সফর-কথা তৃতীয় পর্ব

২০২০ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আমরা স্বাভাবিক জীবন-যাপন থেকে বঞ্চিত হয়েছি করোনা-র কারণে। মাঝে লকডাউন কিছুটা শিথিল হলেও,এখনও পর্যন্ত আমরা প্রায় গৃহবন্দি জীবন কাটাচ্ছি। একঘেয়ে হয়ে উঠেছে জীবন।তাই এখন আমরা মুখিয়ে আছি মুক্তির স্বাদ পাওয়ার জন্য। করোনা থেকে মুক্তি পেলে বেশিরভাগ ভ্রমণপিপাসু মানুষের তাই ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর ইচ্ছে হবেই। কিন্তু কাছেপিঠে কোথায় যাবেন,কী দেখবেন,এই বিষয়ে যাতে আপনি দিশাহারা না হয়ে পড়েন,তারজন্য ‘গৃহশোভা’ নিল এক বিশেষ উদ্যোগ।পাঁচ দিনে পাঁচটি জনপ্রিয় স্পট-এর হদিস থাকছে এই লেখায়। আজ পড়ুন জিম করবেট অঞ্চলের রূপের কথা।

জিম করবেট

সবুজ পাতার ফাঁক থেকে ওই বুঝি বেরিয়ে এল সেই ভয়াল সুন্দর। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অবাধ বিচরণভূমি এই জিম করবেট ন্যাশনাল পার্ক। অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় মানুষের ড্রিম ডেস্টিনেশন হিসাবে ওই জন্যই বোধহয় করবেট পার্ক এত প্রিয়। উত্তরাখণ্ড হিমালয়ের পাদদেশে এই বনস্থলি ভারতের পুরোনো ন্যাশনাল পার্কগুলির অন্যতম।

জঙ্গল ভ্রমণের জন্য এখানে রয়েছে তিনরকমের ব্যবস্থা। জিপ সাফারি, এলিফ্যান্ট সাফারি এবং ক্যান্টার সাফারি। ক্যান্টার হল ১৬ আসনের ওপেন এয়ার বাস। এটি রামনগর থেকে ঢিকালা পর্যন্ত যাতায়াত করে। জিপ সাফারি অন্ততপক্ষে একমাস আগে বুক করে রাখা ভালো। এলিফ্যান্ট সাফারির জন্য অবশ্য অগ্রিম বুকিং-এর প্রয়োজন নেই। ফার্স্ট কাম ফার্স্ট সার্ভ বেসিস-এ পাওয়া যায়। সকালে ৬ টা থেকে ৯টা এবং বিকেলে ৩টে থেকে ৫টা– এই সময়ের মধ্যে জঙ্গল ভ্রমণ করানো হয়।

জঙ্গল ঘোরা যায় মূলত চারটি ভাগে। ঢিকালা জোন, ঝিরনা জোন, বিজরানি জোন এবং দুর্গাদেবী জোন। ঢিকালা অংশে ঢোকার জন্য ধানগাড়ি গেট দিয়ে প্রবেশ করতে হয়। এটাই সবচেয়ে বৃহৎ। থাকার ব্যবস্থা এই অংশেই সবচেয়ে বেশি। ঝিরনা জোনের জন্য প্রবেশদ্বার ঝিরনা গেট। রামনগর থেকে ১৬ কিমি দূরে এর অবস্থান। শাল জঙ্গল আর মানুষ-সমান উঁচু ঘাসের জঙ্গলে ঘেরা বিজরানি জোনে ঢুকতে হলে আসতে হবে আমডানডা গেট-এ। হাতি, বানর, বাঘ, চিতল এ অংশে প্রচুর। দুর্গাদেবী অংশটি পাখি দেখার জন্য আদর্শ, ঢুকতে হয় দুর্গাদেবী গেট দিয়ে। নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জুনের শেষ অবধি করবেট বেড়ানোর আদর্শ সময়। যেতে হলে দিল্লি থেকে রানিখেত এক্সপ্রেস-এ উঠে পড়ুন। নামুন রামনগর স্টেশনে।

 

সফর-কথা দ্বিতীয় পর্ব

২০২০ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আমরা স্বাভাবিক জীবন-যাপন থেকে বঞ্চিত হয়েছি করোনা-র কারণে। মাঝে লকডাউন কিছুটা শিথিল হলেও,এখনও পর্যন্ত আমরা প্রায় গৃহবন্দি জীবন কাটাচ্ছি। একঘেয়ে হয়ে উঠেছে জীবন।তাই এখন আমরা মুখিয়ে আছি মুক্তির স্বাদ পাওয়ার জন্য। করোনা থেকে মুক্তি পেলে বেশিরভাগ ভ্রমণপিপাসু মানুষের তাই ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর ইচ্ছে হবেই। কিন্তু কাছেপিঠে কোথায় যাবেন,কী দেখবেন,এই বিষয়ে যাতে আপনি দিশাহারা না হয়ে পড়েন,তারজন্য ‘গৃহশোভা’ নিল এক বিশেষ উদ্যোগ।পাঁচ দিনে পাঁচটি জনপ্রিয় স্পট-এর হদিস থাকছে এই লেখায়।আজ পড়ুন মাউন্ট আবু-র রূপের কথা।

মাউন্ট আবু

হিলস্টেশন মাউন্ট আবু হতেই পারে আপনার এবারের হ্যাংআউট। দিল্লি থেকে আদি স্বর্ণজয়ন্তী রাজধানী এক্সপ্রেস-এ উঠে, নামুন আবু রোড স্টেশনে। ওখানে থেকে ট্যাক্সি নিয়ে পৌঁছে যান মাউন্ট আবু।

মাউন্ট আবুর প্রাচীন নাম আরবুদাঞ্চল। পুরাণে, এই অঞ্চলটিকে অর্বুদরণ্য (“অর্ধুদার বন”) বলা হয়েছে এবং ‘আবু’ এই প্রাচীন নামের একটি ক্ষুদ্র। এটা বিশ্বাস করা হয় যে  বিশ্বামিত্রের সাথে মতবিরোধের পর  বশিষ্ঠ মাউন্ট আবুতে অবসর নিয়েছিলেন। আরেকটি ইতিহাসের কাহিনী আছে যার মতে “আরবুদা” নামে একটি সর্প নন্দীর জীবন রক্ষা করেছিল (ভগবান শিবের ষাঁড়)। ঘটনাটি ঘটেছিল সেই পাহাড়ে যা বর্তমানে মাউন্ট আবু নামে পরিচিত এবং তাই সেই পর্বের নামকরণ করা হয়েছে “অর্বুদারন্যা” সেই ঘটনার পরে যা ধীরে ধীরে আবু হয়ে ওঠে।

পর্যটকের মন কাড়ার জন্য সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে অপেক্ষায় রয়েছে মাউন্ট আবু। থাকার জন্য থ্রি স্টার হোটেল থেকে মাঝারি ব্যবস্থার নানা হোটেল পাবেন। আর বেড়ানোর জন্যও রয়েছে নানা অপূর্ব স্পট। গাড়ি ভাড়া করে ঘুরে নিন জৈন মন্দির দিলওয়ারা টেম্পল। এই মন্দিরের অভ্যন্তরের নকশা, মনে সারাজীবনের মূল্যবান সঞ্চয় হয়ে থাকবে। আর আছে জলবিহারের জন্য নক্বি লেক। স্থানীয় লোকেদের মতে ওই হ্রদ সৃষ্টি হয়েছে ঈশ্বরের নখের সাহায্যে। তাই এর নাম ‘নক্বি’।

যারা কিছুটা অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় তারা অচিরেই ঘুরে নিতে পারেন মাউন্ট আবু ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি। ফেব্রুয়ারি থেকে জুন হল এখানে ঘোরার আদর্শ সময়। সম্বর, বন্যশূকর, প্যাঙ্গোলিন প্রভৃতি পশু নজরে পড়বে। আবুর অপূর্ব দৃশ্য দেখে নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিন কটা দিন।

 

সফর-কথা-প্রথম পর্ব

২০২০ সালের মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আমরা স্বাভাবিক জীবন-যাপন থেকে বঞ্চিত হয়েছিলাম করোনা-র কারণে। মাঝে লকডাউন কিছুটা শিথিল হলেও,এখনও পর্যন্ত আমরা প্রায় গৃহবন্দি জীবন কাটিয়েছি।তাই একঘেয়ে হয়ে উঠেছে জীবন।সামনেই পুজো৷ এখন আমরা মুখিয়ে আছি মুক্তির স্বাদ পাওয়ার জন্য।  বেশিরভাগ ভ্রমণপিপাসু মানুষের  ডানা মেলে উড়ে বেড়ানোর ইচ্ছে হবেই। কিন্তু কাছেপিঠে কোথায় যাবেন,কী দেখবেন,এই বিষয়ে যাতে আপনি দিশাহারা না হয়ে পড়েন,তারজন্য ‘গৃহশোভা’ নিল এক বিশেষ উদ্যোগ।পাঁচ দিনে পাঁচটি জনপ্রিয় স্পট-এর হদিস থাকছে এই লেখায়। আজ পড়ুন ফাগু-র রূপের কথা।

ফাগু

বেড়াতে যাওয়ার সবথেকে ভালো জায়গা হিমাচল প্রদেশ। বন্ধুদের সঙ্গে হুল্লোড় হোক বা প্রিয় মানুষটির সঙ্গে একান্তে কয়েকটা দিন কাটানো হোক কিংবা পরিবারকে নিয়ে চুটিয়ে মজা করাই হোক– হিমাচল প্রদেশ আদর্শ জায়গা।  হিমাচল প্রদেশে ঘুরতে যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি জায়গা রয়েছে। তার মধ্যে ফাগু অন্যতম৷ নিরিবিলি ও নয়নাভিরাম জায়গা৷ ছুটির মরশুমে যাদের সিমলা যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে, তারা জানেন সেইসময় সিমলার হোটেলের ভাড়া থাকে তুঙ্গে, পর্যটকের অতিরিক্ত ভিড়। সবমিলিয়ে আপনার শান্তিহরণ হওয়ার পূর্ণ আয়োজন। তাই সিমলায় না থেকে, কালকা থেকে সিমলা পৌঁছে গাড়িতে এগিয়ে যান ফাগুতে। প্রকৃতির কোলে নির্জন নিরিবিলি এক শান্তির ঠাঁই ফাগু। এ এক মন ভরানো সবুজ উপত্যকা। যাবার পথেই পড়ে ছোট্ট গ্রাম বাণী। এখানে হোম-স্টে ছাড়াও রয়েছে ছোট্ট গেস্ট হাউস ‘মিস্টি হাট’। জনবসতি তেমন না থাকায়, সকলে এককথায় দেখিয়ে দেয় থাকার এই ছোট্ট নীড়। রান্নাঘর, থাকার ঘর সবই কেয়ারটেকারের জিম্মায়। বললে সে-ই রেঁধে খাওয়াবে আলু পরাঠা, ডাল ফ্রাই প্রভৃতি। চাইলে এখানে থেকে ছোট্ট ট্রেক-এ উঠে যান এখানকার সবচেয়ে উঁচু স্থান হাতু টপ-এ। উপরে হাতু মাতার মন্দির।

Travelogue

ইচ্ছে হলে থাকতে পারেন ফাগুর একমাত্র সরকারি হোটেল অর্থাৎ এইচপিটিডিসি’র অ্যাপল ব্লসম-এ। অপূর্ব নিসর্গের মাঝে ফাগু অচিরেই মন কেড়ে নেবে। কাছাকাছির মধ্যেই নারকান্ডা। পাইনের জঙ্গলে ঘেরা দারুণ স্পট। হিমালয়ের ব্যাকড্রপে ফাগু, এককথায় আপনার সেরা ট্রাভেল ডেস্টিনেশন।

রন উৎসবে কয়েকদিন

ডেস্টিনেশন গুজরাত। কচ্ছের রন বরাবরই এক মায়াটানে আকর্ষণ করে পর্যটককে। আর ডিসেম্বরের পয়লা থেকে মার্চের সাত তারিখ পর্যন্ত উৎসবের সাজে সেজে ওঠে এই লবণ মরুভূমি। রন উৎসবের সেই রঙিন বাসরে থাকে বাড়তি কিছু আকর্ষণও। একই প্যাকেজে ঘুরে নেওয়া যায় নারায়ণ সরোবর, কোটেশ্বর মন্দির, মাতা নো মাঢ়, লিট্ল রান অফ কচ্ছ, কালা দুঙ্গার হিল, বন্নি গ্রাসল্যান্ড।

জায়গাটায় পৌঁছোনোর আগে বুঝিনি যে, এ কোন মায়ার জগতে পা রাখলাম। কাক জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাচ্ছে চরাচর। সাদা নুন মরুভূমি ধুয়ে যাচ্ছে শ্বেতশুভ্র চাঁদের আলোয়। এ এক অপার্থিব দৃশ্য যা ভাষায় বর্ণনার অতীত।

উৎসব প্রাঙ্গণের এক দিকে তখন জমে উঠেছে রঙের রোশনাই। স্থানীয় মহিলারা কাচ আর এমব্রয়ডারির নকশায় সাজানো ঘাঘরা-চোলিতে সেজে প্রদর্শন করছে গুজরাতের লোকনৃত্য। কোথাও আবার তাঁবুর সামনের হাতায় গান বাজনা করছে স্থানীয় লোকশিল্পীরা।

আলোর মালায় সাজানো হয়েছে গোটা উৎসব প্রাঙ্গণ। থাকার জন্য তাঁবুর সারি। ছোটো ছোটো কুটির। মেহেন্দির নকশা উঠেছে উটের গায়ে। তরুণীদের চোখে কটাক্ষ আর কাজলের মিতালি। গায়ে উলকির সনাতনী আঁকিবুকি। গুজরাতের নিজস্ব সংস্কৃতির উত্তাপ সর্বত্র। আন্তরিকতার সঙ্গে ভলান্টিয়াররা আপনাকে এগিয়ে দেবেন আপনার জন্য নির্ধারিত তাঁবুর দিকে। আলাপ করাবেন স্থানীয় লোকশিল্পী, কারুশিল্পীদের সঙ্গে। ঢোকলা, ফেপরা, ছাস, রোটরা–  লোভনীয় গুজরাতি ডিশের স্বাদ মুখে লেগে থাকবে। আর মনে থাকবে ভুজের এই অনবদ্য ল্যান্ডস্কেপ।

একটি ‘বাঙ্গার’ মধ্যে ঢুকে অর্থাৎ মাটির তৈরি গোবর লেপা দেয়াল ঘেরা কুঁড়ে ঘরে ঢুকে চোখ জুড়িয়ে গেল। ঘরের ডেকরে অপূর্ব সব গুজরাতি নকশার ওয়ালম্যাট। ভেজিটেবিল কালার আর কাচের কুচির নকশা তোলা। আমাদের জন্য ওখানেই খাবার ব্যবস্থা হল। খেয়ে তোড়জোড় সাইট সিয়িং-এর। পঞ্চম আইল্যান্ড যাব। তিন দিকে লবণাক্ত জলের মাঝে ভেসে থাকা এক চোখ জুড়োনো দ্বীপ।

এটি ঘুরে রওনা দিলাম কালা দুঙ্গার পিক-এর উদ্দেশ্যে। রনের ওটাই উচ্চতম বিন্দু। পাখির চোখে দেখে নেওয়া যায় লবণ-মরু। অনতিদূরেই পাকিস্তান বর্ডার। উৎসাহীরা এখানে এলে ঘুরে নেন মাণ্ডবী বিচ। অনেকে ওয়াইল্ড লাইফ সাফারি বা উটের পিঠে রন সাফারিও করেন। আমরা ঘুরে নিলাম ধোড়ডো ও হোড়কা নামের দুটি গুজরাতি গ্রাম। এগুলি মূলত গুজরাতি হস্তশিল্পের আঁতুড়ঘর।

কচ্ছের রন পাখির স্বর্গ। শীতে নানা রকম পরিযায়ী পাখির দল আসে এই অঞ্চলে। বন্য গাধা বা ইন্ডিয়ান ওয়াইল্ড অ্যাস-এর দেখা মেলে কালা দুঙ্গারের পথে। কচ্ছের এই প্রান্তর কিছুটা রুক্ষ– কিন্তু এই সৌন্দর্যের সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা সত্যিই চলে না। রন উৎসবে শীত যাপনে একবার যদি আসতে পারেন– এক নতুন রূপে আপনার চোখে ধরা দেবে এই প্রদেশ।

আমেরিকার পূর্ব উপকূলে

বল পরাক্রমী হাডসন নদ যেখানে অতলান্তিক মহাসাগরে এসে আত্মসমর্পণ করেছে– সেখানেই বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাকৃতিক বন্দরের গর্বিত অবস্থান। নিউ ইয়র্ক শহরবন্দর– যা কিনা আমেরিকার প্রধান প্রবেশদ্বার। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম বৃহত্তম শহর এবং সবচেয়ে জনবহুল শহর। শিক্ষা, সংস্কৃতি, বাণিজ্য, অর্থনীতি, ফ্যাশন, টেকনোলজি, বিনোদন– সমস্ত দিক থেকেই ‘পৃথিবীর সাংস্কৃতিক রাজধানী’ নিউ ইয়র্ক বিশ্বের চোখে উন্নততর জীবনের এক সমুজ্জ্বল উদাহরণ।

রাষ্ট্রপুঞ্জের সদর দফতর হওয়ার কারণে আন্তর্জাতিক কূটনীতিরও কেন্দ্রস্থল এই শহর। ‘গ্লোবাল পাওয়ার সিটি’ নিউ ইয়র্কে বছরে প্রায় পাঁচ কোটি ভ্রামণিকের আগমন ঘটে। আর নিউ ইয়র্কের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’ ছুঁতে প্রতি বছর প্রায় দুই কোটিরও বেশি পর্যটকের সমাবেশ ঘটে ‘সিটি অফ স্কাইস্্ক্র্যাপারে’। ১৬২৪ খ্রীস্টাব্দে স্থাপিত হবার পর ১৭৮৫ থেকে ১৭৯০ সাল পর্যন্ত নিউ ইয়র্ক ছিল আমেরিকার রাজধানী। সুতরাং ঐতিহাসিক ঐতিহ্য, বিত্ত-বৈভব মিলে, বিশ্বের মানচিত্রে নিউ ইয়র্কের আবেদন অনস্বীকার্য।

আপার নিউ ইয়র্ক উপসাগরের ‘লিবার্টি আইল্যান্ডে’ অবস্থিত ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি এনলাইটেনিং দ্য ওয়ার্ল্ড’ সম্ভবত পৃথিবীর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ, প্রিয়, বিশ্ববন্দিত এক সুবিশাল ধাতুর প্রতিমূর্তি যা একশো বছরেরও বেশি সময় ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতীক হিসেবে উজ্জ্বল। লোয়ার ম্যানহাটনের ঐতিহাসিক ব্যাটারি পার্ক থেকে লিবার্টির ‘ই-টিকিট’ অনুমোদন করিয়ে নিয়ে আশ্রয় নেওয়া ‘স্ট্যাচু ক্রুজের’ নিশ্চিন্ত ছত্রছায়ায়। ‘স্ট্যাচু ক্রুজের’ দোদুল্যমান ফেরি যখন পৌঁছে দিল ‘লিবার্টি আইল্যান্ডে’, রৌদ্রালোকিত লিবার্টির উন্নত মূর্তিটির পাদদেশে– আমাদের সকলের চোখে তখন বিস্ময়ান্বিত সম্মোহন। রোমান স্বাধীনতার দেবী ‘লিবারটাস’ এর আদর্শে তৈরি ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’ আসলে মুক্তি, আশা ও স্বাধীনতার প্রতীক। ইতিহাস অনুচ্চস্বরে বলে যায় কানে কানে, ‘লিবার্টি আইল্যান্ডে’র পাশেই ‘এলিস আইল্যান্ডের’র দরজা দিয়ে ১৮৯২-১৯৫৪ সালের মধ্যে প্রায় এক কোটি কুড়ি লক্ষেরও বেশি অভিবাসী নিজেদের দেশ ছেড়ে প্রবেশ করেছিল আমেরিকায়ঃ সুস্থ, স্বাধীন, উজ্জ্বল জীবনের আশায়। প্রায় ১৫১ ফুট উঁচু ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’ লোহার দৃঢ় কাঠামোর ওপর তামার পাত দিয়ে আবৃত ‘মাদার অফ এগজাইলস’ যার পায়ের তলায় অবিন্যস্ত শিকল, বাঁধনমুক্ত স্বাধীনতার প্রতীক। মূর্তির ডান হাতে স্বাধীনতার জ্বলন্ত সোনালি মশাল আর বাম হাতে আইনের পুস্তিকা যাতে রোমান হরফে খোদাই করা– ৪ জুলাই, ১৭৭৬ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা অর্জনের সেই অবিস্মরণীয় তারিখটি। লিবার্টির মাথার দৃপ্ত মুকুটের সাতটি সূচ্যগ্র ছটায় প্রকাশিত সাতটি মহাদেশ ও মহাসাগরের দ্যোতনা।

বিশ্বদরবারে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রতীক ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’ আসলে ফ্রান্সের তরফ থেকে এক অসামান্য উপহার। ১৮৮৬ সালে বন্ধুত্বের প্রতীকস্বরূপ বন্ধুরাষ্ট্র ফ্রান্স ‘লিবার্টি’ মূর্তিটি তুলে দেয় আমেরিকার হাতে যা ১৯২৪ সালে আমেরিকার জাতীয় সৌধ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ১৯৮৪ সালে ‘ইউনাইটেড নেশান’ এটিকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ছুটির দিনগুলিতে টুরিস্টদের জন্য লিবার্টি ক্রাউনে’র প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, যদিও একদিনে ২৪০ জনের বেশি পর্যটককে ক্রাউনে উঠতে দেওয়া হয় না। প্রায় পাঁচ-ছয় মাস আগে থেকেই এই ‘ক্রাউন’ টিকিটের জন্য আগাম অনলাইন বুকিং শুরু হয়ে যায়।

‘পেডিস্ট্যল’ থেকে ১৫৪টি সরু, পাকদণ্ডি সিঁড়ি বেয়ে লিবার্টি ক্রাউনের উচ্চতায় পৌঁছোনো এক অসাধারণ অভিজ্ঞতাই বটে, ক্লান্তিতে পা ভারী হয়ে আসে, কিন্তু ২৫টি ক্রাউন উইন্ডো থেকে নিউ ইয়র্ক শহরের চমকপ্রদ দৃশ্য চোখের তারায় ছড়িয়ে নিতে নিতে মনে হল, কষ্টটা বৃথা যায়নি! অবশ্য শুধুমাত্র ‘পেডিস্ট্যল’ (বা বেদি) টিকিট দিয়েই মিউজিয়াম, কোটউড লেভেল এবং লিবার্টি বেদি দর্শন করে নেওয়া যায়, তাই শারীরিকভাবে অসুস্থ বা বয়স্কদের এই রিস্ক না নেওয়াই উচিত।

‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’র মন্ত্রমুগ্ধকর পরিবেশ থেকে বেরিয়ে স্ট্যাচু ক্রুজের ফিরতি পানসি পৌঁছে দিল ব্যাটারি পার্কে। মধ্যাহ্নের নিউ ইয়র্কের সুউচ্চ ইমারতের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আগুনতাতা আকাশ আর ইতিউতি এশিয়ান ফুডস্টলগুলিতে দ্বিপ্রাহরিক উদরপূর্তির আয়োজন! নগরের জনপথের গতি আর অট্টালিকার মিছিল পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম ওয়াল স্ট্রিট ‘বুল’ যা অর্থনৈতিক আগ্রাসনের প্রতীক। পৃথিবীর বৃহত্তম ‘নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ’ এই ওয়াল স্ট্রিটেই অবস্থিত। কাছাকাছিই গগনচুম্বী, ঝলমলে ওয়ান ওয়ার্ল্ড সেন্টারের ঝলমলে উপস্থিতি। আর বাতাস ভারী হয়ে আসা ৯/১১ মেমোরিয়ালের বিনম্র অবস্থান– ১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১ এ সন্ত্রাসবাদী আক্রমণে আগের দুটি টাওয়ারের ধবংসাবশেষের ওপর হামলায় নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত মেমোরিয়ালের বুকে দুঃসহ নৈঃশব্দ্য।

ব্যাটারি পার্ক থেকেই মেট্রোর তীব্র গতি আমাদের নিয়ে এল টাইমস স্কোয়ার’এর চৌকাঠে। ১০-১৫ মিনিটের রাজপথের চঞ্চলতা পেরিয়ে এসে পৌঁছোলাম বিশ্বের চতুর্থ উষ্ণতম অট্টালিকা ‘এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং’, যা ১৯৩১-১৯৭০ সাল পর্যন্ত ছিল বিশ্বের সর্ব্বোচ্চ অট্টালিকা। বিল্ডিং-এর ৮৬ তলার ‘অবজার্ভেশন ডেক’ থেকে পাখির চোখে ধরা দেয় নিউ ইয়র্ক শহর।  ‘এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং’ থেকে পায়ে পায়ে পৌঁছোলাম ‘টাইমস স্কোয়ারে’। ব্রডওয়ে আর সেভেন্থ অ্যাভিনিউ এর সংযোগস্থলে অবস্থিত এই ‘টাইমস স্কোয়ার’ আসলে ‘ব্রডওয়ে থিয়েটার ডিসট্রিক্টে’র সমূহ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। নিশাচর নিউ ইয়র্কের আলোর সাথি টাইমস স্কোয়ার– ব্রডওয়ে থিয়েটার, সিনেমা, ইলেকট্রনিক বিলবোর্ডের জন্য সুপ্রসিদ্ধ বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো ‘টুরিস্ট অ্যাট্রাকশন’! নিউ ইয়র্কের হৃৎস্পন্দন শিরায় শিরায় সঞ্চালিত করে, নাগরিক জীবনের নিশিযাপনের উল্লাস উপভোগ করে চলে টাইমস স্কোয়ার। এই টাইমস স্কোয়ারেরই আর এক আকর্ষণ, ‘মাদাম তুসো মিউজিয়াম’– সেখানে বিশ্ববিখ্যাত মানুষজনের মোমের মূর্তিগুলি কল্পনা আর বাস্তবকে মিলিয়ে মিশিয়ে এক করে দেয়। আর কাজলকালো মহাকাশের নীচে তখন চোখ ধাঁধানো নগরীর রূপকথারা আলোর ঊর্মিমালায় ভেসেই চলেছে।

নিউ ইয়র্কের প্রাণচঞ্চল শহরজীবনের একটুকরো স্মৃতির ঝাঁপিতে পুরে নিয়ে এবারের ঠিকানা– পৃথিবীর প্রশস্ততম জলপ্রপাত– নায়াগ্রা। নিউ ইয়র্ক রাজ্যের অন্তর্গত এই বিশ্ববিশ্রুত জলপ্রপাতে, নিউ ইয়র্ক শহরের ‘পেন স্টেশন’ থেকে ‘অ্যামট্রাকে’র ট্রেন যাচ্ছে প্রতিদিন সকাল ৭.১৫, ১০.২০ ও দুপুর ১.২০। প্রায় ৯ ঘণ্টার জার্নি শেষে ট্রেন নিঝুম ‘নায়াগ্রা স্টেশনে’ এসে পৌঁছোল।

স্টেশন থেকেই ক্যাব নিয়ে প্রথমেই হোটেল, তবে হোটেলের উষ্ণ ব্যবস্থাপনাও দমিয়ে রাখতে পারে না উৎসুক মনের উড়ানকে। তাই ব্যাগপত্র হোটেলে গচ্ছিত রেখেই, ফ্রেশ হয়ে ছুটলাম কিংবদন্তির ভুবনমোহিনী রূপকে প্রত্যক্ষ করতে। হোটেল থেকে মিনিট দশেকের হাঁটা পথ উজিয়ে নায়াগ্রা স্টেট পার্কের অন্তরঙ্গ আলাপ আর পরমাসুন্দরী নায়াগ্রার অকারণ সঞ্চালন! বেলা শেষের স্বর্ণালি সূর্যের স্বর্ণময় আভায় সেজে উঠে নায়াগ্রার জলরাশি ঝাঁপিয়ে চলেছে অতল নীচে। বিশ্বের সর্বাপেক্ষা প্রশস্ত জলপ্রপাত নায়াগ্রা আসলে তিনটি জলপ্রপাতের সম্মিলিত নাম– আমেরিকান ফল্স, ব্রাইডাল ভেল ফল্স ও হর্স শু ফল্স। নায়াগ্রা নদীতে অবস্থিত নায়াগ্রা ফল্স ‘ইরি’ হ্রদের জল বয়ে নিয়ে চলেছে ‘অন্টারিও’ হ্রদে। নায়াগ্রার জলের অদ্ভুত সবুজাভ রঙের মূলে রয়েছে জলে দ্রবীভূত লবণ ও নায়াগ্রার ক্ষয়ীভবনের ফলে উৎপন্ন পাথরের গুঁড়ো। আদিম রূপসী আমেরিকান ফলসের ব্যাপ্তির পাশেই ক্ষীণকটি ব্রাইডাল ভেল ফলসের ঢালাও লাবণ্য, আর এই দুই ফলসের মাঝে অবস্থিত লুনা আইল্যান্ড। আরও একটু দূরে, প্রবল জলকণার আধিক্যে ঝাপসা হর্স শু ফল্স যাকে গোট আইল্যান্ড পৃথক করে রেখেছে ব্রাইডাল ভেল ফলসের থেকে। কাছেই নায়াগ্রা নদীর ওপর নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে উত্তর আমেরিকা আর কানাডার সংযোগকারী সেতু ‘রেইনবো ব্রিজ’। প্রাক সন্ধের শান্ত ছায়া বিদীর্ণ করে কানাডার দিক থেকে নায়াগ্রার ওপর ফেলা রঙিন আলোর বর্ণছটায় চঞ্চলা নায়াগ্রার রূপ যেন স্বর্গের অপ্সরার অধরা মাধুরী!

পরদিন সকালের নরম রোদ্দুর গায়ে মেখে, হোটেলেই ব্রেকফাস্ট পর্ব চুকিয়ে দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ‘মেইড অফ দ্য মিস্টে’র কুহেলিকাময় সফরের জন্য। নায়াগ্রা ‘অবজার্ভেশন টাওয়ার-এর ‘প্রসপেক্ট পয়েন্ট’ থেকে ঘন নীল পাতলা রেইনকোট দেওয়া হয় সকলকে, তাই গায়ে চাপিয়ে নিয়ে উঠে পড়া ‘মেইড অফ দ্য মিস্টে’র বোটে। আমেরিকান ফল্স, ব্রাইডাল ফল্সকে বাঁদিকে রেখে বোট এগিয়ে চলেছে হর্স শু ফলসের উদ্দেশ্যে। প্রায় ৭০-১০ ফুট উঁচু থেকে সগর্জনে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়া আমেরিকান ফলসের জলীয় তান্ডবে রেইনকোটের মধ্যে থেকেও সকলে ভিজে একাকার। হর্স শু ফল্স সেখানে তিনদিক থেকে আকাশ ভেঙে সবিক্রমে লাফিয়ে পড়েছে নীচেঃ সেই অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের বর্ণনা করা সত্যিই সাধ্যাতীত। আকাশবাতাস আচ্ছন্ন অজস্র জলকণার বিন্দুচমকে। একসময় বোট ফিরে আসে ‘প্রসপেক্ট পয়েন্টে’, এক ঝাঁক সিক্ত মনের পসরা নিয়ে।

নীল ফিনফিনে রেইনকোটগুলি ইতিউতি রাখা ক্যাম্পে জমা করে দিয়ে এবার সামনে ‘কেভ অফ দ্য উইনডস’ এর সুস্পষ্ট আহ্বান। নায়াগ্রা স্টেট পার্কের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাবার জন্য সুদৃশ্য ট্রলির ব্যবস্থা আছে– তারই একটির যাত্রী হয়ে এসে পৌঁছোলাম গন্তব্যে। ব্রাইডাল ভেল ফলসের ঠিক পিছনে অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক গুহায় আগে পর্যটকরা আসার সুযোগ পেলেও, পাথর ধসে পড়ায় ১৯২৪ সাল থেকে নিরাপত্তাজনিত কারণে এখন আর ফলসের পিছনে যাবার সুযোগ নেই।

‘এলিভেটরে’ করে নেমে এলাম সবাই নায়াগ্রা নদীর সমতলে যেখান থেকে ধাপে ধাপে মেরুন রঙের কাঠের সিঁড়ি উঠে গেছে উপরে। সেই সুনিয়ন্ত্রিত কাঠের বোর্ডওয়াকের শেষ ধাপ ‘হারিকেন ডেক’– যেখানে উত্তুঙ্গ ব্রাইডাল ভেল ফলসের আকাশ ভেঙে লাফিয়ে পড়া উৎক্ষিপ্ত জলস্রোতের প্রায় ৬-৭ মিটার কাছে গিয়ে পর্যটকরা সেই আদিম বন্যতার স্বাদ নিতে পারেন। পৃথিবীর আর কোথাও কোনও জলপ্রপাতের এত ঘনিষ্ঠ হয়ে তাকে ছোঁয়ার সুযোগ নেই। সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতেই জলরাশির স্পর্ধার সঙ্গে পরিচিতি বাড়তে থাকে। আর ‘হারিকেন ডেক’ এ যখন পা– ক্রান্তীয় ঝড়ের মতো আছড়ে পড়া জলের তান্ডবে প্রত্যেকেই আপাদমস্তক ভিজে একশা! প্রকৃতির এই ‘ভয়ংকর সুন্দর’ রূপের কাছে ক্ষণস্থায়ী, ক্ষুদ্র এই মনুষ্যজীবনের অস্তিত্ব যেন নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর মনে হয়।

সেই বিমুগ্ধতার ঘোর কাটিয়ে কখন যেন পেৌঁছে গেলাম পাশেই গোট আইল্যান্ডে যেখান থেকে হর্স শু ফলসের পূর্নাবয়ব চোখে ধরা দেয়। ২৬০০ ফুট প্রশস্ত হর্স শু ফল্স নায়াগ্রার সবথেকে শক্তিশালী জলপ্রপাত যা প্রায় ১৭৪ ফুট উঁচু থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নীচে, এখানে যেদিকে তাকানো যায়, বিন্দু বিন্দু জলকণার চাদরের আস্তরণে ঝাপসা চারিদিক।

অবেলার হেলে পড়া রোদে তখন নরম অবকাশেরই হাতছানি। নায়াগ্রা শহরে ভারতীয় রেস্টুরেন্টের অভাব নেই, তারই যে-কোনও একটিতে রেস্ত বুঝে ঢুকে পড়ে মধ্যাহ্নভোজনের পর্ব চুকিয়ে নেওয়া। নায়াগ্রার রংবাহারির সন্ধের জন্য তুলে রাখা ভিসিটর সেন্টারের ঠিক নীচের তলাতেই নায়াগ্রা লেজেন্ডস অফ অ্যাডভেঞ্চার থিয়েটার-এর চমক! এই থিয়েটারে সন্ধেবেলায় আধঘণ্টার জন্য অনন্য নায়াগ্রাকে ঘিরে নানা তথ্যসমৃদ্ধ এক ডকুমেন্টরি দেখানো হয়। বাইরে তখন আতশবাজির আওয়াজ– প্রতি শুক্রবার নায়াগ্রার আকাশে আতশবাজির প্লাবন দেখা দেয়, ঘন কালো আকাশ আলো করে জ্বলে উঠতে থাকে একের পর এক বর্ণছটা, উজ্বল আলোর ঝলক! রাতআকাশের আলোর বর্ণালি দুচোখে মাখিয়ে নিয়ে যখন অনেক রাতে হোটেলে ফিরলাম, বাতাসে তখন অদ্ভুত এক শীতল আদর।

আমেরিকার পূর্ব উপকূলের অন্যতম, অপরিহার্য আকর্ষণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডি.সি.– ভ্রমণপিপাসু মনের পরবর্তী ঠিকানা। নায়াগ্রা ফল্স থেকে ওয়াশিংটন ডিসি-র কোনও সরাসরি ট্রেন নেই, চেঞ্জ করে যেতে লেগে যায় প্রায় চোদ্দো ঘণ্টা, দূরত্বও প্রায় ৪০০ মাইলের কাছাকাছি। তবে যে-কোনও ট্রাভেল এজেন্সির তত্ত্বাবধানে ভ্রমণ পরিকল্পনা করলে নিউ ইয়র্ক থেকেই তারা নির্দিষ্ট বাসে করে নিউ ইয়র্ক, নায়াগ্রা, ওয়াশিংটন ডি.সি. পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি সাইটসিয়িং এর ব্যবস্থাও করিয়ে দেয়। এই ধরনের টুর প্রোগ্রামে যাতায়াতের সময়টাও অনেক কম লাগে, ঠিক তেমনই খরচাও অনেক কম হয়। ঘোরার উদ্বেগটুকু টুর পার্টির হাতে তুলে দিয়ে আনন্দটুকু তুলে রাখা যায় শুধুই নিজেদের জন্য।

ইতিহাসের পাতা উলটে দেখি, ১৭৯০ সালে, পোটোম্যাক রিভার ও ইস্টার্ন ব্রাঞ্চের (অ্যানাকোস্টিয়া রিভার) সংযোগস্থলে, আমেরিকার সংবিধান বলে স্থাপিত এই শহরটি পত্তনের জন্য স্থান নির্বাচন করেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন। ১৮১২ সালের যুদ্ধ ও ব্রিটিশ শক্তির আগ্রাসন শহরের অনেক জায়গাতেই অগ্নি সঞ্চার করেছিল যা ইতিহাসে ‘বার্নিং অফ ওয়াশিংটন’ নামেই খ্যাত। রাজধানীতে ফিরে আসার পর তাই সরকারের প্রধান পদক্ষেপই ছিল অগুনতি সরকারি ও পাবলিক বিল্ডিং এর পুনর্নির্মাণকরণ। ১৯০১ সালে ম্যাকমিলান প্ল্যানের মাধ্যমে নগরের কেন্দ্রস্থলের নবীকরণ, অসংখ্য মিউজিয়াম, মনুমেন্টের প্রতিষ্ঠা, সুবিদিত ‘ন্যাশনাল মল’ স্থাপন ও শহরটির সৌন্দর্যায়নের সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পৃথিবীর অন্যতম ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে, সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের রত্নআকর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে ওয়াশিংটন ডিসি।

ক্যাপিটাল হিলে আমাদের হোটেলের কাছেই ইউনিয়ন স্টেশনে’র ফুড কোর্টে পিৎজা, চাউমিন থেকে শুরু করে ইন্ডিয়ান, আমেরিকান সব ধরনের খাবারেরই দেখি পসরা সাজানো রয়েছে, সুতরাং সকালের খাবার সেরেই ব্যাগে জলের বোতল আর লাঞ্চ প্যাক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম রাজধানীর রাজপথের উন্মুখ ইশারায়। শান্ত সকালের রোদ্দুর ভেজা পথ, আর দূরে ইউএস ক্যাপিটালের রৌদ্রালোকিত শুভ্র গম্বুজ। উজ্জল আলো ঠিকরে পড়ছে গম্বুজের গা বেয়ে, ঠিক যেমন ঠিকরে ওঠে আধিপত্যের আত্মাভিমানী আভা! ইউএস কংগ্রেসের অধিবেশন স্থল এই ইউএস ক্যাপিটালের নির্মাণকার্য শুরু হয়েছিল ১৭৯৩ সালে, তারপর নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে মূল ভবনটি পরিপূর্ণতা লাভ করে ১৮২৬ সালে, যদিও তার পরেও নানা সংস্কারসাধন ও সংযোজনের মাধ্যমে প্রবাদপ্রতিম এই অট্টালিকার সর্বাঙ্গীণ উন্নতিকরণের প্রচেষ্টা অব্যাহত।

১৮৬৩ সালে গম্বুজের ওপর ব্রোঞ্জের ‘স্ট্যাচু অফ ফ্রিডম’টি প্রতিস্থাপিত হয়। ১৯ শতাব্দীর নিওক্ল্যাসিকাল স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত এই সুবিশাল অট্টালিকার নতুন প্রবেশপথ ‘দ্য ক্যাপিটাল ভিসিটর সেন্টার’টি সোম থেকে শনি পর্যটকদের জন্য অবারিত দ্বার– আগাম অনলাইন বুকিং করে ক্যাপিটালের অভ্যন্তরে টুরের ব্যবস্থাও আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফাউন্ডিং ফাদার’দের আদর্শের ব্যঞ্জনার মূর্ত প্রতীক এই ইউএস ক্যাপিটাল বর্তমানে আমেরিকার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ এবং মহিমান্বিত অট্টালিকা।

ইউএস ক্যাপিটাল থেকে প্রায় ১.৭ মাইল দূরে বিশ্ববিখ্যাত হোয়াইট হাউসের অভিজাত অবস্থিতি। ক্যাব নিয়ে অথবা হেঁটেই পৌঁছে যাওয়া যায় সেখানে। ১৭৯০ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন এই স্থানটি নির্বাচন করেন এবং ১৭৯২ সালে শুরু হয়ে ১৮০০ সালে বিল্ডিংটির নির্মাণকার্য সম্পূর্ণ হয়। সেই বছর, প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামসের হোয়াইট হাউস পদাপর্ণের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সকল প্রেসিডেন্টই (একমাত্র জর্জ ওয়াশিংটন ছাড়া) হোয়াইট হাউসে বসবাস করেছেন। প্রথমদিকের ‘প্রেসিডেন্টস প্যালেস’ ‘প্রেসিডেন্টস হাউস’ নামে পরিচিত বিল্ডিংটি তার স্থায়ী ও সরকারি নাম ‘হোয়াইট হাউস’ হিসেবে অভিষিক্ত হয়েছে ১৯০১ সালে, প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের আমলে। সময়ের সাথে সাথে বহুবার হোয়াইট হাউসের সম্প্রসারণ, পরিবর্ধন করা হয়েছে। ১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১-এর পর থেকে কেবলমাত্র আমেরিকার বসবাসকারীরাই ‘গ্রুপ টুর’এর মাধ্যমে হোয়াইট হাউস ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে থাকেন। তবে সাধারণ পর্যটকদের উত্তর এবং দক্ষিণ দুই প্রান্ত থেকেই অট্টালিকার সম্মুখভাগ বা বহির্ভাগ দর্শন করার সুযোগ রয়েছে।

হোয়াইট হাউস থেকে ৫/৬ মিনিটের হাঁটা পথের সীমানায়, ওয়াশিংটন ডিসির অনাবৃত নীলাকাশের সামিয়ানা ছুঁয়ে পুলকিত উঁকি-ঝুঁকি আর এক বিস্ময় ওয়াশিংটন মনুমেন্টে’র। সুপ্রসিদ্ধ ন্যাশনাল মলে’র অন্তর্গত ১৮৪৮ থেকে ১৮৮৪ সালের মধ্যে নির্মিত এই সুদীর্ঘ ওবেলিস্কটি স্থাপিত হয়েছিল প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্থে। ১৬৯ মিটারেরও বেশি উঁচু, মার্বেল, গ্রানাইট ও ব্লুস্টোন দ্বারা নির্মিত সুউচ্চ এই চতুষ্কোণ পাথরের পিলারটি পৃথিবীর সর্বোচ্চ ওবেলিস্ক। মনুমেন্টের অবজার্ভেটরি থেকে রাজধানীর অনবদ্য দৃশ্য প্রত্যক্ষ করার সুযোগও রয়েছে। যদিও সময়াভাবে সে রসাস্বাদনে আমাদের বঞ্চিতই থেকে যেতে হল।

ওয়াশিংটন মনুমেন্ট থেকেই উৎফুল্ল চোখের তারায় ভেসে উঠেছিল রিফ্লেক্টিং পুল-এর ঠিক ওপারে, মনুমেন্টের ঠিক বিপরীতেই ন্যাশনাল মলে’র পশ্চিমপ্রান্তে অবস্থিত লিঙ্কন মেমোরিয়ালে’র সুদৃশ্য প্রতিচ্ছবি। ১৯২২ সালে স্থাপিত, ৩৬টি ডরিক স্তম্ভে সুসজ্জিত এই মনুমেন্টটির মধ্যে আমেরিকার ১৬ তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের গভীর চিন্তায় মগ্ন লার্জার-দ্যান-লাইফ মূর্তিটি। মনুমেন্টের প্রাচীরে তাঁর দুটি বিখ্যাত ভাষণের অভিলিখন– পর্যটকমনে জাদুকরি আবেশের সঞ্চার করে।

অসংখ্য মেমোরিয়ালে সমৃদ্ধ রাজধানীর বিশ্বশ্রুত ন্যাশনাল মলে’র চৌহদ্দির মধ্যে অবস্থান করছে বেশ কিছু মেমোরিয়াল লিঙ্কন মেমোরিয়ালের উত্তরপূর্বে একটু হেঁটে এলে ভিয়েতনাম ভেটেরানস মেমোরিয়াল, রিফ্লেক্টিং পুলের ঠিক দক্ষিণেই অবস্থিত কোরিয়ান ওয়ার ভেটেরানস মেমোরিয়াল, এর দক্ষিণ-পশ্চিমে পাষাণশুভ্র আবেদন নিয়ে ওয়েস্ট পোটোম্যাক পার্কের অন্তর্গত মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র মেমোরিয়াল যার কাছাকাছি অবস্থান করছে ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট মেমোরিয়াল। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র মেমোরিয়াল-এর অদূরেই টাইডাল বেসিনের পাড়ে জেফারসন মেমোরিয়ালের নিশ্চুপ গম্বুজ। টাইডাল বেসিনের দক্ষিণ পাড় দিয়ে, চেরি গাছের মিছিল দিয়ে অলংকৃত রাস্তা এঁকে বেঁকে চলে গেছে।

১৯৪৩ সালে, আমেরিকার তৃতীয় প্রেসিডেন্ট থমাস জেফারসনের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত এই শ্বেতশুভ্র নিওক্ল্যাসিকাল বিল্ডিং-টি’র উদ্দেশ্যে। চেরিগাছের উপরে পড়া ফুলে, বসন্তের আঙিনায় টাইডাল বেসিন পরিবর্তিত হয়ে যায় স্বর্গীয় ফুলেল ক্যানভাসে। সেই সময় চেরি ব্লুসম ফেস্টিভ্যালের মুহূর্তে রাজধানী উথলে ওঠে ভ্রমণপিপাসু, সুন্দরের পূজারি ও ফোটোগ্রাফারের ভিড়ে।

টাইডাল বেসিনের ধারে ছোটোখাটো ফুড স্টল রয়েছে, রয়েছে বসার জায়গাও! টাইডাল বেসিনের কাকচক্ষু জলে হেলে পড়া অবেলার আলো গায়ে জড়িয়ে নিয়ে একটু যেন নিশ্চিন্ত অবকাশ। মুখে কিছু দিয়ে, একটু জিরিয়ে নিয়ে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম লিঙ্কন মেমোরিয়াল আর ওয়াশিংটন মনুমেন্টের মাঝেই প্রায় ৭.৪ একর জায়গা জুড়ে অবস্থিত ওয়ার্ল্ড ওয়ার ২ মেমোরিয়াল-এর দিকে। ২০০৪ সালে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ দ্বারা উৎসর্গীকৃত এই মেমোরিয়ালে, ৫৬টি পিলার ও দুটি বিশাল বিজয়তোরণের প্রাচীরের মাঝখানে টলটলে জলে পূর্ণ রেইনবো পুল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত অগুনতি সৈনিক ও জনসাধারণের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত মেমোরিয়ালের বুকে নেমে আসা প্রাক-সন্ধের অস্তরাগের চুম্বনে হোটেলে ফেরার ছাড়পত্র। মাথার ওপর তারা ছড়ানো ঘন নীল চাঁদোয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রাজধানীর বুকেও ফুটে উঠতে থাকে রাজকীয় ঐশ্বর্যের রোশনাই। আলোকোজ্জ্বল ইউএস ক্যাপিটালের অহংকারী, ঔদ্ধত্যময় ঝলকানিতে বিমুগ্ধ সকলের ক্লান্ত চোখেও তখন অসীম আনন্দের ঝরনাধারা।

মিউজিয়ামের আতিশয্যে প্লাবিত রাজধানীর একান্ত দর্শনীয় মিউজিয়াম দুটিকে ছুঁয়ে এবার ফিরে যাবার পালা। ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্টরি এবং ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়াম-দুটি ক্যাপিটাল হিলের কাছাকাছিই অবস্থিত। বলাই বাহুল্য, প্রবেশমূল্য লাগে না! মিউজিয়ামের অজস্র সম্ভারে আশ্চর্যান্বিত উৎসুক মনে তখন মুগ্ধতার নেশাতুর আমেজ।

ওয়াশিংটন ডিসি থেকে বাসে করে নিউ ইয়র্কের প্রাণচঞ্চলতার প্রত্যাবর্তন কিংবা হাতে সময় থাকলে ডিসি থেকেই ট্রেনে করে সিটি অব ব্রাদারলি লাভ ফিলাডেলফিয়ার প্রমোদোদ্যানে ঢুঁ মেরে যাওয়া। ডিসি’র ইউনিয়ন স্টেশন থেকেই ফিলাডেলফিয়ার থার্টিথ স্ট্রিট স্টেশনে যাওয়ার ট্রেন মজুদ, মোটামুটি তিন ঘণ্টা লাগে ট্রেনে। ১৬৮২ সালে স্থাপিত এই শহরটি পেনসিলভ্যানিয়ার বৃহত্তম শহর এবং জনসংখ্যার নিরিখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শহরগুলির মধ্যে রয়েছে পঞ্চম স্থানে। ১৭৯০ সাল থেকে প্রায় দশ বছর, ক্যাপিটাল সিটি ওয়াশিংটন ডিসি নির্মাণের সময়টুকু। ফিলাডেলফিয়াই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজধানী হিসেবে অভিবন্দিত হয়েছে।

ফিলাডেলফিয়ার অন্যতম আকর্ষণগুলির মধ্যে সিটি হলের উচ্চতা অনস্বীকার্য। ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সিটি হল আমেরিকার সর্বোচ্চ, সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ব্যয়বহুল সিটি হল। সিটি হল থেকে শুরু হয়ে বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন পার্কওয়ে’র নৈসর্গিক শোভামন্ডিত প্রশস্ত সড়কের শেষ ঠিকানায় অবস্থিত মিউজিয়াম অফ আর্ট– মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম আর্ট মিউজিয়ামগুলির মধ্যে অন্যতম। প্রায় ৩০০,০০০ এরও বেশি শিল্পের সম্ভার নিয়ে জেগে থাকা সুন্দর নিও ক্ল্যাসিকাল বিল্ডিংটি ফিলাডেলফিয়ার অন্যতম আকর্ষণ। ৫২০ চেস্টনাট স্ট্রিটে অবস্থিত ইনডিপেনডেন্স হল সেই ঐতিহ্যমণ্ডিত ঐতিহাসিক স্থান যেখানে ১৭৭৬ সালে ডিক্লেয়ারেশন অফ ইনডিপেনডেন্স এবং ১৭৮৭ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান-এর আনুষ্ঠানিক আলোচনা এবং পরিগ্রহণ সম্পূর্ণ হয়েছিল।

ইন্ডিপেনডেন্স হল-এর ঢিল ছোড়া দূরত্বে লিবার্টি বেল-এর গৌরবান্বিত অবস্থান। আমেরিকান স্বাধীনতার সমার্থক, স্বাতন্ত্র্যতার প্রতীক এই লিবার্টি বেলে’র সুগভীর ধবনিতে মুখরিত হয়ে উঠেছিল– ৮ জুলাই, ১৭৭৬– ডিক্লেয়ারেশন অফ ইন্ডিপেনডেন্স’র প্রথম প্রকাশ্য পাঠের আনুষ্ঠানিক দিনটি। ফিলাডেলফিয়ার থেকে নিউ ইয়র্কের দূরত্ব খুব বেশি নয়– বাসের দেড় ঘণ্টার ছোট্ট যাত্রাপথের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আনন্দের পরিতৃপ্তি আর আত্মতুষ্টির প্রসাদ অভিজ্ঞতার ঝুলিতে কুড়িয়ে নিতে নিতেই ফিরে আসা নিউ ইয়র্কের প্রাণচঞ্চলতায়। এবার ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে প্রত্যাবর্তনের হাতছানি।

প্রয়োজনীয় তথ্যঃ

কীভাবে যাবেন – কলকাতা, দিল্লি অথবা মুম্বই থেকে ফ্লাইটে নিউ ইয়র্কের জেএফকে এয়ারপোর্ট। এখন একাধিক ট্রাভেল সাইট থেকে বিমানভাড়া ও সময়সারণি পেয়ে যাবেন।

মাঝে ভিসার সমস্যাটাও মিটিয়ে রাখতে হবে। এয়ারপোর্ট থেকে ক্যাব নিয়ে নিউ ইয়র্কের পেন স্টেশন, কাছাকাছি প্রচুর হোটেল আছে– যেমন – হোটেল মেট্রো, দ্য নিউ ইয়র্কার হোটেল– একাধিক ট্রাভেল সাইট থেকে নেটেই বিভিন্ন হোটেল ও তাদের রেট দেখে বুক করে নিতে পারেন। স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’র টিকিটের জন্য অনলাইন বুকিং করে নিতে হবে www.statueoflibertytickets.com-এ। বেশিরভাগ দ্রষ্টব্য স্থান হাঁটা দূরত্বের মধ্যে পড়ে, সময় সুযোগমতো ক্যাবে’র ওপর নির্ভর করাও যায়, এছাড়া প্রতিটি মেগা শহরেই ‘হপ অন হপ অফ’ বাস টুরের ব্যবস্থাও আছে। নেটেই এ বিষয়ে আরও বিশদ জেনে নেওয়া যায়। নিউ ইয়র্ক থেকে নায়াগ্রার দূরত্ব মেটামুটি ৪০৮ মাইলের কাছাকাছি। পেন স্টেশন থেকেই অ্যামট্র্যাক-এর ট্রেন ছাড়ছে প্রতিদিন ৭.১৫, ১০.২০ ও দুপুর ১.২০। সপ্তাহখানেক আগে থেকেই এই ট্রেনের জন্য আগাম বুকিং করতে হয় সাইটে গিয়ে। নায়াগ্রা স্টেট পার্কের জন্য আগাম অনলাইন বুকিং করতে হয় www.niagrafallsstatepark.com। ফলসের কাছাকাছি হোটেল আছে প্রচুরঃ তার মধ্যে ‘কমফোর্ট ইন’ ডে’স ইন অ্যান্ড সুইটস’ এর নাম করা যেতে পারে। নায়াগ্রা থেকে ওয়াশিংটন ডিসি’র দূরত্ব প্রায় ৪০০ মাইল। ক্যাপিটাল হিলে’র কাছাকাছি প্রচুর হোটেল রয়েছে– যেমন হায়াত রিজেন্সি, হলিডে ইন। ইউএস ক্যাপিটাল টুরের জন্য আগাম অনলাইন বুকিং করে নিতে পারেন – www.visitthecapital.gov। ইউএস ক্যাপিটাল থেকে বাসে ফের নিউ ইয়র্ক অথবা ফিলাডেলফিয়ার একদিন সাইটসিয়িং সেরে নিউ ইয়র্ক প্রত্যাবর্তন। হোটেল ভাড়া ও বুকিং এর জন্য নেটেই বিশদ জেনে নিতে পারেন। বেশ কিছু ট্রাভেল এজেন্সি আছে যারা অনেক কম খরচে, কম সময়ে, কম ঝঞ্ঝাটে ভ্রমণের আনন্দটুকু তুলে দেবে আপনার হাতে – যেমন -Take tour,Get bus tour,L&Travel  ইত্যাদি। এদের ওপর নির্ভর করলে থাকা খাওয়া, ঘোরাঘুরি – সমস্ত নিয়ে ৫ দিনের মাথাপিছু খরচ (আসা-যাওয়ার বিমান ভাড়া ধরে নিয়েই) ১৮০০-২০০০ ডলারের মধ্যেই হয়ে যাবে।

কখন যাবেন – এপ্রিল থেকে অক্টোবর-নভেম্বর – আমেরিকার পূর্বোপকূল আবিষ্কার করার উপযুক্ত ও মনোরম সময়। তারপর প্রায় চার-পাঁচ মাস হাড়জমানো হিমেল হাওয়া আর রুপোলি বরফের রাজত্ব চলে এখানে।

——-

শান্তিক্ষেত্র পণ্ডিচেরি

চেন্নাই থেকে পণ্ডিচেরি যাওয়া সবচেয়ে সুবিধাজনক। এবং যাওয়াও যায় দুভাবে। এক এগমোর স্টেশন থেকে ভিল্লুপুরম গিয়ে ট্রেন বদলে পণ্ডিচেরি। অথবা চেন্নাইয়ে তিরুভাল্লুভার বাস টার্মিনাস থেকে সরাসরি বাসে পৌঁছোনো যায় পণ্ডিচেরি।

দক্ষিণ ভারত যাওয়ার পরিকল্পনা করা মাত্র, চেন্নাইয়ের জন্য রওনা দিলাম। এক সময়ে মাদ্রাস এখন চেন্নাই। বালুকাময় বিস্তীর্ণ বিচ মারিনার ওই প্রান্তে তখন আছড়ে পড়ছে ভারত মহাসাগর।সূর্যকিরণে তপ্ত বালুতট,শীতল হচ্ছে অবিরাম ঢেউয়ের স্পর্শে৷  দিগন্ত ছুঁয়েছে সাগর। মেরিনা বিচ-এ বেড়ানো ছাড়াও, একটা দিন চেন্নাইয়ের পথঘাট ঘুরে বেড়াতে মন্দ লাগে না।

পরদিনের বাসযাত্রার জন্য আগে ভাগেই টিকিট কেটে রেখেছি। গন্তব্য পণ্ডিচেরি। সকাল থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত চলে এই বাস সার্ভিস। দূরত্ব ১২৩ কিলোমিটার।

ইডলি আর সম্বর দিয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে, বসে পড়েছি বাসে। সামনের দিকেই সিট মিলেছে। শহরের কোলাহল ছাড়াতেই বিস্তীর্ণ ধানখেত আর নারকেলগাছে ঘেরা গ্রাম দেখতে দেখতে চলেছি। মাঝে মাঝে একটি করে জনপদ আসছে। মানুষজন বাজার করছেন। দক্ষিণী মেয়েরা মাথায় ফুল লাগিয়ে ঘুরছে পথেঘাটে। সেই বিশেষ ধরনের কমলারঙা ফুলও বিক্রি হচ্ছে রাস্তায়।

ঘন্টা চারেকের সফর শেষে নেমেছি পণ্ডিচেরি বাস টার্মিনাসে। এখান থেকে অটোতে পৌঁছোনো যায় পণ্ডিচেরি আশ্রম। কলকাতার শেকসপিয়র সরণির অরবিন্দ ভবন, মানে জুবিলি হাউস থেকে বুকিং করা ছিল পণ্ডিচেরি আশ্রমে থাকার জন্য। দুই শয্যার ঘর। সি সাইড গেস্ট হাউস-এ। তবে পণ্ডিচেরি সি বিচের ধারে আরও অসংখ্য হোটেল আছে। অনায়াসে জায়গা পেয়ে যাবেন। আর রেল স্টেশনের কাছে থাকতে চাইলে রয়েছে সরকারি ব্যবস্থায় গভর্নমেন্ট টুরিস্ট হোম।

অটো ভাড়া করে পণ্ডিচেরি ঘুরে ফেলা যায়। অথবা পণ্ডিচেরি টুরিজম-এর বাসে কন্ডাক্টেড টুরেও ঘোরা যায়। তবে এখানকার মূল আকর্ষণ অরবিন্দ আশ্রমটিই।

সি-বিচ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়বে শিশু উদ্যান, ওয়ার মেমোরিয়াল, গান্ধি স্কোয়ারের গান্ধিমূর্তি। আরও কিছুটা এগোলেই সমুদ্রের উপর লম্বা জেটি। বিচ-এ সানবাথ ও সমুদ্র স্নান দুই-ই চলে। এছাড়া আরও দেখার আছে রাজভবন, মিউজিয়াম, ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউট, আর্ট গ্যালারি, বোট্যানিকাল গার্ডেন, অ্যাকোয়ারিয়াম এবং উস্টেরি লেক।

শান্তির খোঁজে যারা আসেন পণ্ডিচেরি তাদের খালি হাতে ফেরায় না। শ্রীমার আশীর্বাদধন্য অরোভিল-এ রয়েছে মাতৃমন্দির। এর কাছাকাছি কিচেন এবং ডায়নিং হল। বাইরে থেকে আসা লোকেরা এখানে খেতে পারেন ডোনেশনের বিনিময়ে বহু মানুষ ধ্যনমগ্ন হয়ে বসে আছেন ভিতরের হলঘরে। এক আশ্চর্য নিরবতার পরিবেশ চতুর্দিকে। আশ্রমিকরা নানা কাজে ব্যস্ত কিন্তু সম্পূর্ণ কোলাহল-মুক্ত পরিবেশ।

পরের দিনটার গন্তব্য ছিল চিদাম্বরম। পণ্ডিচেরি থেকে এর দূরত্ব মাত্রই ৬৪ কিলোমিটার। বাস মিলবে পণ্ডিচেরি বাস টার্মিনাস থেকেই। চিদাম্বরমের খ্যাতি এর নটরাজ মন্দিরের জন্য। মন্দিরের ছাদ সোনায় মোড়া। গ্রানাইট পাথরের এই মন্দির তৈরি হয়েছিল চোল সাম্রাজ্যের শাসকদের হাতে।

Travel Chidambaram

যদিও এই মন্দিরের খ্যাতি নটরাজের অর্থাৎ শিবের জন্যই কিন্তু মূল মন্দিরের দেবতা নিরাকার। মন্দিরের চারটি গোপুরম তৈরি হয়েছে দক্ষিণ ভারতীয় স্থাপত্যশৈলী মেনেই। নটরাজ মন্দির সংলগ্ন গোবিন্দরাজ মন্দিরটিও ভারি সুন্দর। সাপের উপর শুয়ে আছেন বিষ্ণু এমনই একটি বিগ্রহ রয়েছে এখানে। সন্ধ্যায় আরতি হয়।

আমরা শহরের পথে অটো নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে দেখে নিলাম আন্নামালাই বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে গড়ে ওঠা ছিমছাম আন্নামালাইনগর। আর ১৮ কিমি দূরে পিছাভরম টুরিস্ট কমপ্লেক্স।

পরের দিনটি বিশ্রাম নেওয়ার পালা। তারপর রওনা দেব তিরুপতি দর্শনে।লম্বা সফরের মাঝে ২-৩টি দিন পণ্ডিচেরি ঘুরে যেতে মন্দ লাগবে না৷

কপিলাস

হাতে মাত্র দুটো দিন ছুটি। ছুটব যে বহুদূর সেটা সম্ভব নয়। তাহলে কোথায় যাই? এই ভাবনাতেই ভর করল কপিলাস। শুধু কপিলাস নয়, দেখে নেওয়া যেতে পারে আশপাশের দু’একটা অল্পচেনা গন্তব্যও। এই অফবিটের কথা শুনেছি অনেকের কাছে। কিন্তু তা সময়াভাবে যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এবার তারই বাস্তবায়ন। তবে এ পথে শুধু ধর্মীয় ভাবাবেগ নয়, আছে অনাবিল প্রকৃতির রূপও। তাছাড়া বেআক্বেলে পর্যটকদের হইহুল্লোড় এড়িয়ে নিজেদের মতো করে ঘোরা যাবে। আমরা চারজনের ছোট্ট টিম। টিকিট ছিল ফলকনামায়। নির্ধারিত সময়েই ছাড়ল গাড়ি। আর তারপরই আমাদের মনের কোণে খুশির পারদ চড়তে লাগল।

ওড়িশার পুরাতন রাজধানী কটকে নামলাম প্রাক-দুপুর নাগাদ। ফলে স্টেশনের ফুডপ্লাজায় অ্যাডভান্স লাঞ্চটা সেরে নিলাম। এবার গাড়ি খোঁজার পালা। কথা হল আমরা ধবলেশ্বর দেখে ঢেঙ্কানল যাব। কটক থেকে কিছুটা দূরে ধবলেশ্বর। পাঁচ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে ছুটছে গাড়ি। শহরের সীমানা ছাড়তেই ছলকানো সবুজ। রাস্তার দু’দিকের সবুজের ব্যাপ্তি চোখ বন্ধ করতে দিচ্ছে না এক মুহূর্তের জন্যও। পথচলতি ছোটো-বড়ো জনপদের দেখা মিলছে। চোখে পড়ছে ঢেঙ্কানলগামী যাত্রীবাহী দু’একটা বাস আর বাদুড়ঝোলা স্থানীয় রুটের ট্রেকার। মেইন রাস্তা ছেড়ে গাড়ি এবার ঢুকল বাঁহাতি শাখাপথে।

মাত্র ১১ কিমি পথ ভাঙতেই মঞ্চেশ্বর। এখানেই এই রাস্তার শেষ। গাড়ি থেকে নামতেই চোখে পড়ল বহমান মহানদী। ঘাটজুড়ে কালারফুল নৌকো সার-সার অপেক্ষমান। ওপারের দীপভূমিই ধবলেশ্বর। ধবলেশ্বর মন্দিরের ধবজাসহ শ্বেতশুভ্র চুড়ো– এপার থেকেও দৃষ্টিতে ধরা দিল। ওপারে পৌঁছোতে দুটো অপশন। নৌকায় চড়ে অথবা ব্রিজ ধরে হন্টন। আমরা ব্রিজ পথ ধরি। মহানদীর উপর হ্যাঙ্গিং ব্রিজটা দেখে হৃষিকেশের লক্ষ্মণ বা রামঝোলার স্মৃতিটা মনের স্ক্রিনে ভেসে উঠল।

শৈবতীর্থ ধবলেশ্বরের প্রতিষ্ঠাকাল আনুমানিক খ্রিস্টীয় দশম থেকে একাদশ শতকের মধ্যে। উৎকল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় এই মন্দির গড়ে ওঠে। স্থানীয় বিশ্বাসে জাগ্রত এই দেবতাকে দর্শন ও পূজার্চনা করতে সারা দিন ধরেই মানুষজনের যাতায়াত। তবে জানা গেল কার্তিক ও বৈশাখে ভক্ত সমাবেশ হয় সবচেয়ে বেশি। এইসময় মন্দিরকে কেন্দ্র করে বড়ো মেলাও বসে। সিঁড়ির মুখ জুড়ে দেখি পুজোর উপচারের বহু দোকান। জুতো খুলে মন্দিরে প্রবেশ করলাম। ওড়িশার নিজস্ব শৈলীতে গড়া ধবলেশ্বর মন্দির। এখানে পাণ্ডার দল থাকলেও, সেভাবে এদের দৌরাত্ম্য নেই। অনেকটাই মিল পাচ্ছি পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের পরিবেশের সঙ্গে। গর্ভগৃহ এখানে অনেকটা নীচুতে। ফাঁকা মন্দিরে পুজো দিতে কোনও অসুবিধা হল না। বাইরে বেরিয়ে দ্বীপটা একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। দ্বীপজুড়ে গাছগাছালির সবুজ বিন্যাস। এই দ্বীপে রাতবাসের জন্য রয়েছে ওটিডিসি’র পান্থনিবাস। আমাদের অনেকের ইচ্ছা ছিল নৌবিহারের। কিন্তু আমাদের হাতে অত সময় ছিল না। ফলে ঝোলাপুলে অঙ্গ দুলিয়ে পুনরায় মঞ্চেশ্বর ফেরা। বয়স্ক বিকালের আকাশে তখন রঙের খেলা শুরু হয়ে গেছে। তারই প্রতিবিম্ব মহানদীর জলে। অসাধারণ লাগছিল এই সিচুয়েশনটা। নদীপাড়ে চায়ের দোকানে বসে টি-ব্রেকের ফাঁকে উপভোগ করছিলাম এই প্রকৃতিরূপ। স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে আলাপচারিতাও বেশ জমে গিয়েছিল। কিন্তু অচেনা রাস্তার কথা ভেবে উঠতে বাধ্য হলাম।

পুনরায় জাতীয় সড়কে উঠতেই হাওয়ার বেগে ছুটতে থাকে গাড়ি। ঢেঙ্কানল পৌঁছোতে সন্ধ্যা হল। ঢেঙ্কানল শহরে অবশ্য হাতে গোনা কয়েকটা হোটেল। কিন্তু অফবিট বলে লোকজনের ভিড় সেভাবে থাকে না। ফলে হোটেল পেতে অসুবিধা হল না।

পরদিন চা-পর্ব মিটিয়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমেই কপিলাস মন্দির অভিমুখে। ঢেঙ্কানল ছাড়তেই ছলকানো সবুজে মন ছুঁয়ে গেল। পেলব সবুজকে সঙ্গে নিয়েই ছুটে চলে গাড়ি। কীছুটা দূরেই শৈবতীর্থ কপিলাস। ড্রাইভারের পরামর্শেই ব্রেকফাস্ট-টা সারা হল কাইটি নামক স্থানে। এখানে অক্ষয় দেউড়ির মিষ্টির দোকানে বিখ্যাত কাকড়া (গুড়পিঠের মতো একধরনের মিষ্টি) আর বড়াভাজার স্বাদ অসাধারণ। সঙ্গে ঘনদুধের স্পেশাল চা। বিগ-ব্রেকফাস্টের পরই গাড়ি ছুটল রুদ্ধশ্বাসে। পথে পড়ল দত্তাত্রেয় সাঁইবাবার শাখা আশ্রম। এই নিরিবিলি আশ্রমে ঢুকে সকলেরই মন ভরে গেল।

ওড়িশার কৈলাস নামে খ্যাত কপিলাস। সমতল ছেড়ে একটু পরেই গাড়ি উঠল পাকদণ্ডি পাহাড়ি পথে। এই পাহাড়শীর্ষেই আছে কপিলাস মন্দির। গোটা পাহাড়টা ঢেকে আছে শাল, সেগুন, আমলকী, আকাশমণি, কেন্দু, মহুয়া, পলাশের জঙ্গলে। যত উপরে উঠছি, দূর-প্রকৃতি তত মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠছে। গাড়ি পার্কিং করে, ছায়া সুনিবিড় পথ ধরে এগিয়ে চলি। সামনেই মন্দির ফটক। ম্যাক্সিমাম তীর্থযাত্রীরা অবশ্য খাড়াই সিঁড়ি ভেঙে ওঠে। সবুজ বনানীর মাঝে দেখি শ্বেতশুভ্র একাধিক ছোটো-বড়ো মন্দির। এর মধ্যে সুউচ্চ ওড়িশি শৈলীর মন্দিরটাই মেইন মন্দির।

পাহাড়ের গায়ে একাধিক মন্দিরের মধ্যে রয়েছে চন্দ্রশেখর, বিশ্বনাথ, গণেশ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। লোকবিশ্বাস, মহাভারতের যুগে পঞ্চপাণ্ডবরা নাকি এখানে এসেছিলেন। গর্ভগৃহে লিঙ্গরাজকে দেখতে কয়েকটা পিচ্ছিল ধাপ সিঁড়ি ভাঙতে হল। বাইরে দেখি ভোগের প্রসাদ বিক্রি হচ্ছে। ভক্তরা কিনছেও লাইন দিয়ে। তবে এই মন্দিরে পাণ্ডার তুলনায় হনুমানবাহিনীর দৌরাত্ম্য সবচেয়ে বেশি। অন্যান্য শৈবতীর্থের মতো এখানেও শ্রাবণে ভক্তরা বাবার মাথায় জল ঢালে। আর শিবরাত্রিতে পাহাড়গুলি জুড়ে বসে মেলা। গাড়ি নিয়ে এবার চলে এলাম পাহাড়তলির পাদদেশে। এখানে রাস্তার ধারেই রয়েছে কপিলাস চিড়িয়াখানা ও সায়েন্সপার্ক। চিড়িয়াখানাটা বেশ বড়ো। সম্বর, বাইসন, ভালুক, বাজ, ময়ূর, হাতি, বদরির উপস্থিতি মন ভরিয়ে দিল। আছে ঘড়িয়াল প্রজনন কেন্দ্র। তবে চিতল হরিণের আধিক্য চোখে পড়ার মতো। পাশেই বিজ্ঞানের শিক্ষামূলক যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজানো সায়েন্স পার্কটাও মন ভরিয়ে দিল।

গাড়ি এবার ছুটল জোরান্ডায়। এখানে আছে মহিমাশ্রম। অনেকে একে কৌপিনধারী সাধুদের আশ্রম বলেও উল্লেখ করে। গাড়ি থেকে নেমে সামনেই দেখলাম বিশাল তোরণদ্বার। খুবই জেল্লাদার সে তোরণ পেরিয়ে এগিয়ে যাই। সামনে গাছপালার মাঝে পায়ে চলা ফালি পথ। এখানে-ওখানে লম্বা বারান্দাওয়ালা স্কুলবাড়ির মতো কয়েকটা বিল্ডিং। কৌপিনধারী সাধুরা সব গাছপালা পরিচর্চায় ব্যস্ত। চলছে অনেকটা জমিজুড়ে চাষবাসের কাজও। ফুল-ফলের গাছও চোখে পড়ার মতো। আরও এক তোরণদ্বার পেরিয়ে মূল মন্দিরে প্রবেশ করলাম। যে মন্দির দেখি বিগ্রহহীণ, শূণ্য। পর-পর দেখে নিলাম মহিমাস্বামীর সমাধি, ধুনিমন্দির এবং গদি মন্দির ইত্যাদি। এখানকার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ অসাধারণ। মন্দির চত্বরে ময়ূরের অবাধ বিচরণ। এই ধর্ম সম্বন্ধে বিশদ জানতে তোরণদ্বারের কাছে বুকস্টল থেকে একটা পুস্তকও কিনলাম। তবে বল্কলধারী মহান্তদের সাক্ষাৎ পেতে মূল আখড়ায় প্রবেশ করতে হবে। বলে-কয়ে সাক্ষাৎও হল। জানলাম অনেক কথাই। শুনলাম এখানে প্রতি বছর মহিমাস্বামীর আবির্ভাব তিথিকে স্মরণ করে ফেব্রুয়ারি মাসে বিরাট উৎসব চলে।

এবার গাড়ি নিয়ে ঢেঙ্কানলের হোটেলে ফিরে এলাম। স্নানপর্বের পর মধ্যাহ্নভোজন সারা হল। তারপর চেক আউট করে, ব্যাগপত্তর ডিকিতে তোলা হল। আজই আমরা কটকে ফিরব, তবে সপ্তশয্যা দেখে। ঢেঙ্কানলের দক্ষিণ-পূর্বে রর কিমি দূরে সপ্তশয্যা। জঙ্গল মাঝে গাড়ি যেখানে পার্কিং করল, তারপরও র কিমি মতো চড়াইপথ। সে বনপথ জুড়ে পাখির গান, হনুমানদের এগাছ-ওগাছ, রংবেরঙের প্রজাপতি, বিচিত্র ধরনের মাকড়সার সমাবেশ।

রোমাঞ্চকর অনুভূতিপূর্ণ জঙ্গল ট্রেকিং লাগল অসাধারণ। শেষে সিঁড়িপথও ভাঙতে হল বেশ খানিকটা। পথ শেষে পৌঁছোলাম এক সাদামাটা মন্দিরে। পাহাড়শীর্ষে এই রামসীতার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, ঢেঙ্কানলের রানি রত্নপ্রভা। এই পাহাড়েই সাতজন ঋষি সাতটি গুহায় বসে তপস্যা করেছিলেন বলে শোনা যায়। কিন্তু জঙ্গল গহিনে ঝরনাও ছিল নাকি, খোঁজাখুঁজি করতে হবে। তবে আদৌ এসব এখন পাওয়া যাবে কিনা বলা শক্ত। তাছাড়া এত সময়ও নেই আমাদের হাতে। তবে পৌরাণিক পটভূমির প্লেসটা কিন্তু লাগল অসাধারণ। সপ্তর্ষির স্মরণে মূর্তিও বানানো হয়েছে এখানে। জনশ্রুতি এই যে শ্রীরামচন্দ্র, সীতা ও লক্ষ্মণসহ সাতদিন এখানে কাটিয়েছিলেন। পুরোহিত জানাল, এখানে রামনবমীতে বেশ বড়োসড়ো উৎসব হয়। তবে ইচ্ছা থাকলেও বেশিক্ষণ থাকা গেল না। কারণ আবার র কিমি জংলি উৎরাই পথ নামতে হবে। ফিরে গাড়িতে উঠতেই ছুটতে শুরু করল গাড়ি। মনে মনে ভাবছি সাতকোশিয়ার গর্জ বা লবঙ্গীর জঙ্গল এ যাত্রায় আর হল না। আবার প্রতীক্ষায় থাকতে হবে অন্য কোনও লম্বা ছুটির জন্য।

কীভাবে যাবেনঃ

হাওড়া থেকে দক্ষিণ-পূর্ব রেলপথে পুরী, চেন্নাই, হায়দ্রাবাদ বা বেঙ্গালুরুগামী যে-কোনও ট্রেনে কটক নামুন। কটক রেল স্টেশন থেকে অটো বা রিকশায় চ্ কিমি দূরে বাদামবাড়ি বাসস্ট্যান্ড। বাস বা ট্রেকারে মঞ্চেশ্বরে নেমে ধবলেশ্বর দেখুন। আবার ঢেঙ্কানলগামী বাস ধরে ঢেঙ্কানল আসতে হবে। এসব ঝামেলা এড়াতে সবচেয়ে ভালো হয় একটা গাড়ি ভাড়া করে নেওয়া। পরদিনও গাড়ি ভাড়া করেই সমস্ত স্থানগুলি দেখে নিতে হবে।

কোথায় থাকবেনঃ

ধবলেশ্বরে একমাত্র থাকার জায়গা সরকারি পান্থশালা।  ঢেঙ্কানলেও রয়েছে সরকারি পান্থনিবাস। ইচ্ছা হলে কপিলাসেও থাকতে পারেন। আছে ওড়িশা পর্যটন দফতরের পান্থশালা ও মন্দির কমিটির অতিথিশালা।

কখন যাবেনঃ

অক্টোবর থেকে মার্চ উপযুক্ত সময়।

মনে রাখবেনঃ

ঢেঙ্কানল ম্যালেরিয়া উপদ্রুত এলাকা। অতএব মশা প্রতিরোধক সমস্ত ব্যবস্থা নিতেই হবে। অফবিট-এর ফলে পরিবহণ ও খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা খুব একটা ভালো পাবেন না। তাই সঙ্গে গাড়ি আর ঝোলায় শুকনো খাবার রাখলেই ভালো।

হর কি দুন

সকাল সাড়ে সাতটায় চড়ে বসলাম জিপ-এ। যেতে হবে তালুকা। সেখান থেকেই ট্রেক-এর শুরু। তালুকার পর ৫-৬ কিমি গাছের ছায়ায় ছায়ায় পথ গিয়েছে সুপিন নদীর সঙ্গে মিতালি পাতাতে পাতাতে। গোবিন্দ পশুবিহার জাতীয় উদ্যানের বুক চিরে পথ। পাইন, চিনার, ওক, অচেনা গাছ-গাছালি, মস, ফার্ন আর রংবেরঙের পাখি ও প্রজাপতির মেলা। দমছুট হয়ে যাওয়ার আগেই একটি টি-ব্রেক। তারপর আবার পথচলা।

প্রথম দিনের গন্তব্য তালুকা থেকে ওসলা। সুপিন নদীকে সঙ্গী করে নদীর খাত বরাবর যে-পথ শুরু হয়েছিল তা ক্রমশ খাড়াই হতে থাকে। কখনও পথ কাটে ছোটো ছোটো ঝরনার ধারা, কখনও পাথর টপকে চড়াই ভাঙ্গা। ১০ কিমি হাঁটার পর যখন বেশ ক্লান্ত, গাইড জানায় লাঞ্চ-ব্রেক নেওয়ার সময় হয়েছে। প্রায় জনপ্রাণীহীন জঙ্গলের পথের বাঁকে হঠাৎই উঁকি মারে একটা ছোট্ট চালাঘর। চা, নুডল্স, ওমলেট নিয়ে শতত ব্যস্ত হয়ে ওঠে দোকানদার।

লাঞ্চ সেরে আবার হাঁটা। হঠাৎই কয়েকঘর বসতির আভাস পেয়ে মন চঞ্চল হয়ে ওঠে– ওই বুঝি আমাদের বহু আকাঙ্খিত ওসলা। কিন্তু হতাশ হতে হয় জেনে যে ওটা ওসলা নয়, অন্য একটি ছোট্ট গ্রাম, নাম গাংগার। প্রকৃতির ক্যানভাসে তখন হঠাৎই দৃশ্য বদল। পথের ক্লান্তি দূর করে বন্দরপুঁছ পাহাড় শ্রেণির অফুরান সৌন্দর্য।

চারটে বাজতে না বাজতেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি। সঙ্গে চটপটিয়ে শিল। রেইনকোট চড়িয়ে কোনওক্রমে এগোতে থাকি। গালে সুচের মতো এসে বিঁধতে থাকে বরফকুচি। এভাবেই একসময় দেখা মেলে ওসলার। বেশ খানিকটা চড়াই ভেঙে পাথুরে পথ পেরিয়ে পৌঁছোনো গেল ওসলার রাত্রিবাসের গন্তব্যে।

সাকুল্যে ত্রিশ ঘর মানুষের বাস ওসলায়। তারই মধ্যে একটি বাড়িতে ব্যবস্থা হয়েছে আমাদের হোম স্টে-র। উষ্ণ কম্বলের আলিঙ্গনে, কাঠের বাড়িতে রাত্রিবাস যে কত আরামপ্রদ হতে পারে– তা এই ওসলায় না এলে জানা যেত না। আশপাশে সবই কাঠের বাড়ি। একটু বর্ধিষ্ণু পরিবারের বাড়িতে সুন্দর নকশা তোলা কাঠের উপর। একটি মন্দির রয়েছে যা দুর্যোধনের মন্দির বলে উল্লিখিত হলেও, বর্তমানে সেখানে সোমেশ্বর মহাদেব পূজিত হন। সভ্যতার যতই অগ্রগতি হোক, ওসলায় এলে মনে হয় সময় যেন থমকে দাঁড়িয়েই আছে– এতটাই বাহুল্যবর্জিত এই গ্রাম।

পরদিন যাত্রা শুরু হর কি দুনের উদ্দেশে। এই পথে গাছপালা তেমন নেই। রুক্ষ পাথুরে প্রান্তর আর সরু পথের বেশিটাই চড়াই। গুজ্জররা ভেড়ার পাল নিয়ে চরাতে এসেছে এদিক ওদিক। পথ আটকায় স্থানীয় ছেলেমেয়েরা, চকোলেটের আশায়। দুপুর পেরোতেই হঠাৎ শিলাবৃষ্টি শুরু হল। হাঁটতে হাঁটতে বুকে চাপ ধরে। তারপর একটা গ্লেসিয়ার পেরিয়ে হঠাৎ-ই খানিকটা সমতল বুগিয়াল। সামনেই চোখ ঝলসে দেওয়া রূপ নিয়ে ধরা দেয় স্বর্গারোহিণী এবং হর কি দুন। পাশাপাশি দুই শৃঙ্গ পাশ দিয়ে প্রবাহিত জৌনধার গ্লেসিয়ার। পাহাড়ের পাদদেশে বরফের গালিচা। প্রচন্ড হাওয়ায় যেন পাঁজরে ধাক্বা লাগে। জিএমভিএন-এর একটি কুটির ও বন দফতরের একটি কুটির ছাড়া থাকার অন্য কোনও ব্যবস্থা নেই হর কি দুন-এ। হর কি দুন-এর সৌন্দর্য পথের ক্লান্তি নিমেষে ভুলিয়ে দেয়। কিন্তু এখনই টেন্ট পিচ করা দরকার। আকাশে আবার কালো মেঘের আঁকিবুকি। বৃষ্টি নামল বলে।

সূরযকুণ্ড মেলা

সূরযকুণ্ডের পোশাকি ঠিকানা ফরিদাবাদ, হরিয়ানা হলেও, এটির অবস্থান বস্তুত ইন্ডিয়া গেট থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে। সত্তর টাকার টিকিট কেটে ঢুকে পড়লে এক রঙিন দুনিয়া যেন চট করে ধরা দেবে আপনার হাতের মুঠোয়। গেট-এর পাশেই মহেশ মূর্তি– এলিফ্যান্টা কেভ-এর আসল মূর্তিটির রেপ্লিকা। মেলা সাজাতে কোথাও রংবিরঙ্গী কৃত্রিম ফুল, কোথাও টেরাকোটা, ডোকরা বা প্লাস্টার অফ প্যারিস ব্যবহার হয়েছে। কোথাও আবার ডালিয়া আর গাঁদাফুলের বাহারি বৈচিত্র্য। ভারতের নানা রাজ্য স্টল সাজিয়েছে নিজেদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ শিল্পসম্ভারে। পাল্লা দিয়ে সেজেছে আন্তর্জাতিক স্টলগুলিও।

লকডাউনের আগের বছর উপভোগ করেছি এই মেলা। ওই বছর প্রতিবেশী দেশ হিসাবে ছিল শ্রীলংকার স্টল। তারা এনেছিল হ্যান্ডিক্রাফট্-এর চোখধাঁধানো উপচার, বিশেষ প্রজাতির নুআরা এলাইয়া চা আর সুরেলা সংগীতের সম্ভার। স্টলে আরও আছে অবাক হওয়ার উপকরণ। গোল্ড ডাস্ট দিয়ে বোনা ভেলভেটের শিল্পকর্মে উদ্ভাসিত ক্যান্ডির প্রাচীন মন্দির। আছে কাঠের মুখোশ ও পাথরের তৈরি নানা শিল্পকর্ম। মেলায় হাঁটতে হাঁটতে একদল যন্ত্রসংগীত শিল্পীর সঙ্গে দেখা। গলায় ঝোলানো অ্যাকর্ডিয়ান, গিটার, ড্রাম। তাদের ঘিরে ছোটোখাটো ভিড়। শব্দগুলো ভালো বুঝতে না পারলেও মুগ্ধ হয়ে শুনলাম শ্রীলংকার ওই শিল্পীদের সংগীত।

 

চোখে পড়ল ভুটানের স্টলটা। এঁরা গতবারও এসেছিলেন অপূর্ব থাংকা-র কালেকশন নিয়ে। পাকিস্তান বা নেপালের সদস্যরা অংশগ্রহণ করেননি এ মেলায়, কিন্তু উগান্ডার স্টলে বেশ ভিড়। ভাঙা ইংরেজিতে উগান্ডার মহিলা বিক্রেতারা গল্প জুড়লেন আমার সঙ্গে, দেখালেন তাদের হস্তশিল্প, গয়না, টোটেম প্রভৃতি।

হঠাৎই একটি পরিচিত হাসি দেখতে পেলাম অন্যপাশের স্টলে। কাবুলের সেই কার্পেট বিক্রেতা। বছর বছর আসেন এই মেলায় অংশ নিতে। বিক্রিবাটাও হয় ভালো। বোখারা কার্পেট-এর সম্ভারে এবারও তিনি সেরা।

বলাই হয়নি, সূরযকুণ্ডের ওপেন থিয়েটারে বহু দেশ-বিদেশের লোকশিল্পীরা অনুষ্ঠান করেন।  ওই বছরের থিম স্টেট ছিল গোয়া। তাই স্টেজ সাজানোয় ছিল সূর্য, ওয়াটার সার্ফিং, নারকেল বীথি ও ঝিনুকের ডেকর। সেই বছর হরিয়ানা তাদের গ্রামের একখণ্ড রেপ্লিকা তুলে ধরেছিল মাটির পুতুল সাজিয়ে। গাই-বাছুর-হুঁকো হাতে বৃদ্ধ– সব মিলিয়ে বেশ বিশ্বাসযোগ্য দৃশ্যায়ন। এই রেপ্লিকা কুঁড়েঘরগুলোই স্টেজ আর্টিস্টদের সাজঘর। দলে দলে শিল্পীরা আসছেন আর দিনভর তাদের নৃত্যকলা প্রদর্শন করে যাচ্ছেন মঞ্চে।

আলাপ জমালাম কয়েকজন সিড্ডি উপজাতির শিল্পীর সঙ্গে। জানা গেল এরা নাকি আফ্রিকার বান্টু জনজাতির বংশধর। একসময় গুজরাতে এদের আগমন হয়েছিল পর্তুগিজদের দাস হিসাবে। তারপর গুজরাতেই পাকাপাকি বাস। ‘ধমাল’ নৃত্য, ময়ূরের পালক লাগানো পোশাক, ফেস পেইন্টিং– সব মিলিয়ে এক বর্ণাঢ্যতা দিয়েছে এই শিল্পীদের।

যেন মেলায় রোশনাই ছড়াতে এসেছিল একদল উজবেক সুন্দরী। তাদের নৃত্য যেন চোখ ফেরাতে দেয় না। যাকে বলে ‘ফোটোগ্রাফারস্ ডিলাইট’– এই সুন্দরীরা যেন তাই-ই। আমাদের ব্রজভূমির ‘ময়ূর নৃত্য’-ও বেশ মন কাড়ল।

সূরযকুণ্ডের মেলা বস্তুত একটি পুষ্করিণী ঘিরে হয়। প্রাচীন কালে এখানে একটি সূর্যমন্দির ছিল। তারই নামানুসারে এটি সূরযকুণ্ডের মেলা বলে পরিচিত। সাদামাটা মধ্যবিত্তদের মেলা হিসাবেই এটি জনপ্রিয় এবং যাকে বলে ‘আপ-মার্কেট’ তেমন খরিদ্দার এখানে বড়ো একটা আসেন না। পরিবার নিয়ে এ এক ছাপোষা আউটিং। যেদিকে তাকাবেন সেদিকেই অপরূপ সব শিল্পকর্ম। রাজস্থানি পুতুল, পটচিত্র, ডোকরার কারুকৃতি কিংবা অন্ধ্রের চামড়ার খেলনা। ছিল নানা ধরনের খাবারের দোকান। খেয়ে, গান-বাজনা শুনে, কেনাকাটা করে কাটিয়ে দিন সারা দিনটা। তবু সূরযকুন্ডের মেলার আকর্ষণ কিছুতেই যেন ফুরোবার নয়।

রেশমপথের রেশমিগ্রাম জুলুক

রাত ৯-৪০ মিনিটে কলকাতা-ডিব্রুগড় ট্রেনে উঠে পড়লাম লাগেজপত্তর নিয়ে। আমাদের এবারের ডেস্টিনেশন পূর্ব সিকিমের ‘সিল্করুট’ বা রেশমপথ। ট্রেন নৈহাটি ছাড়তেই আলুপরোটা আর টম্যাটো-সস সহ ডিনার সেরে যে যার নির্দিষ্ট সিটে। পরদিন নিউজলপাইগুড়ি-তে পৌঁছোতে প্রায় ২ঘন্টা  লেট। ততক্ষণে আমাদের নিতে হাজির ড্রাইভার ধীরাজ তামাং। আর দেরি না করে লাগেজ গুছিয়ে চলা শুরু। সিল্করুটের পথে জুলুকে যাওয়ার আগে আমরা একদিন থাকব পেডং শহরের মাথায়, পাহাড়ের কোলে সবুজে ছাওয়া নতুনভাবে গড়ে ওঠা অফবিট স্পট সিলারি গাঁওতে।

মহানন্দা স্যাংচুয়ারির মাঝখান দিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে চলল গাড়ি। করোনেশন ব্রিজ, সেবক ব্রিজকে পাশ কাটিয়ে দাঁড়ালাম একটি রেস্তোরাঁয় ব্রেকফাস্ট করতে। বেশ সাজানো গোছানো খাবার হোটেল। সবধরনের খাবার পরিবেশন করা হয় এখানে।

ব্রেকফাস্ট করে গাড়ি চলল তিস্তা বাজারের দিকে। হঠাৎ-ই রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা তিস্তা নদী সঙ্গী হল আমাদের। কালিম্পং হয়ে আলগাড়া থেকে পেডং-এর দিকে যেতে যেতে দেখা পেলাম ধাপচাষের নক্সা আঁকা পাহাড় আর ছোটো ছোটো জনবসতির। পেডং বাজারের কিছুটা আগে গাড়ি বাঁক নিল  বাঁদিকের রাস্তায়। রাস্তাটি পাহাড়ের গা বেয়ে সোজা চলেছে সিলারি গাঁওতে। মাত্র চার কিলোমিটার পথ। এখানে এসে মনে হল আমরা যেন প্রকৃতির নিজস্ব এয়ার কন্ডিশনিং ব্যবস্থায় প্রবেশ করলাম। প্রত্যেকে গায়ে চাপালাম হালকা শীতবস্ত্র। এই চার কিমি পাথর বিছানো পথে পাহাড়ের গা বেয়ে জঙ্গলের ছায়াঘন পরিবেশে দুলতে দুলতে এগিয়ে চলেছি ক্রমশ উপরের দিকে। থামলাম সাইলেন্ট ভ্যালি দেখতে।

জায়গাটি একেবারে নিশ্চুপ, শান্ত প্রকৃতির। বিশাল বিশাল পাইনগাছগুলো একটি জায়গায় গায়ে গা লাগিয়ে দাঁড়িয়ে। ড্রাইভার বলল– এটাই সাইলেন্ট ভ্যালি, অপূর্ব লাগে দেখতে। অবশেষে প্রায় ৬০০০ ফুট উচ্চতায় উঠে পৌঁছোলাম সিলারি গাঁওতে। আজ আমরা এখানেই নাইট স্টে করব।

হিমালয়ের কোলে সবুজ অরণ্যে ঘেরা নীল আকাশের নীচে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙঘা প্রায় সব সিজনে হাতছানি দেয় এই সিলারি গাঁও থেকে। অসাধারণ ছবির মতো সুন্দর এই গ্রাম রোমান্টিকতায় ভরা। মাত্র ২৫-৩০ ঘর বসতির নিরিবিলি এই গ্রামে দিনভর শোনা যায় হাজারো প্রজাতির পাখির কিচিরমিচির। পাখির অপূর্ব এই কলকাকলি পর্যটকদের মন ভরিয়ে দেবে। সিলারি গাঁও-তে আমাদের থাকার জায়গা হেভেন ভ্যালিতে। এখানে থাকার ব্যবস্থা খুব সুন্দর। সবই হোম স্টে। লাঞ্চ সেরে পায়ে হেঁটে একটু ঘুরে নেওয়া। পাহাড়ের গায়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে সরু ভাঙাচোরা ট্রেকিং পথে ক্রমশ উপরে উঠতে হয়। প্রায় মিনিট ৩০ হেঁটে পৌঁছে গেলাম রামিতেদাড়া ভিউ পয়েন্টে। পাহাড়ি সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে চারপাশের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করতে থাকলাম আমরা। শুধু এই ভিউ পয়েন্ট থেকেই তিস্তা নদী আর কাঞ্চনজঙঘাকে একই ফ্রেমে ধরা যায়। এখানকার সূর্যাস্ত এককথায় অসাধারণ।

সন্ধ্যা হতেই শীতের হাওয়ার দাপট বেড়ে গেল। এই মে মাসের শেষে জ্যাকেট, টুপি, মাফলার গায়ে দিতে হচ্ছে– ভাবতেই রোমাঞ্চ লাগছে। আঁধার যেন সিলারির বুকে ঝপ্ করে নেমে এল। তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে এলাম সকলে। গরম গরম-পকোড়া সহ কফি খেতে খেতে শুরু হল আড্ডা। রাত সাড়ে আটটায় রুটি, সবজি, চিকেনকারি দিয়ে জমিয়ে ডিনার সারলাম সকলে। কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে সোজা খাটে জোড়া কম্বলের তলায়। পরদিন সকালেই আমরা রওনা দেব জুলুকের উদ্দেশ্যে।

চা-খেয়ে স্নান সেরে সকলে প্রস্তুত। জুলুক থেকে আমাদেরকে নিতে গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে ড্রাইভার কাম গাইড কর্মা শেরপা। আরও তিনদিন ও আমাদের সঙ্গে থাকবে আর ঘোরাবে। পেশায় কর্মরত মিলিটারি ড্রাইভার। নিজের ছুটিতে এইভাবে গাড়ি ভাড়া খাটায় আর নিজে ড্রাইভিং এবং গাইডের কাজ করে থাকে। সকাল সকাল ব্রেকফাস্ট সেরে রওনা হলাম জুলুকের উদ্দেশে। ফিরতি পথে ওই ড্যান্সিং রোড ধরে এগিয়ে গেলাম। পেডং থেকে সোজা রাস্তায় পেট্রোল পাম্প থেকে গাড়িতে তেল ফুলট্যাঙ্ক করে নিয়ে কিছুদূর গিয়ে দাঁড়াতে হল ঋষিখোলার চেকপোস্টে।

ঋষিখোলার (খোলা মানে নদী) ওপর বিশাল ব্রিজ। নীচে বয়ে চলেছে সরু ঋষি নদীর জলধারা। বর্ষার সময় এই নদীর রূপই বদলে যায়। এখানে চেকপোস্টে আইডি কার্ডের জেরক্স কপি জমা করে প্রবেশ করলাম সিকিমে। ঋষিখোলা থেকে প্রকৃতি যেন আরও ঘন সবুজে জমাট হতে লাগল। পথ চলতে চলতে মাঝেমধ্যেই থামতে হচ্ছিল পাহাড়ি প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় রূপ ক্যামেরাবন্দী করতে। পাহাড়ের গায়ে পাইন, ফার, ওক, বার্চ, ম্যাপেল, শিমুল, সহ এক প্রজাতির অপূর্ব দেখতে বাঁশগাছের ঘন বনে ঢাকা ছায়াপথ ধরে চলতে চলতে পেছনে সরে যাচ্ছে ছোটো ছোটো জনপদ।

এপথে ১৯ কিলোমিটার চলা শেষে পৌঁছোলাম রংলীতে। বেশ ছিমছাম, সুন্দর সাজানো, ছোট্ট শহর। দোকান, বাজার, হোটেল, রেস্তোরাঁ সবকিছু একসঙ্গে জুড়ে আছে এখানে। আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট সবরকমের জিনিস মিলবে। গাড়ি এসে দাঁড়াল স্ট্যান্ডে। পারমিট করাতে হবে এখান থেকে। এক কপি পাসপোর্ট ছবি আর আইডি কার্ডের কপি দিয়ে ফর্ম ফিল-আপ করে জমা করতে হয় ইমিগ্রেশন অফিসে। তবে জমা দিয়ে পারমিট করিয়ে আনে গাড়ির ড্রাইভার নিজে। অফিস খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে ৩-৩০পর্যন্ত। এই ক্ষণিকের বিরতিতে হালকা স্ন্যাক্স, কোল্ডড্রিংক্স খেলাম সকলে। এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, সিল্করুট যাত্রায় রংলীর পর আর কোনও বড়ো জনপদ মিলবে না। তাই প্রয়োজনীয় যা কিছু দরকার, এখান থেকেই কিনতে হবে।

বেলা প্রায় একটার সময় ড্রাইভার শেরপা পারমিট করিয়ে নিয়ে আনল। শুরু করলাম যাত্রা। ঘন ছায়াপথে বাঁক খেতে খেতে গাড়ি চলল পাহাড়ি চড়াই-এর দিকে। দূরে পাহাড়ের সবুজ প্রকৃতির মাঝে চোখে পড়ল ধাপচাষের জ্যামিতিক নক্সা আর রংবেরঙের বাহারি ফুল। ১০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে এসে দাঁড়ালাম লিংথাম চেকপোস্টে। জুলুকে প্রবেশের জন্য অনুমতি মিলবে এখানে পারমিট পরীক্ষা করার পর। কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের অনুমতি দেওয়া হল জুলুকে যাওয়ার। চলতে চলতে হঠাৎ রাস্তার পাশে দেখতে পেলাম একটা বেশ লম্বা আকৃতির ঝরনাকে। নাম ‘কিউখোলা ফল্স’।

উঁচু উঁচু পাথরের মধ্যে দিয়ে দুধসাদা জলধারা দুরন্ত গতিতে পড়ছে নীচে। সবুজের বুক চিরে সাদা জলধারার নেমে আসা দেখে সকলে নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। সটান দলবল-সহ চলে গেলাম ঝরনার কাছে। এই অপূর্ব সুন্দর ঝরনাধারার সামনে নিজেকে ধরে রাখতে একে একে ফোটোশেসন চলল বেশ কিছুক্ষণ ধরে। আমাদের দলের শিশুসদস্য ছোট্ট ঋষি, জলধারা দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে সোজা চলে এসেছে পাথরের মধ্যে দিয়ে বয়ে আসা জলের ধারে। আপনমনে ছোটো ছোটো নুড়ি কুড়িয়ে ছুড়ে ফেলতে লাগল ঝরনায়। হঠাৎ-ই সম্বিত ফিরল ড্রাইভারের ডাকে– ‘দুপুর গড়িয়ে এল তাড়াতাড়ি চলুন!’

আর একমুহূর্ত দেরি না করে উঠে পড়লাম গাড়িতে। দেখতে দেখতে পৌঁছোলাম এক শান্ত, নির্জন ছোট্ট জনপদ পদমচেন-এ। হিমালয়ের পাদদেশে ৭০০০ ফুট উচ্চতায় ঘন জঙ্গল ঘেরা নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার এই জায়গাকে লোয়ার জুলুকও বলা হয়। শহরটা মিলিটারিদের নিয়ন্ত্রণাধীন। ছোটো ছোটো দোকান, মিলিটারি হাসপাতাল, হোটেলও রয়েছে। পর্যটকরা ইচ্ছা করলে এখানেও রাত্রিবাস করতে পারেন। এখান থেকে আরও ৮ কিলোমিটার চড়াই পথ গেলে জুলুক। পথ চলতে চলতে কিছুক্ষণের মধ্যে চারপাশের পরিবেশে পরিবর্তন ঘটল। ঘন কুয়াশার মতো সারি সারি মেঘে ঢেকে যেতে লাগল। হিমেল হাওয়া আমাদের গাড়ির জানলা দিয়ে ঢুকে শরীর ছুঁয়ে গেল বেশ কয়েকবার। প্রত্যেকে গায়ে জড়িয়ে নিলাম মোটা শীতবস্ত্র। দূরের পাহাড়ের গায়ে ক্রমশ ভিড় জমাতে লাগল সাদা-কালো মেঘেদের দল। ড্রাইভার কর্মা গাড়ির স্টিয়ারিং ধীরে ধীরে একবার এদিক একবার ওদিক করতে লাগল অতিসন্তর্পণে।

জুলুকে প্রবেশ করতে করতে সমগ্র জুলুকের আকাশ, পাহাড় ঘিরে ধরল মেঘবালিকারা। এ যেন মেঘমুলুকের দেশে এসে পড়লাম। গাড়ি এসে দাঁড়াল জুলুকের একমাত্র থাকার জায়গা দিলমায়া রিট্রিটের দোরগোড়ায়। ঘড়িতে তখন বেলা ৩-৪০ মিনিট। এখানে থাকার ও খাওয়ার সমস্ত বন্দোবস্ত করে ছিলেন এই হোমস্টের মালিক গোপাল প্রধান। হাসিমুখে স্বাগত জানালো আমাদের। তার আপ্যায়ন ও আতিথেয়তা দেখে মুগ্ধ হতে হয়।

জুলুক সম্পর্কে একটা ছোট্ট তথ্য জানিয়ে রাখি প্রথমেই। ৯৫০০ ফুট উচ্চতায় হিমালয়ের সবুজ পর্বতশ্রেণির কোল ঘেঁষে সম্প্রতি গড়ে উঠেছে পূর্ব সিকিমের সিল্করুটের প্রবেশদ্বার এই জুলুক। মাত্র ১৫০ ঘর নেপালির বসতি। জনসংখ্যা ৬০০ জনের মতো। একদিকে কাঞ্চনজঙঘার সাদা বরফ ঢাকা পর্বতচূড়া-সহ হিমালয়ের বিভিন্ন পর্বতশিখর বিরাজ করছে, আর অন্যদিকে সবুজের মিছিলে হারিয়ে যাওয়া ছোটো ছোটো টিন ও কাঠের তৈরি ঘরবাড়ি সমেত জুলুকের গ্রাম। নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে সমগ্র জুলুক তুষারে ঢাকা পড়ে যায়। শুধু যেন বরফের সাম্রাজ্য। গাছপালা, ঘরবাড়ি পাহাড়চূড়া সবেতেই বরফ। অনিন্দ্যসুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য। উপর থেকে দেখলে মনে হয় যেন কোনও চিত্রশিল্পী রংতুলি দিয়ে এঁকে দিয়েছে প্রকৃতির গায়ে তার ক্যানভাস। অপরূপ শোভায় শোভিত জুলুকের পরিবেশ। পাহাড়ের মাথায় জলপাই রঙের সেনাছাউনি। ধাপচাষের জ্যামিতিক নক্সা, আর হলুদ পতাকায় মোড়া মন্দির আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে জুলুককে।

হোমস্টের ঘরে লাগেজ নামিয়ে রেখে হাতমুখ ধুয়ে লাঞ্চ সারলাম। ততক্ষণে সূর্য্যিমামা পাটে যেতে বসেছে। খাওয়া শেষে ক্যামেরা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সুন্দরী জুলুকের রূপরস আহরণ করতে। পায়ে হেঁটে পাথর বিছানে রাস্তায় একটু উপরের দিকে এলে দেখা যায় বালাসুর সানসেট পয়েন্ট। আমি আর আমার দুই সঙ্গী পৌঁছে গেলাম এই পয়েন্টে। হঠাৎ যেন পাহাড়ের গা থেকে ভেসে বেড়ানো মেঘেরা সরে গিয়ে অভ্যর্থনা জানাল। ধীরে ধীরে আকাশ পরিষ্কার হতে থাকল। চোখের সামনে ধরা দিল কাঞ্চনজঙঘার বরফঢাকা পর্বতচূড়ায় সূর্যের আবির খেলা। হলুদ থেকে কমলা আর কমলা থেকে লাল হয়ে সারা পাহাড়চূড়ায় যেন আগুন ধরতে লাগল। অসাধারণ সেই দৃশ্য। চোখে না দেখলে ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। জুলুকের আঙিনায় দাঁড়িয়ে এই নয়নজুড়ানো দৃশ্য উপভোগ করা এককথায় আসাধারণ।

সানসেট দেখে ফেরার পথে দেখা একদল কচিকাঁচার সাথে। সরল সাদাসিধে স্বভাবের এই শিশুগুলোর মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকে। দেখা হতেই হাত নাড়ে, কেউ কেউ আবার হাত বাড়িয়ে মিঠাই চাইল। পকেটে তখন কোনও লজেন্স ছিল না, অগত্যা কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দিলাম। খুব খুশি হয়ে ‘থ্যাংক ইউ’, বলে ছুটে চলে গেল। সন্ধে নেমে আসছে দেখে পা চালালাম খুব দ্রুত। রাস্তার ধারে পাথরের ওপর বেশ কয়েকটি সুন্দর ছোট্ট চেহারার পাখিরও দেখা মিলে গেল। পক্ষীবিশারদ নই বলে নাম বলতে পারলাম না। হিমালয়ের পাহাড়ী চড়াই হতে পারে। এরকম বিভিন্ন প্রজাতির পাখি পাওয়া যায় জুলুকের গাছগাছালিতে।

সকলে মিলে আড্ডায় বসলাম ছবির মতো সুন্দর দোতালা হোমস্টের ঘরে। কেয়ারটেকার সুরাজ ঘরে এসে দিয়ে গেল থালাভরা গরম গরম ভেজপকোড়া আর চা। বাইরে যেন নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে কালোপাহাড়। শুধু শোনা যাচ্ছে বিট্টুর (এখানকার পোষা কুকুর) ডাক। বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইছে। রাত বাড়তেই তাপমাত্রার পারদ ক্রমশ কমতে থাকে। রাত ৮-৩০ বাজতে না বাজতেই রাতের খাবার সেরে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করল। অগত্যা আড্ডা ছেড়ে বাধ্য হলাম ডাইনিং হলে যেতে। এখানে ডাইনিং হলে খাবার সময় যে যার দলকে সঙ্গে নিয়ে একসঙ্গে বসে খেতে হয়। ওরা সকলের খাবার একসঙ্গে পরিবেশন করে। রাতের খাবারে মেনু হল চিকেন কারি, আলুভাজা আর রুটি। বেশ তৃপ্তি সহকারে রসনাতৃপ্তি করে ঘরে এসে সোজা লেপের তলায়। ততক্ষণে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। টিনের চালে বৃষ্টির সিম্ফনিতে ঘুমটা বেশ ভালোই হল। কিন্তু ভোর চারটের সময় সূর্যোদয় দেখতে যাওয়া হল না বৃষ্টির জন্য।

ভোরবেলায় যখন ঘুম ভাঙল তখন পাহাড়ের ঘুম ভাঙেনি। সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘবালিকারা পাহাড়ের গায়ে জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্ঠে। আমাদের হোস্ট বেড-টি দিয়ে গেল ভোর ৫-৩০ মিনিটে। গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে ঝুলবারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। গত রাতে ভালোই বৃষ্টি হয়েছে তাই সূর্যের দেখা পেলাম না। বৃষ্টি হওয়াতে এখান থেকে লুং থুং সানরাইজ ভিউ পয়েন্টে (প্রায় ১২৫০০ ফুট উচ্চতায়) যাওয়া হল না সূর্যোদয় দেখার জন্য। সকালে তাই আমরা জুলুক সাইট সিয়িং-এ যাওয়া ঠিক হল। ব্রেকফাস্ট সেরে সকলে প্রস্তুত। ড্রাইভার কাম গাইড কর্মা শেরপা এসে হাজির। সামান্য কিছু শুকনো খাবার আর জল সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে।

গাড়ি বাঁক ঘুরতেই এসে পড়লাম ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধ সিল্করুটে। ইতিহাসের কিংবদন্তির আলোছায়ায় ঘেরা ৭০০০ মাইল দীর্ঘ রেশমপথ সিকিমের সীমান্তজুড়ে বিস্তৃত ছিল চিন থেকে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে। একসময় জেলেপ-লা, নাথু-লা, কুপুপ, নাথান, জুলুক, অরিটার হয়ে চিনারা এই পথে সিল্ক নিয়ে আসত কালিম্পং পর্যন্ত। তারপর  সেগুলো ছড়িয়ে পড়ত সারা ভারতে। প্রায় ২০ দিন ধরে ইয়াকের পিঠে চেপে তারা আসত বাণিজ্য করতে। পুরো ব্যাবসাটা দেখাশোনা করত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। আর সেই থেকে এ রাস্তার নাম সিল্করুট।

আমরা জুলুকের নয়নাভিরাম প্রকৃতির মাঝখান দিয়ে সিল্করুট ধরে ক্রমশ পাক খেতে খেতে উপরে উঠছি। ১০ কিলোমিটার পাকদন্ডি পেরিয়ে দাঁড়ালাম থাম্ভি ভিউ পয়েন্টে। এখান থেকে সপরিবারে কাঞ্চনজঙঘা, পান্ডিম, কাবরু এবং হিমালয়ের বরফঢাকা পর্বতশিখরগুলো একদিকে দেখা যায় আর অন্যদিকে মনভোলানো ভুলভুলাইয়ার দেখা মেলে। চোখ জুড়িয়ে যায় এ দৃশ্য দেখে। রেশমপথের রাস্তাগুলো পাহাড়ের বাঁকে কোথায় যে হারিয়ে যাচ্ছে তা উপর থেকে খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই তার এইরকম নাম। নীচে পাহাড়গুলোর গায়ে জড়িয়ে রয়েছে বিশাল ময়াল সাপের প্যাঁচানো দেহের মতো রেশমপথ। নীচ থেকে মেঘেদের দল ক্রমশ উঠে আসছে উপরের পাহাড়ে। থাম্ভি থেকে হেয়ারপিন সংকুল ৯৮টি রাস্তা আর শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙঘার দৃশ্য জুলুককে আরও আকর্ষণীয় করে তুলেছে। দেখতে দেখতে কালো মেঘে ঢাকা পড়লাম। আবার পরক্ষণেই পরিষ্কার হয়ে উঠল। এই মেঘরোদ্দুরের লুকোচুরি খেলার সাক্ষি হয়ে রইলাম।

এই অপরূপ প্রাকৃতিক শোভায় খানিকটা বিভোর হয়ে পড়েছিলাম। সম্বিত ফিরল শেরপাজির ডাকে। আমাদের আরও উপরে উঠতে হবে। ঝটপট করে চড়ে বসলাম গাড়িতে। আরও চড়াইপথ ভেঙে ৬ কিলোমিটার যাওয়ার পর থামলাম ‘লুং থুং সানরাইজ ভিউ পয়েন্ট’ নামক জায়গায়। এখানে প্রায় সকল পর্যটক ভোররাতে সূর্যোদয় দেখতে আসে জুলুকে বেড়াতে এলে। আবহাওয়া পরিষ্কার থাকলে এখান থেকে সূর্যোদয় এক কথায় অসাধারণ। এখানে দাঁড়িয়ে চোখের সামনে দেখা যায় একদিকে ভুটানের সীমান্ত আর ১৮০ ডিগ্রি কোণে ছড়ানো কাঞ্চনজঙঘার ধবল রূপ। দাঁড়িয়ে থেকে শুধু তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা।

হঠাৎ আমাদেরই এক সঙ্গীর ডাকে পিছন ফিরে তাকালাম। তিনি ততক্ষণে ঠিক পিছনের পাহাড়ের ঢালে উঠে পড়েছেন ফুল তুলতে। পাহাড়ের গা জুড়ে ভরে রয়েছে লাল রোডোডেনড্রন ফুলে। এই জনমানবশূণ্য পাহাড়ের গায়ে মনে হয় কেউ ফুলের বাগান সাজিয়ে রেখেছে। প্রকৃতির কি অদ্ভুত খেলা! রেশমপথে যেতে যেতে এই রকম ফুলে ভরা বাগান দেখতে পারা এক অসাধারণ সুন্দর অভিজ্ঞতা। এখান থেকে বেশ কিছুটা এগিয়ে লুং থুং সেনাছাউনি দেখে আবার ফিরে এলাম জুলুকে।

সবে গাড়ি থেকে নেমেছি, দেখা পেলাম হিমালয়ান মোনাল পাখির। দ্রুত উড়ে গেল এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ের জঙ্গলে। দেখতে অনেকটা আমাদের ময়ূরের মতো। নীল রঙের পালকে ঢাকা দেহ, গলায় হলুদ রেখা আর মাথায় বড়ো লাল রঙের ঝুঁটি। বিকেলের দিকে হাঁটতে হাঁটতে দেখা হল একদল পাখির সাথে। হিমালয়ের কোলে দুর্লভ প্রজাতির পাখির সন্ধান মেলে প্রায়ই।

আজ আমাদের মায়াবী জুলুকে থাকার শেষ দিন। তাই যেন পাহাড়ের মুখগুলোও ভারাক্রান্ত। লাইন দিয়ে যুদ্ধের সেনাদের মতো ধীরে ধীরে মেঘেদের দল ভিড় করতে থাকে সমগ্র জুলুকের গায়ে। আমাদের সকলের মনও আজ বিষাদময়। নীল আকাশের নীচে সবুজ সহ্যদ্রিঘেরা এই জুলুকের আকর্ষণে বার বার ছুটে যেতে মন চায়। তবে হাতে সময় নিয়ে আসলে এখান থেকে ঘুরে আসা যায় লুং থুং নাথান হয়ে কুপুপে। জুলুক থেকে নাথান হয়ে টুকলা ভ্যালির পাশ দিয়ে ওল্ড বাবা মন্দির দেখে পৌঁছানো যায় কুপুপে। ১৪০০ ফুট উচ্চতার কুপুপে পৌঁছে দেখা যায় বিখ্যাত এলিফ্যান্ট লেকটিকে। আমাদের অবশ্য সে সুযোগ নেই তাই। আমরা ভারাক্রান্ত মনে স্বপ্নের জুলুকের স্মৃতি বহন করে ফিরে চললাম বাস্তবের আঙিনায় কর্মময় জীবনে।

প্রয়োজনীয় তথ্য

কীভাবে যাবেনঃ

কলকাতা থেকে ট্রেনে বা বাসে শিলিগুড়ি অথবা এনজেপি স্টেশন। ওখান থেকে জুলুকের গাড়ি ভাড়া করে যাওয়া যায়। জুলুক পর্যন্ত সরাসরি কোনও বাস সার্ভিস নেই। তাই গাড়ি ভাড়া করে আসতে হবে। দিনপ্রতি ভাড়া পড়বে ২৫০০-৩০০০ টাকা।

কোথায় থাকবেনঃ

জুলুকের থাকার উত্তম ব্যবস্থা করে থাকেন গোপাল প্রধান অথবা সুরজ প্রধান, তাদের হোমস্টে দিলমায়া হোমস্টে-তে। এখানে সবই হোমস্টে, কোনও হোটেল পাবেন না এখানে। জনপ্রতি, দিনপ্রতি খরচ ৮৫০-৯০০ টাকা।

কখন যাবেনঃ

বেড়ানোর আদর্শ সময় অক্টোবর-নভেম্বর মাস। এছাড়া বর্ষাকাল বাদে এপ্রিল থেকে মে মাসেও যেতে পারেন।

এখানে থাকা ও খাওয়ার সব ব্যবস্থা একসঙ্গে করা হয়।

শীতবস্ত্র সঙ্গে রাখবেন। বাচ্চা সঙ্গে থাকলে বাচ্চার খাবার সঙ্গে রাখবেন।

জুলুক ভ্রমণের জন্য ২ কপি পাসপোর্ট ছবি এবং আই ডি কার্ডের ফোটোকপি ও ওরিজিনাল সঙ্গে রাখবেন।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব