অচেনা এক ছত্তিশগড়

ভারতের ২৮ তম অঙ্গরাজ্য ছত্তিশগড়। আগে অঞ্চলটি ছিল দক্ষিণ কোশল। কালচুরি বংশের রাজারা এখানে রাজত্ব করতেন। সারা রাজ্য জুড়ে সৌন্দর্যের কোনও কমতি নেই। রয়েছে পাহাড়ের সবুজ, গহন বনের হাতছানি, বন্য নদী, মায়াবী জলপ্রপাত, আদিবাসীদের ঘ্রাণ, শিল্পের সম্ভার– সব মিলিয়ে ছত্তিশগড় ইচ্ছে ডানা মেলে উড়ে যাবার এক অনবদ্য ঠিকানা। হারিয়ে যাওয়ার হাজার পথ এখানে খোলা রয়েছে, যে-কোনও পথ বেছে নিয়ে পা বাড়ালেই চলবে।

জগদলপুর

ছত্তিশগড়ের সেরা গন্তব্য জগদলপুর। আদিবাসী অধ্যুষিত জগদলপুর বস্তার জেলার সদর শহর। বস্তার ভারতের বৃহত্তম জেলাগুলির মধ্যে অন্যতম। নতুন রাজ্য হিসাবে আত্মপ্রকাশ করার সময় বস্তার জেলাকে ভাগ করে নতুন জেলা দন্তেওয়াড়া সৃষ্টি হয়েছে। তাতেও জগদলপুরের গুরুত্ব এতটুকু কমেনি। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকেই প্রচারের আলোয় চলে আসে বস্তার সুন্দরী। আর এখন তো ছত্তিশগড় পর্যটনের বিজ্ঞাপন মানেই জগদলপুর ও চিত্রকোট জলপ্রপাত। মূলত কাঙের ঘাটি (কেউ বলেন কাঙ্গের ঘাটি) ন্যাশনাল পার্ক, তিরোথগড় জলপ্রপাত, কাঙের ধারা, কোটময়র গুহা, দন্ডক গুহা, কৈলাশ গুহা– এই হল জগদলপুরের ভ্রমণ মানচিত্রের শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ বিন্দু। এর বাইরে দলপত সাগর, অ্যানেথ্রোপলজিক্যাল মিউজিয়াম, বালাজি মন্দিরও ঘুরে দেখেন অনেকে।

কাঙের ঘাটি ন্যাশনাল পার্ক

ভারতের গভীরতম জাতীয় উদ্যান, জগদলপুর থেকে ৪৩ নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে কেশলুর মোড়, সেখান থেকে বাঁদিকে গেলে কাঙের ঘাটি জাতীয় উদ্যান। বেশ কিছুটা পথ পাহাড়ের সাথে সখ্য স্থাপন করে এগিয়েছে। এই পথ চলে গিয়েছে হায়দরাবাদের দিকে। কেশলুর থেকে বাঁদিকের পথ ধরতেই গহন বন এসে মিতালি পাতায়। আঁকাবাঁকা পথ ধরে যেতে যেতে এক জায়গায় গাড়ি থামায় চালক। জঙ্গলের পর্দা ভেদ করে অনেক দূরে দেখা যায় জলের ধারা নেমে আসছে পাহাড়ের ঢাল ধরে। ওটাই ভারতবিখ্যাত তিরোথগড় জলপ্রপাত। একসময় গাড়ি এসে থামে কাঙ্গের ঘাটি জাতীয় উদ্যানের প্রবেশপথে। জগদলপুর থেকে নিয়ে আসা অনুমতিপত্র এখানে দেখাতে হল। কোটময়র গুহা যেতে এবং দেখতে হলে গাইড নেওয়া বাধ্যতামূলক এবং তার চার্জ ধরে নেওয়া হয়েছে পার্কের এন্ট্রি ফি’র সাথেই। মায় পেট্রোম্যাক্সের ভাড়া অবধি নেওয়া হয়েছে। কাঙের ঘাটি জাতীয় উদ্যান যথার্থ অর্থেই একটি ভার্জিন ডেস্টিনেশন। আছে বহু ধরনের গাছগাছালি, বন্যপ্রাণী। জাতীয় উদ্যানে প্রবেশ করলেই পাওয়া যায় মন কেমন করা জংলি গন্ধ। ইতিউতি চেয়ে দেখলে গহিন বনের আদিম অন্ধকার, পাহাড়তলির আশেপাশে ঘোর লাগা আলো। প্রাচুর্য ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য কাঙের ঘাটির সর্বত্র চোখে পড়বে। কাঙের ধারা জলধারাটি বনের গভীরে মুখ লুকিয়ে রেখেছে। এদিক-ওদিকে ছোট্ট টিলা। ধাপে ধাপে নেমে গিয়েছে শান্ত জলধারা। নিঃসীম নির্জনতার মাঝে কুুলুকুলু ধবনি তুলে বয়ে যায় কাঙের নদী। নিশ্চিন্তে। মনে ভর করে স্বপ্নমেদুরতা। সেই স্বপ্নমেদুরতাকে পুঁজি করেই পৌঁছে যাওয়া কোটময়রের কাছে। গুহায় প্রবেশ করতে হয় অত্যন্ত সন্তর্পণে। পেট্রোম্যাক্সের আলো নিয়ে পথ দেখিয়ে চলেন গাইড। বুঝিয়ে দেন প্রকৃতির অনন্য সৃষ্টির রহস্য। স্ট্যালাগটাইট ও স্ট্যালাগমাইট ফর্মেশনে তৈরি হয়েছে অসাধারণ গুহা-স্থাপত্য।

কাঙের ঘাটি জাতীয় উদ্যানের প্রবেশপথের বিপরীতে একটি গেট আছে। মাঝ বরাবর চলে গিয়ে জগদলপুর-হায়দরাবাদ সড়ক। সেই গেট থেকে তিরোথগড় জলপ্রপাতের দূরত্ব মাত্রই ৪ কিমি। মুনগাবাহার নদী নির্দিষ্ট ছন্দে বহমান হয়ে এসে এখানে ঝাঁপ দিয়েছে গিরিতলে। তারপর আবার ঝাঁপ দিয়ে বয়ে গেছে পূর্বদিকে। বর্ষার পর তিরোথগড়ের রূপ বর্ণনাতীত। যেন ভরা যৌবনের ঢল নেমে এসেছে! দুগ্ধ ফেনিল জলধারা অনেক পর্যটককেই স্নান করতে প্রলোভিত করে। অনেকে করেনও। তবে অত্যন্ত সতর্কতা আবশ্যক। নানা সময়ে ঘটে গেছে নানা দুর্ঘটনা। এখানে রয়েছে একটি মন্দির। তিরোথগড়ে বিভিন্ন ধারা এখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। বড়োই অপরূপ সেই রূপ। প্রকৃতি যেন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে, রচেছে এই নিসর্গ।

চিত্রকোটের পথে

সকালের দিকে ঘুরে আসুন কাঙের ঘাটি জাতীয় উদ্যান, দুপুরে জগদলপুর ফিরে এসে লাঞ্চ সেরে চলুন চিত্রকোটের দিকে। চিত্রকোট যাবার পথেই পড়বে অ্যানথ্রোপলজিক্যাল মিউজিয়াম। আদিবাসী প্রধান রাজ্য ছত্তিশগড়ের আদিবাসীদের জীবনযাত্রার ধরণ ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান পেতে হলে দেখতেই হবে এই জাদুঘরটি। এরপরেই প্রধান আকর্ষণ। প্রায় সবাই মিউজিয়াম দেখে সরাসরি চলে যান ‘ভারতের নায়াগ্রা’ চিত্রকোট জলপ্রপাত দেখতে। কিন্তু যাত্রাপথের ধারে যে দুটি রমণীয় জলপ্রপাত দেখার আছে, তা অনেকেই জানেন না! জগদলপুর থেকে ১৫-১৬ কিমি এসে বাঁদিকের পথ ধরুন। ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’ ধরে তাহলেই পৌঁছে যাবেন চিত্রধারা জলপ্রপাতের সামনে। অ-পূ-র্ব! বিস্মিত হয়ে দেখতে হয়! ধাপে ধাপে নেমে এসেছে দুগ্ধফেনিল জলধারা। যেন ছন্দময়ী রমণী! দু’পাশে সবুজ বনস্থলি জড়িয়ে ধরে টিলাকে। আকাশে উড়ে বেড়ায় মেঘ, বৃষ্টির হুমকি সে দিয়েই রেখেছে। রমণীয় এই পরিবেশে দাঁড়িয়ে একপশলা বৃষ্টিতে ভিজতে বেশ লাগে। স্থানীয়রা এই প্রপাতটিকে মেহেন্দ্রি গুমর বলে। ‘গুমর’ শব্দের অর্থ হল জলপ্রপাত।

চিত্রধারা দেখে সোজা ছুটতে থাকলাম চিত্রকোট রোড ধরে। হঠাৎই লোহন্ডিগুড়ার কাছে এসে গাড়ি বাঁদিকের পথ ধরে। এই রাস্তা চলে গেছে বারসুরের দিকে। প্রায় ১৪ কিমি পথ এসে হঠাৎ গাড়ি ডানদিকে ঘুরে মাঠের উপর দিয়ে ছুটতে শুরু করে। হঠাৎ করে থেমেও যায় আবার। সামনে অতলান্ত খাদ আর সবুজ পরিবেশ। ডানদিকে নজর যেতে তাক লেগে যায়। স্থানটির আকৃতি অনেকটা ঘোড়ার ক্ষুরের মতো। তীব্রবেগে নেমে এসেছে জলধারা, ভীষণ তার গর্জন। এই সুন্দর শুধু সুন্দর নয়, ভয়ংকর সুন্দর। ছত্তিশগড়ের সম্পূর্ণ আদিম গন্তব্য, এখনও পর্যটকদের ভিড়ে স্বকীয়তা হারায়নি। এমনকী ছত্তিশগড়ের পর্যটন মানচিত্রেও ব্রাত্য রয়ে গেছে জলপ্রপাতটি, যার স্থানীয় নাম তমদা গুমর। এই জলধারা সোজা গিয়ে মিশে গেছে ইন্দ্রাবতীর বুকে। সেই ইন্দ্রাবতীই আবার সৃষ্টি করেছে চিত্রকোট জলপ্রপাত। এরপর সেদিকেই রওনা দিই। অবশেষে পৌঁছে গেলাম ‘ভারতের নায়াগ্রা’ চিত্রকোট জলপ্রপাতের সামনে। অ-সা-ধা-র-ণ! বেশ কিছু সময় শুধু হতবাক হয়ে রইলাম। ইন্দ্রাবতী নদীর আস্ফালন আমাদের বিস্ময়কে অন্য স্তরে উন্নীত করে। বিরাট বড়ো এলাকা জুড়ে নেমে আসছে ইন্দ্রাবতীর জলধারা। তার গায়ে সূর্যের রশ্মি পড়ে সৃষ্টি করেছে রামধনু। প্রকৃতি আর নদী এখানে বৈঠকি আড্ডা বসিয়েছে। নদীর চলনেও যেন পাওয়া যায় বুনোগন্ধের মৌতাত। নৈঃশব্দের বুক চিরে শুধু জলপ্রপাতের পতনের বজ্রনির্ঘোষ! ৯৬.৩২ মিটার উঁচু থেকে নেমে এসেছে উত্তুঙ্গ রূপী ইন্দ্রাবতী। গোদাবরীর শাখানদী এই ইন্দ্রাবতী। একদিকে রয়েছে দুর্দান্ত একটি রিসর্ট। সেখানে একটি পূর্ণিমা রাত কাটিয়েই দেখুন না। চাঁদচোয়ানো জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাবে চরাচর।

দেবনগরী দন্তেওয়াড়া

ছত্তিশগড়ের পর্যটন রাজধানী জগদলপুরের মায়া কাটিয়ে পরদিন ছুটে চলি দন্তেওয়াড়া জেলার দন্তেওয়াড়ার দিকে। দেবনগরী দন্তেওয়াড়া ৫১ শক্তিপীঠের অন্যতম। সতীর দাঁত পড়েছিল এখানে। দেবীর নাম দন্তেশ্বরী, সেই থেকে জেলা ও স্থানের নাম দন্তেওয়াড়া। ডঙ্কিনী আর সঙ্কিনী নদীর সঙ্গমে অবস্থিত বিখ্যাত দন্তেশ্বরী মন্দির। চতুর্দিকের পরিবেশ বড়োই মায়াবী। তবে সবথেকে বড়ো প্রাপ্তি এখানকার নির্জনতা। কুমারী অরণ্য চতুর্দিকে। যেন সবুজের বান ডেকেছে। মেঘের আবডাল সরিয়ে উঁকি দিচ্ছে অর্কপ্রভ। অঘোষিত চমকে নামতে পারে বৃষ্টিও। দিন-দুপুরেও কানে আসে পাখির ডাক।

দন্তেওয়াড়ায় থাকার জায়গা মাত্রই দুটি, একটি হল হোটেল মধুবন এবং দ্বিতীয়টি মন্দির কমিটির গেস্ট হাউজ। হোটেলে চেক-ইন করেই পা বাড়ালাম মন্দিরের পথে। হোটেল মধুবন থেকে দন্তেশ্বরী মন্দিরের দূরত্ব ১ কিমির মতো হবে। শহরে অটো চলে না। রিকশাও না। ফলে যেতে হবে পায়ে হেঁটে অথবা গাড়ি করে। দুটি প্রবেশ তোরণ অতিক্রম করে মূল মন্দির। পরিবেশ খুব সুন্দর। সামান্য দূরে রয়েছে একটি সেতু। ওই সেতু অতিক্রম করেই দন্তেওয়াড়ায় প্রবেশ করতে হয়। রাস্তাটি গিদম এসে দন্তেওয়াড়া হয়ে চলে গিয়েছে কিরন্ডুলের দিকে। সেখানে রয়েছে বাইলাডিলা আয়রন ওর। ভারতের উৎকৃষ্টতম লৌহ ও আকরিক খনি বাইলাডিলা আয়রন ওর।

দন্তেশ্বরী মন্দিরের ঠিক পিছনে ডঙ্কিনী আর সঙ্খিনী নদীর সঙ্গম ঘটেছে। খুব শান্তিতে পূজা দেওয়া যায় এখানে। পান্ডার কোনও উৎপাত নেই। ভিড় নেই একদম। তবে মাড়াই উৎসবের সময়ে মন্দিরে খুব ভিড় হয়। এছাড়া দুর্গাপূজা, দশেরা, কালীপূজা বিভিন্ন সময়ে মন্দিরে ধুমধাম করে উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আশেপাশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রচুর লোকজন চলে আসেন এখানে।

দন্তেশ্বরী মন্দির দেখে পৌঁছোই ঠিক পাশেই অবস্থিত ভুবনেশ্বরী দেবী মন্দিরে। এরপর দন্তেশ্বরী ও ভুবনেশ্বরী দেবীর পায়ের ছাপ দেখে সরাসরি সঙ্গমস্থলে হাজির হই। এখানে রয়েছে ভগবান বিষ্ণু ও চৈতন্যদেবের চরণপাদুকা। কোনও একসময় চৈতন্য মহাপ্রভু এখানে এসেছিলেন। সঙ্গমস্থলটি সম্পূর্ণ সবুজ প্রকৃতিতে আবৃত। মনের মধ্যে যেন গুনগুনিয়ে ওঠে যুগ-যুগান্তর। সুপ্রাচীন কোনও ঐতিহাসিক ক্ষণে পৌঁছে যাই। বন্যশোভাময় অরণ্যানী। নাম না জানা কত পাখি কুহুকেকা ধ্বনি ভরিয়ে রাখে প্রকৃতিকে। গুমোটভাব হঠাৎ করে কেটে যায়। চমক ভাঙে ঘোর বজ্র-নির্ঘোষে। বৃষ্টি নামে। ভিজে মাটি। বৃষ্টি যেন গদ্যময় জীবনযাত্রায় ছন্দ নিয়ে আসে! ফিরে চলি হোটেলে। দন্তেওয়াড়ায় একরাত কাটিয়ে চলে যাই বন্দরনগরী বিশাখাপত্তনম। তারপর ফিরে আসা কলকাতায়।

কীভাবে যাবেন

ট্রেনঃ  হাওড়া থেকে ২৮৪১ আপ করমণ্ডল এক্সপ্রেস, ২৮৩৯ আপ চেন্নাই মেল, ২৮৬৩ আপ যশবন্তপুর এক্সপ্রেস ধরে বিশাখাপত্তনম নেমে ধরুন ১ ভি.কে। নামুন জগদলপুর। আবার হাওড়া থেকে মুম্বাইগামী রেলপথে যাত্রা করে রায়পুর নেমে বাস ধরে যেতে পারেন জগদলপুর বা দন্তেওয়াড়া। ফেরার পথে দন্তেওয়াড়া থেকে কোরাপুট এসে একরাত থেকে ৮০০৬ ডাউন কোরাপুট-হাওড়া এক্সপ্রেসেও ফিরতে পারেন।

কোথায় থাকবেন

জগদলপুরে থাকার হোটেল প্রচুর। সরকারি-বেসরকারি হোটেলের অভাব নেই। তবে দন্তেওয়াড়ায় থাকার জন্য রয়েছে শুধু হোটেল মধুবন অথবা মন্দির কমিটির গেস্ট হাউজ।

যোগাযোগ

ছত্তিশগড় পর্যটন, ব্লক – এ-ই ৩২৪, সেক্টর – ১, সল্ট লেক, কলকাতা – ৬৪, ফোন – (০৩৩) ২৩৩৪৪৯৬৮

দেখুনঃ

  • বস্তার ও দন্তেওয়াড়া জেলার উৎসব
  • গোঁচা উৎসব – বস্তার (রথযাত্রার সময় হয়)
  • নারায়ণপুর উৎসব – নারায়ণপুর বস্তার (ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ)
  • কাজরি উৎসব – সারা রাজ্যে হয় (জুলাই-আগস্ট)
  • মাড়াই উৎসব – বস্তার ও দন্তেওয়াড়া (ডিসেম্বর থেকে মার্চ)
  • বস্তার দশেরা – জগদলপুর বস্তার (সাধারণত অক্টোবর)

কুলডিহা

নীলগিরি পাহাড়ের কোলে ধানিজমি, গ্রাম, অরণ্য নিয়ে একদিকে সিমলিপাল অন্যদিকে কুলডিহা। সিমলিপাল যদি আলগা চটক হয়, তবে কুলডিহা এক হরিণ চোখের ফড়িং মেয়ের সরলতা ও সাজ নিয়ে সমগ্রটা।

সিমলিপাল থেকে কুলডিহাকে আলাদা করেছে সুখুয়াপোতা আর পাগুয়া নামের দুই পাহাড়। যে-ভাগটায় ছোটো বড়ো মিলিয়ে মেলা কাঠবিড়ালী– সেটাই ‘কুলডিহা’। ক’জন মিলে ক’দিন ধরে কষে মেখেছি কুলডিহার সাতশো রঙা সবুজ ও জঙ্গলের আনাচ-কানাচের ভয়। এখানে পৌঁছানো সহজ ছিল না, বাধা ছিল প্রায় নীলগিরি পাহাড়ের মাপে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পৌঁছোলাম। এমনিতেই কুলডিহার কাঁকনে ঘন ঘন বাঁক– বিপুল বনানী পেরোনো জঙ্গলে রোদ ঢোকে না। তায় এই বিবরণ বাদ দিলে আঁধার পেরিয়ে প্রবেশ আরও শক্ত হবে বৈকি। আসলে আপাত সহযোগী মানুষটির কোনও রাখঢাক নেই, দু-হাট খোলা মনোভাব। অনেক চেষ্টায় ফোনে তো পেলাম কিন্তু কিছু শোনার আগেই তাঁর প্রস্তুত রাখা প্রশ্নমালার সামনে পড়তে হল। প্রায় ‘হ্যালো’ শব্দটির গায়ে গায়ে জুড়ে এক নিঃশ্বাসে তার প্রশ্ন– কোথায় যেতে চাই– চাঁদিপুর, ভিতরকণিকা, কপিলাস, পঞ্চলিঙ্গেশ্বর, সিমলিপাল…

বাপরে– উত্তর দেব কি, মাথার মধ্যে ভীমরুলের ভোঁ ভোঁ। যেন বাসে উঠেছি, কনডাক্টর হাঁকছে– বেলেঘাটা, কাদাপাড়া,

চিংড়িঘাটা, মেট্রোপলিটন… কোনওমতে ওই ছেদহীন নামমালার মাঝখানে নিজের চাওয়াটুকু সিঁধিয়ে দিয়ে বলতে পেরেছিলাম– ‘কুলডিহা, কুলডিহা’। ফোনের ওপারের মানুষটি নিলাজ ধাতুতে গড়া– দিব্যি নির্ভার। দয়ার দান দিচ্ছেন ভঙ্গিমায় একটি নৈর্ব্যক্তিক আওয়াজ শুধু ছুড়ে দিলেন। কী যে মানে আওয়াজটির… বুঝতে পারিনি বলেই খেজুরে আলাপে গেলাম, কেন-না বুকিং পেতে আমাকে হবেই। উনিও অনড়। বলতে থাকলেন যে কুলডিহার যেহেতু চাহিদা প্রচুর সেহেতু হবে না-টা ধরেই নেওয়া যায়। আশ্চর্য, উনি কিন্তু এখনও ডেট জানেন না। তাতেও ‘না’ বলছেন মানেই আগাম ভেবে রাখা।

আশা নিয়ে বহুক্ষণ বাজে বকেছি– চূড়ান্ত হিউমিলিয়েটিং দশায় দাঁড়িয়ে এবার মেজাজ আমার তীক্ষ্ণ হল। প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ডেট দু’টো জানালাম– তিনিও কম নন, অনায়াসে ডিসেম্বরের সব ডেট বুকড্ বলে জানিয়ে দিলেন। সিগার চিবোতে-চিবোতে কথা বললে যেমন কটকট শব্দ ওঠে, মানুষটি কথা বলছিলেন সেই ঢঙে। আমি বুঝে যাচ্ছিলাম, ওটা আত্মবিশ্বাসের ভঙ্গিমায় অন্যপ্রান্তের মানুষটিকে রেয়াত না করার স্টাইল যা বহু ব্যবহারে ক্লিশে। বেশ, সে থাক তার জায়গায়– আমি আমার।

মোষে-মোষে যুদ্ধ হলে যেমন শিঙে শিঙ বাধিয়ে দু’টোই দাঁড়িয়ে থাকে ও ফের ঝটকা মেরে খুলে নিয়ে ঢুঁসোয়– আমাদের অবস্থা খানিক তেমন। হারাতে চলেছি আন্দাজ পেতেই জেদ চড়ল। অসম্ভবকে সম্ভাবনায় বদলানো আমার স্পেশাল এবিলিটি, হেরে যাচ্ছি খালি কুলডিহায়।

বুকিং এখনও চালু হল না অথচ বুকড্… পষ্টাপষ্টি ভদ্রলোকের কাছে অবিশ্বাসী মনোভাব পৌঁছে দিলাম। তিনি এ ধরনের বার্তালাপ শোনেন না বরং হাত কচলানি পেতেই অভ্যস্ত। এত সহজে অচেনার কাছে ধরা পড়ে যাওয়া… ইগো তেঁনার টাল খাচ্ছে বুঝলাম। ঠান্ডা পাথুরে গলায় জানিয়ে দিলেন– সরকারি অফিস থেকে যেহেতু বুকিং হয়, সেহেতু আমি যেন ওখানেই যোগাযোগ করি।

হাঃ। বাণ ছুড়ল ও’পক্ষ, একদম শব্দভেদী বাণ। চ্যালেঞ্জ-ঋদ্ধ অ্যাটিটিউডে বিঁধে এবার আমার মুখে কুলুপ। ‘কুলডিহা-কুলডিহা’ করে কতবার টাল খেয়েছে আস্থা– তবু যে কেন… আমার গোঁয়ার্তুমির ফাঁক গলে এটাও বুঝি যায়। একসময় বালেশ্বরের অফিসে ফোন করে শুনেছি যে ফোনে বুকিং হবে না সরাসরি করতে হবে। তার মানে ভাবলাম হয় মানি অর্ডার নয় থ্রু অনলাইন পেমেন্ট। কিন্তু নাহ্, অফিস জানাল হবে না। অগত্যা? বুঝে পাচ্ছি না কি করি। কলকাতা থেকে বালেশ্বরে গিয়ে বুকিং? সম্ভব, না এমন হয় কখনও? ব্যাপারটা এমন অদ্ভুত কেন প্রশ্ন করে জানতে পারলাম এটাই নাকি নিয়ম।

‘নিয়ম? কোনও বনেই এমন শুনিনি। যারা হিল্লি-দিল্লি-হায়দরাবাদ থেকে আসবে?’ উত্তর তো দূর, ফোন কেটে গেল তৎক্ষণাৎ। ভুল আমারই– কথার ভিতরের কথাটা বুঝতে চাইনি বলে। ওদিকে এজেন্টের চ্যালেঞ্জ ভেতরে ধোঁয়াচ্ছে। ভদ্রলোকের আত্মবিশ্বাস দেখি বাঁকা পথের খুঁটিতে মজবুতিতে গাড়া– এবার নুইতে হল আমাকে। স্পষ্ট জানালেন যে আগে কন্ট্যাক্ট করা পাবলিকের প্রেফারেন্স আগে ও তারপরেও আছে উপরির একটা হিসেব। ওসব ঠিকঠাক পেয়ে গেলে তবেই বুকিং মেলা না মেলার প্রশ্ন।

আমি যে প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তিকে টাকায় না মেপে ইচ্ছেগুলোকেই প্রায়োরিটি দিই– এই খবর কি মানুষের কানে পৌঁছে গিয়েছিল? সাধারণত বেড়াতে বেড়িয়ে কোনও আকস্মিক সিচুয়েশনে পড়া ও তাকে কাটিয়ে ওঠাও এক ধরনের এনজয়মেন্ট। অ্যাডভেঞ্চার না থাকলে আর পরিপাটি চৌহদ্দি ছেড়ে পথে বেড়ানো কেন? এখানের প্রকৃতিতে যত আয়োজন– সমস্যাও তত। প্রত্যেক জায়গার মতো কুলডিহারও একটা বিশেষত্ব আছে– তা হল প্রতি পদে ঘুসঘাস, অন্যান্য ডিলিং যা প্রকৃতির প্রণোদনাকেও ছাপিয়ে গেছে।

আমি জানতাম যে কুলডিহা ছাড়িয়ে দশ কিলোমিটার ভিতরে আর একটি জায়গা আছে নাম– যোধাচুয়া। কপাল ঠুকে ওখানেই ব্যবস্থা চাইলাম। আমার জানার বহরে এবার এজেন্ট মানুষটি চমকালেন। জানালেন যে, যে-দলে আট থেকে আটষট্টি বছরের মানুষজন আছে তাদের জন্য যোধাচুয়া সুবিধেজনক নয়। ফেসেলিটিস প্রায় নেই বললেই হয়। তোলা জলে স্নান-পান তায় থাকার জন্য দু’টি মোটে ঘর। এ’ছাড়া নির্জনতা ছাড়া অ্যাস সাচ কিছু নেই। দোষ দিই না তাঁকে– এমনটা তিনি ভাবতেই পারেন। বেড়ানোর ধাঁচধরণ আজকাল এত শৌখিনতায় জড়িয়েছে যে অসমবয়সিরা একসঙ্গে থাকার আনন্দেই যে আনন্দ পেতে পারে তা তাঁর বোধে ঢুকছে না।

অনেকগুলো জঙ্গলে ঘোরার অভিজ্ঞতায় জানি, অরণ্য গভীর থেকে গভীরতম হলে প্রাপ্তির কোটা ভরবেই। তায় যদি উপরি হিসেবে জোটে নির্জনতা তবে তো সোনায় সোহাগা। বিনা বাক্যব্যয়ে ওখানেই ব্যবস্থা চাইলাম। ভদ্রলোক এবার খাতির নেওয়ার বদলে কিছুটা খাতির দিলেন। জানালেন প্রথমদিন আমাদের ‘যোধাচুয়া’-য় থাকতে হলেও পরদিন উনি ‘কুলডিহা’-য় ব্যবস্থা করে দেবেন। হঠাৎই দেখি দয়ার সাগর… আসলে কোথাও দিয়ে আমাদের বোধহয় আসলি ভ্রামণিক বলে মনে হচ্ছে ওঁনার। তাই ছেলে-ছোকরার যে-দল পরপর দু’দিন বুকিং নিয়ে রেখেছে, তাদের উনি একদিন ‘কুলডিহা’য় ও পরদিন ‘যোধাচুয়া’-য় পাঠিয়ে দেবেন বলে জানালেন। আমি অবাক হলাম, বুকিং দিয়ে রাখা মানুষকে কীভাবে… জিজ্ঞাসা করাতে গলায় সেই পুরোনো আস্থার আওয়াজ উঠে এল ফের। ওঁনার ওপরেই ছাড়তে বললেন ব্যাপারটা।

কী বলব, আমি তো আপ্লুত। এবার খুব দূর থেকে হলেও তীর দেখা যাচ্ছে– তরি এই ভিড়ল বলে। উল্লসিত আমি ফের প্রশংসার খাতা খুললাম, ‘সো কাইন্ড অফ ইউ।’ ভদ্রলোক ব্যারিটোন ভয়েসে দয়াটয়া ডিসকার্ড করে জানালেন যে এখনও সবটাই চলছে হাওয়ায়। এরপরের অগ্রগতি নির্ভর করছে ঠিকঠাক সময়ে ঠিকঠাক প্রাপ্তির ওপর। সঙ্গে এটাও বলে দিলেন– ইমিডিয়েটলি শুধু বুকিং-এর টাকা পাঠালেই হবে, বাকি পেমেন্ট বালেশ্বরের অফিসে পৌঁছে দিতে হবে। তারপর এন্ট্রি ফি, ক্যামেরা, ড্রাইভার, জ্বালানী, বাংলো সব মুখে-মুখে হিসেব করে জানালেন কোন অ্যামাউন্টটি সরকারি, কোনটি উনি নেবেন ও ফরেস্ট অফিসারের জন্য কত টাকা। একই সঙ্গে জানাতে ভুললেন না যে পনেরো দিনের মধ্যে টাকা পেয়ে গেলে আগামী দশ দিনের মধ্যে আসল কাগজ পেয়ে যাব। বাঁকা পয়সার এই কনফিডেন্স দেখে আমি থ। মিনমিন করে ক্ষীণ স্বরে তবু জানতে চেয়েছিলাম যে বিট অফিসার সরকারি চেয়ারে বসে এমনটা করে কি করে? ভদ্রলোক থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন ওঁর থেকেও অনেক রহিস পার্টি আছে, তবু ওপরওয়ালারা ওঁনাকেই গুরুত্ব দেন।

বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালাবার একটা প্লাস পয়েন্ট আছে। আমার আগ্রহী মনোভাব যেমন পৌঁছে যায় মানুষটির কাছে তেমনি বিশ্বাসটাও। তাই কথা প্রসঙ্গে আমার বলতে অসুবিধে হল না যে টাকা শুধু উনি দেন না, ‘রহিস পাবলিকে’ও দেয়। তবে ওপরওয়ালা কেন ওঁনাকেই প্রেফার করেন… আসলে ওঁনার স্পেশালিটি ঠিক কোথায় একটু বুঝতে চাই, এই আর কি। ভদ্রলোক জানালেন– ওখানে পৌঁছে চোখের ওপর ঘটনা পরম্পরা দেখলে নিজেই সবটা বুঝতে পারব। তাছাড়া কুলডিহার জাংগল-ক্যাম্পটি নাকি উনিই চালান। এ ব্যাপারে গভর্নমেন্ট-এর উৎসাহ অনন্ত। এটা দেখে উনি ব্যাপারটাকে দু’ভাবে ভেবেছেন। এক– পর্যটকের কাছে নিজেকে পরিচিত করে তোলা, দুই– অবস্থার সুযোগ নিয়ে উপার্জনের পন্থা খুঁজে বার করা। এসব ক্ষেত্রে চোখের চামড়া পাতলা হলেই প্রাপ্তি। সুতরাং… যেমন জঙ্গলে আগে জলের অসুবিধে ছিল, উনি ইনিশিয়েটিভ নিয়ে দু’টো টিউবওয়েল বসিয়েছেন। তাছাড়া গ্যাস, সোলার লাইট, পানীয় জল নিয়ে কুলডিহা এখন রানি। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে এল– তাহলে যোধাচুয়ায়? নাঃ, পরিষ্কার জানালেন সেখানে কিছু করেননি। কেন না বেশিরভাগ মানুষই কুলডিহায় এলে যোধাচুয়ায় যাবেই– যেহেতু ভরপুর সবুজ, গভীর অরণ্য। কিন্তু ফেসিলিটিস্ তেমন নেই বলে থাকার কথা খুব একটা কেউ ভাবেন না।

আমার যা বোঝার ছিল বুঝেছি, অনর্থক কথা না বাড়িয়ে প্রয়োজনীয় প্রসঙ্গে গেলাম। জানালাম দু-একদিনের মধ্যেই ওঁনার অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাচ্ছি, বুকিং আমার চাই-ই। এবার যে অ্যামাউন্ট উনি বলেছেন, তার সঙ্গে যেন একস্ট্রা পঁচিশ টাকা জুড়ে পাঠাই, তা উনি মনে করালেন। ওটা নাকি ক্যাশ ট্রান্সফারের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কেটে নেবে। ভদ্রলোকের একদিকে অনায্যতার ডিলিং, অন্যদিকে পেশাদারিত্ব। মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। দিন কয়েকের মধ্যেই টাকা মিটিয়ে অপেক্ষায় রইলাম– নাঃ, কোনও হেরফের নেই, কথা তো কথাই। দশ দিনের মধ্যে পাকা কাগজ হাতে এল।

জঙ্গলে যাচ্ছি, সঙ্গে চাল-ডাল-জল… হাতি থেকে আলপিন বাদ নেই কিছুই। সবাই মিলে বোঁচকা টেনে কোনওমতে কোচে পৌঁছোলাম। গাড়ি স্পিড নিতেই এবার ভাবনপথে হাজির পরের সিন। নেমে কা’কে ফোন করব, নীলগিরিতে বিসলেরি ওয়াটার পাব কিনা, কাঠের জ্বালে খাবারে ধোঁয়া গন্ধ ছাড়বে কিনা… ভাবতে-ভাবতে পৌঁছে গেলাম ‘বালেশ্বর’। কতটুকু আর– সাড়ে তিন ঘণ্টার জার্নি। প্ল্যাটফর্ম থেকে বাইরে বেরোতেই শুনতে পেলাম ডাক– ‘স্বপ্নমগন?’ ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ ‘স্বপ্নমগন’, প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে কথাটা ধরলাম। ঝাঁ চকচকে বোলেরোর গায়ে ঠেসানে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটিই প্রশ্নকর্তা। আগাম ব্যবস্থা করে রাখা এই গাড়িটির ড্রাইভার উনি, নাম দীপ্তিময়।

আমাদের দলের নাম ‘স্বপ্নমগন’। ড্রাইভার দীপ্তিময়ের ব্যবহারে ছিল এমন এক দীপ্তি যা না থাকলেই মুশকিল। যতই হোক ক’দিন এর সঙ্গেই কাটবে। এন্ট্রি পারমিটের জন্য আমাদের বিট-অফিসে নিয়ে গেল দীপ্তিময়। অফিসার ওড়িয়া মহিলা। তিনি হ্যালাফ্যালার একটা কাগজে হিসেব লিখে হাতে ধরিয়ে বললেন– ‘কিছু বলার আছে?’ আমার বিস্ময় চরমে। বলার থাকলেই বা কে শুনবে, নিয়ম তো নিয়মই। হঠাৎ এজেন্ট ভদ্রলোকের কথাটা মনে পড়ল– ‘এখানে এলে নিজেই দু’চোখে দেখবেন ম্যাম…’ না, অফিসারের ইঙ্গিতটা নজর এড়ায়নি বরং নিজেই উনি হেল্প করলেন। জানালেন, সঙ্গে ক্যামেরা থাকলেও উনি পেপারে লিখবেন না, ছোটো ছেলেমেয়ে থাকলে তাকে পাঁচবছরের কম দেখানোয় আপত্তি নেই। বদলে যে টাকাটা উনি নেবেন, রসিদে তার উল্লেখ থাকবে না। আমি ভাবলাম, অসুবিধে কি, যেমনি ঠাকুর, তেমনি তার নৈবেদ্য। জেনেবুঝেই এসেছি যখন। আধঘণ্টায় কাজ মিটিয়ে ‘নীলগিরি’ থেকে মাছ-বাজার-বিসলেরি কিনে ছুট। আমরা পৌঁছোলে রান্না হবে, তারপর খাওয়া, তারপর… কি জানি কি তারপর, আগে তো পৌঁছোই।

কুয়াশা অভেদ্য রোদের চাপা তাপ গায়ে মেখে- তাল, সুপারি, জংলি লতাপাতার সখ্যতা দেখতে-দেখতে পেরিয়ে গেলাম শেষ জনপদ নীলগিরি। বনের সরু পথ, পথের দু’ধারে সারিবদ্ধ গাছ, ফাঁক দিয়ে তার রোদ্দুর পড়ে আলো-ছায়ার আলপনা আর অদূরে নদীর পটচিত্র। কাকে ছেড়ে কাকে দেখি ভাবতে-ভাবতেই ঝুপ্পুস আওয়াজ ও দু’পাশে ফোয়ারার মতো স্রোত। দেখি গাড়িটি কেন্দুনদীতে নেমে পড়েছে আর অ্যাক্সিলেটর দাবিয়ে জেদি নদী পেরিয়ে যাচ্ছে দীপ্তি, চাকার চারপাশে সেই আক্ষেপেরই জোয়ার। হঠাৎই গাড়ির নীচে বোল্ডার পড়ে ভেতরে বিপুল উথাল-পাতাল। আনাজপাতি, বিশ-লিটারি বিসলেরি, মানুষজন সব একধারসে গড়াগড়ি। জঙ্গলের প্রতিটি বাঁকে সে এক নতুনকে আবিষ্কার। এতই বদল ছবি এই জঙ্গল দেখিয়েছে যে আগের রূপ মুছতে না মুছতেই চোখে অন্য অপরূপ এসে দাঁড়াচ্ছিল।

বেলা দেড়টা নাগাদ পৌঁছোলাম যোধাচুয়ায়। বাজার-দোকান কেয়ারটেকারের জিম্মায় দিয়ে বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে পড়লাম। যদিও ঠান্ডা তবু আস্তানা জুটতেই শরীরে ক্লান্তি নেমেছে ঝাঁপিয়ে। ছেলেরা বিছানা জুটতেই কেউ কম্বল-বালিশের নীচে, কেউ প্রকৃতির সঙ্গে আড্ডায়। কাঠের জ্বালে ফোটানো গরম জল হাজির হল তক্ষুনি।

মুলোশাকের ক্যাশমেমো-র মতোই দেখি বুনো বাথরুমে আবার টালির বাহার। ওদিকে দরজার দক্ষিণ কোণে মৌমাছি বাসা বেঁধেছে, সিলিং-এ উইয়ের আঁকিবুকি। তবু মনের মধ্যে কী যে ছন্দময় গান। আসলে বুনো জায়গার বন্যতাটাই আসল– যেন এটাই চাইছিলাম, ঠিক এমনই অগোছালো উদভ্রান্তি। নিজের ঘরে অথচ একটা মথ উড়ে গেলেও অশান্তি। অভ্যাস-মুক্তির এই আনন্দকে ছুঁয়ে যে আরাম উড়ছে আকাশে তা শিকড়ের টান বলে চিনতে পারলাম।

ইতিমধ্যে কাঠের জ্বালে রান্নাবাড়ি সারা, খিচুড়ি-ডিম-পাঁপড়-ভাজায় লাঞ্চ সেরে বেরোলাম। ঘণ্টাখানেক জঙ্গল চষে যখন সন্ধ্যা নামছে, তখন দীপ্তি বলল ও পুকুরিয়ার দিকে গাড়ি ঘোরাচ্ছে। কিছুটা আন্দাজ করলেও বুঝে পেলাম না এমন কি আছে সেটা দেখবার। ধন্ধ কাটাতে দীপ্তি জানাল ওটা একটা বড়ো পুকুর যেখানে জন্তু-জানোয়ার জল খেতে আসে। বলেই ফেললাম, একে অন্ধকার তায় কৃষ্ণপক্ষ…

দীপ্তি ভারি দৃপ্ত। বলল, আমি তো আছি। ভয়ের ভার আমাদেরও কম না। প্রায় সাথেসাথেই বলে ফেললাম, ওরা তোমায় চেনে বুঝি? শ্লেষের শব্দকে ঠাট্টায় নেবার মতো শিক্ষা আছে দীপ্তির। তাই মৃদু হেসে গাড়িতে উঠল, পিছুপিছু আমরাও পৌঁছে গেলাম পুকুরিয়া। বেশ বড়োসড়ো পুকুর যার মাঝদরিয়ায় আর্টিস্টিক কেতায় দাঁড়িয়ে আছে একটা ঝুপড়ি মতন গাছ। ও’পারে দৃষ্টি-অগম্য। আঁধারে কুুচি-কুচি জোনাকি আর চূড়ান্ত নিস্তব্ধতার থম বাড়িয়ে চতুর্দিকে ঝিঁঝিঁর ঝুমঝুম। এমনই সময় খুব কাছ থেকে জল পড়ার শব্দ শুনে দুদ্দাড়িয়ে দলের একজন দৌড়ে গিয়ে উঠল গাড়িতে। আকস্মিক এই ঘটনায় একেই ঘাবড়েছি, তায় মারাত্মক চমকে দিয়ে কোথা থেকে যেন তীব্র আলো পড়ল ঝোপে। দেখি দীপ্তি স্পটলাইট ফোকাস করেছে… এবং যেদিকে-সেদিকে আলোয় ভাসতে-ভাসতে দেখি আমাদেরই এক দলের সদস্য কড়ে আঙুল তুলে জানান দিচ্ছে জল বিয়োগের কথা। তিনি যে কখন টুকটুক করে ঝোপের আড়ালে তা যেমন জানা ছিল না, তেমনি জানা ছিল না দীপ্তির সঙ্গে স্পটলাইট আছে। জোড়া আকস্মিকতার ধাক্বায় তখন ‘স্বপ্নমগন’-এর স্বপ্ন ভেঙে খানখান।

খুব হয়েছে, গাড়িতে ফিরলাম, কাচ তুলে দিয়ে চুপচাপ বসলাম। দীপ্তি আশাবাদী। বলল ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারলে হাতি একসময় পাবই। মশা কামড়াচ্ছে তবু চড়-চাপটা মুলতুবি রেখেছি পাছে হাতি পালায়। এভাবে মিনিট পাঁচেক কেটেছে কি কাটেনি, হঠাৎই স্তব্ধ চরাচরে ফোঁসর-ফোঁসর শব্দ। দীপ্তি সঙ্গে সঙ্গে স্পটলাইট তাক করল। কিন্তু কোথায় কি! আওয়াজ তো গাড়ির ব্যাকসিট থেকে আসছে। যিনি চেম্বার খালি করেছেন তিনি এখন নিশ্চিন্তির নিদ্রায়। তাঁরই নাসিকা গর্জন।

আঃ, আমরা আবার ঠকলাম, আবার হাসলাম পা কাঁপিয়ে অথচ টুঁ-শব্দটুকু না করে- পাছে হাতি পালায়। হায় বেচারি দীপ্তি ও তার স্পটলাইট– এক আধটা হরিণ পেলেও হতো। পুরো অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স। অগত্যা গাড়ি ছুটল বাংলোর দিকে। আমাদের সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে দীপ্তির স্পটলাইট এমন অজায়গা-বেজায়গায় জ্বলে উঠল যে ও নিজেই চমকে-টমকে একশা।

জলে-জঙ্গলে অন্ধকার নামলে খুব বেশি কিছু করার থাকে না। তাই ফিরেই সবাই ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে ছাদে উঠলাম। একতলা বাংলোর দোতলায় ছাদ, ঘন আঁধারে হাত-পাও ঠাওর হচ্ছে না। মোবাইলের আলোয় ধাপি খুঁজে নিয়ে বসলাম। আড্ডায় মেতে থাকলাম কিছুক্ষণ ও হিম পড়া শুরু হতেই নামলাম।

ভোরে বাইরে বেরিয়ে দেখি গাছের পাতা-মাটি-উঠোন সব ভিজে, টুপটাপ শব্দও হচ্ছে অথচ আমাদের পা ভিজছে না। তবে? বড়ো বড়ো গাছের এক পাতা থেকে অন্য পাতায় শিশির জমা জল পড়ে চলেছে অবিরাম আর তারই শব্দ টুপটাপ।

ব্রেকফাস্ট সেরেই দুদ্দাড়িয়ে উঠলাম গাড়িতে– গন্তব্য কুলডিহা। পথে পড়ল ঋষিয়া ড্যাম। বিশাল নদী, নদীতে ফুরফুরে নৌকো, গ্রাম্য দিকপাশ, ন্যাংটা ছেলেপিলে, ধান আছড়ানো পাছাড়ে মগ্ন কৃষক, খড়-ছাউনির চালের মাথায় সারে-বাহারে টুনটুনিদের কিচিমিচি। এমনই উন্মনা হলাম যে শেষে দীপ্তিকেই ডাকতে হল। জানাল বেলা হয়েছে ঢের। কুলডিহা পৌঁছে রান্না হলে তবে খাওয়াদাওয়া তারপরে জঙ্গলে ঘোরা। ব্যস, আর বলতে হল না- ইঙ্গিতেই কাম ফতে। দৌড়ে সেঁধিয়ে গেলাম গাড়িতে। আবার বনতলের ছায়া মেখে জার্নি।

গাড়ির ঠিক আগেই পাইলট কারের মতো একটি হলুদ বুলবুলি চলেছে। তার উড়ালের সঙ্গে চলতে-চলতে পৌঁছে গেলাম কুলডিহা। এখানে টেন্টে উঠলাম নতুনের স্বাদ নিতে। ‘স্বপ্নমগন’-এর মনজমিতে তাঁবুর ছায়া পড়তেই সব বাক্যিহারা। ঘুলঘুলি জানালা, দড়ির ফাঁসকল-আঁটা দরজা, কাঠি-পর্দা ভেদ করে ভেতরে রোদের আঁকিবুকি। ত্রিপলের তাঁবুটি যেন আপ্যায়ন নিয়ে সেজেগুজেই বসে।

এবার নজর গেল দূরে। গাছের গায়ে ঠেসানে রাখা ইয়াব্বড়ো হাতির মাথার খুলি। কুল, বাঁদরলাঠি, গোলঞ্চর গাছ দিয়ে ঘেরা বাগানে পাখি আর অঢেল প্রজাপতি। বাংলোটি পরিখা দিয়ে ঘেরা। কি জানি কেন, হয়তে জন্তুর ভয়। সামনে সরু পথ, মাটি-মাটি উইঢিবি, অদূরে সল্টলিক। একটা তীব্র আবেশে জাপটে গেল মন। কাটতেও সময় লাগল না– কেন-না এজেন্ট মানুষটি দেখা করতে এসেছেন। তিনি এসেছেন পঞ্চলিঙ্গেশ্বর থেকে জনা কুড়ির দল নিয়ে। দলটি একেবারে বেয়ারা টাইপের, বনের প্রাপ্য মর্যাদাই দেয় না। হট্টগোল, চিল্লামেল্লি, ব্যাডমিন্টন– যেন পার্কের মাঠে চড়ুইভাতিতে এসেছে। এ এক অদ্ভুত বিড়ম্বনার জায়গা- বারণের কেউ নেই, করলেও বোঝার মন নেই। এল, খেল, খেলল, জন্তু কেন দেখল না-র অনুযোগে ধুন্ধুমার চ্যাঁচাল ও পাতা মাড়িয়ে খচরমচর শব্দ তুলে চলেও গেল। এজেন্টটির পঞ্চলিঙ্গেশ্বরে হোটেল আছে। ওখানকার টুরিস্টদেরই এই ট্রিপে আনে। প্রায় রোজই নাকি সারাদিনের জন্য ঢোকে আর সন্ধ্যার মুখে বেরিয়ে যায়। কি পায় এভাবে মানুষ? জঙ্গল কি কারুর ঘুঙুর বাঁধা পা যে নাচতে বললেই নাচবে? আসলে একজনের পয়সার প্রয়োজন আর অন্যজনের কম সময়ে প্রাপ্তির। ব্যস, মিলে গেল হিসেব।

ওরা চলে গেল, ঠান্ডা হল কুলডিহা। এবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। ঘণ্টাখানেক সময়ের শুশ্রূষা পেতেই অস্তিত্ব মাড়ানো গানহারা কুলডিহা ফের ছন্দে হেসে উঠল, তার গালের পড়া টোলে মুখ দেখতে দেখলাম ভিজে আকাশকে। হঠাৎই এক ধাড়ি স্ক্যুইরাল পুচ্ছ নাচিয়ে দৌড়ে গেল এক গাছ থেকে অন্যয়। শুধু প্রকৃতিবিক্ষণ। এরই মধ্যে তার রান্নাবান্না সারা হয়ে গেছে। কুলডিহায় গ্যাস আছে। চাইলে কেয়ারটেকারও রেঁধে দেয়। খেয়েদেয়ে কাছের ওয়াচটাওয়ারে উঠলাম, নজর সল্টলিকে। কিন্তু ঝাড়া দু’-ঘণ্টা কাটিয়েও কোথায়? মশায় অতিষ্ট হয়ে ঘরে ফিরলাম।

মিনিট পনেরো বাদেই দরজায় ধাক্বাধাক্বি- দেখি কেয়ারটেকার ও ড্রাইভার দীপ্তি স্পটলাইট নিয়ে রেডি। একটা হাতি নাকি পরিখার আশপাশে ঘুরছে। নিজের মতো যাবার উপায় নেই, একটা পার্টিকুলার পয়েন্ট অবধি ওদের সঙ্গে গেলাম। কৃষ্ণপক্ষের রাত জানান দিচ্ছে আঁধারের নিশ্ছিদ্রতা। কিছুটা পরেই ফস্ করে আলো জ্বলল। সেই স্পটলাইট। কাঠকুটো মড়মড়িয়ে ভাঙার আওয়াজ পেলাম, গাছপালার দোলাচল দেখলাম, কিন্তু তিনি কোথায়? হয়তো অন্ধকার গায়ে মেখে ধূসর তিনি কাছেই।

পরদিন ভোরে ভাগ্যিস ক’টা নাচুনে হরিণকে নুন চাটতে দেখেছিলাম। কুলডিহা বনের সার্থকতা এই বনের মধ্যেই স্থিত। প্রাণীকুল তার সম্পদ ঠিকই কিন্তু তাদের জন্য যাওয়া মুখ্য হলেই মুশকিল। এক এক জঙ্গল এক এক ভাবে তার সৌন্দর্যকে তুলে ধরে। এই জংলি ঘেরাটোপ এত ঘন-এত মজবুত যে আমি চাইলেও চোখ দিয়ে সবুজের নিশ্ছিদ্রতা ডিঙোনো যাবে না।

তাঞ্জোর ও অন্যান্য

রওনা দিয়েছি চেন্নাই থেকে তাঞ্জোরের উদ্দেশ্যে। রকফোর্ট এক্সপ্রেস চেন্নাইয়ের এগমোর স্টেশন থেকে রাত সাড়ে দশটায় ছেড়ে, পরদিন সকাল সাড়ে ছ’টায় আমাদের তাঞ্জোর পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে রওনা হল।

তাঞ্জোর পৌঁছেই প্রথমে ফ্রেশ হওয়া ও প্রাতরাশ সারার পালা। তারপর চললাম তাঞ্জোর প্যালেস দেখতে। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে দ্বারা সংরক্ষিত মিউজিয়াম দেখতে দেখতে যেন ইতিহাসের সরণি বেয়ে হাঁটলাম। ব্রোঞ্জ নির্মিত প্রচুর নটরাজমূর্তি শোভা পায় এই মিউজিয়ামে। এই সংগ্রহশালা যেন নিজেই একটি শিল্পকীর্তি। একেবারে উপর পর্যন্ত পৌঁছোতে সিঁড়ি দিয়ে প্রায় ছ’তলা উঠতে হয়। আর উপরে পৌঁছে পাখির চোখে ধরা দেয় গোটা শহরটা।

travel Thanjavur

শুধু বাংলা থেকেই নয়, বহু মানুষ বেঙ্গালুরু থেকেও বেড়াতে আসেন তাঞ্জোর-কুম্বাকোনম। ৩ রাত ৪ দিনের ছুটি কাটানোর একেবারে উপযুক্ত স্থান। ইতিহাস ও সংস্কৃতির গাঁটছড়া এই স্থানমাহাত্ম্য বাড়িয়ে দিয়েছে। কুম্বাকোনম বস্তুত চোল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। ফলে এক সময় প্রচুর মন্দির গড়ে ওঠে এ অঞ্চলে। তার মধ্যে বৃহদেশ্বর মন্দির, একাধিক নবগ্রহ মন্দির, উপ্পালিপ্পন মন্দির ও দারাসুরমের ঐরাবতেশ্বরম অন্যতম। আরও দেখার আছে টেম্পল অফ সেক্রেড রিভারস কুম্বাকোনম, সর্বেশ্বরণ মন্দির ও স্বামীমালাই স্থিত মুরুগান মন্দির। দেখতে ভুলবেন না তাঞ্জোর পেন্টিং-সমৃদ্ধ আর্ট গ্যালারি। এগুলোর প্রিন্ট তুলনামূলকভাবে কম দামে ওখান থেকে কিনতে পারেন প্রিয়জনদের দেওয়ার জন্য। ফেরার পথে অনেকেই একই সঙ্গে তিরুচিও ঘুরে নেন, মাত্রই ২-৩ ঘন্টার গাড়িপথ।

তাঞ্জোরের মন্দির চোল রাজারা শুধুমাত্র দেবদেবী প্রতিষ্ঠা করার জন্যই গড়ে তোলেননি, বস্তুত এগুলি সংগীত-নৃত্য-শিল্প-স্থাপত্যের একেকটি অপরূপ নিদর্শন। এখনও এই সংস্কৃতির নিদর্শনগুলি খোদিত রয়েছে মন্দিরগাত্রে।

বৃহদেশ্বর মন্দিরটি স্থাপনা করেন রাজা রাজা চোল। তাঁর পুত্র রাজেন্দ্র চোল, ভারতের উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত অর্থাৎ গঙ্গার কোল ছুঁয়ে থাকা রাজ্যগুলি জয় করার পর স্থাপনা করেন গঙ্গাইকোন্ডা চোলাপুরম। তাঁর পৌত্র রাজা রাজা (দ্বিতীয়) নির্মাণ করেন দারাসুরমের বিখ্যাত মন্দির। এই তিন প্রজন্মের স্থাপত্য কীর্তি নিয়েই আজকের তাঞ্জোর। পরবর্তীকালে অবশ্য এই অঞ্চলে পান্ডেয়, নায়ক ও মহারাজা সাম্রাজ্যেও তৈরি হয় বেশ কিছু মন্দির।

Destination Tamil Nadu

বৃহদেশ্বর মন্দিরের কারুকাজ মুগ্ধ করবে যে-কোনও শিল্প রসিককেই। মন্দির প্রাঙ্গণে একটি বিশাল নন্দী মূর্তি। মন্দিরের ভিতরে বৃহদেশ্বর শিব। মন্দির প্রাঙ্গণে বেশ কিছু ছোটো মন্দিরে কার্তিকেয়, ছয় মুখ বিশিষ্ট শিব ছাড়া অন্যান্য মূর্তির অবস্থান। চোখ ভরে দেখে নিন মন্দিরের কারুকার্য।

তাঞ্জোর গেলে তাঞ্জোর পেন্টিংস সংগ্রহ করতে ভুলবেন না। রাংতা, সেমিপ্রেশাস স্টোনস্ বসানো এই সব শিল্পকলা পাবেন থেরকু ভিধির সরস্বতী মহল নামের বিপণিতে।

তাঞ্জোর থেকে ত্রিচি অর্থাৎ তিরুচেরাপল্লি যারা ঘুরে নিতে চান, তাদেরও অজস্র মন্দির দর্শনের সুযোগ ঘটবে। রয়েছে ত্রিচির রক ফোর্ট টেম্পল।৪০০টি সিঁড়ি ভেঙে উঠে এক অপূর্ব ভিউ পাবেন। আরও দেখে নিন রঙ্গনাথস্বামী মন্দির। এটি দশম শতাব্দীতে নির্মিত এক বিষ্ণু মন্দির। মন্দিরটির গায়েও অপূর্ব ভাস্কর্য খচিত রয়েছে। এই মন্দির সফর অচিরেই আপনার মন ভরিয়ে দেবে।

পাহাড়ি পটে স্বর্গের রং

চোখের মতো লেন্স হয় না আর মনের মতো মেমরি কার্ড মেলে না। চোখের সেন্সর যার যত বেটার, তার ফ্রেমও তত ওয়াইড। অ্যাপার্চারের হ্যাপা নেই, হোয়াইট ব্যালেন্সের বালাই নেই। শার্টার স্পিড হল চলতি হাওয়ার পন্থি… হাওয়া যেমন দেবে চোখের পাতা তেমন পড়বে। প্রতিটা মানুষের শরীরে এ এক ডিফল্ট ক্যামেরা। এর ভরসাতেই ডিএসএলআরটাকে ব্যাগে পুরলাম।

ভোরের আলো পাইন পাতায় গা ঘষে যখন হিমাচলি পাকদণ্ডিতে নুয়ে পড়েছিল, ঠিক তখন থেকেই ঠায় চলছে। এখন আলোর গায়ে রোদের আগুন। সূর্যটাও সকাল থেকে আশকারা পেয়ে মাথায় চেপে বসেছে। নীলচে সবুজ পীরপাঞ্জাল আর চাপচাপ মেঘমাখা ধৌলাধার তার শৈলমায়ায় ঘিরে রাখলেও, গাড়ির কাচ নামালেই মুখ পুড়ে যাচ্ছে। পাহাড় মানেই ঠান্ডা না কি? বেলা যত বাড়ে তুষার তত গলে। এতক্ষণ পাহাড়টা বেশ বুক চিতিয়েই ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই প্রসারিত বক্ষটা কেমন যেন চুপসে গেল। তবে ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে ডেপথ-এ থাকা কালার শেডসগুলো এখন অনেকটা ক্লোজ শটে। হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারব।

রংবিরঙ্গি ফুলের জলসার মাঝখান দিয়ে ছুটে চলেছি।

ইতিহাসের শহর ডালহৌসিতে সত্যিই বসন্ত এসে গেছে। ভরাট সবুজকে বুকে জড়িয়ে উঠে যাওয়া খাড়া পাহাড়ের প্রাচীরের গায়ে লাল-হলুদ রং করা কাঠের মনকাড়া স্তম্ভ। অনেকটা আলোর স্তম্ভের মতো। কিন্তু দুপাশে ঝুলন্ত বাক্সে আলোর বদলে উপচে পড়া ফুলেল বনসাই। চড়া রোদে ঝলসে যাওয়া পাকদণ্ডিকে আপন প্রাণের মাধুরী ঢেলে সাজিয়ে রেখেছে।

উৎসব আছে না কি? ড্রাইভারভাইয়ের কাছ থেকে জানলাম কোনও উৎসব নয়। সামনেই বাচ্চাদের স্কুল। তাই স্কুলের আগের ও পরের কিছু রাস্তা এমন করে সাজানো। মনটা শিশু হয়ে গেল চকিতে। সত্যিই তো, মানুষ হবার শুরুর লগ্নে আগে তো প্রকৃতির পাঠ তারপর খাতার পাতায় আঁকিবুঁকি শিক্ষা। নইলে যে সবটাই বৃথা। প্রকৃতির বসন্ত ফুরোলেও মনের বসন্তকে ফুরোতে দিতে নেই। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে ইতিহাসের ডালহৌসি তুষারের সাদা চাদরে নিজেকে ঢেকে নেয়। তখন অন্য মজা। মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর ডালহৌসি বেড়াবার আদর্শ মরশুম।

রাত আস্তানা এখানে নয়। সেই ধরমশালাতে। তাই গাড়িটা একটা নিরাপদ জায়গা দেখে থামল। মাটিতে পা রাখতেই ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে শহরের প্রাণকেন্দ্র গান্ধি চক। কিন্তু চকে এসে চক্ষু দুখানা যে এমন চড়কগাছে চড়ে বসবে কে জানত? সামনেই ঠাঠা রোদে এলো গায়ে একখানা ফিনফিনে ধুতি জড়িয়ে লাঠি হাতে জাতির জনক এগোবেন বলে ভাবছেন। ব্যস ওইটুকুই। এক পা চলার ক্ষমতাও তাঁর নেই। বর্তমানের এন্তার বৈদ্যুতিক তারে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়েছেন গান্ধিজি। কোনও মারীচ যেন লক্ষণের ছদ্মবেশে রামের পরম ভক্তকে কালো কালো তারের গণ্ডিতে আটকে রেখেছে। ক্যামেরাবাতিক মনটা নিমেষেই মুষড়ে গেল। সান্ত্বনা খুঁজতে গান্ধিজিকে টপকে পিছনের গির্জাতে। এমন কদর্য চকের গায়ে এক টুকরো রোদ ছিটোনো শান্তিনিকেতন। গাছগাছালির রম্যস্পর্শে মনোরম এই যিশু ও মাতা মেরির ঘরটি ব্রিটিশ আমলের।

ইংরেজরা এখানে এসেছিল ১৮৫৪ তে। সেনাবাহিনী ও সরকারি পদাধিকারিকরা গরমকালের অবসর যাপনের জন্য এখানে এসে সময় কাটাতেন। তখনই এই শহরের পত্তন। ভারতের তৎকালীন গভর্নর লর্ড ডালহৌসির শহর বলে কথা। চেহারার সবখানেই তার ছাপ স্পষ্ট। পায়ে পায়ে ঢুকে পড়ি। শূন্য হাওদামহলের শেষ প্রান্তে রঙিন কাচে মাতা মেরি ও যিশুর ছবি। সামনে প্রার্থনামঞ্চ। সবেমাত্র দু-তিনটে ছবি তুলেছি কি তুলিনি, অমনি কোত্থেকে পিতা যিশুর এক পরমপুত্র তেড়ে এল। ‘দেখতে পাচ্ছেন না ছবি তোলা নিষেধ’… বাপ রে বাপ! সে কী ধমক তার। আমি যেন যিশুর ছবি বেচে কোটিপতি হয়ে যাব! অগত্যা সিক্ত মার্জারের মতো গুটিগুটি পায়ে রাস্তায় লাফিয়ে পড়লাম।

গান্ধি চকে চার্চের দিকে মুখ করে দাঁড়ালে ডানহাতে দুটি পথ। একটি ঊধর্বমুখী কালাটপ স্যাংচুয়ারির দিকে যাচ্ছে। অন্যটি নিম্নমুখী সাতধারা, পঞ্চপুলা। বাঁ-হাতেও দুটি এবং সামনে-পেছনে একটি করে রাস্তা চলে গেছে। সামনের রাস্তাটি কোলাহলের বাজার ছেড়ে নিজের মনে পালিয়েছে একটু নির্জনতার খোঁজে। ছায়ানির্জন আলোমাখা রাস্তা এঁকেবেঁকে সুভাষ বাউলি। চলতে চলতে পথের পাশে সাদা রঙের এক ছোটো জায়গা। সাইনবোর্ডে সুভাষচন্দ্রের সাথে এই জায়গার যোগাযোগ সম্পর্কিত তথ্যাবলি।

কেবলমাত্র বেড়াবার স্থানরূপেই ডালহৌসির খ্যাতি নয়। এখানকার স্থানমাহাত্ম্যের সঙ্গে আবহাওয়ারও এক বড়ো অবদান আছে। শোনা যায়, রোগীদের হাওয়া বদলের আদর্শ জায়গা এটি। সেই সূত্রেই ১৯৩৭ সালে ডা. ধরমবীরার অতিথি হয়ে আরোগ্য লাভের আশায় এখানে আসেন বঙ্গতনয় সুভাষ। ঠিকানা ছিল মেহেরস হোটেলের ১২ নম্বর ঘর। বাস স্ট্যান্ড থেকে ১ কিমি দূরত্বে এখানকার ঝরনার জলে আরোগ্য পান সুভাষচন্দ্র। সেই থেকেই এখানকার নাম সুভাষ বাউলি। ঝরনা নেই। আছে সিমেন্টে বাঁধানো এক আয়তকার ছোট্ট কুণ্ড। সেখানকার জল খাওয়া তো দূরস্থান, একঝলক চোখের দেখা দেখেই পেটটা কেমন মুচড়ে উঠল। তবু কেন জানি না মনে হচ্ছে  এখানে যে অনন্ত শান্তি তা বুঝি আর কোথাও নেই। এ আমার ইতিহাসের নস্ট্যালজিয়া নয়, প্রকৃতির প্রতি উদাসী সম্মোহন।

সুভাষ বাউলির রাস্তায় গাড়িটা গড়াতেই ছায়ামাখা ঝিমধরা সবুজের গন্ধ। সিঁড়ি বেয়ে সুভাষ বাউলির মাথায় কিংবা চাতালে উঠতেই দুটো চোখের ফ্রেমজুড়ে হাত নেড়ে অভিবাদন জানাচ্ছে ধৌলাধার, পীরপাঞ্জালের সমুদ্র। ধৌলাধারের পশ্চিমাংশে এই ডালহৌসি। চোখ ফেরানো দায়। নীচের পাকদণ্ডি সাপের চেহারা নিয়েছে। তাকে বেড় দিয়েছে শৈলতরুর দল। তারই ফাঁক দিয়ে অবিন্যস্ত সবুজ-নীল-ঘন নীল পাহাড়ের তরঙ্গমালা। দিগন্তখোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে পাহাড় দেখা একরকম। সেখানে লুকোচুরির রোমাঞ্চটা নেই। আর ঝিরিঝিরি পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে চোরাপলকে পাহাড়ি লাবণ্যে চোখ ভাসানো আরেকরকম। সেখানে আড়ালে লুকিয়ে থাকা প্রতিটি শৃঙ্গকে খুঁজে তার রসাস্বাদন অনবদ্য অভিজ্ঞতা।

এমনি করেই ভেসে গেল কিছুটা সময়। আমাদের ঘিরে কনসার্ট জমাল অচিনপাখির দল। সঙ্গে জঙ্গুলে রোমাঞ্চ। মল রোড শপিং সেন্টার লেখা তোরণের তলা দিয়ে গলে গেলেই ক্যাফে ডালহৌসি। ঘুরতে আসা মানুষজন সকাল কিম্বা বিকেলের জলযোগটা সেখানেই সারে। আবার গাড়ি ছোটানো। গন্তব্য ধরমশালা। তবে তার আগে রাস্তাতেই অজিত সিং রোড ধরে যেতে যেতে সাতধারা, ছোট্ট জনপদ পঞ্চপুলা। রাস্তা বেঁকতেই গাড়িটাকে দাঁড় করিয়ে পাখির চোখে গোটা ডালহৌসিটাকে এক ঝলক দেখে নেওয়া। দঙ্গল বেঁধে নিশিদিন দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ি জঙ্গলের আড়াল দুহাতে সরিয়ে শহর নয়, এক খণ্ড ইতিহাস উঁকি মেরে আছে। যতই বাকরোটা পাহাড়ের মাথায় চড়ছি তুষারমৌলী হিমালয়ের সৌন্দর্য যেন পরতে পরতে খুলছে। রোদ্দুর সরে যাচ্ছে। পালটে যাচ্ছে চিত্রপট।

উদরপুরে ছুঁচোর নাচন আর সহ্য হচ্ছে না। এখন ভেতো বাঙালির পেট ভরানোর পালা। পৌঁছে গেছি বাকলোহ। এখান থেকেই রাস্তাগুলো একেকটা দিকে ভাগ হয়ে গেছে। অতি সাধারণ এক ধাবায় দ্বিপ্রাহরিক আহার। খাবারও প্রায় শেষের পথে। তবু যা আছে সেটাই এখন অমৃত। এবার ধরমশালার রাস্তা। এখনও ৭৮ কিলোমিটার। বাঁকের পর বাঁক। কখনও পাহাড়ি গাঁয়ের খেতিবাড়ি আবার কখনও নুড়িপাথর ছাপিয়ে চলা খরস্রোতা নদীর পাশ কাটিয়ে ছুটে চলা। একটু একটু করে পৃথিবীর মাটি থেকে আলো তার আগুনরঙা শতরঞ্চি গুটিয়ে নিচ্ছে। ধরমশালার কাছাকাছি আসতেই দুপাশে হলুদ সবুজ নকশিকাঁথার মাঠের মাঝে ধৌলাধারের আগুনঢালা রূপ। দিন ফুরোনোর লালচে চেলি তার সর্বাঙ্গে। পলক ফেলতে মন চাইছে না। ধৌলাধারের পাদদেশেই হিমাচলের ধরমশালার অবস্থান।

শুরু থেকেই ঠিক করেছিলাম শহর থেকে কিছু দূরে রাত কাটাব। সেইমতো লোয়ার ধরমশালা থেকে তিন-চার কিলোমিটার আগে চেক্রতে আমাদের রাতের আস্তানা মিডওয়ে রিসর্ট। সময়টা নভেম্বরের শুরু। ঘরভাড়াতেও ডিসকাউন্ট মিলে গেল। ১২০০ টাকার ঘর ৯০০ টাকায়। রাস্তার ধারে পাহাড়ের কোলে নিরিবিলি ঠিকানা। পাশেই মন্দির। সন্ধে হতেই টংটং ঘণ্টাধবনির সাথে মন্ত্রোচ্চারণ। অসাধারণ পরিবেশ। ঘরের বারান্দায় দাঁড়াতেই চোখে পড়ে আকাশছোঁয়া পাহাড় আর তার বুক চিরে সাদা সিঁথির মতো গাড়িপথ। খানিকটা নীচে নেমে ছুঁতে পারা যাবে ফেলে আসা শৈশবটাকে। মেরি গো রাউন্ড, দোলনা, স্লিপ এবং অবশ্যই কেয়ারি করা সবুজের বাহার। পাশেই বিকেলের পড়ন্ত রোদ গায়ে জড়িয়ে নিশ্চুপ শুয়ে আছে এক নদী। সাদা সাদা নুড়ি-পাথরের পথ পেরিয়ে নীরব চলা তার। কী নাম এই নদীর? হোটেলের লোকটাও গাঁইগুই করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। আশ্চর্য! এরাও জানে না? পৃথিবীর বুকে এও এক অনাম্নী অঙ্গনা।

হিমকুয়াশার নেশা জমানো আরও একটা সকাল। পাইন-দেওদার-চিরের প্রাচীর দেওয়া পাকদণ্ডি। কাংড়া উপত্যকায় এই ধরমশালা। জেলাসদরও বটে। কাংড়ার রাজা ধরমচাঁদ ১৮৫৫ সালে এই শহরটাকে গড়ে তোলেন। কিন্তু দাপুটে ব্রিটিশের সর্বগ্রাসী মনোভাবের দরুন, রাজা ধরমচাঁদ আজকের পর্যটকদের কাছে ওই নাম না জানা নদীটার মতোই। এখন এটা ব্রিটিশপ্রভুদের নামেই কাটে।

১৮১৫ থেকে ১৯৪৭, এই একশো বত্রিশ বছর ধরে ব্রিটিশদের গড়ে তোলা ৮০ টি হিলস্টেশনের মধ্যে ধরমশালা যে অন্যতম তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। লর্ড এলগিন মহাশয় ধরমশালার প্রেমে হাবুডুবু খেয়ে এখানে একটি গ্রীষ্মাবাস গড়ে তোলার তোড়জোর শুরু করেন। তবে ওই পর্যন্তই। ১৮৬৩ সালে লর্ড এলগিনের মৃত্যুর সঙ্গে-সঙ্গে গ্রীষ্মাবাস পরিকল্পনারও অকালমৃত্যু ঘটে। ধরমশালা শহরের দুটো ভাগ, আপার এবং লোয়ার। মাঝে দূরত্ব ১০ কিলোমিটারের মতো। তবে ৩ কিলোমিটারের একটা চড়াই পথ আছে লোয়ার থেকে আপারে ওঠার। সেটা ট্রেকপথ। তাই সাধারণ মানুষজন সচরাচর সে পথ মাড়ান না। বলাই বাহুল্য, আমিও ওই প্রথম দলের দলি। গ্যাঁট খসিয়ে গাড়ি নিয়ে কে আর চায় পায়ের শুকতলা খসিয়ে অতি রোমাঞ্চিত হতে?

গাড়িটা দিব্যি চলছিল। লোয়ার ধরমশালায় ঢুকতেই অদ্ভূত কাণ্ড! গাড়িতে আছি না কচ্ছপের পিঠে বোঝার উপায় নেই। একে সরু রাস্তা, চড়াই, তার ওপর এদিক-ওদিক বাঁক নিয়েছে। থিকথিক করছে লোক। কোতোয়ালি বাজার ভরে উঠেছে অজস্র দোকানের ভিড়ে। ধীর পদে আঙুলের ফাঁকে ঝোলানো চকমকে মালাগুলো জপতে জপতে তিব্বতীয় লামাদের দল হেঁটে চলেছে। মুখে বিড়বিড়ে মন্ত্রোচ্চারণ। দিনের আলো তাদের সাদা চামড়ায় পিছলে মেরুন বসনে উছলে উঠছে। অনেক লোকের ভিড়ে তারা যেন নক্ষত্রের মতো ঝলমল করছে। লোয়ার ধরমশালাতেই কাংড়া আর্ট মিউজিয়াম। মঙ্গল থেকে শনিবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে। কিন্তু আমাদের কপালে সে শিকে ছিঁড়ল না। আজ সোমবার।

নির্বাক থেকে সবাক হয়ে হাই ডেফিনেশনের যুগেও হাওয়া বদলের হদিশ মানেই ম্যাকলয়েডগঞ্জ। আরও আছে। তবে এটা অন্যতম। আমি এখন সেইখানেই। বেশ খানিকটা চড়াই টপকে লোয়ার থেকে আপারে উঠে দলাই লামা মন্দির। এটাই ম্যাকলয়েডগঞ্জ। তবে আগে ভাগসুনাগ মন্দির এবং ভাগসু ঝরনাটা দেখে নেওয়াই সুবিধাজনক। কারণ সেখানে যাবার রাস্তাটা দলাই লামা মন্দির যাবার রাস্তা থেকে বাঁহাতে বেঁকে গেছে। কিন্তু ভিড়ভাট্টার গুঁতোয় ক্ষণিকের ভুলে আগেই দলাই লামা। যাইহোক, পাথর-পুঁতির রঙিন মালা, চামড়ার ব্যাগ, সারে সারে ধাতব বুদ্ধমূর্তি, ঘর সাজাবার হিমাচলি শৌখিন জিনিসের দোকান টপকে গাড়ি রাখবার জায়গা। ঠিক তার সামনেই দলাই লামা টেম্পল।

অনেক ভ্রমণপিপাসুদের কাছেই ধরমশালায় আসার প্রধান কারণ দলাই লামার বাসগৃহটি দেখা। দলাই লামার মন্দির, মার্চ থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত ভোর ৪টেয় খুলে বন্ধ হয় রাত ১০টায়। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি-র সময়টায় ভোর ৫টায় খোলে আর বন্ধ হয় রাত ৮টায়। শান্তির পথে তিব্বতকে মুক্ত করার জন্য ১৯৮৯ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারে সম্মানিত হন।

মূল ফটকে প্রবেশ করে নাক বরাবর সোজা গিয়ে ডানহাতে বেঁকতেই কালো মর্মরে তিব্বতী রাষ্ট্রীয় শহিদ স্মারক ফেলে সামনেই অন্দরমহলের সিঁড়ি। কড়া চেকিংয়ের ব্যবস্থা। গোটা ধরমশালা জুড়ে তিব্বতীয় শরণার্থীর ভিড়। নিজেদের দেশ ছেড়ে আজ ওরা পরভুঁয়ের বাসিন্দা। ভারতের অতিথি। অথচ আমাদের মানে প্রতিটি ভারতীয়দেরই প্রবেশের সময়ে মাথা থেকে পা অবধি তুমুল চেকিং করে তবে ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে। সত্যি বলতে কি, কিছুটা আঁতে লাগলই। কিন্তু ঢুকতেই শান্তির হাওয়া চারিয়ে গেল গোটা শরীর জুড়ে।

কী শান্ত, সৌম্য, ধীরস্থির এখানকার চারপাশ। মানুষগুলো যেন হাঁটছে না, কোনও এক অমোঘের টানে ভেসে চলেছে হাওয়ার মতো, বয়ে যাচ্ছে নদীর মতো। গলার স্বরে শান্ত নদীর কুলকুল ধ্বনি। বিরাট চাতাল শীতলতায় ডুবে আছে। হঠাৎ-হঠাৎ করে মৌনতাকে চুরমার করে ফুঁসে উঠছে একেকটা হাততালির শব্দ। আজব কাণ্ড! কোত্থাও কোনও জলসার নামগন্ধ নেই। সকলেই চোখ বুঁজে কিংবা সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছে। একমনে দেবতা বুদ্ধের দোরের সামনে দেশি-বিদেশির ইচ্ছেকামনা। তাহলে হাততালিটা দিচ্ছে কে? চাতালটার কোণের দিকে লামাদের পাঠের আসর বসেছে। তাঁদেরকে যারা শিক্ষা দিচ্ছে তাঁরাই দেখি নিজেদের ভাষায় কী যেন আওড়ে পটাস-পটাস হাততালি দিচ্ছে। ওঁদের এহেন গূঢ় শিক্ষার অর্থ বোঝার ব্যর্থ চেষ্টা না করে মুখ বাড়ালাম দেবতার ঘরে। দেয়ালে, খিলানে, থামের গায়ে রং ঝলমলে থাংকার শোভা। মাটিতে লাল কার্পেট বিছোনো। ঘরভরা রঙের শামিয়ানার মাঝে সোনার আলোয় জ্বলজ্বল করছেন দেবতা বোধিসত্ত্ব। অর্ধনিমীলিত নয়নযুগলে চোখ রাখলে মন শান্ত হয়। রংবাহারি ধাতুর চালচিত্রে পিঠ ঠেকিয়ে তিনি ধ্যানাসীন।

মন্দিরের মধ্যেই ইচ্ছেখুশির ডানা মেলা যায়। খালি পায়ে যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাও। উপরে উঠতেই আরেক শোভা। মাঝখানের ঘরটাকে ঘিরে আছে প্রার্থনা চাকা। ভক্তের মনোবাঞ্ছাপূরণে অনবরত ঘুরেই চলেছে তারা। ঘরের ভিতর সাধনকক্ষ। অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি কাচের আবডালে রাখা। সারা ঘরজুড়ে শুধুই চোখ ধাঁধানো বর্ণিল কারুকাজ। পাশের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই ‘আমি কেমন করিয়া জানাব আমার জুড়ালো হূদয় জুড়ালো’! পাহাড়ে পাহাড়ে ঢেউ উঠেছে তখন। সকালের আলোর বন্যাও হার মানছে সেই শৈলতরঙ্গের কাছে। এপাশে একচোখে পুরো ম্যাকলয়েডগঞ্জ শহর। বয়ে চলা প্রাত্যহিক জনজীবনের রংছবি। অন্যপাশে আলো-ছায়ায় প্রকৃতির আদি-অকৃত্রিম পাহাড়িখেলা।

দলাই লামা মন্দির যাবার রাস্তাটি ওয়ান ওয়ে। তাই বেরোবার সময়ে গাড়িগুলো মন্দিরের পিছন দিয়ে উতরাই পথে ঘুরে নেমে আবার চড়াই ধরছে। আবারও ঘিঞ্জি বাজার পেরিয়ে একই রাস্তা। গাড়িটা এক জায়গায় এসে থেমে যাবে। বাকিটা হাঁটাপথ। খুব সামান্যই। চলে আসা ভাগসুনাগ মন্দিরে। লাল-সাদা প্রবেশতোরণ পেরিয়ে মন্দির। তবে মন্দিরে ওঠার আগেই চোখ চলে যাবে সামনের জলাশয়টিতে। লোকে বলে উষ্ণ জলের প্রস্রবণ। তবে উষ্ণতার নামমাত্র তো নজরে এল না। ছেলেপুলেরা ইচ্ছেমতো ঝাঁপ দিয়ে সাঁতরে স্নান করছে সেখানে। চতুর্বাহু নারায়ণ জলাশয়ের পাশে বসে একমনে অভয় দান করে চলেছেন উচ্ছ্বসিত সাঁতারুদের। পাশেই গণেশের পাথরমূর্তি। গদা কাঁধে বজরংবলিও রয়েছেন দিব্যি। এবার মন্দিরের গর্ভগৃহ। দেবতার নীলঘরে গুপ্ত কোনও মাইকে অনবরত বেজে চলেছে ওম নমঃ শিবায়। নীলকণ্ঠ মহাদেবের প্রস্তরমূর্তির পাশটিতে পূজারি মানুষটি বসে ভক্তদের পুজো গ্রহণ করছেন। দ্বাপরযুগে দৈত্যরাজ ভাগসু ও সর্পরাজ নাগ এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা। গর্ভঘরের পাশের চত্বরে গিয়ে দাঁড়ালে কাছে-দূরের ধৌলাধারের শোভা, সঙ্গে সবুজ র‍্যাপারে মোড়া পাহাড়পুরীটাকে দারুণ লাগে। সাদা রঙের একচুড়ো মন্দিরটি বেশ সাদামাটা। তবে পর্যটকের মন ভরিয়ে দেবে মন্দিরসংলগ্ন পাহাড়-প্রকৃতি।

মন্দিরের প্রস্রবণকে পাশ কাটিয়ে গেলেই ভাগসু ঝরনা যাবার রাস্তা। নদীছোঁয়া বিপুল খাদের পাশে পাহাড় কেটে রেলিং ঘেরা বাঁধানো রাস্তা হয়েছে ঝরনার কাছে যাবার। মন্দিরে দাঁড়িয়েই দর্শন মেলে জলপ্রপাতটির। মনে হবে যেন সামান্য পথ। কিন্তু আসলে মন্দির থেকে ঝরনার দূরত্ব প্রায় ২ কিলোমিটার। দুপাশে সবুজের ঠাসবুনোটের বুক উজিয়ে উচ্ছল সে ধারার রূপই অন্যরকম। হিমাচলের এই এক মজা। শহর যতই ঘিঞ্জি হোক, আঁকেবাঁকে ঠিক কোথাও না কোথাও লুকিয়ে থাকবে মায়াবী নিসর্গের হাতছানি। ম্যাকলয়েডগঞ্জ থেকে ফরসিথগঞ্জের দিকে গেলে দেওদার জঙ্গলের মাঝে দেখা মেলে সেন্ট জনস চার্চ। জঙ্গুলে ঝিঁঝিঁ আর অপার্থিব নৈঃশব্দ্যের আলিঙ্গনে কেমন একটা ছমছমে হাওয়া খেয়ে যায় সারা শরীরে।

এরপর ডাল লেকের দুরন্ত রাস্তা। যতই পাহাড়ে উঠছি ততই যেন দেওদার-ওক-পাইনের সারি আমাদেরকে জাপটে ধরছে। গাড়ির কাচ ছুঁয়ে যাচ্ছে পথজোড়া আলো-ছায়ার বায়োস্কোপ। এখানকার ডাল লেকে কাশ্মীরি শিকারা নেই। টলটলে জলে ভেসে চলে না ফুলের জলসা। দেওদার জঙ্গলের ছায়া পড়ে লেকের স্থির নীল জল এখানে সবুজ। কয়েকটি সোনালি মাছ ইতিউতি খেলে বেড়াচ্ছে। সম্ভবত ভ্রমণের ছাত্রবন্ধুর পাতাতেই পড়েছি, এই লেকের জলে স্নান করলে না কি কৈলাস ও মানস সরোবরের পুণ্যি মেলে। কিন্তু ওহে বন্ধুসকল, এই ভ্রমণবন্ধুর একটি কথা মানুন, এই ১৭৭৫ মিটার উঁচুতে এসে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেই মন ভোলান। ভুলেও পুণ্যের লোভ করবেন না। লেকের পাশেই শিবমন্দির।

ধরমশালার স্বর্গটাকে ছোঁব বলেই ডাল লেকের রাস্তাতে আসা। কিন্তু সে কোথায়? স্থানীয় একজন বললেন, এই রাস্তায় আরও খানিকটা উঠলে তবেই নাড্ডি পৌঁছোনো সম্ভব। সাত হাজার ফুট উঁচুতে সত্যিই একটুকরো স্বর্গ যেন। কাঠফাটা রোদেও বেশ একটা নিঝুম-নিঝুম ভাব। চারপাশ ঘিরে কাঁধ ছুঁয়ে আছে ধৌলাধার আর পীরপঞ্জাল। পাখির চোখে কাংড়া ভ্যালি। কানের কাছে আকাশ আর সদ্য ফুরোনো শরতের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ। টেলিস্কোপে চোখ রাখলে দূরের পাহাড় হাতের তালুতে। পয়সা লাগে না। নিসর্গের কোলেই গজিয়ে উঠেছে কয়েকটা সৌন্দর্যপিপাসু ভ্রামণিকদের রাত-আস্তানা। তাদেরই মাঝখান দিয়ে একটা সরু রাস্তা উঠে গেছে আরও ওপরে। কিন্তু আর তো কিছু নেই। বাকিটা জুড়ে অতলান্ত খাদ, পাহাড় আর আকাশের ঠিকানা। রাস্তাটা হয়তো দিকশূন্যপুরের নিশানা!

কীভাবে যাবেনঃ  হাওড়া থেকে ট্রেনপথে চাক্বিব্যাংক কিংবা পাঠানকোট পৌঁছোতে হবে। সেখান থেকে গাড়িপথে ৮৮ কিলোমিটার দূরে ধরমশালা। গাড়ি আগে থেকে বুক করে রাখাই ভালো।

কোথায় থাকবেনঃ  ডালহৌসিতে হিমাচল পর্যটনের হোটেল গীতাঞ্জলি (২৪২১৫৫) ও হোটেল মণিমহেশ (২৪২৭৯৩)। খাজিয়ারে হিমাচল পর্যটনের হোটেল দেওদার (২৩৬৩৩৩)। দুটো জায়গাতেই অজস্র বেসরকারি হোটেল আছে। ঘরভাড়া ৬০০-১,৫০০ টাকা।

ডালহৌসি এসটিডি কোডঃ ০১৮৯৯।

 

মেঘপাখির বাসা– লেপচাজগৎ

বাইরের তাপমাত্রা ৭ ডিগ্রিতে নেমে গেছে। প্রচণ্ড বৃষ্টি আর ঝোড়ো হাওয়া। পাশাং-এর বাড়ির ছাদের ঘরে বসে দেখছি কয়েকটা ফ্ল্যাগ এত জোরে জোরে হাওয়ায় উড়ছে যেন মনে হচ্ছে বাইরে প্রলয় চলছে, ঘরে বসে তার কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি মাত্র। এত ঠান্ডাতেও প্রচণ্ড ঘামছি। গলার ভিতরটা শুকিয়ে আসছে। কম্বল সরিয়ে হতভম্বের মতো চেয়ে আছি পাশাংয়ের দিকে।

গতকাল এসে পৌঁছেছি লেপচাজগৎ-এ।

৬৮০০ ফুট উঁচুতে পৌঁছে গেছি। গাড়িটা শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যাবার রাস্তায় ঘুম থেকে একটা বাঁক নিয়ে এগোল। এই রাস্তাটাই নাকি মিরিক চলে যাচ্ছে। ঘুম পেরোতেই সেই সবুজ প্রকৃতি। গাড়ির এক পাশে পাহাড় আর অন্য পাশে খাদ। প্রতি বাঁকেই ঘুরে যাচ্ছে হিসেবটা। ৮ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম লেপচাজগৎ। পাহাড় আর পাইনের জঙ্গল ঘেরা ছোট্ট একটা পাহাড়ি গ্রাম। ঠিক যেন স্বপ্নের মতো।

সকালে ব্রেকফাস্ট-এ ওয়াই-ওয়াই খেতে দিল। খাওয়া শেষে বেরিয়ে পড়লাম ভিউ পয়েন্ট দেখতে। গ্রামের বাড়িঘরের মাঝখান দিয়ে চলে গেছে একটা সরু এবড়োখেবড়ো রাস্তা। গ্রামের রাস্তায় হাঁস মুরগি ঘোরা-ফেরা করছে। লংকা, আচার শুকোতে দেওয়া। একটু এগোতেই দেখতে পেলাম বড়ো বড়ো পাইন গাছের সারি। সাদা রঙের বুদ্ধিস্ট ফ্ল্যাগগুলো পতপত করে হাওয়ায় উড়ছে। হঠাৎ মনে মনে ভাবলাম এই গ্রামে শান্তির বাণী ছড়িয়ে দিয়ে তা কি শহরের অলিগলিতে কি আদৌ পৌঁছোচ্ছে? নাকি দুরত্বটা বড্ড বেশি?

ভিউ পয়েন্টে পৌঁছে দেখি চারিধারটা একধরনের বুনো সাদা ফুলে ভর্তি। ঝাঁকে ঝাঁকে মুক্তো একসাথে। যেন মনে হচ্ছে মুক্তোর চাষ হয়েছে। নীচে পাহাড়ি গ্রাম, আকাঁবাঁকা নদীপথ বারবার মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। নীচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা বেশ ঘিঞ্জি শহর। পাশাং বলল, ওটা দার্জিলিং।

আমরা উঠেছি কাঞ্চনকন্যা হোমস্টেতে। পাশাং তামাং আর তার পরিবারের বাড়ি। দুই ছেলে, এক মেয়ে, স্ত্রী, বৃদ্ধা মা-কে নিয়ে সংসার পাশাংয়ের। মধ্যবয়সি পাশাংয়ের ব্যবহার বারবার মুগ্ধ করে।

পাশাংয়ের কাছেই শুনছিলাম মাত্র ৪০ ঘর মানুষের বাস এখানে। বেশিরভাগই তামাং, দু এক ঘর রাই, আর ছেত্রী। একটা গল্প বলছিল পাশাং, বহু আগে এখানে শুধু লেপচা জনজাতির মানুষের বাস ছিল। সেই থেকেই নাকি লেপচাজগৎ নামটা এসেছে।

ফেরার পথে একটা জঙ্গলের কথা বলছিল পাশাং। আমি বললাম যাব।

ঠিক হল দুপুরে খাওয়ার পর মনোজ আমাদের নিয়ে যাবে জঙ্গলের মধ্যে ঘুম রক দেখতে। পাশাংয়ের বড়ো ছেলে মনোজ তামাং। ও এখন কলকাতায় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। আমাদের বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। ওর কাছেই শুনছিলাম কাছের শহর বলতে সুকিয়া, দার্জিলিং, মিরিক, কার্শিয়াংয়ের সাথে লেপচাজগৎ-এর যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ ভালো। এখান থেকে কাজ করতে, পড়াশোনা করতে ওই শহরগুলোতেই যেতে হয়। স্নানে যাওয়ার আগে একবার এসে দাঁড়িয়েছি ছাদের রেলিংয়ের ধারে। একটা পাকা রাস্তা একেবেঁকে মিলিয়ে যাচ্ছে। রাস্তার দু-ধার ঘেঁষে পাইনের জঙ্গল। আর দেখলাম থেকে থেকেই হঠাৎ কোথা থেকে গোছা গোছা মেঘ ভিড় করে আসছে গাছের মাথায়। আবার হঠাৎ উধাও হয়ে চারিধার ঝকঝকে। পরিযায়ী পাখির দল যেমন ভিড় করে গাছের মাথায়, আবার উড়ে যায় অন্য গাছে, ঠিক তেমনিই মনে হচ্ছিল।

ভীষণ ঠান্ডা লাগছে। এত ঠান্ডা যে জল হাতে ধরলেই মনে হচ্ছে আঙুল কেটে যাচ্ছে। স্নান করব না করব না ভাবছি, দেখি গরমজলের বালতি নিয়ে হাজির পাশাং।

বাঁধাকপির সবজি, মুসুরির ডাল, ডিমের ডালনা, পাঁপড় ভাজা দিয়ে পেট ভরে দুপুরের খাবার খেলাম।

ক্যামেরা নিয়ে নীচে এসে দেখি ততক্ষণে মনোজ একটা লাঠি আর কুকরি নিয়ে রেডি। আমি জানতে চাইলাম এটা দিয়ে কি হবে?

ও বলল, “জঙ্গল হ্যায় না, সাফ করতে করতে ঘুস না পড়তা হ্যায়।”

দুপাশে পাইনের জঙ্গল মাঝের চওড়া পাকা রাস্তা ধরে আমরা এগোচ্ছি। দূর থেকে একটা লম্বা ছেলেকে দেখে আমি বলে উঠলাম, ‘আরে ফুটবলার রুড গুলিট না!’

আমার কথায় স্বভাব শান্ত মনোজ হেসে ফেলে বলল, ‘ও মেরা ছোটা ভাই বিনোদ হ্যায়।’

আমরা দুজনেই খুব হাসলাম। সত্যি পাহাড়ের ছেলেমেয়েরা জন্মগত স্টাইলিশ, এ আমার বরাবরের ঈর্ষা। এক দেড় কিলোমিটার রাস্তা।

হেঁটে পৌঁছে গেলাম জঙ্গলের রাস্তায়। চারিদিকে কুয়াশায় ঢেকে গেছে। পাইনের জঙ্গলে যেন অন্ধকার নেমে এসেছে।

আমার মনে হল যে, কোন-ও ভৌতিক সিনেমার আদর্শ শুটিং স্পট। মনোজ আগে আগে আমরা ওর পিছন পিছন। কাঁটাঝোপঝাড় থেকে বেশ বড়ো বড়ো শ্যাওলাধরা গাছের জঙ্গল। একটা গাছে দেখলাম লাল রঙের বুনো স্ট্রবেরি হয়ে আছে। এমন এমন ফুল, পাতা যা কোনওদিন চোখেই দেখিনি। আর আছে আকাশছোঁয়া পাইন গাছ। মেঘগুলো গাছের মাথায় পাখির মতো এসে বসেছে।

‘আঃ! উফ!’

কাঁটার খোঁচায় জ্যাকেটটা ছিঁড়েই গেল। মনোজ যতটা পারছে ডাল কাটতে কাটতে হাঁটছে। একটা জায়গায় গিয়ে থামতে হল। দুটো পা একসাথে ফেলে এগোনোর উপায় নেই। তার উপর আবার আগের দিন বৃষ্টি হয়েছে, তাই মাটি ভেজা। যেকোনও সময় পা স্লিপ করতে পারে। একটা সরু গাছকে ভর করে এক এক পা দিয়ে মনোজের দেখানো পথ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। বুনো ফুলের গন্ধে চারিপাশটা ম ম করছে। নানা রঙের প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। মানুষের এই পথে একদমই যাতায়াত নেই। তাই মাটির উপরে কোনও রাস্তা তৈরি হয়নি বা কাদায় পায়ের ছাপও পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকী মাকড়সার জালগুলোও ছিঁড়ে ছিঁড়ে এগোতে হচ্ছে।

এক সময় একটা বিশাল গোলাকার পাথরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। এটাই ঘুম রক। দেখে ভালো লাগল যে এখনও এখানে কেউ নিজের নাম বা প্রেমিকার নাম খোদাই করেনি। নইলে কোনও স্মৃতিসৌধ হোক বা পার্কের বেঞ্চ, খোদাইচিত্র দেখে দেখে লজ্জাবোধ হয়।

মনোজের কাছেই শুনলাম আরেকটু এগোলেই একটা ভিউ পয়েন্ট আছে, তার আর একটু উপরে আছে ব্রিটিশ আমলের একটা হাওয়ামহল। এদিকে চারিদিক মেঘ আর কুয়াশাতে ঢেকে গেছে। কতটা যেতে পারব জানি না। ভিউ পয়েন্ট পর্যন্ত পৌছানো গেল। বহু পুরোনো লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা একটা জায়গা। এখন যদিও জায়গাটা খুবই অপরিচ্ছন্ন। আগাছায় ভরে গেছে। লোহার রেলিং-এ মরচে ধরেছে। মনোজ বলল, ‘ব্রিটিশও কা ফেভারিট প্লেস থা।’

আমার একবার মনে হল যেন এখানে কোনও এক শুভ্রবসন সুন্দরী বিদেশিনী অপেক্ষা করতেন তার লেপচা প্রেমিক পুরুষের জন্য। অপূর্ব সুন্দর একটা জায়গা, যেখান থেকে অনেকটা দূর পর্যন্ত দেখা যায় দূরের পাহাড়, নদী।

আমার কল্পনায় জল ঢেলে মনোজের পরামর্শে ফেরার পথে পা বাড়ালাম। আসলে যে-কোনও সময় বৃষ্টি নামবে। ঘন অন্ধকার হয়ে আসছে। হাওয়ামহল দেখা হল না।

মন খারাপ নিয়ে নেমে এলাম। ফেরার পথে মোড়ের দোকানে কফি আর মোমো খেয়ে দুঃখটা একটু পুশিয়ে নিলাম।

মনের মধ্যে একটা আপশোশ কাজ করছে। কি জানি কি ইতিহাস লুকিয়ে আছে হাওয়ামহলের গায়ে। বৃষ্টি নেমেছিল খুব, আর হাওয়াও দিচ্ছিল খুব জোরে। এখন আবার সব পরিষ্কার ঝকঝক করছে। রোদের ঝিলিকও দেখা দিয়েছে।

আমি ভাবলাম এই সুযোগ। মনোজকে নিয়ে হাওয়ামহলটা ঘুরেই আসি। কাল আর সময় হবে না। ঘর থেকে নীচে এসে মনোজের খোঁজ করলাম। বিনীতা বলল, ও বাজারে গেছে। আমার আবার মনটা খারাপ হয়ে গেল। এদিকে সন্ধে হয়ে গেলে আর যাওয়া যাবে না। তাই নিজেই একটা লাঠি নিয়ে জঙ্গলের পথে পা বাড়ালাম।

কিছুক্ষণ আগের বৃষ্টিটাতে মাটি আরও পিছল হয়ে গেছে। স্যাঁতসেঁতে জঙ্গল দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। ভয় ভয় করছে। কাজটা ঠিক হল তো। ঝড়ে দেখলাম কিছু গাছ ভেঙে পড়েছে। বাঘের ভয় না থাকলেও লেপার্ড-এর ভয় আছে। একবার ভাবলাম ফিরে আসি। পিছন ফিরে তাকাতেই প্রাণপাখি উড়ে গেল। একি রাস্তা কোথায়? চারিদিকে ঘন জঙ্গলের মাঝে আমি একা। সামনে পিছনে কোনও রাস্তাই নেই। কিন্তু কীভাবে সম্ভব। আমার স্পষ্ট মনে আছে, এই পথেই মনোজ নিয়ে এসেছিল। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। হাত ঘড়িতে দেখলাম পাঁচটা পনেরো। এক্ষুণি আঁধার নামবে। আমি কী করব এখন?

লাঠি দিয়ে গাছপালা ঠেলে এগোনোর চেষ্টা করলাম। কাঁটার খোঁচাতে হাত পা ছড়ে গেল। রক্ত ঝরছে চিৎকার করছি প্রাণপণ। কিন্তু একেই জনবিরল জায়গা তাতে ঘন জঙ্গল, কে আসবে। আজ মৃত্যুর মুখোমুখি। কান্না আর অসহায়তা ছাড়া আমার সামনে পিছনে কোনও পথই নেই।

প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি।

ধড়মড় করে উঠে বসেছি। এই প্রচণ্ড ঠান্ডাতেও দরদর করে ঘামছি।

সেই এসে ঘুমিয়ে পড়েছি। বৃষ্টি এখনও থামেনি। স্বপ্ন দেখে এমন চিৎকার জুড়েছি যে পাশাং ছুটে এসেছে নীচ থেকে।

ঘড়ি দেখলাম রাত আটটা। রুদ্ধশ্বাস তিন ঘন্টা মৃত্যুর মুখোমুখি। হোক না স্বপ্ন। তবুও খুব ক্লান্ত, বিধ্বস্ত লাগছে নিজেকে।

পরদিন ভোর চারটে নাগাদ দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। পাশাং বলল, আকাশ পরিষ্কার, সূর্যোদয় দেখতে হলে এখনই বেরোতে হবে।

কোনওরকমে জ্যাকেট, মাফলার পরে ক্যামেরা নিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই হাঁটা দিলাম। ভিউ পয়েন্ট থেকে কাঞ্চনজঙঘা খুব কাছাকাছি পরিষ্কার দেখা যায় শুনেছি। প্রায় এক কিলোমিটার পথ। পৌঁছে দেখি কয়েকজন আগেই চলে এসেছেন। ক্যামেরা হাতে অপেক্ষা করছে সবাই। এতবার দেখেছি, তবু আবার দেখার আশ মেটে না। আকাশের রং বদলাচ্ছে। ধূসর, গোলাপি, লাল, কমলা আর সব শেষে নীল। দূরে কখনও সোনালি আবার কখনো রুপোলি আভা দেখা যাচ্ছে। একটু একটু করে পরিষ্কার হচ্ছে আকাশ। কী অপূর্ব সেই দৃশ্য। একদিকের পাহাড়ে সূর্য উঠছে আর অন্য দিকের বরফের পাহাড়ে সেই আলো পড়ে ঝলমল করে উঠছে। নীল আকাশের মাঝে ভেসে উঠেছে রুপালি কাঞ্চনজঙঘা।

আরে এতদিন শুনেছি, আজ প্রথমবার দেখলাম পূর্ণাবয়ব শায়িত বুদ্ধ। সত্যি কী আশ্চর্য! মাথা, নাক, মুখ, শরীর, পা– সত্যি কেউ যেন শুয়ে আছে। তিনি বুদ্ধদেব কিনা জানা নেই। তবে এত শান্ত, সমাহিত ভঙ্গি কার হতে পারে। মনে হচ্ছে কেউ যেন দোয়াতে করে নীল কালি আকাশের গায়ে ঢেলে দিয়েছে, আর তার মাঝেই শুয়ে আছেন শ্বেতশুভ্রবসন কোনও এক যোগী পুরুষ, স্লিপিং বুদ্ধা।

ক্যামেরার লেন্স বন্ধ করেছি বহুক্ষণ। ভিউ পয়েন্ট ফাঁকা। চেয়ে আছি অসীমতার দিকে। আর বুদ্ধের বাণী লেখা সেই সাদা পতাকাগুলো উড়ছে। সেই হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর মন।

কাল রাতে যে অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা, মৃত্যুভয় তাড়া করেছিল, আজ সব ভ্যানিশ হয়ে গেছে।

– বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।

কীভাবে যাবেন

শিলিগুড়ি থেকে শেয়ার গাড়িতে ঘুম। সেখান থেকে গাড়িতে লেপচাজগৎ মাত্র ৭ কিলোমিটার।

অথবা শিলিগুড়ি থেকে সরাসরি গাড়ি নিয়ে লেপচাজগৎ। দূরত্ব ৬৮ কিলোমিটার।

কোথায় থাকবেন

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ফরেস্ট বাংলো আছে। বুকিং কলকাতা WBFDC অফিস। এছাড়া কিছু প্রাইভেট হোম স্টে আছে।

মণিমহেশ

পাহাড়ে একটা চালু কথা আছে, ডাক না এলে পৌঁছোনো যায় না। আমাদের মণিমহেশ যাওয়ার ডাকটা বোধহয় তেমন আকস্মিকভাবেই এসেছিল। যদিও দলটা বড়ো করার চেষ্টা করেছিলাম আমরা, কিন্তু কোনও অজানা দৈব কারণে হয়তো ‘ডাক’ সবার এল না এবং অনেকেই শেষ মুহূর্তে ট্রেক-এর কষ্ট থেকে পরিত্রাণ চাইলেন।

অতএব পথে নামলাম আমরা, চারজনের ছোট্ট দল। দীর্ঘ ট্রেন যাত্রার শেষে হাওড়া থেকে পাঠানকোট পৌঁছোলাম। হিমাচল হিমালয়ের তোরণদ্বার বলা চলে পাঠানকোটকে। গাড়িতে ঘন্টা ছয়েকের যাত্রা শেষে চাম্বা হয়ে পৌঁছোলাম ভারমৌর। মণিমহেশ যাওয়ার পথে রাত কাটাবার মোটামুটি ভদ্রস্থ জায়গা এই ভারমৌর-এই মেলে। পরদিন ভোরে আমাদের ট্রেক শুরু হবে হাডসার থেকে। হাডসার, ভারমৌর থেকে গাড়িতে এক ঘন্টার পথ। পায়ে হাঁটা পথ গেছে হাডসার থেকে গৌরীকুণ্ড হয়ে মণিমহেশের দিকে।

হাডসার থেকে গৌরীকুণ্ড ১৩ কিলোমিটার পথ। তাই ভালো হয় একদিনে পুরো ট্রেকটা না করে, ধনচোতে টেন্ট করা। জন্মাষ্টমীর সময় মণিমহেশ যাত্রা উপলক্ষ্যে প্রচুর তীর্থযাত্রী আসেন এই পথে। সেই সময় বেশ কিছু অস্থায়ী ধাবা, ভান্ডারা চলে পূণ্যার্থীদের জন্য। বাকি সময় এপথ শুনসান পড়ে থাকে পথিকের অপেক্ষায়।

ভোর-ভোর যাত্রা শুরু করলেও প্রথমেই হাডসারের পথ না ধরে, আমরা মনস্থ করলাম ভারমৌরের চৌরাসি মন্দিরটি দেখে নেওয়ার। মূলত শিবমন্দির হলেও এখানে খোদিত আছে চুরাশিটি বিগ্রহ। একটি ধর্মরাজ মন্দিরও রয়েছে। আর হিমালয়ের এই অংশে ভীষণভাবে পূজিত হন কার্তিক।

মন্দির দর্শন সেরে পথ ধরলাম হাডসারের। মণিমহেশ বস্তুত একটি হাই অল্টিটিউট লেক, যা ৪০০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। শিব পূজিত হন এখানে। পাঁচটি কৈলাসের অন্যতম হল মণিমহেশ। সেই অপূর্ব নিসর্গের শরিক হতে চলেছি আমরা। অক্টোবরের শেষেও আমাদের মতো অযাচিত পর্যটকের জন্য কিছু সংস্থান হয়েই যাবে, এই আশায়।

২২৮০ মিটার উচ্চতায় হাডসার থেকে হাঁটা শুরু হতেই প্রথম আধঘন্টা বেশ চটপট পার হয়ে গেল। অপূর্ব একটি পাহাড়ি নদী আমাদের সঙ্গে। পাইন, দেওদার গাছের ছায়া ছায়া পথ। প্রচুর পাখি ও প্রজাপতির দেখা পেতে লাগলাম অচিরেই। মাথা তুলতেই চোখে পড়ে সেই শৈলশুভ্র মণিমহেশ।

মাঝে মাঝে একটু হালকা স্ন্যাক্স আর ছবি তোলার বিরতি নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করি। ঘন্টা পাঁচেক হেঁটে অবশেষে পৌঁছোই ধনচো। এখানে পাপ্পু টি-স্টলে চা আর ম্যাগি পাওয়া গেল। টেন্ট পিচ করলাম। আজ এটাই আমাদের রাতের আস্তানা।

পরদিন সকালে আলু পরোটা প্রাতরাশ করে আবার শুরু হল হাঁটা। এবার লক্ষ্য গৌরীকুণ্ড। যেখান থেকে মাত্র এক কিমি দূরেই মণিমহেশ। সকালের রোদ্দুরে হিমশৈল চোখ ঝলসে দিচ্ছে যেন। ধনচো থেকে পথ কিছুটা রুক্ষ এবং পাথুরে। গাছও কমে আসছে ক্রমশ হাই অল্টিটিউটের কারণে। গ্লেসিয়ারের বরফগলা জল ছোটো ঝরনার মতো করে পথ কেটেছে এখানে ওখানে।

হাতে লাঠি নিয়ে চড়াই ভাঙতে হচ্ছে। বুকে চাপ ধরছে অক্সিজেনের অপ্রতুলতার কারণে। কিন্তু মন ভরিয়ে দিচ্ছে আশপাশের সৌন্দর্য। মণিমহেশ কৈলাশের অবর্ণনীয় রূপ দেখতে দেখতে এগোচ্ছি এক অমোঘ টানে। কোথাও কোথাও পাহাড়ি ছাগল, ভেড়া নিয়ে চলেছে গাদ্দিরা। শেষের কয়েক কিলোমিটার একেবারে পাথরের বোল্ডার টপকে হাঁটা। কিন্তু সেখান থেকেই চোখে পড়ছে গৌরীকুণ্ডের লাল নিশান।

গন্তব্যে পৌঁছোতে দুপুর গড়াল। আমাদের জন্যই যেন অপেক্ষমান ক্ষেমরাজজির তাঁবু। ওঁর দয়াতেই গরম গরম রাজমা-চাওয়াল জুটে গেল চনচনে খিদের সময়ে। অদ্ভুত জীবন ক্ষেমরাজজির। এপ্রিল থেকে অক্টোবর অবধি উনি ওখানেই থাকেন। বরফ গলা শুরু হতেই তিনি পদার্পণ করেন আর শীতের কামড় শুরু হয় যখন অক্টোবরের শেষ থেকে, সবাই চলে যাওয়ার পর তিনি নেমে আসেন ধনচোতে। যাত্রার সময়ে প্রত্যেক তীর্থযাত্রীর দেখভালের দায়িত্ব নিজেই কাঁধে তুলে নেন।

সন্ধে নামতে বাবার ধুনি ঘিরে শুনছিলাম তাঁর নানা অভিজ্ঞতার কথা। রাত গভীর হতে ঠান্ডাও বাড়ল ক্রমশ। আকাশের সলমা চুমকির শোভা ছেড়ে যে যার তাঁবুতে আশ্রয় নিলাম।

সকালে উঠে এক অবর্ণনীয় শোভা দেখলাম। রাতে এক প্রস্থ বরফ পড়েছে। ফলে চারপাশ সাদা। এক কিমি পথ পেরোলেই মণিমহেশ। চোখের সামনেই তার উদ্ভাসিত রূপ। পৌঁছোনোর পর মণিমহেশ হ্রদের রূপ মুগ্ধ করে দিল। বরফ জলে হাত ছোঁয়ালাম। ঘন্টা খানেক ওই বাকরুদ্ধ করা রূপ দেখে ফেরার পথ ধরলাম। পেছনে তখনও তুষার শৃঙ্গের উপর রোদের আলপনা দিচ্ছে সূর্যদেব।

উদয়পুর-পিলাক ছুঁয়ে তৃষ্ণা

উত্তরপূর্ব ভারতের ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য ত্রিপুরা। আমার এবারের সফরনামায় রয়েছে ত্রিপুরার অচেনা কয়েকটা জায়গা। সিপাহিজলা ও তৃষ্ণা অভয়ারণ্য তার মধ্যে অন্যতম। কাল প্রাক দুপুরের উড়ানে নেমেছি রাজধানী শহর আগরতলায়। নামার পরই সোজা লাঞ্চের টেবিলে। এরপর গাড়ি নিয়ে প্রথমে উজ্জয়ন্ড প্রাসাদ। ১৮৯৬ সালে গ্রিক স্থাপত্যশৈলীতে গড়া এই প্রাসাদ এখন স্থানান্তরিত মিউজিয়াম।

ইতিহাস ছুঁয়ে গাড়ি ছুটল সিপাহিজলা অভয়ারণ্যে। মাঝে আধঘন্টার জন্য অবশ্য বিবেকনগরে রামকৃষ্ণ মিশনে গিয়েছিলাম। সিপাহিজলার ২৫ কিমি পথ বেশ আরামদায়ক। সবুজের ব্যাপ্তি চোখ জুড়িয়ে দেয়। সে সবুজের ধারাবাহিকতা এসেছে সিপাহিজলা ঢুকতে রাবার বাগানের উপস্থিতিতে। ইদানীং রাবার শিল্পে ভালোই লাভের মুখ দেখছে ত্রিপুরা। আকাশ ছোঁয়া নিবিড় রাবার গাছের উপস্থিতি, গাড়ি থেকে নামতে বাধ্য করল। চুঁইয়ে পড়া কাঁচা রাবার কাছ থেকে দেখলাম।

সিপাহিজলাকে অভয়ারণ্য না বলে, ত্রিপুরার নন্দন কানন বলাই যুক্তিযুক্ত। ১৮.৫৩ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে হাজার পশুপাখি থাকলেও, তা সবই খাঁচাবন্দি। টিকিট কেটে এবার পায়ে-পায়ে এগিয়ে যাওয়া। বোটানিক্যাল গার্ডেন, ডিয়ার পার্ক, হ্রদ, বোটিং, টয় ট্রেন– এরকম হাজার ব্যবস্থা থাকলেও, অতটা সময় ছিল না আমাদের ঘুরে ঘুরে দেখার। বাঘ, ভল্লুক, নেউল, নীলগাই, পাখপাখালি দেখতেই অনেকটা সময় কাবার। কিন্তু যার জন্য এখানে ছুটে আসা, সেই ‘সিগনেচার অ্যানিম্যাল’ চশমা-বাঁদর কোথায় গেল? কর্তব্যরত বনকর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতেই দেখিয়ে দিল বোর্ড নির্দেশিত পথ। শুনেছি ভারতের আর কোথাও এই বাঁদর দেখা যায় না। বেশ করে চশমা-বাঁদরদের ছবি তুলে, দৌড়ালাম উদয়পুরের দিকে।

মন্দিরের শহর নামে খ্যাত ত্রিপুরার পুরাতন রাজধানী উদয়পুর। এখানে পথে-প্রান্তে রয়েছে অজস্র মন্দির। আজ সকালে প্রথমেই গাড়ি ছুটল মাতাবাড়ি। একান্ন পীঠের অন্যতম মন্দির ত্রিপুরেশ্বরী দর্শনে। শোনা যায় সতীর ডান পা পড়েছিল এখানে। মন্দির রয়েছে এক টিলার ওপর। কথিত আছে ১৪০১ খ্রীষ্টাব্দে মহারাজা ধন্যমাণিক্য স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে ত্রিপুরাসুন্দরীর মূর্তি অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে এখানে এনে স্থাপন করেন। একচালার দোকানের সামনে গাড়ি দাঁড় করিয়ে পুজোর উপচার কেনা হল। মন্দিরে ভিড় নেই একদম। হয়তো বে-বার বলে! পান্ডার দলবলও চোখে পড়ল না।

সুউচ্চ মন্দিরের গঠনশৈলীতে দেখি বাংলা চালাঘরের আদল। শীর্ষদেশ স্তুপাকৃতি ও তার ওপর পূর্ণকলস। পরিবেশ অসাধারণ। কষ্টিপাথরের কালীমূর্তির ছবি তুলতে কেউই বাধা দিল না। তেল সিঁদুর মাখা হাড়িকাঠ বোঝাল এখানে বলিপ্রথা অক্ষুণ্ণ। মন্দির সম্মুখে কল্যাণসাগর হ্রদ। মহারাজা কল্যাণমাণিক্যের পৃষ্ঠপোষকতায় খনন প্রাপ্ত। বিশালাকার দিঘিতে পা ডোবালেই মাছ ও কচ্ছপের গুঁতো খেতে হয়। পর্যটকরা দেখলাম মুড়ি ও বিস্কুট খাওয়াচ্ছে আচ্ছা করে।

টিফিনের পর দেখে নিলাম গুণবতী মন্দির কমপ্লেক্স। এইসব মন্দিরে বৌদ্ধ স্থাপত্যের ছাপ সুস্পষ্ট। বিশেষত শীর্ষদেশটি দেখলেই উপলব্ধি হয়। এবার দেখলাম ত্রিপুরেশ্বর ভৈরব মন্দির আর চতুর্দশ দেবতার মন্দির। চতুর্দশ দেবতার মন্দিরে অবশ্য কোনও বিগ্রহ নেই। রাস্তার উলটো দিকে বিজয়সাগর, বর্তমানে ‘মহাদেব দিঘি’ নামে পরিচিত।

এবার গাড়ি ছুটল গোমতী নদী পেরিয়ে ভুবনেশ্বরী মন্দিরের উদ্দেশ্যে। পথে গোমতী নদীতে বাঁশ ভাসিয়ে নিয়ে যাওয়া দেখলাম, গাড়ি থেকে নেমে। পরিবহন খরচ বাঁচাতে এখানে নদীর স্রোতকে কাজে লাগানো হয়। চতুর্দিকে সবুজের মাঝে গোমতীর পারে ভুবনেশ্বরী মন্দির এককথায় অসাধারণ। মন্দিরটি নির্মাণ করেন মহারাজ গোবিন্দমাণিক্য। মন্দিরের ভিতরে বর্তমানে কোনও বিগ্রহ নেই। শোনা যায় পূর্বে এই মন্দিরে নরবলি দেওয়ার প্রথা ছিল। রবীন্দ্রনাথও এই মন্দির দর্শন করেছিলেন। তাঁর রাজর্ষি উপন্যাস ও বিসর্জন নাটকে এই মন্দিরের বিশেষ উল্লেখ আছে।

বর্তমানে মূল মন্দিরের পাশে একটি ছোটো মন্দির নির্মিত হয়েছে। সেখানে অবশ্য পুজোপাঠ হয়। মন্দিরের হাতায় দেখি, সদ্য গড়ে ওঠা একটি ওয়াচটাওয়ার। ওয়াচটাওয়ারে উঠে গোমতী নদীর ঘোলাটে জল-সহ ছড়ানো সবুজের ল্যান্ডস্কেপ অনবদ্য লাগল। উদয়পুরকেও পেয়ে গেলাম পাখির চোখে। ফেরার পথে ওই রাস্তাতেই দেখে নিলাম মহারাজা গোবিন্দমাণিক্য নির্মিত পুরাতন রাজপ্রাসাদের ধবংসাবশেষ। আর দেখলাম জঙ্গলাকীর্ণ এক জরাজীর্ণ বিষ্ণু মন্দির।

এবার উদয়পুর থেকে ৬১ কিমি দূরে পিলাকের উদ্দেশ্যে যাত্রা। দক্ষিণ ত্রিপুরার

বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থিত পিলাক। পিলাক আবার দুটি অংশে বিভক্ত। পূর্ব ও পশ্চিম পিলাক। এখানে একটি ছোট্ট নদী আছে, তার নামও পিলাক। পার হলাম বাগাফা, শান্তির বাজার, বাইঘোড়া। গাড়ি ঢুকল এবার জোলাইবাড়ি বাজারে। জোলাইবাড়ি থেকে মেইন রাস্তাটা গেছে সাব্রুম-এর দিকে। আমরা ধরলাম ডানদিকের একটা অপ্রশস্ত পথ। মাইলস্টোন বলছে, জোলাইবাড়ি থেকে পিলাক মাত্র ২ কিমি।

পথে পেলাম তালসুপারির সাথে দিগন্ত প্রসারী ধানখেত। ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণ স্থান পিলাক। যেখানে প্রায় ১০ বর্গ কিমি এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হিন্দু-বৌদ্ধযুগের বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। পিলাক বাজার ঢোকার আগে এক প্রত্নস্থল দেখতে গাড়ি থেকে নেমে আলপথ ধরে হাঁটতে থাকলাম। দেখি সেখানে ভারতীয় পুরাতাত্ত্বিক সর্বেক্ষণের তত্ত্বাবধানে আগাছা সংস্কারের কাজ চলছে। চোখে দেখে মনে হল সম্ভবত বড়ো কোনও বৌদ্ধ মনাস্ট্রি ছিল এখানে। বর্তমানে মাটি থেকে সামান্য অংশই কালের স্বাক্ষর দিতে টিকে আছে। ভাঙা দেয়ালের গায়ে অবিকৃত কিছু স্থাপত্য নজর এড়ায় না। চত্বরের ভিতরে ও বাইরেও বেশ কিছু আধভাঙা ভাস্কর্য। পুরাতাত্ত্বিক ফলকে অষ্টম থেকে নবম শতকের মনাস্ট্রি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পুরাতাত্ত্বিক এই স্থানের বেশ কিছু ছবি তুলে এবার বাজারের পথে।

বাজার ঢোকার মুখেই দেখি, পিলাক প্রত্ননিদর্শনের একটা ঘেরা চত্বর। চত্বর জুড়ে বেশ কয়েকটা টিনের শেড। কেয়ারি করা পথ ধরে গিয়ে দেখি চত্বর জুড়ে প্রত্ননিদর্শনের ছড়াছড়ি। সারিবদ্ধ সেইসব প্রত্ননিদর্শনের গায়ে বোর্ড ফলক থাকলেও, কোনও গাইড চোখে পড়ল না। একটু পরেই অবশ্য এগিয়ে এলেন দু’জন ব্যক্তি। অনেক অজানা তথ্য জানালেন গল্পের ছলে। পরে জানলাম এরা এখানকার কেয়ারটেকার। নাম শংকর ও কানু। ওরাই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করাল ভারতের সর্ববৃহৎ সূর্যমূর্তির প্রতি। খননে প্রাপ্ত দশ ফুটের সেই সূর্যমূর্তিটি বেলেপাথরের। হাতে ধরা পদ্মফুল। মূর্তিটির বেশ কয়েক জায়গা ভেঙে গেছে।

এছাড়া চত্বরের অন্য প্রান্তে দেখলাম কিন্নর মূর্তি, গণেশ মূর্তি ইত্যাদি। ওদেরই মুখে শুনলাম, এখানে অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতকের হিন্দু ও বৌদ্ধ স্থাপত্যের সন্ধান মিলেছে। এখানে প্রাপ্ত নবম শতাব্দীর অবলোকিতেশ্বর মূর্তি ও দ্বাদশ শতকের নরসিংহ মূর্তি দুটি বর্তমানে আগরতলা মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে। জানা গেল সমগ্র পিলাক জুড়ে যে-স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের নিদর্শন মেলে, তার বেশির ভাগেই রয়েছে বাংলা, পাল ও গুপ্ত স্থাপত্য-কীর্তির ছোঁয়া।

এছাড়া কোনও কোনও ক্ষেত্রে আরাকান ও মায়ানমারি স্থাপত্যের নিদর্শনও মেলে। পিলাকের উল্লেখযোগ্য প্রত্ননিদর্শনের স্থানগুলি হল শ্যামসুন্দর টিলা, দেববাড়ি, ঠাকুরানি টিলা, বালির পাথর, বাসুদেব বাড়ি এবং সাগরদেব। ত্রিপুরায় যে-শাসকেরা রাজত্ব করেছিলেন, তাদের অনেকেই ছিলেন, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তাই আজও ত্রিপুরায় আনাচে-কানাচে বৌদ্ধ সংস্কৃতির ছোঁয়া মেলে।

এবার ওদের হাত ধরে গেলাম চত্বরের কোণে এক ছোট্ট ঘরে। আমাদের বসতে দিয়ে, আলমারির তালা খোলে ওরা। বেশ কিছু দুষ্প্রাপ্য প্রত্নসামগ্রী বার করে সামনে রাখা একটা টেবিলে ভালো করে সাজিয়ে দেয়। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য স্ফটিকের শিবলিঙ্গ। এছাড়া টেরাকোটার গণেশমূর্তি, ব্রোঞ্জের লক্ষ্মীনারায়ণ মূর্তি, বুদ্ধমূর্তি, অপ্সরা মূর্তি ও বেশ কিছু মুদ্রা উল্লেখযোগ্য। ভালোভাবে দেখে ও ছবি তুলে আবার স্বস্থানে তা রেখে দিল ওরা। তালাবন্দি এইসব মূর্তিগুলো নিয়ে এখানে একটা মিউজিয়াম বানানোর প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি।

শংকরের নির্দেশিত পথে এবার কয়েকটা বাড়ির পর এক স্থানীয় বাড়িতে হাজির হই। খননে প্রাপ্ত এক মনসামূর্তি এখানে দিব্যি শিবঠাকুর রূপে পূজিত হচ্ছেন। শুনলাম এই মূর্তিটিকে আর সরকারিভাবে হস্তগত করা সম্ভব হয়নি। এবার মাঠের মাঝে ধানজমির ফাঁকে এক প্রান্তে উপস্থিত হই। শুনলাম বাঁশঝাড় আর ঝোপজঙ্গল ভরা এই পতিত জমিটার দখল নিয়েছে ভারতীয় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। কারণ এখানকার মাটি খুড়লেই মিলবে প্রত্ন ঐশ্বর্য। জায়গাটা গাছপালা আর ঝোপঝাড়ের মধ্যে ঢিপি আকারের। খননে প্রাপ্ত এক গণেশমূর্তি দেখি একটা টিনের শেডের নীচে রাখা। গণেশের শুঁড় ও পায়ের অংশ সিঁদুরে মাখামাখি, দেখে বোঝা গেল স্থানীয়রা এই মূর্তিতে নিত্য পুজোআর্চা করে।

শংকর ও কানুর অনুরোধে এবার হাজির হই পিলাক বাজার থেকে তিন কিমি দূরে রাজ-রাজেশ্বরী মন্দিরে। এই রাজ-রাজেশ্বরী মূর্তি (দুর্গা) আদৌ হাল আমলের নয়। অষ্টাদশ হস্ত বিশিষ্ট এই মূর্তি এক বিরল বিগ্রহ। পিলাক খননে প্রাপ্ত এই নিদর্শনও সরকার হস্তগত করতে পারেনি। স্থানীয় মানুষজন মন্দির তৈরি করে তাই নিষ্ঠা-সহ পুজোপাঠ করছে। মন্দিরে পৌঁছে দেখলাম শুধু দুর্গা নয়, কার্তিক, গণেশ, লক্ষ্মী-সরস্বতী টোটাল ফ্যামিলিই এখানে হাজির। সবই খননপ্রাপ্ত পাথরের মূর্তি বলে পুরোহিত জানায়। এই রকম কত নিদর্শন যে পিলাক জুড়ে ছড়িয়ে আছে, তার হিসাব ঠিকঠাক দেওয়া শক্ত।

ফিরে এলাম জোলাইবাড়ি। ফেরার পথে এক চায়ের দোকানে টি-ব্রেক নেওয়া হল। চা শেষে পা রাখি তৃষ্ণার পথে। এই অভয়ারণ্য দেখতে বেলোনিয়া হয়ে ড্রাইভার ধরল বড়োপাথারির রাস্তা। বেলোনিয়া থেকে ১৫ কিমি দূরে তৃষ্ণা। বড়োপাথারি থেকে রাস্তা ঢুকেছে ডানদিকে। তবে তৃষ্ণা যেতে, চোখের তৃষ্ণা নিবৃত্ত হলেও, পথের হদিশ পেতে কালঘাম ছুটে গেল। কারণ পথনির্দেশ সর্বত্র নেই বললেই চলে। উদয়পুরে গৌরী হোটেলের ম্যানেজার এক্ষেত্রে ম্যাপ এঁকে আমাদের সাহায্য করেছিলেন।

শেষ পর্যন্ত হাজির হলাম তৃষ্ণা অভয়ারণ্যে। তবে নিয়ম অনুযায়ী আজ বন্ধ এ অরণ্য। অগত্যা কি উপায়! সুদূর পশ্চিমবঙ্গ থেকে এসেছি শুনে বনকর্মীদের মনে দয়া হল। ফলে বনের কিছু অংশ ঝলক দর্শনের অর্ডার মিলল। কিছুটা চলার পর গহিন জঙ্গলমাঝে পার্ক ও সংলগ্ন একটি লেকের ধারে আমরা উপস্থিত হলাম। জায়গাটা লা-জবাব। লেকে বোটিং-এর ব্যবস্থা আছে দেখলাম। বিস্তীর্ণ জলাশয়ে অগুনতি পাখিদের কলকাকলি মুখরিত করল। রঙিন প্রজাপতি আর দিকহারা মৌমাছির ভনভন আওয়াজ যেন অন্য জগতে নিয়ে গেল। ছবিও তুললাম মন ভরে। রকমারি বাঁদরদের উপস্থিতি এখানে লক্ষ্যণীয়। তাই এ অরণ্যকে ‘বাঁদর জঙ্গল’ বললেও অত্যুক্তি হবে না। অন্যান্য জন্তু-জানোয়ারেরও হদিশ মেলে। এবার তৃষ্ণা ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংচুয়ারির অফিসে বনকর্মীরাই অনতিদূরে বাইসন পয়েন্টে যাওয়ার জন্য এক বনকর্মীকে আমাদের গাড়িতে তুলে দিলেন।

জঙ্গলের বুক চিরে ছুটে চলেছে গাড়ি। দেড় কিমির মধ্যে পেয়ে গেলাম বাইসন পয়েন্ট। গেটে ঢুকেও গাড়ি গড়াল জঙ্গুলে পথে অনেকটা। বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই বাইসন পয়েন্ট। ছবির মতো এক স্থানে এসে গাড়ি পার্কিং করা হল। জায়গাটা একটা ঘাসজমিতে গড়া প্রাকৃতিক উঠোন বলা যায়। ঘাস জমির একটু দূরে এক ওয়াচটাওয়ার। মাঝারি জঙ্গলের শুরু তারপরই। জঙ্গল-হাতার মধ্যে বেশ কিছু ছোটো ছোটো জলাশয়। পানীয় জলের চাহিদা মেটায় জীবজন্তুদের। উঠে গেলাম চুয়াল্লিশ ফুট উঁচু ওয়াচটাওয়ারের মাথায়। চোখে সবুজের সুনামি ধরা পড়তেই প্রাণ জুড়িয়ে গেল। এরিয়াল ডিসস্ট্যান্টে বাংলাদেশকেও উঁকি দিলাম।

এই ভরদুপুরে একটা বাইসনের দেখা পেলাম। তবে এতটাই দূরে যে গাছপালার ফাঁকে তার অস্তিত্ব বোঝা চট্ করে সম্ভব নয়। ওই বনকর্মীর মুখেই শুনলাম, ভারত-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে বর্ডার সংলগ্ন এক অভয়ারণ্য তৈরির পরিকল্পনার কথা। জানি না কতটা সত্যি-মিথ্যে খবরটা। এবার হোটেল খুঁজে মধ্যাহ্ন ভোজনের ব্যবস্থা নিতে হবে। বনকর্মীটি বলল, বেলোনিয়ার আগে ভালো হোটেল পাবেন না। যাক্ শেষ পর্যন্ত বারবেলায় ভরপেট খেয়ে গাড়ি ছুটল মেলাঘরে। আজ আমরা রুদ্রসাগরের তীরে সাগর মহল টুরিস্ট লজে থাকব। কাল নীরমহল ও কসবা কালীমন্দির দেখে দুপুরের ফ্লাইটে কলকাতা ফেরা।

কীভাবে যাবেন

হাওড়া বা কলকাতা থেকে প্রথমে ট্রেনে গুয়াহাটি। গুয়াহাটি থেকে ট্রেন বদলে লামডিং। একমাত্র কামরূপ ও কাঞ্চনজঙঘা এক্সপ্রেস লামডিং পর্যন্ত যায়। লামডিং থেকে মিটার গেজ ট্রেনে আগরতলা। গুয়াহাটি থেকে নাইট সার্ভিস বাসেও আগরতলা যাওয়া যায়। সব থেকে ভালো হয় কলকাতা থেকে মাত্র পঞ্চাশ মিনিটের উড়ানে আগরতলা পৌঁছানো। আগরতলা থেকে গাড়ি বুকিং করে ঘোরাই সুবিধাজনক।

কোথায় থাকবেন

আগরতলা – রাজ্য পর্যটন দপ্তরের হোটেল গীতাঞ্জলি অতিথি নিবাস।

সিপাহিজলা – বনবিভাগের টুরিস্ট লজ অবসারিকা, লেক ভিউ রিসর্ট।

উদয়পুর – রাজ্য পর্যটনের গুণবতী টুরিস্ট লজ আছে মাতাবাড়িতে।

পিলাক – জোলাইবাড়িতে আছে পিলাক টুরিস্ট লজ। বাগাফায় আছে পিলাক পান্থনিবাস ও মনু যাত্রীনিবাস। থাকতে পারেন শান্তিবাজার ডাকবাংলোতেও।

তৃষ্ণা – অভয়ারণ্য দেখতে, থাকুন রাজনগরের গেস্টহাউস, ফরেস্ট রেস্ট হাইসে। ১৫ কিমি দূরে বিলোনিয়া শহরে বনদফতরের ‘বনমহল’ বাংলোতেও থাকতে পারেন। আর কাছাকাছি আছে জয়চন্দ্রপুরের কটেজ।

জরুরি তথ্য

প্যাকেজ বুকিং ও অন্যান্য ইনফরমেশন নেওয়ার জন্য কলকাতায় যোগাযোগের ঠিকানা – ত্রিপুরা ভবন, ১ প্রিটোরিয়া স্ট্রিট, কলকাতা-৭১।

 

প্রবালদ্বীপের রূপকথা

প্রথমবার এক সরকারি কাজে লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণে যাতায়াত পুরোপুরি ছিল আকাশপথে– অর্থাৎ বিমানে কোচি পৌঁছে আবার আকাশপথে আগাত্তি দ্বীপে পৌঁছোনো। লাক্ষাদ্বীপের মধ্যে এই একটি দ্বীপেই বিমান অবতরণ করতে পারে। এই আগাত্তি দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যাতায়াতের ব্যবস্থাও ছিল আকাশপথে। তবে বিমানে নয় হেলিকপ্টারে।

এই ভ্রমণের বিশেষত্ব হল, কোচি থেকে সব পরিবহন ও পর্যটন হবে জলপথে জাহাজে। ভারতীয়দেরও লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণের অনুমতিপত্র লাগে। এই সফরে অনুমতিপত্রের ব্যবস্থা করে দেবে আয়োজক সংস্থা অর্থাৎ ‘স্পোর্টস’। সারাবছর নির্দিষ্ট সংখ্যক পর্যটক লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণের অনুমতি পায়, ফলে অনেককে বিফল মনোরথ হতে হয়। যেহেতু দ্বীপের অভ্যন্তরে সরকারি পর্যটক আবাস ও হোটেলের সংখ্যা হাতেগোনা, তাই ‘স্পোর্টস’ আয়োজিত সফরে পর্যটকদের জাহাজে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। আর সারাদিন ঘোরাঘুরি দ্বীপ থেকে দ্বীপান্তরে।

চট করে ইচ্ছে হলেই কিন্তু লাক্ষাদ্বীপ যাওয়া যায় না। অনেক আগে থেকে সিট সংরক্ষণ ও অনুমতিপত্রের জন্য ব্যবস্থা করে রাখতে হবে। যদিও ‘স্পোর্টস’-এর প্রধান অফিস কোচিতে, তবে কলকাতাতেও কয়েকটি ভ্রমণসংস্থার অফিসে লাক্ষাদ্বীপের যোগাযোগ ও বুকিং-এর ব্যবস্থা রয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে ‘ইন্ডিয়া টুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড’-এর অনুমোদিত ‘অশোক ট্রাভেলস অ্যান্ড টুর’। এছাড়া রয়েছে ‘ডলফিন ট্রাভেলস’ ও আরও কয়েকটি অনুমোদিত সংস্থা। সফর নভেম্বর মাসে কিন্তু নাম নথিভুক্ত করতে হল জুন মাসে আর আগস্ট মাসেই প্রাথমিক বুকিং করে রাখতে হল। এরপর ট্রেন-প্লেনের টিকিট কাটা।

লাক্ষাদ্বীপে আছে মোট ৩৬টি দ্বীপ আর তার মধ্যে ১১টি দ্বীপে মানুষ বসবাস করে। এগুলি হল মিনিকয়, কালপেনি, কাভারাত্তি, অ্যানড্রট, আগাত্তি, আমিনি, কাদমাত, কিস্তান, বিত্রা, চেতলাট আর বাঙ্গারাম। এর মধ্যে বাঙ্গারাম দ্বীপ শুধুমাত্র বিদেশিদের মনোরঞ্জনের জন্য উন্মুক্ত, মাত্র শ’খানেক মানুষের বসতি এখানে। কোচি থেকে এই দ্বীপগুলির দূরত্ব ২৫০ থেকে ৫০০ কিলোমিটারের মধ্যে।

বিদেশিদের তো বটেই ভারতীয়দেরও কিন্তু লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণের জন্য অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হয়। এটা এই অঞ্চলে পর্যটক নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। লাক্ষাদ্বীপের প্রাকৃতিক আকর্ষণে দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসেন বহু পর্যটক, তাদের বিশেষভাবে আকর্ষণ করে নীল সমুদ্র, সবুজ প্রবালদ্বীপ, সাদা বালির মসৃণ অসাধারণ সব সৈকত, বিভিন্ন জলক্রীড়ার ব্যবস্থা, সামুদ্রিক প্রাণী দেখার অতুলনীয় সুযোগ। আরও কত কি! আরব সাগরের বুকে ছোটো বড়ো এই ৩৬টি দ্বীপ নিয়ে গড়ে উঠেছে লাক্ষাদ্বীপ। এলাকা জুড়ে রয়েছে প্রায় ৩২ বর্গকিলোমিটার।

লাক্ষাদ্বীপের ইতিহাস চতুর্থ শতক থেকে শুরু করা যায়। কেরলের রাজা পেরুমলের রাজত্বকালে কিছু দুঃসাহসী মানুষ জীবিকা ও বাসস্থানের আশায় কেরল উপকূল থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমিনি, কাভারাত্তি, অ্যানড্রট ও কালপেনি দ্বীপে আশ্রয় নেয়। পরে তারা ছড়িয়ে পড়ে অন্যান্য দ্বীপগুলিতে। পেরুমল ছিলেন হিন্দু রাজা। কেরল থেকে আগত মানুষগুলিও ছিল হিন্দু। কিন্তু সপ্তম শতাব্দী থেকে এই দ্বীপপুঞ্জে ইসলাম ধর্মের প্রচার শুরু করেন সন্ত উবাইদুল্লা। ক্রমে ক্রমে ইসলাম ধর্ম আরও বিস্তার লাভ করে। বর্তমানে লাক্ষাদ্বীপের

জনসংখ্যার প্রায় ৯৪ শতাংশ মুসলমান, ৪ শতাংশ হিন্দু আর বাকি খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ। লাক্ষাদ্বীপ কেন্দ্রশাসিত এক জেলা বিশেষ। এই জেলার অন্তর্গত চারটি তহশিল। কাভারাত্তি দ্বীপ হল তার প্রধান প্রশাসনকেন্দ্র তথা রাজধানী, প্রশাসকই হল প্রশাসনের শীর্ষে।

বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস আকস্মিক আগ্নেয় উৎপাতের ফলেই এই দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে প্রবালের ঘন বেষ্টনী ঘিরে রেখেছে এই দ্বীপগুলিকে। চার্লস ডারউইনের মতে সমুদ্রে সাধারণত মৃত আগ্নেয়গিরিকে ঘিরেই প্রবাল তথা কোরালের সৃষ্টি ও বৃদ্ধি হয়। ক্রান্তীয় জলবায়ু এই পরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক হয়। আগ্নেয়গিরি সমুদ্রের জলে নিমজ্জিত হলে প্রবাল দিয়ে ঘেরা স্ল্যাটলের সৃষ্টি হয়। এই সব শর্ত মেনেই হয়তো লাক্ষাদ্বীপের প্রবাল দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের ১ নভেম্বর থেকে এই দ্বীপপুঞ্জের নাম হল লাক্ষাদ্বীপ দ্বীপপুঞ্জ, এর আগে এর পরিচিতি ছিল লাক্বাডিভ মিনিকয় ও আমিনদিভি দ্বীপপুঞ্জ।

কোচিন তথা কোচি শহর হল গেটওয়ে অব লাক্ষাদ্বীপ। আকাশপথে বা জলপথে, লাক্ষাদ্বীপ যেতে হলে এই কোচিতে আসতেই হবে। তবে কালিকট বা ম্যাঙ্গালোর (দুটিই সমুদ্র উপকূলবর্তী শহর) থেকেও কখনও কখনও লাক্ষাদ্বীপের জাহাজ ছাড়ে। লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণের নির্দিষ্ট তারিখের আগের দিন বিমানে পৌঁছে গেছি কোচি বিমানবন্দরে আর সেখান থেকে কোচির হোটেল মেরিনা রিজেন্সিতে। বিমানবন্দর থেকে এরনাকুলাম তথা কোচির এই হোটেলে পৌঁছোতে সময় লাগল প্রায় ঘন্টাখানেক। রাস্তাঘাট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, রাস্তার অবস্থাও ভালো। কোচির হসপিটাল রোডের এই হোটেল নির্বাচনের প্রধান কারণ হল এখান থেকে কাল ভোরে আমাদের অভীষ্ট গন্তব্য ‘স্পোর্টস’ অফিস ও বোট জেটির অনেকটাই কাছে।

নভেম্বর মাস। কলকাতায় শীত না পড়লেও বর্ষা বিদায় নিয়েছে। কিন্তু কোচিতে এখনও মাঝে মাঝে বৃষ্টি হচ্ছে। সন্ধ্যাটা তাই হোটেলের ঘরেই বসে থাকতে হল বর্ষার কারণে। লাক্ষাদ্বীপের আবহাওয়া গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চলের মতো– শীত প্রায় নেই, তাপমাত্রা ৩২ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড। বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১২০০ – ১৫০০ মিলিমিটার। লাক্ষাদ্বীপে কিন্তু বৃষ্টি যথেষ্ট হলেও বৃষ্টির জল খুব মূল্যবান। পানীয় জলের অভাব মেটানো হয় বিভিন্নভাবে সঞ্চিত বৃষ্টির জলে। লাক্ষাদ্বীপে পানীয় জলের এই অভাবের জন্যই বাকি দ্বীপে মানুষের বসতি গড়ে ওঠেনি।

শুনলে আশ্চর্য হতে হয় যে লাক্ষাদ্বীপের অন্তর্গত দ্বীপগুলি সব প্রবালদ্বীপ বা কোরাল আইল্যান্ড। কোরাল হচ্ছে এক ধরনের অতি ক্ষুদ্র জীব যায় নাম পলিপ। এই পলিপ বসবাস করে ক্যালসিয়াম কার্বোনেটের এক শক্ত খোলস, এপিথিকার মধ্যে। এই পলিপ ফটো-সিন্থেসিসের মাধ্যমে সমুদ্রের জল থেকে ক্যালসিয়াম কার্বোনেট সংগ্রহ করে আর খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে খুব ছোটো ছোটো মাছ বা প্ল্যাংকটন। কোটি কোটি পলিপ একত্র হয়ে প্রবাল কলোনি গঠন করে। প্রবালের শক্ত কাঠামো পরস্পর জুড়ে গিয়ে কোরাল রিফ বা প্রবাল প্রাচীর তৈরি করে। পলিপগুলি মৃত হওয়ার পরও এই কাঠামো থেকেই যায় আর তার ওপরে আবার জন্ম নেয় নতুন পলিপ। এই মৃত পলিপের শক্ত কাঠামোকেই আমরা সাধারণত প্রবাল বলি। এই লাক্ষাদ্বীপে অনেক রকমের কোরালের অস্তিত্বের কথা জানা গেছে। আর প্রবাল প্রাচীরের প্রসঙ্গ উঠলেই মনে পড়ে যায়, পৃথিবীর দীর্ঘতম প্রবাল প্রাচীরের কথা– অস্ট্রেলিয়ার উত্তরপূর্ব তটরেখা বরাবর ‘দি গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ’ যা দৈর্ঘ্যে প্রায় ১২০০ কিলোমিটার।

রাতে শুতে গেলাম উত্তেজনা নিয়ে কারণ কালকেই আমরা লাক্ষাদ্বীপ আবিষ্কারে বেরিয়ে পড়ব। তার আগে লাক্ষাদ্বীপের ইতিহাস ভূগোল প্রকৃতি নিয়ে একটু পড়াশোনা করে নিয়েছি।

বেলা নটা নাগাদ পুরি-সবজি ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে পড়লাম। অটোওয়ালা ভুল করে আমাদের প্রথমে নিয়ে গিয়ে তুলল ‘স্পোর্টস’-এর প্রশাসনিক অফিসে। কিন্তু সেখান থেকে তো জাহাজ ছাড়বে না, রিপোর্ট করতে হবে উইলিংডন আইল্যান্ড ওয়ার্ফ (এফসিআই গোডাউনের কাছে) স্পোর্টস অফিসে। এই উইলিংডন আইল্যান্ড কিন্তু প্রাকৃতিক নয়। কোচিন বন্দর গভীর করার জন্য যে মাটি কাটা হয়েছিল, তা থেকেই সৃষ্ট এই দ্বীপ। রাস্তাঘাট বেশ ফাঁকা ফাঁকা। এরনাকুলাম শহর থেকে একটি সেতু দিয়ে এই দ্বীপ যুক্ত। রাস্তার দুপাশে স্কুল, মেরিন ইউনিভার্সিটি, ফুড কর্পোরেশনের গুদাম, ইন্ডিয়ান অয়েলের ডিপো, হোটেল ইত্যাদি, বসতি অঞ্চল বোধহয় কিছু কম। পৌঁছে গেলাম স্পোর্টস-এর টুরিস্ট অফিসে। একতলার বিশাল হলঘরে দুটি কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন। একই সঙ্গে লাইনে সামিল হয়েছে লাক্ষাদ্বীপের পর্যটক ও দ্বীপের অধিবাসীরা। ধীরে ধীরে লাইন এগোচ্ছে। লাইনের মুখে পৌঁছে আবার অপেক্ষা– নির্দেশ হল ওই বাড়িরই দোতলার অফিস ঘর থেকে বোর্ডিং পাস, মালপত্রের ট্যাগ, উপহার স্বরূপ টিশার্ট রসিদ দেখিয়ে নিয়ে আসার জন্য। সে সব কাজ মিটিয়ে আবার মূল লাইনে ফিরে আসি। জাহাজে, বিমানের মতোই চেক-ইন ব্যবস্থা। লাগেজে ট্যাগ লাগিয়ে নাম-ধাম, কেবিন নম্বর লিখে, কর্তৃপক্ষের পরীক্ষান্তে জমা নিয়ে নিল।

এরপর দেহ ও ব্যাগ তল্লাশির পর কাউন্টারের ওপারে ঘর পেরিয়ে রাস্তায় নামলাম। সেখানেই অপেক্ষা করছে বাস। এই বাসে চেপে আমরা অবশেষে পৌঁছে গেলাম ‘সমুদ্রিকা’ জেটিতে– একেবারে আমাদের জাহাজ কাভারাত্তির সামনে। সাদা ধবধবে বিলাসবহুল প্ত-তলা জাহাজ– যেন বিশাল এক সাদা রাজহাঁস। এর রূপ মন্ত্রমুগ্ধ করবেই। সিঁড়ি বেয়ে জাহাজে উঠে ধীরে ধীরে পৌঁছে গেলাম আমাদের পূর্বনির্ধারিত কেবিনে একেবারে পাঁচতলায়। লাগেজ ইতিমধ্যেই পৌঁছে গিয়েছে ঘরের সামনে। পুরো জাহাজ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। পাঁচতলা ও চারতলা ফার্স্ট ক্লাস কেবিনের যাত্রীদের জন্য নির্দিষ্ট। চারতলায় কেবিন ছাড়াও রয়েছে এক বিশাল ডাইনিং হল ও বিনোদন কক্ষ। তিনতলায় রয়েছে সেকেন্ড ক্লাস কেবিন, ছোটো হাসপাতাল, রিসেপশন ও কর্মীদের থাকার ব্যবস্থা। দোতলায় সেকেন্ড ক্লাস কেবিন আর একতলায় বাংকার ক্লাস। প্রত্যেক তলাতেই একটি করে ডেক।

এই সব দেখতে দেখতে অনেকটা সময় কেটে গেছে। বেলা দেড়টা বেজে গেছে– এখনও জাহাজ ছাড়ার কোনও উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি না। ক্ষুধার তাড়নায় এবার ছুটি চারতলায় ডাইনিং হলে। লাঞ্চের খোঁজখবর নিতে। একটু পরেই লাঞ্চ সার্ভ করা হল– ভাত, ডাল, স্যালাড, পকোড়া, টুনা মাছ ভাজা, চিকেনের ঝোল আর ফল। সবই সেল্ফ সার্ভিস ব্যবস্থা, নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী নিয়ে নিতে হবে।

আমাদের লাঞ্চ শেষ হবার পরই দেখি জাহাজ নোঙর তোলার প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। নানারকম কসরত করে বেলা আড়াইটা নাগাদ জাহাজ ছাড়ল। লাঞ্চের পরেই মাইকে ঘোষণা হল বেলা চারটের সময় এই সফরের টুর ম্যানেজার আমাদের এই পাঁচদিনের লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণের সফরসূচী ও নিয়মাবলী নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করবেন। যথা সময়ে আমরা পৌঁছে গেলাম জাহাজের চ্ছ্র-তলার রিক্রিয়েশন রুমে। টুর ম্যানেজার শুরু করে দিলেন তাঁর বক্তব্য। –‘আমরা চলেছি প্ত দিনের সমুদ্রম প্যাকেজে, আজকে প্রথম দিন। কালকে আমরা পৌঁছে যাব প্রথম দ্বীপে। এই সফরে আমরা তিনটি দ্বীপ ভ্রমণ করব– কাভারাত্তি, মিনিকয় আর কালপেনি। দ্বিতীয় দিনে কাভারাত্তি, তৃতীয় দিনে মিনিকয় আর চতুর্থ দিনে কালপেনি দ্বীপ আমাদের ভ্রমণ সূচীতে পড়ে। পঞ্চম দিনে আমরা ফিরে যাব কোচির জেটিতে। দ্বিতীয় দিন থেকে জাহাজে ভোরের চা, ব্রেকফাস্ট ও ডিনার দেওয়া হবে আর লাঞ্চ সার্ভ করা হবে যে-দ্বীপে সফর সেখানে। সকলকে যে ফোটো আইডেনটিটি কার্ড দেওয়া হয়েছে তা যেন সফরকালে অবশ্যই পরে থাকে প্রত্যেকে।’ এরপর তিনি বুঝিয়ে দিলেন দ্বীপে যাওয়া আসার উপায় ও পদ্ধতি সম্পর্কে। জাহাজ দাঁড়িয়ে থাকবে দ্বীপের তীরভূমি থেকে অনেকটা দূরে, ছোটো ছোটো বোট, জাহাজ থেকে দ্বীপে নিয়ে যাবে আবার ফিরিয়ে দেবে জাহাজে। সমুদ্রের মধ্যে জাহাজ থেকে বোটে আবার বোট থেকে জাহাজে ওঠার সময় যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এই ব্যাপারে দক্ষ কর্মীরা থাকবে– এদের বলা হয় ক্যাচার।’ আধঘন্টার মধ্যেই আলোচনা শেষ।

এবার কেবিনের দিকে একটু নজর দিই। একটা কেবিনে দুজনের বাস। টু-টায়ার বিছানা সাদা ধবধবে চাদরে ঢাকা। রাইটিং টেবিল, আলমারি, সংলগ্ন স্নানাগার (ঠান্ডা ও গরম জল) নিয়ে সুন্দর ব্যবস্থা। কেবিন থেকে ছোট্ট জানালা দিয়ে সমুদ্র দেখা যাচ্ছে। কেবিন থেকে বেরিয়ে ফিরে আসি আপার ডেকে। আকাশে রোদ ঝলমল করছে, আকাশও মেঘমুক্ত নীল। তবে রোদের তেজ খুব বেশি, গরমও লাগছে। জাহাজ কাভারাত্তি এখন জলের ওপর দিয়ে ভেসে চলেছে। ডেকে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি মেলে দিয়েছি সুদূরে। ক্রমে ঝাপসা হয়ে এল তীরের গাছপালা, ঘরবাড়ি।

আমরা চলেছি ভেম্বানদ লেকের মধ্যে দিয়ে। লেকের দুপাশে বিশাল বিশাল হোটেল, জলে নানা ধরনের জলযান– জাহাজ ট্রলার, নৌকা, জেলে ডিঙি। তীরে দেখা গেল লাইন দিয়ে টাঙানো চাইনিজ ফিশিং নেট। এই অঞ্চলেই কেবলমাত্র এই প্রাচীন পদ্ধতিতে এখনও মাছ ধরা হয়। মোহনা ছাড়িয়ে জাহাজ এবার অসীম সমুদ্রে ভেসে পড়ল। সূর্য ধীরে ধীরে পশ্চিম দিকে ঢলে পড়ছে– দিনের শেষের রবির কিরণ এখন ছড়িয়ে পড়ছে জলে। এখন আর সূর্যের সেই প্রখর তেজ নেই। ডেকে যেন এখন পুরো ভারতবর্ষ নয়, গোটা পৃথিবীর মানুষ এসে জুটেছে। ছবি তোলার মহা ধূম।

ইতিমধ্যে টকটকে লাল সূর্য বলের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে আসছে সমুদ্রের বুকে। সমুদ্রের জল এখন সোনালি। সেই সোনালি জলের প্রেক্ষাপটে সাদা পাখির দল নীড়ে ফিরছে স্থলভূমির দিকে। সূর্যদেব ডুব দিলেন সাগরে। আকাশে লাল আলোর আলপনা আর একটু পরেই হঠাৎই যেন অন্ধকার ঘনিয়ে এল প্রকৃতিতে। মোবাইলে আর টাওয়ার নেই– সব সংযোগ ছিন্ন– এখন শুধু প্রকৃতিকেই জড়িয়ে ধরতে হবে। জলের রং এখন ঘোর কৃষ্ণবর্ণ আকাশে তারার উৎসব। জাহাজের দুপাশে সাদা জলের ফেনা তুলে এই অন্ধকারেও যেন ঝলমল করছে। ডেকে এখনও ভিড় জমে রয়েছে– ঠান্ডা হাওয়ায় বেশ আরাম লাগছে।

চা-পানের ডাক পড়েছে। গুটিগুটি ডাইনিং হলের দিকে পা বাড়ালাম। জাহাজ নিঃশব্দে এগিয়ে চলেছে। শুধু একটা হালকা দুলুনি পায়ের নীচে অনুভব করছি। সেই দোলা যেন স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে– এখন আমি আর স্থলে নেই সমুদ্রের ওপর দিয়ে ভেসে চলেছি অচেনা দ্বীপের সন্ধানে। রাত আটটায় ডিনার শেষ করে আর কিছু করার নেই। রাত ন’টাতেই বিছানায়।

১৯৫৬ সালে দ্বীপপুঞ্জের ভারতভুক্তি এবং ১৯৭৩ সালে লাক্ষাদ্বীপের নামকরণ। তবে লাক্ষার সঙ্গে লাক্ষাদ্বীপের কোনও সম্পর্ক নেই। কেউ কেউ মনে করেন জলের নীচে আরও অসংখ্য দ্বীপ আছে। হয়তো লক্ষ দ্বীপ থেকে লাক্ষাদ্বীপ নামকরণ হয়েছে। এবার আসি লাক্ষাদ্বীপের জলবায়ু ও আবহাওয়া সম্পর্কে। গ্রীষ্মপ্রধান এই অঞ্চলে দক্ষিণপশ্চিম মৌসুমি বায়ুর ফলে জুন থেকে অক্টোবর বর্ষাকাল। অক্টোবরের শেষ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ভ্রমণের পক্ষে অনুকূল যদিও নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি-ই শ্রেষ্ঠ সময়। সারা দ্বীপপুঞ্জের প্রধান ফসল হল নারকেল। ব্রেডফ্রুট হল জাতীয় গাছ। আর জলের নীচের জীবজন্তু ছাড়াও আকাশে সামুদ্রিক পাখিদের মধ্যে তারাতালি বিখ্যাত। মাছধরা আর নারকেল চাষ এই দ্বীপের মানুষের প্রধান জীবিকা। টুনা মাছ টিনজাত করা, নারকেল ছোবড়া, নারকেলমালার নানা শিল্পদ্রব্য ইত্যাদিতে এখানের মানুষদের কর্মসংস্থান জড়িয়ে রয়েছে।

খুব ভোরে ঘুম ভাঙল জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দে। জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে কাভারাত্তি দ্বীপের কাছাকাছি হলেও গভীর সমুদ্রে। চোখে পড়ছে কাভারাত্তি দ্বীপের আলো। আস্তে আস্তে আকাশে আলো ফুটছে– সূর্য উঠে নতুন দিনের সূচনা করছে। তা হলে পৌঁছে গেলাম কাভারাত্তি! কোচি থেকে ৪০৪ কিমি দূরে লাক্ষাদ্বীপের প্রধান শহর তথা রাজধানীর দোরগোড়ায় আমরা উপস্থিত। ভোর ছ’টা প্রাতঃকালীন চায়ের সময়– তাই চা-তৃষ্ণা নিয়ে পৌঁছে গেলাম ডাইনিং হলে। চা-কফির সঙ্গে নানাধরনের কেক ও বিস্কিটেরও ব্যবস্থা রয়েছে। ইতিমধ্যে মাইকে ঘোষণা হয়েছে সকাল আট-টার সময় সমস্ত পর্যটকেরা ব্রেকফাস্ট সেরে লাইফ জ্যাকেট পরে যেন জাহাজের প্রবেশ-নির্গমনের দ্বার-এ হাজির হন।

প্রতি ঘরের খাটের নীচে এই জ্যাকেট রাখা আছে। যথাসময়ে ব্রেকফাস্ট সেরে প্রস্তুত হয়ে গায়ে জ্যাকেট চাপিয়ে জাহাজের নির্গমন পথে পৌঁছে গেছি। জাহাজ তো দাঁড়িয়ে আছে গভীর জলে কারণ দ্বীপের আরও কাছে গেলে প্রবাল প্রাচীরের সঙ্গে ধাক্বা লাগার সম্ভাবনা রয়েছে। ছোটো ছোটো স্পিড বোট জাহাজের খোলের কাছে এসে যাত্রীদের তুলে নিয়ে দ্বীপের জেটিতে নামিয়ে দেবে। তবে উত্তাল সমুদ্রে জাহাজ থেকে বোটে ওঠা তত সহজ নয়। এ কাজের জন্য বিশেষজ্ঞ রয়েছে। আগে জাহাজ থেকে আইল্যান্ডার তথা স্থানীয় যাত্রীদের বোটে তোলা হচ্ছে। তারপরই পর্যটকদের পালা।

নীল জলের মধ্যে অদূরে কাভারাত্তি দ্বীপ দেখা যাচ্ছে। আমাদের বোট ছেড়ে দিল। জলের রঙের কি বৈচিত্র্য– নেভি ব্লু, ফিরোজা, আকাশি নীল, তুঁতে সব রং যেন পরতে পরতে মিশে রয়েছে এই সমুদ্রে! বোট যতই এগোচ্ছে ততই দ্বীপের সীমানা স্পষ্ট হচ্ছে। দুলতে দুলতে পৌঁছে গেলাম জেটিতে। কাভারাত্তির জেটি বেশ বড়ো ও প্রশস্ত। অনেক জেলে নৌকো আর ছোটো জাহাজ অপেক্ষা করছে জেটির আশেপাশে। সাদা নরম বালির সৈকত ছুঁয়ে আছে দ্বীপটিকে। জেটি থেকে সামান্য হেঁটেই সৈকতের ধারেই কাভারাত্তি রিসর্ট। মোলায়েম ঢেউ চুমু খেয়ে যাচ্ছে সাদা বালির তটভূমিকে। সমস্ত ভ্রমণার্থীকে দেওয়া হচ্ছে ‘ওয়েলকাম ড্রিংক’ আর কিছু নয় মিষ্টি ডাবের জল। জল খেয়েই যার শেষ নয় খোলা ছাড়িয়ে তার ভেতর মিষ্টি শাঁসও উপভোগ করা যাবে।

ডাব খেয়ে এবার দ্বীপের অন্যান্য প্রকৃতির দিকে চোখ ফেরাই। এখানে প্রধান দুটি রং নীল ও সবুজ। নীল হল সমুদ্রের রং আর সবুজ হল দ্বীপের অসংখ্য নারকেল গাছের রং। অনেকেই সৈকতের নরম বালিতে নেমে সমুদ্র স্নানে মগ্ন হয়ে পড়েছে। জল এখানে উত্তাল নয়, নরম মোলায়েম স্রোত যেন বার বার স্পর্শ করে যাচ্ছে তার শীতল পরশ দিয়ে। ইতিমধ্যে ঘোষণা করা হচ্ছে সারাদিনের প্রোগ্রাম। প্রথমে গ্লাসবটম বোটে সমুদ্র সফর। এই সফরের জন্য প্রত্যেককে কুপন দেওয়া হল। এর জন্য আলাদা কোনও মূল্য দিতে হবে না। ঘোষণা হওয়া মাত্র লাইন পড়ে গেছে। বিতরণ করা হচ্ছে নতুন লাইফ জ্যাকেট আগের জ্যাকেট জমা দিয়ে নতুন জ্যাকেট পরতে হল। বেশ কড়া রোদ।

ঘন্টাখানেক লাইনে দাঁড়িয়ে তবেই গ্লাসবটম বোটে চড়ার সুযোগ পাওয়া গেল। এই ধরনের বোটের মেঝেতে কাঠের ফ্রেমে স্বচ্ছ মোটা কাঁচ লাগানো থাকে। যার ফলে বোটের নীচের জল প্রায় পরিষ্কারভাবে দেখা যাচ্ছে। আর জলের সঙ্গে দেখা যাবে জলের নীচে আশ্চর্য উদ্ভিদ ও প্রাণী জগতের সম্পদকে। স্বচ্ছ জলের নীচে মায়াবী এক জগৎ। বোট এগিয়ে চলেছে তীর থেকে গভীরতায়। প্রথমে স্বচ্ছ জলের নীচে দেখতে পেলাম মাটি, ঢিবি, বালি তারপর একটু গভীরে প্রবেশ করি প্রাণী জগতে! ছোটো বড়ো কচ্ছপ, নানা ধরনের রঙিন ও সাদা-কালো মাছ, মৃত ও জীবিত কোরাল, নানা ধরনের সামুদ্রিক উদ্ভিদ, সি কিউকাম্বার, ইল মাছ। প্রবাল প্রাচীরের ফাঁকে ফাঁকে ঘুরে বেড়াচ্ছে রঙিন মাছের দল। রয়েছে কাঁটাওয়ালা সি-আর্চিন নানা বর্ণের নানা আকৃতির মাছ। মাছের মধ্যে ব্লু-ব্ল্যাক ইয়েলো সার্জেন্ট, টাইগার ফিশ চিনতে পারলাম।

সমুদ্রের তলদেশের গভীরতা চার-পাঁচ ফুট থেকে কুড়ি-পঁচিশ ফুটের মধ্যেই আমাদের ঘোরাঘুরি, তলদেশ কখনও বালি কখনও সবুজ শ্যাওলা বা কখনও বা ঘাসে ঢাকা। কোরালের নানা ধরনের গঠনও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সত্যিই নীল জলের নীচে এক অপরূপ রঙিন সাম্রাজ্য। মাঝে মাঝে বোটের ইঞ্জিন বন্ধ করে বোট স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকছে ফলে আরও ভালোভাবে এই জলের নীচের রঙিন চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ হচ্ছে। প্রায় চল্লিশ মিনিট গ্লাসবটম বোটে ভ্রমণ শেষে বোট এবার তীরের দিকে মুখ ফেরাল। মাঝ সমুদ্রের ঘন নীল জল তীরের দিকে আসতে আসতে রং বদল করছে– নীলের নানা শেডে।

এবার সাঁতার কাটা, সমুদ্রস্নান। কেউ কেউ বিশেষ ধরনের নৌকায় কায়াকিং করছে। সরু প্লাস্টিকের নৌকায় এক-দুই জন বসে একটা চ্যাপটা পাত লাগানো দাঁড় (দু-দিকেই) দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নৌকা চালনা এক নতুন অভিজ্ঞতা। উলটে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকলেও, নতুনদের অগভীর জলে বেশ মজাই লাগবে। তাছাড়া রয়েছে স্নরকেলিং ও স্কুবা ডাইভিংয়ের ব্যবস্থা। এই দুটি জলক্রীড়ার জন্য অবশ্য আলাদা অর্থমূল্য দিতে হবে (স্নরকেলিং তিন’শ টাকা, স্কুবা ডাইভিং কুড়ি মিনিট দু হাজার টাকা)। সৈকতের পিছনেই কাভারাত্তি রিসর্ট। সেখানে পাকা বাড়ি, নারকেল গাছের উদ্যান আর সামনেই নরম বালি ও সবুজ লনের মধ্যে রঙিন চাঁদোয়া লাগিয়ে চেয়ার পেতে খাওয়াদাওয়া অর্থাৎ লাঞ্চের আয়োজন করা হয়েছে। দূরেই রয়েছে ‘গ্রিন টয়লেট’ ব্যবহারের অপেক্ষায়। লাঞ্চের পর সামান্য বিশ্রাম, তারপরে বাসে চড়ে দ্বীপ পরিক্রমা ও মিউজিয়াম সফর।

কাভারাত্তিতে নারকেল গাছের ছড়াছড়ি। রাস্তার দু-পাশেই নারকেল গাছ, পাতা ও ফলের যথেষ্ট বৈচিত্র্য রয়েছে। এই প্রথম লক্ষ করলাম নারকেলের রঙের নানা বৈচিত্র্য– সবুজ হলুদ বাদামি। নারকেল ছাড়াও বাদাম, কৃষ্ণচূড়া ও কলাগাছের দেখা মেলে। তবে নারকেলেরই প্রাধান্য। রাস্তায় মোটর গাড়ির সংখ্যা নগণ্য। কাভারাত্তি থেকে দ্বীপপুঞ্জের প্রশাসন পরিচালিত হয়। শহরে সাধারণ সুযোগ সুবিধা রয়েছে– দোকান, বাজার, স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, রেস্তোরাঁ, মসজিদ। তবে সিনেমা হল চোখে পড়েনি। সমুদ্রের কিনারা ধরে বা ভেতরেও রয়েছে বসতি অঞ্চল। সব বাড়িই একতলা ইটের দেয়াল, টালির ছাদ, পাকা ছাদও রয়েছে। গাড়ি থামল আমাদের গন্তব্য অ্যাকোয়ারিয়াম তথা মেরিন মিউজিয়ামের সামনে।

মিউজিয়ামের সামনে এক খোলা চৌবাচ্চায় এক হাঙরের মুক্ত বিচরণের দৃশ্য খুব আশ্চর্য লাগে। প্রকৃতপক্ষে এখানে মিউজিয়াম একটি নয়, দুটি। মেরিন অ্যাকোয়ারিয়ামটি ১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আর নবতম সংযোজন নিউমেরিন মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮৯ সালে। মিউজিয়াম দুটিতে প্রদর্শিত হয়েছে কিছু দুর্লভ সামুদ্রিক প্রাণী, মাছ, দুর্লভ কোরাল, ইল, অক্টোপাস, স্টোন ফিশ ইত্যাদির জীবন্ত সংগ্রহ। এছাড়া স্পার্ম হোয়েলের বিশাল কঙ্কাল, নানা ম্যাপ – মডেল, ফটো, পেন্টিং, মৎসজীবিদের ব্যবহূত নৌকা (কাভারাত্তি) ও মাছ ধরার নানা সরঞ্জাম প্রদর্শিত হয়েছে। আধঘন্টার মধ্যেই মিউজিয়ামের সবকিছু দেখা হয়ে যায়। গাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে এল সমুদ্রের ধারে রিসর্টে।

বিকেলের চা-পর্বের শেষে টুর ম্যানেজারের নির্দেশে ফিরে চলি জেটির দিকে। সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে তারই প্রতিফলন হচ্ছে সমুদ্রের জলে। নারকেল গাছের সারিতে এই বিকেলে হাওয়ার দোলা লেগেছে তারা যেন বলছে আবার এসো। জেটি থেকে কয়েকটি ট্রিপে ফিরে এলাম জাহাজে। একই রুটিনে রাত ৪-টায় ডিনার সেরে কিছুক্ষণ ডেকে কাটালাম। জাহাজ ইতিমধ্যে ছেড়ে দিয়েছে, অন্ধকারে জল কেটে চলেছে, চলার গতিতে সাদা ফেনার মতো ঢেউ উঠছে। কালকে ভোরে আমরা পৌঁছে যাব মিনিকয় দ্বীপে। এবার বিছানায়, আবার ভোরে উঠতে হবে তো!

ভোরে ঘুম ভেঙে গেল। ডেকে বেরিয়ে দেখি আকাশ মেঘে ঢাকা, বৃষ্টি পড়ছে না তবে রাতে বৃষ্টি হয়েছে। জাহাজ পৌঁছে গেছে মিনিকয় দ্বীপে তবে আজ দ্বীপ থেকে অনেকটা দূরে জাহাজ নোঙর ফেলেছে। বহুদূর থেকে দেখা যাচ্ছে দ্বীপ একেবারে সবুজে ঢাকা অর্থাৎ নারকেল গাছের জঙ্গল। প্রাতঃকালীন চা, একটু পরে ব্রেকফাস্ট সেরে নিতে হল তাড়াতাড়ি কারণ বেরোতে হবে সাড়ে সাতটায়। আবার জ্যাকেটে সজ্জিত হয়ে জাহাজের বাহির পথে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছি। আজ সমুদ্র বেশ অশান্ত, উত্তাল। অনেকগুলি বোট আজ নিয়োগ করেছে কর্তৃপক্ষ যেহেতু তীরভূমি অনেকটা দূরে, তাই বোট ঘুরে এসে আবার ট্রিপ দিতে অনেক বেশি সময় লাগবে। বিশেষজ্ঞ ক্যাচারদের সাহায্যে তরঙ্গায়িত সমুদ্রের মধ্যে দোদুল্যমান বোটে ওঠা হল।

হঠাৎই যেন মেঘ ঘনিয়ে এল। মাথার ওপর তো কোনও ছাদ নেই, বৃষ্টি হলে ভিজতে হবে। ঝিরঝির করে একটু বৃষ্টি হয়ে গেল। অবশ্য বেশিক্ষণ নয়, বৃষ্টি থেমে মেঘ-রোদ্দুরের খেলা শুরু হয়ে গেল আকাশে। প্রায় আধঘন্টা বোটজার্নি করে পৌঁছে গেলাম মিনিকয় দ্বীপের জেটিতে। মিনিকয় হল লাক্ষাদ্বীপের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ। দ্বীপটি লম্বায় প্রায় রচ্ কিলোমিটার আর আকৃতি অর্ধচন্দ্রাকার। এই দ্বীপের অবস্থিতি একেবারে দক্ষিণে। এই দ্বীপ মালদ্বীপের বেশ কাছে বলেই হয়তো এখানের মানুষের সংস্কৃতিতে মালদ্বীপের প্রভাব যথেষ্ট। ভাষাও এখানে মাল, যদিও লাক্ষাদ্বীপের অন্যান্য দ্বীপে মলয়ালম।

আস্তে আস্তে স্পষ্ট হচ্ছে মিনিকয়ের প্রকৃতি। জেটি থেকে এবারে হাঁটাপথ নয়, অপেক্ষমান গাড়িতে উঠে পড়লাম। নারকেল গাছে ঘেরা সবুজ দ্বীপের বুক চিরে গাড়ি ছুটল। পেরিয়ে এলাম বেশ বড়ো সরকারি হাসপাতাল, স্কুল, বাড়িঘর আর নারকেল জঙ্গল যেন ঘিরে রেখেছে। অনেকটা জায়গা নিয়ে এক একটি বাড়ি, সেখানেও গাছগাছালি কম নয়– নারকেল ছাড়াও রয়েছে আম, কাঁঠাল, কলা গাছ। কাজু গাছেরও সারি নজরে আসে। বাড়িঘর বেশ খোলামেলা, মোটেও ঘিঞ্জি নয়। প্রায় আধ ঘন্টা সড়ক পথ পেরিয়ে পৌঁছে গেলাম মিনিকয়ের রিসর্টের সামনে।

নামার সঙ্গে সঙ্গে হাতে ধরিয়ে দিল ওয়েলকাম ড্রিংক নারিয়েল-পানি। বেশ বড়ো রিসর্ট। সামনেই সাদাবালির সৈকত যেন নরম কার্পেট বিছানো আর সমুদ্রের অনন্য নীল জল মৃদু তরঙ্গের পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে সৈকতে। সৈকতের ওপর কাঠের ইজিচেয়ার– তার ওপরে খড়ের ছাউনি বা ছাতা। প্রচুর নারকেল গাছ ছড়ানো ছিটানো। আর সমুদ্রের রং তো শিল্পীর ইজেলে যত রকমের নীল রং হয় তারই যেন এক প্রদর্শনী। বিচে পাতা রয়েছে রংবেরঙের চেয়ার, মাথায় সামিয়ানা– এটাই আমাদের বিশ্রামস্থল, রিসর্টের ঘরে নয়। রিসর্টের বাড়ির সামনে সবুজ লন তারই এক পাশে বিচ-ভলিবলের নেট খাটানো। সমুদ্রে ভাসছে রঙিন নৌকা। ছবি তোলার আদর্শ পরিস্থিতি। তবে ছবি তোলার আর সময় পাওয়া গেল না, মাইকে ঘোষণা হল গাড়িতে চলে আসার জন্য– এখন লাইটহাউসে নিয়ে যাওয়া হবে।

গাড়ি চলল লাইটহাউস অভিমুখে। রাস্তাঘাট ভালো, নারকেল-আম-কাঁঠালের বাগান ছাড়াও এবার চোখে পড়ল কলা, আমলকী, ব্রেডফ্রুট গাছ, কাজুবাদামের সারি ঝুঁকে পড়েছে রাস্তায়। বাড়িঘর অধিকাংশ পাকা, তবে টালির ছাদ। মিনিট দশেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম লাইটহাউস চত্বরে। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে বাতিঘর যেন দ্বীপের শাসনকর্তা। লাইটহাউস ঘিরে রেখেছে বাগান, লন আর নারকেল বীথি। বাতিঘরের চূড়া যেন ফিসফিস করে আকাশ মেঘের সঙ্গে কথা বলছে। ১৮৮৫ সালে নির্মিত এই লাইটহাউস নয় তলা উঁচু। একসঙ্গে ৫০ জন ওপরে উঠতে পারবে। তারা নেমে এলে বাকিরা যাবে। এই সাদা রঙের লাইটহাউসে উঠতে শুরু করি, প্রথমে ১৮০টি সাধারণ সিঁড়ি তারপর খাড়াই ২৬টি ধাপ, এরপর একেবারে খাড়া শেষ ধাপ পেরিয়ে এবারে শীর্ষে। মাঝে মাঝে জানালা রয়েছে ওঠার পথে সেখানে দাঁড়িয়ে প্রকৃতি অবলোকনের সঙ্গে দমও নিয়ে নিয়েছি। একদম ওপরে ঘেরা রেলিং দেওয়া বারান্দা। সেখান থেকে এক অসাধারণ প্রেক্ষাপটে সমুদ্র দর্শন। দুধারে যেন দুরকমের সমুদ্র। একদিকে সমুদ্রের রং সাদা-ঘোলাটে। মাঝখানে সাদা বালির সৈকত পেরিয়ে অনেকটা এলাকা জুড়ে সবুজ নারকেল গাছের জঙ্গল। তারই মাঝে দেখা যাচ্ছে একটি হ্রদ সম্ভবত লোনা জলেরই। আর এক ধারে লেগুনের দিকে নীল-সবুজ সমুদ্র। চিত্রকরের ইজেলেই যেন এর তুলনা মেলে।

অনেকক্ষণ ধরে প্রকৃতির এই রূপ সুধা পান করে মনে ও যান্ত্রিক ক্যামেরায় তার ছবি তুলে নেমে আসি বাতিঘরের চূড়া থেকে। ফিরে আসি রিসর্টে। এই নীল জলের লেগুনটি লাক্ষাদ্বীপের অন্যতম বৃহৎ লেগুন যা প্রবাল প্রাচীর পেরিয়ে মিশেছে গভীর সমুদ্রে। এবার নরম বালির সৈকত পেরিয়ে জলে নেমে পড়েছি। হালকা ঢেউ-এ সাঁতার বা শুধু গলা ডুবিয়ে থাকলেও কি আরাম! আকাশ মেঘলা, কায়াকিং চলল কিছুক্ষণ তবে অগভীর জলে, গভীর জলে যেতে ভরসা হল না। স্নরকেলিং এখানে করলে আলাদা অর্থ দিতে হবে তাই বাদ কারণ কালকেই কালপেনি দ্বীপে বিনামূল্যে কায়াকিং ও স্নরকেলিং করা যাবে। স্কুবা ডাইভিং করার ভরসা নেই। মিনিকয় দ্বীপে ডাইভিং সেন্টার রয়েছে সেখানে জলের নীচের প্রাণী ও গাছপালা, প্রবালের সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় ও রূপদর্শনের সুযোগ আছে।

সমুদ্র-স্নানের পর সৈকতে বসেই প্রকৃতির রূপমাধুরীতে সম্মোহিত ছিলাম। এবার এল দুটি ডাক– প্রথমটি মধ্যাহ্নভোজের ঘোষণা আর একটি হল হঠাৎই তুমুল বৃষ্টির সূচনা। সামিয়ানার নীচেই খাবার আয়োজন সেখানেই ছুটে ঢুকে পড়ি। আজকের মেনু সেই ভাত, ডাল, চিকেন, টুনা মাছ ভাজা, পাঁপড় ভাজা ও চাটনি। তবে বৃষ্টির দাপটে এই উন্মুক্ত প্রান্তর যেন ভেসে যাচ্ছে।

ঘন্টাখানেক এরকম বৃষ্টি চলল। বৃষ্টির পর আকাশে হালকা রামধনু দেখা গেল আর সমুদ্রের রং, বৃষ্টি-মেঘ-সূর্যের আসা যাওয়ার মধ্যে পরিবর্তন হতে থাকল সবুজ, তুঁতে, ফিরোজা, হালকা ও গাঢ় নীলের নানা শেডে। মেঘলা দিনে বেলা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাচ্ছে। রিসর্টের ঢাকা বারান্দায় শুরু হল স্থানীয়দের লোকনৃত্য। নৃত্যশিল্পীরা স্থানীয় গান ছাড়াও নাচছে জনপ্রিয় হিন্দি গানের সঙ্গে। তবে যে-বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করল তা হল, এই নৃত্যশিল্পীদের দলে কোনও মহিলা শিল্পী ছিল না। নাচগানের পর আবার বাসে ওঠা।

না এখনই জেটিতে নয়, গাড়ি চলল গ্রাম ঘুরিয়ে দ্বীপের একটি কমিউনিটি সেন্টারে। মিনিকয় দ্বীপে এরকম ১০টি সেন্টার রয়েছে। সাধারণত এগুলি মহিলারাই পরিচালনা করেন। কমিউনিটি সেন্টারে বিভিন্ন পরিবারের নানা সামাজিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। মিনিকয় দ্বীপে শিক্ষিতের হার প্রায় ৯৭ শতাংশ। তাতেই বোঝা যায় মহিলারাও এখানে যথেষ্ট শিক্ষিত। দ্বীপে প্রাইভেট হোটেল বা রিসর্ট না থাকলেও, কয়েকটি হোম-স্টে বা গেস্টহাউস চোখে পড়ল। বিকেলে আমাদের চা-পান হবে এই কমিউনিটি সেন্টারে। শুধু চা-নয় সেন্টারের মেয়েরা স্থানীয় পোশাক পরে (কালো ঢোলা জামা ও সাদা স্কার্ফ) পরিবেশন করল চা, ডালের বড়া আর পাতায় মোড়া পিঠে। সেন্টারে নজর টেনে নেয় এক বিশাল বোটের উপস্থিতি। দু-দিন পরে এই বোটের রেসের ছচ্তম বার্ষিকী উদ্যাপনের তোড়জোড় চলছে। তবে যা ছিল বার্ষিক অনুষ্ঠান তা অর্থের অভাবে এই সেন্টারগুলি আর নিয়মিত ভাবে সংগঠিত করতে পারছে না।

এই সেন্টার থেকে হাঁটাপথে বোট জেটি। তবে এই জেটি সকালে যেখানে নেমেছিলাম সেই জেটি নয়। লাইফ জ্যাকেট পরে আবার বোটে উঠে পড়লাম। তবে এবারের বোটজার্নি এত নির্বিঘ্নে শেষ হল না। পাঁচ মিনিটের মধ্যে শুরু হল তুমুল ঝড়বৃষ্টি। সমুদ্রও অশান্ত। বড়ো বড়ো ঢেউয়ের ধাক্বায় বোট যেন মোচার খোলের মতো লাফাচ্ছে। আর যেহেতু বোটে কোনও মাথার আচ্ছাদন নেই তাই বসে বসে এই প্রবল বৃষ্টিতে ভিজতে হচ্ছে। ছাতা খুলেও কোনও লাভ হল না। সঙ্গে সঙ্গে হাওয়ার দাপটে মুচড়ে ভেঙে গেল। নিজে ভিজলেও ক্যামেরা বাঁচাতে সচেষ্ট হতে হল। আধঘন্টা এই ভাবে বৃষ্টির মধ্যে বোট চলল, অবশেষে কাভারাত্তি জাহাজের সামনে। তবুও উত্তাল সমুদ্রে বোট থেকে জাহাজে প্রবেশ করাও সহজ নয়। তবু বিশেষজ্ঞ ক্যাচারদের সহায়তায় নির্বিঘ্নে তা সম্পন্ন হল, যদিও এই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা বহুদিন মনে থাকবে।

সেই একই রুটিন মেনে আজকে কালপেনি দ্বীপভ্রমণ। গতকাল সারারাত ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে, ডেক জলে ভেসে যাচ্ছে। সকালে চা-ব্রেকফাস্ট পর্ব সেরে সেই সাড়ে সাতটায় জ্যাকেট পরে জাহাজের দরজায় আমরা প্রস্তুত। এখনও আকাশ মেঘে ঢাকা, সমুদ্রে উদ্দামতা রয়েছে। তবু যেতে তো হবেই। আজ জাহাজ নোঙর করেছে কালপেনি দ্বীপের অনেকটাই কাছে। জাহাজ থেকে বেশ স্পষ্টভাবে নারকেল গাছে ঢাকা দ্বীপটি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। কোচিন থেকে এখানে সরাসরি এলে পাড়ি দিতে হতো ৬২ কিলোমিটার। জাহাজ থেকে বোটে করে কালপেনি দ্বীপে পৌঁছোতে লাগল সাত-আট মিনিট। তবে সমুদ্র বেশ অশান্ত। জেটিতে নেমে আবার গাড়িতে চড়ে পৌঁছে গেলাম কুমেল বিচ রিসর্ট। পথটি বড়োই সুন্দর– সবুজ নারকেল গাছের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কালো পিচ রাস্তা পৌঁছে দিল রিসর্টের দোরগোড়ায়।

প্রবেশ করেই প্রথামতো ওয়েলকাম ড্রিংক– মিষ্টি ডাবের জল ও শাঁস। এই দ্বীপও নারকেল গাছে ছাওয়া আর নীল জল আছড়ে পড়ছে সৈকতে। তবে কুমেল রিসর্টের বিচ তত প্রশস্ত নয়। নারকেল গাছের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ছে অদূরে এক লাইটহাউস, রং তার সাদাকালো। তবে এই লাইটহাউস দর্শন বা ওঠার কোনও প্রোগ্রাম আমাদের সূচীতে নেই। এটি কুমেল সৈকত, স্পোর্টস বিচ নামেও পরিচিত কারণ এখানে ‘স্পোর্টস’ সংস্থার অফিস রয়েছে। একটু পরেই ঘোষণা হল এখনই পোশাক পরিবর্তন করে (অর্থাৎ স্নানের পোশাক পরে) গাড়িতে বসতে, কারণ যাওয়া হবে নর্থ টিপ বিচে। সেই সৈকতে সাঁতার সহ অন্যান্য জলক্রীড়ার ব্যবস্থা রয়েছে, অসুবিধা হল যেহেতু নর্থ টিপ বিচে মাত্র একটি চেঞ্জিং রুম বা শাওয়ার রুম রয়েছে। তাই এই ব্যবস্থা। কুমেল রিসর্টে অনেকগুলি চেঞ্জিং রুম রয়েছে।

অচিরেই পৌঁছে গেলাম নর্থ টিপ বিচে। এটাই লাক্ষাদ্বীপের অন্যতম বড়ো লেগুন। এখানে আজকে সাঁতার ছাড়াও স্নরকেলিং আর কায়াকিং করা হবে। আর তার জন্য অতিরিক্ত অর্থমূল্য দিতে হবে না। তাই প্রায় সকলেই অংশগ্রহণে আগ্রহী। মুখে নল লাগিয়ে জলে মুখ ডুবিয়ে জলের নীচের অতুলনীয় সব সম্পদ কোরাল, রঙিন মাছ, উদ্ভিদ ইত্যাদি দেখার সুযোগ রয়েছে স্নরকেলিংয়ের মাধ্যমে। তবে সমুদ্রের একটু গভীরে যেতে হবে। আর কায়াকিং-এ এখানে নতুন শিক্ষানবিশিকে ট্রেনার সঙ্গে নিয়ে ঘুরিয়ে আনছেন। শিখিয়ে দিচ্ছেন বোট চালনার কায়দাকানুন।

এখানে সমুদ্রের অসাধারণ রূপ। সাদা-রুপোলি বালির সৈকত তবে মাঝে মাঝে পাথরের নুড়ি ও বোল্ডার রয়েছে। সমুদ্র একদিকে নীল সবুজ ফিরোজা রঙের অতুলনীয় রূপ– সেদিকেই চলছে জলক্রীড়া আবার আর এক পাশে প্রবল ঢেউ নিয়ে উপস্থিত আর-এক সমুদ্র– এ সমুদ্রের রং সাদা-ঘোলাটে। এ এক অনন্য রূপ। ঘন্টাখানেকের বেশি সময় কেটে গেছে এই টিপি সৈকতে। জলক্রীড়া স্নানপর্ব প্রায় সকলেরই মিটে গেছে। হঠাৎই নজরে পড়ল আকাশের দিকে। আকাশের রং কুচকুচে কালো, মেঘে ঢাকা– একেবারে বৃষ্টির অপেক্ষায় রয়েছে প্রকৃতি। সত্যিই তাই আর মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই প্রবল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ছুট লাগাই চেঞ্জিং রুমের উদ্দেশ্যে। প্রায় ঘন্টাখানেক চলল এই বৃষ্টি। ছাদের নীচে থেকেও ভিজে একশা। কফি শপে এক কাপ কফি পান করে, বৃষ্টি একটু কমলেই গাড়িতে চেপে রিসর্টে।

মূল কালপেনি দ্বীপের সামান্য দূরত্বে সমুদ্রের মধ্যে রয়েছে দুটি বসতিহীন দ্বীপ টিলাক্বম ও পিট্টি। তবে নারকেল গাছের জঙ্গল রয়েছে এই দুটি দ্বীপেও। এখানকার বাসিন্দারা ওই দুটি দ্বীপে গিয়ে নারকেল সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। টিপ-টিপ করে বৃষ্টির মধ্যেই মধ্যাহ্নভোজ শুরু হয়ে গেল। খাওয়াদাওয়ার পরই শুরু হল লোকনৃত্য। ব্যবস্থাপনায় রয়েছে স্থানীয় ক্লাবের ছেলেরা আর আশ্চর্য এখানেও নাচের দলে কোনও মহিলা সদস্য নেই।

লাক্ষাদ্বীপের মানুষের পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে একটু জানিয়ে রাখি। ঐতিহ্যগত পোশাক হিসাবে লাক্ষাদ্বীপবাসীরা কেরালাকেই অনুসরণ করে তবে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার এখানে চোখে পড়ে। মেয়েরা ‘কাচি’ পরে কোমর থেকে বাঁধা হয় সোনা-রুপোর বন্ধনী দিয়ে কোমরে। শরীরের ওপরের অংশে রংবেরঙের অলংকৃত (এমব্রয়ডারি) করা আঁটোসাঁটো জ্যাকেট আর মাথায় রঙিন স্কার্ফ। ছেলেরা সাধারণত লুঙ্গিতে অভ্যস্ত তবে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা সবাই এখন ঝুঁকে পড়েছে জিন্স কালচারের দিকে।

একটু বিশ্রামের পর আমরা গাড়ি করে চলেছি নারকেল প্রসেসিং ফ্যাক্টরি ও গেঞ্জি কারখানা দেখতে। শুকনো নারকেল থেকে দুটো আলাদা মেশিনে তেল ও নারকেলের পাউডার তৈরি হচ্ছে। কাউন্টার থেকে এগুলির বিক্রির ব্যবস্থাও রয়েছে। প্যাকেট করে নারকেল নাড়ুও বিক্রি হচ্ছে। নারকেলের পর হোসিয়ারি ফ্যাক্টরি। এখানে গেঞ্জি তৈরি করে বিক্রি হচ্ছে। এদের উৎসাহদানের জন্য কয়েকটি গেঞ্জি কিনলাম, উপহারও তো দেওয়া যাবে। এই কারখানার কর্মী সবাই মহিলা। বোরখা পরে কাজ করছে।

ইতিমধ্যে সূর্য ডুবে গেছে। অন্ধকার নেমে এসেছে দ্বীপের বুকে। জেটিতে আলো জ্বলে উঠেছে। জেটি থেকে আমাদের জাহাজ-বাড়ি দেখা যাচ্ছে, সেখানেও জ্বলে উঠেছে আলো। তবে সমুদ্র বেশ অশান্ত, তাই বোট থেকে জাহাজে উঠতে বেশ অসুবিধা হল। আজকেই জাহাজে শেষ রাত। কাল সকাল আটটার মধ্যে কোচি-র জেটিতে পৌঁছে যাবে জাহাজ। জিনিসপত্র গোছগাছ করি, জাহাজি সংসারের কালকেই ইতি।

প্রয়োজনীয় তথ্য

১) লাক্ষাদ্বীপের দ্বীপগুলিতে কোচিন ও ম্যাঙ্গালোর থেকে জাহাজে যাওয়া যায়। কোচিন থেকে বিমানে একমাত্র আগাত্তি দ্বীপে যাওয়া যায় কারণ ওখানে একমাত্র বিমানবন্দর আছে। কলকাতা থেকে সরাসরি কোচিন পৌঁছোবার ট্রেন শালিমার-ত্রিবান্দ্রম এক্সপ্রেস রবিবার ও মঙ্গলবার চলে। আবার চেন্নাই পৌঁছে আলেপ্পি এক্সপ্রেস ধরে কোচি পৌঁছোনো যায়। কলকাতা থেকে কোচির কোনও সরাসরি উড়ান নেই। চেন্নাই অথবা বেঙ্গালুরু হয়ে যেতে হবে।

২) লাক্ষাদ্বীপ ভ্রমণের জন্য ভারতীয়দেরও আগাম অনুমতিপত্র সংগ্রহ করতে হবে। ঝামেলা এড়াতে অধিকাংশ ভ্রমণার্থী ‘স্পোর্টস’ আয়োজিত প্যাকেজ টুরে যেতে পছন্দ করেন। অনুমতিপত্রের দায়িত্ব তখন ‘স্পোর্টস’ সংস্থার।

যোগাযোগঃ ৪৮৪২৬৬৮৩৮৭

 

মেঘ-কুয়াশার লেপচাজগৎ

মেঘ বলল, যাবি?

লুকোচুরি খেলতে ডাকছে পাইনবন। লাবণ্যমাখা পাইনের পাতায় পাতায় চিকন শিহরণ। সবুজের নিভৃত হোরিখেলা। এক ঝাঁক নিস্তব্ধতা, আকাশচুম্বী ঋজু পাইনবনকে সম্বল করে মায়াজড়ানো পথটা। পথ তখন কথা বলে। ভাব জমায়। ভোরের কথা। কুয়াশায় ভিজে জেরবার হয়ে থাকা ভোর। নিতান্তই সমতলের শহুরে মানুষ আমি। তার ভাষা তো আমি জানি না। আমার অপলক নজর থাকে, সূর্যগোলক কখন উঠবে। আর সহসা হুমড়ি খেয়ে পড়বে বরফিলা কাঞ্চনজঙ্ঘার অবয়বে। তবে সে দেখার কি আর জো আছে? মেঘেরা হুড়মুড়িয়ে নেমে এসেছে। এ মেঘ মায়ার সঞ্চার করে লেপচাজগৎ পাহাড়ি গ্রামে।

এক্কেবারে মেঘ-কুয়াশায় লেপটে থাকা পাইনবন। পাইনের পাতায় পাতায় উগরে দেওয়া জলকণা। টুপটাপ টুপটাপ। একাই হাঁটছি। এন্তার সেলফি তুলছি পাইনের সঙ্গে। এতোল-বেতোল হিমেল হাওয়া। কানামাছি খেলতে ডাকছে কুয়াশা ও কাঞ্চনজঙ্ঘা। এই নিয়ে জলছবির মতো আলো ও আশ্বাসভরা একরত্তি লেপচাজগৎ। ছিনিয়ে নিচ্ছে দৃষ্টিসুখ, মন্ত্রের মতো।

দি ফাইভ ট্রেজার্স অফ স্নো কাঞ্চনজঙ্ঘা সম্পর্কে এমনই বিশ্বাস এখানকার পাহাড়ি মানুষজনের। প্রায় ৬,৯৫৬ ফুট উচ্চতায় লেপচা সম্প্রদায় অধ্যুষিত লেপচাজগৎ গ্রামটির অবস্থান। আকাশপানে মাথা উঁচিয়ে রাজকীয় কাঞ্চনজঙ্ঘার শ্বেতশুভ্র শিখরগুলি লেপচাজগতের অহংকার বাড়িয়ে তুলেছে। পাহাড়বাসীরা বিনম্রচিত্তে বলেন, স্লিপিং বুদ্ধ।

নির্ভার, বোবাচিহ্ন হয়ে আছে প্রকৃতি…

প্রকৃতি ও পাইন জঙ্গলের বৈভব নিয়ে লেপচাজগৎ ইদানিং উত্তরবঙ্গ পাহাড়কুলে পর্যটকপ্রিয় স্থান হিসেবে পর্যটন মানচিত্রেও দিব্যি গুরুত্ব অর্জন করে নিয়েছে। চিরকালীন দার্জিলিং আপামর বাঙালিদের বহুবার ঘোরা। সামান্য চেনা নিরিবিলি নির্ভার বোবাচিহ্নের মতো কুয়াশা ও রোদের আলস্য মেখে এই পাহাড়ি গাঁ দার্জিলিং-এর কাছেই। দূরত্ব মাত্র ১৯ কিলোমিটার। ঠিক করলাম, পাইন ফার বার্চ জুনিপারে মোড়া, কুয়াশার গ্রাসে চলে যাওয়া লেপচাজগতের হোমস্টেতে ছোট্ট সফর সারব।

আহা! আজ সকালটা…

অন্য আরেক পাহাড়ি গ্রাম তিনচুলেতে দুরাত কাটিয়ে প্রাতরাশ শেষে আগাম পরিকল্পনা মোতাবেক পাড়ি জমালাম লেপচাজগৎ অভিমুখে। দূরত্ব ২৮.৪ কিলোমিটার। তিনচুলে-লোপচু বাজার রোড ধরে পেশক চা-বাগান, লামাহাট্টা, ছয় মাইল, ঘুম ইত্যাদি পাহাড়ি জনপদ ছুঁয়ে প্রবেশ করি পাইনবনের আঙিনায়। কুয়াশার ছত্রছায়ায় তখন অদ্ভুত মায়াময় লেপচাজগৎ। ভাঙাচোরা রোদ্দুর গায়ে জড়িয়ে ঘন পাইন গাছের সন্নিবদ্ধ সারি। সেখানেই চলে প্রকৃতির অপার রূপবৈচিত্রের খেলা। এখানে বেড়াতে আসা ভ্রামণিকদের সোহাগে ভরিয়ে রাখতে সদা প্রস্তুত হয়ে থাকে লেপচাজগৎ।

একাকী গ্রাম, নিরিবিলি আস্তানা…

এক সংস্থার সঙ্গে অনলাইনের মাধ্যমে হোমস্টে প্রাকবুকিং করা ছিল। মূল সড়ক থেকে খাড়াই সিঁড়ি বেয়ে নেমে আমাদের জন্য বরাদ্দ সাদামাটা ঘর। কিছুটা স্যাঁতস্যাঁতেও। জানলার পর্দা সরাতে, পাশের হোমস্টে-র জানলা। ফলতঃ বাইরের শোভা কিছুই দেখতে পাব না। প্রথম দর্শনেই হতাশ করে দিল। হোমস্টে মালিক-মালকিনদের দেখা নেই। যাদের হাস্যমুখ ও মধুর আপ্যায়নটাই মন কেড়ে নেয়। যাক বাইরে বেড়াতে এসে এইসব তুচ্ছ মলিনতাকে ভ্রুক্ষেপ করি না।

 

কনকনে শীত থেকে তখনকার মতো রেহাই পেতে ব্যাগপত্তর বিছানায় রেখেই গরম কফি পান করতে বাইরে এলাম। ছুটকো দুএকটা দোকানঘর ও কয়েকঘর হোমস্টে নিয়ে একাকী লেপচাজগতের চৌহদ্দি। পাইনগাছের গুঁড়িতে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত টানটান করে বাঁধা রঙিন লুংদার বৌদ্ধ পতাকা।

এইসব পাহাড়ি এলাকায় নেট কানেকশনের খুব অসুবিধা হয়। এক্কেবারেই নেই। হোমস্টেতে নাম কা ওয়াস্তে ওয়াইফাই করা যাবে, একটা নম্বর দেওয়া ছিল। মোবাইলের সংযোগ এই আছে তো, এই নেই। তবে বাইরে এসে মোবাইলের সঙ্গে সামযিক বিরতি নেওয়াই ভালো। না-ই বা হল ফেসবুক হোয়াটসঅ্যাপ!

প্রকৃতির সারেঙ্গিবাদন…

লেপচাজগতের চোখের পাতায় এখনও যেন ঘুমের আদর লেপটে আছে। মূল সড়ক ধরেই পায়চারি করা ছাড়া আপাতত আর কোনও উদ্দেশ্য নেই, বিধেয় নেই। গ্রামের ত্রিসীমানায় নিঃশব্দ পদচারণ করে যাই। পায়ে হেঁটেই এক লহমায় শেষ হয়ে যাবে লেপচাজগৎ গ্রামের একরত্তি ভূখণ্ড। এখানে পাইন, ওক, ধুপি, কারতুস, চাপ, কাওলা, উতিচে ইত্যাদি নামের সব পাহাড়ি গাছ মিলেমিশে সবুজ। আর আছে রডোড্রেনড্রন। পাহাড়িয়া পাখিদের স্বরবিতান।

খাদের গার্ড-ওয়ালে বসে ক্ষুদে বাঁদরের পাল। কুয়াশার আবডালে জেগে আছে একফালি গ্রাম ও দুধারে গজিয়ে ওঠা বেশ কিছু হোমস্টে। প্রায় সব পরিবারই এখানে হোমস্টে খুলে রেখেছেন, বাড়তি আয়ের জন্য। সীমিত ব্যবস্থা, সাধাসিধে আযোজন। হোমস্টে মানেই স্থানীয় কোনও পরিবারের গৃহে অতিথি হয়ে থেকে যাও, নগদ অর্থ মূল্যে। নির্ধারিত মূল্যে খাওয়াদাওয়াও সেখানেই। তারপর তো আরাম করো, খানিক ঘোরো-ফেরো। হাতের নাগালেই প্রকৃতি।

হোমস্টে মালিকের তরুণ ছেলেটিই একা হাতে সব সামলাচ্ছিল। ওর নাম যুবরাজ রাই। বেশ মিষ্টি ও সপ্রতিভ। কার্শিযাং স্কুলে বারো ক্লাসে পড়ে। আমাদের জন্য বরাদ্দ ঘরটির পাশেই তার নিজের ঘর। সেটাই আবার অতিথিদের খাওয়ার ঘরও। দুটি প্লাস্টিকের ডাইনিং টেবিল ও গোটাকতক চেয়ার পাতা। এসেই লক্ষ্য করেছি, একটা হলুদরঙা ইলেকট্রিক গিটার দেয়ালে ঠেস দেওয়া। যুবরাজ অবসরে বাজায়। আমাদের ও পরিচিত কয়েকটা হিন্দি ফিল্মের সুর বাজিয়ে শুনিয়েছিল।

লেপচাজগৎ থেকে ঘুমন্ত বুদ্ধ কাঞ্চনজঙ্ঘা অসাধারণ। অবশ্যই আকাশ মেঘমুক্ত হওয়া চাই। কাঞ্চনজঙ্ঘা মুগ্ধ করবেই। অবাক অনুসন্ধানকে লেন্সবন্দি করার বাসনা গাঢ় হয়। দূরত্বের গন্ধ মুছে দেয়, মোবাইল ভর্তি সেই সব আলোকচিত্রগুলি।

লেপচাজগতের ডানায় পরিযায়ী রং…

গ্রামের মধ্যস্থিত পাহাড়টিলার টঙে পরিচ্ছন্ন প্রকৃতিবীক্ষণ স্থল। পাইনবন চিরে পাহাড়পথের বাঁধানো সিঁড়ি টপকে উপরে পেঁছোতে হয়। ও তেমন কিছু নয়। পাইন ঘেঁষে যতই পথ ভাঙি, পাইনবন আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। তারপরই সমতল অংশ। এখানেই তুষারশোভন কাঞ্চনজঙ্ঘার ভরা সংসারের মোহময় উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। তবে এই মুহুর্তে দৃশ্যমান্যতা নেই। মেঘ-কুয়াশার কাটাকুটি খেলা নিয়ে অনর্গল চারপাশ। এমন কী, ঘাসের ওপর বিগত রাতের শিশির হিমাঙ্কের নীচে নেমে তুহিন হয়ে জমে রয়েছে। লোহার বেঞ্চ ও দোলনা আহ্বান জানাচ্ছে, দুদণ্ড বসার জন্য।

শীতও বেশ জাঁকিয়ে ধরেছে। হাড়গোড়ে ঠোক্কর লাগার জোগাড়। নির্জন প্রকৃতির মাঝে চলে এসেছেন আরও কয়েটি পরিবার। এমন শান্ত পরিমণ্ডলে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস কথাবার্তাকেও মনে হচ্ছে অহেতুক কোলাহল। এখান থেকে উত্তর-পূর্বে দার্জিলিং, খাদের ওপারেই সিকিমের নামচি। কাঞ্চনজঙ্ঘা কখনও মেঘের অবয়বে, কখনও এমনিই। কানামাছি খেলা চলে। চলতেই থাকে।

এ পাহাড় সরল স্পর্শের, সহজ সংগীতের…

লেপচাজগতের পালকে এখন শীতের অধিবেশন। হিমেল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে দু-কান ছুঁয়ে ভোরের পবিত্রতায় নির্জন নিসর্গ, পাখির কলতান, কুয়াশায় মুখ লুকিয়ে থাকা ঘুমন্ত বুদ্ধ। এখানে মার্চ-এপ্রিলে পালিত হয় গুরাস মেলা। তখন তুমুল রডোড্রেনড্রন ফুলে ফুলে ছয়লাপ হয়ে থাকে এই পাহাড়িগ্রাম। এইসব পাহাড়ি গাঁয়ে রডোড্রেনড্রন ফুলের পাপড়ির নির্যাস থেকে প্রস্তুত হয় এক ধরনের কানট্রি লিকার। এখানে সেটিকে বলা হয় রক্সি বা গুরাস পানীয়। পাহাড়ি অঞ্চলে এটি বেশ চালু পানীয়।

পুরো গ্রামটিতে সাকুল্যে গুটি তিনেক দোকান। সেখানে চা, কফি, মোমো, থুকপা, ম্যাগি, জলের বোতল, বিস্কুটের প্যাকেট, সিগারেট মেলে। ভাগ্যিস বাড়ি থেকে লম্বা স্টিলের ফ্লাস্কটা এনেছিলাম। দফায় দফায় দোকান থেকে ধোঁয়া ওঠা গরম কফি ভরে আনি। সঙ্গে ডজন দুয়েক কাগজের কাপ। লেপচাজগতের অদ্ভুত শীতলতায় সেই ধোঁয়া ওঠা কফি উষ্ণ শুশ্রূষা দেয়।

সকাল জুড়ে, বিকেল জুড়ে…

পাহাড়ের নিজস্ব কিছু ভাষা থাকে। স্তব্ধ ও নীরব। লেপচাজগতের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত টাঙানো মন্ত্রপুতঃ রংদার বৌদ্ধ পতাকাগুলি নীরবতার মধ্যে বহমান। হাওয়ায় উড়ছে পতপত করে। পাহাড়িয়া ভূমিপুত্রদের অগাধ বিশ্বাস, এমন করেই হাওয়ার বিস্তারে ছড়িয়ে যাবে তথাগত বুদ্ধের বাণী দেশ থেকে দেশান্তরে। নীরবতার ভেতরেই জাগরুক থাকে পবিত্র মন্ত্রধ্বনি।

 

স্থানীয় একটি সংস্থার গাড়ি বুক করে ঘুরে আসি কাছেপিঠে। পাহাড়ি আলোছায়ার পথ উজিয়ে মিরিক, গোপালধারা চা-বাগিচা, সীমানা ভিউ পযে্ট, মানেভঞ্জন, সুখিয়াপোখরি, ঘুম, বাতাসিয়া লুপ। শীতের শিহরণ, পাহাড় ছোঁয়া হিমেল বাতাস চা বাগানের সবুজ, নতুন ভাবে মন ও চোখকে জিরেন দেয়। ঘুম থেকে গড়িয়ে আসা মসৃণ পথটিই লেপচাজগৎ বুড়ি ছুঁয়ে চলে গেছে পশ্চিমে সুখিয়াপোখরি হয়ে মানেভঞ্জন-সান্দাকফুর দিকে। দিনভর সওয়ারি জিপ ও পর্যটকদের গাড়ির আনাগোনা এই পথে।

আরেকটি দ্রষ্টব্য ৭,৯০০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট ঘুম রক। আদপে এটি একটি বৃহদায়তন বিশাল শিলাখণ্ড। ব্রিটিশ আমলের প্রাচীন বাংলোটি এখন পশ্চিমবঙ্গ বন নিগমের অতিথি আবাস। বন আবাসের পাশ দিয়ে চলে যাওয়া বিজন পথটি নেচার ওয়াকিং ট্রেইল পৌঁছে দেবে যেখানে, কাঞ্চন দর্শন মুগ্ধ করবে পথিককে।

পাহাড় যেন এক চিরন্তন বোধের জন্ম দেয়…

অপরাহ্ণ ঘনিয়ে লেপচাজগতের আকাশকোণে বিকেল নেমে আসে। তুষারধবল পাহাড়কোলে সূর্যের আস্তে আস্তে নিভে যাওয়া। লেপচাজগৎ গ্রামে সূর্য পাটে নেমে যেতেই হাড়হিম শীতের প্রাবল্য আরও জাঁকিয়ে ধরে। শীতের দৌরাত্মি নিয়ে গাঢ় হয় বিকেল-সন্ধে-রাত। থমথমে শীতল সন্ধে ঘনাতেই পাটকিলে রঙা চাঁদ, মেঘে ভর করে নুয়ে আসে।

বরফগলা ঠান্ডা বাতাস জানলার কাচে টোকা মারে। শরীরে শীতপোশাক জড়িয়ে নিই আরও এক প্রস্থ। সঙ্গে আনা রুমহিটারের দ্বারস্থ হই হোমস্টে মালিকের অনুমতিসাপেক্ষে নগদ ৪০০ টাকা অর্থমূল্যে। তবে ঠান্ডারও আলাদা ওম আছে। নরম তুলতুলে চাইনিজ জোড়া কম্বলের তলায় সেঁধিয়ে যেতেই ওম লাগে বেশ।

কীভাবে যাবেন : হাওড়া-শিয়ালদহ স্টেশন থেকে ট্রেনে নিউ জলপাইগুড়ি বা কলকাতা থেকে উড়ানপথে বাগডোগরা বিমানবন্দর। সেখান থেকে ভাড়াগাড়িতে বা ট্রেকারে লেপচাজগৎ চলে আসা যায়। অনেকসময় হোমস্টেতে কথাবার্তা বলে রাখলে গাড়ি পাঠিয়ে দেয় নির্ধারিত অর্থমূল্যে।

কোথায় থাকবেন : অনেক পর্যটকই লেপচাজগৎ ঘুরে আসেন, থাকেন না। রাত্রিবাস করতে চাইলে, এখানে অনেকগুলি হোমস্টে রয়েছে। অনলাইন বুকিং এর মাধ্যমে বা ফোনে কথা বলে ঠিক করে নেওয়া যেতে পারে।

কখন যাবেন : বছরভর যাওয়া যেতে পারে লেপচাজগৎ। উপযুক্ত ও ভারী শীতবস্ত্র জরুরি।

বদ্রিনাথ থেকে চরণপাদুকা ও মানাগ্রাম

যোশিমঠ থেকে বদ্রিনাথগামী জিপ ছাড়ল বিকেল সোয়া ৩টে নাগাদ। চেনা পাহাড় ও উচ্ছ্বল অলকনন্দাকে পাশে রেখে প্রায়শই ভঙ্গুর পথে বদ্রিনাথ জিপ স্ট্যান্ডে পৌঁছোলাম বিকেল সাড়ে ৪টেয়। লাগেজ পিঠে তুলে মিনিট ৬-৭ হেঁটে চলে এলাম ভারত সেবাশ্রম সংঘের নতুন বাসভবনে। সেখান থেকে বদ্রিনাথ মন্দির প্রায় ঢিল-ছোঁড়া দূরত্বে। আমরা দুই বন্ধু দেখা করলাম আশ্রমের ভারপ্রাপ্ত মহারাজ-এর সঙ্গে। ঘর পেতে অসুবিধে হল না। চারতলা বাসভবনে দোতলার এক ঘরে ঠাঁই হল আমাদের। থাকার ব্যবস্থা প্রায় ভালো হোটেলের সমতুল্য। মেঝেতে কার্পেট পাতা, দুই শয্যা বিশিষ্ট খাটের দুপাশে আয়না সহ কাপ বোর্ড আর বাথরুমে গিজার-এর গরম জল। ঘর প্রতি ভাড়া ৬০০ টাকা।

গরম জলে হাত-মুখ ধুয়ে নীচে নেমে এলাম। এক দোকানে এসে গরম চা খেলাম। এবার চলে এলাম অলকনন্দার দক্ষিণ তীরে অবস্থিত বদ্রিনাথ মন্দিরে। নর ও নারায়ণ পর্বত দুটির মাঝে এই বদ্রিক্ষেত্র। শ্রীক্ষেত্রের উচ্চতা ১০,২২৪ ফুট।

 

বিকেল সাড়ে ৫টা, প্রচণ্ড ঠান্ডায় মন্দির প্রাঙ্গণে ভিড় নেই। সিংহদ্বার দিয়ে প্রবেশ করে প্রথমে নাট মন্দির, তারপর গর্ভমন্দির। প্রাণ ভরে দর্শন করলাম বদ্রিনাথজিকে। মন্দির প্রদক্ষিণ করে এসে বসলাম আদি গুরু শ্রীশঙ্করাচার্যের শুভ্র মূর্তির পদতলে। সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় প্রভু বদ্রিনাথজির আরতি শুরু হল মহাসমারোহে। কেরালার নাম্বুদিরি বংশোদ্ভূত ব্রাহ্মণ পুরোহিত রাওয়ালজি যখন আরতি করছিলেন, আমি অপলকে দেখছিলাম বদ্রিবিশালজিকে। কালো শালগ্রাম শিলায় নির্মিত ধ্যানমগ্ন চতুর্ভুজ মূর্তি নারায়ণের। দুটি হাত ভগ্ন– শৃঙ্গারের সময় চন্দন দিয়ে হাত দুটি গড়ে নেওয়া হয়। প্রভুর কপালে চন্দন তিলক, গলায় মালা, শরীরে মূল্যবান পোশাক এবং মাথায় সোনার ছাতা। দুই হাতে যোগমুদ্রা। নারায়ণের কপালে হীরকনির্মিত উজ্জ্বল তৃতীয় নেত্র। প্রভুর বাম পাশে নর ও নারায়ণের মূর্তি। ডানপাশে ধনপতি কুবের, গরুড় এবং সিদ্ধিদাতা গণেশ। নারায়ণের সামনে কৃষ্ণসখা উদ্ধব এবং বীণা-সহ দেবর্ষি নারদ। শীতকালে ওই উদ্ধবজির মূর্তিকে নারায়ণের প্রতিনিধি হিসেবে যোশিমঠে নিয়ে গিয়ে পূজা করা হয়।

প্রজ্জ্বলিত দীপশিখা, ধূপের সুগন্ধ এবং ঘণ্টাধবনিতে রচিত হয়েছে এক স্বর্গীয় পরিবেশ। আধ ঘণ্টা পরে আরতি শেষ হলে মন্দির চত্বর ঘুরে দেখলাম। সেখানে ছোটো ছোটো মন্দিরে পর পর রয়েছেন হনুমানজি, গণেশজি, নবদুর্গা, লক্ষ্মীদেবী এবং শেষে মুণ্ডহীন ঘণ্টাকর্ণজি। মন্দিরের প্রধান প্রবেশ দ্বারে গরুড় মূর্তি শোভা পাচ্ছে। বাঁদিক থেকে প্রদক্ষিণ করলে প্রথমে মা লক্ষ্মীর মন্দির, তারপর ভোগমণ্ডি– যেখানে বদ্রিনাথজির ভোগ রন্ধন করা হয় এবং প্রভুকে ভোগ উৎসর্গ করার পরে, সেই প্রসাদি-ভোগ বিতরণ করা হয় সকল পূণ্যার্থীকে। ভোগমণ্ডির পর মন্দির কার্যালয় এবং তার পাশে সিংহাসনে উপবিষ্ট শ্বেত পাথরে নির্মিত শ্রীশঙ্করাচার্যের অতি সুন্দর মূর্তি।

আনন্দ চিত্তে বেরিয়ে এলাম মন্দির চত্বর থেকে। এবার ঘুরে ঘুরে দেখে নিলাম উলটোদিকে আলোকোজ্জ্বল দোকানগুলো। রাত ৮টার পরে একটা ছোটো হোটেলে এসে গরম রুটি-ডাল-সবজিতে ডিনার সারলাম। ভারত সেবাশ্রমে ফিরে মহারাজকে শুভরাত্রি জানিয়ে চলে এলাম নিজেদের ঘরে।

সকাল ৭টায় উঠে মুখ ধুয়ে পরিষ্কার হলাম। সাড়ে ৭টার মধ্যে তপ্তকুণ্ডের কাছে পৌঁছলাম। কুণ্ডের অবস্থান মন্দিরের সামনে কিছুটা নীচে। তপ্তকুণ্ড আসলে বেশ কয়েকটি গন্ধকপূর্ণ উষ্ণ প্রস্রবণের সমষ্টিতে তৈরি। এখানে মোট পাঁচটি কুণ্ড আছে– ঋষিগঙ্গা, কুর্মধারা, প্রহ্লাদধারা, তপ্তকুণ্ড ও নারদকুণ্ড। ওই পাঁচ কুণ্ডকে বলা হয় পঞ্চতীর্থ। তপ্তকুণ্ডের জলের উষ্ণতা বছরভর ৫৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। গরম পোশাক বন্ধুর কাছে রেখে স্নানের পোশাকে চলে এলাম কুণ্ডের পাশে। প্রথমে পা দুটি জলে ডোবাতে মনে হল তা বুঝি পুড়েই যাবে, কারণ বাইরের উষ্ণতা মাত্র ৩-৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এরপর ধীরে ধীরে কুণ্ডের জলে সমগ্র শরীর ডোবাতে অনুভব করলাম কি আরামদায়ক এই স্নান। আমি কুণ্ড থেকে উঠে আসতেই বন্ধু গেল স্নানে, অনেকক্ষণের জন্য।

পরিষ্কার পোশাক পরিধান করে চেনা দোকান থেকে বদ্রিনাথজির পূজার ডালি সাজিয়ে নিলাম দুজনে। সকাল সাড়ে ৮টায় মন্দিরে পৌঁছোলাম। ছোটো লাইনে দাঁড়িয়ে পূজা দেওয়া সম্পন্ন হল ৯টার মধ্যেই। তারপর মন্দির কার্যালয় থেকে ‘যাত্রী ভোগ’-এর দু’টি রসিদ কেটে নিলাম। এই রসিদ না কাটলেও চলে, কারণ মন্দিরে উপস্থিত সব দর্শনার্থীকেই বিনামূল্যে ভোগ-প্রসাদ দেওয়া হয়। দোকান থেকে পূজার ডালি দুটো প্যাক করিয়ে চলে এলাম মন্দির চত্বরের বাইরে। মন্দিরের উলটো দিকে অলকনন্দার তীরে অবস্থিত এক ভালো হোটেলে গরম আলু পরোটা ও চায়ে নাস্তা সেরে নিলাম। ঘরে ফিরলাম সকাল ১০টা নাগাদ।

ঘরে বসে না থেকে চলে এলাম আশ্রমের ছাদে। সেখান থেকে পাখির চোখে দেখছিলাম ক্রমবর্দ্ধমান বদ্রিনাথ শহরকে, যা চামোলী জেলার এক নগর পঞ্চায়েত। পবিত্র বদ্রিনাথধাম নর ও নারায়ণ পর্বতদুটির মাঝে বিস্তৃত– নীলকণ্ঠ (৬৫৯৮ মিটার) শৃঙ্গের ৯ কিলোমিটার পূর্বে এবং নন্দাদেবী (৭৮১৬ মিটার) শৃঙ্গের ৬২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। নবম শতাব্দীতে হিন্দু ধর্মের মহান সংস্কারক আদিশঙ্করাচার্য দ্বারা বদ্রিনাথ এক পুণ্য তীর্থস্থান হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। বদ্রিনাথ মন্দির বহুবার ভূমিকম্প ও ধস-এর কারণে ধবংসপ্রাপ্ত হয়। বর্তমান মন্দির ‘গর্ভগৃহ’, ‘দর্শন মণ্ডপ’ ও ‘সভা মণ্ডপ’ নিয়ে গঠিত। মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী ও উজ্জ্বল রঙে বৌদ্ধবিহার-এর সঙ্গে সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। আশ্রমের ছাদ থেকে জুম করে ছবি তোলার সময়ে হঠাৎই লেন্সে ধরা পড়ল ‘চরণ পাদুকা’ যাওয়ার পথ। তখনই দুজনে মিলে ঠিক করলাম, দুপুরে মন্দিরে ভোগ খাওয়ার পর যাব সেই জায়গায়।

শহরে একটু ঘোরাঘুরি করে দুপুর ১২টা নাগাদ আবার চলে এলাম মন্দিরে। ভোগ-প্রসাদের লাইনে দাঁড়ালাম মন্দির প্রদক্ষিণ করার পর। সোয়া ১২টায় ভোগ বিতরণ শুরু হল। আমরা প্রসাদ পেলাম সাড়ে ১২টায়। মিনিট ২০ পরেই চরণ পাদুকা-র পথে হাঁটা শুরু করলাম। বদ্রিনাথ মন্দিরের পিছন দিক থেকে রাস্তা এগিয়েছে। কালী কমলীওয়ালা ভবন অতিক্রম করে কিছুটা এগিয়ে ডান দিকে চড়াই পথ গিয়েছে চরণ পাদুকা পর্যন্ত।

দূরত্ব প্রায় আড়াই কিলোমিটার। কিছুটা দূরত্ব অতিক্রম করে পেৌঁছোলাম ক্রিয়াযোগ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। ছবি তুলে এগিয়ে চললাম লক্ষ্যের দিকে। চড়াই পথে আরও ৫০০ মিটার দূরত্ব পেরিয়ে পৌঁছলাম হনুমান গুফায়। সেখানে এক সন্ন্যাসী থাকেন। খাওয়ার পরই হাঁটা, তাই চড়াই ভাঙতে একটু কষ্ট হচ্ছিল। এবার চড়াই পথে প্রায় ১ কিলোমিটার হেঁটে পৌঁছলাম গুপ্তগঙ্গা গুফায়। সেখানেও বাস করেন এক সন্ন্যাসী। তাঁর কাছ থেকে জানলাম, গুহার নীচে বয়ে চলেছে এক নদী, নাম গুপ্তগঙ্গা। বারো মাসই জল থাকে সেখানে।

ধীরে ধীরে পার হচ্ছিলাম ছোটো-বড়ো বোল্ডার। চারিপাশের প্রকৃতি রুক্ষ– গাছপালা বলতে পাথরের খাঁজে খাঁজে শুধু কাঁটা-গুল্ম। আরও কিছু দূর এগোতে দেখি, পথের পাশে ছোটো, শিলানির্মিত নন্দাদেবী মন্দির। মন্দিরে প্রণাম জানিয়ে এগিয়ে গেলাম। ইতিমধ্যে আবহাওয়া খারাপ হয়েছে। প্রথমে কনকনে ঠান্ডা বাতাস, তারপরই শুরু হল তুষারপাত। হালকা বরফকণা ঝরে পড়তে লাগল আমাদের ওপর। এদিকে কয়েকশো মিটার দূরেই যে অভীষ্ট লক্ষ্য! এগিয়ে যাওয়া থামাই কী করে!

মিনিট তিনেক পরেই বন্ধ হল তুষারপাত এবং ১০ মিনিট পরেই পৌঁছলাম ১১,০৮৯ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত চরণ পাদুকায়। সামনেই এক বিশাল প্রস্তর খণ্ড, যার উপর ভগবান বিষ্ণুর উজ্জ্বল পদচিহ্ন। কথিত আছে, প্রভু বিষ্ণু পৃথিবীতে প্রথম বার পা রাখেন এই স্থানেই। ভাগবৎ পুরাণ থেকে জানা যায়, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর বন্ধু তথা মন্ত্রী উদ্ধবকে বলেন, তাঁর চরণ পাদুকা-সহ বদ্রিনাথে এসে অলকনন্দাকে দর্শন করতে। অবাক হয়ে দেখছিলাম পাদুকা চিহ্ন দুটিকে– লাল সিঁদুর দিয়ে রাঙিয়ে রাখা হয়েছে। ছবি তুললাম চরণ পাদুকার। মেঘলা আবহাওয়া, তবু দেখতে পাচ্ছি গাড়োয়ালের রানি নীলকণ্ঠকে, এবং উলটোদিকে নর পর্বতকে। চরণ পাদুকার কাছে বয়ে চলেছে পবিত্র ঋষিগঙ্গা।

আমরা নামতে শুরু করলাম সাবধানে, কারণ তুষারপাতের পর পিছল পথে পদস্খলনের সম্ভাবনা থাকে। দুপুর ২ টো ৪৫ মিনিটে আমরা ফিরে এলাম বদ্রিনাথ মন্দিরের কাছে। তখনই শুরু হল দ্বিতীয় বারের তুষারপাত। প্রচণ্ড ঠান্ডায় কিছুটা পথ ছুটে এসে ঢুকে পড়লাম আমাদের চেনা চা-দোকানে। দোকানি সর্বাঙ্গে মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিল। তাকে উঠিয়ে আমরা দোকানের অনেকটা ভিতরে গিয়ে বসলাম। দোকানি পরম যত্নে আদাসহ দুধ-চা খাওয়াল আমাদের। আশ্রমের ঘরে ফিরলাম বিকেল সাড়ে ৩টে নাগাদ।

সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার পরে আবার পথে বার হলাম। প্রথমেই জেনে নিলাম, মানাগ্রাম যাওয়ার গাড়ি কোথা থেকে ছাড়ে। তারপর হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম মন্দিরে। ভিড় কম, এসে দাঁড়ালাম গর্ভগৃহের সামনে। সাড়ে ছটায় বদ্রিবিশালজির আরতি শুরু হল। আবার সেই আনন্দময় অনুভূতি! সন্ধ্যা ৭টা আরতি শেষ হল। প্রচণ্ড ঠান্ডা– দিন ১৫ পরেই বন্ধ হবে মন্দিরের দরজা। পরের ছ মাস বদ্রিনারায়ণ পূজিত হবেন যোশিমঠের শ্রীনৃসিংহ মন্দিরে।

মন্দির চত্বর থেকে চলে এলাম পথে। এক বড়ো দোকানে বসে খেলাম চা ও সিঙ্গাড়া। এরপর মন্দির সংলগ্ন দোকানগুলি ঘুরে ঘুরে দেখলাম এবং কিছু কেনাকাটাও করলাম। রাত সাড়ে ৮টা নাগাদ এসে পৌঁছলাম হোটেলে। গরম রুটি-ডাল-সবজিতে ডিনার সেরে ঘরে ফিরলাম রাত করে।

সকাল সাড়ে ছটায় বিছানার মায়া কাটিয়ে উঠে পড়লাম। ঘর থেকে বারান্দায় আসতেই দেখি অদূরেই বরফ-ঢাকা, অপরূপা নীলকণ্ঠ শৃঙ্গ সূর্যালোকে সোনালি বর্ণ ধারণ করেছে। মুখ ধুয়ে চা পান করলাম আয়েশ করে। স্নান সেরে তৈরি হতে পৌনে ৮টা বেজে গেল। ভারত সেবাশ্রম থেকে মানা গ্রাম যাবার কার স্ট্যান্ড মাত্র ৩ মিনিটের হাঁটা পথ। এই পথে শেয়ার জিপ পাওয়া যায় না। তাই মানা গ্রাম যাতায়াতের জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করা হল ৪০০ টাকায়। গাড়িতে বসতেই ড্রাইভার জানাল, পেৌঁছোনোর পর আমাদের ২ ঘণ্টা সময় দেওয়া হবে মানা গ্রাম ঘুরে দেখার জন্য। সকাল সোয়া ৮টায় গাড়িতে চেপে যাত্রা করলাম মানা-র পথে।

বদ্রিনাথ থেকে দূরত্ব মাত্র ৩ কিলোমিটার। এই পথে কিছুটা এগোলেই ভৃগু গুম্ফা– ভৃগুমুনির তপস্যাস্থল। তারপর মাতামূর্তি মার্গ। পাহাড়ের ঢালে কিছুটা উচ্চতায় মাতামূর্তির ছোট্ট এক মন্দির। মাতামূর্তি (মাতা মুক্তি) ছিলেন নর ও নারায়ণের মা। মসৃণ রাস্তার বাঁ পাশে অনেকটা নীচে বয়ে চলেছে অলকনন্দা। মানা ভারত-চিন (তিব্বত) সীমান্তে শেষ গ্রাম। ১ কিলোমিটার অতিক্রম করতেই পথের ডান পাশে বেশ কয়েকটা মিলিটারি ক্যাম্প– ভারতের অতন্দ্র প্রহরীরা সদাই ব্যস্ত সেখানে।

গাড়ি চলেছে মধ্যম গতিতে। পথের দু’পাশেই রুক্ষ পাহাড়– সেখানে রৌদ্র-ছায়ার খেলা। অলকনন্দার ওপাড়ে পাহাড়ের কোলে সেনাবাহিনীর অফিস ও কোয়ার্টার। অলকনন্দার পুল পার হয়ে আসতে হবে মানা গ্রামে। এই স্থানেই সরস্বতী ও অলকনন্দার সঙ্গম, নাম কেশবপ্রয়াগ। মিনিট ১০ পরেই রাস্তার উপর স্বাগতবার্তা – সীমান্ত গ্রাম মানা, ইন্ডিয়াজ লাস্ট ভিলেজ। চামোলী জেলায় অবস্থিত এই গ্রামকে উত্তরাখণ্ড সরকার ‘পর্যটন গ্রাম’ আখ্যা দিয়েছে। গাড়ি এসে থামল স্ট্যান্ডে। ড্রাইভার আবার মনে করিয়ে দিল, মানা গ্রামে আমাদের জন্য বরাদ্দ ঠিক ২ ঘণ্টা।

মানা গ্রামে মহাভারতের স্মৃতি আজও বিদ্যমান। জনমানসে বিশ্বাস, পঞ্চপাণ্ডব মহাপ্রস্থানের পথে এই মানা গ্রাম হয়েই এগিয়ে যান স্বর্গারোহিনীর উদ্দেশে। দ্রৌপদী বেগবতী সরস্বতী নদী পার হতে অসমর্থ হলে মহাবলী ভীম একটি লম্বাকৃতি প্রস্তরখণ্ড নিয়ে দুই পাহাড়ের খাঁজে ফেলে তাঁর পারাপারের ব্যবস্থা করে দেন। রেলিং দিয়ে ঘেরা এই জায়গার নাম তাই ‘ভীমপোল’। এই মানা গ্রাম হল পুরাণ বর্ণিত মণিভদ্রাশ্রম– পৃথিবীর আদিগ্রাম। যে পর্বতের উপর এই গ্রাম, সেই পর্বতের নাম মারীচ। তাই, এই স্থানের আদি অধিবাসীদের বলা হয় ‘মার্চা’। সকাল ৯টা, তিব্বত সীমান্তে ভারতের শেষ গ্রামে তখনও ব্যস্ততা শুরু হয়নি। গ্রামের রাস্তা পাকা। দু’পাশেই স্থানীয় অধিবাসীদের তৈরি উলের পোশাকের দোকান– কয়েকটি সবেমাত্র খুলেছে। এক চায়ের দোকানে জিজ্ঞেস করতে স্থানীয় এক ভদ্রলোক এসে দেখিয়ে দিলেন, গণেশ গুফা যাবার পথ।

মানা গ্রামের অবস্থান সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৩২১৯ মিটার উচ্চতায়। জাতীয় সড়ক ৫৮-এর শেষ প্রান্তে এই গ্রাম। এখানকার অধিবাসীরা প্রধানত মার্চা, জাড ও ভোটিয়া উপজাতি। বদ্রিনাথ মন্দির বন্ধ হওয়ার পরই মানা গ্রামের সমস্ত অধিবাসী নীচে নেমে যায় অতিরিক্ত তুষারপাতের কারণে। চড়াই পথে, ঘরবাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে পৌঁছে গেলাম গণেশ গুফায়। কথিত আছে, গণপতি গণেশ মহর্ষি বেদব্যাসকে এইস্থানেই মহাভারতের কাহিনি বর্ণনা করেন। সুন্দর, শান্ত পরিবেশে ওই গুফা– দু’পাশে গাছপালা, পিছনে পাহাড়।

সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে প্রবেশ করলাম গুফায় এবং প্রণাম জানালাম গণেশজিকে। একটু এগিয়েই ব্যাস গুফা– ব্যাসদেব তাঁর পত্নী বিটিকাকে নিয়ে এখানেই থাকতেন। কথিত আছে, চতুর্বেদ রচনাকালে ব্যাসদেব এই গুফাতেই বাস করতেন। গুহার মাঝে কালো পাথরে তৈরি ব্যাসদেব-এর উপবিষ্ট মূর্তি। গুহার বাইরের দেয়ালে লাল অক্ষরে লেখা – তাঁর পবিত্র গুহা ৫৩২১ বছরের পুরোনো। ব্যাস গুফার কাছেই এক চায়ের দোকান যেখানে সাইন বোর্ডে লেখা – ভারত কী আখিরি চায় দুকান, ইন্ডিয়াজ লাস্ট টি শপ’। সেই দোকানে বসে চা খেলাম দু’জনে এবং তার ছবি তুললাম মেমেন্টো হিসেবে।

এবার আমরা এগিয়ে চললাম ভীমপুল-এর পথে। ৫-৬ মিনিট হাঁটার পর কিছুটা নীচে নেমে এসে পৌঁছলাম সেই স্থানে। দেখি, দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে তীব্র বেগে নেমে আসছে সরস্বতী নদী। ভীমপুল একটি বিশাল লম্বাটে পাথর, দুই পাহাড়ের মাঝে বেগবতী সরস্বতীর উপর আড়াআড়ি ভাবে অবস্থিত। বিপরীত দিকে সরস্বতী মন্দির পাহাড়ের কোলে। বিদ্যাদেবীকে প্রণাম জানিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলাম এবং ৬-৭ মিনিট হেঁটে পৌঁছে গেলাম কার স্ট্যান্ডে।

গাড়ির ড্রাইভার আমাদের অপেক্ষাতেই ছিল। আমরা গাড়িতে উঠে বসতেই সে ইঞ্জিন স্টার্ট করল। সুন্দর, সাজানো, ছোট্ট মানা গ্রাম আমাদের মুগ্ধ করেছিল। জেনেছিলাম, মানা গ্রাম আসলে ছিল গন্ধর্বদের দেশ। পুরাণ বর্ণিত স্বর্গ। নীলকণ্ঠ পর্বতের কোলে বাস করতেন উর্বশীরা– পরে তাঁরা বসুধারার পথে কুবেরের আলয়ে অলকাপুরীতে চলে যান। ভাবছিলাম, হাতে আর একদিন সময় থাকলে যেতে পারতাম ৬ কিলোমিটার দূরে বসুধারা জলপ্রপাতের স্বর্গীয় রূপ দেখতে।

এইসব ভাবতে ভাবতে দেড় কিলোমিটার অতিক্রম করে পেৌঁছে গেলাম মিলিটারি ক্যাম্পের কাছে। গাড়ি থেকে নেমে সেখানে উপস্থিত জওয়ানদের সঙ্গে করমর্দন করলাম। আমি সর্বদাই গর্ববোধ করি ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য। সামনেই রাস্তার উপর বর্ডার রোড অর্গানাইজেশনের বিরাট হোর্ডিং-এ লেখা – লাস্ট ইন্ডিয়ান ভিলেজ, সীমান্ত গ্রাম মানা। আমাদের গাড়িতে জায়গা রয়েছে দেখে দু’জন সেনা অফিসার আমাদের সঙ্গে বদ্রিনাথ চলে এলেন। তাঁরা এগিয়ে গেলেন আমাদের বিদায় জানিয়ে। আমরাও গাড়ির ভাড়া মিটিয়ে ধীর পায়ে চলে এলাম বদ্রিনাথ মন্দিরে। বেলা ১১টার পরেই দর্শন হল বদ্রিনাথজির। এবার চলে এলাম ব্রহ্মকমল রেস্তোরাঁয় চা-নাস্তা সেরে নিতে। ফিরে এলাম ভারত সেবাশ্রমের নির্দিষ্ট ঘরে। দ্রুত লাগেজ গুছিয়ে নিলাম। মহারাজের সঙ্গে দেখা করে প্রণাম জানালাম তাঁকে। কথা দিলাম, আবার আসব পরিবারের সঙ্গে।

লাগেজ পিঠে নিয়ে প্রায় ১০ মিনিট হেঁটে পৌঁছলাম শহরের বাস/কার স্ট্যান্ড-এ। প্রায় ২০ মিনিট অপেক্ষা করার পর যোশিমঠ যাবার শেয়ার জিপে উঠতে পারলাম। পাঁচ মিনিট পরেই জিপ যাত্রা শুরু করল যোশিমঠের পথে। মন পড়ে রইল, পরম পবিত্র বদ্রিনাথধাম-এ। হূদয়ে উপলব্ধি করলাম, চরণ পাদুকা ও মানা গ্রাম-এর অমোঘ আকর্ষণ।

 

পড়ার জন্য সীমাহীন গল্প-নিবন্ধসাবস্ক্রাইব