৃত্তিকা। হয়তো খুশিই হল। অসহায় মেয়েদের অ-সুখের মধ্যেই ক্ষণিকের সুখ খোঁজা ছাড়া উপায় কি?

ফ্ল্যাটে ঢুকেই ঝাঁপিয়ে পড়ল রূপম। মৃত্তিকাও সাড়া দিয়ে ফেলল। শরীর নিজের প্রয়োজনেই নিরস মনকে সরস করে তুলল। সারাদিন রূপমের ব্যবহারেও অন্যরকম ইঙ্গিত। হয়তো চিকিৎসায় ফল মিলেছে। তা ছাড়া মিথ্যের জোয়ারেও কি কখনও কখনও ভাসতে ইচ্ছে করে না? মরীচিকা তো মানুষই দেখে। মৃত্তিকাও দেখল। চাতকের মতো ছুটে গেল তৃষ্ণা নিবারণের আশায়। শৃঙ্গারের চরম পর্যায়ে খসে পড়ল আবরণ। তারপরেই বিপত্তি। নির্দ্বিধায় মনের সঙ্গ ত্যাগ করে শরীর ছুটল অন্ধকার পানে। কিছুতেই মোড় ঘোরাতে পারল না রূপম। মৃত্তিকা আবারও রূপান্তরিত হল পাষাণ প্রতিমায়।

ওষুধের উত্তেজনাও অতিক্রম করতে পারল না মনের অপরাধবোধ। তবুও হাল ছাড়ল না রূপম। শরীরের অনুভূতিই বলে দিচ্ছে কাজ হবে। হয়তো মাত্রা একটু বাড়াতে হবে। কোর্স শেষ হলেও রয়ে গিয়েছে বেশ খানিকটা ওষুধ। একসঙ্গে দু’দাগ গলায় ঢালল রূপম। অ্যাকশন শুরু হতেই আবার ঝাঁপাল। তবুও ফিরে এল অন্ধকার। এবার পুরো বোতলটাই শেষ করল। শরীর যেন আগুনের গোলা, হৃদপিণ্ডে অশ্বের গতি। টলোমলো পায়ে আবারও ঝাঁপাল। এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না মৃত্তিকা। হিংস্র বাঘিনীর মতো থাবা বসাল রূপমের গালে। আকস্মিক আক্রমণে রূপম হতভম্ব। সম্বিৎ ফিরতেই বেরিয়ে গেল ফ্ল্যাট ছেড়ে।

‘করেছেন কি মশাই? মারা পড়বেন যে!’

রূপমের ফোনে আঁতকে উঠলেন কবিরাজ। ওষুধটা নিজস্ব আবিষ্কারই বলা যায়। আয়ুর্বেদ, ইউনানি, অ্যালোপ্যাথির অদ্ভুত মিশ্রণ। নিজের উপরেও প্রয়োগ করেছেন। ফল ভালোই। বাজার চলতি ওষুধগুলোর চেয়ে তো বটেই। পঞ্চাশেও পঁচিশের জোশ এনে দেয়। তাই মওকা বুঝে দামও নিয়েছেন চড়া। কিন্তু ছেলেটির যে কেন কাজ হল না, বুঝতে পারলেন না। তা ছাড়া মাত্রাতিরিক্ত সেবনে কী রিঅ্যাকশন হতে পারে একেবারেই জানা নেই। জানার প্রয়োজনও পড়েনি কখনও। তবে ভালো কিছু যে হবে না সেটা নিশ্চিত। ছেলেটিও যে কেন অসহযোগী বউয়ের সঙ্গে খামোখা লিপ্ত হতে গেল, ভেবে পেলেন না।

ফ্রি-স্কুল স্ট্রিটে মারিয়া গোমসের সঙ্গে তোফা ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। অভিজ্ঞ, লাস্যময়ী, ছোকরার আড় ভাঙতে দশ মিনিটও সময় নিত না। নিজেরও ফাউ জুটত। কিন্তু সেসব চুলোয় দিয়ে এখন প্রাণ বাঁচানোই দায়। ফোনে যে পরিমাণ উত্তেজনার আঁচ পেলেন, তাতে দোকানে ঝামেলা অবধারিত। তড়িঘড়ি ঝাপ বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই। আপনি বাঁচলে বাপের নাম।

‘শালা… আটশো টাকা নিয়ে জোচ্চুরি!’ বন্ধ দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আস্ফালন করা ছাড়া উপায় রইল না রূপমের। বেগতিক বুঝে কবিরাজ ফোনও সুইচ-অফ করে দিয়েছেন। কবিরাজকে ধমক-ধামক, মারধর দিলে হয়তো উত্তেজনা কিছুটা কমত। তা না হওয়াতে দিশেহারা হয়ে পড়ল রূপম। শরীরময় যেন হাজারও সাপের ছোবল। ইচ্ছে করছে পৃথিবীটা ভেঙে-চুরে, তছনছ করে ফেলতে। আচমকাই প্রতিমার কথা মনে পড়ল। ও-ই পারবে যন্ত্রণার অবসান ঘটাতে। হন্তদন্ত হয়ে চলল চপলামাসির বাড়ি। কিন্তু বিধি বাম, প্রতিমা অন্য খদ্দেরে ব্যস্ত। অপেক্ষা করতে বললেও মানতে নারাজ রূপম। পাগলের মতো দরজায় লাথি, ধাক্বা, সঙ্গে গালাগাল। বাড়িময় হইচই। কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না উন্মত্ত খদ্দেরকে। শেষে পাড়ার ছেলেদের ডেকে একরকম জোর করেই রূপমকে বাড়ি থেকে বের করে দিল চপলা।

ক্রমাগত ব্যর্থতায় রূপম হতোদ্যম। টলোমলো পায়ে হাঁটতে হাঁটতে ফিরিঙ্গি কালীবাড়ির সামনে। হোঁচট খেয়ে পড়েই যাচ্ছিল। সামলালেন এক বৃদ্ধা মহিলা। ধমকের সুরে বললেন, ‘কী রে ছেলে, সামলাতে পারিস না তো মদ গিলিস কেন?’

মাথায় রক্ত চড়ল রূপমের। জীবনে কোনওদিন মদ ছুঁয়েও দেখল না, আর এই মহিলা কিনা বলছেন মদ গিলেছে? ঝাঁঝের সঙ্গে বলল, ‘কী ভুলভাল বকছেন। কে আপনি?’

‘আমি তোর মা রে’, অবলীলায় বললেন মহিলা।

গায়ে কাঁটা দিল রূপমের। মন যেন তৈরি হয়েই ছিল। চুম্বকের মতো ‘মা’ শব্দটা গেঁথে নিল। নিমেষে এঁকে ফেলল পূর্ণ অবয়ব। লালপাড় ঘিয়ে শাড়ি, মাথায় জটা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, এই তো মা! কই মায়ের মুখে তো কোনও ঘেন্না নেই? বরং মিটিমিটি হাসছেন। তা হলে কি ক্ষমা করেছেন অবোধ সন্তানকে? অপ্রকৃতিস্থ হলেও মস্তিষ্ক যেন দ্বিধাগ্রস্ত। ঘোর লাগা চোখে রূপম বলল, ‘আপনি আমার… কে বললেন?’

‘মা রে মা… আমি তোর মা। এখন দশটা টাকা দে তো, ঘুগনি-মুড়ি খাই।’

‘মা’ ছাড়া আর কোনও শব্দই কানে ঢুকল না রূপমের। মস্তিষ্কও মেনে নিল মনের কথা। অপলকে চেয়ে রইল মহিলার দিকে। মহিলার হাসি যেন পবিত্র জলের ধারা। পাপ, অপরাধবোধ ধুয়ে-মুছে সাফ।

‘কী রে ছেলে… দে। দোকান বন্ধ হয়ে যাবে যে…’, মহিলা আন্তরিক। যেন নিজের ছেলের কাছেই চাইছেন। সম্মোহিতের মতো পঞ্চাশ টাকা দিল রূপম। হাসিমুখে আশীর্বাদ করলেন মহিলা, ‘স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখী হও বাবা’। তারপর জনারণ্যে মিলিয়ে গেলেন। রূপমকে দিয়ে গেলেন পরম প্রাপ্তি। কদর্য অতীত রূপান্তরিত হল নির্মল বর্তমানে।

দুশ্চিন্তায় ঘুম নেই মৃত্তিকার। আপশোশও হচ্ছে। অতটা বাড়াবাড়ি না করলেও চলত। নিজের অক্ষমতায় তো কোনও হাত নেই রূপমের। বরং কাটিয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। তারই মন্দ ভাগ্য যে, এইরকম একজনের সঙ্গে বিয়ে হল। তবে বিয়ের আগে রূপম যে সমস্যার কথা জানত না এটা নিশ্চিত। তবুও মাথা ঠিক রাখা মুশকিল। এত বড়ো বঞ্চনা মেনে নেওয়া বড়োই যন্ত্রণার। কিন্তু অপমানিত হয়ে রূপম যদি কিছু করে বসে? কী জবাব দেবে সবার কাছে? মোবাইলে ফোন করলেও ধরছে না। মেসেজ করলেও উত্তর আসছে না। অনুতপ্ত মৃত্তিকা ক্রমাগত ঘর-বারান্দা করতে লাগল।

ভোর রাতে রূপম ফিরল। শান্ত, সমাহিত। চুপ করে সোফায় বসে রইল। যেন বসেই থাকবে। অনন্তকাল। রূপমের এমন রূপ মৃত্তিকার অদেখা। কেমন যেন মায়া হল। সরাসরি ক্ষমা চাওয়ার অনভ্যস্ততায় হাত রাখল রূপমের কাঁধে। বোঝাতে চাইল আপশোশ, অনুতাপ। সমাহিত রূপম গ্রাহ্য করল না। কানে ক্রমাগত বেজেই চলেছে, ‘স্ত্রী-পুত্র নিয়ে সুখী হও…’। এমন করে তো কেউ কোনওদিন বলেনি!

নিশ্চুপ রূপমকে এবার ভয় পেল মৃত্তিকা। মেন্টাল শক পেল নাকি? বউ গায়ে হাত তুললে পৗরুষে আঘাত লাগাটা খুবই স্বাভাবিক। মানসিক ভারসাম্য হারালে দায়ভার কি তার উপরেই বর্তাবে? এক ঝটকায় রূপমের মাথাটা বুকে চেপে শক্ত করে বেড় দিল মৃত্তিকা। তারপর আদরে আদরেই যেন ক্ষমা প্রার্থনা করতে লাগল। কখন যে নিজের শরীরে মিশিয়ে নিয়েছে টেরও পেল না। একসময় রূপম অনুভব করল শরীর, মন নিশ্চিন্তে হাত ধরাধরি করে চলেছে। পাড়ি দিয়েছে অনন্ত পথ। অতিক্রম করেছে কৃষ্ণগহ্বর।

 

সিদ্ধান্ত

অফিসে পৌঁছে টেবিলে ফাইলগুলো একপাশে সরিয়ে রেখে দীপান্বিতা কাজে বসে পড়ল। এমাসে দুটো ফুল-ডে আর একটা হাফ-ডে লিভ এরমধ্যেই নেওয়া হয়ে গেছে। তার উপর মার্চ মাস পড়তে মাত্র নয় দিন বাকি। এর মধ্যে জমা কাজগুলো শেষ করে ফেলতে হবে। ঘড়ি দেখল দীপান্বিতা। আজকে লাঞ্চের আগে অনেকটা কাজ সেরে ফেলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হল ও।

টেবিলে নামিয়ে রাখা মোবাইলটা হঠাৎ-ই বেজে উঠল। বিরক্ত হল দীপান্বিতা। স্ক্রিনে চোখ রেখে দেখল রঞ্জনের নাম। নামটা দেখেই ও শঙ্কিত হয়ে উঠল। রোজই কোনও না কোনও বাহানায় দীপু-কে বাড়িতে ডেকে নিয়ে যাওয়াটা রঞ্জনের রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই নামেই রঞ্জন ওকে ডাকে। দুমাস হল ওদের বিয়ে ঠিক হয়েছে, শুধু রঞ্জনের একটা প্রেমোশনের আপেক্ষা। তারপরেই ও বিয়েটা সারতে চায়। অথচ প্রায়দিনই রঞ্জনের কোনও না কোনও আত্মীয় দীপান্বিতার সঙ্গে দেখা করতে চায়, এই অজুহাতে রঞ্জন দীপু-কে জোর দেয় ওর বাড়ি আসতে। এটা দীপান্বিতার একেবারেই পছন্দ নয়। অথচ মা-বাবা দেখেই এই বিয়ে ঠিক করেছেন তাই রঞ্জনের সঙ্গে দেখা না করলে

মা-বাবা মনে কষ্ট পাবে এই ভেবে দীপান্বিতাও হবু বরের হ্যাঁ-তে হ্যাঁ মেলাতে থাকে।

‘হ্যালো’, ফোনটা কানের কাছে নিয়ে আসে দীপান্বিতা।

‘দীপু, আমি বলছি। আজ প্লিজ হাফ ডে নিয়ে নাও অফিসে। মাসি হঠাৎ-ই গতকাল রাতে আমাদের বাড়ি এসেছে। মাত্র দু’দিন থাকবে। তোমাকে খুব দেখতে চাইছে। আগে শুধু একদিন তোমাকে দেখেছিল। আমি ঠিক দুটোর সময় তোমাকে অফিস থেকে তুলে নেব। আর হ্যাঁ, বাড়ি গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে শাড়ি পরে নিও। আমি অপেক্ষা করব। মাসি আবার একটু সেকেলে ধরনের মানুষ। তোমাকে অন্য পোশাকে দেখলে কিছু একটা মন্তব্য করে বসতে পারে।’

‘শোনো রঞ্জন, আজ আমি কিছুতেই ছুটি নিতে পারব না, আর হাফ-ডে মাসে একটাই নিতে পারি। সেটাও তো নেওয়া হয়ে গেছে।’

‘দীপু, আমি মা-কে কথা দিয়ে এসেছি যে তোমাকে নিয়েই আসব। সুতরাং ছুটি তুমি কীভাবে ম্যানেজ করবে সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু আসতে তো তোমাকে হবেই। এছাড়াও তুমি এলে রান্নাঘরেও মা-কে একটু সাহায্য করে দিতে পারবে।’

‘আমাকে কিছু না জানিয়েই তুমি কীভাবে কথা দিয়ে দিলে রঞ্জন?’ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করল দীপান্বিতা।

‘তোমাকে জিজ্ঞেস করার কী আছে? সব কাজ কি তোমাকে জিজ্ঞেস করে করতে হবে নাকি?’

‘হ্যাঁ রঞ্জন, আমার সঙ্গে যে-কাজটার সম্পর্ক থাকবে সেটা অবশ্যই আমাকে জিজ্ঞেস করতে হবে বই কি… একে তো মাঝেমাঝেই তুমি কারও না কারও সঙ্গে দেখা করাতে আমাকে তোমাদের বাড়ি নিয়ে যাও আর নিজে কোথায় উধাও হয়ে যাও। তোমার আত্মীয়স্বজন আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইতেই পারেন। কিন্তু রঞ্জন, বারবার তোমাদের বাড়ি যাওয়াটা কি দেখতে আদৗ ভালো লাগে?’

‘দীপু, এখনও আমাদের বিয়ে হয়নি এর মধ্যেই তুমি আমাদের বাড়ি যেতে চাইছ না? নাকি আমার বাড়ির লোকেদের তোমার আর পছন্দ হচ্ছে না?’ বেশ রেগেই প্রশ্নটা করে রঞ্জন।

‘তুমি আমাকে ভুল বুঝছ রঞ্জন। আমি মোটেই একথা বলিনি। বরং আমি তোমার সঙ্গে আরও বেশি সময় কাটাতে চাই। তোমাকে আরও জানতে চাই যাতে আমরা একে অপরকে আরও ভালো ভাবে বুঝতে পারি, পছন্দ-অপছন্দগুলো জানতে পারি’, বোঝানোর বৃথা চেষ্টা করে দীপান্বিতা।

‘কোনও দরকার নেই অত বোঝবার। বোঝা-শোনার জন্য সারাটা জীবন পড়ে আছে। আমার বাড়ির লোকেরা তোমার সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে চায় আর তোমার উচিত ওদের মনের ইচ্ছা পূরণ করা। আমি ঠিক দুটোয় তোমাকে নিতে আসব, গেটে দাঁড়িও’, বলে ফোন কেটে দেয় রঞ্জন।

রঞ্জনের অফিস দীপান্বিতার ঠিক পাশের বিল্ডিং-এই। প্রথম প্রথম আসতে যেতে দুজনের প্রায়ই দেখা-সাক্ষাৎ হতো। আগে আলাপ, তারপর বন্ধুত্ব। রঞ্জনের বাড়ি থেকেই দীপান্বিতার মা-বাবার কাছে মেয়ের বিয়ের প্রোপোজালটা আসে। যেহেতু রঞ্জন মেয়ের ভালো বন্ধু, তাই ওনারাও সম্মতি দিতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। দেড় মাসের মধ্যে বিয়ের কথা হয়ে যায়। কিন্তু তারপরেই কারও না কারও সঙ্গে দেখা করাতে দীপান্বিতাকে নিজেদের বাড়ি নিয়ে যেতে জোর দেওয়া শুরু করে রঞ্জন। প্রথম প্রথম দীপান্বিতার ভালোই লাগত যে শ্বশুরবাড়ির সকলেই ওকে দেখতে চায় কিন্তু পরে সেটাই ওর গলার কাঁটা হয়ে উঠল।

দীপান্বিতা চাইত রঞ্জনের সঙ্গে সময় কাটাতে যেটার সত্যিই প্রয়োজন ছিল। সব জিনিস নিয়েই রঞ্জন নিজের মতামত পোষণ করত। এমনকী দীপান্বিতা কী পোশাক পরবে, বাড়িতে কী রান্না হবে, এমনকী টিভির চ্যানেল কী থাকবে সবটাই রঞ্জনই নিয়ন্ত্রণ করত।

একদিন বাড়িতে ছুটির দিনে দীপান্বিতা খাবার টেবিলে সবেমাত্র বসেছে মা-বাবার সঙ্গে একসাথে মধ্যাহ্নভোজ সারবে বলে, হঠাৎই রঞ্জন বাড়িতে এসে হাজির।

ওকে দেখে দীপান্বিতার মা শশব্যস্ত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাড়াতাড়ি হাত ধুয়ে চেয়ার এগিয়ে দিলেন রঞ্জনের দিকে, ‘এসো বাবা, তুমিও আমাদের সঙ্গে বসে পড়ো।’

‘না-না মাসিমা, আজ আর খাওয়া হবে না। এখুনি আমাকে বেরোতে হবে। তাছাড়া দেখছি মাছ রান্না করেছেন। ওটা আমি আবার একদম খেতে পারি না’, বিরক্তির ভঙ্গিতে উত্তর দেয় রঞ্জন।

এবার দীপান্বিতার বাবা পাশ থেকে বলে ওঠেন, ‘আমার মেয়ের আবার মাছ দারুণ পছন্দের।’

‘তাতে কী হয়েছে?’ রঞ্জন জবাব দেয়, ‘এখন পছন্দ যত খুশি খেয়ে নিক, বিয়ের পর তো আর খাওয়া হবে না, আমার পছন্দ মতোই ওকে খেতে হবে।’

‘তার মানে?’ চমকে ওঠেন দীপান্বিতার বাবা।

রঞ্জনের ভুরু সামান্য কুঁচকে উঠল, ‘মানে আবার কি মেশোমশায়ই, স্বাভাবিক ভাবেই বিয়ের পর দীপুকে আমার পছন্দ অপছন্দ অনুযায়ী তো চলতে হবে… আমার কথা শুনে চলবে আমার বউ এটাই তো আমাদের সমাজের রীতি।’

‘উঁহু রঞ্জন’ কথার মাঝেই দীপান্বিতা বলে উঠল, ‘সবকিছু আমি তোমার ইচ্ছেমতোই বা করব কেন? আমার জীবন আমি আমার মতন করে কাটাতে চাই। তোমার ইশারায় আমি নাচব না’, দীপান্বিতার দুই চোখে কৗতুকের ঝলক।

‘দীপু, একটা কথা ভালো করে শুনে রাখো। আজও সমাজে পুরুষের মর্যাদা নারীর থেকে অনেক বেশি। সুতরাং বিয়ের পর তোমার নয়, আমার কথাই…’

‘আরে আরে রঞ্জন রাগারাগি বন্ধ করো’, মা, রঞ্জনকে কথার মাঝেই থামিয়ে দেন… ‘তুমি বাইরের ঘরে গিয়ে বসো, দীপু খেয়ে উঠেই যাচ্ছে।’ রঞ্জন বাইরে চলে গেলে মা বললেন, ‘দেখ দীপু, প্রথম প্রথম রঞ্জন হয়তো তোর উপর একটু অধিকারবোধ দেখাতে চাইছে। পরে দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে। সংসার মানেই দুটো মানুষের মধ্যে অ্যাডজাস্টমেন্ট। চিন্তা করিস না। খাওয়া সেরে দুজনে বাইরে থেকে কোথাও ঘুরে আয়, ভালো লাগবে।’

দীপুকে বুঝিয়ে বললেও মায়ের চোখে চিন্তার গাঢ় ছায়া ঘনিয়ে এল।

রঞ্জনের প্রোমোশন হতেই ওদের বিয়ের দিন স্থির করা হয়ে গেল। দুই বাড়ির ইচ্ছেতে শীতকালটাই বাছা হল বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য। এর মধ্যে দীপান্বিতা আর রঞ্জন কিছুটা করে সময় নিজেদের জন্য বার করে নিত, দেখা করত অফিসের বাইরে সুবিধামতো। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন পাশ করে এমবিএ করেছিল দীপান্বিতা। ওর নিজস্ব কিছু ভাবনা, কিছু স্বপ্ন ছিল। কিন্তু বেশিরভাগ সময় রঞ্জনের কথাই ওকে শুনে চলতে হতো। কেমন জানি স্বার্থপর হয়ে উঠত রঞ্জন। বাধ্য হতো রঞ্জনের কথামতো চলতে।

একদিন রঞ্জন জানাল, অফিসের পর ওর কিছু বন্ধুবান্ধব দীপান্বিতার সঙ্গে দেখা করতে চায়। দীপান্বিতাও রাজি হল আসতে যেহেতু অফিসের পরই পুরো ব্যাপারটা অ্যারেঞ্জ করা হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে ঠিক সেদিনই অফিস ছুটির কিছু আগে কোম্পানির এমডি কয়েকজনকে নিয়ে মিটিং কল করলেন যার মধ্যে দীপান্বিতারও নাম ছিল। ও সঙ্গে সঙ্গে রঞ্জনকে ফোন করে খবরটা জানাল। তা-সত্ত্বেও রঞ্জন জোর করতে লাগল আসার জন্য যেটা একেবারেই সম্ভব ছিল না। মোবাইল সাইলেন্ট মোড-এ রেখে দীপান্বিতা মিটিং-এ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে সন্ধে গড়িয়ে গেল। রঞ্জন বন্ধুদের সঙ্গে অপেক্ষাই করতে থাকল। অভ্যাসবশত বারবার মোবাইলে ফোন করতে থাকল রঞ্জন। মোবাইল সি্্ক্রনে রঞ্জনের নাম ফুটে উঠতে দেখেও দীপান্বিতা মিটিং-এর মাঝে ফোন তুলতে পারল না।

এদিকে বারবার ফোন করলেও দীপান্বিতা ফোন না ধরায় রঞ্জনের রাগ বাড়তে লাগল। মিটিং শেষ হতে আটটা বেজে গেল। কাজের থেকে ফ্রি হয়েই মোবাইলে চোখ রাখল দীপান্বিতা। রঞ্জনের বাইশটা মিস্ড কল দেখে ঘাবড়ে গেল ও। সঙ্গে সঙ্গে ফোন করল রঞ্জনকে।

ফোন বাজতেই নিজের রাগ সামলাতে পারল না রঞ্জন, ফোনেই দীপান্বিতার উপর চেঁচিয়ে উঠল, ‘তুমি নিজেকে কী ভাবো? আমরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি আর তুমি আসবার দরকারই মনে করলে না। বন্ধুদের সামনে আমাকে অপমান না করলেই চলছিল না? আমি কতবার তোমাকে ফোন করেছি… একবারও তুলতে পারলে না… এতই ব্যস্ততা তোমার?

রঞ্জনের চ্যাঁচামেচিতে ঘাবড়ে গিয়ে দীপান্বিতা প্রথমে কোনও উত্তরই মুখে আনতে পারল না। তারপর নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে বলল, ‘রঞ্জন, আমি তো মিটিং আছে জানতে পেরেই তোমাকে ফোন করেছিলাম। জানিয়েছিলেম যে আজ কিছুতেই আসা সম্ভব হবে না। এমডি-র সঙ্গে মিটিং… তুমি তো ভালো করেই জানো এই ধরনের মিটিং-এ ফোন সাইলেন্ট-এ রাখতে হয়।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমি সব জানি। আমাকে শেখাবার কোনও দরকার নেই। তোমাকে আমি যখন আসতে বলেছি তখন আসতে হবে… আমার কাছে তোমার কাজটা সেকেন্ডারি’ রাগের মাথায় রঞ্জনের মুখে যা এল তাই দীপান্বিতাকে বলে গেল।

রঞ্জনের ফোনটা আসার পর থেকেই দীপান্বিতা মনে মনে একেবারে ভেঙে পড়ল। আজকেই সকালে নিজের প্রোমোশনের খবরটা পেয়েছিল দীপান্বিতা। উদগ্রীব হয়ে ছিল কতক্ষণে রঞ্জনকে খবরটা জানাবে কিন্তু সে সুযোগটুকুও ওর কপালে জুটল না। বিয়ের দিন যতই এগিয়ে আসতে লাগল ততই দীপান্বিতার মনে হতে লাগল একটা বোঝা যেন ওর মাথার উপর চেপে বসছে যেটার ভার সহ্য করার ক্ষমতা ওর নেই। আজও ওর মনে হল, ও মস্ত কোনও ভুল করে ফেলছে না-তো রঞ্জনকে বিয়ে করবে স্থির করে।

বাড়ি যখন ফিরল ক্লান্তিতে ভেঙে পড়ছে শরীর। মানসিক ভাবে নিজেকে বড়ো বিপর্যস্ত মনে হল ওর। বাড়িতে ফিরে দেখল মা কোথাও বাইরে বেরিয়েছেন, বাবা একাই বাড়িতে। দীপান্বিতাকে দেখে বাবা তাড়াতাড়ি রান্নাঘরে গেলেন মেয়ের জন্য চা তৈরি করতে। দীপান্বিতা ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল চা অলরেডি টেবিলে হাজির।

‘বাবা, তুমি কেন চা তৈরি করতে গেলে? আমি তো আসছিলামই’, চেয়ার টানতে টানতে বাবাকে বলে দীপান্বিতা।

‘মা, তোকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। অফিসে খুব বেশি চাপ ছিল? মিটিং কেমন হল? শরীর খারাপ লাগছে নাকি? আজও রঞ্জনের সঙ্গে ঝগড়া করে এসেছিস?’ বাবার একের পর এক প্রশ্নবাণের সম্মুখীন হতে হল দীপান্বিতাকে।

‘বাবা, তোমার কি মনে হয় আমিই সবসময় ঝগড়া করি? আজকে তো রঞ্জনের সঙ্গে ফাটাফাটি ঝগড়া হয়ে গেছে। আজকে ওর বন্ধুদের সঙ্গে আমার দেখা করার কথা ছিল কিন্তু এমডি-র সঙ্গে মিটিং ফিক্স হওয়ার পর আমি ওকে আগাম জানিয়ে দিই যে, আমি কোনওভাবেই আজ যেতে পারব না। তা-সত্ত্বেও ও কতগুলো যে কল করে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। মিটিং শেষ হতেই আমি ওকে ফোন করেছি কিন্তু ভালো ভাবে কথা বলা তো দূরের কথা, এমন চ্যাঁচামেচি শুরু করল যে, আমার কথা বলারই কোনও সুযোগ হয়নি। এখনও আমাদের বিয়ে হয়নি… কোন অধিকারে ও আমার উপর এভাবে চ্যাঁচাবার সাহস পায়? ও নিজেও চাকরি করে সুতরাং আমার অসুবিধে ও কেন বোঝার চেষ্টা করবে না? স্বামী বলেই ও আমার উপর বসিং করবে আর আমার দোষ না থাকলেও স্ত্রী বলে সব শুনে যাব? এভাবে তো চলতে পারে না’, দ্বীপান্বিতার কথায় ওর মনের ভাব পরিষ্কার ফুটে ওঠে।

বাবা কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। যে-মেয়েকে তিনি সবসময় আগলে এসেছেন, তাকে আজ এতটা অসহায় দেখে কী বলবেন, ভেবে পেলেন না।

দু’জনে চুপচাপ বসে থাকতে থাকতেই দ্বীপান্বিতার মা-ও চলে এলেন। দুজনকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীরে মিটিং থেকে কখন ফিরলি?’

‘আধ ঘন্টার উপর হয়ে গেছে মা।’

‘সকালে প্রোমোশনের কথা বলছিলিস, কিছু জানতে পারলি কি?’

‘হ্যাঁ মা, আমার প্রোমোশন হয়েছে। স্যার আজকে জানালেন।

দু-দিনের মধ্যে কাগজ হাতে পেয়ে যাব।’

‘বাঃ, এ তো খুবই খুশির খবর। কিন্তু তুই এরকম মনমরা হয়ে রয়েছিস কেন? রঞ্জনকে ফোন করে আসতে বললে পারতিস তো, বাড়ির জামাই বলে কথা। এতে আমাদের খুশি আরও দ্বিগুন হতো’, মা উঠতে উঠতে বললেন।

দীপান্বিতা ‘না’ করা সত্ত্বেও মা জোর দিতে লাগলেন রঞ্জনকে খেতে ডাকার জন্য। বাধ্য হয়ে বাবা উঠে রঞ্জনকে ফোন করলেন কিন্তু রাত্রি হয়ে যাওয়াতে রঞ্জন জানাল ও পরের দিন আসবে। রাত্রে ওদের সঙ্গেই খাওয়াদাওয়া করতে রাজি হয়ে গেল ও।

পরের দিন দীপান্বিতা অফিসের কাজ নিয়েই সারাদিন ব্যস্ত থাকল। ইচ্ছে হল না রঞ্জনকে একটা ফোন করে কথা বলে। সারাদিনই মনটা বিষণ্ণ রইল। সন্ধেবেলায় মা-কে রান্নাঘরে একটু সাহায্য করে দেওয়ার জন্য তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এল।

ওর বাড়ি ফেরার প্রায় এক ঘন্টা পর রঞ্জন এসে পৌঁছোল। এসে জানতে পারল নিমন্ত্রণের কারণটা। দীপান্বিতার প্রোমোশনের খবরটা পেয়ে খুশি হয়েছে বলে মনে হল না। বরং আরও গম্ভীর হয়ে উঠল ওর চোখমুখ। বাড়িতে কারওরই নজর এড়াল না। দীপান্বিতার মা জিজ্ঞেস করেই বসলেন, ‘কী হল রঞ্জন, তুমি খুশি হওনি?’

‘একটা প্রোমোশনে এত খুশি হওয়ার কী আছে? বাড়িতে তো ওকে কোনও কাজ করতে হয় না… সব কাজ আপনিই করেন। সুতরাং কোম্পানির কাজ ও মন দিয়ে করতে পারে। মন দিয়ে কাজ না করলেও প্রোমোশন যখন হবার তখন হবেই’, তাচ্ছিল্যের সঙ্গে উত্তর দেয় রঞ্জন। দীপান্বিতার মুখের দিকে চোখ পড়তেই ওকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘দীপু এখানে যা করছ করে নাও, আমার বাড়িতে এসব চলবে না। বাড়ির সব কাজ তখন তোমাকে করতে হবে। বউ এলে মা আরাম করবে… ওখানে যা ইচ্ছে তাই করতে পারবে না। বাড়ির বউ, বউয়ের মতোই থাকবে, মেয়ে হয়ে ওঠার চেষ্টা কোরো না…’। আরও অনেক কিছুই বলে যাচ্ছিল রঞ্জন আর বাকি তিনজন অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিল। হঠাৎ বাবা বলে উঠলেন, ‘একী রঞ্জন, এসব তুমি কী বলে যাচ্ছ? আজকালকার ছেলে তুমি, এরকম সংকীর্ণ মানসিকতা কী করে হয় তোমার? আমি অবাক হচ্ছি… দীপু তোমার বউ হতে চলেছে… ওকে অপমান অন্তত কোরো না।’

‘প্লিজ মেশোমশাই, আপনি আমাদের দুজনের মধ্যে পড়বেন না। দীপুকে আগে থেকে আমি সব বলে দিতে চাই যাতে পরে গিয়ে ও আমাকে দোষারোপ না করতে পারে।’

ঘটনাক্রম কোথা থেকে কোথায় পৌঁছে গেল মুহূর্তের মধ্যে। সবাই বিনা বাক্যব্যয়ে চুপ করে খাবার খেয়ে নিল। আনন্দের পরিবেশ বিষাদে পরিণত হল। খাবার খেয়েই রঞ্জন বেরিয়ে গেল, পেছনে ফেলে গেল অনেকগুলো প্রশ্ন।

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন কাছে এগিয়ে আসতে লাগল। মাত্র আর এক মাস বাকি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রঞ্জনের স্বভাবের সত্যিটাও সকলের দৃষ্টির সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল। জেদ, স্বার্থপরতা, হীন মনষ্কতা মানুষকে কতটা নীচে নামাতে পারে তার উদাহরণ প্রতিনিয়ত সকলের সামনে ফুটে উঠতে লাগল। ও কারও কথা শুনতে প্রস্তুত নয়, অথচ সকলকে ওর ইচ্ছা অনুসারে চলতে হবে।

রঞ্জনের মা ভালোমানুষ, বহুবার দীপান্বিতাকে বলেছেন, রঞ্জন যেমন ব্যবহার করে দীপান্বিতাও যেন ওর সঙ্গে ওই একই রকম ব্যবহার করে। একমাত্র ওই উপায়তেই রঞ্জনকে বোঝানো যাবে ও যা করছে ভুল করছে।

কিন্তু দীপান্বিতার মন সায় দেয়নি। একটা মানুষকে সঠিক রাস্তায় আনতে এটা কখনও স্থায়ী সমাধান হতে পারে না। রঞ্জনের মতো ব্যবহার করতে থাকলে জীবনযুদ্ধে যে ও জয়ী হবেই তার নিশ্চয়তা কী?

অশান্ত মন-কে শান্ত করার কোনও উপায় ছিল না দীপান্বিতার কাছে। কীভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে, প্রতিনিয়ত তার সন্ধান করতে থাকত ও। অফিসের কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করত। প্রতিদিনের মতো সেদিনও অফিস যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল, তখনই মোবাইলটা বেজে উঠল। দীপান্বিতা তাকিয়ে দেখল রঞ্জনের ফোন। তুলতে ইচ্ছা হল না… রিং বাজতেই থাকল, তারপর একসময় কেটে গেল। দ্বিতীয়বার ফোনটা বাজতেই মা এসে ফোনটা ধরে দীপান্বিতার হাতে ধরিয়ে দিলেন। বাধ্য হয়ে ওকে কথা বলতেই হল।

‘হ্যালো, কী করছিলে? ফোন তুলছিলে না কেন? আচ্ছা শোনো আজকে একবার দেখা করতে চাই। পুরো ছুটি নিতে পারলে ভালো নয়তো হাফে বেরিও। কী করবে ফোন করে আমাকে জানিয়ে দিও। আর হ্যাঁ, অ্যাভয়েড করার চেষ্টা কোরো না, নয়তো আমি তোমার অফিসে পৌঁছে যাব।’

রঞ্জনের শাসানি শুনে দীপান্বিতা ভয় পেল। বুঝতে পারল ছুটি না নিলে রঞ্জন সত্যি ওর অফিস পৌঁছে যাবে। বাধ্য হয়ে অফিস পৌঁছে হাফ-ডে-র জন্য দরখাস্ত করল। ছুটি মঞ্জর হতেই রঞ্জনকে ফোনে জানিয়ে দিল। তাড়াতাড়ি করে দেড়টার মধ্যে অফিসের সব কাজ গুছিয়ে নিয়ে রঞ্জনের অপেক্ষায় বসে রইল।

ঠিক দুটোর সময় রঞ্জন নিজের গাড়িতে ওকে তুলে নিয়ে পরিচিত একটি রেস্তোরাঁয় এসে বসল।

‘কী ব্যাপার, হঠাৎ ছুটি নিতে বললে কেন?’ দীপান্বিতা জিজ্ঞেস না করে পারল না।

‘আসলে তোমাকে কিছু জরুরি কথা বলার ছিল’, একটু ভেবে উত্তর দিল রঞ্জন, ‘দীপু, আর কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের বিয়ে। তারপর তুমি আমাদের বাড়ির সদস্য হয়ে যাবে। যদিও এখনও তোমার ওখানে আসা-যাওয়া রয়েছে তবুও কয়েকটা জিনিস আমি পরিষ্কার করে বলে দিতে চাই। আমার বাড়িটা তোমার শ্বশুরবাড়ি, বাপের বাড়ি নয় সুতরাং বউয়ের মতন তোমাকে থাকতে হবে। বাপের বাড়ির মতো স্বাধীনতা ওখানে থাকবে না, বাড়ির সব কাজও তোমাকেই করতে হবে। আমি এত কথা তোমাকে বলছি কারণ আমার মনে হয় বাড়ি আর অফিস দুটো একসঙ্গে সামলানো তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি বরং চাকরি-টা ছেড়ে দাও।’

চমকে উঠল দ্বীপান্বিতা, ‘কী বলছ রঞ্জন তুমি? চাকরি কেন ছাড়ব? বাড়ি আর চাকরি দুটোই আমি একসঙ্গে ভালো ভাবে সামলাতে পারব, এই বিশ্বাসটুকু আমার নিজের উপরে আছে। তোমাকে এই নিয়ে ভাবতে হবে না, শুধু আমার উপর বিশ্বাস রাখো’, আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে দীপান্তিতা বলে। যদিও রঞ্জনের যা স্বভাব, তাতে ও যে এই কথাগুলো মেনে নেবে না সেটা দীপান্বিতা খুব ভালো ভাবেই জানত, তবুও ও শেষ চেষ্টা একবার করে দেখতে চাইল।

‘দীপু, আমি তোমার মতামত নিতে বা তোমার সঙ্গে পরামর্শ করার জন্য এখানে আসিনি। আমি কি চাই, সেটা তোমাকে পরিষ্কার করে বলব বলে এখানে ডেকেছি। চাকরি তোমাকে ছাড়তে হবে আর জেনে রাখো আমার বাড়ির নিয়ম হচ্ছে সব সিদ্ধান্ত পুরুষরাই নেবে… নিজের কাজের দক্ষতা দেখাতে চাও বাড়িতে বসে দেখাও। আমার উপর ছড়ি ঘোরাবার চেষ্টা কোরো না। আমার বাড়িতে আমি যা বলব তাই মানতে হবে, এটা তুমি যত তাড়াতাড়ি মেনে নেবে ততই তোমার জন্য মঙ্গল। আজ এখন উঠব, একটা কাজ আছে’, বলে রঞ্জন উঠে দাঁড়াল এবং দীপান্বিতা-কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রেস্তোরাঁ ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

পেছন থেকে দুবার ডাক দিতেও যখন রঞ্জন ফিরে তাকাল না, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দীপান্বিতা উঠে দাঁড়াল। রেস্তোরাঁর বিল মিটিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে এসে রাস্তায় দাঁড়াল। বাড়ি ফিরতেই বাবা মেয়েকে দেখে বুঝে গেলেন বড়োসড়ো কোনও ঝড় বয়ে গেছে মেয়ের উপর। মেয়েকে বসিয়ে ভিতর থেকে ওর জন্য খাবার জল এনে সামনে রাখতেই দীপানিবতা নিজেকে আর সামলাতে পারল না। বাবার বুকে মাথা দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

‘কী হয়েছে দীপু, কাঁদছিস কেন মা?’

‘বাবা, আজ রঞ্জন দেখা করতে এসেছিল’, চোখ মুছে দীপান্বিতা পুরো ঘটনা বাবাকে খুলে বলল। সব শুনে উনি চিন্তায় পড়ে গেলেন, এখনই বিয়ের আগে যদি রঞ্জনের এরকম ব্যবহার হয় তাহলে বিয়ের পর কী হবে?

‘বাবা, বিয়ের পর আমি কিছুতেই রঞ্জনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারব না… আমার মন কিছুতেই এই বিয়েতে সায় দিচ্ছে না, কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না’, কান্নাভেজা গলায় বাবাকে জানায় দীপান্বিতা।

‘এত উতলা হোস না মা। তোর মা বাড়িতে ফিরুক, আলোচনা করে দেখি। তুই গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নে।’

হাত-মুখ ধুয়ে বসার ঘরে বসতেই মা ফিরে এলেন। দীপান্বিতা উঠে গেল তিনজনের জন্য চা বানিয়ে আনার জন্য। চা করে এনে বসে পড়ল সোফায়। বাবাই রঞ্জনের কথাটা তুললেন চা খেতে খেতে, ‘শুনছ, আজ রঞ্জন এসেছিল দীপুর সঙ্গে দেখা করতে। দীপুকে চাকরি ছাড়তে বলেছে। দীপু রঞ্জনকে বিয়ে করতে চাইছে না… কী করা যায়? বাবা জানতে চাইলেন।

মা তাকাল মেয়ের দিকে, বলল, ‘দীপু, প্রথম থেকেই রঞ্জনের স্বভাব, ওর ব্যবহার আমার অদ্ভুত মনে হয় কিন্তু তাও আমার মনে হতো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে। তোরা দুজন দুজনকে চিনবি, বুঝতে পারবি। কিন্তু আজ তুই অন্য কথা বলছিস। বিয়ের আর এক মাসও বাকি নেই। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাইকে বলা হয়ে গেছে… সবকিছু গোছানো শেষ… এই সময় সম্বন্ধ ভেঙে গেলে সবাই মেয়ের দোষই ধরবে।’ বেশ চিন্তিত মনে হল মায়ের কণ্ঠস্বর!

মায়ের কথায় লজিক ছিল এটা অস্বীকার করতে পারল না দীপান্বিতা। ভারাক্রান্ত মনে রাতের খাবার খেয়ে বিছানায় এলিয়ে দিল ক্লান্ত শরীরটাকে। চেষ্টা করেও বিয়ের জন্য মনটাকে কিছুতেই রাজি করাতে পারল না ও। রঞ্জনের প্রতি মনজুড়ে বিতৃষ্ণা ভরে গেছে ওর, এই অবস্থায় কী করে ও রঞ্জনকে স্বামী বলে মেনে নেবে ভেবে পেল না।

সকালে উঠে প্রতিদিনের মতো টেবিল থেকে চা আনতে গিয়ে বাবার মুখোমুখি হল দীপান্বিতা। ইশারায় টেবিলে বসতে বললেন ওকে তারপর উঠে এসে মেয়ের পাশে বসে ওর হাত দুটো তুলে নিলেন নিজের হাতে। আশ্বাসের সুরে বললেন, ‘অনেক ভেবে দেখলাম বুঝলি মা, রঞ্জনকে ফোন করে বলে দে যে তুই ওকে বিয়ে করবি না… তারপর যা হবে আমি আর তোর মা বুঝে নেব।’

‘বাবা তুমি এটা কি বলছ? সত্যিই আমি রঞ্জনকে বলে দেব যে ওকে আমি বিয়ে করব না?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে দীপান্বিতা।

‘হ্যাঁ মা, কাল অনেক রাত পর্যন্ত আমি আর তোর মা এই নিয়ে অনেক ভেবেছি। মেয়ে সুখে থাকুক, মনের মতো স্বামী পাক এটাই সব মা-বাবার ইচ্ছা থাকে। যে-সম্পর্কটাকে বিয়ের আগেই বোঝা মনে হচ্ছে আমার মেয়ের, বিয়ের পর সেই সম্পর্কটাই হয়তো মেয়ের জন্য প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে। এর থেকে ভালো সম্পর্কটা ছেড়ে বেরিয়ে আসা। যা মা যা, তুই আর দেরি করিস না। এখনই ফোনটা কর।’

দীপান্বিতার হঠাৎ-ই মনে হল মাথাটা খুব হালকা লাগছে। মাথার উপর চেপে থাকা ভারী বোঝাটা নেমে গিয়ে বেশ ফুরফুরে মনে হল নিজেকে। মা-বাবার আশীর্বাদ রয়েছে যে ওর উপর।

মোবাইলটা হাতে তুলতেই ওটা বেজে উঠল। রঞ্জন ফোন করছে। একটু শ্বাস নিয়ে দীপান্বিতা এপাশ থেকে উত্তর দিল, ‘হ্যালো…’ রঞ্জনের অধীর কণ্ঠ ভেসে এল, ‘দীপু, কী ঠিক করলে তাহলে? আজ রেজিগনেশনটা দিচ্ছ না, দিচ্ছ না?’

‘না রঞ্জন, রেজিগনেশন আমি দেব না। এই মুহূর্তে আমি তোমার সঙ্গে আমার সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করছি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে তোমাকে আমি বিয়ে করব না।’

রঞ্জন ‘হ্যালো… হ্যালো…’ করতে করতেই দীপান্বিতা ফোনটা কেটে দিল। একটা সম্পর্ক শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে গেল অথচ দীপান্বিতার মনে তার বিন্দুমাত্র রেখাপাত ঘটল না।

 

জয়ের শিখরে

বীর বাহাদুর রাণা

‘নমস্কার। পর্বতারোহী সংঘের বার্ষিক সভা আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হবে। আপনারা একটু  ধৈর্য ধরুন। আমাদের আজকের সভার প্রধান অতিথি বিখ্যাত পর্বতারোহী অমৃতেন্দু মিত্র অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছোবেন। তার পরই আমরা সভার কাজ শুরু করব।’

সুন্দরী অল্পবয়সি ঘোষিকাটি মঞ্চের ডানদিকে অদৃশ্য হয়ে গেল। হলের মধ্যে পিন পতনের শব্দ হলেও বুঝি শোনা যাবে। এয়ার কন্ডিশনারের কৃত্রিম ঠান্ডা আলতো করে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বেশ খানিকক্ষণ আগেই হলে পৌঁছে, নিজের জন্য নির্ধারিত জায়গায় বসে পড়েছিল রিনা। রিনা মল্লিক, কামেট শিখরে অভিযানকারী দলের সদস্য।

হলটা এখনও মোটামুটি ফাঁকাই। চেনাশোনা দু-চারজন রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে। ঘাড় ঘুরিয়ে এসবই দেখছিল রিনা। হলে ঢোকার দরজাটা অল্প ফাঁক করে ঢুকে এল মন্দিরা যোশী। অতীতে বহু স্মরণীয় অভিযানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই সাহসী মহিলার নাম। এখন একটু বয়স হয়েছে ঠিকই, কিন্তু চলাফেরায় তেজ দেখলে সেকথা কে বলবে?

রিনাকে দেখেই উল্লসিত হয়ে উঠলেন মন্দিরা। একগাল হেসে সৗজন্যের হাতটি বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমি কেবল তোমাকে জয়ী হতে দেখতে এসেছি রিনা। ওরা যখন বলল, পর্বতারোহণের ইতিহাস থেকে কলঙ্কজনক অধ্যায়টাকে ওরা মুছে ফেলতে চায়, তখনই আসতে রাজি হয়ে গেলাম। খানিকটা দেরি হয়তো হল, কিন্তু তোমার প্রাপ্য সম্মানটা তো ওরা দিতে চাইছে! ভুল তো মানুষ মাত্রেই হয়!’

মন্দিরা যোশীর আন্তরিক হাসিমুখটা দেখে মন ভরে গেল রিনার। সেদিকে তাকিয়ে থেকেই, রিনা যেন এক বছর আগের এক অপ্রিয় অতীতে ফিরে গেল। পাহাড়ে তখন সন্ধ্যা নামছে। হাড়ের মধ্য দিয়ে ঢুকছে কনকনে ঠান্ডা। পোশাকের পর পোশাক চাপিয়েও সামলানো যাচ্ছে না শৈত্যের আগ্রাসন।

বিকেল পাঁচটা। কামেট শিখরে বেস ক্যাম্প ফেলেছে দশ সদস্যের পর্বতারোহী দল। একটু আগেই ডাক পড়েছে পাশের রান্নাঘরের টেন্টে। খাবার রান্না মোটামুটি শেষ। আড়ম্বর তো নেই কিছু। অতএব সেখানে বসে খেতে খেতেই পরের দিনের অভিযানের রূপরেখা তৈরি করে ফেলা হবে। এটাই নিয়ম। কেউ স্পষ্ট করে না বললেও সকলেই জানে। পর্বতে সন্ধ্যা নামে তাড়াতাড়ি। এমন নিরালা, নির্বান্ধব পরিবেশে বেশিক্ষণ জেগে থাকার প্রশ্ন নেই। চারদিকে কেবলই ধু-ধু বরফ। তার আড়ালে দিগন্তও ঢাকা পড়ে গেছে। আলো যত পড়ে আসে, ততই রহস্যময় হয়ে পড়ে সেই বরফের ময়দান। যেমন রহস্যময়, তেমনই ভীতিপ্রদ। দেখতে দেখতে ক্রমে সেই ভয়ও একঘেয়ে হয়ে যায়।

বরফের চাদর পেরিয়ে সকলেই কিচেন টেন্টে গিয়ে হাজির হল। টিমটিমে আলোর খুব সামনে দুটি মাথা ঝুঁকে রয়েছে। তাদের একজন নগেন্দ্র রাই। তার হাতে টোপো শিট। সেটিকেই বারবার তিনি খুঁটিয়ে দেখছেন। কারণ, খাওয়াদাওয়ার পর তাকেই অভিযাত্রীদের চূড়ান্ত নাম ঘোষণা করতে হবে।

রিনা টেন্টের পর্দা সরিয়ে ঢুকে চারদিকে চোখ ফিরিয়ে অন্যান্য সদস্যদের দেখল একবার। কিচেন টেন্টের একেবারে কোণে শেরপা তামাং, বনরোত, লুসাইরা রাতের খাবারদাবার তৈরি করছে। বিউটেন গ্যাসের বার্নার জ্বলছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অত উপরে অন্য কোনও গ্যাস, জ্বালানি হিসাবে কাজ করে না। বরফকে গরম করে তবে জল পাওয়া যায়। টেন্টের পর্দাটা টানটান করে আটকে দিল রিনা। বাইরে থেকে কনকনে বাতাস ঢুকে আসবে না হলে। টেন্টের বাইরে এখন মাইনাস আঠারো ডিগ্রি। ইতিমধ্যেই বরফের কামড়ে সদস্যদের কারও কারও আঙুলের ডগা বিশ্রীভাবে ফাটতে শুরু করেছে। রিনা গ্লাভস-এর মধ্যে হাতটা মুঠো করল।

নগেন্দ্র রাই কথা বললেন।

‘আপনারা জানেন, ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বত, কামেটের শৃঙ্গে পৌঁছোনোর জন্য চূড়ান্ত পর্যায়ের অভিযান কালই শুরু করতে হবে আমাদের। ওই উচ্চতায় পৌঁছোতে হলে, আমাদের কাল শেষরাত ৩টের সময় এই বেস ক্যাম্প ছাড়তে হবে।’

নগেন্দ্র রাই তীক্ষ্ণ চোখে সকলের দিকে একবার তাকিয়ে নিলেন। হাতে ধরা কাগজটি সামান্য তুলে ধরে বললেন, ‘কালকের অভিযাত্রী দলে যারা থাকবেন, তাদের নাম নিয়েই আমরা এতক্ষণ আলোচনা করছিলাম। সর্বসম্মতিক্রমে, এবং অবশ্যই ডা. যোশীর পরামর্শ নিয়ে আমরা সাতজন সদস্যের নাম চূড়ান্ত করেছি!’

টেন্টের মধ্যে এখন বুঝি পিন পতনের শব্দও শোনা যাবে। বাইরে শুধু হিম-বাতাসের কোলাহল। সকলেই নিশ্বাস বন্ধ করে সেই চূড়ান্ত ঘোষণার প্রহর গুনতে থাকল। এমন ঐতিহাসিক অভিযানে, অভিযাত্রী দলের সদস্য হতে চায় সকলেই।

নগেন্দ্র রাই তার অসম্ভব ব্যারিটোন গলায় বলতে থাকেন নামগুলো। একটি করে নাম উচ্চারিত হয় আর রিনা কড় গুনে হিসাব রাখে। এই বুঝি তার নামটিও ভেসে আসবে। সেই চূড়ান্ত মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে সে। একসময় নগেন্দ্র রাই নাম পড়া শেষ করে চোখ তুলে তাকান। বলেন, ‘এই সাতজনকেই বেছেছি আমরা। বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে মানসিক জোর এবং তারপরই স্বাস্থ্য।’

রিনা আর না বলে পারল না। এই হিমবাতাসেও তার কপালে যেন ঘাম জমার মতো অনুভব হচ্ছে। জয়ের এত কাছে এসেও জয় অধরাই থেকে যাবে তার কাছে? এই ভাবনা তাকে পীড়িত করল।

‘স্যার আমার নাম কেন নেই এই তালিকায়?’ কথাগুলো যেন ছিটকে বের হল তার মুখ থেকে। বরফ ঝড়ের তীব্রতার মতোই।

নগেন্দ্র রাই সেই ক্ষুরধার দৃষ্টিতে তাকালেন রিনার দিকে। তার ঠোঁটের কোণে এক ঝলক হাসি খেলে গেল। শেষে অত্যন্ত সুভদ্র গলায় বললেন, ‘আপনার সবচেয়ে বড়ো অসুবিধার জায়গা আপনার বয়স, ম্যাডাম। আপনাকে নির্বাচিত না করার মুখ্য কারণও এটাই। রাস্তাটা অত্যন্ত দুর্গম, আপনি জানেন। তা ছাড়া ডা. যোশী জানালেন, আপনার ব্লাডপ্রেশারও ফ্লাকচুয়েট করে ঘনঘন আর পায়েও একটা পুরোনো চোট আছে। ফলে, এই শারীরিক অবস্থায় আপনাকে এত উঁচুতে যাওয়ার অনুমতি আমি দিতে পারি না। এটা আমাদের অন্যান্য সদস্যদের উপরেও একটা খারাপ প্রভাব ফেলবে।’

রিনা বেশ অবাক-ই হয়ে গেল। বয়সটা তার পক্ষে একটা বাধা, সন্দেহ নেই। কিন্তু, শারীরিক কোনও অসুস্থতা এখানে আসা ইস্তক ভোগায়নি তাকে। ডা. যোশীও তাকে একরকম অভয় দিয়েই এসেছেন এতদিন। সেই তিনিই নগেন্দ্র রাইকে তার সম্পর্কে অন্যরকম রিপোর্ট দিয়েছেন দেখে ভারি অবাক হল রিনা। ডা. যোশী মাথা নীচু করে বসে রয়েছেন।

রিনা বলল, ‘কিন্তু স্যার, আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। অভিযানের জন্য মানসিকভাবেও আমি প্রস্তুত। আপনি প্লিজ আমায় কালকের টিমে শামিল করে নিন।’

শেষদিকে রিনার কথাগুলো অনুনয়ের মতো শোনাল। কিন্তু নগেন্দ্র রাই নরম হওয়ার লোক নন। ততটাই কঠোর গলায় বললেন, ‘আমি আপনার ব্যাপারে কোনও ঝুঁকি নেব না ম্যাডাম!’

এক বাক্যে গোটা টেন্টে গভীর নীরবতা নেমে এল।

‘এটাই তাহলে আপনার শেষ সিদ্ধান্ত?’ রিনা প্রশ্ন করে।

‘সিদ্ধান্ত একবারই নেওয়া হয়,’ নগেন্দ্র রাই বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘এই সিদ্ধান্ত দলের ক্যাপ্টেনের। এরপর আপনি যদি কিছু করেন, সেটা আপনার দায়!’

নগেন্দ্র রাই উঠে পড়লেন। ডা. যোশীও। ফের রিনার দৃঢ় গলা চমকে দিল তাদের, ‘স্যার, আমি হেরে যেতে আসিনি। আপনি এবং দলের বাকি সদস্যরা শুনে রাখুন, কাল অবশ্যই আমি অভিযানে যাব। নিজের ট্রেকিং আমি নিজেই করবঃ!’

‘আপনি কিন্তু দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছেন ম্যাডাম,’ নগেন্দ্র রাই ফুঁসে উঠলেন রাগে, ‘এমন হলে ভবিষ্যতে আপনার ট্রেকিংয়ের কেরিয়ার সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমনকী আপনার অতীতের কৃতিত্বগুলিও কেড়ে নেওয়া হতে পারে। সেটা মাথায় রাখলে আপনি ভালো করবেন বোধহয়!’

‘ডা. যোশী, আপনি কী মনে করছেন?’ ক্যাপ্টেনের কথার কোনও জবাব না দিয়ে রিনা সরাসরি প্রশ্ন ছুড়ে দেয় দলের চিকিৎসকের দিকে।

ডা. যোশী না তাকিয়েই মৃদু গলায় বলে ওঠেন, ‘আপনার ব্লাডপ্রেশার আর স্বাস্থ্যের সার্বিক অবস্থা দেখার পরও ঝুঁকিটা নেওয়া উচিত হবে না ম্যাডাম!’

ডা. যোশীর দিক থেকে যে কোনও সাহায্যই পাওয়া যাবে না, সেকথা বিলক্ষণ বুঝে গেছিল রিনা। তাই বলল, ‘রাজ্যস্তরে আমাকে যখন নির্বাচন করা হয়, সেখানেও চিকিৎসকরা আমার শারীরিক অবস্থার পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন। আমি ঘুষ দিয়ে পাশ করিনি।’

প্রতিদ্বন্দ্বী আরও অনেকে ছিল। কিন্তু তারা আমাকেই যোগ্য বলে মেনে নিয়েছিলেন। এখন আপনারা অন্যরকম কথা বলছেন। তাহলে কি তারা ভুল ছিলেন?’

উত্তর এল না। উত্তরের প্রত্যাশাও করেনি রিনা। নিজের রাস্তা তাকে নিজেকেই তৈরি করে নিতে হবে, এ কথা সে বুঝে গেছে। রিনা অপেক্ষা করল না আর। টেন্টের পর্দা সরিয়ে বাইরে বরফের আস্তরণে পা রাখার আগে শেরপাদের বলে গেল, তার খাবারটা তার টেন্টে দিয়ে আসতে। এদের সঙ্গে খাওয়াদাওয়া করে লোকদেখানো টিমস্পিরিট দেখাতেও তার বিবমিষা এল।

টেন্টে ফিরে এসে সে পরের দিনের ইতিকর্তব্য ঠিক করতে বসল। একাএকা ট্রেকিংয়ের কথা বলে এলেও, বিষয়টা সহজ নয় মোটেই। যথেষ্ট ঝুঁকিও রয়েছে। ঠিক তখনই শেরপা রাজু টেন্টের বাইরে দাঁড়িয়ে ভিতরে আসার অনুমতি চাইল। ঘড়িতে সময় দেখল  রিনা। ঠিক সাতটা বাজে। তার মানে, শেরপা রাজু রাতের খাবার নিয়ে এসেছে তার নির্দেশমতো। এ সময় মনে মনে সে যেন শেরপা রাজুকেই খুঁজছিল। উৎসাহভরে বলল, ‘ভিতরে এসো শেরপাঃ!’

খাটো চেহারার ভারি হাসিখুশি মানুষ শেরপা রাজু। বেশ করিতকর্মা অভিযাত্রী, আবার রাঁধুনিও বেশ ভালো। ধোঁয়া ওঠা গরম খাবার সামনের টেবিলে রেখে শেরপা রাজু হেসে বলল, ‘খেয়ে নিন ম্যাডাম!’

নগেন্দ্র রাইয়ের সঙ্গে তর্কবিতর্কের সময় শেরপা রাজু কাছাকাছিই ছিল। বোঝা যায়, সমস্ত আলোচনাটাই সে শুনেছে। তার দেহভঙ্গিমার মধ্যে, কেমন যেন তার প্রতি একটু হলেও সমবেদনার আভাস খুঁজে পেল রিনা। দলের বাকিদের বেশিরভাগই যে ক্যাপ্টেন রাইয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যাবে না, তা হলফ করেই বলা যায়। প্রত্যেকের কাছেই কেরিয়ারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। জলে থেকে কুমিরের সঙ্গে সংঘাতে যাওয়ার মতো অবিমৃশ্যকারিতা দেখাতে প্রস্তুত নয় কেউ।

শেরপা রাজুকে দেখে একটু হলেও মনে বল পেল রিনা। জিজ্ঞেস করল, ‘শেরপা রাজু, এর আগে কতবার কামেট শৃঙ্গে উঠেছ তুমি?’

মুখে হাসি ধরে রেখে তিনটে আঙুল তুলে ‘তিনবার দেখাল শেরপা রাজু।

রিনা মুখ কালো করে বলল, ‘আমি যেতে পারব না ওখানে, শেরপা?’

শেরপা রাজু সহসা চোখ নামিয়ে নিল। তারপর হঠাৎ-ই রিনার চোখে চোখ রেখে খুব দৃঢ় গলায় বলে উঠল, ‘আমার মন বলছে, আপনি পারবেন ম্যাডাম। এত দূর যখন পৌঁছোতে পেরেছেন, তখন আর ওইটুকু উঁচুতে যেতে পারবেন না?’

তারপর একটু থেমে থেকে বলল, ‘কালকে আমাদের দলের গাইড তামাং শেরপা। আপনি ওর সঙ্গে চলে যাবেনঃ!’ সারারাত রিনার মাথার মধ্যে শেরপা রাজুর কথাটাই যেন গেঁথে রইল। তাকে ঘুমোতে দিল না। থেকে থেকে এপাশ-ওপাশ করতে থাকল রিনা। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, কামেট শিখরে যে করে হোক পৌঁছোতেই হবে তাকে। পরদিন শেষ রাত দুটোর সময় দলের অন্যরা যখন প্রস্তুত হতে থাকল, রিনাও তৈরি হয়ে নিল।

নগেন্দ্র রাই এগিয়ে এসে শান্ত গলায় বোঝানোর মতো করে বললেন, ‘ম্যাডাম, আপনাকে আমি শেষবারের জন্য পরামর্শ দিচ্ছি। দয়া করে ঝুঁকি নেবেন না। এই দেখুন না কেন, আমার শরীরটা ঠিক নেই বলে আমিও যাচ্ছি না। সাতজনের দল গঠন করা হয়েছিল, এখন ছজন যাবে!’

নগেন্দ্র রাই উৎসুক চোখে রিনার দিকে চেয়ে রইলেন। চোয়াল শক্ত হয়ে রইল রিনার। কঠোর গলায় জবাব দিল, ‘আমি যাব। আপনি বেস ক্যাম্পে বসে থাকুন আর ক্যারম খেলুন!’

‘শাট আপ!’ রীতিমতো চেঁচিয়ে উঠলেন নগেন্দ্র রাই, ‘আমার সঙ্গে তর্ক করবেন না–!’

চেঁচামেচি শুনে মুহূর্তে অন্য সদস্যরাও এগিয়ে এসেছিল। নগেন্দ্র রাইকে তারাই কোনওরকমে শান্ত করে অন্যধারে সরিয়ে নিয়ে গেল। নগেন্দ্র রাই তখনও গরগর করছিলেন ভয়ানক রাগে।

কিন্তু এসবের ফলে অভিযান শুরু করতে দেরি হয়ে যেতে পারে ভেবে, দলের সদস্যরা তড়িঘড়ি ধামাচাপা দিয়ে দিল বিষয়টাকে। চারদিকে এখনও বরফের মতো শীতল শক্ত অন্ধকার। অভিযাত্রীদের তীব্র টর্চের আলো ধীরে ধীরে সেই অন্ধকারকে কেটে এগোতে থাকল। গাইড তামাংয়ের পিছন পিছন বরফের ঘন আস্তরণে পা রাখল রিনা। ভারী জুতো পরে থাকায় বরফের মধ্যে পা বসে যাচ্ছিল। এক জায়গা থেকে পা তুলে অন্য জায়াগায় রাখতে অনেকটা সময় যাচ্ছিল। অভিযাত্রীদের গতি স্বভাবতই হয়ে পড়ছিল অত্যন্ত ধীর।

কত সময় গেল তার হিসাব কে রাখে। ধীরে ধীরে দিগন্তের অন্ধকারও যেন হালকা হচ্ছে।

ক্যাপ্টেন ডোগরা কখন পাশে চলে এসেছেন, খেয়াল করেনি রিনা। চমক ভাঙল কাঁধের কাছে তার কণ্ঠস্বর শুনে।

‘ম্যাডাম, আপনি ঠিক কাজ করলেন না। টিম লিডারের নির্দেশকে অমান্য করা তো দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের সমান!’ ক্যাপ্টেন ডোগরা ঠান্ডা বাতাসের সঙ্গে রীতিমতো যুঝছেন, সেটা তার হাঁফিয়ে কথা বলার ভঙ্গি থেকেই পরিষ্কার।

রিনা চলতে চলতেই বলল ‘ক্যাপ্টেন, সেনাবাহিনিতে এমন অনুশাসন চলে, কিন্তু আমাদের সিভিলে চলে না। আমার অতীতের রেকর্ড দেখেই আমাকে নির্বাচন করা হয়েছিল। আমি তো কলকাতায় ফিরেই নগেন্দ্র রাইয়ের নামে নালিশ জানাব!’

সূর্যোদয়ের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠল আকাশ। ঘড়ির কাঁটা ভোর পাঁচটার দাঁড়িতে স্থির হয়ে পেরিয়েও গেল। সূর্যের হালকা লাল আভা কামেটশৃঙ্গের উপর ছড়িয়ে পড়ে আশ্চর্য প্রাকৃতিক সুষমা সৃষ্টি করেছে।

সাধারণভাবে কোনও পর্বতশৃঙ্গে ওঠার জন্য ভোরের সময়টাকেই বেছে নেন পর্বতারোহীরা। কারণ এসময়ে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ থাকে বেশি। বরফ ঝড়ের সম্ভাবনাও অনেক কম থাকে। দলের অন্যান্য সদস্যরা ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে থাকল। রিনাও ক্যামেরা ঠিক করে শাটার টিপল। যতদূর চোখ যায় কেবলই বরফ। মাঝেমধ্যে কয়েকটি দুর্লভ প্রজাতির বড়ো গাছ।

হঠাৎ-ই দলটা দাঁড়িয়ে পড়ল। গাইড তামাং কিছু বলছে। উৎকর্ণ হল রিনা। তামাং সকলকে তাদের সেফটি বেল্টের সঙ্গে দড়ির প্রান্ত বেঁধে নিতে নির্দেশ দিচ্ছে। এখান থেকেই শুরু হচ্ছে অভিযানের চূড়ান্ত পর্যায়।

উচ্চতা যতই বাড়তে থাকল, ততই অভিযাত্রী দলের সদস্যদের মাথাও ঘুরতে শুরু করল অল্পবিস্তর। আশপাশের বড়ো গাছগুলির পাতা ও কাণ্ড থেকে ভেসে আসা তীব্র কটু গন্ধে অনেকে বমি করতে শুরু করল। ডা. যোশী তাদের সকলকেই ওষুধ দিলেন। কিন্তু কলকাতার আর-এক অভিযাত্রী মৃদুল সরকার বেশ অসুস্থ হয়ে পড়ল। ওষুধেও কমল না তার অস্বস্তি।

গাইড তামাং ঝুঁকি নিতে চাইল না। মৃদুলকে দলের এক শেরপার সঙ্গে বেস ক্যাম্পের দিকে রওনা করিয়ে দিল। ব্যবস্থাপনায় সময় গেল কিছুটা। তারপর, আবার সকলে সামনের দিকে যাত্রা শুরু করল। দু-কিলোমিটারের মতো হেঁটে, আরও দুজন সদস্যের শারীরিক অস্বস্তি বাড়তে থাকল। অদূরে বরফের মধ্যে সুদীর্ঘ পরিখা। অসতর্ক থাকলে তার মধ্যে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও প্রবল। ওই দুজন সদস্য তেমন মানসিক জোর পেলেন না। এক শেরপাকে দ্রুত পাঠিয়ে মৃদুলদের থামিয়ে, তাদের সঙ্গেই এই দুজনকেও বেস ক্যাম্পে পাঠানোর বন্দোবস্ত করল তামাং। ভীষণ শীত আর পায়ের তলায় পুরু বরফ থাকার জন্য হাঁটতে অত্যন্ত কষ্ট হচ্ছিল। সদস্যদের দিকে ফিরে তাকিয়ে তামাং সতর্ক করল, আপনাদের মধ্যে কেউ যদি ফিরে যেতে চান তো এখনই উপযুক্ত সময়। এরপর আমরা বরফের গ্লেসিয়ার পাব। উচ্চতাও বাড়বে। অক্সিজেনের সমস্যাও হবে। মনে রাখবেন, আমরা কিন্তু অক্সিজেন ছাড়াই এই অভিযানে নেমেছি!’

তামাংয়ের সাবধানবাণী শুনে, পুষ্পা যাদব আর রীতা সান্যাল বেঁকে বসল। বেস ক্যাম্পের ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল তারা। ডা. যোশী রিনার কাছে এসে বললেন, ‘এখনও সময় আছে রিনাদেবী। আপনি আর-একবার ভেবে দেখুন।

মৃদু হেসে রিনা জবাব দিল, ‘আমার কোনও অসুবিধা হচ্ছে না ডাক্তাবাবু।’

সকাল আটটা বেজে দশ মিনিটে কামেট শিখরে পৌঁছে গেল অভিযাত্রী দলটি। অন্যান্য অনেক দেশের পতাকা দণ্ড এখনও সেখানে পোঁতা আছে। বরফ আর আবহাওয়ার অত্যাচারে পতাকার রং বেশ ধূসর। ডা. যোশী, তামাং আর ক্যাপ্টেন ডোগরার মুখে তৃপ্তির হাসি খেলে গেল। ডা. যোশী বরফের মধ্যে পুঁতে দিলেন পর্বতারোহী অ্যাসোসিয়েশন এবং দেশের পতাকা। সাফল্যের আনন্দে বিহ্বল হয়ে, এই অনন্ত পৃথিবীর বুকে চারটি আপাতনিঃসঙ্গ চরিত্র পরস্পরকে অভিনন্দনের বন্যায় ভাসিয়ে দিল।

ডা. যোশী হাসিমুখে এগিয়ে এসে রিনার হাত নিজের হাতে নিয়ে বললেন, ‘অভিনন্দন রিনাদেবী। আপনি আমাদের সব আশংকাকে ভুল প্রমাণিত করেছেন।’

‘ধন্যবাদ তো তামাং দাজু পাবে। সে আমাকে প্রতিনিয়ত সাহস জুগিয়ে গেছে, ঠান্ডায় হিহি করে কাঁপতে কাঁপতে কোনওরকমে বলল রিনা।

ক্যাপ্টেন ডোগরা ওয়াকিটকিতে বেস ক্যাম্পে নগেন্দ্র রাইকে বললেন, ‘স্যার, আমরা কামেট শৃঙ্গে পৌঁছে গেছি–!’ তার গলার উচ্ছ্বাস যেন কোনও বাধা মানছিল না।

ওপাশ থেকে নগেন্দ্র রাই জানতে চাইলেন, ‘রিনা মল্লিক সুস্থ আছেন তো?’

‘স্যার, শি ইজ পারফেক্ট.. আমরা তিনজনই সুস্থ আছি!’ ডা. যোশী আড়াচোখে একবার রিনার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে উঠলেন।

ওয়াকিটকি বন্ধ করে দিলেন নগেন্দ্র রাই। খানিক ঈর্ষাও হল তার, সেইসঙ্গে অপমানও। মুখের মতো জবাব দিয়েছে রিনা, এর থেকে বেশি রাগের কারণ কী আর হতে পারে তার কাছে!

কামেট শিখরে অভিযাত্রী দলের সদস্যরা একে অন্যের ছবি ক্যামেরাবন্দি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রিনা তামাংকে বলল, পশ্চিমদিকে বরফের নীচে পড়ে থাকা অস্থি-পাঁজরের ছবি তুলে নিয়ে যাবে।

জাপানের এক সাহসিনী পবর্তারোহী ফু তরিকোর শবদেহ এই বরফের তলাতেই খুঁজে পাওয়া গেল। তার একটি হাতে পরে থাকা সোনার ব্রেসলেটটি তখনও অটুট। ক্যামেরায় ছবি তুলে নিল রিনা। তামাং তাড়া দিল, বরফপাত শুরু হওয়ার আগে বেস ক্যাম্পে ফিরতেই হবে।

বেস ক্যাম্পে সন্ধেবেলা সেলিব্রেশনের খাওয়াদাওয়া সারতে সারতে রিনা রসিকতা করেই বলেছিল, ‘নগেন্দ্রজি, আপনি তো বলেছিলেন, শারীরিক অবস্থার জন্য আমি নাকি শৃঙ্গে পৌঁছোতেই পারব না। কিন্তু আমি পেরেছি!’

নগেন্দ্র রাই উত্তর দেননি।

পরের দিন বরফ ঝড় থামার পরে নীচের দিকে যাত্রা শুরু করল অভিযাত্রী দল। দিল্লিতে পৌঁছোল বারো দিন পরে। প্রশাসনের তরফে স্বাগত জানানোর জন্য কেউ না থাকলেও, পর্বতারোহী সংঘের কর্তারা ছিলেন। সেদিনই নগেন্দ্র রাইয়ের সই করা প্রেস বিজ্ঞিঀ৫ পৌঁছে গেল খবরের কাগজের অফিসে। পরের দিন সকালে বেশ গুরুত্ব দিয়ে ছেপে বের হল খবরটা, আর সবকটা কাগজ খুঁটিয়ে পড়ে, রিনার চোখের জল যেন কোনও বাধা মানতে চাইল না। খবরে অভিযাত্রী দলের সদস্য হিসাবে বাকি সকলের নাম থাকলেও, কোথাও নাম নেই তার। মনের বেদনা ক্রমে ভয়ানক ক্রোধে বদলে গেল। চোখের জল শুকিয়ে ঠিকরে পড়ল আগুন। রিনার নাম তো নেই-ই, এমনকী তামাংয়ের নাম-ও নেই। রাজনীতিটা বুঝতে অসুবিধা হল না রিনার। তামাং শেষ পর্যায়ের অভিযানের গাইড হলেও, রিনাকে সঙ্গে নেওয়ার জন্য নগেন্দ্র রাইয়ের কোপে পড়েছে।

পরদিন থেকেই শুরু হল প্রকৃত যন্ত্রণাটা। অফিসে কিংবা পাড়ায়, যারই সঙ্গে দেখা হয়, সে-ই কৗতূহলী হয়ে নানা কথা জানতে চায়। সকলের কাছে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরতে ধরতে ক্লান্ত হয়ে পড়ল রিনা।

পর্যটন সচিবকে চিঠি লিখল। কিন্তু জানতে পারল, সেই চিঠিও সচিবের টেবিলে পৌঁছোয়নি শেষমেশ। নগেন্দ্র রাই-ই যে-এর পিছনে রয়েছে, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ রইল না রিনার। নানা কারণে কর্তাদের গুডবুকে রয়েছে নগেন্দ্র। ফলে, তার হাতটাও অনেক লম্বা।

কয়েকদিন পরে, অফিসে যেতেই এমডি-র ঘরে ডাক পড়ায় একটু অবাক-ই হয়েছিল সে।

এমডি সামনের চেয়ার দেখিয়ে বসতে বলেছিলেন তাকে। তারপর চশমাটা খুলে কপালে উদ্বেগের রেখা ফুটিয়ে তুলে বলেছিলেন, ‘আপনার জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে।’

‘আপনি খবরের কাগজে ছাপা হওয়া খবরটার কথা বলছেন কি স্যার?’

এমডি চশমাটা পরে নিয়ে বলে উঠলেন, ‘না, না, সেসব নয়। তবে পর্যটন দফতর থেকে আপনার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের তদন্ত চালানোর নির্দেশ দিয়ে ফ্যাক্স এসেছে। সঙ্গে আপনাদের টিম লিডারের অভিযোগপত্রের কপি।’

‘কিন্তু স্যার, আমার সঙ্গে কার্যত প্রতারণা করা হয়েছে। আর এর জন্য টিম লিডার নগেন্দ্র রাই-ই দায়ী, রিনা প্রায় মরিয়া হয়েই বলে ওঠে, ‘আমি কামেট শৃঙ্গে উঠেছি। এই দেখুন তার ছবি। অসংখ্য ছবি তুলেছি, দেখুন না…!’

এমডি শান্ত গলায় বললেন, ‘আমি কী করব বলুন তো! আমার তো হাত-পা বাঁধা। আপনি নিজেই বরং পর্যটন সচিবের সঙ্গে দেখা করুন!’

রিনা বুঝল, এখানে কথা বাড়ানো বৃথা। তার অফিস এ ব্যাপারে হাত ধুয়ে ফেলতে চাইছে। হয়তো খুব শিগগির নানা চার্জে সাসপেনশনের চিঠিও পৌঁছে যাবে তার বাড়িতে।

কিন্তু পর্যটন সচিবের সঙ্গে দেখা করার জন্য এমডি-র পরামর্শ মাথায় ঘুরছিল তার। ইতিমধ্যে খবরের কাগজগুলিতেও তার সাক্ষাৎকার বের হতে শুরু করেছে। পর্যটন সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময় পাওয়াটাও তাই মোটের উপর সহজ হল।

সচিব বললেন, ‘দেখুন ম্যাডাম, নগেন্দ্র রাই তার রিপোর্টে লিখেছেন, আপনি কামেট শিখরে পৌঁছোনইনি। সবচেয়ে বড়ো কথা, ওনার নির্দেশ অমান্য করেছেন।’

‘স্যার, এই ছবিগুলো দেখুন। আর এই ব্রেসলেটটা। এই সবই তো কামেট শৃঙ্গের।’ স্পষ্ট

ভাষায় বলে উঠেছিল রিনা।

সচিব বললেন, ‘কিন্তু, দলের ক্যাপ্টেন যতক্ষণ না সেকথা মানছেন এবং সে ব্যপারে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন, আমরা কী করতে পারি বলুন! আপনি বরং নগেন্দ্র রাইয়ের সঙ্গে দেখা করে ক্ষমা চেয়ে নিন। মানে, একটা ‘সরি’ বলা আর কি! সচিব হাসলেন।

শেষপর্যন্ত নগেন্দ্র রাইয়ের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা! মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না রিনা। খবরের কাগজগুলো এসময় ত্রাতা হয়ে দেখা দিল। মনে হচ্ছিল, যুদ্ধটা যেন তার একার নেই, সকলের। রিনার সমর্থনে রীতিমতো জনমত তৈরি হতে থাকল। পর্বতারোহী সংঘের দফতরে আর সরকারের কাছেও, প্রতিবাদীদের স্বাক্ষরের সংগ্রহ পৌঁছোল হাজারে হাজারে। চাপের কাছে মাথা নত করতেই হল কর্তাদের। নগেন্দ্র রাইয়ের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হল। তার পরেরটুকু ইতিহাস। কামেট শৃঙ্গের মতোই, এই যুদ্ধটাও জিতে গেল রিনা।

সেই সংঘর্ষের আর সহনাগরিকদের ভালোবাসার কথা মনে পড়লে আবেগে চোখে জল চলে আসে আজও। সেরকম বিহ্বলতার মধ্যেই যেন অনেক দূর থেকে কেউ ডাক দিল তার নাম ধরে। যেন অনেক উঁচুতে সর্বোচ্চ শিখর থেকে পর্বতে পর্বতে ধাক্বা খেতে খেতে পৌঁছোল সেই স্বর, ‘আমরা রিনাদেবীকে মঞ্চে আসতে অনুরোধ করছি!’

সেই স্বর যেন বাস্তবে ফিরিয়ে আনল রিনাকে। দূরে ঝাপসা একটা মঞ্চ। সারা হল ফেটে পড়ছে করতালিতে।

বিব্রত রিনা, আর-একটা শৃঙ্গজয়ের দিকে এগোল।

যক্ষের প্রশ্ন

অনুভা বিরক্ত বোধ করছিল। শহরে গাড়ির সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। গাড়ি চালানো দায় হয়ে পড়ছে। আর পার্কিং স্পেস পাওয়া একপ্রকার প্রায় অসম্ভব। হাসপাতালের পার্কিং লট-এও ঘুরে ঘুরে এতক্ষণে গাড়ি পার্ক করতে পারল অনুভা। এত সব কিছু ভাবতে ভাবতে সে হাসপাতালের সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল।

দোতলায় অনুভার বান্ধবী কাম সহকর্মী ভারতী ভর্তি রয়েছে। কিডনির পাথর অপারেশন হয়েছে গতকাল। আজ অনুভা ওকে দেখতে এসেছে।

ভারতীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে কেবিনটার চারপাশে চোখ বোলাল অনুভা। ভারতীকে নিয়ে মোট তিনজন পেশেন্ট রয়েছে। একজন তার মধ্যে বাড়ির লোকের সঙ্গে কথা বলছে, অপরজন চুপচাপ বিছানায় বসে। অনুভার সেদিকে দৃষ্টি পড়তেই খেয়াল করল মহিলাও একদৃষ্টিতে তারই দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওরও চেনা মনে হল। মনে করার চেষ্টা করল অনুভা। মহিলার চোখদুটোও কেমন জানি অস্বাভাবিক উজ্জ্বল হয়ে উঠল অনুভাকে দেখে, যেন বহুদিন পর হঠাৎ করে পরম কোনও আত্মীয়র সঙ্গে দেখা হয়ে গেছে।

দুজনেই দুজনের মনোভাব পড়ার চেষ্টা করে। হঠাৎ-ই অনুভার বিস্মৃতির পরদা সরে গিয়ে পুরোনো কিছু মুখ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মনে মনে চমকে ওঠে অনুভা। পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় ওই মহিলার বিছানার কাছে। অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে, ‘নিভা না?’

ম্লান হাসি ফুটে ওঠে মহিলার ঠোঁটে, ‘চিনতে পেরেছ আমাকে?’

‘তুমি এখানে এই অবস্থায়?’ অনুভা কিছুতেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না। এক মুহূর্ত চুপ থেকে আবার বলল, ‘তোমার কী হয়েছে? আমি তো ভাবতেই পারছি না কোনওদিন তোমাকে এই অবস্থায় দেখতে পাব। কি চেহারা ছিল আর এখন কি চেহারা হয়েছে তোমার। কী করে এমন হল?’

বসে বসে বোধহয় হাঁপিয়ে উঠেছিল নিভা। ক্লান্তিও বোধ করছিল নিশ্চয়ই, অনুভাকে অনুরোধ করল খাটের পিছনের দিকটা উঠিয়ে দিতে যাতে পিঠটা বালিশে এলিয়ে দিতে পারে। ইশারায় অনুভাকে পাশে রাখা চেয়ারটায় বসতে বলল।

‘অনুভা, আমি জানি অনেকগুলো প্রশ্ন তোমার মনে এসে জমা হয়েছে… বুঝতে পারছি না কী করে সবগুলোর উত্তর দেব আর একদিনে এত কথা বলাও যাবে না… হাঁপিয়ে যাই… ফুসফুসের সমস্যা আমার।’

‘তোমার হয়েছে কী, সেটা বলবে?’ অধৈর্য হয়ে ওঠে অনুভা।

‘একটা রোগ হলে তো বলব… যখন একবার দেখা হয়েছে তখন জানতেও পারবে সবকিছু। রোজ এসে আমার কথা শোনার সময় আছে তোমার কাছে?’ ব্যাকুল শোনায় নিভার কণ্ঠস্বর।

‘হ্যাঁ, আমি আসব’, নিভাকে দেখে অনুভার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসতে চাইছিল। ওর খালি মনে হচ্ছিল, জগৎ সংসারে নিভা ছাড়া ওর যেন আর কেউ নেই এবং বেশিদিন ও নিভাকে নিজের কাছে ধরে রাখতে পারবে না। অনুভা, নিভার হাতটা নিজের হাতে চেপে ধরে।

নিভার শরীরে শিহরণ জাগে, নতুন আশার সঞ্চার হয়। এত যুগ বাদে অনুভার কথা শুনে ওর মনে হয় আজও ওর খেয়াল রাখার জন্য কেউ অন্তত আছে। বাঁচার ইচ্ছে হয় নতুন করে।

অনুভা চারপাশটা দেখে আবার প্রশ্ন করে, ‘তোমার সাথে কেউ আছে… মানে তোমাকে দেখাশোনার… তোমার বাড়ির কেউ?’

নিভার দীর্ঘশ্বাস কানে যায় অনুভার, ‘না। কেউ নেই।’

‘কেন বাড়ির লোকজন?’

‘অনুভা, যারা আমার নিজের ছিল তাদের আমি অনেক আগেই ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছি, আর জীবনের চলার পথে যাদের আমি নিজের বলে মনে করে নিয়েছিলাম তারা আমাকে মাঝ রাস্তায় ছেড়ে চলে গিয়েছে। এখন আমি সম্পূর্ণ একাকী। নিজের বলতে কেউ নেই আমার। আজ কত বছর পর তোমার সঙ্গে দেখা। মনে হচ্ছে আবার সেই পুরোনো দিনগুলোয় ফিরে গেছি। এটা কি স্বপ্ন অনুভা… তুমি আবার আসবে তো?’

‘হ্যাঁ, নিভা। আমি আবার আসব। শুধু দেখা করার জন্য নয়, দেখাশোনা করারও তো কাউকে চাই… তোমার হাসপাতালের খরচা কে দিচ্ছে?’

ম্লান হাসিটা আবার নিভার ঠোঁট ছুঁয়ে মিলিয়ে যায়, ‘আছে একজন ভালোবাসার লোক। কিন্তু আমার এই অসুখটার জন্য আমার থেকে সে এতটাই দূরত্ব তৈরি করে নিয়েছে যে হাসপাতালে আমাকে দেখতে একদিনও আসেনি। চাকর গোছের একটা লোককে পাঠিয়ে দেয় যে,

দু-তিনদিন অন্তর এসে হাসপাতালের টাকা আর যা-যা দরকার দিয়ে যায়। ফলে আমার চিকিৎসা ঠিকঠাকই চলছে। আমার ভালোবাসার বদলে এই উপকারটা ও আমার করে যাচ্ছে।’

অনুভা সেদিন তাড়াতাড়িই নিভা আর ভারতীকে বিদায় জানিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে বেরিয়ে আসে কারণ অফিস থেকে ছুটি নিয়েই ও ভারতীকে দেখতে গিয়েছিল সুতরাং অফিসে ফেরার দরকার ছিল। অফিসে কিছু কাজে মন বসাতে পারল না। খালি নিভার মুখটা মনে পড়ছিল আর কলেজের দিনগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।

একই বিষয় ছিল কলেজে ওদের দুজনের। দুজনেই শিক্ষিত পরিবারের মেয়ে। অনুভার বাবা ছিলেন আইএএস অফিসার আর নিভার বাবা আর্মিতে উচ্চপদস্থ পদে ছিলেন। দুজনেই বন্ধু ছিলেন এবং কলেজে অনুভা এবং নিভার বন্ধুত্ব বেশ গাঢ় হয়। অনুভা ছিল ঘরোয়া এবং পারিবারিক সংস্কার মেনে চলার মতো মানসিকতা ছিল অনুভার। অথচ নিভা ছিল ঠিক বিপরীত। সমস্ত নিয়মবিরুদ্ধ কাজ করাই ছিল নিভার চরিত্রের বিশেষত্ব। সম্ভবত আর্মি লাইফস্টাইলের স্বাচ্ছন্দ্য এবং স্বাধীনতায় পরিবেশে বড়ো হওয়ার জন্য নিভার স্বভাব এইভাবেই গড়ে উঠেছিল।

নিভার স্বপ্ন ছিল বড়ো অফিসার হওয়ার। অনুভার জানা ছিল না নিভা বাস্তবে কতটা সাফল্য পেয়েছে। তবে নিভা বরাবরই বিয়ে করার বিরুদ্ধে ছিল কেননা ওর মনে হতো বিয়ে মানেই অপরের দাসত্ব করা। তখন মাঝেমধ্যে লিভ ইন রিলেশনশিপ নিয়ে কলেজের আড্ডাগুলোয় ঝড় উঠত। নিভা-কে সেখানে ব্যাপারটাকে সাপোর্ট করতেই দেখেছে অনুভা। এছাড়াও অনুভা জানত কলেজের দুই তিনজন ছেলের সঙ্গে নিভার ঘনিষ্ঠতার কথা।

অনুভা নিভাকে বহুবার বুঝিয়েছে লাইফ-টা এইভাবে নয়ছয় না করার জন্য কিন্তু নিভা এতে অনুভাকে উপহাসই করেছে। শেষে অনুভাই হেরে গিয়ে সরে গিয়েছে। কলেজ শেষ করে দু’জনে আলদা হয়ে নিজেদের পথ বেছে নিয়েছে। অনুভা সরকারি পরীক্ষায় পাস করে আজ কেন্দ্রীয় সরকারে অফিসার পদে বহাল। ভালো পরিবারে বিয়ের পর এখন অনুভা দশ বছর বয়সি মেয়ের মা। অথচ এই পনেরো বছরে নিভার কোনও খবরই অনুভার কাছে ছিল না। সুতরাং ওর-ও মনে প্রবল আগ্রহ ছিল জানার এতগুলো বছর নিভা কীভাবে কাটিয়েছে যে আজ ওর এই দুর্দশা।

পরের দিন অফিস করে অনুভা হাসপাতাল যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ল। স্বামী আর মেয়েকে আগেই বলে রেখেছিল দেরি করে বাড়ি ফিরবে। অনুভা-কে দেখেই নিভার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, হয়তো ও ভেবেই বসেছিল অনুভা আসবে না। ফল নিয়ে গিয়েছিল অনুভা। মাথার কাছে রাখা টেবিলটায় নামিয়ে রেখে টুল-টা টেনে বসল নিভার সামনে। ওর হাত দুটো নিজের হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘আজ কেমন শরীর তোমার?’

হাসি ফুটে উঠল নিভার মুখে। আনন্দের হাসি। উত্তর দিল, ‘মনে হচ্ছে এবারের মতো বেঁচে যাব।’

রাতে হিমাংশু বাড়ি ফিরলে, অনুভা নিভার কথা সব খুলে বলল স্বামীকে। পরের দিন ওরা দু’জনেই হাসপাতালে গেল নিভাকে দেখতে। হিমাংশু নিভার ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে ওর শরীর সম্পর্কে খোঁজখবর করতে জানতে পারল, নিভার শুধুমাত্র ফুসফুস নয়, অত্যধিক মদ্যপান এবং স্মোকিং-এর জন্য ওর কিডনি এবং লিভারও ক্ষতিগ্রস্ত। অনুভাও নিভা সম্পর্কে অতশত জানত না, হিমাংশুর মুখ থেকে সব জানতে পেরে ও বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল।

এরপর থেকে অনুভা নিয়মিত নিভার দেখাশোনা আরম্ভ করে দিল। বাড়ি থেকে খাবার বানিয়ে অফিস বেরোবার আগে নিভাকে দিয়ে আসত। অফিস ফেরত-ও হাসপাতাল হয়ে বাড়ি ফিরত। ওর জন্য আলাদা করে আয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল অনুভা। এছাড়াও ডাক্তারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হিমাংশু বজায় রেখে দিয়েছিল, ফলে চিকিৎসাটাও সঠিক দিশায় মোড় নিল।

প্রায় একমাস লেগে গেল নিভার মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠতে। ডাক্তার জানাল ওকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যেতে পারে তবে ওষুধপত্র এখন চলবে।

বাড়ি যাওয়ার দিন অনুভা আর হিমাংশু দুজনেই এল হাসপাতালে নিভার সঙ্গে দেখা করতে। হঠাৎই অনুভার মনে হল নিভা এখনও যথেষ্ট সুন্দরী যদিও অসুস্থ অবস্থায় থাকাকালীন নিভার চেহারা এতটা মনোযোগ দিয়ে দেখেনি অনুভা। তবে উদাস মনে হল নিভাকে। অনুভা জিজ্ঞেস করল, ‘বাড়ি যাচ্ছ… এত মনমরা হয়ে বসে আছো কেন? তোমার তো খুশি হওয়া উচিত।’

উদাস দৃষ্টি মেলে ধরল নিভা, ‘বাড়ি… কার বাড়ি? আমার কোনও বাড়ি নেই।’

‘কেন? তোমার সেই বন্ধু যে তোমার চিকিৎসা করাচ্ছিল…’

ম্লান হাসির রেখা ফুটে উঠল নিভার ঠোঁটে, ‘যে মানুষ আমাকে দেখতে একটিবারও হাসপাতালে এল না, যে জানে আমার শরীরটা তার আর কোনও কাজে আসবে না, সেই লোকটা আমাকে তার বাড়িতে রাখবে?’

‘তাহলে ও কেন তোমার চিকিৎসা করাচ্ছিল?’

‘এই একটাই উপকার ও করেছে। হয়তো আমার ভালোবাসার ঋণটা ও এইভাবে মিটিয়ে ফেলতে চেয়েছে। লোকটা খুব ধনী। একটা অসুস্থ রোগীকে বাড়িতে রেখে ওর কী লাভ যেখানে টাকা ছড়ালেই এমন শয়ে শয়ে সুন্দরী মেয়েরা ওর কাছে এসে ভিড় করবে। আমি নিজেও ওর কাছে ফিরে যেতে চাই না কারণ পুরুষ সমাজ-টাকে আমি ভালো করে চিনে নিয়েছি। যদি কোনও মেয়েদের আশ্রম থাকে, আমি সেখানেই যেতে চাই’, আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে কথাগুলো বলে নিভা হাঁপাতে থাকে।

অনুভাও একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায়। কী করবে বুঝতে না পেরে হিমাংশুর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে যায়। পরক্ষণেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দৃঢ় কণ্ঠে বলে, ‘ঠিক আছে তোমাকে কোথাও যেতে হবে না, তুমি আমার বাড়িতে থাকবে।’

‘তোমার বাড়িতে?’ বিশ্বাস করতে পারে না নিভা নিজের কানকে।

‘হ্যাঁ, আমার বাড়িতে। ব্যস আর কোনও প্রশ্ন নয়, চলো এবার।’

অনুভাদের চার বেডরুমের যথেষ্ট বড়ো ফ্ল্যাট। একটা রুমে ওরা নিভার থাকার ব্যবস্থা করে দিল। অনুভা আর হিমাংশুর ব্যবহারে নিভা এতটাই অভিভূত হয়ে পড়েছিল যে ধন্যবাদের একটা শব্দও ওর মুখ থেকে বেরোল না।

আর্মির পরিবেশে নিভা বড়ো হয়েছিল। বাড়িতে মদ, পার্টি এসবের কোনও কমতি ছিল না। বাড়িতে পার্টি না হলেও, রোজই নিভার বাবা ক্লাব থেকে ড্রিংক করেই ফিরতেন। মা-ও পার্টিগুলোতে ড্রিংক করতেন। সুতরাং এই পরিবেশেই নিভা শৈশব পার করে যৌবনে পড়েছিল। এটাই ওর মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। যৌবনে পড়তে পড়তেই নিভার মদ এবং সিগারেটে একটা আসক্তি তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

সরকারি চাকরির জন্য তৈরি হতে কোচিং ক্লাসে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছে ছিল নিভার। সেইমতো মা-বাবাকেও জানিয়েছিল নিভা।

‘মা, আমি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য তৈরি হতে চাই। কোচিং ক্লাসের খোঁজ নিয়েছি। যাদবপুর ইউনিভার্সিটির কাছে।’

ব্যারাকপুর থেকে ‘অত দূরে যাবি রোজ কী করে? কাছে কিছু নেই?’ নিভার মা-কে চিন্তিত শোনাল।

‘ভাবছি ক্লাসের আশেপাশে পিজি-তে থেকে যাব’, নিভা উত্তর দেয়।

‘বাড়ি থাকতে পিজি-তে থাকবি?’

এতক্ষণ নিভার বাবা চুপচাপ সবকিছু শুনছিলেন। এবার স্ত্রী-কে থামিয়ে বলে ওঠেন, ‘বোকার মতো কথা বলছ কেন? রোজ যাতায়াতেই যদি সময় চলে যায় তাহলে পড়বে কখন? এছাড়া ও যথেষ্ট স্মার্ট। ইচ্ছে হলেই বাড়ি চলে আসবে। আমরাও দেখা করতে চাইলে চলে যাব। অসুবিধাটা কোথায়?’

নিভার মা চুপ করে যান। বাপ, বেটি রাজি মানে মেয়েকে কেউ আটকাতে পারবে না, সেটা উনি ভালো ভাবেই জানেন। সুতরাং কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। এক বছরের কোর্সে নিভা ভর্তি হয়ে গেল এবং বাড়ি ছেড়ে পিজিতে থাকতে শুরু করল। নিভা সুন্দরী, স্মার্ট সুতরাং কোচিং-এও ও বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল। বেশিরভাগ ছেলে-মেয়েরাই ওখানে পয়সাওয়ালা পরিবার থেকে। সুতরাং প্রায় দিন পার্টি মজলিস লেগেই থাকত। আর নিভাও ধীরে ধীরে প্রতিটা পার্টির মক্ষীরানি হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে পছন্দের ছেলেদের সঙ্গে রাত কাটাতেও শুরু করল নিভা।

নিভার খবর ওর মা-বাবার কাছেও বেশিদিন চাপা থাকল না। তারা মেয়েকে পিজি ছাড়িয়ে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার অনেক চেষ্টা করলেন কিন্তু মেয়ের এক গোঁ, ‘কোচিং শেষ হলে তারপর বাড়ি ফিরব।’

নিভার মা কঠোর হলেন, ‘নিভা তুমি যা যা করে বেড়াচ্ছ তাতে কি মনে হয় তুমি কোচিং-এর পড়া শেষ করতে পারবে? পড়া শেষ হলেও কম্পিটিশনের জন্য তৈরি হওয়া দরকার। আর তার জন্য পড়াশোনা করতে হবে, ছেলেদের হাত ধরে সারাদিন ঘুরে বেড়ালে কিছুই হবে না।’

‘মা, প্লিজ। বাবাকে একটু বুঝিয়ে বলো। আর তো কটা মাস’, মায়ের কথা না শোনার ভান করে নিভা।

‘না, তা হবে না নিভা। তোমার কথা শুনে তোমার বাবা খুব দুঃখ পেয়েছেন। আমি ওনাকে কিছু বলতে পারব না। তুমি যদি নিজের ইচ্ছে মতো চলতে চাও তাহলে আমরা টাকাপয়সা দেওয়া সব বন্ধ করে দেব। তারপর যা ইচ্ছে হয় তাই কোরো।’

অতএব নিভাকে নিজের বাড়ি ফিরে আসতে হয়। কিন্তু বাড়িতে হাজার প্রতিবন্ধকতা থাকাতে মনে মনে ও অধৈর্য হয়ে পড়তে থাকে। বুঝতে পারত, মা ওর উপর সারাক্ষণ নজর রাখছে।

যারা এতদিন মক্ষীরানিকে ঘিরে ছিল তারাই ওকে প্রলোভন দিতে শুরু করল। বাড়ি ছেড়ে চলে আসলে ওর প্রয়োজনীয় সব কিছু ভার এমনকী থাকা-খাওয়া-অর্থ সব তারাই বহন করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিল নিভাকে।

নিভা বুদ্ধি দিয়ে কোনওকিছুই বিবেচনা কোনওদিন করেনি, আজও তার অন্যথা হল না। একবারও মা-বাবা বা নিজের ভবিষ্যৎ ভাবল না। বন্ধুদের দেখানো প্রলোভনটাই ওর কাছে বড়ো হয়ে দাঁড়াল। একদিন মা-বাবার অনুপস্থিতিতে নিভা নিজের জামাকাপড় এবং সামান্য টাকাপয়সা নিয়ে বাড়ি ছেড়ে বন্ধুর বাড়ি গিয়ে উঠল। বন্ধুরা আগেই ওর জন্য ফ্ল্যাট দেখে রেখেছিল সুতরাং নতুন ফ্ল্যাটে শিফ্ট করতে দেরি লাগল না।

নিভার মা-বাবা নিজেরা যতটা পারলেন খোঁজাখুঁজি চালালেন কিন্তু আর্মি মহলে বদনাম হয়ে যাওয়ার ভয়ে পুলিশে রিপোর্ট লেখালেন না তাহলে হয়তো নিভার খোঁজ পাওয়া অসুবিধা হতো না। আবার এমনও হতে পারে তাঁরা উচ্ছৃঙ্খল জীবনে অভ্যস্ত মেয়ের জীবন থেকে সরে যাওয়াই সব দিক থেকে শ্রেয় বুঝতে পেরেছিলেন তাই মেয়েকে ফিরে পাওয়ার এবং সঠিক পথে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার আশা পুরোপুরি ত্যাগ করেছিলেন।

 

নিভাও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পার্টি, নতুন নতুন বন্ধু নিয়ে ফ্ল্যাটে রাত কাটানো, এই ধরনের উচ্ছৃঙ্খল জীবনে নিজেকে অভ্যস্ত করে তুলল। তার শরীরের দুর্নিবার আকর্ষণে ধনী পরিবারের ছেলেরা ওর শরীরের বিনিময়ে ওর সব খরচ নিজেরাই বহন করে দিত। কিন্তু কতদিন চলত এইভাবে? ফুলের মধুও ধীরে ধীরে কমে আসতে শুরু করল। একটা দুটো করে মৌমাছি অন্য ফুলে আকৃষ্ট হতে আরম্ভ করল। তাছাড়া কোচিং ক্লাস শেষ হতেই অনেকে পরীক্ষার জন্য তৈরি হওয়ার বাহানায় আসা কমিয়ে দিল বা বন্ধ করে দিল। রসদে টান পড়তেই নিভার চেতনা ফিরল। বন্ধুদের জিজ্ঞাসা করলেই উত্তর পেত, ‘ব্যস্ততা বাড়ছে, সময় এভাবে আর কত নষ্ট করা যায়? তুই এবার নিজেও কিছু একটা কর কারণ বেঁচে থাকতে টাকার দরকার।’ অনেকেই পরামর্শ দিত, মা-বাবার কাছে ফিরে যেতে যেটা নিভার কাছে অসম্ভব ছিল।

 

কৃষ্ণেন্দুকে নিভা সবথেকে ভালো বন্ধু বলে মনে করত। ওকে একদিন নিভা বলল, ‘কৃষ্ণেন্দু, আচ্ছা বলতো তোদের সঙ্গে বন্ধুত্ব রাখার জন্য আমি আমার বাড়ি, মা-বাবা সব ছেড়ে চলে এলাম। আর তোরা এক এক জন করে আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছিস। এখন তাহলে আমার কী হবে?’

 

‘নিভা, আমি যেটা বলব তোর সেটা শুনতে ভালো লাগবে না। কিন্তু আসল সত্যিটা হল, তুই আমাদের বন্ধুত্বের জন্য নয়, নিজের সুখ এবং স্বার্থের জন্য বাড়ি ছেড়ে এখানে চলে এসেছিস। বিনা স্বার্থে এখানে কেউ কারও জন্য কিছু করে না। স্বার্থসিদ্ধি হয়ে গেলে সবাই সরে যায় যেটা তোর ক্ষেত্রে এখন হচ্ছে।’

কৃষ্ণেন্দুর কথা শুনে নিভার কাঁদতে ইচ্ছে করে কিন্তু কারও সামনে চোখের জল ফেলা নিভার পক্ষে সম্ভব নয়। ভবিষ্যতের কথা ভেবে অবসাদ ঘিরে ধরে নিভাকে। বুঝতে পারে না ও এখন কী করবে?

‘আমি এখন কী করব কৃষ্ণেন্দু?’ কান্নাভেজা স্বরে নিভা প্রশ্ন করে, ‘এ আমি কী করে বসলাম?’

‘যৗবনে বহু মেয়েই এভাবে ভেসে যায় যার জন্য পরে তাদের অনুতাপ, অনুশোচনার অন্ত থাকে না।’

‘কৃষ্ণেন্দু, তুইও তো কোনওদিন আমাকে বোঝাসনি, অথচ তোকেই অমি আমার সবথেকে ভালো বন্ধু বলে মনে করতাম।’

কৃষ্ণেন্দু হাসে, ‘কী বোকার মতো কথা বলছিস নিভা? তুই কোনওদিন কোনও একটা ছেলেকে নিয়ে সন্তুষ্ট থেকেছিস? মদের অভ্যাস এবং সেক্স-এর ক্ষিদে তোর ভেতরকার মানুষটাকে কবেই মেরে দিয়েছে। এক সঙ্গে এতগুলো ছেলের সঙ্গে তোর প্রেমের সম্পর্ক, তো কোন ছেলেটা তোর সঙ্গে নিষ্ঠার সঙ্গে প্রেম করবে বলতে পারিস? সবাই আসলে তোর শরীরটাকে ভোগ করতে চেয়েছে। ভোগ করেছে, ছেড়ে চলে গেছে। সবার সঙ্গেই শুয়েছিস সুতরাং শুধু একটা ছেলের কাছ থেকে সত্যিকারের অটুট সম্পর্কের দাবি তুই কি করে করতে পারিস?’

কৃষ্ণেন্দুর কথাগুলো তিক্ত হলেও কঠোর বাস্তব সেটা নিভা বুঝতে পারছিল। হঠাৎ কৃষ্ণেন্দুর হাত দুটো চেপে ধরে নিভা, ‘কৃষ্ণেন্দু আমি ভুল করেছি। সব বন্ধুরা ছেড়ে চলে গেছে। তুই প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাস না।’

কৃষ্ণেন্দু হাত ছাড়িয়ে নেয়। ‘না-রে নিভা আমার পক্ষে তোর সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। এক বছর আমার নষ্ট হয়েছে। পরীক্ষায় পাস করতে পারিনি, বাড়িতেও সকলে খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছে। এই বছর পাস করতেই হবে, কেরিয়ারের প্রশ্ন। সরি নিভা।’

নিভা এসে আবার কৃষ্ণেন্দুর হাত ধরে, ‘কৃষ্ণেন্দু প্লিজ। আমি সত্যিই তোকে ভালোবাসি। আমি জানি আমার জীবনে বহু ছেলে এসেছে কিন্তু বিশ্বাস কর যখনই মন খারাপ হয়েছে তখনই তোরই কথা মনে হয়েছে। আমাকে এভাবে ছেড়ে যাস না।’

‘বোঝার চেষ্টা কর নিভা। তোকে ছেড়ে না গেলে আমার ভবিষ্যৎ পুরো ডুবে যাবে। আগে আমাকে জীবনে দাঁড়াতে দে।’

‘কৃষ্ণেন্দু, ভালোবাসার ভিক্ষে আমি চাইছি না। চুটিয়ে প্রেম করেছি, সেক্সলাইফ-ও এনজয় করেছি কিন্তু পেটের খিদের কাছে হার মানতেই হয়। আমার অর্থ উপার্জন করার কোনও পথ নেই। আমার ভালোবাসার বদলে এইটুকু উপকার অন্তত করে দে, থাকার জন্য একটা ঘর আর পেট চালাবার জন্য একটা যে-কোনও কাজ। বেশ্যাবৃত্তি আমি করতে পারব না।’ নিভার স্বরে কাকুতি ঝরে পড়ে।

মেয়েটাকে দেখে মায়া হয় কৃষ্ণেন্দুর। আর সকলের মতো মুখ ঘুরিয়ে নিতে পারে না। একটু ভেবে জিজ্ঞস করল, ‘প্রাইভেট চাকরি করতে পারবি?’

‘হ্যাঁ, এছাড়া উপায়ই বা কী আছে?’

‘তাহলে ঠিক আছে। তুই এই ফ্ল্যাটেই থাক। যতদিন না চাকরি হয় আমি ভাড়া দিয়ে দেব। বাবাকে বলে কোথাও একটা তোর চাকরির ব্যবস্থা করছি।’

‘আমি তোর উপকার কোনওদিনও ভুলব না।’ কৃষ্ণেন্দু কিছু একটা ভাবল তারপর বলল, ‘তুই কেন বাড়িতে চলে যাচ্ছিস না কাকু, কাকিমা-র কাছে?’

নিভা, কৃষ্ণেন্দুর কাছ থেকে এই প্রশ্ন আশা করেনি। আশ্চর্য হল, পালটা বলল, ‘কী মুখ নিয়ে যাব? কী বলব ওদেরকে যে এতদিন আমি কী করেছি। না কৃষ্ণেন্দু, আমি ওখানে যেতে পারব না। ওখানে গিয়ে ওদেরকে নতুন কোনও সমস্যায় আমি ফেলতে পারব না।’

কৃষ্ণেন্দু, বাবাকে বলে নিভাকে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে ব্যবস্থা করে দিল চাকরির। তবে যে ধরনের লাইফস্টাইলে নিভা অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল, সেটা মেনটেন করার জন্য চাকরির টাকা যথেষ্ট ছিল না। উদ্দাম সেক্সলাইফ থেকে সরে এলেও নিভা মদ আর সিগারেটে আসক্তি ছাড়তে পারল না। একাকিত্ব ওকে কুরে কুরে খেতে লাগল। মা-বাবার কথা, পুরোনো সব কথা মনে পড়লেই ও মদের বোতল খুলে বসত, সবকিছু ভুলতে চাইত।

কৃষ্ণেন্দু যখনই আসত, নিভার অবস্থা দেখে ওকে সাবধান করার চেষ্টা করত, ‘এত খাস না নিভা, অসুস্থ হয়ে পড়বি।’

‘ভীষণ ভয় করে কৃষ্ণেন্দু, একাকিত্ব আমাকে গ্রাস করতে আসে’, নিভার চোখ ছলছল করে।

‘ভালো কথা বলছি নিভা, এভাবে একা একা থাকিস না। বাড়ি ফিরে যা। দেখবি কাকু-কাকিমা তোকে ঠিক ক্ষমা করে দেবেন’, কৃষেন্দু বোঝানোর চেষ্টা করে।

নিভার সেই একই উত্তর, ‘কোন মুখে ফিরব ওদের কাছে? ওরা আমাকে নিয়ে কী কী ভেবেছিল আর আমি কি হয়েছি… ক্ষমা হয়তো করে দেবে ঠিকই কিন্তু সমাজে তারা মুখ দেখাবে কী করে?’

‘কেন, এখনও তো তারা সমাজে মেলামেশা করছেন, তখনও করবেন’, প্রত্যুত্তরে বলে কৃষ্ণেন্দু।

‘হয়তো তারা আমাকে মৃত ভেবে নিয়েছেন। তুই ওদের চিনিস না। ওরা যদি আমাকে ক্ষমাই করে দিত তাহলে এতদিনে আমাকে ঠিক খুঁজে বার করত। এটা এমন কিছু মুশকিলের ছিল না। বরং আমার মনে হয় ওরা পুলিশে রিপোর্ট পর্যন্ত লেখাননি।’ কৃষ্ণেন্দুর এত বোঝানোর পরেও নিভার সেই একই গোঁ।

এরপর ধীরে ধীরে কৃষ্ণেন্দুর আসাও কমতে লাগল যত পরীক্ষা কাছাকাছি আসতে আরম্ভ করল। কৃষ্ণেন্দুর পরীক্ষাও দেওয়া হয়ে গেল এবং যথারীতি সিভিল সার্ভিস-এর পরীক্ষায় পাস করে গেল।

লখনউ-তে ট্রেনিং সুতরাং কৃষ্ণেন্দু নিভার সঙ্গে দেখা করে বিদায় জানাতে এল।

নিভা ভিতরে ভিতরে পুরোপুরি ভেঙে পড়ল এবার, ‘তুই এবার পুরোপুরি আমার থেকে দূরে চলে যাচ্ছিল। আর কোনওদিন কি আমাদের দেখা হবে কৃষ্ণেন্দু?’

‘নিভা, এক বছরে মানুষের মধ্যে অনেক পরিবর্তন আসে। ট্রেনিং চলাকালীন আমি আর আসতে পারব না। এভাবে জীবনটা নষ্ট করিস না। যতটা নীচে নামার নেমেছিস, এবার উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা কর। অফিসে ভালো স্যালারি পাচ্ছিস, কাউকে বিয়ে করে সংসারে মন দে। আমি যতটা পারব সাহায্য করব।’

নিভা উত্তর দিল না। কৃষ্ণেন্দু লখনউ চলে গেল। চিন্তা করাও ছেড়ে দিল নিভা, সময় এবং ভবিতব্যের হাতে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণ করে দিল। যারা নিভাকে চিনত তারা বেশ বুঝতে পারল নিভা নিজেকে শোধরাবার কোনও চেষ্টাই করছে না, বাঁচার ইচ্ছেটাই যেন ও ছেড়ে দিয়েছে।

এই ভাবেই কয়েক বছর কেটে গেল। কৃষ্ণেন্দু ভালো ভাবে সেটেল করে গেল। মাঝেমধ্যে শহরে এলেও ইচ্ছে করেই হয়তো নিভার সঙ্গে দেখা করত না কিন্তু প্রত্যেক মাসে নিভার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দশ হাজার করে টাকা জমা করে দিত যাতে নিভার কোনওরকম অসুবিধা না হয়।

নিভা বিয়ে করবে না ঠিকই করে নিয়েছিল। ও ভালো করেই জানত কৃষ্ণেন্দুকে ও কোনওদিনও পাবে না কিন্তু মনে একটা আশা টিমটিম করে জ্বালিয়ে রেখেছিল। অপেক্ষা যত লম্বা হচ্ছিল নিভার মদের মাত্রা ততই বাড়তে থাকছিল। একদিন কানে এল, কৃষ্ণেন্দু বিয়ে করে নিয়েছে। সামান্য আশাটুকুও ভেঙে গেল নিভার। মদ আর সিগারেটে নিজেকে পুরোপুরি ডুবিয়ে দিল ও। ওর এমন অবস্থা হল, রোজ অফিস যাওয়াটাও ওর পক্ষে সম্ভবপর হতো না।

সরাসরি কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গে ওর আর কোনওরকম সম্পর্ক ছিল না। কৃষ্ণেন্দুর বাবার ঠিক করে দেওয়া একটা চাকর গোছের লোক নিভার খোঁজখবর নিতে আসত। ওর কাছ থেকেই নিভা কৃষ্ণেন্দুর কথা জানতে পারত আর সম্ভবত ওই, কৃষ্ণেন্দুকে নিভার সব খবর জানাত।

অতিরিক্ত মদ এবং সিগারেট খাওয়ার ফলে নিভা অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগল। কৃষ্ণেন্দুর বাবার চাকর প্রায় রোজই আসত ওকে দেখতে। ওরই সামনে একদিন নিভার রক্তবমি হল। ওই নিভাকে সঙ্গে নিয়ে এসে সরকারি হাসপাতাল ভর্তি করে দিল।

মেডিকেল রিপোর্টে ধরা পড়ল অত্যধিক মদ এবং সিগারেট খাওয়ার জন্য নিভার কিডনি, লিভার, ফুসফুস সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কৃষ্ণেন্দু ওই লোকটির মাধ্যমে হাসপাতালের সব খরচ বহন করতে লাগল কিন্তু একটিবারও নিভাকে দেখতে নিজে হাসপাতালে এল না।

চিকিৎসায় কোনও ঘাটতি রাখতে দেয়নি কৃষ্ণেন্দু ঠিকই কিন্তু ভালো ভাবে চিকিৎসা চলতে থাকলেও নিভার উপকার খুব একটা হচ্ছিল না ডাক্তাররা বেশ বুঝতে পারছিলেন। ওর মনের বোঝাটাই শরীরের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শরীরের জন্য নয়, মনের কষ্টটাই ওকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছিল ধীরে ধীরে। নিভার যখন এই অবস্থা, ঠিক তখনই আশীর্বাদের মতোই নিভার জীবনে অনুভার প্রবেশ। নিভার নতুন জীবনের সূত্রপাত অনুভার হাত ধরেই সুস্থ হয়ে নিভা অনুভার বাড়িতে এসে গেল ঠিকই কিন্তু একটাই অস্বস্তি ওর মনের মধ্যে খচখচ করে বিঁধতে লাগল, কতদিন এভাবে আশ্রিত জীবনযাপন করবে?

মহাভারতে যক্ষের প্রশ্নের উত্তর দিতে না পারায় যুধিষ্ঠিরের কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের একে একে মৃত্যু বরণ করে নিতে হয়েছিল। ঠিক সেরকমই নিভার জীবনেও একটাই প্রশ্নের কোনও উত্তর ছিল না। এরপর কী হবে নিভার জীবনে? পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে অসুখে ভুগে নিভার সৗন্দর্যের ধার অনেকটাই কমে এসেছিল, চাকরিও চলে গিয়েছিল আর কৃষ্ণেন্দুর সঙ্গেও সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল।

অনুভার স্বামী হিমাংশু সরকারি দফতরে উঁচু পদে ছিলেন। তিনি চেষ্টা করে নিভাকে একটি সংস্থার কাজ জুটিয়ে দিলেন। সংস্থাটি অনাথ বাচ্চাদের দেখাশোনা এবং শিক্ষাদানের কাজ করত। আরও কিছুদিন অনুভার কাছে থেকে অনুভার চেষ্টাতেই নিভা একটা ছোটো ফ্ল্যাট খুঁজে নিল। ঘরদোর মোটামুটি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করিয়ে নিয়ে অনুভাকে সঙ্গে করে নতুন ফ্ল্যাটে চলে এল নিভা। দু’দিন নিভার কাছে কাটিয়ে অনুভা নিজের বাড়ি ফেরার জন্য তৈরি হয়ে নিল।

‘আমি আবার একা হয়ে যাব, অনুভা।’

‘না, তুমি একলা নও। আমরা সবাই তোমার সঙ্গে আছি। আগে স্বার্থসিদ্ধির জন্য তেমার সো-কলড বন্ধুরা তোমাকে ঘিরে থাকত, তাই তোমার পতনটাও তাড়াতাড়ি হয়েছিল। এখন তোমার জীবনের একটা লক্ষ্য রয়েছে, বাচ্চাদের জন্য সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরি করা। লক্ষ্য স্থির রেখে যদি অতীতের কথা চিন্তা করো তাহলে দেখবে একা রাস্তা চললেও কখনও ভুল রাস্তায় পা ফেলবে না’, অনুভা আশ্বাস দেয়।

লজ্জা পেয়ে নিভা মুখ নামিয়ে নেয়। অনুভা ওর মুখটা তুলে ধরে। নিভার চোখে জল। বহু বছর পর নিভার চোখ থেকে আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ে।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব