ও এসেছিল ( শেষ পর্ব )

এরপর থেকেই ক্রমশ এই পরিবারের সঙ্গে তার পরিচয় আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে থাকে। এভাবে কখন পলাশ-মৌ-এর ঘনিষ্ঠতা গভীরে পৌঁছেছে তা ওরা নিজেরাও বুঝতে পারেনি। পরিচয় থেকে ক্রমশ তা প্রেমে পরিণত হয়।

মৌ-এর জন্ম ও পড়াশোনা দিল্লিতেই, তাই দিল্লির রাস্তা-ঘাট ওর কাছে খুব পরিচিত ছিল। দিল্লির লোকেদের নার্ভও ওর ভালো ভাবে জানা ছিল। ওর সঙ্গে পলাশ দিল্লির বহু জায়গায় ঘুরেছে। সেসব দিনের কথা মনে পড়ে যায় পলাশের। মনে পড়ে যায় দিল্লির সেইসব সুখস্মৃতি।

মৌ-এর হাত ধরে ছুটির দিনে ইন্ডিয়া গেটের সামনে বেড়াতে যাওয়া। মনে পড়ে সেই দিনগুলো যখন লোদী গার্ডেনের বা মোগল গার্ডেনের ফুলগুলো হাতছানি দিয়ে ডাকত, মনটা চলে যেত সেই স্বপ্ন-পুরীর এক অচিন রাজ্যে। ওই পুরোনো স্মৃতিগুলো তাকে আজও বড়ো কষ্ট দেয়।

সেই পুরোনো রাস্তা, লোদি গার্ডেন, ইন্ডিয়া গেট, যেখানে সে মৌ-এর হাত ধরে দিনের পর দিন ঘুরে বেড়িয়েছে সেগুলো যেন তাকে দেখে আজও বিদ্রূপ করে আর প্রেমের বদনাম করে বেড়ায়। হঠাৎ একটা বড়ো ভমিকম্পে মনে হল ওদের স্বপ্নের প্রাসাদটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

পলাশ দিল্লি থেকে ফেরার আগে মৌ-এর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে ওর দেখা পায়নি। জানতে পেরেছিল ওরা সরোজিনীনগর থেকে অন্য কোথাও শিফট করে গেছে। এর

দু-একদিনের মধ্যেই পলাশকে কলকাতা ফিরতে হয়েছিল চাকরিতে জয়েন্ট করার তাগিদে। এরপরও পলাশ দুবার দিল্লি গেছে মৌ-এর খোঁজ নিতে কিন্তু মৌ-এর খোঁজ পায়নি। হয়তো মৌ-ও তাকে খুঁজে বেড়িয়েছে এদিক সেদিক।

মৌ-কে সে একদিন খুঁজে বার করবেই এই আশায় আজও সে বিয়ে করেনি। তার স্থির বিশ্বাস পলাশ একদিন মৌ-কে খুঁজে বের করবেই। কিন্তু আজ এ কী দৃশ্য সে দেখল। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। একটিবার যদি মৌ-কে বলতে পারত এই আশায় আজ বুক বেঁধেছিল। মৌ-কে বলবে ঠিক করেছিল যে, এবার সে আর মৌ-কে ওর থেকে দূরে সরে যেতে দেবে না।

ও বড়ো ছেলেমানুষি করত। দরকারের থেকে বেশি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত। আনন্দ হলে বাচ্চাদের মতো খুশি হতো। ওদের বাড়ির বাগানটা ছিল খুব বড়ো, উদ্যান বলা চলে। কোথাও ফুলের কেয়ারি, কোথাও ফলের গাছ, কোথাও আবার এমনিই জংলা।

পলাশ মাঝে মাঝে বলত, মালি এনে জায়গাটা পরিষ্কার করে ভালোমতো সাজানো বাগান করার কথা। যদিও সে পরিকল্পনা বাস্তবে রূপ নেয়নি। মৌ ওই আধ-বুনো বাগানটাকেই বেশি ভালোবাসত।

পলাশের স্পষ্ট মনে আছে, একবার ওদের বাড়ি গিয়ে দেখল, মৌ বাগানের একটা শ্যাওলা ধরা বড়ো পাথরের ওপর বসে, হাতে আচারের বয়াম নিয়ে জীবনানন্দের কবিতা আবৃত্তি করে যাচ্ছে নিজের মনেই।

একবার সন্ধেবেলা পাণ্ডব কেল্লার কাছে বোটে চেপে আকাশের তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে কবিতা আবৃত্তি করে শুনিয়েছিল পলাশকে। খুব ভালো আবৃত্তি করতে পারত। আবৃত্তি করতে করতে হারিয়ে যেত এক অচিন রাজ্যে।

একবার ছুটির দিনে ভোরবেলা বেড়াতে বেরিয়ে দুজনে খুব আনন্দ করেছিল। দিল্লির রাস্তার দুপাশে চিরহরিৎ গাছের সারি, পাতার ফাঁক দিয়ে মৌ-এর মুখে যখন সকালের মিষ্টি রোদ এসে পড়ত, তখন কী সুন্দরই না লাগত তাকে।

রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ কোনও ভিখারি নজরে পড়লে দৌড়ে গিয়ে মৌ তাকে সাহায্য করে আসত। কখনও কখনও যে দুজনের মধ্যে মান-অভিমানের পালা চলেনি তেমন নয়। তবে নিজেরাই তা মিটিয়ে ফেলত। কখনও একজন আরেকজনকে ছেড়ে থাকতে হবে তা স্বপ্নেও ভাবেনি।

একবার পলাশ মজা করে মৌ-কে জিজ্ঞাসা করেছিল, আচ্ছা তুমি প্রেম বলতে কী বোঝো?

তার উত্তরে মৌ যা বলেছিল, তা পলাশ আজও মনে করে নিজের মনেই হাসতে থাকে।

মৌ বলেছিল, প্রেম অনেকরকম হয়। তবে জীবনের প্রথম প্রেম সকলের কাছেই স্মরণীয় হয়ে থাকে। প্রথম প্রেমের কোনও নির্দিষ্ট বয়স নেই। অনেকের বেলায় খুব কম বয়সে প্রথম প্রেম এসে থাকে। প্রথম প্রেম বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আসলে প্রেম হয় না, সেটা হয়ে থাকে ইনফ্যাচুয়েন। প্রথম প্রেম হতে পারে কোনও বাল্যবন্ধু, হতে পারে গৃহশিক্ষক বা স্কুলের শিক্ষক বা শিক্ষিকা, হতে পারে বয়সে বড়ো কোনও ব্যক্তি, হতে পারে কোনও ফিল্মের নায়ক বা নায়িকা, হতে পারে পাড়ার কোনও হ্যান্ডসাম তরুণী বা বড়ো দাদার বয়সি কোন লোক।

—আরেকরকম প্রেম হল Love at First Site অর্থাৎ প্রথম দেখাতেই প্রেম। এ ধরনের প্রেম অবশ্য একতরফাই হয়। ছেলেদের ক্ষেত্রেই এ ধরনের প্রেম বেশি দেখা যায়। এই প্রথম দেখাটা বিয়ে অনুষ্ঠানে, শপিং মল-এ, কলেজে, ইউনিভার্সিটি-তে, কোচিং সেন্টারে, স্যারের বাড়িতে বা বন্ধুদের আড্ডা-তেই বেশি দেখা যায়। এ ধরনের প্রেমে অবশ্য বন্ধুদের বা বড়োদের সাহায্যের দরকার পড়ে। এ ধরনের প্রেমের সূত্রপাত রূপ সৌন্দর‌্য ও দৈহিক সৌন্দর‌্যের ভমিকাই বেশি।

—বাব্বা, এসব শুনে তো মনে হচ্ছে, তুমি প্রেম নিয়ে ডক্টরেট করেছ!

—আরও আছে মশাই। বন্ধুত্ব থেকে প্রেম। এই ধরনের প্রেমের ক্ষেত্রে প্রেমিক ও প্রেমিকা দুজনেই প্রথমে বন্ধু থাকে।

এক রাতের প্রেম এগুলোকে প্রেম বললে পাপ হবে। নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে ছেলেরাই এ ধরনের প্রেমের আযোজক। দৈহিক বাসনাকে পূর্ণতা দেওয়াই এই প্রেমের প্রধান উদ্দেশ্য।

বিবাহোত্তর প্রেম এই প্রেমে শুধুমাত্র স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে যা দেখা যায়। বিয়ে ঠিক পর পর প্রথম কয়েক মাস এই প্রেম প্রবল থাকে।

পরকীয়া প্রেম এটা নিয়ে আর নাই বা বললাম। এটা সবাই জানে।

না বুঝেই প্রেম সাধারণত এ ধরনের প্রেম স্কুল-পডুয়াদেরই হয় বেশি।

কর্মক্ষেত্রে প্রেম এটাও তোমাদের কাছে অজানা নয়। আজকাল তো মোবাইলেও প্রেম হয়। ইন্টারনেটে ও সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমেও প্রেম হচ্ছে। সেখানে ধোঁকাও হচ্ছে খুব বেশি।

—তুমি বরং এ নিয়ে একটা ডিপ্লোমা বা ডিগ্রি করে ফেলো। ভালো নম্বর পাবে।

এসব পুরোনো কথা ভাবতে ভাবতে মনটা বড়ো উদাস হয়ে যায়।

এখনও পলাশ মাঝে মাঝে মৌ-এর কথা ভাবতে ভাবতে প্রায়ই আনমনা হয়ে যায়। এটা অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টার, অবস্তিও অনেকদিন লক্ষ্য করেছে। তাই সে একদিন পলাশকে জিজ্ঞাসা করেই ফেলল, আচ্ছা, স্যার আপনার মনের মধ্যে মনে হয় অনেক দুঃখ জমে আছে। আপনাকে মাঝে মাঝেই আনমনা হতে দেখি। কারও সঙ্গে মনের কথা ভাগ করে নিন, নয়তো অসুস্থ হয়ে যাবেন। প্রতিবারই পলাশ এর উত্তর না দিয়ে কোনও না কোনও বাহানায় এড়িয়ে গেছে।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেল অবস্তির ডাকে।

অবস্তি বলল, স্যার, এবার আপনি বাড়ি যান। আমি ডিনার করে ফিরেছি।

পলাশের শরীরটা কেমন যেন ভারী লাগছিল। কিছুতেই দাঁড়াতে পারছিল না। টেবিলে ভর দিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

অবস্তি পরীক্ষা করে দেখল পলাশের নিথর দেহটায় আর প্রাণ নেই। আচানক স্ট্রোকে একটা সুস্থ লোকের এভাবে চলে যাওয়াতে, সারা স্টেশন চত্বরে এক শোকের ছায়া নেমে এল।

ও এসেছিল ( প্রথম পর্ব)

পলাশ মিত্র ছোটোবেলা থেকে কলকাতাতেই মানুষ হয়েছে। যখন স্কুলে পড়ত তখন বাবাকে হারিয়েছে। এরপর রেলের চাকরিতে জয়েন্ট করার পর মাকে-ও হারিয়েছে। তাই এখন একদম একা। বর্তমান জীবনটা বড়ো শুষ্ক, কঠিন, মরুভমির মতো লাগে। মা মারা যাওয়ার পর বেশ কয়েকটা বছর কেটে গেছে কিন্তু কিছুতেই মা-কে ভুলতে পারেনি। বাবা মারা যাওয়ার পর মা-ই ছিল তার অনুপ্রেরণা।

মা একটা স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন তাই ছেলেকে যথাযথ শিক্ষা দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু আজও মায়ের মৃত্যুটা পলাশ কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। কারণ মা স্কুল থেকে ফেরার পথে একদিন গাড়ির ধাক্কায় মারা যান। আজও পলাশের জীবনে একটা নিঃসঙ্গতা তাড়া করে বেড়ায়। কী করলে যে জীবনে একটু শান্তি ফিরে পাবে তা বুঝে উঠতে পারে না। তাই তো নিজের ইচ্ছেয় দূরবর্তী একটা স্টেশনে চাকরি নিয়ে চলে এসেছে।

বর্তমানে পলাশ মিত্র হাতিয়া স্টেশনের স্টেশন মাস্টার। স্টেশনের পাশেই কোয়ার্টারে থাকে। রেলওয়ে সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়েছিল। তারপর বদলি হতে হতে এখানে এসে পৌঁছেছে। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত স্টেশনেই থাকে। মা, বাবা দুজনেই গত হয়েছেন, তাই পিছুটান বলে কিছু নেই। পলাশ কাজের মধ্যেই আনন্দ খুঁজে নেয়। ওই স্টেশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টার বীরেন্দর অবস্তি অনেকবার বলেছে পলাশবাবু আপনি এবার বিয়েটা করে নিন। কিন্তু পলাশকে কিছুতেই রাজি করাতে পারেননি। পলাশ যখন একা একা বসে থাকে নিজের কেবিনে, তখন মাঝে মাঝে উদাস হয়ে নানা কথা ভাবতে থাকে। এটা বীরেন্দরের চোখ এড়ায়নি।

পলাশের মনে অতীতের কথাগুলো তাকে আরও উদাস করে দেয়। পশ্চিমবঙ্গে চাকরি না পেয়ে দিল্লি চলে যায়। সেখানে গিয়ে একটা ফুড ডেলিভারি সার্ভিসের ডেলিভারি বয়-এর চাকরিও সে করেছে। তাই এখানকার খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে দেখলেই তার মনটা কেমন নরম হয়ে যায়। তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তাই রেলের ছোটো-বড়ো সব কর্মচারীই পলাশকে খুব ভালোবাসে।

দিল্লিতে ফুড ডেলিভারি বয়-এর চাকরি করতে করতে যখন প্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল সে, তখন একদিন মা-র ফোন এল। মা জানালেন যে, ওর রেলের চাকরিটা হয়ে গেছে। দিল্লি যাওয়ার আগে যে-ইন্টারভিউ দিয়ে গিয়েছিল তাতে সে পাশ করেছে। চাকরির জয়েনিং লেটার এসেছে। খবরটা পেয়ে দিল্লির সব পাট চুকিয়ে বাড়ি ফিরে এসেছিল পলাশ।

প্রতিদিনই সারাদিনের ডিউটি সেরে সন্ধ্যায় কোয়ার্টারে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে রাতের ডিনার সেরে আবার ফিরে আসে স্টেশনে। বিশেষ করে হাওড়া-রাঁচি এক্সপ্রেসটাকে পাস করাতে। এটা একটা বেশ নামকরা ট্রেন এই লাইনের। কোয়ার্টারটা স্টেশনের সঙ্গে একেবারে লাগোয়া তাই খুব একটা অসুবিধে হয় না।

অন্যদিনের মতো সেদিনও রাঁচি এক্সপ্রেসটাকে পাস করাতে স্টেশনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে, বীরেন্দর অবস্তির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। বীরেন্দর বলল আমি আপনাকেই খবর দেওয়ার জন্য পোর্টারকে বলতে যাচ্ছিলাম। যাক আপনি যখন এসে গেছেন তাহলে আপনি রাঁচি এক্সপ্রেসটা পাস করিয়ে দেবেন। আমি খাবারটা খেয়ে আসছি ততক্ষণে। আর হ্যাঁ, আপনার সঙ্গে এক মহিলা দেখা করতে এসেছেন। আমি তাকে আপনার কেবিনে বসিয়ে রেখে এসেছি।

—এত রাতে আবার কে এল দেখা করতে! ঠিক আছে আপনি যান। আমি দেখে নেব।

কেবিনে ঢুকেই পলাশ চমকে উঠল। দেখল একটা চেয়ারে মৌ বসে আছে। উচ্ছ্বাস চেপে রাখতে না পেরে সে বলে উঠল আরে তুমি, এখানে। আর আমি তোমাকে তন্ন তন্ন করে কোথায় না খুঁজেছি। কোথাও তোমার খোঁজ পাইনি। কী খাবে বলো। তোমার মুখটা দেখে কেমন শুকনো শুকনো লাগছে, নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে তোমার। কী হল কোনও কথা বলছ না কেন?

এমন সময় পোর্টার এসে খবর দিল বাবু, রাঁচি এক্সপ্রেস স্টেশনে ঢুকছে। এদিকে একটা ডেডবডি এসেছে দূরের এক গ্রাম থেকে। রাঁচি হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে পোস্টমর্টেমের জন্য। আপনার সই চাই।

—তুমি যাও আমি আসছি বলেই পলাশ মিত্র, মৌ-কে উদ্দেশ্য করে বলল, তুমি একটু বসো, আমি যাব আর আসব। আমার কাজটাই এরকম বুঝলে, বলেই কেবিন থেকে বেরিয়ে প্ল্যাটফর্মে বেরিয়ে গেল।

যে-কামরায় বডিটা তোলা হবে তার সামনে বডিটা রাখা আছে। পলাশ সেখানে পৌঁছে কাগজে সই করতে করতে বলল মুখের কাপড়টা খুলে মুখটা একটু দেখাও। এটা নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। একবার দেখে কনফার্ম করে নেওয়া আর কী।

ডেডবডির মুখ থেকে কাপড়টা সরাতেই পলাশের মাথাটা কেমন যেন ঝিম-ঝিম করে উঠল। এ কী করে সম্ভব। এ তো মৌ-এর ডেডবডি। এইমাত্র যাকে ওর কেবিনে বসিয়ে রেখে এসেছে। ইতিমধ্যেই ডেডবডিটা হাতিয়া এক্সপ্রেসে কামরায় তোলার সময় দেখল, মৌ কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে পলাশের দিকে তাকিয়ে হাসছে। যেন কিছু বলতে চাইছে।

পলাশের মুখ দিয়ে কোনও কথা বেরোল না। পাগলের মতো নিজের কেবিনের দিকে দৌড়ে গেল। কেবিনে ঢুকে দেখল সেখানে মৌ নেই। ওর মাথাটা যেন ঘুরছে মনে হচ্ছে। চোখে অন্ধকার দেখছে। একি স্বপ্ন না সত্যি? মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল নিজের চেয়ারে।

পলাশ ভূত-প্রেত ইত্যাদিতে কোনও দিনই বিশ্বাস করে না। রাতের পর রাত অনেক ছোটো ছোটো রেলওয়ে স্টেশনে ডিউটি দিয়েছে। ট্রেনের তলায় কাটা-পড়া বহু ডেডবডি তাকে দেখতে হয়েছে কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে, তা এর আগে কখনও ভাবেনি। এ কী করে সম্ভব তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না!

চোখের সামনে পুরোনো দিনের স্মৃতিগুলো ভেসে উঠল একে একে। দিল্লিতে চাকরি করতে গিয়ে তার পরিচয় হয়েছিল মৌ-এর সঙ্গে। পরিচয়টাও খুব অদ্ভুত ভাবে হয়েছিল। একদিন ফুড ডেলিভারি করতে গিয়ে পলাশের আলাপ হয়েছিল মৌ-এর বাবার সঙ্গে। মৌ-এর বাবা কথায় কথায় পলাশের সঙ্গে গল্প জমিয়ে দেন এবং জানতে পারেন যে, পলাশ একজন শিক্ষিত যুবক। কিন্তু অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এই ডেলিভারির কাজ করতে দিল্লিতে এসেছে।

এরপর আরও জানতে পারেন যে, পলাশ একাই থাকে এখানে তাই রাতে ফিরে গিয়ে কোনও কোনও দিন খাওয়াও জোটে না কপালে। এরপর একদিন পলাশ যখন দুটো খাবারের প্যাকেট নিয়ে মৌ-দের বাড়িতে ডেলিভারি দিতে যায়, সে সময় মৌ এসে একটি প্যাকেট নেয় এবং অন্যটি পলাশের হাতে দিয়ে বলে, বাবা আজ বাড়িতে নেই। বলেছেন এটা আপনার জন্য। আর আগামী রবিবার আমাদের বাড়িতে আপনার নিমন্ত্রণ।

পলাশ এরকম একটা পরিস্থিতির জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিল না। তাই অনেক আপত্তি সত্ত্বেও মৌ-এর অনুরোধে প্যাকেটটি নিতে রাজি হয় এবং রবিবার নিমন্ত্রণ রক্ষা করবে বলে জানিয়ে আসে।

প্রতিধ্বনি ফেরে (শেষ পর্ব )

স্বর্ণাভর মস্কো থেকে ফেরার দিন চলে এল। পূর্ব নির্ধারিত সময়মতো সন্ধ্যা ছটায় ফ্লাইট ল্যান্ড করার কথা। নম্রতা হাতে একগোছা গোলাপ নিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে পৌনে পাঁচটায় মৃগাঙ্ককে সঙ্গে নিয়ে এয়ারপোর্টে এল। নির্দিষ্ট সময়মতো ফ্লাইট ল্যান্ড করল। একে একে সব যাত্রীরা চলে গেল। কিন্তু নম্রতার চোখ স্বর্ণাভকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। সে সংশয়পূর্ণ গলায় মৃগাঙ্ককে বলল, মৃগাঙ্কদা, সব যাত্রী তো চলে গেল। স্বর্ণাভ কোথায়! ও কি ফ্লাইট মিস করল!

সব যাত্রী চলে যাবার পরও নম্রতা বেশ কিছুক্ষণ স্বর্ণাভর জন্য অপেক্ষা করল। তার সে অপেক্ষা অপেক্ষাই থেকে গেল। স্বর্ণাভ ফিরল না। মৃগাঙ্ক বলল, বাড়ি ফিরে চলো। স্বর্ণাভ আজ আসবে না। হয়তো পরের কোনও ফ্লাইটে ফিরবে। ফোনও তো করা যাবে না। স্বর্ণাভ নিজে থেকে নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবে। ও জানে তুমি ওর জন্য চিন্তা করবে। দেখো, ঠিকই সময় করে কাল ফোন করে নেবে।

প্রবহমান সময় বয়ে গেল। সময় করে স্বর্ণাভর কোনও ফোন নম্রতার কাছে এল না। তারপর বিদেশ থেকে কত ফ্লাইট দেশে ল্যান্ড করল। নম্রতার অপেক্ষার পথ ধরে স্বর্ণাভ ফিরে এল না। মৃগাঙ্ক দুএকবার নম্রতাকে অনুরোধ করল তার বাবার কাছে ফিরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু বাবার মুখোমুখি দাঁড়ানোর মতো নম্রতার মুখ ছিল না। বেশ কয়েক মাস তার ছন্নছাড়া জীবন কাটল। সে মানসিক দিক থেকে খুবই ভেঙে পড়ল। এর প্রতিফলন তার শরীরে এবং বাহ্যিক চেহারায় পড়ল। এরই মধ্যে জীবন গতিপথ বদলাল।

এক রাতে নম্রতা মদ্যপ অবস্থায় ট্যাক্সি থেকে নেমে বাড়ি ফেরার রাস্তায় হাঁটছিল। নেশার ঘোরে তার দুপা টলছিল। সে আপন মনেই বলে উঠল, আজ ডিস্কোয় ড্রিংকটা খুব বেশি হয়ে গেল। এতটা না খেলেই হতো। ট্যাক্সির ড্রাইভারও বাজে। সবে এগারোটা বাজে। গভীর রাত আমাকে বুঝিয়ে বাড়ি পর‌্যন্ত এল না। সব বেইমান। পৃথিবীতে সব বেইমান। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে একজন ভদ্রলোকের সামনে টাল সামলাতে না পেরে সে পড়ে গেল। সে ভদ্রলোক অপরিচিত কেউ নন। নম্রতার বাবা প্রভাসবাবু। নম্রতা চোখটা ঈষৎ খুলে প্রভাসবাবুকে অস্ফুট কণ্ঠে ডাকল, বাবা। তারপরই সে জ্ঞান হারাল।

সকালে যখন নম্রতার হুঁশ ফিরল তখন দেখল সে বাবার কাছে। নিজের বাড়িতে বাবার সেবা শুশ্রূষায় সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠল। প্রভাসবাবু সব ভুলে মেয়েে ক্ষমা করে দিলেন। তিনি নম্রতাকে এটাও জানিয়ে দিলেন যে, এক মাসের মধ্যে নম্রতার বিয়ে দেবেন। বাবার কথার উপর কথা বলার ক্ষমতা নম্রতার ছিল না। স্বর্ণাভ যেন তার সমস্ত ক্ষমতা নিংড়ে নিয়ে চলে গেছে। একরকম পরিস্থিতির চাপে বাধ্য হয়ে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এমডি ধ্রুব অধিকারীকে নম্রতা বিয়ে করে।

বিয়ে দীর্ঘ পনেরো বছর স্বর্ণাভর খোঁজ পাওয়ার বহু চেষ্টা সে করেছে। কিন্তু প্রতিবার ব্যর্থই হয়েছে। আজ না চাইতেই নম্রতার ভালোবাসার মানুষ স্বর্ণাভ তার দুহাতের নাগালে এসেছে। কিন্তু পূর্বের পরিচিত স্বর্ণাভ আর যে-মানুষটা আজ নম্রতার সামনে দাঁড়িয়ে তাদের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান। দূর নক্ষত্রের মতো আজকের এই স্বর্ণাভ নম্রতার কাছে ভীষণ অপরিচিত।

নম্রতার গলায় কান্না দলা পাকিয়ে এসেছিল। সে সামলে নিয়ে বলল, সময় কারওর জন্য অপেক্ষা করে না ঠিকই। একটা মানুষ তার ভালোবাসার মানুষের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে পারে। তোমার আসার জন্য আমি আজও অপেক্ষা করে আছি।

—তুমি ভীষণ বোকা আর ছেলেমানুষ। আমি অপেক্ষা করিনি তোমার জন্য। অতীত সবসময় অতীত, বর্তমানটাই জীবন। আমার বর্তমান আমার নাম, যশ, খ্যাতি, অর্থ এনে দিয়েছে। ওই দ্যাখো আমার স্ত্রী, আমার বর্তমান।

স্বর্ণাভর প্রসারিত হাতের দিকে নম্রতা চেয়ে দেখল একটু দূরে কাঠের বেঞ্চে একজন ভদ্রমহিলা বসে আছেন। স্বর্ণাভ নম্রতার হাত ধরে বলল, চলো তোমার সঙ্গে আমার স্ত্রী অ্যাবেলার পরিচয় করিয়ে দিই।

নম্রতার মুখচোখ রাগে বিরক্তিতে লাল হয়ে উঠল। সে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে স্বর্ণাভকে বলল, ছি! ছি! তোমার মতো বিশ্বাসঘাতকের জন্য আমি এতদিন অপেক্ষা করেছি। এটা ভাবলে আমার নিজের উপরে ঘৃণা হচ্ছে। তোমার জন্য আমি আমার স্বামী ধ্রুবকে আঘাত করেছি প্রতিটা মুহূর্তে। নাম, যশ, খ্যাতি, অর্থের এত লোভ তোমার স্বর্ণাভ যে, সব অতীত ভুলে বিদেশিনিকে ঘরে তুলে স্ত্রীর মর‌্যাদা দিতে হয়েছে। আমার বাবাই ঠিক ছিল। আমি সবটাই ভুল করেছি। নম্রতা কথা শেষ করে কাঁদতে কাঁদতে একটা চড় মারল স্বর্ণাভর গালে। তারপর লন ছেড়ে ছুটতে ছুটতে হোটেলের ঘরের দিকে পা বাড়াল। কিছুটা পথ গিয়ে ধ্রুবর সঙ্গে তার সজোরে ধাক্কা লাগল। ধ্রুবও হোটেলের রুম থেকে নম্রতাকে খুঁজতে বেরিয়েছিল।

ধ্রুবর প্রতি নম্রতা স্বভাবিক আড়ষ্টতাবশত নিজেকে সামলে নিল। ধ্রুব বলল, জীবনে চলার পথে অসতর্ক হতে নেই নম্রতা। সাবধানে দেখে পা ফেলতে হয়। আজ তোমার চোখ মুখ দেখে আমি জিজ্ঞাসা করব না যে তোমার কী হয়েছে। কারণ তোমার চোখ মুখ তা বলে দিচ্ছে। তোমার সঙ্গে যা হয়েছে তা ভালো হয়নি। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সস্ত্রীক স্বর্ণাভকে দেখে ধ্রুব হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ল।

নম্রতা ধ্রুবর বুকে মাথা রেখে জ্যাকেটটা দুহাতে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি তোমার সঙ্গে যা করেছি ভুল করেছি। জানি এই ভুলের কোনও ক্ষমা হয় না। পারলে আমাকে ক্ষমা কোরো।

ধ্রুব নম্রতার মুখটা একটু তুলে বলল, চলো রুমে। আশা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। তোমার চোখে আমি জল দেখতে চাই না। তোমাকে সারাজীবন হাসিখুশি দেখতে চাই। যার জন্য তুমি জল ফেলছ মনে রেখো সে তোমার চোখের জলের যোগ্যই নয়। ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে ক্ষমার সম্পর্ক হয় না। আর তুমি আমাকে না ভালোবাসলেও আমি তো তোমাকে ভালোবাসি। আমার বর্তমান-ভবিষ্যৎ সবকিছুই তোমাকে ঘিরে। আর ভাগ্যিস তুমি এখানে বেড়াতে এলে নাহলে বাকি জীবনটাও আমি তোমার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হতাম। হোল্ড মি টাইট নম্রতা। জ্যাকেটের কলারটা আর একবার ধরো প্লিজ।

ধ্রুবর কথা শুনে নম্রতা হাসতে হাসতে তাকে জড়িয়ে ধরল। ধ্রুবও নম্রতাকে সজোরে জড়িয়ে ধরে দীর্ঘ চুম্বন করল। মনে হল নির্জনতার বুকে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল নম্রতা। ধ্রুবর বুকে মাথা রেখে সে অদূর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখল।

ধীর পায়ে সন্ধ্যা নামছে হিমালয়ে কোল জুড়ে। ঠান্ডা হাওয়ায় ভেসে আসছে পাহাড়ি ফুলের গন্ধ। ঠান্ডায় প্রায় জনমানবশূন্য হয়ে গেল হোটেলের বাইরের লন। ঝিঁঝি পোকার ডাক, অদূরে ঝরনার শব্দ কানে আসছে। আকাশ, বাতাস, একটা পাহাড়ি-সন্ধ্যা সাক্ষী থাকল ধ্রুব-নম্রতার ভবিষ্যৎ স্বপ্নের।

প্রতিধ্বনি ফেরে (পর্ব ৪ )

ধ্রুবর প্রতি নম্রতার খারাপ আচরণের একটাই সঙ্গত কারণ ছিল জোরপূর্বক বিয়ে নম্রতার মতের বিরুদ্ধে বাবা প্রভাসবাবু ধ্রুবর সঙ্গে তার বিয়ে দেন। একসময় নম্রতার ভালোবাসার মানুষ ছিল বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব স্বর্ণাভ মিত্র। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন স্বর্ণাভর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। স্বর্ণাভর সঙ্গে তার বয়সের ফারাক ছিল প্রায় পনেরো বছর। প্রথম প্রথম তাদের সম্পর্ক ছিল শিক্ষক এবং ছাত্রীর। স্বর্ণাভর নবজন্ম নামে একটি নিজস্ব নাট্যদল ছিল। ছাত্রী হিসাবে নম্রতা নবজন্ম নাট্যদলে যোগ দেয়। প্রায় চার বছর সে ওই দলে যুক্ত ছিল। স্বর্ণাভর প্রতি তার ভালোলাগার সূত্রপাত তখন থেকেই। সেই নাট্যদল প্রায় কুড়ি বছর রংমহল থেকে স্টার, নন্দন থেকে রবীন্দ্রসদন মাতিয়ে রেখেছিল বিপুল পরিমাণে দর্শককে।

ছত্রিশ বছরের স্বর্ণাভর প্রতি একুশ বছরের নম্রতার ভালোলাগা, দায়িত্ববোধ, নম্র ব্যবহার নাট্যদলের অন্যান্য সদস্যের চোখ এড়ায়নি। স্বর্ণাভও নম্রতার আচার-আচরণ সম্বন্ধে বিশেষ ভাবে অবহিত ছিল। শিক্ষিতা, সুন্দরী, মার্জিত রুচিবোধের অধিকারী নম্রতার ভালোবাসার কাছে ধরা দেয় স্বর্ণাভ। এই পৃথিবীতে স্বর্ণাভর আপন বলতে কেউ ছিল না। তার যখন পনেরো বছর বয়স, তখন একটা রেল দুর্ঘটনায় বাবা-মা দুজনেই মারা যান। জীবনের সঙ্গে একাকী লড়াই করতে করতে একসময় তার মাথায় জয়ে মুকুট ওঠে।

নম্রতার কাছে আশ্রয় পেয়ে স্বর্ণাভ জীবনের সমস্ত না পাওয়া ভুলে যায়। পাঁচ বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তারা দুজনে একে অপরকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। বাবা প্রভাসবাবু থিযোর অভিনেতা স্বর্ণাভর সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিতে রাজি হলেন না। তিনিও জেদের বশবর্তী হয়ে সাত দিনের মাথায় সুপাত্রের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেন। শৈশবে মাতৃহারা নম্রতাকে কোলে পিঠে করে অপার স্নেহে মানুষ করার অধিকারবশত প্রভাসবাবু মেয়ে বিয়ে তড়িঘড়ি করে ঠিক করে ফেলেন দিল্লিনিবাসী এক আইপিএস অফিসারের সঙ্গে।

নম্রতা প্রভাসবাবুর এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। বিয়ের ঠিক তিনদিন আগে নম্রতা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কয়েক মাস স্বর্ণাভর সঙ্গে সে কলকাতার বাইরে চলে যায়। কিছুদিন কাটিয়ে আবার তারা কলকাতায় ফিরে আসে। নম্রতার বাবা, মেয়ে আচরণে চাপা অভিমানবশত কোনও খোঁজখবর নেন না। তিনি ভাবেন যে তাঁর একমাত্র মেয়ে লোকসমাজে তাঁর উঁচুমাথা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে যখন চলে গেছে তখন সে মেয়েে ভুলে যাওয়াই শ্রেয়। ফলে তিনি নিশ্চুপ থাকেন।

এদিকে স্বর্ণাভর বালিগঞ্জের বাড়িতে নম্রতা তার সঙ্গে লিভ-ইন সম্পর্কে থাকতে শুরু করে। বেহিসেবি রঙিন জীবন কাটাতে কাটাতে সাত বছর চোখের নিমেষে কেটে যায়। ভালোবাসার বিভিন্ন মুহূর্ত উদ্যাপন করতে ইউরোপের দর্শনীয় স্থানগুলিতে নম্রতাকে নিয়ে পাড়ি দেয় স্বর্ণাভ। পাহাড়ি খরস্রোতা নদীর মতো দুজনের জীবন নিজস্ব ছন্দে ভেসে যেতে থাকে। কিন্তু জীবন সবসময় একই ছন্দে একই গতিতে বয়ে চলে না। জীবনেও ছন্দপতন হয়, গতি ও গতিপথ দুই বদলায়। স্বর্ণাভ-নম্রতার জীবনেও ছন্দপতন হল।

দীর্ঘদিনের পরিশ্রমের পর কেরিয়ারে সাফল্য অর্জন করে মস্কোর আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উত্সবে যোগ দেবার আমন্ত্রণ স্বর্ণাভর কাছে এল। মস্কো থেকে যেসময় তার ডাক এল সেসময় নম্রতা খুব অসুস্থ। ইউরিলিথিয়সিসে আক্রান্ত হয় নম্রতা। ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে জানান অপারেশন করানো ছাড়া অন্যত্র উপায় তিনি দেখছেন না। পাঁচ দিনের মধ্যে নম্রতার অপারেশন করাতে হবে। স্বর্ণাভর পক্ষে নম্রতাকে কলকাতায় এভাবে ফেলে রেখে মস্কো যাওয়াতে তার মন সায় দিচ্ছিল না। স্বর্ণাভর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু মৃগাঙ্কর উপর নম্রতার দেখভাল ও অপারেশনের দায়িত্ব দিয়ে সে কিছুটা নিশ্চিন্ত হল।

নম্রতা স্বর্ণাভকে একরকম জোর করেই মস্কো যেতে রাজি করাল। সে স্বর্ণাভকে বলল, দেখো, তুমি যখন সম্মান, পুরস্কার নিয়ে কলকাতায় ফিরবে তখন আমার চেয়ে কেউ এত গর্বিত হবে না। আমি একদম সুস্থ হয়ে যাব। তোমার সাফল্যে আমি যে কতটা খুশি হব তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। মৃগাঙ্কদা তো রইলই আমার দেখভাল করার জন্য। তুমি চিন্তা কোরো না। আমি তোমার জন্য দুহাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করব স্বর্ণাভ। তুমি তো জানো তোমাকে ছাড়া আমি নিজের অস্তিত্বকে কল্পনা করতে পারি না।

স্বর্ণাভ নম্রতাকে বুকের কাছে টেনে কপালে চুম্বন করে বলল, লাভ ইউ মাই হার্ট। তুমি আমার সবকিছু। তুমি ছাড়া আমার জীবনে আমি কিছু ভাবতে পারি না। আমাকে এভাবে বিদায় জানাতে তোমার ইচ্ছে করছে!

নম্রতা আধো গলায় স্বর্ণাভকে জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি যেভাবে আমার শরীরের প্রতিটি রক্তবিন্দুতে মিশে থাকো সেখানে তোমাকে ছাড়া একটা সেকেন্ড থাকা আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। কিন্তু কী করব বলো! ইচ্ছার বিরুদ্ধেও কখনও কখনও কাজ করতে হয় মানুষকে। দশটা দিনই তো, দশ বছর তো নয়! তোমার কথা ভাবতে ভাবতে আমার এক একটা দিন, চব্বিশ ঘণ্টা কেটে যাবে। আমি তোমার ভালোর জন্য সবকিছু করতে পারি। তোমার জন্য আমি এ পৃথিবী ছাড়তে পারি। শুধু তুমি আমায় ছেড়ে যেও না তাহলেই হবে।

—একদম এসব কথা বলবে না। একবার ভেবে দেখেছ তুমি পৃথিবীতে না থাকলে আমার কী হবে!

—মজা করে বললাম তো। তুমি সিরিয়াসলি নিয়ে নিলে।

—এসব বিষয় নিয়ে মজা করবে না। তুমি জানো এগুলো আমি পছন্দ করি না।

নম্রতা হাসতে হাসতে বলল, সরি বাবা। কান ধরছি। নম্রতা স্বর্ণাভর ভেজা ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে অপ্রত্যাশিত দীর্ঘ একটা চুমু খেল। তার ঈষৎ বাদামি চোখের তারায় দুষ্টুমি খেলে গেল।

—ম্যাডাম, এটা আমার উপরি পাওনা ছিল।

—না মশাই, তোমার উপরি পাওনা নয়। এটা ভালোবাসার ঘুস। আমার দেওয়া একটা স্মৃতিচিহ্ন যা তোমার কাছে আমৃত্যু থেকে যাবে।

মস্কো যাওয়ার দিন স্বর্ণাভকে ফ্লাইটে বিদায় জানাতে মৃগাঙ্কর সঙ্গে নম্রতা এল। স্বর্ণাভ চলে যাওয়ার পরের দিন নম্রতার অপারেশন। ভালোভাবেই সম্পন্ন হল। দিন তিনেক রেস্টে থাকার পর স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরল নম্রতা। বিদেশ থেকে স্বর্ণাভ টেলিফোনে মৃগাঙ্কর কাছে সব খবরাখবর পেল। একদিন তার নম্রতার সঙ্গেও কয়েক মিনিট কথা হল। দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেল।

ক্যালেন্ডারের পাতায় কালির দাগ দিয়ে দিনের হিসাব করতে করতে নম্রতা মৃগাঙ্ককে বলল, আর তিনটে দিন বাকি তোমার বন্ধুর ফিরতে। আমায় ছেড়ে যাব না যাব না করতে করতে গেল। আর গিয়ে দেখো ফোন করতে ভুলে গেল। জানি ওখান থেকে ফোন করা সমস্যা। তবু চারদিন হল বোধহয় ফোন করেনি। এইজন্যই বলে যে বিদেশে গেলে মানুষ দেশকে ভুলে যায়। দুদিন ফোনেই যা খবর নেবার তোমার কাছে নিয়ে নিয়েছে।

—তুমি মিথ্যাই রাগ করছ। হয়তো কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর তিনদিন পর ফিরবে বলে তোমাকে অপেক্ষা করাচ্ছে। তোমাকে আমার বন্ধু অবসরে মিস করবেই। তুমি মিলিয়ে নিও আমার কথা তিন দিন পর।

—ধুর, মিস করবে না ছাই! বিদেশিনি মহিলাদের দেখতে দেখতে ওর সময় ভালোই কাটছে। ওর কি এদিককার কথা মনে আছে!

—অত যখন বিশ্বাস করে ছাড়ার ক্ষমতা নেই তখন যেতে দিলে কেন! আমার বন্ধু তো তোমায় ফেলে যেতে চায়নি। তুমিই জোর করে পাঠালে। এখন দোষারোপ করছ!

—মৃগাঙ্কদা, আমার ওর উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে। ও কী করতে পারে কী পারে না সেটা বোধহয় আমার থেকে ভালো কেউ জানে না। সেদিন বিকেলে ঘণ্টাখানেক চায়ে আসরে নম্রতার সঙ্গে গল্প করে মৃগাঙ্ক চলে গেল।

প্রতিধ্বনি ফেরে ( পর্ব ৩ )

নম্রতারা গাড়িতে ওঠামাত্র গাড়ি ছেড়ে দিল। হোটেলের উদ্দেশ্যে পাহাড়ের নীচে দিয়ে গাড়ি নামতে থাকল। ঘড়িতে আড়াইটে বেজে গেছে। রৌদ্রোজ্জ্বল নীলাকাশ কোথা থেকে হঠাৎ করে কালো মেঘে ছেয়ে গেল। নম্রতার মতোই মেঘেরও মুখ ভার। কখন যে মনের আকাশ ঘন কালো মেঘে ছেয়ে বৃষ্টি নামবে স্বামী ধ্রুব বোধ হয় তার আঁচও পাবে না।

নম্রতা জানলার দিকে উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ধাক্কা লাগা ওই অচেনা ভদ্রলোকের কথা ভাবতে লাগল। নম্রতার মন কেন তোলপাড় হচ্ছে আজ। নম্রতা ভাবল যে কেনই বা ওই একঝলক ভদ্রলোকের চোখের চাহনি তার মনকে এত নাড়িয়ে দিয়ে গেল। অত্যধিক ঠান্ডায় ভদ্রলোকের মুখের অর্ধেক অংশ মাফলারে ঢাকা ছিল। সে তো তার সম্পূর্ণ মুখ দেখতে পায়নি। শুধু ভদ্রলোকের চোখ নয়, তার গলার স্বর, হাঁটাচলা সবটাই নম্রতার পূর্ব পরিচিত। এসব কেন মনে হচ্ছে!

আশার গলার আওয়াজে নম্রতার সম্বিত ফিরল। হোটেলের সামনে গাড়ি দাঁড়াতেই আশা চিত্কার করে বলল, মাম্মা, আমরা হোটেলে চলে এসেছি। গাড়ি থেকে নেমে হোটেলের ঘরে ঢোকামাত্র অঝোরে বৃষ্টি শুরু হল।

বাথরুম থেকে নম্রতা ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই ধ্রুব বলল, হোটেলের রুমেই খাবার দিয়ে যেতে বললাম। ওয়েট করো একটু। ধ্রুব আশাকে নিয়ে বাথরুম গেল হাত মুখ ধুতে। মিনিট পনেরোর মধ্যে একটি অল্পবয়সি মেয়ে ঘরে খাবার দিয়ে গেল। খাবার খেয়ে ধ্রুব আশাকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে নিজেও ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ল।

বালিশে মাথা দিয়ে নম্রতার চোখে ঘুম নেই। একটা অপরিচিত অথবা একটা অর্ধপরিচিত চোখ তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। নম্রতা আপন মনেই বলে উঠল, ইস, লোকটা তাড়াহুড়ো করে না চলে গেলে অন্ততপক্ষে নামটা জিজ্ঞাসা করা যেত। কিন্তু কেন ওই অপরিচিত লোকটার সবকিছু আমার এত চেনা লাগল! লোকটি কী সত্যিই আমার পূর্বপরিচিত! কে ওই ভদ্রলোক? লোকটার সঙ্গে আমার কি আর দেখা হবে? ধ্রুবর কথায় লোকটি টুরিস্ট যদি হয় তাহলে আবার দেখা হওয়ার সম্ভবনা আছে। দেখা হওয়ার সম্ভবনা থাকলেই বা কী লাভ! কিন্তু কী কারণে আমি লোকটিকে খুঁজছি!

ধ্রুব অর্ধ্বউন্মীলিত চোখে নম্রতার গায়ে হাত দিয়ে বলল, কী এত ভাবছ! একটু ঘুমোলে শরীরটা ফ্রেশ হতো।

নম্রতা হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, দুপুরে ঘুমোনো আমার কোনওদিনই অভ্যাসে নেই। তাছাড়া সন্ধে হয়ে গেছে অনেকক্ষণ।

ধ্রুব চোখ রগড়াতে রগড়াতে বিছানা ছেড়ে উঠে দেখল পাহাড়ের গায়ে চাপ চাপ অন্ধকার নেমে এসেছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। প্রচণ্ড ঠান্ডা হাওয়া বইছে সোঁ সোঁ শব্দে। বৃষ্টির হওয়ার ফলে বাইরে বরফ পড়ার মতো আবহাওয়া। লাচেন নদীর গর্জন শোনা যাচ্ছে জানলার কাছে দাঁড়ালে। হোটেলের একটি ছেলে ধোঁয়া ওঠা দুকাপ কফি দিয়ে গেল। কফির কাপে চুমুক দিয়ে নম্রতা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়ল। আশা বিছানায় অকাতরে ঘুমাচ্ছে।

ঘরের নিস্তব্ধতাকে ভেঙে ধ্রুব নম্রতাকে বলল, তুমি আমাকে এড়িয়ে গিয়ে ভুল করছ। আমি কোনও দোষ না করেও শাস্তি পাচ্ছি। স্বাভাবিক সহজ একটা সম্পর্ককে অযথা অস্বাভাবিক জটিল করে তুলে আমরা দুজনেই ভালো থাকব না। আমিও এতে ভালো নেই। আর তুমিও ভালো থাকবে না।

নম্রতা ধ্রুবর কথার জোরপূর্বক প্রতিবাদ করে একটু উঁচু স্বরে বলল, কে বলল তোমাকে যে আমি ভালো নেই! আমি খুব ভালো আছি। ভালো না থাকার মতো তো কিছু ঘটেনি।

ধ্রুব শান্ত স্বরে বলল, জোর গলায় ভালো আছি বললেই কি ভালো থাকাটা প্রমাণিত হয়! ধ্রুবর এই কথার কোনও প্রত্যুত্তর নম্রতা দিল না। কফি শেষ করে শূন্য কফি মগটা টেবিলে নামিয়ে আশার কাছে চলে এল। আশা ঘুম থেকে উঠে পড়ে যেন নম্রতাকে স্বস্তি দিল।

দুটো দিন লাচেনে কাটানোর পর নম্রতা-রা গ্যাংটকে ফিরে এল। গ্যাংটকের হোটেলে ওরা যখন পৌঁছোল তখন ঘড়ির কাঁটায় বিকাল চারটে। ধ্রুব আর আশা গাড়ি থেকে নেমে হোটেলের রুমে চলে গেল। নম্রতা বাইরে হোটেলের লনে পায়চারি করতে করতে মেঘলা বিকেল উপভোগ করতে লাগল।

বড়ো লন জুড়ে দেশি-বিদেশি ফুলের মেলা। অদূরে পাহাড়ের চূড়ায় সূর্য মুখ লুকাচ্ছে। সকাল থেকেই ঠান্ডা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। মাথার উপর দিয়ে তুলোর মতো মেঘগুলো বিক্ষিপ্ত ভাবে চলে যাচ্ছে। ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া এসে নম্রতার চোখে মুখে চুম্বন করে যাচ্ছে। সে গায়ে উপর শালটা ভালো করে জড়িয়ে হালকা শ্বাস ছেড়ে কাঠের বেঞ্চে বসল। নম্রতার এক হাত দূরত্বে একটা লোক দাঁড়িয়ে ঘনঘন সিগারেট খাচ্ছিল। সিগারেটের গন্ধ নম্রতার কোনওদিনই সহ্য হয় না। ওই গন্ধে নম্রতার অস্বস্তি হতেই নম্রতা বেঞ্চ ছেড়ে উঠে লোকটির কাছে দাঁড়িয়ে বলল, এক্সকিউজ মি। শুনুন, আপনি স্মোক করলে দূরে গিয়ে করুন। সিগারেটের পোড়া গন্ধে আমার অসুবিধা হয়।

লোকটি মুখ থেকে মাফলার নামিয়ে বলল, আপনার যদি অসুবিধা হয় আপনি সরে বসুন। পাশে আরও বেঞ্চ রয়েছে। লোকটির গলার ভারী কণ্ঠস্বর চিনতে ভুল হল না নম্রতার। লোকটির মুখের দিকে তাকাতেই নম্রতার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। নম্রতার গোলাপি দুটো ঠোঁট ঈষৎ কেঁপে উঠল। কম্পিত গলায় সে বলল, স্বর্ণাভ। তুমি বেঁচে আছো!

বয়সের সঙ্গে স্বর্ণাভর কিছু পরিবর্তন বাহ্যিক রূপের হয়েছে। লম্বা চওড়া সুদর্শন পুরুষ স্বর্ণাভ। টিকালো নাক। বুদ্ধিদীপ্ত মুখ। ফরসা গায়ে রং বয়স বাড়ার সঙ্গে যেন আরও ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়েছে। মাথাভর্তি কালো ঢেউখেলানো চুলে অল্পবিস্তর পাক ধরেছে। শরীর স্বাস্থ্য আগের চেয়ে অনেক ভালো। ভোরের নরম আলোর মতো দুচোখে সেই পূর্বের মতোই মোহময় দৃষ্টি। বয়স প্রায় আটান্নর ঘর ছুঁয়েছে।

নম্রতারও অবশ্য বাহ্যিক পরিবর্তন হয়েছে। বয়স তেতাল্লিশের ঘরে পা দিয়েছে। আগের মতো গোলগাল চেহারা নম্রতার নেই। শরীর অনেক ভেঙে গেছে। ধবধবে ফরসা রং অনেকখানি ম্লান হয়েছে। মুখের মধ্যে হালকা বয়সের ছাপ পড়েছে। মুখে সারল্যের চিহ্নমাত্র নেই। বয়স বাড়ার ফলে মুখ অনেকখানি দৃঢ় এবং আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ। ঈষৎ বাদামি চোখের তারা ধূসর বর্ণ নিয়েছে। চোখে কালো মোটা ফ্রেমের চশমা। কালো মেঘের মতো একঢাল ঘন কালো চুল উঠে তার ঘনত্ব কমিয়েছে।

স্বর্ণাভ নম্রতার কথার উওর খুঁজে না পেয়ে স্মিত হাসল শুধু। স্বর্ণাভর থেকে কোনও প্রত্যুত্তর না পেয়ে নম্রতা উঁচু গলায় বলল, তুমি হাসছ? জানো, তোমার অপেক্ষায় আমি আজও কাউকে নিজের ভাবতে পারি না। তোমার জন্য আমি সংসার করেও সংসারী হতে পারিনি। তুমি এই পৃথিবীতে থাকা সত্ত্বেও একবার আমার সঙ্গে এতগুলো বছর দেখা করলে না! কেন? কী অপরাধ করেছি আমি? এভাবে তুমি কেন মুখ লুকিয়ে থেকে গেলে!

স্বর্ণাভ হাসতে হাসতে বলল, তোমার স্বামী আছে। তোমার তো একটা মেয়ে আছে শুনেছি। অথচ তুমি কিনা সংসারী হতে পারোনি! এই কথাগুলো ফিল্মের ডায়লগের মতো। এই পৃথিবীতে কেউ কারও জন্য অপেক্ষা করে না। আমিও করিনি। সময় নিজের নিয়মে নিজের মতো বয়ে যায়। তুমিই তো নিজে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।

প্রতিধ্বনি ফেরে ( পর্ব ২ )

অবশেষে সিকিম যাওয়ার সময় হয়ে এল। সাতদিনের প্রোগ্রাম। ধ্রুব নম্রতা এবং আশাকে সঙ্গে নিয়ে রাতের ট্রেনে পাড়ি দিল সিকিমের উদ্দেশ্যে। ট্রেন থেকে সকালে শিলিগুড়িতে নেমে গাড়িতে প্রায় ছয় ঘণ্টার জার্নি। ধ্রুব অবশ্য সব আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিল। ছয় ঘণ্টা জার্নির পর ধ্রুবরা গ্যাংটকের হোটেলে পৌঁছাল। ধ্রুব এবং আশার মেজাজ ফুরফুরে হলেও নম্রতার মুড বেশ অফ। সেটা ধ্রুবর দৃষ্টি এড়ায়নি। নম্রতা-রা একদিন গ্যাংটকে থাকার পর লাচেন এবং লাচুং-এর উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

সারাদিন ঘুরে বেড়িয়ে লাচুং-এর হোটেলে দ্বিতীয় দিন রাত্রে ধ্রুব নম্রতার কাছাকাছি আসার চেষ্টা করল। আশা বাচ্চা মেয়ে সারাদিন বেড়ানোর ফলে তার শরীর ক্লান্ত ছিল। বিছানায় শুতেই সে বেঘোরে ঘুমিয়ে পড়ল। রাতের খাবার খেয়ে নম্রতা হোটেলের ঘরের লাগোয়া বারান্দায় নীরবে দাঁড়িয়ে কী যেন ভাবছিল। পাহাড়ের বুকে তারাগুলো জোনাকির মতো জ্বলছে। রাত্রের নিস্তব্ধতায় পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝরনার জলের শব্দ, নীচে খরস্রোতে বয়ে চলা লাচুং নদীর শব্দ যেন শান্ত মনকে উত্তাল করে তুলছে। বরফাবৃত উত্তুঙ্গ হিমালয়, রাতের প্রশান্ত আকাশকে যেন চুম্বন করতে চাইছে। ধ্রুব বিছানা ছেড়ে নম্রতাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল, এত ঠান্ডায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছো কেন? ঘরে শোবে চলো।

—তুমি শুয়ে পড়ো। অযথা সময় নষ্ট কোরো না।

—সময় নষ্ট! এই প্রথমবার আমি সময়ে সদ্ব্যবহার করছি। তোমাকে একা ফেলে আমি ঘরে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যেতে পারব না তা তুমি ভালো করেই জানো। তোমাকে আমি ভালোবাসি।

ধ্রুবর হাত ছাড়িয়ে একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে নম্রতা উদাস কণ্ঠে বলল, ভালোবাসার সংজ্ঞাটা যে ঠিক কি সেটাই আমি এখনও বুঝে উঠতে পারি না। কেউ আমাকে সত্যিই ভালোবাসতে পারে সে বিশ্বাসও আমি করি না।

—তার মানে তুমি বিশ্বাস করো না যে আমি তোমাকে ভালোবাসি। তাই তো! আমাকে আমার ভালোবাসার প্রমাণ দিতে কী করতে হবে তাই বলো।

—আমি তোমাকে কিছু প্রমাণ দিতে বলছি না। যার প্রমাণ দেবার কথা, সে তো বিনা প্রমাণেই অনেক কিছু প্রমাণ করে দিয়ে গেল।

ধ্রুব নম্রতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার দুটো হাত জড়িয়ে ধরে বলল, কী হয়েছে তোমার! আমার সঙ্গে কি কিছু শেয়ার করা যায় না! আমি কি এতটাই তোমার অযোগ্য স্বামী হিসেবে! আচ্ছা নম্রতা, স্বামী হিসাবে নয়, বন্ধু হিসাবে তো তুমি আমাকে তোমার মনের দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা শেয়ার করতেই পার। বিয়ে হওয়ার পর থেকে আমি বুঝি তুমি কষ্ট পাচ্ছো কোনও কারণে। তোমার অতীত আমি কোনওদিন জানতে চাইনি। আজ বড়ো জানতে ইচ্ছে করছে। আমাদের একটা মেয়ে আছে। তার কথা ভেবে আমাদের দাম্পত্যের দূরত্ব ঘোচাতে হবে নম্রতা। আমি আর পারছি না।

ধ্রুবর কথা নম্রতা এড়িয়ে গিয়ে বলল, রাত অনেক হল। চলো ঘরে।

ধ্রুব বলল, তুমি আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছ!

নম্রতা বলল, এড়িয়ে যাচ্ছি না। এসব কথা বলার সময় এটা নয়। আর তাছাড়া তুমি কি আশার মতো বাচ্চা নাকি! আমি আশার জন্য এখানে বেড়াতে এসেছি। বিয়ে এত বছর পর সিকিমে এসে আমরা নিজেদের নিয়ে আলোচনা করতে আসিনি। আফটার অল, আমি এসব নিয়ে কখনও ভাবিনি। দাম্পত্য, প্রেম, ভালোবাসা আমি তোমার থেকে কিছু চাইছি না। এই সহজ কথাটা বুঝতে এত সময় লাগছে কেন! আমি এই পৃথিবীতে কারওর কাছে কিছু প্রত্যাশা করি না। প্রত্যাশা বড়ো আঘাত দেয়। কথা শেষ করে নম্রতা বিছানায় চলে গেল।

ধ্রুব কিছুক্ষণ পর বিছানায় নীরবে নম্রতার পাশে শুয়ে পড়ল। পাশে শুয়ে সে টের পেল নম্রতা চোখের জলে বালিশ ভেজাচ্ছে। মাঝে মাঝে নম্রতা কাঁদতে কাঁদতে ফুঁপিয়ে উঠছে। স্ত্রীর চোখের জলের কারণ খুঁজে না পাওয়ায় স্বামী হিসাবে ধ্রুবর নিজেকে বড়ো অসহায় মনে হল।

নতুন সকাল আসে নতুন একটা দিনের সূচনা করতে। রাতের সব কালিমাকে এক নিমেষে মুছে দিয়ে জীবনকে আলোকিত করতে। পাহাড়ি সূর্যটাও নম্রতার রাতের মলিন মুখটাকে তার রাঙা আলোয় ভরিয়ে দিয়েছে। নম্রতার সারা মুখে ছড়িয়ে আছে স্নিগ্ধতার মাধুর্য। বারান্দায় কফি মগ হাতে নিয়ে সে, আশার সঙ্গে গল্পে মশগুল। রাত্রের নম্রতার সঙ্গে এই মানুষটার আকাশ-পাতাল তফাত। ধ্রুব মাঝেমাঝে আশা এবং নম্রতাকে তাড়া লাগাতে থাকে তৈরি হওয়ার জন্য। আধ ঘণ্টার মধ্যেই তারা লাচেনের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাবে। নির্দিষ্ট সময়মতো ড্রাইভার এসে হাজির।

পাহাড়ি সর্পিল পথ বেয়ে গাড়ি লাচুং ছেড়ে ছুটল লাচেনের উদ্দেশ্যে। চোপতা উপত্যকা, কালাপাহাড় দেখিয়ে ধ্রুবদের গাড়ির ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে চলল গুরুদোংমার লেকের পথে। গাড়ি যত পাহাড়ের উপর উঠতে থাকল চোখে পড়ল শুধু সোনালি ধূসর পাহাড়। গাছপালা প্রায় নেই বললেই চলে। ভারতীয় সেনাদের এলাকা অতিক্রম করে গাড়ি ছুটল গুরুদোংমার লেকের দিকে। একদিকে নীচে পাহাড়ের গা বেয়ে লাচেন নদী খরস্রোতে বয়ে চলেছে অন্যদিকে রুক্ষ বিস্তৃত প্রান্তর।

উন্নতশির পাহাড়ের মাথায় সাদা বরফের মুকুট যেন আলাদা শোভাবর্ধন করছে। পাহাড়ি রাস্তার দুধারে মনে হচ্ছে কেউ যেন বরফের গুঁড়ো ছিটিয়ে রেখেছে। গাড়ির চাকা বরফ গুঁড়ো করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে। অদূরে পাহাড়ের গা থেকে নেমে আসা ঝরনার জল বরফে জমাট বেঁধে যেন থমকে গেছে।

আশা বাবা-মার সঙ্গে এই বেড়াতে আসাটা খুব উপভোগ করছে। নম্রতার বর্তমান কখনও কখনও তার অতীতকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। ধ্রুব নম্রতার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করতে চাইলেও পারছে না। নম্রতার ক্ষণে ক্ষণে মুড অফ হয়ে যাচ্ছে। বিস্তীর্ণ পাহাড়ি পথ পিছনে ফেলে গাড়ি এসে পৌঁছোল গুরুদোংমার লেকে। লেকে ঘুরতে ঘুরতে নম্রতার অন্যমনস্কতার জন্য একজন লোকের সঙ্গে জোরে ধাক্কা লাগল। নম্রতার সঙ্গে ধাক্কা লাগায় লোকটির হাত থেকে জলের বোতলটা ছিটকে পড়ে গেল। নম্রতা বোতল তাড়াহুড়ো করে কুড়িয়ে লোকটির হাতে তুলে দিয়ে বলল, সরি। আমি আসলে বুঝতে পারিনি।

নম্রতা লোকটির চোখের দিকে তাকাতেই তার মাথায় তুলে রাখা রোদচশমা চোখে পড়ে ভারিক্কি গলায় বলল, ইটস ওকে। সাবধানে চলবেন তো। কথা শেষ করে লোকটি ঝড়ের গতিতে গাড়িতে ওঠার জন্য পা বাড়াল। লোকটির চোখ, হাঁটাচলা, ওই ভারী কণ্ঠস্বর নম্রতার খুব পরিচিত মনে হল।

লোকটির পিছন পিছন ছুটতে ছুটতে সে ডাকল, এই যে শুনছেন। একটু দাঁড়ান। নম্রতাকে ছুটতে দেখে ধ্রুব সামনে এসে দাঁড়াল।

ধ্রুব বলল, কাকে ডাকছ তুমি? কে ছিল?

নম্রতা ব্যাকুল গলায় বলল, আরে ওই যে ভদ্রলোক। যার সঙ্গে আমার একটু আগে ধাক্কা লাগল। ধাক্কা খেয়ে ওনার হাতে জলের বোতল পড়ে গেল।

ধ্রুব ভদ্রলোককে দেখতে না পেয়ে বলল, কেউ তো নেই ওখানে দুটো গাড়ি ছাড়া। আমাদের মতোই টুরিস্টদের গাড়ি হবে। তাড়াহুড়ো করে ভদ্রলোক ততক্ষণে গাড়ি নিয়ে ওখান থেকে কেটে পড়েছে।

আশা মায়ের হাতটা নাড়িয়ে বলল, মাম্মা, তুমি কি কাউকে খুঁজছ?

নম্রতা আনমনা হয়ে বলল, না। না তো।

ধ্রুব বলল, চলো। আমরা গাড়ির কাছে যাই। ড্রাইভার আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।

পিছুটান

দেখতে দেখতে বেশ কিছুদিন হয়ে গেল এখানে। চুপচাপ নিস্তরঙ্গ এই ছোট্ট জনপদটা বেশ লাগছে আমার। সবুজে ঘেরা চারপাশ। আকাশ এখানে দিনে নীল, রাতে ঘন কালো। আর যখন সেই ঘন কালো আকাশ জুড়ে সলমাজরির ফুলকারি কাজের মতো ঝিকিমিকি তারা দেখি, আমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে যায়। ছেলেবেলায় ছোটোকাকু মাঝেমাঝে আমায় এমন রাতে ছাদে নিয়ে যেত তারা চেনাতে। সপ্তর্ষিমণ্ডল, শুকতারা, ধ্রুবতারা…

এখানে এসে আবার আমার তারাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হচ্ছে। আকাশ, গাছ, পাখি, কাঠবিড়ালি— সবার সঙ্গে চেনাজানা বাড়ছে। শহরে তো শুধু ইট-কাঠ-কংক্রিট আর ব্যস্ত দৌড়ে বেড়ানো মানুষের ভিড়।

আমি খুবই সাধারণ মধ্যমেধার একজন মানুষ। কী পড়শোনা, কী অন্যকিছু, কোনও কিছুতেই তেমন ছাপ ফেলার মতো কিছু করতে পারিনি আজ অবধি। আমি যাকে বলে একটা এলেবেলে, ভিড়ে মিশে থাকা মনিষ্যি. যার ওই একটা নামই আছে শুধু।

বাবা-মা গত হয়েছেন, বোন তার সংসার নিয়ে নাজেহাল। চারপাশে সবাই কমবেশি ব্যস্ত, শুধু আমারই অখণ্ড অবসর। পৈত্রিক বাড়ির একটা অংশের ভাড়া আর বাবার রেখে যাওয়া কিছু টাকায় আমার চলেই যেত ঠিকঠাক। আসলে কোনও কাজই খুব বেশিদিন আমার ভালো লাগত না, একঘেয়ে লাগত। তাই কখনও কাজ আমায় ছাড়ত কখনও আমি কাজকে।

বন্ধুবান্ধব সবাই যে যার মতো নিজের জীবনে শিকড় গেড়ে বসেছে। তাদের কত গল্প! বউয়ে টকঝাল খুনসুটি, সন্তানের স্কুল, পরীক্ষা, ভবিষ্যৎ। নিজেদের পরকীয়া, অবদমিত যৌনতা, সুগার, প্রেশার, আমাশা, ফ্ল্যাটের ইএমআই, গাড়ির মাইলেজ, বসের শয়তানি, বকেয়া ডিএ। ওদের কত্ত বিষয় আলোচনার, যেগুলো আমার কিচ্ছু নেই। তাই ধীরে ধীরে একসময় ওদের থেকে আলাদা হয়ে গেলাম। ওরা ওদের মতো আর আমি আমার মতো, একা।

তবে কি, একা থাকতে থাকতে একটা সময় বেশ ক্লান্ত লাগত। মাঝেমাঝেই মনে হতো একটা সংসার থাকলে বেশ হতো। একটা মিষ্টি মতো বউ। যার পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর, দু-একটা ছেলেপিলে, কিছু দায়িত্ব, একটু ঝগড়াঝাঁটি, মান-অভিমান আর এসব জড়ানো অনেকটা ভালোবাসা মাখানো রাশি রাশি স্বপ্ন। তারপরই হাসি পেত। আমার মতো লোকের নাকি আবার বউ, ছেলে-মেয়ে সংসার… ঠিক এমন সময়ে এই চাকরির সুযোগটা এসেছিল।

আমার ভাড়াটে ছেলেটি বেশ চৌকশ। কোথায় একটা চাকরি করে, শখের ফটোগ্রাফার আর কী সব এনজিও-র সঙ্গে যুক্ত। ছটফটে মজারু ছেলে। ও একদিন হঠাৎ বলল, দাদা আজকাল কী করছেন?

এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ভারি মুশকিল। যদি বলি কাজ করছি, তো কী কাজ? কোথায় অফিস? কত দেয়? হাজার প্রশ্ন! আর যদি বলি কিছু করছি না, তবে কেন করছেন না? না করলে চলছে কী করে? আরও একঝুড়ি কথা। আমার বেশি কথা বলতে ভালো লাগে না। তাই হুঁ হা করে এড়িয়ে যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু সে ছেলে ছাড়লে তো?

—একটা কাজ আছে, করবেন? আপনার ভালো লাগবে।

—এই রে, আমার মতো লোকের জন্যও কাজ?

—কেন? মানে আমাকেই বলছ কেন? কাজের লোকের তো অভাব নেই।

—না মানে, ওরা একজন পিছুটানহীন লোক চাইছেন, তাই…

সত্যিই তো। এভাবে তো ভাবিনি। আমার এই জীবনটা নিয়ে আমি যা খুশি করতে পারি। আমার পথ চেয়ে কেউ বসে থাকার নেই। আমারও কারও কাছে কোনও দায় নেই। আমার না আছে শিকড় না নিজস্ব পরিসর। আমি সত্যিই পিছুটানহীন। তা এহেন আত্মপোলব্ধিতে অন্যের কী হতো জানি না, আমার বেশ মজাই লেগেছিল।

রাজি হবার সময় সত্যি ভাবতে পারিনি এরকম একটা জায়গায় থেকে কাজ করতে হবে আমায়। শহর থেকে অনেক দূরে, শাল মহুলে ঘেরা এই ছোট্ট জনপদে একটা আবাসিক স্কুলের কেরানি এখন আমি। ছাত্ররা সবাই স্থানীয় গ্রামের। বেশির ভাগই বোর্ডিং-এ থাকে। আমার কাজ বোর্ডিং-এর খাতাপত্র লেখা, ছেলেপুলেগুলোর ওপর নজর রাখা, খাবারদাবার এর তদারকি করা এইসব। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা বোর্ডিং-এই।

আমার জন্য বরাদ্দ ছাদের ঘরটা চমৎকার। জানলা খুললেই স্কুলের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে সবুজ মাঠ পেরিয়ে দূরের গহিন জঙ্গলটা দেখা যায়, যার একটু ভিতরে একটা আদিগন্ত বিস্তৃত জলাশয় আছে। রাতে ছেলের দল খেয়েদেয়ে যখন শুয়ে পড়ে, আমি ঘর ছেড়ে ছাদে চলে আসি। দূর জঙ্গলটা থেকে তখন কতরকম শব্দ মিঠে হাওয়ায় ভেসে আসে। শনশনে হাওয়ায় ডালপালার আড়মোড়া ভাঙা, রাতচরা পাখির তীক্ষ্ন ডাক, অজানা জন্তুর গরগরানি আর সেসব ছাপিয়ে অদ্ভুত একটা ছলছলে জলের আওয়াজ ভেসে আসে। প্রশান্ত, গম্ভীর, বাঙ্ময়। যেন একটা গভীর ডাক, একটা আকুল আহ্বান। আমি একদিন যাব। আমায় যেতেই হবে ওইখানে।

আজ অকারণেই আমার মনটা খারাপ। দুপুর শেষ হতেই কিছুই যেন ভালো লাগছিল না। কাজে মন বসছিল না। কাউকে কিছু না জানিয়ে স্কুল চৌহদ্দির পিছন দিকটার ঢালু জমিটায় এসে বসেছি। এখান থেকে বড়ো বড়ো গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে সেই জলাটা আবছা দেখা যায়।

আমার ভিতরে আজ কদিন একটা ইচ্ছে পাক খাচ্ছে। যাই চলে এই ঘাস জমি পেরিয়ে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ওই জলাশয়ে কাছে। দুদণ্ড বসি ওর পাড়ে। স্কুলের মাস্টারমশাইরা পই পই করে বারণ করেছেন জঙ্গলে যেতে। সাপ-খোপ, বুনো জন্তু কী না আছে ওখানে! বোর্ডিং-এর রান্নার মাসি একদিন বলছিল, ওই জলার নাকি মায়াটান আছে। মানুষকে ভুলিয়ে ভালিয়ে টেনে নিয়ে যেতে চায়। যতসব গ্রাম্য রটনা।

এখন দুপুর গড়িয়ে পড়ছে বিকেলের কোলে। কয়েজন গ্রাম্য নারীপুরুষ গরু ছাগলের খুঁট ধরে বেরিয়ে আসছে জঙ্গল থেকে। কারও মাথায় ঝরা শালপাতার বোঝা, কারও হাতে কাঠকুটো, ডালপালা। আপন মনে কলকল করতে করতে ওরা চলে যাচ্ছে দূর গাঁয়ে দিকে। ওদের কথা, হাসি, ছাগলগুলোর গলার ঘন্টার টুংটাং আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। মানুষ আর গরু ছাগলের পায়ে অভিঘাতে মেঠো পথে ধুলোর ঘুর্ণি উঠছে। ওদিকের বিশাল প্রাচীন গাছগুলোর মাথায় সূর‌্য আগুনরাঙা থালার মতো ধীরে নেমে আসছে। আর সেসবের মধ্যে দিয়ে আমার কানে আসছে পাড়ে মৃদু মৃদু ধাক্কা খাওয়া জলের শব্দ। ছলাৎ… ছলাৎ…। আমায় বিবশ করে ফেলছে সেই শব্দ।

হঠাৎ যেন ঘোর ভেঙে দেখি একটা ছোট্ট ছেলে, এই দশ কি বারো বছর বয়ে হবে, ঢলঢলে হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি পরা, হাতে একটা মাছ ধরার ছিপ নিয়ে হনহন করে জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে। আমি তো অবাক। এই সময়ে একা একটা বাচ্চা ছেলে ওদিকে যাচ্ছে কেন?

—এই ছেলে, তুই কোথায় যাচ্ছিস রে?

ভয়ানক চমকে ছেলেটা দাঁড়িয়ে পড়ল। আমি উঠে ওর কাছে গেলাম। ছেলেটা আমাকে দেখছে আমিও ওকে। একমাথা রুখুশুখু চুল, শ্যামলা মুখটায় টানা টানা দুটো চোখ। কী ভীষণ মায়া জড়ানো তাতে।

—তুমি কে?

—আমি? আমি ওই স্কুলে থাকি। শহরের লোক।

—ও, তা তুমিও জলা দেখতে যাচ্ছ?

ভারি আশ্চর্য তো! আমার জলা দেখার ইচ্ছের কথা ও জানল কী করে?

—বললি না তো তোর নাম কী?

—ছোটু।

—আরে বাঃ ভারি সুন্দর নাম তো। তা তোর প্যান্টুটা কি কোমরে ঢলঢল করছে? হাত দিয়ে ধরে আছিস যে?

—হঁ।

—আচ্ছা দাঁড়া।

আমি ওর সামনে হাঁটু মুড়ে বসলাম। তারপর প্যান্টুটা ধরে ওর কোমরের ঘুনসির মধ্যে দিয়ে গলিয়ে ওপর দিকে তুলে আবার একটু নামিয়ে দিলাম। প্যান্টটা টাইট করে আটকে রইল ওর ঘুনসিতে। একগাল হাসি উপহার দিল ছোটু।

—চলো তোমায় জলা দেখিয়ে নিয়ে আসি। আমি দুটো মাছ ধরব ওখান থেকে। মা আর আমি খাব।

—ও তা বেশ। চল…

ছেলেটা ভারি সরল আর মিশুকে তো। আমি ভাবছিলাম আমাদের শহরের বাচ্চারা অচেনা লোকের সাথে এত কথা বলত না।

—ঘরে তোরা কে কে থাকিস রে?

—আমি আর মা।

—তোর বাবা?

—বাবা নেই। চলে গেছে। আর আসে না।

আমার বুকটা হু হু করে উঠল। আহা রে, এতটুকু ছেলের বাবা নেই। কেন জানি না কীরকম একটা জ্বালা করে উঠল চোখ দুটো। ছোটু মহা উৎসাহে হাত পা নেড়ে আপনমনে বকবকম করতে করতে তরতরিয়ে হাঁটছে। আমি ওর সাথে তাল রাখতে গিয়ে হাঁফিয়ে যাচ্ছি।

—তা মাছ যে ধরবি তোর চার কোথায়?

—এই তো।

বলে পকেট থেকে ছেঁড়া কাগজে মোড়া একদলা মোটা লালচে ভাত বার করল ও।

—ও আচ্ছা।

আমরা এখন জঙ্গলে ঢুকে পড়েছি। খুব চুপচাপ চারদিক। দূরে অস্পষ্ট পাখির ডাক আর বড়ো গাছগুলোর নীচে পড়ে থাকা শুকনো পাতার ওপর দিয়ে আমাদের চলার শব্দ ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই।

শুধু একটা গন্ধ। ভেজা, গহন, গভীর, প্রাচীন একটা গন্ধ ধীরে ধীরে আমার ইন্দ্রিয়কে বশ করে আনছে। কী মাদকতা এই গন্ধে। আমি অস্থির হয়ে উঠছিলাম। আরও কাছে যেতে হবে এ গন্ধের

—উই দ্যাখো গো জলা। আমরা এসে গেছি গো।

হঠাৎ যেন উঁচু গাছগুলোর মাথা থেকে ঝুপ করে দলা দলা নরম অন্ধকার নেমে এল নীচে। কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগল আমাদের ঘিরে। আমরা এখন জলের একদম কাছে এসে দাঁড়িয়েছি।

দ্রুত সন্ধে নেমে আসছে। ছোটু দেখলাম পাড়ের কাদা মাড়িয়ে পায়ে পাতা ডুবিয়ে ভাত বেঁধানো বড়শিটা জলে ছুড়ে দিল। কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপর জলে একটা আলোড়ন উঠল। আমি ছোটুর পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম তোলপাড় হচ্ছে জল। ছোটুর ছিপে টান পড়েছে। ও প্রাণপণে ছিপটা টেনে ধরে পাড়ের দিকে আনতে গেল কিন্তু উলটে নিজেই জলের মধ্যে নেমে যেতে লাগল।

আমি খুব উৎসাহ পেয়ে গেলাম। বড়ো কোনও রাঘব বোয়াল গেঁথেছে নির্ঘাত। ছোটুর হাতের পাশ দিয়ে চেপে ধরলাম বঁড়শিটাকে। টানতে লাগলাম পাড়ের দিকে।

পারছি না। পারছি না দুজনে। উলটে নেমে যাচ্ছি জলের গভীরে। ওটা আমাদের টেনে নিচ্ছে ভিতর পানে। আঁধার আরও গভীর হচ্ছে চারপাশে। আমার পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে শ্যাওলা। ছোটুর হাতটা ছেড়ে গেল বোধহয়। আমি শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ছিপটায় টান দিলাম আর তখনই এক অপার্থিব দৃশ্য দেখলাম।

আমার মাথার ওপরে, চারপাশে চরাচর জোড়া মিশকালো আকাশ। সারা আকাশ জুড়ে সলমাজরির ফুলকারি কাজের মতো তারাদের ঝিকিমিকি। আমি কোমর অবধি ডুবে আছি সেই তরল কালো আকাশে! আমার চারপাশে সেই আকাশ ছাওয়া অমোঘ মায়া আমায় পিছু টানছে। চারপাশে কী যেন ভেসে বেড়াচ্ছে মাছের মতো। সরে যাচ্ছে দূরে, আবার কাছে আসছে।

আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকছে। ফিশফিশ করে বলছে আয় আয়। ডুব দে আরও গভীরে। পাড়ে কেউ নেই তোর জন্য অপেক্ষায়। আর ফিরে যাওয়ার কী দরকার? এখানে আয়। এখানে নির্জন অন্ধকার বড়ো গভীর আর শীতল। সব তাপ তোর জুড়িয়ে যাবে। আয়… আয়…

আমি অনুভব করলাম এই অমোঘ ডাক— এই টান, অস্বীকার করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি বিবশ। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম আমি পাড়ে যাব না।

সেই গন্ধটায় চারপাশ ম’ ম’ করছে। আমি ডুবে যাচ্ছি সেই আদিম গন্ধে। হঠাৎ মনে হল ছোটুর কথা। ও কোথায়? আমি থমকে গেলাম, জোর করে নিজের মনকে সংযত করার চেষ্টা করলাম।

—ছোটু, ছোটু, কোথায় তুই?

—এই তো আমি, মাছ পেয়েছি গো।

আমি পিছু ফিরলাম। ছোটু পাড়ে দাঁড়িয়ে ওর হাতে একটা রুপোলি মাছ ছটপট করছে। ছোটুর মুখে হাসি। এমন হাসি, এত মধুর, অমলিন, স্বর্গীয় যে, আমার বুকটা হু হু করে উঠল।

আমি দেখতে পেলাম তকতকে নিকানো মাটির উনুনে, কাঠকুটো আর শুকনো ডালপালার আগুনে লোহার কড়াইয়ে মাছ ভাজা হচ্ছে। টাটকা মাছের গন্ধে ম’ ম’ করছে চারপাশ। ছোটু বসে আছে ধোঁয়া ওঠা মোটা লালচে ভাত রাখা থালার সামনে। একগোছা রেশমি চুড়ি পরা হাতে ভাজা মাছের দুটো টুকরো তুলে দিচ্ছে ওর পাতে, মাথায় ঘোমটা টানা কেউ একজন। তারপর সে আমার দিকে ফিরল।

—আসুন, এবার আপনিও বসুন।

আমি দেখলাম তার মুখে সলজ্জ হাসি। গর্জন তেল মাখানো প্রতিমার মুখের মতো চকচকে মুখ তার, কপালে সিঁদুর। সেই সিঁদুরের কমলা গুঁড়ো তার নাকের ওপর পড়েছে। তার হাতে ধরা গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের থালা। আমার জন্য।

আর কিছু ঠিক ঠাওর করতে পারলাম না। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে, গলার কাছে দলা পাকানো কী একটা ঠেকছে।

আমি আর কিচ্ছু না ভেবে শরীরের সব শক্তি দিয়ে পিছু ফিরলাম। আমায় ফিরতে হবে। পাড়ে যেতে হবে। এক উলটো টান আমায় পাড়ের দিকে টানছে। সে টান অগ্রাহ্য করার শক্তি নেই আমার।

এখন আমার হাতে ধরা ছোটুর হাত। ওর গা মাথা আমি মুছিয়ে দিয়েছি আমার জামা দিয়ে।

ছোটু বকবক করছে। ওর গাঁয়ের গল্প, বন্ধুদের কথা, মায়ের কথা বলছে।

আমার মনে এখন অদ্ভুত এক প্রশান্তি। অথই জল ছেড়ে শুকনো ডাঙায় ওঠার নিশ্চিন্তি। ছোটুর হাতের উত্তাপ আমার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। আমি ভিতরে ভিতরে ছটফট করছি। দেখতে পাচ্ছি কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করছে গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের থালা নিয়ে যার পরনে ঢাকাই শাড়ি কপালে সিঁদুর।

আকাশের নিকষ কালো অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ফুটফুটে একফালি চাঁদ। আমার শরীর মন জুড়ে এখন ভীষণ খিদে।

স্ময়ন

নির্জন রাস্তার ওপর রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছি। আমার আয়ু বড়োজোর আর কিছুক্ষণের। ছটফট করার মতো শক্তিটুকুও লোপ পেয়েছে। এই গল্পের নায়ক অন্য কেউ। আমি পার্শ্বচরিত্র মাত্র। আমি প্রীতিশাকে খুব ভালোবেসেছিলাম। ও আমার সঙ্গে একই কলেজে একই বিভাগে পড়ে। বিএ, বাংলা বিভাগ। তবে প্রথম দিন থেকে আমার মনে প্রীতিশার প্রতি ভালোলাগার অনুভূতি সৃষ্টি হলেও ও অন্য একজনকে ভালোবেসে ফেলেছিল। ছেলেটির নাম স্ময়ন। সে পুরো ক্লাসের চোখের মণি হয়ে উঠেছিল। ওর পার্সোনালিটিতেই এমন কিছু ছিল, যা প্রফেসর থেকে শুরু করে ক্লাসের সহপাঠীদের প্রবল ভাবে আকৃষ্ট করত। অল্প সময়ের মধ্যেই সে আমারও খুব ভালো বন্ধু হয়ে গিয়েছিল। পড়াশোনায়ও সে খুব ভালো। আমিও তার আশেপাশেই নম্বর পেতাম।

প্রীতিশার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বেশ জমে উঠেছিল। বসন্তের মনোরম দুপুরে ক্যান্টিনে বসে ওর সঙ্গে সময় কাটাতে বেশ ভালোই লাগত। সেইসব দিনগুলোর কথা কোনও দিন ভুলব না। আমি মনে মনে ঠিক করে ফেলেছিলাম আর কয়েকদিনের মধ্যেই প্রীতিশাকে আমার মনের কথা জানিয়ে দেব। তবে ওই যে কথায় আছে, ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই। তবে এক্ষেত্রে অন্য কথা আসবে। কপালে নেই তো ঘি, ঠকঠকালে হবে কি? আমার আগেই স্ময়ন বাজি মেরে দিয়েছিল। প্রীতিশা আমারই চোখের সামনে অন্য একজনের হয়ে গিয়েছিল। সেই মুহুর্তে আমার মনের ভেতরটা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল।

প্রীতিশা এই ঈশানের জীবন থেকে একটু একটু করে ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিল। সে কোনও দিনও আমার হবে না, ব্যাপারটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারলাম না। আমি মানছি, আমার স্মার্টনেস স্ময়নের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু তাই বলে প্রীতিশা আমার মন বুঝল না, সেটা ভেবেই ভিতরে ভিতরে আমি গুমরে মরছি। না, এভাবে চলতে থাকলে একদিন হয়তো আমি পাগল হয়ে যাব। আমি মনে মনে ঠিক করলাম— প্রীতিশার সঙ্গে একান্তে কথা বলব। পরের দিন প্রথম ক্লাস শেষ হওয়ার পর ওর কাছে গিয়ে বললাম, “তোর সঙ্গে কিছু কথা আছে। আমার সঙ্গে ওপরে চল।”

প্রীতিশা আমার পিছন পিছন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে জিজ্ঞেস করল, “কী কথা? এখানে বলা যায় না?”

“না যায় না।”

আমি ওকে তিনতলার একটা ফাঁকা ক্লাসরুমে নিয়ে গিয়ে চোখে চোখ রেখে বললাম, “আমি তোকে আজ একটা কথা বলতে চাই। জানি না কথাটা শোনার পর তোর-আমার বন্ধুত্ব টিকবে কি না, কিন্তু আমি যেভাবে কষ্ট পাচ্ছি, তার তুলনায় সেই কষ্ট অনেক কম হবে।”

“ধোঁয়াশা না করে পরিষ্কার করে বল কী বলতে চাস?”

“আমি তোকে খুব ভালোবাসি। কলেজের প্রথম দিন থেকে একটু একটু করে তোর প্রতি যে-ভালোলাগার অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা অজান্তেই কবে ভালোবাসায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল। আমি তোকে মনের কথা বলব বলব করেও বলতে পারিনি।”

“তবে আজ কেন বলছিস? তুই জানিস আমি স্ময়নকে ভালোবাসি। ক’দিন পরেই আমাদের এনগেজমেন্ট।”

“ক’দিন পর। এখনও তো হয়নি। তবে আটকাচ্ছে কোথায়? কত মেয়ে বিয়ের দিন মণ্ডপ ছেড়ে পালিয়ে যায়। সেখানে তো তোর…”

“পাগলামো করিস না। আমি তোকে কখনও ভালোবাসতে পারব না। কারণ আমি এখন স্ময়নের হয়ে গিয়েছি। তুই তো সব জানিস। তারপরেও তুই কেন এমন জেদ করছিস?”

আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। ঠিক সেই মুহুর্তে নিজেকে সামলানো বড়োই কঠিন হয়ে পড়েছিল। আমি ওকে কাছে টেনে নিয়ে গালে, কপালে, চোখে চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগলাম। প্রীতিশারও ভিতরটা বোধহয় সেই মুহুর্তে উথাল-পাথাল হয়ে গিয়েছিল। কয়েক মুহুর্ত পর বুঝতে পারলাম আমি বড়ো ভুল করে ফেলেছি। এমনটা করা আমার উচিত হয়নি। প্রীতিশা কিছুক্ষণের জন্য কাঠ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারপর কিছু না বলে শ্রেণিকক্ষ থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।

আমি বুঝতে পারিনি ঠিক সেই মুহুর্তে আমার কী করণীয় ছিল। তখনও আমি বুঝতে পারিনি আজ রাতে আমার জীবনে এমন মারাত্মক ঘটনা ঘটবে, যা আমাকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেবে। তবে আমার জীবনই শুধু নয়। তার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল আরও দুটো জীবন। এক প্রীতিশা, দুই আমার বাবা।

বাবা শ্বাসকষ্টের রোগী। বাবার আজ একটু বেশিই শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছিল। ইনহেলার শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাবার এই কষ্ট আমি একেবারেই সহ্য করতে পারছিলাম না। তাই আমি তড়িঘড়ি করে মেডিকেল শপে ইনহেলার আনতে ছুটে গিয়েছিলাম।

বাড়ি ফেরার রাস্তাটা রাত দশটার পরে জনমানবশূন্য হয়ে পড়ে। সেই সুযোগ নিয়েই আমার সামনে হঠাৎ করে স্ময়ন এসে পড়ে। তারপরই আমার মুখের ওপর এলোপাথাড়ি ঘুষি চলতে থাকে। আর সে বলতে থাকে, “বল, তুই প্রীতিশার সঙ্গে কী করেছিস? ও কেন আজ হঠাৎ করে আমার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক শেষ করার কথা বলল? তুই ওকে ফুসলিয়েছিস। আমি তোকে ছাড়ব না।”

প্রচণ্ড যন্ত্রণার মধ্যেও আমার এটা ভেবে সুখ হচ্ছিল যে, প্রীতিশা আমার ভালোবাসা স্বীকার করে নিয়েছে। আমার ভালোবাসা জিতে গিয়েছে। এর থেকে আনন্দ আমার আর কিছুতেই হবে না। ঠিক সেই মুহুর্তে স্ময়ন আচমকা প্যান্টের পকেট থেকে ছুরি বের করে পরপর দুটো কোপ আমার পেটের ওপর মারল। আমি অসহ্য যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে পেটে হাত দিয়ে বসে পড়লাম। সে আমার আর্তনাদ শুনেই প্রচণ্ড ভয় পেয়ে চম্পট দিয়েছে।

আমি ওঠার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলেছি। বেশ বুঝতে পারছি আমার আয়ু বড়োজোর আর কিছুক্ষণের। তারপর সব শেষ। এই তল্লাটে কেউ নেই যে আমাকে হসপিটালে নিয়ে যাবে। আমার প্রাণ বাঁচাবে। যখন প্রীতিশা আমার চোখের সামনে অন্যের হয়ে গিয়েছিল, তখন মরে যেতে ইচ্ছে করছিল। আর আজ যখন ও আমার হয়ে গেল, তখন বাঁচার প্রবণতা আরও বেড়ে যেতে শুরু করল। কিন্তু আমার আয়ু আর ক্ষণিকের, কথাটা ভাবতেই চোখের জলে চারপাশের পরিবেশটা ঘোলাটে হয়ে এল।

আমি রাস্তার ওপর এলিয়ে পড়লাম। চোখদুটো বুজে এলো। ঠিক সেই মুহুর্তেই মনে হল কারা যেন এদিকে ছুটে এসে আমায় টেনে তুলছে, আর বলছে, “ওকে তাড়াতাড়ি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। না হলে ও বাঁচবে না। ভাগ্যিস এ রাস্তায় সিসিটিভি লাগানো ছিল। তাই দেখতে পেলাম কেউ ওর পেটে চাকু মেরেছে।”

ব্যস্, এটুকুই শুনতে পেয়েছিলাম। তারপর জ্ঞান হারাই। হসপিটালে চোখ খুলতেই দেখি প্রীতিশা আমার মাথার কাছে বসে আছে। আমি উঠে বসার চেষ্টা করতেই ও বলল, “ঈশান, এখন উঠিস না। ডাক্তারবাবু রেস্ট নিতে বলেছেন। আর স্ময়নকে আমি পুলিশে দিয়েছি। আমি বুঝতে পারিনি ছেলেটার তলে তলে এই ছিল। আমি ওকে খুব ভালো ভেবেছিলাম। যাই হোক, আমি এখন তোর, শুধুই তোর।”

শেষপর্যন্ত আমি পার্শ্বচরিত্র থেকে গল্পের নায়ক হয়ে গিয়েছি। আর বাবার কাছে ইনহেলারও সময়মতো পৌঁছে গিয়েছিল। প্রীতিশাকেও সারা জীবনের মতো পেয়ে গিয়েছি। একেই বলে হ্যাপি এন্ডিং।

সন্ধে আলোর মুখোমুখি

এই নিয়ে চতুর্থবার সন্ধে আলোর মুখোমুখি রেস্তোরাঁয় শিমুল ও শিরিন। খুব একটা ভিড় থাকে না। নিরিবিলিতে কথা বলা যায়। ওয়েটার আগেই জল দিয়ে গেছিল। এবার কোল্ড কফি সার্ভ করে গেল। শিরিন অফিস-ফেরতা আর শিমুল আপাতত এখানে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে সাড়ে সাতটা নাগাদ যাবে নিজের চেম্বারে। তারপর গোটা দশেক রোগী দেখে খুব বেশি হলে ন’টা সাড়ে ন’টা নাগাদ ফ্ল্যাটে ফিরে শিরিনের কথা ভাববে!

আর মাসখানেক বাকি তবুও যেন তর সইছে না। দোষ কী, বিয়ে পাগলা হলে যা হয়! সবে মাস চারেক সে বিবাহ বিচ্ছিন্ন। আর শিরিন বছরখানেক আগের বিয়ে থেকে বিচ্ছিন্না। তফাত বলতে এইটুকুই যা!

শিরিন কফিতে একটা হালকা সিপ দিয়ে বলল, দ্যাখো মাসখানেকের যোগাযোগ এমন তো আর খুব বেশি না অথচ মনে হচ্ছে তুমি যেন আমার কতদিনের! কী গো হার্ট স্পেশালিস্ট, তাই না? গতকালই আমার খুব মনে হচ্ছিল আর ঠিক আজ সকালেই তুমি দেখা করতে চাইলে। আমার কী সুবিধাটাই না হল তুমি হৃদয় বিশারদ হওয়াতে। আমি যে চাইছিলাম সেটা ঠিক বুঝে ফেলেছ কি বলো! শিমুল গদগদ কৃতার্থের একটা হাসি ছড়াল। বলল, আমিও না খুব ছটপট করছিলাম কাল সারারাত্তির।

—কেন গো কী জন্য? অপর্ণার জন্য মন খারাপ করছিল বুঝি?

—আরে, বাদ দাও তো ওর কথা। ও এখন অতীত।

—তবে কার কথা ভাবছিলে?

—কার আবার, তোমার।

—ও তাই। তা আমার কীসের?

এবার শিমুল ক্লিন বোল্ড। কথা আটকে গেছে।

—আরে বলো বলো… এতে লজ্জার কী আছে। শুনলে হয়তো আমারও ভালো লাগবে।

—যাঃ, তোমাকে শুনতে হবে না।

—আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যখন বলবে না-ই ভেবেছ তখন আমিই বলে দিই।

—আরে আরে করছটা কী? কিচ্ছু বলার দরকার নেই।

—কেন?

—বলার নয় বলে। কারণ…

—কারণটা শুনি

—ওসব হাতে কলমে করার

শিরিন কপট রাগ দেখিয়ে বলে, ওরে মিচকে পাজি শয়তান কোথাকার। আমার সাথে ফাজলামি! ঠিক আছে আমিও দেখে নেব কার কত দম।

তারপর দু’জনেই খিলখিল করে হেসে উঠেই আবার চেপে গেছে কারণ ততক্ষণে দু’একজন খদ্দের ওদের দিকে দৃষ্টিপাত করার মতো অপরাধ করে ফেলেছে। তারপর কিছুক্ষণ চুপচাপ। কে জানে ওরা প্রত্যেকেই হয়তো ছেলে মেয়েদের কথা ভাবছিল এমনও হতে পারে, কারণ আগের পক্ষের সুবাদে দু’জনেই বাবা-মা। কিন্তু ছেলেমেয়েরা এদের কারওরই কাছে থাকে না, তাই ঝাড়া হাত-পা ।

না ওদের দু’জনের কেউই সম্ভবত সন্তানদের কথা ভাবছিল না। দু’জনেই স্রেফ নিজের নিজের ভালোমন্দের হিসেব নিকেশ নিয়ে মজে ছিল। শিমুলের মনে হচ্ছিল অপর্ণার মতো শিরিনও যদি সব লুটে নিয়ে যায় তাকে চূড়ান্ত ঠকিয়ে! কে জানে কপালে কী যে আছে! আর শিরিন ভাবছিল আমি তো এইরকম একজন গৌরী সেন-এর খোঁজেই ছিলাম এতদিন। আমার অপেক্ষা এখন প্রায় সফলের দিকে, ভেবেই মনটা খুশিতে ডগমগ করে উঠল। মানুষ এমন নির্বোধও হয়? কিন্তু তার তো কিছু করার নাই। বোকাকে তো ঠকতেই হয়! আর এখানে শিরিন নিমিত্তমাত্র।

শিরিনের নিজস্ব ফ্ল্যাট গাড়ি বেসরকারি চাকরি চোখটানা আকর্ষণের চিকন চেহারা৷ হলই বা পঁয়ত্রিশ ঊর্ধ্ব, কী নেই! তুলনায় শিমুল খুব খুবই গরিব। শুধু টাকা আর টাকা, টাকা ছাড়া কিচ্ছুটি নেই। তা বলে দু’একখানা গাড়ি বাড়ি থাকবে না, তা কি কখনও হয়? আসলে পঞ্চাশ ঊর্ধ্ব শিমুলের চেহারা জৌলুসের দিক থেকে একেবারেই সাদামাটারও অধিক। সে যাই হোক, ম্যারেজ ওয়েবসাইট এই মুহূর্তে ওদের দু’জনকে দু’জনের করে দিয়েছে এমন ভীষণ ভাবে, যেন ওরা জীবনে এই প্রথমবার প্রেম এবং বিয়েতে আবদ্ধ হতে চলেছে!

শিরিন অবশ্য অনেক পরিণত, তুলনায় শিমুলের আচার আচরণে একটু বেশি পরিমাণেই আদেখলেপনা ঝরে পড়ে। শিরিনের ভালোই লাগে। এই হ্যাংলাপনাটা ও ওর প্রাক্তন, অমিতের কাছে অনেক আশা করেও পায়নি। আর মূলত এই না পাওয়াটাকেই শিরিনের মনে হয়েছিল অমিত ওকে তেমন ভালোবাসে না কিংবা পাত্তা দেয় না, যতটা ওর পাওয়া উচিত। ফলস্বরূপ বিয়ে পরবর্তী বছর দশেকের মাথায় সরকারি ভাবে ছাড়াছাড়ি। যদিও ওদের বিয়েটা আদৌ দেখাশোনা করে নয় বরং কলেজজীবনের প্রেম পরিণতিরই ছিল।

আর শিমুল? তার সাদা চামড়ার স্মার্ট প্রাক্তনী, ম্যাদামারা শিমুলকে কতই বা সহ্য করে। একটা ইযং হ্যান্ডসাম জুটিয়ে শিমুলেরই অ্যাকাউন্ট ভেঙে খাচ্ছিল হাড়ে মজ্জায়, শিমুলের উপস্থিতি অনুপস্থিতি ব্যতিরেকে যখন তখন, তাও আবার শিমুলেরই ফ্ল্যাটে। শিমুল ওসব অ্যাডভেঞ্চার বন্ধ করে ভদ্রস্থ হয়ে থাকার কথা বললেও, মহিলা তখন ডিভোর্স পেতে মরিয়া। শিমুল তবুও বুঝিয়েছে৷ কিন্তু না, অগত্যা দেনাপাওনা বুঝে নিয়ে ডিভোর্স।

শুনেছি শিমুল নাকি ঘুমের ঘোরে প্রাক্তনীর নাম ধরে অপর্ণা অপর্ণা করে প্রায়ই চেঁচিয়ে উঠত। তবে এখন আর ওঠে না। ঠাকুরের নাম জপের মতন সাঁঝ-সকাল একশো আটবার করে শিরিনের নাম ভজে। জয় রাধে।

একটা ছোটো বেসরকারি ফার্মের চাকুরে শিরিন আর কতই-বা মাইনে পায়৷ মেরেকেটে ৩০-৪০ হাজার টাকা, তার বেশি না। তবু তার ঠাটবাট চোখ টাটানোর মতো। গাড়ি, বাড়ি, গয়না, পোশাকআশাক, ঝাঁ চকচকে জীবনযাপন— তার মাইনের সাথে সামঞ্জস্যহীন। তবে তার স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট নামক একটি একস্ট্রা কাজ, বিশেষত কোম্পানির সম্মানিত অতিথি সেবার জন্য– হিসাব বহির্ভূত আয়ের সংস্থান এতটাই স্ফীত যে, মূল মাইনে তার কাছে নাকি নেহাত নস্য।

কোম্পানি তাকে ব্যবহার করে বড়ো বড়ো সরকারি-বেসরকারি সংস্থার অর্ডারগুলো হাতায় আর শিরিন নিজেকে ব্যবহার করে উপার্জনকে একলাফে হাজার থেকে লক্ষে নিয়ে যায়! দু’পক্ষই লক্ষ্যে স্থির। কোনও ছুত্মার্গ নেই। শিরিন জানে জল এমনই পবিত্র যে ধুয়ে দিলে সব মুছে সাফ। যেন এক ফিনিক্স পাখি! কোম্পানির চোখে শিরিন তাই বিশেষ অ্যাসেটরূপে আদৃত। মালিকের নেক নজরে সতত জাজ্বল্যমান। যার জন্য শিরিনের যে-কোনও আবদার, তা সে যৌক্তিক অযৌক্তিক যাই হোক না কেন, পূরণ হয়ে যায় তৎক্ষণাৎ।

অপর্ণার বিদায়ে বিমর্ষ ক’টা সপ্তাহ শিমুলের যে কীভাবে কেটেছে, থ্রি বেডরুমের অত বড়ো একটা ফ্ল্যাটে একা একদম তার ভেতরের মতোই শূন্যতা ঠাসা ছিল। তবে শিরিনের আগমন সম্ভাবনাময় হয়ে উঠতেই এখন আবার ভরে উঠছে ক্রমাগত।

সম্প্রতি ইন্ডিয়ান পেট্রোলিয়ামের একটা বড়োসড়ো কাজ পাওয়ার সম্ভাবনাকে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ওদের প্রোজেক্ট ম্যানেজার হাসান রায়ের দেখভালের দায়িত্ব এখন শিরিনের উপর বর্তেছে। এতে সফল হলে শিরিনের মালিক এক লক্ষ টাকা দেবে বলেছে তাকে।

শিরিন সঙ্গে সঙ্গে তার ফ্ল্যাটের ইএমআই পরিশোধের কথা চিন্তা করে দেখল এবারের এই টাকাটা জমা দিলেই ফ্ল্যাটটা ঋণমুক্ত হয়ে এক্কেবারে তার নিজস্ব হয়ে যাবে। মাত্র এক বছর সময়ের মধ্যেই শিরিন পঞ্চাশ লাখের ফ্ল্যাটটা কিনে ফেলল স্রেফ এই স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্টের দৌলতে।

হাসানের বদান্যতায় শিরিনের কোম্পানি পৌনে এক কোটির অর্ডারটা খুব সহজেই পেয়ে গেল। শিরিনের নিজেরও কদর বেড়েছে যত দিন গেছে হাসানের সহায়তায়। পরবর্তীতে শিরিন অন্যান্য অনেক তেল কোম্পানি ছাড়াও স্টিল, ইলেকট্রিক্যাল-সহ মাইনিং ও আইটি সেক্টটরের অনেককেই পরিষেবা দিয়েছে। তাই শিরিন এখন হাসানের খুবই আস্থাভাজন এবং হাসানও।

ব্রেক আপের সময় শিরিন খুব ভেঙে পড়েছিল। হাসান সেই সময়গুলো ওকে মানসিক ভাবে অনেক সাপোর্ট করেছিল। তার জন্যে শিরিন যথেষ্ট কৃতজ্ঞ। হাসানের যে-কোনও ডাকে শিরিনের কখনও না নেই। এই তো সেদিন হাসান ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে কলেজ রি-ইউনিয়নে শিরিনকে নিয়ে গেল। অন্যান্য বন্ধু-বান্ধবরা তো ভেবেছিল শিরিন বুঝি হাসানের স্ত্রী। কিন্তু যখন শুনল যে স্ত্রী না, তখন কেউ চোখ কোঁচকাল কেউ বা শিরিনের গ্ল্যামার দেখে হাসানের ভাগ্যকে বাহবা না দিয়ে পারল না।

ওদের দু’জনের জন্য হাসানের ইচ্ছা অনুযায়ী ফাইভ স্টার হোটেলে আলাদা করে রুম বুক করা হয়েছিল। একজন বন্ধু আবদার জুড়েছিল শিরিনের সাথে কিছুটা সময় কাটানোর জন্য, হাসান না করেনি। আর হাসানের ইচ্ছাই শিরিনের ইচ্ছা। শিরিন ডিসেম্বরের হাড় কাঁপানো শীতেও হালকা সাদা গাউনের মোহ ছড়িয়ে কী নাচটাই না নেচেছিল, সেবার মূল ফাংশনের মঞ্চ ফাটিয়ে– জাস্ট ভাবা যায় না!

শিরিন ওর পরিচিতদের-কে বলেছিল ও-নাকি ওদের কোম্পানির তরফে আইআইটি-তে গেছিল রিক্রুটমেন্টের জন্য ইন্টারভিউ নিতে। তা শুনে অনেকেই দুই আর দুইয়ে চার করতে পারেনি। কারণ একটা ছোটো কোম্পানি আর শিরিনের মতন একজন নন-টেকনিক্যাল মানুষ আইআইটি-তে ইন্টারভিউ! অসম্ভব। তাছাড়াও ক্যাম্পাসিংয়ে আইআইটি-র মতো প্রতিষ্ঠান ওইরকম ঘেঁচুমেচু-দেরকে গ্রাহেকর মধ্যেই নেয় না। তাতে অবশ্য শিরিনের কিছু যায় আসে না। তার মানে এই নয় যে, শিরিন আগে কখনও রিক্রুটমেন্টের জন্য একেবারেই যায়নি। অনেকবারই গেছে তবে ছোটোখাটো ইঞ্জিনিয়রিং কলেজগুলোতে।

একবার তো শিমুলকেও নিয়ে গেছিল তার আধিপত্য জাহিরের বহর দেখানোর জন্য। অবশ্য ইন্টারভিউটাকে শিমুলের একটা প্রহসন বলেই মনে হয়েছিল। তবে শিরিন তার মিশনে সফল ছিল কারণ শিমুল শিরিনের স্ট্যাটাসটা বিশ্বাস করেছিল। ফেরার সময় শিমুল জিজ্ঞাসা করেছিল, এটা কী রকম ইন্টারভিউ? শুধু নাম ধাম জানতে চাওয়া, আর কোনও প্রশ্ন নেই!

শিরিন ভ্রু নাচিয়ে বলেছিল, আছে আছে আঙ্কেল এসব তুমি বুঝবে না। শিমুল নাছোড়, শুনবেই। শিরিন বলেছিল তবে শোনো এটা একটা আই ওয়াশ মাত্র।

—তার মানে?

—মানে কিছু না। আমার কাজ শুধু যে-কোনও দু’জনকে খুশি মতন তুলে নেওয়া। ব্যস। খতম।

—সে আবার কী?

—আরে বাবা ওই কলেজ আমাদের কোম্পানিতে দু’জন ছাত্রকে ছয় মাসের জন্য চাকরিতে বহাল রাখার মূল্য বাবদ ষাট হাজার টাকা দিয়ে রেখেছে। আমরা মাসিক তিন হাজার করে দিয়ে ছয় মাস পরে ভাগিয়ে দেব।

—তাতে লাভ?

—প্রথমত আমাদের চব্বিশ হাজার টাকা ক্যাশ আর ফ্রি-তে ছয় মাস কাজ করিয়ে নেব আমাদের খুশি মতন। মানে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ। আর কলেজ, ছাত্রদের পড়া শেষে হান্ড্রেড পার্সেন্ট প্লেসমেন্ট দেখাবে। আমাদের মতন এইরকম প্রচুর কোম্পানির সাথে এই সমস্ত কলেজের এইভাবেই চুক্তি হয়। বেচারা ছাত্রদের কাছ থেকে কলেজ টাকা নেয় আর আমরা নিই কলেজের থেকে। মাছের তেলেই মাছভাজা যাকে বলে আর কী।

শুনে তো শিমুলের চক্ষু চড়ক গাছ! কিছু বলেনি। বোধহয় বলার মতো অবস্থায় ছিল না বলেই।

যাইহোক, হাসানের বন্ধুদের অনেকেই এখন শিরিনের উষ্ণতায় ধন্য। শিরিন তো এটাই চায়। হাসানের পরিচিতির বিস্তারটাকে শিরিন কাজে লাগিয়েছে খুব সফল ভাবে। শিরিনের এখন বিভিন্ন রকমের ছোটো বড়ো মাঝারি মাপের অনেক মই রয়েছে, যখন যেমন দরকার সেটা ব্যবহার করে।

সারা বছর এত ব্যস্ত থাকতে হয় শ্বাস ফেলার সময় নেই। নিজের অফিস গেলেও হয়, না গেলেও ক্ষতি নেই। শুধু দরকারের সময় কোম্পানির ডাকে সাড়া দিলেই হল। মালিক তাতেই খুশি। তবে শিরিনের মনের কোণের কোথাও যেন আলাদা করে একটা পার্মানেন্ট মইয়ের চাহিদা তৈরি হচ্ছিল। কেন কে জানে, সে নিজেও ঠিক বুঝতে পারছিল না।

যাইহোক, শিরিন ম্যারেজ সাইট-এর শিমুলের অ্যাডটা নিয়ে হাসানের পরামর্শ চাইল। ডা. শিমুলের বায়োডাটা দেখে হাসান সায় দিল। আহ্ কি আনন্দ! এবার আরও মুক্ত হয়ে গেলাম। আর কোনও চিন্তা রইল না। বলা যায় ভবিষ্যতটাও বেশ সুরক্ষিত হয়ে গেল পাকাপোক্ত ভাবে ডাক্তারবাবুর সমর্থ ছাদের নীচে।

সবাই খুব খুশি। জমিয়ে বিয়ে হয়ে গেল। ডাক্তারবাবুর মনে এখন ঘরেতে ভ্রমর এলো গুনগুনিয়ে..। কিন্তু কপালে না থাকলে ঘি ঠকঠকালে হবে কী! মধুচন্দ্রিমা মাস ছয়েক যেতে না যেতেই খতম।

শিরিন অন্য একটা চাকরি নিয়ে শ্রীরামপুর থেকে দিল্লি। হাসান কলকাতা থেকে ফরিদাবাদ যা দিল্লির হাত বাড়ালেই দূরত্বের!

শিমুলও আবার যে কে সেই। ফ্ল্যাট ভরতি একাকিত্বের ভিতর থেকে ঘুমের ঘোরে প্রায়ই অস্পষ্ট চিৎকারে গুঙিয়ে ওঠার সেই ডাক অপর্ণা অপর্ণা… ধ্বনি থেকে প্রতিধ্বনিত হয় প্রতিনিয়ত।

তবে ওই পরিযায়ী পাখির মতন শিরিনের মাঝে মধ্যে আসা-যাওয়া আর দেশ-বিদেশের ভ্রমণ সঙ্গী হওয়া কখনও সখনও তার বেশি না। শিমুলের নিজেকে কেমন যেন অতিথি অতিথি বলে মনে হয় শিরিনের কাছে। তাই যতটা বা যেটুকু পাওয়া হয় সেটাই অনেক ভেবে নেওয়া ছাড়া আর শিমুলের করারই বা কী আছে! শিরিন অবশ্য শিমুলকে নিজের উদ্বৃত্তটুকু দিয়ে শান্ত করে রাখে। শিমুলের সেটা জানার কথা নয়, কাজেই জানতেও পারে না। আর পারবেও না কোনওদিন।

শিরিন তার নিজের মাইনের সমস্ত টাকা গচ্ছিত রেখে মাস খরচের পুরো টাকাটাই শিমুলের থেকে নেয়। তাছাড়া রূপচর্চা ও হেলথ ম্যানেজমেন্টের জন্য আলাদা তো নেয়-ই। এই তো কিছুদিন আগে স্লিম অ্যান্ড ট্রিম হওয়ার জন্য লাখ দু’য়েক টাকা খরচ করে লাইপোসাকশন পদ্ধতিতে তলপেটের চর্বি নামিয়ে এল শিমুলের গাঁটের কড়ি খসিয়ে৷

তারপরের কোনও একদিন হাসান, শিরিনকে দেখে বলেছিল, ব্রাভো মিসেস…। হাসানের কথা শেষ হওয়ার আগেই শিরিন বলেছিল, হাসান রায়।…ঠিক তখনই, যখন কলকাতার চেম্বারে ডা. শিমুল একটা রোগীর হার্টের নির্ভরতাজনিত কোনও বিশ্বাসযোগ্যতার অন্বেষণে বারংবার গলদঘর্ম হয়ে যাচ্ছিল।

সবিনয় নিবেদন

ঘড়িতে আটটাও বাজেনি। এত সকাল সকাল মেয়ে দোলন ফোন করছে দেখে, একটু অবাকই হল ডলি। রান্নাঘরে ব্যস্ততার মাঝে কাপড়ে হাত মুছতে মুছতে এসে ডলি ফোনটা তুলল। তাকিয়ে দেখল স্বামী বিকাশও খবরের কাগজটা নামিয়ে রেখে ফোনটা ধরবে বলে ঘরে ঢুকছে। ডলিকে ফোনটা তুলতে দেখে জিজ্ঞাসু চোখে ঘরের ভিতরে এসে ডলির সামনে দাঁড়াল। ইশারায় ডলি বিকাশকে জানাল মেয়ের ফোন।

ফোনটা তুলতেই দোলনের আনন্দঘন কণ্ঠস্বর ওপাশ থেকে ভেসে এল৷ মা, আমি খুব শিগগিরি অর্ণবের সঙ্গে তোমাদের মিট করাব। খুব ভালো ছেলে। আমার সঙ্গেই ম্যানেজমেন্ট পড়ছে, এবছরই শেষ। আমরা একসঙ্গেই দুজনে, ইন্ডিয়া ফিরে ভবিষ্যতের জন্য সিদ্ধান্ত নেব।

স্পিকারে ফোনটা থাকায় সব কথাই বিকাশেরও কানে যাচ্ছিল। সুদূর দুবাই থেকে মেয়ের মুখে শোনা এরকম একটা খবরে বিকাশ খুশি হল৷ ডলির হাত থেকে ফোনটা নিয়ে বলল, খুব ভালো খবর, তাড়াতাড়ি দেশে ফের। অর্ণব ছেলেটি কোথাকার?

ওরা জয়পুরের পুরোনো বাঙালি।

বাঃ তাহলে প্রথমত ছেলেটি ভারতীয়, উপরি পাওনা বাঙালি। তোর মা তো ভেবে ভেবে পাগল হয়ে গিয়েছিল যে, দুবাই গিয়ে মেয়ে হয়তো কোনও শেখ বা ইংরেজকে বিয়ে করে বসবে।

দোলনের হাসি ভেসে এল ফোনে৷ মা যখন যেটা ভেবেছে সেটা কখনও সত্যি হতে দেখছ বাবা? মা কেন কিছু বলছে না এই ব্যাপারে?

তোর মা অর্ণবের নাম শুনে শক খেয়েছে মনে হচ্ছে। ঠাট্টার স্বরে বলে বিকাশ।

ডলির মেজাজ সত্যি সত্যিই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। ইচ্ছে করেই ও কোনও উত্তর দিল না। বিকাশ ফোন রাখতেই ডলি রাগে ফেটে পড়ল।

আমি জানতাম বিকাশ, পড়াশোনার নাম করে ওখানে বসে মেয়ে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। এবার বুঝবে মেয়েকে পড়তে পাঠিয়েছিলে নাকি পাত্র খুঁজতে।

কী যা-তা বলছ ডলি, দ্যাখো কিছুদিনের মধ্যেই ও চাকরি পেয়ে যাবে। নিজের পছন্দের ছেলে খুঁজে নিয়ে কী এমন ভুল করেছে দোলন? ও যথেষ্ট পরিণত মনস্ক, বিচক্ষণ মেয়ে যা সিদ্ধান্ত নেবে সঠিকই নেবে।

বিকাশের কথায় ডলি দমে না গিয়ে বলতে লাগল, ঠিক আছে ওকে এখানে আসতে দাও তখনই বুঝতে পারবে। ওর সঙ্গে কারও সম্পর্ক টেকার নয়! কাজের কোনও ছিরিছাঁদ নেই, কোনও গুণ নেই। এই যে এতগুলো টাকা লোন নিয়ে পড়তে পাঠানো হল, একবার বিয়ে করে বসে গেলে লোনের টাকা শোধ হবে কী করে? জানতাম, এই মেয়ে কোনওদিন কাউকে শান্তিতে থাকতে দেবে না।

ডলির কথা শুনে বিকাশও রাগ সামলাতে পারল না। তিক্ত স্বরে বলল, তোমার তো সবই আগে থেকে জানা, নিজেকে অন্তর্যামি মনে করো তুমি। পাড়া প্রতিবেশীদের সঙ্গে অন্যের সমালোচনা করা ছাড়া দুনিয়ার আর কোনও খবর কিছু রাখো?

বিকাশ রেগে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ওর ইচ্ছা হচ্ছিল অর্ণব সম্পর্কে ইতিবাচক চিন্তা করতে, স্ত্রীয়ের সঙ্গে বসে মেয়ের বিয়ে নিয়ে আলোচনা করতে– কিন্তু কিছুই করা হল না। মাথা ঠান্ডা করতে আবার কাগজ মুখে বসে পড়ল সে।

ডলির এই স্বভাব বিকাশের কাছে নতুন নয়। বরাবরই খারাপটা চিন্তা করতেই ডলি ভালোবাসে। আর সব সময় ওই একটাই কথা, এর ফল বুঝতে পারবে। বড়ো মেয়ে তনুশ্রী বরের সঙ্গে কানাডায় সেটলড। দোলন ম্যানেজমেন্ট পড়তে দুবাইতে। যে-কোনও কথা কারওর সঙ্গে হলেই ডলির দাবি, ও সবকিছু জানে। কারণ ও বাস্তবটা দেখেছে! সব ব্যাপারে ওর এত জ্ঞান যে, কোথাও কোনও কিছু ওর অগোচরে থাকে না। এমনকী রান্না, ফ্যাশন কিংবা রাজনীতি সবকিছুই নাকি ওর জানা।

কিছুদিন আগেই, বিকাশের কানে এসেছিল ডলি কাউকে ফোনে বলছে, কৃষক আন্দোলন যে হবে সেটা ও নাকি আগে থেকেই জানত। বিকাশ তখনই ডলিকে বলেছিল, এ আবার কী ধরনের কথা ডলি। কৃষক আন্দোলনের কথা আগে থেকেই তুমি জানতে? একটু ভেবেচিন্তে তবে তো কথা বলবে!

আরে আমি জানতাম বলেই না বলেছি। কিছুতেই দমবার পাত্রী নয় ডলি।

অফিসের কলিগদের সামনেও বহুবার বিকাশকে লজ্জিত হতে হয়েছে। মেয়েটাও বান্ধবীদের বাড়ি নিয়ে আসতে চাইত না, মায়ের বেফাঁস কথা বলার অভ্যাসের ভয়ে৷বিকাশ মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে কর্মরত, ফলে আর্থিক অবস্থা ওদের ভালোই। ডলি কৃপণ মানসিকতার মহিলা এবং নিজের জ্ঞান সম্পর্কে এতটাই অহং যে, সত্যিকারের বন্ধু বলে ওর কেউ ছিল না। ডলির জ্ঞানের বড়াইকে বাইরের লোক ওর মূর্খতা জেনে পিছনে হাসাহাসি করত। বাড়িতেও ডলির ব্যবহারে কেউ সন্তুষ্ট ছিল না।

দোলনের সঙ্গে কথা না বলা পর্যন্ত ডলি মনে মনে ছটফট করছিল। পরদিন ডলি দোলনকে ফোন করল। কোনওরকম ভূমিকা না করেই সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল, এখুনি বিয়ে করে নিলে তোমার লোনের টাকা কে শোধ করবে?

তুমি কেন চিন্তা করছ মা? আমি ইন্ডিয়া ফিরে এসে চাকরি করব। আমার লোন আমিই শোধ করব। প্রথমে দিল্লি হয়ে দু’জনে কলকাতায় আসব। অর্ণবের সঙ্গে তোমাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর অর্ণব জয়পুর ফিরে যাবে। দোলনের স্বরে এতটুকু উত্তেজনা প্রকাশ পেল না। ডলি কোনওরকম আগ্রহ দেখাল না। ফলে হতাশ হয়ে দোলন ফোন কেটে দিল।

দুবাইতে পড়াশোনা শেষ করে ওরা দু’জনে দিল্লি হয়ে কলকাতা পৌঁছোবার কথা বিকাশকে ফোন করে জানিয়ে দিল। কথা হল বিকাশ অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা এয়ারপোর্টে গিয়ে ওদের গাড়িতে তুলে নেবে। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। ডলি ওদের জন্য ডিনারের ব্যবস্থা করে রেখেছিল।

অর্ণবকে দেখেই ডলির খুবই ভালো লাগল কিন্তু ভিতরে ভিতরে একটা রাগ ডলির ভিতর থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ডানা ঝাপটাচ্ছিল। মেয়েকে দুবাই পড়তে পাঠিয়েছিল আর সেখানে ও কিনা বাবা-মায়ের অনুমতির অপেক্ষা না করে, বিয়ে করবে বলে পাত্র পছন্দ করে একেবারে বাড়ি নিয়ে এল। বিকাশের উপরেও রাগ কিছু কম হচ্ছিল না। এমন ব্যবহার করছিল যেন দোলনের বিয়ে হয়ে গেছে অর্ণবের সঙ্গে। দোলনের মুখেই শুনেছিল, অর্ণবদের জয়পুরে প্রতিষ্ঠিত ব্যাবসা। বনেদি ধনী পরিবার, আধুনিক মনস্ক। অর্ণবরা দুই ভাই, অর্ণবই বড়ো। ছোটো ভাই অভয় এখনও পড়াশোনা করছে।

অর্ণবের সঙ্গে কথা বলে, মেলামেশা করে ডলি অর্ণবের কোনও খুঁত বার করতে না পেরে মনে মনে ফুঁসতে লাগল। ডলি কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না, দোলন নিজেই নিজের পাত্র ঠিক করেছে। অর্ণবকে বিকাশেরও খুব ভালো লেগেছিল ফলে বাড়ির সদস্যের মতোই বিকাশ অর্ণবের যত্নআত্তিতে মেতে উঠল।

ডিনার সারতে সারতেই দোলন জানাল, মা আমরা পরশু দিল্লি ফেরত যাব। ওখানে অর্ণবের মা-বাবাও আসবেন। অর্ণব আমাকেও ওদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চায়। আমি দু-তিনদিনের মধ্যেই ফিরে আসব।

ডলি একটু অসন্তুষ্ট হয়ে বলল, আমি জানতাম, আমাদের জিজ্ঞেস না করেই নিজেই শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত তুমি নেবে। বিকাশ পরিস্থিতি সামলাবার জন্য ডলিকে একপ্রকার থামিয়ে বলল, খুব ভালো করেছিস মা, ঘুরে আয়। আর ডলি, তুমি তো তোমার মেয়েকে খুব ভালো করেই চেনো। এটা বরং ভালোই হল।

দোলন মায়ের মনের তিক্ততা টের পেল না। সে নিজের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ছিল। দোলন আর অর্ণবের চোখে নতুন জীবনের স্বপ্নের ঘোর লাগা ভাব ডলি বা বিকাশ কারও চোখই এড়াল না। ওদের দু’জনকে ভালোবাসায় ডুবতে দেখে বিকাশের মন আনন্দে ভরে উঠল।

রাত্রে শোবার ঘরে একলা পেয়ে ডলি এতক্ষণ মনের মধ্যে চেপে রাখা অভিযোগগুলো জানাতেই, বিকাশ মেজাজ হারিয়ে বলেই ফেলল, কখনও তো জীবনে খুশি হওয়ার চেষ্টা করো ডলি। এত ভালো ছেলে পছন্দ করেছে দোলন, ও যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছে। ও নিশ্চয়ই সব জেনেবুঝেই আমাদের সঙ্গে পরিচয় করাতে নিয়ে এসেছে।

তুমি বুঝছ না বিকাশ, দোলন কারও সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারে না। বিয়ে করে যখন হাত কামড়াবে তখন আর আপশোশ করেও কোনও লাভ হবে না। বাড়ির একটা কাজও করতে পারে না। সারাদিন খালি আরাম, নয় আড্ডা। বিয়ে পর ওকে কাঁদতে হবে।

বিকাশ রাগ সামলাতে পারল না। তুমি কেমন মা যে, কেবল মেয়ের খারাপ চিন্তাই করছ? শেম অন ইউ ডলি।

দোলন নিজের মায়ের স্বভাব খুব ভালো করেই জানত, তাই মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি, দুঃখ ওর ছিলই। কিন্তু অর্ণবের প্রতি ভালোবাসাতেও ওর বিন্দুমাত্র খাদ ছিল না। দু’জনেই তাই চাইছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়েটা সেরে নিতে। কিন্তু দোলন খুব ভালোই বুঝতে পারছিল, ওদের বিয়ের ব্যাপারটা মা কিছুতেই ভালো চোখে দেখবে না।

একটা গোটা দিন মা-বাবার সঙ্গে কাটিয়ে দোলনরা দিল্লি চলে গেল। পরের দিন বড়ো মেয়ে তনুশ্রীর ফোন এল। বাবার মুখে সব শুনে দোলনের জন্য ওর আনন্দ আর ধরছিল না। মা-কে বোঝাবার চেষ্টা করল, মা অর্ণব খুব ভালো ছেলে এবং ওদের পরিবারও খুব ভালো। আমার এক বান্ধবী জয়পুরে থাকে, ওরা খুব ভালো করে অর্ণবের পরিবারকে চেনে। আমরা চেষ্টা করলেও বোনের জন্য এত ভালো পাত্র খুঁজতে পারতাম না।

তনু আমি জানতাম, তুই বোনের হয়ে কথা বলবি। আর ও যে কাউকে না জানিয়ে প্রেম করে বসল তার কী…?

উফ…ফ মা, এই যে তোমার ইগো, এটাই তোমার সব থেকে বড়ো সমস্যা। কখনও তো অন্য কারও কথা শোনার চেষ্টা করো। তনুশ্রী ফোন কেটে দিল।

 

এদিকে দিল্লিতে দোলনকে, অর্ণব তার মা-বাবা অনিল এবং মধুমিতার সঙ্গে আলাপ করাল। দোলনের ওদের খুব ভালো লাগল, ওদেরও অর্ণবের পছন্দ খুব ভালো লাগল। দিল্লি থেকে অর্ণবের মা-বাবা ডলি আর বিকাশের সঙ্গেও ফোনে কথা বললেন। ওনারাও চাইছিলেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দোলনকে বাড়ির বউ করে আনতে।

বিকাশও বিয়েতে সম্মতি দিয়ে দেওয়াতে অর্ণবের মা-বাবা বিকাশদের জয়পুর ঘুরে যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানালেন। আপনারা একবার আসুন, আমাদের ঘরবাড়ি দেখে যান। আপনাদের মনে যদি কোনও প্রশ্ন থাকে তাহলে আপনাদেরও দরকার নিশ্চিন্ত হওয়ার। মা-বাবা হিসেবে নিশ্চয়ই আপনারা ভাবছেন যে, দোলন এসে আমাদের বাড়িতে ভালো থাকবে কিনা।

দুটো পরিবারেই বিয়ের তোড়াজোড় শুরু হয়ে গেল। দোলন তিনদিন দিল্লিতে থেকেই কলকাতার বাড়িতে ফিরে এল। বাক্স ভর্তি উপহারের বহর দেখে বিকাশ জিজ্ঞাসু চোখে তাকাতেই দোলন বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ওনারা কিছুতেই ছাড়লেন না। অর্ণবের মা-বাবা জোর করে সব দিয়ে দিলেন। বাবা ওনারা ভীষণ ভালো, আমার খুব ভালো লেগেছে ওনাদের। ডলি উপহারগুলি দেখেও মুখে কিছুই বলল না। উঠে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

এরই মধ্যে মুম্বই-তে দোলন জব অফার পেয়ে পনেরো দিনের মাথায় মুম্বই চলে গেল। ওদিকে অর্ণব নিজের পৈতৃক ব্যাবসায় বাবার সঙ্গে জয়েন করল। অর্ণবের মা-বাবা বিয়ের কথা বলতে কলকাতায় এসে হোটেলে উঠলেন। বিকাশদের বাড়ি গেলেন দেখা করতে। অনিল আর মধুমিতার মধুর দাম্পত্য সম্পর্ক দেখে ডলি অবাক হয়ে গেল। এই বয়সেও একে অপরকে যেন চোখে হারাচ্ছেন, এতটাই দু’জনের মনের মিল। সঙ্গে করে ওনারা ডলিদের জন্য প্রচুর উপহারও নিয়ে এসেছিলেন। দু’জনের মুখ থেকেই বারেবারে ডলি নিজের রান্নার প্রশংসা শুনে মনে মনে গর্ববোধ করল।

সুযোগ বুঝে ডলি বলল, দোলন কিন্তু রান্না করতে পারে না, আগে থেকে আপনাদের জানিয়ে রাখা ভালো। কারণ পরে আপনারা বলতে পারবেন না যে, আগে থেকে আমি আপনাদের কিছুই জানাইনি।

ডলির কথা শুনে মধুমিতা জোরে হেসে উঠলেন৷ বললেন, আপনার মেয়েটি ভারি মিষ্টি। ও নিজেই আমাকে বলেছে যে, ও বাড়ির কোনও কাজ করতে পারে না। আর ওকে আমাদের বাড়ি গিয়ে কোনও কাজ করতেও হবে না। আমার বাড়িতে কাজের লোক রয়েছে সঙ্গে রান্নার জন্য আলাদা দু’জন লোক আছে। আমি নিজেই প্রয়োজন না পড়লে রান্নাঘরে ঢুকি না। আজকালকার মেয়েরা কেরিয়ার তৈরি করতেই ব্যস্ত, ওরা ওটার জন্যই ম্যাক্সিমাম পরিশ্রম করে। তবে দরকার পড়লে জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সবই ওরা করে নেয়। আর এখন তো দোলন একলাই রয়েছে, কিছু না কিছু তো ওকে করতেই হচ্ছে।

ডলি চুপ করে রইল। গল্পগুজবে অনেকটা সময় ভালোভাবে কেটে গেল। ওঁদেরও হাতে প্রচুর উপহার দিয়ে ডলি আর বিকাশ ওনাদের বিদায় জানাল। ঠিক হল শীত পড়ার আগে আগেই বিকাশ আর ডলি জয়পুর যাবে বিয়ের সব কথাবার্তা ফাইনাল করতে। অনিল আর মধুমিতার ইচ্ছা সেসময় দোলনকেও ওখানে এনে আশীর্বাদটা সেরে ফেলা।

ডলি বিকাশের সঙ্গে আলোচনা করল, জয়পুর যাওয়া মানে আবার একটা বড়ো খরচা, তাছাড়া আবার উপহার নিয়ে যেতে হবে। বিয়ে, আশীর্বাদ আলাদা করে করার কী দরকার ছিল? বিয়ের দিনই তো আশীর্বাদ সারা যেত।

দোলন জানত, মা এরকম একটা কিছু ভাবতে পারে, তাই নিজেই জয়পুরের আসা-যাওয়ার টিকিট কেটে বাবাকে পাঠিয়ে দিল আর মায়ের হাতেও বেশ কিছু টাকা পাঠাল যাতে উপহার কেনা নিয়ে মা-কে টাকার জন্য ভাবতে না হয়। মা-কে শুধু বলল, জয়পুরে আসা-যাওয়ার টিকিট-টা অর্ণব কিনে আমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমাদের তিনজনেরটাই।

এতেও যে ডলি পুরোপুরি খুশি হল তা নয়। বিকাশকে বলল, নিশ্চয়ই এর মধ্যে কোনও গণ্ডগোল রয়েছে, নয়তো বিয়ের জন্য এত তাড়াহুড়ো কেন করবে? এত ধনী পরিবার দোলনকে বউমা করার জন্য কেন পাগল হয়ে উঠেছে? কিছু তো ব্যাপার আছে নিশ্চয়ই, পরে ঠিক জানা যাবে দেখে নিও।

বিকাশ বলল, গণ্ডগোল ওদের নয়, তোমার মাথায় শুধু!

নির্দিষ্ট দিনে বিকাশ আর ডলি জয়পুর পৌঁছে গেল৷ দোলনও সোজা মুম্বই থেকে এসে পৌঁছোল। তনুশ্রী কানাডা থেকে আসতে পারল না। বিয়েতেই সোজা আসবে বলে জানাল। অর্ণবদের বিশাল চারতলা বাড়ি, চাকরবাকর দেখে ডলির মাথা ঘুরে যাওয়ার অবস্থা হল। এত বৈভব থাকা সত্ত্বেও কারও কোনও অহংকার নেই, সকলেই যেন মাটির মানুষ। কিন্তু ডলির স্বভাব যাবে কোথায়? ও কোনও একটা ভুলভ্রান্তি বার করার জন্য ছটফট করতে লাগল।

শাশুড়ির সঙ্গে দোলনের সম্পর্ক দেখে মনে মনে অবাক না হয়ে পারল না ডলি। ফোনে ফোনে কথা বলে দোলনের আশীর্বাদের শাড়ি, গয়না থেকে শুরু করে সাজগোজের খুঁটিনাটি প্রসাধনী– সব আগে থেকেই কিনে গুছিয়ে রেখেছেন মধুমিতা। দেওর অভয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক ডলিকে ঈর্ষান্বিত করে তুলল। দু’জনের মধ্যে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করা দেখে মনে হচ্ছিল, যেন কত পুরোনো পরিচয় ওদের।

বিকাশ আর ডলির জন্য আরামদায়ক, সবরকম সুবিধাযুক্ত বিশাল গেস্টরুমের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন অনিল এবং মধুমিতা। বড়ো অনুষ্ঠান করে, জয়পুরে পরিচিত সবাইয়ের উপস্থিতিতে খুব ধুমধাম করে দোলন আর অর্ণবের আশীর্বাদ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হল। বিকাশ অনুষ্ঠানের খরচ ভাগ করে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল অর্ণবের বাবাকে। কিন্তু উনি হাত জোড় করে সেটা গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। বেয়াইমশাই আমাদের কিছু চাই না। দোলন আমাদের বাড়ি আসছে তাই সেই আনন্দেই আমাদের এইটুকু অন্তত করতে দিন। আমাদের সত্যিই কিছু চাই না।

অনুষ্ঠান শেষে একান্তে ডলি বিকাশকে বলল, আমার তো কিছু ভালো ঠেকছে না। বাইরের দেখনদারি যাদের এত, আমি জানি সেইসব লোকেরা পরে খোলস ছেড়ে অন্যরূপ ধরে। দাঁড়াও দু’দিন পরেই দোলন সব বুঝতে পারবে।

পরের দিন দোলনকে একা পেয়ে ডলি নিজের অনুমানের কথা জানাতে দ্বিধা করল না। দোলনও রাগ সামলাতে পারল না৷ বলল, মা, তোমাকে নিয়ে পেরে ওঠা অসম্ভব। এরা এত ভালো তবুও তোমার ওই এক কথা। সবকিছুই আজ ওনারা আমার পছন্দ অনুযায়ী করেছেন। আমার ড্রেস, গয়না সব অর্ণবের মা-ই কিনেছেন৷ একটা জিনিসও আমাকে কিনতে দেননি। কালকে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে বিয়ের জন্য প্রয়োজনীয় আর সবকিছু কিনতে যাবেন, যাতে আমার পছন্দ হয়। এর পরেও তুমি এই ধরনের কথা বলছ!

তোদের মতো মেয়েদেরই পরে কাঁদতে হয়। ডলিও দমবার পাত্রী নন।

মায়ের মানসিকতা দেখে রাগে, দুঃখে দোলনের চোখে জল এসে যায়। বিকাশ স্নেহভরে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কপালে স্নেহচুম্বন এঁকে দেয়। কাঁদিস না মা, জানিসই তো তোর মা দরকারের থেকে একটু বেশিই আন্দাজ করে।

বিকাশ আর দোলন দু’জনেরই ডলির প্রতি মন বিষিয়ে উঠেছিল কিন্তু তাতে ডলির আগেও কোনওদিন কিছু যায় আসেনি, আজও কোনও প্রভাব পড়ল না।

অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার পরের দিন সকলে একসঙ্গে বসে কথাবার্তা চলছে। মধুমিতা ডলির দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাদের সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। সঙ্গে সঙ্গে ডলির চোখে সন্দেহের কালো ছায়া ঘনিয়ে এল। আড়চোখে বিকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ বলুন।

দেখুন আমাদের টাকাপয়সার কোনও অভাব নেই, সন্তানের আনন্দতেই আমাদের আনন্দ। আমাদের ইচ্ছে তাড়াতাড়ি ওদের বিয়ে দিয়ে বাড়িতে মেয়ে নিয়ে আসার। আমি আর ধৈর্য ধরতে পারছি না। আমরা সবকিছু গুছিয়ে নেব, আপনাদের চিন্তা করতে হবে না। দোলন পড়াশোনার জন্য যেটা লোন নিয়েছে আমরাই সেটা শোধ করে দেব। বিয়ের পর ও এসে আমাদের পারিবারিক ব্যাবসায় যোগ দিক আমরা সেটাই চাই। মুম্বইতে একা একা থেকে ওখানে চাকরি করার ওর কোনও দরকার নেই। ওরা দু’জনে মিলেমিশে ব্যাবসা সামলাক, আমাদের সঙ্গে থাকুক, আর কী চাই?

বিকাশ হাত জোড় করে বলল, আপনারা যা চান তাই হবে। আমাদের একটা ফ্ল্যাট আছে যেটা ভাড়ায় দেওয়া। দোলনকে দেওয়ার জন্যই ইনভেস্ট করেছিলাম। ওটা বিক্রি করে দিলেই লোন শোধ করে দিতে পারব। কোনও সমস্যা হবে না। আপনারা যখন বলবেন আমি বিয়ে দিতে রাজি আছি।

মধুমিতা আনন্দে দোলনকে জড়িয়ে ধরলেন। নিজের কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ব্যস, আমার ছেলের বউ তাড়াতাড়ি এবাড়িতে আসুক আমি এটাই চাই। দোলন তুমিও মুম্বই গিয়ে এখানে আসার প্ল্যান শুরু করে দাও। আমি শিগগিরি ঠাকুরমশাইয়ের সঙ্গে কথা বলে বিয়ের দিন দেখছি।

দোলনের লজ্জানত চেহারা দেখে, দেওর অভয় দোলনের সঙ্গে ঠাট্টা করতে শুরু করে দিল। বিয়ের অনুষ্ঠান নিয়ে বড়োদের মধ্যে কথাবার্তা শুরু হতেই ডলি মনে মনে শঙ্কিত এবং আশ্চর্যও হল। এত তাড়াতাড়ি সবকিছু ঘটে যাচ্ছে, এত মসৃণ ভাবে এবং এরা কী করে এত ভালো হতে পারে, এসব ভেবে ভেবেই ডলির মনের অস্বস্তি বাড়তে শুরু করল।

কলকাতায় ফেরার পথে দোলন ডলিকে জিজ্ঞেস করল, মা, ওখানে তোমার সব ঠিক লাগল তো?

দেখা যাক, একটু যেন বেশি ভালো বলেই মনে হল। দেখি তুমি কতদিন ওদের সঙ্গে সুখে থাকতে পারো। তখন সবকিছু বোঝা যাবে, তাই না? দোলন চুপ করে রইল।

ডলি বিকাশকে বলল, তুমি তো নিজেই ওদের সঙ্গে বসে সব সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে। আমাকে একবার জিজ্ঞেসও করলে না!

জিজ্ঞেস করার কী আর আছে। সবই আমার সঠিক মনে হয়েছে তাই রাজি হয়ে গেছি। কাটাকাটা উত্তর দিল বিকাশ।

দু’টো পরিবারেই বিয়ে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল। দু’মাস পরেই বিয়ে স্থির হল। তনুশ্রীকেও বিয়ের দিন জানিয়ে দেওয়া হল, যাতে আগে থাকতে সব ব্যবস্থা করে ওরা সপরিবারে আসতে পারে। দোলন মুম্বই ফিরে গিয়ে ইস্তফা দিল চাকরিতে। সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে আবার কলকাতা ফিরে এল। ওদিকে মধুমিতা ফোনে দোলনকে জিজ্ঞেস করে করে, ওর পছন্দমতো বিয়ের জোগাড়যন্ত্র করতে লাগলেন এবং প্রতিটা জিনিস পছন্দমতো গুছিয়ে রাখতে শুরু করে দিলেন দোলনের জন্য।

ডলি সব দেশেশুনে মন্তব্য করল, বড়োলোকেদের ব্যাপারই আলাদা। লোক দেখানো আয়োজন, একবার সব মিটে গেলে তখন আসল রূপ বেরোবে।

বিয়ের দিন ক্রমশই এগিয়ে আসছিল অথচ ডলির ব্যবহারে কোনও পরিবর্তন না আসাতে দোলনও মনে মনে কষ্ট পেল। বিয়ের জোগাড় করাটা যেন একটা বোঝা, এমন ব্যবহার করে যাচ্ছিল ডলি। মেয়ের যে ভালো পরিবারে বিয়ে হতে চলেছে, তাতে ডলির মনের আনন্দ কিছুই প্রকাশ পেল না। বরং সবসময় অর্ণবদের পরিবার সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্যে দোলন মনে মনে মুষড়ে পড়ত। বিকাশ সব বুঝতে পারত কিন্তু বাড়িতে অশান্তি বাড়ার ভয়ে চুপ করেই থাকত।

তনুশ্রীও স্বামী আর দুটো বাচ্চাকে নিয়ে এসে পৌঁছোল। বাচ্চারাও মাসির বিয়ে উপলক্ষে আনন্দে মেতে উঠল। বাড়িতে আনন্দের পরিবেশ থাকা সত্ত্বেও ডলির একমাত্র নিরানন্দ মানসিকতা সকলকেই ভিতরে ভিতরে ব্যথিত করে তুলেছিল।

বিকাশ নিজের বাজেট অনুযায়ী মেয়ের বিয়ের সব খরচার টাকা অনিলের অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে দিয়েছিল কারণ বিয়ের সমস্ত জোগাড়ের দায়িত্ব অর্ণবের পরিবারই নিয়েছিল। বিয়ের পাঁচদিন আগে দোলন তার পরিবারের সঙ্গে জয়পুরে এসে পৌঁছোলে অনিল আর মধুমিতা নিজেরা এসে এয়ারপোর্টে সকলকে অভ্যর্থনা জানিয়ে গাড়ি করে হোটেলে নিয়ে এলেন, যেখানে বিয়ের এলাহি ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

ভালো ভাবে বিয়ের সব অনুষ্ঠান নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়ে গেল। আয়োজনের কোথাও কোনও খামতি ছিল না। ডলিরাও সকলে কলকাতায় ফিরে এল। তনুশ্রীরাও আরও কিছুদিন কাটিয়ে কানাডা ফিরে গেল। বিকাশ অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল আর ডলি নিজের মতো চলতে লাগল। এখনও নিজের অনুমানই সঠিক বলে মনে করতে লাগল ডলি। দোলন ফোন করলেই, শ্বশুরবাড়ির সকলে ওর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করছে একটাই প্রশ্ন থাকত ডলির। দোলন প্রশংসা করলে বলত, এরকম ব্যবহার আর কিছুদিন পাবি, তারপরই বুঝবি কী লোক ওরা।

দোলন অর্ণবের সঙ্গে পারিবারিক ব্যাবসায় সাহায্য করতে শুরু করল। একটা নতুন শোরুম খোলার কথাবার্তা চলছিল, যার পুরো দায়িত্বই ছিল দোলন আর অর্ণবের উপর। একটা গাড়ি আর ড্রাইভার দোলনের জন্য সবসময় থাকত যাতে প্রয়োজনে সর্বত্র ও যেতে পারে। দোলন বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে খুবই আনন্দে ছিল কারণ সকলেই ওকে বাড়ির মেয়ের মতোই ভালোবাসত। কিছুদিন পরেই দেওরেরও বিয়ের ঠিক হয়ে গেল, অভয়েরই কলেজ-বান্ধবী পারমিতার সঙ্গে।

ডলির কানে অভয়ের বিয়ের খবর পৌঁছোতেই ডলি দোলনকে সাবধান করার চেষ্টা করল। দোলন এখন বুঝবি, বাড়িতে ছোটো জা আসছে। শ্বশুরবাড়ির ভালোবাসা যখন ভাগাভাগি হয়ে যাবে, তখন পরিস্থিতিও কতটা বদলায় দেখে নিস। পরে বলিস না আমি সাবধান করিনি। দোলন উত্তর দিল না।

অভয়ের বিয়েতে ডলি আর বিকাশ দুজনেই গেল এবং আগের মতোই সম্মান পেল। সবকিছু আগের মতোই নির্বিঘ্নে সুসম্পন্ন হল। পারমিতার সঙ্গে দোলনের বন্ধুত্ব হতে মুহূর্ত দেরি হল না। দুই বোনের মতোই দু’জনের মধ্যে সম্পর্ক গাঢ় হয়ে উঠল।

ডলিরাও নিজেদের বাড়ি ফিরে এল। মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা হলেই দোলন, পারমিতার প্রশংসায় খানিকটা সময় কাটাত। কিন্তু ডলির সেই একটাই কথা, দোলন আমি জীবনে অনেক কিছু দেখেছি, তুই বড্ড বেশি সহজ-সরল মেয়ে৷ জায়ের সঙ্গে বোনের মতো সম্পর্ক অনেক দেখেছি। যেটা কিছুদিনেই দেখবি একেবারে বদলে গেছে। তখন আমার কথা মিলিয়ে নিস।

আজ আর দোলন ধৈর্য রাখত পারল না। ওর সমস্ত সংযমের বাঁধ ভেঙে গেল। ডলি যে-ঘরে ছিল সেখানে বিকাশও বসে কাজ করছিল। ফোন স্পিকারে দেওয়া ছিল। বিকাশের কানে গেল দোলনের কথাগুলো, হ্যাঁ মা, আমি বুঝে গেছি তোমার কাছে সব সম্পর্কই ফালতু, বেকার। তুমি কোন সম্পর্কে ভালোবাসা খুঁজে পাও, একটা উদাহরণ অন্তত দাও। কেন সবসময় তোমার মনে হয় সবকিছুর শেষ খারাপই হবে? আমি তো এই পারিবারে এসেই প্রথম বুঝতে পেরেছি, শান্তিতে থাকা কত সহজ। তুমি যদি কাউকে ভালোবাসো তাহলে সেও তোমাকে ভালোবাসবে… ইশ এটা যদি তুমি জানতে! এখানে এসে আমি যা যা শিখেছি, তোমার কাছে এত বছর কাটিয়ে আমি সেটা শিখতে পারিনি। আর কোনওদিন এ ব্যাপারে তুমি আমাকে কিছু বলবে না।

কিছুদিন পরেই বুঝতে পারবি কারণ যা বোঝার আমি সব বুঝে গিয়েছি।

এখানে আমি এত ভালোবাসা পেয়েছি যে, আমি খুবই আনন্দে আছি। আর এও জানি ভবিষ্যতেও আমি খুশিতেই থাকব।

ডলির পাংশু মুখটা দেখে বিকাশের করুণা হল। কিন্তু এটা যে দরকার ছিল বিকাশ খুব ভালো করেই জানত। দোলন আগে কখনও এরকম ব্যবহার করেনি। আজ নিজের কথা শেষ হতেই এমন ভাবে ফোন নামিয়ে রেখেছে যে, ডলির মুখ-চোখ বিবর্ণ হয়ে উঠেছে। বিকাশ  হাসি চাপতে চুপচাপ কাজ থেকে উঠে অন্য ঘরের দিকে পা বাড়াল।

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব