বৃষ্টি বৃষ্টি

আজ সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে অঝোরে।

আকাশে কালো ঝাঁক মেঘ। বৃষ্টির দাপটে আর হাওয়ার ভারে কোথায় কোন দিকে চলে যাচ্ছে বোঝা মুশকিল। সকাল গড়িয়ে দুপুর হল ভিজতে ভিজতে, দুপুর গড়িয়ে বিকেলের মুখোমুখি অন্ধকার নামল। পুরো শহরটা বৃষ্টিতে ঝাপসা, তার ভেতরেই চলছে বাস, ট্রাম। ছাতা মাথায় লোকজন, বৃষ্টি বলে কাজ থেকে কোনও ছুটি নেই। তবে সব দৃশ্যাবলি পালটে গেছে! মনে হচ্ছে, অচেনা শহর যেখানে সব সময় বৃষ্টি হয়, খানিকটা চেরাপুঞ্জির মতন। কলকাতা তবে অঝোর বর্ষণে চেরাপুঞ্জি হল? হোক না। পালটে যাক সবকিছু– প্রকৃতি, শহরের ধুলোমাটি, মানুষজন।

গড়িয়াহাট থেকে ত্রিকোণ পার্কের রাস্তার কোনায় এই দোতলা রেস্তোরাঁ। দোতলায় জানলার ধারে বসে আছে শ্রেয়া। বৃষ্টিভেজা চেনা শহর সামনে। না, ঠিক চেনা নয়, নতুন শহর। ভেজা ট্রাম, বাস, ট্রাম লাইনে বুলেভার্ডের নাম জলে ডুবে গেছে। ডোবা ট্রাম লাইন, একটা ট্রাম দাঁড়িয়ে গেছে, এগোচ্ছে না, জল নামলে এগোবে। বুলেভার্ডের জলে মনে হচ্ছিল, এই শহরের গায়ে বড়ো নদী থেকে বান এসেছে। তার এখানে আসার পরে সন্ধে নেমেছে, মনে হচ্ছে, বেশ রাত। তাকে হাওড়ায় কদমতলায় ফিরতে হবে, অত দূরের গাড়ি পাওয়া একটু অনিশ্চিত এই ঝাম বৃষ্টিতে।

নীলেশের দেখা নেই, হয়তো আসবে না, বসিয়ে রাখবে।

যতটুকু সে জেনেছে, আজকাল তার আড্ডাখানা খালাসিটোলায়, মদে টালমাটাল হলেই সে নিজের মধ্যে নিজেকে ফিরে পায়। কোনও দিন ফ্রি স্কুল স্ট্রিটের ওদিকের বারের ছোটো নাচনি জুটে যায়। কোনও দিন গার্ডেনরিচের জুয়োর আড্ডা থেকে ফিরতে ফিরতে রাত ফুরোয়। সব কিছু খুইয়ে ওটাই খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরেছে নীলেশ। এমন পুরুষের ছায়াগ্রহ থেকে বেরিয়ে অনেকটা স্বস্তি পেয়েছে শ্রেয়া। প্রথমে সংকোচ, কষ্ট, লজ্জা ছিল, এখন কিছু নেই।

এই রেস্তোরাঁয় আসা নতুন নয়। যখন ওদের দু’জনের জানাচেনা, তখন থেকে। নীলেশ একটা পেন্টস্ কোম্পানির সেলসের নীচুতলার অফিসার ছিল। সপ্রতিভ, স্মার্ট চেহারা, মুখে অনর্গল বাংলা, ইংরেজি, কিছুটা হিন্দি। শ্রেয়া হাওড়ার বেলিলিয়াস রোডে একটা নামি ইংলিশ মিডিয়াম গার্লস স্কুলের টিচার। স্কুল রং করাবার টেন্ডারে নীলেশ এসেছিল। প্রিন্সিপালকে খুব স্মার্টভাবে রাজি করিয়েছিল। শ্রেয়ার দেখাশোনার মাধ্যমে কাজটি।

প্রথম পরিচয়টুকু যখন গাঢ় হল, টেন্ডারের লাভ-ক্ষয়ের পাওনাটুকু ওদের লুকোচুরি দিয়ে আরও এত কাছে এনেছিল, মনে হয়েছিল, ইট কাঠের বাড়ি কোনও আশ্রয় নয়। তারা দু’জনে পরস্পরের আশ্রয়। দুই বাড়িতে ওদের বিয়ের অভিমত একরকম ছিল না। তবু তারা সান্ত্বনা পেয়েছিল, যখন কোর্ট ম্যারেজ হয়ে গেল। নীলেশ ঠাট্টা করে ছুটির দিনে মাঝে মাঝে বলত, ‘তুমি কাগজের বউ’। সঙ্গে কিছুটা আদর আতিশয্য, মনে হতো, মেয়েলি জীবনে যা কিছু ধরাবাঁধা, তার বাইরে, শুধুই আনন্দ! দিশেহারা হয়ে যেত শ্রেয়া। তার মেয়েলি বয়সের আনাচেকানাচে।

ব্রাউন ড্রেস পরা কাজের ছেলেটা ওকে অনেকদিন থেকে চেনে, বছর তিনেক আগে তারা যখন এখানে প্রায়ই আসত। জানলার ওপিঠে রাস্তা, এপিঠে ছোটো টেবিল, এটাই ছিল তাদের পছন্দের জায়গা। কথা বলতে বলতে শহরটাকে মগ্ন চোখে দেখা। নীলেশ আচ্ছন্নের মতো অন্যরকম বলত। তারা শহরের কেউ নয়, শুধু দুটি মানুষের ভালোলাগা বলে এখানে থাকা। শহরটি নিজেই বড়ো জটিল, বিশ্রাম বলে কিছু নেই। তাদের দু’জনের পরস্পরের মনের জটিলতা কোথায়, কখন কেটে গেল, তারা বুঝতে পারেনি। জীবন তো এমনই, বোঝা যায় না!

নীলেশ তিরিশ, শ্রেয়া পঁচিশ। পাঁচ বছরের ফাঁকটুকু নিয়ে শ্রেয়া অন্য চোখে দেখত নীলেশকে। প্রথমে সমীহ খানিকটা দূরত্ব। ওটা একদিন সরে গিয়ে প্রেম-ভালোবাসা, সেটাও সরে গিয়ে প্রথম কদম ফুলের আমোদে শারীরিক সম্পর্ক। শ্রেয়ার বয়সটা আকুল-বিকুল। তখন মেয়েরা অবলম্বনই খোঁজে। পছন্দ-অপছন্দের আড়াল পড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক বা ওটা সরিয়ে আরও কাছাকাছি আসা।

কাজের ছেলেটা কাছে এসে দাঁড়াল, ‘দিদি, আর একবার চা, না কফি?’ শ্রেয়া মাথা নাড়াল, এখন নয়। ছেলেটা চলে গেল অন্য টেবিলে। ঘড়ি দেখল শ্রেয়া। নীলেশের আসার সময় ফুরিয়ে গেছে। মোবাইল নাড়াচাড়া করে দেখল। কোনও কল মেসেজ আসেনি। তার মোবাইল নম্বরটা এখনও নীলেশের ফোনে আছে. না মুছে গেছে?

বিয়ের দিনকাল বছর দুয়েক গড়াতেই তারা পরস্পরের কাছ থেকে মুছে যাচ্ছিল।

বাঘাযতীন স্টেশনে দু’ নম্বর প্ল্যাটফর্মের উলটোদিকে জলাজমি, ডোবা। তবু বাড়িঘর উঠছিল। ওখানেই একটা দোতলা ঘরের ওপরে দু’কামরার ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছিল নীলেশ। এদিকটা নাবাল বলে আরও অনেক ফাঁকা জমি ছিল তখন, এলোমেলো ছাঁদের কিছু বাড়িঘর। তখন ভোরের মিহি নৈঃশব্দ্য ভেঙে কয়েকজনের কীর্তনের দল চৈত্র-বৈশাখ দু’মাস খোল খঞ্জনি বাজিয়ে ঘরে ঘরে নামগান শোনাত। প্রোমোটারদের জমি দখল চলছিল। একদিন দলটা কবে, কোথায় চলে গেল, কেউ জানল না তেমন করে।

বাড়ির একটু দূরে একটা জলাভূমি ছিল, সেখানে থোকা থোকা শালুক, জলপিপি, কোঁচবক, কখনও কখনও পানকৌড়ি। মজা জলাভূমি, বর্ষার জল থৈ থৈ, অন্য সময় প্রায় শুকনো। বর্ষায় জলাভূমির পাড়ে কাশফুল ফোটে। ওটাও প্রোমোটারের দখলে, বুজিয়ে আবাসন উঠবে, বদলে যাবে চারপাশ।

তার আগেই বদলে গিয়েছিল নীলেশ।

বিয়ের কিছুদিনের মধ্যে নানা অসংগতি ধরা পড়ছিল শ্রেয়ার চোখে। নীলেশের জুয়োখেলার, মদের নেশা, কাজে মন নেই। সে বুঝতে পারছিল, নীলেশের কাছে পরিবার, সংসার এসব অবান্তর কথা। জীবন আছে বলে, ওদিকে একটা মোড় নেবে, তা কেন? বিয়ের আগে স্বাভাবিক মেলামেশায় নিজের চরিত্রের অনেক কিছু আড়ালে রেখেছিল, জানতে দেয়নি।

কাজের প্রতি কোনও নিষ্ঠা ছিল না নীলেশের। পেন্টস্ কোম্পানিতে সেলসের কাজ, মাসের সেলস্ টার্গেট ছিল, সেটা কোনও দিনও পূর্ণ করতে পারেনি, চেষ্টাও ছিল না। পরিণতি এগিয়ে এল, একদিন চাকরিটা আর রইল না। তারপরই উড়নচন্ডী ও ছন্নছাড়া জীবন। টাকাপয়সা ও অন্যান্য ব্যাপারে শ্রেয়ার মুখাপেক্ষী, তাও বেশ জোর খাটিয়ে। খালাসিটোলায় মদের আড্ডা, নাচনি-বারের মেয়েদের কাছে যাওয়া, জুয়োর দান ফেলা, টাকা উঠলে ঘরে না ফেরা। এক অবাঞ্ছিত কষ্ট, ভাঙচুর নিয়ে শ্রেয়ার জীবন নানা নিন্দায় জড়িয়ে যাচ্ছিল।

শেষে ঘর ছাড়তে হল। বাঘাযতীনের ভাড়ার ঘর ছেড়ে হাওড়ার কদমতলায় বাবার বাড়ি। একবছরের মাথায় ডিভোর্স নেওয়ার সব কাগজপত্র তৈরি। কেস আদালতে উঠবে। নিজেকে নতুন করে গুছিয়ে নিয়েছে শ্রেয়া। মুছে ফেলেছে পুরোনো জীবন। একটা ঘটনা কোনও দিনই মোছা যাবে না, তার যৌবনের কুমারীত্ব নেই, সেটা লুঠ হয়ে গেছে নীলেশের হাতে। এই লুকোনো জায়গাটা কাউকে বোঝানো যায় না, দেখানোও যায় না। নীলেশ ভেবেছিল, ওটুকু দিয়েই সে শ্রেয়ার হাতে দড়ি পরিয়ে বেঁধে রেখেছে কিন্তু শ্রেয়া ততদিনে তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, সব কাছের মানুষ কাছের হয় না। নীলেশ তার জীবনে প্রকৃত মানুষ ছিল না, চোখে একটাই শৌখিন নেশা ছিল শরীর লুঠপাটের।

নীলেশ এখনও বাঘাযতীনের ভাড়ার ঘরে থাকে, টাকাপয়সা কোথা থেকে পাচ্ছে, কে জানে। শ্রেয়ার জানারও দরকার নেই। সে পাঠ বছর খানেক হল উঠিয়ে দিয়েছে। আজ সকালে তাকে ফোনে বলেছিল, ডিভোর্সের কাগজে সই করতে হবে। দু’জনের বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া ভালো।

শ্রেয়া যখন কথা বলছিল, ঘরের দরজা বন্ধ, বাইরে অশ্রান্ত বৃষ্টি, ফোনের আওয়াজ ভালো শোনা যাচ্ছিল না, তবু নীলেশকে সব বলেছিল, পুরোপুরি বিচ্ছেদের কথা। সঙ্গে সঙ্গে সে রাজি। বিকেল বা সন্ধের সময় ত্রিকোণ পার্কের রেস্তোরাঁয় আসতে বলেছিল। তার বাড়ি থেকে ত্রিকোণ পার্ক দূর নয় কিন্ত শ্রেয়ার কদমতলা থেকে দূর। সেই দূর ভেঙে এসে পড়েছে শ্রেয়া। এর পেছনে আর একটা নতুন জীবনের হাতছানি ছিল।

এখনও সমানে বৃষ্টি, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, মেঘ ডাক দিচ্ছে, নীলেশ আসেনি।

তার শর্তে শ্রেয়া রাজি হয়েছিল। ডিভোর্সের কাগজপত্রে নীলেশ সই করবে, তার বদলে হাজার দশেক টাকা চাই। এটাই তার শেষ দাবি, এরপর তো জীবন থেকে মুক্তি। কথাগুলোয় কোনও হূদ্যতা ছিল না। হাসি ছিল চিবিয়ে চিবিয়ে। কাছাকাছি না থেকেও যথেষ্ট অত্যাচার করা যায়। নীলেশের বাইরে ও ভেতরটা সবই ধরা পড়ছিল। এ জিনিস যে লুকোনো যায় না।

শ্রেয়া মোবাইলে ডায়াল করল নীলেশকে, রিং হচ্ছে, তুলছে না। লাইন কাটল সে। এখন অনিশ্চিতভাবে বসে থাকতে হবে এখানে, কতক্ষণ কে জানে। হয়তো নীলেশ আসবে না। তার বিদ্রূপের হাসি বারবার কানে বেজে উঠছিল। কাগজে সই করার বাহানায় বারবার তাকে ডেকে পাঠাবে, সইয়ের দরও বাড়িয়ে দেবে, তবু আসবে না। স্বস্তি নেই। রাগে, ক্ষোভে শ্রেয়া আনমনা হয়ে যাচ্ছিল। নীলেশ মানুষটা যে এত স্বার্থপর, এটুকু জানা ছিল না। তার জীবনটা বারবার বৃষ্টিতে ভিজেছে– প্রথম প্রথম শান্ত, নির্মল আনন্দে, আনন্দটুকু ফুরিয়ে গেলে বেলাটুকু ফুরিয়ে গেল, তখন ঝমঝম দামাল বৃষ্টি।

অনেকক্ষণ থেকে চায়ের কাপটা সামনে রাখা। বৃষ্টি বাতাসে কখন ঠান্ডা হয়ে সর পড়েছে। এটা আর খাওয়া যাবে না। রাস্তায় বাস, ট্রাম আগের মতো, বৃষ্টি বলে কোথাও কিছু বন্ধ হয়নি। শহর থামতে জানে না। সুখ দুঃখ নিয়ে তার জীবন যে কোথায়, কখন থেমে গেল, সেটা আজ আর মনে পড়ে না। ওখানে উঁকিঝুঁকি দিয়ে আর লাভ কী? ওই জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নানা উদ্বেগ, দুর্ভাবনা, নীলেশের তাকে নিয়ে ছেলেখেলা। সব কিছু ফুরিয়ে তার চারপাশে শূন্য হয়ে যাওয়ার বেদনা, দুঃখ।

সেই শূন্য জীবনটা আবার ভরে দিতে চাইছে অতীন বলে একজন।

তাদের গার্লস স্কুলের সায়েন্সের টিচার অতীন মিত্র, একই বয়সি। স্কুলের পরিবেশে নানা কিছুতে মানিয়ে নিতে তাকে সাহায্য করেছে। দু’জনে বেশ কাছাকাছি এখন। বাইরে কত খোলা আলো বাতাস নির্জনতা! শ্রেয়া হাঁপিয়ে উঠেছিল। এখন তার নানা অনুশোচনা কিছুটা খেয়ালিপনায় চাপা পড়ে গেছে, মূর্ত হয়ে উঠেছে নতুন জীবন।

গত রবিবারে মেঘলা দিনে তারা চলে গিয়েছিল ত্রিবেণী সঙ্গমে।

হুগলি-রূপনারায়ণ-দামোদর এই তিন নদীর সঙ্গম গাদিয়াড়ায়। অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য! মেঘলা দিন, কিন্তু সারা দুপুর বৃষ্টি ছিল না। লোকাল ট্রেনে উলুবেড়িয়া স্টেশন। ওখান থেকে বাস, ঘন্টা দেড়েক পরে গাদিয়াড়া। ভ্যান রিকশায় নদীর পিকনিক স্পটে। খাবারের প্যাকেট সঙ্গে। সারা দুপুরটা সেখানেই কাটিয়েছিল শ্রেয়া ও অতীন। বিকেলের মুখে ঝেঁপে বৃষ্টি চারদিক আঁধার করে, নদীর মোহনা ঝাপসা। ফেরা হয়ে ওঠেনি সেদিন। একটা হোটেলে দু’জনকে রাত কাটাতে হয়েছিল। পরের দিন সকালে ফেরা।

সারারাত নদী মোহনার, সঙ্গমের ঝড়বৃষ্টি।

তিন নদীতে বৃষ্টির শব্দ, আলাদা নয়, একই – ঝমঝমাঝম। রাতে আলো চলে গেল। লোডশেডিং। সেদিন শ্রেয়ার জীবনে এক পশলা বৃষ্টি নেমেছিল সেই নির্জন, নিঃসঙ্গ রাতে। আগের সমস্ত গ্লানি তাকে জড়িয়ে ছিল না, ক্রমশ খুলে যাচ্ছিল, এক পরম শান্তি। অতীন মিশে যাচ্ছিল পুরোপুরি শ্রেয়ার সঙ্গে। অতীনের কাছে টর্চ, জ্বালতে দেয়নি শ্রেয়া।

বাইরে বৃষ্টি, ঘরে বৃষ্টি।

দুটো বৃষ্টি এক নয়। দুটো বৃষ্টি এক নয়, দাপট এবং গহনতা, মগ্নতা, সব আলাদা আলাদা, কারও সঙ্গে কারও মিল নেই। এত বৃষ্টির ধারা? তবু মনে হচ্ছিল, এক স্তব্ধতার ভেতর তারা দু’জনে হয়ে উঠেছিল ব্যাকুলতর। শ্রেয়ার ব্যাকুলতা ফুল কুড়োবার মতো কুড়োচ্ছিল অতীন।

সকালে ব্রেকফাস্টের সময় কথাটা তুলেছিল সে। সারারাত বৃষ্টির পরে শান্ত, ধোয়া, ঝিমধরা ভোর। নদীর বাতাসে গাছপালায় দোলন। কোথাও মলিনতা নেই। তিন নদী মিলেমিশে একাকার। রাতেও তো তারা ওরকম মিলেমিশে…।

‘আমাদের বিয়ের আগে তোমার ডিভোর্সটা হয়ে যাওয়া দরকার।’ অতীন কফি খাচ্ছিল।

‘হ্যাঁ, তাই হবে।’

কথা দিয়েছিল শ্রেয়া। যেটুকু দিলে নিজের বিমূঢ়তা বোঝানো যায়, সেটুকু সে অতীনকে সে রাতেই দিয়েছে। কোথাও কোনও উদ্বেগ ছিল না। সব ব্যাকুলতা শান্ত হয়ে ছিল নিজের মতো। খোলা ছাদে অন্ধকারে জ্যোৎস্নার আবিলতায়। কী সুখ, কী সুখ! একবারও নীলেশের কথা মনে হয়নি। সে আর অতীন, দু’জন মানুষ তুমুল বৃষ্টিতে মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল। নদীটা উঠে এসেছিল ঘরে, তারা ডুবে গিয়েছিল। স্পষ্টই মনে হচ্ছিল, এ-ডোবা জলে ডোবা নয়, অন্য কিছু।

শ্রেয়া দেখল, নীলেশ ঢুকছে।

অবিন্যস্ত, ভেজা চেহারা। ভেজা চুল, মুখ। ভেঙে পড়া চেহারা। ভাঙা গাল, চোখ বসা, চোখের নীচে কালো ছাপ। ময়লা শার্ট। আগে হাতে ঘড়ি থাকত। এখন নেই, জুয়োর অড্ডায় হয়তো বিক্রি হয়ে গেছে। টলায়মান চেহারা। শ্রেয়ার সামনে চেয়ারে বসতে মদের গন্ধ পেল শ্রেয়া। গা গুলিয়ে উঠছিল। নিজেকে চেপে রাখল। যে কাজে এসেছে, তার ভাঙনটুকু নয়, আসলটুকু নিয়ে ফেরা। মুখ বুজে নীলেশের সব বিরোধিতা সহ্য করতে হবে, অপূর্ণ বলে কিছু নিয়ে সে ফিরবে না।

‘বৃষ্টির জন্যে আসতে দেরি হল।’ হাসল নীলেশ। ‘স্কুলে পড়েছিলাম ইমপেশন্ট রেইন, এটা তাই।’

‘কোথায় ছিলে এতক্ষণ? আমি কখন থেকে বসে আছি এখানে।’

‘গার্ডেনরিচ, বেহালা হয়ে আসছি। দুটো জুয়োর আড্ডায় জিতেছি।’

জামার কলার তোলা, এলোমেলো। মুখে দাড়ি, হয়তো শেভ-টেভ করে না। কথাগুলো স্পষ্ট নয়, জড়িয়ে যাচ্ছিল। অর্ডার নিতে সেই ছেলেটা এল, নীলেশকে দেখে মাথা ঝোঁকাল। দু’কাপ কফি আর এক প্লেট ডিম টোস্টের অর্ডার দিল শ্রেয়া। নিজের জন্যে শুধু কফি। বাইরে সমানে বৃষ্টি, গাদিয়াড়ার নয়, কলকাতার। এখানে কোনও বিস্তৃত মোহনা নেই, শুধু ঘরবাড়ি। সাগরের নিম্নচাপ কি বাড়ল? তাকে তো ভিজতে ভিজতে অনেক দূর যেতে হবে– সেই কদমতলা।

শ্রেয়া ব্যাগ থেকে ডিভোর্সের কাগজ বের করল। কোথায় কোথায় সই করতে হবে দেখাল। নীলেশের জামার পকেটে পেন নেই। ব্যাগ থেকে নিজের পেন বের করে দিল শ্রেয়া। নীলেশ চেয়ে আছে তার দিকে, কৌতূহল নেই। অন্যমনস্ক। মুখ তুলে বাইরের বৃষ্টি দেখল। কাগজ দেখছে না, পেনটা ঘোরাচ্ছে। হাওয়ায় কাগজ উড়ে যাচ্ছিল, হাত দিয়ে চেপে রাখল শ্রেয়া। মনে হল, জীবনকে সে হাত দিয়ে চেপে রেখেছে, কাগজ নয়। নীলেশের কাছে এ কাগজ হুড়মুড় করে বৃষ্টি ঢোকার মতো নয়। কিছু একটা পৌরুষেয় অপূর্ণতা, কোথায় তার কষ্ট, মুখে ফুটে উঠছে। মুখ ঘোরাল সে শ্রেয়ার দিকে, সেখানে একরাশ দুর্বলতা, হাসিখুশির চিহ্ন নেই। এ মুখে একদিন আনন্দ ছিল, এখন কিছু নেই।

‘তুমি চলে গেলে বাড়ি ছেড়ে’ নীলেশ আরও অন্যমনস্ক হয়ে গেল নিজের ভেতর। হয়তো ওরকম প্রচ্ছন্নে থাকতে তার ভালো লাগে। ‘আমি এখনও ওখানেই আছি। কষ্ট করে ভাড়া জুটিয়ে আসছি, যে মাসে জুয়োয় টাকাপয়সা পাই, অসুবিধে হয় না, না পারলে ভাড়া বাকি। বাড়িওলা মেনে নিয়েছে। সবসময় যে কাজের মেয়েটি ছিল, তাকে এখনও রেখেছি। যেদিন খুব ড্রিংক করে আসি, সে আমাকে যত্ন করে ঘরে তোলে। তারও জানা হয়ে গেছে, আমার সন্তান দেওয়ার ক্ষমতা নেই, নপুংসক। তুমি জানার পরে বাড়ি ছেড়েছিলে, ও কিন্তু ছাড়েনি।’

রেস্তোরাঁর ছেলেটা কফি, টোস্ট নিয়ে এল। সাজিয়ে চলে গেল। টেবিলে ডিভোর্সের কাগজের ওপর ব্যাগ চাপা দিল শ্রেয়া, উড়ে না যায়। এ যেন মাটির তলার কোনও একটা বীজ, মাটির ওপরে উঠে এসেছে, সামলে রাখতে হবে। নীলেশ একবারও কাগজটা দেখল না। কাঁটাচামচে ডিমটোস্ট খাচ্ছে। বেশ খিদে, ঠোঁট দিচ্ছে কফিতে। ওর হাত কাঁপছে, কফির কাপটা পড়ে না যায়, হয়তো মদটা আজ বেশি হয়ে গেছে বৃষ্টির দিনে। আগেও বৃষ্টিভেজা রাতে ঘরে মদের বোতল ঢুকত।

সংসারে যা কিছু মেয়েলি প্রাপ্য তা পাবে বলেই নীলেশকে নিয়ে ঘর বেঁধেছিল শ্রেয়া। তার কিছুই সে পায়নি। রাতে বিছানায় নীলেশ শুধু জেগে থাকত, বুকে ব্যথা বা নেশার ঘোরে ঘুমিয়ে পড়ত। একবারও ফিরে তাকাত না শ্রেয়ার দিকে। শ্রেয়ার তখন বড়ো কষ্টে মনে হতো, সে বিবাহিত হলেও সংসারে প্রাপ্য বলে মানুষটির কাছে কিছুই নেই। দু’জনের সম্পর্ক ভেঙে দূরত্ব তৈরি হতে শুরু করেছিল।

‘তোমার কি বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ভালো লাগে?’ নরম, হালকা, আন্তরিক গলায় এমন একটা কথা শুনে অবাক হল শ্রেয়া। বৃষ্টিও কি মানুষকে বদলে দেয়? সম্পর্কগুলো ধুয়ে মুছে যায়, না নতুন করে জোড়া লাগে? চেনা মানুষটাকে কৌতূহল নিয়ে দেখল শ্রেয়া।

টোস্ট খাওয়া হয়ে যেতে প্লেট সরিয়ে রাখল নীলেশ। খালি কফির কাপটা শ্রেয়ার কাপের পাশে রাখল, পাশাপাশি কিন্তু মাঝখানে একটু ফাঁক। দুটো খালি কাপের এটাই হয়তো সান্ত্বনা, তারা পাশাপাশি আছে।

নীলেশ কাগজের দিকে হাত বাড়াল। ব্যাগের নীচ থেকে কাগজটা বেশ আগ্রহ নিয়ে বের করে দিল শ্রেয়া। পাশেই পেন পড়ে আছে। পেন তুলে নিল নীলেশ, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল। দেখছিল না, ভাবছিল কিছু। তার ভাঙাচোরা চেহারা দেখে শ্রেয়ার হঠাৎ মনে হল, এই নীলেশকে সে চেনে না। সে কি কাগজে সত্যিই সই করবে, কি করবে না? বড়ো আশা নিয়ে এসেছে শ্রেয়া আজকের প্রবল বৃষ্টিতে। আর একটা জীবন তার নাগালের বাইরে, যদিও গাদিয়াড়ার বৃষ্টিতে ভিজেছিল দু’জনে। ওই জীবনটাও কি কোনও শূন্য জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে? এক জীবনে কত পুরুষকে সে দেখবে?

‘সই দেওয়ার পরে আমাদের সম্পর্ক শেষ হয়ে যাবে?’

নীলেশ সই করল! পেনটা শুইয়ে রাখল কাগজের পাশে। অবাক হল শ্রেয়া। রোগীরা ওষুধ খাওয়ার আগে যেমন শুকনো হাসি হাসে, বাহানা করে, নীলেশের ইচ্ছে তেমনই যেন কিছু, বলছে না।

‘সম্পর্ক শেষ করার জন্যই তো কাগজপত্রে সই করা। এ কাগজ যাবে কোর্টে, জজের বিচারে ডিভোর্স হবে। আমরা তখন বিচ্ছিন্ন পরস্পরের কাছ থেকে।’

‘বি-চ্ছি-ন্ন শব্দটি বেশ। এই বৃষ্টিবাদলার দিনে শব্দটি শুনতে ভালো লাগছে। আমার কিন্তু আরও শর্ত আছে। আসলে আজ দু’বোতল ঠাররা নিয়েছি, মাথাটা ঠিক কাজ করছে না, কোনটা নকল কোনটা আসল বুঝতে পারছি না, ঝাপসা লাগছে। তোমাকে ঠিক দেখা যাচ্ছে না, চেনা যাচ্ছে না– সব ঝাপসা ঝাপসা, অথচ একদিন তুমি আমার ছিলে। তোমার সবই আমার চেনা– রূপ, যৌবন, শরীর।’

চমকে উঠল শ্রেয়া। নীলেশের অনেক কথাতে চমক ছিল। স্পষ্ট হয়ে উঠত না অনেক কিছু– তাদের একসঙ্গে থাকা, নরনারীর স্বাভাবিক বা গোপন সম্পর্ক, কিন্তু আজ অন্যরকম লাগছে তাকে। পুরুষ যখন ঝাপসা হতে থাকে তখন তার আর নিজের অন্তর নিয়ে হয় বড়ো মুশকিল।

‘শর্ত তো তোমার একটাই, দশ হাজার টাকা চেয়েছিলে, এনেছি।’ শ্রেয়া ব্যাগে হাত রাখল– ‘চেন খুলতে হবে, টাকাটা ভেতরে।’

‘আমি তো ভুলেই গেছলাম। দাও।’

ব্যাগের ভেতর পাঁচশ টাকার কুড়িটা নোট রবার ব্যান্ডে বাঁধা। সেটা বের করে নীলেশকে দিল শ্রেয়া। টাকাটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল নীলেশ। হাতের তালুতে কয়েকবার বাজাল। বৃষ্টি দেখল জানলা দিয়ে। ঘন বৃষ্টি, ট্রাম লাইন ঝাপসা, ভেজা আলোর নীচে বাস, ট্রাম। এই দুর্যোগের বেলাতেও সবাই চলমান।

হঠাৎ শ্রেয়ার ব্যাগ কাছে টেনে নিল নীলেশ। চেন খুলে পুরো টাকার বান্ডিল ঢুকিয়ে রাখল। ‘এটা আমার কাছে থাকলে জুয়োয় বা মদে উড়ে যাবে। খালাসিটোলায় পড়ে থাকব, কোথাও যাব না। আমার শর্ত ফিরিয়ে নিলাম।’

শ্রেয়া দেখল ডিভোর্সের কাগজটা এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে টেবিলে, পেনটা চাপা দেওয়া। হাওয়ায় কাঁপছে, বিয়ে ভাঙার কাগজ। শ্রেয়া কাগজের বউ নয়। মানুষ, যুবতি। অতীনকে গুছিয়ে নিয়েছে নতুন ঘর বাঁধার। চিরটা কাল সে ভাঙা ঘাটে নৌকো লাগিয়ে থাকবে না, ঘাট বদল করবে।

‘আমার অন্য শর্ত আছে সই করার।’

নীলেশ হাসল। দুর্বল মুখে হাসিটা আরও দুর্বল, বেমানান। শ্রেয়ার সঙ্গে সে বাগড়া করতে আসেনি, কোনও অসদাচরণ নয়। শ্রেয়া কথা বলল না, বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। মুখ তুলল, সে মুখে প্রশ্নের চিহ্ন কিন্তু শব্দ নেই। ঘরের ভেতরে উজ্জ্বল আলো, পাখাও চলছে।

‘আজকের রাতটা আমার সঙ্গে কাটাতে হবে, বাঘাযতীনের বাড়িতে, তারপর কাগজে সই করব।’

শ্রেয়ার মনে হল, চারদিকে নিরবচ্ছিন্ন আঁধার, ঘুটঘুটে, দামাল বৃষ্টি। কত রকম শব্দ ভাসছে। ভাসতে ভাসতে দূরে চলে যাচ্ছে। নীলেশ তুচ্ছ, তার খালাসিটোলাটা উঠে আসছে দু’হাত বাড়িয়ে। জুয়োর পাশা ফেলেছে নীলেশ। পাশার দান বেয়ে তাকে ঘরে উঠতে হবে, সেখানে শুরু হবে রাতের দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ খেলা।

শক্ত হল শ্রেয়া, ‘তোমার শর্তে আমি রাজি নই।’

‘আসলে বাইরে বৃষ্টি পড়ছে তো। বৃষ্টি পড়লে মন নরম হয়। আমি মোদো-মাতাল। বৃষ্টিতে বদলে যাই। অ্যান্টিসোশ্যাল লোকও বৃষ্টি দেখে ভাবে, কোনও মেয়েকে ভালোবাসবে। বৃষ্টি দেখে আজ আমার পুরোনো ঘরের কথা মনে পড়ল, তুমি আর আমি। বেশ যেও না।’ নীলেশের নরম গলা।

নীলেশ ডিভোর্সের কাগজটা নিয়ে শ্রেয়া যেখানে সই করতে বলেছিল, সই করল। কাগজটা হাতে দিল। ব্যাগবন্দি করল শ্রেয়া। ‘রাত হচ্ছে, বৃষ্টির রাত। আমাকে সেই কদমতলায় ফিরতে হবে।’

‘সেইজন্যই তো কাছাকাছি করে তোমাকে ডেকে ছিলাম। যা কিছু পাপ, ধুয়ে ফেলার ইচ্ছে, এই বৃষ্টিতেও সেটা হল না। ঠিক আছে, যাও।’

নীলেশের দিকে তাকাল শ্রেয়া। আত্মতৃপ্তি না হলে মুখ যেমন বিষণ্ণ ভাঙাচোরা মনে হয়, ঠিক তেমনি। মদের ঘোরে টলমলে, চকচকে চোখ, একটা অসহায় অন্য জগতের মানুষ। এলোমেলো চুল নেমে এসেছে কপালে, সবই হতশ্রী, বোঝা যায়।

‘বৃষ্টিটা পুরোনো কথা মনে পড়িয়ে দেয়।’ বলল নীলেশ। ‘একবার বৃষ্টির দিনে ছাদে আমরা দু’জনে ভিজেছিলাম, মনে আছে? তুমি গাইছিলে– বারি ঝরে ঝরঝর, আজ বারি সারাদিন। এখনও ভুলিনি কিছু। ছোটোবেলায় বৃষ্টিতে কাগজের নৌকো ভাসাতাম, ডুবে যেত। তোমার ডিভোর্সের কাগজে তৈরি নৌকোটা ভাসিয়ে দিলে ভেসে যাবে, ডুবে যাবে।’

‘না, ডিভোর্সটা আমার চাই।’

অতীনকে নিয়ে শ্রেয়া মুক্তির আনন্দ চাইছে। খালাসিটোলার মানুষের বৃষ্টিতে ভেসে যাবে না সে। কতদিন একা একা। ভালো লাগছে না কিছু। কাঁধে ব্যাগ নিল সে, দরজার কাছে গিয়ে একবার পেছন ফিরল শেষবারের মতো। নীলেশ জানলায় বৃষ্টি দেখছে। এই বৃষ্টিতে তার পুরোনো নেশা ফিরে এসেছে, শ্রেয়াকে নিয়ে রাত কাটাবে। ওটা কি খালাসিটোলার নেশা থেকে আরও গাঢ়, আরও আনন্দময়, নাকি পুরোটাই বেদনাময়?

সে দেখল, দুটো খালি কাপ পাশাপাশি, মাঝে একটু ফাঁক বা দূরত্ব। থাক না দূরত্বটুকু। কী দরকার কাছাকাছি আসার? এলেই টুঙ্ শব্দ উঠবে, সেই নাড়াচাড়ায় হয়তো একটা কাপ ভেঙেও যেতে পারে। দূরত্বে থেকেও তো তার জীবনটা ভেঙে গেল। সবই অসময়– জীবন, বৃষ্টি।

রাস্তায় বেরিয়ে শ্রেয়া দেখল, বেশ জোরেই বৃষ্টি পড়ছে। ছাতা খুলল সে। একটা ডবলডেকার বাস ভিজতে ভিজতে আসছে, মাথায় লেখা – হাওড়া। এই বাস অনেক বছর বন্ধ ছিল, আবার শুরু হয়েছে। এগিয়ে গেল সে বাসের দিকে।

পেছনে তাকালে সে দেখতে পেত, রেস্তোরাঁর জানলার বাইরে নীলেশের মুখ ঝুঁকে আছে। কাউকে খুঁজছে। বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে আসছে মুখটা, সেই সঙ্গে ঝাপসা– সমস্ত নিঃসঙ্গতা, সম্পর্ক, ঘরবাড়ি। কারও কোনও অপেক্ষা নেই। বৃষ্টি– বৃষ্টির মতো ঝরল। শ্রেয়া চলে গেল।

ভালো থেকো

কদমতলার মোড়ের এই ওষুধের দোকানটায় সপ্তাহে একদিন করে বসে দিগন্ত। নাগরিক জীবনে জটিলতা যত বাড়ছে, মনোরোগের চিকিৎসকের কাছে ভিড়ও বাড়ছে সেভাবে। আজ মিতুলের জন্মদিন। ষষ্ঠীকে বলা ছিল যাতে বেশি পেশেন্টের নাম না লেখে। মিতুল পুনেতে এমবিএ পড়ছে, বাড়িতে এসেছে কয়েকদিনের ছুটিতে। মা নেই, মিতুলের জীবনে বাবাই সব। এবার জন্মদিনে ঠিক হয়েছে সন্ধেবেলা বেরিয়ে পড়বে দুজনে। ডিনার করবে নিরিবিলি কোনও রেস্তোরাঁয়। সাতটার সময় শেষ পেশেন্টকে দেখে যখন উঠতে যাবে দিগন্ত, তখন ষষ্ঠী এসে বলল– স্যার, সবাইকেই কাটিয়ে দিয়েছি। কিন্তু একজনকে কিছুতেই বিদায় করতে পারলাম না। দু’ঘণ্টা থেকে মানুষটা ঠায় বসে আছে। আপনাকে না দেখিয়ে কিছুতেই যাবে না বলছে।

দিগন্তর টেবিলে কাজের জিনিসের পাশাপাশি রয়েছে একটা কাচের বোল ভর্তি ছাতিম ফুল। তার বাড়ির সামনের এক টুকরো বাগানে একটা ছাতিম গাছ আছে। দিগন্তর যেদিন যেদিন চেম্বার, সেদিন লোক দিয়ে দিগন্তর বাড়ি থেকে ছাতিম ফুল আনিয়ে রাখে ষষ্ঠী। লম্বা একটা ঘ্রাণ নিয়ে মুখটা তুলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দিগন্ত বলল– পাঠিয়ে দাও। কিন্তু মনে রেখো এটাই লাস্ট।

ষষ্ঠী চলে গেল। পর্দা সরিয়ে একটু দ্বিধাগ্রস্ত পায়ে যে– মানুষটি ঘরে এল, তার গালে কয়েকদিনের দাড়ি, কপালে বলিরেখা, চোখের নীচে পুরু কালির আস্তরণ। দিগন্ত বলল– বসুন। নাম কী আপনার?

– ইয়ে, প্রণয় ঘোষ।

প্রেসক্রিপশনের পাতায় নামটা লিখতে লিখতে দিগন্ত কেজো গলায় বলল– হ্যাঁ, কী অসুবিধে বলুন।

– ইয়ে স্যার… মাসখানেক হল অদ্ভুত একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে কেউ কানের কাছে এসে ফিসফিস করে আমাকে কিছু বলছে।

– পুরুষকণ্ঠ? নাকি কোনও মহিলার গলা? চিনতে পারেন গলার স্বরটা কার?

– মনে হয় গলাটা শ্রুতির, মানে আমার স্ত্রীর। একটা কথাই শুধু শুনতে পাই। ‘ভালো থেকো’। ব্যস। ওই একটাই কথা। আর কিছু নয়।

দিগন্ত চোখ কুঁচকে দেখল পেশেন্টকে। তাকিয়ে থাকল একটুক্ষণ। কপালে দুটো বাড়তি ভাঁজ ফেলে বলল– আপনার স্ত্রী আপনার সঙ্গে একবাড়িতেই থাকেন নিশ্চয়ই?

– না স্যার, ও তিন মাস আগে এক্সপায়ার করেছে।

সাইকায়াট্রিস্টদের অনেক অদ্ভুত জিনিস শুনতে হয়। তবুও মুখটা নির্বিকার করে রাখাটাই নিয়ম। দিগন্ত তার উলটোদিকের লোকটির দিকে ভাবলেশহীন মুখে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করল কয়েক সেকেন্ড। বলল– কথাটা কখন শোনেন? দিনে নাকি রাতে?

– দিন বা রাত বলে কিছু নেই স্যার। আসলে যখন কাজের মধ্যে থাকি তখন কিছু টের পাই না। কিন্তু একটু একা হলেই কানের কাছে ফিসফিস করে কেউ বলে ‘ভালো থেকো’। শব্দটা এমন ডিসটার্ব করছে যে, রাতে ঘুমোতে পারছি না।

– আপনার বাড়িতে কে কে আছেন? ছেলে-মেয়ে?

– একটাই মেয়ে। তিন্নি। পড়াশোনায় ভালো ছিল। বিয়ে করে বিদেশে থিতু হয়ে গেছে। জামাই এলাহাবাদের ছেলে।দু’জনে একই কোম্পানিতে চাকরি করে। বাড়িতে আমি একা থাকি। কাজের মাসি আছে একজন। সকালে এসে রান্না করে দিয়ে চলে যায়।

– এই সমস্যা নিয়ে আপনি কোনও ইএনটি-র কাছে গিয়েছিলেন কি?

– গিয়েছিলাম। বেশ কিছু পরীক্ষা করিয়ে ডক্টর দাশ বললেন, কানে কোনও সমস্যা নেই। উনি আপনার কাছে আসতে বললেন।

ফোন বাজল। মিতুল বিরক্ত হয়ে বলল– তোমার রোগী দেখা শেষ হয়নি এখনও?

দিগন্ত বলল– আর পাঁচ-দশ মিনিট লাগবে, তারপর বেরোচ্ছি। ফোনটা রেখে দিগন্ত বলল– আপনার স্ত্রী নেই বলছিলেন। কী হয়েছিল ওঁর?

– নিউরোলোজিক্যাল সমস্যা। বছর খানেক বেচারি খুব ভুগেছে। মাস তিনেক আগে– আমি তো বলব চলে গিয়ে বেঁচেছে শ্রুতি।

– কী ধরনের সমস্যা ছিল ওঁর?

– এমনিতে সুস্থই ছিল শ্রুতি। গতবারের আগের শীতে আমরা দুজনে জয়ন্তী গিয়েছিলাম বেড়াতে। একটা লজে উঠেছিলাম। পরদিন সকালে শুকনো নদীর খাত ধরে হাঁটতে বেরিয়ে দেখা হয়ে গেল একজন তান্ত্রিকের সঙ্গে। এক হাতে একটা সিঁদুরমাখা ত্রিশূল, অন্য হাতে একটা মালসা নিয়ে বিশাল চেহারার লোকটা হেঁটে আসছিল উলটোদিক থেকে। ওই শীতের মধ্যে খালি গা, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, লাল আগুনের গোলার মতো চোখ। আমাদের দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। শ্রুতির দিক থেকে লোকটা চোখ সরায় না কিছুতেই।

– তারপর?

– আমার হাত শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে গেল একদিকে। কী শক্ত খরখরে হাত ওই লোকটার সেটা বলে বোঝাতে পারব না স্যার! আমাকে বলল বহুদিন ধরে সাধনসঙ্গিনী খুঁজছে সে। কিন্তু যোগ্য কাউকে পাচ্ছিল না। শ্রুতির মধ্যে সেই আধার সে দেখতে পেয়েছে। শ্রুতিই নাকি পারবে তার সাধনসঙ্গিনী হতে।

– হুম। তখন কী করলেন আপনি?

– আমার তখন হতবুদ্ধি অবস্থা। ফাঁকা এলাকা, আশেপাশে কেউ নেই যে সাহায্য চাইব। সেই তান্ত্রিকের হাত ছাড়িয়ে শ্রুতিকে টেনে নিয়ে হাঁটা দিলাম। লোকটা আচমকা হাতের মালসা থেকে সিঁদুর আর ছাইয়ের মতো কিছু একটা শ্রুতির কপালে লেপে দিল। তারপর হো হো করে হাসতে লাগল। আমরা পা চালিয়ে জায়গাটা ছেড়ে এলাম। যেন পালিয়ে বাঁচলাম ওখান থেকে। কিন্তু কী আশ্চর্য, পরদিন রাতেই ঘটল সেই অদ্ভুত ঘটনাটা।

– কী ঘটনা ঘটল?

– সারাদিন ধরে বক্সা ফোর্ট দেখা হয়েছিল সেদিন। অতটা উঁচুনীচু পথ হেঁটে হেঁটে রাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম দুজনে। শুতে শুতেই আমি ঘুমিয়ে কাদা। আমার ডায়াবেটিস আছে, রাতে বাথরুমে যেতে হয়। ভোররাতে একবার ঘুম ভেঙেছিল। কিন্তু বাথরুম থেকে ফিরে এসে যা দেখলাম তাতে আমার গায়ের সব রোম খাড়া হয়ে গেল।

– কী দেখলেন?

– দেখি ওই শীতের মধ্যে শ্রুতি উদোম গায়ে বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে। যেভাবে বাসে ট্রেনে লোক দাঁড়িয়ে থাকে সেভাবে। চোখমুখ অন্যরকম। আমি অবাক হয়ে বললাম– কী করছ? নেমে এসো! শ্রুতি অদ্ভুত হেসে অচেনা গলায় বলল– এই তো পরের স্টপেজেই নামব!

দৃশ্যটা কল্পনা করে শিহরন জাগল দিগন্তর শরীরে। তবুও মুখটাকে নির্বিকার রেখে বলল– তখন কী করলেন আপনি?

– বুঝিয়ে-সুঝিয়ে অনেক কষ্টে শান্ত করে শুইয়ে লেপ দিয়ে ঢেকে দিলাম ওকে। একটু পরে ঘুমিয়েও পড়ল ও। কিন্তু জয়ন্তী থেকে বাড়ি ফিরে আসার পর আমূল বদলে গেল শ্রুতি। কথাবার্তা একটু কেমন কেমন। সব সময়েই আনমনা। কিছু বললে চমকে চমকে ওঠে। বিড়বিড় করে একা থাকলে। শেষদিকে আমাকে চিনতে পর্যন্ত পারত না। ওই তান্ত্রিকই ওর সর্বনাশ করে দিল!

দিগন্ত আশ্বাসের স্বরে বলল– আপনি যা ভাবছেন তা নয়। আপনার স্ত্রীর যেটা হয়েছিল সেটা এক রকমের নিউরোলজিকাল ডিসওর্ডার। অনেক কারণে এটা হতে পারে। ওই তান্ত্রিকের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই। যাক গে, স্ত্রীকে ভালো জায়গায় ট্রিটমেন্ট করানো উচিত ছিল আপনার।

– ট্রিটমেন্টের কিছু বাকি রাখিনি স্যার। কিন্তু লাভ হয়নি। শেষদিকে শ্রুতি ঘরেই পায়খানা-পেচ্ছাপ করত। যখন তখন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ত বাইরে। সে জন্য কী বলব… এমনকী ঘরে বেঁধে পর্যন্ত রাখতে হয়েছে ওকে। কোনও উপায় ছিল না আর।

– আপনার মেয়ে-জামাই সব শুনে আসেনি বিদেশ থেকে?

– ছুটে এসেছিল দু’জনে। তখন শ্রুতির বাড়াবাড়ি চলছে। কিন্তু ওদের দু’জনকে দেখলে আরও বেশি ভায়োলেন্ট হয়ে যেত শ্রুতি। তখন সিডেটিভ ইঞ্জেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখতে হতো ওকে। কিছুদিন থেকে ওরা একরকম পালিয়ে ফিরে গেল বিদেশে।

– কে দিত ওষুধ?

– একজন অ্যাটেনডেন্ট রাখা হয়েছিল নার্সিংহোম থেকে। মাঝবয়েসি একটা মেয়ে, তার নাম বকুল। সারাদিন থাকত। স্নান করানো থেকে খাওয়ানো-দাওয়ানো সব বকুলই করত।

– আপনার স্ত্রীর ডেথ সার্টিফিকেট কে ইস্যু করেছিল বলুন তো?

– আমাদের ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান ডক্টর ধৃতিমান ব্যানার্জি।

মোবাইলটা আবার বাজল। মিতুল গজগজ করতে করতে বলল– বাবা, এনাফ ইজ এনাফ। তোমার আর আসার দরকার নেই আজ। সারা রাত্তির তুমি চেম্বারেই থেকে যেও।

দিগন্ত কিছু বলার আগেই মিতুল লাইনটা কেটে দিল। অপ্রস্তুত হয়ে ফোনটা একটুক্ষণ হাতে ধরে থাকল দিগন্ত। মিতুলের রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু এখন তার মুখোমুখি বসা লোকটির মনের অন্ধকার অলিন্দে আলো ফেলছে সে। এই পেশেন্ট ছেড়ে সে এখন যাবে কী করে!

– কে ফোন করেছিল স্যার? আপনার মেয়ে নাকি?

দিগন্ত হেসে বলল– হ্যাঁ। আমারও স্ত্রী নেই। বাড়িতে আমাকে শাসন করার লোক আমার মেয়েই। আজ বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান আছে। সেজন্য তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কথা বলে রেখেছে মেয়ে।

– যদি কিছু না মনে করেন স্যার… কী হয়েছিল আপনার স্ত্রীর?

দিগন্তর মুখে একটা ছায়া পড়েই মিলিয়ে গেল। একটা শ্বাস গোপন করে বলল– ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক। রাত্রে বুকে ব্যথা হয়েছিল। হসপিটালে নিতে নিতেই সব শেষ।

– ওহ। সরি স্যার।

দিগন্তর নাকে ছাতিমের গন্ধ আসছে। তাদের বাগানের ছাতিম গাছটায় বরাবর ফুল ফোটে খুব। পারমিতার প্রিয় ছিল ছাতিমফুল। বিকেলে সেই গাছের নীচে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত পারমিতা। মজার ব্যাপার, পারমিতা চলে যাবার পর ছাতিম ফুলের নেশা পেয়ে বসেছে দিগন্তকেও। কিছু একটা চিন্তা করে দিগন্ত বলল– আচ্ছা, হাউজ ফিজিশিয়ান ওই ডাক্তারের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক ঠিক কেমন বলুন তো?

– কার কথা বলছেন, ধৃতিমান? আমরা এক পাড়াতে থাকতাম, স্কুলে দু’জনে একসঙ্গে পড়েছি। ধৃতিমান পড়াশোনায় ভালো ছিল, জয়েন্ট এনট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে ডাক্তারি লাগিয়ে দিয়েছিল। দিন দিন ডাক্তারিতে পসার করেছে, কিন্তু একটুও অহংকার নেই। এই যে শ্রুতিকে দেখতে আসত আমাদের বাড়িতে, কিছুতেই ভিজিট নিত না।

আন্দাজে একটা ঢিল ছুড়ে দেখতে ইচ্ছে করছে দিগন্তর। একটা চান্স নেবে নাকি? অনেক সময় এভাবেই কাজ হয়। একটা ট্রাই করে দেখা যেতেই পারে। দিগন্ত দৃঢ় গলায় বলল– দেখুন আমি জানি আপনার মধ্যে কোথাও একটা অপরাধবোধ কাজ করছে। সেজন্য আপনার মৃতা স্ত্রী আপনার অবচেতনে ঘুরেফিরে আসছেন। আপনি কিছু একটু লুকোচ্ছেন আমার কাছে। প্রণয় ঘোষ আকাশ থেকে পড়েছে যেন। বলল– কীসের অপরাধবোধের কথা বলছেন স্যার?

দিগন্ত তাকিয়ে আছে প্রণয় ঘোষের দিকে। যেন ভেতরটা পড়ে নিচ্ছে এমন গলায় বলল– একটা কথা বলুন, সিডেটিভের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে চিরকালের মতো কে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল আপনার স্ত্রীকে? আপনার সেই ডাক্তার বন্ধু? নাকি আপনি নিজে?

হঠাৎ ঝাঁকি খেয়ে গেলে যেমন হয়, তেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে প্রণয় ঘোষের মুখ। ঠোঁটদুটো কাঁপছে একটু একটু।আবছা গলায় বলল– ক্-কী বলছেন স্যার আপনি?

দিগন্ত নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসেছে। প্রণয় ঘোষের পিছনে দাঁড়িয়ে পিঠে হাত রাখল আলতো করে।নরম গলায় বলল– দেখুন আমি পুলিশের লোক নই, গোয়েন্দাও নই। আপনি তো জানেন, ডাক্তারের কাছে কিছু লুকোতে নেই। আপনি নির্দ্বিধায় আমাকে সব বলতে পারেন। যা বলবেন সেটা আপনার-আমার মধ্যেই থাকবে। কিন্তু মনে রাখবেন আপনার চিকিৎসা করার জন্য আমার সব জানা জরুরি।স-অ-ব।

প্রণয়ের মুখের প্রত্যেকটা পেশি কাঁপছে। চোখের কোলে দু’-এক বিন্দু জল এসে পড়েছে। জামার হাতা দিয়ে চোখের জল মুছে নিল প্রণয়। ভেঙে পড়া গলায় বলল– শ্রুতিকে আমি কতটা ভালোবাসতাম সেটা আমিই শুধু জানি। কিন্তু চেনা মানুষটা যখন ধীরে ধীরে অন্যরকম হয়ে গেল, সে যে কী যন্ত্রণা… বিশ্বাস করুন স্যার, আর কোনও উপায় ছিল না।

দিগন্ত একটু শক্ত গলায় বলল– ইউথেনেশিয়া বা করুণামৃত্যু বিশ্বের কিছু দেশে চালু হলেও আমাদের দেশ যে এখনও অ্যাপ্রুভ করেনি, সেটা আপনার না জানা থাকলেও আপনার ডাক্তার বন্ধুটি নিশ্চয়ই জানেন। তাহলে?

প্রণয় ঘোষ অসহায় মুখ করে বলল– বিশ্বাস করুন স্যার, শ্রুতির চিকিৎসার জন্য সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে আমি অনেক খরচ করেছি। কিন্তু কিছু হচ্ছিল না। শেষ দিকে শ্রুতি অস্রাব্য গালিগালাজ করত, হাতের কাছে যা পেত ছুড়ে মারত। এই দেখুন আমার কপালের কাটা দাগ। সাঁড়াশি ছুড়ে মেরেছিল সামনে থেকে। চারটে স্টিচ পড়েছিল এখানে। একদিন ধৃতিমানের সামনে আমার গলা টিপে ধরেছিল। সেদিন ধৃতিমান বাঁচায় আমাকে। তারপর থেকে ওর হাত বেঁধে রাখা হতো।

– তার মানে এরকম একটা ফেজ যখন চলছে তখনই ডিসিশনটা নিয়েছিলেন আপনারা। তাই না?

– কথাটা প্রথম তুলেছিল তিন্নি। ও যখন এসেছিল তখন কাছ থেকে দেখেছে সব। ওকেও শ্রুতি চড়-ঘুঁসি মেরেছে, ঘরের মধ্যে পায়খানা করে ওর মুখে লেপে দিয়েছে। বিদেশে ফিরে যাবার পর কাঁদতে কাঁদতে তিন্নি আমাকে বারবার ফোন করে বলেছে কিছু একটা করতে। চূড়ান্ত কিছু।

দিগন্ত নিস্পৃহতা ডিঙিয়ে আর্দ্র স্বরে বলল– সেই রাতের কথাটা এবার মনে করুন তো। ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন?

প্রণয় ঘোষ নখ খুঁটতে খুঁটতে বলল– আগের সপ্তাহেই ডিসিশন নিয়েছিলাম আমরা। সেদিন রাতে বকুল চলে যাবার পর দশটা নাগাদ ধৃতিমান এল। একটা হাত বাঁধা, শ্রুতি তখন ঘুমোচ্ছিল। অন্য হাতে চ্যানেল করাই ছিল। সিরিঞ্জ রেডি করে আমার হাতে ধরিয়ে দিল ধৃতিমান।কীভাবে ওষুধ পুশ করতে হয় সেটা শিখিয়ে দিয়েছিল।

– তারপর?

– ধৃতিমান অপেক্ষা করছিল বাইরে। আমি ওষুধটা পুশ করে ওকে ডাকলাম। ধৃতিমান ঘরে এসে শ্রুতিকে দেখল। তারপর চলে গেল। আমি গেট বন্ধ করে দিয়ে জেগে রইলাম সারা রাত। পরদিন সকালে এসে ডেথ সার্টিফিকেট লিখে দিয়েছিল ধৃতিমান। সকালের মধ্যেই পাড়ার জ’না পাঁচেক ছেলের সঙ্গে মরচুয়ারি ভ্যানে করে শ্মশানঘাটে নিয়ে গিয়েছিলাম বডি। এক ঘণ্টার মধ্যে দাহ করে ফেলা হয়েছিল। কেউ কিছু বুঝতে পারেনি।

দিগন্ত ভুরু তুলে বলল– আপনার স্ত্রী কি ঘুমের মধ্যেই মারা গিয়েছিলেন?

– না ঠিক তা নয়। কী হয়েছিল পুরোটা বলি। সেদিন রাতে ধৃতিমান যখন বাইরে, তখন আমি বিবেকের তাড়নায় ছটফট করছি। কিছুতেই কাজটা করে উঠতে পারছি না। এক সময় মনের সবটুকু জোর এক করে শ্রুতির হাতের চ্যানেলে সিরিঞ্জের ওষুধ পুশ করে দিলাম। শ্রুতির শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে সব পুরোনো কথা মনে পড়ছিল। হু হু করছিল ভেতরটা। ঠিক তখনই হঠাৎ ধীরে ধীরে চোখ মেলল শ্রুতি। কী বলব স্যার, একদম স্বাভাবিক চোখের দৃষ্টি। আমার দিকে একপলক তাকিয়ে কেমন একটু হেসে বলল– ‘ভালো থেকো’।

রোম দাঁড়িয়ে গেছে দিগন্তর। বিভ্রান্ত মুখে দিগন্ত বলল– কী বললেন?

– ‘ভালো থেকো’। একদম সুস্থ মানুষের মতো করে কথাটা বলে আবার চোখ বুজে ফেলেছিল ও। তারপর থেকেই কথাটা গেঁথে গেল আমার বুকের মধ্যে।

দিগন্ত একটু ঝাঁকি খেয়েছিল। নিজেকে গুছিয়ে নিল এবার। বলল– সেদিন কী হয়েছিল আমি বুঝিয়ে বলছি। সেই চূড়ান্ত সময়ে আপনার মস্তিষ্কের নিউরনের ব্যালান্স ঠিক ছিল না। ফলে একটা হ্যালুসিনেশনের মতো হয়েছিল আপনার। সেটা খুব স্বাভাবিক। আপনি যেহেতু খুনি নন একেবারেই নর্মাল মানুষ, তাই একটা অপরাধবোধ আপনাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। আপনার স্ত্রীর মৃত্যুর পর এই যে একটু একলা হলেই কানের কাছে ‘ভালো থেকো’ শব্দটা শুনছেন, সেটা আসলে একটা অডিটরি হ্যালুসিনেশন। বিভ্রম একরকম। যা শুনছেন সবটাই আপনার কল্পনা।

প্রণয় ঘোষ একটু অবাক হয়ে বলল– কল্পনা? কী বলছেন স্যার?

দিগন্তর হাসিতে আত্মবিশ্বাসের ঝলক। ঘাড় নেড়ে বলল– হ্যাঁ, কল্পনা। এমন কেস মোটেই রেয়ার নয়। আসলে সত্যি সত্যি কিন্তু কোনও শব্দ আসছে না। আপনি ভুল শুনছেন। আপনাকে মনের জোর বাড়িয়ে এই ফেজ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে যত শিগগির সম্ভব। নইলে কিন্তু এরপর ভিজুয়াল হ্যালুসিনেশনও হতে পারে।

– এর কি কোনও চিকিৎসা নেই স্যার?

– নিশ্চয়ই আছে। আগে মনোবিশ্লেষণের সাহায্যে আমরা চিকিৎসা করতাম। কিন্তু এখন অনেক ভালো ভালো ড্রাগস এসে গেছে আমাদের হাতে। খসখস করে প্রেসক্রিপশন লিখে প্রণয়ের হাতে দিয়ে দিগন্ত বলল– আমি ওষুধ লিখে দিয়েছি। আপনি পনেরো দিন বাদে আমাকে রিপোর্ট করবেন।

প্রণয়ের দেওয়া ফিজ নিতে নিতে দিগন্ত পেশাদারি গলায় বলল– ভয় পাবেন না। আপনার যা হয়েছে সেটা একরকম মানসিক রোগ। এই ধরনের পেশেন্টরা নিরানব্বই শতাংশই আর ডাক্তারের কাছে রিপোর্ট করতে ফিরে আসেন না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আপনিও আর আসবেন না।

প্রণয় ঘোষ চলে যাবার পর চেয়ারে বসে গা এলিয়ে দিল দিগন্ত। ষষ্ঠী উঁকি দিয়েছে দরজা ফাঁক করে। দিগন্ত শ্রান্ত গলায় বলল– এক কাপ কফির ব্যবস্থা করতে পারবে ষষ্ঠী? টায়ার্ড লাগছে একটু। কফিটা খেয়েই বেরোব।

দিগন্ত লম্বা শ্বাস নিল একবার। ছাতিম ফুলের ঘ্রাণের অনুষঙ্গে ফেলে আসা দিনগুলো ভেজা বাতাসের মতো ছুঁয়ে দিয়ে গেল যেন তাকে। সুখী দাম্পত্যই ছিল তাদের দু’জনের। কিন্তু পারমিতা আর তার মাঝখানে আচমকা এসে পড়েছিল তৃতীয় একজন। সদর হসপিটালের অ্যানিস্থেসিস্ট ডক্টর সেনাপতির স্ত্রী অদিতি।

রূপসি দু’ধরনের হয়। কোনও কোনও সুন্দরী নারীর রূপ হয় সুগন্ধি চন্দনের মতো, স্নিগ্ধ। কেউ কেউ আবার রূপের আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয় সব। গ্রীষ্মবনের মধ্যে এক ধরনের জ্বালা আছে। অদিতি ছিল ঠিক তেমন। তার সঙ্গে দিগন্তর আলাপ হয়েছিল একটা পার্টিতে। সাদামাটা কথা হয়েছিল একটা দুটো। তারপর থেকেই দিগন্তর দিকে একটু একটু করে ঝুঁকে পড়ল অদিতি। সাপের মতো জড়িয়ে নিল নিজের বেষ্টনীতে। ডক্টর সেনাপতি সারাদিন মদে চুর হয়ে থাকতেন। তিনি জানতেও পারলেন না তাঁর স্ত্রী কীভাবে খাদের অতলে ধীরে ধীরে টেনে নিয়ে যাচ্ছে দিগন্তকে।

সেদিন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অদিতির সঙ্গে সারাটা দিন গরুমারা ফরেস্টের এক রিসর্টে কাটিয়ে এসেছিল দিগন্ত। ডক্টর সেনাপতি কিছু জানতে না পারলেও কোনও শুভানুধ্যায়ী পারমিতার কানে পেৌঁছে দিয়েছিল মুচমুচে খবরটা। সন্ধেবেলা তীব্র অশান্তি হয়েছিল দিগন্ত আর পারমিতার মধ্যে। ঝগড়াঝাঁটির পর পারমিতা থম মেরে ছিল সারাক্ষণ। দিগন্তও বউয়ের সঙ্গে কোনও কথা বলেনি। স্টাডিরুমে জার্নাল পড়ছিল অনেকক্ষণ ধরে। অনেক রাতে দিগন্ত বিছানায় এসে দেখে মিতুল ঘুমোচ্ছে অকাতরে, কিন্তু পারমিতা শোয়নি। বসে আছে বিছানায়। ঠিকরে বেরোচ্ছে চোখ। দিগন্ত সামনে যেতেই ঘরঘরে গলায় বলেছিল, বুকের মধ্যে চাপ ধরে আসছে। কষ্ট হচ্ছে খুব।

ঘুমন্ত মিতুলকে বাড়িতে তালাবন্দি করে রেখে গাড়ি চালিয়ে পারমিতাকে নিয়ে হসপিটালের দিকে যাচ্ছিল দিগন্ত। গাড়ির মধ্যেই কষ্ট বেড়ে গিয়েছিল পারমিতার। ড্রাইভিং সিটে ছিল দিগন্ত, পিছনের সিটে কোলকুঁজো হয়ে শুয়ে গোঙাচ্ছিল পারমিতা। দিগন্ত গাড়ির গতি কমিয়ে পিছন ফিরে ঝুঁকে দেখছিল বারবার। পারমিতা দিগন্তর হাত আঁকড়ে ধরেছিল শেষ সময়ে। একটা কথাই শুধু বলেছিল ফিসফিসিয়ে। ‘ভালো থেকো’। ওই একটাই কথা। তারপর চোখ বুজে ফেলেছিল চিরকালের মতো।

প্রণয় ঘোষ যতক্ষণ তার চেম্বারে ছিল দিগন্ত সারাক্ষণ চেষ্টা করেছে পেশাদারি নির্লিপ্তি বজায় রাখার। কিন্তু এই দুটো ঘটনাটার যে এমন অদ্ভুত মিল, তার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কিছুতেই থই পায়নি। প্রণয় ঘোষ জানে না, জানবেও না কোনওদিন যে, কিছুদিন ধরে সে যা শুনছে, গত দশ বছর ধরে সেটাই শুনে আসছে দিগন্ত। একটু একলা হলেই পারমিতা কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে ‘ভালো থেকো’।

দিগন্ত তার ডাক্তার বন্ধুদের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধপত্র খেয়েছে বিস্তর, কিন্তু লাভ হয়নি। পারমিতার মৃত্যুর পর অদিতি ছিটকে চলে গেছে তার নিজস্ব বৃত্তে। দিগন্ত থেকে গেছে অন্যদিকে। মিতুলের সুখস্বাচ্ছন্দ্য ঘিরে এখন আবর্তিত হয় তার ভাবনা। তবুও একটু একা হলেই তার নিজস্ব নিভৃতিতে পারমিতা চলে আসে তার কাছে। কানের কাছে মুখ নিয়ে শুধু একটা কথা বলে। ‘ভালো থেকো’।

মৃত্যুর সময় আমাদের চেতনা ক্ষীণতর পর্যায়ে চলে যায়। চরমতম মুহূর্তে চেতনার পূর্ণ অবলুপ্তি ঘটে। সমস্ত স্মৃতি লোপ পায় আর জীবের মন, বুদ্ধি, অহংকার, ইন্দ্রিয়, প্রকৃতি ও কর্মফল জীবাত্মাকে অবলম্বন করে সূক্ষ্মদেহে অব্যক্ত স্থিতিতে চলে যায়। কিন্তু দিগন্ত কিছুতেই ভেবে কূল পায় না, চেতনার ক্ষীণতম মুহূর্তে দু’জন ভিন্ন মানুষ কী করে এই একটা কথাই উচ্চারণ করেছিল! এর মধ্যে কি কোনও গভীর তাৎপর্য আছে? দুটো মৃত্যুর ক্ষেত্রেই সে আর প্রণয় ঘোষ, তারা দুজনে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ভাবে দায়ী। সেজন্য কি চরমতম সময়ে তাদের দুজনের দুর্বল হৃদয় ভুল শব্দ পৌঁছে দিয়েছিল তাদের মস্তিষ্ককে? ওই ‘ভালো থেকো’ কথাটা কি সে কারণেই শুনতে পায় তাদের অবচেতন মন?

কফির কাপটা টেবিলে রাখল দিগন্ত। কাচের পাত্র থেকে দু’হাতের অঞ্জলিতে তুলে আনল একরাশ ছাতিম ফুল। ছাতিমফুলের গন্ধের মধ্যে একটা বিধুর বিষণ্ণতা আছে। সেই বিষণ্ণতা চারিয়ে গেল তার সমস্ত শরীরে। এতদিনে দিগন্ত বুঝে গেছে যে সে নিজে শতকরা একশোভাগ মনারোগীর দলে। প্রণয় ঘোষ সেরে উঠতেও পারে কিন্তু এ জীবনে রোগমুক্তি ঘটবে না তার। কোনও নিশ্চয়তায় সে পেৌঁছোতে পারবে না কোনওদিন। ‘ভালো থেকো’ কথাটা তার রক্তের মধ্যে মিশে গেছে। বিদ্রুপের মতো ঘুরপাক খাচ্ছে অহর্নিশ তারা শিরা-ধমনি জুড়ে। এভাবেই প্রত্যয়-অপ্রত্যয়ের অনিকেত দোলাচলে তাকে কাটাতে হবে সারা জীবন। তার বাকি জীবন এভাবেই উত্তীর্ণ হবে এক আদি-অন্তহীন অনিশ্চয়তায়।

সোনার বাঁশি

গ্যাসে গরম দুধ ফুটছে আর দুলাল অল্প অল্প করে ছানা কাটা পাউডার মিশিয়ে যাচ্ছে। ছানা কাটাও যে এত শক্ত কাজ কে জানত! কাল পাউডার বেশি পড়ে গেছিল, কী তেতো, কী তেতো! মুখেই তোলা গেল না। জানলায় একটা কাক এসে বসে রোজ সকালে, তার পেটেই গেল সব।

আজ তাই দুলাল খুব সাবধানে পাউডার মেশাচ্ছে। ছোট্ট সুন্দর প্লাস্টিকের কৌটোয় এই এতটুকু একটা বেগুনি চামচ, তাতে করেই তুলছে একটু একটু করে। দুধটা দানা পাকাতে শুরু করেছে। দুলাল পাউডার মেশানো বন্ধ করে। চামচটা কৌটোয় রেখে দেখে, যেটুকু পাউডার আছে তাতে এ মাসটা হেসেখেলে চলে যাবে। রান্নাঘরের লাগোয়া ছোট্ট স্টোররুম। এই জায়গাটা দুলাল রেখেছিল লিফটের জন্য। পাঁচতলা অ্যাপার্টমেন্ট। যারা চার বা পাঁচতলায় থাকবে তাদের কথা ভেবেই লিফট করতে চেয়েছিল। সবারই তো বয়স হচ্ছে। কিন্তু বউগুলো মহা বেয়াড়া। কাঁইমাঁই কাঁইমাঁই করে বলল, ‘লিফট চাই না, আমাদের কিচেনের সঙ্গে অ্যাটাচড স্টোররুম চাই।’ ব্যস্, লিফট বন্ধ। দুদিন পরেই টের পাবে মজা। মেয়েদের হাঁটু সবার আগে খারাপ হয়। এদিকে ফেসিয়াল করাবে, ওদিকে হাঁটু পালটাতে হবে। নকল হাঁটু নিয়ে সিঁড়ি ভাঙার কষ্ট বুঝবে হাড়ে হাড়ে!

সেই স্টোররুমে গিয়ে থরে থরে সাজানো ছোটো-বড়ো কৌটোর মধ্যে দুলাল চিত্রার্পিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল। চাল, ডাল, আটা, ময়দা, তেল, মশলা যা আছে আরও দু’মাস চলে যাবে। বাথরুমের বক্স মিররের মধ্যেও শ্যাম্পু, সাবান, বডি অয়েল। কমোডের পেছনের তাকে বাথরুম ঘষার অ্যাসিড, ব্রাশ। তাকে এখনও সংসারের একটা ছোট্ট জিনিসও একটা স্কচ-ব্রাইট কি টুথপেস্ট – কিছু কিনতে হয়নি।

শংকরী সব সাজিয়ে রেখে গেছে। যেমন বাড়িঘর, তেমনি নিজের শরীরটাও ঘষেমেজে রাখতে পছন্দ করত। পার্লারে যাবার সময় পেত না বলে একটা মেয়ে নিয়মিত বাড়িতে এসে ফেসিয়াল, হেনা, বডি মাসাজ করে দিয়ে যেত। দুলালের পছন্দ ছিল না এসব, বিশেষ করে আদুড় গায়ে বাইরের লোককে দিয়ে বডি মাসাজ, যতই মেয়েমানুষ হোক না। শংকরী মুখ টিপে হেসে বলত, ‘যে মন্দিরে নিত্য ঘন্টা বাজিয়ে পুজো করতে যাও, সেটা ঘষেমেজে না রাখলে হবে?’ মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত ঝকঝকে রাখা যার রোজকার সাধনা ছিল, সে টের পেল না তার দেহমন্দিরে কালসাপ বাসা বেঁধেছে?

দুলাল ছানা আর দুটো ক্রিমক্র্যাকার বিস্কিট নিয়ে শোবার ঘরের লাগোয়া ব্যালকনিতে এসে বসল, এই তার সকালের ব্রেকফাস্ট। ছেলে উঠলে তাকে ডিম-টোস্ট কিংবা নুডলস করে দেবে। তবে সে দশটার আগে নয়। একটু পরে রান্নার মাসি আসবে। তাকে রান্না বুঝিয়ে দিতে হবে। এই রে, ফ্রিজ থেকে মাছ বার করে রাখা হয়নি তো। দুলাল ছানার বাটি রেখে দৌড়ে ভেতরে যায়। ইস্, একদম বরফ হয়ে আছে। মাসি এসে চ্যাঁচামেচি জুড়ে দেবে। একদিকে ভাত, অন্যদিকে মাছ ভাজতে বসিয়ে সে তরকারি কুটে নেয়। আজ মাছের বরফ গলার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হবে তাকে। দুলাল জানে, মাসি গরমজল ঢেলে দেবে মাছে, এত দামি মাছটা একদম নষ্ট হয়ে যাবে।

দুলাল দেখল আটটা কাতলার পিস একসঙ্গে জমাট বেঁধে আছে। রান্না তো হবে মাত্র দুটো। রাতে তারা বাপ-ব্যাটা রুটি তরকারি খায়। তরকারি মাসিই করে যায়। গদি থেকে ফেরার পথে দুলাল রুটি কিনে আনে। ছেলে তো অর্ধেক দিন চাইনিজ-মাইনিজ খেয়ে আসে। মাসির রান্না তরকারি তার গলা দিয়ে নামে না। এত পয়সা নষ্ট দেখে খেপে যায় দুলাল। কিন্তু এটা সত্যি, শংকরীর হাতের রান্না যে খেয়েছে, সে কাজের মাসির হাতে খাবে কী করে? সকালে তবু গরম গরম মাছের ঝোল ভাত বেরোনোর তাড়ায় খেয়ে নেওয়া যায়। ভাতের মধ্যে দুলালের জন্যে একগাদা সেদ্ধ দেওয়া থাকে– উচ্ছে, পেঁপে, ভিন্ডি, কখনও কুমড়ো। নীচের ফ্ল্যাট থেকে বাচ্চুর মা ছেলের জন্যে ভাজাভুজি দিয়ে যায় রোজই। কিন্তু রাতের খাবার গলা দিয়ে নামে না। পয়সা দিয়ে কেনা সবজি, তাই শুধু মুখেই খানিকটা খেয়ে নেয় দুলাল। বাকিটা ফেলা যায়। রুটি চারটে দুধ-কলা দিয়ে খায় শেষে।

নাঃ, দুপিস দুপিস করে মাছ আলাদা আলাদা বাক্সে তুলে রাখতে হবে। দুলাল ঠিক করে আজই ফেরার পথে কিনে আনবে চারটে ছোটো প্লাস্টিকের বাক্স। আবার কী ভেবে রান্নাঘরে যায় একবার। গ্যাসের বাঁপাশের তাকে অনেক বাসনপত্র ধুয়েমুছে রাখা। এত বাসন লাগে না বলে দেখার দরকার হয়নি। দুলাল দেখল সেখানে ছোটো ছোটো চারটে মাছ রাখার ট্রান্সপারেন্ট প্লাস্টিকের বক্স ধুয়ে রাখা আছে। তাকে এগুলোও কিনতে হবে না। স্বস্তির শ্বাস ফেলল দুলাল। বেমক্বা জলও চলে এল চোখে। একটা মানুষ চলে গিয়েও ঘরের প্রতিটি কোনাকাঞ্চিতে ছড়িয়ে আছে। এ ঘর থেকে ও ঘরে গেলেই তার সঙ্গে দেখা হয়ে যাচ্ছে দুলালের। শুধু তাকে ছুঁতে পারছে না সে। সেই বেদানার আভা ঠিকরোনো গায়ে মুখ রাখতে পারছে না।

দুলালের মনে পড়ল ব্যালকনিতে ছানা আর বিস্কিট ফেলে এসেছে। সে আবার দৌড়ে গেল। এতক্ষণে কাক সেসবের ভুষ্টিনাশ করেছে নির্ঘাত। এ শহরে পাখি বলতে শুধু কাক। এত ধুলো, ধোঁয়া, শব্দ, মোবাইল টাওয়ার– কিছুই এদের দমাতে পারে না। নাঃ, খাবার ঠিকই আছে। শুধু ধুলো পড়েছে একটু। পাঁচতলায় হাওয়া বড্ড বেশি। ছানা একটু মুখে দিয়েছে, অমনি দুলালের মনে পড়ল তরকারির সবজি গুছিয়ে আসা হয়নি, যাক, মাসি নেবে নয় গুছিয়ে। বিস্কিটে একটা কামড় বসাতেই ডোরবেল বাজল। উঃ, একটু খাওয়ারও ফুরসত নেই। মাসি এসে পড়ল নাকি এত তাড়াতাড়ি! খেতে খেতে উঠে গেলে

শংকরী খুব রাগ করত। কিছুতেই উঠতে দিত না দুলালকে খাওয়া ফেলে। নিজেই গ্যাস কমিয়ে ছুটে যেত দরজা খুলতে। আর এখন! দুলাল তার আধখাওয়া বিস্কিট আর ছানার প্লেট ডাইনিং টেবিলে রেখে দরজা খুলে দিল। না, রান্নার মাসি নয়, মানি, সেজ ভাইয়ের মেয়ে। ওরা তিনতলায় থাকে।

‘জেঠু, আমাদের কমোডের ফ্ল্যাশ কাজ করছে না!’ দুলালের মাথা চিড়িক করে উঠল রাগে। মানিকতলায় ভাড়া বাড়ি থেকে সল্টলেকের এই পাঁচতলা ফ্ল্যাটে পুরো পরিবারটিকে যে একার চেষ্টায় নিয়ে এসেছে। বহু আগে কিনে রাখা জমি। বাড়ির প্ল্যান পাকা করানো থেকে পাথর কেনা, পার্টির ছেলেদের টাকা দেওয়া থেকে বেসমেন্টে দারোয়ানের ঘর– সব ঝক্বি সামলে সে তিল তিল করে বাড়িটা তুলেছে। শুধু বাড়ি নয়, প্রতিটি ফ্ল্যাটের খাট, আলমারি, ড্রেসিংটেবিলের মতো আসবাবও দেওয়া হয়েছে যৌথ ব্যাবসা থেকে। এভাবে একতরফা পেতে পেতে বউগুলো কি তেলিয়ে গেছে। বাথরুমের মগ থেকে ফেসিয়ালের খরচ সবই বারোয়ারি খরচ থেকে আদায় করতে চায়। আক্বেল দ্যাখো, ফ্ল্যাশ কাজ করছে না তো প্লাম্বারকে ফোন কর, তা না, ভাসুরকে ডাকছে। শংকরী থাকলে নয় একটা কথা ছিল। তখন তো তাকে সংসারের কুটোটি নাড়তে হতো না। এখন দুলাল নিজের ঘর সামলাবে না ভাইয়ের বাথরুম দেখতে ছুটবে!

‘তোর বাবাকে বল প্লাম্বারকে ফোন করতে।’ বলেই দুলাল দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দেয়। আবার বেল। এবার রান্নার মাসি। রান্নার মাসি ভেতরে ঢুকে এলে দুলাল আর দরজা বন্ধ করে না। মাসি বললেও, রাঁধুনিটি যুবতি মেয়েমানুষ। পাঁচবাড়ি কাজ করেও ঢলোঢলো শরীর। তাই সে যতক্ষণ কাজ করে, ততক্ষণ দরজা খোলা রাখে দুলাল। ঘরের কাজ সারতে সারতে বারবার দরজায় চোখ রাখে। এ বাড়িতে সকাল থেকে ঘরে ঘরে বাইরের লোক কাজে ঢোকে। বেশিরভাগই কেষ্টপুরের খালপাড় থেকে। সুযোগ বুঝে কে কখন কী হাতিয়ে নেবে তার ঠিক কী। তার চোখ থেকে থেকে রান্নার মাসিকেও নজর করে। আঁচলে চাল ডাল বেঁধে নিয়ে গেলে যদিও তার কিছু করার নেই। চুপচাপ হজম করে যেতে হবে। বলতে গেলে সে উলটে কেস খেয়ে যাবে। সংসারে কেবল একা মেয়েমানুষ নয়, একা পুরুষমানুষেরও অনেক বিপদ। সেদিন যখন দেখল শাক কুটতে কুটতে মশা মেরে, সেই হাতেই শাক ধুল, তখন রান্নাঘরে একটা অল-আউট জ্বালিয়ে আসা ছাড়া তার কিছু করার ছিল না। দুলাল ফ্রিজ থেকে থোড়, উচ্ছে, পেঁপে আর বেগুন বার করে দিল।

‘থোড় চচ্চড়ি সরষে দিয়ে, উচ্ছে আর পেঁপে সেদ্ধ, বেগুন দিয়ে মাছের ঝোল।’

থোড় দেখে মাসির মুখ কালো। তার ওপর দুলাল বলল, ‘মাছের তেল আছে অনেকটা, চালের গুঁড়ো দিয়ে দাদার জন্য বড়া বানিয়ে দিও।’

মাসি খরখরে গলায় বলে, ‘চালের গুঁড়ো বার করে দিয়ে যান মেসো।’

চালের গুঁড়ো! এতদিন দরকার পড়েনি কোনও। দুলাল আবার স্টোররুমে ঢোকে। খুঁজতে হয় না বেশি। প্রতিটি কৌটোর গায়ে লেবেল সাঁটা। শংকরী নিজের হাতে বড়ো বড়ো করে লিখে আঠা দিয়ে সেঁটে রেখেছে। দুলাল লেখাটার গায়ে হাত বুলোয়। তার মাথা ঝিমঝিম করে। এইসব তো একদিন না একদিন ফুরোবেই। তখন আবার কিনে কৌটোয় কৌটোয় তুলে রাখা– এসব তো কাজের লোক দিয়ে হবে না। তাকেই করতে হবে। শংকরীর ভাঁড়ার যেন না ফুরোয়! ফুরোচ্ছেও না। সব জিনিস চাইলেই পেয়ে যাচ্ছে। এমনকী ঠাকুরের ধূপ, বাতাসা, কাটিং মিছরি পর্যন্ত এখনও কিনতে হয়নি। লক্ষ্মীবারের হত্তুকি, সুপুরি, এক টাকার কয়েন সব রাখা নিখুঁতভাবে। পিসিমা এসে পনেরো দিন ছিল, তখন সব ওলটপালট করেছিল। দুলালের সহ্য হয়নি।

শংকরী চলে যাবার পরদিনই পিসিমা চলে এসেছিল নবদ্বীপ থেকে। অন্য গোত্রের মানুষ, তার ঠাকুরসেবায় দোষ নেই। সে সময় দুলাল কোনও দিকে তাকায়নি। ওর শরীর মন কেমন অসাড় হয়ে গেছিল। মাঝে মাঝে নিজেকে ঝাঁকিয়ে নিয়ে ও জিজ্ঞেস করত ‘আমি কি বেঁচে আছি?’ কিন্তু শ্রাদ্ধের জোগাড়যন্ত্র শুরু হতেই ও আর এমন নিভৃতে থাকতে পারল না। খুঁটিনাটি কেনাকাটা, প্যান্ডেল, নেমন্তন্নের লিস্ট, কার্ডের ডিজাইন, খবরের কাগজে শোকস্তম্ভ– সব কিছুই সে ছাড়া হবে না। এমন অপদার্থ তার ভাইগুলো! নেমন্তন্নর লিস্ট করতে বসে মনে পড়ল অনেকদিন আগে যে -পুরুতঠাকুর তাদের মানিকতলার বাড়িতে পুজো করতে আসতেন, সেই ইন্দুমাধব ভট্টাচার্যির কথা। বয়স হওয়ার জন্য অনেকদিন আসতে পারেন না, বেঁচে আছেন কিনা কে জানে।

ঠাকুরের সিংহাসনের পাশে একটা ছোট্ট তেপায়া চৌকিতে রাখা লক্ষ্মীর পাঁচালির মধ্যে একটুকরো কাগজে তাঁর ঠিকানা লিখে রেখেছিল শংকরী। সেই ঠিকানাটা খুঁজতে ঠাকুরঘরে এসে দুলাল অবাক। পুবমুখে রাখা সিংহাসনটা উত্তরমুখ করে কে বসাল! সবকিছুই পরিপাটি করে রাখা কিন্তু আগের মতো কোনওটাই নয়। গঙ্গাজলের সারি সারি বোতল, ঠাকুরের একরাশ বাসন, পঞ্চপ্রদীপ, চামর– সবকিছু পিসিমা নিজের ইচ্ছেমতো, সুবিধেমতো গুছিয়ে নিয়েছে। রাগে দুলালের মাথা দপদপ করতে লাগল। এখনও শ্রাদ্ধ চোকেনি।

শংকরীর নিজের হাতে সাজানো সংসার এলোমেলো করা শুরু হয়ে গেল! সে চিৎকার করে ডাকল, ‘পিসি, ও পিসি।’ বাড়িতে থইথই করছে আত্মীয়স্বজন। বাইরের লোকও বিস্তর। তার মধ্যেই রাগে দিগ্বিদিক শূন্য দুলাল পিসিকে যা-তা শুনিয়ে দিল। পিসি কেঁদেকেটে তক্ষুনি নবদ্বীপ চলে যেতে চাইল। তখন আবার তাকে হাতে পায়ে ধরে রাখতে হল দুলালকে।

সেই পিসি সপ্তাখানেক আগে চলে গেছে। সিংহাসন আবার আগের মতো পুবমুখো করে বসানো হয়েছে। শুধু ঠাকুরের সিংহাসন নয়, আলমারি, আলনা, যেখানে যেমন ছিল সব তেমনটাই রেখে দিয়েছে দুলাল। শুধু রান্নাঘরটা পারছে না। এই পাঁচবাড়ি কাজ করা রান্নার লোকগুলো যা করে যায়। অনেক চেষ্টা করেও রান্নাঘরটা আগের মতো রাখতে পারছে না দুলাল।

অথচ শংকরী তাকে প্রতিমুহূর্তে আড়াল থেকে সাহায্য করে যাচ্ছে। এখনও অবধি চাল, ডাল, মশলা থেকে শুরু করে সাবান, ফিনাইল কিছুই কিনতে হয়নি তাকে! সব কিছু থরে থরে সাজিয়ে রেখে গেছে শংকরী।

মধুসূদনদাদার দইয়ের ভাঁড়ের মতো তার সংসারের রসদ যেন অফুরন্ত। শ্রাদ্ধের সময় প্রচুর এক টাকা, দু’টাকার কয়েনের দরকার হয়েছিল। সেগুলোও হঠাৎ একটা পুরোনো পাউডারের কৌটোয় পেয়ে গেল। একটা বেবি পাউডারের কৌটো। ছেলেমেয়েকে ছোটোবেলায় এই পাউডার মাখাত শংকরী। দুলাল কিন্তু কৌটোর মধ্যে ছেলেমেয়ের নয়, শংকরীর গায়ের গন্ধ পেল। কৌটোয় একটু তলানি পাউডার পড়ে ছিল সত্যি সত্যি। আর সেই পাউডারের গুঁড়ো গায়ে মেখে একরাশ কয়েন– এক টাকা, দু টাকা, পাঁচ টাকা, দু-একটা দশ টাকারও। সেগুলো হাতে নিয়ে দুলাল তাদের একসঙ্গে পথচলার এতগুলো বছর দেখতে পাচ্ছিল। কত বছর ধরে এগুলো সঞ্চয় করেছে শংকরী! এই সংসারের মতো, তিলে তিলে সে জমিয়ে তুলেছে খুচরোর ভাণ্ডারও।

সব আছে, শুধু সেই-ই নেই।

কয়েনগুলো পেয়ে যাবার পর থেকে জীবনটা ভারি রহস্যময় মনে হচ্ছে দুলালের। আগে এরকম কখনও হয়নি। শংকরী যখন ছিল তখন বড়োবাজারে গদিতে যাওয়া আর বাড়ি ফেরা– এর বাইরে কোনও কিছু নিয়ে ভাবার দরকার হয়নি তার। এখন মনে হচ্ছে জীবনের আনাচেকানাচে তার জন্য অনেক অজানা অপ্রত্যাশিত বিস্ময় অপেক্ষা করে আছে। দুলাল বাড়িতে যতক্ষণ থাকে, এটা ঝাড়ে, ওটা ঝাড়ে, এটা টানে, ওটা খোলে আর দুরুদুরু বুকে ভাবে, এবার কী বেরোবে। শংকরী কোথায় না কোথায়, কত কী যে লুকিয়ে রেখে গেছে। ‘ও মেসো, হয়ে গেছে। ঠান্ডা হলে বাটিগুলো ঢাকা দিয়ে দেবেন। আমি ওবেলার তরকারি আলাদা বাটিতে রেখেছি। ঘাঁটাঘাঁটি করলে নষ্ট হয়ে যাবে।’

দুলাল দরজা বন্ধ করতে যায় রান্নার মাসির পেছন পেছন। হঠাৎ মাসি ঘুরে দাঁড়িয়ে ব্লাউজের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দেয়। দুলালের গলা শুকিয়ে কাঠ। হাত ঢুকোনো আর বার করে আনার ফাঁকে এক ঝলক দেখা যায় পুরুষ্ট দুই স্তনের মধ্যের গহন খাঁজ।

মহিলাটি দুলালের চোখের তাক বুঝে ঠোঁট টিপে হাসে, তারপর হাত বাড়িয়ে দুলালের হাতে দুটো একশো টাকার নোট দেয়। দুলাল হতভম্বের মতো তাকায়।

‘শুকনোলংকা খুঁজতে গিয়ে একটা কৌটোর মধ্যে পেলাম। আমরা গরিব হতে পারি, চোর নই।’

দুশো টাকা আর অপমানটুকু গিলে নিয়ে দুলাল দেখে মহিলা কেমন দপদপিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। দুলাল অসহায় ভাবে দেখে ওর চলে যাওয়া। কাল আবার আসবে তো? দরজা বন্ধ করে ঘুরে দাঁড়াতেই চমকে যায়। ছেলের ঘরের দরজা খোলা। বিছানায় উপুড় শোয়া ছেলে একটু উঁচু হয়ে তার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বাবলু কি দেখেছে দুলাল রান্নার মাসির বুকের খাঁজের দিকে…

সে ঢোঁক গিলে বলে, ‘কী রে, দশটা বেজে গেল। ওঠ এবার। আমাকে তো সব গুছিয়ে বেরোতে হবে।’

বাবলু ওই একই ভঙ্গিতে শুয়ে শুয়ে বলে,

‘বাপি আজ রাতে আমি দীঘা যাচ্ছি।’

‘দীঘা! কেন?’

‘এমনি, ভালো লাগছে না। ইন্দ্ররা যাচ্ছে গাড়ি নিয়ে, আমাকে ধরেছে। ঘুরে আসি।’

একুশ পূর্ণ হয়নি এখনও। সামনের এপ্রিলে ওর জন্মদিন। এই প্রথম শংকরী পায়েস রাঁধবে না। ছেলে নিয়ে অশান্তির শেষ ছিল না শংকরীর। অত টাকা দিয়ে বিবিএ-তে ভর্তি করা হল, দুম করে ছেড়ে দিয়ে গাড়ির বিজনেস করবে বলে মেতে উঠল। রাত দুপুরে ফেরা, এক রাশ বন্ধু, ক্লাব, পুজো। অবশ্য এখনও ছেলের মুখ থেকে মদের গন্ধ পায়নি দুলাল। কিন্তু দীঘা! মা চলে গেছে দু ‘মাসও হয়নি।

দুলাল বিড়বিড় করে বলল ‘যা খুশি কর।’

ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। নীচ দিয়ে গাড়ি ছুটছে বিরামহীন। কোথাও কিছু অভাব, বেদনা চোখে পড়ে না। শুধু তার ঘরেই… বেআদব ছেলেকে তার ঘাড়ে ফেলে ড্যাং ড্যাং করে চলে গেল শংকরী। মনটা হুহু করে। বেরোতে ইচ্ছে করে না একেকদিন। কিন্তু ফাঁকা বাড়িতে থাকার কথা ভাবলেই আঁতকে ওঠে। গদিতে তবু পাঁচটা লোকের মুখ দেখা যায়। বাবলু তো একটু পরেই বেরিয়ে যাবে।

বাবলু চ্যাঁচায় ‘বাপি শুনে যাও।’

এতবড়ো ছেলে, একটু দুধ গরম করে নেওয়া কি ম্যাগি করা– সেটুকুও পারে না। সব বাপ করে দেবে। ছেলেকে মাথায় তুলে দিয়ে গেছে শংকরী। এখন ঠ্যালা সামলাও।

‘কী হল? ম্যাগিটা করতে পারছিস না?’

‘সে সব নয়। একেবারে ভাত খেয়ে বেরোব।’ মেঝেতে বসে ছেলে ব্যাগ গুছোচ্ছে।

‘কী হল আবার?’

‘বাপি, দ্যাখো তো, মা বলেছিল, আমার দুটো ইনার কিনেছে। দ্যাখো না প্লিজ কোথায় আছে। বাড়িরগুলো নিয়ে যাওয়া যাবে না।’

খুব ক্লান্ত লাগে দুলালের। মনে হয়, পালিয়ে যায় কোথাও। এই সংসার তাকে একটুও রেহাই দেবে না। সারাদিন সে এগুলোই করবে নাকি?

ব্যাজার মুখে শোবার ঘরে এসে আলমারি খোলে দুলাল। সব থরে থরে সাজানো। ছেলের, বাপের, শংকরীর কাপড়জামা– সব আলাদা আলাদা তাকে। এমনভাবে গুছিয়ে গেছে শংকরী যে অন্ধ মানুষও খুঁজে পেয়ে যাবে। কিন্তু দুলাল বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে আলমারি খুলে। তার মনে হয়, এই মহাসমুদ্র থেকে প্রার্থিত জিনিসটি সে খুঁজে পাবে না।

‘পেলে, বাপি?’ ছেলের চিৎকারে হুঁশ ফেরে দুলালের। গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে সে। ছেলের তাকে খুব সহজেই পেয়ে যায় প্যাকেটে নতুন দুটো ইনার। আলমারি এবার বন্ধ করলেই হয়। দুলাল তবু দাঁড়িয়ে থাকে আরও খানিকক্ষণ। হ্যাঙারে ঝোলানো শংকরীর শাড়িগুলোর ঘ্রাণ নেয়। প্রতিটা দামি শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ আর ক্লাচব্যাগ মিলিয়ে মিলিয়ে রাখা। সেজেগুজে বেরোলে মাথা ঘুরে যেত সবার। সেসময় দুলালের তাকিয়ে দেখার সময় হয়নি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আলমারি বন্ধ করতে গিয়ে থমকে যায় সে। আরে, এই দামি দামি ক্লাচব্যাগগুলোর মধ্যে এই ছেঁড়া ছেঁড়া পার্সটা কেন? আবছা মনে পড়ে, বহুবছর আগে নবদ্বীপ যাবার সময় ট্রেন থেকে কিনেছিল এটা। বহুদিন দেখেনি। এটা ব্যবহার করত নাকি শংকরী?

কী মনে হতে ব্যাগটা বার করে খোলে দুলাল, অমনি তার চোখ যেন ঝলসে যায়। ব্যাগের মধ্যে অল্প কিছু খুচরো টাকা আর একটা হলুদ রসিদের মধ্যে শুয়ে এটা কী? একটা বাঁশি! সোনার বাঁশি! রসিদটা খুলে দেখে চিত্রালি জুয়েলার্সের বিল। পেড। শংকরী এত টাকা মিটিয়ে দিয়ে গেছে! চায়নি তো তার কাছে! নিজের জমানো হাতখরচ থেকেই এত টাকা মিটিয়ে দিয়ে গেছে শংকরী?

দুলাল বিছানায় ধপ্ করে বসে পড়ে। তার মনে পড়ে যাচ্ছে এবার। গোপালের জন্য একটা সোনার বাঁশি গড়িয়ে দেবার আবদার করেছিল শংকরী। চিত্রালি থেকেই বরাবর সে গয়না বানায়। সেখানে দেখে পছন্দ করে এসেছিল। শুনেই দুলাল চটে লাল। ‘অত বাড়াবাড়ি কোরো না। গোপালের সোনার বাঁশি! যত্তসব। তুমি বাঁশি গড়ালে বাকি বউরা তো সোনার সিংহাসন চেয়ে বসবে।’

আর একটাও কথা বলেনি শংকরী এ নিয়ে। কিন্তু বাঁশি সে ঠিকই গড়িয়ে রেখে গেছে। নিজের তিল তিল করে জমানো পয়সা দিয়ে শোধও করে গেছে। জন্মাষ্টমীতে হয়তো গোপালের হাতে তুলে দেবে, এমন সাধ ছিল তার। কিন্তু কালরোগ একটুও সময় দিল না। টাটা মেমোরিয়াল থেকে ঘুরে আসার এক সপ্তাহের মধ্যেই…

দু-তিনবার ডেকে সাড়া না পেয়ে এঘরে আসে বাবলু। বাবাকে ওইভাবে খাটে বসে থাকতে দেখে একটু ঘাবড়ে যায় সে।

‘কী হল, পাওনি?’

উত্তরে দুলাল ছেলের চোখের সামনে তার হাতের পাতা মেলে ধরে। সোনার বাঁশির আভায় মুহুর্তে ঘর আলো হয়ে যায়। এখন শুধু ফুঁ দেবার অপেক্ষা।

নীরবে

আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি, সেই আমাদের একটিমাত্র সুখ..

ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথেই অর্ণবের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল তৃয়ার। একেবারে মুখোমুখি। একমুখ দাড়ি আর ঢলঢলে পাঞ্জাবিতে বেশ অচেনাই লাগছিল তাকে। তবু তৃয়া চিনেই ফেলে, প্রায় আঠারো বছর পরেও। সেই আগের চঞ্চল, ডায়নামিক অর্ণব বদলে গেছে অনেকটাই। অবাক হয়ে লক্ষ্য করছিল তৃয়া। সেদিন দুজনে হেঁটে গিয়েছিল কিছুটা পথ। তৃয়ার মনে পড়ে যাচ্ছিল কলেজের সেই সব দামাল দিনগুলোর কথা। তখনও তো তারা হেঁটে গিয়েছিল কত কত পথ একসঙ্গে, পায়ে পা, হাতে হাত মিলিয়ে কথা ফুরোত না দুজনেরই।

অর্ণব একের পর এক সুনীল, শক্তি, কিটস, শেলি আবৃত্তি করত আর তৃয়া মুগ্ধ হয়ে শুনত। দুজনে মিলে গড়ে তুলেছিল তাদের নিজস্ব জগৎ। কখনও বা উদাত্ত গলায় গেয়ে উঠত অর্ণব –

এই তো হেথায় কুঞ্জ ছায়ায় স্বপ্ন মধুর মোহে, এই জীবনের যেকটি দিন পাব, তোমায় আমায় হেসে খেলে

খিল খিল করে হেসে উঠত তৃয়া। তারপর দুজনে সেই মধুর স্বপ্ন দেখত দুচোখ ভরে।

হাঁটতে হাঁটতে আড়চোখে অর্ণবকেই দেখছিল তৃয়া। একটু বেশিই বয়স্ক দেখাচ্ছে না! অথচ তারা তো একই বয়সি। তেমন কথা বলছে না অর্ণব আগের মতো। তৃয়াই বলে চলছে তার স্বামীর কথা, সন্তানের কথা, আরও কত কী! অর্ণবের কি কোনও গল্পই নেই?

চা খাবি? এখানে একটা আড্ডা-ঘর খুলেছে, ওই কফি হাউসের ছোটো সংস্করণ আর কি! দার্জিলিং টি-টা দারুণ বানায়। এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল তৃয়া।

না রে! চা খাই না এখন আর, অল্প হাসল অর্ণব।

চা খাস না! এত নেশা ছিল! অবাক হয় তৃয়া।

সে তো কত কিছুরই নেশা ছিল, বলেই থমকাল অর্ণব।

তৃয়ার বুকের ভেতরটা হঠাৎই কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগল। অর্ণব-কে তা বুঝতে না দিয়ে হালকা গলায় বলে উঠল, হ্যাঁ রে, কিছু নেশা শেষ অবধি টানা যায় না।

আচমকা দুজনের মাঝখানে একটা নিস্তব্ধতা চলে এল। এ নীরবতা ভাঙার সাধ্য তৃয়ার অন্তত নেই।

(২)

ব্যাপার কী! ক’দিন খুব অন্যমনস্ক দেখছি। মাথায় একটা হালকা চাঁটি মারল সৈকত। চমক ভেঙে সৈকতের চোখের দিকে তাকাল তৃয়া। ওর চোখ জুড়ে কৌতুক।

তৃয়াও হেসে জবাব দিল, ভাবছি।

ভাবছ! তা কী ভাবা হচ্ছে ম্যাডাম? আমার পক্ষে না বিপক্ষে? হাসতে হাসতেই বলল সৈকত।

ছেলেটা মহা ফাজিল। বাড়িতে থাকলে সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখে। অন্য কিছু ভাবারই অবকাশ পায় না তৃয়া।

যদি বিপক্ষে ভাবি… তৃয়া চোখ নামাল।

সে কি ম্যাডাম! পুরোনো প্রেম আবার এল কি ফিরিয়া?

সৈকত কি বুঝে নিল কিছু! তৃয়া সৈকতের এলোমেলো চুলগুলো আরও খানিকটা ঘেঁটে দিয়ে বলল, পাগল একটা!

হেসে উঠল সৈকত। তৃয়ার কপালে স্নেহ চুম্বন আঁকতে আঁকতে বলে উঠল- তুই জীবন ছাইড়া গেলে মাইনষে কইবে মরা জীবন রে..

সৈকত-কে আঁকড়ে ধরল তৃয়া, প্রবল ভাবে।

(৩)

আবার দেখা যদি হল সখা প্রাণের মাঝে আয়…

অ্যাই অর্ণব! এত হনহন করে যাচ্ছিস কোথায়?

তোর সঙ্গে পরে কথা বলছি তৃয়া, একটু ব্যস্ত আছি।

অবাক হয় তৃয়া। ঠিক অবাক অবশ্য নয়, গলাটা কেমন ব্যথা ব্যথা করছে। গত দুদিন ধরেই অর্ণব এটা করে চলেছে। যখনই ডাকছে তৃয়া, সময় নেই ওর। অথচ তৃয়া টের পাচ্ছে সমস্ত কলেজ জুড়ে অর্ণবের তীব্র উপস্থিতি। শুধু তৃয়া ডাকলেই…

অভিমান করে তৃয়া। এড়িয়ে চলারও চেষ্টা করে। পারে কি? উলটে কী এক অমোঘ টানে আরও কাছে কাছে চলে আসে অর্ণবের। তৃয়া অপেক্ষা করে ওই একটি মাত্র ডাক শোনার জন্য!

(৪)

সুখের সংসার বলতে ঠিক যা বোঝায় তৃয়ার সংসারটাও ঠিক তেমনই। তবু হঠাৎ হঠাৎ এই সুখের মধ্যিখানে অর্ণব নামের একটা কাঁটা অনবরত খোঁচাতে থাকে। তৃয়া রক্তাক্ত হয়, জখম হয় সৈকতও। অথচ এই রক্তক্ষরণ বন্ধের উপায় জানা নেই কারাওরই। সৈকতের ভালোবাসার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করার পরও, তৃয়া বুঝতে পারে কোথায় যেন কিছু শূন্যস্থান এখনও রয়ে গেছে। আজও কোনও অলস দুপুরে বা একাকী রাতে ছাদে দাঁড়ালে এক রাশ হিমেল বাতাস কোত্থেকে এসে, তৃয়ার সব কিছু উড়িয়ে নিয়ে চলে যায়। দু’গাল বেয়ে লোনা জল হু হু করে গড়িয়ে যেতে থাকে। তৃয়া আর আটকায় না তাকে। সে জানে এই শূন্যস্থান একমাত্র পূরণ করতে পারে অর্ণব। শুধু একটিবার দেখা হোক।

 

দীর্ঘ দিবস দীর্ঘ রজনী ,দীর্ঘ বরষমাস…

ঝগড়া, ভুল বোঝাবুঝি, চিত্কার নাহ্ তাদের সম্পর্কের মধ্যে এগুলো কোনওদিনই অযাচিত ভাবে ঢুকে পড়েনি। শুধু তৃয়া যেদিন টের পেল অর্ণব স্বেচ্ছায় দূরে চলে যেতে চাইছে, আর পিছু ডাকেনি সে। হয়তো কেঁদেছে, তবে সে কান্নার খবর অর্ণব পায়নি। হয়তো অভিমান করেছে, মনে মনে অসম্ভব যুদ্ধ করেছে, আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছে অর্ণবকে শুধু ধরা দেয়নি আর কিছুতেই। কোনওদিন জানতে চায়নি তৃয়া, কেন? দাঁতে দাঁত চেপে থেকে গেছে এতগুলো দিন।

বাবা-মায়ের পছন্দ করা ছেলে সৈকতকে হয়তো ভালোবেসেছে একদিন। তবু! এখনও কলেজের ওই রাস্তাগুলো দিয়ে কোনও সময় চললে অজান্তেই ঘাড় ঘোরায় তৃয়া। কেউ কি ডাকছে? ওই তো ওই ছেলেটা! অর্ণব না! ভুলতে চেয়ে কিছুতেই আর ভুলে যেতে পারেনি তৃয়া, কিছুতেই না।

আজ এতগুলো বছর পর অর্ণবকে দেখে পুরোনো সবকিছুই আবার যেন চোখের সামনে চলে আসছিল। সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে পিছিয়ে যাচ্ছিল তৃয়া… ওই তো সেদিন কলেজের সামনের সেই বিরাট খেলার মাঠে বসে তারা দুজন ভিড়, কোলাহলের মধ্যেই দুজনে দুজনাতে মগ্ন। কখনও হাতে হাত ছুঁয়ে হেঁটে যাচ্ছে চেনা-অচেনা পথ পেরিয়ে অলীক সুখের দিকে। সে হাঁটা আর আজকের হাঁটার সঙ্গে তেমন মিল খুঁজে পেল না তৃয়া। তখন হাঁটতে গিয়ে সময়ে খেয়াল থাকত না দুজনেরই। আজ বারবার হাত ঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছে তৃয়া। ছেলের ছুটি ১-টায়, সৈকতও আজ আগেই ফিরবে। আইনক্স-এ জঙ্গল বুক-এর টিকিট কাটা।

অবাক হয় সে। গলার মধ্যে সেই আঠারো বছর আগেকার কষ্ট কষ্ট ব্যথাটা আর নেই তো! অর্ণবের কথা জানতে ইচ্ছে করে তার। কী করে সে এখন? চাকরি জুটিয়েছে আদৌ? বিয়ে করেছে? অর্ণবের অদ্ভুত শীতলতার কাছে আজও তৃয়া নিজেকে খুলতে পারে না। দুজনে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে যায় আরও কিছুটা দূর।

তুই এখনও কবিতা লিখিস? জানতে চায় তৃয়া।

ম্লান হাসে অর্ণব, কবিতা আর ধরা দেয় না রে। হারিয়ে গেছে অক্ষর, আঠারো বছর আগে।

একদিন হারাবে অক্ষর, সেদিনও কি প্রেম থাকবে? শব্দ বদলে ভালোবাসা দেব, শুধু তুই ছুঁয়ে থাকলে মন্ত্রের মতো — উচ্চারণ করে তৃয়া।

তোর এখনও মনে আছে? এবার যেন অর্ণবের অবাক হওয়ার পালা।

ওই একটা ডায়ারিতে লিখে রেখেছিলাম, মাঝে মধ্যে চোখে পড়ে, তাই হয়তো মনে আছে। চোখ নামাল তৃয়া।

অর্ণব হাসল। হয়তো বুঝে নিল শুধু এই কবিতাটিই না, অর্ণবের লেখা প্রায় সব কবিতাই হুবহু বলে দিতে পারে তৃয়া আজও।

তুই আজও গান গাস? আচমকাই জানতে চায় অর্ণব।

গা-ন! ধুর, সময় কোথায়? ছেলে যা দুষ্টু। তৃয়া হাসে। সৈকত বলে, জানিস তো! আবার শুরু করার কথা… কিন্তু!

কিন্তু কী?

আর নতুন করে কোনও কিছু শুরু করতে ইচ্ছে করে না রে। তৃয়ার গলায় সামান্য হতাশা কি ঝরে পড়ল?

অর্ণব হাসল আবার। আড়চোখে তৃয়াকে দেখল সে। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে মেয়েটা। পুরোদস্তুর সংসারি হয়ে উঠেছে। আগের চাইতে অনেক বেশি সুন্দরী আর পরিণত লাগছে তাকে। ভালো লাগল অর্ণবের। এই পরিপূর্ণতা সে কোনওদিনই দিতে পারত না তৃয়াকে, কোনওদিনই না।

ইদানীং সৈকতকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরতে মন চায় তৃয়ার। অফিসে থাকলে ঘনঘন ফোন বেজে ওঠে সৈকতের, কখন আসবে? সৈকত বুঝতে পারে আর তাদের মধ্যে কোনও কাঁটা নেই। তার অজান্তেই কে যেন সরিয়ে নিয়েছে ওটা, তাদের মাঝখান থেকে। সৈকত স্ত্রী-র কাছে কিছু জানতে চায় না। কিছু জানারও নেই তার। সৈকত শুধু জানে তারা বাঁচবে একসঙ্গে আরও দীর্ঘ দীর্ঘ বছর।

 

মম দুঃখবেদন মম সফল স্বপন তুমি ভরিবে সৌরভে..

আর বেশি দূর এগোনো যাবে না রে, ছেলেটার ছুটির আগে স্কুলের গেটের কাছে পৌঁছোতে হবে, নইলে কান্নাকাটি শুরু করে দেবে। হালকা গলায় বলে উঠল তৃয়া।

ওহ্ যাবি? তা যা, হঠাৎ যেন চমক ভাঙল অর্ণবের।

সরাসরি তৃয়া-র দিকে তাকাল অর্ণব। একটু হাসল। কিছুই তো জানতে চাইলি না?

জেনে গেছি যে! তৃয়ার গলায় হাসি ঝরে পড়ল।

কী জেনে গেছিস? জানতে চাইল অর্ণব।

সে আর তোর শুনে কাজ নেই। আমি চলি রে। খুব ভালো থাকিস। বলেই হাতটা বাড়িয়ে দিল তৃয়া।

হাত বাড়িয়ে আবার সেই পুরোনো স্পর্শ খুঁজে পেল অর্ণব। কিন্তু সেই অতীতের উষ্ণতার দেখা মিলল না। হাত ছেড়ে তৃয়া হাঁটতে শুরু করল, যেখানে তার ছেলে অপেক্ষা করছে। সৈকত-কেও হোয়াটসঅ্যাপ-এ মিস ইউ লিখে পাঠিয়ে দিল তৃয়া। হাঁটতে হাঁটতেই শুনতে পেল অর্ণব বলছে, একবার কিছু বলার সুযোগ দিতে পারতিস! তৃয়া? একবার শুনে যা…

তৃয়া এই ডাকটার জন্যই তো এতদিন অপেক্ষা করছিল। কিন্তু আজ আর কিছু শুনতেই ইচ্ছে করল না তার। তৃয়া তার হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল।

ছায়া ছায়া পাপ

এই ভর সন্ধেবেলায় হঠাৎ বাবুর ঘরে ডাক পড়ল কেন ভেবে পেল না দেবু। সন্ধের গা ঢাকা অন্ধকারে ত্রিপলের ছাউনি দেওয়া লরি থেকে ষোলো বস্তা চিনি আর আট টিন সরষের তেল সবে গুনে গেঁথে ঢুকিয়েছে গোডাউনে, এমন সময় দিনুদা এল, ‘এই দেবা– বাবুর সঙ্গে দেখা করিস একবার।’

সরষের তেলের টিন গুনতিতে ব্যস্ত দেবু ঘাড় না ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবু কোথায়?’

‘গদিতে।’ এটুকু বলেই পিছন ফিরল দিনুদা। এমনিতেই কম কথার মানুষ। তবু ঝড়াং করে পিছন ফিরতে মনটা ‘কু’ গাইল দেবুর। চট্ করে গোনাগুনতির কাজটা ভোম্বলকে বুঝিয়ে দিয়ে সঙ্গ নিল দিনুদার। হাজার হোক বাবুর খাস লোক বলে কথা!

‘কী ব্যাপার দিন্দা?’

‘কী ব্যাপার– আমি কোথ্থেকে জানব? কত্তাবাবুর কথা তো জানিস!’ উত্তর আরও ভাসাভাসা করে দিনুদা এগিয়ে গেল চত্বর ছেড়ে।

গদি বলতে গোডাউন চত্বর-এর এমুড়ো ওমুড়ো ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা খানদশেক লরি আর ম্যাটাডোর ভ্যানের ফাঁকফোকর দিয়ে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে ব্রিটিশ আমলের অ্যাসবেস্টস শেড দেওয়া ঘরটি তার কথাই বোঝাচ্ছে। দেখতে তেমন আহামরি না হলে কী হয়– ওই ঘরটিই এই আমোদঘাটার সামন্তবাড়ির প্রাণভোমরা। এখান থেকেই নকুল সামন্ত’র মাকড়সার জাল বিস্তার। ওদিকে কাশ্মীর, পঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি থেকে শুরু করে এদিকে অন্ধ্রপ্রদেশ, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড আর পাশের রাজ্য বিহার পর্যন্ত বাবুর সাম্রাজ্য ছড়ানো। সেই ঘরে ডাক পড়েছে দেবুর। বুক একটু ধড়াস ধড়াস তো করবেই।

ঘরে ঢোকবার আগে দরজার কাচে নিজের ধুলোমাখা চেহারাটা একবার জরিপ করে নিল তাই। অন্ধকার মাখামাখি হয়ে কাচের গায়ে নিজেকে পরিষ্কার দেখতে পেল না। পাশে এখন কেউ নেই দেবুর। থাকলে নির্ঘাত বুকের ধুকপুকুনি শুনতে পেত।

একটু ইতস্তত করে কাচের দরজাটা আলগা হাতে ঠেলল। ভেতরে পা রাখতে ঠান্ডা এক ছোঁয়া পেল শরীরে। ঘরে মিহি করে এসি চলছে।

ধোপদুরস্ত ধুতি-পাঞ্জাবিতে বাবুর দুধসাদা গায়ের রং খোলতাই হয়েছে খুব। ঠিক মাঝবয়েসি এক রাজা যেন। মাথার কোঁকড়ানো চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। ডান আর বাঁ-হাতের আঙুলগুলোয়  রংবেরঙের পাথর বসানো আংটি। সোনার ঘড়িতে ঘরের আলো চমকায়। মুখে অনবরত চিবিয়ে চলা সুগন্ধি পান। গন্ধে ঘর ম’ ম’ করছে।

একটা তাকিয়ায় কনুই রেখে মোবাইল কানে চেপে কার সঙ্গে বাবু কথা বলে চলেছে নীচুগলায়। দেবুকে ঘরের মধ্যে ঢুকতে দেখে আঙুলের ইশারায় বসতে বলল সামনের নীচু বেঞ্চটায়। শরীরের অস্বস্তি চেপে সাবধানে বসল দেবু। সামনে শুধু ওর নয়, ওরই মতো অন্তত একশো লোকের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা– আমোদঘাটার মুকুটহীন সম্রাট নকুল সামন্ত। বিনবিন করে কপালে ঘাম ফুটছে এই এসির ঠান্ডাতেও, টের পেল দেবু।

ঘরে এখন কেবল দু’জন। প্রথমে একটু ভয়ই করছিল। কে জানে কীসের জন্য এমন জরুরি তলব। দু’একদিনের মধ্যে বেফাঁস কিছু করে ফেলেছে কিনা মনে করবার চেষ্টা করল প্রাণপণে। কথায় বলে, বাবুর চোখ আর বাঘের চোখ!

এমন সময় কত্তাবাবুর নীচুগলায় বলা কথাগুলো শুনতে পেল, ‘গোডাউনের কাজকম্ম কেমন চলছে দেবু?’

টাকরার কাছে শুকিয়ে আসছিল যেন। চেষ্টা করে বলতে পারল, ‘আজ্ঞে ভালোই। এই তো আমোদপুরের লরি আনলোডিং হচ্ছিল!’

নাকের সামনে থেকে মাছি তাড়ানোর মতো ভঙ্গি করে বাবু থামিয়ে দিল ওকে, ‘জানি-জানি। সেজন্যে ডাকিনি তোকে!’ তবে কীসের জন্যে এই অসময়ে ডাক? দমবন্ধ হয়ে আসছিল দেবুর। আজ ঘাড়ে মুণ্ডু নিয়ে ফিরতে পারলে হয়। নকুল সামন্ত মনে হয় মানুষের মন পড়তে পারে। পাশে রাখা ঠান্ডা জলের বোতলটা হাত বাড়িয়ে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘একটা কাজ করতে হবে দেবা!’

‘আজ্ঞে বলুন!’ গলা রীতিমতো কাঁপছিল ওর। হাতের বোতলটাও।

‘ব্যাপারটা কিন্তু খুব গোপনীয়!’ ফিসফিসে গলায় বলা বাবুর কথাগুলো কানের কাছে হিম হয়ে এল কেমন।

‘কেউ জানবে না আজ্ঞে!’ জলে ভেজানো গলায় বাবুকে আশ্বস্ত করবার চেষ্টা করল দেবু।

‘ঠিক বলছিস?’ সামন্তকত্তার গলায় আশঙ্কা আর উৎকণ্ঠার মিশেল।

‘আজ্ঞে ঠিক।’ একটু জোরের সঙ্গে বলল দেবু।

‘তবে এদিকে আয়।’ তাকিয়া ছেড়ে সোজা হয়ে বসল কত্তা। দেবুও বেঞ্চ ছেড়ে ফরাসের একধারে উঠে এল। পাঁচ বছর চাকরি করছে বাবুর এখানে। কোনওদিন এমন করে সামন্তবাবুর কাছটিতে বসতে পারবে ভাবেনি দেবু।

আরও মিনিট কুড়ি পার করে যখন কত্তার কাছ থেকে ছাড়া পেল তখন দেবুর বুকপকেটে দুটো একশো টাকার নোট। কড়কড়ে। দোমড়ানো মোচড়ানোর কোনও সিন নেই। একেবারে বাবুরই মতো ঝকঝকে। ফিট। যা শুনেছে সব মনে মনে রাখবার দাম। পরে আরও পাওয়া যাবে। নকুল সামন্ত ফালতু বকোয়াস করে না। ভূতগ্রস্ত মানুষের মতো এলোমেলো পায়ে গদিঘর থেকে নিজের ডেরার দিকে চলল দেবু ওরফে দেবিদাস পুরকাইত। আজ, এই এখন থেকে পরীক্ষা শুরু হল ওর।

দুই

‘দিন যায়, রাত না ফুরায়।’ ছেলেবেলায় দেখা কৃষ্ণযাত্রায় বিরহিণী রাধার গানের বাণী যেন অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে রিখিয়ার জীবনে। মাঝে মাঝে একলা ঘরে সাজপোশাক ছেড়ে সামন্তবাড়ির বউমা দেয়ালজোড়া বেলজিয়াম কাচের আয়নার সামনে দাঁড়ায়। একেবারে একা।

নিজের অপ্সরা-শরীরের যেখানে যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলি দেবার সেগুলিকে নিপুণহাতে যিনি তৈরি করে পাঠিয়েছেন, তাঁকে ধন্যবাদ দেবার পাশাপাশি নানাভাবে অভিসম্পাতও দেয় রিখিয়া। কী দরকার ছিল ভগবানের ওকে এত সুন্দর করে গড়ে তোলবার! মাথায় প্রপাতের মতো একঢাল চুল, টানাটানা চোখ, সুগোল দুটি স্তন এবং সুশোভন শ্রোণিদেশ– এসব কী কাজে লাগল ভগবান?

যে-মানুষটার কোনও ক্ষমতা-ই নেই, সেই মানুষটা বিছানার সঙ্গী হয়ে আছে এই সত্যটা অনেক দাম দিয়ে বুঝতে হল রিখিয়াকে। নিশ্চুপ পড়ে থেকে সামন্তবাড়ির একমাত্র উত্তরাধিকারী দীপেনের আঁচড় কামড় সহ্য করতে করতে গোটা বছর ধরে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হল রিখিয়াকে।

গরিব বাবার একমাত্র মেয়ে। তায় যথেষ্ট সুন্দরী। কলেজের ক্লাস শুরু করতে না করতেই উঠেপড়ে লেগেছিল অচিনপুরের কৃষ্ণদাস বৈরাগ্য। খোঁজ খোঁজ করতে করতে কোনওমতে আমোদঘাটার ডাকসাইটে ব্যবসায়ী নকুল সামন্তর নজরে মেয়েকে এনে ফেলা হতেই, বাবা হাত তুলে সোজা হরিদ্বারের পথে। মেয়ে ভাসল কি ডুবল পিছু ফিরে আর দেখার প্রয়োজন মনে করল না। শুধু বড়ো সামন্ত’র অঢেল পয়সা, রঙিন আলোর রোশনাই, গ্রামসুদ্ধ লোক খাওয়ানো আর মেয়ের সর্বাঙ্গ মুড়ে দেওয়া গয়না দেখেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, এ বিয়ে সুখের না হয়েই যায় না। হায়– এত সহজেই যদি সব সুখ কেনা যেত বাবা!

অনেক দুঃখে মনের অসুখ মনেই চেপে রাখে রিখিয়া। সব ছেড়ে যে-মানুষটা ওকে সুখী মনে করে অনেক দূরে সরে গেছে, সেই বাবার উপরও কোনও অভিমান রাখেনি। শুধু একটাই প্রশ্ন মাঝে মাঝে বিব্রত করে রিখিয়াকে, মা বেঁচে থাকলেও এতটাই নির্লিপ্ত থাকতে পারত বাবা? কে জানে, হয়তো পারত।

গত বৈশাখে ওর বিয়ের পর থেকে এবছর অঘ্রাণ পর্যন্ত মাত্র দুবার ফোন করেছে বাবা। হাসি হাসি মুখে নিজের কাল্পনিক সৌভাগ্যের কিছুটা হলেও সত্যি খবর পৌঁছে দিয়েছে রিখিয়া। ফোনের ওপারে মানুষটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলেছে, ‘সব তোর কপাল মা! নইলে নকুল সামন্তর ছেলের সঙ্গে বিয়ে– হয়!’

হাসি বজায় রাখবার চেষ্টা করতে করতেই রিখিয়া বলেছে, ‘সত্যি বাবা– সবই আমার কপাল। সঙ্গে তোমার আশীর্বাদও ছিল তো!’

মানুষটা কী বুঝল কে জানে। কৃষ্ণনাম করতে করতেই ফোন রেখে দিয়েছিল। সেই শেষ। ইচ্ছা করেই আর রং মিলন্তির খেলায় নামেনি ও। এ বছর বৈশাখ পার হয়ে অঘ্রাণ আসতে এত দেরি হল কেন নিজের মনেই সে প্রশ্ন করে মাঝে মাঝে। বিশাল ফ্রেঞ্চ উইনডোর ধারে একলা দাঁড়িয়ে বিধুর প্রকৃতির কাছে জানতে চায় রিখিয়া, ‘ও অঘ্রাণ– অচিনপুরের মাঠে কি ধান পেকেছে এখন? ঝরতি পড়তি ধানের শিষ এখনও কি আগের মতো তুলে নিয়ে গর্তে ঢোকে মেঠো ইঁদুর? বলো না ও অঘ্রাণ, এখনও কি বাসস্ট্যান্ডের পাশে ‘সত্যনারায়ণ টকিজ’-এর অন্ধকার হলে পাশাপাশি বসে পরস্পরের শরীরের ওম-এ উত্তাপ খুঁজে নিতে থাকে সুদর্শন, দেবিকা, সৌভিক কিংবা দয়াময়ীর মতো আমার বন্ধুরা– আগেকারই মতো?

ও অঘ্রাণ, তুমি কি বলতে পারো একটা শূন্য কলশির সঙ্গে ঘর করতে হলে মেয়েদের আরও কত কী মেনে নিতে হয়? অথচ কলশিটা বিশ্বাসই করতে চায় না তার শূন্যতা। এরপর কী করবার থাকে আর?’

প্রশ্নের পর প্রশ্ন ভাসে বাতাসে। উত্তর আসে না। চেষ্টা করতে করতে হাল ছেড়ে দেয় রিখিয়া। সামন্তবাড়িতে শাঁখ বাজল। শাশুড়ি-মা সন্ধে দিলেন। খাটের উপর হারমোনিয়ামের সামনে এসে বসল রিখিয়া। মনের আগল খুলে দিল গানের সুরে, বাণীর নির্যাসে, ‘আমায় অনেক দিয়েছ নাথ।’ শাশুড়ি-মা’র পায়ের শব্দ ঘরের দরজার বাইরে এসে থামল।

তিন

বিকেলের পড়ন্ত রোদের এক আলাদা মায়া আছে। একটু পরেই পাটে বসতে চলেছেন সূর্যদেব। হিমের আঁশমাখা সেই রোদ একটু একটু করে গায়ে মাথায় মেখে নিলে একধরনের আমেজ আসে শরীরে। বাঁধের উপর দাঁড়িয়ে সেই রোদের আমেজ নিচ্ছিল সায়ন।

একসময় দামোদর ছিল গোটা রাজ্যের দুঃখ। দুঃস্বপ্নের নদ। এখন বললে লোকে হাসবে। নদের খাত জুড়ে বালি আর বালি। লরির পর লরি দাঁড়িয়ে। সেই বালি তুলে নিয়ে বাজারে ঢেলে দিয়ে আসবে। তৈরি হবে আকাশচাটা ফ্ল্যাটবাড়ি। আশ্চর্য এক লেনদেনের সম্পর্ক যেন। তুমি দেবে আর আমি নেব। অথবা উলটোটা। বাঁধের একপাশে বটগাছের কোল ঘেঁষে তৈরি হয়েছে চায়ের দোকানটি। সেটি বেশ পরিচ্ছন্ন দেখে একপলকেই পছন্দ হয়ে গেল সায়নের। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হোস্টেল হলেও যথেষ্ট পরিচ্ছন্ন ওদের রোজের থাকা-খাওয়ার পরিবেশ। সেই অভ্যাস বাইরেও। চায়ের দোকানি উনোনে আঁচ দিয়েছিল। ধোঁয়া কুণ্ডলি পাকিয়ে পাকিয়ে এলাকা ছাড়া হয়ে নদীগর্ভের দিকে। গরম চায়ের আহ্বানে এই বাঁধের দিকের দোকানটিতে। নাহলে আমোদঘাটায় চায়ের দোকানের কমতি নেই। তবে রিখিয়ার এসএমএস অনুযায়ী লোকালয় থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকাই ভালো। আপাতত সেই চেষ্টাতেই সায়ন।

‘এখানে কাদের বাড়ি এসেছেন?’

বাঁধের পাশের মাঠটিতে ছেলেদের ব্যাটিং, বোলিং আর ফিল্ডিং দেখতে দেখতে এতই মগ্ন হয়ে পড়েছিল সায়ন যে, প্রশ্নটা শুনতেই ভুল হয়ে গেল প্রথমে। দ্বিতীয়বার আবার জিজ্ঞেস করতে তবে শুনতে পেল।

ঘাড় ঘুরিয়ে সাদা প্যান্ট শার্টের সঙ্গে মাথায় কাউন্টি ক্যাপ চাপানো ভদ্রলোককে দেখতে পেল সায়ন। ঝোঁকের মাথায় বাঁধের দিকটায় চলে এসেছে বটে কিন্তু এমন একটা সমস্যা যে হতে পারে সেটা ভেবে দেখেনি। অথচ পরিষ্কার নির্দেশ আছে কোনওমতেই সামন্তবাড়ির নাম নেওয়া চলবে না।

অগত্যা আমতা আমতা করে বলল, ‘এই চা খেতে আর কী!’ সম্ভবত এমন উত্তর প্রত্যাশা করেনি কাউন্টি ক্যাপ। তাই সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া হল ‘অহ্!’

একটু থেমে আবার জিজ্ঞেস করল লোকটা, ‘থাকেন কোথায়?’

এতো মহা ফ্যাসাদ হল। টুকটুক করে খুঁটিনাটি সব জানতে চাইছে। তাড়াতাড়ি ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের একটা জবাব দিল সায়ন, ‘কলকাতা!’

কাউন্টি পরা লোকটা বেশ খানিকক্ষণ হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। বোধহয় সায়নের মাথার ঠিক – বেঠিকত্ব নিয়ে সন্দেহ হল। ট্রাউজারের পকেট থেকে রুমাল বার করে মুখ মুছতে মুছতে মাঠের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে সায়নকে ভালো করে মেপে নিয়ে বলল, ‘ধান্দা যে অন্যকিছু আছে সেটা বুঝলাম। সেজন্যেই এমন ভাসানো জবাব। ঠিক হ্যায়, আমিও কালো ঘোষ। এত সহজে আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারা যাবে না।’

কথা বলতে বলতে নিজের বড়াই করা লোকটার স্বভাব বুঝতে ঠিকই পারল সায়ন। কিন্তু এখনই লোকটির থেকে দূরত্ব তৈরি করতে না পারলে ওর সমূহ বিপদ। এটুকু বুঝতে দেরি হল না মোটেই।

রিখিয়ার জরুরি এসএমএস পাবার পর ওর মনে হয়েছিল এসব বড়োলোকের বাড়ির বউয়ের খামখেয়ালিপনা ছাড়া কিছু নয়। সঙ্গে সতর্কবার্তা সামন্তবাড়ির কেউ কোনও অবস্থাতেই যেন জানতে না পারেন সায়নের ধারণাটাকেই পোক্ত করেছিল শুধু। কিন্তু এখানে এই আমোদঘাটায় এসে রিখিয়ার সঙ্গে বারদুয়েক মোবাইলে কথা বলবার পর সেই ধারণাটা ভেঙে চৌচির হয়ে গেছে।

‘বিনোদিনী গার্লস উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়’- এর চৌকাঠ টপকে অচিনপুর মহাবিদ্যালয়ে পা দেওয়া সদ্য যুবতি রিখিয়া নামের মেয়েটি যে ভিতরে ভিতরে এতখানি দুঃসাহসী হয়েছে, মনটাকে করেছে ইস্পাতের মতো দৃঢ়- সেকথা জেনে এখন নিজেরই কেমন ভয় ভয় লাগছে সায়নের।

অথচ বিয়ের রাতে সব বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে এমন একটা পরিস্থিতি যে তৈরি হতে পারে, স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি কেউ। দিব্যি সকলের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলেছে মেরুন-রঙা বেনারসি আর আগাপাশতলা গয়নার অ্যাড-এর মতো কনের থ্রোন-এ বসে থাকা পরিটি। কই, কোথাও তো কোনও সিঁদুরে মেঘ নজরে পড়েনি। বরং বরের রাজপুত্তুরের মতো চেহারা নিয়ে দেবিকা আর দয়াময়ীরা যখন ঠাট্টা তামাশা করেছে, তখনও লজ্জায় মুখ নামিয়ে নিয়েছিল রিখিয়া। সেটাও নজর এড়ায়নি ওদের। অথচ এক বছরের একটু বেশি সময়ের মধ্যে সবকিছু পালটে যায় কী করে। এ এক আশ্চর্য রহস্য!

সে রহস্য যাই হোক। এখন এই ভদ্রলোককে অবিলম্বে পাশ কাটানো দরকার। না হলে সব বরবাদ হতে সময় লাগবে না বিশেষ। মাথায় একটা প্ল্যান আসতে সেটারই প্রয়োগ শুরু করে দিল সায়ন।

‘ছেলেগুলি কিন্তু দারুণ!’

‘মানে?’ ঘাবড়ে যেয়ে ভদ্রলোক চোখ তুললেন ওর দিকে।

‘মানে বুঝলেন না? প্রত্যেকেই দারুণ প্লেয়ার!’ বিশদ হল সায়ন।

‘বলছেন?’ প্রশংসায় আপ্লুত হয়ে পড়েছেন ভদ্রলোক বুঝতে ভুল হল না ওর।

‘বলব না মানে–! মাঠের দিকে যে তাকাবে সে-ই বলবে। ওয়েল ডিসিপ্লিন্ড!’

কালো ঘোষ এতক্ষণে হাতে চাঁদ পেল যেন।

‘এই– লাখ কথার এক কথা বলেছেন! আরে বাব্বা– ডিসিপ্লিন না থাকলে চলবে কেন? নিজের হাতে তৈরি করেছি মশাই এদের! ফি বছর এখান থেকেই তিন-চারজন ডিস্ট্রিক্ট টিমে–!’

ভদ্রলোককে আর বাড়তে দেওয়া উচিত নয়। মাঠের একেবারে দূরতম প্রান্তে প্রায় নদীর কাছাকাছি লং অন-এ ফিল্ডিংরত ছোকরাকে দেখিয়ে বলল, ‘কেবল ওই যে ছেলেটিকে ফিল্ডিং করতে দেখছেন– ওই ছোকরার নড়াচড়া বেশ স্লো। দেখুন-দেখুন!’ সায়নের পাশে এসে চোখের উপর হাত এনে ছোকরাকে ভালো করে লক্ষ করল কালো ঘোষ। তারপর সায়নের দিকে ফিরে বলল, ‘গুরু লোক ভাই আপনি! ঠিকই ধরেছেন। ও ব্যাটা হিরন্ময়– চিরকালের ফ্ল্যাটফুটেড!’

কথা বলতে বলতে মাঠের দূরতম প্রান্তে নদীর কাছাকাছি যাবার জন্যে হাঁটা দিলেন ভদ্রলোক।

মনে মনে হিরন্ময় নামের ছেলেটির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিল সায়ন, ‘ক্ষমা করিস ভাই। এছাড়া আর উপায় ছিল না আমার। এখন আমায় অন্য একজনকে সময় দিতে হবে।’ চায়ের দোকানি ততক্ষণে চা-এর কাপ হাতে ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে। নদীর বুক থেকে হামাগুড়ি দিয়ে ততক্ষণে কাকের ডানায় অন্ধকার উঠে আসছে।

 

চার

 নেহাত দেবার কপাল খারাপ তাই। নইলে এসব পরের বউয়ের ওপর নজরদারি করবার লোক-ই নয় ও। তার সঙ্গে স্বয়ং বড়ো সামন্তর কথাও মাথায় রাখতে হচ্ছে।

দেবার প্রাণভোমরা বাপঠাকুরদার ভিটেটুকু পর্যন্ত হাতফেরতা হতে হতে এখন বড়ো সামন্তর হেফাজতে। কোন কুক্ষণে মোদোমাতাল বাপটা টিপছাপ দিয়ে ওকে রাস্তায় বসিয়ে রেখে গেছে এমন করে ,কিছুই জানা নেই। আসল সত্যিটুকু জানে শুধু নকুলবাবু। সামন্তগুষ্টির এখনকার চাঁই। সে যে মুখ ফুটে বলবে, সে গুড়ে বালি।

ঝ্যাঁটা মারো, জুতোপেটা করো অমন মদখেকো বাপকে। নেশার জন্যে যে কিনা ছেলে-বউয়ের কথা ভাবে না। কোথায় থাকবে, কীভাবে থাকবে ভাবনা নেই। শুধু নিজের নেশার বস্তুটি চাই। নেশার ঘোরে মা-র গায়ে বাবার হাত তোলা ছায়া ছায়া মনে পড়ে দেবার। তারপর তো এক বর্ষায় মা বর ছেড়ে, ছেলেকে ছেড়ে দূর আকাশের বাসিন্দা হয়ে গেল। দেবু তখন এগারো কি বারো। সেই শুরু সামন্তর তাঁবেদারি। চলছে তো চলছেই। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস। বছরের পর বছর। দেবুর মুখে রা’টি নেই। যদি বাবুর মতিগতি ফেরে। যদি কোনওদিন দেয়ালের চোরা কুঠুরি থেকে ঈশ্বর বিশ্বম্ভর পুরকাইতের নামের বাড়ির দলিল দেবুর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বাবু বলে, ‘এই দেবা– এটা নিয়ে যা!’

আরও কিছুক্ষণ হয়তো চলত চিন্তার নদীতে দেবিদাসের সাঁতার, যদি না জঙ্গলের বাইরে ঘাসজমিতে উতলমাতাল ঝড় উঠত। ঘাসবনে দুটি ছায়াশরীরের তুমুল ওলটপালট। কেউ কাউকে যেন ছাড়তেই চায় না। চকাস্ চকাস্ শব্দ। সব, সবই ঘটে চলেছে মাত্র কয়েকহাত দূরে। অথচ শব্দ করবার উপায় নেই। এমনকী পায়ের গোছে বিছুটি পাতার ঘষা লেগে জ্বলছে বেশ। তবু হাত পা নট্ নড়নচড়ন। পাছে নড়াচড়ার এই চক্বরে ধরা পড়ে যায় ওর গোয়েন্দাগিরি।

বাবুর কড়া নির্দেশ বউদিমণি কোথায় যাচ্ছে, কী করছে সব খবর দিতে হবে। এদিকে একজোড়া শরীরের হাঁসফাঁস করা শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ। বউদিমণির মুখে সুখের একটানা ‘উঁ’ ‘উঁ’ শব্দ। এসব কীসের ঠিকই বোঝে দেবু। আর বোঝে বলেই ওর যন্ত্রণা বেশি। বিয়ের পর মেয়েমানুষ কীসে সুখী হয় সবচেয়ে বেশি, তা কি বাবু জানে না?ওর মতো উদ্গান্ডু বোঝে আর আমোদঘাটার বেতাজ বাদশা নকুল সামন্ত বোঝে না এটা বিশ্বাস করে না দেবু।

সামন্তদের আড়তের দেড়তলায় আট ফুট বাই দশ ফুট যে -খুপরি ঘরটায় এতদিন থেকে এল দেবু, মাঝে মাঝে একলা সময়ে সেই ঘরটাই কেমন অচেনা মনে হয়। যেন গিলে খেতে আসে রাক্ষুসে হাঁ করে। অনেক রাতে নিজের চেনা শরীরের মধ্যে অচেনা এক শরীর জেগে উঠলে কেমন হন্যে হয়ে ওঠে দেবু। হাত বাড়িয়ে সরু বিছানায় পাশে কোনও জ্যান্ত শরীরের স্পর্শ পেতে চায়। ঘুম ভেঙে সেই ‘অন্য’ আর একজনের মুখোমুখি হয়। প্রশ্ন করে নিজেকে, ‘তোর কীসের এত জ্বালারে দেবা? গড়িয়ে গড়িয়ে বছরগুলো তো কাটালি এখন আর মাত্র ক’টা বছর কাটিয়ে দিলেই তো–!’ প্রশ্নটার ঝুঁটি ধরে ঝাঁকুনি দেয় আদত দেবা, ‘কী বললি হতচ্ছাড়া! এ জ্বলন কীসের তা যদি জানতিস!’ হাজার বোঝালেও বুঝতে চায় না শরীরের মধ্যে জেগে ওঠা অবুঝ অথচ তেজিয়ান সেই ঘোড়া। ঘাসে ঢাকা মাঠে দৌড় শুরু করবার জন্যে ছটফট করতে থাকে।

বাধ্য হয়ে বাকি রাতটুকু উপুড় হয়ে শুয়ে থেকে নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করে যায়। বড্ড কষ্ট হতে থাকে তখন। গোটা শরীর যেন তেতে আগুন হয়ে ওঠে। জঙ্গলের মধ্যে মশার কামড় কিংবা বিছুটি লেগে যে জ্বলন তার চেয়েও ভয়ংকরতর এক জ্বলুনিতে জ্বলতে থাকে দেবু।

বড়ো কত্তা যতই ওকে নতুনবউদির ওপর নজর রাখবার কথা বলুক, এসব কথা দেবা কখনও জানাবে না। মেয়েমানুষের জ্বলন বলে কথা! যদি ঘরের ওষুধে না সারে তাহলে তো বাইরের ডাক্তার ডাকতেই হয়। এর মধ্যে কোনও দোষ দেখতে পায় না দেবু। ক্ষমতা থাকলে ছোটোকত্তা দীপুবাবুকে সামলে নিক বড়োবাবু। তা নয়– যত্তোসব!

আস্তে আস্তে নতুনবউদির কথা ভেবে মনটা নরম হয়ে এল খুব। আহারে, কতই-বা বয়স! কত স্বপ্ন নিয়ে সোয়ামির ঘর করতে এসেছিল গরিবের ঘর থেকে। পয়সার জোরে আর যা-ই হোক মন তো কিনতে পারেনি কত্তা!

ততক্ষণে ঘাসবনে ঝড় থেমেছে। আকাশে চাঁদ না থাকলেও দেবুর সামনে তখন বনজ্যোৎস্না। দুটি তৃপ্ত হৃদয় অস্ফুটে তাদের মনের কথা বলে। সবটা না হলেও সেই কথার টুকরোটাকরা পাখনা মেলে উড়ে আসতে থাকে কানে।

‘এভাবে কতদিন চালাবে বলো রিখি?’

চট্ করে একথার জবাব দেওয়া মুশকিল। নতুনবউদিও অনেক সময় নিয়ে বলল, ‘দেখি কতদিন চালানো যায়।’

‘ব্যাপারটা তোমার পক্ষে খুব রিস্কি হয়ে যাবে না তো?’

‘হলে হবে। পরোয়া করি না। বাড়ির কথা এরা জানাজানি হতে দেবে ভেবেছ!’

নতুনবউদির ভয়হীন গলা শুনে চমকে উঠল দেবু। মেয়ের সাহসকে পেন্নাম জানাতে হয়! এ তো দেখছি বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা! ‘জানাজানি হলে কী হতে পারে ভেবে দেখেছ?’ ছেলেটির গলায় অজানা আশঙ্কা।

‘কী আবার হবে– শূলে চড়াবে নয়তো ফাঁসি। তবু এই নিত্য যমযন্ত্রণার চেয়ে ঢের ভালো হবে!’ প্রায় কান্নাজড়ানো গলায় বউদিমণির জবাব শুনতে শুনতে জঙ্গলে একহাত জিভ কাটল দেবু। এসব কি বলছ গো বউদি! তোমার দুখ্যু আমি বুঝি। হাজার প্রশ্নেও আমার মুখ থেকে একটি কথাও বেরোবে না আর– দেখে নিয়ো! পাশাপাশি পড়ে থাকা দুটি ছায়াশরীর আবার মুহূর্তের অবকাশে এক হয়ে যায়। জঙ্গলের মধ্যে মানুষপ্রমাণ শর গাছ। তার মধ্যে এক নিঃশব্দপ্রায় দেবতা। দুটি চোখ মুদে। স্বর্গীয় এক দৃশ্যের মধ্যে ডুব দিয়েছে। ঘাসবন থেকে আর একবার চকাস্ করে ভেসে আসা শব্দ শুনল দেবু। অদ্ভুত এক তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল ওর ঠোঁটে। ঘরছাড়া, দিকহারানো একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে বিপদ মাথায় নিয়ে কেমন করে বাঁচতে হয় শিখিয়ে দিয়ে গেল যেন।

জামাকাপড় পরে নেবার ঘসঘস আওয়াজ হল। আবছা অন্ধকারে চুড়ির রিনরিন। আরও একটু পরে নতুন বউদির গলা শুনতে পেল, ‘আবার কবে দেখা হবে– জানিয়ে দিয়ো!’

ছেলেটির গলা স্বপ্নালু মানুষের মতো শোনায়, ‘পরের বার কবিতা সংকলনটা নিয়ে আসব।’

‘সত্যি?’ বউদিমনির গলায় চাপা উচ্ছ্বাস।

‘সত্যি! ওটাতো তোমাকেই উৎসর্গ করেছি রিখি!’

এমন জটিল বাংলা শব্দ ‘উৎসর্গ’ বাবার জন্মে শোনেনি দেবু। তবু আবার এক চকাস্ শব্দ ওকে বুঝিয়ে দিল সেটা ভালো কিছুই হবে।

কতক্ষণ আবেশে বুঁদ হয়েছিল খেয়াল ছিল না দেবুর। সম্বিত ফিরল যখন অদ্ভুত এক সুগন্ধ ছড়িয়ে বউদিমণি চলে গেল মাঠ ফাঁকা করে। ওকে উতলমাতাল করে রেখে।

আবিষ্টের মতো দুটি হাত কপালে ছোঁয়াল দেবু। আহা গো বউদিমণি, তোমার কষ্ট আর কেউ না বুঝুক এই ছাই-ফেলতে ভাঙা কুলো দেবা বোঝে। তুমি সব্বোসুখি হও গো। প্রাণ থাকতে আমি তোমার সুখের রাস্তায় কাঁটা হয়ে দাঁড়াব না কখনও!

শরগাছের বন ছেড়ে বেশ কয়েক পা এগিয়ে এসেছে দেবিদাস, এমন সময় মোবাইলে আলো জ্বলে উঠল। স্বয়ং বড়োকত্তা। খুব সন্তর্পণে কথা বলতে লাগল দুজন।

‘কী রে, সব ঠিক আছে?’

‘হুঁ।’ উত্তর সংক্ষিপ্ত করল দেবু।

‘বউমা?’

‘এই তো আট চক্বর শেষ করে মাঠ থেকে বাড়ির দিকে গেল।’ যতদূর সম্ভব গলা স্বাভাবিক রেখে উত্তর দিল দেবু ওরফে দেবিদাস পুরকাইত।

সামন্তবাড়ির লক্ষ্মী সহায় থাকলে ওর ভাগ্য ফিরতেও দেরি হবার কথা নয়। চাই কি, বসতবাড়িটার হাতবদলও হয়ে যেতে পারে। খুশি খুশি মুখে ফোনশুদ্ধ দুটি হাত আকাশে বসে থাকা অথচ এখনও অদেখা মানুষ নাকি দেবতাটির উদ্দেশে, এবার তুলল দেবু।

গণেশ এসেছে

গণেশ এসেছে। এসে চেয়ারে না বসে, বসেছে চেয়ারের হাতলে। কাঠের এই চেয়ার বহু বছরের পুরোনো। শক্তপোক্ত, দু’পাশে হাতল। হাতলগুলো চওড়া। চেয়ারটাকে রাখা হয়েছে খাটের গা ঘেঁষে। যাতে ডাক্তারবাবু, আত্মীয়স্বজন, বাড়ির লোকজন রোগীর কাছে বসতে পারে। গত চার মাস, না চার মাস নয়, গত চার মাস এগারো দিন এই ব্যবস্থা চলেছে। প্রথম প্রথম এঘর, ওঘর থেকে মোড়া, চেয়ার, এমন কী টুল পর্যন্ত টেনে আনা হচ্ছিল। পরে দেখা গেল, সিচুয়েশনের অবনতি হচ্ছে। ঘরে ডাক্তার, ভিজিটর বসবার জন্য পাকাপাকি ব্যবস্থা রাখতে হবে। বারান্দায় রাখা চেয়ারটাকে মুছে-টুছে ঘরে আনা হল। আজ থেকে আর এই চেয়ারের দরকার হবে না।

গণেশ যখন এল তখনও আলো ফোটেনি। ফুটব ফুটব করছে। দূরে একটা দুটো কাক ডেকে উঠল। আড়মোড়া ভাঙা ডাক। রাস্তা দিয়ে ঝনঝন আওয়াজ করে চলে গেল দুধের গাড়ি। রমাকান্তবাবু পাশ ফিরতে গেলেন। একটু পারলেন, বেশিটা পারলেন না। পাশ ফেরবার শক্তি মানুষটার আর নেই। শ্বাস নিতেও কেমন যেন অসুবিধে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কেউ নব ঘুরিয়ে ঘরের বাতাসের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। খানিক আগে বুকের ভিতরে একধরনের চাপা ধড়ফড়ানি শুরু হয়েছে। শরীর জানান দিয়ে দিচ্ছে, সময় ফুরিয়ে গেল… সময় ফুরিয়ে গেল…। পরিস্থিতি যা তাতে মনে হয়, আজই কিছু একটা হয়ে যাবে। কখন হবে? বেলাবেলি? নাকি দুপুরের পর? দুপুরের পর হলে ভালো। বাড়ির সবার খাওয়া-টাওয়া হয়ে যাবে। নইলে রাত পর্যন্ত আটকে থাকা। মরা বাড়িতে হাজার ফ্যাঁকড়া। এইটা করা যাবে না, ওইটা করা যাবে না।

মাধবীর আলসারের সমস্যা আছে। বেশিক্ষণ কিছু না খেলে পেটে ব্যথা হয়। তারও তো বয়স কম হল না। স্বামীর মৃত্যুর পর আলসারে কাবু স্ত্রীদের জন্য কি কোনও ছাড় আছে? হালকা কিছু খেতে পারে? পারা উচিত। যাই হোক, সবথেকে ভালো হয় ঘটনা বিকেলের দিকে ঘটলে। তবে সে তো আর কারও হাতে নেই যে সকলকে স্নানটান করিয়ে, মাছের ঝোল ভাত, কাঁচা আমের চাটনি খাইয়ে, ছোট্ট একটা ভাতঘুম দিয়ে তবে ঘটবে। মৃত্যু কখন আসে কেউ বলতে পারে না। জন্ম-মৃত্যু খুবই অনির্দিষ্ট একটা বিষয়। তারা স্বেচ্ছাচারী। নিজের খুশি মতো চলতে পছন্দ করে।

রমাকান্তবাবু ঠোঁটের ফাঁকে হাসতে চেষ্টা করলেন। একটু পারলেন, একটু পারলেন না। আর কোনও কিছুই সবটা পারবার সময় নেই।

মুক্তি… মুক্তি। রোগ, যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। মুক্তি দীর্ঘ জীবন বয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিশ্রম আর ক্লান্তি থেকে। মুক্তি বেঁচে থাকবার যাবতীয় গ্লানি, অবহেলা থেকে। আহ্! রমাকান্তবাবু আবার হাসবার চেষ্টা করলেন। মুক্তির হাসি।

মুক্তি শুধু নিজের নয়, মুক্তি বাড়ির লোকেদেরও। তারাও এবার যবনিকাপতন চায়। নিজের মধ্যে একথা বলাবলিও করছে। পরশু রাতেই বড়ো ছেলে শুভ দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে তার বউকে চাপা গলায় বলছিল। শুভ ভেবেছিল, বাবা ঘুমিয়ে পড়েছে। শুনতে পাচ্ছে না। রমাকান্তবাবু সবই শুনেছেন, জেগে ছিলেন। শুনতে ভালোই লেগেছে। এখন আর স্ত্রী ছেলেমেয়ে, পুত্রবধূ, জামাইরা কী বলল সেটা আসল কথা নয়, আসল কথা হল, এখনও তারা কাছে আছে। তাদের চোখে দেখা যায়, গলা শোনা যায়, ছোঁয়া পাওয়া যায়। কয়েকমাস ধরেই এই অনুভূতিটা হচ্ছে। বারবার মনে হয়েছে, বেশিদিন নয়, এবার দূরে চলে যেতে হবে। অনেক দূরে। কতদূরে তাও ঠিক মতো জানা নেই। হাজার চেষ্টা করলেও ভালোবাসার মানুষদের সঙ্গে আর দেখা হবে না, গলা শোনা যাবে না। বিগত কটাদিন বেশিরভাগ সময়ে রমাকান্তবাবু আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে কাটিয়েছেন। চোখ বুজে পড়ে থেকেছেন। সবাই ভেবেছে, রোগী ঘুমোচ্ছে। শরীর বোধহয় খানিকটা ভালো। রমাকান্তবাবু ভুল ভাঙাননি। ভাঙাতে গেলেও বিশ্বাস করবে না। ভাববে, অসুস্থ মানুষ ভুল বকে। ঘুমোলেও বলে ‘জেগে ছিলাম’। তার থেকে চুপ করে থাকাই ভালো।

মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের কাছে ঘুম আর জেগে থাকার মধ্যে বিশেষ ফারাক নেই। কে বুঝবে একথা? এ এক ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। সবাইকে বলবার মতোও নয়। বোঝানো তো যায়ই না। আর দরকারই বা কি? সেদিনও রমাকান্তবাবু তাই ছিলেন। বড়োছেলে আর তার বউয়ের কথা কানে এসেছে সব।

শুভ তার বউকে বলেছিল, ‘উফ্ আর কতদিন বলো তো? এ তো আর টানা যাচ্ছে না। টাকার পর টাকা গলে যাচ্ছে। ডাক্তারবাবু তেমনি। আরে বাবা, যদি চান্স না থাকে তাহলে এত দামি দামি মেডিসিন দেবার মানে কী? আর কতদিন বলো তো?’

বউমা বিরক্ত গলায় বলল, ‘আমাকে বলছ কেন? বাবা তোমার, কবে মরবে, কবে বাঁচবে তুমিই জানো। আমি কী করে বলব?’

বড়োছেলে মুখে ‘ফুঃ’ ধরনের আওয়াজ করে বলল, ‘এমন ভাবে বলছ ঝুমা, যেন তোমার বাবার মৃত্যুর ডেট তুমি জেনেশুনে বসে আছো। বাবা হলেই সব জানা যায়?’

ঝুমা ঝাঁঝিয়ে উঠল, ‘আমার বাবার কথা আসছে কোথা থেকে? আমার বাবাকে টানছ কেন? বালাই-ষাট সে মরবে কীসের জন্য? সে তো আর শ্বশুরমশাইয়ের মতো চার মাস বিছানায় কেতরে নেই। ডাক্তার, বদ্যির পিছনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকাও খসাচ্ছে না, ছেলেমেয়ে, পুত্রবধূ, জামাইদের ছুটিয়েও মারছে না। সে আছে নিজের মতো।’

বড়োছেলে বলল, ‘আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে, তোমার বাবা হলেন বিরাট পরোপকারী। আমার বলাটাই ভুল হয়েছে। আই অ্যাম সরি।’

ঝুমা গজগজ করে বলল, ‘কথায় কথায় আমার বাবাকে টানবে না। নিজের বাবাকে নিয়ে ঝামেলায় পড়েছ, যা বলবার তাকে বলো।’

‘কী বলব?’

ঝুমা রাগ রাগ গলায় বলল, ‘কী আবার বলবে, অনেক সমস্যা করেছেন এবার শেষ করুন।’

শুভ অবাক গলায় বলল, ‘বাবাকে বলব, শেষ করুন! মানে তুমি মরে যাও! এসব কী বলছ ঝুমা!’

ঝুমা নিজেকে সামলে নিতে নিতে বলল, ‘মরে যাও বলবে কেন? বলবে…  বলবে, এবার ভালো হয়ে ওঠো। তোমার সেবাযত্ন করতে করতে তো বাড়িশুদ্ধ সবার নাজেহাল অবস্থা। টাকাপয়সাও তো জলের মতো বেরিয়ে যাচ্ছে। এত বয়স হয়েছে, এটা বুঝতে পারছ না?’

বড়োছেলে চুপ করে থেকে চাপা গলায় বলে, ‘অ্যাই ঝুমা, ঝুমা, অ্যাই ঝুমা…’

‘ধেড়ে বয়েসে বারবার বউয়ের নাম বলে আহ্লাদ করছ কেন? কী বলবার বলে ফেল।’

বড়োছেলে ফিসফিস করে বলে, ‘একটা কাজ করো না।’

ঝুমা সন্দেহ ভরা গলায় বলল, ‘কী কাজ? শ্বশুরমশাইকে বিষ খাওয়াব?’

শুভ বলল, ‘উফ্ তোমার মুখে কিছু আটকায় না। তুমি ডাক্তারবাবুকে জিজ্ঞেস করবে?’

ঝুমা বলল, ‘কী জিজ্ঞেস করব?’

শুভ কিছু একটা বলল। রমাকান্তবাবু শুনতে পেলেন না। যদিও গত চার মাস ধরে কান খুব ভালো সার্ভিস দিয়েছে। প্রকৃতির কি এটাই মজা? শরীরের সব অঙ্গ কাহিল করে দিয়ে একটাকে তরতাজা করে রাখে? তার বেলায় যেমন শ্রবণ ক্ষমতাকে রেখেছে? মনে হচ্ছে, যুবক বয়েসের কান ফিরে পেয়েছেন। দূরের কথাও শুনতে সমস্যা নেই।

ঝুমা খানিকটা জোর গলায় বলল, ‘একথা তুমি জিজ্ঞেস করতে পারছ না? ডাক্তারবাবুকে ফোন করে  জিজ্ঞসা  করো।’

শুভ ‘শ্শ্শ্’ আওয়াজ করে বলল, ‘এই আস্তে, বাবা শুনতে পাবে।’

‘শুনতে পাবে না। অনেকক্ষণ থেকে ঘুমোচ্ছে। আজকাল তো বেশিরভাগ সময়টা ঘুমিয়েই থাকে। জিজ্ঞেস করলে বলে ঘুম হয় না। তুমি বরং এখনই ডক্টর রায়কে ফোন করো।’

শুভ আমতা আমতা করে বলল, ‘আমার বলাটা কি ঠিক হবে ঝুমা?’

ঝুমা অবাক গলায় বলল, ‘কেন? হবে না কেন? তুমি তার ছেলে। তুমি জিজ্ঞেস করতেই পারো। তাছাড়া তুমি তো আর মরবার কথা বলছ না। বলবে, দেখুন ডাক্তারবাবু আমাদের তো একটা প্ল্যানিং করতে হবে। উনি আর কতদিন এভাবে কষ্ট পাবেন যদি জানতে পারি সুবিধে হয়… এত টাকাপয়সা খরচ… জোগাড়ও তো করতে হবে। তার থেকে বড়ো কথা… আমরা এই কষ্ট চোখে দেখতে পারছি না। আমার স্ত্রী তো… আমার স্ত্রী তো রোজ কান্নাকাটি করে।’

‘তুমি আমার মরণাপন্ন বাবার জন্য কান্নাকাটি করো? এতবড়ো একটা মিথ্যে কথা বলা কি ঠিক হবে ঝুমা?’

ঝুমা চাপা গলায় স্বামীকে ধময় দেয়।

‘চুপ করো। বেশি ঢঙ দেখিও না। তোমার মা কী বলছেন?’

শুভ বলল, ‘কী বলেছেন?’

রমাকান্তবাবু কান খাড়া করলেন। মাধবী বলেছে! সে আবার কী বলল!

ঝুমা বলল, ‘কাল বিকেলে ঘরে ডেকে আমাকে বলল, বউমা তোমার শ্বশুরমশাইয়ের হাগামোতার কাপড় আমি আর ধুতে পারব না। এক-দুদিন হলে হয়, মাসের পর মাস হলে হয় না। খোকাকে বলো, লোক রাখতে। সে বড়ো হয়েছে, রোজগারপাতি করে। বাবার হাগামোতার পিছনে পয়সা খরচ করতে পারবে না এমন নয়। সংসারে অনেক ঝি-গিরি  করেছি, আর নয়। তোমার শ্বশুরমশাই চলে গেলে, নিজের মতো একটু হাত-পা ছড়িয়ে থাকব। নিজের স্ত্রী-ই তো এসব বলছে। আমি কেন কাঁদতে যাব?’

শুভ বলল, ‘আচ্ছা আচ্ছা, চুপ করো। আর মায়ের নিন্দে করতে হবে না। আমি দেখছি।’

শুধু স্ত্রী, বড়োছেলে-বউমা নয়, রমাকান্তবাবুর মেয়ে জামাইও খুব অসুবিধেতে রয়েছে। কাজকর্ম ফেলে তাদের ছুটে ছুটে আসতে হচ্ছে। তার ওপর টাকাপয়সা নিয়েও একটা টেনশন আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। শুভ যে-কোনও সময় তার দিদির কাছে হাত পাততে পারে। বলা যায় না, হয়তো আয়া রাখবার টাকাটাই চেয়ে বসতে পারে। এই ক’দিনে রমাকান্তবাবুকে নিয়ে মেয়ে জামাইয়ের মধ্যেও ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে। সেদিন তো পাশের ঘরে দুজনে খুব একচোট চ্যাঁচামেচি করল। করবারই কথা। একজন যদি চার মাস ধরে ‘মরছি মরব’ করে শুয়ে থাকে তাহলে সকলেরই সমস্যা। তার ওপর রমাকান্তবাবুর জামাই কোনও হাবিজাবি লোক নয়। সে নামকরা মানুষ। তার একটা পরিচয় আছে। কলেজে পড়ায়। সেটা বড়ো কথা নয়, বড়ো কথা হল তাকে প্রায়ই টিভিতে দেখা যায়। আলোচনায় চান্স পায়। নির্যাতিত, নিপীড়িত, মানুষের জন্য গলা ফাটায়। কখনও সরকারের বিরুদ্ধে, কখনও বিরোধীদের বিরুদ্ধে। যে- চ্যানেল যার কথা বলতে বলে সেই চ্যানেলে গিয়ে তাই বলে। যাওয়ার আগে দাড়ি, চুল শ্যাম্পু করে ফুরফুরে করে নেয়। রঙচঙে জামা পরে। মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ঝগড়া করে। রমাকান্তবাবু যখন সুস্থ ছিলেন, মুগ্ধ হয়ে জামাইয়ের প্রোগ্রাম দেখতেন। গিন্নি ঝামেলা করত। রিমোট টিপে সিরিয়াল দেখতে চলে যেত।

‘আহা করো কী, শ্যামলের কথা শুনছি।’

গিন্নি ধাতিয়ে উঠত, ‘রাখও তোমার জামাইয়ের কথা। খালি বকবক আর বকবক। কে আমার বক্তিতে দেওয়ার লোক এল রে! ওর লেকচার কেন শুনতে যাব? দেশের জন্য কোন কম্মটা করেছে তোমার জামাই? এমন ভাবে দাড়ি নেড়ে কথা বলে মনে হয়, টেগার্ট সাহেবকে বোম মারবে।’

‘মেয়ে কিন্তু রাগ করবে। সে রাতে ফোন করে জিজ্ঞেস করবে, তার বরের কথা শুনেছি কিনা।’

গিন্নি আরও রেগে যেত।

‘বনির আশকারাতেই তো জামাইটা গোল্লায় গেল। ঘরের কাজ করে না, কলেজে যায় না, খালি ক্যামেরায় মুখ দেখানোর জন্য ছোকছোকানি। ছিছি। এই সব ছেলেকে মারতে হয় চড়।’

সেদিন মেয়ে জামাইয়ের ঝগড়া পুরোটা না হলেও, কিছু কথা ভেসে আসছিল। আজকাল কেমন শীত শীত করে। রক্তের জোর কমে গেছে। সেদিন শীত ভাবটা বেশি ছিল। চাদর গায়ে দিয়ে গুটিয়ে শুয়েছিলেন রমাকান্তবাবু। সেই অবস্থাতেই শুনলেন, জামাই বনির ওপর চ্যাঁচাচ্ছে।

‘কী মনে করছ কী? আমার কোনও কাজ নেই? কলেজ, সেমিনার, ছাত্রছাত্রী, টিভি সব ফেলে এখানে এসে তোমার বাবার নাড়ি ধরে থাকব আর আহা উহু করব?’

বনি বলল, ‘রোজ কোথায় আসছ? সপ্তাহে তো মোটে একদিন আসো। বড়োজোর দু’বার। তাতেই এত বিরক্ত! দাদা তো সব সময় রয়েছে। সবকিছু সামলাচ্ছে।’

জামাই রাগি গলায় বলল, ‘তোমার দাদার কাজটা কী? দশটা পাঁচটার অফিস করেই খালাস। তাও মাথার কোনও কাজ নেই। মাথা থাকলে তো কাজ থাকবে। মাছি-মারা কেরানি।’

বনি বলল, ‘ইস্ আমার দাদার মাথা নেই, আর ওনার বিরাট মাথা।’

জামাই বলল, ‘তাছাড়া তোমার দাদা রমাকান্ত রায়ের ডাইরেক্ট পুত্র। পুত্র, পিতার রোগশয্যার পাশে সর্বদা থাকবে এটা আর নতুন কথা কী?’

বনি তেড়েফুঁড়ে বলল, ‘এখন পুত্রই সব করবে, আর সেদিন যে বড়ো বলছিলে, অ্যালার্ট থেকো বনি। তোমার বাবা মনে হচ্ছে আর বেশিদিন নেই। যে-কোনও সময় ফুটুস হবেন, এরপরেই কিন্তু সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা নিয়ে গোলমাল লাগবে। তোমার মায়ের পোরশনটা বাদ দিলে বাকিটা কিন্তু তুমি আর তোমার দাদা ফিফটি ফিফটি। কই তখন তো ডাইরেক্ট পুত্র বলে দাদাকে পুরো সম্পত্তি দেওয়ার কথা বলোনি। বলেছিলে?’

জামাইয়ের সব কথা কানে এল না। ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু শুনতে পেলেন।

‘আমি তো আইনের কথা বলেছি বনি… নারীর সমঅধিকারের কথা… তুমি মেয়ে বলে তোমাকে বঞ্চনা আমি সমর্থন করব না… কোনও নারীর ওপর অন্যায় আমি মানি না… শুধু তুমি নও… টিভির অনুষ্ঠানে কি আমি মুখ দেখাতে যাই?… যাই বলো?… ন্যায়ের কথা বলতে যাই…।’

বনি দাবড়ে ওঠে, ‘বাজে কথা বন্ধ করো। বাবাকে নিয়ে আর পারছি না। খুব জ্বালাতনে পড়লাম। তুমি দাদাকে বুঝিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দাও। হাসপাতালে সেজেগুজে দেখতে যাব। না গেলেও কিছু নয়।’

‘খেপেছ? হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলেই তোমার দাদা টাকা চেয়ে বসবে। আমার কাছে টাকা কোথায়? তোমাদের ফিফটি আগে পাই তারপর…।’

অন্য সময় হলে এসব কথা শুনে মাথায় আগুন ধরে যেত। ইচ্ছে করত, পিছনে একটা লাথি মেরে জামাইকে বাড়ি থেকে বের করে দিই। যাবার সময় মেয়েকেও গলাধাক্বা লাগাই। জীবনের এই পর্যায়ে কোনও কথাতেই আর রাগ হয় না। এখন আত্মীয়স্বজন, কাছের মানুষের গালমন্দও ভালো লাগে। মনে হয়, সবই মায়া।

বাইরে আলো ফুটছে। ঘরেও আলো এসেছে। পায়ের কাছে জানালাটা খুলে দিতে পারলে ভালো হতো। ঠান্ডা হাওয়া ঢুকত। বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যেত। শুধু কাক নয়, আরও নানারকম পাখির ডাক ভেসে আসছে। কোথায় একটা ঘুঘু ডাকছে না? এত সকালে কি ঘুঘু ডাকে? নাকি ভুল শুনছেন? মৃত্যুর দোরগোড়ায় এসে ভুল শোনাটা আশ্চর্যের কিছু নয়। ডান হাতটা খাট থেকে ঝুলে পড়েছে। রমাকান্তবাবু হাতটা তুলতে গেলেন। ঝিনঝিন করে উঠল। ভারী লাগছে। মৃত্যুকালে শরীরের ওজন কি বেড়ে যায়? হতে পারে। আবার না-ও হতে পারে। যে-পেশি দিয়ে নিজের হাতটাকে তুলবেন তার শক্তিও তো ক্ষীণ হয়ে এসেছে। ইস্, কেউ হাতটা তুলে দিতে পারলে ভালো হতো।

এমন সময় গণেশের দিকে আবার নজর পড়ল রমাকান্তবাবুর।

গণেশটা কী করছে? মিটিমিটি হাসছে কেন? এসে হাতটা তুলে দিতে পারে তো? বেটা চেয়ারের হাতলেই বা বসেছে কেন? হারামজাদার বদভ্যাসটা গেল না। কখনও ভদ্র সভ্য হয়নি। স্কুলে এসে বেঞ্চের মাথায় বসত। বাইরে গেলে পাঁচিলের টঙে উঠে পা দোলাত। একবার গাছে বসে পেয়ারা খেতে গিয়ে পড়ে গেল। পা ভাঙল। কোন ক্লাসে যেন? সিক্স? নাকি সেভেন? বকাঝকা কম খায়নি। তাও শিক্ষা হয় না ছেলেটার।

‘কী রে রমা, কেমন আছিস?’

রমাকান্তবাবু একথার জবাব দিলেন না। বিরক্ত গলায় বললেন, ‘চেয়ারের হাতলে বসেছিস কেন? নেমে বস। কেউ দেখলে কী ভাববে।’

গণেশ ফিচ্ করে হেসে বলল, ‘হাতলে বসলেই তো মজা। কেউ দেখলে বয়েই গেছে।’

রমাকান্তবাবু বিড়বিড় করে বললেন, ‘মারব, একটা চড়। এটা তোর নলিনীবালা হাই স্কুলের ক্লাসঘর নয় যে বেঞ্চের মাথায় থাকবি। এটা ভদ্রলোকের বাড়ি।’

গণেশ মাথা কাত করে চোখ পিটপিট করে বলল, ‘ভদ্রলোকটা কে?’

রমাকান্তবাবু চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘কেন! তোর কি আমাদের ভদ্রলোক বলে মনে হচ্ছে না?’

গণেশ হাতল থেকে নেমে খাটের পাশে এসে বসল। রমাকান্তবাবু হাঁই হাঁই করে উঠলেন, ‘অ্যাই করিস কী! করিস কী! জুতো পরে রোগীর বিছানায় বসছিস! কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই! জুতো খোল, আগে জুতো খোল। মাধবী যদি দেখে…।’

গণেশ থমকে গিয়ে বলল, ‘উফ্ বড্ড জ্বালাস।’

গণেশ জুতো খুলে খাটের তলায় রাখল। ছোটো মাপের স্কুলের জুতো। ধুলো মাখা। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের কাছে তাপ্পি। গণেশটা বিরাট পাজি। শুধু স্কুলের জুতো নয়, স্কুল ড্রেসও পরে এসেছে। খাকি রঙের হাফপ্যান্ট, নীল রঙের জামা। তার কি অন্য কোনও পোশাক নেই? এত বছর পর বন্ধুর বাড়ি এলি, একটু সেজেগুজে, চুল আঁচড়ে আসতে অসুবিধে কোথায়? বদের ধাড়ি একটা। বেটা খাটে পা গুটিয়ে আরাম করে বসেছে দ্যাখো, যেন একটু পরেই ক্যারাম খেলা শুরু হবে।

রমাকান্তবাবুর গায়ে হাত রেখে নরম গলায় গণেশ বলল, ‘বললি না তো আছিস কেমন?’

রমাকান্তবাবুর রাগ হচ্ছে। এই ছেলে তো মহা ঝামেলা পাকাচ্ছে। একটু পরেই মাধবী ঘরে আসবে। সে এসে যদি দেখে রোগীর বিছানায় কেউ বসে আছে, রাগারাগি করবে। গত মাস পর্যন্ত মাধবী এ ঘরেতেই ক্যাম্প খাট পেতে শুত। ঘুমের অসুবিধে হয় বলে নিজের ঘরে চলে গেছে। ঠিকই করেছে। চার মাস ধরে রাতে রোগীর ঘরে শুয়ে থাকা অসম্ভব। স্বামী হলেও অসম্ভব। ঘণ্টায় ঘণ্টায় ওঠো রে, জল দাও রে, গায়ের চাদর ঠিক করো রে, বুকে পিঠে হাত বুলিয়ে দাও রে, ইউরিন পট ধরো রে, ওষুধ খাওয়াও রে। তাহলে ঘুমোবে কখন? শুভ বলেছিল, ‘এক কাজ করা যাক। মা যখন শুচ্ছে না, আমি একজন নার্সকে বলি। রাতে এসে বাবার ঘরে থাকবে। যদি তোমরা রাজি হও বলতে পারি।’

নার্স মেয়েটি এসেছিল। কম বয়েস এবং দেখতে শুনতে ভালো। ঝুমা তাকে পত্রপাঠ বিদায় করে। স্বামীকে সে বিশ্বাস করে না।

তারপর থেকে রাত একাই কাটান রমাকান্ত। ভালোই লাগে। একা থাকলে, নিজের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়া যায়।

গণেশ ঝুঁকে পড়ে বলল, ‘কেমন আছিস বলবি না?’

রমাকান্তবাবু রাগ দেখিয়ে বললেন, ‘দেখতেই তো পাচ্ছিস। বারবার এক কথা জিজ্ঞেস করিস কেন?’

গণেশ হেসে বলল, ‘আমার তো মনে হচ্ছে ভালোই আছিস।’

রমাকান্তবাবু বললেন, ‘অবশ্যই ভালো আছি। একটু শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে এই যা।’

গণেশ বলল, ‘ও কিছু নয়, একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবে। আমি যখন জলে ডুবে যাচ্ছিলাম তখনও শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। পরে ঠিক হয়ে গেল।’

রমাকান্তবাবু বললেন, ‘বুঝলাম। এবার আমার হাতটা তুলে দে দেখি।’

গণেশ হেসে বলল, ‘থাক। খাট থেকে হাত ঝুলিয়ে মরলে একটা নাটক নাটক ভাব হবে।’

রমাকান্তবাবু চোখ পাকিয়ে বললেন, ‘ফাজলামি করবি না গণেশ। ফাজলামির জন্য তোর সঙ্গে কতবার মারপিট করেছি মনে পড়ে? ক্লাস এইটে একবার আমার পেনসিল নিয়ে পালিয়েছিলি। তোকে ল্যাং মেরে ফেলে দিয়েছিলাম। তোর মাথা ফুলে আলু হয়ে গেল। মনে পড়ছে?’

গণেশ হেসে বলল, ‘না, মনে পড়ছে না। আমি তো আর তোর মতো মরতে বসিনি, যে পুরোনো কথা মনে পড়বে।’

ঘরের আলো আরও বেড়ে গেছে। আজ বোধহয় খুব রোদ উঠবে। এও একটা মুশকিল। সবাইকে গরমে বেরোতে হবে। শুভটার আবার অ্যালার্জির ধাত। বেশি গরমে গায়ে অ্যালার্জি বেরোয়। অবশ্য এখন তো ডেডবডি ঘাড়ে করে শ্মশানে নিয়ে যাবার ব্যাপার নেই। কাচে ঢাকা গাড়ি আছে। তাও একটা ছোটাছুটি তো থাকে। ঘর বার করতে হয়।

‘আমার অসুখের খবর তোকে কে দিল গণেশ?’

‘বাবলুদা।’

‘বাবলুদা! হার্ট অ্যাটাকে যে মারা গেছে সেই বাবলুদা?’

গণেশ একটা হাই তুলে বলল, ‘হ্যাঁ। রঞ্জনাও বলল। রঞ্জনাকে মনে আছে? বিষ খেয়েছিল।’

রমাকান্তবাবু একটু চুপ করে থেকে নিচু গলায় বললেন, ‘মনে আছে।’

গণেশ ফিচ করে হেসে বলল, ‘তোর সঙ্গে প্রেম ছিল না? বিয়ে করলি না কেন? বেচারি এভাবে মরত না।’

রমাকান্তবাবু গণেশের দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘রঞ্জনা তোকে কিছু বলে?’

গণেশ নাক টেনে বলল, ‘বলে না। তবে বুঝি তোর ওপর খুব অভিমান। পাগলি একটা। সেই কবে কলেজের প্রেম…। এখনও জিইয়ে রেখেছে।’

রমাকান্তবাবু বললেন, ‘ওরা সব আছে কেমন?’

গণেশ বলল, ‘ভালো আছে।’

রমাকান্তবাবু আবার একটু চুপ করে থেকে বললেন, ‘তুই কেন এসেছিস?’

গণেশ সহজ ভাবে বলল, ‘তোকে নিতে এসেছি। অনেকটা পথ। দুজনে গল্প করতে করতে চলে যাব।’

‘তুই কি আমাকে বিকেল পর্যন্ত সময় দিবি গণেশ? বাড়ির সবাই খেয়ে-টেয়ে নিত… সারাদিন ধকল যাবে… বিকেল বিকেল হলে রোদটাও কম হতো…।’

গণেশ বলল, ‘না, মৃত্যু সময় দেয় না। আমাকেও দেয়নি।’

মাধবী ঘরে ঢুকলেন। ঢুকেই থমকে দাঁড়ালেন। কেমন একটা গন্ধ না?

রমাকান্তবাবু হেসে বললেন, ‘এসো মাধবী। তোমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিই। আমার স্কুলের বন্ধু গণেশ। খুব পাজি। বেটা ক্লাস এইটে পড়বার সময় জলে ডুবে ফট করে মরে গেল। সাঁতার জানত তবু মরল। ডাক্তারবাবু বললেন, গণেশ নাকি সাঁতার দেবার সুযোগই পায়নি। মাঝপুকুরে পেৌঁছোতেই হার্টফেল করে। বেঁচে থাকা কী কঠিন বলো মাধবী। সব আয়োজন, প্রস্তুতি নিয়েও বাঁচা যায় না।’ কথা শেষ করে জোরে হেসে উঠলেন রমাকান্ত। বললেন, ‘যাবার আগে ওকে একটা জোর ধমক দাও তো মাধবী। রোগীর বিছানায় ওঠবার জন্য ওর ধমক খাওয়া উচিত।’

মাধবী চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। তিনি ঘরে ঢুকেই বুঝতে পেরেছেন, রমাকান্তবাবু মারা গেছেন। ঘরে মৃত্যুর মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে চলে গেছেন।

পরদিন সকালে রমাকান্তবাবুর খাটের তলা থেকে এক জোড়া জুতো পাওয়া গেল। ছোটো জুতো। ধুলোমাখা, ডানপায়ে তাপ্পি।

অভিনয়ের পরে

মাঝরাতে ঘুম ভাঙতেই বিপ্লবের মনে পড়ল আজকের রাতটাই শেষ, তারপর থেকে পুরো একা। আচ্ছা পুরোপুরি একার জীবনটা ঠিক কেমন কাটবে? আদৌ কি কাটাতে পারবে ও? কথাটা ভাবতেই হাসি পেল। স্রেফ বোকা বোকা ভাবনা। পারলেও কাটাতে হবে, না পারলেও। আচ্ছা ঈশানীও কি একই কথা ভাবছে এখন? নাকি ঘুমোচ্ছে? ইচ্ছে থাকলেও জানার উপায় নেই। যদিও ঈশানী আর বিপ্লবের মধ্যে দূরত্ব মাত্র একটা দেয়ালের। কিন্তু সেই দেয়াল যতটা না দৃশ্যত তার থেকে অনেক বেশি অদৃশ্য।

বিপ্লব আর ঈশানীর আজ একসঙ্গে থাকার শেষ রাত। অবশ্য একসঙ্গে থাকা শব্দটা না বলে বরং এক ছাদের নীচে থাকার শেষ রাত্তির বলাই ভালো। কারণ একসঙ্গে থাকার রাত্তিরগুলো শেষ হয়ে গিয়েছিল প্রায় মাস চারেক আগে। কিংবা আরও একটু আগে থেকেই। সেই যবে থেকে অশান্তি শুরু হয়েছিল। সেইসব দিনগুলো ঝগড়া, অশান্তি, কান্নার সন্ধে, রাতগুলো…। উফফফ…!

কথাটা মনে হতেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল বিপ্লব। শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না। জানলার কাছে এসে দাঁড়াল। এখন মার্চ মাসের শুরু। ভরা বসন্তকাল। শেষ রাতের দিকে শীত এসে জানলার পাশে দাঁড়ায়। এখনও সে কিছুটা রয়ে গেছে সেই খবর দিতে। কাচের শার্সির ওপারে ঘন অন্ধকার আর শিরশিরে ঠান্ডা দাঁড়িয়ে। বিপ্লবের ইচ্ছে হল কাচের জানলাটা খুলে সেই অন্ধকার আর শীতলতা গায়ে মাখতে। খুলতে গিয়েও খুলল না।

থাক। অনেকদিন আগে, অনেক অনেক দিন আগে- এমনই একটা ঘন মাঝরাতে আদর শেষ করে আদিম ভাবে ও আর ঈশানী এসে দাঁড়িয়েছিল এই জানলাটার সামনে। এমন অন্ধকার ছিল বাইরেটা। ঈশানী কাচের জানলা খুলে দিতেই ঠান্ডা নরম হাওয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরেছিল ওদের দুজনকে। তারপর প্রায় ভোররাত পর্যন্ত দুজন দুজনকে ওইভাবে জড়িয়ে থেকে পরস্পরের শরীরের ওম নিয়েছিল। মনে হয় যেন গত জন্মের কথা…। একটা জীবনের মধ্যেই মানুষের কতগুলো জন্ম যে লুকিয়ে থাকে…

জানলার সামনে থেকে সরে এল বিপ্লব। মন খারাপ লাগছে। কেমন যেন এলোমেলো লাগছে সব। আবার পুরোটা ভাবতে চেষ্টা করতে শুরু করল। সত্যিই কি ওর কোনও দোষ ছিল? ছিল হয়তো কিংবা ছিল না। আর ভেবে লাভ নেই। সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে।

তারপরেও আরেকবার ভাবার চেষ্টা করতে থাকল। আজ থেকে বেশ কিছু বছর আগের কথা। ছয় বছর। কম্পিটিটিভ এক্সামের ট্রেনিং ইন্সটিটিউটে দুজনের পরিচয়। পরিচয় গড়িয়ে বছর দুয়েকের প্রেম। প্রেম গড়িয়ে চার বছর আগে বিয়ে। ততদিনে বিপ্লবের সরকারি ব্যাংকে চাকরি। গড়িয়াতে টু বিএইচকে ফ্ল্যাট নেওয়া। ঈশানীর সরকারি চাকরি পাওয়ার যে খুব ইচ্ছে ছিল তা নয়। সরকারি চাকুরে বাবার জোরাজুরিতে ভর্তি হয়েছিল ঠিকই কিন্তু মনপ্রাণ পড়ে থাকত গ্রুপ থিয়েটারে। ছোটোবেলা থেকে শখ। কলকাতার একটা নামকরা গ্রুপে ছিল। মাঝে মাঝে টুকটাক টিভি সিরিয়ালেও কাজ করেছে। বিয়ের আগে ঈশানী বারবার একটাই শর্ত রেখেছিল বিপ্লবের কাছে, আমার বাবার মতো তুমিও বলবে না তো অভিনয় করা, গ্রুপ করা ছেড়ে দিতে?

আমি তো ভাবছি আমিও তোমাদের গ্রুপে ভিড়ে যাব। আরেকটু বেশি সময় থাকতে পারব তোমার সঙ্গে। তখন হেসে বলত বিপ্লব।

কিন্তু বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই যখন আবার পুরোদমে নিজের অভিনয় জগতে ফিরে গেল ঈশানী, তখন থেকেই একটু একটু করে মনের অনেক ভেতরে একটা ক্ষোভ জমতে শুরু হয়েছিল বিপ্লবের। জমতে জমতে পাথর, পাথর জমে পাহাড়। দিন নেই রাত নেই রিহার্সাল। তারপর আজ বাঁকুড়াতে শো তো কাল আকাদেমি, বাড়ি ফেরার কোনও সময়ের ঠিক নেই। দিন রাত সব এক। ক্ষোভটা একসময় প্রকাশ পেতে শুরু করল।

ঈশানী প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো, সংসারটা এইভাবে চললে কিন্তু একদিন সব ভেসে যাবে।

কী চাইছ তুমি, আমি সব ছেড়ে দিই?

তা বলছি না। কিন্তু একটু কম করলে কি হয় না?

না হয় না। এটা আমার প্রফেশন। আর তা ছাড়া বিয়ের আগে থেকেই তুমি কিন্তু সব জানতে।

হ্যাঁ জানতাম, কিন্তু এতটাও জানতাম না, তাহলে…

কী তাহলে?

কিছু না।

দিনে দিনে অসহ্য হতে শুরু করল। তীব্রতা বাড়তে বাড়তে একটা সময়ে দুজনেই বুঝল এই সম্পর্কটার আর কোনও অর্থ নেই। শুধুমাত্রই এক ছাদের নীচে থাকা। দুজনের শোবার ঘর আলাদা হয়ে গিয়েছিল আগেই। মন আলাদা হয়েছিল তারও অনেক আগে। তবু সামাজিক ভাবে থাকতে থাকতে একসময় দুজনেই বুঝল দিনের পর দিন এই অভিনয়ের কোনও মানে হয় না। এতে কষ্ট আরও বাড়ে। সুতরাং পাকাপাকি ভাবে আলাদা হয়ে যাওয়াই সততা।

সেই সিদ্ধান্তের আজই শেষ দিন। শেষ রাত। নিজের জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিয়েছে ঈশানী। আর বহুদিন পর আজ সারাটা দিন পরস্পর দুজনের সঙ্গে খুব স্বাভাবিকভাবেই কথা বলেছে।

সকাল হওয়ার অপেক্ষা করতে থাকল বিপ্লব।

কলিংবেলটা ননস্টপ বাজছে। এত সকালে আবার কে এল? রান্নার মাসিকে আজ আসতে বারণ করে দিয়েছিল বিপ্লব। যদিও সে সবই জানে তবু চোখের সামনে বাড়ির বউ চলে যাচ্ছে সেটা দেখাতে চায়নি ও। তাই রান্নার লোক, কাজের মাসি আজ দুজনেরই ছুটির দিন। তাহলে কে?

বিপ্লব দরজাটা খুলল। আর খুলতেই চূড়ান্ত বিস্ময়। সমীরণ! তাও আবার একা নয়, সঙ্গে ওর স্ত্রী, সায়ন্তনী।

কী রে ভূত দেখছিস নাকি? সর, ভেতরে ঢুকব। একগাল হেসে বলল সমীরণ। বিপ্লবের অনেকদিনের বন্ধু।

বিপ্লব খানিকটা হতভম্ব হয়ে দরজাটা খুলতেই হইহই করে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল সমীরণ, তারপর ওর সেই স্বভাবসিদ্ধ বাজখাঁই গলায় কোথায় তোর বউ? ডাক ওকে। বলে নিজেই ডাকতে শুরু করল, ঈশানী ও ঈশানী গেলে কই? আমরা এসে গেছি। এমন ভাবে বলল যেন ওর আসার কথা আগে থেকেই বলে রাখা ছিল। সমীরণটা চিরকালই এমন। হুল্লোড়বাজ। ধীরে সুস্থে কিছু করতে পারে না। সবকিছুতেই হইহই। অবশ্য ওর এই স্বভাবের জন্যই সেই কলেজ লাইফ থেকে ও খুব জনপ্রিয় ছিল। একডাকে চিনত সকলে। কলেজের সোশাল কিংবা প্রিন্সিপাল ঘেরাও, অ্যানুয়াল ফেস্ট কিংবা ইউনিয়নের চাঁদা তোলা– সব কিছুতেই এগিয়ে ছিল সমীরণ। দারুণ মজাদার, দেখতে সুন্দর বলে মেয়েদেরও নয়নের মণি ছিল ও। তবে প্রেমে অ্যালার্জি ছিল ওর। বক্তব্য ছিল ওসব লাইনে আমি নেই ভাই। প্রেমে বহুত টাইম দিতে হয়। আর আমার কাছে নো টাইম ফর দ্যাট।

সত্যি সত্যিই অনেক অফার আসা সত্ত্বেও কোনও প্রপোজাল অ্যাকসেপ্ট করেনি কখনও। বরং একেকটা মেয়ের অফার নিয়ে রীতিমতো মজা করত, অপদস্থ করত তাকে। তাতেই মজা পেত।

বন্ধুরা বলত এই যে তুই এত লোভনীয় অফার হেলায় হারাচ্ছিস একদিন এর জন্য তোকে পস্তাতে হবে দেখিস। মেয়েদের দীর্ঘশ্বাসের ফল কিন্তু মারাত্মক।

শুনে হো হো করে হাসত সমীরণ।

সেই সমীরণও একদিন বিয়ে করল এবং রীতিমতো সম্বন্ধ করেই ঢাকঢোল পিটিয়ে বিয়ে করল। সমীরণ চাকরি করত একটা বেসরকারি স্কুলে। ইংরেজি পড়াত। আর ওর স্ত্রী গভর্নমেন্ট স্কুলের ইতিহাসের টিচার। সত্যি বলতে সমীরণের বউকে মোটেও সুন্দর দেখতে নয়। অন্তত সমীরণের পাশে তো একেবারেই বেমানান। তাই নিয়ে বিপ্লব আর ওর বন্ধুরা মিলে বিস্তর আলোচনা করেছে। কানাঘুষোয় যেটা জানা গিয়েছিল যে সমীরণ নাকি কিছু একটা কেসে ফেঁসে গিয়েই বিয়েটা করতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু সেটা সকলের কাছে গোপন রেখেছিল বলেই কেউ সরাসরি ওর কাছ থেকে কিছু জানতে পারেনি। তাও এইসবই প্রায় বছর তিনেক আগের কথা।

তারপর প্রায় বছর খানেক হয়ে গেল সমীরণ আচমকা ডুব। কারও সঙ্গে যোগাযোগ নেই। যদিও বন্ধুদের মধ্যে বিয়ের পরেও সব থেকে বেশি যোগাযোগ রাখত ওই। ওর মাধ্যমেই বাকি বন্ধুদের হালহকিকত জানা যেত। সেই সমীরণই যখন আচমকা সকলের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বন্ধ করে দিল তাই নিয়েও অল্পবিস্তর আলোচনা হয়েছিল বন্ধুদের মধ্যে। তারপর যা হয় আর কি। কিছুদিনের মধ্যেই আবার যে যার জগতে। ভুলেই গেছিল সকলে। বিপ্লবও।

সেই সমীরণ আজ আবার সামনে। তবে প্রথমে দেখেই একবারে চিনতে পারেনি বিপ্লব। একটু সময় লেগে গেছিল। সেই সুন্দর চেহারাটা একেবারে ফুলে বেগুন। মুখটাও ফুলে ঢোল। চোখের তলায় কোলেস্টেরলের কোলবালিশ। শুধু যেন বাইরের হইহই-টাই রয়ে গেছে। আসল সমীরণ গেছে হারিয়ে। অবশ্য এমনটা না-ও হতে পারে, পুরোটাই বিপ্লবের ভ্রম। পৃথিবীর দুখী মানুষেরা বাকি সকলকেই দুখী দেখতে চায়।

কিন্তু তার থেকেও বড়ো সমস্যা হল এই আজকের দিনে সমীরণের সস্ত্রীক চলে আসা। হতচ্ছাড়াকে এতদিন পর আজই আসতে হল! একটু পরেই হয়তো ও সব জেনে যাবে। তারপর কী করবে কে জানে! আচ্ছা মুশকিল তো। পুরো অকওয়ার্ড সিচুয়েশন।

কোথায় রে তোর বউ কোথায় লুকোল, শিগগির ডাক। আর তুই চটপট বাজারে যা। ভালো করে বাজার করবি। আজ আমরা কিন্তু দুপুরটা এখানেই কাটাব। যাব সেই বিকেলে।

সে তো খুবই ভালো কথা, কিন্তু আগে একটা ফোন তো করতে পারতিস।

হুঁ পারতাম। বাট করিনি। এমনকী তোর এখান থেকে সন্ধেবেলায় যাব আরেকজনের বাড়িতে। রাত্রে ওর ফ্ল্যাটেই থাকব। ওদেরও কিছু বলিনি। গিয়ে ব্যাটাদের চমকে দেব। তবে কাদের কাদের বাড়ি যাব জিজ্ঞেস করিস না। বলব না। পরে সব জানবি।

তা এমন প্ল্যানের কারণ? জিজ্ঞেস করল বিপ্লব।

ধীরে বৎস ধীরে, সব বলে দিলে কী করে হবে? বললাম তো সব ক্রমশ জানবি। আরে ও ঈশানী তুমি গেলে কই? হ্যাঁ রে তোর বউ বাড়িতে নেই?

হুঁ আছে তো। ওর ঘরে… বলেই থমকে গেল বিপ্লব।

ওর ঘরে মানে? তোরা কি আলাদা আলাদা ঘরে থাকিস নাকি?

আরে না না মানে অন্য ঘরে।

দাঁড়াও আমি ডাকছি, কোনদিকে ঘরটা? জিজ্ঞেস করল সায়ন্তনী।

অ্যাঁ…

আরে ঘরটা বলো। অ্যাঁ, কি?

বাধ্য হয়ে আঙুল তুলে বিপ্লব ওর ঘরের পাশের বন্ধ দরজাটা দেখাল।

দরজার সামনে গিয়ে টোকা দেওয়ার ঠিক আগের মুহূর্তেই দরজা খুলে বেরিয়ে এল ঈশানী। একেবারে ঠিক সময় বুঝেই বেরিয়েছে। বিপ্লব টেনশনে ছিল ঈশানীর রিয়্যাকশনটা ঠিক কেমন হবে। হয়তো খারাপ কিছু, সকলকে অপ্রস্তুত করে দেওয়ার মতো কিছু। কিন্তু না, একেবারে স্টেজের মতোই নিখুঁত অভিনয় করল। দরজা খুলেই একগাল হাসি দিয়ে বলল, ওরেব্বাবা এত সকাল সকাল অতিথির আগমন যে। ব্যাপার কি?

এই একটু হনিমুনে বেরিয়েছি দুজনে। বলে সায়ন্তনীর হাত ধরল সমীরণ। দেখে এক মুহূর্তের জন্য বুকের ভেতরটা অকারণে চিড়িক করে উঠল বিপ্লবের। আর এক পলকের মধ্যে চোখাচোখি হল ঈশানীর সঙ্গে। দেখে মনে হল না ঈশানীর মধ্যে ওই দৃশ্যের কারণে কোনও ভাবান্তর হয়েছে।

খুব ভালো করেছিস। কিন্তু চেহারাটার এমন অবস্থা করলি কী করে?

সঙ্গদোষে ভাই। বলেই সায়ন্তনীর দিকে তাকাল সমীরণ। দুপুরে কী খাওয়াবি বল?

বিপ্লব অকূলপাথারে পড়ল। কি বলবে ভেবে পেল না। ঈশানী কি এখনই বেরিয়ে যাবে? ভাবতে ভাবতেই দেখল সায়ন্তনী ঈশানীর ঘরের দিকে এগোচ্ছে। তোমাদের বাড়িতে সেই একবারই এসেছিলাম বিয়ের পর। ওর কাছে শুনেছি তোমরাও এখনও আমাদের মতো ঝাড়া হাত পা? তা ফ্যামিলি প্ল্যানিং আর কতদিন?

সায়ন্তনীর কথা শুনে সামান্য হাসল ঈশানী। উত্তর দিল, দেখি কতদিন।

এই, তোমরা কোথাও বেরোনোর প্ল্যান করছিলে নাকি? সায়ন্তনীর কথায় চমকে উঠল বিপ্লব।

কেন?

ঘরে বড়ো বড়ো বাক্স রাখা দেখছি খাটের উপর।

হ্যাঁ একটু বেরোনোর ছিল। ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দিল ঈশানী।

এবাবা তাহলে তো সত্যিই ভুল দিনে চলে এসেছি। পরে একদিন… বলে থামল সায়ন্তনী।

অন্যদিনে কি আর আসার সুযোগ পেতাম আমরা, বলে জোর করে হাসল সমীরণ।

আরে বাবা কোনও ব্যাপার না। আমরা দুজনে কোথাও যাচ্ছিলাম না। আমারই একা এক জায়গায় যাওয়ার ছিল। সেটা বিকেলে গেলেও চলবে।

একা? মানে? এই এত বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে একা একা নিরুদ্দেশে যাচ্ছিলে কোথায়? ঈশানীকে জিজ্ঞেস করল সায়ন্তনী।

সায়ন্তনীর প্রশ্নে বিপ্লব কাঠের পুতুলের মতো স্থির হয়ে থাকল। এর কী উত্তর দেবে ঈশানী, তার অপেক্ষা করতে থাকল।

কিছু না, একটা শো আছে, সেই কারণেই। বিকেলে বেরোলেও হবে।

নাহ্, অভিনয়টা সত্যিই নিখুঁত পারে ঈশানী। কী অবলীলায় বলতে পারল এত বড়ো মিথ্যাটা, কিন্তু একটা ব্যাপারে ও মনে মনে অবাক হচ্ছিল যে, সমীরণ যেহেতু ওর বন্ধু তাই ওর কাছে নিজের পরিবারের দৈন্য লুকানোর একটা দায় আছে, কিন্তু ঈশানীর সেই দায় নেই, এমনকী ওদের দুজনের সঙ্গে কোনও ঘনিষ্ঠতাও নেই কোনওকালে। তাহলে এই লুকোচুরি কেন? নেহাতই সৌজন্য? আশ্চর্য!

যা যা ব্যাটা জমিয়ে বাজার করে নিয়ে আয়। বলল সমীরণ।

হ্যাঁ যাচ্ছি। তুই যাবি সঙ্গে?

খেপেছিস? আমি আজ বউ ছাড়া এক মুহূর্তও থাকছি না।

কেন রে আজ ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি নাকি তোর?

উঁহু। তার থেকেও বড়ো ব্যাপার। পরে জানবি। এখন যা বেরো। আমরা তিনজনে মিলে একটু গল্প করি।

কিচেনে ঢুকে বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে বিপ্লব ভাবল আজ সকালটা কেমন হওয়ার ছিল আর কেমন হতে চলেছে। সমীরণরা না আসলে হয়তো এতক্ষণে ঈশানী চলেও যেত। কিন্তু বদলে যেটা হল তা আরও ঘাঁটা কেস। পুরো একটা জগাখিচুড়ি সিচুয়েশন। ব্যাগটা হাতে নিয়ে ফিরতেই চমকে উঠল বিপ্লব। সামনে ঈশানী দাঁড়িয়ে রয়েছে। দুজনে মুখোমুখি হল। দুজনেই চুপ।

কিছু বলবে?

তোমার বন্ধু চিংড়ি খেতে চাইছে সেটাই বলতে এলাম।

আচ্ছা। বলে একটু থেমে বিপ্লব বলল, সরি, আমি আসলে জানতাম না ওরা এইভাবে চলে আসবে।

ইটস ওকে।

তোমার প্রবলেম হচ্ছে বুঝতে পারছি।

আমি বিকেলে যাব।

থ্যাংকস, মুখ থেকে বেরিয়ে গেল বিপ্লবের। যেভাবে মানুষ পরিচিত কিংবা স্বল্প পরিচিত মানুষের কাছ থেকে উপকার পেলে বলে ওঠে, সেইভাবেই বলল।

তার উত্তর দিল না ঈশানী। সমীরণ আর সায়ন্তনী এখন ড্রয়িংরুমে বসে। ওদের গলার শব্দ আসছে। এই সাতসকালে অন্যের বাড়ি এসে এত ফুর্তির কী আছে ভেবে পেল না বিপ্লব।

ফ্ল্যাট ছেড়ে বেরিয়ে এল। অন্যমনস্ক ভাবেই বাজার করছিল আর বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল অনেক পুরোনো দিনগুলোর কথা। ঈশানীর কথা, সমীরণের কথা, কলেজ জীবনের সেই দিনগুলো। অনেক অনেক কথা। সব কেমন যেন হয়ে গেল জীবনটার।

ঈশানীর সঙ্গে অশান্তি খুব বেশিদিন এগোয়নি। আসলে ওদের দুজনেরই লড়াই ঝগড়া এইসব করতে রুচিতে বাধে। তবে দুজনেই বুঝতে পারছিল, হচ্ছে না, এইভাবে আর খুব বেশিদিন নয়। আর বেশিদূর এগোনো যাবে না। কিন্তু সেই কথাটা কে কবে বলবে তাই নিয়ে ভাবতে ভাবতেই একদিন ছুটির দিন সকালে ঈশানী নিজেই দায়িত্ব নিয়ে বলেছিল বিপ্লবকে। তোমার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে।

কী কথা শোনার আগেই বুঝে গিয়েছিল বিপ্লব। যেভাবে বোঝা যায়। তবু বসেছিল, শুনেছিল সবটা। তারপর বলেছিল ওকে। আমার কোনও আপত্তি নেই।

আপাতত ডিভোর্স নয়, তবে সেপারেশন। ঈশানী ওর গ্রুপেরই একটি মেয়ের সঙ্গে তার মেসে রুম শেয়ার করে থাকবে।

সেই আলোচনা হয়েছে প্রায় দিন দশেক আগে। হ্যাঁ ঠিক দশ দিন আগেই।

বাজার থেকে বাড়িতে আসতেই হাউ হাউ করে উঠল সমীরণ। কী রে এত দেরি! আমরা তো ভাবলাম বাজার করতে গিয়ে পালালি বুঝি। যা চিপকুস তুই। বলে নিজেই হো হো করে হেসে উঠল। বিপ্লব সামান্য হেসে বলল নাহ্, কোথায় আর পালাব? আমার পালানোর কোনও জায়গা নেই। বলে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে কিচেনে ঢুকল। ওর পিছনে আসল ঈশানী। ওকে দেখে বিপ্লব নীচু গলায় বলল, সরি, তোমায় খুব প্রবলেমে ফেলে দিলাম। রান্নার লোকও আজ আসবে না।

ইটস ওকে। তুমি ওদের কাছে গিয়ে বসো, আমি সামলে নিচ্ছি। বিপ্লব অবাক হচ্ছিল, এই মেয়েটাই আজ চলে যাচ্ছিল, হয়তো… হয়তো না, সত্যিই চলে যাবে চিরকালের জন্য বিপ্লবকে ছেড়ে, অথচ এত ক্যাজুয়াল রয়েছে কী করে। কই বিপ্লব তো এমন সহজ হতে পারছে না, বারবার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠছে। আচ্ছা এমনটা কি ঈশানীও ভাবছে? না নিশ্চয়ই ভাবছে না। বিপ্লব কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঈশানীকে, পারল না।

কিচেনের সামনে এসে দাঁড়াল সায়ন্তনী। কী ব্যাপার কত্তা-গিন্নিতে কি ফুসুর ফুসুর হচ্ছে? যান আপনি বন্ধুর সঙ্গে গপ্পো করুন গে আমরা এদিকটা দেখছি।

নাহ্ গুজুর গুজুর আর কি?

থাক আর লজ্জা পেতে হবে না। কতদিন বিয়ে হল যে এখনও ফিসফিসে প্রেমের কথা ফুরোল না? মুচকি হেসে বলল সায়ন্তনী।

উত্তর দিল না বিপ্লব। ঈশানীও কিছু বলল না। ম্লান হেসে সরে এল বিপ্লব। সমীরণের কাছে গেল। সামনে যেতেই কথার ফুলঝুরি শুরু।

সারাদিন কেটে গেল গল্পে, খাওয়াদাওয়া, পুরোনো সব কথায়। বিপ্লব যেন সত্যিই কখন ভুলে গেল আজ সকালে কী ঘটতে চলেছিল কিংবা ওরা চলে যাওয়ার পর কী ঘটবে। সমীরণ আর সায়ন্তনীর কারণেই হয়তো বিপ্লব বা ঈশানী কেউই খুব বেশিক্ষণ চুপ বা গম্ভীর থাকতে পারেনি। বিপ্লব অবাক হচ্ছিল বিয়ের এত বছর পরেও ওদের দুজনের মধ্যে কী গভীর বন্ধুত্ব, প্রেম। একে অপরের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলে কিংবা খুনসুটি করে যেন সদ্য বিয়ে হয়েছে কয়েকদিন আগে। এমনও হয়?

কথায় কথায় দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধে। বাইরে রোদ্দুর ঢলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিপ্লবের বুকের ভেতরেও মেঘ জমা হচ্ছিল। অস্থির হয়ে উঠছিল মনটা। অথচ এমন তো হওয়ার কথা ছিল না। ওর আর ঈশানীর মধ্যে এমন আর কিছু নেই যার জন্য একসঙ্গে থেকে যাওয়া যায়। তাহলে? ঈশানীর মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিল বিপ্লব। ওরও কি এমন কিছু হচ্ছে। কিন্তু কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। আগাগোড়া নিখুঁত অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছিল ঈশানী।

একসময় উঠে দাঁড়াল সমীরণ। না রে আর না, ঢের গপ্পো হল, এবার উঠি, নইলে বাকি ব্যাটাদের জ্বালানো হবে না।

এখনই চলে যাবি? ফস করে মুখ থেকে বেরিয়ে এল বিপ্লবের।

হ্যাঁ আর দেরি করলে পৌঁছোতে পারব না। আজই যেতে হবে। আর তো সুযোগ হবে না ভাই। বলেই হো হো করে হেসে উঠল সমীরণ। বলল আমরা দুজনেই, যে রেটে ব্যস্ত থাকি। দুজনের ভালো করে কথা বলারই ভাগ্য হয় না, বেরোনো তো দূরের কথা।

তোদের দেখে কিন্তু সেটা মনে হয় না। বলল বিপ্লব।

আর দেখে কি কিছু মনে হয় রে ভাই। এই যেমন তোদের দুজনকে বাইরে থেকে দেখে কেউ বলবে… বলে পজ দিল সমীরণ।

ধক করে উঠল বিপ্লবের বুক। জেনে গেছে সব! কে বলল? কী করে বুঝল।

আরে ভাই সব বোঝা যায়, হাঁ করে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে কী হবে? এমন অমর প্রেম তোদের পুরো চিরদিনই তুমি যে আমার… বলেই আবার হাসি।

তাড়া দিল সায়ন্তনী। অনেক ইয়ার্কি হয়েছে এবার চলো।

ওক্বে স্যার গুডনাইট। থ্যাংক ইউ ম্যাম। দারুণ লাঞ্চ হল। আজীবন মনে রাখব। ঈশানীর দিকে তাকিয়ে বলল সমীরণ।

আবার আসবেন দুজনে। সামান্য হেসে বলল ঈশানী।

দেখা যাক। চললাম তাহলে।

চলে গেল দুজন। বিপ্লব আর ঈশানী আবার একা। এক মুহূর্ত পরস্পর দুজনের মুখের দিকে তাকাল তারপর ঈশানী নিঃশব্দে চলে গেল ওর ঘরের দিকে। এবার বোধহয় ও-ও বেরোবে।

ফোন বাজছে বিপ্লবের। হাতে মোবাইলটা তুলে নিয়ে দেখল অরূপের ফোন। অরূপও ওদের গ্রুপের বন্ধু। নাম্বার আছে ঠিকই যোগাযোগ খুব কম। আজ হঠাৎ!

হ্যাঁ অরূপ বল।

হ্যাঁ রে তোদের বাড়িতে কি সমীরণ আর ওর বউ এসেছিল?

হ্যাঁ এই তো বেরোল। কেন?

আশ্চর্য চিজ তো ওরা!

কেন কী হয়েছে?

আজ ভোর পাঁচটার সময় ওরা দুজন আচমকা আমাদের বাড়ি এসেছিল। ঘুম থেকে টেনে তুলে প্রায় ঘন্টা খানেক ছিল দুজনে। চা খেয়ে তারপর বিদায় নিয়েছে। বলে আজ নাকি ওরা দুজন মিলে সব পুরোনো বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি ঘুরবে। কিন্তু কাদের বাড়ি যাবে কিছুতেই বলেনি।

হ্যাঁ আমাকেও তাই বলেছে। কিন্তু ব্যাপার কী?

আরে ব্যাপারটা অদ্ভুত। ওরা চলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর আমার ড্রয়িংরুমে সোফার কোণে একটা ছোটো ভাঁজ করা কাগজ পাই। খুলে দেখি, চিঠি। সমীরণের। সেখানে লিখেছে আজ নাকি ও আর সায়ন্তনীর একসঙ্গে থাকার শেষ দিন। মানে দুজনে সেপারেট হয়ে যাচ্ছে। তাই শেষবারের মতো দুজনে বন্ধুদের বাড়ি বাড়ি ঘুরবে। আমি একবার শুনেছিলাম যে ওদের মধ্যে ঠিক বনিবনা হচ্ছে না। সে ঝামেলা ওদের বিয়ের কিছুদিন পর থেকেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু তাই বলে এতদিন পরে এমন অদ্ভুত প্ল্যান… ওরা কি পাগল নাকি?… এসবের মানে কি? চিঠিটা পেয়েই আমি অনেকবার ফোনে ট্রাই নিয়েছিলাম কল করার, কিন্তু ফোন সুইচ্ড অফ…

কথা আর কানে আসছিল না বিপ্লবের। ধপ ধপ করে শব্দ হচ্ছিল ভেতরে। ফোনটা কেটে দিল বিপ্লব। ঈশানী খুব ধীরে ধীরে নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে। একহাতে ওর বড়ো বাক্স আর অন্য হাতে একটা খোলা কাগজ।

তোমার বন্ধুর চিঠি। আমার ঘরের খাটে রেখে গিয়েছে, বলে কাগজটা বাড়িয়ে দিল ঈশানী।

চিঠি নিতে এগিয়ে এল না বিপ্লব। একভাবে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঘরের মাঝখানে।

কাগজটা খুব যত্নে ড্রয়িংরুমের সেন্টার টেবিলের ওপর রাখল ঈশানী। তারপর নিজের বাক্স সমেত পা ঘষে ঘষে এগোল মেইন গেটের দিকে। ভাঙা গলায়, সাবধানে থেকো বলে, ছিটকিনি নামিয়ে দরজা খুলে বেরোতে যাবে, পিছন থেকে বিপ্লব খুব নীচু গলায় বলে উঠল, ঈশানী।

উঁ।

বলছি …. যে তোমার কাছে  … মানে … আর সামান্য একটু সময় হবে?

ঈশানী উত্তর দিল না। তাকাল বিপ্লবের দিকে, তাকিয়েই রইল। আর নেহাত যান্ত্রিক কারণেই আবার বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা ….

কর্ণ

না না না! এইটা হতে পারে না। কিচ্ছু করার নেই কর্ণের, ও তো নিরুপায়…

সকালের চায়ের প্লেট-টা হাতে নিয়ে রানু ঘরে ঢুকতে গিয়ে দেখে, সুজিতবাবু ঘুমের ঘোরে এরকম ভুল বকছেন। এটা আজ নতুন নয়, গত সপ্তাহ থেকেই এ রোগের লক্ষণ দেখা দিয়েছিল। তাই, সুজিতবাবুর বউমা রানু তার স্বামী রজতকে বলে, ওগো,বাবার কিছু একটা প্রবলেম হচ্ছে বোধহয়। সকালবেলা হলেই ঘুমের ঘোরে এরকম ভুল বকেন। একটা ডাক্তার ডাকতে হয় তো এবার!

সুজিতবাবুর একমাত্র ছেলে রজত, ক্রিকেট কোচ, ময়দানের একটি নামজাদা ক্লাবের। বল আসলে স্ট্রেট ব্যাটে কী ভাবে ছয় মারতে হয়, বাচ্চাদের শেখানো যার নিত্য নৈমিত্তিক কাজ। এহেন স্ত্রীর কথাটাকেও তিনি ফুলটস বানিয়ে উড়িয়ে দিলেন শান্তিপল্লীর এই দোতলা বাড়ির বাইরে। আরে বাবার প্রেশার জানো না! আর তাছাড়া ষাট পেরিয়ে গেছে। এখন এরকম হয়, আমি কয়েকটা ভিটামিন এনে দেব’খন।

রজতবাবুর এমন কাটা কাটা দাঁত চিবানো কথা যে, রানুও আর খুব বেশি কথা বাড়াতে পারে না, তবে ষাট পেরোলেই যে-এমন কাণ্ড ঘটে, সেটাও সে মনে মনে কিছুতেই সমর্থন করতে পারেল না।

তিনমাস হল রিটায়ার করেছেন সুজিতবাবু, বনমালীপুর আদর্শ শিক্ষামন্দিরের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক। স্কুলের নামের সাথে তাঁর চরিত্রও একেবারে খাপে খাপ মিলে যায়। গায়ে চেক শার্ট, সুতির প্যান্ট, চোখে বাইফোকাল একটা চশমা, খুব গম্ভীর, শান্ত প্রকৃতির একজন মানুষ। অবশ্য গম্ভীর মানেই যে ছাত্র পেটানোর দুর্নাম আছে, তা কিন্তু নয়। ছাত্ররাও খুব ভালোবাসে তাঁকে। স্কুলের এক ছাত্রেরই দিদিকে ছেলের বউ করে এনেছেন ঘরে। ওনার স্ত্রী অকালে চলে যাওয়ার পরে এখন, এই রানুই ঘরের একমাত্র লক্ষ্মী। তিনবছর হল বিয়ে দিয়েছেন ছেলের, এখনও ছেলেপুলে হয়নি।

সুজিতবাবু মানুষটাকে সব্বাই এতো ভালোবাসত যে, একদম এক কথাতেই রানুর বাবা এই বিয়েতে মত দেন। রানু বাংলা অনার্স-এর ২য় বর্ষ, একটু তাড়াতাড়িই বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ের আগে রানুকে পইপই করে ওর মা-বাবা বুঝিয়ে পাঠিয়েছেন, ওরে, মাস্টারমশাই-কে একটু দেখবি বাবা, যত্নআত্তি করবি কিন্তু। মানুষটা বড়ো ভালো। রানু অবশ্য সেই কথা মন্ত্রের মতো জপ করে। বরং ওনার ছেলে যতটা না মাথা ঘামায় বাবার শরীর নিয়ে, তার চেয়ে বেশি খেয়াল রাখে রানু।

আজকেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে দৌড়ে ঘরে স্বামী-কে ডাকতে গিয়ে দেখে, সে মানুষ দিব্যি চাদর টেনে ঘুমাচ্ছে আর নাক ডাকছে। ডাকতে গিয়েও আর ডাকল না, ভাবল ডাকলেও তো সেই একই কথা শোনাবে। ধীরে ধীরে তার শ্বশুরমশাইয়ের খাটের কাছে গিয়ে দেখল, এই ঠান্ডাতেও মানুষটা দরদর করে ঘামছেন। মাথায় হাত দিল, নাহ্ জ্বর তো নেই। তবে কি প্রেশার বাড়ল? সুজিতবাবুর পরনের গেঞ্জিটা চপচপে ভিজে গেছে ঘামে। চায়ের প্লেটটা টেবিলে নামিয়ে আসতে আসতে কপালে হাত রেখে ডাকল, বাবা, ও বাবা!

সুজিতবাবু তখনও বিড়বিড় করে ঘুমের ঘোরে কী বকে যাচ্ছেন। আরও দুবার ডাকার পর হুঁশ ফিরল তাঁর। ধড়মড় করে উঠে বসে বললেন, আরে রথ… চাকাটা… কর্ণের তো দোষ নেই বলো!

কথাটা শুনেই রীতিমতো তাঁকে ঝাঁকিয়ে দিয়ে বলল রানু, বাবা! বাবা! কে কর্ণ? আমি রানু, এই তো। শরীর খারাপ? কী হয়েছে? আমি চা নিয়ে এসেছি। কোনওমতে এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে থামল রানু।

এবার সম্বিত্ ফিরে পেয়ে সুজিতবাবু বলেন, ওহ, বউমা তুমি! তারপর হাতড়ে হাতড়ে টেবিল থেকে চশমাটা নিয়ে পরেন। খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর বলেন, কাগজ দেয়নি?

রানু চায়ের প্লেটটা টেবিল থেকে নিয়ে সুজিতবাবুর হাতে তুলে দিয়ে বলে, বাবা কাগজ দিচ্ছি। আগে আপনি বলুন তো আপনার কী হয়েছে?

একটু হেসে বলেন সুজিতবাবু, আরে! না না, ও একটু গরম লাগছিল!

গরম লাগলে মানুষ ভুল বকে বাবা? আপনি বলুন না আমায় ডাক্তার ডাকব? ওকে ডাকব?

আরে না গো কিচ্ছু হয়নি আমার, এ বুড়ো বয়সে এসব হয়। ভুল বকছিলাম বুঝি, বলে হা হা করে হেসে ব্যাপারটা-কে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন।

সুজিতবাবু এত গম্ভীর মানুষ যে, তাঁর মুখে এরকম হাসি এতই বেমানান, লোকে এমনিই সন্দেহ করবে।

বাবা আজ বলে তো নয়, এই কয়েক দিন ধরেই দেখছি। আপনার ছেলে বলল, প্রেশার বাড়লে নাকি হয়! বলল ভিটামিন ট্যাবলেট নিয়ে আসবে। আমার নিজের বাবারও তো প্রেশার আছে, কই আজ অবধি তো তাকে ভুল বকতে শুনিনি। আর তাছাড়া আমি বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই যদি এমন ধারা দেখতাম, তবে না হয় ভাবতাম,আপনার সত্যিই বুঝি এরকম অসুখ-বিসুখ আছে। আজ অবধি তো এইরকম দেখিনি। এটা শুরু হয়েছে এই ক’সপ্তাহ ধরে। কে কর্ণ, কী সব বলছিলেন বাবা! আপনি শুয়ে শুয়ে মহাভারত আওড়াচ্ছিলেন।

না গো বউমা কিস্যু হয়নি আমার। একদম ঠিক আছি, বলে উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু রানুর মুখে তখনও প্রশ্নের অমাবস্যা দেখে তিনি আবার বললেন, আচ্ছা যদি সেরকম বুঝি রথীন ডাক্তারকে গিয়ে দেখিয়ে নেব। আচ্ছা এখন কাগজটা দাও, দেখি কী লিখেছে।

রানু আর কথা বাড়াল না, যদিও বা তার মনে অসংখ্য প্রশ্ন আর চিন্তা উঁকি মেরে যাচ্ছে। এ অকাল অমাবস্যা। মনে মনে ভাবল, থাক কারও-র দরকার নেই,সে নিজেই এ সমস্যার সমাধান করবে।

 

টিচার্স রুমে এসে কোনওমতে ব্যাগটা ছুড়ে দিলেন রামতনুবাবু। চেয়ারটা টেনে নিয়ে ধুপ করে বসে পড়লেন। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছতে মুছতেই জিজ্ঞেস করলেন নতুন কেরানিকে, এই ফ্যানটা আর একটু জোর হবে না? উফ এটা শীতকাল না গরমকাল বোঝা দায়!

এই এলেন, হাঁফাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে। দশ মিনিট বসুন, দেখবেন ঠান্ডা লাগবে। কথাটা ভেসে এল সাইডের টেবিল থেকে। এই ছেলেটা নতুন জয়েন করেছে, খুব একটা পছন্দ না রামতনুবাবুর। আড়ালে ডেঁপো ছোঁড়া বলে ডাকেন। তবে ছেলেটা মোক্ষম সময়ে তাঁকে সাপোর্ট করেছিল বলে খুব জব্দ করতে পেরেছিলেন আগের নন টিচিং স্টাফ নিবারণবাবুকে। তাই কাজের ছেলে ভেবে তার সাথে হাসিপূর্বক সহাবস্থান করাই শ্রেয় বলে মনে করেন তিনি।

বনমালীপুর আদর্শ বিদ্যামন্দির অনেক প্রাচীন স্কুল। সেই স্বাধীনতার বছরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এখানকার জমিদার অনন্তনারায়ণবাবু। স্কুল হিসাবেও সুনাম আছে। এই সুনামের মধ্যে আর একটি পালক যোগ  হয়েছে। জেলার মধ্যে মাধ্যমিকে প্রথম কুড়িতে স্থান পেয়েছে স্কুলেরই এক পড়ুয়া। অনন্তনারায়ণবাবুর বংশধর সুমন্তবাবু বর্তমানে স্কুলের পরিচালন কমিটির হেড। প্রথমে খুব অল্প পরিসরে শুরু হলেও দিনকে দিন কলেবরে বেড়েছে এই স্কুল। নতুন একটা বিল্ডিং হয়েছে, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর জন্য। টিচার্স রুমের পরিধিটাও বেড়েছে। আগে সবাই একসাথেই বসতেন। এখন হেডমাস্টারের জন্য আলাদা একটি ঘর, আগে যেখানে শুধু একটি আলাদা টেবিল ছিল।

রামতনুবাবু তার গরম লাগাটাকে আর উত্তপ্ত বাক্যালাপে বাড়ালেন না। হ্যাঁ, সেই বলে ওখানেই ইতি টানলেন। এমনই সময় ঢুকলেন সমর ঘোষ, ইতিহাস শিক্ষক। সুজিতবাবু রিটায়ার করায় তাঁর চাপ বেড়েছে। আরও বেশি ক্লাস নিতে হচ্ছে। তাই বেশিরভাগ সময়ই উত্তপ্ত থাকেন। এসে ব্যাগটা রেখেই নতুন কেরানির ওপর উগরে দিলেন রাগ, এই তোমায় বলেছি না, সাইন করার খাতাটা টেবিলের ওপরেই রাখবে। চোদ্দো ঘন্টা ধরে খুঁজতে পারব না। ওদিকে সাড়ে দশটার একটু পার হয়ে গেলেই তো লাল কালি মেরে দেবে, সিএল হয়ে যাবে। লাস্ট কথাগুলো হেডমাস্টারকে শুনিয়ে তিনিও এই সবে নিজের ঘরে এসে ঢুকলেন। কম কথার মানুষ, হাসি হাসি ভাব নিয়ে থাকেন কিন্তু খুব চালাক। কুল মাইন্ডে সব কিছু খেলেন তিনি।

ওদিকে রামতনুবাবু তখন ঠান্ডা হয়ে এসেছেন। ব্যাগ থেকে সোয়েটার বের করে পরে নিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললেন, আরে বলতেই ভুলে গেছি, সেই যে চোর কী যেন নাম, হ্যাঁ নিবারণ, ওর সঙ্গে দেখা হল। আমাদের বাড়ির ওদিকেই থাকে তো। বাজারে গেছি, দেখি চাল কিনতে এসেছে, দর করছিল মিনিকিটের। তাকিয়ে ছিল হাঁ করে যেন গিলে খাবে। বলেই হো হো করে হাসতে লাগলেন তিনি। তারপর বললেন, চাল চোর এসেছে চাল কিনতে।

 

জানলাটায় জং লাগা, হাত দিতেই কিছুটা মরচে উঠে এল হাতে। তাই হাতটা সরিয়ে নিলেন। সুজিতবাবু জানলায় হাত দিয়ে ভাবছিলেন। এখন তো শুধু ভাবারই কাল, অবসর এক কল্পনা সমারোহ। না রানুকে কিছুতেই জানতে দেওয়া যাবে না, সেদিন রাতে তাঁর ছেলেকে কার সাথে কথা বলতে শুনেছিলেন, উফ্ আর বলিস না। ওনার হয়েছে এখন আসরের মাঠের জন্য টাকা দেওয়ার হুজুগ। কোথায় টাকা জমাবে, তা না শুধু উড়িয়ে যাচ্ছে। বাথরুমটায় টাইলস বসাব বলে চাইলাম, দিল না। নিজের ছেলেকে না দিয়ে অন্যের অন্ন জোগাচ্ছে। বাপই যদি এমন বেইমানি করে তাহলে আর কী করার।

আড়াল থেকে বেইমান শব্দটা শুনেই যেন বুকে লেগে গেল তাঁর, বুকের যে-খচখচানিটা অবসরের একমাস আগে থেকে বাসা বেঁধে আছে। আসলে স্কুলের মিড ডে মিলের চাল-ডালে অনেক দিন থেকেই গরমিল হচ্ছিল। নিবারণবাবুর ওপরেই দায়িত্ব ছিল কোন খাতে কত টাকা খরচ হচ্ছে রেজিস্টার খাতায় লিখে হেডমাস্টারকে পেশ করার। এমনকী মজুত খাবারের ঘরের চাবিও থাকত তাঁর কাছেই। তাই সন্দেহের তিরটা গিয়ে পড়ে তাঁর দিকেই। কিন্তু তাতে তো কাউকে আর দোষী ঠাউরানো যায় না। মিটিং হল পরিচালন সমিতির। সুমন্তবাবুও বললেন, স্কুলের এত নাম খারাপ হচ্ছে, ওঁকে বের করে দেওয়া হোক। কিন্তু সায় দিলেন না সুজিতবাবু। উনি বরাবরই একটু নীতিবাগীশ মানুষ। হ্যাঁ হতেই পারে কাজটা নিবারণ করেছে, আবার নাও তো হতে পারে। যতক্ষণ প্রমাণ না হয় ততক্ষণ তো কেউই চোর নয়। বিনা প্রমাণে দুম করে কাউকে টানা হবে, তা পছন্দ করতেন না তিনি। কথাটা বাকি কলিগদের বোঝাতে গিয়ে হল হিতে বিপরীত। সবাই বাঁকা চোখে দেখতে লাগল তাঁকে। মিটিং আটকাল না, ইচ্ছা করেই অনুপস্থিত থাকলেন তিনি।

নিবারণকে চুরির অপবাদ দিয়ে বার করে দেওয়া হল স্কুল থেকে প্রমাণ ছাড়াই। তারপর থেকে কানাঘুষো শুরু হল তাঁর নামে। একদিন তো সুমন্তবাবু নিজেই বাঁকা হাসি দিয়ে বললেন, কী মাস্টারমশাই, দল বদলালেন নাকি! খুব খারাপ লেগেছিল তাঁর। কোনও দিন পার্টি পলিটিক্স করে চাকরি পাননি, পেয়েছেন নিজের যোগ্যতায়। মনমরা হয়ে শুধু অবসরের দিন গুনতে লাগলেন। ওই ঘটনার পর থেকে স্কুলের শেষদিন অবধি কোনও কলিগ তাঁর সঙ্গে হাসিমুখে কথা পর্যন্ত বলেননি। কথাটা তাঁর বাড়ির লোক আজ অবধি জানে না।

ইতিহাসের পাতা থেকে বারবার মনে উঠে আসছে কর্ণের কথা। পাণ্ডবের পক্ষ না নেওয়ায় আজও প্রবলভাবে সমালোচিত হয় সে চরিত্র। কৌরবদের লালনপালনে বড়ো হওয়া কর্ণ, আজ যদি পাণ্ডবদের পক্ষ নিতেন সেটা কি বিশ্বাসঘাতকতা নয়! ছেলের চাকরি থেকে কতরকম সাহায্য করেছেন তিনি, সুমন্তবাবুও সেটা মানেন। আজ অবধি যেখানে কোনও অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি তিনি, সেখানে বিনা প্রমাণে কীভাবে একটা মানুষের বিরুদ্ধে কথা বলবেন তিনি? এটাও কি অন্যায়ের মধ্যে পড়ে না। কে তবে বিশ্বাসঘাতক?

উনি তো আর সুজিতবাবু নেই, উনি এখন কর্ণ! স্বপ্নে বারবার দেখছেন, তাঁর দিকে আঙুল তুলে সবাই তাঁকে বলছে বিশ্বাসঘাতক। কর্ণের দুঃখ কেউ বুঝবে না? নাহ, রানুকে কিছুতেই বলা যাবে না কথাগুলো।

জন্মদিন

অস্বস্তিটা ক্রমশ বাড়ছে । এই ক’দিন রূপসা লোকটাকে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে, তার অফিসের উলটোদিকের ফুটপাতে। তার কেবিন থেকে মাথা তুললেই যে-জানলা দিয়ে অনেকখানি আকাশ  আর গলির মোড় পর্যন্ত দেখা যায়, গত এক সপ্তাহ ধরে লোকটাকে ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে রূপসা, দিনের নানা সময়ে।

লোকটার হাবেভাবে একটা কথা বেশ স্পষ্ট — সে কোনও ভাবেই ঠিক লুকিয়ে থাকতে রাজি নয়। যেন চায় রূপসা তাকে লক্ষ্য করুক। বয়স আন্দাজ সত্তর। রূপসা তার বাবাকে কোনওদিনও দেখেনি। তবে বেঁচে থাকলে হয়তো তাঁরও, এর কাছাকাছি বয়সই হতো। বাবার বয়সি এই লোকটা, তার কন্যাতুল্য একটা মেয়েকে এভাবে কেন দেখছে! কী চায় লোকটা!অস্বস্তিটা কিছুতেই তাকে কাজে মন বসাতে দেয় না। বুঝে উঠতে পারে না, অফিসের পর লোকটা তাকে ফলো করে কেন?

অফিস থেকে বেরিয়ে আজ বাসে উঠতেই লোকটাও পেছনের গেট দিয়ে উঠে পড়ল। এবার একটু খুঁটিয়ে লোকটাকে দেখার চেষ্টা করল রূপসা৷মুখ ভর্তি পাকা দাড়ি। গত সাতদিনে একবার মাত্র তাকে জামা বদলাতে দেখেছে । খুব একটা সচ্ছলতার ছাপ নেই চেহারায় ।

আজ জানালার ধারে সিট পেয়েছে রূপসা। যতটা সম্ভব লোকটার অস্তিত্ব ভুলে সে জানলার বাইরে তাকিয়ে রইল। অফিস ছুটির কলকাতা৷ ভিড় বাড়ছে বাসে৷ ঘরমুখো লোখের ভিড় পেরতিটি বাসস্টপেই৷এত লোকের ভিড়ে আদৌ কি বোঝার উপায় আছে কে কী চায়? কার কী মতলব! বরাবরই নিজের আত্মরক্ষার দায়িত্ব তাকে নিজেকেই নিতে হয়েছে। আর- পাঁচটা মেয়ের মতো, মাথার উপর বাবা থাকার সুবিধা তো সে পায়নি। মাকে যে সমস্যার কথা বলবে, সে উপায় নেই। গত তিন বছর ধরে নার্ভ-এর অসুখে, মায়ের শরীরের অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকে।

কাকে বলবে সমস্যাটা? প্রবীরকাকু ! বাবার একসময়ের এই বন্ধু, নানা দুর্দিনে, বিপদে আপদে পাশে থেকেছে। তার জন্মের বছর চারেক পরেই বাবার মৃত্যু হয়েছিল। মায়ের কাছে একটাই সাদা কালো ছবি আছে, মা বাবার সঙ্গে রূপসার। তার চার বছরের জন্মদিনের। একটা সাদা ফ্রিল দেওয়া ফ্রক পরে সে বসে আছে বাবার কোলে।গাল ফোলা ফোলা, নরম নরম, ফুটফুটে রূপসা। পুরোনো হতে হতে ছবিটা জায়গায় জায়গায় বেশ ঝাপসা। মা সেটা বের করে দেখাতেও যেন অস্বস্তি বোধ করে। রূপসা বোঝে আসলে মা, বাবাকে ভুলে থাকতে চায়।

আজ তার জন্মদিন। জন্মদিন শব্দটা মাথার মধ্যে এক মুহুর্ত ঘুরপাক খেয়ে অন্য ভাবনার পরতে চাপা পড়ে গেল। তার স্টপেজ এসে গেছে। তড়িঘড়ি নামল রূপসা। দূরত্ব রেখে লোকটাও। রূপসা আড়চোখে একবার দেখে নিয়ে, গলির দিকে পা বাড়াল। লোকটা তাকে ফলো করছে। রূপসা গতি বাড়াল। লোকটাও। না ভয় পেলে চলবে না। মাঠ পেরিয়ে ক্লাবঘর। কী একটা কারণে আজ দোকানগুলোর কয়েকটা বন্ধ। ফলে রাস্তায় অন্য দিনের মতো লোকজন নেই। ক্লাব অবধি যাবে , নাকি তার আগেই একটা ব্যবস্থা করবে লোকটার? ভাবতে ভাবতে রূপসা হাঁটা থামায় ।

দূরত্ব একটু কমতেই পিছন ফিরে সরাসরি জিজ্ঞেস করে লোকটাকে, ‘কী চাই আপনার? কে আপনি? আমায় ফলো করছেন কেন?’
লোকটা একটুও অপ্রস্তুত না হয়ে, একটা স্মিত হাসি নিয়ে রূপসার দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর আরও কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে, খুব ধীরে ধীরে বলে, ‘আমি তোর বাবা রূপসা।’
রূপসা প্রায় থতমত খেয়ে তাকায়।
‘ কী আজেবাজে বকছেন! আমার বাবা কবে মরে ভূত হয়ে গেছে! ‘
কথাটা বলতে গিয়ে মনে খটকা লাগে, সে কি ভূত দেখছে নাকি! কী বলতে চাইছে লোকটা। নাহ, সে ঘাবড়ে গেছে, এটা একদম বুঝতে দেওয়া যাবে না। তাই একটুও জড়তা না রেখে বলে,’কী ধান্দা সত্যি করে বলুন তো? ‘ রূপসার গলায় ঝাঁঝ স্পষ্ট। ভিতু সে কোনও দিনই নয়। কিন্তু একটাই ডাউট হচ্ছে, লোকটা তার নামটা জানল কী করে! তার মানে খোঁজখবর নিয়েই এসেছে।

লোকটা এবার আরও একটু কাছে এগিয়ে এল। যেন স্ট্রিট লাইটের লালচে আলোয় ভালো করে দেখতে চায় রূপসার মুখ। না, লোকটার তাকানোর মধ্যে কোনো বদ মতলব নেই, বরং কেমন একটা মায়া মায়া ভাব আছে।সেই শান্ত দৃষ্টি নজর এড়ায় না রূপসার। কিশোরী বয়স থেকে সে অনেক রকম পুরুষের মুখ দেখেছে। কারও কারও চোখে অন্য ভাষাও পড়েছে। কিন্তু এই লোকটার চাহনি তেমন নয়।
লোকটা আবার কাতর ভাবে বলে, ‘আমি সত্যিই তোর বাবা রূপসা। আমি মারা যাইনি। পালিয়ে গিয়েছিলাম।’

এবার রূপসা যেন আর ঠিক ততটা অবিশ্বাস করতে পারে না লোকটাকে। ভিতরে একটা অদ্ভুত তোলপাড় হতে শুরু করেছে তার। সে সোজাসুজি লোকটার চোখে চোখ রাখে। কিন্তু সেই দৃষ্টির কাছে হার মেনেই যেন লোকটা চোখ নামিয়ে নেয়। তারপর  দেরে যাওয়া গলায় আবার বলতে শুরু করে, ‘হ্যাঁ তোদের ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলাম আমি। অন্য একজনের সঙ্গে সংসার করব বলে। কিন্তু সেই পাপের শাস্তি আমি পেয়েছি। সংসার , ব্যবসা , সব খুইয়েছি নিজেরই দোষে। আমি তোদের কাছেও অপরাধী মা। মুখ নেই তোদের সামনে এসে দাঁড়ানোর । আমি কোনও দায় দায়িত্ব নিইনি তোদের। ‘

রূপসা মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে, ‘ কিন্তু মায়ের মুখে আমি শুনেছি আমার বাবা মারা গেছে।মা কী করে বলল এত বড়ো  মিথ্যে!’
‘তোর মা আমার সম্মান বাঁচাতে তোকে মিথ্যে বলেছে মা।ভালোবাসত তো খুব৷ প্রবীর সবই জানে। ওর সঙ্গে যোগাযোগটা খুব ক্ষীণ ভাবে হলেও রয়ে গেছে এত বছর ধরে। তোদের সব খবরই আমি পাই। জানি তোর মায়ের চাকরিটা ছিল বলে তোকে বড়ো করতে পেরেছে। কিন্তু আজ আমি অনুতপ্ত রূপসা।’

কথাটা বলার পর লোকটা জামার হাতায় চোখ মোছে। রূপসার মনের ভিতর কী যেন একটা ঝড় শুরু হয়েছে। সে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। উলটো দিকে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা, যাকে এইমাত্র বাবা বলে সে জেনেছে, তাকে আরও একবার খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে চায় যেন। তারপর কঠিন গলায় প্রশ্নটা করেই ফেলে– ‘এতদিন পরে কী চান আপনি? কেন এলেন? ‘
আগন্তুক এবার আবেগরুদ্ধ গলায় বলতে শুরু করে,’আমি আর বেশি দিন নেই। প্রায়শ্চিত্ত করার সময়ও হাতে নেই আর। আজ তোর জন্মদিন। তোকে একটা জিনিস দিতে চাই শুধু। এত বছর ধরে এগুলো আগলে রেখেছিলাম। আজ তোকে দিয়ে আমার ছুটি। আর কোনও দিন সামনে আসব না তোর। পারলে আমায় ক্ষমা করিস।’

লোকটা একটা খবরের কাগজে মোড়া প্যাকেট এগিয়ে দেয় রূপসার দিকে। হাতে দিয়েই হনহন করে হাঁটা দেয়। কিন্তু তার হাঁটায় যেন আর তেমন জোর নেই, কেমন যেন ঝুঁকে পড়া চেহারা । হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রূপসা তার চলে যাওয়াটা দেখে।

কখন কীভাবে একটা ঘোরের মধ্যে বাড়ি ফিরেছে , মনে পড়ে না রূপসার। এখন রাত এগারোটা। মা পাশের খাটে অঘোরে ঘুমোচ্ছে।ঘুমের ওষুধ খায় রোজই৷মায়ের দিকে আলগোছে একবার তাকিয়ে নিয়ে, টেবিল ল্যাম্পের আলোয় প্যাকেটটা খোলে রূপসা। খুলতেই বেরিয়ে আসে একটা পুরোনো ফোটোগ্রাফ । হাতে ধরা ফোটোটা আলোর কাছে ধরতেই বুঝতে পারে, এটা সেই পুরোনো সাদাকালো ছবিটারই প্রতিলিপি, যা সঙ্গোপনে রয়েছে, মায়ের ডায়ারির ভাঁজে। তবে এটা অনেকটাই পরিষ্কার। খুব যত্নে রাখা ছিল বোধহয়। প্যাকেট থেকে এবার বেরিয়ে আসে ছোট্ট একটা ফ্রক। সেই সাদা ফ্রিল দেওয়া জন্মদিনের ফ্রকটা!
কত কিছুতেই কতবার কষ্ট পেয়েছে রূপসা। কেঁদে দুঃখ ভুলেছে। কিন্তু আজ কেন এমন হচ্ছে! বুকটা ফেটে যাচ্ছে তবু  বাবা বলে একবার ডেকে উঠতে পারছে না৷ কিছুতেই পারছে না।চোখটা অসম্ভব জ্বালা করছে রূপসার। সে কাঁদতে পারছে না। মা বলে ,জন্মদিনে কাঁদতে নেই।

ছুটি

হঠাৎ গোঁ ধরেছিল ছেলেটা। কাল থেকে অ্যানুয়াল পরীক্ষা শুরু, কিন্তু কিছুতেই পড়তে বসবে না। বিকেলে খেতে খেতে নিনজা হাতোড়ি, ছোটা ভীম, বেনটেন রোজকার মতো কালও অনুমোদন করা হয়েছে। খাওয়ার ছলে বেশ খানিকক্ষণ টিভি দেখতে থাকে এমনিতেই। কিন্তু কাল ওকে বোকাবাক্সের সামনে থেকে নড়ানোই যাচ্ছিল না। লিটারেচারের কী বিরাট সিলেবাস। অত প্রশ্নোত্তর, শব্দার্থ, ইডিয়ামস, কবিতা, বানান– তিথি নিজেও মনে রাখতে পারত কিনা সন্দেহ। আর রন্তির ভ্রূক্ষেপ নেই। দশ পূর্ণ হল। ক্লাস ফাইভে উঠবে। ছেলের নিজেরও তো গরজ থাকবে। তা নয়। মা চামচে মেখে গিলিয়ে না দিলে এক বর্ণ পড়বে না। আধাখ্যাঁচড়া প্রস্তুতি নিয়েও পরীক্ষার আগের দিন নিশ্চিন্তে কার্টুনে ডুবেছিল।

অনেকক্ষণ বোঝানোর পর পিঠে একটা চাপড় বসায় তিথি। এমন দুর্বিনীত ছেলে, মাকেই উলটে আক্রমণ করে। তবে রে? ছেলেকে এলোপাতাড়ি মেরে ধরে শোবার ঘরে টেনে নিয়ে যায় মা। যার জন্য নিজের প্রিয় ধারাবাহিক ছেড়ে দিচ্ছে, তার একটু হুঁশ থাকবে না? উলটে মাকে মার? ভাগ্যিস শাশুড়ি ওই সময় ফ্ল্যাটে ছিলেন না।

মার খেয়ে রন্তি আরও গোঁয়াড় হয়ে উঠল। এমন বিশ্রী জেদ, আদর করে ভুলিয়েও গলানো গেল না। বাবা অফিস থেকে ফিরেছে ছেলের জন্য বেনটেন কমিক্স আর এক প্যাকেট হিমায়িত চিকেন কাটলেট নিয়ে। কী আক্বেল। পড়ানোর বেলা গোল্লা, পরীক্ষার আগে এমন বিনোদনের বই কেউ কেনে? সাধারণত যেদিন এই ধরনের খাদ্য আসে, সেদিনই ভেজে উদ্বোধন করা হয়। ছেলে বই নিয়ে সদ্য বসেছে, আর দেরিও হয়ে গেছে। তাই বলল, ‘আজ থাক, কাল ভালো করে পরীক্ষা দাও। কাল ভেজে দেব। আর পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলে যা চাইবে তাই দেব। সোনা বাবা আমার, পোয়েমদুটো লিখে দেখাও তো। ওগুলো থেকে ফিল ইন দি ব্ল্যাঙ্কস আসবে না? কমা ফুলস্টপ, সেমিকোলন সব ভালো করে দেখে নাও।’

‘কোলন আর ড্যাশও আছে। টু আ বাটারফ্লাই আমার মুখস্থ।’ অসন্তুষ্ট গলায় গজগজ করল রন্তি। তারপর দুটো মাঝারি কবিতা লিখতেই সাড়ে ন’টা বাজিয়ে দিল। প্রায় পঞ্চাশখানা প্রশ্নোত্তর ঝালানো বাকি। তাছাড়া সাহিত্যের টেক্স্ট থেকেও ব্যাকরণের প্রশ্ন আসে। সবই করিয়েছে তিথি একবার করে। কিন্তু পরীক্ষার আগে না দেখলে? ছেলের ঠাকুমা বলেন, ‘ও সব পারবে’। বাবা বলে, ‘বাদ দাও’।

অগত্যা জেনারেল লি’র অধিনায়কত্বে খ্যাঁদা-নেকো জাপানিদের তাকেশি’স কাসল অভিযান দেখতে দেখতে খাবার টেবিলের বদলে সেন্টার টেবিলে ডিমের ঝোল ভাত মেখে রন্তিকে গিলিয়ে দিল। খাওয়ার ব্যাপারে রন্তিকে সাধতে হয় না। কিন্তু আজ একে মার-বকুনি, তার ওপর আলু-পটল দিয়ে ডিমের ডালনা। মুখে মুখে প্রশ্নোত্তর ধরতে গিয়ে দেখল ছেলে হাঁ করে হাড়গোড় গুঁড়োনো খেলার একশো সাতান্নতম রিপিট টেলিকাস্ট আর ভাত গিলছে। মায়ের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না একটাও। চুলের মুঠি ধরে একবার নাড়া দিয়ে থালা হাতে উঠে গেল তিথি। ‘ব্রাশ করে সোজা বিছানায় যা। আইদার টেক্স্ট বুক, কিংবা ঘুম। কমিকস্ খুলতে দেখলে ছিঁড়ে ফেলব।’

রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত গোঁজ মারা ভাবটা কমেনি। ঠাকুমার রসিকতায় জবাব দিল না। মা মেরেছে তাই বাবার আদরে ভুলবে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে বালিস ভিজিয়েছে। তিথি রান্নাঘর, টেবিল ফ্রিজ, কোলাপ্সিব্ল গেটে তালা, বসার ঘরের আলো-পাখা, রাতের গা ধোয়া ইত্যাদি সেরে এসে দেখে বাপ নাক ডাকাচ্ছে। ছেলে বাবার ঘাড়ের কাছে মুখ গুঁজে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। তিথি আর মনোময় দুজনেই লম্বা দোহারা। ছেলেটার এখন থেকেই কী সুন্দর সুঠাম দেহ। মায়ের চোখ ডাইনির চোখ। নিজেকে শাসন করল তিথি।

‘মায়ের সঙ্গে কি অমন করতে আছে সোনা? আমার কষ্ট হয় না তোকে মারতে? এত বড়ো হয়েছিস এটুকু বুঝবি না? অয়না দ্যাখ তোর চেয়ে ছোটো হয়েও কেমন ভালো রেজাল্ট করে। মাথায় কি তোরও বুদ্ধি কম? পরীক্ষার পর কত আনন্দ করব। বাবা বিরিয়ানি রাঁধবে। একদিন বাইরেও খেয়ে আসব। সোনা বাবা আমার…।’ ছেলের পাশে শুয়ে তার গুঁজে রাখা অভিমানী মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিতে চাইল। ডান পা-টা নিজের পেটের ওপর চাপাতে চাইল। রন্তি ঘুমের মধ্যেও মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল না। কাঠ হয়ে থাকল। এগারো বছরের ছেলের সঙ্গে গায়ের জোরে পেরে ওঠে না মা। ছেলের ঘাড়ে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শুয়ে পড়ল। তার স্কুলেও পরশু থেকে পরীক্ষা শুরু।

একজনের অফিস, একজনের স্কুল ও সংসার। পাশের ঘরে বৃদ্ধা শাশুড়ি। তাঁর জায়গাও বেশি লাগে, আর রন্তিও মাকে ছেড়ে ঠাকুমার কাছে শোবে না। রাতে ঘুমের ঘোরে ছেলে এখান সেখান হাত-পা ছুড়লে অস্বস্তি লাগে। কিন্তু উপায় কী? স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত আড়াল নেই। তাগিদও নেই। তেরো বছর তো হল। ছেলেই মা-বাবার অগ্রাধিকার। কাল থেকে পরীক্ষা শুরু। শেষ হতে দু সপ্তাহ।

দশ বছরে কয়েকটা টিকার বুস্টার ডোজ আছে। দীর্ঘদিন সর্দিকাশিতে ভোগায় সেগুলো দেওয়া যাচ্ছিল না। ডাক্তারের কাছে গিয়ে সর্দির প্রেসক্রিপশন হাতে ফিরতে হচ্ছিল। এমনিতেই তিনখানা টিকা একদিনে দেবেন না। দশ বছর বয়স থাকতে মেয়েকে সুস্থ অবস্থায় পাবে তো? সর্দিকাশি, পেট ইত্যাদি মোটামুটি ঠিক আছে দেখে পরীক্ষার আগের দিনই ডাক্তার সান্যালের কাছে ঘুরে এল শ্রেয়সী। আসার পথে রাই বায়না ধরল ফুচকা খাবে। মাথা খারাপ? পরশু থেকে পরীক্ষা শুরু। রাত্রে বাড়িতে ফ্রায়েড রাইস, মাংসের প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়েকে ভোলাতে চাইল। রাই তবু ঘ্যানঘ্যান করে, ‘বেশি নয়, মোটে চারটে ফুচকা মা। কিছু হবে না। তুমি ওষুধ কিনে বাড়ি চলো।’

‘পাঁচ টাকার ফুচকার খেসারত একশো টাকার ওষুধের কোর্স, সেই সঙ্গে অরুচি? না বললাম না? কাল বাদে পরশু থেকে পরীক্ষা শুরু। একেই আজ এটা কাল ওটা করে ভুগিস। রাতে ফ্রায়েড রাইস আর চিকেন করব বললাম তো। এখন বরং একটা আইসক্রিম খা। আসতে আসতে চেটে খাবি, গলায় ঠান্ডা না লাগিয়ে।’

আইসক্রিম যতই প্রিয় হোক, ফুচকার গন্ধে নাকে মুখে জল এলে আইসক্রিম কি তার বিকল্প হতে পারে? নিমরাজি হয়ে মাথা নাড়ল রাই। ওপারে দোকান। মা মেয়ে রাস্তা পার হতেই একটা ফাঁকা অটো হাঁকতে হাঁকতে পাশে দাঁড়াল। লাইনে না দাঁড়িয়েই বাহন পেয়ে যাওয়ায় শ্রেয়সী আর আইসক্রিমের দোকানে না ঢুকে সোজা অটোয় চড়ে পড়ল মেয়ের হাতে ধরে।

‘তুমি মিথ্যেবাদী।’

মাথায় চড়াক করে রক্ত উঠলেও শান্ত হয়ে মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা করে, ‘তোমায় কি আইসক্রিম, চকোলেট দিই না? কিন্তু আইসক্রিম খেলে আধ ঘন্টা অটোর লাইনে দাঁড়াতে হতো। এখন তাড়াতাড়ি বাড়ি গিয়ে হাত পা ধুয়ে পড়তে বসাটা জরুরি নয় এই সময়? আচ্ছা বাবাকে ফোন করে দিচ্ছি বাড়ি ফেরার সময় আইসক্রিম নিয়ে আসবে। এখন বাড়ি গিয়ে দুধ ফিনিশ করলে কিন্তু।’

তরুণকে ফোন করল শ্রেয়সী। তরুণের ফিরতে রাত হবে। সে দোকানের কর্মচারী শান্তনুর হাতে পাঠিয়ে দেবে। শান্তনু কোনও কাজে গিয়ে ফেঁসে গেছে। তরুণ ফিরল রাত দশটায়। এতক্ষণ বকুনি সহ ঘ্যানঘ্যান করতে করতে পড়ছিল রাই। রাতে বাবাকে খালি হাতে ফিরতে দেখে আর নতুন করে হতাশা প্রকাশ করল না। ফুচকার বদলে আইসক্রিম, তাও না দুধ-বোর্নভিটা। এখন রুটি তরকারি। মা ফ্রায়েড রাইস করতে পারেনি। রান্নার মাসিরও তাড়া ছিল। গতকালের একটু পনির উদ্বৃত্ত ছিল। তাই দিয়ে শান্ত হয়ে মায়ের হাতের রুটি খেয়ে নিল রাই ডিজনিতে হাসির ধারাবাহিক দেখতে দেখতে। রাতে ঘুম আসার আগে পর্যন্ত মায়ের মুখে মুখে প্রশ্নোত্তরও ঝালিয়ে নিল। হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘কাল করবে তো মা? সব পরীক্ষা শেষে দাদা-বউদির বিরিয়ানি আনবে বাবা?’

‘নিশ্চয়ই’। কে জানে, মেয়ে মনে মনে মা-বাবাকে মিথ্যেবাদী বলল কি না।

মেয়েটা দিন দিন বেয়াড়া হয়ে যাচ্ছে। সেভেন হল। এর মধ্যেই বাবার কানের পোকা খেয়ে ট্যাব আদায় করেছে। মাকে দিদি নম্বর ওয়ানে গিয়ে প্রাইজ জিতে আসার অনুপ্রেরণা দিয়ে কাজ হয়নি। নিজেই বাড়ি থেকে ইন্টারনেটে মায়ের আর নিজের অনলাইন আবেদন জমা করেছে। বছর ঘুরতে চলল। কতদিন আর দরকারি জিনিস অনিশ্চিত ইভেন্টের হাতে ফেলে রাখা যায়?

পড়াশুনো কী করছে দেখাতে চায় না। সারাক্ষণ কম্পিউটারে নেট খুলে খানাতল্লাশি চালায়। নাকি পড়াশুনো হচ্ছে। অত অত মোটা বইয়ের পাহাড় থাকতে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রীর ইন্টারনেট থেকে বাড়তি কী এমন তথ্য জানার থাকতে পারে? তিনটে টিউশনি। নেট-এ খোঁজাখুঁজি। তাও ফলাফল ভালো থেকে ক্রমশ মাঝারি হয়ে যাচ্ছে। কিছু বললে যা মূর্তি ধারণ করে। মাকে তো পাত্তাই দেয় না। বাবাকে একটু মানে। আবার আবদারের বেলায়ও বাবা। কিন্তু এই বয়স থেকে একা একা নেটে থাকা মা-বাবা কেউই অনুমোদন করে না। পৃথিবীর কদর্যতম দৃশ্যটাও কয়েকটা মাউস ক্লিকের অপেক্ষায় সাইবার দুনিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। নারী-পুরুষের ভালোবাসার মাধুর্য বোঝার আগেই যদি চরমতম বিকৃতি আর বীভৎসতার সঙ্গে পরিচয় হয়ে যায় তাহলে রুচি, মানসিকতা কেমন দাঁড়াবে? অবশ্য তেমন কিছু ব্রাউজিং-এর প্রমাণ পাওয়া যায়নি। শুধু গাদা গাদা চ্যাট। পড়ার বই খুলে রেখে ট্যাব হাতে চেনা-অচেনা মানুষের সঙ্গে গপ্পো।

বাধ্য হয়ে পরীক্ষার দুদিন আগে সাত্যকী বারো বছরের মেয়ের গায়ে হাত তুলল। এগালে-ওগালে এলোপাতাড়ি। মল্লিকা ঝাঁপিয়ে পড়ে থামাতে এলে তার গায়েও দু-একটা পড়ল। পরীক্ষার আগে কেউ এভাবে মেরে মনমেজাজ খারাপ করে দেয়? নিজে যখন বুঝবে না, বোঝাতে হবে। মেয়ে বড়ো হচ্ছে। এভাবে বাপের মার খেলে আত্মসম্মানে লাগবে না? এখনকার ছেলেমেয়েরা মা-বাবার সব কিছুতে হস্তক্ষেপের অধিকারটা মেনে নেয় না। একদিকে আত্মকেন্দ্রিক। কিন্তু রাগলে নিজের চূড়ান্ত ক্ষতি করে ফেলে, ভালোবাসার মানুষের ওপর প্রতিশোধ নিতে দুবার ভাববে না। মল্লিকা সাত্যকীকে ঠেলে সরাতে গেল, ‘ছাড়ো। ওকে বুঝিয়ে বললেই শুনবে’।

‘বাবাকে লেলিয়ে দিয়ে এখন সাধু সাজা হচ্ছে। আমার বইখাতা খুলে স্পাইং করো না তুমি?’

সদ্য কিশোরী কন্যার এই মন্তব্যে মা দিশাহারা হয়ে গেল। বাবা তো অফিস থেকে ফিরে প্রায়দিন দেখে মেয়ে টিউশনি থেকেই ফেরেনি। মা-ই মেয়ের খাতা বই দেখে যতটা সম্ভব পড়াশুনোর খবর নিয়ে নেয়। পারিজাতের সেটাও অপছন্দ? মায়ের গোয়েন্দাগিরি মনে হয়? মায়ের স্নেহ-চিন্তাকে চরবৃত্তি মনে হলে সে মেয়ের মুখে ঠাটিয়ে চড়ই মারা উচিত। কিন্তু তাহলে মোবাইলের সেল্ফিতে যে কেষ্টঠাকুরের ছবি আছে, তার সম্পর্কে জানা যাবে না, জানা যাবে না এমন আরও অনেক কিছুই। প্রশ্ন করলে হয়তো শুনতে হবে, মোবাইল ব্যক্তিগত বস্তু। তেরো বছরের নাবালিকা তার মাকে ব্যক্তিগত ব্যাপারে আড়াল করবে? এখনও বিছানার চাদরে, পোশাকে দাগ লাগলে কেচে দিতে হয়। মেয়ের সঙ্গে কি মারামারি করবে? মরিয়া হয়ে বলল, ‘পরীক্ষাগুলো তো উৎরোতে হবে পুপু। বন্ধুবান্ধব, আনন্দ-ফুর্তি তো আছেই।’

‘কিচ্ছু নেই। ঘাড় গুঁজে পড়ে পড়ে চোখে পাওয়ার আর ঘাড়ে পিঠে ব্যথা বাড়ানো ছাড়া আমাদের জীবনে কোনওটাই সিকিওরড নয়। পরীক্ষা তো দেব আমি। পড়ার ফাঁকে একটু রিল্যাক্স করলে এত গায়ে জ্বালা তোমাদের?’

সন্দীপন পড়াশোনায় মনোযোগী। মনোযোগ আর আগ্রহ আরও অনেক বিষয়ে। ভালো আঁকে, ফুটবল খেলে। ওদের সেকশনে নতুন আগত একটি মেয়ে গত বছর থেকেই সন্দীপনকে হটিয়ে প্রথম হচ্ছে। নিশ্চয়ই প্রিন্সিপাল বা টিচারদের সঙ্গে চেনাজানা আছে। এদিকে ছেলের নামে অন্য ছাত্রদের, বিশেষ করে মেয়েদের অভিভাবকরা নিয়মিত নালিশ জানায়। সন্দীপন ওদের মারে, ল্যাং মেরে ফেলে দেয়, বেণি ধরে, কানের রিং ধরে টানে। হিংসা! সব হিংসায় ফেটে যাচ্ছে। ভালো ফল করে কিনা। তাই যুক্তি করে ওকে পিছিয়ে দেওয়া। হলে একটা নতুন স্টুডেন্ট, তাও আবার মেয়ে, কালো শিকলি চেহারা কখনও ফার্স্ট হয়? ছেলেরা তো হাতেপায়ে দুরন্ত হবেই। দাদু আদর করে নাম রেখেছেন গুন্ডা। গুন্ডার অধীনে আবার স্কুলে একটা দলও আছে। ইচ্ছা করেই ছেলেকে বেশি বয়েসে পড়াচ্ছে সঙ্গীতা। বার্থ সার্টিফিকেটের বয়স বারো দেখালেও সন্দীপন আসলে চোদ্দ বছরের। ওর সঙ্গে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলো পারবে কেন? কী পড়াশুনোয়, কী খেলাধুলোয়। ছেলেকে শেখানো আছে, ‘মার খেয়ে ফিরবি না, মেরে আসবি’।

কেন করবে না। সকলেই এগিয়ে যেতে চায়। তোমার সামনে যারা আছে দরকারে তাদের মাড়িয়েই এগিয়ে যেতে হবে। তোমায় কেউ একচুল জায়গা ছেড়ে দেবে? যারা পেরে ওঠে না, তারাই নালিশ করে। তা বলে ছেলে কি হাত-পা গুটিয়ে থাকবে? মারামারির ভয় যখন, তোদের মেয়েদের গার্লস স্কুলে পড়ালেই পারতিস। অত বড়ো খেলার মাঠ দেখে রাত থাকতে লাইন দিয়ে খুকিদের ভর্তি করিয়েছিস। এখানেও গুন্ডার নামে নালিশ। সে নাকি খেলার ক্লাসে মেয়েদের ইচ্ছা করে মেরে ফেলে দেয়। সঙ্গীতা মাঝে সাঝে স্কুলে গিয়ে দেখেছে, খেলার পিরিয়ডে ছেলেরা স্যারের সাথে ফুটবল, ক্রিকেট, বাস্কেট বল খেলে। মেয়েরা গজালি করে, নয় রুমাল চোর খেলে, নয় তো স্রেফ বসে বা পায়চারি করে কাটায়। ব্যাডমিন্টনের র‍্যাকেট চাইলেও নাকি দিতে চায় না গেমস্ টিচার, দিলেও ছেলেরা কেড়ে নেয়। মেয়েরা খেলেই না তো মার কখন খাবে? আমার ছেলে কি খেলা ফেলে তোদের মেয়েদের পেছনে ধাওয়া করে?

ওই শুঁটকি অরিত্রিকে এবার বিট করতেই হবে। গুন্ডার চাইতে দু’বছর ছোটো হয়েও অমন রেজাল্ট এমনকী অংকেও? তা খাতায় কলমে কম দেখিয়েও মা পুত্রের বয়সের সুবিধাটা মনে মনে স্বীকার না করে পারে না। ছেলে আজকাল কম্পিউটারে ইন্টারনেট খুলে জোর পড়াশুনো শুরু করেছে। কী পড়ে দেখাতে চায় না। ছেলের বাবা চাকরিসূত্রে অন্যত্র থাকে। মা নিয়ম করে ছেলেকে কোচিং ক্লাসে নিয়ে যায়। শুধু ক্লাসে নয়, আইসিএসসিতেও স্কুল থেকে ফার্স্ট হতে হবে।

কাল থেকে যুদ্ধ, মানে পরীক্ষা শুরু। গুন্ডা সকাল বেলা বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছে বলে সাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে। দুপুর দুটো বাজতে চলল, এখনও পাত্তা নেই। প্রথমে অর্ণবের বাড়ি, তারপর এর বাড়ি ওর বাড়ি ফোনাফুনি। সোয়া দুটোয় সিঁদুর মুখে বাড়ি ফিরে মায়ের কোনও প্রশ্নেরই জবাব দিতে চায় না। একবার ঝেঁজে বলল, ‘এই জন্যই মোবাইল চাই। বাড়িবাড়ি ফোন করতে হতো না তোমায়।’ ক্লাস সেভেনের ছেলে মোবাইল নিয়ে ঘুরবে? স্কুলেও তো অনুমতি দেবে না। আবার আসল বয়সটা মনে পড়ল। মায়ের কথায় উদ্ধত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক খোঁচাখুঁচিতে বলল, ‘তোমায় বলে কী হবে? তুমি তো না-ই বলবে।’ এখন থেকে এমন কী চাই যা মাকে বলা যাবে না? কাল থেকে পরীক্ষা শুরু সে খেয়াল আছে? পড়াশুনোয় ভালো বলেই ও অনেক বদমায়েশি করে পার পেয়ে যায়। এবার রেজাল্ট খারাপ হলে আর ছাড় দেওয়া যাবে না।

সারাদিন জিজ্ঞাসাবাদে নির্বিকার থেকে রাতে ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল, ‘একটা স্পোর্টস্ সাইকেল দেখেছি। চল্লিশ হাজার পড়বে। আইসিএসসি দেখিও না। এই পরীক্ষার পরই চাই।’

সপ্তম থেকে অষ্টম শ্রেণিতে উঠতেই এই। ম্যাট্রিকুলেশন পাস করলে তো হেলিকপ্টার চাইবে। এর চেয়ে অরিত্রি, মেঘা, তিতিক্ষাদের পেটানোর অনুমতি চাইলে দেওয়াটা অনেক সহজ হতো। এই প্রথম ছেলেকে অচেনা লাগল মায়ের, ভয়ও হল। মাথা নাড়ল শুধু, যার মানে হ্যাঁ ও হতে পারে, নাও হতে পারে। পরীক্ষাটা তো উৎরোক। দর কষাকষি পরে।

স্নেহা শান্ত মেয়ে। অঙ্কে একটু দুঃখ আছে। কিন্তু বেয়াড়া নয়। পড়ালে খুব একটা আপত্তি করে না, অঙ্ক ছাড়া। একটু আদুরি আহ্লাদী প্রকৃতির। রোজ নিয়ম করে মা আর বাবার কাছে চটকাই মটকাই খাবে। সান্তাক্লজের রহস্য জানার পরও সান্তার কাছে উপহার চাই। গত বছর জন্মদিন পালন হয়নি ঘটা করে। এবার পরীক্ষার ঠিক পর জন্মদিন। মানে জন্মদিনের ঠিক আগেই পরীক্ষা শেষ হয়ে যাচ্ছে। লক্ষ্মীসোনা হয়ে ভালো করে পরীক্ষা দিয়ে বার্থ ডে সেলিব্রেশনটাও জমকালো করে করতে হবে। এইটুকু বায়না রাখাই যায়। বেচারার সব প্রিয় খেলনা খুড়তুতো ভাই এসে ভেঙে দিয়ে যায়। ভাইকে বড্ড ভালোবাসে। তাকে কিছু বলতে পারে না, পাছে কাকিমা আর নিয়ে না আসে। সে চলে গেলে মায়ের কোলে কিংবা বাবার বুকে মুখ গুঁজে হাপুসনয়নে কাঁদে।

বহুদিনের শখ আইপডের। বন্ধুদের আছে। ওকে বস্তুটা ঠাম্মা, দিদা, মাসি না মা-বাবা কে দেবে ঠিক না হওয়ায় এখনও পায়নি। এবার জন্মদিনে সেটাই দাবি। অঙ্কিতা নিজে বড়ো সিস্টেমেই গান শুনতে ভালোবাসে। অমন স্বার্থপরের মতো কানে গুজি গুঁজে অনেক কথা কানে না ঢুকিয়ে গান শোনা তার পোষায় না। তবে ধুমধাড়াক্বা গান পরিত্রাহি বাজলে মনে হয়, যার যেমন রুচি তেমন গান হেডফোনেই শোনা ভালো।

পরীক্ষা শুরুর কদিন আগেই মাসিমণি তার আদরের বোনঝিকে একটা আইপড দিয়ে গেল। অনেকগুলো নতুন গান লোড করা আছে। ব্যস! সারাদিন মারমার গান শোনা। এখন কি গান নিয়ে মেতে থাকার সময়? পড়াশুনোর বারোটা বাজবে জানালে মাসি বলবে, ‘আমার ইচ্ছে দিয়েছি। তোদের পছন্দ না হলে ডাস্টবিনে ফেলে দে।’

বুঝিয়েসুঝিয়ে যন্ত্রটা পরীক্ষা পর্যন্ত মায়ের জিম্মায় চালান করা গেলেও জন্মদিনের জন্য তাহলে নতুন কিছু চাই। নতুন মানে ট্যাব। টিভি রিয়ালিটি শোতে কাউকে ট্যাব জিততে দেখলেই এমন হাততালি দেয়, যেন পুরস্কারটা সেই জিতেছে। এমনিতে অঙ্কিতার অ্যানড্রয়েড মোবাইল অঙ্কিতার চেয়ে স্নেহাই ভালো চেনে। ক্লাস ফোর তো কী? এখনকার বাচ্চারা মায়ের পেটে থাকতে কম্পিউটার নাড়াঘাটা করতে শিখে আসে। অঙ্কে ভয় থাকলেও, কম্পিউটারের ঘাঁতঘোঁত ফাইলের অবস্থান খুঁজে বার করতে ওস্তাদ। মাকে কাজ করতে দেখে নিজে নিজে পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন বানাতে শিখে ফেলেছে। মোবাইলে গান আর গেম ডাউনলোড তো হাতের ময়লা। সে তো ট্যাব চাইতেই পারে। কিন্তু বাড়িতে তিনজন মানুষের জন্য পাঁচটা সিম এটা ওটা অফার পরখ করতে গিয়ে জমে গেছে। প্রীতমের তাই বাচ্চার হাতে এখন থেকে নেট সমৃদ্ধ ট্যাবলেট তুলে দেওয়ার ইচ্ছা নেই। বলে, ‘যা করার পিসিতে করো। আর একদম নেট খুলবে না। আমি বা মা পাসওয়ার্ড দিয়ে মেশিন ওপেন না করা পর্যন্ত ওয়েট করবে। আমি এত বছর সিস্টেমস্-এ আছি, এখনও পর্যন্ত আমিই একটা ল্যাপটপ কিনলাম না, আর পাকু-মার ট্যাব চাই।’

মৌমিতা সদ্য চাকরির আনন্দে বলে ফেলল, ‘ডোন্ট ওরি। আই উইল টেক কেয়ার অব দ্যাট।’

সোজা প্রীতমের প্রেস্টিজে ছ্যাঁকা। সে কি নিজের মেয়েকে কিনে দিতে পারে না? এই বয়স থেকে এত বিলাসিতা ঠিক মনে করে না বলেই তো আপত্তি করছে। প্রিয় শ্যালিকাকে দেখলে হাসা বন্ধ। মৌমিতাও দমবার পাত্রী নয়। ‘কেন, হিয়া আমার কেউ নয়? মাসি হিসাবে আমার কোনও শখ থাকতে পারে না? অধিকার নেই? আমি আনন্দ করে কিনে দেওয়া মানেই প্রীতমদাকে ছোটো করা? তোরা আমাকে পুজোয় টাকা দিস না? আমার বিয়েতে দামি গয়না দিসনি? তোদের বিয়ের সময় আমি তো স্টুডেন্ট ছিলাম। কী দিয়েছি? আজ আমার আনন্দে যদি কারও মুখ গোমড়া হয়, তাহলে আমি আর এ বাড়ি আসব না। হিয়ার জন্মদিনেও নয়…’

আচ্ছা মুশকিল! অঙ্কিতা বরকে বোঝায়, না বোনকে। বড়োদের মান হানাহানিতে হিয়া অর্থাৎ স্নেহা বেচারা বোমকে গেছে। মায়ের কানে কানে বলল, ‘মাসিকে বলো, আমার ট্যাব চাই না। শুধু এগ্জামের পর আমরা, মাসি-মেসো সবাই মিলে আইনক্সে একটা থ্রিডি দেখব, নয়তো সিটি সেন্টার টুতে সেভেন ডি। আর সবাই মিলে বাইরে খাব। আর আমার বার্থডেতে মাসি সকাল থেকে এসে থাকবে।’

মৌমিতা শুনতে পেয়ে ঝুঁকে বোনঝিকে হামি খেয়ে বলল, ‘আমার তরফ থেকে ডান। তোর বাবা ছুটি না নিলেও আমি কিন্তু আমার নতুন চাকরিতেও একদিন ছুটি নিয়ে হিয়া সোনার সঙ্গে কাটাব, ক্যারাম খেলব। আর ওটা আমাদের সিক্রেট। রাইট?’

নিজের হাতে খেতে পারে না। মা খাওয়ালেও ন্যাকরচ্যাকর। কিন্তু কাল থেকে যে পরীক্ষা শুরু। লক্ষ্মী মেয়ের মতো টিভি না দেখেই খেয়ে দাঁত মেজে শুয়ে পড়ল। শোবার ঘর থেকে একটু পরে ডাকল, ‘মা তোমাদের হয়েছে? তুমি ছাড়া ঘুম আসে না মা।’

একটা টাটা সুমোয় গাদাগাদি করে চোদ্দজন বাচ্চা। সবাই বাচ্চা নয়। সপ্তম অষ্টম শ্রেণির ছেলেমেয়েরা কেউ কেউ আকারে বড়ো মানুষই বলা যায়। মাঝেমাঝে এইসব গাড়ির পারমিট, ফিটনেস সার্টিফিকেট নিয়ে ধরপাকড় ওঠে। আবার সব মিটমাট হয়ে যায়। গরজ বড়ো বালাই। গাড়ি বন্ধ থাকলে গাড়িওয়ালাদেরও ক্ষতি, ছাত্রছাত্রী পক্ষেরও ক্ষতি। ধেড়েগুলো কুচোকাচাদের ওপর দাদাগিরি দিদিগিরি ফলায়, ঝগড়া থামায়, আবার বাধায়ও। কিন্তু পরীক্ষার কদিন বেশির ভাগই স্কুল যাবার পথে বই মুখে নিবিষ্ট। আজকের মতো ছুটি। বাড়ি ফেরার পালা। কালকের দিনটা পার করতে পারলেই ক্লাস ফাইভের কেল্লা ফতে। সিক্স, সেভেন আর এইট শেষ হতে আরও পাঁচ দিন। রোজ পরীক্ষা নয়, মধ্যে বিরাম আছে। কারো দুটো কারও তিনটে পরীক্ষা বাকি। ক্ষুদেগুলো কাল পরীক্ষার পর কী করবে তার জোর আলোচনা চালাচ্ছে। বড়োগুলো তাদের কাউকে কাউকে খ্যাপাচ্ছে। হই হই করতে করতে চলেছে টায়েটায়ে ভর্তি যান। গাড়ির চালকও যোগ দিয়েছে গুলতানিতে। এই গাড়িকাকু ওদের সবার খুব প্রিয়। না খেতে পারা টিফিন উদ্ধার করে সাহায্য করে। আবার যাদের যেদিন পরীক্ষার ইতি, সেদিন তাদের চকোলেট খাওয়ায়। বড়োগুলোর পরীক্ষা শেষ হতে দেরি থাকলেও চ্যাঁচাচ্ছে, ‘আমরাও আছি কিন্তু মোহিতকাকু। নো পার্শিয়ালিটি। কালকেই সবাইকে খাইয়ে দাও। শেষের দিন আমরা ফিস্ট করব। ওফ্ তোমাকে কখন থেকে গান লাগাতে বলছি না? আর ওই সামনের গদ্ধড় বাসটাকে ওভারটেক করতে পারছ না? পুরো রাস্তাটা আগলে চলছে।’

‘…ক্যাঁ…চ্’! বড়ো রাস্তার এক পাশটা খাওয়া। এক্সপ্রেসওয়ে কে বলবে? গদ্ধড় বাসটাকে কাটাতে গিয়ে পাশ থেকে একটা দৈত্যাকার লরির সঙ্গে একেবারে মুখোমুখি। কাছাকাছি লোকালয় ছিল না। দেরিতে লোক পৌঁছোল। গাড়ির হেল্পারটি লাফিয়ে পালাতে পেরেছে, গুরুতর আহত। চালক ঘটনাস্থলেই শেষ। পকেটে তার আজও লজেন্স আছে। ফুচকা, আইসক্রিম, বিরিয়ানি, সাইকেল, ট্যাব, জন্মদিন সান্তাক্লসের ছোটো ছোটো স্বপ্নগুলো দুমড়ে দলা পাকিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে চেপে ভাঙা রাস্তা দিয়ে ছুটে চলল।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব